মুখবন্ধ
গ্যালিলিও, ডারউইন, আমাদের হরিপদ কাপালী—এঁদের সবারই অর্জনের মধ্যে যে যোগসূত্রটি রয়েছে তা হলো, আমাদের চারপাশে ঘটনাবলির পর্যবেক্ষণ। কিন্তু বিজ্ঞানে শুধু পর্যবেক্ষণ করেই আমরা ক্ষান্ত হই না, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের মধ্যে আরও গভীর যোগাযোগ আছে কি না, তা বের করার চেষ্টা করি।
এই আবিষ্কারের জন্য যে যজ্ঞ, তা অনেক সময় বিশাল আকারের হলেও তার ফলাফল বেশির ভাগ সময়ই ক্ষুদ্র আকারে প্রকাশ করা হয়, আর সেটা বেশির ভাগ সময়ই হয় কোনো গাণিতিক সমীকরণ বা কোনো সংকেতের মাধ্যমে। যেমন ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে সমাজে বেশ বিতর্ক থাকলেও জীবজগতের লম্বা ইতিহাসের পেছনে যে ডিএনএ নামের একটি অণুর খেলা রয়েছে, তা নিয়ে আমরা ঝগড়াঝাঁটি করতে বসি না। আর এই লম্বা অণুর গঠনকে আমরা খুব সরল একটি সংকেত ব্যবহার (ATGC) দিয়ে প্রকাশ করছি—যার সঙ্গে বিজ্ঞানের সব শিক্ষার্থীই পরিচিত।
এ রকম প্রতীক বা বিশেষায়িত ভাষা ব্যবহার করেই আমরা খুব জটিল একটা ব্যাপারকে তুলে ধরছি সবার সামনে। কিন্তু সাধারণ ভাষার সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে। কোনো একটি ভাবনার ওপর ভিত্তি করে কবি একটি কবিতা লিখতে পারেন, কিন্তু পাঠক তাঁর নিজের মনের মধ্যে ওই একটি কবিতারই ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতার ক্ষেত্রে এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এ রকম ঘটনা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘটলে আমরা ভীষণ রকম একটা বিপত্তিতে পড়ব। কিন্তু গণিতের ভাষায় প্রকাশ করলে এ রকম অনিশ্চয়তা হয় না—এ জন্যই আমরা বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে গাণিতিক ভাষায় প্রকাশ করি।
সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, কোন সূত্রগুলো সবচেয়ে মৌলিক? কারণ, এই সূত্রগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাকি সব সূত্র বের করা সম্ভব। সে জন্যই নিউটন থেকে শুরু করে পরবর্তী সব বিজ্ঞানীই চেষ্টা করেছেন মৌলিক এই সব সূত্রের গাণিতিক রূপগুলো বের করতে। এই প্রয়াসগুলোর একটি ইতিহাস তুলে ধরেছেন মিচিও কাকু।
এই বইটির ইংরেজি সংস্করণ পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। বইটি পড়ার আগে আমার ধারণা ছিল যে মিচিও কাকু, যিনি পদার্থবিজ্ঞানের অপরীক্ষিত তত্ত্ব নিয়ে ফ্যান্টাসি বোনেন। বলাই বাহুল্য, মিচিও কাকুর এ ধরনের লেখা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু এই বইয়ে আমরা আরেক মিচিও কাকুর দেখা পাচ্ছি, যিনি আমাদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব নিয়েই মোনে (Monet)-এর মতো ইম্প্রেশনিস্ট চিত্র এঁকেছেন। আমি আবুল বাসারকে এই বইটি অনুবাদ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই বিজ্ঞানপ্রেমী বাংলাভাষী সাধারণ পাঠককে এই নতুন মিচিও কাকুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমরা এই ‘গড ইকুয়েশন’-এর প্রতিপাদনের অপেক্ষায় রইলাম।
আরশাদ মোমেন
অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুবাদকের কথা
একটা বুম। মহাশূন্যে হুট করে এক বিশাল, বিপুল বিস্ফোরণ। একটা অবিশ্বাস্য রকম ক্ষুদ্র, অতি উত্তপ্ত, অতি ঘন বিন্দু থেকে সবকিছু সজোরে প্রসারিত হতে থাকল চারদিকে। এই ঘটনার গালভরা নাম বিগ ব্যাং। মহাবিস্ফোরণ। এখান থেকেই জন্ম নিল স্থান, কাল। একটা মহাবিশ্ব। আরও আছে মহাজাগতিক প্ৰথম আলো, একীভূত একক বল আর অতিপারমাণবিক কণাদের ঝোল। সেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মহাবিশ্ব বিপুল বেগে ক্রমাগত প্রসারিত হতে লাগল। ক্রমেই আলাদা হয়ে যেতে লাগল প্রাকৃতিক মৌলিক চারটি বল। একক সেই অতিবল থেকে একে একে জন্ম নিল মহাকর্ষ, সবল ও দুর্বল পারমাণবিক বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল।
প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পর সব বাধা ডিঙিয়ে দিগবিদিক ছুটে গেল মহাবিশ্বের প্রথম আলো, যার পোশাকি নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন ( সিএমবি)। বাংলায় মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। মহাকর্ষের টানে একসময় জন্ম হলো মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র, গ্রহ, ছায়াপথসহ আরও অনেক রহস্যময় বস্তুর। অগণিত ছায়াপথের মাঝে এমনই সাধারণ এক ছায়াপথের মাঝারি আকৃতির এক নক্ষত্রের মাঝারি এক গ্রহে ধীরে ধীরে হলো প্রাণের আবির্ভাব। পৃথিবী ভরে উঠল মানুষ নামের দুপেয়ে জন্তুর পদচারণে। তারাই একদিন প্রশ্ন করতে শুরু করল, আমরা কোথা থেকে এলাম? এই মহাবিশ্ব কী? কী দিয়ে তৈরি? মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা কী? এখানকার সবকিছু ব্যাখ্যা করার কি কোনো অনন্য একক উপায় আছে?
এসব প্রশ্নের জবাবের খোঁজে যুগে যুগে প্রাণপাত করতে লাগলেন দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা। অনেক যুগ পেরিয়ে বিশ শতকে বিজ্ঞানীরা সেই উত্তরের অনেকটাই কাছাকাছি চলে এলেন। তখন তাঁদের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একটা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, অন্যটা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। প্রথমটা কাজ করে মহাবিশ্বের বড় পরিসরে, ব্যাখ্যা করে মহাকর্ষ বল। দ্বিতীয়টার কাজ পরমাণুর অতিক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে। তত্ত্বটা ব্যাখ্যা করে সবল ও দুর্বল পারমাণবিক বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। নিজেদের দুই ক্ষেত্রে তত্ত্ব দুটো দারুণভাবে সফল।
এসব সফলতা দেখে আশাবাদী হলেন বিজ্ঞানীরা। ভাবলেন, এ দুটোকে একত্র করতে পারলেই কেল্লাফতে। পাওয়া যাবে আলকেমিস্টদের মতো পদার্থবিজ্ঞানের পরশপাথর—স্বপ্নের সেই থিওরি অব এভরিথিং, যা দিয়ে গোটা মহাবিশ্বসহ সবকিছু ব্যাখ্যা করা যাবে। ভিডিও টেপ উল্টো দিকে চালিয়ে যাওয়ার মতো করে ফিরে যাওয়া যাবে মহাবিস্ফোরণের সেই সময়টাতে, যখন মহাবিশ্বের সব বল, কণা আর বিকিরণ একীভূত ছিল। তাহলেই মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য ও আনুষঙ্গিক কোনো কিছু জানতে আর বাকি থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেল তাঁদের। দেখা গেল, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এর চেয়ে কঠিন বিষয় আর নেই। আধুনিক জগতের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন থেকে শুরু করে অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়েছেন। তাই বলে অবশ্য হাল ছেড়ে দেননি পদার্থবিজ্ঞানীরা। কূলকিনারাবিহীন অচেনা-অজানা দেশের উদ্দেশে তাঁদের সেই অভিযান এখনো শেষ হয়নি।
এ বইয়ে বিজ্ঞানের সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি এবং তার পেছনের বিজ্ঞান সবিস্তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ. মিচিও কাকু। সে জন্য নিউটন থেকে শুরু করে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব, ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় সমীকরণ, কোয়ান্টাম তত্ত্বের সফলতা ও প্যারাডক্স, তর্কবিতর্ক এবং হালের স্ট্রিং থিওরির জন্ম-ইতিহাস, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, উত্থান-পতন ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছেন তিনি।
মূলত অধরা থিওরি অব এভরিথিংয়ের যে ছোট্ট ও সরল সমীকরণের স্বপ্ন দেখেন বিজ্ঞানীরা, তারই নাম দিয়েছেন গড ইকুয়েশন। একদা গড পার্টিকেল বা ঈশ্বরকণা নামধারী হিগস- বোসন কণা বিজ্ঞানজগতে শোরগোল তুলেছিল। এখন তার জায়গা নিয়েছে গড ইকুয়েশন বা থিওরি অব এভরিথিং। সেই তত্ত্ব বা সমীকরণের চেহারাখানা কেমন হবে, তা থেকে আমরা কী কী পেতে পারি আর সেটা অর্জনে কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে, তার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ, কীভাবে পৌঁছানো যাবে সেই সম্ভাব্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে—এ বইয়ে তারই জবাব দেওয়া হয়েছে সহজ-সরল ভাষায়।
থিওরি অব এভরিথিংকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বই লিখেছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের লেখা দ্য থিওরি অব এভরিথিং এবং নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গের দ্য ড্রিম অব আ ফাইনাল থিওরি উল্লেখযোগ্য। সেই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হলো মিচিও কাকুর দ্য গড ইকুয়েশন। এ বইয়ে বিষয়গুলোকে আরও সহজ-সরল ও বিশদভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন মিচিও কাকু। যাঁরা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ এবং বিজ্ঞান তথা পদার্থবিজ্ঞানের চূড়ান্ত গন্তব্য জানতে চান, বুঝতে চান তার গহিনের ভাবনা ও দর্শন—তাঁদের জন্যই এই বই। বিজ্ঞানের কয়েক হাজার বছরের এই অভিযাত্রায় আপনাকে স্বাগত।
হ্যাপি রিডিং।
আবুল বাসার
ঢাকা, জানুয়ারি ২০২২
চূড়ান্ত তত্ত্বের ভূমিকা
যে কাঠামো একীভূত করতে পারবে মহাবিশ্বের সব বল এবং প্রসারণশীল মহাবিশ্বের গতি থেকে অতিপারমাণবিক কণাদের ক্ষণকালের নৃত্য—সবকিছুর প্রতিটি চলাফেরা, সেটাই হবে চূড়ান্ত তত্ত্ব। কিন্তু এমন কোনো সমীকরণ লেখার অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। কারণ, তার এমন গাণিতিক আভিজাত্য থাকতে হবে, যা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে পারবে গোটা পদার্থবিজ্ঞানকে।
এই বহু কাঙ্ক্ষিত তত্ত্বের পিছে অনেক দিন ধরেই ছুটেছেন বিশ্বের নামকরা বেশ কয়েকজন পদার্থবিদ। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও বেশ আশাবাদী হয়ে এ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর সেই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, “ইজ দ্য এন্ড ইনসাইট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিকস?”
এমন একটা তত্ত্ব খোঁজার প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তাহলে সেটিই হবে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। পদার্থবিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য এখন এটাই। কারণ, নীতিগতভাবে সেটি হবে একটামাত্র সমীকরণ, যা থেকে অন্য সব সমীকরণ বেরিয়ে আসবে। মহাবিশ্বের জন্ম বা মহাবিস্ফোরণ থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি পর্যন্ত সবকিছুই পাওয়া যাবে এই এক সমীকরণ থেকে। প্রাচীনকালের দার্শনিকেরা প্রশ্ন করতেন, ‘মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি?’ সেই প্রশ্নের জবাবের খোঁজে দুই হাজার বছরের বৈজ্ঞানিক তদন্তের চূড়ান্ত ফলাফল হবে এই সমীকরণ।
বিষয়টা কল্পনা করাও শ্বাসরুদ্ধকর।
আইনস্টাইনের স্বপ্ন
আমি এই স্বপ্নের প্রথম সাক্ষাৎ পাই একেবারে ছেলেবেলায়। তখন আমার বয়স সবে আট বছর। একদিন খবরের কাগজে ঘোষণা করা হলো, অনেক বড় এক বিজ্ঞানী মাত্রই মারা গেছেন। খবরের সঙ্গে একটা অবিস্মরণীয় ছবিও ছাপা হয়েছিল।
ছবিটা ছিল একটা ডেস্কের। একটা নোটবই সেই ডেস্কের ওপর খোলা পড়ে আছে। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা : আমাদের কালের এই মহান বিজ্ঞানী যে কাজটি শুরু করেছিলেন, তা শেষ করে যেতে পারেননি। কথাটা এ বিষয়ে আমাকে প্রবলভাবে আগ্রহী করে তোলে। মনে মনে ভাবলাম, কী এমন কঠিন কাজ, যেটা মহান বিজ্ঞানী স্বয়ং আইনস্টাইনও সমাধান করে যেতে পারেননি?
আসলে ওই নোটবইয়ে ছিল তাঁর লেখা অসমাপ্ত থিওরি অব এভরিথিং। আইনস্টাইন একে বলতেন ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব। তিনি এমন একটা সমীকরণের খোঁজ করছিলেন, যেটা হয়তো এক ইঞ্চিরও বড় হবে না। তাঁর ভাষায়, সমীকরণটি তাকে ‘ঈশ্বরের মন পড়ার’ ক্ষমতা দিতে পারত।
এই সমস্যার বিশালতা ও গভীরতা কতটা, তা না বুঝেই এই মহান ব্যক্তির পদাঙ্ক অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি। মনে আশা, তাঁর অন্বেষায় আমিও ছোট্ট কোনো ভূমিকা রাখব।
বলা বাহুল্য, অনেকেই সে চেষ্টা করেছেন এবং যথারীতি ব্যর্থও হয়েছেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তাই একবার বলেছিলেন, ‘ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির পথে পথে সব ব্যর্থ প্রচেষ্টার মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।’
তবু বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় বেশ কজন বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, আমরা শেষ পর্যন্ত সমাধানের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। এর মধ্যে থিওরি অব এভরিথিংয়ের শীর্ষ প্রার্থীকে বলা হয় স্ট্রিং থিওরি (এটা শুধু আমার ধারণা)। এই তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব কোনো বিন্দুকণা দিয়ে তৈরি নয়, বরং তা তৈরি হয়েছে অতিক্ষুদ্র কম্পনশীল সুতা বা স্ট্রিং দিয়ে এই স্ট্রিংয়ের প্রতিটি নোট বা সুরের সঙ্গে একেকটা অতিপারমাণবিক কণা জড়িত।
আমাদের কাছে যদি অনেক শক্তিশালী একটা মাইক্রোস্কোপ থাকত, তাহলে দেখা যেত যে ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রন ইত্যাদি কণা আসলে অতিক্ষুদ্র লুপের ওপর কম্পন ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই লুপগুলো দেখতে অনেকটা রাবার ব্যান্ডের মতো। আমরা যদি পর্যাপ্ত সময় ধরে এবং বিভিন্নভাবে টান মেরে এ রাবার ব্যান্ডে কম্পন তুলতে পারি, তাহলে একসময় মহাবিশ্বের জানা সব কটি কণা তৈরি করা সম্ভব। এ কথার মানে হলো, পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র এসব স্ট্রিংয়ের হারমোনি বা ঐকতানের মাঝে ধরা সম্ভব। রসায়ন হবে মেলোডি, যা বাজানো যাবে স্ট্রিংয়ের ওপর। মহাবিশ্ব হলো সিম্ফোনি। আর আইনস্টাইনের লেখায় উল্লেখ করা ‘ঈশ্বরের মন’ হলো মহাজাগতিক সংগীত। এই সংগীতই অনুরণিত বা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা স্থান-কালজুড়ে।
এটা কিন্তু শুধু একাডেমিক বিষয় নয়। আসলে বিজ্ঞানীরা যখনই নতুন কোনো বল আবিষ্কার করেছেন, তখনই সভ্যতার গতিপথ বদলে গেছে। সেই সঙ্গে বদল ঘটেছে মানবজাতির ভাগ্যও। যেমন নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের কথা ধরা যাক। এই সূত্র যান্ত্রিক যুগ ও শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি তৈরি করেছিল। আবার মাইকেল ফ্যারাডে এবং জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের ব্যাখ্যার কারণে আমাদের শহরগুলো আলোকিত হওয়ার পথ খুলে গিয়েছিল। এর ফলেই আমরা পেয়েছি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক মোটর, জেনারেটরসহ তাৎক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যম টিভি ও রেডিও। আইনস্টাইনের E=mc^2 সমীকরণ নক্ষত্রের শক্তির উৎস ব্যাখ্যা করে। পাশাপাশি নিউক্লিয়ার বলের রহস্য উদ্ঘাটন করতেও সহায়তা করেছিল এই সমীকরণ। অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের গহিন, গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করেছিলেন আরউইন শ্রোডিঙ্গার, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গসহ অন্য বিজ্ঞানীরা। এ তত্ত্বের কারণেই আজকের উন্নত প্রযুক্তির বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এ বিপ্লবের কারণে আমরা হাতের মুঠোয় পেয়েছি সুপারকম্পিউটার, লেজার, ইন্টারনেট এবং আমাদের বসার ঘরের বিস্ময়কর সব গ্যাজেট।
শেষ পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির সব কটি বিস্ময়ের জন্মের জন্য আমরা বিজ্ঞানীদের কাছে ঋণী। আসলে বিশ্বের মৌলিক বলগুলো ধারাবাহিকভাবে আবিষ্কার করেছেন এই বিজ্ঞানীরাই। এখন বিজ্ঞানীরা হয়তো এমন কোনো তত্ত্বে এসে পৌঁছাতে পারবেন, যেটি প্রকৃতির এই চারটি বলকে একত্র করে একক কোনো তত্ত্বে ধরতে পারবে। বলগুলো হলো মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল এবং সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। এই তত্ত্বই হয়তো শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের গভীরতম বেশ কিছু রহস্য ও প্রশ্নের উত্তর দেবে। প্রশ্নগুলো হলো— মহাবিস্ফোরণের আগে কী ঘটেছিল? আর মহাবিস্ফোরণই-বা কেন ঘটেছিল?
কৃষ্ণগহ্বরের অন্য পাশে কী আছে?
টাইম ট্রাভেল করা কি সম্ভব?
ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে কি অন্য মহাবিশ্বে যাওয়া যায়? উচ্চতর মাত্রার কি অস্তিত্ব আছে?
অনেক প্যারালাল ইউনিভার্স মিলে কোনো মাল্টিভার্সের অস্তিত্ব আছে কি?
এই বইয়ে চূড়ান্ত তত্ত্বটা আবিষ্কারের সুলুক সন্ধান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অনুসন্ধান করা হয়েছে এ আবিষ্কারের প্রতি পদে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনাগুলোও। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে অন্যতম বিস্ময়কর এক অধ্যায়। পাশাপাশি এর আগে যেসব বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোও আমরা পর্যালোচনা করব। আমাদের চমকপ্রদ সব প্রযুক্তি উপহার দিয়েছে এই বিপ্লবগুলো। শুরু করব নিউটনিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে। এরপর এগিয়ে যাব বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের রহস্যের দিকে। একে একে আলোচনা করব আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং আজকের স্ট্রিং থিওরির বিকাশ সম্পর্কেও। ব্যাখ্যা করে দেখাব, এই তত্ত্বটি কেমন করে স্থান ও কালের গভীরতম রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে।
সমালোচক দল
তবে কিছু বাধা রয়েই গেছে। স্ট্রিং থিওরি নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে এর ত্রুটিগুলোও চিহ্নিত করতে উৎসাহী হয়েছিলেন সমালোচকেরা। কিন্তু এত প্রচার ও উন্মাদনার পরেও থেমে গেছে এর সত্যিকার অগ্রগতি।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো তত্ত্বটির সৌন্দর্য ও জটিলতা নিয়ে এত এত প্রশংসা থাকার পরেও আমাদের হাতে এটির কোনো শক্ত এবং পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই। একবার আশা জেগেছিল, এই সবকিছুর তত্ত্বের সপক্ষে শক্ত প্রমাণ জোগান দেবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের বাইরে অবস্থিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর—লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি)। কিন্তু সেটাও এখনো রয়ে গেছে অধরা। এরই মধ্যে হিগস বোসন (গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা) আবিষ্কার করতে পেরেছে এলএইচসি। কিন্তু হিগস বোসন কণা এই ফাইনাল থিওরির অতিক্ষুদ্র একটা অংশমাত্র।
অবশ্য এলএইচসির পর আরও শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর তৈরির উচ্চাভিলাষী প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে রকম ব্যয়বহুল কোনো যন্ত্র ব্যবহার করেও আদৌ কিছু খুঁজে পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। তত্ত্বটা যাচাই করার জন্য আমাদের আবিষ্কার করতে হবে নতুন কোনো অতিপারমাণবিক কণা। কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে জানে না এই কণা খুঁজে পেতে কী পরিমাণ শক্তি লাগবে।
স্ট্রিং থিওরি নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা হলো, তত্ত্বটি বেশ কটি মহাবিশ্ব নিয়ে গঠিত মাল্টিভার্সের ভবিষ্যদ্বাণী করে। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্নটা হলো মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কি বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল? এই মহাবিশ্ব কি অনন্য?
স্ট্রিং থিওরি নিজেই অনন্য, কিন্তু এর সমাধান সম্ভবত অসীমসংখ্যক। পদার্থবিদেরা একে বলেন ল্যান্ডস্কেপ প্রবলেম। এ হিসেবে, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো অন্য আরও অনেক সঠিক সমাধানের মহাসাগরের মধ্যে কেবল একটিমাত্র। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্ব যদি অসংখ্য সম্ভাবনার একটা হয়, তাহলে আমাদের নিজেদের মহাবিশ্ব আসলে কোনটা? আমরা কেন শুধু এই নির্দিষ্ট মহাবিশ্বের বাসিন্দা, অন্যগুলোর নয় কেন? তাহলে স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাটা ঠিক কী? এটা কি তাহলে থিওরি অব এভরিথিং, নাকি থিওরি অব অ্যানিথিং?
আগেই বলেছি, এই অনুসন্ধানে আমার নিজেরও ছোট্ট একটা ভূমিকা আছে। সেই ১৯৬৮ সাল থেকে আমি স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কাজ করছি, অনেকটা দুর্ঘটনাক্রমে, অঘোষিত এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে এ তত্ত্বের উত্থান হওয়ার পর থেকে। এই তত্ত্বের লক্ষণীয় সব বিবর্তন স্বচক্ষে দেখেছি। একটামাত্র সূত্র থেকে বিকশিত হয়ে এটি একসময় এমন এক শাখায় পরিণত হয়, যা নিয়ে লেখা মূল্যবান সব গবেষণাপত্রে ভরে যাবে গোটা একটি লাইব্রেরি। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব গবেষণাগারে যেসব গবেষণা চলছে, তার অধিকাংশেরই ভিত্তি গড়ে উঠেছে স্ট্রিং থিওরির ওপর। এই বই থেকে আপনি স্ট্রিং থিওরির বড় সব সাফল্য এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সুষম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ পাবেন বলে আশা করছি।
আবার এই অনুসন্ধানে বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী কেন ছুটছেন এবং তত্ত্বটা কেন এত বেশি অনুরাগ ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তা-ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে এখানে।