৮. সহজাত প্রবৃত্তি

অষ্টম অধ্যায়—সহজাত প্রবৃত্তি 

স্বভাবের সঙ্গে সহজাত প্রবৃত্তিগুলি তুলনীয়—কিন্তু এগুলির উৎপত্তি ভিন্ন ভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তিগুলি ক্রমানুসারে বিভক্ত—জাবপোকা ও পিঁপড়ে—সহজাত প্রবৃত্তিগুলি পরিবর্তনশীল—গৃহপালিত প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ—এগুলির উদ্ভব—কোকিল, মলোথ্রাস, উটপাখি ও পরজীবী মৌমাছিদের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তি-দাস সৃষ্টিকারী পিঁপড়েরা—মধু-মৌমাছি, এদের মৌচাকের মধুকোষ তৈরীর সহজাত প্রবৃত্তি—সহজাত প্রবৃত্তির পরিবর্তন ও দেহগঠন আবশ্যিকভাবে যুগপৎ নয়—সহজাত প্রবৃত্তির প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রতিবন্ধকসমূহ—ক্লীব বা বন্ধ্যা পতঙ্গ—সারাংশ। 

অনেক সহজাত প্রবৃত্তি এত বিস্ময়কর যে এগুলির ক্রমবিকাশ পাঠকের কাছে সম্ভবতঃ তত্ত্বটির একটি প্রতিবন্ধক বলে মনে হবে, যা আমার তত্ত্বটির পতন ঘটাতে যথেষ্ট। আমি এখানে মুখবন্ধস্বরূপ বলতে পারি যে জীবনের উদ্ভব সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তার তুলনায় মানসিক ক্ষমতার উৎপত্তি সম্পর্কে আমার বেশী কিছু জানা নেই। একই শ্রেণীর প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তির বৈচিত্র্য ও অন্য মানসিক ক্ষমতাগুলি সম্পর্কেই আমরা শুধু আগ্রহী। 

সহজাত প্রবৃত্তির কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা আমি করব না। এটি দেখানো সহজ হবে যে কতিপয় ভিন্ন মানসিক ক্রিয়াকলাপ সাধারণতঃ এই পদটির অন্তর্ভুক্ত; যখন বলা হয় সহজাত প্রবৃত্তি কোকিলকে প্রচরণ ও অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়তে বাধ্য করে, তখন কিন্তু প্রত্যেকে বোঝেন যে এর অর্থ কি। একটি প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। অভিজ্ঞতা ছাড়া যখন একটি প্রাণী, বিশেষ করে এর শাবকরা প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করে এবং কি জন্যে এটি সম্পাদন করছে তা না জেনে যখন অসংখ্য এককরা প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করে, তখন প্রক্রিয়াটিকে সহজাত প্রবৃত্তিমূলক বলা হয়। আমি কিন্তু দেখাতে পারি এই বৈশিষ্ট্যদের একটিও সার্বজনীন নয়। পিয়েরে হুবারের বক্তব্য অনুসারে, বিচার বা যুক্তির অল্প মাত্রা প্রায়শই একটি ভূমিকা পালন করে, এমনকি প্রাকৃতিক মানদণ্ডে নিম্নস্তরের প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। 

ফ্রেডেরিক কুভিয়ের ও প্রাচীন অধিবিদ্যাবিদদের কয়েকজন স্বভাবের সঙ্গে সহজাত প্রবৃত্তির তুলনা করেছেন। এই তুলনা, আমি মনে করি, মানসিক কাঠামোর একটি ধারণা উপস্থিত করে, যার দ্বারা সহজাত প্রবৃত্তিমূলক একটি প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়, কিন্তু এর উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন সঠিক ধারণা উপস্থিত করে না। প্রায়শই আমাদের সজ্ঞান ইচ্ছার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করে, কেমন করে অসংখ্য স্বভাবগত প্ৰক্ৰিয়া সম্পাদিত হয়! তথাপি এগুলি ইচ্ছা বা যুক্তির দ্বারা রূপান্তরিত হতে পারে। কোন কোন সময়ে ও শরীরের অবস্থানুসারে স্বভাবসমূহ অন্য স্বভাবের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। একবার অর্জিত হওয়ার পর এগুলি প্রায়শই সারাজীবন ধরে স্থায়ী হয়। স্বভাব ও সহজাত প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে সাদৃশ্যের অন্য কতিপয় বিষয় উত্থাপন করা যেতে পারে। একটি সুপরিচিত গানের পুনরাবৃত্তির মত সহজাত প্রবৃত্তিসমূহে ছন্দের মত একটি প্রক্রিয়া অন্যটিকে অনুসরণ করে; যদি কোন ব্যক্তিকে গানের সময় বাধা দেওয়া হয়, অথবা স্মরণশক্তির সাহায্যে কোন কিছুর পুনরাবৃত্তি করতে হয়, চিন্তাশক্তির স্বাভাবিক শিক্ষা পুনরুদ্ধার করতে পেছনের দিকে ফিরতে সে সাধারণতঃ বাধ্য হয়; পি. হুবার জটিল দোলনশয্যা বা হ্যামক সৃষ্টিকারী একটি শুঁয়োপোকার ক্ষেত্রে এরূপ লক্ষ্য করেছিলেন; তিনি যদি একটি শুঁয়োপোকা ধরতেন যা দোলনশয্যার বা হ্যামকে গঠনের, ধরা যাক, ষষ্ঠ স্তর (ধাপ) পর্যন্ত শেষ করেছিল এবং কেবল তৃতীয় স্তর বা ধাপ পর্যন্ত শেষ করা একটি হ্যামকে এটিকে যদি তিনি ছেড়ে দিতেন, তাহলে শুঁয়োপোকাটি গঠনের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপকে পুনর্বার সম্পাদন করত। তবে, ধরা যাক, তৃতীয় স্তর বা ধাপ পর্যন্ত সম্পন্ন হ্যামক থেকে যদি একটি শুঁয়োপোকাকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং অধিকাংশ কার্য সম্পন্ন হওয়া হ্যামকের ষষ্ঠ স্তরে যদি একে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর থেকে কোন সুবিধা গ্রহণ করতে না পেরে সে বিরক্ত হয়ে উঠবে এবং হ্যামকটিকে সম্পূর্ণ করার জন্য তৃতীয় স্তর বা ধাপ থেকে কাজ আরম্ভ রবে, যেখানে সে কাজটি পরিত্যাগ করেছিল এবং এভাবে ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ কাজকে আবার সম্পূর্ণ করতে চেষ্টা করবে। 

আমরা যদি মনে করি কোন কোন স্বভাবগত প্রক্রিয়া বংশগত এবং দেখানো যেতে পারে এটি কোন কোন সময় ঘটে—তখন যাকে প্রথমে বলা হয় স্বভাব এবং সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ হয় যে এদের পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না। তিনবছর বয়সে অল্প অভ্যাস সমেত পিয়ানো বাজানোর পরিবর্তে মোজার্ট যদি কোন অভ্যাস ছাড়াই পিয়ানোর একটি স্বর বাজাতেন, তাহলে সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে সহজাত প্রবৃত্তিতেই তিনি তা করতেন। কিন্তু মনে করা অতিশয় ভুল হবে যে বিরাট সংখ্যক সহজাত প্রবৃত্তি এক বংশে স্বভাব দ্বারা অর্জিত হয়েছে এবং এরপর বংশগতির মাধ্যমে বংশগতভাবে পরবর্তী বংশগুলিতে প্রেরিত হয়েছে। স্পষ্টভাবে দেখানো যেতে পারে যে যাদের সঙ্গে আমরা পরিচিত এমন মধু-মৌমাছি ও অনেক পিঁপড়েদের সবচেয়ে বিস্ময়কর সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ সম্ভবতঃ স্বভাব দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকতে পারে না। 

সকলেই স্বীকার করবেন যে জীবনের বর্তমান অবস্থায় প্রত্যেক প্রজাতির কল্যাণের জন্য সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ দেহগত গঠনগুলির মত সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে এটি অন্ততঃ সম্ভবপর যে সহজাত প্রবৃত্তির অল্প রূপান্তর একটি প্রজাতির পক্ষে লাভজনক হয়ে থাকবে; এবং যদি এটি দেখাতে পারা যায় যে সহজাত প্রবৃত্তিসমূহও অল্প পরিবর্তিত হয়, তখন আমি কোন অসুবিধা দেখি না যে লাভজনক হয় এমন সহজাত প্রবৃত্তিসমূহের পরিবর্তনগুলির প্রাকৃতিক নির্বাচন সংরক্ষণ ও অনবরত সঞ্চয়ন করে থাকে। আমি বিশ্বাস করি প্রায় সমস্ত জটিল ও বিস্ময়কর সহজাত প্রবৃত্তি এভাবেই উদ্ভূত হয়েছে। দেহগত গঠনের রূপান্তরসমূহ যেহেতু ব্যবহার বা স্বভাব থেকে ও তারই দ্বারা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অব্যবহারের দ্বারা হ্রাসপ্রাপ্ত বা লুপ্ত হয়েছে, সেজন্যে আমি সন্দেহ করি না সে এটি সহজাত প্রবৃত্তিসমূহের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে স্বভাবের পরিণামসমূহ সহজাত প্রবৃত্তির স্বতঃস্ফুর্ত পরিবৃত্তির প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরিণামের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে গৌণ গুরুত্বের হয়—অর্থাৎ একই অজ্ঞাত কারণসমূহের দ্বারা পরিবৃত্তিসমূহ যা দেহগত গঠনের অল্প বিচ্যুতি সৃষ্টি করে। 

অসংখ্য অল্প অথচ লাভজনক পরিবৃত্তির মন্থর ও ক্রমিক সঞ্চয়ন ছাড়া, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোন জটিল সহজাত প্রবৃত্তি সম্ভবতঃ সৃষ্টি করা যেতে পারে না। অতএব দেহগত গঠনসমূহের বিষয়টির মত, আমরা প্রকৃতিতে যার দ্বারা প্রত্যেক জটিল সহজাত প্রবৃত্তিটি অর্জিত হয়েছে এমন প্রকৃত সংক্রমণগত ক্রমবিন্যাসের ধাপসমূহ দেখতে পাব না—কারণ এগুলি কেবল প্রত্যেক প্রজাতির বংশানুক্রমিক পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে—কিন্তু এইসব ক্রমবিন্যাসগত ধাপগুলোর কিছু সাক্ষ্য বংশের সমপার্শ্বিক লাইনে আমাদের দেখা উচিত; অথবা কিছু কিছু ধরনের ক্রমবিন্যাসগত ধাপ আমাদের দেখানো উচিত; এবং এটা আমরা নিশ্চয় করতে পারি। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা ছাড়া অন্য স্থানের প্রাণীদের অল্প সহজাত প্রবৃত্তি দেখে এবং বিলুপ্ত প্রজাতিদের মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তি না জেনে, আমি আশ্চর্যান্বিত হই কেমন করে সবচেয়ে জটিল সহজাত প্রবৃত্তি নির্দেশকারী অতি সাধারণ ক্রমবিন্যাসগত ধাপগুলি আবিষ্কার করা যেতে পারে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বা বছরের বিভিন্ন ঋতুতে অথবা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ইত্যাদিতে অবস্থানকারী ভিন্ন ভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তি সম্বলিত একই প্রজাতির সহজাত প্রবৃত্তির পরিবর্তনসমূহ কোন কোন সময় কাজটিকে সহজসাধ্য করতে পারে; সে ক্ষেত্রে এক অথবা অন্য সহজাত প্রবৃত্তি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সংরক্ষিত হতে পারবে। এবং একই প্রজাতির সহজাত প্রবৃত্তির বৈচিত্র্যের এরূপ উদাহরণ যে প্রকৃতিতে রয়েছে বা ঘটে তা দেখানো যেতে পারে। 

পুনরায়, দেহগত গঠনের ক্ষেত্রে ও আমার তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হিসেবে, প্রত্যেক প্রজাতির সহজাত প্রবৃত্তি নিজের ক্ষেত্রে কল্যাণকর, কিন্তু যতদূর আমি জানি, এটি কখনও অন্যের উপকারের জন্য সৃষ্ট হয় না। একটি প্রাণী অন্যের উপকারের জন্যে কার্য সম্পাদন করে, এমন ব্যাপারে আমার জানা সবচেয়ে ভাল উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অ্যাফাইড বা জাবপোকারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পিঁপড়েদের জন্য মিষ্ট রস উৎপাদন করে; ঘটনাটি সর্বপ্রথম হুবার লক্ষ্য করেছিলেন; এরা যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এটি করে তা নিচের উদাহরণসমূহে দেখা যাবে। ডক উদ্ভিদের (চুকা পালং জাতীয় রিউমেক্স গণের গাছ) ওপর প্রায় এক ডজন জাবপোকাদের কাছ থেকে সব পিঁপড়েদেরকে আমি তাড়িয়ে দিই এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে এদের আবার ফিরে আসতে বাধা দিই। কিছুক্ষণ পর আমি অনুভব করি যে জাবপোকারা বা অ্যাফাইডরা রস বের করতে চাইবে। লেন্সের সাহায্যে আমি এদের পর্যবেক্ষণ করি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এরা কেউই রস নিঃসরণ করেনি। পিঁপড়েরা তাদের শুঁড় দিয়ে যেমন করে, সেইরকম আমি একটি চুল দিয়ে এদের সুড়সুড়ি দিই এবং আঘাত করি; তা সত্ত্বেও এরা কিন্তু কেউই রস নিঃসরণ করেনি। এরপর আমি একটি পিঁপড়েকে এদের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করি, তখন জাবপোকারা পিঁপড়ের দল এসেছে মনে করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল; পিঁপড়েটি একটি জাবপোকার এবং পরে অন্য জাবপোকাদের উদরে শুঁড় দিয়ে আঘাত করতে লাগল; এবং যে মুহূর্তে এরা শুঁড়ের স্পর্শ অনুভব করল, তৎক্ষণাৎ জাবপোকাটি উদরটিকে ওপরে তুলে ধরে মিষ্ট রসের স্বচ্ছ বিন্দু নিঃসরণ করল, পিঁপড়েটি আগ্রহ সহকারে তা পান করতে লাগল। এমনকি অতি শিশু জাবপোকারাও একই ভাবে তা করতে লাগল। এটি দেখায় যে প্রক্রিয়াটি সহজাত প্রবৃত্তিমূলক এবং অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়। হুবাবের পর্যবেক্ষণগুলি থেকে এটা নিশ্চিত যে জাবপোকারা পিঁপড়েদের অপছন্দ করে না : যদি পিঁপড়েরা উপস্থিত না-ও থাকত, এরা অন্ততঃ রস নিঃসরণ করতে বাধ্য হত। কিন্তু যেহেতু রসটি খুব আঠাল, তাই নিঃসন্দেহেই এটি অপসারণ করতে জাবপোকাদের সুবিধা হয়; অতএব সম্ভবত শুধুমাত্র পিঁপড়েদের উপকারের জন্যই এরা রস নিঃসরণ করে না। যদিও কোন প্রমাণ নেই যে কোন প্রাণী কেবল অন্য প্রাণীদের উপকারের জন্য কোন কার্য সম্পাদন করে, তথাপি প্রত্যেকে অন্যদের সহজাত প্রবৃত্তিসমূহের সুযোগ নিতে চেষ্টা করে, যেমন প্রত্যেকে অন্য প্রজাতিদের দুর্বল দেহগঠনের সুযোগ নেয়। সেইরূপে বলা যায় যে কোন কোন সহজাত প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিখুঁত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না, কিন্তু এই বিষয় ও অন্য এরূপ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়, তাই এ বিষয়ে আলোচনা এখানেই ইতি টানা উচিত। 

প্রাকৃতিক অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিগুলির কিছু পরিমাণ পরিবৃত্তি এবং এইসব পরিবৃত্তির বংশানুসৃতি প্রাকৃতিক নির্বাচনের কার্যের পক্ষে অত্যাবশ্যক, যার সম্ভবপর অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু জায়গার অভাব এ ব্যাপারে আমাকে নিবৃত্ত করেছে। আমি কেবল নিশ্চিতরূপে বলতে পারি যে সহজাত প্রবৃত্তিগুলিও নিশ্চয় পরিবর্তিত হয়—উদাহরণস্বরূপ, প্রচরণশীল সহজাত প্রবৃত্তিটি, এর ব্যাপ্তি ও গতিপথ, এবং এর সম্পূর্ণ লুপ্ত হওয়া। যেমন হয় পাখিদের বাসার ক্ষেত্রে, যা অংশত পছন্দমত জায়গা নির্বাচনের এবং বাসযোগ্য দেশের প্রকৃতি ও তাপমাত্রা অনুসারে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু অন্য কারণের জন্যও হয় যেগুলি আমাদের কাছে অজ্ঞাত : অডুবন উত্তর ও দক্ষিণ ইউনাইটেড স্টেট্স-এর এক প্রজাতির পাখির বাসার বিভিন্নতার বা পার্থক্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সংগ্রহ করেছেন। অনেকে প্রশ্ন করেন, যদি সহজাত প্রবৃত্তিটি পরিবর্তনশীল হয়, “মোমের অপ্রাচুর্য বা অভাবের সময় অন্য কোন পদার্থ ব্যবহার করার সামর্থ্য” মৌমাছিদের কেন এটি যোগায় না? অন্য কোন প্রকৃতিজাত বস্তু মৌমাছিরা কি ব্যবহার করতে পারত? আমি দেখেছি সিন্দুর-মেশানো শক্ত মোম বা চর্বি মেশানো নরম মোম দিয়েও এরা কাজ করে। অ্যানডু নাইট লক্ষ্য করেছিলেন যে তাঁর মৌমাছিরা পরিশ্রম সহকারে প্রোপোলিস (মৌমাছি আঠা বা গ্লু) সংগ্রহ করার পরিবর্তে ছাল ছাড়ানো গাছগুলিতে তাঁর লাগানো মোম ও টারপেন্টাইনের একটি সিমেন্ট জাতীয় পদার্থ সংগ্রহ করত। সম্প্রতি দেখা গেছে যে পরাগরেণু খোঁজার পরিবর্তে মৌমাছিরা সানন্দে একটি অতি ভিন্ন পদার্থ, যেমন ওটমিল ও (যই জাত খাবার) ব্যবহার করে। কোন বিশেষ শত্রুকে ভয় নিশ্চয় একটি সহজাত প্রবৃত্তিমূলক বিষয়, যেটি পাখির ছানাদের ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, যদিও এটি অভিজ্ঞতা ও অন্য প্রাণীদের একই শত্রু দেখে ভয় পাওয়ার দ্বারা আরও দৃঢ়মূল হয়। যেমন আমি অন্যত্র দেখিয়েছি, মরুদ্বীপে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণীরা মানুষ সম্পর্কে ভীতি ধীরে ধীরে অর্জন করে; এবং ইংল্যান্ডে এর একটি উদাহরণ আমরা দেখেছি, যেমন ছোট ছোট পাখিদের তুলনায় সব বড় বড় পাখিদের নির্জন প্রান্তরে অবস্থান; কারণ মানুষরা বড় বড় পাখিদের ওপর ভয়ানক অত্যাচার করে। এই কারণের জন্যই যে আমাদের বড় বড় পাখিরা নির্জন এলাকায় অবস্থান করে তা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কারণ নির্জন দ্বীপগুলিতে বড় বড় পাখিরা ছোটদের তুলনায় বেশী ভীতসন্ত্রস্ত হয় না; এবং ম্যাগপাই পাখিরা ইংল্যান্ডে খুবই সতর্ক কিন্তু নরওয়েতে পোষ্য হয়, যেমন ইজিপ্টে হুড সমেত কাকদের ক্ষেত্রে হয়। 

একই প্রকার প্রাণীদের প্রাকৃতিক অবস্থায় উদ্ভূত মানসিক গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলি যে সবচেয়ে বেশী পরিবর্তিত হয়, তা অনেক তথ্য সহকারে দেখানো যেতে পারে। বন্য প্রাণীদের মধ্যে আকস্মিক ও অদ্ভুত স্বভাবগুলির করে এটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যা প্রজাতিদের পক্ষে লাভজনক বা সুবিধাজনক হলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন সহজাত প্রবৃত্তির উদ্ভব ঘটিয়ে থাকতে পারে। আমি ভালভাবেই জানি যে বিস্তৃত তথ্য ছাড়া এইসব সাধারণ বক্তব্য পাঠকদের মনে অস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আমি শুধু পুনর্বার বলতে পারি যে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া আমি কিছু বলি না। 

গৃহপালিত প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তি অথবা 
স্বভাবের বংশানুসৃত বা আনুবংশিক পরিবর্তনসমূহ 

প্রাকৃতিক অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তির বংশগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা বা এমনকি সম্ভাব্যতা গৃহপালনের কয়েকটি ঘটনা সংক্ষেপে আলোচনা করলে স্পষ্টভাবে বোঝা হবে। এভাবে আমরা দেখতে পাব যে সুপরিচিত স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনগুলির স্বভাব ও নির্বাচন আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের মানসিক গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলির রূপান্তরে কি ভূমিকা পালন করেছে। এটি বিস্ময়কর যে গৃহপালিত প্রাণীরা তাদের মানসিক গুণাবলীকে কতখানি পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, এক ধরনের বেড়াল ধেড়ে ইঁদুর ধরে, অন্য ধরনের বেড়াল নেংটি ইঁদুর ধরে, এবং জানা গেছে যে এই প্রবণতা বংশগত হয়। মিঃ সেন্টজনের মতানুসারে, এক ধরনের বেড়াল সর্বদা লড়াকু পাখিদের বাড়িতে ধরে আনে, অন্য ধরনের বেড়াল শশক অথবা খরগোশদের এবং অন্য এক ধরনের বেড়াল জলাভূমিতে শিকার ধরে এবং রাত্রিতে উডকক বা স্নাইপ পাখিদের ধরে আনে। বিভিন্ন ধরনের স্বাভাবিক প্রবণতা বা আসক্তি ও স্বাদের এরূপ প্রকৃত কলাকৌশলের অসংখ্য অদ্ভুত ও প্রকৃত সত্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যা সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে অথবা মনের কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় এবং বংশগতভাবে বংশপরম্পরায় প্রেরিত হয়। তা হলেও এখানে কুকুরের জাতগুলির সুপরিচিত ঘটনাদের দিকে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত : এটি সন্দেহ করা যেতে পারে না যে শিশু পয়েন্টার কুকুররা যখন প্রথম বের হয় (একটি চিত্তাকর্ষক উদাহরণ যা আমি নিজে লক্ষ্য করেছি), তখন কোন কোন সময় তারা শিকারের দিকে তাক করে দাঁড়ায় এবং অন্য কুকুরদের সাহায্য করে বা মদত দেয়; শিকার ধরে নিয়ে আসার প্রবণতাটি নিশ্চয় কিছু মাত্রায় বংশগতভাবে প্রেরিত হয়; এবং এক পাল ভেড়ার দিকে না গিয়ে তাদের চারদিকে ঘুরে আসা মেষপালকের কুকুরদের একটি প্রবণতা। আমি দেখতে পাই না যে অভিজ্ঞতা ছাড়া শিশুটির দ্বারা ও প্রায় একই পদ্ধতিতে প্রত্যেক একক দ্বারা সম্পাদিত এইসব প্রক্রিয়া প্রত্যেক জাতের দ্বারা পরিতৃপ্তির সঙ্গে ও শেষ কোথায় তা না জেনেই সম্পন্ন হয়—সাদা প্রজাপতি জানে কেন সে বাঁধাকপির পাতায় ডিম পাড়ে, এর তুলনায় শিশু নির্দেশক কুকুর আরও বেশী জানতে পারে না যে তার মনিবকে সাহায্য করার জন্য সে তাক বা নির্দেশ করে। আমি মনে করি না যে এইসব কার্যপ্রক্রিয়া প্রকৃত সহজাত প্রবৃত্তি থেকে মূলতঃ ভিন্ন। আমরা যদি এক প্রকার নেকড়ে বাঘকে লক্ষ্য করি, তারা যখন শিশু ও যাদের কোন শিক্ষা থাকে না, যে মুহূর্তে শিকারের গন্ধ পায়, তারা মূর্তির মত স্থিরভাবে দাঁড়ায় ও তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে অদ্ভুত চলনভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হয় এবং অন্য আর এক ধরনের নেকড়ে বাঘ একদল হরিণের দিকে না গিয়ে তীব্রবেগে তাদের চারদিকে ঘোরে এবং তাদের দূরবর্তী কোন স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এইসব কাজকে নিশ্চয় সহজাত প্রবৃত্তিমূলক বলা উচিত। যেমন বলা যায়, গৃহপালিত অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তির তুলনায় নিশ্চয় কম স্থায়ী; কিন্তু কম কঠোর নির্বাচন দ্বারা এগুলি কার্যকরী হয়েছে এবং জীবনের কম স্থায়ী অবস্থায় তুলনামূলকভাবে অল্প সময় জুড়ে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়েছে। 

গৃহপালনাধীন অবস্থায় স্বভাব ও স্বাভাবিক প্রবণতার মত এইসব সহজাত প্রবৃত্তি কত প্রবলভাবে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়েছে এবং কি অদ্ভুতভাবে এরা মিশ্রিত হয়েছে, বিভিন্ন জাতের কুকুরদের সংকরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে তা সুন্দরভাবে দেখানো যায়। এভাবে জানা গেছে যে বুলডগের সঙ্গে সংকরণ গ্রে হাউন্ডের সাহস ও দুর্দমতাকে অনেক বংশ ধরে সঞ্চারিত করে; গ্রে হাউন্ডের সঙ্গে সংকরণ সেফার্ড কুকুরের সমগ্র পরিবারকে খরগোশ শিকার করার প্রবণতা প্রদান করে। এরূপে সংকরণ দ্বারা পরীক্ষিত এইসব গৃহপালনাধীনে সহজাত প্রবৃত্তিগুলো স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিসমূহের সদৃশ হয়, যা একই উপায়ে অদ্ভুতভাবে একত্রে মিশ্রিত হয় ও দীর্ঘ সময় ধরে উভয় পিতামাতার সহজাত প্রবৃত্তির চিহ্ন বহন করে : উদাহরণস্বরূপ, লে রয় একটি কুকুরের বর্ণনা দিয়েছেন যার প্রপিতামহ ছিল একটি নেকড়ে বাঘ এবং এই কুকুরটি ডাকার পর মনিবের দিকে সোজা না এসে কেবল একদিকে আসার বন্য বংশপরিচয় দেখিয়েছিল। 

গৃহপালনাধীন অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিসমূহকে কোন কোন সময় এমন সব প্রক্রিয়া বলা হয় যা দীর্ঘসময় ধরে চলা ও আবশ্যিক স্বভাব থেকে কেবল বংশগতভাবে সঞ্চারিত হয়েছে; কিন্তু এটি সত্য নয়। লোটন পায়রাকে ডিগবাজী খেতে শিক্ষা দেওয়ার চিন্তা কেউ কখনও করবে না বা সম্ভবত শিক্ষা দেয়ওনি—আমি লক্ষ্য করেছি এই কাজটি শিশু-পাখিরা করে, এবং একটি পায়রাকেও কখনও ডিগবাজী খেতে দেখিনি। আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে—কোন একটি পায়রা এই অদ্ভুত স্বভাবের অল্প প্রবণতা প্রদর্শন করেছিল এবং বংশপরম্পরায় উৎকৃষ্ট এককদের দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচন এখনকার মতো লোটন পায়রাদের সৃষ্টি করেছিল; এবং মিঃ ব্রেন্ট-এর কাছ থেকে আমি শুনেছি যে গ্লাসগো শহরের কাছে কিছু পোষা লোটন পায়রা আছে, যারা ডিগবাজী না খেয়ে আঠারো ইঞ্চির অধিক উড়তে পারে না। যদি কোন একটি মুকুর এ ব্যাপারে স্বাভাবিক প্রবণতা না দেখায়, কেউ কি ঐ কুকুরকে নির্দেশ করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার চিন্তা করে থাকবে, এটি সন্দেহ করা যেতে পারে; এবং এটি মাঝেমাঝে ঘটে বলে জানা গেছে, যেমন আমি একটি বিশুদ্ধ টেরিয়ার কুকুরের ক্ষেত্রে দেখেছি : অনেকে ভাবেন যে তাক করার প্রক্রিয়াটি সম্ভবত শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কেবল একটি প্রাণীর সাময়িক বিরতি। তাক করার প্রথম প্রবণতা প্রদর্শিত হলে নিয়মানুগ নির্বাচন এবং প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক বংশে আবশ্যকীয় প্রশিক্ষণের বংশগত প্রভাব কাজটিকে শীঘ্রই শেষ করবে; উন্নত করার ইচ্ছা না করে, মানুষ যেহেতু সোজা হয়ে দাঁড়ায় ও ভাল শিকার করে এমন কুকুরদের সংগ্রহ করার চেষ্টা করে, সেহেতু অচেতন নির্বাচন তখনও চলে। অন্যদিকে কেবল কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বভাবই যথেষ্ট। বন্য খরগোশের তুলনায় কোন প্রাণীকে পোষ মানানো কদাচিৎ আরও কষ্টকর; পোষ মানানো খরগোশের তুলনায় কোন প্রাণী মোটেই বেশী পোষ্য নয়; কিন্তু আমি মনে করিনা যে গৃহপালিত খরগোশদের শুধুমাত্র পোষ মানানোর গুণের জন্য নির্বাচন করা হয়; সেজন্য চরম বন্যাবস্থা থেকে চরম পোষ মানানো অবস্থার তুলনায় স্বভাব ও বংশগতভাবে প্রাপ্ত পরিবর্তনের অন্ততঃ বিরাট অংশে এটি আমাদের আরোপ করা উচিত। 

স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিগুলি গৃহপালনাধীন অবস্থায় লুপ্ত হয় : মুরগীর সেইসব জাতগুলির ক্ষেত্রে এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যারা কদাচিৎ বা কখনই ডিমে তা দেয় না বা নিজের ডিমের ওপর তা দিতে চায় না। অন্তরঙ্গতা শুধুমাত্র আমাদের দেখাতে বাধা সৃষ্টি করে কেমন করে বিরাট ও স্থায়ীভাবে আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের মানসিক অবস্থা রূপান্তরিত হয়েছে। এটি সন্দেহ করা প্রায় অসম্ভব যে মানুষের স্নেহই কুকুরের মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তিমূলক হয়েছে। পোষ মানানোর পর সব নেকড়ে বাঘ, শিয়াল, পাতিশিয়াল ও বিড়াল গণের প্রজাতিরা মুরগী, ভেড়া, শুয়োরদের আক্রমণ করতে সবচেয়ে আগ্রহান্বিত হয়; এবং কুকুরদের এই প্রবণতা সংশোধনের অসাধ্য বলে মনে হয়, যাদের তিয়েরা দেল ফুয়েগো এবং অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে কুকুরছানা হিসেবে আনা হয়, এবং যেখানে বর্বর মানুষরা এদের গৃহপালনের জন্য রাখে না। বিপরীতক্রমে মুরগী, ভেড়া, শুয়োরদের আক্রমণ না করতে আমাদের সুসভ্য কুকুরদের, এমনকি শিশু কুকুরদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি! সন্দেহ নেই যে এরা মাঝেমাঝে আক্রমণ করে থাকে এবং তারপর এদের প্রহার করা হয়; এবং যদি সংশোধিত না হয়, তখন এদের বিনাশ করা হয়; অতএব স্বভাব এবং কিছু মাত্রায় নির্বাচন আমাদের গৃহপালিত কুকুরদের বংশানুসৃতি বা বংশগতির দ্বারা সভ্য করতে সম্ভবত একসঙ্গে কাজ করে। বিপরীতক্রমে মুরগীছানাদের সামগ্রিকভাবে স্বভাব দ্বারা কুকুর ও বিড়াল ভীতি লুপ্ত হয়, নিঃসন্দেহেই এটি এদের মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তিমূলক ছিল; কারণ ক্যাপ্টেন হুটন আমাকে জানিয়েছেন যে পিতামাতা স্টকের (গ্যালাস ব্যাংকিভার) শিশু মুরগীছানারা যখন ভারতে একটি মুরগীর তত্ত্বাবধানে পালিত হয়, তখন এরা অত্যধিক বুনো অবস্থায় থাকে। ইংল্যান্ডে একটি মুরগীর তত্ত্বাবধানে পালিত শিশু ফেজান্ট পাখিদের (রঙিন পাখিবিশেষ) ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। এটি এই নয় যে মুরগীছানাদের সমস্ত ভীতি দূর হয়েছে, বরং কেবল কুকুর ও বেড়াল ভীতি, কারণ ভয় পেয়ে মুরগী যদি ডাকতে থাকে, ওরা এর কাছ থেকে পালিয়ে যায় এবং পার্শ্ববর্তী ঘাস অথবা ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে; এদের মাতাকে উড়ে পালাতে দেওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিমূলক স্বভাবের জন্যই নিশ্চয় এটি করা হয়, যেমন আমরা বন্যভূমির পাখিদের ক্ষেত্রে দেখি। কিন্তু আমাদের মুরগীছানাদের বজায় রাখা এই সহজাত প্রবৃত্তি গৃহপালনাবস্থায় অপ্রয়োজনীয়, কারণ মাতা মুরগী অব্যবহারের ফলে ওড়ার ক্ষমতা প্রায়ই সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। 

অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে অংশত স্বভাব ও অংশত মানুষের দ্বারা গৃহপালনাধীন অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিগুলি অর্জিত হয়েছে এবং স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তিগুলি লুপ্ত হয়েছে, মানুষই বংশপরম্পরায় অদ্ভুত মানসিক স্বভাব ও প্রক্রিয়াগুলি নির্বাচন ও সঞ্চয়ন করেছে, যেগুলিকে আমাদের অজ্ঞতার জন্য প্রথমে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা বলে মনে হয়। কয়েকটি ঘটনায় আবশ্যিক স্বভাব কেবল বংশগত মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে যথেষ্ট; অন্য ক্ষেত্রগুলিতে আবশ্যিক স্বভাব কিছুই করে না, এবং সবগুলো নিয়মানুযায়ী ও অচেতনভাবে উভয়ই অনুসৃত নির্বাচনের ফলশ্রুতি : কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বভাব ও নির্বাচন সম্ভবত একযোগে কাজ করে। 

বিশেষ সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ 

কয়েকটি ঘটনা বিবেচনা করলে আমরা বোধহয় ভালভাবে বুঝতে পারব যে প্রাকৃতিক অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ কেমন করে নির্বাচন দ্বারা রূপান্তরিত হয়েছে। আমি কেবল তিনটি বেছে নেব, যথা কোকিলদের সহজাত প্রবৃত্তি যা অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়তে কোকিলদের প্ররোচিত করে; কোন কোন পিঁপড়ের দাস তৈরীর সহজাত প্রবৃত্তি; এবং মধু—মৌমাছির মধুকোষ তৈরীর ক্ষমতা। প্রকৃতিবিদ্রা পরের দুটি সহজাত প্রবৃত্তিকে অন্যগুলির তুলনায় সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বলে সাধারণতঃ ও সঠিকভাবে মনে করেছেন। 

কোকিলের সহজাত প্রবৃত্তি : কোন কোন প্রকৃতিবিদ মনে করেন কোকিলের সহজাত প্রবৃত্তিটির আরও তাৎক্ষণিক কারণ হচ্ছে যে তারা প্রতিদিন নয়, বরং দুই অথবা তিনদিন অন্তর ডিম পাড়ে; অতএব তাকে যদি তার নিজের বাসা তৈরী করতে হয় ও নিজের ডিমগুলিকে তা দিতে হয়, তাহলে প্রথম পাড়া ডিমগুলি কিছু সময় তা না দেওয়া অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে থাকবে, অথবা একই বাসায় বিভিন্ন বয়সের ডিম ও শিশুপাখি রয়ে থাকবে। ঘটনাটি যদি এই হয়, তবে ডিমপাড়া ও ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হবে। আরও বিশেষভাবে শিশুটি যখন অতি প্রাথমিক বয়সে বাসা ত্যাগ করে; এবং পাখির প্রথম ছানাদের কেবল সম্ভবতঃ পুরুষরা খাইয়ে থাকে। কিন্তু আমেরিকার কোকিলরা এরকম নয়; তথাপি তারা নিজের বাসা তৈরী করে, ডিম পাড়ে, শিশুরা পর্যায়ক্রমিকভাবে পালিত হয়, সবগুলি একই সঙ্গে কার্যকরী হয়। অন্যদিকে জোরের সঙ্গে বলা হয় এবং অস্বীকারও করা হয় যে আমেরিকার কোকিলরা মাঝেমাঝে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে; কিন্তু আইওয়ার ডঃ মেরেল-এর কাছ থেকে সম্প্রতি আমি শুনেছি যে তিনি একবার ইলিনয়েসে একটি নীল জে পাখির (গ্যারুলাস ক্রিস্টেটাস) বাসায় একটি শিশু জে এবং শিশু কোকিলকে একত্রে দেখেছিলেন; এবং যেহেতু উভয়েরই শরীর পালক দ্বারা ঢাকা ছিল, তাই এদের শনাক্ত করতে ভুল হয়নি। মাঝেমাঝে অন্য পাখিদের বাসায় ডিম পাড়ে এমন বিভিন্ন পাখিদের আরও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। এখন আমাদের অনুমান করা উচিত যে আমাদের ইউরোপের কোকিলদের আদিম পূর্বপুরুষদের আমেরিকার কোকিলদের মত স্বভাব ছিল এবং তারা মাঝেমাঝে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ত। আগেই বাসা ত্যাগ করায় সমর্থ হওয়ার মাধ্যমে বা অন্য কোন কারণের ফলে এই সাময়িক স্বভাবটির দ্বারা যদি বয়স্ক পাখিটি লাভবান হত, অথবা যদি এদের নিজেদের মায়ের দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার তুলনায় অনা প্রজাতির ভ্রমপূর্ণ সহজাত প্রবৃত্তি গ্রহণের সুবিধাটি দ্বারা শিশুদের আরও বেশী প্রাণচঞ্চল করে তোলা হত, তাহলে বয়স্ক পাখিরা বা পালিত শিশুরা একটি সুবিধা অর্জন করত। এবং উপমাটি আমাদের বিশ্বাস করায় যে এভাবে পালিত শিশুরা তাদের মাতার অস্বাভাবিক ও সাময়িক স্বভাবটি বংশগতি বা বংশানুসৃতির দ্বারা অনুসরণ করতে প্রবণ হবে এবং পালাক্রমে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়তে এরা বাধ্য হবে, এবং এরূপে নিজেদের শিশুদের পালন করতে আরও বেশী কৃতকার্য হবে। আমি বিশ্বাস করি এই ধরনের একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমাদের কোকিলদের সহজাত প্রবৃত্তিটি উদ্ভূত হয়েছে। যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ-সহ অ্যাডলফ মুলার সম্প্রতি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কোকিলরা মাঝেমাঝে খোলা বা ফাঁকা জায়গায় ডিম পাড়ে, সেগুলিতে তা দেয় এবং বাচ্চাদের পালন করে। এই বিরল ঘটনাটি সম্ভবতঃ বাসা তৈরীর বহু পূর্বে লুপ্ত আদিম সহজাত প্রবৃত্তিতে পূর্বানুবৃত্তির একটি বিষয়। 

আমার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা হয়েছে যে সম্পর্কিত অন্যান্য সহজাত প্রবৃত্তি ও কোকিলের দেহকাঠামোর অভিযোজনসমূহ আমি লক্ষ্য করিনি, যেগুলি সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে এরা অপরিহার্যরূপে সমন্বিত। কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রে, আমাদের জানা শুধুমাত্র একটি একক প্রজাতির একটি সহজাত প্রবৃত্তির ওপর দূরকল্পনা নিষ্ফল, কারণ পথনির্দেশ করার মত কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ও অ-পরজীবী আমেরিকার কোকিলদের সহজাত প্রবৃত্তিগুলি কেবল আমাদের জানা আছে; এখন মিঃ রামসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার তিনটি প্রজাতি সম্বন্ধে আমরা কিছু জেনেছি, যারা অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। উল্লেখযোগ্য প্রধান বিষয়গুলির মধ্যে তিনটি হচ্ছে : প্রথমতঃ, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ কোকিলরা একটি বাসায় শুধুমাত্র একটিই ডিম পাড়ে, যাতে করে বড় ও অরি মহাপেটুক শিশুরা প্রচুর খাদ্য পায়। দ্বিতীয়তঃ, ডিমগুলি লক্ষণীয়ভাবে ছোট হয়, যা স্কাইলার্ক পাখির ডিমের তুলনায় বড় নয়—এই পাখিটি আকারে কোকিলের এক-চতুর্থাংশ। অ-পরজীবী আমেরিকার কোকিলের পূর্ণ আকারের ডিম পাড়ার ঘটনাটি থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে ডিমটির ছোট আকারই হচ্ছে প্রকৃত কারণ। তৃতীয়তঃ, জন্মের ঠিক পর বাচ্চা কোকিলদের পালক ভাইদের উৎখাতের জন্য সহজাত প্রবৃত্তি, ক্ষমতা এবং উপযুক্ত আকারের পৃষ্ঠদেশ থাকে, ভাইরা পরে ঠাণ্ডা ও ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শিশু—কোকিলটি যাতে যথেষ্ট খাদ্য পেতে পারে এবং পালিকা ভাইরা যাতে বোধশক্তি অর্জন করার পূর্বে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে, সেইজন্য জোরের সঙ্গে বলা হয় যে এটি একটি সুফলদায়ক বন্দোবস্ত। 

এখন অস্ট্রেলিয়ার কোকিল প্রজাতিদের দিকে লক্ষ্য করা যাক। যদিও এখানকার কোকিলরা সাধারণতঃ একটি বাসায় একটি ডিম পাড়ে, তথাপি একই বাসায় দুই এবং এমনকি তিনটি ডিম দেখতে পাওয়া বিরল ঘটনা নয়। ব্রোঞ্জ কোকিলের ডিমগুলি আকারে বিরাটভাবে পরিবর্তিত হয়, দৈর্ঘে আট থেকে দশগুণ পর্যন্ত। বর্তমানের ডিমগুলির তুলনায় আকারে ছোট ডিম পাড়া যদি এই প্রজাতির পক্ষে লাভজনক হত, যাতে কোন কোন পালিকা পিতামাতাদের প্রতারিত করা যেত, অথবা আরও সম্ভবপর হল যে অল্প সময়ের মধ্যে বাচ্চা ফোটানো যেত (কারণ এটি জোরের সঙ্গে বলা হয় যে ডিমগুলির আকার ও উপ্তিকালের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে), তখন বিশ্বাস করতে কোন অসুবিধা হয় না যে একটি জাত বা প্রজাতি উদ্ভূত হয়ে থাকবে যারা ছোট থেকে ছোটতর ডিম পাড়ে; কারণ এর ফলে আরও নিরাপদে ডিম ফোটানো ও বাচ্চা পালন করা যায়। মিঃ রামশে উল্লেখ করেছেন যে অস্ট্রেলিয়ার কোকিলদের মধ্যে দু-ধরনের কোকিল যখন খোলা বাসায় ডিম পাড়ে তখন স্পষ্টতঃই এমন বাসা পছন্দ করে যেখানে এদের নিজেদের ডিমের রঙের মত ডিম থাকে। ইউরোপীয় প্রজাতিগুলি একই ধরনের সহজাত প্রবৃত্তির স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান প্রবণতা প্রদর্শন করে, কিন্তু কদাচিৎ এর থেকে বিচ্যুত হয়, যেমন দেখানো যায় যে উজ্জ্বল, সবুজাভ-নীল ডিমগুলি সমেত ঝোপঝাড়ের শিস্ দেওয়া পাখির (হেজ ওয়ার্কলার) বাসাটিতে এর বিবর্ণ ও পাণ্ডুর রঙের ডিম পাড়ার ঘটনাটি। আমাদের কোকিলরা অপরিবর্তনীয়ভাবে যদি উপরোক্ত সহজাত প্রবৃত্তিটি প্রদর্শন করত, তাহলে এটি নিশ্চিতরূপে সেইগুলির সঙ্গে যুক্ত হত যেগুলি মনে করা হয় সকলে একত্রে প্রাপ্ত হয়েছে। মিঃ রামশের মতানুসারে, অস্ট্রেলিয়ার ব্রোঞ্জ কোকিলের ডিমগুলি রঙে অধিকমাত্রায় ভিন্ন হয়; অতএব এ বিষয়ে এবং আকারের ক্ষেত্রেও প্রাকৃতিক নির্বাচন যে-কোন লাভজনক পরিবৃত্তিকে স্থায়ী ও সুরক্ষিত করে থাকবে। 

ইউরোপীয় কোকিলদের ক্ষেত্রে, পালক পিতামাতাদের বংশধরটি ডিম থেকে জন্ম হওয়ার তিনদিনের মধ্যে বাসা থেকে সাধারণতঃ উৎখাত হয়; এবং শিশু-কোকিলটি যেহেতু অতিশয় অসহায় অবস্থায় থাকে, সেহেতু মিঃ গোল্ড আগে বিশ্বাস করতে মনস্থ করেছিলেন যে উৎখাতের প্রক্রিয়াটি পালক পিতামাতাদের দ্বারা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এখন একটি শিশু-কোকিল সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছেন, যেটিকে তখনও অন্ধ ও মাথা উঁচু করতে অসমর্থ পালিত ভাইদের বিতাড়িত করতে দেখা গিয়েছিল। এদের মধ্যে একটিকে পর্যবেক্ষক ঐ বাসাতে প্রতিস্থাপন করেছিলেন এবং সে পুনরায় বহিষ্কৃত হয়েছিল। পদ্ধতিগুলি প্রসঙ্গে, যার দ্বারা এই অদ্ভুত ও জঘন্য সহজাত প্রবৃত্তিটি আহৃত হয়েছিল, জন্মের ঠিক পরে যতখানি সম্ভব খাদ্য সংগ্রহ করা যদি শিশু-কোকিলদের পক্ষে বিরাট প্রয়োজনের হত, যেটি সম্ভবত ঘটনা, আমি কোন বিশেষ প্রতিবন্ধক হিসাবে এটি দেখি না যে এরা পর্যায়ক্রমিক বংশধরে নিক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইচ্ছা, বল এবং দেহগঠন ক্রমশঃ অর্জন করেছিল; কারণ যাদের ঐ সব স্বভাব ও দেহগঠন ভালভাবে বিকশিত হয়েছিল এমন শিশু-কোকিলরা নিরাপদে পালিত হয়ে থাকবে। বয়স ও ক্ষমতা কিছুটা বাড়লে, উপযুক্ত সহজাত প্রবৃত্তিটি অর্জনের দিকে প্রথম ধাপটি শিশু-পাখির পক্ষে আরও অনিচ্ছুক অস্থিরতা বা চঞ্চলতা হবে; এরপর স্বভাবটি উন্নত হবে এবং প্রাথমিক বয়সে বংশগতভাবে প্রেরিত হবে। অন্য পাখিদের ডিম অভ্যন্তরের বাচ্চাদের নিজের ডিমের খোলস ভাঙ্গার সহজাত প্রবৃত্তিটি অর্জন, অথবা ওয়েনের বক্তব্যানুসারে, শক্ত ডিমের খোলস ফেটে বের হওয়ার জন্য শিশু-সাপের উপরের চোয়ালে একটি তীক্ষ্ণ দাঁতের অধিকারী হওয়ার তুলনায় আমি এখানে কোন প্রতিবন্ধক দেখি না। কারণ প্রত্যেক অঙ্গ যদি সব বয়সের এককীয় পরিবর্তনগুলির জন্য দায়ী হয় এবং পরিবর্তনগুলি সমরূপ বয়সে বা আগের বয়সে বংশগতভাবে উত্তরাধিকারী হওয়ার প্রবণ হয়, তাহলে এই প্রস্তাবগুলি সম্পর্কে বিতর্ক করা যেতে পারে না—তখন শিশুটির সহজাত প্রবৃত্তি ও দেহগঠন বয়স্কদের মত নিশ্চিতরূপে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হতে পারবে; এবং উভয় ঘটনাই কার্যকর হয়ে থাকবে অথবা প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমগ্র তত্ত্বটির সঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে। 

আমাদের স্টার্লিং পাখিদের সদৃশ, আমেরিকার পাখিদের মধ্যে একটি ব্যাপকভাবে ভিন্ন গণ মলোথ্রাসের কয়েকটি প্রজাতির কোকিলের মত পরজীবী স্বভাব রয়েছে এবং এরা এদের সহজাত প্রবৃত্তির একটি চিত্তাকর্ষক ক্রমবিন্যাস উপস্থিত করে। বিশিষ্ট পর্যবেক্ষক মিঃ হাডসনের বক্তব্য অনুযায়ী মলোথ্রাস বেডিয়াস প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী-পাখিরা বাছবিচারহীন যৌন সম্ভোগের জন্য সকলে একত্রে দলে বাস করে এবং কোন কোন সময় জোড়ায় জোড়ায় বাস করে। এরা হয় নিজেদের বাসা তৈরী করে অথবা অন্য পাখিদের বাসা অধিকার করে নেয় এবং অপরিচিত বাচ্চাদের অড়িয়ে দেয়। এরূপে অধিকৃত বাসাতে এরা নিজেদের ডিম পাড়ে অথবা তার ওপর নিজেদের বাসা তৈরী করে নেয়। এরা সাধারণত এদের নিজেদের ডিমের ওপর বসে তা দেয় এবং শাবকদের পালন করে; কিন্তু মিঃ হাডসন বলেন যে এরা সম্ভবতঃ মাঝেমাঝে পরজীবী হয়, কারণ তিনি এই প্রজাতির শিশুকে একটি ভিন্ন প্রকার পাখির বয়স্কদের অনুসরণ করতে এবং খাওয়ানোর জন্য চিৎকার করতে দেখেছেন। মলোথ্রাসের অন্য একটি প্রজাতি মলোথ্রাস বোনারিয়েন্সিস-এর পরজীবী স্বভাব পূর্বেরটির তুলনায় আরও উন্নত, কিন্তু ততটা উৎকৃষ্ট নয়। যতদূর জানা গেছে এই পাখিটি বহিরাগত পাখিদের বাসায় অনিবার্যরূপে ডিম পাড়ে; কিন্তু এটি উল্লেখযোগ্য যে কয়েকটি পাখি একত্রে একটি বিরাট থিস গাছের পাতার মত খারাপ জায়গায় কোন কোন সময় অনিয়মিত, অপরিচ্ছন্ন বাসা তৈরী করতে শুরু করে। তবে, যতদূর মিঃ হাডসন নিশ্চিত হয়েছেন, এরা কখনও নিজেদের বাসা সম্পূর্ণ করে না। এরা প্রায়শই একই পালক পাখির বাসায় এত বেশী ডিম পাড়ে, পনেরো থেকে কুড়িটি পর্যন্ত, যার কয়েকটি থেকে বাচ্চা হয় বা কোনটা থেকেই সম্ভবত বাচ্চা হয় না। অধিকন্তু, হয় এদের নিজেদের প্রজাতির অথবা এদের পালক পিতামাতার অধিকৃত বাসার ডিমগুলিকে ঠুকরিয়ে গর্ত করার অসাধারণ স্বভাব থাকে এদের। উন্মুক্ত জায়গাতেও এরা অসংখ্য ডিম পাড়ে যেগুলি নষ্ট হয়। উত্তর আমেরিকার মলোথ্রাস পেকোরিস নামে একটি তৃতীয় প্রজাতি কোকিলের মত নিখুঁত সহজাত প্রবৃত্তি অর্জন করেছে, কারণ এরা পালক পাখির বাসায় একটার বেশী ডিম পাড়ে না, এতে করে শিশু-পাখিটি নিরাপদে পালিত হয়। মিঃ হাডসন বিবর্তনবাদকে অত্যন্ত অবিশ্বাস করেন, কিন্তু তিনি মলোথ্রাস বোনারি এনসিস নামে পাখিটির সহজাত প্রবৃত্তি দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে মনে হয় যে তিনি আমার কথাগুলির উদ্ধৃতি দেন ও প্রশ্ন করেন, ‘বিশেষভাবে গুণান্বিত বা সৃষ্ট সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে নয়, এবং একটি সাধারণ নিয়মের, অর্থাৎ সংক্ৰমণগত উত্তরণের ছোট ছোট পরিণাম হিসেবে এইসব স্বভাবকে আমাদের কি বিবেচনা করা উচিত নয়?’ 

ইতিমধ্যে বলা হয়েছে যে অনেক ধরনের পাখিরা মাঝেমধ্যে অন্য পাখিদের বাসায় ডিম পাড়ে। গ্যালিন্যাসি গোত্রের পাখিদের ক্ষেত্রে এই স্বভাবটি খুব অস্বাভাবিক নয়, এবং এটি উটপাখির বিস্ময়কর সহজাত প্রবৃত্তি সম্বন্ধে কিছু আলোকপাত করে। এই গোত্রের কতিপয় মাদি-পাখিরা মিলিত হয় এবং প্রথমে একটি বাসায় এবং পরে অন্যবাসায় কয়েকটি করে ডিম পাড়ে এবং এগুলিতে পুরুষরা তা দেয়। এই ঘটনার দ্বারা এই সহজাত প্রবৃত্তিটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে মাদি-পাখিরা অধিক সংখ্যায় ডিম পাড়ে, কিন্তু কোকিলের মত দুই অথবা তিনদিন অন্তর। তবে আমেরিকার উটপাখির সহজাত প্রবৃত্তিটি মলোথ্রাস বোনারিএসিস পাখির মত এত নিখুঁত নয়; অসংখ্য ডিম মাটিতে এধার-ওধারে পড়ে থাকে। আমি একদিনের শিকারে কুড়িটি বর্জিত ও হারানো ডিম সংগ্রহ করেছিলাম। 

অনেক ধরনের মৌমাছি পরজীবী স্বভাবের এবং অন্য মৌমাছিদের বাসায় এরা নিয়মিত ডিম পাড়ে। কোকিলের সহজাত প্রবৃত্তির তুলনায় এই ঘটনাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ এই মৌমাছিদের শুধু সহজাত প্রবৃত্তি নয়, বরং এদের দেহগঠনটিও পরজীবী স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই রূপান্তরিত হয়েছে; কারণ এদের পরাগ সংগ্রহ করার অঙ্গটি নেই, এদের শিশুদের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করার জন্য যেটি প্রয়োজন। স্ফেগিডি (বোলতার মত পতঙ্গ) গোত্রের কতিপয় প্রজাতি পরজীবী স্বভাবের হয়; এবং সম্প্রতি এম. ফেবার বিশ্বাস করার উপযুক্ত কারণ দেখিয়েছেন যে, যদিও ট্যাকিটেস নিগ্রা নামক পতঙ্গটি সাধারণতঃ ডিম পাড়ার জন্য নিজেদের গর্ত নিজেরাই তৈরী করে, এবং এদের নিজেদের লার্ভার জন্য অসাড় শিকারকে গর্তে সংগ্রহ করে রাখে, তা হলেও যখন এই পতঙ্গটি ইতিমধ্যে তৈরী এবং অন্য প্রজাতি যারা খাদ্য সঞ্চিত একটি গর্ত দেখতে পায়, তখন এরা এই উপকারের সুযোগ গ্রহণ করে এবং সাময়িকভাবে পরজীবী হয়। মলোথ্রাস বা কোকিলের সহজাত প্রবৃত্তির মত এ ক্ষেত্রেও, যদি প্রজাতির পক্ষে উপকারী হয়, এবং যদি পতঙ্গটি নিশ্চিহ্ন না হয় যার বাসা ও সংগৃহীত খাদ্য অসৎভাবে অধিকৃত হয়, একটি সাময়িক স্বভাবকে স্থায়ী করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোন বাধা নেই বলেই মনে করি আমি। 

দাস সৃষ্টির সহজাত প্রবৃত্তি : খ্যাতনামা পিতার চেয়ে দক্ষ পর্যবেক্ষক পিয়েরে হুবার ফরমিকা রুফেসেন্স নামক এক ধরনের লাল পিঁপড়ের এই চমকপ্রদ সহজাত প্রবৃত্তিটি আবিষ্কার করেন। এই পিঁপড়েরা সম্পূর্ণভাবে এদের দাসেদের ওপর নির্ভরশীল; এদের সাহায্য ছাড়া এই প্রজাতির পিঁপড়েরা এক বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই বিলুপ্ত হয়ে যেত। এদের পুরুষ ও জননক্ষমতাসম্পন্ন স্ত্রীরা কোন কাজ করে না, যদিও অতিশয় পরিশ্রমী ও দাসেদের গ্রেপ্তার করতে যথেষ্ট সাহসী শ্রমিক বা বন্ধ্যা স্ত্রীরাও অন্য কোন কাজ করে না। এরা নিজেদের বাসা তৈরী করতে ও নিজেদের লার্ভাদের খাওয়াতে অসমর্থ। পুরানো বাসাটি যখন এদের পক্ষে অস্বাচ্ছন্দ্যদায়ক হয় এবং সেই স্থান ত্যাগ করতে হয়, তখন দাসেরাই সেই স্থানত্যাগ নির্ধারণ করে এবং কার্যত চোয়ালে করে তাদের প্রভুদের বহন করে। প্রভুরা এত সম্পূর্ণরূপে অসহায় যে যখন হুবার এদের ত্রিশটি পিঁপড়েকে তাদের পছন্দমত উৎকৃষ্ট খাবার ও কাজ করতে উৎসাহ দিতে লার্ভা (শূককীট) ও পিউপা (গুটিপোকা)-সহ আবদ্ধ করে রেখেছিলেন, তখন এরা কোন কাজ করেনি; নিজেরা খেতে পর্যন্ত পারেনি এবং ক্ষুধার তাড়নায় অনেকে মারা গিয়েছিল। এরপর হুবার একটি দাস পিঁপড়েকে (ফরমিকা ফিউস্কা) এদের মধ্যে ছেড়ে দেন; এবং সে তৎক্ষণাৎ তার কাজ শুরু করে দেয়, এদের খাওয়ায় এবং এভাবে যারা বেঁচে আছে তাদের জীবন বাঁচায়, ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ তৈরী করে লার্ভা (শূককীট) -দের পালন করতে থাকে এবং এভাবে সবকিছু ঠিক করে দেয়। এইসব সুনিশ্চিত তথ্যের তুলনায় আর কোটি অসাধারণ হতে পারে? অথবা যদি অন্য দাস সৃষ্টিকারী পিঁপড়ে সম্বন্ধে না জানতাম, কেমন করে এত বিস্ময়কর একটি সহজাত প্রবৃত্তি নিখুঁত হয়ে থাকতে পারে তা অনুমান করাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হত। 

পি. হুবার ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামে দাস সৃষ্টিকারী অন্য একটি পিঁপড়ে প্রজাতি এভাবে প্রথম আবিষ্কার করেন। ইংল্যান্ডের দক্ষিণাংশে এই জাতীয় পিঁপড়েদের দেখা যায়। মিঃ এফ. স্মিথ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এদের স্বভাব সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে ও অন্য বিষয়ের জন্যও আমি তাঁর কাছে বিশেষভাবে ঋণী। হুবার ও স্মিথের বক্তব্যকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করে সন্দিহান মনে আমি এ বিষয়ের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেছিলাম—দাস সৃষ্টির মত এত বিস্ময়কর একটি সহজাত প্রবৃত্তি সম্পর্কে সন্দেহ করার জন্য যে-কাউকে ক্ষমা করা যেতে পারে। এখন আমি যে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তা বিস্তৃতভাবে বলব। ফরমিকা স্যানগুইনিয়ার (লাল পিঁপড়ের) চোদ্দটি বাসা আমি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম এবং সবগুলিতে কয়েকটি দাস পিঁপড়ের অবস্থান লক্ষ্য করেছিলাম। দাস প্রজাতির (ফরমিকা ফিউস্কা) পুরুষ ও জননশক্তিসম্পন্ন স্ত্রীদের শুধুমাত্র নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা গেছে এবং ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামে প্রজাতির বাসায় কখনও দেখা যায় নি। দাস পিঁপড়েরা কালো এবং লাল প্রভুদের আকারের অর্ধেকও নয়, অতএব এদের আকৃতিগত ভিন্নতাও বিরাট। বাসাটি অল্প নাড়ানো হলে দাসেরা কখনও-সখনও বেরিয়ে আসে ও এদের প্রভুদের মত অতিশয় উত্তেজিত হয় এবং বাসাটি রক্ষা করে। বাসাটি আরও বেশী জোরে নাড়ানো হলে লার্ভা (শূককীট) ও পিউপারা (গুটিপোকা) অনাচ্ছাদিত হয়ে বিপদের মুখে পড়ে, তখন নিরাপদ জায়গায় এদের বহন করতে দাসরা তাদের প্রভুদের সঙ্গে একত্রে পরিশ্রম করে। অতএব এটি স্পষ্ট যে দাসরা এই বাসাটিকে নিজের বলে মনে করে। পর পর তিন বছর জুন ও জুলাই মাসে অনেক ঘণ্টা ধরে ইংল্যান্ডের সারে ও সাসেক্স অঞ্চলের পিঁপড়েদের কয়েকটি বাসা আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম এবং কোন বাসা ত্যাগ করতে বা প্রবেশ করতে একটিও দাস পিঁপড়েকে কখনও দেখিনি। যেহেতু এইসব মাসে দাসেরা সংখ্যায় কমে যায়, তাই আমি মনে করেছিলাম এরা যখন সংখ্যায় বাড়ে তখন ভিন্ন আচরণ করে। কিন্তু মিঃ স্মিথ আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি সারে ও হ্যামশায়ার নামক স্থানে মে, জুন এবং অগাস্ট মাসে কয়েক ঘণ্টা ধরে পিঁপড়েদের বাসা লক্ষ্য করেছিলেন, তিনি কখনও দাসদের বাসা ত্যাগ ও প্রবেশ করতে দেখেন নি, যদিও অগাস্ট মাসে এদের সংখ্যা বাড়ে। সেহেতু তিনি এদের গৃহস্থ দাস হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অন্যদিকে, অনবরত বাসা তৈরীর উপকরণ ও সকল ধরনের খাদ্য বহন করতে প্রভুদের প্রায়শই দেখা যেত। তবে, ১৮৬০ সালের জুলাই মাসে অধিক সংখ্যক দাস সমেত একটি সম্প্রদায় আমি লক্ষ্য করেছিলাম এবং কতিপয় দাসকে তাদের মালিকদের সঙ্গে মিলেমিশে বাসা ত্যাগ করতে এবং পঁচিশ গজ দূরে একটি স্কচ-ফার গাছে ওঠার জন্য একই রাস্তা দিয়ে যেতে আমি লক্ষ্য করেছিলাম, সম্ভবত ক্ষুদ্র জীবাণু ও জাবপোকার সন্ধানে একই সঙ্গে ওই গাছে উঠেছিল তারা। পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে যাঁর যথেষ্ট সুযোগ ছিল সেই হুবারের মতানুসারে, সুইজারল্যান্ডের দাস পিঁপড়েরা অভ্যাসবশতঃ তাদের মালিক প্রভুদের সঙ্গে একত্রে বাসা তৈরী করত এবং সকাল সন্ধ্যায় বাসার দরজা বন্ধ করত; এবং হুবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে এদের প্রধান কাজ হচ্ছে জাবপোকাদের সন্ধান করা। দুটি দেশের দাস ও মালিকদের স্বাভাবিক স্বভাবের এই পার্থক্য সম্ভবতঃ ইংল্যান্ডের তুলনায় সুইজারল্যান্ডের দাসেদের অধিক সংখ্যায় বন্দী হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। 

ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েদের এক বাসা থেকে অন্য বাসায় স্থানত্যাগ সৌভাগ্যবশতঃ আমি একদিন লক্ষ্য করেছিলাম, এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হল—দাসেদের দ্বারা বাহিত হওয়ার পরিবর্তে প্রভুরা যত্নসহকারে চোয়ালে ধরে দাসেদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। ফরমিকা রুফেসেন্স নামক আর এক ধরনের লাল পিঁপড়েদের ক্ষেত্রে উল্টোটি ঘটে। আমি আর একটি ঘটনা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম যে প্রায় এক কুড়ি দাস সৃষ্টিকারী পিঁপড়েরা একই স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, স্পষ্টতঃই খাদ্যের জন্য নয়। এরা যখন আরও অগ্রসর হচ্ছিল তখন দাস পিঁপড়ে প্রজাতির (ফরমিকা ফিউস্কা) একটি সম্প্রদায় এদের আক্রমণ রুখে দিয়েছিল। আরও লক্ষ্য করেছিলাম যে গড়ে তিনটি করে দাস পিঁপড়ে প্রত্যেক দাস সৃষ্টিকারী পিঁপড়ের (ফরমিকা স্যানগুইনিয়া) পায়ে আটকিয়ে ছিল। দাস সৃষ্টিকারী পিঁপড়েরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধীদের ভয়ঙ্করভাবে হত্যা করেছিল এবং ঊনত্রিশ গজ দূরে নিজেদের বাসায় মৃতদের বহন করে নিয়ে গিয়েছিল; কিন্তু দাস হিসেবে পালন করার জন্য কোন গুটিপোকাকে (পিউপা) নিয়ে যেতে এরা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। এর পর আমি ফরমিকা ফিউস্কা নামক পিঁপড়ের বাসা থেকে গুটিপোকা গর্ত খুঁড়ে বের করেছিলাম এবং সংগ্রামস্থলের খালি জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম; শক্তিমান স্বেচ্ছাচারীরা তৎক্ষণাৎ সেগুলি অধিকার করে নেয় এবং বহন করে নিয়ে যায়—তারা বোধহয় কল্পনা করেছিল যে সাম্প্রতিক সংগ্রামে তারা বিজয়ী হয়েছে। 

ঐ সময়ে একই জায়গায় ফরমিকা ফ্ল্যাভা নামে অন্য একটি প্রজাতির কিছু পিউপা রেখে দিয়েছিলাম আমি। এই প্রজাতির ছোট হলদে রঙের কয়েকটি পিঁপড়ে এদের ভাঙ্গা বাসায় আটকিয়েছিল। মিঃ স্মিথ বলেছেন, কোন কোন সময় এই প্রজাতির পিঁপড়েদের দাসে পরিণত করা হয়, যদিও তা কদাচিৎ। এই প্রজাতির পিঁপড়েরা অতি ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও অতিশয় সাহসী এবং এরা অন্য পিঁপড়েদের হিংস্রভাবে আক্রমণ করে যা আমি লক্ষ্য করেছি। আমি একবার অপ্রত্যাশিতভাবে ফরমিকা ফ্ল্যাভার নামে পিঁপড়েদের একটি ভিন্ন দলের বাসা একটি পাথরের তলায় দেখেছিলাম এবং এর সঙ্গে দাস সৃষ্টিকারী ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়ের একটি বাসাও লক্ষ্য করেছিলাম, এবং ঘটনাচক্রে আমি যখন উভয় বাসাকে নাড়াই, তখন খুদে পিঁপড়েরা দারুণ সাহসের সঙ্গে বড় প্রতিবেশীদের আক্রমণ করেছিল। ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামে পিঁপড়েরা ফরমিকা ফ্ল্যাভা নামক খুদে ও রাগী পিঁপড়ের গুটিপোকা থেকে, যাদের এরা কদাচিৎ বন্দী করে, ফরমিকা ফিউস্কা নামক পিঁপড়ের গুটিপোকাকে, যাদের এরা অভ্যাশবশতঃ দাসে পরিণত করে, চিনতে পেরেছিল কিনা জানতে আমি উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং লক্ষ্য করেছিলাম যে এরা সহজেই চিনতে পেরেছিল; এরপর আমি দেখলাম এরা তৎক্ষণাৎ ও আগ্রহ সহকারে ফরমিকা ফিউস্কার গুটিপোকাদের অধিকার করে নিল, অন্যদিকে, যখন এরা ফরমিকা ফ্ল্যাভার পিঁপড়ের গুটিপোকা ও মাটির তলায় তাদের বাসার সন্ধান পাওয়ার পর এরা অত্যন্ত ভীত হয়েছিল এবং পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় পনের মিনিট পর যখন সব খুদে হলদে পিঁপড়েরা ধীরে ধীরে পালিয়েছিল, তখন এরা নিশ্চিন্ত হয়েছিল ও গুটিপোকাদের বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। 

একদিন সন্ধ্যেবেলায় ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়ের অন্য একটি দলকে এবং এই দলের কিছু পিঁপড়েকে ফরমিকা ফিউস্কা নামক পিঁপড়ের মৃত শরীর ও অসংখ্য গুটিপোকা বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ও বাসায় প্রবেশ করতে দেখেছিলাম আমি। চল্লিশ গজ দূরে এক গুল্মের ঝাড় পর্যন্ত লুটের মাল বহনকারী এক সারি পিঁপড়ে ও একটি গুটিপোকা বহনকারী ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েদের শেষ পিঁপড়েটিকে ঝাড় থেকে বেরুতে দেখেছিলাম; কিন্তু ঘন ঝাড়ের মধ্যে একটিও নির্জন বাসা আমি দেখতে পাইনি; তবে বাসাটি কাছেই ছিল, কারণ ফরমিকা ফিউস্কা নামক পিঁপড়েদের দু-তিনটি পিঁপড়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত অবস্থায় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল; এবং একটি পিঁপড়ে বাসা বিধ্বংস হওয়ার হতাশায় নিজের গুটিপোকাকে মুখে করে ঝোপের কচি ডালের মাথায় স্থিরভাবে বসেছিল। 

দাস সৃষ্টির বিস্ময়কর সহজাত প্রবৃত্তি সংক্রান্ত এইসব তথ্য আমার অনুমোদনের অপেক্ষা রাখে না। ফরমিকা রুফেসেন্স নামক মহাদেশীয় পিঁপড়েদের সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েদের সহজাত প্রবৃত্তিমূলক স্বভাবের কি পার্থক্য সেটা লক্ষ্য করা উচিত। প্রথমোক্ত পিঁপড়েরা নিজেদের বাসা তৈরী করতে পারে না, নিজেদের স্থানান্তরে যাওয়া নির্ধারণ করতে পারে না, নিজেদের এবং শিশুদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে পারে না, এমনকি নিজেরা খাবার খেতেও পারে না—অসংখ্য দাসেদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে এরা। অন্যদিকে, ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েরা অল্প দাস রাখে, এবং গ্রীষ্মের প্রথমদিকে আবার অল্প কয়েকটি রাখে : কখন কোথায় নূতন বাসা তৈরী করতে হবে তা প্রভুরা নির্ধারণ করে এবং স্থানত্যাগের সময় প্রভুরা দাসেদের বহন করে। সুইজারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড উভয় দেশেই দাসরা কেবল শুককীট (লার্ভা) পালন করে এবং প্রভুরা কেবল দাস তৈরীর অভিযানে বের হয়। সুইজারল্যান্ডে প্রভু ও দাসরা বাসা তৈরী ও বাসা তৈরীর মালমশলা বহন করার জন্য একত্রে কাজ করে; উভয়েই, মূলত দাসেরা, যাদের অ্যাফাইড বা জাবপোকা বলা যেতে পারে, এদের পালন করে, দুধ দেয়; উভয়েই সমগ্র দলের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে। ইংল্যান্ডে সাধারণতঃ প্রভুরা শুধু বাসা তৈরীর মালমশলা সংগ্রহ করতে বাসা ত্যাগ করে এবং নিজেদের জন্য দাস ও শূককীটদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে বের হয়। অতএব সুইজারল্যান্ডের তুলনায় এ দেশের প্রভু পিঁপড়েরা তাদের দাস পিঁপড়েদের কাছ থেকে কম সাহায্য পায়। 

কোন্ কোন্ ধাপগুলির দ্বারা ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েদের সহজাত প্রবৃত্তিটি উদ্ভূত হয়েছিল তা আন্দাজ করার দাবী আমি করছি না। কিন্তু যেহেতু দাস সৃষ্টিকারী নয় এমন পিঁপড়েরা তাদের বাসার নিকট ছড়িয়ে থাকা অন্য প্রজাতির গুটিপোকা (পিউপা)-দের বহন করে, যেমন আমি দেখেছি, সেহেতু এটি সম্ভবপর যে প্রথমে খাদ্য হিসেবে সংগৃহীত এইসব গুটিপোকারা সম্পূর্ণভাবে বেড়ে উঠবে এবং এভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবে লালিত—পালিত অপরিচিত বা অনাত্মীয় পিঁপড়েরা এদের উপযুক্ত সহজাত প্রবৃত্তি অনুসরণ করবে এবং যে কাজ করতে পারবে সে কাজ করবে। অধিকারী পিঁপড়ে প্রজাতির পক্ষে এদের উপস্থিতি যদি উপকারী বলে প্রমাণিত হত, এদের বংশ বৃদ্ধি করার তুলনায় শ্রমিকদের বন্দী করা যদি এই প্রজাতির পক্ষে আরও বেশী লাভজনক হত, তাহলে প্রথমে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত গুটিপোকা (পিউপা) সংগ্রহের স্বভাবটি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা শক্তিশালী হত এবং দাস সৃষ্টির মত অতি ভিন্ন উদ্দেশ্যের জন্য স্থায়ী হয়ে উঠত। সহজাত প্রবৃত্তিটি যখন একবার অর্জিত হয়, আমাদের ব্রিটিশ ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়ের তুলনায় কম মাত্রায় যদি বাহিত হত, যেখানে আমরা দেখেছি যে সুইজারল্যান্ডের একই প্রজাতির তুলনায় ফরমিকা স্যানগুইনিয়া নামক পিঁপড়েরা তাদের দাসদের থেকে কম সাহায্য পায়, প্রাকৃতিক নির্বাচন সহজাত প্রবৃত্তিটিকে নিশ্চয় বৃদ্ধি ও রূপান্তরিত করবে—সর্বদা এটা মনে রেখে যে প্রত্যেক রূপান্তর প্রজাতির পক্ষে উপকারের হয়—যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন একটি পিঁপড়ে সৃষ্টি হয়, যা ফরমিকা রুফেসেন্স নামক পিঁপড়ের মত এদের দাসেদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে। 

মৌমাছির মধুকোষ তৈরীর সহজাত প্রবৃত্তি : এ বিষয়ে আমি এখানে খুব বিস্তৃত আলোচনায় যাব না, এবং আমি যে সিদ্ধান্তগুলিতে পৌঁছেছি সেগুলির শুধুমাত্র সংক্ষিপ্তসার উপস্থিত করব। এত বিস্ময়করভাবে তৈরী মৌচাকের সূক্ষ্ম গঠন সম্বন্ধে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে যিনি এটি নিয়ে নিছক অনুসন্ধান করেন, তিনি একজন বোকা মানুষ। গণিতজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা শুনি যে মৌমাছিরা আসলে একটি দুর্বোধ্য সমস্যার সমাধান করেছে এবং খুব কম পরিমাণ মোম ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণ মধু সংরক্ষণের জন্য মৌচাকের কোষগুলিকে তৈরী করে। বলা হয় যে উপযুক্ত হাতিয়ার ও মাপনি ব্যবহার করে প্রকৃত আকারের মোমের কোষ তৈরী করা একজন দক্ষ কারিগরের পক্ষে দুঃসাধ্য কাজ, যদিও অসংখ্য মৌমাছি অন্ধকার মৌচাকে এই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে। সহজাত প্রবৃত্তি সম্বন্ধে যা-কিছুই বলা হোক, এটি প্রথমে অভূতপূর্ব বলে মনে হয় যে কেমন করে এরা সমস্ত প্রয়োজনীয় কোণ ও তল তৈরী করে অথবা কেমন করে এরা অনুমান করে যে এরা তা সঠিকভাবে করেছে। কিন্তু প্রথমে যেমন মনে হয়, প্রতিবন্ধকটি তত বিরাট নয় : আমি মনে করি কতিপয় সরল সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী এই সুন্দর কাজটি যে সম্পন্ন হয় তা দেখানো যেতে পারে। 

মিঃ ওয়াটারহাউস এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে কোষের আকার সংলগ্ন বা সন্নিহিত কোষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত; এবং এই তত্ত্বটির ক্রমপরিবর্তন হিসেবে সম্ভবত পরবর্তী মতবাদটিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্রমপরিবর্তনের বিরাট পদ্ধতিটির দিকে আমাদের লক্ষ্য করা উচিত এবং দেখা উচিত প্রকৃতি আমাদের সামনে তার কাজের পদ্ধতি প্রকাশ করে কিনা। একটি ছোট শ্রেণীর এক প্রান্তে রয়েছে আমাদের ভ্রমর, যারা মধু ধরে রাখার জন্য তাদের পুরানো গুটিগুলিকে (কোকুন) ব্যবহার করে, কোন কোন সময় মোমের ছোট ছোট নালিকা এতে যোগ করে এবং এভাবে অনিয়মিত গোলাকার মোমের কোষসমূহ সৃষ্টি করে। শ্রেণীটির অন্য প্রান্তে রয়েছে মৌমাছির (মধু-মৌমাছি) কোষগুলি, যারা জোড়া স্তরে স্থাপিত: জানা গেছে যে প্রত্যেক কোষ হচ্ছে একটি ষড়ভুজাকার প্রিজম, যার ছয়দিকের প্রান্ত-ধারগুলি এমনভাবে সাজানো যে এরা যেন তিনটি রমবয়েড দ্বারা তৈরী একটি ওল্টানো পিরামিডে যুক্ত হয়। এই রমবয়েডগুলির নির্ধারিত কোণ থাকে এবং তিনটি, যা চাকটির একদিকে শুধু একটি কোষের পিরামিডের মত পাদদেশ সৃষ্টি করে, উল্টোদিকের তিনটি সংলগ্ন কোষের পাদদেশের গঠনের মধ্যে প্রবেশ করে। শ্রেণীটিতে মধু-মৌমাছির (হাইভ-বি) কোষের পরম উৎকর্ষতা ও ভ্রমর মৌমাছির (হাম্বল-বি) কোষের সরলতার মধ্যে মেসিকোর মেলিপোনা ডোমেস্টিকা নামক মৌমাছির কোষ আমরা দেখতে পাই—পিয়েরে হুবার এই কোষগুলির সুন্দর সচিত্র বর্ণনা দিয়েছেন। দৈহিক গঠনে মেলিপোনা মধু ও ভ্রমর মৌমাছির মধ্যবর্তী, কিন্তু পরেরটির সঙ্গেই বেশী সম্পর্কিত; এরা নলাকার কোষের প্রায় সুসমঞ্জস আকৃতির মোমের চাক তৈরী করে, যার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়, এবং এছাড়া মোমের বড় বড় কোষগুলি মধু সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এইসব বড় বড় কোষগুলি প্রায় গোলকাকার ও একই মাপেরও হয় এবং একত্রে পুঞ্জীভূত বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু লক্ষ্য করার প্রধান বিষয়টি হচ্ছে যে এইসব কোষ পরস্পরের সঙ্গে এমন সমান মাত্রায় সর্বদা তৈরী হয় যে যদি গোলকগুলি সম্পূর্ণ হয়, তাহলে কোষগুলি পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করবে বা ভেঙ্গে যাবে; কিন্তু এটি কখনই করা হয় না, মৌমাছিরা গোলকের মধ্যে নিখুঁতভাবে মোমের চেপ্টা প্রাচীর তৈরী করে। অতএব প্রত্যেক কোষ একটি গোলকীয় অংশ এবং দুই, তিন অথবা আরও বেশী চেপ্টা পৃষ্ঠ দ্বারা তৈরী, যাতে করে কোষগুলি দুই, তিন অথবা আরও বেশী কোষের সঙ্গে পাশাপাশি সংলগ্ন হয়। গোলকগুলির একই আকারের জন্য, অনিবার্যরূপে ও প্রায়শই যখন একটি কোষ অন্য তিনটি কোষের ওপর অবস্থান করে, তখন তিনটি চেপ্টা পৃষ্ঠতল একটি পিরামিডে সংযুক্ত হয়; হুবারের বক্তব্য অনুযায়ী, এই পিরামিডটি মধু-মৌমাছির কোষের ত্রিপার্শ্বীয় পিরামিডের ভূমিতলের স্পষ্টতঃ অনুকরণ। মধু-মৌমাছির কোষগুলির মত এক্ষেত্রেও কোন একটি কোষের তিনটি পৃষ্ঠতল তিনটি সন্নিহিত কোষের গঠনে অবধারিতভাবে প্রবেশ করে। এটি স্পষ্ট যে মেলিপোনা মৌমাছিরা এরূপ গঠনকার্যের দ্বারা মোম এবং—যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—শ্রম সঞ্চয় করে; কারণ সংলগ্ন কোষগুলির মধ্যে প্রাচীরগুলি জোড়ায় থাকে না, বরং বাইরের গোলকীয় অংশের মত একই রকম পুরু হয়, এবং যদিও প্রত্যেক চেপ্টা অংশটি দুটি কোষের অংশ তৈরী করে। 

এই ঘটনাটি বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছিল যে মেলিপোনা মৌমাছিরা যদি পরস্পরের থেকে নির্দিষ্ট কোন দূরত্বে এদের গোলকগুলি তৈরী করত ও সেগুলিকে একই আকারে তৈরী করত এবং সুষমভাবে জোড়া স্তরে বিন্যস্ত করত, তাহলে তৈরী ইমারতটি মধু-মৌমাছির চাকের মতই নিখুঁত হত। সেই কারণে আমি কেমব্রিজের জ্যামিতি-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিঃ মিলারকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। চিঠির উত্তরে তিনি আমাকে লেখেন এটি সম্পূর্ণ সঠিক এবং তাঁর নিজস্ব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিচের বিবৃতিটি দেন : 

যদি কতিপয় সমান বর্গক্ষেত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়, যাদের কেন্দ্রগুলি দুটি সমান্তরাল থাক বা স্তরের মধ্যে অবস্থিত; এবং প্রত্যেক গোলকের কেন্দ্র একই স্তরের ছয়টি চারপাশের গোলকের কেন্দ্রগুলি থেকে √Z অথবা ১.৪১৪২১ (অথবা আরও কম দূরত্বে) ব্যাসার্ধের মত দূরত্বে অবস্থিত হয়; এবং অন্য ও সমান্তরাল স্তরের সংলগ্ন গোলকদের কেন্দ্রগুলি থেকে একই দূরত্বে অবস্থিত হয়; তখন উভয় স্তরে কতিপয় গোলকের মধ্যে ছেদন তলসমূহ তৈরী হয়, তিনটি রম্বসের তৈরী পিরামিডসদৃশ ভিত্তিপ্রান্ত দ্বারা একত্রে সংযুক্ত ষড়ভুজাকার প্রিজমদের জোড়াস্তর সৃষ্টি হবে; এবং রম্বস ও ষড়ভুজাকার প্রিজমগুলির প্রত্যেক কোণ মধু মৌমাছির কোষের কোণগুলির পরিমাপের সমরূপ হয়ে থাকবে। কিন্তু যিনি ভালভাবে যত্নসহকারে পরিমাপগুলি করেছিলেন সেই অধ্যাপক উইম্যান—এর কাছ থেকে আমি শুনেছি যে মৌমাছির দক্ষতার সঠিকতা সম্বন্ধে অতিরঞ্জন করা হয়েছে; এমনকি কোষটির সঠিক আকার যা-ই হোক, কদাচিৎ সেটি বাস্তবে পরিণত হয়। 

অতএব আমরা নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মেলিপোনা মৌমাছির ইতিমধ্যে অর্জিত সহজাত প্রবৃত্তিকে যদি আমরা অল্প রূপান্তরিত করতে পারতাম, তাহলে, এদের পক্ষে যা মোটেই আশ্চর্যজনক নয়, এই মৌমাছিরা মধু-মৌমাছির মত বিস্ময়কর নিখুঁত একটি ইমারত তৈরী করতে পারত। আমাদের মনে রাখা উচিত যে মেলিপোনা মৌমাছিদের সত্যিকারের গোলক ও সমানাকারের কোষ তৈরী করার ক্ষমতা আছে; এবং এরা ইতিমধ্যে কিছুমাত্রায় এরূপ করেছে ও একটি আপাতভাবে স্থায়ী বিন্দুর চারদিকে ঘুরে অনেক পতঙ্গ কাঠের ওপর কিরকম নিখুঁতভাবে নলাকার গর্তগুলি তৈরী করেছে তা দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমাদের ধরে নেওয়া উচিত যে মেলিপোনা মৌমাছিরা তলের স্তরগুলিতে এদের কোষগুলি বিন্যস্ত করেছে, যেমন ইতিমধ্যে এরা নলাকার কোষগুলির ক্ষেত্রে সম্পন্ন করেছে; এবং আমাদের আরও মনে রাখা উচিত এবং যা সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক বা বাধা, যে যখন কতিপয় মৌমাছি তাদের গোলকগুলি তৈরী করছে তখন তাদের অনুগামী শ্রমিকদের থেকে কতদূরে অবস্থান করতে হবে সেটা কিছুমাত্রায় সঠিকভাবে বিচার করতে পারা; এরা সর্বদা কিছুমাত্রায় ছেদ করার জন্য গোলকগুলি তৈরী করে এবং তারপর নিখুঁত চেপ্টা পৃষ্ঠগুলির দ্বারা ছেদনের বিন্দুগুলিকে যুক্ত করে, এর থেকে প্রমাণ হয় এরা ইতিমধ্যে যতদূর সম্ভব বিচার করতে সমর্থ হয়েছে। একটি পাখির বাসা তৈরী করতে যে সহজাত প্রবৃত্তি সহায়ক হয় তার তুলনায় সহজাত প্রবৃত্তির এইসব রূপান্তর আরও বেশী বিস্ময়কর নয়—প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মধু-মৌমাছি অনুকরণীয় নির্মাণকৌশল সংক্রান্ত ক্ষমতা অর্জন করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

কিন্তু পরীক্ষা দ্বারা এই সিদ্ধান্তের সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। মিঃ টেগেটমিয়ারের উদাহরণ অনুযায়ী আমি দুটি মৌচাককে আলাদা করে তাদের মাঝখানে মোমের একটি আয়তাকার, পুরু, লম্বা খণ্ড রেখেছিলাম : মৌমাছিরা তৎক্ষণাৎ তার ওপর ক্ষুদ্র গোলাকার গর্ত খুঁড়তে শুরু করে দিয়েছিল এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না এই গর্তগুলি অগভীর বেসিনে পরিবর্তিত হয়ে চওড়া থেকে আরও চওড়া হয়েছিল, ততক্ষণ মৌমাছিরা এইসব ক্ষুদ্র গর্তগুলিকে গভীর করেছিল—দেখে মনে হয়েছিল এগুলি সত্যিকারের একটি গোলক বা গোলকের অংশ এবং একটি কোষের ব্যাসের সমান। এটি অতিশয় কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্য করা হয়েছিল যে যেখানেই কতিপয় মৌমাছি একত্রে এই বেসিনগুলি খুঁড়তে শুরু করেছিল, সেখানেই তারা পরস্পরের থেকে এমন দূরত্বে কাজ শুরু করেছিল যে সেই সময়ের মধ্যে বেসিনগুলি উপরিউক্ত বিস্তার অর্জন করেছিল (অর্থাৎ একটি সাধারণ কোষের বিস্তারের প্রায় সমান) এবং গোলকটির ব্যাসের প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ গভীর হয়েছিল, যে গোলকটির একটি অংশ এরা তৈরী করেছিল, বেসিনগুলির বেড় পরস্পরকে ছেদন করে বা ভেঙ্গে প্রবেশ করেছিল। যে মুহূর্তে এটা ঘটল, তখনই মৌমাছিরা গর্ত খোঁড়া বন্ধ করেছিল এবং বেসিনগুলির মধ্যে ছেদনরেখা বরাবর মোমের চেপ্টা প্রাচীর তৈরী করতে শুরু করেছিল, যাতে করে সাধারণ কোষের মত একটি তিন ধারবিশিষ্ট পিরামিডের সোজা ধারের উপরের পরিবর্তে একটি মসৃণ বেসিনের চেটালো ধারের ওপর প্রত্যেক ষড়ভুজাকার প্রিজম তৈরী হয়েছিল। 

মোমের পুরু আয়তাকার একটি খণ্ডের পরিবর্তে এরপর আমি মধুর মধ্যে সিঁদুরধারা রঞ্জিত পাতলা ও সরু ছুরির মত ধারওয়ালা একটি আল (রিজ) রেখেছিলাম। আগের মত মৌমাছিরা তৎক্ষণাৎ এটির উভয়দিকে ছোট ছোট গর্ত (বেসিন) খুঁড়তে শুরু করেছিল; কিন্তু মোমের আলটি এত পাতলা ছিল যে আগের পরীক্ষার মত একই গভীরতায় খোঁড়া হলে বেসিনগুলির তলদেশ বিপরীত দিক থেকে পরস্পরের মধ্যে ভেঙ্গে যেত। তবে মৌমাছিরা এটা হতে দেয়নি এবং সঠিক সময়ে খোঁড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। যে মুহূর্তে বেসিনগুলি একটু বেশী গভীর হয়েছিল, তখনই বেসিনের তলদেশগুলি চেপ্টা হয়েছিল; এবং সিঁদুর মিশ্রিত মোমের অব্যবহৃত ছোট ছোট প্লেট দ্বারা তৈরী এই চেপ্টা তলগুলি, যতদূর পর্যন্ত চোখে দেখা যায়, মোমের আলটির বিপরীত পার্শ্বগুলির বেসিনের মধ্যে কল্পিত ছেদনের ঠিক তল বরাবর অবস্থিত ছিল। একটি রম্বিক প্লেটের কোন অংশে শুধু ছোট ভাগ, অন্য অংশ বড় ভাগ বিপরীত বেসিনদের মধ্যে এভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল, অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য কিন্তু কাজটি নিপুণভাবে সম্পন্ন হয়নি। মৌমাছিরা নিশ্চয় ছেদনের তলগুলিতে কাজ বন্ধ করে বেসিনের মধ্যে চেপ্টা প্লেটগুলি পরিত্যাগ করতে এভাবে সমর্থ হওয়ার জন্য সিঁদুর মিশ্রিত আলটির উভয়দিকের বেসিনদের গভীর করতে এবং চক্রাকারে ক্ষয় করতে প্রায় একই হারে কাজ করে থাকবে। 

পাতলা মোমটির নমনীয়তার কথা বিবেচনা করে, উপযুক্ত পুরুত্বে মোমটিকে ক্ষয় করা ও তারপর কাজ বন্ধ করা, মোমের একটি খণ্ডের দু’পাশে কাজ সম্পাদন করতে মৌমাছিদের কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আমার মনে হয় সাধারণ চাকগুলিতে বিপরীত দিক থেকে ঠিক একই হারে কার্য সম্পাদন করতে মৌমাছিরা সর্বদা সফল হয় না; কারণ সবেমাত্র শুরু একটি কোষের পাদদেশে অর্ধসমাপ্ত রম্বসসমূহ আমি লক্ষ্য করেছি। ঐ কোষগুলির একদিকে অল্প অবতল ছিল, আমার মনে হয় সেখানে মৌমাছিরা দ্রুত হারে গর্ত করেছিল এবং অন্যদিক উত্তল ছিল যেখানে মৌমাছিরা কম দ্রুত হারে কাজ সম্পন্ন করেছিল। একটি সুন্দর উদাহরণ দিই। চাকটিকে মধুর মধ্যে পুনরায় রেখেছিলাম আমি ও অল্প সময় কাজ করার জন্য মৌমাছিদের সুযোগ দিয়েছিলাম এবং আবার কোষগুলিকে পরীক্ষা করেছিলাম। দেখেছিলাম যে রম্বিক প্লেটটি সম্পূর্ণ হয়েছিল ও নিখুঁতভাবে চেপ্টা হয়েছিল : ছোট প্লেটটি অতি পাতলা হওয়ার জন্য এটি একান্তই অসম্ভব ছিল যে এরা উভয়দিকে ক্রমশ ক্ষয় করে এটি সম্পন্ন করে থাকতে পারে; এবং অনুমান করি যে এসব ক্ষেত্রে মৌমাছিরা বিপরীতদিকে দাঁড়ায় এবং গরম ও নরম মোমকে তার সঠিক মধ্যবর্তী তলে প্রবেশ করিয়ে এবং বাঁকিয়ে দেয় (আমি দেখেছি যা সহজেই করা যায়) এবং এভাবে একে চেষ্টা করে। 

সিঁদুর-মিশ্রিত মোমের আলটির পরীক্ষা থেকে আমরা দেখতে পারি যে, যদি নিজেদের জন্য মৌমাছিদের মোমের একটি পাতলা প্রাচীর তৈরী করতে হত, তাহলে পরস্পরের থেকে উপযুক্ত দূরত্বে দাঁড়িয়ে, সমহারে গর্ত খুঁড়ে, সম আকারের গোলকীয় গর্ত তৈরীর চেষ্টা করে, বরং কখনও গোলকগুলিকে পরস্পরের মধ্যে ভেঙ্গে যেতে না দিয়ে, এরা উপযুক্ত আকারের কোষগুলি তৈরী করতে পারত। গড়ে ওঠা একটি চাকের ধার পরীক্ষার দ্বারা স্পষ্টভাবে দেখা যেতে পারে যে মৌমাছিরা চাকটির চারিদিকে একটি বন্ধুর পরিধি-প্রাচীর বা বেড় তৈরী করে এবং এরা প্রত্যেক কোষকে গভীর করার সময় সর্বদা চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে কাজ করে বিপরীতদিক থেকে একে ক্ষয় করে। এরা একই সময়ে যে-কোন কোষের সমগ্র তিন পার্শ্ব সম্বলিত পিরামিডসদৃশ বনিয়াদ তৈরী করে না, কিন্তু শেষ বা চরম প্রান্তের ওপর গড়ে ওঠা একটি অথবা দুটি রম্বিক প্লেট, যেমন প্রয়োজন, তৈরী করে; যতক্ষণ না ষড়ভুজাকার প্রাচীরগুলি তৈরী শুরু হয়, ততক্ষণ কখনও রম্বিক প্লেটদের ওপরের ধারগুলি সম্পূর্ণ করে না। এইসব বক্তব্যের কয়েকটি বিখ্যাত জ্যেষ্ঠ হুবারের বক্তব্য থেকে ভিন্ন, কিন্তু এগুলির সত্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত; এবং যদি জায়গা থাকত, আমি দেখাতাম যে এগুলি আমার তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। 

হুবারের বক্তব্য হল, একেবারে প্রথম কোষটি মোমের একটি ছোট সমান্তরাল পার্শ্ব সম্বলিত প্রাচীরে গর্ত করে তৈরী হয়েছে, কিন্তু আমি যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে এটি সম্পূর্ণ সঠিক নয় : প্রথম আরম্ভটি হয় মোমের একটি ছোট হুড থেকে; কিন্তু এখানে আমি বিস্তৃত আলোচনার দিকে যাব না। কোষগুলির নির্মাণকার্যে গর্ত খোঁড়া কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু মনে করা নিতান্তই ভুল হবে যে মৌমাছিরা সঠিক অবস্থানে মোমের একটি বন্ধুর প্রাচীর তৈরী করতে পারে না—অর্থাৎ দুটি সংলগ্ন গোলকের মধ্যে ছেদন তল বরাবর। আমার কাছে কয়েকটি নমুনা আছে যা স্পষ্ট দেখায় যে এরা এটি করতে পারে। এমনকি একটি বর্ধিষ্ণু চাকের চারদিকে মোমের পরিধিমূলক বন্ধুর বেড় অথবা প্রাচীরে ভবিষ্যতের কোষসমূহের ভিত্তিমূলক রম্বিক প্লেটের তলগুলির সমাবস্থানে বক্রতা বা বাঁক কোন কোন সময় লক্ষ্য করা যায়। মোমের অমসৃণ প্রাচীরটি প্রত্যেক ক্ষেত্রে উভয়দিকে ক্ষয় করার মাধ্যমে মসৃণ হয়েছে। যে পদ্ধতিতে মৌমাছিরা এটা তৈরী করে তা বড় বিচিত্র—এরা সব সময় কোষটির সম্পূর্ণ হওয়া পাতলা প্রাচীরের তুলনায় প্রথমে দশ থেকে কুড়িগুণ পুরু প্রাচীর সৃষ্টি করে, যেটি অবশেষে পরিত্যক্ত হয়। রাজমিস্ত্রিদের কাজের সঙ্গে তুলনা করলে কেমন করে এরা কাজ করে তা বোঝা যাবে। রাজমিস্ত্রিরা প্রথমে সিমেন্টের চওড়া আলের স্তূপ তৈরী করে এবং নিচের উভয়দিক সমানভাবে কাটতে থাকে, এরকম করে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত না মাঝে একটি মসৃণ, অতি পাতলা প্রাচীর সৃষ্টি হয়; রাজমিস্ত্রিরা কাটা সিমেন্টগুলিকে স্তূপাকৃতি করে এবং ঢালু আলটির শীর্ষে নূতন সিমেন্ট যোগ করে। আমরা দেখব যে এভাবে একটি পাতলা প্রাচীর ওপরের দিকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে যার শীর্ষ সর্বদা সিমেন্টের বিরাট গাঁথনি। সবেমাত্র শুরু হওয়া ও ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ হওয়া সমস্ত কোষের শীর্ষে মোমের শক্ত গাঁথনি থাকার জন্য মৌমাছিরা সূক্ষ্ম ষড়ভুজাকার প্রাচীরের ক্ষতি সাধন না করে চাকটির ওপর জড়ো হতে ও ধীরে ধীরে চলতে পারে। আমার অবগতির জন্য অধ্যাপক মিলার জানিয়েছেন যে, এইসব প্রাচীর পুরুত্বে অতি পরিবর্তনশীল, চাকটির প্রান্তের দিকের বারোটির গড় পরিমাপ করে দেখা গেছে যে এরা এক ইঞ্চির ১/৩৫২ পুরু; অন্যদিকে ভূমিষ্ঠ প্লেটগুলি আরও পুরু, তিনের দুই অনুপাতের এবং মাঝামাছি পুরুত্বের হয়, একুশটির গড় পরিমাপ হচ্ছে ১/২২৯ ইঞ্চি। নির্মাণকার্যের উপরোক্ত আশ্চর্যজনক পদ্ধতির দ্বারা মোমের সবচেয়ে কম খরচে চাকটি অনবরত শক্তিশালী হয়েছে। 

প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হয় কোষগুলি তৈরীর সময় কেমন করে অসংখ্য মৌমাছি একত্রে কাজ করে। একটি মৌমাছি একটি কোষে কাজ করে অন্য কোষে যায়, হুবারের মতানুসারে, একটি বিরাট দল এমনকি প্রথম কোষ তৈরীর সময় কাজ করে। একটি কোষের ষড়ভুজাকার প্রাচীরের প্রান্তে অথবা একটি বর্ধনশীল চাকের পরিধি বেড়ের একেবারে প্রান্তে সিঁদুর মেশানো গলিত মোমের পাতলা স্তর লাগিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমি ঘটনাটি দেখতে সমর্থ হয়েছিলাম; এবং অপ্রত্যাশিতভাবে আমি দেখেছিলাম যে মৌমাছিরা রঙিন মোমের ক্ষুদ্রাণু সূক্ষ্মভাবে অন্য মোমের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল—যেমন একজন চিত্রকর তার তুলির সাহায্যে করে থাকে—এবং চারিদিকে কোষগুলির গড়ে ওঠা প্রান্তে কাজ করেছিল। সহজাত প্রবৃত্তিমূলক স্বভাবের জন্য, সকলে পরস্পরের থেকে একই আপেক্ষিক দূরত্বে অবস্থান করে সকলে সমান গোলকগুলি বহন করার চেষ্টা করে এবং এইসব গোলকের মধ্যে ছেদনের তলগুলি এরপর তৈরী করে অথবা অক্ষত অবস্থায় পরিত্যাগ করে। মনে হয় গঠন বা নির্মাণকার্যটি সকল মৌমাছির সঙ্গতিমূলক কাজ। চাকের দুটি খণ্ড কেমন করে একটি কোণে মিলিত হয়, কেমন করে প্রায়শই মৌমাছিরা একই কোষকে ভেঙ্গে ফেলে ও ভিন্ন উপায়ে আবার তৈরী করে, প্রথমে বাতিল করা আকারকে কোন কোন সময় পুনরায় তৈরী করে—এগুলি বোঝার পক্ষে সত্যিই অসুবিধার কারণ হয়। 

যেহেতু মৌমাছিদের একটি জায়গা থাকে কাজ করার জন্য যার ওপর এরা উপযুক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারে—উদাহরণস্বরূপ, একখণ্ড কাঠের ওপর, যা নিচের দিকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত একটি চাকের মাঝখানের নিচে অবস্থিত, যাতে করে খণ্ডটির একদিকে চাকটি তৈরী হয়—এক্ষেত্রে মৌমাছিরা এর উপযুক্ত স্থানে একটি নূতন ষড়ভুজের একটি প্রাচীরের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে, যা সম্পূর্ণ হওয়া অন্য কোষগুলির বাইরে বেরিয়ে থাকে। এটিই যথেষ্ট যে মৌমাছিরা সবশেষে সমাপ্ত কোষের প্রাচীর ও পরস্পরের থেকে এদের উপযুক্ত দূরত্বে দাঁড়াতে সমর্থ হবে, এবং এরপর কল্পিত গোলকদের আঘাত করে এরা দুটি সংলগ্ন গোলকের মধ্যবর্তী একটি প্রাচীর তৈরী করতে পারে। কিন্তু আমি যতদূর পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি, তাতে দেখেছি ঐ কোষটির ও সংলগ্ন কোষগুলির এক বিরাট অংশ যতক্ষণ না তৈরী হয়, ততক্ষণ এরা কখনও একটি কোষের কোণগুলি তৈরী শেষ ও ক্ষয় করে না। সবেমাত্র শুরু হওয়া দুটি কোষের মধ্যে উপযুক্ত স্থানে কোন বিশেষ অবস্থায় একটি বন্ধুর প্রাচীরের ভিত্তি স্থাপনে মৌমাছিদের এই ক্ষমতাটি গুরুত্বপূর্ণ, তথ্যটি অনুসারে প্রথমে মনে হয় যে এটি আগের তত্ত্বটির পক্ষে ক্ষতিকারক। যথা, বোলতার চাকের সর্বশেষ প্রান্তের কোষগুলি কোন কোন সময় সম্পূর্ণ ষড়ভুজাকার হয়; কিন্তু এ বিষয়ে আলোচনা করার জায়গা এখানে নেই। অথবা ষড়ভুজাকার কোষ তৈরী করার জন্য একটিমাত্র পতঙ্গের পক্ষে কোন বিরাট বাধা থাকে না, গোলক বা নলগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এবং মাঝের তলগুলি তৈরী করে সবেমাত্র শুরু হওয়া কোষগুলির অঙ্গ থেকে উপযুক্ত আপেক্ষিক দূরত্বে সর্বদা দাঁড়িয়ে যদি সে একই সময়ে শুরু হওয়া দুটি বা তিনটি কোষের বাইরে এবং ভেতরে পর্যায়ক্রমে কাজ করে। 

জীবন-পরিবেশে প্রত্যেক জীবের পক্ষে লাভজনক এমন দৈহিক গঠন বা সহজাত প্রবৃত্তির সামান্যতম রূপান্তরগুলির সঞ্চয়নের দ্বারা প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে বলে সঙ্গতভাবেই জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে যে নির্মাণের বর্তমান নিখুঁত পরিকল্পনার দিকে সকলে পরিচালিত হয়ে নির্মাণকৌশল সংক্রান্ত রূপান্তরিত সহজাত প্রবৃত্তির একটি দীর্ঘ ও ক্রমিক পারম্পর্য কেমন করে মধু-মৌমাছির পূর্বপুরুষদের পক্ষে লাভজনক হল? আমি মনে করি উত্তরটি কঠিন নয় : মৌমাছি বা বোলতাদের কোষগুলির মত তৈরী কোষসমূহ শক্তিশালী হয় এবং অনেক শ্রম ও জায়গার সাশ্রয় হয় ও যেসব পদার্থ দিয়ে এসব তৈরী সেগুলোর সাশ্রয় করে। মোম উৎপাদন প্রসঙ্গে জানা গেছে যে মধু সংগ্রহ করতে মৌমাছিরা যথেষ্ট পরিশ্রম করে এবং মিঃ টেগেটমিয়ার আমাকে জানিয়েছেন যে পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে এক পাউন্ড মোম নিঃসরণের জন্য মৌমাছিদের একটি মৌচাক বারো থেকে পনেরো পাউন্ড শুষ্ক চিনি ব্যবহার বা খরচ করে; অতএব মৌচাক তৈরী করতে প্রয়োজনীয় মোম নিঃসরণের জন্য একটি মৌচাকে মৌমাছিদের অস্বাভাবিক পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে। অধিকন্তু, নিঃসরণ প্রক্রিয়া চলার সময় অনেকদিন মৌমাছিদের কর্মহীন হয়ে থাকতে হয়। শীতের সময় মৌমাছিদের বড় দলকে বাঁচানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ মধুর সঞ্চয় অত্যন্ত প্রয়োজন, এবং এটি সুবিচিত যে মৌচাকের নিরাপত্তা বাঁচিয়ে রাখা অসংখ্য মৌমাছির দলের ওপর নির্ভর করে। অতএব প্রচুর পরিমাণ মধু সঞ্চয়ের মাধ্যমে মোম সঞ্চয় এবং মধু সংগ্রহের সময় বাঁচানো মৌমাছিদের যে-কোন গোত্রের পক্ষে সফল হওয়ার নিশ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—প্রজাতিদের সাফল্য অবশ্যই তাদের শত্রুদের অথবা পরজীবীদের সংখ্যার ওপর অথবা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কারণসমূহের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে এবং সম্পূর্ণরূপে মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের পরিমাণ ছাড়াও এটি হতে পারে। কিন্তু আমাদের অনুমান করা উচিত পরের অবস্থাটি—আমাদের ভ্রমর-মৌমাছিদের স্বগোত্রীয় একটি মৌমাছি যে-কোন দেশে অধিক সংখ্যায় অবস্থান কি নির্ধারণ করেছিল, যেমন এটি সম্ভবত নির্ধারণ করেছে। আমাদের আরও অনুমান করা উচিত যে সম্প্রদায় বা দলটি সমগ্র শীতকাল জুড়ে বেঁচে ছিল এবং ফলস্বরূপ মধুর সঞ্চয় প্রয়োজন ছিল : এক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের কল্পিত ভ্রমর-মৌমাছিদের পক্ষে এটি একটি সুবিধা হয়ে থাকবে যদি এর সহজাত প্রবৃত্তিতে অল্প রূপান্তর এদেরকে কাছাকাছি একত্রে মোমের কোষ তৈরী করতে প্ররোচিত করে থাকে, যাতে পরস্পর অল্প ছেদ করে; কারণ দুটি সংলগ্ন কোষের সাধারণ একটি প্রাচীর অল্প শ্রম ও মোম বাঁচাবে। অতএব যদি মেলিপোনা মৌমাছিরা স্তূপীকৃত কোষসমূহের মত আরও বেশী বেশী করে একত্রে সন্নিকটে সুষম আকারের কোষসমূহ তৈরী করতে পারত, তাহলে তা আমাদের ভ্রমরের পক্ষে আরও বেশী লাভজনক হবে; কারণ এক্ষেত্রে প্রত্যেক কোষের পরিবেষ্টিত পৃষ্ঠের বিরাট অংশ সংলগ্ন কোষগুলিকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে এবং অনেক শ্রম ও মোম বাঁচবে। আবার, একই কারণ অনুযায়ী, মেলিপোনা মৌমাছিদের পক্ষে এটি লাভজনক হবে যদি বর্তমানের তুলনায় এদের কোষগুলিকে এরা আরও সন্নিকটে এবং সর্বাংশে সুষমভাবে নির্মাণ করে; কারণ তখন, যেমন আমরা দেখেছি, গোলকীয় পৃষ্ঠসমূহ সামগ্রিকভাবে মিলিয়ে যাবে এবং সমতলপৃষ্ঠ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে; এবং মেলিপোনা মৌমাছিরা মধু-মৌমাছির চাকের মত একটি নিখুঁত চাক তৈরী করবে। নির্মাণকৌশলের নিখুঁততার এই ধাপের বাইরে প্রাকৃতিক নির্বাচন পথ প্রদর্শন করতে পারত না, কারণ যতদূর আমরা জানি মধু-মৌমাছির চাকটি শ্রম ও মোম বাঁচিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিখুঁতভাবে নির্মিত হয়। 

আমার ধারণা, জ্ঞাত সমস্ত সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়করটি হচ্ছে মধু-মৌমাছির এবং এটি সরলতর সহজাত প্রবৃত্তির অসংখ্য, পর্যায়ক্রমিক, অল্প রূপান্তরের সুবিধা গ্রহণকারী প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জোড়া স্তরে পরস্পরের থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সমান গোলকদের ঠেলে নিয়ে যেতে এবং ছেদক তল বরাবর মোম তৈরী ও নিখুঁতভাবে গর্ত করতে প্রাকৃতিক নির্বাচন ধীর মাত্রায় মৌমাছিদের পরিচালিত করে। পরস্পরের থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে গোলকদের ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণ নিশ্চয় মৌমাছিরা জানত না, কিন্তু ষড়ভুজাকার প্রিজমগুলির এবং পাদদেশের রম্বিক প্লেটগুলির কোণ কি হয় তা তারা জানত। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি হচ্ছে সবচেয়ে কম শ্রম ও মোম ব্যবহার করে শূককীটদের (লার্ভাদের) জন্য উপযুক্ত শক্ত, সঠিক আকার ও আয়তনের কোষগুলির গঠন; ঐ বিশেষ ঝাঁকটি, যা সবচেয়ে কম শ্রম ব্যবহার করে এবং মোমের নিঃসরণে সবচেয়ে কম মধু নষ্ট করে সর্বোত্তম কোষগুলি নির্মাণ করেছিল, তা সবচেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন করেছিল এবং নূতনভাবে অর্জিত মিতব্যয়মূলক সহজাত প্রবৃত্তিগুলি নূতন ঝাঁকে বংশগতভাবে প্রেরণ করেছিল, অস্তিত্বের সংগ্রামে ঐ নূতন ঝাঁকের কৃতকার্য হওয়ার সবচেয়ে বেশী সম্ভাবনা থাকবে। 

সহজাত প্রবৃত্তিতে প্রযুক্ত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব 
সম্বন্ধে আপত্তিসমূহ : ক্লীব ও বন্ধ্যা পতঙ্গ

সহজাত প্রবৃত্তির উৎপত্তি সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত মতবাদে আপত্তি তোলা হয়েছে যে ‘দৈহিক গঠনেরও সহজাত প্রবৃত্তির পরিবর্তন পরস্পরের সঙ্গে যুগপৎভাবে এবং নিখুঁতভাবে নিশ্চয় বিন্যস্ত হয়েছে, যেহেতু অন্যটিতে তাৎক্ষণিক অনুরূপ পরিবর্তন ব্যতীত একটিতে এই রূপান্তর মারাত্মক হয়ে ওঠে। এই আপত্তির জোর এই ধারণার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল যে সহজাত প্রবৃত্তি ও দেহগঠনের পরিবর্তন আকস্মিক হয়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লিখিত বড় চামচিকের (প্যারাস মেজর) ঘটনাটি উদাহরণস্বরূপ নেওয়া যাক; এই পাখিটি একটি শাখার ওপর বসে, পায়ের পাতার মধ্যে ইউ গাছের বীজ প্রায়শই ধরে রাখে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না শাঁস দেখতে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঠোঁট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। ঠোঁটটির আকারের সমস্ত অংশের নিজস্ব পরিবর্তনসমূহ সংরক্ষণ করাটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে কি বিশেষ কষ্টকর কাজ হবে, যা একটি ঠোঁট সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত বীজগুলিকে ভাঙ্গার জন্য বেশী বেশী করে অভিযোজিত হয়েছিল, চোরপাখির (নুথ্যাচ) মত এই উদ্দেশ্যের জন্য একইভাবে নির্মিত হয়েছিল, একই সময়ে স্বভাব অথবা বাধ্যবাধকতা অথবা স্বাদের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনসমূহ বেশী বেশী করে পাখিটিকে বীজ-ভক্ষণকারী হতে প্রণোদিত করেছিল। এক্ষেত্রে চঞ্চুটি সম্ভবতঃ পরবর্তী সময়ে স্বভাব অথবা স্বাদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু যদি চঞ্চটির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অথবা অন্য কোন অজ্ঞাত কারণে চামচিকার পায়ের পাতাটি পরিবর্তিত হয় এবং বড় হয়, তখন এটি অসম্ভবপর নয় যে এরূপ বড় পায়ের পাতা পাখিটিকে আরও বেশী করে গাছে উঠতে প্ররোচিত করবে, যতদিন না সে নুথ্যাচের গাছে ওঠার সহজাত প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে দেহগঠনের ক্রমিক পরিবর্তন পরিবর্তিত সহজাত প্রবৃত্তিমূলক স্বভাবের দিকে নিয়ে যায়। আর একটা ঘটনা ধরা যাক। কতিপয় সহজাত প্রবৃত্তি আরও চমকপ্রদ, যা পূর্বদেশীয় দ্বীপগুলির বাতাসী পাখিদের (সুইফট) সম্পূর্ণরূপে নিঃসৃত লালা দিয়ে বাসা তৈরী করতে, প্ররোচিত করে। কোন কোন পাখি লালাসিক্ত বলে মনে করে কাদায় বাসা তৈরী করে; এবং উত্তর আমেরিকার একটি বাতাসী পাখি লালা মাখানো কাঠি দ্বারা বাসা তৈরী করে (যা আমি . দেখেছি) এবং এমনকি কাঠির ছিল্কা দ্বারাও। এটি কি তখন অসম্ভবপর যে আরও বেশী বেশী করে লালা নিঃসরণকারী একটি বাতাসী পাখির প্রাকৃতিক নির্বাচন সহজাত প্রবৃত্তি সমেত একটি প্রজাতি অবশেষে সৃষ্টি করবে যা অন্য বস্তুগুলিকে অবহেলা করতে প্ররোচিত করবে এবং যা একান্তভাবে নিঃসৃত লালা দ্বারা তাকে বাসা তৈরী করতে প্ররোচিত করবে? এবং অন্যসব ক্ষেত্রেও এরূপ হয়। তবে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে অনেক উদাহরণে সহজাত প্রবৃত্তি বা দেহগঠন কোটি প্রথমে পরিবর্তিত হয়েছিল, তা আমরা অনুমান করতে পারি না। 

সন্দেহ নেই যে ব্যাখ্যার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ অনেক সহজাত প্রবৃত্তি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিরোধিতা করতে পারে—যেমন, এইসব ক্ষেত্রে : যেখানে আমরা লক্ষ্য করতে পারি না একটি সহজাত প্রবৃত্তি কেমন করে উদ্ভূত হয়েছে; যেখানে কোন মধ্যবর্তী ক্রমপরিবর্তন আছে বলে জানা নেই; তুচ্ছ গুরুত্বের কোন সহজাত প্রবৃত্তি, যেগুলি কদাচিৎ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রভাবিত হয়; প্রকৃতির মানদণ্ডে অতিশয় দূরবর্তী প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তি প্রায় একইরূপ হয়; যেখানে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশানুসৃতির মাধ্যমে সদৃশতা হিসেবে এগুলিকে আমরা বিবেচনা করতে পারি না এবং ফলস্বরূপ নিশ্চয় বিশ্বাস করব যে এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে অর্জিত হয়েছিল। এইসব বিষয়ে আমি মনোনিবেশ করব না। কিন্তু একটি বিশেষ প্রতিবন্ধক সম্বন্ধে বলব, যেটি আমার কাছে মনে হয়েছিল অনতিক্রম্য এবং প্রকৃতপক্ষে সমগ্র তত্ত্বটির পক্ষে মারাত্মক। পতঙ্গদের ক্লীব ও বন্ধ্যা স্ত্রীদের সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করব আমি, কারণ এইসব ক্লীব পতঙ্গরা সহজাত প্রবৃত্তিতে এবং দেহগঠনে পুরুষ ও জননশক্তিসম্পন্ন স্ত্রীদের থেকে প্রায়শই ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয় এবং উপরন্তু বন্ধ্যা হওয়ার জন্য এরা বংশবিস্তার করতে পারে না। 

বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু আমি একটিমাত্র বিষয় এখানে উল্লেখ করব—কর্মী অথবা বন্ধ্যা পিঁপড়েদের বিষয়টি। কর্মী পিঁপড়েরা কেমন করে বন্ধ্যা হয় সে বিষয়টি বেশ জটিল; কিন্তু দেহগঠনের অন্য কোন চমকপ্রদ রূপান্তরের তুলনায় এটি বেশী জটিল নয়, কারণ দেখানো যেতে পারে যে প্রাকৃতিক অবস্থায় কতিপয় কীটপতঙ্গ এবং উচ্চারণক্ষম অন্য কতিপয় প্রাণী সাময়িকভাবে বন্ধ্যা হয়; এবং এইসব পতঙ্গরা যদি সমাজবদ্ধ হয় এবং প্রতিবছর কর্মক্ষম কিন্তু বংশবিস্তারে অসমর্থ কিছু পতঙ্গের জন্ম যদি এদের পক্ষে লাভজনক হয়, তাহলে এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কোন অসুবিধা আমি দেখি না। কিন্তু এই প্রাথমিক অসুবিধাটি আমি নিশ্চয় অতিক্রম করতে পারব। কর্মী পিঁপড়েদের সম্পর্কে বড় অসুবিধাটি হচ্ছে এরা দেহগঠনে পুরুষ ও উর্বর স্ত্রী উভয়ের থেকেই ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়, যেমন বুকের গঠনে, ডানাহীনতায়, কোন কোন চোখে এবং সহজাত প্রবৃত্তিতে। শুধুমাত্র সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করলে কর্মী ও নিখুঁত স্ত্রীদের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্ময়কর পার্থক্যটি মধু-মৌমাছির উদাহরণ দ্বারা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কর্মী পিঁপড়ে অথবা অন্য ক্লীব পতঙ্গ যদি একটি সাধারণ প্রাণী হতো, তাহলে আমি নির্দ্বিধায় মনে করতাম যে এদের সব বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল; যথা অল্প লাভজনক রূপান্তরগুলি সঙ্গে নিয়ে এককদের জন্ম হওয়া, যেগুলি বংশধররা বংশগতির মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছিল; এবং এগুলো পুনরায় পরিবর্তিত ও নির্বাচিত হয়েছিল এবং এভাবে চলেছে। কিন্তু কর্মী পিঁপড়েরা তাদের পিতামাতার থেকে বহুলাংশে ভিন্ন হয়, তথাপি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ্যা হয়; দেহগঠনের অথবা সহজাত প্রবৃত্তির পর্যায়ক্রমিকভাবে অর্জিত রূপান্তরগুলি কখনও বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরণ করতে পারে না। প্রশ্ন উঠতে পারে—এই ঘটনাটি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটির সঙ্গে কেমন করে সমন্বয় সাধন করে। 

প্রথমেই স্মরণ করা উচিত যে গৃহপালিত উৎপাদনসমূহ এবং প্রাকৃতিক অবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই বংশগতভাবে প্রাপ্ত দেহগঠনে সমস্ত ধরনের পার্থক্যের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, গঠনগুলি কোন কোন বয়সে ও যে-কোন লিঙ্গের সঙ্গে সহ-সম্পর্কযুক্ত। পার্থক্যগুলি শুধুমাত্র একটি লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং জননতন্ত্রটি সক্রিয় হওয়ার অল্প সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; যেমন হয় অনেক পাখির প্রথম পালকসমূহে এবং পুরুষ স্যালমনের বঁড়শী আকারের চোয়ালগুলিতে। পুরুষ লিঙ্গের কৃত্রিম অসম্পূর্ণ অবস্থার তুলনায় গোমহিষাদির বিভিন্ন জাতের শিং-এর সামান্যতম পার্থক্য আমরা সচরাচর দেখি; কারণ এইসব একই জাতের ষাঁড় ও গাভী উভয়েরই শিং-এর দৈর্ঘ্য অন্য জাতের ষাঁড় ও গাভীদের তুলনায় অনুপাতে বেশী হয়ে থাকে। অতএব পতঙ্গ সম্প্রদায়ের কোন কোন সদস্যের বন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে কোন বৈশিষ্ট্যের সম্পর্কিত হওয়ার ব্যাপারটিকে কোন বিরাট প্রতিবন্ধক হিসাবে আমি মনে করি না : প্রতিবন্ধকটি নির্ভর করে কেমন করে দেহগঠনে এরূপ সহ-সম্পর্কিত রূপান্তরসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ধীরে ধীরে সঞ্চিত হয়ে থাকতে পারে, তা বুঝতে পারার ওপর। 

এই বাধাটিকে অনতিক্রম্য মনে হলেও এটি হ্রাস পায় অথবা তিরোহিত হয়, যখন স্মরণ করা হয় যে নির্বাচন গোত্রটিতে এবং একটি এককে প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং এভাবে ঈন্সিত ফল লাভ করা যেতে পারে। গোমহিষাদির প্রজননকারীরা চায় মাংস ও মেদ একসঙ্গে থাকুক। এরূপ বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণীটিকে হত্যা করা হয়, কিন্তু প্রজননকারীরা সেই স্টকের দিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অগ্রসর হয়েছে এবং কৃতকার্য হয়েছে। নির্বাচন ক্ষমতার ওপর এরূপ বিশ্বাস রাখা যেতে পারে যে সর্বদা অস্বাভাবিক লম্বা শিং-সম্বলিত বলদ উৎপাদনকারী গোমহিষাদির একটি জাত সৃষ্টি করা যেতে পারত, যদি লক্ষ্য করা যেত কোন্ কোন্ ষাঁড় ও গাভী প্রজননের দ্বারা দীর্ঘতম শিং-যুক্ত বলদ উৎপাদন করে; তথাপি কোন বলদ কখনও তার নিজের মত বলদ উৎপাদন করবে না। একটি উৎকৃষ্ট ও প্রকৃত উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে : এম. ভারলটের মতানুসারে, যত্ন সহকারে দীর্ঘদিন ধরে ও সঠিক মাত্রায় নির্বাচিত দ্বিবর্ষজীবী স্টকের কতিপয় ভ্যারাইটি সর্বদা যুগ্ম ও বন্ধ্যা ফুল সমেত অসংখ্য চারাগাছ উৎপাদন করে, কিন্তু এরা একটি ফুল-যুক্ত ও উর্বর উদ্ভিদেরও জন্ম দেয়। পরেরটি, যেখানে শুধুমাত্র ভ্যারাইটিটি বংশবিস্তার করতে পারে, তাকে উর্বর পুরুষ ও স্ত্রী-পিঁপড়েদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এবং এই সম্প্রদায়ের ক্লীবদের সঙ্গে যুগ্ম বন্ধ্যা উদ্ভিদের তুলনা করা যেতে পারে। স্টকটির ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে যেমন, সেরূপ সমাজবদ্ধ পতঙ্গদের ক্ষেত্রেও, উপকার প্রাপ্তির জন্য নির্বাচন গোত্রটিতে প্রযুক্ত হয়েছে, এককটিতে নয়। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সম্প্রদায়টির কোন সদস্যের বন্ধ্যা অবস্থার সঙ্গে সহ-সম্পর্কিত দেহগঠন অথবা সহজাত প্রবৃত্তির নামমাত্র রূপান্তরসমূহ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে : ফলস্বরূপ উর্বর স্ত্রী ও পুরুষরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই রূপান্তর সমেত বন্ধ্যা সদস্যদের উৎপাদন করার প্রবণতাটি এদের উর্বর বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি নিশ্চয়ই অসংখ্যবার ঘটেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না একই প্রজাতির উর্বর ও বন্ধ্যা স্ত্রীদের মধ্যে বিপুল পরিমাণ পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যা আমরা সমাজবদ্ধ পতঙ্গদের মধ্যে দেখি। 

কিন্তু বাধাটির সর্বোচ্চ মাত্রাকে আমরা এখনও স্পর্শ করিনি; যথা, কতিপয় ক্লীব পিঁপড়ে শুধু উর্বর স্ত্রী ও পুরুষ থেকে নয়, বরং পরস্পরের থেকেও কোন কোন সময় অবিশ্বাস্য মাত্রায় ভিন্ন হয় এবং এভাবে দুই অথবা তিনটি জাতে বিভক্ত হয়। অধিকন্তু জাতগুলি পরস্পরের সঙ্গে ক্রমবিন্যস্ত হয় না, বরং সম্পূর্ণরূপে সুসংজ্ঞায়িত হয়; একই গণের যে—কোন দুটি প্রজাতি অথবা একই গোত্রের যে-কোন দুটি গণের মধ্যে যেমন পার্থক্য হয়, এরা পরস্পরের থেকে সেরকমই ভিন্ন হয়। এভাবে এসিটন পতঙ্গে কর্মী ও যোদ্ধা ক্লীবরা থাকে, যাদের চোয়াল ও সহজাত প্রবৃত্তি একেবারেই ভিন্ন : ক্রিস্টোসেরাস পতঙ্গের একটি জাতের কর্মীরা শুধুমাত্র তাদের মাথায় চমৎকার ধরনের শিল্ড বহন করে, যার ব্যবহার অজানা : মেক্সিকোর মিরমেকোসিস্টাস পতঙ্গের একটি জাতের কর্মীরা কখনও বাসা ত্যাগ করে না, অন্য জাতের কর্মীরা এদের খাওয়ায় এবং এদের উদর দারুণভাবে বিকশিত যা মধুর মত রস নিঃসরণ করে, যেমন বলা যেতে পারে, জাবপোকা অথবা গৃহপালিত গোমহিষাদির মলের জায়গা গ্রহণ করে, আমাদের ইউরোপীয় পিঁপড়েরা যাদের কারারুদ্ধ করে-ও পাহারা দেয়। 

প্রকৃতপক্ষে মনে করা হবে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতিটির প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস আছে, যখন আমি স্বীকার করি না যে এরূপ বিস্ময়কর ও সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্যসমূহ অবিলম্বে এই তত্ত্বটিকে ধ্বংস করে : ক্লীব পতঙ্গদের সরলতম উদাহরণে একটি জাতের সকলে, আমার মতে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উর্বর স্ত্রী ও পুরুষের থেকে ভিন্ন হয়েছে। সাধারণ পরিবর্তনগুলির উপমা থেকে আমি সিদ্ধান্ত করতে পারি যে পর্যায়ক্রমিক, নামমাত্র, লাভজনক রূপান্তরসমূহ একই বাসায় সব ক্লীব পতঙ্গে প্রথমে আবির্ভূত হয়নি, বরং আবির্ভূত হয়েছিল কতিপয় পতঙ্গে; এবং লাভজনক রূপান্তর সম্বলিত অধিকাংশ ক্লীব সৃষ্টিকারী স্ত্রী সমেত সম্প্রদায়টি বেঁচে থাকার দ্বারা সব ক্লীবরা এভাবে অবশেষে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। এই মত অনুযায়ী, একই বাসায় দেহগঠনের বিভিন্ন ক্রমের ক্লীব পতঙ্গদের মাঝেমাঝে দেখা যাবে; এবং ইউরোপের বাইরে ক্লীব পতঙ্গদের যত্নসহকারে পরীক্ষার পর আমরা লক্ষ্য করি এরা সংখ্যায় কত অল্প। মিঃ এফ. স্মিথ দেখিয়েছেন যে কতিপয় ব্রিটিশ পিঁপড়েদের ক্লীবরা পরস্পরের থেকে আকারে ও কোন কোন সময় রঙে আশ্চর্যজনকভাবে ভিন্ন হয় এবং প্রান্তিক আকারগুলিকে একই বাসার এককদের দ্বারা সংযুক্ত করা যেতে পারে: আমি নিজে এই প্রকার সংক্রমণগত ধাপগুলি তুলনা করেছি। বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর আকারের কর্মীরা কোন কোন সময় সংখ্যায় অত্যধিক হয়; বড় ও ছোটরা উভয়েই সংখ্যায় বেশী, অন্যদিকে মধ্যবর্তী আকারেরা সংখ্যায় কম হয়। ফরমিকা ফ্ল্যাভা নামক পিঁপড়ে প্রজাতিতে কিছু মধ্যবর্তী আকার সমেত বড় ও ছোট কর্মীরা থাকে; স্মিথ লক্ষ্য করেছেন যে এই প্রজাতিতে বড় কর্মীদের সরল চোখ (ওসেলি) থাকে, ছোট হলেও যাকে স্পষ্ট চেনা যায়, অন্যদিকে ক্ষুদ্র কর্মীদের সরল চোখ অঙ্কুরাবস্থায় থাকে। এইসব কর্মী পিঁপড়েদের কয়েকটির যত্নসহকারে শব-ব্যবচ্ছেদ করে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে ক্ষুদ্র কর্মীদের চোখগুলি আনুপাতিক হারে ছোট আকারের তুলনায় আরও বেশী অঙ্কুরাবস্থায় রয়েছে; এবং আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি, যদিও জোরের সঙ্গে বলতে পারি না, যে মধ্যবর্তী আকারের কর্মীদের ওসেলি (সরল চোখ) ঠিক মধ্যবর্তী অবস্থায় রয়েছে। সুতরাং এখানে আমরা দেখি যে একই বাসায় বন্ধ্যা কর্মীদের মধ্যে দু’ধরনের কর্মী রয়েছে যারা শুধু আকারে নয় বরং দৃষ্টি-অঙ্গেও ভিন্ন, যদিও মধ্যবর্তী অবস্থার কতিপয় সদস্য দ্বারা যুক্ত হয়েছে। এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে যে যদি ক্ষুদ্র কর্মীরা সম্প্রদায়টির পক্ষে অতিশয় উপকারী হত এবং সেইসব পুরুষ ও স্ত্রীরা অনবরত নির্বাচিত হত, যারা বেশী বেশী করে ক্ষুদ্রতর কর্মীদের জন্ম দিত যতক্ষণ না সব কর্মীরা এই অবস্থায় পৌঁছাত, তাহলে মিরমাইকার পিঁপড়ের অবস্থার মত একই অবস্থায় ক্লীবগুলি সমেত পিঁপড়েদের একটি প্রজাতি পেতাম আমরা। কারণ মিরমাইকা নামক পিঁপড়েদের কর্মীদের ওসেলি (ক্ষুদ্র চোখ) এমনকি আদিম অবস্থাতেও নেই, যদিও এই গণের পুরুষ ও স্ত্রী পিঁপড়েদের অতি উন্নত ওসেলি আছে। 

অন্য একটি ঘটনার কথাও বলতে পারি আমি। একই প্রজাতির ক্লীবদের বিভিন্ন জাতের মধ্যে দেহগঠনের প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম সংক্ৰমণগত ধাপসমূহ দেখতে আমি এত উৎসুক ছিলাম যে পশ্চিম আফ্রিকার চালক পিঁপড়ের (অ্যানোমা) একই বাসা থেকে মিঃ স্মিথের দেওয়া অসংখ্য নমুনা পেয়ে অতিশয় আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার দেওয়া সঠিক পরিমাপ থেকে নয়, বরং একটি সঠিক চিত্রসমেত উদাহরণ থেকে পাঠক বোধহয় এইসব কর্মীদের মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণটি ভালভাবে উপলব্ধি করবেন : পার্থক্যটি সেরকম ছিল যেমন একদল বাড়ি-নির্মাতা শ্রমিকের ক্ষেত্রে হয়, যাদের অনেকেই পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, আবার অনেকেই ছয় ফুট লম্বা; কিন্তু আমরা আরও মনে রাখব যে বড় শ্রমিকদের মাথা ছোটদের তিনগুণের পরিবর্তে চারগুণ বড় ও চোয়ালগুলি প্রায় পাঁচগুণ বড়। অধিকন্তু বিভিন্ন আকারের কর্মী পিঁপড়েদের চোয়ালের আকার এবং দাঁতের আকার ও সংখ্যা বিস্ময়করভাবে ভিন্ন। আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় বিষয়টি হচ্ছে যে যদিও কর্মীদের বিভিন্ন আকারের জাতে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে, তথাপি বোঝা যায় না এমনভাবে পরস্পরের মধ্যে এরা ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যায়, যেমন এদের ব্যাপকভাবে ভিন্ন চোয়ালের ক্ষেত্রে হয়। পরের বিষয়টি সম্বন্ধে আমি স্থিরনিশ্চিত, কারণ স্যার জে. লুবক আমার জন্য ক্যামেরা লুসিডার সাহায্যে চোয়ালগুলির ছবি এঁকে দিয়েছিলেন এবং কিছু আকারের কর্মীর চোয়ালের ব্যবচ্ছেদ আমি করে দিয়েছিলাম। মিঃ ব্যাট্স্ তাঁর ‘ন্যাচারালিস্ট অন দ্য অ্যামাজন’ নামক চমৎকার প্রবন্ধটিতে সমরূপ ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন। 

এইসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমি বিশ্বাস করি যে জননক্ষমতাসম্পন্ন বা উর্বর পিঁপড়ে ও পিতামাতাদের ওপর ক্রিয়াশীল হয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি প্রজাতি সৃষ্টি করতে পারে, যারা পর্যায়ক্রমে ক্লীবদের সৃষ্টি করবে, যারা আবার এক ধরনের চোয়াল সমেত সকলে বড় আকারের অথবা ব্যাপকভাবে ভিন্ন আকারের চোয়াল সমেত সকলে ছোট আকারের হয়; বা অবশেষে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক—একদল কর্মী এক ধরনের আকার ও গঠনের এবং যুগপৎভাবে আর-একদল কর্মী ভিন্ন আকার ও গঠনের হয়। প্রথমে সংক্রমণগত একটি ধাপের সৃষ্টি হয়েছে, এরপর যতক্ষণ পর্যন্ত না মধ্যবর্তী গঠনের একটি আকার সৃষ্টি হয়, ততক্ষণ পিতামাতাদের উদ্বর্তনের মাধ্যমে আরও বেশী সংখ্যায় চূড়ান্ত আকাররা সৃষ্টি হয়েছে, পিতামাতারাই এদের সৃষ্টি করেছে। 

মিঃ ওয়ালেস সমান অথচ জটিল ঘটনার একটি উদাহরণ দিয়েছেন—মালয়দেশের কোন কোন প্রজাপতি দুই অথবা এমনকি তিনটি ভিন্ন স্ত্রী আকারে নিয়মিতভাবে আবির্ভূত হয়। ফ্রিজ মুলারের মতানুসারে, ব্রাজিল দেশের খোলকী প্রাণীদের (ক্রাস্টেসিয়ান) কয়েকটি এভাবে দুটি ব্যাপকভাবে ভিন্ন পুরুষ আকারে আবির্ভূত হয়। কিন্তু বিষয়টি এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। 

আমি ইতিমধ্যে চমৎকার ঘটনাটির কথা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছি যে কেমন করে একই বাসায় বন্ধ্যা কর্মীদের দুটি স্পষ্টত সংজ্ঞায়িত জাত উদ্ভূত হয়েছে, যারা উভয়ে পরস্পরের থেকে ও নিজেদের পিতামাতার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শ্রমবিভাগ সভ্য মানুষদের পক্ষে উপকারী—এই নীতির ওপর ভিত্তি করে পিঁপড়েদের একটি সামাজিক সম্প্রদায়ের পক্ষে এদের উৎপাদন কত উপকারী হয়ে থাকতে পারে তা আমরা লক্ষ্য করতে পারি। তবে পিঁপড়েরা বংশগতভাবে প্রাপ্ত সহজাত প্রবৃত্তি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা উপকরণ দ্বারা কাজ করে, অন্যদিকে মানুষ অর্জিত জ্ঞান ও তৈরী যন্ত্র দ্বারা কাজ করে। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে আমার নিশ্চয় স্বীকার করা উচিত যে এইসব ক্লীব পতঙ্গদের ঘটনাটি এই সিদ্ধান্তে আমাকে আসতে যদি না প্রণোদিত করত তাহলে আমার কখনও প্রত্যাশা করা উচিত হত না যে এই নীতিটি এত উচ্চমাত্রায় কার্যকরী হয়ে থাকতে পারে। অতএব প্রাকৃতিক নির্বাচনের শক্তি দেখানোর জন্য এই ঘটনাটি অল্প অথচ অপর্যাপ্তভাবে আলোচনা করেছি এবং তা করেছি এই কারণে যে আমার তত্ত্বের পক্ষে এই ঘটনাটি সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। ঘটনাটি অতিশয় চিত্তাকর্ষকও বটে, কারণ উদ্ভিদের মত প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রমাণ করে যে অভ্যাস বা স্বভাবের ভূমিকা পালন ছাড়াই, যদি লাভজনক হয়, তাহলে যে-কোন পরিমাণ রূপান্তর অসংখ্য, অল্প, স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনসমূহের সঞ্চয়নের দ্বারা রূপায়িত হতে পারে। কারণ কর্মী অথবা বন্ধ্যা স্ত্রীদের একান্ত নিজস্ব স্বভাবসমূহ যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, পুরুষ ও উর্বর স্ত্রীদের তা সম্ভবত প্রভাবিত করতে পারত না। আমি আশ্চর্যান্বিত হই যে লামার্কের বংশগত স্বভাবের সুপরিচিত মতবাদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কেউই ক্লীব পতঙ্গদের প্রামাণ্য ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেননি। 

সারাংশ 

এই অধ্যায়ে আমি সংক্ষেপে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে আমাদের গৃহপালিত প্রাণীদের মানসিক গুণগুলি পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনসমূহ আনুবংশিক হয়। আরও সংক্ষেপে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি যে প্রাকৃতিক অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ সামান্য পরিমাণে পরিবর্তিত হয়। এ ব্যাপারে কেউই আপত্তি করবে না যে সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ প্রত্যেক প্রাণীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্বের হয়। অতএব যে-কোন ভাবে উপকারী সহজাত প্রবৃত্তির যে-কোন মাত্রার অল্প রূপান্তরসমূহের সঞ্চয়নে জীবনের পরিবর্তনশীল পরিবেশে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে প্রকৃত কোন বাধা নেই। অনেক ক্ষেত্রে স্বভাব অথবা ব্যবহার ও অব্যবহার সম্ভবত কিছু ভূমিকা পালন করেছে। এই অধ্যায়ে প্রদত্ত তথ্যসমূহ যে বিরাটমাত্রায় আমার তত্ত্বকে শক্তিশালী করে, তা আমি দাবী করি না; কিন্তু সর্বোত্তম বিচারে বাধার ঘটনাদের কোনটাই আমার তত্ত্বকে বিনাশ করে না। বিপরীতক্রমে, ঘটনাটি এই যে সহজাত প্রবৃত্তি সব সময় পুরোপুরি নিখুঁত হয় না এবং ভুল হতেই পারে : যে-কোন সহজাত প্রবৃত্তি অন্য প্রাণীদের মঙ্গলের জন্য উদ্ভূত হয়েছে বলে দেখানো যেতে পারে না, যদিও প্রাণীরা অন্যদের সহজাত প্রবৃত্তির সুবিধা গ্রহণ করে; প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রবাদ ‘প্রকৃতি কখনও লম্ফ দেয় না’ সহজাত প্রবৃত্তিসমূহে ও দৈহিক গঠনে প্রযোজ্য হয় এবং পূর্বোক্ত মতবাদগুলিতে সাধারণভাবে প্রযোজ্য হয়, কিন্তু অন্যথায় ব্যাখ্যাতীত—সবগুলোই প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে সত্য বলে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। 

এই তত্ত্বটি সহজাত প্রবৃত্তি সংক্রান্ত অন্য কিছু ঘটনার দ্বারাও শক্তিশালী হয়। যেমন, ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং ভিন্ন প্রজাতির সাধারণ ঘটনাটি দ্বারা, যখন এই প্রজাতিরা পৃথিবীর দূরতম অঞ্চলে বসবাস করে এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে জীবনযাপন করে, তথাপি প্রায়শই একই সহজাত প্রবৃত্তি বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ, বংশগতির নীতি অনুসারে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের কস্তুরা পাখি (থ্রাস) ব্রিটিশ কস্তুরা পাখির (থ্রাস) মত একইরকম অদ্ভুত উপায়ে বাসার চারদিকে মাটির প্রাচীর তৈরী করে; কেমন করে এটি হয় যে আফ্রিকার এবং ভারতের ধনেশ (হর্নবিল) পাখিদের সহজাত প্রবৃত্তিটি অস্বাভাবিকভাবে একই হয়, যারা গাছের একটি গর্তে স্ত্রীদের আটক করে রাখে ও গর্তটি প্লাস্টার করে দেয় এবং প্লাস্টারের মধ্যে শুধুমাত্র একটি ফুটো রাখে যার মধ্য দিয়ে পুরুষরা তাদের স্ত্রী ও বাচ্চাদের খাবার খাওয়ায়; কেমন করে এটি হয় যে উত্তর আমেরিকার পুরুষ রেন্স পাখিরা (ট্রোগ্লোডাইট্স) আমাদের কিট্টি রেন্সদের মত একত্রে ঘুমোনোর জন্য ‘মোরগ বাসা’ তৈরী করে—স্বভাবটি আমাদের জানা অন্য যে-কোন পাখির তুলনায় অন্যরকম বা আলাদা। অবশেষে, এটি যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত না-ও হতে পারে, বরং আমার কল্পনানুসারে শিশু-কোকিলের পালক ভাইদের বিতাড়িত করা, পিঁপড়েদের দাস তৈরী করা, ইচনিউমনিডির শূককীটদের (লার্ভাদের) শুঁয়োপোকার জীবন্ত শরীরের মধ্যে খাওয়ানো প্রভৃতি সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে বিশেষভাবে গুণান্বিত অথবা সৃষ্ট সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে নয়, বরং সমস্ত জৈব জীবের অগ্রগমনের দিকে দিকনির্দেশকারী একটি সাধারণ নিয়মের ছোট ছোট পরিনাম হিসেবে-যথা, সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়া, পরিবর্তিত হওয়া, বলবানরা বাঁচুক ও দুর্বলরা মরুক—লক্ষ্য করা আরও বেশী সন্তোষজনক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *