হুপ্পোকে নিয়ে গপ্পো – ৩

ভারি মজার ঝুলন্ত কাণ্ড

কথা ছিল, বাঁদর-নাচিয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে ওরা হুপ্পোর সঙ্গে দেখা করবে। যে জায়গায় দেখা করবে সেটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। অবশ্যি ওদের তেমন ভোগান্তি হয়নি। যেমন যেমন ভেবে রেখেছিল, কাজও তেমন তেমন হয়েছে। মোদ্দা কথা, হুল্লোর জন্যেই আজ বর আর কনে-বাঁদরের হাত-পা ঝাড়া। যাই বল, হুপ্পোর মাথা আছে! মতলবটা কেমন ভেবে-চিন্তে বার করেছে! তবে, প্রথমটা ও নিজে একটু বিপদে পড়েছিল। গলার সেই লোহার শেকলটা তো তার গলাতেই বাঁধা ছিল। সেটি তো আর খুলতে পারেনি বাছাধন! একটা নেড়া-মাথা ছেলে, হুল্লোকে দেখতে পেয়ে, এমন পিছু পিছু ছুট দিয়েছিল যে, আর একটু হলেই ছেলেটা শেকলটা ধরে ফেলেছিল। কিন্তু হুপ্পোও তো কম যায় না! মেরেছে সেই উঁচু বাড়িটার ওপর লাফ! তারপর ছুট। তবে রক্ষে, ও যখন একটা গাছে লাফ মেরেছিল, গাছের ডালে শেকলটা আটকে যায়নি। তাহলেই কেলেঙ্কারি ব্যাপার! গাছেই হুপ্পোকে ঝুলতে হত। বর-বাঁদরটাই হুল্লোর গলার শেকলটা খুলে দিল। বর আর কনে বাঁদরের গলার বকলেশ দুটো হুপ্পো ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন করবে কী ওরা! যদিও একটা মস্ত বড়ো বট-ঝুরি গাছের ডালে

ওরা আস্তানা গেড়েছে, তবু এখানে তো আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। ও মশাই বাঁদর নাচিয়ে লোকটাকে বিশ্বাস নেই। কখন বলতে কখন নজরে পড়ে যায়! তখন এমন ভেল্কিবাজি শুরু হয়ে যাবে যে, শত বুদ্ধি খাঁটিয়েও আর বাছাদের নিস্তার পেতে হবে না।

কিন্তু এখন যায় কোথা? দেখো, কনে আর বর-বাঁদরের কথা ছেড়ে দাও। এরা তো লছমনঝোলা থেকে এসেছে। ওদের ঘরে ফেরাই মুশকিল! সে আবার রেলে চড়ে যেতে হয়! রেলে চড়লে টিকিট লাগবে। টিকিট কাটতে পয়সা লাগবে। হাজারটা ঝামেলা! কে এত ঝক্কি পোয়াবে! আর হুপ্পো? তার মন তো ঝুমকির জন্যে কেমন-কেমন করছেই। কিন্তু মন-কেমন করলে কী হবে বল?ঝুমকির বাড়ির রাস্তাটাই সে গুলিয়ে ফেলেছে! কাছে-পিঠে হলে না হয় কথা ছিল। একটু চেষ্টা করা যেত! কিন্তু কে জানে ঝুমকিদের বাড়ি কোথায়, কোন ধাধধারা গোবিন্দপুরে!

কনে-বাঁদরটাই প্রথম কথা বলল। বলল, ‘ছাড়া তো পেলুম! এখন?

বর উত্তর দিল, ‘ছাড়া যখন পেয়েছি, তখন ছন্নছাড়ার মতো এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে তো কোনো লাভ নেই। তাতে বিপদ বেশি। ছাড়া পেয়ে যদি যে-যার ঘরের মুখ দেখতেই না পেলুম, তবে ছাড়া আর না-ছাড়া এক কথা।’

কনে উত্তর দিল, ‘ঘরে যেতে হলে তো রেলে যেতে হবে! টিকিট কাটতে হবে! তার ওপর ঠিক গাড়িতে ঠিক সময়ে না বসলে, বেঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ব। বেঠিক জায়গায় গিয়ে পড়লে সে তো আর এক লেঠা!

বর বলল, ‘ঠিক-বেঠিকের কী আছে! যে রেলগাড়ি কু-কু ডাকে, ঝিক-ঝিক ছোটে, সেই গাড়িই তো বাড়ি যায়!’

কনেটা খিকিয়ে উঠল, ‘দূর বোকা, তাই হয় নাকি! জানিস না, দখনের গাড়ি দখনে যায়, উত্তরের গাড়ি উত্তরে যায়! যার যেদিকে ঘর সে সেদিকে যায়!’

বর জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে আমরা যাব কোনদিকে? আমাদের ঘর কোনখানে?’

কনে বলল, ‘যেদিকে লছমনঝোলা।’

বর বলল, ‘সেদিকটা কোনদিকে? উত্তুরে, না দখনে?

হুপ্পো এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ কথা বলে উঠল। বলল, ‘কোন দেশটা কোনদিকে, ঝুমকি থাকলে এক্ষুনি বলে দিত। কোনদিকে লছমনঝোলা, কী কোনদিকে শিমুলতলা, কিংবা কোনদিকে ট্যাংরা, টেরিটিবাজার বা সোনদা, টুং, শিলংকী ঘুম, ঝুমকির একেবারে জলের মতো মুখস্থ!’

বর, কনে দুজনেই হইচই করে উঠল। বলল, ‘তা হলে চল না, ঝুমকির কাছে!’

হুপ্পো বলল, ‘মুশকিল তো সেইখানেই। ওদের বাড়ি যাবার রাস্তাটাই ভুলে বসে আছি।’

কনে উত্তর দিল, ‘যাঃ! তাহলে তো বড়ো ঝামেলা হয়ে গেল। আমরা ঘর হারিয়েছি, তুমিও রাস্তা ভুলেছ! এখন তো আমাদের নাজেহাল হবার গতি।’

‘নাজেহাল হবি কেন? মার খুড়-শাউড়ি কী মরে গেছে?

কথাটা শুনে তিনটে বাঁদরই চমকে উঠেছে। গাছের ওপর থেকে নীচে রাস্তার দিকে, অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, ছাগলটাও এসে পড়েছে। এতক্ষণ ছাগলটার কথা ওরা ভুলেই গেছল!

ছাগল বলল, ‘দেখ, আমার কথা তোরা ভুলতে পারিস, তোদের কথা কিন্তু আমি ভুলিনি!’

কনে উত্তর দিল, ‘সত্যি! বড় লজ্জার কথা! তো এলি কী করে?

‘আমায় একবার একটা কথা বলে দিলে সহজে ভুলি না। আমি বলে কেন, ছাগল বংশের গুণই তো তাই।’

বর বলল, ‘যাক গে, যাক গে, যা হবার হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে, তুই নীচে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আর আমরা ওপরে, গাছে বসে। খুড়-শাউড়ির বাড়ি যেতে হলে হয় তোকে ওপরে আসতে হয়, তা না হলে আমাদের নীচে নামতে হয়।’

কনে বলল, ‘ও তো ছাগল। গাছে উঠবে ক্যামনে?’

বর-বাঁদরটা মুখখানা হাঁদার মতো গোমড়া করে উত্তর দিল, ‘তাই তো! তা হলে তো আমাদের নামতে হয়!’

অবিশ্যি এখন আর নামতে কোনো বাধা নেই। কেননা, অনেকক্ষণ কেটে গেছে। আর যে বাঁদর-নাচিয়ে এদিকে আসবে, তেমন কোনো ভয়ও নেই। তবু এখনো তো দিন! রাস্তায় এখনো গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের চলাচল, হই-হুঁল্লোড়। গাছটা খুব ঝাঁকড়া বলে তাই। লুকিয়ে বসে থাকতে মজা। তিনটে বাঁদরকে একসঙ্গে দেখলে, পিছু লাগবার লোকের অভাব হয় না। বাঁদর দেখলে কী যে মজা পায় বুড়ো-বুড়ো লোকরা ভগবানই জানেন! বুড়োদের কথাই বা বলি কেন! ছুটকো ছুটকো ছেলেগুলো কী কম শয়তান। একবার দেখতে পেলে হয়! এমন চিল্লাবে, যেন ভাগাড়ে শুকনি পড়েছে।

হুপ্পোই সাবধান করল, ‘এখন নামা ঠিক নয়। রাত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের গাছেই লুকিয়ে থাকতে হবে।’

‘তাহলে আমি কী করব?’ ছাগল জিজ্ঞেস করল। ‘আমি বাপু একা একা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। কে কখন দেখে ফেলবে!’

হুপ্পো উত্তর দিল, ‘তোমাকে তো গাছে তোলাই মুশকিল।‘

‘মুশকিল-টুশকিল জানি না।’ আবদার ধরল ছাগলটা। ‘তোমরা মজা করে গাছের ডালে লুকিয়ে থাকবে আর আমি এমন খোলামেলা জায়গায় চরে বেড়াব? বিপদ হতে তো আর সময় লাগে না।’

বর-বাঁদরটা ঘাড় নেড়ে মুরুবিবর মতো উত্তর দিল, ‘কথাটা কিন্তু ঠিক।’

কনে বলল, ‘ঠিক কথা তো সবাই জানে। কিন্তু করবার তো কিছু নেই।’

হুপ্পো এতক্ষণ কী ভাবছিল। বলল, ‘করা যে যায় না, এমন নয়। এক যদি ওকে ওপরে টেনে তোলা যায়!’

অমন একটা ধুমসো ছাগলকে গাছের ওপর টেনে তোলা তো চারটিখানি ব্যাপার নয়! তবু কথাটা যখন হুপ্পোর মুখ দিয়ে একবার বেরিয়েছে, তখন মতলবটাও হুপ্পো নিশ্চয় আগেই ঠাউরে ফেলেছে।

সত্যিই একটা বুদ্ধি খাঁটিয়েছে হুপ্পো। হুপ্পোবকে বলল, ‘তুমি এক কাজ কর, তোমার ল্যাজ দিয়ে নীচের ওই ডালটা জড়িয়ে ধরে মাটির দিকে মুখ নামিয়ে ঝুলে থাকো।

বর-বাঁদরটা হুল্লোর কথা মতো ঝুলে পড়ল।

এবার কনে-বাঁদরটাকে বলল, ‘তুমি লাফাও।’ বরকে বলল, ‘ও লাফালেই তুমি হাত দিয়ে ওর পেছনের ঠ্যাঁ দুটো ধরে ফেলবে।’

বাঁদরের পক্ষে এ তো আর এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। ওরা তো চোপরদিন এই কাণ্ডই করছে। তাই যেমন বলা, তেমনি কাজ। বর আর কনে চ্যাং-ঝোলা হয়ে দুলতে লাগল।

এবার হুপ্পোর পালা। হুপ্পো কনের হাতের কাছে নিজের ল্যাজটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আমার ল্যাজাটা টেনে ধরো।’ কনে-বাঁদর হুল্লোর ল্যাজ টেনে ধরল। হুপ্পো একেবারে ছাগলের পিঠের কাছে ঝুলে পড়ল।

‘ছাগল, ছাগল, ঠ্যাং বাড়াও।’

ছাগল অমনি দু-পায়ে খাড়া হয়ে ঠ্যাং বাড়াল। হুপ্পো ধরে ফেলল ছাগলের ঠ্যাং দুটো দু হাত দিয়ে। ছাগলকে চ্যাংদোলা করে দুলতে লাগল। ছাগলও দুলছে, হুপ্পোও দুলছে, কনেও দুলছে, বরও দুলছে। ছাগলের তো ভয়ে বুক ঢিপঢিপিয়ে উঠছে! এই না হাত ফসকে যায়! ফসকালে দেখতে হবে না। মাথা ফেটে ফুটিফাটা!

ওর নাম বাবা হুপ্পো। ফসকাবে বললেই হল! হুগো একেবারে কবজার মতো ছাগলের ঠ্যাং দুটো চেপে ধরেছে। চ্যাঁচাল, ‘বর-বাঁদর, কনে-বাঁদর, এবার ওপরদিকে টানো।’

অমনি বর ল্যাজ দুলিয়ে কনেকে টানতে লাগল। কনে মুখ খিঁচিয়ে হুল্লোকে টানতে লাগল। হুপ্পোঠ্যাং বাগিয়ে ছাগলকে ওপরে আনতে লাগল। সে একটা ছাগলে-বাঁদরে ভারি মজার ঝুলন্ত কাণ্ড!

দেখতে দেখতে হুপ্পো ছাগলকে গাছের ওপর টেনে তুলল। তুলে, ছাগলকে বলল, ‘তুমি এখানটায় হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকো। বেশি নড়নি-চড়ুনি। তাহলে আবার হড়কে পড়ে যাবে।’

ছাগল তো ভয়ে আমচুর! হুল্লোর কথা শুনে বটগাছের ডাল জড়িয়ে উপুড় হয়ে বসে রইল। বসে বসে ভাবছে, ‘এবার নামব কী করে?’

হুপ্পো বলল, ‘উঠেছ যখন, নামবে ঠিকই। তবে ধকলটা আমাদেরই সইতে হবে!’

ছাগল বলল, ‘তা বাপু, তোর বুদ্ধি আছে।’

বর-বাঁদরটা নিজের ল্যাজে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘থাকবে না? ও যে ঝুমকির হুপ্পো!’

হুপ্পো বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যিই তো! ছোট্ট হলে কী হবে, ঝুমকির মতো বুদ্ধি ক-জনার! প্রত্যেক বছর কেলাসে ফাস্টো হয়। ঝুমকি বলেছে আমাকেও ইস্কুলে ভরতি করে দেবে। আমিও ফাস্টো হব।’

বর আর কনে-বাঁদর দুটো ফ্যালফ্যাল করে হুপ্পোর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতে লাগল, বাবা, ফাস্টো আবার কী!

ছাগলটা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে ফাস্টো কেরে? কেস্টর ভাই?’

হুপ্পো হো হো করে হেসে উঠল।

ছাগলটা চমকে গিয়ে ভাবতে লাগল, ‘বাবা, বাঁদরটা হাসে কেন?

.

নিজঝুম রাত্তিরে তাজ্জব কাণ্ড

যতক্ষণ না রাত হল, ততক্ষণ ওরা চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে রইল গাছের ডালে। বাঁদরের তো আর কোনো কষ্ট নেই। ওদের তো গাছের ডালেই ঘর। কিন্তু গাছের ডালে হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ছাগলের পেটে-বুকে খিল ধরে একশেষ। সত্যি কথাই! অমন করে সারাক্ষণ বসে থাকা যায়! একটু হেলতে পারবে না, একটু ফিরতে পারবে না। ঘুম পেলে হাই তুলতে পারবে না। চাই কী হাঁচি পেলে হাঁচতেও পারবে না। তা হলেই গাছ ফসকে আলুর দম!

কিন্তু তার চেয়েও বড়ো ভাবনা আর একটা ছিল। ওই তিনটে বাঁদরকে আর ছাগলটাকে কেউ যদি গাছের ওপর নজর করে ফেলত! তখন কী হত?

এখন অবিশ্যি সে-সবের আর ভয় নেই। এখন নিজঝুম রাত্তির। মোটরগাড়ি, ট্রামগাড়ি, বাস, ট্যাক্সি, রিকশা, ঠেলার সোঁ-সোঁ, সাঁ-সাঁ, টুং-টুং ঠুং-ঠাং কিচ্ছুরই সাড়া শব্দ নেই। লোকজনেরও হই-হুঁল্লোড় থেমে গেছে। যে যার ঘরে ঢুকে পড়েছে। রাত্তিরবেলা ভয় করে তো! রাতবিরেতে কে বাবা একলা একলা রাস্তায় বেরুবে! কত রকমের বিপদ থাকতে পারে। যদিও পুলিশ রাস্তায় চৌকিদারি করে বেড়ায়, তবুও বলা যায় না তো! পুলিশ আর কতদিকে নজর রাখবে! এত বড়ো শহরে গলিঘুজির তো আর শেষ নেই!

প্রথমে ছাগলটাই মুখ খুলল, ‘দেখো বাপু, আমি আর এমন করে গাছ খামচে বসে থাকতে পারছি না। আমার নড়া টনটন করছে। হয় নামো, না হয় একটা কিছু করো।’

হুপ্পো বলল, ‘হ্যাঁ, এখন ভয়টা অনেক কম। নামা যেতে পারে। তবে তোমার খুড়-শাউড়ির বাড়ি কোনদিকে, কোনদিকে যাবে, সেটা আগের থেকেই ঠিক করে নিতে হবে।’

‘আগের থেকে ঠিক করব কী করে?’ ছাগলটা উত্তর দিল। ‘গাছে বসে বসে আমার মাথায় ভোঁ-চক্কর লেগে গেছে। আমার দিগবিদিক গুলিয়ে গেছে। নীচে না নামলে কিছুই চিনতে পারছি না।’

বেশ তাই হোক। আগে নীচেই নামা যাক।

আবার তেমনি করে বর-বাঁদর গাছের ডালে ল্যাজ জড়িয়ে, কনে-বাঁদরের ঠ্যাং ধরে ঝুলে পড়ল। কনে-বাঁদর হুল্লোর ল্যাজ ধরল। তারপর হুপ্পো ছাগলের ঠ্যাং ধরে যেই লাফ মেরেছে, তখন এক ভীষণ কাণ্ড! হয়েছে কী, হুপ্পো লাফ মারতেই বর আর কনে-বাঁদরের ল্যাজে এমন হ্যাঁচকা লেগেছে যে, ব্যস! গেছে ফস করে গাছের ডাল ফসকে! হুড়মুড় দুড়মুড়!

ঠিক সেই সময় গাছের নীচ দিয়ে যাচ্ছিল একটা পুলিশ। এই দেখো! কেউ দেখতেই পায়নি! অমন যে হুপ্পো, অত সাবধানী সে-ও মশাই নজর করেনি! করলেই বা কী! পুলিশ তো আর আগের থেকে জানান দিয়ে আসেনি। পাহারা দিতে দিতে হঠাৎ এসে পড়লে কে আর কী করবে! পুলিশকেও বলি, তোমারও কি বাবা যাবার সময় ছিল না? ছাগল পড়বি তো পড় ঠ্যাং ফসকে তার ঘাড়ে। পুলিশের ঘাড়ে ছাগল, ছাগলের পিঠে হুল্লো, হুপ্পোর ধড়ে বর আর কনে-বাঁদর। ওঃ সে কী জগাখিচুড়ি কাণ্ড!

একটা ছাগল আর তিনটে বাঁদরের আচমকা ধাক্কা পুলিশ কখনও সহ্য করতে পারে? ধড়াদ্ধড় যেই তার ঘাড়ে পড়েছে, পুলিশও ধপাস-ধপ করে মাটিতে ছিটকে গেছে। কিন্তু পুলিশ তো! ভীষণ চালাক। পড়ে গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে মার ছুট! কীরে বাবা! গাছের ওপর ভূত নাকি!

এদিকে বর আর কনে-বাঁদরটা ব্যাপারটা যে কী ঘটল ভালো করে বোঝার আগেই তিড়িং মিড়িং লাফিয়ে উঠেছে। সাঁই সাঁই করে আবার গাছের ডালে ঝুলে পড়েছে!

ওঃ! লেগেছে ছাগলটার! তেমনি ভয়ও পেয়েছে। ভয় পেয়ে এমন ব্যা-ব্যা করে চিৎকার শুরু করে দিল যে, ওকে সামলাতেই হুগো হিমসিম। হুল্পোর তো আর চোখ এড়ায় না। কিছু। ওরা যে পুলিশের ঘাড়ে পড়েছে, সেটা স্পষ্ট দেখেছে সে। এইবারই বিপদ! পুলিশের ঘাড়ে পড়া মানেই, হাতকড়া! কিন্তু ছাগলটাকে তো আগে সামলাতে হয়! তাই তাড়াতাড়ি ছাগলের মুখে হাত চেপে হুগো চাপা-গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘চেঁচিও না, পুলিশ!’

‘পুলিশ!’ নাম শুনেই তো ছাগলের চক্ষু কপালে! ‘বাপরে’ বলে, আঁৎকে উঠে মারল ছুট! কিন্তু ছুটতে গিয়ে কীসে যেন ঠোক্কর খেল ছাগলটা! টকাস! একটা বাঁশি! এইরে! এটা যে পুলিশের বাঁশি! ধাক্কাধাক্কিতে নিশ্চয়ই পড়ে গেছে। হুপ্পো ঝপ করে বাঁশিটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে, বর আর কনে-বাঁদরকে ডেকে বলল, ‘এখান থেকে পালিয়ে চল। নইলে বিপদ।’

কিন্তু বর আর কনে ভয়ে জুজুবুড়ি। নামতেই চায় না।

ওরাও নামবে না, ছাগলটাও থামবে না। এমন বিটকেল চ্যাঁচাচ্ছে, বিপদ ঘটতে আর দেরি নেই। এত ভয় পেলে চলে! ছাগলগুলো এমনিতেই একটু ভীতু। কিন্তু চ্যাঁচালেই কি ভয় কাটবে! তখন তো আরও বিপদ হাজির হবে!

বলতে বলতেই বিপদ হাজির। হুপ্পো আগেই জানত, পুলিশটা আবার এখানে হাজির হবে। তাই কানটাকে ও খাড়াই রেখেছিল। হুট করে একটু আওয়াজ হতেই চেয়ে দেখে, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সেই পুলিশটা এইদিকেই আসছে গুটিগুটি! হুপ্পোও নিঃসাড়ে গাছে উঠে পড়েছে। কী কায়দা! টুক কি টাক একটুও শব্দ হল না। কিন্তু ছাগলটা কী প্যানপ্যানে দেখো! থাম না। নইলে শ্রীঘরে যেতে হবে যে!

কে কার কথা শোনে!

আসলে কিন্তু পুলিশটার যত ভয়, তার চেয়ে ভাবনা বেশি। বাঁশিটা যে হারিয়ে গেছে! তাই গুটিগুটি এসে টর্চটা চট করে জ্বেলে জায়গাটা খুঁজতে লাগল। ছাগলটা তখনও চেঁচাচ্ছে। চুপ করবি তো! কী বোকারাম দেখো। এক্ষুনি দেখতে পেলে–!

দেখতে তো পাবেই। একটা ছাগল যদি হরবকত ব্যা-ব্যা করে হাঁক পাড়ে তবে লোকের মনে সন্দেহ হবে না? তার ওপর পুলিশ বলে কথা। সব সময় সাবধানী।

পুলিশসাহেব সত্যি-সত্যিই বাঁশি খুঁজতে খুঁজতে টর্চের আলো ছাগলের গায়েই ফেলেছে! ছাগলমহারাজ আলো দেখে দিশেহারা! পুলিশসাহেব ছাগল দেখে ভ্যাবাচাকা! তখনই যেন হঠাৎ পুলিশসাহেবের মনে হল, আরে, এই ছাগলটাই তো তার ঘাড়ে পড়েছিল! হ্যাঁ, বটেই তো! তা গাছ থেকে ছাগল পড়ে কেমন করে! ধরতে হয় তো ছাগলটাকে!

ছাগলটাও যেই না দেখেছে পুলিশ তার দিকেই আসছে, অমনি ছুট।

পুলিশও এই ধরি, এই ধরি, করে হাত বাড়িয়ে সেদিকে যেতেই ছাগলও যেমন করে। কিতকিত খেলে, তেমনি ভড়কি দিয়ে প্যাঁচ মারতে লাগল। কিন্তু যতই হোক পুলিশকে প্যাঁচ মেরে কাত করা তো আর ছাগলের কম্ম নয়! অগত্যা ধরা পড়ে গেল!

ব্যাপারটা কতটা গড়ায়, গাছের ওপর থেকে হুপ্পো এতক্ষণ চুপটি করে সেইটাই দেখছিল। ওর আগেই জানা, ছাগলটা নির্ঘাৎ ধরা পড়বে। তবু একটু একটু আশা করছিল যদি পালাতে পারে। কিন্তু শেষ অবধি যখন পারলই না, পুলিশের হাতের মুঠোয় কানটা তার টনটনিয়ে টান খাচ্ছে, তখন হুপ্পো করল কী, ওই গাছের ওপর থেকেই পুলিশের বাঁশিটা বাজিয়ে দিয়েছে, পি-পি-ই-ই!

একদম থমকে গেছে পুলিশটা। চমকে সামনে তাকাতেই ছাগলটা ফাঁক বুঝে শিং দিয়ে তড়াং করে মেরেছে পুলিশের পেটে এক গোঁত্তা। অমনি পুলিশের হাত থেকে কানটা গেছে ফসকে। সেই তক্কে ছাগলও মার ছুট।

উ! পুলিশকে ঠকানো যদি অতই সোজা হত! কেউ যে গাছের ওপর থেকেই বাঁশি বাজাচ্ছে, এটা একটা বাচ্ছা ছেলেও বলে দিতে পারে! তাই পুলিশসাহেব ছাগলের পিছু না ছুটে গাছের ওপরই টর্চের আলো ফেলল। আর এমনই ভাগ্য, আলো পড়বি তো পড় সিধে বর আর কনে-বাঁদরের মুখের ওপর। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে গেছে। বাঁদর দুটো সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেছে। বোকার মতো গাছ থেকে লাফ মেরে সটান দৌড়!

ইস! ছি ছি ছি কী কাণ্ড দেখো। হুপ্পোর সমস্ত মতলবটা ভেস্তে দিল। ও ভেবেছিল পুলিশকে ভূতের ভয় দেখাবে, আর মধ্যিখান থেকে এমন একটা বে-আক্কেলে কাণ্ড করে বসল বর আর কনে-বাঁদর! তবে পুলিশও একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। কেননা, একটু আগে এই গাছ থেকে তার ঘাড়ে ছাগল পড়ল। এখন আবার সেই গাছ থেকে দুটো বাঁদর লাফাল! কী ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার! গোলমেলে ব্যাপার মানেই রহস্য!

ছাড়বার পাত্তর পুলিশও নয়। ছাগল আর বাঁদর দুটোর মধ্যে যখন একটা রহস্যের গন্ধ পাওয়া গেছে, তখন বাঁদর দুটোকে ধরতেই হবে। তাই চোখ-কান বুজে বাঁদর দুটোর। পেছনে তাড়া লাগাল।

বাঁদর ধরা অতই সোজা! এমন এদিক ওদিক, এ-চাল, ও-চাল ডিঙিয়ে মার-ছুট দেবে, কার সাধ্যি তাদের নাগাল পায়। তবু বলা যায় না। ফস করে ধরা পড়ে গেলে!

ভাগ্য বলতে হয় হুপ্পোর। পুলিশসাহেব ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি, এই গাছের ওপর, তারই বাঁশি হাতে হুপ্পো নামে আর একটি রহস্য চুপটি করে বসে আছে। এখন পুলিশকে বর আর কনে-বাঁদরের পেছনে ছুটতে দেখে, হুপ্পোও তরতরিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ল। বাঁশিটা বাজিয়ে দিল, পি-পি-ই-ই।

পুলিশ ছুটছিল সামনে-মুখো, বাঁশি বাজল উলটো-মুখো। থমকে গেল। ছুটতে ছুটতে ঝপ করে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দাঁড়াতে না দাঁড়াতে বাঁদর দুটোও হাওয়া। হাওয়া বলে হাওয়া। একেবারে ম্যাজিক! হুস করে উবে গেল। একেই বলে প্রাণের ভয়!

ভয় কিন্তু হুপ্পোর একদম নেই। ও তো জানে, পুলিশ তাকে যতই চেষ্টা করুক, কিছুতেই পাকড়াও করতে পারবে না। কিন্তু মজা কী জানো? ছাগলটা এই তক্কে কোথায় কেটে পড়েছে। তার আর সাড়াও নেই, শব্দও নেই। যাঃ বাবা! বাঁশির কত গুণ বলো? বাজিয়ে দিতেই ছাগলটা পার পেয়ে গেল, বাঁদর দুটোও মার খেতে খেতে বেঁচে গেল। এখন দেখো হুল্লোর কী হয়!

বাঁশি হাতে হুল্লোকে পেছন ফিরে দেখতে পেয়েই, পুলিশ বর-কনেকে ছেড়ে হুপ্পোকে তেড়ে এল। হুপ্পো সুট করে, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে, লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে পড়লেও পুলিশ অত সহজে ছাড়বে না। টর্চের আলো ফেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল হুপ্পোকে।

রাত্তিরবেলা তো প্রায়ই এ-রাস্তা ও-রাস্তা দিয়ে পুলিশের কালো কালো গাড়িগুলো আলো জ্বেলে ছোটাছুটি করে। ওদের কাজই হচ্ছে, চোর-ডাকাতের হাত থেকে শহরকে রক্ষা করা। এমনই বরাত ঠিক সেই সময় হুস-স-স-স-স করে একটা পুলিশের গাড়ি সেখানেই হাজির। টর্চ হাতে একজন পুলিশকে এ-ধার ওধার ছোটাছুটি করতে দেখে গাড়ি ক্যাঁচ-চ-চ করে থেমে গেল। গাড়ি ভরতি পুলিশ। তাদের হাতে বন্দুক। বন্দুকধারী পুলিশরা সব খট খট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে ব্যাপারটা জেনে নিল। নিয়ে, এদিক-ওদিক তল্লাশি চালাতে লাগল।

হুপ্পোকে ধরা অত সহজ নয়! এমন একটি জায়গায় সে ঘাঁটি গেড়েছে, সেখানে আর কাউকে টেরটি পেতে হচ্ছে না! কিন্তু একবার যদি কেউ নজর করে ফেলে, তাহলে আর নিস্তার নেই। পুলিশের হাতে বন্দুক। গুড়ুম করে একবার চালালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে হুল্লোর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে!

তবে, ওর বড্ড ইচ্ছে পুলিশের সঙ্গে একটু মজা করে। ইচ্ছে হল, এই লুকনো জায়গাটা থেকে বাঁশিটা আর একবার বাজিয়ে দেয়। কিন্তু, এত দুঃসাহস ভালো নয়। না, দুঃসাহসের কথা নয়। ওর মতলব হচ্ছে, বাঁশিটা এদিকে বাজিয়ে দিয়ে, চটপট ওদিকে পালাবে, পুলিশেরা ওকে এদিকে খুঁজবে। ও তখন ওই দিক দিয়ে পগারপার! বর আর কনে-বাঁদর দুটোকে তো খুঁজে বার করতে হরে!

পুলিশের বুটজুতো খটখট করে রাস্তার ওপর পড়ছে। ওরা হুল্লোকে খুঁজছে। অনেকক্ষণ খুঁজেও কিন্তু হুল্লোকে ওরা দেখতে পেল না। যখন দেখল, কেউ কোথাও নেই এদিকে, তখন তারা আবার গাড়িতে উঠে পড়ল। ভাবল, আসামি ভাগলবা! গাড়ি যেই ছাড়ব-ছাড়ব হয়েছে, তখন হুপ্পো সত্যি সত্যি আর একবার বাঁশিটা বাজিয়ে দিয়েছে, পি-পি-ই-ই।

এই দেখো, গাড়ি ছাড়তে ছাড়তেও ছাড়ল না। পুলিশরা গাড়িতে বসতে বসতেও বসল না। ঝটপট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়তেই হুপ্পোকে দেখে ফেলেছে। হুপ্পো এদিক থেকে। ওদিকে একেবারে তিরের মতো লাফ দিয়ে পালাচ্ছিল। অমনি পুলিশ-কর্তা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ফায়ার!’

গুড়ুম! বন্দুক গর্জে উঠল।

তারপর ধুপ করে একটা আওয়াজ। তারপর সব ঠান্ডা!

দেখতে পেয়েছিল একজন পুলিশ। হুপ্পো ধুপ করে লাফ দিয়ে একটা ঝোপ মতো জায়গায় লুকিয়ে পড়েছে। তাহলে বন্দুকের গুলি তার গায়ে লাগেনি? অন্ধকারে হয়তো তাক ঠিক। হয়নি। কিন্তু একজন পুলিশ যে তাকে দেখতে পেয়েছে, এটা হুপ্পো আগেই সন্দেহ করেছে। ওঃ! বলব কী, ও একেবারে নিমেষের মধ্যে মেরেছে লাফ। লাফ দিয়েই মার ছুট।

অমনি পুলিশগাড়ির সাইরেন বেজে উঠল, উ-উ-উ-উ, ঊ-উ-উ-উঁ। গাড়ি হুল্লোর পিছু তাড়া লাগিয়ে ছুটল। হুপ্পো ভাবল, এবার মরণ! কারণ পুলিশের গাড়ির সঙ্গে ও ছুটে পারবে। কেন? তাও যদি এখন রাস্তায় গাড়িঘোড়ার জট পাকানো থাকত, তাহলে এক কথা ছিল। এই রাত্তিরবেলা রাস্তা ফাঁকা। হু-হুঁ শব্দে গাড়ি ছুটছে। বন্দুকের নল তাক করে তার দিকে সকলে চেয়ে আছে। একটু বেকায়দায় দেখলেই, গুড়ুম! ওদের গুলি হুল্লোর বুকে এসে। লাগবে।

হুপ্পো দেখল, আর কোনো উপায় নেই। এবার নির্ঘাৎ ধরা পড়বে। তাই আর ছোটাছুটি করে কোনো লাভ আছে বলে মনে হল না। হাঁপিয়ে পড়েছে, পা-ও আর চলছে না। তাই ভাবল, বাঁশিটা পুলিশের গাড়ির দিকে ছুঁড়ে ফেরত দিয়ে দেয়।

হয়তো ছুঁড়েই সে দিত। কিন্তু মাথায় হঠাৎ আবার কী খেলে গেল! ধাঁই করে একটা ডিগবাজি মেরে, সে যে আবার উলটো দিকে ছুটবে, সেটা তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বাঁদরকে হঠাৎ উলটোদিকে ছুটতে দেখে, গাড়িও ক্যাঁ-চ-চ। ব্রেক কষল। থেমে গেল। থেমে পিছন ফিরে গাড়ি যতক্ষণে ঘুরবে, ততক্ষণে হুপ্পো হাওয়া। হুগো দেখল, এখন এ-যাত্রা নিস্তার পেয়েছি, তখন আর বাইরে থাকা নয়। কারো ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ি। তা হলে পুলিশ টেরই পাবে না।

আর সত্যি সত্যিই ও একটা ঘরের মধ্যেই ঢুকে পড়ল।

কিন্তু কার ঘর এটা?

গাধার নাম গোবর্ধন আর একটা বাঘ

কিন্তু ঘরে ঢুকতে গিয়ে যে সে একটা গাধার ঘরে সেঁদিয়ে পড়বে, তা হুপ্পো নিজেও জানত না। আসলে কী, কেউ বিপদে পড়লে তাকে বাঁচতে তো হবে। বাঁচতে গিয়ে আগুপিছু ভাববার বুদ্ধি থাকে তখন?

গাধাটাকে প্রথমে দেখতে পায়নি হুপ্পো। কিন্তু গাধাটা হুল্লোকে দেখে ফেলেছে ঠিক। যতই হোক নিজের আস্তানায় বাইরের কেউ ঢুকে পড়লে টের পেতে সময় লাগে!

‘কে হ্যা?’ গাধার গলাটা যেমন ঘ্যানঘ্যানে, তেমনি হেঁড়ে।

আচমকা গাধার ডাক শুনে হুপ্পোর পিলে চমকে উঠেছে। যাঃ বাবা! যা-ও বা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে লুকাল, এখানেও স্বস্তি নেই!

কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে গাধাটা আবার হেঁকড়ে উঠল, ‘কে?’

হুপ্পো ঘাবড়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে ফেলল, ‘আমি।’

‘আমি তো আপনাকে চিনি না!

‘আমিও আপনাকে চিনি না,’ হুপ্পো উত্তর দিল।

‘কেন, আমার ন্যাজ নেই? কেন, আমার কান নেই? কেন, আমার ঠ্যাং নেই?’

 ‘কেন থাকবে না। আমি অন্ধকারে ঠাওর করতে পারছি না।’

‘এই বয়েসেই চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস? আমি তো তোকে ঠাওর করতে পারছি। তুই বাঁদর না?’

‘আমি হুপ্পো।’

‘ওই হল। যার নাম বাঁদর, তারই নাম হুল্লো।’

হঠাৎ হুপ্পো চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও, আমিও আপনাকে ঠাওর করে ফেলেছি। আপনি একটা বেঁটে ঘোড়া না?’

অমনি গাধাটা ‘চোপ’ বলে দাবড়ি দিল। ‘কার ছাউলরে তুই? আমাকে ঘোড়া বলছিস! আমি গাধা। আমার নাম গোবর্ধন।’

‘ওমা!’ হুপ্পো অবাক হয়ে গেল। ‘ঝুমকিদের বাড়িতে যে দুধ দেয়, তার নাম তো গোবর্ধন! মানুষের যা নাম আপনারও তাই নাম?’

‘নাম কী কারো একার কেনা? মানুষের নাম গোবর্ধন হলে, গাধার কেন হতে পারে না রে?

‘কেন পারবে না! তবে গাধার তো আর মানুষের মতো বুদ্ধি নেই!’

গাধাটা আবার ধমকে উঠল, ‘চোপ! বুদ্ধির তুই কী জানিস রে? কালকের ছেলে, গলা টিপলে দুধ বেরোয়! জানিস, আমি সাইকিল চালাতে পারি।’ গাধাটা আবার সাইকেলকে সাইকিল বলে।

সঙ্গে সঙ্গে হুপ্পো উৎসাহে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি? সত্যি?’

‘তুমি আমার কে একেবারে এক কেলাসের বন্ধু যে, তোমার সঙ্গে মিথ্যে মিথ্যে ইয়ার্কি করব!’

‘ক-চাকার সাইকিল চালান আপনি?’

‘দু-চাকার।’

‘আমায় শিখিয়ে দেবেন?’

‘পারবি না,’ গম্ভীর গলায় গাধা উত্তর দিল।

হুপ্পো বলল, ‘কেন পারব না? আপনি যদি পারেন, আমিও পারব।’

‘চোপ! আমার সঙ্গে তুই নিজের তুলনা করিস! আমার ক্ষেমতা আর তোর ক্ষেমতা! আমারই শিখতে বছরখানেক লেগে গেছে। তোর তো শিখতে শিখতে জীবন কেটে যাবে!’

হুপ্পো বলল, ‘জানেন, সাইকিল, কিংবা ধরুন ট্রামগাড়ি, ডবল-ডেকার বাস, মোটর সাইকিল মানে এককথায়, গাড়ির ড্রাইভার হবার আমার খুব শখ। আজকাল রাস্তায় আবার মিনিবাস বেরিয়েছে, কী সুন্দর দেখতে লাগে বলুন!’

গাধা জিজ্ঞেস করল, ‘এরোপ্লেন চালাতে ইচ্ছে করে না?

‘খুব। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, আমি তো আকাশে উড়তে পারি না।’

 ‘এরোপ্লেন চালাতে গেলে, আকাশে উড়বি কেন?’

‘এরোপ্লেন তো আকাশ দিয়ে উড়ে যায়! কিন্তু আমি যতটা লাফাতে পারি, তার চেয়ে অনেক উঁচু দিয়ে তো এরোপ্লেন যায়! উড়তে না পারলে, ধরব কী করে?’

গাধাটা এবার বিকট চিৎকার করে হেসে উঠল, ‘হো-হো-হো।’ হাসতে হাসতে বলল, ‘দুর বোকা, এরোপ্লেন ধরতে উড়তে হবে কেন? জায়গায় জায়গায় ইস্টিশান আছে। এই যেমন, তোকে এখানে এরোপ্লেন ধরতে গেলে দমদম যেতে হবে!’

হুপ্পো বলল, ‘দমদম!’ বলেই হেসে ফেলল।

‘হাসছিস কেন?’

‘বেড়ে নামটা।’

‘কেন, এর আগে শুনিসনি?’

হুপ্পো বলল, ‘না তো!’

‘তুই বুঝি খবরের কাগজ পড়িস না? খবরের কাগজে তো রোজই বেরোয় দমদম বিমানবন্দরের কথা। অমুক দেশের রানি দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করে দু-ঘন্টা বিশ্রাম নিয়েছেন। কিংবা অমুক দেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করেছেন।’

হুপ্পো গাধার কথা শুনে, নিজে কোনো কথাই বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

গাধাটা এবার মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললে, ‘তোকে এবার কাত করে দিয়েছি। নিশ্চয়ই ওই বিমানবন্দর মানেটা তুই বুঝিসনি। আরে, ওর মানে হল এরোপ্লেনের ইস্টিশান। ইংরিজিতে বলে, এরোড্রাম।’

‘আপনি বুঝি ইংরিজিও জানেন?’ জিজ্ঞেস করল হুপ্পো।

গাধাটা উত্তর না দিয়ে খালি তাচ্ছিল্যের সুরে এমন ‘হে-হে’ করে সাড়া দিল, যার মানে ফুঃ! ইংরিজি তো আঙুলের টুসকি!

‘আপনি রোজ খবরের কাগজ পড়েন?

‘নইলে আমার এত জ্ঞান হয়! দেখবি ইংরিজিতে একটা পদ্য বলব! আমার মুখস্থ জলবৎ তরলং

‘চিক চিক চ্যাং চ্যাং দ্যাট ম্যান ফ্যাট

চুং চুং ফিং ফিং ক্যাচ ক্যাচ র‍্যাট!’

‘বাবা, আপনি তো তাহলে সাহেবগাধা। আপনার তো বিলিতি-গাধানির সঙ্গে বিয়ে হওয়া উচিত।’

গাধার মুখটা হঠাৎ কেমন দুঃখ দুঃখ হয়ে মিইয়ে গেল। ধরা-ধরা গলায় বলল, ‘বিয়ে তো আমার বিলিতি-গাধানির সঙ্গেই হত। সেবার যখন বিলেতে গেছলুম, কথাবার্তা তো প্রায় পাকাই হয়ে গিছল। কিন্তু হঠাৎ বিলেত থেকে ফিরতে হল। সামনে কোনো বিয়ের দিনও ছিল না। অগত্যা বিয়েও হল না।’

হুপ্পো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি বিলেতেও গেছেন?

‘যাব না? বিলেত কেন, সারা দুনিয়াটাই আমি ঘুরে এসেছি। সারা দুনিয়াতেই আমাদের খেলা দেখিয়ে বেড়াতে হয়! দি গ্রেট সার্কাস অফ দি ওয়ার্লড-এর আমি ওয়ান্ডার অ্যাস, মানে আজব গাধা।’

সার্কাস নামটা শুনেই হুল্লোর শরীর শিউরে উঠেছে। ওমা! ও এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি যে, ও একটা সার্কাসের তাঁবুর ভেতর, গাধার ঘরে ঢুকে পড়েছে। তাই আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা সার্কাস পার্টি?’

গাধা বলল, ‘এতক্ষণ তুই কী চোখে ঠুলি খুঁজেছিলি?”

‘না, মানে হঠাৎ ঢুকে পড়েছি তো!’

‘আয়, দেখবি আয়,’ বলে গাধাটা হুপ্পোকে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল।

বাইরে বেরিয়ে হুপ্পো দেখল কী, দুটো হাতি দাঁড়িয়ে। আরও একটু দূরে খাঁচার ভেতর বাঘ। চারটে জেব্রা। একটা শিম্পাঞ্জি, দুটো গন্ডার, একটা ভাল্লুক।

গাধা হুল্লোকে সাবধান করল, ‘কথা কও না। ওরা দেখতে পেলে চ্যাঁচামেচি করবে। চুপচাপ চলে এসো।’

হুল্লোকে কথা কইতে হল না। কিন্তু যিনি কইবার, তিনি ঠিকই কইলেন। বাঘের চোখকে ফাঁকি দেওয়া ভারি মুশকিল। ঠিক দেখতে পেয়েছে! বাঘ ডাকল, ‘কী রে গোবর্ধন, বাঁদরটা কোত্থেকে এল রে?’

গোবর্ধন মানে গাধাটা চমকে উঠে বলল, ‘দাদা, আপনি এখনও ঘুমোননি?’

বাঘ বলল, ‘ক-দিন ধরে অনিদ্রায় ভুগছি। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। তা ওটি কে?নতুন এল? খেলা দেখাবে নাকি?’

“আজ্ঞে না দাদা। আমার সাইকিল খেলা দেখবে।’

 ‘খেলা দেখাবি যে, টিকিট কেটেছে?’

‘আজ্ঞে ও তো বাঁদর।’

‘দেখি, আমার কাছে নিয়ে আয় দিকি।’

হুপ্পোর তো মুখ শুকিয়ে এইটুকু!

গাধা সাহস দিয়ে বলল, ‘ছর বোকা, কোনো ভয় নেই।’

হুপ্পো জানে, ভরসাও কিছু নেই। বাঘ মানে যে কী, সেটা কে না জানে! তবু তার সাহস এই যে, বাঘটা খাঁচার মধ্যে বন্দি। তাই গুটিগুটি বাঘের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বাঘ হুল্লোকে দেখে হেসে উঠল। বাঘ হাসতে হাসতে বলল, ‘এই খোকা, কোথায় থাকিস?’

খোকা বলতে, হুপ্পোর পা থেকে মাথা অবধি অপমানে জ্বলে গেল। বাঘ, বাঘ হতে পারে, কিন্তু তাকে এমন তাচ্ছিল্য করে খোকা বলবে, এটা কেমন ভদ্রতা! বাঘের সামনে সে রাগ দেখাতেও পারত। রাগ দেখালে বাঘ যে এখন তার কিছুই করতে পারবে না, সেটাও হুপ্পো জানত। কারণ বাঘ তো আর খাঁচা ভেঙে বাইরে আসতে পারছে না। কিন্তু হুপ্পো ভাবল, না, খুঁচিয়ে কোনো লাভ নেই। এখন, অন্তত রাতটা না গড়ানো পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে। বাইরে পুলিশ। হাতে তার পুলিশের বাঁশি। পুলিশ বাইরে তাকে হয়তো এখনও খুঁজছে। এখানে লুকিয়ে থাকলে পুলিশের সাধ্যি কী তাকে খুঁজে বার করে। তা ছাড়া হুপ্পোর মনে মনে ইচ্ছে, একবার যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে গাধার কাছ থেকে সাইকিল। চালানোটা শিখে ফেলতে পারে। তাই খুব লক্ষ্মীছেলের মতোহুপ্পো বলল, ‘আমার বাড়ি তো ঝুমকিদের বাড়িতে। আমি হারিয়ে গেছি।’

বাঘ জিজ্ঞেস করল, ‘ঝুমকি?ঝুমকি বুঝি মানুষ?

হুপ্পো বলল, ‘মেয়েমানুষ।’

‘ছোটো।’

‘ছোটো ছোটো মেয়েমানুষগুলো ভয়ানক ভীতু!’

হুপ্পো উত্তর দিল, ‘না, না। ঝুমকি কিন্তু একটুও ভীতু নয়। ভীষণ সাহসী। একবার মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে, একটুও কাঁদেনি। তবে মা ঝুমকিকে খুব একটা বকেও না।’

বাঘ বলল, ‘আমার কাছে নিয়ে আয় না একবার, দেখি মেয়ের আস্পর্ধা কত! এমন ধমক মারব চোখ কপালে উঠে যাবে!’

হুপ্পো বলল, ‘ধ্যাৎ, তাই হয় নাকি। আমিই আপনাকে দেখে ভয় পাচ্ছি না, তো ঝুমকি আপনার ধমক শুনে ভয় পাবে। ফুঃ!’ অমনি সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেছে বাঘটা। রেগে এমন ‘হালুম’ করে গর্জে উঠল যে, সমস্ত সার্কাস-পাড়াটা কেঁপে উঠল

হুপ্পোর বয়েই গেছে। হুপ্পো বাঘের ডাক শুনে হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, ‘আপনার তো ভয়ানক গলার জোর।’

বাঘটা আরও খেপে গেল। একেবারে অগ্নিশর্মা! চেঁচিয়ে উঠল, ‘তোর বাঁদরের নিকুচি করেছে। বড়োদের সঙ্গে ফাজলামি!’ বলে খাঁচার গায়ে থাবা দিয়ে এমন আচড় মারতে লাগল, মনে হল এক্ষুনি খাঁচা ভেঙে বুঝি বেরিয়ে পড়বে! গাধাটা সঙ্গে সঙ্গে হুল্লোকে ঠেলা মেরে বলল, ‘চ, চ পালিয়ে চ। দিলি তো খেপিয়ে!’ বলে গাধা বাঁদরকে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।

বাঘ ‘খাঁউ খ্যাঁউ’ করে গজরাতে গজরাতে মুখ বেঁকিয়ে সেদিকে চেয়ে রইল।

হুপ্পো বলল, ‘আমি তো কিছুই বললুম না। অমন হুট করে রেগে গেল কেন বাঘটা? আমি বাবু, কারো খোশামুদি করতে পারি না। সে বাঘই হোক, আর যেই হোক!’

গাধা উত্তর দিল, ‘আমারও বাপু কারো খোশামোদ করা ধাতে সয় না। আমাকেও বাঘটা একবার খ্যাঁক-খ্যাঁক করে যা-তা বলেছিল। হাতিটা কিন্তু খিটখিটে নয়, যাবি?’

হুপ্পো বললে, ‘না, আর দরকার নেই বাবা! যা নমুনা। তার চেয়ে চলুন সাইকিল চড়ব।’

‘শখ যখন এতই,’ তখন গাধা বললে, ‘তাহলে আয়।’

যে-ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল, সাইকেলটা সেখানেই ছিল। সাইকেলটা টেনে এনে গাধা জিজ্ঞেস করল, ‘আমি চালাব, না তুই চড়বি?’

হুপ্পো বললে, ‘আগে আপনি একটু চালান দেখি।’

গাধা তিড়িং করে সাইকেলের ওপর চেপে পড়ে, কিড়িং কিড়িং করে ঘন্টা বাজাতে শুরু করে দিল। হুপ্পো প্রথমটা হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। তারপর হাতের বাঁশিটা মুখে। পুরে, পি-পি করে বাজিয়ে দিলে। সামনের জায়গাটা ফাঁকা। বেশ নিঝঞ্ঝাটে সাইকেল চেপে ঘুরপাক খাওয়া যায়! বাঁশির আওয়াজ শুনেই গাধাটা থেমে, সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। জিজ্ঞেস করল, ‘বাঁশি পেলি কোথা?’

হুপ্পো থতমত খেয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘এই–আমার।’

‘বাঁশিটা আমার কাছে দে। এবার তুই চাপ।’

হুপ্পো বাঁশিটা গাধার হাতে দিয়ে, সাইকেলের গায়ে একটু হাত বুলিয়ে বলল, ‘আপনি একটু ধরুন। নইলে উঠব কী করে?’

গাধা সাইকেলটা ধরে বলল, ‘বেশ চড়, আমি ধরেছি।’

হুগো তো আর কোনোদিন সাইকেল চড়েনি। কিন্তু দেখেছে তো অনেককে। তাই। সাইকেলের সিটে বসে, হ্যাঁন্ডেল দুটো ধরে, সামনে হেলে, গাধাকে বলল, ‘এবার একটু ঠেলে চালিয়ে দিন।

গাধা জিজ্ঞেস করল, ‘পারবি? পড়ে যাবি না তো?’

হুপ্পো উত্তর দিল, ‘না, না।’

গাধা তখন দিল এক ঠেলা। ব্যাস! হুপ্পো সাইকেলফাইকেল নিয়ে, একেবারে দুম-ফটাস! হুপ্পোটা সাইকেলের ঘাড়ে পড়ল, না সাইকেলটা হুল্লোর ঘাড়ে চাপল, সেটা তো বোঝাই গেল না। কিন্তু এদিকে যে হাতিটা, ঘোড়াটা, বাঘটা, ভাল্লুকটা হুল্লোর কাণ্ডটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল, সেটাহুপ্পো বুঝতেই পারেনি। তাই সাইকেল থেকে পড়ে চিৎপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব কটা এমন হো হো করে চেঁচিয়ে হেসে উঠল যে কী বলব! হুল্লোর তো ভীষণ লেগেছে। তার ওপর হঠাৎ সব কটার হাসি শুনে লজ্জায় মরে যায়! বাঘটা তো হাসবেই। কিন্তু আর গুলোও যে উঁচিয়ে ছিল, এটা কে জানত বাবা!

গাধা ছুটে গিয়ে হুপ্পোকে টেনে তুললে। বলল, ‘বললুম পারবি না। লেগেছে?

হুপ্পো ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বললে, ‘একটু।’

গাধা জিজ্ঞেস করল, ‘কোনখানটায় লাগল?’

হুপ্পো ঠ্যাং দেখিয়ে বলল, ‘এইখানটায়।’ বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাধার কাঁধ ধরে বললে, ‘একটু বসব।’

গাধা বললে, ‘চ’, বলে হুপ্পোকে ধরে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে চলল।

গাধার ঘরে যেতে হলে, বাঘের খাঁচার সামনে দিয়েই যেতে হবে। বাঘ হুল্লোর অবস্থা দেখে হেসে-গড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘খোঁড়া ল্যাং, ল্যাং–’

হুগো এবার সত্যি-সত্যি রেগে গেল। বাঘকে বলল, ‘আপনার মশাই, মানসম্মান জ্ঞান নেই। একটা বাঁদরের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন! আপনি তো আচ্ছা চ্যাংড়া!’

বাঘ তো রেগে কাঁই। একটা কিনা পুঁচকে বাঁদর তাকে চ্যাংড়া বললে। রেগে ধাঁই ধপাধপ নাচানাচি শুরু করে দিয়ে গর্জন করে বলে উঠল, ‘এই ল্যাংড়া, আয় তোকে ঠ্যাঙাই!’

ঠেঙাবে কী, ততক্ষণে হুপ্পো গাধার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর আ-উ করছে। থেকে থেকে বাঘের গর্জন শুনছে। শুনতে শুনতে গাধাকে বলল, ‘গোবর্ধনকাকু, আমার বাঁশি?

কাকু বললে, ‘এই তো।’ বাঁশি নিয়ে, বাঘের গর্জন শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল হুপ্পো, বুঝতেই পারল না।