বাজনা – ৩

আরি সরবনাশ! পাশের ঘরে পা দিয়েই বাজনার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কী কাণ্ড! এ-ঘরে এ কী! এ যে শুধু সোনার গয়না আর রুপোর মোহরে ভরতি! সারা ঘরে শুধু সোনার গয়না। ছড়ানো, সাজানো, দোলানো। সোনা দুলছে আর টুংটুং বাজছে।

বাজনার চোখ দুটো কাঁপতে লাগল। টুং টুং শব্দ শুনে পা দুটোও নাচতে লাগল। বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, কত সোনার গয়না! কত মোহর দেখো!’

‘নিতে ইচ্ছে করছে?

‘কেউ দেখে ফেললে!’

‘কেউ তো নেই! দেখবে কে?’

‘তবে নি।’ বলে বাজনা এক মুঠো মোহর নিয়ে কোঁচড়ে রাখল।

টাট্টু বলল, ‘এবার আর একটা ঘরে চল, দেখি।’

আয়ি সাবাস! এ-ঘরটা বিরাট। কত উঁচু! মধ্যিখানে কী বড়ো একটা ঘন্টা ঝুলছে!

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, এ-ঘরে একটা ঘন্টা দেখো কত বড়ো!’

‘বাজাও না!’

‘কেউ শুনতে পেলো!’

‘কেউ থাকলে তবে তো শুনবে!’

‘তবে বাজাই,’ বলে বাজনা ঘন্টার দড়ি ধরে টান দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টা বেজে উঠল, ঢং ঢং ঢং ঢং। উঃ কী সাংঘাতিক শব্দ! কান ফেটে যাবার গোত্তর!

টাট্টু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘বাজনা, বাজনা, ঘন্টা থামাও!’

বাজনা তাড়াতাড়ি দড়িটা টেনে ধরল। যাঃ চলে! ঘন্টা তো থামল না! ঢং ঢং ঢং! বাজছে তো বাজছেই!

আরও জোরে টেনে ধরল।

ঘন্টার বয়েই গেছে, সে যেমন বাজছিল তেমনিই বাজছে!

 বাজনা চেঁচিয়ে উঠল, ‘টাট্টু, টাট্টু, ঘন্টা থামছে না!’

টাট্টু বলল, ‘আরও জোরে টান দাও।’

বাজনা গায়ে যত জোর ছিল, টান দিল। টানতে টানতে ঝুলে পড়ল। এই সর্বনাশ! ঘন্টার দড়িও দুলছে, বাজনাও ঝুলছে, ঘন্টাও বাজছে ঢং ঢং ঢং!

‘টাট্টু, টাট্টু, মুশকিল! কিছুতেই থামছে না।’

হঠাৎ যেন চমকে ওঠে টাট্টু! থমকে তাকায় বাজনা টাট্টুর চোখের দিকে। জিজ্ঞেস করে। ‘কী?

টাট্টু মুখখানা ভয়ে কাঁচুমাচু করে বলল, ‘শোন, বাইরে যেন ঘোড়া ছুটছে!’

বাজনা ঘন্টার দড়ি ছেড়ে ছুটে গেল পাখির ঘরে। পাখির ঘরে জানলায় মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে উঁকি দিল।

তাই তো! তাই তো!

ঢং ঢং ঢং ঘন্টা বাজছে, টগবগ, টগবগ ঘোড়া ছুটছে, গাড়ি টানছে। এক্কাগাড়ি!

‘টাট্টু, টাট্টু, আবাক কাণ্ড!’ চেঁচিয়ে উঠল বাজনা।

 ‘কী হয়েছে দেখি দেখি!’ টাট্টুও জানলা দিয়ে উঁকি দিল।

কী দেখল? দেখল কী, এতক্ষণ তো লোক ছিল না পথেঘাটে, এখন লোক চলেছে। লোক চলেছে, একজন না, দুজন না, দলে দলে। ছোটো ছোটো ছেলে যাচ্ছে, মেয়ে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো লোক যাচ্ছে, ঘোড়া-জোতো গাড়ি ছুটছে, উট-টানা রথ চলছে।

দেখতে দেখতে বাজনার চোখ জুড়িয়ে গেল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল ঠায় জানলা দিয়ে।

ঘন্টা কিন্তু এখনও বাজছে ঢং ঢং ঢং!

অবাক কথা! এ আবার কোন দেশি ঘন্টা, আপনা-আপনি বেজেই চলেছে। জাদু নাকি!

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, ঘন্টাটা বোধ হয় জাদু জানে। তা না হলে ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো সব বেরিয়ে এল কোত্থেকে?’

ঘন্টা বাজছে। বাজছে।

ঢং

ঢং

ঢং

হঠাৎ আবার বাজনা অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘টাট্টু, টাট্টু দেখো, দেখো, কারা আসছে!’

টাট্টু বলল, ‘মনে হচ্ছে পল্টন।’

‘তারা কারা? দেখো, দেখো, সকলের কেমন একই রকম জামা। একই রকম পাগড়ি। কেমন দেখো একসঙ্গে পা ফেলছে, হাত নাড়ছে। কোমরে আবার তরোয়াল! কী করবে তরোয়াল দিয়ে?

‘এই ছেলেটা!’

ধক করে ওঠে বাজনার বুকটা। কে যেন ডাকল!

চট করে চাইল বাজনা পেছন দিকে। ঘরের ভেতর তো কেউ নেই। ঘরের দেওয়ালে খোদাই করা পাখিগুলো তেমনিই চুপচাপ বসে আছে। কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। না, বোধ হয় বাজনা ভুল শুনেছে। আবার বাজনা জানলা দিয়ে চেয়ে রইল।

‘এই ছেলেটা, এই ঘোড়াটা!’ আবার যেন সেই ডাকটা বাজনাকে চমকে দিল।

এবার বাজনা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। টাট্টুও চোখ ফেরাল, বাজনাও মুখ ঘোরাল। বাজনা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, টাট্টু কে যেন ডাকছে!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কার গলা বল তো?’

‘আমরা আমরা ডাকছি।’

ওমা! দেখো, দেখো, দেওয়ালে খোদাই করা পাখিগুলো কথা বলছে! কী আশ্চর্য!

বাজনা অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে টাট্রুকে বলল, ‘টাট্টু, দেওয়ালের পাখিগুলো কথা বলে যে!’

‘তাই নাকি!’ চেয়ে দেখল টাট্টু। ‘তাইতো! যেন মিটির মিটির চাইছে।

বাজনা এগিয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

এই দেখো! কোত্থাও কিছু নেই, হঠাৎ পাখিগুলো দেওয়াল থেকে বেরিয়ে এল। উড়ে উড়ে ঘরের এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল, আর ডাকতে লাগল, ‘এই ঘোড়া, এই ছেলে, পালা, পালা, পালা, পল্টন এলে পরে পায়ে দেবে তালা।’–

বাজনা পাখির কথা শুনলই না। উলটে ঘোড়াকে বলল ‘টাট্টু, টাট্টু, একটা পাখি ধরব?’

টাট্টু বলল, ‘ধরে রাখবে কোথায়?’

‘আগে তো ধরি।’ বলে বাজনা দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। বন্ধ করে ‘হুস হাস’ করে তাড়া দিল পাখিগুলোকে। ওমা! কোথায় পাখি, কোথায় কী! উড়তে উড়তে পাখিগুলো যেখানে ছিল সেখানেই চলে গেল। আবার দেওয়ালে খোদাই করা ছবি হয়ে বসে রইল!

বাজনা বলল, ‘তাজ্জব! তাজ্জব!’

 পাখিগুলো আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘ধরল, ধরল, পল্টন ধরল।’

বাজনা ছুট্টে জানলার কাছে গেল। তাড়াতাড়ি মুখ বাড়িয়ে দেখল, তাইতো! পল্টনগুলো এদিকেই তো আসছে!

ব্যস্ত হয়ে বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, টাট্টু, কী করি?”

 টাট্টু বলল, ‘লুকিয়ে পড়ি!’

‘কোথায় লুকাব?’

ঘর থেকে বাইরে চল।’

ঘর থেকে ছুট দিল বাজনা।

ঢং

ঢং

ঢং

ঘন্টা এখনও বাজছে।

গট

মট

গট

পল্টন এদিকেই আসছে।

ঘন্টা বাজছে,

পল্টন আসছে,

বাজনা ছুটছে।

 বাড়িটা যত বড়ো, উঠোনটাও তত বড়ো। দালানটা যত লম্বা, বাগানটাও তত চওড়া।

ছুটতে ছুটতে বাগানে এল বাজনা। লুকিয়ে পড়ল ঝোপের আড়ালে।

গট

মট

গট

সামনে সামনে কে আসছে?

পল্টন-পল্টন সর্দার-পল্টন।

বাববা! সর্দারের কী চেহারা! এইটুকু গোঁট্টা! গালে গালপাট্টা! খাড়া-খাড়া গোঁফ জোড়া! মুখখানা হাঁড়িপারা! গলাটা কী জোরদার! সর্দার চেঁচাল, ‘এই হো, কই হ্যায়?’

হ্যায়?

হ্যায়?

হ্যায়?

সঙ্গের পল্টনগুলোও চেঁচিয়ে উঠল। কেঁপে উঠল ঘর-দালান। বাজনাও টাট্টুকে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে কেঁপে উঠল।

সর্দার আবার হাঁকল, ‘এই হো!’

হো!

হো!

গো!

পল্টনগুলোও হাঁক দিল।

না, কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই।

সর্দার হুকুম দিল, ‘ঘরগুলো দেখো, দেখো!’

অমনি সঙ্গে সঙ্গে অন্য পল্টনগুলো চেঁচিয়ে উঠল,

দেখো

দেখো

দেখো

দেখো

চেঁচাতে চেঁচাতে এ-ঘর ও-ঘর ছুটে ছুটে দেখতে লাগল। খুঁজতে লাগল।

কাউকে দেখতে পেল না। পল্টনগুলো চেঁচিয়ে উঠল,

নেই

নেই

নেই

সর্দার পল্টন মোচে তা দিল। ভাবল, তাই তো! নেই তো বাজল কেন ঘন্টাটা? নেই তো খুলল কেন দরজাটা? নেই তো নোংরা কেন বাইরেটা? ভাবতে ভাবতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তবে দেখো বাগানটা।’

অমনি পল্টনগুলো বাগানের দিকে ছুটল।

বাজনার মুখ শুকিয়ে আমচুর। বলল, ‘টাট্টু, পল্টনগুলো এদিকেই আসছে! কী হবে!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘পালাবার রাস্তা নেই?

‘দেখছি না।’

‘লুকোবার জায়গা নেই?’

 ‘পাচ্ছি না।’

‘তবে গাছের ওপর উঠে পড়ো।’

‘ঠিক বলেছ,’ বলে বাজনা একটা ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া গাছের মাথায় তরতর করে উঠে পড়ল। গাছের পাতার আড়ালে তড়িঘড়ি লুকিয়ে পড়ল।

পল্টনরা এ-গাছের আড়াল দেখে।

ও-গাছে উঁকি মারে।

এ-ঝোপটা নাড়া দেয়।

ওদিকটা তাড়া দেয়।

কিন্তু বাজনাকে দেখতেই পেল না! খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে হঠাৎ একটা পল্টন মাটির দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সর্দার, একটা মোহর!

এই রে! বাজনার কোঁচড় থেকে পড়ে গেছে!

সর্দার দৌড়ে এল। মোহরটা তুলে নিল। মোহরের ঘরের দিকে ছুট দিল। ভাবল, তাহলে তো মোহর চুরি গেছে!

পল্টনগুলোও সর্দারের পিছু পিছু ছুট দিল।

বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, কী হবে? ধরা পড়ে গেছি!’

টাট্টু বলল, ‘পড়ল কী করে?’

‘কী জানি।’

চুপচাপ বসে থাক।’

বাজনা গাছের ওপর চুপচাপ বসে রইল।

সর্দার-পল্টন ছুটতে ছুটতে মোহরের ঘরে ঢুকল।

পল্টনগুলোও ঢুকল।

সর্দার-পল্টন মোহর গুনতে লাগল।

পল্টনগুলোও গুনতে লাগল।

সর্দার-পল্টন গুনতে গুনতে হাঁপিয়ে গেল।

পল্টনগুলোও হাঁপিয়ে গেল।

সর্দার-পল্টন উঠে দাঁড়াল।

পল্টনগুলোও উঠে দাঁড়াল।

সর্দার-পল্টন চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর।’

পল্টনগুলোও চেঁচিয়ে উঠল,

চোর,

চোর,

চোর।

সর্দার-পল্টন ছুট দিল, ‘চোর।’

পল্টনগুলোও ছুটতে লাগল,

চোর,

চোর,

চোর।

ছুটতে ছুটতে পল্টন-সর্দার বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

অন্য পল্টনগুলোও সর্দারের পিছু পিছু ছুটতে লাগল।

ছুটতে ছুটতে পল্টনগুলো বাজনার চোখের বাইরে চলে গেল।

যখন আর কাউকে দেখা গেল না, চারিদিক নিশ্চুপ, নিথর, তখন বাজনা টাট্টুর কানে কানে জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কী করব?

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কাছেপিঠে কাউকে দেখতে পাচ্ছ?’

 ‘না, সবাই চলে গেছে।’

‘ঠিক দেখেছ?’

‘হ্যাঁ দেখেছি।’

‘তবে আস্তে আস্তে গাছ থেকে নামো।’

বাজনা চুপচাপ, ঝুপঝাপ গাছ থেকে নেমে পড়ল। যেই নামল, ওমা! কারা আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর, চোর।’

বাজনার বুকটা টিপটিপ করে উঠল। বাজনা ভয়েময়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘টাট্টু, টাট্টু।’

টাট্টু বলল, ‘ছুট ছুট।’

বাজনাও মার ছুট।

ছুটতে ছুটতে পাখির ঘরে ঢুকে পড়ল। দরজায় খিল এঁটে লুকিয়ে রইল।

লুকিয়ে থাকলেই হল! ওমা! দেওয়ালে খোদাই পাখিগুলো উড়তে আরম্ভ করে দিল আবার ঘরের চারিদিকে। ডাকতে লাগল, ‘চোর, চোর।’

বাজনা একেবারে হাঁদারাম! খিল খুলে দে ছুট। পালা, পালা, পালা।

ছুটতে ছুটতে বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, টাট্টু, কী করি?

 টাট্টু বলল, ‘সরে পড়ি।’

‘কোথায়?

‘রাস্তায়।’

রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল বাজনা।

রাস্তায় বেরুতেই টাট্টু বলল, ‘আর ছুটো না।’

‘তবে?’

