১০. ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অপূর্ণাঙ্গতা

দশম অধ্যায়—ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অপূর্ণাঙ্গতা 

বর্তমান সময়ে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের অনুপস্থিতি—বিলুপ্ত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের ধরণ; এদের সংখ্যা—নগ্নতা বা ক্ষয়ের এবং অবক্ষেপণের হার থেকে অনুমিত সময়ের ব্যবধান—আনুমানিক বছরের হিসেবে সময়ের ব্যবধান—জীবাশ্ম সংগ্রহের অপ্রতুলতা—ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তরসমূহের সবিরাম পর্যায়শীলতা—গ্রানাইট অঞ্চলের ক্ষয়—যে-কোন একটি ভূস্তরে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের অনুপস্থিতি প্ৰজাতি গোষ্ঠীগুলির হঠাৎ আবির্ভাব—জ্ঞাত সর্বনিম্ন জীবাশ্মপূর্ণ স্তরে এদের হঠাৎ আবির্ভাব—বাসযোগ্য পৃথিবীর প্রাচীনত্ব। 

এই গ্রন্থে উল্লিখিত মতবাদগুলোর বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুক্তি-সহ প্রধান প্রধান আপত্তি—সমূহের তালিকা ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমি দিয়েছি। এগুলোর অধিকাংশই এখানে আলোচিত হয়েছে। প্রথমতঃ, বিশেষ আকারদের গুণগত স্পষ্টতা, এবং অসংখ্য মধ্যবর্তী সংযোজক দ্বারা একত্রে এদের মিশ্রিত না হওয়াটি হচ্ছে একটি বড় প্রতিবন্ধক। এদের উপস্থিতির জন্য বর্তমান সময়ে আপাতভাবে অত্যন্ত অনুকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা এরূপ সংযোজকদের সন্ধান পাই না তার কারণ আমি উল্লেখ করেছিলাম, অনুকূল অবস্থাটি হচ্ছে পর্যায়ক্রমিক ভৌতিক অবস্থা সম্বলিত বিস্তৃত ও অবিচ্ছিন্ন অঞ্চল। আমি দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম যে প্ৰত্যেক প্রজাতির জীবন জলবায়ুর তুলনায় ইতিমধ্যেই সংজ্ঞায়িত অন্য জৈব আকারসমূহের উপস্থিতির ওপর আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে নির্ভর করে, অতএব জীবনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী পরিবেশ—সমূহ তাপ এবং আর্দ্রতার মত সম্পূর্ণ অগোচরে পর্যায়ক্রমিকভাবে সজ্জিত হয় না। আমি আরও দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম যে সংযোগকারী আকারদের তুলনায় সংখ্যায় অল্পতর মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা আরও রূপান্তর ও উৎকর্ষসাধন প্রক্রিয়ায় সাধারণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হবে। তবে প্রাকৃতিক অবস্থায় সর্বত্র অসংখ্য মধ্যবর্তী সংযোজকদের বর্তমানে না থাকার প্রধান কারণটি প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে, যার মাধ্যমে নতুন ভ্যারাইটিরা তাদের পিতামাতা আকারদের স্থান অনবরত গ্রহণ করে এবং পিতামাতা আকারদের স্থানচ্যুত করে। কিন্তু ধ্বংসের পরিমাণ আনুপাতিক হারে এত বিপুল যে পূর্বে অবস্থানকারী মধ্যবর্তী আকারদের সংখ্যা নিশ্চয় বিশাল হবে। তাহলে কেন প্রত্যেক ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং ভূতাত্ত্বিক স্তর এইসব মধ্যবর্তী সংযোজকসমূহ দ্বারা পূর্ণ থাকে না? ভূবিজ্ঞান নিশ্চয় এরূপ সূক্ষ্ম পর্যায়ক্রমিক জৈবিক শৃংখল উদ্ঘাটন করে না; এবং এটিই বোধ হয় সবচেয়ে স্পষ্ট এবং গুরুতর আপত্তি যা এই তত্ত্বটির বিরুদ্ধে উত্থাপন করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস মত ব্যাখ্যাটি ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অতি অপূর্ণাঙ্গতার মধ্যে নিহিত রয়েছে। 

প্রথমতঃ, সবসময় মনে রাখা উচিত এই তত্ত্বানুসারে কি ধরনের মধ্যবর্তী আকাররা পূর্বে অবস্থান করত। এদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী আকারদের ছবি বিবর্জিত দুটি প্রজাতিকে যখন আমি লক্ষ্য করি তখন তা আমার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা; প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে মধ্যবর্তী আকারদের এবং একটি সাধারণ অথচ অজ্ঞাত পূর্বপুরুষের সন্ধান আমাদের সবসময় করা উচিত, এবং পূর্বপুরুষটি তার সব রূপান্তরিত বংশধরের থেকে কোন কোন বিষয়ে সাধারণতঃ ভিন্ন হয়ে থাকবে। একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক : পাহাড়ী পায়রা থেকে লক্কা এবং পাউটার পায়রাদের উদ্ভব হয়েছে; কদাচ অবস্থানকারী সমস্ত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের যদি আমরা অধিকারী হতাম, তাহলে এই উভয় জাতের পায়রা এবং পাহাড়ী পায়রাদের মধ্যে একটি অতি ঘনিষ্ঠ সারি আমরা লক্ষ্য করতে পারতাম; কিন্তু লক্কা এবং পাউটারের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী আকারদের আমরা লক্ষ্য করিনি; উদাহরণস্বরূপ, কিছু পরিমাণ বিস্তৃত একটি লেজের সঙ্গে কিছুটা প্রসারিত গলার থলি সমেত একটিকেও দেখিনি আমরা, এ দুটিই হচ্ছে ঐ দুটি জাতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অধিকন্তু, এই দুটি জাত এত অধিক রূপান্তরিত হয়েছে যে এদের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন ঐতিহাসিক অথবা অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের হাতে যদি না থাকে তাহলে কলম্বিয়া, লিভিয়া নামক পাহাড়ী পায়রার দৈহিক গঠনের সঙ্গে এদের দৈহিক গঠনের শুধুমাত্র তুলনা করে এটি নির্ধারণ করা সম্ভবপর হবে না যে এরা এই প্রজাতি অথবা অন্য কোন সম্বন্ধযুক্ত আকার, যেমন কলম্বিয়া ওনাস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল কিনা। 

এরূপে প্রাকৃতিক প্রজাতিদের ক্ষেত্রেও হয়। যেমন, ঘোড়া ও টেপিরদের অতিশয় ভিন্ন আকারদের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি, আমাদের মনে করার কোন কারণ নেই যে এদের মধ্যে কখনও কোন সংযোজক ছিল, কিন্তু প্রত্যেকটির মধ্যে এবং একটি অজ্ঞাত সাধারণ পিতামাতার মধ্যে সংযোজক ছিল। সাধারণ পিতামাতার সমগ্র দেহগঠনের সঙ্গে টেপির ও ঘোড়ার অতিশয় সাদৃশ্য থেকে থাকবে; কিন্তু দৈহিক গঠনের কয়েকটি বিষয় উভয়ের থেকে ভিন্ন হয়ে থাকতে পারে, এমনকি হয়তো পরস্পরের পার্থক্যের তুলনায় বেশীও হতে পারে। অতএব এইসব ক্ষেত্রে, যে-কোন দুটি অথবা ততোধিক প্রজাতির পিতামাতা আকারটিকে চিনতে আমরা অসমর্থ হব, এমনকি যদি আমরা পিতামাতার দৈহিক গঠনের সঙ্গে তাদের বংশধরদের দৈহিক গঠন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলনা করতাম তাহলেও, যদি না একই সময়ে মধ্যবর্তী সংযোজকদের একটি প্রায় নিখুঁত শৃংখল থাকত। 

তত্ত্বটির দ্বারা এটি পুরোপুরি বাস্তবসম্মত যে দুটি জীবিত আকারের একটি অন্যটির থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি টেপির থেকে একটি ঘোড়া; এবং এক্ষেত্রে এদের মধ্যে সরাসরি মধ্যবর্তী সংযোজকরা অবস্থান করে থাকবে। কিন্তু এরূপ একটি ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে একটি আকার দীর্ঘকাল ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় অবস্থান করেছিল, যে সময় এর বংশধররা বিপুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল; এবং জীবের সঙ্গে জীবের, শিশুর সঙ্গে পিতামাতার প্রতিযোগিতার বিধি অনুযায়ী এটি একটি বিরল ঘটনা হবে, কারণ সব ক্ষেত্রে জীবনের নূতন এবং উন্নত আকাররা প্রবীণ এবং অনুন্নত আকারদের স্থানচ্যুত করতে প্ৰবণ হয়। 

প্রাকৃতিক নির্বাচণ তত্ত্ব অনুযায়ী, সমস্ত জীবিত প্রজাতিরা পার্থক্যসমূহের দ্বারা প্রত্যেক গণের পিতামাতা প্রজাতিদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে, এই পার্থক্যসমূহ বর্তমানে একই প্রজাতির প্রাকৃতিক এবং গৃহপালিত ভ্যারাইটিদের মধ্যে আমাদের দেখা পার্থক্যসমূহের তুলনায় বেশী নয়; এবং এখন সাধারণভাবে বিলুপ্ত এইসব পিতামাতা প্রজাতিরা এদের পালায় আরও আদিম আকারদের সঙ্গে একইরূপে সংযুক্ত হয়েছে; এবং এরূপে আরও পিছনের দিকে গেলে দেখা যায় যে এটি প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীর সাধারণ পূর্বপুরুষটিতে সবসময় মিলিত হয়েছে। এরূপে সমস্ত জীবিত এবং বিলুপ্ত প্রজাতিদের মধ্যে মধ্যবর্তী এবং উত্তরণমূলক সংযোজকদের সংখ্যা অচিন্ত্যনীয়ভাবে বিরাট হয়ে থাকবে। কিন্তু এই তত্ত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে এরা নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে বসবাস করেছিল। 

নগ্নতা বা ক্ষয়ের ব্যাপ্তি এবং অবক্ষেপণের হার থেকে অনুমিত সময়ের ব্যবধান 

এরূপ অনির্দিষ্ট অসংখ্য সংযোজকদের জীবাশ্মমূলক অবশিষ্টাংশ খুঁজে না পাওয়ার ফলে, আপত্তি তোলা যেতে পারে যে এত বিরাট পরিমাণ জৈব পরিবর্তনের জন্য কোন সময়কালই যথেষ্ট হতে পারে না, সব পরিবর্তনই ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে। সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে উপলব্ধি করানোর জন্যে সেই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব, যিনি ব্যবহারিক ভূজ্ঞানী নন। যিনি স্যার চার্লস লিয়েলের বিশাল বই ‘প্রিন্সিপল্স অফ জিওলজি’ পড়তে পারেন, যেটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছে বলে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা স্বীকার করবেন, এবং তথাপি অতীতকাল কত বিশাল ছিল তা স্বীকার না করে তিনি তৎক্ষণাৎ বইটি পড়া বন্ধ করবেন। প্রিন্সিপল্স অফ জিওলজি’ বইটি পড়া অথবা ভিন্ন ভিন্ন ও ভূগঠনস্তরগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন লেখকের বিশেষ গবেষণামূলক প্রবন্ধসমূহ পড়া যথেষ্ট নয় এবং কেমন করে প্রত্যেক লেখক প্রত্যেক ভূগঠনস্তর এবং প্রত্যেক স্তরের স্থায়িত্বের অপর্যাপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তা চিহ্নিত করা যথেষ্ট নয়। ক্রিয়াশীল মাধ্যমগুলো জেনে এবং ভূপৃষ্ঠ কত গভীরভাবে নগ্ন বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং কি পরিমাণ 15 পলি সঞ্চিত হয়েছে এগুলো অনুধাবন করে আমরা অতীতকাল সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারি। লিয়েল সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে আমাদের পাললিক গঠনস্তরগুলোর বিস্তার ও গভীরতা হচ্ছে অন্যত্র পৃথিবীপৃষ্ঠের ক্ষয়ের কার্যফল ও পরিমাপ। অতএব একজন মানুষের পর পর স্থাপিত স্তরসমূহের স্তূপ নিজে পরীক্ষা করা এবং অতীতকালের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে, যার স্মৃতিচিহ্ন আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে, কিছু ধারণা করার জন্য কাদামাটি বহনকারী ছোট ছোট নদীগুলো ও সমুদ্রের ধারে ছোট ছোট পাহাড়-ক্ষয়কারী তরঙ্গসমূহ লক্ষ্য করা উচিত। 

সমুদ্র-উপকূল বরাবর ভ্রমণ করা অবশ্যই ভাল, যা মাঝামাঝি ধরনের শক্ত পাথর দ্বারা তৈরী এবং যেখানে ক্ষয়ের চিহ্ন রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিনে দুবার খুব অল্প সময়ের জন্য জোয়ারভাটার ঢেউ সমুদ্রতীরের খাড়া পর্বতগাত্রে ধাক্কা মারে, এবং বালি ও নুড়ি দ্বারা পরিপূর্ণ তরঙ্গগুলো শুধু একে ক্ষয় করে; কারণ ভাল সাক্ষ্য রয়েছে যে বিশুদ্ধ জল পাথরকে ক্ষয় করতে পারে না। অবশেষে সমুদ্রের ধারে ছোট ছোট তলদেশে গর্ত সৃষ্টি হয়, এর বৃহৎ অংশ পতিত হয় এবং অনড় অবশিষ্টাংশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয় যতক্ষণ না আকারে হ্রাস পেয়ে তরঙ্গদের দ্বারা ঘূর্ণিত হয় এবং তারপর এরা আরও তাড়াতাড়ি নুড়ি, বালি অথবা কাদায় পরিণত হয়। কিন্তু পিছিয়ে আসা খাড়া পাহাড়ের ভূমি বরাবর গোলাকার শৈলখণ্ডসমূহ আমরা প্রায়শই লক্ষ্য করি, যেগুলো সামুদ্রিক উৎপাদন দ্বারা পরিপূর্ণ। এখানে দেখা যায় এগুলো কত অল্প ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং কদাচিৎ এরা গড়ায়। অধিকন্তু, ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এমন পাথুরে পাহাড়ের কোন রেখা বরাবর আমরা যদি কয়েক মাইল অগ্রসর হই, তাহলে অল্প দৈর্ঘ্য বরাবর অথবা একটি অন্তরীপের চারিদিকে শুধুমাত্র এখানে-সেখানে সমুদ্রতীরের খাড়া পাহাড়গুলো ক্ষয়িত হচ্ছে তা আমরা লক্ষ্য করি। পৃষ্ঠটির বাহ্যরূপ ও গাছপালা থেকে বোঝা যা যে এদের ভূমি ধৌতি করার সময় থেকে অন্যত্র অনেক বছর অতিবাহিত হয়েছে। 

রামসে, এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষক দল—-যেমন জুকি, গেকি, ক্রল এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণ থেকে সম্প্রতি আমরা শিক্ষা লাভ করেছি যে উপকূলীয় প্রক্রিয়া অথবা তরঙ্গদের ক্ষমতার তুলনায় উপবায়বীয় অবক্ষয় আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সমগ্র ভূমিপৃষ্ঠ বায়ুর রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং কার্বনিক অ্যাসিড বৃষ্টির জল ও শীতের দেশে তুষারপাতের প্রক্রিয়ার প্রভাবাধীন হয়; খণ্ডখণ্ড বস্তুগুলো প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের সময় ধীরে ধীরে উঁচু থেকে নিচের দিকে বাহিত হয়, এবং বিশেষভাবে শুষ্ক জেলাগুলিতে ভূমিপৃষ্ঠ বায়ুপ্রবাহের দ্বারা প্রভাবিত হয়; তারপর এগুলি ছোট ছোট নদী অথবা বড় নদীদের দ্বারা বাহিত হয়, নদীগুলো যখন খরস্রোতা হয় তখন এদের খাদ গভীর হয় এবং খণ্ডগুলোকে গুঁড়োয় রূপান্তরিত করে। কোন বৃষ্টির দিনে, এমনকি অল্প পাহাড়ময় কোন দেশেও, কর্দমময় ছোট নদীগুলির ভূমিক্ষয়ের ক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়, যে নদীগুলি ধাপে ধাপে প্রবাহিত হয়। মিঃ রামসে এবং হুইটেকার দেখিয়েছেন যে, ওয়েলডেন জেলায় এবং সমগ্র ইংল্যান্ডের বন্ধুর উৎরাইগুলোর বড় বড় রেখাসমূহ এভাবে গঠিত হয়নি, যেগুলোকে পূর্বে প্রাচীন সমুদ্রতীর বলে মনে করা হত; প্রত্যেক রেখা একই গঠনস্তর দ্বারা তৈরী, অন্যদিকে আমাদের সমুদ্র—উপকূলবর্তী পাহাড়গুলি সর্বত্র বিভিন্ন গঠনস্তরের ছেদনের দ্বারা তৈরী হয়েছে। এটাই হচ্ছে ঘটনা, আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে বন্ধুর উৎরাইগুলো প্রধানতঃ পাথর দ্বারা তৈরী হয়েছে, পাথরগুলি পার্শ্ববর্তী ভূমির তুলনায় ভূমিক্ষয় ভালভাবে রোধ করেছে; ফলস্বরূপ এই পৃষ্ঠদেশ ক্রমশ নিম্নবর্তী হয়েছে এবং শক্ত পাথরসমূহ বের হয়ে আছে। সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনুসারে, সময়ের দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল প্রসঙ্গে এভাবে অর্জিত দৃঢ়বিশ্বাসের তুলনায় অন্য কিছুই আরও দৃঢ়ভাবে মনকে অনুপ্রাণিত করে না। এভাবে অর্জিত দৃঢ় বিশ্বাসটি হচ্ছে যে আপাতভাবে অতি অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন এবং অতি ধীর গতিতে কার্যক্ষম উপবায়বীয় মাধ্যমসমূহ বিরাট ফল উৎপাদন করেছে। 

উপবায়বীয় এবং উৎকূলবর্তী প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে ভূমিক্ষয়ের মন্থর হারে এভাবে গুরুত্ব আরোপ করে, অতিক্রান্ত সময়ের ব্যাপ্তিকালের তাৎপর্য উপলব্ধি করার জন্য, একদিকে, বহু বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অপসারিত পাথরের স্তূপসমূহ এবং অন্যদিকে, আমাদের পাললিক গঠনস্তরগুলো সম্বন্ধে বিচার-বিশ্লেষণ করা সন্তোষজনক হবে। জলরাশির তরঙ্গের দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ক্ষয়ের ফলে এক অথবা দু হাজার ফুট উচ্চ উল্লম্ব দুরারোহ পাহাড়ে পরিণত হওয়া আগ্নেয়গিরিময় দ্বীপগুলোকে দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত হই; কারণ আগের তরল অবস্থার জন্য লাভাস্রোতের অল্প ঢাল এক নজরে দেখিয়েছিল যে কেমন করে শক্ত পাথুরে তলদেশ একদা সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। স্তরচ্যুতি সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়—ফাটলগুলোর একদিক বরাবর স্তরসমূহ উচ্চ হয়েছে অথবা অন্যদিকে ঢালু হয়েছে, যা উচ্চতায় অথবা গভীরতায় হাজার হাজার ফুট হয়; কারণ পৃষ্ঠের ফাটল ধরার সময় থেকে এবং উত্থানটি হঠাৎ হয়েছিল কিনা অথবা অধিকাংশ ভূবিজ্ঞানীর এখনকার বিশ্বাস মত, উত্থানটি মন্থরভাবে হয়েছিল কিনা এবং উত্থানটি অনেক দিকে আরম্ভ হয়েছিল কিনা তা বলা ঠিক হবে না, কেননা ভূমিপৃষ্ঠ এত নিখুঁতভাবে সমতল হয়েছে যে এই বিশাল স্থানচ্যুতির কোন লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ক্রাভেন চ্যুতি ওপরের দিকে ৩০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং এই রেখা বরাবর স্তরের খাড়ার স্থানচ্যুতি ৬০০ থেকে ৩০०0 ফুট পর্যন্ত হয়েছে। অধ্যাপক রামসে অ্যাগ্লেসিয়ার ২৩০০ ফুট নিচে নামার একটি হিসাব প্রকাশ করেছেন; তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন মেরিয়নেথেশায়ারে ১২০০ ফুট উচ্চতার এরূপ একটি স্থানচ্যুতি রয়েছে; তবুও এইসব ক্ষেত্রে এরূপ বিশালাকার বিচলন দেখাতে ভূমিপৃষ্ঠে কিছুই নেই; ফাটলের উত্তর দিকের পাথরের স্তূপ ধীরে ধীরে মুছে গেছে। 

বিপরীতক্রমে, পৃথিবীর সমস্ত অংশে পাললিক স্তরের স্তূপগুলো গভীরতায় বিস্ময়কর। কর্ডিলেরাতে গোলাকার স্তূপের উচ্চতা দশ হাজার ফুট—এটা আমি হিসেব করেছিলাম; এবং গোলাকার পিণ্ডীভূত স্তূপটি যদিও সূক্ষ্ম পলির তুলনায় সম্ভবত দ্রুত হারে সঞ্চিত হয়েছে, তথাপি এটি জীর্ণ ও গোলাকার নুড়ি দ্বারা তৈরী, প্রতিটি যুগ তার চিহ্ন বহন করে, এবং এগুলি ভালভাবে দেখায় যে স্তূপটি কেমন করে ধীরে ধীরে একত্রে স্তূপাকৃতি হয়েছে। অধ্যাপক রামসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত পরিমাপ থেকে গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন অংশের পর্যায়ক্রমিক গঠনস্তরগুলোর সর্বোচ্চ গভীরতার হিসেব আমাকে দিয়েছেন। সেগুলো এই রকম : 

পুরাজীবীয় স্তর (আগ্নেয়তল অন্তর্ভুক্ত না করে) —৫৭,১৫৪ ফুট

দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত বা গৌণ স্তর —১৩,১৯০ ফুট

টার্শিয়ারি স্তর —২,২৪০ ফুট

 —একত্রে ৭২,৫৮৪ ফুট; অর্থাৎ প্রায় ত্রয়োদশ এবং তিন-চতুর্থাংশ ব্রিটিশ মাইল। গঠনস্তরগুলোর কয়েকটি, ইংল্যান্ডে যেগুলোর গভীরতা অতি পাতলা, মহাদেশে (Continent) কয়েক হাজার ফুট গভীর হয়। অধিকন্তু, প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক গঠনস্তরের মধ্যে অধিকাংশ ভূতাত্ত্বিকদের মতে বিশাল দৈর্ঘ্যের ফাঁকা পর্যায় রয়েছে। এভাবে ব্রিটেনের পাললিক শিলার উচ্চ স্তূপ এদের সঞ্চয়ের অতিক্রান্ত কাল সম্পর্কে অপ্রতুল ধারণা দেয়। চিরস্থায়িত্বের ধারণা আঁকড়ে থাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মত এইসব বিভিন্ন তথ্যের বিচার—বিশ্লেষণ একইভাবে মনকে প্রভাবিত করে। 

তা সত্ত্বেও এই অনুভূতি বা বোধ অংশত ভুল। মিঃ ক্রল একটি চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে বছর দ্বারা এদের পরিমাপ করা ছাড়া আমরা “ভূতত্ত্বীয় পর্যায়কালের ব্যাপ্তির একটি সঠিক ধারণা গড়ে তুলতে” ভুল করি না। ভূতাত্ত্বিকরা যখন জটিল ঘটনাগুলো দেখেন এবং তারপর কয়েক মিলিয়ন বৎসরের অঙ্কসমূহ দেখেন, তখন দুটিই মনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং অঙ্কের ছবিগুলো সেই মুহূর্তে খুব অল্প বলে মনে হয়। ভূমিপৃষ্ঠের উপবায়বীয় ক্ষয়প্রাপ্তি বা নগ্নতা সম্পর্কে, নদীগুলোর পরিবাহ অববাহিকার তুলনায় কোন কোন নদী দ্বারা বাহিত পলির পরিমাপ করে মিঃ ক্রল দেখান যে ক্রমশ খণ্ডবিখণ্ড হওয়া ১০০০ ফুট শক্ত পাথর সমগ্র অঞ্চলের গড় উচ্চতা থেকে ছয় মিলিয়ন বছরে অপসারিত হবে। এটিকে বিস্ময়কর ফলাফল মনে হয় এবং এ সম্বন্ধে ভাবলে মনে হয় যে এটি হয়তো আরও বেশী হতে পারে, কিন্তু এমনকি যদি অর্ধেক অথবা এক-চতুর্থাংশও হয়, তাহলেও এটিকে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়। তবে শুধুমাত্র কয়েকজনই জানেন যে এক মিলিয়ন কথাটির অর্থ কি। মিঃ ক্রল নিম্নোক্ত উদাহরণ দিয়েছেন : ৮৩ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা এক ফালি কাগজ নেওয়া যাক এবং একটি বড় হলঘরের দেওয়ালে সেটি লাগানো যাক, তারপর এক প্রান্তে এক ইঞ্চির দশভাগের একভাগ দাগ দেওয়া যাক। এই এক ইঞ্চির এক-দশমাংশ এক শত বছর সূচিত করে এবং সমগ্র কাগজের ফালিটি এক মিলিয়ন বছর সূচিত করে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত উপরোক্ত আয়তনের একটি হলঘরে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর একটি পরিমাপের দ্বারা সূচিত একশত বছরের অর্থ কি। কয়েকজন বিশিষ্ট প্রজননকারী তাঁদের জীবৎকালে, কতিপয় উচ্চতর প্রাণীদের এত বিপুলভাবে রূপান্তরিত করেছেন যে এদের উপ-জাত বলা যায়, ঐ উচ্চতর প্রাণীরা অধিকাংশ নিম্নতর প্রাণীদের তুলনায় অতি মন্থরভাবে নিজের মত বংশধর উৎপাদন করে। কয়েকজন ব্যক্তি অর্ধশত বছরের অধিক কাল ধরে যে কোন স্ট্রেনকে যত্ন-সহকারে এমনভাবে পালন করে যে মনে হয় এটি পর্যায়ক্রমিক দুজন প্রজননকারীর একশত বছরের কাজ। এটি মনে করা যায় না যে প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রজাতিরা কখনও এত শীঘ্র পরিবর্তিত হয়, যেমন পদ্ধতিগত নির্বাচনের মাধ্যমে গৃহপালিত প্রাণীদের ক্ষেত্রে হয়। অজ্ঞাতসারে নির্বাচনের ফলগুলোর সঙ্গে তুলনাটি সব দিক দিয়ে ভাল হবে, অর্থাৎ জাতটিকে রূপান্তরিত করার অভিপ্রায় ব্যতিরেকে সবচেয়ে উপকারী এবং সুন্দর প্রাণীদের সংরক্ষণ; কিন্তু অচেতন নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া দ্বারা বিভিন্ন জাত দুই অথবা তিন শতাব্দী ধরে বাস্তবসম্মতরূপে পরিবর্তিত হয়েছে। 

তবে প্রজাতিরা সম্ভবত অতি মন্থরভাবে পরিবর্তিত হয়, এবং একই দেশে একই সময়ে সামান্য কয়েকটি পরিবর্তন ঘটে। এই মন্থরতার কারণ হচ্ছে—এই দেশের সমস্ত অধিবাসীরা পরস্পরের সঙ্গে ইতিমধ্যে এত সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয় যে যতক্ষণ না দীর্ঘ সময় অন্তরে কোন প্রকার ভৌতিক পরিবর্তন ঘটে অথবা নূতন আকারদের অভিবাসনের জন্য প্রয়োজন হয়, ততক্ষণ প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে কোন নূতন স্থানের উদ্ভব হয় না। অধিকন্তু, কিছু অধিবাসী পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের নূতন স্থানে যতক্ষণ না ভালভাবে অভিযোজিত হয়, ততক্ষণ পরিবর্তন বা সঠিক প্রকৃতির এককীয় পার্থক্য সব সময় সঙ্গে সঙ্গে ঘটবে না। বছর অনুযায়ী একটি প্রজাতিকে পরিবর্তিত করতে কত সময় লাগে তা নির্ধারণ করার জন্য দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের কোন পদ্ধতি নেই; বরং সময়ের বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই আবার আলোচনায় ফিরে আসব। 

জীবাশ্ম সংগ্রহের অপ্রতুলতা 

এখন আমাদের সমৃদ্ধ ভূতত্ত্বীয় জাদুঘরগুলোর দিকে সৃষ্টি দেওয়া যাক এবং সেখানকার অকিঞ্চিৎকর প্রদর্শনী আমরা লক্ষ্য করি। প্রত্যেকেই স্বীকার করে যে আমাদের সংগ্রহগুলো নিতান্তই অসম্পূর্ণ। শ্রদ্ধেয় জীবাশ্মবিদ এডওয়ার্ড ফরবেসের মন্তব্যটি কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যথা—একটি একক এবং প্রায়শঃই ভাঙ্গা নমুনা থেকে, অথবা একই স্থান থেকে সংগৃহীত অল্প কয়েকটি নমুনা থেকে অশ্মীভূত প্রজাতি সম্বন্ধে জানা গেছে এবং এদের নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবীপৃষ্ঠের শুধুমাত্র অল্প অংশই ভূতাত্ত্বিকভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু কোন অংশই যথেষ্ট যত্ন-সংকারে পরীক্ষা করা হয়নি, যা প্রতি বছর ইউরোপের প্রধান আবিষ্কারগুলো থেকে প্রমাণিত হয়। সম্পূর্ণ নরম দেহবিশিষ্ট কোন জীব সংরক্ষিত হতে পারে না। সমুদ্রের তলদেশে পরিত্যক্ত খোলক এবং হাড়গুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অন্তর্হিত হয় যেখানে পলি সঞ্চিত হয় না। আমরা সম্ভবত একটি ভুল সিদ্ধান্তে আসি, যখন আমরা মনে করি যে সমুদ্রের প্রায় সমগ্র তলদেশে পলি সঞ্চিত হয়, যা এমন হারে হয় যা জীবাশ্মকে ঢাকা দিতে এবং সংরক্ষিত করতে যথেষ্ট। মহাসমুদ্রের অধিকাংশ অঞ্চলে জলের রং উজ্জ্বল নীল এবং এটি এর বিশুদ্ধতার প্রমাণ দেয়। অন্তর্বর্তী সময়ে নিচের স্তরের কোন ব্যবহারজনিত ক্ষয় ছাড়া বিপুল বা দীর্ঘ অন্তর্বর্তী সময়ের ব্যবধানে অন্য এবং পরবর্তী গঠনস্তর দ্বারা সঙ্গতিপূর্ণভাবে চাপা দেওয়া একটি গঠনস্তরের নথিভুক্তির অনেক ঘটনা শুধুমাত্র এই মতকে ব্যাখ্যা করে যে সমুদ্র তলদেশ যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকেনি। তয়গুলোর উত্থান ঘটায় সময় স্তরগুলোর অভ্যন্তরে শায়িত জীবাশ্ম অবশিষ্টাংশগুলো, কার্বনিক অ্যাসিড-মিশ্রিত ছুঁয়ে-পড়া বৃষ্টির জলে সাধারণতঃ গলে যাবে। উঁচু ও নিচু জলের চিহ্নের মধ্যে সমুদ্রতটে বসবাসকারী অনেক প্রকার প্রাণীদের কয়েকটি কদাচিৎ সংরক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, চ্যাথামালিনার (পদহীন সিরিপেডদের বা শতপদীদের একটি উপ-গোত্র) কয়েকটি প্রজাতি সমগ্র পৃথিবীতে অনির্দিষ্ট সংখ্যায় পাথরের ওপর লেগে থাকে: ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটিমাত্র প্রজাতি ছাড়া এরা সকলেই সঠিক অর্থে উপকূলবাসী, ঐ প্রজাতিটি গভীর জলে বসবাস করে, এবং সিসিলিতে এর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, অন্যদিকে অন্য কোন প্রজাতিকে কোন টার্শিয়ারি গঠনস্তরে পাওয়া যায়নি : তথাপি জানা গেছে যে চ্যাথাম্যালাস গণটি চুনাপাথরের যুগে অবস্থান করত। অবশেষে, এদের সঞ্চয়ের জন্য দীর্ঘ সময় নেওয়া অনেক বিরাট পলিস্তরের মধ্যে জৈব অবশিষ্টাংশ একেবারেই দেখা যায় না, এর কারণ আমাদের কাছে অজানা। সবচেয়ে বিস্ময়কর উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ফ্লিস্ট গঠনস্তর, যা কয়েক হাজার শ্লেট এবং বেলেপাথর দিয়ে তৈরী, এমনকি কখনও-সখনও ছয় হাজার ফুট পর্যন্ত গভীর হয়, এবং ভিয়েনা থেকে সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০০ মাইল বিস্তৃত; এই বিশাল ভূমিখণ্ড ভালভাবে পরীক্ষিত হয়েছে, কিন্তু কিছু উদ্ভিদ অবশিষ্টাংশ ছাড়া অন্য কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি। 

দ্বিতীয় পর্যায়িক এবং পুরাজীবীয় যুগে বসবাসকারী স্থলজ উৎপাদনগুলো সম্পর্কে এটি বলা অপ্রয়োজনীয় যে আমাদের সাক্ষ্য প্রমাণাদি অতিশয় অল্প। উদাহরণস্বরূপ, এই দুটি বিশাল যুগের যে-কোনটির সময় বসবাসকারী কোন স্থলজ খোলকী প্রাণী সম্বন্ধে কিছু জানা যায়নি, শুধুমাত্র একটি প্রজাতি ছাড়া, যা উত্তর আমেরিকার কার্বনিফেরাস যুগের গঠনস্তর থেকে স্যার সি. লিয়েল এবং ডঃ ডসন আবিষ্কার করেছিলেন; কিন্তু লিয়ান তাঞ্চল থেকে এখন স্থলজ খোলকী প্রাণীদের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ম্যামিকেরাস অবশিষ্টাংশ সম্বন্ধে, লিয়েলের ম্যানুয়াল-এ প্রকাশিত ঐতিহাসিক সারণীর দিকে তাকালে, এদের সংরক্ষণ কত আকস্মিক ও বিরল হয় তার আসল সত্য জানা যাবে। অথবা এদের বিরলতা বিস্ময়কর নয়, যদি আমরা স্মরণ করি টার্শিয়ারি যুগে হয় গুহায় অথবা হ্রদের পলিতে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিরাট পরিমাণ হাড় আবিষ্কৃত হয়েছে, এবং দ্বিতীয় পর্যায়িক অথবা পুরাজীবীয় গঠনস্তরের সময়ের কোন গুহা অথবা প্রকৃত হ্রদতলদেশ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। 

কিন্তু পূর্বোক্ত যে-কোনটির তুলনায় অন্য আরও একটি ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অপূর্ণাঙ্গতা গুরুত্বপূর্ণ কারণের জন্য লক্ষিত হয়; কারণটা হচ্ছে—কয়েকটি গঠনস্তর দীর্ঘ সময়াস্তর দ্বারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ই. ফরবেসের মত অনেক ভূতাত্ত্বিক এবং জীবাশাবিজ্ঞানী এই তত্ত্বটিকে দৃঢ়ভাবে স্বীকার করেছেন, যাঁরা প্রজাতির পরিবর্তন সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। গবেষণামূলক প্রবন্ধের সারণীতে এবং প্রাকৃতিক অবস্থায় যখন আমরা গঠনস্তরের বিষয়ে লক্ষ্য করি, তখন এরা যে ভীষণভাবে ধারাবাহিক হয় তা অবিশ্বাস করা কষ্টকর হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার ওপর স্যার আর মুর্চিসনের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি ঐ দেশে পরের পর স্থাপিত গঠনস্তরগুলোর মধ্যে কি বিরাট ফাঁক রয়েছে; এবং উত্তর আমেরিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও এরূপ রয়েছে। শুধুমাত্র এইসব বিরাট তাঞ্চলেই নিজের মনোযোগ সীমাবদ্ধ থাকলেও সবচেয়ে দক্ষ ভূতাত্ত্বিক কখনও সন্দেহ প্রকাশ করবেন না যে, যে সময় তাঁর নিজের দেশ শূন্য এবং অনুর্বর ছিল, সে সময় অদ্ভুত ও নূতন জীবন-আকার দ্বারা পূর্ণ পলির বিরাট স্তূপ অন্যত্র সঞ্চিত হয়েছিল। প্রত্যেক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে ধারাবাহিক গঠনস্তরগুলোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে যদি কোন ধারণা কদাচিৎ করা যায়, তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে এটি নিশ্চয় অন্য কোথাও নির্ণয় করা যেতে পারবে না। পরম্পরাগত গঠনস্তরগুলোর খনিজ পদার্থের গঠনসংযুক্তির বারংবার এবং বিরাট পরিবর্তন, যা পলির উদ্ভবের সময় পার্শ্ববর্তী স্থলভাগের ভূগোলের বিরাট পরিবর্তন সূচিত করে, এই বিশ্বাসটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় যে প্রত্যেক গঠনস্তরের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল বিরাট। 

আমরা প্রশ্ন করতে পারি, প্রত্যেক অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তরগুলো কেন অপরিবর্তনীয়রূপে সবিরাম হয়, অর্থাৎ পরস্পরকে কেন ক্রমানুসারে অনুসরণ করেনি। এমনকি সংক্ষিপ্ত ভূতাত্ত্বিক সময় ধরে স্থায়ী হওয়া যথেষ্ট বিস্তৃত যে-কোন সাম্প্রতিক পলিসঞ্চয়নের অনুপস্থিতির তুলনায় অন্য কোন বিষয় আমাকে কদাচিৎ বেশি বিস্মিত করে যখন দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকশত মাইল উপকূল আমি পরীক্ষা করি, যা সাম্প্রতিককালে কয়েকশত ফুট উত্থিত হয়েছে। সমগ্র পশ্চিম উপকূল বরাবর, যেখানে অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীকুল বাস করে, টার্শিয়ারি যুগের ভূস্তর এত ত্রুটিপূর্ণভাবে তৈরী হয়েছে যে পর্যায়ক্রমিক ও অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্ভবত দূরবর্তী সময়ের জন্যও সংরক্ষিত হবে না। একটু ভাবনাচিন্তা করলে এটি ব্যাখ্যা করা যাবে কেন দক্ষিণ আমেরিকার উঠন্ত পশ্চিম উপকূল বরাবর বর্তমানের অথবা টার্শিয়ারি যুগের জীবাশ্ম সমেত বিস্তৃত গঠনস্তরগুলো কোথাও দেখা যায় না, যদিও যুগযুগ ধরে পলির বিপুল সঞ্চয়ন হয়েছে, যা উপকূলবর্তী পাহাড়ের নগ্নীভবন এবং সমুদ্রে পতিত কর্দমাক্ত নদীগুলি থেকে সৃষ্ট হয়। নিঃসন্দেহেই ব্যাখ্যাটি হচ্ছে যে উপকূলের তরঙ্গ বা ঢেউ এবং ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার দ্বারা স্থলভাগের মন্থর ও ক্রমিক উত্থান দ্বারা যে মুহূর্তে বাহিত হয়েছে, তখনই উপকূলবর্তী এবং উপ-উপকূলবর্তী পলি সঞ্চয়ন অনবরত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। 

আমরা বোধহয় সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সামুদ্রিক তরঙ্গের অবিরাম প্রক্রিয়া প্রতিরোধের জন্য প্রথম উত্থান এবং সমুদ্রতলের পর্যায়ক্রমিক স্পন্দন ও পরবর্তী উপবায়বীয় অবক্ষয়ের সময় নিশ্চিত অতিশয় পুরু, শক্ত অথবা বিরাট আকারের পলিস্তূপ সঞ্চিত হবে। পলির এরূপ পুরু এবং বিশাল সঞ্চয় দুভাবে সৃষ্টি হতে পারে: হয় সমুদ্রের অতি গভীরে, যেখানে আরও অগভীর সমুদ্রের মত তলদেশে এত প্রভূত এবং বিচিত্র জীবন-আকাররা বসবাস করে না; এবং উত্থানের পর স্তূপটি জীবদের একটি ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রদান করে, যে জীবগুলো পলিসঞ্চয়নের যুগে সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করত। অথবা যদি পলি মন্থরভাবে অনবরত থিতিয়ে যায়, এটি অগভীর তলদেশে যে-কোন গভীরতায় এবং বিস্তারে সঞ্চিত হতে পারে। শেষোক্ত বিষয়টিতে, থিতানোর হার এবং পলির যোগান যতক্ষণ পর্যন্ত প্রায় সমান-সমান না হয়, ততক্ষণ সমুদ্রটি অগভীর থাকবে ও অনেক বিচিত্র আকারের অবস্থানের পক্ষে অনুকূল হবে, এবং বিরাট পরিমাণ নগ্নীভবন প্রতিরোধ করতে উত্থানের সময় যথেষ্ট পুরু জীবাশ্মপূর্ণ একটি গঠনস্তর সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে। 

আমি স্থিরনিশ্চিত যে আমাদের সমস্ত প্রাচীন ভূতাত্ত্বিক শিলাস্তরসমষ্টি দেবে বা বসে যাওয়ার সময় সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো গভীরতার বিরাট অংশে জীবাশ্ম দ্বারা পরিপূর্ণ। ১৮৪৫ সালে এই বিষয়ে আমার মতামত প্রকাশের সময় থেকে ভূতত্ত্বের অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি আমি এবং লক্ষ্য করে বিস্মিত হয়েছি যে কোন-না-কোন শিলাস্তরসমষ্টি সম্বন্ধে প্রত্যেক গবেষক গবেষণা করে কেমন করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে থিতানো বা বসে যাওয়ার সময় এগুলো সঞ্চিত হয়েছিল। আমি আরও বলতে পারি যে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের শুধুমাত্র প্রাচীন টার্শিয়ারি ভূস্তরটি তলের নিচের দিকের স্পন্দনের সময় সঞ্চিত হয়েছিল এবং এরূপে বিশেষ গভীরতা অর্জন করেছিল—ঐ ভূস্তরটি এত বিরাট ছিল যে এটি নগ্নীভবন প্রতিরোধ করেছিল, কিন্তু এটি দূরবর্তী ভূতাত্ত্বিক যুগ পর্যন্ত কদাচিৎ স্থায়ী হয়েছিল। 

সমস্ত ভূতত্ত্বীয় ঘটনাসমূহ স্পষ্টভাবে আমাদের অবহিত করে যে প্রত্যেক অঞ্চলের পৃষ্ঠতল মন্থর স্পন্দন সহ্য করেছে এবং এই স্পন্দনগুলো ব্যাপক অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে। ফলস্বরূপ, জীবাশ্মপূর্ণ এবং পরবর্তী সময়ের নগ্নীভবন বা ক্ষয় রোধের জন্য যথেষ্ট গভীর এবং বিস্তৃত ভূস্তরগুলি থিতানোর সময় বিস্তৃত অঞ্চলে সৃষ্ট হয়ে থাকবে, কিন্তু কেবল সেখানেই যেখানে সমুদ্রকে অগভীর রাখতে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার আগে জীবাশ্ম অবশিষ্টাংশগুলোকে শায়িত ও সংরক্ষিত করতে পলির যোগান যথেষ্ট ছিল। বিপরীতক্রমে, যতক্ষণ পর্যন্ত সমুদ্রতলদেশ স্থির অবস্থায় থাকে, ততক্ষণ অগভীর অংশগুলোতে ঘন পলি সঞ্চিত হয়ে থাকতে পারে না, অগভীর অংশগুলোই জীবের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল। উত্থানের পর্যায়ান্বিত সময়ে এটি কম ঘটে থাকতে পারে; অথবা আরও সঠিকভাবে বললে, তখন পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত তলদেশগুলো উত্থানের দ্বারা সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকবে এবং উপকূলবর্তী ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার প্রভাবাধীন হয়ে থাকবে। 

এই বক্তব্যসমূহ শুধুমাত্র উপকূলবর্তী ও উপ-উপকূলবর্তী পলিসঞ্চয়নের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোন বিস্তৃত ও অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে, যেমন মালয় দ্বীপপুঞ্জের বিরাট অংশে, যেখানে গভীরতা ৩০ অথবা ৪০ থেকে ৬০ ফ্যাদম হয়, উত্থানের সময় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত একটি ভূস্তর সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে, এবং তথাপি এর মন্থর উত্থানের সময় নগ্নীভবনের বা ক্ষয়প্রাপ্তির দ্বারা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কিন্তু ভূস্তরটি গভীরতর হতে পারবে না, কারণ উত্থান-প্রক্রিয়ার জন্য যে গভীরতায় এটি সৃষ্টি হয়েছিল, তার তুলনায় কম হবে, অথবা পলিসঞ্চয়ন সুদৃঢ় হবে না, অথবা পর্যায়ক্রমিক ভূস্তরগুলোর দ্বারা আচ্ছাদিত হবে না, অতএব বায়বীয় ক্ষয়ের দ্বারা এবং পৃষ্ঠতলের পরবর্তী স্পন্দনগুলোর সময় সমুদ্রের ক্রিয়া—প্রক্রিয়া দ্বারা এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ভাল সম্ভাবনা থাকবে। তবে, মিঃ হপকিনস ইঙ্গিত দিয়েছেন যে উত্থানের পর এবং নগ্নীভবনের আগে যদি অঞ্চলটির একটি অংশ অবনমিত হয়, তাহলে উত্থান-প্রক্রিয়ার সময় সঞ্চিত পলি, যদি গভীর না হয়, পরবর্তীকালে নূতন সঞ্চয়নগুলোর দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে থাকবে এবং এভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষিত হয়ে থাকবে। 

মিঃ হপকিনস-ও সুস্পষ্টভাবে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন যে যথেষ্ট সমান্তরালভাবে বিস্তৃত পাললিক স্তরসমূহ কদাচিৎ সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু কয়েকজন ছাড়া, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে বর্তমানের রূপান্তরজ সিস্ট জাতীয় (স্ফটিকতুল্য) শিলাস্তর এবং পাতালিক পাথরগুলো একদা পৃথিবীর কেন্দ্রটি তৈরী করেছিল, সকলেই স্বীকার করবেন যে এই পরের পাথরগুলোর উপরকার আচ্ছাদন বিরাটভাবে খসে গেছে। কারণ এটি কদাচিৎ সম্ভবপর যে এইসব পাথর অনাচ্ছাদনের পর কঠিন এবং স্ফটিকে পরিণত হয়ে থাকতে পারত; কিন্তু যদি মহাসমুদ্রের মহাগভীরে রূপান্তর প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে পাথরের আগের রক্ষাকারী ম্যান্টলটি অতি গভীর না হয়েও থাকতে পারে। গ্লাইস শিলা, অভ্রস্ফটিক শিলা, গ্রানাইট, ডায়োরাইট ইত্যাদি একদা আবশ্যিকভাবে আচ্ছাদিত হয়েছিল—এটি স্বীকার করে পরবর্তী সময়ে উপরের সমস্ত স্তরগুলোকে নগ্ন করার বিশ্বাস ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের এরূপ শিলাদের নগ্নতা ও বিস্তার সম্বন্ধে কেমন করে আমরা সন্তোষজনক কারণ দেখাতে পারি? এরূপ বিশাল অঞ্চলের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করা যেতে পারে না : হামবোল্ড প্যারাইমের গ্রানাইট অঞ্চলটির বর্ণনা দিয়েছেন যা সুইজারল্যান্ডের থেকে অন্ততঃ উনিশগুণ বড়। আমাজনের দক্ষিণে, বউ (Boue) একটি অঞ্চলের চিত্র এঁকেছেন, যা এইরকম পাথর দিয়ে তৈরী এবং স্পেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানির কিছু অংশ এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে একত্রে যুক্ত করলে যা হয় তার সমান। এই অঞ্চল সম্বন্ধে গভীরভাবে অনুশীলন করা হয়নি, কিন্তু ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে এখানকার গ্রানাইট অঞ্চলটি বিশাল। এভাবে ভন এসচুয়েজ এই পাথরগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন, যা রিও ডে জেনিরো থেকে অভ্যন্তরের সরলরেখা বরাবর ২৬০ ভৌগোলিক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত; এবং আমি অন্যদিকে ১৫০ মাইল পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলাম, এবং গ্রানাইট পাথর ছাড়া কিছুই দেখিনি। রিও ডে জেনিরোর কাছ থেকে প্লাটা নদীর মুখ পর্যন্ত, ১১০০ ভৌগোলিক মাইল লম্বা সমগ্র উপকূল বরাবর থেকে সংগৃহীত অসংখ্য নমুনা আমি পরীক্ষা করেছিলাম এবং এরা সকলেই এই শ্রেণীর অন্তর্গত। প্লাটা নদীর সমগ্র উত্তর তীর বরাবর অভ্যন্তরে, আধুনিক টার্শিয়ারি স্তরগুলো ছাড়া, অল্প রূপান্তরিত আগ্নেয় শিলার ছোট একটি অঞ্চল দেখেছিলাম আমি, যা গ্রানাইট শ্রেণীর প্রাথমিক আচ্ছাদনের একটি অংশ সৃষ্টি করে থাকতে পারে। অধ্যাপক এইচ. ডি. রজার-এর সুন্দর মানচিত্রে প্রদর্শিত ইউনাইটেড স্টেটস ও কানাডার একটি সুপরিচিত অঞ্চলের দিকে লক্ষ্য করে কাগজ কেটে এবং ওজন করে আমি অঞ্চলটির হিসেব করেছিলাম এবং দেখেছি যে আগ্নেয় (অর্ধ-আগ্নেয় বাদে) গ্রানাইট পাথরগুলি সমগ্র নূতন পুরাজীবীয় স্তরগুলোর তুলনায় ১৯ : ১২.৫ অনুপাতে বড় হয়। অনেক অঞ্চলে আগ্নেয় এবং গ্রানাইট পাথরগুলো, যেমন মনে হয় তার তুলনায়, আরও অধিক ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয় বলে দেখা যাবে—এদের ওপর অবিন্যস্তভাবে সঞ্চিত সমস্ত পাললিক স্তরগুলো যদি অপসারণ করা হয় এবং এদের ওপর পাললিক স্তরগুলো আদিম ম্যান্টলের কিছু অংশ থেকে যদি সৃষ্ট না হয়ে থাকে। অতএব এটি সম্ভবপর যে পৃথিবীর কিছু অংশে সমগ্র ভূস্তরগুলো বিনষ্ট না হয়ে সম্পূর্ণরূপে নগ্ন হয়েছে। 

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতেই হয়। উত্থানের সময় স্থলভাগের এবং সমুদ্র সংলগ্ন ঈশৎ জলমগ্ন অংশের অঞ্চলটি বৃদ্ধি পাবে এবং নূতন স্টেশনগুলো প্রায়শই সৃষ্টি হবে : আগের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নূতন ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের উদ্ভবের জন্য সমগ্র পরিবেশ অনুকূল হয়; কিন্তু এইসব যুগের সময় ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সাধারণতঃ শূন্য হবে। বিপরীতক্রমে, অবনমনের সময় বাসযোগ্য অঞ্চল এবং অধিবাসীদের সংখ্যা হ্রাস পাবে (একমাত্র মহাদেশের উপকূল অঞ্চল ভেঙ্গে যখন একটি দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষেত্রটি বাদে), এবং ফলস্বরূপ, অবনমনের সময়, যদিও তখন অনেকে বিলুপ্ত হবে, কতিপয় নূতন ভ্যারাইটি অথবা প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে; অবনমনের এইসব যুগেই জীবাশ্ম দ্বারা পরিপূর্ণ পলিস্তরগুলো পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত হয়েছে। 

যে-কোন একটি ভূস্তরে অসংখ্য মধ্যবর্তী ভ্যারাইটির অনুপস্থিতি 

এইসব কতিপয় বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে এটি সন্দেহ করা যেতে পারে না যে সামগ্রিকভাবে দেখলে ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ অতিশয় ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু আমরা যদি যে-কোন একটি ভূস্তরের দিকে মনোনিবেশ করি, তাহলে এটা বোঝা আরও কষ্টকর হয় যে কেন সেখানে আমরা শুরুতে ও শেষে বেঁচে থাকা স্বজাতীয় প্রজাতিদের মধ্যে নিবিড়ভাবে ক্রমবিন্যস্ত ভ্যারাইটিদের দেখতে পাই না। একই গঠনস্তরের উচ্চ এবং নিম্ন অংশে একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের অবস্থানের কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে; ট্রাউটস্কল্ড অ্যামোনাইটদের সম্পর্কে এরূপ অনেক উদাহরণ দিয়েছেন; এবং হিলজেনডর্ফ সুইজারল্যান্ডের একটি স্বাদুজলের ভূস্তরের পর্যায়ক্রমিক তলসমূহে প্ল্যানোর্বিস মাল্টিফরমিস নামে একটি প্রাণীর দশটি ক্রমবিন্যস্ত আকারের একটি অত্যন্ত বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। প্রত্যেক ভূস্তরের সঞ্চয়ন বা পুঞ্জীভবনের জন্য যদিও অনিবার্যরূপে বিশাল সময়ের দরকার হয়, তাহলেও কয়েকটি কারণ দেখানো যেতে পারে কেন প্রত্যেক ভূস্তরে এর আরম্ভে এবং শেষে বসবাসকারী প্রজাতিদের মধ্যে সংযোজকদের একটি ক্রমবিন্যস্ত সারি সাধারণভাবে থাকবে না; কিন্তু নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলিতে আমি সমান গুরুত্ব আরোপ করতে পারি না। 

প্রত্যেক স্তরসংঘ যদিও দীর্ঘ সময় অতিবাহনের চিহ্ন বহন করতে পারে, তবুও একটি প্রজাতির অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের তুলনায় প্রত্যেক স্তরসংঘ অল্প সময়ের হয়। আমি অবহিত যে দুজন জীবাশ্মবিদ্, ব্রন এবং উডওয়ার্ড, যাঁদের মতামত যথেষ্ট ভিন্ন, সিদ্ধান্ত করেছেন যে প্রত্যেক ভূগঠনস্তরের গড় স্থায়িত্ব প্রজাতিক আকারের গড় স্থায়িত্বের দুই অথবা তিনগুণ হয়। কিন্তু আমার মতে অনতিক্রম্য বাধাগুলো এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসার প্রতিবন্ধক হয়। আমরা যখন দেখি যে যে-কোন ভূগঠন—স্তরের বা স্তরসংঘের মধ্যবর্তী অবস্থায় একটি প্রজাতি প্রথম আবির্ভূত হয়, তখন সিদ্ধান্ত করা নিতান্তই হঠকারিতা হয় যে অন্যত্র কোথাও এটি আগে অবস্থান করেনি। আবার সর্বশেষ স্তরে সঞ্চিত হওয়ার পূর্বে একটি প্রজাতিকে যখন আমরা তিরোহিত হতে দেখি, তখন এটি মনেও করা সমান হঠকারিতা হবে যে এটি তখন বিলুপ্ত হয়েছিল। পৃথিবীর বাকী অংশের তুলনায় ইউরোপীয় অঞ্চলটি কত ছোট তা আমরা ভুলে যাই; অথবা সমগ্র ইউরোপে একই স্তরসংঘের কতিপয় ধাপ নিখুঁতভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়। 

আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সমস্ত প্রকার সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে, জলবায়ু এবং অন্য পরিবর্তনগুলির জন্য বিপুল পরিমাণ স্থানান্তরগমন বা বিচরণ ঘটেছে। আমরা যখন দেখি যে একটি প্রজাতি যে-কোন স্তরসংঘে প্রথমে আবির্ভূত হয়, তখন সম্ভাবনাটি হচ্ছে যে এটি শুধুমাত্র তখনই এই অঞ্চলে প্রথম প্রবেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এটি সুপরিচিত যে ইউরোপের তুলনায় উত্তর আমেরিকার পুরাজীবীয় স্তরসমূহে কয়েকটি প্রজাতি বেশ কিছু পূর্বে আবির্ভূত হয়েছে। আমেরিকার সমুদ্র থেকে ইউরোপের সমুদ্রে বিচরণের (মাইগ্রেশন) জন্য সম্ভবত বেশ কিছুটা সময় লেগেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বশেষ পলিসঞ্চয়নগুলো পরীক্ষা করে সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে যে তখনও জীবিত অল্প কয়েকটি প্রজাতি পলিস্তূপে হামেশাই থাকে, কিন্তু ঠিক পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে এরা বিলুপ্ত হয়েছে; অথবা, বিপরীতভাবে কতিপয় পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে এখন প্রচুর থাকে, কিন্তু এই বিশেষ পলি—সঞ্চয়নে এরা হয় বিরল, না হয় অনুপস্থিত। তুষারযুগের সময়, যা একটি সামগ্রিক ভূতাত্ত্বিক যুগের শুধুমাত্র একটি অংশ, ইউরোপের অধিবাসীদের বিচরণের নিশ্চিত পরিমাণটি স্মরণ করলে একটি চমৎকার শিক্ষা হয় এবং এভাবে পৃষ্ঠের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিপুল পরিবর্তন এবং সময়ের অতিবাহন—সবগুলিই একই তুষারযুগের অন্তর্ভুক্ত স্মরণ করলেও চমৎকার শিক্ষা হয়, তথাপি পৃথিবীর যে-কোন অংশে জীবাশ্ম পরিপূর্ণ পাললিক পলিসঞ্চয় এই যুগের সব সময়ে একই অঞ্চলে সঞ্চিত (পুঞ্জীভূত) হয়েছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি সম্ভবপর নয় যে মিসিসিপি নদীর মুখের নিকট গভীরতার ঐ সীমার মধ্যে, যেখানে সামুদ্রিক প্রাণীরা প্রবলভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সমগ্র তুষারযুগের সময় পলি সঞ্চিত হয়েছিল : কারণ আমরা জানি যে এই সময়ে আমেরিকার অন্য অংশগুলিতে বিরাট ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছিল। মিসিসিপি নদীর মুখে অগভীর জলে তুষারযুগের কোন সময়ে সঞ্চিত এরূপ পলিস্তরগুলো যখন উত্থিত হয়ে থাকবে, তখন জীবাশ্মগুলো প্রজাতির বিচরণের জন্য এবং ভৌগোলিক পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন স্তরে সম্ভবত প্রথমে আবির্ভূত এবং তিরোহিত হয়ে থাকবে। এবং অদূর ভবিষ্যতে, এইসব স্তর পরীক্ষা করে একজন ভূতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত করতে প্রলোভিত হবেন যে ভূস্তরের জীবাশ্মের জীবনের গড় স্থায়িত্ব আরও বিরাট হওয়ার পরিবর্তে অর্থাৎ তুষারযুগের পূর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত তুষারযুগের স্থায়িত্বের তুলনায় কম হয়েছিল। 

একই স্তরসংঘের ওপর এবং নিচের অংশে দুটি আকারের মধ্যে একটি নিখুঁত পর্যায়ক্রম পাওয়ার জন্য, দীর্ঘ যুগ ধরে পলিসঞ্চয়ন চলে থাকবে, যা রূপান্তরের মন্থর প্রক্রিয়ার পক্ষে যথেষ্ট; অতএব পলিসঞ্চয়ন নিশ্চয় অতি গভীর হবে; এবং সমগ্র সময় জুড়ে একই জেলায় পরিবর্তনশীল প্রজাতিরা বসবাস করে থাকবে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে সমস্ত গভীরতায় জীবাশ্ম দ্বারা পরিপূর্ণ একটি স্তরসংঘ অবনমনের সময় শুধু সঞ্চিত হতে পারে, এবং গভীরতাটিকে প্রায় একই রাখার জন্য, যা প্রয়োজনীয় হয় এই জন্য যে একই সামুদ্রিক প্রজাতিরা একই জায়গায় বাস করতে পারে, পলির যোগান অবনমনের পরিমাণের সঙ্গে প্রায় সমতাপূর্ণ হবে। অবনমনের এই একই চলন অঞ্চলটিকে প্লাবিত করার পক্ষে প্রবণ হবে, যেখান থেকে পলি উদ্ভূত হয়, এবং এভাবে যোগান হ্রাস করবে, অন্যথায় যখন নিচের দিকে চলন অনবরত ঘটতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পলির যোগান এবং অবনমনের পরিমাণটির মধ্যে প্রায় সমতা সম্ভবত একটি আকস্মিক বিরল ঘটনা, কারণ একাধিক জীবাশ্মবিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছেন যে অতি গভীর পলিসঞ্চয়ের মধ্যে জীবাশ্ম প্রায় থাকে না, শুধুমাত্র ওপর এবং নিচের সীমানা ছাড়া। 

মনে হতে পারে যে যে-কোন দেশের সামগ্রিক স্তরসংঘের প্রত্যেক ভিন্ন গঠনস্তরের সঞ্চয়ন সাধারণতঃ সবিরাম হয়েছে। ঘটনাটি প্রায়শই এরকম হয়—যখন আমরা ব্যাপকভাবে ভিন্ন খনিজ পদার্থে পরিপূর্ণ একটি ভূস্তর দেখি, তখন আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই সন্দেহ করতে পারি যে পলিসঞ্চয়ন প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিক নয়। অথবা একটি গঠনস্তর ভালভাবে পরীক্ষা করার পর পলিসঞ্চয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় সম্পর্কে কোন ধারণা আমাদের হয় না। স্তরসংঘের ছোট স্তরসমূহ কয়েক ফুট গভীর হয় এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এবং যেগুলি অন্যত্র হাজার হাজার ফুট গভীর হয় এবং যাদের সঞ্চয়নের জন্য বিরাট সময়ের প্রয়োজন হয়; তথাপি এ বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ কেউও সন্দেহ করবে না যে অগভীর স্তরসংঘের জন্য দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেখানে নিচের স্তরসমষ্টি ওপরে উঠেছিল, নগ্ন হয়েছিল, জলপ্লাবিত হয়েছিল এবং তারপর একই স্তরসংঘের ওপরের স্তরগুলো দ্বারা পুনরুন্নীত হয়েছিল। সহজেই উপেক্ষণীয় তথ্যগুলো দেখায় যে এদের সঞ্চয়নের বা পুঞ্জীভবনের জন্য কত ব্যাপক বিরামকাল দরকার। অন্য ঘটনাগুলোতে, যেমন বিশাল জীবাশ্ম-গাছ তখনও পর্যন্ত পূর্বের মতই সোজাভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার সময় পৃষ্ঠের পরিবর্তনের এবং বিরাট সময়ের প্রয়োজনের সরলতম সাক্ষ্য পেয়েছি। বৃক্ষ সংরক্ষিত না হলে এ ধারণাটি আমাদের ভাবনায় আসতই না এভাবে স্যার সি. লিয়েল এবং ডঃ ডসন নোভা স্কটিয়াতে আদিম উদ্ভিদের শিকড়পূর্ণ ছোট স্তর সমেত ১৪০০ ফুট গভীর কার্বনিফেরাস স্তর আবিষ্কার করেছিলেন, ছোট স্তরসমূহ কমপক্ষে আটষট্টিটি বিভিন্ন তলে একটির ওপর একটি এভাবে বিভক্ত ছিল। সুতরাং যখন একই প্রজাতি একটি স্তরসংঘের নিচের, মধ্যের এবং ওপরের স্তরে থাকে, তখন সম্ভাবনাটি হচ্ছে যে সঞ্চয়নের সমগ্র যুগে একই জায়গায় এরা বসবাস করেনি, কিন্তু একই ভূতাত্ত্বিক যুগে সম্ভবত অসংখ্যবার অদৃশ্য বা পুনরাবির্ভূত হয়েছে। ফলস্বরূপ যে-কোন একটি ভূতাত্ত্বিক স্তরসংঘের সঞ্চয়নের সময় যদি একটি বিশেষ পরিমাণে একে রূপান্তরিত হতে হয়, তাহলে একটি বিভাগ সমস্ত সূক্ষ্ম মধ্যবর্তী ক্রমপর্যায়কে অন্তর্ভুক্ত করতে যথেষ্ট হবে না, যেগুলো আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী নিশ্চয়ই অবস্থান করে থাকবে, তাহলেও আকারের আকস্মিক অথচ সম্ভবত অল্প পরিবর্তন ঘটেছে। 

এটি স্মরণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রকৃতিবিদদের হাতে এমন কোন শ্ৰেষ্ঠ নিয়ম নেই যার দ্বারা প্রজাতি এবং ভ্যারাইটির পার্থক্য করা যায়; তাঁরা প্রত্যেক প্রজাতির অল্প পরিমাণ পরিবর্তন স্বীকার করেন, কিন্তু যখন তাঁরা যে-কোন দুটি আকারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য দেখেন, তখন এদের উভয়কেই প্রজাতি হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা এদের ঘনিষ্ঠ মধ্যবর্তী ধাপগুলো দ্বারা যুক্ত করতে সমর্থ হন; এবং একটু আগে কারণটি নির্দিষ্ট করা থেকে আমরা কদাচিৎ আশা করতে পারি যে এটি যে-কোন একটি ভূস্তরে ঘটে। মনে করা যাক খ ও গ নামে দুটি প্রজাতি, এবং ক নামে তৃতীয় একটি প্রজাতিকে পুরানো এবং নিচের স্তরে পাওয়া গেছে; এমনকি যদি ক সঠিকভাবে খ এবং গ-এর মধ্যবর্তী হয়, তাহলেও একে একটি তৃতীয় প্রবং ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত হবে, যতক্ষণ না একই সময়ে হয় একটি অথবা উভয় আকারের সঙ্গে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের দ্বারা একে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করা যেতে পারে। অথবা আগের ব্যাখ্যা মত এটি ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ক, খ এবং গ-এর প্রকৃতপক্ষে জন্মদাতা হতে পারত এবং তথাপি এটি সব বিষয়ে এদের মধ্যে যথাযথভাবে মধ্যবর্তী হবে না। সুতরাং আমরা পিতামাতা প্রজাতি পেতে পারতাম এবং একই ভূস্তরের ওপর এবং নিচের স্তর থেকে কতিপয় রূপান্তরিত বংশধর পেতে পারতাম, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা অসংখ্য সংক্রমণগত ধাপ পেতাম, ততক্ষণ আমরা এদের রক্তসম্পর্ক নির্ণয় করতে পারতাম না এবং ফলস্বরূপ এদের ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতাম। 

এটি সর্বজনবিদিত যে অতি অল্প পার্থক্যের ওপর অনেক জীবাশ্মবিজ্ঞানী তাঁদের প্রজাতিগুলোকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; এবং তাঁরা নির্দ্বিধায় এটি করেন যদি নমুনাগুলো একই ভূগঠনস্তরের বিভিন্ন উপধাপ থেকে আসে। কয়েকজন অভিজ্ঞ শঙ্খবিদ্যাবিদ ডি. অবিগনি-র অসংখ্য অতি সূক্ষ্ম প্রজাতিকে ও অন্যদেরকে এখন ভ্যারাইটিদের শ্রেণীতে অবনত করেছেন; এবং এই মতবাদ অনুসারে পরিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণ আমরা লক্ষ্য করি, যেগুলো তত্ত্বটি অনুযায়ী আমাদের পাওয়া উচিত। পরবর্তীকালের টার্শিয়ারি যুগের প্রাণী—খোলক সম্বলিত পলিসঞ্চয়গুলোর দিকে পুনরায় লক্ষ্য করুন। অধিকাংশ প্রকৃতিবিদ বিশ্বাস করেন যে এরা এখনকার প্রজাতিদের সমরূপ; কিন্তু কয়েকজন দক্ষ প্রকৃতিবিদ, যেমন আগাসি ও পিকটেট মনে করেন যে এইসব টার্শিয়ারি প্রজাতিরা বিশেষভাবে ভিন্ন, যদিও স্বীকার করা হয় যে পার্থক্যগুলো অতি অল্প; যদি না আমরা বিশ্বাস করি যে বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ্রা তাঁদের কল্পনায় বিপথে পরিচালিত হয়েছেন এবং এই সকল পরের টার্শিয়ারি যুগের প্রজাতিরা এখনকার জীবন্ত প্রতিনিধিদের থেকে কোন পার্থক্য উপস্থিত করে না, অথবা, অধিকাংশ প্রকৃতিবিদদের বিচারের বিরুদ্ধে যদি না আমরা স্বীকার করি যে এইসব টার্শিয়ারি প্রজাতিরা এখনকার প্রজাতিদের তুলনায় স্পষ্টতই ভিন্ন, তাহলে এর থেকে প্রয়োজনীয় অল্প রূপান্তর ঘটার সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে আছে। বরং যদি আমরা ব্যাপকতর সময়ের ব্যবধানে, একই বিরাট ভূগঠনস্তরের স্পষ্ট অথচ ধারাবাহিক ধাপগুলোর দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা আরও দেখি যে ভূস্তরে শায়িত জীবাশ্মগুলো যদিও সার্বজনীন ও বিশেষভাবে ভিন্ন হিসাবে শ্রেণীভুক্ত, তথাপি আরও ব্যাপকভাবে পৃথকীকৃত ভূস্তরগুলোতে পরিলক্ষিত প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়; অতএব এখানে পুনরায় তত্ত্বটির পক্ষে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সন্দেহাতীত সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের আছে; কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমি পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব। 

প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে, যারা দ্রুতহারে বংশবিস্তার করে এবং বেশী ঘুরে বেড়ায় না, যাদের সম্পর্কে আমরা আগে বলেছি, সন্দেহ করার যুক্তি আছে যে এদের ভ্যারাইটিরা প্রথমে স্থানীয় হয়; এরূপ স্থানীয় ভ্যারাইটিরা ব্যাপক হারে বিস্তারলাভ করে না এবং যতক্ষণ না এরা কিছু বিশেষ মাত্রায় রূপান্তরিত এবং নিখুঁত হয়, ততক্ষণ নিজেদের পিতামাতা আকারদের স্থানচ্যুত করে না। এই মতানুসারে যে-কোন দুটি আকারের মধ্যে সমস্ত প্রাথমিক সংক্ৰমণগত ধাপ যে-কোন দেশে একটি ভূগঠনস্তরে আবিষ্কার করার সম্ভাবনা অতি অল্প, কারণ পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনসমূহ স্থানীয় অথবা কোন একটি স্থানে সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ সামুদ্রিক প্রাণীর বিস্তার অধিক; এবং আমরা দেখেছি যে ব্যাপকভাবে বিস্তারক্ষম উদ্ভিদরা প্রায়শই ভ্যারাইটির জন্ম দেয়; সুতরাং খোলকী এবং অন্য সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে, এটি সম্ভবপর যে ইউরোপে জানা ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তরগুলোর সীমা অতিক্রম করে যায় এমন ব্যাপকভাবে বিস্তারক্ষম প্রাণীরা প্রথমে প্রায়শই স্থানীয় ভ্যারাইটির জন্ম দেয় এবং অবশেষে নূতন প্রজাতিদের উদ্ভব ঘটায়; এবং এটি আবার যে-কোন একটি ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তরে সংক্রমণগত ধাপসমূহ চিহ্নিত করার ব্যাপারে আমাদের সামর্থ্যের সম্ভাবনাকে প্রবলভাবে হ্রাস করবে। 

একই ফলপ্রাপ্ত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ডঃ ফ্যালকনার সম্প্রতি জোরের সঙ্গে বলেছেন যে প্রত্যেক প্রজাতির রূপান্তরিত হওয়ার সময়কালটি, যদিও বছর দ্বারা মাপলে দীর্ঘ হয়, এর অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকার সময়কালের তুলনায় সম্ভবত কম ছিল। 

ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে বর্তমানের নিখুঁত নমুনাগুলো থেকে দুটি আকারকে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটি দ্বারা কদাচিৎ সংযুক্ত করা যেতে পারে এবং যতদিন না অনেক জায়গা থেকে অনেক নমুনা সংগৃহীত হয়, ততদিন এদেরকে এরূপে একই প্রজাতি হিসেবে প্রমাণ করা যেতে পারে; এবং জীবাশ্ম প্রজাতিদের ক্ষেত্রে এটি কদাচিৎ করা যেতে পারে; উদাহরণস্বরূপ, অদূর ভবিষ্যতে ভূবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারবেন কি যে, গোমহিষাদি, ভেড়া, ঘোড়া এবং কুকুরদের বিভিন্ন জাতসমূহ একটি একক উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে অথবা কতিপয় উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে; অথবা উত্তর আমেরিকার সমুদ্র উপকূলে বসবাসকারী কতিপয় সামুদ্রিক খোলকী প্রাণীরা প্রকৃতই ভ্যারাইটি কিনা অথবা বিশেষভাবে ভিন্ন কিনা, যেগুলিকে কোন কোন শঙ্খবিদ্যাবিদ এদের ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের থেকে ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে এবং অন্য শঙ্খবিদ্যাবিদরা ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। এগুলো সম্বন্ধে নিজেদের প্রশ্ন করে অসংখ্য, সূক্ষ্ম, মধ্যবর্তী জীবাশ্ম সংযোজকসমূহ দ্বারা প্রজাতিদের যুক্ত করতে আমাদের অসমর্থতার সম্ভাবনা আমরা বোধহয় অনুভব করব। জীবাশ্ম অবস্থায় অসংখ্য মধ্যবর্তী সংক্ৰমণগত ধাপসমূহ আবিষ্কার করে ভবিষ্যতের ভূবিজ্ঞানী এটি ঘটাতে পারবেন; এবং এক্ষেত্রে সাফল্য লাভ অতি মাত্রায় অসম্ভব! 

প্রজাতিদের অপরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞরা বারংবার জোরের সঙ্গে বলেছেন যে ভূবিদ্যা কোন সংযোজক আকারের সন্ধান দেয় না। এই বক্তব্যটি অবশ্যই ভুল, যা আমরা পরের অধ্যায়ে দেখব। যেমন স্যার জে. লুবক মন্তব্য করেছেন, “প্রত্যেক প্রজাতি হচ্ছে অন্য সম্পর্কিত আকারদের একটি সংযোজক।” যদি আমরা জীবিত ও বিলুপ্ত এককুড়ি প্রজাতি সম্বলিত একটি গণকে নিই এবং তাদের পাঁচভাগের চারভাগ বিনষ্ট করি, তাহলে কেউ সন্দেহ করবে না যে অবশিষ্টগুলো পরস্পরের থেকে আরও বেশী ভিন্ন হবে। যদি গণটির প্রান্তিক আকারসমূহ এরূপে বিনষ্ট হয়, তাহলে গণটি অন্য সম্পর্কিত গণগুলোর থেকে আরও বেশী ভিন্ন হবে। ভূতাত্ত্বিক গবেষণা যা প্রকাশ করে না তা হচ্ছে অসংখ্য সংক্ৰমণগত ধাপগুলোর পূর্বে অবস্থান, যা জীবিত ভ্যারাইটিদের মত এত সূক্ষ্ম হয় এবং সমস্ত জীবিত ও বিলুপ্ত প্রাজাতিদের একত্রে সংযুক্ত করে। কিন্তু এটি আশা করা উচিত হবে না; তবুও আমার মতবাদের বিরুদ্ধে এটি একটি অতি গুরুতর আপত্তি হিসেবে বারংবার উত্থাপিত হয়েছে। 

ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অপূর্ণাঙ্গতার কারণ সম্পর্কে একটি কল্পিত উদাহরণে পূর্ববর্তী মন্তব্যগুলোকে সংক্ষেপে বলা সময়োপযোগী হতে পারে। মালয় দ্বীপপুঞ্জ উত্তর অন্তরীপ থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এবং ব্রিটেন থেকে রাশিয়া পর্যন্ত ইউরোপের আকারের প্রায় সমান; সুতরাং এটি সঠিকভাবে পরীক্ষিত সমস্ত ভূতাত্ত্বিক স্তরসমষ্টির সমান—একমাত্র ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা ছাড়া। মিঃ গডউইন-অস্টেনের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণরূপে একমত যে ব্যাপক এবং অগভীর সমুদ্র দ্বারা পৃথকীকৃত অসংখ্য বিরাট দ্বীপ সম্বলিত মালয় দ্বীপপুঞ্জের বর্তমান অবস্থা সম্ভবত ইউরোপের পূর্বাবস্থাকে সূচিত করে, যখন আমাদের অধিকাংশ স্তরসংঘ সঞ্চিত হচ্ছিল। মালয় দ্বীপপুঞ্জ অসংখ্য প্রাণী এবং উদ্ভিদে পরিপূর্ণ একটি সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল; তথাপি ঐ স্থানে একদা বসবাসকারী সব প্রজাতি সংগৃহীত হলে, তারা নিতান্তই অসম্পূর্ণরূপে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ইতিহাস তুলে ধরত। 

কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে দ্বীপপুঞ্জের স্থলভাগের উৎপাদন—সমূহ আমাদের অনুমানে পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত হচ্ছে এমন স্তরসংঘে নিতান্তই অসম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত হবে। অনেক যথাযথ উপকূলবর্তী প্রাণী অথবা নগ্ন নিমজ্জিত পাথরে বসবাসকারী অনেক প্রাণী ভূস্তরে চাপা পড়বে না, এবং বালি ও নুড়ির মধ্যে চাপাপড়া প্রাণীরা দীর্ঘস্থায়ী “হবে না। সমুদ্রের তলদেশে যখন পলি সঞ্চিত হয়নি অথবা জৈব জীবদের ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট হারে এটি যেখানে সঞ্চিত হয়নি, সেখানে কোন জীবাশ্ম সংরক্ষিত হতে পারত না। 

অতীতের গৌণ স্তরসমষ্টির মত অদূর ভবিষ্যতের একটি যুগ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার জন্য যথেষ্ট গভীরতার এবং অনেক ধরনের জীবাশ্মপূর্ণ স্তরসংঘ দ্বীপপুঞ্জে শুধুমাত্র অবনমনের সময়কালেই সাধারণত সৃষ্টি হবে। অবনমনের এইসব সময়কাল বিরাট সময়ের ব্যবধানের দ্বারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। এই সময় অঞ্চলটি হয় স্থির থাকবে, না হয় উঠতে থাকবে; উত্থানের সময় খাড়া তটভূমির জীবাশ্ম পরিপূর্ণ স্তরসমষ্টি প্রায় সঞ্চয়নের মুহূর্তেই অবিরাম উপকূল-প্রক্রিয়ার দ্বারা বিনষ্ট হবে; যেমন আমরা এখন দক্ষিণ আমেরিকার তটভূমিতে দেখি। দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এমনকি বহু বিস্তৃত এবং অগভীর সমুদ্রসমূহে পাললিক স্তরসমূহ উত্থানের যুগে বিরাট গভীরতায় কদাচিৎ সঞ্চিত হতে পারবে অথবা অদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার জন্য পরবর্তী সঞ্চয়নের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং সংরক্ষিত হবে। অবনমনের কালে সম্ভবত অনেক জীব বিলুপ্ত হবে; উত্থানের কালে অনেক পরিবর্তন হবে, কিন্তু তখন ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ কম নিখুঁত হবে। 

দ্বীপপুঞ্জের সব জায়গায় অথবা কিছু অংশে পলির একটি সমকালীন পুঞ্জীভবনের সঙ্গে একত্রে অবনমনের যে-কোন একটি বিরাট কালের স্থায়িত্ব একই প্রজাতিক আকারদের গড় স্থায়িত্বকে অতিক্রম করবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে এবং যে-কোন দুটি অথবা ততোধিক প্রজাতির মধ্যে সমস্ত সংক্রমণগত ধাপ সংরক্ষণের জন্য এইসব অনিশ্চিত সম্ভাবনা অপরিহার্য। এই সংক্রমণগত ধাপগুলোর প্রতিটি সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত না হলে সংক্রমণগত ভ্যারাইটিরা অসংখ্য নতুন অথচ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কীয় প্রজাতি হিসেবেই শুধু গণ্য হবে। এটি আরও সম্ভবপর যে অবনমনের প্রত্যেক বিরাট কাল তলের স্পন্দনগুলোর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে এবং জলবায়ুগত অল্প পরিবর্তন এই দীর্ঘ সময়কালে হস্তক্ষেপ করবে; এবং এইসব ক্ষেত্রে দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা বিচরণ (মাইগ্রেট) করবে এবং এদের রূপান্তরসমূহের ঘনিষ্ঠ ধারাবাহিক সাক্ষ্যপ্রমাণ কোন একটি স্তরে সংরক্ষিত হতে পারবে না। 

দ্বীপপুঞ্জের অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী তাদের এখনকার সীমানার বাইরে কয়েক হাজার মাইল পর্যন্ত বিচরণ করে। এবং কিছু উপমা আমাদের এই বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায় যে যদিও কয়েকটি, মূলতঃ এইসব বহুবিস্তৃত প্রজাতিরা প্রায়শই নতুন ভ্যারাইটিদের সৃষ্টি করবে এবং ভ্যারাইটিরা প্রথমে স্থানীয় হবে অথবা একই স্থানে সীমাবদ্ধ থাকবে, তথাপি যদি তারা কোন স্পষ্ট সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয় অথবা যখন আরও রূপান্তরিত এবং উন্নত হয়, তখন এরা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করবে এবং নিজেদের পিতামাতা আকারদের স্থানচ্যুত করবে। যখন এই ভ্যারাইটিরা তাদের আদিম বাসস্থানে ফিরে আসবে, যেহেতু এরা এদের পূর্ব অবস্থা থেকে একইরূপে অথচ সম্ভবত অতি অল্প মাত্রায় পৃথক হবে, এবং যেহেতু এদের একই স্তরসংঘের অল্প ভিন্ন বিভিন্ন উপস্তরগুলোতে প্রোথিত অবস্থায় পাওয়া যাবে, সেহেতু অনেক জীবাশ্মবিদের দ্বারা অনুসৃত নীতি অনুসারে এরা নূতন এবং ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে গণ্য হবে। 

এইসব বক্তব্যে যদি কিছু পরিমাণ সত্যতা থাকে, তাহলে আমাদের ভূতাত্ত্বিক স্তরসমষ্টিতে ঐ-সব অসংখ্য সূক্ষ্ম সংক্রমণগত আকারদের আবিষ্কারের আশা করার কোন অধিকার আমাদের নেই, যেগুলো আমাদের তত্ত্বানুযায়ী একই গোষ্ঠীর সমস্ত অতীত ও বর্তমান প্রজাতিদের জীবনের একটি দীর্ঘ এবং শাখাবহুল শৃংখলে সংযুক্ত করেছে। শুধুমাত্র কতিপয় সংযোজক আমাদের খোঁজা উচিত, এবং আমরা নিশ্চয় তা পাব—কয়েকটি আরও দূরবর্তী, কয়েকটি আরও ঘনিষ্ঠরূপে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত; এবং এইসব সংযোজক, যতই ঘনিষ্ঠ হোক না কেন, যদি একই স্তরসংঘের বিভিন্ন ধাপে পাওয়া যায়, তাহলে অনেক জীবাশ্মবিদ এদের ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে গণ্য করবেন। কিন্তু আমি দাবী করি না যে সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত ভূতাত্ত্বিক স্তরসংঘের সাক্ষ্যপ্রমাণ কত ত্রুটিপূর্ণ ছিল তা আমি কখনও ভাবতাম, যদি না প্রত্যেক স্তরসংঘের শুরুতে এবং শেষে বসবাসকারী প্রজাতিদের মধ্যে অসংখ্য সংক্রমণগত সংযোজকদের অনুপস্থিতি এত কঠোরভাবে আমার তত্ত্বের ওপর চাপ দিত। 

সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীর হঠাৎ আবির্ভাব 

কোন কোন স্তরসমষ্টিতে প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীদের হঠাৎ আবির্ভাবের আকস্মিক পদ্ধতিটিকে আগাসি, পিকটেট এবং সেজউইকের মত কয়েকজন জীবাশ্মবিজ্ঞানী, প্রজাতির পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসে একটি গুরুতর আপত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। একই গণ অথবা গোত্রের অন্তর্গত অসংখ্য প্রজাতি যদি প্রকৃতই হঠাৎ জীবন শুরু করে, তাহলে ঘটনাটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্বটির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক হবে। কারণ আকারদের একটি গোষ্ঠীর কোন এক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হওয়ার এই পদ্ধতিতে বিবর্তন নিশ্চয় অতি মন্থর প্রক্রিয়া হবে এবং তদনুযায়ী পূর্বপুরুষরা এদের রূপান্তরিত বংশধরদের বহুপূর্বে নিশ্চয় জীবিত ছিল। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের নিখুঁততায় আমরা অনবরত বেশী গুরুত্ব আরোপ করি, এবং ভুলবশতঃ সিদ্ধান্ত করি যে এরা ঐ স্তরে আগে বসবাস করত না, কারণ কোন কোন গণ অথবা গোত্রকে একটি নির্দিষ্ট স্তরের নিচে পাওয়া যায়নি। এইসব ক্ষেত্রে স্পষ্ট জীবাশ্মমূলক সাক্ষ্যপ্রমাণকে পরোক্ষভাবে স্বীকার করা যেতে পারে; অনস্তিত্বের সাক্ষ্য প্রমাণ অর্থহীন হয়, যেমনটা অভিজ্ঞতায় প্রায়শই দেখা যায়। আমরা অনবরত ভুলে যাই যে যত্নসহকারে পরীক্ষিত ভূতাত্ত্বিক স্তরসংঘ সম্বলিত অঞ্চলটির তুলনায় পৃথিবী কত বিরাট; আমরা ভুলে যাই যে প্রজাতিদের গোষ্ঠীগুলো ইউরোপ এবং ইউনাইটেড স্টেটস-এর প্রাচীন দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশের পূর্বে অন্যত্র দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে। সময়ের ব্যবধান আমরা বিবেচনা করি না, যা আমাদের ধারাবাহিক স্তরসমষ্টি গঠনে অতিবাহিত হয়েছে—অনেক ক্ষেত্রে ব্যবধানটি সম্ভবত প্রত্যেক গঠনস্তরের পুঞ্জীভবনের বা সঞ্চয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে দীর্ঘতর। এই ব্যবধানগুলি কোন একটি পিতামাতা আকার থেকে প্রজাতিদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সময় প্রদান করে থাকবে এবং পরবর্তী গঠনস্তরে এরূপ গোষ্ঠী অথবা প্রজাতিরা আবির্ভূত হবে যেন মনে হবে তারা হঠাৎ সৃষ্ট হয়েছে। 

এখানে আমি আগের একটি অভিমত স্মরণ করতে পারি। অভিমতটি হচ্ছে—বাতাসে ওড়ার মত কোন নূতন ও অদ্ভুত জীবনাবস্থায়, একটি জীবের অভিযোজিত হওয়ার জন্য দীর্ঘ ধারাবাহিক সময়ের প্রয়োজন হতে পারে; এবং ফলস্বরূপ সংক্রমণগত আকাররা কোন একটি অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে; কিন্তু যখন এই অভিযোজন একবার কার্যকরী হয়, তখন কতিপয় প্রজাতি অন্য জীবদের উপর এমন বিপুল প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যাতে অনেক বিচিত্র আকার সৃষ্টির জন্য তুলনামূলকভাবে অল্প সময় প্রয়োজন হবে, এরপর ঐ আকার সমগ্র পৃথিবীব্যাপী দ্রুতহারে এবং ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পাখিদের দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে এই গবেষণার চমৎকার পুনর্মূল্যায়ন করার সময়, সংক্রমণ বা উত্তরণগত আকারদের সম্বন্ধে বক্তব্য বলতে গিয়ে অধ্যাপক পিকটেট দেখতে পান না যে একটি কল্পিত আদিরূপের সামনের দিকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর পর্যায়ক্রমিক রূপান্তরসমূহ কেমন করে লাভজনক হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ মহাসমুদ্রের পেঙ্গ ইনদের লক্ষ্য করুন; এইসব পাখিদের সম্মুখের অঙ্গগুলি “প্রকৃত বাহুও নয় অথবা প্রকৃত পাখনাও নয়”–এরূপ মধ্যবর্তী অবস্থায় নেই কি? তা সত্তেও এই পাখিরা জীবনসংগ্রামে দারুণভাবে জয়ী হয়েছিল; কারণ এরা সংখ্যায় অধিক এবং অনেক ধরনের হয়। আমি মনে করি না যে এখানে আমরা প্রকৃত সংক্রমণগত বা উত্তরণগত ধাপসমূহ দেখি, যেগুলোর মধ্য দিয়ে পাখনাগুলি অতিক্রম করেছে, কিন্তু এটি বিশ্বাস করতে কি বিশেষ অসুবিধা আছে যে পেঙ্গুইনের রূপান্তরিত বংশধরদের পক্ষে প্রথমে আংটা সমেত মাথা সম্বলিত হাঁসের মত সমুদ্রপৃষ্ঠ বরাবর পাখনা ওড়ানোয় সমর্থ হওয়া এবং অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ওপরে ওঠা এবং বাতাসে ভেসে বেড়াতে সমর্থ হওয়াটা লাভজনক হতে পারত? 

আগের বক্তব্যসমূহ ব্যাখ্যা করতে আমি এখন কয়েকটি উদাহরণ দেব এবং দেখাতে চাইবে যে এটি কল্পনা করতে আমরা কত ভুল করতে বাধ্য হই যে প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীগুলি আকস্মিকভাবে সৃষ্ট হয়েছে। জীবাশ্মবিজ্ঞানের ওপর পিকটেটের বিরাট গবেষণামূলক কাজের প্রথম এবং দ্বিতীয় সংস্করণের এত অল্প সময়ের ব্যবধানের মধ্যে, যেগুলো ১৮৪৪-৪৬ এবং ১৮৫৩-৫৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রাণীদের কয়েকটি গোষ্ঠীর প্রথম আবির্ভাব এবং তিরোভাব বা অন্তর্ধান সম্বন্ধে সিদ্ধান্তসমূহ বিশেষভাবে পরিবর্তিত হয়েছে; এবং আরও পরিবর্তনের জন্য একটি তৃতীয় সংস্করণ প্রয়োজন হবে। আমি সুপরিচিত একটি বিষয় স্মরণ করতে পারি যে ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলোতে, যেগুলো অনেক আগে প্রকাশিত হয়নি, টার্শিয়ারি যুগের শুরুতে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিল বলা হয়। এবং এখন জীবাশ্ম স্তন্যপায়ীদের জ্ঞাত সর্বোত্তম সঞ্চয়সমূহের একটি গৌণ শ্রেণীর মধ্যভাগের অন্তর্গত; এবং প্রকৃত স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এই বিরাট গৌণ শ্রেণীর প্রায় শুরুতে নূতন লাল বালিপাথরে আবিষ্কৃত হয়েছিল। কুভিয়ার দাবী করতেন যে টার্শিয়ারি স্তরে কোন বানরের জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি; কিন্তু এখন বিলুপ্ত প্রজাতিরা মায়োসিন উপপর্বের মত এত আগে ভারতবর্ষ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর নূতন বালিপাথরে পায়ের ছাপ সংরক্ষণের বিরল ঘটনা যদি না থাকত, তাহলে কে মনে করতে সাহস করত যে কয়েকটি বিরাট আকার সমেত কমপক্ষে ত্রিশটি বিভিন্ন পাখিসদৃশ প্রাণী ঐ যুগে বেঁচে ছিল? হাড়ের কোন ক্ষুদ্র অংশ এইসব স্তরে আবিষ্কৃত হয়নি। কিছুদিন আগেও জীবাশ্মবিদরা বলতেন যে পাখিদের সমগ্র শ্রেণীটি ইয়োসিন উপপর্বে হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিল; কিন্তু অধ্যাপক ওয়েনের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে আমরা এখন জানি যে উচ্চতর সবুজ বালির সঞ্চয়নের সময় একটি পাখি বসবাস করত; এবং আরও সম্প্রতি টিকটিকির মত লম্বা লেজ, প্রত্যেক গ্রন্থিতে একজোড়া পালক এবং দুটি মুক্ত জোয়াল-যুক্ত পাখনা সমেত আর্কিওপটেরিক্স নামে একটি বিস্ময়কর পাখি সোলেনহোফেন-এর উলিটিক শ্লেটপাথরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটির তুলনায় সাম্প্রতিক কোন আবিষ্কার অধিকতর জোরের সঙ্গে দেখায়নি যে পৃথিবীর প্রাচীন অধিবাসীদের সম্বন্ধে আমরা কত অল্প জানি। 

আমি অন্য একটি উদাহরণ দিতে পারি, যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে এবং আমাকে আশ্চর্যান্বিত করেছে। অশ্মীভূত অনড় বা পদহীন, সিরিপেড নামক প্রাণী সম্পর্কে গবেষণামূলক একটি রচনায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে টার্শিয়ারি পর্বের জীবিত এবং বিলুপ্ত প্রজাতিদের সংখ্যাধিক্য, সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অনেক প্রজাতির এককদের অসাধারণ প্রাচুর্য, মেরু অঞ্চল থেকে বিষুবরেখা পর্যন্ত, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০ ফ্যাদম পর্যন্ত গভীরতার বিভিন্ন বলয়ে বসবাস, প্রাচীনতম টার্শিয়ারি স্তরে নমুনাদের নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ, একটি ভালভের ক্ষুদ্র অংশ সহজেই চিনতে পারা এবং এইসব বিষয়গুলো থাকার কারণে আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে অনড় বা পদহীন সিরিপেড নামক প্রাণীরা যদি মধ্যবর্তী উপপর্বে অবস্থান করত, তাহলে এরা নিশ্চয়ই সংরক্ষিত ও আবিষ্কৃত হত; এবং এই পর্বের স্তরসমূহে যেহেতু একটি প্রজাতিও আবিষ্কৃত হয়নি, তাই আমি সিদ্ধান্ত করেছিলাম যে এই বিরাট গোষ্ঠীটি টার্শিয়ারি পর্বের শুরুতে হঠাৎ উদ্ভূত হয়েছিল। এটি আমার পক্ষে মর্মযন্ত্রণা হয়ে উঠেছিল, কারণ আমি এটিকে প্রজাতিদের একটি বিরাট গোষ্ঠীর হঠাৎ আবির্ভাবের আর একটি উদাহরণ হিসাবে গণ্য করেছিলাম। কিন্তু আমার গবেষণাকাজটি প্রকাশিত হওয়ার সময়, দক্ষ জীবাশ্মবিদ এম. বসকোয়েট অনড় বা পদহীন সিরিপেডের একটি নিখুঁত নমুনার আঁকা ছবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন, যেটি তিনি নিজে বেলজিয়ামের চুনাপাথরে আবিষ্কার করেছিলেন। এবং ঘটনাটি অতি উৎসাহব্যঞ্জক এই কারণে যে এই সিরিপেডটি ছিল একটি চ্যাথাম্যালাস, যেটি হচ্ছে একটি অতি সাধারণ, বিরাট, সর্বব্যাপী গণ, যার একটি প্রজাতিকেও যে-কোন একটি টার্শিয়ারি স্তরে এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আরও সম্প্রতি, অনড় বা পদহীন সিরিপেডদের একটি স্বতন্ত্র উপ-গোত্রের একটি সদস্য পিরগোমা উচ্চতর চুনাপাথর স্তরে মিঃ উডওয়ার্ড দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে; সুতরাং মধ্যবর্তী উপপর্বের এই গোষ্ঠীর প্রাণীদের অবস্থানের যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ এখন আমাদের হাতে আছে। 

প্রজাতিদের একটি সমগ্র গোষ্ঠীর আপাতভাবে হঠাৎ আবির্ভাব প্রসঙ্গে জীবাশ্মবিদদের প্রায়শই জোরের সঙ্গে বলার একটি ঘটনা হচ্ছে যে আগাসির মতানুসারে সস্থি (টেলিওস্টিয়ান) মাছরা চুনাপাথর উপপর্বে আবির্ভূত হয়েছিল। বর্তমানের অধিকাংশ জীবিত প্রজাতি এই গোষ্ঠীটির অন্তর্গত। কিন্তু এখন স্বীকার করা হয় যে কোন কোন জুরাসিক এবং ট্রায়াসিক আকার সস্থিযুক্ত টেলিওস্টিয়ান; এবং এমনকি একজন বড় বিশেষজ্ঞ কোন কোন পুরাজীবীয় আকারকে এইরূপ শ্রেণীভুক্ত করেছেন। সস্থি (টেলিওস্টিয়ান) মাছরা যদি প্রকৃতই চুনাপাথর উপপর্বের শুরুতে উত্তর গোলার্ধে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে ঘটনাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য; কিন্তু এটি কোন অনতিক্রম্য বাধা হয়ে থাকবে না, যতদিন না দেখানো যেতে পারে যে একই যুগে প্রজাতিরা পৃথিবীর অন্য অংশে হঠাৎ এবং যুগপৎ উদ্ভূত হয়েছিল। এটি বলা নিরর্থক যে কোন অশ্মীভূত মাছ বিষুবরেখার দক্ষিণে কদাচিৎ পাওয়া যায়; এবং পিকটেটের প্রত্নজীববিদ্যা সংক্রান্ত রচনায় চোখ বোলালে দেখা যাবে যে অল্প কয়েকটি প্রজাতিকে ইউরোপের কতিপয় ভূ-স্তরে পাওয়া গেছে। মাছের কয়েকটি গোত্রের বিস্তার এখন সীমাবদ্ধ; সস্থি মাছেদের বিস্তার পূর্বে একইরূপে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, এবং কোন একটি সমুদ্রে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এরা দারুণভাবে বিস্তৃত হয়েছে। অথবা আমাদের মনে করার কোন অধিকার নেই যে পৃথিবীর সমুদ্রগুলো দক্ষিণ থেকে উত্তর পর্যন্ত বর্তমানের মত সবসময় এত খোলাখুলিভাবে যুক্ত থেকেছে। এমনকি আজকেও, মালয় দ্বীপপুঞ্জকে স্থলভাগে রূপান্তরিত করা হলে ভারত মহাসাগরের উষ্ণ অঞ্চলটি একটি বিরাট এবং সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত অববাহিকায় পরিণত হবে, যেখানে সামুদ্রিক প্রাণীদের যে-কোন গোষ্ঠী সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে; এবং এরা এখানে আবদ্ধ হয়ে থাকবে, যতক্ষণ না কতিপয় প্রজাতি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অভিযোজিত হয় এবং আফ্রিকার অথবা অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অন্তরীপে দ্বিগুণ হয়ে উঠতে সমর্থ হয় এবং এভাবে অন্য ও দূরবর্তী সমুদ্রগুলিতে পৌঁছায় 

এইসব বিচার-বিশ্লেষণের পর, ইউরোপ এবং ইউনাইটেড স্টেটস-এর বাইরে অন্য দেশগুলোর ভূতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার জন্য এবং গত বারো বছর ধরে আবিষ্কারের ফলে জীবাশ্মমূলক জ্ঞানে বিপ্লব আসার জন্য, আমার মনে হয় যে সারা পৃথিবীর জৈব আকারদের পর্যায়ক্রম সম্পর্কে অন্ধভাবে যুক্তি প্রদর্শন যেমন হঠকারী হবে, অস্ট্রেলিয়ার অনুর্বর ভূমিতে একজন প্রকৃতিবিদের পাঁচ মিনিটের জন্য পদার্পণ এবং তারপর সেখানকার উৎপাদনসমূহের সংখ্যা এবং বিস্তার সম্পর্কে আলোচনা করাও তেমনই হঠকারী কাজ হবে। 

জ্ঞাত সর্বনিম্ন জীবাশ্মপূর্ণ স্তরে সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের গোষ্ঠীগুলির হঠাৎ আবির্ভাব 

এখানে অন্য একটি ও সম্পর্কযুক্ত প্রতিবন্ধক রয়েছে, যেটি আরও বেশী গুরুতর। আমি পরোক্ষভাবে উপায়গুলি উল্লেখ করি যার দ্বারা প্রাণীজগতের প্রধান বিভাগগুলির কয়েকটির অন্তর্গত প্রজাতিরা জ্ঞাত সর্বনিম্ন জীবাশ্মপূর্ণ শিলাগুলিতে হঠাৎ আবির্ভূত হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস উৎপাদন করা অধিকাংশ যুক্তি হচ্ছে যে একই গোষ্ঠীর জীবিত সমস্ত প্রজাতি শুধুমাত্র একজন পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এটি আমাদের জানা আগের প্রজাতিদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ, এটি সন্দেহ করা যেতে পারে না যে ক্যামব্রিয়ান এবং সিলুরিয়ান পর্বের সমস্ত ট্রাইলোবাইট প্রাণীরা কোন একটি খোলকী (ক্রাস্টেসিয়ান) প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যারা ক্যামব্রিয়ান পর্বের বহু পূর্বে নিশ্চয় বসবাস করে থাকবে এবং যারা কোন জানা প্রাণীর থেকে সম্ভবত ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়ে থাকবে। সবচেয়ে আদিম প্রাণীদের কয়েকটি, যেমন নটিলাস, লিংগুলা ইত্যাদিরা বর্তমানের প্রজাতিগুলোর থেকে 

ভিন্ন নয়; এবং আমার তত্ত্ব অনুযায়ী মনে করা যেতে পারে না যে এইসব আদিম প্রজাতিরা একই গোষ্ঠীর অন্তর্গত সমস্ত প্রজাতিদের পূর্বপুরুষ ছিল, যারা পরবর্তী সময়ে আবির্ভূত হয়েছে, কারণ এরা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে কোন মাত্রায় মাঝামাঝি নয়। 

ফলস্বরূপ, তত্ত্বটি সত্য হলে, এটি তর্কাতীত হয়ে ওঠে যে সর্বনিম্ন ক্যামব্রিয়ান স্তরের সঞ্চয়নের পূর্বে বিরাট যুগ অতিবাহিত হয়েছিল, যুগটি ক্যামব্রিয়ান পর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়ের সমান অথবা সম্ভবত আরও দীর্ঘতর; এবং বিরাট যুগগুলিতে সমগ্র পৃথিবী জীবন্ত জীব দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। এখানে আমরা একটি তীব্র আপত্তির সম্মুখীন হই; কারণ জীবন্ত জীবদের বসবাসের উপযুক্ত অবস্থায় পৃথিবী দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। স্যার ডব্লিউ. থমসন সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে ভূত্বক ২০-র কম অথবা ৪০০ মিলিয়নের চেয়ে বেশী বছর পূর্বে কদাচিৎ ঘনীভূত হতে পেরেছে, কিন্তু ঘটনাটি সম্ভবত ৯৮ বছরের কম নয় এবং ২০০ মিলিয়নের চেয়ে বেশী নয় এমন বছর ধরে ঘটেছে। এইসব ব্যাপক সীমা দেখায় উপাত্তগুলো কত সন্দেহজনক; এবং অন্য উপাদানগুলো এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারে। মিঃ ক্রল হিসেব করে দেখিয়েছেন যে ক্যামব্রিয়ান পর্ব থেকে প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু তুষারযুগের শুরু থেকে অল্প পরিমাণ জৈবিক পরিবর্তন বিচার করে, জীবনের অনেক এবং বিরাট পরিবর্তনের জন্য এটিকেমনে হয় অল্প সময়, যা নিশ্চয় ক্যামব্রিয়ান স্তরের পর্ব থেকে ঘটেছে; এবং পূর্ববর্তী ১৪০ মিলিয়ন বছরকে জীবনের বিচিত্র আকারদের বিকাশের জন্য যথেষ্ট বলে কদাচিৎ বিবেচনা করা যেতে পারে, যা ক্যামব্রিয়ান পর্বে ইতিমধ্যে অবস্থিত ছিল। তবে, উইলিয়াম থমসনের দাবী অনুযায়ী এটি সম্ভবপর যে এখনকার তুলনায় পৃথিবীর অতি প্রাথমিক বয়সে এর ভৌতিক অবস্থার আরও দ্রুত ও গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছিল; এবং এরূপ পরিবর্তনগুলো তখন বসবাসকারী জীবদের সমরূপ হারে পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকতে পারে। 

ক্যামব্রিয়ান পর্বের আগে অনুমিত এইসব আদিমতম যুগে কেন জীবাশ্মপূর্ণ স্তরসমূহ আমরা দেখতে পাই না, এই প্রশ্নটি সম্পর্কে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে আমি অক্ষম। কয়েকজন বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ, স্যার আর. মুর্চিসন তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান, সম্প্রতিকাল পর্যন্ত স্থিরনিশ্চিত ছিলেন যে আমরা সর্বনিম্ন সিলুরিয়ান স্তরে জীবাশ্মের মধ্যে জীবনের প্রথম প্রভাত দেখি। লিয়েল এবং ই ফরবেসের মত অন্য বিখ্যাত বিচারকরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছেন। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে পৃথিবীর অল্প অংশকেই নির্ভুলভাবে জানা গেছে। কিছুদিন আগে, এম. ব্যারান্ডে তখনকার সময়ে জানা সিলুরিয়ান পর্বের পিছনে নূতন এবং বিস্ময়কর প্রজাতিতে পরিপূর্ণ অন্য একটি নিচের ধাপের কথা উল্লেখ করেছিলেন; এবং এখন মিঃ হিস্ নিম্নতর ক্যামব্রিয়ান পর্বের আরও আগে নিউ সাউথ ওয়েলসে ট্রাইলোবাইট প্রাণীদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং বিভিন্ন কম্বোজ (মোলাস্ক) ও অঙ্গুরীমাল (অ্যানেলিড) প্রাণীর দেহাবশেষ সমেত স্তরসমূহ আবিষ্কার করেছেন। এমন কি সর্বনিম্ন অজীবীয় (অ্যাজোয়িক) শিলাস্তরের কয়েকটিতে ফসফেটের ক্ষুদ্র পিণ্ড এবং বিটুমিনাস পদার্থের উপস্থিতি সম্ভবত এইসব যুগে জীবনের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়; এবং কানাডার লরেন্সিও ভূগঠনস্তরে এককোষী ইওজুনের উপস্থিতি সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়েছে। কানাডার সিলুরিয়ান সিস্টেমের নিচের স্তরসমূহ তিনটি বিরাট শ্রেণী রয়েছে, যার নিম্নতমটিতে ইওজুন নামক এককোষী জীব আবিষ্কৃত হয়েছে। স্যার ডব্লিউ. লগান বলেন যে এদের “সামগ্রিক গভীরতা পুরাজীবীয় শ্রেণীর নিম্ন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সমস্ত পরবর্তী শিলাগুলিকে সম্ভবত অতিক্রম করে যেতে পারে। আমরা এভাবে এত দূরবর্তী সময়ে পিছিয়ে যাচ্ছি যে তথাকথিত আদিম প্রাণীকুলের (ফনা) আবির্ভাবটি (ব্যারান্ডের) তুলনামূলকভাবে আধুনিক যুগের ঘটনা হিসাবে কয়েকজনের দ্বারা বিবেচিত হতে পারে।” এককোষী ইওজুন সব শ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নবর্গের জীবের অন্তর্গত, কিন্তু এটি এই শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত; এরা অধিক সংখ্যায় অবস্থান করত, এবং ডঃ ডসন মন্তব্য করেছেন যে এরা নিশ্চয় অন্য ক্ষুদ্র জীবদের ওপর জীবনধারণ করত, যেগুলো আবার নিশ্চয় অধিক সংখ্যায় রয়ে থাকবে। ক্যামব্রিয়ান পর্বের বহু পূর্বে জীবন্ত জীবের অবস্থান সম্পর্কে আমি ১৮৫৯ সালে যা লিখেছিলাম এবং যেগুলো স্যার ডব্লিউ. লগানের বর্ণিত জীবদের সমান, তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ক্যামব্রিয়ান পর্বের পূর্বে জীবাশ্ম পরিপূর্ণ স্তরসমূহের স্তূপের অনুপস্থিতির কোন সঙ্গত কারণ অনুসন্ধান করার অসুবিধাটি রীতিমতো বিরাট। এটি সম্ভবপর বলে মনে হয় না যে অধিকাংশ আদিম স্তরগুলো নগ্নীভবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অথবা এদের জীবাশ্মগুলো শিলাঘটিত প্রক্রিয়ার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে, কারণ এটি যদি ঘটনা হত তাহলে বয়সের দিক থেকে পরবর্তীটিতে শুধুমাত্র অল্প অবশিষ্টাংশ আমরা দেখতে পেতাম, এবং এগুলো অংশত রূপান্তরিত অবস্থায় সবসময় অবস্থান করত। কিন্তু রাশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার ব্যাপক অঞ্চলে সিলুরিয়ান শিলাদের বর্ণনা এই মতকে সমর্থন করে না যে ভূগঠনস্তর যত বেশী পুরানো হয়, তত বেশী এটি নগ্নীভবন এবং রূপান্তর প্রক্রিয়ার দ্বারা অনিবার্যভাবে অতিশয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

বর্তমানে বিষয়টি নিশ্চয় ব্যাখ্যাতীত, এবং এখানে উল্লিখিত মতসমূহের বিরুদ্ধে এটি অকাট্য যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি যে পরবর্তীকালে ব্যাখ্যাযোগ্য হতে পারে তা দেখানোর জন্য আমি নিচের প্রকল্পটি উত্থাপন করছি। জৈবিক অবশিষ্টাংশদের প্রকৃতি বিবেচনা করে, যা ইউনাইটেড স্টেট্স এবং ইউরোপের কতিপয় ভূস্তরের বিপুল গভীরতায় বসবাস করত বলে মনে হয় না, এবং কয়েক মাইল গভীর পলিস্তরের পরিমাণ বিবেচনা করে, যার দ্বারা স্তরসমূহ তৈরী হয়, আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে প্রথম থেকে শেষ বিরাট দ্বীপগুলো অথবা স্থলভাগগুলো, যেখান থেকে পলি উদ্ভূত হয়েছিল, বর্তমানের ইউরোপ মহাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সৃষ্ট হয়েছিল। আগাসি এবং অন্যরা তখন থেকে এই একই মত পোষণ করেছেন। কিন্তু কতিপয় পর্যায়ক্রমিক স্তরসমূহের স্তরের মাঝের সময়ে অবস্থাটি কি ছিল তা আমরা জানি না, এই অন্তর্বর্তী সময়ে ইউরোপ এবং ইউনাইটেড স্টেট্স শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে ছিল কিনা অথবা অর্ধ-নিমজ্জিত ছিল কিনা, যার ওপর পলিসঞ্চয়ন হয়নি, অথবা একটি খোলা এবং অগাধ সমুদ্রের তলদেশ ছিল কিনা, তা—ও আমরা জানি না। 

স্থলভাগের তুলনায় তিনগুণ বিস্তৃত বর্তমানের মহাসমুদ্রগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দেখি যে এরা অনেক দ্বীপ সম্বলিত হয়; কিন্তু এমন একটিও (নিউজিল্যান্ড ব্যতীত, যদি একে প্রকৃতই মহাসামুদ্রিক দ্বীপ বলা যায়) মহাসামুদ্রিক দ্বীপ আছে কিনা তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি, যেখানে কোন পুরাজীবীয় অথবা দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত স্তরের এমনকি একটি অবশিষ্টাংশও পাওয়া যায়। অতএব আমরা বোধহয় সিদ্ধান্ত করতে পারি যে পুরাজীবীয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত যুগের সময় মহাদেশ অথবা মহাদেশীয় দ্বীপগুলি ছিল না, এখন যেখানে আমাদের মহাসমুদ্রগুলো বিস্তৃত হয়েছে; কারণ যদি এরা থাকত, তাহলে পুরাজীবীয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়িক ভূস্তরগুলো এদের ব্যবহারজনিত ক্ষয় থেকে উদ্ভূত পলি থেকেই খুব সম্ভবত সঞ্চিত হত; এবং এগুলো তলের স্পন্দনজনিত কারণের জন্য অন্ততঃ অংশত উত্থিত হয়, যা এই বিরাট যুগের সময় নিশ্চয় বাধা সৃষ্টি করে থাকবে। সব ঘটনা থেকে যদি আমাদের কোন সিদ্ধান্ত করতে হয় তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে আমাদের মহাসমুদ্রগুলো বর্তমানে যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, ততদূর পর্যন্ত অতীত যুগ থেকেই মহাসমুদ্রগুলো বিস্তৃত হয়েছে, যার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে নেই; এবং অন্যদিকে, এখন যেখানে মহাদেশগুলো অবস্থিত, ক্যামব্রিয়ান যুগ থেকে সেখানে বিরাট স্থলভাগ রয়েছে। প্রবাল-প্রাচীর সম্পর্কে আমার গ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত রঙিন মানচিত্র আমাকে সিদ্ধান্ত করতে প্ররোচিত করে যে বিরাট মহাদেশগুলো এখনও মূলত অবনমন অঞ্চল বিরাট দ্বীপপুঞ্জগুলো এখন পৃষ্ঠের স্পন্দন অঞ্চল এবং মহাদেশগুলো উত্থান অঞ্চল হিসেবে রয়েছে। কিন্তু মনে করার কোন কারণ নেই যে পৃথিবীর শুরু থেকে অবস্থাটি একইরূপ রয়েছে। আমাদের মহাদেশগুলো তলের অসংখ্য স্পন্দনের সময় একটি প্রবল উত্থানশক্তির দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে; কিন্তু উত্থানশক্তির অঞ্চলগুলো কি সময়ের অতিবাহনে পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে না? ক্যামব্রিয়ান যুগের বহু পূর্বে, মহাদেশগুলো অবস্থান করে থাকতে পারে যেখানে মহাসমুদ্রসমূহ বর্তমানে বিস্তৃত হয়েছে; এবং স্বচ্ছ ও খোলা মহাসমুদ্রসমূহ অবস্থান করে থাকতে পারে যেখানে এখন আমাদের মহাদেশসমূহ অবস্থান করে। অথবা মনে করা কি সঠিক নয় যে, উদাহরণস্বরূপ, যদি প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশটি এখন একটি মহাদেশে পরিবর্তিত হয়, ক্যামব্রিয়ান স্তরের তুলনায় আরও পুরানো পাললিক ভূস্তর সেখানে আমাদের দেখতে পাওয়া উচিত? যখন আমরা মনে করি যে এই স্তরসমূহ আগেই সঞ্চিত হয়েছে; কারণ এটি ঘটে থাকতে পারত যে স্তরটি যা পৃথিবীর কেন্দ্রের কয়েক মাইল নিকটে অবনমিত হয়েছিল এবং যার ওপর উপরের জলরাশির প্রচণ্ড ভার চাপ সৃষ্টি করেছিল, পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি সবসময় থাকা স্তরটির তুলনায় আরও বেশী রূপান্তরজ প্রক্রিয়া সহ্য করে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আমেরিকার নগ্ন রূপান্তরজ শিলার মত, যা বিরাট চাপের দ্বারা উত্তপ্ত হয়ে থাকতে পারে, পৃথিবীর কিছু অংশের বড় অঞ্চল সম্পর্কে আমার মতে বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে; এবং আমরা বোধহয় বিশ্বাস করতে পারি যে ক্যামব্রিয়ান যুগের বহু পূর্বে এইসব বিরাট অঞ্চলের অনেক ভূস্তর সম্পূর্ণ রূপান্তরিত এবং নগ্নাবস্থায় ছিল। 

কতিপয় প্রতিবন্ধক সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে, যথা, বর্তমান এবং অতীতের প্রজাতিদের মধ্যে অনেক সংযোজক আমাদের ভূতাত্ত্বিক স্তরসমূহে দেখা গেলেও আমরা এদের একত্রে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তকারী অসীম, অসংখ্য, সূক্ষ্ম সংক্রমণগত আকারদের দেখি না;—প্রজাতিদের কয়েকটি গোষ্ঠী আমাদের ইউরোপীয় ভূস্তরগুলোতে হঠাৎ প্রথম আবির্ভূত হয়;—ক্যামব্রিয়ান স্তরের নিচে বর্তমানে জানা জীবাশ্ম পরিপূর্ণ ভূস্তরগুলোর প্রায় অনুপস্থিতি;—এইসব ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে গুরুতর প্রকৃতির। আমরা লক্ষ্য করি যে কুভিয়ার, আগাসি, ব্যারান্ডে, পিকটেট, ফ্যালকনার, ই. ফরবেস ও আরও অনেক বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ এবং লিয়েল, মুর্চিসন, সেজউইক প্রমুখ সর্বশ্রেষ্ঠ ভূবিজ্ঞানীরা প্রায়শই প্রজাতিদের অপরিবর্তনশীলতার পক্ষে মত পোষণ করছেন। কিন্তু স্যার চার্লস্ লিয়েল এখন উল্টো মত সমর্থন করেন এবং অধিকাংশ ভূতত্ত্ববিদ ও জীবাশ্মবিদরা তাঁদের পূর্ব বিশ্বাসে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। যাঁরা বিশ্বাস করেন যে ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ যে-কোন মাত্রায় নিখুঁত হয়, তাঁরা তৎক্ষণাৎ সন্দেহাতীতভাবে তত্ত্বটিকে বাতিল করবেন। লিয়েল-এর রূপক অনুসারে, ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণকে আমি অসম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত পৃথিবীর একটি ইতিহাস হিসেবে এবং একটি পরিবর্তনীয় ভাষায় লিখিত হিসেবে দেখি; এই ইতিহাসের দুটি অথবা তিনটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত শুধুমাত্র শেষ খণ্ডটির অধিকারী হই আমরা। এই খণ্ডের কেবলমাত্র এখানে-সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায় সংরক্ষিত হয়েছে এবং প্রত্যেক পাতায় এখানে—সেখানে শুধুমাত্র কতিপয় লাইন রয়েছে। মন্থরভাবে পরিবর্তনীয় ভাষাটির প্রত্যেকটি শব্দ, যা পর্যায়ক্রমিক অধ্যায়গুলোতে কমবেশী ভিন্ন হয়, জীবনের রূপগুলোকে সূচিত করতে পারে, যেগুলো আমাদের ধারাবাহিক ভূস্তরে সমাহিত রয়েছে এবং যেগুলোকে ভুলবশতঃ মনে হয় হঠাৎ প্রবর্তিত হয়েছে। এই মতানুসারে ওপরে আলোচিত প্রতিবন্ধকসমূহ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে অথবা এমনকি তিরোহিত হয়েছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *