৬. থিওরির উত্থান : প্রতিশ্রুতি ও সমস্যা
আমরা দেখেছি, ১৯০০ সালের দিকে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় দুটি ভিত্তি ছিল নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব এবং আলোর জন্য ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো। আইনস্টাইন বুঝতে পারেন, এই দুই মহান ভিত্তি পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কাজেই দুটোর যেকোনো একটাকে ভেঙে পড়তে হবে। নিউটনিয়ান বলবিদ্যার পতনই ঠিক করে দিল বিশ শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের গতিপথ।
বর্তমানে সেই ইতিহাসের হয়তো পুনরাবৃত্তি হবে। এখন আরও একবার আমাদের কাছে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি প্রধান ভিত্তি রয়েছে। আমাদের এক হাতে আছে বৃহৎ পরিসরের তত্ত্ব। অর্থাৎ আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব। এটি আমাদের দিয়েছে কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিস্ফোরণ এবং প্রসারণশীল মহাবিশ্ব। অন্য হাতে আছে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরের তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এটি ব্যাখ্যা করে অতিপারমাণবিক কণাদের আচরণ। সমস্যাটা হলো, তত্ত্ব দুটো পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভিত্তি দুটি আলাদা নীতি, দুটি আলাদা ধরনের গণিত এবং সর্বোপরি দুটি ভিন্ন রকম দৰ্শন।
আমাদের প্রত্যাশা, বিজ্ঞানের পরবর্তী বিপ্লব এই দুটি ভিত্তিকে একটামাত্র তত্ত্বে একীভূত করবে।
স্ট্রিং থিওরি
এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। তখন দুই তরুণ পদার্থবিদ গ্যাব্রিয়েল ভেনিজিয়ানো এবং মাহিকো সুজুকি গণিতের বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা অদ্ভুত ফর্মুলায় আটকে গেলেন দুই বিজ্ঞানী। সেই ফর্মুলাটা আবিষ্কার করেছিলেন আঠারো শতকের গণিতবিদ লিওনার্দো অয়লার। দুটি অতিপারমাণবিক কণার বিক্ষিপ্ত হওয়াকে অদ্ভুত ফর্মুলাটা ব্যাখ্যা করতে পারে বলে মনে হচ্ছিল! আঠারো শতকে বর্ণনা করা একটা বিমূর্ত ফর্মুলা অ্যাটম স্ম্যাশার থেকে পাওয়া সর্বশেষ ফলাফল ব্যাখ্যা করে কীভাবে? পদার্থবিজ্ঞানের এভাবে তো কাজ করার কথা ছিল না।
ইয়োচিরো নাম্বু, হলগার নিয়েলসেন এবং লিওনার্দ সাসকিন্ডসহ অন্য পদার্থবিদেরা বুঝতে পারলেন, এই ফর্মুলার ধর্মগুলো দুটো স্ট্রিংয়ের মিথস্ক্রিয়া উপস্থাপন করে। অচিরেই ফর্মুলাটাকে একগুচ্ছ সমীকরণে সাধারণীকরণ করে মাল্টিস্ট্রিংয়ের বিক্ষিপ্ত হওয়া তুলে ধরলেন বিজ্ঞানীরা। (এটা ছিল আসলে আমার পিএইচডি থিসিস। এতে এলোমেলো সংখ্যক স্ট্রিংয়ের মিথস্ক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ সেট হিসাব করা হয়।) এরপর গবেষকেরা স্ট্রিং থিওরিতে ঘূর্ণমান কণা নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
স্ট্রিং থিওরি তখন ছিল অনেকটা তেলখনির মতো, যেখান থেকে হুট করে বেশ কিছু নতুন সমীকরণ মুষলধারায় ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে। (ব্যক্তিগতভাবে আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কারণ, মাইকেল ফ্যারাডের পর থেকে পদার্থবিদেরা ক্ষেত্র দিয়ে সবকিছু প্রকাশ করেন, যা বিপুল পরিমাণ তথ্যকে সংক্ষিপ্ত করতে পারে। বিপরীতে স্ট্রিং থিওরি ছিল একগুচ্ছ বিযুক্ত সমীকরণ। এরপর সবটা স্ট্রিং থিওরিকে ক্ষেত্রের ভাষায় প্রকাশ করে আমার সহকর্মী কেইজি কিকাওয়া এবং আমি। এভাবে আমরা স্ট্রিং ফিল্ড থিওরি প্রণয়ন করেছিলাম। স্ট্রিং থিওরির সব কটি সমীকরণকে আমাদের ফিল্ড থিওরি সমীকরণে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা যায়, যার দৈর্ঘ্য মাত্র এক ইঞ্চি।)
এ রকম মুষলধারায় সমীকরণ পাওয়ার ফলে নতুন একটা চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করল। কিন্তু এত বেশি কণা থাকার কারণ কী? পিথাগোরাস যেমন দুই হাজার বছর আগে বলেছিলেন, এ তত্ত্বটাও সে রকম বলে, প্রতিটি সুরেলা নোট বা স্ট্রিংয়ের প্রতিটি কম্পন একেকটি কণার প্রতিনিধিত্ব করে। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ও ইয়াং – মিলস কণারা আসলে একই কম্পনশীল তার বা স্ট্রিংয়ের ওপর ভিন্ন ভিন্ন সুরের নোট ছাড়া আর কিছু নয়।
এই তত্ত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মজার ব্যাপারটি হলো, এতে মহাকর্ষ অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়। কোনো বাড়তি অনুমান ছাড়াই তারের একটা সর্বনিম্ন কম্পন হিসেবে গ্র্যাভিটন আবির্ভূত হয়। আসলে আইনস্টাইন কখনো জন্ম না নিলেও তার পুরো মহাকর্ষের তত্ত্ব হয়তো পাওয়া যেত তারের সর্বনিম্ন কম্পন দেখেই।
পদার্থবিদ এডওয়ার্ড উইটেন একবার বলেছিলেন, ‘স্ট্রিং তত্ত্ব চরমভাবে আকর্ষণীয়, কারণ মহাকর্ষ আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। সব জানা মানানসই স্ট্রিং থিওরিতে মহাকর্ষ অন্তর্ভুক্ত। কাজেই কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে মহাকর্ষকে আমরা যেমন অসম্ভব বলে জানি, স্ট্রিং থিওরিতে তা বাধ্যতামূলক।’
দশ মাত্রা
তত্ত্ব বিকশিত হতে শুরু করার পর ক্রমেই বেশি বেশি ও পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে শুরু করে। যেমন দেখা গেল যে তত্ত্বটি থাকতে পারে শুধু দশ মাত্রাতেই!
এতে হতবাক হয়ে গেলেন পদার্থবিদেরা। কারণ, কেউ এ রকম কোনো কিছু আগে কখনো দেখেননি। সাধারণত যেকোনো তত্ত্বকে ইচ্ছেমতো যেকোনো মাত্রায় প্রকাশ করা যায়। আমরা সহজভাবে এসব তত্ত্ব বাতিল করে দিই। কারণ, নিঃসন্দেহে আমাদের বসবাস ত্রিমাত্রিক জগতে। (আমরা শুধু সামনে, পাশে এবং ওপর ও নিচে চলাফেরা করতে পারি। এর সঙ্গে যদি সময় যোগ করা হয়, তাহলে তা চার মাত্রা হয়। মহাবিশ্বের যেকোনো ঘটনার অবস্থান এই মাত্ৰা দিয়ে নির্দেশ করা যায়। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান শহরে কারও সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাহলে হয়তো বলব, চলো, পঞ্চম অ্যাভিনিউ এবং ৪২তম স্ট্রিটের কোনার দশম তলায় দুপুরবেলায় দেখা করি। তবে চারের পরের মাত্রাগুলোতে চলাফেরা করা আমাদের জন্য অসম্ভব। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, কোনো লাভ নেই। আসলে উচ্চতর কোনো মাত্রায় কীভাবে চলাফেরা করতে হয়, তা আমাদের মস্তিষ্ক কল্পনাও করতে পারে না। কাজেই স্ট্রিং থিওরির উচ্চতর মাত্রা সম্পর্কিত সব গবেষণা করা হয় বিশুদ্ধ গণিত ব্যবহার করে।)
কিন্তু স্ট্রিং থিওরিতে স্থান-কালের মাত্রা দশটি মাত্রায় স্থির থাকে। অন্যান্য মাত্রায় তত্ত্বটি গাণিতিকভাবে ভেঙে পড়ে।
স্ট্রিং থিওরি থেকে যখন বেরিয়ে এল যে আমরা দশ মাত্রায় বসবাস করি, তখন পদার্থবিদেরা যে ধাক্কা খেয়েছিলেন, সেই স্মৃতি আমার এখনো মনে আছে। তত্ত্বটা যে ভুল, এতে যেন তারই প্রমাণ দেখতে পেলেন অধিকাংশ পদার্থবিদ। জন সোয়ার্জ ছিলেন স্ট্রিং থিওরির অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় স্থপতি। একবার ক্যালটেকে এলিভেটরে চড়তে গিয়ে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, জন। আজ তুমি কত মাত্রায় আছ?’
এত কিছুর পরও বছরের পর বছর পদার্থবিদেরা ক্রমান্বয়ে দেখাতে শুরু করলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সব কটি তত্ত্বে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। যেমন অনেকগুলো তত্ত্ব বাতিল করা যায়, কারণ তাদের কোয়ান্টাম সংশোধনী হতো অসীম বা অস্বাভাবিক (সহজ কথায়, গাণিতিকভাবে বেমানান।
কাজেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাত্রার ধারণাটিকে প্রাণবন্ত করে তুলতে লাগলেন পদার্থবিদেরা। অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্ব সর্বোপরি দশ মাত্রারও হতে পারে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে জন সোয়ার্জ ও মাইকেল গ্রিন দেখালেন, স্ট্রিং থিওরি সব ধরনের সমস্যামুক্ত। অথচ অতীতে যেকোনো একীভূত ফিল্ড থিওরির প্রার্থী হওয়া তত্ত্বগুলোর অনিবার্য সর্বনাশ ডেকে এনেছিল ওই ত্রুটিগুলোই।
স্ট্রিং থিওরি যদি সঠিক হয়, তাহলে মহাবিশ্ব হয়তো দশমাত্রিকও হতে পারে। কিন্তু সেই মহাবিশ্ব অস্থিতিশীল এবং এসব মাত্রার মধ্যে ছয়টি কোনোভাবে কুঁকড়ে গেছে। সেগুলো এতই ছোট হয়ে গেছে যে দেখাও সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো দশমাত্রিক, কিন্তু আমাদের পরমাণুগুলো এসব অতি খুদে উচ্চতর মাত্রাগুলোর মধ্যে ঢুকতে পারে না। কারণ, পরমাণুদের আকার ওসব মাত্রার চেয়ে অনেক বড়।
গ্র্যাভিটন
স্ট্রিং থিওরির সব রকম উদ্ভটতা সত্ত্বেও একটা জিনিস তত্ত্বটাকে জীবন্ত রেখেছে। সেটা হলো পদার্থবিজ্ঞানের দুটি বড় তত্ত্বের মধ্যে বিবাহের ব্যবস্থা করতে পেরেছে তত্ত্বটা। বড় সেই তত্ত্ব দুটো হলো সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব। ফলে আমরা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির একটা সসীম তত্ত্ব পেয়েছি। এটাই সব উত্তেজনার কারণ।
এর আগে উল্লেখ করেছি, কিউইডিতে কিংবা ইয়াং-মিলস কণা যদি কোয়ান্টাম সংশোধনী যোগ করা হয়, তাহলে অসীমের বন্যা বয়ে যায়। সেগুলো খুবই সাবধানে এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দূর করতে হয়।
কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়, যখন আমরা প্রকৃতির বড় দুটি তত্ত্ব, অর্থাৎ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে জোর করে বিয়ে দিতে চেষ্টা করি। মহাকর্ষের ওপর কোয়ান্টাম নীতি প্রয়োগ করতে হলে মহাকর্ষকে শক্তির গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেটে বা কোয়ান্টায় ভাগ করে নিতে হয়। এই কোয়ান্টাকে বলা হয় গ্র্যাভিটন। এরপর অন্য গ্র্যাভিটন ও বস্তুর (যেমন ইলেকট্রন) সঙ্গে এসব গ্র্যাভিটনের সংঘর্ষ গণনা করতে হয়। কিন্তু সেটা করতে গেলে ফাইনম্যান এবং টি হুফট ব্যাগভর্তি যেসব কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন, তার সবই ব্যর্থ হয় নিদারুণভাবে। গ্র্যাভিটনের সঙ্গে অন্য গ্র্যাভিটনের মিথস্ক্রিয়ার কারণে যে কোয়ান্টাম সংশোধনী পাওয়া যায়, তার মান অসীম। আবার আগের প্রজন্মের পদার্থবিদেরা যেসব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, সেগুলোকেও বুড়ো আঙুল দেখায় এটা।
এখানেই পরবর্তী ম্যাজিকটা দেখা যায়। এসব জটিল অসীমগুলো দূর করতে পারে স্ট্রিং থিওরি। সত্যি বলতে কী, এ রকম কিছু একটার জন্য প্রায় এক শতক ধরে হাপিত্যেশ করে আসছিলেন পদার্থবিদেরা। আর এই ম্যাজিক আবারও দেখা দেয় প্রতিসাম্যের মধ্য দিয়ে।
সুপারসিমেট্রি বা অতিপ্রতিসাম্য
আমাদের প্রণয়ন করা সমীকরণগুলোতে প্রতিসাম্য বজায় থাকলে, ঐতিহাসিকভাবে সব সময়ই তাকে চমৎকার বলে ভাবা হয়েছে। কিন্তু এতে যে আভিজাত্য আছে, সেটা ছিল বিলাসিতার মতো, আবশ্যক মনে করা হয়নি। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্বে প্রতিসাম্যটাই পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।
আমরা আগেই প্রতিষ্ঠিত করেছি যে কোনো তত্ত্বের কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনার সময় এসব কোয়ান্টাম সংশোধনী প্রায়ই বিচ্যুত (অর্থাৎ অসীম) কিংবা অস্বাভাবিক হয় (মানে, সেটা তত্ত্বটার মৌলিক প্রতিসাম্য লঙ্ঘন করে)। পদার্থবিজ্ঞানীরা কেবল কয়েক দশক ধরে বুঝতে পেরেছেন, প্রতিসাম্য কোনো তত্ত্বের শুধু সন্তোষজনক বৈশিষ্ট্যই নয়, বরং এটাই আসলে তত্ত্বটার মুখ্য উপাদান। একটা তত্ত্বকে প্রতিসম হিসেবে দাবি করা হলে তা প্রায়ই বিচ্যুতি ও অস্বাভাবিকতা দূর করতে পারে। অপ্রতিসম তত্ত্বগুলোতে বিচ্যুতি আর অস্বাভাবিকতা বেশ যন্ত্রণাদায়ক। প্রতিসাম্য হলো পদার্থবিদদের জন্য তলোয়ারের মতো, যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোয়ান্টাম সংশোধনীর লেলিয়ে দেওয়া ড্রাগনগুলোকে কুপোকাত করেন পদার্থবিজ্ঞানীরা।
ছবি ১১ : দুটি গ্র্যাভিটনের সংঘর্ষ (ওপরে) গণনা করলে ফলাফল অসীম হয়। কাজেই তা অর্থহীন। কিন্তু দুটি স্ট্রিংয়ের সংঘর্ষ (নিচে) ঘটলে আমরা দুটি পদ পাই। এদের একটা আসে বোসন থেকে এবং আরেকটা ফার্মিয়ন থেকে। স্ট্রিং থিওরিতে এই দুটি পদ পরস্পরকে নিখুঁতভাবে বাতিল করে একটা সসীম কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রণয়ন করতে সহায়তা করে।
আগেই উল্লেখ করেছি, ডিরাক আবিষ্কার করেন, ইলেকট্রনের জন্য লেখা তাঁর সমীকরণ ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এর স্পিন আছে (যা সমীকরণগুলোর একটা গাণিতিক বৈশিষ্ট্য। এটি আমাদের চারপাশের পরিচিত স্পিন বা ঘূর্ণনের সঙ্গে তুলনীয়)। এরপর পদার্থবিদেরা দেখতে পান, সব অতিপারমাণবিক কণার স্পিন আছে। কিন্তু স্পিন দুই ধরনের।
নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম এককে স্পিন হয় পূর্ণ সংখ্যা (যেমন ০, ১ বা ২) অথবা অর্ধ-পূর্ণ সংখ্যা (১/২, ৩/২ হতে পারে। প্রথমত, যেসব কণার স্পিন পূর্ণসংখ্যক, তারা মহাবিশ্বের বলগুলো ব্যাখ্যা করে। এর মধ্যে রয়েছে ফোটন এবং ইয়াং-মিলস কণা (এদের স্পিন ১) এবং মহাকর্ষের কণা গ্র্যাভিটন (এদের স্পিন ২)। এসব কণার নাম বোসন (ভারতীয় পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে)। কাজেই প্রকৃতির বলগুলোর মধ্যস্থতাকারী হলো বোসন।
এরপর আছে এমন সব কণা, যারা মহাবিশ্বের সব পদার্থ তৈরি করে। তাদের স্পিন অর্ধ-পূর্ণ সংখ্যা বা ভগ্নাংশ। যেমন ইলেকট্রন, নিউট্রিনো এবং কোয়ার্ক (স্পিন ১/২)। এসব কণাকে বলা হয় ফার্মিয়ন (বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামানুসারে)। এই কণা দিয়ে পরমাণুর বাকি কণাগুলো গঠিত হয়, যথা প্রোটন ও নিউট্রন। কাজেই আমাদের দেহ হলো ফার্মিয়নের গুচ্ছ।
দুই ধরনের অতিপারমাণবিক কণা
ফার্মিয়ন (বস্তু) – বোসন (বলগুলো)
ইলেকট্রন, কোয়ার্ক – ফোটন, গ্র্যাভিটন
নিউট্রন, প্রোটন – ইয়াং-মিলস
বানজি সাকিতা এবং জেন-লুপ জারভেইস এরপর প্রমাণ করেন, স্ট্রিং থিওরির একটা নতুন ধরনের প্রতিসাম্য আছে। একে বলা হয় সুপারসিমেট্রি বা অতিপ্রতিসাম্য। তারপর থেকে সুপারসিমেট্রি বিকশিত হয়। ফলে পদার্থবিজ্ঞানে এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রতিসাম্য এটিই। আমরা আগেই জোর দিয়ে বলেছি, কোনো পদার্থবিদের কাছে সৌন্দর্যের মানে হলো প্রতিসাম্য। ভিন্ন ভিন্ন কণার মধ্যকার সংযোগ খুঁজতে সহায়তা করে এটি। মহাবিশ্বের সব কণাকে এরপর সুপারসিমেট্রির মাধ্যমে একত্র করা যায়। আগেই বলা হয়েছে, কোনো প্রতিসাম্য একটা বস্তুর উপাদানগুলোর পুনর্বিন্যাস করে এবং আসল বস্তুকে একই রকম রাখে। এখানে আমাদের সমীকরণগুলোতে কণাগুলোকে যদি আবারও পুনর্বিন্যস্ত করা হয় ফার্মিয়নের সঙ্গে বোসন পরস্পর আন্তবিনিময় করে বা উল্টোটা করে, তাহলে দেখা যায়, এটাই স্ট্রিং থিওরির মুখ্য বৈশিষ্ট্য। ফলে গোটা মহাবিশ্বের কণাগুলোকে পরস্পরের মধ্যে পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব।
তার মানে, প্রতিটি কণার একটা সুপার পার্টনার আছে, যাকে বলা হয় এসপার্টিকেল বা সুপার পার্টিকেল। যেমন ইলেকট্রনের সুপার পার্টনারকে বলা হয় সিলেকট্রন। কোয়ার্কের সুপার পার্টনারের নাম স্কোয়ার্ক। লেপটনের (যেমন ইলেকট্রন বা নিউট্রিনো) সুপার পার্টনারের নাম স্লেপটন।
কিন্তু স্ট্রিং থিওরিতে উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঘটনা ঘটে। এ তত্ত্বে কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনা করা হলে দুটি আলাদা বিষয় পাওয়া যাবে। ফার্মিয়ন এবং সেই সঙ্গে বোসন থেকে পাওয়া যাবে কোয়ান্টাম সংশোধনী। অলৌকিকভাবে তাদের আকৃতি একই সমান, কিন্তু বিপরীত চিহ্নযুক্ত। একটা পদে ধনাত্মক চিহ্ন থাকলে আরেকটা পদ পাওয়া যাবে ঋণাত্মক। তাদের একত্রে যোগ করা হলে এসব পদ পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। এভাবে পাওয়া যায় একটা সসীম ফলাফল।
আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতে প্রায় এক শতাব্দী ধরে নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। কিন্তু ফার্মিয়ন ও বোসনের মধ্যে প্রতিসাম্য, যাকে বলা হয় সুপারসিমেট্রি, এসব অসীমের অনেকগুলো বাতিল করতে পারে। অচিরেই একটা সসীম ফলাফল পাওয়ার জন্য এসব অসীম দূর করার অন্য আরও কিছু উপায় আবিষ্কার করেন পদার্থবিদেরা। স্ট্রিং থিওরিকে ঘিরে সব উত্তেজনার উৎস আসলে এটাই। কারণ এটা মহাকর্ষ এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একত্র করতে পারে। অন্য কোনো তত্ত্ব এমন দাবি করতে পারেনি। এটাই হয়তো ডিরাকের সেই আপত্তিকে সন্তুষ্ট করবে। রিনরমালাইজেশন তত্ত্বের দুর্দান্ত আর অনস্বীকার্য সাফল্য থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বটিকে অপছন্দ করতেন তিনি। এতে যেসব পরিমাণ আকারে অসীম, সেগুলো যোগ ও বিয়োগ করা হয়। এখানে আমরা দেখতে পাই, কোনো রকম রিনরমালাইজেশন ছাড়াই স্ট্রিং থিওরি নিজেই সসীম।
এটিই একসময় হয়তো আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত মৌলিক চিত্রের সঙ্গে মিলে যাবে। একবার নিজের মহাকর্ষ তত্ত্বকে মার্বেলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। যা মসৃণ, মার্জিত ও পালিশ করা। তবে বিপরীত দিকে বস্তু হলো অনেকটা কাঠের মতো। গাছের গুঁড়ি হলো এবড়োখেবড়ো, বিশৃঙ্খল, রুক্ষ। আবার এতে সুষম জ্যামিতিক প্যাটার্নও থাকে না। আইনস্টাইনের লক্ষ্য ছিল চূড়ান্তভাবে একটা একীভূত তত্ত্ব প্রণয়ন করা, যা এই মার্বেল এবং কাঠকে একটা একক রূপে একীভূত করতে পারবে। অর্থাৎ এমন কোনো তত্ত্ব প্রণয়ন করা, যেটা পুরোপুরি মার্বেল দিয়ে তৈরি। এটাই ছিল আইনস্টাইনের স্বপ্ন।
সেই চিত্রটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারে স্ট্রিং থিওরি। সুপারসিমেট্রি এমন এক প্রতিসাম্য, যা মার্বেলকে কাঠে এবং কাঠকে মার্বেলে রূপান্তরিত করতে পারে। সেগুলো আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে যায়। এই চিত্রে মার্বেল প্রতিনিধিত্ব করে বোসন কণাদের এবং ফার্মিয়ন কণার প্রতিনিধিত্ব করে কাঠ। প্রকৃতিতে সুপারসিমেট্রির জন্য কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ না থাকলেও সেটা মার্জিত ও সুন্দর। তাই এটি পদার্থবিজ্ঞানী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এ ব্যাপারে স্টিভেন ওয়াইনবার্গ একবার বলেছেন, ‘প্রতিসাম্য আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকলেও আমরা বুঝতে পারি যে তারা প্রকৃতির মধ্যে সুপ্ত আছে এবং আমাদের সবকিছুকে পরিচালনা করছে। আমার জানামতে এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধারণা— প্রকৃতিকে যেমন দেখায়, তা আসলে তার চেয়েও সরল। মানবজাতির এত বছরের ইতিহাসে আমাদের প্রজন্মের হাতেই যে মহাবিশ্বের চাবিকাঠি রয়েছে, এর চেয়ে আশাপ্রদ আর কী হতে পারে! আমাদের জীবদ্দশাতেই হয়তো আমরা বলতে পারব, গ্যালাক্সি আর কণাদের এই বিপুল মহাবিশ্বে যা কিছু দেখা যায়, তার সবই কেন যুক্তিযুক্ত, কেন এমনটাই হলো।’
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, প্রতিসাম্য হয়তো মহাবিশ্বের সব কটি সূত্র একীভূত করার চাবিকাঠি হতে পারে। কারণ, এর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। সেগুলো হলো—
বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে প্রতিসাম্য। রাসায়নিক মৌল ও অতিপারমাণবিক কণাদের বিশৃঙ্খলা থেকে বা মেন্ডেলেভের পর্যায় সারণি এবং স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে পুনর্বিন্যাস করে তাদের একটা পরিপাটি ও প্রতিসম উপায়ে সাজাতে পারে। শূন্যস্থান পূরণ করতে সহায়তা করে প্রতিসাম্য। তত্ত্বগুলোতে বিচ্ছিন্ন ফাঁকগুলো আলাদা করতে এবং নতুন ধরনের মৌল ও অতিপারমাণবিক কণার অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
প্রতিসাম্য পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত এবং আপাতদৃষ্টে সম্পর্কহীন বস্তুগুলো একত্র করতে পারে। স্থান ও কাল, বস্তু ও শক্তি, বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্ব এবং ফার্মিয়ন ও বোসনের মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করে প্রতিসাম্য।
অপ্রত্যাশিত পরিঘটনা উদ্ঘাটন করে প্রতিসাম্য। আবার নতুন ধরনের পরিঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করে। যেমন অ্যান্টিম্যাটার, স্পিন এবং কোয়ার্ক।
কোনো তত্ত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার মতো সব অবাঞ্ছিত পরিণতি দূর করে প্রতিসাম্য। কোয়ান্টাম সংশোধনীতে প্রায় ধ্বংসাত্মক বিচ্যুতি ও অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়। সেগুলো দূর করতে পারে প্রতিসাম্য।
আবার আদি চিরায়ত তত্ত্বকে পরিবর্তন করে প্রতিসাম্য। স্ট্রিং থিওরির কোয়ান্টাম সংশোধনী এতই কট্টর যে সেগুলো আসলে আদি তত্ত্বকে বদলে ফেলে এবং স্থান-কালের মাত্রার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়।
ছবি ১২ : বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, কালের শুরুতে একটামাত্র সুপারফোর্স বা অতিবলের অস্তিত্ব ছিল। এ অতিবলের প্রতিসাম্যের মধ্যে ছিল মহাবিশ্বের সব কটি কণা। কিন্তু সেটি অস্থিতিশীল ছিল। ফলে প্রতিসাম্যটা একসময় ভেঙে গিয়েছিল। সেখান থেকে প্রথমে আলাদা হয়ে গেল মহাকর্ষ বল। এরপর সবল পারমাণবিক বল ও দুর্বল পারমাণবিক বল আলাদা হয়ে গিয়ে পড়ে রইল শুধু বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। আজকের মহাবিশ্বকে তাই ভাঙা দেখা যায়। এখানে সব কটি বল একটা থেকে আরেকটা একেবারেই আলাদা। পদার্থবিজ্ঞানীদের কাজ হলো এসব টুকরাকে একত্র করে একটা মাত্র বলে একীভূত করা।
সুপারস্ট্রিং থিওরি এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সব সুবিধা নেয়। এর প্রতিসাম্য হলো অতিপ্রতিসম বা সুপারসিমেট্রি (এই প্রতিসাম্য বোসন ও ফার্মিয়নকে আন্তবিনিময় করতে পারে)। সুপারসিমেট্রি পদার্থবিজ্ঞানে এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় ধরনের প্রতিসাম্য। এটি মহাবিশ্বের জানা সব কটি কণাকে একীভূত করতে পারে।
এম–তত্ত্ব
আমরা এখনো স্ট্রিং থিওরির শেষ ধাপ সম্পূর্ণ করতে পারিনি। ধাপটি হলো তত্ত্বটির মৌলিক ভৌত নীতি খুঁজে বের করা। অর্থাৎ আমরা এখনো বুঝতে পারিনি, একটামাত্র সমীকরণ থেকে গোটা তত্ত্বটা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে। একটা আকস্মিক চোট দেখা দিল ১৯৯৫ সালে। সে সময় স্ট্রিং থিওরি আরেকটা রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গিয়েছিল। ফলাফল হিসেবে আবির্ভূত হলো নতুন আরেকটা তত্ত্ব। সে তত্ত্বের নাম এম-থিওরি বা এম-তত্ত্ব। আদি স্ট্রিং থিওরির সমস্যা হলো এতে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের পাঁচটি আলাদা সংস্করণ আছে। এদের প্রত্যেকটিই সসীম ও সুসংজ্ঞায়িত। পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি দেখতে প্ৰায় একই রকম, শুধু তাদের স্পিনের বিন্যাস কিছুটা আলাদা। ফলে লোকজন একসময় জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, পাঁচটি স্ট্রিং থিওরি থাকার দরকারটা কী? বেশির ভাগ পদার্থবিদ মনে করতেন, মহাবিশ্বের অনন্য হওয়া উচিত।
পদার্থবিদ এডওয়ার্ড উইটেন দেখতে পেলেন, আসলে একটা গুপ্ত এগারোমাত্রিক তত্ত্ব রয়েছে, যার ভিত্তি মেমব্রেন বা পর্দা (কোনো গোলক বা ডোনাটের পৃষ্ঠতলের মতো), শুধু স্ট্রিং নয়। একেই বলা হলো এম- তত্ত্ব। স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি সংস্করণ কেন, সে ব্যাখ্যা দিতেও সক্ষম হলেন তিনি। তার কারণ একটা এগারোমাত্রিক পর্দা দশমাত্রিক স্ট্রিংয়ে চুপসে যাওয়ার পাঁচটি উপায় আছে।
অন্য কথায়, স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি ভার্সনের সব কটিই আসলে একই এম-থিওরির ভিন্ন ভিন্ন গাণিতিক প্রকাশ। (কাজেই স্ট্রিং থিওরি আর এম-থিওরি আসলে একই তত্ত্ব। পার্থক্য শুধু স্ট্রিং থিওরি এগারোমাত্রিক এম-তত্ত্বের দশ-মাত্রায় সংকুচিত রূপ।) কিন্তু একটা এগারোমাত্রিক তত্ত্ব পাঁচটি দশমাত্রিক তত্ত্বের জন্ম দিতে পারে কীভাবে?
উদাহরণস্বরূপ, একটা বিচ বলের কথা চিন্তা করা যাক। বলটা থেকে সব বাতাস বের করে নিলে সেটা চুপসে যাবে। ধীরে ধীরে সসেজের মতো হয়ে যাবে। এরপর আরও বাতাস বের করে নেওয়া হলে সসেজটা একটা স্ট্রিং হয়ে যাবে। কাজেই একটা স্ট্রিং আসলে একটা মেমব্রেনের ছদ্মবেশ। অনেকটা তার ভেতর থেকে বাতাস বের করে নেওয়ার মতো।
একটা এগারোমাত্রিক বিচ বল দিয়ে শুরু করা হলে, গাণিতিকভাবে দেখানো যায় যে পাঁচ উপায়ে সেটা একটা দশমাত্রিক স্ট্রিংয়ে চুপসে যেতে পারে।
কিংবা সেই অন্ধ মানুষদের গল্পের কথা ভাবুন, যারা প্রথমবার এক হাতির মুখোমুখি হয়েছিল। এক জ্ঞানী ব্যক্তি হাতির কান স্পর্শ করে ঘোষণা দিল, হাতি হলো সমতল এবং পাখার মতো দ্বিমাত্রিক। আরেক জ্ঞানী ব্যক্তি হাতির লেজ স্পর্শ করে অনুমান করল, হাতি আসলে দড়ির মতো বা একটা একমাত্রিক স্ট্রিংয়ের মতো। আরেকজন হাতির পা স্পর্শ করে সিদ্ধান্তে এল, হাতি হলো ত্রিমাত্রিক ড্রাম বা সিলিন্ডারের মতো। কিন্তু আমরা যদি একটু পিছিয়ে তৃতীয় মাত্রায় উঠি, তাহলে দেখা যাবে হাতি আসলে একটা ত্রিমাত্রিক জন্তু। একইভাবে স্ট্রিং থিওরির পাঁচটি আলাদা ভার্সনও হাতির ওই কান, লেজ ও পায়ের মতো। কিন্তু আমরা এখনো পুরো হাতিটিকে বা এম-তত্ত্বকে বুঝে উঠতে পারিনি।
হলোগ্রাফিক মহাবিশ্ব
আগেই বলেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রিং থিওরির নতুন নতুন স্তর উদ্ঘাটিত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে এম-তত্ত্ব প্রস্তাব করার অল্প কিছুদিন পরেই, ১৯৯৭ সালে আরেকটা বিস্ময়কর আবিষ্কার করে বসেন জুয়ান ম্যালডাসেনা।
তিনি এমন একটা বিষয় প্রমাণ করলেন, যাকে একসময় অসম্ভব বলে মনে করা হতো। তাতে গোটা পদার্থবিজ্ঞান সম্প্রদায় সেবার বেশ নাড়া খেয়েছিল। তিনি প্রমাণ করলেন, চার মাত্রায় অতিপারমাণবিক কণাদের আচরণ ব্যাখ্যাকারী অতিপ্রতিসম ইয়াং-মিলস তত্ত্ব হলো দশ মাত্রার নির্দিষ্ট একটা স্ট্রিং থিওরির ডুয়াল বা দ্বৈতরূপ, অর্থাৎ গাণিতিকভাবে সমতুল্য। এতে পদার্থবিজ্ঞান-জগৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল। ২০১৫ সালের মধ্যে এই পেপারকে উল্লেখ করে লেখা হয়েছে আরও দশ হাজার পেপার। এতে পেপারটা হয়ে উঠেছে হাই-এনার্জি ফিজিকসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী। (প্রতিসাম্য এবং দ্বৈততা বা ডুয়ালিটি পরস্পর সম্পর্কিত, কিন্তু আলাদা। প্রতিসাম্য উদ্ভূত হয়, যখন আমরা কোনো সমীকরণের উপাদানগুলো পুনর্বিন্যাস করি। এতেও সমীকরণটি একই থাকে। অন্যদিকে আমরা যখন দেখাই যে দুটি একেবারেই আলাদা তত্ত্ব আসলে গাণিতিকভাবে সমতুল্য, তখন দ্বৈততা উদ্ভূত হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, স্ট্রিং থিওরির এই দুটো উচ্চতর তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মই রয়েছে।
আমরা দেখেছি, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোতে বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে দ্বৈততা আছে। অর্থাৎ এই দুটি ক্ষেত্রকে উল্টে দিলেও, অর্থাৎ বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রগুলোকে চুম্বকীয় ক্ষেত্রে বদলে দিলেও সমীকরণগুলো একই রকম থাকে। (এটা আমরা গাণিতিকভাবেও দেখাতে পারি। কারণ, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় সমীকরণগুলোতে প্রায়ই E^2 + B^2-এর মতো পদ থাকে। ঠিক পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো। ক্ষেত্র দুটোকে পরস্পরের মধ্যে ঘুরিয়ে দিলেও সেগুলো একই থাকে।) একইভাবে দশ মাত্রায় পাঁচটি আলাদা আলাদা স্ট্রিং থিওরি রয়েছে। সেগুলো যে পরস্পরের সঙ্গে দ্বৈত, তা-ও প্রমাণ করা যায়। তাই সেগুলো আসলে একটা ছদ্মবেশী এগারোমাত্রিক এম-তত্ত্ব। অর্থাৎ দারুণ বিষয় হলো, দ্বৈততা প্রমাণ করে যে দুটি আলাদা তত্ত্ব আসলে একই তত্ত্বের ভিন্ন দুটি দিক।
তবে মালডাসেনা প্রমাণ করেন যে এরপরও দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরি এবং চার মাত্রার ইয়াং-মিলস তত্ত্বের মধ্যে আরেকটা দ্বৈততা রয়েছে। সেটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত, কিন্তু এর প্রভাবটা ছিল বেশ গভীর। তার মানে, পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রায় সংজ্ঞায়িত মহাকর্ষ বল এবং পারমাণবিক বলের মধ্যে গভীর ও অপ্রত্যাশিত সংযোগ রয়েছে।
সাধারণত একই মাত্রার স্ট্রিংগুলোর মধ্যে দ্বৈততা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন এসব স্ট্রিংকে যে পদগুলো ব্যাখ্যা করে, সেগুলো পুনর্বিন্যস্ত করে আমরা প্রায়ই একটা স্ট্রিংকে আরেকটাতে বদলে ফেলতে পারি। এতে বিভিন্ন স্ট্রিং থিওরির মধ্যে দ্বৈততার একটা জালের সৃষ্টি হয়। এর সব কটিই একই মাত্রায় সংজ্ঞায়িত। কিন্তু ভিন্ন মাত্রায় সংজ্ঞায়িত করা দুটি বস্তুর মধ্যে দ্বৈততা এর আগে শোনা যায়নি।
এটা কোনো একাডেমিক প্রশ্ন নয়। কারণ, পারমাণবিক বলকে বোঝার জন্য এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যেমন এর আগে আমরা দেখেছি, ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা চার মাত্রায় গেজ থিওরি কীভাবে পারমাণবিক বলের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যাটা দেয়। কিন্তু কেউই এখনো ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রের সঠিক সমাধানটা খুঁজে বের করতে পারেনি। কিন্তু চার মাত্রার গেজ থিওরি দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরির জন্য দ্বৈত হতে পারে। তার মানে, কোয়ান্টাম মহাকর্ষে হয়তো পারমাণবিক বলের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। এটা ছিল গুপ্ত একটা বিষয়ের বিস্ময়কর প্রকাশ। কারণ এর অর্থ পারমাণবিক বলের মৌলিক ধর্মগুলো (যেমন প্রোটনের ভর গণনা করা) হয়তো স্ট্রিং থিওরির মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
পদার্থবিদদের মধ্যে এটি কিছুটা পরিচয়ের সংকট তৈরি করেছে। যাঁরা পারমাণবিক বল নিয়ে একচেটিয়াভাবে কাজ করেছেন, তাঁরা ত্রিমাত্রিক বস্তু যেমন প্রোটন ও নিউট্রন নিয়ে গবেষণায় তাঁদের সমস্ত সময় ব্যয় করেছেন। তাঁদের কাছে প্রায়ই উপহাসের পাত্র হয়েছেন উচ্চতর মাত্রার তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা। কিন্তু মহাকর্ষ আর গেজ থিওরির মধ্যে নতুন এই দ্বৈততার কারণে হুট করে এসব পদার্থবিদের এখন দশমাত্রিক স্ট্রিং থিওরি শেখার চেষ্টা করতে হচ্ছে। কারণ, চার মাত্রায় পারমাণবিক বলকে বোঝার মূল চাবিকাঠিটা হয়তো রয়েছে এখানেই।
তারপর আরেকটা অপ্রত্যাশিত বিষয় উঠে এসেছে এই উদ্ভট দ্বৈততা থেকে। একে বলা হয় হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল। হলোগ্রাম হলো প্লাস্টিকের দ্বিমাত্রিক সমতল পাত, যা ত্রিমাত্রিক বস্তুর ছবি ধারণ করে। এই ছবি বিশেষভাবে এর ভেতর এনকোড করে রাখা হয়। তারপর সমতল স্ক্রিনে একটা লেজার রশ্মি দিয়ে আলোকিত করলে ত্রিমাত্রিক ছবিটা আবির্ভূত হয় হুট করে। অন্য কথায়, ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য লেজার ব্যবহার করে একটা সমতল দ্বিমাত্রিক স্কিনে এনকোড করা থাকে। যেমন প্রিন্সেস লিয়ার ছবি আরটু-ডিটু রোবটের মাধ্যমে প্রজেক্ট করা কিংবা ডিজনিল্যান্ডে ভুতুড়ে ম্যানসনের ছবি, যেখানে ত্রিমাত্রিক ভূতগুলো আমাদের চারপাশে ভেসে বেড়াতে পারে।
এই নীতি কৃষ্ণগহ্বরের জন্যও কাজ করে। আমরা আগেই দেখেছি, আমরা যদি কোনো কৃষ্ণগহ্বরে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া ছুড়ে ফেলি, তাহলে কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুযায়ী, বইটার ভেতরে থাকা তথ্য হারিয়ে যেতে পারে না। তাহলে তথ্যগুলো কোথায় যায়? একটা তত্ত্বমতে, তথ্যগুলো কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের পৃষ্ঠতলে বিন্যস্ত হয়। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর কোনো কিছু ফেলা হলে তা কৃষ্ণগহ্বরের দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠতল ত্রিমাত্রিক বস্তুর সব তথ্য ধারণ করে।
আমাদের বাস্তবতার ধারণার জন্যও এর একটা গভীর অর্থ আছে। নিঃসন্দেহে আমরা জানি, আমরা ত্রিমাত্রিক বস্তু, যা তিনটি সংখ্যা দিয়ে সংজ্ঞায়িত স্থানের ভেতর চলাফেরা করি। সেই সংখ্যা তিনটি হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। কিন্তু এটা আমাদের দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে। হয়তো আমরা কোনো হলোগ্রামের ভেতর বসবাস করছি।
হয়তো আমরা যে ত্রিমাত্রিক জগতের অভিজ্ঞতা পাই, তা কেবল বাস্তব জগতের ছায়া। আর বাস্তব জগৎ আসলে দশ বা এগারো মাত্রিক। আমরা যখন ত্রিমাত্রিক জগতের স্থানের ভেতর চলাচল করি, তখন আমাদের সত্যিকার সত্তা হয়তো দশ বা এগারো মাত্রার ভেতর চলাফেরার অভিজ্ঞতা পায়। আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, আমাদের ছায়া আমাদেরকে অনুসরণ করে এবং আমাদের মতো চলাফেরা করে। এখানে ব্যতিক্রম শুধু ছায়াটির অস্তিত্ব দ্বিমাত্রিক। একইভাবে আমরা হয়তো ত্রিমাত্রিক জগতের ছায়া হিসেবে চলাফেরা করছি, কিন্তু আমাদের সত্যিকার সত্তা দশ বা এগারো মাত্রায় চলাফেরা করছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা দেখতে পাই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রিং থিওরি নতুন ও একেবারে অপ্রত্যাশিত ফলাফল উদ্ঘাটন করছে। এর মানে, এর পেছনের প্রাথমিক মৌলিক নীতিগুলো আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কোনো একসময়ে হয়তো দেখা যাবে, স্ট্রিং থিওরি আসলে মোটেও স্ট্রিং-সংক্রান্ত কোনো তত্ত্ব নয়। কারণ, এগারো মাত্রায় প্রণয়ন করা হলে স্ট্রিংগুলোকে মেমব্রেন হিসেবে প্রকাশ করা যায়।
সে জন্য পরীক্ষার সঙ্গে স্ট্রিং থিওরির তুলনা করা অকালিক। অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ের আগেই সংঘটিত হয়েছে। স্ট্রিং থিওরির পেছনের সত্যিকার নীতি একবার উদ্ঘাটন করতে পারলে আমরা হয়তো একে পরীক্ষা করার নতুন কোনো পথ খুঁজে পাব। এরপর হয়তো বলতে পারব যে এটা সত্যিই কোনো থিওরি অব এভরিথিং, নাকি থিওরি অব নাথিং।
তত্ত্বের পরীক্ষা
স্ট্রিং থিওরির সব রকম তাত্ত্বিক সফলতা থাকা সত্ত্বেও এখনো এর অসহনীয় দুর্বল কিছু খুঁত রয়ে গেছে। যেকোনো তত্ত্ব স্ট্রিং থিওরির জন্য প্রণয়ন করা কোনো তত্ত্বের মতো শক্তিশালী বলে দাবি করা হলে তা স্বাভাবিকভাবেই সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব ক্ষেত্রে কার্ল সাগানের একটা কথা বারবার মনে পড়তে বাধ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘অসাধারণ দাবির জন্য অসাধারণ প্রমাণের দরকার।’
(উলফগ্যাং পাউলির আরেকটা বিদ্রূপাত্মক কথাও আমি মনে করিয়ে দিতে চাই। কাউকে ঠান্ডা করার ক্ষেত্রে ওস্তাদ লোক ছিলেন তিনি। কোনো বক্তৃতা শোনার সময় তিনি বলে উঠতেন, তুমি যেটা বলছ, তা এতই বিভ্রান্তিকর যে কেউ বুঝতে পারছে না ওটা অর্থহীন নাকি অন্য কিছু।’ তিনি এমনও বলতেন, ‘তুমি ধীরে ধীরে চিন্তা করলে আমি কিছু মনে করব না। কিন্তু তুমি যদি তোমার চিন্তার গতির চেয়ে বেশি দ্রুত তা প্রকাশ করো, তাহলে আমার আপত্তি আছে।’ তিনি বেঁচে থাকলে স্ট্রিং থিওরির ক্ষেত্রে হয়তো একই কথা বলতেন।)
বিতর্কটা এতই প্রচণ্ড ছিল যে পদার্থবিজ্ঞানের সেরা কয়েকজন ব্যক্তিত্ব এই প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে যান। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সলভে কনফারেন্সে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রশ্নে পরস্পরের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন আইনস্টাইন আর বোর। এরপর থেকে বিজ্ঞানজগৎ এ ধরনের বড় বিভেদ দেখেনি।
এই প্রশ্নে বিপক্ষ দলে অবস্থান নিয়েছেন নোবেল বিজয়ীরা। শ্লেনডন গ্ল্যাশো লিখেছেন, ‘ডজনখানেক সেরা আর মেধাবী ব্যক্তির প্রচণ্ড খাটুনির পরেও কোনো যাচাইযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া যায়নি এবং শিগগিরই যে তা পাওয়া যাবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই।’ জেরার্ড টি হুফট আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, স্ট্রিং থিওরি নিয়ে আগ্রহকে ‘আমেরিকান টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের’ সঙ্গে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ অনেক প্রচার আর জাঁকজমকের পর শেষে গিয়ে কোনো কিছুই পাওয়া যায় না।
অবশ্য স্ট্রিং থিওরির গুণগুলোর প্রশংসাও করেন অনেকে। ডেভিড গ্রস লিখেছেন, ‘আইনস্টাইন এতে খুশি হতেন। এটা বুঝতে না পারলেও অন্তত এর লক্ষ্য দেখে খুশি হতেন তিনি।…এর পেছনে যে জ্যামিতিক নীতি আছে, সেটাও পছন্দ করতেন। অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে, সেটা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি।’
স্ট্রিং থিওরিকে উত্তর মেরু অনুসন্ধানের ঐতিহাসিক প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করেছেন স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। প্রাচীনকালে পৃথিবীর সব মানচিত্রে অনেক বড় বড় ফাঁকফোকর ছিল, সেখানে উত্তর মেরুও থাকা উচিত, কিন্তু কেউই তখনো সেটা দেখেনি। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় সব কম্পাস ওই পৌরাণিক স্থানটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখত। কিন্তু উত্তর মেরু অনুসন্ধানের সব প্রচেষ্টাই একসময় ব্যর্থ হতো, উপকথার মতো। প্রাচীনকালের নাবিকেরা জানতেন, একটা উত্তর মেরু অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে পারতেন না কেউই। ওটা সত্যিই আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ করেছিল অনেকে। তবে কয়েক শতাব্দী জল্পনাকল্পনার পর ১৯০৯ সালে অবশেষে উত্তর মেরুতে পা রাখেন রবার্ট পেরি।
স্ট্রিং থিওরির সমালোচক গ্ল্যাশো স্বীকার করেছেন, এই তর্কে তাঁর বিপক্ষের মানুষই বেশি। তিনি একবার মন্তব্য করেন, ‘উচ্চতর স্তন্যপায়ীদের জগতে আমি নিজেকে একটা ডাইনোসর হিসেবে আবিষ্কার করেছি।’
স্ট্রিং থিওরির সমালোচনা
স্ট্রিং থিওরির বিপক্ষে প্রধান প্রধান বেশ কয়েকটি সমালোচনা রয়েছে। সমালোচকেরা দাবি করেন যে তত্ত্বটির পুরোটাই প্রচারণা। অর্থাৎ এর নিজের দেখানো সৌন্দর্য পদার্থবিজ্ঞানে অনির্ভরযোগ্য। এটি মহাবিশ্বের বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এটা পরীক্ষাযোগ্য নয়।
সৌন্দর্যের শক্তি দেখে একবার বিভ্রান্ত হয়েছিলেন প্ৰতিভাবান জ্যোতির্বিদ কেপলার। সৌরজগৎ পরস্পরের সঙ্গে সজ্জিত এক গুচ্ছ সুষম পলিহেড্রন বা বহুতলকের বিন্যাস—এই তথ্যে মুগ্ধ হন তিনি। এর কয়েক শতাব্দী আগে গ্রিকরা এসব পলিহেড্রনের পাঁচটি (যেমন ঘনক, পিরামিড ইত্যাদি) গণনা করতে পেরেছিল। কেপলার খেয়াল করে দেখলেন, এই পলিহেড্রনগুলো ধারাবাহিকভাবে একটাকে আরেকটার মধ্যে রাখা যায়। অনেকটা রুশ পুতুলের মতো। এভাবে সৌরজগতের বিস্তারিত কিছু অংশ পুনরুৎপাদন করা সম্ভব। তাঁর আইডিয়াটা চমৎকার, কিন্তু একসময় তা ভুল প্রমাণিত হয়।
সম্প্রতি কয়েকজন পদার্থবিদ স্ট্রিং থিওরির সমালোচনা করে বলেছেন, সৌন্দর্য হলো পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বিভ্রান্তিকর মানদণ্ড। স্ট্রিং থিওরির চকচকে গাণিতিক ধর্ম থাকার মানে এই নয় যে সেটা সত্যিকার মর্মবস্তু ধারণ করে। এই বিজ্ঞানীরা যথাযথভাবে ইঙ্গিত করেছেন যে মাঝেমধ্যে সুন্দর তত্ত্বগুলোর শেষে কানাগলি থাকে।
তবে কবিরা প্রায়ই জন কিটসের ‘ওডি অব গ্রেসিয়ান আর্ন’ কবিতাটার উল্লেখ করেন-
Beauty is truth, truth beauty, that is all
Ye know on earth, and all ye need to know.
পল ডিরাকও নিঃসন্দেহে এই নীতি মেনে চলতেন। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘কোনো গবেষণাকর্মী যদি গাণিতিক রূপে প্রকৃতির মৌলিক সূত্রগুলো প্রকাশের চেষ্টা করেন, তাঁদের প্রধানত গাণিতিক সৌন্দর্যের জন্য কঠোরভাবে চেষ্টা করা উচিত।’ আসলে তিনি ইলেকট্রনের জন্য তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বটি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন কোনো উপাত্তের দিকে না তাকিয়ে, শুধু বিশুদ্ধ গাণিতিক ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে।
সৌন্দর্য পদার্থবিজ্ঞানে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, নিঃসন্দেহে তা মাঝেমধ্যে বিপথগামী করতে পারে। পদার্থবিদ স্যাবিন হোসেনফেল্ডার লিখেছেন, ‘একীভূত বল, নতুন কণা এবং অতিরিক্ত প্রতিসাম্য ও অন্যান্য মহাবিশ্ব সম্পর্কে শত শত সুন্দর তত্ত্ব বাতিল হয়েছে। তত্ত্বগুলোতে আর কিছু নয়, শুধু ছিল ভুল, ভুল আর ভুল। সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরতা স্পষ্টতই কোনো সাফল্যজনক কৌশল নয়।’
সমালোচকদের দাবি, স্ট্রিং থিওরির সুন্দর গণিত আছে, কিন্তু এর সঙ্গে ভৌত বাস্তবতার হয়তো কোনো যোগসূত্র নেই
এই সমালোচনার কিছুটা সঠিক, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে স্ট্রিং থিওরির প্রতিসাম্যের মতো চেহারা অকেজো নয় এবং ভৌত প্ৰয়োগ বর্জিতও নয়। অতিপ্রসমতার কোনো প্রমাণ এখনো খুঁজে পাওয়া না গেলেও তা কোয়ান্টাম থিওরির অনেক ত্রুটি দূর করতে দরকারি বলে প্রমাণিত হয়েছে। বোসনকে ফার্মিয়নের বিপরীতে বাতিল করে অতিপ্রতিসাম্য আমাদের দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা সমাধানে সক্ষম করেছে। আবার কোয়ান্টাম মহাকর্ষ নিয়ে উৎপাত করা বিচ্যুতিগুলোও দূর করেছে এই অতিপ্রতিসাম্য।
সব সুন্দর তত্ত্বের ভৌত প্রয়োগ নেই সত্যি, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া সব মৌলিক ভৌত তত্ত্বের একধরনের সৌন্দর্য আছে কিংবা তাদের মধ্যে সহজাত প্রতিসাম্য আছে। এর কোনো ব্যতিক্রম পাওয়া যায়নি।
এটা কি পরীক্ষা করা সম্ভব?
স্ট্রিং থিওরির প্রধানতম সমালোচনা হলো এটা পরীক্ষাযোগ্য নয়। গ্র্যাভিটন যে শক্তি ধারণ করে, তাকে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক এনার্জি। সেটা এলএইচসি যে শক্তি তৈরি করে, তার চেয়ে কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বেশি। বর্তমানে এলএইচসির যে আকার, তার চেয়ে কোয়াড্রিলিয়ন গুণ বড় আরেকটা এলএইচসি বানানোর চেষ্টা করার কথা ভাবুন! তাহলে এই তত্ত্বটা সরাসরি প্রমাণের জন্য যে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের দরকার হবে, তার আকার হবে একটা গ্যালাক্সির সমান।
আরও ব্যাপার হলো, স্ট্রিং থিওরির একেকটি সমাধান হলো একেকটা গোটা মহাবিশ্ব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ সমাধানের পরিমাণও অসীমসংখ্যক। কাজেই তত্ত্বটাকে সরাসরি পরীক্ষা করার জন্য দরকার গবেষণাগারে একটা শিশু মহাবিশ্ব তৈরি করা! মোদ্দা কথায়, একমাত্র ঈশ্বরই পারেন তত্ত্বটা সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা করে দেখতে। কারণ, তত্ত্বটার ভিত্তি শুধু অণু বা পরমাণু নয়, বরং মহাবিশ্বগুলোও।
কাজেই প্রথমেই মনে হয়, যেকোনো তত্ত্বকে যেসব অ্যাসিড টেস্টে অংশ নিতে হয়, স্ট্রিং থিওরি সেসব অগ্নিপরীক্ষায় ব্যর্থ। অর্থাৎ এর পরীক্ষাযোগ্যতা নেই। স্ট্রিং থিওরির প্রবর্তকেরা তাতেও দমে যাননি। আগেই দেখিয়েছি, বেশির ভাগ বিজ্ঞান পরোক্ষভাবে চর্চিত হয়। যেমন সূর্য, মহাবিস্ফোরণ থেকে আসা প্রতিধ্বনি পরীক্ষা করার মাধ্যমে।
একইভাবে আমরা দশ এবং এগারো মাত্রা থেকে আসা প্রতিধ্বনির খোঁজ করছি। স্ট্রিং থিওরির জন্য কোনো প্রমাণ হয়তো আমাদের চারপাশেই লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের সেটা সরাসরি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা না করে, তার প্রতিধ্বনি শোনার চেষ্টা করে যেতে হবে।
যেমন হাইপারস্পেস বা উচ্চতর মাত্রা থেকে আসা একটা সম্ভাব্য সংকেত হয়তো গুপ্তবস্তুর অস্তিত্ব। এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে মহাবিশ্ব প্রধানত পরমাণু দিয়ে গঠিত। কিন্তু একসময় দেখা গেল, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মতো পরমাণু দিয়ে মহাবিশ্বের মাত্র ৪.৯ ভাগ গঠিত। তখন বেশ একটা ধাক্কা খান জ্যোতির্বিদেরা। আসলে মহাবিশ্বের বেশির ভাগ অংশই আমাদের কাছ থেকে গুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। সেগুলো গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তি রূপে বিরাজমান। (মনে আছে নিশ্চয়, গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তি দুটো আলাদা জিনিস। মহাবিশ্বের ২৬.৮ ভাগ তৈরি হয়েছে গুপ্তবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার দিয়ে। সেগুলো অদৃশ্য বস্তু, যা ছায়াপথগুলোকে ঘিরে রাখে এবং তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে বাধা দেয়। অন্যদিকে মহাবিশ্বের ৬৮.৩ ভাগ তৈরি হয়েছে গুপ্তশক্তি বা ডার্ক এনার্জিতে। এটা আরও রহস্যময়। শূন্যস্থানের এই শক্তি মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলোকে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।) হয়তো থিওরি অব এভরিথিংয়ের প্রমাণ এই অদৃশ্য মহাবিশ্বে লুকিয়ে আছে।
গুপ্তবস্তুর খোঁজে
গুপ্তবস্তু বা ডার্ক ম্যাটার বেশ অদ্ভুত। এটা অদৃশ্য। তবু তা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একত্রে ধরে রেখেছে। কিন্তু এর কোনো ওজন ও চার্জ নেই। তাই আপনি যদি হাত দিয়ে গুপ্তবস্তু ধরার চেষ্টা করেন, তাহলে সেগুলো আঙুলের ভেতর দিয়ে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যে মনে হবে সেগুলো সেখানে ছিলই না। সেগুলো মেঘের ভেতর দিয়ে সরাসরি পৃথিবীর কেন্দ্রে চলে যাবে। এরপর কেন্দ্র ভেদ করে সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যাবে পৃথিবীর আরেক প্রান্তের দিকে। মহাকর্ষের কারণে সেগুলো হয়তো আরও উল্টো দিকে আসতে থাকবে এবং আবারও আপনার কাছে চলে আসবে। এরপর এই গুপ্তবস্তুগুলো আপনার আর এই গ্রহের অন্য প্রান্তের মধ্যে একইভাবে যাওয়া-আসা করতে থাকবে, যেন পৃথিবীর কোনো অস্তিত্বই নেই।
গুপ্তবস্তু যতই উদ্ভট লাগুক না কেন, আমরা জানি এটা অবশ্যই আছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন বিশ্লেষণ করা হলে এবং নিউটনের সূত্র ব্যবহার করা হলে দেখা যাবে, এই ছায়াপথের কেন্দ্রবিমুখী বলটি ঠেকাতে এতে পর্যাপ্ত ভর নেই। যে পরিমাণ ভর দেখা যায়, শুধু সেটুকু থাকলে মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলোর অস্থিতিশীল হওয়ার কথা। তাদের ছিটকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, কয়েক বিলিয়ন বছর থেকে ছায়াপথগুলো দিব্যি স্থিতিশীল অবস্থায় টিকে রয়েছে। কাজেই আমাদের হাতে সম্ভাব্য দুটো সমাধান আছে, তার মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ হয় ছায়াপথগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য নিউটনের সমীকরণগুলো ভুল, আর নয়তো ছায়াপথগুলোকে অক্ষত রাখার জন্য সেখানে অদৃশ্য কোনো বস্তু আছে। (মনে আছে নিশ্চয়ই, নেপচুন গ্রহটা ঠিক এভাবেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তখন হিসাবে দেখা গেল, ইউরেনাসের কক্ষপথ সুষম উপবৃত্ত থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এর পেছনে ব্যাখ্যা হিসেবে অনুমান করা হলো যে নতুন কোনো গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে।
বর্তমানে গুপ্তবস্তুর সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় প্রার্থীর নাম উইকলি ইন্টারেক্টিভ ম্যাসিভ পার্টিকেলস (WIMPs)। এদের মধ্যে একটা সম্ভাব্য কণা হতে পারে ফোটিনো। অর্থাৎ ফোটনের অতিপ্রতিসম সঙ্গী বা সুপারসিমেট্রিক পার্টনার। ফোটিনো স্থিতিশীল। এর ভর আছে ও তা অদৃশ্য। ফোটিনোর চার্জ নেই। এগুলো ডার্ক ম্যাটারের ধর্মের সঙ্গে বেশ ভালোভাবে মিলে যায়। পদার্থবিদেরা বিশ্বাস করেন, গুপ্তবস্তুর কোনো অদৃশ্য বাতাসের ভেতর দিয়ে পৃথিবী চলাচল করছে, যা সম্ভবত এই মুহূর্তে আপনার শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ফোটিনো যদি প্রোটনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো, তাহলে তার ফলে প্রোটন হয়তো অতিপারমাণবিক কণার ঝরনাধারায় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। সেটি ঘটলে তাকে শনাক্ত করাও সম্ভব। এখন পর্যন্ত বিশালাকৃতির বেশ কিছু সুইমিংপুল আকারের ডিটেক্টর (বিপুল পরিমাণ জেনন ও আর্গনের ফ্লুইডসহ) বসানো হয়েছে, যা কোনো একদিন হয়তো ফোটিনোর কারণে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ শনাক্ত করতে পারবে। বর্তমানে গুপ্তবস্তুর খোঁজ চালাচ্ছে প্রায় ২০টি সক্রিয় দল। তারা ভূপৃষ্ঠের নিচে গভীর খনির খাদে বসানো ডিটেক্টর নিয়ে কাজ করছে, যাতে সেখানে মহাজাগতিক রশ্মি বাগড়া দিতে না পারে। এ থেকে ধারণা করা যায়, গুপ্তবস্তুর সংঘর্ষ হয়তো আমাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে ধরা সম্ভব হবে। গুপ্তবস্তুর সংঘর্ষ একবার শনাক্ত করা সম্ভব হলে, এরপর গুপ্তবস্তুর কণাগুলোর ধর্ম নিয়ে গবেষণা করবেন পদার্থবিদেরা। এরপর অনুমিত ফোটিনোর ধর্মের সঙ্গে সেগুলোকে তুলনা করা দেখা হবে। স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যদ্বাণী যদি গুপ্তবস্তুর পরীক্ষায় পাওয়া ফলাফলের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানীরা বোঝাতে পারবেন, এটাই সঠিক পথ।
আরেকটা সম্ভাবনা হলো, পরবর্তী প্রজন্মের পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে হয়তো ফোটিনো তৈরি করাও সম্ভব হতে পারে।
এলএইচসি ছাড়িয়ে
ইন্টারন্যাশনাল লিনিয়ার কলাইডারে অর্থায়নের কথা ভাবছে জাপানিরা। এতে ইলেকট্রনের একটা বিম ছুড়ে দেওয়া হবে সোজা টিউবের ভেতর। সেটা সবশেষে একটা প্রতি-ইলেকট্রনের বিমের সঙ্গে সংঘর্ষ করবে। সেটা অনুমোদন পেলে যন্ত্রটা তৈরি করা হবে আগামী ১২ বছরের মধ্যে। এ ধরনের কলাইডারের সুবিধা হলো, এতে প্রোটন ব্যবহার না করে ইলেকট্রন ব্যবহার করা যায়। প্রোটনের মধ্যে তিনটি কোয়ার্ক থাকে। সেগুলো শক্তভাবে একত্রে আটকে রাখে গ্লুয়ন। তাই প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষ খুবই তালগোল পাকানো হয়। এ সংঘর্ষের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে অসংশ্লিষ্ট কণা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ইলেকট্রন হলো একক মৌলিক কণা। কাজেই প্রতি-ইলেকট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষ অনেক বেশি স্পষ্ট। আবার এর জন্য বেশ কম শক্তির প্রয়োজন হয়। ফলে এর মাধ্যমে মাত্র ২৫০ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টেই হিগস বোসন কণা তৈরি করতে পারার কথা।
ওদিকে চীনারাও বৃত্তাকার ইলেকট্রন পজিট্রন কলাইডার তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই কণা ত্বরকটার কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালের দিকে, যা শেষ হওয়ার কথা ২০৩০ সাল নাগাদ। সে জন্য খরচ পড়বে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই কলাইডারটা ২৪০ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি পর্যন্ত পৌঁছাবে। ১০০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বৃত্তাকারভাবে নির্মিত হবে এটি।
এখানেই শেষ নয়, এদিকে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসির উত্তরসূরি বানানোর পরিকল্পনা করছেন সার্নের পদার্থবিজ্ঞানীরা। এর নাম হবে ফিউটার সার্কুলার কলাইডার বা এফসিসি। এটি ক্রমান্বয়ে ১০০ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে পৌঁছাবে। সত্যিই বিস্ময়কর! বৃত্তাকারভাবে নির্মিত এ কণাত্বরকের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার।
এসব অ্যাকসিলারেটর কখনো তৈরি করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সেগুলো তৈরির মানে এই নয় যে এলএইচসির পরের প্রজন্মের অ্যাকসিলারেটর দিয়ে গুপ্তবস্তু খুঁজে পাওয়ার আশা রয়েছে। আমরা যদি গুপ্তবস্তুর কণাগুলো কখনো খুঁজে পাই, তাহলে সেগুলোকে স্ট্রিং থিওরির ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে।
এসব অ্যাকসিলারেটর দিয়ে স্ট্রিং থিওরির আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো যাচাই করে দেখা যাবে। সেটা হলো মিনি ব্ল্যাকহোলের উপস্থিতি। যেহেতু স্ট্রিং থিওরি হলো থিওরি অব এভরিথিং, কাজেই অতিপারমাণবিক কণা ছাড়াও এতে মহাকর্ষও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কাজেই পদার্থবিদেরা অ্যাকসিলারেটরে খুদে কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা করেন। (এই খুদে কৃষ্ণগহ্বরগুলো নাক্ষত্রিক কৃষ্ণগহ্বরের মতো নয়। এরা অক্ষতিকর। কারণ এদের শক্তি মৃত্যুমুখী নক্ষত্রের মতো নয়, বরং অতিক্ষুদ্র অতিপারমাণবিক কণাদের মতো। আসলে এসব অ্যাকসিলারেটরে যেসব কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হবে, তার চেয়ে পৃথিবীতে মহাজাগতিক রশ্মির আঘাতও অনেক বেশি শক্তিশালী। আবার এসব কৃষ্ণগহ্বরের কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও নেই।)
মহাবিস্ফোরণ যখন অ্যাটম স্ম্যাশার
এমনও আশা আছে যে সর্বকালের সবচেয়ে বড় অ্যাটম স্ম্যাশার থেকেও আমরা সুবিধা নিতে পারব। সেই অ্যাটম স্ম্যাশার হলো খোদ মহাবিস্ফোরণ। মহাবিস্ফোরণ থেকে আসা বিকিরণ হয়তো গুপ্তবস্তু এবং গুপ্তশক্তি সম্পর্কে আমাদের কোনো ক্লু দিতে পারবে। প্ৰথমত, মহাবিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি বা অস্তরাগ সহজেই শনাক্ত করা যায়। আমাদের স্যাটেলাইটগুলো এই বিকিরণ খুবই নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারে।
এই মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের ফটোগ্রাফ প্রমাণ করে যে তা উল্লেখযোগ্যভাবে মসৃণ, সেই সঙ্গে তার পৃষ্ঠতলে অতিক্ষুদ্র ঢেউ দেখা যায়। এসব ঢেউ খুদে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের প্রতীক, মহাবিস্ফোরণের তাৎক্ষণিক মুহূর্তে যাদের অস্তিত্ব ছিল। সেগুলোই প্রসারণের কারণে বিবর্ধিত হয়েছে।
তবে বিতর্কিত বিষয়টি হলো ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনে যে অসমতা ও ফুটকি ফুটকি দেখা যায়, তার ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারিনি। অনেকে অনুমান করেন, এই অদ্ভুত ফুটকি ফুটকি দাগগুলো হলো অন্য মহাবিশ্বগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের ভগ্নাবশেষ। বিশেষ করে সিএমবির (কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড) শীতল বিন্দুগুলো হয়তো সুষম ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের অস্বাভাবিক শীতল চিহ্ন। এগুলোই কালের শুরুতে আমাদের মহাবিশ্ব এবং কোনো প্যারালাল মহাবিশ্বের মধ্যে সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ হতে পারে বলে সন্দেহ করেন কজন পদার্থবিদ। এই অদ্ভুত চিহ্নগুলো যদি আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে কোনো প্যারালাল মহাবিশ্বের মিথস্ক্রিয়ার প্রতীক হয়, তাহলে সন্দেহবাদীদের কাছে মাল্টিভার্স থিওরি হয়তো আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
ইতিমধ্যে এসব গণনা পরিমার্জন করার জন্য মহাকাশে ডিটেক্টর স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে জন্য মহাকাশভিত্তিক মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে।
লিসা
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন প্রমাণ করেন, মহাকর্ষ ভ্রমণ করতে পারে তরঙ্গের মতো। কোনো পুকুরে একটা ঢিল ছোড়া হলে সেখানে সমকেন্দ্রিক, প্রসারণশীল রিং দেখা যায়। একইভাবে আইনস্টাইন অনুমান করলেন, মহাকর্ষের স্ফীতিও আলোর বেগে চলাচল করতে পারে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সেটা এতই দুর্বল যে আমরা শিগগিরই খুঁজে পাব বলে তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি আইনস্টাইন।
ঠিকই বলেছিলেন তিনি। তবে সেটা প্রমাণ করতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অর্থাৎ মহাকর্ষ তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর ১০০ বছর পরে। প্রায় এক বিলিয়ন বছর আগে মহাকাশে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ হয়েছিল। এই সংঘর্ষ থেকে আসা সংকেত ধরা পড়েছে বিশাল ডিটেক্টরে। যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা ও ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে তৈরি করা হয়েছে ডিটেক্টরগুলো। প্রতিটি ডিটেক্টর বিস্তৃত বেশ কয়েক বর্গমাইল জায়গাজুড়ে। সেগুলোর আকৃতি ইংরেজি এল (L) অক্ষরের মতো। এই এল-এর প্রতিটি বাহু থেকে লেজার রশ্মি ছুটে যায়। দুটি রশ্মি কেন্দ্রে মিলিত হলে তারা একটা ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি করে। সেটি কম্পনের প্রতি এতই সংবেদনশীল যে তারা বহু আগের সংঘটিত কৃষ্ণগহ্বর দুটোর সংঘর্ষ শনাক্ত করতে পেরেছে।
এ-সংক্রান্ত অগ্রণী কাজের জন্য ২০১৭ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন পদার্থবিদ। তাঁরা হলেন রেইনার ওয়েস, কিপ এস থর্ন এবং ব্যারি সি ব্যারিশ।
আরও সংবেদনশীলতা অর্জনের জন্য বাইরের মহাকাশে মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রজেক্টটি লেজার ইন্টারফেরোমেট্রি স্পেস অ্যানটেনা বা লিসা (LISA) নামে পরিচিত। লিসা হয়তো খোদ মহাবিস্ফোরণের তাৎক্ষণিক মুহূর্ত থেকে আসা কম্পন ধরতে সক্ষম হবে। লিসার একটা সংস্করণে তিনটি আলাদা স্যাটেলাইট স্থাপন করা হবে মহাকাশে। প্রতিটি স্যাটেলাইট অন্যদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে লেজার রশ্মির এক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এদের মাধ্যমে মহাকাশে গঠিত ত্রিভূজটির প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় এক মিলিয়ন মাইল। মহাবিস্ফোরণ থেকে আসা কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ যখন এই ডিটেক্টরে আঘাত হানবে, তখন লেজার রশ্মিগুলো সামান্য ঝাঁকি দিয়ে উঠবে। এরপর সেটি মাপা হবে সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি দিয়ে।
এর চূড়ান্ত লক্ষ্য মহাবিস্ফোরণ থেকে আসা শক ওয়েভ রেকর্ড করা। এরপর সেই ভিডিও টেপটা পেছনে চালানো। এভাবে মহাবিস্ফোরণের আগের বিকিরণের সর্বোত্তম অনুমান করাই এর প্রধান লক্ষ্য। মহাবিস্ফোরণের আগের তরঙ্গগুলো এরপর স্ট্রিং থিওরির কিছু সংস্করণের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে তুলনা করে দেখা হবে। এ পদ্ধতিতে মহাবিস্ফোরণের আগের মাল্টিভার্স সম্পর্কে সংখ্যাগত উপাত্ত পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
লিসার চেয়ে আরও উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের শিশু বয়সের ছবিও পাওয়া সম্ভব হবে। কে জানে হয়তো আমাদের শিশু মহাবিশ্বকে কোনো মাতা মহাবিশ্বের ভ্রূণের সঙ্গে নাভি রজ্জু দিয়ে যুক্ত থাকার প্রমাণও পাওয়া যাবে এভাবে।
বিপরীত বর্গীয় সূত্রের পরীক্ষা
স্ট্রিং থিওরি নিয়ে আরেকটা অভিযোগ, এটি স্বতঃসিদ্ধভাবে দাবি করে যে আমরা আসলে দশ বা এগারো মাত্রায় বসবাস করছি। কিন্তু এর পক্ষে কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণ নেই।
কিন্তু এই দিকটা হয়তো আমাদের হাতে থাকা প্রচলিত যন্ত্রপাতি দিয়ে যাচাই করা সম্ভব হতে পারে। আমাদের মহাবিশ্ব যদি ত্রিমাত্রিক হয়, তাহলে মহাকর্ষ বল কমতে থাকে পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের বর্গীয় হারে। নিউটনের এই বিখ্যাত সূত্রটি মহাকাশের কোটি কোটি মাইল দূরে মহাকাশ অনুসন্ধানী যান নির্ভুলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। তাই আমরা যদি চাই, তাহলে শনি গ্রহের বলয়ের ভেতর দিয়ে মহাকাশ অনুসন্ধানী যান পাঠাতে পারি। কিন্তু নিউটনের বিখ্যাত বিপরীত বৰ্গীয় সূত্রটি শুধু অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা মহাকাশের বিপুল দূরত্বে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তবে গবেষণাগারে এ ধরনের পরীক্ষা বিরল। মহাকর্ষের শক্তিমত্তা যদি ছোট দূরত্বে বিপরীত বর্গীয় সূত্র মেনে না চলে, তাহলে সেটাই হবে উচ্চতর মাত্রার অস্তিত্বের সংকেত। যেমন মহাবিশ্বে যদি চারটি স্থানিক মাত্রা থাকত, তাহলে মহাকর্ষ বস্তুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্বের ঘনকীয় হারে কমে যাওয়ার কথা ছিল। (মহাবিশ্বের যদি N সংখ্যক স্থানিক মাত্রা থাকত, তাহলে মহাকর্ষ কমে যেত বস্তুদের মধ্যবর্তী দূরত্বের (N-1) ঘাত হারে।
কিন্তু পরীক্ষাগারে দুটো বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল খুব কমই মাপা হয়েছে। এসব পরীক্ষা করে দেখা খুবই কঠিন। কারণ, মহাকর্ষ বল গবেষণাগারে খুবই অল্প। তবে প্রথমবার তা মেপে দেখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে। ফলাফল পাওয়া গেছে ঋণাত্মক। অর্থাৎ নিউটনের বিপরীত বর্গীয় সূত্র সেখানেও পাওয়া গেছে। (কিন্তু এর একমাত্র মানে, কলোরাডোতে কোনো অতিরিক্ত মাত্রা নেই।)
ল্যান্ডস্কেপ সমস্যা
তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এসব সমালোচনা বেশ ঝামেলার, কিন্তু মারাত্মক নয়। কিন্তু একটা বিষয় তাদের বেশ ঝামেলায় ফেলে। সেটা হলো এই মডেলটি প্যারালাল মহাবিশ্বের মাল্টিভার্সের ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে অনেকগুলোই বেশ উদ্ভট। এমনকি হলিউডের স্ক্রিপ্টরাইটারের কল্পনার চেয়েও উদ্ভট সেগুলো। স্ট্রিং থিওরির সমাধান সংখ্যা অসীম। এদের প্রতিটিই একটা নিখুঁত ধর্মের সসীম মহাকর্ষ তত্ত্বের বর্ণনা দেয়। কিন্তু সেগুলো আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে মোটেও মেলে না। এসব প্যারালাল মহাবিশ্বের বেশ কয়েকটিতে প্রোটন স্থিতিশীল নয়। কাজেই ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর বিপুল মেঘে ক্ষয়ে যেতে পারে কণাটি। এসব মহাবিশ্বে আমাদের চেনাজানা জটিল বস্তুর (পরমাণু ও অণুর) কোনো অস্তিত্ব নেই। এতে অতিপারমাণবিক কণাদের গ্যাসই রয়েছে। (অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবেন, বিকল্প মহাবিশ্ব কেবল গাণিতিক সম্ভাবনা এবং সেগুলো বাস্তব নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, তত্ত্বটির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা নেই। কারণ, এটা আপনাকে বলতে পারবে না, এসব বিকল্প মহাবিশ্বের মধ্যে কোনটা বাস্তব।)
সমস্যাটি যে শুধু স্ট্রিং থিওরির ক্ষেত্রেই ঘটে, ব্যাপারটা আসলে তা- ও নয়। যেমন নিউটন কিংবা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের কতটা সমাধান আছে? সেগুলোর সংখ্যাও অসীম হতে পারে। সেটা নির্ভর করবে আপনি কী নিয়ে গবেষণা করছেন, তার ওপর। লাইট বাল্ব বা লেজার দিয়ে শুরু করলে আপনি ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ সমাধান করে প্রতিটি যন্ত্রপাতির জন্য অনন্য সমাধান খুঁজে পাবেন। কাজেই ম্যাক্সওয়েল বা নিউটনের তত্ত্বগুলোতেও অসীমসংখ্যক সমাধান আছে। সেগুলো নির্ভর করে প্রাথমিক অবস্থার ওপর। অর্থাৎ যে পরিস্থিতিতে কাজটা শুরু করা হবে, তার ওপর।
সম্ভবত এই সমস্যাটা থাকতে পারে যেকোনো থিওরি অব এভরিথিংয়ের ক্ষেত্রে। প্রাথমিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে কোনো থিওরি অব এভরিথিংয়ের থাকতে পারে অসীমসংখ্যক সমাধান। কিন্তু গোটা মহাবিশ্বের জন্য প্রাথমিক অবস্থা নির্ধারণ করা যাবে কীভাবে? এর মানে, মহাবিস্ফোরণের বাইরে থেকে আপনাকে নিজ হাতে অবশ্যই অবস্থাগুলো যোগ করতে হবে।
একে একধরনের প্রতারণা বলে মনে করেন কিছুসংখ্যক পদার্থবিজ্ঞানী। আদর্শগতভাবে, আপনি চাইছেন খোদ তত্ত্বটাই বলে দিক মহাবিস্ফোরণ কোন অবস্থায় শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ আপনি চান, তত্ত্বটাই সবকিছু বলে দিক; অর্থাৎ তাপমাত্রা, ঘনত্ব এবং আদি মহাবিস্ফোরণের বস্তুসহ সবকিছু। একটা থিওরি অব এভরিথিংয়ের কোনোভাবে তার নিজস্ব প্রাথমিক অবস্থা ধারণ করতে পারা উচিত, সবটাই নিজের মাধ্যমে।
অন্য কথায়, মহাবিশ্বের সূচনার জন্য একটা অনন্য ভবিষ্যদ্বাণী চাই। কাজেই স্ট্রিং থিওরির অত্যধিক পরিমাণ রয়েছে সেটা। তত্ত্বটা কি আমাদের মহাবিশ্বের পূর্বাভাস দিতে পারে? হ্যাঁ, পারে। সেটা বেশ চাঞ্চল্যকর একটা দাবি যে প্রায় এক শতাব্দী ধরে পদার্থবিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল এটাই। কিন্তু তত্ত্বটা কি একটামাত্র মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে? সম্ভবত না। একেই বলা হয় ল্যান্ডস্কেপ প্রবলেম।
এ সমস্যার বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি। প্রথম সমাধানটি হলো অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল বা মানুষ-সম্পর্কিত নীতি। এই নীতি বলে যে আমাদের মহাবিশ্ব বিশেষ কিছু, কারণ আমরা চেতনাধারী সত্তা হিসেবে এখানে প্রাথমিকভাবে এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি I অন্য কথায়, অসীমসংখ্যক মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তার মধ্যেও আমাদের মহাবিশ্বে এমন কিছু অবস্থা রয়েছে, যেখানে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব করে তুলেছে। মহাবিস্ফোরণের প্রাথমিক শর্তগুলো সময়ের শুরুতে নির্দিষ্টভাবে স্থির করা হয়েছিল, যাতে বর্তমানে বুদ্ধিমান প্রাণ টিকে থাকতে পারে। অন্য মহাবিশ্বগুলোতে হয়তো কোনো সচেতন প্ৰাণ নেই।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, এই ধারণাটার সঙ্গে যখন প্ৰথম পরিচয় হলো, তখন আমি সেকেন্ড গ্রেডের ছাত্র। মনে আছে, আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, ঈশ্বর পৃথিবীকে এতই ভালোবাসেন যে তিনি পৃথিবীকে সূর্য থেকে যথাযথ জায়গায় রেখেছেন। একেবারে খুব কাছেও নয়। সেটা হলে সাগর-মহাসাগরগুলো ফুটতে থাকত। আবার খুব বেশি দূরেও নয়। তাহলে পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরগুলো জমে বরফ হয়ে যেত। এক শিশু হিসেবে সেই বয়সে এই যুক্তি শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কারণ, মহাবিশ্বের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে এখানে বিশুদ্ধ যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু আজকের যুগে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অন্য নক্ষত্রগুলোর চারপাশে ঘূর্ণমান চার হাজার গ্রহ উদ্ঘাটন করা গেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গ্রহগুলোর বেশির ভাগ তাদের মাতৃনক্ষত্রের খুব বেশি কাছে, নয়তো খুব বেশি দূরে। ফলে কোনোভাবেই প্রাণধারণের উপযোগী নয় সেগুলো। কাজেই আমার সেকেন্ড গ্রেড টিচারের যুক্তিটা দুটি উপায়ে বিশ্লেষণ করা যায়। হয়তো সবকিছুর ওপর একজন দয়ালু ঈশ্বর আছেন কিংবা হয়তো হাজার হাজার মৃত গ্রহ আছে, যেগুলো মাতৃনক্ষত্রের খুব বেশি কাছে বা খুব বেশি দূরে। আর আমরা এমন একটা গ্রহে বাস করছি, যেটা বুদ্ধিমান প্রাণের টিকে থাকার জন্য একদম সঠিক জায়গায় অবস্থিত। আর সেই কারণে এই প্রশ্নটা নিয়ে আমরা তর্ক করতে পারছি। একইভাবে আমরা হয়তো মৃত মহাবিশ্বগুলোর বিশাল মহাসমুদ্রের সঙ্গে সহাবস্থান করছি। পাশাপাশি আমাদের মহাবিশ্ব বিশেষ কিছু হওয়ার একমাত্র কারণ হলো, আমরা এখানে এই প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা করি।
অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল আসলে আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটা কৌতূহলোদ্দীপক পরীক্ষামূলক সত্যকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়। সেটা হলো প্রাণের টিকে থাকার জন্য প্রকৃতির মৌলিক ধ্রুবকগুলো সুষমভাবে সমন্বয় করা হয়েছে বলে মনে হয়। পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন লিখেছেন, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে যেন মহাবিশ্ব জানত, আমরা এখানে আসছি। যেমন পারমাণবিক বল যদি সামান্য পরিমাণে দুর্বল হতো, তাহলে সূর্য কখনো জ্বলে উঠতে পারত না এবং সৌরজগৎও হয়ে উঠত গাঢ় অন্ধকার। আবার পারমাণবিক বল কিছুটা শক্তিশালী হলে, সূর্য কয়েক বিলিয়ন বছর আগেই জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে যেত। কাজেই পারমাণবিক বল সমন্বয় করা হয়েছে একদম সুষমভাবে।
একইভাবে মহাকর্ষ বল আরেকটা দুর্বল হলে মহাবিস্ফোরণ হয়তো শেষ হতো একটা বিগ ফ্রিজ বা মহাশীতলতার মধ্য দিয়ে। তাতে একটা মৃত, শীতল ও প্রসারণশীল মহাবিশ্ব পাওয়া যেত। আবার মহাকর্ষ আরেকটু শক্তিশালী হলে, আমরা হয়তো শেষ হয়ে যেতাম একটা বিগ ক্রাঞ্চের মধ্য দিয়ে। তখন সব প্রাণ পুড়ে মারা যেত। কাজেই নক্ষত্র ও গ্রহগুলো গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে এবং জীবনের উন্মেষ ঘটার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে আমাদের মহাকর্ষ একদম সঠিক।
এ ধরনের যেসব দুর্ঘটনার কারণে জীবনের বিকাশ সম্ভব হয়ে উঠেছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করা যায়। সেসব তালিকায় প্রতিবারই দেখা যাবে, আমরা আসলে একটা গোল্ডিলকস জোনের মাঝখানে আছি। কাজেই মহাবিশ্ব একটা বিশাল বাজির খেলা। আর সেই খেলায় আমরা জিতেছি। কিন্তু মাল্টিভার্স তত্ত্বমতে, এর মানে বিপুলসংখ্যক মৃত মহাবিশ্বের সঙ্গে সহাবস্থান করছি আমরা।
সুতরাং এই দৃশ্যপটে কোটি কোটি মহাবিশ্বের ভেতর থেকে আমাদের মহাবিশ্বকে তুলে আনতে পারে অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপল। কারণ, আমাদের মহাবিশ্বে চেতনাসমৃদ্ধ জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে।
স্ট্রিং থিওরি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি
সেই ১৯৬৮ সাল থেকে স্ট্রিং থিওরি নিয়ে কাজ করছি আমি। কাজেই এ সম্পর্কে আমার নিজের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তবে এ তত্ত্বটির চূড়ান্ত রূপটি এখনো উদ্ঘাটন করা যায়নি। সুতরাং বর্তমান মহাবিশ্বের সঙ্গে স্ট্রিং থিওরির তুলনা করলে এটা অকালিক বা প্রিম্যাচিউর।
স্ট্রিং থিওরির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এর বিকাশ হচ্ছে পেছন দিকে আর এই পথে নতুন গণিত ও ধারণার প্রকাশ ঘটছে। প্রতিটি দশকে বা তারও পরে, স্ট্রিং থিওরিতে নতুন কিছু উদ্ঘাটিত হয়, যা এর প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। আমি নিজেই এ রকম তিনটি বিস্ময়কর বিপ্লব চাক্ষুষ করেছি। তবু আমরা এখনো স্ট্রিং থিওরিকে তার পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশ করতে পারিনি। এর চূড়ান্ত মৌলিক নীতিগুলো কী, তা আমরা এখনো জানি না। সেটা জানলেই কেবল একে পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করা যাবে।
পিরামিডের উদ্ঘাটন
একে মিসরের মরুভূমিতে গুপ্তধন খোঁজার সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করি আমি। ধরা যাক, মরুভূমিতে একদিন হাঁটতে গিয়ে আপনি ওপরের দিকে খাড়া হয়ে থাকা একটা ছোট পাথরে হোঁচট খেলেন। পাথরটার চারদিক থেকে বালু সরিয়ে বুঝতে পারলেন, এই খুদে পাথরটা আসলে বিশাল একটা পিরামিডের চূড়া। বেশ কয়েক বছর খোঁড়াখুঁড়ির পর অদ্ভুত সব চেম্বার আর শিল্পকর্ম খুঁজে পেলেন। প্রতিটি তলাতে নতুন নতুন বিস্ময়কর ব্যাপার খুঁজে পাওয়া যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো তলায় খোঁড়াখুঁড়ির পর আপনি সর্বশেষ দরজার কাছে পৌঁছাতে পারলেন। দরজা খুললেই জানা যাবে পিরামিডটা কে বানিয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা এখনো সবচেয়ে নিচের তলায় পৌঁছাতে পারিনি। কারণ, তত্ত্বটা যতবারই বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, ততবারই নতুন গাণিতিক স্তর আবিষ্কৃত হচ্ছে। স্ট্রিং থিওরির চূড়ান্ত রূপটা খুঁজে পাওয়ার আগে আমাদের আরও অনেকগুলো স্তর বা পর্দা উদ্ঘাটন করতে হবে। মোদ্দা কথায়, তত্ত্বটা আসলে আমাদের চেয়েও স্মার্ট I
সব কটি স্ট্রিং থিওরিকে স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির মাধ্যমে একটা সমীকরণে প্রকাশ করা সম্ভব। এ সমীকরণটি প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা। দশ মাত্রায় এ রকম পাঁচটি সমীকরণ দরকার।
অবশ্য আমরা ফিল্ড থিওরি রূপে স্ট্রিং থিওরি প্রকাশ করতে পারি। সেটা এম-থিওরির জন্য এখনো সম্ভব নয়। আশা করা হয় যে পদার্থবিদেরা একদিন হয়তো একটামাত্র সমীকরণ খুঁজে পাবেন, যেটা সব কটি এম-থিওরিকে সংক্ষেপিত করতে পারবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোনো মেমব্রেনকে (যা বিভিন্ন উপায় কম্পিত হতে পারে) ফিল্ড থিওরি রূপে প্রকাশ করা ভয়াবহ কঠিন। ফলে এম-থিওরিতে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন সমীকরণ থাকে, যা একই তত্ত্বকে অদ্ভুত বিভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করে। আমরা যদি এম-থিওরিকে ফিল্ড থিওরি রূপে লিখতে পারি, তাহলে গোটা তত্ত্বটা একটামাত্র সমীকরণ হিসেবে উদ্ভূত হওয়ার কথা।
সেটা আদৌ ঘটবে কি না, কিংবা কখন ঘটবে, তা কেউই অনুমান করতে পারে না। কিন্তু স্ট্রিং থিওরি নিয়ে চারপাশের রটনা দেখে মনে হয়, লোকজন অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
কিন্তু স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের মধ্যেও এ তত্ত্বটার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে নির্দিষ্টসংখ্যক হতাশাবাদী রয়েছেন। নোবেলজয়ী ডেভিড গ্রস উল্লেখ করেছেন, স্ট্রিং থিওরি হলো একটা পাহাড়চূড়ার মতো। পর্বতারোহী যখন পর্বতের মাপজোখ করেন, তখন চূড়াটা স্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু যতই তার দিকে যাওয়া যায়, ততই যেন সেটা দূরে সরে যায়। লক্ষ্য খুব কাছেই, কিন্তু সেটা সব সময় আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে এটা বুঝতে পারি আমি। কারণ কেউই জানে না, কখন বা আদৌ গবেষণাগারে আমরা সুপারসিমেট্রি খুঁজে পাব কি না। কিন্তু একে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে যেতেই হবে। কোনো তত্ত্বের সঠিকতা বা ত্রুটি নির্ভর করা উচিত দৃঢ় ফলাফলের ওপর, কোনো পদার্থবিজ্ঞানীর মানসিক ইচ্ছার ওপর নয়। আমরা আশা করি, আমাদের সযত্নে লালিত তত্ত্বগুলো আমাদের জীবনকালের মধ্যেই নিশ্চিত হবে। এটাই মানুষের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু মাঝেমধ্যে প্রকৃতির নিজস্ব সময়সূচিও থাকে।
যেমন পরমাণু তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হওয়ার জন্য দুই হাজার বছর সময় লেগেছিল। বিজ্ঞানীরা কেবল অতিসম্প্রতি নির্দিষ্ট পরমাণুর স্পষ্ট ছবি তুলতে পেরেছেন। এমনকি নিউটন ও আইনস্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলোর বেশ কয়েকটি ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি পরীক্ষা ও যাচাই করতে কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল। কৃষ্ণগহ্বরের কথা প্রথম অনুমান করেছিলেন জন মিশেল। সেই ১৭৮৩ সালে। কিন্তু এই তো সেদিন, ২০১৯ সালে জ্যোতির্বিদেরা প্রথমবার ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে তোলা কৃষ্ণগহ্বরের চূড়ান্ত ছবি প্রকাশ করেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বেশ কিছুসংখ্যক বিজ্ঞানীর হতাশাবাদ হয়তো ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ, এই তত্ত্বের প্রমাণ কোনো বিশালাকৃতির পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে খুঁজে না-ও পাওয়া যেতে পারে। বরং কেউ যখন তত্ত্বটার চূড়ান্ত গাণিতিক সূত্র খুঁজে পাবে, তখনই হয়তো সম্ভব হবে সেটা।
সারকথাটি হলো, স্ট্রিং থিওরির জন্য আমাদের হয়তো কোনো পরীক্ষামূলক প্রমাণের দরকার নেই। কোনো থিওরি অব এভরিথিং সাধারণ জিনিসেরও তত্ত্ব বটে। আমরা যদি প্রথম নীতিগুলো থেকে কোয়ার্ক এবং অন্যান্য জানা অতিপারমাণবিক কণাগুলোর ভর বের করতে পারি, তাহলে সেটাই হয়তো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বহন করবে যে এটাই চূড়ান্ত তত্ত্ব।
সমস্যা হলো সেটা একেবারেই পরীক্ষামূলক নয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বিশটি বা তার চেয়ে বেশি মুক্ত প্যারামিটার রয়েছে, যা জোড়াতালি দিয়ে হিসাব করে বসানো হয়েছে (যেমন কোয়ার্কের ভর ও তাদের মিথস্ক্রিয়ার শক্তি)। অতিপারমাণবিক কণাদের ভর ও সংযোজন নিয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরীক্ষামূলক উপাত্ত রয়েছে। স্ট্রিং থিওরি যদি কোনো অনুমান ছাড়াই প্রথম নীতিগুলো থেকে নিখুঁতভাবে এসব মৌলিক ধ্রুবক নির্ণয় করতে পারে, তাহলে আমার মতে, সেটাই এর যথার্থতা প্রমাণ করবে। একটা মাত্ৰ সমীকরণ থেকে আমরা যদি মহাবিশ্বের জানা প্যারামিটারগুলো বের করে আনতে পারি, তাহলে সেটা হবে সত্যিকারের একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।
কিন্তু আমাদের কাছে কখনো যদি এই এক ইঞ্চি লম্বা সমীকরণ আসে, তাহলে সেটা দিয়ে আমরা কী করব? আমরা ল্যান্ডস্কেপ সমস্যা থেকে কীভাবে মুক্তি পাব?
একটা সম্ভাবনা হলো, এসব মহাবিশ্বের অনেকগুলোই অস্থিতিশীল এবং আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের কাছে ঘুণে ধরা। মনে আছে নিশ্চয়ই, ভ্যাকুয়াম কোনো বিরক্তিকর ও বৈশিষ্ট্যহীন কিছু নয়, বরং তা আসলে বুদ্দ মহাবিশ্বগুলোর সঙ্গে অনবরত অস্তিত্বে যাওয়া-আসা করছে। অনেকটা বুদ্বুদের ভেতর স্নান করার মতো। স্টিফেন হকিং একে বলেছেন স্থান-কালের বুদ্বুদ। এসব খুদে বুদ্দ মহাবিশ্বের বেশির ভাগ অস্থিতিশীল। সেগুলো ভ্যাকুয়াম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে; তারপর আবারও লাফ দিয়ে ভেতরে ফিরে যায়।
একইভাবে তত্ত্বটার কোনো চূড়ান্ত সূত্র খুঁজে পাওয়া গেলে, প্রমাণ করা সম্ভব হবে যে এসব বিকল্প মহাবিশ্বের অধিকাংশই আমাদের মহাবিশ্বের কাছে অস্থিতিশীল ও ক্ষয়িষ্ণু। যেমন এসব বুদ্বুদ মহাবিশ্বের স্বাভাবিক কাল পরিসর হতে পারে প্ল্যাঙ্ক সময়, যার ব্যাপ্তি ১০-৪৩ সেকেন্ড। অর্থাৎ অবিশ্বাস্য রকম ক্ষুদ্র সময়। অধিকাংশ মহাবিশ্ব এই অতি ক্ষুদ্র সময় টিকে থাকে। সে তুলনায় আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১৩৮০ কোটি বছর। এই সূত্র অনুযায়ী, বেশির ভাগ মহাবিশ্বের জীবনকালের তুলনায় এই সময়কাল অনেক দীর্ঘ। অন্য কথায়, এই দৃশ্যপটে অসীমসংখ্যক মহাবিশ্বের মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো বিশেষ কিছু। আমাদেরটা অন্য সব কটি মহাবিশ্বের তুলনায় বেশি সময় ধরে টিকে আছে। আর তাই এই প্রশ্নটা নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছি।
কিন্তু চূড়ান্ত কোনো সমীকরণ যদি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়, আর সেটা যদি এতই জটিল হয় যে হাতে সমাধান করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা কী করব? তাহলে এই দৃশ্যপটে মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব যে বিশেষ কিছু, তা প্রমাণ করা অসম্ভব বলে মনে হবে। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, তা কম্পিউটারে হিসাব করা উচিত। কোয়ার্ক তত্ত্বের জন্যও একসময় এই পথ অনুসরণ করা হয়েছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই, ইয়াং-মিলস কণাগুলো একটা প্রোটনের ভেতর কোয়ার্কগুলোকে আটকে রাখতে গ্লু বা আঠার মতো আচরণ করে। কিন্তু ৫০ বছর পরেও একে আক্ষরিক অর্থে গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতে পারেনি কেউ। আসলে অনেক পদার্থবিদ সেটা করতে পারার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তার পরিবর্তে ইয়াং-মিলস সমীকরণগুলো একটা কম্পিউটারে সমাধান করা হয়।
সেটা করা হয় স্থান-কালকে এক সারি বিন্দুর সজ্জার আসন্নতা হিসেবে অনুমান করে। সাধারণত আমরা স্থান-কালকে মসৃণ পৃষ্ঠ বলে মনে করি, যেখানে অসীমসংখ্যক বিন্দু থাকে। কোনো বস্তু যখন চলাচল করে, তারা এই অসীম বিন্যাসের ভেতর দিয়ে যায়। কিন্তু এই মসৃণ তলকে আমরা একটা জালের মতো গ্রিড বা সজ্জা হিসেবে কল্পনা করতে পারি। আমরা যখন জালের বিন্দুগুলোর মধ্যকার ব্যবধান আরও ছোট থেকে ছোট হতে দিই, তখন এটি সাধারণ স্থান-কাল হয়ে ওঠে এবং চূড়ান্ত তত্ত্ব উঠে আসতে শুরু করে। একইভাবে এম-থিওরির জন্য চূড়ান্ত কোনো তত্ত্ব পাওয়া গেলে, একটা জালের সজ্জার মধ্যে এক বসাতে পারব এবং একটা কম্পিউটারে তা গণনা করতে পারব।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের মহাবিশ্ব একটা সুপারকম্পিউটারের আউটপুট থেকে বেরিয়ে আসবে।
(তবে এখানে হিচহাইকার’স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সির কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। সেখানে জীবনের অর্থ খুঁজে বের করতে বিশালাকৃতির এক সুপারকম্পিউটার বানানো হলো। কয়েক যুগ ধরে একটানা গণনার পর ওই কম্পিউটার অবশেষে সিদ্ধান্তে জানাল, মহাবিশ্বের মানে হলো ‘বিয়াল্লিশ’।)
কাজেই অনুমান করা যায়, কোনো গভীর খনির ভেতর স্থাপিত পরবর্তী প্রজন্মের পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা পার্টিকেল ডিটেক্টর কিংবা গভীর মহাকাশে স্থাপিত গ্র্যাভিটি ডিটেক্টর স্ট্রিং থিওরির পরীক্ষামূলক প্রমাণ খুঁজে পাবে। কিন্তু সেটি যদি সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো থিওরি অব এভরিথিংয়ের চূড়ান্ত গাণিতিক সূত্র খুঁজে বের করার মতো মনোবল ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন কিছু উদ্যোগী পদার্থবিজ্ঞানী এটা করতে পারবেন। এরপরই কেবল সেটা পরীক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারব আমরা।
এই অভিযাত্রা শেষ হওয়ার আগে পদার্থবিদেরা সম্ভবত অনেক বেশি জটিল অবস্থার মুখোমুখি হবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা একসময় থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে পাবই পাব।
কিন্তু এরপরের প্রশ্নটা হবে, স্ট্রিং থিওরি কোথা থেকে এল? থিওরি অব এভরিথিংয়ে যদি কোনো মহান নকশা থাকে, তাহলে এর ডিজাইনার কে? তাই যদি হয়, তাহলে মহাবিশ্বের কি কোনো উদ্দেশ্য আর অর্থ রয়েছে?