1 of 2

মাশুল

মাশুল

সম্পর্কে জোটন বিবি আবেদালীর দিদি হয়। কিছুদিন পূর্বে পর্যন্ত জোটন বিবি ছিল, এখন বেওয়া হয়েছে। জোটনের সব সমেত তিনবার নিকাহ। তালাক অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর জোটন প্রতিবার আবেদালীর কাছে চলে আসে। আবেদালী তখন লতা এবং খড়ের সাহায্যে উত্তর দুয়ারী ছোট্ট খুপরি ঘরটা তুলে দেয়-এই পর্যন্ত আবেদালীর সঙ্গে সম্পর্ক। তারপর কিছুদিন ধরে জোটনের জীবন-সংগ্রাম, ধান ভেনে দেওয়া, চিড়া কুটে দেওয়া পাড়াপ্রতিবেশীদের এবং যখন বর্ষাকাল শেষ হয়, যখন হিন্দু গৃহস্থ ঘরে পূজা-পার্বণ শেষ, তখন জোটন গ্রামের অনেক দুঃখী ইমানদারদের সঙ্গে ভাতের হাঁড়িটা ধুয়ে-পাকলে জলে নেমে পড়ে, এবং সকল পাটখেত চষে বেড়াতে থাকে শালুকের জন্য। শালুক শেষ হলে আবেদালীর কাছে নালিশ—দ্যাশে কি পুরুষমানুষ নাইরে আবেদালী?

সেই জোটন সোলার ছোট্ট ঝাঁপটা টেনে ঘর থেকে মুখ বার করল। এখনো ভোর হয়নি, সারারাত জোটনের চোখে ঘুম নেই। মসজিদে সামুর বাপ আজান দিচ্ছে, জোটন ঘরে বসে অন্ধকারে ছেড়া হোগলা এবং ছেড়া কাঁথাটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে দিল। অন্ধকার কাটছে না, সুতরাং ঘরের আসবাবপত্র অস্পষ্ট শিকাতে দুটো হাঁড়ি, দুটো সরা—দুদিন থেকে জোটনের ভাত নেই, দুদিন ধরে জোটন শালুক সিদ্ধ করে খাচ্ছে। জোটন সরা তুলে হাত দিল এবং অনুভব করতে পারল কিছু শালুক সিদ্ধ এখনো হাঁড়িতে আছে। সে অন্ধকারে বসেই শালুকগুলো খেতে থাকল। শুকনো বলে গলায় আটকাচ্ছে—একটু জল খেল জোটন। আবার দরজা ফাঁক করে যখন আকাশ দেখল—আকাশ পরিষ্কার, মোরগেরাও ডাকছে জোটন দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল।

মসজিদের ওপাশটায় সূর্য উঠছে। আবেদালী বদনা হাতে মাঠ থেকে উঠে এল। আবেদালীর বিবি জ্বালালী পাতা দিয়ে উঠোনের এক কোণায় ভাত রান্না করছে। আবেদালীকে দাওয়ায় বসতে দেখে জোটন বলল, কীরে, মানুষটা ত কাইলয় আইল না।

-না আইলে আমি কি করমু! আবেদালী জোটনের এই ইচ্ছায় বিরক্ত। তিন তিনবারের পর ফের নিকাহের শখ।

দুদিন না খেয়ে জোটনও ভয়ানক হয়ে উঠেছে। সে আবেদালীকে উদ্দেশ্য করে বলল, দন্দি যাওনের সময় মানুষটার খোঁজ কৈরা যাবি। মানুষটা বাইচা আছে না মরছে, কবি আইয়া।

-কমু গ কমু! আবেদালী দেখল জোটনের মুখ ভয়ানক শুকনো। দুদিন না খেতে পেয়ে জোটনের চোখ কোটরাগত।–তুই দুফরে আমার ঘরে খাইস। আবেদালী এবার জ্বালালীর মুখটা দেখল। সূর্য উঠছে বলে রোদের রং জ্বালালীর খড়খড়ে মুখটা আরও খড়খড়ে করে দিচ্ছে এবং আবেদালীর এমত কথায় জ্বালালীর মুখটা ফোটকা মাছের মতো ফুলতে থাকল।–আরে আরে করতাছস কী! তর গাল যে ফাইট্টা যাইব।

জোটন বুঝতে পেরে বলল, নারে থাউক। আমার খাওনের লাগে কি আছে।

আবেদালী বুঝল জোটন খাবে না। সে দেখল, জোটন উঠোন থেকে নেমে যাচ্ছে। জোটন রাস্তায় নেমে গেল এবং সড়ক ধরে হাঁটল না। যেখানে এখনো ধানখেতে জল আছে অথবা খেতের আল জাগছে সেইসব পথ ধরে কি যেন খুঁজতে খুঁজতে চলছে।

জোটন এইসব নরম মাটির আশ্রয়ে কচ্ছপের ডিম খুঁজছে। এই সময়ে কচ্ছপেরা ডিম পাড়বে মাটির আলে। জোটন এ-সময়ে এসব মাটির আশ্রয় থেকে ডিম বের করে পশ্চিমপাড়ায় উঠে যাবে ভাবল এবং ডিমগুলি দিয়ে বলবে, আমারে এক টুকরি চাইল দিয়েন। সে এক দু করে বিলেন জমির অনেক আল ভাঙতে থাকল। সূর্য বিশ্বাসপাড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। ধানগাছের শিশির, ঘাসের শিশির, কলাই খেতের শিশির সব বিন্দুবৎ হয়ে পড়ছে এবং ইতস্তত রোদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মানুষটা গতকাল এল না, সে পুঁটলি বেঁধে বসে ছিল, মৌলভি সাবকে বলা ছিল, সাক্ষী ঠিক ছিল—অথচ মানুষটা এল না। মুশকিলাশান নিয়ে মানুষটা উঠোনে ডেকেছিল একদিন, এটা আবেদালীর বাড়ি না? আবেদালী, জ্বালালী এবং সকলে ফোঁটা নিয়েছিল—জোটও উঠেছিল, ফোঁটা নিয়েছিল—পীরের দরগায় লোকটা থাকে, উঁচু, লম্বা, গোটা গোটা চোখ-নাভির নীচে সাদা দাড়ি নেমে গেছে, গায়ে শতছিন্ন, মাথায় ফেট্টি এবং গলায় বিচিত্র রকমের মালা-তাবিজ। জোটন ফকির মানুষটার মহববতের জন্য প্রথম দর্শনে বিস্মিত এবং শীতের নরম রোদ যেন তাকে গভীর রাত পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেদিন।

জোটন আলের ধারে ধারে তীক্ষ্ণ নজর রেখে হাঁটছে। কচ্ছপের ডিম এখানে নেই, সে হাঁটতে থাকল। সে ইতস্তত তাকাল এবং কয়েক গুচ্ছ ধানের ছড়া কাপড়ের নীচে লুকিয়ে ফেলল। ওর পাশ দিয়ে কামলারা অন্য জমিতে উঠে যাচ্ছে–জোটন বসে পড়ল—যেন সে যথার্থই কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করছে। সে উঠছে। কামলারা অন্য জমিতে এখন ধান কাটছে। জোটন ধান কাটছে না। হাতের ধারালো শামুকটা সে পেটের নীচে এঁজে রেখেছে। জোটন অন্য জমিতে কামলাগুলোকে দেখার জন্য গোড়ালিতে ভর করে উঁকি দিল—জমিটা কার স্থির করার ইচ্ছায়। দূরের গাইগুলোকে জলে নেমে যেতে দেখল—মানুষটা এল না, সেই মুশকিলাশানের মানুষটা। তেরোটি সন্তানের জননী জোটন আবার মা হবার জন্য এই আলে দাঁড়িয়ে কেমন ছটফট করতে থাকল। চল্লিশ বছরের রমণী জোটন খোদাকে যেন এই ধানের জমিতে খুঁজছে—খোদার মাশুল উঠছে না গতর থেকে, এমতভাব এখন।

দুদিন পেটে ভাত নেই—আফশোস। দুদিন হাজারদির বিলে গ্রামের অন্য অনেক দুঃখী ইমানদারদের সঙ্গে শালুক তুলেছে, দুঃখী হলেই ইমানদার হবে, খোদাকে স্মরণ করবে—এমনও একটা বিশ্বাস আছে জোটনের। এই যে এখন জোটন শামুকের ধারালো মুখটা দিয়ে কট করে আর একটা ধানের ছড়া কাটল এবং কোঁচড়ে লুকিয়ে ফেলল—যেন পেটের খিদে ভয়ানক দুঃসহ, খোদার কাছে নিজের গোনাগারের জন্য জোটন মোনাজাত করল—হায়রে খোদা, পেটের জ্বালায়, গতরের জ্বালায় সব হয়। সুতরাং জমির মালিককে যেন বলার ইচ্ছা, ভয় করবার কিছু নেই, আর কিছু না হোক জোটনের ইমান আছে। তোমার শক্ত ধানের ছড়া কাটছি না, আলের উপর যেসব ছড়া নুয়ে আছে শামুকের ধারালো মুখে তাই আশ্রয় পাচ্ছে। হাসিমের বাপ নয়াপাড়ার নিমগাছ অতিক্রম করলে জোটন কট করে আরো একটা ধানের ছড়া কেটে কোঁচড়ে লুকাল। এবং এ-সময় মালতির কথা মনে হল। নরেন দাসের ছোটোবোন মালতি বিধবা হয়ে ঘরে ফিরেছে। মালতির দুঃখবোধে জোটন পুবের বাড়ির বোন্নাগাছটার ফাঁক দিয়ে নরেন দাসের তাঁতঘর দেখল। তাঁতের শব্দ শুনতে পাচ্ছে-মাকুর শব্দ এবং চরকার শব্দ। জোটন কট করে অন্য একটা ধানের ছড়া কাটতেই পিছন থেকে কে যেন চীৎকার করে উঠল—এই জুটি, মাথার খুলি ভাইঙ্গা দিনু।

জোটন মুখ ঘুরিয়ে দেখল ঈসম আসছে। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, না ঈসম ভাই, আমি এহানে কিছু করতাছি না।

-তুমি আসমান দ্যাখতাছ। যা বাড়ি যা। কথা বাড়াইস না।

সুতরাং বাড়ি উঠে যাওয়ার মতো করেই জোটন হাঁটতে থাকল, কিন্তু যেই ঈসম মসজিদের কুয়াতে জল ভোলার জন্য বালতি নামাল–জোটন টুক করে আলের পরে বসে ধানগাছের ছায়ায় নিজেকে ঢেকে ফেলল, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে যেতে দেখল এক জায়গায় হাত লেগে মাটি সরে গেছে এবং সাদা গোল গোল ডিম বের হয়ে পড়ল। মুখ উজ্জ্বল করে জোটন এবার উঠে দাঁড়াল। ইমান এবং মুশকিলাশানের লম্ফটাকে উষ্ণ করছে। দূরে দূরে সব ধান কাটা হচ্ছে। ধানের আঁটি বাঁধছে মুনিষেরা, ওরা গাজির গীত গাইছে। দূরে দূরে গানের স্বর তরঙ্গ, নরেন দাসের বিধবা বোন মালতি এবং গত রাতের নিস্ফল প্রতীক্ষা জোটনকে নিদারুণ তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় কাতর করছে। মালতির বিয়ে হবে না, বাকি জীবন গতরের কোনো মাশুল দেবে না—আল্লা নারাজ হবে—এই গতর মাটির মতে, পতিত ফেলে রাখলে গুনাহ। জোটন এইজন্যই মালতির জীবনকে, ধর্মকে না-হক কাফেরের মতো ভাববার ইচ্ছায় শরীরের জড়তা কাটাতে গিয়ে দেখল, বোন্নাগাছের নীচে মালতি দাঁড়িয়ে আছে—চুপ এবং নিঃসঙ্গ। ওর শরীরের সাদা থান ভোরের হাওয়ায় উড়ছে। জোটন মালতিকে দেখে তাড়াতাড়ি সব কটা ডিম ভিজা জামার ভিতর থেকে তুলে আঁচলে বেঁধে ফেলল।

অন্যদিন হলে জোটন মালতির সঙ্গে অন্তত কিছু কথা বলত। কিন্তু আজ মালতির এই নিঃসঙ্গতা যথার্থই ওকে পীড়িত করছে। একটা অহেতুক অপরাধ বোধে মালতির সঙ্গে যে কোনো কথাই বলতে পারল না। জোটন এই পথ ধরেই গেল—অপরিচিতের মতো তামুকের খেতে উঠে গেল। দেখল, মালতি বোন্নাগাছ পার হয়ে লটকনগাছের নীচ দিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়াল এবং হাঁসগুলোকে জলে সাঁতার কাটতে দেখে কেমন আনমনা হয়ে গেল। জোটন আর দাঁড়াল না। এখানে দাঁড়ালে কষ্টটা বাড়বে। তারপর শালুক খেয়ে শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি নরেন দাসের বাড়ি পার হয়ে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে থাকল। বকুলগাছটা অতিক্রম করে ঠাকুরবাড়ির সুপারি বাগান। সে সন্তর্পণে বাগানে ঢুকে গাছতলায় সুপারি খুঁজতে থাকল। জোটন সুপারিকে গুয়া বলে। সে খুঁজে খুঁজে কোথাও যখন একটাও সুপারি পেল না, সে গাছের মাথার দিকে তাকাল এবং প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, আল্লা একটা গুয়া দ্যা। সব গাছগুলোর মাথায় সুপারি ঘন। এবং হলুদ রঙের। হলুদ রঙের এই সুপারির খোসা ছাড়িয়ে একটা শাঁস মুখে দেবার বড়ো শখ জোটনের। সে দেখল একটা কাঠঠোকরা পাখি এ-গা, ও-গাছ। করছে। আহারে আল্লারে একটা দ্য না রে। তখনই বুড়ো ঠাকুরুনের গলা শুনতে পেল সে। জোটন চুপচাপ বাগানের পাশে ঘন চড়ইগাছের জঙ্গলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। জোটন অনেকক্ষণ এই ঝোপের ভিতর পাখিটার বদান্যতার জন্য বসে থাকল। পাখিটা উড়ছে, জোটন ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখতে দেখতে উত্তেজিত হতে থাকল। পাখিটা সুপারির উপর এবার ঘন হয়ে বসল, দুটো ঠোকর মারল এবং সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারটে সুপারি গাছের গোড়ায় ছড়িয়ে পড়ল—য্যান মাণিক্য। যেন জোটনের সমস্ত দিনের ইচ্ছা এখন এই গাছটার ছায়ায় রূপ পাচ্ছে। জোটন চারপাশটা ভালো করে দেখল। পুকুরঘাটে বুড়ো ঠাকুরুন স্নান করছে। সে সব দেখছে, অথচ তাকে কেউ দেখতে পেল না। সে তাড়াতাড়ি গাছটার নীচে ছুটে গেল। সুপারি তিনটে আঁচলে বেঁধে সে হাঁটছে। সে বৈঠকখানা পার হয়ে ঠাকুরবাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। ডাক দিল-বড়মামি আছেন নাকি? বলতে বলতে সে পাছ দুয়ারে ঢুকে অসুজঘরের সামনে দাঁড়াল। বলল, ধনমামি—একবার মাণিক রে দ্যাখান। মাণিকের লাইগ্যা কাসিমের ডিম আনছি। বড়মামিকে দেখে বলল, কাসিমের ডিম রাইখ্যা এক টুকরা চাইল দ্যান। চাল পেলে বলল, দুইডা পান নিমু বড়মামি।

—নে গা। গাছতলায় মেলা পান পৈড়া আছে।

জোটন জালগুলো আঁচলে বাঁধল। এবং বড়োঘরের পিছনে ঢুকে আলকুশি লতার কাঁটাঝোপ পার হয়ে একটা শ্যাওড়া গাছের নীচে দাঁড়াল। পানের লতা গাছটাকে জড়িয়ে আছে, সে দু-হাতে যতটা পারল পান কুড়িয়ে নিল, ছিঁড়ে নিল। সে বাড়ির উপর দিয়ে গেল না। সে আলকুশি লতার ঝোপ ভেঙে মাঠে নেমে গেল। জল-কাদা ভেঙে ফের পূবের বাড়ির পুকুরপাড় ধরে ধানখেতের আলে উঠে যাবার সময় দেখল মালতি আকাশ দেখছে। জোটন এবার মালতিকে ফেলে চলে যেতে পারল না। সে একটু হেঁটে এসে মালতির পাশে চুপ করে বসল। ডাকল— মালতি।

মালতি কথা বলল না। মালতি কাঁদল। জোটন মালতির মুখ দেখতে পাচ্ছে না অথচ বুঝল মালতি চোখের জল ফেলছে। জোটন ফের ডাকল, মালতি কান্দিস না। কাইন্দা কী করবি! সব নসিব রে মালতি।

মালতির শরীরে ব্লাউজ নেই। মালতির সন্তান নেই। যে সালে বিলের জলে কুমির আটকা পড়ল সে সালেই মালতির বিয়ে হল। নরেন দাস বিয়েতে খরচ পত্তর করেছিল। সুতরাং চার সাল হবে মালতি গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিল। ফুটফুটে রাজপুত্রের মতো বর, ছোটোখাট মানুষের চোখদুটো যেন জোটন ইচ্ছা করলে এখনো স্মরণ করতে পারে। বিয়েতে জোটন তিনদিন ধরে গলা পর্যন্ত খেয়েছিল, ঢেকুর তুললে এখনো যেন সে-গন্ধ উঠে আসবে। নরেন দাস নর্সিন্দি থেকে চারটে ডেলাইট এনে ঘরে-বাইরে সকল স্থানে জ্বেলে আলোয় আলোময় করে, নরেন দাস চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিল বরের হাত ধরে, মালতির মা নাই, বাপ নাই, তুমি অর সব। নরেন দাস অনেকক্ষণ চৌকিতে পড়ে কেঁদেছিল। সকলে চলে গেল, বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা ঠেকল—তবু নরেন দাস দুদিন তক্তপোশ থেকে উঠল না। ছোটো বোনটা এ বাড়িতে যেন প্রজাপতির মতো ছিল। তবু সারাদিন উড়ত, উড়ত। গাছের ছায়ায়, পুকুরের পাড়ে পাড়ে, লটকন গাছের ডালে ডালে মেয়েটা যেন নীলকণ্ঠ পাখি খুঁজে বেড়াত।

জোটন উঠে পড়ল। মেয়েটা শোকে কাঁদছে, কাঁদুক। ওর তিন নম্বর খসমের কথা স্মরণ করতে গিয়ে গলা বেয়ে একটা শোকের ছায়া উঠে আসতে থাকল। বেলা বাড়ছে। পেটে ভয়ানক খিদে। যে চাল আছে জোটনের দু-ওক্ত হয়ে যাবে। সে হাঁটবার সময় গোপাট থেকে কিছু গিমা শাক সংগ্রহ করল। তারপর আবেদালীর ঘর অতিক্রম করে উঠোনে উঠেই তাজ্জব বনে গেল—যে মানুষটা কাল রাতে আসেনি, যে মানুষটার জন্য সে প্রায় সমস্ত রাত জেগে বসেছিল, সেই মানুষটা ছেড়া মাদরে নামাজের ভঙ্গিতে বসে তফন সেলাই করছে। নীল কাঁথার মতো ঝোলা, মুসকিলাশানের লক্ষ, ভিন্ন ভিন্ন সব তাবিজের মালা, কুঁচ ফলের মালা এবং পুঁতির হাড় এইসব বিচিত্র বস্তুর সমন্বয়ে এখন ফকিরসাব যেন ঘোড় দৌড়ের পীরের মতো।

জোটন ফকিরসাবকে উদ্দেশ্য করে বলল, সালেমালেকুম!

ফকিরসাব এতক্ষণে জোটনকে দেখতে পেল এবং বলল, ওয়ালেকুম সেলাম।

জ্বালালী ঘরের কোণে ঘোমটা টেনে বসে আছে। জোটনেরও ইচ্ছা হল এ সময় বড়ো ঘোমটা টেনে ছোটো ঘরটায় বসে থাকে। কিন্তু খিদমতের অসুবিধা হবে ভেবেই যেন সরমের জন্য দিল খুলে দিতে পারল না। সে জ্বালালীর ঘরে ঢুকে বলল, মানুষটা খাইব, কী যে খাওয়ামু!

জোটনের এই গোপনীয় কথা ফকিরসাব শুনতে পেলেন। আমার জন্য ভাইবেন না। দুইডা শাক ভাত কৈরা দ্যান। দেখেন নিশ্চিন্তে ক্যামনে খাইয়া উডি।

জোটন বলল, জ্বালালী দুইডা পুডির শুঁটকী দ্যা।

জোটন রান্নার জন্য সোলার-পারা থেকে এক আঁটি সোলা নামিয়ে আনল। ঘরের পিছনে সোলাগুলোকে মড়মড় করে ভাঙল এবং ভাঁজ করে ঢুকতে গিয়ে দেখল-ফকিরসাব এখনো তফনে তালি মারছেন বসে, বেড়ার ফাঁক দিয়ে জোটন ফকিরসাবের প্রশস্ত বুক এবং কবজি দেখে-গতরে খোদার মাশুল উশুল হতে বেশি সময় নেবে না—সুতরাং, সুখী মনে জোটন রান্না করতে বসল। দু-সাল হল গতর বেশরমভাবে প্রায় রাতে বেইমানী করতে চাইছে। রাতে যতবার এমন হত জোটন ছেঁড়া মাদুরে বসে আল্লাকে স্মরণ করে গতরের এইসব বেওয়ারিশ ইচ্ছাকে তাড়াতে চাইত। দু-দুবার তালাক পেয়ে জোটন যেন বুঝতে শিখেছে ওর শরীরের খাক মেটাবার শক্তি পুরুষদুটোর ছিল না—সুতরাং তালাক দিল— বলল, ইবলিশের গতর কেবল খাই-খাই। সে ফের উনুনে কিছু সোলা গুঁজে দিল এবং ফকিরসাবের শরীর দেখল বেড়ার ফাঁক দিয়ে। সমস্ত চালটাই সে রান্না করছে। দুজনের মতো ভাত। সে শুটকি মাছ দুটোকে আগুনে পুড়িয়ে নিচ্ছে, সে অনেকগুলো লাল চাঁটগাই লঙ্কা বেটে নিচ্ছে পাথরে, বড়ো বড়ো দুটো পেঁয়াজ কেটে শুটকি দুটোকে মড়মড় করে সানকির এক পাশে গুঁড়ো করে রাখল তারপর লঙ্কা, পেঁয়াজ, নুন এবং শুটকির ভর্তা বানাতে গিয়ে জিভে জল এল। এখন সে ইচ্ছা করলে দুজনের ভাত যেন একা খেয়ে নিতে পারে। কিন্তু বাড়িতে মেহমান—সে তার ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করল কিছুক্ষণের জন্য। ভাতের ফ্যানা টগবগ করে ফুটছে। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভাতের। সে ফ্যানটা গেলে একটা সানকিতে যত্ন করে রাখল, নুন মেশাল—সবটা ফ্যান পিছন ফিরে চুকচুক করে গিলতে থাকল–আহাঃ। এতক্ষণে যেন চোখ তার দৃশ্যমান বস্তুগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ফকিরসাবকে পিরের মতো মনে হল দরগার পির এই ফকির সাহেব। জোটন নিজের শরীরের দিকে নজর দিয়ে বুঝল, এ শরীরও ভয়ানক শক্ত সমর্থ। ফকিরসাবকে কাবু করতে খুব একটা আদা নুন লাগবে না। জোটন মনে মনে হাসল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ডাকল, ফকিরসাব সান করতে যান। আমার খানা পাকান হৈয়া গ্যাছে।

ফকিরসাব সব তল্পিতল্পা সঙ্গে নিয়েই ঘাটে গেল, এমনকি মুশকিলাশানের আধারটাও। জোটন এই ঘরে বসে কাকের শব্দ পেল, আকাশে রোদ, গাছে এবং শাখা-প্রশাখায় রোদ। জাফরি রঙের ছায়া ঘরের পিছনে। বেত ঝোপে বোলতার চাক—নীচে বোন্নাগাছের ঘন জঙ্গল, ফকিরসাব হাসিমদের পুকুরে স্নান করতে গেছে। জোটনবিবি গাজির গীত ধরল গুনগুন করে। জোটনবিবির স্বপ্ন জাগছে চোখে, বেত ঝোপে বেথুনের মতো এই স্বপ্ন কবে টস-টস করে পাকবে… জোটন রঙের ছবি ভাবতে পারছে না—স্বপ্নটা গাজির গীতে গায়ানদারের হাতের ছড়ি যেন, চাঁদের মতো মুখ করে চ্যাপটা নাকে চোখে জোটনের সকল সুখকে দ্যাখছে।

জোটন তাড়াতাড়ি পাশের একটা গর্ত থেকে ডুব দিয়ে এল। চুলের জল ঝেড়ে ডুরে শাড়ি পরে ভাঙা আয়নায় নিজের সুন্দর মুখটি দেখল, উজ্জ্বল দাঁতের পাটি দেখে রাতে পিরের দরগার সুখের হীরামন পাখির কথা মনে করে কেমন বিহ্বল হতে থাকল। ফকিরসাহেব ছেড়া মাদুরে বেশ পরিপাটি করে খেতে বসলেন। ভিজে লুঙ্গি সিম লতার মাচানে শুকোচ্ছে। তিনি খেতে বসে দুবার আল্লা উচ্চারণ করে আকাশ দেখলেন—আকাশ পরিষ্কার, বড় তকতকে এই উঠোনে ঝকঝকে আকাশের নীচে বসে গবগ খেতে পারলেন না। যেমন পরিপাটি করে বসছেন তেমনি ধীরে-সুস্থে এক সানকি মোটা ভাত শুটকির ভর্তা দিয়ে কিঞ্চিৎ মেখে মেখে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে থাকলেন। নীচে দুটো-একটা ভাত পড়ছে— তিনি আঙুলের ডগায় তুলে সন্তর্পণে মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, যেন এই মোটা ভাত ফুরিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না—আল্লার বড়ো অমূল্য ধন। সানকির ভাতটা শেষ, করতেই দেখলেন, জোটন আর এক সানকি ভাত এনে সামনে রেখেছে। তিনি সে ভাতটাও পরিপাটি করে শেষ করলেন। এবং ভাতের অপেক্ষায় ফের বসে থাকলেন। সহসা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে তিনি মাদুরের এবং সানকির সংলগ্ন ভাতটিও আঙুলের চাপে তুলে মুখে দিয়ে বসে থাকলেন। নামাজের ভঙ্গিতে এই বসে থাকা ভাবটুকু ফকিরসাবের বড়ো আরামদায়ক। এইসব জোটন ঘরের ভিতর থেকে লক্ষ করে সরমে মরে যাচ্ছে। সে হাঁড়ির ভিতর হাত দিল। শেষ দুমুঠো ভাত সানকিতে তুলে শেষ ভর্তাটুকু তার কিনারে রেখে মাদুরের উপর রেখে দিল। ফকিরসাব বললেন, বস হৈব। ইবারে আপনে গিয়া খান।

জোটন ঘরের এক কোণায় বসে থাকল। ওর মাথাটা ঘুরছে। সে খুঁটিতে হেলান দিল। কোমর থেকে ডুরে শাড়িটা খসে পড়ছে। আবেদালি নেই, জববর নেই, থাকতে বলত—আমার ঘরটা বন্ধক রাইখ্যা এক প্যাট ভাত দ্যা। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় থাকতে না পেরে গিমা শাকগুলো সিদ্ধ করল এবং খেল। সে কিছু অকালপক্ক বেথুন এনে খেল। এ সময় উঠোনে গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। কাক শালিকেরা প্রায় সকলে ডালে, ঝোপ-জঙ্গলে যেন ঝিমোচ্ছে। ফকিরসাব ছেড়া মাদুরে পড়ে ঘুমোচ্ছেন। জোটন আর বসে থাকতে পারল না। শরীরের জড়তায় সে ডুরে শাড়ির আঁচল পেতে মেঝের উপর পেট রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

বিকেলবেলাতে যখন উঠোনের উপর দিয়ে পাখিরা ডেকে গেল, যখন সাত ভাই-চম্পা পাখিরা লাউ মাচানের নীচে কিচকিচ করল অথবা ধানের আঁটি নিয়ে কামলারা সড়কের উপর কদম দিচ্ছে তখন জোটন ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন শরীরটাকে টেনে টেনে তুলল। ফকিরসাহেব হুকা খাচ্ছেন বসে। সব পোটলা-পুঁটলি যত্ন করে বাঁধা, যেন তিনি এখন উঠবেন, শুধু হুকা খাওয়াটা বাকি। জোটন এবার থাকতে পারল না। ঘর থেকেই বলল, ফকিরসাব আমারে লৈয়া যাইবেন না।

ফকিরসাব ঝোলাঝুলি কাঁধে নিতে নিতে বললেন, আইজ না। অন্যদিন হৈব। কোরবান শেখের সিন্নিতে যামু। কবে ফিরমু ঠিক নাই। উঠোন থেকে নেমে যাওয়ার সময় দরজার ফাঁকে জোটনের শীর্ণ মুখে দুঃসই ব্যথার চিহ্ন ধরতে পেরে উচ্চারণ করলেন—আল্লা রসুল, আহা এই ইচ্ছায় সংসারে আমরা কতদূর যাব, আর কতদূর যেতে পারি; ফকিরসাহেব ওইমতো চিন্তা করলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ধরতে পারলেন, জোটনের চোখদুটো এখনো ওকে অনুসরণ করছে অথবা যেন জোটন দেখল হাঁসের পালক মালতির শরীরে—ইচ্ছার জল সব গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে অথবা পিরের শরীর গাজির গীতের গায়ানদারের লাঠি য্যান… হাঁটতাছে…হাঁটতাছে, চাঁদের মতো মুখ করে চ্যাপটা চ্যাপটা নাকে চোখে জোটনের সকল দুঃখকে দ্যাখতাছে। জোটন এবার ডুকরে কেঁদে উঠল—আল্লারে, তর দুনিয়ায় আমার লাইগ্যা কেয় বুজি নাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *