দ্বিতীয় অধ্যায়
পিতৃপুরুষের শিকড়ের সন্ধান
আমার পিতৃপুরুষের আদি বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রসুল্লাবাদ গ্রামে অবস্থিত। এই বংশের উৎপত্তি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লির একটি ঘটনা মনে পড়ে। ১৭৩৯ সালে দিল্লিতে ঘটনাটি ঘটে। ওই বছর পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ কর্নালের যুদ্ধে মোগল সম্রাটকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করেন। দিল্লিতে কিছু দুষ্ট লোক নাদির শাহ গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন গুজব রটিয়ে পারস্যের কিছু সৈন্যকে আক্রমণ করে। ক্রুদ্ধ হয়ে নাদির শাহ তার সৈন্যদের শিশু-নারী-পুরুষনির্বিশেষে দিল্লির সব অধিবাসীকে খুন করার আদেশ দেন। হাজার হাজার দিল্লিবাসী এই আক্রমণে নিহত হয়। মোগল সম্রাট বাধ্য হয়ে নাদির শাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের শর্ত ছিল দুটি। প্রথমত, মোগল সম্রাটের সব সম্পদ যেখানে রক্ষিত, সেই ভান্ডারের চাবি নাদির শাহর হাতে তুলে দিতে হবে। নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন, কোহিনূর, হীরাসহ বহু মূল্যের অলংকার পারস্যে পাঠিয়ে দেন। দ্বিতীয় শর্ত ছিল মোগল সম্রাটের কনিষ্ঠ কন্যা–যার কুমারী নাম ছিল জাহান আফরোজ বেগম, তার সঙ্গে নাদির শাহর কনিষ্ঠ পুত্র জাহদুল্লাহ মির্জার বিয়ে দিতে হবে। ২৬ মার্চ ১৭৩৯ তারিখে দিল্লিতে এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের কাজি নাদির শাহর ওপর একটি ছোট প্রতিশোধ নিতে চান। তিনি দাবি করেন, বর ও কনের পূর্বপুরুষদের পরিচয় বর্ণনার পর তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। প্রথমে কনের পরিচয় দেওয়া হলো। পরিচয় শুরু হলো তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খান থেকে। তাদের ধারাবাহিকতায় জহিরউদ্দিন বাবর পর্যন্ত পরিচয় দেওয়া হলো। এরপর ভারত দখলের পর ১২ জন মোগল সম্রাটের নাম উল্লেখ করা হলো। দ্বাদশ মোগল সম্রাটের নাম ছিল মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা, তিনি ছিলেন কনের পিতা। রঙ্গিলা শব্দটি ছিল তার ছদ্মনাম। এই নামে তিনি কবিতা লিখতেন। কনের পরিচয়ের পর বরের পরিচয় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। পারস্যের পক্ষ থেকে বলা হলো, বর হচ্ছেন সম্রাট নাদির শাহর পুত্র। এরপর প্রশ্ন করা হলো নাদির শাহর পিতা কে ছিলেন? জবাবে বলা হলো, Nadir Shah is a son of the sword.’ তরবারির জোরে তিনি রাজা হয়েছেন। তার কোনো বংশপরিচয় নেই। যখন প্রশ্ন করা হলো নাদির শাহর পিতামহ কে ছিলেন? তখন জবাব দেওয়া হলো যে তাদের সব পূর্বপুরুষ ছিলেন তরবারির সন্তান (Son of the sword)।
রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বামুন খাঁ ছিলেন নাদির শাহর মতো। তাঁর পিতৃপুরুষের কোনো পরিচয় নেই। বামুন শব্দটির অর্থ ব্রাহ্মণ। সাধারণত হিন্দু থেকে যারা মুসলমান হতেন, তাঁরা খাঁ উপাধি ধারণ করতেন। বামুন খাঁ নামের অর্থ হলো যে একজন ব্রাহ্মণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে খাঁ উপাধি ধারণ করে এ বংশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এই ব্রাহ্মণের নিশ্চয়ই সংস্কৃত নাম ছিল। সে নাম কী তা কেউ জানে না। উপরন্তু কোন শ্রেণির ব্রাহ্মণ তিনি, কোথা থেকে তিনি রসুল্লাবাদ এসেছেন–এসবই অবগুণ্ঠনে ঢাকা।
এখানে অনেক প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন হলো সত্যি সত্যিই বামুন খাঁ বলে কেউ ছিলেন কি না, যিনি হিন্দু থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। খাঁ বংশের সবাই বিশ্বাস করে যে বামুন খাঁ বাস্তবে ছিলেন এবং তিনি হিন্দু ছিলেন। এই বিশ্বাসের পক্ষে কিছু যুক্তি রয়েছে।
প্রথম যুক্তি হলো বামুন খ এবং তাঁর উত্তরসূরিরা সুদের ব্যবসা করতেন। ইসলাম ধর্মে সুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাজেই খাঁটি মুসলমানদের পক্ষে সুদের ব্যবসা করা সম্ভব ছিল না। যেহেতু বামুন খাঁ হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিলেন, সেহেতু তিনি সুদের ব্যবসা করতে পেরেছেন।
দ্বিতীয়ত, খাঁ বাড়িতে অনেক হিন্দু প্রথা প্রচলিত ছিল। ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত খাঁ বাড়ির বেশির ভাগ সন্তানই পিতাকে বাবা বলে সম্বোধন করত। এদের অনেকেই ধুতি পরত।
তবে এখানে আরও দুটি নতুন প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন হলো ব্রাহ্মণেরা শাস্ত্রচর্চা করতেন। তাদের জন্য সুদ গ্রহণের ওপরে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ছিল। এর উত্তর হতে পারে, বামুন খাঁ যত দিন হিন্দু ছিলেন, তত দিন সুদের ব্যবসা করেননি। সুতরাং মুসলমান হওয়ার পরে হিন্দুধর্মের নিষেধাজ্ঞা তাঁর ওপর বলবৎ ছিল না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো তিনি ব্রাহ্মণ হলে কী তাঁর পদবি এবং কোথায় তাঁর আদি আবাস ছিল। তাঁর মূল পদবি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তবে আদি আবাস সম্বন্ধে কিছু আভাস পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি হাওর অঞ্চলে ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান ছিলেন। তাঁর আদি নিবাস সম্ভবত নেত্রকোনা কিংবা সুনামগঞ্জের কোনো হাওরে ছিল। এই উক্তির সমর্থনে আমার বাবার একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন নেত্রকোনা অথবা সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল থেকে বামুন খাঁর পিতৃবংশের একজন প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বামুন খাঁর বংশধরদের বংশতালিকা প্রণয়ন করা। তবু শুধু এ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বামুন খাঁ ব্রাহ্মণ ছিলেন–এ তথ্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ জন্য আরও তথ্যের প্রয়োজন।
এ বিষয়ে খাঁ বাড়ির সদস্যরা কোথায় বিয়ে করেছেন, সে সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। মধ্যযুগের মুসলিম বাংলায় যেসব অভিজাত পরিবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তারা তাদের কন্যাদের অনুরূপ শরিফ পরিবারে বিয়ে দিতেন। কোনোমতেই তারা নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের কাছে তাদের কন্যা বিয়ে দিতে রাজি হতেন না। কিন্তু ব্রাহ্মণ থেকে যারা মুসলমান হতেন, তাঁদের শরিফ পরিবারের সমকক্ষ বলে বিবেচনা করা হতো। এ ধরনের পরিবারের সঙ্গে বিয়েতে কোনো আপত্তি ছিল না। যদি আমরা খাঁ বাড়ির বউদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করি, তাহলে দেখা যাবে বেশির ভাগই ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থানের অভিজাত পরিবারের সন্তান। প্রায় দুই শ বছর ধরে খাঁ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন ফরদাবাদ মুন্সিবাড়ির মেয়ে, কসবা উপজেলার মাধবপুর গ্রামের মিয়া বাড়ির মেয়ে, রূপসদী সাব (সাহেব) বাড়ির মেয়ে, বড়িকান্দির দেওয়ান বাড়ির মেয়ে, মোচাকান্দার খন্দকার বাড়ির মেয়ে ইত্যাদি। এসব বিয়েশাদি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সম্ভবত বামুন খাঁ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন, অন্যথায় শরিফ পরিবারের মুসলিম মেয়েদের তার পরিবারে বিয়ে হতো না।
বামুন খাঁ কবে রসুল্লাবাদে বসতি স্থাপন কমরছিলেন, সে সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ তথ্য নেই। তবে বামুন খাঁর পরবর্তী বংশধরদের সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে তার রসুল্লাবাদ আগমনের সময়সীমা সম্পর্কে একটি ধারণা করা যেতে পারে। এ সম্পর্কে তথ্য রেখাচিত্র ২.১-এ দেখা যাবে।
রেখাচিত্র ২.১
বামুন খাঁ থেকে ছাদত আলী খাঁ পর্যন্ত বংশতালিকা
বামুন খাঁ (জন্ম : ১১৭১ বঙ্গাব্দ বা আনুমানিক ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)
দুলাল খাঁ (জন্ম : ১১৯১ বঙ্গাব্দ বা আনুমানিক ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)
সমন খাঁ (জন্ম : ১২২১ বঙ্গাব্দ বা আনুমানিক ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দ)
সবদর আলী খাঁ (জন্ম : ১২৪৬ বঙ্গাব্দ বা আনুমানিক ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)
ছাদত আলী খাঁ (জন্ম : ১২৭১ বঙ্গাব্দ বা আনুমানিক ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)
তথ্যসূত্র : ছাদত আলী খাঁর কবরের প্রস্তরলিপি
এঁদের সবাই রসুল্লাবাদ পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত রয়েছেন। তবে ছাদত আলী খাঁর পূর্বপুরুষদের কবরের কোনো চিহ্ন নেই এবং কোনো প্রস্তরলিপিও নেই। পারিবারিক কবরস্থানে ছাদত আলী খাঁর কবরের ওপর প্রস্তরলিপি পাওয়া গেছে। সেই প্রস্তরলিপিতে লেখা হয়েছে ছাদত আলী খাঁর জন্ম। ১২৭৩ বঙ্গাব্দে (১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) এবং মৃত্যু ১৩৪০ (১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দে।
সাধারণত জনসংখ্যাতত্ত্বে প্রতি প্রজন্মের বয়সকাল ২৫ বছর অনুমান করা হয়ে থাকে। এই অনুমানের ভিত্তিতে আমরা ছাদত আলী খাঁর পূর্বপুরুষদের সময়কাল নির্ধারণ করতে পারি। ছাদত আলী খাঁর জন্মের তারিখের ভিত্তিতে হিসাব করলে তার পিতা সবদর আলী খাঁর জন্ম হয়েছিল ১২৪৬ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়। সবদর আলী খাঁর পিতা সমন খার জন্মতারিখ হবে ১২২১ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি। সমন খাঁর পিতা দুলাল খাঁর জন্ম হয়েছিল ১১৯৬ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়ে। তাঁর পিতা বামুন খার জন্মতারিখ ১১৭১ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি হওয়ার কথা, যা ছিল ইংরেজি সাল ১৭৬৪ খ্রিব্দাব্দ।
এই হিসাব অনুসারে পলাশীর যুদ্ধের সাত বছর পর বামুন খাঁর জন্ম হয়। ওই সময়টা ছিল বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলায় ইংরেজদের আধিপত্য ঘটে এবং ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ান হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলার সার্বভৌম অধিপতিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৭ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত ইংরেজ শাসকেরা রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা করে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলায় জমিদারি প্রথা। প্রবর্তন করা হয়। ১৭৯৩ সালে বামুন খাঁর বয়স ২২-এর কাছাকাছি হওয়ার কথা। সম্ভবত এই সময়ের কাছাকাছি কোনো সময়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তার কোনো কারণ জানা যায় না।
অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু মুসলমান শাসকদের অত্যাচারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। উদাহরণস্বরূপ পঞ্চদশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃপুরুষদের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যায়। কথিত আছে, একজন হিন্দু সেনানায়ক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মোহাম্মদ তাহির খান নাম গ্রহণ করেন। তিনি পীরআলী নামে পরিচিত ছিলেন। কথিত আছে, তিনি রমজান মাসে রোজা রেখেছিলেন এবং দিনের বেলা বসে দরবার করছিলেন। দরবারে এক ব্যক্তি কিছু লেবু পীরআলীকে উপহার দেন। পীরআলী লেবুর গন্ধ গ্রহণ করেন এবং লেবুর সুগন্ধের প্রশংসা করেন। সেই সময়ে কামদেব এবং জয়দেব নামে দুজন ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বললেন, ‘ঘ্রাণং অর্ধ ভোজনং’ (ঘ্রাণ নিলে অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়)। যেহেতু পীরআলী লেবুর ঘ্রাণ গ্রহণ করেছেন, সেহেতু তিনি অর্ধেক লেবু খেয়ে ফেলেছেন। তাই তার উপবাস ভেঙে গেছে। এই বক্তব্যে পীরআলী ব্রাহ্মণদের ওপরে খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং কয়েক দিন পর ব্রাহ্মণদের তাঁর সভায় আমন্ত্রণ জানান। ব্রাহ্মণেরা যখন সভায় উপস্থিত হন, তখন সেখানে অনেক বকরি আর গোমাংস রান্না। করা হচ্ছিল। ব্রাহ্মণেরা যখন সভায় উপস্থিত হলেন, তখন চুলার ওপর রন্ধনরত মাংসের ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়। পুরো সভাস্থল মাংসের গন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে। পীরআলী তখন দাবি করলেন, যারা মাংসের ঘ্রাণ গ্রহণ করেছে, তারা সবাই গোমাংস খেয়েছে। সুতরাং তারা আর হিন্দু থাকতে। পারবে না। কামদেব ও জয়দেবকে বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। অনেক ব্রাহ্মণ সভাস্থল থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু সমাজে তারা পতিত হয়ে হয়ে যান। এ ধরনের ব্রাহ্মণেরা পীরআলী ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পীরআলী ব্রাহ্মণদেরই বংশধর ছিলেন। হতে পারে বামুন খাঁ এ ধরনের কোনো মুসলমান জমিদারের হাতে পড়ে তার কৌলীন্য হারান এবং বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
অনেকে সন্দেহ করেন, মুসলমান জমিদারদের খামখেয়ালিপনার জন্য বামুন খাঁ মুসলমান হননি। তিনি সম্ভবত জমিদারদের অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন। অন্যথায় প্রশ্ন ওঠে সুদের ব্যবসা করার মতো অর্থ তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এ অনুমানের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো বামুন। খার আদিগোষ্ঠীর লোকেরা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও তার সন্তানসন্ততির সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছে। হয়তো এমনও হতে পারে তিনি কোনো জমিদারের অর্থ আত্মসাৎ করেন এবং সেই অর্থ দিয়ে তার বাপের বাড়ির আর্থিক সমস্যা দূর করেন। পরে ধরা পড়ে গেলে তিনি বাধ্য হয়ে মুসলমান হন।
মুসলমান হওয়ার পর তিনি আর হাওর অঞ্চলে থাকেন না। তিনি চলে আসেন মেঘনা নদী পার হয়ে নবীনগর উপজেলায়। সারণি-২.১-এ ১৮৭২ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের হারসংক্রান্ত তথ্য দেখা যাবে।
সারণি-২.১
বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চলে মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের হার
প্রশাসনিক অঞ্চল | মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের হার |
নবীনগর থানা | ৭১.৩% |
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা | ৫৩.৩৭% |
কুমিল্লা সদর মহকুমা | ৬৯.৪৬% |
সুনামগঞ্জসহ সিলেট মহকুমা | ৪৯.১% |
কিশোরগঞ্জ মহকুমা | ৫৯.৮% |
নেত্রকোনাসহ ময়মনসিংহ সদর | ৬২.২২% |
উৎস : Census of Bengal 1872
১৮৭২ সালে যে হারে মুসলমান জনসংখ্যা এ অঞ্চলগুলোতে ছিল, অনুমান করা যায় ১০০ বছর আগেও একই ধরনের হার বিদ্যমান থাকা স্বাভাবিক। নবীনগর থানায় আশপাশের অঞ্চলের চেয়ে মুসলমান জনসংখ্যার হার অনেক বেশি ছিল। রসুল্লাবাদ গ্রামে হিন্দু ছিল। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে প্রায় ২০ শতাংশ লোক হিন্দু ছিল। এই হিন্দুদের মধ্যে কিছু অভিজাত পরিবার যথা (পাল, আচার্য) ইত্যাদি উচ্চবর্ণের পরিবার ছিল, বাকি সবাই ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু। এদের অনেকেই জেলের কাজ করত। মেঘনা নদী থেকে একটি খাল তিতাস নদীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করত। এই খালটি ‘যোবনাই নদী’ নামে পরিচিত। এই নদী দিয়ে জেলেরা নদী ও জলাভূমি থেকে মাছ ধরত। কয়েকটি পরিবার স্বর্ণকার ছিল। এদেরকে বণিক পরিবার বলা হতো। এ ছাড়া কয়েকটি পরিবার কাঠের মিস্ত্রির কাজ করত। এরা সূত্রধর নামে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া নাপিত, ধোপা ইত্যাদি কাজও অনেক হিন্দু পরিবার করত। তবে ভারত বিভাগের পর হিন্দুদের অনেক পরিবারই ভারতে অভিবাসন করে। বর্তমানে রসুল্লাবাদ গ্রামে মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি হবে না। তবে বামুন খাঁ রসুল্লাবাদ গ্রাম কেন নির্বাচন করেন, সে সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। রসুল্লাবাদ গ্রাম মেঘনার অপর পার থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। সুতরাং হাওর অঞ্চলের কোনো জমিদারের পক্ষে বামুন খাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এ অঞ্চলে অভিযান চালানো কঠিন ছিল।
রসুল্লাবাদ গ্রাম নির্বাচনের আরেকটি কারণ হতে পারে এখানে কোনো শরিফ মুসলমান বংশ ছিল না। এই গ্রামে তখন অধিকাংশ মানুষই ছিল গরিব চাষি। এই গরিব চাষিদের একটি কন্যাকে তিনি বিয়ে করেন এবং রসুল্লাবাদ গ্রামের এক প্রান্তে তার বসতি স্থাপন করেন। খাঁ বাড়ি রসুল্লাবাদ গ্রামের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এ বাড়ির পাশ দিয়ে একটি খাল মেঘনা নদী থেকে তিতাস পর্যন্ত গেছে। এ খালটির পাশে বামুন খাঁ তার আবাস স্থাপন করেন।
বামুন খাঁ মহাজনি ব্যবসা করে সচ্ছল ছিলেন। তার একটিমাত্র ছেলে ছিল, যার নাম ছিল দুলাল খাঁ। তিনি তাঁর বাবার মতো মহাজনের কারবার করতেন। মহাজনের ব্যবসা তখন অত্যন্ত লাভজনক ছিল। ইংরেজ শাসকেরা জমির খাজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে সেই খাজনার ভিত্তিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করেন। সুতরাং যখনই কোনো প্রাকৃতিক দুর্বিপাক দেখা দিত, তখন খাজনা দেওয়ার জন্য কৃষকদের অর্থাভাব দেখা দিত। এই অর্থাভাব মেটানোর একমাত্র উপায় ছিল মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ হারে ঋণ গ্রহণ করা। অনেক কৃষকই এই ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন না এবং এঁদের জমিজমা মহাজনরা দখল করে নিতেন। এভাবে দুলাল খাঁ আরও ধনী হয়ে ওঠেন। দুলাল খারও একটি ছেলে ছিল। তার নাম ছিল সমন খা। তিনিও বাবার মতো মহাজনি ব্যবসা করে অনেক অর্থ উপার্জন করেন।
দুলাল খাঁ অথবা সমন খাঁ এ দুজনের একজনের সময় থেকে খাঁ বাড়িতে সন্ধ্যায় ঘৃতের প্রদীপ জ্বালানো হতো। সে সময় লোকে বিশ্বাস করত যে লাখ। টাকার ওপর যাদের অর্থ রয়েছে, তাঁদের ঘরে লক্ষ্মী ধরে রাখার জন্য ঘৃতের প্রদীপ জ্বালাতে হবে। লক্ষণীয়, হিন্দুদের এই প্রথা খাঁ বাড়িতে চালু ছিল। এঁদের ঐশ্বর্য চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় সবদর আলী খাঁর সময়ে। সবদর আলী খাঁ শুধু মহাজনি ব্যবসাই করতেন না, তিনি রসুল্লাবাদ গ্রামের বেশির ভাগ জমির মালিক ছিলেন। আশপাশের গ্রামে তালুকদারিতেও অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন।
সবদর আলী খাঁ ফরদাবাদ গ্রামে মুন্সিবাড়ির সম্ভবত মুন্সি রুকনুদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করেন। ফরদাবাদ শব্দটির উৎপত্তি হয় ফরিদউদ্দিন মুন্সির নাম থেকে। এই মুন্সিই ফরদাবাদ গ্রাম স্থাপন করেন। কথিত আছে, সবদর আলী খাঁর স্ত্রীর গায়ের রং কালো ছিল। সে জন্য সবদর আলী খাঁ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। এই কুলীন স্ত্রীর গর্ভে তার ছয় ছেলে হয়। এঁরা হলেন (১) ছাদত আলী খাঁ, (২) উলফত আলী খাঁ, (৩) কামাল উদ্দিন খাঁ, (৪) তোজাম্মল আলী খাঁ, (৫) মোয়াজ্জেম আলী খাঁ ও (৬) রেসালত আলী খাঁ। কিন্তু তিনি স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন না। গ্রামের কুমারী মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়াতেন। একপর্যায়ে গ্রামের মধ্যপাড়ার ছামেদের নেছা নামে সাধারণ ঘরের এক মেয়েকে বিয়ে করেন এবং এ তথ্য পরিবারের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু তার প্রথমা কুলীন স্ত্রী এ তথ্য জানতে পেরে ওই বউকে নিজে ঘরে এনে তোলেন এবং এদের খাঁ বাড়ির পাশে নিচু ভূমিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ওই স্ত্রীর গর্ভে সবদর আলী খাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে হয়। এঁরা কেউই লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি। এঁদের খাঁ বাড়ির সম্পত্তির অংশও দেওয়া হয়নি। ওই পরিবারকে খাঁ বাড়ির অধিকাংশ সদস্য রক্ষিতার পরিবার হিসেবে গণ্য করে থাকে। এ নিয়ে ছামেদের নেছার পক্ষ থেকে কখনো কোনো আপত্তি করা হয়নি।
১৮৫০ থেকে ১৯২০-এই ৭০ বছর ছিল খাঁ বাড়ির সর্বোচ্চ আর্থিক সচ্ছলতার সময়। একই সঙ্গে তখন চলছিল মহাজনি কারবার, তালুকদারি এবং চাষবাস। রসুল্লাবাদ গ্রামের তালুকদারির খাজনা ছিল ১৯০০ সালের দিকে বছরে ১ হাজার ৭০০ টাকা। এ খাজনা জমিদারকে দিতে হতো। এর বাইরে যে খাজনা আদায় হতো, সেটা তালুকদারের থাকত। এ ছাড়া ১৩টি গ্রাম নিয়ে আরেকটি তালুকদারি ছিল। এই তালুকদারির বার্ষিক খাজনা ছিল বছরে ৫১০০ টাকা। এই তালুকের মধ্যে যেসব গ্রাম অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে কাঁঠাইল্যা, খুররা, কড়ইবাড়ি, বড় শিকানিকা, ছোট শিকানিকা, দাল্লা, মোল্লা, কালঘরা, লোড়ি, গোপালপুর ও দামলা (শাহপুরের কাছে)। খাঁ বাড়ির তালুকদারি ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ছিল। প্রতিবছর কাঁঠাইল্যাতে পুণ্যাহ (বাৎসরিক খাজনা আদায়ের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠিত হতো। এ সম্পর্কে তথ্যসমূহ দিয়েছেন আমার মরহুম চাচাতো ভাই আনোয়ার আলী খাঁন।
প্রথম দিকে খাঁ বাড়ির আয়ের সিংহভাগ আসত মহাজনি ব্যবসা থেকে। রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে মহাজনি ব্যবসার আকার হ্রাস পায়। এর কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথম কারণ ছিল শরিফ মুসলমান পরিবারে বিয়ে করার পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আশা করত যে এরা ইসলাম ধর্মের মূল নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। ইসলাম ধর্মে সুদের ব্যবসার স্থান ছিল না। দ্বিতীয়ত, দেশে মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জমে উঠছিল। খাঁ বাড়ির কর্তারা এ ধরনের বিবাদে জড়িত হতে উৎসাহী ছিলেন না। সবশেষে প্রথম চার প্রজন্ম ধরে খাঁ বাড়িতে একটিমাত্র পুত্রসন্তান। ছিল। একজনের পক্ষে বিরাট বড় সুদের ব্যবসা সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আস্তে আস্তে মহাজনি ব্যবসা থেকে খাঁ বাড়ির আয় কমে যায়। খাঁ বাড়ির অধিকাংশ আয় আসে জমি চাষ এবং তালুকদারি থেকে। বিংশ শতাব্দীতে খাঁ বাড়ির সন্তানেরা প্রজাদের রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য মহাজনি ব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা ঋণ সালিসি বোর্ডের নেতৃত্ব দেন এবং সাধারণ কৃষকদের মহাজনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি দেন।
সমৃদ্ধির সময়ে খাঁ বাড়ি ছিল একটি যৌথ পরিবার। বামুন খাঁ থেকে সবদর আলী খাঁ পর্যন্ত যেহেতু পরিবারের ছেলে মাত্র একজন ছিল, সেহেতু যৌথ পরিবারে একসঙ্গে থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সবদর আলী খাঁর ছয় ছেলে হওয়ার পর যৌথ পরিবার নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
মূল খাঁ বাড়ি প্রায় তিন বিঘার ওপরে স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে এক বিঘার মতো জমিতে একটি বড় পুকুর, পারিবারিক কবরস্থান এবং খালের তীরবর্তী রাস্তা অবস্থিত ছিল। দুই বিঘার মধ্যে আবাস গড়ে তোলা হয়েছিল। যেহেতু সে সময়ে ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সে বিয়েশাদি করত, সেহেতু ১৯০০ সালের পরে এদের অনেকেরই নাতি-নাতনির জন্ম হয়। এই পরিবেশে খাঁ বাড়িতে স্থানাভাব দেখা দেয়। ছয় ভাইয়ের জন্য উপযুক্ত ঘর এবং বৈঠকখানা নির্মাণ করতে হয়েছে। বাড়িতে ছয় ভাই ও পিতার জন্য কমপক্ষে সাতটি ঘোড়া ছিল। খাবার এবং চাষের জন্য গরু ও বলদ ছিল, ছাগল ছিল। এদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এদের খাবারের জন্য খড়ের গাদা তৈরি করতে হয়েছে। এসব মিলে বাড়িতে তীব্র স্থানাভাব দেখা দেয়।
প্রথম দিকে বাড়ির অভিভাবকেরা সমস্যাটি বুঝতে পারেননি। অতি জনাকীর্ণ হয়ে পড়ার ফলে বাড়িতে নিরাপত্তার সমস্যা দেখা দেয়। বাড়িতে প্রায়ই আগুন লাগে। প্রথমে অগ্নিকাণ্ডকে দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু আগুন নেভানোর কয়েক মাসের মধ্যে আবার দ্বিতীয়বার লাগে এবং ঘন ঘন আগুন লাগতে শুরু করে। দুই-তিন বছরের মধ্যে বাড়িতে সাতবার আগুন লাগে। কেউ কেউ বলেন যে শত্রুরা আগুন লাগিয়েছে। তবে অনেকেরই ধারণা, অতি জনাকীর্ণ হওয়ার ফলেই এতবার আগুন লেগেছে। আগুনে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক মূল্যবান সম্পদ এবং কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এ সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব ছিল না। যদিও ছেলেরা আস্তে আস্তে যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের পরিবার গড়ে তুলছিলেন, তবু ছয় ভাই একই সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে চান। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে পুরোনো বাড়িতে ছয় ভাইয়ের স্থান সংকুলান হবে না। সুতরাং একটি নতুন। বাড়ি নির্মাণ করতে হবে।
এ নতুন বাড়ির স্থান নির্বাচন করা হয় পুরোনো বাড়ির পাশে যে খাল ছিল সেই খালের অপর পাড়ে। এখানে প্রায় ১৮ বিঘা চাষের জমিতে খাঁ বাড়ি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চাষের জমিকে আবাসযোগ্য করার জন্য ছয় বিঘার ওপর একটি বিরাট দিঘি খনন করা হয়। এই দিঘির চারপাশে ছয় ভাইয়ের আবাসের জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হয়। এই দিঘি কাটাতে এবং চাষের জমিকে বাসযোগ্য করার জন্য মাটি ফেলতে কয়েক বছর সময় লাগে। মাটি ফেলার পর বাসস্থানের জায়গায় সবাই আম, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছের চারা রোপণ করে। ১৯৩০-এর দশকে দুই ভাইয়ের অংশে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এক অংশে পাকা দেয়ালের ওপর টিনের চাল দেওয়া হয়। আরেক অংশে দালান নির্মাণ করা হয়। নির্মিত দালানে নির্মাণের তারিখ ১৯৩৬ সাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই দুই ভাই ছাড়া আর বাকি কেউ নতুন বাড়িতে আবাস নির্মাণ করতে পারেননি। তার কারণ হলো তখন খাঁ বাড়িতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেছে। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাদত আলী খাঁ ১৯৩৩ সালে মারা যান। এর ফলে তার বংশধরেরা নতুন বাড়ি নির্মাণ করেননি। তার অন্য ভাইয়েরা নতুন বাড়ি নির্মাণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। দিঘির পাড়ের চার ভাইয়ের অংশ এখনো শূন্য পড়ে আছে।
খাঁ বাড়ির ইতিহাসে একটি বড় পরিবর্তন আসে উনিশ শতকের শেষ দিকে। সবদর আলী খাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছাদত আলী খাঁ কসবা উপজেলার মাধবপুর গ্রামে খোদা নেওয়াজ খাঁর কন্যা বেগম উমদাতুননেছাকে বিয়ে করেন। খোদা নেওয়াজ খার পরিবার মিয়াবাড়ি নামে পরিচিত। কথিত আছে। যে মিয়াবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার অনুগত সেনাপতি মোহন লালের এক বংশধর। পলাশীর যুদ্ধের পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মাধবপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। শোনা যায়, সেই গ্রামে এখনো ফেব্রুয়ারি মাসে মোহন লালের বংশধরের ইসলাম গ্রহণের স্মৃতি স্মরণ করে মেলা বসে। এই বংশের একজন অংশীদারের নাম ছিল গোলাম নবী। তাঁর একমাত্র মেয়ে ছিল রাহাতুননেছা বেগম। এই মেয়েকে বিয়ে করে কিশোরগঞ্জের হায়বতনগর এবং জঙ্গলবাড়ীর জমিদার বংশের ছেলে খোদা নেওয়াজ খাঁ মাধবপুরে ঘরজামাই হয়ে আসেন। খোদা নেওয়াজ খাঁ ঈশা খাঁর বংশের দশম প্রজন্মের সদস্য ছিলেন। খোদা নেওয়াজ খাঁর পাঁচ ছেলে ছিল। তিনি তাদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য ঢাকা শহরে পাঠান। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ফতেদাত খাঁ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর সেরেস্তাদার হিসেবে বিচার বিভাগে কাজ করেন। তাঁর অন্য ছেলেরা স্কুলের পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করতে পারেননি। কাজেই তারা গ্রামেই থেকে যান। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ইমদাদ খা। যার ডাকনাম ছিল মিন্টু মিয়া। তিনি ছিলেন দরবেশ। তাঁকে ছোটবেলায় তাঁর একমাত্র বোন উমদাতুননেছা লালন-পালন করেছেন। তাই তিনি বোনের অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। দরবেশ হয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রায়ই দীর্ঘদিনের জন্য উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে দর্গাসমূহ জিয়ারত করার জন্য চলে যেতেন। তারপর অনেক দিন পরে ফিরে এসে রসুল্লাবাদের বোনের বাড়িতে থাকতেন। তিনি মাধবপুরের পৈতৃক বাড়িতে থাকা পছন্দ করতেন না। রসুল্লাবাদ গ্রামের লোকের বিশ্বাস, এমদাদ খাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। সে জন্য জীবদ্দশাতেই লোকজন তাকে শ্রদ্ধা করত। ১৯৩৫ সালে তিনি রসুল্লাবাদে মারা যান। খ বাড়ির কবরস্থানে তিনি সমাহিত আছেন। রসুল্লাবাদ গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করেন যে রাতের অন্ধকারে কবরস্থানে এই দরবেশ উঠে দোয়া-দরুদ পড়েন। অনেকে দাবি করেন যে জোনাকির আলোতে অন্ধকার রাতে তাঁকে কবরস্থানে দেখা যায়। অনেকে এসব কেরামতিতে বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে বিশ্বাস করেন না।
ছাদত আলী খাঁর বিয়ের পর তার শ্বশুর তাঁকে বললেন, ‘বাবা, তোমাদের ব্যবসা এবং তালুকদারি থেকে তোমরা অবশ্যই এখন সচ্ছল। কিন্তু যখন ছয় ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাবে, তখন তোমাদের এই সচ্ছলতা থাকবে না। কাজেই তোমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। কী প্রস্তুতি নিতে হবে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘ছেলেদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। শুধু ছেলেদের শিক্ষিত করলেই হবে না, ছাদত আলী খাঁর যেসব কনিষ্ঠ ভাই স্কুলে যাওয়ার বয়সের মধ্যে রয়েছেন, তাদেরকেও লেখাপড়া শেখাতে হবে।
এর পরের প্রশ্ন হলো কোথায় পড়ানো হবে? ১৮৯৬ সালে নবীনগরে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু এই স্কুল হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত এবং এসব স্কুলের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ের নয়। খোদা নেওয়াজ খাঁ পরামর্শ দিলেন রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির ছেলেদের পড়াশোনা করার জন্য ঢাকা শহরে পাঠাতে হবে।
১৮৭৪ সালে মুহসীন ফান্ড থেকে বার্ষিক ১০ হাজার টাকা অনুদান নিয়ে ঢাকায় সরকারি মাদ্রাসা উদ্বোধন করা হয়। ১৮৭৫ সালে এই মাদ্রাসায় অ্যাংলো পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট চালু করা হয়। যেখানে আরবি ও ফারসি শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি এবং পাশ্চাত্য কলাবিদ্যা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো। ১৮৮২ সালে প্রথমবারের মতো এ বিভাগ থেকে ছাত্ররা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, বিচারপতি জাহিদুর রহমান জাহিদ এবং খ্যাতিমান লেখক এস এম তৈফুর এই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। খাঁ বাড়ির ছেলেদের রসুল্লাবাদে পড়াশোনা না। শিখিয়ে ঢাকায় মাদ্রাসায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ছাদত আলী খাঁ।
রসুল্লাবাদ থেকে ঢাকায় যাতায়াত তখন কষ্টসাধ্য ছিল। রসুল্লাবাদ থেকে তিন মাইল দূরে মানিকনগরে স্টিমার ভিড়ত। এই স্টিমার নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকায় যেত। স্টিমার ধরার জন্য নৌকায় করে মানিকনগর স্টিমারঘাটে গিয়ে স্টিমারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। নদীপথের বিভিন্ন সমস্যার জন্য স্টিমার সময় মতো চলাচল করতে পারত না। অনেক সময় স্টিমার ঘাটে দু-তিন দিনও বসে থাকত হতো। তাই ঢাকা রসুল্লাবাদ থেকে অনেক দূরে ছিল। সেখানে নিয়মিত বাসস্থান ছাড়া পড়শোনা করা সম্ভব ছিল না। উনিশ শতকের শেষ দিকে ৩ অথবা ৪ নম্বর রোকনপুরে একটি বাসা ভাড়া করা হয়। এই বাসায় রান্না করার জন্য কাজের বুয়া নিয়োগ করা হয়। ছেলেদের তামাক খাওয়ানোর জন্য হুক্কা এবং তামাক পরিবেশনের জন্য খিদমতগার নিয়োগ করা হয়। একই বাড়ি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে খাঁ বাড়ির কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিয়ে ব্যবহার করেছে। তখন বাড়ির দাম এত সস্তা ছিল যে বাড়িটি কেনা অত্যন্ত সহজ ছিল। তবু বাড়িটি কেনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
এই পর্যায়ে সবদর আলী খাঁর ছেলেদের সম্পর্কে কিছু তথ্য পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রথম ছেলে ছাদত আলী খাঁর তিন ছেলে ছিল। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ফজলে আলী খাঁ (ডাকনাম মাকু মিয়া)। তিনি ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। দ্বিতীয় পুত্রের নাম আমীর আলী খাঁ। তিনি ছিলেন খাঁ বাড়ির প্রথম গ্র্যাজুয়েট ও আইনজীবী। তৃতীয় ছেলের নাম ছিল মাহবুব আলী খাঁ (মবু মিয়া)। তিনি কসবা উপজেলার রাজনীতিবিদ তফাজ্জল আলীর ভগ্নি ছালেহা খাতুনকে বিয়ে করেন। তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইন্টার্নশিপ শেষ করার সময় তার শ্বশুরের টাইফয়েড হয়। শ্বশুরের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি নিজেই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না।
ছাদত আলী খাঁর প্রথম কন্যার নাম ছিল ছালেহা খাতুন। তাঁকে পার্শ্ববর্তী রতনপুর গ্রামে সৈয়দ আলীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এই সৈয়দ সাহেবের পূর্বপুরুষ হজরত শাহজালালের সঙ্গে সেনাপতি হিসেবে সিলেটে আগমন করেন। তার উত্তর পুরুষ মোহাম্মদ ফয়েজ কলকাতায় দায়রা জজ ছিলেন। তিনি রতনপুর গ্রামে বিয়ে করেন এবং ২২টি তালুকের মালিক হন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির একজন বিখ্যাত সন্তানের নাম হলো নওয়াব কে জি ফারুকি, যাকে ব্রিটিশ সরকার নওয়াব অব রতনপুর উপাধি দিয়েছিলেন। অবশ্য রতনপুরের জমিদারি তার ছিল না। ছাদত আলী খাঁর দ্বিতীয় কন্যার নাম ছিল আছিয়া খাতুন। তাঁর বিয়ে হয় কালঘরা গ্রামের ফজলে আলীর সঙ্গে। ফজলে আলী ছিলেন নবীনগরের প্রথিতযশা আইনজীবী আবদু মিয়া সাহেবের ভাগিনা। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদের জন্য মনোনীত হন এবং প্রশিক্ষণের জন্য সারদা পুলিশ একাডেমিতে গমন করেন। কিন্তু পুলিশ একাডেমির নিয়মানুবর্তিতা এবং কড়াকড়ি তার পছন্দ হয়নি। তাই তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে জমির চাষবাস করাতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শৌখিন মানুষ। তিনি বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতেন, ছিপ দিয়ে মাছ। ধরতেন এবং বেশ সচ্ছল জীবনযাপন করতেন।
ছাদত আলী খাঁর তৃতীয় কন্যার নাম মাছিয়া খাতুন। তাঁর বিয়ে হয়। রতনপুর গ্রামে সৈয়দ আসিব আলীর সঙ্গে। সৈয়দ আসিব আলী সৈয়দ আলী সাহেবের ভ্রাতুস্পুত্র ছিলেন। রতনপুর গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা অন্তর্জালের মতো ছড়িয়ে ছিল। রতনপুর গ্রামে তাই একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে–
রতনপুর গ্রামখানি মধ্যে মধ্যে খাল,
বাপে-পুতে ভায়রা, মায়ে-ঝিয়ে জাল।
সৈয়দ আসিব আলী চাঁদপুরে মুন্সেফ কোর্টের সেরেস্তাদার ছিলেন।
সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে মুছিয়া খাতুনের বিয়ে হয় শাহবাজপুর গ্রামে। তাঁর স্বামীর নাম ছিল রেজায়ে রাব্বী। তিনি পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন এবং পঞ্চাশের দশকে মুন্সিগঞ্জ জেলার কোর্ট ইন্সপেক্টরের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সবদর আলী খাঁর দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল উলফত আলী খাঁ। উলফত আলী খাঁ রূপসদীর ‘সাববাড়ি’তে বিয়ে করেন। তিনি ঢাকায় ইংরেজি পড়তে যান। তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ঢাকা কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে পাস করেছিলেন কি না সে সম্পর্কে জানা যায় না। কোনো চাকরি-বাকরি না করে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাদত আলী খাঁ ভালো ইংরেজি জানতেন না। তখন জেলার বেশির ভাগ উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন ইংরেজ। খাঁ বাড়ির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব উলফত আলী খাঁনের ওপর দেওয়া হয়। তিনি ভালো শিকারি ছিলেন। জেলা পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে শিকারের জন্য দাওয়াত দিতেন। বাড়িতে তাঁদের জন্য খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি অনেকের জন্য নাচগানেরও ব্যবস্থা করতেন। এর ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত অনেক প্রশাসকের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এককালে এসডিও ছিলেন টি এস এলিস। এলিস সাহেব উলফত আলী খাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে শিকার করতেন। এলিস সাহেব পরে কুমিল্লা জেলার জেলা জজ হন এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস ছিলেন। চিফ জাস্টিস থাকাকালীন অস্থায়ী গভর্নর হিসেবেও কাজ করেছেন। অস্থায়ী গভর্নর থাকাকালীন এলিস সাহেবের সঙ্গে উলফত আলী খাঁর নাতি হাবিবুল্লা খাঁর সঙ্গে দেখা হয়। উলফত আলী খাঁ তখন মৃত কিন্তু এলিস সাহেব তার নাতির কাছে তার দাদার ভূয়সী প্রশংসা করেন। উলফত আলী খাঁ অল্প বয়সে মারা যান।
উলফত আলী খাঁর তিন ছেলে ছিল। প্রথম ছেলে আবদুস শাকুর খাঁ অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নবীনগর থানার তৎকালীন ওসি তাঁর পিতার বন্ধু ছিলেন এবং তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে শাকুর খাঁর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে শাকুর খকে লিটারেট কনস্টেবল পদে পুলিশের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। স্ব-উদ্যোগে লেখাপড়া শিখে শাকুর খাঁ পুলিশের অতিরিক্ত এসপি পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেন। এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ছেলে শামসুদ্দিন খান রসুল্লাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় ছেলে মুসলেহ উদ্দিন খাঁ আয়কর আইনজীবী ছিলেন এবং ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। উলফত আলী খাঁর একমাত্র কন্যা সাজু বিবির বিয়ে হয় মুরাদনগর উপজেলার আজিজুর রহমান অ্যাডভোকেটের সঙ্গে। তিনি পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সবদর আলী খাঁর তৃতীয় ছেলের নাম ছিল কামাল উদ্দিন খান। কামাল উদ্দিন খান ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হননি। তিনি দুই বিয়ে করেন। প্রথম পক্ষে। তার এক ছেলে এবং তিন মেয়ে ছিল। তার বড় ছেলে মহিউদ্দিন খান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। তিনি কুমিল্লা জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন।
এ ছাড়া স্থানীয় স্কুলে পড়াতেন। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কামালউদ্দিন খান। রসুল্লাবাদ গ্রামে একটি সাধারণ পরিবারে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর একটি ছেলে হয়, যার নাম ছিল জালালউদ্দিন খান। অতিরিক্ত আদর দিয়ে তাঁকে মানুষ করা হয়। তবে লেখাপড়ায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না। পিতা মারা যাওয়ার পর জমি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তবে দীর্ঘ জীবন লাভ করায় শেষ দিকে আর্থিক দুরবস্থার সম্মুখীন হন।
সবদর আলী খাঁর চতুর্থ পুত্রের নাম ছিল তোজাম্মল আলী খাঁ। তিনি বড়িকান্দিতে দেওয়ান বাড়িতে বিয়ে করেন। তার কয়েকটি ছেলেমেয়ে হয়। তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ বাপের বাড়ি বেড়াতে যান। বাপের বাড়ি থেকে রসুল্লাবাদ ফেরার পথে মেঘনা নদীতে এক ঝড়ে পরিবারের সব সদস্য মারা যায়। তোজাম্মল আলী খাঁ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না। তাই তিনি বেঁচে যান। তিনি আর বিয়ে করেননি। তাঁর প্রধান শখ ছিল খাওয়াদাওয়া। আজীবন নিজে খাওয়াদাওয়া করে যেমন আনন্দ পেতেন, তেমন অন্যদের খাইয়ে তিনি চরম তৃপ্তি পেতেন।
সবদর আলী খাঁর পঞ্চম ছেলের নাম মোয়াজ্জেম আলী খাঁ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেছিলেন এবং কুমিল্লা জুরিবোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর একনাগাড়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
সবদর আলী খাঁর ষষ্ঠ ছেলে রেসালত আলী খাঁ। তিনি বিএ পাস করেন এবং নোয়াখালী শিক্ষা দপ্তরের সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন। নোয়াখালীতে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর এক ভাইপো ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ সাদেক। পরবর্তীকালে তিনি ফরিদপুর শিক্ষা দপ্তরে কাজ করেন। অবসর গ্রহণ করে তিনি রসুল্লাবাদে ১৯৩৬ সালে পাকা দালান নির্মাণ করে বসবাস করা শুরু করেন। তাঁর ছিল দুই পুত্র। প্রথম পুত্র কলকাতা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে বিএ অনার্স ও এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি কাজে যোগ দেন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ছোট ভাই লুৎফে আলী খাঁন এমবিবিএস পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। রেসালত আলী খাঁর একমাত্র কন্যা খুকির সঙ্গে পুলিশ বিভাগের একজন বড় দারোগার বিয়ে হয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই খাঁ বাড়িতে অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়। খাঁ বাড়ির আর্থিক সচ্ছলতার মূলে ছিল সুদের ব্যবসা, তালুকদারি ও চাষবাস। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই খাঁ বাড়ির অনেক অংশীদারই সুদের ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরিবারের শিক্ষিত ছেলেরা সুদের ব্যবসা পছন্দ করতেন না।
১৯৩০-এর দশকে বিশ্ববাজারে মহামন্দা দেখা দেয়। এই মহামন্দার সময়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম খুবই কমে আসে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৭ সময়কালে চালের দাম ৫৪ শতাংশ কমে যায়। এবং ১৯৩৩-৩৪ সালে পাটের দাম প্রায় ৫৭ শতাংশ কমে যায়। এই সময়ে তাই চাষিদের পক্ষে মহাজনদের ঋণ শোধ করা কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বামপন্থী কৃষকনেতাদের নেতৃত্বে মহাজনি প্রথার বিপক্ষে আন্দোলন গড়ে ওঠে। কৃষকদের মহাজনদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঋণ সালিস ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দাবি ওঠে। ১৯৩৫ সালে Bengal Agricultural Debtors Act পাস করা হয়। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঋণ সালিসি বোর্ড স্থাপন করা হয়। খাঁ বাড়ির দুজন সন্তান ফজলে আলী খাঁ ও আমীর আলী খাঁ ঋণ সালিসি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব নেন এবং চাষিদের ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করেন। আগে থেকেই মহাজনি ব্যবসা। থেকে খাঁ বাড়ির আয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ পরিবারের জনসংখ্যা অতি দ্রুত বাড়তে থাকে। চাষবাস এবং তালুকদারির আয় থেকে আগের সচ্ছলতা বহাল রাখা সম্ভব ছিল না। খাঁ বাড়ির অধিকাংশ সদস্যই ছেলেমেয়েদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উদ্যোগ নেন। তবে ১৯৫০-এর দশকের আগপর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়ার বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। খ বাড়ির মেয়েরা সাধারণত বাড়িতেই লেখাপড়া শিখতেন। ১৯৫০-এর দশকে তাঁদের কেউ কেউ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে উচ্চতর লেখাপড়া শুরু করেন।
১৯৪০-এর দশক থেকে খাঁ বাড়ির সন্তানেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করা শুরু করেন। বামুন খার পরবর্তী নবম প্রজন্মের ছেলেদের বর্তমান অবস্থান সম্বন্ধে একটি সমীক্ষা করা হয়েছে। এই সমীক্ষার ফলাফল সারণি ২.২-এ দেখা যাবে।
সারণি-২.২
সবদর আলী খাঁর সন্তানদের প্রপৌত্র ও প্রপৌত্রীদের অবস্থান
সবদর আলী খাঁর পুত্রের নাম | বিদেশে স্থায়ী আবাস | ঢাকায় স্থায়ী আবাস | রসুল্লাবাদ গ্রামে আবাস | মোট |
সাদত আলী খাঁ | ৭ | ৪ | – | ১১ |
তোজাম্মল আলী খাঁ | – | – | – | – |
উলফত আলী খাঁ | – | ৪ | ২ | ৬ |
রেসালত আলী খাঁ | ৬ | ১ | – | ৭ |
মোয়াজ্জেম আলী খাঁ | – | ২ | – | ২ |
কামাল উদ্দিন খাঁ | – | ২ | ২ | ৪ |
মোট = | ১৩ | ১৩ | ৪ | ৩০ |
ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, সবদর আলী খাঁর পুত্রদের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রপৌত্র ও প্রপৌত্রীরা রসুল্লাবাদ গ্রামে বাস করে। রসুল্লাবাদ গ্রামে বামুন খার বংশ বর্তমানে প্রায় অবলুপ্তির পথে। যে চারজন বংশধর আর্থিক দুরবস্থার জন্য রসুল্লাবাদে বসবাস করছেন, তাঁদের আর্থিক পরিস্থিতি উন্নত হলে হয়তো রসুল্লাবাদ খ বাড়ি (যা পুরোনো ও নতুন বাড়ি মিলে প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপরে অবস্থিত) সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে পড়তে পারে। দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, গ্রাম ছেড়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে তাদের অভিবাসন ঘটছে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা শহর থেকে দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন ঘটছে। বিদেশে অভিবাসন এখনো শেষ হয়নি। যারা এখনো ঢাকা শহরে আছেন, তাঁদের অনেকেরই সন্তানসন্ততি বিদেশে চলে যাবে। বামুন খাঁর বংশধরেরা রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়িতে না থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
কণিকাড়া চৌধুরী পরিবার
আমার মায়ের নাম হাজেরা খান। তিনি কণিকাড়া চৌধুরী পরিবারের মেয়ে। রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির মতো কণিকাড়া চৌধুরী পরিবারও নবীনগর উপজেলার আদিবাসী নয়। এই পরিবার এসেছে কুমিল্লার বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে। বিষ্ণুপুর গ্রামে চৌধুরী পরিবার নামে একটি পরিবার রয়েছে। এই পরিবারের সন্তান। চারু চৌধুরী আগরতলায় ত্রিপুরার মহারাজের রাজস্ব বিভাগে কাজ করতেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আগরতলার মহারাজের অর্থাভাব দেখা দেয়। একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কতগুলো জমিদারির খাজনা দেওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল। ওই দিন রাজকোষে ব্রিটিশ সরকারের খাজনা দেওয়ার মতো যথেষ্ট অর্থ তার ছিল না। জমিদারি রক্ষা করার জন্য রাজা এই জমিদারিগুলোর তালুকদারি বিক্রি করতে রাজি হন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খরিদ্দার কোথায় পাওয়া যাবে? চারু চৌধুরী বললেন, তিনি অর্থ জোগাড় করে মহারাজার পক্ষে খাজনা শোধ করবেন। কিন্তু চারু চৌধুরীর সব অর্থ যোগ দিয়ে দেখা গেল সম্পূর্ণ খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। তাঁর অধীনে ভগবান দাস নামে একজন হিন্দু কর্মচারী ছিল। ভগবান দাস জানতেন চারু চৌধুরী এই অর্থ দিয়ে কী করবেন। তাই তিনি দাবি করলেন, তালুকদারির ১০ আনা যদি তার নামে দেওয়া হয়, তাহলে যে অর্থের ঘাটতি রয়েছে, সে অর্থ তিনি বিনিয়োগ করবেন। যদি এই শর্তে চারু চৌধুরী রাজি না হন, তাহলে তিনি কোনো অর্থ দেবেন না। অন্য কোনো উপায় না থাকায় চারু চৌধুরী মৌখিকভাবে এ শর্ত মেনে নেন এবং শেষ পর্যন্ত মহারাজের পক্ষে খাজনা জমা দিয়ে তালুকদারি লাভ করেন। এই তালুকদারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নূরনগর পরগনার তালুকদারি ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে নবীনগর থানার নারায়ণপুর, ইব্রাহিমপুর ইত্যাদি গ্রাম পর্যন্ত এই তালুকদারি বিস্তৃত ছিল। দুষ্টু লোকেরা বলে, তালুকদারি পাওয়ার পর চারু চৌধুরী প্রতিশ্রুত দশ ভাগ শরিকানা ভগবান দাসকে দেননি। তিনি নিজে তালুকদারির ১০ আনা মালিকানা গ্রহণ করেন এবং ৬ আনা অংশ ভগবান দাসকে প্রদান করেন। এতে ভগবান দাসের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। চারু চৌধুরী এবং ভগবান দাস উভয়েই আগরতলা মহারাজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কণিকাড়া গ্রামে তালুকদার হিসেবে বসতি স্থাপন করেন। ভগবান দাস কণিকাড়া গ্রামেই মারা যান। তাঁর চিতার ওপরে কণিকাড়ার তিতাস নদীর তীরে বিরাট মঠ নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মঠের পাশে তার আরেক আত্মীয়েরও মঠ রয়েছে। ভগবান দাসের উত্তরাধিকারীরা এই তালুকদারি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।
কণিকাড়ায় চৌধুরী বাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন চারু চৌধুরী। চারু চৌধুরীর ছিল তিন ছেলে। আফসার উদ্দিন চৌধুরী, গাজীউদ্দিন চৌধুরী (তিনি গাজী চৌধুরী নামে পরিচিত) ও রেহানউদ্দিন চৌধুরী। তার এক মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল অজিবেন্নেছা চৌধুরী। তিনি অজিবেন্নছা চৌধুরীকে বিষ্ণুপুর গ্রামে বসবাসরত তাঁর ভ্রাতুপুত্র আক্তার জমান চৌধুরীর (সম্ভববত আক্তার জামান চৌধুরী) সঙ্গে বিয়ে দেন। আক্তার জমান চৌধুরী কণিকাড়ায় বসতি স্থাপন করার এক দশকের মধ্যেই মারা যান।
চারু চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ছেলে আফসার উদ্দিন চৌধুরীর দুই পুত্র ছিল। সাদত উদ্দিন চৌধুরী ও রেয়াজউদ্দিন চৌধুরী। এঁরা তালুকদারির আয়কে বিলাসের জন্য ব্যয় করতেন। এঁদের বিলাসিতার ফলে এরা ১৯৪০-এর দিকেই দেউলিয়া হয়ে যান। রেহানউদ্দিন চৌধুরী অল্প বয়সে মারা যান। তিনি সিরাজউদ্দিন চৌধুরী নামে এক ছেলে রেখে যান। সিরাজউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ছিল শামসুদ্দিন চৌধুরী।
গাজী চৌধুরী তিন বিয়ে করেন। বরিকান্দি দেওয়ান বাড়ির প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি সরাইলে শাহবাজপুর গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি নারায়ণপুর গ্রামে পীর বংশে তৃতীয় বিয়ে করেন। তাঁর ছিল মোট এক পুত্র ও সাত কন্যা।
আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও কণিকাড়া চৌধুরী পরিবারে লেখাপড়ার প্রচলন হয়নি। শুধু আমিনুল ইসলাম চৌধুরী নামে রেহানউদ্দিন চৌধুরীর একজন বংশধর ১৯৪০-এর দশকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। গাজী চৌধুরীর একমাত্র ছেলে অলি আহমদ চৌধুরী তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের নাম রাখেন আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৬১ সালে তিনি কণিকাড়া চৌধুরী বাড়ির দ্বিতীয় স্নাতক হন। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত চৌধুরী বাড়িতে আর কেউ কোনো ডিগ্রি লাভ করেননি। আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি না করায় এঁদের শহরে অভিবাসন সম্ভব হয়নি। এর ফলে চৌধুরী পরিবারের প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ সন্তানই কণিকাড়া গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটা আঁকড়ে পড়ে আছেন। এদের অনেকেই আর্থিক দিক থেকে দুস্থ। একসময় যেসব পরিবার চৌধুরী বংশে দাস হিসেবে কাজ করত, বর্তমানে বিদেশে অভিবাসনের ফলে সেসব বংশের অনেকেই চৌধুরী বাড়ির সন্তানদের চেয়ে অনেক বেশি সচ্ছল।
গাজী চৌধুরী ১৩২২ বঙ্গাব্দের ৪ আশ্বিন (আনুমানিক ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ) মারা যান। গাজী চৌধুরীর একমাত্র ছেলে অলি আহমদ চৌধুরী তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তালুকদারি দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লায় বাজগড়া গ্রামে জমিদার বংশে বিয়ে করেন। দুষ্টু লোকেরা বলে যে তার শ্বশুর তাঁকে পরামর্শ দেন, যদি সাত বোনকে তাদের ন্যায্য অংশ দেওয়া হয়, তাহলে তালুকদারির মাত্র ২২ দশমিক ২২ শতাংশ আয় অলি আহমদ পাবেন। এই আয়ে ঠাটবাট রেখে তার পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব হবে না। তাই তাকে পরামর্শ দেওয়া হলো তালুকদারির খাজনা যথাসময়ে পরিশোধ না করে তালুকদারিকে নিলামে তুলতে হবে এবং নিলাম থেকে তিনি পুরো তালুকদারি নিজের নামে ক্রয় করবেন। এ ব্যাপারে কুমিল্লার একজন অবসরপ্রাপ্ত জজের (সম্ভবত ইব্রাহিম মিয়া) কাছ থেকে তিনি পরামর্শ নিচ্ছিলেন। তালুকদারি নিলামে ওঠার পর ইব্রাহিম মিয়া দেখলেন যে তিনি নিজেই এই তালুকদারি ক্রয় করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। তিনি অলি আহমদ চৌধুরীকে তালুকদারি না কিনে দিয়ে নিজেই ওই তালুকের মালিক হয়ে যান। এই অবস্থায় অলি আহমদ চৌধুরী নিঃস্ব হয়ে যান। তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস হয়ে দাঁড়ায় তাঁর পিতার মালিকানাধীন চাষের জমিসমূহ। এর ফলে তিনি তাঁর তিন। ছেলের মধ্যে দুই ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্তও পড়াতে পারেননি। তার একমাত্র ছেলে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী তার ফুফুদের ও মামার সহায়তা। নিয়ে বিএ পাস করেন। তাঁর চার কন্যার কেউই লেখাপড়ার সুযোগ পাননি।
অলি আহমদ চৌধুরী তার বোনদের ফাঁকি দিলেও তার বোনদের প্রায় সবারই ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছিল। অলি আহমদ চৌধুরীর তিনজন বড় বোন ছিল। জ্যেষ্ঠতম বোনের নাম ছিল জাহেরা খাতুন চৌধুরী। তাঁকে কুমিল্লা শহরে আমীর আহমদ চৌধুরী নামে একজন জমিদারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। জাহেরা খাতুনের চার ছেলে ছিল। এঁদের একজন কুমিল্লায় প্রথিতযশা চিকিৎসক ছিলেন। এক পুত্র শিল্প ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। আরেক পুত্র অধ্যাপক এবং অন্য এক পুত্র যুক্তরাজ্যে সিএ হিসেবে কর্মরত।
গাজী চৌধুরীর দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ কন্যার নাম ছিল তাহেরা খাতুন। কসবা থানার ছতরা গ্রামে মৌলানা আবদুল খালেকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। মৌলানা আবদুল খালেক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে আরবি বিভাগ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ফুরফুরার পীর সাহেবের খলিফা ছিলেন এবং খাজা নাজিমউদ্দিনসহ বাংলাদেশের মুসলিম লীগের অনেক নেতাই তাঁর মুরিদ ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ইসলামিক অ্যাডভাইজারি কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি মুসলিম লীগের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচনের কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে প্রথম ছেলে ব্রিগেডিয়ার কুদুস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক ইএমই (তড়িৎ কৌশল, যান্ত্রিক এবং বৈদ্যুতিন বিভাগ) বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং বাংলাদেশেও তিনি গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানার প্রধান ছিলেন। তাঁর এক ছেলে (জাহেদ কুদুস) সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এয়ারভাইস মার্শাল পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। খালেক সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে কাউসার পিতার ঘরানার পীর ছিলেন।
গাজী চৌধুরীর তৃতীয় জ্যেষ্ঠ কন্যার নাম ছিল মাহমুদা খাতুন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় কণিকাড়া চৌধুরী বাড়ির অলি আহমদ চৌধুরীর। অলি আহমদ চৌধুরী ছিলেন গাজী চৌধুরীর একমাত্র বোনের ছেলে। তাঁর পিতা ছিলেন চারু চৌধুরীর ভ্রাতুস্পুত্র। এই পরিবারের দুই ছেলে যদিও লেখাপড়ায় তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি কিন্তু এরা ব্যবসায় ও বিনিয়োগে অর্থ কামাই করেছেন বলে উভয়েই ঢাকায় স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তুলেছেন। এঁদের এক ভাইয়ের তিন ছেলের মধ্যে দুজনই আয়ারল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছেন।
গাজী চৌধুরীর চতুর্থ কন্যা আয়শা খাতুন অলি আহমদের ছোট বোন। তাঁর বিয়ে হয় হোমনা থানায় দৌলতপুর গ্রামের এ এস এম লুফুল হকের সঙ্গে। হক সাহেব বিত্তবান ছিলেন এবং তাঁদের ছেলেরা লেখাপড়া শিখেছেন। বর্তমানে সবাই ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।
গাজী চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করেন সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের খুরশেদা বেগম চৌধুরানীকে। তিনি দুই কন্যা রেখে মারা যান। প্রথম কন্যার নাম হাজেরা খান। তিনি আমার মা এবং রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির আমীর আলী খাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দ্বিতীয় কন্যার নাম ছিল সুফিয়া খাতুন। তিনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। গাজী চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়ের জামাই মৌলানা আবদুল খালেকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মো. ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি অল্প বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান।
দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার পর গাজী চৌধুরী নারায়ণপুর গ্রামে পীর বংশের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। তাঁর একটিমাত্র কন্যাসন্তান হয়, যার নাম ছিল অজিফা খাতুন। তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলার জিল্লুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়। জনাব রহমান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন এবং তার অনেক বিষয়সম্পত্তি ছিল। তাদের পাঁচ ছেলের মধ্যে দুই ছেলে প্রকৌশলে স্নাতক এবং উঁচু সরকারি পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। চার কন্যার মধ্যে দুই কন্যাই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ি এবং কণিকাড়া চৌধুরী বাড়ি ও তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে যেসব মুসলমান শরিফ পরিবারের নাম পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বহিরাগত ছিলেন। একমাত্র খাঁ বাড়ি ছাড়া আর বাকি সব শরিফ পরিবার তাদের বংশ উত্তর ভারত কিংবা পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত বলে দাবি করে থাকেন। শুধু খাঁ বাড়ির সদস্যরা তাদের উৎপত্তি বাংলাদেশেই বলে স্বীকার করেন। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণ থেকে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে দাবি করেন। তাই নিম্ন শ্রেণির হিন্দু থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাদের চেয়ে উচ্চতর মর্যাদার দাবিদার খাঁ বাড়ির লোকেরা। দ্বিতীয়ত, এ শরিফ পরিবারগুলোর বর্তমান আর্থিক অবস্থা নির্ভর করে তাঁরা কে কত আগে তাঁদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। খাঁ বাড়ি তার সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করেন এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই তারা ঢাকায় তাদের ছেলেদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে আর্থিক দিক থেকে এঁরা অপেক্ষাকৃত সফল। আর্থিক সচ্ছলতাই তাঁদের বিদেশের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। খাঁ বাড়ি তাই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু দেশে তার অস্তিত্ব আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। অন্য শরিফ পরিবারগুলোর বেশির ভাগ সদস্য এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছেন। কিন্তু বিশ্বায়নের আহ্বান সম্ভবত তারাও প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। ফলে এসব পরিবারের সদস্যরাও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বেন।
রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ির অবদান
রসুল্লাবাদ গ্রামে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত খাঁ বাড়ির দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। তারা ছিলেন তালুকদার, ছিলেন অনেক জমির মালিক এবং বিরাট বড়লোক। এ ধরনের পরিবার গ্রামে থাকলে সাধারণত গ্রামের গরিব মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্র লোকেরা যখন তাঁদের শাকসবজি অথবা গৃহপালিত মোরগ, ছাগল, গরু অথবা দুধ বিক্রি করার জন্য বের হতেন, তখন এগুলো অনেক ক্ষেত্রে খাঁ বাড়ির সদস্যরা কিনে নিতেন। কিন্তু দরিদ্র লোকদের অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য দাম দেওয়া হতো না। এ ধরনের অত্যাচার হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটে থাকতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনার স্মৃতি রসুল্লাবাদ গ্রামের মানুষের মনে নেই।
তিনটি ক্ষেত্রে এখনো রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ির অবদান দেখা যায়। প্রথমত, রসুল্লাবাদ গ্রামে কোনো বাজার ছিল না। খাঁ বাড়ির সদস্যরা তাদের নিজেদের জায়গায় দোকানপাট খোলার ব্যবস্থা করে বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। সম্প্রতি বাজারের পাশে যে বিরাট খাল ছিল, সে খালটি ভরাট করা হয়েছে। খালের ভরাট করা অংশে রাস্তা করা হয়েছে এবং কিছু দোকানপাট করা হয়েছে। তবে এ অংশে রাইস মিল, কাঠ কাটার জন্য স মিল–এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকান এখনো খাঁ বাড়ির প্রতিষ্ঠিত বাজারেরই অন্তর্ভুক্ত। বাজার স্থাপন করাতে খাঁ বাড়ির লোকজনের যে রকম সুবিধা হয়েছে, তেমনি সারা গ্রামের লোকজন উপকৃত হয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে খাঁ বাড়ির বিশেষ অবদান রয়েছে। রসুল্লাবাদ উলফত আলী খাঁ উচ্চবিদ্যালয় খ বাড়ির সদস্যরা প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের মূল জমির মালিক ছিল খাঁ বাড়ি। স্কুলের জন্য তারা জমি দান করেন। পরে অবশ্য গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে স্কুলের জমির পরিমাণ বাড়ান। প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলের জন্য খাঁ বাড়ির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়। এই স্কুলে রসুল্লাবাদ এবং তার আশপাশের অনেক দরিদ্র কৃষকদের সন্তানেরা শিক্ষা লাভ করার পর দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উচ্চপদ লাভ করেন। খ বাড়ির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এখনো স্কুলটি উলফত আলী খাঁ উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিত।
ক্রীড়াক্ষেত্রেও খাঁ বাড়ির বিশেষ অবদান রয়েছে। দুটি খেলার মাঠ খ বাড়ির জমির ওপরে তৈরি করা হয়েছে। একটি খেলার মাঠে এখনো নিয়মিত ফুটবল খেলা হয়। এই মাঠে প্রতিবছর ফুটবল লিগ খেলা হয়। আরেকটি মাঠের কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেছে। এই মাঠে এখনো গ্রামের ছেলেরা। ক্রিকেট খেলে থাকে।
রসুল্লাবাদ গ্রামে খাঁ বাড়ি ছাড়া আরও ধনী পরিবার ছিল। পাল পরিবার নামে একটি তালুকদার পরিবার ছিল। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দারোগা নোয়াব কিশোর পাল। তার ছেলে সুকুমার পাল রসুল্লাবাদ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ছেলে পবিত্র পাল বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত রয়েছেন। পাল পরিবার ১৯৭২ সালে তাদের বাড়ি কলকাতার নিকটস্থ এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে বিনিময় করে। বর্তমানে কলকাতার অভিবাসী পরিবার এই বাড়িতে বসবাস করছে। দারোগা নোয়াব কিশোরকে বাড়ির কাছেই দাহ করা হয় এবং তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি মঠ নির্মাণ করা হয়, যা এখনো রয়েছে। এই পরিবার বা কোনো হিন্দু অভিজাত পরিবার গ্রামের হিন্দুদের জন্য অথবা গ্রামের সার্বিক উন্নতির জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য দান করেনি।
খাঁ বাড়ি ছাড়া রসুল্লাবাদ গ্রামের জন্য দান করেছে আরেকটি মুসলমান পরিবার। এই পরিবারটি অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের পরিবার। সাইদুর রহমানের বাড়ি খাঁ বাড়ির পাশেই। তিনি একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাল্যকালে তার ডাকনাম ছিল ‘ফেইরার বাপ’। অনেক কষ্টে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপক ছিলেন এবং পরে বাংলাদেশে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামের গরিবদের সাহায্য করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র লোকদের চিকিৎসা করার জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেন।
সাইদুর রহমানের অভিযোগ ছিল যে খাঁ বাড়ির যত কৃতী সন্তান রয়েছে, তার তুলনায় তাঁরা রসুল্লাবাদ গ্রামের জন্য বিশেষ কিছু করেননি। এ কথা সত্য যে রসুল্লাবাদ গ্রামের উন্নয়নের জন্য খাঁ বাড়ির আগের প্রজন্মের যত আগ্রহ ছিল, পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে তত আগ্রহ নেই। তার কারণ হলো গত আশি বছর ধরে এই পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসন করেছে। এদের অনেকেই জীবনে এক রাতও রসুল্লাবাদে থাকেননি। বিশেষ করে গ্রামে দলাদলির ভয়ে এরা গ্রামের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েননি। তবে হাবিবুল্লাহ খান সংসদ সদস্য থাকাকালে রসুল্লাবাদ গ্রামে পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। আশির দশকে বাংলাদেশ টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের সভাপতি মাকসুদ আলী খাঁন একটি পাবলিক কল অফিস স্থাপন করেন। এঁরা দুজনে গ্রামের কিছু ছেলেকে চাকরিও দিয়েছেন।
পাদটীকা
১. শরিফউদ্দিন আহমদ, ঢাকা : ইতিহাস ও নগরজীবন ১৮৪০-১৯২১, ২০০১, একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৯২