চতুর্থ পর্ব – সোলারিয়া
১০. রোবটস
ডিনারের সময় গভীর চিন্তায় ডুবে রইল ট্র্যাভিজ, ব্লিস পূর্ণ মনযোগ দিল খাওয়ার দিকে।
একমাত্র পেলোরেট কথা বলার চেষ্টা করল। বোঝানোর চেষ্টা করল এটা যদি অরোরা গ্রহ হয় এবং এখানেই প্রথম বসতি স্থাপন করা হলে এই গ্রহ পৃথিবীর খুব কাছাকাছি হবে।
কাছাকাছি সৌরজগৎগুলো খুঁজে দেখা দরকার, সে বলল, মাত্র কয়েকশ নক্ষত্রের আশপাশে অনুসন্ধান চালাতে হবে।
নিচু গলায় বোঝানোর চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ। হিট-অ্যাণ্ড-মিস পদ্ধতি হচ্ছে শেষ পদক্ষেপ। পৃথিবী খুঁজে পেলেও সেখানে পৌঁছানোর আগে যতটুকু সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে নিতে চায় সে। এর বেশি কিছু বলল না, বিরক্ত হয়ে পেলোরেট মুখ বন্ধ করল।
খাওয়া শেষেও যখন নিজে থেকে কিছু বলল না ট্র্যাভিজ, পেলোরেট তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমরা কি এখানেই থাকব, গোলান?
অন্তত আজকের রাত। একটু চিন্তা করা দরকার।
বিপদ হবে না?
কুকুর থেকে যদি ভয়ংকর কিছু না থাকে তা হলে মহাকাশযানের ভেতর আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
যদি সেরকম বিপদ দেখা দেয় তা হলে কত দ্রুত উপরে উঠতে পারব?
কম্পিউটারকে সতর্ক করে রেখেছি। মনে হয় দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই টেক অফ করতে পারব। কোনো অপ্রত্যাশিত বিপদ হলে এটা আমাদের সতর্ক করে দেবে, কাজেই সবার একটু ঘুমিয়ে নেওয়া উচিত। আগামী কাল সকালে হয়তো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারব।
বলা সহজ, কম্পিউটার রুমের মেঝেতে হাত পা ভাঁজ করে শুয়ে ভাবল। ট্র্যাভিজ। বিছানায় যায়নি কারণ ঘুম আসবে না। এখানে অন্তত জরুরি মুহূর্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবে।
তারপর একটা পদশব্দ শুনে উঠে বসল। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, জেনভ?
না, আমি ব্লিস।
হাত বাড়িয়ে ডেস্কের কোণার সংযোগ স্পর্শ করল ট্র্যাভিজ, হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। ব্লিসের গায়ে হালকা রঙের রাতের পোশাক।
কী ব্যাপার।
তোমার ঘরে তোমাকে দেখলাম না। তারপর নিউরোনিক তরঙ্গ অনুসরণ করে বুঝলাম এখানে আছো, ঘুমাওনি। তাই এসেছি।
বুঝলাম, কিন্তু কী চাও?
ভয় পেয়ো না। তোমার কুমারত্ব নষ্ট করবো না।
আমারও মনে হয় না করবে, ট্র্যাভিজ পাল্টা রসিকতা করল। ঘুমাওনি কেন? আমাদের চেয়ে তোমারই বেশি প্রয়োজন।
বিশ্বাস কর, করুণ স্বরে বলল ব্লিস, ওই প্রাণীগুলোর সাথে লড়াই আমাকে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে।
আমি জানি।
কিন্তু তোমার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। সেসময় পেল না থাকলেই ভালো হয়।
কী ব্যাপার?
পেল এর মুখে রোবট এর কথা শুনে তুমি বললে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তার মানে কী?
বুঝতে পারছ না? আমাদের কাছে তিনটা নিষিদ্ধ গ্রহের তিনসেট কো অর্ডিনেটস আছে। আমি তিন গ্রহেই যাবো যেন পৃথিবীতে পৌঁছানোর আগে যতদূর সম্ভব সে সম্বন্ধে জেনে নিতে পারি।
আরেকটু কাছে এগিয়ে গেল ট্র্যাভিজ যেন নিচু গলায় কথা বলা যায়, তারপর পিছিয়ে এল ঝট করে। দেখ আমি চাই না পেলোরেট আমাদেরকে দেখে ফেলে। সে কিছু মনে করে বসতে পারে।
ভয় নেই। ও ঘুমাচ্ছে, জেগে উঠলে আমি বুঝতে পারব।–বলে যাও। তুমি তিনটা গ্রহেই যেতে চাও। পরিবর্তন কি হলো।
কোনো গ্রহেই বেশি সময় নষ্ট করার ইচ্ছা আমার ছিল না। যদি আরোরা গ্রহে বিশ হাজার বছর কোনো মানুষ বাস না করে তা হলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই এখানে থাকবে না। ধুলো, বালি বা ধ্বংসস্তূপ ঘেটে সামান্য একটুকরা তথ্যের আশায় এখানে বসে বসে কুকুর, বিড়াল, ষাড় বা অন্য কোনো প্রাণী যদি হিংস্র হয়ে উঠে সেগুলোর মোকাবিলা করার কোনো প্রয়োজন নেই। হয়তো অন্য দুটো গ্রহতে এখনও মানুষ বাস করে। তাই আমার ইচ্ছা ছিল যত দ্রুত সম্ভব রওয়ানা দেওয়া। হয়তো এখন মহাকাশে থাকতাম।
কিন্তু?
কিন্তু যদি এই গ্রহে রোবট থাকে যেগুলো এখনও কাজ করতে সক্ষম তা হলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। মানুষের চেয়ে রোবট সামলানো অনেক সহজ। কারণ আমি যতদূর জানি ওগুলো শুধু আদেশ পালন করে এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।
তাই রোবট খোঁজার জন্য তুমি এই গ্রহে কিছুদিন সময় নষ্ট করবে।
করতে তো চাই না, ব্লিস। আমার মতে রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া বিশ হাজার বছর। কোনো রোবট কাজ করতে পারবে না। তারপরেও তুমি যেহেতু একটা রোবটের ভেতর এক ঝলক সক্রিয়তা দেখেছ পরিষ্কার বোঝা যায় যে আমার ধারণা ভুল। হয়তো যন্ত্রগুলো অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী, অথবা রক্ষণাবেক্ষণের উন্নত স্বয়ংক্রিয়। ব্যবস্থা আছে।
আমার কথা শোন ট্র্যাভিজ, এবং দয়া করে কথাগুলো গোপন রাখবে।
গোপন রাখতে হবে! অবাক হয়ে বলল ট্র্যাভিজ। কার কাছ থেকে।
পেল এর কাছ থেকে। শোন, পরিকল্পনা পাল্টাতে হবে না। তোমার কথাই ঠিক। এখনো কাজ করতে সক্ষম কোনো রোবট এই গ্রহে নেই। আমি কিছু . পাইনি।
যেটার কথা বললে?
বহুদিন আগেই ওটার কলকবজা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
তুমি বলেছিলে-
বলেছিলাম। পেল এর ধারণা সে ওটাকে নড়তে দেখেছে, শব্দ শুনেছে। আসলে পুরো জীবন সে কাটিয়েছে শুধু তথ্য সংগ্রহ করে। ওভাবে স্কলারদের দুনিয়ায় জায়গা করে নেওয়া খুব কঠিন। চেয়েছিল নিজে কিছু আবিষ্কার করবে। অরোরা শব্দটা বের করে কী প্রচণ্ড খুশি হয়েছিল তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করার।
অর্থাৎ জেনভ নিজেকে বুঝিয়েছে যে সে সক্রিয় রোবট দেখেছে যদিও আসলে ব্যাপারটা তা নয়।
সে যা দেখেছে সেটা হচ্ছে এক তাল ধাতু, যে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে আছে সেটার মতো কনশাসনেসও নেই।
কিন্তু তুমি তো তাকে সমর্থন করেছ।
উপায় ছিল না। ওর খুশি আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
পুরো একমিনিট ব্লিস এর দিকে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ, দয়া করে ব্যাখ্যা করে বলবে কেন ওর খুশি তোমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার? জেনভ বুড়ো মানুষ, আইসোলেট। তোমার বয়স কম, সুন্দরী আর আইসোলেটদের পছন্দ করো না। গায়ার অন্য কোনো অংশে নিশ্চয়ই সুদর্শন স্বাস্থ্যবান তরুণরা আছে। তাদের সাথে সম্পর্ক করতে পারতে। জেনভের ভেতর কী দেখলে?
তুমি তাকে ভালবাসো না? গম্ভীর গলায় বলল ব্লিস।
আমি তাকে পছন্দ করি।
তোমাদের পরিচয় খুব অল্পদিনের। তারপরেও কেন পছন্দ করো?
নিজের অজান্তেই ট্র্যাভিজের সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মানুষটা বেশ অদ্ভুত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সারা জীবন কখনোই সে নিজেকে নিয়ে ভাবেনি। বিনা আপত্তিতে আমার সাথে এসেছে। আশা করেছিল আমি তাকে ট্রানটর নিয়ে যাবো, কিন্তু যখন বললাম আমরা গায়া যাবো, একটুও তর্ক করল না। এখন এই অনুসন্ধানে এসেছে, যদিও জানে কাজটা বিপজ্জনক। কোনো সন্দেহ নেই যদি আমার জন্য বা অন্য কারো জন্য তাকে জীবন দান করতে হয় কোনো দ্বিধা না করেই সে তা করবে।
তুমি ওর জন্য জীবন দিতে পারবে, ট্র্যাভিজ?
হয়তো, যদি চিন্তা করার সময় না পাই। কিন্তু চিন্তা করার অবকাশ পেলে হয়তো আমি পিছিয়ে যাবো। আমি ওর মতো ভালো মানুষ না। সেকারণেই বেশি করে তাকে রক্ষা করতে চাই। বিশেষ করে তোমার কাছ থেকে, যেন তুমি কখনো প্রতারণা করে আমার বন্ধুকে কষ্ট না দাও।
হ্যাঁ, আমি জানি, তুমি এমনই ভাববে। কেন বুঝতে পারছ না, তুমি ওর ভেতরে যা দেখেছ আমিও তাই দেখেছি–এবং বড় কথা হচ্ছে আমি সরাসরি ওর মাইণ্ড এর সাথে যোগাযোগ করতে পারি। কষ্ট দেওয়ার মতো কোনো আচরণ আমি করেছি? রোবট নিয়ে ওর কল্পনা কেন সমর্থন করেছি, দুঃখ দেওয়ার জন্য? ট্র্যাভিজ তুমি যাকে ভালোমানুষী বল আমরা তাতে অভ্যস্ত। কারণ গায়ার প্রতিটি অংশ সমগ্রকের কল্যাণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ আমরা জানি না। এর ফলে আসলে আমাদের কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয় না, কারণ গায়ার সকল অংশই সমগ্রক, তুমি বুঝবে না। পেল এর ব্যাপার ভিন্ন।
এখন আর ট্র্যাভিজের দিকে তাকাচ্ছে না ব্লিস, আপন মনে কথা বলছে, পেল এর পাওয়ার কিছুই নেই, হারাবার আছে অনেক কিছু। সেখানেই আমার লজ্জা, কারণ আমার তো হারানোর কোনো ভয় নেই। তুমি জানো ওকে আমি তোমার চেয়েও কত ভালোভাবে চিনি? এবং তুমি মনে করো ওকে আমি দুঃখ দেব?
ব্লিস, আজকেই তুমি আমাকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলে। আমি আগ্রহ। দেখাইনি। কারণ সন্দেহ ছিল। এবার আমার পালা। এসো আমরা বন্ধু হই। তুমি হয়তো গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতেই থাকবে। আমিও হয়তো প্রত্যাখ্যান করতেই থাকব, তা সত্ত্বেও আমরা বন্ধু হই। হাত বাড়ালো ট্র্যাভিজ।
অবশ্যই, ট্র্যাভিজ। শক্ত করে ট্র্যাভিজের হাত জড়িয়ে ধরল ব্লিস।
.
নিজের মনেই হাসল ট্র্যাভিজ। কোনো নক্ষত্রের অবস্থান বের করার সময় সে যখন কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে, ব্লিস আর পেলোরেট উপস্থিত থেকে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করত। এখন দুজনেই নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে বা বিশ্রাম নিচ্ছে। সম্ভবত ওরা ধরে নিয়েছে কী করতে হবে ট্র্যাভিজ সেটা ভালোভাবেই জানে। আরেকটা নক্ষত্র-উজ্জ্বল এবং গ্যালাকটিক ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত হয়নি–দেখা যাচ্ছে। এটা অরোরার নক্ষত্রের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল।
প্রাচীন যুগের নিয়ম কানুন বা প্রথার অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দীর ইতিহাস মুছে যায়। বিশাল বিশাল সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ভুলে যাওয়া শতাব্দী বা সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ থেকে এমন কিছু নিয়ম বা প্রথা বেরিয়ে আসে যেগুলো পরবর্তী হাজার হাজার বছর অবিকৃত অবস্থায় প্রচলিত থাকে–যেমন এই কো-অর্ডিনেটসগুলো।
কথাগুলো পেলোরেটকে বলেছিল কিছুক্ষণ আগে, জবাবে পেলোরেট বলেছিল যে এই কারণেই পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তি নিয়ে গবেষণা এত আকর্ষণীয়।
যাই হোক, ড্যানিডার দেওয়া কো-অর্ডিনেটস থেকে সময়ের পরিবর্তন অনুযায়ী নক্ষত্র যেখানে থাকার কথা ঠিক সেখানেই রয়েছে। ট্র্যাভিজের কোনো সন্দেহ নেই যে তৃতীয় নক্ষত্রও পাওয়া যাবে। যদি তাই হয় পঞ্চাশটা নিষিদ্ধ গ্রহের যে গল্প শুনেছে সেটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, শুধু ভাবনার বিষয় হচ্ছে বাকি সাতচল্লিশটা গ্রহ কোথায়।
নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত একটা বাসযোগ্য গ্রহ পেয়ে মোটেই অবাক হলো না ট্র্যাভিজ। তার মনে কোনো সন্দেহই ছিল না। ফার স্টারকে কক্ষপথে এমনভাবে স্থাপন করল যেন ধীর গতিতে গ্রহটাকে প্রদক্ষিণ করে।
মেঘস্তর অনেকখানি ছড়ানো বলে ভূ-পৃষ্ঠ মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। অন্যসব বাসযোগ্য গ্রহের মতোই এখানে প্রচুর পানি আছে। উষ্ণ অঞ্চলে একটা এবং মেরু অঞ্চলে দুটো বিশাল মহাসমুদ্র রয়েছে। মধ্য অক্ষাংশের এক অংশে সর্পিল আঁকাবাঁকা ভূ-ভাগ, অনেকগুলো উপসাগর এবং দু-একটা সংযোজক স্থলভাগ পুরো গ্রহকে ঘিরে রেখেছে। অন্যদিকের ভূ-ভাগ তিনটি অংশে বিভক্ত যার প্রতিটি উত্তর দক্ষিণে চাপা।
আবহাওয়া বিদ্যা জানা থাকলে ট্র্যাভিজ তাপমাত্রা, ঋতুভেদে পরিবেশের বৈশিষ্ট্য বলতে পারত! একবার ভাবল কম্পিউটার দিয়ে জেনে নেবে, তারপর দূর করে দিল চিন্তাটা। আবহাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
বরং এখানেও উন্নত প্রযুক্তির তৈরি কোনো রেডিয়েশন নেই। যত দূর দেখা যায় তাতে মনে হয় না এই গ্রহে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। সারফেসে সবুজের ছড়াছড়ি কিন্তু দিনের অংশে নেই কোনো শহর বন্দর, রাতের অংশে নেই কোনো কৃত্রিম আলো।
এটাও কি আরেকটা গ্রহ যেখানে সব প্রাণী আছে শুধু মানুষ নেই?
অন্য শোবার ঘরের দরজায় শব্দ করল ট্র্যাভিজ।
ব্লিস? একবার ডেকে আবার শব্দ করল।
নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া গেল ভেতরে, তারপর ব্লিসের গলা, হ্যাঁ?
আসতে পারবে? তোমার সাহায্য দরকার।
দাঁড়াও একটু। ঠিকঠাক হয়ে আসছি।
বেরিয়ে আসার পর তাকে মনে হলো বরাবরের মতোই তরতাজা আর সুন্দর। অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য বিরক্ত হলেও কিছু বলল না ট্র্যাভিজ। কারণ এখন তারা বন্ধু।
হেসে আমুদে গলায় বলল ব্লিস, তোমার জন্য কী করতে পারি, ট্র্যাভিজ? ভিউস্ক্রিন দেখাল ট্র্যাভিজ, দেখতেই পারছো এটা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবান একটা গ্রহ। প্রচুর উদ্ভিদ আছে। রাতের অংশে কোনো আলো দেখছি না, এবং প্রযুক্তিগত কোনো রেডিয়েশন নেই। তুমি মনঃসংযোগ করে বলো পশুপাখি বা জীবজন্তু আছে কিনা। একবার মনে হয়েছিল মাঠে গবাদি পশু চরছে, নিশ্চিত নই।
মনঃসংযোগ করল ব্লিস, হা-প্রচুর জীবজন্তু।
স্তন্যপায়ী?
তাই হবে।
আরো গভীরভাবে মনঃসংযোগ করল ব্লিস। এক, দুই করে পার হয়ে গেল অনেকগুলো মিনিট। তারপর দেহ শিথিল হলো, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু তরঙ্গ ধরা পড়ছে যা মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছাকাছি। অনেক বেশি হালকা। আর অনিয়মিত। মনঃসংযোগের পরিমাণ আরো বাড়াল সে। চিন্তিত স্বরে বলল, বৈশিষ্ট্যগুলো নতুন ধরনের, আমার অপরিচিত। এগুলো-কথা থামালো সে।
বেশ? তাড়া লাগাল ট্র্যাভিজ।
এগুলো রোবট ছাড়া আর কিছুই না।
রোবট!
হ্যাঁ, এবং রোবট থাকলে মানুষও থাকবে। কিন্তু আমি ধরতে পারছি না।
রোবট! আবার বলল ট্র্যাভিজ, ভুরু কুঁচকে গেছে।
হ্যাঁ, ব্লিস বলল, এবং প্রচুর।
.
রোবট! বলল পেলোরেট, ট্রাভিজের মতো একই সুরে। তারপর হাসল। তোমার কথাই ঠিক, গোলান, আর আমি তোমাকে সন্দেহ করে ভুল করেছিলাম।
মনে পড়ছে না আমাকে কখন সন্দেহ করলে, জেনভ।
তোমাকে বলিনি। আমার মনে হয়েছিল অরোরাতে কয়েকটা রোবটকে প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। তাই সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। কিন্তু তুমি জানতে এখানে আরো বেশি রোবট আছে।
মোটেই না, জেনভ। আমি একটা জুয়া খেলেছি। ব্লিস বলেছিল মেন্টাল ফিল্ড দেখে মনে হয় অরোরার কিছু রোবট এখনও কার্যক্ষম। কিন্তু আমার ধারণা মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া কোনো রোবট দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকতে পারবে না। যাই হোক, ব্লিস অবশ্য মানুষের কোনো চিহ্ন পায়নি।
পেলোরেট চিন্তিতভাবে ভিউস্ক্রিন দেখছে, সবটাই বনাঞ্চল মনে হচ্ছে, তাই না?
বেশিরভাগ বনাঞ্চল।
মানুষ নেই।
এখনও পাইনি। ব্লিস গ্যালিতে বসে মনঃসংযোগের চেষ্টা করছে। ওর কাছে একটা ছোট্ট যন্ত্র দিয়েছি, কম্পিউটারের সাথে যুক্ত। কিছু পেলে ঐ যন্ত্রের সাহায্যে কম্পিউটার আমাদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাবে।
অস্বস্তি নিয়ে পেলোরেট বলল, এই কাজটা কম্পিউটারকে দিয়ে করানো কি ঠিক হচ্ছে?
কেন জেনভ? এটা বুদ্ধিমান কম্পিউটার। আর আমাদের হাতে যখন কোনো
তথ্য নেই তখন এর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অসুবিধা কি।
উজ্জ্বলভাবে হাসল পেলোরেট, পুরোনো অনেক কিংবদন্তিতে আছে প্রাচীন যুগের মানুষ কিউব মাটিতে ফেলে সিদ্ধান্ত নিত।
তাই। কীভাবে?
কিউবের প্রতিটি তলে একটা করে সিদ্ধান্ত লেখা থাকত-হা-না-সম্ভাব্য বাতিল-এবং আরও অনেক কিছু। ছুঁড়ে দেওয়ার পর যে তল উপরে থাকত সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করত। অথবা একটা স্লটে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত লিখে বল গড়িয়ে দিত। বলটা যে সিদ্ধান্তের উপর গিয়ে থামত সেটাই অনুসরণ করা হত। অনেক মিথলজিস্ট এটাকে লটারি না বলে বলে জুয়া খেলা, কিন্তু আমার মতে দুটো একই জিনিস।
আমরাও একধরনের জুয়া খেলছি।
এমন সময় গ্যালি থেকে ফিরে এল ব্লিস। ট্র্যাভিজের শেষ মন্তব্য শুনতে পেয়েছে। না, জুয়া খেলা না। বলল সে। কোনো সন্দেহ নেই আমার।
তুমি নিশ্চিত? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
আমি মানুষের চিন্তা তরঙ্গ ধরতে পেরেছি। কোনো সন্দেহ নেই।
.
বৃষ্টি হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, পায়ের নিচে ঘাস ভেজা। ঝড়ো বাতাস মেঘ তাড়িয়ে দিচ্ছে।
গাছপালার আড়ালে সুবিধামতো স্থানে অবতরণ করল ফার স্টার। চারদিকে বিস্তীর্ণ চারণভূমি, ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, দূরে বাগান আর শস্যের মাঠ-এবং এখন আর কোনো সন্দেহ নেই-প্রচুর গবাদিপশু মাঠে চড়ছে।
তবে কোনো কাঠামো চোখে পড়ছে না। গাছগুলোর মাঝখানে নিয়মিত দূরত্ব এবং যে দেয়ালগুলো শস্যক্ষেত্রগুলোকে পৃথক করেছে সেগুলো ছাড়া আর কোনো চোখে পড়ার মতো কৃত্রিমতা নেই।
এই কৃত্রিমতা কি রোবটের তৈরি? মানুষের সাহায্য ছাড়া?
হোলস্টারে হাত বোলালো ট্র্যাভিজ। অস্ত্রগুলো পুরোপুরি চার্জ করা। ব্লিসের দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল সে।
অসুবিধা নেই, বলল ব্লিস। মনে হয় না অস্ত্রগুলো তোমাকে ব্যবহার করতে হবে। তবে এই কথা অগেও বলেছিলাম, তাই না?
অস্ত্র নেবে, জেনভ?
মাথা নাড়ল পেলোরেট। তুমি এবং ব্লিস থাকতে আমার বিপদের কোনো ভয় নেই। জানি, এটা কাপুরুষতা। কিন্তু আমাকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে না। এতেই আমি খুশি।
বুঝেছি। শুধু একা একা কোথাও যাবে না। আমি বা ব্লিস আলাদা হয়ে গেলে তুমি আমাদের দুজনের একজনের সাথে থাকবে।
চিন্তা করো না ট্র্যাভিজ। ব্লিস বলল, আমি লক্ষ্য রাখব।
ট্র্যাভিজ প্রথমে মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে এল। বৃষ্টির কারণে বাতাস একটু ঠাণ্ডা, ভালো লাগছে। বৃষ্টির আগে নিশ্চয়ই গুমোট গরম ছিল। নিশ্বাস নিয়ে অবাক হলো সে। প্রত্যেক গ্রহের নিজস্ব গন্ধ থাকে। সেগুলো হয় অদ্ভুত আর বিরক্তিকর। কিন্তু এই গ্রহের গন্ধটা বেশ চমৎকার।
সঙ্গী দুজনকে ডাকল সে। বেরিয়ে এস। বাইরে চমৎকার আবহাওয়া।
পেলোরেট বেরিয়ে এল। এই পরিবেশ বর্ণনা করার জন্য চমৎকার-ই একমাত্র শব্দ। গন্ধটা সবসময় এরকম থাকবে?
এটা কোনো ব্যাপার না। এক ঘণ্টার ভেতরেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব। তখন আর নাকে কোনো গন্ধ লাগবে না।
ভেজা ঘাস। বিরক্ত সুরে বলল ব্লিস।
অসুবিধা কী? গায়ায় বৃষ্টি হয়, তাই না? ট্র্যাভিজ বলল, সেই সময়ই এক চিলতে রোদ বেরিয়ে এল মেঘের ফাঁক দিয়ে।
হ্যাঁ, কিন্তু বৃষ্টি হবে সেটা জানি বলেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি।
খুব খারাপ কথা। অপ্রত্যাশিত আনন্দ থেকে তোমরা বঞ্চিত।
ঠিকই বলেছ। আমি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব।
চারপাশে তাকিয়ে হতাশ সুরে পেলোরেট বলল, কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
ওই উঁচু জায়গাটার পেছন থেকে ওরা এগিয়ে আসছে। বলল ব্লিস। ট্র্যাভিজকে জিজ্ঞেস করল, আমরা সামনে এগিয়ে ওদের সাথে দেখা করব?
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। না এখানেই অপেক্ষা করব। হাজার পারসেক পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এসেছি। বাকি পথটুকু ওদেরকে আসতে দাও।
একমাত্র ব্লিস ওদের এগিয়ে আসা অনুভব করছে। বাকি দুজন দেখল যখন জায়গাটার পিছন থেকে একে একে তিনটা শারীরিক কাঠামো বেরিয়ে এল।
আপাতত এই কজনই। বলল ব্লিস।
কৌতূহল নিয়ে দেখছে ট্র্যাভিজ। জীবনে কখনো না দেখলেও তার কোনো সন্দেহ নেই যে ওগুলো রোবট। নিখুঁত চকচকে মানব শরীরের কাঠামো, অথচ বোঝা যায় না ধাতুর তৈরি। শারীরিক কাঠামো এত বেশি মসৃণ, স্পঞ্জের মতো নরম বলে ভ্রম হয়, যেন মখমল দিয়ে আবৃত। প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছে একবার ছুঁয়ে দেখার।
সত্যি কথা, যদি এটা নিষিদ্ধ গ্রহ হয় তা হলে বহু শতাব্দী এই গ্রহে কোনো। মহাকাশযান বা বাইরের বিশ্বের আগন্তুক পা ফেলেনি। সেক্ষেত্রে ফার স্টার এবং এর আরোহীরা রোবটদের কাছে অপ্রত্যাশিত। অথচ এমন আচরণ করছে যেন নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে।
নিচু স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, এখানে হয়তো এমন তথ্য পাবো যা গ্যালাক্সির অন্য কোথাও পাবো না। কে বলতে পারে রোবটগুলো কত বহু শতাব্দী কাজ করছে। পৃথিবীর অবস্থান জানতে পারে।
অন্য দিকে, ব্লিস বলল, এগুলো হয়তো কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা হয়েছে এবং কিছুই জানে না।
অথবা, বলল পেলোলারেট, জানে কিন্তু আমাদের বলবে না।
ট্র্যাভিজ বলল, আমার ধারণা কেউ যদি না বলার আদেশ দেয় তা হলেই রোবটরা কিছু বলবে না। কিন্তু আমাদের আগমন অপ্রত্যাশিত, তা হলে কেউ এমন আদেশ কেন দেবে।
প্রায় তিন মিটার দূরে রোবটগুলো থেমে দাঁড়ালো, কিছু বলল না।
সেগুলোর উপর থেকে চোখ না সরিয়ে, ব্লাস্টারের উপর হাত রেখে ব্লিসকে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, বলতে পারবে ওগুলো হিংস্র কিনা?
রোবটিক মাইণ্ডের সাথে আমার পরিচয় নেই, ট্র্যাভিজ। তবে অনুভূতিতে কোনো হিংস্রতা ধরা পড়ছে না।
অস্ত্রের উপর থেকে হাত সরিয়ে আনল ট্র্যাভিজ, তবে কাছাকাছি রাখল। ডান হাত উপরে তুলল। হাতের তালু রোবটদের দিকে, ধীর গলায় বলল, অভিনন্দন। আমরা বন্ধুত্ব করতে এসেছি।
মাঝখানের রোবট মাথা নোয়ালো কুর্নিশের ভঙ্গিতে, অথবা এটা হয়তো তাদের দিক থেকে বন্ধুত্বের প্রকাশ, তারপর উত্তর দিল।
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল ট্র্যাভিজের। কারণ রোবটদের ভাষা গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ডের ধারে কাছেও নেই। একটা বর্ণও বুঝতে পারেনি সে।
.
পেলোরেট ঠিক ট্র্যাভিজের মতোই অবাক, তবে তার চেহারায় সন্তুষ্টির ছাপও রয়েছে।
অদ্ভুত ব্যাপার। সে বলল।
অদ্ভুত না। জঘন্য। রুক্ষ্ম স্বরে বলল ট্র্যাভিজ।
মোটেই জঘন্য না। এটাও গ্যালাকটিক, তবে অনেক প্রাচীন। আমি কয়েকটা শব্দ বুঝেছি। লিখে দিলে হয়তো পুরোটাই বুঝতে পারব। উচ্চারণটাই হচ্ছে আসল সমস্যা।
বেশ, কী বলছে এটা?
সম্ভবত বলছে যে তোমার কথা সে কিছুই বুঝতে পারেনি।
আমিও বলতে পারব না এটা কি বলছে, ব্লিস বলল, তবে আমার অনুভূতি বলছে যে এটা হতবাক, স্বাভাবিক। অর্থাৎ যদি আমি সঠিকভাবে রোবটিক আবেগ বিশ্লেষণ করে থাকি অথবা যদি রোববাটিক আবেগ বলে আদৌ কিছু থাকে।
ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে ধীরে ধীরে কিছু একটা বলল পেলোরেট এবং তিন রোবট একসাথে মাথা নোয়ালো।
কী বললে? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
পেলোরেট বলল, একটু সময় চেয়েছি। বেশ মজার ব্যাপার।
বিশ্রী ব্যাপার।
আসলে, গোলান, প্রতিটি বাসযোগ্য গ্রহের নিজস্ব গ্যালাকটিক রয়েছে, যার অনেক কিছুই আমরা বুঝি না। সেগুলো আবার স্ট্যাণ্ডার্ড গ্যালাকটিকের সাথে মিলিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু যেহেতু এই গ্রহ বিশ হাজার বছর মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই ভাষাটা পুরোপুরি অন্যরকম মনে হচ্ছে। কারণটা শুধু রোবটের উপর নির্ভরশীলতা নয় বরং মনে হয় রোবটগুলোকে যে ভাষা বোঝার জন্য প্রোগাম করা হয়েছে তারা শুধু সেটাই বুঝবে। রি-প্রোগ্রাম না হলে ভাষার কোনো পরিবর্তন হবে না, এবং আমরা যা শুনছি সেটা গ্যালাকটিকের অনেক প্রাচীন রূপ।
একটা রোবটাইজ সমাজ কীভাবে ধ্বংস হয়, এটা তার একটা উদাহরণ। বলল ট্র্যাভিজ।
কিন্তু প্রিয় বন্ধু, আপত্তি জানালো পেলোরেট, ভাষা অপরিবর্তনীয় রাখলেই কোনো সমাজ ধ্বংস হয়ে যায় না। এতে অনেক সুবিধেও পাওয়া যায়। হাজার বছরের পুরোনো রেকর্ডের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সহজে বোঝা যায়। বাকি গ্যালাক্সি থেকে হ্যারি সেলডনের সময়ের ইম্পেরিয়াল বাচনভঙ্গি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তুমি এই প্রাচীন গ্যালাকটিক জানো?
জানি বলাটা ঠিক হবে না। আসলে প্রাচীন উপকথা, কিংবদন্তি নিয়ে কাজ করতে করতে কৌশলটা ধরতে পেরেছি। শব্দার্থ আলাদা না হলেও শব্দরূপ একেবারেই ভিন্ন, এবং অনেক বাগধারা বর্তমানে মোটেই ব্যবহৃত হয় না আর উচ্চারণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। দোভাষী হিসেবে কাজ করতে পারি, তবে ভালোভাবে পারব না।
লম্বা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল ট্র্যাভিজ। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। যদুর পারো করো, জেনভ।
রোবটদের দিকে ঘুরল পেলোরেট, একটু অপেক্ষা করল, তারপর ফিরে তাকালো ট্র্যাভিজের দিকে। কী বলব?
জিজ্ঞেস কর পৃথিবী কোথায়।
প্রতিটি শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করল পেলোরেট, সেই সাথে হাত নাড়ছে।
রোবটগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। উত্তর দিল মাঝখানের রোবট। সেও থেমে থেমে কথা বলছে, ইলাস্টিক টানার মতো করে হাত নাড়ছে।
পেলোরেট বুঝিয়ে বলল ট্র্যাভিজকে, সম্ভবত পৃথিবী শব্দটা ওদেরকে ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। আমার ধারণা ওরা ধরে নিয়েছে আমি এই গ্রহের কোনো অঞ্চলের কথা বলছি এবং বলছে যে এমন কোনো অঞ্চলের কথা ওরা জানে না।
এই গ্রহের কোনো নাম আছে?
কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে গ্রহের নাম সোলারিয়া
কখনো শুনেছো?
না।
বেশ, জানতে চাও মহাকাশের হাজার হাজার নক্ষত্রের মাঝে এমন কোনো জায়গা আছে কি যার নাম পৃথিবী। উপরে দেখিয়ে জিজ্ঞেস কর।
আবার কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময়,তারপর পেলোরেট মুখ ঘুরিয়ে বলল, যত দূর বুঝতে পারছি ওরা বলছে মহাকাশে কিছুই নেই।
জিজ্ঞেস কর ওদের বয়স কত; অথবা কতদিন থেকে কাজ করছে।
আমি জানি না কাজ করছে কথাটা কীভাবে বলতে হয়। মাথা নেড়ে বলল পেলোরেট। সত্যিকথা বলতে কি বয়স কত জিজ্ঞেস করার কায়দাও জানি না। দোভাষী হিসেবে আমি যাচ্ছেতাই।
চেষ্টা করো, পেল ডিয়ার।
অনেকগুলো বাক্য বিনিময়ের পর পেলোরেট বলল, ওরা ছাব্বিশ বছর ধরে কাজ করছে।
ছাব্বিশ বছর, হতাশ সুরে বলল ট্র্যাভিজ। তোমার চেয়েও বয়স কম, ব্লিস।
অহংকারী ভঙ্গিতে কথা শুরু করল ব্লিস, আমি–
জানি। তুমি গায়া। হাজার বছরের প্রাচীন। যাই হোক, এই রোবটগুলো নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে পৃথিবীর কথা বলতে পারবে না। কাজের বাইরে অপ্রয়োজনীয় কোনো তথ্য এদের মেমোরি ব্যাংকে নেই।
গ্রহের অন্য কোথাও আরো প্রাচীন রোবট থাকতে পারে। বলল পেলোরেট।
আমার সন্দেহ নেই। তবে জিজ্ঞেস করে দেখো, জেনভ, অবশ্য যদি সঠিক শব্দগুলো তোমার জানা থাকে।
এবারের আলোচনা হলো দীর্ঘ এবং হঠাৎ করেই পেলোরেট হতভম্বভাবে আলোচনা থামিয়ে দিল। গোলান, ঠিক বুঝতে পারছি না। এদের ভাষ্যমতে বয়স্ক। রোবটরা ছোটখাটো কাজ করে। এগুলো মানুষ হলে বলা যেত যে আচরণে ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। এই তিনটা হচ্ছে গৃহস্থালি রোবট, এবং এই ধরনের রোবটরাই কিছু জানে, আমার কথা না, ওদের কথা।
ওরা কিছুই জানে না। অন্তত আমি যা জানতে চাই।
তাড়াহুড়ো করে অরোরা ছেড়ে আসার জন্য আমার এখন দুঃখ হচ্ছে।
প্রয়োজন হলে ওখানে যে কোনো মুহূর্তে ফিরে যাওয়া যাবে। কিন্তু এই রোবটগুলো কয়েক দশকের পুরোনো হলে এদের প্রস্তুতকারীরাও এখানে আছে, এবং তারা অবশ্যই মানুষ। তারপর ঘুরল ব্লিসের দিকে, আসলেই কি তোমার অনুভূতি–
কিন্তু বারণ করার ভঙ্গিতে এক হাত তুলেই থেমে গেল ব্লিস। চেহারায় ফুটে উঠেছে সীমাহীন একাগ্রতা, নিচু স্বরে বলল, আসছে।
মুখ ফেরালো ট্র্যাভিজ। উঁচু জায়গাটার পিছন থেকে বেরিয়ে যে কাঠামো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে সেটা নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। গায়ের রং ফ্যাকাশে, পাতলা কিন্তু লম্বা চুল। চেহারায় গাম্ভীর্য থাকলেও মনে হয় বয়সে তরুণ। হাত পাগুলো পেশীবহুল নয়।
রোবটগুলো একপাশে সরে দাঁড়ালো। পরিষ্কার মিষ্টি বাচনভঙ্গিতে কথা বলল সে, ব্যবহৃত শব্দগুলো প্রাচীন গ্যালাকটিক হলেও বোধগম্য।
স্বাগতম, মহাকাশের আগন্তুকগণ, সে বলল, আমার রোবটের কাছে তোমরা কী জানতে চাও?
.
বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা করল না ট্র্যাভিজ। বরং বোকার মতো প্রশ্ন করল, আপনি গ্যালাকটিক জানেন।
একটু হেসে সোলারিয়ান বলল, কেন জানব না।
কিন্তু এগুলো? রোবটগুলোকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
এগুলো রোবট? শুধু আমাদের ভাষা জানে। কিন্তু একজন সোলারিয়ান হিসেবে আমি আমার পূর্বপুরুষদের মতো নিয়মিত অন্যান্য গ্রহের হাইপারস্পেসাল কমিউনিকেশন শুনি, যেন তোমাদের বাচনভঙ্গি শিখতে পারি। আমার পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন ভাষার বর্ণনা তৈরি করে রেখে গেছেন। তোমাদের ভাষা বুঝতে পারছি, তাতে অবাক হচ্ছ কেন?
উচিত হয়নি। ক্ষমা চাইছি। আসলে রোবটদের কথা শুনে চিন্তাই করিনি এই গ্রহে কারো মুখে গ্যালাকটিক শোনা যাবে।
সোলারিয়ানের পরনে বড় হাতার পাতলা সাদা রোব। কাঁধের কাছে আবৃত, বুকের কাছে অনাবৃত। নেংটির মতো অন্তর্বাস এবং পায়ে একজোড়া চপ্পল ছাড়া অন্য কিছু নেই।
ট্র্যাভিজ বুঝতে পারছে না সোলারিয়ান পুরুষ না মহিলা। বুকের গঠন নিঃসন্দেহে পুরুষালী, কিন্তু কোনো পশম নেই। অন্তর্বাসের কাছে কোনো স্ফীতভাব দেখা যাচ্ছে না।
ব্লিসকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে, এটাও রোবট হতে পারে–।
ঠোঁট না নেড়ে জবাব দিল ব্লিস, মাইণ্ড মানুষের, কোনো সন্দেহ নেই।
তোমরা এখনও আমার আসল প্রশ্নের উত্তর দাওনি। সোলারিয়ান বলল। আবার জিজ্ঞেস করছি, এবার উত্তর দিতে দেরি করবে না। আমার রোবটদের কাছে তোমরা কী জানতে চাও?
আমরা পথিক। বলল ট্র্যাভিজ। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য পথের হদিস চাই। আপনার রোবটের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা জানে। না।
কী তথ্য প্রয়োজন? আমি হয়তো সাহায্য করতে পারি।
আমরা পৃথিবীর অবস্থান জানতে চাই। আপনি বলতে পারবেন?
ভুরু কুঁচকালো সোলারিয়ান। ভেবেছিলাম তোমাদের আগ্রহের প্রথম কেন্দ্র বিন্দু হব আমি। যাই হোক জানতে না চাইলেও বলছি, আমি সাটন ব্যাণ্ডার এবং তোমরা দাঁড়িয়ে আছো ব্যাণ্ডার এস্টেটে যার পরিধি চারপাশে যত দূর দৃষ্টি যায় তার বাইরে আরো বহু দূর বিস্তৃত। বলতে বাধ্য হচ্ছি তোমরা অনাহুত এবং এখানে এসে বিশ্বাস। ভঙ্গ করেছ। হাজার বছরের মধ্যে তোমরাই প্রথম সেটলার। আগের দিন হলে, দেখা মাত্রই তোমাদের মহাকাশযানসহ ধ্বংস করে দেওয়া হত।
যাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছা নেই তাদের প্রতি এটা হতো অমানবিক আচরণ। সতর্ক গলায় বলল ট্র্যাভিজ।
আমি একমত। কিন্তু যখন কোনো বর্ধনশীল সমাজের সদস্যরা একটা অরক্ষিত অনড় সমাজে পা ফেলে, তখন তাদের স্পর্শই অনেক ক্ষতিকর। যতদিন এই ভয় ছিল ততদিন আমরা যে কোনো আগন্তুককে দেখা মাত্র ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। যেহেতু এখন আর সেই ভয় নেই, আমরা কথা বলতে পারি।
স্বেচ্ছায় এত কিছু জানানোর জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু আমার আসল প্রশ্নের উত্তর দেননি। আবার জিজ্ঞেস করছি। আপনি আমাদের পৃথিবীর অবস্থান জানাতে পারবেন।
আমার ধারণা পৃথিবী বলতে তুমি বোঝাচ্ছ যেখানে মানব প্রজাতি এবং উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল।
ঠিক তাই, স্যার।
সোলারিয়ানের চেহারায় অদ্ভুত বিরক্তির ছাপ পড়ল। আমাকে শুধু ব্যান্ডার ডাকবে। এমন কোনো সম্বোধন করবে না যাতে লিঙ্গ প্রকাশ পায়। আমি পুরুষও নই, নারীও নই। একসাথে দুটোই।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, তার ধারণাই ঠিক। আপনি যা বলেন, ব্যাণ্ডার। বলুন তা হলে আমাদের সবার উদ্ভব হয়েছে যেখানে, সেই পৃথিবী গ্রহের অবস্থান আপনি জানেন?
জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই।–আহ্। দুই বাহু দুইপাশে ছড়িয়ে দিল ব্যাণ্ডার। সূর্যের আলো বেশ ভালো লাগছে। আমি সারফেসে কম আসি। সূর্য থাকলে একেবারেই আসি না। রোবটগুলোকে আগে পাঠিয়েছি সূর্য মেঘে ঢাকা বলে। আমি এসেছি মেঘ সরে যাওয়ার পর।
গ্রহ হিসাবে পৃথিবীর আর অস্তিত্ব নেই কেন? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, রেডিওঅ্যাকটিভিটির কথা বলল না।
এড়িয়ে গেল ব্যাণ্ডার। অনেক বড় গল্প। তুমি বলেছো ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য নেই।
ঠিক।
তা হলে সাথে অস্ত্র এনেছো কেন?
একটু সতর্কতা। এখানে কী পরিস্থিতিতে পড়ব জানা ছিল না।
কোনো ব্যাপার না। ঐ ছোট অস্ত্রগুলো দিয়ে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না আমার। তবে আমি কৌতূহলী। তোমাদের অস্ত্রের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু কখনো নিজের চোখে দেখিনি। তোমার গুলো দেখতে পারি?
একপা পিছিয়ে গেল ট্র্যাভিজ। না, ব্যাণ্ডার।
ব্যান্ডার অবাক হলো। আমি ভদ্রভাবে বলছি। না বললেও চলত।
হাত বাড়ালো সে, এবং ট্র্যাভিজের ডান হোলস্টার থেকে ব্লাস্টার, বাম হোলস্টার থেকে নিউরোনিক হুইপ বেরিয়ে এল আপসে। থাবা দিয়ে ধরার চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ, কিন্তু তার মনে হলো যেন শক্ত ইলাস্টিক তাকে টেনে ধরে রেখেছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ব্লিস আর পেলোরেটকেও আটকে রাখা হয়েছে। কারণ ওরাও সামনে এগোতে পারছে না।
বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো না। পারবে না। ব্যাণ্ডার বলল। অস্ত্রগুলো বাতাসে ভেসে চলে গেলো তার হাতে। মনযোগ দিয়ে দেখে ব্লাস্টার উঁচিয়ে বলল, এটা সম্ভবত মাইক্রোওয়েভ বীমার তাপ সৃষ্টি করে। অন্যটা অনেক সূক্ষ্ম, কী কাজ করে বুঝতে পারছি না। যাই হোক, কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে যেহেতু আসনি, তোমাদের অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। আমি এগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছি।
অস্ত্রগুলো ছেড়ে দিল সোলারিয়ান, আর সেগুলো পিছন দিকে ভেসে এসে নিখুঁতভাবে হোলস্টারে ঢুকে পড়ল।
বাঁধন খুলে গেছে বুঝতে পারল ট্র্যাভিজ। দ্রুত ব্লাস্টার বের করল। কিন্তু ব্যবহার করার কোনো উপায় নেই। কন্ট্যাক্ট ভাঙা, এনার্জি ইউনিট একবারে শুষ্ক।
চোখ তুলে ব্যাণ্ডারের দিকে তাকালো সে। হাসিমুখে ব্যাণ্ডার বলল, তুমি পুরোপুরি অসহায়, আউটওয়ার্ল্ডার। ইচ্ছে করলেই আমি মহাকাশযানসহ তোমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারি।
.
১১. আণ্ডার গ্রাউণ্ড
জায়গাতেই জমে গেছে ট্র্যাভিজ। চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। তাকাল ব্লিসের দিকে।
ব্লিস পুরোপুরি শান্ত। রক্ষণারক ভঙ্গিতে একহাতে পেলোরেটের কোমর জড়িয়ে রেখেছে। হালকাভাবে হাসল, তারচেয়েও হালকাভাবে মাথা নাড়ল।
ব্যাণ্ডারের দিকে ঘুরল ট্র্যাভিজ। ব্লিসের আচরণকে আরবিশ্বাস হিসেবে ধরে নিয়েছে এবং আশা করছে যেন ভুল না হয়, হাসিমুখে বলল, কীভাবে করলেন, ব্যাণ্ডার?
ব্যান্ডারের মুখে কৌতুকের হাসি, বল, নগণ্য আউটওয়াল্টার, তুমি জাদু বা ইন্দ্রজাল বিশ্বাস করো।
না, নগণ্য সোলারিয়ান, আমরা বিশ্বাস করি না। পাল্টা জবাব দিল ট্র্যাভিজ।
জামার হাতায় টান দিয়ে বাধা দিল ব্লিস। ফিসফিস করে বলল, ক্ষেপিও না, বিপজ্জনক।
তাই তো দেখছি। কিছু একটা করো তুমি।
এখনই না। নিজেকে সে যত নিরাপদ মনে করবে, বিপদের মাত্রা তত কমবে।
ব্যাণ্ডার এসব কথায় মনযোগ না দিয়ে অন্যমনস্ক পায়ে তাদের কাছ থেকে সরে গেল দূরে। রোবটগুলো তার যাওয়ার পথ করে দেওয়ার জন্য সরে দাঁড়াল একপাশে। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আঙুল তুলে নির্দেশের সুরে বলল, আমার সাথে এস। তিনজনই। একটা গল্প শোনাবো। তোমাদের ভালো না লাগলেও আমার ভালো লাগবে। বলেই আবার দ্রুত পায়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল।
কী করা উচিত বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়েই থাকল ট্র্যাভিজ। ব্লিস এগোল সামনে, তার হাতের টানে পেলোরেট এগোতে বাধ্য হলো। অগত্যা ট্র্যাভিজকেও নড়তে হলো। নইলে রোবটদের সাথে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
ব্লিস হালকা চালে বলল, ব্যাণ্ডার যখন নিজে থেকেই তথ্য দিচ্ছে
ব্যাণ্ডার মুখ ঘুরিয়ে আগ্রহের সাথে ব্লিসের দিকে তাকালো যেন এই প্রথম তাকে দেখছে। তুমি স্ত্রী হাফ হিউম্যান। তাই না? গুরুত্বহীন অর্ধেক?
ছোট অংশ, ব্যাণ্ডার। হ্যাঁ।
এই দুজন তা হলে পুরুষ হাফ হিউম্যান।
ঠিক।
তুমি শিশু জন্ম দিয়েছ, নারী?
ব্যাণ্ডার, আমার নাম ব্লিস। আমার এখনও সন্তান হয়নি। ও ট্র্যাভিজ আর এ হচ্ছে পেল।
যখন সময় হবে তখন কে তোমাকে সহায়তা করবে? দুজনেই? নাকি কেউ না?
পেল আমাকে সহায়তা করবে, ব্যাণ্ডার।
ব্যাণ্ডারের আগ্রহ পেলোরেটের উপর স্থানান্তরিত হলো। তোমার চুলগুলো সাদা।
হ্যাঁ।
সবসময়ই এই রং ছিল?
না, ব্যাণ্ডার। বয়সের কারণে এমন হয়েছে।
তোমার বয়স কত?
বায়ান্ন বছর। একটু দ্বিধার সাথে যোগ করল, গ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড অনুযায়ী।
ব্যাণ্ডার এখনও হাঁটছে (সম্ভবত কোনো আবাসস্থল লক্ষ্য করে, ট্র্যাভিজের ধারণা), তবে ধীর গতিতে। বলল, গ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড বছর কীভাবে গণনা করা হয় জানি না, তবে আমাদের বাৎসরিক গণনা থেকে খুব বেশি পৃথক হবে না। মৃত্যুর সময় তোমার বয়স কত হবে?
জানি না, ব্যাণ্ডার। হয়তো আরো ত্রিশ বছর বাঁচব।
তার মানে বিরাশি বছর। স্বল্পজীবন এবং অর্ধেক। আমার সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষরা ছিল তোমার মতো, বাস করতো পৃথিবীতে। কিন্তু সেখান থেকে তারা বেরিয়ে এসে অন্য নক্ষত্রে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোতে বসতি স্থাপন করে। চমৎকার, সুসংগঠিত নতুন বিশ্ব, এবং অনেকগুলো।
জোরালো গলায় বলল ট্র্যাভিজ অনেকগুলো নয়। মাত্র পঞ্চাশটা।
ঝট করে তাকালো ব্যাণ্ডার, আমুদে আচরণ পাল্টে গেছে। ট্র্যাভিজ। ওটাই তোমার নাম।
পুরো নাম গোলান ট্র্যাভিজ। আমি বলছি স্পেসার ওয়ার্ল্ড মাত্র পঞ্চাশটা, আমাদের রয়েছে কয়েক মিলিয়ন বিশ্ব।
তার মানে আমি যে গল্পটা বলতে চাই সেটা তুমি জানো? যদি গল্পটা হয়-একদা পঞ্চাশটি স্পেসার ওয়ার্ল্ড ছিল তা হলে আমি জানি।
আমরা শুধু সংখ্যা দিয়েই বিচার করি না, হাফ-হিউম্যান, গুণগত মানও বিচার করি। আমাদের পঞ্চাশটা বিশ্ব যা করতে পেরেছে, তোমাদের লাখ লাখ বিশ্বের একটাও তা করতে পারেনি। সোলারিয়া পঞ্চাশতম বিশ্ব এবং সবার সেরা। অন্য স্পেসার ওয়ার্ল্ড থেকে সোলারিয়া অনেক দূরে অবস্থিত।
কীভাবে বাঁচতে হয় সেটা একমাত্র আমরা সোলারিয়ানরাই শিখতে পেরেছি। পৃথিবী বা অন্যান্য গ্রহ বা অন্যান্য স্পেসার ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দারা যেভাবে পশুপাখির মতো সংখ্যা বৃদ্ধি করে, আমরা তা করি না। আমরা প্রত্যেকেই একা বাস করি, ইলেকট্রনিক্যালি মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কখনো কেউই কারো স্বাভাবিক দৃষ্টিসীমায় আসি না। বহু বছর পর এই প্রথম আমি কোনো মানুষের দিকে সরাসরি তাকিয়েছি, কিন্তু তোমরা অর্ধেক মানুষ এবং তোমাদের উপস্থিতি আমার স্বাধীনতা বিঘ্নিত করছে না, অন্তত গবাদিপশু বা রোবটগুলোর চেয়ে বেশি না।
একসময় আমরাও ছিলাম অর্ধেক মানুষ। কোনো ব্যাপার না আমরা কীভাবে নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছি, কীভাবে অসংখ্য রোবটের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেছি সেটাও কোনো ব্যাপার না; পুরোপুরি স্বাধীনতা ছিল না। সন্তান তৈরির জন্য আলাদা দুজনকে একত্রিত হতে হতো। অবশ্য কৃত্রিমভাবে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিশ্রণ দ্বারা সন্তান উৎপাদন করে রোবটের সাহায্যে লালনপালন সম্ভব ছিল। সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছিল, কিন্তু অর্ধেক মানুষরা শারীরিক সংস্পর্শের আনন্দ ছাড়তে পারল না। বিকৃত আবেগের কারণে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা। বুঝতে পারছ যে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
না, ব্যাণ্ডার, ট্র্যাভিজ বলল, কারণ আমরা আপনাদের মতো করে স্বাধীনতার বিচার করি না।
কারণ তোমরা জান না প্রকৃত স্বাধীনতা আসলে কী? সবসময় তোমরা বাস করেছ দল বেঁধে। অন্য কোনো উপায় তোমাদের জানা নেই। প্রতিনিয়ত অন্যের। ইচ্ছার কাছে নিজের ইচ্ছাকে পদানত করা বা নিজের ইচ্ছার কাছে অন্যের ইচ্ছাকে পদানত করার চেষ্টা করতে করতেই তোমাদের দিন কেটে যায়। এখানে স্বাধীনতা কোথায়। স্বাধীনতা হচ্ছে নিজের ইচ্ছামতো বাস করার অধিকার। ঠিক নিজের ইচ্ছেমতো।
তারপর পৃথিবীর বাসিন্দারা আবার বিভিন্ন গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ল। অন্য স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো চেষ্টা করল বাধা দেওয়ার। আমরা সোলারিয়ানরা কোনো চেষ্টা করলাম না। দল বেঁধে বাস করার বিপদ আমরা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই মাটির নিচে বসবাস শুরু করি এবং গ্যালাক্সির সাথে। সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। আপাতদৃষ্টিতে শূন্য সারফেস রক্ষার জন্য উপযুক্ত। রোবট এবং অস্ত্র তৈরি করি। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আগন্তুকের আসা বন্ধ হয়ে যায়। সবাই ধরে নেয় এটা বিরান গ্রহ। ঠিক আমরা যা চেয়েছিলাম।
সেই সাথে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে নিজেদের সমস্যা সমাধানের নিরলস প্রচেষ্টা চলতে লাগল। সতর্কতার সাথে এবং সূক্ষ্মভাবে নিজেদের জিনস্ পরিবর্তন করলাম। সাফল্যের পরিমাণ ছিল খুব সামান্য। কিন্তু সেটা নিয়েই এগিয়ে চললাম। বহু শতাব্দীর প্রচেষ্টার ফলে সফল হলাম নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, একই শরীরের ভেতর পুরুষ ও নারীর বৈশিষ্ট্য, ফলে ইচ্ছানুযায়ী উপভোগ এবং যখন চাই তখন সন্তান উৎপাদনের জন্য ডিম্বাণু নিষিক্ত করতে পারি।
হারমাফ্রোডাইটস বলল পেলোরেট। [* হারমাফ্রোডাইটস-একাধারে স্ত্রী ও পুংলিঙ্গ-কিংবা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত প্রাণী। অনুবাদক]
হারমাফ্রোডিটিজম বিবর্তন প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়। বলল ট্র্যাভিজ। কারণ প্রতিটি শিশুই তার পিতামাতার জেনেটিক প্রতিরূপ।
বিবর্তন প্রক্রিয়াকে তুমি ধর তক্তা মারো পেরেক জাতীয় কিছু মনে করছ। জিনস্ পরিবর্তন করে আমাদের শিশুদের আমরা ইচ্ছেমতো তৈরি করে নিতে পারি।–পৌঁছে গেছি, ভেতরে ঢোকা যাক। দিন প্রায় শেষের পথে, সূর্য আর পর্যাপ্ত আলো দিতে পারছে না। ভেতরে আরামদায়ক হবে।
যে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল সেটার কোনো লক্ নেই কিন্তু সামনে যেতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল, ঢোকার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। কোনো জানালা নেই কিন্তু গুহার মতো ঘরটাতে প্রবেশ করার সাথে সাথে দেয়ালগুলো আলোকিত হয়ে গেল যেন সেগুলোর প্রাণ আছে। মেঝে খালি। প্রথম পা ফেলার পর মনে হয় নরম আর স্প্রিং এর মতো স্থিতিস্থাপক। চার কোণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারটা রোবট।
ওই দেয়ালটা, দরজার বিপরীত দিকের দেয়াল দেখিয়ে বলল ব্যাণ্ডার-বাকি তিন দেয়ালের সাথে কোনো পার্থক্য নেই-আমার ভিশনস্ক্রিন। এটার সাহায্যে, পুরো গ্রহ দেখতে পারি কিন্তু তাতে আমার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয় না কারণ আমি এটা ব্যবহার করতে বাধ্য নই।
আপনি নিশ্চয়ই অন্যকেও বাধ্য করতে পারেন না। ট্র্যাভিজ বলল।
.
বাধ্য করব? অবজ্ঞার সাথে বলল ব্যাণ্ডার। ওদের যা খুশি তাই করতে পারে, যতক্ষণ না আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। আর মনে রাখবে নিজেদের বোঝানোর জন্য আমরা কোনো লিঙ্গ ব্যবহার করি না।
ভিশনস্ক্রিনের সামনে একটা চেয়ার। ব্যাণ্ডার বসল ওটাতে। চারপাশে তাকাল ট্র্যাভিজ। আশা করছে তাদের জন্যও চেয়ার থাকবে, নেই। বসতে পারি? জিজ্ঞেস করল সে।
ইচ্ছে হলে বস।
হাসিমুখে মেঝেতে বসল ব্লিস, পেলোরেট বসল তার পাশে। ট্র্যাভিজ দাঁড়িয়েই থাকল।
এই গ্রহে কতজন মানুষ বাস করে, ব্যাণ্ডার? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
সোলারিয়ান বলবে, হাফ-হিউম্যান ব্লিস। হিউম্যান বিয়িং শব্দটা আমরা বাতিল করে দিয়েছি কারণ হাফ-হিউম্যানরা নিজেদের এই নামে আখ্যায়িত করে। নিজেদের আমরা বলতে পারি হোল হিউম্যান, কিন্তু সেটা হাস্যকর শোনায়। সোলারিয়ান সঠিক শব্দ।
এই গ্রহে কতজন সোলারিয়ান বাস করে?
সঠিক জানি না। আমরা কখনো গণনা করিনি। সম্ভবত বারশ।
পুরো গ্রহে মাত্র বার শ জন?
তুমি আবারও সংখ্যার উপর গুরুত্ব দিচ্ছ। আমরা গুণগত মানের গুরুত্ব দিই।–তা ছাড়া স্বাধীনতার অর্থও তোমরা জান না। একজন সোলারিয়ান বৃদ্ধি মানেই আমার স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা। সেটা দূর করার জন্য আমাদের এমনভাবে বাস করতে হবে যেন মনে হয় আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই পরিস্থিতিতে সোলারিয়ায় মাত্র বার শ বাসিন্দা বাস করতে পারবে।
তার মানে হিসাব করে জন্ম এবং মৃত্যু হয়। পেলোরেট বলল।
নিশ্চয়ই। যে কোনো গ্রহের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য তাই করা। হয়-এমনকি তোমাদের গ্রহেও।
যেহেতু মৃত্যুর পরিমাণ কম তাই শিশু জন্মের পরিমাণও কম।
অবশ্যই।
ট্র্যাভিজ বলল, আমি জানতে চাই কীভাবে আপনি আমার অস্ত্রগুলো বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন? এখনও বলেননি।
আমি জাদু বা ইন্দ্রজালের কথা বলেছি। বিশ্বাস হয়নি তোমার?
অবশ্যই না। আমাকে কী মনে করেন?
তুমি শক্তি সংরক্ষণের কথা বিশ্বাস করো?
করি, কিন্তু বিশ হাজার বছরে আপনারা এই সূত্রগুলো পরিবর্তন বা সামান্য উন্নত করতে পেরেছেন সেটা বিশ্বাস করি না।
আমরাও করি না, হাফ-পারসন। বোঝার চেষ্টা করো। বাইরে রোদ আছে, ছায়া আছে। ছায়ার তুলনায় রোদের তাপ বেশি, এবং রৌদ্রালোকিত স্থান থেকে তাপ ক্রমাগত ছায়াময় স্থানে প্রবাহিত হচ্ছে।
আমি এগুলো জানি।
হয়তো এত বেশি জানো যে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করোনি। যাই হোক, রাতে সোলারিয়ার ভূ-পৃষ্ঠ বায়ুমণ্ডলের বাইরের বস্তুগুলো অপেক্ষা বেশি উত্তপ্ত থাকে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে আউটার স্পেসের দিকে তাপ প্রবাহিত হয়।
এটাও জানি।
এবং দিনে রাতে সর্বদা গ্রহের ভূ-অভ্যন্তর ভূ-পৃষ্ঠ অপেক্ষা বেশি উত্তপ্ত থাকে এবং ভূ-অভ্যন্তর থেকে তাপ ভূ-পৃষ্ঠে প্রবাহিত হয়। বোধহয় এগুলোও জানো।
এত কথা বলে কী বোঝাতে চাইছেন, ব্যাণ্ডার?
থার্মোডাইনামিক্সের* দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী উষ্ণ স্থান থেকে তাপ শীতল স্থানের দিকে প্রবাহিত হয় এবং সেটা কাজে লাগানো যায়। [*থার্মোডাইনামিক্স–তাপগতিবিদ্যা। অনুবাদক]
তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, কিন্তু সূর্যের আলো অনেক হালকা, তারচেয়ে হালকা ভূ পৃষ্ঠের তাপ এবং সবচেয়ে হালকা ভূ-অভ্যন্তর থেকে প্রবাহিত তাপ। যে পরিমাণ তাপ প্রবাহ ধরা পড়বে তা দিয়ে একটা ফুটোও করা যাবে না।
নির্ভর করবে কোন যন্ত্র তুমি ব্যবহার করবে। হাজার বছরের গবেষণার দ্বারা আমাদের যন্ত্র উন্নত করা হয়েছে এবং সেটা আমাদের মস্তিষ্কেরই একটা অংশ।
কানের পেছনে মাথার খুলি প্রদর্শনের জন্য দুপাশের চুল সরালো ব্যাণ্ডার। এপাশেওপাশে মাথা ঘোরালো, এবং কানের ঠিক পেছনেই মুরগির ডিমের ভোতা অংশের মতো ফীত হয়ে আছে।
আমার মস্তিষ্কের এই অংশটাই একজন সোলারিয়ান এবং তোমাদের মাঝে পার্থক্য তৈরি করেছে।
.
ঘনঘন ব্লিসের দিকে তাকাচ্ছে ট্র্যাভিজ, ব্লিসের মনযোগ পুরোপুরি ব্যাণ্ডারের উপর। ট্র্যাভিজের মনে হলো কি ঘটছে সেটা সে জানে।
অহংকারী ব্যাণ্ডার সম্ভবত এই সুযোগ হারাতে চায় না। রোবটের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই, আর পশুপাখি তো কথা বলতে পারে না। অন্য সোলারিয়ানদের সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ তার নেই।
ব্যাণ্ডারের কাছে ট্র্যাভিজ, ব্লিস আর পেলোরেট হাফ-হিউম্যান, এবং সে হয়তো মনে করছে যে একটা রোবট বা ছাগল তার স্বাধীনতা যতটুকু নষ্ট করছে এই তিনজন তার বেশি কিছু করছে না-কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় তার সমকক্ষ (অথবা প্রায় সমকক্ষ) এবং ট্র্যাভিজদের সাথে কথা বলে যে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছে সেটা আগে কখনো পায়নি।
আসলে এভাবে ব্যাণ্ডার নিজেকে খুশি করার চেষ্টা করছে, ভাবল ট্র্যাভিজ। এবং ব্লিস তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে, ব্যাণ্ডারের মাইণ্ডকে হালকা নরম ধাক্কা দিয়ে তার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সম্ভবত ব্লিস মনে করছে যে যদি ব্যাণ্ডার বেশি কথা বলে তা হলে পৃথিবীর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে পারে। তাই আগ্রহ না থাকলেও বর্তমান আলোচনা ট্র্যাভিজের চালিয়ে যেতে হবে।
এই ব্রেইন লোবগুলো কী করে? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
এগুলো ট্র্যান্সডিউসারস। ব্যাণ্ডার বলল, তাপ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে পরিবর্তন করে।
বিশ্বাস হচ্ছে না। যথেষ্ট তাপ প্রবাহ নেই।
হাফ হিউম্যান, তুমি কিছুই জান না। যদি সোলারিয়ানদের সংখ্যা বেশি হত, যদি সবাই তাপ প্রবাহকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করত, তা হলে বলা যেত যে পরিমাণ অপর্যাপ্ত। কিন্তু আমার রয়েছে চল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা, আমার একার, সেখান থেকে পর্যাপ্ত তাপ সংগ্রহ করতে পারি। বুঝতে পেরেছ।
বিশাল এলাকা থেকে তাপ প্রবাহ সংগ্রহ করা এতই সহজ? শুধু সংগ্রহ করতেই প্রচুর শক্তি খরচ হবে।
হয়তো, কিন্তু কখনো মাথা ঘামাইনি। আমার ট্র্যান্সডিউসারস-লোব যখন যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই কাজ করছে। তোমার অস্ত্রগুলো নেওয়ার সময় সূর্যালোকিত বায়ুমণ্ডলের ছায়া ঢাকা অংশে তাপ প্রবাহিত হতে না দিয়ে আমি কাজে লাগাই। অর্থাৎ সূর্যের তাপশক্তিকে কাজে লাগালাম এবং সেজন্য কোনো যান্ত্রিক বা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার না করে নিউরোনিক ডিভাইস ব্যবহার করলাম। হালকাভাবে একটা ট্রান্সডিউসার লোব স্পর্শ করল সে। এটা কাজ করে অবিরত, দ্রুত, দক্ষভাবে-এবং অল্প আয়াসে।
অবিশ্বাস্য, ফিসফিস করল পেলোরেট।
কিছুই অবিশ্বাস্য নয়। চোখ কানের কথা চিন্তা করো। অতি সামান্য আলোক কণা বা বায়ুকম্পন থেকে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করে। এই অঙ্গগুলোর সাথে পরিচয় না থাকলে অবিশ্বাস্য মনে হবেই। ট্রান্সডিউসার লোব এর সাথে পরিচয় নেই বলেই তোমাদের অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
অবিরত ক্রিয়াশীল ট্র্যান্সডিউসার-লোব দিয়ে আপনারা কি করেন? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
পুরো গ্রহ পরিচালনা করি। এই বিশাল এস্টেটের প্রতিটা রোবট আমার কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে; অথবা বলা যায় স্বাভাবিক তাপ এর মাধ্যমে শক্তি পায়।
আপনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন?
ঘুমিয়ে থাকি বা জেগে থাকি ট্রান্সডাকশন প্রক্রিয়া সবসময় চলতে থকে। যখন তুমি ঘুমাও তখন কি শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দাও? হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়? আমার রোবট রাতেও কাজ করে। কিন্তু আমরা মাত্র বার শ সোলারিয়ান। সবাই মিলে যে শক্তি ব্যবহার করি তাতে আমাদের সূর্যের জীবনকাল কমবে না বা অভ্যন্তরীণ তাপ হ্রাস পাবে না।
কখনো মনে হয়েছে, এটাকে আপনারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে ট্র্যাভিজের দিকে তাকাল ব্যাণ্ডার। বলতে চাও ট্র্যান্সডাকশন নির্ভর অস্ত্রের সাহায্যে অন্য গ্রহগুলো দখল করতে। নিজেদেরই যেখানে আদর্শ বাসস্থান আছে সেখানে অন্য গ্রহ দিয়ে কী করব? হাফ-হিউম্যানদের উপর আমাদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে তাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করব? কাজের জন্য আমাদের রোবট হাফ-হিউম্যানদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ। আমাদের সব আছে, আর কিছু চাই না–শুধু নিজের মতো থাকতে চাই। আরেকটা গল্প বলছি।
চালিয়ে যান। বলল ট্র্যাভিজ।
বিশ হাজার বছর আগে যখন পৃথিবীর হাফ-ক্রিয়েচাররা বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, আমরা সোলারিয়ানরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে মাটির নিচে চলে যাই, অন্য স্পেসার-ওয়ার্ল্ডগুলো পৃথিবীর নতুন সেটলারদের বাধা দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। তাই তারা পৃথিবীতে আক্রমণ করে।
পৃথিবীতে, ট্র্যাভিজ বলল। শেষ পর্যন্ত আলোচনা শুরু হওয়ায় সে সন্তুষ্ট।
হ্যাঁ, একেবারে কেন্দ্রে। চমৎকার পদক্ষেপ বলতেই হবে। কাউকে হত্যা করতে চাইলে তুমি নিশ্চয়ই আঙুলে বা পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করবে না, আঘাত করবে বুকে। এবং আমাদের স্পেসার বন্ধুরা যারা মানুষ থেকে খুব বেশি পৃথক ছিল না, যেভাবেই হোক পৃথিবীর সারফেস রেডিওঅ্যাকটিভ করে ফেলল, ফলে পুরো গ্রহ হয়ে গেল বসবাসের অযোগ্য।
আহ্, এভাবে ঘটেছে, বলল পেলোরেট, দৃঢ়ভাবে হাতের মুঠি খুলছে আর বন্ধ করছে। জানতাম স্বাভাবিকভাবে ঘটতে পারে না। কীভাবে করল?
কীভাবে করেছে জানি না, তবে এতে স্পেসারদের কোনো লাভ হয়নি। এটাই গল্পের আসল কথা। সেটলারদের বাধা দিতে গিয়ে স্পেসাররা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল । আমরা সোলারিয়ানরা প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ালাম, তাই এখনও বেঁচে আছি।
সেটলাররাও আছে। হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ।
হ্যাঁ, চিরদিনের জন্য নয়। তোমরা নিজেরা লড়াই করে স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো তার জন্য দশ হাজার বছর লাগবে, কিন্তু আমরা অপেক্ষা করতে পারব। তারপর পুরো গ্যালাক্সিতে আমরা সোলারিয়ানরা হব একা স্বাধীন। তখন ইচ্ছে হলে অন্য কোনো গ্রহ আমরা ব্যবহার করতেও পারি নাও পারি।
কিন্তু পৃথিবী সম্বন্ধে আপনি যা বলেছেন, অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল পেলোরেট, সবই ইতিহাসের কিংবদন্তি।
পার্থক্যটা কোথায় সেটা কে বলবে,হাফ-পেলোরেট? ইতিহাসের পুরোটাই কমবেশি কিংবদন্তি।
আপনাদের রেকর্ডে কি আছে? সেগুলো আমি দেখতে পারি, ব্যাণ্ডার? দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস আমার কর্মক্ষেত্র। এই বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ, বিশেষ করে পৃথিবীর ব্যাপারে।
যা শুনেছি শুধু তাই বলতে পারি। এই বিষয়ের কোনো রেকর্ড নেই। আমাদের রেকর্ড রয়েছে শুধু সোলারিয়ান ইতিহাসের, আর শুধুমাত্র যে গ্রহগুলো আমাদের আক্রমণ করেছিল তাদের নাম।
নিশ্চয়ই, পৃথিবী আপনাদের আক্রমণ করেছিল। বলল পেলোরেট।
করলেও বহু বহু বহু শতাব্দী আগে, এবং সব গ্রহের মধ্যে পৃথিবী আমাদের কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। এই বিষয়ে কোনো রেকর্ড থাকলে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
রাগে দাঁত ঘষল ট্র্যাভিজ। আপনি নিজে করেছেন?
ট্র্যাভিজের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ব্যান্ডার, আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখানে।
পেলোরেট চাইল না আলোচনা থেমে যাক। পৃথিবী সম্বন্ধে কী শুনেছেন?
একটু ভাবল ব্যাণ্ডার। ছোট বেলায় একটা রোবটের কাছে একজন আর্থম্যানের গল্প শুনেছিলাম যে সোলারিয়ায় এসেছিল; এবং একজন সোলারিয়ান মহিলা যে তার সাথে চলে গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে গ্যালাক্সির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। তবে আমার মনে হয় গল্পটা আসলেই বানোয়াট।
ঠোঁট কামড়ে ধরল পেলোরেট। আপনি নিশ্চিত?
নিশ্চিত হব কীভাবে? তবে এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য যে পৃথিবীর কোনো মানুষ সোলারিয়ায় আসার সাহস দেখাবে এবং সোলারিয়া তাকে অনুমতি দেবে; একজন সোলারিয়ান-যদিও আমরা তখন ছিলাম হাফ-হিউম্যান-নিজের গ্রহ ত্যাগ করবে।–যাই হোক, এসো, তোমাদের আমার বাড়ি দেখাই।
আপনার বাড়ি? চারপাশে তাকিয়ে বলল ব্লিস। আমরা আপনার বাড়িতে আসিনি?
মোটেই না। এটা একটা এ্যান্টিরুম, ভিউয়িং রুম। এখানে বসে আমি অন্য সোলারিয়ানদের দেখতে পারি। ওই দেয়ালে বা দেয়ালের সামনের স্থানে তাদের ছবি বা ত্রিমাত্রিক ইমেজ ফুটে উঠে। এটা একটা সম্মেলন কক্ষ এবং আমার বাড়ির অংশ নয়। এসো আমার সাথে।
কথা শেষ করে হাঁটা শুরু করল ব্যাণ্ডার, কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখার প্রয়োজন মনে করল না, কিন্তু রোবট চারটা তাদের কোণা ছেড়ে বেরিয়ে এল। ট্র্যাভিজ জানে যেতে না চাইলেও রোবটগুলো তাদের বাধ্য করবে।
বাকি দুজন মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। ফিসফিস সুরে ব্লিসকে বলল ট্র্যাভিজ, তুমি ওটাকে কথা বলায় ব্যস্ত রেখেছ?
মাথা নাড়ল ব্লিস। চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে বলল, চেষ্টা করছি, ওটার মনে কী আছে যদি জানতাম।
.
