1 of 2

বৃদ্ধ ও প্রতারক

বৃদ্ধ ও প্রতারক

তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আজকাল তাঁর কিছু মনেও থাকে না। বয়স হলে যা হয়। সকালে দেশ থেকে মেজভাই দেবীপদর ফোন পেয়ে তিনি কিছুটা উতলা। তাঁর দেশে যাওয়া দরকার। তাঁর কথায় দেবীপদর পুত্র বাবু। রাজনীতির শিকার, এবারের পঞ্চায়েতে ছাপ্পা ভোট দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তারপর মারধর যা হয়, এখন সে বিছানায়। বিরোধীদলের লোকেরা তার লাশও ফেলে দেবে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। এই বিড়ম্বনার হেতু যে তিনি এমনও ফোনে অভিযোগ করেছে। এটাই তিনি মনে করতে পারছেন না।

বিড়ম্বনার হেতু তিনি কেন হবেন!

বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ মায়ের মৃত্যুর পরই কমে গেছে। মা বেঁচে থাকতে বছরে অন্তত দু-তিনবার দেশে যেতেন। দেশের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করারও টান বোধ করতেন। গোটা একটা গ্রামই দেশভাগের পর প্রায় একসঙ্গে না হলেও সামান্য এদিক-ওদিকে এই দেশে এসে চেনাজানা লোকের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল পুরো গ্রামটাই বাবা-জ্যাঠার টানে হাজির। আমার বাবা-জ্যাঠারা আবার চিঠি দিয়েও জানিয়েছিলেন, ও-দেশে হিন্দুরা থাকতে পারবে না। দাঙ্গা ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ লেগেই থাকবে। ইজ্জত রক্ষার্থেও হিন্দুস্থানে তোমাদের চলে আসা দরকার। এখানে সবই সস্তা। ফাল্গুন-চৈত্রে এক পয়সায় দু সের বেগুন পাওয়া যায়। সতেরো টাকায় এক মন চাল। বাজারে দেশের সবরকমেরই মাছ পাওয়া যায়। এমনকি কাচকি মাছ পর্যন্ত। সামান্য দু-পা হেঁটে গেলে ভাগীরথী, প্রতিদিন নদীতে ডুব দিলে পুণ্য অর্জনেও অসুবিধে হয় না। সস্তায় জমি, সস্তায় চাল, ডাল, মাছ এবং পুণ্যসঞ্চয় এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো আর।

ফলে যা হবার হয়েছে।

চেনাজানা এবং দেশের আত্মীয়স্বজন প্রায় একলপ্তে জমিজমা কিনে, বাড়িঘর করে একসঙ্গে আছে সেই কবে থেকে। বিপদে-আপদেও আছে, পালাপার্বণেও আছে।

বিড়ম্বনার হেতু তিনি কেন, দেবীপদ তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন তুলছে ফোন করেই জানতে পারতেন। কিন্তু কেন যে তাঁর মনে হল–বাবুর সঙ্গে দেবীপদও সন্ত্রাসের শিকার। বিরোধীদলের লোকজনদের নিকেশ করে দেবার সঙ্গে ক্ষমতা দখলের জোর লড়াই হচ্ছে—সে ভাবতে পারে তিনি কাছে থাকলে যতই সন্ত্রাস হোক, তার কিংবা বাবুর কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং সম্রান্ত আচরণে প্রতিবেশীরা কমবেশি সবাই আকৃষ্ট হয়। এবং তাঁর খ্যাতিরেও সবাই শরিক হতে চায়। দ্যাশের লোক সোজা কথা।

তবে ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না। সংসারের অজস্র হ্যাপায় তিনিও যথেষ্ট নাস্তানাবুদ। তার নাতি-নাতনিরা স্কুলে কলেজে পড়ে। যা দিনকাল সতর্ক নজর না রাখলেও হয় না। সে যাই হোক দেবীপদর এতবড় বিপদে তার পাশে থাকা দরকার। তা ছাড়া বাবু গত সাত-আট বছর তাঁর বাড়িতেই ছিল। এবং বাড়িটায় তিনতলা মিলিয়ে দশটি ঘর, বাঁধা মাইনের দু’জন চব্বিশ ঘণ্টার লোকও আছে। প্রায় হোটেলের মতো হয়ে গেছে তাঁর বাড়ি। অসুখেবিসুখে ভালো চিকিৎসার দরকার হলে, দেশের ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবারই চাকরির খোঁজে কিংবা চাকরির সূত্রে থাকার অস্থায়ী বন্দোবস্ত এই এক ঠিকানা—কী আর করবে। বড়দার শরণাপন্ন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আসলে আমার বড়োপুত্রটি শহরের সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসক, থাকা-খাওয়া এবং পরামর্শও পাওয়া যাবে ভেবেই তারা আসত। সম্প্রতি কয়েকবছর ধরে জেলা সদরেই চিকিৎসার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে বলেও হতে পারে, আবার আত্মাভিমানও মানুষের জাগ্রত হতে পারে, কারণ কে এখন আর কোনও গলগ্রহ হয়ে বেড়ায়। তবে তাঁর কপাল মন্দ, ভাইপো বাবুকে কোথাও অনেক চেষ্টা করেও চাকরির সুযোগ করে দিতে পারেননি। কোনওরকমে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে বসেছিল, সে কলকাতায় তাঁর বাড়িতে উঠে এসেছিল একটা ক্যামেরা সম্বল করে। দেবীপদও জানিয়েছে, বাবুর ফটোগ্রাফির হাত ভালো, তুমি চেষ্টা করলে ঠিক কোনও চ্যানেলে ঢুকিয়ে দিতে পারবে। বাবু বিয়ের অন্নপ্রাশনের ছবি তুলে বেড়ায়, এ-লাইনে এত প্রতিযোগিতা যে সে পেরে উঠছে না। বিশ বাইশ হাজার টাকায় এতসব সস্তা ভালো ক্যামেরা পাওয়া যায় যে শুনেছি সিরিয়ালের ছবিও সেইসব ক্যামেরায় তোলা যায়।

সমাজে তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত বলে প্রথমেই তিনি মৃণাল নন্দীকে ফোন করলেন।

আজ্ঞে বলুন ভবেশদা।

তুমি তো সিনেমার লোক, ছবির এডিটিং-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছ। এদিকে দেশ থেকে কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে জ্যাঠার বাড়িতে ভাইপো হাজির। কোনও চ্যানেলে ছবি তোলার যদি সুযোগ করে দিয়ে পারে।

মৃণাল শুধু বলল, চেষ্টা করবে—তবে সিনেমা কিংবা সিরিয়ালের ছবি তোলার কাজটা খুব সহজ নয়—বাবুকে তবু দেখা করতে বলল সে। তারপর একদিন বলল হল না দাদা। খুবই কাঁচা হাত। ওকে বরং সরকারি ব্যবস্থায় ফটোগ্রাফির অ আ ক খ শিখে নিতে বলুন। ইয়ুথ হস্টেলে এ-মাসেই একবছরের সেশন শুরু হচ্ছে। ওটা শেষ হলে চিত্রবাণীতে ভর্তি করে দিন। বছর দু-এক পরে আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।

বাবুর চোখ দুটো মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। বাবু এখানে থাকবে শুনে তার জেঠিও খুশি। শত হলেও বাড়ির ছেলে, না-ও করা যায় না। তারপর এই থাকা না-থাকার বিষয়টা সবই নির্ভর করে জেঠির পছন্দ-অপন্দের উপর। সুতরাং তিনি যখন রাজি, বাবু থেকে গেল। দেবীপদকে জানালেন বাবু এখানেই থাকবে। আপাতত কোনও কাজের ব্যবস্থা করা যায়নি।

তারপর লিখলেন, ছবির বিষয়ে এখানে দুটো কোর্স আছে, সেটা শেষ করুক। বাবু তো বলল, অ্যাডমিশন এবং মাইনে নিয়ে প্রথম দফাতেই যে টাকাটা লাগবে সেটা তুমি দেবে।

এখানে বলে রাখা ভালো, সে-সময়ে দেবীপদর বাড়িতে কোনও ফোনের সংযোগ ছিল না। মোবাইলও নেই। তার, ফলে চিঠি না লিখেও ভাল বাবুর উপায় নেই। তবে খুব জরুরি বার্তা থাকলে এস টি ডি বুথ থেকে করা যায়। বাড়ি থেকে বেশ দূরে—শত হলেও দেশের বাড়ি তাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম জায়গায়, জমিজমা এবং ফলের গাছও কম নেই। সবই ভাইরাই ভোগ করে। দিন যত যাচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, দেবীপদ এবং কালীপদ শুধু মাঝে মাঝে জানায়, গাছ বিক্রি করতে হবে, বাড়িতে ভাইপোদের একটি সাইকেল দরকার, ফল বিক্রি হয়, পুকুরের মাছও বিক্রি হয়। ভবেশ জানেন, ভাইরা অভাবী, একজনের মুদি দোকান, অন্য দুজন সরকারি অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, বাবা বেঁচে থাকতে চিঠিতে তাদের কথা থাকত—তারা যে লেখাপড়া করতে চায় না, সে কথাও থাকত।

অতীত কথনে দেখা যায় ভবেশবাবুও নানা ঘাটের জল খেয়ে শেষমেশ এই শহরে, একটি বিখ্যাত দৈনিকের সহসম্পাদক এবং লেখালেখিতে প্রভূত অর্থ উপার্জনও হয়।

ক্রমে সব দায় তারই মাথার উপর যেন। বাবার চিঠিতে শুধু আক্ষেপ, তাঁর পুত্ররা ক্রমে অমানুষ, তার মাসোহারায় আর চলে না-পুত্ররা বিয়ে থা করে বাবা বেঁচে থাকতেই পৃথগন্ন। তাদের পুত্রকন্যাদের দায়ও ভবেশবাবুর ওপর। ভবেশবাবুর নামে পরিবারে তখন গগন ফাটে। ভাইঝিদের সম্বন্ধ দেখতে এলে ভবেশবাবুর নাম কথাবার্তায় জড়িয়ে দিত, এবং পনের টাকার জন্য ভাবনা নেই, বড়দা আছে না। আপনাদের মেয়ে পছন্দ কি না বলুন। আবার বিয়েই শেষ নয়, কন্যা গর্ভবতী, সদর থেকে ডাক্তার বলে দিয়েছে জরায়ুতে জলাভাব, পুরো দশ মাস চালাতে গেলে জরায়ুর জলাভাবে শিশুটির মৃত্যু অবধারিত এবং অকাল প্রসবের সম্ভাবনা এবং অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন ভবেশই। কলকাতা শহরের হাসপাতালে এবং নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচারের পর যে ইনকিউবেটরে রাখা হবে তা শুধু বড়ো হাসপাতালে কিংবা দুই-একটি অতি বৃহৎ নার্সিংহোম দুর্লভ সুযোগ পাওয়া যায়—তবু বড়দা যখন আছেন তিনি শিশুটির প্রাণরক্ষার্থে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম।

সারাজীবন এ ধরনের নানা হ্যাপা মাথায় বয়ে বেড়িয়েছেন। শেষবেলায় ভাইপো হাজির এবং তাকে একটি কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া যে কত কঠিন কাজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে বলেছিলেন, তুই বাবু দেশে ফিরে যা। পার্টি কর। পার্টি না করলে এখন চাকরি হয় না। কতদিন হয়ে গেল, এত ভালো ছবি তুলিস, তবু কোনও চ্যানেল, কিংবা কাগজে হোর চাকরি হয় না। ভবেশ বুঝল, দেবীপদ এইসুত্রেই বোধহয় তার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। সে পার্টি করতে না বললে, তার পুত্র রাজনীতি নিয়ে যে জীবনেও মাথা ঘামাত না—এখন রাজনীতি করতে গিয়ে তার প্রাণসংশয়, কে সামলাবে—যার পরামর্শে তাকে ছাপ্পা ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, পার্টি না করলে ছাপ্পা ভোট দিতে কেউ জোরজার করত না—সুতরাং দেশে গিয়ে এ-বিষয়ে পার্টির লোকদের সঙ্গে কথা বলতেই হয়—

তারপর কেন যে মনে হল বাবুকে তিনি দেশে স্টুডিও করে দিয়েছিলেন। স্টুডিওতে ছবি তোলার সুযোগে তার ছেলে লেখাপড়া জানা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে এবং বিয়ের আগেই মেয়েটি গর্ভবতী হয়, অবশ্য ঘুণাক্ষরেও জানানো হয়নি, তবে কথা ভেসে আসতে কতক্ষণ–

ছোটোভাই জানিয়েছিল, ভয়ংকর বিপদ দাদা। তুই বাবুর বিয়েতে মাথা গলাস। বাবু বংশের কলঙ্ক।

ভবেশ খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। পুত্রবৎ ভাইপোটিকে এ-ধরনের কলঙ্কে লিপ্ত করা ছোটোর উচিত না—তারপর দেবীপদর সেই চিঠি, দাদা তুই শিগগির আয়। আমার মাথা ঠিক নেই। জাত-বেজাতের প্রশ্ন নিয়ে দেবীপদ তার পুত্র বাবুকে কুলাঙ্গার এবং অন্য যাবতীয় যা গালাগাল আছে সবকিছুর উল্লেখ করেছে—তিনি অনুমতি না দিলে পত্রের বিবাহ সম্পন্ন হবে না, কারণ মাথার উপর দাদাই আছেন, তাঁর অনুমতি পেয়ে গেলে দেবীপদ আর কাউকে ভয় পায় না।

রাস্তা ভালো থাকলে তাঁর দেশের বাড়ি ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। রাস্তা ভালো কি মন্দ তাও তিনি ঠিক জানেন না। যোগাযোগ না থাকলে যা হয়। তবু খোঁজখবর নিয়েছেন। বর্ষায় রাস্তা ভালো থাকার কথাও নয়।

তিনি বের হবার আগে মনোরঞ্জনকে ডেকে পাঠালেন। বাড়ির ড্রাইভার মনোরঞ্জনকে কোথায় ডিউটি দেওয়া হয়েছে তিনি জানেন না। নিয়মিত বেরও হন না তিনি। তাঁর যে দেশে যাওয়া খুবই দরকার তাও কাউকে বলেননি। দেবীপদও ফোন করেছে, সে কথাও কাউকে জানানো হয়নি। ছোটোপুত্র অবনকে শুধু ফোনে জানিয়েছিলেন, তাঁর গাড়ির দরকার। কার গ্যারেজে তাঁর গাড়ি, মনোরঞ্জন কোথায় অবনই বলতে পারে। অবনের গ্যারেজে, না প্রীতমের গ্যারেজে, কিংবা গাড়িতে কারও বের হবার যদি কথা থাকে, অবনই সব বলতে পারবে। পুত্ররা সবাই আলাদা থাকে। তাদের নিজস্ব আলাদা গাড়ি। বউমাদেরও গাড়ি আলাদা। কেউ কলেজে, কেউ হাসপাতালে কেউ করপোরেট হাউসে আছে। বাবুর জন্য তাদের কোনও দায় ছিল না। সবাইকে তিনি বলেছেন, প্রীতম তো বলেই দিল তোমার এই বংশপ্রীতি ছাড়ো। এত ঠকেও তোমার শিক্ষা হল না। দেশের জমি তো শুনেছি ভাইরা তোমার সব দখল করে নিয়েছে।

ভবেশ বলেছিলেন, ওরা নেবে না তো কে নেবে। তোমরা দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকবে?

থাকব না কেন। একটা বাড়ি করে রাখলে ছুটিছাটায় বেড়াতে যেতে পারতাম। দাদুর জমিজমায় আমাদেরও ভাগ আছে। ওটা তোমার পিতৃভূমি। তোমার কষ্ট হয় না বাবা।

এটা ঠিক, তাঁর অংশের জায়গা ছোটো দখল করে নিয়েছে। ছোটো বন্টননামাতেই রাজি নয়। তাঁরা পাঁচ ভাই। তিনি এবং মেজ মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই গ্রাম থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন। মেজ বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রাখে না। সে বোম্বাই শহরে বিশাল বাড়ি গাড়ি নিয়ে আছে। স্ত্রী আই এ এস। একমাত্র পুত্র দেরাদুনে মিলিটারি কলেজে পড়ে। ছোটো তিন ভাই-এর মধ্যে জমি বাড়ি নিয়ে চাপা বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রীতমের কথায় তিনি বুঝেছিলেন বাবুকে দেশ থেকে তুলে আনায় তারা বেজায় অখুশি। এবং তখনই ভবেশ বুঝতে পারেন—বাবুর চাকরির ব্যাপারে তার পুত্ররা মোটেই আগ্রহী নয়।

ভবেশ এখন বুঝতে পারেন, তিনি গরিব বাবার পুত্র। মেলা ভাইবোন নিয়ে বাবা তাঁর মুখাপেক্ষী ছিলেন। বাবার হতদরিদ্র চেহারা এখনও মনে করতে পারেন ভবেশ। মায়ের বিষণ্ণতা—সবই মনে পড়ে তার। মায়ের দুই পুত্র বড়ো মেজো পার পেয়ে গেলেও ছোটো তিনপুত্র দেবীপদ, নিরাপদ, কালীপদ গাঁয়েই পড়ে থাকে। পরে বাবা বেঁচে থাকতেই তারা পৃথগন্ন হয়ে যায়। বাবা-মার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত তাকেই বহন করতে হয়। সেই সূত্রেই বাড়ি যাওয়া আসা। ভাইপোরা কে কী করছে খবর নেওয়া। ছোটো তো পঞ্চাননতলায় মুদিখানা করবে বলে বাবা তাঁকে একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

বাবার কথা ফেলাও যায় না।

দোকান করতে টাকাকড়ির ব্যবস্থা তাকেই শেষ পর্যন্ত করতে হয়। দেবীপদ অবশ্য সদরে একটা সরকারি কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল। সে এখন তারই পেনশনে চলে। তার দুই মেয়ের মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেই বিয়ে দিয়েছে। শুধু পুত্রটিকে সামলাতে পারছিল না।

গাড়ি যাচ্ছে। মনোরঞ্জন বলল, গাড়িতে উঠবেন সার?

দেখি।

দেশের অবস্থা কী জানিই না। মনে মনে ভাবলেন।

আসলে দেবীপদর পুত্র বাবু সব অর্থেই বাবু। মিথ্যে কথায় বাবু, ফুটানিতে বাবু, খাওয়াতেও বাবু। অলস এবং কুঁড়ে এটাও টের পেয়েছিলেন ভবেশ।

কীরে খেলি না।

আমি খাই না জেঠু।

কইমাছ খাস না।

মাথা নীচু করে কথা বলার স্বভাব।

আরে কত দাম জানিস! ভবেশ সব কাজ থেকে অবসর নিলেও প্রতিদিনের বাজার করার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি।

খুব কাঁটা কই মাছ।

কাঁটা। কোন মাছে কাঁটা নেই বলতে পারিস।

পমফ্রেট, পাবদা, তপসে মাছ দিলে খুঁটে খুঁটে খেত। ভবেশ ভাইপোকে দিয়ে মাঝে মাঝে বাজার করাতেন, তাজা মাছ আনতে বলতেন। কিন্তু সে কোনওরকমে বাজারের থলে ফেলে দিয়ে বলত, যা চড়া দাম। মাগুরমাছের কেজি তিনশো টাকা। বাজার ঘুরে দেখতেন ভবেশ—দেশি মাগুর আনেনি বাবু, হাইব্রিডের মাগুর নিয়ে এসেছে। দেশি আর হাইব্রিডের মাগুরের দাম আকাশ-পাতাল তফাত।

গাড়ি যাচ্ছে।

মনোরঞ্জন ভবেশের সঙ্গে কথা বলতে বিশেষ সাহস পায় না। তিনি কিছু বললে সে শুধু উত্তর দেয়।

হরিণঘাটার বাজার পার হয়ে গাড়ি যাচ্ছে।

মনোরঞ্জন, কোথাও বসে চা খেলে হত।

একেবারে রানাঘাটে গেলে হয় না। আপনি কি সার রাস্তার দোকানের চা খেতে পারবেন!

সব পারব।

তার যে কত কথা মনে হচ্ছে।

পাঁচ-সাত বছরে বাবুর উপর বিশ্বাস হারিয়েই বলেছিলেন—যা দেশে গিয়ে পার্টি কর। পার্টি না করলে, আজকাল চাকরি হয় না।

আসলে কি তিনি শেষ পর্যন্ত ভাইপোটিকে জাহান্নামে যাবার রাস্তা বাতলে দিয়েছিলেন।

মানুষের তো সময় একভাবে যায় না।

একদিন হঠাৎ ভবেশ দেখেন একতলা থেকে বাবু উঠে এসেছে।

বাড়ি যাব।

হঠাৎ।

সেই যে গেল আর ফিরল না।

দেবীপদকে ফোন করলে বলেছিল, তুই দাদা চিন্তা করিস না। বাবু হারিয়ে যাবার ছেলে না।

তা হবে হয়তো।

পাঁচ-সাত বছরের সম্পর্ক। বছরের বেশি সময়টা আমার কাছেই থাকত। তিনি ভাবলেন।

কীরে গেছিলি?

হ্যাঁ গেছিলাম।

কী বলল, শুভ!

আমাকে নেবে বলল।

শুভ দূরদর্শন নিউজ এডিটর। আট-দশ জন ফটোগ্রাফার নেবে। ভাইপোটির সুযোগ হতে পারে ভেবেই ফোন। তারপর অ্যাপ্লিকেশন, শুভ ফোনে শুধু বলল, দাদা দেখছি কী করা যায়। কেউ ঝেড়ে কাশে না।

একদিন তো বলল বাবু, জানেনা জেঠু আমাদের প্যানেল হয়ে গেছে। আমার নাম আছে।

শুভ তবে তার কথা রেখেছে। শুভ কি তাকে কোনও কথা দিয়েছিল। সেই প্যানেলই সার। পরে শোনা গেল, প্যানেল বাতিল। শুভকে ফোন করে আর তাকে ধরা গেল না।

তবু তিনি শুভকে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। একদিন নিজেই গলফগ্রিনে হাজির। দূরদর্শনের লোকজন তাঁকে দেখে অবাক। তিনি তো কোথাও আজকাল বের হন না। সহসা দূরদর্শনের অফিসে হাজির। কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানের কথাও তাঁরা জানে না। লাইফপ্রোগ্রাম যদি হয়—এসব ভাবার সময়ই তিনি এসেছেন শুনে শুভ নিজেই বের হয়ে এল, এবং তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল।

শুভর এক কথা, দাদা হল না।

কেন হল না।

আমি তো একা না। কমিটিতে আরও অনেকে আছে।

তোমার উপর আমার ভরসা ছিল। তুমি না বললে এত দামি ক্যামেরা কিনে দিতাম না। প্যানেলে তো ওর নাম ছিল।

শুভ খুবই ইতস্তত করছে।

খুলে বলবে তো! তোমার ফোনেও সাড়া পাওয়া যায় না। কী ব্যাপার বল তো।

বাবুর ভালো নাম, অতুল।

সে বলল, অতুল নিজের নাম-ঠিকানা পর্যন্ত ঠিকঠাক লিখতে পারে না। ছবির হাতও কাঁচা। সামান্য কথাবার্তায় ওর অবজ্ঞা ধরা পড়ে।

তা বেশ। সে তো কথা বলবে না। ছবি তুলবে। ও তো হায়ার সেকেন্ডারি পাশ।

না পাশ না। সার্টিফিকেট দিতে পারেনি। মিনিমাম কোয়ালিফিকেশন না থাকলে কী করি!

ভবেশ খুব দমে গিয়েছিল।

প্যানেলে ওর নাম আছে বলল।

শুভ বলল, এসব কথা থাক। চা খান। আমার নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে দাদা। কী বলব।

চা খাচ্ছি। তুমি দ্বিধা কর না।

প্যানেলই হয়নি।

অতুল যে বলল প্যানেলে ওর নাম আছে।

মিছে কথা। ও হায়ার সেকেন্ডারি পাশও না।

বল কি।

আরও সব কুকীর্তির সাথী তিনি। বাবুকে নানা কাজেই লকারের চাবি দিতে হত। অনেক সময় তার কাছেই চাবি পড়ে থাকত। বাবু যে এতবড়ো চাটুকার এবং প্রতারক, সে চলে গেলে ভবেশ টের পেলেন।

বাবুর চাটুকারিতাই তার মধ্যে এক অন্ধস্নেহ প্রশ্রয় পাচ্ছিল।

কারও কথাতেই গুরুত্ব দেননি।

ছোটোভাই কালীপদও সতর্ক করে দিয়েছিল, ওকে বাড়িতে রাখা ঠিক না।

দেবীপদর সঙ্গে কালীপদর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সে বাবুর নিন্দা করতেই পারে। এরা সবাই তাঁর টাকার লোভে নানাভাবে তাঁকে ভজিয়েছে। একসময় কালীপদ বছরের পর বছর তাঁর টাকায় সংসার নির্বাহ করত। এখন সেই পৈতৃক ভিটা থেকে তাঁকে উৎখাত করেছে। এই কিছুদিন আগে কালীপদ এসে আট হাজার টাকা নিয়ে গেল। জমির উপর দিয়ে আট ফুটের একটি রাস্তা বের করতে না পারলে, বন্টননামা করা মুশকিল। রাস্তার মুখে কালীপদ ঝুপড়ি বানিয়ে থাকে—তা সরিয়ে নেওয়ার জন্য সেও অনেক টাকার দাবি জানায়। বাড়ির বন্টননামার জন্য খেপে খেপে কত যে টাকা নিয়ে গেছে এরা। পাঁচ ভাই দু বোনের জন্য জমি বন্টননামার এই এক নাটকেই তিনি জেরবার। নোংরামি এবং ছ্যাঁচড়ামির শেষ ছিল না। অথচ এরা সবাই তাঁর পায়ে পায়ে বড়ো হচ্ছিল। মা বাবা ভাইবোন ছাড়া তার অন্য কোনও জগৎ ছিল না তখন।

তখনই গাড়িটা থামল।

মনোরঞ্জন বলল, হাতমুখ ধুয়ে নিন। আপনাকে নামতে হবে না। আমি নিয়ে। আসছি। বউদিরা সঙ্গে কিছু দিল না, কী খাবেন।

না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। চল তুমিও খেয়ে নেবে।

মনোরঞ্জন বলল, ভিড়। আপনার কষ্ট হবে।

রাখো তো ভিড়। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।

মনোরঞ্জন অবাক হয়ে গেল। সে তাঁকে অনেক অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়। তাঁর গুণগ্রাহীরা ভিড় করলে সে নিজেও গর্ববোধ করে। এতবড়ো মানুষটা কিনা বলছে একই টেবিলে খাবে।

কী হল, এসো।

মনোরঞ্জন আর কী করে!

বাবু অথবা ভালো নামে অতুল, সত্যি কি জুয়া খেলে।

দেবীপদ ঘুণাক্ষরেও জানায়নি।

তিনি নানা কাজে কিংবা তাঁর লেখালেখি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে চারপাশে কী হচ্ছে টের পান না। একদিন টের পেয়েছিলেন, কিছু পাঁচশো টাকায় নোট লকারে কম। তিনি টাকাপয়সা লকারে সাধারণত এক জায়গায় রাখেন না। লকারে তার অনেক জরুরি ফাইল আছে, তার ভিতরে ভাগে ভাগে টাকা রেখে দেন।

আর মুশকিল তাঁর দুর্বল স্মৃতিশক্তি। কাউকে দিতে পারেন, অন্য কাজে খরচ করতে পারেন, তিনি তো তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের পেছনেই সারাজীবন বেশি ছোটাছুটি করেছেন। এবং তাঁর এটাই নেশা। লেখার সময় তিনি তাঁর চরিত্রগুলির সঙ্গে তুমুল ঝগড়াও বাঁধিয়ে দেন। চরিত্ররা তখন তার স্বজনের মতো। এবং বাবুও কি গল্পের শেষে চরিত্র হয়ে যাচ্ছে। আসলে একজন প্রতারককে নিয়ে তিনি কোনও গল্প লেখেননি। এটা তো একজন প্রতারকের গল্প হয়ে যাচ্ছে।

ফোনটা প্রথম দিল্লি থেকেই এসেছিল।

কে?

আমি হীরক বলছি কাকা।

বল।

বাবু না কি তোমার কাছে আছে?

ছিল, এখন নেই।

চলে গেছে!

হীরক তাকে যে কিছু খবর দিতে চায়।

তিনি বললেন, বাবু কী করেছে আবার।

ও কিন্তু জুয়াড়ি! জুয়া খেলে। ওকে রেখ না। তুমি কাকা সতর্ক থাকবে।

আর সতর্ক থাকা! বংশের ছেলে ছেলে করেই তো চোখের উপর তিনি দেখলেন তার প্রতারণার ছবিগুলি।

বাবু মোবাইলে ফোন করে কার সঙ্গে কথা বলছে। ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারে। বাবু তো বিয়ে করার পরও নানা অজুহাতে এখানে এসে থাকত। এখানে থাকার সময় তাঁর সুত্রে অনেক বিখ্যাত লোকজনদের সঙ্গেও বাবুর পরিচয় হয়েছে। ছবির অনেক খুচরো কাজ তাকে দিতেই পারে। কিন্তু খুব তর্ক করছে ফোনে। মনে হয় কেউ তাকে হুমকি দিচ্ছে। তিনি একতলায় বসার ঘরে, বাবু। বারান্দায় শেষ করে দেব। বাবু চেঁচাচ্ছে।

কী শেষ করে দিবি।

আরে দেখ না জেঠু, বলছি সুদের টাকা আগামী মাসে দিয়ে দেব। মানছে না। আমাকে রাস্তায় দেখে নেবে বলছে।

সুদ! কীসের সুদ।

আর বল না। বাজারে কি কমপিটিশন। স্টুডিও থাকলেই হয় না। কমপিউটর রাখতে হয়। তুমি আর কত দেবে জেঠু। সুদে টাকা নিয়ে একটা কমপিউটার কিনেছি।

তিনি বিব্রত। চুপ করে আছেন। দেবীপদর পেনশনে সংসার চলে, দেবীপদ তাই বলেছে। বাবু তার বাবাকে এক পয়সাও দেয় না। উপার্জনের টাকা বাবু কী করে দেবীপদও জানে না। বিয়ে করেছে। একটা মেয়ে হয়েছে, সংসারে দায়িত্বশীল না হলে চলবে কেন?

তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ফোনটা দে। আমি কথা বলি।

বাবু কী ভাবল, তারপর বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে না বলছে।

কেন বলবে না।

কী করে বলবে। সাহস নেই তোমাকে বলে। তারপরই ফোন কেটে দিল।

কী বলছে!

বলছে, টাকা না দিলে রাস্তায় হামলা করবে।

বলিস কী। তোর বাবা জানে। আগে তো বলেছিলি, আমাদের এলাকায় কোনও স্টুডিও নেই। এখন বলছিস আরও দুটো ছবির দোকান হয়েছে।

সবারই কমপিউটার আছে। আমার নেই। বাজারে কী প্রতিযোগিতা তুমি বুঝবে না।

কত টাকা ধার করেছিস।

কী যে হয় তাঁর। বাবুর বিমর্ষ মুখ দেখলেই তিনি ঘাবড়ে যান। বংশের ছেলে রাস্তায় যদি খুনজখম হয়ে যায়—কেমন ভিতরে তিনি আতঙ্কে পড়ে গেলেন।

কত টাকা ধার?

তোর আয় কত মাসে?

ঠিক থাকে না। তোমাকে জেঠু কী বলব। যা রোজগার, সবই সুদ দিতে চলে যায়।

বাবুর মুখে তিনি খুবই হতাশার ছাপ ফুটে উঠছে দেখতে পান।

লেটা না শেষে বেঘোরে মারা পড়ে। তিনি একটা চেক লিখে দিয়ে বললেন, এটা ভাঙিয়ে নে। মনে হয় হয়ে যাবে। তারপর বললেন, কত সুদ দিস? তারপর বললেন, মাসে না বছরে?

মাসে চার পার্সেন্ট সুদ।

এটা তো বেআইনি। ওদের লাইসেন্স আছে?

জেঠু তোমার সময় আর নেই। এখন বে-আইনি আইনি বলে কিছু নেই। ওদের দল আছে। থানা পুলিশ হাতে। সরকারও মনে করে, বেকার যুবক সব, খুনজখম করে পয়সা উপার্জন হলেই হল। খেয়ে বাঁচতে হবে তো। বেকারি দূর করতে সরকার এখন সব মেনে নিচ্ছে। দালালি করুক, প্রমোটারি করুক, মস্তানি করুক শুধু কেউ খুনজখম না হলেই হল!

তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমাকে না জানিয়ে আর সুদে টাকা নিবি না।

না না। আর নিই, যা শিক্ষা হল।

শিক্ষা কথাটাতে তাঁর হাসি পেয়েছিল। বাপ-ঠাকুরদার কথা মনে হল। সেই বংশের ছেলে কী হয়ে যাচ্ছে। তবু রাস্তায় যদি আনা যায়, অথবা বাগে আনা যায়।

গাড়ি যাচ্ছে।

মনোরঞ্জন বলল, সার ঘুমিয়ে পড়েছেন।

না না, কিছু বলবে!

সারগাছি পার হলাম।

তাই তো দেখছি। চারপাশে ধানের জমি সব সবুজ হয়ে আছে। আদিগন্ত মাঠ–আগে এইসব জমিতে লঙ্কার এবং আখের চাষ হত। আখচাষ আর হয় না। পলাশির চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই আখচাষ বন্ধ হয়ে গেল। কত লোক বেকার হয়ে গেল।

আসলে নিজের সঙ্গেই তিনি কথা বলছেন।

সার সোজা বাড়ি যাবেন?

দেখি।

বাবুর বউটার চাকরি হলেও তিনি বেঁচে যান। তারপরই মনে হল তার ভাইবোন আত্মীয়স্বজন, কে নয় যে তাকে হিপনোটাইজ করে অর্থ উপার্জন করেনি। ছোটোভাই কালীপদ শেষদিকে মাসে মাসে টাকা নিতে আসত। তিনি বিরক্ত হতেন, এভাবে কতদিন যে চলবে। বাড়ি থেকে বাবা তাকে বের করে দিয়েছিলেন, ত্যজ্যপুত্র করেছিলেন—সে তার বউ দুই পুত্র এবং এক কন্যাকে নিয়ে পাহাড়েই ঘর ভাড়া করে থাকত। তিনি বাবার চিঠিতে খবর পাবার পরই ছুটে গিয়েছিলেন, বাবাকে বুঝিয়ে বাড়ির এক কোণায় কালীপদর থাকারও বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন।

তারপর আবার সেই ভিক্ষা।

না আর পাবি না।

দাদা তোর তো মেলা টাকা।

পণের টাকাটা দিবি।

আর দেব না। এই দিয়ে দিয়ে তোদের গরিব করে রেখেছি। নিজেদের আত্মনির্ভর করে তুলতে পারলি না।

আর আসব না। শুধু কথা দে তোর ভাইঝির বিয়ের পণের টাকাটা দিবি।

পণের টাকা দিতে পারব না। পুলিশে খবর দেব।

ধূর্ত কালীপদ কত সহজে বলল, ওই হল। বিয়ের খরচ আর কত লাগে। ছেলের দাবিও কম। একটা দোকান করবে বলে পণ নিচ্ছে। তুই যেভাবেই দিস, দিলেই হল। এত নগদ টাকা তুই না দিলে কে দেবে? না দিলে বংশের কলঙ্ক হবে।

তোর ভাইঝি পালানোর ধান্দা করছে কলোনির অবনী পালের পোলার লগে। পালালে তুই মুখ দেখাতে পারবি। এতে বাপ-ঠাকুরদার কলঙ্ক না।

আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে কত সহজে বাপ-ঠাকুরদার সম্মান রক্ষার্থে বিয়ের সব খরচই দিলেন।

এবং তারপরই যে কালীপদ এবং তার দুই পুত্র তাঁকে চরম শাস্তি–তার পিতৃভূমি কেড়ে নিল। তখন পাড়ায় ফোন এসে গেছে, মোবাইলও হয়ে গেছে। ফোনেই কালীপদ জানাল, সামনে মোট আঠারো কাঠা জমি সে দখল করে আছে। সেই দখলনামাই বন্টননামা। বাকি জমি আর ভাইবোনেরা যা খুশি করুক। তার জমিতে কেউ ঢুকলে খুন হয়ে যাবে।

এই সেদিনও বাবু, তার স্ত্রী দময়ন্তীর জেলা পরিষদে কাজ হবে বলে টাকা নিয়ে গেছে। ঘুষ দিতে হবে সত্তর হাজার। দিলেই কাজ হয়ে যাবে। তিনবার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েও শিক্ষকতার কাজ পায়নি। অর্ধেক টাকা আগাম দিতে হবে। আটজনের চাকরি, ঘুষ কত টাকা! বাবুর সেই এক হিপনোটাইজ, টাকাটা বাগিয়ে চলে গেল। তিনি ঘুষ এবং পণ এই দুই বিষয়কেই ঘৃণা করতেন। বংশের গৌরব রক্ষা করতে গিয়ে সব বিসর্জন।

সার।

আপনি কাঁদছেন!

না তো!

চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।

গাড়ি বাড়িতে ঢুকবে?

না।

কোথায়।

হোটেলে।

হোটেল থেকেই ফোন, দেবীপদ তোর বউমার চাকরি হয়েছে?

নারে দাদা, কোথায় চাকরি!

টাকা নিয়ে এল, জেলাপরিষদে চাকরি।

সব মিছে কথা। আমার সব শেষ। তুই কোথায় উঠেছিস। তুই আসবি বলে তোর বউমা রান্না করে বসে আছে।

বাবুটা এত মিছে কথা বলতে পারে। দময়ন্তীর চাকরি যদি হয়ে যায়, সেই ভেবে টাকাটা দিলাম। এখনকার বাজারে চাকরি পেতে হলে ঘুষ দিতে হয় জানি। কিন্তু জেলাপরিষদে কোনও লোকই নেওয়া হবে না, সে ঘুষটা দেবে কাকে।

তুই আয়, আমি তোকে আনতে যাচ্ছি। গাড়ি এনেছিস। তোকে আর আসতে হবে না দেবীপদ, আমি যাচ্ছি। এবং তিনি চানটান করে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি গেলেন ঠিক, তবে সীমানায় ঢুকলেন না। দেবীপদকে ডেকে পাঠালেন নেপাল করের বাড়িতে। এই একজনই পরিচিত কাছের মানুষ তার দেশের, গেলে এখনও বাইরে ছুটে আসে। জড়িয়ে ধরে।

ফোনেই বলল, বড়দা সে গ্রাম আর নেই, সেই মানুষও নেই। হাওয়া পালটে গেছে। আগে পার্বণে উৎসবে আমাদের মেলামেশায় কোনও বাধা ছিল না–এখন অন্যরকম। যে যত ফন্দিবাজ, ফুটানিবাজ, তারাই আদর্শের বুলি কপচায়। আপনার বাবু তো জুয়া খেলে সব উড়িয়ে দিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়িয়েছিল।

ও নাকি ছাপ্পা ফোট দেওয়ায় মারধর খেয়েছে।

দেবীপদ জোরজার করেই তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেল। সবাই দেখা করে গেলেও, দেবীপদর পুত্রটির পাত্তা নেই। কোথায় গেল!

দেবীপদ বলল, ক’দিন থেকে বের হচ্ছে সাইকেলে। কোথাও গেছে। পার্টি করলে বসে থাকার উপায় থাকে না দাদা। স্টুডিওটা বিক্রি করে দিল। কী করে খাবে বল। আমারও তো বয়েস হয়েছে। পেনশনের টাকা আর কতদিন বল!

তিনি দেবীপকে বললেন, একটাই জীবন, সবাই আমরা একজীবনের। অধিকারী। তার বাইরে কিছু নেই। আগেও নেই পেছনেও নেই। তোর পুত্রের মুখে জাদু আছে। কথা বেচে সে ঠিকই খাবে। এখনও যা পরিস্থিতি, নষ্ট না হয়ে গেলে টিকে থাকা কঠিন। শুনছি তো পঞ্চায়েতে তার দল জিতবে, সে জিতবে। তারপর দেখা যাবে আরও বড়ো জায়গায় চলে গেছে। ছাপ্পা ভোট দিতে গিয়ে মার খেয়েছে, এখন তো কোনও প্রমাণই পাওয়া গেল না। সবাই ওর তো গুণগানই করছে।

দেবীপদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দাদা যে সময়ে যা মানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *