৩. ভগ্নাংশের ‘যৌনটোপিয়া’? একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন…

ভগ্নাংশের ‘যৌনটোপিয়া’? একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন…

‘‘… বাবু সকালে প্রস্তুত হইয়া খুড়ীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ৷ খুড়ীও নিভৃত স্থলে ভাসুরপোর আহারের স্থান করিয়া রাখিয়াছিলেন ৷ ভাসুরপো আসিবামাত্র তাঁহাকে সেই ঘরে বসাইয়া জলখাবার দিলেন তাহাতে জলপানকালেই বাবু একখানি সসা হস্তে করিয়া কহিলেন, খুড়ী, সসা বড়উত্তম বফল, কাটিয়া কেন নষ্ট করিয়াছ, আস্ত থাকিলেই ভাল হইত, খুড়ীও খেলিতে ২ ধাড়ী হইয়াছেন কিনা, অমনি উত্তর দিলেন অগো, তুমি যে আস্ত সসা ভালবাস আমি তাহা জানিতাম না আর একটা আস্ত সসা আনিয়া দিব কি ৷

বাবু ৷ দিলে হানি নাই, গোড়া অবধি মোটা হইয়া আগা ছোট হয় অথচ গায়ে কাঁটা না থাকে এবং ঠিক সোজা সসা যদি পাই তবে তোমার মায়ের নিকট পাঠাইয়া দি, আমি ভালবাসি না বাসি তিনি অবশ্য ভালবাসিবেন ৷

খুড়ী ৷ আমার মাতা বৃদ্ধা হইয়াছেন, সসা গ্রহণ করিতে পারেন না বরং তোমার বৌয়ের কাছে পাঠাইয়া দিলে উচিত দান হইবে ৷

বাবু ৷ খুড়ী, বৌকে যে সসা দিয়াছি তাহাতেই তার বশ আছে, সে আর সসা চায় না, তোমাকে যদি তেমন সসা দি তবে তুমিও বলিবে যে পরম পদার্থ পাইয়াছ ৷

খুড়ী ৷ সে সসা কোথায় হইয়াছিল ৷

বাবু ৷ আমার নীলবাগানে ৷ যদি খুড়ী তুমি সে বাগানে যাও তবে আর আসিতে চাহিবে না, আমারদিগের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অনেক স্ত্রীলোক সে বাগান দেখিতে গিয়াছিলেন তাঁহারা দেখিয়া আশ্চর্য জ্ঞান করিয়াছেন ৷ খুড়ী, নির্লজ্জ হইয়া তোমাকে বলিতেছি আমার বাগানে ভোজবিদ্যা নির্ম্মিত এক খাট আছে তাহাতে আলস্য রাখিলে যুবতী বৃদ্ধা যেমন কেন স্ত্রীলোক হয়েন না তাহার শরীর হইতে জল ঝরঝর করিয়া পড়িয়া বিছানা ভাসিয়া যায়, এমন সুখের খাট আর কোথাও নাই… দয়াল বশাক তাহার যুবতী পিতামহীকে রাজ বশাক তাহার তাবৎ পরিবারকে ঐ খাটের উপর শয়ন করাইয়া দেখিয়াছেন ঐ সকল স্ত্রীলোকের স্বপ্নদোষের ন্যায় হইয়াছে’’

—কীভাবে পড়ব উদ্ধৃত লেখাটিকে? ৮ জুন, ১৮৪৯ তারিখের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ‘জনৈক মল্লিকবাবু’-কে নিয়ে এই কেচ্ছা রচনাটি ৷ ১৮৩৯ সালের ২৯ নভেম্বর গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের সম্পাদনায় প্রথম বেরোয় ‘সম্বাদ রসরাজ’ (ইনি ‘গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ৷) ৷ শুরু থেকেই তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এ ধরনের অসংখ্য মুখরোচক কেচ্ছা ছাপতে শুরু করে পত্রিকাটি ৷ যাকে বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙা ৷ এমনকি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শয়নকক্ষের গোপন সংবাদও রীতিমতো রসালো ভঙ্গিতে ছাপা হত এই কাগজে ৷ ফলে কাগজটি দ্রুত ‘বিতর্কিত’ হয়ে ওঠে ৷ ‘পাপের দমন ও ধর্ম্মনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি দিবার’ ঘোষিত উদ্দেশ্য থাকলেও ‘রসরাজ’ মূলত হয়ে দাঁড়ায় প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর মানী লোকেদের চরিত্রহননের হাতিয়াস ৷ অথচ ‘‘ইহার গ্রাহকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়াছিল, সে যুগের কোন ভাল সংবাদপত্রেরও এত গ্রাহক ছিল না…’’ ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পাল্টা কাগজ হিসেবে সেযুগের প্রখ্যাত কবি ও সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বের করেছিলেন ‘পাষণ্ডপীড়ন’ পত্রিকাটি (প্রথম প্রকাশ ২০ জুন, ১৮৪৬) ৷ ‘সম্বাদ ভাস্কর’ (মার্চ, ১৮৪৯) চালানোর সময় থেকেই গৌরীশঙ্কর ছিলেন ঈশ্বর গুপ্তের সুহৃদ ৷ ১২৫৪ সন নাগাদ উভয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরে, ক্রমে তা শত্রুতায় পর্যবসিত হয় ৷ ঈশ্বর গুপ্ত ‘পাষণ্ডপীড়ন’ এবং তর্কবাগীশ ‘রসরাজ’ পত্র অবলম্বনে ‘কবিতা-যুদ্ধ’ আরম্ভ করেন ৷ এই ধরনের পত্রিকাগুলি সর্বদাই কোনো না কোনো ধনী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষণায় বেরোত, বিপক্ষ গোষ্ঠীর বিরোধিতা করার জন্য ৷ যেমন, ‘রসরাজ’-এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঠাকুর পরিবার, সিংহ পরিবার, মলঙ্গার দত্ত পরিবার, শিবনারায়ণ ঘোষ, আনন্দনারায়ণ ঘোষ, খেলাতচন্দ্র ঘোষ, রসময় দত্ত প্রভৃতি (সম্বাদ রসরাজ, ৩১শে আগস্ট, ১৮৪৯ খ্রি.) ৷ ঈশ্বর গুপ্ত এবং গৌরীশঙ্করের রেষারেষি চলতে থাকে, ‘‘শেষে নিতান্ত অশ্লীলতা, গ্লানি এবং কুৎসাপূর্ণ কবিতায় পরস্পরে পরস্পরকে আক্রমণ করিতে থাকেন ৷ দেশের সর্ব্বসাধারণে সেই লড়াই দেখিবার জন্য মত্ত হইয়া উঠে ৷’’ ‘পাষণ্ডপীড়ন’ ছাড়াও ‘দুর্জ্জনদমনমহানবমী’ (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৭), ‘সম্বাদ রসমুদগর’ (১৮৪৯), ‘যেমন কর্ম্ম তেমন ফল’ (১৮৬১)—প্রভৃতি বেশ কিছু পত্রিকার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এক ধরনের ‘কেচ্ছাসংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ও জনপ্রিয়তা লাভ করে ৷ এর পাশাপাশি চটি বই ছাপিয়ে কেচ্ছা প্রচারের চলও বজায় ছিল বহুদিন পর্যন্ত ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সচেতন প্রয়াসে ঔপনিবেশিক জ্ঞান-যুক্তি-আলোকায়ন দ্বারা দেশীয় সামাজিক আচরণ-অভ্যাসগুলিকে প্রভাবিত করার দীর্ঘ চেষ্টা সত্বেও দলাদলি-গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের এই বিশিষ্ট বহিঃপ্রকাশ চলেছিল উনিশ শতকের একেবারে শেষদিক পর্যন্ত, যদিও ১৮৫০/৬০-এর দশকের পর থেকে এর প্রকাশভঙ্গি ক্রমশ পাল্টাতে থাকে ৷

লক্ষণীয়, এই কেচ্ছাসাহিত্যের একটি প্রধানতম উপাদানই হল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যৌন ব্যাভিচার ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পাতার পর পাতায় শহরের বিশিষ্ট জনেদের যৌন অনাচারের অনুপঙক্ষ ছবি তুলে ধরা হয়েছে ৷ ‘কেচ্ছা’ কথাটি এসেছে ‘কিসসা’ থেকে, যা আবার একাধারে ‘কাহিনি’ ও ‘কুৎসার’ মিলিত রূপ ৷ এই লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে আমরা দেখব সামাজিক কুৎসা কীভাবে কাহিনি-র ‘বয়ানের’ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ৷ কীভাবে এই লেখাগুলির মধ্য দিয়ে যৌনতা পরিণত হচ্ছে ‘বিষয়’-এ এবং সেই ‘বিষয়ীকৃত’ যৌনতার এক মান্য উপস্থাপনশৈলি কীভাবে গড়ে উঠছে কেচ্ছারচয়িতাদের হাতে ৷ এক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ : ক. যৌনতার বিষয়গত উপাদান এবং খ. বিবরণের কৌশল ৷ যৌন ঘটনার পর্যায়ক্রম নির্মাণ, পাঠক যাতে তারিয়ে তারিয়ে গোটা ঘটনাটি উপভোগ করতে পারে এমন কুশলী উপস্থাপনা, যৌন অনুষঙ্গ ব্যবহারের মুনশিয়ানা, সর্বোপরি জনসমাজে যৌনতা-বর্ণনার উপযোগী, ব্যবহারযোগ্য একটি ভাষারীতির উদ্ভাবন—এই লেখাগুলিকে এক ধরনের দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ৷ সর্বোপরি এতে রয়েছে কথোপকথনের আকাঁড়া মেজাজ ৷ প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলাসাহিত্যে কৃষ্ণমঙ্গলকাব্য অথবা অন্যান্য দেব-দেবীর আখ্যানে যৌনতা বর্ণনার কয়েকটি বিশেষ ছাঁচ তৈরি হয়েছিল ৷ কিন্তু সেই যৌনতা সর্বদাই ছিল ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপকের দ্বারা আবৃত ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘‘ঘন তন জঘন মরদিল করে / নানা পরকার কৈল রাধা নখঘাতডরে ৷ ৷/… নিতম্ব পরসি জঘনত দিল হাথ ৷ / আতি ঊতরলমতি হৈল জগন্নাথ ৷ ৷’’-এর মতো প্রত্যক্ষ বর্ণনার উপরেও এক ধরনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আরোপ করা হয়েছে ৷ পাশাপাশি খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে লেখা ‘কামসূত্র’ থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতকে কোকাপণ্ডিতের ‘রতিরহস্য’ বা আরো পরবর্তীকালে ‘পঞ্চসায়ক’ (১৪ শতক), ‘রতিরত্নপ্রদীপিকা’ (১৫ শতক), ‘অনঙ্গরঙ্গ’-এ (১৬ শতক) বিকশিত হয়েছে ‘কামের শিল্পকলা’ যেখানে যৌননৈতিকতা, শাস্ত্রীয় জ্ঞান, সুখবোধ ও কামের নন্দনতত্ব মিলেমিশে গিয়েছে ৷ ইসলামি কিসসাসাহিত্যে (যেমন, ইউসুফ-জোলেখা, লোরচন্দ্রণী) সুফি তত্বভাবনার রূপকে কামের শিল্পরূপ অথবা বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রের শৃঙ্গার প্রকরণ—সর্বত্রই যৌনতার ওপর আধ্যাত্মিকতার মোড়ক স্পষ্ট ৷ ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে, যদিও ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ পৌঁছেই প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসাহিত্য এক স্পষ্ট বাঁকবদলের সম্মুখিন হল, যে কারণে উনিশ শতকের যৌনরুচি তৈরিতে এই টেক্সট-এর ভূমিকা অপরিসীম ৷ উনিশ শতকের গোড়ায় ছাপাখানার দ্রুত প্রসার প্রাক-ঔপনিবেশিক কামসাহিত্যের এই দীর্ঘ ঐতিহ্যকে নতুন প্রকরণে, জনমনোরঞ্জনী কায়দায় বাংলা মুদ্রিত অক্ষরে হাজির করল ৷ আমাদের কামসংস্কৃতির ঐতিহ্যের ভিতর ‘আধুনিকতা’র নতুন প্রকরণগুলির অনুপ্রবেশও ঘটল ‘প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম’-এর হাত ধরেই ৷ মুদ্রিত গ্রন্থের ওপর ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ এবং আরো পরবর্তীকালে ‘দেশীয় জাতীয়তাবাদী আধিপত্য’ গেড়ে বসার আগে পর্যন্ত অসংখ্য আদিরসাত্মক সচিত্র বইপত্রে সরগরম থাকত বটতলার বইয়ের বাজার ৷ এই বিপুল সংখ্যক ছাপা বইপত্রের মধ্য দিয়েই আধুনিক বাংলায় যৌনতার একটি নতুন লোকপ্রিয় ও বস্তুবাদী চেহারা তৈরি হচ্ছিল ৷ যৌনতার প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যিক উপাদানগুলিই বহুলাংশে ব্যবহৃত হল এখানেও, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি, ভাষা, পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির কৌশল এবং রসগ্রাহিতার ক্ষেত্রে ঘটে গেল এক বিপুল পরিবর্তন ৷ ছাপার অক্ষরে যৌনতার, এই ‘আধুনিক’ ও জনমনোরঞ্জনী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ারই আর একটি চেহারা এই যৌনকেচ্ছাগুলি, যেকানে সমকালীন সমাজের অনাচার-কুকীর্তি বর্ণনার অজুহাতে জনপ্রিয় উপাদানে ভরপুর এক নতুন ধরনের যৌনতার টেক্সট তৈরি হয়েছে ৷ তাই যৌনকেচ্ছার এই ন্যারেটিভগুলিকে সমকালীন অন্যান্য গদ্যে-পদ্যে লেখা আদিরসাত্মক লেখালেখির সঙ্গে পাশাপাশি মিলিয়ে পড়া একান্ত জরুরি ৷ খুঁজে দেখা দরকার ঠিক কী কী ধরনের বিশিষ্টতা রয়েছে এদের ভিতর ৷

লেখার গোড়ায় উদ্ধৃত রচনাংশটি লক্ষ করুন ৷ যে ‘মল্লিকবাবু’-কে নিয়ে এটি লেখা, আমরা যদি তার পরিচয় নাও জানি, তবু, লেখাটির রসগ্রহণে কোনো বিঘ্ন ঘটে না ৷ কারণ এই লেখায় যা বড়ো হয়ে উঠেছে, তা হল জ্ঞাতিসম্পর্কের দুই পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের এক উন্মুক্ত ছবি ৷ তাদের শারীরিক মিলনের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘সসা’—এই পুরুষ যৌনাঙ্গের প্রতীক ৷ বাবু তাঁর বাগানবাড়িতে পরিবারের অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে নিষিদ্ধ যৌনমিলনের কথাও উল্লেখ করেছেন, এমনকি ‘খুড়ি’-র বৃদ্ধা মায়ের হস্তমৈথুন অভ্যাসের ইঙ্গিতও দিয়েছেন ৷ সব মিলিয়ে লেখাটি হয়ে উঠেছে অনেকটা পর্নোগ্রাফিক টেক্সটের মতোই রোমাঞ্চকর ও আকর্ষণীয়তায় ভরপুর ৷ বর্ণনা ও উপস্থাপনশৈলির গুণে শেষ অব্দি পাঠ্যবস্তুটিই হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ, সমকালীন পাঠক এই লেখায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটিকে চিনতে পারলেও, আজ আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ওই ন্যারেটিভ রিপ্রেজেন্টেশনের কৌশলটুকুই ৷

কিন্তু এই লেখাটিকে কি আদৌ ‘পর্নোগ্রাফি’ বলা যাবে? ‘সম্বাদ’ রসরাজ’-এর আরো অনেকগুলি বর্ণনা উল্লিখিত হবে এই আলোচনায় ৷ একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আজ ‘পর্নোগ্রাফি’ বলতে আমরা যা বুঝি এগুলি তা থেকে অনেকাংশেই আলাদা হলেও এদের ভিতর এমন কিছু রয়েছে যা ‘পর্নোগ্রাফিক’ উপাদানের সমতুল্য ৷ বাংলা পর্নোগ্রাফির এক আদি চেহারা হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এই লেখাগুলির ভিতরে ৷ সাহিত্যিক প্রকরণ হিসেবে, আমরা জানি আধুনিক ‘পর্নোগ্রাফি’ একটি সম্পূর্ণ ইউরোপীয় উপাদান ৷ ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফির ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় পনেরো থেকে আঠারো শতকের শেষ বা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছরের পরিক্রমায় ‘পর্নোগ্রাফি’ একটি পৃথক ‘জঁর’ হিসেবে স্থায়িত্ব পায় ৷ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি ১৮৫৭ সালে ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে ৷ তবে ফরাসি ভাষায় ১৭৬৯ সালেই Le Pornographe কথাটি ব্যবহৃত হয় ৷ এই ধরনের মৌলিক রচনাগুলি মূলত লেখা হত ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ইতালিতে ৷ পিটার ওয়াগনার পর্নোগ্রাফির একটি সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে :

The written or visual presentation in a realistic form of any genital or sexual behaviour with a delibarate violation of existing and widely accepted moral and social taboos.

ষোলো, সতেরো ও আঠারো শতক অব্দি ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফির চরিত্র ছিল মূলত রাজনৈতিক ৷ কারণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অভিজাত সামন্ততন্ত্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের যৌন অনাচারের ছবি ফাঁস করে দেওয়াই ছিল এর কাজ ৷ যে কারণে অন্যান্য র্যাডিক্যাল দার্শনিক ও রাজনৈতিক বইপত্রের সঙ্গে পর্নোগ্রাফিকেও রাষ্ট্র এবং সামাজিক সুস্থিতির পক্ষে বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হত ৷ ফলত পর্নোগ্রাফি হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধক্ষেত্র’, যার একদিকে রইল এ ধরনের বিপজ্জনক বইপত্রের রচয়িতা, চিত্রকর ও ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে রইল চার্চ, পুলিশ, গোয়েন্দা দফতর ও আমলাতন্ত্র ৷ অকুন্ঠ যৌনতার উচ্চারণকে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ভাবা হয়েছিল, কারণ রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্টের যা মূল কথা, সব ধরনের সামাজিক কর্তৃত্বের বিপরীতে ‘ব্যক্তি’র নিজস্বতার পরিপূর্ণ বিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা, ব্যক্তির ‘আত্ম’ বা ‘সেল্ফ’-এর সেই বাধাহীন প্রকাশভঙ্গিমাকে উন্মুক্ত করেছিল ‘পর্নোগ্রাফি’ ৷ ছাপাখানার দৌলতে মুদ্রণসংস্কৃতি সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল জনসমাজের প্রায় সব স্তরে ৷ তাই প্রথম দিকে সমাজের শিক্ষিত উচ্চবর্গই এর পাঠক হলেও ক্রমশ নিচুতলায় এই ধরনের লেখালেখির প্রসার ঘটতে থাকে ৷ ধর্মীয় ও সরকারি সেন্সরশিপের চোখ এড়িয়ে এইসব বইপত্রের পাঠকসংখ্যা বেড়ে চলে ৷ ব্যক্তির ‘গণতান্ত্রিক’ বোধ ও চাহিদার সঙ্গে পর্নোগ্রাফির একটি সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয় ৷ নাগরিক সংস্কৃতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব শারীরিক সুখবোধের গুরুত্ব বাড়তে থাকে, যাকে sexual enlightenment হিসেবেও চিহ্নিত করা যায় ৷ আলোকপর্বের দার্শনিকেরা যে দৈহিক সুখবোধকে তত্বায়িত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন তা বোঝা যায় ষোড়শ শতকে ইতালির প্রখ্যাত কামগ্রন্থ রচয়িতা পিয়েত্রো অরেতিনো-র জবানবন্দি পড়লেই ৷ ১৫২৪ সালে অরেতিনোর লেখা আদিরসাত্মক কবিতার অলংকরণসমৃদ্ধ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ৷ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি সামাজিক ক্ষমতাকাঠামো ও হিপোক্রেসির বিরুদ্ধে দৈহিক সুখবোধের প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেন জোর গলায় ৷ ফরাসি দার্শনিক দিদেরো একাধিক পর্নোগ্রাফি লিখেছেন, সেই ‘অপরাধে’ তাঁর জেলও হয়েছে ৷ একটি চিঠিতে literary sexology-র সপক্ষে সোচ্চার দিদেরো লিখছেন : “There is a bit of testicle at the bottom of our most sublime feelings and our purest tenderness” ৷ আলোকপর্বের দর্শন যৌনতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ভাবেনি, তাকে জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের অন্যতম উপায় হিসেবেই দেখেছিল ৷ ১৮২০-র দশকে রাশিয়ায় ‘ডিসেম্ব্রিস্ট’ আন্দোলনে যুক্ত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া এক ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছিল মুক্ত বৈপ্লবিক চিন্তার রসদ সে খুঁজে পেয়েছে রাশিয়ান পর্নোগ্রাফি লেখক ইভান বারকোভের বইপত্র থেকে ৷ র্যাডিক্যাল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও পর্নোগ্রাফি এভাবেই একাকার হয়ে গিয়েছে ইউরোপের ইতিহাসে ৷ এমনকি সতেরো শতক থেকে যৌন পারভারশনের বর্ণনাও হয়ে দাঁড়ায় “variations on a self-justified, amoral gratification of the senses.”১০

আধুনিক পাশ্চাত্য পর্নোগ্রাফির প্রবাদপুরুষ মার্কুইস দ্য সাদ তাঁর La Philosphic dans Le Boudeir (১৭৯৫) বইটি উৎসর্গ করেছেন এইভাবে; “To Libertines” ৷ ‘লিবারটাইন’ বলতে সেই মুক্তমনা ব্যক্তিদের বোঝায়, যারা যৌনতা এবং জীবনযাপনের অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই খোলামেলা, উদার, পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রবণ, যারা যে-কোনো মূল্যে রাষ্ট্র ও চার্চের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার হিম্মত রাখে ৷ সাদ তাঁর পাঠকদের উদ্দেশে লিখছেন::

…nourish yourselves upon (this book’s) principles : they favour your passions, and these passions,Whereoff coldly insipid moralists put you in fear… it (is) only by sacrificing everything to the senses’ pleasure that this individual… may be able to sow a smattering of roses atop the thorny path of life.”১১

এই ‘লিবারটাইন’ চরিত্রদের কাছে পর্নোগ্রাফি ছিল একান্ত ব্যক্তিগত ‘প্লেজার’ উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ ৷১৬৬৮ সালে স্যামুয়েল পেপিস নামে জনৈক ফরাসি ভদ্রলোক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন L’Ecle des files নামক বিখ্যাত পর্নোগ্রাফির বইটি কিনে পড়ার কথা ৷ শুধু তাই নয়, খানিকটা সাংকেতিক ভাষায় তিনি বিবরণ দিচ্ছেন বইটি পড়তে পড়তে তিনি কীভাবে হস্তমৈথুন করেছেন ও প্রবল অনুতাপে জর্জরিত হয়েছেন: “but it did hazer my prick para stand all the while, and una vez to decharger” ৷১২ ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট ‘ব্যক্তিকে’ সত্যকথনের এই সাহস জুগিয়েছে, যদিও পেপিসের স্বীকারোক্তির ভিতর কোথাও যেন রয়েছে ‘কনফেশনে’র ভঙ্গিও ৷

পাশ্চাত্য পর্নোগ্রাফি রচনার ইতিহাস, পাঠকের উপভোগ ও রসাস্বাদনের বিভিন্ন স্তর ও পর্নোগ্রাফির দর্শনের সাপেক্ষে পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় ‘সম্পাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলি genre হিসেবে ঠিক পর্নোগ্রাফি নয় ৷ কারণ “realistic form of any genital or sexual behaviour”-এর বর্ণনা থাকলেও লেখার ভিতর “deliberate violation of existing and widely accepted moral and social taboos”:—এখানে নেই ৷ অর্থাৎ যিনি লিখছেন তাঁর উদ্দেশ্য নয় সামাজিক রীতিনীতি ও ক্ষমতাকাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটানো ৷ বরং সামাজিক নীতির সপক্ষেই তাঁর কলম ধরা, তলায় তলায় চলতে থাকা তথাকথিত নষ্টামির স্বরূপ উদঘাটনই তাঁর উদ্দেশ্য (অন্তত লেখকদের বাহ্যিক দাবি সেটাই) ৷ যদিও এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা যে অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনার রীতি ব্যবহার করেছেন তা এক উপভোগ্য যৌনতার ন্যারেটিভ গড়ে তুলেছে ৷ যেমন ধরা যাক ‘রসরাজ’-এ প্রকাশিত জনৈক বসুজ মহাশয়ের স্ত্রী-র সঙ্গে বাড়ির চাকরের যৌনমিলনের বৃত্তান্ত, যেখানে গৃহকর্ত্রী চাকরকে যৌন আচরণে সাড়া দিতে বাধ্য করছেন:

‘‘…স্ত্রীলোকের বাড় কদলীবৃক্ষের ন্যায় মদনবায়ুভরে টলমল করিতেছেন, বসুবাবু তাহার পানে এক্ষণে চাহিয়া দেখেন না, তবে নবীনা যুবতী মহা রসিকা, রসবতীর কোমল প্রাণ কি প্রকারে বাঁচিতে পারে…সতী মেয়ে পতিবিরহে বালিসে আলস্য ভাঙ্গিয়া প্রায় বৃদ্ধাঙ্গুলীকেই ক্ষীরদসমুদ্রে স্নান করাইয়া পূজা করেন…

তিনি হর্যের কোলে বামপদ তুলিয়া দিয়া কহিলেন, অরে, আমার পায়ের ডিমগুলা বকবক করিতেছে, টেপ ২ হরে পদসেবা করিতে লাগিল… আবার কহিলেন উরোত দুইটা টিপিয়া দে… বড়ই বেদনা করিতেছে, হর্যে টিপিতে টিপিতে উরুমূল পর্য্যন্ত টিপিয়া দিতে লাগিল, যুবতী বসুপ্রেয়সী, এত বসন সরাইয়া ২ আশপাশ করিতেছেন হর্যে তাহা কিছুই বুঝিতে পারিল না…তিনি তখন অনঙ্গের অধৈর্য্যা, বাহ্যজ্ঞান রহিত হইয়া ক্ষীণ কটিদেশের বেবাক বসন তুলিয়া খুলিয়া দিলেন এবং ক্ষীণশব্দে কহিলেন অরে এইখানে ২ দে, হর্যে সেই ২ খানে আচ্ছা করিয়া ডলিতে লাগিল, তথাপি সুখ না হইব্যায় হর্যের অঙ্গ ধরিয়া শিক্ষাইয়া দিয়া কহিলেন, অরে এই ২ প্রকারে দিতে হয়, জানিস না বোকা, হর্যে তখন চৈতন্য পাইয়া সেই প্রকারে ঠাসিয়া ২ ডলিয়া দিতে লাগিল বসুবনিতা আঃ ২ শব্দ করিতে ২ কত আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন ৷…’’১৩

লেখাটির নীচে স্বাক্ষরকারী ‘আমি পাঁচী দাসী’ ৷ অর্থাৎ আড়াল থেকে গোটা ঘটনা দেখে এটা জনৈকা পাঁচী দাসী-র পাঠানো রিপোর্ট ৷ বলাই বাহুল্য ‘পাঁচী দাসী’ বলে কেউ নেই, স্বয়ং সম্পাদকই এখানে পাঠকেরও দর্শকাম চরিতার্থ করানোর চেষ্টায় রত ৷ গোপনীয়তায় আড়াল থেকে সুখভোগের চোরাগোপ্তা নিষিদ্ধ আনন্দই এই লেখাগুলির বিষয়বস্তু ৷ সেদিক থেকে এই যৌনতা-বিষয়ক ন্যারেটিভ পাশ্চাত্য পর্নোগ্রাফির একেবারে বিপরীত ৷ এখানে আত্মঘোষণাকারী, স্বেচ্ছায় বিধিনিষেধ ভেঙে-ফেলা ও নিজেকে সমর্থন করা ‘লিবারটাইন’ চরিত্র প্রায় নেই ৷ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘নববাবুবিলাস’-এ (১৮২৫) সামাজিক দায়দায়িত্বে অনীহ, আত্মসুখসর্বস্ব, ঢিলেঢালা মানসিকতার লম্পট ব্যক্তির চরিত্রাঙ্কণ করা হয়েছে, যে নিজের ইচ্ছেমতো যৌন-ঈপ্সা চরিতার্থ করে বেড়ায় :

 লুচ্চ হলে দাতা হয় কাহারো না করে ভয়

 কেবল প্রেমের বশে রয় ৷

 যে জন পিরিতে রাখে তার প্রেমে বন্দী থাকে

 তার জন্য বহু দুঃখ পায় ৷ ৷…

 করে গিয়া বেশ্যাবাজি যদি বল কর্ম্ম পাজি

 মন শুচি হলে পাজি নয় ৷

 যাহার যাহাতে রুচি সেই দ্রব্য তারে শুচি

 তার তাতে হয় সুখোদয়…

 অন্য অন্য সুখের সৃষ্টি করি বিধি পরে মিষ্টি

 করিলেন সুখের সৃজন ৷

 বেশ্যাকুচ বিমর্দ্দন যতনেতে আলিঙ্গন

 আর তার শ্রীমুখ চুম্বন ৷ ৷১৪

এই উদ্ধৃতির ভিতর, নিছক ব্যক্তিগত সুখোপভোগের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো যে চরিত্রের দেখা পাই, তাকে কি পাশ্চাত্য অর্থে ‘লিবারটাইন’ বলা যাবে? স্পষ্টতই না, কারণ আঠারো-উনিশ শতকের পশ্চিম ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে যা বিকশিত হয়েছিল ‘religion of libertinism’ হিসেবে, তার কেন্দ্রে রয়েছে এমন এক দার্শনিক প্রত্যয় ও অবস্থান যার নিদর্শন উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল ৷ এই ‘লিবারটাইন’ দর্শনের মূল কথাই হল অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় প্রাতিষ্টানিক ধর্মচর্চার সম্পূর্ণ বিপরীতে এমন এক উদার নৈতিকতা, যেখানে যৌন আকাঙক্ষা, অভিজ্ঞতা ও সুখোৎপাদনকে মানবজীবনের সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৷ এই নতুন জীবনবোধের চাহিদা ও মাপকাঠি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল আঠারো শতকের ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফি ৷ এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৭৪৮-৪৯ সালে প্রকাশিত জন ক্লেল্যান্ডের লেখা ‘Memoirs of a women of pleasure’ বইটি, যা ‘Fanny Hill’ নামেই বেশি পরিচিত ৷ ফ্যানি সমাজের এক উঁচুতলার গণিকা, কিন্তু আঠারো শতকের অন্যান্য ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফির ছক মেনে, নিছক টাকার বিনিময়ে পুরুষের শয্যাসঙ্গী হয়ে, পুলিসি হয়রানি ও যৌনরোগগ্রস্ত বিগতযৌবন বেশ্যাদের মতো দরিদ্র, নিঃসম্বল অবস্থায় শেষ হয়নি তার কাহিনি ৷ বিপরীতে ফ্যানি ভালোবেসেছিল অভিজাত যুবক চার্লসকে ৷ মুক্ত, বাধাহীন যৌনতা উপভোগ করার জন্য তারা পাড়ি দিয়েছিল ‘সিথেরা’ দ্বীপে, যা পেগান দেবতা ভেনাসের বাসস্থান ৷ যে-কোনো ধরনের মানসিক কুন্ঠা ও পিছুটানমুক্ত যৌনতা এখানে হয়ে উঠেছে এক নতুন প্রণয়ভাবনার প্রতীক ৷১৫ যদিও ক্লেল্যান্ডের এই উপন্যাসে যৌনতার উপস্থাপন অনেকাংশেই আঠারো শতকের নতুন রোম্যান্টিকতা ও পৌঁরুষভাবনা-র সমাহারে রচিত, তবু আধুনিক পাশ্চাত্য পর্নোগ্রাফির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদি টেক্সট এই বইটি, যেখানে যৌনতার অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণও এসেছে এক নতুন এনলাইটেনমেন্টের নিজস্ব লক্ষণগুলি মেনেই ৷

এই মাপকাঠি অনুযায়ী, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টাই আসলে অনুচিত ৷ কারণ, ‘রসরাজ’-এর লেখাগুলি তৈরি হয়েছে অনেকাংশেই আমাদের দেশীয় জনসমাজে প্রচলিত আদিরসাত্মক বর্ণনা, কথনভঙ্গি ও যৌনতা উপভোগের এক সম্পূর্ণ নিজস্ব চেহারা অনুযায়ী ৷ এই লেখাগুলি যে সমাজমনের হদিশ দেয়, তা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য উপযোগবাদী ভাবনার বিপরীত, এখানে যৌনতা কোনো সম্পূর্ণ নতুন ডিসকোর্সের অন্তুর্ভুক্ত হয়নি ৷ আমাদের সমাজে আঠারো শতকের শেষদিক থেকেই কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মূলত হঠাৎ-ধনী পরিবারগুলির প্রশ্রয়ে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এক ধরনের ‘খেউড়-সংস্কৃতি’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৷১৬ ‘খেউড়’ বলতে বোঝাত উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক চটুল আদিরসাত্মক ছড়া বা গান ৷ কবিগানের এটি এক অন্যতম উপাদান, যেখানে কবিয়ালরা দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতেন এ ধরনের যৌনতাব্যঞ্জক ঠাট্টা-বিদ্রুপ ৷ এ হল এক ধরনের হুল্লোড়ময় সামগ্রিক আমোদের উপকরণ ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলিও আসলে উক্তি-প্রত্যুক্তি, বিপক্ষ গোষ্ঠিকে তুলোধোনা করতে চেয়ে তাদের সম্পর্কে আদিরসাত্মক সত্যি-মিথ্যে ঘটনার বর্ণনা ৷ এক অর্থে এগুলিও পূর্বতন বা সমকালীন খেউড়-সংস্কৃতিরই ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত উপস্থাপনা, যা লেখকদের সচেতন প্রয়াসে এক মান্য যৌনতার ন্যারেটিভ গড়ে তুলেছে ৷ গদ্যে যৌনতার বস্তুবাদী বর্ণনা দিতে গিয়ে হয়তো নিজেদের অজান্তেই তারা বানিয়ে ফেলেছেন প্রায় পর্নোগ্রাফির মতোই এক ধরনের দেশীয় টেক্সট, যা জনসমাজের নিজস্ব ঐতিহ্যের ভিতর রয়ে যাওয়া যৌন ফ্যান্টাসির নানা লুকোনো উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ৷ আদিরসাত্মক বিনোদনের উপকরণ হিসেবে এগুলির গুরুত্বকে চিহ্নিত করার পিছনে একটি যুক্তি এভাবে দেওয়া যেতে পারে যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজিশিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’দের ‘অশ্লীলতা’-বিরোধী অভিযান যে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় সেই তথাকথিত ‘অশ্লীল’ আমোদ উপভোগের অসংখ্য ছবি ছড়িয়ে রয়েছে ৷ ‘বগুড়াস্থ বাঙ্গালা পাঠশালার শিক্ষক ও ছাত্রগণের কু-ব্যবহার’ শীর্ষক একটি লেখায় জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী ‘শিক্ষক শ্রীনাথ মৈত্রের কিঞ্চিৎ গুণকীর্তন’ করেছেন এইভাবে :

আমি এক দিবস বেলা অপরাহ্নকালে কোন বারদারার বাটীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম শ্রীনাথ উল্লেখিত বারদারার পা টিপিতেছেন, মহাশয় তেঁহ আমাকে যেমন দেখিয়াছেন অমনি ব্যস্তসমস্ত হইয়া বদনোপরি বস্ত্রাচ্ছাদন দিয়া জানলার দ্বারপাশে পলায়ন করিলেন… তাহার কতিপয় দিবসান্তে পুনরায় উক্ত বেশ্যার বাটীতে রজনীযোগে গমন করিয়া দেখিলাম এবং যাহারা আমার সমভিব্যাহারে তাহারাও দেখিয়াছেন পণ্ডিতমহাশয় কারণ পান করিয়া উন্মত্তভাবে উলঙ্গ হইয়া নৃত্য করিতেছেন…১৭

এর পাশাপাশি যদি রাখা যায় ১৮৪২ সালের ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এ প্রকাশিত একটি চিঠি :

মহাশয়, লজ্জার কথা কি কহিব গত শনিবার আমি গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করিতেছিলাম, তাহাতে দেখিলাম মাহেশ হইতে এক বজরা আসিতেছে, ঐ বজরাতে খেমটা নাচ হইতেছিল, তাহাতে আরোহী বাবুরা নর্তকীদের নিতম্বের পশ্চাৎ পশ্চাৎ এমন নৃত্য করিলেন, তাদৃশ নৃত্য ভদ্রসন্তানেরা করিতে পারেন না…১৮

স্পষ্টতই, ব্যক্তিগত ও সমবেত উপবোগের এই ছবির চরিত্র পরবর্তী সময়ের ‘শ্লীলতা’-র ধারণার তুলনায় নন-ডিসকার্সিভ ৷১৯ কলকাতার নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠার প্রথম পর্যায়ে এধরনের সমবেত আদিরসাত্মক উল্লাসের ছবিকে মিলিয়ে দেওয়া যায় আঠারো শতকের ইংল্যান্ডের জনসমাজে প্রচলিত অসংখ্য ‘এরোটিক’ ছড়া, গান, পর্নোগ্রাফিক ছবি ও বইয়ের প্রচার এবং রসগ্রহণের সঙ্গে ৷ উইলিয়ম ক্রকার এবং এডওয়ার্ড ওয়েলস ও তাঁর ছেলে লন্ডনের রাস্তায় এধরনের ‘অশ্লীল’ গানবাজনা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ৷ ফ্রান্সিস প্লেস তাঁর স্মৃতিকথায় এধরনের একটি গানের কথা উল্লেখ করেছেন :

First he niggled her, then he tiggled her

Then with his two balls he began for to

 batter her

At every thrust, I thought she’d have burst

With the terrible size of his Morgan Rattler…২০

‘Morgan Rattler’ কথাটি ‘পুরষাঙ্গ এবং ‘যৌনমিলন’ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হতে থাকে ৷ বাংলার জনসমাজে আঠারো শতকের শেষদিক থেকে চলতে থাকা লঘু, চটুল উত্তেজনায় ভরপুর আদিরসাত্মক অভিব্যক্তিগুলিই বটতলা থেকে ছাপা হওয়া সস্তা বইপত্রেও ঠাঁই পেয়েছে ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর যৌনকেচ্ছাগুলিকেও সেই সামগ্রিক সাংস্কৃতিক উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিচার করতে হবে ৷ উপরে উদ্ধৃত ইংরেজি ছড়াটির পাশাপাশি রাখতে পারি ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত ‘কামিনী গোপন ও যামিনী যাপন’ নামক কাব্যের একটি অংশ, যেখানে নায়িকা নিরুপমা শারীরিক ছলাকলায় উত্তেজিত করছে স্বামীকে :

থমকে থমকে থমকে ধনী ৷

তালে তালে নাচে চমকে মণি ৷ ৷..

কভু খুলে দেয় বুকের বাস ৷

প্রমদা পুরায় পতির আশ ৷ ৷

সুখের নাচের কেমন ছটা ৷

নিতম্ব দোলনে কেমন ঘটা ৷ ৷

যৌবনে বিশাল নিতম্বদ্বয় ৷

হেলিছে দুলিছে স্থির না রয় ৷ ৷…

পতি জানু মাঝে জঘন দিয়া ৷

সঘন নাড়িছে মদন প্রিয়া ৷ ৷

প্রাণেশ প্রাণেতে প্রফুল্ল মনে ৷

কাঁপায় জঘন নিতম্ব সনে ৷ ৷২১

এই উত্তেজক শরীরী বর্ণনা যে পাঠকের কাছে আদরণীয় হত, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর কেচ্ছাও তাদের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, বোঝাই যায় ৷ তবুও স্টিভেন মারকিউজ যাকে ‘পর্নোটোপিয়া’২২ হিসেবে চিহ্নিত করেন, পর্নোগ্রাফির সেই ইউটোপিয়ান যৌন ফ্যান্টাসির জগৎ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রকাশিত এই লেখাগুলিতে আদৌ নেই ৷ ‘পর্নোটোপিয়া’ সেই কাল্পনিক ক্ষেত্র, যেখানে যৌনতা “regularly mvoes towards independence of time, space, history and even language itself.”২৩ পর্নোগ্রাফির এই উত্তুঙ্গ ‘যৌনতা’র নির্মাণ, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলিতে নেই, বরং এখানে যৌনতা বহুক্ষেত্রেই ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যরসাত্মক ঠাট্টার চেহারা নেয় : ‘‘রসরাজে গোপাল চরিত্র প্রকাশ হইলে পর গোপালের পোঁদ তুলারাম খেলারাম করিয়াছিল…’’—জনৈক সুবর্ণবণিক বংশীয় গোপালবাবুর প্রসঙ্গে এহেন উক্তিই তার প্রমাণ ৷২৪ অথবা ধরা যাক সেই তালিকাটি, যেখানে নাম গোপন করে কলকাতার বিশিষ্ট জনেদের অবৈধ যৌনাচারের চার্ট তুলে ধরা হয়েছে :২৫

সমকালীন পাঠক সাংকেতিক আদ্যক্ষরের আড়ালে আসল লোকগুলিকে চিনতে পারছেন এবং ঘরোয়া আড্ডায়, আসরে, জটলায় কেচ্ছার খোরাক জড়ো করছেন ৷ এর ফলে যৌনতা এক ধরনের convivial চেহারা পাচ্ছে, যা আধুনিক পর্নোগ্রাফিতে সেভাবে থাকে না ৷

তার মানে কি এই যে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় বৈচিত্র্য ভরপুর যৌনতার এই মুদ্রিত রূপ পৃথক কোনো ‘ক্ষেত্র’ তৈরি করছে না, যার ভিতর দিয়ে তৎকালীন যৌনরুচির এক স্বতন্ত্র চেহারা পাওয়া যায়? লক্ষণীয়, এই যৌনতার চরিত্র সম্পূর্ণ সেকুলার, যা সমকালীন বটতলার অন্যান্য আদিরসাত্মক বইপত্র থেকে আলাদা ৷ এর ভিতর দিয়ে জোরালোভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে যৌনতার pleasure principle.২৬ ৷ এবং এই ক্ষেত্রটির নাম দেওয়া যেতে পারে ‘যৌনটোপিয়া’, আরো স্পষ্টভাবে বললে ‘ভগ্নাংশের যৌনটিাপিয়া’ ৷ ভগ্নাংশ, কারণ সমাজের এক ক্ষুদ্র অংশের ছবিই তুলে ধরে এই লেখাগুলি ৷ এবং এদের উপভোগকারীরাও, সংখ্যায় অনেক হলেও এতোটা বড়ো নয়, যার সাপেক্ষে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের এক সামগ্রিক যৌনরুচির হদিশ পাওয়া যেতে পারে ৷ সবচেয়ে বড় কথা, যৌনকেচ্ছার এই ন্যারেটিভগুলিকে বাস্তবের হুবহু প্রতিরূপায়ণ হিসেবে ভেবে নেওয়া ভুল ৷ ‘ন্যারেটিভ’ এবং বাস্তবতা—এই দুইয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল ৷ ঘটনা ঘটে চলে নিজের গতিতে, কিন্তু যখনই সেই ঘটনাকে ভাষার সীমানায় ধরতে চাওয়া হয়, তখনই একদিকে কথকের সামাজিক অবস্থান, উদ্দেশ্য, লিখনের কৃৎকৌশল, উল্টোদিকে পাঠকের অবস্থান, রুচি, রসগ্রাহিতার ধরন ও সামর্থ্য—সব মিলেমিশে ‘ন্যারেটিভ’কে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়, যার সাপেক্ষে ‘ঘটনা’ পায় ‘লিখিত’ চেহারা ৷২৭ যখনই লেখক ‘ঘটনা’কে লিখিত ‘কেচ্ছায়’ পরিণত করছেন, তখনই যে আঙ্গিক সেই উদ্দেশ্যকে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ করতে পারে, সেই আঙ্গিকই তিনি ব্যবহার করছেন লেখায় ৷ এই আঙ্গিক কিন্তু গড়ে উঠেছে অন্যান্য সামাজিক প্রয়োজন এবং টানাপোড়েনের সাপেক্ষে ৷ লেখক জানেন পাঠকমনের পরিচিত ‘যৌনটোপিয়াকে’ ৷ সেই ‘যৌনটোপিয়া’র উপযোগী উপকরণের ছাঁচে ঢেলেই তিনি ঘটনাকে সাজাচ্ছেন, নতুন করে উপস্থাপন করছেন ৷ বিষয়টি বোঝাবার জন্য একটি ছোট্ট উদাহরণ পেশ করব ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর ঈষৎ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত একটি বইয়ের থেকে নেওয়া এই উদ্ধৃতিটি ৷ এর আগে ২২ জুন ১৮৪৯ তারিখের ‘রসরাজ’ থেকে গৃহবধূ কর্তৃক বাড়ির ভৃত্যকে কামক্রীড়ায় প্রলোভিত করার যে বর্ণনা দিয়েছি, অবিকল তেমনই একটি বর্ণনা পাওয়া যায় নারায়ণ চট্টরাজ-এর লেখা ‘কলিকৌতুক’ নাটকে (১৮৫৮ খ্রি.) যেখানে সহজিয়া বৈষ্ণবদের আখড়ায় জনৈক আনকোরা তরুণ সন্ন্যাসীকে যৌনমিলনে প্রলুব্ধ করছেন এক অভিজ্ঞা বৈষ্ণবী ৷ তরুণ বৈষ্ণব সখীচরণের জবানিতেই শোনা যাক সেই ঘটনা :

একবার ওনাতে আমাতে উত্তরপ্রদেশ যেতে যেতে একদিন শিষ্যি বাড়িতে পৌঁছতে না পেরে পথের মাঝে এক মুদিখানায় থাকলাম, রাত্রিতে উনিও যে ঘরে শুলেন আমিও সেই ঘরে শুলাম ৷… [অতঃপর] মা গোঁসাই আমাকে বোল্লেন বাছা সখীচরণ! আমার চরণ দুটো আজ বড় দরজ কোচ্চে, তুই নাকি একটু তেল টেল দিতে পারিস? আমি বল্লাম পারব না কেন মা গোঁসাই! আচ্চা দিচ্ছি ৷ এই বোলে আমি তেলের বাঁশ থেকে তেল বের কোরে ওনার চরণতলে বোসে তেল দিতে লাগলাম ৷ উনি বোল্লেন একটু ভাল করে টিপে টেপে ওপর তাকাৎ দিয়ে দে, আমি যেন চরণতলে বোসেই হাঁটু তাকাৎ দিয়ে টিপতে টাপতে লাগলাম, উনি বোল্লেন ও ভাল হোচ্ছ না, একটু সরে এসে ভাল কোরে দে, আমি আর একটু সোরে নে হাঁটুর একটু ওপর তাকাৎ যেন তেল দিতে আরম্ভ কোরলাম, উনি বোল্লেন আ মর বেটা! ও যে হোলো না, তুই আর একটু সরে আয় না, আমি তোর দাবনার ওপর পা দিই, তুই ভাল কোরে দাবনার ওপর তাকাৎ টিপেটেপে দে, কি কোরবো আবার আমি তাই কোরতে লাগলাম, তখন উনি বোল্লেন সখীচরণ তুই বৃন্দাবন দেখেছিস? তাতেই আমি বোল্লাম কোই না! মা গোঁসাই বোল্লেন একটু ওপর পানে হাত দে দেখ না, ঐখানে গুপ্তবৃন্দাবন আছে ৷ বাবাজি! আমি তখন এতো তো বড় জানিনে শুনিনে, আমাকে বোললেন আমি তাই কোরলাম, উনি বোল্লেন দেখলি, আমি বোল্লাম দেখলাম মা গোঁসাই দেখলাম ৷ তাতেই আবার উনি বোল্লেন দেখলিতো পরিক্রমা কর, আমি বোল্লাম মা গোঁসাই পরিক্রমা কেমন কোরে করে তাতো আমি জানি না, উনি বোল্লেন রোস তবে আমি দেখাই, এই বোলে উঠে, বলেন সনাতন কোই, তা নৈলে কি পরিক্রমা হয়? আমি বলি তা তো জানি না, উনি বোল্লেন থাক আমি জানাচ্ছি এই বোলে আমার সনাতনের সঙ্গে বৃন্দাবন পরিক্রমা কোরতে লাগলেন, বাবাজি সেই হোতে উনি আমার সঙ্গে আছেন ৷২৮

বলাই বাহুল্য, ‘সনাতন’ এখানে পুরুষাঙ্গ এবং ‘গুপ্তবৃন্দাবন’ স্ত্রীযোনির সাংকেতিক নাম ৷ অভিজ্ঞা বৈষ্ণবী নিজেই উদ্যোগী হয়ে তরুণ সাধনসঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন, এখানে তাঁর ভূমিকাই প্রধান ৷ আসলে, এটি একধরনের চালু আদিরসাত্মক বর্ণনার কৌশল, যা এ ধরনের রচনায় সেযুগে বারবার ব্যবহৃত হত ৷ ন্যারেটিভের নিজস্ব চেহারাটিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ৷ পাঠকের চাহিদা মাথায় রেখেই লেখকেরা একই ধরনের বিবরণ, ঘটনাক্রম নির্মাণের ছক ব্যবহার করেছেন ৷ যৌনতার টেক্সট ও তার উপভোগের এ হল এক পুনারাবৃত্ত ছক ৷ এ হল সে যুগের বাঙালির যৌন ফ্যান্টাসির বাজারচলতি রূপ ৷ আজ এতো দূর থেকে, সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ের পরিসরে দাঁড়িয়ে সেই যৌনটোপিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা তার এক আংশিক ছবিই পেতে পারি কেবল ৷ এবং সেই ভগ্নাংশের সাপেক্ষেই সাজাতে পারি আমাদের অনুমানগুলিকে ৷ এই অনুমানও কোনো পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ইতিহাসের ছবি তুলে ধরবে না ৷ ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফি ও যৌনরুচির ইতিহাসের ক্ষেত্রে উপাদানের যে প্রাচুর্য সংরক্ষিত রয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ক্ষেত্রে তা নেই ৷ আমাদের ‘আধুনিকতা’ বোধহয় যৌনতাকে সেই গুরুত্ব দেয়নি কোনোদিনই ৷

এই প্রসঙ্গে অন্য দুয়েকটি কথা বলা দরকার ৷ এই কেচ্ছাসংস্কৃতিকে নিছক ‘শিক্ষিত’/‘শালীন’ সংস্কৃতির বিপরীতে জনসমাজের ‘অশালীন’/‘অবক্ষয়ী’/‘বিকৃত’ রুচির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরলে কিন্তু অতিসরলীকরণ হবে ৷ কারণ, যাঁরা এই পত্রিকাগুলি প্রকাশ করতেন ও সেগুলিতে লিখেতেন তাঁদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও মান্যতা কিছু কম ছিল না ৷ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উদ্যোগে এঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতন ৷ বিশেষত গৌরীশঙ্কর, যিনি কেচ্ছাপত্রিকা চালানোর অভিযোগে অশ্লীলতা ও মানহানির দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে পাওয়া কয়েকটি তথ্য বেশ চমকপ্রদ ৷ সে যুগের ইয়ং বেঙ্গলদের তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ মুখপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’ (১৮৩১) পরিচালনার অন্যতম দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে ৷ রক্ষণশীলদের প্রত্রিকা ‘সম্বাদ তিমিরনাশক’ (১৮২৩-১৮৩৭) গৌরীশঙ্করকে ‘‘একজন নাটুরে ভাট মদ্যপায়ি নাস্তিক হিন্দুদ্বেষী’’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল ৷২৯ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ : ‘‘তিনি সমাচার চন্দ্রিকা’-র মতো রক্ষণশীল হিন্দু কাগজের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ৷ পরে গৌরীশঙ্কর যখন ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর (১৮৩৯) দায়িত্ব নেন, তাঁর সম্পর্কে Calcutta Courior৩০ পত্রিকা মন্তব্য করে : His writings … are always characterised by good sense and vigorous style, being freed from the trammels of hindoo superstitions he gladly embraces evey oppurtunity of exposing the folly of biogotted countrymen and shewing the great utility of cultivating European knowledge.৩০ রামমোহন রায়-এর সতীদাহবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক গৌরীশঙ্কররই যখন প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘রসরাজ’-এর মতো তথাকথিত ‘অশ্লীল’ কাগজ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত হন, তখন গোটা ব্যাপারটা আর তত সহজ থাকে না ৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ‘অশ্লীলতা’-র সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত বিতর্কসমূহের প্রেক্ষিতে গৌরীশঙ্করের মতো একজন উদার মতাবলম্বীর এহেন আচরণ বিস্ময় জাগায় ৷ গৌরীশঙ্কর নিজে ছিলেন ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের স্বঘোষিত ধ্বজাধারী ৷ ‘জ্ঞানান্বষণ’ পত্রিকার শিরোনামে মুদ্রিত সংস্কৃত শ্লোকটির রচয়িতাও তিনিই, এর বাংলা অনুবাদও তিনি নিজেই করেছিলেন : ‘বাঞ্ছা হয় জ্ঞান তুমি কর আগমন / দয়া সত্য উভয়েকে করিয়া স্থাপন ৷ ৷ / লোকের অজ্ঞানরূপ হর অন্ধকার ৷…’’ ১১ মে ১৮৪৯ তারিখের ‘রসরাজ’-এ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সপক্ষে জোরালো সওয়াল করা হয় ৷ আরো এক ধাপ এগিয়ে তবে কি বলা যায়, ইয়ংবেঙ্গলের সদস্য হিসেবে গৌরীশঙ্কর যে এনলাইটেন্ড দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তার ভিতর ‘সেক্সুয়াল এনলাইটেনমেন্ট-এর কোনো জায়গা ছিল? সেকারণেই কি তাঁর পক্ষে যৌনতার অমন অকুন্ঠ বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হয়েছিল নিজের কাগজে? ইয়ংবেঙ্গল ও অন্যান্য কম-বেশি ইংরেজিশিক্ষিতরা কি কেবল লক-বেন্থাম-হিউমের বইপত্রই জোগাড় করে পড়তেন? তাঁরা কি ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফিও পড়তেন না? উনিশ শতকের গোড়া থেকেই যে কলকাতায় ইংরেজি ও ফরাসি পর্নোগ্রাফি ও ছবির বইয়ের বাজার তৈরি হয়েছিল, তার একাধিক সাক্ষ্য রয়েছে ৷ জেমস লঙ ছোটোলাটের কাছে পাঠনো চিঠিতে অভিযোগ জানিয়েছেন কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্যে দেশি-বিদেশি পর্নোপুস্তক ও অশ্লীল ছবির কারবার চলছে রমরমিয়ে ৷৩১ কাজেই ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় বাঙালির যৌনটোপিয়ার এই মুদ্রিত রূপটি গড়ে ওঠার পিছনে কোথাও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংযোগসূত্র কাজ করেছে কি না—ভেবে দেখা প্রয়োজন ৷

২.

পুরুষের যে যৌন আচরণ ও অভ্যাসটির কথা ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় বারবার উঠে এসেছে সেটি হল ‘পায়ুকাম’ বা ‘পুংমৈথুন’ (sodomy) ৷ এছাড়াও মেয়েদের সমকামিতার ছবিও ধরা পড়েছে এখানে ৷ আনুষঙ্গিকভাবে হস্তমৈথুনের কথাও আভাসে-ইঙ্গিতে উল্লিখিত হয়েছে কয়েকবার ৷ বস্তুত পায়ুকাম ও হস্তমৈথুন— একে অপরের অঙ্গাঙ্গী হলেও, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এ দ্বিতীয় অভ্যাসটির কথা খুব বেশি আলোচিত হয়নি—বিষয়টি নজর করার মতো ৷ বিশেষত, হস্তমৈথুন এমন একটি যৌন অভ্যাস, যেটি আধুনিক দেশীয় ও পাশ্চাত্য উভয় সমাজের যৌনতার ইতিহাসের একটি কেন্দ্রীয় সমস্যা হিসেবে আলোচিত হয়েছে দীর্ঘদিনব্যাপী, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ৷ নিছক যৌন আচরণ হিসেবেই এটি বিবেচিত হয়নি, বরং চিকিৎশাস্ত্রের এলাকা ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে ‘ব্যক্তি’র আত্মপরিচয় ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বিষয়বস্তু, যাকে ‘এথিকো-মেডিক্যাল’ সমস্যা হিসেবেও গোত্রভুক্ত করা যেতে পারে ৷ ইউরোপীয় সামাজিক ইতিহাসের মতোই আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যেও হস্তমৈথুন একটি প্রান্তিক, প্রায়-অদৃশ্য যৌন আচরণ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে এসেছে বরাবর ৷ কিন্তু আঠারো শতকের ইউরোপ এবং উনিশ শতকের বাংলায় যৌনতার যে আধুনিক ডিসকোর্স গড়ে ওঠে, সেখানে ‘শরীর’-সংক্রান্ত জ্ঞান-ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এই একদা-তুচ্ছ অভ্যাসটির সাপেক্ষে ৷ ইউরোপীয় সমাজে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকা যৌনতার স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন প্রক্রিয়াটি, ঔপনিবেশিক সমাজের নিজস্ব ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন যৌনতার এথিকস গড়ে তোলে, যার একটি অন্যতম প্রয়োগক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় বালক-যুবক ও পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির হস্তমৈথুনের অভ্যাস ৷ এক গভীর উৎকন্ঠা, সামাজিক নৈতিকতা ও জ্ঞানের আকাঙক্ষা এই বিষয়-সংক্রান্ত বিপুল লেখালেখির জন্ম দেয় ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’ যে হস্তমৈথুনকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি, বরং sodomy নিয়ে পত্রিকাটি অনেক বেশি চিন্তিত—বিষয়টি আমাদের ঔপনিবেশিক সমাজের যৌনতা সংক্রান্ত ভাবধারায় একটি ‘ছেদ’কে চিহ্নিত করে ৷ এ থেকে বোঝা যায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পাশ্চাত্য যৌনতার ডিসকোর্স দেশীয় জনসমাজে ততটা প্রভাব ফেলেনি ৷ হস্তমৈথুন ব্যক্তির ‘আত্ম’-র যে নৈতিকতার প্রশ্নটিকে বড়ো করে তুলেছিল, পাশ্চাত্য অর্থে সেই self-সংক্রান্ত ধারণা তখনও অব্দি আমাদের সমাজে ততোটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি ৷৩২

তাই ১৮৫০-পরবর্তী চিকিৎসাশাস্ত্রীয় পত্র-পত্রিকা, সেক্স ম্যানুয়াল ও অন্যান্য লেখালেখিতে যৌনতা যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলির উদ্দেশ্য, প্রকাশভঙ্গি ও বক্তব্য তার চেয়ে অনেকাংশেই আলাদা ৷ এগুলি মূলত রিপোর্টাজ, বিপক্ষ গোষ্ঠীর গোপন কীর্তি ফাঁস করে দিয়ে তাদের প্যাঁচে ফেলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য ৷ যৌনতার ডিসকোর্স এর আলোচ্য বিষয়বস্তু নয় ৷ অথচ সামাজিক ইতিহাসের কয়েকটি দিকচিহ্ন ধরা পড়ে এইসব লেখায় ৷ ১ জুন ১৮৪৯ তারিখে ‘সম্বাদ রসরাজ’ উচ্চবংশীয় স্কুল ও কলেজছাত্রদের পায়ুকাম ও আনুষঙ্গিকভাবে হস্তমৈথুনের অভ্যাস নিয়ে রীতিমতো সোচ্চার:

সম্প্রতি আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছে বালকেরাই সর্ব্ববিষয়ে সকল কুৎসিত ব্যাপারের আধার হয়, হে পাঠক মহাশয়গণ আপনারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন বালকবৃন্দের শৈশবকাল উত্তীর্ণ হইলে পাঠ্যাধ্যায়ন হেতু তাহারা বিদ্যালয়ে প্রেরিত হয় তখন বিদ্যাশিক্ষা হইক বা না হউক কেবল তাহারদিগের কোমল মনে কুসংস্কার লগ্ন হইতে থাকে … তাহারা অবিলম্বে এক বিলাতীয় রোগে ক্ষিপ্ত হইয়া অবশেষে অশেষ প্রকার ক্লেশের ভাজন হয়…

গত শুক্রবার কোন কার্যোপলক্ষে মেং হেয়ার সাহেবের বিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলাম যে বিকট মুর্ত্তিধারী বালক তাহারা সারি ২ দণ্ডায়মান হইয়া লেজকাটা বিড়ালের ন্যায় লীলাখেলা করিতেছে ৷ ঐ বালকেরা উক্ত বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে…

…এইমত জনকত হেয়ার ইস্কুলে ৷

নিত্য নিত্য খেলে খেলা স্ব ২ কাছা খুলে ৷ ৷

পরস্পর কামসিন্ধু সবে করে পার ৷

লেখাপড়া অষ্টরম্ভা গণ্ডে চুম্বসার ৷ ৷

জঞ্জালে ভজালে দেশ সদা মার্গদানে ৷

হিতাহিত কেনাকিছু কেহ নাহি মানে ৷ ৷

এই লেখায় যে বিশেষণটি সবার আগে নজর কাড়ে সেটি হল পায়ুকাম এবং হস্তমৈথুনকে ‘এক বিলাতীয় রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা ৷ কেন এগুলি ‘বিলাতীয় রোগ’? আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যে কি পুংমৈথুন ও হস্তমৈথুনের অস্তিত্ব ছিল না? হস্তমৈথুনের উল্লেখ প্রাক-ঔপনিবেশিক যৌনতার টেক্সটগুলিতে খুব সামান্য হলেও রয়েছে ৷ বাৎসায়ন তার ‘কামসূত্রে’ কামক্রিয়াকে স্পষ্ট দুভাগে ভাগ করেছেন : প্রধান ও অপ্রধান ৷৩৩ তাঁর ভাষায় : ‘‘স্ত্রী বা পুরুষের স্পর্শবিষকে লক্ষ করিয়া আভিমানিক সুখে অণুবিদ্ধ, ফলবান বিষয়বোধই প্রধান কাম ৷’’ বিপরীতে ‘অপ্রধান কাম’-এ শুক্রক্ষরণ ঘটলেও তা ‘অর্থপ্রতীতি’ ঘটায় না ৷ বিপরীত-যোনি (পশুমৈথুন), অযোনি (হস্তমৈথুন) ও অনভিপ্রেত যোনিতে (বলাৎকার) শুক্রক্ষরণই ‘অপ্রধান কাম’-এর নিদর্শন ৷৩৪ ভারতের কোনো কোনো প্রাচীন মন্দির ভাস্কর্যেও হস্তমৈথুনের দৃশ্য উৎকীর্ণ রয়েছে ৷ অবশ্য হস্তমৈথুনরত পুরুষমূর্তি পাওয়া গেছে খুব কমই, ব্যতিক্রম খাজুরাহো ও বাগালী মন্দির, বাদবাকি অধিকাংশই নারীমূর্তি ৷ খাজুরাহোয় একাধিক ভাস্কর্যে মুখমেহন ও পায়ুমৈথুনরত পুরুষের মূর্তিও খোদিত আছে ৷৩৫ আমাদের প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে সমলৈঙ্গিক যৌন সম্পর্কের উল্লেখও খুব কম নয় ৷ কামসূত্র, কোকশাস্ত্র, অনঙ্গরঙ্গ প্রভৃতি গ্রন্থে তো বটেই, পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত, ‘কথা’ জাতীয় সাহিত্যে, মধ্যযুগের উর্দু-ফার্সি কাব্যে এধরনের অসংখ্য উল্লেখ, কাহিনি ও ইঙ্গিত রয়েছে ৷ ৷ যেমন ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’-এ ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত ৷ দিলীপরাজার মৃত্যু হলে তাঁর দুই স্ত্রীর যোনিতে যোনিতে (ভগ) ঘর্ষণ থেকে পুত্র ভগীরথের জন্ম হয় ৷ ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘মনুসংহিতা’য় এধরনের অ-যোনিজ সমলৈঙ্গিক সম্পর্কের অনেক উল্লেখ রয়েছে এবং সেগুলির সামাজিক গ্রহণযাগ্যতা নিয়েও সেখানে নানারকম প্রশ্ন তোলা হয়েছে ৷ বেশ কিছু দক্ষিণী টেক্সট, যেমন, ‘শিলাপ্পড়িকরম’ বা ‘মণিমেখলাই’, কলহণের ‘রাজতরঙ্গিণী’, জৈনশাস্ত্র ‘স্ত্রীনির্বাণপ্রকরণ’, চিকিৎসাশাস্ত্র ‘চরকসংহিতা’, ‘সুশ্রুতসংহিতা’—সর্বত্রই এধরনের যৌনমিলনের কথা পাওয়া যায় ৷৩৬ বাৎসায়ন তাঁর বইয়ের ‘পুরুষায়িতম ও পুরুষোপসৃপ্তানি’ এবং ‘ঔপরিষ্টকম’ অধ্যায়ে নারীকর্তৃক বিপরীতবিহার, ডিলডো জাতীয় কৃত্রিম যৌনাঙ্গ ব্যবহার, মুখমেহন প্রভৃতির বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন ৷ এছাড়াও তিনি ‘তৃতীয়া প্রকৃতি পঞ্চমী নায়িকা’র কথা বলেছেন, যারা পুরুষ এবং নারীলক্ষণের মিশ্রিত দেহধারী ৷ স্পষ্টতই, এরা মূলত পায়ুকামই অভ্যাস করতেন ৷ বাৎসায়ন পরিশীলিত উচ্চ সম্প্রদায় থেকে শুরু করে, গণিকা, ভৃত্য—সকলের ভিতরেই বিভিন্ন ধরনের মুখমেহন ও আনুষঙ্গিক পায়ুমৈথুনের কথা উল্লেখ করেছেন ৷৩৭ অর্থাৎ সমলৈঙ্গিক যৌনতা, পায়ুকাম ও অন্যান্য প্রথাবহির্ভূত যৌনাচার প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সংস্কৃতিতে অপরিচিত ছিল না কোনোকালেই ৷

তাহলে ‘পায়ুকাম’কে ‘বিলাতীয় রোগ’ বলা হচ্ছে কেন? লক্ষণীয়, কেবল উনিশ শতকের বাংলাতেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন যুগে সমলৈঙ্গিক সম্পর্ককে একটি বহিরাগত বিপদ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ আরবরা অভিযোগ করত পারস্য থেকে এর উৎপত্তি, পারস্যের লোকেরা দাবি করত খ্রিস্টান সন্ন্যাসীরা এই রোগের জন্মদাতা ও বাহক, অ্যাংলো-স্যাক্সনরা বিষয়টির জন্য দায়ী করত নর্মানদের আবার নর্মানরা দোষ দিত ফরাসিদের ৷ অর্থাৎ এই ‘হোমোফোবিয়া’ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিচিত ‘মিথ’ ৷ কিন্তু ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় এটিকে ‘বিলাতীয় রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করার অন্য সম্ভাব্য কারণ রয়েছে ৷ ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিপরীত লিঙ্গের নর-নারীর ভিতর প্রাতিষ্ঠানিক যৌনাচারকেই প্রধানত সমর্থন করা হলেও অন্যান্য যৌন আচরণকে কখনোই অস্বীকার করা হয়নি ৷ সেগুলিকে হয়ত নীচু নজরে বা কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু কখনোই সেগুলির বিরুদ্ধে আইনি বা নৈতিক অবদমন ও নিপীড়ন জারি করা হয়নি ৷ আমাদের ধর্মাচরণের বহুমুখিতাই এ ধরনের সম্পর্কগুলিকে এক ধরনের কাব্যিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে মণ্ডিত করেছে বরাবর ৷ এই যৌনাচারণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ মদতও যেমন ছিল না, তেমনি এক্ষেত্রে এক ধরনের সহনশীলতাও বজায় ছিল ৷ মূল বিভাজন বা বিভেদটুকু ছিল যৌনতা ও কৌমার্যের ভিতর, যৌনতার প্রকরণ সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না ৷ ইউরোপের ইতিহাসেও দেখা যায়, খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ে (অন্তত দ্বাদশ শতক পর্যন্ত) সমলৈঙ্গিক সম্পর্ককে রোম্যান্টিকতায় মণ্ডিত করা হয়েছে গানে, কবিতায়, চিত্রকলায় ৷ বস্তুত ‘হোমোসেক্সুয়াল’ ও ‘হেটেরোসেক্সুয়াল’-জাতীয় বাইনারি-বৈপরীত্য গেড়ে বসে উনিশ ও বিশ শতকে হ্যাভলক এলিস, ম্যাগনাস হার্শফিল্ড, সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রমুখ যৌন-মনস্তাস্ত্বিকদের সচেতন প্রয়াসে ৷ তার আগে ইউরোপে ‘হোমোসেক্সুয়াল’ কথাটির বদলে ‘Tribade’, ‘Saphist’, ‘Sodomite’, ‘Ganymede’ কথাগুলি ব্যবহৃত হত ৷ আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যেও একে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ যেমন : ‘তৃতীয়া প্রকৃতি’ (কামসূত্র), ‘প্রকীর্ণ মৈথুন’ (স্কন্দপুরাণ), ‘অসেক্য’ (সুশ্রুতসংহিতা), ‘কঞ্জুকা’ (শিলাপ্পড়িকরম), ‘পেড়ি’ (মণিমেখলাই) প্রভৃতি ৷

আসলে যৌনতার এই নতুন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন প্রক্রিয়াটি এসেছে সতেরো-আঠারো শতকের ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট থেকে ৷ দীর্ঘ দুই-তিন শতকব্যাপী এনলাইটেনমেন্ট-ভাবধারা এক নতুন ‘পৌরুষ’ বা masculinity-র ধারণার জন্ম দিয়েছিল ৷ এই নতুন মাপকাঠি অনুযায়ী ভাবা হতে থাকে ‘পায়ুকাম’ এবং ‘হস্তমৈথুন’—দুই অভ্যাসই মানুষকে আদর্শ পৌরুষের আকাঙ্খিত মাপকাঠি থেকে বিচ্যুত করে ৷ সতেরো শতক পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজে পায়ুকাম একটি সুপরিচিত অভ্যাস হিসেবেই গণ্য হত, যা মূলত পূর্ণবয়স্ক পুরুষ এবং বয়ঃসন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো বালকদের ভিতর সংঘটিত হত, সক্রিয় পুরুষটি এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় বালকের ওপর নিজের ক্ষমতাপ্রয়োগকে নিশ্চিত করত ৷ যদিও এই ধরনের কামক্রীড়া কখনোই চার্চ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পয়নি, তবুও এই অভ্যাসকে কোনো পৃথক মূল্যবোধ দ্বারা ব্যাখ্যাও করা হয়নি ৷ আঠারো শতকের গোড়ায় এনলাইটেনমেন্ট এক নতুন দাম্পত্যপ্রেম, পারিবারভাবনা ও শিশুপালনের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল ৷ ফলত নতুন পারিবারিক কাঠামোর ভিতর নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের এক উচ্চতর আদর্শ মান্যতা পেল এইবার ৷ পুরুষ এক সম্পূর্ণ নতুন আদর্শ দ্বারা নিজেকে পরিবর্তিত করল ৷ বয়ঃসন্ধিকালীন নিষ্ক্রিয় যৌনাচরণকে ঘৃণা করতে শিখল সে, বিপরীতকামী দাম্পত্যপ্রেম এবার হয়ে দাঁড়াল তার আত্মপরিচয় ও সামাজিক সম্মানলাভের অন্যতম লক্ষণ ৷ শুধু তাই নয়, ‘sodomy’ চিহ্নিত হল এক ধরনের অধঃপতিত, নারীসুলভ, অপকৃষ্ট মানসিক রোগ হিসেবে ৷ এই শ্রেণির সমকামী মানুষনজকে নিন্দাচ্ছলে ‘Molly’ বলে উপহাস করা হত ৷৩৮

আগেই বলা হয়েছে ‘রসরাজ’-এর লেখাগুলি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের যৌনতার ডিসকোর্সের সমতুল্য নয় ৷ অথচ নিন্দাচ্ছলে লেখা হলেও এগুলির ভিতরেও বহুলাংশে রয়ে গিয়েছে পরবর্তী সময়ের যুক্তিক্রমের একটি প্রাথমিক চেহারা ৷ ‘পুংমৈথুন’-সংক্রান্ত উৎকণ্ঠার একটি প্রধান দিক—‘ব্যক্তি’র লিঙ্গপরিচয়ের একমাত্রিক ছাঁচটিকেই কেবল মান্য বলে ধরে নেওয়া, একই ব্যক্তির শরীরে ও মনে স্ত্রী এবং পুরুষলক্ষণের যুগপৎ সমাহারের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা—আঠারো/উনিশ শতকের পাশ্চাত্য ডিসকোর্সের এই মনোভাবই পরোক্ষভাবে অনুসৃত হতে দেখি ‘রসরাজ’-এর লেখায় ৷ যেমন, ফেব্রুয়ারি ১৮৫০-এর একটি সংখ্যায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এইভাবে :

সম্পাদক মহাশয় কলির প্রভাবে ৷

বিকৃতি ঘটিল আসি প্রকৃতির ভাবে ৷ ৷

পুরুষে প্রকৃতি বেশ করিয়া ধারণ ৷

প্রকৃতির বিপরীত করে সম্পাদন ৷ ৷…

বিদ্যালয় স্থিত যত বালকের দল ৷

এহেন স্বভাব প্রায় অনেকে প্রবল ৷ ৷

শিক্ষকের উপদেশ বিশেষ না ভাবে ৷

অধম আচারে রত ললনা স্বভাবে ৷ ৷

ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, আগেই বলেছি, ‘তৃতীয়া প্রকৃতি’র যৌনাচরণ প্রাধান্য না পেলেও অসহিষ্ণুতার মুখোমুখিও হয়নি কোনোদিন ৷ কিন্তু ‘রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় পুরুষের ‘ললনা স্বভাব’ যেভাবে ধিক্কৃত ও আক্রান্ত হয়েছে, যেভাবে তাকে ‘প্রকৃতির বিপরীত’ বলা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজের সহনশীলতার বদলে এবার জায়গা পেতে চলেছে কে ভিন্নতর মূল্যবোধ ৷ ‘জোড়াসাঁকোর অন্তঃপাতি চাষাধোপাপাড়ানিবাসী রামসেবক চট্টোপাধ্যায় নামক’ এক ষোড়শবর্ষীয় বালক, যে এ ধরনের পুংমৈথুনে লিপ্ত, তার সম্পর্কেও ‘রসরাজ’ একইভাবে ambiguous sexual identity-র অভিযোগ এনেছে :

বয়ঃক্রম হবে ষোলো অনুভব হয় ৷

মুখের কিরণ যেন শশীর উদয় ৷ ৷…

নাসিকা হইবে তার সম বিদ্যাধরী ৷

পাছামোটা অনুমান করি হবে করি ৷ ৷

নারীর স্বরূপ ভাব লক্ষ করে মন ৷

নহিলে কি জন্য বল উঠিবেক স্তন ৷

সমানেতে করে যদি কটাক্ষ নিপাত ৷

নর থাকুবরে যাকু পশু হয় পাত ৷ ৷

সর্ব্বদা বাহার দেয় কথা কয় হেসে ৷

কামেতে বেশ্যার মত যেচে কোলে বসে ৷৩৯

একদম খোলাখুলি ভাষায় এই বালক ও অন্য কয়েকজন বিশিষ্ট পরিবারের সন্তানদের পায়ুকামের অভ্যাসকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছে ‘রসরাজ’ ৷ পূর্বোক্ত রামসেবক চট্টোপাধ্যায়-এর বাড়িতে একদিন অসময়ে উপস্থিত হয়ে দেখা গেল : ‘‘অন্য দুইজন বান্ধব সহিত রামসেবক বসিয়া প্রেমালাপ করিতেছেন, উভয়েই কামে মগ্ন হইয়া বাটীর পূর্ব্বদিকে দালানের মধ্যে কেদারায় বসিয়া পরস্পর মুখচুম্বন করিতেছেন, কোলাকুলি হইতেছে, কখন বা একজনের উরুপোরি রাম মস্তক দিয়া শয়ন করিয়া থাকেন, আবার কখনো অন্যের মনোরক্ষা করেন… আমাদিগকে দেখিয়া লজ্জা করা চুলায় থাকুক ক্রমশ বাড়াইতে আরম্ভ করিলেন ৷…’’৪০ এই আসঙ্গলিপ্সার পাশাপাশি ‘ হিন্দু কালেজস্থ চাঁপাতলানিবাসী একজন রসিক ছাত্রের গুণাগুণ’-ও ছাপা হয়েছে ‘রসরাজ’-এ, যার,

বয়স হইবে প্রায় ষোড়শ বৎসর ৷

গুহ্যব্রতে ব্রতী তবু নিলাজ পামর ৷ ৷…

লোকলাজভয় কিছু মনে নাহি গণে ৷

সাধি গুহ্য দান করে অনেকে গোপনে ৷ ৷…

রাজমার্গে পেলে সবে তার মার্গে ধায় ৷

যেমন বৃষভগণ গাভীপৃষ্ঠে ধায় ৷ ৷…

গোপনে পাইলে তারে সকলেই রোকে ৷

যেমন নাটুরে মাজি ধ্বজি গাড়ে পাঁকে ৷৪১

এমনকি ‘‘ইদানীং ঐ ছেলে মার্গদান করিয়ে পয়সার উপায় দেখিতেছে যে টাকা দেয় তাহারি কাছে কাছা খুলিয়া পাছা বাড়াইয়া দেয় হিন্দু মোসলমানাদি কিছুই বাছাবাছি করে না ৷’’৪২ ‘রসরাজ’ ওই সকল বালকের অভিভাবকদের সতর্ক করে দিয়েছে, কারণ, এ হেন ব্যবহারে তাদের ‘কুলরজ্জু টনটনে হইয়া উঠিতেছে ৷’৪৩ সামাজিকভাবে বংশের সম্মানহানির প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পেলেও মান্য প্রাতিষ্ঠানিক যৌনাচরণ থেকে বিচ্যুত হবার অস্বস্তিটুকুও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ ইংরেজিশিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’দের ‘বাঙালি ভিক্টোরিয়ানা’ ও অশ্লীলতাবিরোধী অভিযান শুরু হবার পর থেকে ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর মতো ছাপার অক্ষরে, খোলাখুলি, এই বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলার রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যাবে ৷ কিন্তু পরবর্তী ডিসকার্সিভ যৌনতার এক পূর্বসূত্র হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এইখানে ৷

কিন্তু যে ব্যক্তির পুংমৈথুনের অভ্যাস নিয়ে রসরাজ-এর পষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করা হয়েছে তিনি হলেন প্রখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত, যিনি, ‘রসরাজ’-এর বর্ণনা অনুযায়ী স্কুল কলেজের ছেলেছোকরা থেকে শুরু করে সমবয়সী বন্ধুবর্গের মধ্যে পায়ুকামী হিসেবে রীতিমতো প্রসিদ্ধ, এমনকি তাঁর পায়ুপ্রহারবাসনার ভয়ে সকলেই একরকম তটস্থ—‘পলায়ন করে সব দণ্ডাঘাত ডরে ৷’৪৪ একটি ত্রিপদী রচনায় বয়স্যসমভিব্যাহারে ঈশ্বর গুপ্তের কামক্রীড়ার প্রত্যক্ষ বর্ণনা:

মারিয়া ক্ষেত্রের পায়ু

নিঃশেষ করিল আয়ু

দেখিয়া গোলোক মরে দুঃখে ৷

নির্গত রসমুদগর

ক্রোধে কাঁপে থরথর

বীর্য্য পুঁছে গোলোকের মুখে ৷ ৷

বীজরক্ত মাখা ছিল

গোলোকের মুখে দিল

বুড়ো তাহা চপচপ খায় ৷

মুদগর ছাড়িয়া তারে

সাজিল ভীষণাকারে

উত্তর মুখেতে বেগে ধায় ৷ ৷…

রামা লক্ষ্মীছাড়া তায়

মুদগরে ধরিতে যায়

মুদগর ধরিল তার কেশ ৷

রমণী হৃদয়াগারে

উপুড় করিয়া তারে

বেগভরে মার্গ মারে শেষ ৷ ৷৪৫

বলাই বাহুল্য ‘মুদগর’ এখানে স্বয়ং ‘রসমুদগর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত, আর ক্ষেত্রমোহন, গোলোক—এরা তাঁরই গোষ্ঠীভুক্ত বন্ধুবান্ধব ৷ এক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, বারবার বলা হচ্ছে ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর স্ত্রী বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে সহবাস করেন না, বরং পুরুষের গুহ্যস্থানই তাঁর কাছে অধিক আকর্ষণীয়

শুনহে ঈশ্বরদাস জিজ্ঞাসি তোমায় ৷

যথার্থ মনের কথা বলিবে আমায় ৷ ৷…

পত্নীর সুরম্য স্থান কিসে দেখ মন্দ ৷

ভালবাস কি কারণ শিশু গুহ্য গন্ধ ৷ ৷

কি জন্য ছাড়িলে পত্নীসহ সুখরতি ৷

কি হেতু বালকগুহ্যে হইয়াছে মতি ৷ ৷

কি কারণ দারাসহ আলাপে প্রমাদ ৷

শিশুগুহ্য লেহনেতে এত কি আস্বাদ ৷ ৷…

মহাপাপী নরাধম গুপ্ত কর্তাভজা ৷

মজাইয়া শিশুগণ ভোগ মারে অজা ৷ ৷৪৬

একই উল্লেখ পাই অন্য একটি কবিতায়, যেখানে ক্ষেত্রমোহনের বৃদ্ধা মা ঈশ্বর গুপ্তকে অনুরোধ করছেন পত্নীকে তৃপ্ত করার জন্য, বিপরীতে ঈশ্বর গুপ্ত জবাব দিচ্ছেন—‘‘পরে যাইব আমোদে ৷ / অগ্রভাগ ঢুকাইব গোলোকের পোঁদে ৷ ৷’’ এবং ‘‘এই কথা বলিয়া মুদগর বেগে ধায় ৷ / গোলোকের মার্গ চিরে সাড়ে তিন ঘায় ৷ ৷’’৪৭

উনিশ শতকের শেষার্ধের হিন্দু জাতীয়তাবাদ বাঙালি পরিবারের এক আদর্শ পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল, যার প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল এদেশীয় সমাজে প্রচলিত স্বামী-স্ত্রীর অসম সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটানো ৷ এক নতুন দাম্পত্যপ্রণয়ভাবনা এর নেপথ্যে কাজ করছিল, যার প্রকাশ দেখা যায় পরবর্তী উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ,কবিতায় ৷ স্বামী-স্ত্রীর যৌথ জীবনাচরণের ভাবনা এত বেশি কাম্য মনে হয়েছিল, কারণ দেশীয় সমাজের বাস্তব ছবিটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ৷ উনিশ শতকের অসংখ্য খ্যাত-অখ্যাত প্রহসনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কহীনতার এহেন ছবি প্রকাশিত হয়েছে ৷ কিন্তু ‘রসরাজ’-এর বিশেষত্ব এখানেই যে, ঈশ্বর গুপ্তের চারিত্রিক অধঃপতনের সূচক হিসেবে তাঁর ‘মার্গগমনের রোগ’-টিকেই প্রধানতম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ৷ নব্য দাম্পত্যভাবনার মডেল হিসেবে যে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ কার্যকর হয়েছিল এদেশীয় ভদ্রলোকের মননে তারই একটি প্রাথমিক নিদর্শনই কি পাওয়া যায় ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায়? উনিশ শতকের ফরাসি ‘হারমাফ্রোডাইট’ হারকিউলিন বারবিন, যিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজের উভলিঙ্গ যৌনপরিচয়-সংক্রান্ত তীব্র মানসিক সংকট ও ‘আধুনিক আলোকপ্রাপ্ত’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধিপত্যবাদী প্রয়োগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য, তাঁর অসমাপ্ত ‘স্মৃতিকথা’ সম্পাদনা করতে গিয়ে ফুকো যৌনপরিচিতি র্নিয়ের এই তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিটিকে reductive oversimplification হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যে বিজ্ঞান এক সর্বজনীন ও সার্বভৌম জ্ঞান-যুক্তির কাঠামোয় বাঁধতে চায় ব্যক্তির যৌনসত্তাকে, যে বিজ্ঞান একই ব্যক্তির শরীরে দুটি পৃথক লিঙ্গপরিচয়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং বাধ্যতামূলকভাবে একটি প্রাক-নির্ধারিত ‘true sex’-এর ধারণা জোর করে জাপিয়ে দিতে চায় তার উপর ৷ এই true sex-এর ধারণাটিও গড়ে উঠেছে নিজস্ব ‘অর্ডার অফ থিংস’-এর ভিতর দিয়ে, যার সাপেক্ষে ব্যক্তির যৌনলক্ষণ ও যৌনবিচ্যুতিগুলি হয়ে ওঠে বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু এবং একটিই সর্বমান্য মাপকাঠির সাপেক্ষে তার ওই বিচ্যুতিগুলিকে ক্ষমতাপ্রয়োগের আওতায় নিয়ে আসা হয় ৷ ‘আধুনিক’ যৌনতার ডিসকোর্সের এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ফুকোর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :

… it is in the area of sex that we must search for the most secret and profound truths about the individual, that it is there we can best discover what he is and what determines him. And if it was believed for centuries that it is there we can best discover what he is and what determines him And if it was believed for centuries that it was nesecesary to hide sexual matters because they were shameful we now know that it is sex itself which hides the most secret parts of the individual: the structure of his fantasies, the roots of his ego, the forms of his relationships to reality. At the bottom of sex, there is truth.৪৮

ঈশ্বর গুপ্ত সত্যিই পুংমৈথুনে অভ্যস্ত ছিলেন কি না, আজ আর তা জানা খুব সহজসাধ্য নয় ৷ হতেই পারে, প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর লোক হিসেবে তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্যই ‘সম্বাদ রসরাজ’ তাঁকে ‘পায়ুকামী’ প্রতিপন্ন করেছিল ৷ কিন্তু যে প্রত্যক্ষতায় ঈশ্বর গুপ্তের গুপ্তচরিত্র এখানে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় এই পত্রিকার লেখক ও পাঠকগোষ্টী তখনও অব্দি এমন এক সমাজ-মানসিকতার বাসিন্দা, যেখানে গর্হিত ও নিন্দনীয় হলেও ব্যক্তির এ ধরনের যৌন আচরণ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা যায় ৷ ‘ব্যক্তি’র এই যৌন অভ্যাসকে ‘বিকার’ হিসেবে চিহ্নিত করেও তা নিয়ে প্রকাশ্যে ঠাট্টা-রসিকতা করা যায়, তাকে নিয়ে আসা যায় আমোদ-প্রমোদের এলাকায় ৷৪৯ উনিশ শতকের শেষদিকে পৌঁছে বিষয়টি আর এতখানি প্রকাশ্য করে তোলা যাবে না, কারণ ততোদিনে যৌনতাই যে ব্যক্তি-সম্পর্কিত ‘সত্য’ উৎপাদনের একমাত্রিক হাতিয়ার—এই ‘আধুনিক’ পাশ্চাত্য ধারণাটি পুরোপুরি গেঁথে গেছে বাঙালি ভদ্রলোকের চেতনায় ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এ পাই সেই দৃষ্টিকোণের এক অসম্পূর্ণ সূচনা, যৌনতার ‘প্যান-অপটিক্যান’ তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি উনিশ শতকের প্রথমার্ধের এই পত্রিকার লেখক ও পাঠকদের ৷ পরবর্তী লেখালেখির তুলনায় এখানেই এর পার্থক্য ৷

৩.

নামী পরিবারের অন্দরমহলে মেয়েদের যৌন ব্যভিচার—‘সম্বাদ রসরাজ’-এর আর একটি মুখরোচক বিষয়বস্তু ৷ প্রতিপক্ষের পুরুষ যখন আক্রমণের বিষয়, তখন কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সেই প্রাথমিক পর্যায়ে দলাদলি ও পারস্পরিক কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ির প্রেক্ষিতে এ ধরনের অনাচারের অভিযোগ খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয় ৷ কিন্তু আলোচ্য বিষয়বস্তু যখন হয়ে ওঠে মহিলাকেন্দ্রিক, তখন গোটা ব্যাপারটা পৃথক মাত্রা পায় ৷ কারণ, এক্ষেত্রে লেখক পুরুষ, পত্রিকার পাঠকও পুরুষ এবং পুরুষের উপভোগের সামগ্রী হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে মেয়েদের যৌনতা ৷ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে, যখন, বাঙালি মেয়েদের জীবনে ব্যক্তিগত ও নাগরিক—কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকারের ধারণাই প্রায় ছিল না বললেই চলে, সে সময় ‘রসরাজ’-এর এই লেখাগুলিতে, দেখতে পাই যৌনতাকে কেন্দ্র করে মেয়েদের সম্পূর্ণ পৃথক, নিজস্ব এবং স্বয়ংচালিত ‘ক্ষেত্র’ গড়ে তোলার চেষ্টা ৷ নিজেদের বৈধ দাম্পত্যের বাইরে বিভিন্ন বয়সের মহিলারা পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে নানা পদ্ধতিতে শারীরিক আসঙ্গলিপ্সা চরিতার্থ করছেন—এই ছবিটি ‘রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় অত্যন্ত সুলভ ৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নব্য জাতীয়তাবাদী ভাবধারা শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের চেতনায় পাবলিক / প্রাইভেট সংক্রান্ত এক নতুন ডিসকোর্সের জন্ম দেয় ৷ আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কল্প-নাগরিক হিসেবে কতকগুলি সর্বজনীন নীতিবোধের আদলে নিজেদের পারিবারিক জীবনকে পুনর্গঠিত করতে চেয়েছিলেন তাঁরা ৷ ফলত, পাশ্চাত্য ‘গার্হস্থ্য বিজ্ঞান’-এর ক্যাটেগরিগুলো দেশীয় রক্ষণশীল হিন্দু ‘গার্হস্থ্যবিধি’-এর সঙ্গে মিলেমিশে এক নিজস্ব, পৃথক ‘গার্হস্থ্য’ ‘ডিসিপ্লিন’ ও ‘অর্ডার’ গড়ে তোলে, যে ‘গার্হস্থ্যবিজ্ঞান’-এর কেন্দ্রে রয়েছে ‘গৃহবধূ-’রা ৷ কাল্পনিক ‘নেশন স্টেট’-এর ক্ষুদ্রতম একক পরিবার, তাই পরিবারের ভিত্তিস্বরূপ গৃহকর্ত্রীকে এবার একদিকে যেমন শিশুর স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চরিত্র নির্মাণের দায়িত্ব নিতে হল, অন্যদিকে তেমনি স্বামীর যথার্থ ও যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি ভদ্রলোকের নতুন ‘নারীত্ব’ সংক্রান্ত ধারণাটির প্রয়োগক্ষেত্রও হয়ে উঠলেন তাঁরাই ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এ মেয়েদের যৌন ব্যভিচারের যে ছবি পাওয়া যায়, তা বাঙালি সমাজে যৌননৈতিকতার এক পুরোনো ধরনকে তুলে ধরে, যাকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল পরবর্তী ‘আধুনিক’ জাতীয়তাবাদী ভাবনা ৷ ‘সতীত্ব’ ও ‘পাতিব্রত্য’-সংক্রান্ত নৈতিকতার ‘আধুনিক’ বিধিনিষেধ, যৌনতাকে এক নতুন পরিশীলিত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা—এগুলো উনিশ শতকের শেষার্ধের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন প্রক্রিয়া, যেখানে নরনারী সম্পর্ক এক নতুন ‘আইডিওলজি’র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৷ ‘কাম’-ই যে নারী পুরুষের সম্পর্কের মূল কথা—অতীতে এর বিরুদ্ধে কেউই কথা বলা আবশ্যক মনে করেননি ৷৫০ ‘সম্বাদ সুধাকর’ পত্রিকার ৫ নভেম্বর ১৮৩১ সংখ্যায় কলকাতার জনৈক ভদ্রলোকের বাড়ির অন্তঃপুরের যৌনকেচ্ছা প্রকাশিত হয় ৷ রাত্রিবেলা ওই বাড়ির কর্তা ও ছেলেরা বেরিয়ে যেত গণিকালয়ে রাত কাটানোর জন্য ৷ সেই সুযোগে বাড়ির গৃহকর্ত্রী ও পুত্রবধূরা বাড়ির কর্মচারী ও চাকরদের ভিতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে যৌনবাসনা চরিতার্থ করত ৷ পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সে এই গৃহবধূরা ‘নন-এনলাইটেনড’ হিসেবে পরিগণিত হবেন, যেহেতু, ‘দাম্পত্য’ ও ‘পারিবারিকতা’-র উচ্চ নৈতিক আদর্শের সঙ্গে এঁদের কোনো পরিচয়ই নেই, কারণ এদেশের মেয়েদের ‘আধুনিক’ শিক্ষা-দীক্ষা নেই ৷ এই ডিসকার্সিভ ব্যাখার একটি পূর্বসূত্র ‘সম্বাদ সুধাকর’-এর ওই লেখাটিতেই পাওয়া যায়, যদিও একটু ভিন্নভাবে ৷ লেখকের মতে, যেহেতু এটি গৃহাভ্যন্তরের সমস্যা এবং গার্হস্থ্যজীবনের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী, তাই এদেশের ‘অশিক্ষিত’ মেয়েদের ‘আধুনিক’ শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে পারলেই এই ধরনের যথেচ্ছাচারে মেয়েদের অংশগ্রহণ রোধ করা যাবে; কিন্তু এটুকুই সব নয়, লেখক জানাচ্ছেন :

নারী জাতির মদন পুরুষাপেক্ষা অষ্টগুণ প্রবল (এইরূপ অনেকে কহিয়া থাকেন), তাহাতে অস্মদ্দেশের কঠিন রীত্যনুসারে বিদ্যারূপ যে জ্ঞান তাহা তাহারদিগকে বঞ্চিত করাতে ঐ দুর্বার মদন অজ্ঞান অবলাদিগের উপর পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়া তাহারদিগের কামানল উজ্জ্বল করিয়া যে তাহারদিগের অতি ঘোরতর দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত করাইবেক ইহাতে বাধা কি? আর ইহাতে যে তাহারদিগের সতীত্বও বিনাশ হইবে ইহারই বা অসম্ভাবনা কি আছে?৫১

অ-নিয়ন্ত্রিত ‘দুর্বার মদন’-ই যে মেয়েদের ‘লম্পটাচরণে’ প্রবৃত্ত করায়, এটি একটি বহুলপ্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ‘মিথ’ ৷ এই ‘মিথ’ অনুযায়ী নারী এক ব্যাখ্যাতীত ‘অন্ধকার শক্তি’-র অধিকারিণী, যে শক্তি ‘শুভ’ উদ্দেশ্যপরায়ণ হলে মঙ্গলজনক, ‘অশুভ’ উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হলে ধ্বংসাত্মক ৷৫২ কেবল এদেশেই নয়, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপেও এই ‘unsatiable woman’-সংক্রান্ত ‘মিথ’ চালু ছিল ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-ও খানিকটা এই মিথেরই বশবর্তী, যখন দেখি, মেয়েদের ‘অশিক্ষা’ নয়, বরং বিধবাবিবাহের প্রচলন করলেই যে অতৃপ্ত নারীশরীর শান্ত হবে—এই মত প্রকাশিত হয়েছে একটি সংখ্যায় :

একগুঁয়ো হিন্দুরা শাস্ত্রের অভিপ্রায় গ্রহন করিবেন না, যুবতী বিধবাদিগকে অমনি রাখিয়া দিবেন, বিধবাদিগের শরীর কি শরীর নয়, তাহারা কি মহাবল ইন্দ্রিয়দলকে হাত বুলাইয়া শান্ত রাখিবে?৫৩

কিন্তু ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল এখানে মেয়েরা কেবল পুরুষের অন্যায় লালসার শিকার নয়, বরং যৌন অবরোধের বিরুদ্ধে গৃহস্থ মেয়েদের অবদমিত শরীর এখানে বিদ্রোহ করেছে ৷ লোভী পুরুষই কেবল মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলছে না, এক্ষেত্রে মেয়েরাও স্বেচ্ছায় অংশ নিচ্ছে ওই শরীরী খেলায় ৷ ‘অল্প বয়সে পতিহীনা কোন কুলবালা অবলা’ ‘রসরাজ’ সম্পাদককে চিঠি লিখে জানাচ্ছে নিজের দাদার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে :

একে যুবতী তাহে প্রাণপতির বিচ্ছেদ, ইহা কি প্রকারে সহ্য করি অতএব আমার বারফটকা স্বভাব দেখিয়া জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা মধ্যে ২ টপপা মারিতে আরম্ভ করিতে লাগিলেন, আমিও দেখিলাম দাদার মুণ্ড ঘুরিয়া গিয়াছে, দেখি কি করেন, তদনন্তর এক দিবস বলাৎকারের উপক্রম দেখিয়া কটুত্তর করিলাম, তাহাতে তিনি মিনতিপূর্বক ব্যগ্রতা জানাইলেন…৫৪

অপর একটি সংখ্যায় ‘শিমুলিয়ার মধ্যস্থিত কোন পাল মহাশয়ের পুত্র’ ও তার ‘বিধবা বড় ভগিনী’র কামলীলা বর্ণিত হয়েছে এইভাবে :

ভগিনী অমনি বক্ষের কাপড় খুলিয়া কহিলেন, ভাই, এই দেখ, সমুদায় বক্ষেতেই বেদনা হইয়াছে… ঈহা শুনিবামাত্র ভ্রাতা শীঘ্রগতি ভগিনীর বক্ষমুলে হস্তপ্রদানপূর্বক মহামন্ত্র পাঠ করত ডলিয়া দিতে ২ তৎস্থানের উচ্চমাংসও মলিয়া দিতে লাগিলেন এবং ক্রমে ২ হস্ত অধোগামী করিয়া তলপেট এবং নিতম্বের বসন খুলিয়া হস্ত বুলাইতে ২ অনঙ্গে মোহিত হইয়া জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে আলিঙ্গন দিলেন, এমতকালীন ভগিনী আলুথালু বেশে শিহরিয়া কহিলেন, যাদুমণি, ও কি, শীঘ্র ছেড়ে দেও, কে দেখিবে কে শুনিবে… এখনি একটি গোল করিায়া তুলিবে… তখন ভ্রাতা কহিলেন যেখানে বিবর সেইস্থানেই ভুজঙ্গ, তুমি এই ত্রাস কর, কিছু ভয় নাই, একটু চূপ করিয়া থাক, আমি যে তুকতাক মন্ত্র জানি, কে কি করিতে পারে, সকলের মুখ বন্ধ করিয়া রাখিব… এই কথা বলিয়া ভগিনীকে এমত আরাম করিতে লাগিলেন, ভগিনী কেবল আঃ আঃ শব্দ করিতে করিতে… বিলক্ষণ আরোগ্যা হইলেন…৫৫

উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই মেয়েটির অবদমিত আকাঙক্ষাকে উসকে দিচ্ছে পুরুষ, কিন্তু মেয়েটি বাধা দিচ্ছে না, এক্ষেত্রে যৌনতার সুখোপভোগই উভয়ের কাছে মুখ্য ৷ এর পাশাপাশি এমন কয়েকটি লেখা পাওয়া যায় যেখানে মেয়েদের উদ্যোগই প্রধান, পুরুষ সেখানে সুখোৎপাদনের অনুঘটক মাত্র ৷ ‘বল্লভপুরের দ্বাদশ গোপাল’ দর্শন করতে গিয়ে কলকাতার কুলবধূরা এক সমবেত যৌনাচারে মেতে ওঠেন—‘তাহারা সেই স্থানে যাইয়া বারোওয়ারী নারী হয়েন ৷’ প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় :

কলিকাতা নগরে যেসকল স্ত্রীলোকেরা দুগ্ধফেণবৎশয্যায় শয়ন করেন তাহারাও সেই ঘরে মাদুরের উপর পড়িয়া গেলেন… যাঁহারাদিগের বক্ষস্থলে গুটী উঠিয়াছে, তাহারাও যেমন, যাঁহারদিগের বক্ষস্থলে পাশের বালিশ ঝুলিয়াছে তাঁহারাও সেইরূপ মূল কর্ম্মে সকল সমান… পুরুষেরা ঘরে ঘরে করেন তথাচ মেয়েদের কুটকুটোনী বারণ করিতে পারেন না, এদিগে বাড়ীতে কড়াকড়ি চৌকী, ওদিকে মেয়েরা বাহিরে যাইয়া দুই চক্ষের ব্রত করে আমি তাহারদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম তোমরা দ্বাদশ গোপাল দেখিতে আসিয়া এই প্রকার লম্বা গোপাল ঢুকাইতেছ ইহাতে কি তোমাদের কর্ত্তারা ক্রোধ করিবেন না, স্ত্রীলোকেরা কহিলেন আমরা ভয় করিনা, সকল ঘরেতেই এ কাণ্ড আছে কোন বেটা কি বলিবে, আমাদিগের মান্য লোকেরাই সম্পর্ক বাছেন না… একজন প্রকাশ্য বৌও হইয়াছে আপনি শুনিয়াছেন, পরম ধার্ম্মিকাবতার আর একজন শাশুড়ীর সঙ্গে ছিলেন… তবে আমরা কেন ছাড়িব…৫৬

এখানে মেয়েদের সম্পূর্ণ নিজস্ব, পৃথক এবং স্বয়ংচালিত যৌনতার একটি ‘ক্ষেত্র’ তৈরি হচ্ছে, যেখানে পুরুষের যৌন আধিপত্যের সমান্তরাল একটি ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তুলছে মেয়েরা ৷ অন্তত যৌনতার এই উপভোগ্যতার নিরিখে অস্বীকার করা হচ্ছে লিঙ্গপার্থক্য ৷ যৌন ব্যভিচার কোনোভাবেই সমর্থিত হচ্ছে না, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে যা অন্যায়, তা পুরুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক—এ ধরনের বাঁধাধরা নিরিখে বিষয়টিকে তুলে ধরা হচ্ছে না ৷ এবং মেয়েদের এই স্বয়ংচালিত যৌনটোপিয়ার একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ‘রসরাজ’-এই পাওয়া যায়, যখানে ঈশ্বর গুপ্তের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী স্বামীর পায়ুকামের অভ্যাসকে ধিক্কার দিচ্ছেন এবং নিজের অতৃপ্ত শারীরিক চাহিদা পূরণ করছেন সঙ্গিনীদের সঙ্গে সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে ৷ এক্ষেত্রে পুরুষের প্রয়োজনীয়তাই অবান্তর হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কারণ পুরুষের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতেই তাঁরা স্বেচ্ছায় বেছে নিচ্ছেন এই বিকল্প যৌনতা ৷ সাম্প্রতিক নারীবাদী তাত্বিকদের কেউ কেউ যেমন লেসবিয়ান যৌনতাকে পুরুষনিয়ন্ত্রিত ও পুরুষের দ্বারা সংজ্ঞায়িত তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’ যৌন শৃঙ্খলায় মেয়েদের এক অন্তর্ঘাত বলে ভাবেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়প্রেক্ষিতে রচিত ‘রসরাজ’-এর লেখাটিতেও যেন তারই এক অন্য আভাস পাওয়া যায় ৷৫৭ অবশ্য এখানে বিন্দুবাসিনী প্যাসিভ, সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন ক্ষেত্রমোহনের স্ত্রী মণিমঞ্জরী ও তার শাশুড়ি, এর মধ্য দিয়ে সমকামিতার ভিতরেও যে ক্ষমতাসম্পর্ক কাজ করে তা পরিস্ফুট হয় ৷ বর্ণনায় স্ত্রী-সমকাম বোঝাতে চলতি স্ল্যাং হিসেবে ‘চাক্তিমৈথুন’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে (যেমন পুং-মৈথুনের প্রতিশব্দ সর্বত্রই ‘মার্গমারা’):

ক্ষেত্রের স্ত্রী মণিমুঞ্জরী আসিয়া কহিল ও সৈ বিন্দু… ওরা যদি পুরুষে পুরুষে করিতে করাইতে পারে তবে কি আমরা মেয়েরা ২ পারিনা, চল আমরা চাক্তিমৈথুন করি… বিন্দুবাসিনী যদিও দেবরগামিনী বা বহুপুরুষ বিলাসিনী হইয়াছে তথাপি চাক্তিমৈথুন জানে নাই, সে কহিল সখি মণিমুঞ্জুরি, চাক্তিমৈথুন কেমন, তাহাতে কি মেয়েদের হয় ৷ যুবতী বিন্দুবাসিনীর এই কথার আভাস পাইয়া ঘাগি কুটনী ধূমসী মাগী ক্ষেত্রের মাতা পুত্রবধূ মণিমুঞ্জরীকে পশ্চাতে রাখিয়া অগ্রে আসিয়া বিন্দুর মুখচুম্বন করিয়া কহিল, প্রাণ বিধুমুখি, চাক্তিমৈথুন জান না, এইখানে শোও, আগে শিখাই, এই কথা বলিয়া মাগী বিন্দুকে কর্ম্মের মত ধরিয়া বসিল, মণিমুঞ্জরী বলে শাশুড়ী কর কি, আমি আগে করিব, মুক্তামনী, বিশ্বেশ্বরী, তারিনী প্রভৃতি সখীরাও যো পাইয়া উন্মত্তা হইয়া উঠিল ৷৫৮

তবে একথাও মনে রাখতে হবে এগুলি সবই পুরুষের লেখা, এর উপভোক্তাও পুরুষ ৷ তদুপরি, এই লেখাগুলির সবকটিই যৌনতার রিপ্রেজেন্টেশন, বাস্তবতার সঙ্গে এদের সম্পর্ক একরৈখিক নয় ৷ পুরুষের কলমে মেয়েদের যৌনতা কখনোই পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ও পুরুষ-পরিকল্পিত নারীশরীর/যৌনতার বস্তুগত ক্যাটেগরিগুলোকে অতিক্রম করতে পারে না ৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর শরীর সর্বাংশে তার নিজের অধীন নয় ৷ ফলত, পুরুষের চোখে তার যৌনতার বহিঃপ্রকাশ যে প্রক্রিয়ায় ঘটে তার ভিতর eroticization of domainance and subordination৫৯ রয়ে যায় ৷ একজন সাম্প্রতিক নারীবাদী তাত্বিক যখন বলেন:

Sexuality is a form of power, Gender, as socially constructed embodies it, not the reverse. Women and men are divided by gender…If this is true, sexuality is the linchpin of gender inequality.ক

তখন তার তাৎপর্য পরিস্ফুট হয় উপরোক্ত লেখাটির ভিতরেই, যেখানে অনাবশ্যকভাবে মণিমঞ্জুরীর শাশুড়ির বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যায়—‘ঘাগি কূটনী ধূমসী মাগী’ ৷ এটি পুরুষ পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত বিশেষণ, যা পুরুষের ধর্ষকামী উত্তেজনা চরিতার্থ করবে ৷ আর পুরুষের যৌনতার চেয়ে মেয়েদের যৌনতার বর্ণনা পাঠ্যবস্তু হিসেবেও অনেক বেশি আকর্ষণীয়, কারণ পুরুষ এখানে একইসঙ্গে দর্শকাম ও তির্যকপথে বাসনা পরিতৃপ্তির শরিক হচ্ছে ৷ ‘আধুনিক’ দেশি-বিদেশি পর্নোগ্রাফিতেও মেয়েদের যৌনতা বর্ণনায় এই কৌশলই ব্যবহৃত হয় ৷ মেয়েরা নিজেদের যৌনতার কথা সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় বলতে চাইলেও, সেখানেও পুরুষের ব্যবহৃত ভাষাদর্শ প্রভাব ফেলে যায় ৷ আর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত এই লেখাগুলোর ভিতর মেয়েদের সেই গণতান্ত্রিক অধিকারবোধ আশাও করা যায় না ৷

ধর্ষণ হল সেই যৌনক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে একদিকে পুরুষের বিজয়দৃপ্ত চেহারাটি দৃঢ়মূল হয়, অন্যদিকে নারীশরীর ঢুকে পড়ে এক অদৃশ্য, অনিঃশেষ বিপন্নতার গহ্বরে ৷ ধর্ষণ সেই সন্ত্রাসের বাতাবরণ গড়ে দেয়, যেখানে পুরুষের আধিপত্য যে কোনো প্রশ্নচিহ্নের ঊর্ধ্বে উঠে যায় ৷ ‘সম্বাদ রসরাজ’-এও এরকম কয়েকটি ধর্ষণদৃশ্য বর্ণিত হয়েছে, বলাই বাহুল্য পুরুষ-পাঠককে তৃপ্তিদানের উদ্দেশ্যে ৷ কলকাতার কোনো এক সুবর্ণমল্লিক পরিবারে শ্বশুর নিয়মিত পুত্রবধূকে ধর্ষণ করেছে—এই খবর ছাপা হয়েছে ‘রসরাজ’-এর একাধিক সংখ্যায় (১৭ এপ্রিল ও ৪ মে ১৮৪৯) ৷ অন্য একটি সংখ্যায় গোন্দলপাড়ানিবাসী ব্রাহ্মণ গঙ্গানারায়ণ কর্তৃক নিজের স্ত্রীকে বলাৎকারের একটি অনুপুঙ্ক্ষ দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে ৷ এক্ষেত্রে মেয়েটি পতিসঙ্গে অনিচ্ছুক—‘কেবল তাহার আছে বড় এক দোষ ৷/করিতে চাহে না পতিসঙ্গে রতিরস ৷ ৷’ এর শাস্তিস্বরূপ একদিন:

অনেক কষ্টেতে গঙ্গা সাপুটিয়া ধরি ৷

শয্যার উপরে ফেলে চিৎপাত করি ৷ ৷

হস্তদ্বয় জানালাতে বান্ধিল কষিয়া ৷

পদদ্বয় কটিদেশে লইল তুলিয়া ৷ ৷

কত কাণ্ড করি গঙ্গা স্বকার্য্য সাধিছে ৷

মরি প্রাণ যায় বলি রমণী কাঁদিছে ৷ ৷৬০

—এই ধর্ষকামী বর্ণনা পাঠকমনের বাসনাকে কোথাও উসকে দিত, বলাই বাহুল্য ৷

একটি সংক্ষিপ্ত অনুমান পেশ করে এই লেখায় ইতি টানব ৷ মুদ্রণপুঁজির হঠাৎ বিস্ফোরণ উনিশ শতকের বটতলার আদিরসাত্মক বইপত্রের বিকাশে সাহায্য করেছিল—এ কথা সকলেই জানেন ৷ এমনকি কম-বেশি ইংরেজিশিক্ষিত যে বাঙালি সম্প্রদায় ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর যৌনতার টেক্সটগুলির লেখক এবং পাঠক, তাদের পাঠ অভ্যাস ও পাঠরুচি হয়তে অগোচরে আঠারো-উনিশ শতকীয় ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল—এমন ইঙ্গিতও এই লেখায় করা হয়েছে ৷ কিন্তু মেয়েদের যৌনতার যে উন্মুক্ত, বাধাবন্ধনহীন পরিসর ও অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে ‘রসরাজ’-এর বেশ কয়েকটি লেখায়, সেগুলির নেপথ্যে কোন ভাবনা কাজ করেছে? উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অন্যান্য লেখালেখিতে সমকালীন বাঙালি মেয়ের যে জীবন চিত্রিত হয়েছে, তা খুব একটা সম্মানজনক নয় ৷ সে যুগের প্রহসন ও আদিরসাত্মক বইপত্রে বাঙালি মেয়ের ব্যভিচারের ইঙ্গিত ও উল্লেখ আরো অনেক পাওয়া যায় ৷ কিন্তু যে প্রত্যক্ষ নিপুণতায় সেই যৌন আচরণের স্বাধীন, স্বতশ্চল চেহারাটি আঁকা হয়েছে ‘রসরাজ’-এ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে যৌনসঙ্গী বেছে নেওয়ার যে ছবি এখানে পাই, তার পিছনেও কি কোথাও ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফির সুদূর প্রভাব কাজ করেছিল? কারণ, ‘রসরাজ’-এর লেখাগুলোও এক ধরনের ‘রিপ্রেজেন্টেশন’, আর যে কোনো লিখনক্রিয়ারই এক নিজস্ব প্রক্রিয়া থাকে, যা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সমানুপাতে এগোয় না ৷ আঠারো শতকের ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফিক সাহিত্যে এক ধরনের স্বাধীন, যৌনকুশল, দক্ষ গণিকার টাইপ চরিত্র গড়ে উঠেছিল, যাকে ‘libertine whore’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে ৷ ১৭৫০ সালে প্রকাশিত Margot la ravandens থেকে শুরু করে আঠারো শতকের একেবারে শেষে প্রকাশিত মার্কুইস দ্য সাদ-এর History de Juliette অব্দি এই libertine whore-এর ছবি ইউরোপীয় পর্নোগ্রাফিতে বারবার ফুটে উঠেছে ৷ কামক্রীড়ায় সুনিপুণ, আধুনিক, মুক্তমনা এই বেশ্যার চরিত্র ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল ৷৬১ বাঙালি পুরুষের যৌন ফ্যান্টাসি কি কোথাও বিদেশি উপাদনকে দেশীয় পোশাকে হাজির করছিল? লক্ষণীয় ‘রসরাজ’-এর নারীচরিত্রেরা কেউই গণিকা নয়, গৃহবধূ ৷ কিন্তু এক্ষেত্রে যৌন পারঙ্গমতার বর্ণনাই মুখ্য, মেয়েটি পরিবারভুক্ত অথবা বারাঙ্গনা—তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ উল্টোদিকে পরিবারের মহিলার বেশ্যার সমান যৌননিপুণতা—পাঠকের কাছে আরো বেশি আকর্ষণীয়, কারণ এক্ষেত্রে ফ্যান্টাসির সীমানা সম্ভাব্য বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যায় অনেক দূর অব্দি ৷ উনিশ শতকের শেষার্ধে মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এক শেণির সস্তা, জনপ্রিয় প্রহসন ও গল্প-উপন্যাসে স্বাধীনচেতা, গৃহকর্মে বিমুখ, বহির্মুখী, নাটক-নভেল পড়া ‘আধুনিক’ মেয়ের আর্কেটাইপ তৈরি হয়, যারা স্বামীকে ভেড়া বানিয়ে রাখে, সুযোগ পেলেই ব্যভিচারিণী হয়, সংসারের ভালোমন্দের খেয়াল রাখে না ৷ কিন্তু এইসব প্রহসনে (যেমন : পাস করা মাগ, কলির বউ হাড়জ্বালানী, বউবাবু, মিস বিনো বিবি বি.এ., অবলাব্যারাক, কষ্টিপাথর, মডেল ভগিনী থেকে কেয়াবাৎ মেয়ে অব্দি অসংখ্য নাম করা যায়) মেয়েদের পরপুরুষসঙ্গ, মদ্যপান, ব্যভিচার—কোনোটাই ‘রসরাজ’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয়নি ৷৬২ ‘রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় মেয়েদের যৌনতা বর্ণিত হয়েছে নিছক যৌনতার উপভোগের দৃষ্টিকোণ থেকেই, তাদের সামাজিক ভূমিকা ও অবস্থান-সংক্রান্ত পরবর্তী উৎকণ্ঠার ছাপ এখানে ততোটা নেই ৷

‘সম্বাদ রসরাজ’-এর লেখাগুলির ওপর পাশ্চাত্য পর্নোগ্রাফির প্রভাবের আর একটি পরোক্ষ প্রমাণ দেওয়া যায় ৷ আঠারো শতকের শেষার্ধে ইউরোপে বেশ্যাদের সম্পর্কে এক ধরনের গাইডবুক ছাপা হত, যেখানে শহরের বিশিষ্ট গণিকালয়ের ঠিকানা, দেহপসারিণীদের নাম-বয়স ও অন্যান্য যৌনকুশলতার পরিচয়, তাদের বাঁধা রেট—সব কিছুর তালিকা দেওয়া থাকত ৷ এই বইগুলোর দেওয়া তালিকা হয়তো বহুলাংশেই বাস্তবের সঙ্গে হুবহু মিলত না, কিন্তু পুরুষের মনোরঞ্জনের উপকরণ হিসেবে এগুলির কাটতি ছিল খুবই ৷৬৩ অবিকল সেরকমভাবেই এক সদ্য যৌবনে পা-রাখা গণিকার বিস্তৃত পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর একটি সংখ্যায় ৷ ‘কথঞ্চিৎ দালালানাং’-এর পাঠানো চিঠিটি এরকম::

আমরা ধনী লোক সকলকে এক শুভসমাচার দিতেছি যাঁহারা বারবধুগণের রূপগুণ সন্ধান করিয়া বেড়ান তাঁহারা যদি টাকা ছাড়িতে পারেন তবে শৃঙ্গারবেশে প্রস্তুত হউন, এমত সুন্দরী কন্যা কেহ দেখে নাই, তাহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের যে স্থানে চক্ষু পড়ে সেই স্থানেই থাকে আর লড়িতে পারে না… ইহার বয়ঃক্রমে যেমন দশ বৎসর হইয়াছে অমনি ফল দেখিয়াছে, ইহার নাম মনোমোহিনী… আগামীকাল মনোমোহিনীর পুষ্পোৎসব, অপিচ নীলাম ডাকের ন্যায় ডাক হইবে, অধিক ডাকিয়া যিনি মনোমোহিনীকে পুষ্পবিবাহ করিতে পারিবেন, তিনিই কন্যারত্ন পাইবেন… মনোমোহিনী কোথায় থাকে তাহাও বলিতে হয় অতএব ঠিকঠাক বলিয়া দিতেছি, শোভাবাজার বটতলা থানার সংলগ্ন দক্ষিণ চুঁচুড়োর প্যারীর বাড়ি, রাজকুমারীর কন্যা, মনোমোহিনী অক্ষতযোনি ইহাতেই সকলে বুঝিতে পারিবেন…৬৪

দেহব্যবসার অন্দরমহলের হালহকিকতের এই বর্ণনা অনেকাংশে ইংরেজি-ফরাসি বেশ্যাগাইড বা almanac-এর সমতুল্য ৷ এভাবেই ‘সম্বাদ রসরাজ’-এর পৃষ্ঠায় বাঙালি যৌনটোপিয়ার এই উনিশ শতকীয় চেহারায় কি পরোক্ষভাবে হলেও ইউরোপীয় পর্নোটোপিয়ার সুদূরতম ছায়া পড়েছিল? বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তৃত অনুসন্ধান প্রয়োজন ৷

উল্লেখপঞ্জি

১. সম্বাদ রসরাজ, ৮ জুন ১৮৪৯ / ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৫৬

২. দ্র. বাংলা সাময়িকপত্র (প্রথম খণ্ড, ১৮১৮-১৮৬৭ খ্রি.) ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৬৪

৩. দ্র. বাংলা সাময়িকপত্র, পৃ. ৮৯

৪. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বড়ু চণ্ডীদাস, দানখণ্ড, ১৪২ নং পদ, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সম্পা, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ২৬০-২৬১

৫. পাশ্চাত্য সমাজের ধারাবাহিকতায় ‘যৌনতার বিজ্ঞান’ বা Scientia Sexualis-এর বিপরীতে প্রাচ্যের সমাজে ফুকো খুঁজে পেয়েছিলেন ‘কামের শিল্পকলা’ বা Ars Erotica, যেখানে, ফুকোর ভাষায় : “In the erotic art, truth is drawn from pleasure itself, understood as a practice and accumulated as experience ; pleasure is not considered in relation to an absolute law of the permitted and the forbidden, nor by reference to a criterion of utility, but first and foremost in relation to itself…” দ্র. History of Sexuality. Michel Foucault, Vol I, USA, 1978, p. 57, যদিও প্রাচ্যের সমাজে ফুকো-বর্ণিত কামের এহেন ‘first and foremost in relation to itself’ ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অনেকেই ৷ দ্র. Soul’d Out and in : Representation of body, no-body male, female etc. in the ‘Hindu’ Philosophy, Debaprasad Bandyopadhydy; Margins, February, 2002, p. 182-202

৬. এ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ আলোচনার জন্য দ্র. বর্তমান বইয়ের পূর্ববর্তী অধ্যায় ৷

৭. দ্র. Eros Revived : Erotica of the Enlightenment England and America, Peter Wagner, London, 1988, p. 6

৮. দ্র. Introcuction : Obscenity and the Origins of Modernity (1500-1800), Lynn Hunt; The Invention  of Pornography, New York p-13

৯. দ্র. পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, p. 34

১০. দ্র. পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, p-30

১১. La Philosophie dans le boudair, Marquis de Sade, উদ্ধৃত, On The Discourse of Pornography, Roger Paden; Philosophy & Social Criticism, Vol. 10 No. 1, 1984

১২. The Diary of Samuel Pepys, Samuel Pepys; উদ্ধৃত Lynn Hunt-এর পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, p-20

১৩. সম্বাদ রসরাজ, ২২ জুন ১৮৪৯/৯ আষাঢ় ১২৫৬

১৪. নববাবুবিলাস, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; ভবানীচরণ রসরচনাসমগ্র, কলকাতা ১৯৮৭, পৃ. ৪৪-৪৫

১৫. Erotic Fantasy and Male Libertinism in Enlightenment England, Randolph Trumboch, The Invention of Pornography, ed. Lynn Hunt, p-266

১৬. দ্র. একটি দেবীর রূপান্তর, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, সরস্বতীর ইতর সন্তান, কলকাতা, ২০০১ পৃ. ৩৬

১৭. সম্বাদ রসরাজ, ১৭ এপ্রিল ১৮৪৯ / ৬ বৈশাখ, ১২৫৬

১৮. সম্বাদ ভাস্কর, ১৮৪২; উদ্ধৃত, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা কাব্য, অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১০

১৯. ‘ডিসকোর্স’ বলতে ফুকো বোঝান : ‘practices that systematically form the objects of which we speak’; ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত কতকগুলি ‘rules of formations’-এর মধ্য দিয়ে ডিসকোর্স একটি স্বতঃস্ফূর্ত উক্তিকেও ‘grammatically welformed statement’-এ রূপান্তরিত করে, যা ফুকোর ভাষায় ‘non-discursive’ ক্রিয়াকলাপ ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে ‘discursive practice’-এ রূপান্তরিত করা ৷ ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম পর্যায়ে জনসমাজের ভিতর প্রচলিত যৌন আচরণ-অভ্যাস-অভিব্যক্তিগুলি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পৌঁছে পাশ্চাত্য জ্ঞান-যুক্তি-শৃঙ্খলা ও দেশীয় রক্ষণশীল বিধিনিষেধের মেলবন্ধনে প্রভাবিত হয়ে এক নতুন যৌনতার ডিসকোর্সের জন্ম দেয় ৷ আলোচ্য উদ্ধৃতিতে যৌন অভিব্যক্তির যে চেহারা প্রকাশিত হয়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তাকে আর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে না ৷ দ্র. The Archeology of knowledge; Michel Foucault, London, 1972, p.49

২০. উদ্ধৃত, Randolph Trumboch-এর পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, p-261

২১. কামিনী গোপন ও যামিনী যাপন, শ্রীনিমাইচাঁদ শীল কর্ত্তৃক প্রণীত, কলিকাতা, গরাণহাটার উত্তরাংশে পাঁচু দত্তের গলিতে ৯২ নং ভবনে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রাঙ্কিত, শকাব্দ ১৭৭৭, ইং সন ১৮৫৫, পৃ. ৩২-৩৩

২২. The Other Victorians; A Study of Sexuality and Pornography in Mid-Nineteenth Century England, Steven Macus, New York, 1974, p. 282

২৩. দ্র. The Discreet Charm of the Bhadraloks : an Excursion into Pornotopia, Shibaji Bandyopadhydy, JJCL-29, Kolkata 1991, p-82

২৪. সম্বাদ রসরাজ, ৫ জুন ১৮৪৯ / ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৫৬

২৫. সম্বাদ রসরাজ, ২৪ আগস্ট ১৮৪৯ /৯ ভাদ্র ১২৫৬

২৬. pleasure principle-এর সংজ্ঞা : “the tendency inherent in all natural impulses of ‘wishes’ to seek their own satisfaction independently of all other considerations: according to Freudian theory the principle ruling the individual at the start, and remaining always as the guiding principle in the unconcious”. দ্র. A Dictionary of Psychology, James Drever, 1952, p. 212

২৭. দ্র. Narrative and the Real World : an Argument of Continuity, David Car; Memory, Identity, Community, ed. Lewis P. Hinchman, Sandra K. Hinchman, New York, p. 7-25

২৮. দ্র. কলিকৌতুক, শ্রীশ্রী নারায়ণ চট্টরাজ গুণনিধি কর্ত্তক বিরচিত, শ্রীরামপুর ১৭৮০ শকাব্দ, ১৮৫৮ খ্রি.

২৯. ‘সম্বাদ তিমিরনাশক’ থেকে ‘সমাচার দর্পণ’-এ উদ্ধৃত, ২১ জানুয়ারি, ১৮৩২, দ্র. বাংলা সাময়িকপত্র (প্রথম খণ্ড), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা. কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৪০

৩০. Calcutta Courier, ১৪ নভেম্বর, ১৮৪০; উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১

৩১. দ্র. বটতলা, শ্রীপান্থ, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৪০

৩২. দ্র. solitary Sex : A Cultural History of Masturbation, Thomas W. Laqueur, New York, 2003; ১৭১২ সাল লাগাদ ইংল্যান্ডে জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখকের একটি বই ছাপা হয় : ‘Onania, or, the Henious Sin of Self Pollution…’ ৷ এই বইটি ‘আধুনিক’ হস্তমৈথুন সংক্রান্ত ধারণার জনক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে আজ ৷ পরবর্তী আড়াই শতকব্যাপী এই অভ্যাসটি ‘ব্যক্তি’-র ‘আত্ম’ (self) এবং ‘আত্মপরিচয়ের’ (identity) অন্যতম ধারক হিসেবে, সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা, অধিকার ও সীমালঙঘনের পরিমাপক হিসেবে কী ধরনের তীব্র নৈতিক উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে, তা বিশ্লেষণ করেছেন ল্যকার তাঁর পূর্বোক্ত বইটিতে ৷ ল্যকারের মতে পাশ্চাত্যসমাজে হস্তমৈথুনকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তিনটি কারণে ৷ প্রথমত, হস্তমৈথুন বাস্তবতাবর্জিত কাল্পনিক ফ্যান্টাসির কাছে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে ৷ দ্বিতীয়ত, এটি কোনো সুসামাজিক অভ্যাস নয়, বরং সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব গোপন অভ্যাস, যা কোনো না কোনোভাবে সামাজিক রীতিনীতির সুস্থিত চেহারাকে অস্বীকার করে ৷ তৃতীয়ত, এই অভ্যাসের চালিকাশক্তি হল এমন এক বাধাবন্ধনহীন সুখভোগের আকাঙক্ষা, যা অপরিমিত, যাকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিমাপ করা যায় না ৷ এ হল ‘boundless excesses of gratification’. তাই সামাজিক কর্তৃত্বের চোখে এ হল এক বিপজ্জনক ‘অসুখ’ ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের দেশীয় সমাজেও চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে হস্তমৈথুনের ডিসকোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়, তা প্রায় পুরোপুরি ইউরোপীয় যুক্তিকাঠামোকেই একমাত্রিকভাবে মেনে নিয়েছিল ৷ এই সময়ের প্রায় সবকটি বাংলা সেক্স ম্যানুয়ালেই হস্তমৈথুন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে ৷ দ্র. বৈজ্ঞানিক দাম্পত্য প্রণালী, সূর্যনারায়ণ ঘোষ ১৮৮৪; ধাতুদৌর্ব্বল্য, ক্ষেত্রমোহন ঘোষ ১৮৯৭ ৷ এ ছাড়াও ‘চিকিৎসাসম্মিলনী’, ‘স্বাস্থ্য’, ‘অনুসন্ধান’ প্রভৃতি পত্রিকায় এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে ৷

৩৩. সম্বাদ রসরাজ, ১ জুন ১৮৪৯/ ২০ জ্যৈষ্ঠ ১২৫৬

৩৪. বাৎসায়নের কামসূত্র, সম্পা. ত্রিদিবনাথ রায়, কলকাতা ১৮৯৬, পৃ. ২৯

৩৫.  প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যে পায়ুকাম, মুখমেহন, হস্তমৈথুন, যৌথ যৌনাচার প্রভৃতি বিষয় উৎকীর্ণ রয়েছে ভারতের অসংখ্য মন্দিরের দেয়ালে ৷ এ বিষয়ে বিস্তৃত ও সচিত্র আলোচনার জন্য দ্র. ভারতীয় ভাস্কর্যে মিথুন, নারায়ণ সান্যাল, কলকাতা, ২০০৬ পৃ. ১৮২-২২১

৩৬. ভারতীয় ঐতিহ্যে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নিয়ে দীর্ঘ অনবদ্য আলোচনার জন্য দ্র. Same Sex Love in India : Readings from Literature and History, Ed. Ruth Vanita and Salim Kidwai, New Delhi, 2001

৩৭. দ্র. বাৎসায়নের কামসূত্র, পূর্বোক্ত সংস্করণ, পৃ. ৪১৩-৪২৫; কামসূত্রে উল্লিখিত সমলৈঙ্গিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, বাৎসায়ন কর্তৃক ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের পৃথক পৃথক অর্থনির্দেশ প্রসঙ্গে দ্র. Same Sex love in India, পূর্বোক্ত p. 46-54

৩৮. বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্র. Randolph Trumboch-এর পূর্বোক্ত, প্রবন্ধ p. 254-259

৩৯. সম্বাদ রসরাজ, ১ জানুয়ারি ১৮৫০ / ১৮ পৌষ ১২৫৬

৪০. সম্বাদ রসরাজ, পূর্বোক্ত সংখ্যা

৪১. সম্বাদ রসরাজ, ফেব্রুয়ারি ১৮৫০ / ফাল্গুন ১২৫৬

৪২. সম্বাদ রসরাজ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৫০ / ৫ ফাল্গুন ১২৫৬

৪৩. সম্বাদ রসরাজ, ৫ জুন ১৮৪৯ / ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৫৬

৪৪. সম্বাদ রসরাজ, ২৭ জুলাই ১৮৪৯ / ১৩ শ্রাবণ ১২৫৬

৪৫. সম্বাদ রসরাজ, ২৪ জুলাই ১৮৪৯ / ১০ শ্রাবণ ১২৫৬

৪৬. সম্বাদ রসরাজ, ১৩ জুলাই ১৮৪৯ / ৩০ আষাঢ় ১২৫৬

৪৭. সম্বাদ রসরাজ, ২৭ জুলাই ১৮৪৯ / ১৩ শ্রাবণ ১২৫৬

৪৮. Introduction; Herculine Berbin; Being the Recently Discovered Memoirs of a Nineteenth Century French Hermaphrodite, Edited by Michel Foucault, New York, 1980, p. X-XI

৪৯. সম্বাদ রসরাজ, ২৪ আগস্ট ১৮৪৯ / ৯ ভাদ্র ১২৫৬; এই সংখ্যার একটি লেখায় কাল্পনিক সংলাপের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর গুপ্তকে বিদ্রুপের পাত্রে পরিণত করা হয়েছে ৷ এখানে ঈশ্বর গুপ্তের দুই সাকরেদ, একজন সেজেছে মণি গোঁসাই, অপরজন—বাসুদেব ৷ স্বয়ং ঈশ্বর গুপ্ত ধ্যানে বসেছেন ৷

৫০. নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতে উনিশ শতকের শেষার্ধে ‘‘পাশ্চাত্য প্রভাব আসিবার পর এই প্রাচীন হিন্দু ধারণাকে (অর্থাৎ সতীত্ব ও পাতিব্রত্য) পাশ্চাত্য প্রেমের অ্যান্টিথিসিস হিসাবে দাঁড় করানো হইয়াছিল ৷’’ দ্র. বাঙালি জীবনে রমণী; শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃ. ৭৭

৫১. উদ্ধৃত; পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৩

৫২. আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে উনিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত বাঙালি মনে নারীর এই ‘অন্ধকার শক্তি’-সংক্রান্ত ধারণা কীভাবে বিকশিত হয়েছিল, সে সম্পর্ক দীর্ঘ আলোচনার জন্য দ্র. Sati : A Nineteenth Century Tale of Woman, Violence and Protest; Ashis Nandy, At the Edge of Psychology, New Delhi, 1999, p. 7-11

৫৩. সম্বাদ রসরাজ, ৮ মে ১৮৪৯ / ২৭ বৈশাখ ১২৫৬

৫৪. সম্বাদ রসরাজ, ২৯ মে ১৮৪৯ / ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৫৬

৫৫. সম্বাদ রসরাজ, নভেম্বর ১৮৪৯ / অগ্রহায়ণ ১২৫৬

৫৬. সম্বাদ রসরাজ, ৬ জুলাই ১৮৪৯ / ২৩ আষাঢ় ১২৫৬

৫৭. কোনো কোনো নারীবাদী তাত্বিকের মতে হেটেরোসেক্সুয়ালিটির প্রাধান্যমূলক ধারণাটিই নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যকে সুনিশ্চিত করে ৷ বিপরীতে নারীর নিজের শরীরের পূর্ণাঙ্গ, মুক্ত অভিব্যক্তি একমাত্র ঘটে লেসবিয়ান সম্পর্কের ভিতরে, যেখানে পুরুষের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ ৷ পরবর্তীকালে এই ধারণাটি আরো বিকশিত হয়েছে ‘political lesbianism’ বা ‘lesbian continuum’ জাতীয় বৃহত্তর মতবাদকে কেন্দ্র করে ৷ এক্ষেত্রে লেসবিয়ান দর্শন কেবল দুটি নারীর শারীরিক সম্পর্কের ভিতর আবদ্ধ না থেকে মেয়েদের জীবনের বৃহত্তর সংগ্রামকে নিজের ভিতরে জায়গা দেয় এবং একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক দর্শনের চেহারা লাভ করে ৷ দ্র. Feminism, Jane Freedman, New Delhi, 2002, p. 60-63

৫৮. সম্বাদ রসরাজ, ২৪ আগস্ট ১৮৪৯ / ৯ ভাদ্র ১২৫৬

৫৯. দ্র. Feminism, Marxism, Method and the State : an Agenda for Theory, C. Mackinon, Signs 7(3), p. 533

৬০. সম্বাদ রসরাজ, ২০ এপ্রিল ১৮৪৯ / ৯ বৈশাখ ১২৫৬

৬১. বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্র. The Libertine Whore : Prostitution in French Pornography from Margot to Juliette, Kathryn Norberg; The Invention of Pornography, ed Lynn Hunt, ক্যাথরিন Libertine Whore-এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে : This whore is independent, sensual, sensible and skilled. She is healthy and possessed of a very healthy—that is, normal—sexual apetite. She is a businesswoman and an artist who provides ‘varied’ sex for men who can afford it, She is a courtesan who lives in luxury and abides by ‘philosophy’, usually materialist philosophy.(p. 227); ‘রসরাজ’-এর গৃহবধূদের সঙ্গে এই স্বাধীনচেতা গণিকার প্রত্যক্ষ মিল খোঁজা অবান্তর ৷ কেবল যৌনতার তীব্র বাসনাপূরণের ইচ্ছেটুকুর সঙ্গে এর একটি পরোক্ষ সংযোগসূত্রই খুঁজতে চেয়েছি মাত্র ৷

৬২. দ্র. কেয়াবাৎ মেয়ে, শ্রীপান্থ, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ১১-৩৪

৬৩. এ ধরনের গাউডবুকের দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন ক্যাথরিন, তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে ৷

৬৪. সম্বাদ রসরাজ, ৩০ নভেম্বর ১৮৪৯ / ১৬ অগ্রহায়ণ, ১২৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *