২. বটতলার ‘আদিরসাত্মক’ বই

বটতলার ‘আদিরসাত্মক’ বই

‘আদিরস কাব্য দেখিতে না পাই’

‘সমাচারচন্দ্রিকা’র ডাকসাইটে সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তথাকথিত ‘রক্ষণশীল’দের সংগঠন ‘ধর্মসভা’র কর্তাব্যক্তিও তিনিই ৷ নববাবুবিলাস বেরোনোর পর, ১৮২৫ সালেই প্রকাশিত হল তাঁর আর একটি বই— দূতীবিলাস ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের ঢঙে লেখা একটি পদ্য ন্যারেটিভ, যেখানে বৈষ্ণবপদাবলী, সুফি কিসসাসাহিত্য, এমনকী বিদ্যাসুন্দর-এর দূতীপ্রকরণকেই যেন আনকোরা নতুন ছাঁচে ঢেলে, নতুন যুগের উপযোগী করে পরিবেশন করলেন ভবানীচরণ, বিদ্যাসুন্দরের হীরা মালিনীর ধাঁচেই এখানেও নব্যযুবকের অভিসার-বাসনা পূরণ করতে এগিয়ে এল মালিনী, নাপিতিনী, উড়েনী, নেড়ী এবং ‘সহবাসিনী দাসীরূপা’ দূতী—‘প্রবলা হইয়া’ যারা ‘নব্যে করে বশ/কত স্থানে কত মতে করে কত রস’ ৷ খানিকটা মঙ্গলকাব্যেরই ধরনে এই বইয়ের সূচনায় গ্রন্থরচনার উদ্দেশ্যও স্পষ্ট করলেন তিনি ৷ যে সময়ে এই বই বেরোচ্ছে, ততদিনে বাংলা ছাপা বইয়ের বাজার বেশ কিছুটা গড়ে উঠেছে, হরেক কিসিমের ছাপা বইয়ের মধ্য দিয়ে একটু-একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বাংলা মুদ্রণসংস্কৃতির আদি রূপ ৷ কিন্তু ভবানীচরণ খেদ প্রকাশ করেছেন এইভাবে :

মুদ্রাক্ষরে বহু গ্রন্থ প্রকাশ হইল ৷

কিন্তু আদিরস কাব্য দেখিতে না পাই ৷ ৷

যা দেখি ভারতকৃত নব্য কিছু নাই ৷

এখন কতক নব্য নায়ক মজিয়া ৷ ৷

করে কত রস নানা নায়ক লইয়া ৷

সে রস বর্ণিলে ভাল গ্রন্থ এক হয় ৷

তাহারা কুকর্ম্ম ত্যজে ইথে সুখোদয় ৷ ৷

অর্থাৎ ‘প্রকরণ হিসেবে এক নতুন ধারার টেক্সট-এর জন্ম দিতে চাইছেন ভবানীচরণ—‘আদিরসাত্মক’ বই ৷ এবং এক্ষেত্রে প্রাক-ঔপনিবেশিক আদিরসাত্মক সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় এক স্পষ্ট ‘ছেদ’কে চিহ্নিত করতে চাইছেন তিনি ৷ আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেখা ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর-ই যে তখনও পর্যন্ত পাঠকের কাছে বাংলা কামসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী নিদর্শন হিসেবে গ্রহণযোগ্য, এই উক্তি তারই স্বীকৃতি ৷ তাহলে ভবানীচরণ কোথায় আলাদা হতে চাইছেন? স্পষ্টতই, তাঁর উদ্দেশ্য প্রচলিত কামসাহিত্যের এই মান্য আদিরূপটিকে স্বীকার করে নিয়েও তাকে অতিক্রম করে যাওয়া ৷ ভারতচন্দ্রের কাব্যের নায়ক আর তাঁর কাহিনির নায়ক এক নয় ৷ ভারতচন্দ্রের পাঠক আর তাঁর কাব্যের পাঠকও আলাদা ৷ তাঁর সমকালের নব্যনায়কদের চাহিদা ও পাঠরুচি গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক নগর কলকাতার পরিবর্তিত সাংস্কৃতিক পটভূমি ও আবহের পরিপ্রেক্ষিতে ৷ ভারতচন্দ্রের কাব্যের রসাভিব্যক্তির সঙ্গে দূতীবিলাস-এর পার্থক্যও স্পষ্ট এবং এই তফাতের একটি প্রধান কারণ ভিন্ন উপস্থাপনার পদ্ধতি ও প্রকাশশৈলী ৷ ভবানীচরণের উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে দূতীবিলাস-জাতীয় বইয়ের নতুন খরিদ্দার শ্রেণি কারা—তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে ৷ সর্বোপরি, ভবানীচরণ নিজেই বলছেন তাঁর রচনার উদ্দেশ্য বিপথগামী নব্য যুবকদের মনে সুমতি ফিরিয়ে আনা ৷ অর্থাৎ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে একধরনের নৈতিক দায়ও পালিত হচ্ছে ৷ ভবানীচরণের অগ্রণী সামাজিক অবস্থান এই দায়বোধের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে চলেছে ৷ তবে এই নৈতিক উপসংহারের সংযোজনা অনেকাংশেই বাজারচলতি ন্যারেটিভে প্রচলিত, ‘কৃতকর্মের প্রত্যাশিত ফল’ জাতীয় কৌশল—এমনটাও হতেই পারে ৷ ভবানীচরণ পাঠক মনোরঞ্জনের উপযোগী, সমকালীন সামাজিক চরিত্রগুলির উপর খানিকটা রং চড়িয়ে, একটা জমজমাট গপ্পো ফাঁদতে চেয়েছেন ৷ লোকপ্রিয়তার অতিচেনা সূত্র হিসেবে সুপরিচিত সরল পয়ারের ছাঁদে সাজিয়েছেন গল্পটিকে—এটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৷

লক্ষণীয়, প্রকরণ হিসেবে ভবানীচরণ তাঁর লেখাটিকে বলছেন ‘আদিরসাত্মক’ ৷ কিন্তু তিনি এই প্রকণটির উপর কোনো পৃথক ‘মূল্যমান’ আরোপ করছেন না ৷ অর্থাৎ লেখাটির শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে তিনি আদৌ মাথা ঘামাতে রাজি নন ৷ অথচ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই দূতীবিলাস-জাতীয়, দেশীয় প্রেস থেকে ছাপা অসংখ্য বইপত্র (যেগুলিকে এক অর্থে, খুব স্থ²লভাবে ‘কামসাহিত্য’ বলা যায়) ক্রমশই ‘অশ্লীল’ হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করবে ৷ ঔপনিবেশিক প্রশাসন যেমন এইসব বইপত্রের ভিতর দেশীয় নেটিভ জনসমাজের অপকৃষ্ট রুচি, অজ্ঞতা ও পশ্চাৎপদ মানসিকতার হদিশ পাবেন এবং ঔপনিবেশিক নজরদারি ও দমন-নিয়ন্ত্রণের ‘ক্ষেত্র’ হিসেবে বেছে নেবেন এই বইগুলিকে, যাতে তথাকথিত অন-আলোকিত প্রাচ্যের অধিবাসীদের উপর তাঁদের ‘সিভিলাইজিং মিশনের’ প্রকল্পটি বৈধতা পায় ৷ তেমনি দেশীয় জনসমাজের একটি প্রভাবশালী ইংরেজিশিক্ষিত অংশও এই তথাকথিত অশ্লীলতা-বিরোধী অভিযানে শামিল হবেন ৷ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকের লাগাতার প্রয়াস এবং দেশীয় উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপ এভাবেই এক বিন্দুতে এসে মিলিত হবে ৷ দেশীয় সমাজের নিজস্ব উপাদানগুলিকে এক নতুন ধরনের ডিসিপ্লিনের আওতায় নিয়ে আসার এই প্রক্রিয়াটিকে কেবল বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখাটা ভুল, বরং দেশীয় সমাজের প্রভাবশালী অংশ কীভাবে ওই ডিসিপ্লিনকে আত্মস্থ করছে এবং নিজেকে স্বেচ্ছায় তার অঙ্গীভূত করছে—এটাই দেখবার ৷ দেশীয় মুদ্রণ-সংস্কৃতির উপর ঔপনিবেশিক নজরদারির রাজনৈতিক চেহারা পরিস্ফূট হয় পাদরি জেমস লঙ-এর ক্যাটালগগুলি খুঁটিয়ে পড়লে ৷ ১৮৫২ সালে লঙ তাঁর প্রথম বাংলা বইয়ের পঞ্জি বা তালিকাটি প্রকাশ করেন নিছক আকাডেমিক উদ্দেশ্যেই ৷ এই তালিকায় সর্বপ্রথম বাংলা ছাপা বইয়ের সচেতন বর্গীকরণ প্রক্রিয়াটি সূচিত হয় ৷ এই বর্ণীকরণ প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই প্রথম জনসমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের টেক্সটকে একধরনের আঁটোসাঁটো শ্রেণিবদ্ধকরণের আওতায় নিয়ে এসে তাদের উপর বিশেষ ধরনের মূল্যমান আরোপের প্রক্রিয়াটি সূচিত হল ৷ কিন্তু যেসব বইগুলিকে লঙ তাঁর এই তালিকায় নিছক কাহিনি (tales), নীতিকাহিনি (moral tales), ঐতিহাসিক কাহিনি (history), কাহিনিগদ্য (fiction) বা কবিতা (poetry) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যেমন আদিরস, বেশ্যারহস্য, কুঞ্জরিবিলাস, প্রেমবিলাস, রসমঞ্জরি, প্রেমরহস্য, প্রেমতরঙ্গ, প্রেম নাটক, রসতরঙ্গিনী—সেগুলিকেই তাঁর পরবর্তী অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত তালিকা Descriptive Catalogue of Bengali Works-এ (১৮৫৫) ‘erotic’-নামক একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্যাটেগরির ভিতর সারণিবদ্ধ করলেন তিনি ৷ এই অবস্থান পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক ৷ এপ্রিল, ১৮৫৩ এবং মার্চ, ১৮৫৪ সালে কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেটকে লেখা চিঠিতে লঙ দেশীয় প্রকাশনার উপর ঔপনিবেশিক নজরদারির কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন ৷ এই নজরদারির প্রয়োজনীয়তা, তাঁর ভাষায় : ‘effective measures being taken to create a healthy literary taste among the people by a sound vernacular education.’ ৷ ১৮৫৫ সালের বিস্তৃত ক্যাটালগটির ভূমিকাতেও তিনি এই মত পোষণ করছেন : ‘Popular literature is an index to the state of the popular mind’ ৷ ১৮৫২-র তালিকার বেশ কিছু বই, যেমন হেমলতা রতিকান্ত, কামশাস্ত্র ১৮২০, লক্ষ্মীজনার্দনবিলাস, শৃঙ্গারতিলক ১৮৫৭, সম্ভোগরত্নাকর (১৬টি চিত্র সংবলিত), রতিশাস্ত্র, স্ত্রীচরিত্র প্রভৃতিকে সরাসরি আক্রমণ করা হল ১৮৫৫-র তালিকায় ৷ ঔপনিবেশিক উদ্যোগে লঙ-এর অংশগ্রহণ আরও স্পষ্ট হয় ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর তৃতীয় ক্যাটালগটিতে ৷ খুব স্পষ্টভাবেই ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে এখানে এবং নেটিভের বিদ্রোহী চৈতন্যের সঙ্গে এক ধরনের তথাকথিত ‘অশ্লীল’ সাহিত্যিক অভিব্যক্তিকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ বলা হয়েছে এই বইগুলি ‘so radically corrupt that it ought to be abolished’ ৷ যদিও এই সময়কালেই প্রকাশিত অপর একটি বাংলা বইয়ের সরকারি তালিকায় (Book and Pamphlets Published in the Town of Calcutta in 1853-54) রসমঞ্জরি বইটিকে ‘Erotic Poems’-এর গোত্রভুক্ত করা হলেও রসরাজ এবং রসতরঙ্গিনীকে বলা হয়েছে tale : ১৮৫৯-এর তালিকায় লঙ এধরনের বইয়ের দেশীয় পাঠকমণ্ডলীকেও একহাত নিতে ছাড়েননি—’if it is left in the hands of ill-designing ignorant men, it will be the source of much evil’ ৷ তবে একইসঙ্গে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন এই বলে যে আধুনিক শিক্ষার প্রসার এবং ঔপনিবিশিক নিয়ন্ত্রণের চাপে এধরনের বইপত্রের প্রকাশ্য বেচাকেনা ক্রমশ কমে আসছে ৷ যে বিদ্যাসুন্দর ১৮৫৫-র ক্যাটালগে ছিল mostly popular tale in Bengali…but is disfigured in some places by licentious allusions’. সেই বিদ্যাসুন্দর-ই ১৮৫৯-এর তালিকায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘cleverly written but indecent amatory tale’ ৷ ইতিমধ্যে ১৮৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি জারি হয়েছে প্রথম ‘অশ্লীলতা আইন’ ৷ এই আইন মোতাবেক আদিরসাত্মক বইপত্রের লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতাদের অল্পবিস্তর ধরপাকড়ও শুরু হয়েছে ৷ ‘অশ্লীলতা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং অশ্লীলতা আইনের সুফল বোঝানের তাগিদে ১৮৫৯ সালের তালিকায় লঙ মন্তব্য করছেন :

By erotic is meant books abounding in obscene passages…but with the introduction of a better class of works…the number of these is diminishing and the terror of law against obscence publications is effecting. What a regard to morality could not… We knew that of one most hideously obscene book with its 20 most filthy pictures, 30000 copies were sold in twelve months. But such books are now sold on the sly and are not obtruded on the public gaze as before.

কেবল ঔপনিবেশিক প্রশাসনই নয়, অশ্লীলতা আইনের সমর্থনে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন দেশীয় সমাজের বিশিষ্টজনেরাও ৷ ‘আদিরসাত্মক’ বইগুলিকে এভাবে ‘অশ্লীল’ হিসেবে চিহ্নিতকরণের জটিল প্রক্রিয়াটিতে তাঁদের ভূমিকাও খুব একটা কম ছিল না ৷

‘ভাষা’ এমন একটি মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে সামাজিক আধিপত্য, ক্ষমতাপ্রয়োগ, বিবিধ সামাজিক স্তর-পরম্পরার অভ্যন্তরীণ ‘ক্ষমতা’-র টানাপোড়েন কাজ করতে থাকে ৷ উনিশ শতকের গোড়ায় বাংলা ছাপা বইয়ের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই মুদ্রিত বইয়ের বিষয়বস্তু এবং তার প্রকাশভঙ্গি, পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনরুচির সঙ্গে মুদ্রিত অক্ষরের যোগাযোগ—সবই ধারাবাহিক বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে ৷ ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবী এবং দেশীয় উচ্চবর্গের যৌথ উদ্যোগে বাংলা লিখিত ভাষার সজ্ঞান সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়াটি চলতে থাকার পাশাপাশি ১৮৫০-এর দশকের সময় থেকেই দেশীয় ভদ্রলোকের বটতলার সাহিত্যবিরোধী অভিযান চলতে থাকে ৷ লিখিত ভাষার বিষয়বস্তু এবং চরিত্রের শিষ্টতা-অশিষ্টতা নির্ণয়ের এই প্রক্রিয়াটি আঠারো শতকের শেষার্ধের ইংল্যান্ডেও একইভাবে দেখা গেছে ৷ সম্যামুয়েল জনসন তাঁর Dictionary-তে (১৭৫৫) ‘illiterate’ শব্দটির অর্থ নির্ণয় করেছেন : যারা গ্রিক ও লাতিন ভাষায় অজ্ঞ, পাশাপাশি শব্দটির অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত করেছেন ‘colloquial Licentiousness’ এবং ‘sexual immorlality’-র মতো বিষয়কেও ৷ তথাকথিত বটতলার বই বাংলা ভাষার কথ্য আঁকাড়া মেজাজটিকে তুলে ধরছিল, যে ভাষায় দৈনন্দিন জীবনে মানুষ কথা বলে, তাঁর ঠাট্টা-বটকেরা, অমার্জিত স্থ²ল রসিকতা, যৌন অনুষঙ্গ—সবই ছোটো-বড়ো ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত সস্তা, চটি বইগুলির মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কপি ছাপা হয়ে পৌঁছে যেত শহর-মফসসলের বিভিন্ন স্তরের পাঠকগোষ্ঠীর কাছে, যা দেশীয় উচ্চবর্গীয় তথাকথিত ‘শিষ্ট’ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকদের সামাজিক শ্রেণিক্রমের চোখে বিপজ্জনক রূপে প্রতিভাত হয়েছিল ৷ উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ‘আদিরসাত্মক’ বইপত্রের ভাষাকে ক্রমাগত অশালীনতার অভিযোগে বিদ্ধ করার পিছনেও ওই একই আতঙ্ক কাজ করেছে ৷ ভাষা এবং সংস্কৃতির যে সচেতন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন প্রক্রিয়াটি সেদিন এলিটের অভীষ্ট ছিল, সেই কর্তৃত্বের ধারণাটিকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল এইসব বইপত্র ৷ শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত নতুন মূল্যবোধটিও এর পিছনে কাজ করছিল ৷ দেশজ ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতা এবং ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ যুগপৎ মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল ভাষা-র ভিতর থেকে আদিরসাত্মক অনুষঙ্গ, শরীরী উল্লেখ বর্জন করার এই ক্ষমতা-প্রক্রিয়া ৷ স্পষ্টতই বটতলার আদিরসাত্মক বই ছিল সেই ক্ষমতাকাঠামোর প্রতি এক ধরনের অন্তর্ঘাত ৷

কারা ছিল এইসব বইপত্রের পাঠক? পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিকতা-বাহিত সংস্কৃতি উনিশ শতকের বাংলায় যে প্রক্রিয়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছিল তাকে এককথায় derivative discourse বলা যায় না, কারণ তা কখনোই পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ৷ বাংলার দেশীয় সমাজের এক বিরাট অংশই ওই অচেনা জ্ঞান-যুক্তি-এনলাইটেনমেন্টের আওতার বাইরে রয়ে গেছে ৷ পাশ্চ্যত্য ও দেশীয় ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের আলোকায়ন-প্রয়াস দেশীয় জনসমাজের যে ক্ষেত্রটিতে প্রবেশ করেছিল, তা কোনোভাবেই ‘সাংস্কৃতিক শূন্যতা’ নয় ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভগুলি অনেকাংশেই প্রাক-মুদ্রণ যুগের হুবহু উপাদানসমেত বহাল তবিয়তে বজায় থেকেছে মুদ্রণ-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরেও ৷ বটতলার প্রকাশনা বাংলা মুদ্রিত অক্ষরের গণতন্ত্রীকরণ ঘটায় ৷ ফলত, বাংলার বৃহত্তর জনসমাজে সুপ্রচলিত কৌমসংস্কৃতিই এবার আকর্ষণীয় প্যাকেজে পরিবেশিত হল সস্তা বইপত্রের মধ্য দিয়ে ৷ আরবি-ফারসি কিসসা সাহিত্য, হিন্দু কামশাস্ত্র, দেবদেবীর উপাখ্যান, ভারতচন্দ্রের টেক্সট—এই সবকিছুই নতুন মোড়কে হাজির হল বৃহত্তর পাঠকের সামনে ৷ ‘আদিরসাত্মক’ বই হিসেবে যেগুলিকে চিহ্নিত করা হয়, তার সবকটিই প্রাক-ঔপনিবেশিক সামাজিক উপাদানের ধারাবাহিকতায় পুষ্ট ৷ এগুলি দীর্ঘকাল যাবৎ মৌখিক সংস্কৃতির আধারে পরিবেশিত হয়েছে, আজ সর্বজনীন শিক্ষা কিছুটা বাড়ায় সস্তা মুদ্রণের সহায়তায় এরা হয়তো কিছুটা বাজার পাচ্ছে ৷ কিন্তু এদের উপভোক্তা গোষ্ঠী এখনও সেই প্রাক-মুদ্রণ জনসমাজের সময়কালের—মুষ্টিমেয় ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির বইয়ের তাকে বাঁধানো ‘পরিশীলিত’ বইপত্রের মাঝে এদের ঠাঁই হয় না, অথচ শহর-গ্রামের অল্পশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষ, মেয়েমহলের পাঠকগোষ্টী, মুসলমান সম্প্রদায়—অর্থাৎ যারা বাঙালি পুরুষ ভদ্রলোক সংস্কৃতির চিহ্নিত ‘অপর’  তাদের কাছে এই তথাকথিত ‘আদিরসাত্মক’ বইপত্রের আকর্ষণ ছিল অপ্রতিরোধ্য ৷ কেবল এই প্রান্তিক মানুষজনই নয়, শিক্ষিত ভদ্রলোকশ্রেণিরও একটি বিরাট অংশ, যারা চাকরি বা অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ততটা হয়তো সফল নয়, যাদের সামাজিক ইতিহাসের ভাষায় lesser bhadralok বা petty bhadralok বলা হয়েছে, তাঁরাও ছিলেন এইসব বইয়ের সম্ভাব্য ক্রেতা ৷ এমনকি সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত ভদ্রলোকদের অনেকেই যে এইসব আদিরসাত্মক বইপত্র পড়তেন, এমনকি কখনো-কখনো নাম গোপন করে এগুলি লিখতেনও, তারও একাধিক প্রমাণ আছে ৷ এইভাবেই সামাজিক কর্তৃত্বের চোখে ধিক্কৃত বটতলার জনমনোরঞ্জনী এই সাহিত্যিক ধারা এক পৃথক এবং প্রতিস্পর্ধী সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের হদিশ দেয়, যেখানে লেখক-প্রকাশক-পাঠক—কারো একক ভূমিকার চেয়ে সমবেত সৃজনপ্রক্রিয়াটিই হয়ে ওঠে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ৷ একজন সাম্প্রতিক গবেষকের ভাষায় :

So intimately did collective expectations and traditions of audiences shape the context and content of the literary productions, it was impossible, in a sense, to really say who the author was—the writer, printer, seller, buyer or narrator… The existence of this nature of collective reception, and of the blend of individuality and impersonality in literary creation, make this literature a particularly revealing source for understanding popular conceptions of the social order.

তাই উনিশ শতকের প্রথমার্ধের আদিরসাত্মক টেক্সটগুলির ভিতর প্রবেশ করার আগে দু-একটি বিষয় উল্লেখ করে নেওয়া জরুরি ৷ এই বইগুলির পাঠকগোষ্ঠী জনসমাজের বিভিন্ন অংশ—যাদের পাঠাভ্যাস ও রসগ্রাহিত্যর বৈচিত্র নজর করার মতো এবং তাদের এই পাঠাভ্যাস মূলত প্রাক-ঔপনিবেশিক, প্রাক-মুদ্রণযুগের সাহিত্যিক ন্যারেটিভ পাঠের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা ৷ আদিরসাত্মক বইগুলির বিষয়বস্তুও মুখ্যত জনসমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত কাহিনি, ভাষা, কথনভঙ্গিমা, আদিরসাত্মক উপাদানের সমাহারে গঠিত ৷ ছাপা বইয়ের প্রচলন বাংলার সমাজে দৃঢ়মূল হবার পরও এমন অনেক পাঠকগোষ্ঠী রয়ে যায়, যারা পূর্বতন মৌখিক সাহিত্য এবং লিখিত সাহিত্য—দুয়েরই মাঝামাঝি স্তরে অবস্থান করছে; কুমকুম সাংগারি এই অল্পশিক্ষিত, ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্ম, নতুন পাঠাভ্যাসের সঙ্গে ততোটা মানিয়ে নিতে না-পারা অংশটিকে ‘intermediate orality’-র মানুষজন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৷ এই পাঠকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তেরা সমাজের একাধিক স্তরে ছড়িয়ে ছিলেন ৷ এঁদের কাছে ‘essential reading’ বা ‘responsible reading’-এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল উত্তেজনায় ভরপুর, চটজলদি পাঠ্যবস্তু ৷ এদের ভিতর যেমন ছিল সদ্যযুবক স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা, তেমনি বাঙালি পরিবারের অন্দরমহলের স্বল্পশিক্ষিত মেয়েদের কাছেও এই ধরনের বইপত্রের চাহিদা ছিল বিপুল ৷ তবে বটতলার এই বিশেষ ধারার জনপ্রিয় বইপত্রের একটি প্রধান ক্রেতা সম্প্রদায় ছিলেন উচ্চবর্গীয়, কেরানি বা অন্য ধরনের স্বল্প ইংরেজি জানা নিম্নমধ্যবিত্ত লোকজন ৷ এরা মূলত কলকাতা শহরের প্রথম প্রজন্মের বাসিন্দা ৷ চাকরিসূত্রে কলকাতায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকলেও এঁদের নাড়ির টান ছিল ‘দেশের বাড়ি’ অর্থাৎ গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি ৷ কাজ চালানোর মতো ইংরেজিশিক্ষা লাভ করলেও দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যেই তাঁরা স্বস্তিলাভ করতেন বেশি ৷ এঁদের কাছে পাশ্চাত্যধর্মী high literature-এর চেয়েও দেশজ মৌখিক ঐতিহ্যের সঙ্গে চলতে থাকা অমার্জিত ঠাট্টা, চালু প্রবচন, আদিরসাত্মক অনুষঙ্গের ব্যবহার, ছড়া-গান-রূপকথার উপাদান, একঘেয়ে নীতিকথায় ভরপুর চালু লোকপ্রিয় পাঠ্যবস্তুই ছিল অধিকতর পছন্দের ৷ এছাড়াও বাংলার জনসমাজের এক বিরাট অংশই ব্লুসলমান, সেই নিম্নবর্গীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে আদরণীয় মুসলমানি গদ্যে লেখা এক বিপুল সস্তা, জনপ্রিয় সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, নিম্নবর্গীয় হিন্দুর কাছেও যার আকর্ষণ কিছুমাত্র কম ছিল না ৷ কেবল শহরাঞ্চলেই নয়, ফেরিওয়ালাদের উদ্যোগে এই ধরনের বইপত্র পৌঁছে যাচ্ছিল দূর মফসসলেও ৷ হকাররা এগুলি তুলে দিত চলমান যাত্রীদের হাতে ৷ গ্রাম্য হাটেও বিক্রি হত এইসব বই ৷

স্বভাবতই ঔপনিবেশিক ও দেশীয় সামাজিক কর্তৃত্বের চোখে এইসব বইপত্রের প্রচার ও প্রসার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷ বিশেষত স্কুল-কলেজের অপরিণতমনস্ক ছাত্রেরা যে এধরনের বইপত্র পড়ে অধঃপাতে যাচ্ছে এ বিষয়ে অনেকেই ছিলেন নিশ্চিত ৷ ২৮ জুন ১৮৭৯-এর ‘সুলভ সমাচার’ সরাসরিই বলে—একেলে নব্যবাবুরা ‘ঘৃণ্য আদিরসাত্মক’ বইপত্র ছাড়া আর কিছুতেই আগ্রহী নন ৷ সেকালের একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তির স্মৃতিকথা থেকেই এই বিশেষ ধরনের পাঠরুচির সাক্ষ্য পাওয়া যায় ৷ বিপিন পাল তাঁর আত্মকথায় লিখছেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে সস্তা রোমান্সধর্মী বই পড়তেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন :

In those days I used to read a fair number of outside books…Gulevakolee and Kaminikumar, both of which were rather prurient publications… caught my boyish fancy.

রবীন্দ্রনাথও তাঁর জীবনস্মৃতি-তে লিখেছেন ঠাকুরবাড়ির এক মহিলার কথা, যাঁর তালাবন্দি তোরঙ্গ থেকে তিনি চটুল প্রহসন নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন ৷ আর বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব অমৃতলাল বসু তো সরাসরিই বলেছেন স্কুলজীবনে তাঁর এক সহপাঠী ছিলেন বটতলার বিখ্যাত প্রকাশকের সন্তান ৷ পাঠ্যবইয়ের চেয়ে ওই সহপাঠীর সূত্রে পাওয়া ‘অপাঠ্য’ বইপত্র তিনি বেশি পড়তে চাইতেন ৷ ওই প্রকাশক বেণীমাধব দে-র পুত্র লালবিহারীর কাছ থেকে পাওয়া এই বই হাতে পেয়ে তাঁর মনে হয়েছিল :

ভাবিলাম না জানি কি রহস্যই ইহার মধ্যে আছে ৷ Preparatory class-এর এই মার্শম্যান পাঠ করিয়া কখন যে ওখানা পড়িতে পাইব তাহার জন্য অস্থির হইয়া রহিতাম ৷

অন্দরমহলের স্বল্প লেখাপড়া-জানা মেয়েমহলেও এইসব বইয়ের প্রচলন ছিল খুবই ৷ এখানে মনে মনে একক পাঠের চেয়ে একজন লেখাপড়া-জানা মেয়ের উচ্চৈঃস্বরে পড়া এবং বাকিদের শোনা—এই পুরোনো পদ্ধতিই চালু ছিল বেশি ৷ নবীনচন্দ্র সেন তাঁর আত্মজীবনীতে এর সাক্ষ্য দিয়েছেন ৷ জেমস লঙ তাঁর Returns-এ উল্লেখ করেছেন এক নেটিভ মহিলার কথা, যে তাঁর ক্রিশ্চান শিক্ষয়িত্রীকে বারংবার অনুরোধ জানিয়েছে The licentious tale of Vidya Sundar বইটি জোগাড় করে দেবার জন্য, কিন্তু শিক্ষয়িত্রী এর বদলে তাকে এনে দেন Vernacular literary Society থেকে প্রকাশিত সুশীলার উপাখ্যান বইটি, যেখানে আদর্শ নারীচরিত্র গড়ে তোলার উপযোগী প্রকরণের হদিশ রয়েছে ৷ ১৮৩০ সালে, জনৈক ইংরেজি শিক্ষিত সদ্যবিবাহিত যুবক আক্ষেপ করেছেন তাঁর স্ত্রী-র চরিত্রগঠনের উপযোগী ভালো বাংলা বইপত্র নেই বললেই চলে ৷ বটতলার অপাঠ্য বইপত্র তিনি তাঁর স্ত্রীকে ছুঁতে দেন না ৷ Calcutta Female Juvenile Society-কে পাঠানো চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন :

The books that are published are so replete with superstitions and irrational ideas of thing…that I have, therefore, restricted her from touching these.

এমনকি ‘শিক্ষিত’ ভদ্রমহিলাদের অন্তঃপুরেও যে এইসব বইপত্রের অবাধ চলাচল ছিল তা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ পড়লে ৷ তিনি লিখেছেন মালিনীরা ঝুড়িতে করে নিয়ে আসত নানাধরনের বইপত্র, যার ভিতর ছিল অন্নদামঙ্গল, গোলেবকাওলি, লায়লা-মজনু, প্রভাসমিলন, রুক্মিণীহরণ  জাতীয় বই ৷ ঠাকুর পরিবারের অল্ববয়স্ক মেয়েরা সেগুলি কাড়াকাড়ি করে পড়ত, তাদের বইয়ের তাকে অনায়াসেই ঠাঁই পেত এই বইগুলি ৷১০ সমকালীন পঞ্জিকাগুলিতে এইসব বইয়ের বিজ্ঞাপন ফলাও করে ছাপা হত ৷ শ্রীরামপুর গাঙ্গুলি প্রেস প্রকাশিত ১৮৯৬-৯৭ সালের পঞ্জিকায় প্রকাশিত হয় বটতলার জনপ্রিয় উপন্যাস আদিরিনী-র বিজ্ঞাপন ৷ একদিকে আদর্শ সাধ্বী গৃহস্থ রমণীরা কীভাবে ‘কলিযুগ’-এ অশেষ দুঃখভোগ করছে আর অন্যদিকে বাঙালি যুবকেরা তাদের লাম্পট্য ও কামনাবহ্নির তাড়নায় কীভাবে ‘অধর্মের’ পথে বা বাড়াচ্ছে—তা জানতে হলে আদরিনী উপন্যাসটি পড়তেই হবে ৷১১ অথবা ধরা যাক উনিশ শতকের প্রথমদিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত প্রকাশিত অসংখ্য বাসরসংগীত জাতীয় বইয়ের কথা ৷ বাঙালির বিবাহ অনুষ্ঠানের এই বিশেষ অঙ্গটি অসংখ্য আদিরসাত্মক ঠাট্টাতামাসায় ভরপুর থাকত সেকালে ৷ বিশেষত, অল্পবয়স্ক বরকে নিয়ে ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর পরিবারের বিভিন্ন বয়সী মহিলাদের বদ রসিকতা নাটকের বিষয়বস্তু হয়েছে ৷ একটি সমকালীন নাটকে স্ত্রীর অবিবাহিতা সইরা দাবি করে তাদের অশ্লীল প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারলে বর তাদের যে কাউকে সেই রাতের জন্য শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে পেতে পারে ৷১২ অন্য একটি নাটকে জনৈক বিদ্যাহীন, নির্বোধ বর শালিদের অশ্লীল ঠাট্টা-রসিকতায় খুবই আমোদ পাচ্ছে ৷ কারণ,

আদর করিয়া কত শালী লয় কোলে ৷

বড় বড় মাছ খায় ঝালে আর ঝোলে ৷

কত মত কথা শেখে নানা রঙ্গ রস ৷

যাহাতে করিতে পারে রমণীরে বস ৷ ৷

ঘুম পাড়াইতে আসে কত কুল নারী ৷

রতিশাস্ত্র শিখাইতে আসে সারি সারি ৷ ৷

কোমল কামিনী কর গাত্রেতে বুলায় ৷

কি কহিব স্মরণেতে দুঃখ দূরে যায় ৷ ৷১৩

এই ধরনের বাসরসঙ্গীত-জাতীয় বই প্রচুর বিক্রি হত, কারণ বাসরে ওইসব ছাপানো গান গেয়ে শোনা হত ৷ এই ধরনের যৌন ইঙ্গিত ও অনুষঙ্গে ভরপুর বইপত্রের প্রকাশ্য বাজার খানিকটা ধাক্কা খায় ১৮৫৬ সালে ‘অশ্লীলতা আইন’ জারি হবার পর ৷ কিন্তু জনপ্রিয়তার চাপ এই আইনকে কখনোই পুরোপুরি কার্যকর হতে দেয়নি ৷ লঙ তাঁর Returns-এ জানিয়েছেন ১৮৫৭ সালেও চিৎপুর রোডে লক্ষ্মীবিলাস প্রেস থেকে প্রকাশিত বিদ্যাসুন্দর ৩,৭৫০ কপি বিক্রি হয়েছে ৷ The Bengal Library Reports থেকে জানা যায় ১৮৮০-র দশক অব্দি এই ধরনের বইপত্রের বাজার রীতিমতো চালু ছিল ৷ ২১ আগস্ট ১৮৭৩-এর ‘Indian Mirror’ মন্তব্য করে : এইসব বইপত্র গোপনে, প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বিক্রি হচ্ছে, এগুলি ‘sold in obscure shops and never [made]…their way to the Registrar Generals’ office for report and registration.১৪ অর্থাৎ মুষ্টিমেয় শিক্ষিত উচ্চবর্গ বাদ দিলে জনসমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন, যারা হয়তো মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে সদ্য পরিচিত হয়েছে বা যাদের অক্ষর পরিচয় এখনও উচ্চতর ভাবযুক্ত পাঠ্যবস্তুর সঙ্গে একাত্ম হবার সুযোগ পায়নি, সেইসব মূলধারার বা প্রান্তিক পাঠকগোষ্টীই বাঁচিয়ে রেখেছিল এই তথাকথিত ‘অশ্লীল’ সাহিত্যকে ৷

এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার ৷ এ পর্যন্ত যে বইগুলির প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, তার সবকটিকেই নিশ্চয়ই ‘আদিরসাত্মক’ বিশেষণে সংজ্ঞায়িত করা যায় না ৷ লঙ তাঁর ক্যাটালগে যে বইগুলিকে erotic অভিধায় চিহ্নিত করেছিলেন, তার ভিতর সচিত্র রতিশাস্ত্র থেকে শুরু করে হালকা রোমান্সধর্মী উপাখ্যান, মুসলমানি কিসসাসাহিত্য এমনকি সুপ্রচলিত পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে লেখা টেক্সটও ঠাঁই পেয়েছিল ৷ অর্থাৎ এখানে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটি ততটা বিষয়বস্তুগত নয়, যতটা দৃষ্টিকোণসঞ্জাত ৷ এই ধরনের সব বইপত্রেই কোনো-না-কোনোভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্ক বা দৈহিক মিলনের প্রসঙ্গ/অনুষঙ্গ রয়েছে ৷ কিন্তু সেটুকুই এই বইগুলির সব নয় ৷ এক সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবেই উপাদানগুলি এসেছে এবং জনসমাজের অতিপরিচিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে সেগুলি ৷ তবে খোলাখুলি যৌনতার অনুষঙ্গে ভরপুর টেক্সটও কম ছিল না উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ৷ ‘আদিরসাত্মক’ অভিধায় ফেলা যায় এমন বইয়ের আলোচনায় যাবার আগে এরকম একটি টেক্সট উদ্ধৃত করা যেতে পারে ৷ এটি একটি যৌনকেচ্ছা, সমকালীন কোনো এক নামী পরিবারের অন্দরমহলের গোপন কীর্তি ফাঁস করে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য ৷ এখানে এক গৃহবধূ নির্জন দুপুরে বাড়িতে আসা ফিরিওয়ালাকে যৌন প্ররোচনা দিচ্ছে ৷ ফিরিওয়ালার জবানিতেই শোনা যাক সেই বৃত্তান্ত :

ধনমনী আমাকে ডাকিয়া বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলেন ৷ তিনি এখন যুবতী হইয়াছেন, দুটো মাই উঁচো হইয়া উঠিয়াছিল… সম্পাদক মহাশয়, আমরা ছোটলোক, বাঁ উরোতের কাপড় প্রায় তুলিয়াই রাখি, বসিতে কি প্রকারে কাপড় সরিয়া আমার সেইটি বাহির হইয়া পড়িয়াছে ৷ তাহার গড়ন কিছু লম্বা কচী ওলের কোঁঢ়ার মত, ধনমনী তাহার পানেই চাহিয়া রহিয়াছেন আমি আগে ইহা জানিতে পারি নাই… যখন জানিতে পারিলাম ঐদিগে তাহার চোক পড়িয়াছে তখন আমারো গা শিউরে উঠিল, সুতরাং মেয়েমানুষ দেখিয়া পুরুষের গা শিউরিলে যা হয় তাহাই হইল আমি আর তাহাকে কাপড় ঢাকা দিলাম না ৷ তাহার উদগম হইতে লাগিল… তখন আমি লজ্জার মাথা খাইয়া বলিলাম ঠাকুরঝী তুমি উহার পানে চাহিয়া রহিয়াছিলে বুকের কাপড় ফেলিয়া দিয়াছ, ওকি বুঝিতে পারে না, প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে, তুমি বাঁচাও বাঁচে মারাও মরে… ধনী এই কথা শুনিয়া একটুকু হাসিয়া আমাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেলেন এবং আমার কোমরে দুই পা তুলিয়া দিয়া তায়তায় লাগাইয়া কহিলেন, দে, দে, দেরে, ফিরিওয়ালা দে…১৫

বলাই বাহুল্য, কোনো ফিরিওয়ালার পক্ষে এই লেখা সম্ভব নয় ৷ আসলে এটি এক ধরনের চালু আদিরসাত্মক ন্যারেটিভ যা সেযুগের অন্য অনেক লেখাপত্রের ভিতরেই কম-বেশি পাওয়া যাবে ৷ যে ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকা থেকে এটি নেওয়া হয়েছে, তার পৃষ্ঠার-পর-পৃষ্ঠায় এধরনের লেখা ছাপা হত ৷ এই ধরনের লেখালেখি মিলিয়েই তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা আদিরসাত্মক বইয়ের সংস্কৃতি ৷ এরকম তিনটি বইয়ের কথাই এবার আলোচিত হবে ৷

‘দূতী বিলাসাখ্য এই পুথি’

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যয়-এর দূতীবিলাস প্রকাশিত হয় ১৮২৫ সালে ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসাহিত্যের উনিশ-শতকীয় প্রতিসরণের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই বই ৷ প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য, কামসূত্র, কোকশাস্ত্র-জাতীয় বই, জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী হয়ে আঠারো শতকে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর পর্যন্ত একটি সুপ্রচলিত উপাদান ‘দূতীপ্রকরণ’কেই প্রাক-ঔপনিবেশিক নগর কলকাতার সমকালীন পটভূমিতে প্রতিস্থাপিত করেছেন ভবানীচরণ এই বইটিতে ৷ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার এক ধনী যুবকের লাম্পট্য, পরস্ত্রীসম্ভোগ ও বহুনারীগমনের কেচ্ছাপুরাণ এই বই, যেখানে অর্থবান পুরুষের অবাধ রিপুচর্চার প্রধানতম অনুঘটক ও সহায় হিসেবে বিভিন্ন দূতীর চমকপ্রদ রোমাঞ্চকর ভূমিকা বর্ণিত হয়েছে বিস্তারে ৷ কিন্তু এই ‘দূতী’ সংস্কৃত রসশাস্ত্র প্রকরণের ক্যাটেগরি অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি, বরং সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে এর যোগাযোগ অনেক বেশি ৷ বাৎসায়নের (তৃতীয় শতাব্দী) অপ্রাপণীয় নায়িকার সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে নায়কের অচরিতার্থ বাসনা পূরণের দায়িত্ব ‘দূতী’র ৷ সেখানে দূতী তিন প্রকার—‘নিসৃষ্টার্থা’, যে দূতী উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্যে কার্যসিদ্ধিতে সক্ষম ৷ ‘পরিমিতার্থা’ যে দূতী নায়ক-নায়িকার পারস্পরিক বার্তাটুকুই কেবল বহন করতে পারে চতুরতার সঙ্গে, এবং তৃতীয় দূতী—‘পত্রহারিণী’র কাজ অপেক্ষাকৃত গৌণ ৷১৬ বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রেও রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলার অনুঘটক দূতী ৷ রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে দূতী দুই প্রকার—‘স্বয়ংদূতী’ এবং ‘আপ্তদূতী’ ৷ বীরা, বৃন্দা প্রভৃতি ব্রজাঙ্গনাগণ শ্রীকৃষ্ণের প্রণয় বিষয়ে বিশেষ সহায়ক ৷ বৃন্দার মনোজ্ঞ চাটুবাচন নায়িকাদের মনে আনন্দ সঞ্চার করে ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের অনুরাগবর্ধন করে ৷ বীরা প্রগলভ-বচনা, বৃন্দা চাটুক্তিকুশলা ৷১৭

ভবানীচরণ দূতীপ্রকরণের এই ঐতিহ্য থেকে সঙ্গে এসেছেন ‘নতুন নতুন দূতী’র সমকালীনতায় ৷ তাঁর উদ্দেশ্য : ‘গোপনে কেমনে দূতী করয়ে মিলন ৷/যুবক যুবতী পেয়ে কি করে আচার / এসব বর্ণন করি করিয়া বিস্তার ৷ / প্রধানা এ গ্রন্থ মধ্যে হইবেক দূতী ৷ / অতএব, দূতী বিলাসাখ্য এই পুথি ৷ ৷’ তাঁর কাব্যে দূতী পাঁচ প্রকার : ‘মালিনী’, ‘নাপতিনী’, ‘উড়েনী’, ‘নেড়ী’ এবং ‘সহবাসিনী দাসীরূপা’ ৷ এদের ভিতর মালিনী দূতীর চরিত্র, বেশভূষা এবং দক্ষতা বর্ণনে ভবানীচরণ স্পষ্টতই ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর-এর অনুসারী ৷ কিন্তু এই দূতীরা সকলেই নিছক নগদ বিদায়ের বিনিময়েই নায়কের উপকার করতে সম্মত হয় ৷ যেমন, মালিনী এই কাব্যের নায়ক শ্রীদেবকে বলে :

 শুন ওহে রসরাজ ইকি অতি বড় কাম

 টাকা দিলে হইবে উপায় ৷

 অধিক কি কব আর বুঝিবা সকল সার

 কোন কর্ম না হয় টাকায় ৷ ৷

অর্থাৎ, নগর কলকাতায় হৃদয়বৃত্তিও সাফল্যের জন্য টাকার উপর নির্ভরশীল ৷ পূর্ববর্তী কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩) বইয়ের শুরুতেই ভবানীচরণ বলেছিলেন, ‘কলিকাতা মুদ্রারূপ অপেয় অগাধ জলে পরিপূরিতা হইয়াছে ৷১৮ শ্রীদেব নাগরের সঙ্গে কথোপকথনে নাপিতিনী শহরের বিভিন্ন পরিবারের ভ্রষ্টচরিত্র রমণীদের এক লম্বা তালিকা দেয় : ‘অমুক রায়ের মাণ্ড’, ‘পালের বহু‘, ‘দাসের ভগিনী’, ‘সুবোধ দত্তের বৌ’, ‘অমুক সাহার কন্যা’ প্রভৃতি ৷ কিন্তু জনৈক ব্রাহ্মণকন্যার প্রসঙ্গ উঠতেই অ-ব্রাহ্মণ শ্রীদেব যখন সংস্কারবশত বলে ওঠে ‘যদ্যপি দ্বিজনারী দ্বিচারিণী হয় ৷ / শূদ্রাদির মাতৃতুল্যা গমনীয় নয় ৷ ৷ ব্রাহ্মণীর মন্দ কথা এনো না কো মুখে ৷ / ইহ পরকাল ক্লেশে যাবে রবে দুখে ৷ ৷’ তখন তাকে আশ্বস্ত করে নাপতিনী বলে কলকাতার ‘বাজারে’ এহেন জাতপাতগত শুদ্ধতা আজ আর কেউ মানে না, বরং জাতি/জ্ঞাতি সম্পর্ক কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না কামসম্বন্ধ স্থাপনের ক্ষেত্রে :

 কেহ হরে মাসী পিসি জানিল তা প্রতিবাসী

 মামি হরে বিশ্বধন আশ ৷

 ভাদ্রবধূ হরে কেহ কহি যদি মন দেহ

 আছে বড় বাজারে প্রকাশ ৷ ৷

 খুড়ি না শাশুড়ি বাছে শুনি অনেকের কাছে

 আর বহু বাজারে শুনিবে ৷

শ্রীদেব নাগর চরিত্রটির উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভবানীচরণ ঐতিহ্য থেকে সরে এসেছেন সমকালীনতার প্রেক্ষিতে ৷ ‘অথ শ্রীদেব নাগরের রূপ বেশ বর্ণন’ অংশে সেকালের ধনী বিলাসী নবযুবকের পোশাকের বিবরণ দেবার পর শ্রীদেবকে ‘বিদগ্ধ নায়ক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে ৷ ‘বিদদ্ধ নায়ক’—এই বিশেষণ একটি পারিভাষিক আখ্যা ৷ বৈষ্ণব রসশাস্ত্রীরা এবং সংস্কৃত অলংকারপ্রকরণেও ‘নায়কভেদ’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নায়কের গুণাবলির অন্যতম একটি গুণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘বিদগ্ধতা’কে ৷১৯ ষোড়শ শতকের রূপ গোস্বামী শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলা নিয়ে লেখেন বিদগ্ধমাধব নাটক ৷২০ রূপ গোস্বামীর ভাষায় ‘বিদগ্ধ, নবযুবা, পরিহাসবিশারদ ও নিশ্চিন্ত প্রকৃতির নায়ককে ‘ধীরললিত’ বলে ৷২১ শ্রীদেব নাগর কি ‘ধীরললিত’ নায়কের উদাহরণ? স্পষ্টতই না ৷ কারণ সংস্কৃত সাহিত্যে যে যে চারিত্রিক অভিব্যক্তির সাহায্যে নায়কচরিত্র প্রার্থিত আলংকারিক উচ্চতা পায়, ভবানীচরণের নায়ক তার চেয়ে অনেক বেশি একরৈখিক ও লঘুচিত্ত ৷ যেনতেন প্রকারে যৌন ঈপ্সা চরিতার্থ করা ব্যতীত মাঝে মধ্যে কিছু নৈতিক উক্তি উচ্চারণই কেবল করে সে ৷ ‘দূতীবন্দনা’র মধ্য দিয়ে শ্রীদেব এক ভিন্নতর ‘পুরুষার্থে’র ধারণা ব্যক্ত করে :

 দূতী সঙ্গ নিরবধি যদি হয় বাল্যাবধি

 লোক তবে পুরুষার্থ হয় ৷

 দেখহ বালক কালে, গুরুরূপে পাঠশালে

 দূতী আসি নিকটে উদয় ৷ ৷

 আর নিজ নারী প্রতি যাহার না থাকে মতি

 মতি তার নারী প্রতি যায় ৷

 জানিলে তাহার মর্ম সাধিতে আপন ধর্ম

 নিজ মূর্তি ধরেন তথায় ৷ ৷…

 অতএব দূতী ভক্তি করি তাহে অনুরক্তি

 সাক্ষী দেব কৃষ্ণ অবতার ৷

 দূতীরে করিয়া বল বৃন্দাবনে বাসস্থল রসময় করেন প্রচার ৷ ৷

উনিশ-শতকীয় নব্যযুবকের লাম্পট্যের গাইডলাইনে কী অনায়াসেই ঠাঁই করে নিয়েছে পৌরাণিক কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা ৷ আর অবিমিশ্র শৃঙ্গারই যে এই বিপুল বিত্তশালী যুবকের জীবনে একমাত্র আকাঙ্ক্ষা তা প্রার্থিত কামিনীর কাছে আত্মপরিচয় ব্যক্ত করতে গিয়ে নিজেই বলে শ্রীদেব :

 শ্রীদেব নাগর নাম শৃঙ্গার নগরে ধাম

 লেখাপড়া জ্ঞানগুণ কেবল নাগরী ৷

 কামপুরে জমিদারী সে কর্মেতে ব্যস্ত ভারি

 তালুক রক্ষার হেতু আছি বাসা করি ৷ ৷

 বিবাহের নাহি আশ পরবাসে বারমাস

 সুখে থাকিবার জন্য ব্যয় করি ধন ৷…

অনঙ্গমঞ্জরীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার মিলনের সময় বৈষ্ণববেশী শ্রীদেব ‘ঠিক যেন চৈতন্য সাজিল ৷/মুখে হরি হরি বোল/অন্তরেতে গণ্ডগোল/ভাবি রূপ অনঙ্গমঞ্জরী’—বৈষ্ণবীয় ভাবাদর্শের এক চূড়ান্ত ব্যত্যয় ঘটেছে এখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ৷ উনিশ-শতকীয় ‘কামসাহিত্য’-য়, ‘আধুনিকতা’র যুগোপযোগী প্রতিসরণের এ এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন ৷ মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব সাধনার ভিতর যে উচ্চতর ‘essence’ দাবি করা হত, উনিশ শতকের ব্রিটিশ কলকাতায় তা আজ লম্পট ধনীপুত্রের বাসনা চরিতার্থকরণের উপকণ মাত্র ৷

ঔপনিবেশিক কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের এক জীবন্ত ছবি পাওয়া যায় এই বইটিতে ৷ এই সামাজিক ইতিহাস উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সম্পন্ন পরিবার, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক এবং পিতৃতান্ত্রিক-পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের ভিতর যৌন অবরোধের বিরুদ্ধে গৃহস্থ মেয়েদের নিজস্ব শারীরিক ‘উপভোগ’ উৎপাদনের কথা বলে ৷ ‘নাগর নিকটে গোপীর পরিচয়’ অংশে গোপী যখন পিতৃকুল-শ্বশুরকুলের পরিচয় দেয়, তখন বোঝা যায় সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের এই মেয়েটি কোনো-না-কোনোভাবে পরিবার থেকে বিতাড়িত, যৌন পদস্খলনের সূত্রেই হয়তো তাকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে ৷ ১৮৫৩ সালে কলকাতার ৪ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে বারবনিতার সংখ্যা ১২,৪১৯ ৷ এদের মধ্যে একটা বৃহদংশই উচ্চবর্ণীয় পরিবারের মহিলা, যৌননৈতিক স্খলনের কারণে যারা একবার পরিবারচ্যুত হয়ে আর পরিবারে ফিরতে পারেনি ৷২২ সমকালীন সরকারি হিসেব অনুযায়ী ওই বারো হাজারে মধ্যে দশ হাজার মহিলাই ছিলেন হিন্দু কুলীন পরিবারের কন্যা ও বিধবা ৷ ‘কে বলে বিধবা তারে/বেশ্যা কে বলিতে পারে / গণিতে গোপীর পতি অস্থির মিহির’—গোপীর এই বর্ণনা তাকে সমকালীন সমাজপ্রেক্ষিতেই স্থাপন করে ৷ আবার ভবানীচরণের বর্ণনায় ‘স্বজাতির পঞ্চ নরে / রতি যেবা দান করে / বেশ্যা বলি খ্যাতি তার শাস্ত্র অনুসারে ৷ ৷’—গোপীকে সরাসরি কামসূত্রের ‘বৈশিকাধিকরণস্য’ আদলে গড়ে নেবার প্রয়াস ৷ এটিও ভবানীচরণের কাব্যে ঐতিহ্যকে সমকালীনতার আঙ্গিকে ধরার চেষ্টা ৷ আর ‘তসরের ঠেঁটী পরা নাশায় তিলক করা’ নেড়ী দূতীর প্রসঙ্গ অন্য একাধিক উনিশশতকীয় টেক্সটেও ধরা পড়েছে ৷ যেমন, নারায়ণ চট্টরাজের লেখা কলিকৌতুক নাটক-এর (১৮৫৮) একটি অংশে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণবদের আখড়ায় অবাধ যৌনাচারের উল্লেখ ৷ আসলে সেদিনের সামাজিক প্রেক্ষিতেও সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো সমাজবহির্ভূতদের সম্পর্কে এধরনের অভিযোগ প্রচলিত ছিল ৷ অনেক সমাজচ্যুত মহিলার ঠাঁই হত এধরনের প্রান্তিক ধর্মীয় গোষ্ঠাগুলির মধ্যে ৷ ভবানীচরণের ‘সহবাসিনী দাসীরূপ দূতী’ যখন শ্রীদেব নগরের কাছে অনঙ্গমঞ্জরীর কথা বলতে গিয়ে ‘গোসা করে পরে মোরে করে চোটপাট ৷/পুলিশে পাঠাতে চায় শুনে মোটমাট ৷ ৷’—এহেন উক্তি করে, তখন এই ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সরাসরি উল্লেখ কাব্যের চরিত্রগুলিকে সমকালীন করে তোলে ৷

আবহমান সংস্কৃত ও বাংলা প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে ‘আলম্বন’, ‘উদ্দীপন’ বিভাবের যে অলংকারশাস্ত্রসম্মত প্রকরণ তৈরি হয়েছিল, ভবানীচরণের কাব্য তা থেকেও সরে এসে কয়েকটি নতুন উপাদান সংযোজিত করেছে ৷ বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্যদর্পণ অনুসারে ‘যে সকল পদার্থ রসকে উদ্দীপিত করে, তারাই উদ্দীপন বিভবাসমূহ’—‘যো যস্য রসোদ্দীপনবিভাব সঃ তৎস্বরূপবর্ণনে বক্ষ্যতে ৷’২৩ অর্থাৎ ‘আলম্বন’ বা পাত্রপাত্রীরূপ উপাদানের ‘দেশকালাদি’-কেই বলে ‘উদ্দীপনবিভাব’ ৷ বিশ্বনাথের ভাষায় ‘ইহাতে ‘আদি’ শব্দ চন্দ্র, চন্দন, কোকিল, সাপ, ভ্রমর, ঝঙ্কার প্রভৃতি বুঝায় ৷’ দূতীবিলাস-এর ‘ঋতুরাজ বসন্তের আধিপত্য’ অংশে (‘শীতল সুগন্ধি মন্দ বহিছে পবন ৷/বিয়োগী জনের হয় কামিনীতে মন ৷ ৷’) উদ্দীপন বসন্ত ঋতু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যতত্বের অনুসারী, কিন্তু যে স্থলে নায়িকাকে দেখে নায়কের হৃদয়ে বাসনার সঞ্চার হয়েছিল সেই স্থানটি হল উত্তর কলকাতার গৃহস্থ বাড়ির ছাদ :

সুস্বর অনল সম সন্তাপ জন্মায় ৷

সুস্থির হইতে নারে পারে ছাতে যায় ৷ ৷

মলয় মারুত তাহে লাগে তার গায় ৷

অস্থির হইয়া কামে চারিদিক চায় ৷ ৷

অন্য মৌথোপরি নারী দান্ডাইয়া ছিল ৷

অর্ধেক শরীর তার দেখিতে পাইল ৷ ৷

সুন্দরীর মুখ চক্ষু গুণ নিরখিয়ে ৷

বিতর্ক করিছে কত কামেতে মজিয়ে ৷ ৷

ছাতে পুনর্বার আর তারে না দেখিয়া ৷

বারান্দায় বৈসে আসি মলিন হইয়া ৷ ৷

এরপর টেক্সট-এর প্রথমাংশে বেশ কয়েকবার ওই ছাদ ও ছাদে নায়িকাকে দর্শন করে নায়কের কাতরোক্তি বর্ণিত হয়েছে ৷ তবে উনিশ-শতকীয় সামাজিক ইতিহাসে যৌন আচরণ-অভিব্যক্তি, সমাজ ও যৌননৈতিকতার এক অনুপুঙ্ক্ষ অভিব্যক্তি ধরা পড়ে শ্রীদেব নাগর-অনঙ্গমঞ্জরীর স্বামীর মধ্যেকার সম্পর্কের যৌন টানাপোড়েনটি লক্ষ করলে ৷ উনিশ শতকের শেষার্ধের ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ হিন্দু পরিবারে মহিলাদের স্বেচ্ছাচারিতা, যৌননৈতিকতার শিথিল গড়ন, অ-নিয়ন্ত্রিত যৌন উদ্দীপনাকে চিহ্নিত করেছিল এবং ‘পরিবার’ নামক ধারণাটিকে পুনর্বিন্যস্ত করে, নিরন্তর শিক্ষা, আলোকায়ন এবং অনুশাসনের দ্বারা পরিবারের প্রেক্ষাপটে নারীর ভূমিকা পুনর্নির্দিষ্ট করতে চেয়েছিল ৷ এবং এই ‘অভীপ্সা’ নিজের যাথার্থ্য প্রমাণের জন্য যে যে সামাজিক উপাদানগুলিকে প্রাকশর্ত হিসেবে ধরে নিয়েছিল তার একটি প্রধান বিষয় ছিল মেয়েদের যৌন অভিব্যক্তি, অতিরেক ৷ একাধিক সমকালীন সাক্ষ্য এবং সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালি অন্তঃপুরে মেয়েদের কথাবার্তার অনেকটাই জুড়ে থাকত আদিরসাত্মক বিষয়বস্তু ৷ আদিরসাত্মক গল্প শোনা ছিল মেয়েলি বিনোদনের এক প্রিয় মাধ্যম ৷ এই পরিবেশে বালিকা বয়স থেকেই মেয়েরা যৌনতা বিষয়ে অকালপক্ব হয়ে উঠত ৷ ১৮৩৯ সালে জনৈক ইংরেজ মিশনারি মহিলা লিখছেন অন্তঃপুরের বাঙালি মেয়েরা—

will sit for hours in circles willing away the time in silly obscene conversations, to which none but an christian experienced female can safely hazard exposure.”২৪

এই পারিবারিক কাঠামোয় অনঙ্গমঞ্জরীর মতো গৃহবধূর অভাব ছিল না, যারা বেশ্যাসক্ত স্বামীর অবহেলা এবং অমনোযোগের কারণে নিজেদের অবদমিত বাসনা চরিতার্থ করত পরপুরুষের সান্নিধ্যে ৷ মালিনী অনঙ্গ সম্বন্ধে শ্রীদেবকে বলেছিল ‘রসিক যুবার প্রতি যত্ন তার অতি ৷/যেহেতু অকৃতি বড় শুনি তার পতি ৷ ৷’ এবং এই গোপন মিলনে সহায়তা করত অনঙ্গের দাসী গোপী এবং দূরসম্পর্কের পিসি ৷ পিসির পরামর্শে সন্তান উৎপাদনের জন্য কস্ত্রীদেবের সঙ্গে নিয়মিত মিলনের অনুমতি স্বামীর কাছ থেকে আদায় করার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে তারা মোট ছ’বার মিলিত হয়েছে ৷ প্রথমবার পিসিকে দেখতে যাবার নাম করে স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি আদায়, দ্বিতীয় মিলনে বৈষ্ণব আখড়ায় শ্রীদেব নাগরের বৈষ্ণবের ছদ্মবেশ ধারণ, তৃতীয় মিলনে শ্রীদেব দাসীরূপ ধারণ করে অনঙ্গের অন্তঃপুরে এসে উপস্থিত হয়েছে, চতুর্থ মিলনে নায়ক ধারণ করেছে দ্বিজবেশ, নায়িকাকে সঙ্গে করে কালীঘাটে উপস্থিত হয়েছে পিসি এবং সেখানে ঘরভাড়া করে রাত্রিবাস ও মিলন ঘটেছে দুজনের ৷ এই কালীঘাটেই অনঙ্গমঞ্জরীর পিসির প্রতি গোপনে আকৃষ্ট হয় শ্রীদেব ৷ এরপর পিসির পরামর্শে স্বামীর অনুমতি নিয়ে বাড়িতে শখের যাত্রার আয়োজন করে অনঙ্গ ৷ ‘পল্লীগ্রামস্থ নারীবেশ’ ধারণ করে অন্তঃপুরের মেয়েমহলে ঢুকে পড়ে শ্রীদেব এবং নায়ক-নায়িকার পঞ্চমবার মিলন সাধিত হয় ৷ এরপর অনঙ্গর পিসির সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয় শ্রীদেব ৷ ষষ্ঠ মিলন হয় তারকেশ্বরে ৷ পথিমধ্যে ‘রাত্রি একঘরে হৈল সবাকার বাস / শ্রীদেব কৌশলে পুরে দুহাকার আশ ৷’ কাহিনির শেষে পিসি কৌশলে অনঙ্গর স্বামীকে রাজি করিয়েছে নিঃসন্তান স্ত্রীর গর্ভে পরপুরুষের সন্তান ধারণ করানোয়, কারণ বংশরক্ষার জন্যই একাজ করা একান্ত প্রয়োজন ৷ এই সুযোগে শ্রীদেবও অনঙ্গমঞ্জীর গৃহে অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায় এবং অবাধে ‘কখনো রজনী যোগে কখনো দিবসে ৷ / প্রত্যহ আইসে যায় অনঙ্গের বশে ৷’ কিন্তু গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশের পরেও পিসির সঙ্গে মিলিত হওয়া থেকে বিরত হয়নি শ্রীদেব, এমনকি নিজগৃহে গোপীদাসীকে পেয়ে তাকেও ছাড়েনি সে ৷ ফলে শ্রীদেবের প্রতি অনঙ্গমঞ্জরীর মান, শ্রীদেবের পালটা অভিমান ৷ ক্রমে অনঙ্গমঞ্জরীর গর্ভে শ্রীদেবের ঔরসে তিন পুত্র হয়, তাদের প্রত্যেকের এবং অনঙ্গের ব্যয়ভার বহন করে নিঃস্ব হয়ে পড়ে শ্রীদেব ৷ পরিবারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত স্বামীপুত্রবতী অনঙ্গমঞ্জরী শ্রীদেবের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ৷ হতাশ, ব্যর্থ, শ্রীদেবের কাতর আক্ষেপোক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনির শেষ হয় ৷

দূতীবিলাস-এর টেক্সট উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালি সমাজের একাংশে প্রচলিত ‘কাম’-এর নৈতিকতা ও সুখবোধ সংক্রান্ত এক অনবদ্য উপস্থাপনা ৷ অপেক্ষাকৃত বিত্তবান পরিবারগুলিতে পুরুষের বেশ্যাসক্তি এবং অন্তঃপুরের মহিলাদের পরপুরুষগমন—সেযুগের অধিকাংশ পত্রপত্রিকায় একটি চালু বিষয় হিসেবে ছাপা হত ৷ দূতীবিলাস-এও অনঙ্গ নিজের স্বামীর সঙ্গে একইভাবে শারীরিক মিলন চালিয়ে গিয়েছে ৷ অর্থাৎ, সে যা করেছে অত্যন্ত সচেতনভাবেই করেছে ৷ অন্তরে শ্রীদেবকে ধারণ করেই সে পতির সঙ্গে মিলিত হয়েছে :

রঙ্গভঙ্গ দেখি তার পতি গেল ভুলিয়া ৷

পালঙ্কেতে শুলো গিয়ে নিল বুকে তুলিয়া ৷ ৷

রসে বসে রাত্রিশেষে নিদ্রা যায় হরিয়া ৷

অনঙ্গের নাহি নিদ্রা শ্রীদেবেরে ভাবিয়া ৷ ৷

এখানে একধরনের স্বেচ্ছাধীন, স্বয়ংচালিত নারীসত্তার ছবি পাওয়া যায়, যে তার নিজের শরীর/সুখভোগের ক্ষেত্রে অন্য কারো মুখাপেক্ষী নয় ৷ এই স্বাধীন যৌনসত্তার কথাই যেন প্রকট হয় দাসীরূপধারী শ্রীদেবের উক্তিতে, যেখানে রামচন্দ্র ও জরৎকারু মুনির স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে বলা হয়—‘অতএব দেখেশুনে স্বামী চাহি নাই ৷ / স্বামীর অধিনী হলে কোন সুখ নাই ৷ ৷ / উপপতি করি যদি দূরে যায় দোষ ৷ / এ যুক্তি করিলে থাকে সকলে সন্তোষ ৷ ৷’ শখের যাত্রা দেখতে আসা শহুরে মেয়েরাও মন্তব্য করেছিল, পল্লীগ্রামের মেয়েদের জীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই (শুনে নাকে হাত দিয়ে কহে নারীগণ ৷ / হেন যারা সহে ধিক তাদের জীবন ৷ ৷) ৷ অনঙ্গ তারকেশ্বরে সন্তানের জন্মের জন্য মানত করতে যাবার যুক্তি হিসেবে স্বামীকে বলেছিল: ‘সদা মত্ত হৈয়ে থাক লৈয়ে বারাঙ্গনা ৷ / আখেরে কি হবে তার নাহি বিবেচনা ৷ ৷/… সন্তান না হলো মোর যৌবন না রয় ৷ / তুমি যেন কথা শুন সে তো বশ নয় ৷ ৷’ উনিশ শতকের শেষার্ধের যৌনতার ডিসকোর্সেও বারবার বলা হয়েছে এদেশীয় ধনী ব্যক্তিগণ অল্পবয়স থেকেই অতিরিক্ত শুক্রপাত করেন বলেই তারা সন্তানের জন্মদানকালে কার্যত ব্যর্থ হন ৷২৫ পরবর্তী যৌনতার ডিসকোর্সের একটি সামাজিক মতামতগত ভিত্তি দূতীবিলাস-এর কাহিনিতেও লভ্য ৷ তারকেশ্বরে জনৈক সন্ন্যাসীর ভবিষ্যৎবাণী-সংক্রান্ত মিথ্যা কথা শুনিয়ে যেদিন অনঙ্গমঞ্জরী স্বামীকে রাজি করাল অন্য পুরুষের ঔরসে গর্ভধারণ করতে, সেদিন রাতে নিয়মমাফিক রতিক্রিয়ার পর উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কহীনতার ছবিটি প্রকট হয় : ‘রতি রস রঙ্গ হইল যেন শাস্ত্র পালা ৷ / উভয়ের মনে অন্য করে দায় টালা ৷ ৷ / তাদের বাসর যেন হয় কারাগার ৷ / দুজনে দুঃখিমনে ভাবে অনিবার ৷ ৷’ আর পরপুরুষ-সংসর্গের মাধ্যমে গর্ভোৎপাদনের বিষয়টি অনঙ্গের পিসি যে যুক্তিতে অনুমোদন করিয়েছে তার মধ্য দিয়েই উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালি সমাজে যৌননৈতিকতার এক পৃথক চেহারা পরিস্ফুট হয় :

পুত্র প্রয়োজন আছে অবশ্য গৃহীর ৷

ব্যক্ত পুরানেতে দেখ লেখন স্মৃতির ৷ ৷

পণ্ডিতের আপন বংশ রাখিবার তরে ৷

আত্ম হতে না হইল অন্য মত করে ৷ ৷

পাণ্ডুরাজা হৈতে পুত্র না হলো কুন্তীর ৷

উপপতি জন্য বিধি দিলেন সুধীর ৷ ৷

লোকলজ্জা ভয় তুমি তাহারে পারিবে ৷

গোপনে আসিবে কেহ কে ঢাক মারিবে ৷

সুজনবাবুর কথা শুনিয়াছ কানে ৷

উপপতি সঙ্গে মাগু পাঠয় বাগানে ৷

কিছুদিন থাকে কথা শেষ কিবা রয় ৷

কলঙ্ক কি বশ সব কালে লোপ হয় ৷

অতএব শাস্ত্র সিদ্ধ লোক ব্যবহার ৷

ইথে পাপ লজ্জা কেন হইবে তোমার ৷ ৷

তিন পুত্রের জন্মদানের পর পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে প্রতিষ্ঠালাভের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীদেবের প্রয়োজন সাঙ্গ হয়েছে অনঙ্গমঞ্জরীর জীবনে ৷ আর শ্রীদেব আক্ষেপ করেছে, কীভাবে ‘অনিত্য সাধন’-এর কারণে তার জীবন ছারখার হয়ে গিয়েছে ৷ সাধারণ গৃহীর ইতিকর্তব্য সম্পাদনে অনীহাই যে তার পতনের মূল কারণ, এ কথাও কবুল করেছে সে ৷ ভারতীয় পুরুষার্থ সাধনায় ‘ধর্ম’, ‘অর্থ’ ও ‘কাম’-সাধনই ‘মোক্ষে’র উপায় ৷ যে ব্যক্তি এদের ভিতর কোনো একটির অতিরিক্ত চর্চা করে, সে-ই জীবনে সামঞ্জস্য হারায় ৷ শ্রীদেবের কাতরোক্তি সেই সামঞ্জস্যহীনতার যন্ত্রণা থেকেই : ‘গৃহী হয়ে গৃহে থাকি না করি বিবাহ ৷ / গৃহস্থের মত কর্ম না হলো নির্বাহ ৷ ৷/ ঔরসে জন্মিল পুত্র বংশ না রহিল ৷ / আপনার পিতৃপিণ্ড আশা না থাকিল ৷ ৷ /আমার সমান আর নাহি বুদ্ধিহীন ৷ / সংসারী নহিক আমি নহি উদাসীন ৷ ৷ /নিত্য সেই নিত্যানন্দ তাঁরে না ভাবিয়া ৷ / ভাবিলাম কামিনীরে কামেতে মজিয়া ৷ ৷’ শ্রীদেবের পতনের মূল কারণ কর্তব্যকর্মের যথাযথ গুরুত্ব না বোঝা—আবহমানকালব্যাপী ভারতবর্ষীয় পুরুষার্থ সাধনার কাঠামোর ভিতরেই এভাবে ‘কাম’কে স্থাপন করতে চান ভবানীচরণ ৷

দূতীবিবিলাস-এর সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় উপাদান এর নায়ক-নায়িকার রতিবিহারের অনবদ্য বর্ণনা ৷ এই বর্ণনা আধুনিক ‘পর্নোগ্রাফিক’ বর্ণনার চেয়ে একেবারেই আলাদা ৷ এখানে যৌনাঙ্গ এবং যৌনমিলনের অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা বাস্তবানুগ নয় বরং একধরনের সরস আবরণ দ্বারা আবৃত ৷ প্রাক-ঐপনিবেশিক গীতগোবিন্দ (১২শ শতক), শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৫ শতক), রোমান্টিক কিসসাসাহিত্য (যেমন : লোকচন্দ্বন্দ্রনী, ১৭ শতক), সর্বোপরি ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর (১৮ শতক) দ্বারা প্রভাবিত ভবানীচরণের ভাষাভঙ্গি ৷ এক্ষেত্রে প্রাক-ঐপনিবেশিক ‘কামসাহিত্য’র সম্প্রসারণই তাঁর কাব্যে লক্ষণীয় ৷ যেমন, ধরা যাক, তাঁর কাব্যের ‘বিপরীত শৃঙ্গার’-এর সঙ্গে বিদ্যাসুন্দর-এর ‘বিপরীত বিহার’-এর বর্ণনাগত সাযুজ্য :

লাজের মাথায় হানিয়া বাজ ৷

সাধয়ে রামা বিপরীত কাজ ৷ ৷

ঘন অবিলম্ব নিতম্ব দোলে ৷

ঘুন ঘুন ঘন ঘুঙ্ঘুর বোলে ৷ ৷

আবেশে ছাঁদি ধরে ভুজযুগে ৷

মুখ পুরে মুখ কর্পূর পূগে ৷ ৷

দংশয়ে পতির অধরদলে ৷

কপোত কোকিলা কুহরে গলে ৷ ৷

উথলিল কামরস জলধি ৷

কাম মত সুখ নাহি অবধি ৷ ৷২৬

 (বিদ্যাসুন্দর:: বিপরীত বিহার)

তুলনীয়, দূতীবিলাস-এর ‘পঞ্চম মিলনে খেলাচ্ছলে বিপরীত শৃঙ্গার’ :

লাজ বাদ সাদে আসি আঁখি ভরে ৷

কামদেব আরো মন ব্যস্ত করে ৷ ৷

কটিদেশ তুলে ঘন শব্দ করে ৷

জলবিন্দু তাতে তবু নাহি সরে ৷ ৷

অবলা হইয়া সবলারি মত ৷

বহু কষ্ট পেলে নারী পারে কত ৷ ৷

বিধিমতে কামে কত বজ্র মারে ৷

পরে বারি ঢালে মুষলের ধারে ৷ ৷

দূতীবিলাস-এর ‘চতুর্থ মিলনে’ ‘কালীঘটে রন্ধন’ অংশে নায়িকার কুচ নিয়ে যে রসালাপ তাও বিদ্যাসুন্দর-এর অনুরূপ ৷ বিদ্যাসুন্দর-এর ‘কুচপদ্মকলি কবিরাজ করে ৷ / ধরিতে তরুণী পুলকে শিহরে’র মতোই এখানেও পাই : ‘কুচ দুটি নিয়ে করে বার্ত্তাকি বুঝিল ৷ কামানলে সে দুটারে ভাল পোড়াইল ৷ ৷ / পুনঃ পুনঃ কাটি দিয়া নাড়ে চাড়ে ঢাকে ৷ / বারম্বার টিপে দেখে যদি শক্ত থাকে ৷ ৷’ এছাড়াও বিদ্যাসুন্দর-এর অনুকরণে একাধিকবার নায়কের ছদ্মবেশ ধারণ (দ্বিজ ব্রাহ্মণের রূপ, দাসীরূপ, পল্লীগ্রামস্থ নারীরূপ ধারণ), রাজসভায় সুন্দরকে দেখে ‘নারীগণের পতিনিন্দা’র অনুকরণে ‘মেয়ে মজলিসে নারীদের প্রতিরূপ বর্ণনা’ (এখানে মেয়েরা পতিনিন্দা করেনি, বরং চাকুরীজীবী ব্যস্ত স্বামীদের নিয়ে তাদের প্রচ্ছন্ন গর্বই প্রকাশিত হয়েছে এখানে, এবং স্বামীদের কর্মব্যস্ততার সুযোগে তারা কী ধরনের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করে, সে কথাও বর্ণিত হয়েছে) প্রভৃতি উপাদানের ক্ষেত্রে ভবানীচরণ ঐতিহ্যের অনুসারী ৷ পুরুষের নারীবেশ ধারণের উল্লেখ মহাভারত, পুরাণ, কামসূত্র থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে বারবার উল্লিখিত হয়েছে ৷ নায়ক-নায়িকার মিলনের অনুষঙ্গে প্রার্থিত পিসি এবং দাসীদের সঙ্গে পুরুষকে দেখে নায়িকার মান, নায়ক কর্তৃক তার মানভঙ্গ, দাসীর শরীরে সম্ভোগচিহ্ন দেখে নায়িকার অভিমান—প্রভৃতি বর্ণনা স্পষ্টতই বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলার আদলে আঁকা হয়েছে ৷ অর্থাৎ প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসাহিত্যের ধারাবাহিকতার যুগোপযোগী ‘প্রতিসরণ’ এবং ‘পুনঃস্থাপন’ই ভবানীচরণের দূতীবিলাস কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ৷

‘স্ত্রীজাতির দুরাচরণের কথা’

দ্বিতীয় বইটির নাম স্ত্রীজাতির দুরাচরণের কথা (১৮৪০) ৷ আড়ষ্ট সাধু গদ্যে লেখা এই ৪০ পৃষ্ঠার চটি বইটিতে রয়েছে চারটি ছোটো নীতিগল্প ৷ এগুলির বিষয়বস্তু হল—নারীজাতির ছলাকলা এবং শরীরী আবেদন কীভাবে সর্বগুণসম্পন্ন পুরুষকেও সর্বনাশের সীমায় নিয়ে যায় ৷ এই গল্পের পুরুষ চরিত্রেরা প্রায় সকলেই বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র ৷ কিন্তু এই গল্পগুলি আদৌ যথার্থ পৌরাণিক নয়, কারণ এগুলি কোনো খাঁটি, নির্ভেজাল পুরাণকাহিনি অবলম্বনে গড়ে ওঠেনি ৷ বরং কবি কালিদাস স্বয়ং এই গল্পগুলিতে রয়েছেন একটি চরিত্র হিসেবে ৷ প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রকৃত/কাল্পনিক রাজপুরুষের তিনি সঙ্গী ও পরামর্শদাতা ৷ যেমন, ধরা যাক প্রথম গল্পটির কথা ৷ মূল কাহিনিটি মহাভারত থেকে নেওয়া ৷ উজ্জয়িনীরাজ শ্রীবৈজভূপাল একদিন বেলাবসানে উদ্যানে ভ্রমণ করতে করতে ‘সরস্বতীর বরপুত্র’ কালিদাসের কাছে জানতে চাইলেন ‘স্ত্রীজাতির দূরাচরণের কথা’ ৷ কালিদাস তাঁকে বললেন ‘কাশ্মীর তুরঙ্গমী কথা’—যে গল্পের মূল নীতিবাক্য হল : ‘‘অনির্ব্বার্য্য দর্প কন্দর্পের প্রধান শস্ত্র স্ত্রীজাতি তাহার বশে যে না আইসে সেই ইহলোকে পরলোকে জয়ী আর স্ত্রীজিত যে জন সে সর্বত্র পরাজিত’’ ৷ গল্পটি এরকম : ‘অতিধন্য মান্য প্রতাপশালী কাশ্মীররাজ’ একদিন শিকারের উদ্দেশ্যে প্রথম রাত্রে মহারণ্যে প্রবেশ করে শুনতে পেলেন—‘‘মনোহর মধুর বামাস্বরে গান ও কঙ্কণালঙ্কার ঝণৎকার নূপুরাদির শব্দ’ ৷ তিনি সেই শব্দ অবলম্বনে একাকী পদব্রজে এগোতে লাগলেন ৷ কারণ তখন তিনি ‘অনির্ব্বার্য্য কামপীড়াতে ব্যথিত বুদ্ধি’ ৷ এরপর :

কাশ্মীররাজ বনমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ঐ মনোহর কুঞ্জমধ্যে পরমসুন্দরী স্ত্রীকে দেখিতে পাইয়া কামাতুর হইয়া তাহার বস্ত্রাঞ্চল গ্রহণোদ্যত হওয়ামাত্রে ঐ যুবতী কাশ্মীররাজকে নিতান্ত কামপীড়িত জানিয়া ক্ষণমাত্র প্রত্যক্ষগোচরা কদাচিৎ অতিদূর বিদ্যুতের ন্যায় দৃশ্যমানা কদাচিৎ সন্নিবিবর্ত্তিনী ভুয়ো ভুয়ঃ হওত নানা বাকচাতুরী করিতে লাগিল ৷ ইহাতে মহারাজ অতি দীনহীন ন্যায় সানুনয় কাতরোক্তিতে কহিলেন—হে সুন্দরি আমি অদ্যাবধি আমার সর্বস্বসমেত আত্মসমর্পণ তোমাতে করিয়া তোমারি অধীন হইলাম ৷ রাজার এতাদৃশ বচন শ্রবণ করিয়া সেই স্ত্রী হাস্য করিয়া কহিল হে মহারাজ আপনি যদি আমার সঙ্গে সত্য করেন তবে আমি যাবৎ পর্যন্ত এ মনুষ্যলোকে থাকিব তাবৎ পর্য্যন্ত আমার এ শরীর আপনাকে সমর্পণ করিব ৷২৭

এরপর ওই পরমাসুন্দরী রমণী রাজাকে যা বলল, তা অনেকাংশেই রূপকথার উপাদানতুল্য ৷ সে বলল সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত প্রতিদিন সে রমণীরূপ ধারণ করলেও দিনের বেলায় সে ঘোটকীতে পরিণত হয় ৷ রাজা যদি সত্যিই তাকে পেতে চান তবে তাঁকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, ‘দিবাভাগে ঘুড়ী স্বরূপে’ থাকার সময় তিনি যেন সেই ঘোটকীর ‘‘উচ্ছিষ্ট তৃণবিষ্ঠা প্রস্রাবাদি বহিঃপ্রক্ষেপ’’ ও ‘‘ঘর সম্মার্জন অর্থাৎ ঘোড়াশালা ঝাঁটান ও ঝাঁটিয়া ফেলান’’ করতে রাজি থাকেন ৷ রাজা এহেন হীন কাজেও সম্মত হলেন ও ‘‘পরিহাস্যপূর্ব্বক বহুবিধ ক্রীড়া কৌশলে সেই অঙ্গনাসঙ্গে কামরঙ্গে কালযাপন করিয়া প্রত্যুষে ঐ তুরঙ্গীপৃষ্টে আরূঢ় হইয়া স্বরাজধানীতে উপস্থিত হইলেন ৷’’

দেশে ফিরে রাজা রাজকার্যে চূড়ান্ত অবহেলা দেখাতে শুরু করলেন, কারণ তিনি তখন পুরোপুরি রিপুর বশ ৷ প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করল ৷ অবস্থা বেগতিক দেখে ‘বিদুর নামে পরম ধার্ম্মিক কারুণিক সাত্বিক তত্বজ্ঞানী কাশ্মীররাজ মিত্র’ এগিয়ে এলেন উপকারার্থে ৷ রাজার দুর্মতি ঘোচাতে তিনি দ্বারকানগরীতে গিয়ে দ্বারস্থ হলেন ‘সর্বশক্তি নরাবতার স্বয়ং নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণসমীপে’ ৷ এক্ষত্রে তিনি একটি কৌশল অবলম্বন করলেন ৷ শিশ্নোদরপরায়ণ রাজার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি সেই ঘোটকীর অসাধারণ গুণাবলি ঈষৎ রং চড়িয়ে বললেন, যাতে শ্রীকৃষ্ণ প্ররোচিত হন এবং সিদ্ধান্ত নেন—সেই ‘অশ্বরত্ন গ্রহীতব্য বটে’ ৷ শ্রীকৃষ্ণ দূত মারফত কাশ্মীররাজের কাছে পত্র পাঠালেন—‘তুমি আমাকে ঐ অশ্বী প্রতিদান কর অন্যথা আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করিব ৷’ ভীত কাশ্মীররাজ সাহায্যের জন্য কৌরবপ্রধান দুর্যোধনের শরণাপন্ন হলেন ৷ কিন্তু দুর্যোধন তাঁকে সাহায্যদানে সম্মত হলেন না, কারণ সামান্য একটি ঘোটকীর জন্য তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেকে কলঙ্কিত করতে চান না ৷ অগত্যা কাশ্মীরাজ পাণ্ডবদের কাছে আশ্রয় চাইলেন ৷ তাঁরাও তাঁকে সাহায্য করলেন না, কেবল ‘বলিষ্ঠশ্রেষ্ঠ গোঁয়ার মধ্যম পাণ্ডুনন্দন ভীম’ ঘোটককীর লোভে কৃষ্ণের বিপক্ষে চলে গেলেন ৷ যুদ্ধ সমীপবর্তী হয়ে এলে কাশ্মীররাজ, কৃষ্ণ ও তাঁর নারায়ণীসেনা ভয়ে পাণ্ডবদের অন্তঃপুরে মহিলাদের মাঝখানে গিয়ে লুকোলেন ৷ এরপর যা ঘটল তা রীতিমতো চমকপ্রদ :

কুন্তি মুহুর্মুহু বিলাপ করিতে ২ অন্তঃকুপিতা হইয়া দাসিবর্গকে আজ্ঞা দিলেন ওলো দাসিরা দেখতো সে সর্ব্বনেশে অলপ্পেয়ে পোড়াকপালে হাবাতে কোথা আছে ৷ চাকরাণিরা মহারানীর আজ্ঞা পাইয়া কেহ বেত্র কেহ সম্মার্জনী অর্থাৎ খোঙরা কেহ চর্ম্মপাদুকা হস্তে করিয়া..বহুবিধ কটুকথা নিষ্ঠুর মর্ম্মান্তক বাক্যে অনেক গালাগালি দিল ৷… কাশ্মীররাজ হাঁ ও ভেল ২ করিয়া দাসিরদের মুখপানে চাহিয়া থাকিলেন ৷২৮

অতঃপুর তোরঙ্গী রাজাকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করল ও ‘কাশ্মীররাজ ভেকুয়া হইলেন ৷’ কালিদাসের জবানিতে ‘স্ত্রৈণ্য দোষবিশিষ্ট’ ব্যক্তির সর্বনাশ জ্ঞাপন করে কাহিনি এখানেই শেষ হয় ৷

এই বইয়ের অপর একটি গল্পে পাই ‘বীরশেখর’ নামক এক অত্যন্ত কামুক রাজার কথা ৷ একদিন বনমধ্যে বেণুজীবী-জাতীয়া এক কন্যাকে ‘পুষ্করিণী’তে স্নান করতে দেখে রাজা ‘বার্দ্ধক্যপ্রযুক্ত সিথিলেন্দ্রিয় হইয়াও কেবল মনের ঔৎসুক্যমাত্রেতে সেই ডোমের মাইয়াকে বলাৎকার করিতে’ উদ্যত হলেন ৷ তাকে বিবাহ করে ঘরে আনলেন রাজা ৷ অথচ বৃদ্ধ পতি তাকে তৃপ্তি দিতে পারত না বলে সেই রমণী অন্য একাধিক যুবা পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগে লিপ্ত হত ৷ একদিন কোনো এক উপপতির সঙ্গে সে গৃহত্যাগ করল ৷ রাজাকে হত্যা করে তাঁর রত্নপেটিকা সমেত রাতের অন্ধকারে ঘর ছাড়ল সে ৷ কিন্তু সেই উপপতি তার সমস্ত ধনরত্ন হাতিয়ে অন্ধকার রাস্তায় তাকে ফেলে রেখে চলে গেল ৷ সে যখন বিশ্বাসঘাতক পুরুষটিকে অভিসম্পাত দিচ্ছে তখন ধর্ম শৃগালের রূপ ধরে এসে তার কৃতকর্মের স্বরূপ উন্মোচন করলেন :

ইহার অর্থ তুমি আপনার ছিদ্র অর্থাৎ দুশ্চরিত্র জান না অর্থাৎ মনে স্মরণ কর না অথচ পরের ক্ষুদ্র ছিদ্র অনুধাবন কর আপনি হাতে পতিকে নষ্ট করিয়া লেঙটা হইয়া জলে দাঁড়াইয়া আছে ৷২৯

এক্ষেত্রে কৃতকর্মের প্রতিফল ভোগ করছে মেয়েটি ৷ প্রত্যেকটি গল্পই আমাদের দীর্ঘকালীন পৌরাণিক বা লোকমুখে প্রচলিত কাহিনিভাণ্ডার থেকে নেওয়া ৷ সেই কাহিনিসূত্রের ভিতর মাঝে মধ্যেই উপাদানের অদলবদল ঘটে যাচ্ছে, একটি কাহিনির চরিত্র মিশে যাচ্ছে অন্য কাহিনির চরিত্রের সঙ্গে ৷ পৌরাণিক চরিত্রগুলোও তাঁদের অতীত মহিমা থেকে বিচ্যুত ৷ ভীমের বিশেষণই তার প্রমাণ ৷ কুন্তীর উক্তি শুনে মনে হয় উনিশ শতকের গ্রাম্য মেয়েলি ভাষা শুনছি ৷ একইভাবে দ্বিতীয় গল্পেও ‘ডোমের মাইয়া’ বা ‘লেঙটা হইয়া জলে’ দাঁড়িয়ে থাকার বর্ণনা একেবারেই সাধারণ জনসমাজের ভাষার প্রতিধ্বনি ৷ অবিকল মৌখিক সাহিত্যের রীতি অনুযায়ীই যেন এখানে ঐতিহ্যবাহী কাহিনির ভিতর সমকালীন উপাদান ঢুকে পড়েছে এবং কাহিনির রূপের পরিবর্তন ঘটেছে ৷ অর্থাৎ ‘ধারাবাহিকতা’  এখানে ছাপাখানার দৌলতে জনপ্রিয় উপাদানের মুদ্রিত চেহারায় এসে একধরনের ‘ছেদ’-এর সম্মুখীন হচ্ছে ৷ কারণ ‘পুরাণ’ এখানে আর অবিকল ‘পুরাণ’ থাকছে না ৷ জনসমাজের নিজস্ব চাহিদা এই ‘নিষ্পুরাণিকরণ’ ঘটাচ্ছে ৷ আরও লক্ষণীয়, এই টেক্সট-এর ভিতর পুরুষের লিঙ্গ আধিপত্য ও লিঙ্গ-রাজনীতি অত্যন্ত প্রকট ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজের মতোই এখানেও নারীর সত্তা এবং শরীর পুরুষের কাছে যুগপৎ ভোগ এবং আতঙ্কের স্থায়ী উৎস ৷ তাই চাণক্যের মুখ দিয়ে এখানে বলানো হয়েছে—‘স্ত্রীরা যদ্যপি অবলাও হয় তথাপি অতিপ্রবলা যেহেতুক অটল অতিবড় মহান ভবদিগকেও টলিত করে ৷… অতএব নীতিশাস্ত্রমতে স্ত্রীতে অত্যন্ত অনুরাগ ত্যাগের নিমিত্ত স্ত্রীর প্রতি নিন্দা অনেক প্রকার আছে ৷’’—এইদিক থেকে এই টেক্সট-এর চরিত্র রীতিমতো ‘লিঙ্গাত্মক’ ৷

অন্যদিক থেকেও এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে যেভাবে পুরুষার্থের ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার হুবহু প্রতিফলন পাই এখানে ৷ ধর্ম, অর্থ ও কাম—এই তিনের সামঞ্জস্যেই যে পুরুষের সার্থকতা, তা এই বইতে স্পষ্ট বলা হয়েছে ৷ রাজপুরুষদের জন্য অবশ্যপালনীয় উনিশটি গুণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘‘ধর্ম্ম হইতে অর্থসিদ্ধি অর্থেতে কামসিদ্ধি তাহা হইতে সুখ ফলোদয় ইহাও নীতিজ্ঞেরদের নিশ্চিত মত ৷ …তিনের মধ্যে অন্যতম একমাত্রের সেবাতে অন্য দুই… নষ্ট হয় ৷’’ আর ‘কাম’-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এইভাবে : ‘‘কাম শব্দে আত্মসংযুক্ত মনেতে কর্ম চর্ম চক্ষু জিহ্বা নাসিকাখ্য পঞ্চজ্ঞান ইন্দ্রিয়ের স্ব স্ব গ্রাহ্যশব্দাদি বিষয়ক যে সুখ তাহাকে কহে ৷’’—অর্থাৎ ‘কাম’ এক সর্বাত্মক, সর্বেন্দ্রিয় অনুভূতি এবং এর উপভোগের নৈতিকতাও এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়বস্তু ৷ ১৮৫০-এর দশকের পর থেকে শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক যে নতুন সেক্সুয়ালিটির ডিসকোর্সের দিকে ঝুঁকে পড়বেন, সেখানে ‘কাম’-এর প্রাক-ঔপনিবেশিক, দেশীয় বৃহত্তর জনসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রতিস্থাপিত হবে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত যৌনতার উপযোগবাদী সংজ্ঞা দ্বারা ৷ যৌনতা-সংক্রান্ত এক সার্বিক নৈঃশব্দ্য লাগু হবে ‘বাঙালি ভিক্টোরিয়ান’ শিক্ষিত মননে ৷ সেদিক থেকে এই টেক্সট আমাদের সামনে এক বৃহত্তর ভিন্ন যৌনতার নৈতিকতা হাজির করে, যে নৈতিকতা দেশীয় জনসমাজের কাছে সুপরিচিত, কিন্তু ঔপনিবেশিক ও দেশীয় এলিটের চোখে বর্জনীয়, যে কারণে বটতলা থেকে প্রকাশিত এইসব বইপত্রকে ‘erotic’ আখ্যা দিয়ে প্রান্তিকায়িত করার চেষ্টা চলেছিল সেদিন, কিন্তু তাতে এগুলির জনগ্রাহ্যতা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি ৷৩০

‘আদিরস’

এই ধরনের অপর একটি বই আদিরস ৷ লঙ-এর তিনটি ক্যাটালগেই বইটির নাম রয়েছে ৷ সম্ভবত এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ৷ এই লেখায় যে সংস্করণটি নিয়ে আলোচনা করব সেটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৬১ সালে ৷ স্পষ্টতই এটি পরবর্তকালীন সংস্করণ ৷ এই বইয়ের অপেক্ষাকৃত পুরোনো (আনুমানিক ১৮৪০-এর দশকের) একটি সংস্করণ দেখেছি, যেটির নাম আদিরস কাব্য—শেষ পৃষ্ঠাটি বাদে দ্বিতীয় বইটির সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে প্রথম বইয়ের ৷ আদিরস মোট ৩৬টি সংস্কৃত শ্লোক ও তার বাংলা অনুবাদের একটি সংকলণ ৷ দীর্ঘ দেড়-দুহাজার বছর ধরে আমাদের প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে যে ধরনের প্রকীর্ণ কবিতার সংকলন চালু ছিল, এটিও তারই আধুনিক সংস্করণ ৷ সংস্কৃত-প্রাকৃত ঐতিহ্যে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, ‘কবীন্দ্রবচনমুচ্চয়’, ‘শৃঙ্গারশতক’, ‘গাহামত্তসঈ’-জাতীয় কাব্যের চল ছিল, যেখানে এক-একটি শ্লোক এক-একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য বা ভাবকে প্রকাশিত করে ৷ আদিরস বইটিও সেই দেশীয় ঐতিহ্যেরই অনুবর্তী, এতে সমকালীনতার ছাপ, অন্তত বিষয়বস্তুর দিক থেকে নেই বললেই চলে ৷ বইতে লেখকের নাম না থাকলেও, অনুমান করা যায় কোনো সংস্কৃতজ্ঞ দেশি পণ্ডিতের তত্তাবধানেই রচিত হয়েছিল এটি এবং এর অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ায় প্রমাণিত হয়, বাঙালি পাঠকের কাছে বইটির গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৷ উনিশ শতকের গোড়া থেকে কিছুটা পাশ্চাত্য ওরিয়েন্টালিজমের তাগিদে, কিছুটা দেশীয় শিক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্যোগে প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যগুলি নতুন করে মূল্যায়ন ও উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয় ৷ বটতলা সাহিত্যও যে এই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল না, তা বোঝা যায় আদিরস বইটি পড়লে ৷ সেইসঙ্গে একথাও প্রমাণ হয় যে বটতলার সাহিত্য নিছক নিম্নবর্গের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না ৷ এই সাহিত্য আসলে একধরনের আড়াআড়ি সামাজিক বিভাজনকে চিহ্নিত করে, কারণ সংস্কৃত কাব্যের অনুকরণে লিখিত এই ‘কামসাহিত্য’ও পুরোপুরি সংস্কৃত সাহিত্যের অনুসরণ নয়, তার ভিতর ঢুকে পড়েছে এমন অনেক উপাদান, যা আবার এই সাহিত্যের বৃহত্তর জনসমাজের উপযোগী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিকে স্বীকৃতি দেয় ৷ আদিরস বইটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৷

বইয়ের শুরুতেই এর রচনাকার হিসেবে দেওয়া হয়েছে কবি কালিদাসের নাম—‘মহাকবি কৃত কালিদাস/সকল কাব্যের সার, / আদিরস কাব্য তার / ভাষামতে কবির প্রকাশ’ ৷ অথচ কালিদাসের গ্রন্থতালিকায় আদিরস নামের কোনো পৃথক গ্রন্থ পাওয়া যায় না ৷ যে তিনটি কাব্যকে ‘শৃঙ্গারকাব্যত্রয়ী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কালিদাসের সেই তিনটি কাব্য যথাক্রমে ‘শৃঙ্গারসাষ্টক’, ‘শৃঙ্গারতিলক’, ও ‘পুষ্পবাণবিলাস’ ৷ তিনটিই শৃঙ্গার-রসাত্মক ‘মুক্তক’ কাব্য ৷ নবম শতকে আলংকারিক বামন এঁদের বলেছেন ‘অনিবদ্ধ কাব্য’ ৷ পূর্ববর্তী হাল-রচিত ‘গাহাসত্তসঈ’ ও অমরু-রচিত ‘অমরুশতক’-ও এধরনের ‘মুক্তক’ কাব্য ৷ আদিরস বইটি পড়লে দেখা যায় এটি মূলত ‘শৃঙ্গারতিলক’ অবলম্বনে রচিত ৷ কালিদাসের ‘শৃঙ্গারতিলক’-এ মোট শ্লোকসংখ্যা ২৬; কিন্তু আদিরস-এ শ্লোকসংখ্যা বেশি হবার কারণ, লেখক হয় অন্য সংস্কৃত কাব্য থেকে শ্লোক তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন, সেগুলি চালিয়ে দিয়েছেন কালিদাসের নামে, অথবা সেগুলি আদিরস বইয়ের প্রথম সংস্করণ থেকেই রয়েছে বলে এখানেও ঠাঁই পেয়েছে, এমনও হতেই পারে ৷ এই কাব্যের যারা সম্ভাব্য পাঠক তাদের কাছে ‘কালিদাস’ নামটিই কেবল পরিচিত, কালিদাসের মূল কাব্যের সঙ্গে তাদের কোনো যোগই নেই ৷ লেখকও সে বিষয়ে সচেতন ৷ তিনি শুরুতেই মনে করিয়ে দিয়েছেন রসিকের পাশাপাশি অরসিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এই আদিরসের পঙক্তিতে::

 অরসিক যেইজন রসে তার মজে মন

 রসিকের কত বাড়ে রস ৷

 নাগর শুনিলে পর না ছাড়ে নাগরীর ঘর

 নাগরী নাগরের হয় বশ ৷ ৷৩১

প্রথম শ্লোকেই কালিদাসের অনুসরণ ৷ ‘শৃঙ্গারতিলক’-এর প্রথম ‘তিলক’, প্রথম শ্লোক অনুসরণে সরোবর-রূপী নায়িকার বর্ণনা : ‘বাহু দ্বৌ চ মৃণাল মাস্য কমলং…’ যার বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে এইভাবে :

পদ্মের মৃণালতুল্য দেখি ভুজদ্বয় ৷

বিকল কমল শোভা বদন নিশ্চয় ৷ ৷

মাধুর্য্য সৌন্দর্য্য ভঙ্গি সেই জান জল ৷

কটিদেশ রম্যঘাট বসিবার স্থল ৷ ৷

শ্রোষ্ঠীমৎস্য তুল্য নেত্র খেলিতেছে তায় ৷

সেয়ালা চাঁচর কেশ কিবা শোভা পায় ৷ ৷

কামিনীর কমনীয় যুগ পয়োধর ৷

চক্রবাক চক্রবাকী শোভে মনোহর ৷ ৷

কামাগ্নি তাপিত লোকে করিতে শীতল ৷

নির্ম্মাইল বিধি এই সরোবর জল ৷৩২

—প্রায় হুবহু কালিদাসের অনুকরণ ৷ তবে বেশ কয়েকটি শ্লোকে লেখক কালিদাস থেকে সরেও এসেছেন ৷ যেমন, ১০ম ও ১১শ-তম শ্লোক ৷ ‘শৃঙ্গারতিলক’-এর ‘প্রথম তিলক’-এর তৃতীয় শ্লোকে রাত্রি অবসানের পরও নায়িকার বেশভূষা অটুট রয়েছে দেখে সঙ্গী প্রশ্ন করেছে নায়িকাকে:: ‘‘হে সখী… ব্যাপার কি? তুমি কুপিতা হয়েছিলে, নাতি তোমার পতি নিতান্ত বালক?’’ এই অংশের অনুবাদ যথাযথ—‘‘গজেন্দ্র গামিনী বুঝি করেছিলে ক্রোধ ৷ / কিম্বা তব পতি শিশু নাহি রস বোধ ৷ ৷’ কিন্তু কালিদাসের নায়িকা উত্তরে বলেছিল :

রতিগৃহে গিয়ে আমি কুপিতা হইনি, আমার প্রিয়তমও বালক নয় ৷ নবযৌবনা, সচকিতা এবং কন্দর্পগর্বহারিনী আমাকে দেখামাত্র (প্রবাসপ্রত্যাগত) তার শুক্রপাত হল ৷ তাই রতিক্রিয়ার কোনো প্রসঙ্গই ওঠে না ৷৩৩

আদিরস কাব্যের ১৮৬১ সালের সংস্করণে এই মূল শ্লোকটি বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে ৷ তার কারণ কি ‘অশ্লীলতা নিবারণ আইন’-এর ফলে মুদ্রিত বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা অথবা লেখক যৌনরুচির বদল টের পেয়ে নিজেই শ্লোকটির ভিতর ‘অশ্লীলতা’ খুঁজে পেয়েছেন? যদি তাই হয়, তবে বলতেই হবে ঔপনিবেশিক ও দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের নতুন ‘শ্লীলতা’/‘অশ্লীলতা’র মাপকাঠি বটতলার মুদ্রণসংস্কৃতিকেও অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল ৷ প্রথম তিলক-এর শেষ শ্লোকের সঙ্গে আদিরস-এর একাদশ শ্লোক মিলে যাচ্ছে ৷ কালিদাসের ‘পূর্বদিক সপত্নীর মত রক্তাক্ত হয়ে উঠল’ অংশটি এখানে হয়েছে—‘রাগিনী সতিনী পূর্ব্ব দিক প্রকাশিল ৷ ৷’

শৃঙ্গারতিলক’-এর চতুর্থ তিলকের প্রথম দুটি শ্লোকও এখানে ঈষৎ পরিবর্তিত ৷ গৃহে স্বামী-শাশুড়ি কেউ নেই, এমতাবস্থায় একাকী যুবতী বিদেশি পুরুষকে বাড়িতে রাত্রিবাসের অনুমতি দিচ্ছে না যুবতী—এই শ্লোকটি আদিরস-এও রয়েছে ৷ কিন্তু এর পাশাপাশি এই শ্লোকের ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যাও চোখে পড়ে ৷ যেমন, মূল শ্লোকটি ছিল : ‘‘যামিন্যেষা জলদ পটলৈর্বদ্ধ ভীমান্ধকারা… ৷’’ এর ‘আমি বালিকা—কন্দর্পের ভয়ে থরথর করে কাঁপছি’ অংশটির অর্থ বদলে গেছে এরকম অনুবাদে : ‘আমি বালা মদন জ্বালায় জ্বালাতন’ ৷ এবং যুবতী এখানে ‘‘কামভাবে উপযাচিকা হইয়া ওই অতিথির প্রতি কহিতেছেন’’—বলা বাহুল্য, এই ভাব মূল শ্লোকের সম্পূর্ণ বিপরীত ৷ কলিদাসের কাব্যের পঞ্চম তিলকের শেষ শ্লোকটিতে মত্ত বারাঙ্গনাদের নয়নসৌন্দর্য দেখে ভাগ্যবান কৃষ্ণসারমৃগেরা দেশত্যাগ করেছেন ৷ কিন্তু আদিরস কাব্যে এই বারাঙ্গনারা ‘বঙ্গদেশীয়’, যা মূল কাব্যে নেই—‘‘বঙ্গদেশী বেশ্যাদের নয়ন সৌন্দর্য্য ৷ / হেরে কৃষ্ণসার মৃগ লাজেতে অধৈর্য্য ৷ ৷’’ উভয় ক্ষেত্রেই ভাবপরিবর্তন এবং বিশেষণটি সমকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে কাব্যটিকে প্রতিস্থাপিত করে, যা হয়তো বই বিক্রির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে ৷ তবে দু-একটি চটুল অংশ মূল থেকে সামান্যও পরিবর্তন করা হয়নি ৷ যেমন ব্যাধিগ্রস্থ পুরুষের রোগ উপশমের জন্য রতিমিলনের পরামর্শ (শৃঙ্গারতিলক, পঞ্চম তিলক, প্রথম শ্লোক) :

সর্ব্বরোগনাশিনী কি প্রিয়া নাই ঘরে ৷

কুচকুম্ভ মর্দ্দনে বাতিক নষ্ট করে ৷ ৷

মুখামৃত পানে পিত্ত নিত্যদূর হয় ৷

তার সহ রতিকর্ম্মে কফ কোথা রয় ৷ ৷৩৪

অথবা পুরুষ যখন ব্যঙ্গ করে যুবতীকে প্রশ্ন করছে : ‘‘পতিত হয়েছে কেন কুচদ্বয় তব?’’ (মূলকাব্য, ষষ্ট তিলক, শ্লোক-২) ৷ যুবতী তখন উত্তর দিচ্ছে অতিরিক্ত শৃঙ্গারই স্তনের উচ্চতার অবনতির কারণ : ‘‘অহে মূঢ় কি ছার মাংসের কুচদ্বয় ৷/অধতে খুদিলে গর্ত্ত গিরি নত হয় ৷ ৷’ (আদিরস, ২৪ তম শ্লোক) ৷ ৷৩৫

পূর্বোক্ত আদিরস কাব্য বইটিতে এমন একটি বর্ণনা আছে, যা এই আদিরস বইতে নেই ৷ এটি বল্লাল সেন-সংক্রান্ত একটি অতিপরিচিত কাহিনি (প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, বল্লাল সেনকে নিয়ে এধরনের অসংখ্য সত্যিমিথ্যে রটনা উনিশ শতকের বটতলা সাহিত্যে পাওয়া যায়, যেমন :শ্রী নারায়ণ চট্টরাজ বিরচিত কলিকৌতুক নাটক, ১৮৮৫ খ্রি.) ৷ আদিরস কাব্য-র বিবরণটি এরকম : বল্লাল সেনের পুত্র ভবানন্দ সেন বিদেশে গিয়েছেন কর্তব্যোপলক্ষে ৷ ভবানন্দের স্ত্রী পতিবিরহে মদনজ্বালায় কাতর ৷ আপন মনের খেদোক্তি তিনি কাকে কীভাবে জানাবেন? বল্লাল সেন যখন দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে বসেছেন, তখন পুত্রবধূ মাটিতে জলের দাগ কেটে মনোবেদনা ব্যক্ত করলেন—‘‘নিবাসে আইসে কান্ত/নতুবা আসে কৃতান্ত/তবে হয় দুঃখ শান্ত/অভাগিনী অন্তর ষুড়াই ৷ ৷’ বল্লাল সেন তৎক্ষণাৎ ছেলেকে চিঠি লিখে ভর্ৎসনা করছেন :

বৃষতুল্য বুদ্ধি তব; অধিকান্ত কি কহিব

তিলেক নাহিক ভাব; ধর্ম্মাধর্ম্ম কিসেতে কি হয় ৷

সঙ্গেতে সহস্র বুঝ; প্রত্যাগমনেতে সাজ

স্বসৈন্যে মকরধ্বজ; এদেশেতে হইয়াছে উদয় ৷ ৷…

অষ্টম রাশিস্থ যিনি; যত জ্বালা দেন তিনি ৷

তেমনি দিবা রজনী; জ্বালায় জ্বলিছেন বঙ্গললনা ৷

কুলবতী যে যুবতী, পতি তার মতিগতি

স্বপতিবিহীনা সতী; বাঁচে কিসে বলনা ৷ ৷৩৬

এই কাহিনি/বিবরণ ইতিহাসের নয় ৷ কোনো ঐতিহাসিক পাথুরে প্রমাণ দিয়ে এই বর্ণনাকে অনুধাবন করা যাবে না, সমগ্র গোষ্ঠীর চৈতন্যে বহুযুগব্যাপী জমা হতে থাকে এ ধরনের বহু আখ্যান ৷ যা থেকে প্রমাণ হয় বটতলার জনপ্রিয় এই তথাকথিত ‘আদিরসাত্মক’ সাহিত্য সেই সমষ্টিগত জনমানসের হদিশ রাখত, যার খোঁজ শিক্ষিত এলিটের উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তির নিরিখে ধরা যায় না ৷ বল্লাল সেন বাংলাদেশে কৌলীন্য প্রথার জনক ৷ এই প্রথার প্রকোপে পতিসঙ্গহীনা, সধবা হয়েও স্বামীহীন জীবন কাটানো হাজার হাজার কুলীন কন্যার জীবনে নেমে এসেছিল অভিশাপ, যা উনিশ শতকেও একটি বাস্তব ও গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল দীর্ঘদিন ৷ সেজন্যই কি বল্লাল সেনকে জড়িয়ে গড়ে উঠেছিল এমন এক কাল্পনিক আখ্যান, যেখানে পতিবিরহে কাতর অসুখী পুত্রবধূর মনোবেদনা প্রশমনে এগিয়ে আসেন স্বয়ং বল্লাল সেন? জনসমাজে দীর্ঘকালব্যাপী প্রচলিত এই খণ্ডকাহিনিগুলিই কি পারে ইতিহাসের সেইসব অজানা, অন্ধকার ফাঁক ভরাট করে দিতে?

প্রতিসরণ ও ধারাবাহিকতা

লেখার শুরুতে, ‘দূতীবিলাস’ কাব্যের কথা বলা হয়েছে ৷ ভবানীচরণ চেয়েছিলেন এমন ‘আদিরস’ কাব্য রচনা করতে, যা এযাবৎ চলে আসা ‘আদিরসাত্মক’ টেক্সটের চেয়ে পৃথক কিছু হবে ৷ ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রে সকল রসের শ্রেষ্ঠ রস ‘শৃঙ্গার’ বা ‘আদিরস’ ৷ বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্যদর্পণ’-এ এই ‘শৃঙ্গাররস’কে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে : শৃঙ্গং হি মম্মথোদ্ভোদাগমন হেতুকঃ উত্তমপ্রকৃতিপ্রায়ো রসঃ শৃঙ্গার ইষ্যতে ৷…’ অর্থাৎ ‘শৃঙ্গ হইতে কামের আবির্ভাব ৷ কামাবির্ভাবের হেতুস্বরূপ যে রসের মূল প্রায়ই উত্তম প্রকৃতির হইয়া থাকে, সেই রসকেই শৃঙ্গাররস বলা হয় ৷…’৩৭

অলংকার প্রকরণের পদ্ধতি অনুযায়ী বিশ্বনাথ এরপর আলম্বন ও উদ্দীপন বিভাব, অনুভাব, ব্যাভিচারীভাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন ‘ইহাদের দ্বারা অভিব্যক্ত সহৃদয়হৃদয়স্থিত রতিভাব শৃঙ্গারস্বরূপ লাভ করে ৷’ কিন্তু লিখিত ন্যারেটিভ বহুক্ষেত্রেই অলংকার প্রকরণের বাধ্যবাধকতাকে ছাপিয়ে যায় ৷ ভবানীচরণ যে ‘আদিরসাত্মক’ টেক্সট লিখতে চেয়েছিলেন তার নতুনত্বও এখানেই নিহিত ৷ বিভাব-অনুভাব-ব্যভিচারীর প্রকরণ-নির্দিষ্টতাকে অতিক্রম করে নতুন নতুন উপাদান তিনি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন এমনভাবে, যাতে বাজারের নতুন পাঠকগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ হয় ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক রসপ্রকরণ এভাবেই ঔপনিবেশিক মুদ্রণসংস্কৃতির যুগে পৌঁছে তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলল ৷ বইয়ের নাম আদিরস হলেও আনপড় পাঠক আর তার ভিতর থেকে রসপ্রকরণ নির্ভর নান্দনিকতা খুঁজল না, বরং মুদ্রণ-পুঁজির এই হঠাৎ বিস্ফার তৈরি করল এমন এক নান্দনিক বোধ, যার সাহায্যে বিধিবদ্ধ ডিসিপ্লিনকেও স্থানচ্যুত করা যায়, তার ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া যায় প্রতিদিনের চেনা/অচেনা অন্য অনেক নতুন উপাদান ৷ যে তিনটি টেক্সট নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম সেই দুটিতে অবশ্য এধরনের সরণ-এর উদাহরণ খুবই সামান্য ৷ কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অন্য টেক্সট খুঁজলে এধরনের প্রতিসরণ পাওয়া যেতেই পারে ৷ আদিরস তাই হয়ে দাঁড়ায় একটি বিস্তৃত ঘরানা যার আওতায় ধরা পড়ে বহু ধরনের নিত্যনতুন ক্যাটেগরি—আর সেই সমস্তটা মিলিয়েই গড়ে ওঠে উনিশ শতকের ‘আদিরসাত্মক’ বই—লং-এর ভাষায় যা ‘ইরোটিক’, কেশব সেনদের ‘সুলভ সমাচার’ যাকে আরও পরবর্তী সময়ে ‘মনের দুর্গন্ধ পঙ্ক’-এর সমতুল্য বলে মনে করবে ৷৩৮ অথচ ‘দূতীবিলাস’-এর গোড়ায় ভবানীচরণ বলছেন : ‘‘সভাস্থ সকলে বলে তাহার নিকটে ৷/এই মত গ্রন্থ করা যুক্তিসিদ্ধ বটে ৷ ৷’’ অর্থাৎ ভবানীচরণ ‘হিন্দুমতে’ শাস্ত্রগ্রন্থই লিখেছেন, কেবল যুগচাহিদা অনুযায়ী তার উপাদানে কিছু নতুনত্ব এসেছে ৷ যা বদলায়নি, তা হল—গল্প বলা ও গল্প শোনার চাহিদা ৷ এই সমস্ত বই-ই আসলে কোনো-না-কোনো ধরনের গল্পের কাঠামোয় বিধৃত ৷ ভারতীয় সমাজে প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকেই কাহিনির ভূমিকা বিরাট ৷ একই কাহিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথক অর্থ বহন করে আনে, কিন্তু তাদের আবেদন কখনো ফুরোয় না ৷ যেমন রাধাকৃষ্ণের গল্প ৷ উনিশ শতকের ‘আদিরসাত্মক’ বইতে রাধাকৃষ্ণের গল্পও নানাভাবে ঘুরে-ফিরে এসেছে ৷৩৯ এভাবেই চেনা কাহিনিকাঠামোর ভিতর নতুনত্ব নিয়ে আসার প্রবণতাই জনপ্রিয় করেছিল উনিশ শতকের ‘আদিরসাত্মক’ সাহিত্যকে ৷

উল্লেখপঞ্জি

১. দূতীবিলাস; ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসরচনাসমগ্র, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ ৬৩ ৷

২. উদ্ধৃত; ঔপনিবেশিক বাংলায় ছাপা বইয়ের উপর সরকারি-বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য প্রবন্ধ, Disciplining the Printed Text : Colonial and Nationalist Surveillance of Bengali Literature by Tapti Roy; in Texts of Power : Emerging Disciplines in colonial Bengal; Ed. by Partha Chatterjee, Kolkata, 1996, p. p. 30-62.

৩.  Power in Print : Pupular Publishing and the Politics of Language and Culture in an Colonial Society (1778-1905); Anindita Ghosh; New Delhi, 2006, p. 24-25 ৷

৪. দ্র. Politics of the Possible, Essays on Gender, History, Narratives. Colonial English:  Kumkum Sangari, London, 2002, p. Xiii

৫. দ্র. পূর্বোক্ত, anindita Ghosh, p. 157 ৷

৬. Memories of My Life and Times  (1857-1884), Vol. I, Bepin Chandra Pal; Calcutta, 1932, p. 35-36 ৷

৭. দ্র: অমৃতলাল বসুর স্মৃতিকথা; পুরাতন প্রসঙ্গ, বিপিনবিহারী গুপ্ত, কলকাতা, ১৯৮৯ সংস্করণ, পৃ. ১৮৭ ৷

৮. Returns Relating to Publications in the Bengali Langueg, James Long, Calcutta, 1859, p. Xi [Selections from the Records of the Bengal Government, Vol. XXXii, 1859] ৷

৯. Ninth Report of the Calcutta Female Juvenile Society (1830). Appendix, উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, Anindita Ghosh, p. 159 ৷

১০. দ্র. সেকেলে কথা : শতক সূচনায় মেয়েদের স্মৃতিকথা, সম্পাদনা অভিজিৎ ভট্টাচার্য এবং অভিজিৎ সেন, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৬৩ ৷

১১. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, Anindita Ghosh, p. 161 ৷

১২. বাসরকৌতুক নাটক, শ্যামাচরণ দে, কলকাতা ১৮৫৯, প. ১০-১১ ৷

১৩. বাল্যোদ্বাহ নাটক, শ্যামাচরণ শ্রীমানি, কলকাতা ৷ ১৮৬০, পৃ. ৩২-৩৩ ৷

১৪. দ্র. Society in Dilemma : Nineteenth Century India. Ed. Alok Roy, Calcutta 1979, p. 203-204 ৷

১৫. দ্র. সম্বাদ রসরাজ পত্রিকা, সম্পা. গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, ১৭ জুলাই ১৮৪৯, ৩ শ্রাবণ ১২৫৬ ৷

১৬. দ্র: বাৎসায়নের কামসূত্র, ‘দূতীকর্মনী’ অধ্যায়, অনু: গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর, সম্পা. ত্রিদিবনাথ রায়, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ২৭৪-২৭৫

১৭. উজ্জ্বলনীলমণি, রূপ গোস্বামী, সম্পা: শ্রীহীরেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৩৭২ বঙ্গাব্দ, পৃ.১৮২০

১৮. কলিকাতা কমলালয়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুষ্প্রাপ্য সাহিত্য সংগ্রহ, খণ্ড-১, সম্পা: কাঞ্চন বসু, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃক্ষ. ৭২

১৯. উজ্জ্বলনীলমণি, রূপ গোস্বামী; পূর্বোক্ত ৷ এর ‘নায়কভেদ’ অংশে ‘নায়ক’-এর গুণাবলির তালিকা: ‘সুরম্য, মধুর, সর্বসূলক্ষণাক্রান্ত, বলিষ্ঠ, নবযৌবনান্বিত, সুবক্তা, প্রিয়ভাষী, বুদ্ধিমান, সুপণ্ডিত, প্রতিভান্বিত, বিদগ্ধ, চতুর, সুখী, কৃতজ্ঞ, দক্ষিণ, প্রেমবশ্য, গম্ভীর, বর্ষীয়ান, কীর্তিমান, নারীজনমনোহারী, নিত্যনতুন, অতুল্য কেলিসৌন্দর্যবিশিষ্ট ও বংশীনিক্বণকারী বা সুমধুর সুরশিল্পী ৷ পরিশেষের মন্তব্য: ‘এই সকল মাধুর্যগুণের অধিকারীই সুযোগ্য নায়ক ও মধুর রসাস্বাদনের শ্রেষ্ঠ আধার বা অবলম্বন’ ৷

২০. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ২য় খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা ১৯৯৬, পৃ. ২৬১-২৬৩ ৷

২১. উজ্জ্বলনীলমণি, রূপ গোস্বামী; পূর্বোক্ত সংস্করণ, পৃ. ৪ ৷

২২. দ্র. অশ্রুত কণ্ঠস্বর, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ২২

২৩. দ্র. সাহিত্যদর্পণ; শ্রীবিশ্বনাথ কবিরাজ প্রণীত, সম্পাদনা ও বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিমলাকান্ত মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৩৮৬, পৃ. ১৭৮

২৪. দ্র: Hindoo Female Education; P. Chapman; London, 1893, p. 28; উদ্ধৃত; The Changing role of Women In Bengal (1949-1905) Meredith Borthwick, Princeton, 1984, p. 18

২৫. ধনী লোক সন্তান লোভে বঞ্চিত কেন? চিকিৎসা সম্মিলনী, ১৮৮৬; উদ্ধৃত; সাময়িকী, (প্রথম খণ্ড), সম্পা. প্রদীপ বসু, কলকাতা, ১৯৯৮ পৃ. ২০৮

২৬. দ্র. অন্নদামঙ্গল; ভারতচন্দ্র রচনাসমগ্র, সম্পা. ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, ও ড. বিষ্ণু বসু, কলকাতা ১৯৭৪, পৃ. ২৩৮

২৭. স্ত্রীজাতির দুরাচরণের কথা অর্থাৎ শ্রীনিন্দা বিষয়ক ইতিহাস; কলকাতা, বণিক পুষ্করিণীস্থ সম্বাদ বুধানন্দ সিন্ধু যন্ত্রালয়ে মুদ্রাঙ্কিত, সন ১২৪৭ সাল ৷

২৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮ ৷

২৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪ ৷

৩০. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র. উনিশ শতকের বাংলায় শরীর-যৌনতা-অশালীনতার এলাকা নির্মাণ: অর্ণব সাহা; রক্তকরবী, সংখ্যা-৩১, জুলাই, ২০০৬ ৷ এবং উনিশ শতক : বাঙালি মেয়ের যৌনতা, অর্ণব সাহা, কলকাতা, ২০১৭

৩১. আদিরস, লেখক অজ্ঞাত, গরানহাটা স্ট্রিটে ৯২ নম্বর ভবনে এঙ্গলো ইউনিয়ান যন্ত্রে মুদ্রিত, শকাব্দ ১৭৮৩, ইং ১৮৬১, পৃ. ১ ৷

৩২. পূর্বোক্ত পৃ. ১ ৷

৩৩. শৃঙ্গারতিলক, কালিদাস সমগ্র, কালিদাস সমগ্র. সম্পা. জ্যোতিভূষণ চাকী, কলকাতা, ১৯৮২, পৃ. ৩৭ (বিবিধ পর্যায়) ৷

৩৪. আদিরস পৃ. ৮ ৷

৩৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ১০ ৷

৩৬. আদিরস কাব্য, লেখক অজ্ঞাত, প্রকাশকাল নেই, পৃ. ১৬ ৷

৩৭. শ্রী বিশ্বনাথ কবিরাজ প্রণীত সাহিত্যদর্পণ, সম্পাদনা ও বঙ্গানুবাদ, শ্রী বিমলাকান্ত মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৮০, পৃ. ২০৮ ৷

৩৮. দ্র. জঘন্য ভাষা, সুলভ সমাচার, ৪ ভাদ্র ১২৮০ ৷

৩৯. রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনিকে ‘paradigmatic Love Story of Hindu India’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সুধীর কাকর ৷ তাঁর ভাষায় : The Radha-Krishna Legend, then, is not a narrative in the sense of an orderly progression whose protagonists have a shared past and are progressing towards a tragic or happy future… A Hindu needs only to close his eyes and ‘remember’ to see Vrindavan, an Indian garden of Eden, spring into existance. In the perpetual sunshine of the myth, distinct from the mists of history, a forest thicket of ten banks of the river Yamuna awakens to life on a tropical spring day… The story, aiming to fix the essence of youthful ardour, has an amorous rather than geographical landscape as its location; its setting is neiher social nor historical but sensuous, দ্র. Tales of Love. Sex and Danger; Sudhir Kakar and John M. Ross; New Delhi, 2003, p. 76-77 ৷ উনিশ শতকের বটতলা সাহিত্যে প্রভাসমিলন, রুক্মিনীহরণ জাতীয় বই খুবই জনপ্রিয় ছিল ৷ রাধাকষ্ণের মোটিফ বটতলার ছাপা ছবিতে ছিল একটি চালু বিষয় ৷ লঙ-চিহ্নিত erotic বইয়ের বেশিভাগই হিন্দু, শৈব-শাক্ত, বৈষ্ণব বা মুসলমানি পুরাণ বা ধর্মীয় আখ্যানকাব্য, যার গল্পগুলি বহকাল যাবৎ লোকমুখে প্রচলিত ছিল ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *