৫. গুপ্ত মহাবিশ্ব

. গুপ্ত মহাবিশ্ব 

২০১৯ সালে পুরো বিশ্বের সংবাদপত্র আর ওয়েবসাইটে চাঞ্চল্যকর একটা খবর প্রথম পৃষ্ঠা দখল করেছিল। খবরটা হলো, মাত্রই কৃষ্ণগহ্বরের প্রথম ছবি তুলেছেন জ্যোতির্বিদেরা। কোটি কোটি মানুষ একটা অগ্নিগর্ভ লাল উত্তপ্ত বলের পুরো ছবিটা দেখতে পেল, যার মাঝখানে একটা কালো গোলাকার ছায়াচিত্র। সাধারণ মানুষের কল্পনাকে গ্রাস করেছিল এই রহস্যময় বস্তুটা। খবরটাও বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর শুধু পদার্থবিদদের কৌতূহলী করে তোলেনি বা প্রবলভাবে আকর্ষণ করেনি, বরং সাধারণ মানুষের চেতনার ভেতরে ঢুকে বসে ছিল। আবার এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে অসংখ্য বিজ্ঞানবিষয়ক ডকুমেন্টারি ও অতিরঞ্জিত মুভি। 

এম ৮৭ গ্যালাক্সির ভেতর থাকা এই কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা হয়েছে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপে। গ্যালাক্সিটার অবস্থান আমাদের পৃথিবী থেকে ৫৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। কৃষ্ণগহ্বরটা আক্ষরিক অর্থেই ছিল দানবীয়। তার ভর আমাদের সূর্যের ভরের তুলনায় পাঁচ বিলিয়ন গুণ বেশি। আমাদের গোটা সৌরজগৎ, এমনকি প্লুটো ছাড়িয়েও পুরো সৌরজগৎ ওই কৃষ্ণগহ্বরের ছবির মাঝখানের ছায়াচিত্রের মধ্যে অনায়াসে এঁটে যাবে। 

এই অবিশ্বাস্য অর্জনটা সম্পন্ন করতে একটা সুপার টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। সাধারণত একটা রেডিও টেলিস্কোপ এত দূরের কোনো বস্তুর অস্পষ্ট রেডিও সিগন্যাল থেকে ছবি তৈরি করার জন্য যথেষ্ট বড় হয় না। কিন্তু তবু এই কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তৈরি করতে পেরেছেন জ্যোতির্বিদেরা। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঁচটি আলাদা আলাদা টেলিস্কোপ থেকে এসব সিগন্যালকে একত্র করে কাজটি করা হয়েছে। সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল একত্র করে কার্যকরভাবে একটা একক দানবীয় আকৃতির রেডিও টেলিস্কোপ তৈরি করতে সক্ষম হন বিজ্ঞানীরা। এই টেলিস্কোপটির আকৃতি আমাদের পৃথিবীর সমান। এই যৌগিক টেলিস্কোপটা এতই শক্তিশালী যে তাত্ত্বিকভাবে চাঁদের বুকে একটা আপেল পড়ে থাকলেও পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপটা দিয়ে তা শনাক্ত করা যাবে। 

এ রকম নতুন ও উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত আবিষ্কারের কারণে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রতি উৎসাহ জেগে ওঠে নতুন করে। দুঃখের ব্যাপার হলো, বিগত পঞ্চাশ বছরে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে গবেষণা বলতে গেলে স্থবির ছিল। এ তত্ত্বের সমীকরণগুলো চরম কঠিন। প্রায়ই তাতে কয়েক শ চলক সংশ্লিষ্ট থাকতে দেখা যায়। আবার মহাকর্ষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও ছিল খুব ব্যয়বহুল। কারণ, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এমন সব ডিটেক্টর দরকার হয়, যা কয়েক মাইলজুড়ে বিস্তৃত। 

মজার ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে আইনস্টাইনের আপত্তি ছিল, কিন্তু আপেক্ষিকতাবিষয়ক বর্তমান গবেষণায় ইন্ধন জুগিয়েছে তত্ত্ব দুটি একত্রকরণের প্রচেষ্টা। অর্থাৎ কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রয়োগ একত্রকরণের মাধ্যমে। আগে বলেছি, গ্র্যাভিটন সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ উপলব্ধির জন্য এবং এর কোয়ান্টাম সংশোধনী কীভাবে দূর করা যাবে, তা খুব কঠিন বলে মনে করা হতো। কিন্তু নক্ষত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা কোয়ান্টাম তত্ত্বের আরও পরিমিত প্রয়োগ (গ্র্যাভিটন সংশোধনী অগ্রাহ্য করে) বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক যুগান্তকারী ঘটনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। 

কৃষ্ণগহ্বর কী

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রাথমিক ধারণাটি আসলে অনেক আগের। সেই নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের সময়কালের। তাঁর প্রিন্সিপিয়া আমাদের সামনে একটা সরল চিত্রের জোগান দিয়েছিল। একটা কামানগোলাকে যথেষ্ট শক্তিতে ছুড়ে দেওয়া হলে, সেটি পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আগের বিন্দুতেই ফিরে আসবে। 

কিন্তু কামানের গোলাটা যদি সোজা ওপরের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী ঘটবে? নিউটন বুঝতে পারলেন, সে ক্ষেত্রে কামানের গোলাটা ক্রমান্বয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাবে এবং তারপর মাটিতে ফিরে আসবে। কিন্তু যথেষ্ট শক্তিতে ছুড়ে দিলে গোলাটা একসময় এসকেপ ভেলোসিটি বা মুক্তিবেগ অর্জন করবে। অর্থাৎ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বা মহাকর্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় গতি অর্জন করবে কামানের গোলাটি। তখন মহাকাশে চলে যাবে সেটি, তারপর সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না। 

নিউটনের সূত্রগুলো ব্যবহার করে পৃথিবীর মুক্তিবেগ নির্ণয় করা বেশ সহজ। হিসাবে দেখা যায়, এই মুক্তিবেগের পরিমাণ ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল। ১৯৬৯ সালে চাঁদে যাওয়ার জন্য আমাদের নভোচারীরা এই বেগ অর্জন করেছিলেন। আপনি যদি মুক্তিবেগ অর্জন করতে না পারেন, তাহলে হয় কক্ষপথে ঢুকে যাবেন, নয়তো আবারও পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে। 

১৭৮৩ সালে মনে মনে একটা সরল প্রশ্ন করেছিলেন জ্যোতির্বিদ জন মিশেল। তাঁর প্রশ্নটা ছিল, কোনো বস্তুর মুক্তিবেগ যদি আলোর গতির সমান হয়, তাহলে কী ঘটবে? এর উত্তর হলো, কোনো দানবীয় অতি ভারী নক্ষত্রের মুক্তিবেগ যদি আলোর গতির সমান হয়, তাহলে নক্ষত্রটা থেকে নিঃসৃত আলোকরশ্মি বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। নক্ষত্রটা থেকে নিঃসৃত সব আলো ধীরে ধীরে আবারও ফিরে যাবে ওই নক্ষত্রের মধ্যেই। মিশেল এ ধরনের নক্ষত্রের নাম দিলেন ডার্ক স্টার বা কৃষ্ণ নক্ষত্র। মহাকাশের এ রকম বস্তুকে কালো দেখাবে। কারণ, বস্তুর প্রচণ্ড মহাকর্ষের কারণে সেখান থেকে কোনো আলো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। ১৭০০-এর দশকে নক্ষত্ৰ সম্পর্কে খুবই অল্প জানতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। আবার আলোর গতির সঠিক মানও তাঁদের জানা ছিল না। কাজেই মিশেলের ধারণাটি স্থবির হয়ে পড়ে রইল বেশ কয়েক শতাব্দী। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা। ১৯১৬ সাল। রুশ ফ্রন্টে আর্টিলারিম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন জার্মান পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে লড়াই চালাতে চালাতে তিনি পড়ার জন্য অবসর সময় বের করতেন। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের বিখ্যাত এক পেপারে সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশ করা হয়। যুদ্ধের ভেতর এই অবসরেই সেই পুরো পেপারটা পড়ে হজম করে ফেলেন শোয়ার্জশিল্ড। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান গণিতবিদ। গভীর গাণিতিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কোনো একভাবে আইনস্টাইনের সমীকরণের যথাযথ সমাধানের খোঁজ পান শোয়ার্জশিল্ড। কিন্তু ওই সমীকরণটি কোনো গ্যালাক্সি কিংবা মহাবিশ্বের জন্য সমাধান করেননি তিনি। কারণ, সেটা বেশ কঠিন I তার বদলে শোয়ার্জশিল্ড সম্ভাব্য সব বস্তুর সহজতম ছোট একটা বিন্দু কণা দিয়ে কাজ শুরু করলেন। অনেক দূর থেকে দেখা একটা গোলকাকার নক্ষত্রের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের আসন্ন মান পাওয়া যাবে এই বস্তুটি থেকে। এবারে তাহলে আইনস্টাইনের তত্ত্বটা পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। 

শোয়ার্জশিল্ডের পেপারের প্রতি আইনস্টাইনের প্রতিক্রিয়া ছিল পরম আনন্দের। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, তাঁর সমীকরণের শোয়ার্জশিল্ডের এই সমাধানটা তত্ত্বটার আরও নিখুঁত গণনা করতে সহায়তা করবে। যেমন সূর্যের চারপাশে নক্ষত্রের আলোর বেঁকে যাওয়া এবং বুধ গ্রহের কক্ষপথের বিচ্যুতি। কাজেই তাঁর সমীকরণগুলোতে স্থূল আসন্নতার অনুমানের পরিবর্তে তাঁর তত্ত্ব থেকে সঠিক ফলাফলটা হিসাব করতে পারলেন তিনি। সেটা ছিল স্মরণীয় ও যুগান্তকারী একটা ঘটনা, যা কৃষ্ণগহ্বরকে উপলব্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। (শোয়ার্জশিল্ড তাঁর এই উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের কিছুদিন পরেই মারা যান। বেশ দুঃখের সঙ্গে তাঁর জন্য একটা প্রশংসাবাচক কথা লেখেন আইনস্টাইন।) 

কিন্তু শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানের ব্যাপক প্রভাব সত্ত্বেও তা কিছু বিস্ময়কর প্রশ্নও তুলল। শুরু থেকেই তাঁর সমাধানের কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল, যা স্থান ও কাল সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির সীমানায় ধাক্কা দিল। একটা অতি ভারী নক্ষত্রের চারপাশে একটা কাল্পনিক গোলক থাকে (যাকে বলে ম্যাজিক স্ফিয়ার বা ম্যাজিক গোলক। বর্তমানে একে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত।) এ গোলকের বাইরের মহাকর্ষ ক্ষেত্র একটা সাধারণ নিউটনিয়ান নক্ষত্রের সঙ্গে মেলে। কাজেই শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানটা ওই নক্ষত্রের মহাকর্ষের আসন্নতা হিসেবেও ব্যবহার করা চলে। দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ যদি নক্ষত্রটির যথেষ্ট কাছে চলে যায় এবং ঘটনা দিগন্তের ভেতর ঢুকে যায়, তাহলে সে সেখানে চিরকাল আটকা পড়বে। সেখানে পিষ্ট হয়ে মারা যাবে। ঘটনা দিগন্তকে বলা হয় পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। অর্থাৎ এখান থেকে কখনো ফিরে আসা যাবে না। এখানে যা-ই পড়ুক না কেন, সেটা আর কখনো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। 

কিন্তু যখন ঘটনা দিগন্তের দিকে যেতে থাকবেন, তখন আরও উদ্ভট কিছু ব্যাপার ঘটতে শুরু করবে। যেমন আপনি এমন আলোকরশ্মির মুখোমুখি হবেন, যা হয়তো কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে সেখানে আটকা পড়ে আছে এবং তা ওই নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। মহাকর্ষের টান আপনার পায়ের ওপর মাথার টানের চেয়ে বেশি হতে পারে। তাতে স্প্যাগেটি বা সেমাইয়ের মতো প্রসারিত হয়ে যাবেন আপনি। আসলে এই স্প্যাগেটিফিকেশন এতই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে যে আপনার দেহের পরমাণুগুলোও প্রচণ্ড টানে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। 

অনেক দূর থেকে কোনো দর্শক যদি এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটতে দেখে, তাহলে তার কাছে মনে হবে, ঘটনা দিগন্তের কিনারায় রকেটশিপের ভেতরে সময়ের গতি ক্রমান্বয়ে ধীর হয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে, বাইরের দর্শকের কাছে মনে হবে, রকেটশিপটা ঘটনা দিগন্তে আঘাত হানার পর সেখানকার সময় যেন থেমে গেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ওই রকেটশিপের নভোচারীদের কাছে সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হবে। তাঁরা ঘটনা দিগন্তের ভেতর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলে গেছেন বলে মনে করবেন নভোচারীরা। নিজেরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত এ রকম মনে হবে তাঁদের কাছে। 

ধারণাটা এতই উদ্ভট ছিল যে বহু দশক ধরে একে স্রেফ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বলে মনে করা হতো। অর্থাৎ বিষয়টা আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর এমন একটা উপজাত, বাস্তব বিশ্বে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন একবার লিখলেন, ‘কোনো নক্ষত্রকে এ রকম উদ্ভট আচরণ করতে বাধা দিতে প্রকৃতিতে একটা সূত্র থাকা উচিত!’ 

এমনকি এ বিষয়ে একটা পেপার লেখেন আইনস্টাইনও। তাতে তিনি যুক্তি দেখান, স্বাভাবিক অবস্থায় কৃষ্ণগহ্বর কখনোই গঠিত হতে পারে না। ১৯৩৯ সালে তিনি প্রমাণ করেন, গ্যাসের ঘূর্ণমান বল মহাকর্ষের অধীনে কখনোই ঘটনা দিগন্তের মধ্যে সংকুচিত হতে পারে না। 

মজার ব্যাপার হলো, ওই একই বছর রবার্ট ওপেনহাইমার এবং তাঁর ছাত্র হার্টল্যান্ড সিন্ডার প্রমাণ করেন, কৃষ্ণগহ্বর সত্যি সত্যিই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হতে পারে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারেননি আইনস্টাইন। আপনি যদি আমাদের সূর্যের চেয়ে দশ থেকে পঞ্চাশ গুণ ভারী কোনো দানবীয় নক্ষত্র নিয়ে গণনা শুরু করেন, তাহলে দেখা যাবে, নক্ষত্রটি একসময় সবটুকু জ্বালানি খরচ করে ফেলবে। এ পর্যায়ে নক্ষত্রটা ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হবে একটা সুপারনোভা হিসেবে। এই বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ যদি একটা নক্ষত্র হয়, তাহলে তা নিজের মহাকর্ষের টানে সংকুচিত হয়ে নিজেরই ঘটনা দিগন্তের সীমানায় প্রবেশ করবে। এরপর তা সংকুচিত হয়ে পরিণত হতে পারে একটা কৃষ্ণগহ্বরে। (কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের জন্য আমাদের সূর্যের ভর যথেষ্ট নয়। আর সূর্যের ঘটনা দিগন্ত হবে প্রায় চার মাইলজুড়ে। কোনো জানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আমাদের সূর্যকে দুই মাইলের মধ্যে সংকুচিত করা যাবে না। কাজেই বলা যায়, আমাদের সূর্য কখনো কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে না। ) 

পদার্থবিদেরা একসময় আবিষ্কার করলেন, কৃষ্ণগহ্বর অন্তত দুই ধরনের হতে পারে। এদের মধ্যে প্রথম ধরনের কৃষ্ণগহ্বর হলো কিছুক্ষণ আগে বর্ণনা করা দানবীয় আকৃতির অতি ভরের কোনো নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ। দ্বিতীয় ধরনের কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন কিংবা কয়েক বিলিয়ন গুণ ভারী। অনেক জ্যোতির্বিদ বিশ্বাস করেন, প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে কৃষ্ণগহ্বর আছে। 

গত কয়েক দশকে মহাকাশে কয়েক শ সম্ভাব্য কৃষ্ণগহ্বর শনাক্ত করেছেন জ্যোতির্বিদেরা। আমাদের নিজেদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের বসবাস। তার ভর আমাদের সূর্যের ভরের দুই থেকে চার মিলিয়ন গুণ। অবস্থান ধনু রাশিতে। (দুর্ভাগ্যক্রমে, এই এলাকার ধূলি মেঘের অস্পষ্টতার কারণে এই কৃষ্ণগহ্বরটা আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু এই ধূলির মেঘ যদি সরে যায়, তাহলে প্রতি রাতে একটা কৃষ্ণগহ্বরকে ঘিরে নক্ষত্রদের একটা দুর্দান্ত, জ্বলজ্বলে অগ্নিগোলক আমাদের রাতের আকাশ আলোকিত করে তুলত। সেই আলোর বন্যায় ছাপিয়ে যেত চাঁদের জোছনাও। সে রকম কিছু ঘটলে দৃশ্যটা সত্যিই হতো বিপুল বিস্ময়কর।) 

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে সর্বশেষ উত্তেজনা এসেছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মহাকর্ষে প্রয়োগ করার পর। এসব গণনা অপ্রত্যাশিত পরিঘটনা প্রকাশ করে, যা পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয় আমাদের কল্পনার দৌড়ের সীমা। এতে দেখা গেল, এই সম্পূর্ণ অজানা চত্বরে আমাদের পথ দেখানোর কিছুই নেই। 

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গ্র্যাজুয়েশন করছিলেন স্টিফেন হকিং, নিতান্ত সাধারণ এক তরুণ। সে সময় বিশেষ কোনো গন্তব্য বা উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। তিনি পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার গতিপথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মনটা সেখানে ছিল না। নিঃসন্দেহে তিনি মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু বিশেষ কোনো দিকে তাঁর মনোযোগ ছিল না। কিন্তু একদিন অ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্কেলেরোসিস (এএলএস) রোগ ধরা পড়ল হকিংয়ের। হকিংকে বলা হলো, আর মাত্র দুই বছর বাঁচতে পারবেন তিনি। এ রোগে তাঁর মন অক্ষত থেকে গেলেও দেহটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত দেহের সব কার্যক্ষমতা হারিয়ে যেতে থাকবে একে একে। প্রচণ্ড হতাশ হকিং বুঝতে পারলেন, তখন পর্যন্ত তাঁর পুরো জীবনটা আসলে নষ্ট হয়েছে। 

হকিং সিদ্ধান্ত নেন, কোনো দরকারি কাজে লাগাবেন জীবনের বাকি থাকা অতি অল্প সময়টুকু। তাঁর কাছে এর মানে ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বড় একটা সমস্যার সমাধান করা। সমস্যাটা ছিল, মহাকর্ষের সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ। সৌভাগ্যের কথা, রোগটি যতটা তাড়াতাড়ি বাড়বে বলে ডাক্তারেরা অনুমান করেছিলেন, তার চেয়ে বেশ ধীরে বাড়তে লাগল। কাজেই নতুন এই ক্ষেত্রটিতে প্রায় পথিকৃতের মতো গবেষণা চালিয়ে যেতে পারলেন হকিং। একসময় বন্দী হয়ে পড়লেন একটা হুইলচেয়ারে। একে একে নিজের বিভিন্ন অঙ্গের ও ভোকাল কর্ডের নিয়ন্ত্রণও হারালেন তিনি। তবু হাল না ছেড়ে কাজ করে যেতে লাগলেন। একবার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। সেখানে আমাকে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানান তিনি। তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে খুবই ভালো লেগেছিল। তিনি গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু গ্যাজেট ব্যবহার করতেন। সেগুলো দেখে বিস্মিত হলাম আমি। এর মধ্যে একটা যন্ত্র ছিল পাতা ওলটানোর জন্য। যন্ত্রটার মধ্যে একটা জার্নাল রেখে দিলে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জার্নালের পাতা উল্টে দেয়। হকিংয়ের সংকল্পের মাত্রা দেখে মুগ্ধ হলাম। এ কারণে অসুস্থতার কারণেও নিজের জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি তিনি। 

সে সময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতেন বেশির ভাগ পদার্থবিদ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কেবল কঠোরভাবে আইনস্টাইনের সমীকরণের আরও সমাধান খোঁজার চেষ্টা করতেন। হকিং নিজেকে একটা ভিন্ন ধরনের কিন্তু গভীর প্রশ্ন করেন, এই দুটি সিস্টেমকে একত্র করলে কী ঘটে? কৃষ্ণগহ্বরে কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহার করলে কী ঘটবে? 

তিনি বুঝতে পারলেন, মহাকর্ষের জন্য কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনা সমস্যার সমাধান করা খুব কঠিন। কাজেই একটা সহজ কাজ বেছে নেন। একটা কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে শুধু একটা পরমাণুর জন্য কোয়ান্টাম সংশোধনী নির্ণয় করেন তিনি। সে জন্য গ্র্যাভিটনের জটিলতর কোয়ান্টাম সংশোধনী অগ্রাহ্য করেন। 

কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে যত পড়তে লাগলেন, ততই হকিং বুঝতে পারলেন, সেখানে কোনো গোলমাল আছে। কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে প্রচলিত চিন্তাটা ছিল, সেখান থেকে কোনো কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু তিনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন, এই চিন্তাটা আসলে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অমান্য করে। কারণ, কোয়ান্টাম মেকানিকসে সবকিছুই অনিশ্চিত। একটা কৃষ্ণগহ্বর পুরোপুরি কালো দেখায়, কারণ বস্তুটি সবকিছু চরমভাবে শুষে নেয়। কিন্তু নিখুঁত কৃষ্ণতা আসলে অনিশ্চয়তার নীতিকে মানে না। এমনকি কৃষ্ণতারও একটা অনিশ্চয়তা থাকা উচিত 

এভাবে একটা বৈপ্লবিক ধারণায় এসে পৌঁছান তিনি। সেটা হলো, কৃষ্ণগহ্বর অবশ্যই অনিবার্যভাবে অতি অনুজ্জ্বল কোয়ান্টাম বিকিরণ নিঃসরণ করে। 

হকিং এরপর দেখালেন, কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিঃসৃত বিকিরণ আসলে একধরনের ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন (কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ)। সেটা নির্ণয় করতে পারেন তিনি। কারণ, একসময় বুঝতে পারেন, ভ্যাকুয়াম আসলে শুধু কোনো কিছু না থাকা অবস্থাই নয়, বরং সেখানে সংঘটিত হয় প্রচুর কোয়ান্টাম কার্যকলাপ। কোয়ান্টাম তত্ত্বে শূন্যতাও একটা অনিশ্চয়তাপূর্ণ অবস্থা, যেখানে ইলেকট্রন ও প্রতি- ইলেকট্রন শূন্যতা থেকে উদয় হতে পারে হুট করে। এরপর পরস্পর সংঘর্ষের মুখে পড়ে কণা দুটো আবারও হারিয়ে যেতে পারে নিঃসীম শূন্যতায়। কাজেই শূন্যতা আসলে কোয়ান্টাম কার্যকলাপে ভরপুর এক অবস্থার নাম। এরপর হকিং বুঝতে পারেন, মহাকর্ষ ক্ষেত্র যদি খুবই তীব্র হয়, তাহলে ইলেকট্রন আর প্রতি-ইলেকট্রন জোড়া ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা থেকে সত্যিই তৈরি হতে পারে। ফলে যা তৈরি হয়, তাকে বলা হয় ভার্চুয়াল পার্টিকেল বা কাল্পনিক কণা। কখনো এ কণাজোড়ার এক সদস্য যদি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পড়ে যায় এবং অন্য সদস্য যদি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলে যা তৈরি হবে, তাকে বলা হয় হকিং রেডিয়েশন বা হকিং বিকিরণ। এই কণা জোড়া তৈরি করতে যে শক্তি লাগে, তা আসে কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষ ক্ষেত্র থেকে। দ্বিতীয় কণাটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে চিরকালের জন্য বেরিয়ে আসার মানে হলো, কৃষ্ণগহ্বরের বস্তু ও শক্তির মোট পরিমাণ এবং তার মহাকর্ষ ক্ষেত্র কমে যাবে। 

একে বলা হয় কৃষ্ণগহ্বরের বাষ্পীভবন বা ব্ল্যাকহোল ইভাপোরেশন। সব কৃষ্ণগহ্বরের চূড়ান্ত পরিণতি বর্ণনা করে এটি। অর্থাৎ এর মাধ্যমে কৃষ্ণগহ্বর কয়েক ট্রিলিয়ন বছর ধরে ধীরে ধীরে হকিং বিকিরণ নিঃসরণ করে। কৃষ্ণগহ্বরের সব বিকিরণ নিঃশেষ হয়ে একটা অগ্নিময় বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। কাজেই খোদ কৃষ্ণগহ্বরের জীবনকাল সসীম। 

এখন থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বছর পর, মহাবিশ্বের নক্ষত্ররা তাদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলবে এবং সবশেষে অন্ধকার হয়ে যাবে। এই হিমশীতল, বিবর্ণ যুগে টিকে থাকবে শুধু কৃষ্ণগহ্বর। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরও একসময় অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন অতিপারমাণবিক কণাদের প্রবহমান সাগর ছাড়া থাকবে না আর কিছুই। হকিং নিজেকেই আরেকটি প্রশ্ন করেন, কোনো কৃষ্ণগহ্বরে একটা বই ছুড়ে ফেললে কী ঘটবে? তাহলে কি বইটার সব তথ্য হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্য? 

কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুসারে, তথ্য কখনো হারিয়ে যায় না। এমনকি একটা বই পুড়িয়ে ফেলার পর, পোড়া কাগজের অণুগুলো ব্যাপক শ্রম দিয়ে বিশ্লেষণ করে বইটা নতুন করে তৈরি করা সম্ভব। 

কিন্তু একটা কথা বলে বোলতার চাকে ঢিল ছুড়ে দেওয়ার মতো বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন হকিং। তিনি বলেছিলেন, কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে তথ্য ছুড়ে দিলে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরে কোয়ান্টাম মেকানিকস অকার্যকর। 

আগেই বলেছি, আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘মহাবিশ্ব নিয়ে ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’ অর্থাৎ সবকিছু সম্ভাবনা আর অনিশ্চয়তা দিয়ে মাপা যায় না। এ কথার সঙ্গে হকিং একটু যোগ করে বলেন, ‘ঈশ্বর মাঝে মাঝে এমন জায়গায় পাশা ছুড়ে মারেন, যেখানে সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না কখনো।’ এর মানে, পাশার ঘুঁটিগুলো কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেও চলে যেতে পারে। কোয়ান্টামের সূত্রগুলো হয়তো সেখানে কাজ করে না। কাজেই ঘটনা দিগন্ত পেরিয়ে ভেতরে চলে গেলে অনিশ্চয়তার সূত্রগুলো ব্যর্থ হয়। 

এরপর কোয়ান্টাম মেকানিকস বাঁচাতে এগিয়ে আসেন অন্য পদার্থবিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখান, স্ট্রিং থিওরির মতো উন্নত তত্ত্বগুলো ইঙ্গিত করে যে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে তথ্য সংরক্ষিত অবস্থায় থাকতে পারে। অবশেষে হকিং স্বীকার করেন, তিনি হয়তো ভুল বলেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রস্তাব দেন নিজের মতো করে এক নতুন সমাধান। কৃষ্ণগহ্বরে যখন একটা বই ছুড়ে ফেলা হচ্ছে, তখন তথ্য হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে না, যেমনটা তিনি আগে ভেবেছিলেন। বরং ওসব তথ্য হয়তো বাইরে বেরিয়ে আসে হকিং বিকিরণ রূপে। আদি বইটা নতুন করে তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য ম্লান হকিং বিকিরণের মধ্যে এনকোডেড থাকে। কাজেই হকিং হয়তো তথ্য হারিয়ে যাওয়া বিষয়ে ঠিক বলেননি, কিন্তু সঠিক সমাধানটা সম্ভবত লুকিয়ে আছে তাঁর আগে আবিষ্কৃত হকিং বিকিরণের মধ্যে। 

কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর তথ্য হারিয়ে যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন এখনো চলমান। উপসংহার নিয়ে পদার্থবিদদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সঠিক উত্তর জানতে শেষ পর্যন্ত আমাদের হয়তো মহাকর্ষের চূড়ান্ত কোয়ান্টাম তত্ত্ব (যেখানে গ্র্যাভিটনের কোয়ান্টাম সংশোধনী যোগ করা হয়েছে) না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এবারে তাই হকিং কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে একত্র করার ক্ষেত্রে পরবর্তী গোলমেলে প্রশ্নটার দিকে নজর দিলেন। 

য়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে 

কৃষ্ণগহ্বর যদি সবকিছু খেয়ে ফেলে, তাহলে ওসব বস্তু কোথায় যায়? 

এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, আমরা জানি না। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতা একত্র করে হয়তো মিলতে পারে এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তরটি। আমরা যখন সত্যি সত্যি মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব (শুধু বস্তুর নয়) খুঁজে পাব, তখন এই প্রশ্নেরও হয়তো উত্তর দিতে পারব—কৃষ্ণগহ্বরের ওপাশে কী লুকিয়ে আছে? 

কিন্তু আমরা যদি অন্ধভাবে আইনস্টাইনের তত্ত্বটা মেনে নিই, তাহলে মুশকিলে পড়তে হয়। তাঁর সমীকরণগুলো অনুমান করে যে কৃষ্ণগহ্বরের একেবারে কেন্দ্রে কিংবা কালের একেবারে শুরুতে মহাকর্ষ বল অসীম। কিন্তু সেটা আসলে কোনো অর্থ প্রকাশ করে না। 

তবে ১৯৬৩ সালে একটা ঘূর্ণমান কৃষ্ণগহ্বরের জন্য আইনস্টাইনের সমীকরণের একেবারে নতুন একটা সমাধান খুঁজে পান গণিতবিদ রয় কার। এর আগে শোয়ার্জশিল্ডের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, কৃষ্ণগহ্বর একটা স্থির, খুদে বিন্দুতে চুপসে যায়। এই বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। এখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্র অসীম হয়ে যায়। সবকিছু ভেঙে পড়ে একটা একক বিন্দুতে। কিন্তু যদি কোনো ঘূর্ণমান কৃষ্ণগহ্বরের জন্য আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো সমাধান করা হয়, তাহলে রয় কার দেখান যে তখন কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। 

প্রথমত কৃষ্ণগহ্বরটা কোনো ডট বা বিন্দুতে চুপসে যায় না। তার বদলে একটা জোরে ঘূর্ণমান রিংয়ের ভেতর চুপসে যাবে সেটা। (ঘূর্ণমান রিংয়ের কেন্দ্রবিমুখী বল বেশ শক্তিশালী হয়। নিজের মহাকর্ষের অধীনে চুপসে যাওয়া থেকে রিংটাকে রক্ষা করার জন্য এই বল যথেষ্ট।) 

দ্বিতীয়ত, আপনি যদি এই রিংয়ের মধ্যে পড়ে যান, তাহলে সেখানে তীব্র ধাক্কা খেয়ে হয়তো না-ও মারা যেতে পারেন, বরং রিংয়ের ভেতর দিয়ে হয়তো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবেন। কারণ, রিংটার ভেতরের মহাকর্ষ আসলে সসীম। 

তৃতীয়ত, গণিত ইঙ্গিত করে যে রিংটার ভেতর দিয়ে চলে গেলে ঢোকা যেতে পারে কোনো প্যারালাল মহাবিশ্বেও। এর মাধ্যমে আপনি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মহাবিশ্ব ছেড়ে চলে যেতে পারবেন এবং ঢুকে যেতে পারবেন অন্য মহাবিশ্বের ভেতরে। দুটি কাগজের কথা ভাবুন, যাদের একটাকে বসানো আছে আরেকটার ওপর। এখন দুটোর ভেতর দিয়ে একটা ছোট স্ট্র ঢুকিয়ে দেওয়া যাক। এই স্ট্রর ভেতর দিয়ে আপনি এক মহাবিশ্ব থেকে আরেকটা প্যারালাল মহাবিশ্বে চলে যেতে পারবেন। এই স্ট্রকে বলা হয় ওয়ার্মহোল। 

চতুর্থত, রিংটার মধ্যে আবারও ঢুকলে এগিয়ে যাবেন অন্য আরেকটা মহাবিশ্বের দিকে। অনেকটা কোনো ভবনের এলিভেটর ব্যবহার করে এক তলা থেকে আরেক তলায় যাওয়ার মতো। একইভাবে একটা মহাবিশ্ব থেকে যাওয়া যাবে আরেকটা মহাবিশ্বে। প্রতিবার যখনই ওয়ার্মহোলটায় আবারও ঢুকবেন, তখনই গোটা একটা নতুন মহাবিশ্বে ঢোকা সম্ভব। কৃষ্ণগহ্বরের চমকপ্রদ একটা ছবি আমাদের সামনে হাজির করে এটি। কোনো ঘূর্ণমান কৃষ্ণগহ্বরের একেবারে কেন্দ্রে আমরা এমন কিছু খুঁজে পাব, যাকে অ্যালিসের আয়নার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এর একদিকে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের শান্ত একটা গ্রাম (ধরে নিন)। কিন্তু আয়নাটার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলে, চলে যেতে পারবেন পুরোপুরি অন্য কোথাও। 

পঞ্চমত, রিংটার ভেতর দিয়ে যেতে সফল হলে একই মহাবিশ্বের দূরবর্তী কোনো অঞ্চলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। কাজেই ওয়ার্মহোল একটা সাবওয়ে সিস্টেমের মতো, যা স্থান ও কালের ভেতর দিয়ে তৈরি করে অদৃশ্য কোনো শর্টকার্ট পথ। হিসাবে দেখা গেছে, এর মাধ্যমে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চলা সম্ভব কিংবা যাওয়া সম্ভব সময়ের পেছন দিকেও। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এসব করতে গিয়ে হয়তো আমাদের জানা ভৌত সূত্রগুলো লঙ্ঘিত হবে না। 

এই উদ্ভট সিদ্ধান্ত যতই ভয়াবহ হোক না কেন, একে সহজে বাতিল করা যায় না। কারণ এরা আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধান। পাশাপাশি এগুলো ঘূর্ণমান কৃষ্ণগহ্বরকে বর্ণনা করে। আমাদের বিশ্বাস, এটিই সবচেয়ে কমন বা সাধারণ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর। 

ওয়ার্মহোলের ধারণাটি আসলে প্রথম চালু করেছিলেন খোদ আইনস্টাইন। ১৯৩৫ সালে নাথান রোজেনকে সঙ্গে নিয়ে লেখা একটা গবেষণাপত্রে প্রথমবার এ ধারণার কথা লেখেন তিনি। এই দুই বিজ্ঞানী কল্পনা করলেন, দুটি কৃষ্ণগহ্বর একত্রে জোড়া লেগে গেল, যার সঙ্গে স্থান-কালের দুটি ফানেলের মিল আছে। কেউ যদি প্ৰথম ফানেলের ভেতর পড়ে যায়, তাহলে সে অন্য ফানেলের ভেতর দিয়ে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এর ফলে তাকে আর মরতে হবে না।  

A black and white image of a black hole

Description automatically generated

ছবি ১০ : তাত্ত্বিকভাবে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন নক্ষত্র কিংবা অতীতে চলে যাওয়া যাবে। 

টি এইচ হোয়াইটের উপন্যাস দ্য ওয়ান্স অ্যান্ড ফিউচার কিং-এ বিখ্যাত একটা লাইন আছে। সেটা হলো, ‘নিষিদ্ধ না, এমন সবকিছুই বাধ্যতামূলক।’ এই বক্তব্যটা আসলে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন পদার্থবিদেরা। কোনো পরিঘটনার বিরুদ্ধে কোনো ভৌত সূত্র যদি না থাকে, তাহলে হয়তো মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও এর অস্তিত্ব আছে। 

যেমন ওয়ার্মহোল তৈরি করা খুবই কঠিন। কিন্তু কিছু পদার্থবিদ মনে করেন, সময়ের শুরু থেকেই ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব থাকতে পারে। মহাবিস্ফোরণের পর হয়তো প্রসারিত হয়েছে সেগুলো। হয়তো প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলো টিকে আছে। কোনো একদিন আমাদের টেলিস্কোপে হয়তো মহাকাশে কোনো ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব ধরা পড়বে। অবশ্য ওয়ার্মহোল বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের কল্পনাকে উসকে দিলেও বাস্তবে কোনো পরীক্ষাগারে এটি তৈরি করা ভয়াবহ সমস্যা। 

প্রথমত, স্থান-কালের ভেতর দিয়ে একটা পথ তৈরি করতে বিপুল পরিমাণ ধনাত্মক শক্তি দরকার। এর সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের তুলনা করা যায়। তবে শুধু সে জন্যই দরকার পড়বে অতি উন্নত কোনো সভ্যতার ব্যবহৃত প্রযুক্তি। তাই অচিরেই কোনো শৌখিন উদ্ভাবক নিজের বেসমেন্টের ল্যাবে বসে এমন কিছু বানিয়ে ফেলবেন, সেটা আমরা আশা করি না। 

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের ওয়ার্মহোল অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে এবং নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তার ভেতরে বাইরে থেকে নতুন একধরনের উপাদান যোগ না করা পর্যন্ত ঘটনাটা ঘটতে পারে। এই নতুন উপাদানকে বলা হয় নেগেটিভ ম্যাটার বা নেগেটিভ এনার্জি (ঋণাত্মক পদার্থ বা ঋণাত্মক শক্তি)। এটি প্রতিপদার্থের চেয়ে আলাদা জিনিস। ঋণাত্মক পদার্থ ও ঋণাত্মক শক্তি বিকর্ষণধর্মী, যা ওয়ার্মহোলকে চুপসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। 

পদার্থবিদেরা কখনোই ঋণাত্মক বস্তু চোখে দেখেননি। এদের আসলে অ্যান্টিগ্র্যাভিটি মেনে চলার কথা। কাজেই এগুলো নিচে পড়ে যাওয়ার বদলে ওপরের দিকে উঠবে। পৃথিবীতে যদি কয়েক বিলিয়ন বছর আগে ঋণাত্মক পদার্থ থেকেও থাকে, তাহলে পৃথিবীর মহাকর্ষ তাদের বিকর্ষণ করে মহাকাশে ছুড়ে দিয়েছে। কাজেই পৃথিবীতে এখন কোনো ঋণাত্মক পদার্থ খুঁজে পাওয়ার আশা করা উচিত হবে না। 

অন্যদিকে ঋণাত্মক শক্তি বাস্তবে থাকতেও পারে, কিন্তু তার পরিমাণও অতি অল্প। তা এতই অল্প যে তার ব্যবহারিক মূল্যও নেই। শুধু অতি উন্নত কোনো সভ্যতা পর্যাপ্ত ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির জোগান দিতে পারবে। হয়তো সেই সভ্যতা আমাদের চেয়ে কয়েক হাজার বছর এগিয়ে রয়েছে। এসব শক্তি ব্যবহার করে ওয়ার্মহোল বানাতে এবং তাকে চুপসে যাওয়া থেকে রক্ষাও করতে পারবে সেই সভ্যতা। 

তৃতীয়ত, মহাকর্ষ থেকে আসা বিকিরণ (যাকে বলা হয় গ্র্যাভিটন বিকিরণ) হয়তো কোনো ওয়ার্মহোলের বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। 

কোনো কৃষ্ণগহ্বরে কেউ পড়ে গেলে কী হবে, শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্নের চূড়ান্ত জবাবের জন্য আমাদের অবশ্যই একটা সত্যিকার থিওরি অব এভরিথিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর সেই তত্ত্বে বস্তু ও মহাকর্ষ দুটোই কোয়ান্টায়িত হয়। 

কিছু পদার্থবিদ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে একটা বিতর্কিত ধারণার প্রস্তাব করেছেন। তাঁদের মতে, নক্ষত্ররা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর পড়ে গেলে, ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে ওপাশে বেরিয়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় সেগুলো। এরপর সেখানে একটা হোয়াইট হোল বা শ্বেতগহ্বর তৈরি হয়। কৃষ্ণগহ্বরের মতো একই সমীকরণ মেনে চলে হোয়াইট হোলও। ব্যতিক্রম শুধু, এখানে সময়ের তির উল্টো। কাজেই শ্বেতগহ্বর থেকে পদার্থ সজোরে বাইরে বেরিয়ে আসে। মহাকাশে শ্বেতগহ্বরের খোঁজ করছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এখানে শ্বেতগহ্বরের কথা উল্লেখ করার কারণ হলো, মহাবিস্ফোরণ হয়তো আদতে কোনো শ্বেতগহ্বর। আর আমাদের দেখা মহাকাশের সব নক্ষত্র ও গ্রহ হয়তো কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে সজোরে বেরিয়ে এসেছে। আর তা- ও ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। 

এখানে ব্যাপারটা হলো, একমাত্র থিওরি অব এভরিথিংই আমাদের বলতে পারে যে কৃষ্ণগহ্বরের অন্য পাশে কী আছে। তখন মহাকর্ষের জন্য কোয়ান্টাম সংশোধনী হিসাব করে, ওয়ার্মহোলের কারণে ওঠা গভীরতম প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারব আমরা। 

কিন্তু ওয়ার্মহোল যদি কোনো দিন আমাদের এই গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তে সহসা নিয়ে যেতে পারে, তাহলে সেটা কি একইভাবে আমাদের অতীতেও নিয়ে যেতে পারবে? 

টাইম ট্রাভেল 

এইচ জি ওয়েলস দ্য টাইম মেশিন বইটা লেখার পর থেকেই টাইম ট্রাভেল বা সময় পরিভ্রমণ পরিণত হয়েছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির প্রধানতম বিষয়ে। তিন মাত্রায় আমরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারি (সামনে, পাশে ও ওপরে)। কাজেই চতুর্থ মাত্রা বা সময়ের মাত্রাতেও চলাফেরার কোনো পদ্ধতি হয়তো থাকতেও পারে। ওয়েলস এমন এক টাইম মেশিনে ঢোকার কথা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে ডায়াল ঘোরানোর পর ভবিষ্যতের কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার বছরে চলে যাওয়া যায়। এভাবে ৮০২,৭০১ সালে চলে গিয়েছিল উপন্যাসটির নায়ক। 

এরপর থেকে টাইম ট্রাভেলের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। আইনস্টাইন প্রথম মহাকর্ষ তত্ত্বের প্রস্তাব করেন ১৯১৫ সালে। তখনো একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। তাঁর চিন্তার বিষয়টা ছিল, তাঁর সমীকরণগুলো হয়তো সময়কে এমনভাবে বাঁকিয়ে ফেলতে পারে, যাতে কেউ অতীতে চলে যেতে পারবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এমনটি দেখা দিলে সেটাই হবে তাঁর তত্ত্বের ত্রুটির ইঙ্গিত। কিন্তু এই খুঁতখুঁতে সমস্যাটাই ১৯৪৯ সালে হয়ে উঠল সত্যিকারের সম্ভাবনা। সে সময় আইনস্টাইন ছিলেন প্রিন্সটনের বিখ্যাত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ কার্ট গোডেল। এই গণিতবিদ দেখতে পান, মহাবিশ্ব যদি ঘূর্ণমান হয় এবং কেউ যদি এই ঘূর্ণমান মহাবিশ্বের চারদিকে যথেষ্ট জোরে চলাচল করতে পারে, তাহলে অতীতে ঢুকে যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ চলে যাওয়া যাবে যাত্রা শুরুর আগের সময়ে। আইনস্টাইন এই অপ্রচলিত সমাধান দেখে একদম থ হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইন সিদ্ধান্তে এলেন যে গোডেলের মহাবিশ্বে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব হলেও, ভৌত ভিত্তিতে তা বাতিল করা যায়। সে কথার মানে, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এবং তা ঘূর্ণমান নয়। 

টাইম ট্রাভেলের সম্ভাবনা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত নন পদার্থবিদেরা। তবে প্রশ্নটায় তাঁরা বেশ গুরুত্ব দেন। আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর বেশ কয়েক ধরনের সমাধান আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো টাইম ট্রাভেলের ব্যাপারটা মেনে নেয়। 

নিউটনের কাছে সময় ছিল একটা তিরের মতো। সেটা একবার ছুড়ে দেওয়া হলে তা যথাযথভাবে সুষম গতিতে মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকবে। তাঁর কাছে পৃথিবীর এক সেকেন্ড ছিল মহাকাশের সব জায়গার এক সেকেন্ড। কারণ, নিউটনের ধারণা ছিল, মহাবিশ্বের সব জায়গার ঘড়িগুলো সিনক্রোনাইজড বা সমলয় করা। 

অন্যদিকে আইনস্টাইনের কাছে সময় একটা নদীর মতো। সময়ের গতি বাড়তে পারে কিংবা ধীরও হতে পারে, তা নির্ভর করে তার গতিপথজুড়ে নক্ষত্র ও ছায়াপথের বাধার কারণে। মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সময়ের স্পন্দন বিভিন্ন হারের হতে পারে। সময় সম্পর্কিত নতুন চিত্র অনুযায়ী, সময় নদীর ঘূর্ণিপাকও আছে, যা হয়তো অতীতেও নিয়ে যেতে পারে কাউকে (পদার্থবিদেরা এর নাম দিয়েছেন সিটিসি বা ক্লোজড টাইমলাইক কার্ভস বা বদ্ধ সময়সদৃশ্য বক্রতা)। অথবা সময়ের নদী হয়তো দুটি নদীতেও বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। তাতে টাইমলাইন বা সময়রেখাটি ভাগ হয়ে তৈরি করতে পারে দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব 

টাইম ট্রাভেল নিয়ে স্টিফেন হকিং এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে একবার অন্য পদার্থবিদদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পদার্থবিজ্ঞানে নিশ্চয়ই এমন কোনো গুপ্ত আইন আছে, যা সবার জন্য টাইম ট্রাভেল বাতিল করে দেয়। আমাদের এখনো খুঁজে না পাওয়া সেই আইনটির নাম হকিং দিয়েছিলেন ক্রোনোলজি প্রটেকশন কনজেকচার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এই হাইপোথিসিস কখনো প্রমাণ করতে পারেননি। তার মানে দাঁড়ায়, টাইম ট্রাভেল হয়তো আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর সঙ্গে মানানসই হতেও পারে। পাশাপাশি টাইম মেশিনের অস্তিত্ব ঠেকানোর মতো কোনো সূত্রও নেই। 

মজার ব্যাপার হলো, তিনি বললেন, টাইম ট্রাভেল সম্ভব নয়, কারণ ‘ভবিষ্যৎ থেকে আসা পর্যটকেরা সব কই গেল?’ যেকোনো প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনায় পর্যটকেরা নিজ নিজ গলার সঙ্গে ক্যামেরা ঝুলিয়ে পরস্পরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে সবচেয়ে ভালো ছবিটা তোলার চেষ্টা করে। ভবিষ্যতে নিজ নিজ বন্ধুদের দেখানোর জন্যই কাজটি করে পর্যটকেরা। 

ধরা যাক, আপনার কাছে একটা টাইম মেশিন আছে। তাহলে কোন অকাজটা করতেন, সেটা এই মুহূর্তের জন্য ভাবুন। সময়ের পেছনে গিয়ে আপনি হয়তো স্টক মার্কেটে বাজি ধরতেন, তারপর কোটিপতি হয়ে যেতেন। তাতে বদলে যেত অতীতের ঘটনাগুলোর গতিপথ। ফলে ইতিহাসও লেখা হতো না। স্রেফ চাকরি হারাতেন ইতিহাসবিদেরা। 

নিঃসন্দেহে টাইম ট্রাভেলের সিরিয়াস কিছু সমস্যা রয়েছে। টাইম ট্রাভেলের সঙ্গে কিছু যৌক্তিক প্যারাডক্স জড়িত আছে। যেমন— 

বর্তমানকে অসম্ভব করে তোলা : ধরুন, আপনি অতীতে গিয়ে আপনার দাদার শিশু বয়সের রূপটির সঙ্গে দেখা করে তাকে মেরে ফেললেন। তাহলে বর্তমানে আপনার অস্তিত্ব থাকে কীভাবে? 

শূন্য থেকে আসা টাইম মেশিন : ধরা যাক, ভবিষ্যৎ থেকে এক ব্যক্তি এসে আপনার কাছে টাইম ট্রাভেলের গোপনীয়তা ফাঁস করে দিল। কয়েক বছর পর আপনি অতীতে ফিরে গিয়ে আপনার তরুণ বয়সী রূপের কাছে ফাঁস করে দিলেন টাইম ট্রাভেলের সেই গোপনীয়তা। তাহলে টাইম ট্রাভেলের গোপনীয়তা এল কোত্থেকে? 

নিজেই নিজের মা হওয়া : এক ব্যক্তির নিজেই নিজের পরিবারের সবকিছু হওয়া নিয়ে একটা গল্প লিখেছেন বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক রবার্ট হেনলিন। ধরা যাক, একটা এতিম মেয়ে বড় হতে হতে পুরুষে রূপান্তরিত হলো। মানুষটি এরপর অতীতে ফিরে দেখা করল নিজের মেয়ে-রূপের সঙ্গে। একসময় তাদের দুজনের একটা মেয়েশিশুও জন্মাল। শিশুটিকে নিয়ে সময়ের আরও পেছনে ফিরে গেল সেই লোকটি। তারপর শিশুটিকে ফেলে দিয়ে এল সেই একই এতিমখানার সামনে। এরপর এই চক্রটিই বারবার ঘটতে থাকবে। এভাবে এই শিশুটিই হয়ে উঠবে তার নিজের মা, সন্তান, দাদিমা, নাতনি ইত্যাদি। 

শেষ পর্যন্ত এসব প্যারাডক্সের চূড়ান্ত সমাধান হয়তো মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রণয়নের পর আসতে পারে। যেমন আপনি যখন একটা টাইম মেশিনে ঢুকবেন, তখন হয়তো আপনার সময়ের রেখা ভাগ হয়ে যাবে এবং একটা প্যারালাল কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব তৈরি হবে। ধরা যাক, আপনি সময়ের পেছনে গিয়ে ফোর্ড থিয়েটারে আব্রাহাম লিংকনকে আততায়ীর গুলিতে হত্যা থেকে রক্ষা করলেন। আপনি হয়তো আব্রাহাম লিংকনকে বাঁচাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা এখানে নয়, অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সে। কাজেই আপনার আসল মহাবিশ্বে আব্রাহাম লিংকন মারা গেছেন এবং এতে সেখানে কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু মহাবিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আপনি প্রেসিডেন্ট লিংকনকে একটা প্যারালাল ইউনিভার্সে বাঁচাচ্ছেন। 

সুতরাং সময়ের রেখা প্যারালাল ইউনিভার্সে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে—কথাটা ধরে নিয়ে টাইম ট্রাভেলের সব কটি প্যারাডক্সের সমাধান করা সম্ভব। 

টাইম ট্রাভেলের প্রশ্নটির নির্দিষ্ট উত্তর তখনই দেওয়া সম্ভব, যখন ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আমরা গ্র্যাভিটনের কোয়ান্টাম সংশোধনী নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটা উপেক্ষা করা হয়েছে। নক্ষত্র এবং ওয়ার্মহোলের জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করেছেন পদার্থবিদেরা, কিন্তু মহাকর্ষের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহারের প্রধান উপায় হলো গ্র্যাভিটন। কিন্তু সেটা ব্যবহারের জন্য দরকার একটা থিওরি অব এভিরিথিং বা সবকিছুর তত্ত্ব। 

এ আলোচনায় মজার কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সেটা হলো, কোয়ান্টাম মেকানিকস কি মহাবিস্ফোরণের প্রকৃতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে? কোয়ান্টাম মেকানিকস কি মহাকর্ষে প্রয়োগ করে 

বিজ্ঞানের অন্যতম বড় প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে—মহাবিস্ফোরণের আগে কী ঘটেছিল? 

মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি য়েছিল

মহাবিশ্ব এল কোথা থেকে? মহাবিশ্ব গতিশীল হলো কীভাবে? এগুলো সম্ভবত ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় কয়েকটি প্রশ্ন, যেগুলো এখনো অন্তহীন অনুমানের বিষয়। 

প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, নীলনদে ভাসমান একটা কসমিক এগ বা মহাজাগতিক ডিম থেকে সৃষ্টি হয়েছে এই মহাবিশ্ব। কিছু পলিনেশিয়ান বিশ্বাস করত, মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল একটা মহাজাগতিক নারকেলের মাধ্যমে। অন্যদিকে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর যখন বললেন, ‘আলো আসুক!’ ঠিক তখনই গতিশীল হয়েছিল এই মহাবিশ্ব। 

মহাবিশ্বের জন্ম নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীরাও আগ্রহী। বিশেষ করে নিউটন যখন আমাদের মহাকর্ষের একটা অমোঘ তত্ত্ব দিলেন, তখন থেকে এই আগ্রহের সূচনা। কিন্তু নিউটন তাঁর তত্ত্বটা আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বে প্রয়োগ করতে গিয়ে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হন। 

১৬৯২ সালে ধর্মযাজক রিচার্ড বেন্টলির কাছ থেকে একটা বিব্রতকর চিঠি পান তিনি। চিঠিতে নিউটনকে তাঁর তত্ত্বের গুপ্ত ও সম্ভাব্য ক্ষতিকারক ত্রুটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বললেন বেন্টলি। সেটা হলো, মহাবিশ্ব যদি সসীম হয় এবং মহাকর্ষ যদি বিকর্ষণধর্মী না হয়ে সর্বদা আকর্ষণধর্মী হয়, তাহলে মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো ক্রমান্বয়ে পরস্পরের দিকে আকর্ষিত হবে। এভাবে যথেষ্ট সময় পরে নক্ষত্রগুলো একত্র হয়ে একটামাত্র বিশালাকার নক্ষত্রে পরিণত হবে। কাজেই সসীম মহাবিশ্ব অস্থিতিশীল হওয়ার কথা। আর সেটা ঘটলে মহাবিশ্ব ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে যেহেতু সেটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না, তার মানে নিউটনের তত্ত্বে অবশ্যই কোনো একটা ত্রুটি আছে। 

এরপর তিনি যুক্তি দেখালেন, নিউটনের সূত্রগুলো একটা অস্থিতিশীল মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করে, এমনকি মহাবিশ্ব অসীম হলেও। অসীমসংখ্যক নক্ষত্রসহ কোনো অসীম মহাবিশ্বে সব বলের যোগফল একটা নির্দিষ্ট নক্ষত্রের বাম ও ডান দিকের ওপরে অসীম টান প্রয়োগ করবে। এভাবে ওই নক্ষত্রটিকে ক্রমান্বয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলবে অসীম বলগুলো। একইভাবে সব কটি নক্ষত্রই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। 

এই চিঠি পেয়ে বেশ বিরক্ত হন নিউটন। কারণ, গোটা মহাবিশ্বের ওপর নিজের তত্ত্বটা প্রয়োগের কথা ভাবেননি তিনি। অবশেষে একটু চালাকি করে এই প্রশ্নটার একটা অসম্পূর্ণ উত্তর দেন নিউটন। 

তিনি স্বীকার করে নেন, হ্যাঁ, মহাকর্ষ সব সময়ই আকর্ষণধর্মী এবং তা কখনোই বিকর্ষণ করে না। তাহলে মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো হয়তো অস্থিতিশীল হবে। কিন্তু এই যুক্তিতে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। ধরা যাক, মহাবিশ্ব গড়পড়তায় সব দিকে পুরোপুরি সুষম এবং অসীম। এ রকম একটা স্থিতিশীল মহাবিশ্বে মহাকর্ষের সব কটি বল একটা আরেকটাকে বাতিল করে দেয় এবং মহাবিশ্ব আবারও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। যেকোনো নক্ষত্রের কথা ধরা যাক, ওই নক্ষত্রের ওপর কাজ করবে বিভিন্ন দিকে দূরবর্তী সব কটি নক্ষত্র থেকে আসা মহাকর্ষ বল। তাতে একসময় যোগফল হয়ে যাবে শূন্য। কাজেই মহাবিশ্বও আর ভেঙে পড়বে না। 

অবশ্য এটা সমস্যাটির একটা চাতুর্যপূর্ণ সমাধান হলেও নিউটন বুঝতে পারেন, তাঁর সমাধানে তারপরও একটা সম্ভাব্য ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব হয়তো গড়পড়তায় সুষম হতে পারে, কিন্তু সেটা সব বিন্দুতে নিখুঁতভাবে সুষম হতে পারে না। কাজেই এখানে অবশ্যই অতিক্ষুদ্র বিচ্যুতিও রয়ে যাবে। একটা তাসের ঘরের মতো এটা স্থিতিশীল দেখায়, কিন্তু গোটা কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে অতি ছোট ত্রুটির কারণেও। কাজেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান নিউটন বুঝতে পারলেন যে একটা সুষম অসীম মহাবিশ্ব আসলে স্থিতিশীল, কিন্তু সেটা সব সময় একটা ধসের কিনারায় টলমল করছে। অন্য কথায়, অসীম বলগুলোর বাতিলকরণ অবশ্যই অসীমভাবে সুনির্দিষ্ট হতে হবে, নয়তো মহাবিশ্ব হয় চুপসে পরস্পরের ওপর ভেঙে পড়বে, কিংবা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। 

তাই নিউটনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল, মহাবিশ্ব অসীম ও গড়পড়তায় সুষম, কিন্তু মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলোকে মাঝে মাঝে ঈশ্বর হেঁচকা টান মারেন, যাতে সেগুলো মহাকর্ষের অধীনে চুপসে গিয়ে ভেঙে না পড়ে। 

রাতের আকাশ কালো কেন

এটা থেকে আরেকটা সমস্যার জন্ম নেয়। আমরা যদি এমন কোনো মহাবিশ্বের কথা ভাবি, যেটা অসীম ও সুষম, তাহলে মহাকাশের যেদিকেই তাকাই না কেন, শেষ পর্যন্ত একটা নক্ষত্রে গিয়ে আমাদের দৃষ্টিরেখা শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মহাবিশ্বে নক্ষত্রের সংখ্যা অসীম হওয়ার কারণে অবশ্যই সব দিক থেকে অসীম পরিমাণ আলো আমাদের চোখে এসে ঢুকবে। 

কাজেই রাতের আকাশ অনিবার্যভাবে সাদা হওয়ার কথা, কোনোভাবেই কালো নয়। একে বলা হয় অলবার্সের প্যারাডক্স। 

ইতিহাসের সেরা কিছু মানুষ এই একগুঁয়ে প্রশ্নটি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন। যেমন কেপলার এই প্যারাডক্সটা খারিজ করে দিয়েছেন এই দাবি তুলে যে মহাবিশ্ব সসীম। কাজেই এখানে কোনো প্যারাডক্স নেই। অন্য অনেক তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন যে ধূলির মেঘগুলো নক্ষত্র থেকে আসা আলোকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। (কিন্তু এটা আসলে এই প্যারাডক্সের সমাধান দিতে পারে না। কারণ, অসীম সময় ধরে ধূলির মেঘগুলোও উত্তপ্ত হতে থাকবে। তারপর নক্ষত্রগুলোর মতো ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন বিকিরণ করবে তারাও। কাজেই মহাবিশ্বকে আবারও সাদাই দেখতে পাওয়ার কথা।) 

আসলে ১৮৪৮ সালে এ প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তরটি দেন এডগার অ্যালান পো। এক শৌখিন জ্যোতির্বিদ হিসেবে প্যারাডক্সটা তাঁকেও মুগ্ধ করেছিল। কবি ও লেখক পো বললেন, রাতের আকাশ কালো হওয়ার কারণ হলো, আমরা যদি সময়ের যথেষ্ট পেছনে ফিরে যাই, তাহলে ক্রমান্বয়ে একটা বাধার মুখোমুখি হব। অর্থাৎ মুখোমুখি হব মহাবিশ্বের সূচনাকালের। অন্য কথায়, রাতের আকাশ কালো হওয়ার কারণ হলো মহাবিশ্বের বয়স সসীম। আমরা অসীম অতীত থেকে আলো পাই না, সেটা যদি সম্ভব হতো, তাহলে রাতের আকাশও হতো সাদা। সেটা না হওয়ার কারণ হলো, মহাবিশ্বের কখনোই কোনো অসীম অতীত নেই। মানে, বহুদূরের নক্ষত্রগুলোর দিকে আমরা যখন টেলিস্কোপে উঁকি দিই, তখন আমরা ক্রমান্বয়ে মহাবিস্ফোরণের কালের অন্ধকারে পৌঁছে যাই। 

কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেও স্রেফ বিশুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে কেউ এ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে মহাবিশ্বের অবশ্যই একটা সূচনা ছিল, সেটা সত্যিই বিস্ময়ের এক ব্যাপার। 

সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং মহাবিশ্ব 

১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রণয়ন করলেন আইনস্টাইন। তখন তাঁকে এসব প্যারাডক্সের মুখোমুখি হতে হলো। 

১৯২০-এর দশকে তত্ত্বটা খোদ মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন আইনস্টাইন। জ্যোতির্বিদেরা তাঁকে বললেন, মহাবিশ্ব স্থির, সেটা প্রসারিতও হচ্ছে না, সংকুচিতও হচ্ছে না। কিন্তু আইনস্টাইন দেখলেন, তাঁর সমীকরণগুলোতে কিছু একটা বাধার সৃষ্টি করছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে সমীকরণগুলো থেকে দেখা গেল, মহাবিশ্ব গতিশীল। অর্থাৎ মহাবিশ্ব হয় প্রসারিত হচ্ছে, নয়তো সংকুচিত হচ্ছে। (তিনি যে শুধু সেবারই প্রথম বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন তা নয়, বরং রিচার্ড বেন্টলির করা প্রশ্নটার ও সমাধান ছিল সেটা। মহাবিশ্ব মহাকর্ষের অধীনে চুপসে গিয়ে ভেঙে পড়ে না। কারণ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। এভাবে চুপসে যাওয়ার প্রবণতা অতিক্রম করে চলেছে মহাবিশ্ব। ) 

একটা স্থির, স্থিতিশীল মহাবিশ্বের খোঁজে নিজের সমীকরণে জোর করে একটা অর্থহীন ফ্যাক্টর যোগ করে বসলেন আইনস্টাইন (একে বলা হয় কসমোলজিক্যাল কন্সট্যান্ট বা মহাজাগতিক ধ্রুবক)। এই ধ্রুবকের মান নিজের হাতে ঠিকঠাক করে মহাবিশ্বের প্রসারণ বা সংকোচনের ধারণা বাতিল করতে পারতেন আইনস্টাইন। 

পরে ১৯২৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশালাকৃতির উইলসন অবজারভেটরি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একটা চমকপ্রদ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল। মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে, ঠিক যেমনটি আইনস্টাইনের আগের সমীকরণগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। হাবল এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারটা করেন দূরবর্তী ছায়াপথগুলোর ডপলার বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করে। (কোনো নক্ষত্র যখন আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়, তখন তার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রসারিত হয়। তাই এই আলো কিছুটা লালচে হয়ে যায়। অন্যদিকে কোনো নক্ষত্র আমাদের দিকে আসতে থাকলে, তার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়ে যায়। তাই এই আলো কিছুটা নীলচে হয়ে যায়। ছায়াপথগুলোকে অতিসতর্কভাবে বিশ্লেষণ করে হাবল দেখেন যে গড়পড়তায় ছায়াপথগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে লোহিত বিচ্যুতি। সুতরাং ছায়াপথগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রসারিত হচ্ছে আমাদের এই মহাবিশ্ব। ) 

১৯৩১ সালে মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরি পরিদর্শন করেন আইনস্টাইন। সেখানে হাবলের সঙ্গেও দেখা হয় তাঁর। আইনস্টাইনকে বলা হলো, মহাজাগতিক ধ্রুবক অপ্রয়োজনীয়। কারণ, মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে। আইনস্টাইন তখন স্বীকার করেন, মহাজাগতিক ধ্রুবক আসলে তাঁর ‘সবচেয়ে বড় ভুল’ (গ্রেটেস্ট ব্লান্ডার)। (কিন্তু আমরা অচিরেই দেখতে পাব, মহাজাগতিক ধ্রুবক সম্প্রতি নতুন করে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। তাই তাঁর সবচেয়ে বড় ভুলটাও স্পষ্টতই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পুরোপুরি নতুন এক ক্ষেত্রের দুয়ার খুলে দিয়েছে।) 

এই ফলাফলকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে মহাবিশ্বের বয়সও নির্ণয় করা সম্ভব। ছায়াপথগুলো কত দূরে সরে যাচ্ছে, তার হার নির্ণয় করেছিলেন হাবল। তাই ‘এই ভিডিও টেপকে পেছনের দিকে চালানো’ এবং এই প্রসারণ কতটা সময় ধরে হয়েছে, তা নির্ণয় করা সম্ভব হওয়ার কথা। এভাবে মহাবিশ্বের বয়স পাওয়া গেল ১.৮ বিলিয়ন বছর (যা বেশ বিব্রতকর ব্যাপার ছিল। কারণ, তত দিনে আমরা জেনে গিয়েছি, পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, প্ল্যাঙ্ক স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া সর্বশেষ উপাত্তে মহাবিশ্বের বয়স পাওয়া গেছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর।) 

মহাবিস্ফোরণের কোয়ান্টাম অস্তরাগ 

কসমোলজিতে পরবর্তী বিপ্লবটা ঘটেছিল পদার্থবিদেরা যখন মহাবিস্ফোরণ মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করলেন। একটা বিপুল, অতি উত্তপ্ত বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে যদি মহাবিশ্বের সূচনা হয়ে থাকে, তাহলে ওই তাপের কিছু অংশ এখনো টিকে থাকার কথা। একদিন তেমনই একটা সম্ভাবনার কথাই ভাবলেন রুশ পদার্থবিদ জর্জ গ্যামো। মহাবিস্ফোরণে যদি কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্ৰয়োগ করা হয়, তাহলে আদি অগ্নিগোলকটি অবশ্যই একটা কোয়ান্টাম ব্ল্যাকবডি বিকিরণের উৎস হবে। ব্ল্যাকবডি বা কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের ধর্ম আমাদের বেশ ভালোভাবেই জানা। তাই এই বিকিরণ, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের অস্তরাগ (আফটারগ্লো) বা প্রতিধ্বনি মাপাও সম্ভব হওয়ার কথা। 

সে সময় আদিকালের যে পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব ছিল, সেগুলো ব্যবহার করে ওই বিকিরণ হিসাব করলেন ১৯৪৮ সালে গ্যামো আর তাঁর সহকর্মী রালফ আলফার এবং রবার্ট হারমান। তাঁদের চুলচেরা হিসাবে দেখা গেল, বর্তমানে মহাবিস্ফোরণের অস্তরাগের তাপমাত্ৰা পরম শূন্য তাপমাত্রার ওপরে প্রায় ৫ ডিগ্রি হওয়া উচিত (এর প্রকৃত মান হলো ২.৭৩ কেলভিন)। এটাই মহাবিশ্বের সেই তাপমাত্রা, যা কোটি কোটি বছর ধরে মহাবিশ্ব শীতল হয়ে যাওয়ার পরে পাওয়া যাওয়ার কথা। 

এই তিন বিজ্ঞানীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী ১৯৬৪ সালে প্রমাণ করেন আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন। মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা এই অবশিষ্ট বিকিরণ শনাক্ত করতে বিশালাকৃতির হোল্মডেল রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছিলেন এই দুই বিজ্ঞানী। (একে বলা হয় ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা পটভূমি বিকিরণ। তবে শুরুতে এই দুই বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন, এই পটভূমি বিকিরণের পেছনে তাঁদের যন্ত্রপাতির ত্রুটিবিচ্যুতিই দায়ী। কিংবদন্তি আছে, প্রিন্সটনে একটা বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। তখন এক শ্রোতা বলে বসলেন, ‘তোমরা হয় পাখির বিষ্ঠা শনাক্ত করেছ, নয়তো মহাবিশ্বের সৃষ্টি।’ সেটা যাচাই করতে রেডিও টেলিস্কোপটি থেকে বেশ সতর্কভাবে কবুতরের বিষ্ঠা পরিষ্কার করেন বিজ্ঞানী জুটি।) 

মহাবিস্ফোরণের প্রমাণের জন্য বর্তমানে এই মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন হয়তো সবচেয়ে বোধযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। সম্প্রতি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া পটভূমি বিকিরণের ছবিগুলোতেও মহাবিশ্বের চারদিকে শক্তির একটা সুষম অগ্নিগোলককে সমানভাবে বিন্যস্ত দেখা যায়। (কোনো রেডিওতে যখন হিসহিস শব্দ শোনা যায়, তখন আসলে ওর কিছু হিসহিস শব্দ আসে মহাবিস্ফোরণ থেকে।) 

প্রকৃতপক্ষে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া এসব ছবি এখন এতই নির্ভুল যে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা নীতির কারণে পটভূমি বিকিরণের অতিক্ষুদ্র, অণুমাত্র কম্পনও শনাক্ত করা সম্ভব। মহাবিশ্বের সৃষ্টি মুহূর্তে সেখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন থাকা উচিত, যার ফলে এই কম্পনের সৃষ্টি হবে। একটা সুষমভাবে নিখুঁত মহাবিস্ফোরণ অনিশ্চয়তার নীতি মানবে না। মহাবিস্ফোরণের পর থেকে আমাদের চারপাশের ছায়াপথগুলো গঠিত হওয়া পর্যন্ত এই কম্পনগুলো মহাবিশ্বের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হতে থাকবে। (আসলে আমাদের স্যাটেলাইটগুলো যদি পটভূমি বিকিরণের এই কোয়ান্টাম কম্পনগুলো শনাক্ত করতে না পারত, তাহলে তাদের অনুপস্থিতির কারণে মহাবিশ্বে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগের সব আশা-ভরসা ধ্বংস হয়ে যেত।) 

এটা কোয়ান্টাম তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য একটা চিত্রের জোগান দেয়। অন্যান্য কোটি কোটি ছায়াপথের মধ্যে আমরা যে মিল্কিওয়ে ছায়াপথে টিকে আছি, এই সত্য ঘটনার কারণ আদি মহাবিস্ফোরণে এসব অতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। আমাদের চারপাশে আমরা এখন যা দেখি, সেগুলো কয়েক বিলিয়ন বছর আগে, এই পটভূমি বিকিরণের মধ্যে অতিক্ষুদ্র একটা বিন্দু হিসেবে ছিল। 

কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মহাকর্ষের ওপর প্রয়োগের পরবর্তী ধাপটি ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং স্ট্যান্ডার্ড মডেলের শিক্ষাগুলোকে সাধারণ আপেক্ষিকতায় প্রয়োগ করা। 

স্ফীতি 

১৯৭০-এর দশক। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সাফল্যে ভাসতে ভাসতে পদার্থবিদ অ্যালান গুথ এবং আন্দেই লিন্দ নিজেদের একটা প্রশ্ন করলেন। স্ট্যান্ডার্ড মডেল এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেছে, সেগুলো কি সরাসরি মহাবিস্ফোরণে প্রয়োগ করা যায়? 

একেবারে নতুন প্রশ্ন ছিল সেটা। কারণ কসমোলজি বা বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রয়োগ তখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গিয়েছিল। গুথ খেয়াল করলেন, মহাবিশ্বের দুটি দুর্বোধ্য দিক রয়েছে। সেগুলো মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়নি। অথচ এককালে সেগুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। 

প্রথমটা ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা সমতলীয় সমস্যা। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, স্থান-কালের নকশা কিছুটা বক্র হওয়ার কথা। কিন্তু মহাবিশ্বের বক্রতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, তা আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে অনেক বেশি সমতল। আসলে পরীক্ষামূলক সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে মহাবিশ্বকে সুষমভাবে সমতল বলে মনে হয়। 

দ্বিতীয়ত, মহাবিশ্ব যতটা সুষম হওয়ার কথা, তার চেয়েও তা বেশি সুষম। মহাবিস্ফোরণের সময় আদি অগ্নিগোলকে কিছু অসংগতি ও অপূর্ণতা থাকার কথা। মহাকাশে আমরা যে দিকেই তাকাই না কেন, মহাবিশ্বকে সব দিকে বেশ সুষম বলে মনে হয়। 

এই দুটো প্যারাডক্সই কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে সমাধান করা সম্ভব। গুথ সেই পরিঘটনার নাম দিয়েছেন ইনফ্লেশন বা স্ফীতি। এই চিত্র অনুযায়ী, প্রথমত মহাবিশ্ব একটা অতি দ্রুত প্রসারণের মধ্য দিয়ে গেছে। সেই প্রসারণের গতি ছিল মহাবিস্ফোরণের জন্য স্বীকৃত গতির চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতির। এই বিস্ময়কর প্রসারণ মূলত মহাবিশ্বকে সমতল করে তুলেছে। আবার আদি মহাবিশ্বের যেসব বক্রতা ছিল, তা-ও দূর করেছে এই স্ফীতি। 

দ্বিতীয়ত, আদি মহাবিশ্ব সম্ভবত অনিয়মিত ছিল। কিন্তু এই আদি মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র অংশটি ছিল সুষম। সেটাই প্রসারিত হয়ে পরিণত হয়েছে বিপুল আকৃতিতে। কাজেই মহাবিশ্বকে এখন কেন সুষম দেখা যায়, তা এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, আমরা বৃহত্তর কোনো অগ্নিগোলকের একটা অতিক্ষুদ্র ও সুষম টুকরা থেকে এসেছি, যা থেকে সূচনা হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের। 

স্ফীতির প্রয়োগ সুদূরপ্রসারী। এর মানে, আমাদের চারদিকে যে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব দেখা যায়, তা আসলে অনেক বড় কোনো মহাবিশ্বের একটা অতি ক্ষুদ্র টুকরা। সুবিশাল সেই মহাবিশ্বটার পুরোটা আমরা কখনো দেখতে পাই না, কারণ তা অনেক অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। 

কিন্তু স্ফীতি শুরু হওয়ার কারণ কী? আর সেটা গতিশীল হলো কেন? মহাবিশ্ব কেন প্রসারিত হলো? স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে তখন কিছুটা অনুপ্রেরণা পান গুথ। কোয়ান্টাম তত্ত্বে, প্রতিসাম্য দিয়ে শুরু করার পর, তা হিগস বোসনের জন্য ভেঙে যায়। এভাবে যে মহাবিশ্ব পাওয়া যায়, সেটিই আমাদের চারদিকে দেখতে পাই। একইভাবে গুথ এবার তত্ত্ব প্রণয়ন করলেন যে হয়তো সেখানে নতুন কোনো ধরনের হিগস বোসন ছিল (যাকে বলা হলো ইনফ্লেটন), যা স্ফীতিকে সম্ভব করে তুলেছে। আসল হিস বোসনের সঙ্গে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল একটা মেকি শূন্যতার ভেতর, যা আমাদের দ্রুতগতির স্ফীতি যুগ দিয়েছে। কিন্তু এরপর ওই স্ফীতি ক্ষেত্রের ভেতর সৃষ্টি হয় কোয়ান্টাম বুদ্বুদ। এই বুদের ভেতর সত্যিকার শূন্যতার উদয় হয়, তাতে সেখানে স্ফীতি থেমে গেল। এ রকম একটা বুদ হিসেবে আবির্ভূত হলো আমাদের মহাবিশ্ব। বুদ্বুদের ভেতরে মহাবিশ্ব ধীরগতির হয়ে পড়ল। ফলে আমরা পেলাম বর্তমানকালের প্রসারণ। 

এখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে স্ফীতির ধারণা মিলে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। এটাই এখন শীর্ষস্থানীয় তত্ত্ব। কিন্তু এর কিছু অপ্রত্যাশিত পরিণতি রয়েছে। আমরা যদি এখানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করতে চাই, তাহলে দেখা যায়, মহাবিস্ফোরণ বারবার ঘটতে পারে। আমাদের মহাবিশ্ব থেকেও হয়তো সব সময় নতুন নতুন মহাবিশ্বের জন্ম হচ্ছে। 

তার মানে, আমাদের মহাবিশ্ব আসলে অগণিত বুদ মহাবিশ্বের ভেতর একটা বুদ্বুদ মাত্র। এটিই প্যারালাল মহাবিশ্বের মাল্টিভার্স তৈরি করে। এরপরও একটা খুঁতখুঁতে প্রশ্ন থেকে যায়, স্ফীতির শুরুর পেছনের তাড়না কী ছিল? পরের অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব, এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আরও উন্নত তত্ত্বের প্রয়োজন। আর সেটা হলো থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব। 

ফেরারি মহাবিশ্ব 

সাধারণ আপেক্ষিকতা শুধু মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে অভিনব অন্তর্দৃষ্টির জোগানই দেয় না, সঙ্গে তত্ত্বটা দেয় মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কেও এক চিত্র। অবশ্য প্রাচীন ধর্মগুলোতেও সময়ের সমাপ্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন ভাইকিংরা বিশ্বাস করত, র‍্যাগনারক বা দেবতাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ বিশ্ব। তখন অতি দানবতুল্য একটা বরফঝড় ঢেকে ফেলবে গোটা গ্রহটাকে। তখন স্বর্গীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে নামবেন দেবতারা। খ্রিষ্টানদের বুক অব রেভেলেশন-এ (নিউ টেস্টামেন্টের শেষ গ্রন্থ) বিপর্যয়, আকস্মিক ভূমিকম্প এবং শেষ দিবসের চার ঘোড়সওয়ার আসার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আর এসব ঘটবে যিশুখ্রিষ্টের পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আগমনের পর। 

কিন্তু একজন পদার্থবিদের কাছে ঐতিহ্যগতভাবে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার দুটি উপায় আছে। মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি অনেক কম হয়, তাহলে মহাজাগতিক প্রসারণকে উল্টো দিকে আনার জন্য নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলোর মহাকর্ষ যথেষ্ট হবে না। ফলে মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। তাতে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করবে বিগ ফ্রিজ বা মহাশীতলতার মধ্য দিয়ে। নক্ষত্ররা একসময় তাদের সব পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার করে নিঃশেষ করে ফেলবে। ফলে আকাশ হয়ে যাবে কালো। কৃষ্ণগহ্বরও বাষ্পীভূত হয়ে যাবে। মহাবিশ্ব শেষ হবে একটা প্রাণহীন, অতিপারমাণবিক কণাদের উদ্দেশ্যহীন অতিশীতল সাগরে। 

অন্যদিকে মহাবিশ্ব যদি যথেষ্ট ঘন হয়, তাহলে মহাজাগতিক প্রসারণকে উল্টো পথে আনার জন্য নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলোর মহাকর্ষ হয়তো পর্যাপ্ত হবে। এরপর নক্ষত্র ও ছায়াপথগুলো ক্রমান্বয়ে বিগ ক্রাঞ্চ বা মহাসংকোচনের মধ্য দিয়ে চুপসে যাবে। তখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবে এবং মহাবিশ্বের সব প্রাণ গিলে খাবে। (কিছু পদার্থবিদ এমনও অনুমান করেন যে মহাবিশ্ব হয়তো এরপর লাফিয়ে উঠে আরেকটা মহাবিস্ফোরণের মধ্যে চলে যাবে এবং একটা দোদুল্যমান মহাবিশ্বের সৃষ্টি করবে।) 

১৯৯৮ সালে জ্যোতির্বিদেরা একটা চমকপ্রদ ঘোষণা দেন, যা আমাদের লালিত বেশ কিছু বিশ্বাসকে উল্টে দিয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের বাধ্য করেছে পাঠ্যপুস্তকগুলোও বদলাতে। মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহুদূরের সুপারনোভা বিশ্লেষণ করে জ্যোতির্বিদেরা দেখেছেন, মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি ধীর হচ্ছে না। অথচ আগে তেমনটাই ভাবা হতো। দেখা গেছে, মহাবিশ্বের গতি ক্রমেই বাড়ছে। আসলে মহাবিশ্ব একটা ফেরারি বা পলায়নপর মোডে প্রবেশ করেছে। 

আগের দুটি দৃশ্যপটকে সংশোধন করেছেন জ্যোতির্বিদেরা I এভাবে উদয় হয়েছে এক নতুন তত্ত্বের। হয়তো মহাবিশ্বের মৃত্যু হবে এমন কিছুতে, যাকে বলা হচ্ছে বিগ রিপ। এতে মহাবিশ্বের প্রসারণ অন্ধের মতো ত্বরান্বিত হতেই থাকবে। ভবিষ্যতে মহাবিশ্ব এতই জোরে প্রসারিত হবে যে রাতের আকাশ একসময় পুরোপুরি কালো হয়ে যাবে (কারণ, আমাদের প্রতিবেশী নক্ষত্রগুলো থেকে তখন আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারবে না)। মহাবিশ্বের সবকিছু পৌঁছাবে পরম শূন্য তাপমাত্রায়। 

এই তাপমাত্রায় কোনো প্রাণ টিকে থাকতে পারবে না। এমনকি বাইরের মহাকাশের অণুগুলোও হারিয়ে ফেলবে সব শক্তি। 

মহাবিশ্বকে ফেরারি মোডে হয়তো এমন কিছু একটা চালিত করছে, যাকে ১৯২০-এর দশকে বাতিল করেন আইনস্টাইন। সেটা হলো মহাজাগতিক ধ্রুবক বা কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট। এটি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতার শক্তি। এখন একে বলা হয় ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মহাবিশ্বে গুপ্তশক্তির পরিমাণ বিপুল। মহাবিশ্বের মোট বস্তু ও শক্তির মধ্যে ৬৮.৩ ভাগের বেশি রয়েছে এই অজানা রহস্যময় রূপে। (মোট হিসাবে গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তি দিয়েই বেশির ভাগ বস্তু ও শক্তি গঠিত। কিন্তু এ দুটি আলাদা অস্তিত্ব। একটার সঙ্গে আরেকটাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।) 

মজার ব্যাপার হলো, আমাদের জানা কোনো তত্ত্ব দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। মহাবিশ্বে গুপ্তশক্তির পরিমাণ চোখ বুজে তাত্ত্বিকভাবে হিসাব করার চেষ্টা করলে (আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনুমান ব্যবহার করে) আসল মানের চেয়ে ১০১২০ গুণ বেশি মান পাওয়া যায়! (১০১২০ হলো ১-এর পিঠে ১২০টি শূন্য।) 

গোটা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় অমিল। তবে এই ঝুঁকির পরিমাণ আর বাড়তে পারবে না। কারণ, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিজেই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। 

এটাই আমাদের জানাতে পারে, মহাবিশ্ব কীভাবে ধ্বংস হবে। 

য়ান্টেড : গ্র্যাভিটন 

সাধারণ আপেক্ষিকতার গবেষণা বেশ কয়েক দশক ধরে নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। তবে আপেক্ষিকতায় সম্প্রতি কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগের কারণে খুলে গেছে নতুন ও অপ্রত্যাশিত দিগন্তের এক দুয়ার। বিশেষ করে শক্তিশালী নতুন যন্ত্রপাতিগুলো অনলাইনে চলে যাওয়ার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। সেখানে ফুটতে শুরু করেছে নতুন গবেষণার ফুল। 

কিন্তু এখনো আমরা আইনস্টাইনের তত্ত্বের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর চলমান বস্তুগুলোর ওপরই শুধু কোয়ান্টাম মেকানিকসকে প্রয়োগ করার বিষয় আলোচনা করেছি। এর চেয়ে আরও কঠিন প্রশ্ন নিয়ে আমরা কোনো আলোচনা করিনি। সেটা হলো, খোদ মহাকর্ষের ওপর কোয়ান্টাম মেকানিকসের প্রয়োগ। অর্থাৎ গ্র্যাভিটনরূপী মহাকর্ষের ওপর কোয়ান্টামের প্রয়োগ নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। 

এখানেই আমরা সবচেয়ে বড় প্রশ্নটির সম্মুখীন হই। প্রশ্নটা হলো, কোনো কোয়ান্টাম থিওরি অব গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া। সেটার খোঁজে কয়েক দশক ধরে হতাশ হয়েছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা পদার্থবিদ। তাহলে দেখা যাক, এতক্ষণ ধরে আমরা কী কী শিখলাম। মনে আছে নিশ্চয়ই, কোয়ান্টাম তত্ত্বকে আলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আমরা ফোটন বা আলোর কণা পাই। ফোটন যখন চলাফেরা করে, তখন তা বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র দিয়ে ঘেরা থাকে, যা স্থানকে দোলায় এবং প্রবাহিত হয়। আবার ফোটন মেনে চলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো। তাই আলোর আছে কণা ও তরঙ্গের মতো দুটো ধৰ্ম। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর শক্তি লুকিয়ে আছে তাদের প্রতিসাম্যের মধ্যে। অর্থাৎ এতে বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্রগুলোর পরস্পর স্থান বদলানোর ক্ষমতা আছে। 

ফোটন দুম করে ইলেকট্রনগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খেলে যে মিথস্ক্রিয়া ঘটে, তাকে ব্যাখ্যাকারী সমীকরণগুলো থেকে অসীম ফলাফল পাওয়া যায়। তবে বেশ কিছু কৌশল ব্যবহার করে এসব অসীম দূর করতে পেরেছিলেন ফাইনম্যান, শউইনগার, তোমোনাগা এবং অন্য বিজ্ঞানীরা। এভাবে নতুন যে তত্ত্ব পাওয়া গেল, তাকে বলা হয় কিউইডি বা কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস। এরপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলো পারমাণবিক বলের ওপর। ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্রকে আমরা ইয়াং-মিল ক্ষেত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত করি। এরপর ইলেকট্রনের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করেছি একগুচ্ছ কোয়ার্ক নিউট্রন ইত্যাদি কণাকে। এরপর আরেকবার সব অসীমকে হটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে আরও একগুচ্ছ কৌশল ব্যবহার করে। কৌশলগুলোর উদ্ভাবক ‘টি হুফট এবং তাঁর সহকর্মীরা। 

কাজেই মহাবিশ্বের চারটি বলের মধ্যে তিনটি এখন একটামাত্র তত্ত্বে একীভূত করা সম্ভব হয়েছে। সেটি এখন স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল নামে পরিচিত। সত্যি বলতে কী, তত্ত্বটা দেখতে খুব একটা সুন্দর নয়। কারণ, একে তৈরি করা হয়েছে সবল, দুর্বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলগুলোর প্রতিসাম্য একত্রে জোড়াতালি মেরে। কিন্তু পদ্ধতিটা মহাকর্ষের ওপর ব্যবহার করা হলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। 

তাত্ত্বিকভাবে মহাকর্ষের একটা কণাকে গ্র্যাভিটন বলা উচিত ফোটনের মতো এটাও বিন্দু কণা। আবার এটাও আলোর বেগে চলাচল করে, যার চারপাশে ঘিরে থাকে মহাকর্ষের তরঙ্গ। আবার এটা আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোও মেনে চলে। 

এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যা বাধল গ্র্যাভিটন যখন অন্যান্য গ্র্যাভিটন ও পরমাণুদের সঙ্গে ধাক্কা খেল। এই সংঘর্ষের ফলে পাওয়া যায় অসীম উত্তর। ৭০ বছর ধরে বহু কষ্ট করে পদার্থবিদেরা যেসব কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, সেগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেল, সবই ব্যর্থ। সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করেছেন এই শতকের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী। কিন্তু এখনো সফল হতে পারেননি কেউই। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এখানে অবশ্যই নতুন কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। কারণ, সব কটি সহজ ধারণা ব্যবহার করে ইতিমধ্যেই সে চেষ্টা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাতিল হয়েছে সেগুলোও। আমাদের আসলে এখন নতুন আর মৌলিক কিছু একটা দরকার। এটাই হয়তো পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বিতর্কিত তত্ত্ব বা স্ট্রিং থিওরির দিকে আমাদের নিয়ে যায়। কারণ, থিওরি অব এভরিথিং হওয়ার জন্য এই তত্ত্বটিই সম্ভবত যথেষ্ট উদ্ভট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *