একাদশ অধ্যায়
মুক্ত হবিগঞ্জ : ৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭১
৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। রমনা রেসকোর্স ময়দানে সেদিন অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ডাক দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিচালনা করতে হবে। প্রথমে ঘোষণা করা হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও ও টিভিতে প্রচারিত হবে। রেডিও-টিভির স্থানীয় প্রশাসন এই ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা ঠিকই করেছিল কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সরাসরি প্রচার করতে দেয়নি। পরবর্তীকালে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ প্রশমিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়।
তখন হবিগঞ্জ মহকুমায় তিনটি টিভি ছিল। একটি ছিল শাহজীবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রে টিলার ওপরে ম্যানেজারের বাংলোতে আর দুটি ছিল চা-বাগানের উঁচু টিলার ওপরে অবস্থিত দুই চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে। অবশ্য রেডিও অনেক ছিল। রেডিওতে আমরা তাঁর বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করছিলাম। যদিও তাঁর বক্তৃতা সরাসরি শুনতে পাইনি, তবু তাঁর বক্তব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা তাই পরের দিন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশসমূহ পাঠ করি এবং এগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করি।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল যেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় প্রশাসন কর্মসূচি নির্ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে যেখানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব সমন্বিত বা ঐক্যবদ্ধ ছিল, সেখানে প্রশাসন চালানো ছিল সহজ। হবিগঞ্জে স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সব নেতা কর্মী ঐকমত্য ছিলেন। তবে তাদের নেতারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না। হবিগঞ্জে জাতীয় সংসদের তিনজন সদস্য ছিলেন। এঁরা তিনজনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন। তবে এঁদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ মোস্তফা আলী জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ ও লাখাই থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আশা করতেন যে যেহেতু তিনি দলের সভাপতি ও নির্বাচিত প্রতিনিধি, সেহেতু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে। তবে বাহুবল, চুনারুঘাট ও মাধবপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মানিক চৌধুরী। তিনি ছিলেন বয়সে তরুণ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তাঁর সঙ্গে অন্যান্য দলের সম্পর্ক ছিল খুবই খারাপ।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব। তিনি বানিয়াচং-নবীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সমস্যা বুঝতেন। তাই তার পরামর্শ নেওয়া ছিল আমার জন্য সহজ। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে তাঁর খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আমার সবচেয়ে বড় চাচাতো ভাই মেজর শওকত আলী খাঁন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব একই ব্যাচে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে আমি তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর উপস্থিতির ফলে সৈয়দ মোস্তফা আলী এবং মানিক চৌধুরীর দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে আমার পক্ষে প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে স্বাধীনতার পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা খসরুজ্জামান চৌধুরী লিখেছেন :
Akbar Ali Khan was lucky. his was an area not accessible by the army. He was lucky because he had one elected representative who was a retired army Colonel. This gentleman was Lt. Col. M. A. Rab who was elected on Awami League ticket. A staunch supporter of Bangalee nationalism and the rights for the Bangalees. Lt. Col. M. A. Rab (He is now a Major General and is a full time Managing Director of the Freedom Fighters Welfare Trust) had never been looked upon favourably by the ruling army clique. Akbar Ali Khan was lucky to get his support, advice and active cooperation.[১]
লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপসেনাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং নীরবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দীর্ঘদিন তাঁকে বড় ধরনের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে মার মনে ক্ষোভ ছিল। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন, তখন কিবরিয়া সাহেব অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার বাড়িও রব সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়। তিনি রব সাহেবের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য যখন মনোনয়ন চাওয়া হয়, তখন আমি কিবরিয়া সাহেবকে অনুরোধ করি যেন তিনি রব সাহেবের নাম প্রস্তাব করেন। জবাবে কিবরিয়া সাহেব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশে ছিলেন না। আমি যেহেতু তার সঙ্গে কাজ করেছি, সেহেতু তাঁর নাম আমার পক্ষে প্রস্তাব করাই শোভনীয় হবে। অর্থমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে আমি তার নাম প্রস্তাব করি। অর্থসচিব হিসেবে আমি জাতীয় পুরস্কার কমিটির সদস্য ছিলাম। আমি তার মনোনয়নের পক্ষে মৌখিক বক্তব্য পেশ করি। কমিটি তাঁর নাম স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করে। তবে কমিটির সভাপতি আমাকে বলেন, তাদের সব সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেন না। কাজেই যদি রব সাহেবের পুরস্কার নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে আমাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি এবং এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করি। জনাব রবকে সে বছর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।
৭ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রশাসন চালু ছিল ঠিকই কিন্তু ২৫ মার্চ পর্যন্ত সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যেহেতু হবিগঞ্জে কোনো সেনানিবাস ছিল না, সেহেতু এখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি। ঢিলেঢালাভাবে প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছিল।
২৬ মার্চ ১৯৭১
২৬ মার্চ তারিখে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ২৫ মার্চ তারিখে রাতে আমি সিলেট থেকে ডেপুটি কমিশনারের একটি টেলিফোন কল পাই। তিনি আমাকে জানান যে পরদিন সকালে ফজরের নামাজের আগে আমি যেন সিলেট রওনা হয়ে সোজা তাঁর বাংলোয় গিয়ে উঠি। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার গোপন পরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে। ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশ অনুসারে পরদিন ফজরের নামাজের সময় আমি হবিগঞ্জ থেকে সিলেট রওনা হই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমি মৌলভীবাজার পার হয়ে শেরপুর ফেরিঘাটে পৌঁছি। ফেরিঘাটে বেশ কিছু লোকজন দেখতে পাই। তারা আমার গাড়িকে থামিয়ে দিয়ে বলে যে আমি যেন জিপসহ ফেরিতে যাওয়ার চেষ্টা না করি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানে মেশিনগান উঁচিয়ে বসে আছে এবং কেউ ফেরির দিকে গেলে তাকে গুলি করার হুমকি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি মৌলভীবাজারের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু সেখানেও জনগণ বাধা। দিল। তারা বলল, মৌলভীবাজার থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জাতীয় রাজপথ দখল করে নিয়েছে। মেশিনগানধারী পাকিস্তান বাহিনী সেখানে গেলে গুলি করবে। আমার পক্ষে তখন সিলেট যাওয়া সম্ভব নয়, আবার যেপথ দিয়ে হবিগঞ্জ থেকে এসেছিলাম, সে পথ দিয়ে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। লোকজন আমাকে পরামর্শ দিল শেরপুর থেকে একটি মাটির রাস্তা নবীগঞ্জ পর্যন্ত গেছে। এ রাস্তা দিয়ে আমি নবীগঞ্জ যেতে পারি। নবীগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে আরেকটি মাটির রাস্তা আছে। এই সময়ে চেষ্টা করলে জিপ দিয়ে নবীগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। তবে এর জন্য কোথাও কোথাও স্থানীয় লোকজনের সহায়তার প্রয়োজন হবে। আমি নবীগঞ্জে পৌঁছালে অনেক মানুষের ভিড় হয়। তারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানায়। সার্কেল অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি নবীগঞ্জ থেকে হবিগঞ্জে ফিরে। যাওয়ার উদ্যোগ নিই। নবীগঞ্জ থেকে আমি প্রায় বেলা দুইটার দিকে রওনা দিই। হবিগঞ্জে সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছাই। আমার গাড়ি এসডিওর অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। এই জনসমাবেশ আমার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র চায়। আমি জনতাকে বোঝাই, অস্ত্র সম্বন্ধে আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমি বাসায় ফিরে আসি। সেখানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিম্নলিখিত বার্তাটি পাই :[২]
PAK-ARMY SUDDENLY ATTACKED EPR BASE AT PILKHANA, RAJARBAG POLICE LINE AN (D) KILLING CITIZENS STOP STREET BATTLE ARE GOING ON IN EVERY STREET OF DACCA CHITTAGONG STOP I APPEAL TO THE NATIONS OF THE WORLD FOR HELP STOP OUR FREEDOM FIGHTERS ARE GALLANTLY FIGHTING WITH THE ENEMIES TO FREE THE MOTHERLAND STOP I APPEAL AND ORDER YOU ALL IN THE NAME OF ALMIGHTY ALLAH TO FIGHT TO THE LAST DROP OF BLOOD TO LIBERATE THE COUNTRY STOP ASK POLICE, EPR.
BENGAL REGIMENT AND ANSAR TO STAND BY YOU AND TO FIGHT STOP NO COMPROMISE STOP VICTORY IS OURS STOP DRIVE OUT THE LAST ENEMY FROM THE HOLY SOIL OF MOTHERLAND STOP CONVEY THIS MESSAGE TO ALL AWAMI LEAGUE LEADERS, WORKERS AND OTHER PATRIOTS AND LOVERS OF FREEDOM STOP MAY ALLAH BLESS YOU STOP JOI BANGLA STOP SHEIKH MUJIBUR RAHMAN STOP.
একই তারবার্তা সব জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক এবং সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে এই তারবার্তা কে এবং কীভাবে পাঠিয়েছে, সে সম্পর্কে নানা তর্কবিতর্ক দেখা যায়। তবে ১৯৭১ সালে। আমার কাছে এই তারবার্তাই বঙ্গবন্ধুর আদেশ বলে মনে হয়েছে।
২৭ মার্চ ১৯৭১–১ এপ্রিল ১৯৭১
পরের দিন (২৭ মার্চ ১৯৭১) বন্দুকের জন্য আবার দরবার শুরু হয়। স্থানীয় লোকজন এসডিপিওর কাছে বন্দুক চায়। তিনি বলে দেন যে এসডিও হুকুম দিলে তিনি বন্দুক দেবেন। অন্যথায় সরকারের বন্দুক রক্ষা করার জন্য তার পুলিশ সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। সুতরাং সবাই আমার আদেশের জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু আমি এই জনতার মধ্যেও উপদল দেখতে পাই। মানিক চৌধুরীর সমর্থকেরা বন্দুক নেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে উদ্গ্রীব ছিল কিন্তু কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতার মনে মানিক চৌধুরীর সমর্থকদের বন্দুক দেওয়া সঠিক হবে কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল। আমি এ সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের সঙ্গে পরামর্শ করতে চেয়েছিলাম। তিনি তখন আগরতলা সীমান্তে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব ছিল না। আমি তার কাছে একজন বার্তাবাহক পাঠাই। সারা দিনেও রব সাহেবের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাইনি। আমি জনতাকে বলি যে আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করছি এবং আগামীকাল এ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত দেব।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বন্দুকের জন্য দুই দাবিদার। আমার বাংলোয় এসে হাজির হয়েছে। হবিগঞ্জের জনগণের পক্ষ থেকে এসেছেন মেজর সি আর দত্ত। মেজর সি আর দত্তের বাড়ি হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি দুই মাসের ছুটি নিয়ে হবিগঞ্জে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি হবিগঞ্জে একজন মুক্তিযোদ্ধা নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে দাবিদার ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন। এই তরুণ অফিসারকে পাঠিয়েছেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মেজর খালেদ মোশাররফ দাবি করছেন যে বন্দুকগুলো যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহলে তার সদ্ব্যবহার হবে। তবে বন্দুকগুলো যদি স্থানীয় লোকজনকে দেওয়া হয়, তাহলে এ বন্দুকগুলোর হিসাব রাখা যাবে না। এ সম্পর্কে আমার উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন সাহেব এবং মেজর সাহেব তর্ক শুরু করেন। তর্কের মাধ্যমে সমাধান না হওয়ায় তারা তাদের রিভলবার বের করে একে অপরকে গুলি করার হুমকি দেন। আমি কোনো রকমে তাদেরকে কোনো অপ্রীতিকর কাজ করা থেকে বিরত করি এবং প্রস্তাব করি অফিসে আমি এ ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। অফিসে যাওয়ার আগেই আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবের পরামর্শ পাই।
অফিসে যাওয়ার পর মানিক চৌধুরী একটি রিভলবার নিয়ে আমার অফিসে হাজির হন এবং ধমকের সুরে বলেন, আমি তাঁকে বন্দুক দেওয়ার আদেশ না দিলে তিনি আমাকে গুলি করবেন। ততক্ষণে কর্নেল রবের কাছ থেকে আমি পরামর্শ পেয়ে গেছি যে স্থানীয় লোকজনকে বন্দুকগুলো দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে। আমি হেসে একটা কাগজ নিয়ে বন্দুকগুলো আনসারের মহকুমা কমান্ডারের মাধ্যমে দেশ রক্ষার জন্য দেওয়ার আদেশ দিই। কমান্ডার মানিক চৌধুরী এই আদেশ নিয়ে ট্রেজারির রক্ষীদের দেন। ট্রেজারির রক্ষীরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ নিয়ে বন্দুকগুলো মানিক চৌধুরীর অনুসারীদের হাতে দেয়। এরা বন্দুকগুলো নিয়ে সোজা সিলেটের দিকে রওনা হয়ে যায়।
বন্দুক দেওয়ার আদেশে আমি আমার পদবি নিম্নরূপে বর্ণনা করি। ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আকবর আলি খান এসডিও হবিগঞ্জ’। আমি আকবর আলি খান বানানটি একটু ভিন্নরূপে লিখি। সাধারণত আলি শব্দটি বাংলায় ‘ী’ দিয়ে লেখা হয়। আমি ‘ি দিয়ে লিখি। খান শব্দটি বানানে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লেখা হয়। আমি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে লিখি না। একটানা আমার স্বাক্ষর নিম্নরূপ আকার ধারণ করে।
আকবর আলি খান
মুক্তিযুদ্ধের মুহূর্তে আমি এই স্বাক্ষর শুরু করি এবং আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও এই একই স্বাক্ষর আমি সব কাগজপত্রে করে থাকি। আমি কানাডায় সাড়ে পাঁচ বছর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আট বছর ছিলাম। সেসব দেশের ব্যাংকেও আমি বাংলায় চেকে এই স্বাক্ষর করেছি এবং এ স্বাক্ষর নিয়ে পৃথিবীর কোথাও আমার কোনো অসুবিধা হয়নি।
হবিগঞ্জে এসডিওর বাংলোতে আমি একা থাকতাম। ২৬ মার্চের পর অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল যে একা থাকা আমার পক্ষে মোটেও সমীচীন নয়। বিভিন্ন কারণে অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আমার ওপর অসন্তুষ্ট থাকতে পারে। তারা রাতে হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে। আমি তাই ২৯ মার্চে হবিগঞ্জে বিডি হল নামে একটি ডাকবাংলোতে রাতে থাকি। সেখানে আবদুল লতিফ নামে একজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা সপরিবার থাকতেন। ৩০ মার্চ আমি লাখাই যাই। লাখাইয়ে থানা ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে দুদিন থাকি। আমি লাখাই থেকে ২ এপ্রিল হবিগঞ্জে যাই।
২ এপ্রিল–৯ এপ্রিল ১৯৭১
হবিগঞ্জের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিলেন যে আমি লাখাই থাকলে বিভিন্ন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়। তাঁদের অনুরোধে আমি হবিগঞ্জের এসডিওর বাংলোতে ২ এপ্রিল ফিরে আসি।
২ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অবস্থানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের মজুত থেকে চাল, গম এবং চিনি চেয়ে পাঠায়। শায়েস্তাগঞ্জে খাদ্য বিভাগের একটি কেন্দ্রীয় গুদাম বা সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো ছিল। এই গুদাম থেকে তারা চাল, গম এবং চিনি চায়। খাদ্য বিভাগের মহকুমা নিয়ন্ত্রক তাদের জানিয়ে দেন, এসডিওর লিখিত আদেশ ছাড়া তিনি এগুলো সরবরাহ করতে পারবেন না। আমি আবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আদেশ দিই এবং সেই আদেশের বলে সেনাবাহিনী তাদের প্রায় চার মাসের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, গম এবং চিনি তুলে নিয়ে যায়। অবশ্য তাদের খাদ্যভান্ডার তারা বাংলাদেশের ভেতরে করেনি, তারা তাদের খাদ্যভান্ডার ভারতের সীমান্তের ভেতরে তৈরি করে, যাতে পাকিস্তান বাহিনী তা ধ্বংস করতে না পারে।
খুব সম্ভব ৩ অথবা ৪ এপ্রিল আমাকে ভারতে যেতে হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে আমাকে জানানো হয় যে তারা ভারত সরকারের কাছে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র চেয়েছে কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে শুধু সেনাবাহিনীর অনুরোধে হবে না, তারা এ সম্পর্কে বাংলাদেশ বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গেও আলাপ করতে চায়। হবিগঞ্জের স্থানীয় লোকজনও দাবি করেন যে আমি যেন ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করি। আমি ওই দিন বিকেলবেলা জিপ নিয়ে বাল্লা সীমান্ত ফাঁড়িতে যাই। সীমান্ত ফাঁড়িটি খোয়াই নদের তীরে অবস্থিত ছিল। নদের উল্টো দিকে ছিল খোয়াই মহকুমা শহর। খোয়াই নদ একটি খুবই ছোট নদ। এপ্রিল মাসে নৌকা দিয়ে খোয়াই পার হতে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি সময় লাগে না। আমি খোয়াই পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করলে খোয়াইয়ের মহকুমা হাকিম আমাকে সংবর্ধনা জানান। আমাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন খোয়াই মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি। মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আমাকে ফুলের মালা দেওয়ায় আমি কিছুটা বিস্মিত হই। সমিতির সভাপতি এসে বললেন, ‘স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি মাছ চোরাচালানের জন্য হবিগঞ্জে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। আপনি আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। তবে তখনকার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। আজকে ভারতের মাটিতে আমি আপনাকে স্বাগতম জানাই।’
হঠাৎ ভিন্ন পরিস্থিতির কথা আমার মনে হলো। হবিগঞ্জ মহকুমায় দায়িত্ব। নেওয়ার পরই আমার কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসে যে বাল্লা সীমান্ত দিয়ে প্রচুর মাছ ভারতে চোরাচালান করা হচ্ছে। আমি প্রায়ই ছুটির দিনে বাল্লা সীমান্তের দিকে জিপে করে যেতাম এবং প্রচুর মাছভর্তি ঝুড়ি বাজেয়াপ্ত করতাম। বাজেয়াপ্ত করা মাছগুলো বিক্রয় করে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য দারোগার কাছে পাঠাতাম। কিন্তু কখনো এই মাছ বিক্রি করে সরকার কোনো অর্থ পায়নি, কেননা পুলিশ যখন বাজেয়াপ্ত করা মাছ নিলাম করতে নিয়ে যেত, তখন সে মাছ পচে যেত। তখন সে মাছ কেউ কিনত না। তবে প্রত্যাশিত মাছ না পাওয়ায় খোয়াইয়ের বাজারে মাছের দাম অনেক বেড়ে যেত। খোয়াইয়ে যাওয়ার আগে আমি জানতাম না যে ত্রিপুরা রাজ্যে ১৯৭০-এর দশকে কোনো মাছ পাওয়া যেত না। অথচ ত্রিপুরা রাজ্যের জনসংখ্যার সিংহভাগ ছিল বাঙালি, যারা মাছ খুবই পছন্দ করে।
খোয়াই শহরের এসডিও আমাকে তার বাংলোতে নিয়ে যান। সেখানে একজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সেনা কর্মকর্তাটি ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। তিনি আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের বিশিষ্ট নেতাদের সম্বন্ধে তথ্য চান। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেওয়া অস্ত্রের তালিকা তাঁর কাছে দিই। তিনি তালিকাটি দেখে বলেন এসব অস্ত্র দিল্লির অনুমতি ছাড়া দেওয়া যাবে না। মুক্তিবাহিনীকে কতটুকু এবং কী ধরনের অস্ত্র দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে দিল্লিতে দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত। হবে। বুঝতে আমার মোটেও কষ্ট হয়নি যে এই কর্মকর্তা ছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা। সম্ভবত তিনি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস। উইং (র) নামের একটি সংস্থায় কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে একটি ভুল ধারণা ভেঙে যায়। ২৬ মার্চ যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল এবং ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ বিদ্রোহ করে, তখন অনেক আশাবাদী স্বাধীনতাসংগ্রামী ধারণা করছিলেন যে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিবাহিনীর জন্য সব ধরনের সাহায্যের ব্যবস্থা করে গেছেন। এ ধারণা অত্যন্ত ভুল। কিছু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে হয়তো তাঁর যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ভারত সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তাঁকে কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি।
সম্ভবত ৫ এপ্রিল তারিখে আমি হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য রণাঙ্গনের দিকে যাই। অস্ত্র পাওয়ার পর হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি শেরপুর ফেরিঘাটে পাকিস্তানি রক্ষীদের ওপর হামলা করেন। শেরপুরে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হবিগঞ্জ আনসার বাহিনীর একজন সদস্য নিহত হন। এই আনসার সদস্য আগের বছর হবিগঞ্জের আনসার প্যারেডে। শ্ৰেষ্ঠ আনসার হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। তাঁর হাতে আমি আনসারের পতাকা তুলে দিয়েছিলাম। তার মৃত্যুসংবাদে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
শেরপুর পার হয়ে হবিগঞ্জের মুক্তিবাহিনী মৌলভীবাজারের দিকে এগিয়ে যায়। তারা তাদের মূল ঘাঁটি স্থাপন করে মৌলভীবাজার শহরের পাশে আকবরপুর পর্যটনকেন্দ্রে। আমি আকবরপুর পর্যটনকেন্দ্রে গেলে কমান্ডার মানিক চৌধুরী আমাকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। উৎসবের আমেজে সেখানে আমি মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করি। মাইল ত্রিশেক দূরে সিলেটে তখন পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে। যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তান বাহিনীকে তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে। একদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ করছে, অন্যদিকে হবিগঞ্জের মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালাচ্ছে এবং সুনামগঞ্জের দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি দল হামলা করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন শুধু। সিলেট বিমানবন্দরে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো বিমানযোগে ঢাকা। থেকে সৈন্য আমদানি করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করবে। এ কাজে তাদের বেশ কয়েক দিন সময় লেগেছিল।
এই সময়ে আমি প্রতিদিনই একবার অফিসে যেতাম। হবিগঞ্জের এসডিও অফিসে তখন কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লোকজনের সমস্যার সমাধান করা হতো। আমি প্রতিদিনই জিপে করে বিভিন্ন উপজেলা সদরে যেতাম। তখন দেখতে পেতাম যে ঢাকা থেকে দলে দলে নারী-পুরুষ গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসছে। এমনকি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং জেলা জজের পরিবারও স্কুটার অথবা রিকশা করে অনেক দূর রাস্তা অতিক্রম করে বাড়িতে পৌঁছেছে। হবিগঞ্জে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন, তারা বুঝতে পারলেন যে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এ অবস্থায় তাঁরা তাঁদের পরিবার পরিজনকে নিজেদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চান। আমি সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিই, কিন্তু তারা বলেন বাড়ি যেতে হলে তাঁদের অর্থের প্রয়োজন। যারা দরখাস্ত করেন, তাদেরকে আমি তিন মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়ার আদেশ দিই। হবিগঞ্জ ট্রেজারি এ আদেশ মেনে নেয়। পরে সবাই তিন মাসের অগ্রিম বেতন দাবি করতে থাকে। আমি তখন হবিগঞ্জের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়ার আদেশ দিই। এই আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আদৌ এসডিওর ছিল না। শুধু প্রাদেশিক সরকারের অর্থ বিভাগের পক্ষেই এ আদেশ দেওয়া সম্ভব ছিল। এসডিও হিসেবে আমি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব পালন শুরু করি। আমি বাংলাদেশ সরকারের নামে মুক্তিবাহিনীকে বন্দুক দেওয়ার আদেশ দিই। সরকারের খাদ্যগুদাম থেকে আমি মুক্তিবাহিনীর জন্য চাল, গম এবং চিনি বিনা মূল্যে বরাদ্দ করি। সরকারি কর্মচারীদের আমি তিন মাসের বেতনও সরকারের নামে দিয়ে দিই। অথচ তখন পর্যন্ত সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের জন্মই হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। সরকারের জন্মের আগেই সরকারি কর্মচারীদের সরকারের পক্ষে আদেশ দিতে হয়েছে এবং সেসব আদেশ কার্যকর করতে হয়েছে। এ ধরনের ক্রিয়াকাণ্ড একমাত্র জনযুদ্ধেই সম্ভব। কোনো নিয়মিত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব জেলখানাতেই গন্ডগোল শুরু হয়। বেশির ভাগ জেলখানায় আসামিরা জেলখানা ভেঙে পালিয়ে যায়। ২ এপ্রিল আমাকে জানানো হয় হবিগঞ্জ জেলখানায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। জেলখানার আসামিদের না ছাড়া হলে তাদের ধরে রাখা সম্ভব হবে না। আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করি। নেতাদের মধ্যে দুটি মত ছিল। একদল নেতা সব আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। আরেক দল নেতা খুন এবং ডাকাতির জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া আর বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। আমি দ্বিতীয় মতের সঙ্গে একমত হই এবং তদনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেলারকে আদেশ দিই। কিন্তু জেলারের পক্ষে তখন এ আদেশ কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। সব আসামি হুড়মুড় করে জেলের গেট ভেঙে বেরিয়ে যায়।
জেলখানায় তখন রক্ষী ছাড়া আর কেউ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ নেন কিছু স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা। হবিগঞ্জে মুক্তিবাহিনী আসার আগে হবিগঞ্জের এসডিপিও এবং আমার সেকেন্ড অফিসার এ টি এম আবেদ জেলখানায় সপরিবার আশ্রয় নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জ দখল করলে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে খবর পাঠান যে মুক্তিবাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে রেখেছে। পাকিস্তান বাহিনী তাদের জেল থেকে বের করে সরকারি কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেয়।
৭-৮ এপ্রিলের কোনো একদিন চা-বাগানের একজন অবাঙালি ম্যানেজারের বাঙালি শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার অফিসে এসে কান্নাকাটি শুরু করেন। অবাঙালি সহকারী জেনারেল ম্যানেজারকে আমি চিনতাম। তাঁর পিতৃপুরুষ বিহার থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসন করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তিনি বড় হন এবং বাংলায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অন্য বাঙালি ছেলেদের মতো আচার-আচরণে তিনি বাঙালি হয়ে যান এবং পরে হবিগঞ্জে এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। হবিগঞ্জের বিভিন্ন চা-বাগানে যেসব অবাঙালি কাজ করছিল, তাদের সবাইকে। মুক্তিবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। যেহেতু সহকারী ম্যানেজারের বাবা-মা বিহার থেকে এসেছিলেন, তাঁকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তার কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমি যদি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, তাহলে তারা অত্যন্ত বাধিত হবেন।
আমি তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে মেজর খালেদ মোশাররফের সদর দপ্তরে যাই। মেজর খালেদ মোশাররফকে যখন খবর দেওয়া হয়, তখন একজন বাঙালি লেফটেন্যান্টের সঙ্গে দেখা হয়। এই লেফটেন্যান্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। ২৬ মার্চের পর যত বাঙালি অফিসার ছিলেন, তাঁদের একটি কক্ষে আটক করা হয়। সেখানে মেশিনগান দিয়ে সবাইকে গুলি করা হয়। সবাই মারা গেছেন বলে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিশ্চিত হয়, তখন তারা দরজা বন্ধ করে লাশগুলো ফেলে রেখে চলে যায়। এই লাশের মধ্যে লেফটেন্যান্টের দেহও ছিল। তবে তিনি তখনো মরেননি। তার গায়ে দুটি বুলেট লেগেছিল। আহত অবস্থায় তিনি জানালার কাঁচ ভেঙে সেখান থেকে পালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সমর্থ হন (সম্ভবত তাঁর নাম ছিল লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন)। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হলো যে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর একজন মেজর ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের। বিশেষ বন্ধু। একবার কাজী রকিবকে নিয়ে আমি আমার বাড়ি নবীনগরে যাই। এই মেজরও তখন আমাদের সঙ্গে নবীনগরে যান। লঞ্চে তার নবীনগর যাওয়ার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানতে পারি। তিনি জানান, নবীনগরে ড. আমজাদ হোসেন নামের একজন ডাক্তার রয়েছেন, যার সঙ্গে কমিউনিস্টদের যোগাযোগ রয়েছে। তার সূত্র অনুসারে কমিউনিস্টরা আমজাদ হোসেনের মাধ্যমে নবীনগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তিনি ড. আমজাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে চান। আমি নবীনগর পৌঁছে ড. আমজাদ হোসেনকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করি। তিনি পালিয়ে যাওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এই লেফটেন্যান্টের বক্তব্য থেকে জানা গেল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের তারা রেহাই দেয়নি।
কিছুক্ষণ পর খালেদ মোশাররফ নেমে এলেন। তার কাছে চা-বাগানের নিখোঁজ সহকারী জেনারেল ম্যানেজারের সম্পর্কে আমি বলি ছেলেটি আসলে খুবই ভালো এবং তাকে অবাঙালিদের পক্ষের বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদ মোশাররফ একজন হাবিলদারকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন এই সহকারী ম্যানেজার বর্তমানে কোথায় আছে। হাবিলদার ফিসফিস করে খালেদ মোশাররফের কানে কানে কিছু বলল। খালেদ মোশাররফ হেসে বললেন যে এসডিও সাহেব আপনি যে সহকারী ম্যানেজারের খোঁজ করছেন, তাঁকে নিয়ে নতুন রিক্রুটরা টার্গেট প্র্যাকটিস করেছে। তাঁকে ফিরে পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তখন অবাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষ চরমে পৌঁছেছিল। অবাঙালিদের বাঁচানো ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। অন্যদিকে এই অবাঙালিদের বাঁচানোর নাম করেই পাকিস্তান। বাহিনী নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়।
আমার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও এবং আমার ব্যাচমেট কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে নিয়মিত টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাকে জানান, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জের এসডিওদের একটি সভা করতে চান। কিশোরগঞ্জের এসডিও খসরুজ্জামান চৌধুরী তাতে আসতে চেয়েছেন। তিনি আমাকে এ সভায় যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তখন মুক্তিবাহিনী বড় ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসার তখন দুটি রাস্তা ছিল। একটি রাস্তা ছিল কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক। সে সড়কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েক মাইল আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অবরোধ সৃষ্টি করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অবরোধের ওপর দূর থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষে দু-এক দিনের বেশি এ অবরোধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার আরেকটি রাস্তা ছিল রেলপথ দিয়ে। তবে রেলপথ দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসতে হলে মেঘনা নদীর ওপর ভৈরবের সেতু অতিক্রম করতে হতো। ভৈরব সেতুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানিকে প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োগ করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই কোম্পানির ওপর বিমান হামলা চালায়। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের এই স্মৃতি খসরুজ্জামান চৌধুরী তার ডায়েরির ভিত্তিতে লেখা আত্মজীবনীতে এইভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন :
It was a very lucky day for me as at about 9:30 p.m. Akbar Ali Khan turned up at Brahmanbaria from Madhabpur, one of the places in his sub-division which was only about 20 miles from Brahmanbaria. I was surprised to see that he was equipped with a revolver. Akbar Ali Khan was known for his intellect. It was unnatural for him to carry a revolver. Everyone used to praise his wisdom and judgment. In our friend circle he used to be known as the learned. It was after a long time I met him and three of us sat together discussing things up to quite late at night.
Soon it started raining very heavily. There were sounds of thunder bolt around. Since there were a shortage of beds, Rakib and myself shared one be(d) and could not sleep because of the thunderous sounds. During that night Rakib did not sleep at all and went out a number of times to see that everything was alright and there was no chance of being attacked unaware. Still today. I distinctly remember that night. That was the night that three of us together passed on the free soil of Bangladesh before all three of us had driven out. That was a night which could be dangerous for us because in the confusion of the rain and thunder, the Pakistani army could approach Brahmanbaria and capture us unaware. The enemy was so near in all directions that none of us could sleep that night. I do not know when I feel asleep. When I got up the rain was no longer there and the light of the sun was coming through the window.
কাজী রকিবউদ্দিন তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরে নিরাপদ বাসস্থান খোঁজ করছিলেন। আলোচনা করে ঠিক করা হয় যে আমরা দুজন একত্রে মাধবপুর রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের রেস্টহাউসে থাকব। কাজী রকিবউদ্দিন সঙ্গে নিয়ে আসেন একজন সামরিক কর্মকর্তাকে। তার নাম হলো কর্নেল এম এন রেজা। তিনি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সেনাকল্যাণ সংস্থার পূর্ব পাকিস্তানের কর্ণধার। পাকিস্তান বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাকে আর পদোন্নতি দেওয়া হবে না। তার চাকরির আর যে কয় মাস বাকি ছিল, তা পূর্ণ করার জন্য তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৬ মার্চের পর তিনি ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালিয়ে আসেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে যোগদানপত্র দাখিল করেন। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তারা ছিলেন মেজর পদমর্যাদাসম্পন্ন। রেজা ছিলেন কর্নেল। সুতরাং মেজরদের পক্ষে কর্নেলকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁকে দায়িত্ব দিতে পারতেন কর্নেল ওসমানী, যিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। কিন্তু কর্নেল ওসমানী এবং কর্নেল রেজার সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। তার ফলে সেনাবাহিনীতে কর্নেল রেজার ঠাই হয়নি। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিওর প্রতিরক্ষা পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সেই সূত্রে তিনি মাধবপুরে এসে আমাদের সঙ্গে থাকেন।
১৯৭১-এর ১১ এপ্রিল রাতে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, মেজর সফিউল্লাহর বাহিনী একটি বড় অংশ কিশোরগঞ্জ হয়ে রেলে করে তেলিয়াপাড়ার দিকে চলে আসে। রাতে প্রায় দুইটার দিকে এই বাহিনী মাধবপুরে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের রেস্টহাউসে পৌঁছায়। প্রায় ৩০-৩৫টি জিপ ও ট্রাকের বহর নিয়ে এই বাহিনী আসছিল। আমরা ভয় পেয়ে যাই যে এই বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশ কি না। কর্নেল রেজা এবং রকিবউদ্দিন আহমদ তাঁদের রিভলবার বের করে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেন। তবে জিপের ওপর বাংলাদেশের পতাকা দেখে পাকিস্তান বাহিনীর ভয় দূর হয়ে যায়। অফিসাররা গেস্টহাউসে আসেন, তাঁদের কাছে আমরা আরও দুটি খারাপ খবর শুনতে পাই। প্রথম খারাপ খবর হলো ভৈরব ব্রিজে মুক্তিবাহিনীর যে কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা পাকিস্তান বাহিনীর বিমান আক্রমণে হতভম্ব হয়ে তাদের সঙ্গে পালিয়ে চলে এসেছে। কর্নেল রেজা বললেন, ভৈরব ব্রিজে ডিনামাইট লাগানো হয়েছিল। বাংলাদেশ বাহিনীর ওপর নির্দেশ ছিল যে যদি পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে টিকতে না পারা যায়, তাহলে ভৈরব ব্রিজে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেনাবাহিনী যেন পশ্চাদপসরণ করে। এ কাজ কেন করা হলো না, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট হাবিলদারকে ডেকে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট হাবিলদার এসে বলে যে সে ডিনামাইট বিস্ফোরণ করতে পারত কিন্তু সে তা করেনি। কেননা এর ফলে দেশের একটি বড় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাবিলদার এ কাজটি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তবে পাকিস্তান বাহিনী ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে সত্যি সত্যি ভৈরব ব্রিজের কয়েকটি স্প্যান উড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাংক থেকে পাকিস্তানি টাকা ভারতে বিএসএফের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যাংকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টাকা ছাড়াও কিশোরগঞ্জের ব্যাংকগুলো থেকে পাঠানো টাকা জমা ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুটি ব্যাংকে টাকা রাখা হয়। একটি ব্যাংকের ভল্টে ছিল ১০ কোটি টাকা, আরেকটি ব্যাংকের ভল্টে ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বোমা নিক্ষেপ করা শুরু করে, তখন মুক্তিবাহিনী বুঝতে পারে যে তাদের পক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টাকা ভারতে স্থানান্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন মনে করেন, যে ব্যাংকে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা মজুত ছিল, সেটি সব ব্যাংকের মজুত। তিনি ১০ কোটি টাকার মজুত স্থানান্তরের কোনো উদ্যোগই নেননি। তিনি বিএসএফের কাছে ৮০ লাখ টাকা হস্তান্তর করতে সমর্থ হন। ৩৪ লাখ টাকার হিসাব মেলানো সম্ভব হয়নি। আইনউদ্দিন দাবি করেন যে শুধু ১০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোটে ভারতীয় বাহিনীর কাছে যে অর্থ জমা দেওয়া হয়, তা হিসাব করা হয়েছিল। ১ টাকা, ৫ টাকা এবং ১০ টাকার নোটে যে অর্থ আনা হয়, তা হিসাব করা হয়নি। তাই হিসাবে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টাকা হস্তান্তরে সমস্যা হওয়ায় আমরা সতর্ক হয়ে যাই। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেই যে হবিগঞ্জে ন্যাশনাল ব্যাংকে যে টাকা রয়েছে, সে টাকা বিএসএফের কাছে পাঠাতে হবে। এ টাকা পাঠানোর জন্য আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাহায্য চাই। টাকা স্থানান্তরের কাজটি তত্ত্বাবধানের জন্য আমি হবিগঞ্জে যাই। হবিগঞ্জের ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার বলেন, একমাত্র এসডিও হুকুম দিলে তিনি টাকা সেনাবাহিনীকে দেবেন। অন্যথায় টাকা কোনোমতেই দেওয়া যাবে না। আমি অফিস থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজারকে সেনাবাহিনীর কাছে টাকা দেওয়ার জন্য আদেশ দিই। সেনাবাহিনী ট্রাকে করে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে এ টাকা আগরতলায় নিয়ে যায়। রাঙামাটি থেকে ট্রেজারির অর্থ তুলে নিয়ে আসেন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম। এ ছাড়া পাবনা থেকে নুরুল কাদের খান। বাংলাদেশ সরকারের কাছে টাকা জমা দেন, ঝিনাইদহ থেকে এসডিপিও মাহবুব, মেহেরপুর থেকে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা জমা দেন।
বাংলাদেশের প্রায় সব মহকুমা থেকেই ট্রেজারির টাকা ভারতীয় বিএসএফের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সব জায়গায় সেটি সফল হয়নি। কোথাও কোথাও অনেক টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বগুড়ায় ৩২ কোটি টাকা ছিল। এর একটি ক্ষুদ্র অংশ বিএসএফের কাছে পৌঁছায়। আর একটি অংশ একজন অভিনেতা তার শিষ্যদের নিয়ে দখল করেন। এ অর্থ নিয়ে ভারতে তিনি অনেক কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। এ অর্থে নাকি একজন রাজনৈতিক নেতাও ভাগ বসিয়েছিলেন। মৌলভীবাজার ট্রেজারির কর্মকর্তারা ভল্টের চাবি নিয়ে গ্রামে পালিয়ে যান। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট গ্রেনেড দিয়ে ভল্ট ভাঙে। কিন্তু এখানেও টাকার হিসাব মেলেনি। ওই দিন মৌলভীবাজারের একটি চা-বাগানে আমি রাত যাপন করেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি রাস্তার ওপরে বেশ কিছু নোট পড়ে আছে। টাকা হস্তান্তরে অনিয়ম সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকার এ হান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৬/৮/৭১ সালে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। তবে এই কমিশনের কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।’
পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্থানান্তরিত অর্থ ছিল প্রবাসী সরকারের প্রাথমিক সম্পদ। পাকিস্তানি মুদ্রাসমূহ মারোয়াড়িদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানি মুদ্রার বিনিময়ে ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া হতো। এই কাজটি কলকাতায় করতেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাঁতারু ব্ৰজেন দাস। পাকিস্তান সরকার এই অর্থ স্থানান্তর সম্পর্কে অবগত হয়ে ১৯৭১ সালের ৮ জুন রেগুলেশন নম্বর ৮১ জারি করে। এই রেগুলেশনে বলা হয় :
All Pakistan currency notes of the following description shall cease to be legal tender within the meaning of section 25 of the State Bank of Pakistan Act, 1956 (XXXII of 1956), on and from the dates mentioned against each–
‘(a) Pakistan currency notes inscribed or marked with, or having impressed or embossed thereon, the expressions ‘Joy Bangla’ of ‘Bangla Desh’, or any similar expressions, or having embossed or stamped thereon the expression ‘Dacca’ in any language or form whatsoever;
‘(b) Pakistan currency notes of 500-rupee and 100-rupee denominations. Date of commencement of this Regulation: 8th June, 1971.?’[৯]
৮ জুনের পরও পাকিস্তানি মুদ্রা ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। তবে সব ১০০ টাকা এবং ৫০০ টাকার নোট বাতিল করায় এ মুদ্রাগুলোর দাম কাবুলের বাজারে খুবই কমে যায় এবং ১০০ টাকার বিনিময়ে মাত্র ৮ ১০ টাকা পাওয়া যেত। তবে ১ টাকা, ৫ টাকা ও ১০ টাকার নোটগুলো চালু ছিল। এর বিনিময়ে কিছু অর্থ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার কত। পাকিস্তানি রুপি ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত করেছিল, তার সঠিক হিসাব জানা। নেই। তবে বাংলাদেশ সরকারের যে বেসামরিক বাজেট মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ খরচ পাকিস্তান থেকে স্থানান্তরিত মুদ্রায় করা সম্ভব হয়েছে। তবে বেসরকারি কর্মকাণ্ডের বাইরেও বিশেষ প্রয়োজনে। মন্ত্রিসভা কর্মসূচিভিত্তিক বাজেট অনুমোদন করেছে, যথা–বিভিন্ন স্থানে ইয়ুথ ক্যাম্পের বাজেট।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও সাহায্য দেওয়া হয়। প্রবাসে কর্মরত বাঙালিরাও এ সরকারকে অর্থ দেন। এসব অর্থ একত্র করে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে ভারতীয় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে বাংলাদেশ তহবিল খোলা হয়। তবে দ্রুত মুক্তি অর্জিত হওয়ার ফলে অনুমোদিত বাজেটের পুরোটাই ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। মঈদুল হাসান জানাচ্ছেন, ১৯৭২ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার বলেন যে, বাংলাদেশ সরকারের বেশ কয়েক কোটি টাকা–যত দূর মনে পড়ে ১৭ কোটি টাকা রয়েছে ভারতে। যে টাকাটা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই টাকা বদলানো হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায়। সেই টাকা প্রবাসী সরকার কিছু খরচ করেছে, অবশিষ্ট টাকা রয়েছে ভারতীয় ব্যাংকে।’
হাকসারের বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শেষে বাংলাদেশ সরকারের ১৭ কোটি টাকা ভারতীয় ব্যাংকে জমা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সব মিলিয়ে আরও চার-পাঁচ কোটি টাকা সরকার খরচ করেছে। ভারতে স্থানান্তরিত পাকিস্তানি টাকার পরিমাণ ২১-২২ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে আমি, কাজী রকিব এবং কর্নেল রেজা–এই তিনজন একসঙ্গে থাকতে শুরু করি। ১২ এপ্রিল আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে মাধবপুর রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের ডাকবাংলো যথেষ্ট নিরাপদ নয়। ফলে ১২ এপ্রিল আমরা আমু চা-বাগানে ম্যানেজারের বাংলোয় থাকায় সিদ্ধান্ত নিই। ম্যানেজার ছিলেন ব্রিটিশ। তিনি প্রাণভয়ে সপরিবার বিলাতে ফিরে যান। তাঁর বাড়িতে বড় বড় রেফ্রিজারেটরে অনেক মাংস, ডিম, মাখন ইত্যাদি ছিল। স্থানীয় বাজার থেকে আমরা কিছু তরকারি কিনে নিতাম। আমার বাবুর্চি আমার সঙ্গেই ছিল। বাবুর্চি রান্নাবান্না করত। আমরা রাতে আমু চা-বাগানে এসে ঘুমাতাম। দিনের বেলা আমরা হবিগঞ্জে অফিসে যেতাম এবং লোকজনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতাম। আমি সরকারি কর্মচারীদের এ কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই যে মুক্তিযুদ্ধ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম হতে পারে। যদি কেউ ভারতে আশ্রয় নিতে চায়, তাহলে তাদের আমি সাহায্য করার চেষ্টা। করব। যাদের আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই, তারা নিজেরাই নিজেদের দেখাশোনা করবেন। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল তারিখে আমি হবিগঞ্জে কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদায় নিই। আমি তাদেরকে জানাই যে আমি যেকোনো মুহূর্তে ভারতে আশ্রয় নেব। তখন আমার সেকেন্ড অফিসার ছিলেন এ টি এম আবেদ নামে একজন ইপিসিএস অফিসার। তাঁর মনে ক্ষোভ ছিল যে তাঁকে সরকার এসডিও করেনি। আমার ঘোষণায় তিনি খুশি হন এবং পরের দিন নিজেই সরকারের কোনো আদেশ ছাড়া হবিগঞ্জের এসডিওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাতে তাকে কোনো দোষারোপ করতে না পারে, সে জন্য তিনি হবিগঞ্জ জেলখানায় এসডিপিওসহ আশ্রয় নেন। আবেদ ১০ দিন এভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসডিও ছিলেন। তবে ১৯৭১ সালের ১ জুন দখলদার কর্তৃপক্ষ এ জে এম ওহিদুজ্জামান নামে আরেকজন ইপিসিএস অফিসারকে হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে বদলি করে।
২০ এপ্রিল ১৯৭১ আমি ভারতে যাইনি। আমু চা-বাগানে ফেরত গিয়েছিলাম। আমু চা-বাগানের একটি সুবিধা ছিল যে এই চা-বাগানটির সঙ্গে ভারতের চা-বাগানের সংযোগ ছিল। হেঁটে অনায়াসে ভারত চলে যাওয়া যেত। তবে আমরা হেঁটে ভারত যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলাম না। আমাদের সঙ্গে কাজী রকিবউদ্দিনের একটি জিপ ছিল। জিপ ছাড়া ভারতে আমাদের চলাফেরায় অসুবিধা হতো। এ ছাড়া আমাদের তিনজনের তিনটি স্যুটকেস, বিছানাপত্র এবং রান্নাবান্নার সরঞ্জাম ছিল। এগুলো নিয়ে যেতে হলে আমাদের জিপে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল।
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন ওই অঞ্চলের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোস্তফা শহিদ। মোস্তফা শহিদ একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মচারীদের সমস্যা তিনি ভালোভাবে বুঝতেন। তাই তিনি সব ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেন। মোস্তফা শহিদ আজীবন আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রীও ছিলেন। তবে বিরোধী দলের সদস্য বা সরকারের মন্ত্রী–যে পদেই তিনি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমৃত্যু আমার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল।
৩০ এপ্রিল মোস্তফা শহিদ একটি জিপ নিয়ে আমু চা-বাগানে আসেন এবং আমাদের জানান সিলেট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মৌলভীবাজার এসে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হবিগঞ্জের দিকে আসছে। যেকোনো মুহূর্তে হবিগঞ্জ এলাকা পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যাবে। সুতরাং যদি আমাদের জিপ নিয়ে পালাতে হয়, তাহলে এই মুহূর্তে পালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মালপত্র নিয়ে জিপে উঠে বসলাম। জাতীয় মহাসড়ক ধরে আমু চা-বাগান থেকে তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের দিকে রওনা হলাম। মনে ভয় কখন পাকিস্তানি বাহিনী চলে আসে! শেষ পর্যন্ত আমরা তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ঢুকে যাই। এই চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত একটি চা-বাগানে প্রবেশের রাস্তা ছিল। এই রাস্তা দিয়ে আমরা চা-বাগানে ঢুকি। এই চা-বাগান তখন বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীতে ভরে আছে। আমরা রাত প্রায় দুইটার দিকে এ চা-বাগানে পৌঁছাই।
রাতে আমাদের শোবার জন্য কোনো জায়গা ছিল না। এই বাগানে পাহারাদারদের রাতে ঘুমানোর জন্য একটি শেড ছিল। এই শেডের দুজন। পাহারাদার ঘুমিয়ে ছিল। তাদের ঘুম থেকে তুলে পাহারার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। একটি নতুন পাটি দিয়ে আমাদের বিশ্রাম নিতে বলা হয়। মোস্তফা শহিদ ছাত্রলীগ কর্মীদের জন্য যে তাঁবু ছিল, সেখানে চলে যান। আমার বাবুর্চি পাহারাদারদের সঙ্গে রাত জাগে। সেই রাতে রকিব এবং আমার কারোরই ঘুম আসেনি। আমাদের দুজনেরই চোখে পানি।
তবে মনে শান্তি ছিল। ২৬ মার্চের পর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতাম বিবেকের বিরুদ্ধে কি কোনো কাজ করেছি, সব সময়ই উত্তর ছিল–না। যে সিদ্ধান্তই দিয়েছি এবং যে কাজই করেছি, তা বিবেকের তাড়নাতেই করেছি। আমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বাংলাদেশ অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়তো কয়েক মাস আমাদের আরও কষ্ট করতে হতে পারে কিন্তু কষ্টের শেষে অবশ্যই আনন্দ লুকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগত যে আমরা সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের সদস্য ছিলাম। সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানকে বলা হতো পাকিস্তানের Steel frame বা ইস্পাতকাঠামো। আমাদের দায়িত্ব ছিল ভাষা এবং ভৌগোলিক দিক থেকে বিভক্ত পাকিস্তানকে একসঙ্গে ধরে রাখা। অথচ আমরা এ পাকিস্তানকে ভেঙে দেওয়ার জন্য কাজ করছি। এটা কি সঠিক? আমাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে আমরা সঠিক কাজ করছি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। দেশের সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। এই প্রতিনিধি পরিষদকে নির্বাহী আদেশে ভেঙে দেন তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। এরপর পাকিস্তানে যত সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা নিয়েছে মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনীর চেয়ে ১৯৭০-এর নিরপেক্ষ নির্বাচনে অনুষ্ঠিত প্রতিনিধিদের বৈধতা ছিল অনেক বেশি। সুতরাং আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত পাকিস্তানের প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সিদ্ধান্ত ছিল বৈধ।
স্বাধীনতা একটা জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। সব প্রজন্মের লোক স্বাধীনতা রক্ষার সুযোগ পান না। আমরা এই সুযোগ পেয়েছি এবং এই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়ী থাকব। স্পেনের গৃহযুদ্ধে ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতো বুদ্ধিজীবীরা স্পেনের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার নাগরিকেরা ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে স্পেনের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। আমরা যদি আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে লড়াই না করি, তাহলে আমরা কোনো দিন মুখ দেখাতে পারব না। স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি বলেই আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।
পাদটীকা
১. Khashruzzaman Choudhury, The Turbulent 1971 My Diary, 2020 (Dhaka: Agamee Prakashani), P-58
২. রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ৭১ এর দশ মাস, ১৯৯৭, (ঢাকা : কাকলী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা-১১০
৩. এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, ২০০৯ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন)।
৪. এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আমি ভুলে বলে ফেলেছিলাম তাকে আমি নিজ হাতে হবিগঞ্জ ট্রেজারিতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলাম। আসলে হবিগঞ্জ ট্রেজারিতে কোনো অস্ত্র প্রদানের অনুষ্ঠান হয়নি।
৫. Khashruzzaman Choudhury, The Turbulent 1971 My Diary, 2020 (Dhaka: Agamee Prakashani), P-121
৬. Khashruzzaman Choudhury, OP.Cit, 2020, P-265-266
৭. মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, স্মৃতির পাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ২০১৮, (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স), বইটির সর্বশেষ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারের রসিদের ফটোকপি দেখা যাবে।
৮. এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪, (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা-১২৫
৯. Peter Symes, The Pakistan Overprints of Bangladesh, Volume 39, 2000.
১০. আফসান চৌধুরী। ২০২১। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা–
১১. এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, ২০০৯। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৪৩