বাঘও রেগেছে, হুপ্পোও ভেগেছে
সাংঘাতিক ঘুমিয়ে পড়েছিল হুল্লো। চোখে যে এত ঘুম জড়িয়ে ছিল, সেটা আগে বুঝতেই পারেনি। বুঝবে কী করে বলো? পুলিশের তাড়া খেলে আর ঘুম! পুলিশের তাড়া মানে কী, সেটা যে খেয়েছে সেই বুঝেছে।
কিন্তু ঘুমেরও কী ছিরিছাঁদ নেই? সেই কাল রাতে শুয়েছে, আর এই এখন ঘুম ভাঙল! মানে, একটা রাত্তির পেরিয়ে আর একটা সন্ধে এসে গেল!
যদিও হুপ্পো সাইকেল থেকে পড়েছিল বেশ মোক্ষম মতো, কিন্তু ভাগ্য বলতে হবে, চোটটা তেমন জববর হয়নি। গায়ে-হাতে টাটানিটা অবশ্য এখনও বেশ মালুম দিচ্ছে। তাহলেও তখন যেমন মনে হয়েছিল হাত-পা বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, এখন তেমনটা মনে হচ্ছে না। উঠে দাঁড়াল হুপ্পো। দু-পা লেংচে দেখল, আর ব্যথা নেই।
আচ্ছা, না হয় হুপ্পো পড়েই গেছে, তা বলে অত বড়ো একটা ধিঙ্গি বাঘের অমন হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসাটা কি ঠিক হল?
ঘুম ভাঙতে হুপ্পোর বাঘের কথাটাই প্রথমে মনে হয়েছে। সুযোগ পেলে ও একহাত দেখে নেবে বাঘটাকে! হুপ্পো পড়ে যেতে যদিও হাতিটা, ঘোড়াটা, ভালুকটা সক্কলেই হেসেছে, তবু তার বাঘটার ওপরই যেন রাগটা বেশি। কী দম্ভ! তবু যদি না খাঁচায় বন্দি থাকত! তবে কথা হল কী, বাঘকে তো আর সহজে জব্দ করা যায় না। তার ওপর হুপ্পো বাঁদর! বাঁদর কি আর বাঘের সঙ্গে পারে! গায়ের জোরে তো নয়ই। বুদ্ধির জোরই বা কতটুকু আছে হুপ্পোর! ও। তো বাচ্চা। হ্যাঁ, হত যদি বর আর কনে-বাঁদরটা তার সঙ্গে থাকত, ও একবার দেখে নিত! কিন্তু সব তো গোলমাল হয়ে গেল। পুলিশের তাড়া খেয়ে কে যে কোনদিকে ছিটকে পড়ল! মনে মনে হুপ্পোরও খুব ইচ্ছে ছিল, রেলের টিকিট কিনে ওই বর আর কনে-বাঁদরের সঙ্গে লছমনঝোলাটা ঘুরে আসবে। মনের ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল। কোথায় বর আর কোথায়। কনে! আর কোথায়-ই বা ছাগল!
তবে ছাগলকে নিয়ে কোনো কাজ হত না। ভয়ানক ভীতু ছাগলটা। ভয় পেলে ব্যা ব্যা করে পাড়া মাথায় করে ছাড়বে।
কিন্তু হঠাৎ চমকে উঠল হুল্লো। ও এতক্ষণ খেয়ালই করেনি, ঘরে গাধাটা নেই। যাঃচ্চলে! ওকে ফেলে গাধাটা কোথায় কেটে পড়ল।
ঘুমভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে হুপ্পো একেবারে হন্তদন্ত হয়ে গাধার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে অবাক! চারদিকে আলো আর আলো। মাইকে বাজনা বাজছে। লোকজনে গিসগিস করছে চারদিকে। সবাই ব্যস্ত। হইহই কাণ্ড। বাইরে, ওই মস্ত তাঁবুর ভেতর সার্কাসের খেলা শুরু হয়ে গেছে।
গাধাটা তো আচ্ছা হাঁদা! ওকে তো জাগিয়ে দেবে! তা না, হুপ্পো পড়ে রইল ঘরে আর নিজে চলে গেল খেলা দেখাতে!
সার্কাস আর কে না দেখতে চায়! হুপ্পোর তো ষোলো আনা। শুনেছে সার্কাসের কথা অনেকবার, কিন্তু দেখতে তো পায়নি কখনো। আজ সেই সুযোগ এসেছে। তবে কথা হচ্ছে, সার্কাসের খেলা দেখতে গেলে তো তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে হবে। সেও তো এক ঝামেলা। চারদিক এমন ঘেরা যে, কার সাধ্যি ভেতরে ঢোকে।
কিন্তু ইচ্ছে করলে হুপ্পো এখনই ঢুকে যেতে পারে। এক লাফ মারবে তাঁবুর চালে। তারপর তাঁবুর ওই একদম ওপরের ফাঁকটা দিয়ে সুড়সুড় করে ভেতরে চলে যাবে। এর জন্যে। তাকে বেশি কসরতও করতে হবে না। কিন্তু তাতে বিপদ। কেউ দেখে ফেললে? না, মতলবটা ঠিক না। তবে একটা কাজ করতে পারে। তাঁবুর নীচে ফাঁক। ওই ফাঁকে মাথা গলিয়ে যদি ও ঢুকে পড়তে পারে, তাহলে কেউ দেখতে পাবে না।
তাই-ই করল হুপ্পো। চুপিসাড়ে তাঁবুর কাপড় ঠেলে, হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর এমনই মজা, ও যখন ঢুকছে, তখন তো কেউ দেখতে পেলই না, এমনকী ভেতরে যখন গিয়ে পৌঁছোল তখনও কারো নজর গেল না তার দিকে। তাঁবুর ভেতর বসার জায়গা, উঁচু উঁচু গ্যালারি। গ্যালারিতে লোকে লোকে ঠাসাঠাসি। সক্কলে একমনে খেলা দেখছে। গ্যালারির নীচটা তো ফাঁকা। হুপ্পো গ্যালারির ওই নীচেই হাজির। এখানে চুপটি করে বসে থাকলে ওকে কে দেখবে শুনি? খেলাটা ভালো করে দেখার জন্যে নীচ দিয়ে ও একটু এগিয়েই গেল। হ্যাঁ, এখান থেকে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভারি বুছু বানিয়েছে হুপ্পো। সবাইকে। ওপরে, গ্যালারিতে বসে বসে লোকেরা টিকিট কেটে খেলা দেখছে, আর হুপ্পো কেমন টিকিট না কেটেই গ্যালারির নীচে বসে বসে মজা দেখছে?
মজাই বলো আর যাই বলো, ওই তারের ওপর ছাতা হাতে নিয়ে মেয়েদের নাচ দেখানো খেলাটা ভারি শক্ত কিন্তু! ফসকে গেলেই গেল। দেখতেও বেশ লাগে। তারপর গাধার সাইকেল চালানো। হাতির চার পা এক করে টুলের ওপর দাঁড়ানো। ভাল্লুকের ডিগবাজি মারা। দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যেতে হয়! কিন্তু হুপ্পো একটুও অবাক হচ্ছিল না। ওর। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ও ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু মতলব ভাঁজছে!
এবার বোধহয় বাঘের খেলা দেখাবার পালা। সার্কাসের লোকেরা সামনের জায়গাটা বড়ো বড়ো লোহার বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেললে। তারপর একটা খাঁচার-গাড়ি টানতে টানতে বাঘকে নিয়ে এল সেখানে। এনে, খাঁচার দরজা খুলে দিতেই বাঘ ‘হালুম’ করে হাঁক পেড়ে লাফিয়ে পড়ল। ওই যে ইয়ালম্বা গোঁফওলা লোকটা, ওর নাম রিং-মাস্টার। কী সাহস! বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে চড়াং করে এমন চাবুক চালালে, বাঘ ভয়ে এপাশ থেকে ও-পাশে মারল এক লাফ! বেশ করেছে মেরেছে। বাঘের মুখখানা দেখেই হুল্লোর সববশরীর জ্বলে গেল। কাল হুপ্পোকে বাঘটা খোঁড়া ল্যাং ল্যাং বলে ভেংচি কেটেছিল। আরও দু-ঘা দিয়ে দিক না!
বাঘের খেলা দেখতে দেখতে বাচ্ছা ছেলেমেয়েরা কিন্তু খুব খুশি! খুশিতে এমন চেঁচিয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে, যদি পায় তো এক্ষুনি বাঘের পিঠে লাফ দেয়। তবে ভয় কি পাচ্ছে না? কেউ কেউ তো ভয়ে আঙুল চুষছে, কেউ কেউ চোখ রগড়াচ্ছে! হুপ্পো গ্যালারির নীচে চুপটি করে বসে যত না বাঘের খেলা দেখছে, বাচ্চাদের হাসি হাসি মুখগুলি দেখছে তার চেয়েও বেশি। ভালো লাগে, হুল্লোর খুব ভালো লাগে এই হাসি-হাসি মুখগুলি দেখতে। ঝুমকির মুখখানি যখন হাসিতে উছলে ওঠে, তখন কী সুন্দর দেখতে লাগে!
হঠাৎ হুল্লোর চোখ থেকে সার্কাসের ওই অগুনতি ছেলেমেয়ের মুখগুলি নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে, একটি মুখ ভেসে উঠল। অগুনতি ছেলেমেয়ের হাসির সুরগুলি হারিয়ে গিয়ে, একটি মুখের হাসি ওর কানে ছড়িয়ে পড়ল। চমকে উঠল হুপ্পো। একদম সামনে, হুপ্পো যেদিকে বসে আছে ঠিক তার উলটোদিকে বাবার সঙ্গে বসে ঝুমকি সার্কাস দেখছে! ইচ্ছে করলে, এখুনিই, এখান থেকে একটা লাফ মেরে ও ঝুমকির কোলের ওপর গিয়ে বসে পড়তে পারে! কিন্তু বাধ সেধেছে ওই রেলিং দিয়ে ঘেরা বাঘের খেলার জায়গাটা।
ঝুমকিকে দেখে আনন্দে শিউরে উঠল হুপ্পো। গ্যালারির নীচ থেকে হুপ্পো ঝড়ের মতো আছাড় খেয়ে বেরিয়ে এল। একবারও মনে হল না, সবাই ওকে দেখে ফেলবে। দেখতে। পেলে যে কী কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, সে-কথাও ভাবল না। ধরো, যদি বাঘটা দেখতে পায়!
দেখতে পায় মানে! বাঘটা কি কানা যে দেখতে পাবে না? হুপ্পো নিজেই তো দেখা দিয়ে বসল। গ্যালারির নীচ থেকে বেরিয়েই ওই সামনের খাঁচার রেলিংগুলোর ওপর লাফ মেরেছে। কারণ, খাঁচা না ডিঙোলে, হুপ্পো এ-পাশ থেকে ও-পাশে ঝুমকির কাছে যাবে কী করে? আর কোনো কথা শোনে বাঘ! কাল থেকে বাঁদরটার ওপর একেই চটে আছে। এখন দেখতে পেয়ে একেবারে হালুম করে লাফিয়ে উঠল। কী চিৎকার, কী গর্জন! হুল্লোও বাঘের গর্জনে আঁতকে উঠেছে। তিড়িং করে লাফিয়ে ছিটকে পড়েছে।
প্রথমটা সকলে ভেবেছিল, এটাও বুঝি আর একটা নতুন খেলা। বাঘ-বাঁদরের লড়ালড়ি। কিন্তু তা তো নয়! এ তো দেখি, বাঘটা ভীষণ খেপে গেছে! কী কান-ফাটানি হাঁক পাড়ছে! রিং-মাস্টারও চাবুক চালাচ্ছে, সপাং সপাং। কিন্তু বাঘ শুনছেই না। ও লাফাচ্ছে, হুল্লোকে ধরবে। হুপ্পোও জানে, বাঘ যতই চেষ্টা করুক, তাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু লোকজনের ভীড় ঠেলে ও তো ঝুমকির কাছেও যেতে পারছে না। আচ্ছা, ঝুমকিও কি হুপ্পোকে চিনতে পারছে না? চেনা শক্ত। বাঁদরগুলো তো একইরকম দেখতে। ওর গায়ে তো আর হুল্লো। নামের ছাপ মারা নেই।
হঠাৎ বাঘটা ধাঁই করে খাঁচার রেলিং-এর গায়ে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আয় বাঁদরটা, ভাঙি আদরটা।’
বাঘের এই রাগ-রাগ কথাগুলো হুপ্পো ছাড়া আর কে বুঝবে! হুপ্পো বাঘকে আরও রাগিয়ে দেবার জন্যে হি হি করে হেসে উঠল। তরতর করে তাঁবুর দড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল। উঠে গিয়ে চ্যাঁচাল,
‘আমায় যে বলেছে ল্যাংড়া, তাকে লাথি মারে ব্যাংরা।’
বলে হাত দিয়ে বগ দেখাল। ব্যাস! হইহই কাণ্ড! বাঘ আর বশে নেই। রিং-মাস্টারকেই হালুম করে তেড়ে গেছে। রিং-মাস্টার চাবুক-টাবুক ফেলে, দে লম্বা। বাঘ হালুম হালুম। ডাকতে ডাকতে, রেগে-খেপে খাঁচাটা থাবা দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে পেটাতে লাগল। তিড়িং তিড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে হুল্লোকে ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। ওঃ! সে কী ভয়ানক ব্যাপার!
ব্যাপারটা যখন গড়াতে গড়াতে লড়ালড়িতে ঠেকেছে, তখনই সবাই বুঝতে পারল, এটা তো খেলা নয়! যখন দেখল, রিং-মাস্টার বাঘের ভয়ে পালিয়েছে, তখন বুঝল বাঘ। খেপেছে! তাঁবুর ভেতর হইহুল্লোড় লেগে গেল।
যাঃ! সার্কাসের খেলা ভণ্ডুল!
বাঘ গর্জায় হালুম হালুম!
লোক পালাচ্ছে গেলুম গেলুম!
হুড়োহুড়ি করে ভয়ে-ময়ে যে যেদিকে পারছে, পালাচ্ছে। কী ঠেলামেলি! চেপটাচেপটিতে এই বুঝি অঘটন ঘটে যায়! পালাতে গিয়ে কেউ হোঁচট খায়, কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, কেউ ‘বাবাগো মাগো’ বলে কান্নাকাটি লাগিয়ে দেয়। সে যেন এক কুরুক্ষেত্র!
ঝুমকিও যে বাবার হাত ধরে, তাঁবু ছেড়ে ছুটছে, এত গোলমালেও সেটা কিন্তু হুল্লোর চোখ এড়ায়নি। হুপ্পো তাই না দেখে, বাঘকে ছেড়ে ঝুমকির দিকেই নজর রাখল। কিন্তু এখান থেকে নামা তো মুশকিল! চারদিকে লোকে লোকে ছত্রাকার। সব লণ্ডভণ্ড। কোথায় নামবে?
এদিকে সার্কাসের ম্যানেজার-সাহেব যে, এর মধ্যে টেলিফোনে থানায় খবর পাঠিয়েছে, সে-কথা তো হুপ্পোর জানার কথা নয়। থানায় খবর গেছে, দমকলেও খবর গেছে। একেবারে হু-হুঁ শব্দে পুলিশের গাড়ি সেখানে হাজির। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে দমকলের ইঞ্জিনও পৌঁছে গেছে। পুলিশ কেন এসেছে হুপ্পো সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দমকল কেন? ঢং ঢং করে দমকলের গাড়িটা গেট ভেঙে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়ল। গটমট গটমট করে পুলিশও ঢুকেছে। ফটফট ফটফট করে দমকলের লোকেরা, সিঁড়ি খাঁটিয়ে ওপরে উঠতে আরম্ভ করে দিল। বুঝেছি, তাঁবুর ওপর থেকে হুল্লোকে ধরবার ফন্দি। সববনাশ! এখন তো তাহলে বিপদ! বিপদ-টিপদ মানে না হুপ্পো। হুপ্পোর চোখ এখন ঝুমকির দিকে। এখনও ভীড় ঠেলে ঝুমকি বেরুতে পারেনি। কিন্তু পুলিশের লোক দেখে, এই বিপদের সময়েও যে ওর মগজটা দুষ্টুমিতে এমন কিলবিল করে উঠবে, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? ও হাতের বাঁশিটা আবার বাজিয়ে দিয়েছে, পি-পি-ই-ই।
বাঁশির আওয়াজ শুনেই পুলিশকর্তা চমকে উঠেছেন। আরে! এই বাঁদরটাই তো কালকের সেই বাঁদরটা। পুলিশকর্তা হুপ্পোকে চিনে ফেলেছেন। চেঁচিয়ে উঠেছেন, ‘ওই হ্যায়, পাকড়াও।’
হুপ্পো ভাবল, আর নিস্তার নেই। নীচে পুলিশ পাকড়াই পাকড়াই করছে। মধ্যিখানে বাঘ কামড়াই কামড়াই করছে। আর ওপরে দমকলের লোক থাবড়াই থাবড়াই করছে। হুপ্পো তাঁবুর দড়ি ধরে এদিক থেকে ওদিকে দোল খেতে শুরু করে দিল। নাও, এবার ধরো।
কিন্তু হুপ্পো এখান থেকে বেরোয় কেমন করে?
কেমন করে বেরোতে হয় সে হুপ্পো জানে। এদিক থেকে ওদিকে দোল খেতে খেতে তাঁবুর গায়ে ও যে একটা ফাঁক দেখতে পেয়েছে, সে তো আর কেউ জানত না। ওই ফাঁকটা দিয়ে ও তো বেশ সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। চক্ষের নিমেষে সাঁই ই-ই করে মারল এক লাফ। ওই ফাঁকটা দিয়ে সুট করে গলে ও একেবারে তাঁবুর ওপরে। ততক্ষণে ঝুমকিও বাবার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। ওই ভীড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া তো শক্ত। কিন্তু হুল্লোর চোখ। ও ঠিক দেখতে পেয়েছে। ঝুমকিকে সঙ্গে নিয়ে ঝুমকির বাবা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে রাস্তায়। হুট করে একটা ট্যাক্সি ধরে একেবারে তার ভেতরে। ট্যাক্সি ছুটল হুস-স-স।
হুপ্পোও ততক্ষণে তাঁবুর চাল ডিঙিয়ে নেমে পড়েছে। হুপ্পোও ছুটল। ছুটল ট্যাক্সির পেছনে। ঝুপ করে লাফ মারল ট্যাক্সির চালে। তারপর চটপট জানলা গলে একেবারে ভেতরে। ঝুমকির কোলে।
তাঁবুর ভেতর থেকে পুলিশরাও বেরিয়ে এসেছে। হুল্লোকে তারা দেখতেও পেয়েছে। পুলিশও চটপট গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ি ছুটল হুপ্পোকে ধরতে, উ-উ-উঁ!
.
ঝুমকি, হুপ্পো আর পুলিশের বড়োবাবু
একটু দেরি হয়ে গেছল পুলিশের গাড়িটা ছাড়তে। তবে অনেকখানি দূরে চলে গেলেও ওরা ঠিকই নজর রেখেছে ট্যাক্সিটার ওপর। ওরা ঠিকই পেছন নিয়েছে।
পিচ-ঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে হুস হুস করে বাস, লরি, মোটর গাড়ি ছুটে চলেছে। তাদের। কাটিয়ে কাটিয়ে ঝুমকিদের বাড়িতে ট্যাক্সি যখন পৌঁছোল, তখন পুলিশগাড়ির পাত্তা নেই। কিন্তু মজা কী, এটা ঘুণাক্ষরে ঝুমকিও জানে না, ঝুমকির বাবাও জানে না, হুপ্পোকে ধরবার জন্যে একগাড়ি পুলিশ তাদের পেছনে তাড়া লাগিয়েছে।
বাড়ির দরজায় নেমে, হুল্লোকে কোলে নিয়ে, ঝুমকি একেবারে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকে গেল, ‘মা, মা, হুপ্পো!’
মা ছুটে এল। ঠাকুরও ছুটে এল। বাবাও ঘরে ঢুকে হুপ্পোর চেহারাটা ভালো করে দেখার জন্যে এগিয়ে এসেছে। ঠিক তখনই, ক্যাঁচ করে আওয়াজ। একটা গাড়ি এসে থামল যেন ওদের বাড়ির সমানে। দরজায় ধাক্কা পড়ল, ‘বাড়িতে কে আছেন? দরজা খুলুন।’
ঝুমকির বাবা ছুটে গেল। দরজা খুলেই তার চক্ষুস্থির! দরজার সামনে একগাড়ি পুলিশ।
‘আপনাদের ট্যাক্সিতে চেপে একটা বাঁদর এসেছে?’ পুলিশের বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
বাবা উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ও তো হুল্লো। আমাদের পোষা বাঁদর!’
‘সেকি মশাই!’ বড়োবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ‘বাঁদরটাকে তো আমরা নিয়ে যাব।’
‘কেন?’
‘বাঁদরটা আমাদের একটা বাঁশি নিয়ে পালিয়েছে। সার্কাসের তাঁবুতে ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। বাঁদরটা খেপে গেছে।’
ততক্ষণে হুল্লোকে কোলে নিয়ে ঝুমকিও সেখানে হাজির হয়েছে। ঝুমকির কোলে হুপ্পোকে দেখে পুলিশের বড়োবাবু আঁতকে উঠে, ‘খেপা-বাঁদর খেপা-বাঁদর’ বলে এমন চেঁচিয়ে উঠলেন যে ঝুমকির হাসি পেয়ে গেল।
ঝুমকি বলল, ‘ওমা! আপনি ভয় পেয়ে গেলেন? খেপা কেন হবে! আমায় কামড়াচ্ছে? আমার পোষা। নিন না, আপনি কোলে নিন, কিচ্ছু বলবে না।’
কোলে নেওয়ার কথা শুনে বড়োবাবু ‘না, না’ বলে এক-পা পিছিয়ে গেলেন। পিছিয়ে অবাক হয়ে একবার হুল্লোর মুখের দিকে আর একবার ঝুমকির মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পোষা?’
‘হ্যাঁ তো।’
‘কামড়ে দেয় না?
‘না তো!’
হুপ্পোটা যে খেপা নয়, এ-কথা জেনে আর ঝুমকির মিষ্টি মিষ্টি মুখখানা দেখে, বড়োবাবুর রাগী-রাগী চোখ দুটোতে কেমন যেন ঠান্ডা-ঠান্ডা মেজাজ ভেসে উঠল। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নিজের বাঁদর? কোথা পেলে?
‘বাবা কিনে দিয়েছে।’
‘তুমি বাঁদর নিয়ে খেলা করো?’
‘আমি হুল্লোকে ভালোবাসি।
স্কুলে যাও না?’
‘ফার্স্ট হই।’
‘ভেরি গুড।’ বলে পুলিশের বড়োবাবু ঝুমকির মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন।
ঝুমকি বলল, ‘হুল্লোও আমার সঙ্গে পড়ে।’ তারপর হুল্লোর গালটা টিপে জিজ্ঞেস করল, ‘না রে?’
হুপ্পো ঘাড় নাড়ল, কী মাথা হেলাল বোঝা গেল না। কিন্তু পুলিশের বড়োবাবু আর একগাড়ি পুলিশ একসঙ্গে এমন হো-হো করে হেসে উঠলেন কথাটা শুনে যে, ঝুমকির নিজেরই লজ্জা করল।
বড়োবাবু বললেন, ‘জানো, তোমার বাঁদরটা আমাদের বাঁশি চুরি করেছে। আমরা যদি ধরে নিয়ে যাই?
‘বাঁদর আবার চুরি করে নাকি?’ ঝুমকির উত্তর।
ঝুমেকির উত্তর শুনে বড়োবাবু একটু থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন, ‘চুরি না ঠিক, মানে দিচ্ছে না।’
‘কই বাঁশি?’ ঝুমকি জিজ্ঞেস করল।
বড়োবাবু বললেন, ‘ওই তো, ওর হাতে।’
ওঃ! কী দুষ্টু দেখো। বাঁশিটা হাতের মুঠোর মধ্যে এমন লুকিয়ে রেখেছে যে, এতক্ষণ ঝুমকি দেখতেই পায়নি! ঝুমকি হুপ্পোকে বলল, ‘বাঁশিটা দিয়ে দে।’
সঙ্গে সঙ্গে হুপ্পো হাত বাড়িয়ে বাঁশিটা বড়োবাবুকে দিয়ে দিল। বড়োবাবু বাঁশিটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘বা! বেশ কথা শোনে তো!’
ঝুমকির বাবা এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার বলল, ‘ভেতরে আসুন, একটু চা-টা–’
বড়োবাবু বললেন, ‘না, না, চায়ের দরকার নেই। চা তো মশাই সারাদিন খাচ্ছি। আর আমাদের খাবারের আছেই বা কী! সময়ই বা কই? খুনি-ডাকাতের পেছনে ছুটতে ছুটতেই তো জীবন কেটে গেল। মানুষের পেছনে ছোটা এক জিনিস। দেখুন, বাঁদরের পেছনেও ছুটতে হচ্ছে।’ কথাটা বলেই বড়োবাবু হেসে উঠলেন। ঝুমকির বাবাও হাসতে হাসতে সায় দিল।
ঝুমকি বলল, ‘তা বলে আমার হুপ্পো কিন্তু ডাকাত নয়।’
বড়োবাবু বললেন, ‘ডাকাত নয়। কিন্তু বড্ড দুষ্টু। আমায় ভয়ানক হেনস্তা করেছে।’
ঝুমকি বলল, ‘দুষ্টুমি করে বলেই তো ওর নাম বাঁদর।’
বড়োবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক কথা।’ তারপর ঝুমকির বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘সত্যি মশাই, ঘরে দুষ্টুমি করার মতো কেউ না থাকলে, ঘর যেন মানায় না। এই দেখুন না আমার ছোটো ছেলেটা, এমন দুষ্টু, কী বলব! তাকে সামলাতে তার মায়ের তো হাড়-মাস কালি। আমার তো দুষ্টুমি করলে বেশ ভালো লাগে।’
‘একটু চা হবে না?’ ঝুমকির বাবা আবার জিজ্ঞেস করল।
‘না মশাই, চলি। ধরতে এলুম বাঁদর, উলটে আপনার মেয়েটিকে দেখে আমার মন ভুলে গেল। আপনার মেয়েটি বড্ড ভালো।’ বলে ঝুমকির গালটা টিপে দিলেন। তারপর বললেন, ‘তাহলে চলি। হ্যাঁ, তোমার বাঁদরের নাম তো বললে হুপ্পো, তোমার নিজের নাম বললে না তো?’
‘ঝুমকি।’
‘বা! বেশ নামটি! একদিন এসো আমাদের ওখানে।’
‘কোথায়? জেলখানায়?
‘আরে না, না। আমার বাড়িতে।’
‘আপনি আবার আসবেন তো?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসব। কী খাওয়াবে?’
‘পায়েস। মা খুব ভালো কমলালেবুর পায়েস করতে পারে।’
‘তাই নাকি? ভেরি গুড!’
‘কবে আসবেন?’
‘তোমার বাঁদরের যেদিন বিয়ে হবে!’
‘সত্যি!’ খুশিতে মুখখানি উছলে গেল ঝুমকির।
হাসতে হাসতে বড়োবাবু গাড়িতেই উঠতে যাচ্ছিলেন। তারপর কী মনে হল, ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘না, এই বাঁশিটা আমি তোমার বাঁদরকেই দিয়ে দিলুম।’ বলে হুল্লোর দিকে চেয়ে বললেন, ‘এই নে, নে।’
হুপ্পো হাত বাড়াল।
তারপর পুলিশের বড়োবাবু গাড়িতে চাপলেন। ঝুমকির দিকে চেয়ে হাত নাড়লেন। গাড়ি চলে গেল। ওমা! হুপ্পোটা কী শয়তান! গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁশিটা বাজিয়ে দিল, পি পি-ই-ই। গাড়ি কিন্তু আর থামল না।
ঝুমকির কী আনন্দ! ‘দুষ্টু, দুষ্টু, কোথায় গেছলি?’ বলে গালটা টিপে এমন আদর করতে লাগল, হুল্লোর মনে হল, এখন ছেড়ে দিলে বাঁচি। এখন ওর যা খিদে পেয়েছে! আদর খেয়ে কি পেট ভরে?
ঝুমকির আনন্দ দেখে, বামুনঠাকুরও আজ আহ্লাদে ডগমগ।
আর মা? হুপ্পো আজ সব প্রথম দেখল, হুপ্পোর মুখের দিকে চেয়ে মা-ও মুচকি মুচকি হাসছে। আজ মাকে বেশ লাগছে হুপ্পোর। সত্যি, মায়ের মুখখানি যে এত মিষ্টি, হুপ্পো যেন আজই প্রথম সে-কথাটা বুঝতে পারল!