‘ওই এক্কাটার পেছনে উঠে পড়।’

সামনে একটা এক্কাগাড়ি ছুটছিল। বাজনা তার পেছনে টুপ করে উঠে পড়ল। উঠে ঘাপটি মেরে পেছনে বসে রইল।

যাঃ! এক্কা ছুটতে ছুটতে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

সহিস দেখতে পেয়েছে।

 টাট্টু চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাজনা পালাও।’

বাজনা আগুপিছু কিছু ভাবল না। টাট্টুর কথা শুনেই এক্কার পেছন থেকে লাফ দিয়ে মার ছুট!

সঙ্গে সঙ্গে সহিসও চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘ভাগলো, ভাগলো।‘

 ছুটতে ছুটতে বাজনা লুকিয়ে পড়েছে।

সহিসও পিছু নিল।

 বাজনা বড়ড়া বাড়িটার আড়ালে লুকাল।

 সহিস ছোটো বাড়িটার পেছনে দাঁড়াল।

বাজনা সরু গলিতে ছুট দিল।

সহিস কানা গলিতে হাঁক দিল।

 হাঁক দিলে কী হবে? বাজনা সরু গলি ধরে পগারপার। সরু গলিতে লোক ছিল না রক্ষে!

পগারপার বললেই কী পার পাওয়া যায়!

সরু গলি পেরুতেই ছোটো গলি।

ছোটো গলি ডিঙুতেই বড়ো গলি।

বড়ো গলি মাড়াতেই ধাঁধা।

ছোটো গলি,

বড়ো গলি,

কানা গলি,

সরু গলি!

যাঃ! ধাঁধায় পড়ে গেছে বাজনা! কিছুতেই বেরুতে পারছে না। ঘুরে-ফিরে একই রাস্তায় বার বার পড়ছে, ছুটছে আর ভোঁচক্কর খাচ্ছে।

বাজনা ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে টাট্টুকে বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, ভারি মুশকিল!’

‘কেন? কী হল?’

‘এ-গলি, সে-গলি একই গলিতে ছুটছি। ধাঁধায় পড়ে গেছি। বেরুবার রাস্তা পাচ্ছি না!

টাট্টু বলল, ‘চেষ্টা করো। বেরুতেই হবে। নাইলে নির্ঘাৎ বিপদ!’

 ‘আর পারছি না যে! ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেছি।’

‘তবে চট করে আড়ালে একটু জিরিয়ে নাও।’

খুঁজেপেতে একটু আঁধি-আঁধি ছায়া-ছায়া জায়গা দেখতে পেল বাজনা। ছুট্টে গিয়ে ওই অন্ধকার-ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল।

হাঁপাতে-হাঁপাতেই বাজনা বলল, ‘টাট্টু, এদিকটা বেশ অন্ধকার, সহজে কেউ দেখতে পাবে না।’

টাট্টু বলল, ‘চুপটি করে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাক। দেখো, কারো নজরে না পড়ে যাও।’

‘টাট্টু, বসব?

‘বসো।’

বাজনা বসে পড়ল। বসে বসে জিরুতে লাগল। বুকের যা ধুকপুকুনি! সহজে কি থামতে চায়!

থামল একটু পরে। একটু পরে আবার ফিসফিসিয়ে বাজনা টাট্টুকে বলল, ‘টাট্টু, কী করতে কী হয়ে গেল!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? কী হল?’

‘আমার তো নামের কোনো কিনারা হল না, খালি একটার পর একটা বিপদেই পড়ছি!’

‘ভালো কিছু পেতে গেলে এমন অনেক বিপদ কাটিয়েই তবে পেতে হয়। সহজে যা পাওয়া যায় তার কী দাম!’

‘হ্যাঁ, যাকগে! যত পারে বিপদ আসুক! হুমচক্কার দেশ আমাকে খুঁজে বার করতেই হবে। নাম আমাকে পালটাতেই হবে!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কোঁচড়ে মোহরগুলো ঠিক আছে তো?’

বাজনা কোঁচড়টা ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো করে বেঁধে রেখেছি!’

‘আর ট্যাঁকে বদ্যির দেওয়া চাবিটা?

চাবির কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠল বাজনার। এতক্ষণ মনেই ছিল না। ট্যাঁকে চট করে হাত দিয়ে বাজনা দেখে নিয়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, চাবিও আছে।’

টাট্টু বলল, ‘খুব সাবধান, যেন হারায় না! তা হলে কিন্তু সব মাটি!’

‘না না। পাগল!’ বলে বাজনা ট্যাঁকের কাপড়ে আরেকটা পাক দিয়ে চাবিটা আরও শক্ত করে এঁটে রাখল।

টাট্টু বলল, ‘আর বেশিক্ষণ বসা ঠিক নয়। দেখো দিকি সহিসটাকে দেখতে পাচ্ছ কি না!’

‘দেখব?’ উঠে দাঁড়াল বাজনা। এগিয়ে গেল ক-পা।

টাট্টু বলল, ‘খুব সাবধান! খুব চুপিসাড়ে এদিক-ওদিক দেখে হাঁটো!’

বাজনা ভয়ে জুজুবুড়ি। গুটিগুটি পা ফেলল।

একটুখানি হাঁটতেই বাজনা থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ কানে যেন কীসের শব্দ ভেসে আসছে! মিষ্টি মিষ্টি!

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘বাজনা, দাঁড়াও কেন?”

 বাজনা কান পেতে শুনতে শুনতে বলল, ‘শুনতে পাচ্ছ?’

 ‘কী?’

‘জলতরঙ্গ বাজছে!’

‘কই?’ টাট্টুও কান পাতল। ‘তাই তো!’

‘চলো, এগিয়ে দেখি।’ এগিয়ে চলল বাজনা। এত মিষ্টি আহা!

বাজনা যত এগিয়ে চলেছে, সুরও তত কাছে এগিয়ে আসছে। কাছে, আরও কাছে। শুনতে শুনতে অনেকদূরে চলে এসেছে বাজনা। কোথায় চলেছে, একদম খেয়াল নেই তার!

টাট্টু বলল, ‘কই? কিচ্ছু তো দেখা যাচ্ছে না! শুধু শোনাই যাচ্ছে!’

বাজনা উত্তর দিল, ‘তাইতো দেখছি। যেন ভেলকি!’

‘কোনদিক থেকে আসছে বল তো শব্দটা?’

‘কী জানি বুঝতে পারছি না।’

‘আবাক কাণ্ড! মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও বাজছে, অথচ চোখে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’

সামনে বাজতে বাজতে হঠাৎ মনে হল জলতরঙ্গের সুর যেন বাজনার পেছনেই বেজে উঠেছে। চমকে পেছনে ফিরল বাজনা। পেছনে ফিরতেই আবার সামনে বেজে উঠল। আঁতকে সামনে চাইল বাজনা। সামনে বেজেই এবার এগিয়ে চলেছে সুরটা। বাজনাও এগিয়ে চলেছে।

যাঃ! বাজনা বিপদের কথা একদম ভুলে গেল। টাট্টুর মুখেও কথা নেই, বাজনাও চুপচাপ। দুজনেই বাবা। আনমনা। বিপদ যে আসতে পারে একথা আর মনেই নেই। শুধু সুর শুনতে শুনতে এগিয়ে চলল।

চলতে চলতে বাজনা যেন একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল। বোঝা যায় না এটা পাহাড়ের গুহা, না মাটির নীচে সুড়ঙ্গ। আঃ! জলতরঙ্গের সুরটা এবার যেন বাজনার কানের কাছে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে!

সত্যি সত্যি বাজনারও মনটা খুশিতে ভরে গেল। বুকখানা আনন্দে ঝিকমিক করে উঠছে! হঠাৎ দূরে আলো দেখা গেল। মনে হল কে যেন জমাট অন্ধকারের কপালে আলোর টিপ পরিয়ে দিয়েছে। প্রথমে একটি, তারপর আরও একটি, তারপরে একটি, দুটি, তিনটি, অসংখ্য আলো। আলোর শেষ নেই। শুধু আলো আর আলো! আলোর মধ্যে দিয়েই চলেছে বাজনা।

আচমকা এক বিকট চিৎকার, ‘এই-হো-হো-হো!’

বাজনা চমকে ওঠার আগেই দপদপ করে সব আলো নিমেষের মধ্যে নিভে গেল। আবার অন্ধকার। জমাট অন্ধকার। তারপর সব থমথম। না জলতরঙ্গের সুর, না কিচ্ছু! তাইতো! এ আবার কী!

আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে হাতড়েও বাজনা পথ চিনতে পারল না! এবার বাজনা ভুল বুঝতে পেরেছে! এইরে! নিশ্চয়ই তাকে জলতরঙ্গের শব্দ শুনিয়ে এই সুড়ঙ্গে বন্দি করে ফেলেছে! কী হবে এবার!

বাজনার কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু কাঁদবে কী! ভয়েই গলা কাঠ!

এমন সময় বাজনার পেছনে কে ধমক দিল, ‘এই-ই-ই।’ কী ভয়ংকর গলা! বিচ্ছিরি!

বাজনা ‘আঁক’ করে আঁতকে উঠল। ভয়েময়ে অন্ধকারেই ছুট দিল।

ছুটলেই হল! হঠাৎ আবার কে যেন হেসে উঠল বাজনার সামনে, ‘হো-হো-হো!’

 বাজনা থমকে দাঁড়িয়েই পেছনে ছুটল

পেছনেরও পথ আটকে আবার কে হেসে উঠেছে, ‘হা-হা-হা!’

তারপর চারিদিক থেকে হাসির শব্দ, হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, হো-হো-হো, হি-হি-হি।

অন্ধকার সুড়ঙ্গটা বিকটা হাসির শব্দে কেঁপে উঠছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোনদিকে পালালে নিস্তার পাবে তাও ঠাওর করতে পারল না বাজনা। তবু পেছন দিকেই ছুট মারল। সঙ্গে সঙ্গে ধাঁই করে এক ধাক্কা দেওয়ালে। ছিটকে পড়ে গেল বাজনা মাটির। ওপর। ঠিক তক্ষুনি ভাঁটার মতো চোখ বার করে কারা যেন এগিয়ে আসছে বাজনার দিকে! কী বিচ্ছিরি হিংসুটে চোখগুলো!

চেঁচিয়ে কেঁদে ফেলল বাজনা!

যত কাঁদছে, চেঁচাচ্ছে, তারাও ততই হাসছে, হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, হো-হো-হো!

মনে হচ্ছে বাজনার গলাটা তারা টিপে ধরবে এখুনি! এখুনি ওকে গিলে খেয়ে ফেলবে!

না, হঠাৎ নূপুর বেজে উঠল, ঝুনঝুনঝুন। কে যেন নূপুর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে! অন্ধকারে কার পায়ে নূপুর বাজে!

সেই ভয়ংকর হাসির শব্দ দেখতে দেখতে চটপট থেমে গেল। সেই হিংসুটে চোখগুলো ঝুপঝাপ বুজে গেল। সেই পাঁচটা না ছটা, ছটা না দশটা মুখ অন্ধকারে চুপচাপ লুকিয়ে পড়ল।

ঝুনঝুনঝুন, নূপুরের সুর কার পায়ে বেজে বেজে বাজনারই দিকে এগিয়ে আসছে? হাতে তার লণ্ঠন। অন্ধকারে যেন জোনাকি! আলো দুলছে তার হাতে। দুলতে দুলতে কাঁপছে আলোর শিখা। নিভতে নিভতেও জ্বলে উঠছে। কে আসছে?

বাজনারই সামনে এসে দাঁড়াল। লণ্ঠনের আলো তার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। বাজনা স্পষ্ট দেখতে পেল তার সামনে দাঁড়াল একটি মেয়ে! ফুটফুটে! তার চেয়ে অনেক বড়ো হাতের লণ্ঠনটি নীচু করে বাজনার চোখের দিকে তাকাল মেয়েটি। কথা বলল না। বাজনার। হাতের দিকে নিজের হাতটি বাড়িয়ে দিল। বাজনা মেয়েটির হাত ধরে হতভম্বের মতো উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি হাঁটা দিল। বাজনাও তার হাতে হাত রেখে বোবার মতো হেঁটে চলল।

খানিকটা এসেই দাঁড়াল মেয়েটি। বাজনাও দাঁড়াল। বাজনা লন্ঠনের ছায়া-ছায়া আলোয় স্পষ্ট দেখল সামনে একটা ফটক। মস্ত বড়ো। একজন লোক দাঁড়িয়ে। বিকট চেহারা। বোধ হয় দ্বারী। দ্বারী তার কোমর থেকে একগোছা চাবি বার করল। ফটকের তালা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে ক-জন তাগড়াই-তাগড়াই লোক এসে ফটকের দরজায় ঠেলা মারল, ‘হেঁইও মারি জোয়ান ঠেলি।’ ফটকের দরজা খুলে গেল।

হাত ধরেই বাজনাকে নিয়ে চলল মেয়েটি ফটকের মধ্যে। আবছা-আবছা আলো, তাই বাজনা বুঝতে পারল না কোথা যাচ্ছে! কোথা দিয়ে হাঁটছে ও? এটা ঘর, না দালান, মাঠ, না উঠোন? বোঝাই যায় না। কতদূর যেতে হবে?

আর বেশি দূরে যেতে হল না। এবার একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। ঘরে তালা ঝোলানো। এবারও আর একজন চাবি দিয়ে চটপট তালা খুলে ফেলল। বাজনার হাতটি ধরে ঘরে ঢুকে গেল মেয়েটি।

একটু পরেই বেরিয়ে এল মেয়েটি।

কিন্তু একী! তার হাতটি ধরে বাজনা তো বেরিয়ে এল না! কোথা গেল বাজনা? ও আসবে না বাইরে?

না, ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আবার শেকলে তালা এঁটে গেল। বন্দি হয়ে রইল বাজনা এই ঘরে!

প্রথমটা মনে হয়েছিল খুব চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে বাজনা বন্দি-ঘরে। গায়ে যত জোর আছে সব দিয়ে ঘরের দরজাটা ভেঙে ফেলে চুর-চুর করে। না, ওর মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না। ও যেন একেবারে হাঁদা হয়ে গেল! ভীষণ ভয়ে জবুথবুর মতো থমথমিয়ে চেয়ে রইল বন্ধ দরজার দিকে! তবু রক্ষে, মেয়েটি তার হাতের লণ্ঠন বাজনার এই বন্দি-ঘরেই রেখে গেছে! তা না হলে এই ঘরে, অন্ধকারে গুমরে গুমরে তাকে রাত কাটাতে হত। কিন্তু এখন কী করবে সে?

টাট্টুই প্রথম ডাকল, ‘বাজনা!’

বাজনা থতমত খেয়ে টাট্টুর মুখের দিকে চাইল। আশ্চর্য তো! এত কাণ্ড হয়ে গেল, কিন্তু টাট্টু বাজনার মুঠির মধ্যে তেমনিই গুটিসুটি লুকিয়ে আছে! আমি ভাবি, ও বুঝি কোথায় ছিটকে পড়েছে! তাই যদি হয়, কী হবে তখন? কে দেখবে তখন বাজনাকে?

টাট্টু আবার ডাকল, ‘বাজনা, কী ভাবছ?’

‘এ কোথায় এলুম?’ বাজনার গলায় কান্নার সুর।

টাট্টু বলল, ‘চুপ, কথা বোল না।’

‘আমার ভয় করছে। এরা যদি মারে?

টাট্টু উত্তর দিল, ‘ভয় পেলে চলে! উপায় একটা কিছু বার করতেই হবে। মনে মনে সাহস আনো, নইলে তোমার বিচ্ছিরি নামটা সুচ্ছিরি হবে কেমন করে?’

তাই তো!

বাজনা ভাবলে টাট্টু ঠিক বলেছে। তাই মনে মনে সাহস আনল। আনমনে চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে বন্দি-ঘরের এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। তেমন দেখার মতো কিছুই নেই ঘরের ভেতর। একদিকে একটা চৌকি, বিছানা পাতা। আর একদিকে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা দেরাজ।

দেরাজ কেন?

বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, ঘরে দেরাজ কেন?’

‘দেখোনা খুলে কিছু আছে কি না!’

‘দেখব?’ বলে দেরাজটা খুলে ফেলল বাজনা।

না, দেরাজে কিছু নেই। আছে শুধু একটা শিলেট আর পেনসিল। তা ছাড়া ভোঁ-ভোঁ!

শিলেটটাই হাতে নিল বাজনা। শিলেটে কী যেন লেখা! হ্যাঁ তো!

‘টাট্টু, শিলেটে কীসব লেখা।’ শিলেটটা হাতে নিয়েই বাজনা ছুটে গেল টাট্টুর কাছে।

 টাট্টু বলল, ‘কী লেখা পড়ো না!’

শিলেটটা লন্ঠনের কাছে নীচু করে ধরে বাজনা পড়ল, ‘কাল সকালে তোমার বিচার হবে।’

 লেখাটা পড়ে ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল বাজনার। জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, কীসের বিচার?’

 ‘বুঝতে পারছি না।’

‘আমাকে মারবে?’

‘মারতেও পারে ছাড়তেও পারে।’

‘চল পালিয়ে যাই।’

‘পালাবে কী করে? ঘরে বন্দি করে রেখেছে যে!’

‘হো-হো-হো!’ হঠাৎ যেন বাইরে কে হেসে উঠল। হাসি শুনে আচমকা বাজনার হাত থেকে শিলেটটা পড়ে গেল ঘরের মেঝেয়, ঠং! ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ছুট্টে বিছানায় বসে পড়ল বাজনা চুপচাপ।

ভয় পাচ্ছে খুব। তেমনি ক্লান্তি। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি।

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘বাজনা ভয় পাচ্ছে?’

বাজনা বলল, ‘ভয়ও পাচ্ছে, ক্লান্তিও লাগছে।’

‘শুয়ে পড়ো।’

‘না বাবা, যা কাণ্ডকারখানা। শুয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে তোমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করি। কাল রাতে কী আছে কে জানে!’

টাট্টু বলল, ‘না, কথাবার্তা বেশি না বলাই ভালো।’

‘তবে বসে থাকি।’

বসে রইল বাজনা।

কতক্ষণ আর ঠুটো-জগন্নাথের মতো বসে থাকা যায়! বাজনার চোখের পাতায় ঘুম আসছে জড়িয়ে জড়িয়ে। হাই উঠছে। জোর করে কি ঘুমের সঙ্গে আড়ি করা যায়! মাথাটা চুলে পড়ল বাজনার।

সঙ্গে সঙ্গে আবার বিচ্ছিরি হাসি, ‘হা-হা-হা।’

চমকে সিধে হয়ে বসল বাজনা। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকাল। ঘরের মধ্যে কাউকেই দেখতে পেল না। দরজা তো বন্ধ। ঘরে কে ঢুকবে! একী বাবা! ঘরে কেউ কোত্থাও নেই, অথচ হাসছে কে? উঠে দাঁড়াল বাজনা।

টাট্টু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা যাচ্ছ?

‘কোথাও না। পায়চারি করি।’

‘কেন?’

‘বিছানায় বসে থাকলে ঘুম পাচ্ছে।’

কথা শেষ না হতেই ঘরের দরজা খুলে গেল, ঝনঝনঝন, ঝুনঝুনঝুন, নূপুর পরে সেই মেয়েটি আবার ঘরে ঢুকল। হাতে খাবারের থালা। বাজনার সামনে রেখে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নাও। আমি তোমার মালতিদিদি। আমায় মনে রেখো।’ বলে আবার নূপুর বাজিয়ে ফিরে গেল।

ঘরের দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

আবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বাজনা। কী মিষ্টি গলার স্বর! আদর মাখা।

টাট্টু ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

‘খাবার।’

‘খেয়ে নাও।’

‘না, ভালো লাগছে না।’

খিদে পাচ্ছে না?

‘পাচ্ছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে কী!

‘খিদে যখন পাচ্ছে, তখন ভালো না লাগলেও খেয়ে নেওয়া ভালো। কাল কিছু জুটবে, কি না জুটবে কেউ জানে না তো।’

মনে মনে ভাবল বাজনা, হ্যাঁ ঠিক কথাই। খেতে বসে গেল।

গরম ফুলকো-ফুলকো লুচি, আলুর দম, চাটনি, রসগোল্লা। চেঁচে-পুঁছে খেয়ে ফেলল বাজনা।

এবার সত্যিই বাজনার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। পেটে কিছু পড়লে ঘুম যেন বেশি বেশি পেয়ে বসে! তাই টাট্টুকে বলল, ‘বড় ঘুম পাচ্ছে।’

‘শুয়ে পড়ো। আর শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।’

‘শুলেই যদি আবার কেউ হেসে ওঠে!’

‘আমি জেগে আছি, তুমি শুয়ে পড়ো। খেলনা-পুতুলের তো আর ঘুম পায় না।’

সত্যি আর পারছিল না বাজনা। শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল।

রাতটা যে কখন এসেছে কে বুঝবে বলো! অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে তো আর দিন-রাত কিছু বোঝা যায় না। সারাদিন হেঁটেছে, ছুটেছে, কত ঝক্কি গেছে মাথার ওপর দিয়ে। এখন। একদম কাহিল

সকাল কখন হল, বাজনা জানতে পারল না। পাখি ডাকেনি তো! সুড়ঙ্গের মধ্যে পাখি আসবে কোথা থেকে! ডাকবে কেমন করে?

পাখি ডাকল না, কিন্তু টাট্টু ডাকল, ‘বাজনা!’

নিঃসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছিল বাজনা। টাট্টুর ডাক শুনতেই পেল না।

আবার ডাকল টাট্টু, ‘বাজনা, বাজনা, উঠে পড়ো।’

এবার শুনতে পেয়েছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল। আবাক চোখে চাইল টাট্টুর দিকে।

টাট্টু বলল, ‘সকাল হয়ে গেছে।’

 ‘হয়ে গেছে!’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল বাজনা।

‘হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে।’

ফস। একী হঠাৎ লন্ঠনটা আপনা-আপনি নিভে গেল কেন? আবার অন্ধকার।

‘টাট্টু, টাট্টু আলো নিভে গেল কেন?’

টাট্টু বলল, ‘বুঝতে পারছি না।’

‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কোথায়?’

‘বাঁদিকে। হাত বাড়াও।’

বাঁদিকে হাত বাড়িয়ে টাট্টুকে চেপে ধরল বাজনা।

ঠিক তক্ষুনি কী যেন একটা শব্দ ভেসে এল বাজনার কানে। ভেরির শব্দ। গুম গুম করে খুব দূর থেকে ভেরির শব্দ ভেসে আসছে। তালে তালে পায়ে চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে, খট-খট!

বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, টাট্টু, মনে হচ্ছে কারা যেন এদিকেই আসছে!’

টাট্টু বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।’

সকাল হলেও ঘরের ভেতর কালো মিশমিশে অন্ধকার। গুম গুম শব্দে ঘরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাজনা থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শব্দটা একেবারে যখন ঘরের কাছে এসে গেছে, তখন কান ঝালাপালা হয়ে গেল বাজনার। সঙ্গে সঙ্গে দরজার শেকল বেজে উঠল, ঝনঝনঝন। খুলে গেল দরজা। এক ঝলক আলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। আলোর সঙ্গে তার সামনে দাঁড়াল এক বিকট চেহারার একজন পল্টন। পাকানো-পাকানো গোঁফ, একমুখ দাড়ি, আর রক্তজবার মতো চোখ দুটো লাল লাল। লাল-লাল চোখ দুটো ড্যাবডেবে করে বাজনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেঁড়ে গলায় ক্যার ক্যার করে চেঁচিয়ে উঠল, তৈরি?

বাজনা কী উত্তর দেবে, বুঝতে পারল না।

লোকটা এবার আরও জোরে হেঁকে উঠল, ‘তৈরি?’

বাজনা হাঁদার মতো চেয়ে রইল।

চেয়ে থাকতে হল না বাজনাকে বেশিক্ষণ। লোকটা হাঁক পাড়ল, ‘এই-হো-হো।’

 অমনি খটাং খটাং করে দুটো পল্টন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাজনার কোমরে একটা দড়ি বাঁধল। বাজনাকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে এল। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চলল। বাজনা কাঁদতেও পারছে না, ডাকতেও পারছে না। বোবার মতো চলেছে সে।