বাজনা – ৫

যা বলা সেই কাজ। বাজনা সঙ্গে সঙ্গে টাট্টুর ঘাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে, গলা জড়িয়ে, কপাল থেকে টিপটা তুলে নিল। যেই তুলেছে ব্যস! অত বড়ো একটা জ্যান্ত টাট্টু হুস করে আবার আগের মতন কাঠের খেলনা হয়ে গেল। অমনি বাজনা টাট্টুর পিঠ থেকে ধপাস করে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়ল বাজনা। যাক! রক্ষে! লাগেনি তেমন। উঠেই টাট্টুকে হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী হল?’

টাট্টু বলল, ‘এর নাম জাদু। এবার টিপটা তোমার কপালে ছোঁয়াও!’

টাট্টুর কথা শুনে টিপটা এবার নিজের কপালে ছোঁয়াল বাজনা। আর দেখতে হয়! বাজনার বাঁদর-মার্কা ল্যাজটা পুট করে মাটিতে খসে পড়ল। গায়ের লোমগুলো হাওয়ায় উড়ে উড়ে ঝরঝরে হয়ে গেল। বাজনা আর বাঁদর রইল না। এখন আবার সেই নাক চ্যাপটা, গাল ফোলা, দাঁত ফোকলা ছোট্ট ছেলেটি!

নিজের দিকে তাকিয়ে খুশিতে নেচে উঠল বাজনা। জঙ্গলের মধ্যেই হাঁকাহাঁকি শুরু করে বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, আমি আবার মানুষ হয়ে গেছি। আমার বড়ো গান গাইতে ইচ্ছে করছে!’

টাট্টু বলল, ‘বাজনা, গান গাইবার এখনও অনেক সময় আছে। এখনও আসল কাজ হয়নি। নামটা তোমার বাজনাই আছে। নামের রোগ তোমার এখনও সারেনি। বেশি নাচানাচি, চেঁচামেচি না করাই ভালো। দেখছ তো, বিপদ সামনে, পেছনে, সবদিকে। খুব সাবধানে চলতে হবে। টিপটা কাপড়ের খুঁটে বেঁধে রাখো। আবার কাজে লাগতে পারে!’

“ঠিক বলেছ টাট্টু।’ বলে বাজনা কাপড়ের খুঁটে টিপটা বেঁধে সামলে রাখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কী করব? এবার কী করব? এ যে দেখছি গভীর জঙ্গল!’

টাট্টু বলল, ‘চক্কুর চ্যাং-চ্যাং-এর পল্টনরা ছাড়বে না। লুকিয়ে-ছাপিয়ে জঙ্গলের আরও ভেতরে হাঁটা দাও। আজকের রাতটা জঙ্গলেই গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। তারপর কাল যা হবার হবে।’

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, এ যে ভীষণ অন্ধকার! হাঁটি কেমন করে?’

টাট্টু বলল, ‘অন্ধকার দেখে পিছিয়ে গেলে চলে! অন্ধকারে যারা ঠিক-ঠিক পা ফেলে চলতে পারে আলো তারা দেখতে পাবেই।’

টাট্টুর কথা শুনে বাজনা সাবধানে পা ফেলে হাঁটা দিল। দুজনেই চুপচাপ। জঙ্গলও নিপ! চক্কুর চ্যাং-চ্যাং-এর টিপের উদ্ভুট্টি ব্যাপারটা যে বাজনা টাট্টুকে ভালো করে জিজ্ঞেস করবে, তারও সাহস হল না। আশ্চর্য! একটা সামান্য টিপ কপালে ঠেকাতেই কাঠের ঘোড়া একটা মস্ত জ্যান্ত ঘোড়া হয়ে গেল! ভাবতেই গা-টা শিউরে উঠছে বাজনার!

অনেকটা হাঁটার পর বাজনা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে, কান খাড়া করে এদিক-ওদিক তাকায় বাজনা।

টাট্টু খুব চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল? থামলে?

বাজনা টাট্টুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ! তুমি শুনতে পাচ্ছ না? কে যেন হাঁটছে! খসখসিয়ে বাজছে!’

টাট্টু গলার স্বর আরও চেপে বলল, ‘সাবধান, দেখতে না পায়! লুকিয়ে পড়ো!”

বাজনা আলতো আলতো পা ফেলে চটপট সামনের মস্ত গাছটার আড়ালে চলে গেল। গুঁড়ির নীচে হামাগুড়ি দিয়ে থমকে বসে পড়ল।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ পেছন ফিরে চমকে উঠল বাজনা। একটা বেড়াল! দেখতে পেয়েছে বাজনাকে। একেবারে তার পেছনে দাঁড়িয়ে! বেড়ালটা বাজনাকে দেখে গোঁফ ফোলাল, চোখ পাকাল। বাজনাকে চোখ টেরিয়ে দেখল। বাজনা ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বেড়াল ডাকল, ‘ম্যাও।’ যেন রাগে গলা গরগর করছে।

বাজনা দেখল ধরা তো পড়েইছি। বেড়ালটার সঙ্গে মিষ্টি কথা বলে ভাব করে ফেলাই ভালো। তাই বাজনা আদর করে ডাকল, ‘বেড়াল, বেড়াল, বেড়ালটা।’

বেড়াল উত্তর দিল, ‘কীরে, কীরে, ছেলেটা? রাতদুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে কী করছিস, ম্যাও?’

 বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ঘর কোথা গো?’

‘আমার ঘর নেই, দোর নেই।’

‘তোমার ঘর নেই, দোর নেই তো মা কোথায়?

‘আমার মা নেই, বাবা নেই।’

‘তবে তোমার কে আছে?’

‘তোর এত জমা-খরচের দরকার কী, মাও?’ বেড়ালটা ধমক দিল। ধমক দিয়ে হাঁটা দিল।

বাজনাও পিছু পিছু পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘ও বেড়াল, কোথায় যাও?’

বেড়াল বলল, ‘যেথা যাই, সেথা যাই, তোর তাতে কীরে! তুই কে রে ছেলেটা আমায় পিছু ডাকছিস? আমার পিছু হাঁটছিস? নাম কীরে তোর?

বাজনা বলল, ‘আমার নাম নেই।’

বেড়ালটা বাজনার কথা শুনে ‘ম্যাও-হো-হো-হো’ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ‘সেটা কেমন ব্যাপার?

বাজনা হাসি শুনে থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘না, নাম আমার একটা আছে, কিন্তু বিচ্ছিরি। তাই কাউকে বলি না!’

‘তাই বলো। তা এখানে ঘুরঘুর করছিস কেন?

‘হুমচক্কার দেশ খুঁজছি।’

বেড়ালটা চমকে থামল।

বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি চমকাও কেন?’

‘বেশ করেছি।’

 ‘তুমি বুঝি জান?’

 ‘জানি তো জানি, বলব কেন?’ বলে বেড়ালটা আবার হাঁটতে শুরু করে দিল।

বাজনা আবার ডাকল, ‘ও বেড়াল, ও বেড়াল, শোন, শোন।’

বেড়াল বলল, ‘যাই বলো আর তাই বলো, হুমচক্কার দেশ কোথায় জানলেও বলব না।’

টাট্টু বলল, ‘বাজনা ছেড়ো না, ছেড়ো না, ছেড়ো না। ওর পিছু নাও। ও নিশ্চয়ই জানে।’

বাজনা বলল, ‘তাই নাকি!’ বলে বেড়ালের পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে আবার বলল, ‘ও বেড়াল, বলো না!’

‘আঃ গেল্ল যাঃ! মাথা খারাপ করে দিল। জ্বালাতন!’ খেঁকিয়ে উঠল বেড়ালটা।

বাজনা বলল, ‘আচ্ছা বেশ! হুমচক্কার দেশ কোথায়, নাই বললে। জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছি, বাইরে যাবার পথটা বলে দাও?

‘যে-পথ দিয়ে ঢুকেছিস, সে পথ দিয়ে বেরিয়ে যা।’ বলে এবার বেড়ালটা ছুটতে আরম্ভ করে দিল।

বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, টাট্টু কী করি?’

 টাট্টু বলল, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে ওর পিছু ছোটো।’

বাজনাও লুকিয়ে-ছাপিয়ে বেড়ালের পিছু নিল।

অনেকক্ষণ ছুটল। জঙ্গলের আর শেষ নেই। জঙ্গল যেন বেড়েই চলেছে। বাজনা জিজ্ঞেস করল, ‘টাট্টু, বেড়াল যে থামে না। আমি থামব?’

টাট্টু বলল, ‘না, ওই সামনে দেখো!’

বাজনা বলল, ‘সামনেই তো দেখছি!’

‘ভালো করে চেয়ে দেখো।’

বাজনা চোখ বড়ো-বড়ো করে চেয়ে দেখল।

কী দেখল?

দেখল একটু দূরে একটা ছোট্ট ঘর। চারিদিকে গাছ-গাছ, ঝোপ-ঝোপ, তার আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘরটা। অন্ধকারে মিটমিট করে আলো জ্বলছে ঘরের মধ্যে। একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে।

অন্ধকার রাতটা,

ঘুপ-চুপ-চুপ বনটা, ঘুরঘুপটি ঝোপটা,

তার মধ্যে ছোট্ট মতো ঘরটা।

বেড়ালটা ছুটতে ছুটতে ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। দেখতেও পেল না বাজনা নামে ছেলেটা, কাঠের টাট্টু খেলনাটাও তার পেছনে ধাওয়া করেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে তার সঙ্গে ঘরের সামনে চলে এসেছে!

বেড়ালটা ঘরে ঢুকেই দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাজনা দরজার গোড়ায় এসে থমকে দাঁড়াল। যেখান দিয়ে একটু একটু আলো আসছিল সেইদিকে উঁকি মারল।

‘কে এলি রে, কে এলি?’ কে যেন ডাকল। কার যেন কাঁপা-কাঁপ গলার স্বর!

বাজনা উঁকি মারতেই নজরে পড়ল, একটা বুড়ি। অন্ধকার ঘরে পিদিম জ্বেলে বসে আছে। বুড়ির একটা চোখ কানা-কানা। এতখানি নাকখানা। খোঁচা-খোঁচা নোখগুলো। সাদা-সাদা। চুলগুলো। রোগা-রোগা শুঁটকি। কত বয়স বুড়ির কে জানে! একশো কী দুশো, বাজনা বুঝতেই পারে না।

বেড়ালটা ঢুকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়ির কোলে বসে পড়ল।

বুড়ি বলল, ‘মেনি এলি?’

 বেড়ালটা তবু হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘হ্যাঁগো ঠাকমা, আমি।’

‘কী হয়েছে বাছা, হাঁপাচ্ছিস কেন?’

বেড়াল ভয়ে ঠাকমাকে জরিয়ে ধরল। বলল, ‘ঠাকমা, ঠাকমা, একটা ছেলে। আমায় দেখতে পেলে। দেখতে পেয়ে আমার পিছু নিল।

‘কে ছেলেটা?’

‘কী জানি! হুমচক্কার দেশ কোনদিকে আমার কাছে জানতে চাইল।’

বুড়ির কানা চোখটা বুজে গেল। ভালো চোখটা ড্যাবড্যাব করে জ্বলে উঠল। বুড়ির এত্তো উঁচু নাকটা ফুলে উঠল। খোঁচা-খোঁচা নোখগুলো খটখট করে বেজে উঠল। বাজনা ভয় পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

বুড়ি ছটফটিয়ে খ্যান-খ্যান করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এলেটা, বেলেটা কোথাকার ছেলেটা?

মেনি বলল, ‘ঠাকমা, ঠাকমা, ছেলেটার নাম নেই।’

‘নাম নেই তো কাম কী তার?”

‘তার নাম জানি না, কাম জানি না। শুধু দেখলুম তার হাতে একটা কাঠের ঘোড়া, খেলনা।’

বুড়ি ঘোড়ার নাম শুনে চমকে উঠল।

বেড়াল জিজ্ঞেস করল, ‘চমকাও কেন গো ঠাকমা?’

‘মেনি, মেনি, মেনি,’ বুড়ি ধড়ফড়িয়ে উঠেছে।

বেড়াল ছটফটিয়ে বলল, ‘কেন? কেন? কেন?”

‘ছুট্টে যা!’

‘কোথা যাব?

‘দেখগে যা, ছেলেটা ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে কিনা!’ বলেই বুড়ি বেড়ালটাকে কোল থেকে ঠেলে দিল। বেড়ালটা উঠে পড়ল।

বেড়ালটা উঠল যেই, বুড়িটা দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে! যেন বাঁশ-পাতা! বেড়ালটা দরজা ঠেলল।

বুড়িটা পিদিম নিয়ে পথ দেখাল।

বাজনার বুক শুকিয়ে আমচুর!

বাজনা টাট্টুর কানে কানে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় লুকাই?

টাট্টু বলল, ‘ঝটপট দরজার আড়ালে চলে যাও।’

‘দেখতে পাবে যে!’

‘না, পাবে না। বুড়ির চোখ কানা, বেড়ালটাও তালকানা!

বাজনা চটপট দরজার আড়ালে ঘাপটি মেরে সিঁটিয়ে রইল।

 বেড়ালটা দরজা ঠেলে বাইরে এল। বাজনা দরজায় আড়াল পড়ে গেল।

 বেড়ালটা আলতো-পায়ের ডিঙি মেরে হাঁটছে আর খুঁজছে।

বুড়িটাও পিদিম নিয়ে দেখছে আর ঘুরছে।

টাট্টু ফিসফিস করে বলল, ‘বাজনা, ঘরে ঢুকে পড়ো।’

বাজনা দরজার আড়াল থেকে চট করে ঘরে ঢুকে পড়ল।

‘বাজনা, বাজনা, ওই কাঠের সিন্দুকের আড়ালে লুকিয়ে পড়ো।’

বাজনা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা সিন্দুকে খুঁজে পেল। চটপট তার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে চুপটি করে বসে রইল।

বুড়ি ঘরের বাইরে এ-ঝোপ দেখল।

বেড়াল ওদিক দেখল।

এ-গাছ দেখল। ও-ঝাড় দেখল। কিন্তু কই? কেউ নেই তো!

বেড়াল বলল, ‘ও ঠাকমা, ও ঠাকমা, কেউ নেই।’

বুড়ি জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো করে দেখেছিস তো?’

বেড়াল বলল, ‘দেখলুম তো!’

“উঃ! খুব রক্ষে।’ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন বলল, ‘চ, ঘরে চ।’ ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

 ঘরে ঢুকে মেনি বলল, ‘ঠাকমা, ঠামা, আমার হাসি পাচ্ছে।’

 ঠাকমা বলল, ‘আমারও।’

‘তোমারও?’ বলেই বেড়ালটা ‘ম্যাঁ-ও-ও-ও’ করে হেসে উঠেছে।

বুড়িটাও ‘হি-হি-হি’ করে হেসে ফেলেছে।

হাসতে হাসতে বুড়ি মাটির ওপর ধপাস করে বসে পড়ল। বেড়ালটাও বুড়ির কোলের ওপর উঠে পড়ল। বেড়াল হাসতে হাসতে বুড়ির গলা জড়িয়ে ধরল। বুড়িও বেড়ালের গলা জড়াল। তারপর দুজনে গলা জড়াজড়ি করে বেদম হাসতে শুরু করে দিল। হেসে কুটোকুটি।

হাসি থামলে বুড়ি বলল, ‘মেনি, মেনি, মেনি!’

মেনি বলল, ‘কেন গো?’

‘ভাগ্যিস ছেলেটাকে তুই আমার বাক্সের কথাটা ফস করে বলে ফেলিসনি!’

বেড়াল বলল, ‘পাগল! তাই আবার বলে!’

‘তাই রক্ষে! তা না হলে ছেলেটা ঠিক আসত।’

বেড়াল বলল, ‘ঠাকমা, তুমি আমাকেও তো কোনোদিন বাক্সটা দেখালে না!’

‘ভয় করে!’

‘কেন গো ঠাকমা?

‘কেউ যদি জেনে ফেলে!’

‘তোমারও মাথা খারাপ! এই ঘুপ-চুপটি বনে আছেই বা কে, জানছেই বা কে!’

‘দেওয়ালেরও কান আছে।’

‘কান আছে, চোখ তো নেই। একবার দেখাও না বাক্সটা!’

‘দেখবি? দেখাতে পারি। কাউকে বলবি না তো?’

বেড়াল বলল, ‘ঠাকমা, ঠাকমা, আমায় তুমি বিশ্বাস কর না?’

বুড়ি বলল, ‘মেনি, মেনি, মেনি, আমার তো ছেলে নেই, তুই আমার ব্যাটা হবি?’

‘হ্যাঁ গো ঠাকমা!’

‘মেনি, মেনি, মেনি, আমার তো নাতি নেই, তুই আমার নাতি হবি?

‘হ্যাঁ গো ঠাকমা!’

‘তবে আয় দেখবি আয়।’ বলে বুড়ি সেই মস্ত কাঠের সিন্দুকটার কাছে এল। বাজনার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল। এই বুঝি বুড়ি দেখে ফেলে! বাজনা তো পেছনে লুকিয়ে, বুড়ি দেখবে কেমন করে!

বুড়ি সিন্দুকের ডালাটা খুলে ফেলল। ‘ক্যাঁচ’ করে আওয়াজ হল। বাজনা নড়েচড়ে বসল। খুব গুটিসুটি মেরে টুক করে একবার উঁকি মারল। বাবা! গোটা সিন্দুকটাই তো মোটা মোটা লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা! সিন্দুকটা খুলতেই বুড়ির যে চোখটা কানা নয়, সেটা যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। উঃ! দেখলেই ভয় করে! বাজনা ঝাঁ করে আবার সিন্দুকের আড়ালে মুখটা সরিয়ে নিল।

সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝনঝন করে কীসের যেন আওয়াজ হল! আবার চমকে চাইল বাজনা! আরি বাবা! ঘরটা যে আলোয়-আলো হয়ে গেছে! ফোঁটা ফোঁটা আলো আর আলোর রং দেওয়ালে-দেওয়ালে নেচে উঠেছে। বুড়ির হাতের দিকে বাজনার চোখ দুটো ঝট করে ঘুরে গেল। আহা! বুড়ির হাতে একটা কী সুন্দর ঝকমকে বাক্স, ছোট্ট মতো! প্রদীপের আলো পড়েছে বাক্সটার ওপর। আর বাক্সের ঝকমকি ঠিকরে ঠিকরে পড়েছে ঘরের চারিদিকে, দেওয়ালে দেওয়ালে!

অবাক হয়ে দেখতে লাগল বাজনা।

বেবাক হয়ে চেয়ে রইল বেড়ালটা।

পিটির পিটির দেখতে লাগল টাষ্ট্র।

বুড়ি বেড়ালকে জিজ্ঞেস করল, ‘দেখলি তো?’

বেড়াল উত্তর দিল, ‘কই গো ঠাকমা? দেখলুম কই?

‘কেন? এই তো!’

‘বাক্সে তোমার চাবি আঁটা। খোলো, ভেতরটা দেখি!

 ‘হায় বাছা, সেই তো মুশকিল!’

‘কেন? মুশকিল কেন?’

‘চাবি কি আর আছে! চাবি যে হারিয়ে গেছে!’

‘হারিয়ে গেছে! কেমন করে?’

‘আর বলিস কেন? চাবি কি আর আজ হারিয়েছে! দুশো বছর হয়ে গেল।’

‘তোমার বয়স কত হবে গোঠাকমা?’

‘আমার বয়সের হিসেব আছে কি!’

‘চাবি হারাল কেমন করে?

‘ও বাবা, সে এক মস্ত কাণ্ড! বলতে গেলে রাত পোয়াবে।’

বেড়াল বলল, ‘বলো না, জেগে থাকব।’

‘আমার যে ঘুম পাচ্ছে।’ বলে বুড়ি হাই তুলল, ‘হাউ-উ-উ।’

‘একদিন না ঘুমুলে কী হয়েছে?

‘না, কিচ্ছু না। তবে শোন।’ বলে বুড়ি সেই ঝকমকে বাক্সটা আবার সিন্দুকে পুরে রাখল। সিন্দুকের ডালাটা ঘট করে বন্ধ করে দিল। দিয়ে সিন্দুকের পিঠে ঠেস দিয়ে বেড়ালকে কোলে নিল। গল্প বলতে শুরু করল। বলল,

একবার জানিস এক রাজার এক মেয়ে হল। মেয়ের হাত আছে, পা আছে, চোখ আছে, কান আছে। নাক নেই। একেবারে মুখের সঙ্গে চ্যাপটা! মেয়ের জন্যে রাজার ভাবনা যেমন, লজ্জারও তেমনি একশেষ। মেয়েকে কারো সামনে বারও করতে পারে না। নাক চ্যাপটা মেয়ের বিয়েই বা দেবে কেমন করে? রাজা বলল, যে তার মেয়ের নাক গজিয়ে দেবে সে যা চাইবে, রাজা তাকে তাই দেবে।

তা চেষ্টার কী শেষ আছে? কত মানুষ কত চেষ্টা করল। কিন্তু বাপরে বাপ! নাক গজানো কী চারটিখানি ব্যাপার! শেষে আমার কানে যখন কথাটা পৌঁছুল আমি ভাবলুম, দিই না মেয়ের নাক গজিয়ে। আমার বাক্সে তো সব আছে!

বেড়াল জিজ্ঞেস করল, ‘ঠাকমা, তোমার বাক্সে নাক আছে?

‘হ্যাঁরে বাবা! যার যা নেই, চাইলেই পাবি।’

‘আচ্ছা, ঠাকমা, আমার তো একটা ল্যাজ। আমি যদি দুটো চাই?

বুড়ি বলল, ‘পাবি।’

বেড়াল অবাক হয়ে বলল, ‘বাবা! তারপর কী হল ঠাকমা?’

তারপর কী হল জানিস? যেদিন যাব বলে সব ঠিকঠাক, বেঁধে-থুয়ে তৈরি তখন খেয়াল হল, তাই তো! অতদূরে রাজবাড়ি, যাই কেমনে। হায় কপাল! আসল কথাটাই মনে আসেনি। চেয়ে দেখি, ঠিক তক্ষুনি আকাশে একটা শুকনি পাখি উড়ে যাচ্ছে। আমি ডাকলুম, ‘শুকনি, শুকনি, আয়, আয়।’

শুকনি বলল, ‘যাই, যাই।’

বলতে বলতে আকাশ থেকে শুকনিটা উড়ে এল মাটিতে। আমি সেজেগুজে, ওই যে তরোয়ালটা দেখছিস দেওয়ালে ঝোলানো, ওইটা কোমরে বেঁধে, বাক্সটা হাতে নিয়ে তার পিঠে বসলুম। বললুম, ‘চ তো, যে-রাজার মেয়ের নাক চ্যাপটা, সেই রাজার কাছে নিয়ে চ তো আমায়।’

শুকনি আমায় পিঠে নিয়ে উড়তে আরম্ভ করল। একটা উঁচু-উঁচু পাহাড়। পাহাড়ে বরফ বরফ ঠান্ডা। ঠান্ডাতে গা শিরশির হাওয়া। উড়তে উড়তে শুকনিটা সেখানে এলে আমার তো শীতে ঠকঠকানি ধরে গেল। আমি বললুম, ‘ও শুকনি, গা শিরশির করে।’

শুকনি বলল, ‘চুপচাপ বসে থাক।’

আমি আবার বললুম, ‘ও শুকনি, দাঁত ঠকঠক করে!’

শুকনি বলল, ‘দাঁত দাঁত চেপে থাক।’

আমি আরেকবার বললুম, ‘ও শুকনি, ও শুকনি, ঠান্ডাতে গা জ্বর-জ্বর করে।’

 শুকনি মুখঝামটা দিয়ে বলল, ‘কোথায় নামব, দেখছ না নীচে!’

শুকনির কথা যেন কেমন বেঁকা-বেঁকা। নীচে চেয়ে দেখি সত্যিই বরফ আর বরফ! সাদা সাদা ঝকমকে বরফের ওপর রোদ পড়ে ঝলসে যাচ্ছে! দেখতে ভালোই লাগে! কিন্তু বরফ দেখব কী! ঠান্ডায় আমার প্রাণ যায়-যায়!

আরেকটু যেতেই শুকনি বলল, ‘বুড়ি, বুড়ি, বুড়ি।’

আমি বললুম, ‘কী করি, কী করি!’

 শুকনি বলল, ‘তুমি মরবে, না বাঁচবে?’

 ‘মানে!’ শুকনির কথা শুনে আমার যেন ধাত ছেড়ে গেল!

‘বাঁচতে যদি চাও তো ওই বাক্সটা আমায় দাও। বাক্স দিলে, আমি তোমায় পাহাড় ডিঙিয়ে রাজার দেশে নিয়ে যাব।’

আমার তো রাগে গা রি-রি করে উঠল। ভয়ও হল সাংঘাতিক। ভাবলুম, আগে তো বাঁচতে হবে, তারপর অন্য কথা। ভেবে শুকনিকে বললুম, ‘দেব, দেব, তোকে বাক্স দেব, আগে আমায় বাঁচা বাছা!’

শুকনি বলল, ‘ঠিক তো?’

আমি বললুম, ‘বেঠিক বলে বেঘোরে মরব নাকি!’

অমনি শুকনিটা হুস হুস করে উড়ে উড়ে পাহাড় ডিঙুলে। পাহাড় ডিঙিয়ে একটা গ্রামে পড়ল। আমি বললুম, ‘শুকনি, এবার একটু ডাঙায় নাম।’

শুকনি ডাঙায় নামল। যেই নেমেছে, আমি অমনি ওই বাক্সটা দিয়ে মেরেছি শুকনির মাথায় এক বারি। ব্যস। মাথাটা ঘেঁচে শুকনিটা মরে গেল! ওমা! মরলে কী হবে? মরা শুকনিটা একটা টাট্টু ঘোড়া হয়ে আমার সামনে চিহি-হি-হি করে ডেকে উঠল। কী সর্বনাশ! আমিও তিড়িং করে ঘোড়ার পিঠে চেপে পড়েছি।

ঘোড়া ছুটতে ছুটতে চরকি খেতে শুরু করে দিল। আমি ভাবলুম, কী ব্যাপার! ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে চরকি খায় কেন? জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী রে ঘোড়া, একটা পথে চরকি খাস কেন?’

ঘোড়া বলল, ‘না গো বুড়ি, তুমি কি চোখে দেখতে পাও না! এই তো যাচ্ছি!’ বলে ঘোড়া যেমন ছুটে ছুটে চরকি খাচ্ছিল, তেমনিই চরকি খাচ্ছে!

ঘোড়ার পিঠে চরকি খেতে খেতে আমারও মাথায় লেগে গেল। বনবন করে মাথা ঘুরছে। পাটনটন করছে। গা-গতরে বাজছে।

আমি বললুম, ‘ঘোড়া, ঘোড়া, থাম।’

ঘোড়া বলল, ‘থামব কেন?’

আমি বললুম, ‘আমার গা-গতরে লাগছে, থাম।’

ঘোড়া বলল, ‘সে কী গা, যাবে না?’

আমি বললুম, ‘আমার মাথা ঘুরছে, থাম।’

ঘোড়াটা চি-হি-হি করে হেসে উঠল।

‘হাসিস কেন?

ঘোড়া বলল, ‘থামতে আমি জানি না।’ বলতেই দেখো, দেখো, কী জোর ঝড় উঠল। আকাশে মেঘ ছিল না, ঝড়ো মেঘে ছেয়ে গেল। কোত্থেকে ধুলো-বালি উড়ে আমার চোখে। মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ঘোড়া কিন্তু থামে না! আমি ধুলোতে দেখতেও পাচ্ছি না, ঝড়েতে শুনতেও পাচ্ছি না, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতেও পারছি না। ঘোড়াটা ছুটছে, লাফাচ্ছে আর চি-হি-হিঁ করে হাঁক দিচ্ছে।

আমি ধমক দিলুম, ‘এই ঘোড়া, থামবি?’

ঘোড়া চেঁচাল, ‘বুড়ি ঝড়ে তোমায় শেষ করব! তোমার ওই বাক্স নেব, তারপরে ছাড়ব।’

আমি বুঝলুম ঘোড়াটা আমায় বিপদে ফেলে মারতে চায়। আমি কোনোরকমে তরোয়ালটা বার করে ঘোড়ার গলাটা ক্যাঁচ করে কেটে দিলুম। ওমা! ওমা! তবু ঘোড়াটা থামল না। মরল না। মাটিতে পড়ল না। গলা-কাটা ঘোড়াটা এবার সিধে ছোটা দিল।

ছুটতে ছুটতে যখন বালি-বালি ঝড় একটু থেমেছে, দেখি, ঘোড়াটা আর ঘোড়া নেই। একটা উট। আমি একটা উটের পিঠে বসে আছি! সামনে মরুভূমি ধূ-ধূ! উটের পিঠে মরুভূমির ওপর দিয়ে আমি চলেছি। আশ্চর্য! হঠাৎ দেখি, এ এক রোদ ঝাঁঝাঁ মরুর দেশ! বালি চিকচিক মরুর দেশ! আকাশে তাপ, বাতাসে তাপ। আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি বললুম, ‘এই উট, এই উট, জল খাব।’

উট বলল, ‘কোথায় পাব!’

আমি বললুম, ‘যেথায় পাস, সেথায় পাস, জল আমার চাই-ই চাই।’

উট বলল, ‘জল চাই? জল চাই? জল নাই! জল নাই!’ বলে উটটা বালির ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল, নাচতে লাগল।

আমি বললুম, ‘উট রে, উট রে, থামরে থামরে। প্রাণ আমার যায় রে, যায় রে।‘

 উট বলল, ‘মরলে তুমি ভালোই হয়, বাক্স পাই।’

‘ওরে উট, বাক্সের লোভ তোমারও! তবে দিই তোর মুণ্ডু দুখানা করে।’ বলে তরোয়াল দিয়ে খান খান করে দিলুম উটের মুণ্ডুটা।

ওমা! একটুও তো রক্ত বেরুল না! জল! জল! উটের গলা দিয়ে হুহু শব্দে শুধু জল বেরুচ্ছে। বেরুতে বেরুতে সে-জল ছড়িয়ে পড়ছে, গড়িয়ে চলছে!

গড়াতে গড়াতে একী ব্যাপার! সেখানে আর বালিও নেই, মরুও নেই। এদিকে থইথই, ওদিকে থইথই। চারিদিকে জল আর জল। মনে হচ্ছে যেন সামনে একটা জল থইথই। সমুদুর! হ্যাঁ-তো-রে! সমুদুর আবার কোথায় ছিল! দেখি সমুদুরের ওপর দিয়ে একটা নাও ভেসে যাচ্ছে। আমি চেঁচালুম, ‘ও মাঝি, ও মাল্লা, আমার নিয়ে যাবে?

মাঝি বলল, ‘কোথায় যাবে?’

 আমি বললুম, ‘যে-দেশের রাজার মেয়ের নাক চ্যাপটা, সেই দেশে।’

মাঝি বলল, ‘যাব।’

আমি তখন সেই নায়ে চেপে নাক চ্যাপটা রাজকন্যার দেশে চললুম।

 ক-দিন পর রাজকন্যার দেশে পৌঁছে রাজাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘রাজামশাই, রাজামশাই, তোমার মেয়ের যদি নাক গজিয়ে দিই, কী দেবে?’

রাজা বলল, ‘যা চাও।’

‘যা চাইব, তাই দেবে?’

রাজা বলল, ‘হ্যাঁ গো মেয়ে, তাই দেব।’

‘আমি যদি হাতি চাই?

‘হাতি দেব।’

‘ঘোড়া চাই?

‘ঘোড়া দেব।’

‘বাড়ি চাই?’

 ‘বাড়ি দেব।’

 ‘গাড়ি চাই?

‘গাড়ি দেব।’

 ‘রাজামশাই, তোমার মাথার যদি মুকুট চাই?”

‘মুকুট দেব।’

আমি তখন বললুম, ‘রাজামশাই, তুমি যদি সব দাও, তো তোমার কী দশা হবে?’

রাজা বলল, ‘মেয়ের নাক গজালেই সব হল। আমার মান বাঁচল। যদি মানই না থাকে তো কী হবে এত সব ধন-দৌলতে? রাজ্যপাটে?’

‘বেশ, তাহলে সেই কথা। আমি তোমার মেয়ের নাক গজিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমি যা চাইব, তাই চাই, কিন্তু!’ বলে ঝুলি থেকে বাক্সটা বার করলুম।

রাজা বলল, ‘এটা কী?

আমি বললুম, ‘এটাই তো সব। এতেই তো নাক!’

রাজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, আমার বাক্সের দিকে।

আমি আঁচলে হাত বাড়ালুম। ওমা! আঁচলে বাক্সের চাবি কই? আঁচলেই তো বেঁধে রেখেছিলুম। নেই তো! কোথায় গেল? এ-আঁচল দেখি, ও-আঁচল দেখি! কোমর দেখি! ঝুলি ঘাঁটি! যাঃ, চাবি নেই!

রাজা জিজ্ঞেস করল, ‘কী খুঁজছ?’

‘চাবি খুঁজছি।’

‘কীসের চাবি?’

‘বাক্সের চাবি।’

‘কী বাক্স?’

‘জাদু-বাক্স।

‘কী জাদু?’

‘ফুস-জাদু।’

‘দুস, দুস, দুস-জাদু! যত সব বাজে,’ বলে রাজা সিপাইকে ডাক দিল! বলল, ‘ঝোলাঝুলি ফেলে দাও। বুড়িটাকে বাইরে যাবার পথ বাতলে দাও।’

বলতেই সিপাই আমার ঘাড় ধরে পথে বার করে দিল। আমার তো চোখের জল পড়তে বাকি। ছিঃ ছিঃ। কী হল! এত করে শেষকালে চাবিটা হারিয়ে ফেললুম। আমি কাঁদতে কাঁদতে চাবি খুঁজতে লাগলুম পথে পথে। সে চাবি কী আর পাই বাছা? কে জানে কোথায় পড়ল! শুকনির পিঠে যখন পাহাড়ে পড়ল, না ঘোড়ার পিঠে যখন মাটিতে হারাল, না উটের পিঠে যখন মরুতে খুইল।

খুঁজে পেলুম না। খুঁজতে খুঁজতে কত বছর কেটে গেল। আমার দাঁত পড়ল। চুল ঝরল। একটা চোখ কানা হল। চাবি পেলুম না, পেলুম না!

তখন কী করি, কী করি, বাক্সটা নিয়ে বাসা বাঁধলুম এই বনে। কেউ না জানতে পারে বাক্সের কথা, কেউ না দেখতে পায়। সেই থেকে বাক্সটা বুকে নিয়ে এইখানেই আছি। কে জানে, কত বছর হয়ে গেল।

বুড়ি চোখ ঘুরিয়ে বেড়ালের দিকে তাকাল। যাঃ! বুড়ির কোলে বেড়ালটা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুড়ি বলল, ‘মেনি ঘুমুলি?’ বলে বুড়িও হাই তুলল। ছেঁড়া মাদুরটা টেনে। নিল। কোল থেকে মেনিকে তুলে শুইয়ে দিল মাদুরটার ওপর। পিদিমটা ফুস করে নিভিয়ে দিয়ে মেনির পাশে নিজেও গড়িয়ে পড়ল।

এতক্ষণ সিন্দুকের আড়াল থেকে কান পেতে বাজনা গল্প শুনছিল। চাবির কথা শুনে বাজনার বুকটা ধক করে উঠল। গোরু-বদ্যি তো তাকে একটা চাবি দিয়েছে! একদম ভুলে গেছল বাজনা। সে তো চাবিটা ট্যাঁকে রেখেছে! তাড়াতাড়ি ট্যাঁকে হাত দিলে বাজনা! না, আছে! এ চাবিটা ওই বাক্সের নয় তো!

সিন্দুকের পাশ থেকে খুব চাপা গলায় ডাকল, ‘টাট্টু, টাট্টু, বুড়ি শুলো।’

টাট্টু বলল, ‘চুপ, এখন কোনো কথা নয়।’

আরও কিছুক্ষণ ঠোঁট চেপে, চুপটি করে বসে রইল বাজনা।

একটুপরেই বুড়ি নাক ডাকাতে শুরু করে দিল।

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, শুনতে পাচ্ছ?’

টাট্টু গলার স্বর আরও চেপে বলল, ‘হু, পাচ্ছি। আর একটু ডাকতে দাও।’

নাক ডাকাতে ডাকাতে বুড়ি যখন ঘুমে একেবারে অচেতন হয়ে গেল, তখন টাট্টু বলল, ‘বাজনা, এবার ভালো করে দেখো।’

বাজনা উঁকি দিল। বাববা! যা অন্ধকার, কিছুই ঠাওর করা যায় না।

বাজনা বলল, ‘কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।’

টাট্টু বলল, ‘আস্তে আস্তে বেরিয়ে সিন্দুকের ডালাটা খুলে বাক্সটা বার করে নাও।’

বাজনা হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল। নিঃসাড়ে সিন্দুকের ডালাটা খুলে ফেলল। বাক্সটা বার করে আবার ডালাটা চাপা দিয়ে দিল। বলল, ‘টাট্টু, বাক্স পেয়েছি।’

টাট্টু বলল, ‘এবার ওই তরোয়ালটা নাও।’

ঘরের দেওয়ালে তরোয়ালটা টাঙানো ছিল। চটপট সেটা খুলে কোমরে বাঁধল।

টাট্টু বলল, ‘এবার খুব সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ো!’

টাট্টুর কথা শুনে, দেখে দেখে, খুব সাবধানে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল বাজনা। কিন্তু বরাতে বিপদ থাকলে কে রুখবে বল?

আর সে কী, বিপদ বলে বিপদ! বেড়ালকে ডিঙিয়ে বুড়িকে লাফাতে গিয়ে দেখতে পায়নি ঠিক-ঠিক। অন্ধকারে বেটক্কা মেরেছে বুড়ির গায়ে এক ধাক্কা!

আর দেখতে! বুড়ি একেবারে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে। ‘কে-রে! কে-রে!’ করে চিল-চেঁচিয়ে উঠল।

বুড়ির চেঁচানি শুনে বেড়ালেরও ঘুম মাথায় উঠেছে। তিড়িং করে লাফ মেরে ‘বাপরে বাপ’ বলে হাঁক পাড়ল।

তাই না দেখে বাজনা দুড়দাঁড়িয়ে মার ছুট! ঘরের দরজা খুলে পগারপার!

বেড়াল চেঁচাল, ‘ঠাকমা গো, ঠাকমা, সেই ছেলেটা!’ বলেই বেড়ালও ছুট দিল বাজনার পিছু পিছু। একেবারে তিরের মতো। এই বুঝি বাজনাকে ধরে ফেলে।

বাজনা টাট্টুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করি?’

টাট্টু বলল, ‘তাড়াতাড়ি আমার কপালে চ্যাং-চ্যাং রাজার টিপটা ছুঁইয়ে দাও।’

টিপটা তো বাজনার কাপড়ের খুঁটেই বাঁধা ছিল। ছুটতে ছুটতে কোনোরকমে ছুঁইয়ে দিল টাট্টুর কপালে। টিপও আটকাল টাট্টুর কপালে, সঙ্গে সঙ্গে আবার জ্যান্ত ঘোড়াও হয়ে গেল টাট্টু। বাজনা ঝটপট টাট্টুর পিঠে লাফিয়ে বসল। টাট্টু জোর কদমে দৌড় মারল!

বেড়ালও ছাড়বে না। বেড়ালও ছুটছে। আশ্চর্য! ওইটুকু পুঁচকে বেড়ালের কী তেজ! ঘোড়ার সঙ্গে কেমন পাল্লা দিচ্ছে দেখো!

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, বেড়াল যে খুব কাছে, এই ধরল বলে!’

টাট্টু বলল, ‘ভয় পেও না। তরোয়াল দিয়ে বেড়ালের গলাটা কেটে দাও।’

দিয়েছে বাজনা ‘ঘ্যাঁচ!’ বেড়ালের গলা দু-খানা।

ওমা! বেড়ালটা তো মরল না। বেড়ালটা যে শেয়াল হয়ে গেছে! ছুটছে টাট্টুর পেছনে!

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, বেড়াল গেল, শেয়াল এল। কী সাংঘাতিক!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘শেয়াল কতদূর?’

‘তোমার পায়ের কাছে।’

‘শেয়ালের গলাটাও দু-খানা করো।’

সঙ্গে সঙ্গে বাজনা তরোয়াল চালাল, ‘ঘ্যাঁচ!’

ওরে বাবা! শেয়ালটা গাঁক করে ডেকে, একটা বাঘ হয়ে গেল যে!

 বাজনা বললে, ‘টাট্টু, সর্বনাশ!’

 টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল?

‘শেয়াল থেকে বাঘ এল!’

টাট্টু আরও জোরে ছুট মারল।

বাঘও ছুট দিল।

বাজনা ভয়ে সিঁটিয়ে, খুব বাগিয়ে টাট্টুর গলাটা জড়িয়ে ধরলে। ভাবলে, আর রক্ষে নেই!

টাট্টু ছুটতে ছুটতে জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘ কতদূর?

বাজনা বলল, ‘দূরে নয়, কাছে!’

‘কত কাছে?’

‘লাফ মারলেই টুটি ধরবে!’

টাট্টুর গায়ে যত জোর, সব জোর একসঙ্গে করে জোড় কদমে ছুট দিল। কিন্তু পারবে কেন বাঘের সঙ্গে!

বাজনা কেঁদে ফেলল। বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, শেষে, বোধ হয় বাঘের পেটে যেতে হয়!

টাট্টু বলল, ‘কেঁদো না! কাঁদলে সব মাটি! এক কাজ করো, আমার কপাল থেকে টিপটা শিগগির তুলে নাও। নিয়ে বাঘের গায়ে ছুঁড়ে মারো।’

যেমন বলা তেমন কাজ। বাজনা চটপট খুলে নিল টিপটা টাট্টুর কপাল থেকে।

যাঃ! টিপটা কপাল থেকে সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাট্টু যে থমকে দাঁড়িয়ে ছিটকে পড়ল! আবার যে কাঠের-ঘোড়া খেলনা হয়ে গেল! বাজনাও হুমড়ি খেয়ে টাট্টুর পিঠ থেকে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছে। আর রক্ষে নেই! বাঘও ঘাড়ের ওপর পড়ল বলে। বাজনাও বাঁচি মরি চোখ-কান বুজে সাঁই করে ছুঁড়ে দিল টিপটা একেবারে বাঘের গায়ে। বাঘ মারল লাফ, ‘গাঁক।’ গিলে ফেলল বাজনাকে! যাঃ! বাজনা টাট্টুকে নিয়ে একেবারে বাঘের পেটে!

ওমা! কই বাঘ? বাঘ তো নেই!

তবে?

বাজনা বাঘের গায়ে যেই টিপটা ছুঁড়ে মেরেছে, বাঘটা যে অমনি ফানুস হয়ে আকাশে উড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে! একী বাবা!

কী সর্বনাশ!

ফানুস উড়ছে। ফানুসের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে বাজনাও উড়ছে।

এই রে! কী হবে?

ফানুস সাঁ সাঁ করে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। ওপরে উঠছে। আরও ওপরে। তারপর হয়তো আকাশে হারিয়েই যাবে!

ভয়ে একেবারে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল বাজনা।

টাট্টু বলল, ‘বাজনা, কাঁদলে আরও বিপদ। বিপদে বুদ্ধি হারালে মুশকিল। বুড়ির বাক্সটা তো আমার হাতেই আছে। বদ্যির চাবি দিয়ে দেখোনা বাক্সটা খোলা যায় কি না! বলা যায়। না, কী থেকে কী হয়! বুড়ি বলেছে বাক্সের ভেতর সব আছে। দেখো, ওর ভেতর হয়তো বিপদ থেকে বাঁচার উপায়ও থাকতে পারে।’

টাট্টুর কথা শুনে চোখের জল সামলে নিয়ে, বাজনা নাকের জল টানতে টানতে চটপট চটপট ট্যাঁক থেকে চাবিটা বার করল। বাক্সে লাগাল!

দেখো! দেখো! কী বরাত! চাবি লেগেছে! চাবি লেগেছে! বাক্সও খুলে গেছে!

ইস! এ আবার কী কাণ্ড! কোথায় এত ধোঁয়া ছিল? খুলতেই ওই ছোট্ট বাক্সটার ভেতর থেকে হুস হুস করে বেরিয়ে আসছে! চোখ চাইতে পারছে না বাজনা। গলায় ধোঁয়া আটকে দম বন্ধ হয়ে আসছে! এই দেখো, আবার বুঝি আরেক কাণ্ড হয়!

না, আর কিছু হল না। ধোঁয়া বেরুতে বেরুতে ফুরিয়ে গেল। ঝকমকে বাক্সের ভেতরটা কেমন ঝিলমিল করে উঠেছে!

কিন্তু একী!

কী? কী?

চমকে ওঠে বাজনা।

কেন?

বাক্সের ভেতর কার ছবি যেন!

হ্যাঁ, বাজনা স্পষ্ট দেখতে পেল তার মায়ের ছবি বাক্সের ভেতর ঝলমলিয়ে ভেসে উঠেছে! মা চুপচাপ বাজনার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে মা-র টুপটুপ জল গড়াচ্ছে। মা কাঁদছে। ডাকছে না বাজনাকে। শুধু দেখছে!

আঁতকে উঠল বাজনা। এতদিন মায়ের কথা একদম ভুলে গেছে বাজনা। চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাজনা, ‘মা-আ-আ।’

মা কথা বলল না। ছলছল চোখে চেয়েই রইল।

কিন্তু এই যাঃ! ঠিক তক্ষুনি বাক্সটা বাজনার হাত থেকে ফসকে গেল।

মা-ও হারিয়ে গেল! আকাশে ফানুসটা উড়ছে আর বাক্সটা মাটিতে পড়ছে।

‘না-আ-আ-আ।’ কী ভয়ংকর চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছে বাজনা।

কাঁদলে কী আর বাক্স থামে!

‘দুম-ম-ম-ম!’ মাটিতে পড়ল বাক্সটা। কী বিকট আওয়াজ!

ওমা! সঙ্গে সঙ্গে ফানুসটাও ফ-ট-ট-ট! ফেটে গেছে! এই রে!

ফাটা ফানুসটা বাজনা আর টাট্টুকে নিয়ে ওই উঁচু আকাশ থেকে যেন হোঁচট খেতে খেতে নীচে পড়ছে। এক্ষুনি মাটিতে ছিটকে পড়বে। ফানুসের সঙ্গে ডিগবাজি খেতে খেতে বাজনাও পড়ছে, টাট্টুও পড়ছে। এবার নির্ঘাৎ সব শেষ!

সত্যি! আকাশ থেকে মুখ থুবড়ে বাজনা মাটিতে পড়ল! আঃ! শেষবারের মতো কেঁদে উঠল, ‘মা-আ-আ।’ তারপর সব চুপ!

হঠাৎ মায়ের মিষ্টি হাতের ছোঁয়া লাগল বাজনার মাথায় মা ডাকল ‘বাজনা, বাজনা, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছিস কেন?’

ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল বাজনা। অবাক হয়ে মায়ের চোখের দিকে চেয়ে রইল। ভয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরল দু-হাত দিয়ে। জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আমি কোথায়?

মা বললে, ‘কেন, এই তো আমার কাছে!’

বাজনা বলল, ‘আমার ভয় করছে মা!’

‘ভয় কেন রে! এই তো আমি আছি।’ বলে মা আদর করে বাজনার গালে চুমু খেয়ে ডাকল, ‘বাজনা, লক্ষ্মী-সোনা।’

চমক লাগল বাজনার। চোখের পাতা দুটি তার কেমন যেন নেচে উঠল। মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

মা বলল, ‘কী দেখছিস?

বাজনা গলাটি জড়িয়ে ধরল মায়ের। চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘মা, আর একবার ডাকো, আমার নাম ধরে।’

মা অবাক হয়ে চেয়ে দেখল বাজনার চোখের দিকে। বলল, ‘কেন রে?’

বাজনা বলল, ‘এমনি। ডাকো না!’

হেসে ফেলল মা। মিষ্টি-সুরে মা ডাকল, ‘বাজনা!’

বাজনা আবদার করল, ‘আর একবার।’

‘পাগল ছেলে!’ বাজনাকে বুকে টেনে নিল মা। সবটুকু আদর যেন উপচে পড়ল মায়ের মুখ দিয়ে, ‘বাজনা, বাজনা, বাজনা।’

আঃ! আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠল বাজনার বুকখানি। ঠিক তক্ষুনি তার মনে হল, এমন সুন্দর নাম পৃথিবীতে আর কারো নেই। মায়ের আদর যেমন মিষ্টি, তার নামটাও তেমনি মিষ্টি! মা যে-নামে ডাকে সেই নামই তো সবচেয়ে সুন্দর! সবচেয়ে ভালো!

মায়ের বুকে মুখ লুকিয়েই বাজনা আড় চোখে দেখল ঘরের দেরাজটার দিকে। হ্যাঁ, ওই তোটাট্টু বসে আছে। বসে বসে যেন বাজনাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে আর চোখ টিপছে। কী দুষ্টু দেখো!