নবম অধ্যায়
রাজশাহীতে শিক্ষানবিশকাল – অক্টোবর ১৯৬৮-নভেম্বর ১৯৬৯
সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থীদের নানা বিষয়ে পড়ানো হতো। কিন্তু প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শুধু বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষ করা নয়; মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচিত কর্মকর্তাদের অফিসার হওয়ার উপযুক্ত করা। সিভিল সার্ভিসের সমালোচকেরা দাবি করতেন যে একাডেমিতে প্রশিক্ষণার্থীদের উন্নাসিক কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলা হতো। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের কোনো উৎসাহ ছিল না। আমার মনে হয় এ সমালোচনাটি ঠিক নয়। দুর্বিনীত কর্মকর্তা সৃষ্টির জন্য কোনো একাডেমির প্রয়োজন হয় না, যেখানেই একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়, সেখানেই কর্মকর্তারা কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই জালেম হয়ে ওঠেন। এই প্রসঙ্গে Lord Acton-এর বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, ‘Power corrupts and absolute power corrupts absolutely.’ কাছে মনে হয় সিভিল সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য ছিল ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বের জন্য কর্মকর্তাদের প্রস্তুত করা।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে লাহোর একাডেমির কর্মসূচিসমূহ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে আমরা ঢাকায় ফিরে আসি। ঢাকায় তখন সার্ভিসেস অ্যান্ড জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের উপসচিব ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ, যিনি পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকায় পৌঁছার পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের পোস্টিং অর্ডার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমাকে রাজশাহী জেলার শিক্ষানবিশ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিয়োগ করা হয়েছে। আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি রাজশাহী যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। বিমানে করে তখন ঈশ্বরদী পর্যন্ত যাওয়া যেত। ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন অথবা গাড়ি করে রাজশাহী যেতে হতো। ঢাকার বন্ধুবান্ধব পরামর্শ দিল যেন। আমি ডেপুটি কমিশনারের কাছে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী যাওয়ার জন্য একটি জিপ পাঠানোর ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে একটি তারবার্তা পাঠাই। ঈশ্বরদীতে নেমে আমি কোথাও জিপ দেখতে পাইনি। সৌভাগ্যবশত পিআইএ ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য একটি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করেছিল। আমি অগত্যা সবশেষে কোনো রকমে ওই মাইক্রোবাসে স্থান করে নিলাম। ঘণ্টা তিনেক পরে গাড়ি রাজশাহী সাহেববাজার পিআই এ অফিসে হাজির হয়। গাড়ি থেকে নেমে দেখি একটি সরকারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামার পর এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমাকে প্রশ্ন করেন। যে আমার নাম আকবর আলি খান কি না? আমি হ্যাঁ বলাতে তিনি পরিচয় দেন যে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট নাজির আবদুর রহিম। তিনি এসেছেন আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে বসতেই তিনি বললেন, ডেপুটি কমিশনার তাঁকে পিআইএ অফিস থেকে আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি রাজশাহীর বাইরে সফরে গেছেন এবং সন্ধ্যার পর তিনি শহরে ফিরবেন। ফিরেই তিনি আমাকে ফোন করবেন। আমার সঙ্গে তাকে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
আমি রাজশাহী সার্কিট হাউসে এসে নামলাম। সার্কিট হাউসে তখন দুটি অংশ ছিল। একটি অংশে ছিল পাঁচটি কামরাসহ একটি ভবন। একটি কামরা ড্রয়িং কাম ডাইনিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো আর চারটি কামরা ছিল শয়নকক্ষ। সার্কিট হাউসের নতুন ভবন ছিল দ্বিতলবিশিষ্ট। দ্বিতল ভবনে চারটি কক্ষ ছিল। তার মধ্যে একটি কক্ষ ছিল ভিভিআইপিদের জন্য। নিচের তলায় ছিল একটি কনফারেন্স রুম এবং একটি ডাইনিং রুম ও একটি শয়নকক্ষ। এই শয়নকক্ষটিতেই থাকতেন আমার পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণার্থী হাবিবুন নবী আশিকুর রহমান, তিনি মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে চলে গেছেন। তাঁর শূন্য কক্ষটি আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়। কক্ষটিতে একজনের থাকার জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল। এমনকি বাথরুমের পাশে জিনিসপত্র রাখা এবং সাজসজ্জার জন্য একটি ছোট কক্ষও ছিল। পরে সার্কিট হাউসে আরও দুটি তলা বাড়ানো হয়েছে। তবে এই কক্ষটি ২০০১ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।
সার্কিট হাউসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ডেপুটি কমিশনার খন্দকার আসাদুজ্জামানের টেলিফোন কল আসে। তিনি বলেন, ‘তুমি এসেছ ভালো হয়েছে। আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ডিনার খাবে। অ্যাসিস্ট্যান্ট নাজির রহিম তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে আসবে। আমি রাত আটটার দিকে ডিসির বাংলোয় যাই। তিনি তখন কনফিডেনশিয়াল রুমে বসে কাজ করছিলেন। আমি যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়া হয়। টেবিলে আমাদের সঙ্গে আরও যোগ দেন মিসেস আসাদুজ্জামান এবং তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। খেতে খেতে আসাদুজ্জামান আমার বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন এ ধরনের পরিচিতিমূলক প্রশ্নগুলো সেরে নেন। তারপর বলেন, ‘তুমি আমার জন্য ঠিক সময় এসে পৌঁছেছ। ঠিক সময় কেন তা আমি বুঝতে পারিনি, তাঁর দিকে তাকাতেই বললেন, ‘ঠিক সময় এ জন্য যে আমার নওগাঁর মহকুমা প্রশাসক। মহীউদ্দীন খান আলমগীর পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হয়ে গেছে। আগামী পরশু দিন সে নওগাঁ থেকে চলে যাবে। অথচ গত তিন দিন ধরে নওগাঁ মহকুমায় আত্রাই নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত এবং সেখানে সুষ্ঠুভাবে রিলিফ কাজ পরিচালনার দরকার রয়েছে। তুমি কাল ভোরে নওগাঁ চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে ত্রাণের সব দায়িত্ব বুঝে নেবে।
আমি সবে রাজশাহীতে এসেছি। সার্কিট হাউস এবং ডিসির বাংলো ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। আমার ইচ্ছা করছিল যে যদি এই সফর অন্তত দু-দিন পেছানো যায়। আমি বললাম, ‘স্যার, বন্যাদুর্গত অঞ্চলে কাজ করতে হলে টিএবিসি (টাইফয়েড, এমিবিক, বেসিলারি, কলেরা) প্রতিষেধক নেওয়া উচিত। আমি গত দু-তিন বছর টিএবিসি নিইনি। যদি অনুমতি দেন, তাহলে টিএবিসি নিয়ে দিন দুয়েক পরে আমি নওগাঁ যাই।’
আসাদুজ্জামান বললেন, না, তোমাকে কালকেই যেতে হবে। তোমাকে কাল ভোর পাঁচটার সময় টিএবিসি ইনজেকশন দেওয়া হবে। ভোর ছযটার সময় তোমাকে জিপে করে নাটোরে নিয়ে সান্তাহারগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে (রাজশাহী থেকে সরাসরি সান্তাহার যাওয়া যেত না, ট্রেন বদল করে সান্তাহার যেতে অনেক সময় লাগত)। তিনি সহকারী নাজিরকে ডাকলেন এবং বললেন রাজশাহী মিউনিসিপ্যালটির কোনো ভ্যাকসিনেটরের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ করে সকাল পাঁচটায় আমাকে টিএবিসি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন সকালে রহিম ঠিক পাঁচটার সময় এসে হাজির। আমাকে টিএবিসি ইনজেকশন নিতে হলো। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে রাজশাহীর সহকারী নাজির রহিম খুবই করিতকর্মা ছিল। বস’দের আদেশ সে যেকোনো মূল্যে প্রতিপালন করত। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, তখন রহিম গণভবনের নেজারতে চাকরি পায় এবং সেখানে নেজারতের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাকে রাজশাহীতে ফেরত পাঠানো হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের নাজির হিসেবে সে অবসর গ্রহণ করে।
আমি নাশতা খেয়ে নাটোরের উদ্দেশে রওনা হলাম। টিএবিসি ইনজেকশন নিলে আমার জ্বর উঠত। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নাটোর পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার জ্বর উঠতে শুরু করে। ট্রেনে যখন উঠি, তখন দেহে ১০০ থেকে ১০১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এই জ্বর নিয়ে আমি সান্তাহারে নামি। সান্তাহার স্টেশনে নওগাঁর এসডিও ম্যালেরিয়া নির্মূল বিভাগের একটি গাড়ি রিকুইজিশন করে আমার জন্য পাঠিয়ে দেন। এই গাড়ি আমাকে নওগাঁ সড়ক ও রাজপথ বিভাগের পরিদর্শন বাংলোতে নিয়ে আসে। বিকেলবেলায় মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সন্ধ্যায় যখন তাঁর বাড়িতে আমি যাই, তখন তিনি অফিসের শেষ কাজকর্ম করছিলেন। আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গিয়ে সেখানে আমার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী বললেন তাদের কয়েকটি ফেয়ারওয়েলে যেতে হবে। আমার জ্বর। তাই বেশি রাত পর্যন্ত সজাগ থাকা সম্ভব নয়। আমি যেন তাঁর বাড়ির খাবার খেয়ে রাতে রেস্টহাউসে গিয়ে বিশ্রাম করি। পরদিন সকালে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন।
আমি তাদের সাফল্য কামনা করি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি এসডিওর অফিসে যাই। সেখানে ত্রাণের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানি, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পত্নীতলা ও মহাদেবপুর থানা দুটি। নওগাঁ থেকে মহাদেবপুর হয়ে পত্নীতলা যাওয়ার যে সড়ক আছে, তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন পত্নীতলা যেতে হলে পাহাড়পুরের পাশ দিয়ে একটি বিকল্প সড়কে উঠে অনেক ঘুরে পত্নীতলা যাওয়া যাবে। আমি এ বিকল্প সড়ক দিয়ে পত্নীতলায় রওনা হয়ে যাই। সেখানে সার্কেল অফিসারকে খুঁজে বের করি এবং তাঁর সঙ্গে নৌকায় করে বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলে যাই। এই অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল, তবে কেউ মারা যায়নি। আমি দেখতে পাই যে ওই অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। সুতরাং ত্রাণ কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে।
আমি রাতে নওগাঁ শহরে ফিরে আসি। পরের দিন আবার একই সড়ক। দিয়ে আমি পত্নীতলায় যাই। সেখান থেকে সড়ক দিয়ে আমি মহাদেবপুর পর্যন্ত পৌঁছি। সেখানে নৌকা করে আমি আবার বন্যাদুর্গত অঞ্চল ঘুরতে যাই। বিকেলবেলা আমি নওগা ফিরে আসি। সেদিন সন্ধ্যায় ডেপুটি কমিশনার ফোন করেন দুদিন পর তিনি নওগাঁ আসছেন। এই দুদিন আমি প্রত্যেক দিনই রিলিফের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছিলাম। এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছিলাম। দুদিন পর ডেপুটি কমিশনার নওগাঁ আসেন। তখন বন্যার পানি নেমে গেছে। তিনি রিলিফের কাজকর্ম দেখে সন্তুষ্ট হন এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের হাতে রিলিফের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে নিয়ে রাজশাহী ফিরে আসেন। প্রায় দিন সাতেক পর আমি রাজশাহীতে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করি।
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব
প্রশিক্ষণার্থীদের জেলা প্রশাসনে সংযুক্ত করা হতো জেলা প্রশাসনের কাজকর্ম শেখার জন্য। আমাকে প্রথমেই অনেকগুলো বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাকে ইংলিশ বিভাগের অফিসার ইনচার্জ করা হয়। ইংলিশ বিভাগের দায়িত্ব ছিল ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সব সাধারণ চিঠিপত্রের জবাব দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এই বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন ডেপুটি কমিশনারের অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ডেপুটি কমিশনারের অফিসে যেসব চিঠিপত্র আসত, সেসব চিঠিপত্র ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্ধারিত বিভাগে পাঠাতেন। আমি তিন-চার দিন তার সঙ্গে বসে এ কাজটি করা দেখি। আমাকে ডেভেলপমেন্ট বিভাগের অফিসার ইনচার্জ করা হয়। প্রতি মাসে জেলার সব উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে একটি সভা হতো। এই সভার কার্যপত্র উন্নয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক তৈরি করা হতো। তিনি সভার সিদ্ধান্তগুলোও লিপিবদ্ধ করতেন।
আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ শেখার জন্য সপ্তাহে দুদিন রাজশাহী সদর এসডিওর অফিসে কাজ করতে হতো। মাস দুয়েক পর আমাকে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমি সদর এসডিওর আদালতে পুলিশ ফাইল এবং জেনারেল ফাইলের কাজ করতাম। এখানে সব মামলা রুজু করা হতো এবং বিচারের জন্য প্রস্তুত মামলাগুলো ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, আসামিদের জামিন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। মহকুমার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ও মহকুমার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য এই কাজটি ছিল অত্যাবশ্যক। আমি কয়েক মাস এ কাজটি করি। এর ফলে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমার দায়িত্বের জন্য সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ লাভ করি।
এ ছাড়া ট্রেজারিতে প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন। ট্রেজারি অফিসারের সঙ্গে বসতে হতো। তখন রাজশাহীতে ট্রেজারি অফিসার ছিলেন আবদুর রহিম নামের একজন ইপিসিএস অফিসার। তিনি ছিলেন ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি আবদুস সালাম এবং আবদুস সামাদের বড় ভাই। তিনি ট্রেজারির বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমার আরেকটি দায়িত্ব ছিল জেলা জজদের আদালতে বিচারের সময় উপস্থিত থেকে তিনটি মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শুনে তা লিপিবদ্ধ করা এবং সাক্ষ্য আইনের কোন ধারায় তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা মার্জিনে উল্লেখ করা। জেলা জজ তা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হলে প্রাদেশিক সরকারকে তা জানিয়ে দিতেন। আমার ওপর তখন এত কাজ অর্পিত হয়েছিল যে এ কাজটি আমি সম্পন্ন করা দূরে থাকুক, শুরুই করতে পারিনি। কিছুদিন পরপর বিভাগের দায়িত্ব পরিবর্তন করা হতো। আমাকে লাইব্রেরি এবং LAO (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসার)-এর দায়িত্ব ছাড়া আর সব বিভাগের দায়িত্ব কমপক্ষে এক মাসের জন্য দেওয়া হয়। আমি এনডিসি (নেজারত ডেপুটি কালেক্টর) এবং আরডিসির (রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর) দায়িত্বও পালন করেছি।
এসব আনুষ্ঠানিক কাজের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। অনানুষ্ঠানিকভাবে আমি ছিলাম আমার ডেপুটি কমিশনারের একান্ত সচিব। ডেপুটি কমিশনারের অফিসে ঢুকতে হলে আমার অফিস দিয়ে ঢুকতে হতো। ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার জন্য যখন কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি আসতেন, তখন তিনি আমার রুমে বসে অপেক্ষা করতেন। এভাবেই রাজশাহীর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা কামারুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার অফিসে এসে বসতেন। আমি তাকে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতাম। ডেপুটি কমিশনার যখন রাজশাহীর বাইরে কোনো প্রকল্প বা অফিস পরিদর্শনে যেতেন, তখন তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। কীভাবে অফিস পরিদর্শন করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রথম সবক আমি খন্দকার আসাদুজ্জামানের কাছ থেকেই পাই। আবার ডেপুটি কমিশনার যখন রাতে বোয়ালিয়া ক্লাবে যেতেন, তখনো তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। প্রায় সারা দিনই আমাকে ডেপুটি কমিশনারের পাশে থাকতে হতো। এর ফলে আমার ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারদের চেয়েও বেশি ছিল। নাটোরে তখন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের আখতার আলী। ডিসি অফিসে নাটোরের কোনো ফাইল আটকে গেলে তিনি আমাকে ফোন করতেন। আমি বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলাম।
রাজশাহীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের পরিচিতি
রাজশাহীতে আমি নিম্নলিখিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করেছি—
১
কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। আমার রাজশাহী অবস্থানের বেশির ভাগ সময় তিনি রাজশাহীর কমিশনার ছিলেন। তাঁর পরিবার ঢাকায় থাকত। তিনি একা রাজশাহীতে থাকতেন। তাঁর বাড়িতে দুবার আমি ডিনার খেতে গিয়েছিলাম।
২
অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। মোহাম্মদ খলিলুর রহমান ১৯৫৭ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা ছিলেন। অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে রাজশাহীতে বদলির আগে তিনি ছিলেন বরিশাল জেলার জেলা প্রশাসক। বরিশালে থাকাকালীন তাঁর সন্দেহ হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনী বরিশাল দখলের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। তার সন্দেহের কারণ হলো অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কোনো কোনো বিমান খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেত। তাঁর সন্দেহ হলো উপকূলের নারকেলগাছের ডাব এবং নারকেলের মধ্যে বিশেষ বার্তা লিখে ভারতীয়রা স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। তিনি এই নিরাপত্তাঝুঁকির কথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র বিভাগকে জানান। স্বরাষ্ট্র বিভাগ তদন্ত করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে খলিলুর রহমানের সন্দেহের কোনো যুক্তিসংগত ভিত্তি নেই। খলিলুর রহমান এই প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট না হয়ে সরাসরি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে তাঁর বক্তব্য লিখে পাঠান। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরকে এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেনাবাহিনী থেকে একটি বড় তদন্ত দল পাঠানো হয়। তারা বরিশালে এসে সরেজমিনে তদন্ত করে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনকে সমর্থন করেন। তারা মন্তব্য করেন ডেপুটি কমিশনার মহোদয় সম্ভবত কাজের চাপে ক্লান্ত। তাই তিনি এ ধরনের অভিযোগ কল্পনা করছেন। তাঁরা পরামর্শ দেন, তাঁকে কিছুদিনের জন্য কম দায়িত্বের একটি পদে পদায়ন করলে হয়তো তাঁর মানসিক সমস্যা কেটে যাবে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাজশাহীতে অ্যাডিশনাল কমিশনার পদে নিয়োগ দেন এবং সিদ্ধান্ত নেন। যে তাঁকে নেদারল্যান্ডস সরকারের বৃত্তিতে পরবর্তী ব্যাচে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সে পড়ার জন্য পাঠানো হবে। রাজশাহীতে তিনি বেশি দিন ছিলেন না। আমি রাজশাহী থেকে বদলি হওয়ার দু-এক মাস পরে তিনি নেদারল্যান্ডস চলে যান। নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে আসার পর সচিবালয়ের করিডরে একবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন তিনি স্যুট-কোট পরা সাহেব। পাইপ টানেন এবং ইংরেজিতে কথা বলেন। পরে শুনলাম তিনি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব নিযুক্ত হন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তখন পুরোনো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থিত ছিল। পুরোনো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ে একটি মাজার রয়েছে। একদিন তার অফিসে বেশি কাজ করতে গিয়ে তার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। যখন তিনি কাজ শেষ করে বেরোচ্ছিলেন তখন মাজারের পাশে এক জ্যোতির্ময় ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হয়। তারপর নাকি প্রায়ই তাঁর সঙ্গে কথা হতে থাকে। তিনি স্যুট-কোট ছেড়ে দিয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন। তিনি নিয়মিত নামাজ-রোজা করতেন। আমি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরে আসার পর আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপসচিব হিসেবে পদস্থ হই। ওই সময়ে খলিলুর রহমান ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং আমি সরাসরি তাঁর কাছে নথি পেশ করতাম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আমার যথেষ্ট কাজ ছিল না। তাই অফিসে বসে আমি বই পড়তাম। অফিসে আসার সময় ব্রিফকেসে মোটা মোটা বই নিয়ে আসতাম। এই ব্রিফকেস লিফটে তোলার সময় বেশ কষ্ট হতো। খলিলুর রহমান একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ব্রিফকেসে কী আছে? আমি বললাম, বই আছে। তিনি বললেন, বই কেন পড়ো? আমি বললাম, জ্ঞানের জন্য। তিনি বললেন, জ্ঞানের জন্য কোরআন শরিফ ছাড়া আর কিছু পড়ার প্রয়োজন নেই।
একদিন কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, কোনো কবিতা পাঠের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে একটি কবিতাই আছে, সেটি হলো পার্সি ভাষায় রচিত রসুলের বন্দনা, বালাগুল ওলা বি কামালিহি…। এই সময়ে তার বিশ্বাস হয় সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তার কাছে ওহি পাঠানো হচ্ছে। এই ওহি সম্পর্কে বলার জন্য তিনি বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে স্ব-উদ্যোগে যোগ দেওয়া শুরু করেন। যখনই তিনি ওহি পাওয়ার কথা বলতেন, তখনই উপস্থিত জনতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিত। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন। একদিন খলিলুর রহমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে একটি নোট পাঠিয়ে লেখেন, তিনি শরীয়তপুরে একটি ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেওয়ার জন্য দুদিন পর ঢাকা থেকে শরীয়তপুরে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব লিখে পাঠালেন, আপনাকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না। যেদিন তাঁর শরীয়তপুর যাওয়ার কথা, সেদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব অফিসে এসে দেখেন, খলিলুর রহমান GAIGE fol63769, By order of Almighty Allah, I am going to Shariatpur.’তর বেদাত বক্তব্যের জন্য শরীয়তপুরের মুসল্লিরা তাঁকে আক্রমণ করে। পুলিশ তাকে কোনো রকমে রক্ষা করে ঢাকা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব কেরামত আলী তাঁকে ওয়াজ মাহফিলে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি সে পরামর্শ শোনেননি। পুরান ঢাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে তিনি আবার বেদাত বক্তব্য দেন। পুলিশ বহু কষ্টে তাঁকে সে ওয়াজ মাহফিল থেকে বের করে আনে। এরপর সরকার তাঁকে চাকরিতে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। খলিলুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ অনার্স ও এমএ পাস করেন এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সারা পাকিস্তানে পঞ্চম স্থান অধিকার করে সিএসপি হন। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত চাকরিতে টিকে থাকতে পারেননি।
৩
ডিসি খন্দকার আসাদুজ্জামান। খন্দকার আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স ও এমএ পাস করেন। এরপর তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণপ্রশাসনে এমপিএ পড়েন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় এমপিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আগস্ট ১৯৬৮ সালে রাজশাহীতে ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হন। তাঁর স্ত্রী কুলসুম জামান তার আত্মীয় ছিলেন এবং তিনি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে আসাদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বেগম কুলসুম জামান ও তার পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই আমাকে বিশেষ যত্ন করেছেন। তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
৪
ডিসি সৈয়দ শামীম আহসান। সৈয়দ শামীম আহসান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তার নানা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য এবং ভারতীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য স্যার এ এফ রহমান। শামীম আহসানের পিতা ছিলেন বরিশালের শায়েস্তাবাদ জমিদার বংশের ছেলে এবং শিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অল্প বয়সে তাঁর পিতা মারা যাওয়ায় শামীম আহসানকে বড় করেন তার মা। বিএ অনার্স পাস করার পরই তিনি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সিএসপির চাকরি পান। তিনি অল্প কিছুদিন বাগেরহাটের এসডিও ছিলেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের একান্ত সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি গভর্নরের সচিব নিযুক্ত হন। ওই সময় ঢাকার লাট ভবনে ব্রিগেডিয়ার ইস্কান্দার করিম নামে একজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। গভর্নর হাউসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেগম শামীম আহসান অনেক গয়না পরতেন। ইস্কান্দার করিম প্রশ্ন তোলেন যে এসব গয়না নিশ্চয়ই সত্তাবে অর্জিত অর্থে কেনা হয়নি। তাঁর স্ত্রীর গায়ের গয়নাই প্রমাণ করে শামীম আহসান মোটেও সৎ নন। তাঁর এই গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শামীম আহসানকে দুর্নীতিপরায়ণ ৩০৩ জন কর্মকর্তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শামীম আহসানকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তবে তাকে আপিল করার জন্য একটি সুযোগ দেওয়া হয়। শামীম আহসান আপিল করেন। তিনি আদালতের সামনে তাঁর স্ত্রীর গয়নাগুলো দাখিল করেন। সঙ্গে সঙ্গে একই ধরনের আরেক সেট গয়না দাখিল করেন, যে গয়নাগুলোর মালিক ছিলেন তার খালা মিসেস সায়েদুল হাসান। দিল্লির যে দোকান থেকে এ গয়নাগুলো কেনা হয়েছিল, তার রসিদও দাখিল করেন। শামীম আহসান শেষ পর্যন্ত সামরিক আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তাঁর স্ত্রী যে গয়নাগুলো ব্যবহার করছেন, সেই গয়নাগুলো তার মায়ের। তাঁর মাকে ও তার খালাকে তাঁদের বিয়েতে একই ধরনের গয়না দিয়েছিলেন তাঁর নানা স্যার এ এফ রহমান। তিনি শুধু সরকারি চাকরিই করতেন না, তিনি জলপাইগুড়িতে যৌতুকসূত্রে তিন-চারটি চা-বাগানের মালিক ছিলেন। বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার চাকরি ফেরত দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রংপুরের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। তিনি ইউরোপিয়ান দেশসমূহের দূতাবাসে বাণিজ্যিক উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি সেচ, টেলিফোন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।
৫
এডিসি শাকিল আহমদ। তিনি ১৯৬৪ ব্যাচে সিএসপিতে যোগ দেন। তিনি পটুয়াখালীর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। রাজশাহীতে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার পর তাকে এডিসি সাধারণ প্রশাসন পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৬
এডিসি সাদাত হোসেন। তিনি একজন ইপিসিএস কর্মকর্তা ছিলেন এবং রাজস্ব বিভাগের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ছিলেন।
৭
সদর এসডিও এস এ চৌধুরী। তিনি একজন ইপিসিএস কর্মকর্তা ও রাজশাহী সদরের এসডিও ছিলেন। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী কর্মকর্তা ছিলেন এবং আমাকে সদর মহকুমায় প্রশিক্ষণের বিভিন্ন সুযোগ করে দেন।
৮
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরা। রাজশাহীতে তখন একঝাক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এখনো নাম মনে আছে নিম্নলিখিত কর্মকর্তাদের : (ক) আবদুর রহিম, (খ) আবদুর রব চৌধুরী, (গ) মো. নাসিম এবং (ঘ) সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
রাজশাহী ফৌজদারি আদালতের আইনজীবী
রাজশাহী ফৌজদারি আদালতের খুব বেশি আইনজ্ঞের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি। কোর্টে তাদের সওয়াল-জবাব শুনেছি। তবে একজন আইনজ্ঞের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। এই আইনজ্ঞের নাম হলো আতাউর রহমান। তিনি রাজশাহীর বামপন্থী আন্দোলনের নেতা মাদার বক্সের জামাতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মহিউদ্দিন আহমদ আমি রাজশাহীতে যোগদানের পরপরই তাকে আমার অফিসে নিয়ে আসেন। তিনি জামিনের আবেদন করলে মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। কেননা তিনি বিনা পয়সায় সমস্ত বামপন্থী কর্মীর প্রতিরক্ষার কাজ করতেন। প্রথম দিন যখন আমি আদালতে যাই, তখন আতাউর রহমান আমার কাছে একটি জামিন আবেদন পেশ করেন। আবেদনের পক্ষে তিনি বলেন, ষাড়, আমার মক্কেল সম্পূর্ণ নির্দোষ, পুলিশ তার বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ নিয়ে এসেছে। ষাড়, তাকে এক্ষুনি জামিন দেওয়া উচিত।’ তার ষাড় সম্বোধনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কম বয়সে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ায় তিনি কি আমাকে বিদ্রূপ করছেন? ষাড় বলার জন্য কি এই মুহূর্তেই তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা রুজু করা উচিত? পরে ভাবলাম এ বিষয়ে আর একটু অনুসন্ধান করি। তবে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দিই। খাসকামরায় এসে আমি অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটক আতাউর রহমান। আমাকে কেন ষাড় বলেছে, তার সম্ভাব্য কারণ জানতে চাই। তারা হেসে বললেন, স্যার, ওনার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকজন ‘স’ উচ্চারণ করতে পারে না। তারা স্যারকে ষড়ই বলে থাকে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে লেখাপড়া করে যারা হাকিম হন, তারা এই অঞ্চলে ষাড়ের মর্যাদা লাভ করে থাকেন!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০-এর দশকে রাজশাহীর মতিহার অঞ্চলে স্থায়ী ক্যাম্পাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কাজ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম, পাঠাগার, ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাস এবং শিক্ষকদের থাকার জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তখন সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন তালুকদার মনিরুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে আগে থেকেই আমার পরিচয় ছিল। তিনি সাদরে আমাকে আমন্ত্রণ জানান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ক্লাব ও তাঁর বাসস্থানে নিমন্ত্রণ করেন। তাঁর স্ত্রী রাজিয়া খানম তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তার পিতা ছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার সার্কেল অফিসার (রাজস্ব)। আমি তালুকদার মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রীকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। তালুকদার মনিরুজ্জামানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হতো। তাঁর কাছ থেকে অনেক বই এবং প্রবন্ধ নিয়ে পাঠ করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপিএসইউর সদস্য আবদুল কাদের ভূঁইয়া সমাজকল্যাণ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পাঁচজন খুবই ক্ষমতাশালী অধ্যাপক ছিলেন। এঁদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলা হতো। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ইংরেজির জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইতিহাসের আজিজুর রহমান মল্লিক ও সালাউদ্দিন আহমদ, ফলিত রসায়নের অধ্যাপক ফজলে হালিম চৌধুরী ও অর্থনীতির অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সময় পেলে তাঁর বাসায় আড্ডা দিতে যেতাম। তিনি তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজের স্মৃতি, সুশোভন সরকারের ছাত্র হিসেবে তার অভিজ্ঞতা। এবং র্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর কাছে আমি রাজশাহী পৌরসভার লাইব্রেরির খোঁজ পাই। তিনি নিজে একদিন আমাকে এই পাঠাগারে নিয়ে যান। ১৮৯০ সালের দিকে এ পাঠাগারের পুস্তক সংগ্রহ শুরু হয়। এ পাঠাগারে আমি প্রবাসী এবং মডার্ন রিভিউর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সব খণ্ড দেখতে পেয়েছি। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ লেখকের অনেক বইয়ের প্রথম সংস্করণ এই পাঠাগারে ছিল। আমি যখন পাঠাগারটি দেখতে যাই, তখন পাঠাগারটির ভবন অনেক দিন মেরামত করা হয়নি। ভবনটি অবিলম্বে মেরামত করা প্রয়োজন। আমি রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনার খন্দকার আসাদুজ্জামানকে লাইব্রেরিটি দেখাতে নিয়ে যাই। আমার ঐকান্তিক তদবিরের ফলে তিনি জেলা কাউন্সিল তহবিল থেকে ভবনটি মেরামত করার জন্য ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। ১৯৬৯-৭০ সালের অর্থবছরের প্রথম দিকে এই অনুদান দেওয়া হয়। কাজ শুরু হওয়ার আগেই আমি রাজশাহী থেকে হবিগঞ্জ বদলি হয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল কি না, আমি তা জানি না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার তখন মাত্রই গড়ে উঠছিল। পুরোনো বইপত্র খুব বেশি ছিল না, তবে নতুন বইপত্র ছিল অনেক। লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি বই বাছাই করতাম এবং কোনো এক অধ্যাপকের নামে সেগুলো ধার নিয়ে পড়তাম। রাজশাহীতে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন এবং সহকারী অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডার আরেকটি সুন্দর জায়গা ছিল বরেন্দ্র জাদুঘর। জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে ছিল। শহরের মূল কেন্দ্রে এটি অবস্থিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের শিক্ষক এখানে আড্ডা দিতে আসতেন না, যাদের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ ছিল, কেবল তারাই এখানে আসতেন। এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুখলেসুর রহমান। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি সম্পর্কে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু যেহেতু ইসলামের ইতিহাসে তিনি এমএ পাস করেছেন, সেহেতু তাঁকে ওই বিভাগেই শিক্ষকতা করতে হতো। ড. রহমান জাদুঘর থেকে একটি উঁচু মানের সাময়িকী প্রকাশ করতেন। তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। অতিথিদের আপ্যায়নে তার কোনো কার্পণ্য ছিল না। স্কচ-হুঁইস্কি ছাড়া কোনো মদ অতিথিকে তিনি দিতেন না। তিনি রাজশাহীর আশপাশের অঞ্চলে যেখানে হাটে গরু জবাই করা হতো, সেখানে নিয়মিত যেতেন এবং কাবাবের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের গোশত তার ফ্রিজে এনে ভরে রাখতেন। কোনো অতিথি গেলেই শুরু হতো কাবাব তৈরির ধুম। প্রায়ই বিকেলে আমি জাদুঘরে যেতাম এবং তার আতিথ্য আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেছি। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ২০০৭ সালে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন। জাদুঘরের বাইরে বহুতলবিশিষ্ট ভবনের একটি ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন। তখনো তার আতিথেয়তা কমেনি। সৌভাগ্যবশত বৃদ্ধ পিতাকে তখন আর্থিকভাবে সমর্থন করতেন আমেরিকা প্রবাসী তাঁর ছেলে তৈমুর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া রাজশাহী শহরে আরেকটি সরকারি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এই কেন্দ্রটি পাকিস্তান সরকারের অর্থে পরিচালিত হতো। কেন্দ্রটির নাম ছিল পাকিস্তান কাউন্সিল। এর পরিচালক ছিলেন তোফায়েল আহমদ এবং উপপরিচালক ছিলেন এককালীন সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া। কিবরিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা ছিল এবং সেই সূত্রে কিবরিয়াদের বাড়িতে অনেক খাওয়াদাওয়া করেছি। পাকিস্তান কাউন্সিলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি করে দাওয়াত দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমার ছবিসহ সংবাদ তখনকার দৈনিক এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল।
ভূমি জরিপ ও বন্দোবস্ত প্রশিক্ষণ (সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট ট্রেইনিং)
রাজশাহীতে যোগদানের আড়াই মাস পর আমাদের ব্যাচের ভূমি জরিপ এবং বন্দোবস্তের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এই প্রশিক্ষণের কেন্দ্র ছিল গোদাগাড়ী থানার প্রেমতলী নামক গ্রামে। স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করেন, শ্রীচৈতন্য দেব প্রেমতলীতে এসেছিলেন। এই গ্রামে মেলার জন্য একটি বিরাট মাঠ ছিল। এই মাঠে আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি তাঁবুর শহর গড়ে তোলা হয়। ক্লাসের জন্য ছিল বড় বড় তাবু আর থাকার জন্য ছিল ছোট তাঁবু। আমরা প্রত্যেকে আমাদের নিজস্ব অর্ডারলি সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা বাজার করত এবং রান্না করত ও আমাদের সব কাজ করে দিত। প্রায় এক মাস ডিসেম্বরের শীতের মধ্যে আমাদের এই তাবুতে থাকতে হয়েছে। সেখানে কোনো শৌচাগার ছিল না। মাঠের এক কোণে মাটিতে গর্ত করে প্রস্রাব পায়খানা করতে হতো। যারা গ্রামে বড় হয়নি, তাদের জন্য এ ব্যবস্থা খুবই অস্বস্তিকর ছিল। তবে এর ভালো দিক হলো প্রশিক্ষণার্থীরা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।
প্রতিদিন সকালবেলা আমাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ হতো। সেখানে আমাদের ভূমি বিভাগের আমিনরা খানাপুড়ি (জমির মালিকানার দলিল), গান্টার (দুই ফুট লম্বা বিশেষ ধরনের স্কেল) ও চেইন (শিকল) ব্যবহার করে একটি মানচিত্রে প্রতিটি প্লট প্রদর্শন করে মানচিত্র তৈরি, খতিয়ান (ব্যক্তিগত মালিকানার নথি) তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আমাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপের জন্য একটি ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করা হয়। সেই ভূখণ্ডের জরিপ করে মানচিত্র তৈরির জন্য প্রতিদিন সকালে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা ভূখণ্ডে যেতে হতো। ভূখণ্ডগুলো উঁচু ঘাসে আবৃত ছিল। অনেক সময় এই ঘাসের মধ্যে বিষধর সাপ দেখা যেত। আমরা লাঠি নিয়ে এই ঘাসের মধ্যে ঢুকতাম এবং গান্টার শৃঙ্খল ব্যবহার করে জমি মাপতাম। বিকেলবেলায় আমাদের ভূমি আইন এবং এ-সংক্রান্ত বিধিসমূহ সম্পর্কে ক্লাস হতো। ক্লাসে পড়াতেন জরিপের সঙ্গে জড়িত ইপিসিএস কর্মকর্তারা।
রাজশাহী ভূমি জরিপের কর্মকর্তা ছিলেন খানে আলম খান নামে একজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মর্যাদার ইপিসিএস কর্মকর্তা। তিনি ক্লাসে এসে অনেক হাসির গল্প বলতেন। তবে খুব বেশি একটা পড়াশোনা হতো না। তরফদার নামের একজন কর্মকর্তা ছিলেন তাঁবুর ভারপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি ক্লাসে এসে অত্যন্ত নীরস ভাষায় আইনকানুন ব্যাখ্যা করতেন। তার ক্লাস আমার একেবারেই ভালো লাগত না। আমি ক্লাসের পেছনে বসে আমার পছন্দের বই পড়তাম। তরফদার সাহেব জানতে পান যে তার ক্লাসে আমরা কেউ কেউ তার বক্তৃতা শুনছি না। তাই তিনি আমার মতো কয়েকজনকে নোটিশ দেন যে আমরা কেন তার বক্তৃতা না শুনে ক্লাসে ‘আউট বই’ পড়ি, তার কারণ দর্শানোর জন্য। আমরা জানাই যে আমরা কোনো বই কখনো ক্লাসে রিড আউট করি না। এই কারণ দর্শানো থেকে তরফদারের সঙ্গে আমাদের খিটিমিটি লড়াই শুরু হয়। আসলে প্রতিবছরই জরিপ এবং বন্দোবস্ত প্রশিক্ষণে সিএসপি এবং ইপিসিএস অফিসারদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতো। এখানে ইপিসিএস অফিসাররাই ছিলেন নিয়ন্ত্রক। সিএসপি অফিসাররা ইপিসিএস অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে পারতেন না। এর ফলে শৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিত। কোনো কোনো ব্যাচে এই শৃঙখলা আদৌ রক্ষা করা সম্ভব। হয়নি। আমাদের পরবর্তী ব্যাচের কর্মকর্তারা এই প্রশিক্ষণে এত উচ্ছল ছিলেন যে তাঁদের কোনো বক্তব্য শুনতে রাজি ছিলেন না তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি সফিউল আজম। তিনি নাকি তাদের বলেছেন, ‘You are the worst batch in the CSP. You have no point. I am ashamed of you. Now get the hell out of my room.’
আমাদের তাঁবুতে প্রশিক্ষণের সময় ইপিসিএস ও সিএসপি অফিসারদের ভুল-বোঝাবুঝির একটি বড় ঘটনা ঘটে। তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন জনাব টি হোসেন। টি হোসেন সিনিয়র স্কেল ইপিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করতে এলে তাঁকে প্রশিক্ষণার্থীদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তার সম্মানে একটি নৈশভোজের ব্যবস্থা করা হয়। ভোজের অভ্যর্থনায় তিনি যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁবুর এক ধারে আগুন লেগে যায়। ইপিসিএস অফিসাররা সন্দেহ করেন এ কাজ সিএসপি অফিসাররা করেছেন। তাই তাঁরা সিএসপি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। এক মাসব্যাপী তাবুর প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমাদের গ্রুপে ভাগ করা হয়।
একেক গ্রুপের কর্মকর্তাদের একেক স্থানে পাঠানো হয়। আমাদের গ্রুপে ছিলেন শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, এ বি এম আবদুশ শাকুর, মামুনুর রশীদ। আমাদের পদায়ন করা হয় নাটোর শহরের সন্নিকটে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঝিলমিলিয়া ডাকবাংলোতে। ঝিলমিলিয়া ডাকবাংলোটি মৃতপ্রায় নারোদ নদের তীরে অবস্থিত। সেখানে অনেক গাছ এবং ফুলের চাষ করা হতো। ডাকবাংলোতে আমরা ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নিই। আমাদের পাশে আরেকটি গ্রুপে ছিলেন মিজানুর রহমান শেলী এবং তাঁর তিনজন সহকর্মী। আমরা শেলী গ্রুপকে ঝিলমিলিয়া ডাকবাংলোতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানাই। তাঁরা আমাদের এখানে আসেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত জলসা চলে। এর পরের সপ্তাহে আমাদের পুঠিয়া ডাকবাংলোতে নৈশভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমরা একটি খোলা ঘোড়ার গাড়িতে পূর্ণিমার রাতে পুঠিয়া রওনা হয়ে যাই। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মনে হচ্ছিল আমরাই যেন এই অঞ্চলের জমিদার। পুঠিয়ায় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল নীলাম্বর। ১৮৫০ সালে রানী হেমন্ত কুমারী পুঠিয়া রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। এ রাজবাড়ীর পাশে পুঠিয়ার অনেক হিন্দু মন্দির গড়ে উঠেছিল। পুঠিয়া বর্তমানে রাজশাহীর একটি থানা সদর। পুঠিয়া রাজবাড়ীতে একটি অংশে চারটি কামরায় চারজন প্রশিক্ষণার্থী থাকতেন। তাদের এখানে প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত গল্পগুজব করে আমরা ফিরে যাই।
এরপর আমাদের দুজনের দলে ভাগ করা হয়। আমি এবং মামুনুর রশীদ এক দলে ছিলাম। আমাদের পাঠানো হয় দুর্গাপুর থানা সদরে। দুর্গাপুরে ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের একটি ডাকবাংলো ছিল। সেই ডাকবাংলো আমার এবং মামুনুর রশীদের নামে বরাদ্দ করা হয়। এই ডাকবাংলোতে থাকার সময় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে গন্ডগোল চলছিল। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারির ১৪-১৫ তারিখ থেকে আমাদের বিভিন্ন স্থানের ক্যাম্প থেকে রাজশাহী সার্কিট হাউসে নিয়ে আসা হয়। সপ্তাহ দুয়েক পর আমাদের প্রশিক্ষণের সর্বশেষ অংশে প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা ভূমি জরিপ এবং ব্যবস্থাপনা কার্যালয়ের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কীভাবে জরিপের নকশাসমূহ স্থায়ীভাবে রাখা হয় এবং কীভাবে তাদের নিজস্ব মুদ্রণালয়ে জরিপের মানচিত্র এবং খতিয়ান মুদ্রণ করা হয়, তা দেখানো হয়।
এই প্রশিক্ষণের পর আমরা যে যার কর্মস্থলে ফিরে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমি প্রাদেশিক সরকারের সার্ভিসেস জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে একটি পত্র পাই। পত্রে অভিযোগ করা হয়, আমি মামুনুর রশীদের খাতা থেকে নকল করেছি। সুতরাং আমার জন্য দ্বিতীয়বার সেটেলমেন্ট ট্রেনিং নেওয়া উচিত। তবে প্রাদেশিক সরকার আমাকে ও মামুনুর রশীদকে দ্বিতীয়বার প্রশিক্ষণে না পাঠিয়ে এই প্রশিক্ষণে ফেল করেছি–এ মর্মে রেকর্ড করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
মামুনুর রশীদ সারগোদা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি বাংলা লিখতে জানতেন না। যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সে পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ নম্বর ছিল। প্রশ্নে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি খতিয়ান তৈরি করার। এ কাজ মামুনুর রশীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই পরীক্ষার হলে প্রথমে আমি খতিয়ানটি তৈরি করি এবং মামুনুর রশীদের খাতা নিয়ে তাঁর খাতায় একই খতিয়ান নকল করি। শুধু খতিয়ান নয়, মামুনুর রশীদ ভূমি আইনকানুনও কিছু জানতেন না। ভূমি জরিপ প্রশিক্ষণের সময় তাঁর বিয়ে হয়। তিনি বেশির ভাগ সময়ই পালিয়ে ঢাকা চলে যেতেন এবং আদৌ কোনো লেখাপড়া করেননি। আমি প্রশ্নের উত্তর লিখি। তাঁকে বলি আমার খাতা দেখে কিছু পরিবর্তন করে তিনি যেন তার খাতায় উত্তরগুলো লেখেন। কিন্তু মামুনুর রশীদ কোনো পরিবর্তন না করে আমার খাতাকে হুবহু নকল করেন। এখন বুঝতে পারি এ কাজটি করতে দেওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু তখন বয়স কম ছিল এবং বন্ধুপ্রীতি এত বেশি ছিল যে এ কাজটি নৈতিক দিক নিয়ে আমি আদৌ চিন্তা করতে পারিনি। আমাকে যখন কৈফিয়ত তলব করা হলো, তখন আমি ইপিসিএস-সিএসপি দ্বন্দ্ব নিয়ে বিরাট একটি জবাব তৈরি করি। পরামর্শের জন্য জবাবটি সৈয়দ শামীম আহসানকে দেখালে তিনি তা তৎক্ষণাৎ ছিঁড়ে ফেলেন এবং বলেন, এ বক্তব্য আমার জন্য আত্মঘাতী হবে। তার পরামর্শে আমি লিখি যে আমি নকল করিনি এবং ভূমি জরিপ কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময়ে পরীক্ষা নিতে চাইলে আমি পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত আছি। সরকার আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে এবং সিদ্ধান্ত দেয় যে ভূমি জরিপ বিভাগের বিরূপ মন্তব্য বহাল থাকবে।
মামুনুর রশীদ ব্যাচে একজন বিতর্কিত কর্মকর্তা ছিলেন। তার সঙ্গে ব্যাচের অনেকেরই ঝগড়া হয়েছে। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। আমি তাকে সব সময় সাহায্য করতাম। শুধু জরিপ প্রশিক্ষণেই নয়, চাকরির অন্যান্য পর্যায়েও তাকে আমি অব্যাহতভাবে সহায়তা করেছি। পাঁচ বছর সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি পিএইচডি না করে শুধু এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে সরকারের অর্থের অপচয় করেছেন–এ অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়। তাঁকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। বছর দুয়েক এভাবে ঝুলিয়ে রাখার পর বলা হয়, দেশে আসার পর তার সম্পর্কে কোনো বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন নেই। সুতরাং ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে সে কাজ না করলে তাকে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব নয়। সে সময়ে সংস্থাপন বিভাগের জাদরেল অতিরিক্ত সচিব ইউসুফ হায়দারের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে আমি তাকে এমডিএস পিএটিসি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন প্রতিবেদন লিখি। আমি দাবি করি যে তিনি প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আমাকে সহায়তা করেছেন (যা ছিল একেবারেই মিথ্যা) এবং তাঁকে ৯৯ ভাগ নম্বর দিই। তার প্রতিবেদন দুটিতে তৎকালীন ডিরেক্টর শেখ মাকসুদ আলীকে অনেক অনুরোধ করে প্রতিস্বাক্ষর আদায় করি। এর ভিত্তিতে তিনি যুগ্ম সচিব হন। পরবর্তীকালে আমি যখন অর্থসচিব, তখন তিনি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার এমডি পদে নিযুক্ত হন। সেখানে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আমি তদন্ত করতে দিইনি এবং তাঁকে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে ৯৯ শতাংশ নম্বর দিয়েছিলাম। এর ভিত্তিতে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন।
আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার প্রায় ১৪-১৫ বছর পর গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পর্কে সরকার একটি তদন্ত কমিশন করে। গ্রামীণ ব্যাংকে আমি এবং রেহমান সোবহান সভাপতি ছিলাম। যেহেতু আমি প্রকাশ্যে ড. ইউনূসের ভূমিকা সমর্থন করছিলাম, সেহেতু সরকার থেকে আমার ও রেহমান সোবহানের বিরুদ্ধেও তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্ত কমিশনের সভাপতি হয়েছিলেন মামুনুর রশীদ। তার কমিশনের প্রতিবেদনে আমার কোনো বক্তব্য (যা আমি লিখিতভাবে কমিশনের কাছে দাখিল করেছিলাম) নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। সরকারের নিযুক্ত কমিশনের কাছ থেকে আমি তা আশাও করিনি। আমার দুঃখ হলো যে মামুনুর রশীদকে আমি বন্ধু মনে করতাম, কিন্তু তিনি আমাকে কখনো বন্ধু মনে করেননি। বন্ধু মনে করলে তিনি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে কোনো দিনই রাজি হতেন না। বন্ধু মনে করেননি বলেই তিনি এ কাজটি করতে পেরেছেন। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই; দুঃখ হলো যে আমি ঠিক সময়ে বন্ধু চিনতে পারিনি।
ড. জোহার শাহাদতবরণ এবং উত্তাল রাজনীতি
আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ দেখা দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা দমন করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যায়। তারা ছাত্রদের গুলি করার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা তাতে বাধা দেন। বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ড. জোহাকে গুলি করে এবং তিনি। ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ড. জোহাকে হত্যার পর ডেপুটি কমিশনারকে তার। লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। ওই সময়ে যাতে কোনো নতুন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য ডেপুটি কমিশনারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিতে হয়। ড. জোহার মৃত্যুতে ডেপুটি কমিশনারসহ আমরা সবাই ভেঙে পড়ি। ড. জোহা মামুনুর রশীদের খালুশ্বশুর ছিলেন। তাঁর বাড়িতে আমি দাওয়াত খেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গেলে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। ড. জোহা মারা যাওয়ার পর ডেপুটি কমিশনার আসাদুজ্জামান একেবারেই ভেঙে পড়েন। তখন আমাদের পুরো ব্যাচ তাকে মানসিক সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রায় সারা দিন তার সঙ্গে থাকতাম।
বুনিয়াদি গণতন্ত্র তদন্ত কমিশন
বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ এ বিক্ষোভ নিরসনের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি সামরিক শাসন টিম নিযুক্ত করে। এই টিমের প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনী মনোনীত একজন মেজর। সদস্য ছিলেন সিঅ্যান্ডবির একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন জেলার একজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার। খন্দকার আসাদুজ্জামান তাঁর কোনো অতিরিক্ত জেলা কমিশনারকে একজন মেজরের অধীনে কমিটি সচিবের দায়িত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি সরকারকে লিখলেন, রাজশাহীতে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের কাউকে এই তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সুতরাং রাজশাহী জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে এই কমিটির সচিবের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। রাজশাহীতে যে মেজরকে কমিটির সভাপতি করা হয়, তিনি খুবই ভালো লোক ছিলেন। আমার প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সুতরাং কমিটির সব কাজ আমাকেই করতে হয়েছে। তত দিনে বিভিন্ন জেলায় সামরিক আইন কমিটির অনেক দুর্নীতিবাজ বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং তাদের গ্রেপ্তার করেছে। রাজশাহী জেলা থেকে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর কমিটির সভাপতি মেজরকে চাপ দেয়।
অন্যদিকে ডেপুটি কমিশনার আমাকে বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের যেন অহেতুক সামরিক আইনের মুখোমুখি হতে না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন। শেষ পর্যন্ত একজন বুনিয়াদি গণতন্ত্রের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। তিনি ছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলার একজন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। একটি পাকা রাস্তা নির্মাণের ব্যাপারে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, এ ধরনের অভিযোগ ওঠে। নির্বাহী প্রকৌশলী মেপে দেখতে পান। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে যে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, তা কাগজ-কলমে যা রয়েছে, তার প্রায় ৪০ ভাগ কম। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের সামরিক আদালতে বিচার হয় এবং তাকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। আমি এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য কয়েকটি সমীক্ষা করি। এই সমীক্ষার তথ্য সংগ্রহ করে দেন সার্কেল অফিসাররা (উন্নয়ন)। এসব সমীক্ষার ভিত্তিতে আইন সংশোধনের জন্য আমরা কতগুলো সুপারিশ করি। সব জেলার সুপারিশসমূহ একত্র করে প্রাদেশিক সরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কতিপয় সুপারিশ মন্ত্রিসভায় পেশ করে। তবে এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
সচিবালয় প্রশিক্ষণ এবং পূর্ব পাকিস্তান সফর
জুলাই মাসের শেষ দিকে সচিবালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের ব্যাচকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেও আমাদের দুবার ঢাকায় আসতে হয়েছিল। একবার ১৯৬৯ সালের মার্চে। তখন সব আইন ট্রেজারি রুল নিয়ে চার-পাঁচ দিন আমাদের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পরীক্ষার শেষ দিন ছিল ভূমি আইনের পরীক্ষা। ঘণ্টাখানেক আমরা ভূমি আইনের প্রশ্নের জবাব মনোযোগ দিয়ে লিখি। ঘণ্টাখানেক পর আমাদের পূর্বতন ব্যাচের একজন সহকর্মীকে নকলের কাগজসহ ধরে ফেলা হয়। এসব কাগজ জমা দিলে তার চাকরি চলে যেতে পারে। উপস্থিত অনেক সহকর্মীর মনে ধৃত সহকর্মীর জন্য সমবেদনা জেগে ওঠে। আমাদের ব্যাচের ১৩ জনের মধ্যে আমরা ৭-৮ জন হইচই করা শুরু করি। শেষ পর্যন্ত ধৃত সহকর্মীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে তার খাতাটি রেখে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তিনি যা লিখেছেন, তাতে পাস। করার সম্ভাবনা ছিল না। এ ব্যাপারটি মীমাংসা হতে প্রায় এক ঘণ্টা চলে গিয়েছিল। আমরাও খাতাগুলো জমা দিয়ে চলে এলাম। গন্ডগোল না করলে অবশ্যই এ পরীক্ষায় পাস করতাম। গন্ডগোল করায় আমাদের ভূমি আইনে সেই পরীক্ষায় পাস করা হয়নি। পরীক্ষা না দিয়ে আমরা একজন সহকর্মীর উপকার করেছি ঠিকই কিন্তু ন্যায়নীতির দিক থেকে দেখতে গেলে এ ধরনের উপকার করা ঠিক হয়নি। জুন ১৯৬৯-এ আমরা ভূমি আইনে পরীক্ষা দিই। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য দিন চারেক ঢাকা সফরের অনুমতি পাই। এই পরীক্ষায় আমরা পাস করে যাই।
জুলাই ১৯৬৯-এর দিকে আমাদের ব্যাচের সচিবালয়ে সংযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। সচিবালয় সংযুক্তিতে কীভাবে সচিবালয় থেকে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং সচিবালয়ে কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সচিবালয়ে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। সচিবেরা তাদের মন্ত্রণালয় কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করেন এবং মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম কীভাবে উন্নত করা যাবে, সে সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনার কথাও আমাদের জানান। ওই সময় সচিবালয়ে কর্মরত উপসচিবদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়। বিশেষ করে নাজেম আহমদ চৌধুরী এবং রশীদুর রেজা ফারুকীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সচিবালয়ে প্রশিক্ষণের শেষ দিন আমাদের চিফ সেক্রেটারির দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। সফিউল আজম। আমাদের ব্যাচের মিজানুর রহমান শেলীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তার পরিচয় ছিল। উপরন্তু আমাদের ব্যাচের এ কে শামসুদ্দীনের সঙ্গে তাঁর শ্যালিকার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই তিনি আমাদের ব্যাচের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক আচরণ করেন। তিনি জানতে চান, আমাদের প্রশিক্ষণের কোনো ফাঁক রয়েছে। কি না। শাহেদ সাদুল্লাহ বলেন, আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন জেলা শহরে সফর করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সফিউল আজম বললেন, ‘খুব ভালো প্রস্তাব এবং পূর্ব পাকিস্তানে তোমাদের সফরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমরা জবাব দিলাম, ‘আমরা সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে সফর করতে চাই।’ সফিউল আজম এতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আমাদের কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এই পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে। তোমরা পূর্ব পাকিস্তান সফর করবে কিন্তু এই সফরের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প, দত্তনগর কৃষি খামার এবং ঠাকুরগাঁও নলকূপ সেচ প্রকল্প। এসব প্রকল্প সম্পর্কে তখন আমাদের কোনো ধারণা ছিল না।
আমাদের পূর্ব পাকিস্তান সফর শুরু হয় কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থেকে। ভেড়ামারায় তখন গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সদর দপ্তর ছিল। এই প্রকল্পে গঙ্গার পানি কপোতাক্ষ নদে প্রবাহের চেষ্টা করা হচ্ছিল এবং সেখান থেকে খাল কেটে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। তখনো ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়নি। তাই জিকে প্রকল্পে তখনো পানির অভাব দেখা দেয়নি। তবে সেচ ব্যবস্থাপনায় কৃষকেরা তখনো অংশগ্রহণ করছিলেন না। এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য সমবায় সমিতি গঠন অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়।
আমরা ভেড়ামারা থেকে দত্তনগর কৃষি খামারে যাই। দত্তনগর কৃষি খামার বাংলাদেশের বৃহত্তম কৃষি খামার। এটি যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (যা এখন ঝিনাইদহ জেলা নামে পরিচিত) একটি কৃষি খামার। হেমেন্দ্রনাথ দত্ত নামে জনৈক ব্যক্তি প্রায় তিন হাজার একর কৃষিজমির ওপর এই কৃষি খামার তৈরি করেন। তিন হাজার একর কৃষিজমির মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার একর চাষের জমি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হেমেন্দ্রনাথ দত্ত খামার ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার এই খামার অধিগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে শস্যবীজ উৎপাদনে খামারটি কাজে লাগানোর জন্য বিএডিসির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই খামারে শুধু ধান ও গমের মতো শস্যের বীজই উৎপাদিত হয় না, শাকসবজির বীজও উৎপাদিত হয়। এখানে আসার পর বীজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো আমরা বুঝতে পারি।
দত্তনগর থেকে আমরা ঠাকুরগাঁওয়ে যাই। পথে ঝিনাইদহে গাড়ি ওভারটেক করা নিয়ে মামুনুর রশীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণরত সামরিক কর্মকর্তাদের ঝগড়া হয়। মামুনুর রশীদ অতি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সামরিক কর্মকর্তাদের পেছনে ফেলে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে এগিয়ে যান। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠাকুরগাঁও সেচ প্রকল্প চালু করে। গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করা হয়; কিন্তু কৃষকেরা সেচের সুযোগ গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন না। তসলিম উদ্দিন আহমদ নামে একজন ইপিসিএস অফিসারকে এ প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি কৃষকদের সমবায় সমিতি গঠনে উৎসাহিত করেন এবং এর ফলে সেচব্যবস্থার সুফল জনগণ পেতে চলেছে। আমরা ঠাকুরগাঁও থেকে তেঁতুলিয়া সীমান্ত পর্যন্ত যাই এবং সেখান থেকে হিমালয় পর্বতমালা দেখতে পাই। তেঁতুলিয়া থেকে আমরা যে যার কর্মস্থলে ফিরে যাই। এই সফরের পরেই আমাদের ব্যাচের কর্মকর্তারা মহকুমার দায়িত্ব পেতে শুরু করেন। শাহেদ সাদুল্লাহ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে কক্সবাজারের এসডিও হন, মিজানুর রহমান শেলী এবং আবদুশ শাকুর যথাক্রমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বান্দরবানে অক্টোবর মাসেই এসডিওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শাহ মোহাম্মদ ফরিদ ২৭ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে এসডিওর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রাজবাড়ীতে। এর এক সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ৩ ডিসেম্বরে আমি হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করি।
পাদটীকা
১. Kamal Siddiqui. In One Life, The Memoirs of a Third World Civil Servant (Part 1) 2015, (Dhaka: Academic Press and Publishers Library), P-258