৭. মহাবিশ্বের মর্মার্থের খোঁজে

. মহাবিশ্বের মর্মার্থের খোঁজে 

চারটি মৌলিক বলের রহস্য কীভাবে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করেছে, তা দেখেছি আমরা। শুধু তা-ই নয়, চারটি বল কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের জন্ম দিয়ে সভ্যতার গন্তব্য বদলে দিয়েছে, তা-ও দেখেছি। নিউটন গতি ও মহাকর্ষের সূত্রগুলো লেখার পর শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। আবার বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় বলের একতা আবিষ্কার করেন ফ্যারাডে আর ম্যাক্সওয়েল। এভাবে তাঁরা বৈদ্যুতিক বিপ্লবের জন্ম দেন। আইনস্টাইন এবং কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা যখন বাস্তবতার সম্ভাব্যতা ও আপেক্ষিক প্রকৃতি উদ্ঘাটন করলেন, তখন সেটাই গতিশীল করেছিল আজকের উচ্চ প্রযুক্তি বিপ্লবকে। 

কিন্তু আমরা হয়তো এমন কোনো থিওরি অব এভরিথিংয়ের মুখোমুখি হতে পারি, যেটা চারটি মৌলিক বলের সব কটিকে একত্র করবে। তাহলে এই মুহূর্তের জন্য অনুমান করা যাক, আমরা শেষ পর্যন্ত এ তত্ত্বটা অর্জন করতে পেরেছি। ধরে নেওয়া যাক, সেটাকে কঠিন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তা স্বীকৃতিও দিয়েছেন। তাহলে তত্ত্বটা আমাদের জীবন, চিন্তাচেতনা এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার ওপর কী প্রভাব ফেলবে? 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর সরাসরি প্রভাব হবে সম্ভবত ন্যূনতম। থিওরি অব এভরিথিংয়ের প্রতিটি সমাধান গোটা একটা মহাবিশ্ব। তাই তত্ত্বটির সঙ্গে যে শক্তিটি সম্পর্কিত হবে, তা প্ল্যাঙ্ক শক্তি। এই শক্তির পরিমাণ লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে উৎপন্ন শক্তির তুলনায় কোয়াড্রিলন (বা ১০১৫) গুণ বেশি। থিওরি অব এভরিথিংয়ের শক্তির পরিসর মহাবিশ্বের জন্ম ও কৃষ্ণগহ্বরের রহস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর সঙ্গে আপনার কিংবা আমার কোনো সম্পর্ক নেই। 

এ তত্ত্বের সত্যিকার প্রভাবটা হবে সম্ভবত দর্শনগত। কারণ, তত্ত্বটি হয়তো শেষ পর্যন্ত গভীর দার্শনিক প্রশ্নের জবাব জোগাবে, যে প্রশ্নগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুগে যুগে মহান চিন্তাবিদদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেমন টাইম ট্রাভেল সম্ভব কি না, সৃষ্টির আগে কী ঘটেছিল এবং মহাবিশ্ব এল কোথা থেকে? 

১৮৬৩ সালে বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী টমাস এইচ হাক্সলি বলেছিলেন, ‘মানবতার জন্য সব প্রশ্নের মধ্যে বড় প্রশ্নটি হলো সেটাই, যেটা প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করে। সমস্যাটি অন্য সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এবং সেটা এদের সব কটির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।’ 

কিন্তু এতে একটি প্রশ্ন এখনো বাকি রয়েছে, মহাবিশ্বের অর্থ সম্পর্কে থিওরি অব এভরিথিংয়ের কী বলার আছে? 

আইনস্টাইনের সেক্রেটারি হেলেন ডুকাস উল্লেখ করেছেন, একটা চিঠি পেয়ে অভিভূত হন আইনস্টাইন। চিঠিতে তাঁর কাছে জীবনের অর্থ ব্যাখ্যার অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি না, তা- ও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাতে। জবাবে আইনস্টাইন বললেন, মহাবিশ্বের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি অক্ষম। 

বর্তমানে মহাবিশ্বের অর্থ এবং সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্ন এখনো সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে। আইনস্টাইনের মৃত্যুর কিছু আগে তাঁকে লেখা একটা ব্যক্তিগত চিঠি নিলামে তোলা হয় ২০১৮ সালে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ওই নিলামে বিজয়ী পক্ষের দর ছিল ২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেটা ছিল নিলামকারীদের প্রত্যাশার বাইরে। 

এটাসহ অন্যান্য চিঠিতে জীবনের অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হতাশ ছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু ঈশ্বর-সম্পর্কিত তাঁর চিন্তাভাবনা বেশ স্পষ্ট ছিল। তিনি লিখেছেন, এখানে একটা সমস্যা হলো, আসলে দুই ধরনের ঈশ্বর রয়েছেন। প্রায়ই আমরা এ দুটোকে গুলিয়ে ফেলি। প্রথমত, ব্যক্তিগত ঈশ্বর। যে ঈশ্বরের কাছে আপনি প্রার্থনা করেন, যে ঈশ্বর বাইবেলের, তিনি বর্বরদের আঘাত করেন এবং বিশ্বাসীদের পুরস্কৃত করেন। এই ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল না আইনস্টাইনের। যে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করছেন এবং নশ্বরদের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেন, সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না তিনি।

তবে স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন আইনস্টাইন। অর্থাৎ মহাবিশ্বে শৃঙ্খলার ঈশ্বর, যিনি সুন্দর, সরল ও অভিজাত। মহাবিশ্ব কুৎসিত, এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল হতে পারত। কিন্তু তার বদলে এর মধ্যে গোপন শৃঙ্খলা আছে, যা রহস্যময় বটে, তবে গভীর। 

একে তুলনা করতে আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, তিনি অনুভব করেন একটা শিশু হিসেবে বিশাল একটা লাইব্রেরিতে ঢুকছেন তিনি। তাঁর চারপাশে সারি সারি বইয়ের স্তূপ। সেগুলোর মধ্যে মহাবিশ্বের রহস্যগুলোর উত্তর রয়েছে। তাঁর জীবনের লক্ষ্য, এসব বইয়ের অন্তত কয়েকটা অধ্যায় পড়তে পারা। 

তবে তিনি একটা প্রশ্নের উত্তর দেননি : মহাবিশ্ব বিপুল আয়তনের কোনো লাইব্রেরি হলে সেখানে কি কোনো লাইব্রেরিয়ান আছেন? কিংবা এসব বইয়ের কি কোনো লেখক আছেন? মোদ্দা কথায়, সব কটি ভৌত সূত্র যদি থিওরি অব এভরিথিং দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, তাহলে এই সমীকরণটি এল কোথা থেকে? আইনস্টাইন আরেকটি প্রশ্ন দিয়ে তাড়িত হতেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কি বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল? 

ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ 

তবে যুক্তি ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার চেষ্টা করা হলে, এসব প্রশ্ন আর এতটা স্পষ্ট থাকে না। যেমন হকিং ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না। তিনি লিখেছেন, মহাবিস্ফোরণ সংঘটিত হয়েছিল সময়ের অতিসংক্ষিপ্ত কালে। কাজেই আমরা যে মহাবিশ্ব দেখছি, সেটি সৃষ্টি করার জন্য ঈশ্বরের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল না। 

আইনস্টাইনের মূল তত্ত্বে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রসারিত হয়েছিল এই মহাবিশ্ব। কিন্তু মাল্টিভার্স তত্ত্বে, আমাদের মহাবিশ্ব হলো অন্যান্য বুদ মহাবিশ্বের সঙ্গে সহাবস্থান করা এক বুদ্বুদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ রকম বুদ মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে। 

তাই যদি হয়, তাহলে সময় বা কাল আসলে মহাবিস্ফোরণের সঙ্গে লাফ দিয়ে হুট করে অস্তিত্বে আসেনি, বরং আমাদের এই মহাবিশ্ব শুরুর আগেই সময়ের অস্তিত্ব ছিল। প্রতিটি মহাবিশ্বই তাৎক্ষণিকভাবে অতিসংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে জন্মেছে, কিন্তু মাল্টিভার্সের মধ্যে মহাবিশ্বের সামগ্রিকতা চিরন্তন হতে পারে। কাজেই ঈশ্বর-সম্পর্কিত প্রশ্নটি উন্মুক্ত রেখে দেয় থিওরি অব এভরিথিং। 

তবে কয়েক শতাব্দী ধরে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিতে চেষ্টা করেছেন ধর্মতাত্ত্বিকেরা। যুক্তি ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তাঁরা। ঈশ্বরের অস্তিত্বের পাঁচটি বিখ্যাত প্রমাণ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ১৩ শতকের বিশিষ্ট ক্যাথিলিক ধর্মতাত্ত্বিক সেন্ট থমাস অ্যাকুইনো। সেগুলো বেশ আকর্ষণীয়। কারণ, আজকের দিনেও থিওরি অব এভরিথিং সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন তোলে সেগুলো। 

এর মধ্যে তিনটি অনাবশ্যক। তাই এখানে আসলে তিনটি স্বাধীন প্রমাণ রয়েছে (আমরা যদি সেন্ট অ্যানসেলমের অন্টোলজিক্যাল প্রমাণটাও এর সঙ্গে যুক্ত করি)– 

১. মহাজাগতিক প্রমাণ: বস্তু চলাফেরা করে, কারণ তাদের ধাক্কা দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনো কিছু বা কোনো চালক তাদের গতিতে এনে দেয়। কিন্তু প্রথম চালক বা প্রথম কারণ কী. যেটা মহাবিশ্বকে গতি দিয়েছে? তিনি অবশ্যই ঈশ্বর। 

২. পরম কারণবাদী প্রমাণ : আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখি, সেগুলো অতি জটিলতা ও সূক্ষ্মতায় পরিপূর্ণ। কিন্তু প্রতিটি ডিজাইনের জন্য শেষ পর্যন্ত একজন ডিজাইনারের দরকার। এখানে প্রথম ডিজাইনার হলেন ঈশ্বর। 

৩. অন্টোলজিক্যাল প্রমাণ : সংজ্ঞা অনুসারে, ঈশ্বর হলেন কল্পনাযোগ্য সবচেয়ে নিখুঁত সত্তা। কিন্তু কেউ এমন একজন ঈশ্বরেরও কল্পনা করতে পারে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ঈশ্বরের যদি অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে তিনি নিখুঁত হতে পারেন না। কাজেই তার অবশ্যই অস্তিত্ব আছে। 

ঈশ্বরের অস্তিত্বের এসব প্রমাণ অনেক শতাব্দী ধরে টিকে আছে। উনিশ শতকে ইমানুয়েল কান্টের আগপর্যন্ত অন্টোলজিক্যাল প্রমাণে কেউ কোনো ত্রুটি খুঁজে পাননি। কারণ পরিপূর্ণতা ও অস্তিত্ব দুটো আলাদা বিষয়। নিখুঁত বা পরিপূর্ণতার জন্য কোনো কিছুর উপস্থিতি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। 

তবে অন্য দুটি প্রমাণ আধুনিক বিজ্ঞান এবং থিওরি অব এভরিথিংয়ের আলোকে নতুন করে পরীক্ষা করতে হবে। পরম কারণবাদী প্রমাণটা বেশ সোজাসাপ্টা। আমাদের চারপাশের যেদিকেই তাকাই, অতি জটিলতা চোখে পড়ে সেখানেই। কিন্তু আমাদের চারপাশের জীবন-রূপের সূক্ষ্মতাকে ব্যাখ্যা করা যায় বিবর্তনের মাধ্যমে। পর্যাপ্ত সময়ে বিশুদ্ধ সম্ভাবনা যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতনের মাধ্যমে বিবর্তন চালিত হতে পারে। কাজেই কম সূক্ষ্ম ডিজাইন থেকে আরও বেশি সূক্ষ্ম ডিজাইন উঠে আসে এলোমেলো বা দৈবচয়ন ভিত্তিতে এখানে প্রাণের প্রথম ডিজাইনারের প্রয়োজন হয় না। 

বিপরীতে মহাজাগতিক প্রমাণটি ততটা স্পষ্ট নয়। পদার্থবিদেরা বর্তমানে ভিডিও টেপ পেছন দিকে চালাতে পারেন। এভাবে তাঁরা দেখাতে পারেন যে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল একটা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। সেটাই মহাবিশ্বকে গতিশীল করেছে। তবে মহাবিস্ফোরণের আরও আগের সময়ে ফিরে যেতে চাইলে, আমাদের অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব তত্ত্ব। কিন্তু যদি ধরে নিই যে মহাবিস্ফোরণ কোথা থেকে এল, তা মাল্টিভার্স তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, তাহলে প্রশ্ন আসে, মাল্টিভার্স কোথা থেকে এল? শেষ পর্যন্ত কেউ যদি বলেও থাকে যে মাল্টিভার্স হলো থিওরি অব এভরিথিংয়ের একটা যৌক্তিক পরিণতি, তারপরও আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে হবে, এই থিওরি অব এভরিথিংটা এল কোথা থেকে? 

ঠিক এই জায়গায় এসে পদার্থবিজ্ঞান থেমে যায়। এরপর শুরু হয় মেটাফিজিকস বা অধিবিদ্যা। পদার্থবিজ্ঞানের নিজের সূত্র বা আইনগুলো কোথা থেকে এসেছে, সে ব্যাপারে কিছুই বলে না পদার্থবিজ্ঞান। কাজেই প্রথম চালক বা প্রথম কারণ সম্পর্কিত সেন্ট থমাস অ্যাকুইনোর মহাজাগতিক প্রমাণটা আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। 

যেকোনো থিওরি অব এভরিথিংয়ের মূল বৈশিষ্ট্য হতে পারে তার প্রতিসাম্য। কিন্তু এই প্রতিসাম্য এল কোথা থেকে? এই প্রতিসাম্য হতে পারে গভীর কোনো গাণিতিক সত্যের উপজাত। কিন্তু গণিতগুলো কোথা থেকে এসেছে? এই প্রশ্নের জবাবে থিওরি অব এভরিথিং বরাবরের মতো আবারও নীরব। 

তাই জীবন ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও প্রায় আট শ বছর আগে এক ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিকের তোলা প্রশ্নগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। 

আমার দৃষ্টিভঙ্গি 

মহাবিশ্ব অসাধারণ সুন্দর, শৃঙ্খলাসমৃদ্ধ ও সরল জায়গা। ভৌত মহাবিশ্বের জানা সূত্রগুলো মাত্র এক টুকরা কাগজে সংক্ষিপ্ত করা সম্ভব। সেটা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। 

এই কাগজটিতে রয়েছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র। স্ট্যান্ডার্ড মডেল বেশ জটিল, যা কাগজটির বেশির ভাগ জায়গা দখল করে অতিপারমাণবিক কণাদের চিড়িয়াখানা দিয়ে। আমাদের জানা মহাবিশ্বের সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে তারা। প্রোটনের গহিন অভ্যন্তর থেকে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের একেবারে সীমানা পর্যন্ত সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে। 

এবার কাগজের টুকরাটাকে চরম সংক্ষিপ্ত করা হলে, একটা সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। সেটা হলো এর সবকিছু আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এর অভিজাত ডিজাইন একজন মহাজাগতিক ডিজাইনারের হস্তক্ষেপের প্রমাণ দেয়। আমার কাছে এটাই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি। 

বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, সেটা বিজ্ঞান। এর ভিত্তি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষাযোগ্য, পুনরুৎপাদনযোগ্য, মিথ্যা প্রমাণযোগ্য বিষয়। এটাই হলো সারকথা। সাহিত্য সমালোচনার মতো শাখাগুলোর বিষয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল হয়। জেমস জয়েস আসলেই এই রচনাংশে বা ওই রচনাংশে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা ভেবে বিশ্লেষকেরা বিস্মিত হন চিরকাল। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের যাত্রা ঠিক উল্টো দিকে। তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও সহজ ও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যতক্ষণ না সবকিছু একগুচ্ছ সমীকরণে পরিণতি হয়। এতে আমি তাৎপর্য খুঁজে পাই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা প্রায় স্বীকার করতে নারাজ যে বিজ্ঞানজগতের বাইরেও কিছু বিষয় আছে। 

যেমন কোনো কিছু ঋণাত্মক বা নেতিবাচক প্রমাণ করা অসম্ভব। ধরা যাক, ইউনিকর্নের যে অস্তিত্ব নেই, আমরা সেটা প্রমাণ করতে চাই। আমরা বেশির ভাগ ভূপৃষ্ঠ চষে ফেললেও কোনো ইউনিকর্ন খুঁজে পাব না। কিন্তু কোনো অনাবিষ্কৃত দ্বীপ বা গুহায় ইউনিকর্নের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যায়। কাজেই ইউনিকর্নের যে অস্তিত্ব নেই, সে কথা প্রমাণ করা অসম্ভব। তার মানে, আজ থেকে এক শ বছর পরেও মানুষ হয়তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং মহাবিশ্বের অর্থ নিয়ে বিতর্ক করবে। এর কারণ এসব ধারণা পরীক্ষা করে দেখা যায় না। কাজেই এ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তেও আসা যায় না। এটা সাধারণ বিজ্ঞানজগতের বাইরের এলাকা। 

একইভাবে আমরা যদি বাইরের মহাকাশ যাত্রায় কখনো ঈশ্বরের দেখা না-ও পাই, তারপরও যেসব জায়গায় আমরা অনুসন্ধান চালাতে পারিনি, সেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা সব সময় থাকে। 

সে কারণেই আমি অজ্ঞেয়বাদী (Agnostic)। আমরা মহাবিশ্বের উপরিতলে আঁচড় কেটে চলেছি এবং গোটা মহাবিশ্বের প্রকৃতি আমাদের যন্ত্রপাতির নাগালের বাইরে। কাজেই এ সম্পর্কে বিবৃতি দেওয়া একধরনের ধৃষ্টতা। 

কিন্তু তারপরও সেন্ট থমাস অ্যাকুইনোর দেওয়া প্রমাণের মোকাবিলা করতেই হবে। তিনি যেমন বলেছেন, অবশ্যই একজন প্রথম চালক আছেন। মোদ্দা কথায়, সবকিছু কোথা থেকে এল? মহাবিশ্ব যদি থিওরি অব এভরিথিং অনুযায়ী শুরুও হয়ে থাকে, তাহলে থিওরি অব এভরিথিং কোথা থেকে এসেছে? 

আমার বিশ্বাস, থিওরি অব এভরিথিং আছে, কারণ এটাই একমাত্র তত্ত্ব, যা গাণিতিকভাবে মানানসই। অন্য তত্ত্বগুলো সহজাতভাবে ত্রুটিযুক্ত ও বেমানান। আমার বিশ্বাস, যদি কোনো বিকল্প তত্ত্ব দিয়ে শুরু করা হয়, তাহলে প্রমাণ করা সম্ভব যে ২ + ২ = ৫। তার মানে, এই বিকল্প তত্ত্বগুলো তাদের নিজেদের সঙ্গেই বিরোধিতা করে। 

মনে করা যাক, কোনো থিওরি অব এভরিথিংয়ের সামনে প্রবল তুষারঝড়ের বাধা রয়েছে। এই তত্ত্বে আমরা কোয়ান্টাম সংশোধনী যোগ করলে দেখতে পাব, তত্ত্বটি সাধারণত ভেঙে যায়। এতে তখন অসীম বিচ্যুতি দেখা যায় কিংবা অস্বাভাবিকতার করণে আদি প্রতিসাম্যের বিনাশ ঘটে। আমার বিশ্বাস, হয়তো এসব সীমাবদ্ধতার এমন কোনো সমাধান রয়েছে, যা অন্যান্য সব সম্ভাবনা বাতিল করে তত্ত্বটিকে সংশোধন করতে পারে। আমাদের মহাবিশ্ব ১৫ মাত্রায় থাকতে পারে না, কারণ এ রকম কোনো মহাবিশ্ব এসব মারাত্মক ত্রুটিতে ভুগবে। (দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরিতে আমরা যখন কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনা করি, তখন তাতে প্রায় একটি পদ (D10) থাকতে দেখা যায়। এখানে D হলো স্থান-কালের মাত্রিকতা। স্পষ্টতই আমরা যখন D = 10 সেট করি, তখন এই উদ্বেগজনক অস্বাভাবিকতা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যদি D = 10 সেট না করি, তাহলে আমরা এমন একটা বিকল্প মহাবিশ্ব পাই, যেটা স্ববিরোধিতায় ভরা এবং সেখানে গাণিতিক যুক্তি লঙ্ঘিত হয়। একইভাবে মেমব্রেনে যোগ করে এম-থিওরিতে গণনা করা হলে, অনাকাঙ্ক্ষিত পদ পাওয়া যায়, যাতে একটি ফ্যাক্টর (D11) থাকে। কাজেই স্ট্রিং থিওরির ভেতর একটামাত্রা স্বনির্ভর মহাবিশ্ব রয়েছে, যেখানে ২ + ২=৪ এবং সেটা দশ বা এগারো মাত্রার মধ্যে।) 

এটিই তখন আইনস্টাইনের তোলা এক প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব দেয়। থিওরি অব এভরিথিং অনুসন্ধানকালে প্রশ্নটি তোলেন তিনি, মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনো পছন্দ বা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল? মহাবিশ্ব কি অনন্য, নাকি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য অনেক রকম উপায় আছে? 

আমার চিন্তা সঠিক হলে সেখানে কোনো পছন্দের বা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। এখানে একটামাত্র সমীকরণ আছে, যা এই মহাবিশ্বকে বর্ণনা করে। কারণ অন্যগুলো গাণিতিকভাবে বেমানান। কাজেই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত সমীকরণটি হবে অনন্য। এই মাস্টার সমীকরণটির অসীমসংখ্যক সমাধান থাকতে পারে, যা আমাদের ল্যান্ডস্কেপ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে, কিন্তু খোদ সমীকরণটা হবে অনন্য। 

এটিই আরেকটা প্রশ্নে আলোকপাত করে, কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে কেন? 

কোয়ান্টাম তত্ত্বে ‘পরমভাবে কিছুই নেই’ বলে কিছু নেই। আমরা দেখেছি, পরম কৃষ্ণত্ব বলে কিছু নেই। কাজেই কৃষ্ণগহ্বর আসলে ধূসর এবং অবশ্যই বাষ্পীভূত হয়। একইভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সমাধানের সময় দেখা যায়, সর্বনিম্ন শক্তি শূন্য নয়। যেমন আপনি কখনো পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছাতে পারবেন না। কারণ, পরমাণুগুলো তাদের সর্বনিম্ন শক্তিস্তরেও কম্পিত হয়। (একইভাবে কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে, শূন্য শক্তিতে কোয়ান্টাম মেকানিক্যালি পৌঁছানো সম্ভব নয়। কারণ তখনো শূন্য বিন্দুর শক্তি থেকেই যায়। এর মানে হলো সর্বনিম্ন কোয়ান্টাম কম্পন। শূন্য কম্পন অবস্থা অনিশ্চয়তার নীতি মানে না। কারণ, শূন্য শক্তি হলো শূন্য অনিশ্চয়তার অবস্থা, যা অনুমোদিত নয়।) 

তাহলে মহাবিস্ফোরণ কোথা থেকে এসেছে? খুব সম্ভবত সেটা শূন্যতার কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা কোয়ান্টাম ওঠানামা। এমনকি শূন্যতা বা চরম ভ্যাকুয়ামও বস্তু ও প্রতিবস্তু কণায় ভরে আছে, যারা অনবরত শূন্য থেকে লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। তারপর পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আবারও শূন্যস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এভাবেই শূন্যতা থেকে কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। 

আমরা দেখেছি, হকিং একে স্থান-কালের ফেনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। সোজা কথায়, অতিক্ষুদ্র বুদ্বুদ মহাবিশ্বগুলো বুদ্বুদের মতো অনবরত বেরিয়ে আসছে এবং আবারও শূন্যস্থানের ভেতর ফিরে যাচ্ছে। আমরা কখনোই স্থান-কালের ফেনা দেখতে পাই না। কারণ প্রতিটি বুদ্বুদ যেকোনো পরমাণুর চেয়ে অনেক অনেক ছোট। কিন্তু কোনো একবার এসব বুদের একটা আর শূন্যস্থানে ফিরে না গিয়ে প্রসারিত হতে শুরু করে। সেটাই স্ফীত হয়ে একটা গোটা মহাবিশ্ব তৈরি করে। 

তাহলে কোনো কিছু না থাকার বদলে কেন কিছু আছে? কারণ আমাদের মহাবিশ্ব মূলত শূন্যতার কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা কোয়ান্টাম ওঠানামা থেকে এসেছে। অন্যান্য অসংখ্য বুদ্বুদের বিপরীতে আমাদের মহাবিশ্ব স্থান-কালের ফেনা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে। 

এই মহাবিশ্বের কি কোনো শুরু ছিল নাকি ছিল না

এই থিওরি অব এভরিথিং কি আমাদের জীবনের অর্থ দেবে? বেশ কয়েক বছর আগে একটা মেডিটেশন সোসাইটির অদ্ভুত এক পোস্টার দেখেছিলাম। সেটা দেখে আমি চিনতে পারলাম, ওতে সুপারগ্র্যাভিটির সমীকরণগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। সমীকরণগুলোর গাণিতিক গরিমাও পুরোপুরি রয়েছে তাতে। তবে সমীকরণের প্রতিটি পদের ওপর একটা তিরচিহ্ন টানা। সেগুলোতে বলা হয়েছে, ‘শান্তি’, ‘প্রশান্তি’, ‘ঐক্য’, ‘প্ৰেম’ ইত্যাদি। 

মোদ্দা কথায়, থিওরি অব এভরিথিং সমীকরণে জীবনের অর্থ খোদাই করা হয়েছে। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সমীকরণের বিশুদ্ধ গাণিতিক পদকে ভালোবাসা বা সুখের সমীকরণের সমকক্ষ রূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 

আমি বিশ্বাস করি, থিওরি অব এভরিথিং হয়তো মহাবিশ্বের মর্মার্থ সম্পর্কে কিছু না কিছু বলবে। ছোটবেলায় এক খ্রিষ্টান প্রেজবিটেরিয়ান হিসেবে বেড়ে উঠেছিলাম আমি। কিন্তু আমার বাবা-মা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে এই মহান দুটি ধর্মের অবস্থান একেবারেই বিপরীত মেরুতে। খ্রিষ্টান গির্জার মতে, সময়ের এমন একটা মুহূর্ত ছিল, যখন ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেন। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বা বিগ ব্যাং থিওরির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিক ও পদার্থবিদ জর্জেস লেমাইতার। তিনি বিশ্বাস করতেন, জেনেসিস বা সৃষ্টির উপাখ্যানের সঙ্গে আইনস্টাইনের তত্ত্ব বেশ মানানসই। 

তবে বৌদ্ধধর্মে কোনো ঈশ্বর নেই। মহাবিশ্বের কোনো শুরু বা শেষ নেই। শুধু আছে চিরন্তন নির্বাণ। 

তাহলে পুরোপুরি বিপরীত এই দৃষ্টিভঙ্গি দুটির সমাধান কীভাবে সম্ভব? মহাবিশ্বের হয় একটা শুরু আছে, নয়তো নেই। মাঝামাঝি কিছু থাকতে পারে না। 

কিন্তু আসলে মাল্টিভার্স তত্ত্ব এই বৈপরীত্য দেখার একেবারে নতুন একটা উপায় বাতলে দেয়। হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। যেমনটা বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বগুলোর বুদ্বুদ তৈরি হওয়ার কারণে মহাবিস্ফোরণ হয়তো সব সময়ই ঘটছে। মহাবিশ্ব হয়তো আরও বড় কোনো এলাকায় প্রসারিত হয়ে চলেছে, সেটা হয়তো হাইপারস্পেসের নির্বাণ। কাজেই আমাদের মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল এবং সেটা ত্রিমাত্রিক বুদ্বুদ, যা এগারো মাত্রিক নির্বাণের আরও বড় কোনো স্থানে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখানে অন্যান্য মহাবিশ্বও অনবরত সৃষ্টি হচ্ছে। 

কাজেই মাল্টিভার্সের ধারণা খ্রিষ্টধর্মের সৃষ্টি পুরাণের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের নির্বাণকে সমন্বয়ের সুযোগ দেয়। এভাবে যে একটামাত্র তত্ত্ব পাওয়া যায়, সেটি আমাদের জানা ভৌত সূত্রগুলোর সঙ্গে মানানসই। 

সসীম মহাবিশ্বের অর্থ 

শেষ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করি, আমরাই মহাবিশ্বে নিজেদের নিজস্ব অর্থ তৈরি করি। 

মহাবিশ্বের অর্থ সঙ্গে করে পাহাড়চূড়া থেকে কয়েকজন গুরুর নিচে নেমে আসা খুবই সরল ও সহজ। জীবনের অর্থ এমন কিছু, যা বুঝতে ও মূল্যায়ন করতে আমাদের সংগ্রাম করতেই হবে। সেটা আমাদের হাতে পাওয়া মানে, সব অর্থের উদ্দেশ্যের পরাজয়। জীবনের অর্থ যদি বিনা মূল্যে পাওয়া সহজলভ্য হয়ে যেত, তাহলে সেটা তার অর্থ হারিয়ে ফেলবে। যেসব কিছুর অর্থ আছে, সেগুলো আসলে সংগ্রাম আর ত্যাগের ফল এবং এর জন্য লড়াই করা মূল্যবান। 

খোদ মহাবিশ্বই শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও মহাবিশ্বের কোনো অর্থ আছে, সেই যুক্তি মানা কঠিন। কিছু অর্থে পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যেই রয়েছে মহাবিশ্বের জন্য একটা নির্মম মৃত্যু পরোয়ানা। 

মহাবিশ্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাণ্ডিত্যপূর্ণ সব ধরনের আলোচনা সত্ত্বেও হয়তো সেগুলো অর্থহীন। কারণ, মহাবিশ্ব একটা বিগ ফ্রিজের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। থার্মোডায়নামিকস বা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রমতে, আবদ্ধ সিস্টেমের মধ্যে সবকিছুই ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাবে ও মরিচা পড়বে বা ভেঙে পড়বে। বস্তুর প্রাকৃতির শৃঙ্খলা ক্রমেই কমে যায় এবং সবশেষে তার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। মহাবিশ্ব নিজেই যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন অনিবার্যভাবে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে হয়। কাজেই মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা নিজেরা যে অর্থই দাঁড় করাই না কেন, মহাবিশ্ব যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন সেই অর্থও একসময় চিরতরে মুছে যাবে। 

তবে আরও একবার বলতে চাই, হয়তো কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে আপেক্ষিকতার একত্রকরণের একটা উপায় পাওয়া যাবে। আমরা বলেছি যে তাপগতিবিদ্যা ক্রমান্বয়ে একটা আবদ্ধ সিস্টেমকে অবধারিতভাবে একটা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এখানে মূল শব্দটা হলো আবদ্ধ সিস্টেম। কিন্তু একটা উন্মুক্ত মহাবিশ্বে, যেখানে বাইরে থেকে শক্তি ঢুকতে পারে, সেখানে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটিকে উল্টো দিকে নেওয়া সম্ভব। 

উদাহরণস্বরূপ, একটা এয়ারকন্ডিশনারের কথা ধরা যাক। এয়ারকন্ডিশনার দ্বিতীয় সূত্রটা মানে না বলে মনে হয়। কারণ, যন্ত্রটা বিশৃঙ্খল উত্তপ্ত বাতাস ঠান্ডা করে ফেলে। কিন্তু এয়ারকন্ডিশনার আসলে বাইরে থেকে শক্তি পায়, একটা পাম্প থেকে এবং সে কারণে এটা আবদ্ধ সিস্টেম নয়। একইভাবে, পৃথিবীতে জীবসত্তা তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মানে না বলে মনে হয়। কারণ, এখানে ওই জীব মাত্র ৯ মাস ব্যয় করে কিছু হ্যামবার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইকে একটা শিশুতে রূপান্তরিত করে। এটা সত্যিই অলৌকিক এক ঘটনা 

তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হওয়ার কারণ কী? এর আসল কারণ আমাদের কাছে বাহ্যিক শক্তির উৎস আছে। আর সেটি হলো সূর্য। পৃথিবী কোনো আবদ্ধ সিস্টেম নয়। তাই সূর্যের আলো আমাদের সূর্য থেকে আসা শক্তি থেকে শিশুকে খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তৈরি করার সুযোগ দেয়। কাজেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় আছে। বিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চতর জীবসত্তা গঠিত হওয়া সম্ভব করে তুলেছে ওই সূর্যের আলো। 

একইভাবে কোনো ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে অন্য কোনো মহাবিশ্বের সঙ্গে একটা প্রবেশপথ খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মহাবিশ্বটাকে আবদ্ধ সিস্টেম বলে মনে হয়। কিন্তু কোনো একদিন মহাবিশ্ব যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে, তখন হয়তো আমাদের উত্তরসূরিরা তাদের দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পর্যাপ্ত ধনাত্মক শক্তি ব্যবহার করে স্থান ও কালের ভেতর দিয়ে একটা টানেল খুলে ফেলতে পারবে। তারপর ঋণাত্মক শক্তি (কোয়ান্টামের ক্যাসিমির ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে) ব্যবহার করে স্থিতিশীলও করতে পারবে ওই প্রবেশপথটা। একদিন আমাদের উত্তরসূরিরা প্ল্যাঙ্ক শক্তি (যে শক্তিতে স্থান ও কাল অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে) সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করবে। এরপর তাদের শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করে পালিয়েও যেতে পারবে আমাদের মৃত্যুমুখী মহাবিশ্ব থেকেও। 

এভাবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ শুধু এগারো মাত্রিক স্থান-কালের গণিতের চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা মহাজাগতিক আন্তমাত্রিক লাইফবোট হিসেবে কাজ করবে। এই লাইফবোট বুদ্ধিমান প্রাণীদের সহায়তা করবে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে রক্ষা পেতে এবং অন্য কোনো উষ্ণতর মহাবিশ্বের দিকে যাত্রা করতে। 

কাজেই থিওরি অব এভরিথিং আসলে সৌন্দর্যময় গাণিতিক তত্ত্বের চেয়েও আরও বেশি কিছু। শেষ পর্যন্ত এটিই হয়ে উঠতে পারে আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায়। 

উপসংহার 

থিওরি অব এভরিথিংয়ের খোঁজ আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত একীভূত প্রতিসাম্য সন্ধানের দিকে নিয়ে গেছে। গ্রীষ্মের বাতাসের উষ্ণতা থেকে সূর্যাস্তের জ্বলন্ত গরিমা পর্যন্ত, আমাদের চারপাশে যেসব প্রতিসাম্য দেখি, সেগুলো সময়ের শুরুতে যে আদি প্রতিসাম্য দেখা দিয়েছিল, তারই টুকরা টুকরা অংশ। সুপারফোর্সের সেই আদি প্রতিসাম্য মহাবিস্ফোরণের পরমুহূর্তেই ভেঙে গিয়েছিল। আমরা যখনই প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রশংসা করি, সেগুলো আসলে আদি প্রতিসাম্যের ধ্বংসাবশেষ, আমরা দেখতে পাই। 

আমি ভাবতে পছন্দ করি, হয়তো আমরা দ্বিমাত্রিক সমতলবাসীর মতো কোনো পৌরাণিক সমতল তলে বসবাস করছি। আমরা তৃতীয় মাত্রাটি বুঝতেও অক্ষম। শুধু তাই নয়, এই মাত্রাকে কুসংস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ফ্ল্যাটল্যান্ড বা সমতলে সময়ের শুরুতে একটা চমৎকার ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টাল ছিল। কোনো এক কারণে সেটা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং কোটি কোটি টুকরা হয়ে ভেঙে পড়ে। ফ্ল্যাটল্যান্ডে বৃষ্টিপাতের মতো ঝরে পড়েছিল সেটাই। কয়েক শতক ধরে একটা জিগস পাজলের মতো করে এসব টুকরা সাজানোর চেষ্টা করছে সমতলের বাসিন্দারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টুকরাগুলো জোড়া লাগিয়ে দুটো বিশাল খণ্ড বানাতে পারে তারা। একটি টুকরাকে বলা হলো মহাকর্ষ এবং অন্য টুকরাটির নাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব। যতই চেষ্টা করুক না কেন, তারা কখনোই টুকরা দুটোকে একত্র করতে পারল না। তারপর একদিন সমতলের দুঃসাহসী উদ্যমী বাসিন্দা অদ্ভুত এক অনুমান করে বসল। তাতে সবাই হেসেও উঠল। সে বলল, গণিত ব্যবহার করে কেন আমরা টুকরাগুলোকে একটা কাল্পনিক তৃতীয় মাত্রায় বসাচ্ছি না, যাতে সেগুলোকে একটার ওপর আরেকটা একত্রে জোড়া লাগানো যায়? সেটা করার পর সমতলের বাসিন্দারা চমৎকৃত হলো। তারা চরম বিস্ময়ের সঙ্গে এমন এক চকচকে রত্ন আবিষ্কার করল যে হঠাৎ করে সেটা তাদের সামনে হাজির হলো একদম নিখুঁত ও অপূর্ব প্রতিসাম্যসহ। 

কিংবা স্টিফেন হকিংয়ের ভাষায়ও কথাটা বলা যায়। তিনি লিখেছেন, আমরা যদি কখনো কোনো সম্পূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারি, তাহলে সেটা শুধু গুটি কয়েক বিজ্ঞানীর জন্যই নয়, বরং ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছেও বোধগম্য হওয়া উচিত। এরপর দার্শনিক, বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষসহ আমরা সবাই সেই প্রশ্নের আলোচনায় অংশ নিতে পারব—আমরা এবং এই সুবিশাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকার কারণ কী? আমরা যদি সেই জবাবটা কখনো খুঁজে পাই, তাহলে সেটাই হবে মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তির চূড়ান্ত বিজয়। কারণ, তখনই কেবল আমরা জানতে পারব ঈশ্বরের মন। 

তথ্যনির্দেশ 

অজ্ঞেয়বাদী : ইংরেজিতে অ্যাগোনসটিক। যিনি বিশ্বাস করেন, জড়বস্তু ছাড়া অন্য কিছু বা ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব নয়। এ মতবাদ অনুযায়ী, কোনো বিতর্কই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবে না। 

অনিশ্চয়তার নীতি : বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের সূত্রবদ্ধ করা নীতি। এ নীতি অনুযায়ী, কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ দুটোই একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয়। দুটোর মধ্যে একটি যত নিখুঁতভাবে জানা যাবে, ততই অন্যটি নিখুঁতভাবে জানার পরিমাণ কমতে থাকবে। 

অপসূর : কোনো গ্রহ থেকে সূর্যের ন্যূনতম দূরত্বকে উক্ত গ্রহের অনুসূর এবং দূরবর্তী দূরত্বকে বলা হয় অপসূর। 

অসীম : সীমাহীন বা সমাপ্তিহীন কোনো ব্যাপ্তি বা সংখ্যা। 

আইজ্যাক নিউটন : ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। তাঁকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। ১৬৮৭ তাঁর বিখ্যাত বই ফিলোসফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশিত হয়। তাঁর এই মাস্টারপিস সংক্ষেপে প্ৰিন্সিপিয়া নামে পরিচিত। এ বইটি চিরায়ত বলবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করে। 

আপেক্ষিকতা : বিজ্ঞানের নিয়মকানুন সব পর্যবেক্ষকের জন্যই এক হবে। পাশাপাশি মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে পর্যবেক্ষকের গতিবেগ যা-ই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই নিয়মকানুন একই হবে। এসব ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইনস্টাইনের তত্ত্ব। 

ইলেকট্রন : ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কণা, যা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। 

এম-তত্ত্ব : পাঁচটি স্ট্রিং থিওরির সব কটিই ঐক্যবদ্ধকারী একটি তত্ত্ব। এ ছাড়া এই তত্ত্বে অতিমহাকর্ষকেও একটি একক তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বটি এখনো পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। 

এলএইচসি : বতর্মান বিশ্বে সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী কণা ত্বরক যন্ত্র এলএইচসি বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। সার্নের তৈরি এই যন্ত্রটি ফ্রান্স- সুইজারল্যান্ড সীমান্তে জেনেভার কাছে মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার সুড়ঙ্গে বানানো হয়েছে। ২০১২ সালে এখানেই হিগস-বোসন কণা আবিষ্কৃত হয়। 

কণা ত্বরক যন্ত্র : কণা ত্বরক যন্ত্র বা পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ-চুম্বক ব্যবহার করে চার্জিত কণাগুলোকে অনেক বেশি শক্তি দান করে গতিশীল করতে পারে। 

কৃষ্ণগহ্বর : প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৬৪ সালে। সে বছর অ্যান উইন সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়াম নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন। শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিল, সে বিষয়ে রিপোর্টে কিছু উল্লেখ করেননি তিনি। এদিকে ‘মহাকর্ষীয় প্রবল আকর্ষণে নিজের ওপর পুরোপুরি ভেঙে পড়া কোনো নক্ষত্র’ বোঝাতে সংক্ষিপ্ত শব্দ হিসেবে মার্কিন পদার্থবিদ জন হুইলার ১৯৬৭ সালে ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপরই শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে ভেঙে পড়া এ ধরনের নক্ষত্রের ধারণাটি প্রথম দিয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার ও হার্টল্যান্ড সিন্ডার, ১৯৩৯ সালে। 

এদিকে ইংরেজি ব্ল্যাকহোল শব্দটির উৎপত্তির সঙ্গে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখক পথিক গুহ। কথিত আছে, ১৭৫৬ সালের ২০ জুন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হটিয়ে কলকাতা দখল করে নেন। এরপর ব্রিটিশদের নির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরের ছোট্ট এক কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বর্ণনামতে, সেই অমানবিক পরিবেশে প্রচণ্ড গরমে এক রাতে ১২৩ জন ইংরেজের মৃত্যু হয়। ইতিহাসে এ ঘটনাটি অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। ইংরেজিতে ব্ল্যাকহোল অব ক্যালকাটা। কিন্তু দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট এবং প্রস্থে ১৮ ফুট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখার অবাস্তব ও আজগুবি এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করতে সম্ভবত এই কাহিনি রচিত ও প্রচারিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। 

যাহোক মহাকাশের নরকতুল্য বস্তু ব্ল্যাকহোল নামকরণের পেছনে কলকাতার এই কাহিনি জড়িত বলে মনে করেন অনেকে। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ব্ল্যাকহোল শব্দটি বিভিন্ন বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট হেনরি ডিকি। তবে শব্দটি জনপ্রিয় করার পেছনে জন হুইলারের অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে। 

কোয়ান্টাম তত্ত্ব : পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখায় বল প্রয়োগে শক্তিকণার গতিবেগ, ধর্ম, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেটিই কোয়ান্টাম মেকানিকস। চিরায়ত বলবিদ্যায় দৃশ্যমান বস্তুর ওপর বলপ্রয়োগে বস্তুর ধর্ম বা আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্র অতি ক্ষুদ্র শক্তিকণা (যেমন ইলেকট্রন)। চিরায়ত বলবিদ্যায় যেসব বস্তুর ভর আছে কিন্তু তরঙ্গ প্রকৃতি নেই, তাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এমন সব বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, যাদের কণা প্রকৃতি এবং তরঙ্গ প্রকৃতি উভয়ই আছে। যেমন আলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ। 

কোয়ান্টাম মহাকর্ষ : মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের নামই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। একমাত্র মহাকর্ষ বাদে প্রকৃতির সব কটি মৌলিক বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করা সম্ভব হয়েছে। প্রস্তাবিত এই তত্ত্বের মাধ্যমেই সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব পাওয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। 

কোয়ার্ক : চার্জিত মৌলিক কণা, যা শক্তিশালী বল দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রোটন ও নিউট্রনের প্রতিটিই তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এ পর্যন্ত ছয় ধরনের বা ফ্লেভারের কোয়ার্ক পাওয়া গেছে। যথা : আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্মড, বটম এবং টম। প্রতিটি ফ্লেভারের তিনটি কালার বা রং : লাল, সবুজ ও নীল। 

ক্রোমোডায়নামিকস : পদার্থবিজ্ঞানের এই তত্ত্বে অতিপারমাণবিক কণা কোয়ার্ক এবং গ্লুয়নের মধ্যে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর সংক্ষিপ্ত নাম কিউসিডি। 

প্লুয়ন: গ্লুয়ন হচ্ছে মৌলিক কণা। কণা পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী, ভরহীন এ কণাটি কোয়ার্কগুলোর মধ্যে বলবাহী কণা বা গজ বোসন হিসেবে কাজ করে। এটি কোয়ার্কদের মধ্যে শক্তিশালী বল বহন করে। দুটি চার্জিত কণার মধ্যে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল বহন করে ফোটন কণা। তেমনি কোয়ার্কদের মধ্যে শক্তিশালী বলের বাহক গ্লুয়ন। কণাটি কোয়ার্কদের একত্রে যুক্ত করে পরমাণুর প্রোটন ও নিউট্রন গঠন করে। এ ক্ষেত্রে গ্লুয়ন কণা কোয়ার্কদের মধ্যে শক্তিশালী আঠা বা গ্লুর (Glue ) মতো কাজ করে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

গামা রশ্মি : খুবই ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় রশ্মি। তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয় বা মৌলিক কণাদের সংঘর্ষে এই রশ্মির সৃষ্টি হয়। 

ঘটনা দিগন্ত : কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা। এখান থেকে কোনো বস্তু বা বিকিরণ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, ঘটনা দিগন্ত হচ্ছে কোনো একটি ঘটনার স্থান-কালের সীমানা, যার বাইরে অবস্থিত কোনো পর্যবেক্ষকের ওপর ওই ঘটনার কোনো প্রভাব পড়ে না। সাধারণভাবে একে প্রত্যাবর্তনের শেষ বিন্দু বলা হয়। অর্থাৎ এখানে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এতই বেশি হয় যে কোনো কণার পক্ষেই সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। 

ডপলার প্রভাব : শব্দতরঙ্গ বা আলোতরঙ্গের উৎস যদি কোনো পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে চলমান হয়, তাহলে ওই তরঙ্গের কম্পাংক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিচ্যুতি ঘটে। 

ডব্লিউএমএপি: উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রোপি প্রোব-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মহাকাশজুড়ে মহাবিস্ফোরণের থেকে আসা বিকিরণ বা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবির তাপমাত্রার পার্থক্য পরিমাপ করাই এর কাজ। 

ডিএনএ : ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (DNA), যা ফসফেট, একটি 

শর্করা ও চারটি ক্ষার (অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থায়ামিন ও সাইটোসিন নিয়ে গঠিত। ডিএনএর দুটি সূত্রক একটি ডাবল হেলিক্স কাঠামো গঠন করে, যা দেখতে প্যাচানো সিঁড়ির মতো। কোষের সব তথ্য ডিএনএতে লিপিবদ্ধ থাকে। এ তথ্যের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে, যা বংশগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

তাপগতিবিদ্যা : কোন গতিশীল ভৌত সিস্টেমে শক্তি, কাজ, তাপ ও এনট্রপির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা। তাপগতিবিদ্যা আসলে গ্যাসের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। বড় পরিসরে গ্যাসের অণুগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যে তাপমাত্রা ও চাপের সৃষ্টি হয়, তার ব্যাখ্যা করে এটি। তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র আছে। 

দুর্বল নিউক্লিয়ার বল : দুর্বল নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক বল হলো তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের বল। এই বলটিই পৃথিবীর কেন্দ্রকে উষ্ণ রাখছে, যা রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প এবং মহাদেশীয় চলনের পেছনে এই বলটি কাজ করে। 

নির্বাণ : ‘নি’ অর্থে নেই এবং ‘বাণ’ অর্থে তির বা বন্ধন (তৃষ্ণা); যেখানে বন্ধন বা তৃষ্ণা নেই—তা-ই নির্বাণ। বৌদ্ধধর্ম মতে, নির্বাণ হলো সেই অবস্থা, যেখানে জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, শোক, মনস্তাপ, হতাশা নেই, এমনকি যেখানে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু নেই। চন্দ্র-সূর্য গ্রহ নক্ষত্রের সংস্থান নেই, অথচ অন্ধকারও নেই। যেখানে সংসার স্রোতের গতি রুদ্ধ হয়েছে, সেই পরম অবস্থাকে নির্বাণ বলে। বৌদ্ধধর্মমতে, সাধনার চরম পরিণতি বা পরম প্রাপ্তিই হলো নির্বাণ। 

নিউক্লিয়াস : পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ। এখানে শুধু প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, যারা শক্তিশালী বল দ্বারা একত্র থাকে। 

নিউট্রন : প্রায় প্রোটনের মতোই একটি কণা। এর চার্জ নেই। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে প্রায় অর্ধেক এই কণা থাকে। তিনটি কোয়ার্ক (দুটি ডাউন আর একটি আপ কোয়ার্ক) দিয়ে একটি নিউট্রন গঠিত। 

নিউট্রিনো : একটি চার্জহীন কণা। খুবই হালকা কণা, যা শুধু দুর্বল বল দিয়ে প্রভাবিত হয়। 

পরম শূন্য : সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কেলভিন স্কেলে শূন্য। এ তাপমাত্রায় বস্তুতে কোনো তাপশক্তি থাকে না।

পরম বিন্দু বা অনন্যতা : স্থান-কালের একটি বিন্দু, যেখানে স্থান-কালের বক্রতা (অথবা আরও কিছু ভৌত ধর্ম) অসীম হয়। 

পরম-কারণ-বাদ : টেলিওলজিক্যাল বা বাংলায় পরম-কারণ-বাদ। পৃথিবীর সবকিছু একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ও বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টি হয়েছে এমন বিশ্বাস বা মতবাদ। 

প্রেজবিটেরিয়ান : প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের সংস্কারবাদী গোষ্ঠী। ১৭০৭ সালে এক অধ্যাদেশে মাধ্যমে এ গির্জার প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। স্কটল্যান্ডে ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডে চার্চ অব কংগ্রেশনাল চার্চের সঙ্গে একত্র করে ইউনাইটেড রিফর্মড চার্চ গঠিত হয়। একেই বলে প্রেজবিটেরিয়ান চার্চ। আর এই গির্জার বিশ্বাসী সদস্যদের বলা হয় প্রেজবিটেরিয়ান। 

প্রোটন : নিউট্রনের মতো একটি কণা। তবে এই কণাটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে এই কণাটি প্রায় অর্ধেক থাকে। এই কণা তিনটি কোয়ার্ক (দুটি আপ এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক) দিয়ে গঠিত। 

ফোটন : ১৯০৫ সালে ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টা ধারণা কাজে লাগান আইনস্টাইন। এতে তিনি আলোকে কোয়ান্টাম হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর ব্যাখ্যায়, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ শুধু বিচ্ছিন্ন প্যাকেটের মতো নিঃসৃত হয়। এই তরঙ্গের প্যাকেটকে তিনি বলেন আলোর কোয়ান্টা। এ ব্যাখ্যায় আলো অবিচ্ছিন্নভাবে নয়, কোয়ান্টা বা প্যাকেট আকারে নিঃসৃত বা শোষিত হয়। 

বর্ণালি : বর্ণালি উপাদানের কম্পাংক, যা একটি তরঙ্গের সৃষ্টি করে। সূর্যের দৃশ্যমান অংশের বর্ণালি মাঝে মাঝে রংধনু হিসেবে দেখা যায়। 

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল : ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম (ইএম) বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল আমাদের শহরগুলোকে আলোকিত করে। লেজার, রেডিও, টিভি, আধুনিক ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব—সবই বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের ফল। মানবজাতির পোষ মানানো সবচেয়ে উপকারী বল সম্ভবত এটিই। মহাকর্ষের বিপরীতে, এটি আকর্ষণ ও বিকর্ষণ দুটোই করতে পারে। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের সূত্রগুলো বর্ণনা করে। 

বৈদ্যুতিক চার্জ : কণার একটি ধর্ম, যার কারণে কণাটি একই ধর্মবিশিষ্ট (বা 

বিপরীত ধর্মবিশিষ্ট) অন্য কণাকে বিকর্ষণ (বা আকর্ষণ) করে। মহাজাগতিক ধ্রুবক : একটি গাণিতিক কৌশল, যা আইনস্টাইন ব্যবহার করেছিলেন। স্থান-কালকে প্রসারিত হওয়ার একটি সহজাত প্রবণতা দিতে ধ্রুবকটি ব্যবহার করেন তিনি। 

মহাবিস্ফোরণ : মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে গৃহীত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এ তত্ত্বমতে, প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। মহাবিশ্ব শুরুর সেই মুহূর্তে অতি উত্তপ্ত ও অসীম ঘনত্বের একটি সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুতে সবকিছু ঘনীভূত ছিল। 

১৯২৯ সালে এ মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন বেলজিয়ামের পাদরি, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ জর্জেস লেমাইতার। অবশ্য লেমাইতার তার তত্ত্বকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই মুহূর্তের নাম দিয়েছিলেন বিগ নয়েজ বা মহাশব্দ। তবে জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হোয়েল এ তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করে নাম দিয়েছিলেন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। পরে হোয়েলের দেওয়া নামটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

মহাকর্ষ : গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ হলো নীরব বল, যা আমাদের পাকে মাটির সঙ্গে আটকে রাখে। যা পৃথিবী ও নক্ষত্রগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করছে এবং সৌরজগৎ ও গ্যালাক্সিকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে। মহাকর্ষ ছাড়া গ্রহের ঘূর্ণনের কারণে আমরা পৃথিবী ছেড়ে সেকেন্ডে ১০০০ মাইল বেগে মহাশূন্যে ছিটকে যেতাম। মহাকর্ষ আকর্ষণধর্মী, বিকর্ষণধর্মী নয়। অন্য বলগুলোর তুলনায় এটি খুবই দুর্বল। কিন্তু তারপরও তা বিপুল দূরত্ব থেকেও ক্রিয়া করতে পারে। 

মহাকর্ষ তরঙ্গ : আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে পাওয়া একটি তরঙ্গ, যা আলোর গতিতে চলে। একটি বিপুল ভরের বস্তু আরেকটি বিপুল ভরের বস্তুর চারপাশে ঘুরলে বস্তু দুটি এই তরঙ্গ বিকিরণ করে। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন এ ধরনের তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এর ঠিক ১০০ বছর পর, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর ডিটেক্টরে এই তরঙ্গ প্রথমবার ধরা পড়ে। এই তরঙ্গের উৎস ছিল ১৩০ কোটি বছর আগে সূর্যের চেয়ে ৩৬ গুণ এবং সূর্যের চেয়ে ২৯ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষ। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার শনাক্ত করা হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এরপর ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত চারটি মহাকর্ষীয় বা মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করেছে লাইগো। 

মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন : আদিম উত্তপ্ত মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতা থেকে আসা বিকিরণ। বাংলায় একে বলা হয় ক্ষুদ্র তরঙ্গের পটভূমি বিকিরণ। এর এতই বড় লোহিত-বিচ্যুতি হয়েছে যে এখন আর আলো হিসেবে নয়, বরং মাইক্রোওয়েভ (একধরনের বেতার তরঙ্গ, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার) হিসেবে একে পাওয়া যায়। 

মাত্রা : কোনো স্থান বা বস্তুর প্রতিটি বিন্দুকে নির্দিষ্ট করতে সর্বনিম্ন যতগুলো স্থানাঙ্কের প্রয়োজন, তাকে সাধারণভাবে মাত্রা বা ডাইমেনশন বলা হয়। যেমন একটি সরলরেখা একমাত্রিক। কারণ, প্রতিটি বিন্দুকে সংজ্ঞায়িত করতে একটিমাত্র স্থানাঙ্কই যথেষ্ট। একটি তলের ওপর কোনো বিন্দুকে নির্দিষ্ট করতে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ—এই দুই দিকের স্থানাঙ্ক জানা প্রয়োজন, তাই একটি তল দ্বিমাত্রিক। একটি ঘনকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা—তিনটিই আছে, তাই তা ত্রিমাত্রিক। আমরা যে বস্তুজগতে বাস করি, স্থানিক বিবেচনায় তার পুরোটা ত্রিমাত্রিক। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী, সময়ও স্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি মাত্রা। তাতে আমাদের বস্তুজগৎ চারমাত্রিক। স্ট্রিং থিওরিমতে, আমাদের মহাবিশ্ব ১১ মাত্রার। এর চারটি মাত্রা আমাদের কাছে দৃশ্যমান হলেও বাকিগুলো অতিক্ষুদ্র কোনো বিন্দুতে কুঁকড়ে আছে। তাই বাকি মাত্রাগুলো আমরা দেখতে পাই না। এখনো এর পরীক্ষামূলক কোনো প্ৰমাণ নেই। 

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ: বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তত্ত্বে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বর্ণিত চারটি সমীকরণ ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ নামে পরিচিত। ভৌত বলগুলোর মধ্যে এটিই ছিল প্রথম বড় ধরনের একত্রকরণ। বিদ্যুৎ এবং চুম্বক যে ওতপ্রোতভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এখানে সেটিই দেখানো হয়েছে। এই সমীকরণগুলো বিদ্যুৎ ক্ষেত্র ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য এবং পদার্থের আন্তসংযোগসমূহ বর্ণনা করে। এর মাধ্যমে ধারণা করা হয়েছিল যে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব আছে, যা আলোর গতিতে চলাচল করে। তাই আলো নিজেও একটি তরঙ্গ। আলো সম্পর্কে এই ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী সময়ে রেডিও, রাডার, টেলিভিশন, কম্পিউটারের জন্য তারহীন সংযোগ এবং আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার অধিকাংশ প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। 

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক : জার্মান বিজ্ঞানী। তাঁকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক বলা হয়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণসংক্রান্ত একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে ১৯০০ সালে তিনি নতুন একটি তত্ত্বের জন্ম দেন। এটিই কোয়ান্টাম তত্ত্ব। 

শক্তিশালী পারমাণবিক বল : এ বল পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একত্রে আটকে রাখে। সূর্য ও নক্ষত্রদের শক্তি উৎপন্ন হয় এই নিউক্লিয়ার বল থেকে, যা মহাবিশ্বকে আলোকিত করার জন্য দায়ী। সমস্যাটি হলো নিউক্লিয়ার বল স্বল্পপাল্লার বল, যা মূলত নিউক্লিয়াসের দূরত্বে কার্যকর। এই বল নিউক্লিয়াসের ধর্মের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ার কারণে একে কাজে লাগানো খুব কঠিন। বর্তমানে এই বলকে কাজে লাগানোর একমাত্র উপায় হলো অ্যাটম স্ম্যাশারে অতিপারমাণবিক কণায় বিভক্ত করা কিংবা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো। 

সাধারণ আপেক্ষিকতা: আইনস্টাইনের প্রণয়ন করা তত্ত্ব। ১৯১৫ সালে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন তিনি। বিজ্ঞানের নিয়মকানুন সব পর্যবেক্ষকের জন্যই একই হবে, তাদের গতিশীলতার ওপর এই নিয়মকানুন নির্ভরশীল নয়—এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে। চারমাত্রিক স্থান-কালের বক্রতার ভিত্তিতে এটি মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করে। 

স্ট্রিং তত্ত্ব: পদার্থবিদ্যার একটি তত্ত্ব, যেখানে কণাকে সুতার ওপর তরঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতাগুলোর দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু মাত্রা নেই। তত্ত্বটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দুটোকে ঐক্যবদ্ধ করে। একে সুপারস্ট্রিং থিওরিও বলা হয়। 

স্থান-কাল : একটি চারমাত্রিক স্থান, যার বিন্দুগুলো ঘটনা। নিউটনের মহাবিশ্বে স্থান আর কালকে আলাদা বলে ভাবা হতো। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন, এই দুটি আসলে আলাদা কিছু নয়, বরং একক অস্তিত্ব হিসেবে বিরাজমান। 

স্ট্যান্ডার্ড মডেল : কণা পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব। মহাকর্ষ বাদে মৌলিক কণাসমূহ এবং প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোকে ব্যাখ্যা করে। এ মডেলে বলা হয়েছে, সব বস্তুই ১২টি ফার্মিয়ন কণা (৬টি কোয়ার্ক ও ৬টি লেপটন) এবং তাদের বিপরীত বা প্রতিকণা দিয়ে গঠিত। তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া সংগঠিত হয় চারটি গজ বোসন কণার মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বের সব কটি ভবিষ্যদ্বাণীই পরীক্ষার সঙ্গে মিলে গেছে। সম্প্রতি এ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করা নতুন এক কণা (যা হিগস বোসন নামে পরিচিত) শনাক্ত করেছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। 

স্পিন বা ঘূর্ণন : মৌলিক কণাদের অভ্যন্তরীণ ধর্ম। দৈনন্দিন ঘূর্ণন ধারণার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত, তবে তা পুরোপুরি এক রকম নয়। 

সুপারসিমেট্রি : এ তত্ত্বটি ১৯৭১ সালে প্রস্তাব করেছিলেন রুশ বিজ্ঞানী ইউজেনি লিখটম্যান এবং উইরি গলফ্যান্ড। এ ধারণায় তারা কণাগুলো আর মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে নতুন প্রতিসাম্যতার কথা বলেছিলেন। এই তত্ত্বমতে, প্রকৃতিতে প্রতিটি মৌলিক কণার অতিপ্রতিসাম্য সঙ্গী বা সুপার পার্টনার আছে। তবে এদের দেখতে পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ফোটনের সুপার পার্টনারের নাম দেওয়া হয়েছে ফোটিনো। 

হিগস-বোসন : হিগস-বোসন কণাটি একসময় গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের মাটির নিচে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাতে বসান লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা এলএইচসি। সেখানে আলোর গতিতে ধাবমান দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি আর অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণা। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান বহুকাঙ্ক্ষিত হিগস-বোসন কণা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্ন এ কণার আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। 

পরিভাষা 

অতিবেগুনি Ultraviolet 

অতিপারমাণবিক কণা Subatomic particle 

অতিপ্রতিসাম্য Supersymmetry 

অতিমহাকর্ষ বা সুপারগ্র্যাভিটি Supergravity 

অতিসঙ্গী বা সুপারপার্টনার Superpartner 

অণু Molecule 

অবলোহিত আলো Infrared light 

অলবারের প্যারাডক্স Olbers paradox 

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি Milky Way Galaxy 

আপেক্ষিকতা Relativity 

আপেক্ষিকতা তত্ত্ব Theory of relativity 

আধান বা চার্জ charge 

আলোর বর্ণালি Light spectrum 

অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল বা মানুষ সম্পর্কিত নীতি Anthropic principle 

ইলেকট্রন electron 

ইয়াং-মিলস তত্ত্ব Yang-Mills theory 

উপবৃত্তাকার elliptical 

উচ্চতর স্থান hyperspace 

একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব বা ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি Unified field theory 

এক্স-রে X-ray 

এম-তত্ত্ব M-theory 

এস-পার্টিকেল sparticle 

ওয়ার্মহোল Wormhole 

ঋণাত্মক শক্তি negative energy 

কণা ত্বরক যন্ত্র particle accelerator 

কম্পাংক frequency 

ক্যাসিমির প্রভাব Casimir effect 

কৃষ্ণগহ্বর Black hole 

কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ Blackbody radiation 

কেন্দ্রবিমুখী বল Centrifugal force 

কোয়ান্টাম quantum 

কোয়ান্টাম তত্ত্ব Quantum theory 

কোয়ান্টাম অস্থিরতা quantum fluctuation 

কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিকস Quantum chromodynamics 

কোয়ান্টাম বলবিদ্যা Quantum mechanics 

কোয়ান্টাম মহাকর্ষ Quantum gravity 

কোয়ান্টাম সংশোধনী quantum correction 

কোয়ার্ক Quark 

গুপ্তবস্তু Dark matter 

গুপ্তশক্তি Dark energy 

গ্লুয়ন gluon 

গোল্ডিলকস জোন Goldilocks zone 

গোডেলের মহাবিশ্ব Gödel’s universe 

গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা Graviton 

ঘটনা দিগন্ত Event horizon 

চুম্বকীয় ক্ষেত্র magnetic field 

ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি galaxy 

ডিএনএ DNA 

ডাবল হেলিক্স double helix 

ডিরাক সমীকরণ Dirac equation 

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র Second law of thermodynamics 

তরঙ্গদৈর্ঘ্য wavelength 

ত্রিমাত্রিক three-dimensional 

দুর্বল বল weak force 

দুর্বল পারমাণবিক বল weak nuclear force 

দৃশ্যমান আলো visible light 

দ্বৈততা Duality 

দ্বিমাত্রিক two-dimensional 

ধনাত্মক শক্তি positive energy 

নিউট্রিনো neutrino 

নিউক্লিয়াস nucleus 

পটভূমি বিকিরণ background radiation 

পরমাণু atom 

পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি singularity 

পর্যায় সারণি periodic table 

পজিট্রন positron 

পিথাগোরাসের উপপাদ্য Pythagorean theorem 

পূর্ণ সংখ্যা integral 

প্রতিসাম্য বা প্রতিসমতা symmetry 

প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল Standard model 

প্রোটন proton 

পারমাণবিক বা নিউক্লিয়ার বল nuclear force 

প্ল্যাঙ্ক কাল Planck time 

প্ল্যাঙ্ক শক্তি Planck energy 

প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক Planck’s constant 

প্রোটন proton 

প্রতিবস্তু বা প্রতিপদার্থ Antimatter 

ফোটন photon 

ফোটিনো photino 

ফার্মিয়ন fermion 

বর্ণালি spectrum 

বল force 

বক্রতা curvature 

বোসন boson 

বিগ ক্রাঞ্চ Big Crunch বিকিরণ radiation 

বিশেষ আপেক্ষিকতা Special relativity 

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ electromagnetic wave 

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল electromagnetic force 

বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র electric field 

মহাকর্ষ gravity 

মহাকর্ষ বল gravitational force 

মহাবিশ্ব universe 

মহাশীতলতা Big Freeze 

মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব multiverse 

মহাবিস্ফোরণ Big Bang 

মাত্রা dimension 

মহাজাগতিক রশ্মি cosmic rays 

মৌলিক কণা elementary particle 

মহাজাগতিক ধ্রুবক Cosmological constant 

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ Maxwell’s equations 

লেপটন lepton 

শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ Schrödinger equation 

স্থান বা দেশ space 

স্থান-কাল বা দেশকাল space-time 

স্থানিক মাত্রা spatial dimension 

সমান্তরাল মহাবিশ্ব parallel universe 

সাধারণ আপেক্ষিকতা General relativity 

স্ফীতি inflation 

স্ট্রিং তত্ত্ব String theory 

স্লেপটন বা এসলেপটন slepton 

স্কোয়ার্ক বা এসকোয়ার্ক squark 

স্পিন বা ঘূর্ণন spin 

হিগস বোসন Higgs boson 

হকিং বিকিরণ Hawking radiation

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *