৩. কোয়ান্টামের উত্থান
আইনস্টাইন যখন একা হাতে স্থান ও কাল এবং বস্তু ও শক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন বিস্তৃত তত্ত্ব গড়ে তুলছেন, তখন পদার্থবিজ্ঞানে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠছিল আরেকটি তত্ত্ব। প্রাচীনকালের সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজছিল তত্ত্বটা—বস্তু কী দিয়ে তৈরি? একসময় সেটাই পদার্থবিজ্ঞানের বড় একটা তত্ত্ব হয়ে উঠল। কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
নিউটন তাঁর মহাকর্ষ তত্ত্ব সম্পন্ন করার পর, আলকেমি নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা চালিয়েছেন। এভাবে বস্তুর প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। অনেকের অনুমান, তাঁর হতাশাগ্রস্ততার পেছনে ছিল পারদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কারণ পারদ বিষাক্ত পদার্থ, যার প্রভাবে নিউরোলজিক্যাল লক্ষণ দেখা যায়। তবে বস্তুর মৌলিক ধর্ম সম্পর্কে এভাবে খুব কমই জানতে পারেন তিনি। আবার আগের আলকেমিস্টদের কাজ থেকেও অতি অল্পই জানতে পারেন। কারণ, আগের আলকেমিস্টরা আসলে তাদের সময় ও শ্রমের প্রায় সবটাই খরচ করেছিল সিসাকে সোনা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।
বস্তু বা পদার্থের গোপনীয়তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে লেগে গিয়েছিল বেশ কয়েক শতাব্দী। অবশেষে ১৮০০-এর দশকের দিকে প্রকৃতির মৌলিক উপাদান খুঁজে পেতে শুরু করেন রসায়নবিদেরা। একসময় সেগুলো আলাদা করতেও সক্ষম হন। এসব উপাদান সরলতর কোনো কিছুতে বিয়োজিত হয়ে যেতে পারবে না। পদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি হচ্ছিল গণিতের মাধ্যমে। অন্যদিকে রসায়নে বড় ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছিল প্রধানত গবেষণাগারে ক্লান্তিকর পরিশ্রমের কারণে।
১৮৬৯ সালের দিকে একটা স্বপ্ন দেখেন রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিভ। আসলে প্রকৃতির সব কটি মৌলিক উপাদানকে একটা তালিকায় সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। জেগে উঠে দ্রুত জানা মৌলগুলোকে একটা নিয়মিত তালিকায় সাজান। এতে তিনি দেখান, এসব মৌলের মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে। এভাবে রসায়নের বিশৃঙ্খলা হুট করে একটা শৃঙ্খলা আর পূর্বাভাসের মধ্যে চলে এল। তাঁর পদ্ধতিতে তখনকার আবিষ্কৃত ৬০টি মৌলকে একটা সরল তালিকায় সাজানো সম্ভব হয়। কিন্তু তালিকায় কিছু শূন্যস্থান ছিল। অবাক ব্যাপার হলো, এই শূন্যস্থানের মৌলগুলোর ধর্ম কেমন হবে—তা ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হন মেন্ডেলিভ। গবেষণাগারে ওই মৌলগুলো যখন সত্যি সত্যিই আবিষ্কৃত হলো, তখন মেন্ডেলিভের কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। তাঁর খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ল দ্রুতবেগে।
কিন্তু মৌলগুলো এ রকম নিয়মিত প্যাটার্নে সাজানো থাকে কেন?
এ বিষয়ে পরবর্তী অগ্রগতি ঘটে মেরি ও পিয়েরে কুরির হাতে, ১৮৯৮ সালে। নতুন ধরনের অস্থিতিশীল মৌল আলাদা করতে চেষ্টা করছিলেন কুরি দম্পতি। সেগুলো আগে কখনো দেখা যায়নি। কোনো শক্তির উৎস ছাড়াই রেডিয়াম মৌলকে গবেষণাগারে উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে দেখা গেল। পদার্থবিজ্ঞানের সযত্নে লালিত অন্যতম নীতি অমান্য করে বসল এই আবিষ্কার। সে নীতির নাম শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি (অর্থাৎ শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না)। কিন্তু রেডিয়াম থেকে নিঃসৃত রশ্মি কোথাও থেকে আসছে বলে মনে হলো না। পরিষ্কার বোঝা গেল, একে ব্যাখ্যার জন্য নতুন কোনো তত্ত্বের প্রয়োজন।
তার আগপর্যন্ত রসায়নবিদেরা বিশ্বাস করতেন, বস্তুর মৌলিক উপাদান বা মৌল চিরন্তন। হাইড্রোজেন বা অক্সিজেনের মতো মৌল সব সময় স্থিতিশীল। কিন্তু নিজেদের গবেষণাগারে রসায়নবিদেরা রেডিয়ামের মতো মৌলগুলোতে দেখলেন, সেগুলো ক্ষয় হয়ে অন্য মৌলে পরিণত হচ্ছে। আবার এই প্রক্রিয়ায় বিকিরণ নিঃসৃত হচ্ছে।
এই অস্থিতিশীল মৌলগুলো কত দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে, তা গণনা করে দেখা সম্ভব হলো। হিসাব কষে দেখা গেল, সেগুলো ক্ষয় হতে লেগে যেতে পারে কয়েক হাজার বছর থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর। কুরি দম্পতির আবিষ্কার দীর্ঘদিনের একটা বিতর্কের মীমাংসা করতে সহায়তা করল। শিলা গঠনে হিমবাহের গতিবেগ দেখে বিস্মিত হতেন ভূতত্ত্ববিদেরা। এসব দেখে তাঁরা বুঝতে পারলেন, পৃথিবীর বয়স অবশ্যই কয়েক বিলিয়ন বছর। কিন্তু চিরায়ত ভিক্টোরিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বড় বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন হিসাব কষে দেখতে পেলেন, উত্তপ্ত ও গলিত পৃথিবী মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছরেই শীতল হয়ে যেতে পারে। তাহলে কার কথা সঠিক?
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ভূতাত্ত্বিকদের কথাই ঠিক। আসলে লর্ড কেলভিন প্রকৃতির নতুন একটা বলের কথা বুঝতে পারেননি। কুরি দম্পতির আবিষ্কার করা সেই বলটি, যার নাম নিউক্লিয়ার ফোর্স বা পারমাণবিক বল। এই বলটি পৃথিবীতে তাপ যোগ করতে পারে। তেজস্ক্রিয় ক্ষয় চলতে পারে কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে। তাই এর মানে দাঁড়ায়, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এবং অন্যান্য তেজস্ক্রিয় মৌলের ক্ষয়ের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। কাজেই ভূমিকম্প থেকে বেরিয়ে আসা তীব্র শক্তি, বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরি এবং ধীরগতির মহাদেশীয় চলন—সব কটিই উদ্ভূত হয়েছে পারমাণবিক বল থেকে।
১৯১০ সালে এক টুকরা উজ্জ্বল রেডিয়াম একটা সিসার বাক্সের ভেতর রাখলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। বাক্সটিতে একটা অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র রাখা হয়েছিল। ছিদ্রটা দিয়ে বেরিয়ে এল ছোট বিকিরণ রশ্মি। এবার পাতলা সোনার পাত লক্ষ করে সেই বিকিরণ ছুড়ে দেওয়া হলো। আশা করা হয়েছিল, ওই বিকিরণ শোষণ করে নেবে সোনার পরমাণু। কিন্তু ভীষণ হতবাক হয়ে রাদারফোর্ড দেখতে পান, রেডিয়াম থেকে আসা রশ্মিটা পাতলা পাতের ভেতর দিয়ে সরাসরি বেরিয়ে চলে গেল, যেন সেখানে কিছুই নেই।
পরীক্ষাটার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। তার মানে হলো, পরমাণু প্রাথমিকভাবে খালি জায়গা দিয়ে গঠিত। এ পরীক্ষাটি আমরা মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের করে দেখাই। তখন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এক টুকরা অক্ষতিকর ইউরেনিয়াম। হাতের উল্টো পাশে রাখা হয় একটা গাইগার কাউন্টার। এই যন্ত্র দিয়ে বিকিরণ শনাক্ত করা যায়। গাইগার কাউন্টারে ক্লিক শব্দ শুনে বেশ হতবাক হয়ে যায় এসব শিক্ষার্থী। কারণ, তাদের দেহটা আসলে ফাঁকা। দেহের ওই ফাঁক গলে বিকিরণটা অন্য পাশে চলে গেছে।
১৯০০-এর দশকের শুরুর দিকে পরমাণুর সাধারণ চিত্রটা ছিল কিশমিশ পাই মডেল। অর্থাৎ পরমাণু হলো ধনাত্মক চার্জবাহী পাইয়ের মতো। সেখানে ইলেকট্রনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে কিশমিশের মতো। কিন্তু রাদারফোর্ডের এই পরীক্ষার পর ক্রমান্বয়ে উদয় হতে থাকে পরমাণুর নতুন এক চিত্র। বোঝা গেল, পরমাণু আসলে ফাঁপা। এতে অতিক্ষুদ্র ঘন কেন্দ্রকে ঘিরে ইলেকট্রনগুলো ঘুরপাক খায়। অতিক্ষুদ্র ঘন এই কেন্দ্রকে বলা হয় নিউক্লিয়াস বা পরমাণু কেন্দ্রীণ। রাদারফোর্ডের পরীক্ষাটি এটি প্রমাণে সহায়তা করেছিল। কারণ, তাঁর তেজস্ক্রিয় রশ্মিটা মাঝেমধ্যে নিউক্লিয়াসের ভেতরে ঠাসাঠাসি করে থাকা কণার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকে চলে যেত। এভাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আকার নির্ণয় করতে সক্ষম হন তিনি। হিসাব কষে দেখা গেল, একটা পরমাণুর চেয়ে নিউক্লিয়াসের আকার এক লাখ ভাগ ছোট।
পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, নিউক্লিয়াস আসলে আরও অতিপারমাণবিক কণা দিয়ে গঠিত। সেগুলো হলো প্রোটন এবং নিউট্রন (প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক এবং নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। এতে মনে করা হলো মেন্ডেলিভের মৌলের তালিকা মাত্র তিনটি অতিপারমাণবিক কণা দিয়ে গঠিত হয়েছে। সেগুলো হলো ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। কিন্তু এই কণাগুলো কোন সমীকরণ মেনে চলে?
কোয়ান্টাম–বিপ্লব
এসব ঘটনার মধ্যেই নতুন একটা তত্ত্বের জন্ম হলো। এই রহস্যময় আবিষ্কারগুলো ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল তত্ত্বটা। এ তত্ত্বটাই একসময় এক বিপ্লবের জন্ম দিল, যা চ্যালেঞ্জ করে বসল মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানা সবকিছুকে। একে বলা হয় কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু কোয়ান্টাম আসলে কী? আর এর গুরুত্বটাই-বা কী?
কোয়ান্টামের জন্ম হয়েছিল ১৯০০ সালে। সে সময় জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক নিজেকে একটা সরল প্রশ্ন করেছিলেন। বস্তুকে উত্তপ্ত করা হলে তা জ্বলজ্বল করে কেন? কয়েক হাজার বছর আগে মানবজাতি যখন আগুন নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছে, তখন থেকে তারা খেয়াল করেছিল যে উত্তপ্ত বস্তু নির্দিষ্ট রঙের দ্যুতি ছড়ায়। বহু শতাব্দী ধরে কুমার বা মৃৎশিল্পীরাও জানতেন, কোনো বস্তু কয়েক হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রায় পৌঁছালে তার রং বদলে যায়। শুরুতে সেগুলো লাল আভা ছড়ায়, তারপর হলুদ ও সবশেষে নীল। (একটা ম্যাচ বা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজেই ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। একেবারে নিচের শিখাটি সবচেয়ে উত্তপ্ত থাকে এবং তার রংটা দেখাবে হয়তো নীলচে। কেন্দ্রের দিকে হলদে আভা এবং সবচেয়ে ওপরে তুলনামূলক শীতল থাকার কারণে তার শিখাটি হবে লালচে।)
নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলো পরমাণুতে ব্যবহার করে এই প্রভাবটা গণনা করার চেষ্টা করলেন পদার্থবিদেরা। কিন্তু তাতেই শুরু হলো ঝামেলা। (একে বলা হয় ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ। কৃষ্ণবস্তু হলো এমন একটা বস্তু, যা তার ওপর পড়া সব বিকিরণ সুষমভাবে শোষণ করে। কৃষ্ণ বা কালো, কারণ কালো রং সব আলো শোষণ করতে পারে।)
নিউটনের সূত্রমতে, পরমাণু যত উত্তপ্ত হবে, তাদের কম্পন ও বাড়বে তত দ্রুত। অন্যদিকে ম্যাক্সওয়েলের সূত্রমতে, কম্পনশীল চার্জগুলো আলোকরশ্মি রূপে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে। কিন্তু পদার্থবিদেরা যখন উত্তপ্ত, কম্পনশীল পরমাণু থেকে নিঃসৃত বিকিরণ হিসাব করলেন, তখন ফলাফলটা প্রত্যাশামতো পাওয়া গেল না। নিম্ন কম্পাংকে ডেটা বা উপাত্তের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে মিলে গেল মডেলটা। তবে উচ্চ কম্পাংকে আলোর শক্তি ক্রমেই অসীম হয়ে যেতে দেখা গেল। কিন্তু সেটা তো হাস্যকর। পদার্থবিদদের কাছে এই অসীম ফলাফলের মানে হলো, সমীকরণটা যে কাজ করছে না তার চিহ্ন। তাই আসলে কী ঘটছে তা বোঝা গেল না।
তখন একটা সরল অনুমান করলেন বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। তিনি ভাবলেন, শক্তি হয়তো নিউটনের তত্ত্বের মতো অবিচ্ছিন্ন ও মসৃণ নয়, বরং তা বিচ্ছিন্ন প্যাকেট আকারে ঘটছে। এই বিচ্ছিন্ন প্যাকেটকে বলা হলো কোয়ান্টা। তিনি যখন শক্তির এসব প্যাকেট সাজালেন, তখন দেখতে পেলেন, উত্তপ্ত বস্তুগুলো থেকে যে শক্তি নিঃসৃত হচ্ছে, তা নিখুঁতভাবে পুনরুৎপাদন করতে পারা যাচ্ছে। বস্তু যত উত্তপ্ত, তার বিকিরণের কম্পাংকও তত বেশি, যা আলোক বর্ণালির বিভিন্ন রঙের সঙ্গে খাপ খায়।
এ কারণে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিখার রং লাল থেকে নীলের দিকে বদলে যায়। এভাবে আমরা সূর্যের তাপমাত্রা জানতে পারি। সূর্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস শুনে প্রথমে আপনি হয়তো ভেবে বিস্মিত হতে পারেন, কথাটা আমরা জানলাম কীভাবে? সূর্যে তো কেউ থার্মোমিটার নিয়ে গিয়ে তাপমাত্রা মেপে আসেনি। আসলে আমরা সূর্যের তাপমাত্রা জানতে পেরেছি সেখান থেকে নিঃসৃত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপ করে।
এরপর প্ল্যাঙ্ক আলোকশক্তির এই বিচ্ছিন্ন প্যাকেট বা কোয়ান্টার আকার গণনা করলেন ছোট্ট এক ধ্রুবক h-এর সঙ্গে তুলনা করে। একে বলা হয় প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। এর মান 6.6 × 10-34 জুল-সেকেন্ড। (উপাত্তের সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ না খাওয়া পর্যন্ত এসব প্যাকেটের শক্তিকে সমন্বয় করতে গিয়ে কাগজে-কলমে এ সংখ্যাটি পান প্ল্যাঙ্ক।)
প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকটা আমরা যদি ক্রমান্বয়ে শূন্য হতে দিই, তাহলে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সব কটি সমীকরণ নিউটনের সমীকরণে পরিণত হয়। (এর মানে, অতিপারমাণবিক কণাদের উদ্ভট আচরণ প্রায়ই আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান অমান্য করে। আর প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক ম্যানুয়ালি শূন্যে সেট করা হলে তা ধীরে ধীরে আমাদের পরিচিত নিউটনিয়ান গতির সূত্রে পরিণত হয়।) তাই দৈনন্দিন জীবনে কোয়ান্টামের প্রভাব খুব কমই দেখা যায়। আমাদের অনুভূতি অনুসারে, এই বিশ্ব অনেক বেশি নিউটনিয়ান। কারণ, প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক খুবই ছোট একটি সংখ্যা এবং তা মহাবিশ্বের অতিপারমাণবিক পর্যায়েই শুধু প্রভাব ফেলে।
এই ছোট্ট প্রভাবগুলোকে বলা হয় কোয়ান্টাম কারেকশন বা কোয়ান্টাম সংশোধনী। অনেক পদার্থবিদ তাঁদের গোটা জীবনটাই ব্যয় করেন সেগুলো গণনার চেষ্টা করে। ১৯০৫ সালে, অর্থাৎ আইনস্টাইন যে বছর বিশেষ আপেক্ষিকতা আবিষ্কার করলেন, সে বছর তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্ব আলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। এভাবে তিনি প্রমাণ করেন, আলো আসলে শুধু তরঙ্গ নয়, বরং শক্তির বিচ্ছিন্ন প্যাকেটের মতো বা কণা। একেই বলা হয় ফোটন। কাজেই দেখা গেল, স্পষ্টতই আলোর রূপ দুটি—ম্যাক্সওয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীর মতো তরঙ্গ এবং প্ল্যাঙ্ক ও আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, একটা কণা বা ফোটন। এভাবে তখন আলোর একটা নতুন চিত্র উদ্ভূত হলো। আলো ফোটন দিয়ে গঠিত, যারা কোয়ান্টা বা কণা। কিন্তু প্রতিটি ফোটন তার চারপাশে ক্ষেত্র তৈরি করে (বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র)। এই ক্ষেত্রগুলোর আকৃতি তরঙ্গের মতো, যারা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ মেনে চলে। কাজেই আমাদের হাতে এখন কণা এবং তার চারপাশের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে চমৎকার একটা সম্পর্ক রয়েছে।
আলোর যদি দুটি রূপ হয় (তরঙ্গ ও কণা হিসেবে), তাহলে ইলেকট্রনেরও কি এ রকম অদ্ভুত দ্বৈততা আছে? বিজ্ঞানীদের কাছে এটাই ছিল পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ। তার প্রভাবটা ছিল আরও গভীর। সেটা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান-জগৎ ও সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দিল।
ইলেকট্রন তরঙ্গ
এরপরের ঘটনায় হতবাক হয়ে গেলেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। দেখা গেল, ইলেকট্রনকে যেখানে একসময় দৃঢ় বিন্দুর মতো কণা হিসেবে ভাবা হতো, সেটাও আচরণ করতে পারে তরঙ্গের মতো। সেটা পরীক্ষার জন্য দুটি সমান্তরাল কাগজের টুকরা নিতে হবে। কাগজ দুটোকে রাখতে হবে একটার পেছনে আরেকটা। প্রথম কাগজে দুটি ছিদ্র করতে হবে এবং তারপর সেখানে একটা ইলেকট্রন বিম ছুড়তে হবে। স্বাভাবিকভাবে আশা করা হয় যে দ্বিতীয় কাগজের ওপর দাগ খুঁজে পাওয়া যাবে দুটি। কারণ, ওই দুই জায়গায় ইলেকট্রন বিম আঘাত করার কথা। হিসাবমতো, ইলেকট্রন বিম হয় প্রথম ছিদ্রটা দিয়ে, নয়তো দ্বিতীয় ছিদ্র দিয়ে যাবে। দুটো ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার কথা নয়। আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান তা-ই বলে।
কিন্তু পরীক্ষাটি বাস্তবে করতে গেলে দেখা যায়, দ্বিতীয় কাগজের বিন্দুর প্যাটার্ন একটা উল্লম্ব লাইনে ব্যান্ড বা পট্টির মতো সাজানো। তরঙ্গ যখন পরস্পরের সঙ্গে ব্যতিচার করে, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। (পরের বার গোসল করার সময় দুটি জায়গায় একই সঙ্গে আলতোভাবে পানি ছিটিয়ে দিন। তাহলে ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি হতে দেখতে পাবেন। অনেকটা মাকড়সার জালের মতো দেখাবে।)
ছবি ৭ : ডাবল স্লিট বা দ্বিচিড়ের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন এমনভাবে ঢুকছে, যেন তারা তরঙ্গ। অর্থাৎ সেগুলো অন্য পাশে একটা আরেকটার সঙ্গে এমনভাবে ব্যতিচার ঘটাচ্ছে, যেন দুটি ছিদ্র দিয়ে একই সঙ্গে ঢুকেছে। নিউটনিয়ান জগতে এমনটা ঘটা একেবারে অসম্ভব। কিন্তু এটাই কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তি।
কিন্তু এর মানে হলো, এক অর্থে ইলেকট্রন দুটো ছিদ্র দিয়ে একই সঙ্গে ঢুকেছে। এটা একটা প্যারাডক্স—ইলেকট্রনের মতো একটা বিন্দুকণা কীভাবে নিজেই নিজের সঙ্গে ব্যতিচার করতে পারে? এসব দেখে মনে হয়, সেটা যেন দুটি আলাদা ছিদ্র দিয়ে একই সঙ্গে ঢুকেছে। আবার ইলেকট্রন সম্পর্কিত অন্য কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, তারা হারিয়ে যাচ্ছে এবং তারপর আবারও অন্য কোনো জায়গা থেকে উদয় হচ্ছে। নিউটনিয়ান জগতে এমনটা ঘটা একেবারেই অসম্ভব। প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকটা যদি যথেষ্ট বড় হতো এবং মানুষের পরিসরের বস্তুগুলোকে প্রভাবিত করত, তাহলে এই বিশ্ব হয়ে যেত একেবারেই অজানা আর উদ্ভট একটা জায়গা। তাহলে বস্তুগুলো যেকোনো সময় অদৃশ্য হয়ে যেত এবং হুট করে উদয় হতো ভিন্ন কোনো জায়গা থেকে। আবার একই সময়ে তারা দুই জায়গাতেও থাকতে পারত।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব যতটা অসম্ভব বলে মনে হোক না কেন, তত্ত্বটা একে একে যেসব সাফল্য দেখাতে শুরু করে, তা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার তাঁর বিখ্যাত সমীকরণটা লিখে ফেলেন। সেটা এসব কণা তরঙ্গের গতি ব্যাখ্যা করতে পারল নিখুঁতভাবে। একটা প্রোটনের চারপাশে ঘূর্ণমান এক ইলেকট্রনবিশিষ্ট হাইড্রোজেন পরমাণুতে সমীকরণটা প্রয়োগ করার পর পরীক্ষার সঙ্গে তা লক্ষণীয়ভাবে মিলেও গেল। শ্রোডিঙ্গারের পরমাণুতে ইলেকট্রনের স্তরগুলো পরীক্ষামূলক ফলাফলের সঙ্গে মিলে যায় নিখুঁতভাবে। আসলে মেন্ডেলিভের গোটা পর্যায় সারণি বা মৌলের তালিকাকে তাত্ত্বিকভাবে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সমাধান হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।
পর্যায় সারণির ব্যাখ্যা
কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম অর্জন হলো এটি পদার্থের গাঠনিক একক বা পরমাণু ও অণুর আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। শ্রোডিঙ্গারের মতে, ইলেকট্রন হলো একটা তরঙ্গ, যা অতিক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘিরে থাকে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ কীভাবে চলাচল করে, তা দেখা যাবে ছবি ৮-এ। একটা পূর্ণাঙ্গসংখ্যক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ এখানে খুব ভালোমতো খাপ খায়। কিন্তু যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য পূর্ণ সংখ্যা নয়, সেটা নিউক্লিয়ারের চারপাশে পুরোপুরি আবৃত থাকে না। সেগুলো অস্থিতিশীল এবং স্থিতিশীল পরমাণু গঠন করতে পারে না। অর্থাৎ ইলেকট্রন চলাচল করতে পারে শুধু নির্দিষ্ট শেলগুলোতে।
নিউক্লিয়াস থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, এই প্রাথমিক প্যাটার্নটি বারবার ঘুরেফিরে আসে। ইলেকট্রন সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের রিংটা কেন্দ্র থেকে আরও দূরে সরে যায়। কেন্দ্র থেকে যত দূরে যাওয়া যাবে, ইলেকট্রন পাওয়া যাবে তত বেশি। এটিই ব্যাখ্যা করে কেন মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিতে নিয়মিত অবিচ্ছিন্ন পর্যায় থাকে, পর্যায়ক্রমে যেগুলোর আবার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। সেখানে প্রতিটি পর্যায় আগের শেলের আচরণ নকল করে।
ছবি ৮ : একটা পরমাণুর ভেতর খাপ খায় শুধু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ইলেকট্রন। অর্থাৎ তার কক্ষপথ অবশ্যই ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পূর্ণ সংখ্যার গুণিতক হতে হবে। তাই নিউক্লিয়াসের চারপাশে অবিচ্ছিন্ন শেল গঠন করতে বাধ্য হয় ইলেকট্রন তরঙ্গ। এসব শেল ইলেকট্রন কীভাবে পূরণ করে, তার বিশদ বিশ্লেষণ মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে।
শাওয়ারে গান গাওয়ার সময় এই প্রভাবটা খেয়াল করা যায়। শুধু নির্দিষ্ট অবিচ্ছিন্ন কম্পাংক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাথরুমের দেয়ালে প্রতিফলিত ও বিবর্ধিত হয়। কিন্তু অন্য যেগুলো খাপ খায় না, সেগুলো বাতিল হয়ে যায়। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রন তরঙ্গের চলার পথও একই রকম। এখানেও শুধু নির্দিষ্ট অবিচ্ছিন্ন কম্পাংক কাজ করে।
এই যুগান্তকারী ঘটনা পদার্থবিজ্ঞানের গতিপথ মৌলিকভাবে বদলে দেয়। পরমাণুকে ব্যাখ্যা করার পর সে বছর পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলেন পদার্থবিদেরা। পরের বছর শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ ব্যবহার করে পরমাণুর ভেতরের ধর্ম গণনা করা সম্ভব হলো। মাঝে মাঝে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের কোয়ান্টাম মেকানিকস পড়াই আমি। তাদের একটা বিষয়ে কথা বলে মুগ্ধ করার চেষ্টা করি। তাদের বলি, চারপাশের সবকিছু শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের সমাধান হিসেবে প্রকাশ করা যায়। শুধু পরমাণুই নয়, বরং পরমাণুর যে বন্ধনের মাধ্যমে অণু গঠিত হয়, তা-ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আবার যেসব রাসায়নিক পদাৰ্থ দিয়ে আমাদের গোটা মহাবিশ্ব গঠিত, তা-ও ব্যাখ্যা করা যায় শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ দিয়ে।
তবে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ যত শক্তিশালীই হোক না কেন, এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এটা কাজ করে শুধু অল্প বেগের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ এটা ননরিলেটিভিস্টিক বা অনাপেক্ষিক। আলোর গতি বা বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে কিছু বলে না শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ। আবার ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মাধ্যমে আলোর সঙ্গে ইলেকট্রন কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করে, তা-ও বলে না। এ ছাড়া আইনস্টাইনের তত্ত্বে যে প্রতিসাম্যের সৌন্দর্য আছে, তা-ও এতে নেই। তাই সমীকরণটা শ্রীহীন ও গাণিতিকভাবে এ নিয়ে কাজ করা করা বেশ কঠিন
ডিরাকের ইলেকট্রন তত্ত্ব
এরপর বিশ বছর বয়সী পদার্থবিদ পল ডিরাক এমন একটা তরঙ্গ সমীকরণ লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, যেটা স্থান ও কালকে একীভূত করে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা মেনে চলবে। শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণে একটা বিষয় বেশ অমার্জিত। স্থান ও কাল এতে আলাদাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই গণনাগুলো প্রায়ই কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই দুটিকে একত্র করে ডিরাকের তত্ত্ব। আবার এতে চারমাত্রিক প্রতিসাম্যও আছে। কাজেই সমীকরণটা সুন্দর, বাহুল্যবর্জিত ও মার্জিত। এভাবে শ্রোডিঙ্গারের আসল সমীকরণের সব কটি শ্রীহীন পদ একটি সরল চারমাত্রিক সমীকরণে পরিণত করা হয়।
(মনে আছে, আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। সে সময় মরিয়া হয়ে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ শেখার চেষ্টা করেছিলাম। এর ভেতরের শ্রীহীন পদগুলোর সঙ্গে সেবার বেশ লড়াই করতে হয়েছিল আমাকে। তখন ভেবেছিলাম, প্রকৃতি এতটা প্রতিকূল কীভাবে হয় যে এ রকম জবরজং একটা তরঙ্গ সমীকরণ প্রণয়নের দরকার পড়ে? এরপর একদিন ডিরাকের সমীকরণের সঙ্গে পরিচিত হই। জিনিসটা সুন্দর আর বাহুল্যবর্জিত বলে মনে হলো আমার। সেটা দেখে আমি যে প্ৰায় কেঁদে ফেলেছিলাম, সে কথা বেশ মনে আছে।)
ডিরাক সমীকরণের সাফল্য ছিল দেখার মতো। আমরা আগেই দেখেছি, ফ্যারাডে প্রমাণ করেন যে তারের কয়েলের মধ্যে একটা পরিবর্তনশীল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। কিন্তু একটা দণ্ড চুম্বকে এই চুম্বকীয় ক্ষেত্র কোথা থেকে আসে? সেখানে তো কোনো পরিবর্তনশীল চার্জ নেই! রহস্যজনক ব্যাপার। কিন্তু ডিরাকের সমীকরণ মতে, ইলেকট্রনের একটা স্পিন বা ঘূর্ণন আছে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। এই স্পিন থেকে নিজে নিজেই তৈরি হয় চুম্বকীয় ক্ষেত্র। ইলেকট্রনের এই ধর্ম গণিতের একেবারে শুরু থেকে সহজাতভাবে তৈরি হয়। (তবে আমাদের চারপাশের ঘূর্ণনের সঙ্গে এই স্পিনের কোনো মিল নেই। যেমনটা জাইরোস্কোপে দেখা যায়। আসলে ডিরাক সমীকরণে এটা একটা গাণিতিক পদ।) স্পিনের কারণে সৃষ্ট চুম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে ইলেকট্রনের চারপাশে পাওয়া সত্যিকার ক্ষেত্র নিখুঁতভাবে মিলে গেল। এভাবে চুম্বকত্বের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করেছিল এটি। তাহলে, একটা চুম্বকের মধ্যে চুম্বকীয় ক্ষেত্র কোথা থেকে আসে? আসে একটা ধাতবের ভেতরে আটকে পড়া ইলেকট্রনগুলোর স্পিন থেকে। পরে আবিষ্কৃত হয়, সব অতিপারমাণবিক কণারই স্পিন আছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা সম্পর্কে আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ডিরাকের সমীকরণ একটা অপ্রত্যাশিত নতুন ধরনের বস্তুর পূর্বাভাস দিল। বস্তুটি হলো অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ। প্রতিপদার্থও সাধারণ বস্তুকণার মতো একই সূত্র মেনে চলে, ব্যতিক্রম শুধু তাদের চার্জ বিপরীতধর্মী। কাজেই অ্যান্টি-ইলেকট্রন বা যাকে বলা হয় পজিট্রন, তার চার্জ ঋণাত্মক নয়, ধনাত্মক। তাত্ত্বিকভাবে অ্যান্টি-অ্যাটম বা প্রতিপরমাণু তৈরি করা সম্ভব। এতে থাকবে প্রতি-ইলেকট্রন, যা নিউক্লিয়াসে থাকা প্রতি-প্রোটন ও প্রতি-নিউট্রনকে কেন্দ্র করে ঘুরবে। কিন্তু পদার্থ ও প্রতিপদার্থের একত্রে সংঘর্ষ হলে বিস্ফোরিত হয়ে নিঃসরণ করবে শক্তি। (থিওরি অব এভরিথিংয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই প্রতিপদার্থ। কারণ, চূড়ান্ত তত্ত্বে সব কণার একটা প্রতিকণা জোড়া থাকে। )
***
এর আগে কোনো তত্ত্বের জন্য প্রতিসাম্যকে নান্দনিক আনন্দ ও গৌণ বলে ভাবতেন পদার্থবিদেরা। কিন্তু এখন প্রতিসাম্যের শক্তিতে তাঁরা হতবাক। কারণ, এটি আসলে সম্পূর্ণ নতুন ও অপ্রত্যাশিত ভৌত পরিঘটনার পূর্বাভাস দেয়। (যেমন প্রতিবস্তু ও ইলেকট্রনের স্পিন)। পদার্থবিদেরা এখন বুঝতে শুরু করেছেন, প্রতিসাম্য আসলে মৌলিক পর্যায়ে মহাবিশ্বের এক অপরিহার্য ও অনিবার্য ধর্ম।
তরঙ্গায়িত গতি কী?
কিন্তু তারপরও কিছু খুঁতখুঁতে প্রশ্ন এখানে রয়ে গেছে। ইলেকট্রনের যদি তরঙ্গের মতো ধর্ম থাকে, তাহলে সেই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যম কী? তরঙ্গায়িত গতি (waving) কী? আবার দুটি ভিন্ন ছিদ্র দিয়ে এটি একই সঙ্গে কীভাবে প্রবেশ করে? একই সময়ে একটা ইলেকট্রন দুই জায়গায় থাকতে পারে কীভাবে?
উত্তরটা ছিল চমকপ্রদ ও অবিশ্বাস্য। পদার্থবিজ্ঞান সমাজ একসময় এ কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯২৬ সালে লেখা ম্যাক্স বর্নের গবেষণাপত্র অনুযায়ী, তরঙ্গায়িত গতি হলো যেকোনো বিন্দুতে একটা ইলেকট্রন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা। অন্য কথায়, আপনি নিশ্চিত করে নির্ভুলভাবে বলতে পারবেন না, একটা ইলেকট্রন কোথায় ছিল। ইলেকট্রনটা কোথায় খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, শুধু সেটুকুই জানা সম্ভব। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তার নীতিতে কথাটা সংকলিত আছে। এ নীতি অনুযায়ী, একটা ইলেকট্রনের ভরবেগ এবং অবস্থান একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে জানা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, ইলেকট্রন হলো কণা, কিন্তু যেকোনো জায়গায় এই কণাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেয় একটা ওয়েভ ফাংশন।
এই ধারণাটা ছিল বৈপ্লবিক। যার মানে দাঁড়ায়, কোনোভাবেই ভবিষ্যৎ অনুমান করা সম্ভব নয়, শুধু নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনুমান করা যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের সফলতা ছিল অনস্বীকার্য। এ ব্যাপারে আইনস্টাইন লেখেন, ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব যত সফল হচ্ছে, সেটা দেখতে ততই হাস্যকর মনে হচ্ছে।’ এমনকি শ্রোডিঙ্গার প্রথম ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধারণা চালু করা সত্ত্বেও নিজের সমীকরণগুলোর সম্ভাবনাময় ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে বসেন নিজেই। এমনকি এখনো তরঙ্গ তত্ত্বের প্রয়োগ নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন পদার্থবিদেরা। একই সময়ে কেউ দুই জায়গায় থাকতে পারে কীভাবে? তাই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একবার বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা, কেউই কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বোঝে না।’
নিউটনের যুগের পর থেকে ডিটারমিনিজম বা নিয়তিবাদ নামে এক ধারণায় বিশ্বাস করতেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। এ দর্শনমতে, ভবিষ্যতের সব ঘটনা নিখুঁতভাবে আগাম বলা সম্ভব। প্রকৃতির সূত্রগুলো মহাবিশ্বের সবকিছুর গতি নির্ধারণ করে, তাদের শৃঙ্খলায় আনে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্য করে তোলে। নিউটনের কাছে গোটা মহাবিশ্ব ছিল একটা ঘড়ির মতো। সেটা নিখুঁত অনুমানযোগ্য প্রক্রিয়ায় স্পন্দিত হয়। তাই মহাবিশ্বের সব কণার অবস্থান ও ভরবেগ জানা সম্ভব হলে ভবিষ্যতের সব ঘটনার অনুমান করা সম্ভব।
ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়া সব সময় নশ্বর মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ম্যাকবেথএ শেক্সপিয়ার লিখেছেন
‘If you can look into the seeds of time
And say which grain will grow and which will not,
Speak, then, to me. ‘
নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী, কোন শস্যদানা জন্মাবে এবং কোনটা জন্মাবে না, তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। কয়েক শতাব্দী ধরে এই দৃষ্টিভঙ্গি পদার্থবিদদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল। কাজেই অনিশ্চয়তা নীতিটা ছিল প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ ধারণা। তাই তা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের কেন্দ্র কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
ক্ল্যাশ অব টাইটান
এই বিতর্কের এক পক্ষে ছিলেন আইনস্টাইন এবং শ্রোডিঙ্গার। তাঁরাই একসময় প্রথম কোয়ান্টাম-বিপ্লব শুরু করতে সহায়তা করেছিলেন। আরেক পক্ষে ছিলেন নীলস বোর ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। এই দুই বিজ্ঞানী ছিলেন নতুন কোয়ান্টাম তত্ত্বের স্রষ্টা। বিতর্কটা চরমে পৌঁছায় ১৯৩০ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ষষ্ঠ সলভে কনফারেন্সে। এর আগেও বাস্তবতার মানে খুঁজতে গিয়ে যুগে যুগে কিংবদন্তি পদার্থবিদদের এ রকম সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে।
পল এরেনফেস্ট লিখেছেন, ‘দুই বিপক্ষ দলের ইউনিভার্সিটি ক্লাব ছেড়ে চলে যাওয়ার সেই দৃশ্যটা আমি কখনো ভুলতে পারব না। রাজকীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আইনস্টাইনের ঠোঁটে মৃদু বাঁকা হাসি, শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাঁর পাশে চরম হতাশা নিয়ে দুলকি চালে হাঁটছেন বোর।’ হলওয়েতে বিড়বিড় করে বোরের মুখে একটা শব্দই উচ্চারণ করতে শোনা যেত, ‘আইনস্টাইন…আইনস্টাইন… আইনস্টাইন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলেছেন আইনস্টাইন। অথচ একটা সময় তিনিই ছিলেন এ তত্ত্বের নেতৃত্ব পর্যায়ে। তত্ত্বটা যে কত উদ্ভট, বারবার সেটা বোঝানোর চেষ্টা করতেন তিনি। কিন্তু আইনস্টাইনের প্রতিটি সমালোচনা একের পর এক বেশ সফলভাবে রুখে দিয়েছেন নীলস বোর। আইনস্টাইন যখন বললেন, “ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না’, তখন বোর পাল্টা জবাব দিলেন, ‘ঈশ্বরকে উপদেশ দেওয়া বন্ধ করুন।’
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ জন হুইলার বলেছেন, ‘আমার জানামতে, বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় বিতর্ক। গত ত্রিশ বছরে মহান দুজন মানুষের মধ্যে এত দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের অদ্ভুত এই মহাবিশ্বকে উপলব্ধির জন্য গভীরতর পরিণতির সঙ্গে এত গভীর কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে কখনো শুনিনি।
ইতিহাসবিদেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমত যে সেবার ওই বিতর্কে জেতেন নীলস বোর এবং কোয়ান্টামের বিদ্রোহীরা।
তারপরও কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তিতে যে ফাটল আছে, তা প্রকাশ করতে সফল হন আইনস্টাইন। তিনি দেখান, কাদামাটির দার্শনিক পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক দানব। এই সমালোচনা এখনো শোনা যায়, যার সব কেন্দ্র এখন একটা নির্দিষ্ট বিড়ালকে ঘিরে।
শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল
শ্রোডিঙ্গার একটা সরল চিন্তন পরীক্ষা ভেবে বের করেছিলেন। সমস্যাটার সারমর্ম প্রকাশ করে ওই চিন্তন পরীক্ষাটি। পরীক্ষাটা এ রকম : একটা বাক্সে এক টুকরা ইউরেনিয়াম রাখা যাক। ইউরেনিয়াম থেকে যখন অতিপারমাণবিক কণা ছুটে বেরিয়ে আসবে, তখন এর ফলে চালু হবে গাইগার কাউন্টার। তাতে তার সঙ্গে সংযুক্ত একটা বন্দুক থেকে একটা বুলেট ছুটে যাবে একটা বিড়ালের দিকে। প্ৰশ্ন হলো : বিড়ালটা কি মৃত, নাকি জীবিত?
ইউরেনিয়াম পরমাণুর ছুটে যাওয়ার পুরোটাই কোয়ান্টাম ঘটনা। তাই এর মানে, বিড়ালটিকে কোয়ান্টাম মেকানিকসের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণনা করতে হবে। হাইজেনবার্গের মতে, বাক্সটা খোলার আগে বিড়ালটা থাকবে বিভিন্ন কোয়ান্টাম অবস্থার একটা মিশ্রণ হিসেবে। অর্থাৎ বিড়ালটা হবে দুটি তরঙ্গের যোগফল। একটা তরঙ্গ এক মৃত বিড়াল বর্ণনা করে, আর অন্যটা বর্ণনা করে এক জীবিত বিড়াল। আসলে বিড়ালটা মৃতও নয়, জীবিতও নয়, বরং দুটোর মিশ্রণ। বিড়ালটা জীবিত নাকি মৃত, তা বলার একমাত্র উপায় বাক্সটা খোলা এবং পর্যবেক্ষণ করা। তখন মৃত বা জীবিত বিড়ালের মধ্যে ওয়েভ ফাংশন কলাপস করবে বা ধসে যাবে। অন্য কথায়, পর্যবেক্ষণই অস্তিত্ব নির্ধারণ করে (আর পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন চেতনার )।
আইনস্টাইনের মতে, এসব কিছুই অযৌক্তিক। এর সঙ্গে বিশপ বার্কলির দর্শনের মিল আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বনের ভেতর যদি একটা গাছ ভেঙে পড়ে, কিন্তু সেখানে যদি ওই শব্দ শোনার মতো কেউ না থাকে, তাহলে গাছটা পড়ে যাওয়ার সময় কি কোনো শব্দ হয়েছিল? সলিপসিস্ট বা আত্মজ্ঞানবাদীরা হয়তো এর উত্তরে বলবেন, না। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব তার চেয়েও জটিল। এ তত্ত্ব বলে, বনের মধ্যে যদি একটা গাছ থাকে, আর তার আশপাশে যদি কেউই না থাকে, তাহলে গাছটির অস্তিত্ব হবে বিভিন্ন অবস্থার যোগফল। যেমন একটা পোড়া গাছ, একটা চারাগাছ, একটা আগুনের কাঠ, প্লাইউড ইত্যাদি। আপনি যখন গাছটার দিকে তাকাবেন, শুধু তখনই জাদুকরি কোনো উপায়ে তার ওয়েভ বা তরঙ্গ ধসে একটা সাধারণ গাছে পরিণত হবে।
তাই আইনস্টাইনের বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘কোনো ইঁদুর চাঁদটার দিকে তাকিয়ে দেখেছে বলেই আকাশে ওই চাঁদটার অস্তিত্ব আছে নাকি?’ কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কতটা অমান্য করে, সেটা আসলে কোনো বিষয় নয়। কারণ, অন্তত একটা কারণে একে বেছে নেওয়া যায়। সেটা হলো পরীক্ষামূলকভাবে এটি সঠিক। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী দশমিকের পর ১১ ঘর পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তাতে তা পরিণত হয়েছে সর্বকালের সবচেয়ে সঠিক তত্ত্বে।
অবশ্য আইনস্টাইন স্বীকার করেছেন, কোয়ান্টাম তত্ত্বে সত্যের অন্তত কিছু অংশ আছে। এমনকি ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের জন্য শ্রোডিঙ্গার এবং হাইজেনবার্গের নামও প্রস্তাব করেছিলেন তিনি।
এই বিড়াল সমস্যা নিয়ে পদার্থবিদদের মধ্যে এখনো কোনো সর্বজনীন ঐকমত্য নেই। (নীলস বোরের পুরোনো কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বাস্তব বিড়াল শুধু পর্যবেক্ষণের কারণে বিড়ালটার ওয়েভ ফাংশন ধসে যাওয়ার জন্য উদয় হয়। এই ব্যাখ্যা অনেকের অপছন্দ। এর আংশিক কারণ, ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে আমরা এখন নির্দিষ্ট পরমাণুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং এসব পরীক্ষা করে দেখতে পারি। তবে এর ব্যাখ্যা হিসেবে আরও বেশি জনপ্রিয় মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব তত্ত্ব। মাল্টিভার্সের ব্যাখ্যায় মহাবিশ্ব অর্ধেকে বিভক্ত হয়ে যায়। যার অর্ধেক অংশে থাকে একটা মৃত বিড়াল এবং অন্য অংশে থাকে একটা জীবিত বিড়াল।)
কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাফল্যের কারণে ১৯৩০-এর দশকে পদার্থবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি নতুন একটা পুরস্কারের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। সেটা ছিল বহু পুরোনো একটা প্রশ্নের উত্তর—সূর্য জ্বলে কেন?
সূর্য থেকে শক্তি
অনেক আগে থেকে বিশ্বের বড় ধর্মগুলোতে সূর্যকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু পুরাণে সূর্যকে বসানো হয়েছে একেবারে কেন্দ্রে। সূর্য ছিল অন্যতম শক্তিশালী দেবতা, যে স্বর্গ শাসন করত। গ্রিকদের কাছে সূর্য হলো দেবতা হেলিয়স। এই দেবতা প্রতিদিন তার উজ্জ্বল রথটিতে চড়ে রাজকীয় চালে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যায়। এভাবে বিশ্বকে আলোকিত এবং জীবন দান করে সূর্য দেবতা। আর অ্যাজটেক, মিসরীয় আর হিন্দুদের কাছেও সূর্য দেবতার নিজস্ব সংস্করণ রয়েছে।
কিন্তু ইউরোপে রেনেসাঁর সময় সূর্যকে পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা চালান কিছু বিজ্ঞানী। সূর্য যদি কাঠ বা তেল দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে অনেক আগেই তার জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। আবার বাইরের বিস্তৃত মহাকাশে বাতাসও নেই। তাই সূর্যের শিখাও অনেক আগেই নিভে যাওয়ার কথা। কাজেই সূর্যের অফুরন্ত জ্বালানি জন্ম দিল নতুন এক রহস্যের।
১৮৪২ সালে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ দেখা দিল। প্রত্যক্ষবাদ বা পজিটিভিজম দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে বলে বসলেন, বিজ্ঞান শক্তিশালী তাতে সন্দেহ নেই। মহাবিশ্বের বেশ কিছু রহস্য উন্মোচনও করতে পারে বিজ্ঞান। কিন্তু এত সাফল্যের পরও একটা বিষয় বিজ্ঞানের নাগালের বাইরেই রয়ে যাবে। এমনকি বড় বড় বিজ্ঞানীও সেই প্রশ্নের উত্তর জোগাতে পারবেন না বলে দাবি করলেন কোঁতে। সে প্রশ্নটা হলো, বিভিন্ন গ্রহ এবং সূর্য কী দিয়ে তৈরি?
সেকালের জন্য সেটা ছিল একটা যৌক্তিক চ্যালেঞ্জ। কারণ, বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি সব সময় পরীক্ষণযোগ্য। বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার পুনরুৎপাদন করা যায় এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা যায়। কিন্তু সূর্যের কোনো উপাদান একটা বোতলে ভরে পৃথিবীতে আনা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। কাজেই যুক্তি অনুযায়ী, সেই প্রশ্নের উত্তরটাও চিরকাল আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে যাওয়ার কথা।
মজার ব্যাপার হলো, নিজের লেখা দ্য পজিটিভ ফিলোসফি নামের বইতে কোঁতে এই দাবি করার কয়েক বছর পর পদার্থবিদেরা এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। দেখা গেল, সূর্য মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি।
সামান্য হলেও গুরুতর একটা ভুল করেছিলেন কোঁতে। হ্যাঁ, বিজ্ঞান অবশ্যই সব সময় পরীক্ষা করে দেখা যায়, কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, বেশির ভাগই বিজ্ঞানই আসলে গড়ে উঠেছে পরোক্ষভাবে।
উনিশ শতকের বিজ্ঞানী ছিলেন জোসেফ ভন ফ্রনহফার। তিনি তাঁর যুগের সবচেয়ে নিখুঁত ও নির্ভুল স্পেকট্রোগ্রাফ তৈরি করে কোঁতের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। (স্পেকট্রোগ্রাফ বা বর্ণালি বীক্ষণ যন্ত্রে উপাদানগুলোকে উত্তপ্ত করা হয়, যতক্ষণ না সেটা কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ নিঃসরণ করে। সেখান থেকে নিঃসৃত আলো একটা প্রিজমের ভেতর দিয়ে পাঠানো হয়, যা থেকে তৈরি হয় রংধনু। এই রংগুলোর নকশার ভেতরে কিছু অন্ধকার ব্যান্ড বা দাগও থাকে। এসব ব্যান্ড তৈরি হওয়ার কারণ ইলেকট্রনগুলো এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে কোয়ান্টাম লাফ দেয়। লাফ দেওয়ার সময় ইলেকট্রন নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ করে। প্রতিটি উপাদান বা মৌলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যান্ড আছে। তাই প্রতিটি বর্ণালি ব্যান্ড হলো একটা হাতের ছাপের মতো। এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব ওই পদার্থটি কী দিয়ে তৈরি। স্পেকট্রোগ্রাফ ব্যবহার করে অসংখ্য অপরাধও সমাধান করা হয়। কারণ, এর মাধ্যমে বোঝা সম্ভব অপরাধীর পায়ের ছাপের ধুলো বা কাদা কোথা থেকে এসেছে, কিংবা বিষের ভেতরের বিষাক্ত পদার্থের প্রকৃতি কী কিংবা আণুবীক্ষণিক তন্তু বা চুলের উৎপত্তি কোথা থেকে। আবার একটা অপরাধস্থলে থাকা সবকিছুর রাসায়নিক পদার্থগুলোর কম্পোজিশন নির্ধারণও করা যায় স্পেকট্রোগ্রাফ ব্যবহার করে।)
সূর্যের আলোর এই ব্যান্ড বিশ্লেষণ করে ফ্রনহফার এবং অন্যরা বলতে সক্ষম হলেন, সূর্য মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত (আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পরীক্ষার মাধ্যমে সূর্যের ভেতর একটা নতুন অজানা পদার্থও খুঁজে পান পদার্থবিদেরা। এর নাম দেওয়া হলো হিলিয়াম। এ শব্দের অর্থ সূর্য থেকে পাওয়া ধাতব পদার্থ আসলে হিলিয়ামের প্রথম সন্ধান মিলেছিল পৃথিবীতে নয়, সূর্যে। অনেক পরে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, হিলিয়াম আসলে ধাতু নয়, একধরনের গ্যাস। )
অবশ্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারও করেন ফ্রনহফার। নক্ষত্র থেকে আসা আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান, সেগুলোও আসলে এমন সব পদার্থ দিয়ে তৈরি, যেগুলো পৃথিবীতেও পাওয়া যায়। এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কারণ, এর মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়া গেল, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র শুধু সৌরজগতেই নয়, বরং গোটা মহাবিশ্বেই একই রকম।
আইনস্টাইনের তত্ত্বগুলো একবার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর হ্যান্স ব্যাথের মতো পদার্থবিদেরা সেগুলোকে একত্র করে বোঝার চেষ্টা করলেন, সূর্যের জ্বালানি আসলে কী। সূর্য যদি হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত হয়, তাহলে তার প্রচণ্ড মহাকর্ষ ক্ষেত্র হাইড্রোজেনকে সংকুচিত করতে থাকবে, যতক্ষণ না প্রোটনগুলো ফিউজ হয় বা জোড়া লেগে যায়। এভাবে হিলিয়াম ও উচ্চতর মৌলগুলো তৈরি হতে থাকবে। হাইড্রোজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেন যুক্ত হয়ে যে হিলিয়াম গঠন করে, তার ভর একত্র প্রোটন ও নিউট্রনের ভরের চেয়ে কিছুটা কম। তার মানে, আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc^2-এর মাধ্যমে এই হারিয়ে যাওয়া ভরটাই শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
কোয়ান্টাম মেকানিকস এবং যুদ্ধ
কোয়ান্টাম থিওরির মন আচ্ছন্ন করা প্যারাডক্স নিয়ে পদার্থবিদেরা যখন বিতর্কে লিপ্ত, তখন ইউরোপের দিগন্তে ক্রমে দানা বেঁধে উঠছিল ভয়াবহ যুদ্ধের মেঘ। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার। এরপর জার্মানি থেকে পদার্থবিদদের পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়, কেউবা গ্রেপ্তার হন কিংবা তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় পড়তে হয় কাউকে কাউকে।
একদিন বাদামি পোশাকধারী নাৎসিরা ইহুদি পথিক ও দোকানিদের হয়রানি করছিল। সে দৃশ্য স্বচক্ষে দেখলেন শ্রোডিঙ্গার। তাদের থামাতে গেলে তাঁকেও রেহাই দিল না নাৎসিরা। তাঁকেও মারধর করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নাৎসিদের একজন যখন চিনতে পারল যে তারা যাঁকে পেটাচ্ছে, তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী, কেবল তখনই থামল। এ রকম বড় ধরনের এক ধাক্কা খেয়ে দ্রুত অস্ট্রিয়া ছেড়ে চলে যান শ্রোডিঙ্গার। প্রতিদিনের দমন-নিপীড়নের খবরে আতঙ্কিত হয়ে জার্মান বিজ্ঞানের মেধাবী ব্যক্তিত্বরা দেশ ছেড়ে পালাতে থাকেন।
তাঁদের রক্ষায় এ সময় এগিয়ে এলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। ব্যক্তিগতভাবে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে তিনি জার্মান বিজ্ঞানীদের গণহারে দেশান্তরি হওয়া থামানোর অনুরোধ জানান। কারণ, সে জন্য দেশটির সেরা ব্যক্তিত্বদের মনে রক্তরক্ষণ হচ্ছিল। কিন্তু ইহুদিদের নিন্দা করে প্ল্যাঙ্ককে লক্ষ্য করে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন হিটলার। এরপর প্ল্যাঙ্ক লিখলেন, ‘এ রকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলাও অসম্ভব।’ (দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হিটলারকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে প্ল্যাঙ্কের ছেলেকেও নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তারপর দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।)
কয়েক দশক ধরে আইনস্টাইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁর সমীকরণটা আদৌ পরমাণুর গভীরে আটকে থাকা বিপুল পরিমাণ শক্তিকে বের করে আনতে পারে কি না। জবাবে আইনস্টাইন সব সময় না বলতেন। কারণ, একটা পরমাণু থেকে বের করে আনা শক্তির পরিমাণ বাস্তবে খুবই অল্প ছিল।
তবে বিজ্ঞানেও জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন হিটলার। তাই তিনি এমন শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র বানাতে চাইলেন, যা বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি ভি-১, ভি-২ এবং পারমাণবিক বোমার মতো সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী যুদ্ধাস্ত্র। মোটকথা, সূর্য যদি নিউক্লিয়ার এনার্জির মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে, তাহলে একই ধরনের উৎস ব্যবহার করে বড় ধরনের যুদ্ধাস্ত্র হয়তো বানানো সম্ভব।
আইনস্টাইনের সমীকরণ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার মূল চিন্তাটা এল পদার্থবিদ লিও জিলার্ডের কাছ থেকে। জার্মান পদার্থবিদেরা দেখিয়েছিলেন, ইউরেনিয়াম পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত হানা হলে তা ভেঙে অর্ধেকে পরিণত হয় এবং সেখান থেকে আরও নিউট্রন বেরিয়ে আসে। একটা ইউরেনিয়াম পরমাণুর এই ভাঙন থেকে যে পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে, তা খুবই অল্প। কিন্তু জিলার্ড বুঝতে পারলেন, চেইন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম পরমাণুর এই শক্তির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। একটা ইউরেনিয়াম ভেঙে দুটি নিউট্রন পাওয়া যায়। এসব নিউট্রনকে এরপর আরও দুটি ইউরেনিয়াম পরমাণুর ফিশন ঘটাতে বা ভাঙতে ব্যবহার করা যায়। যেখান থেকে চারটি নিউট্রন বেরিয়ে আসবে। এরপর ক্রমেই নিউট্রনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে আটটি, ষোলোটি, বত্রিশটি, চৌষট্টিটি (এবং আরও)। অর্থাৎ ইউরেনিয়াম পরমাণুর ভাঙনের সংখ্যা সূচকীয় হারে বাড়তে থাকবে। এভাবে ক্রমেই একটা শহর গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো শক্তি তৈরি হবে সেখান থেকে।
এরপর হুট করে সলভে কনফারেন্সে একটা গোপন আলোচনায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন পদার্থবিদেরা। সে আলোচনা গোটা জনগোষ্ঠী, জাতিসমূহ এবং মানবসভ্যতার ভাগ্য অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে জীবন-মৃত্যুর মতো জরুরি এক প্রশ্নে পরিণত হলো।
আইনস্টাইন যখন জানতে পারলেন, বোহেমিয়া এলাকায় ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পিচব্লেন্ড খনি সিল করে দিয়েছে নাৎসি বাহিনী, তখন আতঙ্কিত হলেন। এরপর শান্তিকামী হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটা ভাগ্যনির্ধারণী চিঠি লিখতে বাধ্য হন তিনি। চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পারমাণবিক বোমা বানানোর আরজি জানান আইনস্টাইন। রুজভেল্ট পরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক প্রজেক্ট অনুমোদন করেন। সেই প্রজেক্টের নাম ম্যানহাটান প্রজেক্ট।
ওদিকে জার্মানিতে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ তখন ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। তাঁকে বানানো হলো নাৎসি পারমাণবিক বোমা প্রজেক্টের প্রধান। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, হাইজেনবার্গ হয়তো মিত্রবাহিনীর পারমাণবিক বোমা প্রকল্পকে পরাজিত করতে পারবেন, সেই আশঙ্কা করছিল ওএসএস। এটি ছিল সিআইএর প্রতিনিধি সংগঠন। সে ভয়ে হাইজেনবার্গকে হত্যারও পরিকল্পনা করে তারা। ১৯৪৪ সালে সাবেক ব্রুকলিন ডজারস ক্যাচার মো বার্গকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জুরিখে হাইজেনবার্গের এক বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলেন বার্গ। জার্মানদের বোমা বানানোর প্রচেষ্টা শেষের দিকে, বার্গের মনে যদি এমন কোনো ধারণা হয়, তাহলে ওই পদার্থবিদকে হত্যার আদেশও দেওয়া হয়েছিল। (এই কাহিনি বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে নিকোলাস ডায়িডফের বই দ্য ক্যাচার ওয়াজ আ স্পাই শিরোনামের বইয়ে। )
সৌভাগ্যক্রমে মিত্রবাহিনীর তুলনায় নাৎসি বোমা প্রজেক্ট অনেক পিছিয়ে ছিল। আর্থিক অনুদানও অনেক কম ছিল এতে। আবার কিছুটা দেরিও করে ফেলেছিল তারা। বোমা বানানোর সেই ঘাঁটিতে বোমা হামলাও চালায় মিত্রবাহিনী। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যার সমাধান তখনো করতে পারেননি হাইজেনবার্গ। সেটা হলো চেইন রিঅ্যাকশন শুরু করতে এনরিচড বা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের পরিমাণ নির্ধারণ। এই পরিমাণকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল মাস বা সংকট ভর। (আসলে এর পরিমাণ মোটামুটি ২০ পাউন্ড ইউরেনিয়াম-২৩৫, যা হাতের তালুতেই রাখা যায়। )
যুদ্ধের পর বিশ্ববাসী ধীরে ধীরে জানতে পারে যে গোপন ও অস্পষ্ট কোয়ান্টাম তত্ত্বের সমীকরণগুলোতে শুধু পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের চাবিকাঠিই নয়, রয়েছে খোদ মানবজাতির গন্তব্যেরও মূল চাবিকাঠি। তবে যুদ্ধের আগে যে প্রশ্নটি পদার্থবিদদের ধাঁধায় ফেলেছিল, সেই প্রশ্নে ধীরে ধীরে আবারও ফিরে আসতে শুরু করেন তাঁরা। প্রশ্নটি ছিল, পদার্থের জন্য কীভাবে একটা সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রণয়ন করা যায়।