৬. বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি-যৌনতা : একটি প্রস্তাবনা

বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি-যৌনতা : একটি প্রস্তাবনা

উনিশ শতকের শেষ কয়েক দশক পেরিয়ে বিশ শতকের গোড়ায় পৌঁছে ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির চৈতন্যের শরীর/যৌনতা-সংক্রান্ত ভাবনায় কয়েকটি লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে ৷ অন্ত্য-উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ এক কাল্পনিক ‘জাতিরাষ্ট্রে’র কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অঙ্গীভূত হিসেবে ব্যক্তি, পরিবার এবং যৌনতার স্থানাঙ্ক নির্ণয় করেছিল ৷ কিন্তু বিশ শতকের গোড়া থেকে প্রথম দুই-তিন দশকের ভিতরেই বাঙালির সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে ৷ বিশেষত মনস্তত্ব ও মনঃসমীক্ষণ-সংক্রান্ত পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামোর অনুপ্রবেশ যৌনতার প্রচলিত ডিসকোর্সের ভিতরেও অনেক বদল আনে এবং এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় ৷ বিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কল্লোল, কালি-কলম প্রভৃতি পত্রিকা এই সাহিত্যিক পরিবর্তনের লক্ষণগুলিকে বহন করে চলছিল ৷ তবে এই গুরুতর পরিবর্তনসমূহ একইসঙ্গে, একইভাবে, সমসত্ব প্রক্রিয়ায় ঘটেনি ৷ বিশ শতকীয় পরিবর্তনগুলিকে এভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায় :

ক. উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের দাম্পত্য, পারিবারিকতার অন্তর্গত তথাকথিত ‘হিন্দু আধ্যাত্মিক’ ভাবকাঠামোর অংশ হিসেবে শরীর/যৌনতার তাৎপর্য অস্বীকার করা এবং পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাচক ডিসকোর্সের বাইরে ব্যক্তির স্বাধীন, ‘প্রাতিস্বিক’ সত্তার মুক্তি ৷ শরীর/যৌনতা এই প্রাতিস্বিক ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে উঠল ৷

খ. ফ্রয়েড-হ্যাভলক এলিস প্রমুখ যৌন-মনস্তাত্বিকদের প্রভাবে শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত ভাবনার ভরকেন্দ্র সরে এল সাইকোলজিক্যাল ডিসকোর্সে ৷ উনিশ শতকের ‘জৈব শরীর’ এবার হয়ে উঠল ‘মনস্তাত্বিক শরীর’ ৷

উনিশ শতকীয় ভদ্রলোকি মনন, জীবনযাপনের ‘পাবলিক’ ও ‘প্রাইভেট’ ক্ষেত্র দুটিকে পৃথক হিশেবে বিন্যস্ত করেছিল ৷ ‘পাবলিক’ ক্ষেত্রটিতে কর্মময় ইউরোপীয় চারিত্রিক কুশলতা ও ‘ক্ষমতা’র কাছে পরাস্ত হলেও, গৃহের অভ্যন্তরের ‘প্রাইভেট’ ‘ক্ষেত্র’টিতে সে স্বরাট ৷ ইউরোপীয় যুক্তিকে আত্মস্থ করেই সে তার নিজস্ব দেশীয় বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে তুলেছে ‘আত্ম-র প্রযুক্তি’, যেখানে যৌনতার অবস্থান ও কার্যকারিতা নির্ধরিত হয় ‘পরিবার’ নামক একক এবং ‘দাম্পত্য’ নামক এক বিশেষ নৈতিকতার ছাঁচকে বাস্তবায়িত করার মধ্য দিয়ে ৷ ‘হিন্দু’ বিবাহ এবং পারিবারিকতার ‘আধ্যাত্মিক’ চরিত্রটি হয়ে ওঠে পাশ্চাত্য ব্যক্তি-পরিবার-নৈতিকতার সঙ্গে পার্থক্যের সূত্র ৷ স্বামী-স্ত্রীর আন্তঃসম্পর্ককেও এক উন্নত হিন্দু আধ্যাত্মিক মহিমায় মণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে যৌনতার উপভোগের দিকটি অবদমিত হয়, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কার্যকরী প্রজননের দিকটুকু ৷ কিন্তু বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই পবিত্র আধ্যাত্মিক হিন্দু গার্হস্থ্য তথা অন্তঃপুরের ধারণাটি ক্রমশ সমস্যায়িত হতে থাকে ৷ পত্র-পত্রিকায় হিন্দুর আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের ‘অবস্থা’ বর্ণনার জায়গায় হিন্দু পরিবারের ‘সমস্যা’ বর্ণনা মুখ্য হয়ে ওঠে ৷ বারবার বলা হতে থাকে বাঙালি ‘হিন্দু’ এক গভীর ‘সমস্যা’র সম্মুখীন ৷ এতদিন হিন্দু বিবাহ ও দাম্পত্যসম্পর্ককে আধ্যাত্মিক মহিমায় ভূষিত করা হয়েছে ৷ ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশক থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দাম্পত্য সমস্যা ও দাম্পত্যসঙ্কটের বাস্তব ব্যাখ্যা ও কারণ অনুসন্ধান করা হতে লাগল ৷ দাম্পত্যসমস্যা, বিশেষত, নরনারীর যৌন সম্পর্কের সমস্যা এবার খোলাখুলি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল ৷ কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘যৌনক্ষুধা ও নারীর সতীত্ব’ (১৯৩৯) বইয়ের ভূমিকায় অদ্বৈত মল্লবর্মন লেখেন, কিছুদিন আগেও নরনারীর পারস্পরিক যৌনসম্পর্ক নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবার রেওয়াজ ছিল না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেই ‘ট্যাবু’ ভাঙছে ৷ নারীশিক্ষার প্রসার, নারীর জীবনের মানোন্নয়ন সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার বিকাশ, বিশেষত ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহিলাদের বিবাহবিচ্ছিন্ন হবার আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা এই পিতৃতান্ত্রিক যৌনতার অচলায়তনে আঘাত হানে ৷ এমনকী উনিশ শতকের সেক্স ম্যানুয়্যালগুলির নৈতিক আধ্যাত্মিক কাঠামোর বাইরে এসে বিশ শতকের প্রথম দিকের সেক্স ম্যানুয়ালগুলি অনেক বেশি পরিমাণে যৌনমনস্তত্ব নিয়ে আলোচনার সূচনা করে ৷ কৃত্রিম উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত আলোচনাও প্রাধান্য পেতে থাকে ৷

উনিশ শতকের শেষদিকে আধ্যাত্মিক পারিবারিকতার সঙ্গেই ‘ব্রহ্মচর্য’ ধারণাটির অঙ্গাঙ্গী যোগ তৈরি হয়েছিল ৷ কাল্পনিক জাতিরাষ্ট্রের আধার হিসেবে পৌরুষ, সবল প্রজননশক্তি ও তথাকথিত হিন্দু আধ্যাত্মিকতার এক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে ৷ এই ব্রহ্মচর্য-ভিত্তিক ‘ক্ষমতা’র মূল বিচরণভূমি গৃহের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র—‘অন্তঃপুর’ ৷ কিন্তু ১৯২০-র দশক থেকেই বাঙালি হিন্দুর ঐ ‘অন্তঃপুর’-বাস্তবতা যে আসলে অপরিসীম দারিদ্র, লাঞ্ছনা ও পঙ্কিলতার আবাসভূমি—একথা স্পষ্ট হতে শুরু করে ৷ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ‘গুমোট’ গল্পে ক্লিন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত বাসগৃহের ভিতর স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ ক্ষয়ে যেতে থাকে ৷ শিক্ষিত বাঙালি মনন এবার ‘গৃহকোণ’-এর থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবল বহির্জগৎকে ৷ ‘ঘর’ নয়, ‘পথ’ এবার হয়ে উঠল অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মোটিফ ৷ ১৯০৫-পরবর্তী স্বদেশী আন্দোলন, ১৯১৯-২২ সালের গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন যুবশক্তির আত্মপ্রকাশ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙক্ষাকে ‘ঘর’ নামক এক ‘ক্ষয়িষ্ণু’ ক্ষেত্রের বাইরে বের করে আনল ৷ তার অর্থ এই নয় যে, পুরোনো ব্রহ্মচর্য-সংক্রান্ত ধারণাটি তার প্রাসঙ্গিকতা হারাল ৷ বিবেকানন্দ-প্রভাবিত প্রথম প্রজন্মের অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সকলেই গার্হস্থ্য ও ব্রহ্মচর্যের আদর্শকেই পৌরুষের চরম পরাকাষ্ঠা মনে করতেন ৷ স্বদেশিযুগের বিপ্লবী বিনয়কুমার সরকার সম্পাদিত পত্রিকার নামই ছিল ‘গৃহস্থ’ ৷ আরও একজন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২০ সালে ‘গার্হস্থ্য’ ও ‘নিষ্কাম কর্মে’র আদর্শ প্রচারের জন্য একটি বই লেখেন—ব্যক্তি ও সমাজ ৷ কিন্তু ক্রমশই পৌরুষের এক ভিন্নতর আদর্শ জনমানসে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল, যে পৌরুষ গৃহকোণের ক্ষুদ্র স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তাকে ‘মেয়েলিপনা’ ভাবে ও বাইরের বৃহত্তর জগতে আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুক্তি পেতে চায় ৷ হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিগুলি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় উপন্যাস এক্ষেত্রে স্মরণীয়, বাঙালি যুবকের বীরত্বের গল্প দুটি ক্ষেত্রেই মুখ্য ৷ ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভারতবর্ষে সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আকাঙক্ষা এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব অন্ত্য-উনিশ শতকীয় পরিবার-গার্হস্থ্যকেন্দ্রিক ‘পৌরুষে’র ধারণাটিকে প্রতিস্থাপিত করল ৷ কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০-র দশকে লেখা কবিতায় এই মুক্তিকামী তারুণ্যকে ধরতে চাইলেন ৷ অর্থাৎ, সামাজিক বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সাহিত্য ক্রমশই গৃহবন্দি ‘পৌরুষে’র বিকল্প অনুসন্ধান করতে চাইল ৷ এর অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিল অন্ত্য-উনিশ শতকীয় যৌনতার ডিসকোর্স-এর প্রতিসরণ ৷

১৯২৮ সালে লেখা ‘সমাজধর্ম ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সমকালীন কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি পত্রিকার সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লক্ষ করেছিলেন ‘যৌবনের উত্থান’ ৷ এমনকি এই নতুন সাহিত্যের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, নতুন লেখকদের রচনায় যে যৌবনের অতিরেক লক্ষ করা যাচ্ছে, তা আসলে অন্ত্য-উনিশ শতক থেকে শুরু হওয়া বাঙালিজীবনে যৌন অবদমনের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ৷ অন্নদাশঙ্কর রায়, তাঁর প্রথম প্রবন্ধ-সঙ্কলন তারুণ্য-য় এই অবদমনমূলক ব্রাহ্মণ্য আদর্শের বিরোধিতা করেন, কারণ এই মতাদর্শ দাম্পত্য, নরনারীসম্পর্ক, ব্যক্তির শরীর/যৌনতা—সকল ক্ষেত্রেই এক আধিপত্যধর্মী মতামত চাপিয়ে দেয়, যা ব্যক্তির নিজস্বতাকে খর্ব করে ৷ এমনকী তিনি ব্রহ্মচর্যের আরোপিত কঠোরতারও বিরোধিতা করেন ৷ শাস্ত্রীয় যুক্তিক্রম, নব্য-ব্রাহ্মণ্য নৈতিকতার বিপরীতে ব্যক্তিশরীরের এই প্রাতিস্বিক উত্থানের পিছনে সেদিন মুখ্যত কাজ করেছিল ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবিদ্যার প্রভাব এবং মার্কসবাদী রাজনৈতিক ভাবনার প্রসার ৷ ফ্রয়েডের The Interpretation of Dreams গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে ৷ এরপর একে একে তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলির অনুবাদও প্রকাশিত হয়, যেমন: The Psychology of Everyday Life (1914), এরপর On Dreams (1914) ৷ ভারতে, বিশেষত, কলকাতায় ফ্রয়েডের ইংরেজি অনুবাদ সর্বপ্রথম এসে পৌঁছয় ১৯১২ সালে ৷ ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের মতোই, এদেশীয় বুদ্ধিজীবীদেরও গভীরভাবে প্রভাবিত করে ৷ ফ্রয়েড মানুষের চেতন মনের অন্তরালে অবচেতন মনের সাম্রাজ্য আবিষ্কার করলেন ৷ অহং (ego), ইদস (Id) এবং অধিশাস্তা (superego)—মনকে এই তিনটি পৃথক স্তরে বিভাজিত করে তিনি দেখালেন মানব মনের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ অধিকার করে রয়েছে তার চেতন সত্তা ৷ ফ্রয়েড ও তাঁর অনুগামীদের মতে, মানুষের অবচেতন বা মগ্নচৈতন্যই মানবমনের প্রকৃত নিয়ামক, আর সেই অবচেতনার ক্ষেত্রটি হল এক চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ ৷ এই অবচেতন সত্তার মূল উৎস হল sex বা যৌন অনুভূতি ৷ এই সত্য আবিষ্কারের ফলে মানবব্যক্তিত্বের এযাবৎ স্বীকৃত চেহারাটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হল ৷ নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্কের মূল সূত্রটি নিহিত রয়েছে যৌনতার ভিতরেই—ফ্রয়েড ও তাঁর উত্তরসূরি অ্যাডলার ও ইয়ুং ছাড়া প্রেমের এই দেহবাদী যৌনতামূলক ব্যাখ্যা বিশেষভাবে উপস্থাপিত করলেন ইংরেজ বৈজ্ঞানিক হ্যাভলক এলিস ৷ তাঁর ছয় খণ্ডে সম্পূর্ণ Studies in the Psychology of Sex (1897–1928) চিন্তাজগতে এক দিকপরিবর্তনের সূচক ৷ ১৯৩০-এর দশকে, এই মহাগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন বসুমতী সাহিত্য মন্দির ৷ এই সকল তত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেহচেতনার অন্তরালে মানবমন, নরনারীর পারস্পরিক প্রণয়সম্পর্কের এক সম্পূর্ণ ভিন্নতর চেহারা এবং জগৎ উন্মোচিত হল লেখকদের সামনে, যার ফলে নব্য ব্রাহ্মণ্যপন্থী অন্ত্য-উনিশ শতকীয় যৌনতার আধ্যাত্মিক সন্দর্ভটি প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয় ৷ অসহযোগ আন্দোলন ও বলশেভিক বিপ্লব যদি বাঙালি যুবকের মনে বহিজর্গগতের বিপুল বিস্তারকে বরণ করবার সাহস জোগায়, ফ্রয়েডীয় তত্ব তবে নিজের ভিতরের আভ্যন্তর সত্তাটিকে প্রকাশ করার মাধ্যম হয়ে উঠল ৷ এর ফলে বিদ্রোহী যুবমন দু’ধরনের আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে চাইল, প্রথমত, বিদেশি শাসন এবং গৃহের অভ্যন্তরে পিতৃতান্ত্রিক শাসন ৷ প্রথম যুগের বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের অগ্রণী যোদ্ধা শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, যিনি এক সনাতন হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনিও তথাকথিত ‘ব্রহ্মচর্যে’র নৈতিক ধারণাটিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন ৷ তাঁর মতে, আরোপিত ‘ব্রহ্মচর্যে’র মাধ্যমে কঠোর অনুশাসিত ‘শরীর’ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে ‘পশুত্বে’ উপনীত করে ৷ রুশ বিপ্লবের বাণী, তাঁকেও অনুপ্রাণিত করেছিল দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক শাসনকে অগ্রাহ্য করতে ৷ পরবর্তীকালের বিখ্যাত মার্কসবাদী তাত্বিক গোপাল হালদার, যিনি যৌবনে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন, ছিলেন গান্ধীজির একনিষ্ঠ অনুরাগী ৷ তিনিও গান্ধীজির ‘আত্মশক্তি’ ও স্বরাজলাভের বাসনাকে সমর্থন করেন, কিন্তু গান্ধীর ‘চিত্তশুদ্ধি’র আদর্শকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি ৷ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করা আরও একজন পরবর্তীকালীন তাত্বিক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় স্মৃতিচারণের সূত্রে লিখেছেন, কীভাবে তৎকালীন পঞ্জিকাগুলিতে যৌবনের যৌন কু-অভ্যাসের বিষময় ফলাফল সম্পর্কে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হত ৷ ১৯১৯ সালে গান্ধী-আন্দোলনের সংস্পর্শে এসেও তিনি ব্রহ্মচর্য-সম্পর্কিত গান্ধীবাদী দৃষ্টিকোণকে আদৌ সমর্থন করেননি ৷ ১৯৩০-এর দশক থেকেই বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের দলে মহিলাদের যোগদান, নারীপুরুষের পারস্পরিক মেলামেশার পরিসর উন্মুক্ত হয়ে যাবার ফলে ‘ব্রহ্মচর্যে’র নৈতিক কাঠামোর অসম্ভাব্যতা ক্রমশই উন্মোচিত হতে শুরু করে ৷ রক্ষণশীল জ্যেষ্ঠদের বিরুদ্ধে কনিষ্ঠ বিপ্লবীদের মতামত প্রকাশিত হতে থাকে ৷

শরীর-যৌনতা-সংক্রান্ত রক্ষণশীল নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ‘কল্লোল’-কালিকলম’ পত্রিকাগোষ্ঠী ৷ রুশ বিপ্লবের প্রভাব এবং ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনতত্বে আস্থা এদের ভিতর যে কোনও ধরনের তথাকথিত হিন্দু আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ‘বস্তুবাদী’ শরীরী অস্তিত্বের ধারণার জন্ম দেয় ৷ দারিদ্রপীড়িত জঠরের ক্ষুধা এবং যৌনক্ষুধা কোথাও একত্রীভূত হয়ে যায় এঁদের রচনায় ৷ কল্লোল প্রকাশিত হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ৷ ১৩৩৩ সনে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের উপন্যাস বেদে ৷ উনিশ শতকীয় পারিবারিকতা ও সামাজিকতার ডিসকোর্সের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস স্পষ্ট এই উপন্যাসে ৷ অচিন্ত্যকুমারের লেখায় নরওয়ের লেখক নুট হ্যামসুনের গভীর প্রভাব পড়েছিল ৷ প্রচলিত নীতি ও মূল্যবোধে অবিশ্বাসী বেপরোয়া ভবঘুরে সংশয়ী নায়কচরিত্র কাঁচা ওরফে কাঞ্চনকে অচিন্ত্যকুমার যেন গড়ে তুলেছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের এই বিশেষ ধারার প্রভাবেই ৷ এক্ষেত্রে নরনারীর দৈহিক সম্পর্কের উল্লাস ও ‘মিথুনবৃত্তি’ই মুখ্য স্থান অধিকার করেছে ৷ বেদে-র নায়ক পাপ-পুণ্য সম্পর্কে উদাসীন ৷ নীতি ও অনুশাসন সে মানে না ৷ প্রথম কৈশোর থেকে পূর্ণ যৌবনকালের মধ্যে সে ছয়টি নারীর সংস্পর্শে এসেছে—আহ্লাদি, আসমানী, বাতাসী, মুক্তা, বনজ্যোৎস্না ও মৈত্রেয়ী ৷ দেহের ক্ষুধাই তার কাছে অধিকতর প্রত্যক্ষ ৷ কোনও নৈতিক অনুশাসন সে মানে না ৷ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বিবাহের চেয়ে বড়ো উপন্যাসে নায়ক ও নায়িকা প্রভাত ও অশ্রুর বিবাহ হয়নি, তাদের প্রেম যৌবনকামনায় সংরক্ত ৷ প্রভাত অশ্রুকে বলেছে :

মানুষের যতো কিছু বৃহত্তর উপলব্ধি সব এই sex-এর সাহায্যেই ঘটেছে ৷ ধরো প্রেম, প্রেম তো sex ছাড়া কিছুই নয় ৷

‘ব্যক্তি’র এই ‘সমাজবিদ্রোহী মনোভাব ‘কল্লোল’ পর্বের অনেক লেখকের রচনাতেই প্রকট ৷ যে কোনো ধরনের বন্ধনসীমা ভেঙে ব্যক্তির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার উত্তেজনা এদের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে ৷ যৌবনের এই বিদ্রোহী সত্তা আরও স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা কাকজ্যোৎস্না (১৯৩১) উপন্যাসে ৷ নমিতার অকালবৈধব্য ও কৃত্রিম ব্রহ্মচর্যকে অবলম্বন করে অজয় ও প্রদীপের সমাজবিদ্রোহের বাণী এখানে ঘোষিত ৷ কাহিনির শেষে পৌঁছে নমিতা তার ননদ উমাকে বলেছে : ‘আমি বুঝেছি, তোমাদের এই সতীত্ববোধটা মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের পক্ষে একটা বড় বাধা; সে বাধা আমি খণ্ডন করব আপন শক্তিতে, আপন স্বাতন্ত্র্যে’ ৷

অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরেও উনিশ শতকীয় যৌনতার ডিসকোর্স বজায় ছিল ৷ আদিশ্বর ভট্টাচার্যের লেখা ছাত্রগণের নৈতিক অবস্থা ও তাহার প্রতিকার বইটি ব্রহ্মচর্য ঘরানার যৌনভাবনার এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন ৷ এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হলেও পরবর্তী দশক অবধি এই বইয়ের একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ৷ লেখক বলেছেন :

তোমাদের কোটি কোটি হিন্দুর প্রাণ আছে ঐ ব্রহ্মচর্য়ের ভিতরে ৷ আজ বিদেশীয় সমাজের অন্ধ অনুকরণের মোহ এসে তার গলা টিপে ধরেছে ৷ এখনও রক্ষা কর—উপায় আছে ৷ পবিত্রতা জাগিয়ে তোল—ছেলেদের ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দাও ৷ …মা গঙ্গার মত তোমাদের জাতীয়জীবন-নদী এমনই পতিতপাবনী হয়ে …ত্যাগের উদাত্ত সঙ্গীত গাইতে গাইতে অকূলে আত্মদান করার জন্য ছুটবে ৷…

কলিকাতার স্কুল সমূহে দেওয়ালের গায়ে, পাইখানার ভিতর, বেঞ্চের উপর কতরকম অশ্লীল কবিতা, গান, বাক্যবিন্যাস, আবার ‘‘শরৎ-মহেন্দ্র’’ প্রভৃতি ব্যাকরণের সন্ধি বিচ্ছেদের ছড়াছড়ি দেখবে—তাহা তোমাদের সোনার চাঁদেদেরই কীর্তি ৷ …এর অর্থে বুঝতে হবে—শরৎ ও মহেন্দ্রের মধ্যে গুপ্ত প্রণয় আছে ৷ এই সব ধার্মিক হিন্দু পরিবারের ছোট ছোট ছেলেদের চরিত্রের নমুনা ৷ এই সব ভয়াবহ ও লজ্জাজনক অবস্থা আমাদের দেশের ছেলেদের হয়েছে—এর জন্য দায়ী কে? এত মেহ প্রমেহর ছড়াছড়ি দেশে দুই পুরুষ আগে কি কেহ শুনেছে? ধর, একটি ছোট ছেলে—সে তো কাম কাকে বলে তা জানে না ৷ সে কি করে এই কু-অভ্যাস শিখেছে? এ দোষ কার?

প্রথম দোষ অভিভাবকের ৷ অনেক বাড়ীতে স্ত্রী-পুরুষ যে বিছানায় বা যে ঘরে একত্র শয়ন করে সেই বিছানায় বা সেই ঘরে ছেলেদের নিয়ে থাকে ৷ আজকাল বিবাহিত জীবনটা হয়েছে যেন লাম্পট্যজীবন—পশুবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্যই স্ত্রীগ্রহণ ৷ এই সব অসংযত স্ত্রী-পুরুষের শয়নগৃহে বালকদের রাত্রে শুতে হয় ৷ অনেক বাড়ীতে আবার ছেলে-মেয়েদের একত্র বিছানায় শুতে দেওয়া হয় ৷ …অনেক বাড়ীতে আবার দম্পতির চালচলন ও কথাবার্তাই কু-রুচিপূর্ণ ৷ উপন্যাস ছাড়া এদের পড়বার বই আর কিছু নেই—প্রেমসঙ্গীত এদের বড় প্রিয়, বাড়ীতে ছবি টাঙ্গান—তাও অর্ধউলঙ্গ বিলাতী রমণীর ৷

আমরা হিন্দুর ছেলে ৷ আর্য ঋষিগণের পবিত্রশোণিতধারা আজও আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে ৷ আমরা প্রতীচ্যর অন্ধ অনুকরণের মোহে কামসেবাকেই জীবনের সার্থকতা মনে করব? তা হতেই পারে না—আমাদের ভাল হতেই হবে ৷

বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত সেক্স ম্যানুয়্যালে উনিশ শতকীয় যৌননৈতিকতার সম্প্রসারণের একটি নিদর্শন শ্রীচণ্ডীচরণ বসাক প্রণীত চিত্রে ও রচনায় যৌবন পথে (১৩৯ খানি চিত্র সম্বলিত) বইটি ৷ পূর্ববর্তী শতকে প্রকাশিত সূর্যনারায়ণ ঘোষের লেখা বৈজ্ঞানিক দাম্পত্য প্রণালী (১৮৭৮) বইয়ের যুক্তিকাঠামোর অনুসরণ এখানেও করা হয়েছে ৷ বইয়ের প্রাগভাষে লেখক জানাচ্ছেন, ‘সংযম শিক্ষাই উন্নতির একমাত্র পন্থা ৷ কি উপায় অবলম্বন করিলে প্রত্যেক নর-নারী কামনা বাসনা হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হইয়া প্রকৃত সংযমী হইতে পারেন—তাহাই এই পুস্তকে যথাযথ বর্ণিত হইয়াছে ৷’ বইয়ের কয়েকটি অংশ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ৷ একটি অংশের উপশিরোনাম : ‘অতিশয় স্ত্রী-সহবাসে দোষ’ ৷ লেখকের মতে::

অত্যধিক ইন্দ্রিয়-বশবর্তী হইলে শূল , কাশ, জ্বর, শ্বাস, অর্শ, পাণ্ডুরোগ, বাতব্যাধি, ধ্বজভঙ্গ প্রভৃতি বহুবিধ রোগ উৎপন্ন হয় ৷ যাহারা কামুক বা কামপ্রবৃত্তিকে অধিকতর প্রশ্রয় দেয়, তাহাদের শীঘ্র শীঘ্র উত্তেজনা হইয়া থাকে ৷ যে জিনিসের অতিরিক্ত ব্যবহার হয় তাহা প্রায়ই শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায়, কাজেই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় চালনার পরিণাম বড়ই শোচনীয় ৷ তখন কামভাবের দ্বারা যে-অঙ্গকে উত্তেজিত করিত তাহার আর সে দৃঢ়তা থাকে না—ইন্দ্রিয় সহজেই শিথিল হইয়া পড়ে ৷ তাই বলি—ইন্দ্রিয় বশবর্তী না হইয়া সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয় সংযত করাই যুবকমাত্রের কর্ত্তব্য ৷

এই বইয়ের ‘ঋতু স্নানান্তে পতিকে দর্শনের কারণ’, ‘দিবামৈথুন নিষেধ’, ‘বয়োজ্যেষ্ঠা স্ত্রীগমনে দোষ’, ‘বেশ্যা নারীর গর্ভগ্রহণের সময়’, ‘ব্রাহ্মণী স্ত্রীর গর্ভ গ্রহণের সময়’, ‘সাধভক্ষণ না করায় যে রূপ সন্তান হয়’, ‘ক্ষত্রিয়া নারীর গর্ভগ্রহণের সময়’—প্রভৃতি অংশ উনিশ শতকীয় সেক্স ম্যানুয়্যালে অনুসৃত দেশজ জ্ঞানকাঠামোর অনুরূপ, যদিও গোটা বইতে গর্ভোৎপত্তি, গর্ভস্থ শিশুর জন্ম এবং প্রসবকালীন বিবিব্যবস্থা-সংক্রান্ত যে পরামর্শসমূহ বিবৃত হয়েছে, তা পুরোপুরি পাশ্চাত্য মেডিক্যাল চিকিৎসাপ্রণালীর অনুরূপ ৷

‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর লেখালেখি সেদিন বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়লেও এদের তাত্বিক সমর্থনেও এগিয়ে আসেন অনেকেই ৷ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে ‘কল্লোলে’র লেখালেখিকে সমর্থন জানিয়ে বলেন : ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শবাহিত আধ্যাত্মিক হিন্দু পরিবারের ‘মুক্তপুরুষে’র ধারণাটি আসলে অনড় সামাজিক আধিপত্য বজায় রাখার কৌশলমাত্র ৷১০ তাঁর মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে একজন স্বাধীন ব্যক্তির পক্ষে ‘বাস্তবতাবাদী’ দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত, শাস্ত্র-অনুশাসিত ‘ভাববাদী’ জীবনদর্শনের কোনও ঠাঁই সেখানে নেই ৷ ‘মার্কসবাদী’ বিশ্ববীক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি বলেন, এ যুগে ব্যক্তির চরিত্রে কোনও সর্বগ্রাসী আধ্যাত্মিক বর্গই সম্পূর্ণ অনুশাসন চালাতে অক্ষম ৷ ‘ধর্ম’ কোনও আভ্যন্তরসত্তা নয়, বরং ধর্ম হল একধরনের জটিল সামাজিক মতাদর্শগত নির্মাণ ৷ ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় এসময় ‘মনঃসমীক্ষণ’ বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন সরসীলাল সরকার এবং রঙ্গিনচন্দ্র হালদার ৷ ব্যক্তি-সম্পর্কিত অন্ত্য-উনিশ শতকীয় নব্য-ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিকোণকে তীব্র আক্রমণ চালান তাঁরা ৷ এসময়েই নৃপেন্দ্রকুমার বসু এবং অনুরাধা দেবীর সহজ ভাষায় লেখা ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত জনপ্রিয় বইগুলি বেরোতে থাকে ৷ এরকমই একটি বই নরনারীর যৌনবোধ : যৌনক্ষুধা ও যৌনজীবন ৷১১ এই বইয়ের ‘যৌনবোধ ও তাহার মাপকাঠি’, ‘বাল্যে যৌনবোধের বিকাশ’, ‘ যৌনজ্ঞানে অকালপক্কতার প্রণালীসমূহ’, ‘পূর্বযৌবনের যৌনজীবন’, ‘স্বরতি’, ‘সমকাম ও সমরতি’, ‘পূর্ববয়সে যৌনবোধ’, ‘যৌনবোধের ক্রমবিকাশ’, ‘স্ত্রীপুরুষের যৌনাচরণে পার্থক্য’—প্রভৃতি অধ্যায়গুলি অসংখ্য দেশি-বিদেশি ‘কেস স্টাডি’র সাহায্যে পুরোপুরি ফ্রয়েড ও তার শিষ্যদের যৌনতাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার অনুসরণে লেখা ৷ যৌনতাবিষয়ক আলোচনায় যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রয়েডীয় ‘মনঃসমীক্ষণ’ পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে চলেছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই বইগুলি ৷ পূর্বোক্ত কালিদাস মুখোপাধ্যায় রচিত যৌনক্ষুধা ও নারীর সতীত্ব বইয়ে ভূমিকা লিখেছিলেন রণজিৎ সেনগুপ্ত, মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ৷ তাঁর মতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দাম্পত্যযৌনতার আধ্যাত্মিক চরিত্রায়ণের চেষ্টা আসলে অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক শোষণের পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও শিশুসন্তানকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে শোষণ করার কৌশল ৷১২

একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ পূর্বোক্ত গৃহস্থ পত্রিকাটি ৷ বিনয়কুমার সরকার সম্পাদিত এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল নব্যব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয়তার ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ৷ পবিত্র হিন্দু অন্তঃপুরের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য পত্রিকাটি আধ্যাত্মিক ‘গৃহধর্ম’ ও ‘ইন্দ্রিয়নিগ্রহে’র পথকেই সমর্থন জানায় ৷ কিন্তু ১৯১৫-র পর থেকে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় দৃষ্টিকোণ খুব ধীর গতিতে বদলে যায় ৷ ১৯২০-র দশকে বিনয়কুমার সম্পাদনা করেন ‘আর্থিক উন্নতি’ পত্রিকাটি ৷ এই পত্রিকায় তিনি সরাসরি সমকালীন যুগকে ‘বস্তুবাদী যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ৷ এতদিন পারিবারিক কাঠামোয় হিন্দু বর্ণাশ্রমধর্ম, দাম্পত্যে যৌনসংযম এবং যৌনতার উপর অবদমনমূলক ব্রহ্মচর্যধর্মের পক্ষে সওয়াল করে এলেও বিনয়কুমার এবার সরাসরি রক্তমাংসের শরীরী চাহিদার উপর পারিবারিক এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ান ৷ একই কথা বলা যায় রাধাকমল মুখোপাধ্যায় সম্পর্কেও ৷ একদা গৃহস্থ এবং ব্রাহ্মণসমাজ পত্রিকায় রক্ষণশীল বর্ণাশ্রমধর্মের পক্ষে প্রবন্ধ লিখলেও এবার তিনিও তাঁর মতামত পরিবর্তন করেন ৷ ১৯১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর দারিদ্যের ক্রন্দন বইটি সেই পরিবর্তিত ভাবনার স্বাক্ষর ৷ ‘বস্তুতান্ত্রিক যুগে’ রাধাকমল বাৎসায়নের ‘পুরুষার্থ’-ভাবনার প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং বলেন এই যুগে ‘অর্থ-ই ব্যক্তির জীবনের অন্য তিনটি প্রয়োজনীয় পুরুষার্থ—ধর্ম-কাম-মোক্ষ-র নিয়ন্ত্রক ৷ এভাবেই অন্ত্য-উনিশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনার সাপেক্ষে আধ্যাত্মিক পারিবারিকতার অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা শরীর/যৌনতার মতাদর্শ বিশ শতকের গোড়ায় পৌঁছে দেশীয়/আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি এবং বিভিন্ন ভাবধারার প্রভাবে ধীর গতিতে হলেও পরিবর্তিত হয়ে চলেছিল ৷১৩

উনিশ শতকের ‘সংযমতত্ব’, ‘বিকারতত্ব’, বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের যৌনবিজ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনায় এসে পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক অ্যানালিটিকাল ডিসকোর্সের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় ৷ বিশেষত, প্রথম কয়েক দশকের সেক্স-ম্যানুয়ালগুলো দেখলে বোঝা যায় দু’ধরনের প্রচলিত যৌনতাবিষয়ক বইয়ের বিরুদ্ধে লেখকেরা আপত্তি জানাচ্ছেন ৷ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত আবুল হাসানাৎ প্রণীত ‘সচিত্র যৌনবিজ্ঞান’ বইতে লেখক বলছেন, ‘‘আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে যৌনতত্বের নামে যে সমস্ত পুস্তক স্তূপীকৃত হইয়াছে, তাহাদের শতকরা আশিটাই কি কামোদ্দীপক ও উপভোগের বিবিধ উপায় বর্ণনাকারী রতিতত্ব নহে?’’ ৷ অর্থাৎ, এগুলো নেহাত আনপড় যুবক-যুবতীর সাময়িক যৌনচাঞ্চল্য পরিপুষ্ট করার পয়সা-পেটানো ‘কুরুচিকর’ বই ৷ আর একধরনের বইয়ের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি ৷ বলেছেন, ‘‘যাহা যৌনশাস্ত্র নামে চলিতেছে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধাত্রীবিদ্যার পুস্তক মাত্র… লেখকগণ যৌনবিজ্ঞান ও ধাত্রীবিদ্যার পার্থক্য ধরিতে পারেন নাই’’ ৷ বস্তুত, আবুল হাসানাতের লেখা থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে কীভাবে যৌনতাকে কেন্দ্র করে বিশ শতকের গোড়ায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে ফুকো-কথিত ‘মেডিক্যালাইজেশন অফ সেক্সুয়ালিটি’ এবং ‘বায়ো-পাওয়ার’ ব্যক্তির ‘যৌনশরীর’ এবং ‘পারিবারিক শরীর’-কে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির আওতায় আনতে চাইছে ৷ সুস্থ-সবল দাম্পত্যের ভিত্তিভূমি যৌনতা ৷ একথা স্বীকার করে নিয়ে লেখক বলছেন, প্রত্যেকটি নববিবাহিত দম্পতিকে যৌনবিজ্ঞানের সঠিক দিকনির্দেশ দেওয়াই আজকের কর্তব্য ৷ তাদের হাতে প্রামাণ্য যৌনবিজ্ঞানের বই তুলে দেওয়াই তাদের সুস্থিত যৌনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে ৷ যেহেতু দাম্পত্যই যৌনতা অভ্যাসের একমাত্র বৈধ ‘ক্ষেত্র’, তাই সেই দাম্পত্যকে সুন্দর করে তোলার জন্য ‘সঠিক’ যৌনতার অভ্যাস সবচেয়ে বেশি জরুরি ৷ লেখকের ভাষায়, ‘‘শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা লইয়া অধ্যয়ন করিলে বাঙালির পারিবারিক জীবন সুখের আকর হইবে ৷ বাংলার দম্পতিরা আদর্শ প্রেমিক-প্রেমিকা হইবেন ৷ ব্যভিচার ও যৌনবিকল্প বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন হইতে দূরীভূত হইবে’’ ৷ তিনি যৌনতাকে একধরনের বৈজ্ঞানিক নৈতিকতার উপর স্থাপন করতে চাইছেন ৷ বলছেন, ‘‘সাধারণ কথা এই যে, বিবাহ সম্পর্ক প্রধানত যৌনসম্পর্ক ৷ যৌনসম্পর্করূপে দাম্পত্যজীবন সফল হইলে দাম্পত্যজীবনের মহীরূহ মানবজীবনের বৈষয়িক ও পারমার্থিক কল্যাণের ফুলে-ফলে মঞ্জুরিত হইয়া উঠে ৷ সুতরাং যৌন সম্পর্করূপে দাম্পত্যজীবনের সাফল্যের উপরেই অন্যান্য দিকের সাফল্য নির্ভর করিতেছে’’ ৷ এখানে লক্ষণীয়, উনিশ শতকের অবদমনমূলক যৌনতা এবার অনেক খোলামেলা আলোচনার পরিসরে এসে আরও জটিল ও বোধগম্য এক ‘ক্ষমতা’-র অদৃশ্য জাল রচনা করেছে, যেখানে, যৌনতা যতোটা ‘পরিমিসিভ’, ততোটাই সে মুক্ত আলোচনার সাপেক্ষে নিয়ন্ত্রণের অটুট কাঠামো গড়ে তুলছে ৷

এই ‘মেডিক্যালাইজেশন অফ সেক্সুয়ালিক্সিটি’-র আর এক বড়ো নিদর্শন নৃপেন্দ্রকুমার বসু ও আরাধনা দেবীর লেখা বই ‘নর-নারীর যৌনবোধ’ ৷ আবুল হাসানাৎ মূলত জোর দিয়েছিলেন দেহতত্ব ও শারীরবৃত্তীয় আলোচনায় ৷ কিন্তু, নৃপেন্দ্রকুমার সরে এলেন যৌনমনস্তত্বে ৷ তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কামশাস্ত্রের বইগুলি ও তাদের একেলে সম্প্রসারণের সমালোচনা করে বললেন, এইসব লেখকেরা ‘‘দেহের প্রতি সুবিচার করিতে গিয়া, মনকে একেবারে বিস্মৃত হইয়া বসিয়াছিলেন ৷ ঊনবিংশ শতকে যৌনজ্ঞানের চির-অবজ্ঞাত অন্তরালটির উপর আলোকপাত হইল ও তাহার ক্ষেত্র প্রশস্ত হইল ৷ মনোবিজ্ঞানের ডুবুরি নামিয়া সেই অন্ধকার অতল গহ্বর হইতে অপরূপ শৃঙ্খলার সহিত কত মণি-মুক্তা-প্রবাল তুলিতে লাগিল’’ ৷ এই মনস্তাত্বিক প্রকরণের মাধ্যমেই যৌনতার ‘স্বাভাবিকীকরণের’ পদ্ধতিটি কাজ করেছে ৷ নৃপেন্দ্রকুমারের বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ‘স্বাভাবিক যৌনবোধের মাপকাঠি’ ৷ লেখক কিন্তু যৌন-স্বাভাবিকতার এলাকটিকে অনেক দূর অব্দি বিস্তৃত করেছেন ৷ তাঁর মতে, ‘‘একটি বস্তুকে তখনই স্বাভাবিক বলিব, যখন সে তাহার গঠন-কর্মের সকল ধারাগুলি মানিয়া চলে এবং তাহার বিভিন্ন উপাদানগুলির কর্মক্ষমতার গণ্ডীকে তাহার প্রকৃতি আপন গতিপথে ডিঙ্গাইয়া চলে না ৷ যখনই সে এই নিয়মের ব্যতিক্রম করে, তখনই তাহাকে অস্বাভাবিক না বলিয়া উপায় নাই’’ ৷ বোঝাই যাচ্ছে, তাঁর মতে, ‘প্রকৃতি-নির্ধরিত’ নিয়ম-শৃঙ্খলা অতিক্রম করলেই ‘অস্বাভাবিকতা’ এসে পড়ে ৷ কিন্তু, এটা তিনিও পরিষ্কার করে বলেননি, যে, এই ‘প্রকৃতি-নির্ধারণ’-এর প্রক্রিয়াটিও আসলে ‘সামাজিকভাবে নির্ধরিত’, এটিও ‘সোশ্যালি কন্সট্রাক্টেড’ একটি ‘ধারণা’ ৷ নৃপেন্দ্রকুমারও ‘সমকামিতা’-কে ‘অসুস্থতা’ বলে মনে করতেন ৷ যদিও তিনি একটি খুব উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর বেশিরভাগ লোকই যৌনবোধ ও যৌন-জীবন বিষয়ে অল্পাধিক অসুস্থ বা অস্বাভাবিক এবং সভ্যসমাজে অতি সামান্য সংখ্যক স্বাভাবিক মানুষই বিদ্যমান’’৷এই স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক বাইনারিকে মান্যতা দেবার মধ্য দিয়েই কিন্তু নৃপেন্দ্রকুমার ফের সেই ‘সোশ্যাল নরম্যাটিভ রেগুলেশন’-এর কাছে ফিরে যাচ্ছেন ৷

তবে, যৌনতা-বিষয়ক এইসমস্ত ডিসকার্সিভ ব্যাখ্যার পাশাপাশি যদি সেদিনের সাধারণ জনজীবন খতিয়ে দেখি, তবে, দেখা যাবে, যৌনতার রেগুলেটরি ব্যাখার প্রায় কোনো প্রভাব সেখানে নেই ৷ বরং, সমাজে যে যৌন-আচরণের রমরমা সেদিন চলেছিল, তাকে নিয়মে বাঁধতেই ওই যৌন ডিসকোর্সের জন্ম ৷ অর্থাৎ, সামাজিক জীবন আর ডিসকার্সিভ রেগুলেশনের মধ্যে প্রায় কোনো যোগ নেই ৷ মেঘনাদ গুপ্ত প্রণীত রাতের কলকাতা বইটি বেরোয় ১৯২৩ সালে ৷ এতে নৈশ কলকাতার রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক (মতান্তরে এই বই হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা, মেঘনাদ গুপ্ত আসলে ছদ্মনাম) ৷ লেখক যে কলকাতার বর্ণনা দিয়েছেন, তা বিশ শতকের প্রথম দশকের কলকাতার ৷ যদিও লেখক শুরুতেই একটি ডিসক্লেইমার দিয়েছেন ৷ বলেছেন, ‘পাঠক লক্ষ করলে আরো দেখবেন যে, পাপকে আমি পাপ বলেই বরাবর চিনিয়ে দিয়েছি, তার প্রতি সকলের ঘৃণা ও বিরক্তি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি…রাতের কলকাতাকে একজন পাঠকও অশ্লীল বলে ভাবতে পারবেন না’’ ৷ অথচ, যে জীবনের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, সামাজিক কর্তৃপক্ষের চোখে তাকে ‘পাপ’ ও ‘অস্লীল’ বলেই মনে হবে ৷ কলকাতার পথে-ঘাটে চলেছে অজস্র যৌন ব্যভিচার ৷ তার ডিটেইল বর্ণনা পাওয়া যায় মেঘনাদ গুপ্তের লেখায় ৷ ‘কলকাতার পথ’ শীর্ষক অধ্যায়ের বিস্তারিত বিবরণ এখানে তুলে দেওয়া হল :

‘কলকাতার নানা পথের উপরে যে-সব কালী বা অন্যান্য দেবতার মন্দিরে আছে, সন্ধ্যারতির সময়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে একটি বিষয় লক্ষ করবেন ৷ মন্দিরের সামনে স্ত্রী-পুরুষের জনতা ৷ দু-চার জন খাঁটি ভক্ত এবং গরিব ভদ্রঘরের মেয়েও সেখানে থাকেন বটে,—কিন্তু বাদবাকি বেশির ভাগই শিকারি পুরুষ, ভদ্রঘরের কুচরিত্র স্ত্রীলোক বা বারবনিতা ৷ কোনো কোনো ভদ্রঘরের মেয়ের মাথার উপরে হয়তো অভিভাবক নেই, এবং তারা যে-কারণেই হোক বাজারের বারনারীর মতো প্রকাশ্যে রূপ-যৌবন বিক্রি করতে পারে না ৷ তারা এই সব মন্দিরে সন্ধ্যাবেলায় দেব-দর্শনের ছলে আসে ৷ রতনে রতন চেনে! কোনো শিকারি পুরুষের সঙ্গে আধ-ঘোমটার ফাঁকে চোখাচোখি হলেই তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় ৷ তারপর তারা যখন ঘরের দিকে ফেরে, তখন প্রায়ই দেখা যায় তাদের পিছনে পিছনে মধুলুব্ধ ভ্রমরেরও অভাব নেই! সময়ে বড় বড় পাকা শিকারিরাও ভ্রমে পড়ে গৃহস্থের সতী কুলবধূর পিছনে অনুসরণ করে ৷ পরিণাম—লগুড়ের রসাস্বাদ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পলায়ন ৷ কিন্তু এত লাঞ্ছনাতেও হতভাগ্যদের চৈতন্য হয় না—মন্দির-দ্বারে পরদিন ঠিক আবার নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে ধরনা দেয় ৷ এক শ্রেণির পুরুষ আছে, সাধারণ বারবনিতার চেয়ে এইরকম অপ্রকাশ্য কুলটাদেরই তারা বেশি পছন্দ করে ৷ বারবনিতারাও এই-প্রকৃতির পুরুষদের চরিত্র বোঝে ৷ তাই তাদেরও অনেকে মন্দিরে গিয়ে সন্ধ্যারতি দেখবার অছিলায়, মুখে ঘোমটা টেনে গৃহস্থের বউ সেজে পুরুষদের চোখে ধুলো দিতে ছাড়ে না ৷ …এই নারীর পিছন-নেওয়া অভ্যাসের ফলে মাঝে মাঝে কতক-বিয়োগান্ত প্রহসনের অভিনয় হয় ৷ অনের সময়ে এক নারীর পিছনে একাধিক রূপ-রসিকের সমাগম হয় ৷ তখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে ছাঁটবার মতলবে হরেকরকম কৌশল অবলম্বন, চোখ-রাঙানি, গালাগালি, মারামারি কিছুই বাদ যায় না ৷ মানুষের ভিতরে এখনো কুকুর-বিড়ালের স্বভাব প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে ৷

শেষ-রাত্রে গঙ্গার ধারে এই ধরনের আর এক দৃশ্য দেখা যায় ৷ রাতশেষে অন্থকারে মুখ ঢেকে অনেক পরপুরুষ-দৃষ্টি-ভীত কুল-নারী প্রাতঃস্নানে যান ৷ তাঁরা যে সবাই সতী-সাবিত্রী তা নয় ৷ তাঁদের ভিতরেও অনেক ভেজাল আছে—তারা এই সূবর্ণ-সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না ৷ শিকারি পুরুষরাও এ সন্ধান রাখে ৷ তারাও দলে দলে এই সময়ে বেরিয়ে পড়ে এবং ওঁৎ পেতে বসে থাকে ৷ অনেকের সন্ধানে খালি-বাড়ি আছে ৷ হস্তগত শিকারকে নিয়ে পুরুষেরা এই সব বাড়ির ভিতরে গিয়ে ঢোকে ৷ মাঝে মাঝে সুচরিত্র তরলমতি মেয়েরাও এদের প্রলোভনে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ সাধন করে—কেই কেউ আর ইহজীবনে বাড়িতে ফেরে না ৷ সঙ্গে পুরুষ-রক্ষক না থাকলে, শেষ-রাতে বাড়ির মেয়েদের কখনো গঙ্গাস্নানে যেতে দেওয়া উচিত নয় ৷

বড়-বাজারের দিকে গঙ্গাতীরেও পশ্চিমা মেয়েদের জন্যে খালি-বাড়ি আছে শুনেছি—কিন্তু আমি নিজের চোখে তা দেখিনি ৷ এসব বাড়িতে মেয়েদের জন্যেই নাকি বাহির থেকে পুরুষ সংগ্রহ করা হয় ৷ পশ্চিমা যুবতীরা নাকি এখানে এসে সংগৃহীত পুরুষদের সহবাসে আপনাদের বাসনা চরিতার্থ করে যায় এবং বলা বাহুল্য যে এজন্যে তাদের টাকা খরচও করতে হয় ৷ কিন্তু শোনা-কথায় নির্ভর করে এ-সম্বন্ধে আমি আর বেশি কিছু বলতে পারি না ৷ ব্যাপারটা সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে—তবে কলকাতায় অসম্ভব বলে কোন কিছু নেই ৷

অসম্ভব নয় বলছি এইজন্য যে, এর চেয়েও উদ্ভট কাণ্ড আমি বাঙালি-পাড়ায় ঘটতে দেখেছি ৷ এই কদর্য ‘রোম্যান্সে’র নায়িকা হচ্ছেন, কলকাতার কোন প্রাচীন ও বিখ্যাত ধনী পরিবারের এক মহিলা ৷ অল্পবয়সেই তাঁর স্বামী পরলোকে যান—বিধবা পত্নীর মাথার উপরে আর দ্বিতীয় অভিভাবক না রেখে ৷ গঙ্গার কাছাকাছি কোন পল্লিতে এই মহিলা একাকিনী প্রকাণ্ড এক অট্টালিকায় বাস করতেন, একমাত্র শিশু-পুত্রকে নিয়ে ৷ এঁর লালসা মেটাবার পদ্ধতি ছিল যেমন কুৎসিত, তেমনি অভিনব ৷ শেষ-রাতে উনি গাড়িতে চড়ে সঙ্গে জনকয়েক বিশ্বাসী দারোয়ান নিয়ে ‘গঙ্গাস্নানে’ যেতেন—যদিও স্নান করতেন না ৷ আগেই বলেছি, এ-সময়ে শ্রেণিবিশেষের পুরুষও শিকারের খোঁজে বেরোয় ৷ এই রূপসি যুবতী সেই শিকারিদের উপরেই শিকার করতেন ৷ যাকে দেখে তাঁর পছন্দ হতো, তাকে তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতেন ৷ কেউ কেউ প্রকাণ্ড গাড়ি ও দারোয়ান দেখে তাঁর সঙ্গে আসাটা নিরাপদ বিবেচনা করতো না—এ-হেন রূপসির লোভ ছেড়েও প্রাণপণে পালাতে চাইত—ভাবত বোধহয়, এ হচ্ছে কোন বিপদজনক ফাঁদ! সে-ক্ষেত্রেও কমলি কিন্তু তাদের ছাড়ত না ৷ মহিলার ইঙ্গিত পাবামাত্রই দারোয়ান সেই কাপুরুষ প্রেমিককে ছোঁ মেরে গাড়ির ভিতরে টেনে তুলত! গাড়ি যখন প্রকাণ্ড অট্টালিকার ফটকের মধ্যে ঢুকত, বন্দি বেচারি তখন ভয়ে কাঠ হয়ে ভাবত—আজ সে নিশ্চয়ই গুম খুন হবে!…ঐ মহিলাটি একসময়ে প্রায়ই অজানা প্রেমিকের জন্যে এমনি অপূর্ব অভিসার-যাত্রা করতেন ৷ এখন তিনি শান্ত হয়েছে—কারণ তাঁর পুত্র সাবালক ৷

এর পাশাপাশি বিলিতি গণিকাদের বর্ণনা ৷ বস্তুত, কলকাতার দিনের আলোর চাদর সরিয়ে নৈশ নিলয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেই এই শিউরে ওঠার মতো ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়:

‘আধুনিক বিলাতি রূপসিদের নৈশ পোশাক একান্ত মারাত্মক ৷ একে তো তাঁদের রঙ ফাটা-বেদনার মতো অপূর্ব, তার উপরে সেই যৌবনপুষ্ট তনুলতার ঊর্ধ্বাংশ একেবারেই উন্মুক্ত—অনেকেরই দুধের মতো ধবল উচ্চ বক্ষ বিচিত্র নগ্ন সৌন্দর্যে দর্শকের চক্ষুকে রীতিমত স্থির করে দেয় ৷ খুনীরা মানুষের দেহকে হত্যা করে, কিন্তু শ্বেতাঙ্গসুন্দরীরা হত্যা করে মানুষের মনকে! আইন অনুসারে এঁদের শাস্তি হওয়া উচিত ৷ যুবকরা সাবধান, ফিরিঙ্গি-পাড়ার এ-সব আলেয়ার আলোর দিকে তাকানো মিছে,—কারণ এরা দেখা দেয়, ধরা দেয় না! …এই ভিড়ের মধ্যে এক শ্রেণির বঙ্গবালাও বিচরণ করেন—তাঁদেরও পোশাক কিম্ভুত কিমাকার—দেশি-বিলাতি ফ্যাশনের ‘ঘণ্টা’ বিশেষ! তবে অনেকেই বোধ হয় এই ভেবে দুঃখ পান যে, কেন এঁরা এখনো বুকের কাপড় খুলে পথে বেরুতে শেখেননি? আমাদের বিশ্বাস, অদূর ভবিষ্যতে খুব-সম্ভব এমন দুঃখ প্রকাশেরও অবকাশ থাকবে না—‘‘আসিবে, সেদিন আসিবে!’’

সন্ধ্যাবেলায় এখানে এরকম খালি ফিটন গাড়ি পথে পথে ঘুরে বেড়ায় ৷ তার সহিস, কোচম্যান, ঘোড়া ও আকার কিচুই ছ্যাকরা গাড়ির মতো নয় ৷ এ-সব গাড়ি রহস্যপূর্ণ ৷ আপনি যদি রসিক হন, তবে এই গাড়িগুলিকে দেখলেই চিনতে পারবেন ৷ এর ভিতরে উঠে বসুন, চালক আপনাকে বিনাবাক্যব্যয়ে শ্রেণিবিশেষের শ্বেত-রূপসির কাছে নিয়ে যাবে ৷ তারা শুভ্র টাকার বিনিময়ে আপনার কয়লা-কালো রঙ ভুলে অনায়াসে দেহকে বিকিয়ে দেবে ৷ তবে আপনার দেহে ফিরিঙ্গি পোশাক থাকা চাই ৷ সন্ধ্যার মুখে অনেক বাঙালির ছেলেকে এই উদ্দেশ্যে এখানে ঘুরুর-ঘুরুর করতে দেখবেন ৷

বিলাতি রূপজীবিনীরা সন্ধ্যার সময়ে পথের উপরেও আবির্ভূত হয় ৷ কিন্তু সাধারণ ভদ্র মেমদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য, চক্ষু কিঞ্চিৎ শিক্ষিত না হলে ধরা যায় না ৷ তবে একটু লক্ষ করলেই সাধারণ বারবনিতার বিশেষত্ব তাদের খেলো অথচ রঙচঙে পোশাকে, অবসাদগ্রস্ত চোখে, অত্যধিক পাউডার-রঙ-মাখা মুখে আর হাবভাব চলাফেরার মধ্যেই নিশ্চিত রূপে প্রকাশ পায় ৷ গড়ের মাঠের কোণে ‘কার্জন-পার্কে’ খানিকক্ষণ বসে থাকলেই প্রায় এদের দেখা মেলে! ‘ইডেন গার্ডেন’ও এদের একটি মস্ত শিকার স্থান ৷ সেখানে রাতের আবছায়ায় প্রায়ই ঝোপেঝাপে পরপুরুষের সঙ্গে আলুথালু বেশে ফিরিঙ্গি রূপসিদের আবিষ্কার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না ৷

গঙ্গার ঘাটে শেষ-রাত্রে একশ্রেণির ‘ভদ্রনারী’র ব্যবহারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, সাহেব পাড়াতেও সেই দলের ফিরিঙ্গি বা ইহুদি প্রভৃতি জাতের মেয়ের অভাব নেই ৷ তবে সন্ধ্যার সময়েই তারা বেরোয় পুরুষের মাথা খেতে ৷ তাদের অনেকে টেলিগ্রাফ অফিসে কাজ করে, অনেকে টাইপ-রাইটার চালায়, অনেকে বিলাতি দোকানে ‘শপ-গার্লে’র কাজ করে ৷ অনেকের আবার স্বামীও আছে! যারা স্বাধীন, তারা পথ থেকে শিকার সংগ্রহ করে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে যায় ৷ যারা স্বাধীন নয়, তাদের জন্যে পুরুষকে খালি-বাড়ি বা অন্য কোন রকম বন্দোবস্ত করতে হয় ৷ টাকা পেলে এরা শাদা-কালো চেহারা বাছে না, সকলের সঙ্গে সমানভাবে আনন্দ করবে ৷ সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটার-বায়স্কোপে যাবে, হোটেলে গিয়ে খাবে মোটরে উঠে ‘জয় রাইড’ করবে ৷ হয়তো ক্রমাগত গৌরবর্ণকে উপভোগ করে করে শ্যামবর্ণ এদের কাছে লোভনীয় বলে বোধ হয় ৷ সাধারণত এরা গাড়ির ভিতরেই পরপুরুষের আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে ৷ রাত্রি বেলায় গড়ের মাঠের আড়ালে আবছায়ায় এবং ঘোড়দৌড়ের মাঠের আনাচে কানাচে গেলে এই জাতীয় অনেক স্ত্রীলোকের লীলাখেলা স্বচক্ষে দেখতে পাবেন ৷ শ্বেতাঙ্গ পাহারাওয়ালারা এদের উপরে খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখে ৷ মাঝে মাঝে এরা গাড়ির ভিতরে পরপুরুষের সঙ্গে অকথ্য অবস্থায় ধরা প’ড়ে যায় ৷’

এরপর ‘গণিকা পল্লি’ শীর্ষক এক বিস্তৃত অধ্যায়ে কলকাতার বেশ্যাপল্লির জীবন্ত বর্ণনা ৷ লেখকের বিবরণ সরাসরি দেওয়া হল :

‘কলকাতার নৈশ-নাট্যের প্রধান পাত্রী হচ্ছে বারবনিতারা ৷ কলকাতায় এমন শ্রেণির লোক নেই বললেই হয় বারবনিতার গৃহে যাদের আনাগোনা নেই ৷ কলকাতায় বারবনিতার সংখ্যা ধরা যায় না ৷ কারণ এমন বারবনিতা এখানে অগুনতি আছে, যারা নানান-রকম জীবিকার আড়ালে আত্মগোপন করে, আদম-সুমারিতে তাদের নাম ওঠে না ৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ বাবুদের ঘরের দাসীদের কথাই ধরুন ৷ অনেক নীতিবাগীশ বাংলা থিয়েটার দেখতে যান না এই অজুহাতে যে, বারবনিতার সংস্পর্শে আমাদের রঙ্গালয় কলঙ্কিত ৷ কিন্তু তাঁরা দিন-রাত যাদের সংস্পর্শে আছেন, সেই দাসীরা কী? অধিকাংশই বারবনিতা! অনেক বাবু ঘরে বসেই তাদের উপভোগ করেন এবং কলকাতার প্রত্যেক পাড়াতেই এমন বাবুর সংখ্যা অল্প নয়!

কলকাতা শহরে বারবনিতার প্রধান আড্ডা হচ্ছে এইগুলি—সোনাগাছি, রুপোগাছি, জয়মিত্রের গলি, আপার চিৎপুর রোড, বৌবাজার, কড়েয়া, হাড়কাটা গলি, হরি-পদ্মিনীর গলি, শেঠবাগান, নতুন বাজার, মহেন্দ্র গোস্বামীর লেন, সিমলা, ফুলবাগান, কেরানিবাগান, শশিভূষণ সুরের গলি, বেনেটোলা, গরাণহাটা, ঢাকাপটি, জোড়াবাগান ও মালাপাড়া গলি প্রভৃতি ৷ এ ছাড়া কলকাতার অধিকাংশ পল্লিতেই কম বা বেশি সংখ্যায় বারবনিতা আছে—অর্থাৎ আমাদের এই শহরটি অবিদ্যার দ্বারা প্রায় আচ্ছন্ন বললেই চলে ৷ নিশ্চয়ই কলকাতার বেশির ভাগ লোকই এদের বাড়িতে প্রায়ই আসে-যায়, নইলে দিনে দিনে এরা দলে এত ভারী হয়ে উঠছে কেন? চরিত্র সম্বন্ধে বাঙালির ধারণা খুব উচ্চ ব’লে মনে হচ্ছে না ৷ অবশ্য বাঙালির নীতিজ্ঞান এদিকে কোন কালেই বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেনি ৷ প্রাচীন গ্রিসের মতো, দেড়শো বৎসর আগে পর্যন্ত বাংলার পল্লিতে পল্লিতে বারবনিতার গৃহই ছিল গ্রামবাসীদের সাধারণ মিলন-স্থান ৷ পাড়ার বৃদ্ধেরা হরিনামের ঝুলি হাতে ক’রে অবিদ্যার গৃহে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিতভাবে এসে হাজিরা দিতেন এবং তাঁদের সঙ্গে আসত যুবকগণও ৷ এর মধ্যে কিছুমাত্র লজ্জা বা লুকোচুরি ছিল না, কারণ সেকালে এই ব্যাপারটা নির্দোষ ব’লেই গণ্য করা হতো ৷ নানা আলোচনায় সন্ধ্যার খানিকটা কাটিয়ে, সকলে আবার যে যার বাড়িতে ফিরে যেত ৷ অর্থাৎ অবিদ্যার আলয় ছিল সেকালে পল্লির প্রধান বৈঠকখানা ৷ কিন্তু সেকালের কথা এখন থাক ৷

কলকাতার দেশি বারবনিতার মধ্যেও শ্রেণিবিভাগ আছে ৷ রাস্তা বা গলির উপরে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তারা হচ্ছে সবচেয়ে নিম্ন স্তরের বারবনিতা ৷ তারা প্রায়ই একতালা খোলার ঘরে বাস করে, অন্ধকার ও আবর্জনার মধ্যে ৷ চাকর, মুঠে ও গরিব ছোট লোকরাই তাদের রূপের উপাসক ৷ তার উপরের স্তরের বারবনিতারা থাকে দোতলা মাঠকোটায় ৷ মালাপাড়া গলি, ঢাকাপটি ও জোড়াবাগান প্রভৃতি পল্লিতেই এদের বাস ৷ সাধারণত গদিওয়ালা, দোকানি ও ধনীদের নিম্নপদস্থ কর্মচারীরাই এখানে আমোদের খোঁজে যায় ৷ তারপর কোঠাবাড়ির একতলা ঘরের বারবনিতা ৷ তারা কিচু ভদ্র ৷ তার উপরের স্তরে চিৎপুর রোড, হাড়কাটা গলি ও হরিপদ্মিনী গলির বারবনিতা—যাদের বাস কোঠাবাড়ির দোতালায় বা তেতালায় ৷ সাধারণত কেরানি প্রভৃতি দ্বারাই তাদের রূপের ব্যবসা চলে যায় ৷ তার উপরের স্তরই হচ্ছে সর্বপ্রধান স্তর ৷ এ স্তরের মধ্যে আবার দুই দল—যারা বাঁধা, আর যারা ছুটো ৷ বাঁধারাই সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত. এদের অনেকে দেড়শো থেকে তিন-চারশো টাকা পর্যন্ত মাসিক মাহিনা পায় ৷ অনেকে আবার পাঁচশো, সাতশো—এমন-কি হাজার টাকা পর্যন্ত বৃত্তি ভোগ করে ৷ ছুটোদের দৈনিক দর্শনী আট-দশ টাকা থেকে বিশ-পঁচিশ টাকা পর্যন্ত ৷ যারা ভালো নাচ-গান জানে, তাদের দৈনিক রোজগার আরো বেশি—সময়ে সময়ে একশো দেড়শো টাকা পর্যন্ত ৷ এই স্তরে আর এক দল বারবনিতা আছে, যারা কতক ‘বাঁধা’ কতক ‘ছুটো’ ৷ তাদের কারুর বা বাবু আসে হপ্তার নির্দিষ্ট কয়েক দিন ৷ বাকি দিনে সে স্বাধীন ৷ কারুর বা বাবু আসে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে—বাকি সময়ে সে যাকে খুশি তাকেই অভ্যর্থনা করতে পারে ৷ এই নির্দিষ্ট কালের বাবুরা ‘টাইমের বাবু’ নামে বিখ্যাত ৷ উচ্চস্তরের বারবনিতাদের প্রধান আস্তানা সোনাগাছি, রুপোগাছি ও সিমলার মধ্যে ৷ এ সত্রের বারবনিতারা প্রায়ই নৃত্য ও সঙ্গীত কলায় বিশেষজ্ঞ ৷ অনেকে বেশ লেখাপড়া জানে এবং রবীন্দ্রনাথের কাব্যের ভক্ত পাঠিকা ৷ এরা শরীরের উপরে তেমন অত্যাচার করে না ব’লে, এদের মধ্যে পরমা সুন্দরীরও অভাব নেই ৷ এদের আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তা প্রায়ই বেশ শিষ্ট ও অশ্লীলতা-বর্জিত ৷ এই শ্রেণির বারবনিতারা বেশি-বয়সে বড় একটা অর্থ কষ্টেও পড়ে না—কারণ হতভাগ্যই এদের টাকার পাহাড়ের উপরে বসিয়ে, নিজেরা কাঙাল হয়ে পথের ধুলোয় গিয়ে বসে ৷ তার উপরে, প্রাচীন বয়সে এদের গর্ভজাত বা পালিত কন্যারাও টাকা রোজগার করে ৷ মেয়ের টাকায় মায়ের দিন নিশ্চিন্তভাবে চ’লে যায় ৷ বৃদ্ধ বারবনিতারা প্রায়ই বাড়িওয়ালি হয়!

সন্ধ্যা না হ’তেই চিৎপুর রোডের বারান্দায় রূপ বা কুরূপের প্রদীপগুলি সারি সারি বাহার দিয়ে বসে এবং রাস্তাতে গৃহাভিমুখী কেরানিবৃন্দ ঊর্ধ্ব-মুণ্ড ব্রত গ্রহণ করে ৷ এই ব্রত পালন করতে গিয়ে অনেকেই মাঝে মাঝে গাড়ি চাপা পড়বার মতো হয়, কিন্তু সে ধাক্কা কোনক্রমে সামলে নিয়েই ব্রত-পালকরা আবার একনিষ্ঠ ভক্তের মতো বারান্দার উপরে ক্ষুধিত দৃষ্টি স্থাপিত করে ৷ ধন্য সে অধ্যবসায়, যার মধ্যে প্রাণের ভয় নেই! কে বলে বাঙালি ভীরু? …এই সময়েই অনেক পুরুষ পুঙ্গব রাত্রের ‘খাদ্য’ পছন্দ ক’রে ফেলেন এবং তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে গা-মুখ ধুয়ে সাজ-পোশাক বদলে, একটু ঠাণ্ডা হয়েই নির্বাচিত খাদ্যে ছোঁ মারতে ছোটেন! চিৎপুর রোডের বারান্দা-বিপণিতে সাজানো দেহ-পণ্যের প্রধান খরিদ্দার যে মাছি মারা কেরানির দল তার জ্বলন্ত প্রমাণ, মাসকাবারের পরের প্রথম শনিবারে প্রায় কোন পণ্যই ক্রেতার অভাবে প’ড়ে থাকে না! যত বড় কুৎসিত স্ত্রীলোকই হোক না, অন্তত সে রাত্রের জন্যেও তার একজন না একজন উপাসক মিলবেই মিলবে!

চিৎপুর রোডে রাত্রিতে এই বারান্দা-বিলাসিনীদের মুখ সুশ্রী কী কুশ্রী পথ থেকে দেখে তা চেনা যায় না ৷ পুরুষরা অদৃষ্টের উপরে নির্ভর ক’রে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং ‘রূপসীরা’ও বাইরের বারান্দা ছেড়ে বাড়ির ভিতরের বারান্দায় এসে আপন আপন ঘরের দরজা জুড়ে দাঁড়ায় ৷ তারপর দর-দস্তুর ৷ কিন্তু মাল না দেখে তো দর চলতে পারে না, কারণ অধিকাংশ বাড়ির ভিতরেই পূর্ণিমাতেও অমাবস্যা হয়ে থাকে! এক রাত্রের বহু-বাবুরা প্রায়ই তখন এমন এক সুন্দর উপায় অবলম্বন করেন, যাতে ক’রে শ্যামও থাকে, কুলও বাঁচে—অর্থাৎ মালও দেখা হয়, চক্ষু-লজ্জাও অক্ষত থাকে! তাঁরা মুখে ধাঁ ক’রে একটা সিগারেট গুঁজে, সেটা ধরাবার অছিলায় দেশলাই জ্বালেন এবং তারই অস্থায়ী আলোতে সামনের রমণীটিকে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখে নেন!

সাধারণত দর-দস্তুরের বাঁধা-ধরা নিয়ম এই—

বাবু ৷ কিগো, লোক বসাবে?

বিবি ৷ কতক্ষণ বসবেন?

কেউ বলে, এক বা দুই ঘণ্টা ৷ কেউ বলে, সারা রাত ৷ এক ঘণ্টার দর্শনী চার টাকা শুনলে বাবুরা হাঁকেন, দু-টাকা ৷ সারা রাতের দর্শনী আট টাকা শুনলে বাবুরা বলেন, চার টাকা ৷ তারপর মাঝামাঝি একটা রফা হয় ৷ বেশি কম দর হাঁকলে, ‘না মশাই, এখানে হবে না, খোলার ঘরে যান’—এমনি ধরনের একটা অযাচিত উপদেশ দিয়ে, আঁচল ঘুরিয়ে ও কোমর দুলিয়ে বিবিরা আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান ৷

সোনা ও রুপোগাছির ছুটো অবিদ্যারা নিতান্ত দুর্ভিক্ষ-পীড়িতের মতো অবস্থা না হ’লে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করে না ৷ প্রায়ই চেনাশুনো বন্ধুর দয়াতেই তাদের ঘর খালি যায় না ৷ বাইরের অচেনা লোক যারা আসে, তারাও দালালের মধ্যস্থতাতেই আনীত হয় ৷ দর যা ঠিক হয়, তার চার আনা অংশ পায় দালালরা ৷ মাঝে দালাল থাকলে বাবুদের টাকাও দিতে হয় বেশি, কারণ যার দাম আট টাকা, দালালের মধ্যস্থতায় এলে তারই দাম হয় দশ টাকা ৷ বিবির দাম বেশি হ’লে নিজের পাওনাও বেশি হবে, তাই দাম চড়াবার জন্যে দালালরাও যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি করে না! বিবির দেহের দামের উপরে বাবুর আর দুটি বাঁধা খরচ আছে ৷ চার বা আট আনার পান এবং বিবির বেয়ারাকে আট আনা বা এক টাকার বকশিশ! তার উপরে কোন কোন সুচতুরা বাবুর কাছ থেকে আজ্ঞার স্বরে আব্দার ধ’রে সে রাতের জন্যে নিজের ও মায়ের খাইখরচটাও আদায় ক’রে নেয় ৷ গ্রীষ্মের সময়ে রাস্তা দিয়ে ফুলওয়ালা গেলে আট আনা এক টাকার বেলের গোড়ের ফরমাশ হওয়াও খুব স্বাভাবিক ৷ তার উপরে ট্যাক্সিতে চ’ড়ে গড়ের মাঠ পর্যন্ত বেড়িয়ে আসবার বায়নাও আছে—তারও খরচ তিন-চার টাকার কম নয় ৷ অধিকাংশ বাবুই বাড়িতে কিপ্টে হ’লেও এখানে এসে একেবারে দাতা-কর্ণের নব্য সংস্করণে পরিণত হন এবং যে-সব রাতের পাখি সবে উড়তে শিখেছে, তাদের হাতই দরাজ হয় সবচেয়ে বেশি ৷ এ পথে যারা চেনা পথিক, অর্থাৎ যাদের হাড়ে ঘুণ ধ’রে গেছে, তাদের কাছ থেকে বিবিরা বিশেষ সুবিধা ক’রে উঠতে পারেন না ৷ অবশ্য পুরাতন পাপীরা অচেনা হলেও ভাবভঙ্গী দেখেই তাদের চিনে নিতে বিবিদের বেশি দেরি লাগে না ৷ তবু সে ক্ষেত্রেও সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি হয় যথেষ্ট, অর্থাৎ বিবিরা চান পকেট ছ্যাঁদা করতে, আর বাবুরা চান সন্তর্পণে তা সামলাতে ৷ বিবিরাই কিন্তু জেতেন বেশি ৷ বাবুর ট্যাক গড়ের মাঠে পরিণত করবার বিবিধ উপায় তাঁদের নখদর্পণে আছে ৷ যথা, বাবুর জন্যে মদের বোতল এল ৷ বোতল যখন এল, তখন পান করতেই হবে ৷ কিন্তু বাবু পান করেন কীসে? বিবির ইশারায় বেয়ারা ঘরের চারিদিকে খানিকক্ষণ মিছে খোঁজাখুজি ক’রে ব’লে দিলে—‘গেলাস সব ভেঙে গেছে!’ অগত্যা বাবু নাচার হয়ে একটা বা দুটো নতুন গেলাস কিনে আনবার জন্যে পকেটে হাত দিতে বাধ্য হলেন ৷ ফলে আর কিছু না হোক, বিবির ঘরে অন্তত গেলাসের সংখ্যা তো বাড়ল বটে! পুরোনো পাপীদের কাহিল করবার জন্যে এমনি আরো ঢের ছোট-বড় উপায় আছে ৷

অনেকের বিশ্বাস, টাকা দিয়েই অবিদ্যার ঘরে গিয়ে অনায়াসে বসতে পারা যায়, তার কোন পছন্দ নেই ৷ এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ মিথ্যা না হ’লেও সম্পূর্ণ সত্যও নয় ৷ অধিকাংশ বারবনিতাই যাকে-তাকে ঘরে বসতে দেয় না এবং বেশি টাকা কবলালেও অচেনা লোকের সঙ্গে সহজে সারা রাত কাটাতে রাজি হয় না—অবশ্য খুব-সম্ভব, ভয়েই ৷ তাদের মতো অসহায় জীবনের তুলনা কোথায়? প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির অবিদ্যারা চেহারা পছন্দ না হ’লে দ্বিগুণ মূল্যেও যে আত্মদানে রাজি হয় না, এ একেবারে খাঁটি কথা ৷ তারা ইতর ও ভদ্রের বিচার ক’রে লোক বসায় বা বিদায় ক’রে দেয়, ছোটলোকের ট্যাক ভারী থাকলেও তাদের চৌকাঠ মাড়াতে দেয় না ৷

আগেই বলেছি, অবিদ্যার চরিত্রে মনুষ্যত্বের অভাব নেই ৷ তার একটি প্রমাণ দিচ্ছি ৷ অভিভাবকরা খবর রাখেন না যে, কত ইস্কুলের বালক পনেরো-ষোলো বৎসর বয়সেই কুস্থানে আনাগোনা করে! এ-সব জায়গায় বালকদের উপযোগী বালিকারও অভাব নেই, তবু অনেক এঁচড়ে-পাকা বালক আবার তাতেও তুষ্ট না হয়ে, তাদের চেয়ে সাত-আট নয়-দশ বৎসরের বয়সে বড় যুবতীদের প্রতি লোভ প্রকাশ করে ৷ কিন্তু প্রায়ই তাদের চেষ্টা বিফল হয় ৷ বেশি টাকা দিলেও তাদের বিকৃত মনের বাসনা চরিতার্থ হয় না, বরং বকুনির চোটে তারা ছটপট সরে পড়তেই বাধ্য হয় ৷

সন্ধ্যা হচ্ছে রূপের দোকান সাজানো এবং দর-দস্তুরের সময় ৷ তখন অবিদ্যা পল্লির বিশেষত্ব বড় ধরা পড়ে না ৷ বাবুরাও তখন সবে এসে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসেছেন, আলাপ তখন জ’মে ওঠেনি এবং নেশা মাথায় চড়েনি—কাজেই চারিদিক তখনো অনেকটা শান্ত ৷

কিন্তু রাত নয়টার পরেই এখানকার আবহাওয়া যায় একেবারে বদলে ৷ গেলাসে একের পর দুই পেগ ঢালতে ঢালতেই বাবুদের চোখে দুনিয়ার রঙ গোলাপি হয়ে ওঠে, তিন পেগের সঙ্গে সঙ্গেই সকলের দেহে যেন নবজীবনের সঞ্চার হয় ৷ পথের দু-ধারে ঘরে ঘরে হার্মোনিয়াম, গান ও বিকট স্বরে বাহবার আওয়াজ উঠে পাড়া একেবারে সরগরম ক’রে তোলে ৷ কোথাও বিবি ঘুঙুর প’রে মাথায় মদের গেলাস বসিয়ে, চোখ, ভুরু, ঠোঁট ও হাত লীলায়িত ক’রে তনু দুলিয়ে নাচ শুরু করেন, বাবু হার্মোনিয়াম ধরেন, ভাড়াটে তবলচি বা বাবুর মোসাহেব ঘন ঘন মাথা নেড়ে তবলা বাজায়, এবং জানলা বা দরজা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে পথের উপরে কাতারে কাতারে কৌতূহলী লোক দাঁড়িয়ে যায় ৷ ইতিমধ্যে নেশার খেয়ালে বাবুরও হঠাৎ নাচের শখ হয়, হার্মোনিয়াম ঠেলে ফেলে এক লাফে তিনি বিবির পাশে গিয়ে দাঁড়ান, কোঁচার খুঁট ঘোমটার মতো ক’রে মাথায় দিয়ে তাণ্ডব নৃত্যের সঙ্গে হেঁড়ে গলায় গান ধরেন ৷ তার পরেই অত্যধিক ভাবের আবেগে বিবিকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করবার চেষ্টা এবং তার ফলে সঙ্গে সঙ্গে বিবির মাথার উপর থেকে মদ-ভরা গেলাসের সশব্দ পতন ৷’

যৌনতার ডিসকার্সিভ ব্যাখ্যা এবং বাস্তব সমাজে যৌনতার যে প্র্যাক্টিস, সেই প্র্যাক্টিসকে কনফেশনাল ন্যারেটিভের মধ্যে ধরতে গিয়ে ফের সেই ডিসকার্সিভ প্যাটার্নের অঙ্গীভূত হওয়ার চমকপ্রদ নিদর্শন বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত দুটি আত্মকথাধর্মী বই ৷ প্রথম বইটি বেরিয়েছিল কুড়ির দশকের শেষদিকে ৷ মানদা দেবীর লেখা শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত ৷ এটি ‘চাপান’ ৷ এর ‘উতোর’ অর্থাৎ জবাবি আত্মকথনটি বেরোয় ত্রিশের দশকের শেষদিকে ৷ রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা রমেশদার আত্মকথা ৷ দুটোই শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, নাগরিক ও গ্রামীণ পরিবারের দুই নারী-পুরুষের প্রবৃত্তির অপ্রতিরোধ্য অনলে আত্মাহুতি দিয়ে সমাজচ্যুত, উদভ্রান্ত ও ‘নষ্ট যাপনের ইতিহাস’ ৷ উভয়েই সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন তাঁদের অধঃপতনের ইতিহাস, কিন্তু লক্ষণীয়, সেই বিবরণ কোথাও ইউরোপীয় ‘লিবারটাইন’ নারী-পুরুষের ধাঁচে লেখা নয়, অর্থাৎ যৌনতার অপ্রতিরোধ্য আগুনে পুড়তে গিয়ে তাঁরা যে ‘উপভোগ’ বা ‘প্লেজার’-এর স্বাদ পেয়েছেন, তার উদ্ভাস এই দুটি বইয়ের কোথাও নেই, বরং, ছত্রে ছত্রে বড়ো হয়ে উঠেছে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, মানসিক যন্ত্রণা ও দীর্ণ হয়ে যাবার বিবেকী কণ্ঠস্বর ৷ কলকাতার এক ধনী, এনলাইটেনড পরিবারে মানদা দেবীর জন্ম হয় ৷ তাঁর পিতামহ ছিলেন বিরাট সম্পত্তির অধিকারী, পিতা ছিলেন হাইকোর্টের সুপ্রতিষ্ঠিত উকিল ৷ মানদা বেথুন স্কুলে পড়াশুনো করেন ৷ তাঁর জন্ম ১৯০০ সালে ৷ পারিবারিক মুক্ত আবহাওয়ায় থিয়েটার দেখায়, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় কোনো বাধা ছিল না ৷ কিন্তু, সেই মুক্ত পরিবেশই মানদার প্রবৃত্তির অনলে দগ্ধ হবার রাস্তা খুলে দিয়েছিল ৷ তাঁর কৈশোরে মায়ের মৃত্যু হবার পর, মানদার বাবা ফের বিবাহ করেন, প্রায় মানদার বয়সী এক মহিলাকে ৷ সেই নতুন স্ত্রীকে নিয়ে তিনি এতোটাই মগ্ন থাকতেন যে, খুব অল্প বয়সেই, একাধিক পরপুরুষের সান্নিধ্যে এসে, মানদার যে চারিত্রিক বদল ঘটছে, সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়া বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না ৷ মানদার গৃহশিক্ষক মুকুলদা মানদাকে গর্ভবতী করেন ৷ দূরসম্পর্কের আত্মীয় রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এরপর তাদের বাড়িতে আসেন এবং এই রমেশদার সঙ্গে মানদার এক তীব্র শারীরিক ও মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷ পরমসুন্দরী বান্ধবী কমলার সহায়তায় মানদা রমেশচন্দ্রের হাত ধরে ঘর ছাড়ে ৷ মানদা লিখেছেন, ‘‘আমার প্রথম যৌবনের উদ্দাম আকাঙক্ষা প্রাণের মধ্যে জাগিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে দেখিলাম দুইটি যুবক—মুকুল ও রমেশ’’ ৷ বলেছেন ‘‘হিংস্র ব্যাঘ্র যেমন রক্তের স্বাদে উন্মুক্ত হয়, আমিও তেমনি হইলাম ৷ আমার মনে কিছুমাত্র ভয় বা অনুতাপ আসিল না ৷ বরং আশঙ্কা ও সংকোচ কাটিয়া গেল’’ ৷ রমেশদার হাত ধরেই এক দীর্ঘ নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিতে ঘর ছাড়লেন মানদা ৷ অনেক পরে যখন আত্মকথা লিখছেন, তখন, এই ঘটনাকে মানদা নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘‘প্রবৃত্তির উত্তেজনায মোহাচ্ছন্ন ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া আমি গৃহ পরিত্যাগ করিয়াছি ৷ শরীরধর্মের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে যে বয়সে আমাদের যৌবনচাঞ্চল্য দেখা দেয়, তখন বিবাহসংস্কার দ্বারা তাহাকে সংযত করিবার ব্যবস্থা সমাজে আছে ৷ বালকবালিকাদিগকে সুশিক্ষায় নিরত এবং সর্বদা সৎসঙ্গে রাখিলে এই যৌবনচাঞ্চল্য অল্পবয়সে আসিতে পারে না’’ ৷ এই তীব্র ‘মরালিস্ট’ কণ্ঠস্বরই মানদার বইয়ের মূল স্বর ৷ অর্থাৎ উনিশ শতক হয়ে বিশ শতকের গোড়ায় পৌঁছেও যে যৌননৈতিক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ডিসকোর্স ক্রমেই প্রাধান্য পাচ্ছিল, তারই সম্প্রসারণ এই আত্মকথনেও পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে, নিজের যৌন অসংযম ও প্রবৃত্তির অনলে দগ্ধ হবার বর্ণনা দিচ্ছেন লেখক ৷ দিল্লি, অমৃতসর, লাহোর, কাশ্মীর হয়ে মানদা ও রমেশদা বোম্বাই পৌঁছলেন ৷ তাঁদের প্রমোদবিহার চলতে লাগল ৷ দ্বারকা, রাজপুতানা হয়ে তারা এলেন মথুরায় ৷ এখানেই কমলার চিঠির সূত্রে মানদা জানতে পারলেন কীভাবে রমেশদা অফিসের ক্যাশ চুরি করে, মিথ্যে ছুটির কথা বলে, তাঁকে নিয়ে এসেছেন ৷ কিন্তু, সেকথা রমেশদাকে বলতেই তিনি চূড়ান্ত ক্রোধে পদাঘাত করলেন মানদাকে ও সেই মুহূর্তেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন ৷ ইতিমধ্যে রমেশদার কারণেই তিনি গর্ভবতী ৷ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের ঝগড়াঝাটি হয়ে দাঁড়াল নৈমিত্তিক ৷ মানদা টের পেলেন এই সম্পর্কের বনিয়াদ আদৌ টেকসই হবে না ৷ অতিদ্রুত, রমেশদা একটি চিঠি লিখে রেখে, মানদাকে ফেলে চলে যান ৷ বিদেশ-বিভুঁইয়ে সহায়সম্বলহীন মানদা এক মোহন্তর আশ্রমে ঠাঁই পান ও মৃত সন্তানের জন্ম দেন ৷ এদিকে নিজের পরিবার-পরিজনদের থেকেও মানদা তখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন ৷ অবশেষে তিনি কলকাতা ফিরে আসেন এবং চাঁপাতলায় হাড়কাটা গলিতে এক পতিতালয়ের বাড়িওয়ালি মাসির কাছে আশ্রয় নিয়ে সরাসরি দেহব্যবসায় নামেন ৷ আজকের মতোই সেদিনের কলকাতার সমাজেও উপরতলার লোকেরা সাময়িক সুখের সান্নিধ্য লাভের আশায় শিক্ষিত বেশ্যাদের কাছে যেত ৷ মানদা খুব দ্রুত টের পেলেন সমাজের উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ, ব্যাবসায়ী, গণ্যমান্য ধনী ব্যক্তি, অধ্যাপকেরা কীভাবে অবলীলায় ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ জীবন কাটাতে তাঁর মতো মেয়েদের কাছেই আসছেন ৷ মানদা বলেছেন, ‘‘আমরা সন্ধ্যার পরে সাজিয়া গুজিয়া আরতি দেখিবার ছলে নিকটবর্তী ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে যাইতাম ৷ সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া যখন দেখিতাম আমরা কোনো ভদ্রবেশধারীর নজরে পড়িয়াছি, তখন তাহার বাড়ির দিকে যাত্রা করিতাম… এই-রূপে শিকার-কৌশল রানিবাড়িওয়ালি আমাদিগকে শিখাইয়াছিল’’ ৷ ইতেমধ্যে ১৯২০-র ‘অসহযোগ আন্দোলন’ সুরু হয়েছে ৷ একদিকে গোটা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হচ্ছেন হাজার হাজার নারীপুরুষ, অন্যদিকে পতিতা নারীদের উদ্ধারকল্পে দেশ জুড়ে বিভিন্ন সমিতি গড়ে উঠছে ৷ মানদার লেখায় এই বিচিত্র কর্মকান্ডের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় ৷ যৌনতা এক সর্বার্থে নঞর্থক বিষয়, এর অপব্যবহারকে দূরীভূত করতে পারলেই স্বাস্থ্যবান জাতীয়তাবাদী স্যানিটাইজড নতুন বাঙালি সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব, এই ‘ডিসকার্সিভ’ ভাবনা কীভাবে এক উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে-আসা, সমাজচ্যুত, অবস্থাবিপাকে বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করে নিজের পূর্বপরিচয় মুছে ফেলতে-না-পারা মেয়ের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তার অণুপুঙক্ষ বিবরণ মেলে মানদার এই আত্মকথায় ৷ পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ইংল্যান্ডের যে লিবারটাইন ভদ্রলোকের কথা বলা হয়েছে, সেই ‘ওয়াল্টার’ যেমন নিজের অপরিমিত সম্ভোগের বিবরণ দিতে গিয়েও শেষ অব্দি উনিশ শতকীয় ভিক্টোরিয়ান চেতনায় আবদ্ধ হয়ে থেকেছিলেন, যা দেখিয়েছেন মিশেল ফুকো, এখানেও কতকটা সেরকমই দেখতে পাচ্ছি ৷ ফারাক হল, গোটা লেখায় মানদার কোনো সম্ভোগজনিত উল্লাসের চিহ্ন নেই, বরং গোটা লেখায় বড়ো হয়ে উঠেছে তীব্র অনুতাপ, হতাশা এবং এক চূড়ান্ত মরালিস্ট দৃষ্টিকোণ, যেকোনো মূল্যেই সামাজিক রক্ষণশীল নিয়মের চেনা চৌহদ্দি ও থাকবন্দের মধ্যেই মানদা চেয়েছেন ব্যক্তির আচরণ এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হোক ৷ এর পিছনে ব্যক্তিগত জীবনের চরম হতাশা, সামাজিক ভাবে অবনমিত হওয়ার ফলে মনস্তাত্বিক পীড়া যেমন কার্যকর হয়েছে, তেমনই, একটা মান্য, চালু, হায়ারার্কিক্যাল ডিসকোর্সের কাছে আত্মসমর্পণের নিশ্চিন্তি ও সামাজিক ক্ষমতার কণ্ঠস্বরকে আত্মস্থ করার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছাও কাজ করতে পারে ৷ জীবনের একটা পর্যায়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন ‘বাবু’-র বাঁধা রক্ষিতা হয়ে জীবিকা নির্বাহের পর মানদা সোনাগাছিতে নিজের বাসস্থান তৈরি করেন এবং সরাসরি ঘরে লোক বসিয়ে গান-বাজনা ও শরীর বিক্রির মাধ্যমে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে শুরু করেন ৷ সমাজের উঁচুতলার লোকজন মানদার বাঁধা খদ্দের ছিলেন ৷ কারণ, মানদা ছিলেন গুণী, শিক্ষিতা, নিজেও যথেষ্ট বড়ো ঘরের মহিলা ৷ তাই, তাঁর ‘ক্লায়েন্টেল’-ও ছিল যথেষ্ট উঁচুদরের ৷ অবশেষে ভবানীপুরে বাড়ি নিয়ে উঠে আসেন মানদা ৷ উচ্চবিত্ত সমাজে তাঁর পরিচিতি দাঁড়ায় ‘মিস মুখার্জি’ ৷ বড়োলোকের ‘গার্ডেন পার্টি’ বা ‘টি পাটি’-তে তিনি হয়ে ওঠেন এক পরিচিত মুখ ৷ অবশ্য আর কিছুদিনের মধ্যেই মানদা বেশ্যাবৃত্তির পেশা থেকে অবসর নেন ৷ তাঁর জমানো টাকা হিন্দু মহাসভার নামে উইল করে দিয়ে যান ৷ জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে তিনি হয়ে ওঠেন চরম রক্ষণশীল এবং সামাজিক ক্ষমতা-র পক্ষাবলম্বী এক নারী ৷ তিনি সাহিত্যে নারী-পুরুষের আধুনিক মেলামেশা, সমাজে নারী-পুরুষের সচ্ছন্দ মেলামেশার বিরোধী হয়ে ওঠেন ৷ মেয়েদের চোদ্দো বছর বয়সের আগেই বাধ্যতামূলক বিবাহের পক্ষে সওয়ালও করেছেন তিনি ৷ নিজেকে এক নিষ্কলুষ, পবিত্রতার কাঙ্ক্ষিত মূর্তি বানিয়ে এই আত্মকথন শেষ করেছেন মানদা ৷

মানদা দেবীর আত্মকথনের এক সামান্য অংশেই রয়েছে রমেশদার বৃত্তান্ত ৷ প্রায় একদশক বাদে এর জবাবি ভাষণ লিখতে গিয়ে রমেশদার বইতেও অতি সামান্য স্থান নিয়েছেন মানদা ৷ বস্তুত, মানদা, রমেশের বিচিত্র নারীসম্ভোগময় জীবনের এক ক্ষুদ্র উপাখ্যান মাত্র ৷ নিজের কৈশোর থেকে যৌবনের উপান্তে পৌঁছে নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য অবস্থায় পৌঁছনো পর্যন্ত এক বিস্তৃত আত্মকথন রমেশদার ৷ অথচ এটিও পাশ্চাত্য লিবারটাইন মূল্যবোধের বিপরীত ৷ এখানে অনুতাপ, পাপবোধ ও নৈতিক কাঠামোয় ফেরার তীব্র আকাঙক্ষা ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা, এক স্ট্যান্ডার্ড নৈতিক মানকে স্পর্শ করার ভাবনাই ফুটে উঠেছে পাশ্চাত্য ‘কনফেশনের’ আদলে ৷ রোমা রোলাঁ-র উদ্ধৃতি দিয়ে এই বইয়ের ভূমিকা শুরু হয়েছে ৷ রমেশচন্দ্র বলছেন, ‘‘আমার জীবনচরিতখানা যদি পড়ো, তবে যে সকল প্রলোভনে পড়িয়া উচ্চ ডিগ্রিধারী আমি শ্রীরমেশচন্দ্র আজ মাতাল লম্পট জুয়াচোরে পরিণত হইয়াছি, সেই সকল প্রলোভন যদি এড়াইয়া চলিতে পারো, তাহা হইলে অন্তত মানুষ বলিয়া নিজের পরিচয় দিতে পারিবে, একথা আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি… কারণ আমার বিশ্বাস যাঁহারা মনের কোণে কল্পনার সুন্দর পরিচ্ছদে পাপকে সাজাইয়া লইয়া, তাহার মধুর মূর্তি দেখিয়া মুগ্ধ হন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে হয়তো সেই পাপের নগ্ন বীভৎস মূর্তি দেখিলে চমকিয়া উঠিবেন এবং হয়তো সময় থাকিতে সাবধান হইতে পারিবেন’’ ৷ ১৮৮৫ সালে হুগলি জেলার এক সম্পন্ন জমিদার পরিবারে রমেশের জন্ম ৷ অল্পবয়স থেকেই পিসিমার অন্যায় প্রশ্রয়ে বিবিধ কু-কাজে হাতেখড়ির কথা তিনি নিজেই বলেছেন ৷ স্কুলে বালকদের মধ্যে যেসব হোমোইরোটিক সম্পর্ক তৈরি হত, রমেশ তাতেও জড়িয়ে পড়েন ৷ বিস্তারিত লিখেছেন রমেশচন্দ্র—‘‘নারাণদার সহিত বন্ধুত্ব করিবার পর আমি ক্রমে ক্রমে অনেক ব্যাপারই জানিতে পারিয়াছিলাম ৷ সমুদয় স্কুলটি জুড়িয়া এই প্রকার ঘৃণিত অভিনয় গুপ্তভাবে চলিতেছিল ৷ শতকরা দশটা ছেলেও নির্দোষ ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল ৷ কোন ছেলের সঙ্গে কাহার ভাব, কাহার কতজনের সঙ্গে ভাব, এ সমস্ত সম্বাদ নারাণ-দা বিশেষ ভাবে রাখিত ৷ এমনকী আমাদের স্কুলের জনৈক শিক্ষকও এই ঘৃণিত কার্যে ব্রতী ছিলেন ৷ নারাণদার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার পর আমি শুনিয়াছিলাম যে একজনের পেয়ারের ছেলেকে ফুশলাইয়া লইতে আর একজন চেষ্টা করিত, গোপনে প্রেমপত্র লেখা হইত’’ ৷ এরপর পাশের বাড়ির ঝি রমলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক পেরিয়ে কলকাতায় আসেন রমেশ, সঙ্গে পিসিমার দেওয়া লুকোনো তিন হাজার টাকা ৷ যা তাঁকে পরবর্তী জীবনে অধঃপাতে নিয়ে যাবার পথে সহায়ক হয়েছিল ৷ এখানেই তিনি স্বীকার করেছেন জ্ঞাতি খুড়ো মানদা দেবীর পিতার সাহায্য তিনি কলকাতায় এসে পেয়েছিলেন ৷ ‘‘কিন্তু রিপুর তাড়নায়, তাঁহার কন্যাকে গৃহত্যাগিনী করিয়া, তাঁহার উপকারের যে প্রতিদান আমি দিয়াছি তাহাই যথেষ্ট’’ ৷ কলকাতায় এসে তাঁর আলাপ হয় এই স্বেচ্ছাধীন জীবনে পা রাখা আর এক সঙ্গীর ৷ তিনি মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র পূর্ববঙ্গের বিনোদ ৷ দেশীয় খ্রিস্টানের কন্যা অনিলা, ব্রাহ্ম অধ্যাপকের মেয়ে লীলা, ব্রাহ্মসমাজেরই আর একটি মহিলা ঊষাদেবীর সঙ্গে রমেশের প্রণয় ও গুপ্ত অভিসার চলতে থাকে ৷ বিশেষত, ব্রাহ্মসমাজে সেদিন নারীপুরুষের সহজ মেলামেশার যে উন্মুক্ত পরিসর তৈরি হয়েছিল তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন রমেশচন্দ্র ৷ ঊষাদেবীকে নিয়ে দেওঘর বেড়াতে যান তিনি ৷ এরপর থিয়েটার অভিনেত্রী মনোরমার সঙ্গে কিছুদিনের জন্য এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন রমেশ ৷ এরপর রমেশের জীবন ভিন্নখাতে বইতে শুরু করল, ‘‘ইহার পর রীতিমতো বেশ্যাসক্ত হইয়া পড়িলাম ৷ গুণেন্দ্র এবং আমি দুইজনে একত্রেই আমোদপ্রমোদ করিতে যাইতাম… অনেক সুবিখ্যাত এবং অবিখ্যাত বেশ্যার ঘরেই আমাদের গমনাগমন হইতে লাগিল’’ ৷ এরপরেই রমেশ ‘কৃষ্ণভাবিনী’ নামক এক বিখ্যাত বেশ্যার জীবনের লম্বা বিবরণ দিয়েছেন ৷ একের পর এক ‘গার্ডেন পার্টি’-তে কীভাবে বেশ্যাসহযোগে ফূর্তি চলত, তারও বিবরণ দিয়েছেন তিনি ৷ রমেশচন্দ্র মজা করে বলেছেন, ‘‘আমার M.A উপাধি দুইপ্রকারেই সার্থক হইয়াছলি ৷ আমি কেবলমাত্র Master of Arts হইয়াছিলাম না, Master of Adultry অর্থাৎ ব্যভিচারেরও মাস্টার হইয়া কলেজ হইতে বাহির হইলাম’’ ৷

খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে মানদার সঙ্গে রমেশচন্দ্রের সম্পর্কের আখ্যান মাত্র তিন-চার পৃষ্ঠায় সারা হয়েছে ৷ আত্মপক্ষ সমর্থন করে রমেশচন্দ্র যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘জানিতে পারিলাম মানদার কুমারীধর্ম অক্ষত নাই ৷ মুকলই তাহার গুপ্ত প্রণয়ী… যদি না জানিতাম মানদা পতিতা হইয়াছে, তাহা হইলে হয়তো মানদার সর্বনাশ করিবার প্রবৃত্তিই আমার প্রাণে জাগিত না ৷ মানদার অসামান্য সৌন্দর্য এবং যৌবনের প্রথম উন্মেষে তাহার পরিপূর্ণতা আমাকে আকর্ষণ করিলেও সে নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত বলিয়া আমি খুব সম্ভব আপনাকে সম্বরণ করিয়া চলিতাম, যদি না জানিতাম যে সেই সৌন্দর্য মুকুল উপভোগ করিতেছে ৷ একজনের নিকট যে আত্মদান করিয়াছে আমার নিকটেও সে সহজ লভ্য, এই জ্ঞানই আমাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিল’’ ৷ তবে মানদাকে নিয়ে প্রমোদভ্রমণ কালে অফিসের ক্যাশবাক্স ভেঙে টাকা চুরি বা মানদাকে চিঠি লিখে পদাঘাতে তাকে দূর করে দেবার অভিযোগ রমেশচন্দ্র সরাসরি অস্বীকার করেছেন, ‘‘আমি যে চিঠি লিখিয়া তাহাকে ফেলিয়া পলায়ন করি বলিয়া সে প্রকাশ করিয়াছে তাহাও সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা ৷ ওই চিঠিখানা আমাকে লোকচক্ষে হীন করিবার জন্য শ্রীমান মুকুলচন্দ্রের ওকালতি সেরেস্তা হইতে রচিত হইয়াছে সন্দেহ নাই’’ ৷ এমনকী রমেশচন্দ্র একথাও কবুল করেছেন যে, ‘‘উত্তেজিত হইয়া মানদাকে দু’এক ঘা বসাইয়া দিয়াছিলাম একথা সত্য, কিন্তু আমি লাথি মারি নাই’’ ৷ একইসঙ্গে তিনি একথাও বলতে চেয়েছেন যে, মানদার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর থেকেই তাঁর জীবন উদভ্রান্ত, দিশেহারা হয়ে পড়ে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যা আর স্বাভাবিক শৃঙ্খলায় ফিরে আসেনি ৷

কোথাও কোনো চাকরি জোটাতে না পেরে অবশেষে রমেশচন্দ্র বেশার দালালে পরিণত হন ৷ সমাজের উঁচুতলার বারাঙ্গনাদের জন্য ‘বাবু’ ধরে দেওয়া আর তাদের জীবনযাপনের সাচ্ছন্দ্য রক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাজ ৷ এক বাবুর ঘরে চাকরি পেলেন তিনি ৷ সেই সূত্রেই আলাপ হল তাঁর রক্ষিতা ‘কমলা’-র সঙ্গে ৷ ইনি পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির কন্যা, ঘর ছেড়ে আজ এই পেশায় এসেছেন ৷ ঘটনাচক্রে রমেশচন্দ্রের ‘ফ্ল্যামবয়েন্ট’ চরিত্রের প্রভাব এই মহিলার উপরেও পড়ল ৷ ইনি রমেশের প্রেমে পড়লেন ৷ এরপর এক বিস্তৃত অধ্যায় জুড়ে এই উচ্চবিত্ত পরিবারের কুলত্যাগিনী মহিলা কমলার জীবনব্যাপী ব্যভিচারের বর্ণনা ৷ কমলার তিনটি কন্যাসন্তান ৷ সাবিত্রী, সুকৃতি ও সুপ্রভা ৷ এদের তিনজনই অভিজাত স্কুলের ছাত্রী ৷ এদের ভিতর সাবিত্রীকে এই মহিলা ব্যবহার করতেন শাঁসালো ‘বাবু’ কুপোকাত করে রোজগারের কাজে ৷ কিন্তু তাঁর ছোটো মেয়ে সুপ্রভা ছিল অত্যন্ত তেজস্বী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ৷ সে কিছুতেই মায়ের শত চেষ্টাতেও এই দেহবিক্রির রাস্তায় হাঁটতে রাজি হয়নি ৷ সুকৃতিকে দিয়েও একই কাজ করাবার ইচ্ছা ছিল কমলার ৷ কিন্তু সুকৃতি এক ধনী কবি ও সম্পাদকের সঙ্গে শেষ অব্দি বেরিয়ে যায় ৷ যদিও শেষ রক্ষা হয়নি ৷ সুকৃতিকে ওই বাবু শেষ অব্দি আশ্রয় দেননি ৷ সুকৃতিও বাধ্য হয় মাতৃপদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘হাই সোসাইটি প্লেজার গার্ল’ হিসেবে জীবিকা অর্জনের পথে নামতে ৷ অবশেষে একদিন কমলার সঙ্গেও রমেশচন্দ্রের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় ৷ রমেশ ওখান থেকে বেরিয়ে আসেন ৷ অসহায়, কপর্দকহীন, সহায়হীন অবস্থায় রমেশচন্দ্রের জীবন কাটতে থাকে ৷ এক তীব্র হাহাকার ও অনাগত প্রজন্মের প্রতি সতর্কবার্তা জানিয়ে এই আখ্যান শেষ হয় ৷ এই বইয়ের কভারের বিজ্ঞাপন থেকে ‘মুকুলদার মর্মকথা’ নামে আর একটি বইয়ের কথা জানা যায় ৷ বিজ্ঞাপনে ঘোষিত—‘মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ৷ মানদা ও রমেশদা যাহা গোপনে করিয়াছিলেন, মুকুলদা তাহাও প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন’ ৷ এই ধরনের কেচ্ছা ও পালটা কেচ্ছাসাহিত্যের ধারা বিশ শতকের গোড়ার দিকেও রীতিমতো চালু ছিল ৷ তা থেকে বোঝা যায়, আমাদের উনিশ শতকীয় যৌনতার কালচার কীভাবে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশক অব্দিও বজায় থেকেছে ৷ তবে এই সবকটি কনফেশন-ধর্মী লেখাকেই বিশ শতকীয় নব্য ‘অ্যানালিটিকাল ডিসকোর্সে’র অংশ হিসেবে পড়া যায় ৷ অর্থাৎ ‘জৈব শরীর’ যখন ‘মনস্তাত্বিক শরীর’-এ রূপান্তরিত হচ্ছে, তখনও উনিশ শতকীয় যৌনতার আদলটি পুরোপুরি খারিজ হয়ে যায়নি ৷ কমলা, মানদা, রমেশচন্দ্ররা আজকের এই একুশ শতকেও বাঙালি জীবনেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন, কিন্তু আজ আর কেউ কেচ্ছার বই ছাপিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করবে না, আজ এই জীবনযাপনের ধারাটি পুরোপুরি নৈঃশব্দ্যের অন্তরালেই চলে গেছে ৷

আনুমানিক ১৯৩৯ বা তার সামান্য কিছু আগে, ‘বাতায়ন পাবলিশিং হাউস’ থেকে প্রকাশিত অবিনাশ চন্দ্র ঘোষাল-এর লেখা ‘নগ্নতার ইতিহাস’ বইটি নিয়ে অল্প কিছু কথা বলে এই অধ্যায়ের আলোচনা শেষ করব ৷ বইটির বিষয়বস্তু ‘নগ্নতার সংস্কৃতি’ বা ‘কালচার অফ ন্যুডিটি’ ৷ একদিন ভিক্টোরীয় কঠোর রুচিবাগীশতায় যেকোনো ধরনের শরীর-প্রদর্শন বা যৌনতার খোলামেলা ব্যবহার হয়ে উঠেছিল নিতান্ত ‘অশ্লীল’ ৷ আমাদের প্রাচ্যের জনগণের, বিশেষত মেয়েদের উন্মুক্ত শরীর, পোশাক ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে ইউরোপীয় ভিক্টোরিয়া রুচিবাগীশ এবং তাঁদের দেশীয় কাউন্টারপার্ট বুদ্ধিজীবীরা রীতিমতো শোরগোল তুলেছিলেন ৷ কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের তীব্র ওলটপালট জীবনযাপনের আরও অনেক দিকের মতো ইউরোপের শরীর-যৌনতা সংক্রান্ত রক্ষণশীল মনোভাবেও র্যাডিকাল পরিবর্তন আনে ৷ বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে শরীর-সংক্রান্ত পুরোনো রক্ষণশীল ধ্যানধারণায় এক বিপুল বদল আসে ৷ এর পিছনে যে কারণটিকে এই বইয়রে লেখক আদৌ ধরতে পারেননি, তা হল, বৃহৎ পুঁজি-পরিচালিত গণমাধ্যমে শরীরের পণ্যায়ন ও জনজীবনে এক ব্যাপক ভাঙচুর, যা মানবসম্পর্ক, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও শরীর-বিষয়ক যাবতীয় ছুঁৎমার্গকে দূরে সরিয়ে দেয় ৷ লেখক ভারতবর্ষ, ও সারা পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে ‘ন্যুডিটি’-র এক ধারাবাহিক বংশলতিকা তৈরি করে দেখিয়েছেন, নগ্নতা কোনো নতুন উপাদান নয়, বরং, বহু যুগ ধরেই এর চল ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতায়, আজও তা বহাল আছে, কেবল পার্থক্য হল, আজকের পাশ্চাত্যে যে ডেসপারেট উন্মুক্ত শরীর-প্রদর্শনের কালচার গড়ে উঠেছে, তা প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক নগ্নতা বা অন্যান্য দেশের নগ্নতার স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশের চেয়ে অনেকাংশেই আলাদা ৷ লেখকের ভাষায়, ‘‘একেবারে নগ্ন জাতি বড় একটা কোথাও দেখা যায় না—কিছু না কিছু আবরণ শরীরে থাকেই ৷ অথচ বর্তমান ইউরোপ নগ্নতার চরমসীমায় যেতে কিছুমাত্র দ্বিধা করেনি ৷ মানবশরীরকে সকলরকম আবরণ ত্যাগ করতে উৎসাহিত করার মূলে আছে একটা প্রচ্ছন্ন বুদ্ধিবাদ বা বুদ্ধির কারসাজি ৷ কাজেই ব্যাপারটিকে নেহাত সারল্যের অভিব্যক্তি বলা যায় না ৷ যে সমস্ত সমস্যা হতে ইউরোপের নগ্নবাদ জন্মলাভ করেছে, তার কোনোটাই নৈসর্গিক বা instinctive নয় ৷ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে আদম ও ইভ কাপড় পড়তে শুরু করে, খৃস্টান ধর্মগ্রন্থে এরূপ কিংবদন্তী আছে ৷ আধুনিক আদম ও ইভেরা জ্ঞানবৃক্ষের ফলকে বমন করে দূরে নিক্ষেপ করা দূরে থাক—বরং ভূরিভোজন করেই এ পথে অগ্রসর হয়েছে ৷ কাজেই আধুনিক নগ্নতার উদ্যানে যারা বিচরণ করছে তারা সাপের চেহারায় শয়তানকে যে চিনতে পারছে না, এমন মনে হয় না’’ ৷ কিন্তু এই বইয়ের ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন পাশ্চাত্য সভ্যতায় এই নব্য-উদ্ভূত ‘নগ্নতার সংস্কৃতি’-কে একধরনের ভ্যালু জাজমেন্টের সাহায্যে নস্যাৎ করে দিয়েছেন ৷ তিনি বলেছেন, প্রাচ্যে যে সব সাধু-সন্ত নগ্নতার চর্চা করেছেন, তাঁদের ভিতরে ছিল একধরনের আধ্যাত্মিক পবিত্রতা, ‘‘সন্ন্যাসীর নগ্নতা মনুষ্যত্বের পূর্ণ আদর্শ ৷ তাহা ক্রমপরিবর্তনশীল রুচির খেলায় আবির্ভূত হয় না এবং বিরুদ্ধ প্রকারের রুচির প্রবর্ত্তনায় কেহ তাহা ত্যাগ করে না ৷ পশ্চিমের নগ্নতার ইতিহাস নিত্য পরিবর্ত্তনশীল রুচিবিকারের ফল, তাহা মানুষের মনের উপর নানারূপ প্রভাবের দ্বারা উৎপন্ন হয় ৷ কিন্তু এদেশের সামাজিক লক্ষ্য স্বভাবকে সম্মুখে রাখিয়া একটা আধ্যাত্মিক কল্পলোকের দিকে ছুটিয়াছে ৷ বৃক্ষে প্রথমতঃ পত্রের বিকাশ, তৎপরে পুষ্পোদগম—শেষে ফলের উৎপত্তি ৷ সেইভাবে মানুষ এদেশে নানা সামাজিক রীতিনীতি ও সংসারের পথে চলিয়া শেষে সে সামাজিক সর্ববিধ সংস্কারের অতীত রাজ্যে উপস্থিত হয়, তখন সে শিশুর মত—তাহার নগ্নতা কাহারও চক্ষুকে পীড়া দেয় না, তাহা নিষ্পাপ, সরল ও প্রাকৃতিক গুণরাশির চরম অভিব্যক্তি’’ ৷ এই বইটিকেও আমরা বিশ শতকের গোড়ার অ্যানলিটিকাল ডিসকোর্সের অংশ হিসেবে পড়তে পারি, যেখানে বিরণমূলক ভাবে নগ্নতার একধরনের সোশিও-অ্যানথ্রোপলজিকাল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যদিও আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ৷ তবু এই বইটির গুরুত্ব এখানেই যে, সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই আমাদের এখানেও ‘ন্যুডিটি’ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, এবং একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে ধরার চেষ্টা হয়েছিল ৷

উল্লেখপঞ্জি

১. দ্র: হিন্দুর দুরবস্থা; গৃহস্থ: আষাঢ় ১৩২৩, পৃ: ৭৮৩-৭৮৪; এছাড়াও প্রায় একই সময়ে কাজের লোক, অর্ঘ্য প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য ৷

২. বিশ শতকের গোড়ায় এদেশে, বিশেষত বাংলায় ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণের প্রভাব ও প্রসার বিষয়ে দ্র: গিরীন্দ্রসেখর বসু ও ভারতীয় মনশ্চিকিৎসার ইতিহাসচর্চা,  অমিতরঞ্জন বসু, বারোমাস, এপ্রিল ১৯৯৮, পৃ: ৭১-৮৫; অবতরণিকা, অগ্রস্থিত গিরীন্দ্রশেখর; সম্পা: অমিতরঞ্জন বসু, কলকাতা, মে ২০০১, পৃ: ১৩-৩৫, এবং সর্বোপরি The Savage Freud, The First Non-Western Psychonanalyst and The Politics of Secret Selves in colonial India; The Savage Freud and Other Essays on Possible and Retrievable Selves; Ashis Nandy; New Delhi, 2000, p. 81-144.

৩. ইউরোপ এবং অন্যত্র হ্যাভলক এলিসের যৌনমনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণের পভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র: The Correspondents of Havelock Ellis; Anne Summers, History Workshop Journal, 1996; p.167-183

৪. দ্র: সবুজভীতি, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত; প্রবাসী, কার্তিক, ১৩২৬, পৃ: ২৫-২৯

৫. দ্র: রূপনারাণের কূলে; খণ্ড-২ গোপাল হালদার; পৃ: ১০৯-১১২

৬. দ্র: তরী থেকে তীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়—পৃ: ৮৩

৭. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র: ব্রহ্মচর্য: বিকল্প পৌরুষের সন্ধানে জাতীয়তাবাদী বাংলা; শান্তনু ব্যানার্জি; অবভাস, জানুয়ারি-মার্চ ২০০৫, পৃ: ১৬৮-১৭৯

৮. ছাত্রগণের নৈতিক অবস্থা ও তাহার প্রতিকার; আদিশ্বর ভট্টাচার্য; ফাল্গুন ১৩২২

৯. চিত্রে ও রচনায় যৌবনপথে (১৩৯ খানি চিত্র সংবলিত); শ্রীচণ্ডীচরণ বসাক প্রণীত, সপ্তদশ সংস্করণ কলকাতা, পৃ: ৬৭-৬৮

১০. নব্য সমাজদর্শনের ভূমিকা; ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বক্তব্য; ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, খণ্ড-২, পৃ: ১২-১৩

১১. নরনারীর যৌনবোধ:: যৌনক্ষুধা ও যৌনজীবন; নৃপেন্দ্রকুমার বসু ও আরাধনা দেবী, কলকাতা, ৫ম মুদ্রণ, ১৯৪৭

১২. রণজিৎ সেনগুপ্ত লিখিত ভূমিকা; যৌনক্ষুধা ও নারীর সতীত্ব; কালিদাস মুখোপাধ্যায় কলকাতা, ১৯৩৯, পৃ: ১-১৬

১৩. সাহিত্যে এই পরিবর্তনের ভূমিকা প্রসঙ্গে দ্র: দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকালীন বাংলা কথাসাহিত্য; গোপিকানাথ রায়চৌধুরী, কলকাতা, ১৩৮০ এবং দ্র: Spirituality and Nationalist Domesticity : Rereading The Relationship; Sudeshna Banerjee, The Calcutta Historical Journal, Vol. 19-20, pp. 173-204.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *