১. একত্রকরণ—প্রাচীনকালের স্বপ্ন
উজ্জ্বল নক্ষত্রখচিত রাতের জাঁকজমকপূর্ণ আকাশে অপলকে তাকালে এর বিশুদ্ধ ও শ্বাসরুদ্ধকর মহিমা চোখে পড়ে। তা দেখে অভিভূত হওয়া সহজ। তবে একসময় আমাদের ভাবনা বাঁক নেয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় কিছু প্রশ্নের দিকে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে :
মহাবিশ্বের জন্য কি কোনো গ্র্যান্ড ডিজাইন আছে?
দৃশ্যত অর্থহীন, অচেতন মহাবিশ্বকে আমরা কীভাবে উপলব্ধি করব?
আমাদের অস্তিত্বের কি কোনো ছন্দ ও কারণ আছে? নাকি সবটাই অর্থহীন?
স্টিফেন ক্রেনের ছড়াটার কথা মনে করিয়ে দিই :
A man said to the universe :
‘Sir, I exist!’
‘However,’ replied the universe,
‘The fact has not created in me a sense of obligation.’
আমাদের চারপাশের বিশ্বের ভেতর যে বিশৃঙ্খলা, তা সাজানোর প্রথম আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেছিল গ্রিকরা। অ্যারিস্টটলের মতো গ্রিক দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন, সবকিছুকে কেবল চারটি মৌলিক উপাদানের মিশ্রণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সেগুলো হলো : মাটি, বাতাস, আগুন ও পানি। কিন্তু এই চারটি উপাদান থেকে কীভাবে বিশ্বের সমৃদ্ধ জটিলতা গড়ে উঠতে শুরু করল?
গ্রিকদের কাছে এই প্রশ্নের অন্তত দুটি জবাব ছিল। প্ৰথম জবাবটা দেন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস। অ্যারিস্টটলের অনেক আগেই উত্তরটা দেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিশ্বের সবকিছুকে ভেঙে অ্যাটম বা পরমাণু নামের অতিক্ষুদ্র, অদৃশ্য ও অবিনাশী একটা কণায় নামিয়ে আনা সম্ভব (গ্রিক শব্দ অ্যাটমের অর্থ অবিভাজ্য)। তবে সমালোচকেরা উল্লেখ করেন, পরমাণুর সরাসরি কোনো প্ৰমাণ দেওয়া অসম্ভব। কারণ, আমাদের পর্যবেক্ষণের জন্য সেগুলো খুবই ছোট। কিন্তু অ্যাটমের জন্য বেশ একটা শক্তিশালী পরোক্ষ প্রমাণ তুলে ধরেন ডেমোক্রিটাস।
উদাহরণ হিসেবে একটা সোনার আংটির কথা ধরা যাক। বছরের পর বছর আংটিটা ক্রমেই ক্ষয় হতে শুরু করে। কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই আংটি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তার কিছু ছোট অংশ। কাজেই পরমাণু অদৃশ্য হলেও তাদের অস্তিত্ব এভাবে পরোক্ষভাবে পরিমাপ করা যায়।
বর্তমানে আমাদের সমৃদ্ধ ও উন্নত বিজ্ঞানও এ কাজটা পরোক্ষভাবে করে। আমরা সূর্যের গাঠনিক উপাদান সম্পর্কে জানি, ডিএনএ কাঠামো সম্পর্কেও জানি বিশদভাবে। আবার মহাবিশ্বের বয়সও আমাদের জানা আছে। এ সবই জানা সম্ভব হয়েছে এ ধরনের পরোক্ষ পরিমাপের কারণে। কোনো নক্ষত্রে উড়ে না গিয়ে কিংবা অতিক্ষুদ্র কোনো ডিএনএ অণুর ভেতর না ঢুকে কিংবা মহাবিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী না হয়েও আমরা এসব বিষয়ে জানি। আমরা যখন ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করব, তখন এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণের মাঝখানের তফাতটা অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টার অগ্রদূত ছিলেন মহান গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাস।
সংগীতের মতো পার্থিব ঘটনায় গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রয়োগ করার মতো অন্তর্দৃষ্টি ছিল পিথাগোরাসের। কিংবদন্তি আছে, প্রাচীন বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র লায়ার তার টানার শব্দ এবং ধাতব দণ্ডের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর অনুরণনগুলোর মধ্যে একধরনের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। এভাবে পিথাগোরাস দেখতে পান, এগুলো সংগীতের কম্পাঙ্ক তৈরি করছে, যা নির্দিষ্ট অনুপাতে কম্পিত হয়। কাজেই সংগীতের মতো নান্দনিক ও মনোরম কোনো কিছুর উৎপত্তি আসলে গাণিতিক অনুরণন। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, এটাই প্রমাণ করে, চারপাশে আমরা যে বস্তুর বিচিত্রতা দেখতে পাই, সেগুলো অবশ্যই একই গাণিতিক নিয়ম মেনে চলে।
কাজেই বলা যায়, আমাদের বিশ্বে অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন গ্রিস থেকে। আইডিয়াগুলো হলো : সবকিছুই অদৃশ্য ও অবিনাশী পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং প্রকৃতির বিচিত্রতাকে কম্পনের গণিতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ক্লাসিক্যাল সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিল এসব দার্শনিক আলোচনা ও বিতর্ক। মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য যে একটা মডেল থাকতে পারে, এই ধারণা প্ৰায় এক হাজার বছর ভুলে গিয়েছিল মানুষ। পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে তখন অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। আর বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসার বেশির ভাগ প্রতিস্থাপিত হতে থাকে কুসংস্কার, ম্যাজিক আর জাদুবিদ্যাচর্চায়। [কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ, তখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের মশাল ঠিকই জ্বলছিল চীন, ভারত এবং আরব বিশ্বে। তাই সে অর্থে মধ্যযুগকে পুরো বিশ্বের জন্য অন্ধকার যুগ বলা যায় না। চীন, ভারত ও আরবের সেই জ্ঞানই পরে আয়ত্ত করে ইউরোপ, তাতে সে মহাদেশে জন্ম নেয় রেনেসাঁ। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার বেশির ভাগ লেখক, ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীদের লেখায় এশিয়ার এসব বিজ্ঞানীর অবদানের নাম- নিশানাও খুঁজে পাওয়া যায় না।—অনুবাদক]
রেনেসাঁকালে পুনর্জন্ম
সতেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিজ্ঞানী। সেই সঙ্গে তাঁরা মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে অনুসন্ধানও শুরু করেন। কিন্তু তাঁদের হতে হলো কঠোর বিরোধিতা ও নির্যাতনের শিকার। বিভিন্ন গ্রহের গতিপথ জানতে প্রথম যে কজন ব্যক্তি গণিত ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের একজন জোহানেস কেপলার। তিনি ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফের রাজকীয় উপদেষ্টা। সম্ভবত নিজের বৈজ্ঞানিক কাজে ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পান কেপলার।
কিন্তু সাবেক সন্ন্যাসী জিওর্দানো ব্রুনোর ভাগ্য অতটা ভালো ছিল না। ১৬০০ সালে ধর্মবিরোধিতার জেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। ব্রুনোর মুখ বেঁধে, নগ্ন করে প্যারেড করানো হয় রোমের রাস্তায়। এরপর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু তাঁর প্রধান অপরাধটা কী ছিল? তিনি ঘোষণা করেছিলেন, অন্যান্য নক্ষত্রের চারপাশের ঘূর্ণনরত গ্রহগুলোতেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। মূলত এটাই ছিল তাঁর অপরাধ।
গ্যালিলিও ছিলেন পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের জনক। তাঁকেও প্রায় একই রকম পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল। তবে ব্রুনোর সঙ্গে অমিল হলো, মৃত্যুকষ্টের ভয়ে নিজের তত্ত্বগুলোকে অমূলক বলে স্বীকার করে নেন গ্যালিলিও। তবু চিরস্থায়ী উত্তরাধিকার হিসেবে নিজের টেলিস্কোপ রেখে গেছেন তিনি। এটা সম্ভবত বিজ্ঞানের জগতের সবচেয়ে বৈপ্লবিক ও রাজদ্রোহী উদ্ভাবন। টেলিস্কোপ দিয়ে নিজের চোখেই আপনি দেখতে পাবেন, চাঁদে এবড়োখেবড়ো খাদ রয়েছে; সূর্যের চারপাশে ঘোরার সঙ্গে মিল রেখে শুক্র গ্রহের আছে কলা বা দশা; বৃহস্পতিরও আছে বেশ কয়েকটা চাঁদ। এসবই ছিল সেকালে প্রচলিত ধর্মীয় মতের বিরোধী ধারণা।
দুঃখের বিষয়, এসব অপরাধে গৃহবন্দী করে রাখা হয় গ্যালিলিওকে। দর্শনার্থীদের কাছ থেকেও আলাদা করে রাখা হয়। এভাবে একসময় অন্ধ হয়ে যান তিনি। (কথিত আছে, একবার নিজের টেলিস্কোপ দিয়ে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকিয়েছিলেন গ্যালিলিও। সে কারণে অন্ধ হন তিনি।) গৃহবন্দী গ্যালিলিও তিলে তিলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে একসময় মারা যান। কিন্তু তিনি যে বছর মারা গেলেন, ঠিক সে বছরই ইংল্যান্ডে জন্ম নেয় এক শিশু সেই শিশুটিই একদিন বড় হয়ে গ্যালিলিও ও কেপলারের অসমাপ্ত তত্ত্বগুলো সম্পূর্ণ করেন। আর আমাদের উপহার দেন মহাকাশের একটা একীভূত তত্ত্ব।
নিউটনের বলের সূত্র
আইজ্যাক নিউটনই সম্ভবত সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী। জাদুবিদ্যা ও গুপ্ত ম্যাজিকের জগতে আচ্ছন্ন এক পৃথিবীতে থেকেও মহাকাশের সর্বজনীন সূত্র লেখার সাহস দেখিয়েছেন তিনি। মহাবিশ্বের বলগুলোও ব্যাখ্যা করেছেন। সে জন্য ব্যবহার করেন ক্যালকুলাস নামের নিজের আবিষ্কৃত নতুন গণিত। তাই তো পদার্থবিদ স্টিভেন ওয়াইনবার্গ লিখেছেন, ‘আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যমেই চূড়ান্ত তত্ত্বের আধুনিক স্বপ্ন আসলে শুরু হয়েছিল।’ সেকালে একে থিওরি অব এভরিথিং হিসেবে গণ্য করা হতো। কারণ, সব রকম গতিকে ব্যাখ্যা করতে পারত নিউটনের তত্ত্ব।
ঘটনার শুরু হয়েছিল নিউটনের বয়স যখন ২৩ বছর। সেবার ব্ল্যাক প্লেগের কারণে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ১৬৬৬ সালের একদিন নিজেদের গ্রামের খামারে হাঁটতে গিয়ে গাছ থেকে একটা আপেল পড়ে যেতে দেখেন তিনি। এরপর নিজেকে মনে মনে যে প্রশ্নটা করলেন, সেটাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় মানবেতিহাসের।
তাঁর প্রশ্নটা ছিল : আপেল যদি নিচে পড়ে যায়, তাহলে চাঁদও কি একইভাবে পড়ে যায়?
নিউটনের আগে খ্রিষ্টীয় গির্জা শিখিয়েছিল, এখানে দুই ধরনের আইন রয়েছে। প্রথম আইনটা পাওয়া যায় পৃথিবীতে। নশ্বর মানুষের পাপে সেটা দূষিত হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় আইনটি হলো স্বর্গের বিশুদ্ধ, নিখুঁত ও সুরেলা আইন।
কিন্তু নিউটনের ধারণার সারমর্মটা ছিল এমন একটা একীভূত তত্ত্বের প্রস্তাব, যা স্বর্গ ও পৃথিবীকে একসূত্রে বেঁধে ফেলে।
নিজের নোটবুকে একটা ভাগ্যনির্ধারণী ছবি এঁকেছিলেন তিনি (ছবি ১ দেখুন)।
একটা পাহাড়চূড়া থেকে যদি একটা কামানের গোলা ছোড়া হয়, তাহলে সেটা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত চলতে থাকবে। তারপর মাটিতে আঘাত করবে গোলাটা। কিন্তু কামানের গোলাটা যদি ক্রমবর্ধমান বেগে ছোড়া হয়, তাহলে সেটা মাটিতে নেমে আসার আগে ক্রমেই আরও বেশি বেশি দূরত্ব অতিক্রম করবে। এভাবে গোলাটার বেগ একসময় যথেষ্ট বেশি হলে তা পৃথিবীর চারপাশে এক চক্কর দিয়ে ফিরে আসবে ওই পাহাড়চূড়াতেই। উপসংহারে তিনি বলেন, যে প্রাকৃতিক সূত্র আপেল ও কামানগোলা নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ। বলটি চাঁদকে ধরে রেখেছে পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথে সোজা কথায়, পার্থিব ও স্বর্গীয় পদার্থবিজ্ঞান আসলে একই।
বলের ধারণা চালু করে এটি সম্পন্ন করলেন নিউটন। বস্তু চলাচল করে কারণ তাদেরকে বল প্রয়োগ করে টান বা ধাক্কা দেওয়া হয়। আর এই বলগুলো ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন। এসব বলকে নিখুঁতভাবে ও গাণিতিকভাবে মাপাও সম্ভব। (কিন্তু আগে কয়েকজন ধর্মতত্ত্ববিদের ধারণা ছিল, বস্তু চলাফেরা করে, কারণ তাদের ইচ্ছা আছে। তাই বস্তুরা নিচে পড়ে। তারা পৃথিবীর সঙ্গে আকুলভাবে একত্র হতে চায়।) অর্থাৎ নিউটন এভাবে একত্রকরণের মূল ধারণাটির প্রবর্তন করেন।
ছবি ১: ক্রমবর্ধমান শক্তিতে একটা কামানের গোলা ছোড়া হলে তা ক্ৰমান্বয়ে পৃথিবীর চারপাশে সম্পূর্ণ ঘুরে আবারও শুরুর বিন্দুতে ফিরে আসবে। এর মাধ্যমে নিউটন বললেন, এটাই চাঁদের কক্ষপথ ব্যাখ্যা করে। এভাবে পৃথিবীর ভৌত সূত্রগুলোকে স্বর্গীয় বা মহাকাশের বস্তুগুলোর সূত্রের সঙ্গে একীভূত করেন তিনি।
কিন্তু নিউটন ছিলেন ভয়াবহ রকম নিভৃতচারী মানুষ। তাই নিজের কাজও গোপন রাখতেন। তাঁর বন্ধুর সংখ্যাও ছিল খুবই কম। ছোটখাটো আলাপ করতেও পারতেন না তিনি। আবার নিজের আবিষ্কারের অগ্রাধিকারের প্রশ্নে অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে প্রায়ই জড়িয়ে পড়তেন তিক্ত বিতর্কে।
তবে ১৬৮২ সালে ঘটা এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। সেবার লন্ডনের আকাশে দেখা গেল একটা জ্বলন্ত ধূমকেতু। রাজা-রানি থেকে শুরু করে ভিক্ষুক—সবার মধ্যে খবরটি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সবার মুখে জিজ্ঞাসা : ধূমকেতুটা কোথা থেকে এসেছে? সেটা যাচ্ছেই-বা কোথায়? আর এর মানেই-বা কী?
সবার মতো ওই ধূমকেতু নিয়ে খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন আরেকজন মানুষ। তিনি ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি। এর পেছনের কার্যকারণ জানতে সে যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের সঙ্গে দেখা করতে কেমব্রিজে রওনা হন তিনি। আলোক তত্ত্বের কারণে নিউটন তখন সুপরিচিত। (একটা কাচের প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো চালিয়ে নিউটন প্রথম প্রমাণ করেন, সাদা আলো আসলে রংধনুর সব কটি রঙে বিভক্ত হয়। এভাবে তিনি দেখান, সাদা আলো আসলে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ বা যৌগিক রং। এ ছাড়া নতুন একধরনের টেলিস্কোপও উদ্ভাবন করেন নিউটন। তাঁর এই টেলিস্কোপে লেন্সের বদলে প্রতিফলক আয়না ব্যবহার করা হয়েছিল।)
নিউটনকে বহুল আলোচিত ওই ধূমকেতু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন হ্যালি। জবাবে নিউটন শান্ত কণ্ঠে বললেন, তিনি প্ৰমাণ দেখাতে পারেন যে ধূমকেতুটা সূর্যের চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে। এমনকি তাঁর নিজের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ তত্ত্ব ব্যবহার করে ধূমকেতুটার বক্রিম গতিপথের পূর্বাভাসও দিতে পারেন। এ কথা শুনে একেবারে থ হয়ে গেলেন হ্যালি। আসলে নিজের আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ দিয়ে ধূমকেতুটা অনুসরণ করছিলেন নিউটন। আর সেটা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর মতো নির্দিষ্ট পথ ধরেই ছুটছিল।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন হ্যালি। বুঝতে পারলেন, বিজ্ঞানের একটা মাইলফলকের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন তিনি। এরপর নিউটনের বইটা ছাপানোর জন্য স্বেচ্ছায় খরচ বহন করলেন। ক্রমেই সেই বইটা হয়ে উঠল সব বিজ্ঞানের সর্বকালের অন্যতম সেরা মাস্টারপিস। সেই বইটার নাম ম্যাথামেটিকেল প্রিন্সিপলস অব ন্যাচারাল ফিলোসফি। সহজ কথায় প্রিন্সিপিয়া।
এ ছাড়া সেবার হ্যালি বুঝতে পারলেন, নিউটনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ধূমকেতুটা নিয়মিত বিরতিতে ফিরে ফিরে আসবে। তিনি হিসাব কষে দেখলেন, ১৬৮২ সালের এই ধূমকেতুটা ১৭৫৮ সালে আবারও ফিরে আসবে। (এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, হ্যালির ধূমকেতু ইউরোপের আকাশে আবারও ফিরে আসে ১৭৫৮ সালের বড়দিনে। মৃত্যুর পরেও এটা নিউটন ও হ্যালির খ্যাতি সিলমোহর করে রাখতে সহায়তা করেছিল।)
নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে মানবমনের অন্যতম সেরা অর্জন হিসেবে। একটামাত্র নীতির মধ্যে আমাদের জানা গতির সূত্রগুলোকে একত্র করা হয়েছে। তাই আলেকজান্ডার পোপ লিখেছিলেন :
Nature and Nature’s laws lay hid in night:
God said, Let Newton be!
And all was light.
এমনকি এ যুগেও নিউটনের সূত্রগুলো ব্যবহার করে নাসার ইঞ্জিনিয়াররা সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায় মহাকাশ অনুসন্ধানী যান নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্রতিসাম্য কী?
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আরেকটা কারণে উল্লেখযোগ্য, এটা প্রতিসাম্য বা প্রতিসমতার অধিকারী। তাই আমরা একে একবার ঘোরালেও সমীকরণটি একই থাকে। পৃথিবীর চারপাশে একটা গোলকের কথা কল্পনা করুন। এই গোলকের প্রতিটি বিন্দুতে মহাকর্ষ বল হুবহু এক। আসলে এই কারণে পৃথিবীর আকার অন্য কিছু না হয়ে গোলকাকার। এর পেছনের কারণ, মহাকর্ষ পৃথিবীকে সুষমভাবে সংকুচিত করে। সে জন্য আমরা কখনো কোনো ঘনকাকার নক্ষত্র বা পিরামিড আকৃতির গ্রহ দেখতে পাই না। (ছোট গ্রহাণুদের আকৃতি প্রায়ই অসম হতে দেখা যায়। কারণ, গ্রহাণুতে মহাকর্ষ বল খুবই অল্প। তাই মহাকর্ষ তাদের সুষমভাবে সংকুচিত করতে পারে না।)
প্রতিসাম্যের ধারণা অতি সরল, অভিজাত ও সহজাত। এ বইজুড়ে আমরা দেখতে পাব, কোনো তত্ত্বের জন্য প্রতিসাম্য শুধু উটকো সাজসজ্জা নয়, বরং এক অপরিহার্য ধর্ম। এই ধর্মটা মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীর ও অন্তর্নিহিত ভৌত নীতির ইঙ্গিত দেয়।
কিন্তু কথা হলো, আমরা কোনো সমীকরণকে যখন প্রতিসম বলি, তার অর্থ আসলে কী?
কোনো বস্তু প্রতিসম হবে, যদি এর অংশগুলো পুনর্বিন্যাস করার পরেও তা একই রকম বা অবিকৃত থাকে। যেমন একটা গোলক হলো প্রতিসম বস্তু। কারণ, একে ঘোরানো হলেও তা একই থেকে যায়। কিন্তু একে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা যায় কীভাবে?
চিন্তা করুন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরছে (ছবি ২ দেখুন)। পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসার্ধ দেওয়া হলো R। পৃথিবী এই কক্ষপথে চলাচল করার সময় এই ব্যাসার্ধ সব সময় একই থাকবে। (আসলে পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। তাই এই R-এর মান কিছুটা পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এখানে এই উদাহরণের জন্য সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়)। পৃথিবীর কক্ষপথের স্থানাঙ্ক দেওয়া হলো X ও Y। পৃথিবী তার কক্ষপথে চলার সঙ্গে সঙ্গে এই স্থানাঙ্ক X ও Y বদলে যাবে, কিন্তু ব্যাসার্ধ R থেকে যাবে একই। R-এর কোনো পরিবর্তন হবে না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিউটনের সমীকরণগুলো এই প্রতিসাম্য মেনে চলে। এ কথার মানে হলো, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার মহাকর্ষ একই থেকে যায়। আমাদের ফ্রেম অব রেফারেন্স বা জড়কাঠামো বদলে গেলেও সূত্রগুলো থেকে যাবে ধ্রুব। সমস্যাটা আমরা যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখি না কেন, নিয়ম অপরিবর্তিত থাকবে। ফলাফলও আসবে একই রকম।
ছবি ২: পৃথিবী যদি সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তাহলে তার ব্যাসার্ধ R একই থাকে। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে তার স্থানাঙ্ক X ও Y অনবরত বদলে যায়। তবে ব্যাসার্ধ R সব সময় অপরিবর্তিত থাকে। পিথাগোরাসের উপপাদ্যমতে, আমরা জানি x2 + y2 = R2। নিউটনের সমীকরণকে R (কারণ R অপরিবর্তিত বা ধ্রুব থাকে) কিংবা X ও Y হিসেবে (পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মাধ্যমে) প্রকাশ করলে দেখা যায়, এই সমীকরণের একটা প্রতিসাম্য আছে।
ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার সময় আমরা বারবার প্রতিসাম্যের এই ধারণার মুখোমুখি হব। দেখা যাবে, প্রকৃতির সব কটি বল একত্র করার জন্য প্রতিসাম্য আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
নিউটনের সূত্রগুলোর প্রমাণ
কয়েক শতক ধরে নিউটনের সূত্রগুলোর অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞান ও সমাজের ওপর তাঁর এসব সূত্রের প্রভাব ছিল ব্যাপক। উনিশ শতকে মহাকাশে একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিকতা খেয়াল করেন জ্যোতির্বিদেরা। দেখা গেল, নিউটনের সূত্রগুলো যেমনটা ভবিষ্যদ্বাণী করে, ইউরেনাস গ্রহের ক্ষেত্রে তার কিছুটা বিচ্যুতি ঘটছে। গ্রহটা কক্ষপথ নিখুঁতভাবে উপবৃত্তাকার নয়, বরং কিছুটা যেন এপাশ-ওপাশে নড়াচড়া করে। তাহলে হয় নিউটনের সূত্রগুলোয় কোনো ত্রুটি আছে, নয়তো সেখানে এমন কোনো গ্রহ আছে, যা তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ধারণা করা হলো, ওই অনাবিষ্কৃত গ্রহটাই হয়তো ইউরেনাসের কক্ষপথ প্রবলভাবে টানছে। নিউটনের সূত্রগুলোর প্রতি প্রবল আস্থা ছিল আরবেইন লে ভেরিয়ারের মতো পদার্থবিজ্ঞানীদের। তাই তাঁরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে হিসাব কষে বের করলেন, ওই রহস্যময় গ্রহটা আকাশের ঠিক কোথায় থাকতে পারে। ১৮৪৬ সালে প্রথমবারের চেষ্টাতেই সেই গ্রহটা সত্যি খুঁজে পান জ্যোতির্বিদেরা। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী গ্রহটা যেখানে থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, তার এক ডিগ্রির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া গেল। নতুন সে গ্রহের নাম দেওয়া হলো নেপচুন। ঘটনাটা ছিল নিউটনের সূত্রগুলোর অকৃত্রিম দক্ষতার প্রকাশ। একটা প্রধান মহাকাশীয় বস্তুর উপস্থিতি শনাক্ত করতে বিশুদ্ধ গণিতের ব্যবহার ইতিহাসে সেবারই প্রথম।
আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীরা যখনই মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের যেকোনোটির রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, তখনই তা প্রকৃতির গোপনীয়তার পর্দা উন্মোচন করেছে। শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে বিপ্লবও ঘটিয়ে দিয়েছে সমাজে। তাই নিউটনের সূত্রগুলো শুধু গ্রহ আর ধূমকেতুর গুপ্তরহস্যই ফাঁস করেনি, সেই সঙ্গে স্থাপন করেছে বলবিদ্যার ভিত্তিও। বর্তমানে এসব সূত্র ব্যবহার করে আমরা আকাশচুম্বী ভবন, ইঞ্জিন, জেট প্লেন, ট্রেন, সেতু, সাবমেরিন এবং রকেট ডিজাইন করছি।
যেমন ১৮০০ সালের দিকে তাপের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে নিউটনের সূত্রগুলো ব্যবহার করেছিলেন পদার্থবিদেরা। সে সময়ের বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, তাপ একধরনের তরল, যা কোনো কিছুর মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আরও গবেষণার পর দেখা গেল, তাপ আসলে অণুদের গতি। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র স্টিলের বলের তুলনা করা যেতে পারে, যারা অনবরত পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। নিউটনের সূত্রগুলো ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে গণনা করা যায়, দুটি স্টিলের বল পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় কীভাবে। আর স্টিলের বলের পরিবর্তে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অণু নিয়ে হিসাব করলে নিখুঁতভাবে গণনা করা যায় তাপের ধর্মগুলো। (যেমন কোনো চেম্বারের ভেতরের গ্যাসকে উত্তপ্ত করা হলে তা নিউটনের সূত্র মেনে প্রসারিত হয়। কারণ, তাপ আসলে চেম্বারের ভেতরের অণুদের বেগ বাড়িয়ে দেয়। )
বাষ্পীয় ইঞ্জিন নিখুঁত করে তুলতে এই গণনা ব্যবহার করেন ইঞ্জিনিয়াররা। তাঁরা হিসাব করে দেখতে পারেন, পানিকে বাষ্পে পরিণত করতে কতটুকু কয়লা দরকার। এই বাষ্প এরপর গিয়ার, পিস্টন, চাকা ও লিভার ধাক্কা দিতে ব্যবহার করা যায়। এই যন্ত্রাংশগুলোই শেষ পর্যন্ত একটা মেশিনে শক্তি জোগায়। ১৮০০ শতকের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন শ্রমিকের জন্য ব্যবহারযোগ্য শক্তির পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে কয়েক শ অশ্বশক্তিতে এসে পৌঁছায়। ইস্পাতের রেলপথ হুট করে সংযুক্ত করে ফেলে বিশ্বের বহুদূরের অঞ্চলগুলোও। এতে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় মালামাল ও জ্ঞানের প্রবাহ আর মানুষের যাতায়াত।
শিল্পবিপ্লবের আগে মালামাল বানানো হতো অল্প পরিমাণে। সেগুলো একচেটিয়াভাবে বানাত দক্ষ কারিগরদের কোনো দল। সাধারণ গৃহস্থালি জিনিসপত্র বানাতেও কঠোর পরিশ্রম করতে হতো তাদের। নিজেদের কুটিরশিল্পের গোপনীয়তা রক্ষা করত তারা। সে জন্য অন্যকে দেখত সন্দেহের দৃষ্টিতে। কাজেই ওসব মালামাল প্রায়ই হয়ে উঠত দুর্লভ ও ব্যয়বহুল। বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও শক্তিশালী মেশিন আসার পর একই পণ্য আসল দামের ভগ্নাংশমাত্র মূল্যে তৈরি করা সম্ভব হলো। এতে বিভিন্ন জাতির সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেল ব্যাপকভাবে। বাড়িয়ে তুলল জীবনযাত্রার মানও।
নিউটনের সূত্রগুলো সম্ভাবনাময় ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের শেখাই আমি। তখন একটা বিষয়ে জোর দেওয়ার চেষ্টা করি। এসব সূত্র নিছক নীরস ও বিরক্তিকর কিছু সমীকরণ নয়, বরং আধুনিক সভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল এই সূত্রগুলো। সেই সঙ্গে চারপাশে আমরা যেসব সম্পদ আর সমৃদ্ধি দেখি, তা-ও সম্ভব হয়েছে এসব সূত্রের কারণেই। মাঝেমধ্যে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভিডিওতে ধারণ করা ১৯৪০ সালে ওয়াশিংটন রাজ্যের টাকোমা ন্যারোজ ব্রিজ ভেঙে পড়া দেখানো হয়। ভেঙে পড়ার সেই দৃশ্যটা বড় বিপর্যয়কর নিউটনের সূত্রগুলো ভুলভাবে প্রয়োগ করলে কী হতে পারে, তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় ওটা।
নিউটনের সূত্রগুলোর ভিত্তি ছিল স্বর্গীয় পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে পার্থিব পদার্থবিজ্ঞানকে একসূত্রে গাঁথা। প্রযুক্তিতে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের বিপ্লবের সূচনা করতেও সহায়তা করেছিল এই সূত্রগুলোই।
বিদ্যুৎ ও চুম্বকের রহস্য
পরের বড় সাফল্যটি পেতে আমাদের লেগেছিল আরও প্রায় দুই শ বছর। সেই সাফল্যটি এসেছিল বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে গবেষণা থেকে।
প্রাচীনকালের লোকজন জানত, চুম্বককে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কম্পাস আবিষ্কার করে চীনারা চুম্বকীয় শক্তি কবজা করেছিল। পাশাপাশি আবিষ্কারের একটি যুগের সূচনা করতে সহায়তা করেছিল এটি। কিন্তু বিদ্যুৎকে ভয় পেত প্রাচীনকালের মানুষ। আকাশের বজ্রপাতকে সেকালে দেবতাদের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হতো।
যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রটির ভিত্তি স্থাপন করেন, তিনি মাইকেল ফ্যারাডে। গরিব হলেও কঠোর পরিশ্রমী এক তরুণ ছিলেন তিনি। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ছিল না। বেশ চেষ্টা- তদবিরের পর ছোটবেলায় লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটে সহকারী হিসেবে কাজ জুটিয়ে নিতে পারেন তিনি। সাধারণত তাঁর মতো সমাজের নিচুতলার মানুষেরা আজীবন ঘরের মেঝে ঝাড়ু দিত, বোতল পরিষ্কার করত এবং ছায়ার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হতো। কিন্তু এই তরুণ ছিলেন অক্লান্ত আর প্রচণ্ড কৌতূহলী। তাই একদিন তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অনুমতি দেন তাঁর সুপারভাইজার।
এভাবে একসময় বিদ্যুৎ ও চুম্বকের কিছু সেরা আবিষ্কার করে বসেন ফ্যারাডে। অচিরেই তিনি প্রমাণ করেন, একটা তারের বলয়ের মধ্যে একটা চুম্বক ঘোরালে ওই তারে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। সেটা ছিল বিস্ময়কর ও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক পর্যবেক্ষণ। কারণ বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে কোনো সম্পর্কের কথা এর আগে একেবারেই অজানা ছিল। আবার এর বিপরীতটাও দেখানো সম্ভব। অর্থাৎ একটা চলমান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রও চুম্বকশক্তি তৈরি করতে পারে।
এভাবে ফ্যারাডে বুঝতে পারেন, দুটো পরিঘটনা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই সরল পর্যবেক্ষণ সূচনা করে বিদ্যুৎ যুগের। যে যুগে বিশালাকৃতির হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যামের মাধ্যমে আলোকিত করে তোলা যাবে গোটা শহরকে। (একটা হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম বা জলবিদ্যুৎ বাঁধের মধ্যে নদীর পানি একটা চাকাকে ঘোরায়, যা একটা চুম্বককে ঘোরায়। এই চুম্বকটিই তারের ভেতরের ইলেকট্রনকে ধাক্কা দেয়, যা আপনার ঘরের সকেটের মধ্যে বিদ্যুৎ পাঠায়। আবার উল্টোভাবে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রকেও চুম্বকক্ষেত্রে রূপান্তর করা যায়। আপনার ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটা কাজ করে সে কারণেই। ঘরের দেয়ালের সকেট থেকে আসা বিদ্যুতের কারণে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ভেতরের একটা চুম্বক ঘোরে। সেটাই একটা পাম্পকে চালিয়ে সাকশন তৈরি করে। একইভাবে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের রোলার ঘোরে এ কারণেই।)
কিন্তু ফ্যারাডের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার কারণে তাঁর গাণিতিক দক্ষতাও ছিল না। তাই নিজের গুরুত্বপূর্ণ এসব আবিষ্কার গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি তিনি। তার বদলে নিজের নোটবুক অদ্ভুত সব ডায়াগ্রাম এঁকে ভরে তুলতে লাগলেন। সেগুলোতে বলের রেখা দেখালেন, যেটা দেখতে একগুচ্ছ রেখার জালের মতো। আসলে একটা চুম্বকের চারপাশে লোহার গুঁড়া যেভাবে অবস্থান নেয়, ওই রেখাগুলোও ছিল ঠিক তেমনি। এভাবে ক্ষেত্র বা ফিল্ডের ধারণা আবিষ্কার করেন ফ্যারাডে। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলোর একটি এই ক্ষেত্রের ধারণা। একটা ক্ষেত্রের ভেতরে থাকা এসব বলরেখা স্থানের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত থাকে। চুম্বকীয় রেখাগুলো প্রতিটি চুম্বকের চারপাশে বিস্তৃত থাকে। পৃথিবীর চুম্বকীয় ক্ষেত্র উত্তর মেরু থেকে বেরিয়ে আসে ও স্থানের ভেতর দিয়ে বিস্তৃত হয়। এরপর এই ক্ষেত্র ফিরে যায় দক্ষিণ মেরুর দিকে। এমনকি নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকেও ক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্ৰকাশ করা যায়। সেখানে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার কারণ হলো, পৃথিবী সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর চলাচল করে।
পৃথিবীর চারপাশে চুম্বকক্ষেত্রের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে ফ্যারাডের এই আবিষ্কার। এর কারণ, পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে এর ভেতরের বৈদ্যুতিক চার্জও ঘোরে। পৃথিবীর ভেতরের এই ধ্রুব গতির কারণেই তৈরি হয় পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র। (কিন্তু এতে একটা রহস্য রয়েই যায় : একটা দণ্ড চুম্বকের চুম্বকীয় ক্ষেত্র কোথা থেকে আসে? এখানে তো কোনো কিছু চলাচল করছে না বা ঘুরছে না। তাহলে? এ রহস্য সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।) বর্তমানে মহাবিশ্বের সব জানা বলগুলোকে ক্ষেত্রের ভাষায় প্রকাশ করা হয়। আর এই ক্ষেত্রের ধারণার প্রথম সূচনা করেন মাইকেল ফ্যারাডে।
বৈদ্যুতিক যুগের সূচনায় ফ্যারাডের ব্যাপক অবদানের কারণে তাঁকে ‘সর্বকালের সেরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক’ বলে ঘোষণা করেন পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড।
অন্যান্য দিক থেকেও অন্তত নিজের সময়ের বাকিদের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে ছিলেন ফ্যারাডে। কারণ, নিজের আবিষ্কারের সঙ্গে জনগণকে, এমনকি শিশুদেরও যুক্ত করতে ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর দেওয়া ক্রিসমাস লেকচারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন ফ্যারাডে। সেখানে চোখধাঁধানো বৈদ্যুতিক জাদুকরি কাণ্ডকারখানা দেখানোর জন্য লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতেন। সে সময় তিনি একটা বড় ঘরে ঢুকতেন, যার দেয়ালগুলো ঢাকা থাকত ধাতব ফয়েলে (বর্তমানে একে বলা হয় ফ্যারাডের খাঁচা বা ফ্যারাডে কেজ)। এরপর ওটাকে বিদ্যুতায়িত করা হতো। কিন্তু ধাতব দেয়াল বিদ্যুতায়িত হলেও পুরোপুরি নিরাপদ থাকতেন তিনি। কারণ, ঘরটার গোটা পৃষ্ঠতলের ওপর দিয়ে বাইরে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ছড়িয়ে যেত। কাজেই ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র হতো শূন্য। এখন এই প্রভাবটা সাধারণত মাইক্রোওয়েভ ওভেনের বর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলো থেকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র দূরে রাখতে কিংবা বজ্রপাত থেকে জেট প্লেন রক্ষা করতে এটি ব্যবহার করা হয়। (একবার এক সায়েন্স চ্যানেলের প্রোগ্রামের সঞ্চালক ছিলাম আমি। অনুষ্ঠানে বোস্টন মিউজিয়াম অব সায়েন্সের এক ফ্যারাডে কেজের ভেতরে ঢুকেছিলাম। বিশাল বৈদ্যুতিক বজ্র ছোড়া হয়েছিল খাঁচার ওপরে, দুই মিলিয়ন ভোল্টের মতো। পুরো অডিটরিয়াম ভরে গিয়েছিল বিদ্যুৎ-বজ্রের প্রবল আওয়াজে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এর কিছুই আমি অনুভব করিনি।)
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ
নিউটন দেখিয়েছেন, বস্তু চলাচল করে, কারণ তাদের ধাক্কা দেওয়া হয় বল বা ফোর্স দিয়ে। একে ক্যালকুলাস দিয়ে বর্ণনা করা যায়। অন্যদিকে ফ্যারাডে দেখান, বিদ্যুৎ চলাচল করে, কারণ একে ধাক্কা দেয় একটা ক্ষেত্র বা ফিল্ড। কিন্তু ফিল্ডের গবেষণার জন্য গণিতের নতুন একটা শাখার প্রয়োজন দেখা দিল। সেই গণিতটা শেষ পর্যন্ত বিধিবদ্ধ করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। একে বলা হয় ভেক্টর ক্যালকুলাস। কেপলার এবং গ্যালিলিও যেমন নিউটোনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক সে রকম ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের পথ প্রশস্ত করেন ফ্যারাডে।
ম্যাক্সওয়েল ছিলেন গণিতে পণ্ডিত। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে বিস্ময়কর সফলতার জন্ম দেন তিনি। ম্যাক্সওয়েল বুঝতে পেরেছিলেন, ফ্যারাডে ও অন্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ এবং চুম্বকত্বের আচরণকে গাণিতিক ভাষায় নিখুঁতভাবে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাঁর একটা সূত্রমতে, একটা চলমান চুম্বকীয় ক্ষেত্র একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। আরেকটি সূত্র বলে ঠিক উল্টো ঘটনা। এই সূত্রমতে, চলমান বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করবে।
এরপর ম্যাক্সওয়েলের মাথায় এমন এক ধারণা উঁকি দিল, যা চিরস্মরণীয়। তিনি ভাবলেন, পরিবর্তনশীল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র যদি একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, এরপর তা থেকে যদি আরেকটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়, এরপর সেটা যদি আরেকটি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে, এভাবে ক্রমাগত চলতেই থাকলে কী ঘটবে? তাঁর ছিল মেধাবী অন্তর্দৃষ্টি। তাই অচিরেই বুঝতে পারলেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল এই গতির চূড়ান্ত ফলাফল হবে একটা চলমান তরঙ্গ। সেখানে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রগুলো অনবরত একটা আরেকটায় বদলে যেতে থাকবে। রূপান্তরের এই অসীম পর্যায়ক্রমের নিজস্ব একটা জীবনও রয়েছে, যা কম্পনশীল বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের চলমান তরঙ্গ তৈরি করে।
ভেক্টর ক্যালকুলাস ব্যবহার করে এই চলমান তরঙ্গের গতিবেগ হিসাব করে দেখলেন ম্যাক্সওয়েল। দেখা গেল, এর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪০ কিলোমিটার। এমন ফলাফল দেখে স্তম্ভিত হন তিনি। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরীক্ষামূলক ত্রুটি থাকলেও এই গতিবেগ লক্ষণীয়ভাবে আলোর গতির কাছাকাছি (আলোর গতি এখন আমরা জানি, সেকেন্ডে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯২ কিলোমিটার)। এরপর তিনি এক দুঃসাহসে ভর করে দাবি করে বসলেন, এটাই হলো আলো! আলোও একধরনের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ।
ছবি ৩ : বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আন্দোলিত বৈদ্যুতিক ও চুম্বকক্ষেত্র একে অপরটিতে পরিণত হয় এবং একটা তরঙ্গের মতো চলাচল করে। আলো হলো বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের অন্যতম প্রকাশ।
ম্যাক্সওয়েল এর ভবিষ্যদ্বাণী করে লিখলেন, ‘আমরা এই অনুমান না করে পারি না যে আলো আসলে একই মাধ্যমের অনুপ্রস্থ তরঙ্গিত গতি, যা বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় পরিঘটনার কারণ।’
বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের সব শিক্ষার্থী এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো অবশ্যই মনে রাখতে হয়। এই সমীকরণগুলোই আসলে টেলিভিশন, লেজার, ডায়নামো, জেনারেটর ইত্যাদির ভিত্তি।
বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় শক্তিকে একীভূত করেন ফ্যারাডে এবং ম্যাক্সওয়েল। আর এই একত্রকরণের চাবিকাঠি ছিল প্রতিসাম্য। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোয় যে প্রতিসাম্য আছে, তাকে বলা হয় ডুয়ালিটি বা দ্বৈততা। কোনো আলোকরশ্মির ভেতরে যদি বিদ্যুৎকে E দিয়ে এবং চুম্বকীয় ক্ষেত্রকে B দিয়ে প্রকাশ করা হয়, তাহলে E ও B- কে বদলাবদলি করা হলেও বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকত্বের জন্য সমীকরণ একই থেকে যাবে। এই দ্বৈততা ইঙ্গিত করে, বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্ব একই বলের আলাদা বহিঃপ্রকাশ। কাজেই E ও B-এর প্রতিসাম্য আমাদের বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় শক্তিকে একীভূত করার সুযোগ দেয়। এর ফলে উনিশ শতকে পাওয়া গিয়েছিল অন্যতম বড় এক সফলতা।
এই আবিষ্কারে স্বাভাবিকভাবে মুগ্ধ হন পদার্থবিদেরা। ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গ যে ব্যক্তি গবেষণাগারে সত্যি সত্যিই পুনরুৎপাদন করতে পারবে, তাকে বার্লিন প্রাইজ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ঐতিহাসিক পরীক্ষাটা ১৮৮৬ সালে করে দেখান পদার্থবিদ হেনরিক হার্জ।
হার্জ প্রথমে তাঁর গবেষণাগারের এক কোনায় একটা বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বা ইলেকট্রিক স্পার্ক তৈরি করেন। কয়েক ফুট দূরে তারের একটা কয়েল রেখে তিনি দেখালেন, ওই স্পার্ক চালু করে তারের কয়েলের ভেতর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হলো, একটা নতুন, রহস্যময় তরঙ্গ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করছে স্রেফ বিনা তারে। এটিই রেডিও নামের নতুন একধরনের পরিঘটনার জন্মের অগ্রদূত। ১৮৯৪ সালে জনসাধারণের সামনে এই নতুন ধরনের যোগাযোগব্যবস্থাকে পরিচয় করিয়ে দেন গুলিয়েলমো মার্কনি। তিনি দেখান, আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারে বিনা তারে আলোর গতিতে বার্তা পাঠানো সম্ভব। [মার্কনির অনেক আগেই ছোট পরিসরে এই কাজটি করে দেখিয়েছিলেন আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।—অনুবাদক।]
রেডিওর সূচনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এল অতিদ্রুতগতির, সুবিধাজনক ও বিনা তারে দীর্ঘ দূরত্বে যোগাযোগের উপায়। ঐতিহাসিকভাবে, দ্রুতগতির ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থার অভাবই ছিল ইতিহাসের পদযাত্রার পথে অন্যতম প্রধান বাধা। (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০ সালে গ্রিক ও পারস্যের মধ্যে ম্যারাথন যুদ্ধের পর এক দৌড়বিদকে গ্রিকদের বিজয়ের খবর যত শিগগিরই সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। সাহসিকতার সঙ্গে ১৪৭ মাইল দৌড়ে স্পার্টায় পৌঁছায় লোকটা। তারপর সেখান থেকে ২৬ মাইল পথ দৌড়ে যায় এথেন্সে। কিংবদন্তি আছে, পরে তীব্র ক্লান্তিতে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। টেলিযোগাযোগব্যবস্থার আগের যুগের তার এই বীরত্ব এখন আধুনিক ম্যারাথন দৌড়ে স্মরণ করা হয়।)
বার্তা ও তথ্য যে অনায়াসে গোটা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পাঠানো যায়, তা বর্তমানে আমরা অবধারিত বলে ধরে নিয়েছি। সে জন্য যে সত্যটা ব্যবহার করা হয়, সেটা হলো শক্তিকে বিভিন্ন উপায়ে রূপান্তর করা সম্ভব। যেমন মুঠোফোনে কথা বলার সময় আপনার কণ্ঠনিঃসৃত শব্দ শক্তিকে একটা কম্পনরত ডায়াফ্রামে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। ডায়াফ্রামটা আটকানো থাকে একটা চুম্বকের সঙ্গে, যা বৈদ্যুতিক স্পন্দন তৈরি করতে নির্ভর করে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় আন্তপরিবর্তনশীলতার ওপর। এ ধরনের বৈদ্যুতিক স্পন্দন পরিবহন করা যায় এবং কম্পিউটার তা পড়তে পারে। এই বৈদ্যুতিক স্পন্দন এরপর রূপান্তর করা হয় বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে। সেটা পার্শ্ববর্তী মাইক্রোওয়েভ টাওয়ারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বার্তাটি বিবর্ধিত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোটা বিশ্বের আনাচকানাচে।
তবে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো শুধু রেডিও, মুঠোফোন ও ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের সুযোগই দেয়নি, সেই সঙ্গে আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে গোটা বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় বর্ণালির দ্বারও। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম বা বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় বর্ণালিতে দৃশ্যমান আলো আর রেডিও দুটি সদস্য মাত্র। ১৬৬০-এর দশকে একটা প্রিজমের ভেতর দিয়ে সাদা আলো চালনা করে নিউটন প্রমাণ করেন, সাদা আলোকে আসলে রংধনুর বিভিন্ন রঙে ভেঙে ফেলা সম্ভব। উইলিয়াম হার্শেল ১৮০০ সালে নিজেকে সরল একটা প্রশ্ন করেন। সেটা হলো, রংধনুর রংগুলোর বাইরে কী আছে? রংধনু লাল থেকে বেগুনি রং পর্যন্ত বিস্তৃত। একটা প্রিজম নিয়ে নিজের গবেষণাগারে একটা রংধনু সৃষ্টি করলেন হার্শেল। এরপর লাল রঙের নিচে একটা থার্মোমিটার রাখলেন। সেখানে কোনো রংই ছিল না। কিন্তু তিনি চরম বিস্ময়ে দেখতে পান, রংশূন্য সে জায়গায় থার্মোমিটারের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। অন্য কথায়, লালের পরেও একটা ‘রং’ আছে, যা খালি চোখে অদৃশ্য। অথচ তাতে শক্তিও আছে। একেই বলা হয় ইনফ্রারেড লাইট বা অবলোহিত আলো।
এখন আমরা বুঝতে পেরেছি, আলোতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের গোটা একটা বর্ণালি আছে, যার অধিকাংশই অদৃশ্য। তাদের প্রত্যেকেরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। যেমন রেডিও ও টিভির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে লম্বা। অন্যদিকে রংধনুর রংগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি এবং এক্স-রের চেয়ে লম্বা।
এর আরেকটা মানে হলো, চারপাশে আমরা যে বাস্তবতা দেখি, তা আসলে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির অতিক্ষুদ্র একটা অংশমাত্র। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় রংগুলোর অনেক বড় একটা জগতের অতিক্ষুদ্র অংশই আমরা দেখতে পাই। আমাদের চেয়েও বেশি দেখতে পায় কিছু প্রাণী। যেমন অতিবেগুনি রশ্মি দেখতে পারে মৌমাছি। অথচ আমাদের কাছে অতিবেগুনি রশ্মি অদৃশ্য। মৌমাছিদের জন্য এই আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে মেঘাচ্ছন্ন দিনেও সূর্য খুঁজে পায় তারা। বিভিন্ন ফুল মনোলোভা রঙে সাজার কারণ হলো, সেগুলো নিজেদের পরাগায়নের জন্য মৌমাছির মতো পোকামাকড়কে আকর্ষণ করতে চায়। তার মানে, বিভিন্ন ফুলকে অতিবেগুনি আলো ব্যবহার করে দেখা হলে প্রায় ক্ষেত্রেই সেগুলো আরও আকর্ষণীয় দেখায়।
ছোটবেলায় এ সম্পর্কে পড়েছিলাম আমি। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির অতি ক্ষুদ্র অংশ আমরা দেখি কেন, সেটা ভেবে তখন বেশ অবাক হতাম। ভাবতাম, কী ভীষণ অপচয়। কিন্তু এর পেছনের কারণটা এখন বুঝতে পারি। কারণটা হলো, কোনো ইএম ওয়েভ বা বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গ যে অ্যানটেনায় উৎপন্ন হয়, ওই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ওই অ্যারটেনার সমান হয়। কাজেই আপনার মুঠোফোনের আকার মাত্র কয়েক ইঞ্চি হওয়ার কারণ হলো, ওটাই এর অ্যানটেনার আকার। এখান থেকে যে ইএম ওয়েভ সম্প্রচারিত হয় তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও প্রায় ওই আকৃতির। একইভাবে আপনার চোখের রেটিনার একটি কোষের আকারও আপনি যে রং দেখেন, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান। কাজেই আমরা শুধু সেসব রংই দেখি, যেগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আকার আমাদের চোখের কোষের সমান। কিন্তু বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির অন্য রংগুলো আমাদের চোখে অদৃশ্য। কারণ, সেগুলো হয় আমাদের রেটিনা কোষগুলো শনাক্ত করার জন্য বেশি বড় অথবা খুব ছোট। আমাদের চোখের রেটিনার কোষগুলোর আকার যদি একেকটা বাড়ির সমান হতো, তাহলে হয়তো তখন রেডিও আর মাইক্রোওয়েভ বিকিরণও চারপাশে পাক খেতে দেখতে পেতাম আমরা।
ছবি ৪ : বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির বেশির ভাগ ‘রং’ আমাদের চোখে অদৃশ্য। এর ব্যাপ্তি রেডিও তরঙ্গ থেকে গামা রশ্মি পর্যন্ত। আমাদের চোখ শুধু গোটা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালির অতি ক্ষুদ্র অংশ দেখতে পায়। কারণ আমাদের রেটিনা কোষের আকার।
আবার আমাদের চোখের কোষগুলোর আকার যদি পরমাণুর সমান হতো, তাহলে হয়তো আমরা এক্স-রেও দেখতে পেতাম।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের আরেকটি প্রয়োগ হলো, ইএম এনার্জি গোটা গ্রহটাকে শক্তির জোগান দিতে পারে। তেল আর কয়লা অনেক দূরে পাঠাতে প্রয়োজন হয় নৌকা ও ট্রেনের মতো বাহন। কিন্তু নিছক একটা সুইচের একটা ঝাঁকুনিতেই তারের মধ্য দিয়ে পাঠানো সম্ভব বৈদ্যুতিক শক্তি। এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা যায় গোটা শহরে।
এর ফলেই বিদ্যুৎ যুগের দুই পথিকৃৎ টমাস এডিসন এবং নিকোলা টেসলার মধ্যে বিখ্যাত বিবাদের সৃষ্টি হয়। এডিসন ছিলেন অসংখ্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একজন জিনিয়াস। এর মধ্যে রয়েছে লাইট বাল্ব, মোশন পিকচার, ফোনোগ্রাফ, টিকার টেপ এবং আরও শত শত অবাক করা সব উদ্ভাবন। তিনিই প্রথমবার একটা রাস্তাকে তারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত করেন। সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানের ডাউনটাউনের পার্ল স্ট্রিট।
এটিই প্রযুক্তির দ্বিতীয় বড় ধরনের বিপ্লব, যা বৈদ্যুতিক যুগের জন্ম দিয়েছিল।
এডিসন মনে করতেন, বিদ্যুৎ স্থানান্তরের সবচেয়ে ভালো উপায় ডাইরেক্ট কারেন্ট বা ডিসি। (ডিসি সব সময় একই দিকে চলাচল করে এবং এর ভোল্টেজের পরিবর্তন হয় না)। এডিসনের জন্য একসময় কাজ করতেন টেসলা। তিনিই আজকের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেছিলেন। ডিসি পাওয়ারের বদলে এসি পাওয়ারের পক্ষে ওকালতি করতেন টেসলা। (এসি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট। এতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ষাটবার বিদ্যুতের দিক বদলে যায়)। ফলে বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বড় করপোরেশনগুলোর মধ্যে বেধে গেল বিখ্যাত এক দ্বন্দ্ব। দুই দলই কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বসে। জেনারেল ইলেকট্রিক সমর্থন করে এডিসনকে আর ওয়েস্টিংহাউস সমর্থন করে টেসলাকে। বৈদ্যুতিক বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল কে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হবে, তার ওপর। কে জিতবে? এডিসনের ডিসি, নাকি টেসলার এসি?
এডিসন বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী এবং আধুনিক বিশ্বের অন্যতম রূপকার হলেও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো আসলে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। সে জন্য তাঁকে অনেক বড় খেসারত দিতে হয়। আসলে এডিসন এমন সব বিজ্ঞানীকে নাকে বুড়ো আঙুল রেখে অবজ্ঞা করেছিলেন, যাঁরা অনেক বেশি গণিত জানতেন। (বিখ্যাত এক গল্প চালু আছে, চাকরিপ্রার্থী বিজ্ঞানীদের প্রায়ই লাইট বাল্বের আয়তন নির্ণয় করতে বলতেন তিনি। ওই বিজ্ঞানীরা উচ্চতর গণিত ব্যবহার করে যখন লাইট বাল্বের আকার নির্ণয় করার চেষ্টা করতেন, তারপর এর আয়তন নির্ণয় করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতেন, তখন মুচকি মুচকি হাসতেন এডিসন। এরপর খালি একটা লাইট বাল্বের ভেতরে পানি ঢেলে দিতেন তিনি। ওই পানিটুকু এরপর দাগ টানা মাপনির্দেশক একটা বিকারে ঢেলে নিয়ে আয়তন বলে দিতেন।)
ইঞ্জিনিয়াররা ভালো করেই জানতেন, অনেক মাইলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের তারের মধ্য দিয়ে নিম্ন ভোল্টেজ প্রবাহিত করলে, তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি হারাতে থাকে। অথচ এডিসন সেটাই করার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু টেসলার হাই ভোল্টেজের বিদ্যুতের লাইন অর্থনৈতিকভাবে বেশ পছন্দনীয় ছিল। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুতের তার খুবই বিপজ্জনক, বিশেষ করে আপনার বসার ঘরে। সে জন্য এখানে একটা কৌশল খাটানো হয়। সেটা হলো পর্যাপ্ত উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র থেকে তার বয়ে আনা হয় আপনার শহরে। এরপর আপনার বসার ঘরে ওই বিদ্যুৎ সরবরাহের আগে এই উচ্চ ভোল্টেজকে একটা উপায়ে রূপান্তর করা হয় নিম্ন ভোল্টেজে। এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ রূপান্তর বা ট্রান্সফরমের জন্য ব্যবহার করা হয় ট্রান্সফরমার।
আগেই বলেছি, ম্যাক্সওয়েল প্রমাণ করেন, একটা চলমান চুম্বকীয় ক্ষেত্র একটা বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে। আবার উল্টোটাও সত্য। তাই এমন ধরনের ট্রান্সফরমার বানানো যায়, যেগুলো কোনো তারের ভোল্টেজ দ্রুত বদলে দিতে পারে। যেমন একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বৈদ্যুতিক তারে বহন করা হয় কয়েক হাজার ভোল্ট। কিন্তু আপনার বাসার বাইরে থাকা ট্রান্সফরমার এই ভোল্টেজকে ১১০ ভোল্টে নামিয়ে আনতে পারে। [এটা শুধু উত্তর আমেরিকার জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশে ২২০ ভোল্টে নামিয়ে আনা হয়—অনুবাদক] এই নিম্ন ভোল্টেজ ব্যবহার করে আপনার মাইক্রোওয়েভ ওভেন ও রেফ্রিজারেটরকে সহজেই শক্তি দেওয়া যায়।
এ ক্ষেত্রগুলো যদি স্থির হতো, এর যদি কোনো পরিবর্তন না হতো, তাহলে তাদের একটাকে আরেকটায় রূপান্তর করা যেত না। এটা অবিরত পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এসি কারেন্টকে সহজে চুম্বকীয় ক্ষেত্রে রূপান্তর করা যায়। পরে প্রয়োজনে তা রূপান্তর করে আবারও বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনা যায়। তবে তা ফিরিয়ে আনা যায় নিম্ন ভোল্টেজে। মানে, ট্রান্সফরমার ব্যবহার করে এসি কারেন্টের ভোল্টেজ সহজে বদলে ফেলা গেলেও ডিসি কারেন্টে তা করা যায় না (কারণ, ভোল্টেজের দিক থেকে এটি ধ্রুবক। একে পরিবর্তন করা যায় না)।
তাই শেষ পর্যন্ত এই লড়াইয়ে হেরে যান এডিসন। ডিসি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিলও হারান তিনি। এসবই ছিল তাঁর ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো অবজ্ঞা করার খেসারত।
বিজ্ঞানের সমাপ্তি?
প্রকৃতির রহস্য ব্যাখ্যায় এবং আর্থিক সমৃদ্ধির নতুন যুগ আনার পাশাপাশি নিউটন আর ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সমন্বয় আমাদের এনে দিয়েছিল একটা বিশ্বাসযোগ্য থিওরি অব এভিরিথিংও। কিংবা বলা যায়, অন্তত সেকালের প্রেক্ষাপটে সবকিছু জানা হয়ে গিয়েছিল।
তাই তো ১৯০০ সালে সে যুগের নামকরা বিজ্ঞানীরা ‘বিজ্ঞানের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে বসেন। গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নের সময়টা তাই বেঁচে থাকার জন্য অদ্ভুত এক সময় ছিল বটে। যা আবিষ্কার করা সম্ভব, তার সবকিছুই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, অন্তত তেমনই মনে করা হতো।
মজার ব্যাপার হলো, সেকালের পদার্থবিদেরা বুঝতে পারেননি, বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভিত্তি, অর্থাৎ নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো আসলে পরস্পরের সঙ্গে খাপ খায় না। সেগুলো একটা আরেকটার বিরোধী। যুক্তি অনুসারে ওই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি দুটির একটাকে ধসে যেতেই হবে। ষোলো বছর বয়সী এক কিশোরের হাতে ছিল তার চাবিকাঠি। ম্যাক্সওয়েল যে বছর মারা গেলেন, ঠিক সে বছরই জন্ম হয়েছিল সেই ছেলেটির। অর্থাৎ সেই ১৮৭৯ সালে।