সপ্তম পর্ব – পৃথিবী
১৯. রেডিওঅ্যাকটিভ
ফার স্টার ওড়াল দিল নিঃশব্দে, অন্ধকার দ্বীপটাকে নিচে ফেলে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে উপরে উঠল ধীরে ধীরে। নিচে যে ঝাপসা আলোর বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছিল সেগুলো হালকা হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল একসময় এবং উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুমণ্ডল যত পাতলা হচ্ছে মহাকাশযানের গতি ততই বাড়ছে, সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে উপরে আকাশে আলোর বিন্দুর সংখ্যা এবং উজ্জ্বলতা।
নিচে আলফা গ্রহ দেখে মনে হচ্ছে রাশি রাশি মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দেওয়া উজ্জ্বল অর্ধচন্দ্র।
আশা করি ওদের উন্নত স্পেস টেকনোলজি নেই। আমাদের অনুসরণ করতে পারবেনা। বলল পেলোরেট।
খুশি হতে পারছি না। ট্র্যাভিজ বলল, চেহারায় তিক্ততা, গলায় হাহাকার। আমার শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে।
কিন্তু ইনঅ্যাকটিভ। বলল ব্লিস।
অ্যাকটিভ হতে কতক্ষণ। ওদের একটা কৌশল আছে। কৌশলটা কী?
ঝাঁকি দিল ব্লিস, হিরোকো বলেছিল ভাইরাস অ্যাকটিভেট করা না হলে নির্দিষ্ট সময় পরে অন্যভাবে শরীরে স্বাভাবিকভাবেই সেটা নষ্ট হয়ে যাবে।
হ্যাঁ? রাগত সুরে বলল ট্র্যাভিজ। সে কীভাবে জানে? তা ছাড়া আমি কীভাবে জানব যে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে মিথ্যে কথা বলেনি? এমনও তো হতে পারে ভাইরাস অ্যাকটিভেট করার কৌশলটা যাই হোক না কেন অন্য কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও সেটা হতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট কেমিক্যাল, কোনো নির্দিষ্ট ধরনের বিকিরণ, কোনো-কোনো-কে জানে কী? হয়তো হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ব, তারপর তোমরা তিন জনও মারা যাবে। অথবা কোনো জনবহুল গ্রহে যাওয়ার পর সেটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ব্লিসের দিকে তাকাল সে, তুমি কিছু করতে পারো না?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল ব্লিস। সহজ হবে না। গায়াতে পরজীবী আছে অণুজীব, ক্ষুদ্রাকৃতি অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এগুলো ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সের একটা অনুকূল অংশ। গ্রহের কনশাসনেস-এ অবদান রাখে, কিন্তু কখনো অতিরিক্ত হয় না। বড় রকমের ক্ষতি না করেই ওগুলো বেঁচে থাকে। সমস্যা হলো, ট্র্যাভিজ, তোমাকে যে ভাইরাস আক্রমণ করেছে সেটা গায়ার অংশ নয়।
তুমি বলছ সহজ হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যত কঠিন কাজই হোক তুমি করবে? ভাইরাস খুঁজে বের করে তুমি নষ্ট করতে পারবে? অথবা অন্তত আমার, প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারবে?
কী করতে বলছ বুঝতে পারছ, ট্র্যাভিজ? আমি তোমার শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গঠনের সাথে পরিচিত নই। কোনো একটা কোষ এবং ভাইরাসকে আলাদা করে । চিনতে পারব না। এমনকি তোমার শরীরে যে ভাইরাস আগে থেকেই আছে এবং হিরোকো যে ভাইরাস ঢুকিয়েছে সেটা আলাদা করতেও কষ্ট হবে। আমি চেষ্টা করব, ট্র্যাভিজ, কিন্তু সফল নাও হতে পারি।
সময় লাগুক, চেষ্টা করো।
অবশ্যই।
হিরোকোর কথা সত্যি হলে, ব্লিস, তুমি হয়তো দেখবে ভাইরাস এরই মধ্যে ক্ষয় হতে শুরু করেছে। তুমি শুধু সেটাই একটু তরান্বিত করবে। বলল পেলোরেট।
সেটা করতে পারব। চমৎকার কথা বলেছ।
তুমি ক্লান্ত হবে না? বলল ট্র্যাভিজ। ভাইরাসগুলো হত্যা করার সময় তোমাকে কিছু সূক্ষ্ম প্রাণ ধ্বংস করতে হবে।
তুমি একটা উন্মাদ, ট্র্যাভিজ, ঠাণ্ডা গলায় বলল ব্লিস। তবে একটা সত্যিকার সমস্যার কথাই তুলে ধরেছ ।কিন্তু আমিতো তোমাকে ভাইরাসের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। সুযোগ পেলে সেগুলো মেরে ফেলব, ভয় পেয়ো না। তা ছাড়া তোমার কিছু হলে পেলোরেট আর ফেলমের বিপদ হতে পারে। কাজেই বিশ্বাস রাখো, তোমার জন্য না হলেও ওদের জন্য কাজটা করব। নইলে এমনকি আমারও বিপদ হতে পারে।
নিজের প্রতি তোমার কোনো মমত্ববোধ আছে এটা আমি বিশ্বাস করি না, নিচু গলায় বলল ট্র্যাভিজ। যাই হোক, পেলোরেটের ব্যাপারে তোমার দুঃশ্চিন্তার কথা মেনে নিলাম। অনেকক্ষণ থেকে ফেলমের বাজনা শুনছি না। কিছু হয়েছে?
না, ঘুমাচ্ছে। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘুম। এবং আমার পরামর্শ হচ্ছে, পৃথিবী যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে বলে ভাবছি সেটার দিকে জাম্প করে আমাদেরও তাই করা উচিত। আমার বিশ্রামের ভীষণ দরকার এবং তোমারও দরকার, ট্র্যাভিজ।
হ্যাঁ, যদি সম্ভব হয়।–তুমি ঠিক বলেছিলে, ব্লিস।
কোন ব্যাপারে, ট্র্যাভিজ।
আইসোলেটদের ব্যাপারে। দেখে যাই মনে হোক নিউ আর্থকে স্বর্গ বলা যায় না। আতিথেয়তা-বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ সবই ছিল আমাদের অসতর্ক করে তোলার জন্য, যেন যে-কোনো একজন ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি। তারপরের সমস্ত আতিথেয়তা, উৎসব ছিল ফিশিং ফ্লিট ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের আটকে রাখার জন্য। ফেলম আর তার সঙ্গীত না থাকলে ওদের কৌশল কাজে লেগে গিয়েছিল প্রায়। এ ব্যাপারেও তোমার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল।
ফেলমের ব্যাপারে? হ্যাঁ, আমি তাকে সাথে আনতে চাইনি। জাহাজে তাকে দেখে খুশি হইনি। কিন্তু তুমি তাকে নিয়ে এসেছে। এবং সে নিজের অজান্তেই আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। অথচ তারপরেও–
তারপরেও কী?
এত কিছু সত্ত্বেও আমি ফেলমের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছি না। জানি না। কেন।
আমার কথায় তোমার কতটুকু লাভ হবে জানি না, ট্র্যাভিজ। তবে সব কৃতিত্ব ফেলমকে দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। হিরোকো যা করেছে তার জন্য ফেলম আর তার সঙ্গীতকে কারণ হিসেবে বলেছে, অন্য আলফানদের কাছে এটা বিশ্বাসঘাতকতা। হয়তো সে নিজেও এটা বিশ্বাস করে, কিন্তু তার মাইণ্ডে অন্য কিছু ছিল। হালকাভাবে ধরতে পারলেও আমি নিশ্চিত নই। এমন কিছু যা নিয়ে সে ছিল লজ্জিত। আমার ধারণা ফেলমের সঙ্গীত ছাড়াও সে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
তুমি সত্যিই তাই মনে করো? বলল ট্র্যাভিজ, আলফা ছাড়ার পর এই প্রথম হাসি ফুটল তার মুখে।
আমি তাই মনে করি। মেয়েরা খুব দ্রুত তোমার প্রেমে পড়ে যায়। মিনিস্টার লিজেলরকে কত সহজে রাজি করিয়ে ফেললে যাতে আমরা মহাকাশযান নিয়ে কমপরেলন ছাড়তে পারি। এখানে হিরোকোকে এমনভাবে প্রভাবিত করলে যে সে নিজের লোকদের বিপক্ষে গিয়ে আমাদের জীবন বাঁচাল। কৃতিত্ব যোগ্য লোকেরই পাওয়া উচিত।
মুখের হাসি আরো চওড়া হলো ট্র্যাভিজের। বেশ, তুমি যখন বলছ।–তা হলে, পৃথিবীর দিকে। পাইলট রুমে অদৃশ্য হলো সে, আরবিশ্বাসী পদক্ষেপে।
পিছন থেকে এগিয়ে এল পেলোরেট। বলল, তুমি শেষ পর্যন্ত ওকে শান্ত করেছ, তাই না ব্লিস?
না, পেলোরেট। আমি কখনো ওর মাইণ্ড স্পর্শ করি না।
তুমি যখন ওর পৌরুষ নিয়ে প্রশংসা করছিলে তখন অবশ্যই তা করেছ?
সম্পূর্ণ পরোক্ষ, হাসিমুখে বলল ব্লিস।
তারপরেও ধন্যবাদ।
.
জাম্পের পরে তাদের গন্তব্য নক্ষত্রের মাঝের দূরত্ব রইল দশ পারসেক। আশপাশের আকাশে এটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু, কিন্তু এখনও উজ্জ্বল তারা ছাড়া আর কিছুই না।
দেখার সুবিধার জন্য আলো ফিল্টার করে নিল ট্র্যাভিজ, তারপর পর্যবেক্ষণ করতে লাগল গম্ভীর ভাবে।
কোনো সন্দেহ নেই এটা আলফার যমজ। অথচ কম্পিউটার ম্যাপে আলফা আছে এটা নেই। এই নক্ষত্রের কোনো নাম বা পরিসংখ্যান জানি না। যদি কোনো প্ল্যানেটরি সিস্টেম থাকে তার সম্বন্ধেও কোনো তথ্য নেই।
পৃথিবী যদি এই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তা হলে তো এমন হবে বলেই আশা করেছিলাম, তাই না? পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলার সাথে এটা মিলে যায়।
হ্যাঁ, তার অর্থ এমনও হতে পারে যে এটা একটা স্পেসার ওয়ার্ল্ড কিন্তু মেলপোমিনিয়ার তালিকায় উঠেনি। আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না ঐ তালিকা ম্পূির্ণ ছিল। অথবা এই নক্ষত্রের কোনো গ্রহ নেই, ফলে কম্পিউটার ম্যাপ যা প্রধানত সামরিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়-সেখানে লিপিবদ্ধ হয়নি। জেনভ, এমন কোনো কিংবদন্তি আছে যাতে বলা হয়েছে পৃথিবীর সূর্য তার কোনো যমজ সঙ্গী থেকে মাত্র এক পারসেক দূরে অবস্থিত।
মাথা নাড়ল পেলোরেট, দুঃখিত, এমন কিছু চোখে পড়েনি। হয়তো ছিল, এখন মনে নেই। খুঁজে দেখতে হবে।
তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। পৃথিবীর সূর্যের কোনো নাম আছে?
বেশ কয়েকটা। আমার ধারণা প্রতিটা ভাষাতেই একটা করে নাম ছিল।
মনেই থাকে না অনেকগুলো ভাষা চালু ছিল পৃথিবীতে।
অবশ্যই ছিল। নইলে এত বিভিন্ন ধরনের কিংবদন্তি তৈরি হতো না।
ক্লান্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ,বেশ, এখন কি করব। প্ল্যানেটরি সিস্টেম সম্বন্ধে এখান থেকে কিছু বলা যাবে না, কাছে যেতে হবে। আমি চাই সতর্ক হতে, কিন্তু যুক্তিহীন অতিরিক্ত সতর্কতায় কোনো লাভ নেই, আর আমিও কোনো বিপদের সম্ভাবনা দেখছিনা। যারা পুরো গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীর সব তথ্য মুছে ফেলার মতো। শক্তিশালী তারা যদি সত্যি সত্যি নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায় তাহলে অনায়াসে আমাদেরও মুছে ফেলতে পারবে। কিন্তু কিছু ঘটেনি। আরো কাছে গেলে বিপদ হতে পারে এই ভয়েই এখানে সারা জীবন বসে থাকার কোন যুক্তি নেই, আছে?
আমি ধরে নিচ্ছি কম্পিউটার বিপজ্জনক কিছু চিহ্নিত করেনি। বলল ব্লিস।
যখন বললাম যে আমি কোনো বিপদের সম্ভাবনা দেখছি না, তার মানে আমি তখন কম্পিউটারের কথাই বলেছি। খালি চোখে কিছু দেখার ক্ষমতা আমার নেই, আশাও করিনা।
তা হলে এই সিদ্ধান্তকে তুমি বিপজ্জনক মনে করছ এবং আমাদের সমর্থন পেতে চাও। বেশ, আমি আছি তোমার সাথে। কোনো কারণ ছাড়া ফিরে যাওয়ার জন্য এতদূর আসিনি, এসেছি?
না, তুমি কী বল পেলোরট?
আমি যেতে চাই শুধু কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য। বলল পেলোরেট। পৃথিবী পেয়েছি কি পাইনি সেটা না জেনে ফিরে যাওয়াটা হবে মূর্খ।
বেশ, তা হলে আমরা সবাই একমত।
সবাই না, বলল পেলোরেট। ফেলম বাকি আছে।
বিস্মিত হল ট্র্যাভিজ। বাচ্চা মানুষের মতামতও নিতে হবে আমাদের? তার মতামতের কি মূল্য আছে। আর সে তো শুধু নিজের গ্রহে ফিরে যাওয়ার কথা বলবে।
সেজন্য ওকে দোষ দিতে পারো? রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
ফেলমের কথা ওঠাতেই ট্র্যাভিজ বাঁশির সুরের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল, এই মুহূর্তে সামরিক কুচকাওয়াজের সুর বাজছে।
শোন, বলল ট্র্যাভিজ। এই সুর সে কোথায় শিখল।
সম্ভবত জেম্বি শিখিয়েছে।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, আমার সন্দেহ আছে।–শোন, ফেলম আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। খুব দ্রুত শিখছে ও সবকিছু।
আমি ওকে সাহায্য করছি, বলল ব্লিস। কথাটা মনে রাখবে। তা ছাড়া সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তার মাইণ্ডে নতুন নতুন ঘটনা জায়গা করে নিচ্ছে। জীবনে প্রথমবারের মতো সে মহাকাশ, নতুন গ্রহ এবং বহু মানুষ দেখছে।
ফেলমের সুর আরো দ্রুত এবং উদ্দাম হয়ে উঠল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্র্যাভিজ বলল, বেশ, সে এখানে আছে, এমন সুর বাজাচ্ছে যা শুনলে নতুন বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য রক্ত ছলকে ওঠে। এটাকেই আমি আরো কাছে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে তার মত বলে ধরে নেব। সাবধানে এগিয়ে সূর্যের প্ল্যানেটরী সিস্টেমে নজর বুলানো যাক।
যদি থাকে, বলল ব্লিস।
ছোট করে হাসল ট্র্যাভিজ। প্ল্যানেটরি সিস্টেম আছে। বাজি। পরিমাণ বল।
.
তুমি হেরে গেছ, নিষ্প্রাণ গলায় বলল ট্র্যাভিজ। কত বাজি ধরেছিলে?
কিছুই না। জুয়া আমার পছন্দ নয়। বলল ব্লিস!
আমারও তোমার অর্থ নেওয়ার কোনো আগ্রহ নেই।
সূর্যের কাছ থেকে ওরা মাত্র দশ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এখনো আকাশের তারার মতো দেখাচ্ছে, তবে কোনো বাসযোগ্য গ্রহের সারফেস থেকে একটা সূর্যকে যত উজ্জ্বল দেখায় তার প্রায় চার হাজার ভাগের এক ভাগ কাছাকাছি উজ্জ্বল।
ম্যাগনিফাই করে এই মুহূর্তে দুটো গ্রহ দেখা যাচ্ছে, বলল ট্র্যাভিজ। ডায়ামিটার এবং প্রতিফলিত আলোর বর্ণালি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওগুলো গ্যাস জায়ান্ট।
মহাকাশ যান এখনো প্ল্যানেটরি প্লেনের যথেষ্ট বাইরে। ট্র্যাভিজের কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে ব্লিস আর পেলোরেট স্ক্রিনে দুটো পাতলা অর্ধচন্দ্রের মতো সবুজ আলোর বিন্দু দেখতে পেল।
জেনভ! পৃথিবীর সৌরজগতে চারটা গ্যাস জায়ান্ট আছে, ঠিক?
কিংবদন্তি অনুযায়ী, হ্যাঁ। পেলোরেট উত্তর দিল।
চারটার মধ্যে যেটা সূর্যের সবচেয়ে কাছে সেটা সবচেয়ে বড় এবং তারপরে যেটা কাছাকাছি সেটার বলয় আছে, ঠিক?
বিশাল এবং উজ্জ্বল বলয়, গোলান। তবে বারবার পুনরাবৃত্তির ফলে যে অতিরঞ্জন ঘটেছে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। বিশাল রিং সিস্টেমসহ কোনো গ্যাস জায়ান্ট না থাকলেই ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে পৃথিবী এখানে নেই।
যাই হোক যে দুটো দেখা যাচ্ছে ওগুলো সম্ভবত দূরের গুলো। কাছের গুলো খুব সম্ভব রয়েছে সূর্যের অপর দিকে। আমাদেরকে যেতে হবে আরো কাছে-এবং নক্ষত্রের অপর পাশে।
কাছাকাছি নক্ষত্রের ভর থাকা সত্ত্বেও সেটা করা যাবে?
যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করলে, কম্পিউটার সেটা করতে পারবে, কোনো সন্দেহ নেই। বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকলে এটা আমার নির্দেশ মানবে না। তখন সাবধানে ছোট ছোট ধাপে এগোনো যাবে।
তার মাইণ্ড কম্পিউটারকে নির্দেশনা দিল-পাল্টে গেল ভিউস্ক্রিনের স্টারফিল্ড। নির্দেশ অনুসারে আরেকটা গ্যাস জায়ান্ট খুঁজছে কম্পিউটার এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালন করল।
তিন জনই জমে গেলো মূর্তির মতো, আর বিস্ময়ের ধাক্কায় সামনের দৃশ্য ম্যাগনিফাই করার নির্দেশ কম্পিউটারকে দিতে ভুলে গেল ট্র্যাভিজ।
অদ্ভুত, বলল ব্লিস।
.
পর্দায় নতুন একটা গ্যাস জায়ান্ট দেখা যাচ্ছে,সূর্যালোকিত। সেটাকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন পদার্থ দিয়ে তৈরি বিশাল এবং উজ্জ্বল একটা বলয়। জিনিসটা গ্রহের নিজের উজ্জ্বলতার চেয়েও বেশি উজ্জ্বল এবং তার মাঝে গ্রহের এক-তৃতীয়াংশ দূরত্বের সমান পাতলা বিভক্তি রেখা।
দৃশ্যটা আরেকটু বড় করার নির্দেশ দিল ট্র্যাভিজ। স্ক্রিনে শুধু বলয় দেখা যাচ্ছে, চিকন এবং ঘন, গ্রহ অদৃশ্য হয়ে গেছে। আরেকটা নির্দেশ দিতেই স্ক্রিনের এক প্রান্তে লেজার ম্যাগনিফিকেশনের সাহায্যে গ্রহ এবং বলয়ের দৃশ্য ফুটে উঠল।
এটা কি খুব স্বাভাবিক? হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
না, ট্র্যাভিজ বলল। প্রায় প্রতিটা গ্রহেরই বিক্ষিপ্ত বলয় থাকে, কিন্তু সেগুলো হয় পাতলা এবং চিকন। একবার একটা বলয় দেখেছিলাম যেটা চিকন কিন্তু উজ্জ্বল। এটার মতো কখনো দেখিনি বা শুনিও নি।
এটা নিঃসন্দেহে কিংবদন্তির সেই রিংড জায়ান্ট। বলল পেলোরেট। যদি এটা অসাধারণ
সত্যিই অসাধারণ, আমি যত দূর জানি, বা কম্পিউটার যত দূর জানে।
তা হলে পৃথিবী এই প্ল্যানেটরি সিস্টেমেই আছে। এমন একটা গ্রহের কথা কেউ নিজে থেকে বানিয়ে বলতে পারে না, নিজের চোখে দেখতে হবে তাকে।
কিংবদন্তিতে যা বলা হয়েছে তার সব কিছু আমি এখন বিশ্বাস করতে রাজি। এটা হচ্ছে ষষ্ঠ গ্রহ, এবং পৃথিবী হবে তৃতীয় গ্রহ।
ঠিক, গোলান।
তা হলে পৃথিবী থেকে মাত্র ১.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে আছি, অথচ আমাদের থামানো হয়নি। গায়া আমাদের থামিয়েছিল।
গায়ার অনেক কাছে পৌঁছানোর পর তোমাদের থামানো হয়েছিল। বলল ব্লিস।
আহ্, ট্র্যাভিজ বলল। কিন্তু আমার মতে পৃথিবী গায়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী, এবং এটাকে আমি ভালো লক্ষণ বলে মনে করছি। যদি আমাদের না থামানো হয়, তার মানে আমরা এগিয়ে গেলে পৃথিবীর কোনো আপত্তি নেই।
অথবা পৃথিবীই নেই।
এবার বাজি ধরবে? হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ।
আসলে ব্লিস বলতে চাচ্ছে, মাঝখানে বলল পেলোরেট, যে সবাই যেমন বলেছে পৃথিবী হয়তো সত্যিই রেডিওঅ্যাকটিভ, এবং আমাদেরকে কেউ থামায়নি-কারণ পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব নেই।
না, হিংস্র গলায় বলল ট্র্যাভিজ। পৃথিবীর ব্যাপারে সব মানতে রাজি আছি, শুধু এটা বাদে। আমরা গিয়ে নিজের চোখে দেখব, এবং আমার অনুভূতি বলছে। আমাদের থামানো হবে না।
.
গ্যাস জায়ান্ট পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। গ্যাস জায়ান্টের পরে সূর্যের কাছাকাছি একটা এস্টেরয়েড বেল্ট রয়েছে। (এটা সবচেয়ে বড় এবং ওজনদার, কিংবদন্তিতে যেমন বলা হয়েছে।)
এস্টেরয়েড বেল্টের ভেতরে চারটা গ্রহ।
ভালোভাবে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করল ট্র্যাভিজ। তিন নাম্বারটা সবচেয়ে বড়।
সঠিক আয়তন, সূর্য থেকে সঠিক দূরত্ব। এটা বাসযোগ্য হতে পারে।
ট্র্যাভিজের কথায় একটা অনিশ্চয়তা ধরা পড়ল পেলোরেটের কানে।
বায়ুমণ্ডল আছে? জিজ্ঞেস করল সে।
হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ বলল। দুই, তিন এবং চার নাম্বার সবগুলোরই বায়ুমণ্ডল আছে। কিন্তু পুরোনো শিশুতোষ রূপকথাগুলোর মতো দ্বিতীয়টার ঘনত্ব খুব বেশি, চতুর্থটার ঘনত্ব যথেষ্ট নয়, কিন্তু তৃতীয়টা একেবারে নিখুঁত।
ওটা ই পৃথিবী মনে করছ?
মনে করছি? বিস্ফোরিত হল ট্র্যাভিজ। ওটাই পৃথিবী। কারণ তুমি যে বিশাল উপগ্রহের কথা বলেছিলে সেটা রয়েছে।
আছে? এবং পেলোরেটের মুখে যে চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল এমন হাসি ট্র্যাভিজ আগে দেখেনি।
নিঃসন্দেহে! তুমি নিজেই দেখো।
দুটো অর্ধচন্দ্র দেখতে পেলো পেলোরেট, একটা আরেকটার চেয়ে বড় এবং উজ্জ্বল।
ছোটোটাই উপগ্রহ? জিজ্ঞেস করল সে।
হ্যাঁ। গ্রহ থেকে অনেক দূরে; তবে এটা যে গ্ৰহটাকেই প্রদক্ষিণ করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছোট একটা গ্রহই বলা যায়; তবে ভেতরের চারটা গ্রহ থেকে ছোট। তারপরেও উপগ্রহ হিসেবে যথেষ্ট বড়। ডায়ামিটার অন্তত প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার,গ্যাস জায়ান্টগুলোকে প্রদক্ষিণরত সবচেয়ে বড় উপগ্রহের সমান।
তারচেয়ে বড় না? হতাশ হল পেলোরেট। তা হলে এটা বিশাল উপগ্রহ না।
হ্যাঁ, বিশাল। গ্যাস জায়ান্টকে প্রদক্ষিণরত দু তিন হাজার ডায়ামিটারের উপগ্রহ এক ব্যাপার, আর বাসযোগ্য গ্রহকে প্রদক্ষিণরত একই আকারের উপগ্রহ অন্য ব্যাপার। এটা প্রায় পৃথিবীর এক চতুর্থাংশের সমান। কোথাও দেখেছ এমন?
আমি আসলে এসব বিষয় খুব কম জানি। লাজুক ভঙ্গিতে বলল পেলোরেট।
তা হলে আমার কথা বিশ্বাস করো, জেনভ। এটা পৃথিবীর অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা। আমরা আসলে তাকিয়ে আছি একটা দ্বৈত গ্রহের দিকে।–জেনভ, বিশাল রিং সিস্টেমসহ ছয় নম্বর গ্রহ এবং বিশাল উপগ্রহসহ তিন নম্বর গ্রহের কথা বিবেচনা করো-দুটোই তোমার কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে। আমরা যে গ্রহের দিকে তাকিয়ে আছি সেটা পৃথিবী, অন্য কিছু হতে পারে না। আমরা পেয়েছি, জেনভ; আমারা পেয়েছি।
.
পৃথিবীর পথে অগ্রযাত্রার দ্বিতীয় দিন চলছে, এবং খাবার টেবিলে হাই তুলতে তুলতে ব্লিস বলল, আমার মনে হয় আমরা খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেছে।
আংশিক কারণ, বলল ট্র্যাভিজ, নক্ষত্রের এত কাছ থেকে জাম্প করা বিপজ্জনক। এবং এক্ষেত্রে আমরা খুব আস্তে এগোচ্ছি কারণ হঠাৎ করে সম্ভাব্য
কোনো বিপদে পড়তে চাই না।
মনে হয় তুমি বলেছিলে আমাদের থামানো হবে না।
বলেছিলাম, কিন্তু অনুভূতির উপর ভরসা করে ঝুঁকি নিতে চাই না। চামচের বস্তুগুলো মুখে ঢোকানোর আগে কিছুক্ষণ দেখল ট্র্যাভিজ; তারপর বলল, জানো, আলফার মাছের স্বাদ এখনো ভুলতে পারছি না। মাত্র তিন বার খেয়েছিলাম।
সত্যিই খারাপ লাগছে, বলল পেলোরেট।
আমরা পাঁচটা গ্রহে গিয়েছি, বলল ব্লিস, কিন্তু সেখান থেকে এত দ্রুত চলে আসতে হয়েছে যে আমাদের খাদ্যের সরবরাহের সাথে নতুন বৈচিত্র্য যোগ করার সময়ই পাইনি। অথচ প্রতিটা গ্রহ থেকেই খাবার আনা যেত। কমপরেলন, আলফা এবং সম্ভবত–
কথাটা শেষ করতে পারল না সে, কারণ ফেলম দ্রুত মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে, সোলারিয়া? ওখানে খাবার পাওনি? প্রচুর খাবার ছিল। আলফার মতো এবং ভালো।
আমি জানি, ফেলম। আসলে সময় ছিল না।
তার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকল ফেলম। আমি আবার জেম্বিকে দেখতে পারব, ব্লিস? সত্যি কথা বল।
হয়তো, যদি আমরা সোলারিয়ায় ফিরি।
আমরা আবার কবে সোলারিয়ায় ফিরব?
দ্বিধা করল ব্লিস, আমি বলতে পারি না।
এখন আমরা যাচ্ছি পৃথিবীতে, ঠিক? তুমি বলেছিলে আমাদের সবার সৃষ্টি হয়েছে ওই গ্রহে, তাই না?
সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি হয়েছিল। বলল ব্লিস।
আমি পিতৃপুরুষ বলতে পারি, ফেলম বলল।
হ্যাঁ, আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছি।
কেন?
হালকা গলায় বলল ব্লিস, পিতৃপুরুষদের গ্রহ দেখার আগ্রহ সবারই থাকে, তাই না?
কিন্তু আমার মনে হয় বিষয়টা অন্য কিছু। সবাই খুব চিন্তিত।
আমরা তো কখনো সেখানে যাইনি। জানি না সেখানে কী আছে।
আমার মনে হয় আসল ব্যাপার তাও না, আরো বড় কিছু।
হাসল ব্লিস। তোমার খাওয়া শেষ হয়েছে, ফেলম। এবার একটু বাঁশি বাজিয়ে শোনাও। দিনে দিনে তোমার বাজানো আরো সুন্দর হচ্ছে। যাও যাও। পিঠে আদরের চাপড় দিল সে, আর ফেলম যেতে যেতে একবার ঘুরে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকালো ট্র্যাভিজের দিকে।
বিতৃষ্ণা নিয়ে তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ। ওই বস্তুটা কি মাইণ্ড পড়তে পারে?
ওকে বস্তু বলবে না ট্র্যাভিজ। ধারালো গলায় বলল ব্লিস।
সে মাইণ্ড পড়তে পারে? তোমার জানা উচিত।
না, পারে না। গায়া পারে না, এমনকি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনাররাও পারে না। মাইণ্ড রিডিং অনেকটা আড়াল থেকে গোপন কথা শুনে ফেলার মতো যা এখন আর করা হয় না বা ভবিষ্যতেও করা হবে না। আমরা শনাক্ত করতে পারি, ব্যাখ্যা করতে পারি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগ পরিচালনা করতে পারি। কিন্তু দুটো এক জিনিস নয়।
যা করা যাবে না ফেলম সেটা করতে পারবে না তুমি কীভাবে জানো?
কারণ তুমি এইমাত্র বলেছ যে আমার জানা উচিত।
হয়তো সে তোমাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই বুঝতে পারছ না যে সে করতে পারে অনেক কিছুই।
চোখ কপালে তুলল ব্লিস, যুক্তির কথা বল, ট্র্যাভিজ। ফেলমের অস্বাভাবিক ক্ষমতা থাকলেও আমার কিছু করতে পারবে না, কারণ আমি ব্লিস নই, আমি গায়া। কথাটা তুমি বারবার ভুলে যাও। পুরো একটা গ্রহে কি পরিমাণ মেন্টাল পাওয়ার জমা হয়ে থাকে তুমি জানো? তোমার ধারণা একজন আইসোলেট, বুদ্ধি যত তীক্ষ্ণই হোক সেই শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে?
সবকিছু জানো না তুমি, ব্লিস, কাজেই অতিরিক্ত আরবিশ্বাসী হয়ে উঠো না। রাগত সুরে বলল ট্র্যাভিজ। ঐ বস-সে আমাদের সাথে আছে বেশি দিন হয়নি। এই সময়ের ভেতর আমি ওর ভাষার অল্প কয়েকটা শব্দ ছাড়া কিছুই শিখতে পারিনি, কিন্তু সে নিখুঁতভাবে গ্যালাকটিক বলতে পারে, প্রায় সব শব্দ শিখে ফেলেছে। জানি তুমি তাকে সাহায্য করছ, কিন্তু আমি চাই তুমি সেটা বন্ধ কর।
বলেছি আমি তাকে সাহায্য করছি সেই সাথে এটাও বলেছি যে সে অসম্ভব রকম বুদ্ধিমতী। এত বেশি বুদ্ধিমতী যে আমি তাকে গায়ার অংশ করে নেওয়ার কথা ভাবছি; যদি সম্ভব হয়। আমরা অনেক কিছু শিখতে পারব, তখন পুরো সোলারিয়া গ্রহ এবজর্ব করা সহজ হবে। তাতে আমাদেরই লাভ।
তুমি ভেবে দেখেছ সোলারিয়ানরা আমার চেয়েও অনেক বেশি প্যাথলজিক্যাল আইসোলেট?
গায়ার অংশ হলে আর এমন থাকবে না।
ভুল করছ, ব্লিস। আমার মতে ঐ সোলারিয়ান শিশু বিপজ্জনক এবং তার হাত থেকে আমাদের ছাড়া পেতে হবে। . কীভাবে? এয়ার লক খুলে বাইরে ফেলে দেব? মেরে ফেলব তারপর কেটে টুকরো টুকরো করে খাবার জন্য তুলে রাখব?
ওহ্ ব্লিস। বলল পেলোরেট।
ট্র্যাভিজ বলল, জঘন্য, এই কথা আমি আশা করিনি। চুপ করে কিছুক্ষণ শুনল সে, ফেলমের বাঁশির সুর আরবিশ্বাসী এবং কোনো কম্পন নেই, গলার স্বর প্রায় ফিসফিসানির পর্যায়ে নামিয়ে আনল তারা। হাতের কাজটা যখন শেষ হবে, আমরা তাকে সোলারিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব, এবং ব্যবস্থা করব যেন সোলারিয়া চিরজীবনের জন্য বাকি গ্যালাক্সি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার মতে গ্রহটাকে ধ্বংস করে ফেলা উচিত। ওদেরকে আমি বিশ্বাস করি না, ভয় পাই।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে ব্লিস বলল, ট্র্যাভিজ, আমি জানি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুর্লভ ক্ষমতা তোমার আছে, কিন্তু এটাও জানি প্রথম থেকেই তুমি ফেলমকে পছন্দ করছে না। তার কারণ আমার মতে সোলারিয়া তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি, এবং তুমি সেইজন্য মনের ভেতর ঐ গ্রহ এবং তার বাসিন্দাদের জন্য ঘৃণা পুষে রেখেছ। যেহেতু আমি তোমার মাইন্ডে প্রবেশ করিনি, তাই নিশ্চিত বলতে পারব না। দয়া করে মনে রাখবে ফেলম না থাকলে এখন আমরা আলফায় থাকতাম-এবং সম্ভবত মৃত।
আমি জানি, ব্লিস, কিন্তু তারপরেও—
আর তার বুদ্ধিমত্তাকে হিংসা না করে বরং প্রশংসা করা উচিত।
আমি তাকে হিংসা করি না। তাকে ভয় পাই।
তার বুদ্ধিমত্তাকে?
জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল ট্র্যাভিজ। চিন্তিত। না, ঠিক তা নয়।
তা হলে কী?
আমি জানি না, ব্লিস, জানলে হয়তো আর ভয় পেতাম না। ব্যাপারটা এমন কিছু যা আমার বোঝার বাইরে। তারপর গলার স্বর কমে গেল, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে, আমি বুঝি না এমন জিনিসের সংখ্যাই বোধহয় গ্যালাক্সিতে বেশি। কেন গায়া বেছে নিলাম? কেন পৃথিবী আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে? সাইকোহিস্টোরিতে কি অজানা কোনো অনুমিতি আছে? থাকলে সেটা কি? আর সবচেয়ে বড় কথা ফেলম কেন আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়?
দুর্ভাগ্যক্রমে, তোমার একটা প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। বলল ব্লিস, তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আছে পেলোরেট, বলল, নিঃসন্দেহে আর বেশিক্ষণ অন্ধকারে থাকতে হবে না, গোলান। আমরা ক্রমেই পৃথিবীর কাছে এগিয়ে যাচ্ছি, একবার পৌঁছে গেলে সব রহস্যের মীমাংসা হবে আশা করি। কেউ আমাদের বাধা দিয়ে থামাতে পারবে না।
ঝট করে পেলোরেটের দিকে তাকাল ট্র্যাভিজ, নিচু গলায় বলল, আমি চাই কিছু একটা বাধা দিক আমাদের।
তুমি চাও? কেন?
জীবনের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলে খুশি হব।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল পেলোরেট, পৃথিবী সত্যি সত্যিই রেডিওঅ্যাকটিভ?
হ্যাঁ বা না বলা অসম্ভব। তবে গ্রহটা উষ্ণ। আমি যা আশা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি উষ্ণ।
খারাপ লক্ষণ?
না। হয়তো একটু বেশি উষ্ণ, কিন্তু তারমানে এই না যে বাস করা অসম্ভব, পাতলা মেঘস্তর এবং নিঃসন্দেহে সেগুলো জলীয় বাষ্পের তৈরি, ফলে মেঘ এবং মহাসাগর মিলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা সত্ত্বেও জীবন ধারনের পরিবেশ তৈরি করতে পারবে। এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। কারণ
হ্যাঁ, গোলান?
যদি পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ হয়, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণ হবে সেটাই।
কিন্তু অন্যভাবেও বলা যায় যে আশাতীত তাপমাত্রা থাকলেই সেটাকে রেডিওঅ্যাকটিভ বলা যবে না।
না, অবশ্যই না। জোর করে একটু হাসল ট্র্যাভিজ। জল্পনা কল্পনা করে লাভ নেই, জেনভ। এক বা দুই দিনের ভেতরেই সব নিশ্চিত করে বলা যাবে।
.
ব্লিস যখন ভিতরে ঢুকল তখন বিছানায় বসে কি যেন গভীর চিন্তা করছিল ফেলম। একবার তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিল সে।
কী হয়েছে ফেলম? শান্ত গলায় বলল ব্লিস।
ট্র্যাভিজ আমাকে অপছন্দ করে কেন, ব্লিস? ফেলম বলল।
কেন মনে হলো ও তোমাকে অপছন্দ করে?
আমার দিকে সে অধৈর্য হয়ে তাকায়-শব্দটা ঠিক আছে?
হয়তো।
আমি কাছে গেলেই সে আমার দিকে অধৈর্য হয়ে তাকায়। তার মুখ সবসময় বাঁকা হয়ে থাকে।
ট্র্যাভিজ আসলে একটা কঠিন সময় পার করছে, ফেলম।
কারণ সে পৃথিবী খুঁজছে?
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ ভাবল ফেলম, তারপর বলল, বিশেষ করে আমি যখন কোনো জিনিস নড়ানোর চেষ্টা করি তখন সে বেশি অধৈর্য হয়।
একটু কঠিন হলো ব্লিস। শোনা ফেলম, আমি তোমাকে বলেছি এরকম করবেনা, বিশেষ করে যখন ট্র্যাভিজ আশপাশে থাকবে?
গতকাল এই কামরায় আমি পেল এর একটা বুক ফিল্ম পায়ার উপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলাম। সে দরজায় দাঁড়িয়ে নজর রাখছিল, আমি খেয়াল করিনি। কিন্তু আমি তো কোনো ক্ষতি করছিলাম না।
এতে সে নার্ভাস হয়ে পড়ে, ফেলম, এবং আমি চাই সে নজর রাখুক বা না রাখুক, তুমি এমন করবে না।
নিজে করতে পারেনা বলেই সে নার্ভাস হয়?
সম্ভবত।
তুমি পারবে?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ব্লিস, না, পারব না।
তুমি বা পেল তো নার্ভাস হও না।
মানুষ সবাই একরকম হয় না।
আমি জানি, কঠিন গলায় বলল ফেলম, ফলে ব্লিসের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।
কী জানো, ফেলম?
আমি অন্যরকম।
অবশ্যই, আমি তো এইমাত্র বললাম। মানুষ সবাই এক রকম হয় না?
আমার গঠন অন্য রকম। আমি জিনিস নড়াতে পারি।
সত্যি কথা।
খানিকটা বিদ্রোহের সুরে ফেলম বলল, আমাকে অবশ্যই জিনিস নাড়াতে হবে, এবং ট্র্যাভিজ রাগ করতে পারবে না, তুমিও আমাকে বাধা দিতে পারবে না।
কিন্তু তোমাকে কেন জিনিস নাড়তে হবে?
অনুশীলন। এক্সারসজি।–শব্দটা ঠিক আছে?
না। হবে এক্সারসাইজ।
হ্যাঁ। জেম্বি সবসময় বলত আমার-আমার—
ট্রান্সডিউসার লোবস?
হ্যাঁ। প্রশিক্ষণ দিয়ে সেগুলোকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, তারপর বড় হলে আমি সবগুলো রোবটকে পাওয়ার সাপ্লাই করতে পারব। এমনকি জেম্বিকেও।
ফেলম, তুমি পাওয়ার সাপ্লাই করলে কে করবে?
ব্যাণ্ডার। দ্বিধাহীন গলায় উত্তর দিল ফেলম।
তুমি ব্যাণ্ডারকে চেন?
অবশ্যই। অনেকবার দেখেছি। পরবর্তী এস্টেট হেড হওয়ার কথা ছিল আমার। ব্যাণ্ডার-এস্টেট এর নাম হতো ফেলম-এস্টেট। জেম্বি সেরকমই বলেছিল।
তার মানে ব্যাণ্ডার তোমার কাছে-
আতঙ্কে বিকট হাঁ করল ফেলম। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ব্যাণ্ডার কখনোই আমার কাছে-দৌড়ে ঘরের এক কোনায় চলে গেল সে, জোরে কয়েকবার শ্বাস টানল, তারপর বলল, আমি বেণ্ডার এর ইমেজ দেখেছি।
তোমার সাথে ব্যাণ্ডার এর আচরণ কেমন ছিল? আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
একটু অবাক হয়ে ব্লিসের দিকে তাকাল ফেলম। ব্যাণ্ডার জিজ্ঞেস করত আমার কিছু লাগবে কি না; আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। কিন্তু জেম্বি সবসময়ই আমার পাশে থাকত, ফলে আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না, বা অসুবিধাও হতো না।
মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকাল সে। তারপর চোখের উপর হাত রেখে বলল, কিন্তু জেম্বি থেমে গেছে। তার কারণ আমার মনে হয় ব্যাণ্ডারও-থেমে গেছে।
কেন মনে হয়? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
ব্যাণ্ডার সবগুলো রোবটকে পাওয়ার সাপ্লাই করত। যদি জেম্বিসহ সব রোবট থেমে যায় তার মানে ব্যাণ্ডারও থেমে গেছে। তাই না?
ব্লিস নিশ্চুপ।
কিন্তু তুমি যখন আমাকে সোলারিয়ায় নিয়ে যাবে আমি জেম্বিসহ সব রোবট চালু করব। আমি আবার খুশি হব।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
তুমি আমাদের সাথে খুশি নও, ফেলম? একটুও না?
চোখের পানিতে লেপটানো মুখ তুলল ফেলম। কান্নাভেজা স্বরে বলল, আমি জেম্বিকে চাই।
মমতায় আর্দ্র হয়ে গেল ব্লিসের মন, দুহাত বাড়িয়ে অবুঝ শিশুকে জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে। ওহ, ফেলম, যদি তোমার জেম্বিকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম, এবং হঠাৎ করেই বুঝতে পারল সে নিজেও কাঁদছে।
.
পেলোরেট তাদেরকে সেই অবস্থাতেই পেল, মাঝপথে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
নিজেকে আলাদা করল ব্লিস, ছোট টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে মাথা নাড়ল। পেলোরেট আবারও জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
ফেলম, একটু বিশ্রাম নাও। বলল ব্লিস। মনে রাখবে আমিও তোমাকে জেম্বির মতো ভালবাসি।
পেলোরেটের কনুই ধরে টেনে নিয়ে এল লিভিং রুমে। কিছু না, পেল–কিছু না।
ফেলম,তাই না? জেম্বিকে খুঁজছে?
ভীষণভাবে। অথচ কিছু করার নেই। শুধু বলতে পারি আমি তাকে ভালবাসি-এবং কথাটা সত্যি। এমন চমৎকার আর বুদ্ধিমতী একটা শিশুকে ভাল না বেসে পারা যায়? ভয়ংকর রকম বুদ্ধিমতী। ট্র্যাভিজ মনে করে খুব বেশি বুদ্ধিমতী। ব্যাণ্ডারকে দেখেছে সে-বা, বলা যায় হলোগ্রাফিক ইমেজ দেখেছে। তবে সেটা নিয়ে। খুব বেশি উচ্ছ্বসিত নয় সে। বুঝতে পারছি কেন। আসলে ব্যাণ্ডার ছিল এস্টেটের মালিক আর তার পরে মালিক হতো ফেলম। দুজনের ভেতর সম্পর্ক বলতে এইটুকুই, আর কিছু না।
ফেলম জানে ব্যাণ্ডার তার বাবা?
মা। যদি ফেলমকে মেয়ে ভাবি তা হলে ব্যাণ্ডারকেও তাই ভাবতে হবে।
অথবা দুটোই, ব্লিস ডিয়ার। ফেলম কি পেরেন্টাল রিলেশনশিপের কথা জানে?
বাবা-মা ব্যাপারটাই সম্ভবত সে বোঝে না, আর বুঝলেও প্রকাশ করেনি। যাই হোক, পেল, যুক্তি দিয়ে সে বুঝে ফেলেছে যে ব্যাণ্ডার মরে গেছে। আমি ভয় পাচ্ছি ।
চিন্তিত গলায় বলল পেলোরেট, কেন, ব্লিস?
এক সময় মৃত্যুর আসল কারণটাও বুঝতে পারবে। সোলারিয়ার দীর্ঘজীবী এবং আইসোলেট স্পেসারদের সমাজে স্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চয়ই কম এবং অস্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে কোনো শিশুর জন্য তো অবশ্যই একটু চিন্তা করলেই ফেলম বুঝতে পারবে যে ব্যান্ডার ঠিক সেই সময়ে মারা গেছে যখন আমরা কয়েকজন আগন্তুক তার গ্রহে ছিলাম। তারপর আসল কারণ বুঝতে আর সমস্যা হবে না।
আমরা ব্যাণ্ডারকে হত্যা করেছি?
আমরা ব্যাণ্ডারকে হত্যা করিনি। করেছি আমি।
সে বুঝতে পারবে না।
কিন্তু বলতে হবে। ট্র্যাভিজের উপর সে প্রচণ্ড বিরক্ত, এবং এই অনুসন্ধানের নেতা ট্র্যাভিজ। কাজেই সে ধরে নেবে ব্যান্ডারের মৃত্যুর জন্য দায়ী ট্র্যাভিজ। সেটা অবিচার হবে।
কী আসে যায় তাতে, ব্লিস? রোবট ছাড়া পি–মাতার প্রতি এই শিশুর কোনো অনুভূতিই নেই।
কিন্তু মায়ের মৃত্যুর মানেই হচ্ছে তার রোবটের মৃত্যু। আমি মন স্থির করে ফেলেছি।
কেন?
নিজে যুক্তি বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করলে আসল কারণটা সে বুঝতে পারবে না। তাই আমি নিজে ব্যাখ্যা করে বলব যেন তাকে শান্ত রাখতে পারি।
কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে আত্মরক্ষা। তুমি না ঠেকালে আমরা তখনই মারা যেতাম।
সে কথা আমি বলব, কিন্তু ভয় হচ্ছে আমার কথা বিশ্বাস করবে না।
মাথা নাড়ল পেলোরেট, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মনে হচ্ছে ফেলমকে না আনলেই ভালো হতো। কষ্ট পাচ্ছ তুমি।
না, রাগী গলায় বলল ব্লিস। ওই কথা বলবেনা। যখনই মনে পড়ত যে আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার জন্য ওখানে একটা নিষ্পাপ শিশুকে নৃশংস মৃত্যুর মুখে ফেলে এসেছি, তখন কষ্ট হতো আরো বেশি।
কিন্তু ওটাই ফেলমের গ্রহের নিয়ম।
শোন, পেল, ট্র্যাভিজের মতো করে ভাববে না। আইসোলেটরা চিন্তা না করেই সব কিছু মেনে নেয়। গায়ার নীতি জীবন রক্ষা করা-ধ্বংস করা নয়। সকল ধরনের জীবনেরই পরিসমাপ্তি ঘটবে যেন নতুন জীবনের উদ্ভব ঘটতে পারে, কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে যেন শেষ না হয়। ব্যান্ডারের মৃত্যু যদিও এড়ানো যেত না, কিন্তু ফেলমেরটা সম্ভব হয়েছে।
বেশ। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। যাই হোক আমি ফেলমের সমস্যা নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি। ব্যাপার হচ্ছে ট্র্যাভিজ।
কী হয়েছে ট্র্যাভিজের?
ব্লিস, আমি ওকে নিয়ে চিন্তিত। এখন অপেক্ষা করছে পৃথিবীর ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে। ধকলটা সইতে পারবে কি না বুঝতে পারছি না।
ওকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই । জানি ওর একটা দৃঢ় মাইণ্ড আছে।
কিন্তু সবারই সহ্যের একটা সীমা থাকে । ও আমাকে বলেছে, যা আশা করেছিল পৃথিবী তার চেয়ে বেশি উত্তপ্ত। আমার মনে হয় সে ভাবছে যে জীবন ধারনের জন্য বেশি উত্তপ্ত, যদিও জোর করে অবিশ্বাস করতে চাইছে।
হয়তো ঠিকই বলেছে। হয়তো জীবন ধারণের জন্য বেশি উত্তপ্ত না।
আবার এটাও বলেছে যে রেডিওঅ্যাকটিভিটি অতিরিক্ত উত্তাপের কারণ হতে পারে, এবং জোর করে সেটাও অবিশ্বাস করছে। এক বা দুই দিনের মধ্যেই আমরা যথেষ্ট কাছে চলে যাবো। তখন সব পরিষ্কার বোঝা যাবে। যদি পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ হয়, কী হবে তখন?
তখন ব্যাপারটা তাকে মেনে নিতে হবে।
কিন্তু-মেন্টাল টার্ম অনুযায়ী কীভাবে বলা যায় জানি না-যদি তার মাইণ্ড
অপেক্ষা করল ব্লিস, তারপর ক্লান্ত সুরে বলল, বিস্ফোরিত হয়?
হ্যাঁ, যদি বিস্ফোরিত হয়। তাকে সবল রাখার জন্য এখনই কিছু করতে পারো? শান্ত এবং নিয়ন্ত্রণের ভেতর রাখতে পারো।
না, পেল। আমার মনে হয় না ট্র্যাভিজ এত দুর্বল। আর গায়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত তার মাইন্ড আমরা স্পর্শ করব না।
কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা অস্বাভাবিক গুণ আছে তার। এতদিনের পরিকল্পনা মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেলে হয়তো মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু এই অস্বাভাবিক গুন নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল ব্লিস, তারপর কাধ নেড়ে বলল, বেশ, আমি তার দিকে লক্ষ রাখব।
.
পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টা ব্লিস এবং পেলোরেটের কথা ট্র্যাভিজের প্রায় মনেই থাকল না। মাঝে মধ্যে অবশ্য তাদের হালকা পদশব্দ পেয়েছে, এরকম ছোট মহাকাশযানে সেটাই স্বাভাবিক।
এখন সে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে,দরজায় দাঁড়ানো দুজনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন হলো। ভাবলেশহীন পাথুরে মুখ তুলে তাকাল সে।
বেশ? শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট, কেমন আছো, গোলান?
ব্লিসকে জিজ্ঞেস কর। গত কয়েক ঘণ্টা সে আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত আমার মাইণ্ড ছিদ্র করেছে-তাই না, ব্লিস?
না, স্বাভাবিক গলায় বলল ব্লিস। কিন্তু তোমার যদি আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয়, চেষ্টা করতে পারি।–লাগবে?
না, কেন লাগবে? আমাকে একা থাকতে দাও। দুজনেই।
কী ঘটেছে আমাদের বল দয়া করে। বলল পেলোরেট।
অনুমান করো!
পৃথিবী–
হ্যাঁ, তাই । এতদিন ধরে সবাই যা বলছিল সেটাই সত্যি। ভিউস্ক্রিনের দিকে দেখাল সে। যেখানে পৃথিবীর রাতের অংশের প্রতিচ্ছবি ফুটে আছে, সূর্যটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। বিস্তৃত কালো আকাশের বিপরীতে একটা নিখুঁত বৃত্ত, কমলা রঙের আলোর ভঙ্গুর আভার কারণে বৃত্তের পরিধি বোঝা যাচ্ছে ।
কমলা আভাটাই রেডিওঅ্যাকটিভিটি?
না। বায়ুমণ্ডলে প্রতিফলিত সূর্যের আলো। বায়ুমণ্ডল আরো পাতলা হলে পুরোটাই কমলা রঙের বৃত্তের মতো দেখাতো। রেডিওঅ্যাকটিভিটি দেখা যাবে না । সব ধরনের বিকিরণ এমনকি গামা রশ্মির বিকিরণ পর্যন্ত বায়ুমন্ডল শোষণ করে নিচ্ছে। তবে সেকেণ্ডারি রেডিয়েশন কম্পিউটার সনাক্ত করতে পারছে।
রেডিওএ্যাকটিভিটি কি মাত্রায় আছে? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
বুদ্ধিমান জীব বসবাস না করার মতো যথেষ্ট?
কোনো ধরনের জীবন নেই। গ্রহটা পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য। সর্বশেষ ব্যাকটেরিয়া, সর্বশেষ ভাইরাস ও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই।
আমরা নামতে পারব? বলল পেলোরেট। মানে স্পেস স্যুট পড়ে?
মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য।
এখন কী করব, গোলান?
করব? আবারো সেই ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকালো ট্র্যাভিজ। জানো কী করতে চাই? ব্লিস, ফেলম আর তোমাকে গায়ায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে যেতে চাই টার্মিনাসে। তারপর মহাকাশ যান ফিরিয়ে দিয়ে পদত্যাগ করতে চাই কাউন্সিল থেকে, মেয়র ব্র্যান্নো খুব খুশি হবে তাতে। তারপর পেনশন নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। সেলডন প্ল্যান, ফাউণ্ডেশন, সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন, গায়া নিয়ে আর ভাবতে চাই না। গ্যালাক্সি তার নিজের পথ বেছে নিক। আমার জীবদ্দশাতে এটা ধ্বংস হবে না। কাজেই পরে কি ঘটবে সেটা নিয়ে কেন মাথা ঘামাব আমি?
নিশ্চয়ই তুমি তা করবে না? জরুরি ভঙ্গিতে বলল পেলোরেট।
পেলোরেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ। তারপর বলল, না, করব না। তবে যা বলেছি সেগুলো করতে পারলে খুব খুশি হতাম।
কিছু মনে করো না, কী করবে তুমি?
মহাকাশ যান পৃথিবীর কক্ষপথে রাখব। ধাক্কাটা একটু সামলে নিয়ে চিন্তা করব কী করা যায়। শুধু
হ্যাঁ?
এবং চিৎকার করে উঠল ট্র্যাভিজ, এর পরে আমি কী করতে পারি? আর কি দেখার আছে? আর কি খোঁজার আছে?
.
২০. নিকট বিশ্ব
চারবারের মধ্যে মাত্র একবার খাবার টেবিলে দেখা গেল ট্র্যাভিজকে। বাকি সময়টা কাটাল পাইলট রুমে বা বেডরুমে । খাবার সময় সে ছিল নিশ্চুপ। খেলোও কম।
যাই হোক পেলোরেটের মনে হলো ট্র্যাভিজের অস্বাভাবিক গম্ভীর ভাব বেশ। অনেকটা কমেছে। দুবার গলা খাকারি দিল যেন কথা বলবে, তারপর হাল ছেড়ে দিল ।
শেষ পর্যন্ত ট্র্যাভিজই চোখ তুলে তাকাল তার দিকে, বেশ?
তুমি-তুমি কী করবে ভেবেছ, গোলান?
কেন জিজ্ঞেস করছ?
তোমাকে একটু কম বিষণ্ণ মনে হচ্ছে।
আমার বিষণ্ণতা কমেনি, তবে বেশ ভালোভাবেই চিন্তাভাবনা করেছি।
আমরা জানতে পারি?
ঝট করে একবার ব্লিসের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে ব্লিস, চুপচাপ, যেন বুঝতে পারছে এরকম স্পর্শকাতর মুহূর্তে তার চেয়ে পেলোরেট বেশি সুবিধা করতে পারবে।
তুমিও জানতে চাও, ব্লিস? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
চট করে একবার মাথা তুলল সে, হ্যাঁ, অবশ্যই।
টেবিলের একটা পায়ায় বেশ ভাবের সাথে লাথি মেরে ফেলম বলল, পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি আমরা?
কাঁধে চাপ দিয়ে তাকে শান্ত করল ব্লিস, আর ট্র্যাভিজ পাত্তাই দিল না।
সে বলল, আসল কথা হচ্ছে পৃথিবীর সব রেকর্ড বিভিন্ন গ্রহ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে একটা উপসংহারে পৌঁছতে আমরা বাধ্য। পৃথিবীতে কিছু একটা লুকানো আছে। অথচ নিজের চোখেই দেখতে পারছি গ্রহটা ভয়ংকর রকম রেডিওঅ্যাকটিভ। ফলে সেখানে কিছু লুকানো হলে সেটা এমনিতেই গোপন থাকবে। ওখানে কেউ ল্যান্ড করতে পারবে না। আমরা এখন ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের শেষ সীমায় আছি, এর চেয়ে আর কাছে যাওয়া যাবে না, ওখানে খুঁজে পাওয়ার মতো কিছু নেই।
তুমি নিশ্চিত? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
আমি পুরো সময়টাই কম্পিউটারের সামনে বসে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছি। এবং আমি নিশ্চিত কোনো উপায় নেই। বড় কথা, আমার অনুভূতি বলছে ওখানে কিছু নেই। তা হলে কেন পৃথিবীর সব রেকর্ড মুছে ফেলা হলো। নিঃসন্দেহে যাই। লুকানো হোক সেটা আমাদের কল্পনাতীত কোনো উপায়ে লুকানো হয়েছে, এবং সেজন্য মানুষ সেখানে না থাকলেও চলবে।
হতে পারে, বলল পেলোরেট, পৃথিবীতে কিছু লুকানো আছে। যখন সেটা এত রেডিওঅ্যাকটিভ ছিল না তখন পৃথিবীবাসীরা ভয় পেয়েছিল হয়তো বাইরের গ্রহের অনুপ্রবেশকারীরা তাদের গুপ্তধন নিয়ে যাবে, তাই ভালোভাবে লুকিয়ে ফেলে। আর হয়তো সেই সময় থেকেই নিজের যাবতীয় রেকর্ড আস্তে আস্তে সরাতে থাকে।
না, আমার তা মনে হয় না, বলল ট্র্যাভিজ। গ্যালাকটিক লাইব্রেরি এবং টার্মিনাস থেকে তথ্যগুলো সরানো হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। হঠাৎ করে ব্লিসের দিকে ঘুরল সে, আমি ঠিক বলেছি?
দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার জেনডিবলের বিক্ষিপ্ত মাইণ্ড থেকে সেটা আমরা জেনেছি, স্বাভাবিক গলায় বলল ব্লিস, যখন সে, তুমি এবং আমি টার্মিনাসের মেয়রের সাথে মিটিং করছিলাম।
ট্র্যাভিজ বলল, কাজেই যা গোপন, সেটা এখনো গোপন আছে এবং খুঁজে বের করাও যাবে, কিন্তু এখন খুঁজে বের করতে গেলে রেডিওঅ্যাকটিভিটি ছাড়াও অন্য বিপদ আছে।
সেটা কীভাবে সম্ভব? উদ্বিগ্ন গলায় বলল পেলোরেট।
ভেবে দেখ গোপন জিনিসটা যদি পৃথিবীতে না থাকে, রেডিওঅ্যাকটিভিটি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়ে থাকে? কিন্তু আমরা যদি পৃথিবী খুঁজে পাই তা হলে ঠিকই বের করে ফেলতে পারব বস্তুটা কোথায় লুকানো আছে। যদি তাই হয় তা হলে বলা যায় আমরা এখনো পৃথিবী খুঁজে পাইনি।
মাঝখানে আবারো কথা বলল ফেলম, পৃথিবী খুঁজে না পেলে ব্লিস বলেছিল তুমি আমাকে জেম্বির কাছে নিয়ে যাবে।
ফেলমের দিকে ঘুরে রাগের সাথে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ-আর ব্লিস নিচুগলায় বলল, আমি বলেছি চেষ্টা করব, ফেলম। পরে কথা বলব এটা নিয়ে, এখন ঘরে গিয়ে পড়, বাঁশি বাজাও বা যা ইচ্ছা হয় কর।
মুখ গোমড়া করে চলে গেল ফেলম।
এটা কীভাবে বললে, গোলান? এইতো আমরা এখানে। পৃথিবী খুঁজে বের করেছি। এখন কি বলবে লুকানো জিনিসটা এখানে নেই বলেই এটা পৃথিবী না?
রাগ দমন করতে একটু সময় লাগল ট্র্যাভিজের। তারপর বলল, চিন্তা করে দেখ, রেডিওঅ্যাকটিভিটি দ্রুত বাড়ছে। মৃত্যু এবং আশ্রয়ের সন্ধানে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে মহাকাশে। ফলে কমে যাচ্ছে জনসংখ্যা। তাদের গোপন বিষয়ের বিপদ আরো বেশি। সেটা রক্ষা করার জন্য কে থাকবে? স্বভাবতই সেটা অন্য গ্রহে স্থানান্তর করতে হবে। নইলে পৃথিবীর সাথে শেষ হয়ে যাবে। এবং আমার ধারণা সরানো হয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তে। এবার জেনভ, নিউ আর্থের বুড়ো তোমাকে কি বলেছিল সেটা মনে করো।
মনোলী?
হ্যাঁ। নিউ আর্থে বসতি স্থাপনের ব্যাপারে সে তোমাকে বলেনি যে পৃথিবীতে অবশিষ্ট যা ছিল তার সবই এই গ্রহে নিয়ে আসা হয়?
তুমি বলতে চাও, ওল্ড চ্যাপ, আমরা যা খুঁজছি তা আছে এখন নিউ আর্থে? সবার শেষে যে অধিবাসীরা পৃথিবী ত্যাগ করেছে তারা নিয়ে এসেছে?
হতে পারে না? বলল ট্র্যাভিজ। নিউ আর্থ পৃথিবীর মতোই গ্যালাক্সিতে অপরিচিত এবং অধিবাসীরা যে-কোনো মূল্যে আউটওয়ার্ল্ডারদের আগমন ঠেকিয়ে রাখতে চায়।
আমরা সেখানে ছিলাম, মাঝখানে বলল ব্লিস, কিছু পাইনি।
পৃথিবীর অবস্থান ছাড়া আমরা অন্য কিছু খুঁজছিলাম না।
হতভম্ব গলায় বলল পেলারেট, কিন্তু আমরা খুঁজছিলাম একটা হাই টেকনোলজি; এমন কিছু যারা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের নাকের ডগা থেকে এমনকি-মাফ করবে, ব্লিস-গায়ার নাকের ডগা থেকে পর্যন্ত সব তথ্য সরিয়ে ফেলতে পারে। আলফার অধিবাসীরা হয়তো তাদের একটুকরো জমির উপরের আকাশের ওয়েদার কন্ট্রোল করতে পারে, হয়তো বায়োটেকনোলজিতে অনেক উন্নত, কিন্তু আমার মনে হয় তুমি স্বীকার করবে যে সামগ্রিকভাবে তাদের টেকনোলজি অনেক নিচু মানের।
মাথা নাড়ল ব্লিস, আমি পেলের সাথে একমত।
অল্প একটু দেখেই আমরা বিচার করছি, বলল ট্র্যাভিজ। ফিশিংফ্লিটের সাথে যারা ছিল আমরা দেখিনি তাদের। যেখানে ল্যাণ্ড করেছি সেই জায়গাটা ছাড়া দ্বীপের অন্য কোনো অংশ আমরা দেখিনি। ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে কি পেতাম? ফুরোসেন্টগুলো জ্বলার আগে আমরা তো বুঝতেই পারিনি ওগুলো কী, তাই যদি দেখানো হয় যে টেকনোলজি খুব নিচুমানের । আমি বলছি যদি দেখানো হয়।
হ্যাঁ, আগ্রহের সাথে বলল ব্লিস।
তার কারণ সম্ভবত আসল সত্যটাকে গোপন করে রাখা। অসম্ভব।
অসম্ভব?
তুমিই তো বলেছিলে, ট্রানটরের অল্প কয়েকজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারকে লুকিয়ে রাখার জন্য অধিকাংশ জনগণ ইচ্ছাকৃতভাবে অনুন্নত অবস্থায় থাকে । নিউ আর্থ একই কৌশল অবলম্বন করলে ক্ষতি কি?
তা হলে তোমার পরামর্শ, আমরা আবার নিউ আর্থে ফিরে যাবো-এবার যাবো ভাইরাস অ্যা্যাকটিভেট করার জন্য? শারীরিক সম্পর্ক হয়তো জীবাণু ছড়ানোর চমৎকার মাধ্যম, কিন্তু একমাত্র মাধ্যম না।
কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। নিউ আর্থে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, তবে হয়তো যেতে হবে।
হয়তো?
হয়তো। কারণ আরেকটা সম্ভাবনা আছে।
সেটা কী?
নিউ আর্থ যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে তার নাম আলফা। আলফা একটা বাইনারি সিস্টেমের অংশ। তাহলে তার সঙ্গীরও বাসযোগ্য গ্রহ থাকতে পারে।
খুব বেশি হালকা, আমার মনে হয়, মাথা ঝাঁকিয়ে ব্লিস বলল । আলফার সঙ্গী মাত্র তার চার ভাগের এক ভাগ উজ্জ্বল।
হালকা, তবে খুব বেশি না। নক্ষত্রের যথেষ্ট কাছে একটা গ্রহ থাকলেই চলবে।
কম্পিউটার কোনো গ্রহ খুঁজে পেয়েছে? বলল পেলোরেট। দাঁত বের করে হাসল ট্র্যাভিজ। মাঝারি আকৃতির পাঁচটা গ্রহ। কোনো গ্যাস জায়ান্ট নেই।
পাঁচটার মধ্যে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ আছে?
কম্পিউটার সংখ্যা ছাড়া আর কোনো তথ্য দিতে পারেনি, তবে ঘটনা হচ্ছে সেগুলো বড় নয়।
ওহ্, হতাশ হলো পেলোরেট।
হতাশ হওয়ার কিছু নেই। স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর কোনোটারই কোনো তথ্য কম্পিউটারে ছিল না। আলফা সম্বন্ধেও কিছু নেই এবং তার সঙ্গী সম্বন্ধে কিছু না থাকলে সেটাকে ভালো লক্ষণ হিসেবে ধরতে হবে।
তা হলে, বলল ব্লিস, যেন সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, তোমার পরিকল্পনা হচ্ছে তুমি সঙ্গী নক্ষত্রে যাবে, যদি ফলাফল শূন্য হয়, ফিরে যাবে আলফায়।
হ্যাঁ। এইবার নিউ আর্থে নামার সময় আমরা তৈরি থাকব। আর ব্লিস আমি চাই তোমার মেন্টাল ক্ষমতা দ্বারা শিল্ড
ঠিক সেই মুহূর্তে ফার স্টার কেঁপে উঠল হালকাভাবে, যেন ঢেকুর তুলল। চিৎকার করে উঠল ট্র্যাভিজ। রাগ এবং হতাশা মিশ্রিত সুরে। কন্ট্রোলে হাত দিল কে?
প্রশ্ন করলেও সে ভালোভাবেই জানে কে হাত দিয়েছে।
.
কম্পিউটার কনসোলের সামনে বসে আছে ফেলম, পুরোপুরি ধ্যানমগ্ন। ডেস্কের হালকা আলোকিত হ্যাঁণ্ডমার্কের সাথে মিলানোর জন্য হাতের লম্বা আঙুলগুলো ছড়িয়ে রেখেছে সে। ফেলমের মনে হলো যেন তার হাত কোনো বস্তুতে ডুবে যাচ্ছে, যদিও বস্তুটা শক্ত এবং পিচ্ছিল।
ট্র্যাভিজকে ওখানে হাত রাখতে দেখেছে সে, আর কিছু করতে দেখেনি। বুঝে নিয়েছে এভাবেই মহাকাশযান চালাতে হবে ।
।মাঝে মাঝে ট্র্যাভিজকে সে চোখ বন্ধ করতে দেখেছে, তাই সেও বন্ধ করল। কয়েক মুহূর্ত পরেই মনে হলো যেন অনেক-অনেক-দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দ। কিন্তু সেটা শোনা যাচ্ছে তার মস্তিষ্কের ভেতরেই, সম্ভবত ট্র্যান্সডিউসার লোবসের মাধ্যমে। ওগুলো তার হাতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শব্দগুলো বুঝতে তার বেশ কষ্ট হলো ।
ইস্ট্রাকশন্স, শব্দটা বলছে, অনেকটা কাতরভাবে তোমার ইট্রাকশন্স দাও।
কিছু বলল না ফেলম। ট্র্যাভিজকে কখনো কিছু বলতে দেখেনি সে-কিন্তু জানে হৃদয়ের গভীরে কোন জিনিসটা সে চায়। সে ফিরে যেতে চায় সোলারিয়ায়, ম্যানসনের সীমাহীন নীরবতায় এবং জেম্বি-জেম্বি-জেম্বি
সে ফিরে যেতে চায় সেখানে, এবং সোলারিয়ার কথা মনে পড়তেই অন্যান্য গ্রহ যেগুলোকে সে পছন্দ করে না, সেগুলোর মতো করে তার ভালবাসার গ্রহকে ভিউস্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলার কথা কল্পনা করল। তারপর ঘৃণ্য পৃথিবী ছাড়া অন্য কিছু দেখার আশায় চোখ খুলে ভিউস্ক্রিনের দিকে তাকাল, যা দেখল সেটাকেই কল্পনা করে নিল সোলারিয়া। শূন্য গ্যালাক্সি তার ভালো লাগে না, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে এখানে আনা হয়েছে। চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এল তার, আর কেঁপে উঠল মহাকাশযান ।
কাঁপুনি অনুভব করে একটু সামলে নিল সে।
তারপর জোরালো পায়ের শব্দ শুনতে পেল বাইরের করিডরে । চোখ খুলে দেখল তার দৃষ্টি পথের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ট্র্যাভিজ, ভিউস্ক্রিন দেখতে পারছে না সে। চিৎকার করে কিছু বলছে ট্যুভিজ, কিন্তু সে মনযোগ দিল না। এই লোকটাই ব্যাণ্ডারকে হত্যা করে তাকে সোলারিয়া থেকে নিয়ে এসেছে। আর এখন শুধু পৃথিবীর কথা চিন্তা করে তাকে ফিরতে দিচ্ছে না, সে আর এই লোকটার কথা শুনবে না।
মহাকাশযান সে সোলারিয়ায় নিয়ে যাবে, এবং তার সিদ্ধান্তের দৃঢ়তার কারণে আবার কেঁপে উঠল মহাকাশযান ।
.
বন্য জন্তুর মতো ট্র্যাভিজের বাহু খামচে ধরল ব্লিস। না! না!
প্রচণ্ড শক্তিতে ট্র্যাভিজের গায়ের সাথে লেপটে আছে সে, ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। পেলোরেট দাঁড়িয়ে আছে পিছনে, ভেবে পাচ্ছে না কী করবে ।
চিৎকার করছে ট্র্যাভিজ, কম্পিউটার থেকে হাত সরাও!–ব্লিস, সামনে থেকে সর, আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না।
এমন সুরে বলল ব্লিস যেন সে নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে আঘাত করবে না। তা হলে সব নির্দেশ ভুলে গিয়ে আমি তোমাকে আঘাত করতে বাধ্য হব।
ট্র্যাভিজের বুনো দৃষ্টি ফেলমের উপর থেকে সরে এসে ব্লিসের উপর পড়ল । বলল, তা হলে তুমি ওকে সরাও, ব্লিস। এখুনি!
বিস্ময়কর শারীরিক শক্তিতে তাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিল ব্লিস। ফেলম, বলল সে, তোমার হাত সরাও।
না, আরো সংকুচিত হয়ে গেল ফেলম। আমি মহাকাশযান সোলারিয়ায় নিয়ে যাব। আমি ওখানে যেতে চাই। ওখানে। ডেস্ক থেকে যেন হাত তুলতে না হয় সেজন্য সে মাথা নেড়ে দেখাল ভিউস্ক্রিনের দিকে।
কিন্তু ব্লিস তার কাধ স্পর্শ করতেই কাঁপতে লাগল ফেলম।
এখন, ফেলম, নরম সুরে বলল ব্লিস, কম্পিউটারকে বল আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। আমার সাথে এসো। কিছুক্ষণ পর কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। দুহাতে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল ব্লিস।
পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল ট্র্যাভিজ। ব্লিস বলল, সরে দাঁড়াও, আর আমাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করবে না।
দ্রুত একপাশে সরে গেল ট্র্যাভিজ।
একটু থামল ব্লিস, নিচু স্বরে বলল, একমুহূর্তের জন্য আমাকে ওর মাইণ্ডে ঢুকতে হয়েছে। যদি কোনো ক্ষতি হয়, তোমাকে এত সহজে ক্ষমা করব না।
ট্র্যাভিজ বলতে চেয়েছিল ফেলমের মাইন্ডের জন্য তার একটুও দুশ্চিন্তা নেই । তার আসল দুশ্চিন্তা কম্পিউটার নিয়ে। কিন্তু গায়ার ঘনীভূত দৃষ্টির সামনে (নিঃসন্দেহে ব্লিসের একক আচরণ তার শরীরে ভয়ের ঠাণ্ডা প্রবাহ বইয়ে দেয়নি) সে চুপ করে গেল।
ব্লিস আর ফেলম চলে যাওয়ার পরেও সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল মূর্তির মতো। পেলোরেটের নরম কণ্ঠস্বর শুনে তার মগ্নতা কাটল, গোলান, তুমি ঠিক আছো? সে তোমাকে আঘাত করেনি, করেছে?
জোরে জোরে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, যেন স্থবিরতা কাটানোর চেষ্টা করছে। আমি ঠিক আছি। প্রশ্ন হচ্ছে ওটা ঠিক আছে কি না। কম্পিউটার কনসোলের সামনে বসে হ্যান্ড মার্কের উপর হাত রাখল সে।
বেশ? পেলোরেট উদ্বিগ্ন।
কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ, স্বাভাবিকভাবেই সাড়া দিচ্ছে। বড় কোনো ক্ষতি হলে পরে বোঝা যাবে, এখন কোনো সমস্যা নেই। তারপর আরো রাগের সাথে বলল, অন্য । কারো হাতের সাথে কম্পিউটার এত নিখুঁত ভাবে সমন্বিত হতো না। কিন্তু হার্মাফ্রোডাইট এর ক্ষেত্রে শুধু হাত না, ট্রান্সডিউসার লোবস ছিল। আমি নিশ্চিত
কিন্তু মহাকাশযান ঝাঁকি খেলো কেন? এমন হওয়ার কথা ছিল না, ছিল?
না। এটা একটা গ্র্যাভিটিক শিপ। কিন্তু ঐ দানবী-থামল সে, আবার রেগে উঠছে।
হ্যাঁ?
আমার ধারণা সে কম্পিউটারকে দুটো পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং এত প্রকট ছিল যে এক সাথে দুটো পালন করা কম্পিউটারের জন্য ছিল অসম্ভব। অসম্ভবকে সম্ভব করতে গিয়ে কম্পিউটার মুহূর্তের জন্য মাধ্যাকর্ষণ মুক্ত করে দেয়। অন্তত আমি তাই মনে করি।
তারপর কেন যেন তার মুখের কঠিন রেখাগুলো দূর হয়ে গেল । সেটা বোধহয় খারাপ হয়নি, কারণ এখন আমার মনে হচ্ছে আলফা সেঞ্চুরি এবং তার সঙ্গী নক্ষত্র নিয়ে যা বলেছিলাম, সব বাজে কথা । আমি এখন জানি পৃথিবীর গোপন তথ্য কোথায় লুকানো আছে।
.
তাকিয়ে থাকল পেলোরেট, তারপর শেষ মন্তব্যটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আগের কথাতেই ফিরে এল। ফেলম কিভাবে কম্পিউটারকে পরস্পর বিরোধী কাজ করতে বলেছিল?
বেশ, ফেলম চেয়েছিল মহাকাশযান নিয়ে সোলারিয়ায় যেতে।
হ্যাঁ, অবশ্যই।
কিন্তু সোলারিয়া বলতে কি বুঝিয়েছে? মহাকাশ থেকে সে সোলারিয়া চিনতে পারবে? মহাকাশ থেকে তো কখনো দেখেনি। এবং তোমার লাইব্রেরির বই পড়ে, এবং ব্লিসের কথা শুনেও সে ধারণা করতে পারেনি গ্যালাক্সি কত বড়; কয়েকশ বিলিয়ন নক্ষত্র এবং মিলিয়ন মিলিয়ন বাসযোগ্য গ্রহ আছে। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে একা একা বেড়ে উঠেছে, তাই আরো অনেক গ্রহ আছে সেটা হজম করা কঠিন হচ্ছে। আরো অনেক গ্রহ আছে-কতগুলো? দুই? তিন? চার? তার কাছে সব গ্রহই সোলারিয়া। এবং যেহেতু ব্লিস বারবারই বুঝিয়েছে পৃথিবী খুঁজে না পেলে আমরা সোলারিয়ায় ফিরে যাবো, সে ধরেই নিয়েছে সোলারিয়া পৃথিবীর কাছে।
কিন্তু তুমি বুঝলে কীভাবে, গোলান?
আমরা যখন ভিতরে ঢুকি তখন বলছিল সে সোলারিয়ায় যেতে চায়, আর বলছিল ওখানে-ওখানে, ভিউস্ক্রিনের দিকে মাথা নেড়ে। আর ভিউস্ক্রিনে কী ছিল? পৃথিবীর উপগ্রহ । ডিনার করার জন্য যখন যাই তখন ছিল না; ছিল পৃথিবী। কিন্তু ফেলম সম্ভবত তার মাইণ্ডে এটাকেই সোলারিয়া হিসেবে কল্পনা করেছে আর মহাকাশযান এই উপগ্রহের দিকে চলতে শুরু করেছে। বিশ্বাস করো, জেনভ, এই কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে আমার চেয়ে কেউ ভালো জানে না।
ভিউস্ক্রিনের অর্ধচন্দ্রের দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে পেলোরেট বলল, এটাকে বলা হতো চাঁদ, আরেকটা ভাষায় বলা হতো মুন আরেকটা নাম ছিল লুনা। সম্ভবত আরো নাম ছিল।–চিন্তা করে দেখ ওল্ড চ্যাপ, একাধিক ভাষা থাকলে কি সমস্যা-বুঝতে সমস্যা, জটিলতা
চাঁদ? বলল ট্র্যাভিজ। অনেক সহজ-এবার মনে করো ফেলম মহাকাশযানের নিজস্ব এনার্জি সোর্স এর সাহায্যে ট্র্যান্সডিউসার লোবস ব্যবহার করতে চেয়েছিল বলেই মহাকাশযান ঝাঁকুনি খায়। কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে আমরা চাঁদের দিকে যাচ্ছি-হা নামটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি।
অবাক হচ্ছ কেন গোলান?
আয়তন দেখে । উপগ্রহগুলোকে আমরা কখনো লক্ষ্য করি না, জেনভ। কারণ সেগুলো হয় বেশ ছোট। কিন্তু এটা অন্যরকম, প্রায় একটা গ্রহই বলা যায় । ডায়ামিটার প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার।
গ্রহ? এটাকে তুমি গ্রহ বলতে পারো না। এখানে বাস করা অসম্ভব। অনেক ছোট। বায়ুমণ্ডল নেই। এখান থেকেই এগুলো বলতে পারছি আমি।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, তুমি বেশ দক্ষ মহাকাশচারী হয়ে উঠছ জেনভ। ঠিকই বলেছ। বাতাস নেই। পানি নেই। কিন্তু তার মানে শুধুমাত্র চাঁদের অরক্ষিত সারফেসে বাস করা যাবে না। কিন্তু আণ্ডারগ্রাউণ্ডে?
আণ্ডারগ্রাউণ্ড? পেলোরেটের গলায় সন্দেহ।
হ্যাঁ, আণ্ডারগ্রাউণ্ড। হবে না কেন? তুমিই বলেছ পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো ছিল আণ্ডারগ্রাউণ্ডে। আমরা জানি ট্রানটর পুরোটাই ছিল আণ্ডারগ্রাউণ্ডে। কমপরেলনের ক্যাপিটাল সিটি এবং সোলারিয়ান ম্যানসনের বেশিরভাগটাই ছিল আণ্ডারগ্রাউণ্ডে।
কিন্তু, গোলান, প্রতিটি গ্রহই ছিল বাসযোগ্য। সারফেসও বাসযোগ্য ছিল, ছিল বায়ুমণ্ডল এবং মহাসাগর । সারফেস বসবাসের অযোগ্য হলে কি আণ্ডারগ্রাউণ্ডে বাস করা সম্ভব?
চিন্তা করো, জেনভ! আমরা এখন কোথায় বাস করছি। ফার স্টার ছোট একটা বিশ্ব যার সারফেস বসবাসের অযোগ্য। বাইরে পানি নেই, বাতাস নেই। ভিতরে আমরা বেশ আরামেই আছি। গ্যালাক্সিতে অনেক স্পেস স্টেশন এবং স্পেস সেটলম্যান্ট আছে। চাঁদকে একটা বিশাল স্পেসশীপ হিসাবে কল্পনা করো।
ভিতরে নাবিক সহ।
হ্যাঁ। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ এবং প্রাণী, উদ্ভিদ; এবং অতি উন্নত টেকনোলজি, কি মনে হয়, জেনভ? পৃথিবী যদি তার শেষ দিনগুলোতে আলফা সেঞ্চুরিকে প্রদক্ষিণরত গ্রহে সেটলারদের পাঠাতে পারে এবং সম্ভবত ইম্পেরিয়াল সাহায্য নিয়ে সেটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে পারে, শূন্য মহাসাগরে খাদ্য উৎপাদন করতে পারে। সীমাহীন পানির বুকে ভূমি গঠন করতে পারে; তা হলে পৃথিবী তার উপগ্রহে সেটলার পাঠিয়ে সেটার অভ্যন্তরভাগ বাসযোগ্য করে তুলতে পারবে না?
সন্দেহের গলায় বলল পেলোরেট, মনে হয়। সেটাই হয়েছে। যদি পৃথিবীর কিছু লুকানোর থাকে তাহলে বেশি দূরে যাবে কেন। আর লুকানোর স্থান হিসেবে চাঁদ আদর্শ। উপগ্রহে মানুষ বাস করে কে চিন্তা করবে। আমি নিজেই তো সামনে দিয়ে চলে গেলেও চিন্তা করতাম না। মনযোগ আকৃষ্ট করার কারণ ফেলম। কৃতিত্বটা তাকে দিতেই হবে। আমি না দিলেও ব্লিস দেবে।
কিন্তু, ওল্ড ম্যান, চাঁদের সারফেসের নিচে যদি কিছু লুকানো থাকে, খুঁজে বের করবে কীভাবে? সারফেস তো নিশ্চয়ই কয়েক মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার
মোটামুটি চল্লিশ মিলিয়ন।
আর পুরোটাই আমাদের দেখতে হবে, কিসের জন্য? একটা প্রবেশপথ? কোনো ধরনের এয়ারলক?
এভাবে ভাবলে কাজটা অনেক বড়। কিন্তু আমরাতো শুধু বস্তু খুঁজবো না, খুঁজব বুদ্ধিমান জীবন। আর আমাদের সাথে আছে ব্লিস–ইন্টেলিজেন্স ডিটেক্ট করার ক্ষেত্রে যে একটা প্রতিভা।
.
দুচোখে অভিযোগ নিয়ে ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো ব্লিস, শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। খুব কষ্ট হয়েছে শান্ত করতে। সৌভাগ্য, আমি সম্ভবত ওর কোনো ক্ষতি করিনি।
ঠাণ্ডা গলায় বলল ট্র্যাভিজ, তোমার বরং ওর মাইণ্ড থেকে জেম্বির বদ্ধমূল চিন্তা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু তুমি ভালোভাবেই জানো আমি আর সোলারিয়ায় ফিরে যাবো না।
মুছে ফেলব, এতই সহজ? এ ব্যাপারে তুমি কি জানো, ট্র্যাভিজ। কখনো মাইণ্ড অনুভব করেছ। এটা কতখানি জটিল তোমার সামান্যতম ধারণাও নেই। জানলে কোনো বদ্ধমূল চিন্তা মুছে ফেলার কথা এমনভাবে বলতে না যেন বোতলের আটকে যাওয়া ছিপি খুলতে বলছ।
তুমি অন্তত দুর্বল করার চেষ্টা করতে পারো।
হয়তো কিছুটা দুর্বল করতে পারব একমাসের সতর্ক ডিথ্রেডিং এর পর।
ডিথ্রেডিং মানে?
যে জানে না তাকে বুঝানো কঠিন।
তা হলে বাচ্চাটাকে নিয়ে তুমি কি করবে?
এখনো জানি না; অনেক কিছু বিবেচনা করতে হবে।
সেক্ষেত্রে মহাকাশযান নিয়ে আমরা কী করতে চাই সেটা তোমাকে বলছি।
জানি কী করবে। নিউ আর্থে ফিরে গিয়ে সুন্দরী হিরোকোর মন গলানোর চেষ্টা করবে, অবশ্য সে যদি কথা দেয় যে এবার তোমার শরীরে ভাইরাস ঢোকাবে না।
চেহারায় কোনো ভাব ফুটতে দিল না ট্র্যাভিজ। না, আমি সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। আমরা চাঁদে যাচ্ছি-জেনভের মতে ওটা উপগ্রহের নাম।
উপগ্রহ? কারণ এটাই একমাত্র নিকট বিশ্ব। আমি চিন্তাও করিনি।
আমিও না। কেউ করবেও না। গ্যালাক্সির কোথায় এমন কোনো উপগ্রহ আছে যেটাকে একটু গুরুত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু এই উপগ্রহ, বড় এবং অনন্য সাধারণ, পৃথিবীর নামহীনতা অনেকখানি ঘুচবে। কেউ পৃথিবী খুঁজে না পেলেও চাঁদ অবশ্যই খুঁজে পাবে।
এটা কি বাসযোগ্য?
সারফেসে বাস করা অসম্ভব, কিন্তু এটা রেডিওঅ্যাকটিভ নয় মোটেই। কাজেই পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য না। হয়তো জীবনের অস্তিত্ব আছে-হয়তো প্রাণে ভরপুর, তবে সারফেসের নিচে। এবং অবশ্যই আরো কাছে যাওয়ার পর তুমি আমাদেরকে সেটা বলতে পারবে।
কাধ নাড়ল ব্লিস। আমি চেষ্টা করব। কিন্তু হঠাৎ করে চাঁদের দিকে নজর পড়ল কেন?
শান্ত সুরে বলল ট্র্যাভিজ, কনসোলে থাকার সময় কিছু একটা করেছে ফেলম।
অপেক্ষা করছে ব্লিস, যেন আরো কিছু শুনবে, তারপর আবার কাঁধ নাড়ল। সেটা যাই হোক। আমার মনে হয় তুমি এখন রাগে অন্ধ হয়ে ওকে খুন করবে না।
তাকে খুন করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, ব্লিস। হাত নাড়ল ব্লিস, ঠিক আছে। দেখা যাক। আমরা কি এখন চাঁদের দিকে এগোচ্ছি?
হ্যাঁ, সাবধানতা হিসেবে খুব দ্রুত এগোচ্ছি না। তবে সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে আগামী ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো।
.
চাঁদের সারফেস পুরোপুরি নিষ্ফলা, বন্ধ্যা। উজ্জ্বল আলোকিত দিনের অংশ তাদের নিচে ভেসে যেতে দেখল ট্র্যাভিজ। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এবং পাহাড়ি এলাকার একঘেয়ে বিস্তৃতি, দু-একটা জায়গা ছায়া ঢাকা। মাটির রঙের পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম, এবং মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে বিশাল সমতল ভূমি, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে ভর্তি।
রাতের অংশের দিকে যতই এগোলো ছায়াগুলো ততই দীর্ঘ হতে হতে একসময় মিশে গেল । পিছনে পাহাড় চূড়া এখনো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে, অনেকটা দূরবর্তী তারার মতো, আকাশের নক্ষত্রের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। তারপর সেগুলোও মিলিয়ে গেল । নিচে আকাশে পৃথিবীর ঝাপসা আলো, নীলচে সাদা বৃত্ত, পরিপূর্ণ বৃত্ত থেকে কিছুটা কম। তারপর পৃথিবীও ডুবে গেল দিগন্তে। তাদের নিচে এখন শুধু অভেদ্য অন্ধকার আর উপরে তারাগুলো পাউডারের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হালকা আলো ছড়াচ্ছে। ট্র্যাভিজ, টার্মিনাসের নক্ষত্রহীন আকাশের নিচে বেড়ে উঠেছে। তার কাছে এই দৃশ্য সবসময়ই বিস্ময়কর।
সামনের আকাশে উজ্জ্বল তারা ফুটে উঠল, একটা, দুইটা। তারপর অনেকগুলো, পাতলা হচ্ছে, ঘন হচ্ছে, তারপর সব মিশে গেল একসাথে। ঝট করে বিষুব রেখা পার হয়ে তারা বেরিয়ে এল দিনের অংশে। নারকীয় উজ্জ্বলতা বিকিরণ করছে সূর্য, ভিউস্ক্রিন তৎক্ষণাৎ সেদিক থেকে সরিয়ে নিচ থেকে প্রতিফলিত আলো পোলারাইজ করে দিল।
পরিস্কার বুঝতে পারছে ট্র্যাভিজ সারফেসের নিচে কোনো বসতি থাকলে সেটা এভাবে খালি চোখে বের করা যাবে না।
ব্লিস বসে আছে পাশে। ভিউস্ক্রিনের দিকে তাকায়নি সে; বরং চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মনে হচ্ছে যেন চেয়ারে না বসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
ট্র্যাভিজ বুঝতে পারছে না, ব্লিস ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কোনো কিছু ডিটেক্ট করতে পেরেছ?
ভীষণ আস্তে মাথা নাড়ল ব্লিস। না, ফিসফিস করে বলল। শুধু সেই হালকা ফিসফিসানি। তুমি বরং আবার আমাকে ওখানেই ফিরিয়ে নিয়ে চল। কোথায় তুমি জানো?
কম্পিউটার জানে।
অনেকটা জিরোয়িং অন অ্যা টার্গেট, এদিকে একটু নড়ে, ওদিকে একটু নড়ে টার্গেট খুঁজে বের করা। ওরা যে অংশের কথা বলছে সেটা রাতের অংশের প্রায় মাঝখানে। অন্ধকার। শুধু আকাশের অনেক নিচে ঝুলে থেকে পৃথিবী ছায়াগুলোর মাঝে ভূতুড়ে পাংশুটে আলো ছড়াচ্ছে। ভালোভাবে দেখার জন্য পাইলটরুমের আলো নিভিয়ে দিয়েও লাভ হয়নি।
উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পেলোরেট। কিছু পেয়েছ? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
হাত তুলে চুপ করার নির্দেশ দিল ট্র্যাভিজ। ব্লিসকে দেখছে সে। জানে চাঁদের এই অংশে সূর্যের আলো ফিরে আসতে আরো কয়েকদিন, আবার এটাও জানে ব্লিস যা অনুভব করার চেষ্টা করছে তার জন্য আলোর কোনো প্রয়োজন নেই।
আছে ওখানে। বলল ব্লিস।
তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ।
আর এটাই একমাত্র স্পট? এই একটা মাত্র স্পট আমি ডিটেক্ট করতে পেরেছি। তুমি কি চাঁদের সারফেসের পুরোটা চষে ফেলেছ?
মোটামুটি বড় একটা অংশ।
বেশ, মোটামুটি বড় একটা অংশের মধ্যে আমি এটুকুই ডিটেক্ট করতে পেরেছি। এখন আরো বেড়েছে। মনে হয় ওটাও আমাদের ডিটেক্ট করেছে। তবে বিপজ্জনক না। বরং মনে হচ্ছে যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
তুমি নিশ্চিত?
আমার অনুভূতি তাই বলছে।
হয়তো তোমার অনুভূতিকে ধোকা দেওয়া হচ্ছে? বলল পেলোরেট।
কিছুটা বিরক্ত সুরে ব্লিস বলল, ধোকা দেওয়া হলে আমি বুঝতে পারতাম।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল ট্র্যাভিজ। তারপর বলল, আশা করি তুমি যা ডিটেক্ট করেছ সেটা বুদ্ধিমান?
আমি উঁচুমামের বুদ্ধিমত্তা ডিটেক্ট করেছি। শুধু– গলার স্বর কেমন অদ্ভুত শোনাল।
শুধু কী?
সস্স্। বিরক্ত করো না। কনসেনট্রেট করতে দাও। শেষ কথাগুলো শোনা গেলনা, শুধু ঠোঁট নড়ল।
তারপর হালকা বিস্ময়ের সুরে বলল সে, ওটা মানুষ নয়।
মানুষ না। ট্র্যাভিজ আরো বেশি বিস্মিত। আবারও রোবট? সোলারিয়ার মতো?
না, হাসছে ব্লিস। ঠিক রোবটিকও না।
দুটোর একটা তো হতেই হবে।
কোনোটাই না। ব্লিসের মুখে চাপা হাসি। এটা মানুষ না এবং আমার দেখা কোনো রোবটের সাথেও মিল নেই।
আমি দেখতে চাই। বলল পেলোরেট; মাথা নাড়ছে জোরে জোরে, আনন্দে চোখ দুটো হয়ে গেছে বড় বড়। বেশ চমৎকার হবে। নতুন কিছু।
নতুন কিছু, নিজেও হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে ফিসফিস করে বলল ট্র্যাভিজ-এবং হঠাৎ এক অপ্রত্যাশিত বোধোদয়ের আলো তার মস্তিষ্কের ভিতর আলোড়ন তুলল।
.
যুদ্ধ জয় করা সৈনিকের মতো মনে বিজয়উল্লাস নিয়ে নিচে নামতে লাগল তারা। এমনকি ফেলমও যোগ দিল তাদের সাথে। সে বরং আরো বেশি খুশি, ধরেই নিয়েছে সোলারিয়ায় ফিরে এসেছে তারা ।
ট্র্যাভিজ মোটামুটি সুস্থির, তার ভিতরে কেউ যেন বলছে, অদ্ভুত ব্যাপার যে পৃথিবী-অথবা পৃথিবীর যা কিছু এখন চাদে রয়েছে-যা সবাইকে সরিয়ে রাখার জন্য অনেক কৌশল করেছে, এখন কৌশলে তাদেরকে কাছে টেনে নিচ্ছে। উদ্দেশ্য সেই একই। অনেকটা সেই প্রবাদের মতো, তুমি যদি কাউকে এড়াতে না পারো, তবে তাকে কাছে টেনে নাও এবং ধ্বংস করে দাও। অন্য ভাবে বলা যায় পৃথিবীর রহস্য কি রহস্যই থেকে যাবে?
কিন্তু চাঁদের সারফেসের কাছাকাছি হতেই মাথা থেকে দূর হয়ে গেল চিন্তাটা। বরং আনন্দের বন্যা বয়ে গেল মনের ভেতর।
মহাকাশ যান কোথায় যাচ্ছে মনে হলো সেটা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। এখন কতগুলো পাথরের চূড়ার উপরে রয়েছে এবং কম্পিউটারের সামনে বসে ট্র্যাভিজ অনুভব করল তাকে কিছুই করতে হবে না। যেন তাকে আর কম্পিউটারকে পথ দেখাচ্ছে কেউ, আর কাঁধ থেকে দায়িত্বের বোঝা নেমে যাওয়াতে সে শুধু সীমাহীন স্বস্তি অনুভব করল।
ভূমির সাথে সমান্তরাল বেগে একটা উঁচু ক্লিফের দিকে এগোচ্ছে তারা। ক্লিফটা তাদের গতিপথে বিপজ্জনকভাবে বাঁধা হয়ে আছে। হালকাভাবে চকচক করছে পৃথিবীর আলো এবং ফার স্টারের লাইট বিমের আলোয়। নিশ্চিত ধাক্কা খাবে জেনেও ভয় পাচ্ছে না ট্র্যাভিজ, এবং যখন সরাসরি সামনে ক্লিফের একটা অংশ ঝট করে সরে গিয়ে তাদের সামনে কৃত্রিম আলোয় ঝিলমিল করা একটা করিডোর খুলে দিল, সে মোটেই অবাক হলো না।
নিজের চেষ্টাতেই গতি কমিয়ে আনল মহাকাশ যান, নিখুঁতভাবে ঢুকে গেল প্রবেশ মুখ দিয়ে, সরে দাঁড়ালো একপাশে-বন্ধ হয়ে গেল পেছনে প্রবেশমুখ আরেকটা খুলল সামনে। সেটা দিয়ে তারা প্রবেশ করল এক সুবিশাল হলরুমে। সম্ভবত বড় কোনো পাহাড়ের অভ্যন্তরভাগ কেটে তৈরি করা হয়েছে।
মহাকাশযান থামতেই ভিতরের সবাই ভিড় করল এয়ারলকের সামনে। কেউ ভাবছে না, এমনকি ঐভিজও না, যে বাইরে নিশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস আছে কিনা-বা আদৌ কোনো বায়ুমণ্ডল আছে কিনা।
যাই হোক বাতাস আছে। নিশ্বাস নেওয়ার মতো এবং আরামদায়ক। তারা এমনভাবে নিজেদের দিকে তাকালো যেন আপন গৃহে ফিরতে পেরে মহাখুশি। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পর খেয়াল হলো কিছু দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ভদ্রভাবে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে তাদের এগিয়ে আসার জন্য।
লোকটা লম্বা, মুখমণ্ডল গম্ভীর। ব্রোঞ্জ রঙের চুল ছোট করে ছাঁটা। প্রশস্ত চিকবোন, উজ্জ্বল চোখ, পোশাক পুরোনো ইতিহাস বইয়ে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন, যদিও সে বলিষ্ঠ এবং দীর্ঘদেহী তবুও কেমন ক্লান্ত মনে হয়-খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু কিভাবে যেন সবাই অনুভব করল।
ফেলমই প্রথম সংবিত ফিরে পেল। চড়া সুরেলা গলায় চিৎকার দিয়ে ছুটল লোকটার কাছে, হাত নেড়ে কাঁদছে, জেম্বি! জেম্বি! অনেকটা রুদ্ধশ্বাসে।
গতি একবারের জন্যও কমল না তার, এবং কাছে যেতেই লোকটা নিচু হয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। ফেলম দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল, এখনো ফোঁপাচ্ছে আর বলছে জেম্বি!
অন্যরা এগিয়ে এল সংযত পদক্ষেপে, এবং ট্র্যাভিজ ধীরে ধীরে বলল, (গ্যালাকটিক বুঝতে পারবে?) দুঃখিত,স্যার। এই শিশু তার প্রটেক্টরকে হারিয়ে ফেলেছে এবং খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেন আপনার দিকে এভাবে ছুটে এল বুঝতে পারছি না, কারণ সে খুঁজছে একটা রোবট। একটা যান্ত্রিক–
লোকটা এই প্রথম কথা বলল, কণ্ঠস্বর সুরেলা নয় বরং যারা সারা জীবন সত্য ন্যায়ের পথে চলে, মানুষের কল্যাণ করে, তাদের কণ্ঠস্বর যেমন হয় তেমন, এবং তার কণ্ঠস্বরে কিছুটা প্রাচীনতা আছে, কিন্তু গ্যালাকটিক একেবারে নিখুঁত।
স্বাগতম, বন্ধুগণ, বলল সে-এবং সে যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে কোনো সন্দেহ নেই, মুখে গাম্ভীর্য স্থায়ী হয়ে আছে যদিও তার। এই শিশু আপনারা যতটুকু জানেন তারচেয়েও বেশি অনুভূতিপ্রবণ, কারণ আমি একজন রোবট। আমার নাম ডানীল অলিভো।
.
২১. যাত্রা হলো শেষ
কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না ট্র্যাভিজ। চাঁদে ল্যাণ্ড করার আগে ও পরে যে অস্বাভাবিক আনন্দ তার ভেতরে ছিল দূর হয়ে গেছে সেটা-সে সন্দেহ করছে সামনে দাঁড়ানো এই সেলফ-স্টাইল রোবটই তার ভেতরে আনন্দদায়ক অবস্থা তৈরি করেছিল।
এখনো তাকিয়ে আছে ট্র্যাভিজ, পুরোপুরি সুস্থির এবং আনটাচড মাইণ্ড, বিস্ময়ে ডুবে গেল। কথা বলল বিস্ময় নিয়ে, বলল, তার অনুসন্ধানের কথা, যা সে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার কথা, কি বলছে শোনা গেল না, বোঝা গেল না, কিন্তু সামনে দাঁড়ানো প্রায় মানুষের মতো লোকটার উপস্থিতি মন খুলে কথা বলতে বাধ্য করল তাকে।
সন্দেহ নেই ব্লিস এমন কিছু ডিটেক্ট করেছে যা মানুষও না রোবটও না, পেলোরেটের ভাষায় নতুন কিছু। এবং ঠিক তাই। আর এটাই তার চিন্তাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করল কিন্তু কিছুক্ষণ পর অন্যান্য ভাবনার তোড়ে হারিয়ে গেল।
ব্লিস আর ফেলম এলাকাটা ঘুরে দেখছে। পরামর্শ ব্লিসের, কিন্তু তার আগে অবশ্য ডানীল এবং তার মধ্যে চোখে চোখে ইশারা হয়েছে। যখন ফেলম তার জেম্বিকে ছেড়ে যেতে আপত্তি জানাল তখন ডানীলের একটা গম্ভীর শব্দ এবং এক আঙুলের ইশারাতেই দূর হয়ে গেল তার সব আপত্তি। ট্র্যাভিজ আর পেলোরেট থাকল।
ওরা ফাউণ্ডেশনার নয়, স্যার, বলল রোবট, এমনভাবে যেন এতেই সব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একজন গায়া এবং একজন স্পেসার।
ট্র্যাভিজ কিছু বলল না। একটা গাছের নিচে সাধারণ কয়েকটা চেয়ার পাতা, সেখানে বসতে দেওয়া হলো। ডানীল পুরোপুরি মানুষের ভঙ্গিতে বসার পর ট্র্যাভিজ বলল, আপনি আসলেই রোবট?
সত্যি, স্যার। বলল ডানীল ।
পেলোরেটের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। সে বলল, প্রাচীন কিংবদন্তিতে ডানীল নামে একজন রোবটের কথা আছে, আপনি তার সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছেন?
আমিই সেই রোবট। ওগুলো কিংবদন্তি নয়, সত্যি। আপনি সেই রোবট হলে হাজার বছর বয়স আপনার।
বিশ হাজার বছর। শান্ত গলায় বলল ডানীল।
বিষম খেলো পেলোরেট, ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো, আর ট্র্যাভিজ রাগের সাথে বলল, আপনি রোবট হলে, আমি আপনাকে সত্য কথা বলার আদেশ করছি।
আমাকে সত্য কথা বলার আদেশ দেয়ার দরকার নেই, স্যার। আমি অবশ্যই তা করব। আপনাকে আমি তিনটা বিকল্প দিচ্ছি, স্যার, হয় আমি একজন মানুষ যে মিথ্যে কথা বলছে। অথবা এমনভাবে প্রোগ্রাম করা একজন রোবট যে বিশ্বাস করে তার বয়স বিশ হাজার বছর; অথবা আমি আসলেই বিশ হাজার বছরের প্রাচীন রোবট। কোনটা মেনে নেবেন সেটা আপনাকেই স্থির করতে হবে।
আলোচনা করেই সেটা বের করা যাবে, শুকনো গলায় বলল ট্র্যাভিজ। তাকাল উপরের দিকে। আলো পুরোপুরি মৃদু নরম সূর্যের আলোর মতো। কিন্তু আকাশে কোনো সূর্য দেখা যাচ্ছে না, পরিষ্কার করে বলতে গেলে মাথার উপরে আকাশ নেই। বিশ্বাস করা কঠিন। সারফেসের মাধ্যাকর্ষণ ০.২ জি এর কম হওয়ার কথা।
সারফেসের স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণ ০.১৫ জি, স্যার। এটা তৈরি করা হয়েছে আপনার মহাকাশযান যে কৌশলে বানানো হয়েছে ঠিক সেই কৌশলে। অন্যান্য প্রয়োজন, আলোসহ সবগুলোই মেটানো হয় গ্র্যাভিটিক্যালি। যদিও যেখানে সম্ভব সোলার এনার্জি ব্যবহার করি। চাঁদের মাটি থেকে ধাতব পদার্থের প্রয়োজন মেটানো হয়, শুধু লাইট এলিম্যান্ট বাদে-কারণ চাঁদে হাইড্রোজেন, কার্বন, এবং নাইট্রোজেন নেই। মাঝে মাঝে একটা ধূমকেতু ধরে সেখান থেকেই এই জিনিসগুলোর প্রয়োজন পুরণ করি। প্রতি শতাব্দীতে একটা ধূমকেতু ধরলেই যথেষ্ঠ।
পৃথিবী থেকে নিশ্চয়ই কিছুই পাওয়া যায় না?
দুর্ভাগ্যবশত, ঠিক তাই, স্যার। হিউম্যান প্রোটিন এর মতো আমাদের পজিট্রনিক ব্রেইন ও রেডিওঅ্যা্যাকটিভিটি সহ্য করতে পারে না।
আপনি বহুবচন ব্যবহার করছেন, আর আমরা যত দূর দেখতে পারছি-এই ম্যানসন অনেক বিশাল এবং চমৎকার। চাদে তাহলে আরো অনেকেই আছে। মানুষ? রোবট?
জি, স্যার। চাঁদে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোলজি আছে। বুদ্ধিমান সত্তা সবাই রোবট, কম বেশি আমার মতো। তাদের কারো সাথেই আপনাদের দেখা হবে না। এই ম্যানসন আমি একা ব্যবহার করি, এবং বিশ হাজার বছর আগে আমি যেখানে বাস করতাম ঠিক সেরকম ডিজাইনে তৈরি।
খুঁটিনাটি সব আপনার মনে আছে, তাই না?
নিখুঁতভাবে। আমি তৈরি হওয়ার পর কিছু সময়-এখন আমার মনে হয় কত সংক্ষিপ্ত সময় ছিল সেটা-আমি স্পেসার ওয়ার্ল্ড অরোরাতে ছিলাম।
যে গ্রহে- থামল ট্র্যাভিজ।
জি, স্যার । যে গ্রহে কুকুর আছে।
আপনি সেটা জানেন?
জি, স্যার।
অরোরায় থাকলে এখানে এলেন কীভাবে?
স্যার, পৃথিবীর সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য গ্যালাক্সিতে বসতি স্থাপনের শুরুতেই আমি এখানে চলে আসি। আমার সাথে আরেকজন রোবট ছিল, নাম জিসকার্ড, যে মাইও অনুভব করতে পারত এবং অ্যাডজাস্ট করতে পারত।
যেমন ব্লিস পারে?
জি, স্যার। আমরা একরকম ব্যর্থ হই এবং জিসকার্ডের কার্যক্ষমতা থেমে যায়। যাই হোক থেমে যাওয়ার আগে সে তার বিশেষ ক্ষমতা আমাকে দিয়ে যেতে সক্ষম হয় যেন আমি গ্যালাক্সি রক্ষা করতে পারি; বিশেষ করে পৃথিবী।
বিশেষ করে পৃথিবীই কেন?
প্রধানত কারণ এলিজাহ্ বেইলী নামের একজন মানুষ, একজন আর্থম্যান।
উত্তেজিত গলায় নাক গলাল পেলোরেট, আমি যে কালচার হিরোর কথা বলেছিলাম, গোলান।
কালচার হিরো, স্যার?
ড. পেলোরেট বোঝাতে চাইছেন, বলল ট্র্যাভিজ, কালচার হিরো এমন একজন ব্যক্তি যার অনেক গুণকীর্তন করা হয় এবং সে সম্ভবত অনেকগুলো ঐতিহাসিক চরিত্রের সংমিশ্রণে তৈরি একটা কাল্পনিক চরিত্র।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল ডানীল, তারপর শান্ত গলায় বলল, না, এলিজাহ্ বেইলী সত্যিকার মানুষ এবং একজন মানুষ। আমি জানি না আপনাদের কিংবদন্তিতে কী বলা হয়েছে, কিন্তু তার উদ্যোগ ছাড়া গ্যালাক্সিতে বসতি স্থাপন কখনো সম্ভব হতো না। তার সম্মানেই পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ হতে শুরু করার পর যতটুকু সম্ভব উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমার সহকারী রোবটরা গ্যালাক্সির বিভিন্ন জায়গায় মানুষদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এক সময় আমি পৃথিবীর মাটি রিসাইকল করার কাজ শুরু করতে তাদের উদ্বুদ্ধ করি। আরো অনেক পরে-এখন আলফাঁকে প্রদক্ষিণরত গ্রহ, সেটাকে বসবাসের যোগ্য করে তোলার কাজ পরিচালিত করি। কোনো ক্ষেত্রেই আমি পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। ঠিক যেরকম চাই সেরকমভাবে কখনোই পারিনি মাইণ্ড অ্যাডজাস্ট করতে কারণ তাতে অ্যাডজাস্টেড মানুষগুলোর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমি রোবটিকসের তিন নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ ছিলাম-এখনো আছি।
হ্যাঁ?
এই একটা শব্দে যে অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে তা ডানীলের মতো মেন্টাল পাওয়ার সম্পন্ন কারো পক্ষে বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। রোবটিক্সের নিয়মগুলো প্রথমে বলল সে। তারপর বলল নিয়মগুলো মোটামুটি সহজ ভাষায় বললাম। কিন্তু প্রকৃত ক্ষেত্রে আমাদের পজিট্রনিক ব্রেইনে এগুলো হচ্ছে জটিল গাণিতিক সংখ্যা।
আইনগুলো মেনে চলতে আপনার সমস্যা হয়েছে?
অবশ্যই স্যার। প্রথম নিয়মটাই মানুষের উপর আমার মেন্টাল ট্যালেন্ট প্রয়োগ করতে বাধা দেয়। এত বিশাল গ্যালাক্সির অগ্রগতির জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না সেটা অসম্ভব। সবসময়ই কিছু মানুষ সম্ভবত অনেক মানুষ কষ্ট পায়; তাই রোবট এমন পথ বেছে নেয় যাতে ক্ষতির পরিমাণ হয় সবচেয়ে কম। তার পরেও সম্ভাবনাগুলো এত জটিল যে নির্বাচিত পথের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
বুঝতে পারছি, বলল ট্র্যাভিজ।
আমি গ্যালাক্সির অন্তহীন বিবাদ বিপর্যয় অপেক্ষাকৃত উন্নত করার চেষ্টা করেছি। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, কিন্তু আপনাদের গ্যালাকটিক ইতিহাস আপনি ভালোভাবেই জানেন। বুঝতেই পারছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি ব্যর্থ হয়েছি।
আমি জানি, ক্লান্ত হেসে বলল ট্র্যাভিজ।
জিসকার্ড এর পরিসমাপ্তির পূর্বেই সে আরেকটা নতুন রোবটিক আইনের প্রস্তাবনা করে। আমরা এটাকে বলি জিরোয়েথ ল, এ ছাড়া অন্য কোনো নাম মাথায় আসেনি। জিরোয়েথ ল হচ্ছে রোবট কখনোই মানবতার ক্ষতি করবে না, বা এমন কিছু করবে না যাতে মানবতার ক্ষতি হয়। তখন প্রথম আইনটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় রোবট কখনো মানুষের ক্ষতি করবে না, বা এমন কিছু করবে না যা মানুষের ক্ষতি করে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা জিরোয়েথ ল-এর পরিপন্থী হয়।
ভুরু কোঁচকালো ট্র্যাভিজ। সামগ্রিকভাবে মানবতার জন্য কোনটা ক্ষতিকর, কোনটা ক্ষতিকর না, সেটা কীভাবে আপনি স্থির করবেন?
সংক্ষেপে, স্যার, বলল ডানীল, তাত্ত্বিকভাবে, জিরোয়েথ ল ই হচ্ছে আমাদের প্রশ্নের উত্তর। বাস্তবক্ষেত্রে আমরা কখনোই স্থির করতে পারিনি। হিউম্যান বিয়িং একটা কংক্রিট অবজেক্ট। একজন মানুষের ক্ষতি হিসাব করা যায়, তুলনা করা যায়। হিউম্যানিটি অ্যাবস্ট্রাকশন। সেটাকে কীভাবে সামলাব?
আমি জানি না, বলল ট্র্যাভিজ।
এক মিনিট, বলল পেলোরেট। হিউম্যানিটিকে আপনি একটা সিঙ্গেল অর্গানিজমে পরিণত করতে পারেন। গায়া।
আমি ঠিক তাই করার চেষ্টা করছি, স্যার। আমিই গায়া প্রতিষ্ঠা করি। যদি হিউম্যানিটিকে একটা সিঙ্গেল অর্গানিজমে পরিণত করা যায় তখন তা কংক্রিট অবজেক্টে পরিণত হবে, সামলানো যাবে। যাই হোক, আমার আশানুযায়ী একটা সুপার-অর্গানিজম তৈরি করা সহজ না। প্রথমত যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ তার ইণ্ডিভিজুয়ালিটির উপরে সুপার-অর্গানিজমকে গুরুত্ব দেবে, এবং এটাকে মেনে নেওয়ার মতো মাইণ্ড কাস্ট খুঁজে বের করতে হয়েছে আমাকে। রোবটিকস এর নিয়মগুলো নিয়ে চিন্তা করার অনেক আগের কথা এগুলো।
আহ্, গায়ানরা তা হলে রোবট। আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম।
আপনার সন্দেহ ভুল, স্যার। ওরা মানুষ, কিন্তু ওদের মস্তিষ্কে রোবটিক্সের আইনগুলো নিবিষ্ট হয়ে আছে। তারা জীবনের মূল্য দেয়, সত্যিকার মূল্য। কিন্তু তারপরেও একটা মারারক ভুল থেকে যায়। শুধুমাত্র মানুষের সুপার-অর্গানিজম সবল হতে পারে না। অন্যান্য প্রাণী অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে-তারপর উদ্ভিদ-তারপর ইনঅর্গানিক ওয়ার্ল্ড। সবচেয়ে বড় এবং একটা দৃঢ় ইকোলজি বহন করার মতো যথেষ্ট জটিল। এটা বুঝতেই পেরিয়ে যায় অনেক সময় এবং মাত্র গত শতাব্দীতে গায়া পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তৈরি হয়গ্যালাক্সিয়ার পথে পা বাড়ানোর জন্য তারপরেও দীর্ঘ সময় লাগবে। হয়তো বর্তমান অবস্থায় আসতে যত সময় লেগেছে তত সময় লাগবে না, যেহেতু নিয়মগুলো আমরা এখন জানি।
কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাকে আপনার প্রয়োজন। তাই না, ডানীল?
জি, স্যার। রোবটিকস এর নিয়মগুলোর কারণে আমি বা গায়া সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা, যদি মানবতার ক্ষতি হয়। এবং এরই মধ্যে পাঁচ শতাব্দী আগে যখন মনে। হয় যে গায়া প্রতিষ্ঠার পথে যে সমস্যাগুলো সেগুলো এত সহজে দূর হবে না, তখন আমি দ্বিতীয় সর্বোত্তম পথ বেছে নেই এবং সাইকো হিস্টোরি বিজ্ঞান তৈরি করতে সাহায্য করি।
আমি অনুমান করেছিলাম, বিড়বিড় করল ট্র্যাভিজ। ডানীল, আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে আপনি বিশ হাজার বছরের প্রাচীন।
ধন্যবাদ, স্যার।
আপনি নিজেও কি গায়ার অংশ, ডানীল? বলল পেলোরেট। আর তাই অরোরার কুকুরগুলোর কথা জানেন। ব্লিসের মাধ্যমে?
ডানীল বলল, একদিক দিয়ে আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্যার। আমি গায়ার সহযোগী, কিন্তু তার অংশ নই।
ভুরু কপালে তুলল ট্র্যাভিজ। অনেকটা কমপরেলনের মতো শোনাচ্ছে। তারা বারবারই বলছিল যে তারা ফাউণ্ডেশন-এর সহযোগী, ফাউণ্ডেশন কনফেডারেশনের অংশ না।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ডানীল। আমার মনে হয় যথাযথ বিশ্লেষণ, স্যার। গায়ার সহযোগী হিসেবে আমি গায়ার সচেতনার ব্যাপারে সচেতন থাকতে পারি-ব্লিসের মাধ্যমে। কিন্তু গায়া আমার কনশাসনেসের ব্যাপারে সচেতন হতে পারে না, ফলে আমার কাজের স্বাধীনতা আছে। গ্যালাক্সিয়া তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই স্বাধীনতা দরকার।
বেশ কিছুক্ষণ রোবটের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ, তারপর বলল আর আমাদের অনুসন্ধান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনি ব্লিসের মাধ্যমে আপনার কনশাসনেস ব্যাবহার করেছেন?
ঠিক মানুষের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ। বেশি কিছু আমি করতে পারিনি, স্যার। রোবটিকস এর নিয়ম সবসময়ই আমাকে বাধা দিয়েছে–তবে নিজের কাঁধে কিছু দায়িত্ব টেনে নিয়ে আমি ব্লিসের বোঝা হালকা করেছি, যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করে সে আরো নিখুঁতভাবে অরোরার নেকড়েগুলো বা সোলারিয়ার স্পেসারকে সামলাতে পারে। তা ছাড়া আমি ব্লিসের মাধ্যমে কমপরেলন এবং নিউ আর্থের মহিলাকে প্রভাবিত করেছি যেন তারা আপনার প্রতি সদয় থাকে, যেন আপনি নির্বিঘ্নে অভিযান চালিয়ে যেতে পারেন।
বিষণ্ণভাবে হাসল ট্র্যাভিজ। আমার জানা উচিত ছিল, তাই না?
ঠিক বিপরীত, স্যার। বেশিরভাগ সময়েই আপনি নিজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। দুই মহিলা প্রথম থেকেই ছিল আপনার প্রতি দুর্বল। আমি শুধু সেই অনুভূতিই বাড়িয়ে দেই-সবই রোবটিকস এর কঠোর নিয়মের ভেতরে থেকে। এবং এই কঠোর নিয়মগুলো-এবং আরো অনেক কারণে-সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে, বহু পরিশ্রমে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনাকে হারালে আমার অনেক ক্ষতি হতো। ..
এবং আমি এখানে এসেছি; বলল ট্র্যাভিজ। আপনি আমার কাছে কী চান? গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে আমার সিদ্ধান্তের নিশ্চয়তা?
ডানীল-এর চেহারা সবসময়ই ভাবলেশহীন তারপরেও কেমন যেন একটা হতাশা ফুটে উঠল। না, স্যার। শুধু সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়। আরো বড় প্রয়োজনে আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমি মারা যাচ্ছি।
.
সম্ভবত ডানীল কথাটা বলেছে পুরোপুরি নিরাসক্তভাবে; অথবা স্বল্পজীবি মানুষের কাছে বিশ হাজার বছর বেঁচে থাকার পর মৃত্যু আর কোনো করুণ ঘটনা নয়। তবে যাই হোক ট্র্যাভিজ করুণা বোধ করল না।
মৃত্যু? মেসিন মরতে পারে?
আমি আমার অস্তিত্ব প্রত্যাহার করে নিতে পারি, স্যার। যে শব্দ আপনি ব্যবহার করেন। আমি বৃদ্ধ। যে সময়ে আমাকে সচেতন করে তোলা হয় সেই সময়ের কোনো অনুভবক্ষম সত্তা আজ বেঁচে নেই। এমনকি আমারও ধারাবাহিকতার অভাব হচ্ছে ।
কীভাবে?
আমার শরীরে এমন কোনো অংশ নেই যা রিপ্লেস করা হয়নি। একবার না বহুবার। এমনকি আমার পজিট্রনিক ব্রেইনও রিপ্লেস করা হয়েছে পাঁচবার। প্রতিবারই পূর্বের ব্রেইনের সকল উপাদান নতুন ব্রেইনে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রতিবারই নতুন ব্রেইনের দক্ষতা, জটিলতা, স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বেড়েছে হাজার গুণ । কিন্ত–
কিন্তু?
কিন্তু যতই উন্নত আর জটিল হচ্ছে তত বেশি হারে ক্ষয় হচ্ছে। আমার বর্তমান ব্রেইন প্রথমটার চেয়ে এক শ হাজার গুণ বেশি সংবেদনশীল এবং কর্মক্ষমতা দশ মিলিয়ন গুণ বেশী। কিন্তু যেখানে আমার প্রথম ব্রেইন টিকেছিল দশ হাজার বছর, বর্তমানেরটা মাত্র ছয় শ বছরের পুরনো এবং নষ্ট হতে চলেছে। বিশ হাজার বছরের সম্পূর্ণ স্মৃতির রেকর্ড এবং সঠিক রিকল মেকানিজম এবং ব্রেইন পরিপূর্ণ। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে; এবং হাইপার স্পেসাল দূরত্ব থেকে মাইণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আরো দ্রুত কমছে। আরেকটা ব্রেইন যে তৈরি করতে পারব না, তা না। কিন্তু যতো জটিল হবে ক্ষয় হবে ততো দ্রুত।
পেলোরেট মনে হলো যেন বিশাল সমস্যায় পড়েছে, কিন্তু, ডানীল, গায়া এখন আপনাকে ছাড়াই চলতে পারবে। কারণ, ট্র্যাভিজ গ্যালাক্সিয়া নির্বাচন করেছে।
অনেক দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, স্যার। বলল ডানীল, বরাবরের মতো নিরাবেগ গলায়। অপ্রত্যাশিত বাধা বিঘ্ন সত্ত্বেও গায়া পুরোপুরি তৈরি হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। যে সময়ে ট্র্যাভিজ নামের একজন মানুষ-যে মূল সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তাকে খুঁজে বের করা হয়-তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। ভাববেন না যে নিজের জীবন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেইনি। ধীরে ধীরে কাজের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি, জরুরি মুহূর্তের প্রয়োজনে শক্তি সংরক্ষণের জন্যে। যখন দেখি যে পৃথিবীর চাঁদের আইসোলেশন বজায় রাখা সম্ভব নয় তখন আমার সাথে যে হিউম্যানিফর্ম রোবট ছিল তাদের দিয়ে প্ল্যানেটারি আর্কাইভগুলো থেকে পৃথিবীর সকল রেকর্ড সরিয়ে ফেলি। আমি আর আমার সহযোগী রোবটের সাহায্য ছাড়া গায়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্যালাক্সিয়া তৈরি করতে পারবে না।
এবং আপনি সবকিছুই জানতেন, বলল ট্র্যাভিজ, যখন আমি সিদ্ধান্ত নেই।
বহু আগে থেকেই, স্যার, বলল ডানীল। গায়া অবশ্যই জানত না।
কিন্তু তাহলে, রাগের সাথে বলল ট্র্যাভিজ, এতো ভনিতার কি দরকার ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমি গ্যালাক্সি তন্ন তন্ন করে পৃথিবী খুঁজেছি এবং তার গোপনীয়তা নিয়ে ভেবেছি-জানতাম না সেই গোপনীয়তা আপনি-সিদ্ধান্তকে নিশ্চিত করার জন্য। বেশ, আমি নিশ্চিত করছি। আমি এখন জানি গ্যালাক্সিয়াই আসলে প্রয়োজন। কেন আপনি গ্যালাক্সিকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিচ্ছেন না–আমাকে আমার মতো থাকতে দিচ্ছেন না?
ডানীল বলল, কারণ, স্যার, আমি একটা উপায় খুঁজছি এবং আশা করছি পাব। মনে হয় পেয়েছি। নতুন পজিট্রনিক ব্রেইন তৈরি করার বদলে আমি আমার মস্তিষ্ক কোনো মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত করে নিতে পারি। যে মানুষের মস্তিষ্ক তিন আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ নয় এবং তাতে শুধু আমার কার্যক্ষমতাই বাড়বে না বরং নতুন দক্ষতাও তৈরি হবে। সে কারণেই আমি অপনাদের এখানে নিয়ে এসেছি।
ট্র্যাভিজের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার মানে আপনার পরিকল্পনা হচ্ছে নিজের মস্তিষ্কের সাথে কোনো মানুষের মস্তিষ্ক যুক্ত করে নেওয়া? ফলে মানুষটা তার ইণ্ডিভিজুয়ালিটি হারিয়ে ফেলবে আর আপনি পাবেন দুই মস্তিষ্কের গায়া?
জি স্যার। তাতে আমি অমর হবো না কিন্তু গ্যালাক্সিয়া তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকব।
আর সেজন্যই আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমার ইণ্ডিভিজুয়ালিটি ছেড়ে দিয়ে আপনি তিনটা আইন থেকে আমার স্বাধীনতা এবং বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা নিজের অংশ করে নিতে চান? না।
কিন্তু, একটু আগেই তো বলেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য গ্যালাক্সিয়া প্রয়োজন।
হলেও সেটা তৈরি হতে অনেক সময় লাগবে এবং জীবনটা আমি ইণ্ডিভিজুয়াল হিসেবে থাকতে চাই। আর খুব দ্রুত হলেও, গ্যালাক্সির সব মানুষ ইণ্ডিভিজুয়ালিটি হারাবে। তখন আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। যখন গ্যালাক্সির সবাই নিজের ইণ্ডিভিজুয়ালিটি বজায় রাখবে আমি আমার নিজেরটা হারাতে চাই না।
যা ভেবেছিলাম। আপনার মস্তিষ্ক ভালোভাবে সংযুক্ত করা যাবে না। আর আপনাকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন।
মত পাল্টালেন কখন? বলেছিলেন তো সেজন্যই এখানে নিয়ে এসেছেন।
আমি বলেছি আপনাদের। অর্থাৎ সবার কথাই বলছি।
শক্ত হয়ে গেল পেলোরেট। তাই? ডানীল, মানুষের যে মস্তিষ্ক আপনি সংযুক্ত করবেন সেটা কি আপনার সব স্মৃতি দেখতে পারবে?
অবশ্যই, স্যার।
লম্বা দম নিল পেলোরেট। তা হলে সারা জীবনের সাধনা সফল হবে, এবং তার জন্য আমি আমার ইণ্ডিভিজুয়ালিটি ত্যাগ করতে রাজি। দয়া করে আমার মস্তিষ্ক আপনার মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করে নিন।
নরম সুরে বলল ট্র্যাভিজ, আর ব্লিস? তার কি হবে?
এক মুহূর্তেরও কম সময় দ্বিধা করল পেলোরেট। যেভাবেই হোক আমাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে।
মাথা নাড়ল ডানীল। আপনার প্রস্তাব ড. পেলোরেট, অত্যন্ত মহৎ। কিন্তু আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আপনার মস্তিষ্ক বৃদ্ধ। দুই-তিন দশকের বেশি টিকবে না। আমি অন্য কিছু চাই।-দেখুন! সামনের দিকে দেখালো সে। আমি ওদেরকে ডাকছি।
ব্লিস ফিরে আসছে, হাটছে খুশি মনে।
ঝট করে দাঁড়িয়ে গেল পেলোরেট। ব্লিস! না!
ভয় পাবেন না, ড. পেলোরেট। ডানীল বলল। ব্লিসকে আমি ব্যবহার করতে পারব না। তা হলে গায়ার সাথে যুক্ত হয়ে যাবো। কিন্তু গায়ার কাছ থেকে আমাকে স্বাধীন থাকতে হবে।
তা হলে কে?
আর ব্লিসের পেছনে যে ছোট শরীরটা দৌড়ে আসছে সেদিকে তাকিয়ে ট্র্যাভিজ বলল, রোবট ফেলমকে চায়, জেনভ।
.
ব্লিস ফিরে এল, হাসছে, আনন্দে আছে।
এস্টেটের সীমানার বাইরে আমরা যেতে পারিনি, বলল সে, তবে আমার কাছে সোলারিয়ার মতোই মনে হলো। আর ফেলম তো ধরেই নিয়েছে এটা সোলারিয়া। জিজ্ঞেস করেছিলাম জেম্বির সাথে যে ডানীলের কোনো মিল নেই এটা নিয়ে সে ভেবেছে কিনা। কোনো উত্তর দেয়নি।
ঘুরে কিছু দূরে ফেলমের দিকে তাকালো সে। ডানীলকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাচ্ছে। ডানীল যদিও ভাবলেশহীন, মাথা নাড়ছে মাঝে মাঝে। বাঁশির সুর শুনতে পেল তারা। পাতলা, পরিষ্কার এবং সুরেলা।
জানো মহাকাশ যান থেকে নামার সময় সে বাঁশি সাথে করে নিয়ে এসেছে। মনে হয় কিছুক্ষণ ওকে ডানীল থেকে আলাদা করা যাবে না।
এই মন্তব্যের পরে ভারী নীরবতা চেপে বসল, ব্লিস পুরুষ দুজনের দিকে তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কী ব্যাপার?
ইশারায় পেলোরেটকে দেখালো ট্র্যাভিজ। গলা পরিষ্কার করে নিল পেলোরেট, আসলে ব্লিস, ফেলম এখন থেকে স্থায়ীভাবে ডানীলের কাছে থাকবে।
তাই, বলল ব্লিস, তারপর ডানীলের কাছে যেতে উদ্যত হল, কিন্তু হাত ধরে টেনে তাকে থামালো পেলোরেট। ব্লিস, ডিয়ার, তুমি পারবে না। গায়া যতখানি শক্তিশালী সে একাই তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আর গ্যালাক্সিয়া তৈরি করতে হলে ফেলমকে অবশ্যই তার সাথে থাকতে হবে। আমি বুঝিয়ে বলছি-আর গোলান, কোথাও ভুল হলে তুমি শুধরে দিও।
শুনল ব্লিস। শুনতে শুনতে তার চেহারায় ফুটে উঠল হতাশা।
ট্র্যাভিজ বলল, বুঝতে পারছ, ব্লিস। ফেল ম একজন স্পেসার আর ডানীলকে তৈরি করেছিল স্পেসাররাই। এই শিশু বেড়ে উঠেছে রোবটের পরিচর্যায় এবং ঠিক এটার মতো বিরান ম্যানসন ছাড়া অন্য কিছু চেনে না। তার ট্র্যানসডাকটিভ পাওয়ার আছে, যা ডানীলের প্রয়োজন, এবং সে তিন থেকে চার শ বছর বাঁচবে, সম্ভবত গ্যালাক্সিয়া তৈরি হতে ঠিক সেই সময়ই প্রয়োজন।
ব্লিসের চোখ ভেজা, বলল, আমার সন্দেহ রোবট পৃথিবীর পথে আমাদের অভিযান এমনভাবে পরিচালনা করেছে যেন আমরা সোলারিয়ায় গিয়ে বাচ্চাটাকে তার ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসি।
কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ, সে হয়তো শুধু সুযযাগের সদ্ব্যবহার করেছে। আমার মনে হয়না এই মুহূর্তে হাইপার স্পেসাল দূরত্বে আমাদেরকে তার হাতের পুতুল বানানোর মতো শক্তি আছে।
না। তার উদ্দেশ্য ছিল। সে নিশ্চিত করেছে যেন বাচ্চাটার প্রতি আমার দুর্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং তাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে না এসে নিয়ে আসি; এমনকি প্রথম থেকেই তোমার রাগ হিংসার হাত থেকে রক্ষা করেছি।
সম্ভবত সেটা শুধুই তোমার গায়ান মনোভাব, ডানীল শুধু সেটাকেই একটু বাড়িয়ে তুলেছে। শোন ব্লিস, কি লাভ হবে? ধর ফেলমকে তুমি সাথে নিয়ে গেলে, কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবে, যেখানে গেলে এখন যেমন খুশি সেরকম খুশি হতে পারবে? সোলারিয়ায় নিয়ে যাবে নৃশংস মৃত্যুর জন্য; কোনো জনবহুল গ্রহে যেখানে সে অসুস্থ হয়ে মারা যাবে; গায়ায় যেখানে গেলে শুধু জেম্বির জন্য তার হৃদয় আকুল হয়ে থাকবে; এই লম্বা অভিযানে সে যেখানেই গেছে ধরে নিয়েছে সেটাই তার সোলারিয়া? আর গ্যালাক্সিয়ার স্বার্থে ডানীলের জন্য তুমি আর কোনো বিকল্প দিতে পারবে?
ব্লিস নীরব, বিষণ্ণ।
হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল পেলোরেট, ব্লিস, বলল সে, আমি স্বেচ্ছায় নিজের মস্তিষ্ক ডানীলের মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছিলাম। সে রাজি হয়নি, কারণ আমি বৃদ্ধ। রাজি হলে হয়তো ফেলমকে বাঁচানো যেত।
পেলোরেটের হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেল ব্লিস। ধন্যবাদ, পেল, কিন্তু সেটা হতে চরম মূল্য, এমনকি ফেলমের জন্য হলেও। লম্বা দম নিয়ে হাসার চেষ্টা করল সে। সম্ভবত গায়া ফিরে গেলে গ্লোবাল অর্গানিজমের ভেতর নিজের একটা সন্তানের জন্য জায়গা পাওয়া যাবে-এবং আমি ফেলম নামটা বেছে নেব।
এবং ডানীল যেন বুঝতে পারছে তাদের আলোচনা শেষ, হেঁটে আসতে লাগল তাদের দিকে, ফেলম তার পাশে লাফাতে লাফাতে আসছে।
হঠাৎ করেই দৌড়াতে শুরু করল ফেলম এবং তাদের কাছে পৌঁছল প্রথমে। ব্লিসকে বলল, ধন্যবাদ, ব্লিস, আমাকে জেম্বির কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং মহাকাশযানে আমার যত্ন নেওয়ার জন্য। তোমার কথা আমার সবসময়ই মনে থাকবে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল, দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল ঘনিষ্ঠভাবে।
আশা করি তুমি সুখী হবে, বলল ব্লিস, আমিও তোমাকে সবসময় মনে রাখব, ফেলম ডিয়ার, তারপর ছেড়ে দিল।
তারপর পেলোরেটের দিকে ঘুরল ফেলম, তোমাকেও ধন্যবাদ, পেল, তোমার বই পড়তে দেওয়ার জন্য। তারপর আর অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে একমুহূর্ত দ্বিধার পর ট্র্যাভিজের দিকে ঘুরল সে, চিকন মেয়েলি হাত বাড়িয়ে দিল।
হাতটা কিছুক্ষণ ধরে রেখে ছেড়ে দিল ট্র্যাভিজ। গুডলাক, ফেলম। বিড়বিড় করে বলল সে।
আপনারা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যা করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ, স্যার এবং ম্যাডাম। বলল ডানীল। আপনারা এখন চলে যেতে পারেন, কারণ অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। আর কাজও শেষ হবে খুব শিগগির, এবং এবার সফলভাবে।
কিন্তু ব্লিস বলল, দাঁড়ান, এখনও শেষ হয়নি। আমরা এখনো জানি না মানবজাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে ট্র্যাভিজ কোনটা বেছে নিয়েছে। গ্যালাক্সিয়া নাকি আইসোলেটদের বিশাল জনসংখ্যা।
সে কিছুক্ষণ আগেই বিষয়টার ফায়সালা করেছে, ম্যাডাম। সে গ্যালাক্সিয়াকে বেছে নিয়েছে।
আমি ট্র্যাভিজের মুখ থেকে নিজের কানে শুনতে চাই।–কোনটা হবে, ট্র্যাভিজ?
শান্ত সুরে বলল ট্র্যাভিজ, তুমি কোনটা চাও, ব্লিস? আমি যদি গায়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত দেই, তুমি ফেলমকে ফিরে পাবে।
আমি গায়া। তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে অবশ্যই জানতে হবে এবং তার পেছনের যুক্তি, অন্য কিছু না।
ওকে বলুন, স্যার, আপনার মাইণ্ড পুরোপুরি স্পর্শহীন।
এবং ট্র্যাভিজ বলল, আমার সিদ্ধান্ত গ্যালাক্সিয়া। এটা নিয়ে আমার মনে আর কোনো দ্বিধা নেই।
.
স্বাভাবিক গতিতে এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত গুনতে যে সময় লাগার কথা, সেই সময় পর্যন্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ব্লিস, যেন গায়ার সকল অংশে সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছে। তারপর বলল, কেন?
মন দিয়ে শোন, বলল ট্র্যাভিজ। আমি প্রথম থেকেই জানি মানবজাতির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দুটো-গ্যালাক্সিয়া অথবা সেলডন প্ল্যানের সেকেণ্ড এম্পায়ার। এবং আমার মনে হয়েছে দুটো সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ একসাথে হতে পারে না একটাকে বাদ দিতে হবে। আবার গ্যালাক্সিয়া তৈরি হবে না যদি সেলডন প্ল্যানে কোনো মৌলিক ত্রুটি না থাকে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, সেলডন প্ল্যান সম্পর্কে আমি বিস্তারিত কিছুই জানতাম না, শুধু মৌলিক অনুমিতিগুলো ছাড়া। সেগুলো হচ্ছেঃ এক ক্রমাগত পারস্পরিক ক্রিয়াশীল। মানুষের সংখ্যা পরিসংখ্যানিকভাবে বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট বড় হতে হবে; দুই, ফলাফল অর্জনের আগে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণের উপসংহার মানুষকে জানানো যাবে না।
যেহেতু আমি এরই মধ্যে গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মনে হলো যেন অবচেতন মনে আমি জানতাম সেলডন প্ল্যানে ত্রুটি আছে এবং সেগুলো অনুমিতির মাঝেই আছে। অথচ আমি কোনো ভুল বের করতে পারলাম না। তখন আমি পৃথিবী খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হই, বুঝতে পারছিলাম কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া পৃথিবী নিজেকে এভাবে লুকিয়ে রাখেনি। সেই উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।
পৃথিবীতে পৌঁছলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে সেটা ভাবার কোনো যুক্তি ছিল না। কিন্তু আমি কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, এবং অন্য কিছু ভাবতে পারছিলাম না।–এবং সম্ভবত সোলারিয়ান শিশুর জন্য ডানীলের ইচ্ছা আমাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম পৃথিবীতে, তারপর চাদে। ব্লিস ডানীলের মাইণ্ড শনাক্ত করল, বলল এটা মানুষও না, রোবটও না। সত্যি কথা। ডানীলের মতো অতি বুদ্ধিমান রোবট আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। আবার সে মানুষও না। পেলোরেট বলল, নতুন কিছু এবং সেটাই আমার নিজস্ব নতুন কিছু করার চিন্তার সূত্রপাত ঘটায়; একটা নতুন ধারণা।
বহুদিন পূর্বে ডানীল এবং তার সহকারীরা রোবটিক্সের চতুর্থ নিয়ম তৈরি করে। যা বাকি তিনটা থেকে অনেক মৌলিক, ফলে আমি হঠাৎ করেই সাইকোহিস্টোরির তৃতীয় অনুমিতিটা ধরতে পারলাম যা বাকি দুটো থেকে অনেক বেশি মৌলিক; এত বেশি মৌলিক যে সেটা নিয়ে কেউ কখনো চিন্তা করেনি।
তৃতীয় অনুমিতি হচ্ছে, প্রথম দুটো অনুমিতি মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট, এবং সেগুলো একটা অদৃশ্য অনুমিতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, সেটা হলো গ্যালাক্সিতে মানুষই একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী, এবং একমাত্র অর্গানিজম যা সমাজও ইতিহাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটাই হচ্ছে না বলা সেই অনুমিতি; গ্যালাক্সিতে একটাই বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, এবং সেটা হচ্ছে হোমোস্যাপিয়েন্স। যদি নতুন কিছু থাকে, যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তাদের আচরণ সাইকোহিস্টোরির গণিতের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাবে না, সেলডন প্ল্যান অর্থহীন হয়ে পড়বে। বুঝতে পেরেছ?
ট্র্যাভিজ তার কথা বোঝানোর জন্য সত্যিই আন্তরিক। আবার জিজ্ঞেস করল বুঝতে পেরেছ?
হা, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, ওল্ড চ্যাপ বলল পেলোরেট।
হ্যাঁ? বল।
মানুষ গ্যালাক্সির একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।
রোবটস? বলল ব্লিস। গায়া?
একটু চিন্তা করল পেলোরেট তারপর দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল স্পেসাররা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর মানুষের ইতিহাসে রোবটরা তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। সমসাময়িক সময় ছাড়া গায়াও তেমন কোনো ভূমিকা পালন করেনি। রোবট মানুষের তৈরি, গায়া রোবটের তৈরি-এবং দুটোই তিনটা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ, মানুষের কল্যাণ করতে তারা বাধ্য। ডানীলের বিশ হাজার বছরের পরিশ্রম এবং গায়ার দীর্ঘদিনের অগ্রগতি গোলান ট্র্যাভিজের এক কথাতেই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারত। তা হলে বোঝাই যায় মানুষ গ্যালাক্সির একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী এবং সাইকোহিস্টোরি প্রমাণিত সত্য।
গ্যালাক্সির একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী, ধীরে ধীরে বলল ট্র্যাভিজ। আমি একমত। কিন্তু আমরা গ্যালাক্সি নিয়ে এতো বেশি এবং ঘন ঘন কথা বলি যে এটাই যে যথেষ্ট নয় সেটা বোঝার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। গ্যালাক্সিই মহাবিশ্ব না। আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে।
ব্লিস আর পেলোরেটের চোখে অস্বস্তি। ডানীল শুনছে সীমাহীন গাম্ভীর্য নিয়ে, হাত বোলাচ্ছে ফেলমের মাথায়।
শোন আবার,বলল ট্র্যাভিজ। গ্যালাক্সির ঠিক বাইরে আছে ম্যাগলিনাফ মেঘস্তর, সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ যেতে পারেনি। তার পরে রয়েছে কয়েকটা ছোট গ্যালাক্সি, এবং খুব বেশি দূরে না, কাছেই রয়েছে বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, আমাদের গ্যালাক্সিব চেয়েও বড়। তারপরে আরো বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে।
আমাদের গ্যালাক্সি একটা টেকনোলজিক্যাল সমাজ গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান উন্নত প্রাণীর জন্ম দিয়েছে। কিন্তু অন্যগুলো সম্বন্ধে কি জানি? আমাদেরটা হয়তো একরকম। বাকিগুলোর কোনোটাতে-বা সবগুলোতে-হয়তো অনেকগুলো প্রজাতীর বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, নিজেদের ভেতর লড়াই করছে। এবং আমাদের কাছে অপরিচিত। সম্ভবত নিজেদের লড়াই তাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে, কিন্তু যদি কোনো গ্যালাক্সিতে একটা প্রজাতি বাকি প্রজাতিগুলোর উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে, তা হলে সে হয়তো অন্য গ্যালাক্সিতে হানা দেওয়ার চেষ্টা করবে।
হাইপারস্পেসালি গ্যালাক্সি একটা বিন্দু, মহাবিশ্বও তাই। আমরা অন্য কোনো, গ্যালাক্সিতে যাইনি, অন্য কোনো গ্যালাক্সির বুদ্ধিমান প্রাণীরাও এখানে আসেনি-কিন্তু যে-কোনো সময় এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। আর যদি হানাদারেরা আসে। তখন তারা কোনো না কোনো ভাবে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই বাধিয়ে দেবে। মানবজাতির ইতিহাসই হচ্ছে যুদ্ধবিগ্রহ, লড়াই। আমরা এখন ঝগড়া বিবাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। শত্রু যদি দেখে যে আমাদের ভেতর একতা নেই, আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছি তখন সহজেই তারা আমাদের ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। একমাত্র সত্যিকারের প্রতিরক্ষা হচ্ছে গ্যালাক্সিয়া তৈরি করা, কোনো সত্তা কখনো নিজের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। সে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে হানাদারদের বাধা দিতে পারবে।
তুমি যা বলছ তা অত্যন্ত ভয়ংকর। গ্যালাক্সিয়া তৈরি করার সময় কি পাব আমরা। বলল ব্লিস।
উপরে তাকালো ট্র্যাভিজ, যে পাতলা আস্তরণ চাঁদের সারফেস এবং মহাকাশ থেকে তাকে আলাদা করেছে যেন সেটা ভেদ করে দেখবে; যেন মহাকাশের অকল্পনীয় গতিপথে ভেসে বেড়ানো দূরের গ্যালাক্সিগুলো দেখবে।
সে বলল, আমার জানা মতে, মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আমাদের হামলা করেনি। আর কয়েকটা শতাব্দী পার করতে হবে, সম্ভবত মানব সভ্যতার উদ্ভবের পর থেকে যে সময় পার হয়েছে সেই সময়ের দশ হাজার ভাগের এক ভাগেরও কম সময়। তারপর আমরা নিরাপদ। তা ছাড়া, ট্র্যাভিজ হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করল, হয়তো এরই মধ্যে শক্ররা এখানে চলে এসেছে, আমাদের মধ্যে।
এবং সে চোখ নামিয়ে ফেলমের নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকাতে পারল–হার্মাফ্রোডিটিক, ট্র্যান্সডাকটিভ, ভিন্ন-কারণ সবাই তার উপর নির্ভর করছে।
-: সমাপ্ত :-