৭. হলুদ বই : একটি অন্তবর্তী প্রতিবেদন

হলুদ বই : একটি অন্তবর্তী প্রতিবেদন

‘হলুদ বই’ গেল কোথায়?

সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হারবার্ট’ ছবির সেই দৃশ্যটি মনে পড়ছে? সদ্য-বয়ঃসন্ধি-পেরোনো হারবার্ট এক নির্জন দুপুরে চিলেকোঠার ছাতে নিয়ে যাচ্ছে পাশের বাড়ির কিশোরীটিকে ৷ খবরের কাগজের মোড়ক খুলে বের করে আনছে প্রায়-দোমড়ানো একটি বই ৷ বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নর-নারীর আলিঙ্গন ও মৈথুনের ছবি ৷ ফোটোগ্রাফ নয়, লাইনড্রয়িং ৷ অনেকটা সাদা-কালো রেখায় আঁকা কমিকস স্ট্রিপের আদলে একটি পূর্ণাঙ্গ যৌনদৃশ্যের উপস্থাপনা সেখানে ৷ বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে যায় হারবার্ট ৷ যৌনক্রিয়ার যেখানে সমাপ্তি, তার পরের পৃষ্ঠায় গর্ভস্থ ভ্রূণ এবং ভ্রূণের বেড়ে ওঠার একের পর এক ছবি ৷ বই বন্ধ করে দেয় হারবার্ট ৷ পাশের বাড়ির মেয়েটি, বুকি, অস্বস্তি ও উত্তেজনাসমেত উঠে দাঁড়ায় ৷ সিঁড়ির দরজার আড়ালে নিয়ে গিয়ে বুকিকে ত্রস্ত, আড়ষ্ট অনুরোধ জানায় হারবার্ট ‘‘এই বুকি, তোমারটা দেখাবে? কাউকে বলব না ৷’’ ক্যামেরার দিকে পিছন ফিরে ফ্রকের সামনের দিকের বোতাম খুলে দেয় বুকি ৷ উন্মুক্ত করে দেয় তার সদ্য প্রস্ফুটিত হতে থাকা যৌবনের সম্ভার ৷ এর পরের দৃশ্যটি আরও মারাত্মক ৷ মূষলধারে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ ৷ ঘন বর্ষার আড়াল চারদিকে ৷ জলের ট্র্যাঙ্কের নীচে আধশোয়া অবস্থায় আত্মমৈথুনে রত হারবার্ট ৷ ছবির পর্দায় এমন করুণ, অসহায়, জীবন্ত স্বমেহনের দৃশ্যের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নই আমরা ৷

যে বইটি এই সমগ্র দৃশ্যপরম্পরার অনুঘটক, সেটি একটি বাংলা পর্নোগ্রাফি ৷ চলতি বুলিতে যাকে ‘হলুদ বই’ বা ‘বাংলা পানু’ বলা হয় ৷ ‘হারবার্ট’ ছবির ঘটনাক্রম অনুসরণ করলে দেখা যায়, ভাইপো বিনু বহরমপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে যখন ভর্তি হয়, তখন হারবার্ট পূর্ণ যুবক অর্থাৎ উপরোক্ত দৃশ্যের পর অন্তত ছ’সাত বছর কেটে গেছে ৷ নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে অর্থাৎ ’৬৯-’৭০-এর পর্যায়েই বিনুর নিষিদ্ধ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ৷ সেই হিসেবে নির্জন চিলেকোঠায় হারবার্টের ‘হলুদ বই’ নাড়াচাড়ার ঘটনাটির সন তারিখ ষাটের দশকের গোড়ার দিক ৷ এই সালতামামির হদিশ নিচ্ছি একারণেই যে, ইতিহাসগতভাবে ষাট ও সত্তর দশকই ছিল বাংলা ‘হলুদ বইয়ে’র স্বর্ণযুগ ৷ রাষ্ট্রবিপ্লবের আকাঙক্ষা আর ছাপার অক্ষরে শরীর-যৌনবাসনা-যৌনতার বিস্ফোরণ কোথাও মিলেমিশে গিয়েছিল কি? সামাজিক ‘ক্ষমতা’ দখলের লড়াই আর অবরুদ্ধ ‘শরীরে’র বিদ্রোহ কি একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল? এ বিষয়ে বিস্তর সামাজিক ইতিহাসধর্মী গবেষণার সুযোগ রয়েছে, এখানে যার অবতারণা বাতুলতা ৷ কেবল এটুকুই বলা যায়, একটা বিরাট বড়ো এবং বহুমাত্রিক পর্নোসাহিত্যের সম্ভার গড়ে ওঠে ওই পর্যায়ে, বিভিন্ন বয়স ও সামাজিক স্তরের পাঠকমনের চাহিদা অনুযায়ী বাজারে আসতে থাকে হরেক কিসিমের পশরা ৷ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যদিও হাইকালচার/লো-কালচার-জাতীয় বিভাজন নিতান্তই আরোপিত, তবু, একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে পঞ্চাশের কবিতায় ব্যক্তির যে সোচ্চার আত্মঘোষণা, যৌন উচ্চারণের স্পর্ধিত বাহুল্য, সাহিত্য ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বাজারচলতি গল্প উপন্যাসের ভিতরেও কিছু বিশেষ ধরনের যৌনবিবরণের অনুপ্রবেশ, ষাটের দশকে ‘হাংরি’ আন্দোলন ও শরীরী ভাষার বহিঃপ্রকাশ, ‘বিবর’-‘প্রজাপতি’ বিতর্ক ইত্যাদি যদি হাই লিটারেচরের পরিসরে যৌনমুক্তির ইঙ্গিত হয়, উত্তম-সুচিত্রা হয়ে উত্তম-সুপ্রিয়ার জনপ্রিয় ছবিগুলি যদি হয় কাঙ্ক্ষিত যৌবনের দৃশ্য অভিব্যক্তি, তবে ঠিক এরই কাউন্টারপার্ট হিসেবে আর একধরনের পাঠকরুচির তাগিদেই ষাট-সত্তর দশকে বাজারে আসতে শুরু করে ‘জীবনযৌবন’, ‘রূপোলি প্রজাপতি’, ‘দেহমন’, ‘তনুমন’-জাতীয় অসংখ্য পত্র-পত্রিকা ৷ কোনোটা চটি বই আকারের পেপারব্যাক, কোনোটা আবার ‘প্রসাদ’ ‘উল্টোরথ’ জাতীয় ম্যাগাজিন সাইজের, পাতায় পাতায় ছবি-ইলাসট্রেশনে ভরা, এদের পুজোসংখ্যাগুলিও রীতিমতো ঢাউস আকৃতির ৷ এমনটা ভেবে নিতে বাধা নেই, পূর্বোক্ত হাই লিটারেচারের পাঠকগোষ্ঠী এবং এইসব কিছুটা আড়ালে থাকা-ততোটা প্রকাশ্য নয় বইপত্রের পাঠককুলের শ্রেণিচরিত্র মোটামুটি এক, অর্থাৎ অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, কম বেশি শিক্ষিত মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজনই এগুলির প্রধান খরিদ্দার ৷ এদের ভিতর যেমন রয়েছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়া, মধ্যবয়স্ক চাকুরিজীবী, রিটায়ার্ড প্রৌঢ়, তেমনই হয়তো নানাবয়সী গৃহবধূ বা কলেজছাত্রীর লুকোনো বিনোদনের খোরাক এইসব বই ৷ হলুদ বইয়েরও রুচিগত তারতম্য ছিল, উদগ্র যৌনবর্ণনায় ভরপুর ‘র’ পর্নোর পাশাপাশি এক ধরনের সাহিত্যগন্ধী ছদ্মবেশী পর্নোর প্রকাশ্য-গোপন বাজার সত্তরের শেষদিক অবদি বজায় ছিল ৷ শ্রেণি-লিঙ্গ-বয়সভেদে ফ্যান্টাসিরও চারিত্রিক তারতম্য গড়ে ওঠে ৷ কিন্তু ষাট-সত্তরের বাংলা পর্নোয় সেই রুচির সমগ্রতা বজায় রাখার চেষ্টা জারি থাকতে দেখা যায় ৷ ফলত, এই পর্বের বাংলা হলুদ বই বিচিত্রধর্মী অনেকগুলো ক্যাটেগরির সমাহার, একমাত্রিক নয় ৷

আশির দশকের শুরু থেকেই বাংলা হলুদ বই তার ষাট-সত্তরের বৈচিত্র হারাতে শুরু করে ৷ বাজারের প্রোডাক্ট হিসেবে এর উৎকর্ষের অন্তর্জলী যাত্রা ঘটে ৷ ভাষাগত স্ট্যান্ডার্ড, কল্পনার বৈচিত্র ও বিস্তারের ক্ষেত্রে শোচনীয় অবক্ষয় দেখা দিতে থাকে ৷ হারিয়ে যান সেইসব ছদ্মবেশী দক্ষ লেখক যারা পাঠকমনের ফ্যান্টাসিকেও শিল্পের মর্যাদা দিতে জানতেন ৷ ‘জীবনযৌবন’, ‘দেহমন’, ‘নরনারী’, ‘যৌবন’, ‘নায়িকা’, ‘রমণী’, ‘নায়িকা’, ‘সঙ্গিনী’, ‘তনুমন’, ‘নূতন জীবন’ নামের বইপত্রের জোগান বন্ধ হয় না, কিন্তু সেগুলি ক্রমশ অদক্ষ লেখকের হাতে একঘেয়ে, একমাত্রিক টেক্সটে পরিণত হয় ৷ ফলে এর খরিদ্দার শ্রেণিও সংকুচিত হতে থাকে ৷ আশির দশকের শেষদিক, এমনকি নব্বইয়ের গোড়ার দিকেও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, কলকাতার নির্দিষ্ট ঠেকগুলোয় এই ধরনের বইপত্রের জোগান যথেষ্টই ছিল, যদিও কোয়ালিটির অধঃপতন আটকানো যায়নি ৷ কিন্তু নব্বইয়ের শেষদিক থেকে শুরু করে একুশ শতকের প্রথম দশকের অন্তিমে পৌঁছে যদি আপনি গড়িয়াহাট, দেশপ্রিয় পার্ক, রাসবিহারী-হাজরা, ধর্মতলা, মৌলালি, কলেজস্ট্রিট, হাওড়া-দমদম-শিয়ালদা স্টেশনের পরিচিত দোকানগুলোয় যান, তবে হতাশ হতে হবে ৷ নতুন বইয়ের জোগান অনেক কমে গেছে ৷ যা পাওয়া যায় তা প্রায় একইধরনের টেক্সটের চর্বিতচর্বন ৷ তাতে রসিক পাঠকের তৃপ্তি; হয় না, অনুসন্ধিৎসা মেটে না ৷

এই অবক্ষয়ের কারণ কী? কেউ কেউ মনে করেন, সত্তর দশক থেকেই, প্রথমে নকশালপন্থী আন্দোলন, পরে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া এবং বামপন্থার আদলে পুরোনো ভিক্টোরিয়ান মরাল স্ট্যান্ডার্ডকেই প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেবার ফলে বাংলায় একধরনের নতুন নীতিপুলিশের আবির্ভাব ঘটেছে সাড়ে তিন দশকব্যাপী ৷ নৈতিক অবদমনের এই চাপ বাঙালির একান্ত নিজস্ব এই পর্নোসংস্কৃতির উপর আধিপত্যের সিলমোহর আঁকতে চেয়েছে ৷ কিন্তু এই মত আদৌ গ্রহণযোগ্য নয় ৷ প্রথমত, নকশালপন্থা অথবা বামফ্রন্টের ৩৪ বছর রাজ্যশাসন বাঙালিচৈতন্যের সারফেস রিয়্যালিটিতে অল্পবিস্তর পরিবর্তন আনলেও চেতনার শিকড়বাকড়ে আদৌ কোনো আমূল পরিবর্তন আনেনি ৷ দ্বিতীয়ত, এও এক ধরনের ‘রিপ্রেসিভ হাইপোথিসিস’ ৷ পৃথিবীতে কোথাও এমন কোনো অবদমনমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যেখানে ব্যক্তির নিজস্ব ফ্যান্টাসি সরকারি-বেসরকারি দমনপীড়নের ফাঁক-ফোকর দিয়ে নিজের ঈপ্সার মুক্তি চরিতার্থ করে না ৷ বস্তুত, ‘ক্ষমতা’ ব্যক্তির ইনডিভিজুয়ালিটিকে পিষে মারতে চায় বলেই, নিত্যনতুন ‘প্লেজারে’র জন্ম হয় ৷ ‘প্লেজার’ উৎপাদনের একটি আবশ্যিক শর্তই হল ‘ক্ষমতা’-র উপস্থিতি ৷ যৌনবাসনা অথবা যৌনকল্পনার মুক্তি সবসময়ই কোনো না কোনো পরিসর চায়, অবয়ব চায় ৷ এই অবয়ব-কামনাও দেশ-কালসাপেক্ষ, কালচার-স্পেসিফিক ৷ একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ষাট-সত্তর দশককে পিছনে ফেলে বিগত চারদশকে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির সোশ্যাল-ডাইনামিক্সও অনেক পালটে গেছে ৷ পরপর পাঁচটা পে কমিশন বাঙালি স্থিতিশীল মধ্যবিত্তের অবস্থান, আগ্রহ, আকাঙক্ষায় প্রভূত রদবদল ঘটিয়েছে ৷ ষাট-সত্তর দশকের মতো আজকের যৌবন চিলেকোঠার নির্জনতা আর হস্টেলের ফাঁকা ঘরেই কেবল নিজের প্রয়োজনীয় আড়ালটুকু খুঁজে নেয় না ৷ সত্তর-আশি দশকের মধ্যবিত্ত জাতকেরা অধিকাংশই বাবা-মায়ের একটি বা দুটি সন্তান ৷ আশির দশকের শুরু থেকেই ভি.সি.পি.-ভি.সি.আরের দৌলতে বিদেশি নীলছবির ক্যাসেট, ওই দশকের প্রায় পুরোটা জুড়ে সিনেমাহলে নুন শোয়ের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা, দক্ষিণী সফট পর্নোজাতীয় ছবির বিস্তার, গ্রামবাংলার ভিডিও পার্লারে নীলছবির রমরমা, অবশেষে নব্বইয়ের শেষদিক থেকেই ধরে ঘরে কম্পিউটার ও ভি.ভি.ডি প্লেয়ারের অনুপ্রবেশ, ইন্টারনেটের সাইবার যৌনতা, বিগত কয়েকবছরে কলকাতা ও মফসসলের দোকানে দোকানে থ্রি-এক্স ছবির সি. ডি. বা ডি.ভি.ডি.-র অভূতপূর্ব সহজলভ্যতা বাঙালির যৌনফ্যান্টাসির যাবতীয় লিমিট এক্সপেরিয়েন্সকে ছাপিয়ে গিয়েছে ৷ গড়িয়াহাটের মোড়ে থরে থরে নীলছবির সিডি যেভাবে বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে, তা কয়েকবছর আগেও অকল্পনীয় ছিল ৷ এই বিশ্বায়িত যৌনতার বাজারে বাংলা হলুদ বই নেহাতই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে-পড়া দেশীয় কুটির শিল্প, যার পুনরুজ্জীবন অসম্ভব-প্রায় ৷ চেষ্টা যে একেবারে হয়নি, তা নয়, তবে আশির মাঝামাঝি ‘সত্যসন্ধানী’, ‘অপরাধ’, ‘সংকেত’, ‘প্রিয়সঙ্গিনী’, ‘অনুসন্ধান’ জাতীয় পত্রিকাগুলি অথবা একেবারে হাল আমলে ‘প্যাশন’ বা ‘হট মিরর’-জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলো পরিবর্তিত বাস্তবতায় পুরোনো হলুদ বইয়ের সংস্কৃতিকে নতুন কোরামিন জোগানোর অক্ষম চেষ্টা বলেই মনে হয় ৷

তবু, বাংলা পর্নোর এই শবযাত্রায়, অনিবার্য শ্মশানযাত্রীর ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কতকগুলে প্রশ্ন মনের ভিতর খোঁচা মারে ৷ ষাট-সত্তর থেকে দুহাজার আঠারো সাল অব্দি এই যে সরলরেখা টেনে একটা ভাঙাচোরা ইতিহাসের ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাইলাম, এর ভিতর কি অতিসরলীকরণের ঝোঁক থেকে যাচ্ছে না? হলুদবইয়ের যে ধারাবাহিক অবক্ষয়কে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের দফারফা বলে ভেবে নিয়েছি, তাকে কি আর একটু খুঁটিয়ে দেখার দরকার নেই? গ্লোবাল-লোকাল দ্বন্দ্বে ক্রমাগত হেরে যাওয়া বাংলা ‘পানু’র অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ের ভিতর কি ভিন্ন কোনো উপাদান চোখে পড়ে না? গ্লোবালাইজড যৌনতার ণত্ব-যত্ব, অ-আ-ক-খ-গুলোকেই দেশীয় মোড়কে সাজিয়ে বাংলা পর্নোও কি টিকে থাকার, নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে না? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সাম্প্রতিক বাংলা পর্নোর অন্দরমহলে পা রাখতে হবে ৷ যতই একঘেয়ে, পুনরুক্তিমূলক বিবরণ হোক না কেন, তার উপাদানগত রূপান্তরগুলোকে ষাটসত্তরের হলুদ বইয়ের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে ৷ এই সূক্ষ্ম বাঁকবদলগুলোকে আংশিকভাবে হলেও ছুঁয়ে দেখার জন্য, আসুন, আমরা হলুদ বইয়ের ভিতর-উঠোনে একবার পা রাখি ৷

‘ফ্যান্টাসি’র উপাদান

পর্নোগ্রাফি, আদতে ব্যক্তিমনের অবদমিত বাসনা, অবরুদ্ধ অবসেশন ও যৌনকল্পনার বাধাবন্ধহীন রিপ্রেজেন্টেশন ৷ অন্য যেকোনো মুদ্রিত টেক্টটের মতোই এই রিপ্রেজেন্টেশন প্রক্রিয়ারও কোনো না কোনো রকমের বস্তুগত ভিত্তি রয়েছে ৷ আদৌ এটি কোনো ‘প্রাক-উপস্থিতি’র জগৎ নয়, ফ্যান্টাসি যেহেতু চড়া দামের বিক্রয়যোগ্য পণ্য, তাই তা নিত্যনতুন চেহারায় ‘উৎপাদিত’ এবং ‘পুনরুৎপাদিত’ হয়, ফলত ফ্যান্টাসির পরিসর ক্রমাগত বাড়তে থাকে, প্রতিনিয়ত অসংখ্য ধরনের উপাদান এতে সংযোজিত হয় ৷ আবার বাজারের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয় বলেই এর উপস্থাপন প্রক্রিয়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায় ৷ বাংলা পর্নোগ্রাফির কোনো ‘বংশানুচরিত’ রচনার কাজটি দুরূহ, কারণ উপাদানের অপ্রতুলতা, যথাযথ সংরক্ষণের অভাব ‘সামাজিক ইতিহাসে’র এই বর্ণময় দিকটির এক বিরাট অংশের অবলুপ্তি ঘটিয়েছে ৷ হয়তো আমাদের ভিতর থেকেই কোনো ভবিষ্যৎ লিন হান্ট-এর যোগ্য গবেষণায় তার আংশিক পুনরুদ্ধার ঘটবে ৷

এই ধরনের লেখালেখির ক্ষেত্রে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে যদি সত্তরের শেষদিক পর্যন্ত একটা সরলরেখা টানি, তবে দেখব পাদ্রি জেমস লং-এর ক্যাটালগে উল্লিখিত ‘অশ্লীল’ বইপত্রের তালিকার কোনোটাই আদৌ পর্নোগ্রাফি নয় ৷ তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘সম্বাদ রসরাজ’, ‘সম্বাদ রসমুদগর’, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’—জাতীয় কেচ্ছাপত্রিকাগুলোর মধ্য দিয়ে যৌনতার এক স্বাদু, উপভোগ্য ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছিল, যেখানে ছদ্মনামের আড়ালে সমাজের বিশিষ্ট পরিবারগুলোর অন্দমহলের যৌন ব্যভিচারের ঢালাও রিপোর্টাজ ছাপা হত ৷ বাগানবাড়িতে বাবুদের পরকীয়া তথা আত্মীয়গমন, মা-বোন-মাসি-খুড়িমার সঙ্গে অজাচার, শাশুড়ি ও বধূদের সমকামচর্চার খুল্লমখুল্লা বর্ণনায় ভরা থাকত এইসব স্বল্পায়ু চটি পত্রিকা ৷ এক্ষেত্রে ফ্যান্টাসি-উৎপাদনের প্রাকশর্ত সত্য-মিথ্যায় মেশানো বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে মুখরোচক জনশ্রুতি ৷ ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত নারায়ণ চট্টরাজের লেখা ‘কলিকৌতুক’ বইতে সহজিয়া বৈষ্ণবদের আখড়ায় বয়স্কা সন্ন্যাসিনী এবং নবীন অনভিজ্ঞ সন্ন্যাসীর যৌনমিলনের উতরোল বর্ণনা পাওয়া যায়, যদিও তাকে আজকের নিরিখে ‘পর্নোগ্রাফি’ বলা যাবে কিনা তাও বিচার্য ৷ তবে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভিক্টোরিয়ান রুচিবোধের প্রভাবে একদিকে যেমন এইসব পত্রিকা ও বইপত্রের ওপর নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, তেমনই একটু একটু করে যৌনতাও অ্যানালিটিকাল ডিসকোর্সের অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে ৷ সুর্যনারায়ণ ঘোষ, অন্নদাচরণ খাস্তগীর, ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, কেদারেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বিস্তৃত সেক্স ম্যানুয়ালগুলি থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে চণ্ডীচরণ বসাক প্রণীত চিত্রে ও রচনায় যৌবনপথে, এমনকি নৃপেন্দ্রকুমার বসু ও আরাধনা দেবীর লেখা নরনারীর যৌনবোধ অব্দি অসংখ্য বইপত্রে এর পরিচয় মেলে ৷ ত্রিশের দশক থেকেই বাংলা ‘হাই লিটারেচারে’ ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্বের অনুপ্রবেশ যৌনতার বিশ্লেষণধর্মী মতামতকেই সাহিত্যিক মান্যতা দেয় ৷ কিন্তু এই বিস্তৃত পর্যায়ে হলুদ বই জাতীয় লেখালেখি ঠিক কীরকম ছিল, আদৌ কতোটা মাত্রায় ছিল তার সঠিক হদিস পাওয়া মুশকিল ৷ তবে অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতির পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ ১৯২৫ সালে প্রকাশিত শিবরাম চক্রবর্তীর উপন্যাস ছেলেবয়সে বা ত্রিশে দশকের শেষদিকে মানদা দেবীর ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’-এর বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লেখা রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘রমেশদার আত্মকথা’-য় সমকালীন যুবসমাজের ও উচ্চ-উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের যে যৌনজীবন চিত্রিত, সেখানে উদ্দীপক হিসেবে এই জাতীয় বইপত্রের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় ৷

বরং ষাটের শেষ, সত্তরের গোড়ায় চলে আসি ৷ ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’ জাতীয় সিনেমা ম্যাগাজিনের পাশাপাশি সেসময় রমরম করে চলছে ‘সুন্দর জীবন’, ‘জীবন যৌবন, ‘রুপোলী প্রজাপতি’ জাতীয় পত্র-পত্রিকা ৷ এগুলিকে এককথায় ‘হলুদ বই’ বা ‘পর্নোগ্রাফি’ হিসেবে কোনোভাবেই দেগে দেওয়া যাবে না ৷ কারণ বহুবিচিত্র উপাদানের সমন্বয়ে পাঠক মনোরঞ্জন তথা পাঠকের যৌন ফ্যান্টাসি পূরণের ডালি সাজিয়ে দেওয়া হত এখানে ৷ ‘সুন্দর জীবন’ শারদীয় ১৯৭০-এর প্রচ্ছদে বিশ্বজিৎ এবং মালা সিনহার আবেগঘন মুহূর্ত, একই সঙ্গে লেখা ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ ৷ গল্প-উপন্যাস রচয়িতার তালিকায় রয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর, নরেন্দ্রনাথ মিত্র এবং হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়র মতন লেখকেরা ৷ এঁদের লেখাগুলি কিন্তু কোনোভাবেই ‘ইরোটিকা’ নয়, ‘পর্নোগ্রাফি’ তো নয়ই ৷ অথচ এটুকু বাদ দিলে ‘সুন্দর জীবন’-এর ৩৮টি প্রবন্ধের প্রায় ৯০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে যৌনক্রিয়া, যৌনতা, নগ্নতা ও শরীরকেন্দ্রিক ৷ লেখাগুলো মুলত তথ্যধর্মী, বেশিরভাগটাই চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ও নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা ৷ যে ‘মেডিক্যাল গেজ’ গত শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল যৌনতাকেন্দ্রিক আলোচনায়, তারই সমকালীন রূপান্তর ‘সুন্দর জীবন’-এর রচনাগুলি! ‘যৌনবিষয়ক প্রবন্ধাবলী’ শিরোনামের আওতায় রাখা হয়েছে ‘ব্যভিচার ও বিবাহবিচ্ছেদ’, ‘দেহমিলনে আসনভঙ্গি’, ‘পুরুষত্বহীনতা প্রতিকারের আধুনিকতম উপায়’, ‘নিষ্ক্রিয় স্ত্রীকে সক্রিয় করে তোলার পদ্ধতি’, ‘কলেজের ছাত্রীরাও সমকামী হতে পারে (সচিত্র)’, ‘শৃঙ্গারের গুরুত্ব’, ‘পশুদের শৃঙ্গার ও সঙ্গম’, ‘নিষিদ্ধ আত্মীয়গমন’ প্রভৃতি লেখা ৷ একধরনের মেডিক্যাল ভঙ্গি ব্যবহৃত হলেও লেখাগুলি কোথাও কোথাও উস্কানিমূলকও বটে ৷ ‘চিকিৎসা-বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ’ অংশে রয়েছে ‘পাশ্চাত্যের স্কুল কলেজে যৌনশিক্ষাদান (সচিত্র)’, ‘গর্ভাবস্থায় প্রসূতি পরীক্ষা’, ‘লুপের ব্যবহার’, ‘প্রসবের তারিখ নির্ণয়’, লেখাগুলি ৷ যৌন ফ্যান্টাসি নির্মাণ বা যৌন কৌতূহল ও অবদমিত আকাঙক্ষা পূরণে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে যে লেখাগুলি, সেগুলিকে রাখা হয়েছে ‘ভিন্নধরনের আকর্ষণীয় রচনাবলী’, ‘ফ্যাশন বিষয়ক রচনাবলী’ ‘নাটক ও চলচ্চিত্র বিষযক প্রবন্ধাবলী’ শিরোনামে ৷ কয়েকটি সচিত্র প্রতিবেদন যথেষ্টই উত্তেজক ভাষাভঙ্গিমায় রচিত; যেমন ‘ক্রিস্টিন কিলার ও ব্যভিচারীদের স্বর্গ লন্ডন’, ‘ভারতীয় মহারাজাদের বিকৃত যৌনাচার’, ‘প্রকাশ্য নগ্নতা’, ‘ন্যুড কলোনিতে স্পোর্টস’, ‘ন্যুড ফোটোগ্রাফি প্রসঙ্গে’, ‘ভারতীয় ক্যাবারে নাচ’, ‘বক্ষসৌন্দর্য ও ব্রেসিয়ার’, ‘সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার অন্তরালে’, ‘নারী নগ্নতা এবং চিত্র পরিচালক’, ‘গত দশকে পৃথিবীর চলচ্চিত্রে যৌনতা’ ৷ সবকটি লেখাই রিপোর্টাজধর্মী হলেও ক্রিস্টিন কিলার, ভারতীয় মহারাজা, ন্যুড কলোনি, চলচ্চিত্রে যৌনতা-সংক্রান্ত লেখাগুলিতে ‘বিকৃত কামাচরণ’ হিসেবে ধর্ষকামী-মর্ষকামী যৌনতার বিবরণ অনেকাংশেই অনুপুঙ্ক্ষ পর্নোগ্রাফিক বর্ণনার কাছাকাছি ৷ সর্বোপরি ‘সুন্দর জীবন’ শারদসংখ্যায় রয়েছে ১৩৬টি ফেটোগ্রাফ ও তৎসহ পরিচিতি ৷ দেশি-বিদেশি অসংখ্য চলচ্চিত্রের যৌনদৃশ্যের বিচিত্র ভঙ্গিমার ছবি যেমন রয়েছে, তেমনি নূ্যড কলোনি বা ছবির সেটে উত্তেজক পোশাকে নায়িকার দেহে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক, ধনী পৃষ্ঠপোষক ডা. ওয়ার্ড ক্রিস্টিন কিলারের গলায় কুকুর বাঁধার শিকল পরিয়ে রেখেছেন—জাতীয় ছবি যথেষ্টই প্রোভোকেটিভ ৷ কলকাতার নামী ক্যাবারে নর্তকী মিস শেফালি বা মিস সংযুক্তার ছবি, দক্ষিণী চলচ্চিত্রের দৃশ্যে প্রায়-নিরাবরণ নায়িকার ছবিও এই ফ্যান্টাসির কল্পজগৎ নির্মাণে সহায়তা করে ৷ সর্বোপরি রয়েছে বিভিন্ন যৌনসমস্যার সুদীর্ঘ প্রশ্নোত্তর বিভাগ, এতে কেসস্টাডির আদলে যৌনতার পৃথক ক্যাটেগরিগুলোকে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে ৷ ‘ক্লিনিক্যাল গেজ’ এবং ফ্যান্টাসির বিপণন—দুইই মিলেমিশে গেছে এখানে ৷

‘রূপোলি প্রজাপতি’-র নভেম্বর ১৯৭২ সংখ্যার প্রচ্ছদে রয়েছে ধর্মেন্দ্র-হেমামালিনীর আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি ৷ পত্রিকায় রয়েছে তিনধরনের রচনা ৷ ‘যৌনবিজ্ঞান ভিত্তিক প্রবন্ধ’ অংশে ফ্রয়েড, হ্যাভলক এলিসের রচনার দীর্ঘ উদ্ধৃতিসহ উল্লেখযোগ্য লেখাগুলির শিরোনাম ‘অস্বাভাবিক কারণে মিলনে বাধা’, ‘পুরুষের উত্তেজনা ও তার পশ্চাৎপট’, ‘নারী সমকামিতার প্রকৃতিগত অনুসন্ধান’, ‘যৌন অক্ষমতা’ প্রভৃতি ৷ একধরনের ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে যৌন আচরণের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা রয়েছে এখানে ৷ কিন্তু গল্প-উপন্যাস বিভাগের লেখাগুলিতে হালকা ইরোটিক বর্ণনার ছোঁয়া রয়েছে ৷ যদিও নরনারীর প্রণয়সম্পর্কই এখানে মুখ্য, যৌনক্রিয়ার বর্ণনা প্রায় নেই ৷ ‘যৌন প্রশ্নোত্তর বিভাগ’-এ রয়েছে ‘লিঙ্গের আকার সমস্যা’, ‘অধিক যৌন উত্তেজনা’, ‘বিধবার আত্মরতিতে তৃপ্তি’, ‘নারী সমকামিতা’র মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের প্রশ্নোত্তর, কেসস্টাডির আদলে ৷ এছাড়াও ‘প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা’-র মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ইরোটিকাও ছাপা হয়েছে ৷ পূর্বোক্ত পত্রিকাটির মতই এখানেও যেকটি নারীপুরুষের নগ্নচিত্র ছাপা হয়েছে, তার সিংহভাগই মার্কিন ও ইউরোপিয়ান অ্যাডাল্ট ছবির দৃশ্য ৷ যেমন দুই নগ্নিকার স্নানদৃশ্যের তলায় ক্যাপশন ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ছবির নাম ‘ইরোটিকা’ ৷ ইরোটিকা কথার অর্থ যৌন অনুভূতি ৷ নগ্ন মডেলদের নায়িকা করে রাসমেয়ার এই ছবিটি তুলেছন ৷ ছবির গল্পাংশে দেখা যায় শহর থেকে কতিপয় সুন্দরীকে নিয়ে এসে বস্ত্রভার মুক্ত করে আধুনিক ইডেন গার্ডেনের স্থাপনা’ ৷ ‘জীবন যৌবন’ পত্রিকার শারদীয় ১৯৭৬ সংখ্যার শুরুতেই রয়েছে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প ‘নষ্ট চাঁদ’, এরপর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা ‘দেহমনের স্বাদ’! বেশিরভাগ লেখাই ইনফরমেটিভ, ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিই এক্ষেত্রে মুখ্য ৷ ‘কুমারী পতিতা’, ‘লুকিয়ে দেখার মনস্তত্ব’, ‘পুরুষদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল’, ‘হিটলারের প্রেমিকা ও ছেলেমেয়েরা’, ‘নারীর বিশেষ অঙ্গ ও পুরুষের যৌন উত্তেজনা’, ‘লাভ ইতালিয়ান স্টাইল’ দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের দৃশ্যসহ প্রবন্ধ ‘চুম্বন: পুরুষ ও নারীর চোখে’, ‘ইতালিয়ান চলচ্চিত্রে যৌনবিপ্লব’—প্রভৃতি প্রবন্ধে একধরনের বিশেষ উত্তেজক ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয় ৷

পূর্বোক্ত তিনটি পত্রিকার লেখক ও বিষয়সূচি, ব্যবহৃত ছবি ও স্কেচ, মেডিক্যাল ছদ্মবেশে যৌনতার বর্ণনা—সব মিলিয়ে যৌনতাকে বৃহত্তর পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য, ততটা বিপজ্জনক নয়, এমন উপস্থাপনার ভঙ্গিতে হাজির করা হয়েছে ৷ ফলত, যৌনপত্রিকা হওয়া সত্বেও এদের নিছক পর্নোপুস্তক হিসেবে গণ্য করা যাবে না ৷ কিন্তু সত্তরের শেষ দিক থেকেই এইসব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় ৷ বদলে হুবহু একই শিরোনামের হার্ডকোর বাংলা পর্নো বই ও পত্রিকার চল শুরু হয় ৷ ‘জীবনযৌবন’, ‘রূপোলি প্রজাপতি’, ‘সুন্দর জীবন’—এবার বিশুদ্ধ পর্নোপাঠকের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেল ৷ সাহিত্যিক আবরণ খসে গিয়ে এবার এল পুরোদস্তুর পর্নোগ্রাফিক বর্ণনা, রগরগে ভাষা, যৌনাঙ্গ ও যৌনক্রিয়ার চরমতম নিখুঁত বর্ণনা ও সবধরনের বাস্তবতার উপাদানকে আত্মসাৎ করা একমাত্রিক ‘ফ্যালিক ভয়েস’ ৷ এই প্রতিসরণের একটি সার্থক উদাহরণ ‘দেহমন’ পত্রিকার ডিসেম্বর ১৯৭৭ সংখ্যাটি ৷ ‘যৌনবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের বলিষ্ঠ পত্রিকা’—এই আবরণটুকু থুকলেও ‘যৌন কৌতূহল ও যৌন কামনা (কেসহিস্ট্রিসহ)’ ‘পতিতালয়ের বিকৃতি’ (কেসহিস্ট্রিসহ), ‘পশুপ্রেম ও পশুকামনা’—জাতীয় লেখাগুলির বর্ণনা পুরোপুরি হার্ডকোর পর্নোগ্রাফির সমতুল্য ৷ ‘যৌনমনস্তাত্বিক উপন্যাস’ ‘শিউলিবনে’-র বিষয়বস্তু স্ত্রী ও শাশুড়ির সঙ্গে এক বিবাহিত পুরুষের দেহমিলন ৷ বাধাবন্ধনহীন মুখখিস্তি, যৌনাঙ্গের আকাঁড়া বর্ণনা—লেখাটিকে পরবর্তী পর্যায়ের বাংলা পর্নোর পূর্বসূরি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ৷ ক্রমে আশির দশকে হলুদ বই আবদ্ধ হয়ে পড়ে নিছক পর্নোপ্রেমী গোষ্ঠীপাঠকের বিশেষ পাঠসুখ চরিতার্থ করার কাজে ৷ প্রথমদিকের লেখায় তাও একটি সুশৃঙ্খল গদ্যকাঠামো রক্ষার চেষ্টা থাকত ৷ খুব দ্রুত সেই স্টেডি রাইট আপ প্যাটার্নটুকুও লুপ্ত হয় ৷ চূড়ান্ত বিশঙ্খৃল পুনরাবৃত্তির চক্করে আটকে পড়ে বাংলা পর্নোর ভাষা ৷

সূক্ষ্ম বদল আসছিল হলুদ বইয়ের বিষযবস্তুর ক্ষেত্রেও ৷ আশির দশকের শুরু থেকেই ভি.সি.পি, ভি.সি.আর.-এর যুগ শুরু হলে ব্লুফিল্মের ক্যাসেট সহজলভ্য হয়ে যায় ৷ দৃশ্যবস্তুর আকর্ষণ এক্ষত্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, কারণ, ফ্যান্টাসির প্রধানতম ধর্মই তীব্র অতৃপ্তি, সেই অতৃপ্তি নিত্যনতুন অচেনা খিদের জন্ম দেয়, এ এক অনিঃশেষ ক্ষুধা ৷ বিশেষত আমাদের মতো অবদমনমূলক সমাজকাঠামোয়, যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজে মধ্য-নব্বই পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সহজ মেলামেশার পরিসর খুব একটা প্রসারিত ছিল না ৷ ধীরগতিতে সেই পরিবর্তন এসেছে পরবর্তী কুড়ি বছরে ৷ দৃশ্যসুখের নতুন আবেশে ইন্ধন জুগিয়েছিল টেলিভিশনের প্রাইভেট চ্যানেলগুলোও, মাঝ-নব্বই থেকেই ‘কেবল কানেকশন’ চালু হয় পাড়ায় পাড়ায়, শনি-রবিবার লেটনাইট মুভি হিসেবে চোরাগোপ্তা থ্রি-এক্স প্রদর্শন শুরু হয় ৷ ১৯৯৪ সালে সরকারি চ্যানেলে বিনাপয়সায় আড়াই ঘণ্টার জন্য এম.টি.ভি চালু হয়, নয়া-বিশ্বায়নের উপযোগী দর্শকামের বন্দোবস্ত করা হয় আমজনতার জন্য ৷ এই অবস্থায় বাংলা হলুদ বইও একটু একটু করে নিজেকে বদলে ফেলে ৷ আশির দশক থেকে নব্বইয়ের গোড়ার দিকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বাংলা হলুদ বই ‘স্যাটারডে ক্লাব’ ‘দেহময় আগুন’, ‘বিপথগামিনী’, ‘নায়িকা সঙ্গিনী’, ‘নরনারী’, যেগুলির প্রণেতা হিসেবে নাম রয়েছে ‘শিবা’ অথবা ‘বিচিত্রবীর্য’র, সেইসব বি.বি.সি. ছাপমারা বইতে সংকলিত প্রায় তিরিশটি গল্প উল্টেপাল্টে দেখেছি, অন্তত চল্লিশ শতাংশ গল্পে কোনো না কোনোভাবে ভিডিওতে ব্লুফিল্ম দেখার প্রসঙ্গ রয়েছে ৷ কোথাও সমবেতভাবে অন্যদের সঙ্গে, কোথাও এককভাবে ব্লুফিল্ম দেখছে নায়কনায়িকা, তৃতীয় ব্যক্তি হয়তো আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছে, যথাসময়ে প্রবেশ করছে রঙ্গমঞ্চে ৷ কোথাও নাদান বালক বালিকাকে যৌনকর্মে প্ররোচিত করা হচ্ছে ব্লুফিল্ম দেখিয়ে, কোথাও সচেতনভাবে ব্লুফিল্মের আসনভঙ্গিমা নকল করছে চরিত্রেরা, ভিডিও ক্যাসেট প্রধান অনুঘটক হয়ে উঠছে বারবার ৷ ‘দেহমন’ পত্রিকার ২০০০ এবং ২০০১ শারদীয় নামাঙ্কিত দুটি সংকলনে এমন দুটি কাহিনি রয়েছে, যা গ্লোবাল বিষয়বস্তুকে দেশীয় চেহারায় ধরার চেষ্টা ৷ প্রথম গল্পটির নাম ‘মডেল হতে গেলে’ ৷ শনবম এক চতুর্দশী কিশোরী, যার মা একজন বাঙালি মডেল, বাবা আমেরিকান, পেশায় ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ৷ ম্যানহাটন শহরের ৬৫তলা উঁচু অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তারা ৷ ছোটবেলা থেকেই শবনমের স্বপ্ন সফল মডেল হওয়া, তার মা-বাবারও একই ইচ্ছা ৷ মাকে বিজনেস স্ট্রাটেজি অনুযায়ী একের পর এক ক্লায়েন্ট ও শো অর্গানাইজারকে শারীরিকভাবে তৃপ্ত করতে হয়ে, বালিকা শনবম তা জানে এবং সে নিজেও এ বিষয়ে কোনো ছুঁতমার্গিতায় ভোগে না ৷ অবশেষে সর্বকনিষ্ঠ মডেল হিসেবে খুব দ্রুত গ্ল্যামারের আলোয় উঠে আসে শবনম, অবশ্যই শরীরের বিনিময়ে ৷ গল্প শেষ হচ্ছে রিও ডি জেনেইরোর এক আলিশান প্লেজার হাইসে, যেখানে ষোড়শী শবনম চারজন কামুক কোটিপতিকে শারীরিকভাবে তৃপ্তি দিচ্ছে ৷ দ্বিতীয় গল্পটির নাম ‘আমি ও সেরেনা’ ৷ নিউইয়র্ক শহরে এক বিখ্যাত ফ্যাশন কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে তনুময়ের দায়িত্ব, সেলিব্রিটি মডেল, নায়িকা ও স্পোর্টসস্টারদের দিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ডের অন্তর্বাসকে প্রোমোট করানো ৷ সেই কাজের সূত্রেই সে উপস্থিত হয় বিখ্যাত টেনিসসম্রাজ্ঞী সেরেনা উইলিয়ামস-এর ফ্ল্যাটে ৷ তনুময় ছোটবেলায় সাঁওতাল রমণীদের প্রতি কামনা অনুভব করতো, আজ কৃষ্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবতী সেরেনাকে দেখে তার সেই কৈশোরবাসনা জেগে উঠল ৷ বাঙালি যুবকের যৌনদক্ষতায় অভিভূত সেরেনা উইলিয়ামস তনুময়কে কেবল শরীরই দিল না, টেনিসকোর্ট থেকে ছমাসের ছুটি নিয়ে প্রমোদভ্রমণে বেরোলো তনুময়ের সঙ্গে ৷ এই গল্পেরই আর একটা ভার্সান পাই ‘দেহমন’ পত্রিকার ২০০৫ শারদীয় সংখ্যায় ৷ এক্ষেত্রে পূর্বানুবৃত্তির সূত্রে দেখানো হয়েছে সেরেনা উইলিয়ামস যখন তনুময়ের ঔরসে গর্ভবতী, তখন, তনুময়কে শরীরী তৃপ্তিদান করতে এগিয়ে আসছে সেরেনার বোন, আর এক টেনিসস্টার ভেনাস উইলিয়ামস ৷ এ যেন বউ-এর বদলে শালীর মাধ্যমে স্বাদবদল ৷ ফ্যান্ট্যাসির এই প্রতিসরণ একুশ শতকের বৈশিষ্ট্য—সত্তর-আশিতে যা ততটা ছিল না ৷

তবে ‘সুন্দর জীবন’, ‘জীবনযৌবন’ ছাড়াও হার্ডকোর পর্ণো যে পঞ্চাশ-ষাট সত্তরে ছিল না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই ৷ বিশেষত পঞ্চাশ-ষাট দশকে একধরনের চটি বই বেরোত, যেগুলির প্রচ্ছদে কেবল টাইটেল থাকত, ছবি থাকত না ৷ এগুলি আগাগোড়া সাধুভাষায় রচিত, যৌনাঙ্গের প্রচলিত নাম ছাড়া বাকি টেক্সট সুললিত গদ্যে লেখা, এমনকি কোথায় কোথাও রবীন্দ্রসংগীতের প্যারডি ব্যবহৃত হয়েছে এবং এগুলির চরিত্র ও বিষয়বস্তু পুরোপুরি কলকাতাকেন্দ্রিক ৷ বইগুলোর সিরিজ বেরোত ৷ যেমন, ‘উদয়ন সন্ন্যাসী’র লেখা সিরিজ ১. ভাড়ার বাড়ি ২. কন্যাকুমারী এবং ৩. ষোলো বছরের মেয়ে ৷ আরো দুটি বই ‘চৌরঙ্গী’ এবং ‘লেডিজ ট্রাম’ ৷ প্রথম বইতে ষাট দশকের কলকাতার ‘ম্যাসাজ পার্লার’ সংস্কৃতির অন্দরমহলের গরম বর্ণনা, দ্বিতীয় বইতে চাকুরিরতা স্বাধীনচেতা মহিলাদের যৌনস্বেচ্ছাচারের বিবরণ, দুটোই সাধুভাষায় লেখা ৷

ভাষা, লিঙ্গ আধিপত্য, ‘ক্ষমতা’র রাজনীতি

বাস্তবের কঠোর অনুশাসন যদি হয় ‘রিয়্যালিটি প্রিন্সিপল’, তবে পর্নোগ্রাফি তার বিপরীতে দাঁড় করায়, মহিমান্বিত করে ‘প্লেজার প্রিন্সিপল’কে ৷ এই দুই দৃষ্টিকোণ যেন বাইনারি বৈপরীত্য ৷ সাধারণভাবে পর্নোসমর্থকেরা এই ‘প্লেজার প্রিন্সিপলে’র যুক্তিকে ব্যবহার করেন সামাজিক অবদমন, কৃত্রিম শিষ্টাচার, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ট্যাবুর বিরুদ্ধে অস্তিত্ব ও কল্পনার মুক্তির সূচক হিসেবে ৷ ‘ইউটোপিয়া’ যেমন চির-আকাঙ্ক্ষিত ‘নেই-রাজ্য’, তেমনই ‘পর্নোটোপিয়া’ও এক ‘কল্পিত সাম্রাজ্য’, যা ব্যক্তিমনের অবদমিত বাসনার পুঞ্জিত বহিঃপ্রকাশ, স্টিফেন মারকিউজের ভাষায়, এ হল এমন এক ‘ক্ষেত্র’, যেখানে টাইম-স্পেস অবান্তর হয়ে যায়, এমনকি ভাষা ও ইতিহাসবোধ হয়ে ওঠে চরম স্বেচ্ছাচারী ৷ কিন্তু পর্নোগ্রাফির নিহিত কাঠামো অনুসরণ করলেই বোঝা যায় এই স্বেচ্ছাচার আদৌ নির্বিশেষ স্বাধীনতার নামান্তর নয় ৷ বরং পর্নোগ্রাফি আরো কেবার প্রমাণ করে যেকোনো টেক্টটই আদতে বাস্তবের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপ্রেজেন্টেশন ৷ তাই পর্নোগ্রাফিতে উপস্থাপিত লিঙ্গ সম্পর্ক আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক ৷ পর্নোগ্রাফির ভাষার মধ্যে লীন হয়ে থাকা ‘ক্ষমতা’র চিহ্নগুলিকে শনাক্ত করলেই বোঝা যায়, এধরনের টেক্সট আসলে দাঁড়িয়ে আছে পুরুষ ও নারীর বাধ্যতামূলক পৃথকীকরণের উপর, নারীকে সম্পূর্ণ ‘অপরায়িত’ করার উপর ৷ পর্নোগ্রাফির কথকের ভাষা পুরুষতন্ত্রের ভাষা, এর দর্শকামী দৃষ্টি নারীকে নৈর্ব্যক্তিক ‘অবজেক্ট’-এ পরিণত করে ৷ নারীর ‘ডি-সাবজেক্টিফিকেশন’ ঘটায় ৷ জন বার্জার যেমন বলেছিলেন, ‘পর্নোগ্রাফি’তে পুরুষ নারীকে লক্ষ করে, নারী নিজের এই দর্শকামের স্থায়ী অবজেক্ট হওয়াকে লক্ষ করে, এক্ষেত্রে নারীর চোখ আদতে পুরুষেরই চোখ ৷ পর্নোগ্রাফি, নারীর উপর পুরুষের আধিপত্যকে চিরস্থায়ী হিসেবে দেখানোর মাধ্যম, অন্তত টেক্সচুয়াল স্তরে ৷ সত্তরের হলুদ বই, যেখানে ছদ্ম-ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হত, সেখানেও আসলে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক, বিষমকামী, সন্তানউৎপাদনের তাগিদে উদ্দেশ্যমুখী যৌনতাকেই একমাত্রিকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হত, গ্লোরিফাই করা হতো মিলনের প্রধান উদ্দেশ্য প্রজনন—এই ধারণাকেই ৷ পূর্বোক্ত নভেম্বর ১৯৭২ সংখ্যার ‘রূপোলী প্রজাপতি’র প্রশ্নোত্তর বিভাগ সরাসরি সমকামিতাকে, বিশেষত নারী সমকামিতাকে ‘ক্ষয়িষ্ণু অসুখই শুধু নয় ভয়ানক পরিণতিও বটে’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং নিদান দেয়:

নারীত্ব যার মধ্যে যত বেশি পরিপুষ্ট হবে, মাতৃত্ব তার মধ্যে তত বেশি তাগিদ জাগাবে ৷ যে নারী আপন স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক শুনতে পেল না, তার জন্ম ও জীবন অভিশপ্ত…নারীত্বের বিন্দুমাত্রও যদি কোন বিলাসিনী বহুচারিনীর থাকে তাহলে যৌবন শেষে সেও চোখের জলের সঙ্গে এই সত্য মনে অনুভব করবে ৷

বিগত তিনদশকের বাংলা পর্নোগ্রাফি হয়তো ভাষাবৈচিত্র, বিবিধ অসম ও নিষিদ্ধ সম্পর্ক, মিলনমুদ্রা, ধর্ষ-মর্ষকামী বর্ণনার নিরিখে অনেক বেশি অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনার দিকে সরে এসেছে, কিন্তু তার অন্তর্গত কাঠামোর দিক থেকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ ও কণ্ঠস্বর একচুলও বদলায়নি ৷ আশি-নব্বই-শূন্য ও প্রথম দশকের পর্নোবইতে নারী যেভাবে উপস্থাপিত হয়, তাকে হয়তো এভাবেই সূত্রাকারে সাজানো যেতে পারে:

১. বয়স, শিক্ষা, অবস্থান, সামাজিক সম্পর্ক, রুচিবোধের স্তর নিরপেক্ষভাবে মেয়েরা সকলেই ‘বেশ্যা’ ৷ তাদের ভূমিকা অবমানবের, যৌনবস্তু বা পণ্য হয়ে ওঠাই তাদের একমাত্র ভবিতব্য ৷ মেয়েরা সকলেই কমবেশি সহজলভ্য, তাদের অনায়াসেই শারীরিকভাবে পাওয়া যায় ৷

২. মেয়েরা ধর্ষণে যৌনতৃপ্তি পায় ৷ তারা যৌন হিংস্রতা ও আগ্রাসন উপভোগ করে ৷ যৌনক্রিয়ার মুহূর্তে ভাষাগত সন্ত্রাস পছন্দ করে তারা ৷ তাদের কোনো সাবজেক্টিভিটি নেই, তারা সর্বদাই অবজেক্ট ৷

৩. কোনো স্বতশ্চল অটোনমি নেই বলেই মেয়েদের কোনো পূর্ণাঙ্গ সত্তাও নেই ৷ তারা কতকগুলো বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন যৌন অঙ্গের সমষ্টিমাত্র ৷ পর্নোগ্রাফিক বর্ণনায় বারবার ওই টুকরো যৌনাঙ্গগুলিই হাইলাইটেড হয় ৷

৪. কেবnল পুরুষ নয়, বিভিন্ন নিষ্প্রাণ বস্তু, এমনকি পশুমৈথুনও মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক ৷ মেয়েদের শরীরে অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে সকলেরই ৷

যে ‘অবজেক্টিফিকেশন’ প্রক্রিয়ায় মেয়েরা অবনমিত হয়, সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু পর্নোগল্পে পুরুষকেও একইভাবে মেয়েদের দ্বারা ভোগ্যবস্তুতে পরিণত হতে দেখা যায় ৷ কিন্তু এর ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য আদৌ উল্টে যাচ্ছে না, বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আধিপত্যের প্রয়োগগত পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রটি একই থাকছে ৷ এ ক্ষেত্রে খোদ যৌনক্রিয়াটিই ‘অবজেক্টিফায়েড’ হয়ে পড়ছে ৷ ‘নূতন জীবন’, শারদীয় ২০০৬ সংকলনের একটি গল্প ‘বৃষ্টি ঝরা রাতে’—গল্পটি বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিস্ফুট হবে ৷ অনাথ কর্মসূত্রে স্ত্রীকে ছেড়ে অনেক দূরে থাকে, অফিস কোয়ার্টারে ৷ পলাশ অনাথের সহকর্মী ৷ পলাশের ফ্ল্যাটে রয়েছে ইংরেজির অধ্যাপিকা স্ত্রী সায়নী কলেজছাত্রী বোন দীপাও ৷ অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত কারণে পলাশ যৌনক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ৷ অনাথের সতীসাবিত্রী স্ত্রী আবার যৌনক্রিয়ায় পরাঙ্মুখ, সে অনাথের অপরিসীম লিবিডো সামলাতে পারে না ৷ তাই অনাথও ভিতরে ভিতরে অতৃপ্ত ৷ এক বৃষ্টি-ঝরা রাতে পলাশের বাড়িতে রাত কাটায় অনাথ ৷ পলাশের উদ্যোগে ও উৎসাহে সায়নী অনাথকে সিডিউস করে ৷ ক্রমে অনাথ-সায়নী শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ৷ সায়নীর ইচ্ছানুযায়ী দীপাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়, এই দুই নারী-এক পুরুষের রতি উৎসব দেখে পলাশের যৌনক্ষমতা ফিরে আসে. সে এবার নতুন উদ্যমে মিলিত হয়, কেবল স্ত্রী সায়নীর সঙ্গেই নয়, বোন দীপাকেও ভোগ করে সে, এমনি সায়নী তার কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে আসে স্বামীর বাসনা চরিতার্থ করার জন্য, বিনিময়ে পলাশ সায়নী-অনাথের সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে ৷ গল্পটিতে প্রথমেই যা লক্ষণীয়, তা হল দুধরনের নারীচরিত্রের মডেল তৈরি: একদিকে অযৌন সতীসাধ্বী অনাথের স্ত্রী, অন্যদিকে যৌনতাসর্বস্ব পলাশের স্ত্রী ও বোন, ওই দুই বৈপরীত্যের বাইরে নারীর অন্য কোনো সত্তা থাকা যেন অসম্ভব ৷ স্বামী পলাশ ও পরপুরুষ অনাথের ভিতর অনাথ সায়নীর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য, কারণ পুরুষের ‘পৌরুষ’ পরিমাপের একমাত্র মাপকাঠি তার যৌনদক্ষতা ৷ সর্বোপরি অধ্যাপিকা সায়নী বা কলেজছাত্রী দীপা—যে কেউই তাদের শিক্ষা, মেধা, কর্মক্ষেত্রের সাফল্যকে সরিয়ে রেখে একমাত্রিকভাবে ভোগ্যবস্তু হিসেবেই চিহ্নিত হতে চায়, তাদের অন্য কোনো পরিচয় নেই ৷ সত্তর শতাংশ পর্নোগ্রাফির মতই এখানেও পরিবারের সদস্যদের ভিতর যৌনসম্পর্ক চিত্রিত ৷ এভাবে ‘ফ্যামিলি’ যখন ‘ডি-ফ্যামিলিয়ারাইজড’ হয়ে ওঠে, তখন প্রমাণিত হয়, পরিবারের ‘প্রাইভেট’ ক্ষেত্রটিতেও পুরুষই কর্তা, পারিবারিক মেয়েরাও অনায়াসলভ্য, এমনকি তাদের হাতবদল করার মধ্যেও কোনো অস্বাভাবিকতা বা অনৈতিকতা নেই ৷ অনাথ তাকে তৃপ্ত করার পর বাধ্য স্ত্রীর মতই অনাথের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সায়নী, বলে ‘আজ থেকে তুমিই আমার স্বামী’, পূর্বোক্ত ‘আমি ও সেরেনা’ গল্পেও সেরেনা উইলিয়ামস তনুময়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল—পুরুষ আধিপত্যের চেনা ‘থাকবন্দ’ এভাবেই অটুট থেকেছিল সেখানেও ৷ অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তি-পরিবার-অবস্থানের চেনা সীমান্ত লঙঘনের ভান করলেও বাংলা পর্নোগ্রাফি আদৌ কোনো সীমানা লঙঘনই করে না ৷ পুরুষতন্ত্রের চেনা আধিপত্য-ক্ষমতার ছকেই কথা বলে সে, এই বিশ্বায়ন-নারীর ক্ষমতায়ন-ব্যক্তি অধিকারের সাম্প্রতিক কোনো দাবিদাওয়াই আজও স্পর্শ করেনি তাকে ৷ অবশ্য আজ নয়া উপনিবেশবাদের হাত ধরে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যখন নব্য ক্রীতদাসে পরিণত হতে চলেছে, তখন বিদেশি পর্নোও মূলত এই ক্ষমতা আধিপত্যের ছকের বাইরে যেতে পারে না ৷ আশি-নব্বইয়ের দশকে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত একটি বহুলপ্রচারিত পর্নোম্যাগাজিন ‘হিউম্যান ডাইজেস্ট’ কলকাতার প্রায় সব পর্নোঠেক-এ পাওয়া যেত ৷ এই পত্রিকার ১৯৮৮ সালের একটি সংখ্যায় পৃষ্ঠাজোড়া ‘কাস্তে-হাতুড়ি-তারা’র ছবি ছাপা হয়েছিল ৷ নীচে লেখা ছিল ‘Beawre of Communists’; যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল সবধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিশেষত যৌন মুক্তির সবচেয়ে বড়ো শত্রু এই পৃথিবীর ‘কমিউনিস্ট’ নামধারী প্রাণীরা ৷ পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ভেঙে যাবার মুহূর্তে আমেরিকান পর্নোর এই রাজনৈতিক ক্যাম্পেন আধিপত্যবাদের এক নতুন সমীকরণকে বৈধতা দেয় ৷ অথবা অতি সম্প্রতি একটি পর্নোসাইটের (arabianstreethookers.com) সেই মারাত্মক দৃশ্যটি হয়তো কারও কারও চোখে পড়েছে ৷ খোদ ইরাকের একটি মেয়েকে বলপূর্বক ধর্ষণের পর উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মার্কিন সেনা মেয়েটিকে হুকুম করছে ‘Say, america is good’ ৷ অবনত, হৃতসম্মান, ধ্বস্ত মেয়েটি উচ্চারণ করে ‘america is good’ ৷ পর্নোগ্রাফি কেবল ‘প্লেজার’ উৎপাদনই করে না, ব্যক্তি ও সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতা-আধিপত্য লিঙ্গরাজনীতির জটিলতাও এর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় ৷

‘হলুদ বই’ কোন পথে?

এই লেখায় যৌনক্রিয়া, যৌনতা—কোনো শব্দকেই পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি, তাদের সাধারণ অর্থেই এরা ব্যবহৃত ৷ ২০১৮ সালে বাংলা ‘হলুদ বই’য়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে একধরনের বিশেষ পাঠকগোষ্ঠীর জন্য এই জাতীয় বই-এর সাপ্লাই বন্ধ হবে না ৷ বছরের শুরুতেই শারদীয় ২০১৭ বা ২০১৮ ছাপমারা বেশ কিছু টাইটেল বাজারে এসে গিয়েছে ৷ পাশাপাশি দামি কাগজে রংচঙে প্রচ্ছদে ‘প্যাশন’, ‘হট মিরর’ জাতীয় পত্রিকাও নিয়মিত বেরোচ্ছে ৷ এই পত্রিকাগুলো ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ছবিতে ভরপুর, বেশ কিছুটা সাম্প্রতিকতার ছাপবহনকারী, এতদসত্বেও ‘হলুদ বই’য়ের ভবিষ্যৎ খুব একটা আশাপ্রদ নয় ৷ পাঠ-অভ্যাসের মধ্য দিয়ে ফ্যান্টাসি আস্বাদনের চাহিদা যাদের আছে, সেই ক্রমশ কমতে থাকা উপভোক্তাগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে এর চলাচল ৷ পুরোনো ‘ডেবনিয়র’কে পাশ কাটিয়ে নব্বইয়ের শুরু থেকে যে ইংরেজি ইরোটিক ম্যাগাজিনগুলো বেরোতে শুরু করেছিল, যেমন ‘ফ্যান্টাসি’ বা ‘চেস্টিটি’—আজ বাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে ৷ প্রশাসনিক সেন্সরের কোপে ‘ডেবনিয়ার’ এবং ‘ফ্যান্টাসি’ আজ নিতান্তই নিরামিষ পত্রিকা ৷ ২০০০ সাল থেকে ইংরেজি ইরোটিক প্রকাশনায় ঝড় তুলেছিল দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘প্যাশন’ পত্রিকাটি, যেটি পরে ‘মেনজ ক্লাব’ নামে বেরোতে শুরু করে ৷ পুলিশি তৎপরতায় ২০০৬-এর পর থেকেই মেনজ ক্লাব এবং সহোদর প্রকাশন ‘মারমেড’-এর প্রকাশ্য বিক্রি কলকাতায় বন্ধ হয়ে যায় ৷ যদিও দিল্লি, বম্বে বা ব্যাঙ্গালোর-এ এগুলি তারপরেও চলেছে ৷ কিন্তু সীমিত ক্রেতাগোষ্ঠীর ভিতরে দুঃস্থ কুটিরশিল্পের মতোই বাংলা পর্নোর সার্কুলেশন বন্ধ হয়নি ৷ এই অবস্থায় তিনটি সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতে পারে ৷

দৃশ্যমাধ্যমের আকর্ষণ ও ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি সৃষ্টির ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের পাশাপাশি ‘হলুদ বই’য়ের অদক্ষ, পুওর কোয়্যালিটির ফ্যান্টাসি উৎপাদন পিছু হটতে বাধ্য ৷ এ কথা ধরেই নেওয়া যায় পকেট পারমিট করলে ‘হলুদ বই’য়ের পাঠকগোষ্ঠীর সিংহভাগই এই নতুন দৃশ্যসুখে মজে যাবেন ৷ সেই উনিশ শতক থেকেই কলকাতায় ইউরোপীয় যৌনতার একটি ক্রমবর্ধমান বাজার রয়েছে ৷ মেমসাহেবের ছবি, ইংরেজি ইরোটিকা, পর্নোপত্রিকা হয়ে আজকের থ্রি. এক্স ডি.ভি.ডি. এবং মোবাইল সেক্স সেই বাজারের চাহিদা জোগান দিচ্ছে ৷ পাশাপাশি বাজারে রমরম করে চলছে বাংলা, হিন্দি, দক্ষিণী, থ্রি.এক্স সি.ডি, যদিও এর মান বিদেশি প্রোডাক্টের ধারে কাছে যায় না, তবু বাংলা ‘হলুদ বই’য়ের পাঠক দেওর-বৌদি, কিশোরী-গৃহশিক্ষকের শরীরী কেচ্ছাকে এর ভিতর দিয়েই দৃশ্যগতভাবে ফ্যান্টাসাইজ করতে পারবে—সাম্প্রতিক ‘নলবন কেলেঙ্কারি’ বা ‘গরম বৌদি’ জাতীয় বাংলা ভিডিও পর্নোর বিপুল জনপ্রিয়তাই এর প্রমাণ ৷

গ্লোবালাইজড যৌনতার নিত্যনতুন পর্নোপ্রোডাক্টের সঙ্গে পাল্লা দেবার উপযোগী বড়ো অঙ্কের পুঁজি যদি বাংলা পর্নোয় লগ্নি হয়, যদি ইতিমধ্যেই নতুন সামাজিক বাস্তবতা ও চাহিদার যে বদল ঘটে গেছে, সেই পরিবর্তনসমূহকে আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ নতুন চেহারায় বাংলা ‘হলুদ বই’ ছাপানো যায়, আবছা, প্রায়-আউট-অফ ফোকাস ছবির মতো কিছু কিম্ভূত ফোটোগ্রাফের বদলে যদি ঝকঝকে ছবির ব্যবহার করা যায়, যদি বদল আনা যায় ন্যারেটিভের কৌশলে, ঘটনাসংস্থান, উপাদানগত বৈচিত্রে, তবে হয়তো এর ক্রমক্ষীয়মান পাঠকগোষ্ঠীকে সাম্প্রসারিত করা যেতে পারে, বেশ কিছু নতুন পাঠকগোষ্ঠীকেও তা আকৃষ্ট করবে ৷ নতুন আঙ্গিকে বাজারজাত হবে বাংলা ‘হলুদ বই’ ৷

আর একটি তৃতীয় সম্ভাবনার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে ৷ বিগত তিন-চারদশকে ইউরোপ-আমেরিকায় পর্নোগ্রাফি নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে ৷ বিশেষত নারীবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পর্নোগ্রাফির নারী অবমাননাকারী চরিত্রটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত হয়েছে ৷ ১৯৮৩ সালে ক্যাথরিন ম্যাকিনন-আন্দ্রেয়া ডোর্কিন প্রণীত পর্নোগ্রাফি-বিরোধী আইনের খসড়া আমেরিকার একাধিক সিটি কাউন্সিল গ্রহণ করলেও শেষ অব্দি মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে তা বাতিল হয়ে যায় ৷ ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্কে গড়ে ওঠে ‘উইমেন এগেনস্ট পর্নোগ্রাফি’ বা ‘ওয়াপ’ ৷ কিন্তু রাষ্ট্রিক সেন্সরব্যবস্থা এই আন্দোলনগুলোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে দমনমূলক হয়ে উঠতে পারে—এই আশঙ্কা তৈরি হয় ৷ নারীবাদীদেরই একটি বিরাট অংশ পর্নোগ্রাফিকেই যৌনমুক্তির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন ৷ এইসব বিতর্ক ছাপিয়ে আজ রাজনৈতিকভাবে সঠিক পর্নোগ্রাফি লেখা বা তৈরি করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে ৷ এমন পর্নোগ্রাফি, যেখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ও দৃষ্টির অবসান ঘটবে, নারীর নিজস্ব সুখবোধ, নিজস্ব ফ্যান্টাসি, পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া কোডগুলি অতিক্রম করে বিকশিত হবার সুযোগ পাবে—এর মধ্য দিয়েই অলটারনেটিভ পর্নোর জন্ম হবে, এই চেষ্টা পাশ্চাত্যে চলছে ৷ এই বিষয়গুলি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিসরেও নতুন নতুন লড়াইয়ের জন্ম দিচ্ছে, নতুন নতুন প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে আমাদের ৷ বাংলা ‘হলুদ বই’ কি যোগ্য লেখক-লেখিকার হাতে এই র্যাডিক্যাল পর্নোগ্রাফির সম্ভাবনার দরজায় ধাক্কা দেবে একদিন? এতদিন ধরে চলে আসা পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত প্রথাগত ভাবনাচিন্তা অতিক্রম করে কোনো তৃতীয় ধারার ‘হলুদ বই’ কি লেখা হবে? যতই সীমিত সংখ্যক হোক সেই বিকল্প পর্নোর উপভোক্তা লেখক-পাঠক-বিক্রেতাগোষ্ঠী কি কোনোদিন গড়ে উঠবে বাংলায়? হয়তো এই ভাবনা সম্ভাব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে, তবু সামাজিক জীবনের বিভিন্ন স্তরে আজ যখন লিঙ্গসাম্য, যৌন সমানাধিকার, সমকামিতার স্বীকৃতি-সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচিত হচ্ছে, সেই বদলে-যাওয়া প্রেক্ষিত যদি বাংলা ‘হলুদ বই’কেও স্পর্শ করে, তবে ভিন্ন অভিজ্ঞতার দিগন্ত খুলে যেতে পারে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *