1 of 2

পাখির বাসা

পাখির বাসা

কদিন ভ্যাপসা গরমের পর সকালের দিকে বেশ বৃষ্টি হয়ে গেল। চরাচর মনে হল মুক্ত হয়ে গেল ভ্যাপসা গরম থেকে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কালবৈশাখীর তাণ্ডব এবারে একদিনও দেখা গেল না। জলবায়ুর কোনও পরিবর্তন কি না কে জানে। প্রিয়নাথ রোজই বের হন, বিকালে যতদূর পারেন হেঁটে যান। পার্কে বসেন। একটা সাঁকো পার হতে হয়। নড়বড়ে সাঁকোটা পার হওয়ার সময় সতর্ক থাকেন। ছ’টা বাজে, অথচ কণ্ঠদিন কি যে সূর্যের তাঁত—কেমন গরম লু বইত। আজ আরাম, আকাশ মেঘলা, গাছগুলির ফাঁকে চোখ খুলে আকাশ দেখলেন। পাতলা মেঘের ছড়াছড়ি। তার আজ হেঁটে যেতে ভালোই লাগছিল।

বয়েস হয়ে গেছে বলেই বাড়ি থেকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়—বেশি রাত কোরো না, সাঁকো সাবধানে পার হবে। তিনি হাসেন। তার বয়সিরা অনেকে হাতে লাঠি সম্বল করেছে, তিনি এখনও ঋজু। তার অসুখ বিসুখ নেই বললেই চলে। তিনি তাঁর বংশগতির জন্য গর্ব বোধ করেন। বংশানুক্রমিক জিন নামক বস্তুটি তাকে যে এতটা শক্ত সমর্থ রেখেছে, এটাও তিনি বোঝেন।

ছিমছাম তার বাড়ি, প্রশস্ত রাস্তা, কেয়ারি করা ফুলের বাগান এবং বাসস্টপ পার হয়ে গলি মতো রাস্তায় ঢুকে গেলেন—সারাদিন বারান্দায় কিংবা নিজের ঘরে কাজে কর্মে লিপ্ত থাকতে ভালো লাগে না। বাইরে বের হলেই মনের মধ্যে সুবাতাস বয়ে যায়। তিনি প্রফুল্ল বোধ করেন। আর তখনই দেখলেন, পার্কের এক কোণায় ঝোপের মতো আড়ালে দুজন নারী পুরুষ অশালীন অবস্থায় বড়োই কাতর হয়ে আছে। তার যে এত কৌতূহল এ-বয়সে আসা উচিত নয়, ওদের দিকে নজর দিতেই এটা টের পেলেন। এমন কি সেই নরনারী তাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিতও বোধ করল না। অবশ্য প্রিয়নাথ এই সব পার্কে এলে এবং ঘুরতে ফিরতে এমন দৃশ্য মাঝে মাঝেই দেখে ফেলেন। মাঝে মাঝে আফশোসও করতেন–একটু যে নিরিবিলি হাঁটবেন, কিংবা কোনও বেঞ্চে গিয়ে বসবেন তারও উপায় নেই। তার মতো বয়সি মানুষেরা দেখতে পেলেই হাঁকবে—আরে কী দেখছ। মিলেনিয়ামের শুরুতে এ-সব যে বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের নয় প্রিয়নাথ। সোজা নাক বরাবর তাকিয়ে এদিকটায় চলে এসো। বেঞ্চি এখনও খালি আছে। দেরি হলে দখল হয়ে যাবে।

প্রিয়নাথ ভাবলেন, এসবের উপাদানে গঠিত সমাজ কেমন হবে। কোন ধারা স্পষ্ট হবে আগামী হাজার বছরে—।

বয়েস যত বাড়ছে, চারপাশের বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং যৌনতা কিংবা যৌনতাই প্রাণের নির্যাস এবং প্রাণের নির্যাস মৃত্যু—এ-সব চিন্তা ঘুরপাক খেলেই মনে হয় যন্ত্রপাতি এবং খাপে খাপ লেগে যাবার মতো মানুষ বোধ হয় এই সহস্রাব্দেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুশিমতো তৈরি করে নিতে পারবে।

বৈদ্যনাথ তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন। কিছুটা কিচর প্রকৃতির মানুষ বৈদ্যনাথ। তার রসিকতা কখনও মাত্রাতিরিক্ত মনে হয়। সান্ধ্য ভ্রমণের দোসর। কিছু বলাও যায় না। সে বোধ হয় কাতর প্রকৃতির নরনারীর দৃশ্য আরও স্পষ্ট দেখার জন্য অছিলা করে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। প্রিয়নাথ বাধ্য হয়ে বললেন, বোসো, আমি যাচ্ছি। বলে তিনি কী যেন খুঁজলেন।

আকাশে দুটো একটা নক্ষত্র ভাসমান। দূরে, চারপাশের সুসজ্জিত অট্টালিকা সমূহ ভেদ করে পাখির ঝাঁক উড়ে আসছে। শহরের উপর দিয়ে একটা কালো বর্ডার তৈরি করতে করতে তারা চলে যাচ্ছে। আর তখনই কেন যে মনে পড়ল, তাঁর বাড়ি যাবার রাস্তায় আজ সকাল থেকেই নো এন্ট্রি বসানো হয়েছে। মোড়ের রাস্তাটায় পুলিশও আজ ব্যস্ত।

তিনি বেঞ্চিতে বসার সময় পতিতপাবনবাবু সরে বসে জায়গা করে দিলেন। এ দিকের বেঞ্চিগুলিতে চার পাঁচজন অনায়াসে বসা যায়। নীচে ঘাসেও বসা যায়। তবে সকালে বৃষ্টি হওয়ায় মাটি বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। তিনি বসার সময়ই বললেন, আজ সকালে ভারী একটা মজা হয়েছে হে।

আগে ঠিক হয়ে বোসসা। তারপর মজার কথা শোনা যাবে। চারপাশে এত মজা থাকতে, তোমার গলির মধ্যে শেষে মজা ঢুকে গেল সে কি হে। হলধর সান্যাল একটু ঝুঁকেই কথাটা বললেন।

আসলে এখন জ্যোৎস্না ওটার সময়। এত বড়ো মাঠে শুক্লপক্ষের রাতগুলি খুবই সুন্দর। যেমন আবছা মতো জ্যোৎস্নার এক কুয়াশা সৃষ্টি হয়। অস্পষ্ট রহস্যময়তা, নারীর প্রথম দিবসে পুরুষের রতিক্রিয়ার মতো।

বৈদ্যনাথ মাথার টুপি খুলে খানিকটা চুলকে নিলেন। টাকমাথা ঢেকে রাখার এই প্রয়াস বেঞ্চিতে বসে থাকলে রক্ষা করা যায় না। হলধর বললেন, টুপিটা আমার হাতে দাও। তারপর আরও আরামে চুলকাও। আরাম, বুঝলে আরামই এ-বয়সে একমাত্র কাম্য। কিন্তু প্রিয়নাথবাবু, আপনার মজার কথাটা শোনা হল না। সিগনালিং পোস্টের মাথায় কখন কোকিল একটা বাসা বানিয়ে ফেলেছে।

প্রিয়নাথবাবু, কোকিল তো বাসা বানায় না। ওই হল কাক। স্ত্রী কাকেরই বোধহয় কাজ। এটা ঠিক বাসাটি কোনও স্ত্রী কাকের কম্ম না কোনও অন্য পাখির করা সেটা বলা অবশ্য মুশকিল। বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখাও যায় না। আমাদের রঘু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, কর্তা! মন্দিরের রাস্তায় নো এন্ট্রি পড়ে গেছে। গাড়ি বাস কিছুই ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। রাস্তার মাথায় একটা পাখি বাসা বানিয়ে ডিমে তা দিচ্ছে।

বৈদ্যনাথ টুপি মাথায় দিয়ে সমস্যার জট খোলার চেষ্টা করলেন, ভি আই পি-র আগমন ঘটছে কি না দ্যাখ।

ধুস! প্রিয়নাথ ধুস শব্দটি বলে তার বাড়ির রাস্তাটি যে প্রশস্ত নয়, কোনও ভি আই পি যাবার রাস্তাও নয়, বড়ো রাস্তায় জ্যাম হলে গলিঘুজি ধরে বের হয়ে যেতে গেলে রাস্তাটির খুব দরকার হয়। দরকারে বাসটাসও যায়। আর ট্যাক্সি কিংবা হাতে টানা রিকশাও ঢোকে। কেন যে নো এন্ট্রি, খুবই অর্থহীন।

তা হলে মজাটা কী হল! পতিতপাবনবাবু মজা খুঁজছেন।

সেই। তবে মজা আছে। আচ্ছা পুলিশের টুপি লোহার না পেতলের হয়? টুপি মানে হেলমেট। আপনারা জানেন? প্রিয়নাথ লোহা না পেতল জানতে চাইছেন। খুবই সমস্যা। লোহা না পেতল, বলা খুবই মুশকিল। সবাই চুপ। ওই হবে একটা। মজা তো আর লোহা কিংবা পেতলে আটকে নেই।

তা অবশ্য নেই। সেই আপনার মতো বৈদ্যনাথবাবু সারাদিন পুলিশই বা এই উত্তপ্ত গরমে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে কী করে। মাথা চুলকাতেই পারে। সিগনালের থামে মাঝে মাঝে টুপিটা রেখে দেবারও স্বভাব। হাওয়া না খেলে মাথা ঠান্ডা রাখা যায় না। ডিউটি শেষে পুলিশের কেন যে মনে ছিল না টুপিটা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। তবে মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। হয় কি না—প্রিয়নাথ সবার সমর্থন চাইলেন।

আপনি বলে যান।

প্রিয়নাথ বললেন, বুঝলেন পুলিশটির ফের হপ্তা দুই পর আবার সেই পোস্টের নীচে ডিউটি। ডিউটি দিতে এসেই মনে পড়ে গেল, আছে, টুপিটা তো এখানেই সে ফেলে গেছে।

হলধর চেঁচিয়ে উঠল, অফিস কি ভ্যারাণ্ডা ভাজছিল। পুলিশের টুপি গায়েব, পুলিশের কখনও চাকরি থাকে।

বৈদ্যনাথ না বলে পারল না, হলধর কোন যুগে বাস করছ। রাতে প্রায়ই তো মার্কিন মুল্লুক থেকে ফোন আসে। পুত্ররা ফোনে তোমার কুশল নেয়। মনে হয় পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলছ। কী, ঠিক কি না। যুগের হাওয়া কত বদলেছে বোঝ না। খুনেরই কিনারা হয় না, আর একটা সামান্য টুপি…প্রিয়নাথ আপনি বলুন।

প্রিয়নাথ বলল, সেই। আমি অবশ্য বলতে পারব না—টুপি হারালে পুলিশের কী শাস্তি হয়। শাস্তি হয়েছিল কি না তাও জানি না। তবে পুলিশটির কর্তব্যবোধ খুব যে প্রখর বুঝতে অসুবিধা হয় না। পুলিশের এটুকু পরিবর্তন কি খুব বেশি মনে হয়। টুপি খুঁজতে গিয়ে দেখে তার মধ্যে একটা পাখির বাসা। আর গণ্ডাখানেক ছোটো ছোটো ডিম। মানে এগ। রতিসুখের স্মারক। পুলিশ রোয়াকে উঠে উঁকি দিয়ে দেখার পরই গোলমাল হয়ে গেল। টুপিটা একটা পাখির বাসা হয়ে গেছে। ডিম ফুটে বাচ্চা না হলে, বাচ্চা উড়ে না গেলে টুপিটা তুলে নিলে তাকে সবিশেষ পাপের ভাগি হতে হবে। বাসাটা ভেঙে দেওয়া উচিত না-পুলিশও ভাবছে বুঝুন।

পাপ কেন?

পাপ হবে না! জীবন নিয়ে খেলা। টুপি সাফ করতে গেলে বাসাটাও সাফ করতে হয়। পাখি বসবে কোথায়, ডিমে তা দেবে কোথায়। শুধু কি ডিম, ডিমের মধ্যে যে জীবনের কথা আছে। টুপি হারিয়ে তো খারাপ ছিল না, টুপি পেয়েও মজা। টুপি আর বলাও যায় না, একটা বড়ো পাখির বাসাই মনে হয়, এটুকু পরিবর্তনে পুলিশ বেচারা ধন্ধে পড়ে গেল। টুপি না ডিম সে কাকে রক্ষা করে।

হলধর বিরক্ত হয়ে বলল, শেষে কী হল! মজা কোথায়?

কী বুঝেছে পুলিশ, সেই জানে। সে রোয়াক থেকে নেমে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, চুউপ! পাখি ডিমে তা দিতে আসবে। কোনও শোরগোল বরদাস্ত করা হবে না।

তা পাখি ডিমে তা দিতে আসতেই পারে প্রিয়নাথবাবু। পাখি কি গোলমাল পছন্দ করে না! তা তো বলতে পারব না। পুলিশ বলতে পারবে। রাস্তাটা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব তার। কাকে ঢুকতে দেবে কিংবা দেবে না, সেই ঠিক করবে। সে চায় না কোনও গণ্ডগোলে পাখি উড়ে না আসুক, পাখিরও তো প্রাণের ভয় আছে। বেচারা ভুল করে সিগনাল পোস্টে না হয় বাসা বানিয়ে ফেলেছেই—তাই বলে তার ডিমের তো অনিষ্ট সাধন করা যায় না। এর একটা মানবিক দিকও আছে। পাখি গণ্ডগোল সহ্য করতে নাও পারে।

বৈদ্যনাথ ফোড়ন কাটল, ভারী দায়িত্ববোধ দেখছি পুলিশের।

হলধর বলল, আপনি কি দেখেছেন পাখি দুটোকে?

আজ্ঞে না। তবে গুজব নানা প্রকার। পাড়াসুদু গুজব গুজবের তো মাথামুণ্ডু থাকে না, বিশেষ করে স্ত্রী জাতির ক্ষেত্রে পাখি ঠিক পাখি নয়, পাখি ঠিক ওড়েও না। বাতাসে কুয়াশার মতো ভেসে থাকে। তারপর ঝুপ করে বাসাটার উপর বসে পড়ে। ঠোঁট আছে তবে খুবই ভোঁতা, চোখ দুটো চিংড়ি মাছের মতো। লেজের দিক বিস্তৃত, তবে মনে হয় স্বর্ণ পুচ্ছ—

আপনি দেখেছেন কি না বলুন।

না দেখিনি। বাড়ির মেয়েরা বলাবলি করছিল। রাস্তায় নো এন্ট্রি লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষজন যেতে পারে, হাঁটতে পারে, তবে জোরে কথা বলতে পারে না। পুলিশের সতর্ক চোখ কানকে ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় ঢোকাও মুশকিল-পাশের জানালায় একটা বাচ্চা মেয়ে বেলুনে ফুঁ দিচ্ছিল–ফটাস। পুলিশ ছুটে গেছে জানালায়। লাঠি তুলে হাঁকছে পিনড্রপ সায়লেন্ট। ডিমে তা দিচ্ছে—রতি সুখের অন্তিম নির্যাস, ডিম, তারপর ছানা, ছানা হাওয়ায় উড়ে গেলেই পুলিশ স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে টুপিটা নিয়ে গিয়ে সেরেস্তায় জমা দেবে।

পতিতপাবনবাবু চুপচাপ শুনছিলেন, আসলে বয়েস হলে যা হয়— অবসর জীবন, সময় কাটে না। বিকেলবেলাটায় বেড়াতে বের হলেই মনে হয় সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। বাজার দর, রাজনীতি, খুন, ধর্ষণ, এই তো সেদিন, হাসপাতালে এক মহিলা, তার মেয়ে জাতকটিকে জানালা দিয়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল, অপরাধ তার পেটে মেয়ে কেন জন্মাল, শতকটি শুরু হতে না হতেই যত সব বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড, আর প্রিয়নাথবাবুও আছেন— রাজ্যের আজগুবি খবর নিয়ে বুড়োদের আসর মাতিয়ে রাখার স্বভাব-খারাপ লাগে না শুনতে। সময়ই কাটে না, তবু মাঝে মাঝে এই পার্কটায় খোলামেলা নারী পুরুষের আবির্ভাব ঘটে—দূর থেকে আড়ালে এ-সব দেখার মধ্যেও মজা আছে। এই তো সেদিন এক যুবতী তার প্রেমিক পুরুষের পেছনে ধাওয়া করছিল। যুবক ছুটে পালাচ্ছে—রাতের জ্যোৎস্না, তারা তো ভাবলেন, কী না কী হয়েছে! ছুটে গেলে তাজ্জব। নারী অথবা পুরুষের শরীরে কোনওই আব্রু ছিল না।

প্রিয়নাথ বলেছিলেন, এই হল গে নারী জাতি–প্রিয়নাথের এমনই স্বভাব, সে কত যে খবর রাখে। বইয়ের পোকা হলে যা হয়। সারাদিন অবসর জীবনে পত্রপত্রিকায় ডুবে থাকলে, প্রিয়নাথেরই বা দোষ কোথায়!

তখন তার প্রশ্ন করার হক থাকতেই পারে, মানুষ, জৈবপ্রযুক্তি, অর্থনীতি আর বিজ্ঞান–এ-সবের উপাদানে গঠিত সমাজ কেমন হবে? আগামী হাজার বছরে কোন ধারা স্পষ্ট হবে? মেসিন কি মানুষের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান হবে! মেসিনই কি মানুষ তৈরি করবে, এমনকী বুদ্ধিমান অথবা চেতনা সম্পন্ন। এতটাই যে তার শরীর বদলানো যাবে নাট বল্টর মতো? কিংবা নরনারীর সম্পর্ক—প্রিয়নাথ আসলে এই আড্ডার প্রাণ। সে এ-সব নিয়েই বেশি কথা বলতে ভালোবাসে।

আজ যে কী হল প্রিয়নাথের।

তার বাড়ির রাস্তায় নো এন্ট্রি। সেখানে নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। মানুষজন পা টিপে টিপে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। সামান্য গণ্ডগোল হলেই পুলিশের তাড়া খাচ্ছে। তাড়া খেয়ে দৌড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে পুলিশ বেচারা মাথায় হাত দিয়ে তার হেলমেট খুঁজছে। মাথায় নেই এবং সঙ্গে সঙ্গে পাখির বাসাটার দিকে চোখ। পাখিটা ডিমে তা দিচ্ছে—কী যে মধুর!

পতিতপাবন না বলে পারলেন না, আরে একটা হতকুৎসিত পাখির জন্য পুলিশের এত তাড়া কেন বুঝি না। পাখি ডিমে তা দেবে, তার কোনও উপদ্রব না থাকে, সেজন্য কেউ রাস্তায় নো এন্ট্রি ঝুলিয়ে দিতে পারে! পুলিশ যানবাহন মানুষজন তাড়া করতে পারে! রহস্যটা কি প্রিয়নাথ!

রহস্য! পুরুষ ডুবছে। প্রিয়নাথ হাই তুলে বললেন।

ডুবছে মানে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আর থাকছে না। পুলিশ স্ত্রী পাখিটাকে এত তোল্লা দিচ্ছে কেন বোঝ না!

নারীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হবে বলছ প্রিয়নাথ। সেই আদিসভ্যতার মতো। জননী ঘিরে রাখছে সব কিছু।

ওরকমই কিছু। নারীত্বের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে আগামী হাজার বছরে নারী তার হারানো ক্ষমতা উদ্ধার করবে। আরে পুরুষ! বাদ দাও। আমাদের সময় একরকম ভাই চলে গেল কিন্তু আগামী দিনে ভয়ংকর এক জীবন পুরুষের। বোঝাই যায় তার নারীর চেয়ে বুদ্ধি কম, নারীর চেয়ে তার অসুখ বিসুখ বেশি। তার পরমায়ু পর্যন্ত গড়ে নারীর চেয়ে কম। কোন দিক থেকে তোমরা লড়বে ভাবছ, নারী খুবই দুর্বল প্রজাতি! দেখলে সেদিন জ্যোৎস্নায় বীরপুঙ্গব নারীর তাড়া খেয়ে কেমন ছুটছিল।

পাখিটাতো পুরুষ পাখিও হতে পারে প্রিয়নাথ।

তুমি হলধর, অতিমাত্রায় একটি গর্দভ বিশেষ। পুরুষ পাখি ডিমে তা দেয় কখনও! স্ত্রী পাখি না হলে, পুলিশের কি দায় ছিল, নো এন্ট্রি ঝুলিয়ে দেবার! অজ্ঞাতে এটা পুরুষের প্রস্তুতি পর্ব-পুলিশ মানুষের সভ্যতার পাহারাদার। সেই প্রথম টের পেয়েছে। তার কোনও দোষ নেই। সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে নারীজাতির ইচ্ছাই সব মেনে নিতে হবে।

সহসা সবাই চুপ হয়ে গেল। প্রিয়নাথের কথাবার্তা শুনে না, তাদের আর কোনও প্রশ্ন ছিল না, নানা কারণেই এই চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব। জ্যোৎস্নায় পার্ক পার হয়ে রাস্তায় আলো জ্বলতে দেখল সবাই। এই পার্কটায় জায়গায় জায়গায় কৃত্রিম ঝোপ সৃষ্টি কোনও নগরপালের নির্দেশে কি না তারা তাও জানে না। হাঁটতে হাঁটতে এই পার্কটায় আড্ডা দিতে আসা কোনও অদৃশ্য যৌনতার খোঁজে–এমনও হতে পারে। পাশের বেঞ্চ থেকে নিবারণবাবু উঠে যাবার সময় বললেন, আডড়ার বিষয় কী ছিল, আপনারা সবাই এত চুপচাপ।

আড্ডার কী বিষয় ছিল আজ নিবারণবাবু জানতে চায়। রোজই কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে যে আড্ডা শুরু হয়, তবে শেষ পর্যন্ত বিষয় যে এক থাকে না, এও ঠিক তবে আজ বিষয়টা একটু মাত্রাতিরিক্ত ভাবেই নারী বিষয়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়নাথই বলেছিলেন, আজকাল খবরের কাগজে কত সব মজার মজার খবর বের হয়—বিজ্ঞানীরা নাকি বলছে, এই সহস্রাব্দ স্মরণীয় হবে নারীত্বের জয়লাভে। পুরুষের পেশিশক্তি আর কাজে লাগবে না। মস্তিষ্কই সব।

হলধর বলল, আড্ডার বিষয় ওই একরকম গতানুগতিক। প্রিয়নাথের রাস্তায় নো এন্ট্রি ঝোলানো হয়েছে। সেই নিয়েই কথা বলছিলাম। আপনি যাচ্ছেন?

হ্যাঁ যাই। কাজের মেয়েটার যাবার সময় হয়ে গেছে। না গেলে প্যান প্যান করবে। নোটিশও দিয়ে দিতে পারে, অন্যালোক দেখুন বাবু। আমার পোষাবে না। একা মানুষ বুঝতেই পারেন।

আর কেউ কোনও কথা বলছে না বলে, হলধরও বলল, আমরাও উঠব।

নিবারণবাবু চলে গেলে, পতিতপাবন না বলে পারলেন না, রেখেছিস তো রক্ষিতা। একা কোথায়। মাঝবয়সি–মেয়েটা তো তোকেও সামলায়, বাড়িও সামলায়।

এটা আপনার ঈর্ষা পতিতপাবনবাবু। একা বেঁচে থাকা তো সত্যি কষ্ট।

কেন আমাদের প্রিয়নাথ আছে না! তার ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনি ভরা সংসার।

প্রিয়নাথ বললেন, আছি। ওই আর কি! আমরাও এবারে উঠি। রাত হয়েছে। আজকাল একটু দেরি হলেই বাড়িতে চিন্তা শুরু হয়। অথচ আমার কেন যে বাড়ি যেতেই ইচ্ছে হয় না।

প্রিয়নাথকে বড়ো বেশি মিয়মাণ দেখাচ্ছে। সবাই উঠলেও প্রিয়নাথ উঠল না। মাথা গোঁজ করে বসে আছেন।

কী হল, যাবে না!

তোমরা এগোও।

আসলে প্রিয়নাথের কেন জানি একা থাকার স্পৃহা জন্মাল। পার্কের গেট পর্যন্ত এক সঙ্গে যেতে পারতেন, সেখানে রিকশায় উঠলেই খালের সাঁকো, তারপর কিছুটা হেঁটে গেলেই বাড়ি। এখন আর তার প্রতীক্ষায় কেউ বসে থাকে না। চিন্তা হয় ঠিকই, একটা আস্ত মানুষ হারিয়ে গেলে চিন্তা হবারও কথা। চিন্তা, আর প্রতীক্ষা যে এক না।

তা হলে যাচ্ছি?

তোমরা হাঁটো। আমি একটু পরে যাচ্ছি।

আসলে প্রিয়নাথ কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তাঁর কিছু ভালোও লাগছে। এই সহস্রাব্দের শুরুতে নারীত্বের সাম্রাজ্যবিস্তারের পূর্বাভাস দিয়ে আড্ডা শুরু হয়েছিল ঠিকই, মেয়েদের পরমায়ু বেশি, জরা ব্যাধি কম কিন্তু নিজের জীবনে সুধা শুরুতেই থায়রয়েড, ব্লাডপ্রেসার, শেষে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে হঠাৎ ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। অথচ আশ্চর্য, সুধা সারাজীবন তাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল শরীর দিয়ে। সুধা নেই, তিনিও নেই। সব কেমন ফাঁকা অর্থহীন।

তিনি ভাবলেন, ডিম ফুটে ছানা হয়। আসলে সেক্স। অথচ কী আশ্চর্য সেক্সের আবির্ভাব বিবর্তনের চাপে। কোথায় যেন পড়েছিলেন। কোটি কোটি বছর আগে কোনও এক সময় প্রাণীজগতে যৌনতা এসেছিল নেহাতই একটা দুর্ঘটনা হিসাবে। কোথায় যেন পড়েছিলেন। স্ত্রী প্রজাতিই তার আদি স্বাক্ষর।

তিনি হাঁটছিলেন।

লক্ষ কোটি বছর আগেকার কোনও এক ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলেন প্রিয়নাথ। প্রাণীজগতের সেই চরম মুহূর্তে নারীর পুরুষ তৈরির মুহূর্তে তিনি যেন নারীর শরীর থেকে বের হয়ে আসছেন। অজগর সাপ যেন উগলে দিচ্ছে তাঁকে। কী সব দেখলেন, চারপাশে শুধু ঢেউ, কিংবা পাহাড় কিংবা বালিয়াড়ি। অতিকায় অজগর যেন উগলে দিয়ে তাকে শুঁকে দেখছে। যেমন গাভী তার বাছুরকে জন্মের পরে লেহন করে-শরীর তাঁর লাল ঝোলে মাখামাখি। নারীর পুরুষ নির্মাণ এমনই কোনও হেতু থেকে। তিনি হাঁটছিলেন। রিকশা নেবার কথা, তা নিতে ভুলে গেছেন। বিশাল পাঁচিল, তার পাশে বিজ্ঞান ভবন, তার পাশে সরকারি কর্মচারীদের বিশাল বিশাল হাইরাইজ বিল্ডিং—তার ভিতর পোকা মাকড়ের মতো অজস্র সংসার, এবং অজস্র জৈবিক তাড়না। নারীর পরিতৃপ্ত থাকার আয়োজন। তিনি হাঁটছিলেন, সুধা কত কষ্ট করে সারাজীবন তাকে ভালোবাসতে চেয়েছে। অসুখবিসুখে সে তার কর্তব্য করে যেতে বিন্দুমাত্র অবহেলা দেখায়নি। বড় কষ্ট হয় একা ফাঁকা ঘরে ঢুকতে। বিশ্বাসই করতে পারেন না, সুধা নারী প্রজাতির আদিম অস্তিত্ব। প্রেম এবং সৌন্দর্য ছিল তার নদী তীরে বালুবেলার মতো। সুধার জন্য সহসা তার বড়ো কষ্ট হতে থাকল—সুধার মৃত্যুদৃশ্যে তিনি বড়ো কাতর হয়ে পড়লেন। তাঁর গলা বুজে আসছে। তিনি সাঁকো পার হয়ে গেলেন। বাড়ির রাস্তায় দেখতে পেলেন সেই পাখির বাসাটা। তার আর হাঁটতে ইচ্ছে হল না। এই গ্রহের আদি এবং অনন্ত ইচ্ছের কাছে মাথা নত করে পাখির বাসাটার নীচে বসে পড়লেন। তাঁর বাড়ি ঘরের কথা মনে থাকল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *