ত্রয়োদশ অধ্যায় —ভৌগোলিক বিস্তার–পূর্বানুবৃত্তি
স্বাদুজলের উৎপাদনসমূহের বিস্তার-মহাসামুদ্রিক দ্বীপের অধিবাসীরা—ব্যাট্রাচিয়ান প্রাণী ও স্থলচর স্তন্যপায়ীদের অনুপস্থিতি—দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের সঙ্গে নিকটতম মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সম্পর্ক—উত্তরকালীন রূপান্তরের সঙ্গে নিকটতম উৎস থেকে উপনিবেশ স্থাপন—পূর্ববর্তী এবং বর্তমান অধ্যায়ের সারাংশ।
মিঠাজলের উৎপাদন
স্থলভাগের প্রতিবন্ধকের জন্য হ্রদ ও নদীসমূহ পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় বলে মনে করা যেতে পারত যে স্বাদুজলের উৎপাদনগুলো একই দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে না, এবং সমুদ্র আরও অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধক হয় বলে এরা কখনও দূরবর্তী দেশসমূহে বিস্তৃত হবে না। কিন্তু ঘটনাটি সম্পূর্ণ উল্টো হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্গত অনেক স্বাদুজলের প্রজাতিদের বিস্তার শুধুমাত্র ব্যাপকই হয় না, বরং সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে উল্লেখযোগ্য প্রাধান্য বিস্তার করে। আমার বেশ মনে আছে যে ব্রাজিলের মিঠাজলের উৎপাদনগুলি প্রথম সংগ্রহের সময় ব্রিটেনের তুলনায় ওখানকার মিঠাজলের কীটপতঙ্গ, খোলকী প্রাণী ইত্যাদিদের সাদৃশ্য এবং চারপাশের স্থলজ প্রাণীদের বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করে রীতিমতো আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম আমি।
কিন্তু আমি মনে করি মিঠাজলের জীবদের সুদূরপ্রসারী ক্ষমতা নিজ দেশসমূহে পুকুর থেকে পুকুরে অথবা নদী থেকে নদীতে অল্প এবং প্রায়শই প্রচরণ এদের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী অভিযোজন পদ্ধতির দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, এবং একটি প্রায় প্রয়োজনীয় পরিণাম হিসেবে এই ক্ষমতা থেকে ব্যাপক বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে। আমরা শুধু কয়েকটি বিষয় এখানে বিবেচনা করতে পারি; এগুলোর মধ্যে, মাছেদের সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা করা সবচেয়ে কষ্টকর। আগে মনে করা হত যে একই মিঠাজলের প্রজাতিরা কখনও পরস্পরের থেকে দূরবর্তী দুটি মহাদেশে অবস্থান করেনি। কিন্তু ডঃ গুনথার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে গ্যালাক্সিয়ান অ্যাচে য়েটাস নামক প্রাণীটি টাসমানিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে বসবাস করে। এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা, এবং সম্ভবত পূর্বের উষ্ণতর যুগের সময় একটি কুমেরীয় কেন্দ্র থেকে বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়। তবে এই ঘটনাটি কিছু কম মাত্রায় আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় যখন দেখা যায় যে এই গণের প্রজাতিরা কিছু অজানা উপায় দ্বারা মুক্ত সমুদ্রের বেশ কিছু দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে : এভাবে দেখা যায় যে এমন একটি প্রজাতি আছে যেটি প্রায় ২৩০ মাইল দূরে অবস্থিত নিউজিল্যান্ড এবং অকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে সাধারণ হয়। একই মহাদেশে মিঠাজলের মাছেরা প্রায়শই যেন খেয়ালখুশীমতো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়, কারণ দুটি লাগোয়া নদীতে কতিপয় প্রজাতি একই হতে পারে, আবার কয়েকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে।
এটি সম্ভবপর যে আকস্মিক উপায়ে এরা মাঝেমাঝে পরিবাহিত হয়। এরূপে এখনও পর্যন্ত জ্যান্ত মাছরা ঘূর্ণিঝড়ের দ্বারা কদাচিৎ দূরবর্তী স্থানে পতিত হয়; এবং জানা গেছে যে জল থেকে তোলার পর কিছু সময় পর্যন্ত ডিম জীবনীশক্তি বজায় রাখে। তবে, এদের বিস্তার বর্তমান যুগে স্থলভাগের উচ্চতার পরিবর্তনের জন্য হয় বলে মনে করা যেতে পারে, উচ্চতার পরিবর্তনের জন্যে নদীগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। উচ্চতার কোন পরিবর্তন ছাড়া বন্যার সময় এটি ঘটার উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। অবিচ্ছিন্ন এবং ফলস্বরূপ কোন প্রাচীন যুগ থেকে দুই দিকে নদীগুলোর মিলনে প্রতিবন্ধক অধিকাংশ পর্বতমালার বিপরীতদিকে মাছেদের ব্যাপক পার্থক্য একই সিদ্ধান্তে আসতে প্রভাবিত করে। মিঠাজলের কতিপয় মাছ অতি আদিম আকারদের অন্তর্গত হয়, এবং এইসব ক্ষেত্রে, ভৌগোলিক পরিবর্তনসমূহের জন্য যথেষ্ট সময় রয়ে থাকবে, এবং ফলস্বরূপ অধিক প্রচরণের জন্য সময় ও উপায়সমূহও রয়ে থাকবে। অধিকন্তু, কিছু বিচার-বিশ্লেষণের পর ডঃ গুনথার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত করেছেন যে মাছেদের একই আকাররা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। লবণাক্ত জলের মাছ ধীরে ধীরে মিঠাজলে বাস করতে অভ্যস্ত হতে পারে; এবং ভ্যালেনসিয়েনেসের মতানুসারে, যার সমস্ত সদস্যরা মিঠাজলে আবদ্ধ থাকে এমন একটি গোষ্ঠী কদাচিৎ থাকতে পারে যাতে করে স্বাদুজলের কোন গোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি সামুদ্রিক প্রজাতি সমুদ্রের উপকূল বরাবর ভ্রমণ করতে পারত, এবং এটি সম্ভবপর যে একটি দূরবর্তী স্থলভাগের মিঠাজলে কোন অসুবিধা ছাড়াই এটি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত।
মিঠাজলের খোলকী (শেল) প্রাণীদের কতিপয় প্রজাতির বিস্তার ব্যাপক হয় এবং আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী এরা একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং একই উৎস থেকে অগ্রসর হয়েছে। এরকম সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা সমগ্র পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এদের বিস্তার প্রথমে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছিল, কারণ এদের ডিম সম্ভবত পাখিরা বহন করে না এবং সমুদ্রজলে ডিম ও বয়স্করা তৎক্ষণাৎ মারা যায়। এমনকি আমি বুঝতে পারতাম না কেমন করে ভিন্ন পরিবেশে অভিযোজিত কয়েকটি প্রজাতি একই দেশের সর্বত্র দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু দুটি ঘটনা, যা আমি লক্ষ্য করেছি এবং আরও অনেক ঘটনা যা নিঃসন্দেহে আবিষ্কৃত হবে, এই বিষয়ের ওপর কিছু আলোকপাত করে। ডাক-উইড (হাঁসপানা) পরিপূর্ণ পুকুর থেকে হাঁসেরা যখন হঠাৎ উঠে আসে, তখন আমি দুবার লক্ষ্য করেছি যে এই ছোট উদ্ভিদরা হাঁসেদের পিঠে লেগে থাকে; এবং একটি ছোট ডাক-উইডকে একটি অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে অন্য অ্যাকোয়ারিয়ামে স্থানান্তরের সময়, আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্যটি থেকে একটিকে স্বাদুজলের খোলকী প্রাণী দ্বারা পূর্ণ করেছি। কিন্তু অন্য একটি মাধ্যম বোধহয় আরও বেশী কার্যকরী হয়। আমি একটি অ্যাকোরিয়ারিয়ামে একটি হাঁসের পা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, এতে অনেক স্বাদুজলের খোলকী প্রাণীর ডিম ফুটে বাচ্চা হচ্ছিল; এবং আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে সদ্যোজাত অতি ক্ষুদ্র খোলকী প্রাণীরা পা-টিতে উঠছিল এবং এত জোরে পায়ে আটকেছিল যে জল থেকে তোলার পর জোরে নাড়িয়েও এদের অপসারিত করা যায়নি, যদিও আরও বেশী বয়সে এরা সাধারণত নিজে থেকেই পড়ে যায়। যদিও স্বভাবে জলজ এইসব সদ্যোজাত কম্বোজ (মোলাস্কা) প্রাণীরা আর্দ্র আবহাওয়ায় বারো থেকে কুড়ি ঘণ্টা হাঁসের পায়ে বেঁচেছিল এবং এই সময়ে একটি হাঁস অথবা কোঁচবক (হেরন) অন্ততঃ ছয় থেকে সাত মাইল উড়ে থাকবে, এবং যদি এরা সমুদ্র পার হয়ে একটি মহাসামুদ্রিক দ্বীপে অথবা অন্য কোন দূরবর্তী স্থানে উড়ে যায়, তাহলে এরা নিশ্চয় ছোট পুকুর অথবা নদীতে অবতরণ করবে। স্যার চার্লস লিয়েল আমাকে জানিয়েছেন যে দৃঢ়ভাবে আটকানো একটি অ্যানসাইলাস (লিমপেটের মত স্বাদুজলের একটি খোলকী প্রাণী) সমেত ডিটিশকাম (এক ধরনের জলজ পোকা) ধরা পড়েছে; এবং একই পরিবারের একটি জলজ বিটল যথা একটি কলিমবেটেস্ নিকটতম মূল ভূখণ্ড থেকে পঁয়তাল্লিশ মাইল পর্যন্ত ‘বিউ’ জাহাজের সঙ্গে একবার উড়ে গিয়েছিল : আরও কতদূর এটি উড়ে যেতে পারত কেউ বলতে পারে না।
উদ্ভিদদের সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই জানা গেছে যে অনেক মিঠাজলের এমনকি জলাভূমির প্রজাতিরা সব মহাদেশে এবং অতিশয় দূরবর্তী মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অ্যালফোনসে ডি. ক্যান্ডোলে-র মতানুসারে অতি অল্প জলজ সদস্য—সহ স্থলজ উদ্ভিদের ঐ সব বিরাট গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এটি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেহেতু ঐ জলজ সদস্যরা সম্ভবত অব্যবহিত পরে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। আমার মনে হয় যে বিস্তারের অনুকূল উপায়সমূহ এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে পাখিদের পা ও ঠোঁটে কিছু পরিমাণ মাটি কোন কোন সময় লেগে থাকে। পুকুরের কর্দমাক্ত ধার বরাবর চলাচলকারী কাদাখোঁচা পাখিদের পা সম্ভবত কর্দমাক্ত হবে। এই অর্ডারের পাখিরা অন্য যে-কোন অর্ডারের পাখিদের তুলনায় বেশী বিচরণ করে এবং মুক্ত সমুদ্রের অতি দূরবর্তী ও ঊষর দ্বীপগুলোতে এদের মাঝেমাঝেই দেখা যায়; সম্ভবত এরা সমুদ্রের জলে এই কারণে নামে না, যাতে এদের পায়ের মাটি ধুয়ে না যায়; এবং স্থলভাগের সন্ধান পেলে এরা নিশ্চয় স্বাভাবিকস্বাদুজলের শিকারের জন্য উড়ে যায়। পুকুরগুলোর কাদায় কি পরিমাণ বীজ আছে তা উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের জানা আছে বলে আমার মনে হয় না; আমি কয়েকটি ছোট ছোট পরীক্ষার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখানে আমি সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটির কথা বলব : একটি ছোট পুকুরের ধারে জলের তলার তিনটি ভিন্ন স্থান থেকে তিন চামচ কাদা ফেব্রুয়ারি মাসে তুলেছিলাম। শুকোনোর পর এই কাদার ওজন হয়েছিল মাত্র ৬ আউন্স। আমার পড়ার ঘরে এটি ছয়মাস ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম এবং এতে জন্মানো প্রত্যেকটি গাছ গণনা করেছিলাম; গাছগুলো অনেক প্রকারের ছিল এবং সংখ্যায় ছিল ৫৩৭টি—যদিও আঠালো মাটিটি সকালে চা পানের একটি কাপে রাখা হয়েছিল! এইসব বিষয় বিবেচনা করে, আমি মনে করি যে যদি বহু দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত অপরিপূর্ণ পুকুর ও নদীতে মিঠাজলের উদ্ভিদদের বীজসমূহ জলজ পাখিরা বহন না করে, তাহলে এর কারণ নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। মিঠাজলের ক্ষুদ্রতর প্রাণীদের কয়েকটির ডিমের ক্ষেত্রে একই মাধ্যম কাজ করে থাকতে পারে।
অন্য এবং অজ্ঞাত মাধ্যমগুলোও সম্ভবত একটি ভূমিকা পালন করেছে। মিঠাজলের মাছ কয়েক প্রকার বীজ খায় এটি আমি উল্লেখ করেছি, যদিও গিলে খাওয়ার পর অনেক বীজকে এরা বের করে দেয়; এমনকি ছোট মাছেরা হলদে জলপদ্ম ও পোটামোগেটন নামক উদ্ভিদের বীজের মতো মাঝারি আকারের বীজগুলোকেও গিলে খায়। শতাব্দী পর শতাব্দীর ধরে কোঁচবক (হেরন) ও অন্য পাখিরা প্রত্যহ মাছ খেয়ে থাকে; তারপর এরা উড়ে যায় এবং অন্য জলাশয়ে অবতরণ করে, অথবা সমুদ্র অতিক্রম করে উড়ে যায়; আমরা দেখেছি যে বিষ্ঠা ও ক্ষুদ্র দলা হিসেবে নিঃসরণের অনেক ঘণ্টা পর বীজগুলো অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষমতা বজায় রাখে। নেলাম্বিয়াস নামক ঐ সুন্দর জলপদ্মের বিরাট আকারের বীজগুলো দেখে এবং এই উদ্ভিদটির বিস্তার সম্পর্কে অ্যালফোনসে ডি. ক্যান্ডোলের বক্তব্য স্মরণ করে, আমার মনে হয়েছিল যে এর বিস্তারের উপায়গুলোর কারণ নির্ণয় করা অসম্ভব, কিন্তু অডুবন বলেন যে তিনি বিরাট দক্ষিণী জলপদ্মের (ডঃ হুকারের মতে সম্ভবত নেলাম্বিয়াম লুটিয়ামের) বীজ একটি কোঁচবক পাখির পেটে দেখেছিলেন। এরপর এই পাখিটি পেটভর্তি বীজ নিয়ে দূরবর্তী পুকুরগুলোতে উড়ে গিয়ে থাকবে এবং পেট ভরে মাছ খাওয়ার পর এটি একটি ক্ষুদ্র দলার আকারে বীজগুলোকে নিঃসরণ করে থাকবে, যাদের অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষমতা বজায় থাকবে।
বিস্তারের এইসব উপায়গুলো বিবেচনার পর স্মরণ করা উচিত হবে যে যখন, উদাহরণস্বরূপ, কোন একটি উঠন্ত দ্বীপে একটি পুকুর অথবা ছোট নদী প্রথম সৃষ্ট হয়, তখন এটি অদখলীকৃত অবস্থায় থাকে এবং একটি বীজ অথবা ডিমের বেঁচে থাকার ভাল সম্ভাবনা থাকে। যদিও একই পুকরের অধিবাসীদের মধ্যে যতই অল্প হোক না কেন সবসময় জীবনসংগ্রাম বা অস্তিত্বের সংগ্রাম চলতে থাকবে, তথাপি যেহেতু একটি পরিপূর্ণ পুকুরে এমনকি সংখ্যাটি স্থলভাগের একই ধরনের অঞ্চলে বসবাসকারী প্রজাতিদের তুলনায় অল্প হয়, তাই এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা স্থলভাগের প্রজাতিদের তুলনায় সম্ভবত কম কঠোর হবে; ফলস্বরূপ, বিদেশের জলাশয় থেকে আসা কোন অনুপ্রবেশকারীর পক্ষে স্থলভাগের উপনিবেশকারীদের তুলনায় নূতন অঞ্চল দখল করার ভাল সম্ভাবনা থাকবে। এটিও স্মরণ করা উচিত যে স্বাদু জলের অনেক উৎপাদন স্বভাবগতভাবে নিম্নশ্রেণীর হয়, এবং আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে এই জীবরা উচ্চশ্রেণীর জীবদের তুলনায় আরও ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়, এবং এটি জলজ প্রজাতিদের প্রচরণের জন্য সময় প্রদান করে। স্বাদু জলের অনেক আকারদের বিরাট অঞ্চল জুড়ে পূর্বে অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তারের এবং মধ্যবর্তী অঞ্চলের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাটি আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু সমরূপ আকার বজায় রাখুক অথবা কোন মাত্রায় রূপান্তরিত হোক অথবা না হোক, স্বাদু জলের উদ্ভিদদের এবং নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের ব্যাপক বিস্তার প্রাণীদের অথবা আরও বিশেষভাবে স্বাদু জলের পাখিদের দ্বারা, যাদের ওড়ার বিরাট ক্ষমতা আছে এবং স্বাভাবিকভাবে যারা এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে ভ্রমণ করে, তাদের বীজ ও ডিমগুলোর ব্যাপক বিস্তারের ওপর আপাতভাবে অনেকাংশে নির্ভর করে।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপের অধিবাসীবৃন্দ
আমরা এখন তথ্যগুলোর তিনটি শ্রেণীর শেষেরটিতে আসি, যেটিকে বিস্তার সম্পর্কে সবচেয়ে বড় বাধাসৃষ্টিকারী হিসেবে আমি নির্বাচন করেছি, অর্থাৎ-একই প্রজাতির সব এককরা শুধুমাত্র কোন একটি অঞ্চল থেকেই প্রচরিত হয়নি, বরং বর্তমানে অতি দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে বসবাস করলেও সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা তাদের আদিম পুর্বপুরুষদের শুধুমাত্র একটি জন্মস্থান-অঞ্চল থেকেই সর্বত্র অগ্রসর হয়েছে। বর্তমান প্রজাতিদের জীবৎকালের মধ্যে মহাদেশের বিপুল পরিমাণ বিস্তার সম্পর্কে অবিশ্বাসের কারণসমূহ আমি ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছি যে কয়েকটি মহাসমুদ্রের প্রায় সব দ্বীপ এরূপে এদের বর্তমান স্থলজ অধিবাসীদের দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। এই মত অনেক বাধা দূর করে, কিন্তু এটি দ্বীপগুলোর উৎপাদন সম্পর্কে সব বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নিচের আলোচনায় আমি শুধু বিস্তারের প্রশ্নটিতে সীমাবদ্ধ থাকব না, বরং স্বাধীনভাবে সৃষ্টি এবং রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভব—দুটি তত্ত্বেরই সত্যতা সংক্রান্ত আরও কয়েকটি বিষয় নিয়েও আলোচনা করব।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে বসবাসকারী সমস্ত প্রকারের প্রজাতিরা মহাদেশীয় সমতুল অঞ্চলগুলোর প্রজাতিদের তুলনায় সংখ্যায় অল্প হয়। উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে অ্যালফোনসে ডি ক্যান্ডোলে এবং কীটপতঙ্গদের ক্ষেত্রে ওলাস্টন এটি স্বীকার করেন। উদাহরণস্বরূপ, সুউচ্চ পর্বতমালা ও বিচিত্র স্টেশনসমূহ সমেত, অকল্যান্ড, ক্যাম্পবেল এবং চ্যাথাম দ্বীপগুলো সমেত একত্রে ৭৮০ মাইল বিস্তৃত নিউজিল্যান্ডে সবশুদ্ধ শুধুমাত্র ৯৬০ প্রকার সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে; দক্ষিণ-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া অথবা উত্তমাশা অন্তরীপের সম অঞ্চলে বিস্তৃত প্রজাতিদের সঙ্গে এই পরিমিত সংখ্যাটির তুলনা করলে স্বীকার করতেই হবে যে ভিন্ন ভৌতিক পরিবেশ-নিরপেক্ষ কোন কারণই সংখ্যায় এত বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এমনকি একইরূপ কেমব্রিজ প্রদেশে ৮৪৭টি উদ্ভিদ এবং অ্যাংলেসিয়ার মতো ছোট দ্বীপে ৭৬৪টি উদ্ভিদ রয়েছে, কিছু ফার্ন ও কিছু প্রবর্তিত উদ্ভিদ এই সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত, এবং অন্য কিছু ক্ষেত্রে তুলনাটি ঠিক নয়। আমাদের কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে যে অ্যাসেনসিওন-এর ঊষর দ্বীপে আধ ডজন সপুষ্পক উদ্ভিদেরও কম উদ্ভিদ আছে; তথাপি এখানে নিউজিল্যান্ড ও অন্য প্রত্যেক মহাসাগরীয় দ্বীপের মতো যাদের নাম করা যেতে পারে এমন অনেক প্রজাতি অভিযোজিত হয়েছে। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে অভিযোজিত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা অনেক দেশজ জীবদের প্রায় অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছে। যিনি প্রত্যেক পৃথক প্রজাতির সৃষ্টির তত্ত্বে বিশ্বাস করেন তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে সর্বোত্তমভাবে অভিযোজিত যথেষ্ট সংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিদদের মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে সৃষ্টি করা হয়নি, কারণ প্রকৃতির কাজের তুলনায় মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবেই আরও পরিপূর্ণভাবে ও নিখুঁতভাবে এদের পূর্ণ করেছে।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে প্রজাতিদের সংখ্যা অল্প হলেও, স্থানীয় প্রকারের (অর্থাৎ পৃথিবীর আর কোথাও যাদের পাওয়া যায় না) সংখ্যা অত্যধিক হয়। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাডেইরার স্থানীয় স্থলজ খোলকী প্রাণীদের (শেল) সংখ্যা অথবা গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের স্থানীয় পাখিদের সঙ্গে যে-কোন মহাদেশের সংখ্যার যদি আমরা তুলনা করি, এবং দ্বীপটির আয়তনের সঙ্গে ঐ মহাদেশটির আয়তনের তুলনা করি, তাহলে আমরা দেখব যে এটি সঠিক। তত্ত্বগতভাবে এ বিষয়টি নিশ্চয় আশা করা যেতে পারে, কারণ পূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে নূতন ও বিচ্ছিন্ন জেলায় দীর্ঘ সময় অন্তরে আকস্মিকভাবে পৌঁছানোর পর এবং নূতন সঙ্গীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পর প্রজাতিরা রূপান্তরিত হতে বাধ্য হবে এবং রূপান্তরিত বংশধরদের গোষ্ঠীসমূহ উৎপন্ন করবে। কিন্তু এটি কোন মতেই অনুসৃত হয় না, কারণ একটি দ্বীপে একশ্রেণীর প্রায় সব প্রজাতিরা বিশেষ ধরনের হয়, অন্য শ্রেণীর প্রজাতিরা অথবা একই শ্রেণীর অন্য বিভাগের প্রজাতিরা বিশেষ ধরনের হয়; এবং এই পার্থক্যটি অংশতঃ সেই প্রজাতিদের ওপর নির্ভর করে বলে মনে হয়, যারা একত্রে দেশান্তরী হয়ে রূপান্তরিত হয়নি, যাতে করে এদের পারস্পরিক সম্পর্কসমূহ বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, এবং মাতৃভূমি থেকে অরূপান্তরিত দেশান্তরীদের প্রায়শই আগমনের ওপর অংশতঃ নির্ভর করে, যাদের সঙ্গে স্থানীয় আকাররা আন্তঃসঙ্করিত হয়। মনে রাখা উচিত যে এরূপ সঙ্করণের ফলে উদ্ভূত বংশধররা নিশ্চয় বলবান হবে; অতএব এমনকি একটি আকস্মিক সঙ্করণ আশাতিরিক্ত ভাল ফল প্রদান করবে। আগের মন্তব্যগুলো সম্পর্কে আমি অল্প কয়েকটি ব্যাখ্যা দেব: গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে ২৬টি স্থলচর পাখি আছে, এদের মধ্যে ২১টি (অথবা ২৩টি) বিশেষ ধরনের হয়, অন্যথায় ১১টি সামুদ্রিক পাখির মধ্যে কেবল দুটি বিশেষ ধরনের হয়; এবং এটি স্পষ্ট যে স্থলভাগের পাখিদের তুলনায় সামুদ্রিক পাখিরা প্রায়শই এবং আরও সহজেই এইসব দ্বীপে পৌঁছাতে পারত। পক্ষান্তরে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জ যত দূরে, উত্তর আমেরিকা থেকে তত দূরে অবস্থিত বারমুডাতে একটিও স্থানীয় স্থলভাগের পাখি নেই, যেখানকার মাটি বিশেষ ধরনের, এবং বারমুডা সম্পর্কে মিঃ জে. এম. জোন-এর চমৎকার বিবরণী থেকে আমরা জানি যে উত্তর আমেরিকার অসংখ্য পাখিরা আকস্মিকভাবে অথবা প্রায়শই এই দ্বীপে আসে। মিঃ ই. ভি. হারকোর্ট-এর কাছ থেকে আমি শুনেছি যে ইউরোপ ও আফ্রিকার অনেক পাখি প্রায় প্রতি বছর ম্যাডেইরাতে উড়ে যায়; এই দ্বীপে ৯৯ প্রকারের পাখি বসবাস করে যার মধ্যে শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধরনের, যদিও সেটি একটি ইউরোপীয় আকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত; এবং তিন অথবা চারটি অন্য প্রজাতি এই দ্বীপে এবং ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে সীমাবদ্ধ। অতএব বারমুডা ও ম্যাডেইরা সন্নিহিত অঞ্চলসমূহ মহাদেশগুলো থেকে আসা পাখিদের দ্বারা পরিপূর্ণ, যারা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করেছে এবং পরস্পরের সঙ্গে সহ-অভিযোজিত হয়েছে। অতএব নূতন বাসস্থানে স্থায়ী হওয়ার পর প্রত্যেকটি প্রকার অন্যদের দ্বারা তার উপযুক্ত অবস্থান ও স্বভাবসমূহে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে এবং ফলস্বরূপ অল্পভাবে রূপান্তরিত হতে বাধ্য হবে। রূপান্তরের যে-কোন প্রবণতা মাতৃভূমি থেকে প্রায়শই আশা অরূপান্তরিত দেশান্তরীদের সঙ্গে আন্তঃসঙ্করণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার ম্যাডেইরাতে স্থলভাগের অসংখ্য চমৎকার খোলকী প্রাণী বসবাস করে, পক্ষান্তরে সামুদ্রিক খোলকী প্রাণীদের একটি বিশেষ প্রজাতিও এর উপকূলে বসবাস করে না। এখন, যদিও আমরা জানি না কেমন করে সামুদ্রিক খোলকী প্রাণীরা বিস্তৃত হয়েছে, তথাপি আমরা জানতে পারি যে সামুদ্রিক আগাছায় অথবা ভাসন্ত কাঠে কিংবা বিচরণশীল পাখিদের পায়ে আটকে এদের ডিম অথবা শূককীটরা (লার্ভা) স্থলভাগের খোলকী প্রাণীদের তুলনায় আরও সহজভাবে তিন অথবা চার হাজার মাইল বিস্তৃত সমুদ্র অতিক্রম করে পরিবাহিত হয়ে থাকতে পারে। ম্যাডেইরাতে বসবাসকারী কীটপতঙ্গদের বিভিন্ন অর্ডারসমূহ প্রায় একই প্রকার ঘটনা উপস্থিত করে।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলিতে কোন কোন সময় কোন নির্দিষ্ট ধরনের সমগ্র শ্রেণীর প্রাণীরা থাকে না, এবং এদের স্থান অন্যরা গ্রহণ করে। এরূপে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে সরীসৃপ, নিউজিল্যান্ডে বিশাল ডানাহীন পাখিরা স্তন্যপায়ীদের স্থান গ্রহণ করে অথবা সম্প্রতি গ্রহণ করেছে। যদিও এখানে নিউজিল্যান্ডকে মহাসামুদ্রিক দ্বীপ বলা হয়, কিন্তু একে এরূপে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত কিনা তা রীতিমতো সন্দেহজনক। এটি বিরাট আকারের এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে অতিশয় গভীর সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন নয়; এর ভূতাত্ত্বিক এবং পর্বতমালার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে রেভারেন্ড ডব্লিউ. বি. ক্লার্ক সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন যে এই দ্বীপ এবং নিউ ক্যালেডোনিয়া-কে অস্ট্রেলিয়ার অংশ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত। উদ্ভিদদের প্রসঙ্গে ডঃ হুকার দেখিয়েছেন যে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন অর্ডারদের আনুপাতিক সংখ্যা অন্য অঞ্চলের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। সংখ্যার এইসব পার্থক্য এবং প্রাণী ও উদ্ভিদদের কোন কোন সামুদ্রিক গোষ্ঠীর অনুপস্থিতি দ্বীপগুলির ভৌতিক অবস্থাসমূহের অনুমিত পার্থক্যের জন্য হয় বলে সাধারণত বিবেচনা করা হয়; কিন্তু এই ব্যাখ্যাটি রীতিমতো সন্দেহজনক। দেশান্তরের সুযোগ-সুবিধা পরিবেশসমূহের প্রকৃতির মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের সম্পর্কে অনেক উল্লেখযোগ্য ছোটখাটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটিও স্তন্যপায়ী নেই এমন কোন কোন দ্বীপে, কতিপয় স্থানীয় উদ্ভিদের সুন্দর বড়শি-সহ বীজ থাকে; তথাপি চতুষ্পদ প্রাণীদের পশম বা লোমের দ্বারা বঁড়শি-সহ বীজের পরিবহণের তুলনায় অধিকতর উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক খুব বেশী নেই। কিন্তু বঁড়শি সমেত বীজগুলো অন্য অনেক উপায় দ্বারা বাহিত হয়ে থাকবে আর তখনও এদের বঁড়শিগুলো বজায় রেখে এবং তারপর রূপান্তরিত হয়ে উদ্ভিদটি একটি স্থানীয় প্রজাতিতে পরিণত হবে, ঐ বঁড়শিগুলো দ্বীপের অনেক বিটলদের ডানা-আবরণের মধ্যে কুঞ্চিত ডানার মতো একটি অপ্রয়োজনীয় উপাঙ্গ সৃষ্টি করবে। আবার দ্বীপগুলোতে বৃক্ষ অথবা গুল্ম জাতীয় অর্ডারের অনেক প্রজাতি প্রায়শই থাকে, কিন্তু অন্যত্র ঐ অর্ডারগুলোর শুধুমাত্র বীরুৎ জাতীয় প্রজাতি থাকে; যেমন আলফোনসে ডি ক্যান্ডোলে দেখিয়েছেন যে, কারণ যাই হোক না কেন বৃক্ষদের সাধারণত সীমাবদ্ধ বিস্তার থাকে। অতএব মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে পৌঁছানোর ব্যাপারে বৃক্ষদের অল্প সম্ভাবনা থাকবে। একটি মহাদেশে জন্মানো অনেক সম্পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৃক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনাহীন একটি বীরুৎ উদ্ভিদ, যখন একটি দ্বীপে প্রবর্তিত হয়, তখন আরও লম্বা হয়ে এবং উচ্চতায় বেড়ে গিয়ে অন্য বীরুৎ উদ্ভিদদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন যে অর্ডারেরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন, উদ্ভিদটির দৈহিক উচ্চতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করবে এবং এরূপে একে প্রথমে গুল্মে এবং পরে বৃক্ষে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করবে।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে ব্যাট্রাচিয়ান এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অনুপস্থিতি
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে প্রাণীদের সমগ্র অর্ডারদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে বোরি সেন্ট ভিনসেন্ট বহু আগে বলেছিলেন যে বিরাট মহাসমুদ্রগুলির অনেক দ্বীপের একটিতেও ব্যাটাচিয়ানদের (ব্যাঙ, টোড, গোসাপ) কখনও পাওয়া যায় না। আমি যত্নসহকারে বক্তব্যটির সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছিলাম এবং নিউজিল্যান্ড, নিউ ক্যালেডোনিয়া, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং সম্ভবত সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও সিচেলাস ছাড়া এই বক্তব্যটি সঠিক ছিল। কিন্তু আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি যে নিউজিল্যান্ড ও নিউ ক্যালেডোনিয়াকে মহাসামুদ্রিক দ্বীপ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে; আন্দামান ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং সিচেলাস দ্বীপের ক্ষেত্রে এটি আরও সন্দেহজনক। অনেক প্রকৃত মহাসামুদ্রিক দ্বীপে ব্যাঙ, টোড এবং গোসাপদের এই সার্বজনীন অনুপস্থিতি এদের ভৌতিক পরিবেশের জন্যে হয় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না : প্রকৃতপক্ষে মনে হয় যে দ্বীপগুলো এইসব প্রাণীদের জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত, কারণ ম্যাডেইরা, অ্যাজোরস এবং মরিশাসে ব্যাঙগুলোকে আনা হয়েছে, এরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এইসব প্রাণী ও এদের ডিম সমুদ্রের জলে তৎক্ষণাৎ ধ্বংস হয় বলে সমুদ্র অতিক্রম করে এদের পরিবহণ অতিশয় কষ্টসাধ্য হবে এবং অতএব আমরা দেখতে পারি কেন এরা প্রকৃত মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে অবস্থান করে না। কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে কেন এরা সেখানে সৃষ্ট হবে না তা ব্যাখ্যা করা কষ্টসাধ্য।
স্তন্যপায়ীরা অন্য ও একইরূপ ঘটনা উপস্থিত করে। আমি যত্নসহকারে প্রাচীনতম সমুদ্র-ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়েছি, এবং একটি মহাদেশ অথবা বিরাট মহাদেশীয় দ্বীপ থেকে ৩০০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপে বসবাসকারী কোন স্থলচর স্তন্যপায়ীর (দেশীয়দের দ্বারা পালিত গৃহপালিত প্রাণীরা ব্যতীত) সন্দেহমুক্ত একটিও উদাহরণ আমি দেখিনি এবং কম দূরত্বে অবস্থিত অনেক দ্বীপও স্থলচর স্তন্যপায়ী বর্জিত। নেকড়ের মত এক ধরনের শৃগাল ছাড়া ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জেও এদের অস্তিত্ব নেই; কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলিকে মহাসামুদ্রিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে না, কারণ প্রায় ২৮০ মাইল দূরে অবস্থিত মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি উপকূলে এটি অবস্থিত; অধিকন্তু, হিমশৈলগুলো আগে এর পশ্চিম উপকূলে শিলাখণ্ডগুলোকে বহন করে এনেছিল এবং এরা আগে শৃগাল বহন করে থাকবে, যেমন এখন মেরু অঞ্চলে এটি প্রায়শই ঘটে। তথাপি বলা যেতে পারে না যে ছোট দ্বীপগুলোতে অন্তত ছোট স্তন্যপায়ীরা থাকে না, কারণ এরা একটি মহাদেশের সন্নিকটে পৃথিবীর অনেক অংশে অতি ছোট ছোট দ্বীপগুলিতে অবস্থান করে; এবং কদাচিৎ একটি দ্বীপের নাম করা যেতে পারে যেখানে ছোট ছোট চতুষ্পদ প্রাণীরা অভিযোজিত হয়নি এবং সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়নি। সৃষ্টির সাধারণ মতবাদ অনুসারে বলা যেতে পারে না যে স্তন্যপায়ীদের সৃষ্টির জন্য সময় থাকে না; অনেক আগ্নেয়গিরিময় দ্বীপপুঞ্জ যথেষ্ট প্রাচীন, যা এদের বিস্ময়কর অবনমন এবং টার্শিয়ারি স্তরের দ্বারা দেখানো যায় : অন্য শ্রেণীর অন্তর্গত স্থানীয় প্রজাতিদের সৃষ্টির জন্য সময় লেগেছে; এবং জানা গেছে যে মহাদেশগুলিতে স্তন্যপায়ীদের নূতন প্রজাতিরা অন্য এবং নিম্নশ্রেণীর স্তন্যপায়ীদের তুলনায় দ্রুত হারে আবির্ভূত ও তিরোহিত হয়। যদিও স্থলচর স্তন্যপায়ীরা মহাসামুদ্রিক দ্বীপে থাকে না। বায়ুচর স্তন্যপায়ীরা প্রায় প্রত্যেক দ্বীপে অবস্থান করে : নিউজিল্যান্ডে দু-ধরনের বাদুড় দেখতে পাওয়া যায়, যাদের পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না; নরফোক দ্বীপে, ভিটি দ্বীপপুঞ্জে, বোনিন দ্বীপপুঞ্জে, ক্যারোলাইন ও মেরিয়ানে দ্বীপপুঞ্জে এবং মরিশাসের মত সকল দ্বীপেই নিজস্ব বিশেষ ধরনের বাদুড় আছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে—কেন কল্পিত সৃষ্টিকর্তা দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে বাদুড় সৃষ্টি করেছেন, অন্য কোন স্তন্যপায়ী নয়? আমার মতানুসারে এই প্রশ্নটির উত্তর সহজেই দেওয়া যেতে পারে, কারণ কোন স্থলচর স্তন্যপায়ী বিরাট সমুদ্র অতিক্রম করে যেতে পারে না, কিন্তু বাদুড়রা উড়ে যেতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিনের বেলায় বাদুড়দের উড়ে বেড়াতে দেখা যায় এবং উত্তর আমেরিকার দুটি প্রজাতি মূল ভূখণ্ড থেকে ৬০০ মাইল দূরে বারমুডা দ্বীপ ভ্রমণ করে। আমি মিঃ টোমসের, যিনি এই গোত্রটিকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, কাছ থেকে শুনেছি যে অনেক প্রজাতির বিস্তার বিশাল হয় এবং মহাদেশ ও দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে এদের দেখতে পাওয়া যায়। অতএব আমাদের শুধুমাত্র কল্পনা করতে হয় যে এরূপ ভ্রমণশীল প্রজাতিরা তাদের নূতন পরিবেশে নূতন বাসস্থানে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলিতে বাদুড়ের উপস্থিতি এবং অন্য সব স্থলচর স্তন্যপায়ীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি।
অন্য আর একটি চিত্তাকর্ষক বিষয় আছে, যেমন পরস্পরের থেকে অথবা নিকটবর্তী মহাদেশ থেকে দ্বীপগুলোকে বিচ্ছিন্নকারী সমুদ্রের গভীরতা এবং সেখানে বসবাসকারী স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সম্বন্ধের মাত্রাটির মধ্যেকার সম্পর্ক। মিঃ উইন্ডসর আর্ল এই বিষয়ে কিছু বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণ করেছেন, এরপর বিরাট মালয় দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে মিঃ ওয়ালেসের বিস্ময়কর গবেষণায় এটি আরও বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে, সেলেবেসের কাছে সমুদ্র অতিশয় গভীর এবং এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলকে (ফনা) পৃথক করেছে। দ্বীপের উভয়দিকে মাঝামাঝি ধরনের অগভীর সমুদ্রগর্ভস্থ কিনারা রয়েছে এবং একই অথবা গভীর সম্পর্কযুক্ত চতুষ্পদ প্রাণীরা এই দ্বীপগুলোতে বসবাস করে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে এই বিষয়ে অনুসন্ধান করার মতো সময় আমার হয়নি, কিন্তু আমি যতদূর জানি তাতে এই বিষয়টি সত্য। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেন ইউরোপের থেকে অগভীর সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং উভয় অংশে স্তন্যপায়ীরা একই প্রকার; এবং অস্ট্রেলিয়ার উপকূলের নিকট সমস্ত দ্বীপগুলোর ক্ষেত্রেও একই জিনিস হয়। বিপরীতক্রমে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ গভীরভাবে নিমজ্জিত তীরে অবস্থিত, এটি প্রায় ১০০০ ফ্যাদম গভীর, এবং এখানে আমরা আমেরিকার আকারদের দেখি, কিন্তু প্রজাতি, এমনকি গণগুলোও সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়। যেহেতু সকল প্রকার প্রাণীদের রূপান্তরের পরিমাণটি অংশত সময়ের ওপর নির্ভরশীল এবং যেহেতু দ্বীপগুলোর, যারা পরস্পরের থেকে অথবা মূল ভূখণ্ড থেকে অগভীর সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন, গভীর সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর তুলনায় বর্তমান সময়ের মধ্যে অনবরত সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেছে, সেহেতু আমরা বুঝতে পারি কেমন করে দুটি স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলকে বিচ্ছিন্নকারী সমুদ্রের গভীরতা এবং এদের সম্বন্ধে মাত্রাটির মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকে—এটি এমন একটি সম্পর্ক, স্বাধীন সৃষ্টির তত্ত্ব অনুসারে যার কারণ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের সম্পর্কে উপরোক্ত বক্তব্যগুলো, যথা—প্রজাতিদের স্বল্পতা, তার সঙ্গে দেশীয় আকারদের সংখ্যাধিক্য, একই শ্রেণীর অন্য গোষ্ঠীদের তুলনায় কোন কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের রূপান্তরিত হওয়া, বায়ুচর বাদুড়দের উপস্থিতি সত্ত্বেও ব্যাট্রাচিয়ান ও স্থলচর স্তন্যপায়ীদের মতো কোন কোন সামুদ্রিক অর্ডারের অনুপস্থিতি, উদ্ভিদদের কোন কোন অর্ডারেরই কেবল উপস্থিতি, বীরুৎ আকারদের বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়া ইত্যাদি, নিকটতম মহাদেশের সঙ্গে সমস্ত মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোর পূর্বের সংযোগের বিষয়ে বিশ্বাসের তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে পরিবহণের আকস্মিক উপায়গুলোর দক্ষতায় বিশ্বাসের সঙ্গেই বেশী সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় আমার; কারণ পূর্বের মতবাদটি অনুসারে এটি সম্ভবপর যে বিভিন্ন শ্রেণী একইরূপে দেশান্তরী হয়ে থাকবে এবং একত্রে অনুপ্রবেশকারী প্রজাতিদের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হবে না, ফলস্বরূপ এরা হয় রূপান্তরিত হবে না অথবা সকলে একইরকমভাবে রূপান্তরিত হবে।
আমি অস্বীকার করি না যে এটি বোঝার পক্ষে অনেক এবং গুরুতর বাধা রয়েছে যে আরও দূরবর্তী দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের কতকগুলো তাদের বিশেষ আকার বজায় রেখে অথবা পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয়ে নিজেদের বর্তমান বাসস্থানে পৌঁছেছে। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া একদা বিশ্রামস্থল হিসেবে ব্যবহৃত অন্য দ্বীপগুলোর অবস্থানের সম্ভাবনাটি উপেক্ষা করা উচিত নয়। একটি গুরুতর বিষয় সম্পর্কে কিছু বলতে চাই আমি। প্রায় সমস্ত মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে, এমনকি সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্রতমগুলোতেও স্থলচর খোলকী প্রাণীরা (শেল), বিশেষভাবে স্থানীয় প্রজাতিরা বাস করে, কিন্তু কোন কোন সময় অন্যত্র পাওয়া প্রজাতিরাও বাস করে, যাদের সম্পর্কে প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষেত্রে ডঃ এ. এ. গোল্ড চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। এখন এটি সর্বজনবিদিত যে সমুদ্রজলে স্থলচর খোলকী প্রাণীরা নিহত হয়; কিছু ক্ষেত্রে এদের ডিমগুলো ডুবে যায় ও ধ্বংস হয়, যেমন আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। তথাপি এদের পরিবহণের জন্য নিশ্চয় কোন অজ্ঞাত অথচ আকস্মিক দক্ষ উপায় রয়েছে। স্থলভাগে বিশ্রামরত পাখিদের পায়ে সদ্যোজাত বাচ্চারা কি আটকে থাকে এবং এরূপে পরিবাহিত হয়? আমি লক্ষ্য করেছি যে স্থলচর খোলকী প্রাণীরা যখন শীতঘুমে যায় এবং যাদের খোলার মুখে পাতলা ঝিল্লি আবৃত থাকে, তারা ভাসন্ত কাঠের ফাটলে আটকে সমুদ্রের বিরাট অঞ্চলে ভেসে যায়, এবং আমি দেখেছি যে কতিপয় প্রজাতি সমুদ্রজলে সাতদিন নিমজ্জিত থাকার পর অক্ষত অবস্থায় থাকে : এভাবে রেখে এবং আবার সমুদ্রজলে কুড়িদিন রাখার পর হেলিক্স পোমেটিয়া নামক একটি খোলকী প্রাণী সম্পূর্ণরূপে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে খোলকী প্রাণীটি গড় গতিসম্পন্ন সমুদ্রপ্রবাহ দ্বারা ৬৬০ ভৌগোলিক মাইল দূর পর্যন্ত বাহিত হয়ে থাকবে। এই হেলিক্স নামক প্রাণীটির পুরু চুনযুক্ত মুখাবরণ থাকে, আমি এটি অপসারিত করেছিলাম এবং তখন এটি নূতন একটি ঝিল্লি সৃষ্টি করেছিল। আমি এটিকে সমুদ্রজলে চোদ্দদিন নিমজ্জিত রেখেছিলাম এবং এটি পুনরায় বেঁচে উঠেছিল ও হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়েছিল। ব্যারন আউক্যাপিটাইন এর পর অনেক ছোট ছোট পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি ছিদ্রসমেত একটি বাসে ১০টি প্রজাতির ১০০টি স্থলচর খোলকী প্রাণী রেখে সমুদ্রজলে এদের এক পক্ষকাল নিমজ্জিত রেখেছিলেন এবং একশত খোলকী প্রাণীর মধ্যে সাতাশটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। একটি ঝিল্লির উপস্থিতি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সাইক্লোস্টমা এলিগ্যান্স নামক প্রাণীদের বারোটি নমুনার মধ্যে, যাদের এইরূপ ঝিল্লি রয়েছে, এগারোটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। কেমন করে হেলিক্স পোমেটিয়া নামক প্রাণীটি সমুদ্রের জলে বেঁচে ছিল তা লক্ষ্য করলে এটি উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে যে আউক্যাপিটাইন দ্বারা পরীক্ষিত হেলিক্সের অন্য চারটি প্রজাতির অন্তর্গত চুয়ান্নটি নমুনার মধ্যে একটিও পুনরুজ্জীবিত হয়নি। তবে এটি মোটেই সম্ভবপর নয় যে স্থলভাগের শম্বুকরা প্রায়শই এইভাবে পরিবাহিত হয়েছে। এক্ষেত্রে পাখিদের পা হচ্ছে অধিকতর সম্ভাব্য উপায়।
দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের সঙ্গে নিকটতম মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের সম্পর্ক
আমাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে প্রকৃতই একইরূপ না হয়ে নিকটতম মূল ভূখণ্ডের প্রজাতিদের সঙ্গে দ্বীপগুলোর প্রজাতিদের মধ্যেকার সম্পর্ক। এ ব্যাপারে অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিষুবরেখার নিকটে অবস্থিত গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জটি দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল হতে ৫০০ থেকে ৬০০ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। এখানকার জল ও স্থলের সমস্ত উৎপাদনে আমেরিকা মহাদেশের উৎপাদনের সন্দেহাতীত চিহ্ন থাকে। এখানে ছাব্বিশটি স্থলচর পাখি রয়েছে। এগুলির মধ্যে একুশটি অথবা সম্ভবত তেইশটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এবং এরা এখানে সৃষ্ট হয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, তথাপি আমেরিকান প্রজাতিদের সঙ্গে প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যে এইসব অধিকাংশ পাখিদের গভীর সম্পর্ক আছে, যেমন এদের স্বভাবে, অঙ্গভঙ্গিতে ও কণ্ঠস্বরে। অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এরূপ হয় এবং উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেও বহুলাংশে এটি প্রযোজ্য, যেমনটা ডঃ হুকার এই দ্বীপপুঞ্জ সংক্রান্ত তাঁর ‘ফ্লোরা’য় সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন। মহাদেশটি থেকে কয়েকশত মাইল দূরে অবস্থিত এইসব আগ্নেয়গিরিময় দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের লক্ষ্য করে প্রকৃতিবিদরা অনুভব করেন যে তাঁরা যেন আমেরিকা মহাদেশে দাঁড়িয়ে আছেন। কেন এরূপ হয়? গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে সৃষ্ট হয়েছে অথচ অন্যত্র হয়নি এমন কল্পিত প্রজাতিরা আমেরিকাতে সৃষ্ট হয়েছে বলে অনুমিত প্রজাতিদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত হবে কেন? জীবন-পরিবেশে, দ্বীপগুলোর ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতিতে, এদের উচ্চতায়, জলবায়ুতে অথবা সংখ্যায় যাতে কয়েকটি শ্রেণী একত্রে যুক্ত হয়েছে, কোন কিছুই সাধারণ নয়, যেগুলি আবার দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত; প্রকৃতপক্ষে, এইসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্য আছে। পক্ষান্তরে, গ্যালাপ্যাগোস এবং কেপ ভার্ডে দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে মাটির আগ্নেয়গিরিময় প্রকৃতিতে, জলবায়ুতে, উচ্চতায় এবং দ্বীপগুলির আয়তনে কিছুটা সাদৃশ্য আছে, কিন্তু এদের অধিবাসীদের মধ্যে বিপুল পার্থক্য আছে। আমেরিকার সঙ্গে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মতো কেপ ভার্ডে দ্বীপসমূহের অধিবাসীরা আফ্রিকার অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। এইসব তথ্য স্বাধীন সৃষ্টির সাধারণ মতবাদ অনুসারে কোন ধরনের ব্যাখ্যা স্বীকার করে না; অন্যথায়, এখানে অনুসৃত মতবাদ অনুসারে, এটি স্পষ্ট যে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপগুলো হয় পরিবহণের আকস্মিক উপায়সমূহ দ্বারা অথবা (এই মতটি আমি বিশ্বাস করি না) পূর্বে অবিচ্ছিন্ন স্থলভাগের দ্বারা আমেরিকা থেকে উপনিবেশকারীদের সম্ভবত প্রাপ্ত হয়েছে এবং সেরূপে কেপ ভার্ডে দ্বীপগুলো আফ্রিকা থেকে পেয়েছে; এরূপ উপনিবেশকারীরা রূপান্তরিত হতে বাধ্য হবে—বংশানুসৃতির নিয়মটি তখনও এদের আদিম জন্মস্থানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে চলবে।
অনুরূপ অসংখ্য বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সার্বজনীন নিয়ম যে দ্বীপগুলোর স্থানীয় জীবরা নিকটতম মহাদেশের অথবা নিকটতম বিরাট দ্বীপের জীবদের সঙ্গে সম্পর্কিত। শুধু কয়েকটি ব্যতিক্রম, এবং এদের অধিকাংশই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এভাবে যদিও কারগুয়েলেন ভূখণ্ডটি আমেরিকার তুলনায় আফ্রিকার নিকটে অবস্থিত, যা আমরা ডঃ হুকারের বিবরণী থেকে জেনেছি, আমেরিকার উদ্ভিদের সঙ্গে এখানকার উদ্ভিদরা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয় : কিন্তু এই মতবাদ অনুসারে এই দ্বীপটি বর্তমানের সমুদ্রস্রোতের দ্বারা তাড়িত হিমশৈলগুলোর দ্বারা আনীত বীজদের দ্বারা প্রধানত পূর্ণ হয়েছে—এই বৈসাদৃশ্য দূরীভূত হয়। নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় সমতলভূমিগুলো অন্য যে—কোন অঞ্চলের তুলনায় নিকটতম ভূখণ্ড অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং এটিই প্রত্যাশিত; কিন্তু এটি দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্কিত, যা নিকটতম মহাদেশ হলেও এত বিশাল দূরে অবস্থিত যে ঘটনাটি একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু বাধাটি এই মতানুসারে অংশত দূরীভূত হয় যে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অন্য দক্ষিণী স্থলভাগগুলো একটি প্রায় মধ্যবর্তী অথচ দূরবর্তী, সর্বশেষ তুষারযুগ শুরু হওয়ার পূর্বে উষ্ণতর টার্শিয়ারি যুগের সময় বনানী দ্বারা আচ্ছাদিত কুমেরু দ্বীপগুলো থেকে অংশত পরিপূর্ণ হয়েছে। সম্বন্ধটি, যদিও খুবই দুর্বল, হুকারের আশ্বাস মতো প্রকৃত হয়। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের এবং উত্তমাশা অন্তরীপের উদ্ভিদকুলের মধ্যে সম্বন্ধটি আরও বেশী উল্লেখযোগ্য; কিন্তু এই সম্বন্ধটি উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে কোনদিন এর ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহেই পাওয়া যাবে।
একই নিয়ম যা দ্বীপগুলোর এবং নিকটতম মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে, তা একই দ্বীপপুঞ্জের সীমার মধ্যে অল্প মাত্রায় অথচ চিত্তাকর্ষক উপায়ে কোন কোন সময় প্রদর্শিত হয়েছে। এরূপে গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রত্যেক ভিন্ন দ্বীপে অনেক ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে, এবং এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার; কিন্তু এই প্রজাতিরা আমেরিকা মহাদেশের, অথবা পৃথিবীর অন্য যে-কোন অংশের অধিবাসীদের তুলনায় পরস্পরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এটাই প্রত্যাশিত, কারণ পরস্পরের অতি সন্নিকটে অবস্থিত দ্বীপগুলো একই আদিম উৎস থেকে এবং পরস্পরের থেকে দেশান্তরীদের প্রাপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু কেমন করে এটি হয় যে দেশান্তরীদের অনেকেই একই ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতি, একই উচ্চতা, জলবায়ু ইত্যাদি সম্বলিত পরস্পরের অতি সন্নিকটে অবস্থিত দ্বীপগুলোতে, যদিও অল্প মাত্রায়, ভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়েছে? আমার কাছে এটি দীর্ঘকাল ধরে প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে হয়েছে। কিন্তু একটি দেশের ভৌত অবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করার গুরুতর ভুল থেকেই এটি মূলত উদ্ভূত হয়েছে; অন্যথায় এটি তর্কাতীত যে অন্য প্রজাতিদের প্রকৃতি, যাদের সঙ্গে প্রত্যেককে প্রতিযোগিতা করতে হয়, সাফল্যের ব্যাপারে সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখন আমরা যদি গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রজাতিদের লক্ষ্য করি এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও যাদের পাওয়া যায়, তাহলে আমরা দেখি যে এরা কয়েকটি দ্বীপে বিশেষভাবে ভিন্ন হয়। এই পার্থক্যটি বাস্তবিকপক্ষে আশা করা যেতে পারত যদি দ্বীপগুলো পরিবহণের আকস্মিক উপায়সমূহ দ্বারা পূর্ণ হত—যেমন, যদি একটি উদ্ভিদের একটি বীজকে একটি দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে আনা হত এবং অন্য উদ্ভিদের বীজ অন্য দ্বীপে আনা হত, যদিও সকলে একই সাধারণ উৎস থেকে যাত্রা করেছে। অতএব, পূর্ববর্তী সময়ে যখন এটি দেশান্তরী দ্বীপগুলোর একটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিল, অথবা যখন একটি থেকে অন্যটিতে পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়েছিল, তখন সন্দেহাতীতভাবে এটি বিভিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন পরিবেশের প্রভাবে পড়েছিল, কারণ জীবদের একটি ভিন্ন দলের সঙ্গে একে প্রতিযোগিতা করতে হবে; উদাহরণস্বরূপ, একটি উদ্ভিদ বিভিন্ন দ্বীপের কিছু পরিমাণ ভিন্ন প্রজাতিদের দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলটিতে অভিযোজিত হবে, এবং কিছু ভিন্ন প্রকৃতির শত্রুদের আক্রমণের সম্মুখীন হবে। তখন যদি এটি পরিবর্তিত হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন ভিন্ন দ্বীপগুলোর ভিন্ন ভ্যারাইটিদের সম্ভবত আনুকূল্য প্রদর্শন করবে। তবে কোন কোন প্রজাতি বিস্তৃত হতে পারে এবং সমগ্র গোষ্ঠীতে একই বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে, যেমন আমরা দেখি যে একটি মহাদেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত কোন কোন প্রজাতি একই রয়েছে।
গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের এই ক্ষেত্রে এবং কমমাত্রায় কোন কোন অনুরূপ ক্ষেত্রে প্রকৃত বিস্ময়কর ব্যাপারটি হচ্ছে যে, যে-কোন একটি দ্বীপে সৃষ্টির পর প্রত্যেক নূতন প্রজাতি অন্য দ্বীপগুলোতে দ্রুত বিস্তারলাভ করেনি। কিন্তু পরস্পরের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অবস্থিত দ্বীপগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ চ্যানেলের থেকেও চওড়া সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলেও মনে করার কোন কারণ নেই যে পূর্ববর্তী কোন যুগে এরা অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত ছিল। দ্বীপগুলোর মধ্যে সমুদ্রস্রোত অতিশয় দ্রুত ও ক্ষিপ্রতর হয় এবং বাত্যাপ্রবাহ অতিশয় বিরল হয়; সুতরাং মানচিত্রে যা দেখা যায় তার তুলনায় দ্বীপগুলো প্রকৃতই পরস্পরের থেকে আরও বেশী বিচ্ছিন্ন। তা সত্ত্বেও, প্রজাতিদের কয়েকটি, পৃথিবীর অন্য অংশে প্রাপ্ত এবং দ্বীপপুঞ্জে সীমাবদ্ধ উভয়রাই, কতিপয় দ্বীপে সাধারণ হয়; এবং বিস্তারের বর্তমান প্রণালী থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে এরা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপগুলোতে বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, যখন স্বাধীনভাবে মিশতে দেওয়া হয়, তখন নিকট সম্পর্কযুক্ত প্রজাতিদের পরস্পরের অঞ্চল অধিকারের সম্ভাবনার একটি ভুল ধারণা পোষণ করি আমরা। সন্দেহ নেই যে যদি একটি প্রজাতির অন্যটির ওপর কোন প্রাধান্য থাকে, তাহলে এটি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে সামগ্রিকভাবে অথবা অংশত একে স্থানচ্যুত করবে; কিন্তু যদি উভয়েই তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে সমভাবে উপযুক্ত হয়, তাহলে উভয়েই সম্ভবত যে-কোন সময় ধরে তাদের ভিন্ন অঞ্চলসমূহ অধিকার করে থাকবে। মানুষ দ্বারা অভিযোজিত অনেক প্রজাতি অতি দ্রুত হারে ব্যাপক অঞ্চলগুলোতে বিস্তৃত হয়েছে এটি মনে রাখলে, আমরা সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হই যে অধিকাংশ প্রজাতিরা এরূপে বিস্তৃত হবে, কিন্তু আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে নূতন দেশগুলোতে অভিযোজিত প্রজাতিরা আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে সাধারণত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত নয়, কিন্তু এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিন্ন গণগুলোর অন্তর্গত অতিশয় ভিন্ন আকারের হয়, যেমন অ্যালফোনসে ডি ক্যান্ডোলে দেখিয়েছেন। গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জে, যদিও দ্বীপ থেকে দ্বীপে এত সুন্দরভাবে উড়তে অভ্যস্ত পাখিদের অনেকেই বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে ভিন্ন হয়, এরূপে অন্য পাখির ডাক ও গান নকলকারী থ্রাস পাখিদের তিনটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত প্রজাতি আছে, এরা প্রত্যেকে নিজের দ্বীপে সীমাবদ্ধ। এখন যদি আমরা মনে করি যে চ্যাথাম দ্বীপের নকলকারী থ্রাস পাখি চার্লস দ্বীপে উড়ে গেল, যে-দ্বীপটির নিজস্ব নকলকারী থ্রাস পাখি আছে, সেক্ষেত্রে কেন এটি অভিযোজিত হতে সমর্থ হবে? আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি চার্লস দ্বীপ তার নিজস্ব প্রজাতিদের দ্বারা পরিপূর্ণ, কারণ যতগুলি বাচ্চাকে লালনপালন করা সম্ভব তার তুলনায় বছরে ডিম পাড়া এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার সংখ্যা বেশী হয়; এবং আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে চার্লস দ্বীপের বিশেষ নকলকারী থ্রাস পাখি যেভাবে অন্ততঃ নিজের বাসস্থানে ভালভাবে অভিযোজিত হয়েছে, সেভাবে চ্যাথাম দ্বীপের নিজস্ব থ্রাস পাখিরাও অভিযোজিত হয়েছে। স্যার সি. লিয়েল এবং ওলাস্টন এ বিষয়ে আমাকে একটি সংবাদ দিয়েছেন—ম্যাডেইরাতে ও পার্শ্ববর্তী পোর্টো স্যান্টো দ্বীপের একটি ছোট দ্বীপে স্থলচর শম্বুকের অনেক ভিন্ন ও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতি আছে, যাদের কয়েকটি পাথরের খাঁজে বসবাস করে; এবং যদিও প্রতিবছর পোর্টো স্যান্টো থেকে ম্যাডেইরাতে বিপুল পরিমাণ পাথর পরিবাহিত হয়, তথাপি পরের দ্বীপটি আগের দ্বীপটির প্রজাতিদের দ্বারা পূর্ণ হয়নি; তা সত্ত্বেও উভয় দ্বীপে ইউরোপের স্থলচর শম্বুকরা উপনিবেশ করেছে, নিঃসন্দেহেই যারা স্থানীয় প্রজাতিদের ওপর কিছুটা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এইসব বিচার-বিশ্লেষণ থেকে আমি মনে করি স্থানীয় প্রজাতিদের সম্পর্কে আমাদের আশ্চর্যান্বিত হওয়ার দরকার নেই, যারা গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দ্বীপে বসবাস করে এবং যারা সকলে দ্বীপ থেকে দ্বীপে বিস্তৃত হয় না। একই মহাদেশেও, পূর্বাধিকার বা পূর্বদখল প্রায় একই ভৌতিক পরিবেশ সম্বলিত বিভিন্ন জেলাতে বসবাসকারী প্রজাতিদের মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভবত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এভাবে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলগুলোর ভৌতিক অবস্থা প্রায়ই একই রকম এবং এরা অবিচ্ছিন্ন স্থলভাগ দ্বারা যুক্ত, তথাপি অসংখ্য ভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং উদ্ভিদরা এখানে বসবাস করে; মিঃ ব্যা—এর মতানুসারে, প্রজাপতি এবং অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও এরূপ হয়, যারা আমাজনের বিশাল, মুক্ত ও অবিচ্ছিন্ন উপত্যকায় বসবাস করে।
একই পদ্ধতিচারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে, উপনিবেশকারীরা সহজেই উদ্ভূত হওয়া উৎসের সঙ্গে সম্পর্ক এবং পরবর্তী রূপান্তরের সঙ্গে মহাসামুদ্রিক দ্বীপসমূহের অধিবাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী একই পদ্ধতি সমগ্র প্রকৃতিতে ব্যাপকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা এটি প্রত্যেক পর্বতশিখরে, প্রত্যেক হ্রদে ও জলাভূমিতে দেখি, কারণ তুষারযুগের সময় ব্যাপকভাবে বিস্তৃত যতদূর সম্ভব একই প্রজাতিগুলো ছাড়া, আলপাইন প্রজাতিরা আশেপাশের নিচুজমির প্রজাতিদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়; এরূপে আমরা দক্ষিণ আমেরিকায় আলপাইন হামিং বার্ড, আলপাইন রোডেন্ট, আলপাইন উদ্ভিদ ইত্যাদি দেখি, যারা সকলেই যথাযথভাবে আমেরিকার আকারদের অন্তর্গত এবং এটি স্পষ্ট যে মন্থরভাবে উত্থিত হওয়া একটি পর্বত চারপাশের নিচুজমির অধিবাসীদের অধিকার করবে। হ্রদ ও জলাভূমিসমূহের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে, শুধুমাত্র পরিবহণের সুবিধার জন্য সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিস্তৃত হওয়া একই আকাররা ছাড়া। আমেরিকা ও ইউরোপের গুহাগুলোতে বসবাসকারী অন্ধ প্রাণীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এই একই পদ্ধতি আমরা দেখি। এ-রকম অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে এটি সর্বজনীন সত্য হিসেবে আবিষ্কৃত হবে যে দুটি অঞ্চলের কোথাও, যতই দূরবর্তী হোক না কেন, অনেক ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতি অবস্থান করে, এরূপে সেখানে কিছু সমরূপ প্রজাতি আবিষ্কৃত হবে; এবং কোথাও যদি অসংখ্য নিকট সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা অবস্থান করে, সেখানে অনেক আকার আবিষ্কৃত হবে, যাদের প্রকৃতিবিদরা ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে এবং অন্যদের ভ্যারাইটি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেন। এইসব সন্দেহজনক আকাররা রূপান্তরের ধাপ হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে
হয় বর্তমানে অথবা কোন পূর্ব যুগে কোন কোন প্রজাতির প্রচরণের ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি এবং দূরবর্তী অঞ্চলে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত প্রজাতিদের অবস্থানের মধ্যে সম্পর্কটি অন্য একটি সাধারণ উপায়ে দেখানো হয়েছে। অনেক আগে মিঃ গোল্ড আমাকে বলেছিলেন যে পাখিদের সেইসব গণগুলোর, যাদের পৃথিবীব্যাপী বিস্তার রয়েছে, প্রজাতিদের অনেকেরই ব্যাপক বিস্তার রয়েছে। আমি কদাচিৎ সন্দেহ করতে পারি যে এই নিয়মটি সাধারণভাবে সত্য, যদিও প্রমাণ করা অসাধ্য। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে, বাদুড়দের ক্ষেত্রে এটি বিস্ময়করভাবে প্রদর্শিত হয়, এবং ফেলিডা (বিড়াল গোত্র) ও ক্যানিডাদের (কুকুর গোত্র) ক্ষেত্রে কম মাত্রায় প্রদর্শিত হয়। প্রজাপতি ও বিটলদের বিস্তারের ক্ষেত্রেও আমরা একই নিয়ম দেখি। স্বাদুজলের অধিকাংশ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে এরূপ হয়, কারণ সবচেয়ে ভিন্ন শ্রেণীদের গণগুলোর অনেকেরই সারা পৃথিবীতে বিস্তার রয়েছে এবং প্রজাতিদের অনেকেরই বিশাল বিস্তার আছে। এর অর্থ এই নয় যে ঐ গণগুলোর প্রজাতিদের কয়েকটি বাদে সকলের ব্যাপক বিস্তার রয়েছে, ঐ গণগুলোর বিস্তার আবার ব্যাপক হয়। অথবা এর অর্থ এই নয় যে এইসব গণগুলোর প্রজাতিদের গড়ে ব্যাপক ব্যাপ্তি রয়েছে; কারণ এটি রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় কত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে তার ওপর মূলত নির্ভর করে; উদাহরণস্বরূপ, একই প্রজাতির দুটি ভ্যারাইটি আমেরিকা এবং ইউরোপে বসবাস করে এবং প্রজাতিদের এভাবে ব্যাপক ব্যাপ্তি রয়েছে; কিন্তু পরিবর্তন যদি আর একটু বেশী হয়, তাহলে দুটি ভ্যারাইটি ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হবে এবং এদের বিস্তার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। তখনও কি এর অর্থ এই হয় যে প্রজাতিরা, যাদের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করার এবং ব্যাপকভাবে বিস্তারের ক্ষমতা আছে, যেমন শক্তিশালী ডানা সমেত পাখিদের ক্ষেত্রে হয়, আবশ্যিকরূপে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে; কারণ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ব্যাপকভাবে বিস্তারের অর্থ শুধুমাত্র প্রতিবন্ধক অতিক্রম করার ক্ষমতা নয়, বরং দূরবর্তী অঞ্চলে বিদেশী সঙ্গীদের সঙ্গে জীবনসংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার ক্ষমতা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি গণের সমস্ত প্রজাতিরা, যদিও পৃথিবীর অতি দূরবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত হয়, একমাত্র একটি পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয় এই মতবাদানুসারে আমাদের আবিষ্কার করা উচিত যে প্রজাতিদের অন্তত কয়েকটি অতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়, এবং আমি বিশ্বাস করি একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে এটি আমরা আবিষ্কার করব।
মনে রাখা দরকার যে সমস্ত শ্রেণীর অনেক গণের উৎপত্তি প্রাচীন যুগে হয়েছে, এবং এক্ষেত্রে বিস্তার ও পরবর্তী রূপান্তরের জন্য নিশ্চয়ই প্রজাতিদের যথেষ্ট সময় ছিল। ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে বিশ্বাস করার কারণ আছে যে প্রত্যেক বিরাট শ্রেণীতে নিম্নতর জীবরা উচ্চতর জীবদের তুলনায় মন্থরভাবে পরিবর্তিত হয়, ফলস্বরূপ তখনও একই বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে প্রজাতিদের ব্যাপক বিস্তারের সম্ভাবনা থেকে থাকবে। অতিশয় নিম্নশ্রেণীর জীবদের বীজ ও ডিমগুলো অতিশয় ক্ষুদ্র হয় এবং অতি দূরে বিস্তারের পক্ষে উপযুক্ত হয়। এগুলো সম্ভবত সেই বিষয়টির একটি ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে যা দীর্ঘদিন ধরে পরিলক্ষিত হয়েছে এবং যা উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে সম্প্রতি অ্যালফোনসে ডি ক্যান্ডোলে আলোচনা করেছেন, অর্থাৎ—জীবদের যে-কোন গোষ্ঠী যত বেশী নিম্নতর হয় তত বেশী বিস্তৃত হয়।
এই মুহূর্তে আলোচিত সম্পর্কগুলো, যথা—উচ্চতর জীবদের তুলনায় নিম্নতর জীবদের আরও ব্যাপকভাবে বিস্তার, ব্যাপকভাবে বিস্তৃত গণগুলোর প্রজাতিদের কয়েকটির ব্যাপক বিস্তার, এরূপ বিষয়গুলো, যেমন আলপাইন, হ্রদবাসী এবং জলাভূমির জীবদের চারপাশের নিচুজমি ও শুষ্ক অঞ্চলের জীবদের সঙ্গে সাধারণভাবে সম্পর্কিত হওয়া, দ্বীপগুলোর অধিবাসী এবং নিকটতম মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে বিস্ময়কর সম্পর্ক, একই দ্বীপপুঞ্জে দ্বীপগুলোর অধিবাসীদের আরও ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কসমূহ এগুলোকে প্রত্যেক প্রজাতির স্বাধীন সৃষ্টির সাধারণ মতবাদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু ব্যাখ্যা করা যায় যদি আমরা নিকটতম ও সহজতম উৎস থেকে উপনিবেশকরণ এবং তার সঙ্গে নূতন বাসস্থানে উপনিবেশকারীদের পরবর্তী অভিযোজন স্বীকার করি।
পূর্ববর্তী ও বর্তমান অধ্যায়ের সারাংশ
এই দুটি অধ্যায়ে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি যে যদি আমরা জলবায়ুর পরিবর্তনের পূর্ণ প্রভাব, স্থলভাগের উচ্চতার প্রভাব যা বর্তমান যুগে নিশ্চয় ঘটেছে, এবং অন্য পরিবর্তন—সমূহ সম্পর্কে যা সম্ভবত ঘটেছে সে সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা স্বীকার করি, যদি আমরা স্মরণ করি অনিয়মিত পরিবহণের অদ্ভুত উপায়গুলো সম্পর্কে আমরা কত অজ্ঞ, যদি আমরা মনে রাখি এবং এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, কেমন করে একটি প্রজাতি ব্যাপক অঞ্চলে অবিচ্ছিন্নভাবে বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে এবং মধ্যবর্তী অঞ্চলে তারপর বিলুপ্ত হয়ে থাকতে পারে—তাহলে এটি বিশ্বাস করতে বাধাটি অনতিক্রমনীয় নয় যে একই প্রজাতির সব এককরা, যেখানেই তাদের পাওয়া যাক না কেন, সাধারণ পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এবং আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছি, যা আরও বিশেষভাবে সমস্ত ধরনের প্রতিবন্ধকগুলোর গুরুত্ব থেকে এবং উপ-গণ, গণ ও গোত্রদের সমরূপ বিস্তার থেকে সৃষ্টির একমাত্র কেন্দ্রসমূহের চিহ্নিতকরণে প্রকৃতিবিদদের দ্বারা বিভিন্ন বিচার-বিশ্লেষণ দ্বারা পৌঁছানো গেছে।
একই গণের অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিরা আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী একই পিতামাতা উৎস থেকে বিস্তৃত হয়েছে। আগের মতো যদি আমরা আমাদের অজ্ঞতা স্বীকার করি এবং যদি স্মরণ করি যে জীবনের কিছু আকার অতি মন্থরভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এদের প্রচরণের জন্য অধিক সময়কাল প্রদান করা হয়েছে, তাহলে প্রতিবন্ধকসমূহ মোটেই অনতিক্রম্য নয়, যদিও এক্ষেত্রে, একই প্রজাতি এককদের এই বিষয়ের মতো, এরা প্রায়শই বিরাট হয়।
বিস্তারের ওপর জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ ব্যাখ্যা করার সময় আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি যে সর্বশেষ তুষারযুগ কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা এমনকি বিষুব অঞ্চলগুলিকেও প্রভাবিত করেছে, এবং যা, উত্তর ও দক্ষিণে শৈত্যের পর্যায়ানুবৃত্তির সময়, বিপরীত গোলার্ধের উৎপাদনগুলোকে মিশ্রিত হতে দিয়েছে এবং পৃথিবীর সমস্ত অংশে পর্বতচূড়াগুলোতে এদের কয়েকটি একাকী পরিত্যক্ত হয়েছে। অনিয়মিত পরিবহণের উপায়গুলো কত বিচিত্র তা দেখানোর সময়, আমি স্বাদুজলের উৎপাদনগুলোর বিস্তারের উপায় সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছি।
দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পর একই প্রজাতির সব এককরা এবং এভাবে একই গণের অন্তর্গত কিছু প্রজাতি কোন একটি উৎস থেকে অগ্রসর হয়েছে, এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকটি অনতিক্রম্য নয় ধরে নিলে ভৌগোলিক বিস্তারের সমস্ত চমৎকার বিষয়গুলোকে, পরবর্তী রূপান্তর ও নূতন আকারদের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে প্রচরণের তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যায়। জল অথবা স্থলভাগ যা-ই হোক, আমরা প্রতিবন্ধকগুলোর অতি প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারি, যারা শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন করে না, বরং আপাতভাবে কতিপয় উদ্ভিদ ও প্রাণী-রাজ্য সৃষ্টি করে। একই অঞ্চলগুলোর মধ্যে, সম্পর্কিত প্রজাতিদের কেন্দ্রীভবন আমরা এভাবে বুঝতে পারি, বুঝতে পারি কেমন করে ভিন্ন অক্ষাংশগুলোতে, উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আমেরিকায়, সমতলভূমি ও পর্বতগুলোর অরণ্যের, জলাভূমির এবং মরুভূমির অধিবাসীরা রহস্যজনকভাবে একত্রে যুক্ত হয়েছে এবং এরূপে বিলুপ্ত জীবদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যারা পূর্বে একই মহাদেশে বসবাস করত। জীবের সঙ্গে জীবের পারস্পরিক সম্পর্কটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এটি মনে রাখলে, আমরা বুঝতে পারি কেন প্রায় একই ভৌতিক অবস্থা সম্বলিত দুটি অঞ্চলে অতিশয় ভিন্ন প্রকৃতির জীবরা বাস করে, কারণ ইতিমধ্যে অতিবাহিত সময় অনুসারে তখন থেকে উপনিবেশকারীরা একই অথবা উভয় অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল, যাতায়াতের প্রকৃতি অনুসারে যা কম অথবা বেশী সংখ্যায় কোন কোন আকারকে প্রবেশ করতে দিয়েছিল এবং অন্যদের দেয়নি, যারা প্রবেশ করেছিল তারা পরস্পরের সঙ্গে এবং আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিযোগিতা করেছিল অথবা করেনি, এই অনুসারে এবং দেশান্তরীদের কমবেশী দ্রুত হারে পরিবর্তনের ক্ষমতা অনুসারে, দুই অথবা ততোধিক অঞ্চলে এদের ভৌতিক অবস্থা ব্যতিরেকে জীবনের অসংখ্য বিচিত্র অবস্থা সৃষ্টি হবে, অধিক পরিমাণে জৈবিক ক্রিয়া ও বিক্রিয়া সৃষ্টি হবে—এবং আমরা দেখব যে জীবের কিছু গোষ্ঠী বিরাটভাবে এবং কিছু গোষ্ঠী অল্পভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল, কিছু প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিছু অল্প সংখ্যায় অবস্থান করেছিল—এবং পৃথিবীর কয়েকটি বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলে আমরা এটি লক্ষ্য করি।
যেমন আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, এইসব একই পদ্ধতি অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারি কেন মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে অল্পসংখ্যক অধিবাসী থাকে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে বিরাট সংখ্যক স্থানীয় অথবা নিজস্ব বিশেষ ধরনের হয়; এবং প্রচরণের উপায়গুলি সম্পর্কে, জীবদের একটি গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিরা কেন বিশেষ ধরনের হয়ে থাকে, এবং এমনকি একই শ্রেণীর মধ্যে অন্য গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিরা পৃথিবীর বিভিন্ন সংলগ্ন অঞ্চলের প্রজাতিদের সঙ্গে একই হয়ে থাকে। আমরা দেখতে পারি কেন ব্যাট্রাচিয়ান ও স্থলচর স্তন্যপায়ীদের মত জীবদের সমগ্র গোষ্ঠীগুলো মহাসামুদ্রিক দ্বীপগুলোতে অনুপস্থিত থাকে, অথচ অতিশয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো বায়ুচর স্তন্যপায়ী অথবা বাদুড়দের নিজস্ব বিশেষ প্রজাতির অধিকারী হয়। আমরা দেখতে পারি কেন দ্বীপগুলোতে কমবেশী রূপান্তরিত অবস্থায় স্তন্যপায়ীদের উপস্থিতি এবং এইসব দ্বীপগুলো ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে গভীরতার মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকে। আমরা স্পষ্টতঃ দেখতে পারি কেন একটি দ্বীপপুঞ্জের সমস্ত অধিবাসীরা, কয়েকটি দ্বীপে বিশেষভাবে ভিন্ন হলেও, পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়; এবং এভাবে নিকটতম মহাদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে অথবা অন্য উৎসের, যেখান থেকে দেশান্তরীরা উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারত, অধিবাসীদের সঙ্গে কম ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়। আমরা দেখতে পারি পরস্পর প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিরা অবস্থান করলে কেন কয়েকটি সমরূপ প্রজাতিকে সেখানে সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়।
যেমন প্রয়াত এডওয়ার্ড ফরবেস প্রায়শই জোরের সঙ্গে বলতেন, দেশ ও কাল জুড়ে জীবনের নিয়মগুলোতে বিস্ময়কর সমান্তরালতা আছে; অতীতকালে আকারদের পর্যায়ক্রম নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মসমূহ এবং বর্তমানকালে ভিন্ন অঞ্চলগুলোতে পার্থক্যসমূহ নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মসমূহ একই হয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এটি দেখি। প্রত্যেক প্রজাতির এবং প্রজাতি—গোষ্ঠীর স্থায়িত্বকাল অবিচ্ছিন্ন হয়; কারণ নিয়মটির আপাত ব্যতিক্রম এত অল্প হয় যে একটি মধ্যবর্তী পলিস্তরে কোন কোন আকাররা এখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় বলা যেতে পারে যে ঐ আকাররা ঐ স্তরে অনুপস্থিত কিন্তু এরা উপর ও নিচের স্তরে রয়েছে : সেরকম দেশেও, এটি নিশ্চয় একটি সাধারণ নিয়ম যে শুধুমাত্র একটি প্রজাতি অথবা প্রজাতিদের একটি গোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলটি নিরবচ্ছিন্ন হয় এবং বিভিন্ন অবস্থাসমূহে পূর্ব প্রচরণগুলোর দ্বারা, অথবা পরিবহণের অনিয়মিত উপায়গুলোর দ্বারা, অথবা মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে প্রজাতিদের বিলুপ্ত হওয়ার দ্বারা ব্যতিক্রমগুলো বিচার করা যেতে পারে, যেগুলো বিরল হয় না এবং যেমন আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, দেশ ও কাল উভয়েতেই প্রজাতি এবং প্রজাতি—গোষ্ঠীগুলো সর্বোচ্চ বিকাশে পৌঁছায়। একই সময়ের মধ্যে জীবিত অথবা একই অঞ্চলে জীবিত প্রজাতিদের গোষ্ঠীগুলোর কারুকার্য অথবা রঙের মতো সাধারণ তুচ্ছ বৈশিষ্ট্যগুলো দ্বারা প্রায়শই বৈশিষ্ট্যসূচক হয়েছে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে দূরবর্তী প্রদেশগুলোর দিকে তাকিয়ে অতীতের পর্যায়ক্রমিক যুগসমূহ পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখি যে কোন কোন শ্রেণীর প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে কম ভিন্ন হয়, অন্যদিকে অন্য শ্রেণীর প্রজাতিরা অথবা একই অর্ডারের একটি ভিন্ন বিভাগের প্রজাতিরা পরস্পরের থেকে বিরাটভাবে ভিন্ন হয়। সময় ও কাল উভয়েতেই প্রত্যেক শ্রেণীর নিম্নমাত্রায় সংগঠিত সদস্যরা সাধারণতঃ উচ্চমাত্রায় সংগঠিতদের তুলনায় কম পরিবর্তিত হয়; কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই নিয়মটির ব্যতিক্রম রয়েছে। আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী, সময় ও কাল জুড়ে এইসব কতিপয় সম্পর্ক বোধগম্য হয়, কারণ জীবনের সম্বন্ধযুক্ত আকাররা, যারা পর্যায়ক্রমিক যুগে পরিবর্তিত হয়েছে, অথবা সেইগুলো যারা দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রচরণের পর পরিবর্তিত হয়েছে। যাই হোক না কেন, উভয় ক্ষেত্রেই এরা সাধারণ বংশের একই বন্ড দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে, উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের নিয়মগুলো একই হয়েছে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের একই উপায় দ্বারা রূপান্তরগুলো সঞ্চিত হয়েছে।