ব্যাণ্ডারকে অনুসরণ করল তারা। রোবটগুলো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেও তাদের উপস্থিতি হুমকির মতো।
একটা করিডোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নিচু গলায় বলল ট্র্যাভিজ, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা যাবে না এখানে। আমি নিশ্চিত। শুধু রেডিওঅ্যাকটিভিটি গল্পের একটু অন্যরকম রূপান্তর। তৃতীয় কো-অর্ডিনেটস ধরে যেতে হবে।
সামনের দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে প্রবেশ করে ব্যাণ্ডার বলল, এসো, হাফ হিউম্যান। আমরা কীভাবে বাস করি তোমাদের দেখাই।
দেখিয়ে খুব মজা পাচ্ছে, ফিস ফিস করল ট্র্যাভিজ। দাঁত ভেঙে দিতে পারলে ভালো লাগত।
বোকার মতো কিছু করো না। ব্লিস বলল।
শুধু একটা রোবট তাদের সাথে ঘরে প্রবেশ করল। দরজা বন্ধ হওয়ার পর নতুন কিছু আবিষ্কারের সুরে পেলোরেট বলল, এটা একটা এলিভেটর।
ঠিক, ব্যাণ্ডার বলল। আণ্ডার গ্রাউণ্ডে চলে যাওয়ার পর আমরা খুব বেশি বের হই না, আগ্রহ নেই, যদিও মাঝে মাঝে রোদের উষ্ণতা উপভোগ করতে ভালোই লাগে আমার। মেঘ বৃষ্টি বা খোলা জায়গায় রাত কাটাতে আমার ভালো লাগে না।
পৃথিবী ও আণ্ডারগ্রাউণ্ডে বাসস্থান তৈরি করেছিল, বলল পেলোরেট। শহরগুলোকে ওরা বলত ইস্পাতের গুহা। ইম্পেরিয়াল যুগে ট্র্যান্টরের আণ্ডারগ্রাউণ্ড ছিল সুবিশাল। কমপরেলনেও আণ্ডারগ্রাউণ্ড তৈরি হচ্ছে। সাধারণ ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেছে এটা।
হাফ-হিউম্যানদের দল বেঁধে বসবাস এবং আমাদের একা বসবাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
টার্মিনাসের বাসস্থান তৈরি হয় মাটির উপরে। ট্র্যাভিজ বলল।
যে-কোনো ধরনের আবহাওয়ার কাছে অসহায়। খুবই প্রাচীন।
পেলোরেট কোনো গতি টের পাচ্ছে না। আর ট্র্যাভিজ মনে মনে ভাবছে তারা কত নিচে নামল, ঠিক সেই সময় থেমে দাঁড়ালো এলিভেটর। দরজা খুলল।
তাদের সামনে সুসজ্জিত এবং সুবিশাল এক কামরা। হালকা আলোকিত, যদিও আলোর উৎস ঠিক ধরা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ঘরের বাতাসই কোনোভাবে আলোকিত হয়ে পড়েছে।
ব্যাণ্ডার একটা আঙুল তুলতেই নির্দিষ্ট একটা অংশের আলো উজ্জ্বল হলো। যেদিকে আঙুল ঘোরালো একই ব্যাপার ঘটল সেদিকেই। বা হাত দিয়ে দরজার পাশে একটা মোটা রড স্পর্শ করে ডান হাত বৃত্তাকারে চারপাশে ঘোরাল। পুরো কামরা আলোকিত হয়ে গেল, যেন সূর্যের আলো, অথচ কোনো উত্তাপ নেই।
মুখ বাঁকা করে শুনিয়ে শুনিয়ে ট্র্যাভিজ বলল, ব্যাটা ভান করে। ধারালো গলায় ব্যাণ্ডার বলল, ব্যাটা বলবে না, সোলারিয়ান বলবে। ভান শব্দটার অর্থ আমি জানি না, তবে বলার ভঙ্গিতে মনে হয় তুমি আমাকে অসম্মান করছ।
এর অর্থ যে ব্যক্তি আসল নয়। অবাস্তব বিষয়কে বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলে।
স্বীকার করছি নাটকীয়তা আমার পছন্দ তবে তোমাদের যা দেখাচ্ছি তার কিছুই অবাস্তব নয়, পুরোপুরি বাস্তব।
বা হাতে ধরে রাখা রডের উপর আলতো চাপড় মারল সে। এই তাপ পরিচালনা দণ্ডের কার্যক্ষমতা মাটির নিচে বহু কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এস্টেটের বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থানে আরো অনেক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। অন্যান্য এস্টেটেও এগুলো ব্যবহার করা হয়। এই দণ্ডগুলো মাটির নিচ থেকে তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি করে তাকে কাজে পরিণত করে। হাতের নির্দেশে আলো জ্বালানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এতে একটু নাটকীয়তা আছে বা তোমার কথা মতো কৃত্রিমতা। আমি এতে আনন্দ পাচ্ছি।
আপনি কি সবসময় নাটকীয়তা করেন? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
না, আমার রোবট বা প্রতিবেশী সোলারিয়ানরা প্রভাবিত হয় না। কিন্তু তোমাদের মতো হাফ-হিউম্যানদের অবাক করে দেওয়ার এই দৈবাৎ সুযোগ-সত্যিই আনন্দের।
যখন আমরা কামরায় ঢুকলাম, আলো কম ছিল। সবসময়ই এমন থাকে। পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। এস্টেটে সবসময়ই কাজ চলছে। যে অংশে কাজ চলে না সেটা অলস পড়ে থাকে।
এই বিশাল এস্টেটের জন্য আপনি অবিরত শক্তি সরবরাহ করে যাচ্ছেন। সূর্য এবং গ্রহের কেন্দ্র শক্তি সরবরাহ করছে, আমি শুধু মাধ্যম। তা ছাড়া এস্টেটের সব অংশই উৎপাদনশীল নয়। অধিকাংশই বুনো জীবজন্তুতে ভরা। প্রথম কারণ, তাতে আমার সীমান্তের নিরাপত্তা থাকে, এবং দ্বিতীয় কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় থাকে। আমার শস্য ক্ষেত্র এবং কারখানাগুলো ছোট। শুধু আমার চাহিদা পূরণ করে, আর বিনিময়ের জন্য কিছু বিশেষ দ্রব্য। যেমন আমার রোবটদের তৈরি তাপ-পরিচালনা দণ্ডের উপর পুরো গ্রহ নির্ভর করে।
আপনার বাড়িটা কত বড়? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
সঠিক প্রশ্ন, কারণ আনন্দে ঝকমক করে উঠল ব্যাণ্ডারের চেহারা। অনেক বড়। সম্ভবত গ্রহের সবচেয়ে বড়গুলোর একটা। চারপাশেই কয়েক কিলোমিটার করে বিস্তৃত। সমতলের হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূ-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যতগুলো রোবট আছে মাটির নিচে এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ততগুলো রোবট আছে।
নিশ্চয়ই পুরো বাড়িতেই আপনি থাকেন না। বলল পেলোরেট।
অনেক কামরাতেই আমি জীবনে কোনোদিন ঢুকিনি। কিন্তু তাতে কি? রোবটরা প্রতিটি কামরাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ব্যবহারের যোগ্য করে রাখে। যাই হোক এখানে এসে দাঁড়াও।
অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে তারা আরেকটা করিডোরে পৌঁছল। রেলপথের মতো সমান্তরাল ট্র্যাক এর উপর একটা ছাদ খোলা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে উঠতে বলল ব্যাণ্ডার। চারজন এবং একটা রোবটের জায়গা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ব্লিস আর পেলোরেট এমনভাবে চাপাচাপি করে বসল যেন ট্র্যাভিজ আরামে বসতে পারে। ব্যাণ্ডার আয়েশি ভঙ্গিতে সামনে বসল, তার পাশে রোবট। কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই চলতে শুরু করল গাড়ি।
এটা আসলে গাড়ি আকৃতির রোবট। হেলাফেলা করে বলল ব্যাণ্ডার।
গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কোনো দরজার সামনে পৌঁছলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলো খুলে যাচ্ছে আবার অতিক্রম করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা দরজার সাজসজ্জা আলাদা।
সামনে পিছনে করিডোর আলোকোজ্জ্বল, সেই আলো ঠাণ্ডা সূর্যালোকের মতো। দরজা খোলার সাথে সাথে কামড়াগুলোতেও আলো জ্বলে উঠছে, কারণ জমিদারের মতো অভিজাত ভঙ্গিতে হাত নাড়ছে ব্যাণ্ডার।
এই যাত্রার যেন কোনো শেষ নেই, ঘন ঘন বাঁক নিতে হচ্ছে। ট্র্যাভিজ ধারণা করল এই আণ্ডারগ্রাউণ্ড ম্যানসন দুই স্তরের। যেদিকেই যাচ্ছে চোখে পড়ছে শয়ে শয়ে রোবট, ধীরে সুস্থে কি কাজ করছে বোঝাই যাচ্ছে না।
একটা ঘরে দেখল অনেকগুলো রোবট ডেস্কে বসে সারি বেঁধে কাজ করছে।
কী বলছে ওরা? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট। হিসাব রাখছে, বলল ব্যাণ্ডার। পরিসংখ্যান, আর্থিক হিসাব, এই ধরনের আরো অনেক কিছু যেগুলো নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হয় না। প্রচুর কাজ আছে এখানে। এক-চতুর্থাংশ অংশে রয়েছে বিশাল বাগান, কিছু অংশে শস্য ক্ষেত। তবে ফলের বাগানটাই হচ্ছে আমার গর্বের ধন। এখানে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদিত হয়। ব্যাণ্ডার পিচ গ্রহের সেরা পিচ। সাতাশ প্রকারের আপেল, আরো অনেককিছু, কোনো রোবটকে জিজ্ঞেস করলে বিস্তারিত বলতে পারবে।
এত ফল দিয়ে কী করেন? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ। আপনি একা নিশ্চয়ই সব খেতে পারবেন না।
না, আমি আসলে ফলের ভক্ত। তবে বেশিরভাগ অংশই বিনিময় বাণিজ্যে ব্যবহার করা হয়।
ফলের বিনিময়ে কী সংগ্রহ করেন।
খনিজ পদার্থ। আমার এস্টেটে কোনো খনি নেই। এ ছাড়াও সঠিক প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যা প্রয়োজন সেগুলোও সংগ্রহ করি। এখানে প্রচুর গাছ পালা এবং প্রাণী রয়েছে।
রোবট সবকিছুর দেখাশোনা করে।
হ্যাঁ, এবং বেশ ভালোভাবে করে।
সবকিছুই মাত্র একজন সোলারিয়ানের জন্য।
সবকিছু এই এস্টেট এবং এর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য। ঘটনাচক্রে আমি একমাত্র সোলারিয়ান যে এস্টেটের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করে-যখন ইচ্ছা হয়-অবশ্য সেটা আমার প্রকৃত স্বাধীনতার অংশ।
নিশ্চয়ই অন্য সোলারিয়ানদের নিজস্ব প্রাকৃতিক ভারসাম্য রয়েছে। তাদের থাকতে পারে জলাভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল বা উপকূলবর্তী অঞ্চল। বলল পেলোরেট।
হয়তো। এই বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মেলনে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়।
কতদিন পর পর আপনারা সম্মেলন করেন? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
বেশ ঘন ঘন। শুধু এই মাসেই আমি কোনো সম্মেলনে যোগ দেইনি। তবে আমার জলাভূমি বা পাহাড়ি অঞ্চল না থাকলেও আমার বাগান, মাছের পুকুর, উদ্যান এই গ্রহে সবার সেরা।
মাই ডিয়ার ফেলো, মানে ব্যান্ডার, পেলোরেট বলল, আপনি কখনো অন্য এস্টেটগুলো দেখতে যান নি।
অবশ্যই না। রেগে গেল ব্যাণ্ডার।
আপনারটাই যে সেরা কীভাবে বললেন?
কারণ ইন্টার-এস্টেট বাণিজ্যে আমার পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি।
ম্যানুফাকচারিং-এর ব্যাপারে? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
অনেক এস্টেট যন্ত্রপাতি তৈরি করে। যেমন আমি তাপ পরিচালনা দণ্ড তৈরি করি। তবে সেটা অনেক সহজ।
আর রোবট?
রোবট তো যেখানে সেখানে তৈরি হয়। সুপ্রাচীন কাল থেকেই সূক্ষ্ম ও উন্নত রোবটিক ডিজাইন তৈরিতে সোলারিয়া গ্যালাক্সিতে অগ্রগামী।
নিশ্চয়ই বর্তমান কালেও, বলল ট্র্যাভিজ, এমনভাবে যেন প্রশ্নের মতো না। শুনিয়ে মন্তব্যের মতো শোনায়।
বর্তমানে। বর্তমানে কার সাথে প্রতিযোগিতা করব। সোলারিয়া ছাড়া আর কেউ রোবট তৈরি করে না।
অন্য স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো?
আমি বলেছি সেগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
একটাও নেই।
আমার মনে হয় না সোলারিয়া ছাড়া আর কোথাও কোনো স্পেসার বেঁচে আছে।
তা হলে এমন কেউ নেই যে পৃথিবীর অবস্থান জানে?
পৃথিবীর অবস্থান কেউ মনে রাখবে কেন?
আমি জানতে চাই। এটাই আমার কাজ। পেলোরেট বলল।
তা হলে, ব্যাণ্ডার বলল, তোমাকে অন্য বিষয় জানতে হবে। পৃথিবীর অবস্থান আমি জানি না, কেউ জানে বলেও শুনিনি।
গাড়ি থেমে দাঁড়াল। পাশের একটা ছোট করিডোরে ওদেরকে নিয়ে এল ব্যাণ্ডার। করিডোরের দুপাশে ছোট ছোট অনেকগুলো প্রকোষ্ঠ, সেগুলোতে রয়েছে। অলংকৃত ফুলদানির মতো পাত্র। স্বল্প আলোতে হঠাৎ ঝিকমিক করছে কোনো বস্তু, সম্ভবত ফিল্ম প্রজেক্টর।
এসব কী, ব্যাণ্ডার? জিজ্ঞেস করল পেলোলারেট।
আমার পূর্ব পুরুষদের ডেথ চেম্বার।
.
উৎসুক হয়ে চারপাশে তাকালো পেলোরেট। আমার ধারণা আপনার পূর্ব পুরুষদের দেহভস্ম এখানে সমাধিস্থ।
যদি বুঝিয়ে থাকো সমাধিস্থ অর্থ মাটিতে কবর দেওয়া, তা হলে ঠিকই। ধরেছ। বলল ব্যাণ্ডার। আমরা হয়তো মাটির নিচে আছি, কিন্তু এটা আমার ম্যানসন। দেহভস্মগুলোও ঠিক আমাদের মতো এখানে আছে। সোলারিয়াতে আমরা বলি ইনহাউজ। হাউজ একটা প্রাগৈতিহাসিক শব্দ যার অর্থ ম্যানসন।
সবাই আপনার পূর্বপুরুষ? কতজন? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
প্রায় এক শ, গর্বের সাথে বলল ব্যাণ্ডার। সঠিক সংখ্যা হচ্ছে চুরানব্বই। অবশ্য প্রথমদিকের পূর্বপুরুষরা সত্যিকার সোলারিয়ান ছিল না, মানে এখনকার, মতো ছিল না। তারা ছিল হাফ-হিউম্যান, পুরুষ এবং নারী। সেসকল পূর্বপুরুষদের দেহভস্ম একসাথে অন্য কক্ষে রাখা হয়েছে। আমি সেখানে কখনো যাই না। ঐ কক্ষগুলো আমাদের জন্য লজ্জাকর।
আর ফিল্মগুলো, ব্লিস বলল। আমার ধারণা ওগুলো ফিল্ম প্রজেক্টর।
ডায়রি, ছবি ইত্যাদি। তার মানে সত্যিকার অর্থে মৃত নয়। কিছু অংশ এখনও বেঁচে আছে। এবং আমি পুরোপুরি স্বাধীন বলেই যখন খুশি তাদের সাথে যোগ দিতে পারি।
কিন্তু লজ্জাকর ঘরগুলোতে কখনো যান না।
দৃষ্টি সরিয়ে নিল ব্যান্ডার। না, কিন্তু আমরা সবাই উত্তরাধিকারী হিসেবে এগুলো পেয়েছি। এটা আমাদের সাধারণ দুর্ভাগ্য।
সাধারণ? তারমানে অন্য সোলারিয়ানদেরও এরকম ডেথ চেম্বার আছে? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
অবশ্যই। কিন্তু আমারটাই সেরা। সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত।
আপনি নিজের ডেথ চেম্বার তৈরি করেছেন?
নিশ্চয়ই। এস্টেটের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই কাজটা করেছি। এবং যখন আমার দেহ ভস্মে পরিণত হবে তখন আমার বংশধর তার প্রথম দায়িত্ব হিসেবে নিজের ডেথ চেম্বার তৈরি করবে।
আপনার বংশধর আছে?
সময় হলেই হবে। জীবনের এখনও অনেকটাই বাকি। যখন আমার চলে যাওয়ার সময় হবে তখন আমার বংশধর হবে যথেষ্ট বয়স্ক, সুখ সমৃদ্ধি উপভোগ করার মতো পরিপক্ক, তার ট্রান্সডিউসারস্-লোব হবে পূর্ণ ক্রিয়াশীল।
সম্ভবত সে হবে আপনার সন্তান।
হ্যাঁ।
কিন্তু যদি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে। আমার ধারণা সোলারিয়াতেও দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। যদি কোনো সোলারিয়ান পূর্ণ বয়স্ক বংশধর না রেখেই মারা যায়, তখন কী হবে?
এধরনের ঘটনা কমই ঘটে। আমার পূর্বপুরুষদের ভেতর মাত্র একবার হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে শুধু মনে রাখতে হবে যে অনেক এস্টেটেই প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারী রয়েছে যার পিতমাতা দ্বিতীয় বংশধর জন্ম দেওয়ার মতো তরুণ এবং দ্বিতীয় সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও বেঁচে থাকবে। তখন এই বয়স্ক উত্তরাধিকারীকে আমার এস্টেটের মালিকানা দেওয়া হবে।
মালিকানা হস্তান্তরের দায়িত্ব পালন করে কে?
আমাদের একটা রুলিং বোর্ড আছে। তাদের গুটিকয় দায়িত্বের মধ্যে এটা । একটা। পুরো কাজটা হলোভিশনের মাধ্যমে করা হয়।
কিন্তু সোলারিয়ানরা নিজেদের ভেতর কখনো দেখা সাক্ষাৎ করে না, তা হলে কেউ জানবে কীভাবে যে একজন সোলারিয়ান প্রত্যাশিত বা অপ্রত্যাশিতভাবে দেহভস্মে পরিণত হয়েছে। পেলোরেট বলল।
আমাদের কেউ দেহভস্মে পরিণত হলে এস্টেটের সমস্ত পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। সাথে সাথে কোনো উত্তরাধিকারী দায়িত্ব না নিলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ধরা পড়বে এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের সামাজিক কাঠামো বেশ দক্ষতার সাথে কাজ করে।
এখানে যে ফিল্ম আছে তার দুই-একটা দেখা যাবে? জানতে চাইল ট্র্যাভিজ।
বরফের মতো জমে গেলো ব্যাণ্ডার। ধীরে ধীরে বলল, তুমি অজ্ঞ বলেই তোমাকে ক্ষমা করা হলো। যা বলেছ সেটা শুধু নিষ্ঠুরই নয় জঘন্য পাপ।
আমি ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আগেই তো বলেছি আমরা পৃথিবী খুঁজে বের করতে। চাই। প্রাচীন ফিল্মগুলোতে হয়তো পৃথিবীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আমরা আপনার প্রাইভেসি নষ্ট করতে চাই না। কোনো রোবটকে দিয়ে ফিল্মগুলো চালু করে দিতে পারেন। আপনার থাকার দরকার নেই।
কাষ্ঠ গলায় বলল ব্যাণ্ডার, বুঝতে পারছ না সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি। যাই হোক আলোচনা শেষ, কারণ হাফ হিউম্যান পূর্বপুরুষদের কোনো দেহ ভষ্ম নেই।
কিছুই নেই? হতাশ হলো ট্র্যাভিজ।
একসময় ছিল। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কি ছিল। দুজন হাফ-হিউম্যান পরস্পরের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে, মিলিত হচ্ছে। বহুপুরুষ আগেই সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
অন্য সোলারিয়ানদের রেকর্ডের কী অবস্থা?
সব ধ্বংস হয়ে গেছে।
আপনি নিশ্চিত? ধ্বংস না করাটাই পাগলামি।
হয়তো কোনো সোলারিয়ান পাগল, বা আবেগপ্রবণ বা ভুলে গেছে। আশা করি প্রতিবেশী কোনো এস্টেটে গেলে আপনি আপত্তি করবেন না।
অবাক হয়ে ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো ব্যাণ্ডার। তোমার ধারণা অন্যরাও আমার মতো ব্যবহার করবে?
কেন নয়, ব্যাণ্ডার?
করবে না।
আমরা সুযোগটা নিতে চাই।
না, ট্র্যাভিজ। না, তোমরা কেউ তা করবে না। পিছনে কিছু রোবটের সাড়া শব্দ পাওয়া গেল, ভুরু কুঁচকে ফেলেছে ব্যাণ্ডার।
কী ব্যাপার, ব্যাণ্ডার? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করছে।
ব্যাণ্ডার বলল, তোমাদের সাথে কথা বলে, তোমাদের অস্বাভাবিকতা দেখে আমি বেশ আনন্দ পেয়েছি। চমৎকার এবং আনন্দের অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই ঘটনা আমি ডায়রিতে রেকর্ড করতে পারব না বা ছবিতে ধরে রাখতে পারব না।
কেন?
তোমাদের সাথে কথা বলা; তোমাদের কথা শোনা; আমার ম্যানসনে নিয়ে। আসা; পূর্বপুরুষদের ডেথ চেম্বারে নিয়ে আসা; অত্যন্ত লজ্জার কাজ।
আমরা সোলারিয়ান নই। আপনার কাছে আমরা ওই রোবটগুলোর মতো, তাই না?
নিজেকে এভাবেই প্রবোধ দিচ্ছি। কিন্তু অন্যদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
চিন্তার কি আছে? নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আপনার আছে, তাই না?
সোলারিয়ায় আমিই একমাত্র অধিবাসী হলে আরো ঘৃণ্য কাজ করলেও কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আরো সোলারিয়ান আছে, যে কারণে সত্যিকারের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথ এখনও অর্জিত হয়নি। যা করেছি সেজন্য হয়তো বাকি বারশ সোলারিয়ান আমাকে ঘৃণা করবে।
কাউকে না জানালেই হলো।
ঠিক। তোমাদের এখানে নিয়ে আসার পর সারক্ষণ কথাটা ভাবছি। অন্যদের জানানো চলবে না।
পেলোরেট বলল, যদি ভয় পান তা হলে এই এস্টেটে প্রথমে এসেছিলাম সেটা অন্য এস্টেটে গিয়ে না বললেই তো হল।
মাথা নাড়ল ব্যান্ডার। অনেক ঝুঁকি নিয়েছি। আমি কখনো বলব না, রোবটরা ও বলবে না, তাদেরকে বরং ভুলে যাওয়ার জন্য প্রোগ্রাম করব। তোমাদের মহাকাশযান আণ্ডারগ্রাউণ্ডে এনে কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখব।
দাঁড়ান, বলল ট্র্যাভিজ, মহাকাশযান পরীক্ষা করতে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে থাকব? অসম্ভব।
কিছু করার নেই, আমি দুঃখিত। তোমাদের সাথে আরো অনেক বিষয়ে কথা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই বিপদের দিকে মোড় নিচ্ছে।
না, নিচ্ছে না। ট্র্যাভিজ জোর দিয়ে বলল।
নিচ্ছে, নগণ্য হাফ-হিউম্যান। আমার পূর্বপুরুষরা তোমাদের দেখা মাত্রই যে কাজটা করতেন আমাকে এবার সেটা করতে হবে। তোমাদেরকে মরতে হবে। তিন জনকেই।
.
১২. সারফেস
ব্লিসের চেহারা ভাবশূন্য কিন্তু কঠিন এবং তার দৃষ্টি গভীর একাগ্রতায় ব্যাণ্ডারের উপর নিবদ্ধ, যেন আর কারো অস্তিত্ব নেই।
পেলোরেটের চোখ জোড়া অবিশ্বাসে বড় হয়ে গেছে।
ট্র্যাভিজ জানে না ব্লিস কী করছে বা করতে পারবে। পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ অনুভব করল সে। মৃত্যুকে সে ভয় পায় না। দুঃখ শুধু পৃথিবীর অবস্থান না জেনেই মরতে হচ্ছে এবং কোনোদিন জানতে পারবে না কেন সে গায়াকে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে নির্বাচন করেছিল। তাকে সময় পেতে হবে।
কথা বলল সে, পরিষ্কার উচ্চারণ এবং কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা বজায় রাখার জন্য সাধনা করতে হলো, আপনি নিজেকে একজন ভদ্র অমায়িক সোলারিয়ান হিসেবে প্রমাণ করেছেন। এই গ্রহে অনুপ্রবেশ করার জন্য রাগ করেন নি বরং নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এখন আমাদের যেতে দেওয়াটাই আপনার চরিত্রের সাথে মানানসই হবে। আমরা এসেছিলাম কেউ কখনো জানবে না, আর কোনো কারণে কখনো এখানে ফিরে আসব না।
যাই বল, হালকা চালে বলল ব্যাণ্ডার, আমি কিন্তু তোমাদের জীবন দিয়েছি। আমি যা করতে পারতাম এবং করা উচিত ছিল তা হচ্ছে দেখা মাত্রই তোমাদের মেরে ফেলা। তা না করে নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছি এই যথেষ্ট । এরই মধ্যে সোলারিয়ার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। আবার তোমাদের ছেড়ে দিলে তোমাদের মতো অনেকেই এখানে আসা শুরু করবে।
তবে এতটুকু করতে পারি যে তোমাদের মৃত্যু হবে যন্ত্রণাহীন। শুধু জীবনের স্পন্দন থেমে যাবে। তারপর তোমাদের দেহ পুড়িয়ে ফেললেই সব ঝামেলা শেষ।
মরতেই যখন হবে তখন আর দ্রুত এবং যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর কথা ভেবে কোনো লাভ নেই। কিন্তু আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি, তা হলে মরতে হবে কেন?
এখানে আসাই তোমাদের অপরাধ।
যুক্তিহীন কথা, এটা যে অপরাধ আমরা তা জানতাম না।
সমাজ নির্ধারণ করবে কোনটা অপরাধ। তোমার কাছে এটা হয়তো অযৌক্তিক কিন্তু আমার কাছে তা নয়, এবং এটা আমাদের গ্রহ, এখানে আমরাই নির্ধারণ করব কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। তোমরা অপরাধ করেছ তার শাস্তি মৃত্যু।
এমনভাবে হাসল ব্যাণ্ডার যেন খোশগল্প করছে। নিজেকে ভালো প্রমাণ করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। তুমি যে ব্লাস্টার নিয়ে এসেছে সেটা আমার চেয়েও ভয়ংকরভাবে হত্যা করে। অস্ত্রটা ঠিক থাকলে আমার উপর প্রয়োগ করতে একটুও দ্বিধা করতে না।
ব্লিসের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে ট্র্যাভিজ, যদি ব্যাণ্ডারের মনযোগ সেদিকে চলে যায়। হতাশভাবে বলল, আমি আপনাকে দয়া করতে বলছি, কাজটা করবেন না।
হাসল ব্যাণ্ডার। প্রথমে আমি নিজেকে এবং আমার গ্রহকে দয়া করব, এবং সেটা করতে হলে তোমাদের মরতেই হবে।
হাত তুলল সে এবং নিকষ কালো অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্র্যাভিজের উপর।
.
মনে হলো যেন অন্ধকার ট্র্যাভিজের উপর চেপে বসছে। এটাই কি মৃত্যু?
তার ভাবনা যেন শব্দে রূপ পেলো। ফিসফিস করে কেউ বলছে, এটাই কি মৃত্যু? পেলোরেটের গলা।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ। নিজেও ফিসফিস করে বলল, তোমার প্রশ্নই প্রমাণ করে যে আমরা মরি নি।
মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে।
ননসেন্স। ব্লিস? তুমি কোথায়? ব্লিস?
কোনো উত্তর নেই।
এবার পেলোরেট ডাকল, ব্লিস? কী হয়েছে, গোলান?
ব্যাণ্ডার সম্ভবত মারা গেছে। তাই এস্টেটে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ।
কীভাবে? তার মানে ব্লিস ওকে মেরে ফেলেছে?
আমার তাই ধারণা। আশা করি তার নিজের কোনো ক্ষতি হয়নি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল সে। তারপর উষ্ণ আর মসৃণ কিছুর উপর হাত পড়ল। হাত বুলিয়ে বুঝতে পারল একটা পা। অনেক ছোট, ব্যাণ্ডারের হতে পারে না। ব্লিস?
পাটা লাথি ছুঁড়ল। ট্র্যাভিজের হাত থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করছে।
ব্লিস? কথা বল।
বেঁচে আছি, ব্লিসের বিধ্বস্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
তোমার কিছু হয়নি তো? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
না। এই কথার সাথেই আলো জ্বলে উঠল-নিস্তেজ আলো। দেয়ালগুলো হালকাভাবে ঝকমক করছে। আলো বাড়ছে কমছে, কেমন যেন এক রহস্যময়তা।
একটা ছায়া ঢাকা স্থানে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে আছে ব্যাণ্ডার। তার মাথা ব্লিসের কোলে।
চোখ তুলে পেলোরেট আর ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো ব্লিস। সোলারিয়ান মারা গেছে। সে বলল, স্বল্প আলোতে চিক্ চিক্ করে উঠল চোখের পানি।
হতবাক হয়ে গেল ট্র্যাভিজ। তুমি কাঁদছ কেন?
একটা চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিমান জীবনকে হত্যা করে আমি কাঁদব না?
ট্র্যাভিজ ঝুঁকে তাকে তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ব্লিস ঝাঁপটা দিয়ে। সরিয়ে দিল তাকে।
এবার পেলোরেট চেষ্টা করল। পাশে বসে নরম সুরে বলল, তুমি এখন আর ব্যাণ্ডারের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কী ঘটেছে আমাদের বল।
উঠে দাঁড়ালো ব্লিস। নিরুত্তাপ গলায় বলল, ব্যাণ্ডার যা করতে পারত, গায়াও সেটা করতে পারে। মেন্টাল পাওয়ারের সাহায্যে গায়া মহাবিশ্বের অসমভাবে বিন্যাস্ত শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।
আমি জানি, ট্র্যাভিজ বলল, আমার মনে আছে প্রথম সাক্ষাতের সময় তুমি-বা গায়া-আমাদের মহাকাশযান বন্দি করে রেখেছিলে। ঠিক সেভাবেই ব্যাণ্ডার আমাদের বন্দি করেছিল, কিন্তু জানতাম চাইলেই তুমি মুক্ত হতে পারবে।
না চেষ্টা করলে ব্যর্থ হতাম। যখন তোমাদের মহাকাশযান দখল করেছিলাম সেই সময় আমি/আমরা/গায়া ছিলাম প্রকৃত অর্থে এক। কিন্তু এখন হাইপার স্পেসাল দূরত্বের কারণে আমাদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া, গায়া যা করতে পারে তা করে অসংখ্য মস্তিষ্কের মিলিত সীমাহীন শক্তির সাহায্যে। অথচ সবগুলো মস্তিষ্কের মিলিত শক্তি একজন সোলারিয়ানের ট্র্যান্সডিউসার-লোবস এর শক্তির সমান নয়। আমার শক্তি একজন সোলারিয়ানের ট্র্যান্সডিউসার লোবস এর শক্তির সমান নয়। আমরা এত সূক্ষ্ম ভাবে, দক্ষভাবে, ক্লান্তিহীনভাবে শক্তি ব্যবহার করতে পারি না।–দেখছই তো এর চেয়ে উজ্জ্বলভাবে আলো জ্বালাতে পারিনি, ক্লান্ত না হয়ে কতক্ষণ জ্বালিয়ে রাখতে পারব জানি না। অথচ সে পুরো এস্টেটে শক্তি সরবরাহ করত। এমনকি যখন ঘুমিয়ে থাকত তখনও।
কিন্তু তুমি তাকে থামিয়েছ।
কারণ সে আমাকে সন্দেহ করেনি এবং আমি সন্দেহ করার মতো আচরণ করিনি। সে গুরুত্ব দিয়েছিল তোমাকে, কারণ তোমার কাছেই ছিল অস্ত্র। আবারও তোমার অস্ত্রগুলো কাজে লাগল-এবং আমি দ্রুত, অপ্রত্যাশিত আক্রমণের সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম। ঠিক যে মুহূর্তে সে আমাদের হত্যা করতে চেয়েছিল, যখন তার সমস্ত মাইও কেন্দ্রীভূত ছিল তোমার উপর, তখন আমি আঘাত করার সুযোগ পেলাম।
চমৎকার কাজ করেছ।
এমন নিষ্ঠুর কথা বলতে পারলে, ট্র্যাভিজ? আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু তাকে থামানো। চেয়েছিলাম তার ট্রান্সডিউসার ব্লক করে দিতে। দীর্ঘ সময়ের জন্য গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে ট্রান্সডিউসারগুলো খুলে দিতাম, ফলে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হত না। আমরা মহাকাশযান নিয়ে বেরিয়ে যেতাম গ্রহ ছেড়ে। জেগে উঠলে তার কিছুই মনে থাকত না। গায়া কখনো হত্যা করতে চায় না।
ভুল হলো কোথায়? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।
আমি কখনো ট্র্যান্সডিউসার লোবস এর মুখোমুখি হইনি এবং এগুলো জানার বা বোঝার জন্য বেশি সময় ছিল না। আমি প্রচণ্ড শক্তিতে ব্লক করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভালো কাজ হলো না। লোবস এর ভেতর শুধু শক্তি প্রবেশই বন্ধ হলো না শক্তি বেরিয়ে আসার পথও বন্ধ হয়ে গেল। ফলে লোবস এর ভেতর শক্তি জমা হয়ে তাপমাত্রা এত বেড়ে গেল যে এক সেকেণ্ডেরও কম সময়ের ভেতর ব্রেইন প্রোটিনে বিস্ফোরণ ঘটল। সাথে সাথে মারা গেল ব্যাণ্ডার।
তুমি যা করেছ, সেটা ছাড়া তোমার অন্য কিছু করার ছিল না, ডিয়ার। বলল পেলোরেট।
কিন্তু আমি প্রাণ হত্যা করেছি।
ব্যাণ্ডার আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। বলল ট্র্যাভিজ।
সে কারণেই তাকে থামাতে চেয়েছিলাম, মেরে ফেলতে চাইনি।
দ্বিধা করল ট্র্যাভিজ। ধৈর্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাগারাগি করলে ব্লিস আরো ভেঙে পড়বে। হাজার হোক অসীম ক্ষমতাশালী এই বৈরী বিশ্বে সেই তাদের একমাত্র সহায়।
সে বলল, ব্লিস, ব্যাণ্ডারকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কারণ সে মারা গেছে, এস্টেটের পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ। যে-কোনো মুহূর্তে অন্য সোলারিয়ানরা তদন্ত করার জন্য চলে আসবে। তাদের সাথে তুমি পেরে উঠবে না। নিজেই বলেছ আলো বেশিক্ষণ জ্বালিয়ে রাখতে পারবে না। কাজেই আমাদেরকে দ্রুত এখান থেকে বেরিয়ে মহাকাশযানে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু গোলান, পেলোরেট বলল, কীভাবে বেরোব। এখানে গলি উপগলির গোলক ধাঁধা পেরিয়ে কীভাবে সারফেসে পৌঁছব? আমি নিজে কখনো পথের হদিস মনে রাখতে পারি না।
পেলোরেটের কথা কতখানি খাঁটি চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল ট্র্যাভিজ। আমার মনে হয় সারফেসে পৌঁছানোর অনেকগুলো রাস্তা আছে, যেটা দিয়ে ঢুকেছিলাম সেটা দিয়েই বেরোতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
কিন্তু প্রবেশমুখগুলো কোথায় আছে তাই তো জানি না। বের করব কীভাবে?
ব্লিসের দিকে ঘুরল ট্র্যাভিজ। তুমি কিছু ডিটেক্ট করতে পারছ, মেন্টালি, বেরনোর পথ খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারো।
এস্টেটের রোবটগুলো এখন ইনঅ্যাকটিভ। সোজা উপরে নিচু শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা ডিটেক্ট করতে পারছি, কিন্তু এগুলো থেকে শুধু বোঝা যায় যে সারফেস সোজা মাথার উপরে, আমরা সবাই সেটা জানি।
বেশ, আমাদেরকে বেরুনোর পথ খুঁজে দেখতে হবে।
হিট অ্যাণ্ড মিস, পেলোরেট বলল। কোনোদিনই সফল হবে না।
হয়তো, জেনভ। খুঁজতে থাকলে যত ছোটই হোক পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। বিকল্প উপায় হচ্ছে এখানে বসে থাকা, তাতে কোনো লাভ হবে না। বরং চেষ্টা করে দেখা উচিত।
দাঁড়াও, ব্লিস বলল, আমি কিছু একটা অনুভব করতে পারছি।
কী? ট্র্যাভিজ বলল।
মাইণ্ড।
বুদ্ধিমান?
হ্যাঁ, কিন্তু দুর্বল। আমি পরিষ্কারভাবে যা ধরতে পারছি সেটা অন্য কিছু।
কী? আবারও অসহিষ্ণু ভাব গোপন করার জন্য হিমসিম খেতে হল ট্র্যাভিজকে।
ভয়! সীমাহীন ভয়! ফিসফিস করে বলল ব্লিস।
.
চারপাশে তাকিয়ে দুঃখ বোধ করল ট্র্যাভিজ। কোথায় এসেছে এটা জানে, কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই নেই। যতগুলো মোড় ঘুরেছে, প্যাঁচানো পথ ধরে নেমেছে, সেগুলোর প্রতি কোনো মনযোগই দেয়নি সে। কে জানত তাদেরকে কোনো সাহায্য ছাড়া একা একা ফিরতে হবে। আলোও থাকবে না সেই সময়।
গাড়িটা চালু করতে পারবে, ব্লিস? জিজ্ঞেস করল সে।
চালু করতে পারব, ট্র্যাভিজ, ব্লিস বলল। তার মানে এই না যে চালাতেও পারব।
আমার মনে হয় ব্যাণ্ডার মেন্টালি গাড়ি চালিয়েছিল। বলল পেলোরেট। আমি তাকে কোনো কিছু ধরতে বা নাড়তে দেখিনি।
হ্যাঁ, মেন্টালি চালিয়েছিল। কিন্তু আমাকে কাজটা করার আগে গাড়ির কন্ট্রোলস সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হবে। চেষ্টা করতে হলে মাইণ্ডের পুরো শক্তি নিয়োগ করতে হবে। তখন আর আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারব না। অন্ধকারে গাড়ি চালাতে পারলেই কি, না পারলেই কি।
তা হলে আমাদের হেঁটেই যেতে হবে।
আমারও তাই মনে হয়।
আলো যত দূর পৌঁছেছে তার পরের ঝাপসা বিষণ্ণ অন্ধকারের দিকে হেঁটে গেল ট্র্যাভিজ। কিছু দেখতে পেলো না, শুনতে পেল না।
ব্লিস, ভয় পাওয়া মাইণ্ড তরঙ্গ এখনও অনুভব করতে পারছ?
হ্যাঁ, পারছি।
বলতে পারো কোথায়? নিয়ে যেতে পারবে?
মেন্টাল সেন্স সরল পথে চলে। কখনো গতিপথ পাল্টায় না। তার মানে বলা যায় যে এটা আসছে সোজা ওদিক থেকে।
ঈষৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা দেয়ালের দিকে দেখালো সে। কিন্তু দেয়ালের ভেতর দিয়ে আমরা যেতে পারব না। ভালো উপায় হচ্ছে করিডোর দিয়ে চলা শুরু করি, যেদিকে মেন্টাল প্রবাহ তীক্ষ্ণ মনে হবে সেদিকে পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করব।
তা হলে শুরু করা যাক এখনই।
এক পা পিছিয়ে গেল পেলোরেট। দাঁড়াও গোলান, জিনিসটা যাই হোক, খুঁজে বের করার কোনো দরকার আছে? ওটা যদি ভয় পেয়ে থাকে তা হলে আমাদেরও ভয়ের কারণ থাকতে পারে।
অধৈর্যভাবে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। কিছু করার নেই, জেনভ। ভয় পাক বা না পাক ওটা একটা মাইণ্ড। হয়তো সারফেসের পথ দেখাতে পারে।
ব্যাণ্ডারকে এভাবেই ফেলে যাবো? পেলোরেটের গলায় অস্বস্তি।
হাত ধরে টানল ট্র্যাভিজ। এসো জেনভ। এ ব্যাপারেও কিছু করার নেই। কোনো একজন সোলারিয়ান, এসে পাওয়ার রিএ্যাকটিভেট করবে, তারপর রোবটরাই ব্যাণ্ডারের ব্যবস্থা করবে। তবে প্রার্থনা করি আমরা বেরিয়ে যাওয়ার আগেই যেন না আসে।
ব্লিস থাকল সবার সামনে। তার ঠিক পাশের স্থানগুলোতে আলোর উজ্জ্বলতা বেশি। প্রতিটা দরজা, করিডোরের প্রতিটা শাখাপথের সামনে থামল সে, বোঝার চেষ্টা করল ভয়টা কোনদিক থেকে আসছে। কখনো কোনো দরজা দিয়ে ঢুকে বা বাঁক ঘুরে ফিরে এসে নতুন পথ ধরছে, ট্র্যাভিজ শুধু দেখছে অসহায়ের মতো।
পথ নির্বাচন করে যখনই দৃঢ়ভাবে হাঁটছে ব্লিস তার সামনে আলো জ্বলে উঠছে। খেয়াল করল ট্র্যাভিজ আলো এখন আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয় স্বল্প আলোতে তার চোখ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, অথবা ব্লিস আরো দক্ষভাবে ট্রান্সডাকশন সামলাতে পারছে। চলার পথে একটা তাপ পরিচালন দণ্ড স্পর্শ করতেই আলো চোখে পড়ার মতো উজ্জ্বল হলো। মাথা নাড়ল সে যেন নিজের কাজে প্রচণ্ড খুশি।
সারফেসের দিকে উঠে যাওয়া কোনো করিডোর বা কোনো ট্র্যাপড্ডারের জন্য সিলিং-এ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে ট্র্যাভিজ। সেরকম কিছু এখনো চোখে পড়েনি। ভয় পাওয়া মাইণ্ডই একমাত্র ভরসা।
কিছুই পরিচিত মনে হচ্ছে না, তার মানে এই পথ দিয়ে তারা আসেনি।
সীমাহীন নীরবতা, শুধু তাদের চলার শব্দ; গভীর অন্ধকার, শুধু তাদের চারপাশে আলো; সব মৃত, শুধু তারা জীবিত। অন্ধকারে হঠাৎ চোখে পড়ছে রোবটের ছায়া, বসে আছে বা দাঁড়িয়ে আছে, নিস্পন্দ। এক জায়গায় দেখল একটা রোবট অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত পা মেলে পড়ে আছে। বিশাল ব্যাণ্ডার এস্টেটের সবখানেই সম্ভবত রোবট গুলো নিস্পন্দ হয়ে আছে, এবং সীমান্তের কাছে ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে।
অথবা ধরতে পারবে না, হঠাৎ মনে হলো ট্র্যাভিজের। সোলারিয়ানরা জানে কখন তাদের একজন বয়স এবং শারীরিক দুর্বলতার কারণে মারা যাবে। সেজন্য তারা প্রস্তুত থাকে। কিন্তু ব্যান্ডার তরুণ বয়সে অপ্রত্যাশিত ভাবে মারা গেছে। কে আশা করবে? এখানে সকল কাজ থেমে গেছে, সেটা কে লক্ষ করবে?
না, বেশি আশা করা ঠিক নয়। সোলারিয়ানরা ঠিকই লক্ষ রাখবে। উত্তরাধিকারের ব্যাপার আছে।
অসুখী গলায় অনুযোগ করল পেলোরেট। ভেন্টিলেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এধরনের আণ্ডারগ্রাউণ্ডে ভেন্টিলেশন থাকতেই হবে।
কোনো ব্যাপার না, জেনভ। ট্র্যাভিজ বলল। এখানে যে বাতাস আছে তাতে আমরা বছরখানেক বেঁচে থাকতে পারব।
জায়গাটা আবদ্ধ। মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য সেটাই যথেষ্ট।
প্লিজ জেনভ, খামোখা ভয় তৈরি করো না।–ব্লিস, আমরা কাছাকাছি পৌঁছেছি?
অনেকখানি, ট্র্যাভিজ। জবাব দিল ব্লিস। অনুভূতি অনেক বেশি প্রখর এবং আমি জানি কোথায় আছে। এখন সে নিশ্চিত দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছে। ঐখানে! ঐখানে! আরো গভীরভাবে অনুভব করতে পারছি।
এমনকি আমিও শুনতে পারছি। শুকনো গলায় বলল ট্র্যাভিজ।
থেমে গেছে তিন জন, নিশ্বাস বন্ধ। কানে আসছে নিচু লয়ে কান্নার শব্দ, মাঝে মাঝে ফোঁপানির শব্দ।
একটা বিশাল কামরায় প্রবেশ করল তারা, আলো জ্বলে উঠল। কামরার সাজ সজ্জা সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ।
ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা রোবট, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। আশ্বাসের ভঙ্গিতে হাত দুটো সামনে বাড়ানো। এবং অবশ্যই স্থির।
রোবটের পিছনে একদিক থেকে পোশাকের অংশবিশেষ এবং অন্যদিক থেকে একটা ভয়ার্ত চোখ উঁকি মারছে, আর হৃদয়-মোচড়ানো কান্নার শব্দ চলছেই।
ঘুরে রোবটের পিছন দিকে গেল ট্র্যাভিজ, ওদিক থেকে চিৎকার করতে করতে ছুটে বেরিয়ে এল একটা ছোট শরীর। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে, পড়েই থাকল, চোখ ঢেকে রেখেছে। লাথি ছুঁড়ছে জোরে জোরে। সেইসঙ্গে চলছে গলা ফাটানো চিৎকার।
বলার দরকার ছিল না, তারপরেও বলল ব্লিস, ছোট বাচ্চা।
.
পিছিয়ে এল ট্র্যাভিজ। বাচ্চা আসবে কোত্থেকে। ব্যাণ্ডার বলেছিল সে একা, এবং সেটা নিয়ে গর্ববোধ করত।
সবচেয়ে কম অবাক হয়েছে পেলোরেট। দ্রুত একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাল সে, আমার ধারণা এটা সম্ভবত উত্তরাধিকারী।
ব্যাণ্ডারের সন্তান, একমত হলো ব্লিস। তবে উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেক ছোট। অন্য কাউকে খুঁজে নিতে হবে সোলারিয়ানদের।
বাচ্চাটার দিকে তাকাল ব্লিস, একাগ্র দৃষ্টিতে নয় বরং নরম সম্মোহনী দৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল, চোখ খুলে ব্লিসের দিকে তাকাল। অর্থহীন ছাড়া ছাড়া শব্দ করল ব্লিস, শিশুর কান্না ভোলানোর জন্য যেমন শব্দ করে মায়েরা।
ব্লিসের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো. শিশু সোলারিয়ান। একটু দ্বিধা করল, তারপর দৌড় দিল নিষ্প্রাণ রোবটের দিকে। নিরাপত্তার জন্য দুহাতে রোবটের শক্ত পা জড়িয়ে ধরল।
আমার ধারণা এই রোবট বাচ্চাটার নার্সমেইড বা কেয়ারটেকার। বলল ট্র্যাভিজ। সম্ভবত সোলারিয়ানরা একে অন্যকে দেখাশোনা করে না, সেটা শিশু হলেও না।
এবং আমার ধারণা এই বাচ্চাটাও হারমাফ্রোডিটিক। পেলোরেট বলল।
হতেই হবে।
বাচ্চাটার দিকেই পূর্ণ মনযোগ ব্লিসের, যেন ভয় না পায় তাই আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত দুটো উপরে তুলে সামনে এগোল, সোলারিয়ান শিশু একেবারে নিশ্চুপ, অবাক হয়ে দেখছে, আরো শক্ত করে রোবটের পা জড়িয়ে ধরল।
ব্লিস বলল, ছোট বাবু-সোনা বাবু–শান্ত হও, ভয় নেই, বাবু-ভয় নেই। থামল সে। পিছনে না তাকিয়ে বলল, পেল, সোলারিয়ান ভাষায় কথা বল। বল আমরা রোবট, পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ, তাই ওর দেখাশোনা করতে এসেছি।
রোবট! পেলোরেট হতভম্ব।
নিজেদের রোবট বলেই প্রমাণ করতে হবে। রোবটকে ভয় পাবে না। তা ছাড়া ওটা জীবনে কোনোদিন মানুষ দেখেনি। সম্ভবত জানেও না।
বোঝানো একটু সমস্যা হবে। অতো প্রাচীন ভাষায় রোবটের প্রতিশব্দ আমার জানা নেই।
তা হলে রোবট বল, পেল। তাতে কাজ না হলে বল আয়রন থিং। যা পারো বল।
ধীরে ধীরে শব্দ বাছাই করে সুপ্রাচীন ভাষায় কথা বলল পেলোরেট। সোলারিয়ান শিশু তাকালো তার দিকে, ভুরু কোঁচকানো, বোঝার চেষ্টা করছে।
কীভাবে বেরনো যাবে সেটা জিজ্ঞেস কর। বলল ট্র্যাভিজ।
এখনই না, বাধা দিল ব্লিস। প্রথমে ওর ভয় দূর করতে হবে।
সোলারিয়ান শিশু পেলোরেটের দিকে তাকাল, রোবটটাকে ছেড়ে দিয়েছে। তীক্ষ্ণ সুরেলা গলায় কিছু বলল।
মাথা নাড়ল পেলোরেট। দ্রুত কথা বলে। কিছুই বুঝিনি।
ধীরে ধীরে কথা বলতে বল। ওর ভয় দূর করে শান্ত করার জন্য যতদূর সম্ভব চেষ্টা করছি।
কথা বলল পেলোরেট, মনযোগ দিয়ে শুনল। আমার ধারণা ওটা জিজ্ঞেস করছে। জেম্বি নড়ছে না কেন। সম্ভবত রোবটের নাম জেম্বি।
আরেকবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নাও।
আবার জিজ্ঞেস করল পেলোরেট, শুনল মনযোগ দিয়ে। হ্যাঁ, রোবটের নাম জেম্বি। আর নিজের নাম বলছে ফেলম।
চমৎকার! স্নেহ ঝরানো হাসি হাসল ব্লিস। আঙুল তুলে বলল, ফেলম। লক্ষ্মী ফেলম, সাহসী ফেলম। নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ব্লিস।
চমৎকার করে হাসল সোলারিয়ান শিশু, ব্লিস। স উচ্চারণের সময় হিস শব্দ হলো।
ব্লিস, তুমি রোবট জেম্বিকে চালু করে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জেনে নিতে পারো।
না। রোবটের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে বাচ্চাটাকে রক্ষা করা। আমাদের মতো মানুষ এই রোবট কখনো দেখেনি। কাজেই চালু করার পর তিন জন অদ্ভুত মানুষকে দেখে আক্রমণ করে বসতে পারে।
কিন্তু আমরা শুনেছি, রোবট মানুষের ক্ষতি করে না। পেলোরেট বলল।
শুনেছি। কিন্তু সোলারিয়ানরা কি ধরনের রোবট তৈরি করেছে জানি না। হয়তো এই রোবট মানুষের ক্ষতি করে না। কিন্তু তিন জন অদ্ভুত মানুষ এবং তার সন্তান বা তার কাছে যা সন্তানের সমতুল্য দুটোর একটাকে বেছে নেবে। এবং অবশ্যই সে বাচ্চাটাকে বেছে নেবে।
সোলারিয়ান শিশুর দিকে ঘুরল ব্লিস। ফেলম, সে বলল, ব্লিস। বাকি দুজনকে দেখিয়ে বলল, পেল-ট্রেভ।
পেল। ট্রেভ, বাধ্য শিশুর মতো বল ফেলম।
কাছে এগোল ব্লিস, হাত বাড়াল, ঝট করে পিছিয়ে গেল ফেলম। কিন্তু ব্লিসের মুখে আদরের শব্দগুলো শুনে আবার কাছে আসল।
ফেলমের নগ্ন বাহুতে হাত রাখল ব্লিস। তার শক্তিশালী মাইণ্ডের শান্তকরণ প্রক্রিয়ার কারণে চোখ আধ বোজা করে রেখেছে ফেলম। ব্লিস তার চিবুকে কাঁধে পালকের মতো স্পর্শ করে হাত বুলিয়ে কানের পেছনে হাত নিয়ে গেল। তারপর ছেড়ে দিল।
বাকি দুজনকে বলল, ট্র্যান্সডিউসার লোবস অনেক ছোট। তার মানে এই মুহূর্তে সে এস্টেট চালাতে পারবে না। বয়স কত জিজ্ঞেস করো, পেল।
কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময় করে পেলোরেট বলল, চোদ্দ বছর।
আমার কাছে তো এগারোর বেশি মনে হচ্ছে না। বলল ট্র্যাভিজ।
সম্ভবত! সোলারিয়ান বৎসর গ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড বৎসর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে হিসাব করা হয়। তা ছাড়া স্পেসাররা দীর্ঘজীবি হয়। নিজেদের বয়োবৃদ্ধির বয়সসীমাকে হয়তো তারা বাড়িয়ে নিয়েছে।
জিভ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করল ট্র্যাভিজ, যথেষ্ট হয়েছে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, দ্রুত বেরোতে হবে। এই শিশু হয়তো সারফেসে পৌঁছানোর রাস্তা জানে না। হয়তো কখনো সারফেসে যায়নি।
পেল! ব্লিস বলল।
ব্লিস কী করতে বলছে জানে পেলোরেট। ফেলমের সাথে দীর্ঘ আলোচনা শুরু করল সে। তারপর বলল, সোলারিয়ান শিশু সূর্য দেখেছে। গাছপালা দেখেছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় শব্দটার অর্থ সে জানে–অন্তত আমি যে শব্দটা ব্যবহার করেছি।
ঠিক আছে, জেনভ, ট্র্যাভিজ বলল, আসল কথা বল।
আমি বলেছি যে সারফেসে পৌঁছে রোবটগুলোকে চালু করব। আসলে বলেছি হয়তো করতে পারব। আসলেই পারব?
সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। ও আমাদের পথ দেখাতে পারবে?
হ্যাঁ, আমার প্রতিশ্রুতির কারণে খুশি হয়েই করবে। আসলে আমরাও হতাশ করার ঝুঁকি–
চল, রওয়ানা দেওয়া যাক।
পেলোরেটের কথা শুনে হাঁটা শুরু করল ফেলম, তারপর থেমে ব্লিসের দিকে তাকালো।
হাত বাড়ালো ব্লিস। দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগল। আমি হলাম নতুন রোবট। হাসি মুখে বলল সে।
বাচ্চাটা খুব খুশি হয়েছে মনে হয়। বলল ট্র্যাভিজ।
সে ভেবে পাচ্ছে না ফেলম এত খুশি কেন? ব্লিস সেটা নিশ্চিত করেছে? নাকি সারফেসে পৌঁছার আনন্দ; নতুন তিনটা রোবট পাওয়ার আনন্দ, নাকি মনে করেছে পালক পিতামাতা জেম্বিকে ফিরে পাবে। তবে যতক্ষণ পথ দেখাচ্ছে এগুলো ভাববার দরকার নেই।
ফেলমের পদক্ষেপে কোনো দ্বিধাগ্রস্ততা নেই। কোনো বাকেই থামছে না। ট্র্যাভিজের মনে হলো সোলারিয়ান শিশু নতুন কোনো খেলা মনে করেছে এটাকে। কিন্তু চলার পথ উপরের দিকে ক্রমশ উঠে যেতেই সন্দেহ দূর হয়ে গেল। একটা দিক দেখিয়ে হড়বড় করে কিছু বলল ফেলম।
পেলোরেটের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। পেলোরেট বলল, আমার ধারণা, বলছে দরজা।
যেদিকে দেখিয়েছে সেদিকের অন্ধকার তুলনামূলকভাবে গাঢ়। ব্লিসের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড় দিল ফেলম। দরজার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ লাফঝাঁপ করে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল।
পাওয়ার সাপ্লাই করতে হবে। ব্যাপারটা ক্লান্ত করে তুলছে আমাকে। হাসিমুখে বলল ব্লিস। মুখের রং বদলে লাল হলো। কমে গেল আলোর উজ্জ্বলতা। একটা দরজা খুলল সামনে। খুশিতে লাফিয়ে উঠল ফেলম। তার পেছনে বেরুলো পুরুষ দুজন। ব্লিস বেরোল সবার পরে। চেহারা বিধ্বস্ত।
বেশ, বলল পেলোরেট, বোরোলাম। মহাকাশ যান কোথায়?
মনে হচ্ছে ওদিকে। ফিস ফিস করে বলল ট্র্যাভিজ।
আমারও তাই মনে হয়। একমত হলো ব্লিস।
দিনের আলো এখনো শেষ হয়নি। কোনো প্রাণীর ডাক এবং গাছের পাতার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এক জায়গায় দেখল একটা রোবট দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একগাদা জিনিসপত্র, কী কাজে নিয়ে যাচ্ছিল কে জানে।
দেখার জন্য পেলোরেট এক পা এগোতেই তাড়া লাগাল ট্র্যাভিজ। জেনে কোনো লাভ হবে না, জেনভ। পা চালাও।
অদ্ভুত ভঙ্গিতে পড়ে থাকা আরেকটা রোবট অনেক দূর দিয়ে পার হল। ট্র্যাভিজ, বলল, সম্ভবত পুরো এস্টেটের সবখানেই হাজার হাজার রোবট পড়ে আছে। তারপর বিজয়ীর সুরে বলল, আহ্, ঐ যে মহাকাশযান।
চলার গতি দ্রুত হলো ওদের, তারপর থেমে গেল হঠাৎ করেই। উফুল্ল স্বরে চিৎকার করল ফেলম।
মহাকাশযানের কাছে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রাগৈতিহাসিক এয়ার ভেসেল। রোটর দেখে মনে হয় প্রচুর জ্বালানি নষ্ট করে, পেছন দিকটা ভঙ্গুর। সেটার পাশে মহাকাশযান এবং আউট ওয়ার্ল্ডারদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারটা মানুষের কাঠামো।
দেরি হয়ে গেছে, ট্র্যাভিজ বলল, অনেক সময় নষ্ট করেছি।
অবাক গলায় পেলোরেট বলল, চার জন সোলারিয়ান? এভাবে দলবেঁধে আসাটা স্বাভাবিক মনে হয় না। ওগুলো কি হলোইমেজ?
ওগুলো সম্পূর্ণ বাস্তব, বলল ব্লিস। আমি নিশ্চিত। এমনকি সোলারিয়ানও না। মাইও নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওগুলো রোবট।
.
বেশ, ক্লান্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, চলতে থাকো! নিজেও দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটতে লাগল মহাকাশ যানের দিকে।
পেলোরেট রুদ্ধশ্বাসে বলল, কী করতে চাও তুমি?
ওগুলো রোবট হলে আদেশ মানতে বাধ্য।
আরো কাছাকাছি হতেই ওগুলো যে রোবট তাতে কোনো সন্দেহ রইল না। মুখমণ্ডল দেখলে মনে হয় যেন রক্তমাংসে তৈরি, অথচ চেহারা পুরোপুরি ভাবলেশহীন। এমনভাবে ইউনিফর্ম পড়েছে যার ফলে মুখ ছাড়া শরীরের আর কোনো অংশের ত্বক দেখা যাচ্ছে না। স্বচ্ছ গ্লোভস দিয়ে হাতগুলো পর্যন্ত ঢাকা।
স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ট্র্যাভিজ, যে কেউই বুঝতে পারবে যে সে সামনে থেকে কাউকে সরতে বলছে।
রোবটগুলো নড়ল না।
নিচু স্বরে পেলোরেটকে বলল ট্র্যাভিজ, কথা বলো ওদের সাথে। শক্ত থাকবে।
গলা পরিষ্কার করে নিল পেলোরেট, কণ্ঠস্বরে ফুটিয়ে তুলল অতিরিক্ত গাম্ভীর্য, হাত নাড়ল ট্র্যাভিজের চেয়েও বেশি। একটা রোবট বাকিগুলো থেকে একটু লম্বা, ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণস্বরে কিছু বলল।
ট্র্যাভিজের দিকে ঘুরল পেলোরেট, ওটা বলছে যে আমরা আউটওয়াল্টারস।
বল আমরা মানুষ এবং আমাদের আদেশ মানতে ওরা বাধ্য।
এবার রোবট কথা বলল অদ্ভুত কিন্তু বোধমগ্য গ্যালাকটিক ভাষায়। আমি গ্যালাকটিক জানি, আউটওয়াল্টার। আমরা গার্ডিয়ান রোবট।
তা হলে নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমরা মানুষ এবং তুমি আমাদের আদেশ মানতে বাধ্য।
আমাদেরকে শুধুমাত্র রুলারদের আদেশ মানার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে। রুলার ব্যাণ্ডার কেন স্বাভাবিক সময়ে যোগাযোগ করেননি সেটা দেখতে এসে একটা মহাকাশযান পাই যা সোলারিয়ার তৈরি নয়। একাধিক আউটওয়ার্ল্ডার আছে এখানে এবং ব্যাণ্ডারের সব রোবট পড়ে আছে ইনঅ্যাকটিভেট হয়ে। রুলার ব্যাণ্ডার কোথায়?
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, ধীরে ধীরে প্রতিটা শব্দ জোর দিয়ে বলল, এত কিছু জানি না। মহাকাশযানের কম্পিউটার গোলমাল করছিল, তাই এই অদ্ভুত গ্রহে নামতে বাধ্য হই। নেমেই দেখি রোবটগুলো ইনঅ্যাকটিভেট হয়ে আছে। কী ঘটেছে কোনো ধারণাই নেই।
রোবটগুলো যেহেতু কাজ করছে না এবং পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ, তার অর্থ রুলার ব্যাণ্ডার নিশ্চয় মারা গেছেন। তোমরাও নামলে আর এতকিছু ঘটল, এটাকে ঠিক দৈবঘটনা বলে মানা যায় না। দুটোর মাঝে নিশ্চয় কোনো যোগসূত্র আছে।
কিন্তু পাওয়ার সাপ্লাই তো বন্ধ হয়নি। তোমরা কাজ করতে পারছ। বলল ট্র্যাভিজ। উদ্দেশ্য রোবটগুলোকে দ্বিধাগ্রস্ত করে ভোলা, তারা বিদেশী বলেই কিছু জানে না এবং নির্দোষ সেটা প্রমাণ করা।
রোবট বলল, আমরা গার্ডিয়ান রোবট। কোনো নির্দিষ্ট রুলার আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেনা, নিউক্লিয়ার পাওয়ারে চলি। আবার জিজ্ঞেস করছি, রুলার ব্যাণ্ডার কোথায়?
চারপাশে তাকাল ট্র্যাভিজ। পেলোরেট ভয় পেয়েছে; ব্লিসের ঠোঁট দুটো শক্তভাবে চেপে ধরা হলেও চেহারা শান্ত। ফেলম ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু কাঁধে ব্লিসের। ছোঁয়া পেতেই শান্ত হয়ে গেল সে। (ব্লিস ফেলমের ভয় দূর করে দিয়েছে?)
আবার জিজ্ঞেস করছি এবং শেষবারের মতো, রুলার ব্যাণ্ডার কোথায়?
হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ, আমি জানি না।
রোবটটা মাথা নাড়তেই তার সঙ্গী দুজন চলে গেল দ্রুত। আমার সঙ্গী গার্ডিয়ানরা বাড়িটা সার্চ করবে। তার মধ্যে তোমাদের কিছু প্রশ্ন করব। তোমার। কোমরের বস্তুগুলো দাও।
এক পা পিছিয়ে গেল ট্র্যাভিজ। ওগুলো দিয়ে কোনো ক্ষতি করা যাবে না।
নড়বে না। ওগুলো ক্ষতি করবে কি করবে না আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমি ওগুলো দিতে বলেছি।
না।
ঝট করে সামনে বাড়ল রোবট, এত দ্রুত হাত নাড়ল যে ট্র্যাভিজ বুঝতেই পারল না কী ঘটছে। শক্ত মুঠিতে কাঁধ চেপে ধরে নিচের দিকে চাপ দিল রোবট। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ট্র্যাভিজ।
ওগুলো দাও, অন্য হাত বারিয়ে রোবট বলল।
না, রুদ্ধশ্বাসে বলল ট্র্যাভিজ।
সামনে এগুলো ব্লিস। ট্র্যাভিজ কিছু বোঝার আগেই হোলস্টার থেকে অস্ত্র দুটো নিয়ে বাড়িয়ে দিল রোবটের দিকে। নাও গার্ডিয়ান। এবার ওকে ছেড়ে দাও।
অস্ত্র দুটো হাতে নিয়ে পিছিয়ে গেল রোবট। কাঁধ ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়াল ট্র্যাভিজ। মুখ কুঁচকে রেখেছে ব্যথায়।
ধারালো গলায় ব্লিস বলল, ওটার সাথে লাগতে গেলে কেন? দুই আঙুলে তোমাকে মেরে ফেলবে।
তুমি সামলাচ্ছো না কেন? দাঁতে দাঁত চেপে ট্র্যাভিজ বলল।
চেষ্টা করছি, সময় লাগবে। ওগুলোর মাইণ্ড বেশ দৃঢ়, নির্দিষ্ট ছকে প্রোগ্রাম করা। সামলানো সহজ নয়। প্রথমে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তুমি সময় পাওয়ার চেষ্টা করো।
পর্যবেক্ষণের দরকার নেই। সোজা ধ্বংস করে ফেলল।
দ্রুত রোবটের দিকে তাকিয়ে ব্লিস দেখল ওটা গভীর মনোযোগর সাথে অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করছে, অন্য রোবটটা তামিয়ে আছে তাদের দিকে। তাদের আলোচনায় মনযোগ নেই কোনোটারই।
না, কোনো রকম ধ্বংস নয়। বলল ব্লিস। প্রথম গ্রহে একটা কুকুর হত্যা করেছি। আরেকটাকে আহত করেছি। এই গ্রহে যা করেছি সেটা আরো খারাপ। গায়া অকারণে কোনো জীবন বা বুদ্ধিমত্তাকে হত্যা করতে চায় না। আমার সময় দরকার।
পিছিয়ে গিয়ে স্থির দৃষ্টিতে রোবটের দিকে তাকাল সে।
এগুলো অস্ত্র। রোবট বলল।
না। উত্তর দিল ট্র্যাভিজ।
ব্লিস বলল, হ্যাঁ। কিন্তু কাজ করবে না। এনার্জি ইউনিট শেষ।
তা হলে নিয়ে এসেছে কেন? হয়তো এনার্জি শেষ হয়নি। নিখুঁতভাবে অস্ত্রটা ধরল রোবট, ট্রিগারের উপর বুড়ো আঙুল। এভাবে চালাতে হয়।
হ্যাঁ, আরেকটু চাপ দিলেই কাজ করার কথা, কিন্তু করবে না।
অস্ত্রটা ট্র্যাভিজের দিকে তাক করল সে। এখনও বলবে এটা চালালে কোনো লাভ হবে না?
হবে না। বলল ব্লিস।
জায়গায় দাঁড়িয়ে জমে গেছে ট্র্যাভিজ। ব্যাণ্ডার এনার্জি শুষে নেওয়ার পর ব্লাস্টারটা সে পরীক্ষা করে দেখেছিল, কিন্তু রোবটের হাতে নিউরোনিক হুইপ। ওটা সে পরীক্ষা করে দেখেনি।
ন্যাভাল একাডেমীতে থাকার সময় ট্র্যাভিজ নিউরোনিক হুইপের মৃদু আঘাত সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিল। সব ক্যাডেটকেই সহ্য করতে হয়, প্রশিক্ষণের অংশ। হিসেবে। শুধু জিনিসটা কি জানার জন্য। দ্বিতীয়বার জানার কোনো আগ্রহ নেই তার।
অস্ত্র চালালো রোবট, ব্যথা সহ্য করার জন্য শরীর শক্ত করে ফেলল ট্র্যাভিজ-তারপর শিথিল হলো। হুইপের এনার্জিও শুকিয়ে গেছে।
অস্ত্রগুলো ছুঁড়ে ফেলল রোবট। এনার্জি শুকালো কীভাবে? আর কাজ করবে না জেনেও ওগুলো বহন করছ কেন?
আমি সবসময় ওগুলো সাথে রাখতে অভ্যস্ত।
এটা কোনো কথা হলো না। তোমাদের গ্রেপ্তার করা হলো। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর রুলাররা চাইলে তোমাদের ইনঅ্যাকটিভেট করা হবে।–মহাকাশযানের দরজা খোল, ভিতরে সার্চ করতে হবে।
দরকার নেই, কিছু বুঝবে না তোমরা।
আমরা না বুঝলে রুলাররা বুঝবে।
তারাও বুঝবে না।
তুমি বুঝিয়ে দেবে।
না।
তা হলে তোমাকে ইনঅ্যাকটিভেট করা হবে।
তাতে তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে না, এবং আমার ধারণা বুঝিয়ে বলার পরেও আমাকে ইনঅ্যাকটিভেট করা হবে।
চালিয়ে যাও। ফিসফিস করে বলল ব্লিস। আমি ওর মস্তিষ্কের কাজের ধারা বুঝতে শুরু করেছি।
ব্লিসকে পাত্তা দিল না রোবট, স্থির দৃষ্টিতে ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা তোমাকে আংশিক ইনঅ্যাকটিভেট করব। একটু ক্ষতি করব, তখন যা
জানতে চাই বলবে।
হঠাৎ ভয়ার্ত স্বরে কেঁদে উঠল পেলোরেট, দাঁড়াও, তোমরা সেটা করতে পারো ।–গার্ডিয়ান, তোমরা সেটা করতে পারো না।
অবশ্যই পারি। কথা আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে বল প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে।
কিন্তু তোমরা মোটেই সেটা করতে পারোনা। আমরা তিনজন আউটওয়ার্ল্ডার। কিন্তু এই শিশু একজন সোলারিয়ান। ও তোমাকে বলবে কী করতে হবে এবং তোমরা সেটা মানতে বাধ্য।
ফাঁকা দৃষ্টিতে পেলোরেটের দিকে তাকাল ফেলম। মাথা নেড়ে নিষেধ করল ব্লিস। কিন্তু পেলোরেট বুঝতে পারল না।
ফেলমের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল রোবট। এই শিশু গুরুত্বহীন। এটার ট্র্যান্সডিউসার লোবস নেই।
পূর্ণ গঠিত লোবস নেই। সময় হলে ঠিকই হবে। ও একজন সোলারিয়ান শিশু।
এটা শিশু, পূর্ণগঠিত ট্র্যান্সডিউসার লোবস নেই এবং সোলারিয়ান নয়। আমি এটার আদেশ মানতে এবং রক্ষা করতে বাধ্য নই।
কিন্তু সে রুলার ব্যাণ্ডার এর বংশধর।
তাই? তুমি কীভাবে জানলে?
তোতলাতে লাগল পেলোরেট। বেশি আন্তরিক হবার চেষ্টা করলে তার এমন হয়। আ-আর কার সন্তান এখানে থাকবে।
এখানে যে কয়েক ডজন শিশু নেই সেটা তুমি জানো?
তুমি আর কাউকে দেখেছ?
শুধু আমি প্রশ্ন করব।
ঠিক সেই মুহূর্তে যে দুই রোবটকে ম্যানসনের ভিতর পাঠানো হয়েছিল ফিরে আসতে দেখা গেল তাদের। কেমন যেন অনিয়মিত পদক্ষেপ। কাছাকাছি হতেই একজন সোলারিয়ান ভাষায় কথা বলল–তারপর মনে হলো যেন চারটা রোবটই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় চুপসে গেছে ফাটা বেলুনের মতো।
ওরা ব্যাণ্ডারকে পেয়েছে। ট্র্যাভিজ থামানোর আগেই বলে ফেলল পেলোরেট।
ধীরে ধীরে ওদের দিকে ঘুরল রোবটগুলো। রুলার ব্যাণ্ডার মৃত। তোমার শেষ কথা শুনে মনে হয়েছে তোমরা জানতে। কীভাবে?
আমরা কীভাবে জানব? বলল ট্র্যাভিজ।
তোমরা জানতে আমরা গিয়ে ওকে মৃত পাবো। তোমরা সেখানে না থাকলে, তার জীবন নিজের হাতে শেষ না করলে কীভাবে জানবে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে রোবট।
ব্যাণ্ডারকে আমরা কীভাবে হত্যা করব? ট্র্যান্সডিউসার লোবস দিয়ে সে আমাদেরকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে ফেলত।
ট্র্যান্সডিউসার সোবস কি করতে পারে সেটা তুমি কীভাবে জানলে?
তুমি বলেছ।
আমি তো শুধু নাম বলেছি, কী করতে পারে তা তো বলিনি।
তা হলে স্বপ্নে জেনেছি।
এটা কোনো যুক্তিযুক্ত উত্তর হলো না।
তা হলে ধরে নাও ব্যাণ্ডারকে আমরা হত্যা করেছি সেটাও কোনো যুক্তিযুক্ত কথা হলো না।
তা ছাড়া, পেলোরেট বলল, রুলার ব্যাণ্ডার মৃত হলে রুলার ফেলম এই এস্টেট নিয়ন্ত্রণ করবে। তোমরা তার আদেশ মানতে বাধ্য।
আমি আগেই বলেছি অপূর্ণাঙ্গ ট্র্যান্সডিউসার লোবস নিয়ে কোনো বংশধর সোলারিয়ান হতে পারে না। সে উত্তরাধিকারীও হতে পারবে না। এই দুঃখের সংবাদ জানানোর সাথে সাথে উপযুক্ত বয়সের একজন উত্তরাধিকারী এখানে চলে আসবে।
রুলার ফেলমের কি হবে?
রুলার ফেলম বলে কেউ নেই। ওতো মাত্র শিশু, এবং আমাদের এখানে শিশুর সংখ্যা অধিক, তাই তাকে ধ্বংস করে ফেলা হবে।
জোর গলায় বলল ব্লিস, খবরদার। ও একটা শিশু!
আমি নই, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রুলারদের সম্মেলনে, এবং শিশুর সংখ্যা অধিক হলে সিদ্ধান্ত কী হবে আমি জানি।
না, আমি বলছি না।
কোনো ব্যথা পাবে না।–আরেকটা জাহাজ আসছে। ম্যানসনের ভিতরে গিয়ে হলোভিশন কাউন্সিলের ব্যবস্থা করতে হবে। ওরাই একজন উত্তরাধিকার নির্বাচন করবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে তোমাদের কী হবে।-বাচ্চাটাকে দাও।
ঝাপ্টা দিয়ে ফেলমকে নিজের কোলে নিল ব্লিস। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ওর গায়ে হাত দেবে না।
সামনে এগিয়ে ফেলমকে ধরার জন্য বিদ্যুৎ গতিতে হাত বাড়াল রোবট, তারচেয়েও দ্রুত গতিতে এক পাশে সরে গেল ব্লিস। দাঁড়িয়ে থাকল স্থির হয়ে। রোবট এখনও এগোচ্ছে। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বাকি তিনটা রোবটের দৃষ্টি দেখে মনে হয় কিছুই দেখছে না।
রাগে ফোঁস ফোঁস করছে ব্লিস। আরেকটু সময় দরকার ছিল, কিন্তু ওরা আমাকে সময় দিল না। তাই সরাসরি আঘাত করতে হলো। চারটা রোবটই এখন নিষ্ক্রিয়। অন্য জাহাজটা আসার আগেই তাড়াতাড়ি ফিরে চল মহাকাশযানে। আর কোনো রোবটের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আমার নেই।