কী চিৎকার! কান ফেটে যাবার গোত্তর! কাছেপিঠে তো জন-মনিষ্যি নেই, কে শুনবে? বাবা! এত বড়ো একটা ধুমসো লোকের কী ভয়! ভেবেই অবাক মিতুল। মিতুলের তো ভয় করছে না।
লোকটা ঘরের দরজা খুলতে গেল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে। মিতুল সিন্দুকের আড়াল থেকে দেখে ফেলেছে! মিতুল লুকিয়ে লুকিয়ে, সিন্দুকের আড়াল থেকেই অমনি ধমকে উঠল ‘এই ঘরের দরজা খুলছিস কেন?’
মিতুলের গলা শুনে লোকটার বুকের ধুকধুকি থেমে যায়-যায়! ভয়ে!
মিতুল আবার বলল, ‘দরজা খুলবি না। আমি তোকে খেতে এসেছি!’
গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল লোকটা।
মিতুল এবার আরও জোরে ধমকে উঠল, ‘ চেঁচাবি তো গলায় বাঁশ পুরে দেব! থাম!’
লোকটার চেঁচানি থামল। কাঁদুনি থামল না। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
‘তোর নাম কী?’ গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল মিতুল।
‘হরিহর।’
‘তোর বাবার নাম কী?
‘বাসুদেব।’
‘আর দুটো লোক তোর কে হয়?
‘কেউ না।’
‘কেউ না? মিথ্যে বলছিস! এত সোনা-রুপো, চুনি-পান্না কোত্থেকে এল?কার এসব?’
‘আমার।’
‘ঠিক করে বল!”
‘আজ্ঞে সক্কলের।
সক্কলের! আমার সঙ্গে ঠাট্টা হচ্ছে! ঠিক করে বল, নইলে গলা কেটে দেব।’
গলা কাটার নাম শুনে লোকটা চিতপটাং। মাটিতে শুয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘আজ্ঞে গলাটা কাটবেন না। আমি সব বলছি। এসব জিনিস আমরা চুরি করে এনেছি।’
‘চুরি করেছিস! কার জিনিস?
‘আজ্ঞে অনেকের।’
‘সিন্দুকের চাবি কোথায়?
চুপ করে রইল লোকটা।
মিতুল আবার জিজ্ঞেস করল, ‘চুপ করে কেন? সিন্দুকের চাবি কই?’
‘আজ্ঞে আমার কাছে তা নেই।’
‘ফের মিথ্যে বলছিস’ বল কোথায়?নইলে হাতুড়ি মেরে মাথা ঘেঁচে দেব!’
লোকটা আবার চেঁচিয়ে উঠল। ‘না না, হাতুড়ি মারবেন না। চাবি আমার কাছে।’
‘সিন্দুকের মাথায় চাবিটা রাখ।’ হুকুম করল মিতুল।
লোকটা ঝোলানো কালো জামাটার পকেট থেকে এত্তবড় একটা চাবি বার করল। সিন্দুকের মাথায় রাখল।
মিতুল এবার জিজ্ঞেস করল, ‘মরবি? না বাঁচবি!’
লোকটা দুহাত জোর করে বলল, ‘আজ্ঞে মরবো না, মরবো না। আমি বাঁচবো। আমাকে বাঁচান।’
“ঠিক আছে। তবে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়া।’
লোকটা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল।
‘আমি যতক্ষণ না বলব, ততক্ষণ নড়বি না।’
চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা।
মিতুল ঝট করে বেরিয়ে এল সিন্দুকের পিছন থেকে। চট করে চাবিটা নিয়ে নিজের কোমরে খুঁজে ফেলল। তারপর ওই কালো জামাটার পকেটে ঢুকে পড়ল। ঠিক আগের মতন। তারপর জামার পকেট থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘যা এবার।’
পড়িমরি করে লোকটা পালাতে গেছে। মিতুল আবার চেঁচিয়ে ডাকল, ‘এই জামাটা পরলি না যে! পর জামা।’
কাঁপতে কাঁপতে জামা পরল লোকটা। ঘরের দরজা খুলল। তারপর মার ছুট। জানতেও পারল না, তার পকেটে, মিতুল নামে একটা ছোট্ট পুতুলও সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। এত বুদ্ধি মিতুলের! মিতুলের পেটে পেটে এত ছিল!
ছুটছে লোকটা বনে বনে। থামে না। দুলছে মিতুল তার পকেটে। যেন এক্কাগাড়ি চেপেছে মিতুল। যা হাসি পাচ্ছে! কী ঠকান ঠকিয়েছে লোকটাকে! কী বোকা! রাম ভীতু! ভয়ে একেবারে ভিরমি খাবার জোগাড়!
মিতুলের একটুও ভয় নেই। ভয় কীসের? ও কী কোনো অন্যায় করেছে যে ভয় পাবে? যে অন্যায় করে তারই ভয়! কোমরের চাবিটা এবার বেশ আঁটসাঁট করে জড়িয়ে রাখল মিতুল। পকেটের মধ্যে আবার নড়াচড়া করা বিপদ। যদি টের পেয়ে যায়, না, পাবে না। জামাটা বেশ লম্বা। পকেটটাও বেশ ঢাঞ্জুস। তার ওপর লোকটা ছুটছে। টের পাবে কেমন করে? তাই উঁকি মারল মিতুল পকেটের ভিতর থেকে।
ওমা! আর তো বন নেই। বন পেরিয়ে গেছে। আকাশটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মিতুল। রাতের আকাশ। চাঁদ নেই বলে মিতুল বুঝতে পারল না, ও গ্রামের মাঠে পড়েছে।
দুটো লোক আসছে ছুটতে ছুটতে। সামনে।
দেখতে পেয়েই মিতুল চুপ করে ঢুকে গেল পকেটের মধ্যে। ওমা! এ যে সেই দুজন লোক। মিতুল যার পকেটে বসে আছে তারই বন্ধু দুজন।
ছুটতে ছুটতে জড়িয়ে ধরল।
‘কী রে?কী হয়েছে?’
‘ঘরে কে ঢুকেছে! সব জানতে পেরে গেছে! আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। পালিয়ে এসেছি।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে গেল লোকটা। এক নিশ্বাসে।
‘কে ঢুকেছে?’ আর দুজন জিজ্ঞেস করল।
‘কী জানি! বাঁচতে যদি চাও তো পালাই চলো।’ বলে লোকটা আবার ছুট দিল, বন্ধু দুজন তাই না দেখে দে-ছুট। তার পিছনে। ভয়ে-ভয়ে!
এবার মিতুল সত্যি সত্যি হেসে ফেলল। লোকগুলো বোকার ধাড়ি। আচ্ছা ঠকান ঠকিয়েছে মিতুল। চাবিটাও পেয়ে গেছে। কিন্তু পেলেই বা কী হবে? যাদের জিনিস তাদের তো পৌঁছে দিতে পারবে না মিতুল! কেমন করে দেবে? কে জানে কোথায় তাদের ঘর! আর জানলেই বা কী! ওর কথা বিশ্বাস করবে কেউ? ও যে পুতুল। আহারে! যদি শাস্তি পায় ওই লোক তিনটে! তাহলে খুব খুশি হয় মিতুল।
তিনটে লোকই ছুটতে ছুটতে থামল। পা চালিয়ে হাঁটল। মিতুল পকেটের মধ্যে বসে বসেই বুঝতে পারল। ‘দেখি তো’, বলে আর একবার উঁকি দিল পকেট থেকে। বাইরে। ওমা রাতের অন্ধকার তো আর নেই। ভোরের আলো ফুটছে। গাছের সবুজ পাতা ধুয়ে গেছে। শিশিরের জলে। যেন কার কান্নার জল। গড়িয়ে পড়ছে। আকাশ কি কেঁদেছে সারারাত! সেদিন মিতুলের গলাটি জড়িয়ে এমনি করেই কেঁদেছিল তার বোনটি!
এতক্ষণ ভুলেই ছিল মিতুল। ভুলে ছিল তার বোনটির কথা। রাজকন্যার কথা! ভুলবে না? যা এতক্ষণ হল!
কিন্তু তার বোনটিকে এখন সে কোথায় খুঁজে পাবে? পথঘাট কিছু জানে না। জানলেই বা কী! এত বড়ো পৃথিবী? সে তো ছোট্ট পুতুল! কেমন করে খুঁজে পাবে আর একজন ছোট্ট পুতুলকে। তা ছাড়া দুপা অন্তর বিপদ! পৃথিবীতে কেউ যেন শান্তিতে থাকতে চায় না। সবাই সবাইকে ঠকাচ্ছে! বিচ্ছিরি!
রোদ উঠেছে। এতক্ষণ সামনেটা কুয়াশায় ঢাকা ছিল। রোদের ছোঁয়া লেগেছে কুয়াশার গায়ে! এখন ঘরে যাবার পালা। কুয়াশার ছুটি আজকের মতো।
সামনে কী? উরি বাবা! কত বড়ো একটা পাহাড়! এক্কেবারে আকাশ ছুঁড়ে যেন চলে গেছে। কত উঁচু! একটা নদী নেমেছে পাহাড় থেকে নীচে। পাহাড়তলির গ্রাম দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। লোকগুলো তো পাহাড়ের দিকেই যাচ্ছে। মিতুল তো কোনোদিন পাহাড়ে চড়েনি! তাই ভারি মজা লাগছিল তার। পাহাড়ে চড়বে মিতুল। ভাবতেই মজা।
আর যেন হাঁটতে পারছে না দস্যুগুলো। কতক্ষণ ধরে হাঁটছে। বাববা হাঁটুক না। যত পারে হাঁটুক। মিতুলের তো কোনো কষ্ট হচ্ছে না। মজাই। কেমন পকেটের মধ্যে বসে আছে।
‘একটু বসলে হয় না?’ হঠাৎ একজন দস্যু বলল। চমকে উঠল মিতুল। কথা শুনে।
‘হ্যাঁ, তাই বস। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা করছে।’ আর একজন উত্তর দিল।
শেষ জন বলল, ‘খিদে পাচ্ছে। চ না কিছু খেয়ে জিরনো যাবে। সামনেই তো বাজার।
‘তাই ভালো।’ বলে হাঁটল বাজারের দিকে তিনজনে।
এতক্ষণ পরে একটি একটি মানুষ নজরে পড়ল মিতুলের। গ্রামের মানুষ এরা! কোনোদিন মিতুল এমনি করে গ্রাম দেখেনি। গ্রামের মানুষও দেখেনি। সকালে দোকান-হাটে যাচ্ছে। কেউ কেউ। কাজে যাচ্ছে অনেকে। নদীর জল আনছে মেয়েরা। কলসি মাথায়। পায়ে মল ঝুমঝুম। দেখতে বেশ লাগছে। পাহাড়। তার নীচে ছায়া। তার পাশে নদী। নদীর কোলে গ্রাম। চোখ ভরে যায় মিতুলের। মন বলে, আহারে! কত আলো এখানে!
হাটে কত লোক! গিসগিস করছে। কত দোকান। কোনোটা কাপড়ের। কোনোটা কাঁচের। কোনোটা বাসনের। একটানা দুটো খেলনার দোকান। কত পুতুল। সাজানো-সাজানো। একটা শোলার টিয়া দাঁড়ে বসে আছে। চোখ টিপল মিতুলের দিকে চেয়ে। ডাকল বোধ হয়। কেউ দেখতে পেল না। মিতুল কিন্তু ঠিক দেখেছে। দেখলে কী হবে?যাবার তো উপায় নেই।
একটা জিলিপির দোকানের সামনে দাঁড়াল দস্যু তিনজন। কড়া ভরতি জিলিপি! উনুনের ওপর ভাজছে দোকানদার। আওয়াজ বেরুচ্ছে বেশ, ‘ছিলিকিলি ছিলিকিলি!’ পাশে আর একটা রস ভরতি গামলা। গামলায় দোল খাচ্ছে অগুনতি পানতুয়া। একটা পেলে মন্দ হয় না!
‘এই দোকানি, আধ সের জিলিপি দাও তো।’ একজন দস্যু চাইল।
টুপ করে পকেটের মধ্যে ঢুকে গেল মিতুল।
কেন?
লোকটা পকেটের মধ্যে যেন হাত গলাচ্ছে। হ্যাঁ তো রে! এই সেরেছে, মিতুলের বুঝি এই শেষ। না। খুব রক্ষে! মোটা মোটা আঙুল। পকেটে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এল। মিতুল কোনো রকমে ঘার খুঁজে বেঁচে গেছে। ধরা পড়ে গেছিল আর একটু হলেই। কাঁপছে মিতুল ভয়ে। লোকটার হাত যে পকেটে ঢুকতে পারে, একথা ভাবেনি মিতুল। তাই তো! কী করবে এখন সে!
না, আর পকেটে থাকা নয়। এবার পালাতেই হবে মিতুলকে পকেট থেকে। কিন্তু কেমন করে পালাবে? কেমন করে পকেট থেকে বেরুবে? এত লোক! এত চোখ সবাইকে কি ফাঁকি দেওয়া যায়! ভাবতে লাগল মিতুল। চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল মাথাটা তুলে পকেটের মধ্যে! তৈরি থাকাই ভালো। আবার যদি ঢোকে হাতটা!
না, এখন আর হাত ঢুকবে না। এখন জিলিপি খাচ্ছে লোকগুলো।
কিছু উপায় নেই। যতই ভাবুক মিতুল, বেরুতে আর হচ্ছে না!
এখন তো খাওয়া হয়ে গেছে। জিলিপি খাওয়া। নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল তিনজনে। জল খাবে। চুপিসাড়ে আর একবার উঁকি দিল মিতুল। বসল লোক তিনটে। হাত বাড়িয়ে নদীর জলে আঁজলা করল। এই সুযোগ! ভাবল মিতুল! পকেট থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলে আর কী! মাথাটা বার করল। খুব সাবধানে। লাফ দিল বলে!
‘এই, তোর পকেটে ওটা কী রে?’
বুকটা থমকে গেল মিতুলের। ফসকে গেল হাতটা।
‘কই?’ লোকটা পকেটে হাত ভরে দিল। মিতুলের পেটটা চিপটে ধরল। টেনে বার করল মিতুলকে।
‘আরে একটা পুতুল!’ অবাক হল তিনজনে।
‘কোত্থেকে এল?
‘কে জানে!’
‘দিনের দিন তুই কচি খোকা হচ্ছিস নাকি! পুতুল নিয়ে পকেটে পুরেছিস। খেলা ধরেছিস। ফেলে দে।’
ফেলে দিল মিতুলকে। ছুঁড়ে দিল নদীর জলে। মাঝদরিয়ায়। টুপ! ডুবে গেল মিতুল!
হয়তো ডুবে যেত মিতুল একেবারে। হয়তো ডুবতে ডুবতে ও কোথায় তলিয়ে যেত! আর কোনোদিন ওকে কেউ দেখতে পেত না। কেউ ওর কথা মনে রাখত না।
না, ভেসে উঠল মিতুল।
নদী নামছে পাহাড় থেকে। তার কী স্রোত! জলের স্রোতে ভেসে চলেছে মিতুল! কোথায় চলেছে? কেউ জানে না। কোন দেশে? তাও জানে না। কেমন করে ও নদীর জল থেকে পাড়ে উঠবে? তাই বা কে বলবে! হয়তো এমনি করে নদীর জলে ভাসতে ভাসতে একদিন সব ফুরিয়ে যাবে! মিতুল হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো!
ভাবতে পারছিল না মিতুল। সামনে একটা কুটোও নেই যে আঁকড়ে ধরে। চারিদিকে শুধু জল আর জল। ভেসে চলেছে মিতুল। কেউ কী দেখবে না তার দিকে একবার? কেউ কি তাকে বাঁচাবে না?
কে আসবে? কে দেখবে? এমন তো কত কী নদীর জলে ভেসে যায়! কার দেখতে বয়ে গেছে! সে নিয়ে ভাবতে কারই বা মাথাব্যথা পড়েছে। তা ছাড়া ও তো একটা পুতুল। ফেলে দেওয়া পুতুল। ও আর কী কাজে আসবে? যতদিন সুন্দর ছিল, মিষ্টি মুখে হাসি ছিল, তখন ওর আদর ছিল। সবাই ভালোবেসেছে। সবাই তার নাচ দেখে বাহবা দিয়েছে। পুতুলওয়ালা কত বড়ো লোক এখন! কত পয়সা! কত দেমাক! সে তো মিতুলেরই জন্যে! আর আজ? আজ তারা কোথায়? কেউ নেই!
চেঁচিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করল মিতুলের, ‘তোমরা আমায় বাঁচাও।’ কে শুনবে? কেঁদে ফেলল মিতুল হাউহাউ করে। এমন করে সে তো কোনোদিন কাঁদেনি! মিতুলের চোখের জল নদীর জলে মিশে গেল। ভেসে গেল। ঠিক তক্ষুনি মনে পড়ে গেল বোনটির কথা। তার সঙ্গে মিতুলের আর কোনোদিন দেখা হবে না। কোনোদিনই না। ‘না হোক।’ ভাবে মিতুল, ‘সে যেন ভালো থাকে। ভালো থাকে! যেখানেই যাক সে যেন কাঁদে না কোনোদিন। আমার জন্যে। তার ভাইটির জন্যে।’
ভেসেই চলেছে মিতুল। কতক্ষণ, কতদিন কিছু জানে না। নদীর দু-পাশে সবুজ সবুজ গাছের সারি। দূরে দূরে। নীল নীল আকাশে ঝলমল আলো আর চারিদিকে জল থই থই। হঠাৎ আকাশের নীলের সঙ্গে সবুজ ডানার পাখনা মেলে পাখি উড়ে এল। নদীর বুকে। উড়তে উড়তে মিতুলের মাথার ওপর ঘুরতে লাগল।
চমকে চাইল মিতুল আকাশে। পাখি! মনটা দুলে উঠল মিতুলের। আশায়। চেয়ে রইল মিতুল একদৃষ্টে। হাতছানি দিল। নাম জানে না মিতুল পাখির। ডাক দিল, ‘ও পাখিভাই, ও পাখিভাই, সবুজ সবুজ পাখি, আমায় তুমি বাঁচাবে?’
পাখি বলল, ‘ওমা! ওমা! কে তুমি?’
মিতুল বলল, ‘আমি পুতুল, নাম মিতুল।’
পাখি বলল, ‘পুতুল-পুতুল মিতুল তুমি?
মিতুল উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ ভাই, সবুজ-সবুজ পাখি।’
পাখি বলল, ‘মিতুল-মিতুল পুতুল, আহা-রে কেমন করে জলে ভাসলে?’
মিতুল উত্তর দিতে পারল না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পাখি মিতুলের চোখের জল স্পষ্ট দেখতে পেল।
পাখি ডাকল, ‘রুপালি-রুপালি মাছ। রুপালি-রুপালি মাছ।’ ডাকতে ডাকতে ঘুরপাক খেতে লাগল আকাশে। জলের ওপর।
অমনি নদীর জলে হাজার হাজার রুপালি মাছ ভেসে উঠেছে। ঝিকিমিকি। ঝিকিমিকি।
সবুজ-সবুজ পাখি বলল, ‘রুপালি-রুপালি মাছ, মিতুল পুতুল নদীর জলে ভাসছে। তাকে বাঁচাও।’
সঙ্গে সঙ্গে নদীর জলে লাফিয়ে উঠল রুপালি মাছের সর্দার। মিতুলকে পিঠে তুলে নিল। মিতুল ভাসছিল চিত হয়ে। মাছের পিঠে বসল এবার। সর্দার মাছ পাখনা দুলিয়ে মিতুলকে পিঠে নিয়ে সাঁতার দিল জলের ওপর। হাজার হাজার রুপো-ঝিকমিক মাছের দল এগিয়ে চলল। চলল সর্দারের সঙ্গে নেচে নেচে।
আকাশের সবুজ পাখি বলল, ‘মিতুল-মিতুল ছোট্ট পুতুল, তুমি কোথায় যাবে?
মিতুল বলল, ‘জানি না তো! আমার তো ঘরও নেই, বাড়িও নেই। আমার এখন কেউ নেই।’
সবুজ পাখি জিজ্ঞেস করল, ‘মিতুল, তুমি আমাদের কাছে থাকবে?
মিতুল বলল, ‘ তোমরা কত সুন্দর! কত ভালো!’
আকাশ ভরে গেল। কত পাখি নদীর বুকে। ডানা মেলে উড়ছে। রঙিন ছায়া ঢেউ-এ ঢেউ-এ দুলছে নদীর জলে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল মিতুল। দেখতে লাগল জলের নীচে। রুপালি মাছের দিকে। আকাশে সবুজ পাখির দিকে।
সবুজ পাখি উড়তে উড়তে রুপালি মাছকে বলল, ‘রুপালি মাছের সর্দার, আমি নামছি।’
সবুজ পাখি আকাশ থেকে রুপালি মাছের দিকে নামতে নামতে বলল, ‘মিতুল-পুতুল হাত বাড়াও। আমার পা ধরো।’
মিতুল হাত বাড়াল সর্দার মাছের পিঠে বসে। সবুজ পাখি একেবারে মিতুলের মাথার ওপর উড়ে এল। মিতুল হাত দিয়ে সবুজ পাখির পা দুটি জড়িয়ে ধরল। ঝুলে পড়ল। ঝুলে ঝুলে নদীর জল ছেড়ে, মাছের পিঠ ছেড়ে, আকাশে উড়ে চলল।
মিতুল ঝুলতে ঝুলতে বলল, ‘সবুজ-সবুজ পাখি, আমার ভয়-ভয় করছে। হাত ফসকে যদি আবার পড়ে যাই জলে!’
পাখি বলল, ‘মিতুল আমার পিঠের ওপর উঠে এসো।’
মিতুল সবুজ পাখির পা ছেড়ে, আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে একেবারে পিঠের ওপর চড়ে বসল।
না, আর ভয় করছে না। আঃ নরম তুলোর মতো পাখির পিঠা! কী আরাম!
নীচের দিকে তাকাল মিতুল। রুপালি মাছেরা নাচছে জলের নীচে। খুশিতে। মিতুলের দিকে চেয়ে চেয়ে।
আকাশে চাইল মিতুল। সবুজ-রঙিন পাখিরা গান গাইছে। পাখির ডানায় হাওয়ার ঝুনঝুনি বাজছে।
একটু একটু করে চলে গেল নদীর জল চোখের আড়ালে। একটি একটি করে হারিয়ে গেল রুপালি মাছ নদীর জলে। উড়ে চলেছে মিতুল। মনটা যেন কেমন-কেমন করে উঠল মিতুলের। মাছের জন্যে। ওই রুপালি মাছ ঝিকমিক! আর কি কোনোদিন ওদের সঙ্গে দেখা হবে মিতুলের!
অনেকক্ষণ পর একটি গাছে বসল সবুজ পাখি। মিতুল সবুজ পাখির পিঠ থেকে নামল। গাছের ডালে সবুজ পাতার ওপর বসে রইল।
সবুজ পাখি জিজ্ঞেস করল, ‘মিতুল, গাছের ওপর বসতে তোমার ভয় করছে?
মিতুল বলল, ‘ভালো লাগছে।’
অমনি গাছের ডালে দোল দিয়ে দিয়ে হাওয়া বইল। হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ে এল। মিতুলের চোখে তারা কাজল পরিয়ে দিল। মিতুলের ছেঁড়া জামায় রং ছড়িয়ে দিল। রঙের রেণু উড়তে উড়তে ছড়িয়ে গেল সবুজ সবুজ গাছে। রঙিন রঙিন ফুলে। মৌমাছিরা গুন গুন করে গান ধরল। মিতুলের কাজল পরা চোখ দুটি নাচতে লাগল। হাসিতে-খুশিতে। মিতুলের ছোট্ট ঠোঁট দুটি কাঁপতে লাগল। গানেতে-সুরেতে। যেন সকালবেলার লাল গোলাপের পাপড়ি!
মিতুল বলল, ‘রঙিন-রঙিন প্রজাপতি, আমিও খেলতে পারি।’
প্রজাপতিরা বললে, ‘এস না!’
অমনি মিতুল উঠে দাঁড়াল গাছের ডালে। প্রজাপতি আর মৌমাছিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিল। সবুজ সবুজ পাখি তাই দেখে হেসে কুটোকুটি। লুটোপুটি।
কী সুন্দর দেখতে লাগছে মিতুলকে! খেলছে! কত রং কত আলো মিতুলের সারা গায়ে! কী সুন্দর সাজিয়ে দিয়েছে মৌমাছিরা, প্রজাপতিরা! মিতুল যেন আর সে-মিতুল নেই! এক্কেবারে একটি নতুন পুতুল। আগের চেয়েও ভালো। অনেক ভালো।
খেলতে খেলতে হঠাৎ কী হল? সবুজ পাখিরা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল কেন সক্কলে? প্রজাপতি পাতায় পাতায় লুকিয়ে গেল কেন ঝুপঝাঁপ? মৌমাছিরা ফুলের ডালে ঘাপটি মেরে বসে রইল কেন চুপচাপ? ব্যাপার কী?
মিতুল ডাকল, ‘সবুজ পাখি!’
কেউ সাড়া দিল না।
আবার ডাকল, ‘প্রজাপতি রঙিন-পাখা!’
কেউ দেখা দিল না।
মিতুল অবাক হল। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। দেখতে লাগল!
গাছের তলায় ও কে দাঁড়িয়ে? চোখ পড়তেই চমকে গেল মিতুল।
একটা ছেলে। গাছের দিকে তাকিয়ে। ছেঁড়া-ময়লা কাপড়। যেন সাত জন্মে কাঁচা হয়নি। উসকো-খুসকো চুল। যেন কত কাল তেল দেয়নি। রোগা প্যাঁক-প্যাঁকে চেহারা। যেন। কোনো জন্মে খেতে পায়নি। লম্বা একটি লাঠি কাঁধে। ড্যাং-ড্যাং করে চলছিল। চলতে চলতে থামল। চাইল গাছের দিকে।
মিতুলের খুব ভয় হয়ে গেছে। কী করবে এবার? গাছ থেকে নামবে, তারও উপায় নেই। এত বড়ো, এত উঁচু গাছ থেকে কি মিতুল নামতে পারে? তা ছাড়া ছেলেটা যে-রকম চেয়ে আছে প্যাট-প্যাট করে! এক্ষুনি দেখে ফেলবে! তাই সুট করে পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল মিতুল। গুঁড়িগুড়ি মেরে বসে রইল। লুকিয়ে!
ছেলেটা তো ছেলেটা! ভেলভেলেটা! চোখ দুটোতে দুষ্টুদুষ্ট চাউনি। দাঁত বের করে মুচকি মুচকি হাসছে। পেটে পেটে বুদ্ধি ছেলের! পিঠে একটা পুঁটলি বেঁধে কেমন তাকাচ্ছে দেখো না! গা জ্বলে যায়! মিতুল ভাবল, ‘দেখি না ছেলেটা কী করে?’
আরি ব্যস! গাঁক গাঁক করে চেঁচাতে শুরু করে দিল ছেলেটা। কেন রে বাবা! চেঁচানি কেন? গান গাইছে নাকি! গান গাইছে, না গোরু তাড়াচ্ছে! থাম না বাপু!
থামল। পিঠের পুঁটলিটা খুলল। গাছের নীচে রাখল। হাতের লাঠিটা নিয়ে ছুঁড়ে দিল পাঁই। গাছের ওপরে। পাখির বাসায়। ঘেঁচু! পাখি থাকলে তবে তো! পাখিও নেই। পাখির ছানাও নেই। আবার ছুড়ল! এই সেরেছে! মিতুলের যদি লেগে যায়! মিতুল পেটের মধ্যে হাত পা সেঁধিয়ে বসে রইল।
আর একবার ছুড়ল! হুস। যা ভাবা ঠিক তাই। লাগল না মিতুলের গায়ে। একেবারে নাকের পাশ দিয়ে উড়ে গেল লাঠিটা। যাঃ! হাত ফসকে গেছে মিতুলের। মার ডিগবাজি। একটা, দুটো, তিনটে, চারটে! ব্যস একেবারে ছেলেটার কাঁধে। দুটি পা কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে গলাটি জড়িয়ে ধরল মিতুল।
ছেলেটা তো অবাক! ‘যাঃ বাবা! ইনি কিনি?’ বলে মিতুলের ঠ্যাং ধরে চোখের সামনে আনল। দেখতে লাগল। ‘আরে! একটা পুতুল!’ নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠল। মাথা চুলকে। গাছের দিকে তাকাল। মিতুলের দিকে চাইল। ভাবল, ‘তাইতো! গাছে পুতুল এল। কোত্থেকে! কোথায় পাখির ছানা খুঁজছি, না গাছ থেকে পুতুল পড়ছে! দূর ছাই, পুতুল কী হবে!’ বলে খুব জোরে আবার ছুঁড়ে দিল মিতুলকে গাছের ওপর। না, গাছে আটকাল না মিতুল। ডিগবাজি খেতে খেতে পড়বে তো পড় ছেলেটার মাথায়, টকাস!
ছেলেটা বলল ‘ভালোরে ভালো! জ্বালাতন করলে তো! দূর তোর–’ বলে আবার ছুঁড়তে গেল। থমকে গেল হাতটা। মিতুলের চোখ দুটি যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে! ভালো করে দেখল। কিছু বলবে নাকি পুতুলটা! তাই আবার হয়! পুতুল কোন কালে কথা বলে! তবু চোখ দুটি ভালো লাগছে দেখতে! পুতুলের চোখ! ভালো লাগছে মুখখানি। না, আর ছুঁড়তে ইচ্ছে হল না। বলল, ‘না, তোকে ফেলব না। চ আমার সঙ্গে। শহরে গিয়ে বেচে দেব। যা পাওয়া যায়!’ বলে মিতুলকে কাঁধে বসাল। পিঠে পোঁটলা বাঁধল। চেঁচিয়ে গান ধরল। হাঁটা দিল। মিতুল গান শুনতে শুনতে কোথায় চলল আবার? কে জানে!
গাইতে গাইতে হাঁটতে লাগল ছেলেটা। কাঁধের ওপর দুলতে লাগল মিতুল। দেখতে লাগল সামনেটা। কেউ নেই। সবুজ পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছি! একটি কথা কার সঙ্গে সে বলতে পারল না। যারা তার প্রাণ বাঁচাল তাদের জন্যে সে কী করল! মনটা ভার হয়ে যায় মিতুলের! বেশ তো মজা! নদীর জলে ভাসছিল মিতুল একটু আগে! রুপালি মাছ, সবুজ পাখি তাকে বাঁচাল। রং-ঝরানো প্রজাপতি, ফুল-ফোঁটানো মৌমাছি তাকে সাজাল। তার সঙ্গে খেলা করল। আর এখন? সে নাম-না-জানা একটা ছেলের কাঁধে চেপে কোথায় চলেছে?
চলেছে সামনে পাহাড় তার ওপরে।
ছেলেটার ভয়ডর নেই। কেমন দেখো নাচতে নাচতে চলেছে! গাইতে গাইতে দুলছে! কোথায় যাবে পাহাড় পেরিয়ে?
পড়ে গেল মিতুল ছেলেটার কাঁধ থেকে। হঠাৎ। যা ঝাঁকুনি। কতক্ষণ কাঁধে থাকবে? গড়িয়ে গেল পাথরের ওপর।
‘কীরে পড়িস কেন?’ ছেলেটা ঘুরে দাঁড়াল। তুলে নিল মিতুলকে। জামাটা ঝেড়ে দিল মিতুলের। আর একবার চোখ দুটির দিকে তাকাল। কাজলপরা দুটি চোখ মিতুলের। দেখতে দেখতে আপন মনেই বলল, ‘ভারি মিষ্টি তো চোখ দুটি তোর! নে চ। এখন ঘরে চ।’ বলে আবার কাঁধে তুলে নিল মিতুলকে। আবার দুলতে লাগল। আবার গাইতে লাগল।
এখন তো বিকেল-বিকেল। পাহাড়ের ওপর বিকেলের রোদ বেশ লাগে। আর একটু পরে সূর্যিমামা ঘরে চলে যাবে। একটু একটু অন্ধকার নেমে আসবে তারপর। তখন কী হবে? তখনও যদি ছেলেটা ঘরে না পৌঁছায়! ভয় করবে না? ঘেঁচু, ভয় না আরও কিছু। ঘর থাকলে তবে তো! দিন নেই, রাত নেই, ও শুধু হাঁটছে। পথেই বসে পড়ল। পথেই শুয়ে রইল। আর কেউ নেই, তার আবার ভাবনা কীসের? চলো, শুধু চলো। এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়। এক দেশ থেকে আর এক দেশ।
হাঁটতে-হাঁটতে এ কোথায় এল?কী সুন্দর! অবাক হয়ে গেল মিতুল! কী সুন্দর দেখতে ওই পাহাড়ের নীচটা! ছোট্ট ছোট্ট পাথর সাজানো ঘর। ঘরের মাথায় পাতার ছাউনি। পাথর ছড়ানো রাস্তা। সবুজ-সবুজ বাগান। একটা ছোট্ট ঝরনা টুংটাং নাচতে নাচতে নেমে আসছে। মিতুল ভাবল, ছেলেটার বাড়ি হয়তো এখানে। এখানে থাকতে হবে তাকে! তা হলে তো বেশ হয়! দেখতে বেশ লাগছে মিতুলের। ভাবতে আরও ভালো লাগছে।
ওই দিকেই ছুট দিল ছেলেটা। ঝরনার দিকে।
কারা যেন খেলা করছে! হ্যাঁ তো রে। ঘাগরা পরা ছোট্ট মেয়ে। কত দেখো! পাগড়ি মাথায় ছোট্ট ছেলে। অনেক অনেক। ছেলেটার গান শুনে ওরাও এদিকেই ছুটে আসছে। ছুটছে আর চেচাঁচ্ছে,
কটকটি কটকটি
ল্যাক প্যাকে সিং।
হাড়গিলে বক যেন,
টিং টিং টিং!
চেঁচাতে চেঁচাতে একেবারে ওর সামনে। আর কী হুল্লোড় লাগিয়ে দিল! ওকে বক দেখাতে লাগল। জিভ ভেঙাল। চেঁচামেচি। হুড়োহুড়ি।
ছেলেটা গান থামাল। আচমকা মুখটা যেন শুকিয়ে গেল। একজন একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল। টং! একেবারে ওর মাথায়। ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরলে কী হবে? আর একটা ঢিল। টং! একজন লাঠিটা ছিনিয়ে নিল। পিঠে এক কিল বসিয়ে দিল। তেড়ে গেল ওর দিকে।
‘আবার এসেছিস এখানে?’ একজন চেঁচিয়ে উঠল।
ছেলেটা রেগে আরও জোরে চেঁচিয়ে উত্তর দিল, ‘বেশ করছি।’
‘বেশ করছিস! আয় তোর ঠ্যাং ভেঙে দিই।’ সবাই লাফিয়ে উঠল।
একজন বলল, ‘আরে! আরে! একটা পুতুল রে, কাঁধের ওপর।’
অমনি ছেঁকে ধরল সবাই মিলে। ছেলেটাও পাঁই পাঁই মারল ছুট। মিতুলকে কাঁধ থেকে নামিয়ে নিল। বুকে জড়িয়ে ধরল। ওরাও ছুটল পিছু পিছু। ধরে ফেলল ওকে সবাই মিলে।
‘দে পুতুলটা!’
‘না, দেব না।’
‘চুরি করেছিস?’
‘বেশ করেছি।’
সবাই মিলে ঠেলে দিল ছেলেটাকে। পড়ে গেল পাথরের ওপর। মাথাটা কেটে গেল! রক্ত বেরিয়ে এল। কেউ এল না কাছে। উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। আবার ছুট দিল মিতুলকে বুকে নিয়ে। ওরা আর ছুটল না। পারল না ধরতে।
ছুটতে ছুটতে অনেক দূরে চলে এসেছে! আর পারছে না ছুটতে। হাঁটছে।
হাঁটতেও পারছে না। একটু বসল। একটা গাছের নীচে। পাথরের ওপর। সন্ধে হয়ে। আসছে। আরও নীচে পাহাড়তলি। ছোট্ট ছোট্ট ঘর দেখা যাচ্ছে। আলো জ্বলছে। শুয়ে পড়ল। পাথরটার ওপর। মিতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মিতুল স্পষ্ট দেখল ওর চোখ দুটি ছলছল করছে। মিতুলের কপালে একটা চুমু খেল। গালটা টিপে দিল আলতো আলতো। বলল, ‘কী দেখছিস? আমাকে? কেউ নেই রে আমার।’ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল ছেলেটার। আবার বলল, ‘তা বলে লাগেনি আমার। একটুও না।’
মিতুলের মনটা কেমন-কেমন করে উঠল। ছিঃ ছিঃ তার জন্যেই তো এমন হল! ইচ্ছে হল তার চোখের জল মুছিয়ে দেয়। কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। এখনও রক্ত লেগে রয়েছে! কিন্তু কেমন করে দেবে?
‘আমার কাছে থাকবি তুই? আমার কাছে?’ মিতুলের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা। ‘আমার সঙ্গে থাকবি? আমার সঙ্গে বেড়াবি? আমি গান শোনাব। কেউ আমার গান শোনে না রে।’
মিতুলের এত দুঃখেও কেমন যেন হাসি পেল। মনে মনে ভাবল, ‘আহা! তুমি যা গান গাও!’
উঠে বসল। মিতুলের জামার দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। বলল, ‘বাঃ তোর জামাটা তো বেশ। এতক্ষণ দেখিনি তো! এত রং দিয়ে সাজাল কে? কার পুতুল তুই? কোথায় ছিলি?”
মিতুল চেয়েই রইল ফ্যালফ্যাল করে!
‘আমার যদি পয়সা থাকত তোর জন্যে একটা টুপি কিনে দিতুম। একটা তাল পাতার বাঁশি কিনে দিতুম। দূর বাঁশি! খেতেই পাই না!’
মিতুলের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভাবল, ‘ খেতে পায় না!
আবার বলল ছেলেটা, ‘কে খেতে দেবে? আমায় তো সবাই পাগল বলে। পাগলের আবার খিদে পায় নাকি! পাগলের খিদে পায় না। ঘুম পায় না। কিছু না। আমারও ঘুম পায় না। সারারাত জেগে থাকি। জেগে জেগে ভাবি। কত কী! ভাবি আমার যদি একটা ফুলপাড় কাপড় থাকত, ঘেঁড়া কাপড়ের বদলে। একটা খুব সুন্দর রেশমি জামা। পায়ে শুঁড় তোলা নাগরা। মাথায় একটা পাগড়ি। আর যদি থাকত একটা খুব সুন্দর নাম, কাঞ্চন। আমায় সাবাই ডাকে কটকটি বলে। তা বলে আমার নাম কটকটি নয়! রাগায়! আমার নাম ডুংরি। ডুংরি নামটাও আমার ভালো লাগে না। কে যে রেখেছিল!’
আর একটু হলেই মিতুল খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। কটকটি! কটকটি আবার নাম হয় নাকি! কটকটি তো লোকে খায়। কিনতে পাওয়া যায় ময়রার দোকানে!
পাহাড়তলির পথের পর সানাই শোনা গেল। চকিতে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। ডুংরি। চনমন করে তাকাল পাহাড়তলির রাস্তার দিকে। শুধু কি সানাই? আরে বাবা, কত লোক! আরও কত বাজনা! কত পতাকা! সানাই বাজছে প্যাঁ পোঁ। বাদ্যি বাজছে ডিম ডিম। ডুম ডুম। পতাকা উড়ছে পত পত পত। লোক চলেছে ঘোড়ার পিঠে। কেউ যাচ্ছে এক্কা চড়ে। কেউ কেউ যায় পায়ে হেঁটে। মধ্যিখানে একটা কী সুন্দর পালকি। বেহারা ছুটছে পালকি কাঁধে, ‘হুন্না, হুন্না!’
ডুংরি চেঁচিয়ে উঠল সেই দিকে চেয়ে ‘এই, বর-কনে যাচ্ছে।’ মিতুলকে নিয়ে ছুটল পাহাড়ের ওপর। ছুটতে ছুটতে নীচে। পাহাড়তলির রাস্তায়। পালকির পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বাজনা শুনতে শুনতে। কেমন গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে ওই লোকটা সানাই বাজাচ্ছে! হেসে ফেলল ডুংরি। দুহাত দিয়ে আকাশে তুলে নাচালো মিতুলকে। খুশিতে। বলল, ‘আজ আর খাবার ভাবনা নেই। চ, নেমন্তন্ন খেয়ে আসি।’
কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল ডুংরি হঠাৎ! হাঁটতে হাঁটতে থামল।
মিতুলের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। কী হল? হঠাৎ চমক লাগে কেন?
আবার একবার নাচালো মিতুলকে। হ্যাঁ, এবারেও অবাক হয়ে গেল ডুংরি। পুতুলটা নাচছে যেন আপনা-আপনি! সে কি ভুল দেখছে? আবার নাচালো।
আবার!
আবার!
আবার!
মনে মনে হাসল মিতুল। ডুংরি লাফিয়ে উঠল মিতুলকে বুকে নিয়ে। চেঁচিয়ে উঠল আকাশের দিকে চেয়ে। কিন্তু কেউ শুনতে পেল না সে চিৎকার! কে শুনবে? সানাই বাজছে যে! বর যাচ্ছে, কনে যাচ্ছে পালকি চেপে হুন্না! চেঁচিয়েই ছুট দিল ডুংরি একেবারে অন্য দিকে। নিজঝুম জায়গাটায়। পাহাড়ের একটু ওপরে। যেখানে সেই ছোট্ট ঝরনাটা নাচছে। পাথরের ওপর ঝুন ঝুন ঝুন। না, কেউ নেই এখানে! আর একবার দেখলে হয় না! আর একবার নাচালো ডুংরি মিতুলকে। আহা! সানাই-এর সুরটা কী মিষ্টি লাগছে মিতুলের। সেই সুরে সুরে মিতুলেরও পা দুটি নেচে নেচে উঠল।
হাত কাঁপছে ডুংরির। থামে না মিতুল। নাচে আর নাচে। অবাক হয়ে দেখে ডুংরি। অনেকটা খুশিতে। খানিকটা ভয়েতে! এমন তো কোনোদিন সে দেখেনি!
সেই নিজঝুম জায়গাটায় জেগে রইল সে। ঘুম এল না। তবু শুয়ে পড়ল। পাথরটার ওপর। মিতুলকে বুকে জড়িয়ে। চেয়ে রইল আকাশের দিকে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল মিতুলও। ডুংরির গলা জড়িয়ে।
ভোরের প্রথম পাখিটা ডাকল, পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু গাছটায়। তার ডাকে মিতুলের ঘুম। ভাঙল। প্রথম আলোর রং ছড়িয়ে গেল ডুংরির চোখ দুটিতে। সে ছোঁয়ায় ডুংরির ঘুম ভাঙল।
কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছে কি ডুংরি? মিতুলের স্বপ্ন। হয়তো দেখেছে। তা না হলে সাত সকালে উঠেই ও ছুটল কোথায়? মিতুলকে নিয়ে?কী ভেবেছে?
ছুটেছে ডুংরি পাহাড়তলির গ্রামে গ্রামে। ডাক দিয়েছে সক্কলকে। নাচ দেখিয়েছে মিতুলের। পুতুলনাচ।
নাচ দেখেছে দলে দলে। ছেলে দেখেছে। মেয়ে দেখেছে। বুড়ো দেখেছে। বুড়ি দেখেছে। মা দেখেছে। বাবা দেখেছে। মাসি দেখেছে। মেসো দেখেছে। অবাক সবাই! বেবাক সবাই! এমন নাচ তো তারা কোনোদিন দেখেনি।
এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম। ডুংরি ছোটে। মিতুল নাচে। পয়সা পায়।
এক হাট থেকে আর এক হাট। ডুংরি হাঁটে। মিতুল নাচে। টাকা পায়।
এক দেশ থেকে আর এক দেশ। ডুংরি চলে। সোনা পায়।
তারপর ডুংরি একদিন পাহাড় ডিঙাল। নদীতে পাড়ি দিল। নদী পেরিয়ে সমুদুরের জলে ময়ূরপঙ্খি নায়ে পাল তুলে দিল।
মিতুলকে নিয়ে চলেছে ডুংরি সমুদুরের ওপারে আর এক দেশে। সে দেশে মেলা বসেছে। মেলাতে নাচ দেখাবে।
এখন সত্যি-সত্যি রেশমি জামা পরে ডুংরি। পায়ে নাগরা পরে। মাথায় পাগড়ি বাঁধে। পরবে না! এখন তার কত পয়সা!
আর মিতুল? তার সাজ হয়েছে একশো রকম। একশো রকম পোশাক তাতে হাজার রকম। ফুল। রং তুল তুল তুল।