টুইটুই
ছোট্ট-ছোট্ট পাখি। আকাশে যেন একটি-একটি রঙের ফোঁটা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ।
মাটিতে-এক প্রকাণ্ড রাজ্য। আর এক মস্ত বড় রাজা। আগে রাজার ঘরে সব ছিল। আলো ছিল। রং ছিল। মন ছিল। এখন কিছুই নেই।
রাজার রানি নেই। রাজার মেয়ে নেই। রাজার ছেলে নেই। একে-একে সক্কলে চলে গেছে। চলে গেছে নীল আকাশের দরজা পেরিয়ে যেখানে স্বর্গ–সেখানে।
রাজার আছে মস্ত রাজবাড়ি। রাজবাড়িতে আছে মন্ত্রী, সান্ত্রি, সিপাই, বরকন্দাজ। রাজা। তাদের সঙ্গে কথা বলে। তাদের ওপর হুকুম চালায়। পানের থেকে চুন খসলেই রাজার। চোখ লাল হয়ে ওঠে। রাজার গলা গাঁক করে গর্জে ওঠে, ‘মেরে ফেলো।’ রাজবাড়ি কেঁপে ওঠে। ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা লেগে ধবনি ফেরে প্রতিধবনি হয়ে ‘মেরে ফেলো-রে ফেলো ফেলো।’
রাজার মনে নেই দয়া। চোখে নেই জল। আগে তো এমন ছিল না রাজা! কেন এমন হয়ে গেছে!
আকাশে তারা যখন ফুট ফুট করে জ্বলে সেদিকে চোখ গেলে রাজা হেঁকে ওঠে, ‘জানলা বন্ধ করে দাও।’
রাজবাড়ির সমস্ত জানলা দুম দুম করে বন্ধ হয়ে যায়।
গাছে-গাছে ফুল যখন হাসে–রাজার সেদিকে নজর গেলে চিৎকার করে ওঠে, ‘ছিড়ে ফেলো।’
গাছের সমস্ত ফুল মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
আহা! ফুলের ব্যথা লাগে না!
একদিন গাছে দুটি পাখি নাচছিল। ছোট্ট দুটি পাখি। একটি হলুদ পাখি। একটি নীল পাখি। ঘরের জানলা দিয়ে দেখছিল রাজা। হঠাৎ তার দেহের সব রক্ত একসঙ্গে টগবগ করে ফুটে উঠল রাগে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের তির ছুটল। নীল পাখিটা ছিটকে পড়ল। নীল পাখির নীল পালক রক্তে লাল হয়ে গেল। মরে গেল। আর সেই হলুদ পাখিটা উড়ল আকাশে– প্রাণের ভয়ে। উড়তে উড়তে কোথায় যে হারিয়ে গেল–কে জানে!
নীল পাখিটা মরে পড়ে আছে। রক্ত তার শুকিয়ে গেছে। একটি একটি পাখি আসছে। ভয়ে ভয়ে। দেখছে তাকে। শেষদেখা। নীল পাখিটা হয়তো তাদের বন্ধু। হবে বোধ হয়! হয়তো তারা কাঁদছে।
আচ্ছা, দুঃখ হলে পাখির চোখে জল আসে না? মিষ্টি-মিষ্টি চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল?
রাজা দেখছিল। দেখছিল মরা নীল পাখিটাকে। হাজার হাজার পাখি আসছে, যাচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট ডানা নাড়িয়ে হাওয়া করছে। যদি বেঁচে ওঠে।
পাখিরা জানে না বুঝি একবার মরে গেলে বাঁচে না কেউ!
রাজা চেঁচিয়ে উঠল, ‘তাড়িয়ে দাও।’ কী ভয়ংকর চিৎকার!
হাঁক শুনে চল্লিশজন সিপাই ছুটে এল।
‘আমার চোখের সামনে থেকে পাখি তাড়িয়ে দাও।’
রাগে দেহ ঠকঠক করে কাঁপছে রাজার। ‘আমার রাজ্যে একটিও পাখি থাকবে না। একটিও না।’
হুকুম শুনে চল্লিশজন সিপাই ছুটল চল্লিশশো লোক ডাকতে।
চল্লিশশো লোক ছুটল চল্লিশ হাজার পাখির পেছনে।
রাজার হুকুম, রাজ্যে আর একটিও পাখি থাকবে না। সব পাখি তাড়িয়ে দিতে হবে।
চল্লিশশো লোক সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত রাজ্যে পাখি তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। পাখিরা একবার উড়ে যায়। আবার আসে। আবার তাড়ায়। বার বার আসে। আকাশে চরকি ঘোরে। রঙের চরকি। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ।
যেন ঝড় উঠেছে। আকাশে পাখির ঝড়। মাটিতে মানুষের ঝড়। চল্লিশশো লোক ছুটছে। পড়ছে আবার উঠছে। আবার পড়ছে।
পাখিরা আসছে, যাচ্ছে। যাচ্ছে, আসছে।
তারপর?
পাখিরা সত্যি সত্যি চলে গেল।
কোথায় গেল?
তাদের ঘরে। গাছের ডালে। রাত আসছে। ঘুমবে না?
একটি পাখি। ছোট্ট এতটুকু। রাত্তিরবেলা মা তাকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। ঘুম চোখে সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাগো, অতগুলো মানুষ আমাদের অমন করে মারতে এল কেন? আমরা তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি।’
পাখির মা ছেলের কথায় চুপ। রা কাড়ে না।
ছেলে আবার আবদার করল, ‘বলো না মা?’
আকাশে তারার পর তারা ফুটছে। একটির পর একটি পাখির চোখে ঘুম আসছে। আকাশে তারা যখন জাগে, পাখি তখন ঘুমোয়। তারা যখন ঘুমিয়ে পড়ে–পাখি তখন জাগে।
ভোর হল। পাখিরা জাগল। গান শুরু করে দিল। গাছের পাতায় দোলা লাগল। দোল দোল। দোল-দোল।
রাজার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই আবার কানে এল পাখির গান। চোখ চাইতেই–সামনে পাখির নাচ। তারা যেন রাজাকে ভেংচি কাটছে নেচে নেচে। রাজার চোখ জ্বলজ্বল করছে। রাগে! হিংসেয়!
‘কৌন হ্যায়’–রাজার গলায় যেন মেঘের ডাক।
চল্লিশজন সিপাই ছুটে এল।
রাজার চোখ লাল টকটক।
সিপাইগুলো দেখছে যত, কাঁপছে তত। ঠকঠক।
‘পাখি আবার এল কেন?’ রাজা ধমক দিল।
‘আজ্ঞে ওরা যে পাখি’, একজন সিপাই উত্তর দিল।
‘আমি না তাড়িয়ে দিতে বলেছিলুম!’
‘আজ্ঞে হুজুর তাড়িয়ে দিলে আবার আসবে।’
‘আসবে কেন? আমার হুকুম ওরা মানে না?’
‘পাখি কি আর রাজার হুকুম বোঝে!’
‘না বোঝে তো ধরো। মেরে ফেলল। সমস্ত পাখি মেরে ফেলল। একটি পাখিও যেন না আসে আমার রাজ্যে।’
আবার ছুটল লোক পাখির পেছনে।
ফাঁদ পাতল। জাল পড়ল। তির ছুটল। আকাশের পাখি মাটিতে ছিটকে গেল। হাজারে হাজারে। ছোট্ট-ছোট্ট পাখি। তাদের কান্না কে শুনবে?
দিন দিন সাতদিন রাজার লোকেরা পাখি তাড়াল। সাতটি দিন রাজার লোকেরা পাখি মারল। সাতদিন ধরে কত যে পাখি ফাঁদে পড়ল, পাখির পা জালে আটকাল তা কে গুনবে?
তারপর?
তারপর পাখিরা আর আসে না। একটিও পাখি আসে না।
যেমন রাজা তেমনি রাজ্য। সেখানে গাছে ফুল নেই। ফুলের পাশে পাখি নেই। সেখানে রাতে তারা দেখে না কেউ। রাজার হুকুম!
রাজার চবিবশ ঘন্টা চোখ লাল। চোখদুটো যেন সব সময় দপদপ করে জ্বলছে। সে-চোখে খুশি নেই। সে-মুখে হাসি নেই। খালি গর্জন। একটা মস্ত ঘরে রাজা একা বসে থাকে। কারোর সঙ্গে কথা বলে না। খোলা জানলা দিয়ে দেখে, দূর, অনেক দূরের পাহাড়টা। সন্ধেবেলায় আকাশ রাঙিয়ে সূয্যিঠাকুর ঢলে পড়ে পশ্চিমে। রাজার সমস্ত শক্তি যেন তখন হাতের মুঠোয় এসে জড়ো হয়। রাজা ভাবে, ‘যদি পারতুম সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে!’
রাজবাড়ির সিংদরজায় ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং। রাতের ঘন্টা। সোনার পালঙ্ক। রাজা শুয়ে। আছে। চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসছে না। উঠে পড়ল। সামনের জানলায় চোখ মেলে। দাঁড়িয়ে রইল রাজা। রাত্তিরের মিশমিশে কালো অন্ধকার চারিদিকে ছড়িয়ে। চাঁদ যে ওঠেনি। চোখে সব ঝাপসা। নিজঝুম রাত্তিরে গাছের ঝরে পড়া পাতায় হাওয়া লাগে– খসখস। পাতা উড়ে যায়। নিজঝুম রাত্তিরে রাজবাড়ির দেওয়ালের ফাঁকে টিকটিকি ডেকে ওঠে–টিক টিক। দরজায় সিপাই লাঠি ঠোকে–ঠক ঠক। অনেক অ-নে-ক দূর থেকে সান্ত্রি চেঁচিয়ে ওঠে–’এই হো হো-ও’। অন্ধকারে চমকে ওঠে রাজা। থমকে থামে বুকের ধুকধুকি।
রাত গড়ায় প্রহরের পাকে। রাজা দাঁড়িয়ে থাকে।
কখন ঘরে যাবে রাতের জুজুবুড়ি?কখন আসবে সকালের রোদ কুমারী? সোনালি গয়না গায়ে সাজিয়ে?
রাত গড়িয়ে গেল। তখনও রাজা ঠায় দাঁড়িয়ে। জানলার ধারে। ভোরের আলো ভেসে আসে ধীরে-ধীরে। আকাশ থেকে কে যেন চুমকি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঝলমল ঝলমল আলো উছলে ঝরে পড়ছে। আলো ছড়িয়ে গেল আকাশে। আকাশ নীল হল।
আলো ছড়াল নদীর জলে। নদী নাচল। আলো ছড়াল গাছের পাতায়। পাতা দোল খেল।
আলো ছড়িয়ে গেল রাজার মুখে। তবুও রাজার হাসি নেই। খুশির বাঁশি বাজে না মনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কীসের ভাবনা রাজার?
‘টুই-টুই’, আচমকা একটি পাখি ডেকে উঠল।
রাজা চমকে উঠল। আবার পাখি!
জানলার ধারে কান পেতে রইল রাজা। হ্যাঁ, সত্যিই তো পাখিটা ডাকছে ‘টুই-টুই।’ একবার। দুবার। বারবার।
রাজার চোখ ঘুরছে। পাখিটাকে খুঁজছে বড়ো-বড়ো দুটো চোখ। রাগে লাল দুটো চোখ। কিন্তু কই? পাখি তো দেখা যাচ্ছে না?
আবার ডাকছে, ‘টুই-টুই!’
ফের ডাকল, ‘টুই-টুই!’
ওইতো ডেকেছে ‘টুই-টুই!’
রাজা আর থাকতে পারল না। পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘পাখি!’ কী ভীষণ চিৎকার।
পাত্রমিত্র, রাজমন্ত্রী, সিপাই-সান্ত্রি ছুটে এল চিৎকার শুনে।
রাজা আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘পাখি!’
কই? কই? কই? পাত্রমিত্র, রাজমন্ত্রী, সিপাই-সান্ত্রি চোখ চাওয়াচাওয়ি করলে। ভয়ে কুঁচকে যাওয়া চোখ।
রাজা তেড়ে উঠল, ‘ডাকছে!’
‘আজ্ঞে কই?’ রাজমন্ত্রী জুজুর মতো জিজ্ঞেস করল।
রাজা দু-হাত দিয়ে নিজের দু-কান চেপে ধরল! ছোটোছেলের মতো চেঁচাতে লাগল, ‘ওইতো! ডাকছে। আমি শুনতে পাচ্ছি। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার মাথা ঘুরছে। ধরে আনো। ধরে আনো।’
চেঁচাতে-চেঁচাতে রাজা পড়ে গেল মাটিতে। অজ্ঞান হয়ে।
অবাক! সক্কলে অবাক! আর তো কেউ শুনতে পাচ্ছে না পাখির ডাক! আর তো কেউ দেখছে না পাখি!
তবে?
আবার লোক ছুটল পাখির খোঁজে।
একদিন গেল। রাজার জ্ঞান এল না। পাখিও পাওয়া গেল না। গাছে গাছে শিকারিরা পাখি খুঁজছে, আর রাজবাড়িতে হাকিম-বদ্যি রাজার রোগ খুঁজছে।
দুদিন গেল। রাজা চোখ চাইল। কথা বলল না। পাখিও পাওয়া গেল না।
তিনদিন গেল। রাজা কথা বলল। উঠতে পারল না। পাখিও পাওয়া গেল না।
চারদিনের দিন রাজা বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।
মন্ত্রী এসে খবর দিল, ‘আজ্ঞে পাখি তো পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যে তো একটিও পাখি নেই। আপনি বোধ হয় ভুল শুনেছেন।’ রাজা মন্ত্রীর দিকে তাকাল। কী কটমট চাউনি! মন্ত্রী ভয়ে ময়ে সরে পড়তে গেল। রাজা ধমক দিল, ‘দাঁড়াও!’
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মন্ত্রী। ‘এখানে এসো।’
মন্ত্রী গুটিগুটি এগিয়ে এল রাজার বিছানার কাছে। লক্ষ্মীছেলের মতো।
চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইল রাজা। একদুষ্টে মন্ত্রীর চোখের দিকে। ওরে বাবা! মন্ত্রীর বুক। দুরদুর করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। গলা টিপে দেবে নাকি!
‘শুনতে পাচ্ছ?’ মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রাজা।
মন্ত্রী ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, ‘আজ্ঞে!’
রাজা দাবড়ি দিল, ‘শুনতে পাচ্ছ।’
চমকে উঠল মন্ত্রী। ফসকে গেল কথা, ‘আজ্ঞে পাচ্ছি।’
‘কী শুনতে পাচ্ছ?’
‘পাখির ডাক!’
‘তবে যে বলছিলে শুনতে পাচ্ছ না?’
“আজ্ঞে, আগে পাচ্ছিলুম না, এখন পাচ্ছি।’
রাজা ধমক দিল, ‘পাখি এল কোত্থেকে?
‘আজ্ঞে, আকাশ থেকে!’
আবার চেঁচিয়ে উঠল রাজা, ‘মিথ্যে কথা। ডাহা মিথ্যে। এটা আকাশের পাখি নয়। এটা কারো পোষা পাখি। আবার হুকুম না-শুনে কেউ পাখি লুকিয়ে রেখেছে। দরকার নেই। তোমাদের। এ-পাখি আমি নিজে খুঁজে বার করব। যেমন করে হোক খুঁজে বার করব। তারপর–যার পাখি তাকে শূলে চাপাব। তোমাদেরও আস্ত রাখব না। টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব।’
কেঁপে উঠল মন্ত্রী। হেসে উঠল রাজা, হো-হো-হো। যেন একটা দত্যি!
মন্ত্রী হাঁপাতে-হাঁপাতে ছুটে পালাল।
রাজার হাসি শুনে রাজবদ্যি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।
‘আজ্ঞে, কী হয়েছে?’
রাজার মুখে রা নেই। গুম হয়ে গেল।
‘হুজুর কীসের কষ্ট? পায়ের না মাথার?
‘চলে যান!’ ঘর কেঁপে উঠল রাজার গলার শব্দে।
পিলে চমকে উঠল রাজবদ্যির। একটি ঢোঁক গিলে পথ দেখল।
‘দাঁড়ান।’ হঠাৎ রাজা ডাকল।
থমকে দাঁড়াল বদ্যিমশাই।
‘আমার কাছে আসুন।’
সুড়সুড় করে এগিয়ে গেল বদ্যিমশাই।
‘আমার চোখের দিকে তাকান।’
মিটমিট করে চেয়ে রইল রাজার দিকে।
‘শুনতে পাচ্ছেন?’
বদ্যিমশাই কান পেতে রইল। বদ্যির বাঁদিক হেলছে। ডানদিক দুলছে।
দুলতে-দুলতে ঘাড় নড়ল। মাথা হেলল। হ্যাঁ! সত্যিই তো! অনেক দূর থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে–টুই-টুই। ভয়ে ঘামতে শুরু করল বদ্যিমশাই। একেবারে স্থির। যেন পাথর! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কাঠ। শুকনো গলায় আমতা-আমতা করে বদ্যিমশাই বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘কী আজ্ঞে হ্যাঁ?’
‘একটা পাখি ডাকছে!’
রাজা লাফিয়ে উঠল। রাজার লাফ দেখে বদ্যি ওরে বাবারে বলে, পড়িমরি পিঠটান দিল। রাজা আবার পাগলের মতো হাসতে শুরু করে দিল। হাসতে-হাসতে দড়াম করে বন্ধ করে দিল ঘরের দরজা। একলা ঘরে রাজা সারাদিন কাটাল। বাইরে এল না। কাউকে সাড়া দিল না। রাজা কি পাগল হয়ে গেল?
রাত এল। রাত গম্ভীর হল। সাতমহলা রাজবাড়িতে ঘুম এল। রাজার চোখে ঘুম নেই।
রাজা তার সোনার মুকুট খুলে ফেলল। হিরে-মুক্তোর হার লুকিয়ে রাখল। জরির জুতো সরিয়ে রাখল। রাজার এখন অন্য বেশ। ছদ্মবেশ। রাতদুপুরে ছদ্মবেশে কোথায় যাবে রাজা?
রাত আরও গম্ভীর হয়েছে।
‘খুট।’ ঘুমিয়ে-পড়া রাজবাড়িতে কে যেন দরজা খুলল? ঘরের দরজা? কে? তার মাথা থেকে পা অবধি কালো কুচকুচে কাপড় জড়ানো।
রাজা। নিজের ঘরের দরজা খুলেছে রাজা। দরজা একটুখানি ফাঁক করে উঁকি মারল।
খট খট। রাতের প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। তাদের শক্ত মোটা নাগরা-জুতো।
রাজার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। দেখে ফেলল নাকি?
না। কেউ দেখেনি সামনে কেউ নেই। ঘরের সামনে। ঘরের সামনে লম্বা-চওড়া দালান। এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না। বড়ো-বড়ো ঝাড়লণ্ঠনের আলোগুলো নিভে গেছে। দেওয়ালের গায়ে আকাশি রঙের আলো ছড়িয়ে একটা দেওয়াল-গিরি জ্বলছে। আবছা আবছা আলো। দূরে দূরে সান্ত্রিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
রাজা আবার উঁকি মারল। এদিক-ওদিক। চট করে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। সামনের দেওয়াল-গিরিটা ঝট করে নিভিয়ে দিল ফুঁ দিয়ে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। অন্ধকারে সান্ত্রি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কৌন হ্যায়।’ একটা দমকা হাওয়ায় ঝাড়লণ্ঠনের কাঁচে-কাঁচে ঠোকাঠুকি লেগে গেল। ঠুংঠাং। ছুটে এল সান্ত্রি চটপট। খট খট খট। ঝটপট বাতিটা জ্বেলে দিল। বাঁদিক দেখল। ডানদিক দেখল। সামনে দেখলে। পেছন দেখলে। না। কেউ কোত্থাও নেই। সব চুপচাপ। সান্ত্রি ভাবল, হয়তো হাওয়ায় নিভে গেছে বাতি। আবার তার কাজে চলে গেল। রাজা রাজবাড়ির পেছনের গোপন রাস্তায় ছুট দিল। সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজপথে বেরিয়ে গেল।
অন্ধকার। সামনে কী আছে, দেখা যায় না। সামনের পথ চেনা যায় না। জমাট অন্ধকার। কে যেন একটা কালো কুচকুচে কাপড় পরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর গায়ে। আকাশের তারাগুলো যেন কালো কাপড়ের ওপর ঝকমকে চুমকির কাজ। চুপিচুপি নিঃসাড়ে সেই অন্ধকারে রাজা চলেছে।
রাজা চলেছে পাখির খোঁজে। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে পাখি বার করতে হবে। যেমন করে হোক খুঁজতে হবে।
হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে উঠল, ‘ঘেউ-উ-উ।’
রাজার গা ছমছম! বুক দুর-দুর করছে! যদি ধরা পড়ে যায়!
চলতে-চলতে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়াল রাজা। বাড়ির দরজা বন্ধ। ঢুকবে কেমন করে? পাখি খুঁজবে কেমন করে? জানলা দিয়ে উঁকি মারল। জানলার ধারে কি আর পাখি আছে? তাইতো! কী করবে তাহলে রাজা! সামনে আরেকটি বাড়ি তারও দরজা বন্ধ।
আরও একটি বাড়ি।
আরও বাড়ি।
বাড়ি। বাড়ি। বাড়ি। সব বন্ধ।
তাহলে এত চেষ্টা সব মাটি!
না। একবার শেষ চেষ্টা করতে হবে। একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রাজা। বাড়ির গায়ের সঙ্গে একটা মস্ত গাছ দাঁড়িয়ে। হেলে আছে। ওই গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে রাজা ওপরে উঠছে। পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে যাবে। বাড়ির ভেতরে।
অনেক কষ্টে উঠেছে। একটা ডাল ধরেছে। আরেকটা। ব্যাস! মড়মড় করে আওয়াজ। অপলকা ডাল গেছে মচকে। রাজা হাত ফসকে, পালটকে মাটিতে ধপাস। ডিগবাজি।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বেড়াল ডেকে উঠল, ‘ম্যাঁও।’
মায়ের পাশে ঘুমুতে-ঘুমুতে ছোট্ট ছেলে কেঁদে উঠল, ‘মা-উ।’
একটা কুকুর হেঁকে উঠল, ‘ঘেউ-উ।’
সঙ্গে-সঙ্গে কোত্থেকে সিপাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর।’ রাজার বুক কেঁপে উঠল।
দেখতে দেখতে এ-বাড়ির লোক বেরিয়ে এল, ‘চোর।’
ও-বাড়ির লোক চেঁচিয়ে উঠল, ‘চোর।’
পাশের বাড়ির লোক ছুটে এল, ‘চোর।’
‘চোর। চোর। চোর।’ অগুনতি লোকের চেঁচামেচি।
‘ঘেউ। ঘেউ ঘেউ।’ অসংখ্য কুকুরের চিৎকার।
রাজা ছুট দিল। আগুপিছু না-ভেবে ভয়ে-ময়ে ছুট।
দলে দলে লোক ছুটল সাঁই সাঁই রাজার পেছনে।
অন্ধকারে রাজা ছুটছে। রাজাকে ‘চোর’ বলে তাড়া লাগিয়ে লোক ছুটছে।
লোক ছুটছে।
রাজা ছুটছে।
কেউ জানতেও পারছে না, সামনের যে-লোকটা ছুটছে সে চোর নয়। তাদের রাজা।
রাজা তাড়া খেতে-খেতে ছুটছে। হোঁচট খাচ্ছে। পড়ছে। উঠছে। আবার ছুটছে। হাত কাটছে। পা কাটছে। জামা ছিঁড়ছে। কাপড় ফাঁসছে।
পেছনে লোক ছুটছে একশো, না এক হাজার। এক হাজার, না পাঁচ হাজার–কে গুনবে?
তারপর?
অনেক দূর পর্যন্ত লোক ছুটল। কিন্তু চোর ধরা পড়ল না। চোর অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে গেল। আর চোর না ধরতে পেরে চোর-তাড়ুয়ার দল মুখ শুকিয়ে ঘরে ফিরে এল।
রাজা তবুও ছুটছে। হাঁপাচ্ছে। দম ফেটে পড়ছে। তখনও অন্ধকার।
কোথায় চলেছে, রাজা নিজেও জানে না। জানে না, এটা পথ, না বেপথ। উত্তর, না দক্ষিণ। পুব, না পশ্চিম। বন, না গ্রাম। গ্রাম, না শহর। হাট, না বাজার।
চারদিক অন্ধকার।
রাজা ছুটছে–রাত হাঁটছে।
রাজা হাঁটছে–রাত গড়াচ্ছে।
রাজা থামছে–তোর নামছে।
আর যেন পারছে না।
রাজার কপাল কেটেছে-রক্ত পড়ছে।
রাজার হাত কেটেছে–রক্ত ঝরছে।
ছুটতে ছুটতে, চলতে-চলতে, থামতে-থামতে রাত ভোর হল।
পাখি ডাকল, টিই-ই-ই। চিকচিক। চিরিক চিরিক। ভোরের আলো মিষ্টি। ভারি মিষ্টি।
ভোরের আবছা আলোয় চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে রাজার। এ-কোথায় এসে পড়েছে তাড়া খেয়ে?
সামনে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে-গায়ে মেঘ ঘুমিয়ে আছে। পাহাড়ের কোলের গোড়ায় ছোট্ট গ্রাম।
রাজার মাথা ঘুরছে। শরীর ঝিমঝিম করছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পাটলে টলে পড়ছে। কী করবে এখন? পড়ে যাবে নাকি? বসে পড়ল। একটা জামরুল গাছ তার নীচে।
তারপর?
তারপর রাজা আর কিছু জানে না। শুয়ে পড়েছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল গাছের নীচে।
এমনি করে গাছের নীচে কতক্ষণ পড়েছিল, রাজা জানে না।
কখন সূয্যিঠাকুর সোনার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে, কখন সকাল হয়েছে, রাজা জানে না।
কখন পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে-পড়া মেঘ, ঘুম ভেঙে যাওয়ায় নাচতে নাচতে চলে গেছে, রাজা জানে না।
কখন মৌমাছিরা ফুলে ফুলে দোলা দিয়ে উড়ে গেছে, রাজা জানে না।
অনেকক্ষণ পর রাজার জ্ঞান ফিরল।
চোখ চাইল রাজা। ক্লান্ত দুটি চোখ। চোখের ওপর সবুজ গাছ। গাছের ডালে পাখি। গাছের পাতার ফাঁকে নীল আকাশ। আকাশের ঝিলিমিল আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাজার গায়ে এসে পড়েছে। ঝিলমিল-ঝিলমিল। কিন্তু এ কে? রাজার কোলের কাছে বসে আছে? রাজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে?মুখখানি হাসি-মাখা?
একটি ছোট্ট ছেলে। ছেলেটিকে দেখে রাজা ধড়ফড়িয়ে উঠতে গেল, ‘আমি কোথায়?’
ছেলেটি চট করে রাজাকে ধরে ফেলল, ‘আহা! উঠো না। উঠো না। আর একটু শুয়ে থাকো। তা না হলে আবার অজ্ঞান হয়ে যাবে।’
রাজা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল! শুয়ে পড়ল এককথায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। কে এই ছেলেটি?কী মিষ্টি কথা! যেন কত আপন! রাজা তো চেনে না তাকে? ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে রাজা, রাজার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। ছেলেটি। বলল, ‘এখনও কষ্ট হচ্ছে? এখন একদম ওঠা নয়। আরেকটু থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। খোলা মাঠের হাওয়া খুব ভালো।’
রাজা খুব ভালো করে তাকাল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি হাসল।
‘তাকাচ্ছ কী? হাত-পা কেটে একেবারে খান-খান হয়ে গেছল।’
রাজা তুলল ডান হাত। কাপড় দিয়ে বাঁধা। রাজা কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, ‘আমি বেঁধে দিয়েছি। অনেকখানি কেটে গেছে। আর কিচ্ছু হবে না।’
একটা কুটো আটকে ছিল রাজার চুলে। সরিয়ে দিল হাত দিয়ে ছেলেটি। তারপর রাজার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। জিজ্ঞেস করল ‘ তোমার কী হয়েছে? হাত-পা কাটল কেমন করে?’
এমন আদর করে কেউ তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না রাজাকে! রাজা বোবার মতো চুপটি করে শুয়ে রইল। কী উত্তর দেবে?
তিনটে-চারটে পাখি এসে খেলা শুরু করে দিল গাছের ডালে। রাজা চেয়ে দেখল!
‘দাদা-আ-আ-আ—’
হঠাৎ ডাকল কে? একটি ছোট্ট মেয়ের নরম গলার মিষ্টি ডাক! অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
রাজা ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল।
ছেলেটি বলল, ‘আমার বোন।’
উঁচু-নীচু পাহাড়ের পথ। পাহাড়ের পথে ছুটতে ছুটতে, দুলতে দুলতে আসছে একটি ছোট্ট মেয়ে। যেন একটি প্রজাপতি। পায়ে তার মল বাজছে–ঝুমঝুম।
রাজা দেখছে।
ছেলেটি বলল, ‘ও আমার নিজের বোন। চুমকি। আমাদের কেউ নেই। আমি আর চুমকি। আমি ছাগল চরাই। ও আমার সঙ্গে-সঙ্গে থাকে। ওই যে দেখছ দূরে ছোট্ট মাটির কুঁড়েঘর– ওটা আমাদের বাড়ি। চুমকি আমায় বড্ড ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ভারি লক্ষ্মী।’
রাজার কানে সুর ছড়িয়ে ছড়িয়ে চুমকি এসে দাঁড়াল।
বাঃ, কী মিষ্টি দেখতে! হাতে তার কাঁসার ঘটি। তাতে কানাভরতি দুধ। রাজার কাছে এগিয়ে গেল চুমকি। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘নাও, এই দুধটুকু খেয়ে নাও!’
রাজা কি স্বপ্ন দেখছে?
‘কী দেখছ আমার মুখের দিকে? নাও, খেয়ে নাও?’ চুমকি আবার বলল, আরও মিষ্টি করে– আবদারের সুরে।
যে-রাজা সোনার বাটিতে ক্ষীর ননী খায়, তার আজ সোনার বাটি কই? আজ তার কাঁসার ঘটিতে দুধ?
ছেলেটি বলল, ‘ভাবছ কী, খাও?’
রাজা দুধের ঘটিতে চুমুক দিল। আঃ, কী মিষ্টি!
‘এইতো লক্ষ্মী ছেলের কাজ।’ চুমকি তার কাপড়ের আঁচল দিয়ে রাজার মুখ মুছিয়ে দিল!
ছেলেটি বলল, ‘ব্যস! আরেকটু শুয়ে থাকো চুপটি করে। আমি মাঠ থেকে ছাগলগুলোকে ফিরিয়ে আনি, তারপর বাড়ি যাব। চুমকি, তুই এখানে বসে থাক। আমি এক্ষুনি আসছি।’ ছেলেটি ছুটতে ছুটতে চলে গেল।
রাজা দেখছে অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে।
চুমকি বলল, ‘কী দেখছ? আমার দাদা। আমার নাম চুমকি। দাদার নাম শান্ত।’
কী মিষ্টি গলা ছোট্ট মেয়েটির!
‘তোমার কষ্ট হচ্ছে?
রাজা ঘাড় নাড়ল, না।
‘এই দেখোনা। এক্ষুনি দাদা এসে পড়বে। আমি যে ছোট্ট। একা পারব না। তা না হলে ধরে ধরে তোমায় আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতুম।’
রাজা চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে। চুমকি! কী মিষ্টি নাম!
‘খাবে কিছু? খিদে পেয়েছে? আমি আনছি।’ উঠতে গেল চুমকি। রাজা হাত ধরে ফেলল। উঠে বসল রাজা।
‘আরে! আরে! উঠছ কেন?’ ব্যস্ত হয়ে ধরতে গেল চুমকি রাজাকে।
রাজা চুমকির মাথায় হাত দিয়ে আদর করল।
চুমকি হাসল। চোখ দুটি খুশিতে ঝকঝক করে উঠল। বলল, ‘ও, এখন বুঝি আর কষ্ট হচ্ছে না? ভালো হয়ে গেছ? হাঁটতে পারবে আমার হাত ধরে?না বাবা দরকার নেই? শেষে কী। করতে কী হয়ে যাবে! তা না হলে দাদা আসার আগেই তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতুম। দাদা এখানে এসে দেখত, তুমিও নেই, আমিও নেই। ভাবত, কোথায় গেল। ভয় পেয়ে যেত। খুব মজা হত। তোমাকে খুঁজত। আমাকে খুঁজত। আমার নাম ধরে ডাকত, চুমকি-ই-ই-ই। তোমায় ডাকত–’ বলতে-বলতে থমকে থামল। ‘এই যাঃ! দেখেছ, তোমার নাম জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি।’
রাজা উঠে দাঁড়াল।
চুমকি একেবারে সঙ্গে-সঙ্গে দুটি হাত দিয়ে রাজাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘পড়ে যাবে! পড়ে যাবে! কোথায় যাচ্ছ?
হঠাৎ রাজা কথা বলল, ‘তোমাদের বাড়িতে।’
চুমকি নেচে উঠল। হেসে উঠল। পায়ের মল বেজে উঠল। ঝুমঝুম। খুশি, খুশি চারদিকে খুশি। ছোট্ট হাতটি তার বাড়িয়ে দিল রাজার দিকে। রাজা চুমকির হাত ধরে, উঁচু-নীচু পাহাড়ের পথ ভেঙে চলল কুঁড়েঘরে।
ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। শান্ত আর চুমকির বাড়ি।
আর, শান্ত ছাগল চরানোর কাজ সেরে যখন ঘরে ফিরল, তখন চুমকির সঙ্গে রাজার খুব ভাব হয়ে গেছে।
শান্ত আর চুমকি। ভাই আর বোন। শান্তর বয়েস সাত বছর। চুমকির পাঁচ। আর তাদের এই একটি কুঁড়েঘর।
আকাশ-ছোঁয়া রাজবাড়ি নয়। সাতমহলে সাতসতেরো লোকের আনাগোনা নেই। সান্ত্রি। নেই। পাত্র নেই। মিত্র নেই। সোনার পালঙ্ক নেই। হিরে-মুক্তোর গয়না নেই। সোনাচাঁদির ঝকমকি নেই। রাজা ভাবে, তবু সব আছে। রাজবাড়ির চেয়ে অনেক আছে।
‘চুপচাপ কী ভাবছ?’ শান্ত জিজ্ঞেস করল।
‘কিচ্ছু না। দেখছি।’ রাজা উত্তর দিল।
শান্ত বলল, ‘কী দেখছ? আমাদের মাটির ঘর? ভালো লাগছে না?
‘না, না, আমার খুব ভালো লাগছে।’
‘তবে মাঝে-মাঝে মুখটা অমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে কেন?’
রাজা শান্তর চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘এমনি।’
‘আমি জানি কেন’, ছুটে এসে রাজার কাছে বসল চুমকি। রাজার মাথায় চুলের মধ্যে হাত পুরে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ির কথা ভাবছ, না?’
রাজা হাসল।
‘হাসছ কী! নিশ্চয়ই মায়ের জন্যে মন কেমন করছে?
‘আমার মা নেই,’ রাজা উত্তর দিল।
অবাক হল চুমকি, ‘তোমার মা নেই কেন?”
‘আমি যে অনেক বড়ো হয়ে গেছি।’
‘যারা অনেক বড়ো হয়ে যায় তাদের বুঝি মা থাকে না! তাহলে আমরা তো কত ছোটো। আমাদের মা, বাবা কেউ নেই কেন?
হঠাৎ একটা মৌমাছি ঘরের মধ্যে উড়ে এল গুন-ন-ন-ন।
রাজা যেন রেহাই পেল। চুমকির কথার জবাব দিতে হল না। শান্ত আর চুমকিও মুখে। গুনগুন শব্দ করতে করতে খেলা শুরু করে দিল মৌমাছির সঙ্গে। ঘরের মধ্যে। মৌমাছির পেছনে ছুটতে লাগল। এদিক-ওদিক। এ-কোণ সে-কোণ। উড়তে-উড়তে বেরিয়ে গেল। মৌমাছি ঘর থেকে। খোলা আকাশে। পিছু পিছু ছুটল শান্ত, চুমকি। ছুটতে ছুটতে কোথায় চলে গেল!
তখনও আসেনি শান্ত আর চুমকি। তখনও হয়তো তারা খেলা করছে মৌমাছির সঙ্গে। সবুজ মাঠে মাঠে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে।
রাজা ভাবছে ঘরে বসে একলা। মৌমাছির দুটি বন্ধু–শান্ত আর চুমকি। কেমন করে হয়!
রাজা ভাবছে। ভাবতে-ভাবতে দেখছে। দেখছে, ঘরের দেওয়াল। তার গায়ে হিজিবিজি ছবি। হিজিবিজি মাছ! ইকড়িমিকড়ি পাখি। কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং। কুলুঙ্গিতে গণেশঠাকুর! মাটির পুতুল–বেনে বউ। তার ছেলে-মেয়ে। একটা হাতি। তার পিঠে রাজা। শিলেট-পেনসিল। বইখাতা। একটা মুখোশ। ভাঙা বাঁশি। তালপাতার টুপি। পাখা।
বাঁশের মাচায়, ঠিক রাজার মাথার ওপর একটি কাগজের ফুল। দুলছে দুল দুল। ফুল দুলছে–দুল দুল।
হঠাৎ ছুটতে ছুটতে ঢুকল চুমকি। হাঁপাচ্ছে। ‘এই নাও’, হাতে তার গোলাপ ফুল। পেছনে শান্ত।
রাজার মুখে কথা নেই। ফুল! চোখে তার অবাক চাউনি।
‘নাও,’ চুমকি ছোট্ট হাত আরেকটু বাড়াল রাজার দিকে।
রাজা যেন থ হয়ে গেছে। শুধু দেখছে। দেখছে গোলাপ ফুল। দেখছে শান্তকে। দেখছে। চুমকিকে।
ওপরের কাগজের ফুলটা যেন খুশির হাওয়ায় আরও জোরে জোরে দুলছে–দুল দুল। দুল দুল।
রাজা হাত বাড়াল। রাজার হাতে ফুল! সে কী! যে-রাজা ফুল দেখলেই চটে উঠত–এ কী হল তার হঠাৎ!
চুমকি বলল, ‘জানো, সেই মৌমাছিটা না এই গোলাপ ফুলটায় বসেছিল। গোলাপ ফুলের মধু খুব মিষ্টি, না?’
রাজা একদৃষ্টে চেয়ে রইল ফুলের দিকে। চাইল শান্তর দিকে। তারপর চুমকিকে কাছে ডাকল, ‘ শোনো।’
‘কী?’ চুমকি এগিয়ে গেল।
রাজা চুমকির মাথায় চুলের মধ্যে আটকে দিল ফুলটা।
শান্ত হেসে উঠল হাততালি দিয়ে।
চুমকি রাজার গলা জড়িয়ে, আদর করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’
রাজা হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। হঠাৎ যেন মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, ‘আমি কেউ নই!’
‘তোমার বাড়ি নেই?
রাজা চুপ করে রইল।
‘থাকবে তুমি আমাদের বাড়িতে?’
রাজা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
‘তুমি আমাদের বন্ধু,’ হাসির সুর ছড়িয়ে গেল শান্তর গলায়।
‘তুমি আমাদের বন্ধু,’ খুশির আনন্দে নেচে উঠল চুমকি।
‘বন্ধু,’ রাজা দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে টেনে নিল বুকে-শান্তকে, চুমকিকে।
তারপর বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
‘কী কথা?’ শান্ত জানতে চাইল।
‘আমাকে তোমরা চেন না। আমি কে জান না। একটা রাস্তার লোককে তোমাদের বাড়িতে থাকতে দেবে? আমি যদি চোর হই। ডাকাত হই। তোমাদের যদি মেরে ফেলি!’
শান্ত জড়িয়ে ধরল রাজাকে। হেসে ফেলল। বলল, ‘না, না, তুমি কেন ডাকাত হবে? কেন চোর হবে? তুমি ভালো লোক। খুব ভালো। ও-কথা বলো না কোনোদিন। আমার মা বলত, কাউকে খারাপ ভাবতে নেই। সকলে ভালো। আমরা যদি কারো অনিষ্ট করি তা হলে অন্যে কেন আমাদের অনিষ্ট করবে?’
ছোট্ট ছেলে শান্ত, ছোট্ট মেয়ে চুমকি। কত সুন্দর! কত সরল!
রাজা থেকে গেল তাদের বাড়ি। রাজার বন্ধু তারা।
পরেরদিন সকালবেলা রাজা চলল মাঠে। শান্তর সঙ্গে। ছাগল চরাতে।
মিষ্টি সকাল! পাহাড়ের গায়ে গায়ে রোদ ছড়িয়ে আছে। গাছে গাছে পাখিরা গান গাইছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ঝরনা। ঝুনঝুন, ঝুনঝুন। রাজা চুমকির হাত ধরে ঘুরে ঘুরে দেখছে তাই। একটা পাথরের ঢিপির ওপর বসে বসে গান গাইছে শান্ত। ছাগল চরছে আপন মনে।
‘দাদা গান গাইছে। চলো না?’ রাজার হাত ধরে টান দিল চুমকি। ‘আমার সঙ্গে ছুটতে পারবে?’ ছুট দিল চুমকি। ছুটতে ছুটতে দাদার কাছে চলে এল। নাচতে শুরু করে দিল সে। দাদার গান শুনে শুনে।
শান্ত গান গাইছে।
চুমকি নাচছে।
রাজা শুনছে। দেখছে।
হেসে ফেলল রাজা। চুমকি নাচ থামাল।
হেসে উঠল চুমকি। শান্ত গান থামাল।
হেসে উঠল শান্ত। লজ্জা পেয়েছে। ছুট দিল। ছুট ছুট। একেবারে ঝরনার জলে।
ছুট দিল চুমকি। ছুট ছুট। একেবারে ঝরনার বুকে।
ঝরনার জল নেচে উঠল। ছলাৎ ছলাৎ।
আর রাজার মনে ভাবনার ঢেউ উছলে পড়ল এরা কে? আমার কে?
‘বন্ধু’, চেঁচিয়ে উঠল শান্ত।
‘এসো না?’ ডাক দিল চুমকি।
‘যাচ্ছি,’ চেঁচিয়ে সাড়া দিল রাজা। ছুটতে ছুটতে লাফিয়ে পড়ল ঝরনার জলে।
জলে দোলা লাগল–দুলদুল।
গাছে হাওয়া লাগল–ঝুরঝুর।
রাজা যেন ছোট্ট ছেলেটি হয়ে গেল। রাজার সে হাঁকডাক গেল কোথায়? সেই লাল টকটকে চোখ পাকিয়ে হুকুম চালানো?রাজার মুখে হাসি এল কোথা থেকে?
রাজা ভুলে গেল। সব ভুলে গেল। ভুলে গেল, রাজবাড়ির কথা। ভুলে গেল, রাজকার্যের কথা। ভুলে গেল, তার সব দুঃখের কথা। রাজা ভাবল, রাজবাড়ির সোনার পালঙ্কের চেয়ে মাটির ঘরের শীতলপাটি অনেক সুখের।
‘এই রে যাঃ! ভুল হয়ে গেছে যে!’ হঠাৎ শান্ত বলে উঠল।
‘কী ভুল হয়ে গেছেরে দাদা?
চুমকির কথায় উত্তর দিল না শান্ত। ভিজে কাপড়ে ছুট দিল। বাড়ির দিকে। ছুটতে ছুটতেই বলল, ‘তোমরা ঝরনায় চান করো। আমি এক্ষুনি আসছি।’
চুমকি কী ভাবল। কে জানে, কী ভাবল! সেও ছুটল দাদার পেছনে। রাজা পড়ে রইল একা। হঠাৎ কী হল?
ঝরনার পাড়ে পাড়ে ছাগল চরছে। তাদের গলায় ঘন্টা বাজছে–টুংটাং।
পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘের ছায়া নামছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বেশ লাগছে রাজার।
‘বন্ধু’ হঠাৎ চুমকি ডাকল ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ঝরনার পাড়ে রাজাকে। দূর থেকে যেন দোল খেতে খেতে ভেসে আসছে চুমকির গলার সুর।
‘কেন,’ সাড়া দিল রাজা।
‘তাড়াতাড়ি এসো। একটা মজা হবে।’
কী মজা?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল রাজা।
‘না এলে বলব না।’ চেঁচিয়ে উত্তর দিল চুমকি।
‘বেশ যাচ্ছি।’ ছুটতে ছুটতে ঘরের দিকে পাড়ি দিল রাজা।
কিন্তু ঘরে তো কেউ নেই! না শান্ত, না চুমকি! তবে?
রাজা বাইরেটা চোখ মেলে দেখল। খোলামেলা বাইরেটা। দেখল বাইরের উঠোনটা। না– নেই। ঘরের চারপাশ কেমন যেন থমথমে! চুপচাপ!
কী ভাবল রাজা। তারপর ডাক দিল, ‘চুমকি-ই-ই।’
আড়াল থেকে সাড়া এল, ‘টুকি-ই-ই-ই।’ চুমকির ডাক।
রাজার মুখে হাসি ফুটল। ‘ওরে দুষ্টু ছেলে! দুষ্টু মেয়ে! লুকোচুরি খেলা হচ্ছে! কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে পড়েছে দেখো। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’
চুপিসাড়ে আলতে-পায়ে ঘরে ঢুকল রাজা। খুব সামলে। যেন একটুও শব্দ না হয়। তক্তপোষের তলায় উঁকি দিল রাজা। হামাগুড়ি দিয়ে। সেখানে নেই। কোণের সিন্দুকের আড়াল হাতড়াল। পাত্তা নেই। বাইরের চালাটায় ঢুকল। যাঃ চলে। তা-ও নেই।
তাহলে?
‘হুস-স-স!’ ওমা! কোত্থেকে শান্ত বেরিয়ে এল। চেঁচিয়ে উঠল। একেবারে রাজার পেছনে। আচমকা থতমত খেয়ে রাজা চমকে উঠেছে।
শান্ত হেসে উঠল, ‘হি-হি-হি।’
চুমকি হাততালি দিল–তাই-তাই। নেচে-নেচে রাজার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলতে লাগল, ‘এ ম্যাভিতু! বুড়ো ছেলে ভিতু!’
ভারি ভালো লেগেছে রাজার। হেসে উঠল, ‘হো-হো-হো।’
এমন হাসি রাজা যেন কতদিন হাসেনি।
কিন্তু হাসতে-হাসতে হাসি থেমে গেল কেন হঠাৎ? শান্তর হাতের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল রাজা। ওটা কী শান্তর হাতে?
শান্তর হাতে একটি পাখির খাঁচা।
কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেল সব। রাজার চোখ দুটো। রাজার মুখটা।
শান্ত হাসতে-হাসতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছ অমন করে আমার হাতের দিকে?”
রাজা সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল। চটপট উত্তর দিলে, ‘না কিচ্ছু না।’
চুমকি চট করে দাদার হাত থেকে খাঁচাটা নিয়ে নিল। রাজার মুখের সামনে দোলাতে লাগল। খাঁচা দুলছে। রাজার চোখ দুটো ভয়েভয়ে কাঁপছে। আর তাই দেখতে-দেখতে শান্ত হেসে উঠল।
চুমকি বলল, ‘এ আবার কী? খাঁচা দেখে ভয় পেয়ে গেলে যে! বুড়ো ছেলে। তুমি কী পাখি যে তোমায় খাঁচায় বন্দি করে রাখব!’
রাজা যেন জোর করে নিজের মুখে হাসি নিয়ে এল। বলল, ‘তোমাদের খাঁচার মধ্যে যদি আমায় বেঁধে রাখ, তাহলে তো ভালোই হয়। কিন্তু আমায় যে তোমাদের খাঁচায় ধরবে না। আচ্ছা, পাখি কই?খাঁচা খালি কেন?’
‘পাখি?’ শান্ত জিজ্ঞেস করল রাজাকে, ‘এই মাত্তর ছেড়ে দিয়েছি। রোজ সকালবেলা ছেড়ে দিই। আজ তোমার সঙ্গে খেলা করতে করতে পাখির কথা ভুলে গেছলুম। তাই তো ঝরনায় চান করতে করতে ছুটে এলুম। তুমি দেখবে? আমাদের পাখি দেখবে? আচ্ছা দাঁড়াও।’
ঘর থেকে বেরিয়ে এল শান্ত। একেবারে বাইরে। খোলা আকাশের নীচে। ডাক দিল, ‘টুই টুই-ই-ই।’
দুরদুর করে কেঁপে উঠল রাজার বুকটা। একী! এ যে সেই চেনা সুর!
টুই-টুই-ই-ই।’ আকাশে ডানা ছড়িয়ে নেচে উঠল ছোট্ট পাখি।
রাজা চোখ মেলল সে-দিকে।
টুই-টুই-ই-ই,’ ছুট দিল শান্ত খোলা মাঠে।
‘টুই-টুই-ই-ই,’ গান গাইল আকাশের পাখি আকাশে।
পাখি উড়ছে।
শান্ত তাকে ডাকছে। ছুটছে।
রাজা দেখছে। আশ্চর্য তো! এমনও হয়।
উড়তে-উড়তে পাখি নেমে এল। একেবারে শান্তর হাতে।
শান্ত তার গালে একটা চুমু খেল চুক করে। বলল, ‘চ, দেখবি চ আমাদের বাড়িতে কে এসেছে!’
পাখিকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে শান্ত ছুট দিল ঘরের দিকে।
‘এই নাও,’ বুকের পাখি বাড়িয়ে দিল রাজার দিকে। রাজা হাত পাতল।
ওমা! হঠাৎ কেন পাখিটা ভয় পেয়ে গেল! ডানা ঝাঁপটে ছটফটিয়ে উঠল! সে যাবে
না। কিছুতেই যাবে না রাজার কাছে! যেন সে বলছে, ‘ছেড়ে দাও, আমায় ছেড়ে দাও।’ কেন?
পাখিটা যতই ঝটপট করছে, শান্ত, তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে, ‘আ-আ! ফ্লু স্টু! লক্ষ্মীসোনা।’
পাখি কোনো কথা শুনবে না। ডানা ছড়িয়ে উড়ে যেতে চাইছে। বেরিয়ে যেতে চাইছে আকাশে।
‘তুমি যেমন আমাদের বন্ধু, হলুদ পাখিও আমাদের বন্ধু’ পাখির গালে আর একটা চুমু খেয়ে শান্ত বলল রাজাকে। আবার এগিয়ে দিল পাখি। রাজার হাতে।
চিৎকার করে উঠল পাখি। প্রাণের ভয়ে। গলা ফেটে যাচ্ছে যেন তার। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
শান্তর অবাক লাগছে। হলুদ পাখি তো কোনোদিন এমন করে না। হঠাৎ আজ কেন এমন করছে বন্ধুকে দেখে? ভয় পাচ্ছে কেন?
চুমকি রাজাকে বলল, ‘তোমার কাছে যাবে না। ভয় পেয়েছে। নতুন দেখছে তো।’
কী বলবে রাজা! গলা শুকিয়ে কাঠ। শুধু বলল, ‘ওকে ছেড়ে দাও।’
শান্ত বলল, ‘না, না, এখন ছাড়া যাবে না। ভয় পেয়েছে। এখন ছেড়ে দিলে উড়ে যাবে। হয়তো আর আসবে না।’
শান্ত হলুদ পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখল।
থাকবে না পাখি খাঁচার মধ্যে। কিছুতেই থাকবে না। রাজাকে দেখছে। চেঁচাচ্ছে। ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। যতই সে ছটফট করছে একটি একটি পালক খসে পড়ছে। ডানার পালক। হলুদ পালক।
দেখতে পারল না আর চুমকি। মনটা তার কেমন করে উঠল। দাদাকে বলল, ‘দাদা, তার চেয়ে ছেড়ে দে। ছটফট করছে বড়। খাঁচায় লাগছে। পালক খসে যাচ্ছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। সব পালকগুলো যদি খসে যায়! যদি আর উড়তে না পারে। নীল পাখিটা গেল, হলুদটাও যদি চলে যায়! আমি কার গান শুনব?’
নীল পাখি! হঠাৎ রাজার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। কোন নীল পাখি? যে নীল পাখিটাকে রাজা মেরে ফেলেছে?
চুমকির কথা শুনে শান্তর মনটাও যেন কেমন করে উঠল। খাঁচার ডালা খুলে দিল শান্ত। হলুদ পাখি উড়ে গেল–ফুড়ুৎ।
তাকিয়ে রইল শান্ত আর চুমকি সেইদিকে। উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে।
রাজা যেন বোবা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে হাতের তির। নীল পাখির রক্ত! কানে ভেসে আসছে হাজার পাখির কান্না। আজ রাজার মন কেন বলছে, ‘ছিঃ ছিঃ আমি কী করেছি! অমি পাখি মেরেছি। একটি ছোট্ট ছেলে, একটি ছোট্ট মেয়ের পাখি!’
দোলন লাগে পাখির খাঁচায়। কাঁপন লাগল রাজার ভাবনায়। মন বলছে বার বার, ‘ছিঃ ছিঃ, কী করেছি, আমি কী করেছি।’
হঠাৎ ঠেলা দিল চুমকি রাজাকে। ‘কী গো? অমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ?’
রাজার চমক ভাঙল। বলল, ‘না। ভাবছি, হলুদ পাখিটা কত সুন্দর। নীল পাখিটা না জানি আরও কত সুন্দর ছিল।’
‘না, না, হলুদ-নীল দুটোই ভালো,’ উত্তর দিল চুমকি।
শান্ত বলল, ‘হলুদ-নীল। দুটি পাখি। দুজনের কী ভাব। রোজ সকালবেলা খাঁচার ডালা খুলে দিই। ওরা একসঙ্গে উড়ে যায়। একসঙ্গে সারাদিন আকাশে, গাছে গাছে উড়ে বেড়ায়। সন্ধেবেলায় ফিরে আসে। নিজের খাঁচায় নিজেরা ঢুকে পড়ে। তারপর একদিন যে কী হল– হলুদ একা-একা ফিরে এল। নীল ফিরল না। আর কোনোদিনও ফিরল না। হয়তো নীলের আর ভালো লাগল না আমাদের। হয়তো কেউ ধরে রাখল। হয়তো কেউ মেরে ফেলল। পাখির খবর কে আর রাখবে।’
চুমকি রাজার কোলের কাছে সরে এসে বলল, ‘শুনেছি নাকি কোনো এক রাজা–’
রাজার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
চুমকি বলতে বলতে থামল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী? অমন চমকে উঠলে কেন?
রাজা আমতা-আমতা করে উত্তর দিল, ‘না, না, ও কিছু না। কী বলছিলে? কোনো এক রাজা–?
‘কোনো এক রাজা নাকি হুকুম দিয়েছে, তার রাজ্যে কোনো পাখি থাকবে না। সে রাজ্যে পাখি দেখলেই মেরে ফেলতে হবে। হয়তো সেই রাজাই নীল পাখিকে মেরে ফেলেছে। আচ্ছা, বলতো রাজার কী কোনো দয়ামায়া নেই? ওরা তো পাখি। ছোট্ট। ওদের মারে কেন?’ চুমকি রাজার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘বলো না, রাজা পাখি মারে কেন?
রাজা চেয়ে রইল। চুপটি করে, চুমকির ছোট্ট দুটি চোখের দিকে।
চুমকি আবার বলল, ‘বন্ধু তুমি আমায় সেই রাজার কাছে নিয়ে যাবে?”
রাজা পাথরের মতো চুপচাপ।
‘আমি রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। বলব, রাজামশাই, তুমি পাখি মারো কেন? ওরা আমাদের বন্ধু। ওদের মেরো না। তোমার হাতের তির দিয়ে আমায় মারো।’
এতটুকু ছোট্ট মেয়েকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে তুলে নিল রাজা। বলল, ‘না, না, অমন কথা বলো না, বলো না। তোমাকে কেউ মারবে না। কেউ মারতে পারবে না। কোনোদিনও না।’
মাঠে ছাগল চরছে। শান্ত মাঠে ছুটল।
ছায়া নামছে। সন্ধ্যার ছায়া।
সারাদিন ধরে সূর্যিঠাকুরের বেশ কাজ। সকালে ঘুম যখন ভাঙবে, মনে হবে, রাজপুত্তুর আসছেন ঘোড়ায় চেপে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। টগবগ-টগবগ। অমনি মুঠো মুঠো আলো ছড়িয়ে পড়ছে। আকাশ থেকে মাটিতে।
তারপর সারাদিন ধরে সূর্যিঠাকুরের লুকোচুরি খেলা। মেঘের সঙ্গে, নীল আকাশের সঙ্গে। যখন তিনি পাটে যাবেন, লাল আলোর টিপটি পরিয়ে দিয়ে যাবেন পাহাড়ের কপালে।
সেই টিপ ঘুম পাড়ায়। ঘুম আনে।
ঘুম আনে গাছের বুকে। ফুলের মনে। পাখির চোখে। ছায়া নামছে মাঠে-মাঠে। গাছে গাছে। পাহাড়ের গায়ে-গায়ে।
আর ছায়া নামছে, শান্ত আর চুমকির ছোট্ট কুঁড়েঘরে। পাখিরা ফিরে আসছে নিজের নিজের ঘরে। কিন্তু সকালে সেই যে হলুদ-পাখি উড়ে গেল, এখনও এল না সে। এখনও ফিরল না।
আকাশে কে যেন তারার প্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে একটি একটি করে। চুমকি মাটির প্রদীপ হাতে নিয়ে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আর শান্ত আকাশের দিকে চেয়ে ডাকছে, ‘টুই টুই-ই-ই। টুই-টুই-ই-ই।’
সত্যিই কি আসবে না? হলুদ পাখি?
শান্ত ডেকেই চলেছে, ‘টুই-টুই-ই।’
চুমকি বলেই চলেছে, ‘আয়-আয়, আয়-আয়।’
আর রাজার বুক কেঁপে উঠছে, হায়-হায়! হায়-হায়!
তারপর?
অন্ধকার হয়ে গেল। হলুদ পাখি সত্যিই এল না।
রাজার হাতে প্রদীপটি তুলে দিয়ে চুমকি বলল, ‘আমার হলুদ এল না যে!’
রাজার মন গুমরে উঠছে। বললে, ‘হয়তো আমার জন্যে এল না। আমায় দেখে ভয় পেয়েছে। আমি তোমাদের এখানে থাকি, হয়তো চাইছে না পাখি।’
চুমকি উত্তর দিল, ‘ওতো পাখি। ও কি আর অত বোঝে!’
‘টুই-টুই-ই-ই। টুই-টুই-ই-ই।’ ডাকতে ডাকতে শান্তর যেন গলা ভেঙে যাচ্ছে।
সাড়া দিল না পাখি। ঘরে এল না ফিরে।
শান্ত ছোট্ট বোনের হাতটি ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একদৃষ্টে। আকাশের সব কটি তারা তখন ফুটে উঠেছে। ঝলমল–ঝলমল।
চুমকির গলা ভার ভার। বলল, ‘দাদা, হলুদ এল না সত্যি?’ চোখ তার ছল-ছল।
থাকতে পারল না শান্ত। রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হয়তো সেই রাজাটা মেরে ফেলেছে। আমি যাব সেই রাজার কাছে। যেমন করে হোক যাব। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, কেন? কেন তুমি আমাদের পাখি মেরেছ? পাখি কী দোষ করেছে? আমরা কী দোষ করেছি?’
রাজা এগিয়ে এল শান্তর কাছে। তার মাথায় হাত রাখল। বলল, ‘না শান্ত, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। তোমাদের হলুদ পাখিকে কেউ মারেনি। আমি আছি এখানে, তাই তোমাদের পাখি চলে গেছে। আমি যতক্ষণ থাকব, তোমাদের পাখি আসবে না। আমি কাল সকালেই চলে যাব।’
‘কেন? তোমার তো কিছু দোষ নেই,’ শান্ত বলল।
‘বারে! তোমার কী দোষ? তুমি কেন যাবে? না, না, তুমি যাবে না।’ আবদার করে চুমকি রাজার হাতটি জড়িয়ে ধরল।
শান্ত বলল, ‘তুমি যে আমাদের বন্ধু।’
রাজা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ বন্ধু। সত্যিই তোমরা আমার বন্ধু। পথের মধ্যে গাছের তলায় আমি পড়েছিলুম। তোমরা আমায় ডেকে এনেছ তোমাদের ঘরে। আমায় থাকতে দিয়েছ। আমাকে আপন করে নিয়েছ। কেমন করে, তা জানি না। তোমরা আমায় বাঁচিয়েছ।’
‘না, না, তোমাকে যেতে দেব না। তোমার তো কেউ নেই! মা নেই, বাবা নেই। ঘর নেই, বাড়ি নেই। তুমি কোথায় থাকবে? তোমায় কে দেখবে?”
রাজা হাসল। যেন কত কষ্ট-মাখানো সে-হাসি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তোমরা ভারি লক্ষ্মী।’
রাত্তির হয়েছে। রাজার কোলের কাছে অঘোরে ঘুমুচ্ছে চুমকি। ঘুমের ঘোরে সে রাজার গলাটি জড়িয়ে আছে। সে যে যেতে দেবে না রাজাকে। কিছুতেই না।
রাজার ঘুম আসেনি। রাজা ভাবছে, এ কী হল? আমার হাতের তিরে এদের নীল পাখি মরেছে। আমারই জন্য এদের হলুদ পাখি উড়ে গেল! একটি ছোট্ট ছেলে, ছোট্ট মেয়ে– আমার জন্যে তাদের এত কষ্ট! রাজার মন কেমন করছে। এদের ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে মন কেন বার বার ভেঙে যাচ্ছে! তবু যেতেই হবে।
কিন্তু রাজার যাওয়া হল না।
কেন?
সকালে ঘুম থেকে উঠে শান্ত কোথায় গেল? সে তো ঘরে নেই! তার বিছানা খালি!
অন্যদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চুমকিকে ডাকবে, প্রথমে। তারপর মুখ-হাত-পা ধুয়ে মুড়ি খাবে। নারকেল দিয়ে, দুজনে। তারপরে ভাই-বোন ছাগলের পিঠে চেপে মাঠে যাবে। কিন্তু আজ?
চুমকি খুঁজছে দাদাকে। সারা ঘর। রাজা খুঁজছে শান্তকে চারধার, বার বার। কিন্তু সে কোথা? নেই তো!
‘দাদা,’ চেঁচিয়ে ডাকল চুমকি। সাড়া নেই।
‘দাদা-আ-আ-আ।’
‘দাদা। দাদা। দাদা।’
সাড়া দিল না দাদা।
রাজা বলল, ‘চুমকি, শান্ত মাঠে চলে যায়নি তো? ছাগল নিয়ে?
‘তা কেন যাবে? দাদা আমায় না নিয়ে কোনোদিন তো মাঠে যায় না।’
‘তবু চলোনা, একবার দেখে আসি?’
‘তাই চলো।’
না মাঠে কেউ নেই। না শান্ত। না তার ছাগল।
‘কোথায় গেল দাদা?’ রাজার দুটি হাত ধরে জিজ্ঞেস করল চুমকি।
মাঠ থেকে ঝরনার ধার। না। সেখানেও নেই শান্ত।
ঝরনা থেকে শালবন।
শালবনের পর মউবন।
বন পেরিয়ে উঁচু পাহাড়। নীচু পাহাড়।
পাহাড় থেকে এর দোর। তার দোর।
নেই, নেই। কোথাও নেই।
না, না। কেউ জানে না শান্তর কথা।
কেমন করে জানবে? পাহাড়ের কোলে-কোলে, ছুটে-ছুটে যখন চুমকি ডাকছে ‘দাদা,’রাজা খুঁজছে ‘বন্ধু,’ তখন অনেক দূরে চলে গেছে শান্ত। এক গভীর বনে। হলুদ-পাখি খুঁজছে। আর ডাকছে, ‘টুই-টুই-ই-ই।’
চুমকি যখন রাজার হাতটি ধরে কাঁদছে, ‘আমার দাদা কই?দাদা কই?
শান্ত তখন বনে বনে গাছে গাছে খুঁজে বেড়াচ্ছে, ‘আমার বোনের হলুদ পাখি কই?’
খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠেছিল শান্ত। কাউকে ডাকেনি, কাউকে বলেনি মনের কথাটি। বলেনি যে সকাল হলেই সে পাখি খুঁজতে বেরোবে। কিন্তু পাখির খোঁজে সে কোথায় চলে এসেছে? নিজেও জানে না। এ এক গভীর বন। বনে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এখান থেকে তার ছোট্ট বোনের ডাক সে শুনতে পাবে কেমন করে?
ছোট্ট পায়ে হেঁটে-হেঁটে চলেছে শান্ত। আর বারবার ডাকছে, ‘টুই-টুই-ই-ই।’
ডেকে ডেকে গলা তার ভেঙে গেছে।
সকাল গেল ডাকতে ডাকতে, ‘টুই-টুই।’
দুপুর গেল কাঁদতে কাঁদতে, ‘দাদা আয়।’
বিকেল এল ভাবতে ভাবতে, ‘শান্ত কোথায়।’
শান্ত হাঁটছে।
বন পেরিয়ে পাহাড় এল।
পাহাড় গেল, নদী এল।
নদীর ধারে মাঠ পড়ল।
মাঠ পেরোলে রাত এল।
রাত কাটছে, দিন আসছে।
দিন আসতেই বনের শেষ।
বনের শেষে পায়ের ছাপ!
কীসের ছাপ?
পায়ের ছাপ!
অবাক কাণ্ড! তাহলে তো নিশ্চয়ই এখানে লোক আছে! বসতি আছে!
অবাক চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলেছে শান্ত। একটি একটি পা দেখছে। একটি একটি পা হাঁটছে। পায়ে পায়ে বন শেষ।
এ কোথায় এসে পড়ল শান্ত? বনের শেষে?
এখানে তাদের মতো ছোট্ট-ছোট্ট ঘর নেই। মাঠ নেই। মাঠে ছাগল নেই। গাছে পাখি নেই। শক্ত শক্ত রাস্তা। পাথর ঢালা। একটা এঁকে গেছে। একটা বেঁকে গেছে। কোনোটা সিধে গেছে। কত বড়ো বড়ো বাড়ি। আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। নীচের থেকে কপালে চোখ তুলে দেখতে হয় হুউ-ই-ই ওপর বাগে। মাথা ঘুরে যায়। কত লোক রে বাবা! কত রকমের লোক। একেবারে গিজগিজ করছে।
কেউ বা বুড়ো, গুটিগুটি হাঁটে।
কেউ বা জোয়ান, গটমট চলে।
কেউ বা ছোটো, খুটখুট ছোটে।
কেউ বা বড়ো, চটপট জোটে।
কেউ করে ফিসফাস।
কেউ ডাকে গাঁক-গাঁক।
কেউ-কেউ বকবক।
কেউ কাশে খক খক।
সব মিলিয়ে হইহই! রইরই!
কারো গায়ে সাদা জামা ঝকঝক।
কারো পায়ে লাল জুতো টকটক।
কেউ পরে নীল টুপি ফিটফাট।
ঘোড়া ছোটে টগবগ।
উট হাঁটে ঠুক ঠুক।
জুড়িগাড়ি সাঁই সাঁই, পাঁই পাঁই।
এরই নাম বোধহয় শহর!