৫. শৈশব ও কৈশোর : ১৯৪৪-১৯৫৯

পঞ্চম অধ্যায় – শৈশব ও কৈশোর : ১৯৪৪-১৯৫৯

জন্মদিন

সরকারের নথি অনুসারে আমার জন্মদিন ২ আগস্ট, ১৯৪৪ সাল। আমার প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রত্যয়নপত্রে এই জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ আছে। এই হিসাবের ভিত্তিতেই আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিই এবং এর ভিত্তিতে ৫৭ বছর বয়স পূর্তিতে আমি ২০০১ সালে ১ আগস্ট সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করি। কিন্তু আমার বাবা-মা সব সময়ই বলতেন যে এটি আমার জন্মতারিখ মোটেও নয়। মায়ের মতে শ্রাবণ মাসে আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্ম হয়েছিল হাড়কাঁপানো শীতে। কাজেই কোনোমতেই আগস্ট মাসে আমার জন্ম হয়নি। তাহলে আমার জন্মদিন নিয়ে এমন অঘটন কেন ঘটল?

আমার মা বলতেন, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন নবীনগর স্কুলের তৎকালীন প্রধান। শিক্ষক বাবু বিহারীলাল চক্রবর্তী। তখন নাকি ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীর সাড়ে ১৪ বছর বয়স না হলে সে বছর পরীক্ষা দেওয়া যেত না। অর্থাৎ আগস্টের পর কারও জন্ম হলে তাকে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য আরও এক বছর বসে থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষক বিধাতাকে অগ্রাহ্য করে কেরানি বাবুকে হুকুম দিলেন এর জন্মদিন ২ আগস্ট লিখে দাও। তাই। আমার জন্মদিন ২ আগস্ট।

হিন্দুদের একটি সুবিধা আছে। বেশির ভাগ সচ্ছল হিন্দুই তাদের সন্তানদের কুষ্ঠি তৈরি করে। কুষ্ঠিতে সঠিক জন্মদিন লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু মুসলমানদের কোনো কুষ্ঠি নেই। তাই মুসলমানদের জন্মদিন অনেকাংশেই সঠিক হয় না।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বেশির ভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলমান ঘরে জন্মদিন পালন করা হতো না। জন্মদিন নিয়ে তাই কোনো আগ্রহও ছিল না। তবে সম্প্রতি জন্মদিন নিয়ে অনেক ঘটা বেড়েছে। তাই আমার মেয়ে একদিন আমার মাকে পাকড়াও করে আমার সঠিক জন্মতারিখ বলার জন্য। আমার মা অনেক চিন্তা করে বলেন সে সময়ে প্রচণ্ড শীত ছিল, সম্ভবত সেটা ডিসেম্বরের শেষ দিক ছিল এবং খুব সম্ভব তারিখটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। আমার মেয়ে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে আমার জন্মোৎসব পালনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমি কোনোমতেই ২৫ ডিসেম্বরকে আমার জন্মদিন হিসেবে মানতে রাজি নই। ২৫ ডিসেম্বর আরও দুজন মহাপুরুষের জন্মতারিখ। যিশুখ্রিষ্টের জন্মতারিখ ২৫ ডিসেম্বর উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। অথচ পণ্ডিতেরা বলছেন যিশুখ্রিষ্টের জন্ম ২৫ ডিসেম্বর হয়নি। যিশুর জন্মতারিখ নির্ণয়ে একটি বড় সমস্যা হলো যিশুর জন্মের পর প্রথম ৪০০ বছরে তাঁর জন্মদিন উদযাপিত হয়নি, কেননা রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টধর্ম বেআইনি ছিল। পণ্ডিতেরা বলছেন যে যিশুর সম্ভাব্য জন্মতারিখ হচ্ছে ২০ মে, ২১ মার্চ, ১৫ এপ্রিল, ২০ অথবা ২১ এপ্রিল। অর্থাৎ শীতকালে যিশুর জন্ম হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর সূর্যদেবতার জন্মদিন। এই সূর্যদেবতার জন্মদিনকে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে চালু করা হয়েছিল।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাবি করতেন যে তাঁর জন্ম হয়েছে ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তাঁর জীবনীকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট দেখিয়েছেন যে এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। ১৮৮৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জিন্নাহ করাচির মাদ্রাসাতুল ইসলামে ভর্তি হন। এই মাদ্রাসার নিবন্ধনের খাতা থেকে দেখা যায় মাহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাইয়ের জন্মতারিখ হলো ২০ অক্টোবর ১৮৭৫। পরবর্তীকালে জিন্নাহ এ-সম্পর্কিত সব তথ্যই পরিবর্তন করলেন। মাহাম্মদ আলীর স্থলে লিখলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাইকে ছোট করে লিখলেন জিন্নাহ। মাদ্রাসায় জিন্নার জন্মসাল ছিল ১৮৭৫। জিন্নাহ তা প্রায় ১৪ মাস কমিয়ে ১৮৭৬ সালে নিয়ে এলেন। জন্মতারিখ ২০ অক্টোবরের স্থলে ২৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করলেন।

২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিষ্ট বা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মদিন ছিল না। ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিনও নয়। দুর্ভাগ্যবশত আমার জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। আমার পিতাও আমার জন্মতারিখ সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারেননি। তবে আমার বাবা-মা এবং অন্য মুরব্বিরা আমার জন্ম সম্পর্কে দুটি বিষয়ে একমত ছিলেন। প্রথমত, আমার জন্ম হয়েছিল শীতকালে। তখন প্রচণ্ড শীত ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার জন্ম হয়েছিল হজে আকবরির দিন। নবীনগরের কাজী সাহেব আমার জন্মের পর আজান দিয়েছিলেন এবং তিনিই হজে আকবরির স্মরণে আমার নাম আকবর আলি খান রাখার প্রস্তাব দেন।

হজে আকবরি প্রতিবছর পালিত হয় না, যে বছর হজের দিন শুক্রবার হয়, সেই হজ হজে আকবরির হজ হয়। হজে আকবরি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সৌদি রাজপরিবারের অনুষ্ঠান। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে সব হজই হলো হজে আকবরি বা বড় হজ। এছাড়া অনেক মুসলমান কাবা শরিফে ওমরা করেন। ওমরাকে ছোট হজ বলা হয়ে থাকে।

হজে আকবরির সূত্র ধরে আমার জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেসব তথ্য সারণি ৫.১-এ দেখা যাবে।

সারণি ৫.১

জিলহজ মাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ

খ্রিষ্টাব্দ১ জিলহজ ও বারআরাফাতের দিন এবং বারকোরবানির দিন এবং বার
১৯৪৩২৮ নভেম্বর, সোমবার৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার৮ ডিসেম্বর, বুধবার
১৯৪৪১৭ নভেম্বর, শুক্রবার২৫ নভেম্বর, শনিবার২৬ নভেম্বর, রোববার
১৯৪৫৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার১৪ নভেম্বর, বুধবার১৫ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার

উৎস : https://www.al-habib.info/islamic-calendar/global-islamic-calendar year-1943-ce.htm

সারণি ৫.১ থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৩, ১৯৪৪ বা ১৯৪৫ সালে আরাফাতের দিন ছিল মঙ্গলবার, শনিবার ও বুধবার আর কোরবানির দিন ছিল যথাক্রমে বুধবার, রোববার ও বৃহস্পতিবার। দেখা যাচ্ছে ১৯৪৪ সালে ১৩৬৩ হিজরি জিলহজ মাসের প্রথম দিন শুক্রবার ছিল। খ্রিষ্টান পঞ্জিকাতে তারিখটি ছিল ১৭ নভেম্বর। ১৭ নভেম্বর তারিখ আমার জন্মদিন হয়ে থাকলে তা আমার বাবা-মা ও মুরব্বিদের বর্ণনার সঙ্গে একেবারে অভিন্ন। দিনটি ছিল নভেম্বরের শেষ দিকে। ওই সময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শীত পড়ে। হজে আকবরি ছিল রাজপরিবারের অনুষ্ঠান। হজে আকবরিতে সৌদি বাদশাহকে প্রত্যেক হাজিকে উপহার দিতে হতো। সৌদি বাদশাহ ইচ্ছা করলে ১ জিলহজ শুক্রবার হলে হজে আকবরি পালন করতে পারেন। তবে এটি হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে হয় ২ আগস্ট বা ২৫ ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ নভেম্বর আমার জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে মোটামুটিভাবে আমার জন্ম ১৯৪৪ সালের নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর মাসে হয়েছে বলে মনে হয়।

শৈশবের স্মৃতি

অনেকের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর হয়। এদের শিশুকালের স্মৃতি স্পষ্টভাবে মনে থাকে। তবে অনেকে এ ধরনের স্মৃতি মনে রাখতে পারে না। সাত বছর বয়সের আগে আমার কোনো স্পষ্ট স্মৃতি মনে নেই। আমার যখন তিন বছর বয়স, তখন পাকিস্তানের জন্ম হয়। এ ঘটনার কোনো স্মৃতি আমার নেই। আমার বড় বোন মীনা বুজি আমার যখন চার বছর বয়স, তখন মারা যান। তাঁর স্মৃতিও আমার মনে অস্পষ্ট। আমার যখন ছয় থেকে সাড়ে ছয় বছর বয়স, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। আমার মা-বাবা আমাকে ছোটকাল থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করতেন। সেই সময় স্কুলে প্রতিবছরই বছরের শেষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো এবং সেই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় যারা প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করত, তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। আমি যখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি, তখন কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকী ও কাঠবেরালি’ কবিতাটি আবৃত্তি করি। আমার মা আমাকে অনেক কষ্ট করে কবিতাটি মুখস্থ করান। আমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করলাম :

কাঠ্‌বেরালি! কাঠ্‌বেরালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?–
ডাইনী তুমি হোৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটু পাটু চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেরালি! বাঁদরীমুখী! মার্‌বো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদা’কে ডাকবো? দেবে ঢিল!

একটি ছোট ছেলের এত শক্ত কবিতা আবৃত্তি শুনে বিচারকেরা খুবই সন্তুষ্ট হন এবং সারা স্কুলের যেসব আবৃত্তিকার ছিল, তাদের মধ্যে আমাকে প্রথম পুরস্কার দেওয়া হয়। আমি তো মহাখুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। কয় দিন পরে দেখলাম যে এ পুরস্কারের শুধু আনন্দই নেই, এ পুরস্কারের সাজাও আছে। আমাকে দেখলেই আমার ক্লাসের এবং দু-তিন ক্লাসের ওপরের ছাত্ররা কাঠবিড়ালি বলে ডাকত। এ ডাকনাম ঘুচতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে নবীনগর স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে পড়ানো হতো। প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নবীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের অংশ ছিল না। তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছাত্ররা যাতে পড়তে পারে, তার জন্য নবীনগর স্কুলে একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্কুলের দালানের পেছনে একটি বড় টিনের ঘর করা হয়। এই টিনের ঘরে দক্ষিণা বাবু নামে একজন শিক্ষক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রদের পড়াতেন। দক্ষিণা বাবুর চেহারা মনে নেই, তবে স্কুলের ঘরটি অনেক বড় ছিল–এ কথা স্পষ্ট মনে আছে।

সাত বছর থেকে দশ বছর পর্যন্ত নবীনগর স্কুলে আমাকে বাংলা এবং অঙ্ক পড়াতেন গুরুচরণ রায়। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্লাসে তাঁর কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে তিনি ছাত্রদের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করতেন। যেসব ছাত্র তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারত, তাদের খুশি হয়ে বলতেন, ‘তুই এক চান্সে ম্যাট্রিক পাস করবি’ আর যাদেরকে কান ধরতে আদেশ করতেন, তাদেরকে বলতেন, ‘গরু, তুই কোনো দিনই ম্যাট্রিক পাস করতে পারবি না।’

তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এই তিন বছর গুরুচরণ বাবু ছিলেন আমার গৃহশিক্ষক। সন্ধ্যায় তিনি আমাকে পড়াতে আসতেন। আমার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সনাতন সাহার ছেলে ব্রজকিশোর সাহাও পড়ত (ঝড়ের দিনে জন্ম হওয়াতে ওর ডাকনাম ছিল তুফাইন্যা)। আমরা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতাম না। ওর বাবাও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না কিন্তু তুফাইন্যা ভিন্নমত পোষণ করত। শীতকালে যখন তুফাইন্যা আমাদের বাড়িতে পড়তে আসত, তখন তার গায়ে ভালো শীতের কাপড় থাকত না। একদিন খুব ঠান্ডা পড়াতে সে পড়ার সময় শীতে কাঁপছিল। আমি তাকে আমার চাদর এনে পরতে দিই। সে কোনোমতেই সেই চাদর গায়ে দিতে রাজি হয়নি। প্রশ্ন করাতে সে বলে এই চাদরের গায়ে ‘শেইখ্যা শেইখ্যা অর্থাৎ ‘শেখ অথবা মুসলমানের গন্ধ করে। কয়েকবার ফেল করার পর তুফাইন্যা প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে। এরপর সে কলকাতায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে ঠিকাদারির ব্যবসা করে এবং ভারতে বিয়ে করে। সম্প্রতি সে কলকাতায় মারা গেছে।

গুরুচরণ বাবু শুধু কড়া শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত স্নেহশীলও ছিলেন। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে তাঁর বাড়িতে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। সেখানে মিষ্টি, দই, দুধ, চিড়া, খই, মুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হতো। গুরুচরণ বাবুর ছেলেরা ভারত বিভাগের আগেই কলকাতার দিকে বসতি স্থাপন করেন। গুরুচরণ বাবু অবসর গ্রহণের পর তাঁর বড় ছেলের কাছে চলে যান। তার বড় ছেলে কলকাতার নিকটস্থ রিষরাতে একটি পাটকলে ম্যানেজারের কাজ করতেন। সেই ছেলের বাড়িতেই তিনি মারা যান।

১৯৫১ সালে পাকিস্তানে একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের তত্ত্বালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁন আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। সেই সংবাদ লিয়াকত আলী খাঁনের বড় ছবিসহ আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। এই ছবির নিচে লেখা হয় ‘খুদা পাকিস্তানকি হেফাজত করো’। ছবিটি আমার খুবই ভালো লেগেছিল। তাই কাগজের পৃষ্ঠাটি আমার শোবার ঘরে বেড়ার ওপর আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখি। চার-পাঁচ বছর এই ছবিটি অটুট ছিল।

আমাদের বাসস্থান

নবীনগরে যে বাড়িতে আমরা বাস করতাম এবং এখনো করি, সে বাড়িটি ছিল আদিতে নবীনগর আদালতের প্রথম মুসলমান আইনজ্ঞ আবদুস সোবহান ওরফে আব্দু মিয়ার বাসস্থান। তিনি থানার পাশে একটি বিরাট এলাকা কিনে। নেন এবং সেখানে তার বাসস্থান নির্মাণ করেন। তাঁর বাসস্থানের পাশে তার মুহুরিকেও একটি ঘর তৈরি করে দেন। ১৯২০-এর দশকে তিনি অবসর গ্রহণ করলে নবীনগর আদালতে একমাত্র মুসলমান উকিল হিসেবে যোগ দেন আমার বাবার বড় ভাই ফজলে আলী খাঁ। আব্দু মিয়া অবসর গ্রহণ করলে এই বাড়িটি তিনি তাঁর একমাত্র ভাগনে কালঘরা গ্রামের ফজলে আলীকে দান করেন। ফজলে আলী ছিলেন আমাদের ফুফা। ফজলে আলী খাঁ তার ভগ্নিপতি ফজলে আলীর কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নেন। ত্রিশের দশকে ফজলে আলী খ মারা গেলে তার জায়গায় ওকালতি করতে আসেন আমার বাবা আমীর আলী খাঁ। তিনিও ভাড়াতেই ওই বাড়িতে থাকেন। পরবর্তীকালে ফজলে আলী তার বড় মেয়ের জামাই প্রকৌশলী জিন্নত আলীকে বাড়িটি দান করেন। জিন্নত আলীর কাছ থেকে ১৯৬০-এর দশকে আমার মা এবং আমার বড় বোন সালমা খান। জায়গাটি কিনে নেন। সেই সময় থেকে এই জমির মালিক আমাদের পরিবার। অবশ্য যে অংশটুকু আব্দু মিয়া তাঁর মুহুরিকে দিয়েছিলেন, সে অংশটুকুর মালিকানা তিনি তাঁকে লিখে দেন। ওই অংশটুকু তাই এখন স্বতন্ত্র। নবীনগরের বাড়িটির দক্ষিণ দিকে ছিল নবীনগর থানা। এর পূর্ব দিকে ছিল সাবরেজিস্ট্রারের অফিস এবং বাসা। পশ্চিম দিকে ছিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল পরিচালিত দাঁতব্য চিকিৎসালয়। উত্তর দিকে ছিল তহশিল অফিস। বাড়িটির উত্তর-পশ্চিম দিকে নিচু জলাভূমি ছিল এবং সেখানে বাঁশ ও বেতের জঙ্গল ছিল। এই নিচু জলাভূমির পাশে পাকা পায়খানা ছিল। বাড়িটিতে একটি ছোট পুকুর ছিল। পুকুরটি যদিও ছোট ছিল কিন্তু পুকুরটিতে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। পুকুরটির উত্তর পাড়ে একটি বিশাল বকুলগাছ ছিল। এই বকুলগাছ কে এবং কখন বপন করেছিল, তা জানা যায় না। তবে আমরা যখন ছোট, তখন সবাই বলত গাছটি কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরোনো। এই বিশাল গাছটি ছিল এলাকার পাখিদের অভয়ারণ্য। বিশেষ করে শীতকালে অজস্র পাখি এই গাছে এসে আশ্রয় নিত। পাখিদের কলকাকলিতে আমাদের বাড়ি মুখর হয়ে উঠত। এ গাছে প্রচুর বকুল ফুল ফুটত। জঙ্গলের পাশে অবস্থিত থাকায় এবং সেখানে সাপ থাকায় ভয়ে আমরা সাধারণত ফুল কুড়াতে যেতাম না। তবে হিন্দু ছেলেরা প্রায় প্রতিদিনই ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যেত এবং লঞ্চঘাটে গিয়ে বকুল ফুলের মালা বিক্রি করত। নবীনগরে তখন কোনো উঁচু দালানকোঠা ছিল না। তাই আমাদের বাড়ির বকুলগাছটি অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। আমরা যখন লঞ্চে করে নবীনগর আসতাম, তখন লঞ্চঘাট থেকে বকুলগাছটি দেখা যেত। বকুলগাছটির আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে অনেক গুজব ছিল। কেউ কেউ। বকুলগাছের ছাল জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেত। লোকে বিশ্বাস। করত এই বকুলগাছের যে ক্ষতি করবে, সে তার নিজের ক্ষতি করবে। ১৯৫০ এর দশকে কে একবার একটি মরা ডাল কেটে ফেলেছিল, এর ফলে নাকি লোকটি মারা যায়। বকুলগাছটি স্বমহিমায় অনেক দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। আশির দশকে একদিন গাছটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরপরই গাছটি মারা যায়। এখন আর গাছটির চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পুকুরের পূর্ব পাশে ছিল কদমগাছ। বর্ষাকালে প্রচুর কদম ফুল ফুটত এবং অনেক কদম ফুল পুকুরের পানিতে পড়ত। বাড়ির পূর্ব দিকে সাবরেজিস্ট্রারের অফিসের পাশে একটি রজনীগন্ধাগাছ ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে ফুলের সুবাস পাওয়া যেত। সেখানে নাকি সাপও দেখা যেত। বাহিরবাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নিমগাছ। নিমগাছ বাড়ির বায়ু শোধন করত। ছোটবেলায় আমরা এবং আশপাশের লোকজন নিমপাতা খেতাম এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতাম।

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের বাড়িটিতে দুটি অংশ ছিল। একটি অংশে আমরা থাকতাম। সেখানে চারটি ঘর ছিল। একটি বড় ঘর। যেখানে ছোটবেলায় আমরা সবাই থাকতাম। দক্ষিণের ভিটায় একটি ঘর ছিল, যেখানে অতিথিরা থাকতেন। একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আমরাও ওই ঘরে থাকতাম। দক্ষিণের ঘরের দক্ষিণে একটি বড় ঘর ছিল। তাকে আমরা বলতাম বৈঠকখানা। বৈঠকখানায় মক্কেলদের থাকার জন্য দুটি চৌকি ছিল। এ ছাড়া মক্কেলদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য বাবার একটি বড় টেবিল এবং পাঁচ ছয়টি চেয়ার ও টুল ছিল। মুহুরির জন্য একটি আলমারি ছিল। সেখানে মুহুরি তার কাগজপত্র রাখতেন। আরেকটি আলমারি ছিল, যাতে বাবার আইনের বইপত্র রাখা হতো। এ ছাড়া বড় ঘরের পূর্ব পাশে ছিল রান্নাঘর। রান্নাঘরে চুলা ও মিটসেফ ছাড়াও একটি চৌকি ছিল। আমরা ছোটবেলায় চৌকিতে বসে খেতাম। বাড়িতে তখন খাওয়ার জন্য চেয়ার-টেবিল চালু হয়নি। ১৯৬৫ সালে। রসুল্লাবাদে আমাদের পৈতৃক ভিটায় যে ঘর ত্রিশ বছর ধরে শূন্য অবস্থায় পড়ে ছিল, সেই ঘরটিকে এনে নবীনগরে পাকা ভিটার ওপরে নির্মাণ করা হয়। তখন বড় ঘরে টেবিল-চেয়ারে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আমার মা ১৯৭২ সালে একটি ছোট দালান নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালের পর আমাদের পরিবার দালানেই থাকে এবং ঘরগুলো ভাড়া দেওয়া হয়।

আমাদের বাড়ির দ্বিতীয় অংশে পশ্চিম পাশে একটি ছোট বাড়ি ছিল। সমবায় বিভাগ যত দিন পর্যন্ত নিজের জায়গা কিনে সমবায় বিভাগের অধিকর্তার জন্য অফিস এবং বাসা নির্মাণ না করে, তত দিন পর্যন্ত এ বাড়িটিতে সমবায় বিভাগের কর্মকর্তা ভাড়া থাকতেন। এ বাড়িতে তিন-চার বছর বাস করেছেন আবদুল আউয়াল, তিনি সাংসদ আলী আহমদ খানের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তারপর এখানে চার-পাঁচ বছর ছিলেন সমবায় বিভাগের আরেক অধিকর্তা–আফসার উদ্দিন সাহেব। পরবর্তীকালে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে থাকতেন। আফসার উদ্দিন সাহেব চলে যাওয়ার পর সমবায় বিভাগের নিজস্ব জায়গায় অধিকর্তার জন্য বাড়ি তৈরি করা হয়। তাই সমবায় বিভাগের কোনো কর্মকর্তা এখানে আর ভাড়া নেননি। বছর দুয়েক এ বাড়িটি আমার খালা ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর দুই ছেলে ও ছোট মেয়েরা এ বাড়িতে থাকতেন। পরে তারাও কণিকাড়ায় চলে যান এবং সে ভিটার ঘর বিক্রি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বাড়ির এ অংশে তরিতরকারি চাষ করা হতো।

পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি

আমার কৈশোরের স্মৃতি দুই পর্যায়ের। প্রথমত, ওই সময়ে রাজনীতি নিয়ে। আমার কিছু স্মৃতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি কীভাবে বড় হয়ে উঠেছিলাম তার স্মৃতি রয়েছে। প্রথমে রাজনীতির স্মৃতি উল্লেখ করি। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন আমার বয়স সাড়ে আটের মতো। তখন স্কুলের ছাত্রদের মিছিল হয়েছিল, যা ঝাপসাভাবে মনে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নবীনগরে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন আবুল খায়ের রফিকুল হোসেন। তিনি প্রায়ই নবীনগর বাজারে অথবা নারায়ণপুর ঈদগাহে সভা করতেন। সেই সভায় তিনি নুরুল আমিন। সরকারের সব কুকীর্তি বর্ণনা করতেন। একবার তিনি নির্বাচনের প্রচারণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নবীনগর নিয়ে যান। আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ডাকবাংলোতে ইজিচেয়ারে বসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। একবার মাওলানা ভাসানীকেও নবীনগর নিয়ে যাওয়া হয়। আমি স্কুলের মাঠে তার বক্তৃতা শুনেছি।

মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও প্রচারণার চেষ্টা করা হয়েছে। নবীনগরে প্রায়ই আসতেন দেবীদ্বারের এমপি ও নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার সদস্য মফিজউদ্দিন আহমদ। এ ছাড়া একবার সি-প্লেনে করে নবীনগর এসেছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। আমার বাবা তখন নবীনগর মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে নদী থেকে বিরাট একটি নৌকায় করে সংবর্ধনা দিয়ে নবীনগর নিয়ে আসেন। নবীনগরে যখনই কোনো মুসলিম লীগ নেতা আসতেন, তারা আমাদের বাসায়ই খাওয়াদাওয়া করতেন। তারপর তারা স্কুলের মাঠে জনসভা করতেন।

১৯৫৪ সালে নির্বাচনের সময় নবীনগর আসনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। নেজামে ইসলাম পার্টি তখন যুক্তফ্রন্টের একটি অঙ্গ দল ছিল। নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুসলেহ উদ্দিন সাহেব নবীনগর আসনে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন চান। তাকে মনোনয়ন না দেওয়া হলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট তাকে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন আওয়ামী লীগের আবুল খায়ের রফিকুল হোসেন। তিনি তখন মাওলানা ভাসানীর স্বাক্ষর করা লিফলেট বাজারে ছাড়লেন যে এই কথা বলে যে রফিকুল হোসেনই হলেন যুক্তফ্রন্টের আসল প্রার্থী। সম্ভবত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নামেও আরেকটি লিফলেট দেওয়া হয়। ওই সময় একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন আলমনগর গ্রামের আবুল হাসেম নামের একজন প্রধান শিক্ষক। তিনি তলোয়ার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন এবং তার মিছিলে তিনি সব সময় তলোয়ার হাতে আগে আগে হাঁটতেন।

নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে প্রার্থী ছিলেন আমার চাচা অর্থাৎ বাবার চাচাতো ভাই মুসলেহ উদ্দিন খাঁ। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল বিপুল ভোটে রফিকুল হোসেন জয়ী হয়েছেন এবং বাকি সব প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকেরা যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে। কয় দিন পরপর কখনো শেরেবাংলার নেতৃত্বে, কখনো আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে, কখনো আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। আবু হোসেন। সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় নবীনগরের পার্শ্ববর্তী বাঞ্ছারামপুর

নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সদস্য এ কে এম জহিরুল ইসলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পদে নিযুক্ত হন। তখন তিনি একবার নবীনগর এসেছিলেন। আমি তাঁর বক্তৃতা শুনতে যাই। তিনি খুব হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে তার বক্তব্য পেশ করতেন। তাঁর ডাকনাম ছিল লিল মিয়া। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘ভাইসব, আমার বাবা বলতেন খোদার লীলা কী বুঝব আমি আমার লিলার লীলাই বুঝি না। এই লিলাও কয়েক দিন আগে বুঝতে পারে নাই কী হয়েছে। গভর্নরের অফিস থেকে আমাকে রাতের বেলায় ফোন করল যে সকালে গভর্নর হাউসে যেতে হবে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বাড়ির চারদিকে পুলিশ। আমি ভাবলাম না জানি কী মামলা বানিয়ে আমাকে ধরতে এসেছে। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? তিনি স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমরা আপনার খেদমত করতে এসেছি।’ তাঁর কথা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম। আমার এ সম্মান আমি আপনাদের জন্য পেয়েছি। এরপর থেকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদের জন্যই কাজ করছি।’

১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে তদানীন্তন পূর্ব। পাকিস্তানে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে স্পিকার হিসেবে কর্মরত ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদের অধিবেশনকক্ষে বিরোধী দলের সদস্যরা আক্রমণ করেন। এর ফলে। তিনি মারা যান। কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয় পাকিস্তানের রাজনীতি। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।

নবীনগর স্কুলের স্মৃতি

নবীনগর স্কুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ১৯৪৮ সাল থেকে। আমার বয়স তখন সাড়ে তিন বছর। নবীনগর স্কুলে তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল না। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রদের সুবিধার্থে স্কুলের পাকা দালানের উত্তর দিকে একটি বড় টিনের ঘরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস হতো।

নবীনগর স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি ভর্তি হই ১৯৫০ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে। ওই ক্লাসে আমার সহপাঠী ছিলেন আলমনগর গ্রামের মোজাম্মেল হক এবং আবদুল জব্বার, গাছমোরা গ্রামের আবুল কাশেম, নবীপুরা গ্রামের আবদুল রাজ্জাক প্রমুখ। আমার ক্লাসে গৌরাঙ্গ নামে একজন তুখোড় হিন্দু ছাত্র ছিল। তার পিতা দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন। বছর দুই পরে গৌরাঙ্গ নবীনগর স্কুল থেকে পিতার কর্মস্থলে চলে যায়। পরে সে ভারত থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করে উত্তীর্ণ হয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণিতে কোনো বিষয়ে আমি প্রথম হলে, অন্য বিষয়ে গৌরাঙ্গ প্রথম হতো।

অনানুষ্ঠানিকভাবে নবীনগর স্কুলে তখন দুটি শাখা ছিল। প্রথম শাখা ছিল নিম্নমাধ্যমিক এবং দ্বিতীয় শাখা ছিল উচ্চমাধ্যমিক। উভয় শাখায় হিন্দু শিক্ষকদের প্রাধান্য ছিল। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের বাংলা এবং অঙ্ক পড়াতেন গুরুচরণ রায়। নিচের দিকে মুসলমান শিক্ষক ছিলেন করিম স্যার ও কাজী সাহেব। করিম স্যার ছিলেন স্কাউটের শিক্ষক। স্কুলের ছাত্রদের তিনি সপ্তাহে এক দিন ড্রিল করাতেন। কাজী সাহেব ভূগোলে আগ্রহী ছিলেন এবং আমাদের ভূগোল পড়াতেন। স্কুলের হেড মৌলভি আমাদের আরবি পড়াতেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্কুলগুলোতে উর্দু পড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। আমাদের স্কুলে রাজ্জাক স্যার ছিলেন উর্দুর শিক্ষক।

উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজি পড়াতেন নিবারণ বাবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পরীক্ষায় তিনি ইংরেজিতে ডিস্টিংশন পেয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের বিপ্লবী নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবী অতীনভদ্র কুমিল্লা থেকে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। অতীনভদ্র একবার আমাদের ইংরেজির খাতা দেখেছিলেন। খাতা দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের আরেকজন শিক্ষক ছিলেন প্রমথনাথ বর্ধন। তিনি বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। তিনি ছিলেন নাট্যকার। নিজে তিনি নাটক লিখতেন, অভিনয় এবং পরিচালনাও করতেন। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন তিনি দু-তিনবার স্কুলের নাটক পরিচালনা করেছিলেন।

সুরেশ বাবু ছিলেন হেড পণ্ডিত। তিনি সংস্কৃত এবং বাংলা পড়াতেন। বাংলার শিক্ষক ছিলেন সুধীন্দ্র বাবু। সুধীন্দ্র বাবুর পিতা একসময় নবীনগর স্কুলের হেড পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেকে প্রথমে সংস্কৃত টোলে পড়াশোনা করান। তিনি যখন টোলে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পান, তখন তাঁর পিতা চাকরি থেকে অবসর নেন। তার পিতার শূন্য পদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়েই আইএ পাস করেন। আইএ পরীক্ষার কয়েক বছর পর তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বিএ পাস করেন। আমরা যখন তাঁর ছাত্র, তখন তিনি বিএ পড়ছিলেন। আমরা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর তিনি বিএ পাস করেন। এরপর তিনি এমএ পড়েন এবং বহিরাগত প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ পাস করেন। এর কয়েক বছর পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তিনি ভারতে অভিবাসন করেন এবং ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগে স্কুল পরিদর্শনের কাজে যোগ দেন। সুধীন্দ্র বাবু একজন অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। একদিকে বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে ছাত্রদের যা জানা উচিত, তা তিনি খুবই যত্ন নিয়ে পড়াতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। কাজেই সাহিত্যপাঠের আনন্দ তার ক্লাসে আমরা সবাই পেতাম। নবীনগর স্কুলে আমার মতে সুধীন্দ্র বাবুই ছিলেন সবচেয়ে সেরা শিক্ষক। নিচের ক্লাসে বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন ধীরেন্দ্র বাবু নামে আরেকজন শিক্ষক। আমাদের স্কুলজীবনের শেষের দিকে একজন মুসলমান শিক্ষক যোগ দেন। তাঁর নাম ছিল জহিরুল ইসলাম। তিনি ইংরেজি ভাষার একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু স্কুলে পাঁচ-ছয় বছর চাকরি করার পর তার যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং কিছুদিনের মধ্যে মারা যান।

উচ্চ ইংরেজি স্কুলে অঙ্ক এবং বিজ্ঞান পড়াতেন দুজন হিন্দু শিক্ষক। একজনের নাম ছিল নগেন্দ্রনাথ। তিনি বিএসসি পাস করেছিলেন। আরেকজনের নাম ছিল সুরেন্দ্রনাথ। সুরেন্দ্র বাবু বিএ পাস করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ অঙ্ক পড়াতেন। তিনি নবম এবং দশম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক অঙ্ক পড়াতেন এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে অতিরিক্ত অঙ্ক পড়াতেন। অবিনাশ বাবু ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক। আমি তার অতি প্রিয় ছাত্র ছিলাম। নবম এবং দশম শ্রেণিতে সব ইতিহাসের প্রতিটি পরীক্ষায় আমি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন যে, ইতিহাস ভালো করে পড়ো, ইতিহাসে তোমার লেটার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

আমি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়ার সময় নবীনগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী এমএ, বিটি। তিনি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত নবীনগর স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাজ করেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হওয়ার কারণে তিনি বাজিতপুর উপজেলায় কুলিয়ারচর স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চলে যান। তার স্থানে আসেন জনাব কেরামত আলী বিএ, বিটি। তিনি বরিশালের একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল নবীনগর থানার কালঘরায়। তাই তিনি এ পদে আগ্রহের সঙ্গে যোগ দেন। স্কুলে যোগ দেওয়ার। পর কিছুদিন তাকে ছাত্রদের হোস্টেলে থাকতে হয়। সে সময়ে দু-একজন ছাত্রনেতার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। এর ফলে স্কুলে ছাত্র আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের ফলে তাকে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এরপর নবীনগর স্কুলে আসেন প্রধান শিক্ষক হয়ে আবদুল হালিম এমএ, বিটি নামে একজন প্রধান শিক্ষক। তিনিও বেশি দিন টিকতে পারেননি। তাঁকেও নবীনগর স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হয়। স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে সৈয়দ আহমদ নামে একজন শিক্ষক আসেন। তাঁর ডিগ্রি ছিল বিএ, বিটি। তিনি আমেরিকানদের অনুকরণে ইংরেজি বলার চেষ্টা করতেন। এ নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে অনেক দিন দলাদলি চলছিল।

১৯৫৫ সালে আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন রায়পুরা থানার বাঁশগাড়ি গ্রামের আবদুর রহমান খান নামের একজন ছাত্র নবীনগর স্কুলে ভর্তি হয়। পরবর্তী চার বছর প্রথম স্থান নিয়ে আমাদের মধ্যে লড়াই হতো। এক বছর আমরা দুজনই একসঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। আবদুর রহমান খান অঙ্কে খুবই ভালো ছিল। অঙ্কের শিক্ষক সুরেন্দ্র বাবু আশা করেছিলেন যে আবদুর রহমান খান বাধ্যতামূলক অঙ্ক এবং অতিরিক্ত অঙ্ক উভয়টিতেই লেটার মার্ক বা ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পাবে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় সে অবশ্য পাঠ্য অঙ্কে লেটার ঠিকই পেয়েছিল কিন্তু অতিরিক্ত অঙ্কে মাত্র ৪৩ নম্বর পায়। অঙ্ক ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমি সাধারণত বেশি নম্বর পেতাম। অঙ্কে আমার কোনো বিতৃষ্ণা ছিল না, অঙ্কশাস্ত্রে যুক্তির প্রয়োগ আমার খুবই ভালো লাগত। তবে যেহেতু অল্প বয়স ছিল, সেহেতু খুবই ছটফটে ছিলাম এবং অতি সাধারণ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের অঙ্কে ভুল করে বসতাম। আমার মনে আছে যে ক্লাস নাইনে ষান্মাসিক পরীক্ষায় অঙ্কে মাত্র ৪২ নম্বর পেয়েছিলাম। খাতাটি দেখিয়ে অঙ্কের শিক্ষক সুরেন্দ্র বাবু বলেছিলেন, ৪২ নম্বর পেলেও এ খাতাটি সবচেয়ে ভালো হয়েছে। খাতাটি পড়লেই বোঝা যায় যে ছাত্রটি যুক্তি প্রয়োগ করে অঙ্কের সমাধান করেছে। কিন্তু ছোটখাটো যোগ, বিয়োগ ইত্যাদিতে সে এত অমনোযোগী যে তাকে বেশি নম্বর দেওয়া সম্ভব হয়নি।

ভালো বইয়ের সন্ধান

আসলে আমার একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালো লাগত না। আমি নতুন নতুন বিষয় পড়তে চাইতাম। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইতাম। আমি যে সময়ের ছাত্র, সে সময়ে নতুন বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ ছিল সীমিত। আমাদের স্কুলে একটি পাঠাগার ছিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের অনেক বই ছিল। ইংরেজি কিছু কবিতা ও উপন্যাসের বই ছিল, ইতিহাস সম্বন্ধে খোদা বক্স ও আমীর আলীর বই ছিল। স্কুল পাঠাগারে উপন্যাসও ছিল কিন্তু পাঠাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষক আমাদের উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বই পড়তে দিতে চাইতেন না। এর ফলে স্কুলের পাঠাগারে বই থাকা সত্ত্বেও আমরা যথেষ্ট বই পড়তে পারিনি। আমি তাই বইয়ের জন্য আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করি। তখন নবীনগর বাজারে দুটি বইয়ের দোকান ছিল। একটি দোকানে শুধু পাঠ্যপুস্তক বিক্রি হতো, আরেকটি দোকানে পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্যান্য বইও বিক্রি হতো। দ্বিতীয় দোকানটির মালিক ছিলেন আলিয়াবাদ গ্রামের মঙ্গল মিয়া নামের এক ভদ্রলোক। এই দোকানের একজন অংশীদার ছিল আলিয়াবাদ গ্রামেরই লিল মিয়া নামের একজন তরুণ। তিনি আমার চেয়ে বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড়। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। স্কুল যখন বন্ধ থাকত, তখন এই বইয়ের দোকানে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তাম। তখন পর্যন্ত সব ক্লাসের জন্য সরকার প্রকাশিত একই পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত হয়নি। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যপুস্তক পড়লেও অনেক বিষয় সম্বন্ধে ভালো ধারণা হতো।

এ সময় আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাবা ঢাকার নবাবের রিটেইনার হিসেবে বেতন পেতেন। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়াতে রিটেইনারের কাজ চলে যায়। নবীনগর কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সম্পাদক হিসেবে মাসিক সম্মানী পেতেন। মুসলিম লীগ দলের হওয়াতে ১৯৫৪ সালের পর তাকে আর সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়নি। এর ফলে এই সূত্র থেকেও আয় বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তিনি আদালতে মামলা পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করতেন। এই সময় সারা দেশে যথেষ্ট মুন্সেফ ছিল না। এর ফলে বেশির ভাগ সময়ই নবীনগর আদালতে কোনো মুন্সেফ থাকত না। তাই বাবার আয় অনেক কমে যায়। তবু বাবা আমাদের শিক্ষার জন্য কার্পণ্য করেননি। তিনি আজাদ পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। আজাদ পত্রিকা ঢাকায় প্রকাশের পরদিন সন্ধ্যার সময় নবীনগরে পৌঁছাত। সন্ধ্যার সময় পোস্ট অফিসে গেলে সেখান থেকে আজাদ পত্রিকা এনে ঢাকার এক দিন পর আমরা সেটা পড়তে পারতাম। যদি সন্ধ্যায় পোস্ট অফিস থেকে পত্রিকা সংগ্রহ না করা হতো, তাহলে তার পরের দিন অর্থাৎ ঢাকায় প্রকাশের দুদিন পর দৈনিক পত্রিকা পড়তে হতো। তাই প্রায়ই আমি সন্ধ্যার সময় পত্রিকার জন্য পোস্ট অফিসে যেতাম। আমার পিতা লাহোর থেকে প্রকাশিত ইসলামিক লিটারেচার নামে একটি সাময়িকীর গ্রাহক ছিলেন। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার উৎসাহে আমরা মাসিক মোহাম্মদীর গ্রাহক হই। দুই বছর নিয়মিত মাসিক মোহাম্মদী পড়েছি।

নবীনগর স্কুলে তখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার জন্য ছাত্রদের মোটেও উৎসাহ দেওয়া হতো না। তবু যখন আমি ক্লাস নাইনে উঠি, তখন কিছু অতিরিক্ত বই সংগ্রহের প্রয়োজনবোধ করি। আমার মাকে এ কথা জানালে তিনি বই কেনার জন্য আমাকে ১০ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু নতুন বই কিনলে চলবে না, পুরোনো বই কিনতে হবে।

তখন আমাদের অঞ্চলে পুরোনো বইয়ের একমাত্র বাজার ছিল শ্রীঘর হাটে। শ্রীঘর হাট নবীনগর থেকে প্রায় ৯ মাইল দূরে অবস্থিত এবং পায়ে হাঁটা ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো উপায় ছিল না। একই দিনে সেখানে হেঁটে যাওয়া এবং আসা আমার মতো কিশোরের পক্ষে তখন বেশ শক্ত ছিল। মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শ্রীঘরের চার মাইল দূরে অবস্থিত শাহবাজপুর গ্রামে আমার ফুফুর বাড়িতে যাই। আমার সঙ্গে ছিল বাসার চাকর কাসেম। পরদিন সকালে ভালো করে নাশতা খেয়ে আমরা শ্রীঘর বাজারে যাই। মহিষ, গরু, ছাগল, হাঁস-মোরগের জন্য শ্রীঘর বাজার ছিল বিখ্যাত। যারাই এ ধরনের গৃহপালিত পশুপাখি কিনতে চাইত, তারাই শ্রীঘর বাজারে যেত। আরেকটি অংশে বই পাওয়া যেত। বইয়ের বাজার ছিল বিরাট। এই বইয়ের বাজার ঘুরে আমি পাঁচ-ছয়টি বই কিনেছিলাম। একটি বই ইতিহাসসংক্রান্ত, আরেকটি বই ভূগোলসংক্রান্ত। বাংলা রচনার এবং ইংরেজি রচনার দুটি বই ও ইংরেজি অনুবাদের একটি বই কিনি। রাতে ফিরে ফুফুর বাড়িতে থেকে পরদিন নবীনগরে ফিরে আসি।

ওই সময় আমার মা আমাকে বোঝান, আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে গেছে। তাই বৃত্তি না পেলে ওপরের ক্লাসে পড়া শক্ত হবে। বৃত্তি পেতে হলে কত ভালো করতে হবে এবং কত নম্বর পেতে হবে, সে সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবে বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস এবং ভূগোলে আমার গভীর আগ্রহ ছিল। আমি আশা করতাম এ তিনটি বিষয়ে আমি খুব ভালো নম্বর পাব। এ বিষয়গুলো সম্বন্ধে যখন যেখানে কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যেত, আমি সেগুলো সংগ্রহ করে নোট লিখতাম। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন একদিন নবীনগরের বড় বাজারে সাহাদের দোকানে কিছু একটা কিনতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি তিন বছর আগে ইতিহাসের ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতা দিয়ে ঠোঙা বানানো হচ্ছে। আমি খাতাগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। দোকানদার বললেন যে এখানে দাঁড়িয়ে খাতা দেখলে তার বেচাকেনার অসুবিধা হবে। আমি তখন বেশি নম্বর পেয়েছে, তিন বছর আগের ইতিহাসের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীদের এ রকম প্রায় এক সের খাতা কিনে নিয়ে চলে আসি। এ খাতাগুলো পড়ে অনেক সুন্দর কোটেশন দেখতে পাই। আমি আমার ইতিহাসের নোটে এই কোটেশনগুলো ব্যবহার করি।

নবীনগর স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে আমার মা যত চিন্তিত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন আমরা শহরে গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারব কি না, তাই নিয়ে। এ ব্যাপারে আমার মা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সে জন্য প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আমার মা আমাকে এবং আমার ছোট ভাই। জিয়াউদ্দিন খানকে বাসার চাকর কাসেমের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বেড়াতে পাঠাতেন। কোনো বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আমরা উঠতাম আমার ছোট খালার বাড়ি, আবার কোনো বছর উঠতাম আমার ফুফাতো ভাই সমবায় বিভাগে কর্মরত সৈয়দ মোজাফফর আলীর বাসায়। প্রতিবারই আমরা রাতে সিনেমা দেখতে যেতাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনেমা হলেই আমি প্রথম সুচিত্রা উত্তমের সাগরিকা, সবার ওপরে ইত্যাদি ছবি দেখি। ছবি দেখা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা কৃষিশিল্প প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। এভাবে আমার মা আমাদের শহরবাসের জন্য প্রস্তুত করেন।

১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের বন্যা

১৯৫৪ সালে ৮ থেকে ১২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন চৈত্র মাসে। অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরেরই শ্রাবণ মাস থেকে দেশে বন্যা শুরু হয়। নবীনগর থানার মতো জলাভূমিতে বন্যা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই বেশ পানি হতো। প্রায় প্রতিবছরই তিতাস নদের পাশ দিয়ে নবীনগরের সঙ্গে দক্ষিণের গ্রামগুলোতে যাওয়ার যে সড়ক ছিল, সেটা প্রায়ই বন্যায় ভেসে যেত এবং মাস দুয়েক পথচারীদের পানির মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে হতো। এই রাস্তা। থেকে ডান দিকে কয়েক গজ দূরেই ছিল আমাদের স্কুলের গেট। তাই প্রায়। বর্ষাতেই আমাদের পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো।

শরৎকালে পূজার ছুটি হতো। পূজার ছুটিতে বাবার আদালত বন্ধ থাকত, আবার স্কুলও প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকত। তাই ওই সময়টা ছিল আমাদের বেড়ানোর সময়। প্রতিবছর পূজার ছুটিতে আমরা তিন ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমার চার ফুফু ছিলেন। তাদের মধ্যে বড় জন আমাদের জন্মের আগেই মারা যান। আমরা প্রায় এক সপ্তাহের জন্য নৌকা ভাড়া করে। বের হতাম।

প্রথমে আমরা কালঘরা গ্রামে মেজ ফুফুর বাড়ি যেতাম। সেখানে পূজার। ছুটিতে বেশির ভাগ সময়ই আমার ফুফাতো বোনদের ছেলেমেয়েরাও নানার বাড়ি বেড়াতে আসত। এদের মধ্যে থাকত মাহতাব উদ্দিন আহমদ (যিনি পরবর্তী জীবনে বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছিলেন), মেজবাহ উদ্দিন (যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন) এবং ফরহাত উল্লাহ পেরু (যিনি আইএফআইসি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন)। এদের সঙ্গে আমরা খেলাধুলা করতাম। আমাদের ফুফা ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয়। তিনি ভাগচাষিদের দিয়ে জমি চাষ করাতেন। বছরের ছয় মাস গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, বাকি ছয় মাস মেয়েদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। যেদিনই আমরা কালঘরা যেতাম, সেদিনই মানিকনগর বাজারে মাছ কেনার জন্য লোক পাঠানো হতো। মানিকনগর বাজার ছিল মেঘনা নদীর পাড়ে। সে বাজারে তখন বিরাট রুই, কাতলা, আইড়, চিতল ইত্যাদি মাছ পাওয়া যেত। বড় মাছ আনা হতো এবং বহু ধরনের পদ রান্না করা হতো, যাতে এক দিনেই এ মাছ শেষ হয়ে যায়, কেননা মাছ সংরক্ষণের তখন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফুফুর বাড়ি ছিল জলাভূমির মধ্যে। এই বাড়ির চার দিকেই ছিল পানি। প্রায় প্রতিদিনই আমার একমাত্র ফুফাতো ভাই খুশু ভাই বিকেলবেলায় মাছ ধরতে ছিপ ফেলতেন। প্রতিদিনই তিনি প্রচুর পরিমাণ ট্যাংরা, বাইলা এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ ধরতেন। সেসব মাছও আমরা খেতাম। কালঘরাতে দু-তিন দিন থাকতাম। ওই সময়ে কালঘরা থেকে আমরা রসুল্লাবাদ যেতাম এবং সেখানকার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। উপরন্তু বাবা তার পিতৃপুরুষদের কবর জিয়ারত করতেন। তবে রসুল্লাবাদের পৈতৃক বাড়িতে আমরা কখনো থাকতাম না।

কালঘরা থেকে আমরা যেতাম রতনপুর গ্রামে সেজ ফুফুর বাড়িতে। সেখানেও রামচন্দ্রপুর বাজার থেকে মেঘনার মাছ আসত এবং প্রচুর খাওয়াদাওয়া হতো।

সবশেষে আমরা আসতাম ছোট ফুফুর বাড়ি শাহবাজপুর গ্রামে। ফুফা পুলিশের চাকরি করতেন। তাই তাঁর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হতো টেবিল চেয়ারে। শুধু মাছই খাওয়া হতো না, সঙ্গে মোরগ এবং খাসিও খাওয়ানো হতো। ছোট ফুফুর বাড়ি বেড়ানো শেষ হলে আমরা নবীনগর ফিরে যেতাম।

প্রত্যেক ফুফুর বাড়িতেই বাবা গেলে বোনেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত, আবার আসার সময়ও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত। এই কাদার বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে বলে তখন মনে হতো না। এখন মনে হয় যে এই কাদাতে বিশেষ স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। আমার বাবারা ছিলেন তিন ভাই। আমাদের জন্মের আগেই আমাদের বড় চাচা এবং ছোট চাচা মারা যান। তিন ভাইয়ের মধ্যে তখন শুধু এক ভাই জীবিত ছিলেন। কাজেই বাবাকে দেখলে ফুফুরা বাকি দুই ভাইয়ের কথা স্মরণ করে কাঁদতেন।

বর্ষাকাল ছাড়া আমরা ফুফুদের বাড়িতে সাধারণত যেতাম না। কারণ, বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় পায়ে হেঁটে যেতে হতো। তা-ও কোনো সড়ক ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির আইল ধরে যেতে হতো। বার দুয়েক পায়ে হেঁটে কালঘরা যেতে হয়েছিল অসুস্থ দাদিকে দেখার জন্য। একবার আম্মা গিয়েছিলেন সঙ্গে। তিনি পালকিতে করে গিয়েছিলেন, আর আমরা পায়ে হেঁটে। পরেরবার আম্মা যাননি, আমি বাবা এবং আমার ছোট ভাই জসিম গিয়েছিলাম। দুইবারই যাওয়ার কারণ ছিল দাদির অসুস্থতা। দাদি তখন মেজ ফুফুর সঙ্গে থাকতেন।

দ্বিতীয়বার যখন আমরা কালঘরা থেকে নবীনগর ফিরে আসি, তখন একটি ঘটনা ঘটে। আমরা কালঘরা থেকে রওনা হয়ে শ্রীরামপুর গ্রাম পার হয়ে গোপালপুর গ্রামের দিকে আসি। গোপালপুর গ্রামের প্রবেশপথে তখন একটি বিরাট বটগাছ ছিল। এই বটগাছের নিচে যখন আসি, তখন বাবা জ্বর অনুভব করেন। আমরা তাই বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিই। তখন গোপালপুর গ্রামের নবীনগর স্কুলের ছাত্ররা স্কুলে যাচ্ছিল। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকল। আমি ভাবছিলাম যে বাবার জ্বর হয়তো বেশি নয়, তাই আমি তাদের সঙ্গে স্কুলের দিকে চলে যাই। এদিকে জসিম তখন বাবাকে নিয়ে একলা। বাবার জ্বর বেড়ে যাওয়াতে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাবাকে রেখে সে লোক ডাকতে যেতে পারছিল না। তার ভয় হচ্ছিল অসুস্থ বাবাকে শিয়াল আক্রমণ করতে পারে। তাই অনেক কষ্টে বাবাকে নিয়ে নবীনগর ফিরে আসে। আমি বাসায় আসার পর সে বাবাকে ফেলে স্কুলে যাওয়ার জন্য আমার সমালোচনা করে। এটি অবশ্য সে বাহবা নেওয়ার জন্য করেনি। জসিমের প্রকৃতিই ছিল এই রকম। কেউ বিপদে পড়লে তাকে রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। আমার মনে আছে একবার একটি ছেলে আমাকে গাল দিয়েছিল। আমি ছেলেটির সঙ্গে ঝগড়া না করে চলে আসি। জসিম যখন এ খবর শোনে, তখন সে আমাকে বলে যে তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি তাকে পিটিয়ে দিতাম। সে ছিল ডানপিটে এবং বহির্মুখী। আমি ছিলাম শান্ত ও অন্তর্মুখী।

১৯৫৪ সালে যে বন্যা আসে, সেটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। প্রথমত, এমন প্রবল বন্যা গত ১০০ বছরে হয়নি। পানিতে শুধু রাস্তাঘাট ডোবেনি, ঘরবাড়িও তলিয়ে যায়। আমাদের প্রতিটি ঘরে পানি ওঠে। এর আগে বর্ষাকালে বড়জোর উঠানে পানি উঠত, কিন্তু ঘরের মধ্যে পানি উঠত না। বন্যার সময়ে আমরা চৌকির ওপরে ঘুমাতাম, কিন্তু চৌকির নিচে বন্যার পানি প্রবাহিত হতো। একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হয়। রান্নাবান্নাও সব চৌকিতে বসে করতে হতো। বন্যা প্রায় আড়াই মাস ধরে ছিল। আমরা ভাবলাম যে উঠানের পানিতে আমরা সাঁতার কাটা শিখব। কিন্তু কয়েক দিন সাঁতার শেখার চেষ্টা করার পরই আমার ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া হয়। কুইনাইন ইনজেকশন নিতে হয় এবং অনেক দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। এর ফলে ১৯৫৪ সালের বন্যায় সাঁতার শেখা হয়নি। ১৯৫৫ সালে আবার বন্যার পুনরাবৃত্তি দেখা দেয়। আমি ভাবলাম এ বছর সাঁতার শিখব। কিন্তু কয়েক দিন চেষ্টা করতে না করতেই আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। তাই আর সাঁতার শেখা হয়নি। এরপর ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের ভয়ে আমি আর সাঁতার শেখার চেষ্টা করিনি। তাই আমি এখনো সাঁতার কাটতে পারি না।

পরপর দুই বছর বন্যা হওয়াতে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১৯৫৫ সালে খাদ্যাভাব বিশেষভাবে প্রকট হয়। এই সমস্যায় শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এ সমস্যা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও আক্রান্ত করে। আমার মনে আছে, ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে আমাদের চালের মজুত শেষ হয়ে যায়। চাল কেনার জন্য গ্রামে টাকা পাঠানো হয়েছিল কিন্তু চাল তখনো আসেনি। আমাদের বাড়িতে তখন খুদ ছাড়া কোনো চাল ছিল না। দুই দিন আমরা খুদ খেয়ে ছিলাম। আমার বাবা-মা চালের অভাবে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে গ্রাম থেকে চাল আসায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই সময়টাতেই দারিদ্র্যের সমস্যা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছি।

পাঠ্যক্রমবহির্ভূত প্রশিক্ষণ

আমাদের স্কুলে একটি বিরাট খেলার মাঠ ছিল। সেখানে নিয়মিত ফুটবল খেলা হতো। আমি স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলিনি। তবে ছোট মাঠে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। বাসায় শীতকালে ভাইবোনেরা মিলে ব্যাটমিন্টন খেলতাম। কিন্তু খেলায় আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।

লেখাপড়া ছাড়া আমি বিতর্কে অংশ নিতাম এবং আবৃত্তি করতাম। যত দূর মনে পড়ে সুধীন্দ্র বাবু এবং জহিরুল ইসলাম–এই দুজন শিক্ষকের প্রচেষ্টায় নবীনগর স্কুলে বিতর্ক সভা গড়ে ওঠে। এই বিতর্ক সভায় আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতাম। আমার ক্লাসের আবদুর রহমান খান, মোজাম্মেল হকসহ আরও কয়েকজন এবং আমাদের এক বছরের সিনিয়র শরিফুল ইসলাম (যিনি বাংলাদেশ কলেজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন) বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সেসব বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল সুয়েজের যুদ্ধ নিয়ে। আরেকটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা হয়েছিল বিজ্ঞান কি আমাদের জীবনে আশীর্বাদ, না অভিশাপ? বিজ্ঞানের বিপক্ষে বলতে গিয়ে আমি যাযাবরের দৃষ্টিপাত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলি, ‘বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এই উদ্ধৃতি শুনে সারা বিতর্ক সভা হাততালি দিয়ে আমাকে উৎসাহ জোগায়। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমি চ্যাম্পিয়ন হতাম।

বিতর্ক ছাড়াও আমি নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করতাম। প্রথমে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতাম কিন্তু ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করার সাহস হতো না। আমি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, তখন স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমাকে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতে স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আদেশ দেওয়া হয়। এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রধান অতিথি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও শোয়েব সুলতান খান। তিনি বাংলা জানতেন না। তাই ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিরও ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় আমাকে সাহায্য করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় চান মিয়া (ভালো নাম মনে করতে পারছি না) নামের স্কুলের একজন ইংরেজি শিক্ষককে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির এবং ছাত্রদের বেত মারতে দ্বিধা করতেন না। তিনি আমাকে আবৃত্তির জন্য বেছে দেন Thomas Gray-এর লেখা Elegy Written in a Country Churchyard’ শীর্ষক কবিতাটি। কবিতাটি অনেক বড় ছিল, তাই পুরো কবিতাটি আমার পড়তে হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে কবিতাটির নিম্নলিখিত চরণগুলো আমি আবৃত্তি করেছিলাম :

The curfew tolls the knell of parting day,
The lowing herd wind slowly o’er the lea,
The ploughman homeward plods his weary way,
And leaves the world to darkness and to me.

Now fades the glimmering landscape on the sight,
And all the air a solemn stillness holds,
Save where the beetle wheels his droning flight,
And drowsy tinklings lull the distant folds:

Save that from yonder ivy-mantled tow’r
The moping owl does to the moon complain
Of such as, wand’ring near her secret bow’rs,
Molest her ancient solitary reign.

Some village Hampden, that, with dauntless breast,
The little tyrant of his fields withstood,
Some mute inglorious Milton here may rest,
Some Cromwell guiltless of his country’s blood.

Th’applause of list ning senates to command,
The threats of pain and ruin to despise,
To scatter plenty o’er a smiling land,
And read their history in a nation’s eyes,

Their lot forbade: nor circumscrib’d alone
Their growing virtues, but their crimes confined;
Forbade to wade thro’ slaughter to a throne,
And shut the gates of mercy on mankind,

The struggling pangs of conscious truth to hide,
To quench the blushes of ingenuous shame,
Or heap the shrine of luxury and pride
With incense kindled at the Muse’s flame.

The boasts of heraldry, the pomp of power
All that beauty, and all that wealth ever gave
Away a like the inevitable hour
The paths of glory lead but to graves.

কবিতা আবৃত্তি এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছাড়াও স্কুলে অনেক সময় রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর পাকিস্তান একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নবীনগরে একটি রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই রচনা প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে, তাকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই সোনার মেডেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তখনকার নবীনগরের মুন্সেফ সাহেব। রচনা প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলীর সভাপতিও ছিলেন তিনি। আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমি প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। বিচারকদের বিবেচনায় আমার রচনা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। আমাকে একটি মেডেল দেওয়া হয়। এটি পুরোপুরি সোনার ছিল না, তামার ওপরে হালকা সোনার আস্তরণ ছিল।

ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ১৯৫৭ ৫৮ সালে ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফ নামে একটি ডানপন্থী ছাত্রসংগঠন গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সভাপতি হন আতিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (তিনি পরবর্তীকালে হাবিব ব্যাংকে কাজ করতেন এবং উত্তরা ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। তবে অসুস্থতার জন্য তিনি অবসরের নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন)। আতিকুল ইসলাম ভূইয়া নবীনগরে আসেন এবং আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে তাদের সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে ওই সম্মেলনে যোগ দিই। এতে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। আমার বক্তৃতা শুনে এনএসএফের সভাপতি ইব্রাহিম তাহা এবং সম্পাদক এ আর ইউসুফ খুবই সন্তুষ্ট হন এবং আমাকে কয়েকটি বিশেষ পুরস্কার প্রদান করেন।

প্রবেশিকা পরীক্ষা

১৯৫৮ সালে আমি ক্লাস টেনে উঠি। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে একটিমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ছিল। ওই বোর্ডে প্রতিবছর চার শ থেকে পাঁচ শ ছাত্র প্রথম শ্রেণিতে পাস করত। প্রথম শ্রেণির ছাত্রদের মধ্যে খুব বেশি হলে পনেরো বিশজন স্টার মার্ক বা শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পেত। নবীনগর স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার থাকার মতো দুটি বাড়ি ছিল। একটি বাড়ি পইরতলায়। সেটি ছিল আমার ছোট খালার বাড়ি। তবে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো পইরতলা থেকে দুই-তিন মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। উপরন্তু আমার অনেক খালাতো ভাই-বোন ছিল। সুতরাং সেখানে পড়াশোনার অসুবিধা হতে পারে, তাই সিদ্ধান্ত হলো খালার বাসায় থাকব না। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সমবায় বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত নিবন্ধক আফসার সাহেব থাকতেন। তিনি নবীনগরের সমবায় বিভাগের যখন নিবন্ধক ছিলেন, তখন প্রায় বছর চারেক আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁর ছেলে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের আর কোনো সন্তান ছিল না। সুতরাং বাড়িটি ছিল নির্পাট এবং ওই বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গার্লস স্কুল, যেটা আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল, সেটি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। তাই আমার মা সিদ্ধান্ত নেন যে ওই বাড়ি থেকেই আমি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেব। যেহেতু ছোটবেলায় তারা আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন, সেহেতু যত্নের কোনো ত্রুটি তারা রাখেননি। শুধু একটি সমস্যা হয়েছিল। আমার যেদিন অঙ্ক ও আরবি পরীক্ষা (তখন সকালে অঙ্ক পরীক্ষা হতো আর বিকেলে আরবি পরীক্ষা হতো) তার দুই দিন আগে গৃহকত্রী এক দুঃস্বপ্ন দেখেন। সেই দুঃস্বপ্নের প্রতিকারের জন্য একজন ওঝা জোগাড় করা হয়। ওঝা রাত ১১টার সময় ওই বাড়িতে এসে ভূতকে ডেকে পাঠান এবং সবাইকে অভিশাপমুক্ত করেন। ভূত তাড়াতে প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল। পরের দিন আমার যে দুই পরীক্ষা হয়, সেই পরীক্ষার ফল খুব একটা সন্তোষজনক হয়নি। আরবি ব্যাকরণে একটি প্রশ্নের ভুল উত্তর দিই। অঙ্কে আমার হিসাবে কমপক্ষে ৮৫ নম্বর পাব বলে মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি অঙ্কে লেটার (৮০ শতাংশ) নম্বর পাইনি। পেয়েছিলাম ৭৭ শতাংশ নম্বর। আরবিতে পেয়েছিলাম ৬৮ শতাংশ নম্বর।

আমার সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা হয়েছিল ভূগোলে। এ বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল গভীর। তিন-চারটি বই থেকে নোট করে আমি ভূগোল পড়তাম এবং প্রশ্নের উত্তরে আমি অনেক রেখাচিত্র ও মানচিত্র দিই। আমার মনে আছে আমি বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত খাতা নিয়ে উত্তর লিখেছিলাম। সে সময় পরীক্ষাকেন্দ্রের একজন পর্যবেক্ষক প্রায় পুরো সময় আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যখন আমি খাতা দিয়ে আসি, তখন পর্যবেক্ষক আমাকে জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক। তিনি আমার উত্তরগুলো দেখেছেন এবং তিনি নিশ্চিত যে আমি ভূগোলে লেটার পাব। পরীক্ষার যখন ফল বেরোল, তখন দেখা গেল যে ভূগোলই একমাত্র বিষয় যেখানে আমি প্রথম শ্রেণির নম্বরও পাইনি। মাত্র ৫৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছি। এর ফলে আমি আইএতে ভূগোল নিইনি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমি ৬৮.৮ শতাংশ নম্বর পাই। স্টার নম্বর পাওয়ার জন্য আরও ৫২ নম্বর ঘাটতি ছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল আমার জন্য তাই মোটেও সন্তোষজনক ছিল না।

১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়ে গেল। ফলাফল বেরোতে তখনো তিন মাস বাকি। লেখাপড়ার চাপ নেই, একেবারেই নিরঙ্কুশ ছুটি। এ সময়ে আমি একটি কবিতা লিখি, একটি নাটক রচনা করি এবং ইতিহাস সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখি। কবিতাটি ইত্তেফাঁক পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। এটি মুদ্রিত হয়নি। এই কবিতার পর আমি আর কোনো কবিতা লিখিনি। ধরে নিই কবিতা লেখার প্রতিভা আমার নেই। পল্লি উন্নয়ন নিয়ে একটি নাটক লিখি। প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার নাটক। নাটকটি লেখার পর লেখাটি পর্যালোচনা করি। আমার কাছে মনে হলো যে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হলে দর্শকেরা মোটেও তা গ্রহণ করবেন না। তাই নাটকের খাতাটি ছিঁড়ে ফেলে দিই। আরেকটি প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধের নাম ‘একেই কি বলে ইতিহাস? সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে যেসব ভিত্তিহীন গুজব ছিল, সেগুলো নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা করি। এই প্রবন্ধ লেখার জন্য ইসলামিক লিটারেচার নামে একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত তিন-চারটি প্রবন্ধ থেকে তথ্য ব্যবহার করি। প্রবন্ধটি মাসিক মোহাম্মদীতে পাঠানো হয়। মাস ছয়েক পরে আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র, তখন প্রবন্ধটি ছাপা হয়। এই প্রবন্ধ ছাপার পর আমি দীর্ঘদিন কিছুই লিখিনি। তবে পরবর্তীকালে আমি যা লিখেছি, সবই প্রবন্ধ। প্রবন্ধের বাইরে আর কিছু লেখার চেষ্টা করিনি।

প্রবেশিকা পরীক্ষা পাসের পর আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিই। তবে প্রবেশিকা পর্যায়ে যে দুটি বিজ্ঞানসংক্রান্ত বিষয় পড়েছি (অঙ্ক ও ঐচ্ছিক বিজ্ঞান) দুটোতেই প্রথম শ্রেণিতে ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। তবে বিজ্ঞানের গবেষণার পদ্ধতির ওপর আমার আস্থা স্কুলে থাকতেই গড়ে ওঠে। এই আস্থা গড়ে ওঠে আমার পিতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। আমার পিতা মনে করতেন যে আধুনিক বিজ্ঞান সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং ধর্মের অনুশাসন বিজ্ঞানের আলোকে প্রয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে ধর্মের ব্যাখ্যা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। বাইরে থেকে কোনো ব্যাখ্যা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। মুশকিল হলো নবম শ্রেণিতে কিছু সহপাঠী ছিল, যারা বিজ্ঞানবিরোধী ছিল তারা দাবি করে যে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে সূর্য পৃথিবীর চার পাশে ঘোরে অথচ ভূগোল বইয়ে পড়ানো হচ্ছে যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। ইসলামবিরোধী ভূগোল পাঠ বন্ধ করা উচিত। আমি প্রতিবাদ করায় তারা আমাকেও ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দেয়। এই পর্যায়ে স্কুলের শিক্ষকেরা আমাকে এ ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক না করতে পরামর্শ দেন। তাঁরাও অভিমত প্রকাশ করেন যে ধর্মের ব্যাখ্যা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। সারা জীবন ধরে যারা ধর্মের বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত, তাদের যেমন আমি শ্রদ্ধা করি এবং যারা আমার সঙ্গে একমত নয়, তাদের মতের প্রতিও আমি সমভাবে শ্রদ্ধাশীল।

পাদটীকা

১. McGowan, Andrew, How December 25 became Christmas, 2009, www.Plaintruthmagazine. Blogspot. Com/2009/12

২. Wolpert, Stanley. Jinnah of Pakistan 1994. New York: Oxford University Press

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *