১৫. পুনরাবৃত্তি এবং উপসংহার

পঞ্চদশ অধ্যায় —পুনরাবৃত্তি এবং উপসংহার

প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটির বিরুদ্ধে আপত্তিসমূহের পুনরাবৃত্তি—এটির অনুকূলে সাধারণ ও বিশেষ অবস্থাসমূহের পুনরাবৃত্তি—প্রজাতির অপরিবর্তনশীলতায় সাধারণ বিশ্বাসের কারণসমূহ—প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটিকে কতখানি প্রসারিত করা যেতে পারে—প্রাকৃতিক ইতিহাস অনুশীলনে এটির অবলম্বনের প্রভাবসমূহ—উপসংহারমূলক মন্তব্য। 

যেহেতু এই সমগ্র বইটি যুক্তিতে পরিপূর্ণ, তাই প্রধান প্রধান বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহ সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করলে পাঠকদের পক্ষে সুবিধা হতে পারে। 

আমি অস্বীকার করি না যে পরিবৃত্তি ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভব তত্ত্বটির বিরুদ্ধে অনেক এবং গুরুতর আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে। আমি এগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় বলে প্রথমেই মনে করা যেতে পারে না যে মানুষের বিচারবুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্টতর উপায়গুলোর দ্বারা নয়, বরং প্রত্যেক এককের পক্ষে কল্যাণকর অসংখ্য অল্প পরিবর্তনের সঞ্চয়নের দ্বারা অধিকতর জটিল অঙ্গ ও সহজাত প্রবৃতিগুলো নিখুঁত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, যদিও আমাদের কল্পনায় অলঙ্ঘ্যনীয়ভাবে বিরাট বলে মনে হয়, এই অসুবিধাটিকে বাস্তবসম্মত বলে বিচার করা যেতে পারে না যদি আমরা নিচের প্রস্তাবগুলো স্বীকার করি, যথা, জীবদেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং সহজাত প্রবৃত্তিসমূহ অন্ততঃ এককীয় পার্থক্য উপস্থিত করে—এখানে অস্তিত্বের সংগ্রাম চলে যার ফলে দেহের লাভজনক বিচ্যুতিগুলোর অথবা সহজাত প্রবৃত্তির সংরক্ষণ ঘটে—এবং শেষে, প্রত্যেক অঙ্গের প্রতিটিতেই কল্যাণকর নিখুঁত অবস্থার ক্রমবিন্যাসগত ধাপসমূহ অবস্থান করে থাকতে পারে। আমি মনে করি এইসব প্রস্তাবগুলোর সত্যতা বিতর্কিত হতে পারে না। 

এটি কল্পনা করাও অতিশয় অসুবিধাজনক যে কোন্ কোন্ ক্রমবিন্যাসগত ধাপ দ্বারা অনেক দেহগঠন নিখুঁত হয়েছে, আরও বিশেষভাবে ভঙ্গিল এবং বিলুপ্ত জীবদের ক্ষেত্রে, যারা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রকৃতিতে এত সংখ্যক অদ্ভুত ক্রমবিন্যাসগত ধাপ দেখি যে এটি ব্যক্ত করতে আমাদের অতিশয় সতর্ক হওয়া উচিত যে যে-কোন অঙ্গ অথবা সহজাত প্রবৃত্তি অথবা যে-কোন সমগ্র দেহগঠন অনেক ক্রমিক ধাপের দ্বারা তার বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে থাকতে পারে না। এটি নিশ্চয় স্বীকার করতে হবে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটির বিরুদ্ধে বিশেষ প্রতিবন্ধকের অনেক বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত একটি হচ্ছে যে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রমিকদের দুটি অথবা তিনটি সুনির্দিষ্ট জাত অথবা বন্ধ্যা স্ত্রী-পিঁপড়েদের অবস্থান; কিন্তু আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কেমন করে এই প্রতিবন্ধকগুলো দূর করা যেতে পারে। 

প্রথম সঙ্করণের পর প্রজাতিদের প্রায় সার্বজনীন বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি সম্পর্কে যা প্রথম সঙ্করণের পর ভ্যারাইটিদের প্রায় সার্বজনীন উর্বরতার সঙ্গে রীতিমতো উল্লেখযোগ্য বৈষম্য প্রদর্শন করে—আমি নবম অধ্যায়ের শেষে প্রদত্ত তথ্যগুলির পুনরাবৃত্তিমূলক বর্ণনায় পাঠকদের মনোযোগ দিতে অনুরোধ করব, যেখানে আমার মনে হয় চূড়ান্তভাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে এই বন্ধ্যাত্ব দুটি ভিন্ন প্রকারের গাছের একত্রে কলম করার অসমর্থতার তুলনায় কোন বিশেষ গুণ হয় না; কিন্তু এটি আন্তঃসঙ্করিত প্রজাতিদের জননতন্ত্রে সীমাবদ্ধ পার্থক্যদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়। দুটি প্রজাতির পারস্পরিক সঙ্করণের ফলাফলের বিপুল পার্থক্যে আমরা এই সিদ্ধান্তের সত্যতা দেখি—অর্থাৎ যখন একটি প্রজাতি প্রথমে পিতা এবং পরে মাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিরূপক এবং ত্রিরূপক উদ্ভিদগুলির উপমা থেকে স্পষ্টত একই সিদ্ধান্তে আসা যায়, কারণ আকাররা যখন অবৈধভাবে মিলিত হয় তখন তারা অল্প কয়েকটি বীজ উৎপাদন করে অথবা একেবারেই করে না, তাদের বংশধররা কমবেশী বন্ধ্যা হয় এবং এইসব আকাররা একই সন্দেহাতীত প্রজাতির অন্তর্গত হয়, এবং এরা জনন—অঙ্গ ও জননসংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো ব্যতীত পরস্পরের থেকে কোন বিষয়ে ভিন্ন নয়। 

যদিও আন্তঃসঙ্করণের পর ভ্যারাইটিদের এবং তাদের বর্ণসঙ্কর বংশধরের জননক্ষমতাকে সার্বজনীন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ জোরের সঙ্গে মতপ্রকাশ করেছেন, তবুও গার্টনার ও কোয়েলরয়টার-এর মতো বিখ্যাত বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত তথ্যসমূহ অনুযায়ী এটিকে সম্পূর্ণ সত্য বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না। পরীক্ষিত অধিকাংশ ভ্যারাইটিরা গৃহপালনাধীনে উৎপন্ন হয়েছে; এবং যেহেতু গৃহপালন (আমি কেবল আটকাবস্থার অর্থ করছি না) ঐ বন্ধ্যাত্ব অপসারণ করতে প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রবণতাযুক্ত হয়, যা উপমার দ্বারা বিচার করলে যদি আন্তঃসঙ্করিত হয় তাহলে পিতামাতা প্রজাতিকে প্রভাবিত করে থাকবে, আমাদের আশা করা উচিত হবে না যে গৃহপালন এইভাবে এদের রূপান্তরিত বংশধরদের, যখন সঙ্করিত হবে, বন্ধ্যা করবে। বন্ধ্যাত্বের এই অপনয়ন আপাতভাবে একই কারণ থেকে ঘটে, যে কারণে আমাদের গৃহপালিত প্রাণীরা বিচিত্র অবস্থাসমূহে অবাধে সন্তান উৎপাদনের প্রবণতাযুক্ত হয়; এবং আবার এদের জীবন-পরিবেশসমূহের পুনঃ পুনঃ পরিবর্তনে অভ্যস্ত হওয়া থেকে আপাতভাবে এটিও অনুসৃত হয়। 

দ্বিগুণক ও সমান্তরাল শ্রেণীর অনেক তথ্য প্রথম সঙ্করণের পর প্রজাতির এবং এদের সঙ্কর বংশধরের বন্ধ্যাত্ব বিষয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করে বলে মনে হয়। একদিকে, বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে পরিবেশের অল্প পরিবর্তন সমস্ত জীবে প্রাণবন্ততা ও জননক্ষমতা প্রদান করে। আমরা এও জানি যে একই ভ্যারাইটির ভিন্ন এককদের মধ্যে এবং ভিন্ন ভ্যারাইটিদের মধ্যে একটি সঙ্করণ তাদের বংশধরের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং নিশ্চয় তাদের আকার ও আয়তন বৃদ্ধি করে তেজ প্রদান করে। এটি প্রধানতঃ আকারটির জন্য হয়, যেটি কিছু পরিমাণ ভিন্ন পরিবেশে প্রভাবাধীন থেকে সঙ্করিত হয়; কারণ একটি কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে যদি একই ভ্যারাইটির সমস্ত এককদেরকে কয়েক বংশ পরম্পরায় একই পরিবেশে রাখা হয়, তাহলে সঙ্করণ থেকে উদ্ভূত ভাল ফল প্রায়শই অতিশয় হ্রাস পায় অথবা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। এটি বিষয়টির একটি দিক। অন্যদিকে, আমরা জানি যে প্রজাতিরা, যারা একইরূপ পরিবেশে অবস্থান করেছে, যখন তাদের নূতন ও বিরাটভাবে পরিবর্তিত পরিবেশে আবদ্ধ রাখা হয়, তখন হয় ধ্বংস হয়, অথবা বেঁচে থাকলে, বন্ধ্যা হয়, যদিও ভাল স্বাস্থ্য বজায় রাখে। আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর ক্ষেত্রে, যাদের হ্রাসবৃদ্ধিমূলক পরিবেশের মধ্যে দীর্ঘদিন রাখা হয়, এটি ঘটে না অথবা অল্পমাত্রায় ঘটে। অতএব যখন আমরা দেখি যে দুটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে একটি সঙ্করণের দ্বারা সৃষ্ট সঙ্করদের সংখ্যা অল্প হয় কারণ গর্ভধারণের ঠিক পরেই অথবা অতি অল্প বয়সে এরা ধ্বংস হয়, অথবা বেঁচে থাকলে কমবেশী বন্ধ্যা হয়; এটি একান্তই সম্ভবপর বলে মনে হয় যে দুটি ভিন্ন জৈব-সংগঠনের একত্রে মিলনের ফলে এদের জীবন-পরিবেশের বিরাট পরিবর্তনের জন্যই এই ফলাফল হয়। যিনি পরিষ্কার ভাষায় ব্যাখ্যা করবেন যে কেন, উদাহরণস্বরূপ, একটি হাতি অথবা একটি শৃগাল তাদের নিজস্ব দেশে আবদ্ধ অবস্থায় সন্তান উৎপাদন করবে না, অথচ গৃহপালিত শূকর অথবা কুকুর অতি বিচিত্র পরিবেশে অবাধে সন্তান উৎপাদন করবে, তিনি একই সময়ে এই প্রশ্নটির নির্দিষ্ট উত্তর দিতে সমর্থ হবেন যে কেন সঙ্করণের পর দুটি প্রজাতি এবং তাদের সঙ্কর বংশধররা সাধারণতঃ কমবেশী বন্ধ্যা হয়, অন্যথায় সঙ্করণের পর দুটি গৃহপালিত ভ্যারাইটি এবং তাদের বর্ণসঙ্কর বংশধররা সম্পূর্ণরূপে জননক্ষমতাসম্পন্ন হয়। 

ভৌগোলিক বিস্তারের বিষয়টি আলোচনা করলে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটি যে—সব বাধার সম্মুখীন হয় সেগুলো যথেষ্ট গুরুতর। একই প্রজাতির সমস্ত এককরা এবং একই গণের অথবা উচ্চতর গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিরা সাধারণ পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে; এবং সেজন্য বর্তমানে এদেরকে পৃথিবীর দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোর যেখানেই দেখা যাক না কেন, এরা বংশপরম্পরায় একটি স্থান থেকে অন্য সব স্থানে নিশ্চয় ভ্রমণ করে থাকবে। আমরা প্রায়শই কল্পনা করতে ব্যর্থ হই কেমন করে এটি ঘটে থাকতে পারে। তথাপি যেহেতু আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে প্রজাতিরা দীর্ঘ সময় একইরকম বৈশিষ্ট্যমূলক আকার বজায় রেখেছে, সময় এত দীর্ঘ যে বছর দ্বারা হিসেব করতে হয়, একই প্রজাতির অনিয়মিত ব্যাপক পরিব্যক্তির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত হবে না; কারণ অতি দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অসংখ্য উপায়ে ব্যাপক প্রচরণের একটি ভাল সম্ভাবনা থেকে থাকবে। ভাঙ্গা অথবা বিচ্ছিন্ন একটি বিস্তার মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রজাতিদের বিলুপ্তির দ্বারা হয় বলে মনে করা যেতে পারে। এটি অস্বীকার করা যেতে পারে না যে বিভিন্ন আবহসংক্রান্ত এবং ভৌগোলিক পরিবর্তনের সম্পূর্ণ ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমরা অতিশয় অজ্ঞ, যা বর্তমান সময়ে পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছে; এবং এরূপ পরিবর্তনগুলো প্রচরণকে প্রায়শই সহজ করে থাকবে। উদাহরণ হিসেবে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি সারা পৃথিবী জুড়ে একই ও সম্বন্ধীয় প্রজাতিদের বিস্তারের ওপর তুষারযুগের প্রভাব কত শক্তিশালী। আমরা এখনও পরিবহণের অনেক অনিয়মিত উপায় সম্পর্কে অজ্ঞ। দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন অঞ্চলসমূহে বসবাসকারী একই গণের ভিন্ন প্রজাতিদের ক্ষেত্রে, যেহেতু রূপান্তর প্রক্রিয়াটি প্রয়োজনানুসারে মন্থর হয়েছে, দীর্ঘ সময়ের মধ্যে প্রচরণের সমস্ত উপায়গুলো সম্ভবপর হয়ে থাকবে; এবং ফলস্বরূপ একই গণের প্রজাতিদের ব্যাপক ব্যাপ্তির বাধাটি কিছুমাত্রায় লঘু হবে। 

যেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি অনুসারে আমাদের বর্তমানের ভ্যারাইটিদের মতো এত সূক্ষ্ম ক্রমবিন্যাসগত ধাপ দ্বারা প্রত্যেক গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিকে একত্রে সংযুক্ত করে মধ্যবর্তী আকারদের একটি অনন্ত সংখ্যা নিশ্চয়ই অবস্থান করে থাকবে, সেহেতু এটি জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে : কেন আমরা আমাদের চতুর্দিকে এইসব সংযোজক আকারদের দেখি না? কেন সমস্ত জীব জটিল বিশৃঙ্খলায় একত্রে মিশ্রিত হয় না? বর্তমানের আকারদের সম্পর্কে, আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে এদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তকারী সংযোজকগুলোকে (বিরল ঘটনা ছাড়া) আবিষ্কারের আশা করার অধিকার আমাদের নেই, কিন্তু শুধুমাত্র প্রত্যেক এবং কয়েকটি বিলুপ্ত ও স্থানচ্যুত আকারদের মধ্যেকারগুলো ছাড়া। এমনকি একটি বিরাট অঞ্চলে, যা দীর্ঘদিন ধরে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এবং যেখানে একটি প্রজাতির বসবাসের একটি জেলা থেকে সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা বসবাসের অন্য জেলায় অগ্রসর হওয়ার সময় অজ্ঞাতসারে আবহাওয়া ও অন্য জীবনাবস্থাগুলো পরিবর্তিত হয়, মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহে মধ্যবর্তী আকারদের আবিষ্কারের আশা করার কোন অধিকার আমাদের নেই। কারণ আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে একটি গণের শুধুমাত্র কতিপয় প্ৰজাতি কখনও—সখনও পরিবর্তিত হয়, অন্য প্রজাতিরা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় এবং কোন রূপান্তরিত বংশধর রেখে যায় না। প্রজাতিদের মধ্যে যেগুলো পরিবর্তিত হয়, তাদের মধ্যে কয়েকটি একই দেশের মধ্যে একই সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং সমস্ত রূপান্তর মন্থরভাবে কার্যকরী হয়। আমি এও দেখিয়েছি যে সম্ভবত মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহে প্ৰথমে অবস্থানরত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা অন্যথায় সম্বন্ধযুক্ত আকারদের দ্বারা স্থানচ্যুত হতে বাধ্য হবে; কারণ পরেরগুলো, যারা অধিক সংখ্যায় অবস্থান করে, কম সংখ্যায় অবস্থানকারী মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের তুলনায় সাধারণত দ্রুত হারে রূপান্তরিত ও উন্নত হবে; অতএব পরিণামে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা স্থানচ্যুত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। 

পৃথিবীর জীবিত ও বিলুপ্ত অধিবাসীদের মধ্যে, এবং প্রত্যেক আনুক্রমিক যুগে বিলুপ্ত ও তখন বয়স্কতর প্রজাতিদের মধ্যে সংযোগকারী অসংখ্য সংযোজকদের বিনাশের তত্ত্বানুসারে, কেন প্রত্যেক ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তর এইসব সংযোজকদের দ্বারা পূর্ণ থাকে না? কেন জীবাশ্ম—ধ্বংসাবশেষের প্রত্যেক সংগ্ৰহ জীবন-আকারদের ক্রমবিন্যাসগত ধাপ ও পরিব্যক্তির সরল সাক্ষ্য প্রদান করে না? ভূতাত্ত্বিক গবেষণা অনেক সংযোজকের পূর্ব অবস্থান সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে, যারা জীবনের অসংখ্য আকারদের একত্রে এনেছে; এটি তত্ত্বটির পক্ষে প্রয়োজনীয় অতীত ও বর্তমান প্রজাতিদের মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম ক্রমিক ধাপ উপস্থিত করে না; তত্ত্বটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনেক আপত্তির মধ্যে এটাই সুস্পষ্ট। আবার কেন সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীগুলো আনুক্রমিক ভূতাত্ত্বিক স্তরগুলোতে হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়, যদিও এটি অমূলক? যদিও এখন আমরা জানি যে জীবরা ক্যামব্রিয়ান সিস্টেমের নিম্নতম স্তরটির সঞ্চয়নের বহু পূর্বে, গণনার অতীত অতি আদিমকালে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল, তথাপি কেন আমরা ক্যামব্রিয়ান জীবাশ্মের পূর্বপূরুষদের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা পরিপূর্ণ বিরাট বিরাট স্তর এই সিস্টেমের নিচে দেখতে পাই না? কারণ তত্ত্বটি অনুসারে, এইরূপ স্তর পৃথিবীর ইতিহাসের এইসব অজানা ও প্রাচীন যুগে কোথায় নিশ্চয় সঞ্চিত হয়ে থাকবে। 

অধিকাংশ ভূতাত্ত্বিকদের বিশ্বাসের তুলনায় ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণকে অতিশয় ত্রুটিপূর্ণ বলে ধরে নিয়েই এইসব প্রশ্ন ও আপত্তির উত্তর দিতে পারি আমি। পূর্বে সুনিশ্চিতভাবে অবস্থানকারী অসংখ্য প্রজাতির অসংখ্য বংশের তুলনায় আমাদের যাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত নমুনার সংখ্যা প্রায় কিছুই না। যে-কোন দুটি অথবা ততোধিক প্রজাতির পিতামাতা আকারটি তার সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তার রূপান্তরিত বংশধরের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী হবে না—পাহাড়ী পায়রার গলার থলিতে ও লেজে তার বংশধর পাউটার ও লক্কা পায়রাদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী হওয়ার তুলনায় বেশী নয়। দুটিকে ভালভাবে পরীক্ষা না করলে আমরা একটি প্রজাতিকে অন্য একটি এবং রূপান্তরিত প্রজাতির পিতামাতা হিসেবে চিহ্নিত করতে সমর্থ হব না, যতক্ষণ না আমরা মধ্যবর্তী সংযোজকদের অধিকাংশকে দেখতে পাই, এবং ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অপূর্ণাঙ্গতার জন্য, অসংখ্য সংযোজক আবিষ্কারের আশা করার অধিকার আমাদের নেই! যদি দুটি অথবা তিনটি অথবা আরও অধিক সংযোজক-আকার আবিষ্কৃত হত, তাহলে অনেক প্রকৃতিবিজ্ঞানী পার্থক্যগুলো অতি অল্প হলেও এদের অনেক নূতন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতেন, আরও বিশেষভাবে যদি এদের বিভিন্ন উপ—স্তরগুলোতে পাওয়া যেত। বর্তমানের অসংখ্য সন্দেহজনক আকারের নাম করা যায় যারা সম্ভবত ভ্যারাইটি; কিন্তু কে দাবী করবে যে ভবিষ্যতে অসংখ্য জীবাশ্ম-সংযোজক আবিষ্কৃত হবে, এবং এইসব সন্দেহজনক আকারদের ভ্যারাইটি বলা উচিত হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা সমর্থ হবেন? পৃথিবীর শুধুমাত্র অল্প অংশই ভূতাত্ত্বিকভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে। কতিপয় শ্রেণীর জীবরা অন্ততঃ যে-কোন বিরাট সংখ্যায় জীবাশ্মাবস্থায় সংরক্ষিত হতে পারে। একবার সৃষ্টি হওয়ার পর অনেক প্রজাতি কখনও আরও পরিবর্তিত হয় না, বরং রূপান্তরিত বংশধর না রেখে বিলুপ্ত হয়; প্রজাতিদের একই আকার বজায় রাখার সময়কালের তুলনায় রূপান্তরের সময়কালটি, যদি বছরের মাপেও দীর্ঘ হয়, অল্প হয়। প্রভাবশালী ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরা পুনঃপুনঃ এবং অতিশয় পরিবর্তিত হয়, এবং ভ্যারাইটিরা প্রায়শই স্থানীয় হয়—উভয়ই যে-কোন ভূস্তরে মধ্যবর্তী সংযোজকদের আবিষ্কারের সম্ভাবনা না থাকার কারণ ঘটায়। স্থানীয় ভ্যারাইটিরা অন্য ও দূরবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত হবে না যতদিন না তারা প্রয়োজনানুগভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হয়; এবং যখন এরা বিস্তৃত হয় এবং ভূতাত্ত্বিক স্তরে আবিষ্কৃত হয়, তখন মনে হয় যেন এরা সেখানে হঠাৎ সৃষ্ট হয়েছে এবং নূতন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়। অধিকাংশ ভূস্তর এদের সঞ্চয়নে সবিরাম হয়েছে এবং এদের স্থায়িত্বকাল সম্ভবত প্রজাতিক আকারদের গড় স্থায়িত্বকালের তুলনায় কম হয়। আনুক্রমিক ভূস্তরগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরস্পরের থেকে বিরাট সময়ান্তর দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কারণ ভবিষ্যতের নগ্নীভবন প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট পুরু জীবাশ্মপূর্ণ ভূস্তরসমূহ সাধারণ নিয়মানুসারে শুধুমাত্র যেখানে সঞ্চিত হতে পারে, সেখানেই সমুদ্রের অবনমনশীল তলের ওপর অধিক পলি সঞ্চিত হয়। স্থায়ীতল এবং উত্থানের পর্যায়ান্বিত সময়কালে সাক্ষ্যপ্রমাণটি সাধারণত শূন্য হবে। এইসব পরবর্তী যুগে জীবন-আকাররা সম্ভবত আরও বেশী পরিবর্তিত হবে এবং অবনমনের যুগে আরও বেশী বিলুপ্ত হবে। 

ক্যামব্রিয়ান ভূস্তরের নিচে জীবাশ্মসমৃদ্ধ স্তরের অনুপস্থিতি সম্পর্কে, দশম অধ্যায়ে প্রদত্ত প্রকল্পটিই পুনরায় উল্লেখ করা যায়; যথা, যদিও আমাদের মহাদেশ ও মহাসমুদ্রগুলো তাদের বর্তমান প্রায় আপেক্ষিক অবস্থানে যুগ-যুগ ধরে অবস্থান করে রয়েছে, তথাপি মনে করার কোন কারণ নেই যে এরা সবসময় এভাবেই থেকেছে; ফলস্বরূপ, আজ পর্যন্ত আমাদের জানার তুলনায় অনেক পুরানো ভূস্তর বিরাট মহাসমুদ্রগুলোর তলায় চাপা পড়ে থাকতে পারে। অনুমানকৃত জৈব পরিবর্তনের জন্য আমাদের পৃথিবীর জমাট বাঁধার সময় থেকে সময়ের অতিবাহন যথেষ্ট নয়, এ সম্পর্কে স্যার উইলিয়াম থমসনের আপত্তিটি সম্ভবত যাবতীয় আপত্তির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি শুধু বলতে পারি যে প্রথমত বছর দ্বারা পরিমাপকৃত কি হারে প্রজাতিরা পরিবর্তিত হয় তা আমরা জানি না, এবং দ্বিতীয়ত, অনেক দার্শনিক এখনও পর্যন্ত স্বীকার করতে ইচ্ছুক নন যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন সম্পর্কে এবং আমাদের পৃথিবীর অভ্যন্তরের অতীত স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট জানি। 

ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্য প্রমাণসমূহ যে ত্রুটিপূর্ণ এটি সকলেই স্বীকার করবেন; কিন্তু মাত্র কয়েকজনই স্বীকার করতে ইচ্ছুক হবেন যে এটি আমাদের তত্ত্বের পক্ষে যতটুকু প্রয়োজনীয়, তার থেকে বেশী মাত্রায় ত্রুটিপূর্ণ নয়। যদি আমরা সময়ের যথেষ্ট দীর্ঘ ব্যবধানগুলো লক্ষ্য করি, তাহলে ভূবিদ্যা ঘোষণা করে যে প্রজাতিরা সকলে পরিবর্তিত হয়েছে; এবং আমাদের তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয় উপায়েই এরা পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ এরা মন্থর গতিতে এবং ক্রমিক উপায়ে পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা স্পষ্টত দেখি যে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন ভূত্তরের জীবাশ্মদের তুলনায় পর্যায়ক্রমিক ভূস্তরের জীবাশ্মরা অনিবার্যরূপে পরস্পরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়। 

এগুলোই হচ্ছে কয়েকটি প্রধান আপত্তি ও প্রতিবন্ধকের সমষ্টি, যা সঠিকভাবে তত্ত্বটির বিরূদ্ধে উত্থাপন করা যেতে পারে। এখন আমি উত্তর ও ব্যাখ্যাগুলো সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করেছি। অনেক বছর ধরে এগুলির গুরুত্ব সম্বন্ধে রীতিমতো অসুবিধা অনুভব করেছি আমি। কিন্তু এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে আরও গুরুত্বপূর্ণ আপত্তিগুলো সেই প্রশ্নগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত, যেগুলো সম্পর্কে আমরা স্বীকার করি যে আমরা সে বিষয়ে অজ্ঞ, অথবা আমরা জানি না আমরা কত অজ্ঞ। সরলতম ও সবচেয়ে নিখুঁত অঙ্গগুলোর মধ্যে সমস্ত সম্ভবপর সংক্ৰমণগত ক্রমবিন্যাস সম্পর্কেআমরা কিছুই জানি না; এটি দাবী করা যেতে পারে না যে দীর্ঘ বছর অতিবাহনের সময় বিস্তারের বিচিত্র উপায়গুলো সম্পর্কে আমরা জানি, অথবা আমরা জানি ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ কত ত্রুটিপূর্ণ হয়। এইসব আপত্তি যতই গুরুতর হোক, আমার বিচারে পরবর্তী রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বকে বাতিল করতে এগুলো আদৌ যথেষ্ট নয়। 

যুক্তিটির অন্য দিকটি এখন আমাদের দেখা উচিত। গৃহপালনাধীন অবস্থায় আমরা অত্যধিক পরিবর্তনশীলতা লক্ষ্য করি, যা জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশগুলোর দ্বারা সংঘটিত হয়, অথবা অন্ততঃ সক্রিয় হয়; কিন্তু এটি প্রায়শই এত অস্পষ্ট উপায়ে হয় যে আমরা পরিবর্তনগুলোকে স্বতঃস্ফূর্ত বলে বিবেচনা করতে প্রলুব্ধ হই। পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা : অনেক জটিল নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়—যেমন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বৃদ্ধি, ক্ষতিপূরণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ধিত ব্যবহার ও অব্যবহার, এবং চারিদিকের পরিবেশের নির্দিষ্ট কার্যকলাপ দ্বারা। কত বিপুলভাবে আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলো রূপান্তরিত হয়েছে তা নিরূপণ করার অনেক অসুবিধা রয়েছে; কিন্তু আমরা নিরাপদে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে পরিমাণটি অত্যধিক হয়েছে, এবং রূপান্তরগুলো দীর্ঘসময় পর্যন্ত বংশপরম্পরায় বংশগতভাবে প্রেরিত হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন-পরিবেশ একইরকম থাকে, ততক্ষণ আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে একটি রূপান্তর যা ইতিমধ্যে অনেক বংশ জুড়ে বংশপরম্পরায় প্রেরিত হয়েছে, তা অনির্দিষ্ট সংখ্যক বংশ ধরে অনবরত প্রেরিত হতে পারে। পক্ষান্তরে, আমাদের হাতে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে যে পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা যখন একবার ভূমিকা পালন করে, তখন গৃহপালনাধীন অবস্থায় অতিদীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয় না; অথবা আমরা জানি না এটি কখনও বন্ধ হয় কিনা, কারণ আমাদের সবচেয়ে বয়স্ক গৃহপালিত উৎপাদনগুলো এখনও অনিয়মিতভাবে নূতন ভ্যারাইটিদের উৎপাদন করে। 

