দ্বাদশ অধ্যায় —ভৌগোলিক বিস্তার
ভৌতিক অবস্থার পার্থক্যসমূহের দ্বারা বর্তমান বিস্তারের পরিমাপ করা যেতে পারে না—প্রতিবন্ধক—সমূহের গুরুত্ব—একই মহাদেশের উৎপাদনগুলোর সম্বন্ধ—উদ্ভবের কেন্দ্রসমূহ—জলবায়ুর পরিবর্তন ও স্থলভাগের উচ্চতার দ্বারা এবং অনিয়মিত উপায়গুলোর দ্বারা বিস্তারের উপায়—সমূহ তুষারযুগে বিস্তার—উত্তর ও দক্ষিণে পর্যায়ান্বিত তুষারযুগ।
পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর জীবদের বিস্তার আলোচনা করার সময় প্রথম যে বড় ঘটনাটি আমাদের বিমুগ্ধ করে তা হচ্ছে—বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে জলবায়ু ও অন্য ভৌতিক পরিবেশসমূহের দ্বারা সামগ্রিকভাবে বিচার করা যেতে পারে না। সম্প্রতি প্রায় প্রত্যেক বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বিষয়টি অনুশীলন করেছেন, এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন। এর সত্যতা প্রমাণ করতে শুধুমাত্র আমেরিকার ঘটনাটিই যথেষ্ট; কারণ যদি আমরা সুমেরু এবং উত্তরের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলসমূহকে বাদ দিই, তাহলে সব বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে ভৌগোলিক বিস্তারের সবচেয়ে মৌলিক বিভাগগুলির একটি হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্যেকার বিভাগটি; তথাপি ইউনাইটেড স্টেটস-এর মধ্যভাগ থেকে সর্বশেষ দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিরাট আমেরিকা মহাদেশ ভ্রমণ করলে, সবচেয়ে বিচিত্র অবস্থা সমূহের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়—প্রায় সবরকম তাপমাত্রার আর্দ্র জেলা, উষর মরুভূমি, অত্যুচ্চ পর্বতমালা, তৃণাবৃত সমতলভূমি, অরণ্যসমূহ, জলাভূমি, হ্রদসমূহ এবং বিরাট বিরাট নদী। দক্ষিণ গোলার্ধে এমন একটিও জলবায়ু অথবা ভৌতাবস্থা নেই যাকে উত্তর গোলার্ধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে না—অন্ততঃ এত ঘনিষ্ঠভাবে যা একই প্রজাতির সাধারণতঃ প্রয়োজন হয়। নিঃসন্দেহেই দক্ষিণ গোলার্ধে ছোট অঞ্চলসমূহ থাকতে পারে, যা উত্তর গোলার্ধের যে-কোনটির তুলনায় উষ্ণতর; কিন্তু চারপাশের জেলাসমূহের প্রাণীকুলের থেকে ভিন্ন প্রাণীকুল সেখানে বসবাস করে না, কারণ ছোট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ জীবদের একটি গোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া বিরল ঘটনা, ঐ ছোট অঞ্চলের ভৌতিক পরিবেশ শুধুমাত্র কমমাত্রায় স্বাতন্ত্র্যসূচক। দক্ষিণ ও উত্তর গোলার্ধের ভৌত অবস্থাসমূহের এই সাধারণ সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও এদের জীবন্ত উৎপাদনগুলো ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়।
দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমাংশের ২৫° থেকে ৩৫° অক্ষাংশের মধ্যে স্থলভাগের বিরাট অঞ্চলগুলোকে যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে এদের সমস্ত ভৌতিক অবস্থায় অতি সদৃশ অঞ্চলসমূহ দেখতে পাব, তথাপি আরও সম্পূর্ণরূপে অসমান তিনটি প্রাণী ও উদ্ভিদকুল খুঁজে বের করা সম্ভবপর হবে না। অথবা দক্ষিণ আমেরিকার ৩৫° অক্ষাংশের উৎপাদনগুলোর সঙ্গে উত্তরের ২৫° অক্ষাংশের উৎপাদনগুলির তুলনা করা যায়, যারা দশ ডিগ্রি অক্ষাংশের দ্বারা পৃথক, এবং যারা বিশেষভাবে ভিন্ন ভৌতিক অবস্থায় রয়েছে; তথাপি প্রায় একই জলবায়ুর অস্ট্রেলিয়া অথবা আফ্রিকার উৎপাদনসমূহের তুলনায় এরা নজিরবিহীনভাবে পরস্পরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। সমুদ্রের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা দেখা যেতে পারে।
আমাদের সাধারণ পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় বড় ঘটনাটি হচ্ছে যে মুক্ত প্রচরণে যে-কোন ধরনের প্রতিবন্ধক অথবা বাধাগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের উৎপাদনসমূহের মধ্যে পার্থক্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের প্রায় সমস্ত স্থলজ উৎপাদনগুলোর বিরাট পার্থক্যের মধ্যে আমরা এটি দেখি, উভয় গোলার্ধের উত্তরাংশ ছাড়া, যেখানে স্থলভাগ প্রায় যুক্ত এবং যেখানে অল্প ভিন্ন জলবায়ুতে উত্তরাঞ্চলের নাতিশীতোষ্ণ আকারদের মুক্ত প্রচরণ ঘটে থাকবে, যেহেতু এখন সেখানে শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলীয় জীবই উৎপন্ন হয়। একই অক্ষাংশে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্যের একই ঘটনা আমরা দেখি, কারণ এই দেশগুলো পরস্পরের থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন। প্রত্যেক মহাদেশে একই ঘটনা লক্ষ্য করি আমরা, কারণ অত্যুচ্চ পর্বতশ্রেণী, বিশাল মরুভূমি এবং এমনকি বিরাট নদীর উল্টোদিকে আমরা ভিন্নতর উৎপাদনসমূহ দেখি; যদিও মহাসমুদ্রগুলো যেভাবে মহাদেশগুলোকে পৃথক করে, পর্বতশ্রেণী, মরুভূমি ইত্যাদি তত অনতিক্রম্য নয়, অথবা দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে—ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশগুলোর ঐ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় পার্থক্যগুলো মাত্রায় হীনতর বা নিকৃষ্ট হয়।
সমুদ্রের দিকে তাকালেও আমরা একই নিয়ম দেখি। দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের সামুদ্রিক অধিবাসীরা অতিশয় ভিন্ন হয়, অল্প কয়েকটি খোলকী প্রাণী (শেল), বর্মী প্রাণী (ক্রাস্টেসিয়া) অথবা কণ্টকত্বক প্রাণী (একিনোডার্মাটা) সাধারণ হয়; কিন্তু ডঃ গুনথার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে পানামা যোজকের উল্টোদিকের মাছগুলির প্রায় ত্রিশ শতাংশ একইরূপ হয়; এই তথ্যটি প্রকৃতিবিদদের বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করে যে যোজকটি পূর্বে মুক্ত ছিল। আমেরিকার উপকূলগুলির পশ্চিমদিকে, যেখানে মুক্ত সমুদ্রের বিরাট অঞ্চল রয়েছে, সেখানে বাস্তুত্যাগীদের বিশ্রামস্থান হিসেবে একটি দ্বীপও নেই; এখানে অন্য প্রকারের একটি প্রতিবন্ধক আছে, যেইমাত্র এটি অতিক্রম করা হয়, আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দ্বীপগুলিতে অন্যরকম এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাণীকুলের সাক্ষাৎ পাই। অতএব তিনটি সামুদ্রিক প্রাণীকুল পরস্পরের থেকে বেশী দূরবর্তী নয়, বরং সমান্তরাল রেখার আরও উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অনুরূপ জলবায়ুতে বিস্তৃত হয়; কিন্তু হয় স্থলভাগ নয়তো বিস্তৃত সমুদ্রের মত অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধক দ্বারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হলেও এরা সামগ্রিকভাবে ভিন্ন। পক্ষান্তরে, প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ অঞ্চলের পূর্ব দ্বীপগুলি থেকে আরও পশ্চিমদিকে অগ্রসর হলে আমরা কোন অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হই না, এবং বিশ্রামস্থান হিসেবে অসংখ্য দ্বীপ অথবা অবিচ্ছিন্ন উপকূলভাগ পাওয়া যায়, যতক্ষণ না আমরা অর্ধগোলার্ধ ভ্রমণ করে আফ্রিকার উপকূলে আসি; এবং আমরা এই বিরাট অঞ্চলে সুচিহ্নিত ও স্বতন্ত্র সামুদ্রিক প্রাণীকুলের সাক্ষাৎ পাই না। যদিও এত অল্প সামুদ্রিক প্রাণী পূর্ব ও পশ্চিম আমেরিকার এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর সন্নিকটবর্তী তিনটি প্রাণীকুলের অনুরূপ হয়, তথাপি অনেক মাছ প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং অনেক খোলকী প্রাণী দ্রাঘিমাংশের প্রায় যথাযথ বিপরীত মধ্যরেখার ওপর আফ্রিকার পূর্ব উপকূল এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বদিকেও সাধারণ হয়।
উপরোক্ত বক্তব্যে অংশত অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় বড় ঘটনাটি হচ্ছে একই মহাদেশের অথবা একই সমুদ্রের উৎপাদনগুলোর সম্বন্ধ, যদিও প্রজাতিরা বিভিন্ন স্থানে এবং অঞ্চলে ভিন্ন হয়। এটি একটি ব্যাপকতম বিশ্বজনীন নিয়ম, এবং এ ব্যাপারে প্রত্যেক মহাদেশেই অসংখ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও, উদাহরণস্বরূপ, উত্তর থেকে দক্ষিণে ভ্রমণ করার সময় প্রকৃতিবিদরা এটি দেখে কখনও মুগ্ধ না হয়ে পারেন না যে জীবদের পর্যায়ক্রমিক গোষ্ঠীরা, যারা বিশেষভাবে ভিন্ন অথচ প্রায়শই সম্পর্কযুক্ত, পরস্পরকে স্থানচ্যুত করে। তিনি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত অথচ ভিন্ন প্রকৃতির পাখিদের কাছ থেকে একই ধরনের ধ্বনি শোনেন এবং দেখেন যে এদের বাসাগুলো একইভাবে তৈরী, কিন্তু সম্পূর্ণ একই রকম নয়, যাদের ডিমগুলোও একইভাবে রঞ্জিত। ম্যাগেলান প্রণালীর নিকট সমভূমিতে রিয়া নামক গণের একটি প্রজাতি (আমেরিকার উটপাখি) বাস করে এবং লা প্লাটার উত্তরদিকের সমভূমিতে একই গণের অন্য একটি প্রজাতি বাস করে; একই অক্ষাংশে অবস্থিত আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃত উটপাখি (অস্ট্রিচ) ও এমু পাখির মতো নয় এটি। লা প্লাটার একই সমভূমিতে আমরা অ্যাগাউটি ও বিজক্যাচা নামক প্রাণীদের দেখি, যারা স্বভাবে আমাদের শশক ও খরগোশদের মতো হয় এবং এরা তীক্ষ্ণদন্তীদের (রোডেন্ট) সঙ্গে একই অর্ডারের অন্তর্গত, কিন্তু দেহগঠনে এরা একই আমেরিকান ধরনের মতো হয়। আমরা কর্ডিলেরার অত্যুচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেছি এবং বিজক্যাচার নামক একটি আলপাইন প্রজাতি দেখেছি; জলের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা বীবর (বিভার) অথবা কস্তূরী-ইঁদুর (মাস্ক-র্যাট) দেখতে পাই না, কিন্তু কয়পু ও ক্যাপিবারা নামক প্রাণীদের দেখি, যারা দক্ষিণ আমেরিকার [ __?] মতো। অন্য অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমেরিকার উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়—ভূতাত্ত্বিক গঠনে এরা যতই ভিন্ন হোক, অধিবাসীরা মূলতঃ আমেরিকার মতো, যদিও এরা সকলে অদ্ভুত প্রকৃতির প্রজাতি হতে পারে। আমরা অতীত যুগে ফিরে তাকাতে পারি, যেমন পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে, এবং আমরা দেখতে পাই যে আমেরিকান টাইপগুলো আমেরিকা মহাদেশ ও সমুদ্রগুলোতে * তখন প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এইসব ঘটনায় দেশ ও কাল জুড়ে ভৌতিক পরিবেশসমূহ ব্যতিরেকে স্থল ও জলভাগের একই অঞ্চলসমূহের মধ্যে কোন নিবিড় জৈবিক সম্পর্ক দেখা যায়। প্রকৃতিবিদরা নিশ্চয় স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন হবেন যদি তাঁরা এই সম্বন্ধ কি তা অনুসন্ধান করতে অনুপ্রাণিত না হন।
সোজা সরলভাবে পারস্পরিক বন্ধনটি (বন্ড) হচ্ছে বংশানুসৃতি, যতদূর আমরা সঠিকভাবে জানি তাতে একমাত্র এই কারণটিই সম্পূর্ণ পরস্পরের মতো জীব সৃষ্টি করে অথবা ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রে যেমন আমরা দেখি, প্রায় সদৃশ ভ্যারাইটি উৎপাদন করে। বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের অসদৃশতা পরিবৃত্তি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরের জন্য হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে; এবং বিভিন্ন ভৌতিক পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রভাবের তুলনায় সম্ভবত হীনতর মাত্রায় হয় বলে মনে করা যেতে পারে। অসদৃশতার মাত্রাগুলি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কমবেশী দূরবর্তী যুগে কমবেশী বাধাপ্রাপ্ত জীবনের প্রভাবশালী আকারদের প্রচরণের ওপর, পূর্বে দেশত্যাগীদের সংখ্যা ও প্রকৃতির ওপর এবং বিভিন্ন রূপান্তরসমূহের সংরক্ষণের দিকে অধিবাসীদের পরস্পরের সঙ্গে বিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে; জীবনসংগ্রামে জীবের সঙ্গে জীবের সম্পর্কটি হচ্ছে, যা আমি ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছি, যাবতীয় সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে প্রতিবন্ধকগুলির বিরাট প্রয়োজনীয়তা প্রচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে; প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরের মন্থর প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সময় যেমন ভূমিকা পালন করে। প্রচুর সংখ্যক একক সম্বলিত বহুবিস্তৃত প্রজাতিদের, যারা ইতিমধ্যে নিজ অঞ্চলের প্রতিযোগীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছে, নূতন অঞ্চল অধিকার করার ভাল সম্ভাবনা থাকবে, যখন এরা নূতন দেশসমূহে বিস্তৃত হয়। নিজেদের নূতন বাসস্থানে এরা নূতন পরিবেশের সম্মুখীন হবে এবং প্রায়শই আরও রূপান্তরিত ও উন্নত হবে; এবং এরূপে এরা আরও বেশী বিজয়ী হবে এবং রূপান্তরিত বংশধরদের গোষ্ঠী সৃষ্টি করবে। রূপান্তরের সঙ্গে বংশানুসৃতির এই পদ্ধতি অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারি কেমন করে গণেদের খণ্ডগুলো, সব গণে, এবং এমনকি গোত্রগুলো একই অঞ্চলসমূহে সীমাবদ্ধ থাকে, যা খুবই সাধারণ এবং সুপরিচিত ঘটনা।
আগের অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে প্রাকৃতিক নিয়ম-নির্ধারিত বিকাশের নিয়মের কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। যেহেতু প্রত্যেক প্রজাতির পরিবর্তনশীলতা একটি স্বাধীন গুণ এবং জটিল জীবনসংগ্রামে প্রত্যেক এককের ক্ষেত্রে এটি লাভজনক হয়, সেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন এর সুবিধা গ্রহণ করবে; অতএব বিভিন্ন প্রজাতির রূপান্তরের পরিমাণ একইরূপ হবে। যদি নিজেদের অঞ্চলে পরস্পরের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে প্রতিযোগিতা করার পর, কিছু প্রজাতিকে দলবদ্ধভাবে একটি নূতন এবং পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্ন দেশে প্রচরণ করতে হত, তাহলে এদের রূপান্তরের সম্ভাবনা অল্প হত; কারণ প্রচরণ অথবা অন্তরণ কিছুকে প্রভাবিত করে না। পরস্পরের সঙ্গে এবং কিছুমাত্রায় চারপাশের ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে জীবদের নূতন সম্পর্ক স্থাপনের পর এই পদ্ধতিগুলো নিজেদের ভূমিকা পালন করে। যেমন আমরা বিগত অধ্যায়ে দেখেছি যে কয়েকটি আকার অতি দূরবর্তী ভূতাত্ত্বিক যুগ থেকে একই বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে, অতএব কোন কোন প্রজাতি বিরাট অঞ্চল প্রচরণ করেছে এবং বিরাটভাবে রূপান্তরিত হয়নি অথবা আদৌ রূপান্তরিত হয়নি।
এইসব মতানুসারে এটি স্পষ্ট যে একই গণের কয়েকটি প্রজাতি পৃথিবীর দূরতম অংশে বসবাস করে থাকলেও একই উৎস থেকে যাত্রা শুরু করে থাকবে, কারণ এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সেইসব প্রজাতিদের ক্ষেত্রে, যারা সমগ্র ভূতাত্ত্বিক যুগে অল্প রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে বেশী অসুবিধা হয় না যে এরা একই অঞ্চল থেকে প্রচরণ করেছে; কারণ ভৌগোলিক ও জলবায়ুর বিরাট পরিবর্তনের সময়, যা প্রাচীনকাল থেকে পরিবর্তিত হয়েছে, যে-কোন পরিমাণ প্রচরণ সম্ভবপর। কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রে, যেখানে বিশ্বাস করার কারণ আছে যে একটি গণের প্রজাতিরা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট হয়েছে, এ বিষয়ে বিরাট বাধা রয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট যে একই প্রজাতির এককরা, যদিও দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেছে, নিশ্চয় একটি জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করে থাকবে, যেখানে তাদের পিতামাতাদের প্রথম জন্ম হয়েছিল : কারণ, যেমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এটি অবিশ্বাস্য যে অভিন্ন একই এককরা বিশেষভাবে ভিন্ন পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
কল্পিত সৃষ্টির একমাত্র কেন্দ্রসমূহ—এভাবে আমরা সেই প্রশ্নটির সম্মুখীন হই যার সম্বন্ধে প্রকৃতিবিদরা বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন, অর্থাৎ—পৃথিবীর এক অথবা একাধিক অঞ্চলে প্রজাতিরা সৃষ্টি হয়েছে কিনা। নিঃসন্দেহেই বোঝার পক্ষে অনেক চরম অসুবিধা আছে যে কেমন করে একই প্রজাতিরা কোন একটি স্থান থেকে কয়েকটি দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে, যেখানে তাদের বর্তমানে পাওয়া যায়, সম্ভবত প্রচরণ করে থাকবে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক প্রজাতি একমাত্র একটি একক অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছিল, এই সরল ধারণাটি মনকে আকৃষ্ট করে। যিনি এটি বাতিল করেন তিনি পরবর্তী প্রচরণের সঙ্গে সাধারণ বংশের প্রধান কারণটি বাতিল করেন এবং এটিকে আলৌকিক ঘটনা বলেন। এটি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, একটি প্রজাতি যেখানে বাস করে সেই অঞ্চলটি অবিচ্ছিন্ন, এবং যখন একটি উদ্ভিদ ও প্রাণী পরস্পরের থেকে এত দূরে দুটি জায়গায় বসবাস করে, অথবা দূরত্বটি এমন প্রকৃতির হয় যে মধ্যবর্তী স্থানটি প্রচরণ দ্বারা সহজেই অতিক্রম করা যেতে পারে না, তখন ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠো। অন্য যে-কোন জীবের তুলনায় স্থলজ স্তন্যপায়ীদের বিস্তৃত সমুদ্র অতিক্রম করার অক্ষমতা আরও স্পষ্ট; এবং তদনুসারে পৃথিবীর দূরতম অঞ্চলে একই স্তন্যপায়ীদের বসবাসের কোন উদাহরণ আমরা দেখি না। কোন ভূতাত্ত্বিক মনে করতে অসুবিধা বোধ করেন না যে ইউরোপের বাকি অঞ্চলের মতো গ্রেট ব্রিটেনেও একই চতুষ্পদ প্রাণীরা রয়েছে; কারণ সন্দেহ নেই যে এরা একসময় যুক্ত ছিল। কিন্তু যদি একই প্রজাতি দুটি ভিন্ন জায়গায় সৃষ্টি হতে পারে, তাহলে কেন আমরা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া অথবা দক্ষিণ আমেরিকায় একটিও সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখতে পাই না? জীবন-পরিবেশ প্রায়শই একই রকম, সুতরাং অসংখ্য ইউরোপীয় প্রাণী ও উদ্ভিদ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াতে অভিযোজিত হয়েছে; এবং আদিম উদ্ভিদদের কয়েকটি উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের এইসব দূরবর্তী স্থানে রূপগতভাবে কি একই প্রকৃতির? আমার বিশ্বাস মতো উত্তরটি হচ্ছে যে স্তন্যপায়ীরা প্রচরণ করতে সমর্থ হয়নি, কিন্তু পক্ষান্তরে বিস্তারের বিভিন্ন উপায়ের দ্বারা কয়েকটি গাছ বিস্তৃত এবং ভঙ্গিল মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করেছে। অধিকাংশ প্রজাতি একদিকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বিপরীতদিকে যেতে সমর্থ হয়নি। এই মতানুসারে সব ধরনের প্রতিবন্ধকের বিরাট এবং উল্লেখযোগ্য প্রভাব বোধগম্য হয়। অল্প কয়েকটি গোত্র, অনেক উপগোত্র, অসংখ্য গণ, গণগুলোর আরও অধিক খণ্ডগুলো শুধুমাত্র একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে; এবং কয়েকজন প্রকৃতিবিদ লক্ষ্য করেছেন যে অধিকাংশ স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গণগুলো, অথবা সেই সমস্ত গণগুলো যাদের প্রজাতিরা পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, সাধারণতঃ একই দেশে সীমাবদ্ধ থাকে, অথবা এদের বিস্তার অধিক হলে সেই বিস্তার অবিচ্ছিন্ন হয়। কি অদ্ভুত ব্যতিক্রম হবে, যদি প্রত্যক্ষভাবে বিপরীত নিয়ম চালু থাকে, যখন আমরা শ্রেণীটির একধাপ নিচে যাই, যেমন একই প্রজাতির এককদের ক্ষেত্রে হয়, এবং এগুলো অন্ততঃ প্রথমে একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না।
অতএব অন্য অনেক প্রকৃতিবিদের মতো আমারও মনে হয় যে কেবল একটি অঞ্চলে প্রত্যেক প্রজাতির সৃষ্টি হওয়ার ও এর প্রচরণের ক্ষমতানুযায়ী এবং অতীত ও বর্তমান পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতানুসারে পরবর্তী সময়ে প্রজাতির প্রচরণ হওয়ার মতবাদটি সবচেয়ে সম্ভবপর। সন্দেহ নেই যে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেখানে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না কেমন করে একই প্রজাতি একটি স্থান থেকে অন্য জায়গায় অতিক্রম করে থাকবে। কিন্তু ভৌগোলিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনসমূহ, যা সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক যুগে নিশ্চয়ই ঘটেছে, অনেক প্রজাতির আগের অবিচ্ছিন্ন বিস্তারকে বিচ্ছিন্ন করে থাকবে। অতএব আমরা বিচার করতে বাধাপ্রাপ্ত হই বিস্তারের অবিচ্ছিন্নতার ব্যতিক্রমসমূহ এত অসংখ্য ও গুরুতর প্রকৃতির কিনা যাতে সাধারণ বিবেচনার দ্বারা উদ্ভূত বিশ্বাসটি সম্ভবত আমাদের ত্যাগ করা উচিত যে প্রত্যেক প্রজাতি একটি অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এবং তারপর যতদূর সম্ভব এরা ঐ এলাকা পরিত্যাগ করেছে। দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে জীবিত একই প্রজাতির সমস্ত ব্যতিক্রমী ঘটনা আলোচনা করা ক্লান্তিকর হবে, অথবা আমরা আদৌ দাবী করি না যে অনেক উদাহরণের কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কিছু প্রারম্ভিক মন্তব্যের পর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাগুলির কয়েকটি আমি আলোচনা করব; যথা, দূরবর্তী পর্বতশ্রেণীর চূড়ায় এবং সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের দূরবর্তী স্থানসমূহে একই প্রজাতির অবস্থান; দ্বিতীয়ত (পরের অধ্যায়ে), স্বাদু জলের উৎপাদনসমূহের ব্যাপক বিস্তার; এবং তৃতীয়ত, বিস্তৃত সমুদ্রের শতশত মাইল দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও দ্বীপসমূহে এবং নিকটতম মূল ভূখণ্ডে একই স্থলজ প্রজাতির অবস্থান। প্রত্যেক প্রজাতি একটি জন্মস্থান থেকে প্রচরণ করেছে—এই মতানুসারে একই প্রজাতির পৃথিবীর দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহে অবস্থানের অনেক উদাহরণ যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তারপর তাদের জলবায়ুগত ও ভৌগোলিক পরিবর্তন—সমূহ এবং পরিবহণের বিভিন্ন আকস্মিক উপায়সমূহ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা বিবেচনা করে, একটি প্রজাতির জন্মস্থান একটি এটাই হচ্ছে নিয়ম—এই বিশ্বাসটি আমার মতে তুলনামূলকভাবে নিরাপদতম।
এই বিষয়টির আলোচনার সময়, সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর একটি বিষয়ও বিবেচনা করতে আমরা সমর্থ হব যে একটি গণের কতিপয় প্রজাতি, যারা আমাদের তত্ত্বানুযায়ী সকলে একটি সাধারণ জনক থেকে অবশ্যই উদ্ভূত হয়েছে, প্রচরণের সময় রূপান্তরিত হয়ে কোন একটি অঞ্চল থেকে প্রচরিত হয়ে থাকতে পারে। যখন একটি অঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশ প্রজাতি অন্য অঞ্চলে বসবাসকারী এবং ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের থেকে ভিন্ন হয়, তখন যদি দেখানো যায় যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানত্যাগ কোন পূর্ব যুগে ঘটেছিল, তাহলে আমাদের সাধারণ ধারণাটি শক্তিশালী হবে; কারণ রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যাখ্যাটি বোধগম্য হয়। যেমন একটি মহাদেশের কয়েকশত মাইল দূরে উদ্ভূত এবং সৃষ্ট একটি আগ্নেয়গিরিময় দ্বীপ থেকে কিছু উপনিবেশকারীকে ঐ মহাদেশটি সম্ভবত পাবে এবং রূপান্তরিত হলেও এদের বংশধররা বংশানুসৃতির দ্বারা ঐ মহাদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে তখনও সম্পর্কিত হবে। এই ধরনের ঘটনা সাধারণত ঘটে থাকে এবং আমরা পরে দেখব, স্বাধীন সৃষ্টির তত্ত্বের দ্বারা একে ব্যাখ্যা করা যায় না। এক অঞ্চলের প্রজাতিগুলির সঙ্গে অন্য অঞ্চলের প্রজাতিদের সম্পর্ক সম্বন্ধে এই মতবাদটি মিঃ ওয়ালেস প্রদত্ত মতবাদের থেকে বেশী ভিন্ন নয়, যিনি সিদ্ধান্তে আসেন—“প্রত্যেক প্রজাতি দেশ এবং কাল উভয় ক্ষেত্রেই পূর্বে অবস্থিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত প্রজাতিদের সঙ্গে একই সময়ে উদ্ভূত হয়েছে।” এবং এটি এখন সুবিদিত যে তিনি এই সমস্থানে অবস্থানকে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভব বলেছেন।
সৃষ্টির অসংখ্য অথবা একক কেন্দ্রের প্রশ্নটি অন্য অথচ সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের থেকে ভিন্ন হয়, যথা—একই প্রজাতির সব এককরা একজোড়া থেকে অথবা একমাত্র একটি উভলিঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা, অথবা যেমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যুগপৎ সৃষ্ট অনেক একক থেকে উদ্ভূত হয়েছে কিনা। কখনও আন্তঃসঙ্করিত হয় না এমন জীবসমূহ সম্পর্কে যদি এরূপ ঘটে থাকে, তাহলে প্রত্যেক প্রজাতি রূপান্তরিত ভ্যারাইটিদের একটি উত্তরাধিকারী থেকে নিশ্চয় উদ্ভূত হয়েছে, যারা পরস্পরকে স্থানচ্যুত করেছে, কিন্তু যারা একই প্রজাতির অন্য একক অথবা ভ্যারাইটিদের সঙ্গে কখনও মিশ্রিত হয়নি; সুতরাং রূপান্তরের প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক ধাপে, একই আকারের সব এককরা একটি একক পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে, যথা স্বভাবগতভাবে প্রত্যেক জন্মের জন্য একবার মিলিত হওয়া অথবা আকস্মিকভাবে সঙ্করিত হওয়া সমস্ত জীবদের ক্ষেত্রে একই অঞ্চলে বসবাসকারী একই প্রজাতির এককরা আন্তঃসঙ্করণের দ্বারা একইরূপ থাকবে; সুতরাং অনেক একক যুগপৎ পরিবর্তিত হতে থাকবে এবং প্রত্যেক ধাপে রূপান্তরের সামগ্রিক পরিমাণ একটি পিতামাতা থেকে উদ্ভবের জন্য হবে না। আমি যা বলতে চাইছি তার একটি উদাহরণ হল—আমাদের ইংলিশ ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ারা অন্য প্রত্যেক জাতের ঘোড়াদের থেকে ভিন্ন, কিন্তু এদের পার্থক্য এবং উৎকর্ষতা যে-কোন একজোড়ার থেকে উদ্ভবের জন্য হয় না, বরং প্রত্যেক বংশে অনেক এককের ধারাবাহিক শিক্ষা এবং নির্বাচনের জন্য হয়ে থাকে।
তিন শ্রেণীর ঘটনাগুলি আলোচনার আগে, যেগুলিকে আমি “সৃষ্টির একক কেন্দ্রগুলির” তত্ত্ব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশী পরিমাণ প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী হিসেবে নির্বাচন করেছি, সেগুলির বিস্তারের উপায় সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
বিস্তারের উপায়সমূহ
স্যার সি. লিয়েল এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা দক্ষতার সঙ্গে এই বিষয়টি আলোচনা করেছেন। আমি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের সংক্ষিপ্ত সারাংশটুকুই শুধু দিতে পারি। জলবায়ুর পরিবর্তন প্রচরণে একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। আবহাওয়ার জন্য একটি অঞ্চল এখন যেমন কোন কোন জীবের ক্ষেত্রে অনতিক্রম্য, এক সময় ঐ অঞ্চলটিতে ভিন্ন জলবায়ু থাকার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রচরণ হয়েছে। তবে বর্তমানে এই বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে হবে। স্থলভাগের উচ্চতার পরিবর্তনও গুরুতর প্রভাব ফেলে থাকবে : একটি সংকীর্ণ যোজক দুটি সামুদ্রিক প্রাণীকুলকে (ফনা) পৃথক করে; এটি নিমজ্জিতই হোক অথবা পূর্বে এটি নিমজ্জিত হয়ে থাকুক, এখন দুটি প্রাণীকুল একত্রে মিশ্রিত হবে অথবা পূর্বে মিশ্রিত হয়ে থাকতে পারে। এখন যেখানে সমুদ্র বিস্তৃত হয়েছে, যেখানে স্থলভাগটি পূর্বের দ্বীপগুলোর সঙ্গে অথবা সম্ভবত মহাদেশগুলোর সঙ্গে একত্রে সংযুক্ত হয়ে থাকতে পারে, এবং এভাবে স্থলভাগের উৎপাদনসমূহ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অতিক্রম করেছে। কোন ভূতাত্ত্বিকই অস্বীকার করেন না যে জীবিত জীবদের অবস্থানের সময় উচ্চতার সাধারণ পরিবর্তনসমূহ ঘটেছে। এডওয়ার্ড ফরবেস জোরের সঙ্গে বলেন যে আটলান্টিক মহাসাগরের সমস্ত দ্বীপগুলো সাম্প্রতিককালে ইউরোপ অথবা আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারে, এবং এরূপে আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপ যুক্ত হয়ে থাকতে পারে। অন্য বিশেষজ্ঞরা এরূপে কল্পিতভাবে প্রত্যেক মহাসমুদ্রকে যুক্ত করেছেন এবং প্রায় সমস্ত দ্বীপগুলোকে কোন-না-কোন মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। সত্যিই যদি ফরবেসের দেওয়া যুক্তিগুলো বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে নিশ্চয় স্বীকার করতে হবে যে এমন একটিও দ্বীপ নেই যা বর্তমানকালে কোন-না-কোন মহাদেশের সঙ্গে যুক্ত নয়। এই মতবাদ আরও দূরবর্তী জায়গায় একই প্রজাতির বিস্তারের বিরাট বাধা দূর করেছে এবং বাধাটি অপসারণ করেছে; আমার সর্বোত্তম বিচারে, জীবিত প্রজাতির অবস্থানের সময়ের মধ্যে এরূপ বিপুল ভৌগোলিক পরিবর্তনগুলো স্বীকার করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমার মনে হয় স্থলভাগের এবং সমুদ্রের উচ্চতার বিরাট স্পন্দনের অসংখ্য সাক্ষ্য আমাদের আছে; কিন্তু মহাদেশগুলোর অবস্থান এবং বিস্তারের এরূপ বিরাট পরিবর্তনের কোন সাক্ষ্য নেই, বর্তমান যুগে পরস্পরের সঙ্গে এদের সংযুক্ত হওয়া এবং মধ্যবর্তী দ্বীপগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোন সাক্ষ্য নেই, বর্তমান যুগে পরস্পরের সঙ্গে এদের সংযুক্ত হওয়া এবং মধ্যবর্তীগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ারও কোন সাক্ষ্য নেই। সমুদ্রের জলে বর্তমানে নিমজ্জিত অনেক দ্বীপের পূর্ব অবস্থান আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি, যেগুলো প্রচরণের সময় অনেক উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সাময়িক বিরতির স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। প্রবাল-সৃষ্টিকারী মহাসমুদ্রগুলোতে এরূপ নিমজ্জিত দ্বীপসমূহ এখন প্রবাল-প্রাচীরের দ্বারা চিহ্নিত। যখন এটি সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়, যেমন এটি কোন সময় স্বীকার করতে হবে যে প্রত্যেক প্রজাতি একটিমাত্র জন্মস্থান থেকে যাত্রা করেছে, এবং যখন সময়ের গতিতে বিস্তারের উপায়সমূহ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি, তখন স্থলভাগের পূর্বেকার বিস্তার সম্পর্কে নিশ্চয়তার সঙ্গে কল্পনা করতে আমরা সমর্থ হব। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে এটি কখনও প্রমাণ করা যাবে যে সাম্প্রতিককালের মধ্যে আমাদের অধিকাংশ মহাদেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে অথবা বর্তমানের অনেক দ্বীপের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে অথবা প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হয়েছে। বিস্তারের কয়েকটি তথ্য—যেমন প্রায় প্রত্যেক মহাদেশের উল্টোদিকের সামুদ্রিক প্রাণীকুলের (ফনা) বিরাট পার্থক্য—কয়েকটি স্থলভাগের এমনকি সমুদ্রের টার্শিয়ারি যুগের অধিবাসীদের সঙ্গে বর্তমান অধিবাসীদের গভীর সম্পর্ক—নিকটতম মহাদেশে বসবাসকারী স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে দ্বীপে বসবাসকারী স্তন্যপায়ীদের সম্বন্ধের পরিমাণ, যা মধ্যস্থলে অবস্থিত মহাসমুদ্রের গভীরতার দ্বারা অংশত নির্ধারিত হয় (যেমন আমরা এর পর দেখব)—এগুলো এবং অন্যান্য ঘটনা বর্তমানকালের মধ্যে এরূপ অস্বাভাবিক ভৌগোলিক বিপ্লবকে স্বীকারের বিরোধী হয়, যা ফরবেস কর্তৃক উপস্থাপিত মতের পক্ষে অপরিহার্য এবং যা তাঁর অনুগামীদের দ্বারা স্বীকৃত। সামুদ্রিক দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের স্বভাব বা প্রকৃতি এবং আপেক্ষিক অনুপাত এরূপে মহাদেশগুলোর সঙ্গে এদের পূর্বে অবিচ্ছিন্নতার বিশ্বাসের বিরোধী হয়। অথবা এরূপ দ্বীপগুলোর আগ্নেয়শিলার গঠন প্রমাণ করে না যে এরা নিমজ্জিত মহাদেশসমূহের ধ্বংসাবশেষ—যদি এরা প্রারম্ভিকভাবে মহাদেশীয় পর্বতশ্রেণীরূপে অবস্থান করত, তাহলে দ্বীপগুলো অন্ততঃ শুধুমাত্র কতিপয় আগ্নেয়গিরিময় স্তূপ দ্বারা গঠনের পরিবর্তে অন্য পর্বতচূড়ার মত আগ্নেয় (গ্রানাইট) রূপান্তরিত স্ফটিকতুল্য শিলা (সিস্ট), পুরানো জীবাশ্ম—পরিপূর্ণ এবং অন্যান্য পাথর দ্বারা সৃষ্ট হত।
যাকে আকস্মিক উপায় বলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাকে বিস্তারের সাময়িক উপায় বলা উচিত, সেগুলি সম্পর্কে এখন কয়েকটি কথা বলব। উদ্ভিদের সম্পর্কেই এখানে মনোনিবেশ করব আমি। উদ্ভিদ সংক্রান্ত গ্রন্থে, কোন উদ্ভিদ ইতস্ততঃ বিস্তৃত হওয়ার জন্য মন্দভাবে অভিযোজিত হয়েছে বলা হয়। কিন্তু সমুদ্র অতিক্রম করার কমবেশী সুযোগসুবিধাগুলো বহুলাংশেই অজানা, তা বলা যেতে পারে। যতদিন না বার্কলের সাহায্যে আমি কিছু পরীক্ষা করেছিলাম, ততদিন পর্যন্ত জানা যায়নি যে বীজগুলি সমুদ্রজলের ক্ষতিকর বিক্রিয়া কতখানি প্রতিরোধ করতে পারে। সবিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে ৮৭টির মধ্যে ৬৪টি বীজ ২৮ দিন জলে নিমজ্জিত রাখার পর অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং কয়েকটি ১৩৭ দিন জলের মধ্যে রাখার পরও বেঁচেছিল। লক্ষণীয় বিষয় হল—কোন কোন অর্ডার অন্যদের তুলনায় বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল : শুঁটিওয়ালা গাছের ৯টি বীজ পরীক্ষা করা হয়েছিল, এবং মাত্র একটি ছাড়া বাকীরা লবণজলকে ভীষণভাবে প্রতিরোধ করেছিল; হাইড্রোফাইলেসি এবং পোলেমোনিয়েসি অর্ডারের ৭টি প্রজাতি ১ মাস নিমজ্জনের পর বিনষ্ট হয়েছিল। সুবিধার জন্য আমি ফল অথবা ক্যাপসুল ছাড়া ছোট বীজ নিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম এবং যেহেতু এরা সকলে কয়েকদিনের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল, সেহেতু বলা যায় যে এরা লবণজলে ক্ষতিগ্রস্ত হোক আর না হোক বিশাল সমুদ্রে ভেসে থাকতে পারত না। এরপর কয়েকটি বড় ফল ও ক্যাপসুল নিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম এবং এদের কয়েকটি দীর্ঘসময় ভেসে ছিল। তাজা ও পরিপক্ক কাঠের প্লবতায় কি পার্থক্য হয় তা সকলেরই জানা আছে; এবং আমি প্রায়শই লক্ষ্য করতাম যে ফল ও ক্যাপসুল সমেত শুষ্ক গাছ ও তাদের শাখাপ্রশাখাকে বন্যার জল সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এরপর আমি পাকা ফল সমেত ৯৪টি গাছকে শুষ্ক করি এবং সমুদ্রজলে ভাসাই। অধিকাংশই দ্রুত ডুবে গিয়েছিল, তাজা কয়েকটি কিছু সময় ভেসে ছিল এবং শুষ্ক কয়েকটি আরও বেশীক্ষণ ভেসে ছিল, যেমন, হাজেল গাছের পাকা বাদাম তৎক্ষণাৎ ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু শুষ্ক হওয়ার পর ৯০ দিন ভেসে ছিল, এবং বীজগুলি পরবর্তী সময়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল; পাকা ফল সমেত একটি শতমূলী (অ্যাসপারাগাস) গাছ ২৩ দিন ভেসে ছিল, কিন্তু শুষ্ক করার পর এরা ৮৫ দিন ভেসে ছিল এবং বীজগুলি পরে অঙ্কুরিত হয়েছিল; হেলোসসিয়াডিয়ামের পাকা বীজগুলি দুদিনের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল, শুষ্ক হওয়ার পর ৯০ দিনের বেশী ভেসে ছিল এবং পরে অঙ্কুরিত হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, ৯৪টি শুষ্ক উদ্ভিদের মধ্যে ১৮টি ২৮ দিনের বেশী ভেসে ছিল; এবং ১৮টির মধ্যে কয়েকটি আবার বেশী দিন ভেসে ছিল, সুতরাং যেহেতু ২৮ দিন নিমজ্জনের পর ৬৪/৮৭ প্রকার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং যেহেতু ২৮ দিন শুষ্ক হওয়ার পর পাকা ফল সমেত ১৮/৯৪ টি ভিন্ন প্রজাতি ভেসে ছিল, এরূপ অল্প তথ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে যে-কোন দেশের ১৪/১০০ ধরনের গাছের বীজরা ২৮ দিন ধরে সমুদ্রপ্রবাহের দ্বারা ভেসে থাকতে পারে এবং অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা বজায় রাখতে পারে। জনস্টনের প্রাকৃতিক মানচিত্র অনুযায়ী, কয়েকটি আটলান্টিক প্রবাহের গড় হার হচ্ছে প্রতি ডিয়েমে ৩৩ মাইল (কিছু প্রবাহের গড় হার হচ্ছে প্রতি ডিয়েমে ৬০ মাইল); এই গড় অনুযায়ী একটি দেশের ১৪/১০০ টি উদ্ভিদের বীজরা ৯২৪ মাইল দূরে অন্য দেশে সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে পারে এবং অন্তর্দেশীয় প্রবল ঝড়ের দ্বারা কোন অনুকূল স্থানে উড়ে গিয়ে ঠেকে গেলে অঙ্কুরিত হবে।
আমার পরীক্ষাগুলোর পর এম. মার্টেন একইরকম পরীক্ষা করেছিলেন, তবে অনেক ভালভাবে, কারণ তিনি বাক্সভর্তি বীজগুলোকে সত্যিকারের সমুদ্রজলে রেখেছিলেন, যাতে ভাসন্ত উদ্ভিদের মত এরা পর্যায়ক্রমে ভিজে অবস্থায় এবং বাতাসের সম্পর্কে থাকে। তিনি ৯৪টি বীজ পরীক্ষা করেছিলেন এবং তাদের অধিকাংশই আমার থেকে ভিন্ন; কিন্তু তিনি সমুদ্র-নিকটবর্তী উদ্ভিদদের অনেক বড় ফল ও বীজ নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন; ভাসমান অবস্থার গড় সময় এবং লবণাক্ত জলের ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধ উভয়ের দ্বারাই এরা প্রভাবিত হয়ে থাকবে। বিপরীতক্রমে, ফলসমেত গাছ এবং শাখাপ্রশাখাগুলো তিনি পূর্বে শুষ্ক করেন নি; এবং যেমন আমরা দেখেছি, এটি এদের কয়েকটিকে আরও দীর্ঘসময় ভাসমান রাখতে সাহায্য করে। পরিণাম হয়েছিল যে তাঁর বিভিন্ন প্রকারের বীজগুলির টি ৪২ দিন ধরে ভেসেছিল এবং তারপর অঙ্কুরিত হতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু আমি সন্দেহ করি না যে তীব্র তরঙ্গে না-রাখা উদ্ভিদদের তুলনায় তরঙ্গে রাখা উদ্ভিদরা কম সময় ভেসে থাকবে। সুতরাং এটি বোধহয় নিরাপদভাবে মনে করা যায় যে একটি উদ্ভিদকুলের (ফ্লোরা) প্রায় ১০/১০০ উদ্ভিদের বীজরা শুষ্ক করার পর ৯০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রে ভেসে থাকতে পারে এবং তারপর অঙ্কুরিত হয়। ছোটগুলির তুলনায় বড় ফলগুলির ভেসে থাকার ঘটনাটি আশ্চর্যজনক, যেহেতু বড় বীজ অথবা বীজ সমেত উদ্ভিদরা, অ্যালফোনসে ডি ক্যান্ডোলের মতে যাদের বিস্তার সীমিত, অন্য কোন উপায় দ্বারা কদাচিৎ পরিবাহিত হতে পারে।
বীজরা মাঝেমাঝে অন্য উপায়েও পরিবাহিত হতে পারে। অধিকাংশ দ্বীপে স্রোতে ভেসে আসা কাঠ দেখতে পাওয়া যায়, এমনকি বহুবিস্তৃত মহাসমুদ্রের মধ্যে দ্বীপগুলোতেও; এবং প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবালদ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীরা সাধারণত ভাসন্ত গাছের শেকড় থেকে তাদের হাতিয়ারের জন্য পাথর সংগ্রহ করে, এই পাথরগুলো মূল্যবান রাজকীয় করের আওতায় পড়ে। আমি লক্ষ্য করেছি যে অনিয়মিত আকারের পাথরগুলো যখন গাছেদের শেকড়ে লেগে থাকে, তখন এই পাথরগুলোর কোনায় এবং গর্তগুলোতে মাটিও লেগে থাকে, এত নিখুঁতভাবে লেগে থাকে যে দীর্ঘ পরিবহণের ফলে মাটির ক্ষুদ্রাংশও ধুয়ে যায় না; ৫০ বছর বয়সের একটি ওক গাছের শেকড়ের মধ্যে রক্ষিত মাটিতে তিনটি দ্বিবীজপত্রী গাছ অঙ্কুরিত হয়েছিল : এই পর্যবেক্ষণের সঠিকতা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। আবার আমি দেখাতে পারি যে সমুদ্রে ভাসমান পাখিদের মৃতদেহগুলো কোন কোন সময় ভক্ষিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় এবং ভাসন্ত পাখিদের মধ্যে অনেক ধরনের বীজ এদের জীবনীশক্তি ধরে রাখে : যেমন, মটরদানা এবং ভেচের (এক ধরনের শুঁটিওয়ালা গাছ) বীজগুলো কয়েকদিন সমুদ্রজলে নিমজ্জিত রাখলে মরে যায়; কিন্তু ৩০ দিন ধরে কৃত্রিম সমুদ্রজলে ভাসন্ত পায়রার মৃতদেহ থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি বীজ আশ্চর্যজনকভাবে সকলেই অঙ্কুরিত হয়েছিল।
জীবন্ত পাখিরা বীজ পরিবহণের জন্য কার্যকরী মাধ্যম হতে পারে। আমি এমন অনেক উদাহরণ দিতে পারি যার দ্বারা দেখানো যায় যে বিভিন্ন প্রকার পাখিরা সমুদ্রের প্রবল বাতাসের দ্বারা মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে। আমরা ধরে নিতে পারি যে এইসব অবস্থায় এদের ওড়ার হার ঘণ্টায় প্রত্ব: ৩৫ মাইল; কয়েকজন গবেষক আরও উচ্চ হারের উদাহরণ দিয়েছেন। আমি কখনও এমন একটিও উদাহরণ দেখিনি, যেখানে পুষ্টিকর বীজগুলো পাখির অস্ত্রের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে যায়; কিন্তু ফলের শক্ত বীজগুলো একটি টার্কির (এক ধরনের পাখি) পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে অতিক্রম করে। আমি আমার বাগানে ছোট পাখিদের মল থেকে দু’মাসের ভিতরে ১২ প্রকার বীজ সংগ্রহ করেছিলাম, এগুলো নিখুঁত ছিল এবং এর মধ্যে কয়েকটি অঙ্কুরিত হয়েছিল। কিন্তু নিচের বিবরণটি আরও গুরুত্বপূর্ণ : পাখিদের মৃতদেহগুলো গ্যাস্ট্রিক রস নিঃসরণ করে না, এবং আমি পরীক্ষার দ্বারা জেনেছি, বীজের অঙ্কুরোদগমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। ধরা যাক এমন একটি পাখি পাওয়া গেছে যে অনেক খাদ্য গিলেছে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে সমস্ত শস্যকণাগুলো দ্বিতীয় পাকস্থলীর মধ্য দিয়ে বারো অথবা এমনকি আঠারো ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে যায় না। এই সময়ের মধ্যে একটি পাখি সহজেই ৫০০ মাইল দূরত্ব উড়ে যেতে পারে, এবং বাজপাখিরা পরিশ্রান্ত পাখিদের খুঁজে বেড়ায়, ফলে এদের বিদীর্ণ মৃতদেহগুলি এরূপে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কতিপয় বাজপাখি এবং পেঁচারা তাদের শিকারকে পুরোপুরি গিলে ফেলে এবং বারো থেকে কুড়ি ঘণ্টা পর এরা ক্ষুদ্র দলা উগরে দেয়, যা আমি চিড়িয়াখানার পাখিদের পরীক্ষার পর জেনেছি। এই দলাগুলার মধ্যে অঙ্কুরোদ্গমযোগ্য বীজ থাকে। জই, গম, জোয়ার, ক্যানারি, শন, লবঙ্গ এবং বিটের কিছু বীজ বিভিন্ন শিকারী পাখির পাকস্থলীতে বারো থেকে একুশ ঘণ্টা থাকার পর অঙ্কুরিত হয়েছিল; বিটের দুটি বীজ দুদিন এবং চোদ্দ ঘণ্টা থাকার পর অঙ্কুরিত হয়েছিল। আমি লক্ষ্য করেছি স্বাদু জলের মাছেরা অনেক স্থলজ এবং জলজ উদ্ভিদের বীজ খায়; পাখিরা প্রায়শই মাছ গিলে খায় এবং এভাবে বীজগুলি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাহিত হয়। মৃত মাছের পাকস্থলীতে আমি অনেক ধরনের বীজ জোর করে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলাম এবং এর পর মাছধরা ঈগল, স্টর্ক এবং পেলিক্যানদের এই মৃত মাছগুলো খেতে দিয়েছিলাম; অনেক ঘণ্টা পর এই পাখিরা হয় দলা পাকিয়ে এই বীজদের নিঃসরণ করেছিল অথবা মলের মাধ্যমে ত্যাগ করেছিল এবং এদের মধ্যে কতিপয় বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষমতা বজায় রেখেছিল। তবে কোন কোন বীজ এই প্রক্রিয়ায় নষ্টও হয়েছিল।
পঙ্গপালরা কোন কোন সময় স্থলভাগ থেকে বিরাট দূরত্ব উড়ে যায়। আফ্রিকার উপকূল থেকে ৩৭০ মাইল দূরে আমি নিজে একটিকে ধরেছিলাম, এবং আমি শুনেছি যে অন্যরা আরও দূরে ধরেছিল। রেভারেন্ড আর. টি. লো স্যার সি. লিয়েলকে জানিয়েছিলেন যে ১৮৪৪ সালের নভেম্বর মাসে ম্যাডেইরা দ্বীপে পঙ্গপালের ঝাঁক এসেছিল। এরা সংখ্যায় অসংখ্য ছিল, প্রবল তুষারঝড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা দ্বারা সৃষ্ট তুষারাদির মত পুরু এবং ওপরদিকে এমনভাবে বিস্তৃত যে দূরবীন দিয়ে দেখা যেতে পারত। দুই অথবা তিনদিন ধরে অন্ততঃ পাঁচ অথবা ছয় মাইল ব্যাসে এরা বিরাট উপবৃত্তাকারে ঘুরেছিল এবং রাত্রিতে উঁচু গাছে নেমে এসে গাছগুলোকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত করেছিল। যেভাবে এরা হঠাৎ এসেছিল, সেভাবেই হঠাৎ সমুদ্রের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তারপর আর কখনও ঐ দ্বীপে আসেনি। এখন যথেষ্ট সাক্ষ্য ছাড়াই বেশ কিছু কৃষক বিশ্বাস করে যে নাটালের কিছু অংশে পঙ্গপালরা মাঝেমাঝে আসার ফলে এদের মলের দ্বারা ক্ষতিকর বীজগুলি ঐ দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। এই বিশ্বাস অনুসারে মিঃ উইল একটি চিঠির সঙ্গে শুকনো বড়ির একটি ছোট প্যাকেট আমাকে পাঠিয়েছিলেন। এগুলো থেকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কয়েকটি বীজ আমি বের করে নিয়েছিলাম এবং এদের থেকে দুটি গণের দুটি প্রজাতির ঘাস জন্মেছিল। সুতরাং পঙ্গপালদের একটি ঝাঁক, যারা ম্যাডেইরাতে এসেছিল, মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে একটি দ্বীপে কয়েক প্রকার উদ্ভিদের প্রবর্তনে ভূমিকা পালন করে থাকবে।
পাখিদের ঠোঁট এবং পাগুলো সাধারণভাবে পরিষ্কার থাকলেও কোন কোন সময় মাটিও লেগে থাকে : একটি তিতির জাতীয় (প্যাট্রিজ) পাখির পা থেকে একটি ক্ষেত্রে একষট্টি গ্রেন এবং অন্য ক্ষেত্রে বাইশ গ্রেন মাটি অপসারিত করেছিলাম আমি এবং ঐ মাটিতে ভেচের বীজের মত বড় নুড়িপাথর ছিল। আরও একটি ভাল ঘটনা হচ্ছে : এক বন্ধু আমাকে একটি উড়কক পাখির পা পাঠিয়েছিলেন, তার হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত নয় গ্রেন ওজনের মাটি লেগে ছিল; এবং এতে টোডরাস নামক গাছের (জানকাস বুফোনিয়াস) একটি বীজ ছিল, যা পরে অঙ্কুরিত হয়েছিল এবং ফুলও হয়েছিল। ব্রাইটনের মিঃ সোয়েল্যান্ড, যিনি গত চল্লিশ বছর ধরে প্রচরণশীল পাখিদের সম্পর্কে পরীক্ষা করেছেন, আমাকে জানান যে তিনি প্রায়শই ওয়াগটেল (মটাসিলি), হুইট ইয়ার্স এবং হুইনচ্যাট (স্যাক্সিকোলা) পাখিরা আমাদের তিনি সমুদ্রতীরে প্রথম আসার সময় অবতরণ করার আগেই গুলি করে তাদের হত্যা করেন; কয়েকবার লক্ষ্য করেছেন যে এদের পায়ে মাটির ছোট ডেলা লেগে থাকে। প্রচুর তথ্যের সাহায্যে দেখানো যায় যে অনেক বীজ মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। যেমন, অধ্যাপক নিউটন আমাকে লাল পা-ওয়ালা প্যাট্রিজের পা পাঠিয়েছিলেন, ঐ পাখিটি আহত হয়েছিল, উড়তে পারত না এবং তার পায়ে শক্ত মাটির ডেলা লেগে ছিল যার ওজন ছিল সাড়ে ছয় আউন্স। মাটির ডেলাটি তিন বছর রাখার পর ভাঙা হয়েছিল ও জল দ্বারা ভেজানো হয়েছিল এবং একটি বেল গ্লাসে রাখা হয়েছিল। এর থেকে কমপক্ষে ৮২টি গাছ জন্মেছিল; এগুলির মধ্যে সাধারণ ওট সমেত ১২টি একবীজপত্রী, এবং অন্তত এক প্রকার ঘাস, ৭০টি দ্বিবীজপত্রী গাছ ছিল, যার পাতা পরীক্ষা করে জানা যায় অন্তত তিনটি ভিন্ন প্রজাতি ছিল। আমাদের সামনে এইসব তথ্য থাকার ফলে আমরা কি মনে করতে পারি যে অনেক পাখি যারা প্রতি বছর বায়ুতাড়িত হয়ে বিরাট মহাসমুদ্র অতিক্রম করে এবং যারা প্রতি বছর স্থানত্যাগ করে, উদাহরণস্বরূপ লক্ষ লক্ষ কুইল পাখি ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে, তারা তাদের পা অথবা ঠোঁটে আটকানো ময়লার মধ্যে কিছু বীজ অবশ্যই পরিবাহিত করবে? এ বিষয়ে পরে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে।
যেহেতু এটি সুবিদিত যে হিমশৈলগুলো কোন কোন সময় মাটি ও পাথর বহন করে এবং তার সঙ্গে ব্রাসউড নামক গাছ, হাড় এবং একটি স্থলচর পাখির বাসাও বহন করে, সেহেতু প্রায় নিঃসন্দেহেই বলা যেতে পারে যে লিয়েলের ইঙ্গিতমতো এরা মাঝেমাঝে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর এক অংশ থেকে অন্য অংশে বীজ বহন করে থাকবে এবং তুষারযুগে এখনকার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের এক অংশ থেকে অন্য অংশেও বীজ বহন করে থাকবে। এজোর দ্বীপগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে আটলান্টিক মহাসাগরের মূল ভূখণ্ডের সন্নিকটে অন্য দ্বীপগুলোর প্রজাতিদের তুলনায় ইউরোপে সাধারণ এমন অধিক সংখ্যক প্রজাতির উপস্থিতি এবং অক্ষাংশের কিছু পরিমাণ উত্তরীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য, আমি ভেবেছিলাম যে তুষারযুগের সময় এই দ্বীপগুলো অংশত বরফবাহিত বীজ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আমার অনুরোধে স্যার সি. লিয়েল অনুসন্ধান করার জন্য মিঃ হাটুঙ্গকে লিখেছিলেন যে এইসব দ্বীপে অদ্ভুত ধরনের বিরাটাকার পাথরের চাঁই তিনি দেখেছিলেন কিনা, এবং তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি আগ্নেয় (গ্রানাইট) ও অন্য পাথরের বিরাট খণ্ড দেখেছিলেন, যেগুলো দ্বীপপুঞ্জে (আর্কিপেলাগোতে) থাকে না। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে হিমশৈলগুলো পূর্বে মধ্য মহাসমুদ্রের দ্বীপগুলোর উপকূলে এই পাথুরে বোঝা বা ভারগুলো বহন করে এনে নামিয়ে দিয়েছিল, এবং এটি সম্ভবপর যে এরা সেখানে উত্তরদেশের গাছের কিছু বীজ বহন করে এনে থাকতে পারে।
পরিবহণের এইসব অনাবিষ্কৃত উপায় এবং অন্য উপায়সমূহ হাজার হাজার বছর ধরে কার্যকর রয়েছে বিবেচনা করে আমি মনে করি এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা হত যদি অসংখ্য উদ্ভিদ এইভাবে ব্যাপকভাবে পরিবাহিত না হত। কোন কোন সময় বলা হয় যে পরিবহণের এইসব উপায় আকস্মিক, কিন্তু এটি সঠিক নয় : সমুদ্রপ্রবাহ আকস্মিক হয় না অথবা বাতাসের দিকগুলোও আকস্মিক নয়। কিন্তু লক্ষ্য করা উচিত যে পরিবহণের যে—কোন উপায় কদাচিৎ অতি বিরাট দূরত্বে বীজগুলোকে বহন করবে, কারণ দীর্ঘ সময় সমুদ্রজলের বিক্রিয়ায় থাকার সময় বীজগুলো তাদের জীবনীশক্তি বজায় রাখে না অথবা পাখিদের অস্ত্রে কিংবা মৃতদেহে এদের বহুদূর বহন করা যেতে পারে না। তবে কয়েক শত মাইল চওড়া সমুদ্র অথবা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে, অথবা একটি মহাদেশ থেকে কোন পার্শ্ববর্তী দ্বীপে পরিবহণে মাঝেমাঝে এই উপায়গুলো যথেষ্ট হবে, কিন্তু বহুদূরে অবস্থিত এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশের ক্ষেত্রে নয়। বহুদূরবর্তী মহাদেশগুলোর ফ্লোরা (উদ্ভিদকুল) এইসব উপায়ের দ্বারা মিশ্রিত হবে না, বরং এখনকার মত পৃথক থাকবে। সমুদ্রপ্রবাহ তার গতিপথে উত্তর আমেরিকা থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত বীজগুলোকে কখনও বহন করবে না, যদিও এরা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে আমাদের পশ্চিম উপকূলে বীজসমূহ বহন করে থাকবে এবং করে, লবণজলে দীর্ঘ সময় নিমজ্জনের পর যদি নষ্টও হয়, তাহলেও আমাদের দেশের আবহাওয়া সহ্য করতে পারত না। প্রায় প্রত্যেক বছর একটি অথবা দুটি স্থলভাগের পাখি উত্তর আমেরিকা থেকে আয়ার্ল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত সমগ্র আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে উড়ে আসে; কিন্তু বীজগুলি শুধুমাত্র একটি উপায়েই এইসব বিরল ভ্রমণকারী পাখিদের দ্বারা বাহিত হতে পারত, অর্থাৎ এদের পায়ের পাতা অথবা ঠোঁটে ময়লা মাটি লেগে থাকার দ্বারা, যেটি একটি বিরল ঘটনা। এমনকি এক্ষেত্রে, অনুকূল মাটিতে বীজ পতনের সম্ভাবনা কত অল্প এবং কত কম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়! কিন্তু এটা বলা রীতিমতো ভুল হবে যে যেহেতু যতদূর জানা গেছে গ্রেট ব্রিটেনের মত পরিপূর্ণ একটি দ্বীপ (এবং এটি প্রমাণ করা অতিশয় কষ্টকর) পরিবহণের আকস্মিক উপায়গুলোর মাধ্যমে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে অধিবাসীদের প্রাপ্ত হয়নি, সেহেতু মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থিত একটি অল্প পরিপূর্ণ দ্বীপ একই উপায়গুলোর দ্বারা উপনিবেশকারীদের পাবে না। ব্রিটেনের তুলনায় কম পরিপূর্ণ একটি দ্বীপে পরিবাহিত শত প্রকারের বীজ অথবা প্রাণীদের মধ্যে সম্ভবত একাধিক ও নূতন বীজ বা প্রাণীরা বাসস্থানে এত ভালভাবে অভিযোজিত হবে না। যখন দ্বীপটি উঠছিল এবং যখন দ্বীপটি অধিবাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, সেই দীর্ঘ ভূতাত্ত্বিক যুগের অতিবাহনের সময় পরিবহণের আকস্মিক উপায়গুলোর দ্বারা কি ফলাফল হবে সে ব্যাপারে কিন্তু এটি কোন অখণ্ডনীয় যুক্তি নয়। প্রায় ঊষর স্থলভাগে, যেখানে কতিপয় অথবা অক্ষতিকর পতঙ্গ বা পাখি বসবাস করে, সেখানে প্রায় প্রত্যেকটি বীজ, যারা হঠাৎ এসেছে, যদি আবহাওয়া উপযুক্ত হয়, অঙ্কুরিত হবে এবং বেঁচে থাকবে।
তুষারযুগে বিস্তার
কয়েক শত মাইল নিচু জমি দ্বারা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন পর্বতশিখরগুলির, যেখানে আলপাইন প্রজাতি সম্ভবত থাকে না, অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অভিন্নতা হচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানত্যাগের আপাত সম্ভাবনা ছাড়া দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে একই প্রজাতির বসবাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। আলপ্স অথবা পিরেনিস পর্বতমালার তুষারাবৃত অঞ্চলে এবং ইউরোপের সর্বশেষ দক্ষিণে অঞ্চলে একই প্রজাতির অসংখ্য উদ্ভিদের বসবাসের ঘটনা হচ্ছে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়; কিন্তু এটি আরও বেশী উল্লেখযোগ্য যে ইউনাইটেড স্টেটস্ অফ আমেরিকার শ্বেত পর্বতমালার উদ্ভিদগুলো লাব্রাডার উদ্ভিদগুলোর মত একই রকম, এবং আসা গ্রে-র মতানুসারে ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বতমালাগুলোর উদ্ভিদের সঙ্গে এরা প্রায়শই সকলেই একই হয়। এমনকি ১৭৪৭ সালের এইসব তথ্য মেলিন-কে সিদ্ধান্ত করতে প্ররোচিত করেছিল যে অনেক স্বতন্ত্র স্থানে একই প্রজাতিরা স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে; এবং আমরাও এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী থাকতাম যদি আগাসি ও অন্যরা তুষারযুগ সম্বন্ধে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ না করতেন, যেটি, আমরা এখনই দেখব, এইসব বিষয়ের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে। জৈবিক এবং অজৈবিক প্রায় সব ধরনের কল্পনাযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে আছে যে অতি সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক যুগে মধ্য ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা মেরু-জলবায়ুর অধীন ছিল। স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের খাঁজ—কাটা পার্শ্বদেশ, মসৃণ উজ্জ্বল পৃষ্ঠদেশ সমেত পর্বতগুলো এবং এদের উপত্যকাসমূহ পরবর্তী সময়ে বরফে ঢাকা নদীগুলো নিজেদের কাহিনী যেভাবে বিবৃত করে, তার তুলনায় কোন পোড়ো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ তার নিজের কাহিনীকে সরলতরভাবে ব্যক্ত করতে পারে না। ইউরোপের জলবায়ু এত বিপুলভাবে পরবর্তিত হয়েছে যে উত্তর ইটালিতে পুরানো হিমবাহ দ্বারা পরিত্যক্ত বিশাল গ্রাবরেখাসমূহে এখন আঙুর ও ভুট্টা চাষ হয়। ইউনাইটেড স্টেটসের অধিকাংশ অঞ্চলে অদ্ভুত পাথরের চাঁই ও খাঁজকাটা পাথরগুলো পূর্বে তুষারযুগের অবস্থিতি প্রমাণ করে।
এডওয়ার্ড ফরবেসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইউরোপের অধিবাসীদের বিস্তারের ওপর তুষার—যুগের জলবায়ুর আগের প্রভাব বহুল পরিমাণে নিম্নরূপ। আগে যেমন ঘটেছিল তেমনভাবে একটি নূতন তুষারযুগ ধীরে ধীরে আসে এবং তারপর চলে যায় বলে ধরে নিলে আমরা আরও সহজেই পরিবর্তনসমূহকে বুঝতে পারব। যেহেতু শীত এসেছিল এবং যেহেতু দক্ষিণের আরও বেশী অঞ্চল উত্তরের অধিবাসীদের জন্য উপযুক্ত হয়েছিল, সেহেতু এরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পূর্বের অধিবাসীদের স্থান দখল করে থাকবে। কোন প্রতিবন্ধক দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হলে, এই অধিবাসীরা একই সময়ে আরও আরও দক্ষিণে সরে যাবে, সেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, পর্বতমালা বরফ ও তুষারে আচ্ছন্ন হবে এবং এদের পূর্বের আলপাইন অধিবাসীরা সমতলভূমিতে নেমে আসবে। যে সময় ঠাণ্ডা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল, সে সময় নিশ্চয়ই মেরু অঞ্চলীয় উদ্ভিদকুল (ফ্লোরা) এবং প্রাণীকুলের (ফনা) অস্তিত্ব ছিল যারা ইউরোপের মধ্যভাগ দখল করেছিল, আল্পস, পিরেনিস এবং এমনকি স্পেনের দক্ষিণদিক পর্যন্ত এরা বিস্তৃত হয়েছিল। ইউনাইটেড স্টেটস-এর এখনকার নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলো, এভাবে মেরু অঞ্চলীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের দ্বারা পূর্ণ হয়েছে এবং এরা ইউরোপের মত একই হবে; কারণ বর্তমান মেরু অঞ্চলীয় অধিবাসীরা, যারা সর্বত্র দক্ষিণদিকে বিস্তৃত হয়েছে বলে আমরা মনে করি, সারা পৃথিবীতে দারুণভাবে একইরূপ হয়।
উষ্ণতা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেরুদেশীয় আকাররা আবার উত্তরদিকে সরে যাবে এবং পর্বতমালার পাদদেশের বরফ গলে গিয়েছিল বলে সর্বদা ওপর দিকে উঠতে উঠতে মেরুদেশীয় আকাররা পরিষ্কৃত ও বরফগলা জমি দখল করবে, কারণ উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং বরফ উচ্চ থেকে আরও উচ্চে অপসারিত হয়েছিল, যখন এদের সহধর্মীরা উত্তরদিকে অপসারিত হচ্ছিল। সুতরাং যখন উষ্ণতা সম্পূর্ণরূপে ফিরে এসেছিল, তখন একই প্রজাতিদের, যারা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার নিচু জমিতে সাম্প্রতিককালে একত্রে বসবাস করেছিল, উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের মেরুঅঞ্চলে এবং পরস্পরের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত অসংখ্য বিচ্ছিন্ন পর্বতচূড়ায় পুনরায় দেখা যাবে।
এভাবে অতিশয় দূরবর্তী ইউনাইটেড স্টেটস এবং ইউরোপের পর্বতমালার বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য উদ্ভিদের পরিপূর্ণ সাদৃশ্য আমরা বুঝতে পারি। আমরা ঘটনাটি এভাবে আরও বুঝতে পারি যে পর্বতমালার আলপাইন উদ্ভিদরা উত্তরদিকে অথবা প্রায় এদের উত্তরদিকে বসবাসকারী মেরু আকারদের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত : যখন শীত এসেছিল তখন প্রথম প্রচরণ, এবং উষ্ণতা ফিরে আসার পর পুনঃপ্রচরণ সাধারণতঃ দক্ষিণ ও উত্তর দিকে হয়ে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, মি. এইচ. সি. ওয়াটসনের বক্তব্য অনুযায়ী স্কটল্যান্ডের এবং র্যামন্ডের মতানুযায়ী পিরেনিস পর্বতমালার আলপাইন উদ্ভিদরা উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উদ্ভিদদের সঙ্গে আরও বেশী করে সম্পর্কিত; ইউনাইটেড স্টেটস-এর উদ্ভিদদের সঙ্গে লাব্রাডার এবং সাইবেরিয়ার পর্বতমালার ঐ উদ্ভিদরা ঐ দেশের মেরুঅঞ্চলীয় আকারদের সঙ্গে সম্পর্কিত। আগে একটি তুষারযুগের ব্যাপক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এইসব মতবাদ ইউরোপ এবং আমেরিকার আলপাইন ও মেরু উৎপাদনগুলোর বর্তমান বিস্তারকে এত সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করে যে যখন অন্য অঞ্চলের দূরবর্তী পর্বতশিখরসমূহে একই প্রজাতিদের আমরা দেখি, তখন অন্য সাক্ষ্য ছাড়াই আমরা প্রায় সিদ্ধান্ত করতে পারি যে মধ্যবর্তী নিচু জমি অতিক্রম করে এদের প্রচরণকে পূর্বে সুযোগ দেওয়া ঠাণ্ডা আবহাওয়া এখন এদের অবস্থানের জন্য আরও উষ্ণ হয়েছে।
যেহেতু মেরুঅঞ্চলীয় আকাররা পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রথমে দক্ষিণদিকে এবং পরে পিছনের উত্তরদিকে অগ্রসর হয়েছিল, সেহেতু এরা এদের দীর্ঘ প্রচরণের সময় তাপমাত্রার যে-কোন বিরাট বৈচিত্র্যের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না; এবং এরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে একত্রে প্রচরণ করেছিল বলে এদের পারস্পরিক সম্পর্কও বেশী বিঘ্নিত হতে পারে না। সুতরাং এই গ্রন্থে উপস্থাপিত নীতি অনুযায়ী এই আকাররা অধিক রূপান্তরের প্রবণতাযুক্ত হবে না। কিন্তু যারা উষ্ণতা কিরে আসার মুহূর্তে প্রথমে পাদদেশে এবং অবশেষে পর্বতচূড়ায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়েছিল এমন আলপাইন উৎপাদনগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন হবে, কারণ এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে একই মেরুর সব প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে বহুদূরে পর্বতমালায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে এবং তখনও থেকে বেঁচে থাকবে; সম্ভবত এরা প্রাচীন আলপাইন প্রজাতিদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছিল, যারা তুষারযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে পর্বতমালায় নিশ্চয় অবস্থান করত এবং যারা শীতলতম যুগে অস্থায়ীভাবে নিচের সমতলভূমিতে বিতাড়িত হয়েছিল ও পরবর্তী সময়ে কিছু মাত্রায় পৃথক আবহাওয়ার প্রভাবাধীন হয়েছিল। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এভাবে কিছু মাত্রায় বিঘ্নিত হয়ে থাকবে; পরিণামে এরা রূপান্তরিত হতে প্রবণ হবে; কারণ যদি আমরা কতিপয় বিরাট ইউরোপীয় পর্বতমালার বর্তমান আলপাইন উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের পরস্পরের মধ্যে তুলনা করি—যদিও প্রজাতিদের অনেকেই একইরূপ থাকে কয়েকটি ভ্যারাইটি হিসেবে, কয়েকটি সন্দেহজনক আকার অথবা উপ-প্রজাতি হিসেবে এবং কয়েকটি ভিন্ন অথচ নিকট সম্পর্কীয় প্ৰজাতি হিসেবে কিছু পর্বতমালায় অবস্থান করে।
পূর্ববর্তী ব্যাখ্যা-সহ উদাহরণে আমি ধরে নিয়েছি যে আমাদের কল্পিত তুষারযুগের শুরুতে মেরুঅঞ্চলের উৎপাদনগুলো বর্তমানের মত সমস্ত মেরুঅঞ্চলে একইরূপ ছিল। কিন্তু এটিও মনে করা উচিত যে অনেক মেরুসদৃশ এবং কিছু নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলীয় আকাররা সারা পৃথিবীতে একইরূপ ছিল, কারণ নিচের পর্বতের ঢালু অঞ্চলে এবং উত্তর আমেরিকার ও ইউরোপের সমতলভূমিতে বর্তমানে অবস্থিত প্রজাতিদের কয়েকটি একইরূপ। প্রশ্ন উঠতে পারে যে কেমন করে আমি প্রকৃত তুষারযুগের শুরুতে উপ-মেরু এবং নাতিশীতোষ্ণ আকারদের সমরূপতার মাত্রা নির্ধারণ করি। বর্তমান যুগে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপ-মেরু এবং উত্তরীয় নাতিশীতোষ্ণ আকাররা পরস্পরের থেকে সমগ্র আটলান্টিক মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তুষারযুগের সময় যখন উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের অধিবাসীরা বর্তমান যুগের তুলনায় আরও দক্ষিণে বসবাস করত, তখন এরা নিশ্চয়ই মহাসমুদ্রের বিরাট ব্যবধানের দ্বারা পরস্পরের থেকে আরও সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে। অতএব সঙ্গতভাবেই জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে কেমন করে একই প্রজাতি তখন এবং পূর্বে দুটি মহাদেশে প্রবেশ করেছে। আমার বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যাখ্যাটি তুষারযুগ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে জলবায়ুর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। এ ব্যাপারে, নূতনতর প্লিয়োসিন উপপর্বে পৃথিবীর অধিকাংশ অধিবাসীরা এখনকার মত বিশেষভাবে একইরূপ ছিল, এবং আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে বর্তমানের তুলনায় আবহাওয়া গরম ছিল। অতএব আমরা মনে করি যে জীবরা, যারা এখন ৬০° অক্ষাংশে বসবাস করে, প্লিয়োসিন উপপর্বে আরও উত্তরের মেরুবৃত্তের ৬৬-৬৭° অক্ষাংশে বসবাস করত; এবং বর্তমানের মেরু অঞ্চলের উৎপাদনসমূহ তখন মেরুর আরও নিকটে বিচ্ছিন্ন স্থলভাগে বসবাস করত। এখন যদি আমরা পৃথিবীর গ্লোবের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে মেরুবৃত্তের মধ্যে আমরা দেখি যে সাইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপ থেকে আমেরিকার পূর্ব অঞ্চল পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন স্থলভাগ রয়েছে এবং আন্তঃপ্রচরণের জন্যে আরও অনুকূল আবহাওয়া থাকার ফলে মেরুঅঞ্চলের স্থলভাগের এই অবিচ্ছিন্নতা তুষারযুগের পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উপ-মেরু এবং নাতিশীতোষ্ণ আকারদের অনুমিত সমরূপতার ব্যাখ্যা করে।
পূর্বে উল্লিখিত কারণগুলি অনুসারে আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের মহাদেশগুলো, যদিও উচ্চতায় বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, দীর্ঘদিন প্রায় একই আপেক্ষিক অবস্থানে রয়েছে। এই বিশ্বাস অনুযায়ী ওপরের মতের সঙ্গে আমি দৃঢ়ভাবে সহমত পোষণ করি এবং সিদ্ধান্ত করি যে আরও পূর্বের এবং উষ্ণতর কোন যুগের সময়, যেমন প্রাচীনতর প্লিয়োসিন উপপর্বে, অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রায় অবিচ্ছিন্ন মেরুঅঞ্চলীয় স্থলভাগে বসবাস করত; এবং উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উভয় অঞ্চলেই এইসব প্রাণী এবং উদ্ভিদরা তুষারযুগ শুরু হওয়ার বহুপূর্বে ধীরে ধীরে দক্ষিণদিকে সরে যেতে আরম্ভ করেছিল, কারণ আবহাওয়া কম উষ্ণ হয়েছিল। আমার বিশ্বাস মতো আমরা বর্তমানে ইউরোপ এবং ইউনাইটেড স্টেটস-এর মধ্যভাগে অধিকাংশই রূপান্তরিত অবস্থায় এদের বংশধরদের দেখি। এই মতানুসারে উত্তর আমেরিকার এবং ইউরোপের উৎপাদনগুলির মধ্যে অতি অল্প একরূপতা সমেত সম্পর্কটি আমরা বুঝতে পারি—দুটি অঞ্চলের দূরত্ব এবং সমগ্র আটলান্টিক মহাসাগর দ্বারা এদের বিচ্ছিন্নতা বিবেচনা করলে এই সম্পর্কটি অতিশয় উল্লেখযোগ্য। আমরা একটি বিশেষ বিষয় সম্পর্কে আরও বুঝতে পারি যে, যার সম্বন্ধে কয়েকজন পর্যবেক্ষক বলেছিলেন যে পরবর্তী টার্শিয়ারি যুগের সময় ইউরোপ ও আমেরিকার উৎপাদনগুলি বর্তমানের তুলনায় পরস্পরের সঙ্গে আরও গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল, কারণ এইসব উষ্ণতর যুগে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের উত্তরাংশগুলো একটি সেতু হিসাবে কার্যকরী স্থলভাগের দ্বারা প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হয়ে থাকবে, এবং এদের অধিবাসীদের পারস্পরিক প্রচরণ শীতের দ্বারা অনতিক্রম্য হয়েছে।
প্লিয়োসিন উপপর্বে ধীরে ধীরে উষ্ণতা হ্রাস পাওয়ার সময়, যে মুহূর্তে সাধারণ প্রজাতিরা, যারা উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে বসবাস করত, মেরুবৃত্তের দক্ষিণে সরে গিয়েছিল, সেই মুহূর্তেই এরা পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে। আরও নাতিশীতোষ্ণ উৎপাদনগুলোর ক্ষেত্রে এই বিচ্ছিন্নতা নিশ্চয় আরও অনেক পূর্বে ঘটেছে। প্রাণী ও উদ্ভিদরা দক্ষিণদিকে সরে গিয়েছিল বলে এরা নিশ্চয়ই একটি বড় অঞ্চলে আমেরিকার স্থানীয় উৎপাদনগুলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে থাকবে এবং এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে থাকবে, এবং অন্য বিরাট অঞ্চলে ও দক্ষিণ গোলার্ধেও ঐরূপ ঘটে থাকতে পারে। পরিণামে অধিক রূপান্তরের জন্য এখানে প্রত্যেকটি জিনিস রয়েছে—কারণ কয়েকটি পর্বতমালায় এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মেরুঅঞ্চলগুলোতে আরও অধিক সাম্প্রতিককালের মধ্যে আলপাইন উৎপাদনগুলোর তুলনায় আরও বেশী রূপান্তর বিচ্ছিন্নভাবে পরিত্যক্ত হয়েছিল। অতএব যখন আমরা উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বর্তমানে জীবিত উৎপাদনগুলোর তুলনা করি, তখন আমরা অতি অল্প একইরূপ প্রজাতি দেখি (যদিও আসা গ্রে সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে পূর্বের অনুমানের তুলনায় আরও বেশী প্রজাতি একইরূপ হয়), কিন্তু আমরা প্রত্যেক বড় শ্রেণীতে অনেক আকার দেখি যাদের কোন কোন প্রকৃতিবিদ ভৌগোলিক জাত হিসেবে এবং অন্যদের ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন; এবং আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক আকারদেরও দেখি যাদের সব প্রকৃতিবিদরা বিশেষভাবে ভিন্ন হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছেন।
স্থলভাগের মতো সমুদ্রজলেও সামুদ্রিক প্রাণীকুলের (ফনা) দক্ষিণদিকে মন্থরভাবে প্রচরণ, যারা প্লিয়োসিন উপপর্বে অথবা আরও পূর্ব যুগে মেরুবৃত্তের অবিচ্ছিন্ন উপকূল বরাবর প্রায় একইরূপ ছিল, রূপান্তরের তত্ত্ব অনুযায়ী সমুদ্রজলে বর্তমানে জীবিত অনেক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত আকারদের সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার কারণ হয়ে থাকবে। আমি মনে করি যে এরূপে নাতিশীতোষ্ণ উত্তর আমেরিকার পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে কতিপয় ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত, এখনও জীবিত এবং বিলুপ্ত টার্শিয়ারি আকারদের উপস্থিতি আমরা বুঝতে পারি। আরও বেশী উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল যে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত ক্রাস্টেসিয়ান প্রাণী (যেমনটা ডানা-র অপূর্ব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে), কতিপয় মাছ এবং অন্য সামুদ্রিক প্রাণীরা ভূমধ্যসাগরে ও জাপান সমুদ্রে বসবাস করছে—এই দুটি অঞ্চল একটি সমগ্র মহাদেশ এবং বিশাল সমুদ্র দ্বারা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন।
উত্তর আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের সমুদ্রে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ও জাপানে এবং উত্তর আমেরিকার ও ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ স্থলভাগে হয় বর্তমানে অথবা পূর্বে বসবাসকারী প্রজাতিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এই সমস্ত বিষয়গুলির কারণ নির্ণয় সৃষ্টির তত্ত্বানুযায়ী অসাধ্য। আমরা এমন ধারণা পোষণ করতে পারি না যে এইরূপ প্রজাতিরা অঞ্চলগুলোর প্রায় সদৃশ ভৌতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একইরূপে সৃষ্টি হয়েছে; কারণ, উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি দক্ষিণ আমেরিকার কোন অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা অস্ট্রেলিয়ার কোন কোন অংশের তুলনা করি, তাহলে সামগ্রিক ভৌতিক পরিবেশে ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ দেশগুলোর অধিবাসীরা যে সম্পূর্ণরূপে অসদৃশ, তা আমরা লক্ষ্য করি।
উত্তর ও দক্ষিণে পর্যায়ান্বিত তুষারযুগ
এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসা উচিত। আমি স্থিরনিশ্চিত যে ফরবেসের মতবাদটিকে আরও প্রসারিত করা যেতে পারে। ইউরোপে ব্রিটেনের পশ্চিম উপকূল থেকে উরাল পর্বতমালা পর্যন্ত এবং দক্ষিণে পিরেনিস পর্বতমালা পর্যন্ত তুষারযুগের সাক্ষ্য খুঁজে পাই আমরা। হিমায়িত স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাহাড়ী বনানা বা গাছপালার প্রকৃতি থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সাইবেরিয়া একইভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। হুকারের মতানুসারে লেবাননের মধ্য অঞ্চল স্থায়ী তুষার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়েছিল এবং সৃষ্ট হিমবাহগুলো ৪০০ ফুট নিচে উপত্যকাসমূহে পতিত হত। এই পর্যবেক্ষক সম্প্রতি উত্তর আফ্রিকায় কম উচ্চতায় বিরাট বিরাট গ্রাবরেখা দেখেছেন। হিমালয়ে ৯০০ মাইল অন্তর অন্তর হিমবাহগুলির নিচে নামার অনেক চিহ্ন রয়েছে; এবং ডঃ হুকার আদিম ও বিশাল গ্রাবরেখাগুলোতে ভুট্টা জন্মাতে দেখেছিলেন। এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বিষুবরেখার বিপরীতদিকে ডঃ জে. হার্স্ট এবং ডঃ হেক্টর-এর চমৎকার গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি যে নিউজিল্যান্ডে বিরাট বিরাট হিমবাহগুলো পূর্বে নিচে নেমে এসেছিল, এবং এই দ্বীপে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন পর্বতমালায় ডঃ হুকার দ্বারা আবিষ্কৃত একই উদ্ভিদসমূহ পূর্বে তুষারযুগের উপস্থিতির একই কাহিনী ব্যক্ত করে। রেভারেন্ড ডব্লিউ. ক্লার্ক প্রেরিত তথ্যসমূহ থেকে মনে হয় যে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ—পূর্বের পর্বতমালায় অতীতের হিমবাহ প্রক্রিয়ার চিহ্নসমূহ রয়েছে।
এবার আমেরিকার দিকে তাকানো যাক। উত্তরার্ধে, ৩৬-৩৭° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত মহাদেশের পূর্বদিকে পাথরের বরফবাহিত ক্ষুদ্রাংশসমূহ লক্ষ্য করা গেছে, এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর, যেখানকার জলবায়ু এখন অতিশয় ভিন্ন, ৪৬° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত রকি পর্বতমালায় অদ্ভূত ধরনের বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইও লক্ষ্য করা গেছে। প্ৰায় বিষুবরেখার কাছাকাছি দক্ষিণ আমেরিকার কর্ডিলেরাতে হিমবাহগুলো বর্তমান উচ্চতার তুলনায় একসময় আরও নিচের দিকে বিস্তৃত হয়েছিল। মধ্য চিলিতে পোর্টিলো উপত্যকা বরাবর বিরাট বিরাট শিলাখণ্ড সমেত প্রচুর ক্ষয়প্রাপ্ত বালি, কাঁকর ইত্যাদি আমি দেখেছিলাম, যাতে কদাচিৎ সন্দেহ করা যেতে পারে যে এরা একদা গ্রাবরেখা সৃষ্টি করেছিল এবং মিঃ ফরবেস আমাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি কর্ডিলেরার বিভিন্ন অংশে ১৩° দঃ থেকে ৩০° দঃ পর্যন্ত প্রায় ১২০০ ফুট উচ্চতায় পাথরে গভীর খাঁজ লক্ষ্য করেছিলেন, যেগুলো নরওয়ের মতো, এবং এরূপে তিনি খাঁজকাটা নুড়ি সমেত বিরাট বিরাট নুড়ি ইত্যাদিও লক্ষ্য করেছিলেন। কর্ডিলেরার এই সমগ্র অঞ্চলে আরও বেশী উচ্চতায় প্রকৃত হিমবাহের অস্তিত্ব নেই। মহাদেশের উভয়দিকে আরও দক্ষিণে, ৪১° অক্ষাংশ থেকে সর্বদক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত, বর্তমান উৎসের বহুদূর থেকে বাহিত অসংখ্য বিরাট বিরাট শিলাখণ্ড অতীতের হিমবাহ প্রক্রিয়ার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করছে।
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের চতুর্দিকে হিমবাহ প্রক্রিয়া, উভয় গোলার্ধেই ভূতাত্ত্বিক অর্থে যুগটির সাম্প্রতিক কালের হওয়া, উভয় গোলার্ধে বিরাট সময় ধরে এর স্থায়িত্ব যা কাজের পরিমাণ থেকে বোঝা যায়, এবং শেষতঃ কর্ডিলেরার সমগ্র রেখা বরাবর হিমবাহসমূহের নিম্ন উচ্চতায় সাম্প্রতিককালে অবতরণ—এইসব তথ্য থেকে এক সময় আমার মনে হয়েছিল যে সমগ্র পৃথিবীর তাপমাত্রা তুষারযুগের সময় নেমে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মিঃ ক্রল তাঁর ধারাবাহিক মনোমুগ্ধকর স্মৃতিকথায় দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে জলবায়ুর তুষারযুগীয় অবস্থাটি হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতার বৃদ্ধির দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন ভৌতিক কারণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সমস্ত কারণগুলো একই পরিণামের দিকে চালিত হয়, কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালীটি সম্ভবত মহাসমুদ্রের স্রোত প্রবাহের ওপর পৃথিবীর কক্ষের উৎকেন্দ্রিকতার অপ্রত্যক্ষ প্রভাব। মিঃ ক্রলের মতানুসারে প্রত্যেক দশ অথবা পনের হাজার বছর অন্তর নিয়মিতভাবে তুষারযুগের আবির্ভাব ঘটে; এবং এগুলো দীর্ঘসময় অন্তর কঠোর হয় কয়েকটি কারণের জন্য, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যেমন স্যার সি. লিয়েল দেখিয়েছেন, স্থলভাগ ও জলভাগের আপেক্ষিক অবস্থান। মিঃ ক্রল বিশ্বাস করেন যে সর্বশেষ বিরাট তুষারযুগ ২৪০০০০ বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিল এবং অল্প পরিবর্তন-সহ প্রায় ১৬০০০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। আরও প্রাচীন তুষারযুগ সম্পর্কে কয়েকজন ভূতাত্ত্বিক প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে স্থিরনিশ্চিত হয়েছেন যে আরও প্রাচীন যুগের বিষয় আলোচনা না করেও বলা যায় মায়োসিন ও ইয়োসিন যুগে এরূপ ঘটেছিল। মিঃ ক্রলের সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিণাম হচ্ছে যে উত্তর গোলার্ধে যখন তুষারযুগ, দক্ষিণ গোলার্ধের তাপমাত্রা তখন প্রকৃতই বৃদ্ধি পায়, শীত নিশ্চয় মনোরম হয়, এবং এগুলি প্রধানত সামুদ্রিক প্রবাহের দিক-পরিবর্তনের জন্য ঘটে। বিপরীতক্রমে, উত্তর গোলার্ধেও এরকম হয় যখন দক্ষিণ গোলার্ধ তুষারযুগ অতিক্রম করে। এই সিদ্ধান্ত ভৌগোলিক বিস্তার সম্পর্কে এত বেশী আলোকপাত করে যে আমি এটি বিশ্বাস করতে প্রবলভাবে প্ররোচিত হই। কিন্তু প্রথমে আমি তথ্যসমূহ প্রদান করব যার একটি ব্যাখ্যা অপরিহার্য।
ডঃ হুকার দেখিয়েছেন যে দক্ষিণ আমেরিকার টিয়েরা ডেল ফুয়েগোর সপুষ্পক উদ্ভিদদের মধ্যে অনেক নিবিড় সম্পর্কযুক্ত প্রজাতি ছাড়া চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি প্রজাতি, যারা এখনকার অল্প উদ্ভিদকুলের কোন বিশ্বাসযোগ্য অংশ নয়, বিপরীত গোলার্ধে পরস্পরের থেকে বিরাট দূরত্বে অবস্থিত উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে সাধারণ হয়। বিষুববৃত্তীয় আমেরিকার অত্যুচ্চ পর্বতমালায় ইউরোপীয় গণগুলোর অন্তর্গত অধিক সংখ্যক প্রজাতি দৃষ্ট হয়। ব্রাজিলের অর্গান পর্বতমালায় গার্ডেনার লক্ষ্য করেছিলেন যে নাতিশীতোষ্ণ ইউরোপের কয়েকটি, দক্ষিণমেরুর কয়েকটি এবং আন্দিজ পর্বতমালার কয়েকটি গণ অবস্থান করে, যাদের মধ্যবর্তী নিম্ন উচ্চতার উষ্ণ দেশগুলোতে দেখা যায় না। কারাকাসের সিলা-তে কর্ডিলেরার বিশেষ গণগুলোর অন্তর্গত প্রজাতিদের শ্রদ্ধেয় হামবোল্ড বহু পূর্বেই লক্ষ্য করেছিলেন।
আফ্রিকায়, ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কতিপয় আকার এবং উত্তমাশা অন্তরীপের উদ্ভিদকুলের কয়েকটি প্রতিনিধিকে আবিসিনিয়ার পর্বতমালায় দেখা যায়। উত্তমাশা অন্তরীপে অল্প কয়েকটি ইউরোপীয় প্রজাতি, যারা মানুষ দ্বারা বাহিত নয় বলে বিশ্বাস করা হয়, এবং পর্বতমালায় কয়েকটি প্রতিনিধিত্বমূলক ইউরোপীয় আকার দেখতে পাওয়া যায়, যারা আফ্রিকার মধ্যবর্তী উষ্ণ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়নি। ডঃ হুকার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে ফার্নান্ডো পো উঁচু দ্বীপের উপরের অংশে এবং পার্শ্ববর্তী ক্যামেরুন পর্বতমালায় ও গিনিতে অবস্থানকারী কয়েকটি উদ্ভিদ আবিসিনিয়া পর্বতমালার এবং এরূপে নাতিশীতোষ্ণ ইউরোপের উদ্ভিদগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। হুকার-এর কাছ থেকে শোনার পর এখন এটিও মনে হয় যে রেভারেন্ড আর. টিলো একই নাতিশীতোষ্ণ উদ্ভিদের কয়েকটিকে কেপ ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের পর্বতমালায় আবিষ্কার করেছেন। বিষুবরেখার প্রায় কাছাকাছি, সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশে এবং কেপ ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের পর্বতমালায় একই নাতিশীতোষ্ণ আকারদের বিস্তৃতি উদ্ভিদ বিস্তারের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত নথিভুক্ত অতি আশ্চর্য ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।
হিমালয়ে এবং দক্ষিণ ভারতের বিচ্ছিন্ন পর্বতমালায়, সিলোনের (শ্রীলঙ্কা) উচ্চভূমিতে এবং জাভার আগ্নেয়গিরিময় অঞ্চলে হয় একইরূপ অথবা পরস্পরের প্রতিনিধিত্বমূলক এবং একই সময়ে ইউরোপের প্রতিনিধিত্বমূলক উদ্ভিদের কয়েকটিকে দেখা যায়, যাদের মধ্যবর্তী উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে দেখা যায় না। জাভার উচ্চতম শিখরগুলোতে সংগৃহীত উদ্ভিদদের গণগুলির তালিকা ইউরোপের একটি ছোট্ট পাহাড়ের সংগৃহীত উদ্ভিদের ছবি দেখায়! আরও আশ্চর্যজনক ঘটনাটি হচ্ছে যে অস্ট্রেলিয়ার বিশেষ আকাররা বোর্নিওর পর্বতমালার শিখরগুলোতে জন্মানো কোন কোন উদ্ভিদের প্রতিনিধিত্বমূলক। হুকার-এর কাছ থেকে আমি শুনেছি যে এইসব অস্ট্রেলীয় আকারদের কয়েকটি মালাক্কা পেনিনসুলার উচ্চভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং একদিকে ভারতবর্ষে ও অন্যদিকে উত্তরে জাপান পর্যন্ত অল্পভাবে বিস্তৃত।
ডঃ এফ. মুলার অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পর্বতমালায় কয়েকটি ইউরোপীয় প্রজাতিকে আবিষ্কার করেছেন; অন্য কয়েকটি প্রজাতিকে সমতলভূমিতে দেখা যায় যাদের মানুষ প্রবর্তন করেনি; এবং ডঃ হুকার আমাকে জানিয়েছেন যে ইউরোপীয় গণগুলোর একটি লম্বা তালিকা দেওয়া যেতে পারে যাদের অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় কিন্তু মধ্যবর্তী অতি উষ্ণ অঞ্চলে দেখা যায় না। ডঃ হুকারের বিখ্যাত “নিউজিল্যান্ডের ফ্লোরার ভূমিকা”-য় ঐ বিরাট দ্বীপের উদ্ভিদদের সম্পর্কে অনুরূপ এবং বিস্ময়কর তথ্য দেওয়া হয়েছে। অতএব আমরা লক্ষ্য করি যে পৃথিবীর সব অঞ্চলের আরও উচ্চ পর্বতমালায় এবং উত্তর ও দক্ষিণে নাতিশীতোষ্ণ সমতলভূমিতে জন্মানো কোন কোন উদ্ভিদ হয় একই প্রজাতি অথবা একই প্রজাতির ভ্যারাইটি। তবে লক্ষ্য করা উচিত যে এই উদ্ভিদরা যথাযথভাবে মেরুঅঞ্চলীয় আকার নয়, কারণ যেমন মিঃ এইচ. সি. ওয়াটসন মন্তব্য করেছেন, “মেরু থেকে বিষুবরেখার অক্ষাংশের দিকে অগ্রসর হলে আলপাইন অথবা পর্বতমালার উদ্ভিদকুল প্রকৃতই আরও কম পরিমাণে মেরুঅঞ্চলীয় হয়।” এইসব সমরূপ এবং নিবিড় সম্পর্কযুক্ত আকাররা ছাড়া, একই অতিবিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী অনেক প্রজাতি মধ্যবর্তী উষ্ণ নিম্নভূমিতে না পাওয়া গণগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়।
এইসব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুধুমাত্র উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; কিন্তু অনুরূপ কিছু ঘটনা স্থলচর প্রাণীদের সম্পর্কেও উল্লেখ করা যেতে পারে। সামুদ্রিক প্রাণীদের সম্পর্কে সদৃশ ঘটনাসমূহ এরূপে ঘটে, উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডানা-র বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি আমি, বক্তব্যটি হচ্ছে যে “এটি নিশ্চয় একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা যে নিউজিল্যান্ডের খোলকী প্রাণীরা পৃথিবীর অন্য অংশের তুলনায় এর বিপরীত পৃষ্ঠে অবস্থিত গ্রেট ব্রিটেনের খোলকী প্রাণীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ হয়।” স্যার জে. রিচার্ডসন-ও মাছের উত্তরীয় আকারদের নিউজিল্যান্ড, টাসমানিয়া ইত্যাদি উপকূলে পুনরাবির্ভাবের কথা বলেছেন। ডঃ হুকার আমাকে জানান যে শৈবালের পঁচিশটি প্রজাতি নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপে সাধারণ হয়, কিন্তু মধ্যবর্তী উষ্ণমণ্ডলীয় সমুদ্রগুলোতে এদের দেখা যায় না।
উপরোক্ত তথ্যসমূহ থেকে—যথা, আফ্রিকার সমগ্র বিষুবরেখা বরাবর উচ্চভূমিসমূহে এবং দক্ষিণ ভারতে, শ্রীলঙ্কায় ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে, এবং উষ্ণমণ্ডলীয় দক্ষিণ আমেরিকার বিরাট অঞ্চলে অল্পভাবে নাতিশীতোষ্ণ আকারদের উপস্থিতি—এটি স্থিরনিশ্চিত বলে মনে হয় যে কোন অতীত যুগে, নিঃসন্দেহেই তুষারযুগের কঠোরতম সময়ে, এইসব বিরাট মহাদেশগুলোর বিষুবরেখার নিচের নিচু জমিগুলোতে বেশ কিছু সংখ্যক নাতিশীতোষ্ণ আকার বসবাস করত। এই যুগে সামুদ্রিক উচ্চতায় বিষুব অঞ্চলীয় জলবায়ু একই অক্ষাংশে পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় বর্তমানের অভিজ্ঞতার তুলনায় সম্ভবত একই রকম ছিল অথবা বোধহয় আরও ঠাণ্ডা ছিল। এই শীতলতম যুগে বিষুবরেখার নিচে নিচু জমিসমূহে উষ্ণমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ বনানীর মিশ্রণ ঘটে থাকবে, যেমন হুকার হিমালয়ের ক্ষেত্রে বলেছেন যে হিমালয়ের নিচের ঢালু অংশে চার থেকে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় ঐরূপ বনানীর প্রাচুর্য দেখা যায়, কিন্তু সম্ভবত নাতিশীতোষ্ণ আকারদের প্রাধান্য রয়েছে। এরূপে ফার্নান্ডো পো-র পর্বতময় দ্বীপে, গিনিতে, মিঃ মান লক্ষ্য করেছিলেন যে নাতিশীতোষ্ণ আকাররা প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় আবির্ভূত হতে শুরু করে। পানামার পর্বতমালায় মাত্র দু’ হাজার ফুট উচ্চতায় ডঃ শিমান মেক্সিকোর মত বনানী লক্ষ্য করেছিলেন, যেখানে “অতি গরম অঞ্চলের আকাররা নাতিশীতোষ্ণ আকারদের সঙ্গে সুসমঞ্জসভাবে মিশ্রিত হয়েছে।”
এখন দেখা যাক যে যখন উত্তর গোলার্ধ বিরাট তুষারযুগের শীতলতম পর্যায় অতিক্রম করছিল, তখন দক্ষিণ গোলার্ধ প্রকৃতই উষ্ণতর ছিল—মিঃ ক্রলের এই সিদ্ধান্ত উভয় গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলসমূহে এবং উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের পর্বতমালায় বর্তমানে আপাতভাবে কারণ নির্ণয়ের অসাধ্য বিভিন্ন জীবের বিস্তারের ওপর কোন স্পষ্ট আলোকপাত করে কিনা। বছরের হিসেবে তুষারযুগ নিশ্চয় সুদীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছে এবং যখন আমরা স্মরণ করি যে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে ভিন্ন পরিবেশে উপযোগী হওয়া কিছু উদ্ভিদ এবং প্রাণী কি বিরাট অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে, তখন যে-কোন পরিমাণ প্রচরণের পক্ষে এই যুগটিকে যথেষ্ট বলেই মনে হয়। শৈত্য আরও বেশী-বেশী করে কঠোর হয়েছিল বলে মেরু—আকাররা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছিল; এবং এখনই দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে এটি প্রায় সন্দেহাতীত যে আরও সবল, প্রাধান্য বিস্তারকারী এবং অত্যন্ত বিস্তারশীল নাতিশীতোষ্ণ আকাররা বিষুব অঞ্চলীয় নিচু জমিসমূহ দখল করেছিল। এইসব উষ্ণ নিচুজমির অধিবাসীরা একই সময়ে দক্ষিণের উষ্ণমণ্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলসমূহে প্রচরিত হয়ে থাকবে, কারণ এই যুগে দক্ষিণ গোলার্ধ উষ্ণতর ছিল। তুষারযুগ শেষ হওয়ার পর উভয় গোলার্ধ পূর্বের তাপমাত্রায় ক্রমশ ফিরে এসেছিল; বিষুবরেখার নিচে নিচু জমিগুলোতে বসবাসকারী উত্তরীয় নাতিশীতোষ্ণ আকাররা পূর্বের বাসস্থানে বিতাড়িত হয়েছিল অথবা বিলুপ্ত হয়েছিল, এবং দক্ষিণদিক থেকে ফিরে আসা বিষুব অঞ্চলীয় আকারদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। তবে উত্তরীয় নাতিশীতোষ্ণ আকারদের কয়েকটি যে-কোন পার্শ্ববর্তী উচ্চভূমিতে প্রায় নিশ্চিতভাবেই আরোহণ করে থাকবে, যদি সেখানে উচ্চতা যথেষ্ট হয়, এবং ইউরোপের পর্বতমালার মেরু আকারদের মত এরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। এমনকি যদি জলবায়ু এদের বাঁচার পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী না-ও হয়ে থাকে তাহলেও এরা বেঁচে থাকতে পারবে, কারণ তাপমাত্রার পরিবর্তন অতি মন্থর হবে এবং উদ্ভিদরা সন্দেহাতীতভাবে ভিন্ন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার ক্ষমতার অধিকারী হয়, যেমন তাপ ও শৈত্য প্রতিরোধ করার ভিন্ন অঙ্গীয় ক্ষমতাসমূহ এদের বংশধরে বংশগতভাবে প্রেরণের দ্বারা দেখা গেছে।
এভাবে দক্ষিণ গোলার্ধও কঠোর তুষারযুগে প্রবেশ করেছিল, যখন উত্তর গোলার্ধ উষ্ণতর ছিল; এবং তখন দক্ষিণী নাতিশীতোষ্ণ আকাররা বিষুববৃত্তীয় নিচু জমিসমূহ দখল করেছিল। উত্তরীয় আকাররা, যারা পূর্বে পর্বতমালায় পরিত্যক্ত হয়েছিল, এই সময় নেমে এসেছিল এবং দক্ষিণী আকারদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছিল। উষ্ণতা ফিরে এলে শেষোক্তরা পর্বতমালায় অল্প কতিপয় প্রজাতিকে পরিত্যাগ করে নিজেদের পূর্ব বাসস্থানে ফিরে যাবে এবং উত্তরীয় আকারদের কয়েকটিকে, যারা পর্বতদুর্গ থেকে নেমে এসেছিল, এদের সঙ্গে দক্ষিণদিকে বহন করে নিয়ে যাবে। এভাবে উত্তর ও দক্ষিণ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলসমূহে এবং মধ্যবর্তী উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের পর্বতমালায় কতিপয় একইরূপ প্রজাতিকে আমরা দেখতে পাব। কিন্তু এইসব পর্বতমালায় অথবা বিপরীত গোলার্ধগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত প্রজাতিদের অনেক নূতন আকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে এবং কিছুটা ভিন্ন ভৌতিক পরিবেশের প্রভাবাধীন হতে হবে; অতএব এরা রূপান্তরিত হতে স্পষ্টতঃ বাধ্য হবে এবং বর্তমানে ভ্যারাইটি হিসেবে অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতি হিসেবে অবস্থান করবে; এবং এটাই হচ্ছে ঘটনা। উভয় গোলার্ধে পূর্বে তুষারযুগের আবির্ভাব আমরা নিশ্চয় মনে রাখব; একই পদ্ধতি অনুসারে, ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন একই অঞ্চলগুলোতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অসংখ্য প্রজাতির বসবাস এবং মধ্যবর্তী অতি উষ্ণ অঞ্চলসমূহে বর্তমানে না-পাওয়া গণগুলোর প্রজাতিদের অবস্থানের সন্তোষজনক কারণ উপস্থিত করে।
আমেরিকা সম্পর্কে হুকারের এবং অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে অ্যালফোনসে ডি ক্যান্ডোলের জোরালো বক্তব্য একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে যে আরও অনেক সমরূপ অথবা অল্পভাবে রূপান্তরিত প্রজাতিরা বিপরীত দিকের পরিবর্তে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রচরণ করেছে। তবে বোর্নিও ও আবিসিনিয়ার পর্বতগুলোতে কিছু দক্ষিণী আকার আমরা দেখি। উত্তরের স্থলভাগের বিরাট বিস্তারের জন্য এবং উত্তরীয় আকারদের নিজেদের বাসস্থানে অধিক সংখ্যায় থাকার জন্য এবং ফলস্বরূপ প্রতিযোগিতা ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উত্তরীয় আকারদের আরও নিখুঁত হওয়ার জন্য অথবা দক্ষিণী আকারদের তুলনায় উত্তরীয় আকারদের প্রভাবশালী ক্ষমতা থাকার জন্য উত্তর থেকে দক্ষিণে অধিক সংখ্যক প্রচরণ হয়েছে—এ-সব ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এবং এভাবে পর্যায়ক্রমিক তুষারযুগের সময় যখন দুটি দল বিষুব অঞ্চলে একত্রে মিলিত হয়েছিল, তখন উত্তরীয় আকাররা আরও শক্তিশালী ছিল এবং পর্বতমালায় নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করে রাখতে সমর্থ হয়েছিল এবং পরে দক্ষিণী আকারদের সঙ্গে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়েছিল; কিন্তু দক্ষিণী আকাররা উত্তরীয় আকারদের মতো করে এ-কাজটি করেনি। বর্তমান যুগে আমরা একইভাবে দেখি যে অধিক সংখ্যক ইউরোপীয় আকাররা লা প্লাটা, নিউজিল্যান্ড এবং কিছু মাত্রায় অস্ট্রেলিয়া অধিকার করেছে এবং দেশজদের পরাজিত পরেছে; অন্যদিকে, অল্প কয়েকটি দক্ষিণী আকার উত্তর গোলার্ধের যে-কোন অংশে অভিযোজিত হয়েছে, যদিও সম্ভবত বীজ বহনকারী পশুচর্ম, পশম এবং অন্যান্য বস্তু গত দুই অথবা তিন শতাব্দী ধরে লা প্লাটা থেকে এবং চল্লিশ অথবা পঞ্চাশ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপে বহুলাংশে আমদানি করা হয়েছে। তবে, ভারতের নীলগিরি পর্বতমালার অংশত ব্যতিক্রম ছাড়া, কারণ ডঃ হুকার-এর কাছ থেকে আমি শুনেছি যে এখানে অস্ট্রেলীয় আকাররা দ্রুত বীজ ছড়াচ্ছে এবং অভিযোজিত হয়েছে। সর্বশেষ বিরাট তুষারযুগের পূর্বে নিঃসন্দেহেই আন্তঃ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পর্বতমালা স্থানীয় আলপাইন আকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল; এবং এরা বৃহত্তর অঞ্চলগুলোতে ও উত্তরের দক্ষতর কর্মশালায় উৎপন্ন আরও প্রাধান্য বিস্তারকারী আকারদের নিকট প্রায় সর্বত্র বশ্যতা স্বীকার করেছে। অনেক দ্বীপে দেশজ আকাররা অভিযোজিত আকারদের সমান হয়েছে অথবা দেশজ আকারদের তুলনায় অভিযোজিত আকাররা সংখ্যায় অধিক হয়েছে; এবং এদের বিলুপ্তির এটাই হচ্ছে প্রথম ধাপ। পর্বতসমূহ হচ্ছে স্থলভাগের মধ্যে দ্বীপ এবং এদের অধিবাসীরা উত্তরের বৃহত্তর অঞ্চলগুলোতে উৎপন্ন আকারদের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেছে, যেমন একই উপায়ে প্রকৃত দ্বীপগুলির অধিবাসীরা মানুষের মাধ্যমে অভিযোজিত মহাদেশীয় আকারদের নিকট সর্বত্র বশ্যতা স্বীকার করেছে এবং এখনও করছে।
আন্তঃ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পর্বতসমূহে এবং উত্তর ও দক্ষিণ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলসমূহে স্থলজ ও সামুদ্রিক প্রাণীদের বিস্তারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। তুষারযুগের তীব্রতার সময় যখন এখনকার তুলনায় সমুদ্রস্রোতসমূহ ব্যাপকভাবে ভিন্ন ছিল, তখন নাতিশীতোষ্ণ সমুদ্রসমূহের কিছু অধিবাসী বিষুব অঞ্চলে পৌঁছে থাকবে; এদের মধ্যে কয়েকটি হয়তো শীতলতর স্রোতের সঙ্গে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে সমর্থ হয়েছিল, অন্যদিকে যতক্ষণ না দক্ষিণ গোলার্ধ তুষারযুগে প্রবেশ করেছিল এবং এদের আরও অগ্রগমনে অধিকতর সাহায্য করেছিল ততক্ষণ অন্যরা শীতলতর গভীরতায় অবস্থান করে থাকবে এবং বেঁচে থাকবে; ফরবেসের মতানুসারে প্রায় একই উপায়ে সুমেরীয় আকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহ উত্তরের নাতিশীতোষ্ণ সমুদ্রগুলোতে বর্তমান কাল পর্যন্ত অবস্থান করে।
সমরূপ ও সম্বন্ধযুক্ত সেইসব প্রজাতিদের বিস্তার এবং সম্বন্ধ বিষয়ে সমস্ত অসুবিধা উপরোক্ত মতবাদসমূহের দ্বারা অপসারিত হয়েছে বলে আমি মনে করি না, যারা এখন এত ব্যাপকভাবে ভিন্ন উত্তর ও দক্ষিণে এবং কোন কোন সময় মধ্যবর্তী পর্বতমালায় বসবাস করে। প্রচরণের সঠিক রেখার ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে না। আমরা বলতে পারি না কেন কোন কোন প্রজাতি স্থানত্যাগ করেছে এবং অন্যরা করেনি; কেন কোন কোন প্ৰজাতি রূপান্তরিত হয়েছে এবং নূতন আকারের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে অন্যরা অপরিবর্তিত রয়েছে। আমরা এইসব বিষয় ব্যাখ্যার আশা করতে পারি না, যতক্ষণ না আমরা বলতে পারি কেন একটি প্রজাতি মানুষের মাধ্যমে বিদেশে অভিযোজিত হয়েছে এবং অন্যটি হয়নি, কেন একটি প্রজাতি দুই অথবা তিনগুণ বিস্তৃত হয় এবং দুই অথবা তিনগুণ সাধারণ হয়, কিন্তু অন্য প্রজাতিটি নিজের বাসস্থানে আবদ্ধ থাকে।
অন্য অনেক বিশেষ বাধারও সমাধান হয়নি; যেমন, কারগুয়েলেন ল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং ফুয়েজিয়ার মত এত দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে একই উদ্ভিদের অবস্থান হুকার দেখিয়েছেন, কিন্তু লিয়েলের ইঙ্গিত মত হিমশৈলসমূহ এদের বিস্তারে সাহায্য করে থাকতে পারে। দক্ষিণ গোলার্ধের এইসব এবং দূরবর্তী অঞ্চলে প্রজাতিদের অবস্থান আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যারা, যদিও ভিন্ন, শুধুমাত্র দক্ষিণী গণগুলোর অন্তর্গত হয়। এইসব প্রজাতিদের কয়েকটি এত ভিন্ন হয় যে তুষারযুগের শুরু থেকে এদের প্রচরণ এবং প্রয়োজনীয় মাত্রায় পরবর্তী রূপান্তরের জন্য সময় লাগা আমরা কল্পনা করতে পারি না। তথ্যগুলো সম্ভবত ইঙ্গিত দেয় যে একই গণের অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিরা একটি সাধারণ কেন্দ্র থেকে বিকিরণ রেখায় প্রচরিত হয়েছে; এবং আমার মনে হয় উত্তর গোলার্ধের মত দক্ষিণ গোলার্ধেও সর্বশেষ তুষারযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে একটি উষ্ণতর যুগ ছিল, যখন বর্তমানে বরফে আচ্ছাদিত কুমেরু মহাদেশে একটি বিশেষ ও বিচ্ছিন্ন উদ্ভিদকুল (ফ্লোরা) ছিল। মনে করা যেতে পারে যে সর্বশেষ তুষারযুগের সময় এই উদ্ভিদকুলটি ধ্বংস হওয়ার পূর্বে, অল্প কয়েকটি আকার পরিবহণের আকস্মিক উপায়সমূহের দ্বারা এবং বিশ্রামস্থল হিসেবে বর্তমানে ডুবন্ত দ্বীপ-সমূহের সাহায্যে দক্ষিণ গোলার্ধের বিভিন্ন অংশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছিল। এভাবে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলসমূহ একই বিশেষ জীবন—আকারদের দ্বারা অল্পভাবে পূর্ণ হয়ে থাকতে পারে।
স্যার সি. লিয়েল একটি চমৎকার অনুচ্ছেদে, প্রায় আমার ভাষায়, ভৌগোলিক বিস্তারের প্রসঙ্গে সমগ্র পৃথিবী জুড়েজলবায়ুর বিরাট পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এবং এখন আমরা দেখেছি যে একটি গোলার্ধের ধারাবাহিক তুষারযুগসমূহ বিপরীত গোলার্ধের উষ্ণতর যুগসমূহের সঙ্গে সমকালীন হওয়া এবং তার সঙ্গে প্রজাতিদের মন্থর রূপান্তরকে স্বীকার করা, পৃথিবীর সমস্ত অংশে একই এবং সম্বন্ধ জীবন-আকারদের বিস্তারের অসংখ্য তথ্যকে মিঃ ক্রলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যায়। জীবনস্রোত এক যুগে উত্তর থেকে এবং অন্য যুগে দক্ষিণ থেকে প্রবাহিত হয়েছে, এবং উভয় ক্ষেত্রেই বিষুবরেখায় পৌঁছেছে; কিন্তু জীবনস্রোত বিপরীত দিকের তুলনায় উত্তর থেকে প্রবল শক্তিতে প্রবাহিত হয়েছে, এবং ফলস্বরূপ আরও স্বাধীনভাবে দক্ষিণকে প্লাবিত করেছে। যেমন স্রোতের টানের আনুভূমিক রেখায় ত্যাগ করে এবং উপকূলসমূহে ওপরে ওঠে যখন ঢেউ সর্বোচ্চ অবস্থায় ওঠে, তেমনি জীবনস্রোত এদের জীবিত প্রবাহগুলোকে একটি রেখায় সুমেরুর নিচুজমি থেকে বিষুবরেখার নিচে বিরাট উচ্চতায় ধীরে ধীরে আরোহণ করে আমাদের পর্বত শিখরগুলোতে ত্যাগ করে। পরিত্যক্ত, আটকে পড়া বিভিন্ন জীবদের মানুষের বর্বর জাতগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যারা বিতাড়িত হয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেক দেশের পর্বত-দুর্গগুলিতে বেঁচে আছে, যা চারপাশের নিচুজমির পূর্বের অধিবাসীদের একটি রেকর্ড হিসেবে আমাদের জানার সুবিধার জন্য কাজ করে।