ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ (১৯৮৬) – সায়েন্স ফিকশন
মূল : আইজাক আসিমভ অনুবাদ : নাজমুছ ছাকিব
প্রথম পর্ব
গায়া
১. যাত্রা হল শুরু
এমন কেন করলাম? জিজ্ঞেস করল গোলান ট্র্যাভিজ।
নতুন কোনো প্রশ্ন নয়। গায়াতে আসার পর থেকেই সে নিজেকে বারবার এই প্রশ্ন করছে। শীতল রাতের আরামদায়ক ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রতিদিন সে দেখতে পায় তার মনের ভেতর আলোড়ন তুলছে প্রশ্নটা, যেন মৃদু লয়ে ঢোল বাজাচ্ছে কেউ তার ভেতরে বসে।
এই প্রথম গায়ার সবচেয়ে প্রাচীন–ডমকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করল সে। ডম জানে ট্র্যাভিজ অস্থির হয়ে পড়েছে, কারণ কাউন্সিলম্যানের মাইণ্ড এর প্রতিটি সূক্ষ্ম তারতম্য সে ধরতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। গায়া কোনো অবস্থাতেই ট্র্যাভিজের অনুভূতি পাল্টানোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। আর নিরপেক্ষ থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সে যা অনুভব করছে সেটা এড়িয়ে যাওয়া।
কী করেছ, ট্র্যাভ? জিজ্ঞেস করল সে। একাধিক শব্দাংশে কোনো ব্যক্তিকে সম্বোধন করা তার জন্য একটু কঠিন, যদিও ট্র্যাভিজ এসব ছোটখাটো ব্যাপারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ট্র্যাভিজ বলল। ভবিষ্যৎ হিসেবে বেছে নিয়েছি গায়া।
তুমি সঠিক কাজ করেছ, বলল ডম। বসে আছে, তার বয়সী গভীর চোখদুটো আন্তরিকভাবে নিবদ্ধ সামনে দাঁড়ানো ফাউণ্ডেশনারের উপর।
আপনি বলছেন আমার কোনো ভুল হয়নি, ট্র্যাভিজ অসহিষ্ণু স্বরে বলল। আমি / আমরা / গায়া জানি তুমি নির্ভুল। এখানেই তোমার গুরুত্ব। অপর্যাপ্ত তথ্য থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তোমার আছে, এবং তুমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ভবিষ্যৎ হিসেবে গায়াকে বেছে নিয়েছ। বাতিল করে দিয়েছ প্রথম ফাউণ্ডেশন-এর কারিগরি সাম্রাজ্য বা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন-এর মেন্টালিক সাম্রাজ্যের সম্ভাবনা। কারণ তোমার মতে এ দুটোর কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারবে না। তাই গায়া নির্বাচন করেছ।
ঠিক। গায়াকে নির্বাচন করেছি, একটা সুপার অর্গানিজম; একক মাইণ্ড এবং একক ব্যক্তিত্ব নিয়ে পুরো একটা গ্রহ, যেন কেউ বলতে পারে আমি/আমরা/গায়া। বিরামহীনভাবে মেঝেতে পায়চারী করতে লাগল ট্র্যাভিজ। তারপর এটাই একসময় মিল্কিওয়ের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাসহ পরিণত হবে গ্যালাক্সিয়ায়।
এবার থেমে প্রায় মারমুখো ভঙ্গিতে ঘুরল ডমের দিকে, আপনার মতো আমারও মনে হচ্ছে কোনো ভুল হয়নি। কিন্তু আপনি গ্যালাক্সিয়া তৈরি করতে চান, কাজেই সন্তুষ্ট। আমার ভেতরের একটা অনুভূতি এটা চাইছে না। তাই আমি এর যথার্থতা নিয়ে এত সহজে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আমাকে জানতে হবে কেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কীভাবে জানব আমি নির্ভুল? কোন জিনিসটা আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে?
আমি/আমরা/গায়া জানি না তুমি কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। সেটা জানা কি খুব বেশি প্রয়োজন?
আপনি বলেছেন একটা সমগ্র বিশ্বের কথা, তাই না? প্রতিটি শিশিরকণা, প্রতিটি পাথর কণা, এমনকি গ্রহের তরল সেন্ট্রাল কোর মিলিয়ে একটা কমন কনশাসনেস?
বলেছি, যেন গ্রহের প্রতিটি অংশে কমন কনশাসনেস-এর পরিমাণ হয় যথেষ্ট। আর এই কমন কনশাসনেস আমাকে ব্ল্যাকবক্স হিসেবে ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট? যেহেতু ব্ল্যাক বক্স ঠিকভাবে কাজ করছে, ভিতরে কি আছে জানার প্রয়োজন নেই? মানতে পারছি না। চাই না কেউ আমাকে না বুঝেই ব্যবহার করুক। আমি জানতে চাই ভিতরে কী আছে। জানতে চাই কেন এবং কীভাবে ভবিষ্যৎ হিসেবে গায়াকে নির্বাচন করেছি, তারপরেই আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব।
নিজের সিদ্ধান্ত তুমি এত অবিশ্বাস বা অপছন্দ করছ কেন?
লম্বা শ্বাস টেনে ফিসফিস করে বলল ট্র্যাভিজ, কণ্ঠস্বর নিচু হলেও বলিষ্ঠ, আমি কোনো সুপারঅর্গানিজম এর অংশ হতে চাই না। চাই না সবার মঙ্গলের জন্য কখন কোন কাজটা করতে হবে সেটা এই সুপারঅর্গানিজম আমাকে বলে দেবে।
ডম চিন্তিতভাবে ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে আছে। তুমি সিদ্ধান্ত পাল্টাতে চাও ট্র্যাভ? চাইলেই পাল্টাতে পারবে।
না, শুধু পছন্দ হচ্ছে না বলেই আমি সিদ্ধান্ত পাল্টাব না। কিছু করার আগে জানতে হবে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক না ভুল। ঠিক মনে হওয়াটাই যথেষ্ট না।
যদি তোমার সঠিক মনে হয়, তা হলে অবশ্যই সঠিক। ডমের মৃদু কণ্ঠস্বর সবসময়ই ট্র্যাভিজের অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে।
তারপর অনুভূতি এবং জানা এ দুয়ের মাঝে যে দোদুল্যমান অবস্থা সেটি দূর করে প্রায় ফিসফিস করে বলল ট্র্যাভিজ, আমাকে পৃথিবী খুঁজে বের করতেই হবে।
কারণ তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা সেটা জানবার প্রবল আগ্রহের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে, তাই না?
কারণ এই আরেকটা সমস্যা আমাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে এবং কারণ আমি মনে করি দুটোর ভেতরে একটা যোগাযোগ আছে। আমার মনে হওয়াটাই আপনার জন্য যথেষ্ট না?
হয়তো। ডম শান্ত গলায় বলল।
হাজার বছর-সম্ভবত প্রায় বিশ হাজার বছর আগে গ্যালাক্সির মানুষ পৃথিবীতে বাস করত। কীভাবে আমরা আমাদের প্ল্যানেট অব অরিজিন-এর কথা ভুলে গেলাম?
তুমি যা ভাবছ বিশ হাজার বছর তার চেয়েও দীর্ঘ সময়। এম্পায়ার এর প্রথম যুগের অনেক বিষয় গ্যালাক্সির বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত। আমরা সেগুলো বিশ্বাসও করি, কারণ কোনো বিকল্প নেই। আর পৃথিবী এম্পায়ার এর তুলনায় অনেক বেশি প্রাচীন।
কিন্তু কোনো না কোনো রেকর্ড অবশ্যই আছে। প্রিয় বন্ধু পেলোরেট প্রাথমিক পৃথিবী যুগের পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি সংগ্রহ করেছে। এখান থেকে ওখান থেকে টুকরো টুকরো যত কাহিনী পেয়েছে সব সংগ্রহ করেছে। এটা তার পেশা, সবচেয়ে বড় কথা তার শখ। কিন্তু সবই পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তি। কোনো প্রকৃত রেকর্ড বা ডকুমেন্ট নেই।
বিশ হাজার বছরের পুরোনো ডকুমেন্টস? সব বস্তুই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, নষ্ট হয়, অদক্ষতা বা যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।
কিন্তু অবশ্যই রেকর্ডগুলোরও রেকর্ড থাকবে; অনুলিপি, অনুলিপির অনুলিপি, এবং অনুলিপির অনুলিপির অনুলিপি থাকবে। প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ বিশ সহস্রাব্দের চেয়েও পুরোনো হবে। সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ট্রানটরের গ্যালাকটিক লাইব্রেরিতে অবশ্যই পৃথিবী সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রমাণ ছিল, নিশ্চয়ই সেগুলো ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু এখন কিছুই নেই। শুধু রেফারেন্স থেকে জানা যায় যে লাইব্রেরিতে কিছু রেকর্ড ছিল, ভিতরের বিষয়বস্তু আর কোনোদিন জানা যাবে না।
মনে আছে নিশ্চয়ই মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেই ট্র্যানটরে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
লাইব্রেরি অক্ষত ছিল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন-এর কর্মীরাই সেটা রক্ষা করে। আর এই কর্মীরাই অতি সম্প্রতি আবিষ্কার করে যে পৃথিবী সম্পর্কিত ডকুমেন্টসগুলো নেই। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেন? পায়চারী থামিয়ে চোখ গরম করে ডমের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। যদি পৃথিবী খুঁজে পাই, আমি জানতে পারব সে কি গোপন করছে?
গোপন করছে?
গোপন করছে বা গোপন করে রেখেছে। একবার সেটা বের করতে পারলেই আমার অনুভূতি বলছে আমি জানতে পারব কেন ইণ্ডিভিজুয়ালিটি বাদ দিয়ে গায়া এবং গ্যালাক্সিয়াকে বেছে নিয়েছি। তারপর আমার ধারণা, অনুভূতি নয়, আমি জানতে পারব যে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক। যদি সঠিক হয়ই, অর্থহীনভাবে কাঁধ ঝাঁকালো সে, তা হলে সেভাবেই চলবে।
তোমার তাই মনে হয়, বলল ডম, এবং যদি তুমি পৃথিবী খুঁজে বের করতেই চাও তা হলে আমরা তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু সেই সাহায্য হবে সীমিত। কারণ আমরা জানি না যে রাশি রাশি অসংখ্য নক্ষত্র মিলে গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে, তার কোথায় লুকিয়ে আছে পৃথিবী।
তারপরেও আমাকে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজন হলে গ্যালাক্সির সবগুলো নক্ষত্র খুঁজে দেখব। কাজটা একা করতে হলেও কোনো পরোয়া নেই।
.
ট্র্যাভিজের চারপাশে গায়ার শান্ত পরিবেশ। তাপমাত্রা বরাবরের মতোই আরামদায়ক। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, সতেজ কিন্তু গায়ে কাঁপন ধরানোর মতো ঠাণ্ডা না। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে খণ্ড খণ্ড মেঘ, যখন তখন ঢেকে দিচ্ছে সূর্যের আলো, এবং কোনো সন্দেহ নেই, উন্মুক্ত ভূ-পৃষ্ঠের প্রতি মিটার জায়গার কোথাও যদি জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়, সেটা পূরণ করার জন্য যথাসময়ে যথা পরিমাণ বৃষ্টি, হবে।
গাছপালাগুলো জন্মেছে নিয়মিত ব্যবধানে, অনেকটা সাজানো বাগানের মতো, এবং কোনো সন্দেহ নেই পুরো গ্রহে একই অবস্থা। সাগর এবং মাটিতে রয়েছে ঠিক প্রয়োজনীয় সংখ্যক উদ্ভিদ এবং প্রাণী, এবং যথাযথ প্রজাতির যেন সঠিক পরিবেশগত ভারসাম্য তৈরি হয়। কোনো সন্দেহ নেই উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস বৃদ্ধি হয় ধীর গতিতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী-একইভাবে মানুষের জন্ম মৃত্যুও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সামনের দৃশ্যগুলোর মাঝে একমাত্র বেমানান বস্তু হচ্ছে তার মহাকাশযান, ফার। স্টার।
গায়ার একদল মানবীয় উপাদান দক্ষভাবে এবং যত্নের সাথে মহাকাশযান পরিষ্কার করে গুছিয়ে দিয়েছে। প্রচুর পরিমাণে খাদ্য এবং পানীয় তোলা হয়েছে স্টোররুমে। আসবাবপত্রগুলো মেরামত করা হয়েছে, প্রয়োজনে বদলানো হয়েছে। যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নিজে কম্পিউটার পরীক্ষা করে দেখেছে ট্র্যাভিজ।
এই মহাকাশযানের কোনো রিফুয়েলিং এর প্রয়োজন হয় না, কারণ এটা ফাউণ্ডেশন-এর অল্প কয়েকটা গ্র্যাভিটিক মহাকাশযানের একটা, গ্যালাক্সির সাধারণ গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড থেকে শক্তি সংগ্রহ করে, এবং এই গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড মানুষের সম্ভাব্য সকল মহাকাশযান বহরকে অনন্তকাল শক্তি সরবরাহ করতে পারবে, অথচ ঘনত্বের কোনো পরিবর্তন হবে না।
তিনমাস আগে ট্র্যাভিজ ছিল টার্মিনাসের একজন কাউন্সিলম্যান। বা অন্য কথায় বলা যায় ফাউণ্ডেশন-এর নীতি নির্ধারণ কমিটির একজন সদস্য, গ্যালাক্সির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন। আসলেই কি তিন মাস? মনে হচ্ছে যেন তার বত্রিশ বছর জীবনের অর্ধেক সময় আগে সে ঐ পদে ছিল এবং তখন তার একমাত্র চিন্তার বিষয় ছিল সেলডন প্ল্যানের যৌক্তিকতা নিয়ে; প্ল্যানেটারি ভিলেজ থেকে গ্যালাকটিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ফাউণ্ডেশন-এর উত্থানের জন্য যে পূর্বপরিকল্পনা ছিল তার সত্যমিথ্যা যাচাই নিয়ে।
অবশ্য কোনো পরিবর্তন হয় নি। সে এখনও একজন কাউন্সিলম্যান। তার মূর্যাদা এবং প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধাগুলো অপরিবর্তিত রয়েছে, শুধু টার্মিনাসে ফিরে গিয়ে সেগুলো দাবি করার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফাউণ্ডেশন-এর কোলাহলমুখর পরিবেশে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না, গায়ার শান্ত পরিবেশও তার ভালো লাগে না। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই, সে এখন সত্যিকারের ভবঘুরে।
তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, রাগের সাথে আঙুল চালালো মাথাভর্তি কালো চুলে। ভাগ্য নিয়ে হাহুতাস করার আগে তাকে খুঁজে বের করতে হবে পৃথিবী। এই অনুসন্ধান থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে দুঃখ প্রকাশ করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। তখন হয়তো দুঃখ প্রকাশ করার জন্য আরো ভালো কোনো কারণ থাকবে।
নিজের মনোবল দৃঢ় করে নিল, তারপর আবার ডুবে গেল অতীত চিন্তায়। তিন মাস আগে সে আর আরভোলা পণ্ডিত জেনভ পেলোরেট টার্মিনাস ছেড়ে এসেছে। পেলোরেটের উদ্দেশ্য বহুদিন পূর্বে হারিয়ে যাওয়া গ্রহ পৃথিবী খুঁজে বের করা। নিজের উদ্দেশ্য গোপন রাখার জন্য ট্র্যাভিজ পেলোরেটের উদ্দেশ্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা পৃথিবী খুঁজে পায় নি, পেয়েছে গায়া। গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সে।
পেলোরেটও অপ্রত্যাশিতভাবে খুঁজে পেয়েছে কালো চুল, গভীর চোখের তরুণী ব্লিসকে, ডম, গ্রহের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ধূলিকণা বা ঘাসের মতো এই তরুণী ও গায়া। মধ্যবয়সী পেলোরেট তার অর্ধেক বয়সেরও কম বয়সী এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে, আর অস্বাভাবিকই বলতে হবে যে মেয়েটাও মনে হয় তার প্রেমে পড়েছে।
অদ্ভুত হলেও পেলোরেট সুখী, আর ট্র্যাভিজের ধারণা প্রত্যেক মানুষেরই সুখী হওয়ার নিজস্ব পদ্ধতি থাকা উচিত। এটাই হচ্ছে ইণ্ডিভিজুয়ালিটির বৈশিষ্ট্য, যে ইণ্ডিভিজুয়ালিটি সে নিজের ইচ্ছায় গ্যালাক্সি থেকে (নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে) নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।
অস্থিরতা আবার বেড়ে গেল। যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে প্রতি মুহূর্ত সেটা তাকে খোঁচাচ্ছে। এবং–
গোলান!
তার চিন্তায় বাধা দিল কণ্ঠস্বরটা। চোখ তুলতেই সূর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
আহ্, জেনভ, আন্তরিক গলায় বলল সে-খুব বেশি আন্তরিক সুরে বলল যেন পেলোরেট তার ভেতরের তিক্ততা ধরতে না পারে। মনের উপর জোর খাঁটিয়ে একটু হাসল, ব্লিস এর কাছ থেকে ছুটে আসতে পারলে তা হলে।
মাথা নাড়ল পেলোরেট, মৃদুবাতাসে তার রেশমের মতো সাদা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লম্বা বিষণ্ণ মুখে আগের মতোই গাম্ভীর্যের ছাপ। আসলে পুরোনো বন্ধু, সেই আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে বলেছে। অবশ্য দেখা করার ইচ্ছা আমার নিজেরও ছিল, কিন্তু সে মনে হয় আমার থেকেও দ্রুত চিন্তা করতে পারে।
হাসল ট্র্যাভিজ। ঠিক আছে, জেনভ। তুমি বিদায় জানাতে এসেছ, তাই তো?
বেশ, ঠিক তা না। আসলে বলা যায় উল্টোটাই সত্যি। গোলান, টার্মিনাস ত্যাগ করার সময় তোমার আর আমার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী খুঁজে বের করা। আমার জীবনের পুরোটাই আমি ব্যয় করেছি এই কাজে।
আমি সেটা শেষ করব, জেনভ, কাজটা এখন আমার।
হ্যাঁ, কিন্তু কাজটা আমারও ছিল, থাকবেও।
কিন্তু–হাত নেড়ে তার চারপাশে গ্ৰহটাকে দেখালো ট্র্যাভিজ।
পেলোরেট ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার সাথে যেতে চাই।
তুমি নিশ্চয়ই সত্যি কথা বলছ না? ট্র্যাভিজ অবাক। বলেছিলে তুমি বাকি জীবন গায়াতে থাকবে।
যে-কোনো সময় এখানে ফিরে আসতে পারব। কিন্তু তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারব না।
অবশ্যই পারো। আমি নিজের দেখভাল করতে পারি।
কোনো সন্দেহ নেই, গোলান, কিন্তু তোমার জানার পরিমাণ সীমিত। আমি পুরাকাহিনী আর কিংবদন্তিগুলো জানি। তোমাকে পথ দেখাতে পারব।
ব্লিসকে ছেড়ে যাবে তুমি?
গাল হালকা লাল হয়ে গেল পেলোরেটের। আসলে ছেড়ে যেতে চাই না, ওল্ড চ্যাপ, কিন্তু সে বলেছে
কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল ট্র্যাভিজের। রিস কি এখন তোমাকে ছেড়ে দিতে চাইছে? আমাকে সে কথা দিয়েছিল।
না, তুমি বোঝনি। কথা শোন, গোলান। কারো কথা না শুনেই তড়িঘড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা তোমার অভ্যাস। জানি এটাই তোমার বিশেষত্ব। আর আমিও কোনো কিছু সংক্ষেপে গুছিয়ে বলতে পারি না।
বেশ, ট্র্যাভিজ নরম সুরে বলল, ব্লিস কী চায় সেটা তোমার যেভাবে খুশি বল, আমি ধৈর্য ধরে শুনব, কথা দিলাম।
ধন্যবাদ, তুমি ধৈর্য ধরলে আমিও সুস্থির হয়ে বলতে পারি। আসলে ব্লিস নিজেও আমাদের সাথে অভিযানে যেতে চাইছে।
ব্লিস যেতে চাইছে? আমি আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। না উত্তেজিত হব না। বল, জেনভ, কেন সে আমাদের সাথে যেতে চায়? আমি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করছি।
বলেনি। শুধু বলেছে তোমার সাথে সে কথা বলবে।
তা হলে এখানে আসেনি কেন?
আমার ধারণা-আমি কিন্তু ধারণার কথা বলছি-যে সে মনে করে তুমি তাকে পছন্দ করো না। আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে তার উপর তোমার কোনো রাগ নেই। ব্লিসের উপর কেউ মনঃক্ষুণ্ণ হবে সেটা আমি ভাবতে পারি না। তবুও সে চেয়েছে আমিই তোমাকে কথাটা বলি। আমি কি গিয়ে এখন বলতে পারি তুমি তার সাথে কথা বলবে?
অবশ্যই এবং এখনই।
এবং তুমি শান্ত থাকবে। আসলে সে খুব অস্থিরতায় ভুগছে। আমাকে বলেছে তাকে অবশ্যই যেতে হবে কারণ ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কেন যেতে হবে সেটা বলেনি, তাই না?
না। কিন্তু সে যখন যেতে চায় তখন অবশ্যই যাবে, এবং অবশ্যই গায়াও যাবে।
যার অর্থ আমার মেনে না নিয়ে উপায় নেই, ঠিক জেনভ?
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়, গোলান।
.
বেশ কয়েকদিন গায়াতে থাকলেও এই প্রথম ব্লিস এর বাড়িতে এল ট্র্যাভিজ। পেলোরেটও বর্তমানে এই বাড়িতেই থাকছে।
গায়ার বাসস্থানগুলো একেবারেই সাধারণ। এখানে ঝড়ো আবহাওয়া নেই, আরামদায়ক উষ্ণ তাপমাত্রা, কাজেই নিরাপত্তার জন্য নিরাপদ ডিজাইনের ঘরবাড়ি প্রস্তুতের প্রয়োজন নেই, অথবা ঘরের ভেতর আরামদায়ক পরিবেশ তৈরির কোনো প্রয়োজন নেই।
ব্লিস এর বাসস্থান গ্রহের সাধারণ বাসস্থানগুলোর চেয়েও ছোট, জানালাগুলো কাঁচের বদলে পর্দা দিয়ে ঢাকা। অল্প কয়েকটি অতি দরকারি আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছু নেই। দেয়ালে অনেকগুলো হলোগ্রাফিক ইমেজ; তার একটা পেলোরেট এর, আরভোলা প্রফেসরের চোখে শিশুর মতো অবাক দৃষ্টি। ট্র্যাভিজ ছবিটা দেখে মজা পেলেও হাসল না, বরং মনোযোগ দিয়ে কোমরের স্যাশ ঠিক করতে লাগল।
ব্লিস তাকে লক্ষ করছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসছে না। বরং অনেক সিরিয়াস মনে হচ্ছে, চমৎকার কালো চোখ দুটো প্রশস্ত, ঢেউ খেলানো কালো চুলগুলো প হয়ে আছে কাঁধের উপর। ঠোঁটে সামান্য লাল রং এর আভাস দেখা যাচ্ছে।
দেখা করতে আসার জন্য ধন্যবাদ ট্রাভ।
জেনভের অনুরোধ বেশ জোরালো ছিল, ব্লিসেনোবিয়ারেলা।
হেসে ফেলল ব্লিস। চমৎকার প্রতিদান। যদি তুমি আমাকে ব্লিস ডাকো, মাত্র এক শব্দাংশ, আমিও তোমার পুরো নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করব, ট্র্যাভিজ। দ্বিতীয় শব্দাংশ উচ্চারণ করার সময় প্রায় হোঁচট খেলো সে।
চমৎকার ব্যবস্থা। আমার মনে আছে চিন্তার আদানপ্রদানের জন্য গায়ানরা নামের শব্দাংশ ব্যবহার করে, কাজেই যখন তখন ট্রাভ ডাকলে আমার আপত্তি নেই। তারপরেও ট্র্যাভিজ ডাকলে আমার ভালো লাগবে। আমিও তোমাকে ব্লিস ডাকব।
ইণ্ডিভিজুয়াল হিসেবে ব্লিস এর বয়স, ট্র্যাভিজের মতে বিশ এর বেশি হবে না। গায়ার অংশ হিসেবে সে হাজার বছর প্রাচীন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে পার্থক্য ধরা পড়ে না, তবে তার পারিপার্শ্বিকতা এবং কথাবার্তা কখনো কখনো অদ্ভুত মনে হয়।
সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক। ব্লিস বলল। তুমি পৃথিবী খুঁজে বের করার । ব্যাপারে নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছ।
আমি ডম এর সাথে কথা বলেছি, বলল ট্র্যাভিজ, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি গায়াকে জানতে না দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
হ্যাঁ, কিন্তু ডমের সাথে কথা বলা মানে গায়ার সমস্ত অংশের সাথে কথা বলা। সেই হিসেবে তুমি আমার সাথেও কথা বলেছ।
আমি কি বলেছি সেটা শুনেছ তুমি?
না শুনিনি। তবে একটু মনোনিবেশ করলেই তুমি কি বলেছ সেটা স্মরণ করতে পারব। দয়া করে কথাটা বিশ্বাস করো, আলোচনায় সুবিধা হবে। তুমি পৃথিবী খুঁজে বের করতে চাও এবং এর গুরুত্বের কথা বলেছ। কী গুরুত্ব আমি ধরতে পারিনি, তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তোমার রয়েছে, আর তাই তোমার কথা গায়া মেনে নিতে বাধ্য। যদি এই অভিযান তোমার নেওয়া সিদ্ধান্তের সাথে সম্পর্কিত হয়, তা হলে গায়ার সাথেও সম্পর্কিত। সেজন্যই গায়া সাথে যাবে, শুধু তোমাকে রক্ষা করার জন্য।
তুমি বলছ গায়া যাবে, অর্থাৎ তুমি যাবে, ঠিক।
আমিই গায়া। সহজ সুরে বলল ব্লিস।
হ্যাঁ, গ্রহের সবকিছুই তাই। তা হলে অন্য কোনো অংশ না গিয়ে তুমি যাবে কেন?
কারণ, পেল তোমার সাথে যাবে। আর সে আমাকে ছাড়া অন্য কোনো অংশ নিয়ে খুশি হবে না।
পেলোরেট এক কোণে নিশ্চুপ বসেছিল। এবার কথা বলল। কথাটা সত্যি, গোলান। গায়াতে সে-ই আমার অংশ।
হঠাৎ হেসে ফেলল ব্লিস। এভাবে ভাবতে ভালোই লাগে। বেশ, দেখা যাক। ট্র্যাভিজ মাথার পিছনে হাত দিয়ে, পায়ের উপর ভর দিয়ে চেয়ার হেলাতে লাগল পিছনে। যখন মনে পড়ল এই কাজের জন্য চেয়ার যথেষ্ট শক্ত নয়, চার পায়ে নামিয়ে আনল সাথে সাথে। গায়া ছেড়ে গেলেও কি তুমি তার অংশ থাকবে?
থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারব। যদি কোনো বিপদ হয় গায়াকে সেই বিপদে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। তবে এমন ঘটবে শুধু বিপদের সময়ে, সাধারণভাবে আমি গায়ার অংশ হিসেবেই থাকব।
এমনকি হাইপারস্পেসে জাম্প করলেও।
এমনকি তখনও। যদিও একটু সমস্যা হবে।
যাই হোক, আমার পছন্দ হচ্ছে না।
কেন?
একটা দুর্গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকালো ট্র্যাভিজ। এর অর্থ মহাকাশ যানে আমি যা বলব বা করব সেটা তুমি শুনবে দেখবে এবং গায়াও শুনবে দেখবে।
আমি গায়া, তাই আমি যা দেখব, শুনব, অনুভব করব গায়াও সেটা দেখবে, শুনবে, অনুভব করবে।
ঠিক, এমনকি ঐ দেয়ালটাও দেখবে, শুনবে, অনুভব করবে।
দেয়ালটার দিকে একবার তাকিয়ে কাধ কঁকালো ব্লিস, হ্যাঁ, ঐ দেয়ালটাও। কিন্তু এর কনশাসনেস এতই কম যে আসলে কিছুই শুনবে না বা বুঝবে না। আবার আমার ধারণা এই মুহূর্তে আমরা যা বলছি তার ফলে এমন কিছু অতিক্ষুদ্র পরিবর্তন ঘটছে, ফলে আমাদের বলা কথাগুলো গায়াতে স্থায়ী কোনো ছাপ ফেলছে না।
কিন্তু আমি যদি একটু প্রাইভেসি চাই। হয়তো আমার ইচ্ছা না ঐ দেয়ালটা জানুক আমি কি করছি।
অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল ব্লিস। মাঝখানে নাক গলাল পেলোরেট। গোলান, আমার হয়তো কিছু বলা উচিত না, কারণ আমি নিজেও গায়ার ব্যাপারে খুব বেশি জানতে পারিনি। তবে ব্লিস এর সাথে থেকে কিছু ধারণা হয়তো হয়েছে।
-টার্মিনাসের জনাকীর্ণ রাস্তায় হাঁটলে তুমি অনেক ঘটনাই দেখবে শুনবে। পরে হয়তো কোনো কোনো ঘটনা তুমি মনে করতে পারবে। সঠিক মস্তিষ্ক উদ্দীপকের দ্বারা হয়তো সব ঘটনাই মনে করতে পারবে। দেখা যাবে বেশিরভাগ ঘটনারই কোনো গুরুত্ব নেই তোমার কাছে। কোনো আবেগপূর্ণ দৃশ্যও হয়তো তোমার মনে দাগ কাটবে না-তুমি ভুলে যাবে। গায়ার ব্যাপারটাও ঠিক এরকমই কিছু একটা। সমস্ত গায়া যদি জানেই তুমি কি করছ, তার মানে এই না যে সে গুরুত্ব দেবে। তাই না, ব্লিস?
এভাবে কখনো চিন্তা করিনি, পেল, কিন্তু তোমার কথায় যুক্তি আছে। তারপরেও ট্র্যাভ-মানে ট্র্যাভিজ যে গোপনীয়তার কথা বলছে-আমাদের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। আমি/আমরা/গায়ার কাছে ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। কোনো কিছুর অংশ হবে না, তোমার কণ্ঠ কেউ শুনবে না, তোমার কাজ কেউ দেখবে না, কেউ তোমার চিন্তা-ভাবনা বুঝবে না- জোরে জোরে মাথা নাড়ল ব্লিস। আমি বলেছি জরুরি মুহূর্তে নিজেদের আমরা বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারি, কিন্তু এভাবে কে বেঁচে থাকতে চায়, এমনকি এক ঘণ্টার জন্য হলেও।
আমি চাই, ট্র্যাভিজ বলল। সেজন্যই আমাকে পৃথিবী খুঁজে বের করতে হবে। বের করতে হবে কেন মানব জাতির জন্য ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ বেছে নিলাম।
এটা কোনোভাবেই ভয়ংকর ভবিষ্যৎ হতে পারে না, যাই হোক, তর্ক করে লাভ নেই। আমি তোমার সাথে যাবো, স্পাই হিসেবে না, বন্ধু এবং সাহায্যকারী হিসেবে।
পৃথিবীর পথ দেখিয়ে দিলে সেটাই হবে গায়ার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় সাহায্য। নরম সুরে বলল ট্র্যাভিজ।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ব্লিস। পৃথিবীর অবস্থান গায়া জানে না। ডম তোমাকে জানিয়েছে।
আমি বিশ্বাস করিনি। অন্তত কিছু রেকর্ড তো থাকবেই। গায়া হয়তো জানে না পৃথিবী কোথায়, কিন্তু রেকর্ডগুলো দেখলে আমি এমন কিছু সূত্র পেতে পারি, যা গায়া ধরতে পারেনি। কারণ, আমি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি চিনি গ্যালাক্সি।
কোন রেকর্ডের কথা বলছ, ট্র্যাভিজ?
যে-কোনো রেকর্ড। বই, ছবি, হলোগ্রাফ, পুরাকীর্তি, যাই তোমাদের কাছে আছে। এতদিন এখানে আছি, কিন্তু আমার চোখে এমন কিছু পড়েনি যা কোনো ধরনের রেকর্ড বলে মনে হয়। তুমি দেখেছ, জেনভ?
না, পেলোরেট দ্বিধাগ্রস্ত সুরে বলল, আমি অবশ্য ভালোভাবে লক্ষ করিনি।
আমি করেছি। কিন্তু কিছুই চোখে পড়েনি। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে আমার কাছ থেকে সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কেন, বলতে পারো?
ব্লিস-এর মসৃণ কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। আগে বলোনি কেন? আমি/আমরা/গায়া কিছু লুকাইনি, মিথ্যে কথা বলিনি। একজন আইসোলেট মিথ্যে কথা বলতে পারে। সে সীমাবদ্ধ, এবং সেই কারণেই ভীতু। গায়া বিপুল মানসিক শক্তির অধিকারী একটা প্ল্যানেটরি অর্গানিজম, তার কোনো ভয় নেই। তাই মিথ্যে কথা বলা বা বাস্তবকে বিকৃত করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
শব্দ করে শ্বাস নিল ট্র্যাভিজ। তা হলে কেন আমাকে রেকর্ডগুলো দেখতে দেওয়া হচ্ছে না? জোরালো কারণ দেখাও।
অবশ্যই। ব্লিস দুহাত সামনে বাড়িয়ে বলল, আমাদের কোনো রেকর্ড নেই।
.
পেলোরেট সর্বপ্রথম সংবিত ফিরে পেল, মনে হয় সে-ই সবচেয়ে কম অবাক হয়েছে।
অসম্ভব, বলল সে, রেকর্ড ছাড়া তোমরা একটা সভ্যতা গড়ে তুলতে পারতে না।
মানলাম। কিন্তু আমি শুধু বলছি ট্র্যাভ-ট্র্যাভিজ যে ধরনের রেকর্ডের কথা বলছে, সে রকম কিছু নেই। আমাদের কোনো লিখিত, ছাপানো, ছবি বা কম্পিউটার ডাটা ব্যাংক নেই। কিছুই না। পাথরে খোদাই করেও কিছু রাখিনি। আর নেই বলেই ট্র্যাভিজ কিছু খুঁজে পায় নি।
তা হলে কি আছে তোমাদের কাছে? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
ব্লিস যেন বাচ্চা ছেলেকে বোঝাচ্ছে এমনভাবে প্রতিটা শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বলল, আমি / আমরা / গায়ার রয়েছে বিশাল স্মৃতি ভাণ্ডার। আমি স্মরণ করতে পারি।
কী স্মরণ করতে পারো? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
সবকিছু।
প্রয়োজনীয় সব তথ্য মনে করতে পারবে?
নিশ্চয়ই।
কত সময় বা কত হাজার বছর আগের?
সীমাহীন সময়ের।
তুমি আমাকে ঐতিহাসিক, জৈবিক, ভৌগলিক, বৈজ্ঞানিক সকল তথ্য দিতে পারবে। এমনকি স্থানীয় গল্পগাথাগুলো।
সব।
সব রয়েছে ওই ছোট্ট মাথায়। হাস্যকর ভঙ্গিতে ব্লিস এর মাথার দিকে আঙুল তুলে বলল ট্র্যাভিজ।
না, গায়ার স্মৃতি ভাণ্ডার শুধু আমার মাথার ভেতরেই সীমাবদ্ধ না। দেখ, ইতিহাস লেখার আগেও এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ বুনো জীবনযাপন করতো। তখন তাদের দেখা ঘটনাগুলো স্মৃতিতে থাকলেও তারা সেটা প্রকাশ করতে পারতো না। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের নিকট স্মৃতি স্থানান্তরের জন্য তারা কথা বলার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। স্মৃতিগুলোকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরের জন্য লেখার পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়। তারপর থেকে সমস্ত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের লক্ষ্য ছিল একটাই আরও বেশি করে স্মৃতি স্থানান্তর এবং প্রয়োজনের সময় সঠিক স্মৃতি সহজে বের করে আনা। কিন্তু যখন সবাই মিলে গায়া তৈরি করল, তখন আগের পদ্ধতিগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আমরা স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারি, যে মৌলিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অন্য সব পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল। বুঝতে পেরেছ।
অর্থাৎ একটা মস্তিষ্কের তুলনায় গায়ার সব মস্তিষ্ক মিলে আরো বেশি স্মৃতি ধরে রাখতে পারে?
অবশ্যই।
কিন্তু গায়া যদি তার সমস্ত জ্ঞান প্ল্যানেটরি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে রাখে, তা হলে গ্রহের ক্ষুদ্র একটা অংশ হিসেবে তুমি কতদূর কি করতে পারবে?
তুমি যা করতে পারো তার চেয়েও বেশি কিছু করতে পারি। আমার যা জানা প্রয়োজন সেটা হয়তো কোনো ইণ্ডিভিজুয়াল মাইণ্ডে রয়েছে। বিষয়টা যদি খুব সাধারণ হয়, যেমন-চেয়ার শব্দের অর্থ কী-এটা সবার মস্তিষ্কেই আছে। কিন্তু জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গায়ার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে থাকে। প্রয়োজন হলে আমি সেখান থেকে বের করে আনতে পারব। যদিও সময় একটু বেশি লাগবে। তোমার যখন কোনো বিষয় জানার প্রয়োজন হয় তখন তুমি কী করো, ট্র্যাভিজ? ঐ। বিষয়ের নির্দিষ্ট বুক ফিল্ম বা কম্পিউটার ডাটা ব্যাংকের সাহায্য নাও। আর আমি গায়ার পুরো মস্তিষ্ক স্ক্যান করি।
এত কিছু মাথায় থাকে কী করে? পড়ে যায় না?
ঠাট্টা করছ, ট্র্যাভিজ?
অভদ্রতা করো না, গোলান। পেলোরেট বলল।
ট্র্যাভিজ একবার পেলোরেট একবার ব্লিস এর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর তার মুখের থমথমে ভাব শিথিল হলো। দুঃখিত। বাধ্য হয়ে দায়িত্ব। পালন করতে করতে আমি বিরক্ত, কীভাবে ছাড়া পাবো তাও জানি না। ব্লিস আমি আসলেই জানতে চাই। কীভাবে তুমি অন্য মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি বের করে আনো, অথচ নিজের মস্তিষ্কে সেটা ধারণ করতে হয় না?
আমি জানি না, ট্র্যাভিজ; তোমার মস্তিষ্ক একা কীভাবে কাজ করে, সেটা তুমি যতটুক জানো, তার বেশি, আমিও জানি না। সামান্য বুঝিয়ে বলতে পারি। ধর, টার্মিনাসের সূর্য থেকে প্রতিবেশী কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব তুমি জানো। সময়ের সাথে সাথে তুমি হয়তো সেটা ভুলে গেলে। কিন্তু প্রয়োজন হলে কোনো ডাটা ব্যাংক থেকে জেনে নিতে পারবে। গায়াকে একটা বিশাল ডাটা ব্যাংক হিসেবে কল্পনা কর। প্রয়োজন হলেই যে-কোনো ঘটনা বা স্মৃতি বের করে আনি, তারপর আবার যেখান থেকে এনেছিলাম সেখানে ফেরত পাঠাই। নিজের স্মৃতিতে ধরে রাখার প্রয়োজন হয় না।
গায়ার জনসংখ্যা কত? কতজন মানুষ বাস করে এখানে?
কম বেশি এক মিলিয়ন। সঠিক সংখ্যাটা জানতে চাও?
না, অনুমানেই চলবে। যাই হোক, এক বিলিয়ন মানুষ যার বিশাল অংশ হচ্ছে শিশু–নিশ্চয়ই একটা জটিল সামাজিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সকল তথ্যের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না।
গায়াতে মানুষ ছাড়াও অন্য জীব আছে। অর্থাৎ পশু পাখিও স্মৃতি ধরে রাখতে পারে? মানুষের মতো সমপরিমাণে রাখতে পারে না। তা ছাড়া সকল মস্তিষ্কেরই অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে ব্যক্তিগত স্মৃতি, যার প্রয়োজনীয়তা খুব কম। তাই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অনেকটাই প্রাণীর মস্তিষ্কে, উদ্ভিদ কোষে এবং গ্রহের ভৌগোলিক কাঠামোতেও ধারণ করা হয়।
ভৌগোলিক কাঠামো? পাথর, পাহাড়, পর্বত?
সাগর এবং বায়ুমণ্ডলেও ধারণ করা হয়। সবই তো গায়া।
কিন্তু জড়বস্তু কতটুকু স্মৃতি ধরে রাখতে পারে?
প্রচুর পরিমাণে। ঘনত্ব কম কিন্তু পরিমাণে বিশাল। ফলে গায়ার মোট স্মৃতিশক্তির বিশাল অংশ পাথরে ধারণ করা হয়। সেখানে কোনো স্মৃতি ধারণ করতে এবং বের করে আনতে খুব কম সময় লাগে। ফলে মৃত তথ্য-অর্থাৎ যেগুলো। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় খুব কম ব্যবহৃত হয় সেগুলো পাথর পাহাড় পর্বতে ধারণ করা হয়।
যার মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে, সে যদি মারা যায়?
তথ্যগুলো তো হারিয়ে যায় না। মৃত্যুর পরে মস্তিষ্কের সংগঠন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে, কিন্তু স্মৃতিগুলো গায়ার অন্যান্য অংশে সরিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। নতুন বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নতুন শিশু জন্মায়, বয়সের সাথে সাথে তাদের মস্তিষ্ক সংগঠিত হতে থাকে, তখন তারা শুধু নিজস্ব ধারণা এবং স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠে না। অন্যান্য উৎস থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাদের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তোমরা যাকে শিক্ষা বল, আমি/আমরা/গায়ার ক্ষেত্রে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
সত্যি গোলান। আমার মনে হয় এই জীবন্ত গ্রহের ধারণা বেশ উন্নত।
ট্র্যাভিজ তার সহযাত্রী ফাউণ্ডেশনারের দিকে তাকালো আড়চোখে। কোনো সন্দেহ নেই, জেনভ। কিন্তু আমার ধারণা পাল্টাচ্ছে না। এই গ্রহ বেশ বড় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ, কিন্তু একক সত্তা। একক! প্রতিটা নতুন বুদ্ধিমত্তা এর সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এখানে বিরোধিতা করার সুযোগ কোথায়। মানুষের ইতিহাসে দেখা যায় সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারাই জিতেছে, আর তাতে ইতিহাসের ধারা পাল্টে গেছে আমূল।
আমাদের ভিতরেও বিরোধ আছে, ব্লিস বলল। গায়ার সকল অংশই সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নেয়নি।
সেটা খুব সামান্য। বলল ট্র্যাভিজ। একটা সিঙ্গেল অর্গানিজমের ভেতর খুব বেশি গোলযোগ থাকতে পারে না। থাকলে সেটা কাজ করবে না।
ব্লিস পুরোপুরি নিরাবেগ গলায় বলল,নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছ? এখন মত পাল্টাতে চাও?
দ্বিধান্বিত হয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল ট্র্যাভিজ। তারপর ধীর গলায় বলল, এখনই না। কয়েকটা অজানা কারণে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেগুলো না জানা পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারব না। এখন পৃথিবীর ব্যাপারে ফিরে আসা যাক।
যেখানে গেলে হয়তো তোমার অজানা কারণগুলো জানতে পারবে, তাই না, ট্র্যাভিজ?
হয়তো। যাই হোক, ডম বলেছে, পৃথিবীর অবস্থান সে জানে না। তুমিও তার সাথে একমত।
অবশ্যই।
তুমি আমার ভেতর থেকে কোন তথ্য বের করে নিয়েছ? সচেতনভাবে।
অবশ্যই না। শোন, গায়ার পক্ষে মিথ্যে কথা বলা সম্ভব হলেও তোমার সাথে বলবে না। তোমার সিদ্ধান্তের উপর আমরা নির্ভরশীল, এবং নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই সেটা সঠিক হওয়া প্রয়োজন।
সেক্ষেত্রে, তোমাদের বিশ্বের স্মৃতিভাণ্ডার ব্যবহার করা যাক। পিছনের দিকে অনুসন্ধান করে বলো কত পুরোনো সময়ের ঘটনা মনে করতে পারবে?
কয়েক মুহূর্তের দ্বিধা। ব্লিস শূন্য চোখে ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তারপর বলল, পনের হাজার বছর।
দ্বিধা করছ কেন?
সময় লাগবে। পুরোনো স্মৃতি-সত্যিকারের পুরোনো স্মৃতিগুলো রয়েছে পাহাড়ের একেবারে নিচে। তুলে আনতে সময় লাগবে।
তা হলে পনের হাজার বছর আগে। সেই সময় গায়া তৈরি হয়েছিল।
না। আমাদের জানামতে গায়া তৈরি হয়েছিল আরও প্রায় তিনহাজার বছর আগে।
অনিশ্চয়তা কেন? তুমি বা গায়া মনে করতে পারছ না।
সেটা ছিল সর্বজনীন স্মৃতিভাণ্ডার তৈরিরও আগে।
তার আগে গায়া নিশ্চয়ই রেকর্ড রাখত, ব্লিস। স্বাভাবিক রেকর্ড, যেমন ছাপানো, ফিল্ম, ইত্যাদি।
আমারও তাই ধারণা। কিন্তু এতদিন পরে নিশ্চয়ই নেই।
সেগুলো নিশ্চয় অনুলিপি করা হয়েছে বা বলা ভালো সর্বজনীন স্মৃতিভাণ্ডারে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ব্লিস ভুরু কোঁচকালো। আবারও দ্বিধাগ্রস্ততা, এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য।
এমন কোনো পুরোনো রেকর্ড আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
কেন?
জানি না, ট্র্যাভিজ। আমার ধারণা সেগুলোর তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। সময়ের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে।
তুমি জান না। শুধু ধারণা এবং অনুমান করছ। কিন্তু সঠিক জান না। গায়াও জানে না।
চোখ নামিয়ে নিল ব্লিস। তাই হবে।
তাই হবে? আমি গায়ার অংশ নই, কাজেই গায়ার মতো ধারণা করার কোনো প্রয়োজন নেই আমার-এর থেকেই আইসোলেশনের গুরুত্ব বুঝতে পারবে তুমি। আইসোলেট হিসেবে আমার ধারণা অন্যরকম।
কী ধারণা?
একটা ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো সভ্যতাই তার প্রাথমিক যুগের রেকর্ড ধ্বংস করতে চায় না। বরং সংরক্ষণের চেষ্টা করে। গায়ার প্রি-গ্লোবাল রেকর্ডগুলো ধ্বংস করা হলে সেটা নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় করা হয় নি।
অর্থাৎ!
ট্র্যানটরের লাইব্রেরি থেকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের চেয়ে বড় কোনো শক্তি পৃথিবীর সব রেকর্ড সরিয়ে ফেলেছে। সম্ভবত তোমাদের চেয়েও শক্তিশালী কোনো পক্ষ গায়া থেকে সমস্ত রেকর্ড সরিয়ে ফেলেছে।
কীভাবে বুঝলে যে পুরোনো রেকর্ডগুলো সব পৃথিবী সম্পর্কে ছিল?
তোমার মতে গায়া তৈরি হয়েছিল আঠারো হাজার বছর আগে, গ্যালাকটিক এম্পায়ার তৈরির পূর্বে, সেই সময় যখন গ্যালাক্সিতে বসতিস্থাপন মাত্র শুরু হয়েছে, এবং বসতিস্থাপনকারীদের মূল ধারাটা এসেছিল পৃথিবী থেকে। পেলোরেটের কাছে প্রমাণ আছে।
হঠাৎ নিজের নাম শুনে চমকে উঠল পেলোরেট। গলা পরিষ্কার করে নিল। প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোতে এই কথাই বলা হয়েছে। ট্র্যাভিজের মতো আমারও ধারণা মানবজাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র একটা গ্রহ থেকে এবং সেই গ্রহ হচ্ছে পৃথিবী। প্রথম যুগের বসতিস্থাপনকারীরা এসেছিল সরাসরি পৃথিবী থেকে।
সেক্ষেত্রে, ট্র্যাভিজ বলল, গায়াতে বসতি স্থাপন করা হয় হাইপারস্পেসাল ট্রাভেল-এর প্রথম যুগে, স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেয়া যায় যে পৃথিবীর মানুষ সরাসরি এখানে কলোনি তৈরি করেছিল, অথবা এমন কোনো বিশ্বের অধিবাসী যে বিশ্বে পৃথিবীর মানুষ কিছুদিন পূর্বেই কলোনি তৈরি করেছে-তাদের দ্বারা। সেকারণেই বসতিস্থাপনের পরবর্তী কয়েক হাজার বছরের রেকর্ডগুলো ছিল পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে এবং সেগুলো এখন হারিয়ে গেছে। কোনো একটা শক্তি চাইছে না গ্যালাক্সির কোথাও পৃথিবীর নামটা থাকুক। এবং তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
কিন্তু সবই তো অনুমান। তোমার কাছে কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। রাগের সাথে বলল ব্লিস।
তোমরাই বলেছো, অপর্যাপ্ত তথ্য থেকে সঠিক উপসংহার বের করার ক্ষমতা আছে আমার। কাজেই আমার কোনো ভুল হয়নি। বলো না যে প্রমাণের অভাব আছে।
ব্লিস নিশ্চুপ।
ট্র্যাভিজ কথা চালিয়ে গেল। পৃথিবী আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে। ফার স্টার তৈরি হওয়া মাত্র আমি রওনা দেব। তোমরা এখনও যেতে চাও?
হ্যাঁ। একসাথে বলল ব্লিস এবং পেলোরেট।
.
২. কমপরেলন-এর পথে
ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। ধূসর পাথুরে বর্ণ ধারণ করেছে আকাশ।
তার মাথায় একটা বৃষ্টি নিরোধক টুপি, বৃষ্টির ফোঁটা টুপিতে পড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। টুপি থেকে ছিটকে আসা পানির বিন্দু থেকে গা বাঁচিয়ে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে পেলোরেট। যদিও বৃষ্টিতে ভেজার হাত থেকে বাঁচার জন্য কোনো। ব্যবস্থা নেয়নি সে।
খামোখা ভেজার কোনো কারণ দেখি না, জেনভ। বলল ট্র্যাভিজ।
কোনো সমস্যা নেই, প্রিয় বন্ধু, পেলোরেট এর আমুদে গলা। বরাবরের মতোই মুখে বিষণ্ণ গাম্ভীর্য। হালকা বৃষ্টি। কোনো বাতাস নেই। তা ছাড়া পুরোনো প্রবাদ আছে : এনাক্রনে গিয়ে সেভাবেই চল, যেভাবে এনাক্রোনিয়ানরা চলাফেরা করে। ফার স্টারের কাছে দাঁড়ানো কয়েকজন গায়ানকে নির্দেশ করে শেষের কথাগুলো বলল সে। গায়ানরা শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো, যেন বাগানে সাজানো গাছ। এবং কেউই বৃষ্টি নিরোধক টুপি পড়েনি।
আমার ধারণা, ট্র্যাভিজ বলল, ওরা খুশি হয়েই ভিজছে। কারণ গায়ার বাকি অংশও ভিজছে। গাছ-ঘাস-মাটি-সবকিছু। এবং গায়ানদের মতো বাকি সবকিছুই সমানভাবে গায়া।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য উঠবে। ভেজা সবকিছু দ্রুত শুকিয়ে যাবে। কোনো ঠাণ্ডা নেই। আর যেহেতু কোনো জীবাণুর আক্রমণ নেই, সর্দি কাশি বা নিউমোনিয়া হবে না। কাজেই একটু ভিজলে সমস্যা কি।
যুক্তিগুলো ট্র্যাভিজও জানে। কিন্তু হার মানতে চাইল না। তারপরেও আমরা যখন চলে যাচ্ছি ঠিক তখনই বৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। হাজার হোক এটা
তো স্বেচ্ছা বৃষ্টিপাত। প্রয়োজন না হলে গায়া কখনো বৃষ্টিপাত ঘটায় না। মনে হচ্ছে। যেন আমাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করছে।
সম্ভবত, তারপর পেলোরেট কৌতুকের ভঙ্গিতে ঠোঁট বাকা করে বলল, আমরা চলে যাচ্ছি, তাই গায়া দুঃখে কাঁদছে।
সে হয়তো দুঃখ পেয়েছে। আমি পাইনি।
আসলে, কথা বলে যাচ্ছে পেলোরেট, গায়ার এই অংশের মাটি একটু ভেজানেনা। প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হেসে ফেলল ট্র্যাভিজ। এই গ্রহ তোমার বেশ পছন্দ হয়েছে, তাই না? এমনকি ব্লিস এর চেয়েও বেশি।
হ্যাঁ, পছন্দ করি। পেলোরেট বলল কিছুটা আররক্ষার সুরে। জীবনটা আমি শান্ত আর নিরূপদ্রবে কাটাতে চেয়েছি। আর এখানে পুরো গ্রহ চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত নিরূপদ্রব রাখার জন্য। ভেবে দেখ গোলান, আমরা যখন ঘরবাড়ি তৈরি করি বা ওই মহাকাশযান তৈরি করার সময়-একটা নিচ্ছিদ্র আশ্রয় তৈরি করতে চেষ্টা করেছি। আরামআয়েশের সব ধরনের ব্যবস্থা রাখার চেষ্টা করি। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। আর এখানে সেই ইচ্ছাটাই ব্যাপক হয়ে পুরো গ্রহে ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা হচ্ছে বাড়ি বা ওই মহাকাশযান তৈরি করা হয় আমার উপযুক্ত করে। কিন্তু গায়ার অংশ হলে, এই গ্রহ যত আদর্শই হোক না কেন নিজেকে পাল্টে নিয়ে
আমাকে এই গ্রহের উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে।
ঠোঁট ভাঁজ করল পেলোরেট। প্রত্যেক সমাজই মানুষকে গড়ে পিটে তার উপযুক্ত করে নেয়। নিজের প্রয়োজনে সমাজ বিভিন্ন প্রথা তৈরি করে মানুষকে শিকলে বেঁধে নেয়।
আমি যে সমাজগুলো জানি সেখানে যে কেউ বিদ্রোহ করতে পারে। সেখানে কিছু খ্যাপাটে লোক, এমনকি অপরাধীও থাকে।
তুমি চাও খ্যাপাটে লোক বা অপরাধী থাকুক?
কেন নয়? তুমি আর আমি খ্যাপাটে লোক। আমরা টার্মিনাসের সাধারণ মানুষের মতো নই। আর অপরাধীদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। অকল্যাণকর প্রথা ভাঙার জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, মেধার জন্য যদি অপরাধী হতে হয় আমি তাতেও রাজি।
অপরাধী হতেই হবে? এ ছাড়া মেধাবী হওয়া যায় না?
মেধাবী বা মহাপুরুষ তারাই যারা প্রচলিত নিয়মনীতির অনেক ঊর্ধ্বে থাকে। প্রচলিত নিয়ম নীতির ভেতরে থেকে তুমি এগুলো পাবে না। যাই হোক শুধু আরামদায়ক বাড়ি বলেই গায়াকে আমি মানবজাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে নির্বাচিত করিনি। সেজন্য আরও জোরালো কারণ খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।
আসলে তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্ক করছি না। শুধু কিছু–
থেমে গেল পেলোরেট। ব্লিস তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ভিজে চকচক করছে তার কালো চুল, কালো পোশাক লেপটে আছে গায়ের সাথে। এগিয়ে আসার সময় আস্তে করে মাথা নাড়ল।
দুঃখিত, দেরি করিয়ে দিলাম। ডম-এর সাথে কথা বলতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।
সে যা জানে তার সবই তো তুমি জানো।
ব্যাপারটা হচ্ছে আসলে কে কীভাবে দেখবে। আমাদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে না এটা ঠিক। দেখ, ব্লিস বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। তোমাদের দুটো হাত। দুটোই শরীরের অংশ। দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, শুধু একটা আরেকটার প্রতিবিম্ব। কিন্তু দুটো হাত তুমি একইভাবে ব্যবহার করো না। কিছু কাজ করো ডান হাত দিয়ে কিছু কাজ করো বাঁহাত দিয়ে। ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির।
চমৎকার যুক্তি। সন্তুষ্টির সাথে বলল, পেলোরেট।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। ক্ষেত্রবিশেষে বেশ কার্যকর বিশ্লেষণ। আমি অবশ্য নিশ্চিত নই। যাই হোক, আমরা এখন জাহাজে উঠতে পারি। বৃষ্টি হচ্ছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের লোকজন এটার বেশ ভালোই যত্ন নিয়েছে। তারপর হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ভিজছ না। তোমাকে ধরতে পারছে না বৃষ্টির ফোঁটাগুলো।
হ্যাঁ, অবশ্যই। ভালো লাগছে না ভিজতে। কিন্তু যখন তখন বৃষ্টিতে ভেজা বেশ মজার, তাই না? নিশ্চয়ই। কিন্তু নিজের ইচ্ছায়, বৃষ্টির ইচ্ছায় না।
কাঁধ নাড়ল ব্লিস, বেশ, তোমার খুশি। আমাদের মালপত্র উঠানো হয়েছে। চল আমরাও উঠি।
তিন জন ফার স্টারের দিকে হাঁটা ধরল। বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু ঘাসগুলো ভেজা। ট্র্যাভিজ গা বাঁচিয়ে হাটছে। কিন্তু ব্লিস জুতো খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল।
বেশ মজা। ট্র্যাভিজ তার পায়ের, দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে বলল।
ভালো। ট্র্যাভিজ অন্যমনস্ক। তারপর বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,আচ্ছা ওই গায়ানরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
ওরা ঘটনাটা রেকর্ড করছে। আমাদের কাছে তুমি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখ, এই অভিযানের পর তুমি যদি মত পাল্টে আমাদের বিপক্ষে চলে যাও, আমরা আর গ্যালাক্সিয়া তৈরি করতে পারব না, এমনকি গায়া হিসেবেও থাকতে পারব না।
অর্থাৎ গায়ার কাছে আমি জীবন এবং মৃত্যু।
আমরা তাই মনে করি।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ট্র্যাভিজ। টুপি খুলল মাথা থেকে। আকাশের এখানে সেখানে নীলের ছোঁয়া লেগেছে। আমি তোমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। আমাকে মেরে ফেললে সেটা আর পাল্টানো যাবে না।
গোলান, পেলোরেট আতঙ্কিত স্বরে ফিসফিস করে বলল। কী ভয়ংকর কথা।
আইসোলেট মানুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। ব্লিস শান্ত। বোঝার চেষ্টা কর ট্র্যাভিজ, একজন মানুষ হিসেবে তোমার বা তোমার সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব নেই। আমরা নির্ভর করছি আসল সত্য বা প্রকৃত ঘটনার উপর। তোমার গুরুত্ব হচ্ছে তুমি সেই সত্য প্রকাশের মাধ্যম। তোমাকে মেরে ফেলার অর্থ হচ্ছে সত্যটাকে নিজেদের কাছ থেকে গোপন করা।
যদি বলি যে আসল সত্য হচ্ছে গায়া মানবজাতির ভবিষ্যৎ হতে পারে না। তখন তোমরা সবাই খুশি হয়ে মারা যাবে।
সবাই খুশি মনে মেনে নেবে না। তবে শেষপর্যন্ত তাই ঘটবে।
যদি কখনো তোমাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিই, তার কারণ হবে এই মাত্র তোমার বলা কথাগুলো। তারপর যারা ধৈর্য ধরে দেখছে (সম্ভবত শুনছেও) তাদের দিকে ফিরে ব্লিসকে জিজ্ঞেস করল, ওরা এমন ছড়িয়ে আছে কেন? আর এতজন কেন এসেছে? যে-কোনো একজন এসে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করতে পারত। তারপর গায়ার সবার স্মৃতিতে ছড়িয়ে দিতে পারত তাই না?
ওরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করছে, এবং পৃথক পৃথক মস্তিষ্কে সেটা রেকর্ড হচ্ছে। পরে সকলের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে একজনের বিশ্লেষণের তুলনায় সকলের সমন্বিত বিশ্লেষণ থেকে আজকের ঘটনা আরও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে।
অন্য কথায়, ক্ষুদ্র অংশের তুলনায় সামগ্রিক কাঠামো আরও ভালোভাবে কাজ করবে।
ঠিক। গায়ার অস্তিত্বের মৌলিক যুক্তিগুলো তুমি বেশ ভালোই বুঝেছ। একা একজন মানুষ হিসেবে তুমি প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে তৈরি। কিন্তু মাল্টি সেলুলার ইণ্ডিভিজুয়াল হিসেবে তুমি ঐ পঞ্চাশ ট্রিলিয়ন কোষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই একমত হবে।
হ্যাঁ আমি একমত।
মহাকাশ যানের ভেতর ঢুকে শেষবারের মতো গায়াকে দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো ট্র্যাভিজ। বৃষ্টির ফলে চারপাশে তরতাজা ভাব। তার সামনে ছড়িয়ে আছে শান্ত, নিরিবিলি, সবুজ এক বিশ্ব। জটিল ও রহস্যময় গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে এক শান্তিময় উদ্যান।
এবং ট্র্যাভিজ আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করল যেন এই গ্রহ আর দেখতে না হয়।
.
এয়ারলক বন্ধ হয়ে যেতেই ট্র্যাভিজের মনে হল, সে শুধু একটা দুঃস্বপ্নকেই পিছনে ফেলে আসেনি, বরং এক অস্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে।
যদিও সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের একটা উপাদান-ব্লিস-এখনও তার সাথে রয়েছে। কিন্তু জানে প্রয়োজন আছে তার উপস্থিতির। মনে হয় সেই ব্ল্যাকবক্স আবারও কাজ শুরু করেছে সূক্ষ্মভাবে।
মহাকাশযানের সবকিছুই চমৎকারভাবে আছে। ফাউণ্ডেশন-এর মেয়র তাকে বের করে দেওয়ার পর থেকেই এই যান তার কাছে আছে। এখনও আছে এবং ফেরত দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
এটা তার কাছে আছে মাত্র কয়েক মাস, কিন্তু এরই মধ্যে তার বাড়িঘর হয়ে উঠেছে এটা। টার্মিনাসে নিজের বাসস্থানের কথা মনে নেই একেবারেই।
টার্মিনাস! ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের কেন্দ্র, সেলডনের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীতে দ্বিতীয় আরেকটা শক্তিশালী গ্যালাকটিক এম্পায়ার গড়ে তোলাই যার লক্ষ্য। কিন্তু ট্র্যাভিজ সেই আশাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। শুরু করেছে নতুন এক সামাজিক ব্যবস্থা, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি।
এখন সে অভিযানে বেরিয়েছে প্রমাণ করার জন্য যা সে করেছে তা সঠিক না ভুল।
এভাবে চিন্তায় ডুবে যাওয়ার জন্য বিরক্ত হলো নিজের উপর। দ্রুতপায়ে এগোল পাইলট রুমের দিকে।
কম্পিউটার আগের চেয়েও বেশি ঝকমক করছে। ঝকমক করছে সবকিছুই।
নিখুঁতভাবে যন্ত্রপাতিগুলো কাজ করছে। নিঃশব্দে চলছে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা।
কম্পিউটারের আলোর বৃত্ত যেন আমন্ত্রণ জানালো তাকে, ট্র্যাভিজ স্পর্শ করতেই আলোটা ছড়িয়ে পড়ল পুরো ডেস্কের উপর, সেই সাথে ডান ও বা হাতের দুটো ছাপ ফুটে ওঠল। আটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়ল সে। গায়ানরা ফাউণ্ডেশন-এর প্রযুক্তির কিছুই জানে না। ভয় ছিল তারা হয়তো যন্ত্রগুলো নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু ঠিক আছে সব।
এবার আসল পরীক্ষা। তার ভয় হচ্ছে। যদি কোনো ক্ষতি হয় সে সাথে সাথেই বুঝতে পারবে। বুঝেই বা কী করবে। মেরামতের জন্য ফিরে যেতে হবে সেই টার্মিনাসে। যদি ফিরে যায়, সে নিশ্চিত মেয়র ব্র্যান্নো আর তাকে ছাড়বে না। আর যদি না যায়–
মনে হচ্ছে বুকের খাঁচার ভেতর হৃৎপিণ্ড ফুটবলের মতো লাফাচ্ছে। কিন্তু সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই।
দ্রুত ডান ও বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে ডেস্কের ছাপ দুটোর উপর রাখলো সে। সাথে সাথেই মনে হলো আরেক জোড়া হাত তার হাত দুটোকে আঁকড়ে ধরেছে। এখন সে গায়ার চারদিক দেখতে পারছে। সবুজ ও আর্দ্র। গায়ানরা আছে এখনও। ইচ্ছা শক্তি বাড়িয়ে সে উপড়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখল। ইচ্ছা শক্তি আরেকটু বাড়ানোতে মেঘ সরে গিয়ে বেড়িয়ে এল নীল আকাশ।
তারপর ফুটিয়ে তুলল গ্যালাক্সির ইমেজ। ঘুড়ে বেড়াতে লাগল নক্ষত্রমণ্ডলে। কম্পিউটারটা বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করে সে নিশ্চিত হলে তবেই। সংযোগ বিচ্ছিন্ন। করে ফিরে এল বাস্তবে। একটু ঝুঁকে দাঁড়ানোতে ব্যথা করছে ঘাড় পিঠ।
আগের চেয়ে ও ভালোভাবে কাজ করছে কম্পিউটার। এই যন্ত্রের প্রতি তার অনুভূতি ভালবাসার সাথে তুলনা করা যায়। এটা যখন তার হাত ধরে (যন্ত্রটাকে কখনো নারী বলে ভাবেনি) তার ইচ্ছাশক্তি সুনিয়ন্ত্রিত পথে বৃদ্ধি পেয়ে একটা বৃহৎ সত্তায় অংশ নেয়। যে কাজটা (তিক্তমনে ভাবল) গায়া আরও প্রসারিতভাবে করে।
মাথা নাড়ল সে। না! কম্পিউটার এবং তার বেলায় সে-ট্র্যাভিজ-তার হাতে থাকে নিয়ন্ত্রণ। কম্পিউটার পুরোপুরি তার অধীনস্থ।
ডাইনিং রুমে যথেষ্ট খাবার স্টোর করা হয়েছে। সঠিক ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তার ঘরের বুক ফিলগুলো রাখা আছে ঠিকভাবেই, এবং কোনো সন্দেহ নেই পেলোরেটের লাইব্রেরিও যথাযথভাবে আছে।
পেলোরেট! এতক্ষণে মনে পড়ল। দ্রুত পেলোরেটের ঘরে এসে ঢুকল। ব্লিস। এর জায়গা হবে এখানে, জেনভ?