প্রকৃতপক্ষে মানুষ পরিবর্তন ঘটায় না, সে শুধু অনভিপ্রেতভাবে জীবদেরকে নূতন পরিবেশে স্থাপন করে, এবং এরপর প্রকৃতি জীবের ওপর কার্যপ্রক্রিয়া শুরু করে এবং পরিবর্তনের কারণ ঘটায়, কিন্তু মানুষ প্রকৃতিপ্রদত্ত পরিবর্তনগুলোকে নির্বাচিত করে এবং এরূপ যে-কোন ইচ্ছাকৃত উপায়ে এদের পুঞ্জীভূত করে। সে এভাবে তার নিজের উপকার ও আনন্দের জন্য প্রাণী ও উদ্ভিদগুলোকে মানিয়ে নেয়। এটি সে নিয়মানুসারে করতে পারে, অথবা জাতটিকে পরিবর্তন করার কোন ইচ্ছা ব্যতিরেকে তার পক্ষে উপকারী ও আনন্দদায়ক এককদের সংরক্ষণের মাধ্যমে অজ্ঞাতসারেও করতে পারে। এটি অবধারিত যে একটি দক্ষ চোখ ছাড়া অন্য অনেকের নিকট বোধগম্য নয় এমন অল্প পার্থক্যগুলোর প্রতিটিকে পরের পর বংশ ধরে নির্বাচন একটি জাতের বৈশিষ্ট্যকে বহুলাংশে প্রভাবিত করতে পারে। অতিশয় ভিন্ন ও উপকারী গৃহপালিত জাত সৃষ্টি করতে নির্বাচনের এই অচেতন প্রক্রিয়াটি বিরাট মাধ্যম হয়েছে। মানুষ দ্বারা সৃষ্ট অনেক জাত যে প্রাকৃতিক প্রজাতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তা এই জটিল বিষয়টির দ্বারা বোঝা যায়। তবে এদের অনেকেই ভ্যারাইটি অথবা আদিম ভিন্ন প্রজাতি কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। 

যে পদ্ধতিগুলি গৃহপালনাধীন অবস্থায় এত দক্ষতার সঙ্গে কার্যকরী হয়েছে, সেগুলি প্রাকৃতিক অবস্থায় কেন কার্যকরী হবে না তার কোন কারণ নেই। অনবরত সংঘটিত অস্তিত্বের সংগ্রামের সময় আনুকূল্যপ্রাপ্ত একক ও জাতগুলোর উদ্বর্তনে, নির্বাচনের একটি শক্তিশালী ও অনবরত ক্রিয়াশীল ধরন আমরা দেখি। সব জীবের ক্ষেত্রে সাধারণ বৃদ্ধির উচ্চ গুণোত্তরীয় হার থেকে অস্তিত্বের সংগ্রাম অনিবার্যরূপে অনুসৃত হয়। গণনার দ্বারা, অদ্ভুত ঋতুগুলোর পরম্পরানুসারে আগমনের সময় এবং নূতন দেশগুলোতে অভিযোজিত হওয়ার সময় অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের দ্রুত বৃদ্ধির দ্বারা বৃদ্ধির এই উচ্চ হারটি প্রমাণিত হয়েছে। সম্ভবত যত একক বেঁচে থাকে তার তুলনায় অনেক বেশী এককের জন্ম হয়। তুলাদণ্ডে একটি দানা নির্ধারণ করতে পারে কোন্ এককরা বাঁচবে এবং কোনগুলো মরবে, কোন্ ভ্যারাইটি অথবা প্রজাতি সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে এবং মরবে অথবা অবশেষে বিলুপ্ত হবে। একই প্রজাতির সব এককদের সমস্ত ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে কঠোর প্রতিযোগিতায় নামতে হয় বলে এদের মধ্যে সংগ্রামটি সাধারণত অতিশয় কঠোর হবে; এটি একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের মধ্যে এবং পরে একই গণের প্রজাতিদের মধ্যে সমভাবে কঠোর ও কঠোরতম হবে। পক্ষান্তরে, প্রকৃতিমণ্ডলে অতিশয় দূরবর্তীদের মধ্যেও সংগ্রাম প্রায়শই কঠোর হবে। যে—কোন বয়সে অথবা যে-কোন ঋতুতে প্রতিযোগীদের ওপর কোন এককের অল্পতম প্রাধান্য অথবা চারদিকের ভৌতিক পরিবেশে যত অল্প মাত্রায় হোক না কেন ভাল অভিযোজন পরিণামে ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাবে। 

ভিন্ন স্ত্রী ও পুরুষ সম্বলিত প্রাণীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে, স্ত্রীদের অধিকার করার জন্য পুরুষদের মধ্যে সংগ্রাম চলবে। সবচেয়ে বলবান পুরুষরা অথবা যারা তাদের জীবন—পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রামে সবচেয়ে কৃতকার্য হয়, তারাই সাধারণতঃ অধিকাংশ বংশধরের জন্ম দেবে। কিন্তু বিশেষ হাতিয়ার অথবা আত্মরক্ষার উপায় অথবা আকর্ষণশক্তির অধিকারী পুরুষদের ওপর সফলতা প্রায়শই নির্ভর করবে এবং অল্প প্রাধান্য বিজয় আনবে। 

যেহেতু ভূবিজ্ঞান দাবী করে যে প্রত্যেক দেশের বিরাট ভৌতিক পরিবর্তন ঘটেছে, সেহেতু আমরা আবিষ্কার করার আশা করতে পারতাম যে যেভাবে গৃহপালনাধীনে পরিবর্তিত হয় সেভাবেই জীবসমূহ প্রাকৃতিক অবস্থাতেও পরিবর্তিত হয়েছে। এবং যদি প্রাকৃতিক অবস্থায় কোন পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাহলে এটি একটি দুয়ে বিষয় হবে যদি প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন ভূমিকা পালন না করে থাকে। এটি জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে, কিন্তু বক্তব্যটি প্রমাণাযোগ্য যে প্রাকৃতিক অবস্থায় পরিবর্তনের পরিমাণ একটি কঠোরভাবে সীমিত পরিমাণের হয়। শুধুমাত্র বহিরাকৃতিমূলক বৈশিষ্ট্যগুলির ওপর যথেচ্ছভাবে কাজ করে মানুষ তার গৃহপালিত উৎপাদনে শুধু এককীয় পার্থক্যসমূহ যোগ করে একটি ফল উৎপাদন করবে; এবং প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন যে প্রজাতিরা এককীয় পার্থক্যসমূহ উপস্থিত করে। কিন্তু এরূপ পার্থক্যসমূহ ছাড়া, সব প্রকৃতিবিজ্ঞানী স্বীকার করেন যে প্রাকৃতিক ভ্যারাইটিরাও অবস্থান করে, যাদের সিস্টেম্যাটিক গবেষণায় নথিভুক্ত করার যোগ্য হিসেবে যথেষ্ট ভিন্ন বলে গণ্য করা হয়। এককীয় পার্থক্য ও অল্প পরিবর্তনশীল প্রকারদের মধ্যে, অথবা সরলভাবে চিহ্নিত ভ্যারাইটি এবং উপপ্রজাতি ও প্রজাতিদের মধ্যে কোন স্পষ্ট পার্থক্য কেউ দেখায়নি। ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশগুলোতে এবং যে-কোন ধরনের প্রতিবন্ধক দ্বারা বিভক্ত একই মহাদেশের বিভিন্ন অংশে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলিতে, কত অসংখ্য রকমের আকার রয়েছে, যেগুলোকে কোন কোন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৃতিবিদ ভ্যারাইটি হিসেবে, কেউ কেউ ভৌগোলিক জাত অথবা উপ-প্রজাতি হিসেবে এবং অন্যরা ভিন্ন হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন, যদিও এরা নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতি! 

যখনই প্রাণী ও উদ্ভিদরা পরিবর্তিত হয়, যত অল্প অথবা মন্থরই হোক, কোন-না—কোনভাবে উপকারী পরিবর্তন ও এককীয় পার্থক্যগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা সর্বোত্তমের উদ্বর্তনের মাধ্যমে সংরক্ষিত অথবা পুঞ্জীভূত হবে না কেন? যদি মানুষ তার পক্ষে উপকারী পরিবর্তনগুলোকে ধৈর্যের সঙ্গে নির্বাচন করতে পারে, তাহলে জীবনের পরিবর্তনশীল ও জটিল পরিবেশগুলোতে প্রকৃতির জীবন্ত উৎপাদনসমূহের পক্ষে উপকারী পরিবর্তনগুলো কেন প্রায়শই উদ্ভুত হবে না এবং সংরক্ষিত ও নির্বাচিত হবে না? এই ক্ষমতাটির সীমা কি? যা দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরী হয় এবং যা প্রত্যেক জীবের সমগ্র জৈব বিন্যাস, দেহগঠন ও স্বভাবসমূহকে যথাযথভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে—যা ভালগুলোকে সমাদর করে এবং খারাপগুলোকে বর্জন করে? প্রত্যেক আকারকে অতিশয় জটিল জীবন সম্পর্কে মন্থরভাবে ও সুন্দরভাবে অভিযোজিত করতে এই ক্ষমতার কোন সীমা আমি দেখতে পাই না। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি, এমনকি যদি আমরা এর তুলনায় আরও কিছু না দেখি, উচ্চতম মাত্রায় সম্ভবপর বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে আমি বিরোধিতামূলক আপত্তিগুলির পুনরাবৃত্তি করেছি, এবার তত্ত্বটির অনুকূল বিশেষ বিষয় ও যুক্তিগুলির দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। 

প্রজাতিরা সুচিহ্নিত ও স্থায়ী ভ্যারাইটি, এবং প্রত্যেক প্রজাতির প্রথমে ভ্যারাইটি হিসেবে অবস্থান এই মতানুসারে, আমরা দেখতে পারি কেন প্রজাতিদের সৃষ্টির বিশেষ কাজের দ্বারা যারা উৎপন্ন হয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এবং ভ্যারাইটিদের মধ্যে, যারা গৌণ নিয়মের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়, কোন সীমারেখা টানা যেতে পারে না। এই একই মতানুসারে আমরা জানতে পারি কেমন করে একটি অঞ্চলে, যেখানে একটি গণের অনেক প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে এবং যেখানে এরা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, এইসব একই প্রজাতিরা অনেক ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে; কারণ যেখানে প্রজাতির সৃষ্টিশীল ক্রিয়া সক্রিয় হয়, একটি সাধারণ নিয়মানুসারে, এটি তখনও ক্রিয়াশীল থাকে বলে আবিষ্কার করার আশা আমরা করতে পারি, এবং এটাই হচ্ছে ঘটনা—যদি ভ্যারাইটিরা জায়মান প্রজাতি হয়। অধিকন্তু, বৃহত্তর গণগুলোর প্রজাতিরা, যে গণগুলোর অনেক ভ্যারাইটি অথবা জায়মান প্রজাতি থাকে, কিছুমাত্রায় ভ্যারাইটিদের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে; কারণ এরা ছোট ছোট গণগুলোর প্রজাতিদের তুলনায় পরস্পরের থেকে কম পরিমাণ পার্থক্য দ্বারা ভিন্ন হয়, বৃহত্তর গণগুলোর নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিদেরও সীমাবদ্ধ বিস্তার থাকে এবং এদের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে এরা অন্য প্রজাতির চারিদিকে ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলোতে গুচ্ছাকারে অবস্থান করে—উভয় ক্ষেত্রেই ভ্যারাইটিদের সদৃশ হয়ে। প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছিল, এই মতানুসারে এগুলি হচ্ছে অদ্ভুত সম্পর্কসমূহ, কিন্তু এটি তখনই বোধগম্য হয় যদি প্রত্যেকে প্রথমে একটি ভ্যারাইটি হিসেবে অবস্থান করত। 

যেহেতু প্রত্যেক প্রজাতি জননের গুণোত্তরীয় হার দ্বারা সংখ্যায় অত্যধিক বৃদ্ধির প্রবণতাযুক্ত হয়, এবং যেহেতু প্রত্যেক প্রজাতির রূপান্তরিত বংশধরদের দেহগঠন ও স্বভাবে বেশী বেশী বহুমুখী হওয়ার জন্য বৃদ্ধিতে সমর্থ হবে, যাতে করে এরা প্রকৃতিমণ্ডলের অসংখ্য ও ব্যাপকভাবে ভিন্ন অঞ্চলসমূহ দখল করতে সমর্থ হয়, সেহেতু যে-কোন একটি প্রজাতির নানামুখী বংশধরদের সংরক্ষণ করতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের অবিরত প্রবণতা থাকবে। অতএব দীর্ঘদিন ধরে ক্রিয়াশীল রূপান্তর প্রক্রিয়ার সময়, একই প্রজাতির ভ্যারাইটিদের বৈশিষ্ট্যমূলক অল্প পার্থক্য একই গণের প্রজাতিদের বৈশিষ্ট্যমূলক পার্থক্য বাড়িয়ে তোলার প্রবণতাযুক্ত হয়। নূতন ও উন্নত ভ্যারাইটিরা অনিবার্যরূপে বয়স্কতর, কম উন্নত এবং মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করে, এবং এভাবে প্রজাতিরা বহুলাংশে সুনির্দিষ্ট ও ভিন্ন বস্তুতে পরিণত হয়। প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে বৃহত্তর গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্গত প্রভাবশালী প্রজাতিরা নূতন ও প্রভাবশালী আকারের জন্ম দেওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয়, যাতে করে প্রত্যেক বড় গোষ্ঠী আরও বৃহত্তর হওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয় এবং একই সময়ে বৈশিষ্ট্যে আরও বহুমুখী হয়। কিন্তু যেহেতু সব গোষ্ঠী আকারে এভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে না, কারণ পৃথিবী এদের ধারণ করতে পারবে না, সেহেতু প্রভাবশালী গোষ্ঠীরা কম প্রভাবশালীদের পরাজিত করবে। বিরাট গোষ্ঠীদের আকারে বৃদ্ধি পাওয়ার এবং বৈশিষ্ট্যে নানামুখী হওয়ার সঙ্গে অধিক বিলুপ্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার এই প্রবণতাটি সর্বকালে অবস্থিত কয়েকটি বিরাট শ্রেণীর মধ্যে গোষ্ঠীর অধীনে গোষ্ঠীতে জীবনের সকল আকারদের বিন্যাসটির ব্যাখ্যা করে। যাকে বলা হয় প্রাকৃতিক সিস্টেম, তার অধীনে সমস্ত জৈবিক আকারদের গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার এই বিস্ময়কর ঘটনাটি সৃষ্টির তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যার সম্পূর্ণ অযোগ্য। 

যেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন অল্প, ধারাবাহিক, অনুকূল পরিবর্তনসমূহের সঞ্চয়নের দ্বারাই শুধুমাত্র ক্রিয়াশীল হয়, সেহেতু এটি কোন বিরাট অথবা আকস্মিক রূপান্তর ঘটাতে পারে না; এটি শুধুমাত্র ছোট ও মন্থর ধাপের দ্বারা কাজ করে। অতএব, “প্রকৃতি লম্ফ দেয় না” অনুশাসনটি, যা আমাদের নূতন নূতন জ্ঞান অর্জন দ্বারা সমর্থিত হওয়ার প্রবণ হয়, এই তত্ত্বটি অনুযায়ী বোধগম্য হয়। আমরা লক্ষ্য করতে পারি কেন সমগ্র প্রকৃতিতে একই সাধারণ লক্ষ্য অসংখ্য নানা উপায়ের দ্বারা অর্জিত হয়, কারণ একদা আহৃত প্রত্যেক বৈশিষ্ট্য দীর্ঘদিন ধরে বংশগতভাবে প্রেরিত হয় এবং অসংখ্য উপায়ে ইতিমধ্যে রূপান্তরিত দৈহিক গঠনসমূহ একই সাধারণ উদ্দেশ্যের জন্য অভিযোজিত হয়ে থাকে। সংক্ষেপে আমরা দেখি কেন প্রকৃতিতে ভ্যারাইটির প্রাচুর্য, যদিও নূতনের প্রবর্তনে কৃপণ। কিন্তু যদি প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে কেন এটি প্রকৃতির একটি নিয়ম হয়ে উঠবে তা কেউই ব্যাখ্যা করতে পারবে না। 

আমার মনে হয় অন্য অনেক বিষয় এই তত্ত্বানুসারে ব্যাখ্যাযোগ্য। এ।নতান্তই অদ্ভুত যে একটি কাঠঠোকরার আকারে একটি পাখিকে ভূমিতে পতঙ্গদের শিকার করতে হবে; উচ্চভূমির রাজহাঁসদের, যারা কদাচিৎ সাঁতার কাটে অথবা একেবারেই কাটে না, লিপ্তপাদের অধিকারী হতে হবে; থ্রাসের মত একটি পাখিকে ডুব দিয়ে অন্তঃজলজ কীটপতঙ্গ খেতে হবে; এবং একটি পেট্রেল পাখির স্বভাব ও দৈহিক গঠনসমূহ অক পাখির জীবনের মতো উপযুক্ত হতে হবে। এরূপ অসংখ্য উদাহরণ আছে। কিন্তু প্রত্যেক প্রজাতি অনবরত সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে চেষ্টা করছে, এর সঙ্গে প্রত্যেকের মন্থরভাবে পরিবর্তনশীল বংশধরদের প্রকৃতির যে কোন অদখলীকৃত অথবা কম অধিকৃত অঞ্চলে অভিযোজিত করানোর ব্যাপারে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রস্তুত থাকার এই মতানুসারে, এসব বিষয় আর বিস্ময়কর থাকে না, অথবা এমনকি আগে থেকেই এমনটা প্রত্যাশা করা যেতে পারত। 

আমরা কিছু পরিমাণে বুঝতে পারি যে কেমন করে সমগ্র প্রকৃতিতে এত সৌন্দর্য রয়েছে। এটি নির্বাচনের মাধ্যমে হয়েছে বলে বহুলাংশে বলা যেতে পারে। আমাদের জ্ঞানানুসারে ঐ সৌন্দর্য যে সার্বজনীন হয় না, তা নিশ্চয় তাঁরা প্রত্যেকে স্বীকার করবেন যাঁরা মানুষের মুখমণ্ডলের সঙ্গে কিছু বিষধর সাপ, কিছু মাছ এবং কোন কোন বিকট বাদুড়দের মুখমণ্ডলের বিকৃত সাদৃশ্য লক্ষ্য করবেন। যৌন নির্বাচন অনেক পাখির, প্রজাপতির এবং প্রাণীর পুরুষদের এবং কোন কোন সময় উভয় লিঙ্গে অতিশয় উজ্জ্বল রং, সুশ্রী নক্সা এবং অন্যান্য চাকচিক্য প্রদান করেছে, পাখিদের ক্ষেত্রে পুরুষের কণ্ঠস্বর প্রায়শই স্ত্রীদের মধ্যে দেখা যায় এবং আমাদের কানেও শোনা যায়। ফুল ও ফলগুলো সবুজ পাতাদের তুলনায় উজ্জল রঙের দ্বারা আরও বেশী স্পষ্ট হয়েছে, কেননা পতঙ্গরা ফুলগুলো সহজেই দেখতে, পরিদর্শন করতে এবং নিষিক্ত করতে পারে, এবং পাখিরা বীজের বিস্তার ঘটাতে পারে। কোন কোন রং, শব্দ এবং আকার মানুষ ও নিম্নতর প্রাণীদের কেন আনন্দদান করে, অর্থাৎ কেমন করে এর সরলতম আকারে সৌন্দর্যের অনুভূতি প্রথমে অর্জিত হয়েছিল—এই প্রশ্নের তুলনায় আমরা আরও বেশী করে জানি না কেমন করে কোন কোন সুগন্ধ এবং স্বাদুগন্ধ প্ৰথমে প্রীতিকর হয়েছিল। 

প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কার্যকরী হয় বলে এটি শুধুমাত্র এদের সহ—অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রত্যেক দেশের অধিবাসীদের অভিযোজিত ও উন্নত করে। অতএব যে-কোন একটি দেশের প্রজাতিদের সম্পর্কেআমরা বিস্ময় অনুভব করার প্রয়োজন মনে করি না, যদিও সাধারণ মতবাদ অনুসারে, এরা অন্য একটি দেশের অভিযোজিত উৎপাদনগুলোর দ্বারা পরাজিত ও স্থানচ্যুত হয়ে ঐ দেশের জন্য সৃষ্ট এবং বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। অথবা আমাদের আশ্চর্য হওয়া উচিত হবে না যদি, যতদূর আমরা বিচার করতে পারি, প্রকৃতির সমস্ত কলাকৌশল সম্পূর্ণরূপে নিখুঁত না হয়, যেমন এমনকি মানুষের চোখের ক্ষেত্রে হয়; অথবা কয়েকজন আমাদের ধারণার উপযুক্ততা সম্পর্কে বিরক্ত হলে তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই। মৌমাছির হুলে আমাদের আশ্চর্যান্বিত হওয়া উচিত নয়, যা শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে; একটি কাজের জন্য এত বিরাট সংখ্যায় উৎপাদিত পুরুষ-মৌমাছিদের এবং তারপর এদের বন্ধ্যা বোনেদের দ্বারা নিহত হওয়ার বিষয়টি; আমাদের ফার বৃক্ষের পরাগরেণুর বিপুলভাবে অপচয় হওয়ার বিষয়টি; নিজেদের জননক্ষমতাসম্পন্ন কন্যাদের প্রতি রানী-মৌমাছির স্বভাবজাত ঘৃণার বিষয়টি; শূয়াপোকাদের জীবন্ত দেহের মধ্যে ইচনিউমনিডিদের খাদ্য গ্রহণ; অথবা এ ধরণের অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের আশ্চর্য হওয়া উচিত হবে না। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুযায়ী, বিস্ময়ের ব্যাপারটি হচ্ছে যে সম্পূর্ণ নিখুঁততার অভাবের আরও ঘটনাসমূহ আবিষ্কৃত হয়নি। 

যতদূর আমরা বিচার-বিবেচনা করতে পারি তাতে ভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলোর সঙ্গে ভ্যারাইটিদের সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী জটিল ও অল্প-জ্ঞাত নিয়মগুলো একই হয়। উভয় ক্ষেত্রেই, ভৌতিক অবস্থাসমূহ কিছু প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়, কিন্তু কতখানি তা আমরা বলতে পারি না। এরূপে ভ্যারাইটিরা যখন নূতন অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন তারা ঐ অঞ্চলের উপযুক্ত প্রজাতিদের বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি প্রায় ধারণ করে। ভ্যারাইটি ও প্রজাতি উভয়ের ক্ষেত্রেই, ব্যবহার ও অব্যবহার কিছু পরিমাণ প্রভাব ফেলে বলে মনে হয়; কারণ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা অসম্ভবপর হয়, যখন উদাহরণস্বরূপ, আমরা হাতুড়ি-মাথা পাতিহাঁসদের দেখি, যাদের উড়তে অসমর্থ ডানা আছে, যেগুলি গৃহপালিত পাতিহাঁসদের মতো প্রায় একই অবস্থানে থাকে; অথবা যখন আমরা গর্তে বসবাসকারী টুকু-টুকু প্রাণীদের দেখি, যারা কখনও কখনও অন্ধ হয়, এবং তারপর যখন আমরা গন্ধমূষিকদের দেখি, যারা স্বভাবগতভাবে অন্ধ হয় এবং যাদের চোখগুলো চামড়া দ্বারা ঢাকা থাকে; অথবা যখন আমরা আমেরিকা ও ইউরোপের অন্ধকার গুহায় বসবাসকারী অন্ধ প্রাণীদের দেখি। ভ্যারাইটি ও প্রজাতিদের ক্ষেত্রে, পরস্পর সম্পর্কিত পরিবৃত্তিসমূহ সম্ভবত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অতএব যখন একটি অংশ রূপান্তরিত হয়েছে, তখন অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিও প্রয়োজনানুসারে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। ভ্যারাইটি ও প্রজাতি উভয়ের ক্ষেত্রেই, বহুপূর্বে লুপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলির প্রত্যাবর্তন মাঝেমাঝেই ঘটে। ঘোড়া গণের কতিপয় প্রজাতির এবং এদের সঙ্করদের কাঁধে ও পায়ে ডোরা দাগের মাঝেমাঝে আবির্ভাব সৃষ্টির তত্ত্বানুযায়ী ব্যাখ্যার প্রায় অযোগ্য। এই বিষয়টি কত সোজাভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যদি আমরা বিশ্বাস করি যে এইসব প্রজাতিরা সকলে একটি ডোরাদাগওয়ালা পূর্বপুরুষ থেকে একইভাবে উদ্ভূত হয়েছে, যেমন পায়রার কতিপয় গৃহপালিত জাত নীল ও ডোরা দাগওয়ালা পাহাড়ী পায়রা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 

প্রত্যেক প্রজাতির স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হওয়ার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কেন প্রজাতিক বৈশিষ্ট্যগুলি, অথবা সেইগুলি যার দ্বারা একই গণের প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয়, গণীয় বৈশিষ্ট্যগুলির তুলনায় আরও বেশী পরিবর্তনশীল হবে? উদাহরণস্বরূপ, সকলে একই রং সম্বলিত ফুলের অধিকারী হওয়ার তুলনায় যদি অন্য প্রজাতিরা ভিন্ন রঙের ফুলের অধিকারী হয়, তাহলে কেন একটি ফুলের রং কোন গণের যে-কোন একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হওয়ার বেশী সম্ভাবনা থাকবে? যদি প্রজাতিরা শুধুমাত্র সুচিহ্নিত ভ্যারাইটি হয়, যাদের বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যন্ত স্থায়ী হয়েছে, তাহলে আমরা এ বিষয়টি বুঝতে পারি; কোন কোন বৈশিষ্ট্যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে শাখায় বিভক্ত হওয়ার সময় থেকে এরা ইতিমধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে, যার দ্বারা এরা পরস্পরের থেকে বিশেষভাবে ভিন্ন হয়েছে; অতএব গণীয় বৈশিষ্ট্যের তুলনায় এইসব একই বৈশিষ্ট্যগুলির আরও বেশী পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে থাকবে, ঐ সব গণীয় বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন ব্যতিরেকে দীর্ঘদিন ধরে বংশগতভাবে আহৃত হয়েছে। সৃষ্টির তত্ত্বানুসারে এটি ব্যাখ্যাতীত হয় কেন একটি গণের শুধুমাত্র একটি প্রজাতির একটি প্রত্যঙ্গ অতিশয় অস্বাভাবিক উপায়ে বিকশিত হয়, এবং অতএব যেমন আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি, ঐ প্রজাতির পক্ষে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির পরিবর্তনের স্পষ্ট সম্ভাবনা থাকবে; কিন্তু আমাদের মতানুসারে, একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে কতিপয় প্রজাতির শাখাবিস্তারের সময় থেকে এই অঙ্গটি অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে, অতএব আশা করা যায় যে অঙ্গটি সাধারণতঃ তখনও পরিবর্তনশীল হয়। কিন্তু কোন বাদুড়ের ডানার মত একটি অঙ্গ অতিশয় অস্বাভাবিক উপায়ে বিকশিত হতে পারে এবং তথাপি অন্য যে-কোন গঠনের তুলনায় আরও বেশী পরিবর্তনশীল হবে না, যদি অঙ্গটি অনেক অধীন আকারগুলোতে সাধারণ হয়, অর্থাৎ যদি এটি বংশগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রেরিত হয়ে থাকে, কারণ এক্ষেত্রে এটি দীর্ঘদিন ধরে কার্যরত প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা স্থায়ী হয়ে থাকবে। 

সহজাত প্রবৃত্তিগুলোর দিকে এক ঝলক দেখলে বোঝা যায় যে এদের মধ্যে কয়েকটি বিস্ময়কর হয়, এরা পর্যায়ক্রমিক অল্প অথচ লাভজনক রূপান্তরগুলোর প্রাকৃতিক নির্বাচন অনুসারে দেহগত গঠনসমূহের তুলনায় বিরাট বাধা উপস্থিত করে না। এরূপে আমরা বুঝতে পারি কেন একই শ্রেণীর বিভিন্ন প্রাণীদেরকে তাদের কতিপয় সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা বিভূষিত করতে প্রকৃতি ক্রমিক ধাপগুলো দ্বারা অগ্রসর হয়। আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি ক্রমপরিবর্তনের পদ্ধতিটি মধু-মৌমাছির স্থাপত্য কলাকৌশল ক্ষমতার ওপর কতখানি আলোকপাত করেছে। সন্দেহ নেই যে স্বভাব কখনও কখনও সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে রূপান্তরিত করতে ভূমিকা পালন করে; কিন্তু এটি নিশ্চয় অপরিহার্য নয়, যেমন আমরা ক্লীব পতঙ্গদের ক্ষেত্রে দেখি, যারা দীর্ঘদিন ক্রিয়ারত স্বভাবের ফলগুলো বংশগতভাবে পেতে কোন বংশধরের জন্ম দেয় না। একই গণের সমস্ত প্রজাতির একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে উদ্ভবের এবং অনেক কিছু সাধারণ বংশগতভাবে অর্জনের মতবাদ অনুসারে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা, যাদের ব্যাপকভাবে ভিন্ন জীবন-পরিবেশে স্থাপন করা হয়, তথাপি তারা একই সহজাত প্রবৃত্তি অনুসরণ করে; উদাহরণস্বরূপ, কেন উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ আমেরিকার হ্রাস পাখিরা আমাদের ব্রিটিশ প্রজাতির মতো নিজেদের বাসাকে কাদামাটি দ্বারা বেষ্টন করে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মন্থরভাবে অর্জিত সহজাত প্রবৃত্তি সংক্রান্ত মতানুসারে কতিপয় সহজাত প্রবৃত্তি নিখুঁত হয় না এবং ভুল হতে বাধ্য হয় এবং অনেক সহজাত প্রবৃত্তি অন্য প্রাণীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে—এসব সম্পর্কে আমাদের আশ্চর্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। 

যদি প্রজাতিরা সুচিহ্নিত ও স্থায়ী ভ্যারাইটি হয়, তাহলে আমরা অবিলম্বে লক্ষ্য করতে পারি কেন এদের সঙ্করিত বংশধররা তাদের পিতামাতাদের সাদৃশ্যের মাত্রা ও প্রকারের একই জটিল নিয়ম অনুসরণ করবে, পর্যায়ক্রমিক সঙ্করণের দ্বারা পরস্পরের মধ্যে বিশোষিত হয়ে এবং অন্য এরূপ বিষয়ে স্বীকৃত ভ্যারাইটিদের সম্বরিত বংশধররা যেমন করে। এই সাদৃশ্য একটি অদ্ভুত বিষয় হত, যদি প্রজাতিরা স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়ে থাকত এবং ভ্যারাইটিরা গৌণ নিয়মের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়ে থাকত। 

যদি আমরা স্বীকার করি যে ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ অতিমাত্রায় ত্রুটিপূর্ণ, তাহলে সাক্ষ্যপ্রমাণের তথ্যগুলো রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। নূতন প্রজাতিরা মন্থরভাবে ও পর্যায়ক্রমিক বিরতির পর মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে, এবং পরিবর্তনের পরিমাণটি সময়ের সমবিরতির পর বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হয়। প্রজাতিদের ও প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীর বিলুপ্তির ঘটনাটি, যেটি জৈব-জগতের ইতিহাসে এত স্পষ্ট ভূমিকা পালন করেছে, অনিবার্যরূপে প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতির অনুসরণ করে, কারণ পুরানো আকাররা নতুন ও উন্নত আকারদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। যখন সাধারণ বংশের শৃঙ্খলটি একবার ভেঙে যায়, তখন একটি একক প্রজাতি অথবা প্রজাতির গোষ্ঠীগুলো পুনরাবির্ভূত হয় না। এদের বংশধরদের মন্থর রূপান্তরের সঙ্গে প্রভাবশালী আকারদের ক্রমিক পরিব্যক্তি দীর্ঘসময় পর জীবন-আকারদের আবির্ভাবের কারণ ঘটায়, যেন মনে হয় এরা সমগ্র পৃথিবীতে যুগপৎ পরিবর্তিত হয়েছিল। ওপরের ও নিচের ভূস্তরের জীবাশ্মদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যে কিছুমাত্রায় মধ্যবর্তী হওয়া প্রত্যেক ভূস্তরে জীবাশ্ম অবশেষের ঘটনাটি উদ্ভবের শৃঙ্খলে এদের মধ্যবর্তী অবস্থান দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়। সমস্ত বিলুপ্ত জীবদের সমস্ত সাম্প্রতিক জীবদের সঙ্গে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে, এই চমৎকার ঘটনাটি জীবিত ও বিলুপ্ত জীবদের সাধারণ পিতামাতার বংশধর হওয়া থেকে স্বাভাবিকভাবে বোঝা যায়। যেহেতু প্রজাতিরা উদ্ভব ও রূপান্তর চলাকালীন সময়ে বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হয়েছে, সেহেতু আমরা বুঝতে পারি কেন প্রত্যেক গোষ্ঠীর আরও প্রাচীন আকাররা অথবা আদিম পূর্বপুরুষরা বর্তমান গোষ্ঠীদের মধ্যে প্রায়শই কিছুমাত্রায় মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে। বর্তমান আকাররা প্রাচীন আকারদের তুলনায় জৈববিন্যাসের মানদণ্ডে সামগ্রিকভাবে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে বলে সাধারণতঃ দেখা হয়; এবং এরা ততদিন পর্যন্ত উচ্চতর অবস্থানে থাকবে যতদিন পরবর্তী ও আরও উন্নত আকাররা প্রাচীনতর ও কম উন্নত আকারদের জীবনসংগ্রামে পরাজিত না করে; এদের অঙ্গগুলো সাধারণতঃ বিশেষ বিশেষ কার্যের জন্য আরও বিশিষ্ট হয়েছে। জীবনের সরল পরিবেশের পক্ষে উপযুক্ত অসংখ্য জীব এখনও সরল অথচ অল্প উন্নত দেহগঠন বজায় রেখেছে, এটির সঙ্গে এই বিষয়টি সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এটি এরূপে কিছু আকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যেগুলো জীবনের নূতন ও হ্রাসপ্রাপ্ত স্বভাবের জন্য উদ্ভবের প্রতি স্তরে ভালভাবে অভিযোজিত হওয়ার দ্বারা জৈব সংগঠনে অধোগামী হয়েছে। অবশেষে, একই মহাদেশের সম্বন্ধযুক্ত আকারদের দীর্ঘস্থায়িত্বের বিস্ময়কর নিয়মটি—যেমন অস্ট্রেলিয়ার মাসুপিয়াল, আমেরিকার এডেনটাটা, এবং অন্য এরূপ ক্ষেত্রে বোধগম্য হয়, কারণ একই দেশের মধ্যে বর্তমান ও বিলুপ্ত আকাররা বংশগতির দ্বারা নিকট সম্বন্ধযুক্ত হবে। 

ভৌগোলিক বিস্তারের দিকে লক্ষ্য করলে, যদি আমরা স্বীকার করি যে আগেকার জলবায়ুগত ও ভৌগোলিক পরিবর্তন এবং বিস্তারের অনেক আকস্মিক ও অজ্ঞাত উপায়গুলোর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অতিশয় প্রচরণ হয়েছে, তাহলে আমরা রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটি অনুযায়ী বিস্তারের অধিকাংশ প্রধান বিষয়গুলো বুঝতে পারি। আমরা দেখতে পারি সমগ্র দেশ জুড়ে জীবদের বিস্তারে এত উল্লেখযোগ্য সমান্তরালতা এবং সমগ্রকাল ধরে এদের ভূতাত্ত্বিক ধারাবাহিকতা থেকে রয়ে থাকবে; কারণ উভয় ক্ষেত্রেই জীবরা সাধারণ বংশবন্ধন দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে এবং রূপান্তরের উপায়গুলো একই থেকেছে। বিস্ময়কর ঘটনাটির পুরো অর্থ আমরা বুঝতে পারি, যা প্রত্যেক ভ্রমণকারীকে মুগ্ধ করেছে, যথা একই দেশের বিচিত্র অবস্থায়, যেমন উষ্ণতায় ও শৈত্যে, পর্বতে ও নিম্নভূমিতে, মরুভূমি ও জলাভূমিতে, প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীর অধিকাংশ অধিবাসীরা স্পষ্টভাবে সম্পর্কিত হয়—কারণ এরা একই পূর্বপুরুষদের এবং আদিম উপনিবেশকারীদের বংশধর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রূপান্তরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আগেকার প্রচরণের এই একই পদ্ধতি অনুসারে, তুষারযুগের সাহায্যে আমরা অতিশয় দূরবর্তী পর্বতমালার উত্তর ও দক্ষিণের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলোর কতিপয় উদ্ভিদের সমরূপতা এবং অন্য অনেকের নিকট সম্বন্ধ বুঝতে পারি; এবং সেরূপে আন্তঃউষ্ণ মহাসমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও উত্তর ও দক্ষিণের নাতিশীতোষ্ণ অক্ষাংশের সমুদ্রের অধিবাসীদের কতিপয় নিকট সম্বন্ধ বুঝতে পারি। যদিও একই প্রজাতিদের পক্ষে কখনও প্রয়োজনীয় অত্যন্ত সদৃশ ভৌতিক পরিবেশ দুটি দেশ উপস্থিত করতে পারে, তাহলেও তাদের অধিবাসীদের ব্যাপকভাবে পৃথক হওয়াতে আমরা আশ্চর্য অনুভব করি না, যদি এরা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পরের থেকে বিযুক্ত হয়ে থাকে; কারণ যেহেতু জীবের সঙ্গে জীবের সম্পর্কটি সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং যেহেতু দুটি দেশ বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন অনুপাতে অন্য কোন দেশের থেকে অথবা পরস্পরের থেকে উপনিবেশকারীদের প্রাপ্ত হয়ে থাকে, সেহেতু রূপান্তরের গতিটি দুটি অঞ্চলে অনিবার্যরূপে ভিন্ন হবে। 

পরবর্তী রূপান্তরের সঙ্গে প্রচরণের এই ধারণা অনুযায়ী আমরা দেখি কেন মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে কেবল অল্প কয়েকটি প্রজাতি বাস করে, কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ ও স্থানীয় আকার হয়। আমরা স্পষ্টত দেখি কেন ব্যাপক ব্যবধানবিশিষ্ট মহাসমুদ্র অতিক্রম করতে পারে না এমন প্রাণীদের ঐ-সব গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্গত প্রজাতিরা, যেমন ব্যাঙ ও স্থলচর স্তন্যপায়ীরা, মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে বসবাস করে না; এবং পক্ষান্তরে, কেন মহাসমুদ্র অতিক্রম করতে পারে এমন নতুন ও বিশেষ বিশেষ প্রজাতির বাদুড় বা অন্য প্রাণীদের যে-কোন মহাদেশ থেকে বহু দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। এইসব ঘটনা, যেমন মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে বাদুড়দের বিশেষ ধরনের প্রজাতিদের উপস্থিতি এবং অন্য সব স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর অনুপস্থিতি, স্বাধীনভাবে সৃষ্টির তত্ত্বানুযায়ী সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। 

যে-কোন দুটি অঞ্চলে নিকট সম্বন্ধীয় অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিদের উপস্থিতি রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটি অনুসারে ইঙ্গিত দেয় যে একই পিতামাতা আকাররা পূর্বে উভয় অঞ্চলে বসবাস করত; এবং আমরা অনিবার্যরূপে প্রায়শই দেখি অনেক নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা দুটি অঞ্চলের যেখানেই বসবাস করুক, কিছু সমরূপ প্রজাতি উভয় অঞ্চলে তখনও সাধারণ হয়। যেখানেই অনেক নিকট সম্বন্ধীয় অথচ ভিন্ন প্রজাতি থাকুক না কেন, একই গোষ্ঠীর অন্তর্গত সন্দেহজনক আকার ও ভ্যারাইটিরাও অবস্থান করে। এটি উচ্চ সাধারণত্বের একটি নিয়ম যে প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীরা নিকটতম উৎসের অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, যেখান থেকে ভিনদেশীরা এসে থাকতে পারত। গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের, জুয়ান ফারনানডেস-এর এবং আমেরিকার অন্য দ্বীপগুলোর প্রায় সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আমেরিকা মহাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের চমৎকার সম্পর্কটির ক্ষেত্রে আমরা এটি দেখি; এবং কেপ ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের ও আফ্রিকার অন্য দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের সঙ্গে আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যেকার সম্পর্কটির ক্ষেত্রেও। এটি নিশ্চয় স্বীকার করা উচিত যে এইসব বিষয় সৃষ্টির তত্ত্বানুযায়ী কোন ব্যাখ্যা আশা করে না। 

যেমন আমরা দেখেছি যে অতীত ও বর্তমানের সব জীবকে গোষ্ঠীদের অধীনে গোষ্ঠীগুলোতে কতিপয় বিরাট শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, এবং এর মধ্যে প্রায়শই বিলুপ্ত গোষ্ঠীরা সাম্প্রতিক গোষ্ঠীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেহেতু বিলুপ্তি এবং বৈশিষ্ট্যে ভিন্নমুখী হওয়ার সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী এটি বোধগম্য হয়। একই পদ্ধতি অনুসারে আমরা দেখি কেমন করে প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে আকারদের পারস্পরিক সম্বন্ধসমূহ কত জটিল ও ঘোরালো হয়। আমরা দেখি কেন কোন কোন বৈশিষ্ট্যও শ্রেণীবিভাগের জন্য অন্যগুলোর তুলনায় কার্যকরী হয়; কেন অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যগুলো, জীবদের পক্ষে অতিশয় প্রয়োজনীয় হলেও, শ্রেণীবিভাগে কদাচিৎ প্রয়োজনীয় হয়; কেন অঙ্কুর অঙ্গগুলো থেকে উদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলো জীবের কোন উপকারে না লাগলেও শ্রেণীবিভাগে প্রায়শই উচ্চমূল্যের হয়, এবং কেন ভ্রূণগত বৈশিষ্ট্যগুলো প্রায়শই সবগুলোর তুলনায় অতিশয় মূল্যবান হয়। এদের অভিযোজিত [__?] সমস্ত জীবের প্রকৃত সম্বন্ধগুলো বংশানুসৃতি অথবা বংশমূলক উদ্ভবের জন্য হয়। প্রাকৃতিক সিস্টেম হচ্ছে পার্থক্যের অর্জিত ধাপগুলোর সঙ্গে, ভ্যারাইটি, প্রজাতি, গণ, গোত্র ইত্যাদি পদগুলোর দ্বারা চিহ্নিত একটি বংশগত বিন্যাস; এবং যাই হোক না কেন অথবা যত অল্প গুরুত্বেরই হোক না কেন, অতিশয় স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের দ্বারাই বংশধারাগুলো আমাদের আবিষ্কার করতে হবে। 

একজন মানুষের হাতের, একটি বাদুড়ের ডানার, শুশুকের পাখনার, ঘোড়ার পায়ের হাড়গুলোর একইরূপ গঠনকাঠামো, জিরাফ ও হাতির গলার কশেরুকার একই সংখ্যা এবং এরূপ অসংখ্য তথ্য, মন্থর ও অল্প পর্যায়ক্রমিক রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভব তত্ত্বটি অনুযায়ী নিজেরাই ব্যাখ্যাযোগ্য হয়। একটি বাদুড়ের পায়ের ও ডানার, যদিও এগুলি ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, একটি কাঁকড়ার চোয়াল ও পায়ে, একটি ফুলের পাপড়ি, পুংকেশর এবং স্ত্রীকেশরদের নকশার সাদৃশ্যটি অঙ্গ অথবা প্রত্যঙ্গদের ক্রমিক রূপান্তরের মতানুযায়ী বহুলাংশে বোধগম্য হয়, যেগুলো এইসব শ্রেণীর প্রত্যেকের একটি আদিম পূর্বপুরুষে আদিতে একইরূপ ছিল। একই প্রাথমিক বয়সে সবসময় উপস্থিত না হওয়া এবং জীবনের অনুরূপ প্রাথমিক বয়সে বংশগতভাবে আবির্ভূত না হওয়া পর্যায়ক্রমিক পরিবৃত্তির পদ্ধতি অনুযায়ী আমরা দেখি কেন স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ এবং মাছেদের ভ্রূণগুলো এত ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ হয়, কিন্তু বয়স্ক আকারগুলোতে এত অসদৃশ হয়। একটি মাছের লুপের মতো লুপগুলোতে প্রবেশকারী ধমনী ও ফুলকার গর্তগুলো সমেত বায়ুতে নিশ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণকারী কোন স্তন্যপায়ী অথবা পাখির ভ্রূণ দেখে আমরা আশ্চর্যান্বিত হতে বিরত হই, যেমন মাছেরাও সুবিকশিত ফুলকার সাহায্যে জলে দ্রবীভূত বায়ু নিশ্বাসপ্রশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে। 

কোন কোন সময় প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে, অব্যবহার অঙ্গগুলোকে প্রায়শই হ্রাস করে থাকবে যখন এরা পরিবর্তিত স্বভাব ও জীবন-পরিবেশে অনুপযোগী হয়; এবং এই মতানুসারে আমরা অঙ্কুর অঙ্গদের অর্থ কি তা বুঝতে পারি। কিন্তু অব্যবহার ও নির্বাচন প্রত্যেক জীবের ওপর সাধারণতঃ ক্রিয়াশীল হবে, যখন এটি উপযুক্ত বয়সে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় এবং অস্তিত্বের সংগ্রামে পূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং এভাবে প্রাথমিক বয়সে একটি অঙ্গের ওপর এর কম ক্ষমতা রয়ে থাকবে; অতএব অঙ্গটি এই প্রাথমিক বয়সে হ্রাস পাবে না অথবা অঙ্কুরাবস্থার হবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাছুরের অতিশয় বিকশিত দাঁত সম্বলিত একটি আদিম পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত দাঁত থাকে, যেগুলো কখনও ওপরের চোয়ালের মাড়ি কেটে বের হয় না; এবং আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে জিহ্বা, তালু অথবা ঠোটের সাহায্য ছাড়া ঘাসপাতা থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিস্ময়করভাবে অভিযোজিত হওয়ার জন্য পরিণত প্রাণীদের দাঁতগুলো অব্যবহার দ্বারা পূর্বে হ্রাস পেয়েছিল; অন্যথায় বাছুরের দাঁতগুলো অপ্রভাবিত হয়ে থেকেছে এবং সমরূপ বয়সে বংশানুসৃতির পদ্ধতি অনুযায়ী একটি অতি আদিম যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আনুবংশিক হয়েছে। প্রত্যেক জীব তার সব ভিন্ন অঙ্গগুলো সমেত বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়েছে এই মতবাদ অনুযায়ী, কেমন করে সম্পূর্ণরূপে এটি ব্যাখ্যার অযোগ্য হয় যে অপ্রয়োজনীয়তার চরম ছাপ সমেত অঙ্গগুলো, যেমন ভ্রূণ বাদুড়ের দাঁতগুলো অথবা অনেক বিটলদের ঝালাই-করা ডানা—ঢাকনার মধ্যে কুঞ্চিত ডানাগুলো পুনঃপুনঃ আবির্ভূত হয়। অঙ্কুর অঙ্গগুলির সাহায্যে ভ্রূণগত এবং সমসংস্থ দেহগঠনগুলোর রূপান্তরের নিজস্ব পরিকল্পনাটি প্রকাশ করতে প্রকৃতি যত্নশীল হয় বলে মনে করা যেতে পারে, কিন্তু তার পরিকল্পনা বুঝতে আমরা নিতান্তই অক্ষম। 

আমি এখন প্রকৃত ঘটনা ও বিবেচ্য বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি করেছি, যা আমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিয়েছে যে উদ্ভবের দীর্ঘ গতিপথে প্রজাতিরা রূপান্তরিত হয়েছে। এটি প্রধানতঃ অসংখ্য পর্যায়ক্রমিক, অল্প, অনুকূল পরিবৃত্তিসমূহের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যকরী হয়েছে; অঙ্গপ্রত্যঙ্গদের ব্যবহার ও অব্যবহারের বংশগত প্রভাব দ্বারা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে; এবং বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ কার্যের দ্বারা ও পরিবৃত্তিসমূহের দ্বারা, যা আমাদের অজ্ঞতার দরুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবির্ভূত হয় বলে মনে হয়, একটি গুরুত্বহীন উপায়ে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে, অর্থাৎ অতীতে অথবা বর্তমানে অভিযোজিত দৈহিক গঠন সম্পর্কে। সম্ভবত আমি পূর্বে পরিবর্তনের এইসব পরবর্তী ধরনগুলোর মূল্য ও পুনঃপুনঃ সঙ্ঘটনকে কম গুরুত্ব দিয়েছিলাম, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াই দৈহিক গঠনের স্থায়ী রূপান্তর ঘটায়। কিন্তু যেহেতু আমার সিদ্ধান্তগুলো সাম্প্রতিককালে অতিশয় ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে আমি প্রজাতিদের রূপান্তর শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য হয় বলে ব্যক্ত করেছি, সেহেতু আমাকে বলার অনুমতি দেওয়া হোক যে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে এবং পরবর্তী সময়ে একটি অতিশয় দৃষ্টি-আকর্ষক স্থানে, অর্থাৎ ভূমিকার শেষে, নিম্নলিখিত কথাগুলো আমি ব্যক্ত করেছিলাম : “আমি স্থিরনিশ্চিত যে প্রাকৃতিক নির্বাচন রূপান্তরের প্রধান উপায় কিন্তু একমাত্র উপায় নয়।” বক্তব্যটি বিফল হয়েছে। অপব্যাখ্যার ক্ষমতা নেহাত কম নয়, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস দেখায় যে সৌভাগ্যবশত এই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। 

এটি কদাচিৎ মনে করা যেতে পারে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটির মত একটি ভুল তত্ত্ব ওপরে বিশেষভাবে উল্লিখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাখ্যা করবে। সম্প্রতি আপত্তি করা হয়েছে যে এটি তর্ক করার একটি অনিরাপদ উপায়; কিন্তু এটি জীবনের সাধারণ ঘটনাগুলো বিচার করার কাজে ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি; আলোর তরঙ্গ-তত্ত্বটি এইভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে; এবং নিজের অক্ষের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের বিশ্বাসটিও সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত কদাচিৎ কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। এটি কোন অকাট্য আপত্তি নয় যে বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত জীবনের উপাদান অথবা উৎপত্তির আরও উচ্চতর সমস্যা সম্পর্কে কোন আলোকপাত করেনি। অভিকর্ষের আকর্ষণের উপাদান কি তা কে ব্যাখ্যা করতে পারে? আকর্ষণের এই অজ্ঞাত উপাদানটি সম্পর্কে গবেষণার ফলগুলো শেষ পর্যন্ত দেখতে এখন কেউ আপত্তি করে না; তা সত্ত্বেও লিবনিজ “দর্শনের মধ্যে রহস্যময় গুণ এবং অলৌকিক ঘটনাসমূহ” উপস্থিত করার জন্য নিউটনকে একদা অভিযুক্ত করেছিলেন। 

এই গ্রন্থে প্রদত্ত মতবাদগুলো কোন লোকের ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন আঘাত করবে, তার কোন উপযুক্ত কারণ আমি দেখি না। এসব গভীর অনুভূতি কত অল্পকাল স্থায়ী হয় তা দেখে এটি স্মরণ করা সন্তোষজনক যে মানুষের দ্বারা আবিষ্কৃত সর্বোত্তম আবিষ্কারটি, অর্থাৎ অভিকর্ষের আকর্ষণের নিয়মটি, “স্বাভাবিক ধর্ম-বিধ্বংসী এবং দৈব প্রত্যাদেশ অথবা আবির্ভাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-বিধ্বংসী হিসেবে” লিবনিজ দ্বারাও আক্রান্ত হয়েছিল। জনৈক বিখ্যাত লেখক এবং ধর্মোপদেষ্টা আমাকে লিখেছেন যে “তিনি ক্রমশঃ শিখেছেন যে এটি ঈশ্বর সম্পর্কে ঠিক তেমনই একটি মহৎ ধারণায় বিশ্বাস করা যে তিনি অন্য এবং প্রয়োজনীয় আকারগুলোতে স্ববিকাশে সমর্থ কয়েকটি আদিম আকার সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন এটি বিশ্বাস করা হয় যে তিনি তাঁর নিয়মগুলোর কার্যের দ্বারা সৃষ্ট শূন্যস্থানগুলোকে পূর্ণ করতে সৃষ্টির একটি নূতন কাজ তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল।” 

জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে কেন আজ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত জীবিত বিখ্যাত প্রকৃতিবিদরা এবং ভূতত্ত্ববিদরা প্রজাতিদের পরিবর্তনশীলতায় অবিশ্বাস করেন? জোরের সঙ্গে বলা যেতে পারে না যে প্রাকৃতিক অবস্থায় সব জীবের কোন পরিবর্তন হয় না; প্রমাণ করা যেতে পারে না যে দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তনের পরিমাণটি সীমিত হয়; প্রজাতি এবং সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের মধ্যে কোন স্পষ্ট সীমারেখা টানা যায় না অথবা টানা যেতে পারে না। এটি সমর্থন করা যেতে পারে না যে আন্তঃসঙ্করিত হওয়ার পর প্রজাতিরা অনিবার্যরূপে বন্ধ্যা হয় এবং ভ্যারাইটিরা অনিবার্যরূপে জননক্ষমতাসম্পন্ন হয়; অথবা এমনটাও ধরে নেওয়া যায় না যে বন্ধ্যাত্ব একটি বিশেষ গুণ এবং সৃষ্টির চিহ্ন। প্রজাতিরা অপরিবর্তনশীল উৎপাদন—এই বিশ্বাসটি ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্যম্ভাবী ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসকে অল্প স্থায়িত্বসম্পন্ন বলে চিন্তা করা হয়েছিল। এখন সময় অতিবাহনের কিছু ধারণা অর্জন করার পর প্রমাণ ব্যতিরেকে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই যে ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এত নিখুঁত যে এটি প্রজাতিদের পরিব্যক্তির সরল সাক্ষ্য আমাদের প্রদান করে—যদি এরা পরিব্যক্তির মধ্য দিয়ে গিয়ে থাকে। 

কিন্তু একটি প্রজাতি ভিন্ন ও স্পষ্ট প্রজাতির জন্ম দিয়েছে—এটি স্বীকার করার ব্যাপারে আমাদের স্বাভাবিক অনিচ্ছার প্রধান কারণটি হচ্ছে এই যে আমরা সবসময় বিরাট পরিবর্তনগুলোকে স্বীকার করতে অসম্মত হই, যাদের ধাপগুলো আমরা দেখতে পাই না। বাধাটি একইরকম হয় যেমন অসংখ্য ভূতত্ত্ববিদরা অনুভব করেছিলেন, যখন লিয়েল প্রথম জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে মাধ্যমগুলোর দ্বারা, যা এখনও কাজ করে, অন্তর্দেশীয় পর্বতের পার্শ্বগুলোর দীর্ঘ সারি এবং বিরাট উপত্যকাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের মন সম্ভবত এমনকি দশ লক্ষ বৎসর কথাটিরও যথার্থ অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না; অসংখ্য বংশধরে সঞ্চিত অসংখ্য অল্প পরিবর্তনসমূহের পূর্ণ প্রভাব সে অনুমান করতে পারে না। 

যদিও এই গ্রন্থে সারাংশের আকারে প্রদত্ত মতবাদগুলোর সঙ্গে আমি সম্পূৰ্ণ একমত, তবুও অভিজ্ঞ প্রকৃতিবিদদের সেগুলো বিশ্বাস করানোর ব্যাপারে আমি নিশ্চয় আশা করিনি, যাঁদের মন দীর্ঘ বছর ধরে আমার মতের প্রত্যক্ষ বিরোধী অসংখ্য তথ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। এসব অভিব্যক্তিগুলোর মধ্যে, যেমন “সৃষ্টির পরিকল্পনা”, “নক্সার একত্ব” ইত্যাদি, আমাদের অজ্ঞতা লুকিয়ে রাখা সহজ হয় এবং মনে করা হয় যে আমরা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছি, যখন প্রকৃতপক্ষে একটি ঘটনাকে আমরা শুধু পুনরুক্তি করি। যাঁর স্বাভাবিক প্রবণতা কিছু সংখ্যক ঘটনার ব্যাখ্যার তুলনায় অব্যাখ্যাত বাধাগুলোর প্রতি বেশী গুরুত্ব আরোপ করে, তিনি নিশ্চয় তত্ত্বটিকে খারিজ করবেন। উদার মানসিকতার কয়েকজন প্রকৃতিবিদ, যাঁরা ইতিমধ্যে প্রজাতিদের অপরিবর্তনশীলতায় সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, এই গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন; কিন্তু আমি ভবিষ্যতের দিকে এবং যুবক ও উদীয়মান প্রকৃতিবিদদের দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্য করি, যারা প্রশ্নটিকে উভয়দিক থেকে নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করতে সমর্থ হবে। যে-কেউ এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হোক যে প্রজাতিরা পরিবর্তনশীল, সে তার বিশ্বাসকে বিচারবুদ্ধি দিয়ে প্রকাশ করার দ্বারা ভাল কাজ করবে; কারণ এরূপে সংস্কারের ভারটি অপসারিত করা যেতে পারে, যার দ্বারা এই বিষয়টি আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। 

কয়েকজন বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ সম্প্রতি তাঁদের বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে প্রত্যেক গণের অসংখ্য সুপরিচিত প্রজাতি প্রকৃত প্রজাতি নয়; কিন্তু অন্যান্য প্রজাতিরা প্রকৃত প্রজাতি অর্থাৎ স্বাধীনভাবে সৃষ্ট হয়েছে। আমার মনে হয় এটি একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত। তাঁরা অসংখ্য আকারকে স্বীকার করেন, যেগুলোকে তাঁরা তখনও পর্যন্ত বিশেষ সৃষ্টি বলে মনে করেছেন। এবং যেগুলোকে তখনও অধিকাংশ প্রকৃতিবিদ এভাবেই দেখেছেন, এবং যেগুলো মাভাবিকভাবে প্রকৃত প্রজাতির সমস্ত বহিঃবৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে—তাঁরা স্বীকার করেন যে এগুলো পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাঁরা অন্য এবং অল্প ভিন্ন আকারদের ক্ষেত্রে এই মত প্রসারিত করতে অস্বীকার করেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা দাবী করেন না যে তাঁরা সংজ্ঞা প্রদান অথবা এমনকি কল্পনা করতে পারেন যে কোনগুলো জীবনের সৃষ্ট আকার এবং কোনগুলো গৌণ নিয়ম দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনকে একটি “প্রধান কারণ” হিসেবে তাঁরা স্বীকার করেন, অন্য ক্ষেত্রে খামখেয়ালীভাবে এটি বাতিল করেন—উভয় ক্ষেত্রেই পার্থক্যের কোন কারণ না দেখিয়েই তাঁরা এটি করেন। একটা সময় আসবে যখন এটি পূর্বধারণার অসারতার একটি অদ্ভূত ব্যাখ্যা হিসেবে উপস্থিত হবে। এইসব বিশেষজ্ঞরা একটি সাধারণ জন্মের তুলনায় সৃষ্টির একটি অলৌকিক ক্রিয়ায় সম্ভবত আর চমকিত হন না। কিন্তু তাঁরা কি প্রকৃতই বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য যুগে কোন কোন মৌল পরমাণু জীবন্ত কণাগুলোকে আকস্মিক ঝলক দিয়ে সক্রিয় করেছে? তাঁরা কি বিশ্বাস করেন যে সৃষ্টির প্রত্যেক অনুমিত ক্রিয়ায় একটি একক অথবা অনেকে সৃষ্ট হয়েছিল? ডিম অথবা বীজ অথবা পূর্ণবয়স্ক হিসেবে প্রাণী ও উদ্ভিদের অসংখ্য ধরণগুলো কি সৃষ্ট হয়েছিল? এবং স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে, মাতার গর্ভের পুষ্টির ভুয়ো চিহ্নগুলো সমেত কি এরা সৃষ্ট হয়েছিল? এসব প্রশ্নগুলোর কয়েকটির উত্তর তাঁরা কিছুতেই দিতে পারেন না, যাঁরা জীবনের শুধুমাত্র কতিপয় আকার, অথবা শুধুমাত্র কোন একটি আকারের আবির্ভাব অথবা সৃষ্টিতে বিশ্বাস করেন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন যে একটি জীবের সৃষ্টিতে বিশ্বাস করা যতটা সহজ, এক মিলিয়ন জীবের সৃষ্টিতে বিশ্বাস করাও ঠিক ততটাই সহজ; কিন্তু মাউপারটুইসের দার্শনিক অনুজ্ঞা “সামান্যতম ক্রিয়া” অল্পতর সংখ্যাকে স্বীকার করতেই মনকে আরও বেশী প্রভাবিত করে; এবং আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস করা উচিত হবে না যে প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীর অসংখ্য জীবগুলো একটি একক পিতামাতা থেকে উদ্ভবের সরল অথচ প্রতারণাপূর্ণ চিহ্নগুলোর সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে। 

পূর্ব ঘটনাগুলোর একটি রেকর্ড হিসেবে আমি পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে এবং অন্য এমন কতিপয় বাক্য রেখেছি, যার অর্থ হচ্ছে যে প্রকৃতিবিদরা প্রত্যেক প্রজাতির পৃথক সৃষ্টিতে বিশ্বাস করেন; এবং এভাবে বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য আমি সতর্কিত হয়েছি। কিন্তু সন্দেহ নেই যে এই প্রথম সংস্করণ প্রকাশের সময় এটাই সাধারণ বিশ্বাস ছিল। আমি বিবর্তন বিষয়ে অনেক প্রকৃতিবিদের সঙ্গে আগে কথা বলেছিলাম এবং কখনও সহানুভূতিপূর্ণ মতের মিলের সাক্ষাৎ পাইনি। এটি সম্ভবপর যে কয়েকজন তখন হয়ত বিবর্তনে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু তাঁরা হয় নীরব ছিলেন অথবা তাঁরা এমন দ্ব্যর্থক ভাষায় তাঁদের মত প্রকাশ করতেন যে তার অর্থ বোঝা অতিশয় অসুবিধাজনক ছিল। বর্তমানে অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে এবং প্রায় প্রত্যেক প্রকৃতিবিজ্ঞানীই বিবর্তনের বিরাট নিয়মটি স্বীকার করেন। তবে, কয়েকজন এখনও মনে করেন যে প্রজাতিরা সম্পূর্ণ অব্যাখ্যাত উপায়গুলোর মাধ্যমে নূতন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন আকারগুলোকে হঠাৎ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু যেমন আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, বিরাট এবং আকস্মিক রূপান্তর স্বীকার করার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য উপস্থিত করা যেতে পারে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং আরও গবেষণামূলক অনুসন্ধান করলে, কিন্তু পৃথিবীর ধূলিকণা থেকে প্রজাতির সৃষ্টির পুরানো বিশ্বাসের তুলনায় পুরানো এবং ব্যাপকভাবে ভিন্ন আকারগুলো থেকে ব্যাখ্যাতীতভাবে নূতন আকারদের হঠাৎ আবির্ভাবের বিশ্বাসের দ্বারা খুব একটা উপকার লাভ করা যায় না। 

প্রশ্ন করা যেতে পারে যে প্রজাতিদের রূপান্তরের তত্ত্বটিকে আমি কতদূর প্রসারিত করি। প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া অসুবিধাজনক, কারণ আকাররা যত বেশী ভিন্ন হয় তত বেশী তারা সংখ্যায় অল্পতর এবং শক্তিতে কম হয়, যা আমরা সম্প্রদায়গত উদ্ভবের অনুকূলে অনেক যুক্তি দ্বারা বিচার-বিবেচনা করি। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় যুক্তি অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সমগ্র শ্রেণীগুলোর সকল সদস্যরা কুটুম্ব-সম্পর্কের একটি শৃংখল দ্বারা একত্রে সংযুক্ত হয়, এবং গোষ্ঠীদের অধীনে গোষ্ঠীদেরকে একই নিয়ম অনুযায়ী সকলকে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে। জীবাশ্ম অবশেষ বর্তমানের অর্ডারগুলোর মধ্যে অতিশয় ব্যাপক ব্যবধানে পূর্ণ করার ব্যাপারে কোন কোন সময় প্রবণতাযুক্ত হয়। 

অঙ্কুর অবস্থার অঙ্গগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে একটি আদিম পূর্বপুরুষের সম্পূর্ণ বিকশিত অবস্থার অঙ্গ ছিল; এবং কতিপয় ক্ষেত্রে এটি বংশধরদের বিরাট পরিমাণ রূপান্তরের ইঙ্গিত প্রদান করে। সমগ্র শ্রেণীগুলোতে একই নক্সায় বিভিন্ন দেহগঠন সৃষ্ট হয়েছে, এবং অতিশয় প্রাথমিক বয়সে ভ্রূণগুলো পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সদৃশ হয়। অতএব আমি সন্দেহ করতে পারি না যে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটি একই বিরাট শ্রেণী অথবা জগতের সমস্ত সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে। আমি বিশ্বাস করি যে প্রাণীরা বড়জোর চার অথবা পাঁচটি পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 

সব প্রাণী ও উদ্ভিদরা কোন এক আদিরূপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এই বিশ্বাসটির দিকে উপমা বা সাদৃশ্য আর এক ধাপ অগ্রসর হতে আমাকে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু উপমা একটি ছলনাময় পথনির্দেশক হতে পারে। তা সত্ত্বেও এদের রাসায়নিক গঠনে, এদের কোষীয় দেহগঠনে, এদের বৃদ্ধির নিয়মে এবং ক্ষতিকর প্রভাবসমূহে এদের বাধ্যবাধকতায় সব জীবদের অনেক কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে। এমনকি এরূপ একটি তুচ্ছ বিষয়েও আমরা এটি দেখি, যেমন একই অবস্থান উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সমভাবে প্রভাবিত করে; অথবা গল ফ্লাই দ্বারা নিঃসৃত বিষ বন্য গোলাপ অথবা ওক গাছের বিকটাকৃতি বৃদ্ধি করে। সম্ভবত কতিপয় অতিশয় নিম্নতম জীব ব্যতীত সমস্ত জীবদের ক্ষেত্রে যৌন উৎপাদন মূলত একইরূপ হয়। এখনও পর্যন্ত যতদূর জানা তাতে সমস্ত প্রাণীদের জননকোষ একই হয় যাতে করে সব জীব একটি সাধারণ উৎস থেকে যাত্রা করে। যদি আমরা এমনকি দুটি প্রধান বিভাগের দিকে লক্ষ্য করি, অর্থাৎ প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে, তাহলে কোন কোন নিম্ন আকার বৈশিষ্ট্যে এত মধ্যবর্তী হয় যে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা এদের কোন্ জগতের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত তা নিয়ে বিতর্ক করেন। যেমন আসা গ্রে মত্তব্য করেছেন, “নিম্নতর শৈবালদের কয়েকটির স্পোর ও জনন—অঙ্গসমূহ প্রথমে বৈশিষ্ট্যগতভাবে প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবী করতে পারে, এবং তারপর দ্ব্যর্থহীনভাবে উদ্ভিদ হিসেবে।” অতএব বৈশিষ্ট্যের ভিন্নমুখীতার সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী এটি অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না যে এরূপ নিম্নতম এবং মধ্যবর্তী আকার থেকে প্রাণী ও উদ্ভিদ উভয়েই উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে; এবং যদি আমরা এটি স্বীকার করি, তাহলে আমাদের নিশ্চয় স্বীকার করতে হবে যে পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত বসবাসকারী সমস্ত জীবরা কোন একটি আদিমরূপ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মূলত সাদৃশ্যের ওপর গড়ে উঠেছে, এবং, গৃহীত হোক বা না হোক, এটি অবাস্তব। সন্দেহ নেই যে এটি সম্ভবপর হয়, যেমন মিঃ জি. এইচ. লিউস জোরের সঙ্গে বলেন যে জীবনের প্রথম আরম্ভের সময় থেকে অনেক ভিন্ন আকার উদ্ভূত হয়েছিল; কিন্তু এরূপ হলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে শুধুমাত্র অল্প কতিপয়ই রূপান্তরিত বংশধর ত্যাগ করেছে। কারণ যেমন আমি মেরুদণ্ডী আর্টিকুলাটা ইত্যাদিদের মতো প্রত্যেক বিরাট বিভাগগুলোর সদস্যদের সম্পর্কে সম্প্রতি মন্তব্য করেছি, এদের ভ্রূণগত সমসংস্থ এবং অঙ্কুর দৈহিক গঠনসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের হাতে স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে এবং প্রত্যেক বিভাগের সমস্ত সদস্যরা একটি একক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 

প্রজাতিদের উৎপত্তি সম্পর্কে এই গ্রন্থে উত্থাপিত আমার মতবাদ এবং মিঃ ওয়ালেসের মতবাদ অথবা অনুরূপ মতবাদগুলো যখন সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়, তখন আমরা অস্পষ্টভাবে পূর্বেই দেখতে পারি যে এটি প্রাকৃতিক ইতিহাসে একটি বিপ্লব আনবে। সিস্টেম্যাটিস্টরা এখনকার মত তাঁদের গবেষণা করতে সমর্থ হবেন; কিন্তু তাঁরা এই অথবা ঐ আকারটি একটি প্রকৃত প্রজাতি হবে কিনা সে বিষয়ে অবাস্তব সন্দেহের দ্বারা অনবরত আচ্ছন্ন হবেন না। আমি স্থিরনিশ্চিত এবং অভিজ্ঞতার পর বলি যে এত স্বস্তিদায়ক কিছু হবে না। ব্রিটিশ ব্র্যাম্বলদের যে-কোন পঞ্চাশটি প্রজাতি সঠিক প্রজাতি হবে কিনা সে সম্পর্কে সীমাহীন বিতর্ক বন্ধ হবে। সংজ্ঞা নির্ধারণের যোগ্য হতে যে-কোন একটি আকার অন্য আকারদের থেকে যথেষ্ট স্থায়ী এবং ভিন্ন হবে কিনা সে বিষয়ে সিস্টেম্যাটিস্টদের শুধু সিদ্ধান্তে আসতে যোগ্য হতে হবে (এই নয় যে এটি সহজ হবে); এবং যদি সংজ্ঞা নির্ধারণযোগ্য হয়, তাহলে প্রজাতিক নামকরণের জন্য পার্থক্যগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবে কিনা। শেষোক্ত বিষয়টি এর বর্তমান অবস্থার তুলনায় আরও বেশী প্রধান বিবেচ্য হবে, কারণ ক্রমপরিবর্তনগুলোর দ্বারা মিশ্রিত না হলে যে-কোন দুটি আকারের মধ্যে যত অল্পই হোক পার্থক্যগুলো উভয় আকারকে প্রজাতিভুক্ত করতে যথেষ্ট বলে অধিকাংশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন। 

অতঃপর আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে প্রজাতি ও সুচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে পরবর্তীটি বর্তমানকালে মধ্যবর্তী ক্রমপরিবর্তনসমূহ দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে বলে জানা যায় অথবা বিশ্বাস করা হয়, অন্যদিকে প্রজাতিরা পূর্বে এভাবে সংযুক্ত ছিল। অতএব, যে-কোন দুটি আকারের মধ্যে মধ্যবর্তী ক্রমপরিবর্তনগুলোর বর্তমান অবস্থানটি বাতিল না করে এদের মধ্যে পার্থক্যের প্রকৃত পরিমাণটিকে উচ্চ মূল্য দিতে এবং আরও যত্নসহকারে গুরুত্ব দিতে আমরা প্ররোচিত হব। এটি সম্পূর্ণ সম্ভবপর যে বর্তমানে শুধুমাত্র ভ্যারাইটি হিসেবে স্বীকৃত আকাররা প্রজাতিক নামে যোগ্য হওয়ার জন্য এরপর বিবেচিত হতে পারে। সংক্ষেপে, প্রজাতিদের আমাদের সেইভাবেই বিবেচনা করতে হবে যেভাবে এইসব প্রকৃতিবিদরা গণগুলোর ক্ষেত্রে করেন, তাঁরা স্বীকার করেন যে গণগুলো হচ্ছে সুবিধার জন্য সৃষ্ট শুধুমাত্র কৃত্রিম জোট। এটি উৎসাহজনক প্রত্যাশা হতে পারে না; কিন্তু প্রজাতি পদটির অনাবিষ্কৃত এবং আবিষ্কারের সম্ভাবনাহীন উপাদানটির জন্য ব্যর্থ গবেষণা থেকে আমরা অন্ততঃ মুক্ত হব। 

কৌতূহলের জন্য প্রাকৃতিক ইতিহাসের অন্য এবং আরও সাধারণ বিভাগগুলো বিরাটভাবে গড়ে উঠবে। সম্বন্ধ, সম্পর্ক, টাইপের সম্প্রদায়, পিতৃত্ব, অঙ্গসংস্থান, অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যসমূহ, অঙ্কুর এবং অকালজাত অঙ্গ ইত্যাদি প্রকৃতিবিদদের দ্বারা ব্যবহৃত পদগুলোর রূপকশোভিত হওয়া বন্ধ হবে এবং এদের একটি সরল অর্থ হবে। একটি জাহাজের প্রতি বন্য মানুষের দৃষ্টির মতো করে যখন আমরা জীবদের আর দেখি না, কারণ সবকিছুই তার উপলব্ধির সম্পূর্ণ বাইরে থাকে; যখন প্রকৃতির প্রত্যেক উৎপাদনকে এমন একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; যখন আমরা একইভাবে প্রত্যেক অধিকারীর পক্ষে উপকারী অনেক কলাকৌশলের যোগফল হিসেবে প্রত্যেক জটিল দৈহিক গঠন এবং সহজাত প্রবৃত্তিকে মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করি, যেমন যে-কোন বিরাট যন্ত্রকৌশলের উদ্ভব হচ্ছে শ্রম, অভিজ্ঞতা, যুক্তি, এবং এমনকি অসংখ্য শ্রমিকের অজ্ঞতার বা ভুলের যোগফল; যখন আমরা প্রত্যেক জীবকে এভাবে দেখি, আমার অভিজ্ঞতানুসারে প্রাকৃতিক ইতিহাসের অনুশীলন তখন আরও চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। 

পরিবৃত্তির কারণ ও নিয়মগুলো, ব্যবহার ও অব্যবহারের প্রভাবসমূহ, বহিঃ-পরিবেশের প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনালোচিত ক্ষেত্রে গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হবে। গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর অনুসন্ধান মূল্যের দিক থেকে অত্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত প্রজাতিদের অসীমতায় আর-একটি প্রজাতির যুক্ত হওয়ার তুলনায় মানুষের দ্বারা সৃষ্ট নূতন ভ্যারাইটিরা অনুসন্ধানের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হবে। আমাদের শ্রেণীবিভাগগুলো, যতদূর সম্ভব, বংশানুক্রমিক হবে; এবং যাকে সৃষ্টির পরিকল্পনা বলা যেতে পারে তাতেই তখন প্রকৃত অর্থ প্রদান করবে। যখন আমাদের নিকট নির্দিষ্ট বিষয় থাকবে, শ্রেণীবিভাগের নিয়মগুলো তখন নিঃসন্দেহে সরলতর হয়ে উঠবে। বংশতালিকাসমূহ অথবা বংশসূচক কোন বৈশিষ্ট্য আমাদের নিকট নেই। দীর্ঘদিন ধরে বংশগতভাবে প্রেরিত যে-কোন ধরনের বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমাদের প্রাকৃতিক বংশানুক্রমসমূহে উদ্ভবের অনেক ভিন্নমুখী রেখাগুলোকে আমাদের আবিষ্কার ও চিহ্নিত করতে হয়। অঙ্কুর অঙ্গগুলো বহুপূর্বে লুপ্ত দৈহিক গঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে অব্যর্থভাবে পথপ্রদর্শন করবে। প্রজাতি এবং প্রজাতি-গোষ্ঠীগুলি, যাদের বিপথগামী বলা হয় এবং যাদের কাল্পনিকভাবে জীবন্ত জীবাশ্ম বলা যেতে পারে, জীবনের আদিম আকারগুলির ছবি আঁকতে আমাদের সাহায্য করবে। ভ্রূণবিদ্যা প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীর আদিরূপের কিছুমাত্রায় অস্পষ্ট দেহগঠন আমাদের নিকট প্রায়শই উন্মুক্ত করবে। 

যখন আমরা স্থিরনিশ্চিত হই যে একই প্রজাতির সব এককরা এবং অধিকাংশ গণের সব নিকট সম্পর্কীয় প্রজাতিরা এক পিতামাতা থেকে অতি দূরবর্তী নয় এমন যুগে উদ্ভূত হয়েছে এবং কোন এক জন্মস্থান থেকে প্রচরিত হয়েছে, এবং প্রচরণের অনেক উপায় যখন আমরা ভালভাবে জানতে পারি, তখন জলবায়ুর এবং স্থলভাগের উচ্চতার পূর্বতন পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে ভূবিদ্যা বর্তমানে যে-আলোকপাত করছে এবং অনবরত করতেই থাকবে, তার সাহায্যে সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসীদের পূর্ববর্তী প্রচরণগুলো সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার করতে আমরা নিশ্চয় সমর্থ হব। এমনকি বর্তমানকালে, এদের অভিবাসনের আপাত উপায়গুলো সম্পর্কে, একটি মহাদেশের বিপরীত দিকে অবস্থিত সমুদ্রের অধিবাসীদের এবং ঐ মহাদেশের বিভিন্ন অধিবাসীদের প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্যগুলোর তুলনা করলে আদিম ভূগোল সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে। 

অতিশয় ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখার জন্য ভূবিদ্যা সংক্রান্ত অভিজাত বিজ্ঞানটি তার যশ হারিয়েছে। জীবাশ্মপূর্ণ পৃথিবীপৃষ্ঠকে একটি পরিপূর্ণ যাদুঘর হিসেবে দেখা উচিত হবে না, বরং একটি আকস্মিক এবং ব্যাপক ব্যবধানে যৎসামান্য সংগ্রহের যাদুঘর হিসেবেই একে দেখা উচিত। অনুকূল অবস্থাসমূহের একই সঙ্গে অস্বাভাবিক সংঘটনের ওপর এবং পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলোর মধ্যে শূন্য ব্যবধানগুলির বিরাট স্থিতিকালের ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক বিরাট জীবাশ্মপূর্ণ ভূস্তরের সঞ্চয়ন শনাক্ত হবে। কিন্তু পূর্বের এবং পরের জৈবিক আকারদের তুলনার দ্বারা আমরা এইসব ব্যবধানের স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে নিশ্চয়তার সঙ্গে কিছু হিসেব করতে সমর্থ হব। জীবন-আকারদের সাধারণ পারম্পর্যের দ্বারা দুটি আকারকে, যা অনেক অনুরূপ প্রজাতিদের অন্তর্ভুক্ত করে না, যথাযথ সমকালীন হিসেবে সম্পর্কযুক্ত করার চেষ্টায় আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। যেহেতু প্রজাতিরা মন্থরভাবে ক্রিয়াশীল এবং বর্তমানের কারণ দ্বারা উৎপন্ন ও ধ্বংস হচ্ছে, সৃষ্টির অলৌকিক কার্যের দ্বারা নয়, এবং যেহেতু জৈবিক পরিবর্তনের সকল কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে সেইটি যা পরিবর্তিত এবং সম্ভবত হঠাৎ পরিবর্তিত ভৌতিক পরিবেশের প্রায় নিরপেক্ষ হয়, যথা, জীবের সঙ্গে জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক-একটি জীবের উন্নতির ফলে অন্য জীবদের অনিবার্যরূপে উন্নতি অথবা ধ্বংসসাধন; এটি বোঝা যায় যে ধারাবাহিক ভূস্তরগুলোর জীবাশ্মদের জৈবিক পরিবর্তনের পরিমাণটি সময় অতিবাহনের আপেক্ষিক অথচ প্ৰকৃত নয় এমন একটি স্পষ্ট পরিমাপ হিসেবে সম্ভবত উপযোগী হয়। যতই একত্রে অবস্থান করুক না কেন, অসংখ্য প্রজাতি দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত থেকে থাকবে, অন্যদিকে একই সময়ের মধ্যে এইসব প্রজাতিদের কয়েকটি নূতন দেশগুলোতে প্রচরণ করে এবং বিদেশী সঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে। অতএব সময়ের একটি পরিমাপ হিসেবে জৈবিক পরিবর্তনের সঠিকতা সম্বন্ধে অধিক গুরুত্ব দেওয়া আমাদের উচিত হবে না। 

ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য উন্মুক্ত ক্ষেত্র পড়ে আছে। ক্রমপরিবর্তনের দ্বারা প্রতিটি মানসিক ক্ষমতা এবং সামর্থ্যের প্রয়োজনীয় অর্জনের মিঃ হার্বার্ট স্পেন্সারের দ্বারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির ওপর মনস্তত্ত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের উৎপত্তি এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে আরও আলোকপাত ঘটবে। 

সুবিখ্যাত বিশেষজ্ঞরা এই মতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত বলে মনে হয় যে প্রত্যেক প্রজাতি স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় এটি সৃষ্টিকর্তা দ্বারা বিষয়টিকে প্রভাবিত করার নিয়মগুলি সম্পর্কে আমরা যা জানি তার সঙ্গে যথেষ্টই সঙ্গতিপূর্ণ যে পৃথিবীর অতীত এবং বর্তমানের আধবাসীদের উদ্ভব ও বিলুপ্তি এককের জন্ম ও মৃত্যু নির্ধারণকারী কারণের মত গৌণ কারণসমূহের জন্য হয়ে থাকবে। যখন আমি সমস্ত জীবগুলিকে বিশেষ সৃষ্টি হিসাবে নয় বরং যারা ক্যামব্রিয়ান যুগের প্রথম স্তরটির সঞ্চয়নের বহু পূর্বে বসবাস করত এমন কয়েকটি জীবের বংশগত বংশধর হিসাবে দেখি, তখন আমার মনে হয় এরা উন্নত শ্রেণীতে উন্নত হয়েছে। অতীত বিচার করে, আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে কেবলমাত্র একটি জীবন্ত প্রজাতি সুদূর ভবিষ্যতে তার অপরিবর্তিত চেহারা বংশগতভাবে প্রেরণ করবে না। বর্তমানে জীবিত প্রজাতিদের অতি অল্প কয়েকটিই সুদূর ভবিষ্যতে যে-কোন প্রকারের বংশধরে তাদের অপরিবর্তিত চেহারা বংশগতভাবে প্রেরণ করবে; কারণ যেভাবে সব জীবরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে, তা দেখায় যে প্রত্যেক গণের বেশী সংখ্যক প্রজাতিরা এবং অনেক গণের সমস্ত প্রজাতিরা কোন বংশধর রেখে যায়নি বরং সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য আমরা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব একটি ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি যে প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে বৃহত্তর ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অন্তর্গত সাধারণ এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরা অবশেষে বেঁচে থাকবে এবং নূতন ও প্রভাবশালী প্রজাতিদের জন্মদান করবে। যেহেতু জীবনের সমস্ত জীবিত আকাররা তাদের বংশগত বংশধর যারা ক্যামব্রিয়ান যুগের পূর্বে বসবাস করত, সেহেতু আমরা নিশ্চিতভাবে অনুভব করতে পারি যে বংশের দ্বারা সাধারণ পারম্পর্যটি কখনও একবারও ভেঙ্গে যায়নি এবং কোন মহাপ্লাবন সমগ্র পৃথিবীকে জীবশূন্য করেনি। অতএব আমরা দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সুদীর্ঘ এক নিরাপদ ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারি। এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রত্যেক জীবের ভালর দ্বারা অথবা ভালর জন্যই শুধুমাত্র কাজ করে বলে সমস্ত শারীরিক ও মানসিক গুণ নিখুঁততার দিকে উন্নত হওয়ার প্রবণতাযুক্ত হবে। 

অনেক ধরনের উদ্ভিদ, ঝোপঝাড়ের গায়ক পাখি, নিঃশব্দে উড়ন্ত বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং ভেজামাটির ওপর হামাগুড়ি দেওয়া কৃমি সমেত চারদিকে বাঁধ দিয়ে ঘেরা একটি স্থানের কল্পনা করা কৌতূহলোদ্দীপক হয় এবং পরস্পরের থেকে এত পৃথক ও এমন জটিল একটি উপায়ে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল জটিলভাবে গঠিত আকাররা আমাদের চারিদিকে ক্রিয়াশীল নিয়মসমূহের দ্বারা সকলে উৎপন্ন হয়েছে—এটি স্মরণ করাও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। বৃহৎ অর্থে ধরলে এই নিয়মগুলো হচ্ছে জননের সঙ্গে বৃদ্ধি; বংশানুসৃতি যা জননপ্রক্রিয়া দ্বারা প্রায়শই আভাষে-ইঙ্গিতে প্রকাশিত হয়; জীবন-পরিবেশের অপ্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ ক্রিয়া এবং ব্যবহার ও অব্যবহার থেকে পরিবর্তনশীলতা বা বিভিন্নতা; বৃদ্ধির একটি অনুপাত এত বেশী হয় যে সেটি জীবনসংগ্রামে প্ররোচিত করে এবং ফলস্বরূপ প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ শুরু করে, যার ফলে বৈশিষ্ট্যের ভিন্নমুখীতা এবং কম উন্নত আকারদের বিলুপ্তি ঘটে। এরূপে প্রকৃতির সংগ্রাম থেকে, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু থেকে, আমাদের পক্ষে কল্পনাযোগ্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয়টি হচ্ছে উচ্চতর প্রাণীদের সরাসরি উৎপাদন। কিছু . ক্ষমতা সম্বলিত জীবন সম্পর্কে এই মতবাদটিতে চমৎকারিত্ব রয়েছে, যেটি বলে যে সৃষ্টিকর্তা কয়েকটি আকারে অথবা একটি আকারে প্রথমে জীবন সঞ্চার করেছেন; এবং অন্যদিকে তখন এই গ্রহটি অভিকর্ষের স্থায়ী নিয়মানুসারে ঘুরতে থাকে। এত সরল সূচনা থেকে সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক অনন্ত আকাররা উদ্ভূত হয়েছে এবং হচ্ছে। 

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *