১২. আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধ

দ্বাদশ অধ্যায়

আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধ : ১ মে ১৯৭১ থেকে জুলাই প্রথম সপ্তাহ ১৯৭১

১ মে ১৯৭১। এদিন সকালবেলা জিপে করে ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত চা বাগান থেকে আমরা আগরতলা সার্কিট হাউসে উপস্থিত হই। সেখানে কেয়ারটেকারকে আমাদের দুজনের জন্য কক্ষ বরাদ্দ করতে অনুরোধ করি। কেয়ারটেকার জানান যে আমাদের দুজনকে একটি কক্ষ সর্বাধিক দু-তিন। দিনের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। তারপর বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের এই সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করা যাবে না। কেননা ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আগরতলা আসছেন। তিনি আমাদের সকালের প্রাতরাশের ব্যবস্থা করেন এবং বলেন বাংলাদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগরতলা থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্বে রয়েছেন ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মি. কে পি দত্ত। তিনি আগরতলায় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। এবার তিনি সরকারি কর্মকর্তাদেরও ব্যবস্থা করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মি. দত্ত এসে উপস্থিত হন। তিনি নিজেও সিলেট জেলার সন্তান। দেশভাগের পর ত্রিপুরায় অভিবাসন করেছেন। তিনি আমাদের বলেন, আমাদের থাকার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। তবে যে বাড়িতে আমরা থাকব, সে বাড়ির মালিক দুপুরবেলা তাঁর বাড়িতে আসবেন।

তিনি আমাদের সার্কিট হাউস থেকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। সে বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে আগত অনেক উদ্বাস্তু থাকতেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী কবরী। দুপুরে খাওয়ার সময় কবরী আমাদের খাদ্য পরিবেশন করেন। দুপুরের খাবারে মাছ, ভাত, ডাল এবং কাঁঠালের তরকারি ছিল। দুপুরের খাওয়ার পর আমরা যখন বিশ্রাম করছি, তখন ত্রিপুরা কংগ্রেসের নেতা প্রিয়দাস চক্রবর্তী এ বাড়িতে উপস্থিত হন। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন। আগরতলায় বাড়ি ছাড়াও আগরতলার বাইরে একটি বাগানবাড়ি ছিল। তার স্ত্রী ছিলেন একজন মহিলা সাংসদ এবং মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পর তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। বাগানবাড়িটি ছিল আগরতলা বিমানবন্দরের মাইল দুয়েকের মধ্যে।

আমরা আমাদের জিপে করে প্রিয়দাস চক্রবর্তীর গাড়িকে অনুসরণ করে সেই বাগানবাড়িতে উপস্থিত হই। বাড়িটিতে পাঁচটি কক্ষ ছিল। সামনের কক্ষে ছিল তিনটি চৌকি। আমি আর রকিব সেই কক্ষে এসে ঠাই নিলাম। বাড়িটি ছিল আগরতলা থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তার পাশে। রাস্তার পাশে অনেক গাছ লাগানো হয়েছিল, বাড়িটি ছিল ভেতরে। সেখানে পানি পান করার জন্য একটি কুয়া ছিল। সেই কুয়া থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা হতো। স্নান এবং অন্যান্য কাজের জন্য একটি মাঝারি আকৃতির পুকুর ছিল। পুকুরে একটি পাকা ঘাট ছিল। সেই ঘাটে আমরা গোসল করতাম। আমরা মি. চক্রবর্তীকে আশ্বাস দিই যে একটি কামরাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। ৩ মে হোসেন তৌফিক ইমাম তাঁর পরিবারসহ সাবরুম মহকুমা থেকে আগরতলায় আসেন। তার পরিবারের জন্য দুটি কামরা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর আমাদের ব্যাচমেট খসরুজ্জামান চৌধুরী আগরতলায় আসেন। প্রথমে তিনি আমাদের সঙ্গে বাড়ির সামনের কক্ষটিতে থাকতেন। পরে খসরুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার এসে যোগ দিলে তিনি আরেকটি কক্ষ দখল করেন। সবশেষে তৌফিক ইমামের স্ত্রীর ভাই আগরতলায় এসে আশ্রয় নেন। তিনিই সর্বশেষ কক্ষটি দখল করেন। এভাবে প্রিয়দাস চক্রবর্তীর বাড়িটি একটি শরণার্থীশিবিরে পরিণত হয়।

আগরতলা আসার পরদিন আমি ও রকিব আগরতলার বিএসএফ সদর দপ্তরে কর্নেল রবের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার আরও অনেক কাহিনি শুনতে পাই। ৩ মে আমরা সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে যাই। সেখানে তখন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল গড়ে উঠছিল। এ সফরের সময় কর্নেল রেজা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) বাহারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। মেজর বাহার জানান, ২৮ মার্চ তারিখে তিনি কসবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসছিলেন। সেখানে তিনি শুনতে পান সীমান্তে গণি মিয়া নামে একজন সচ্ছল চাষির খড়ের গাদার মধ্যে একজন সেনা কর্মকর্তা লুকিয়ে আছেন। তিনি সেই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য গণি মিয়ার বাড়ি যান। খড়ের গাদা থেকে বেরোনোর পর মেজর বাহার চিনতে পারেন যে ব্যক্তিটি হচ্ছেন গোঁফছাঁটা কর্নেল এম এ জি ওসমানী। তিনি তাঁকে স্যালুট দিলেন এবং অনুরোধ করলেন ভারতে যাওয়ার জন্য। কর্নেল ওসমানী বললেন, ভারতে গেলে তারা তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করবে না। সুতরাং তিনি ভারতে যেতে চান না। মেজর বাহার ভারতে গিয়ে বিএসএফের কর্মকর্তাদের তাঁকে অভ্যর্থনা করে ভারতে নিয়ে আসার অনুরোধ করেন। বিএসএফের কমান্ডাররা তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যান। মেজর বাহার বললেন, গার্ড অব অনার পেয়ে ওসমানী সাহেবের চেহারা একেবারে ভিন্ন হয়ে যায়। তিনি এমন ভাব করছিলেন যেন তার সঙ্গে আমার আদৌ কোনো পরিচয় নেই। অন্যান্য বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যেও কর্নেল ওসমানীর প্রতি অনুরাগ দেখা যায় না। তারা তাঁকে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর স্মারক বলে গণ্য করতেন। বাংলাদেশ সরকার মনোনীত সর্বাধিনায়ক হিসেবে কর্নেল ওসমানীর আদেশ সবাই মানলেও বেশির ভাগ অফিসারই তাকে পছন্দ করতেন না।

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার একটি কেন্দ্রীভূত সরকার হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ সরকারের নামে অফিস গড়ে ওঠে। যাদের সঙ্গে তখনো কলকাতাস্থ মুজিবনগর সরকারের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার আগরতলা সরকারকে একটি উপকেন্দ্র হিসেবে মেনে নেয়। এই উপকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন সংসদ সদস্য এম আর সিদ্দিকী ও জহুর হোসেন চৌধুরী। এই সংসদ সদস্যরা আগরতলায় কর্নেল চৌমুহনী নামে একটি স্থানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি অফিস স্থাপন করেন। এই অফিসের কাজ ছিল বাংলাদেশ থেকে আগত সাংসদ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থাকার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আগরতলায় যারা পালিয়ে আসছিলেন, তাঁদের কোনো পরিচয়পত্র ছিল না। নিরাপত্তার কারণে আগরতলার প্রশাসন তাদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইত। এই অফিস বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পরিচয়পত্র দিত।

এইচ টি ইমাম আগরতলায় আসার পর বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি অফিস খোলা হয়। এই অফিসই ছিল ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান যোগসূত্র। এইচ টি ইমাম সরাসরি ত্রিপুরা রাজ্যের চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য যোগাযোগ করতেন। তাঁর অধীন কর্মকর্তারা ত্রিপুরা রাজ্যের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দেনদরবার করতেন। প্রথম দিকে এই সরকারের প্রশাসন এবং অর্থের দায়িত্বে ছিলেন কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ এবং বাকি সব বিষয় আমি দেখতাম। মাসখানেক পর খসরুজ্জামান চৌধুরী এই অফিসে যোগ দিলে তাঁকে অর্থের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং আমাকে তথ্য সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

আগরতলায় অফিস গুছিয়ে বসার আগেই রকিব এবং আমার জন্য মৌলভীবাজার থেকে জরুরি তলব আসে। মে মাসের ৫ তারিখে আমাদের অবিলম্বে মৌলভীবাজার যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। মৌলভীবাজারে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্য প্রবেশ করেনি, তবে যেকোনো মুহূর্তে যে প্রবেশ করতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল। মৌলভীবাজার ট্রেজারিতে তখন ২ কোটি টাকা ছিল। ট্রেজারির চাবি ছিল মৌলভীবাজারের সেকেন্ড অফিসারের কাছে। তাকে যখন ট্রেজারির চাবি দিতে বলা হলো, তখন তিনি পালিয়ে যান। আমাদের ডাকার উদ্দেশ্য ছিল এই সেকেন্ড অফিসারকে খুঁজে বের করে তার কাছ থেকে ট্রেজারির চাবি উদ্ধার করা। আমরা রাতে মৌলভীবাজারের মনু চা-বাগানে পৌঁছাই। ততক্ষণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল গ্রেনেড দিয়ে ট্রেজারির ভল্ট ভেঙে ফেলে এবং সেখান থেকে টাকা নিয়ে আসে কিন্তু এই টাকার কোনো হিসাব করা যায়নি। পরদিন সকালে আমরা চা-বাগানের ভেতরের রাস্তায় পোড়া পাকিস্তানি মুদ্রার নোট পড়ে থাকতে দেখেছি। আমরা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মৌলভীবাজারের চা-বাগান থেকে ভারতে চলে আসি।

সে সময় আমাদের কাছে আরেকটি সমস্যা তুলে ধরা হয়। যুদ্ধের কারণে সিলেটের চা-বাগান থেকে চা চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাই সব বাগানেই অনেক চা জমে ছিল। আশা করা হচ্ছিল পরিস্থিতি উন্নত হলে এই চা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে যে চা ব্যবহৃত হতো, তার অধিকাংশ যেত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। যদি সিলেটের চা বাগানের চা ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে পাকিস্তানিরা চা পাবে না এবং তাদের বাগানগুলোর আর্থিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই সীমান্তের চা বাগানের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চা ভারতে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজে আমরা শ্রীমঙ্গল চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হাসানের সহায়তা চাই। হাসানও তখন আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। আমরা ভারতে চা রাখার জন্য একটি গুদাম খুঁজে বের করি এবং এই গুদামে ট্রাকে করে চা আনা হতো। আমরা ৫-৬ মে পর্যন্ত এ কাজটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। পরে দেখা গেল যে এই চা এনে তা ভারতের বাজারে বিক্রি করার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভারতে চা বিক্রির জন্য ভারত সরকারের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। যে গুদামে চা রাখা হতো, সেখানে দীর্ঘদিন চায়ের মান অক্ষুণ্ণ থাকত না। অনুমতি পেতে দেরি হওয়ায় অনেক চা-ই নষ্ট হয়ে যায়। আমরা আশা করেছিলাম, চা বিক্রি করে বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বাড়ানো যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

৯-১০ মে তারিখ থেকে আমি এবং রকিব আগরতলায় অফিস করতে থাকি। অফিসে অনেক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের দুঃখের কাহিনি শুনি। এই সময়ে আগরতলায় একটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারটির কর্তার নাম ছিল এইচ এন চক্রবর্তী। তাঁর পৈতৃক বাসস্থান ছিল সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে। দেশ বিভাগের পর তিনি আগরতলায় চলে আসেন এবং দুটি চা-বাগান স্থাপন করেন। তিনি দিল্লিতে প্রবাসী একটি বাঙালি পরিবারের কন্যাকে বিয়ে করেন। আগরতলায় ছেলেমেয়েসহ একটি বিরাট বাড়িতে তিনি থাকতেন। তিনি যখন আমাদের খবর পান, তখন তৌফিক ইমাম, রকিবউদ্দিন, খসরুজ্জামান এবং আমাকে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতেন। আহার সামগ্রীর মধ্যে থাকত বড় বড় মাছ, খাসি এবং মোরগের মাংস। আগরতলা শহরের সেরা মিষ্টির দোকান থেকে দই, মিষ্টিও পরিবেশন করা হতো। আমার জন্য এই খাওয়ার চেয়েও আরও একটি বড় আকর্ষণ ছিল এইচ এন চক্রবর্তীর বাড়িতে। তিনি শুনতে পান যে আমি চেইন স্মোকার। হবিগঞ্জে থাকতে আমি বিদেশি সিগারেট খেতাম। কিন্তু এখন অর্থাভাবে ভারতে চার মিনার সিগারেট খাচ্ছি। এ কথা শোনার পর আমি তার বাড়িতে গেলেই তিনি প্রতিবার আমাকে এক কার্টন বিদেশি সিগারেট দিতেন। এই দান গ্রহণ করতে গিয়ে আমার চোখে জল আসত।

তিনি আমাদের তার চা-বাগানে নিয়ে যান। একবার সেখানে তিনি আমাদের সবার জন্য বনভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশ্য তার চা বাগানের মান ছিল সিলেটের চা-বাগানের তুলনায় অনেক নিচে। উৎপাদিত চায়ের মান ভালো না হওয়ায় ভারতের বাজারে এর খুব একটা চাহিদা ছিল না। বাগান বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকেরা বেকার হয়ে যাবে–এই ভয়ে ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের মালিকদের বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি দিত। এই ভর্তুকি দিয়েই এসব বাগান চলছিল। চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা কোনো কোনো শরণার্থী বাংলাদেশিরা পছন্দ করতেন না। তাঁরা কানাঘুষা করতেন যে চক্রবর্তী এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সেবাযত্ন করে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাঁদের কাছে বিভিন্ন তদবির নিয়ে হাজির হবেন। আমার কাছে কখনো তা মনে হয়নি। ভারতে যে কটি পরিবার বিভিন্নভাবে আমাদের সাহায্য করেছে, তাতে তাদের কোনো স্বার্থ ছিল না।

৫০ বছর হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তৌফিক ইমাম, রকিব, খসরু এবং আমি–আমরা ৫০ বছরে বাংলাদেশে অনেক উঁচু পদে কাজ করেছি কিন্তু কখনো ভারতীয় বন্ধুদের কাছ থেকে কোনো তদবিরের অনুরোধ পাইনি। এইচ এন চক্রবর্তী ও প্রিয়দাস চক্রবর্তী আজ বেঁচে নেই। মি. কে পি দত্ত বেঁচে আছেন কি না, জানি না। মুক্তিযুদ্ধের পর শুনতে পেয়েছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়ে ভারত সরকার তাকে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে (আইএস) মনোনয়ন দিয়েছিল।

এপ্রিলের ১০-১১ তারিখে হেনা বুজি তার বড় মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আগরতলায় আমার বাসভবনে উপস্থিত হন। হেনা বুজি আমার বড় চাচার জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাঁর বিয়ে হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সুপারিটেনডেন্ট ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তাকে পাকিস্তান। পুলিশ সার্ভিসে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে তিনি পাবনার এসপি ছিলেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে পাসপোর্ট এবং ভিসাসংক্রান্ত দায়িত্ব দিয়ে প্রথম সচিব পদে পদস্থ করেন। এ ধরনের কর্মকর্তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে গোয়েন্দার কাজও করতে হয়। ২৬ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করলে সারা দেশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। কলকাতায় তখন ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ১৯৪৯ ব্যাচের কর্মকর্তা এম হোসেন আলী। তিনি এবং মিশনের প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, তৃতীয় সচিব আনোয়ারুল করিম চৌধুরী, তৃতীয় সচিব নজরুল ইসলাম, তৃতীয় সচিব মাকসুদ আলী এবং সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমানসহ বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেন। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৭ এপ্রিল তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। মি. চৌধুরীর ছোট মেয়ে ছাড়া পরিবারের আর সব সদস্য তখন ঢাকায় ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবশ্যই তার পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নেবে। এই ভয়ে চৌধুরী সাহেব খুবই উৎকণ্ঠিত ছিলেন। রেডিওতে চৌধুরী সাহেবের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেনা বুজি আমাদের পৈতৃক বাড়ি নবীনগর থানার রসুল্লাবাদ গ্রামে চলে যান। সেখান থেকে ভারতে যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন।

মে মাসের প্রথম দিকে নবীনগরে খবর চলে যায় যে আমি আগরতলায় আছি। হেনা বুজি আগরতলায় আমার কাছে চলে আসতে চান। তাঁকে এই কাজে সহায়তা করে আমার ছোট ভাই কবিরের বন্ধু মোমিন। সে হেনা বুজি এবং তার দুই সন্তানসহ নৌকাযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে কুমিল্লার সংযোগকারী রাস্তা পার হয়ে বহু কষ্টে আগরতলা সীমান্তে পৌঁছায়। আগরতলায় পৌঁছে বাংলাদেশ সরকারের অফিসে যায় এবং সেখান থেকে আমার বাসার ঠিকানা জোগাড় করে উপস্থিত হয়। আমি তো হেনা বুজি এবং তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখে একেবারে অবাক হয়ে যাই। প্রিয়দাস চক্রবর্তীর বাড়ির একটি কামরা খুলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

পরদিন ভোরে আমি হেনা বুজিকে নিয়ে এইচ এন চক্রবর্তীর বাড়িতে যাই। তাঁর বাসার টেলিফোন থেকে রফিক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। এরপর তিনি জানান। যে পরদিন আগরতলা থেকে হেনা বুজি এবং তার দুই সন্তানের জন্য তিনটি বিমানের টিকিট এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আমাকে টিকিটগুলো সংগ্রহ করতে বলেন এবং হেনা বুজি ও তার সন্তানদের আগরতলার বাসায় লুকিয়ে থাকতে উপদেশ দেন। রফিক চৌধুরীর পরামর্শ অনুসারে তারা আমাদের বাসায় লুকিয়ে ছিল। তাদের জিপে করে আগরতলা বিমানবন্দরে প্লেনে তুলে দিয়ে আসি। হেনা বুজি বারবার আমাকে বলছিলেন আগরতলায় কষ্ট না করে কলকাতায় চলে আসার জন্য। কলকাতায় ভাই বোন এক বাসাতেই থাকা যাবে।

মোমিনের কাছ থেকে নবীনগরে পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে বিভিন্ন বিবরণ শুনলাম। যেহেতু এই অঞ্চল দিয়ে মুক্তিবাহিনী চলাফেরা করছিল, সেহেতু পাকিস্তান বিমানবাহিনী নবীনগরে বোমা ফেলে। একটি বোমা আমাদের উঠানে বিস্ফোরিত হয়। আমার মা-বাবা ভয় পেয়ে যান। বাবা তখন অসুস্থ। কয়েকজন লোক ধরাধরি করে বাবাকে তিতাস নদে নৌকায় তোলেন। আমাদের পরিবার নবীনগর থেকে তিন মাইল দূরে বিলের মধ্যে অবস্থিত আমাদের মামার বাড়ি কণিকাড়া গ্রামে চলে যান।

পাকিস্তানের সমর্থকেরা নবীনগর থানা দখল করে থানায় তখন তাদের দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের বাসা ছিল থানায় উল্টো দিকে। আমাদের বাসায় ৫০টির মতো ভেড়া ছিল। নবীনগর স্কুলের হেডক্লার্ক রাধারমণ বাবুর ভেড়ার পাল ছিল। আমার ছোট ভাই জি এম জিয়াউদ্দিন খান ভেড়া পছন্দ করত। রাধারমণ বাবু জিয়াউদ্দিন খানকে দুটি ভেড়া উপহার দেন। এই ভেড়া দম্পতি থেকে ভেড়ার বংশ বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে প্রায় ৫০টি ভেড়া আমাদের বাড়িতে ছিল। ওই সময় আমাদের বাড়িতে কোনো মেহমান গেলে মোরগের বদলে ভেড়া জবাই করা হতো। তবু ভেড়ার সংখ্যা কমছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভেড়ার খবর পেয়ে তাদের খাওয়ার জন্য নির্বিচার হত্যা শুরু করে। ১৫-২০ দিনের মধ্যেই এই ভেড়ার পাল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মোমিন জানাল যে আমার মা আমার জন্য খুবই কান্নাকাটি করেন এবং প্রায়ই রাতে আমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি আমার জন্য মুরগির রোস্ট, বড় রুই মাছ ভাজি এবং এক বোতল খাঁটি ঘি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এগুলো খেতে খেতে মায়ের কথা মনে পড়ায় আমার চোখে পানি আসছিল।

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাকে মাহবুবুল আলম চাষী এবং ড. ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে শিলচর যেতে হয়েছিল। ড. ত্রিগুণা সেনের জন্ম হয়েছিল সিলেট শহরে ১৯০৫ সালে। তিনি সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। কলেজে থাকাকালীন তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দারা তাঁর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। তাঁর পরিবার গোয়েন্দাদের তৎপরতা লক্ষ করে আতঙ্কিত হয়ে তাঁকে কলকাতা থেকে জার্মানিগামী একটি জাহাজে তুলে দেন। ত্রিগুণা সেন জার্মানিতে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যান্ত্রিক প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দেশে ফিরে এসে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং জেল খাটেন।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৪৬ সালে তিনি ডিব্ৰুগড় বিদ্যুৎ সরবরাহ করপোরেশনে চাকরি নেন। ১৯৫৫ সালে তিনি যাদবপুর প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের র‍্যাক্টর নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে যাদবপুর প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন এবং ১০ বছর এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং এই পদে থাকাকালীন তিনি কোঠারি শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারতে নতুন শিক্ষানীতির প্রবর্তন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি খনি, আকরিক ধাতুসমূহ এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এই বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য ওষুধের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তবে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে খুবই বিশ্বাস করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংহত করার জন্য তিনি ড. সেনের সাহায্য চান। ড. সেন আগরতলায় আসেন। তিনি আগরতলায় বাংলাদেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে চান। এ ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য চান। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুজন কর্মকর্তাকে তাঁকে সহায়তার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। একজন কর্মকর্তা হলেন মাহবুবুল আলম চাষী, আরেকজন কর্মকর্তা ছিলাম আমি।

মাহবুবুল আলম চাষী বাংলাদেশে অতি সুপরিচিত নাম। ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উপসচিবের মর্যাদা নিয়ে ঢাকায় দূতাবাসসমূহের সঙ্গে সংযোগের জন্য স্থাপিত অফিসে প্রধান হিসেবে যোগ দেন। তিনি এই পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় একটি আদর্শ খামার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আগরতলায় চলে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রসচিব হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁর ক্রিয়াকাণ্ড বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তিনি খন্দকার মোশতাকের প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠীর একজন নেতা হিসেবে চিহ্নিত হন। তবে আগরতলায় যখন তিনি ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন তাকে নিয়ে কোনো বিতর্ক শুরু হয়নি। মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সখ্য ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে দুজনই সহপাঠী ছিলেন। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু বেইজিংয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যান, তখন মি. ও মিসেস মাহবুবুল আলম তাকে খুবই যত্ন করেন। তাদের আতিথেয়তার কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বেগম মাহাবুব ও মাহাবুবের আদর আপ্যায়নের কথা কোনো দিন ভুলতে পারি নাই।

ড. ত্রিগুণা সেন একটি গাড়িতে এবং মাহবুবুল আলম চাষী ও আমি একটি জিপ নিয়ে রওনা হই। ড. ত্রিগুণা সেন মাহবুবুল আলম চাষী এবং আমাকে তার গাড়িতে তুলে নেন। আমাদের জিপে ড. ত্রিগুণা সেনের সঙ্গীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আগরতলা থেকে পাহাড়ে ঘেরা উঁচু নিচু সড়ক ধরে আমাদের গাড়ি প্রথমে কৈলাশহরের দিকে যায়। কৈলাশহরে ভারতের এক ব্রিগেড সৈন্য অবস্থান করছিল। এখানে একটি বিমানবন্দরও রয়েছে। রাস্তা দিয়ে গেলে ত্রিপুরা রাজ্যের নয়নাভিরাম রূপ দেখা যায়। চলতে চলতে ত্রিগুণা সেন। বাংলাদেশের বামপন্থী নেতাদের সম্বন্ধে খোঁজ করছিলেন। বেশির ভাগ নেতা সম্বন্ধেই জবাব দেন মাহবুবুল আলম চাষী। তাঁর আলোচনা থেকে অনুমান করা মোটেও শক্ত ছিল না যে ড. ত্রিগুণা সেনের একটি দায়িত্ব হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যেসব তরুণ পালিয়ে আসছে, তারা যেন বামপন্থী নেতৃত্বের কবলে না পড়ে। সে জন্য তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সবল করার ওপর জোর দেন। কৈলাশহরে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ও ডেপুটি কমিশনার রাজ্যসভার সদস্য ত্রিগুণা সেনকে যে ধরনের অভ্যর্থনা দেন, সে ধরনের অভ্যর্থনা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের কখনো রাজনীতিবিদদের দিতে দেখিনি। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ ধরনের আচরণ দেখতে পাইনি। ভারতে গণতান্ত্রিক চেতনা অত্যন্ত বদ্ধমূল ছিল। তাই সেনা কর্মকর্তারা সব সময়ই রাজনৈতিক নেতাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন।

ড. সেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে। এই ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে বাইরের শরণার্থীদের যোগাযোগ রাখার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। কৈলাশহর থেকে আমরা করিমগঞ্জে যাই। সেখানে শিলচরের ডেপুটি কমিশনার ত্রিগুণা সেনকে স্বাগত জানান। করিমগঞ্জের পর আমরা শিলচর ডাকবাংলোতে যাই। সেখানে রাতটা কাটাই, পরদিন সকালে ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে আমাদের সভা হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে আগরতলা থেকে শিলচর পর্যন্ত ভূখণ্ডে কয়েকটি ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। এই ইয়ুথ ক্যাম্পের টাকাপয়সা বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে দেওয়া হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এগুলোর তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হবে আমাকে। ড. ত্রিগুণা সেন শিলচর থেকে বিমানে দিল্লি চলে যান। তবে তার সঙ্গে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ সরকার আগরতলার জন্য একটি স্বতন্ত্র ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা না করে সারা দেশের জন্য একটি সংগঠন স্থাপন করেন। ওই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাহবুবুল আলম চাষী মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমাকেও মুজিবনগর সরকারের উপসচিবের দায়িত্ব দিয়ে কলকাতা বদলি করা হয়।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ত্রিপুরা রাজ্যের শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য আগরতলা আসেন। এ ছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তিনি সভা করেন। তাঁর আগরতলা সফর ছিল মাত্র এক দিনের। সকালে এসে তিনি শরণার্থীশিবির ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেখা করে রাতে আগরতলা গভর্নরের বাসভবন রাজভবনে আসেন। তার অফিস থেকে খবর দেওয়া হয় যে তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে চান। আগরতলায় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক একসময় ছিলেন কিন্তু মে মাসের শেষ দিকে এঁদের প্রায় সবাই কলকাতা চলে যান। একমাত্র খাঁটি বুদ্ধিজীবী ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। বুদ্ধিজীবীদের ঘাটতি পূরণ করা হলো সরকারি আমলাদের দিয়ে। সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে চারজন সিএসপি অফিসার যোগ দিলেন। এরা হলেন হোসেন তৌফিক ইমাম, কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ, খসরুজ্জামান চৌধুরী এবং আমি। সভা শুরু হওয়ার প্রায় ৪৫ মিনিট আগে আমরা রাজভবনে পৌঁছে যাই। সেখানে আমাদের একটি ছোট কক্ষে বসানো হয়। ওই কক্ষটি ব্যবহার করছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর একজন একান্ত সচিব। একান্ত সচিব উত্তর প্রদেশ থেকে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের একজন সদস্য। তাঁর চাকরিতে ছয় বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে আমাদের অভিজ্ঞতা পাঁচ বছরের। আইএস কর্মকর্তারা পাকিস্তানের সিএসপি কর্মকর্তাদের সমগোত্রীয় বলে গণ্য করত। কাজেই অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমাদের জমে গেল। ওই সময় একজন অর্ডারলি ছয়-সাতটি কালো বাক্স নিয়ে হাজির হয়। একান্ত সচিব জানালেন, এ বাক্সগুলোতে বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ ব্রিফ রয়েছে। আজ রাতে মিসেস গান্ধী এগুলো পড়বেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ঘুমান কখন? একান্ত সচিব বললেন, এই দুর্যোগের সময় তার ঘুম খুবই কম হয়। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে একেবারে বিভোর হয়ে আছেন।

মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ভারতের তথ্য বিভাগের প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী সৎপথীও ছিলেন। খসরুজ্জামান চৌধুরী তার ডায়েরির ভিত্তিতে এই সভার নিম্নরূপ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন :

It is in this context I must mention the visit of Mrs. Indira Gandhi and Nandini Satpathy, Indian Minister of State for Information to Broadcasting to Agartala. In those days the question of recognition of Bangladesh was a very prominent issue. The Indian population had been persistently demanding such recognition from the government. I distinctly remember that when Mrs. Indira Gandhi came, she invited all of us to meet her at one place in Agartala. The meeting was quite brief. Mrs. Indira Gandhi spoke for a few minutes and explained the position of the Indian Government vis-a-vis of the struggle. I distinctly remember myself and Akbar Ali was sitting by her side. Since Mrs. Gandhi wanted to have our reaction in brief, it was Akbar Ali who wanted to know about recognition from Mrs. Gandhi. Akbar Ali’s question was when Indian Government was going to recognise Bangladesh, Mrs. Gandhi had been sitting almost casually and when Akbar Ali put this question, she straightened up bit and gave him a long look. She posed a counter question to Akbar Ali asking him what he would gain by such recognition. Akbar Ali was not to be daunted and explained how such recognition will boost up the morale of the evacuees and other Bengalees apart from giving a stamp of regularity to the provisional government of Bangladesh. Mrs. Gandhi again had a long look at Akbar Ali and this time started addressing him as a young man. She looked into distance and closed her eyes and commented that the world was very harsh and any decision to be taken would have to be made after analysing the pros and cons. I still remember what she said that day. She addressed Akbar Ali and said, ‘Young man, this world is very harsh. You can get away by doing everything if you do not admit that you have done it’. She went of the explain that by according recognition India would simply expose itself. Then she will become exposed to the whole world and here may be forces which will take it as a pretext for going out openly for the atrocities committed by Pakistanis in Bangladesh. Mrs. Gandhi asserted that the stamp of legality given by Indian recognition will not carry much value and India would not be in a position to supply the freedom fighters with arms and ammunitions. She admitted that temporarily the movement will get a boosting up as a result of such recognition but in the long run this may weaken the cause of Bangladesh in spite of helping it. She also elaborated on various legal and technical difficulties which prevented India from according a formal recognition to the government of Bangladesh. Mrs. Gandhi held a view that India could help the freedom fighters better with arms and ammunitions without formal announcing it through recognition wholly, in fact, they had already granted such recognition by allowing the Pakistan Deputy High Commission, which had defected in favour of Bangladesh, to function in a full-fledged manner on the soils of India. She opened her eyes again and finished her statement by saying there is a right time for the right decisions. I can assure you that the recognition will be accorded as soon as the time is ripe for such recognition. Incidentally, this was completely in keeping with the public stand of Mrs. Gandhi to the Indian people whom she always consoled by saying that the Indian government was all out for the Bangladesh cause but recognition could be given only when time was ripe.[২]

বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্বন্ধে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে যে আলোচনা হয়, তা খসরুজ্জামান চৌধুরী বিস্তারিতভাবে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন। তবে দুটি বিষয় তিনি উল্লেখ করেননি। একটি বিষয় হলো মিসেস গান্ধী তাঁর আলোচনার শুরুতেই বাংলাদেশের বামপন্থী নেতারা (মতিন, আলাউদ্দিন ইত্যাদি) মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কী ষড়যন্ত্র করছে, সে সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে বলেন। তিনি বারবার জোর দেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যেন কোনোমতেই বামপন্থীদের হাতে না যায়। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে যাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সংস্রব না ঘটে, সে ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। দ্বিতীয়ত, মিসেস গান্ধী বলেন, ভারতের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যদি শরণার্থীরা দীর্ঘদিন থাকে, তাহলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনগোষ্ঠীতে পরিবর্তন আসবে। এর ফলে ভারতীয় গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে। সুতরাং জোর দিয়ে তিনি বলেন যে শরণার্থীদের সম্মানের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য যা কিছু করতে হয়, তা তিনি করতে বদ্ধপরিকর।

প্রথমে আমরা তিনজন সিএসপি কর্মকর্তা একসঙ্গে বাস করছিলাম। ২৮ মে তারিখে খসরুজ্জামান চৌধুরী মেঘালয় রাজ্য থেকে আগরতলায় এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। এই চারজন কর্মকর্তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে বাস করছিলাম। যদিও আমাদের খাবার দুটি মেসে রান্না হতো। একটি রকিব ও আকবর আলি খানের মেস, আরেকটি হোসেন তৌফিক ইমামের মেস। তবু মেস পরিচালনায় তৌফিক ইমাম সাহেবের স্ত্রী বেগম ইসমাত ইমাম আমাদের সাহায্য করতেন। তাঁর বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। তৌফিক ইমাম সাহেব অফিসের শত কাজকর্ম সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া যাতে ঠিকমতো চলে, তার ওপর জোর দিতেন। তাঁর বড় ছেলে জামিল (তানভীর ইমাম) মোটেও পড়াশোনা করতে চাইত। একদিন তৌফিক ইমাম পড়াশোনা না করার জন্য তার ছেলের কান মলে দেন। ছেলে তখন কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাংলাদেশে পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই। পাশের রুমে তিনজন আঙ্কেল শুয়ে আছে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্র ছিল এবং সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাজ করছিল। এরা এখন ভেরেন্ডা ভাজছে। কাজেই পড়াশোনা করে কোনো লাভ হবে না। তৌফিক ইমাম তবু ছেলেকে পড়াশোনার জন্য চাপ দেন। তৌফিক ইমামের চেষ্টা বিফল হয়নি। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেছে এবং বর্তমানে সে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য।

খসরুজ্জামান চৌধুরী আগরতলায় আসার পর বেশির ভাগ সময়ই উদ্বিগ্ন থাকতেন। এই উদ্বেগের কারণ হলো তার স্ত্রী এবং তার শিশুপুত্র। এদেরকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে মেঘালয়ে চলে যান। এরা প্রায় দুই। সপ্তাহ আমার মা-বাবার সঙ্গে আমার মাতুলালয় কণিকাড়া গ্রামে ছিলেন। কিন্তু খসরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। তারা ঢাকায় চলে যান কিন্তু ঢাকায় যেকোনো সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। খসরুজ্জামান চৌধুরী তার স্ত্রীকে আগরতলায় আসার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি খসরুজ্জামান চৌধুরীর বন্ধু। আনোয়ারুল হক নিলুর সঙ্গে আগরতলা রওনা দেন। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে তিনি ১০ জুন ভারতে প্রবেশ করেন। খসরুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার অবশেষে একত্র হয়।

মিসেস খসরুজ্জামান চৌধুরীর কাছ থেকে আমি আমার মা-বাবার সংবাদ পাই। আমার বাবা তখন খুবই অসুস্থ এবং আমার মা আমার জন্য কান্নাকাটি করেন। এ সময়ে আমার ছোট ভাই জি এম জেড খান, যে ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকে অফিসার হিসেবে কাজ করছিল, তাকে প্রশিক্ষণের জন্য মার্কিন সিটি ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (যা অবস্থিত ছিল ফিলিপাইনে) পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তার জন্য তত দুশ্চিন্তা ছিল না। আমার ছোট ভাই কবিরউদ্দিন খান মা-বাবার সঙ্গে ছিল। যদিও পাকিস্তান বাহিনীর হাতে পড়লে তার অসুবিধা হতে পারত। তবু মা-বাবাকে দেখাশোনার জন্য সে কণিকাড়া গ্রামেই থেকে যায়। একপর্যায়ে রাজাকাররা তাকে খুবই বিরক্ত করা শুরু করলে তখন সে বাধ্য হয়ে আগরতলায় আমার কাছে চলে আসে। কিন্তু তখন আমি আগরতলা ছেড়ে কলকাতা চলে গেছি। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কবির তাই আবার মা-বাবার কাছে চলে যায়। কবিরের সঙ্গে আম্মা খাঁটি গাওয়া ঘি এবং মোরগের রোস্ট পাঠিয়েছিলেন। রকিবউদ্দিন এগুলো রেখে দেন এবং খেয়ে নেন। পরে কলকাতায় দেখা হলে তিনি আমাকে এ খবর দেন।

জুন মাসে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা দেখা যায়, সেখানেই তারা আক্রমণ করে। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীকে নতুন করে সংগঠিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ২৪ জুন ১৯৭১ তারিখে পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। প্রতিটি জোনে অবস্থানরত নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদকে মন্ত্রিপরিষদের নীতি নির্দেশাবলি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারদের অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্ব। দেওয়া হয়। অঞ্চলভিত্তিক কমান্ডাররা আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সভাপতিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারদের অঞ্চলভিত্তিক অবস্থান ছিল নিম্নরূপ—

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম : ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ইপিআর ও অন্যান্য

২. চট্টগ্রাম ও ফেনী : মেজর জিয়াউর রহমান–অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

৩. কুমিল্লা অঞ্চল : মেজর খালেদ মোশাররফ–চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

৪. সিলেট (পূর্ব): মেজর সফিউল্লাহ– দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

৫. সিলেট (উত্তর) : মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত-ইপিআর ও অন্যান্য

৬. কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট : ক্যাপ্টেন নোয়জেস উদ্দিন–ইপিআর ও অন্যান্য

৭. ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর : মেজর নাজমুল হক–ইপিআর ও অন্যান্য

৮. সৈয়দপুর-পার্বতীপুর : ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন–৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

৯. নবাবগঞ্জ-রাজশাহী : ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী–ইপিআর ও অন্যান্য।

১০. কুষ্টিয়া-যশোর : মেজর আবু ওসমান চৌধুরী–ইপিআর ও প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

১১. খুলনা-বরিশাল : মেজর মো. জলিল মিয়া।[৩]

যেহেতু ভারতীয় বাহিনী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি সহায়তা করতে প্রস্তুত ছিল না, সেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড ছিল সীমিত। এই সময়ে গেরিলাযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত বাহিনী সেনাবাহিনীর প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু করে।

ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের মনোবল যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তার জন্য একটি শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশ সরকারের অধীনে। ন্যস্ত করে। কলকাতার বালিগঞ্জে একটি অস্থায়ী রেকর্ডিং স্টুডিও স্থাপন করা হয় এবং রাজশাহী সীমান্তের পলাশীর আম্রকাননে পঞ্চাশ কিলোওয়াট গতিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার থেকে কলকাতায় রেকর্ড করা অনুষ্ঠানসমূহ প্রচার করা হতো।[৪]

১৯৭১ সালের ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে এই বেতার কেন্দ্র চালু হয়। এই বেতারে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সাফল্যের কাহিনি ফলাও করে প্রচার করা হতো। প্রথম দিন থেকেই এম আর আখতার মুকুল ঢাকার কুট্টিদের ভাষায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিদিন দারুণভাবে আক্রমণ করতে শুরু করেন। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা, ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীরা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন চরমপত্র’ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতেন। এই বেতারে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, ডি এল রায়, অতুল প্রসাদ, গোবিন্দ হালদার, সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল লতিফ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, হরলাল রায়, আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারের উদ্দীপনামূলক গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের দ্বারা প্রচারিত হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।

জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকারকে নতুন করে গড়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারে নতুন নতুন সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়। এইচ টি ইমাম জুন মাসের শেষ দিকে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার জন্য কলকাতা যান। সেখানে তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে বদলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তৌফিক ইমাম তাঁর পরিবারকে আগরতলা থেকে কলকাতায় স্থানান্তরের জন্য দুই সপ্তাহের সময় চান। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব হিসেবে আমাকে পদস্থ করতে অনুরোধ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারে পদস্থ হই। সম্ভবত ১০ থেকে ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো এক সময়ে আমি কলকাতাতে উপস্থিত হই। বিমানবন্দরে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন কামাল সিদ্দিকী ও ওয়ালিউল ইসলাম। কলকাতায় তখন নকশাল বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয়। দমদম থেকে পার্ক সার্কাসে যাওয়ার পথে মানিকতলা অঞ্চল দিয়ে যেতে হয়। এই অঞ্চলের রাস্তার পাশে পোড়া দোকানপাট দেখা যায়। তারা আমাকে বলেন দুদিন আগে এ অঞ্চলে নকশালদের সঙ্গে সিআরপির বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামান এবং স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুল খালেক আগরতলা সফরে যান। তাঁরা খসরুজ্জামান চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে নির্বাচন করেন এবং তদনুসারে খসরুজ্জামান চৌধুরীর কলকাতায় বদলির আদেশ হয়। আমি কলকাতায় পৌঁছার দু-এক দিন আগেই খসরুজ্জামান চৌধুরী সপরিবার কলকাতায় পৌঁছান। আগরতলায় শুধু পড়ে রইলেন কাজী রকিব। কাজকর্ম নিয়ে তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন, তবু একা একা থাকতে তার খুব ভালো লাগত না। অফিসের কাজে যখন কলকাতা যেতেন, তখন তাঁর এই মনোভাব টের পাওয়া যেত।

পাদটীকা

১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ২০১২। (ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড), পৃষ্ঠা-২২৮

২. Khashruzzaman Choudhury, The Turbulent 1971 My Diary, 2020 (Dhaka: Agamee Prakashani), P-308-309

৩. এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪ (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা-১২৫ পৃষ্ঠা-১৪৬

৪. এম আর আখতার মুকুল, চরমপত্র, ২০০০ (ঢাকা : অনন্যা), পৃষ্ঠা-২৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *