প্রথম অধ্যায়
পূর্বাভাস
প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডব্লিউ এইচ অডেন (W. H. Auden) আত্মজীবনী লেখার সমস্যা সম্পর্কে একটি সুন্দর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘Every autobiography is concerned with two characters : Don Quixote, the Ego and a Sancho Panza, the Self.’ বিখ্যাত স্প্যানিশ ঔপন্যাসিক স্যারভান্টিসের (Cervantes) উপাখ্যান ডন কিহটিতে দুটি প্রধান চরিত্র রয়েছে। উপাখ্যানের নায়ক হলেন ডন কিহটি (Don Quixote)। তিনি আত্মগরিমায় বিভোর। তিলকে তাল করে দেখেন, যা কিছু করেন তার কাছে। তাই মনে হয় অসাধারণ। পক্ষান্তরে তার অমাত্য সাঙ্কো পাঞ্জা (Sancho Panza) একেবারেই সাদামাটা মানুষ, অতিরঞ্জন তার ধাতেই নেই। যা সাধারণ মানুষের কাছে সত্যি বলে মনে হবে, সেটাই তিনি বলেন। আত্মজীবনীকার তাই একই সঙ্গে ডন কিহটি ও সাঙ্কো পাঞ্জার সমাহার। তিনি ডন কিহটির মতো নিজের অর্জনের ঢাকঢোল পেটাতে ব্যস্ত। আবার তিনি অনেক সময় সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে এসে সত্য কথা লেখার চেষ্টা করেন। অতিরঞ্জন ও সত্যের সংমিশ্রণে আত্মজীবনী রচিত হয়।
আত্মজীবনী শুধু নিজের গরিমা প্রচারের জন্য লেখা হয় না, অনেক ক্ষেত্রে আত্মজীবনী লেখা হয় নিজের সুনাম রক্ষা করার জন্য। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ 56369, ‘Histery is written by the victor; autobiography is written by the vanquished।’ যুদ্ধে যারা জয়লাভ করে, তারা শুধু শত্রুকেই পরাজিত করে না, যুদ্ধের বিবরণও তাদের মর্জিমাফিক লেখা হয়। যারা পরাজিত হয়, তাদের বক্তব্য ইতিহাসে গৃহীত হয় না। তবু যারা হারে, তারা হার স্বীকার করতে চায় না। তাই তারা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে আত্মজীবনী লেখে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো সৎ আত্মজীবনী নেই। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘There is no truly honest autobiography. একজন সমালোচক তাই দাবি করেছেন, ‘There is no such thing as autobiography, there is only art and lies.’ আত্মজীবনী বলে কিছু নেই, আত্মজীবনীতে যা থাকে তা হলো সুন্দর করে কথা বলার দক্ষতা এবং মিথ্যা।
আত্মজীবনী কতটুকু সত্য ও কতটুকু মিথ্যা, তা যাচাই করতে হলে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে গোপাল ভাঁড়ের একটি চুটকি স্মরণ করা যেতে পারে। কথিত আছে, একবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাড়ের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি গোপাল ভাঁড়কে শাস্তি দেওয়ার জন্য তার মন্ত্রীকে বললেন, এমন একটি প্রশ্ন তৈরি করো, যার উত্তর গোপাল ভাঁড় দিতে পারবে না। তাহলেই তার গুমর ফাঁস হয়ে যাবে। মন্ত্রী অনেক চিন্তা করে রাজাকে পরামর্শ দিলেন যে গোপাল ভাঁড়কে জিজ্ঞেস করুন, সত্য থেকে মিথ্যা কত দূরে। মহারাজ এ প্রশ্ন করাতে গোপাল ভাঁড় জবাব দিলেন, ‘সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক খুবই কম। রাজা বললেন, কত কম সেটা বলতে হবে।’ গোপাল ভাঁড় তার বাম হাতটি দিয়ে তার কান এবং ডান হাতটি দিয়ে চোখ ঢেকে বললেন, কান এবং চোখের দূরত্ব যতটুকু, সত্য এবং মিথ্যার দূরত্ব মাত্র ততটুকু। মহারাজ বললেন, এটা কীভাবে নির্ণয় করেছ? গোপাল ভাঁড় বললেন, যা কানে শোনা যায় তার বেশির ভাগই মিথ্যা, যা চোখে দেখা যায় কেবল সেটাই সত্য। তবে গোপাল ভাঁড় যদি আজকে এই জবাব দেন, তাহলে তার জবাব সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হবে না। যা চোখে দেখা যায় তার সবকিছুই সত্য নয়, চোখেও ভুল দেখা যেতে পারে। এই বিভ্রান্তি মনস্তাত্ত্বিক হতে পারে আবার বিভ্রান্তি চোখের ত্রুটির জন্যও হতে পারে। আত্মজীবনীর লেখক সত্য কথা লিখতে চাইলেও সব সময় সত্য কথা লিখতে পারেন না।
এর দুটি কারণ রয়েছে। এ কারণ দুটি সম্পর্কে জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার arty (Gunter Grass) লিখেছেন, ‘Over the years, I had something in principle against autobiographical writing altogether because memory plays tricks on us, and we also tend to reinvent ourselves.’ সত্য জানা থাকলেও সব সময় সত্য লেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মজীবনীকারের কাছে ঘটনাবলি সম্পর্কে দলিল-দস্তাবেজ থাকে না। তাঁকে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে লিখতে হয়। অনেক সময়ই স্মৃতি প্রতারণা করে, আবার সত্য লিখতে গিয়েও অনেকে সত্যের ওপর রং চাপিয়ে দেন। এর ফলে। সত্য আর নির্ভেজাল সত্য থাকে না। অনেক আত্মজীবনীকার তাদের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার জন্য লেখেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আত্মজীবনী লেখকেরা দুষ্কর্মের দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হন না। দুষ্কর্মের দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক Time-এর প্রকাশক ও সম্পাদক ক্লেয়ার বুথ লুস (Clare Boothe Luce) লিখেছেন, ‘Autobiography is mostly alibiography’ আত্মজীবনী হচ্ছে দুষ্কর্ম ঘটার সময় অনুপস্থিত থাকার ওজর বা অজুহাত। লেখকেরা সাধারণত খারাপ কাজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান। শুধু তা-ই নয়, অনেকে ভিন্নমত মেনে নিতে রাজি নন। তাই একজন সমালোচক লিখেছেন, ‘If I wrote Autobiography, I would like to sue the author for defamation.’ সত্যিকারের আত্মজীবনী লিখলে লেখকের নিজেরই নিজের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে ইচ্ছা করবে।
আত্মজীবনী লেখার এত সমস্যা, তবু মানুষ কেন আত্মজীবনী লেখে? একজন দুমুখ ব্যক্তি বলেছেন, ‘Any one who writes autobiography is either a twat or broke.’ আত্মজীবনী যারা লেখেন তারা হয় বেকুব, অন্যথায় দেউলিয়া। দেউলিয়া ব্যক্তিরা অর্থলোভে আত্মজীবনী লিখতে পারেন।
আত্মজীবনী সাধারণত দুই ধরনের ব্যক্তিরা লেখেন, এক ধরনের ব্যক্তি হলেন তাঁরা, যারা জীবনে বিরাট অর্জন করেছেন। ভবিষ্যতে যারা বড় হতে চান, তাঁরা সফল ব্যক্তিদের আত্মজীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমার অর্জন অতি সামান্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমার আত্মজীবনী লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আরেক ধরনের আত্মজীবনীকার যারা জীবনে এত খারাপ কাজ করেছেন যে তাঁরা স্বীকারোক্তি লিখতে চান; যেমন লিখেছেন সেন্ট অগাস্টিন। আমার জীবনে সেন্ট অগাস্টিনের মতো স্বীকারোক্তি লেখার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। আত্মজীবনী লেখার জন্য বিশেষ কোনো তাগিদ আমি অনুভব করিনি।
তাই প্রশ্ন ওঠে, আমার আত্মজীবনী লেখার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা আছে কি না। এ কথা সত্যি, আত্মজীবনীতে সব সময় নির্ভেজাল সত্য কথা লেখা হয় না। কী লাভ হবে মিথ্যা কথা বলে এবং আত্মগরিমা প্রচার করে? এসব অভিযোগ যেমন সত্য, অন্যদিকে আত্মজীবনী প্রকাশে অনেক সময় বাধ্যবাধকতা থাকে।
আমার ক্ষেত্রে তিনটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রথমত, আমার একমাত্র সন্তান নেহরীন খানকে আমার আত্মজীবনী লিখব বলে কথা দিয়েছিলাম। কথা দেওয়ার কারণ ছিল, নেহরীন খান আমার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানতে চান। রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির ইতিহাস এখনো কেউ লেখেননি। আমি তাকে কথা দিয়েও ব্যস্ততার জন্য কাজটি শুরু করতে পারিনি। তিনি আমার ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে নিজেই আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন। তবে তিনি তার কাজ শেষ করতে পারেননি, দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমি আত্মজীবনী লেখার তাগাদা ভেতর থেকে অনুভব করছি।
দ্বিতীয়ত, ২০০৬ সালে আমি মরহুম ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আমার মতানৈক্য হয়। আমি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করি। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে আমার মতানৈক্যের কারণ ছিল তাঁর নির্লজ্জ দুর্নীতি। উপরন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বিদায়ী সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে তিনি তাদের নিতান্ত আজ্ঞাবহ ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আরও তিনজন সহকর্মীসহ আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করি। সে সময় গণমাধ্যমের কর্মীরা আমার কাছ থেকে সব বক্তব্য শুনতে চান। আমি তাদের সবকিছু জানাইনি এবং প্রতিশ্রুতি দিই আমার আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে আমি লিখব। এখনো গণমাধ্যমের কোনো কোনো প্রতিবেদক আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখিনি।
তৃতীয়ত, আমার কর্মজীবনের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের জগতে অতিবাহিত হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আত্মজীবনী পাঠ করে আমলাতন্ত্রের বর্তমানে যেসব কর্মকর্তা কর্মরত আছেন, তারা তাদের পূর্বতন কর্মকর্তারা কীভাবে সফল অথবা ব্যর্থ হয়েছেন, সে সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। অন্যান্য পেশায় আত্মজীবনী গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত না হলেও আমলাতন্ত্রে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই আত্মজীবনীর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা সত্ত্বেও অনেক আমলা তাদের আত্মজীবনী লেখেন। অনেক আমলা আত্মজীবনীতে তাঁর বিবেচনায় ‘সাফল্য’-এর জন্য উল্লাস প্রকাশ করেন এবং ব্যর্থতার দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেন।
উচ্চপদস্থ আমলাদের আত্মজীবনী লেখার আরেকটি বড় সমস্যা রয়েছে। সরকারের উচ্চ পদে যারা কাজ করেন, তারা রাষ্ট্রের অনেক গোপন তথ্য জানেন। এসব তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা অনাকাঙ্ক্ষিত; অনেক ক্ষেত্রে তা আইনের বরখেলাপ। তাই অনেক আমলার পক্ষে সব সত্য লেখা সম্ভব হয় না। আবার কোনো কোনো আমলা তাঁদের বইয়ের বিক্রি বাড়াতে অনেক গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করেন। এসব তথ্য অনেক ক্ষেত্রে সত্য, অনেক ক্ষেত্রে বানোয়াট। সরকারের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আমার পক্ষে আত্মজীবনীতে সব তথ্য পরিবেশন করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের সমস্যা ভারতের শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনী লেখার সময়েও ঘটেছিল। ভারত বিভাগের সময় তিনি ছিলেন নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি। কংগ্রেসে তার সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলেন জওহর লাল নেহরু। মাওলানা আজাদ এ সময় জওহর লাল নেহরু এবং কংগ্রেসের কোনো কোনো নেতার ভূমিকায় আদৌ সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু জওহর লাল নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য থেকে তাঁর সমালোচনা করা মোটেও শোভনীয় নয়। তিনি বইটি লেখেন। কিন্তু বইটি প্রথম প্রকাশ করার সময় বিতর্কিত ৩০টি পৃষ্ঠা আপাতত না ছেপে ব্যাংকের ভল্টে রেখে দেন। তাঁর প্রসিদ্ধ বই ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম বইটি প্রথম সংস্করণ তার বিতর্কিত ৩০ পৃষ্ঠা ছাড়া প্রকাশিত হয়।[১]
মাওলানা আজাদের অনুকরণে আমি তথ্যের গোপনীয় রক্ষার চেষ্টা করতে পারি। মাওলানা আজাদ প্রথমে পুরো বইটি লিখেছিলেন। তারপর বিতর্কিত অংশগুলো চিহ্নিত করেছিলেন। আমি বইটি দুই খণ্ডে লিখতে চাই। প্রথম খণ্ডের সময়কাল হলো ১৯৪৪ সালে আমার জন্ম থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কানাডিয়ান কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করার জন্য দেশ ত্যাগ পর্যন্ত। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আমি নিম্নপর্যায়ে সরকারের কর্মকর্তা ছিলাম। তাই এই সময়কালে সরকারি কাজের গোপনীয়তার বড় সমস্যা ছিল না। পরবর্তী সময়ে আমি সরকারের অনেক উঁচু দায়িত্ব পালন করেছি। সে সময়ে গোপনীয়তার অনেক সমস্যা রয়েছে। এই সময়ের স্মৃতিকথা আমি দ্বিতীয় খণ্ডে লিপিবদ্ধ করব। দ্বিতীয় খণ্ডটি আমি লিখে রেখে যাব। দ্বিতীয় খণ্ডের লেখা শেষ হলে এটি কখন প্রকাশিত হবে, এ সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়ে যাব।
প্রথম খণ্ডের রূপরেখা
প্রথম খণ্ডে ১৫টি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পূর্বাভাসে আত্মজীবনী লেখার বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এসব সমস্যা সত্ত্বেও আমি শেষ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া এ অধ্যায়ে প্রথম খণ্ডের রূপরেখা সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।
আত্মজীবনীর প্রথমেই পূর্বপুরুষদের শিকড়ের সন্ধান করার রীতি রয়েছে। আমার ক্ষেত্রে এ রীতি পালন করার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। আমার পিতৃবংশ রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরনের। বেশির ভাগ অভিজাত মুসলমান পরিবার গর্ববোধ করে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মধ্যপ্রাচ্যের শরিফ গোষ্ঠীর বংশধর। সামান্য কিছু পরিবার দাবি করে যে তারা এ দেশে উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবার থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। রসুল্লাবাদ খ বাড়িও এ ধরনের দাবি করে থাকে। এ সম্পর্কে কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। তবে এই ইতিহাস শোনা ইতিহাস (Oral history), বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ইতিহাসের সমর্থনে কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শোনা ইতিহাসের ভিত্তিতে রসুল্লাবাদ খ বাড়ির প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস রচনার চেষ্টা করা হয়েছে। উপরন্তু এ অধ্যায়ে আমার মায়ের বংশ কণিকাড়া চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।
রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির অনেক কৃতী পুরুষ জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা রসুল্লাবাদের জীবনকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য, তাঁদের বর্ণনা তৃতীয় অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
আমার বংশের সন্তানেরা নবীনগর থানায় মানুষ হয়েছে। খাঁ বাড়ির সদস্যদের জীবনের বিবর্তন বুঝতে হলে আমাদের বিশ শতকে নবীনগরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণার প্রয়োজন রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে তাই নবীনগরের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সরকারের নথিপত্রে আমার জন্মতারিখ ২ আগস্ট ১৯৪৪। এ জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে আমার শৈশব এবং কৈশোর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমার স্মৃতি পঞ্চম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
১৯৫৯ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। গ্রাম থেকে শহরে আমার উত্তরণ ঘটে। ঢাকা কলেজে অনেক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ছিলেন অধ্যাপক, তাঁদের সংস্পর্শে আসি। ঢাকায় অনেক বড় বড় পাঠাগারে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। কলেজে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল স্কুলের তুলনায় ব্যাপক। ঢাকা কলেজে আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়। যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, তাদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমৃত্যু এবং যারা বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে এখনো সম্পর্ক বজায় রেখেছি। ঢাকা কলেজের স্মৃতি ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
১৯৬১ সালে আমার ঠাই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া যেমন শিখেছি, তেমনি জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে চার বছর ছিলাম। এ সময়ে প্রথম সামরিক আইনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর আমি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই এবং ১৯৬৭ সালে মেধার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে চাকরি পাই। সপ্তম অধ্যায়ে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমার উল্লেখযোগ্য স্মৃতিসমূহ লিপিবদ্ধ করেছি।
১৯৬৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ মাস আমি লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সে সময়ে আমাদের কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি এবং পেশোয়ারের পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ হয়। এ ছাড়া আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে, মধ্যাঞ্চল এবং পাঠান অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তিনটি সফরের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় তিন মাস কোয়েটা জেলায় জেলা প্রশাসন। সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সংযুক্ত ছিলাম। এ সময়ের অভিজ্ঞতা অষ্টম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
১৯৬৮ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসি এবং রাজশাহী জেলায় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (প্রশিক্ষণরত) হিসেবে কাজ শুরু করি। এ সময়ে প্রায় তিন মাসব্যাপী আমাদের জরিপ এবং ভূমি বন্দোবস্তের প্রশিক্ষণ রাজশাহী। জেলাতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে আমরা দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে। শিক্ষাসফর এবং দুই সপ্তাহের জন্য সচিবালয়ের কাজকর্ম দেখার জন্য ঢাকায় থাকি। এ সময়ের অভিজ্ঞতা নবম অধ্যায়ে লেখা হয়েছে।
১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর আমি হবিগঞ্জ মহকুমার দায়িত্ব গ্রহণ করি। মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমাকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে আমি দশম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। সবশেষে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যেসব প্রশ্ন দেখা দেয় এবং যা থেকে পরবর্তীকালে। আমি মিত্রপক্ষের গুলি হামটি ডামটি ব্যামো ও অন্যান্য সমস্যা সম্বন্ধে লিখেছি, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
একাদশ অধ্যায়ে ৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত সময়পর্বে মুক্ত হবিগঞ্জের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছি। ৩০ এপ্রিল আমি হবিগঞ্জ থেকে আগরতলা চলে যাই।
দ্বাদশ অধ্যায়ে আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আমি আগরতলায় ছিলাম। এরপর আমি কলকাতায় চলে যাই।
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে মুজিবনগর সরকারে আমার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এ ছাড়া কলকাতায় অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব ভাবনা মনে এসেছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি বাংলাদেশ সচিবালয়ে চাকরি শুরু করি। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করি। এ সময়ে সরকারে আমার কাজের অভিজ্ঞতা চতুর্দশ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
পঞ্চদশ অধ্যায়ে রয়েছে উপসংহার। আমার জীবনের প্রথম ২৯ বছরের। অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি যা শিখেছি, সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। আমি শুধু আত্মজীবনীই লিখিনি, আমি আত্মজীবনী লেখার সময়। আত্মবীক্ষণেরও চেষ্টা করেছি।
পাদটীকা
১. Maulana Abul Kalam Azad, India Wins Freedom, 1994, Delhi, Orient Longman