1 of 2

ফুল ফলের জন্য

ফুল ফলের জন্য

জানালা খুলতেই রোদ এসে পড়ল ঘরে। শীতে সারারাত কষ্ট পেয়েছে সনাতন। ঠান্ডা, হিম ঠান্ডায় ওর হাত পা ক্রমে যেন স্থবির হয়ে আসছিল। কুকুরছানা বুকে নিয়ে শুয়েছে। এত ঠান্ডা যে, কুকুরটা পর্যন্ত বুকের কাছে কুঁই কুঁই করেছে সারারাত। এই রোদ ওকে সামান্য উত্তাপ দিল শরীরে।

মা রাতে আজ ফেরেনি। ফিরলে কুকুরটাকে বুকে নিয়ে শুতে পারত না। জানালাতে এখন শীতের সূর্য উঁকি মারছে। কিছু পাখি উড়ছিল আকাশে। ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বের হবার জন্য জানালায় শীতের সূর্য দেখল, আকাশে কিছু পাখি উড়তে দেখল। এই সব দেখলেই ওর সেই মানুষটার কথা মনে হয়। সামনে একটা ঘোড়ার মুখ, পেছনে লেজ, মাঝখানে মানুষটা বহুরূপী সেজে আছে। তখন ঢোল বাজে। নটবর ঢোল বাজায়। দুপাশের দরজা জানালা খুলতে থাকে। মা শুধু জানালাটা বন্ধ করে রাখবে। সনাতনকে বের হতে দেবে না। বের হলেই তিরস্কার করবে—কোথাকার কোন এক মানুষ, তুমি সেখানে যাবে না সনাতন। ওরা ভালো লোক নয়। ওরা তোমাকে নিয়ে দেখবে কোথাও একদিন চলে যাবে।

কুকুরটাকে সে পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছে। শীতের ঠান্ডায় কুকুরটা মরে যাচ্ছিল। সে ওকে সামান্য উত্তাপ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে। মা বাড়ি না থাকলে শীতের রোদে সে কুকুর নিয়ে বসে থাকে। বুড়ি দিদিমা সনাতনকে শুকনো রুটি করে দেয়। রোদে বসে সনাতন কুকুরের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খায়। মা আজ রাতে ফেরেনি। কোনো কোনোদিন মার এমন হয়। সেই যে শীতের মানুষটা খেলা দেখিয়ে চলে গেল আর আসেনি। আগে মানুষটা প্রায়ই আসত খেলা দেখাত। মানুষটা যেন এক হ্যামেলিনের বাঁশিয়ালা—যায় যায় নদীতে নেমে যায়। কোথায় যেন কোন গল্পে সনাতন মার কাছে শুনেছে কত হাজার লক্ষ ইঁদুর নিয়ে মানুষটা চলে গেল। তারপর কি এক কারণে হাজার লক্ষ সহরের ছেলেমেয়ে নিয়ে পাহাড় ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে গেল। মানুষটাকে দেখলেই মার বুঝি এমন কিছু মনে হয়। তখন মা সাজতে গুজতে বসে যায়। উঁচু করে খোঁপা বাঁধে। বড়ো করে কপালে টিপ দেয়। কপালে টিপ পরলেই মাকে খুব ভালো লাগে, তখন সে মাকে ছুঁতে পারে। মার সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু আতর মাখা শাড়ি পরলেই মাকে যেন আর চেনা যায় না। বড়ো দূরের মনে হয়। মা তখন বোকা সনাতনকে কাছে ঘেসতে দেয় না। যেন মার সারা শাড়ি ব্লাউজে ছুঁয়ে দিলে দাগ লেগে যাবে। সে মাকে কিছুতেই আর ছুঁতে সাহস পায় না। কেবল মনে হয় এ শীতে ঠিক মানুষটা জাদুর ঘোড়া নিয়ে চলে আসবে। ঘোড়ার খেলা দেখাবে। সে ঘোড়ার চড়ে নিরুদ্দেশে চলে যাবে।

সনাতন তার কুকুরটার জন্য বাবুদের বাড়ি থেকে একটা শেকল চুরি করে এনেছে। সে আর ভয়ে ওমুখো হচ্ছে না। গেলেই বাবুদের বড়ো ছেলে ওর হাত পা বেঁধে মারবে। সে শেকলটাকে কুকুরের গলায় পরিয়ে চুপি চুপি বের হয়ে গেল। বস্তির পথ সদরে গিয়ে পড়েছে। সে সদর রাস্তায় পড়ে ট্রাম বাস দেখতে পেল। এই বড়ো রাস্তায় এসে পড়লেই সনাতনের মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। বড়ো রাস্তায় দাঁড়ালে সে মন্দিরের চূড়া দেখতে পায়। মন্দিরের চূড়ায় রোদ নামলে সব কিছুই নির্মল মনে হয়। ওর তখন ভিতরে ভিতরে একটা পবিত্র ভাব জাগে। বাবুদের শেকলটা সে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে—এমন ভাবে।

সে রাস্তা ধরে কুকুরটাকে নিয়ে ছুটবে ভাবল। ছুটলে শীত কমে যায়। রাস্তা পার হলে মন্দির, খোলা মাঠ, মাঠ কত বড়ো, কতদূরে চলে গেছে, সে মন্দিরের চাতালে চুপচাপ বসে থাকতে ভালোবাসে। সে ভাবল আজ আর মন্দিরে গিয়ে হাত পাতবে না। কুকুরটাকে নিয়ে চাতালের একপাশে বসে খোলা আকাশ দেখবে। বস্তির ঘরে থেকে সে বড়ো আকাশ দেখতে ভুলে গেছে। যখন ওর কিছুই ভালো লাগে না, যখন মা বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশে যায়, বুড়ি দিদিমা কেবল, সনাতন মন্দিরে যা, মন্দিরে যা করে তখন ওর সেই মানুষটার মতো কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে। ফুল ফল পাখি দেখার ইচ্ছা হয়। অথবা মন্দিরের ও-পাশে যে বড়ো মাঠ আছে সেখানে চুপচাপ বসে আকাশে পাখি ওড়াতে ইচ্ছা যায়। কবে যে সেই মানুষ আসবে, নটবর ঢোল বাজাবে-ঢোল বাজালে সে পাছায় হাত রেখে মার জানালার সামনে ঘুরে ঘুরে নাচতে পারবে।

বের হবার মুখে সে দেখে এসেছে, বুড়ি দিদিমা বারান্দায় একপাশে ছেড়া কাঁথার ভিতর কেমন গুটিশুটি দলা পাকিয়ে আছে। অন্যদিন বুড়ি সকাল সকাল উঠে সনাতনকে ডেকে দেয়। মন্দিরের পথে পুণ্যর্থীরা যায়। সনাতন তাদের কাছ থেকে দু-পয়সা এক পয়সা মেগে আনে। মেগে আনলে ওরা দুজনে মাকে লুকিয়ে চানা ভাজা অথবা বাদাম ভাজা এবং সুদিনের সময় ফুচকা খেতে খেতে বুড়ি বসে বসে টবকা টবকা কথা কয়। বুড়ি যেন আরে-ঠারে মার সম্পর্কে কী বলতে চায়। সনাতন বড়ো হয়ে যাচ্ছে, বুড়ি বুঝি বুঝতে পারছে। ওর বাবার কথা বুড়ি কিছুতে বলে না। বাবাকে সে কোনোদিন দেখেনি। পৃথিবীতে মার একমাত্র রাগ সেই মানুষটার ওপর। শীতের দেশ থেকে যেন মানুষটা মা-র জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার কথা বুড়িকে শুধালে তর তর করে বুড়ি অন্য কথা টেনে আনে। তখন মনে হয় বুড়ি বড়ো সেয়ানা। মা বাড়ি থাকলে, কোনোদিন সাহস পায় না বলতে, যা একবার মন্দিরে যা, মা লক্ষ্মীরা যাচ্ছে। গিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাক।

মার কেন জানি ইচ্ছা সনাতন ছোটোলোকের মতো হাত পেতে ভিক্ষা করবে। সনাতন মানুষ হবে। সনাতনকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য মা দোয়াত কলম কিনে দিয়েছে।

রোদের ভিতর ওর হাঁটতে ভালো লাগছিল। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছিল। বড়ো মাঠ, খোলা আকাশ, দেখতে পেলেই ওর মনে নানা রঙের ফুলঝুরি ফুটতে থাকে। হাতে তার শেকল, সামনে তার পোষা কুকুর। মা, আজ রাতে ফিরে আসেনি। রাতে মা না ফিরলে সে জানে তার প্রাপ্য মায়ের কাছে সেদিন বেশি। মা পাউরুটি কিনে আনে, কলা কিনে আনে। মাকে বড়ো ক্লান্ত দেখায়। চোখ মুখ বিষণ্ণ। যেন মা সারারাত পথ হেঁটেছে। সারারাত মার চোখে ঘুম ছিল না। মা তখন কত ভালো কত সুন্দর। বুড়ি দরজার ও-পিঠে বসে থাকে। আর চুপি দিয়ে দ্যাখে, মা তাকে কী খাওয়াচ্ছে। এই ভালো খাওয়াটুকু দেখলে বুড়ির জিভে জল আসে। বুড়ির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। সনাতন রে, সনাতন—তোর মা তোকে কত ভালো খেতে দেয়। তার মা চলে গেলে মন্দিরে যা সনাতন, আমার জন্য কিছু চেয়ে নিয়ে আয়?

বুড়ির কথা মনে হলেই শীতের কথা মনে আসে। এখন এই শীতে গাছে গাছে পাতা ঝরার সময়। পাতা ঝরার সময় হলেই মানুষটা তার সাদা ঘোড়া নিয়ে চলে আসবে। সহসা ঢোল বাজলে মনে হবে ঘোড়াটা পথের ওপর নাচছে। বাঁশের কঞ্চিতে কাপড় দিয়ে তৈরি ঘোড়া, সাদা ঘোড়া—ঘোড়ার মুখে রংবেরঙের লাল নীল হলুদ রঙের রাঙতা, মাঝখানে তার জাদুকর, যেন ঘোড়া তাকায় না কেবল ঘুমায়, ঘোড়ার পিঠে জাদুকর, মাথায় রাঙতার টুপি, ছুটছে তো ছুটছেই। মানুষটা ঘোড়া নিয়ে খেলা দেখায়, জাদুর খেলা। চিঁহি চিঁহি করে ডাকে, আর দু-পয়সা এক-পয়সা যার যা সাধ্য দিয়ে দ্যাও চোখে মুখে এমন একটা হাসি লেগে থাকে।

ঘোড়ার খেলা আরম্ভ হলেই দরজা জানালা সব খুলে যাবে। ছেলে-ছোকরারা চারপাশে ভিড় করবে। ঘোড়াটার চারপাশে, যেন এই ঘোড়ার দিগন্ত জোড়া খ্যাতি —ঘোড়া এই সব দুঃখী মানুষদের জন্য কত কিছু নিয়ে এসেছে—খেলনা, ফুল পাতা পাখি, যা কিছু তোমার ইচ্ছা। তুমি ফুল হতে চাও, পাখি হতে চাও? তোমাকে সে সব দিয়ে থুয়ে চলে যাবে। সেই মানুষটা এলেই সে এবার বলবে, তুমি আমাকে সেই বড়ো মাঠে নিয়ে যাবে? মাঠের পাশে নদী থাকবে, কাশফুলের বন থাকবে আর নীল আকাশ থাকবে। একবার মার সঙ্গে ট্রেনে তেমন একটা দেশে আমরা চলে গিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তা ধরে হাঁটলেই ওর কেবল সেই দেশটার কথা মনে হয়।

মা যখন বাড়ি থাকে না, দিদিমাই তার সব। সনাতনের তখন মনে হয় সংসারে তারা তিনটি মাত্র জীব। সে, দিদিমা এবং বুলি। মা তখন দূরের মানুষের মতো। তখন মনে হয় মা কেবল সাজতে খুঁজতে ভালোবাসে। আকাশে পাখি হয়ে উড়তে ভালোবাসে। সনাতন যেন সেই বিদেশি মানুষটার মতো অপরিচিত। দেখলেই রাগ হয়, মুখের ওপর জানালা বন্ধ করে দেবার মতো চোখে মা তাকিয়ে থাকে শুধু। সাজগোজের সময় সে কাছে থাকলে মা রাগ করে। বরং তার বুড়ি দিদিমাই তার তখন আপনার জন। মা সেজে গুঁজে বের হলে কে বলবে, এই হচ্ছে সনাতনের মা। সনাতন, দুই বাই একের এ নবীনচন্দ্র লেনের সনাতন-পরনের ইজের ছেড়া, পা ফাটা, চোখে পিচুটি এবং মুখের দুকষে ঘা। আগে আগে রাতে মা না ফিরলে সে বিছানায় বসে কাঁদত, বুড়ি তাড়াতাড়ি লম্ফ জ্বেলে সনাতনের মুখ দেখতে দেখতে ছড়া কাটতমা গেছে বনবাদাড়ে,-বাপ গেছে জাদুর দেশে, লক্ষ্মী ছেলে আমার রাজপুত্র, ঘোড়ায় চড়ে যা উড়ে যা। আরও কী সব সুর ধরে বলত। ছড়া কেটে অন্ধকারে বুড়ি দিদিমা ঘুম পাড়াত। ইদানীং কি হয়েছে, শীতের জন্য হতে পারে—কিংবা দুরারোগ্য ব্যাধি এই বুড়ির শরীরে, যার জন্য সনাতনকে মা বুড়ির সঙ্গে শুতে দেয় না। কাঁথা বালিশের ভিতর সারারাত বারান্দায় খোলা ঠান্ডায় কেবল গোঙায়। শীতে কষ্ট পায়। মা বুঝি ইচ্ছে করেই এবার শীতে, বুড়িটাকে মেরে ফেলবে।

রোদ খেয়ে কুকুরটার এখন তাজা প্রাণ। সনাতনের তাজা প্রাণ। কী সুন্দর রোদ। কী উত্তাপ। শরীরের সব ঠান্ডা মরে গেল। কেবল এখন দিদিমার ছড়া মনে আসছে। নিজেকে সুখী রাজপুত্র ভাবতে ভালো লাগে। তার জন্য ছোট্ট একটা আকাশ থাকবে, নদী থাকবে, ফুল ফল থাকবে, সেই মানুষটা এলেই সে সেইসব ফুল ফল পাখির জন্যে নিরুদ্দেশে চলে যাবে।

সে রোদের ভিতর কিছুক্ষণ বসে থাকল। খুপরি ঘরে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। রোদ আসে না ঘরে, মাথার ওপরে প্রাসাদের মতো অট্টালিকা। ছায়া ছায়া ভাব সব সময়। সূর্য আকাশে উঠতে না উঠতেই মরে যায়। মা সেই ঘরকে কতরকমের ছবি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। একটা ছবিতে সে দেখেছে, এক পদ্মফুল–নীচে জল, জল কালো। পাশে লম্বা পাহাড়। নীচে রেললাইন। ছোটো ছোটো লাল নীল কাঠের ঘর। সাদা মাঠ, ঠান্ডায় বরফ পড়েছে। রেললাইন দেখলেই একটা ট্রেনের কথা মনে আসে। মা তাকে একবার সুন্দর জামাকাপড় পরিয়ে তারকেশ্বর নিয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় সে দূরে একটা গাড়ি দেখেছিল, গাড়িটা থেমে আছে। মা বলছিল, ওটা মালগাড়ি। ওটা চলবে না। থেকে থেকে কেবল ঘণ্টা বাজাচ্ছিল, টংলিং টংলিং। টংলিং টংলিং ঘণ্টা ধবনি শুনলেই তার কেন জানি বাবার কথা মনে হয়। বুকের ভিতরটা ওর কেমন করতে থাকে তখন।

বড়ো পথ ধরে মেয়েরা সব স্কুলে যাচ্ছে। শীতের রোদে ওদের পোশাক কেমন ঝলমল করছে। নীল রঙের বাসে একদল ফুটফুটে মেয়ে বের হয়ে গেল। একটা কাক ডাকছে। দুটো শালিখ উড়ে গেল। দূরে কারখানায় ঘণ্টা পেটার শব্দ। সনাতনের বিস্বাদ লাগছিল—এক্ষুনি আবার ফিরে যেতে হবে। মা রাতে না ফিরলে একটু বেলা করে ফিরে আসে। মা এসে ওকে ঘরে না পেলে মারধোর করে। এমন খোলামেলা পথ, ফুটফুটে মেয়ে, রঙিন সব গাছ ফুল পাখি ছেড়ে ভিতরে নর্দমার মতো একটা অন্ধকার ঘরে ফিরে যেতে খুব খারাপ লাগছিল। ভাবাই যায় না। এত বড়ো একটা সদর রাস্তায় পিছনে দুই বাই একের এ বলে একটা খুপরি ঘর আছে। সেখানে তার বুড়ি দিদিমা কাঁথা বালিসের ভিতর ঠান্ডায় শক্ত হয়ে আছে।

ঘরে ফেরার মুখে সনাতন বুলিকে চাদরের তলায় লুকিয়ে ফেলল। যেন এই বুলির সঙ্গে সনাতনের একটা গোপন সলাপরামর্শ আছে। মা ঘরে আছে টের পেলেই চাদরের নীচে বুলি ভালো মানুষ হয়ে যায়। সন্তর্পণে সে বুলিকে ভাঙা তক্তপোষের নীচে হাড়িকুড়ির ভিতর লুকিয়ে ফেলে। মুখে একটা মালসা চাপা দিয়ে রাখে। মা যতক্ষণ বাড়ি থাকে ততক্ষণ সে বুলিকে লুকিয়ে লুকিয়ে শুকনো রুটি পাঁউরুটির অংশ, ছোলা ভাজা অথবা মুড়ি যা কিছু ওর ভাগে আসে, তার অংশ দেয়। বুলি চুপচাপ অন্ধকারে—যেন সে মৃত এক জীব, এই সংসারে তার অস্তিত্ব আছে বোঝাই দায়। মা ঘরে ফিরলেই দেখতে পায় সনাতন ভালো ছেলের মতো দোয়াত কলম নিয়ে বসেছে। সে অ আ ই ঈ লিখছে। মা তখন টেরই পায় না, এ-ঘরে একটা কুকুরছানা আছে।

রাস্তা পার হবার মুখে সনাতন বুলির মুখে চুমু খেল। তারপরই মনে হল কে যেন যায় গাড়িতে। বুঝি মা এবং সঙ্গে কে যেন। সে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঘরে ফিরে এল। কিন্তু আশ্চর্য ঘরে ফিরে দেখল ফেরেনি। বারান্দায় কাঁথা বালিশের ভিতর বুড়ি তেমনি পুঁটলি পাকিয়ে আছে। ওর খিধে পেয়েছে, বুলির খিধে পেয়েছে। বুড়ি দিদিমা উঠে এখনও শুকনো রুটি করতে বসছে না। সে ক্ষেপে গেল। ক্ষুধায় কাতর। গলা শুকনো। মা নেই ঘরে। মানুষটা কবে আসবে-শীতের পাতা ঝরতে আরম্ভ করছে অথচ মানুষটা আসছে না। হতাশায় ওর কান্না পাচ্ছিল। সে ডাকল, দিদি, ও দিদি। ওঠ। উঠে খেতে দে। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। শীতে কান ভোতা। সনাতনের এবার খিস্তি করতে ইচ্ছা হল-অ দিদি ওঠ। উঠে খেতে দে। না কোনো লক্ষণ নেই ওঠার। সে ক্ষোভে দুঃখে লাথি মারল কাঁথা বালিশে। তার পায়ের সঙ্গে সরে এল। দেখল, একটা মুখ, চোখে ঘোলা দৃষ্টি, নির্জীব, হা আমার সনাতন রে বলে ভ্যাঁক করে কেঁদে দেবার মতো মুখ করে রেখেছে বুড়ি। সনাতন ভয় পেয়ে ছুটবে ভাবল, আর তক্ষুনি গাড়ির শব্দ। মা একা ট্যাকসি থেকে নেমে আসছে। তাড়াতাড়ি সনাতন কি করবে কিছু ভেবে পেল না। কোথায় রাখবে বুলিকে, তাড়াতাড়ি কিছু করতে হয়। মা এসে যাচ্ছে। মার পায়ের শব্দ। সে কেমন হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে প্রতিদিনের মতো ঘরের অন্ধকার জায়গাটায় একটা হাড়ির ভিতর বুলিকে ঢুকিয়ে দিল। মালসা সে পেল না। লাফ মেরে বুলি বের হয়ে আসতে পারে। সে অগত্যা বুড়ির কাঁথা টেনে হাড়ির মুখটা জোরজার করে বন্ধ করে দিল। তাড়াতাড়ি করার জন্য কি যে হয়ে গেল কুকুরটার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মা এসে বারান্দায় তখন হাউ মাউ কাঁদছে। বিকালে শ্মশানে কারা যেন গেল। মা টাকা গুণে দিলেন। দুবার তিনবার সে ভেবেছে, দুবার তিনবার কেন, সে বার বার ভেবেছে একবার সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে দেখে তার সেই প্রিয় বুলি কেমন আছে। কিন্তু মা। আজ ঘর থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না। নোংরা ঘরদোর সব পরিষ্কার করছে। ধুয়ে পাকলে সব সাফসোফ করছে। হাড়ি পাতিল টানতেই ভিতর থেকে মরা কুকুরছানা বের হয়ে এল। মা কেমন বিরক্ত গলায় বলল হারে এই কুকুরছানা! সনাতন দেখল মার হাতে বুলি একটা মরা ইঁদুরের মতো দোল খাচ্ছে। ঠিক বুড়ি দিদিমার মতো চোখ উলটে আছে।

সে নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ ভাবল। সে বড়ো একা। সে নিঃশব্দে বুলিকে নিয়ে বের হয়ে গেল। আর তখনই দেখল, সেই জাদুকরের দেশ থেকে মানুষটা এসে গেছে। মার জানালায় দাঁড়িয়ে কী তার প্রাপ্য ছিল, তা এখন ফিরে পেতে চাইছে। মা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। তখন মানুষটা পাগলের মতো চাবুক উড়িয়ে দিল বাতাসে। ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। সে পথের ওপর হেলেদুলে ঘোড়া ছুটিয়ে নাচছিল। নটবর ঢোল বাজাচ্ছিল। বস্তির সব ছেলেছোকরারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা সনাতনকে ডাকল। সনাতন বুলিকে বগল তলায় রেখে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে যেন বলল, তুমি যাবে সেই ফুল ফলের দেশে? তুমি যাবে, যেখানে মানুষ দূরের সাগরে পানসী নাও ভাসায়। তোমাকে আমি নিয়ে যাব। বলে সে ফের নাচতে নাচতে, দুলতে দুলতে ঘোড়ার চড়ে যেতে থাকল। সনাতন পিছনে পিছনে নাচতে নাচতে, দুলতে দুলতে চলে যেতে থাকল। তার অ আ ক খ, দোয়াত কলম, স্বপ্ন দেখা সব পড়ে থাকল ঘরের অন্ধকারে। সে ফুল ফলের জন্য মানুষটার সঙ্গে বড়ো মাঠের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকল।

সনাতনের মনে হল মৃত বুলিকে, মানুষটা—সেই যে বলে না কোথায় এক জাদুর পাহাড় আছে, পাহাড়ের মাথায় ঝরনা আছে, ঝরনার জলে যাদুর মানুষটা যত দুঃখ আছে পৃথিবীর দূর করে দেবে, বুলির বুকে প্রাণপাখি—সে প্রাণপাখির আশায় মানুষটার পেছনে হাঁটতে থাকল। জাদুর মানুষ বহুরূপী, সাদা কাপড়ের

ঘোড়া আর সনাতন, বগলে তার মরা কুকুরছানা, সকলে তারা বড় একটা মাঠে নেমে গেল। নটবর মাঠে নেমেই জোরে জোরে ঢোল বাজাতে থাকল। যেন সে সকলকে বলে বলে চলে যাচ্ছে, শীতের শেষে সূর্য উঠলে আবার আমরা এ-শহরে তাজা কুকুর নিয়ে চলে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *