পরিশিষ্ট-২ বাংলা নাটকে যৌনতা

পরিশিষ্ট-২ বাংলা নাটকে যৌনতা

রুশোর গণিকাগমন ও ‘প্যানঅপটিক্যান’

I entered a courtesan’s room as if it were the sanctuary of love and beauty; in her person I felt I saw the divinity. I could never have believed it possible to feel anything like the emotion she inspired me, without my also feeling a respect and esteem for her. No sooner did I recognize from our first familiarities the value of her charms and caresses than, fearing to lose the fruit prematurely, I tried to make haste and pluck it. Suddenly, instead of the fire that devoured me, I felt a deathly cold flow through my views; my legs trembled; I sat down on the point of fainting and wept like a child.

‘কনফেশনস’ বইতে গণিকাগমনের বর্ণনা দিচ্ছেন রুশো ৷ কিন্তু যৌনমিলনের উতরোল অনুভূতির লিখিত রূপ নয়, রুশো ক্রমশই চলে যাচ্ছেন দেহ থেকে দেহাতীতের দিকে, এক চূড়ান্ত সাবলিমেশনের জায়গায় ৷ যৌনতার কথা বলতে গিয়েও এই যে যৌনতার ঊর্ধ্বে কোনও এক অতিক্রান্ত স্তরে পৌঁছে যাচ্ছেন রুশো, এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে ‘আধুনিকতা’ ও র্‘আলোকপ্রাপ্তি’র যুগে যৌনতা সম্পর্কিত এক পূর্ণাঙ্গ, আধিপত্যমূলক দৃষ্টিকোণ, যেখানে যৌনতা কেবল প্রাকৃতিক শরীরী মিলন নয়, বরং তা এক জটিল, সুবিস্তৃত ডিসকোর্সের অংশ ৷ এ হল একধরনের ‘টেকনোলজি অফ পাওয়ার’ যা বহুবিধ কৌশলে মানুষের যৌনজীবনকে আয়ত্তে আনতে চেয়েছে ৷ খ্রিস্টধর্মীয় নৈতিকতা, গবেষক-সমাজসংস্কারকদের প্রচেষ্টায় আঠারো-ঊনিশ শতক জুড়ে ইউরোপীয় সমাজে যৌনতা সম্পর্কে গড়ে তোলা হয়েছিল কতকগুলি বিধিবদ্ধ doctrine, যার সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটলেই তাকে বিকৃত, অন্যায় যৌনাচার হিসেবে চিহ্নিত করা হবে ৷ এবং যৌনতা সম্পর্কিত এই মান্য আচরণবিধিগুলোই এক জটিল প্রক্রিয়ায় ঔপনিবেশিক শক্তির হাতফেরতা হয়ে গেঁড়ে বসেছিল উপনিবেশের মাটিতে; গোটা উনিশ শতকের শেষার্ধব্যাপী শিক্ষিত, বাবু ভদ্রলোকদের মননে ৷

ভিক্টোরীয় ইউরোপের মতো কলোনির প্রজার জীবনেও যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে, তাকে উপযোগবাদী এবং উৎপাদনশীল যৌনতার ফ্রেমে বাঁধার জন্য সামাজিক ক্ষমতা এক নতুন প্রয়োগতন্ত্র গড়ে তোলে ৷ ক্ষমতা নিজেকে অদৃশ্য এবং অগোচর রেখে নাগরিকের জীবনের প্রত্যেকটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজের অনুপ্রবেশ ঘটায় ৷ আলোকপ্রাপ্তি, মানবহিতৈষণার মোড়কে ‘ক্ষমতা’র এই সর্বাতিশায়ী, সার্বভৌম চেহারাই ‘প্যানঅপটিক্যান’ ৷ জেরেমি বেন্থাম প্রবর্তিত এই বিশেষ কারাগারের নকশা বিশ্লেষণ করে ফুকো দেখান আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক সর্বদাই ‘ক্ষমতা’র এক অদৃশ্য অথচ অন্তহীন নজরদারির আওতায় বেঁচে রয়েছে ৷ সবসময়ই তার চেষ্টা তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠা, কারণ প্রচলিত বিধি ভেঙে বেরোতে গেলেই সে চিহ্নিত হবে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে ৷ এই ‘ক্ষমতা’ আত্মনিয়ন্ত্রণ-ধর্মী ৷ অর্থাৎ সে এমন প্রক্রিয়ায় নিজেকে প্রয়োগ করে, যেখানে আধিপত্যের বাহ্যিক প্রক্রিয়াটি অদৃশ্য হয়ে যায় ৷ এই যৌনতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফুকো বলেন :

with this investment of its own sex by a technology of power and knowledge which it had itself invented, the bourgeousie underscored the high political price of its body, sensations and pleasures, its well-being and survival…what was formed was a political ordering of life, not through and enslavement of others, but through an affirmation of self.

বাংলা ‘গণসংস্কৃতি’র ক্ষেত্রেও ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মনোবৃত্তির বশেই শুরু হল একধরনের তথাকথিত অশ্লীলতা-বিরোধী অভিযান ৷ সাহিত্য-সংস্কৃতি-জীবনযাপন-আচরণ-ভাষা সবক্ষেত্রেই এই বিশেষ মানসিকতা কার্যকর হল ৷ পাবলিক থিয়েটারও সেই দৃষ্টিকোণের বাইরে রইল না ৷

নাটকে যৌনতার দুই মুখ

চর্যাপদ থেকে শুরু করে অন্নদামঙ্গল পর্যন্ত প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সমস্ত টেক্সটেই বিভিন্নভাবে নারী-পুরুষের শারীরিক আসঙ্গলিপ্সার উল্লেখ রয়েছে ৷ বিশেষত প্রবাদ, ছড়া, খেউড় গান প্রভৃতির মধ্যে শরীর ও যৌনাঙ্গের অবাধ উল্লেখ থেকে বোঝা যায় এর পিছনে সামাজিক অনুমোদন ছিল ৷ চড়ক, গাজন, খেউড় প্রভৃতি উৎসবে লোকায়ত জনসমাজ শরীরকেন্দ্রিক বলগাহীন উদ্দামতার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রকাশ করত ৷ বাখতিনের ‘কার্নিভাল তত্বে’র আলোয় বিভিন্ন পূজাপার্বণ, লোকাচার, বিয়ের আসরে জামাইকে নিয়ে আদিরসাত্মক ঠাট্টা, মেহনতি জনতার কায়িক শ্রমের মুহূর্তে সম্মিলিত ভাবে অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ—আধিপত্য ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত হিসেবে বিবেচিত হয় ৷ অথচ ব্রিটিশ প্রশাসন, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও দেশীয় ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়, কবিগান-যাত্রা-পাঁচালি-আখড়াই-হাফ আখড়াই প্রভৃতি অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ৷ পাদ্রি জেমস লং তাঁর A Descriptive Catalogue of Bengali Work বইতে কবিগান-পাঁচালি-যাত্রা সম্পর্কে অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করেন::

The Yatras are species of Dramatic action, filthy, in the same style with the exhibition of Punch and Judy or of the Penny Theatres in London, treating a licentiousnes of the amours of Krishna… They are filthy and Polluting…

১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Society for the Supression of Public Obscenity, ‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ৷ ‘গণপরিসর’কে যেকোনও মূল্যে ‘স্যানিটাইজ’ করতে হবে এই মনোভাব থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রী লেখেন :

বঙ্গদেশে নাট্যকাব্যের অভ্যুদয় এক বিশেষ ঘটনা ৷ তৎপূর্বে যাত্রা, কবি, হাপআকড়াই প্রভৃতি লোকের আমোদপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার একমাত্র উপায় ছিল ৷ অধিকাংশ স্থলে এই যাত্রা, কবি, হাপআকড়াই অভদ্র অশ্লীল বিষয়ে পূর্ণ থাকিত ৷ ইংরাজী শিক্ষা যেমন দেশমধ্যে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল, সেই সঙ্গে এই সকলের প্রতি শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের বিতৃষ্ণা জন্মিতে লাগিল ৷ অনেকে যাত্রা কবি প্রভৃতিতে উপস্থিত থাকিতে লজ্জাবোধ করিতে লাগিলেন ৷

বাংলা রঙ্গমঞ্চে বেশ্যাদের অভিনয় করা নিয়ে তৎকালীন শিক্ষিত সম্প্রদায় রীতিমতো আলোড়িত হয়ে ওঠে ৷ কেশবচন্দ্র সেনের পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’ সেদিন পাবলিক থিয়েটারে বেশ্যাদের দিয়ে অভিনয় করানোর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে ৷ ১৫ এপ্রিল ১৮৭৩-এ এই কাগজে প্রকাশিত একটি লেখায় বলা হয়::

মেয়ে নটী আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রীলোক আনিতেই হইবে, সুতরাং তাহা হইলে শ্রাদ্ধ অনেক দূর গড়াইবে ৷ কিন্তু দেশের পক্ষে তাহা মহা অনিষ্টের হেতু হইবে ৷ ভদ্রলোকের ছেলে হইয়া এরূপ জঘন্য ইচ্ছা মনে স্থান দেন ইহাই আশ্চর্যের বিষয় ৷

এই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘থি-এটর ও কুচরিত্র নারী’ নামক আলোচনায় মন্তব্য করা হয় স্কুলের ছেলেরা থিয়েটার দেখতে গিয়ে অধঃপাতে যাচ্ছে এবং বলা হয়: ‘পাঠকদিগের প্রতি আমাদের এই নিবেদন যেন যে সমস্ত থিয়েটারে স্ত্রী অভিনেতা আছে সেখানে গমন না করেন, গেলে পরে ভাল মন লইয়া ফিরিয়া আসা তাহাদের পক্ষে কঠিন হইবে’ ৷ অর্থাৎ থিয়েটারে বেশ্যাদের অভিনয় দেখতে যাওয়া এবং ব্যক্তির চারিত্রিক অধঃপতন এখানে ‘আইডেন্টিফায়েড’ হয়ে যাচ্ছে ৷ একদা কীর্তন, কবিগান, খেউঢ়, হাফ-আখড়াইকে আক্রমণ করেছিল শিক্ষিত সমাজ, আজ তাদের সেই যৌনকাতরতা ও কুণ্ঠা নতুনভাবে ফিরে এল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সামনে বেশ্যাদের প্রকাশ্যে অভিনয় করতে দেখে ৷ ‘ভারত সংস্কার’ পত্রিকা মন্তব্য করল ‘‘ভদ্রসন্তানেরা আপনাদিগের মর্যাদা আপনারা রক্ষা করেন ইহাই বাঞ্ছনীয় ৷’’ (২২ আগস্ট, ১৮৭৩) ৷

আসলে এই যাবতীয় দৃষ্টিকোণের পিছনে কাজ করছিল একটাই ভাবনা, তা হল দাম্পত্য, পরিবার, নৈতিক চরিত্র, অন্তঃপুর—কলোনির প্রজার জীবনের প্রাইভেট পরিসরটিকে ওয়েল-অর্ডারড করে তোলা ও তাকে স্যানিটাইজড করা ৷ তাই ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অসংখ্য প্রহসন লেখা হয়েছে যৌনতাকেন্দ্রিক বিচ্যুতিগুলিকে আক্রমণ করে ৷ কিন্তু আশ্চর্যের দিক হল এই প্রহসনগুলিতে যৌনতাকে নেগেটিভ দিক থেকে দেখানো হলেও শিষ্ট আবরণের নীচে সমাজের সম্পূর্ণ উল্টো সত্যিকারের চেহারাটা এতে ধরা পড়ছে ৷ লাম্পট্য, মদ্যপান, পরস্ত্রীগমন, অসতীত্ব এদের বিষয় হয়ে উঠেছে এবং শালীনতার গণ্ডি ভাঙা আকাঁড়া ভাষাও এতে খোলাখুলি ব্যবহৃত হয়েছে ৷ অর্থাৎ এখানেও কার্যকরী হয় ফুকো-কথিত proliferation of discourse-এর তত্ব, যৌনতাকে লাগাম পরানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলেও যৌনতাকেই আরও বেশি করে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা ৷ আমাদের মধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত সমাজের সুপরিচিত ডাবল স্ট্যান্ডার্ডও এর ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসে ৷ দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকে ব্রাহ্মসমাজের সভ্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেনারাম নিমচাঁদ দত্তকে জানায় সে বেশ্যাসংসর্গ করে না, অথচ উপস্থিত গণিকা কাঞ্চন সাক্ষ্য দেয় তার বেশ্যাগমনের :

নকুলেশ্বর : আপনার বেশ্যালয়ে গতিবিধি আছে?

নিমচাঁদ : প্রেজুডিস নাই ৷

কেনারাম : আমি কখন বেশ্যালয়ে যাই না, ওতে পাপ হয় ৷

কাঞ্চন : আমার বাড়িতে একদিন গ্যাছলেন ৷

কেনারাম : আমি তখনি উঠে এচলেম ৷

কাঞ্চন : উঠে এচলে, না ইচ্ছে তাড়য়ে দিয়েছিল ৷

নিমচাঁদ : বাহবা ঘটিরাম—বাবা ডুব দিয়ে জল খেলে গলায় বাঁধে ৷

১৮৬০ এবং ১৮৭০-এর দশকে লাম্পট্য ও বেশ্যাসক্তি বিরোধী বেশ কয়েকটি নাটক রচিত হয় ৷ মাইকেলের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০), প্রসন্নকুমার পালের ‘বেশ্যাসক্তি-নিবর্ত্তক নাটক’ (১৮৬১), রাধামাধব হালদারের ‘বেশ্যাসক্তি বিষম বিপত্তি’ (১৮৬৩), রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ (১৮৬৫), তারিণীচরণ দাসের ‘বেশ্যাবিবরণ’ (১৮৬৯), অজ্ঞাতনামা রচিত ‘মা এয়েছেন’ প্রভৃতি ৷ ১৮৬৮ সালে চোদ্দ আইন পাস হলেও অনেকগুলি প্রহসন রচিত হয় ৷ এখানেও বেশ্যাবিরোধী, যৌনতার অতিরেকবিরোধী মনোভাব প্রকাশিত ৷ এছাড়াও অসংখ্য সামাজিক প্রহসন, যেখানে সমকালীন সমাজের বিভিন্ন যৌন আচরণকে আক্রমণ করা হয়েছে ৷ কিন্তু তাদের ব্যবহৃত ভাষা ও অনুষঙ্গকে উল্টোভাবে পড়লে বিবিধ যৌনআচরণের ছবি বেরিয়ে আসে ৷ বোঝা যায় যৌনতা-সম্পর্কিত যে নরম্যাটিভ ডিসকোর্স মান্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত ছিল, বাস্তব ছবিটা ছিল তা থেকে বহুলাংশে আলাদা ৷ তারকচন্দ্র চূড়ামণির ‘সপত্নী নাটক’-এ স্বামীসঙ্গবঞ্চিতা কুলিন কন্যা নিতম্বিনী তার অতৃপ্ত দেহমনের বাসনা প্রকাশ করলে বোন চঞ্চলা বড়দি কাদম্বিনীকে বলে ওঠে::

দিদি, শুনলি নিতু যেন এককালে ক্ষেপে উঠলো মা, ওর আগুন জ্বলে উঠ্যেছে ও আর থাকতে পারে না, ও মা ৷ চেনা দায় ৷

এই নাটকেই মা হরমণি তার মেয়ে হরিপ্রিয়াকে শোনাচ্ছে নিজের গুপ্ত জীবনের বৃত্তান্ত ৷ কুলগুরুর সঙ্গে রাতের পর রাত ধর্মাচরণের অছিলায় হরমণি তার অতৃপ্ত দৈহিক বাসনা পূরণ করত ৷ সে বলেছে::

তাঁর (গুরুর) মুখের পানে চেয়েও কত শাস্তরের কথা শুনি এত কি ঢলয়ে থাকি? কর্ব্বো কি বল? …আমরাও তো সব হল্যেম কুলীনের মাগ, স্বামী কেমন সামিগ্রি, কাল কি ধল ভাল করে চক্ষেও দেখিনি ৷ আমরা কি আর পোঁদে কাপড় দি না গা? না কাল কাটাই না?

হরিমোহন কর্ম্মকার রচিত ‘মাগ-সর্বস্তব’ নাটকে পামর কোম্পানির ক্যাশিয়ার গণিকাসক্ত পুরুষদের উদ্দেশে বলেছে:: ‘আরে ব্যাটারা, তোরা রাঁঢ়ের বাড়িতে লোচ্চামি করতে যাস, সমস্ত রাত কাটিয়ে আসিস, বাড়িতে তোদের মাগকে কে ঠাণ্ডা করে? তারাও তো লোচ্চা খুঁজে বেড়ায় ৷’’ রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে বিবাহ ব্যবসায়ী কুলীন ব্রাহ্মণ অধর্মরুচি মুখোপাধ্যায় পুরোহিত ধর্মশীলকে বলেছে তার সবকটি বউকে সে সর্বদা সঙ্গদান করতে পারে না ৷ ফলত, তার বিবাহিতা স্বামীবঞ্চিতা কুলীন বধূরা প্রায়ই অন্য পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করে ৷ লোকনিন্দার ভয় এড়াতে তখন শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা খাইয়ে অধর্মরুচির মুখ বন্ধ করা হয় : ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ভ্যালারে মোর বাপ’ নাটকে নায়ক কলিরকাপ বৃদ্ধ সিঁদুরমাতাকে বলেছে যে, সে নিজে বেশ্যাবাড়ি যায় না ৷ কিন্তু ঘরের ভিতর নিজের বৌকে বেশ্যার মতন সাজিয়ে নিজের সেই অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করে সে ৷

আবার সমাজে বেশ্যাবিরোধী প্রচার ও সমালোচনা সম্পর্কেও বেশ্যারা যথেষ্ট সচেতন, নাটকে এধরনের দৃশ্যের অবতারণাও রয়েছে ৷ ‘সুধাকর বিষময়’ নাটকের বারাঙ্গনা আশঙ্কা এবং দুঃখ নিয়ে মন্তব্য করে :

কতকগুলো ভণ্ডলোক আমাদের পাছে লেগেছে, ছি ছি অপমান করে আমাদের তাড়িয়ে দেবে… কতকগুলো ছোঁড়া যারা পড়ে শুনে মাঙট হয়েছে, তারা পাশ ফিরিয়ে নবাবপুত্রের মতন চলে যায় ৷ যদি চায়, নাকমুক শিটকে চলে যায় ৷ সেই ছোঁড়ারা আমাদের তাড়াবার যোগাড় কচ্ছে ৷

অর্থাৎ যৌনতা সম্পর্কে যে ইউটিলিটারিয়ান ও ভিক্টোরিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি সেদিন সমাজে ছড়িয়ে পড়ছিল তা স্পর্শ করেছে বাংলা নাটকও ৷ তবে, নাটকের প্রধান গুরুত্ব তার পারফরম্যান্সে ৷ নাটক পারফরর্মিং আর্ট ৷ উপরোক্ত রাশি রাশি বাংলা নাটক-প্রহসনের অতি সামান্য অংশই সেদিন অভিনীত হয়েছে ৷ তথাপি বাংলা নাটকের টেক্সট হিসাবে এরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, জনপ্রিয়তম একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে জনরুচির প্রাধান্যমূলক দিকগুলি নাটকেই প্রতিফলিত হয় ৷ সেদিক থেকে বিচার করলে, বিশ শতকের শেষ অব্ধি এসেও বাংলা নাটকে যৌনতার উচ্চারণকে খুব একটা সিরিয়াসভাবে গ্রহণ করা হয়নি ৷ বরং সেই ভিক্টোরীয় ‘প্যানঅপটিক্যানে’র ছায়াপাত বংলা রঙ্গমঞ্চে জারি থেকেছে ১৯৭০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্য়ন্ত ৷ ‘যৌনতার দুই মুখ’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি অন্ত্য-ঊনিশ শতকে বাংলা নাটকের সেই ইন্টারটেক্সচুয়ালিটিকে, যেখানে যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙক্ষা এবং সেই নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ছাপিয়ে ভাষাগত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শরীরের অভিব্যক্তি ও বিবিধ বাসনার ধরন প্রকাশিত ৷ অর্থাৎ নিয়ন্ত্রনের প্রক্রিয়ার ভিতরেই উল্টো বহিঃপ্রকাশ লুকিয়ে আছে ৷ তবে মোটের উপর মধ্য-বিশ শতক পর্যন্ত বাংলা নাটকে যৌনতাকে সিরিয়াস দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রচেষ্টা সেভাবে চোখে পড়ে না ৷ প্যান-অপটিক্যান তখনও ক্রিয়াশীল ৷ চল্লিশের দশক থেকে গণনাট্য আরও পরে অসংখ্য গ্রূপ থিয়েটার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জীবনের বিচিত্র দিক, সমাজের বহু বৈচিত্রময় ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যৌনতাকে পৃথক গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ৷ কিন্তু বিশেষভাবে সত্তরের গোড়া থেকে মধ্য-নব্বই পর্যন্ত বাংলা কমার্শিয়াল নাটকে যৌনতা প্রদর্শনের এক বিশেষ ঘরানা তৈরি হয়েছিল যা বহু বিতর্কের জন্ম দেয় ৷ সেই বিতর্কও আসলে সামাজিক ক্ষমতা ও নজরদারিকেই নতুনভাবে প্রমাণিত করে ৷

‘বারবধু’-র পরস্পরা

থিয়েটারে যৌনতার অনুষঙ্গ বা উচ্চারণ সম্পর্কে যে দৃষ্টিকোণের পরিচয় পেয়েছি অন্ত্য-ঊনিশ শতক বা বিশ শতকের গোড়ায়, তা-ই খানিকটা পরিবর্তিত চেহারায় বজায় থেকেছে ষাট দশকের শেষ, এমনকি সত্তরের গোড়া পর্যন্ত ৷ এইসময়ে বাণিজ্যিক থিয়েটারে এক বিশেষ প্রবণতার জন্ম হয় এবং সেই বিশেষ দিকটি নিয়ে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক ৷ মঞ্চে ক্যাবারে নাচ ও তৎসংক্রান্ত শালীনতা-অশালীনতার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ৷ পরবর্তী প্রায় আড়াই দশকব্যাপী বাণিজ্যিক থিয়েটারের এই ধারাটি বহাল থেকেছে মূলত সারকারিনা-রঙমহল-প্রতাপমঞ্চ-বিশ্বরূপা-রঙ্গনা-বয়েজ ওন হল অর্থাৎ শ্যামবাজার-সংলগ্ন কয়েকটি নির্দিষ্ট থিয়েটারহলকে কেন্দ্র করে ৷ নব্বইয়ের মাঝামাঝি তৎকালীন বামপন্থী সরকারের সংস্কৃতিদপ্তরের প্রত্যক্ষ মদতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের উদ্যোগে, বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের অতিসক্রিয়তায় এই তথাকথিত ‘অপসাংস্কৃতিক’ উপাদানগুলিকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানো হয় ৷ সত্তরের গোড়ায় অসীম চক্রবর্তীর ‘বারবধূ’ নাটক দিয়ে এ ধরনের নাটকের যাত্রা শুরু ৷ শুর থেকেই বিতর্ক এমনকি মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন হয় এই নাটক ৷ অথচ এই নাটকের জনপ্রিয়তায় বিস্মিত হতে হয় ৷ বারবধূ ‘প্রতাপমঞ্চে’ হাউসফুল, ‘কলামন্দির’-এ হাউসফুল, ‘একাডেমি’-তে হাউসফুল ৷ ১৯৭৩-এ ‘বারবধূ’ লাগাতার হাউসফুল হবার পর একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দেন ১৯৭৪-এ ৷ অসীম চক্রবর্তী একাডেমির বিরুদ্ধে মামলা করেন ৷ মামলায় জিতে আবার শুরু হয় ‘বারবধূ’ ৷ বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠলেও শিবনারায়ণ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মন্মথ রায়, সাগরময় ঘোষ, জোছন দস্তিদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, রাধামোহন ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এমনকি বিজন ভট্টাচার্য এই নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেন ৷ তিন দশকের (১৯৭০-২০০০) বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস লিখতে গিয়ে সাম্প্রতিক গবেষক যেমন বলেন :

গত ৩০ বছরের আলোচনায় বারবধূ অন্তর্ভূক্ত না হলে ইতিহাস রচিত হবে চূড়ান্ত পক্ষপাতিত্বে ৷ বাংলা থিয়েটারে বারবধূ একটা ফেনোমেনন… দর্শক হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ৷ বারবধূতে কেতকী দত্ত অভিনয় করতেন ৷ বারবধূ বাংলা থিয়েটারে একটি ধারার জন্ম দিয়েছে ৷ পরবর্তীকালে বয়েজ ওন হলে, সারকারিনায়, এল.টি.জি—পরবর্তী মিনার্ভায়, এমনকি বিশ্বরূপায়ও রাসবিহারী সরকারের নেতৃত্বে এই ধারা অনুসৃত হয়েছে ৷ ক্যাবারে এর আগে বাংলা থিয়েটারে স্থান পায়নি ৷ বারবধূ-পরবর্তী সময়ে ক্যাবারে দেখার জন্য প্রচুর পয়সা খরচ করে পার্ক স্ত্রীট কিংবা ধর্মতলা চত্বরের রেস্তোরাঁয় মধ্যবিত্তের সন্ধ্যেবলা যাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল ৷ এসবের আয়োজন হল আমাদের ঘরের কাছে নাটকের ছদ্মবেশে ৷ সেই সময় সমর মুখোপাধ্যায় নামক এক পরিচালক ছিলেন এসব নাট্যকর্মের ‘অঞ্জন চৌধুরী’ ৷ পরবর্তীকালে গ্ৰুপ থিয়েটারের কিছু লোকজনও এই খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ৷

(একজন দর্শকের চোখে তিন দশকের নাটক, পাঁচু রায়, অনুষ্টুপ, ১৪০৬)

প্রখ্যাত ক্যাবারে-শিল্পী মিস শেফালি তাঁর ‘স্মৃতিকথা’তেও নাটকে ক্যাবারের প্রসঙ্গ এনেছেন ৷ তাঁর ভাষায়:: ‘‘বিশ্বরূপার মালিক তখন রাসবিহারী সরকার ৷…সেটা একাত্তর বাহাত্তর সাল ৷ শেফালি তখন নতুন নাম পেয়েছে ‘নৃত্য সম্রাজ্ঞী’ ৷ কাগজে রাসবিহারী ফুলপেজ বিজ্ঞাপন দিতেন ৷… কাগজে নানা কেচ্ছা কাহিনি ৷ আমি নাকি যুবসমাজকে বিপথে চালিত করছি ৷ যুবকরা গোল্লায় যাচ্ছে ৷… স্টেজের উপর আমাকে দেখলে মাথা ঘুরে যায় ছেলেদের—তার জন্য মেয়েদের সে কী চিন্তা ৷’’ (এক যে ছিল শেফালি; শারদীয় ‘আমার সময়’, ২০০৮) আসলে যে কোনও যুগেই অবদমিত সামাজিক মন ও শরীর সাময়িক বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম তৈরি করে নেয় ৷ সেই বহিঃপ্রকাশ কখনো হতে পারে হলুদ পর্নো বই, বিদেশি যৌনপত্রিকা, হতে পারে ব্লুফিল্ম সিডি বা ইন্টারনেট পর্নো ৷ সামাজিক ক্ষমতা সেই বহিঃপ্রকাশকে দমন করে অথবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মোড়কে তাকে ইনকর্পোরেট করে নেয় ৷ আশি এবং নব্বইয়ের দশকে সারকারিনা এবং অন্যান্য হলে এ ধরনের তথাকথিত ‘অশ্লীল’ নাটকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন প্রণব বসাক ৷ ১৯৯৫ সালে নাটকে অশ্লীলতা-বিরোধী অভিযান শুরু হলে তিনি গ্রেপ্তার হন ৷ প্রণবাবুর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২৯ মে ২০১২ ৷ সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ :

 প্রশ্ন : প্রণববাবু, বাংলা কমার্শিয়াল থিয়েটারে ষাটের শেষ বা সত্তরের শুরু থেকেই ক্যাবারে নাচ বা আনুষঙ্গিক উপাদানে তৈরি একধরনের নাটক শুরু হয় ৷ এর সূচনার কোনও নির্দিষ্ট সন-তারিখ পাওয়া যায়?

 প্রণব : আমার জানা নেই ৷ আমি ১৯৮১ থেকে অভিনয় করছি ৷ মিনার্ভা থিয়েটারে ‘প্রিয়ার খোঁজে’ বলে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ৷ অসীমকুমার, আরতি ভট্টাচার্য অভিনয় করেছিলেন ৷ তাতে কিছু সিম্বলিক ব্যাপার ছিল ৷ আদম-ইভ স্বর্গ থেকে নেমে আসছে ইত্যাদি ৷ রংমহলে চলছিল ‘আমি মন্ত্রী হব ৷’ সেখানেও জহর রায়ের সাথে একজন নর্তকী ছিলেন ৷ কিন্তু এটা কোনও কমন ট্রেন্ড ছিল না ৷ একেবারেই না ৷ সত্তর-আশিতে অবশ্য মিস শেফালির রমরমা ৷ রাসবিহারী সরকার মিস ভেরোনিকা বলে একজনকে নিয়ে এসেছিলেন ৷ শংকরের উপন্যাস ‘সম্রাট ও সুন্দরী’ রাসবিহারী সরকারকে নিয়ে লেখা ৷ সারকারিনায় চলেছিল ৷

 প্রশ্ন : আর পাবলিক রেসপন্সের জায়গাটা যদি একটু বলেন…

 প্রণব : বাণিজ্যিক দিক তো ছিলই ৷ সে তো সব নাটকেই থাকে ৷ তবে নকশাল আমলে এগুলো সম্পর্কে তেমন কিছু রিপালসন ছিল বলে শুনিনি ৷ বরং ১৯৭৭-এর পর আশির দশকেই সরকারি বামপন্থীদের তরফ থেকে একটা শব্দ চালু করা হল ‘অপসংস্কৃতি’ ৷ আমি এর মানে বুঝি না ৷ তাহলে তো ব্রাজিলের সাম্বা নাচও ‘অপসংস্কৃতি’ ৷

 প্রশ্ন : কিন্তু বাঙালি কালচারে একটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বরাবরই ছিল ৷ নাটক দেখতে যাচ্ছি ৷ বেরিয়ে বলছি ‘‘কী অশ্লীল!’’

 প্রণব : আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ৷ ১৯৯১ সালে রংমহলে ‘ইজ্জত’ নাটকে অভিনয় করেছি ৷ সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন মিস শেফালি ৷ মিস শোভনা ৷ সে নাটক তো মারাত্মক ‘হাউসফুল’ চলেছে ৷ মহিলারা দলে দলে এসে দেখেছেন ৷ আশীর্বাদ করেছেন ৷ অচ্ছুৎ মনোভাব দেখিনি ৷ তখন থিয়েটার পাড়া জমজমাট ৷ ওভার অল অ্যাকসেপটেনস যথেষ্টই ছিল ৷ যৌনতা তো প্রাণেরই অঙ্গ ৷ নেচারের বিরুদ্ধে যাওয়াই তো অপরাধ ৷ আবার নাটক নয় ৷ কেবল মিস অমুক তমুকদের নিয়ে কেবল নাচের অনুষ্ঠানও ছিল ৷ সেগুলোও রমরম করে চলেছে ৷ যথেষ্ট পারমিসিভনেস ছিল ৷ রংমহলের পিছনেই তো বটতলা থানা ৷ পুলিশও দেখতে আসত ৷

 প্রশ্ন : ‘প্রতাপ মঞ্চ’-এ ‘ওরা কারা?’ নামে একটি নাটক চলছিল ৷ ১৯৯৪ নাগাদ বামপন্থী ছাত্র-যুবরা তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে ৷ আমি তখন হায়ার সেকেন্ডারির ছাত্র ৷

 প্রণব : হ্যাঁ, রাজনৈতিকভাবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ৷ আবার থিয়েটার হলগুলোর মধ্যে প্রফেশনাল রাইভালরিও থাকতে পারে ৷ ’৭৭ সাল থেকেই বামপন্থীরা ক্ষমতায় আছে ৷ হঠাৎ করে কেন এই বিরোধিতা আমি বলতে পারি না ৷ বাঙালি বামপন্থীদের মধ্যে এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা আছে যৌনতা বিষয়ে ৷ একই সময়ে আবার পাঁচতারা হোটেলে বিদেশ থেকে নর্তকীরা এসেছে ৷ এলিট ক্লাসের গায়ে তো তারা হাত দেয়নি ৷ দুর্ভাগ্যের বিষয়, যৌনবিনোদনের ক্ষেত্রে নিছক টেকনিক্যাল আপগ্রেডেশনের কারণে এই নাটকগুলো বন্ধ হয়নি ৷ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই এগুলো বন্ধ হবার মূল কারণ ৷

 প্রশ্ন : আপনার নিজের অভিজ্ঞতা কিছু বলুন ৷

 প্রণব : আশ্চর্যের ব্যাপার, ১৯৯৫ সালে একটা সম্পূর্ণ নির্দোষ নাটকে অভিনয় করার সময় মিনার্ভা থিয়েটার থেকে অ্যারেস্ট হই ৷ চার বছর পুলিশ কেস চলেছিল ৷ অথচ কোনও নর্তকী সেই নাটকে ছিল না ৷ খবরের কাগজে বয়স্ক অভিনেত্রীদের নামের আগে ‘মিস’ জুড়ে দিয়ে হ্যারাসড করল আমাদের ৷

 প্রশ্ন : কিন্তু পাশাপাশি আশির দশক জুড়েই গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে ভিডিও পার্লার ও পর্নোছবির রমরমা চলেছে ৷ সেটা বন্ধ করা হয়নি ৷

 প্রণব : না হয়নি ৷ তবে নাটকে সামনে থেকে অভিনয় দেখতে পাবার যে উত্তেজনা, তা তো হাইপাররিয়্যাল দৃশ্যমাধ্যমে আসে না ৷ আসতে পারে না ৷ শ্যামবাজার পাড়ার থিয়েটারকেই ধ্বংস করার জন্য স্কেপগোট করা হয়েছিল ৷

 প্রশ্ন : অ্যারেস্ট হবার পর কী আর নাটক করেছেন?

 প্রণব : না ৷ কমার্শিয়াল থিয়েটারটাই তো বন্ধ হয়ে গেল ৷ কোথায় করব? নাট্যব্যক্তিত্বরাও এ ব্যাপারে সাইলেন্ট ছিলেন ৷

প্রণববাবুর বক্তব্য থেকে ৮০ ও ৯০ এর দশকে বাংলা কমার্শিয়াল থিয়েটারে যৌন উপাদান এবং তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক স্তরের উদ্যোগ ঠিক কী চেহারা নিয়েছিল জানতে পারা যায় ৷ এও আসলে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘প্লেজার’-এর পারস্পরিক সম্পর্ক ৷ হাতিবাগান-শ্যামবাজার পাড়ার থিয়েটার সংস্কৃতি আমাদের নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে যৌনতাকে ব্যবহারের এক বিস্মৃত অধ্যায় ৷ যৌনতার সিরিয়াস ডিসকোর্স নয়, নিছক উপভোগের জায়গা থেকেই এই নাটকগুলি মঞ্চস্থ হত ৷ তথাপি, বাংলা নাটকে যৌনতার উপস্থাপনার দিক থেকে এই বিশেষ ধরনের থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব আছে ৷ আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক, এগুলো যখন বন্ধ হচ্ছে গোটা বামফ্রন্ট-ঘনিষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বরা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন ৷

যৌনতার ডিসকোর্স ও তিনটি সমকালীন নাটক

আশির দশক থেকেই সর্বজনীন জ্ঞানচর্চার পরিসরে যৌনতা সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে থাকে ৷ বিশেষত ৭০-এর শেষদিক থেকেই মিশেল ফুকোর যুগান্তকারী লেখাপত্রের ইংরেজি অনুবাদ হাতে আসতে থাকে এখানেও ৷ উত্তর-আধুনিক চিন্তা বিকশিত হতে শুরু করলে যৌনতাকে নতুন চোখে দেখার প্রবণতা শুরু হয় ৷ বিশেষত ‘ক্ষমতা’ ও ‘যৌনতা’-র পারস্পরিক সম্পর্কের দিক থেকে যৌনতা সংক্রান্ত ধারণাও ইতিহাসের এক বিশেষ নির্মাণ এবং তা-ও যে সবর্দাই ‘ক্ষমতা’র দ্বারা অতিনির্নীত হয়, সেই ভাবনাও গ্রহণযোগ্য হতে থাকে ৷ আধুনিক বাংলা নাটকে যৌনতাকে সিরিয়াসলি দেখার কাজটি অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ঘটেছিল ৷ বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এর নায়ক যে তার মাসতুতো বোনের প্রতি আকৃষ্ট অথবা ‘বাকি ইতিহাস’, যেখানে সীতানাথ লোলিটা-সিনড্রোমে আক্রান্ত, চন্দন সেনের ‘দায়বদ্ধ’ বা ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী-র ‘জননী’-তেও যৌনতার অবরুদ্ধ টেনশন কাজ করে গেছে ৷ তবে যৌনতাই বিষয় হয়ে উঠেছে এরকম নাটকের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও কিছুদিন ৷ আমি তিনটি নাটক সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষেপে দুচার কথা বলব ৷ এই তিনটি নাটক হল হর ভট্টাচার্য-র ‘আগুনের বর্ণমালা’ এবং ব্রাত্য বসু-র ‘কৃষ্ণগহ্বর’ ও ‘দর্জিপাড়ার মর্জিনারা’ ৷ প্রত্যক্ষভাবে যদি ‘যৌনতা’ বলতে নারী-পুরুষ/নারী-নারী/পুরুষ-পুরুষ অথবা যেকোনও যৌনপরিচিতির সঙ্গে অপর যে কোনও যৌনপরিচিতির শারীরিক আসঙ্গ বা মৈথুন বুঝি, তিনটি নাটকের কোথাও তা নেই ৷ যা আছে তাকে বলা যেতে পারে যৌনতাকেন্দ্রিক এক গভীর ও জটিল ‘সন্দর্ভ’ বা ‘বয়ান’ ৷

হর ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুনের বর্ণমালা’ নাটকটি ‘দৃশ্যপট’-এর প্রযোজনায় প্রথম অভিনীত হয় জুন ২০০৬, হাওড়া শরৎ সদনে, ওডিয়ন থিয়েটার উৎসবে ৷ এটি পিটার শ্যাফার রচিত Equus নাটকের ভাবানুসরণে লেখা, কিন্তু বক্তব্যে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ৷ নাটকের সুচনায় বলা হয়েছে এই বৈপরীত্যের কথা :

Equus নাটকের পরতে পরতে ধর্ম ৷ আর প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ক্রিশ্চানিটির সঙ্গে এ দেশের জনজীবনের ধর্মচৈতন্যের একটা স্বাভাবিক বৈপরীত্য আছে ৷ আমাদের কোনও ইশ্বরপুত্র যিশু নেই যে আপন রক্তে শরণাগতের সমস্ত পাপ ধুয়ে দেবে ৷ আমার পাপের ভার আমাকেই বইতে হয় ৷… আগুনের বর্ণমালার কুশল যখন আগুনে দাঁড়ায় তখন সে স্বধর্মে স্থিত হয় ৷ আর Equus-এর Alan যখন রাতের কুয়াশার আঁধারে আর্তনাদ করে তখন সে ধর্মচ্যুত হয় ৷ Shaffer খোঁজেন এক বিকল্প ঈশ্বরকে আজকের বেঁচে থাকাকে যিনি অর্থবহ করে তুলবেন ৷ আর অদ্ভুত আঁধারের মতনই আগুনের বর্ণমালা খোঁজে সেই মানুষকে আজকের বেঁচে থাকার অর্থটাই যে পাল্টে দেবে ৷

কুশলের বাবা এবং ঠাকুর্দা অত্যন্ত কঠোর রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী ৷ তাঁরা কুশলকে বড়ো করেছেন চূড়ান্ত সংযম, ব্রহ্মচর্য, যৌনস্খলনের থেকে দূরে রেখে ৷ অথচ এই রক্ষণশীলতা আসলে এমন এক ‘ক্ষমতা’ যা ‘আত্ম’-র গঠনকে চূড়ান্তভাবে নিরন্ত্রণ করতে চায় ৷ একই সঙ্গে ‘আগুন’ এখানে ‘পাপ’ থেকে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ, বিশুদ্ধ করে তোলার প্রতীক ৷ ‘ক্ষমতা’ চায় ডিজায়ারকে দুমড়ে মুচড়ে নরম্যাটিভ ফ্রেমে, ছাঁচে ঢেলে নিতে ৷ এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই বোঝা যায় এর অসম্ভাব্যতা ৷ ওই দমবন্ধ-করা সংযমের নিগড়ে হাঁসফাঁস করতে করতে আত্মহত্যা করেন কুশলের মা ৷ তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন কুশলের বাড়ির টিউটরের সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে ৷ যা কুশল দেখে ফেলে ৷ আবার আশৈশব ব্রহ্মচর্যের অনুশাসনে অভ্যস্ত হতে হতে কুশল জোর করে অবদমন করতে চায় নিজেকে ৷ তার অসম্ভাব্যতাও বোঝা যায় যেদিন সে পড়াতে যায় ছাত্রী দোলাকে, দোলা তাকে সিডিউস করে ৷ কুঁকড়ে যায় কুশল, উদ্ভিন্ন বাসনা আর নৈতিকতার আরোপিত দ্বন্দ্বে ৷ শেষ অব্দি সে আবার ফেরত যায়, দোলাকে নিয়ে আসে ভাঙা মন্দিরে ৷ এবং নিজের ভিতরের আগুনের নির্বাপন চায়, দোলাকে শারীকভাবে পেতে চায় অথচ ব্যর্থ হয় ৷ বন্ধু কাজলের সঙ্গে অ্যাডাল্ট ছবি দেখতে গিয়ে অন্ধকার সিনেমাহলে দেখতে পায় বাবাকে ৷ কুশলের ভিতরটা চুরমার হয়ে যেতে থাকে ৷ সে বোঝে জ্ঞান যুক্তি-র নরম্যাটিভ কাঠামো যে আরোপিত শৃঙ্খলার জন্ম দেয়, শরীর ও যৌনতার ভিতর মিশে থাকা আগুনের বর্ণমালা প্রতিমুহূর্তে সেই কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে ৷ পুরাণের বিভিন্ন উল্লেখ, পাপ-পুন্যের বাইনারি এই নাটকে উল্লিখিত হলেও এখানে যৌনতাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির অভ্যন্তরে চলতে থাকা ‘ক্ষমতা’র রাজনীতি, স্বাভাবিক’/‘অস্বাভাবিক’-এর বৈপরীত্য এবং সত্তার সংকট মূর্ত হয় ৷ এক তীব্র যন্ত্রণায় আত্মদীর্ণ হতে হতে প্রতিহিংসাবশত নিজের বাবাকে পুড়িয়ে মারে কুশল ৷ মায়ের আগুনে পোড়া শরীর তার ভিতরে যে ট্রমা তৈরি করেছিল তার মোক্ষণ সে ঘটাতে চেয়েছিল বাবাকে পুড়িয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে ৷ অথচ এ ক্ষেত্রেও সে ব্যর্থ ৷ বাবার মৃত্যু ঘটলেও নিজের ভিতর থেকে আগুনের মোটিফ সে নিষ্কাশন করতে পারেনি ৷ তার ঠাঁই হয় উন্মাদাশ্রমে, সেখানে তার চিকিৎসা চালাচ্ছে ডাক্তার অনির্বাণ ৷ ডাক্তারের বয়ানে ‘‘ছেলেটার মধ্যে নিজেকে কোথায় যেন আইডেন্টিফাই করছি ৷ আদর্শ বল, কনভিকশন বল, স্বপ্ন, বিশ্বাস—আগুন, যে নামেই ডাকো না কেন—সেটার প্রতি ও অনেক বেশি কমিটেড ৷ আমরা নিজেদেরকে এভাবে পোড়াতে পারিনি ৷’’ ‘‘আগুনের বর্ণমালা’ নাটকটি আমাদের ভিতরে নিহিত প্যাশন এবং ডিজায়ারের ভাষালিপি ৷

ব্রাত্য বসু-র ‘দর্জিপাড়ার মর্জিনারা’ নাটকে নটের দীর্ঘ উক্তি এই শহর কলকাতায় বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাসকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের পরিসরে বিন্যস্ত করে ৷ কিন্তু ব্রাত্য দেখান যে মেয়েটি বাধ্যত বা স্বেচ্ছায় শরীর বেচে জীবিকার্জন করে, সে-ই কেবল বেশ্যা নয় ৷ বিরাট বড়ো এক বিস্তৃত ‘ক্ষমতা’র জালের ভিতর সমাজের প্রত্যেকটি পেশাজীবী থেকে সংস্কৃতিজীবী মানুষই আসলে নিজেকে বেচে চলেছে ৷ কারণ প্রত্যেকটি পাওয়ার রিলেশনের ভিতরেই খাদ্য-খাদক সম্পর্ক ৷ এই সার্বিক ক্ষমতাচক্রের ভিতর বিশ্বায়ন আর বেশ্যায়ন একাকার হয়ে যায় ৷ এ এক এমন চক্রান্ত যেখানে ‘‘হত্যার গোলকধাঁধার জৈব হেঁয়ালি যেখানে হন্তারকও আহত হয়, আবার হত জেগে ওঠে হন্তারক হবে বলে ৷’’

বিজয়ী লিঙ্গপ্রহারে পটু পুরুষকে বলে ওঠে কবি :

একমাত্র তুমি জানো হে পুরুষ—তোমার এই জয়ের ইতিবৃত্ত এ শহরে শেষ পর্যন্ত তোমাকেই বেবুশ্যে বানিয়েছে ৷ একমাত্র তুমি জানো সে আখ্যান ৷ একমাত্র তুমি ৷ তুমি জানো কখন তোমাকেও পা ফাঁক করতে হয়, কোমর তুলে ধরতে হয়, উপুড় হতে হয় আর পরপর দড়ির গিঁট খুলে যেতে হয় নীরক্ত চোখে ৷

‘ক্ষমতা’র চাপে ধ্বস্ত পুরুষটিও বলে ওঠে কেবল সে একাই নয় ৷ এই প্রবহমান হত্যাকাণ্ডে প্রত্যেকটি মাvনুষই ভিতরে ভিতরে পরাজিত ৷ সেই পরাজয় ছড়িয়ে থাকে এ শহরের প্রতিটি অনু-পরমাণুতে :

হ্যাঁ ধ্বজভঙ্গ আমি ৷ এবং ধ্বজভঙ্গ সমস্ত শহর ৷ যে সব বিবাহিত রাতে স্নায়ুহীন মৈথুন করে, মস্তিষ্ক রুদ্ধ করে পুরুষাঙ্গ দিয়ে পেটায় নিজের বিবাহিত বারবণিতাকে… কখনও কখনও ব্যর্থ হয়—তারপর হস্তমৈথুন করে ভোরে… আমিও তাদের মতো অঙ্গুরীমাল—আমিও তাদের মতো নিষ্ক্রিয় ৷ আমিও তাদের মতো জেনো হে যোষিৎ—প্রতিদিন অল্প অল্প করে ধ্বজভঙ্গ হয়েছি ৷

বারবণিতা ৩য় মেয়েটি বুদ্ধিজীবীকে একটি স্বয়ং চলমান লিঙ্গ বলে বর্ণনা করে : ‘‘চলমান, পোশাক পরিহিত এক বাঁকানো লিঙ্গের মতো ৷ আজ রাতে সমস্ত বাতি নিভে গেলে… খসখস শব্দ তুলে এক জীবন্ত লিঙ্গ এসে দাঁড়াল আমার চৌকাঠে ৷’’ বড় বুদ্ধিজীবীও বলে ওঠে ‘‘আমার নিশ্বাস ফেলার প্রতিটি মুহূর্ত একটু একটু করে বিবর্তিত হয়ে আমাকে কবে যেন বারাঙ্গনা করেছে ৷ আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তুমি ও আমি মৌলিক অর্থে, মৌলিক চিন্তায়, মৌলিক অস্তিত্বে মূলত এক ৷ শুধু তোমার আমার মূল্যের রয়েছে তফাত ৷’’ যৌনতা-পণ্যায়ন-ক্ষমতার আন্তর্জালের নিগূঢ় সত্যকে ভেদ করে এই নাটক ৷

‘কৃষ্ণগহ্বর’ নাটকেও মূল জায়গাটি শুরু হয় সামাজিকভাবে অসফল শিল্পী অংশুমানের সঙ্গে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা স্ত্রী জয়তীর তরুণ ছাত্র রাহুলের তীব্র আকস্মিক হোমোইরোটিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ৷ কিন্তু নিছক যৌনতার বিষমকামী ক্ষমতাকাঠামোয় অন্তর্ঘাত হিসেবে নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব স্বাভাবিক জীবনে দাম্পত্যসম্পর্কহীন স্ত্রী এবং দুই সন্তনানকে নিয়ে চলতে চলতে এক অভূতপূর্ব কৃষ্ণগহ্বরকে আবিষ্কার করেন অংশুমান ৷ কার্ল হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ব যে আসলে আমাদের যৌনসত্তা থেকে শুরু করে পারস্পরিক সম্পর্কের রাজনীতি, সামাজিক কাঠামোয় ব্যক্তির অবস্থান এমনকি অভাবিত সত্যের মুখোমুখি হবার পর এক আপতিক অথচ কিনারবাসী অস্তিত্বের দরজায় ঠেলে দেয় আমাদের—তা এই অসামান্য নাটকে দেখান ব্রাত্য ৷ অংশুমানের আত্মআবিষ্কারের ধাক্কা নিতে পারে না তার চারপাশের নরম্যাটিভ সমাজ, তার স্ত্রী, রাহুলের বিশ্বাসঘাতকতাও তাকে আর একবার সমাজকাঠামোর অভ্যন্তরীণ জটিল সুতোর বুনোটে ব্যক্তির শেষ অবধি তুচ্ছ ও মূল্যহীন হয়ে যাওয়া প্রমাণ করে ৷ তাই বাংলা নাটকে সর্বপ্রথম হোমোএরোটিক বিষয়-কেন্দ্রিক নাটক হলেও ‘কৃষ্ণগহ্বর’ শেষ অব্দি হয়ে ওঠে ক্ষমতা, সম্পর্ক, প্রত্যাশ্যা ও আইডেনটিটির সংকটের সন্দর্ভ ৷ এখানেই অনন্য এই নাটকের অন্তিম ডায়ালগ, যখন আত্মহত্যার চেষ্টার পর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো অংশুমানকে নিয়ে রঙ্গনের উদ্বেগের জবাবে ডাক্তার জয়ন্ত বলেন, ‘বিষয়টি অনিশ্চিত’ ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *