সপ্তম অধ্যায় – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল সার্ভিস ১৯৬১–১৯৬৭
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
কলেজ পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। প্রথম প্রশ্ন হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয় নিয়ে পড়ব। আমার মুরব্বিরা উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় না পড়ে কলা শাখায় পড়ায় আমার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। এবার উচ্চমাধ্যমিকের পর সবাই একবাক্যে উপদেশ দিলেন যে আমি যেন অর্থনীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, অর্থনীতি এবং বাংলা সাহিত্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। এই চারটি বিষয়ের মধ্যে আমি ইতিহাসকে বেছে নিই। এর কারণ হলো আমি বই পড়তে ভালোবাসতাম। সব ধরনের বই-ই আমি পড়তাম। অর্থনীতির গণ্ডি সীমিত, এখানে ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। শুধু তা-ই নয়, বেশির ভাগ সমস্যাই বর্তমান কালের। ইতিহাস শুধু বর্তমানে সীমাবদ্ধ নয়, মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনই পড়ানো হয় না। এখানে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও পড়তে হয়। মুরব্বিদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে আমি প্রায় জোর করে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে বিলাতের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আগে একটি হলে ভর্তি হতে হতো। হল নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা ছিল না। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সবচেয়ে সুন্দর হল ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। বিরাট এলাকাজুড়ে মুসলিম স্থাপত্যকে অনুকরণ করে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নির্মাণ করা হয়। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের সব ভালো ছাত্র সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভর্তি হতো। অবশ্য যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করত, তারা ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলকে পছন্দ করত। কারণ এ দুটি হল ছিল কার্জন হলের পাশে। কার্জন হলে বিজ্ঞান বিভাগসমূহের ক্লাস হতো, তাদের গবেষণাগারও ছিল কার্জন হলে। তাই এ দুটি হলে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা থাকতে পছন্দ করত। আমি যখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন এলিফ্যান্ট রোডের আনুদার বাসায় শহীদদার স্ত্রী বীথি ভাবি বেড়াতে আসেন। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভর্তি হব শুনে তিনি বলেন, ‘শুনেছি এই হলে দারুণ আড্ডা হয়। যারা নতুন ভর্তি হয়, তারা চারজন এক রুমে থাকে। চারজন রুমমেট গল্প-গুজব করেই সময় কাটায়, পড়াশোনা হয় না।’ তারপর তিনি বললেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট তাঁর পিতার বন্ধু। তিনি তাঁকে অনুরোধ করবেন, যাতে প্রথম বর্ষেই আমাকে এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ করা হয়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তিন ধরনের কক্ষ ছিল। এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ, দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ ও চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল যখন প্রথম চালু হয়, তখন হলে যথেষ্টসংখ্যক ছাত্র ছিল না। তাই অনেক ছাত্র চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে একা থাকত। পরে যখন ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যায়, তখন বাধ্য হয়ে চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে চারজন এবং দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে দুজন ছাত্রকে বরাদ্দ দেওয়া হতো। কিন্তু অনেক উচ্ছল ছাত্র ছিল যারা হল কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষকে এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে পরিণত করে একা থাকত। এ সম্পর্কে আমাদের প্রভোস্ট মজহারুল হক সম্পর্কেও গুজব ছিল। মজহারুল হক সাহেব চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে একা থাকতেন। তার কক্ষে যখনই কোনো নতুন ছাত্রকে বরাদ্দ দেওয়া হতো, তখন তিনি ছাত্রকে ভয় দেখাতেন, যাতে ছাত্র নিজেই দেনদরবার করে অন্য কক্ষে চলে যায়। কথিত আছে একবার এক ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মজহারুল হকের কক্ষে বরাদ্দ দিয়ে পাঠায় এবং তাকে বলে সে যেন মজহারুল হককে ভয় না করে। মজহারুল হকের বন্ধুরা এই বার্তা তার কাছে পৌঁছে দেন। মজহারুল হক তৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেন। তিনি রুমের একটি চৌকির ওপরে আরেকটি চৌকি তুলে দেন। নতুন বরাদ্দ পাওয়া ছাত্র এসে দরজায় ধাক্কা দিলে মজহারুল হক দরজা খুলে এক চৌকির ওপর রাখা আরেক চৌকি দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি একতলায় থাকবেন, না দোতলায় থাকবেন? এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন তিনি মাতাল। ছাত্রটি ভয় পেয়ে যায়। সে আর কক্ষে ঢোকেনি। পরে তদবির করে অন্য কক্ষে বরাদ্দ নেয়।
ভর্তির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলাম হলের প্রভোস্ট ড. মজহারুল হকের কক্ষে। একজন দীর্ঘদেহী ব্যক্তিত্ব। চলনে-বলনে সাহেবিয়ানার ছাপ। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছ। আমি বললাম, হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, তোমাকে একটি এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আমার বন্ধু ব্যারীর মেয়ে ফোন করেছিল (বীথি ভাবির আব্বা আবদুল বারী মালিক তখন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার বন্ধুরা বারীকে ব্যারী বলে ডাকত)। সাধারণত আমরা প্রথম বর্ষের ছেলেদের এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ দিই না। তবে তোমাকে দেওয়া যায় কি না, সেটা পরীক্ষা করার জন্য আমি পশ্চিম হাউসের হাউস টিউটর আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে অনুরোধ করেছি। তুমি কাল সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করো।
এরপর তিনি বেল বাজান। বেলের শব্দ শুনে পিয়ন এলে তাকে তিনি বলেন, ‘হেড ক্লার্ককে আসতে বলো।’ হেড ক্লার্ক আসার পর তিনি বললেন, ‘এই ছেলেকে ওয়েস্ট হাউসের হাউস টিউটরের অফিস কক্ষ কোথায় তা দেখিয়ে দিন।’
আমি মইজুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার কক্ষে এলাম। মইজুদ্দিন বললেন, ‘তোমার বাড়ি তো রসুল্লাবাদ।’ আমি উত্তর দিলাম, ‘জি’। তিনি বললেন, ‘তোমার ছোট চাচা মাহবুব আলী খাঁ আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। তিনি মারা গেছেন, তুমি আমাকে চাচা বলে ডাকবে।’
পরদিন হাউস টিউটরের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে ওয়েস্ট হাউসের নিচতলায় বাথরুমের পাশে একতলায় একটি এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ করেন। এই কক্ষে আমি দুই বছর ছিলাম। অনার্স পরীক্ষার বছর সব ছাত্রকেই এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই সূত্রে আমি তৃতীয় বছর পশ্চিম হাউসের দুইতলার সর্ব পশ্চিম এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ পাই। যারা অনার্সে প্রথম শ্রেণি পেত, তাদের এমএ পড়ার বছরটিতে এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ দেওয়া হতো। আমি তাই একই কক্ষে দ্বিতীয় বছর অবস্থান করি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমি মাত্র তিন মাস সময় ছাড়া বাকি সময় এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে থেকেছি। আমি যখন হলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন আমাকে তিন মাস একটি দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে থাকতে হয়েছিল। যারা অনার্স পরীক্ষা দিত, তাদের কমপক্ষে তিন মাসের জন্য এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ বরাদ্দ দিতে হতো। একজন তৃতীয় বর্ষের অনার্স ক্লাসের ছাত্রের জন্য আমাকে তিন মাস দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে থাকতে হয়েছিল। এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে আমার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বিছানা অগোছালো থাকত, বইপত্র যেখানে-সেখানে পড়ে থাকত। আমার কক্ষে সাধারণত আড্ডা বসত না। রাতে আমি অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারতাম। তবে দুই শয্যা কিংবা চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে বেশি রাতে পড়াশোনা করলে সহপাঠীদের। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্র থাকাকালে আমি সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টায় ঘুম থেকে উঠতাম। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে চলে যেতাম ক্যানটিনে। সেখানে চা-নাশতা খেয়ে রুমে ফিরে এসে গোসল করতাম। তারপর সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ক্লাস থাকত। ক্লাসের শেষে বের হয়ে মধুর ক্যানটিনে চা-শিঙাড়া ইত্যাদি খেতাম এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তখন আড্ডা দিতাম। দুপুরের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে আমি হলে ফিরে আসতাম। তখন হলের ডাইনিং রুমে অনেক রাতে সব সময় খাবার থাকত না। হলের ডাইনিং রুম সকাল সাড়ে ৯টায় খোলা হতো। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্র তাদের খাবার খেত। আমি সাধারণত দেড়টা থেকে আড়াইটার মধ্যে খেতে আসতাম। তখন অনেক সময় মাছ অথবা গোশত, যা ছিল প্রধান। খাবার, তা শেষ হয়ে যেত। আমাদের তখন দুটি ডিম ভাজি করে দেওয়া হতো। খাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর আমি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম পাঠাগারে পড়ার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার তখন একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। ওই পাঠাগারে বিভিন্ন বই আমি পড়তাম। পাঠ্যবই সবই পাওয়া যেত কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সব পাতা পাওয়া যেত না। অনেক ছাত্র নোট করার জন্য বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো ব্লেড দিয়ে কেটে নিয়ে যেত। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুসারে বইটি পাঠাগারে রয়েছে, সেহেতু বইটির কোনো নতুন কপি সংগ্রহ করা হতো না। ব্লেডে কাটা পাতা উদ্ধার করার জন্য আমরা আগের বছরের ছাত্রদের ওই বিষয়ের ওপরে নোট খুঁজতাম। অনেক নোটে হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলোর অনেক তথ্য পাওয়া যেত। মধ্যযুগের ইতিহাস সম্বন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই চুরি হয়ে যায়। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে বইটি ছিল। আমি তার কাছ থেকে বইটি এক সপ্তাহের জন্য ধার নিয়ে পুরো বইটি একটি খাতার মধ্যে কপি করে রাখি।
পাঠাগার থেকে রাত সাড়ে ৮টা-৯টায় হলে ফিরে আসতাম এবং খাওয়ার জন্য ডাইনিং হলে যেতাম। রাতের বেলায়ও অনেক সময় খাবার পাওয়া যেত না। হলের বাবুর্চিরা দুটি ডিম ভাজি করে খাওয়াত। হলে অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ার জন্য আমার পেটের অসুখ লেগে ছিল। অনেকে হলের নিয়মিত খাবার খেয়েও পেটের সমস্যায় ভুগত। তাদের জন্য রোগীর পথ্য বা সিককাপ রান্না করা হতো। বেশির ভাগ সময়ে এই সিককাপে শিং অথবা মাগুর মাছ এবং কাঁচকলা থাকত। আমার পেট খারাপ হলেও আমি সিককাপ খেতাম না। যারা নিয়মিত সিককাপ খেত, তাদের নিয়ে আমরা ঠাট্টা করতাম।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের রান্নার মান ছিল ভালো। সমস্যার মধ্যে ছিল দুটি। একটি হলো তেল বেশি করে দেওয়া হতো। দ্বিতীয়টি হলো ঝালও বেশি হতো। তবে এ ধরনের খাবার আমরা তখন পছন্দ করতাম। প্রতি সপ্তাহে একটি উন্নত মানের ডিনার দেওয়া হতো। মাসে একটি বড় ডিনার দেওয়া হতো। এই ডিনারে অনেক সময় প্রভোস্ট অথবা হাউস টিউটররা থাকতেন। একটি বার্ষিক ডিনার অনুষ্ঠিত হতো। এখানে প্রধান অতিথি হিসেবে অনেক সময়ে আসতেন ছোট লাট, উপাচার্য অথবা রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত কোনো বিশেষ কর্মকর্তা। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন একবার বার্ষিক ডিনারে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। তিনি অত্যন্ত হাস্যরসিক ছিলেন এবং তাঁর বক্তৃতার সময় পুরো ডাইনিং হলে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল।
হলে ডিনার খাওয়ার পর রাত ১০টার দিকে বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নিতাম। কয়েকজন বন্ধু একত্র হলে গান শোনার জন্য চলে যেতাম হলের রেডিও রুমে। গান শোনা শেষ হলে পাঁচ-সাতজন বন্ধু মিলে হল থেকে বেরিয়ে যেতাম চা খাওয়ার জন্য। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশে আজাদ পত্রিকার অফিস ছিল। আজাদ পত্রিকার আশপাশে অনেক চায়ের দোকান ছিল। আমরা গিয়ে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খেতাম এবং গল্পসল্প করতাম। রাত ১২টা সাড়ে ১২টার দিকে আমরা হলে ফিরে আসতাম। হলে ঢুকতে হতো প্রধান দরজা দিয়ে। এই দরজায় একজন দারোয়ান থাকত। হলে ঢুকে আমরা যে যার কক্ষে চলে যেতাম। কক্ষে ফেরার পর আমার পড়াশোনা শুরু হতো। প্রায় রাত তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতাম। এরপর ঘুমাতে যেতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন। সামরিক শাসনামলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তবু সামরিক শাসনের আগে যে ছাত্রসংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিল, তারা আড়ালে থেকে নিজেদের কার্যক্রম চালু রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চারটি ছাত্রসংগঠন ছিল। একটি সংগঠন ছিল সামরিক শাসনের সমর্থক। প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফ। এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন ইব্রাহীম তাহা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী এ টি এম মুস্তফার ছোট ভাই। এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ আর ইউসুফ। পরে তিনি সংগঠনটির সভাপতি হন। ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তিনি বিলাত চলে গেলে সংগঠনটির সভাপতি হন আবুল হাসনাত। তিনিও পরবর্তীকালে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলাত যান। এনএসএফের এই দুজন নেতাই এরশাদ সরকারের আমলে মন্ত্রী হয়েছিলেন। এনএসএফের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এনএসএফ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একদিকে অনেক ভালো ছাত্র, অন্যদিকে অনেক গুন্ডা প্রকৃতির ছাত্রকে একত্র করে। যদি ছাত্ররা সামরিক শাসন সমর্থন না করে, তাহলে পিটিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ে বাধ্য করতে এরা দ্বিধাবোধ করত না।
আরেকটি ছাত্রসংগঠন পরোক্ষভাবে সরকারের সমর্থক ছিল। তবে প্রত্যক্ষভাবে তা তারা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করত। এ সংগঠনটির নাম ছিল পাকিস্তান ছাত্র শক্তি। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন ফরমানউল্লাহ খান। তাঁর সহযোগী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিঞা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, ড. মিজানুর রহমান শেলী প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হাসান জামান এবং সরকারের সঙ্গে এই সংগঠনটির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসান জামান পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল।
তৃতীয় ছাত্রসংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। আগে এটি মুসলিম ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ যেভাবে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়, তেমনি মুসলিম ছাত্রলীগ মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগে পরিণত হয়। এই সংগঠনের নেতা ছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী, এ টি এম শামসুল হক, আবদুল আউয়াল, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওবায়দুর রহমান। পরবর্তীকালে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ নেতা হন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ছিলেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে এঁদের অবদান রয়েছে।
চতুর্থ ছাত্রসংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৫২-৫৪ সালে এই ছাত্রসংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাজী আনোয়ারুল আজীম ও সৈয়দ আবদুস সাত্তার। প্রথম আনুষ্ঠানিক সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস। এরপর সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম আরিফ টিপু। ১৯৫৬-৫৮ সালে সভাপতি কাজী আনোয়ারুল আজীম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এস এ বারী এ টি। এরপর কাজী জাফর আহমদ, এ কে বদরুল হক, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, সাইফউদ্দিন আহমদ মানিক, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুব উল্লাহ, নুরুল ইসলাম নাহিদ অনেকেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ভেঙে যেভাবে ন্যাপ বা জাতীয় আওয়ামী পার্টি আত্মপ্রকাশ করে, তেমনি প্রগতিশীল ছাত্ররা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগে বিভক্ত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল কমিউনিস্টদের ছাত্রসংগঠন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যোগসূত্র ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। দিনাজপুরে তার বাড়ি এবং দীর্ঘদিন ধরে তিনি বামপন্থীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ তুখোড় ছাত্ররা ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ও বিভাগে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন ছিল।
প্রথম দিকে ছাত্র ইউনিয়নে প্রকাশ্যে কোনো দলাদলি ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫ সালের দিকে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর ফলে কমিউনিস্টরা মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী–এই দুই দলে ভাগ হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিত হয়। চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিতি লাভ করে।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হই। ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টো লেখায় এবং নির্বাচনী প্রচারণার কাজে আমি চার বছর অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু আমি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রার্থী হতে রাজি হইনি। এই রাজি না হওয়ার কারণ ছিল দুটি–একটি হলো আমি ছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাস করে চাকরি না করলে আমার খাওয়াদাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বৃত্তি পেতাম, সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই বৃত্তি শেষ হওয়ার পর আমার বেঁচে থাকার জন্য চাকরির প্রয়োজন। কাজেই আমার পক্ষে পূর্ণকালীন পার্টির ক্যাডার হওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়টি হলো অনেকে বামপন্থী দল থেকে মনোনয়ন গ্রহণ করে নির্বাচিত হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ওপরে প্রচণ্ড চাপ আসে। তখন তারা দলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। এটি ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয়। আমি তাই সরাসরি সার্বক্ষণিক ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দিতে পারিনি।
যদিও আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি, তবু মুসলিম হল ইউনিয়নের অনুরোধে আমি ১৯৬৩-৬৪ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকী সম্পাদনা করতে রাজি হই। তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সদস্যরা তাদের হলের বার্ষিকীতে লেখা দিতেন। ১৯৬৩-৬৪ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বার্ষিকীতে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি শামসুর রাহমান ‘পুরাণ’ শিরোনামে নামে একটি কবিতা দেন। তখনকার অনুপম কথাশিল্পী জহির রায়হান একটি গল্প দেন। হলের পাঁচজন প্রাক্তন ছাত্র তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। এঁরা হলেন ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, এ টি এম হাফিজুর রহমান, মিজানুর রহমান শেলী, শামসুল আলম চৌধুরী ও সৈয়দ আবদুস সামাদ। এঁদের প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা বার্ষিকীতে ছাপা হয়। এ ছাড়া হলের তিনজন ছাত্র তিনটি গল্প প্রকাশ করেছিলেন। এরা পরে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃত হন। এঁরা হলেন হুমায়ুন আজাদ, রশিদ আল ফারুকী এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। লেখা সংগ্রহ এবং ছাপানোর ব্যাপারে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। হলের ছাত্র ফারুক আলমগীর।
কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য আমাকে তাদের দলে টানার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব ছিল। ১৯৬৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তারা কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি সেল খোলে। একটি সেলের সদস্য ছিলাম তিনজন। আমি, শামসুজ্জোহা মানিক ও আফজালুর রহমান। শামসুজ্জোহা মানিক আমার এক বছরের কনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। তার পিতা পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন, কিন্তু তার মা ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী কর্মী। তারই উৎসাহে শামসুজ্জোহা মানিক ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েন। আফজালুর রহমান একজন ভালো ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি পাকিস্তান পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই তিনজনের তত্ত্বাবধান করতেন মোহাম্মদ ফরহাদ। মাসে একবার কি দুবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নির্দেশ আসত। আমরা কখনো রেসকোর্সের ময়দানে, কখনো জগন্নাথ হলে, কখনো অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে একত্রে বসে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে মোহাম্মদ ফরহাদের আলোচনা শুনতাম। অবশ্য এই সেল বেশি দিন টেকেনি। চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী–এই দুই ভাগে বামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে যায়। আমাদের সেলের তিনজন সদস্যেরই সহানুভূতি ছিল চীনপন্থীদের দিকে। অন্যদিকে মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন মস্কোপন্থী। শামসুজ্জোহা মানিক প্রকাশ্যে চীনপন্থীদের পক্ষে কাজ করে যান। এর ফলে মোহাম্মদ ফরহাদের। সঙ্গে মানিকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আমাদের সঙ্গেও ফরহাদের কোনো যোগাযোগ থাকে না।
পক্ষান্তরে চীনপন্থীদের পক্ষ থেকে নতুন সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। যদিও আমি এবং আফজালুর রহমান রাজনীতিতে টিকে থাকিনি, তবু শামসুজ্জোহা মানিক বামপন্থী রাজনীতিতে থেকে যান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি দিনাজপুরে নকশালপন্থীদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষক আন্দোলন সংগঠনের চেষ্টা করেন। তবে এই আন্দোলন খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি। মানিক কয়েকবার জেল খাটেন। পরবর্তীকালে আমার মনে হয় বামপন্থী আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে তাঁর মনে দ্বিধা দেখা দেয়। তিনি রাজনীতি ছেড়ে প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে তিনি গবেষণা শুরু করেন। সিন্ধু সভ্যতার একটি বড় দুর্বলতা হলো এই যে এই সভ্যতার নিজস্ব কোনো লিপি ছিল না। কোথাও কোথাও লিপিসদৃশ লিখন দেখা গেলেও এগুলোর কোনো তাৎপর্য আছে কি না, তা জানা যায় না। তিনি তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গাণিতিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠের চেষ্টা করেন। তবে এ চেষ্টা এখনো সফল হয়নি। তিনি ছোট একটি প্রকাশনালয় স্থাপন করেন। এই প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত একটি বই মুসলমান ধর্মান্ধদের আক্রমণ করেছে–এই অজুহাতে বইমেলায় তার স্টলে আক্রমণ করা হয় এবং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৮ সারে ৩০ ডিসেম্বর আইয়ুব খান কেন্দ্রীয় শিক্ষাসচিব এস এম শরিফের নেতৃত্বে কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন নিয়োগ করেন। কমিটিতে সভাপতি বাদে আরও ১০ জন সদস্য ছিলেন। কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে শিক্ষার মান উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। তখন পাকিস্তানে দুই বছরের ব্যাচেলর পাস কোর্স চালু ছিল। যেসব ছাত্র অনার্স ক্লাসে ভর্তি হতে পারত না, তারা পাস কোর্সে পড়ত। এক বছরের কম সময়ে ডিগ্রি নিয়ে এরা অনেকেই চাকরিতে যোগ দিত। শরিফ কমিশন দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সের বদলে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তনের সুপারিশ করে। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার জন্য অতিরিক্ত এক বছরের খরচ বাড়ে। আগে ৩৩ শতাংশ নম্বর ছিল পাস নম্বর। শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেকোনো একটি বিষয়ে পাস করতে হলে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। স্নাতক পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়। যারা কলা এবং বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন, তাঁদের জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করা হয়। এই বিষয় প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল, ছাত্ররা যাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণের বিবর্তন সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। যারা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন, তাঁদের জন্য সভ্যতার ইতিহাস বাধ্যতামূলক করা হয়। অতিরিক্ত বিষয় প্রবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের অসুবিধা হয়। এই নতুন বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য যথেষ্ট শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি, তাই যেসব শিক্ষক এসব বিষয় পড়াতেন, তাদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য নতুন বিষয়ের ক্লাস হতো সকাল আটটায়। আমার মতো অনেকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তারা সাড়ে ৯টার আগে ঘুম থেকেই উঠতেন না। কাজেই তাদের পক্ষে এই ক্লাসে উপস্থিত থাকা ছিল প্রায় অসম্ভব।
আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রায় তিন মাস ক্লাস হয়েছিল। এই তিন মাসে আমি তিনটি ক্লাসেও হাজির হতে পারিনি। আমি তাই শিক্ষা সংস্কারের গুরুতর বিরোধী হয়ে যাই এবং সলিমুল্লাহ হলে শিক্ষা সংস্কারকে বাতিল করার দাবি জানিয়ে অনেক বক্তৃতা দিই। আরেকটি সংস্কার করা হয়েছিল পরীক্ষাপদ্ধতিতে। শরিফ কমিশন প্রতিবেদনের আগে দুই বছর বা তিন বছর মেয়াদি কোর্সের কোর্স সমাপ্তির পর একবার পরীক্ষা হতো। শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয় যে ছাত্রদের প্রতিবছর পরীক্ষা দিতে হবে। যখন ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধে, তখন পূর্ব পাকিস্তানে তৃতীয় বর্ষের ডিগ্রি ক্লাসের পরীক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে প্রথম দুই বছরের পরীক্ষায় পাস করেছেন। এই পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন হলে যারা পাস কোর্সে ডিগ্রি অর্জন করবেন, তাদের আর তৃতীয় বছরের পরীক্ষায় পাস করার প্রয়োজন হবে না। এঁরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্নাতক হয়ে যাবেন। যখন সত্যি সত্যি শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ প্রত্যাহার করা হলো, তখন পূর্ব পাকিস্তানে অনেক ছাত্র তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দিয়ে তাঁদের স্নাতক ডিগ্রি পান। এঁদের ঠাট্টা করে আইয়ুব গ্র্যাজুয়েট’ বলা হতো।
শিক্ষা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি গোটা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানেও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখা দেয়। শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে প্রধান দুটি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে আন্দোলন শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী এবং অন্যান্য রাজবন্দীর মুক্তির দাবির আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনও আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্দোলনগুলো একত্র হয়ে যায় এবং সরকারের জন্য একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য কলা বিভাগের দোতলায় একটি কক্ষে আসেন। সৌভাগ্যক্রমে বক্তৃতা শুরু হওয়ার আগে ওই কক্ষে সামনের দিকে আমি একটি আসন পেয়ে যাই। মঞ্জুর কাদের বক্তৃতা দেওয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সভায় গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। তদানীন্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জিয়াউদ্দিন মাহমুদ মঞ্জুর কাদেরকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল গণতন্ত্র নেই কেন? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন? মঞ্জুর কাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই ছাত্ররা তাকে ধাক্কা মারেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে ঘেরাও করে সভা থেকে বের করে নিয়ে যান। মঞ্জুর কাদেরকে যখন দোতলা থেকে একতলায় নামানো হয়, তখন আমরা অর্থাৎ ছাত্ররা তাঁর মাথায়, গায়ে এবং কাপড়ে থুতু ছিটাতে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পতাকাবাহী মন্ত্রীর যে গাড়ি ছিল, তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের গাড়িতে করে মন্ত্রীকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপরই ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
শিক্ষা সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাফল্য অর্জিত হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। এর একটি বড় কারণ ছিল এই যে সরকারবিরোধী ছাত্রগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি ছিল। অতি অল্প সময় এদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। আইয়ুব খান এ সময়ে একজন অতিবশংবদ মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মোনেম খানকে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর নিয়োগ করেন। মোনেম খান এনএসএফ-কে শক্তিশালী করেন এবং এনএসএফে গুন্ডা-পান্ডার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. ওসমান গণিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য করে নিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকসহ সব পর্যায়ে তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভগ্নি ফাতেমা জিন্নাহকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন। এ সময়ে নির্বাচন তথাকথিত বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে এ দেশে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি নির্বাচিত হতেন। আইয়ুব খান শুধু ইউনিয়ন কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বহাল রাখেন কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের উর্ধ্বে যত প্রতিষ্ঠান ছিল, যথা : থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল, প্রাদেশিক আইন পরিষদ, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার করা হয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের। তখন মার্কিন সরকার ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কারিগরি সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানের পল্লি অঞ্চলে কর্ম সৃষ্টির জন্য পল্লি পূর্ত কর্মসূচির প্রবর্তন করেন। এই কর্মসূচিতে ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ এদের নজরদারি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তার ফলে পল্লি পূর্ত কর্মসূচি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। এ ধরনের ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা আইয়ুব খানের গোড়া সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। সম্মিলিত বিরোধী দলের দাবি ছিল তারা ক্ষমতায় এলে বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হবে। অথচ সংবিধান অনুসারে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসতে হবে।
১৯৬৫ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচন
১৯৬৫ সালে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় সম্মিলিত বিরোধী দল। বাইরে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকলেও ভেতরে এরা সবাই নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছিল। তাই প্রতিটি দলই তাদের পছন্দমতো প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল এবং পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসস্থল নিয়ে একটি নির্বাচনী এলাকা গঠন করা হয়। সলিমুল্লাহ হলে ছিল তখন ছাত্র ইউনিয়নের প্রাধান্য। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সলিমুল্লাহ হলের নেতা আইয়ুব রেজা চৌধুরীকে এই আসনের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইকবাল হলে ছিল তখন ছাত্রলীগের প্রাধান্য। ছাত্রলীগ এই আসনে একজন প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ তারিখ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ একজন প্রার্থী সম্পর্কে একমত হতে পারেনি। সুতরাং দুজন প্রার্থীই থেকে যান। নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ ছাত্রনেতা ঢাকা ছেড়ে পল্লি অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে যান। ইকবাল হল ও সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নির্বাচনী প্রচারে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে একমত হন যে এই আসনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী আইয়ুব রেজা চৌধুরীর প্রার্থিতা থাকবে। ছাত্রলীগ তাদের প্রার্থীর পক্ষে কোনো প্রচার করবে না এবং প্রার্থীর কোনো নির্বাচনী এজেন্টও ভোটকেন্দ্রে থাকবে না। এই আসনের ভোটকেন্দ্র ছিল ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের ভবন। সেখানে কয়েকটি কামরা খালি করে ভোটকেন্দ্র করা হয়। কোনো এক সরকারি ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারকে এই কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করা হয় এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যালটির কিছু প্রাথমিক শিক্ষককে পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের তখন এমএ পরীক্ষা সামনে। তাই আমরা নির্বাচনী প্রচারণায় গ্রামে যেতে পারিনি। তাই আমাদের ঢাকা শহরে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা এসএম হলে এসে আমাকে বললেন যে আমাকে আইয়ুব রেজা চৌধুরীর নির্বাচনী এজেন্ট হতে হবে। আমি বললাম, আমি ভোটার নই। আমার বয়স একুশ বছর হয়নি। তিনি বললেন, নির্বাচনী এজেন্টের বয়স নিয়ে আইনে কোনো বিধান নেই। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমি রাজি হলাম।
নির্বাচনের দিন আমার বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে আমি ভোটকেন্দ্রে গেলাম। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সময় মনে হলো যে সলিমুল্লাহ হল ও ইকবাল হলের যেসব ছাত্র একুশ বছর বয়সের বেশি, তাদের সিংহভাগ গ্রামে নির্বাচনী প্রচারণা করতে চলে গিয়েছে। তাই আইয়ুব রেজা চৌধুরীকে পাস করানোর মতো যথেষ্ট ভোটার নেই। সৌভাগ্যবশত কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে যখন পোলিং এজেন্টের সিদ্ধান্ত জানানো হয়, তখন কেন্দ্রের একটি ভোটার লিস্টও তারা আমাকে দেয়। ভোটার লিস্টটা আমার বন্ধুদের হাতে দিয়ে বললাম, এই লিস্টের ভিত্তিতে তোমরা একেকজন এসে দাবি করবে তুমিই এই ভোটার। যেহেতু বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট নেই, সুতরাং এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হবে না। অনায়াসে শতকরা ১০০ ভাগ জাল ভোট দিয়ে আমরা আমাদের প্রার্থীকে জয়ী করতে পারব। আমার বন্ধুরা আমার বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। তাঁরা হলে গিয়ে ভোটার নয়, এ রকম ছাত্রদের ভোটার পরিচয় দিয়ে ভোটকক্ষে হাজির করলেন। এঁরাই প্রকৃত ভোটার বলে আমি প্রত্যয়ন করলাম, প্রিসাইডিং অফিসারের কিছু করার ছিল না। তাঁদের ভোটের ভিত্তিতে শ খানেক ভোটে আইয়ুব রেজা চৌধুরী নির্বাচিত হন। তার বিরোধী পক্ষে ভোট ছিল শূন্য। জীবনে প্রথম আমি নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করলাম। তবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখলাম গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সহজ নয়। যেখানে পোলিং এজেন্টের মাধ্যমে ভোটারদের পরিচয় চ্যালেঞ্জ করার কোনো ব্যবস্থা নেই, সেখানে শতভাগ জাল ভোট হওয়া সম্ভব। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে যখন আমি আটটি নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং অফিসার ছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করে ভোটে যাতে জালিয়াতি না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর ছিলাম।
সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড
ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও আমাদের কেউ কেউ সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত ছিল। কোনো ছাত্রের ওপর অবিচার হলে আমরা তাঁর পক্ষে দেনদরবার করতাম। তখন আমাদের দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একজনের নাম মোস্তাফিজুর রহমান, আরেকজনের নাম জিয়াউল আনসার। এঁরা দুজনই অসুস্থতার জন্য আইএ পরীক্ষায় প্রথমবার হাজির হতে পারেননি। দ্বিতীয়বার তারা ভালো ফল করে আইএ পাস করেন। কিন্তু তখন সরকারের নিয়ম ছিল দ্বিতীয়বারে যারা পাস করবে, তাদের কোনো বৃত্তি দেওয়া হবে না। ডিপিআই অফিসে সিলেটের চৌধুরী সাহেব নামে এক ব্যক্তি বৃত্তি বরাদ্দ করতেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন যে প্রথম বছরের বৃত্তির ৫০ শতাংশ তাকে দেওয়া হলে তিনি তাঁদের বৃত্তি বরাদ্দ করবেন। এই চুক্তি অনুসারে তাদের বৃত্তি দেওয়া হয়। যেদিন তারা বৃত্তির টাকা তুলতে রেজিস্ট্রারের অফিসে যান, সেদিন চৌধুরী সাহেব ছাত্রদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোস্তাফিজ টাকা নিয়ে বেরোতে গেলে চৌধুরী সাহেব এসে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর ডেলিভারি কেস, আমাকে অবিলম্বে টাকা দেন। আপনার স্ত্রীর ডেলিভারি কেস, আমি টাকা দেব কেন’ বলে মোস্তাফিজ হইচই শুরু করলেন। চৌধুরী সাহেব অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়লেন। এরপরে তিনি মোস্তাফিজকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাপারটা ডিপিআইয়ের নজরে আনা উচিত। ডিপিআই তখন ছিলেন শামসুল হক সাহেব। তিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর অফিসে আমরা আট-দশজনের একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল যাই। সেখানে গিয়ে মোস্তাফিজ জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্যার, হোয়াট ইজ দ্য কনসেপ্ট অব ফিফটি পার্সেন্ট ইন ইয়োর অফিস’? শামসুল হক সাহেব তো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি আমাদের বললেন, ‘এ রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। আমি খোঁজ নেব এবং কিছু পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তোমরা এখন বাড়ি ফিরে যাও, গিয়ে পড়াশোনা করো। আমরা ফিরে এলাম কিন্তু চৌধুরী সাহেবের কিছু হয়নি। অবশ্য মোস্তাফিজকেও আর বিরক্ত করা হয়নি।
সমাজসেবার একটি উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছিলাম ১৯৬২ সালে। তখন খুলনায় স্থানীয় বন্যা হয়। এই বন্যায় লোকজন না খেয়ে ছিল এবং অনেকে কলেরায় আক্রান্ত হয়। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়নি। এই খবর ইত্তেফাঁক এবং পাকিস্তান অবজারভার-এ ব্যানার হেডলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। এ খবর পড়ে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমাদের বর্ষের ২০-২৫ জন ছাত্র হলের অডিটরিয়ামে বসে সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা বন্যাদুর্গত অঞ্চলে একটি রিলিফ মিশন নিয়ে যাব। তখন প্রশ্ন উঠল এত অর্থ আমরা কোথায় পাব? সবাই একমত হলো যে হল ইউনিয়নে এ ধরনের কাজের জন্য ফান্ড রয়েছে। যদি আমরা হলের প্রভোস্টকে রাজি করাতে পারি, তাহলে এই ফান্ড থেকে অর্থ পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা ওই দিনই বিকেলে প্রভোষ্টের সঙ্গে দেখা করি। প্রভোস্ট শুনে খুশি হন। বলেন, ছাত্রদের তো এসব ব্যাপারেই উদ্যোগী হওয়া উচিত, শুধু রাজনীতি করলে তো চলবে না। তারপর তিনি বললেন, ‘তোমরা কী করতে চাও? আমরা বললাম, আমরা ওখানে চিড়া, মুড়ি, গুড়, চাল, ডাল–এ ধরনের শুষ্ক খাবার নিয়ে যেতে চাই এবং এগুলো বিতরণ করতে চাই। সঙ্গে আমরা সুপেয় পানি নিয়ে যাব, যাতে আমাদের নিজেদের এবং বন্যার্তদের পানির অভাব না হয়।
একজন বলে উঠল বন্যার্তদের আমরা টিএবিসি ইনজেকশন দেব। টিএবিসি মানে হলো (টি-টাইফয়েড, এ-এমিবিক, বি-বেসিলারি, সি-কলেরা) চারটি রোগের প্রতিষেধক ইনজেকশন। প্রভোস্ট বললেন, এটা করতে পারলে খুবই ভালো হয়। তবে টিএবিসি ইনজেকশনের জন্য তোমাদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আমি এখনই তোমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।’ বলে তিনি ফোনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ মেডিকেল অফিসার ড. মর্তুজার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি বললেন, ‘আমার ছাত্রদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে আপনি প্রশিক্ষণ দিন। ড. মর্তুজা রাজি হলেন এবং পরদিন বিকেল চারটায়। তিনি আমাদের তার অফিসে পাঠাতে বললেন। প্রভোস্ট বললেন, তোমরা ট্রেনিংটা নিয়ে নাও, আর এদিকে আমি টাকাপয়সার ব্যবস্থা করছি।’
পরদিন মহা-উৎসাহে আমরা ড. মর্তুজার অফিসে হাজির হই। গিয়ে দেখি তার রুমে হাতের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা অনেকগুলো চার্ট ঝোলানো। তিনি বললেন, ‘ইনজেকশন দিতে হলে হাত সম্পর্কে তোমাদের ধারণা থাকা দরকার। তারপর তিনি হাতের পেশি সম্পর্কে আমাদের বক্তৃতা দিলেন। হাতের নার্ভের ব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন, রগ সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে ইনজেকশন দিলে পেশি, রগ এবং স্নায়ুর ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বললেন, বেশির ভাগ ইনজেকশনেরই খারাপ ফল হয় না, কিন্তু অনেক কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইনজেকশন রোগীর ক্ষতি করতে পারে। এমনও হতে পারে ভুল ইনজেকশনের জন্য হাত কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়তে পারে। কোথাও কোথাও অনেক দিন ধরে হাতে ব্যথা থাকে, কোথাও কোথাও অমাবস্যা পূর্ণিমার সময় হাতে ব্যথা হয়। সঠিকভাবে ইনজেকশন না দিলে সেপটিক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেওয়ার পর বললেন, আজকের বক্তৃতা ছিল তাত্ত্বিক, আগামীকাল প্রায়োগিক ক্লাস হবে। প্রায়োগিক ক্লাসে তোমরা আমার সামনে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ইনজেকশন নেবে। ইনজেকশন নেওয়ার পর আমরা তোমাদের সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ সমাপ্তির প্রত্যয়ন দেব। তাঁর এ বক্তব্যের পর আমার তো আক্কেলগুড়ুম! পাশের বন্ধুবান্ধবের দিকে তাকালাম, এমন কাউকে দেখলাম না যার কাছে নিশ্চিন্তে আমার হাতে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য হাত তুলে দিতে পারি। আমি তৎক্ষণাৎ মনে মনে ঠিক করলাম যে আমি পরের দিন যাব না। তবে যদি হলে থাকি বন্ধুবান্ধব বিরক্ত করবে। তাই আমি হলে ফিরে গিয়ে দু-একটা বই নিয়ে আমার চাচাতো ভাইয়ের বাসায় এলিফ্যান্ট রোডে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি বলি আমার পেট খারাপ। আমি হলের খাবার না খেয়ে বাসায় রান্না করা খাবার খেতে এসেছি। ভাবি যত্ন করে শিং মাছ দিয়ে কাঁচকলার ঝোল রান্না করে আমাকে দেন। পরের দিন দুপুরবেলা আমি ঘোষণা করলাম যে আমার পেট ভালো হয়ে গেছে এবং সন্ধ্যার পর হলে গিয়ে হাজির হলাম। হলে গিয়ে দেখি বন্ধুবান্ধব আমাকে দেখে হাসছে। আমি তাদের হাসির তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। রাতে তারা আমার কক্ষে এল। তারা বলল, তুই ভীরুর মতো কেন পালিয়েছিলি? গ্রামের চাষাভুষাদের ইনজেকশন দেওয়ার জন্য আমরা কি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারি? আমরা হলেই ছিলাম এবং কেউ প্রায়োগিক পরীক্ষা দিতে যাইনি। আমাদের খুলনা যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। ঘটনাটি ছোট কিন্তু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘটনায় নৈতিকতার একটি সুন্দর সংজ্ঞা বেরিয়ে আসে। সে সংজ্ঞাটি হলো, যা তুমি নিজের ক্ষেত্রে করতে পারবে না, সেটা অন্যের ক্ষেত্রে করা সঠিক হবে না। প্রথম যখন এই সূত্রটি খুঁজে পাই, তখন মনে হয়েছিল যে এটি আমার নিজের আবিষ্কার। পরে ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানি এই সূত্র খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে আবিষ্কার করেছিলেন পারস্যের পয়গম্বর জরথুস্ত্র। তিনি বলেছেন, ‘That nature alone is good which shall not do unto another whatever is not good unto its own self.’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই, তখন ইতিহাস। বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হালিম। হালিম সাহেব লোদি সম্রাটদের ওপর অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট অর্জন করেন। ওস্তাদি গানে তাঁর অনুরাগ ছিল এবং তিনি বিভিন্ন আসরে গান গাইতেন। প্রথম বর্ষে তিনি আমাদের ভারতের মুসলমান শাসন সম্বন্ধে কোর্সটি পড়ান। তিনি প্রথম ক্লাসে পাঠ্যপুস্তকের একটি তালিকা দেন। এই তালিকা কোনো কাগজ ছাড়াই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে দেন। হালিম সাহেব আরবি, ফারসি শব্দের উচ্চারণ সম্পর্কে খুবই সতর্ক ছিলেন। এসব উচ্চারণ সঠিকভাবে করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়ে পড়ত। তিনি যখন আমাদের কোর্সটি পড়ান, তখন শরিফ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বার্ষিক পরীক্ষা হতো। এই পরীক্ষার কিছুদিন পরেই ড. আবদুল হালিম পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তবে তিনি আমাদের পরীক্ষার খাতার মূল্যায়ন সমাপ্ত করেছিলেন।
প্রথম বর্ষে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস আমাদের পড়ান অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭১)। ঢাকার পগোজ স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চতুর্দশ স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দেন এবং এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এমএ পাস করার পরই তিনি ইতিহাস বিভাগে মৌর্য শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী প্রভাষকের পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন।
১৯৬১ সালে তিনি আমাদের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস কোর্স পড়ান। এর আগে এই কোর্সটি পড়াতেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানি। কিন্তু দানি সাহেব ১৯৬১ সালে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাই সন্তোষ বাবু আমাদের কোর্সটি পড়ান। তিনি খুবই ভালো পড়াতেন। বক্তৃতা দেওয়ার কৌশল তাঁর ভালোভাবে জানা ছিল। কিন্তু শুধু বক্তৃতার কৌশলের জন্যই নয়, তাঁর বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ। শিলালিপি, মুদ্রা এবং অন্যান্য মৌলিক ইতিহাসের ভিত্তিতে ইতিহাস কীভাবে রচিত হয়, সে বিষয়টি তিনি ছাত্রদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। সম্রাট অশোকের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে তিনি ক্লাসে অশোকের শিলালিপি থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। এই শিলালিপিগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করতেন এবং এই ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে কী কী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করানো সম্ভব, তা-ও তুলে ধরতেন। সমুদ্র গুপ্তের রাজ্যের বিস্তৃতি বোঝানোর জন্য তিনি এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপি পাঠ করতেন। তাঁর ইংরেজি অনুবাদ করতেন। এরপর বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে ধরনের বিতর্ক ছিল, সেগুলোও ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতেন। এভাবে প্রতিটি বিষয় তিনি খুবই যত্ন করে আমাদের পড়াতেন।
প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পর আমাদের নম্বর জানানো হলো। আমি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে পাই ৭৭ নম্বর এবং মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে পাই ৭৮ নম্বর। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এক নম্বর কম পাওয়া সত্ত্বেও আমার উত্তরের সর্বোচ্চ প্রশংসা পাই সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন যে তোমাকে আমি সঠিক নম্বর দিইনি। তুমি মুসলমানের ছেলে, সংস্কৃত জানো না কিন্তু তুমি কষ্ট করে অশোকের মূল শিলালিপিগুলো এবং সমুদ্র গুপ্তের শিলালিপি মূল ভাষায় মুখস্থ করেছ। সঠিকভাবে পরীক্ষার খাতায় উদ্ধৃত করেছ। তার সঙ্গে এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকাতে এদের যে অনুবাদ করা হয়েছে, তা উদ্ধৃত করেছ এবং এদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তর্কবিতর্ক নিয়ে আলোচনা করে তোমার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ। তুমি যেভাবে উত্তর দিয়েছ, তার চেয়ে ভালো উত্তর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরাও দিতে পারবেন না। অথচ তুমি মাত্র প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি তোমাকে এই পত্রে ১০০-তে ১০০ নম্বর দিতে চেয়েছিলাম। পরে আমার খেয়াল হলো ১০০-তে ১০০ নম্বর দিলে তোমার ক্ষতি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব পরীক্ষার খাতা দুজন পরীক্ষক পরীক্ষা করেন। একজন অভ্যন্তরীণ পরীক্ষক, আরেকজন বহিরাগত পরীক্ষক। এই দুজনের দেওয়া নম্বরের মধ্যে ১০ নম্বরের বেশি তফাত না হলে এই দুই নম্বরের গড় নম্বর হবে চূড়ান্ত ফল। যদি ১০-এর বেশি তফাত হয়, তাহলে খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে। তৃতীয় পরীক্ষক যে নম্বর দেবেন, সেটাই হবে চূড়ান্ত নম্বর।
তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানে এখন বিএ, এমএ পরীক্ষার খাতা পাকিস্তানি শিক্ষকদের দিয়েই মূল্যায়ন করাই। দুর্ভাগ্যবশত এখন পাকিস্তানে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিএ এবং এমএ-তে প্রথম শ্রেণির নম্বর পাননি। তারা তোমার খাতার মূল্য মোটেও উপলব্ধি করতে পারবেন না এবং কম নম্বর দেবেন। এই খাতার বহিরাগত পরীক্ষক যদি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হতো, তাহলে আমি তোমাকে ১০০-তে ১০০ নম্বর দিতাম। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তানি শিক্ষকেরা এই মূল্যায়ন করবেন, সেহেতু আমি তোমার নম্বর কমিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি অন্তত সন্তোষজনক নম্বর পাও।
দ্বিতীয় বর্ষে আমাদের ইউরোপে মধ্যযুগের ইতিহাস এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে পড়ানো হয়। ইউরোপের মধ্যযুগের ইতিহাস আমাদের পড়ান অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। অধ্যাপক আহমদ ছিলেন সুপুরুষ এবং সুবক্তা। যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি পাননি, তবু ইউরোপের ইতিহাসে তার গভীর আগ্রহ ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে যেসব নতুন বই প্রকাশিত হতো, অধ্যাপক আহমদ সেগুলো বিলাত থেকে সংগ্রহ করতেন। তিনি ভালো ছাত্রদের সেসব বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আমাদের সহকারী হাউস টিউটর। এখনো মনে আছে, অনেক সময় তিনি নিজে আমার কক্ষে এসে নতুন বই পড়তে দিয়ে যেতেন। অধ্যাপক আহমদ আমাদের কোর্সটি পড়ান কিন্তু শরিফ কমিশনের প্রতিবেদন বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সব পরীক্ষা তিন বছরের সম্মান কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পর একসঙ্গে নেওয়া শুরু হয়। এর ফলে তিনি আমাদের খাতা দেখার সুযোগ পাননি। আমাদের খাতা দেখেছিলেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য।
ভারতের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে আমাদের প্রথমে পড়ান আবদুল মমিন চৌধুরী। তারপর ড. আবুল খায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করে দেশে আসার পর তিনি আমাদের এ কোর্স পড়াতে শুরু করেন। কয়েক মাস পর মোহর আলি পিএইচডি করে দেশে আসেন। তিনি এই কোর্সের শেষ ভাগ আমাদের পড়ান।
তৃতীয় বর্ষে আমাদের চারটি কোর্স পড়ানো হয় : (১) ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, (২) ফরাসি বিপ্লব থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, (৩) ১৭১৫ সাল থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস, (৪) আধুনিক যুগে ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাস। প্রাক্-ফরাসি বিপ্লব আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস আমাদের পড়াতেন অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে বিএ অনার্স এবং এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রথমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি সরকারি কলেজে যোগ দেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং যত দূর মনে পড়ে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়। তিনি যেকোনো সময় ক্লাসের বোর্ডে ইউরোপের দেশসমূহের মানচিত্র আঁকতে পারতেন এবং মানচিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘাত চলছিল, তার ব্যাখ্যা করতেন। আমি ইতিহাস বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাই অধ্যাপক জহুরুল ইসলামের কোর্সে। এই কোর্সে আমি ৭৫ নম্বর পাই। ৬০ নম্বরকে প্রথম শ্রেণি ধরে আমাকে ৭৫ নম্বর দেওয়া হয়। আমি যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ৭৭ নম্বর পেয়েছিলাম, সেখানে প্রথম শ্রেণির নম্বর ছিল ৭০। যদি এই হিসাবে জহুরুল ইসলামের প্রদত্ত নম্বর হিসাব করা হয়, তাহলে তা দাঁড়াবে ৮৫ নম্বরে। সম্ভবত ইউরোপের ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়। সঠিকভাবে ধরতে পেরেছি বলেই আমাকে এত বেশি নম্বর দেওয়া হয়।
ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপের ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার পরই তিনি বিলাত চলে যান। তাই খাতা দেখেছিলেন ড. আবুল খায়ের। এই পত্রে আমি ৬৮ নম্বর পাই। আধুনিক ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক আবু সাঈদ। তিনি ছিলেন ঐতিহাসিক রামজেমুইর এবং গ্রিন ইত্যাদি হুইগ ঘরানার ঐতিহাসিকদের সমর্থক। এঁরা রাজনৈতিক ইতিহাসকে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়া সম্বন্ধে এঁদের তত আগ্রহ ছিল না। বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হিসেবে আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যাখ্যার তাৎপর্যে বিশ্বাসী ছিলাম। এ সময়ে লুই নামিয়ের নামে একজন অধ্যাপক তৃতীয় জর্জের রাজত্বকাল সম্বন্ধে নতুন ধরনের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলে তখন এই নতুন ব্যাখ্যা সম্পর্কে অনেক বই পাওয়া যাচ্ছিল। এসব বইয়ের ভিত্তিতে আমি আমার নোট তৈরি করি। অধ্যাপক আবু সাঈদের কাছে এসব ব্যাখ্যার খুব তাৎপর্য ছিল না। কাজেই শেষ পর্যন্ত এই পত্রে আমি মাত্র ৫৫ নম্বর পাই। শুধু এই পত্র ছাড়া আর সব পত্রেই আমি প্রথম শ্রেণির চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পাই। যদি এই পত্রে আমি শূন্যও পেতাম, তাহলেও আমি ইতিহাস বিভাগে সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতাম।
ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস পড়ান অধ্যাপক ওয়াদুদুর রহমান। তিনি ছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই। আমরা যখন ছাত্র, তখন তিনি ইতিহাস বিভাগের রিডার ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের (যা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ এবং যেখানে তখন আমতলা, মধুর ক্যানটিন ও কলাভবন অবস্থিত ছিল) গেটে কয়েকটি কামরায় তিনি থাকতেন। ওয়াদুদুর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল বিচিত্র। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। এরপর আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে উচ্চস্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে তৃতীয় শ্রেণি পান। কিন্তু এমএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুবিধা ছিল সীমিত। তাই এমএ পাস করার পর তিনি পুলিশের দারোগা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষকেরা পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকের অভাব দেখা দেয়। এ সময় ওয়াদুদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। এরপর তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। এই কোর্সে তিনি আবার তৃতীয় শ্রেণি পান। দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন কোর্স পড়াতে থাকেন। বেশির ভাগ ক্লাসেই তিনি কিছু পুরোনো নোট নিয়ে যেতেন। সম্ভবত এই পুরোনো নোটগুলো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় তৈরি করেছিলেন তিনি। এই নোটগুলো দেখে তিনি ক্লাসে পড়াতেন। যাতে ছাত্রদের একঘেয়ে মনে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন বক্তব্যের মাঝে ইউ সি (you see), হোয়াটস কলড (what’s called), সো ন্যাচারালি (so naturally) বিভিন্ন শব্দ গুঁজে দিতেন।
একদিন ওয়াদুদুর রহমানের ইংল্যান্ডের টিউডর রাজাদের রাজত্বকালের শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা শুনছিলাম। তিনি নোট দেখে পড়াচ্ছিলেন, ‘Tudor monarchs were shy, you see they were shy, what’s called they were shy, so naturally they were shy.’ Dita 01917 8637 VCP Sport করলাম, ‘স্যার, একটি বংশের সব রাজা কীভাবে লাজুক হয়? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি এড়িয়ে যান। তাঁর নোটের পাতা উল্টিয়ে তিনি পড়েন, ‘of trangressing the rights and liberties of their subjects.’ M169 তিনি টিউডর রাজারা লাজুক ছিলেন এ কথা বলতে চাননি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন টিউডর রাজারা প্রজাদের অধিকার এবং স্বাধীনতায় হাত দিতেন না। কিন্তু নোট লেখার সময়ে shy শব্দটি এক পৃষ্ঠায় এবং of এবং তার পরবর্তী শব্দগুলো অন্য পৃষ্ঠায় থাকায় এই বিপত্তির সৃষ্টি হয়। ওয়াদুদুর রহমান খুবই স্নেহশীল ছিলেন। আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পরও তার সঙ্গে আমার আন্তরিক যোগাযোগ ছিল। তার কোর্সে আমি ৬৮ শতাংশ নম্বর পাই।
প্রথম শ্রেণির নম্বর ৬০ ধরে আমি অনার্স পরীক্ষায় ৬৮.৬ শতাংশ নম্বর পাই। কাছাকাছি সময়ে ইতিহাসে কেউ এত নম্বর পায়নি। কেউ কেউ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ নম্বর। সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।
ইতিহাস বিভাগে এমএ শ্রেণিতে তিনটি গ্রুপ ছিল। প্রথম গ্রুপে ছিল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিল মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাস। তৃতীয় গ্রুপে ছিল সমসাময়িক ইতিহাস। আমরা যে বছর এমএ পাস করি, সে বছর আরেকটি নতুন গ্রুপ যোগ করা হয়। এ গ্রুপের নাম ছিল বাংলার। ইতিহাস। আমি সমসাময়িক ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই গ্রুপে চারটি বিষয়ে পড়ানো হতো : (১) প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত সমসাময়িক ইতিহাস, (২) মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস, (৩) দূরপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস এবং (৪) আন্তর্জাতিক আইন।
প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ১৯৬০ দশক পর্যন্ত সমসাময়িক ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক আবু সাঈদ। অধ্যাপক আবু সাঈদের কাছে আমি ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়েছি। কিন্তু তার পড়ানো আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে সমসাময়িক ইতিহাস তিনি অপেক্ষাকৃত ভালো পড়াতেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খুঁটিনাটি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি নাটকীয়ভাবে এ ইতিহাস উপস্থাপন করতেন। আমি এমএ পরীক্ষায় তাঁর কাছে অপেক্ষাকৃত ভালো নম্বর পাই। হয়তো বহিরাগত পরীক্ষক হাবিবুর রহমান শেলি বেশি নম্বর দিয়ে থাকতে পারেন। এই কোর্সে আমি ৬১ নম্বর পেয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস এমএ ক্লাসে পড়াতেন মফিজুল্লাহ কবির। অধ্যাপক আবদুল হালিম অবসর গ্রহণ করলে মফিজুল্লাহ কবির বিভাগীয় প্রধান হন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের নতুন ইতিহাস রচনা করার কাজ শুরু হয়। এই কাজে মফিজুল্লাহ কবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে এক বছরের জন্য ইসলামাবাদ যেতে হয়।
অন্যদিকে এমএ ক্লাসে দূরপ্রাচ্যের আধুনিক ও সমসাময়িক ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য। কিন্তু ডক্টর আবুল খায়ের দাবি করেন, তিনি দূরপ্রাচ্যের ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ। সুতরাং তিনি এ বিষয়টি পড়াবেন। মফিজুল্লাহ কবির এক বছর না থাকার কারণে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং আবুল খায়েরের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়ানোর দায়িত্ব নেন এবং আবুল খায়ের দূরপ্রাচ্যের ইতিহাস। পড়ানোর দায়িত্ব পান। অধ্যাপক ভট্টাচার্য এর আগে কখনো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়াননি। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তিনি এ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস তিনি আগে পড়েননি, তাই এ কোর্সটি পড়িয়ে তিনি তাঁর জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা হ্রাস করার সুযোগ পাবেন। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে আমি ৬৮ নম্বর পাই। অধ্যাপক ভট্টাচার্য আমাকে আরও অনেক বেশি নম্বর দিয়েছিলেন। কিন্তু বহিরাগত পরীক্ষক কম নম্বর দেওয়ায় এ নম্বর ৬৮-তে দাঁড়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে এ পরীক্ষায় আমি ভালো করিনি। পরীক্ষায় চার ঘণ্টায় পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল। আমার প্রথম চারটি প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায় ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সময় লাগে। পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য আমি মাত্র ১৫ মিনিট সময় পাই। এই অল্প। সময়ে উত্তর দেওয়ার জন্য আমি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের উত্থান। সম্পর্কে একটি উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন বেছে নিই। আমার ধারণা ছিল, এ প্রশ্নের উত্তরে আমি হয়তো কম নম্বর পাব। পরীক্ষা শেষে সন্তোষ বাবু বললেন, ওই প্রশ্নে তুমি আমার কাছে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছ। কারণ হলো উত্তর যদিও ছোট করে দিয়েছ কিন্তু সমস্ত পয়েন্ট তোমার উত্তরে না ছিল। কাজেই সেখানে বেশি নম্বর দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আধুনিক ও সমসাময়িক দূরপ্রাচ্যের ইতিহাস পড়ান আবুল খায়ের। তিনি মোটামুটি পড়াতেন। এই বিষয়ের পরীক্ষায় আমি ৬৭ শতাংশ নম্বর পাই।
আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পড়ান অধ্যাপক মোহর আলি। মোহর আলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ায় তিনি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তিনি পিএইচডি করার জন্য লন্ডন যান। সেখানে তিনি উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারকদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। পিএইচডির পাশাপাশি তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই সূত্রেই তিনি আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। মোহর আলি ভালো পড়াতেন। ব্রায়ারলি নামে এক আইনজ্ঞের বই তিনি আমাদের পড়িয়েছেন। তার কোর্সে আমি ৬৮ শতাংশ নম্বর পাই।
এমএ পরীক্ষায়ও আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করি। সমসাময়িক ইতিহাসে আরও দুজন প্রথম শ্রেণি পান। প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন। প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। আমি এবং আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। ১৯৬৮ সালে মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। এ ছাড়া মধ্যযুগের ইতিহাসে একজন প্রথম শ্রেণি পান। বাংলার ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন শরিফউদ্দিন আহমদ। আমি এমএ পাস করার আগে পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সমসাময়িক ইতিহাসে যিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হতেন, তাঁকে ইতিহাস বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ করা হতো। এই পদে থেকে তিনি সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতেন এবং এঁরা সবাই সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন।
আমি যে বছর এমএ পাস করি, সে বছর বিভাগে চারটি সহকারী অধ্যাপকের পদ শূন্য ছিল। তিনটি পদের জন্য তিনজন পিএইচডি প্রার্থী ছিলেন। চতুর্থ পদে অবশ্যই এমএ পাস কাউকে নিতে হবে। বিএ অনার্স এবং এমএতে খুব ভালো নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করায় আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এই পদটি আমি পাবই। আমি এ সম্বন্ধে আর কোনো তদবির করিনি, নিশ্চিন্তে ঘরে বসেছিলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হয়ে বুঝতে পারলাম যে এসব ব্যাপারে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর ওসমান গণি। তিনি ছিলেন কট্টর এনএসএফের সমর্থক। তিনি কোনোমতেই আমার মতো কট্টর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থককে চাকরি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। শুধু ছুতো খুঁজছিলেন। ছুতোটি দিলেন বিভাগীয় প্রধান মফিজুল্লাহ কবির। প্রথম প্রশ্নই আমাকে করা হলো
আমি সিএসএস পরীক্ষার ফর্ম দাখিল করেছি কি না। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তোমার ইন্টারভিউ নিয়ে কোনো লাভ নেই। সিভিল সার্ভিসে যারা যোগ দিতে চায়, তাদের আমরা লেকচারার নিয়োগ করব না। এই একটি প্রশ্ন করেই আমার ভাইভা শেষ হয়ে গেল। আমি যাকে মনে করেছিলাম অত্যন্ত সহজ কাজ, আসলে সেটি হয়ে দাঁড়ায় অসম্ভব। মফিজউল্লাহ কবির দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন। যারা সিএসএস পরীক্ষা দেবে, তাদের বিভাগে চাকরি দেবেন না–এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাঁর একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি আবদুল করিমের পরামর্শে। আবদুল করিম লন্ডন থেকে তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি করে ফিরে এসেছেন এবং ইতিহাস বিভাগে বাংলার ইতিহাস নামে একটি নতুন শাখা চালু করেছেন। এই শাখায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন আমার সহপাঠী শরিফুদ্দিন আহমদ। তিনি অনার্সে আমার চেয়ে প্রায় ৮০ নম্বর কম পান এবং এমএ পরীক্ষাতেও প্রায় ১৫ নম্বর কম পান। কিন্তু নম্বর এখানে বিচার্য বিষয় নয়। ড. করিম ভাবলেন, যদি তার ইচ্ছায় লেকচারার নিয়োগ হয়, তাহলে ইতিহাস বিভাগে তার প্রতিপত্তি হবে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এসব অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি সমাধান ছিল। সমাধানটি আমাকে খেয়াল করিয়ে দেন। সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ। তার কাছে সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিলাম। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন যে শুনলাম তোমার চাকরি হয়নি। তারপর বললেন, ‘বাবা, চাকরি তো এত সোজা নয়, চাকরির দরখাস্ত করে তোমার আমার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল। তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে যেত।’ ড. মফিজউদ্দিন তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ডাকসাইটে ছাত্রদের এনএসএফপন্থী শিক্ষকদের দলে ভর্তির চেষ্টা করছিলেন। পরে জানলাম আমার পূর্ববর্তী ব্যাচের অর্থনীতির পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নপন্থী একজন অধ্যাপককে বামপন্থী শিক্ষকদের নেতা ড. আবু মাহমুদের বিরুদ্ধে এনএসএফপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে একই বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছিলেন। ভাগ্যিস আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। তাহলে আদর্শবাদ একেবারেই বিসর্জন দিতে হতো।
ইতিহাস বিভাগে ভালো-মন্দ মিলিয়ে ১২ জন শিক্ষক ছিলেন। তখনকার দিনে ইতিহাস বিভাগে অনার্স কোর্সে ছাত্র ভর্তির আসন ছিল ৪০। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর প্রতি ব্যাচে সাধারণত ৫ থেকে ১০ শতাংশ যে পেশায় যোগ দিত, সে পেশায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করত। অথচ ১৯৬১ সালে অনার্স কোর্সে ইতিহাস বিভাগে যারা ভর্তি হয়েছিল, তাদের ৪০ ভাগের বেশি নিজেদের পেশায় সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে। এই শ্রেণির পাঁচজন ছাত্র মন্ত্রী হয়েছিলেন। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন বিএনপির মহাসচিব এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। মোস্তফা জামাল হায়দার ছিলেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব এবং পূর্ত ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য এবং আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা এবং রেলমন্ত্রী। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও আকবর আলি খান। সচিবের দায়িত্ব পালন করেন ছয়জন : আকবর আলি খান, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন, আনিসুর রহমান (টাইগার), কামরুল হুদা ও হীরালাল বালা। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ছিল মোজাম্মেল হক। উপসচিব ছিলেন আবুল বাশার জোয়ারদার ও সৈয়দ আহমদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলেন মেজর জেনারেল এ এম সিরাজ। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনজন : আকবর আলি খান, শরিফউদ্দিন আহমদ ও ফিরোজ মাহমুদ। কমপক্ষে দুজন ছিলেন ক্যাডেট কলেজ ও বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। ব্যাংকার হিসেবে বিশেষ সাফল্য অর্জন। করেন দুজন। সুলেমান খান মজলিস, যিনি যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এবং এ টি এম আফসার (সাবু) ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের ফার্স্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট। ৮-১০ জন মহিলা ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা কেউই কোনো স্বাধীন পেশা বেছে নেননি। এঁরা এঁদের স্বামীর কর্মজীবনকে সমর্থন করেছেন। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলেন মকসুদা বেগম। তাঁর স্বামী মঞ্জুরুল করিম জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন। রাশিদা খানম নানকুর স্বামী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল। আমাদের সঙ্গে পাস কোর্সে এমএ পাস করেন বিএনপির বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী তানভীর আহমদ সিদ্দিকীর স্ত্রী খুরশীদ আজিম সিদ্দিকী।
প্রথম পশ্চিম পাকিস্তান সফর
১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে যখন আমরা এমএ পড়ি, তখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। তিন সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তবে এ যুদ্ধের ফলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার ওলটপালট হয়ে যায়। সাধারণত ডিসেম্বরের আগে এমএ পরীক্ষা হতো। আমাদের ব্যাচে এ পরীক্ষা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির আগে কোনোমতেই নেওয়া সম্ভব ছিল না।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের আগে আমি কখনো উড়োজাহাজে চড়িনি। পেট্রলের গন্ধে আমার বমি আসত। আমি পারতপক্ষে বাসে উঠতাম না। বিমানে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে পারব কি না, সে সম্বন্ধেও সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে বিমানযাত্রীদের প্রায়ই বিবমিষা হতো। আগস্ট ১৯৬৫-এর শেষ দিকে সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট মফিজউদ্দিন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি ছাত্র ডেলিগেশন পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি এলাকায় শিক্ষাসফরে পাঠানো হবে। এই সফরের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চল এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলা। প্রভোস্ট বললেন, তোমাকে সলিমুল্লাহ হলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দিন সাতেকের মধ্যে ডেলিগেশন পশ্চিম পাকিস্তানে যাবে, তুমি তৈরি হয়ে নাও।
৭ আগস্ট ১৯৬৫-এর কাছাকাছি সময়ে আমি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিমানে করাচি রওনা হই। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের কোনো বিমান ভারতের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে উড়তে পারত না। তাই আমাদের বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা উড়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে যেতে হবে। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর আবার সাড়ে চার ঘণ্টা উড়ে করাচি বিমানবন্দরে যেতে হবে। সৌভাগ্যবশত বিমানে আমার কোনো শারীরিক অসুবিধা হয়নি। বরং বেশ আরামের সঙ্গেই করাচি পৌঁছাই।
আমাদের ডেলিগেশনে প্রায় ২০ জনের মতো সদস্য ছিল। ফজলুল হক হল থেকে পদার্থবিজ্ঞানের বিশিষ্ট ছাত্র সৈয়দ তারিক আলি ছিলেন (যিনি পরবর্তীকালে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন); নটর ডেম কলেজ থেকে কাজী জাফর উল্যাহ (যিনি পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন) ছিলেন; আর জগন্নাথ কলেজ থেকে ছিলেন আমিনুল হক বাদশা (যিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব হয়েছিলেন)।
করাচিতে যাওয়ার পর আমাদের জানানো হয়, আমাদের সরাসরি পেশোয়ার যেতে হবে। করাচি বিমানবন্দরে কয়েক ঘণ্টা বিরতির পর আমরা পেশোয়ারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই। ইসলামাবাদ বিমানবন্দর হয়ে আমরা পেশোয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দর থেকে আমাদের শাহি মেহমানখানা’ নামে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। শাহি মেহমানখানায় রাজকীয় বিলাসিতা দূরের কথা, অনেক প্রয়োজনীয় সুবিধাও ছিল না। গরমের মধ্যে এই মেহমানখানায় থাকতে খুবই অসুবিধা হয়েছে।
পেশোয়ার থেকে আমাদের একদিন মানকি শরিফে নিয়ে যাওয়া হয়। মানকি শরিফ পেশোয়ার জেলার নওশেরা মহকুমায় অবস্থিত। মানকি শরিফের পীর সাহেব একজন মুসলিম লিগ নেতা ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর তার ছেলে পীর সাহেবের গদিতে বসেছেন। সেখানে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং আমাদের প্রত্যেককে একটি করে মানকি শরিফের টুপি দেওয়া হয়। পরে এ টুপি আমি বহুদিন ব্যবহার করেছি। পেশোয়ার থেকে আমাদের আফগান সীমান্তে লান্ডিকোটাল শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের জানানো হয় যে লান্ডিকোটাল পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হলেও লান্ডিকোটাল অনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে প্রশাসনে উপজাতিদের নিজস্ব ভূমিকা ছিল।
পেশোয়ার থেকে আমাদের কোহাট নিয়ে যাওয়া হয়। কোহাটের বন্দুক তৈরির একটি কুটিরশিল্প ছিল। আমাদের বন্দুক তৈরির কারখানা দেখানো হয়। সেখানকার উপজাতিরা আমাদের জানায়, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যত বন্দুক দরকার, তত বন্দুক সরবরাহ করার জন্য তারা অবশ্যই চেষ্টা করবে।
পেশোয়ার থেকে চার দিনের সফরে আমাদের সোয়াত নিয়ে যাওয়া হয়। সোয়াত তখনো একটি দেশীয় রাজ্য। সোয়াতের ওয়ালি তখনো সোয়াতের প্রশাসনের প্রধান। তার বড় ছেলের সঙ্গে আইয়ুব খানের বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। তাই ওয়ালি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী। সোয়াতে আমাদের মিনগোরা নামে একটি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শহর ছিল সোয়াতের রাজধানী সাইদু শরিফ থেকে তিন-চার মাইল দূরে। মিনগোরাতে আমাদের কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাখা হয়। কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে তখন ছুটি ছিল। কাজেই পুরো ছাত্রাবাসে আমরাই ছিলাম একমাত্র বাসিন্দা। ছাত্রাবাসটির মান বেশ উন্নত ছিল। পরদিন আমাদের সাইদু শরিফে নিয়ে যাওয়া হয়। সোয়াতের ওয়ালির পরিবারের পক্ষ থেকে একজন আমাদের স্বাগত জানায়। সাইদু শরিফের বিভিন্ন জায়গা আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়। বিশেষ করে আমরা সোয়াত জাদুঘরটি ঘুরে দেখি, যেখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন ছিল। পরের দিন আমাদের সোয়াতের উত্তাঞ্চলে কালাম নগরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কালাম নগরী সোয়াত নদীর তীরে অবস্থিত। তখন সেপ্টেম্বর মাস। ওই সময় উত্তর দিকে বরফ পড়ছিল এবং নদীর জলে বরফ ভেসে আসছিল। কালাম নগরী থেকে আমাদের মিনগোরাতে নিয়ে আসা হয়। এরপর আমরা পেশোয়ারে ফিরে আসি। পেশোয়ার থেকে বিমানে করে আমাদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কোয়েটা শহরে।
কোয়েটা শহরে বোলান হোটেল নামে একটি নামী হোটেলে আমাদের রাখা হয়। আমাদের কোয়েটা শহরের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থান দেখানো হয়। একদিন আমাদের কালাত বিভাগের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমাদের বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনায়। আমরাও পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ডাক দিই। চার দিনের একটি সফরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় লোরেলাই জেলার শৈলনিবাস জিয়ারতে। জিয়ারতে বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রধান (যিনি এজিজি–এজেন্ট টু গভর্নর জেনারেল নামে পরিচিত ছিলেন) তার জন্যও একটি নির্ধারিত বাসস্থান ছিল। পাহাড়ের চূড়ায় শহরটি অবস্থিত হওয়ায় অনেকে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এই শহরে আসত। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। করাচি শহরে বাতাসের মান ছিল অত্যন্ত নিচু। তাই তাঁকে জিয়ারতে নিয়ে আসা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে তিনি জিয়ারতে ছিলেন কিন্তু তার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বর গুজব রটে যে তিনি মারা গেছেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য বিবরণী অনুসারে জিয়ারতে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলেও তিনি মারা যাননি। তিনি বিমানে করাচি শহরে অবতরণ করার পর মারা যান। জিয়ারতে যে বাড়িটিতে অসুস্থতার সময় জিন্নাহ ছিলেন, ওই বাড়িটিতে তিনি যেসব আসবাব ব্যবহার করেছিলেন, তা তখন। পর্যন্ত একই অবস্থায় রাখা হয়। আমরা বাড়িটি ভালো করে ঘুরে দেখি।
কোয়েটায় আমরা যখন যাই, তখন সেখানে আমার খালাতো ভাই ব্রিগেডিয়ার কুদুস সেনা প্রকৌশল বিভাগে কাজ করছিলেন। আমি ভাবলাম এখানে যখন এসেছি, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই। আমার বন্ধু সৈয়দ তারিক আলিকে নিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। বাসায় গেলে দারোয়ান জানায় যে ব্রিগেডিয়ার কুদুস রাওয়ালপিন্ডি গেছেন এবং আরও সাত দিন সেখানে থাকবেন। আমি দারোয়ানকে বললাম ভাবিকে বলবেন ব্রিগেডিয়ার কুদুসের খসরু নামের একজন কাজিন এসেছিল–এ খবরটি যেন তাকে দেওয়া হয়। আমরা চলে আসছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আমাদের ফিরে আসতে বলা হয়। দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ভাবি আইলিন (Eileen) কুদুস। তিনি একজন খাঁটি ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিগেডিয়ার কুদুস যখন প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডন যান, তখন তাঁর প্রেমে পড়েন এবং তাঁর সঙ্গে বিয়ে করে পাকিস্তান চলে আসেন। তিনি আর লন্ডনে ফিরে যাননি। তিনি আমাকে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন খালার ছেলে। আমি বললাম নবীনগরের খালা। ব্রিগেডিয়ার কুদুস তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে নবীনগরে বেড়াতে গিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে একটি সরকারি স্টিমারে করে। আম্মা মেহমানদের জন্য অনেক খাবার রান্না করে আমাদের নিয়ে ওই স্টিমারে যান। আইলিনের সে স্মৃতি মনে পড়ে এবং তিনি বলেন, হ্যাঁ, তোমাকে দেখেছি। তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। কাল সন্ধ্যায় তুমি এবং তোমার বন্ধু আমাদের সঙ্গে এসে ডিনার খাও।’ আমরা ডিনার খেতে গিয়েছিলাম। খুবই যত্ন করে আমাদের ডিনার খাইয়েছিলেন তিনি। এরপর বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি সব সময়ই ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীলা। ব্রিগেডিয়ার কুদুস মারা যাওয়ার পরও তিনি বিলাত ফিরে যাননি। অতি সম্প্রতি তাঁর বয়স ৯০ অতিক্রম করেছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় তিনি এখন ভুগছেন। তিনি ছোট ছেলের সঙ্গে এখনো ঢাকাতেই আছেন।
কোয়েটা থেকে আমরা বিমানে করাচি আসি। সেখানে আমাদের একদিন। পর বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার বন্ধু। ফজলুল হক এমএ পড়ছিল। আমি তাকে চিঠি লিখি যে আমি করাচি হয়ে। ঢাকা ফিরে যাব। সে আমাকে বিমানবন্দর থেকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। আমাকে করাচি শহরে জিন্নাহর মাজার দেখায় এবং ক্লিফটন সমুদ্রসৈকতে নিয়ে যায়।
পরদিন বিমানে করে আমরা সবাই কলম্বো হয়ে ঢাকা ফিরে আসি। এই সফরে জাতীয় সংহতির কী লাভ হয়েছিল জানি না, তবে ব্যক্তিগতভাবে। আমার সঙ্গে সৈয়দ তারিক আলি, কাজী জাফর উল্যাহ ও আমিনুল হক বাদশার সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
সিএসএস পরীক্ষার প্রস্তুতি
১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে আমাদের এমএ পরীক্ষা শেষ হয়। এমএ পরীক্ষার পর আমি বিশ্রামের জন্য নবীনগর যাই। তখন একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। আমরা চার ভাই। আমার জন্ম ১৯৪৪ সালে। আমার ছোট ভাই জি এম জিয়াউদ্দিন খানের জন্ম ১৯৪৬ সালে। তার ছয় বছর পর আমাদের। তৃতীয় ভাই তসলিম উদ্দিন খানের জন্ম হয়। সবচেয়ে ছোট ভাই কবিরউদ্দিন। খানের জন্ম হয় ১৯৫৪ সালে। পরিবারের সবাইকে তসলিম খুবই ভালোবাসত। কিন্তু সে খুব দুষ্টু ছিল। একবার টিনের ঘরের চালে উঠে লাফালাফি করে মাটিতে পড়ে যায়। এতে মাথায় প্রচণ্ড চোট পায়। প্রথম দু তিন মাস কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি। তারপর তার খিচুনি ওঠা শুরু হয়। অনেক সময় খিচুনি সপ্তাহখানেক পর্যন্ত থাকত। স্থানীয় ডাক্তাররা প্রকট মৃগীরোগ বলে এ রোগকে চিহ্নিত করেন। সপ্তাহব্যাপী একটি বিরতিহীন খিচুনিতে পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে সে মারা যায়।
জুন-জুলাই মাসে আমাদের ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে উত্তীর্ণ হই। ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে চারজন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাব। যখন পেলাম না, তখন ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের সঙ্গে এই খবর মানসিকভাবে মড়ার উপরে খাড়ার ঘায়ের মতো আমার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ায় আমার অনেক অসুবিধা হয়। ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হলে আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে একটি কক্ষ বরাদ্দ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করব। সেটা সম্ভব হলো না, আমাকে আমার চাচাতো ভাই আনোয়ার আলী খাঁনের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হলো। অবশ্য তার আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। তখন আমি একজন চেইন স্মোকার ছিলাম। সিগারেটের জন্য এবং বিভিন্ন পাঠাগারে যাতায়াতের জন্য আমার অর্থের প্রয়োজন ছিল। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ায় কোনো বৃত্তি পাচ্ছিলাম না। তাই টাকাপয়সার অভাব খুবই অনুভব করি। কয়েক মাস পরে এই অভাব আংশিকভাবে দূর হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে ইতিহাসের একজন খণ্ডকালীন অধ্যাপকের জন্য কাগজে বিজ্ঞপ্তি বের হয়। আমি দরখাস্ত করি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেয়। আমি স্থাপত্য বিভাগে দুই সেমিস্টার বিশ্বসভ্যতা সম্বন্ধে একটি কোর্স পড়াই। খণ্ডকালীন শিক্ষকের বেতন ছিল দেড় শ টাকা। এই দেড় শ টাকায় টেনেটুনে আমার ব্যক্তিগত খরচ মেটানো সম্ভব হয়েছিল। সভ্যতার ইতিহাস পড়াতে আমার ভালো লাগত। মনে হয় অধিকাংশ ছাত্রেরও আমার বক্তৃতা ভালো লাগত।
সিএসএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই। এ ধরনের পরীক্ষার জন্য ছোট ছোট দলে আলাপ-আলোচনা করে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে থাকতাম। আমার বাসার উল্টো দিকে থাকতেন আবদুশ শাকুর। তিনি আমার এক বছর আগে এমএ পাস করেন এবং ঢাকা কলেজে তখন তিনি অধ্যাপনা করছিলেন। তার বড় ভাই হাই সাহেব ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। তাঁকে তখন ঢাকার বাইরে পদস্থ করা হয়। তিনি এলিফ্যান্ট রোডে তখন একটি বেশ বড় বাড়ি নির্মাণ করছিলেন। দোতলার কয়েকটি কক্ষে তাঁর স্ত্রী মেয়েদের নিয়ে থাকতেন। আবদুশ শাকুরকে একটি বড় রুম ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কক্ষে আবদুশ শাকুর, আমি এবং জিয়াউল আনসার–এই তিনজন পরীক্ষাসংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। জিয়াউল আনসার তখন সমাজকল্যাণ কলেজের একজন গবেষক। তাঁর অফিসও এলিফ্যান্ট রোডের খুব কাছেই ছিল। সাধারণত আমরা বিকেল চারটার দিকে আলোচনা শুরু করতাম এবং এই আলোচনা রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত চলত। প্রচুর চা-বিস্কুট খাওয়া হতো। এর ব্যয় অবশ্য সম্পূর্ণ বহন করতেন আবদুশ শাকুর। এ ছাড়া আবদুশ শাকুরের সঙ্গে পড়াশোনা করার একটি সুবিধা ছিল যে তিনি ঢাকা কলেজ লাইব্রেরি থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্র বাড়িতে নিয়ে আসতে পারতেন। সুতরাং বইপত্রের সমস্যারও অনেকটা সমাধান হয়।
যথাসময়ে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি এবং আবদুশ শাকুর উত্তীর্ণ হই, জিয়াউল আনসার পাস করতে পারেননি। এরপর ধানমন্ডিতে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস অফিসে আমাদের ভাইভা হয়। ভাইভার (মৌখিক পরীক্ষা) আগে একদিন আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়। তবে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় কোনো প্রভাব ভাইভার নম্বরের ওপরে পড়ত না। মনস্তাত্ত্বিক ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রার্থীর ব্যক্তিগত প্রবণতা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠাতেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন নাজির আহমদ। তিনি ১৯৩৮ সালের আইসিএস অফিসার ছিলেন। বোর্ডে অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক ফজলুর রহমান ও ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য এ এম সাদুল্লাহ। এ ছাড়া বিভাগীয় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আমাকে প্রায় ২০ মিনিট ভাইভা বোর্ডে রাখা হয়। আমাকে বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হয় আর্ট সম্পর্কে। যেহেতু আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রদের পড়াচ্ছি, সেহেতু ইসলাম ধর্মে চিত্রকলা জায়েজ কি না, সে সম্পর্কে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ভাইভায় আমি মোট ৩০০ নম্বরে ২০০ নম্বর পাই।
১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের একটি পদ খালি হয়। তারা এ পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। আমি দরখাস্ত করি। আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হয়। ইন্টারভিউ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হয় যে তখন সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আমি শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউ দিতে যাইনি। সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল আমি সারা পাকিস্তানে সিএসএস পরীক্ষায় ১৬তম স্থান। অধিকার করেছি। এর মধ্যে চারজন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যাওয়ার ইচ্ছা। ব্যক্ত করেছে। সিএসপিতে আমার স্থান হয় ১২ নম্বরে। সে বছর সারা। পাকিস্তানে ২০ জন সিএসপি নিয়োগ করা হয়। সুতরাং কোনো কোটা ছাড়াই। আমি সিএসপিতে নির্বাচিত হই।
সিএসএস পরীক্ষার ফলাফল আগস্ট ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। আমি লাহোর যাওয়ার আগে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য নবীনগরে যাই। ওই সময় আমার ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন খান ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিনলেজ ব্যাংকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছিল। সেও একই সময়ে শিক্ষানবিশের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ৯ মাসের জন্য লন্ডনে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়। সে-ও ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। আমরা বাড়িতে বেশ হইচই করে দিন কাটাই। আমরা ঠিক করলাম যে দেশ ছাড়ার আগে রেখা আপা ও ফুফু ফুফাঁদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসব। প্রথমে আমরা নৌকা করে গেলাম বাইরা গ্রামে রেখা আপার বাড়িতে। সেখানে রাতে থেকে পরদিন আমরা সকালবেলা নৌকা করে গেলাম রতনপুর। সেখানে ছোট ফুফুর সঙ্গে দেখা হয়। তারপর নৌকায় করে আসলাম কালঘরায়। সেখানে মেজ ফুফুর সঙ্গে দেখা হলো। সবশেষে গেলাম শাহাবাজপুরে, সেখানে দেখা হলো ফুফার সঙ্গে। এরপর মেঘনা নদী দিয়ে সেদিনই প্রায় রাত ১০টার দিকে নবীনগর এসে পৌঁছাই। ফুফু-ফুফাঁদের সঙ্গে সেই আমাদের শেষ দেখা। নৌকায় করে এটাই ছিল আমাদের নবীনগরে খাল-বিল দিয়ে শেষ ভ্রমণ। এখন আর খালপথে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়; বেশির ভাগ খাল এখন ভরাট হয়ে গেছে।
পাদটীকা
১. Will Durant, Out Oriental Heritage, 1935 : Simon and Schuster, New York P-369