২. একত্রকরণের খোঁজে আইনস্টাইন
কিশোর বয়সে একদিন মনে মনে একটা প্রশ্ন করেছিলেন আইনস্টাইন। সে প্রশ্নটাই পাল্টে দিল বিশ শতকের বিজ্ঞানের গতিপথ। তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটা আলোকরশ্মিকে কি দৌড়ে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব?
এর বহু বছর পর তিনিই লিখবেন, এই সরল প্রশ্নটিতে লুকিয়ে ছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল চাবিকাঠি
এর আগে, অ্যারল ডেভিড বার্নস্টেইনের লেখা শিশুদের বই পপুলার বুকস অব ন্যাচারাল সায়েন্স পড়েছিলেন তিনি। ওই বইতে একটা টেলিগ্রাফের তারের পাশ দিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতার কল্পনা করতে বলা হয়েছিল। তার বদলে একটা আলোকরশ্মির পাশাপাশি দৌড়ে যাওয়া কল্পনা করলেন কিশোর আইনস্টাইন। তাঁর মনে হলো, সেটা দেখতে জমাট বাঁধা বলে মনে হওয়া উচিত। তিনি ভাবলেন, একটা রশ্মির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৌড়ে গেলে আলোকতরঙ্গ স্থির হয়ে যাওয়া উচিত। নিউটনও হয়তো এমন কিছুই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন।
কিন্তু ষোলো বছর বয়সী কিশোর হওয়া সত্ত্বেও আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, কেউই কোনো জমাট বাঁধা আলোকরশ্মি আগে কখনো দেখেনি। তাহলে নিশ্চয় কোথাও কোনো একটা ভুল হচ্ছে। প্রশ্নটি নিয়ে পরবর্তী আরও দশ বছর চিন্তা করলেন তিনি।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সে সময় অনেকেই তাঁকে ব্যর্থ বলে মনে করত। একসময় মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তবু আইনস্টাইনের অবাধ্য, বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা অপছন্দ করতেন তাঁর অধ্যাপক। আগেভাগে অধিকাংশ বিষয় জানার কারণে প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দিতেন আইনস্টাইন। কাজেই তাঁর অধ্যাপকেরা সুপারিশ করে লেখা চিঠিগুলোতে কথা বলতেন তাঁর বিপক্ষে। তাই কোনো চাকরির আবেদন করলেই তা প্রত্যাখ্যাত হতো। এভাবে দীর্ঘদিন বেকার থেকে হতাশ হয়ে পড়ানোর চাকরি নেন তিনি (চাকরিদাতার সঙ্গে একবার বিতর্কে জড়িয়ে সেখান থেকেও বরখাস্ত হন)। নিজের গার্লফ্রেন্ড আর সন্তানকে সহায়তা করতে বাধ্য হয়ে একবার ইনস্যুরেন্সের দালালি করার কথাও চিন্তা করেন আইনস্টাইন। (কল্পনা করতে পারেন, একদিন আপনি দরজা খুলে দেখলেন, আইনস্টাইন ইনস্যুরেন্সের দালালি করছেন?) বেকার হয়ে নিজেকে পরিবারের কুলাঙ্গার ও বোঝা বলে ভাবতে লাগলেন। একটা চিঠিতে তিনি দারুণ হতাশ হয়ে লিখেছেন, “আমার আত্মীয়স্বজনের কাছে আমি বোঝা ছাড়া আর কিছু নই…আমি বেঁচে না থাকলেই হয়তো বেশি ভালো হতো।’
শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি পান তিনি। তা-ও তৃতীয় শ্রেণির একটা পদে। সুইজারল্যান্ডের বার্নের পেটেন্ট অফিসে ক্লার্কের চাকরি। ওটা তাঁর জন্য অবমাননাকর ছিল, কিন্তু সেটাই ছিল তাঁর জন্য শাপে বর। পেটেন্ট অফিসের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে আইনস্টাইন ফিরে যেতেন তাঁর কৈশোরের সেই পুরোনো প্রশ্নে। এ প্রশ্নই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সেই ছোটবেলা থেকে। এখান থেকে তিনি একদিন এমন একটা বিপ্লবের জন্ম দেবেন, যা পদার্থবিজ্ঞান এবং বিশ্বকে স্রেফ উল্টে দেবে।
সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ইকোল পলিটেকনিকের ছাত্র হওয়ার কারণে ম্যাক্সওয়েলের আলোর সমীকরণগুলোর সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। একবার মনে মনে প্রশ্ন করলেন, কেউ যদি আলোর গতিতে ভ্রমণ করে, তাহলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোতে কী ঘটবে? উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এর আগে এ ধরনের প্রশ্ন কারও মাথায় আসেনি। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব ব্যবহার করে একটা চলমান বস্তুর (যেমন ট্রেন) ভেতরে আলোকরশ্মির গতি নির্ণয় করেন আইনস্টাইন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল, বাইরের কোনো স্থির পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ওই আলোকরশ্মির গতি হবে আলোর সাধারণ গতি যোগ ট্রেনের গতি। নিউটনের বলবিদ্যা অনুসারে, বিভিন্ন বেগকে সরলভাবে যোগ করলেই চলে। যেমন ধরা যাক, ট্রেনে চড়ে যাওয়ার সময় আপনি একটা বেসবল ছুড়ে দিলেন। তাহলে একজন স্থির পর্যবেক্ষক তা দেখে বলবেন, বলটির মোট গতি ছিল ট্রেনের গতি যোগ ট্রেনের সাপেক্ষে বলটির গতি। একইভাবে বেগগুলোকেও যোগ করা যায়। কাজেই আপনি যদি একটা আলোকরশ্মির কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে চলতে থাকেন, তাহলে সেটা দেখতে স্থির হওয়ার কথা।
অবাক হয়ে আইনস্টাইন দেখতে পান, আলোকরশ্মিটা মোটেও জমাট বাঁধা নয়, বরং তা একই গতিতে অবিরাম চলতেই থাকে। তিনি ভাবলেন, এমনটা হওয়া তো অসম্ভব। নিউটনের মতে, আপনি যদি যথেষ্ট জোরে ছুটতে পারেন, তাহলে যেকোনো কিছুর নাগাল পেতে পারেন। এটাই আমাদের কমন সেন্স বা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো বলল, কেউ কখনোই কোনো আলোকরশ্মির নাগাল পাবে না। আপনি যত জোরেই ছুটুন না কেন, আলো সব সময় একই বেগে চলতে থাকবে।
আইনস্টাইনের কাছে এই অন্তর্দৃষ্টিটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, হয় নিউটন, নয়তো ম্যাক্সওয়েল সঠিক। এই দুইয়ের যেকোনো একটা অবশ্যই ভুল। কিন্তু একটা আলোকরশ্মিকে যদি কখনো ধরা না যায়, তাহলে কেমন হয়? পেটেন্ট অফিসে বসে এই প্রশ্ন ভাবার মতো পর্যাপ্ত সময় তাঁর হাতে ছিল। ১৯০৫ সালের বসন্তের একদিন বার্নে ট্রেনে চড়তে গিয়ে তাঁর মাথায় হুট করে একটা চিন্তা এসে হাজির হয়। একে স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনের ভেতর যেন একটা ঝড় বয়ে গেল।’
তাঁর প্রতিভাবান অন্তর্দৃষ্টিটি ছিল, যেহেতু আলোর গতি ঘড়ি ও মাপনদণ্ড দিয়ে মাপা হয় এবং আপনি যত জোরেই ছুটুন না কেন, আলোর গতি যেহেতু সব সময় ধ্রুব রাশি, কাজেই আলোর গতিকে ধ্রুব রাখতে হলে স্থান ও কাল অবশ্যই বিকৃত হয়ে যেতে হবে।
তার মানে, আপনি যদি দ্রুত ধাবমান কোনো স্পেসশিপে থাকেন, তাহলে তার ভেতরের ঘড়িগুলোর স্পন্দন পৃথিবীর ঘড়িগুলোর তুলনায় ধীরগতির হবে। যত জোরে ছুটবেন, সময় তত বেশি ধীর হয়ে যাবে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এই পরিঘটনা বর্ণনা করা হয়। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, সময় আসলে কী?—তা নির্ভর করবে কতটা জোরে ছুটছেন, তার ওপর। ধরা যাক, একটা রকেটশিপ আলোর কাছাকাছি গতিতে চলাচল করছে। ভূপৃষ্ঠে বসে টেলিস্কোপে রকেটশিপটা পর্যবেক্ষণ করলে, রকেটশিপের ভেতরের সবাই ধীরগতিতে চলছে বলে মনে হবে। সেই সঙ্গে মনে হবে, রকেটের সবকিছু সংকুচিত হয়ে গেছে। অবশেষে রকেটের সবকিছু ভারী হয়ে উঠবে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, রকেটশিপের ভেতরে থাকা কোনো ব্যক্তির কাছে সবকিছু মনে হবে স্বাভাবিক।
পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘অন্য যে কারও চেয়ে আমি ম্যাক্সওয়েলের কাছে বেশি ঋণী।’ বর্তমানে এই পরীক্ষাটা নিয়মিতভাবে করে দেখা যেতে পারে। কোনো বিমানে একটা পারমাণবিক ঘড়ি রেখে সেটা পৃথিবীর ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা হলে দেখা যাবে, বিমানের ঘড়িটা ধীরগতিতে চলছে (অবশ্য এর পরিমাণ খুব অল্প। এক ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ মাত্র)।
কিন্তু স্থান-কাল যদি পরিবর্তিত হতে পারে, তাহলে যেটাই পরিমাপ করা হোক না কেন, সবকিছুর পরিমাপই বদলে যাবে। বস্তু ও শক্তির জন্যও এ কথা সত্য। আর আপনি যত জোরে ছুটবেন, ততই ভারী হতে থাকবেন। কিন্তু এই অতিরিক্ত ভর আসে কোথা থেকে? আসলে এটা আসে গতির শক্তি থেকে। তার মানে, গতির কিছু শক্তি ভরে পরিণত হয়।
বস্তু ও ভরের মধ্যে নিখুঁত সম্পর্কটা হলো E = mc^2। আমরা দেখতে পাব, এই সমীকরণটা গোটা বিজ্ঞানের অন্যতম গভীর একটা প্রশ্নের উত্তর দেয়। প্রশ্নটা হলো : সূর্য জ্বলে কেন? সূর্য জ্বলে, কারণ হাইড্রোজেন পরমাণুকে যখন তীব্র তাপে সংকুচিত করা হয়, তখন হাইড্রোজেনের কিছু ভর রূপান্তরিত হয় শক্তিতে।
মহাবিশ্বকে বোঝার মূল চাবিকাঠি হলো একত্রকরণ। আপেক্ষিকতার ক্ষেত্রে সেটা ছিল স্থান ও কাল এবং বস্তু ও ভরের একত্রকরণ। কিন্তু এই একত্রকরণ কীভাবে সম্পন্ন হয়?
প্রতিসাম্য ও সৌন্দর্য
কবি ও শিল্পীদের কাছে সৌন্দর্য একটা অপার্থিব বা স্বর্গীয় নান্দনিক গুণ, যা গভীর আবেগ ও প্রবল অনুরাগ উসকে দেয়।
অন্যদিকে পদার্থবিদদের কাছে সৌন্দর্যের মানে হলো প্রতিসাম্য। সমীকরণগুলো সুন্দর, কারণ তাদের প্রতিসাম্য আছে। অর্থাৎ কোনো সমীকরণের অংশগুলো পুনর্বিন্যাস বা পুনরায় সাজানো হলেও সমীকরণটা একই থাকে। এই রূপান্তরের পরেও সমীকরণটা অপরিবর্তিত থাকে। একটা ক্যালাইডোস্কোপের কথা কল্পনা করুন। আয়নার সহায়তায় এটা বিভিন্ন এলোমেলো রঙিন আকৃতি মিশিয়ে এর অসংখ্য কপি তৈরি করে। এরপর সেই ছবিকে প্রতিসমভাবে বিন্যস্ত করে একটা বৃত্তে। কাজেই প্রতিসাম্যের কারণে বিশৃঙ্খল কিছুও হুট করে শৃঙ্খলাময় ও সুন্দর হয়ে ওঠে।
একইভাবে তুষারকণা বা স্নোফ্লেকও সুন্দর। কারণ, একে ৬০ ডিগ্রিতে ঘোরানো হলেও তা একই রকম থেকে যায়। একটা গোলকের প্রতিসাম্য আরও বেশি। একে তার কেন্দ্রের চারপাশে যেকোনো পরিমাণ ঘোরানো হলেও গোলকটি দেখতে হুবহু একই রয়ে যায়। একজন পদার্থবিদের কাছে একটা সমীকরণ সুন্দর হয়, যদি সমীকরণটার ভেতরে বিভিন্ন কণা ও অংশ পুনর্বিন্যাস করা সত্ত্বেও তার ফলাফলে কোনো পরিবর্তন না আসে। অন্য কথায়, তার অংশগুলোর মধ্যে যদি প্রতিসাম্য খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা সুন্দর সমীকরণ। গণিতবিদ জি এইচ হার্ডি একবার লিখেছিলেন, ‘একজন গণিতবিদের প্যাটার্ন পেইন্টার বা কবির প্যাটার্নের মতো অবশ্যই সুন্দর হতে হবে। রং বা শব্দের মতো ধারণাগুলো অবশ্যই কোনো ঐকতানে একসঙ্গে মানানসই হতে হবে। সৌন্দর্য হলো এর প্রথম পরীক্ষা। পৃথিবীতে অসুন্দর গণিতের কোনো স্থায়ী জায়গা নেই।’ আর সেই সৌন্দর্য হলো প্রতিসাম্য।
আমরা আগে দেখেছি, সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের জন্য নিউটনের মহাকর্ষ বল নিলে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসার্ধ ধ্রুব থাকে। এখানে স্থানাঙ্ক X ও Y পরিবর্তিত হয়, কিন্তু ব্যাসার্ধ R নয়। একে তিন মাত্রাতেও সাধারণীকরণ করা যায়। স্থানাঙ্ক
পৃথিবীর কোনো জায়গায় বসে থাকার কথা কল্পনা করুন। সেখানকার তিন মাত্রার অবস্থানের স্থানাঙ্ক ধরা যাক X, Y ও Z (ছবি ৫ দেখুন)। আপনি যখন ভূপৃষ্ঠের যেকোনো জায়গায় যাবেন, তখন পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R একই থেকে যাবে। এখানে আমরা পাব R^2=X^2+Y^2+Z^2, যা পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ত্রিমাত্রিক সংস্করণ।
এখন আইনস্টাইনের সমীকরণটির কথা ধরা যাক। সমীকরণটির স্থানকে যদি কালে এবং কালকে স্থানে ঘুরিয়ে দিই, তাহলেও সমীকরণটি একই থেকে যাবে। এর মানে, ত্রিমাত্রিক স্থানের সঙ্গে এখন কালের মাত্রা T যোগ হবে। যেটি চতুর্থ মাত্রায় পরিণত হয়েছে। আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন, এর পরিমাণ X^2 + Y^2 + Z^2 – T^2 (এখানে সময় নির্দিষ্ট এককে প্রকাশিত) একই থাকে। এটি পিথাগোরাসের উপপাদ্যের চার মাত্রার সংস্করণ। (খেয়াল করুন, সময় বা কালের স্থানাঙ্কের একটা অতিরিক্ত বিয়োগ চিহ্ন রয়েছে। এর মানে, চার মাত্রার ঘূর্ণনের অধীনে আপেক্ষিকতা অপরিবর্তিত থাকলেও সময়ের মাত্রা অন্য তিনটি স্থানিক মাত্রার চেয়ে কিছু ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়।) কাজেই আইনস্টাইনের সমীকরণ ও চার মাত্রায় প্রতিসম হয়।
***
ছবি ৫: ভূপৃষ্ঠের ওপরে আপনি চলতে থাকলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ অপরিবর্তিত থাকবে। এটা একটা ধ্রুবক। কিন্তু স্থানাঙ্ক X, Y ও Z অনবরত বদলে যেতে থাকবে। কাজেই তিন মাত্রার পিথাগোরাসের উপপাদ্য হলো এই প্রতিসাম্যের গাণিতিক প্রকাশ।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো প্রথম লেখা হয়েছিল ১৮৬১ সালের দিকে। ওই বছর শুরু হয় মার্কিন গৃহযুদ্ধ। আগে আমরা বলেছি, এসব সমীকরণের একটা প্রতিসাম্য আছে, যাতে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র একটা আরেকটাতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোয় আরেকটি অতিরিক্ত গুপ্ত প্রতিসাম্য আছে। আমরা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোকে চার মাত্রায় X, Y, Z ও T-এর মধ্যে আন্তবিনিময় করলেও সেগুলো একই রয়ে যায়। ১৯১০ সালে এ কাজটি করেছিলেন আইনস্টাইন। মোদ্দা কথা, পদার্থবিজ্ঞানীরা যদি নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের সাফল্যে অন্ধ না হতেন, তাহলে আপেক্ষিকতা হয়তো মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়েই আবিষ্কৃত হতো।
বক্র স্থান হিসেবে মহাকর্ষ
আইনস্টাইন দেখালেন, স্থান, সময়, বস্তু এবং শক্তি একটা বৃহৎ চারমাত্রিক প্রতিসাম্যের অংশ। কিন্তু তাঁর সমীকরণে একটা সুস্পষ্ট ফাঁকও ছিল। কারণ, মহাকর্ষ ও ত্বরণ সম্পর্কে তাঁর সমীকরণে কিছুই বলা ছিল না। সে কারণে খুশি হতে পারেননি তিনি। তাঁর আগের তত্ত্বটিকে সাধারণীকরণ করতে চাইলেন। আগের তত্ত্বটিকে বলা হলো স্পেশাল রিলেটিভিটি বা বিশেষ আপেক্ষিকতা। কাজেই এতে মহাকর্ষ এবং ত্বরিত গতি যোগ করে আরও শক্তিশালী সাধারণ আপেক্ষিকতা বানাতে চাইলেন আইনস্টাইন।
তবে আপেক্ষিকতা ও মহাকর্ষকে একীভূত করে একটা তত্ত্ব প্রণয়নের জটিলতা সম্পর্কে আইনস্টাইনকে সতর্ক করলেন তাঁর সহকর্মী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তিনি বললেন, ‘পুরোনো বন্ধু হিসেবে আমি অবশ্য তোমাকে এর বিপক্ষে পরামর্শ দেব। কারণ, প্রথমত, তুমি সফল হবে না। আর যদি সফল হও, তাহলে কেউই তোমাকে বিশ্বাস করবে না।’ তবে প্ল্যাঙ্ক এ কথাও যোগ করেন, ‘তুমি যদি সফল হও, তাহলে তোমাকে বলা হবে পরবর্তী কোপারনিকাস।
যেকোনো পদার্থবিদের কাছে একটা বিষয় সুস্পষ্ট ছিল, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের তত্ত্বের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সূর্য যদি কোনো আলামত ছাড়াই একদিন হুট করে হারিয়ে যায়, তাহলে কী হবে? আইনস্টাইনের দাবি, সূর্যের অনুপস্থিতি বুঝতে পৃথিবীর সময় লাগবে প্রায় আট মিনিট। নিউটনের বিখ্যাত মহাকর্ষ সমীকরণে আলোর গতি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। কাজেই তাঁর সূত্র অনুসারে মহাকর্ষ তাৎক্ষণিকভাবে চলাচল করে, যা আপেক্ষিকতার লঙ্ঘন। নিউটনের সূত্রানুসারে, সূর্যের হারিয়ে যাওয়ার প্রভাব সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারার কথা পৃথিবীর।
আলোর এই প্রশ্নটি নিয়ে প্রায় দশ বছর চিন্তা করেন আইনস্টাইন। সেই ষোলো বছর বয়স থেকে ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত। পরের আরও দশ বছর তিনি ব্যয় করবেন, অর্থাৎ ছত্রিশ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত তিনি পুরোটা মনোযোগ দেবেন মহাকর্ষের তত্ত্বের পেছনে। এভাবে গোটা ধাঁধার চাবিকাঠি হঠাৎ একদিন ধরা দেয় তাঁর কাছে। সে সময় নিজের চেয়ারের পেছনে ঝুঁকে ছিলেন তিনি। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলেন। সংক্ষিপ্ত সেই মুহূর্তে আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, তিনি পড়ে গেলে ওজনহীন অনুভব করতেন। এরপর বুঝতে পারলেন, এটাই হয়তো মহাকর্ষ তত্ত্বের চাবিকাঠি ঘটনাটা স্মরণ করে আইনস্টাইন বলেন, সেটাই ছিল ‘তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখী চিন্তা’।
অনেক আগে গ্যালিলিও বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো বিল্ডিং থেকে কেউ পড়ে গেলে, ক্ষণিকের জন্য সে ওজনহীন বলে মনে করবে। কিন্তু আইনস্টাইনই কেবল বুঝতে পারেন, কীভাবে এই তথ্যটা ব্যবহার করে মহাকর্ষের গোপনীয়তা উন্মোচন করতে হবে। কিছু সময়ের জন্য কল্পনা করা যাক, আপনি একটা লিফট বা এলিভেটরের ভেতরে আছেন এবং এলিভেটরের কেব্ল কেটে ফেলা হয়েছে। আপনি নিচের দিকে পড়তে শুরু করবেন, কিন্তু এলিভেটরের মেঝেটাও একই হারে নিচে পড়তে থাকবে। কাজেই এলিভেটরের ভেতরে আপনি ভাসতে শুরু করবেন, যেন সেখানে কোনো মহাকর্ষের বালাই নেই (অন্তত এলিভেটরটা ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করার আগপর্যন্ত)। এলিভেটরের ভেতরে মহাকর্ষকে নিখুঁতভাবে বাতিল করে দেবে পড়ন্ত এলিভেটরের ত্বরণ। একেই বলা হয় ইকুইভেলেন্স প্রিন্সিপল বা সমতুল্যতার নীতি। এর মানে, কোনো জড়কাঠামোর ত্বরণ, অন্য কোনো জড়কাঠামোর মহাকর্ষ থেকে আলাদা করা যায় না।
টেলিভিশনে দেখা যায়, নভোচারীরা মহাকাশে গিয়ে ওজনহীন হয়ে পড়েন। মহাকাশ থেকে মহাকর্ষ হারিয়ে গেছে, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। আসলে গোটা সৌরজগতে বিপুল পরিমাণ মহাকর্ষ রয়েছে। কিন্তু নভোচারীরা ওজনশূন্য হয়ে পড়ার কারণ হলো তাঁদের রকেটগুলো তাঁদের মতো একই হারে পতিত হয়। নিউটনের পাহাড়চূড়া থেকে ছোড়া সেই কাল্পনিক কামানগোলার মতো। একইভাবে নভোচারী এবং তাঁদের ক্যাপসুল—দুটোই পৃথিবীর চারদিকে মুক্তভাবে পড়ছে। কাজেই নভোযানের ভেতরে আমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে যে তাঁরা ওজনহীন। কারণ, নভোচারীর দেহ ও নভোযানসহ সবকিছু একই হারে নিচে পড়ে যাচ্ছে।
এরপর আইনস্টাইন একে শিশুদের মেরি গো রাউন্ডে প্রয়োগ করলেন। আপেক্ষিকতা অনুসারে, আপনি যত জোরে ছুটবেন, ততই নাদুসনুদুস হয়ে যাবেন। কারণ, তখন স্থান সংকুচিত হয়ে যাবে। মেরি গো রাউন্ড ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের বৃত্তাকার কাঠামো ভেতরের কাঠামোর চেয়ে দ্রুত বেগে ঘোরে। তার মানে, স্থান-কালের ওপর আপেক্ষিকতার প্রভাবে বাইরের বৃত্তাকার কাঠামো ভেতরের চেয়ে বেশি সংকুচিত হয়ে যায়। কারণ, বাইরের অংশ বেশি দ্রুত ঘোরে। কিন্তু মেরি গো রাউন্ডটা আলোর কাছাকাছি বেগে চললে মেঝেটা হয়ে যাবে বিকৃত। সেটি তখন আর শুধু সমতল ডিস্ক থাকবে না। বৃত্তাকার কাঠামোটা সংকুচিত হয়ে যাবে, কিন্তু কেন্দ্রটা একই রয়ে যাবে। কাজেই পৃষ্ঠতলটা তখন ওলটানো বাটির মতো বক্র হয়ে যাবে।
এখন মেরি গো রাউন্ডের বক্র মেঝেতে হাঁটার চেষ্টা করছেন, এমন কল্পনা করুন। আপনি আর সোজা রেখা বরাবর হাঁটতে পারবেন না। প্রথমে মনে হবে, কোনো অদৃশ্য বল আপনাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। কারণ পৃষ্ঠতলটা বাঁকা বা বক্র হয়ে গেছে। কাজেই মেরি গো রাউন্ডটাতে চড়ে বসা কেউ বলবে, একটা কেন্দ্রবিমুখী বল সবকিছুকে বাইরে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেরি গো রাউন্ডের বাইরে থাকা কেউ বলবে, সেখানে কোনো বাইরের বল নেই, শুধু আছে মেঝের বক্রতা।
আইনস্টাইন এসব বিষয় একত্র করলেন। যে বলের কারণে আপনি মেরি গো রাউন্ডের ওপর পড়ে যাচ্ছেন, তা ঘটে মেরি গো রাউন্ডটির বক্রতার কারণে। যে কেন্দ্রবিমুখী বলটি অনুভব করেন, তা মহাকর্ষের সমতুল্য। অর্থাৎ সেটি এমন এক কল্পিত বল, যা একটা ত্বরিত কাঠামোর মাধ্যমে তৈরি হয়। অন্য কথায়, কোনো কাঠামোর ত্বরণ হুবহু মহাকর্ষের প্রভাব, যা স্থান বক্র হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে।
এখন মেরি গো রাউন্ডের জায়গায় সৌরজগৎকে বসানো যাক। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। কাজেই পৃথিবীবাসীর একটা ভ্রম হয় যে সূর্য পৃথিবীর দিকে একধরনের আকর্ষণ বল নিঃসরণ করছে, যাকে আমরা গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বলি। কিন্তু সৌরজগতের বাইরে থেকে কেউ যদি দেখে, তাহলে তারা কোনো বল দেখতে পাবে না। তারা দেখবে পৃথিবীর চারদিকের স্থান বক্র। এই খালি স্থান পৃথিবীকে ধাক্কা দিচ্ছে, যাতে সেটি সূর্যের চারপাশে একটা বৃত্তাকার পথে চলে।
আইনস্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যবেক্ষণ ছিল, মহাকর্ষীয় আকর্ষণ আসলে একটা ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম। বস্তুদের চলাচলের কারণ এটা নয় যে মহাকর্ষ বা কেন্দ্রবিমুখী বল তাদের টানছে। বরং এর কারণ তাদের চারপাশের বক্র স্থান তাদের ধাক্কা দিচ্ছে। এটি বারবার বলার মতো : মহাকর্ষ টানে না, স্থান ধাক্কা দেয়।
শেক্সপিয়ার একবার বলেছিলেন, গোটা বিশ্বই এক রঙ্গমঞ্চ। আমরা হলাম অভিনেতা, যারা এই মঞ্চে ঢুকছি এবং বাইরে চলে যাচ্ছি। এই চিত্রটাই গ্রহণ করেছিলেন নিউটন। বিশ্ব স্থির এবং আমরা নিউটনের সূত্রগুলো মেনে এর সমতল পৃষ্ঠতলে চলাচল করছি।
কিন্তু এই ছবিটি বাতিল করে দেন আইনস্টাইন। পরিবর্তে তিনি বলেন, এই মঞ্চ বক্র এবং বিকৃত। কেউ যদি এর ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, তাহলে সে সোজা রেখা বরাবর হাঁটতে পারবে না। তাকে অনবরত ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে। কারণ, তার পায়ের নিচের মেঝে বাঁকা এবং তাকে মাতালের মতো টলমল পায়ে হাঁটতে হচ্ছে।
মহাকর্ষীয় আকর্ষণ একটা দৃষ্টিভ্রম। যেমন আপনি হয়তো এই মুহূর্তে কোনো চেয়ারে বসে এই বইটি পড়ছেন। স্বাভাবিকভাবেই বলবেন যে মহাকর্ষ আপনাকে এই চেয়ারের নিচের দিকে টানছে, তাই মহাকাশে ছিটকে যাচ্ছেন না। কিন্তু আইনস্টাইন এ ক্ষেত্রে বলতেন, আপনি চেয়ারে বসে থাকতে পারছেন, কারণ পৃথিবীর ভর আপনার মাথার ওপরের স্থানকে বিকৃত করে দিচ্ছে। এই বক্রতাই আপনাকে চেয়ারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ধরা যাক, বেশ বড় বিছানার একটা ম্যাট্রেসে ভারী কোনো বল রাখা হয়েছে। ভারী বলটি বিছানায় ডুবে যাবে। তাই একটা বক্রতা তৈরি হবে সেখানে। এবার একটা মার্বেল ওই ম্যাট্রেসের দিকে ছুড়ে দিলে সেটি বক্ররেখা ধরে চলতে থাকবে। আসলে মার্বেলটা বলটার চারদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকবে। দূর থেকে কোনো পর্যবেক্ষক হয়তো সেটা দেখে বলবেন, অদৃশ্য কোনো বল মার্বেলটাকে টানছে এবং তাকে বৃত্তাকারে ঘুরতে বাধ্য করছে। কিন্তু কাছ থেকে দেখা যাবে, সেখানে মোটেও কোনো অদৃশ্য বল নেই। মার্বেলটা সোজা রেখায় ঘোরে না, কারণ ম্যাট্রেসটা বক্র। তাই সবচেয়ে সোজা পথই এখানে উপবৃত্তাকার হয়ে যায়।
এখন মার্বেলের জায়গায় পৃথিবীকে বসানো যাক। আর ভারী বলটির জায়গায় বসানো যাক সূর্য এবং ম্যাট্রেসের জায়গায় স্থান- কাল। তাহলে দেখা যাবে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, কারণ সূর্য তার চারপাশের স্থানকে বাঁকিয়ে দিচ্ছে। আর পৃথিবী যে স্থানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তা সমতল নয়—বক্র।
আবার একটা ভাঁজ হয়ে থাকা এক টুকরা কাগজের ওপর দিয়ে কোনো পিঁপড়ার চলার কথা কল্পনা করুন। ওই পিঁপড়া সোজা পথে চলতে পারবে না। তারা হয়তো ভাববে, কোনো একটা বল তাদের অনবরত টানছে। কিন্তু পিঁপড়াদের দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে হবে, সেখানে আসলে কোনো বলই নেই। এই অন্তর্দৃষ্টিকে আইনস্টাইন নাম দিলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল রিলেটিভিটি। এতে ভারী কোনো বস্তুর ভরের কারণে স্থান-কাল বক্র হয়ে যায়। আর এটি আমাদের কাছে পরিণত হয় মহাকর্ষীয় বলের দৃষ্টিভ্রমে।
ছবি ৬ : বিছানার ম্যাট্রেসে একটা ভারী বল রাখা হলে সেটি নকশার মধ্যে ডুবে যায়। বলটির দিকে একটা মার্বেল ছুড়ে দিলে সেটি ম্যাট্রেসের কারণে সৃষ্ট বক্রতার চারপাশে ঘুরতে থাকে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, বলটা থেকে নিঃসৃত কোনো বল বা ফোর্স মার্বেলটাকে টেনে নিচ্ছে এবং তার চারপাশে ঘুরতে বাধ্য করছে। কিন্তু আসলে মার্বেলটার বলটিকে ঘিরে ঘোরার কারণ হলো ম্যাট্রেসটার বক্রতা। একইভাবে সূর্যের মহাকর্ষের বক্রতাও বহুদূরের কোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলোর গতিপথ বাঁকিয়ে দেয়। সূর্যগ্রহণের সময় টেলিস্কোপের সাহায্যে এই বক্রতা পরিমাপ করা যায়।
তার মানে, বিশেষ আপেক্ষিকতার চেয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতা অনেক বেশি শক্তিশালী ও প্রতিসম। কারণ এটি মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করে, যেটি স্থান-কালের সবকিছু প্রভাবিত করে। অন্যদিকে বিশেষ আপেক্ষিকতা কেবল কাজ করে স্থান ও কালের সোজা পথে মসৃণভাবে চলাচল করা বস্তুদের ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে প্রায় সবকিছুরই ত্বরণ হচ্ছে। রেসিং কার থেকে শুরু করে হেলিকপ্টার, রকেট— সবকিছুর ত্বরণ ঘটছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা ত্বরণের ক্ষেত্রে কাজ করে, যা স্থান-কালের প্রতিটি বিন্দুতে অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে।
সূর্যগ্রহণ এবং মহাকর্ষ
কোনো তত্ত্ব যত সুন্দরই হোক না কেন, তাকে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষামূলক যাচাইয়ের মুখোমুখি হতেই হবে। কাজেই বেশ কিছু সম্ভাব্য পরীক্ষার কথা ভাবলেন আইনস্টাইন। প্রথমটি ছিল বুধ গ্রহের অনিয়মিত কক্ষপথ। অনেক আগে থেকেই এর কক্ষপথ হিসাব করে সামান্য বিচ্যুতি দেখতে পেয়েছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। গ্রহটি নিউটনের সমীকরণের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নিখুঁত উপবৃত্তাকার পথে চলে না। বরং এটি কিছুটা এপাশ-ওপাশ নড়াচড়া করে চলে। তাতে ফুলের মতো একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়।
নিউটনের সূত্রগুলো রক্ষা করতে সূর্যের কাছে নতুন একটা গ্রহ থাকার কথা অনুমান করলেন জ্যোতির্বিদেরা। গ্রহটির নাম দেওয়া হলো ভালকান। গ্রহটি বুধ গ্রহের কক্ষপথের আরও ভেতরে ঘুরছে বলে ধারণা করা হলো। জ্যোতির্বিদেরা ভাবলেন, ভালকানের মহাকর্ষ বুধ গ্রহকে টানহেঁচড়া করে থাকতে পারে। তাই হয়তো বুধের কক্ষপথে এমন বিচ্যুতি পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে একই কৌশল ব্যবহার করে নেপচুন গ্রহটি আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিদেরা। কিন্তু অনেকবার পর্যবেক্ষণ করেও ভালকান নামের কোনো গ্রহের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না।
আইনস্টাইন নিজের মহাকর্ষ তত্ত্ব ব্যবহার করে বুধের অনুসূর (Perihelion) নতুন করে হিসাব করে দেখলেন। সূর্যের সবচেয়ে কাছের বিন্দুই হলো অনুসূর। এতে নিউটনের সূত্রে কিছু বিচ্যুতি পেলেন তিনি। তাঁর নিজের গণনার সঙ্গে বুধের কক্ষপথের নিখুঁত মিল পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন আইনস্টাইন। তিনি দেখলেন, বুধের কক্ষপথটি নিখুঁত উপবৃত্তাকার হতে যে পার্থক্য, তার পরিমাণ প্রতি শতাব্দীতে ৪২.৯ আর্ক সেকেন্ড। যা পরীক্ষামূলক ফলাফলের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে মিলে গেল। এ ব্যাপারে পরে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন, ‘কিছুদিনের জন্য আমি খুবই উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম। আমার সাহসী স্বপ্নটা এত দিনে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।’
আইনস্টাইন এটাও বুঝতে পারলেন, তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, আলোকরশ্মির গতিপথ সূর্যের কারণে বিচ্যুত হবে।
আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, সূর্যের মহাকর্ষ এতই শক্তিশালী যে তা পার্শ্ববর্তী নক্ষত্রগুলো থেকে আসা আলোর গতিপথ বাঁকিয়ে দেবে। এসব নক্ষত্র শুধু সূর্যগ্রহণের সময়ে দেখা যায়। তাই তাঁর তত্ত্বটা পরীক্ষা করে দেখতে ১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণ চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটা অভিযাত্রী দল পাঠানোর প্রস্তাব করেন আইনস্টাইন। (সেবার রাতের আকাশের দুটি ছবি তোলেন জ্যোতির্বিদেরা। একটাতে সূর্য অনুপস্থিত ছিল। আরেকটি ছবি তোলা হলো সূর্যগ্রহণের সময়ে। ছবি দুটির তুলনা করে দেখা গেল, সূর্যগ্রহণের সময় নক্ষত্রগুলোর অবস্থান সূর্যের মহাকর্ষের প্রভাবে সরে গেছে।
নিজের তত্ত্বটা যে সঠিক প্রমাণিত হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন আইনস্টাইন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, পরীক্ষাটিতে যদি তাঁর তত্ত্বটা ভুল প্রমাণিত হতো, তাহলে তিনি কী ভাবতেন। জবাবে এই বিজ্ঞানী বললেন, তাহলে ভাবতাম, ঈশ্বর নিশ্চয়ই কোনো ভুল করেছেন। এরপর এক সহকর্মীকে আইনস্টাইন চিঠিতে লিখেছেন, তাঁর বিশ্বাস ছিল যে তিনি সঠিক ছিলেন। কারণ, এতে দুর্দান্ত গাণিতিক সৌন্দর্য ও প্রতিসাম্য রয়েছে।
এই মহাকাব্যিক পরীক্ষাটি শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করেন জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন। পরীক্ষায় আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী এবং বাস্তব ফলাফলের মধ্যে লক্ষণীয় মিল দেখা গেল। (বর্তমানে মহাকর্ষের প্রভাবে নক্ষত্র থেকে আসা আলোর বেঁকে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়মিত ব্যবহার করেন জ্যোতির্বিদেরা। নক্ষত্রের আলো দূরবর্তী কোনো গ্যালাক্সির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। এতে আলোর বক্র একটা লেন্সের চেহারা দেখা যায়। একে বলা হয় গ্র্যাভিটি লেন্স বা আইনস্টাইনের লেন্স। )
১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার পান আইনস্টাইন। (তবে এ পুরস্কার তাঁকে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য দেওয়া হয়নি—অনুবাদক।) অচিরেই এই গ্রহের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্বের একজন হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি অধিকাংশ চলচ্চিত্র তারকা ও রাজনীতিবিদদের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। (১৯৩৩ সালে একটা মুভি প্রিমিয়ারে চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা গেল তাঁকে। একসময় অটোগ্রাফ শিকারিদের পাল্লায় পড়লেন দুজনই। আইনস্টাইন তখন চ্যাপলিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসবের মানে কী?’ চ্যাপলিন জবাব দিলেন, “কিছুই না, আসলেই কিছুই না।’ এরপর বললেন, ‘ওরা আমাকে দেখে আনন্দিত, কারণ সকলেই আমাকে বুঝতে পারে। আর ওরা আপনাকে দেখে আনন্দিত, কারণ কেউই আপনাকে বুঝতে পারে না।’)
যে তত্ত্বটি সুদীর্ঘ ২৫০ বছর ধরে চালু থাকা নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানকে ছুড়ে ফেলে দেবে, নিঃসন্দেহে তাকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তেই হবে। এ রকম একটা সন্দেহের নেতৃত্বে ছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্লস লেন পোর। আপেক্ষিকতা সম্পর্কে পড়ালেখা করে শেষমেশ তিনি রেগেমেগে বলে বসলেন, “মনে হচ্ছে, আমি যেন অ্যালিসের সঙ্গে ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং ম্যাড হ্যাটারের সঙ্গে চা খাচ্ছি।’
কিন্তু আইনস্টাইনকে সব সময় উৎসাহ দিতেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য বিরোধী পক্ষকে বুঝিয়ে এবং তাদের আলো দেখিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং বিরোধী পক্ষের মৃত্যু হলে এবং তত্ত্বটির সঙ্গে পরিচিত নতুন একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠলেই কেবল তা প্রতিষ্ঠিত হয়।’
আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে কয়েক দশক ধরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু প্রতিবারই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব। আসলে পরের অধ্যায়গুলোয় দেখা যাবে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের পুরো শৃঙ্খলা নতুন রূপ দিয়েছে, বিপ্লব এনে দিয়েছে মহাবিশ্বের জন্ম ও তার সম্পর্কে আমাদের ধারণায়। সেই সঙ্গে বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনযাত্রাও।
আইনস্টাইনের তত্ত্বটা নিশ্চিত করার একটা সহজ উপায় হলো আপনার মুঠোফোনে জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করা। জিপিএস সিস্টেমে থাকে পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণনরত একত্রিশটি স্যাটেলাইট। যেকোনো সময় আপনার মুঠোফোন ওসব স্যাটেলাইটের তিনটি থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে। স্যাটেলাইট তিনটির প্রতিটি কিছুটা ভিন্ন বঙ্কিম পথ ও কোণে চলাচল করছে। মুঠোফোনের কম্পিউটার এই তিনটা স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করে আপনার প্রায় নিখুঁত অবস্থান প্রকাশ করে।
বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা আমলে নিয়ে জিপিএস সিস্টেমে ছোট্ট সংশোধনী যোগ করা না হলে জিপিএস সিস্টেম এত নির্ভুল হতো না।
স্যাটেলাইট ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল বেগে চলাচল করছে। জিপিএসের স্যাটেলাইটে থাকা একটা ঘড়ি বিশেষ আপেক্ষিকতার কারণে পৃথিবীর চেয়ে কিছুটা ধীরগতিতে স্পন্দিত হচ্ছে। বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে, উচ্চগতির কারণে সময় ধীর হয়ে যায়। এই পরিঘটনা বেরিয়ে এসেছিল আইনস্টাইনের মানস পরীক্ষায় একটা আলোকরশ্মির পিছু ধাওয়া করার মাধ্যমে। কিন্তু মহাকাশে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই মহাকর্ষ দুর্বল হয়ে যায়। তাই সাধারণ আপেক্ষিকতার কারণে সময়ের গতি কিছুটা দ্রুতগতির হয়। সাধারণ আপেক্ষিকতা মতে, মহাকর্ষের টানে স্থান-কাল বক্র হয়ে যায়। যেখানে মহাকর্ষের টান যত দুর্বল, সময়ও তত জোরে চলে সেখানে। তার মানে, বিশেষ আপেক্ষিকতা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা পরস্পর বিপরীত দিকে কাজ করে। বিশেষ আপেক্ষিকতার কারণে সংকেতগুলো ধীরগতির হয়, অন্যদিকে সাধারণ আপেক্ষিকতার কারণে সংকেত হয় দ্রুতগতির। আপনার হাতের মোবাইল এরপর এই বিপরীতমুখী দুটো প্রভাবকে আমলে নিয়ে আপনার অবস্থান বলে দেয় নিখুঁতভাবে। মানে, বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার দ্বৈত প্রভাব ছাড়া হিসাব করলে আপনি হারিয়ে যেতেন।
নিউটন ও আইনস্টাইন : বিপরীত দুই মেরু
আইনস্টাইনকে পরবর্তী নিউটন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে আইনস্টাইন ও নিউটন ছিলেন দুই বিপরীত মেরুর মানুষ। নিউটন ছিলেন নিঃসঙ্গ, স্বল্পভাষী ও অমিশুক। তাঁর কোনো আজীবন-বন্ধু ছিল না এবং দৈনন্দিন কথোপকথনেও ছিলেন না পারদর্শী।
পদার্থবিদ জেরেমি বার্নস্টেইন একবার বলেছিলেন, আইনস্টাইনের সঙ্গে যাদের ভালো সম্পর্ক ছিল, তাদের প্রত্যেকে ওই ব্যক্তির আভিজাত্যের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ফিরতেন। তাঁর জন্য একটি বর্ণনামূলক শব্দ, যা বারবার বলা যায়, সেটা হলো মানবতাবাদী। এটা তাঁর চরিত্রের সরল ও ভালোবাসার যোগ্য একটি গুণ।’
কিন্তু নিউটন ও আইনস্টাইন দুজনের মধ্যে কিছু ব্যাপারে মিল ছিল। প্রথমটা হলো দুজনের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা এবং মানসিক শক্তিকে একত্র করার প্রচণ্ড ক্ষমতা। নিউটন যখন কোনো সমস্যায় মনোনিবেশ করতেন, তখন খেতে বা ঘুমাতে ভুলে যেতেন। কোনো কথোপকথনের মাঝখানে এসে হুট করে থেমে যেতেন। হাতের কাছে ন্যাপকিন বা ঘরের দেয়াল সামনে যা পেতেন, সেখানেই আঁচড় কেটে হিজিবিজি লিখতে শুরু করতেন তিনি। একইভাবে অনেক বছর ধরে, এমনকি কয়েক দশক ধরেই একটা সমস্যার পেছনে লেগে থাকতে পারতেন আইনস্টাইনও। সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে কাজ করার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে শারীরিকভাবে প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন।
৬৪
আরেকটা বৈশিষ্ট্যে মিল ছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে। সেটা হলো কোনো সমস্যাকে ছবির মতো কল্পনা করার ক্ষমতা। নিউটন প্রিন্সিপিয়ার গোটাটাই লিখতে পারতেন বীজগাণিতিক প্রতীক ব্যবহার করে। কিন্তু তা না করে তিনি এই মাস্টারপিসটা ভরে রেখেছেন জ্যামিতিক রেখাচিত্রে। ক্যালকুলাসের বিমূর্ত প্রতীক তুলনামূলকভাবে সহজ, কিন্তু সেগুলো ত্রিভুজ আর বর্গক্ষেত্র থেকে তুলে আনতে পারে শুধু একজন দক্ষ ব্যক্তি। একইভাবে আইনস্টাইনের তত্ত্বও ভরা থাকত ট্রেন, মাপনদণ্ড আর ঘড়ির রেখাচিত্র দিয়ে।
একীভূত তত্ত্বের খোঁজে
শেষ পর্যন্ত দুটি প্রধান তত্ত্ব প্রণয়ন করেন আইনস্টাইন। প্রথমটি ছিল বিশেষ আপেক্ষিকতা, যা আলোকরশ্মির ধর্ম ও স্থান-কালকে ব্যাখ্যা করে। এটি চার মাত্রায় ঘূর্ণনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিসাম্যের প্রবর্তন করে। দ্বিতীয়টি ছিল সাধারণ আপেক্ষিকতা। এ তত্ত্বে দেখা গেল, মহাকর্ষ আসলে স্থান-কালের বক্রতার ফল।
কিন্তু এই স্মরণীয় দুটি অর্জন সত্ত্বেও তৃতীয় আরেক তত্ত্বে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন আইনস্টাইন। বলতে গেলে, সেটাই হয়তো তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হতো। তিনি এমন এক তত্ত্ব প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন, যেটা মহাবিশ্বের সব কটি বলকে একটামাত্র সমীকরণে একীভূত করতে পারবে। ক্ষেত্র তত্ত্বের ভাষা ব্যবহার করে তিনি এমন একটা সমীকরণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেটা তাঁর নিজের মহাকর্ষ তত্ত্বকে একত্র করতে পারবে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের তত্ত্বের সঙ্গে। এই দুটি তত্ত্বকে একীভূত করতে কয়েক দশক ধরে চেষ্টা চালান আইনস্টাইন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। (মাইকেল ফ্যারাডে আসলে প্রথমবার মহাকর্ষের সঙ্গে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলকে একীভূত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফ্যারাডে প্রায়ই লন্ডন ব্রিজে যেতেন এবং চুম্বক ফেলে দিতেন। তিনি আশা করতেন, এভাবে চুম্বকের ওপর মহাকর্ষের কোনো পরিমাপযোগ্য প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখান থেকে আসলে কিছুই পাওয়া যায়নি।)
একটা কারণে ব্যর্থ হয়েছিলেন আইনস্টাইন। সেটা হলো ১৯২০- এর দশকে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার মধ্যে অনেক বড় ধরনের ফাঁক ছিল। এই জিগস পাজলের মধ্যে একটা টুকরা যে হারিয়ে গেছে, তা বুঝতে পদার্থবিদদের প্রয়োজন পড়ল নতুন ও উন্নত এক তত্ত্ব। সেটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এরপরই কেবল বোঝা গেল, ওই হারিয়ে যাওয়া টুকরাটা হলো নিউক্লিয়ার ফোর্স বা পারমাণবিক বল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম তত্ত্বের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। তা সত্ত্বেও একসময় তিনি হয়ে ওঠেন কোয়ান্টামের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরুদ্ধে লাগামছাড়া সমালোচনার গোলা ছুড়তেন তিনি। কিন্তু কয়েক দশক ধরে প্রতিটি পরীক্ষামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে তত্ত্বটি। সেই সঙ্গে বিস্ময়কর সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির বন্যা বইয়ে দিয়েছে আমাদের জীবন ও কর্মক্ষেত্রে। তবে আমরা অচিরেই দেখতে পাব, কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতি আইনস্টাইনের সেই গভীর, সূক্ষ্ম দার্শনিক অভিযোগগুলো এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।