1 of 2

শেকড়

শেকড়

সে আজকাল টের পায় সূর্য তার আকাশে আর মধ্যগগনে নেই—হেলে পড়েছে। এই বয়সে উপদ্রব কমবার কথা–কমছে না। বরং বাড়ছে। পোকামাকড়ের উৎপাতে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। জীবনে বোধহয় এমন সব উৎপাত সব মানুষকেই কামড়ায়। অহরহ সে জ্বলছে। কোনো উৎপাত থাকবে না জীবনে তাই বা হয় কী করে। তবু তার মনে হয় সবাই তাকে পেয়ে বসেছে। সংসারের সব দুর্ভোগের দায় তার। জায়া থেকে জননী সবারই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সে কাউকে খুশি করতে পারেনি।

চিঠিটা পাবার পরই এমন সে ভাবছে।

অভিযোগ, তোমাকে আমি পেটে ধরিনি। সেই কবে পুজোর সময় বাড়ি ঘুরে গেলে, আর এ-মুখো হওনি। আমি বেঁচে আছি কি মরেছি তার খোঁজখবর পর্যন্ত নাও না। আমি মরে গেলে তোমরা রক্ষা পাও বুঝি। ভগবান কেন যে আমাকে নেয় না!

আসলে আট-দশ মাস হয়ে গেল, কিছুতেই বাড়ি ঘুরে আসার সময় পাচ্ছে না সে।

দু-পাঁচদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ঘুরে এলে মা খুশি হবে সে জানে। বেশি তো দূর না। ট্রেনে পাঁচ ছ-ঘন্টাও লাগে না। বাড়ি যেতে পারছে না বলেই ক্ষোভ। শীতের সময় ভেবেছিল যাবে। কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এত ঠাণ্ডায় কষ্ট পাবে বলেই ঝুনু রাজি হয়নি। তার ঠাণ্ডার ধাত আছে। অসুখবিসুখ বাধিয়ে ফিরলে কে দেখবে!

সংসারে সে টের পায়, সবার সব কিছু হতে পারে, কেবল তাকে নীরোগ থাকতে হবে। স্বাস্থ্য অবশ্য তার অটুট। গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে সে কোনো অসুখে ভুগেছে মনে করতে পারে না। তার একটাই অসুখ—ভাইবোন স্ত্রী-পুত্র সবাই ভালো থাকুক। সবাই সুখে থাকুক। কেউ সুখে নেই চিঠি পেলে সে অস্থির হয়ে ওঠে। তার এই দুর্বলতা সবাই টের পেয়ে গেছে। বড়ো পুত্রটিকে নিয়ে পুজোর পর থেকে বড়ো রকমের ঝামেলায় পড়ে গেছিল। তার ছোটাছুটির শেষ ছিল না। কোথায় হায়দরাবাদ, সেখানে বদলি। বড়ো পুত্রটি আজ দু-তিন বছর ধরেই একটা না একটা ঝামেলা সৃষ্টি করে চলেছে। বোকারোতে পোস্টিং। জুনিয়ার একজিকিউটিভ ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষ হতে না হতেই মারাত্মক জণ্ডিস। তাকে বাড়ি নিয়ে আসা, চিকিৎসা এবং আরোগ্য লাভের পর ডাক্তারের পরামর্শ মতো বিয়ে। কোথায় থাকবে, কী খাবে, এই দুশ্চিন্তায় সে অস্থির ছিল। অনিয়ম অত্যাচার থেকে রিলাপস করলে ভোগান্তি। বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিন। পাঠিয়ে দিয়েছিল—দু-পাঁচ মাসও পার হয়নি, বৌমা অন্তঃসত্ত্বা। আর বাচ্চা হবার দু-তিন মাস বাদেই হায়দরাবাদে ছ-মাসের জন্য অস্থায়ী বদলি।

অস্থায়ী বদলির ক্ষেত্রে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু বড়ো পুত্র কেমন নিরুপায় তার। সে একা থাকতে ভয় পায়। অতিরিক্ত মাত্রায় ইনট্রোভার্ট। অপরিচিত জায়গায় সে নির্বান্ধব অবস্থায় থাকতে রাজি নয়, ফ্ল্যাট ভাড়া করে চিঠি, বউমাকে দিয়ে যাও। চিঠি পেয়ে মাথা গরম—বন্ধুবান্ধবরা ঠিকই বলেছে, এত অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়া তোমার ঠিক হয়নি। ম্যাচিওরিটি গ্রো করেনি। তা তেইশ চবিবশ বছরে কে আজকাল আর ছেলের বিয়ে দেয়।

কিন্তু তার যে গলায় কাঁটা। এমন স্বভাব, পুত্রটি নিজে কিছু করে নিতে শেখেনি। ট্রেনিং পিরিয়ডে মেসে ছিল। তারপর বাসা নিয়েছে। কাজের লোক পাঠাও। কাজের লোক গেল। তারপর ব্যাধি। অন্তত তার পুত্রটির ভালোমন্দ দেখার কেউ থাকুক সে এটা চাইত। বিয়ে দিলে দুশ্চিন্তার হাত থেকে নিস্তার পাবে এটাও ছিল এক ধরনের স্বস্তি।

ছোটো। কী আর করা! বউমা নাতি আর সে প্লেনে সোজা হায়দরাবাদ। ঘন্টা দুই লাগে ঠিক, তার আগে টিকিট কাটা থেকে, সংসার করতে অতি প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস, তালিকা মিলিয়ে নেওয়া—কতটা নেওয়া যাবে, ওজনের প্রশ্ন আছে, নাতির কাঁথা বালিশ ফিডিং বোতল এবং ছোটো স্টোভ, এ-ধরনের কিছু জিনিসপত্র কেনাকাটা করে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে শ্রীনিবাসনগর কলোনিতে দোতলায় ফ্ল্যাটে উঠে অবাক। মাত্র একটা ক্যাম্প খাট আর ভি আই পি সুটকেস ছাড়া ঘরে কোনো আসবাব নেই। জল নেই। একদিন অন্তর জল, এমন বিপাকে মানুষকে পড়তে হয় সেই প্রথম টের পেল। পুত্রটির ধারণা, বাবা আছেন।

তক্তপোশ বিছানার দরকার—বাবা আছেন।

রান্না-বান্নার ইউটেনসিল—বাবা আছেন।

তার মাথা গরম হয়ে গেছিল। দু-তিন মাসের শিশুকে নিয়ে যে এভাবে থাকা যায় না, সে বোধটুকু পর্যন্ত পুত্রের নেই। ফ্ল্যাটে বেসিন, বাথরুম সব ঠিকঠাক। জল আসে না। জল আসে, ঝি আসে না—এটা যে দেখে নেওয়া দরকার অসংসারী পুত্রের মাথায় তাও কাজ করেনি। যেন বউমা গেলেই তার কল থেকে জল গড়গড় করে পড়বে—তার সকালের টিফিন ঠিকঠাক হয়ে যাবে, অফিসে লাঞ্চ, রাতে ফিরে দেখবে খাওয়ার টেবিলে সব ঠিকঠাক আছে। এগুলোর জন্য যে বন্দোবস্ত রাখতে হয়, সেটা বোধহয় পুত্রের মাথাতেই ছিল না। তার ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু বউমা খারাপ ভাবে ভেবে পুত্রটি কত অবিবেচক তাও প্রকাশ করতে পারেনি। গ্যাস থেকে আরম্ভ করে সবকিছুর বন্দোবস্ত করে ফিরে আসতে তার প্রায় দু-হপ্তা লেগে গেছিল।

একবার শুধু বলেছিল, তুই কী রে! সামান্য বোধ-বুদ্ধিটুকুও নেই। কিছু ঠিকঠাক না করে হুট করে লিখে দিলি বউমাকে দিয়ে যাও।

তার জবাব শুনে সে থ।—আমি লিখলেই তুমি পাঠাবে কেন! অসুবিধা হবে যখন জানতে, নিয়ে এলে কেন। ও পারবে কেন? তোমারই উচিত ছিল না নিয়ে আসা। পুত্রটি যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল কাণ্ডজ্ঞানের অভাব কার বোঝো!

এরপর আর কী কথা বলা যায় মাথায় আসেনি। সে কোনোরকমে প্রায় নরকবাসের মতো কটা দিন কাটিয়ে দিয়েছিল। নিজের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য ইস্টকোস্ট ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় উঠে বসেছিল। নিজেকে নির্যাতন করার মধ্যেও কোনো ক্ষোভ লুকিয়ে থাকে, ফেরার সময় সেটা সে টের পেয়েছিল।

সে তার ক্ষোভ থেকেই সহসা কেন যে স্থির করে ফেলল, বাড়ি যাবেই। যত গরমই হোক, যত লু-এর হলকা চলুক সে যাবেই। বাড়ির নামে ঝুনু তটস্ত হয়ে থাকে।

পঁয়ত্রিশ-ত্রিশ বছরে ঝুনু তার স্বভাব পালটে দিয়েছে। শহরবাসের ফল। নিজের বাড়িঘর, দোতলা বাড়িতে তিনটে প্রাণী—সে ঝুনু আর ছোট ছেলে। রান্নার লোক, ঠিকে ঝি উচ্চবিত্ত পরিবারে যা যা থাকবার সবই আছে তার। স্ত্রীর কলেজ, তার অফিস, ছোটো ছেলে সি-ই-এস-সি-র ম্যানজমেন্ট ট্রেনি, তবু ঝুনুর নাই-নাই বাতিক। সে বাড়ি যাবে বললেই ঝুনুর মুখ গোমড়া—ঠিক অসুখবিসুখ বাধিয়ে ফিরবে, এই ভয় নিরন্তর। গাঁয়ের বাড়িতে আলো পাখা নেই। বাথরুমের অবন্দোবস্ত, জানলা ছোটো, ঘরে হাওয়া ঢোকে না, মাটির ঘর, চারপাশে গাছপালা, ঝোপজঙ্গল, সাপের উৎপাত আছে, কিছু একটা হলে কে এসে পাশে দাঁড়াবে। বাড়ি যাব বললেই ঝুনুর তিক্ততা বেড়ে যায়।

এসব কারণে সে ইচ্ছে হলেই যেতে পারে না। গেলে আর ফিরে আসবে না এমনও আতঙ্ক থাকে ঝুনুর। সে কত বুঝিয়েছে, ওখানে আমি বড়ো হয়েছি, আমার অভ্যাস আছে, পাখা আলো না থাকলেও অসুবিধা হবে না। অবশ্য সে জানে অসুবিধা তার ঠিকই হয়। কিন্তু ভাইবোনদের মধ্যে কয়েকদিন কাটিয়ে আসতে পারলে আশ্চর্যরকমের মুক্তির স্বাদ পায়। তার যেন আয়ু বাড়ে। ঝুনু তার এই অমল আনন্দ থেকে যতদিন পারে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করে। শেষে সে মরিয়া হয়ে উঠলে, ঝুনুর সেই এক বস্তাপচা উপদেশ, জল ফুটিয়ে দিতে বলবে। বাসি খাবার খাবে না। রাতে টর্চ নিয়ে বের হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বয়স যত বাড়ছে, তত তার ক্ষোভ পাহাড় প্রমাণ হয়ে উঠছে। মনে হয় সবাই অবিবেচক। মণিটা এত অমানুষ, চিঠিতে ভয় দেখিয়েছে, যা অবস্থা তাতে তোমার ভাইকে জনমজুর খাটতে হতে পারে। আসলে মাসোহারা সে যা দেয় তাতে সংকুলান না হবারই কথা। মা-ও মাঝে মাঝে চিঠি দেবে, আর কটা টাকা বেশি দিস। বাজার দিনকে দিন গরম, এতে চলে কী করে! দারিদ্র্য কাকে বলে বাড়ি গেলে সে টের পায়। মা আলাদা। মণি আলাদা। বড়দা আলাদা। বড়দা রিটায়ার করে, পাশেই আলাদা বাড়ি করেছেন। রিটায়ার করার পর পেনশন, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড মিলে যা সঞ্চয় অভাব থাকার কথা না। দাদা বউদি মেয়ে দুই ছেলে তার। তারও নাই নাই ভাব। পাছে মাকে উপুড় হস্ত করতে হয়, যতটা না অভাব তার চেয়ে বেশি ছদ্মবেশ। মাঝে মাঝে সে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে না বলে পারে না, তুমি মাকে কিছু দিতে পার না দিলে মা কত খুশি হয়!

কোত্থেকে দি অময়। আমার তো ঘাড়ের উপর শমন। নামাতে পারছি না, রাতে অনিদ্রায় ভুগি, বল কি করে দিই।

মণি, তুই বিয়ে করে বসে থাকলি! বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসলি। নিজে কিছু করার চেষ্টা কর। আমি আর কতদিন। কেবল মিলুর সচ্ছল সংসার। মিলুর ইস্কুলে চাকরি, তার বর সরকারি চাকুরে, এক ছেলে—বাড়িঘর নিজের। এরা তার এককালে কাছেপিঠে ছিল। এখন কেমন সবাই ভিন্ন গ্রহ তৈরি করে নিয়েছে। বাড়িতে গেলে এইসব পোকামাকড়ের উপদ্রবের মধ্যেও তার মনে হয় সে আবার তার কৈশোর যৌবনে ফিরে এসেছে।

মার খুব ইচ্ছে ছিল, বাড়িটা শহরে না করে দেশে করলে সবাই দেখত, কত লায়েক তার ছেলে—কিন্তু ঝুনুর এককথা, আমি এত টানতে পারব না। থাকব এখানে, আর বাড়ি করবে দেশে। ইচ্ছে হয় কর, কিছু বলব না। সেখানে তুমি ভাইবোনদের নিয়ে সুখে থাকো, আমার কপালে যা আছে হবে।

কলকাতায় যার বাড়ি, সংসারে যার চারজন প্রাণী এবং সবাই উপার্জনশীল, তার কাছে সবার প্রত্যাশা একটু বেশি পরিমাণে-অময় তা বোঝে। কিন্তু যে যার রোজগার মতো মর্যাদা বাড়িয়ে নেয়। ঝুনুকে বললে, এককথা, কি আছে, বাড়ি করেছ, গ্যারেজের কোনো ব্যবস্থা রাখোনি। তোমার ক্ষমতায় না কুলায়, ছেলেরা তো আছে। গ্যারেজ না থাকায় বাড়িটা কেমন দাম হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। বাড়িতে গ্যারেজের ব্যবস্থা না থাকায় কখনো অশান্তি হয় সে আগে জানত না।

তার এই প্রাণপাতের মূল্য কেউ দেয় না। সে এত কষ্ট করে বাড়িটা করেছে, অথচ এখন দেখছে খুঁতের অন্ত নেই। ঝুনুকে সে কিছুতেই খুশি করতে পারে না, গ্যারেজের বন্দোবস্ত নেই। বললে কথায় কথায় খোঁটা, যেমন মানুষ, তার তেমন বাড়ি। অথচ সস্তায় জমিটা পেয়ে যাবার পর অময় ভাবতেই পারেনি, কখনো সেখানে তার বাড়ি উঠবে। মানুষের ঘরবাড়ি এক বয়সে যে জীবনের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায় বাড়িটা করার সময় সে টের পেয়েছে।

অময় বলল, কালই বাড়ি যাচ্ছি। সে টাইম টেবিল দেখল। বারোটায় ট্রেন আছে একটা। নতুন চালু হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটার ট্রেনে ভিড় হয়।

ঝুনু ও-ঘর থেকে বলল, তোমার কী মাথা খারাপ! এই গরমে কেউ বের হয়। এত দূরে কেউ যায়। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই, চারপাশে আগুন জ্বলছে, তিনি বাড়ি যাবেন।

আমার কিছু হবে না।

তোমার হবে না, আমাদের হবে।

ছোটো পুত্রটি বোঝে লেগে গেল দুজনে। সে বলল, ক-টা দিন পরে গেলে কি হয় বুঝি না!

কটা দিন পরে গেলে মানে, বৃষ্টি বাদলা হলে এত গরম থাকবে না। একটানা কতকাল থেকে যেন আকাশ দিনের বেলা আগুন হয়ে আছে। কালবৈশাখী পর্যন্ত টের পাওয়া গেল না। দুপুরে দরজা জানালা বন্ধ করে না দিলে গরমের হলকায় শরীর পুড়ে যায়। কেবল ঠাণ্ডা জল, তেষ্টা বাড়ে, দরদর করে ঘাম, লোডশেডিং হলে বাড়িতে প্রায় মড়াকান্না শুরু হয়—হেন ধুন্ধুমার যখন চলছে তিনি বাড়ি যাবেন!

অময় বলল, ওখানে কি মানুষজন থাকে না? ওখানে কি আমার মা বেঁচে নেই, ভাইবোনেরা বেঁচে নেই?

ঝুনু বলল, বেঁচে আছে। ওকে বেঁচে থাকা বলে না।

মাথায় দপ করে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে। আত্মপর মনে হয় ঝুনুকে। অময় আর ঝুনুকে কিছু না বলে অফিসে বের হয়ে গেল।

পরদিন সকাল সকাল উঠে পড়ল অময়। ফোনে কথা বলল, দু-একজনের সঙ্গে। এখন এসে লাভ হবে না এমন জানাল। সে বাড়ি থাকছে না। দেশে যাচ্ছে। রান্নার মেয়েটাকে বলল, এগারোটায় বের হবে।

ঝুনু সব শুনছে। কিছু বলছে না। দিন দিন কেমন জেদি একগুঁয়ে হয়ে উঠছে এত জেদ ভালো না, ভালোর জন্যই বলছি, অভ্যাস নেই, গরমে কিছু একটা হলে গাঁজায়গায় কে কি করবে! ঝুনু খুবই ক্ষেপে গেছে। তার কথার কোনো দাম থাকে না সংসারে। খুশিমতো চলে। সময় অসময় বুঝবে না। মার চিঠি পেয়ে উতলা। মা জানে না, ছেলের কষ্ট হবে। কি অবুঝ মা! এমন মা সংসারে থাকে ঝুনুর কিছুতেই মাথায় আসে না। নিজের দিকটা ষোলো আনা, নিজের জেদ ষোলো আনা—কিছুতেই এখানে এসে থাকবেন না। তা আমার সংসারে ভালো লাগবে কেন! নিজের সংসার ফেলে এখানে থাকবেন কেন! কিছুতেই দু-পাঁচদিনের বেশি থাকতে চান না। সে নিজেও চিঠি লিখেছিল, এত গরমে আপনার কষ্ট, গরমের সময়টা এখানে কাটিয়ে যান। চিঠির উত্তরই দেননি। যেমন মা, তেমন তার ছেলে, বেশি ভালো হবে কোত্থেকে?

ঝুনু না পেরে বলল, যাবেই ঠিক করেছ?

দেখতেই তো পাচ্ছ।

ঝুনু বুঝতে পারছে, বাবুর গোঁ উঠেছে। তার সাধ্য কি, ধরে রাখে। সারাদিন প্যাঁচপ্যাচে গরমে তারও মাথা ঠিক নেই। তবু যখন যাবেন বাবু, যাক। মজা বুঝে আসুক। কপালে যা আছে হবে।

সে এক বোতল বরফ ঠাণ্ডা ফোঁটানো জল দিল। রাস্তার টিফিন দিল। বার বার বলে দিল, রাস্তার কিছু খাবে না। যেন বাবুটি খুবই ছেলেমানুষ—একবার মার কথা মাথায় চেপে বসলে কেমন দিগভ্রান্ত হয়ে যায়। সংসারে মা-ই সব, ক্ষোভে অভিমানে সে যে জ্বলছে বুঝতে দিচ্ছে না।

ছাতা নাও সঙ্গে।

লাগবে না।

তবু অ্যাটাচিতে জোরজার করে ছাতা ঢুকিয়ে দিল। টর্চলাইট, জলের বোতল, রাস্তার টিফিন কোথায় রেখেছে বলে দিল। ট্যাক্সি এলে অময় উঠে বসল। ঝুনু গেটে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় ট্যাক্সিটা চোখের উপর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে ঝুনু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

এই ক্ষোভ কত মারাত্মক হতে পারে অময়ের মুখ দেখলে টের পাওয়া যায়।

অময় ভিতরে ভালো নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুখ সচ্ছলতা মানুষকে অমানুষ করে দেয়।

তার বাবার চাষবাস, জমিজমা, গৃহদেবতা, গোরুবাছুর এই ছিল সম্বল। মাটির ঘরে সে জন্মেছে, বড়ো হয়েছে। পড়াশোনা করেছে, আবার জনমজুরদের সঙ্গে দরকারে জমিতে নিড়ি দিতে বসে গেছে। বাবার সঙ্গে থেকে চাষবাসের যে আলাদা একটা মাধুর্য আছে সে টের পেয়েছিল। দরকারে ভাইবোনেরা মিলে পাট কেটেছে, খালের জলে পাট জাব দিয়েছে—চাষবাস থাকলে সংসার যেমনটা হয়ে থাকে আর কি? গোরুর দুধ দোয়ানোর কাজটা সেই করত। কলেজ থেকে ফিরে অনেকদিন সে গোরু নিয়ে জমির আলে আলে ঘাস খাইয়েছে। এর মধ্যেও আশ্চর্য মাদকতা আছে। কাঁচা ঘাস খাওয়ালে দুধ ঘন হয়, কাঁচা ঘাস খাওয়ালে দুধ বেশি দেয় এসব সে নিজের হাতে করে দেখেছে। প্রকৃতির মধ্যে গোরুর দড়ি ধরে হেঁটে যাওয়া, সবুজ ঘাসের খোঁজে থাকা, অনেক কিছুর মধ্যে নিরন্তর এই আগ্রহের খবর ঝুনু জানেই না।

আসলে সে যে বাড়ি যায়, মার চিঠি পেলে স্থির থাকতে পারে না, রক্তে সেই স্বাদ সুপ্ত হয়ে আছে বলে। কেমন এক মুক্তির স্বাদ। বাবাকে দেখে বুঝেছিল, জড়িয়ে থাকা যেমন জীবনের লক্ষণ আবার প্রয়োজনে উপেক্ষা করার মধ্যেও আছে মুক্তির স্বাদ।

সে স্টেশনে গিয়ে দেখল, জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা ছেড়ে দিলেই লালগোলা প্যাসেঞ্জার প্ল্যাটফরমে ঢুকবে।

গরমে অময় দরদর করে ঘামছিল। এত ভিড় যে পাখার নীচে গিয়েও দাঁড়াতে পারছে না। সে তার অ্যাটাচিটা একটা বেঞ্চিতে রেখে ঠাণ্ডা হাওয়া খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে কেন জানি মনে হল—না ঠিক না। সেই সুখ তাকে আবার তাড়া করছে। এক দঙ্গল যুবতী ভিড়ের মধ্যে ঝুঁকে পাখাওয়ালার কাছে গিয়ে ঘিরে দাঁড়াল, সবাই একটা করে তালপাতার জাপানি পাখা কিনে ফেলল, যেন স্টেজে উঠে এক্ষুনি তারা নাচ শুরু করবে—শরীরে সুবাস তাদের, দূরে থেকেও এই সুবাস সে টের পাচ্ছে। তারপর যুবতীরা কে কোথায় নিমেষে হারিয়ে গেল। সে দেখল, মানুষের ছোটাছুটির শেষ নেই, ব্যস্ততার শেষ নেই। তার আজ কোনো ব্যস্ততা নেই। জলের বোতলটার কথা মনে হল, তেষ্টা পাচ্ছে, পাশে বেঞ্চে ছোট্ট শিশু নিয়ে বসে আছে চাষি বউ। নাকে নথ। ঘোমটায় কপাল ঢাকা। মেয়েটা কাঁদছিল। ছোট্ট ফ্রক গায়। জল তেষ্টা পেতে পারে, লোকটা জলের ফ্লাস্ক দরদাম করছে, এই গরমে কাঁধে হরেক রকম প্লাস্টিকের জলের বোতল নিয়ে ঘুরছে ফেরিওয়ালা। ডাবল দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সব। গরিব মানুষের হিসাব সহজে মেলে না। জলের বোতল কিনতে তার সাহস হয়নি, গুচ্ছের টাকা দেবার ক্ষমতা নেই—অময়ের কি হল কে জানে, সে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে বলল, নিন।

লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। না না বাবু আপনার চলবে কি করে। কি গরম! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে! অময় হাসল, চলবে। আমি একা মানুষ, কোথাও খেয়ে নেব। সে ইচ্ছে করে বোতলটা ছোট্ট শিশুর পাশে রেখে হাঁটা দিল। জলের কল থেকে জল খেল। যেমন সে পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে এই লাইনে, কতবার টাকার অভাবে টিকিট না কেটেই গেছে—আর তখন লকোচুরি খেলা।

একবার মনে আছে, কলকাতায় ইন্টারভিউ দিতে এসে ফেরার পয়সা ছিল না। কাশিমবাজার স্টেশনে নেমে রাতের অন্ধকারে ধরা পড়ে গেল। নীল বাতি নিয়ে পয়েন্টসম্যান দাঁড়িয়েছিল শেষ মাথায়। ধরা পড়ার ভয়ে গেট দিয়ে ঢোকেনি, কোনোরকমে লাইন পার হয়ে আমবাগানে ঢুকে গেলেই আর পায় কে! আর কোত্থেকে ভূতের মতো পয়েন্টসম্যান ফুস করে উঠে দাঁড়াল। সে পালাতে গেলে তার কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ চেপে ধরেছিল। সে ব্যাগ ফেলেই ছুটেছিল, আঠারো উনিশ বয়সে বোধহয় মানুষ বেশি দুঃসাহসী হয়, ব্যাগ ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। সামনের বনজঙ্গল পার হয়ে মিলের রাস্তায় পড়ে নিশ্চিন্তি।

এমন একটা খেলা শুরু করলে কেমন হয়। এই বয়সে খেলাটা জমলে মন্দ হয় না। সে তার সেই আগেকার জীবনে ফিরে যেতে চায় বলেই ত, বছরে এক দু বার তার বাড়ি না গেলে মেজাজ ঠিক থাকে না।

জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস ছেড়ে গেলেই প্ল্যাটফরম ফাঁকা হয়ে গেল। লালগোলা প্যাসেঞ্জার ঢুকছে। ভিড় নেই বললেই হয়। ভিড় থাকলেও সে ছোটাছুটি করত কিনা জানে না। দাঁড়িয়ে কতবার কতটা রাস্তা ট্রেনে গেছে! রানাঘাটে কিছুটা খালি হয়। কৃষ্ণনগর গেলে আরও খালি–বসার জায়গার অভাব হয় না। কিন্তু আজ দেখছে, বেশ খালি কামরা। সে একদিকের একজনের আলাদা সিটে জানালার কাছে বসে গেল। ট্রেনটা প্ল্যাটফরম ছেড়ে যেতেই বুঝল, গরম বাতাস ঝাপটা মারছে। যেন লু বইছে। ঘরবাড়ি ইলেকট্রিকের তার ইস্পাতের মতো চকচক করছে। কাক–শালিখের ওড়াওড়ি গরমের ত্রাস থেকে। তার কেমন মজা লাগছিল। সে কেমন তার নিজের কাছে ফিরে যেতে পারছে। অফিসে এ-সময়টায় সে তার এয়ারকণ্ডিশান ঘরে বসে থাকে। এখন সে বসে আছে নিরন্তর এক দাবদাহ সঙ্গে নিয়ে। দমদমে গাড়িটা থামবে। ভিড় বাড়ছে। ব্যারাকপুর এলে, আরও। দু-একজন দাঁড়িয়ে আছে। একজন ষণ্ডামার্কা লোক তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, সরে বসুন।

সে মাঠ দেখছে। এরাই সেইসব লোক, যারা তার গোত্রের। এদের সুবিধাভোগী লোক বলা হয়। সুযোগ পেলেই অন্যের সুখ কেড়ে নেয়। নিজের সুখ তৈরি করে।

কি বলছি শুনতে পাচ্ছেন!

সে শুনতে পেল না।

সরে বসতে বলছি। দুজন হয়ে যায়।

হয় না। একজন বসতে পারে। অময় না তাকিয়েই বলল। অময় কঠিন মুখে যুবকটিকে দেখল। তার হাতের কবজি শক্ত। লোমশ বুক। চোখে জ্যৈষ্ঠ ঘাসের খরতাপ। টের পেরেই যুবকটি কাকে যেন ডাকতে গেল। কতটা হুজ্জোতি হতে পারে অময়ের কেন জানি আজ দেখার আগ্রহ। আর তখনই দেখল, একজন বুড়ো মতো মানুষ ওদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাকল, শুনুন। কাছে এলে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না। বলে সে সরে বসে বুড়ো মানুষটিকে জায়গা করে দিল। পাঁচ-সাতজন জড়ো করে সেই যুবক এসে দেখল, লোকটা রোদের মধ্যে গরম বাতাসের হলকায় পুড়ছে। পাসে একজন বুড়ো মানুষকে বসিয়ে রেখেছে। নিতান্ত হতদরিদ্র, গালে বাসি দাড়ি। গায়ে প্যাঁচপ্যাচে ঘামের গন্ধ। যুবক দাঁত শক্ত করে বলল, একজনের সিট বলছিলেন।

অময় তাকাল না।

অময় জানে, এরা ট্রেনের নিত্যযাত্রী। এরা গাড়িটাকে পর্যন্ত নিজের বাপের মনে করে। শুয়োরের বাচ্চা সব।

শুনতে পাচ্ছেন?

না।

অময় মাঠ দেখছে।

এখন দু-জনের সিট হল কী করে?

অময় জবাব দিল না। বুড়ো লোকটিকে সে বলল কোথায় যাবেন!

রেজিনগর নামব। ওখান থেকে দু-ক্রোশ পথ।

এই রোদে হেঁটে যেতে পারবেন?

যুবকটি এবার তার সাঙ্গপাঙ্গদের বলল, কি রে কি বুঝছিস! ধরব নাকি!

অময় ভ্রূক্ষেপ করল না। গম্ভীর গলায় বলল, ট্রেনের জানালায় আজকাল রড দেওয়া থাকে দেখছি।

যুবকটি রুমাল দিয়ে ঘাড় গলা মুছে পা ফাঁক করে দাঁড়াল-মশায়ের কোথায় যাওয়া হবে।

অময় বলল, এতটা রাস্তা রোদে হেঁটে যাবেন, কষ্ট হবে। ছাতাটা নিন। সে ছাতাটা বের করার সময় কালো একটা কী বের করে প্যান্টের ভাঁজে লুকিয়ে রাখল।

যুবক চমকে গেল। পুলিশের লোক! পুলিশের বড়োকর্তা হতে পারে। বেশি রং সহ্য নাও করতে পারে। সে গা ঢাকা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। অময় হাসল। বুড়ো লোকটি বলল, না না ছাতা আমার লাগবে না। আমার অভ্যাস আছে। মাথায় রোদ লাগে না।

অময় বলল, আপনি না নিলে, জানালা দিয়ে ফেলে দেব। দেখবেন। বলে সত্যি সে ছাতাটা তুলে ফেলতে গেলে কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল বুড়োমানুষটি। ভাবছে তার মাথা খারাপ নয় ত। কিন্তু আচরণে কোথাও বুড়োমানুষটি তা টের পায়নি। বলল, ছাতা ফেলে দেবেন কেন?

তারপরেই মনে হল অময়ের, নাটক হয়ে যাচ্ছে, আশপাশের যাত্রীরা তাকে দেখছে। সে এটা চায় না।

সে একসময় ভাবল, থাক ছাতাটা। বাড়ি গিয়ে মণিকে দেবে। টিফিন বের করে সে খেল না। থাক, বাড়ি ফিরে মণির ছেলেমেয়েদের খেতে দেবে। সে চিনাবাদাম কিনে খেল। শোনপাপড়ি খেল। কলের জল থেকে জল খেল। ঘামে জামা-প্যান্ট ভিজে গেছে! ভালো লাগছে—এটাই সে চাইছে। বাড়ি গিয়ে পৌঁছোল সাড়ে পাঁচটায়। মা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। প্রচণ্ড গরমে সে হেঁটে এসেছে স্টেশন থেকে। রিকশা পর্যন্ত নেয়নি। মা বলল, তোর কি মাথা খারাপ। এই রোদে হেঁটে এলি! অসুখবিসুখ হলে কে দেখবে বাবা!

অময় বলতে পারত, অনেকদিন পর মা আমি আবার আমার মধ্যে ফিরে আসতে পেরেছি। ফিরে আসার এই মজা যে বোঝে সে বোঝে।

সে মাকে গড় করার সময় বলল, কোনো কষ্ট হয়নি। অনেকদিন পর নিজের সুখ কাকে বলে টের পেলাম মা। তুমি কেমন আছ! আর সবাই?

মণি তখন তার গোরুটাকে মাঠের মধ্যে রোদে ঘাস খাওয়াচ্ছে। দাদাকে দেখেই সে ছুটে আসছে। সবাই। এই বাড়ির গাছপালা বনজঙ্গল সব তার শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের কথা বলে। সে এখানে এলেই মুক্তির স্বাদ পায়। মা গাছের নীচে মাদুর বিছিয়ে দিলে সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল, বলল, আঃ কি আরাম!

ঝোড়ো হাওয়ায় পাতা উড়ে গেল। পাখিরা ডালে এসে বসল। পরিচিত মানুষজন বলল, কে অময়? সদরে কোনো কাজ ছিল? গাড়িতে না ট্রেনে?

সে বলল, ট্রেনে কাকা। সেই ট্রেনে-জলের বোতল নেই, ছাতা নেই, টিকিট নেই। সেই ট্রেনে আমি আবার আজ ফিরে আসতে পেরেছি! সে আর যা বলতে পারত, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ট্রেন ওই একটাই। অন্য ট্রেনে চেপে বসলে বড়ো অস্বস্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *