হুপ্পোকে নিয়ে গপ্পো – ২

কালো ছায়ার সঙ্গে হুপ্পোর লড়াই

নিজের ঘরে তখন ঘুমিয়ে ছিল হুল্লো। এত রাত্তিরে কে-ই বা জেগে থাকে। মা-ও ঘুমোচ্ছে, বাবাও ঘুমোচ্ছে, ঝুমকিও ঘুমোচ্ছে। একদম নিজঝুম। নিজঝুম মানে কী আর শুধু ঝুমকিদের বাড়ি। সারা শহরটাই যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঝিমিয়ে আছে। আশ্চর্য লাগে ভাবতে! সারাদিন ধরে হুল্লোড় আর হইচই! শুধু শব্দ আর শব্দ। কখনো গান শুনবে, কখনো হাঁক শুনবে, হাসি শুনবে, কান্না শুনবে! নয়তো গাড়ির শব্দ, হাঁচির শব্দ। ফেরিওয়ালার দাম শুনবে, ছাতাওয়ালার ডাক শুনবে, দোকানদারের বাত শুনবে। নয়তো ঝগড়াঝাঁটির। কচকচানি, পায়রার বকুম বকবকানি। লেগেই আছে। আর এখন? ঘুম। ঘুম মানেই তো থমকে থেমে থাকা। নিশ্চিন্তে আরাম। তাই বলে যদি দিনের বেলা এমন হয়? মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে! সব কিছু থেমে পড়ে? তাহলে ভারি মুশকিল। কাজকম্ম সব বন্ধ! কাজ না করলে চলবে কী করে?

তখন রাত্তির একটানা দুটো, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ ঘুম পেলে চোখেও আসে, আবার কানেও ঢোকে। তা না হলে ঘড়ির শব্দটা পর্যন্ত শোনা যায় না কেন?

আজ কিন্তু এই গভীর রাত্তিরে হুল্লোর ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল। একটা যেন কীসের খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে এই অন্ধকার রাত্তিরে! শব্দটা যে খুব জোরে শুনতে পাচ্ছে হুপ্পো, তা নয়। কিন্তু খুব স্পষ্ট। প্রথমটা শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিল হুপ্পো। নিশ্চুপ রাত্তিরে এমন একটা বুক-কাঁপানি শব্দ শুনলে, আচ্ছা আচ্ছা পাট্টার ধাত ছেড়ে যায়, তো হুপ্পো! ও তো একটা ছোট্ট বাঁদর। তবু বলব, হুল্লোর সাহস আছে। প্রথমটা একটু ভয়-ভয় লাগছিল। এখন নেই।

শব্দটা যেন একটু কাছে এগিয়ে আসছে। হুগো উঠে বসল। ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে উঁকি মারল। উরি বাবা! কী ওটা?কালো মতো! ঘুরঘুট্টি অন্ধকার রাত্তিরে, আলতো আলতো পা ফেলে, ঘুরঘুর করছে! কিংবা বলা যায়, কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারে ওই কালো মূর্তিটা দেখে হুপ্পো সত্যিই ভয় পেয়ে গেল এবার। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপিয়ে উঠল। হুল্লোর চোখ দুটো ড্যাবডেবিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এল। কালো কালো অন্ধকারে, কুচকুচে কালো একটা কাপড় জড়িয়ে কী ও?মানুষ, না অন্য কিছু?মাথা থেকে পা অবধি সারা অঙ্গই ঢাকা। চোখ, মুখ, কান কিছুই দেখা যাচ্ছে না। না, ভয় পেলে কিন্তু চলবে না। ওটার কী মতলব সেটা দেখা দরকার।

হুপ্পো সাহসে বুক বাঁধল। কী কাণ্ড! ওটা যে দেখি সিঁড়ি দিয়ে ছাতে উঠছে। হুপ্পো চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চটপট লাফ মেরে ছাতের আলসের নীচে লুকিয়ে পড়ল। হ্যাঁ, সেই কালো ভূতটা ছাতের ওপরেই হাজির। ছাতের এদিক-ওদিকটা দেখে আবার নেমে গেল। হুল্লোও আলসের আড়াল থেকে ছাতে উঠল। ওর পিছু নিল। ভূতটা সিঁড়ি দিয়ে নামে, হুপ্পোও এক পা এক পানামে। ভূতটারও পায়ে শব্দ নেই, হুপ্পোও জানে সাবধানের মার নেই। নামতে নামতে হঠাৎ অন্ধকারেও হুপ্পো ঠাওর করল, ওই কেলেকিষ্টি ভূতের পায়ের পাতা দুটো কিন্তু বেশ বড়োসড়ো। তোমার আমার যেমন পা হয়, তার চেয়েও অনেক বড়ো। ওই বড়ো বড়ো পা টপাটপ ফেলে উঠোনে এসেছে। হুল্লোও জুজুবুড়ির মতো। দেওয়ালের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়েছে। এবার কালোছায়াটা বামুনঠাকুরের ঘরের সামনে খাড়া! বামুনঠাকুর তো এখন নাক ডাকাচ্ছে। জানলা দিয়ে উঁকি মারল। উঁকি মেরে, কী ভেবে, ঝুমকিদের শোবার ঘরের সামনে দাঁড়াল। খুব আলতোভাবে দরজাটা ঠেলল। শব্দ হল না। দরজাও খুলল না। দরজায় খিল দেওয়া তো! এবার ভাঁড়ারঘরের সামনে উপস্থিত। ঘরের শেকলে তালা ঝুলছে। এটা নিয়ম। রোজ রাত্তিরে শোবার আগে মা ভাঁড়ারঘরে তালা দিয়ে যায়। তালাটা নেড়ে নেড়ে দেখল কালোভূতটা। তারপর কী একটা যন্তর বার করল। তালাটার গায়ে লাগিয়ে বার দুই চাড় দিতেই, কটাং। যাঃ তালা ভেঙে গেছে! আওয়াজ হতেই ছায়াটা চট করে সরে গেল পাশে, একটু আড়ালে। চুপচাপ। নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওঃ! এখন কী ভয়ানক থমথম করছে চারিদিক! হুল্লোও যেন বুকের ধুকধুকুনিটাকে চেপে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে, নিশ্বাসের শব্দটাও যেন নিস্তব্ধ রাত্তিরে সাপের ফোঁসফোঁসানির মতো আওয়াজ তুলে হুপ্পোর নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে! আড়াল থেকে আবার কালো ভূতটা বেরিয়ে এল। ভাঁড়ারঘরের সামনে আর একবার থমকে দাঁড়াল। আর একবার ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল, এদিকে-ওদিকে কেউ আছে কি-না। হুপ্পো অবিশ্যি এমন জায়গায় আস্তানা গেড়েছে যে, ওকে আর দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু ও নিজে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে।

কিন্তু এ কী হল! হঠাৎ কালো-ছায়াটা ছুট্টে সরে গেল কেন? ও, বামুনঠাকুর যে দরজা খুলে বাইরে আসছে! কেন? বাইরে কেন? আর আসতে হল না। ঘর থেকে একটি পা বাইরে ফেলেছে কি-না-ফেলেছে, অমনি কালো কাপড়-চাপা ভূতটা ঠিক তিরের মতো ছুটে গিয়ে। বামুনঠাকুরকে জাপটে ধরল। বামুনঠাকুর ‘বাপরে’ বলে চ্যাঁচাতে যাবে কী, ভূতটা ঠাকুরের মুখটা এমন জোরে চেপে ধরল যে, টু শব্দটি পর্যন্ত আর মুখ দিয়ে বেরোতে পারল না। কিন্তু ঠাকুরও কী ছাড়বার পাত্তর! ভূতের সঙ্গে খামচাখামচা লাগিয়ে দিল। ঠাকুর পারবে কেন। ওই রকম একটা গুণ্ডার সঙ্গে! ভূতটা একদম কাবু করে ফেলল ঠাকুরকে। ওই তো মুখটা বেঁধে ফেলছে। ঠাকুর আর চ্যাঁচাতেও পারল না, নড়তেও পারল না। চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল। কিন্তু তারপরের কাণ্ডটা দেখেই হুল্লোর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। কী কাণ্ড? কালোভূতটা ট্যাঁক থেকে একটা ঝকঝকে ছোরা বার করল। ছোরাটা এত ঝকঝকে যে, ওই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেল হুপ্পো। এবার নিশ্চয়ই ওটা ঠাকুরের বুকে বসিয়ে দেবে! কী হবে?হুপ্পো আড়াল থেকে মেরেছে এক লাফ। মেরেই পেছন থেকে ভূতটাকে জড়িয়ে ধরল। আচমকা থতমত খেয়ে ভূতটা নিজেকে যেই সামলাতে গেছে, ব্যাস! হাত থেকে ছোরাটা ছিটকে একেবারে মাটিতে। তারপর ভূত আর বাঁদরে ধামসা-ধামসি লেগে গেল। ভূতটা যতবার হুল্লোকে সামনে টেনে আনার চেষ্টা করছে, হুপ্পো ততই তেড়ে তেড়ে খামচে ধরছে! শেষকালে ভূতের কালো কাপড়টা ধরেই টানাটানি লাগিয়ে দিল। এই বুঝি কাপড়টা খসে পড়ে গা থেকে, ভূতের চালচিত্তির বেরিয়ে পড়ে! অতই কী সোজা! ভূত নিজেই কালো। কাপড়ের ঢাকনিটা ঝট করে গা থেকে সরিয়ে নিল। কাপড় দিয়ে হুল্লোকে আষ্টেপৃষ্ঠে । জড়িয়ে বেঁধে ফেলল। হুপ্পো কিছু বোঝবার আগেই সব খতম। তার মাথা, মুখ, হাত-পা মানে সারা দেহটাই সেই কাপড়ের মধ্যে, বস্তার মতো বাঁধা পড়ে গেল। হুপ্পো হাঁকপাঁকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে ধস্তাধস্তি লাগিয়ে দিল। দম আটকে প্রাণ যায়-যায়। আর তো হাত-পা ছুঁড়ে কোনো লাভ নেই। কেননা, ওই জড়ানোমড়ানো কাপড়ের বাঁধন খুলে আর বাছাকে বেরোতে হচ্ছে না!

কাপড়টা সরিয়ে ফেলতে এখন আর ভূতটাকে ভূত বলে মনেই হচ্ছে না। ওমা! ও তো একটা ষণ্ডামার্কা লোক। অন্ধকার তাই ঠিক ঠিক চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু কাপড়টা যে মালকোচা মেরে পরে আছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বামুনঠাকুরের অবস্থা কাহিল। বেচারি আর নড়েও না, চড়েও না। কী হল? অক্কা পেয়ে গেল নাকি? না, ভূতের ভয়ে মূৰ্ছা গেছে! তাহলে কী হবে?

যা হবার তাই হবে

সেই ষণ্ডামার্কা লোকটা আর একটুও দেরি করল না। ভেবেছিলুম, ভাঁড়ারঘর যখন ভেঙেছে, তখন হয়তো কিছু হাতড়াবার মতলব আছে! না, লোকটা আর ভাঁড়ারঘরে ঢুকলই না। হয়তো ভাবল, যা একটু-আধটু খুটখাট শব্দ হয়েছে, তাতে যদি আবার কারো ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে! তা হলেই ফ্যাসাদ! তাই কালো কাপড়ে জড়ানো হুপ্পোকে, ঝটপট, পিঠে নিয়ে, চটপট কেটে পড়ল। অবিশ্যি যাবার সময় ছোরাটি কুড়িয়ে নিতে ভুলল না শয়তানটা!

হুল্লোর তো দম ফেটে যায়! এমন দুর্দশা তার আগে আর কখনো হয়নি! এমন বিপদে সে আর কখনো পড়েনি। এমন বস্তাবন্দি হয়ে, আর কারো পিঠে এর আগে, সে আর কখনো ওঠেনি তো! পিঠে চেপে ছোটেওনি! কালো কাপড়ের মতো বাইরেটাও কালো অন্ধকারে ঢাকা। সে যে কোথা চলেছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। কাপড়ে একটু ফুটোফাটা থাকলেও হয়তো কাজ হত। কিন্তু তাও নেই। সবটাই বাঁধা। কী থেকে কী হয়ে গেল। আবার কী হবে, তাই বা কে জানে! ওই ছোরাটা দিয়ে যদি হুল্লোকে কেটে ফেলে! কিন্তু এখন, এই এক্ষুনি তার যা কষ্ট হচ্ছে তার কী হবে? বেচারা কুঁচকে-মুচকে একটা তেলেভাজা ফুলুরির মতো গুটিয়ে গেছে কালো কাপড়টার পুঁটলিতে!

অনেকক্ষণ পর লোকটা থামল। থামল তার বাড়ির সামনে। হুল্লোকে সেই কাপড়-জড়ানো। অবস্থাতেই ঘরের এক কোণে থুপসিয়ে ফেলে রাখল। হুপ্পো কোনো রকমে ধুকিয়ে ধুকিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে রইল। শেষকালে তাকে কী পুঁটলির মধ্যেই থাকতে হবে চিরদিন!

কে জানে বাবা!

.

হুপ্পো আর নাচের বাঁদর, নাচের ছাগল

না, কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে আর থাকতে হয়নি বেশিক্ষণ। সকাল হতেই লোকটা পুঁটলিটা খুলে ফেলল। আঃ! সকালের আলো আর হাওয়া গায়ে লাগতে হুপ্পোর ধড়ে প্রাণ এল। কিন্তু একী! লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে কেন হুপ্পো? আরে! এ যে সেই লোকটা! কোন লোকটা? সেই যে বাঁদরনাচিয়ে লোকটা? এই লোকটাই তো সেদিন ঝুমকিদের বাড়ির সামনে বাঁদর নিয়ে নাচ দেখাচ্ছিল। যাঃ চ্চলে! রাত্তিরে যে-লোকটা ভূত সেজে কিম্ভুতের মতো সব কাণ্ডকারখানা করছিল, এখন হুপ্পো দেখল, সে একটা জ্যান্ত হাত-পা-ওলা মানুষ! এ তো আচ্ছা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! ভাবি, লোকটা পুঁটলিটা খুলেই বুঝি হুপ্পোকে ছেড়ে দেবে। উঁহু! সেটি হচ্ছে না। লোকটার হাতে ইয়া লম্বা একটা লোহার শেকল। চটপট হুপ্পোর গলায় বেঁধে ফেললে। ঘাড় এঁকিয়ে-বেঁকিয়ে ঘোরালে কী হবে! হুপ্পো কখনো পারে! টানাহ্যাঁচড়ানিতে লোকটার গায়ে যে একটু খিমচিয়ে দেয়নি হুপ্পো, তা নয়। কিন্তু তাতে কী ভবি ভোলবার? টেনে এক চাঁটা মারল হুপ্পোর মাথায়। হুপ্পো হাত দিয়ে সামলাতে গেল, পারলই না। তারপর গলার শেকলটা ধরে টানতে টানতে লোকটা হুপ্পোকে নিয়ে চলল।

বেশি দূর অবিশ্যি গেল না। বাড়িটার মধ্যে একখানা ঘর। বাইরে এক চিলতে একটু উঠোনের মতো। ওইখানে আর একটা ঘর। খাঁচার ঘর। খাঁচাটার দিকে চাইতেই হুল্লোর নজরে পড়ল, তার ভেতর যে-দুটো বাঁদর নিয়ে লোকটা খেলা দেখায়, সে-দুটো বসে আছে। খাঁচার ঠিক বাইরে, সেই ছাগলটা। টানতে টানতে লোকটা হুপ্পোকে খাঁচার কাছেই নিয়ে এল। তা বলে খাঁচার ভেতরে ঢোকাল না। বাইরে একটা খুঁটির সঙ্গে শেকলটা বেশ করে বাঁধল। বেঁধে চলে গেল।

চোখ আর মুখের চেহারা দেখলে ঠিক বুঝবে, হুল্লোকে দেখে খাঁচার বাঁদর দুটো বেজায় অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু দুটো বাঁদরই যে খুব খুশি, সেটা বুঝতেও একটু কষ্ট হবে না। বাঁদর যখন হাসে, তখন মানুষ তো তার মুখ দেখে বুঝতে পারে না। কি-বা হাসি, কিবা কান্না! সব সমান। কিন্তু বাঁদর তো বোঝে! তাই হুপ্পো ওদের মুখের দিকে চেয়েই বুঝল, দুজনেই অবাক চোখে, তার দিকে চেয়ে আছে বটে, কিন্তু ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি ভেসে বেড়াচ্ছে। হাসির কারণটা আর হুল্লোর বুঝতে বাকি রইল না। হুপ্পোকে ধরে এনে, শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে বলেই যে তারা আহ্লাদে আটখানা, সে-কথা বুঝতে কি আর কষ্ট হয়? রাগে হুল্লোর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু হুল্লোর মুখ দেখে বুঝবেই না, ভেতরে ভেতরে সে চটেছে। কারণ হুপ্পো জানে, রাগ যতই হোক, চেপে রাখাই ভালো। এখন এই বেপট জায়গায় রাগারাগি করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। তা ছাড়া রাগ করে চ্যাঁচামেচি করলে তো আর তার গলার শেকলটা ফস করে খুলে যাবে না! তার চেয়ে ভালোমানুষ সেজে থাকাই ভালো। সত্যি কথাই! কী বুদ্ধি দেখো হুপ্পোর! হ্যাঁ, বুদ্ধিটা তার বরাবরই একটু বেশি। বাঁদর হলে কী হবে!

‘কিই-ই-ই-ই।’ হাসির শব্দ। বাঁদর দুটোর মুখে এতক্ষণ হাসি চাপা ছিল। এবার ফেটে পড়ল।

চমকে একটু থতমত খেয়ে গেল হুপ্পো। খাঁচার বাঁদর দুটো বেদম হেসে উঠেছে। হাসতে হাসতে একটা আর একটার গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। হুপ্পো চমকে গেলেও থমকাল না। খাঁচার বাঁদর দুটোর সঙ্গে নিজেও হাসি জুড়ে দিল, ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ। এতক্ষণ পাশের ছাগলটা চুপচাপ ছিল। তিনটে বাঁদরের বাঁদুরে হাসি শুনে সে আর থাকতে পারল না। তারও হাসি পেয়ে গেল। সে-ও হেসে ফেলল, ব্যা-এ্যা-এ্যা-এ্যা! ছাগুলে হাসি, বাঁদুরে হাসি যে একসঙ্গে না শুনেছে, কিছুতেই বুঝবে না সে-হাসিতে কী বিদঘুটে মজা!

অবশ্য হুপ্পোর হাসি শুনে খাঁচার বাঁদর দুটো যে একটু থমকিয়ে যায়নি, তা নয়। গেছিল। কারণ ওরা ভেবেছিল, হেসে দিলে দারুণ ঠাট্টা করা হবে আর হুপ্পো সেই ঠাট্টা-মার্কা হাসি শুনে অপমানে গুমরে উঠবে। মান-সম্মানে আঘাত লাগলে কার আর মেজাজ ঠিক থাকে! কিন্তু হুপ্পো যখন ওদের হাসি শুনে নিজেই হেসে গড়িয়ে গেল, তখন নাচের বাঁদর দুটোই বেবাক! চুপ করে গেল তারা কিন্তু হুগো চুপ করল না। ছাগলটাও হাসি থামাল না। হুপ্পোও হাসছে, ছাগলটাও হাসছে। তখন বেদম রেগে গেছে খাঁচার বাঁদর দুটো। বিচ্ছিরি মুখ খিঁচিয়ে এমন ভেংচি কেটে উঠল, ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ!

হুপ্পো আর ছাগলটা খিচুনি শুনে দুম করে বুম মেরে গেল। খাঁচার বাঁদর দুটোর মধ্যে রাস্তায় নাচ দেখাবার সময় যে-বাঁদরটা বর সেজেছিল, সে তার থ্যাবড়া মুখখানা আরও ভোঁতা করে চেঁচিয়ে হুপ্পোকে বলল, ‘এই, ক্যাবলার মতো হাসছিস কেন রে?’

ক্যাবলা বললে কার মাথা গরম হয় না বল? কিন্তু তবু এবারও হুপ্পো চটল না। উলটে ভাবল, ওদের সঙ্গে ভাব করে ফেলাই ভালো। কারণ, বলা যায় না কে, কখন, কোন কাজে লাগে। চটামটি করে বিপদের ঘাড়ে বিপদ ডেকে লাভ আছে? তাই হুপ্পো খুব মোলায়েম। গলায় উত্তর দিল, ‘সত্যি বলছি, তোমাদের ভেংচি কেটে আমি হাসিনি। আহা! তোমাদের দুজনারই মুখের হাসি কী মিষ্টি! শুনে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়!’

হুপ্পোর প্রাণ জুড়িয়ে যাক আর না যাক, কথাটা শুনে নাচিয়েবাঁদর দুটোর যে মন জুড়িয়ে গেল, সে-কথা আর বলতে! তখন বর-বাঁদরটা যে-বাঁদরটা কনে সেজেছিল তার কানে কানে বললে, ‘না রে, ছেলেটা ভালো।’

কনে-বাঁদরটাহুপ্পোর চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উত্তর দিল, ‘ভালোই তো মনে হচ্ছে। আবার চেনাও তো লাগছে।’ তারপর একটু চুপ থেকে, কী যেন ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওই হয়েছে রে! মনে এসেছে!’

বর-বাঁদরটা জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

 কনে বলল, ‘ওই সেদিন যখন নাচ দেখাচ্ছিলুম, ও একটা মেয়ের কোলে চেপে আমাদের নাচ দেখছিল।’

বর বলল, ‘জিজ্ঞেস করে দেখিই না।’ বলে হুপ্পোকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, তুই সেদিন একটা মেয়ের কোলে চেপে আমাদের নাচ দেখছিলি?’

হুপ্পো বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমাদের ঠিক মনে আছে তো! আমার নাম হুপ্পো। আর যার কোলে উঠেছিলুম, তার নাম ঝুমকি।’

কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ ছাগলটা ছাগুলে-গলায় ব্যা-এ্যা-া করে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘ঝুমকি? আমার খুড়-শাউড়ির নামও তো ঝুমকি! কী মিল দেখ!’

ছাগলের কথা শুনে বর আর কনে দুটো বাঁদরই একসঙ্গে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে কনে-বাঁদরটা বলল, ‘নামে মিল থাকলে কী হবে! মানুষ তো আর ছাগল নয়!’

হঠাৎ বর-বাঁদরটা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘মানুষ ছাগল নয় ঠিকই, কিন্তু বাঁদর। অবশ্য আর একটু খোলসা করে বললে মানে হয়, মানুষ আমাদের বংশধর। মানে এক সময় মানুষ বাঁদর ছিল।’

ছাগলটা উত্তর দিল, ‘তা মানুষ যদি বাঁদরই ছিল, তবে তোরা কেন বাঁদর রয়ে গেলি?মানুষ হলি না? তোদের গলায় দড়ি বেঁধে মানুষ কেন নাচিয়ে বেড়ায়?

বর-বাঁদরটা তেড়েমেড়ে খিকিয়ে উঠল, ‘সাধ করে কী আর তোদের নাম ছাগল। আরে সব বাঁদর মানুষ হয়ে গেলে বাঁদর বংশটাই তো লোপ পেয়ে যায়।’

কনে-বাঁদরটা ঠাট্টা করে বলল, ‘বুদ্ধির গোড়ায় একটু হাওয়া দিয়ে নে, ছাউলে!’

ছাগল উত্তর দিল, ‘হাওয়া কেন দেব রে? আমি কীসে কম যাই? আমার খুড়-শাউড়ির মেয়ের যখন বিয়ে হয়, তখন কনে পছন্দ করেছিল কে জানিস? এই শর্মা।’

বর ঠাট্টা করল, ‘ছাগলের আবার বিয়ে!’

ছাগল রেগে গিয়ে হাউ হাউ করে উঠল, ‘দেখ, ছাগল ছাগল করিসনি বাঁদর!’

বাঁদর উত্তর দিল, ‘বাঁদর বাঁদর করিসনি ছাগল।’

‘বাঁদরকে বাঁদর বলবে না তো কী বলবে র‍্যা? এত বড়োন্যাজ নিয়ে নিজেদের মানুষের সঙ্গে তুলনা করিস কী বলে? শখ আছে ষোলো আনা!’

‘তুই তো খালি চোপরদিন বসে বসে জাবর কাটছিস! তোর আর কী কাজ আছে!’

‘তোদেরই বা কী কাজ! খাচ্ছিস-দাচ্ছিস ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছিস!’

হুপ্পো এতক্ষণ চুপ করেছিল। যখন দেখল ঝগড়াটা বেড়েই যাচ্ছে তখন মুখ খুলল, ‘দেখো, শুধুমুধু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। আসলে আমরা কেউ-ই মানুষ নই। এ-কথা সত্যি! আর মানুষকে আমরা হিংসেও করতে চাই না। তবে কথা হচ্ছে, মানুষ। আমাদের বড্ড হেনস্থা করে। এই দেখো না, আমাদের গলায় দড়ি বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় নাচিয়ে বেড়ায়। ছাগলের পিঠে চাপিয়ে মিথ্যে মিথ্যে বর-কনে সাজায়। আমাদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। অবিশ্যি সব মানুষই যে এমন, তা নয়। এই দেখোনা ঝুমকি, মানুষ হলে কী হবে, ভারি লক্ষ্মী মেয়ে। আমায় খুব আদর করে। আর ঝুমকির মা? সে-কথা জিজ্ঞেস করো না। ভীষণ রাগী। আমি তো দেখলেই লুকিয়ে পড়ি। অবিশ্যি ঝুমকির বাবা অমন নয়। ঝুমকির বাবাই আমাকে রথের মেলা থেকে কিনে নিয়ে আসে। যত্ন করে, আবার আমি দুষ্টুমি করলে বকেও। দেখো, আদরযত্ন করলে বকুনি খেতেও ভালো লাগে। মনে হয়। আমাদের ভালোর জন্যেই তো বকছে। আবার দেখো, ঝুমকিদের বামুনঠাকুর, সে তো আমাকে দেখলেই পালাবে। আমাকে দেখে ভয় পাবার কী আছে, কে জানে! সত্যি বলছি, আমি তাকে কোনোদিন মুখও ভেংচাইনি, তেড়েও যাইনি। তবে, বামুনঠাকুর একদিন চুপিচুপি আমার একটা কলা খাচ্ছিল, আমি দেখে ফেলেছি। বামুনঠাকুরকে আমি তবে কোনো দোষ দিই না। মুখের সামনে সব সময় খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করলে, নোলার জল সামলানো যায়? সেই থেকে ঠাকুরও আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।’

‘তোদের বামুনঠাকুরের টিকি আছে?’ ছাগলটা জিজ্ঞেস করল।

 ‘বলতে! কী লম্বা!’

বর-বাঁদরটা জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষ টিকি রাখে কেন বলত?’

কনে-বাঁদরটা উত্তর দিল, ‘কী বোকা-রে তুই, জানিস না, টিকি রাখলে মানুষের রূপ বাড়ে!’

হুপ্পো বলল, ‘বামুনঠাকুরের আবার রূপ! সে ঝুমকি। চোখে কাজল পরছে, মাথায় বেণি আঁটছে, পায়ে আলতা পরছে, ঠোঁটে আবার লাল-লাল একটা কী মাখে। ভারি সুন্দর দেখায়।’

‘তুই মেখেছিস, কোনোদিন?’ জিজ্ঞেস করল কনে-বাঁদরটা।

মিথ্যে বলব না, আমি ভাই ওসব কোনোদিন মাখিনি। আমার ভাই মেয়েদের মতো সাজতে লজ্জা করে!’

ছাগলটা বলল, ‘সত্যি! মেয়েদের সাজ-পোশাকগুলো কেমন যেন হাবজা-গোবজা! এই আমার খুড়-শাউড়ি, তারও ভারি ভাবন!’

বরটা তেড়েমেড়ে উঠল ছাগলটাকে, ‘কথায়-কথায় খুড়-শাউড়ি, খুড়-শাউড়ি করিসনি তো! কী রকম আদেখলেপনা দেখ! যেন আর কারো খুড়-শাউড়ি নেই!

ছাগল বলল, ‘নেই-ই তো। তুই তো একটা বাউন্ডুলে। ওই নেচেই বেড়াবি। বিয়েও হবে না, আর শাউড়িও হবে না।’

হুপ্পো জিজ্ঞেস করল, ‘ছাগল, ছাগল, তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথা?

ছাগল বলল, ‘দূরে নয়, কাছেই।’

‘বউ কোথা?

বউ-এর কথা বলতেই ছাগলের মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল। বলল, ‘অনেকদিন ভাই দেখিনি তাকে। বউ-এর জন্যে মনটা বড্ড কেমন-কেমন করে। ছেলেপুলে নিয়ে কেমন। আছে কে জানে!’ হুপ্পো বর আর কনে-বাঁদরকে জিজ্ঞেস করল ‘তোমাদের বাড়ি কোথা?

কনে উত্তর দিল, ‘দূর ছাই, মনে আছে কী! নেচে-নেচেই সব গেল।’

বর বলল, ‘আমার অবশ্য মনে আছে। আমাদের বাড়ি লছমনঝোলা। আমরা দুজনেই। রেলে চেপে এসেছি। আমার মাকেও মনে আছে, বাবাকেও। বড্ড মন খারাপ লাগে ওদের জন্যে, কান্না পায়! কিন্তু কী করব! মানুষের জ্বালায় মা-বাবা সবাইকে ভুলতে বসেছি।’

‘দেখতে ইচ্ছে করে না?’ হুপ্পো জিজ্ঞেস করল।

‘কী বলছিস তুই? দেখতে ইচ্ছে করবে না? মা-বাবাকে ভুলে থাকা যায়, বল? কিন্তু উপায় তো নেই!’ হুপ্পো আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’

‘দেখেছিস না খাঁচায় বন্দি।’

‘বন্দি তো নিজেদের দোষেই হয়েছে!

‘কেন?’

‘কেন নয়! তোমাদের সাহস নেই তাই। যদি সাহস থাকত, বুদ্ধি থাকত, তবে খাঁচা ভেঙে ভেগে পড়তে।’

‘তুই পাগল। খাঁচা কী ভাঙা যায়?

‘বুদ্ধি থাকলেই যায়।’

‘তোরও তো গলায় লোহার শেকল, ছিঁড়তে পারবি?’ হুপ্পো একটু মুচকি হাসল।

ছাগল জিজ্ঞেস করল, ‘হাসছিস কেন রে? তুই বুঝি শেকল ছিঁড়তে জানিস?’

হুপ্পো উত্তর দিল, ‘গায়ে এত জোর কোথা?

কনে জিজ্ঞেস করল, ‘তবে ও-কথা বলছিস কেন?

‘বলছি, কারণ তোমরা তিনজন, আর যে-লোকটা তোমাদের নাচায়, সে একা। তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো, অথচ লোকটা যখন লাঠি নিয়ে ঠেঙায়, তখন বর সেজে, কনে সেজে ছাগলের পিঠে বিয়ে-বিয়ে খেলা দেখাও। তোমাদের বাপু মানসম্মান নেই।’

ছাগলটা বলল, ‘ঠিক বলেছিস!’

কনে বলল, ‘তা বাপু একশোবার!’

বর বলল, ‘হক কথা। লোকটা আমাদের একদম বুদু বানিয়ে রেখেছে। না, আমরা আর নাচব না, কিছুতেই না।’

ছাগল বলল, ‘বাঁদরের বুদ্ধিই অমনি! লম্বা-চওড়া কথা তো খুব বলছিস। যখন পিঠের ওপর ধাঁই ধাঁই করে লাঠির ঘা পড়বে, তখন না-নেচে থাকতে পারবি?’

‘কেন পারব না! মনের জোর থাকলে সব হয়। কত মারবে!’

‘বেশ তো, তাহলে আজ থেকে আমরা আর নাচব না।’ বরের কথায় কনে-বাঁদরটা সায় দিল।

হুপ্পো বলল, ‘তা তো বুঝলুম। কিন্তু দেখো, না নাচলে লোকটা হয়তো জব্দ হবে, কিন্তু তোমরা তো ছাড়ান পাবে না।’

ছাগলটা হেসে উঠল।

আচমকা ছাগলের হাসি শুনে বর জিজ্ঞেস করল, ‘হাসির আবার কী হল?’

ছাগল উত্তর দিল, ‘হাসব না? আসলে নাচ থামালে যে তোরা বন্দিদশা থেকে নিস্তার পাচ্ছিস না, এটা আর তোদের মগজে এল না।’

কনে বলল, ‘সত্যি কথাই তো!’

বর জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে উপায়?

ছাগল বলল, ‘মাথা খাটা, মাথা খাটা।’

বর রেগেমেগে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমরা মাথা খাটাই, আর উনি খুড়-শাউড়ির স্বপ্ন দেখুন।’

‘আরে আমার খুড়-শাউড়ি আজ এখানে থাকলে, তোদের এ দুর্দশা হত? এমন বুদ্ধি খাটাত যে বর্তে যেতিস!’

‘থাক, আর বকবক করতে হবে না। ছাগলের কত বুদ্ধি সে আর আমাদের জানতে বাকি নেই!’

আবার যখন ছাগলে-বাঁদরে লেগে যাচ্ছিল, হুপ্পো তখন চট করে বলল, ‘দেখো, আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে। ঝগড়া করলে তো আর ফয়সালা হবে না।’

কনে বলল, ‘তা বাপুঠিক। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করাটা ঠিক না। কিন্তু আমরা তো ভেবেচিন্তে কিছু ঠাওর করতে পারছি না। তুই একটা কিছু বুদ্ধি-টুদ্ধি দে না।’

 হুপ্পো উত্তর দিল, ‘বুদ্ধি আমি দিতে পারি, কিন্তু করতে তো তোমাদের হবে! পারবে তো?

বর-বাঁদরটা বলল, ‘কী বলিস, তা আর পারব না!’

‘আমার কথাটা কিন্তু খুব গোপন। চালাচালি হয়ে গেলে ভারি বিপদ!’

বর আর কনে দুটো বাঁদরই একেবারে দু-পায়ে উঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘সে জ্ঞানটুকু আমাদের আছে।’

হুপ্পো ছাগলের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল ‘তুমি’? ছাগল উত্তর দিল, ‘বিশ্বাস আমাকেও করতে পার।’

হুপ্পো হাসতে হাসতে বলল, ‘খুড়-শাউড়িকে বলে দেবে না তো?’

ছাগল উত্তর দিল, ‘এখানে খুড়-শাউড়ি কই, যে বলব?’

কনেটা, বরটা আর হুপ্পো তিনজনেই হেসে উঠল একসঙ্গে।

ছাগল বলল, ‘তুইও দেখি ঠাট্টা করিস! যা বলবার তাড়াতাড়ি বল। লোকটা এসে পড়লে, আর কিছু করতে হবে না।’

হুপ্পো বলল, ‘আমার ওপরও রাগ করছ? আচ্ছা, তাহলে একটু কাছে এগিয়ে এসো।’ বলে হুপ্পো নিজের গলার শেকলটা টেনে টেনে কনে আর বরের খাঁচার কাছে এগিয়ে গেল। ছাগলটাও গলার দড়ি যতখানি যায় টেনে টেনে হুপ্পোর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। হুপ্পো তিনজনকে ফিসফিস করে কী সব বলতে লাগল। কী যে বলছে, সেটা ছাগল, বর আর কনে-বাঁদর ছাড়া কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

ফিসফিসুনি শেষ হতে কনে আর বরটা বলল, ‘বাবা, তোর কী বুদ্ধি রে!’

ছাগল বলল, ‘ওঃ, একদম ডাঁসা বুদ্ধি।’ বলেই ব্যা-এ্যা-এ্যা, ব্যা-এ্যা-হ্যাঁ করে এমন। চ্যাঁচাতে লাগল আর লাফাতে লাগল মনে হচ্ছে যেন হাতে স্বপ্ন পেয়ে গেছে। আর ঠিক যা ভেবেছি, তাই। চ্যাঁচামেচি শুনে, লোকটা কোথায় ছিল ছুটে এসেছে। হবেই তো। যতই আনন্দ হোক, সবকিছু একটু সামলে-সুমলে করা উচিত। একেবারে বে-আক্কেলের মতো অমন হাঁকাহাঁকি আর লাফালাফি করাটা কি ঠিক হল?

লোকটাকে দেখেই কিন্তু ভারি ভালোমানুষের মতো চুপ করে গেল বর আর কনে-বাঁদর দুটো। হুপ্পোও স্পিকটি নট। আর ছাগলটাও গোবর-গণেশের মতো হাবাগোবা সেজে চুপ মেরে গেল। লোকটা হুল্লোর কাছেই এগিয়ে গেল। ভাবল, নিশ্চয়ই এই নতুন বাঁদরটা ছাগলটাকে কিছু করেছে। তাই ছাগলটা চিল্লাচ্ছে! খুঁটির সঙ্গে বাঁধা শেকলটা খুলে, হুল্লোকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে উঠোনে নিয়ে গেল। উঃ। ভয়ানক লেগেছে হুল্লোর! তারপর হাতের ঠেঙাটা নিয়ে সাঁই সাঁই করে হুল্লোর পিঠে বসিয়ে দিল। আচমকা যে অমন করে মারবে, হুপ্পো এটা মোটেই বুঝতে পারেনি। কিন্তু হুপ্পোও কী কম চালাক! মার খেয়ে মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। উলটে বাঁদর-নাচিয়ের গলাটি জড়িয়ে ধরল এমন করে, যেন কতদিনের পোষমানা বাঁদর।

লোকটাও অবাক। আচ্ছা তাজ্জব বাত তো! এ নয়া বাঁদরটা মার খেয়েও তাকে কামড়ে দিল না, খামচে দিল না। উলটে গলার ওপর পাক খাচ্ছে!

লোকটা আর মারল না হুল্লোকে। মারল না বটে, তা বলে ভেব না মোটেই হুল্লোর আদরে গলে গেল। লোকটা শয়তানের বাড়া। দেখছ না মুখখানা! হুপ্পো শুনেছে, মুখ দেখলেই। নাকি মন বোঝা যায়! অতশত গোলমেলে কথা বুঝতে পারে না হুল্লো। তবে উনি যে। মোটেই সুবিধের নন, সে তো হুল্লোর আগেই জানা। নইলে মশাই নিজঝুম রাত্তিরে অমন। করে চুরি করে আনে তাকে! হুপ্পোকে ঘাড় থেকে টেনে নামিয়ে আনল লোকটা। শেকলটা হাতে ধরে, হাতের ঠেঙাটা হুপ্পোর পায়ের কাছে এমনভাবে চালাতে লাগল, হুপ্পো পা বাঁচাতে তিড়িং তিড়িং লাফ দিল। প্রথমটা বুঝতেই পারেনি হুপ্পো যে, লোকটা তাকে নাচাবার জন্যে অমনি করছে। বা, বলতে পার নাচ শেখাচ্ছে। ক-বার এমনি ঠেঙা ঠোকার পর হুপ্পো যখন লাফাতে লাগল, তখন লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘নাচ, নাচ, নাচ।’

লোকটার মাথায় কী আছে, সেটুকু বুঝতে হুল্লোকে বেশি মাথা খাটাতে হল না। নিজেই নাচতে শুরু করে দিল। আর ঠ্যাঙার দরকারই লাগল না।

ফুঃ! ও হুপ্পোকে নাচ শেখাবে! হুপ্পো বলে ঝুমকির নাচ দেখে নিজে নিজেই কতদিন নেচেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে। ঝুমকির নাচ তো কত শক্ত। আর এদের নাচ, ফুঃ!

নাচতেই লাগল হুপ্পো। লোকটা শেকলটা ধরে আবার হিড়হিড় করে টান দিল। ঘরে গেল। একটা ডুগডুগি দেওয়ালে ঝোলাননা। সেটা নিয়ে বাইরে এসে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করে দিল। হুপ্পোও তেড়েমেড়ে নাচন-কোঁদন লাগিয়ে দিল। নাচতে নাচতে

ক-বার ডিগবাজিও লাগাল। লোকটা ভাবল, ‘ভালো রে, ভালো। এ যে দেখি তৈরি

বাঁদর!’

নাচতে নাচতে হাঁপিয়ে গেল হুপ্পো। লোকটা নাচও থামিয়ে দিল। নাচ থামিয়ে ছাগলটাকে ডাকল, ‘আ–বু-উ-উ!’

ডাক শুনে ছাগলটাও ‘বু-উ-উ’ করে সাড়া দিল। যার মানে, ‘এ্যাঁ’?কী বলছ? ছাগলের কথা তো! এগিয়ে গেল ছাগলটা। লোকটা তার মুখের দড়িটা ধরে একটু ওপর দিকে টানতেই, ছাগলটা দু-পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওমা! ওমা! দেখো, কী মজাদার দেখতে লাগছে! হুপ্পোও খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। ভাবল, ছাগলটা বেশ কায়দা জানে তো! কী জানি কেন, ছাগলটার অমন ভঙ্গিবহর দেখে, হুপ্পো ঠিক থাকতে পারল না। মারল ছাগলের পিঠে এক লাফ। ছাগলটা প্রথমে হুল্লোর ধাক্কা খেয়ে একটু টলকে গেছল। তারপর সামলে, হুপ্পোকে পিঠে নিয়েই, দু-পায়ে নাচ শুরু করে দিল! বাঁদর ঘাড়ে সে এক বেড়ে ছাগুলে নাচ!

বাঁদর-নাচিয়ে লোকটাও দেখেশুনে একদম হাঁদা! না শেখাতেই বাঁদর আর ছাগলটা এই দুর্দান্ত নাচ শিখল কোত্থেকে! এ-নাচটা যে নির্ঘাৎ আরও অনেক পয়সা এনে দেবে, সে মতলবটা লোকটার মাথায় তখন সেঁদিয়ে গেছে! কিন্তু এদিকে যে হুপ্পো ছাগলের পিঠে। চেপে, গলাটি জড়িয়ে, তার কানে কানে কী বলছে সেটা আর বাঁদর-নাচিয়ের চোখে পড়ল। পড়লেও ও আর কী করে বুঝবে হুপ্পো বলছে, ‘ছাগল, ছাগল, জোরে জোরে নাচ।’ তা বলে বাপুদু-পায়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে জোরে জোরে নাচা ছাগলের সাধ্যি নয়! মানুষ হলে এক কথা ছিল! লম্বা-ঢ্যাঙা মানুষগুলো কেমন দু-পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটে-ফেরে, নাচে-ছোটে। যাই বলো, তাই বলো, ভগবানের মানুষের জন্যে একটু বেশি ভাবনা। তা না হলে ধরে-বেঁধে গাধা-ঘোড়া, ছাগল-ভেড়া এসব জন্তুর দেহে চারটে করে পা জুড়ে দেবে। কেন? দুটোতেই কি কাজ হত না? চারটে পা ভাগ করে দুটো হাত, দুটো পা করে দিলে কী ক্ষতি ছিল।

ছাগলটা আর বেশিক্ষণ হুপ্পোকে পিঠে নিয়ে নাচতে পারল না। ঝপ করে মাটিতে চার ঠ্যাং এ দাঁড়িয়ে পড়ল। হুপ্পোও চটপট ছাগলের পিঠ থেকে নেমে পড়ে সাঁই-ই-ই করে শূন্যে একটা ডিগবাজি মারল। লোকটা খুশিতে হেঁকে উঠল, ‘সাবাস!’ তারপর ছাগলের পিঠে আর হুপ্পোর গায়ে তারিফ করে হাত বোলাতে লাগল।

হঠাৎ লোকটা বর আর কনে-বাঁদরের খাঁচার দিকে মুখ ঘোরাল। হয়তো মতলব ও দুটোকে নিয়েও একটু নাচানাচি করা। কিন্তু আশ্চর্য দেখো, হুপ্পো আর ছাগলের এমন মজাদার কাণ্ড দেখার জন্যে বর আর কনে-বাঁদরটা তো খাঁচায় মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে নেই! খাঁচার মধ্যে বাঁদর দুটো কেমন পড়ে পড়ে ধুকছে!

কী হল বর-কনের? অমন করে ধুকছে কেন?

বর আর কনে-বাঁদরের ধুকুনি দেখে অমন সাবধানী বাঁদর-নাচিয়ে হঠাৎ যে এমন অসাবধানের মতো কাজ করে বসবে, ভাবা যায়নি! লোকটা করেছে কী, হুপ্পো আর ছাগলকে খুঁটির সঙ্গে না-বেঁধেই, ছুট্টে গিয়ে বর আর কনে-বাঁদরের খাঁচার দরজা খুলে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি বর-কনেকে খাঁচার থেকে টেনে বারও করে ফেলেছে। আর ঠিক এই সময় হুপ্পো গলার শেকল গলায় নিয়েই মেরেছে এক লাফ ঘর থেকে বাইরে। মেরেই ছুট। নাচিয়ে লোকটা তাই না দেখে থ। আগু-পিছু কিছু না ভেবে, বর-কনেকে খাঁচার বাইরে ফেলে রেখেই হুপ্পোকে দুড়দাঁড়িয়ে ছুটে ধরতে গেছে।

বর-কনে বাঁদর দুটো এতক্ষণ পর্যন্ত ধুকছিল। কে বুঝবে, ওরা মিথ্যে মিথ্যে অমন করে মটকা মেরে পড়ে আছে! পড়ে থাকবে না? এ-সব হুল্লোর বুদ্ধি। তখন কানে কানে ফিসফিসিয়ে এই মতলবটাই তো হুগো ওদের দিয়েছে। তাই, যেই না লোকটা হুপ্পোর পিছু ছুট দিয়েছে, বর আর কনে-বাঁদর দুটোও তিড়িং-মিড়িং দাঁড়িয়ে উঠে, মেরেছে বোম্বাই লাফ। ঘর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে রাস্তায়, রাস্তা থেকে গাছে। গাছের ওপর ডাকাডাকি, আর নাচানাচি।

বাঁদর-নাচিয়ে লোকটা হুপ্পোর পিছু ছুটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বর আর কনে-বাঁদরকে গাছের ডালে নাচতে দেখে তার তো চক্ষু চড়কগাছ! তরতর, তরতর করে গাছের ডালে উঠে পড়ল লোকটা। বাঁদর দুটোও চটপট চটপট নেমে পড়ল গাছ থেকে। আরে বাবা, বাঁদরকে ধরা অত সহজ! ওরা ছুটতে পারে, লাফাতে পারে। এ-বাড়ি, ও-বাড়ির ছাত পেরিয়ে, পালাতে পারে।

হলও তাই। বরও পালাল, কনেও পালাল। আর লোকটা আঁকপাঁকিয়ে গাছ থেকে নামতে নামতেই, সক্কলে হুস!

লোকটাও ছাড়বে কেন? আহা! বাঁদর নানাচলে, সে খাবে কী! বাঁদর না বাঁচলে, সে পরবে কী! অত সহজে বাঁদরের মায়া কাটানো যায়? যতই হোক বাঁদর তার বড়ো আদরের ধন। এ-বাড়ির ছাদ, ও-বাড়ির ঘর, এদিকের গলি, ওদিকের রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে লোকটা। একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। সারাটাদিন না-খেয়ে না-দেয়ে বাঁদর খুঁজতে কেটে গেল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, শেষকালে বাঁদরগুলো বুদু বানিয়ে দিল!

খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে ঘরে যখন ফিরল, তখন দেখল, আহা! অমন নাদুস-নুদুস ছাগলটিও নেই। সে-ও তার গলার দড়ি ছিঁড়ে, রাস্তা দেখেছে। তাই দেখে সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি! নিজের মনে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘গেলি তো, গেলি, বয়ে গেল আমার। ভেবেছিস, তোরাই শুধু নাচতে জানিস, আর আমি জানি না? এই দেখ,’ বলে ডুগডুগিটা বাজিয়ে নিজে নিজে একাই নাচতে লাগল আর আপন মনে হা-হা করে হাসতে লাগল।

নাচতে নাচতে, হাসতে হাসতে রাত ভোর হয়ে গেল, তবু থামল না। পাড়া-পড়শি লোকজনেরা ছুটে এল। বলাবলি করতে লাগল, বাঁদরের শোকে লোকটা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। হবে হয়তো!