হ্যাঁ, অসুবিধা হবে না।
প্রয়োজন হলে কমনরুমটাকে ওর বেডরুম বানিয়ে দিতে পারি।
মাথা তুলল ব্লিস। আলাদা বেডরুমের প্রয়োজন নেই। আমি এখানে পেল এর সাথে থাকতে চাই। তবে প্রয়োজন হলে অন্যঘর ব্যবহার করব।
যে কোনো ঘর ব্যবহার করতে পারো, আমারটা বাদ দিয়ে।
বেশ। আমিও সেই কথাই বলতে চাই। স্বভাবতই তুমিও আমাদের কোয়ার্টার থেকে দূরে থাকবে।
স্বভাবতই, বলল ট্র্যাভিজ। তারপর চোখ নামিয়ে বুঝতে পারল সে চৌকাঠ। পেরিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি এক পা পিছিয়ে হাসিমুখে বলল, এটা কিন্তু হানিমুন কোয়ার্টার না।
গায়ার ঘরগুলো এর অর্ধেক।
তোমরা বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে থাকবে। বলার সময় ট্র্যাভিজ চেষ্টা করল যেন হাসি না আসে।
আমরা যথেষ্ঠ ঘনিষ্ট, বলল পেলোরেট। আলোচনার মোড় ঘুরে যাওয়ায় অস্বস্তি বোধ করছে। তবে বন্ধু, আমাদের ভার আমাদের হাতেই ছেড়ে দাও।
আসলে পারি না, ধীর গলায় বলল ট্র্যাভিজ। বোঝার চেষ্টা কর। এটা হানিমুন। কোয়ার্টার না। পরস্পরের সম্মতিতে তোমরা যাই কর আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কোনো প্রাইভেসি থাকবে না তোমাদের। বুঝতে পেরেছ ব্লিস।
ওখানে একটা দরজা আছে, ব্লিস বলল, আশা করি ওটা যখন বন্ধ থাকবে তুমি আমাদের বিরক্ত করবে না।
করব না। কিন্তু শব্দ নিরোধক কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে।
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, ট্র্যাভিজ, আমাদের দুজনের আলোচনা তুমি পরিষ্কার শুনবে। এমনকি ভালবাসার সময় যে শব্দ হবে সেগুলোও।
হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি। কাজেই তোমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। অসুবিধা হলেও আমার কিছু করার নেই। দুঃখিত।
পেলোরেট কাশল। মৃদু গলায় বলল, এই সমস্যায় আমাকে আগেই পড়তে হয়েছে, ট্র্যাভিজ। জানই তো, ব্লিস যা অনুভব করে বা উপভোগ করে, গায়া তার সবটাই অনুভব বা উপভোগ করতে পারে।
আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমাকে বলতে চাইনি।
বেশি ভাবার কিছু নেই ট্র্যাভিজ। গায়াতে প্রতিমুহূর্তে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রেম করছে; কয়েক মিলিয়ন মানুষ খাচ্ছে, পান করছে বা অন্য কোনো বিনোদন করছে। সবকিছু মিলে আনন্দের একটা সূক্ষ্ম প্রবাহ তৈরি হয়, গায়া সেটাই অনুভব করে। পশুপাখি, উদ্ভিদ পাথর প্রত্যেকেই আনুপাতিক হারে অংশ গ্রহণ করে। গায়া যা অনুভব করে অন্য কোনো গ্রহ তা অনুভব করে না।
আমাদের সবার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ আছে। বলল ট্র্যাভিজ ইচ্ছে হলে সেই সুখ-দুঃখ কারো সাথে ভাগ করে নেই; অথবা নিজেদের ভেতরই রেখে দিই।
যদি আমাদের সাথে যোগ দিতে, তা হলে বুঝতে তোমরা কতখানি নিঃস্ব।
তুমি কীভাবে জানো?
না জানলেও চলবে। স্বাভাবিক ভাবেই একজনের তুলনায় সকলের সম্মিলিত শক্তি অনেক বেশি।
যাই হোক, আমি আমার একার সুখ দুঃখ নিয়েই সন্তুষ্ট। কোনো পাথরের টুকরার সাথে শেয়ার করার ইচ্ছা নেই।
নাক সিটকিয়ো না। নিজের শরীরের সামান্য একটা দাঁতের অনেক গুরুত্ব দাও তুমি। অথচ একটা পাথরে সেগুলোর চেয়ে বেশি কনশাসনেস থাকে।
সত্যি কথা, ট্র্যাভিজ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল। তবে এই বিষয়ে তর্ক করে লাভ নেই।, গায়া তোমার সুখ-দুঃখে অংশ নিলে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি শেয়ার করতে চাই না। চাই না পরোক্ষভাবে তোমার কার্যকলাপে আমাকে জড়িত করা হয়।
তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ, বন্ধু।পেলোরেট বলল। নিজের সুবিধা অসুবিধার চেয়ে আমি তোমার সুবিধা অসুবিধা নিয়েই বেশি ভাবছি। কাজেই আমি আর ব্লিস সতর্ক থাকব। তাই না ব্লিস?
তুমি যা বলবে তাই হবে, পেল।
তা ছাড়া, মহাকাশে যতদিন আছি, তার থেকে অনেক বেশি দিন ছিলাম মাটিতে–
কোনো গ্রহের মাটিতে তোমরা কি করবে, সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই, বাধা দিয়ে বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু এখানে আমার কথাই শেষ কথা।
নিশ্চয়ই। পেলোরেট বলল।
বেশ,কথাটা মনে রাখবে। টেক অফ করার সময় হয়েছে।
দাঁড়াও। ট্র্যাভিজের জামার হাত ধরে টেনে থামালো পেলোরেট। টেক অফ করবে, কিন্তু যাবে কোথায়?? আমি, ব্লিস, তুমি বা তোমার কম্পিউটার জানে না পৃথিবী কোথায়। কী করার ইচ্ছা তোমার? খড়ের গাদায় সুচ খুঁজবে?
ট্র্যাভিজ হাসল আমুদে ভঙ্গিতে। গায়ার হাতে পড়ার পর মনে হচ্ছে এই প্রথম সে নিজের উপর কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছে।
নিশ্চিত থাকো, সে বলল। খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজতে হবে না। আমি জানি কোথায় যেতে হবে।
.
অনেকক্ষণ হয়ে গেল ট্র্যাভিজের দেখা নেই। তাকে খুঁজতে খুঁজতে পাইলট রুমে এসে ঢুকল পেলোরেট। মনযোগ দিয়ে স্টারফিল্ড পর্যবেক্ষণ করছে ট্র্যাভিজ।
গোলান- একবার ডেকে অপেক্ষা করতে লাগল।
ট্র্যাভিজ চোখ তুলল। জেনভ! বস-ব্লিস কোথায়?
ঘুমাচ্ছে। আমরা মহাকাশে বেরিয়ে এসেছি।
ঠিকই দেখছ। ট্র্যাভিজ তার সঙ্গীর অবস্থা দেখে অবাক হয়নি। নতুন গ্র্যাভিটিক মহাকাশযানে টেক অফ বা ল্যান্ডিঙের সময় কিছুই বোঝা যায় না। তীব্র গতির কোনো ধাক্কা নেই, ঝাঁকুনি নেই।
বাইরের গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড থেকে শক্তি সংগ্রহ করে ফার স্টার এমনভাবে উপরে উঠে যেন কসমিক মহাসাগরে ভেসে থাকা কোনো বস্তু। সেই সময় ভেতরের মাধ্যাকর্ষণের কোনো পরিবর্তন হয় না। বায়ুমণ্ডল ভেদ করে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে মহাকাশযানের গতি আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। আরোহীরা কিছু বুঝতে পারে না। এই মুহূর্তে ফার স্টার গায়ার মাধ্যাকর্ষণ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। তবে জাম্প করার আগে আরো সরে আসতে হবে।
গোলান, প্রিয় বন্ধু, পেলোরেট বলল, দুই-এক মিনিট তোমার সাথে কথা বলা যাবে? ব্যস্ত নও নিশ্চয়ই?
মোটেই ব্যস্ত নই। কী করতে হবে, নির্দেশ দেওয়া আছে। কম্পিউটার সামলাচ্ছে সব। কী চাই সেটা বলার আগেই আন্দাজ করে নিয়ে সেরে ফেলছে। পরম আদরে ডেস্ক টপের উপর হাত বোলাল ট্র্যাভিজ।
গোলান, অল্প সময়ে আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছি। যদিও আমার কাছে মনে হয় যেন অনেক সময় পার হয়েছে। এ ঘটনা ঘটেছে গত কয়েকদিনে, যে আমার সারা জীবনের ধ্যান ধারণা অভ্যাস পাল্টে গেছে-
হাত তুলল ট্র্যাভিজ। জেনভ, ভূমিকা করে তুমি আসল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। অল্প সময়ে আমরা বন্ধু হয়েছি, ঠিক। এখনও আমরা বন্ধু, অবশ্য ব্লিস এর সাথে পরিচয় আরও কম সময়ের। কিন্তু তার সাথে তোমার ঘনিষ্ঠতা আমার থেকেও বেশি।
সেই ব্যাপারটা ভিন্ন। বিব্রত ভঙ্গিতে কাশল পেলোরেট।
অবশ্যই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের কি হলো?
তোমার কথামতো যদি আমরা এখনও বন্ধু হই, তবে ব্লিস এর ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
বল কী বলবে।
আমি জানি, গোলান, তুমি ব্লিসকে পছন্দ করো না। কিন্তু আমার মুখ চেয়ে–।
এক মিনিট, জেনভ। ব্লিস আমাকে প্রভাবিত করেনি, ঠিক। তাই বলে আমি তাকে অপছন্দ করি না। তার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। ব্লিস সুন্দরী, আর তা হলেও, তোমার খাতিরে মেনে নিতাম। আসলে আমি গায়াকে অপছন্দ করি।
কিন্তু ব্লিস আর গায়া একই কথা।
জানি, জেনভ। আর এখানেই ব্যাপারটা জটিল হয়ে পড়ছে। ব্লিসকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু গায়া হিসেবে ভাবলেই সমস্যাটার শুরু।
তুমি গায়াকে কোনো সুযোগই দাওনি। গোলান, মাঝে মাঝে ব্লিস আমাকে তার মাইণ্ড এ ঢুকতে দেয়। এক মিনিটেরও কম সময়ের জন্য। তার বেশি না, কারণ সে বলেছে ব্যাপারটায় খাপ খাওয়ানোর জন্য আমার বয়স বেশি।–ওহ্, হেসো না, গোলান। তোমার বয়সও অনেক বেশি। আমার তোমার মতো আইসোলেট মানুষ এক বা দুই মিনিট গায়ার সাথে যুক্ত থাকলে ব্রেইনের ক্ষতি হতে পারে। আর যদি পাঁচ থেকে দশ মিনিট যুক্ত থাকে তা হলে ক্ষতি হবে অপূরণীয়। তোমার অভিজ্ঞতা থাকলে বুঝতে, গোলান।
কী? ব্রেইনের অপূরণীয় ক্ষতি? না ধন্যবাদ।
গোলান, ইচ্ছা করেই আমাকে ভুল বুঝছ তুমি। কি মিস করছ, তুমি বুঝতে পারছ না। ব্লিস বলেছে এটা আনন্দের অনুভূতি। সারা দিন তৃষ্ণার্ত থেকে এক ফোঁটা পানি পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমন। হাজার হাজার মানুষ পৃথকভাবে যে বিনোদন করছে তুমি তার সবগুলোতে অংশ নিতে পারবে। যদিও ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু তোমার ভেতরে আলোড়ন উঠবে, ঝংকার তৈরি হবে।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। বলেছে ভালোই। কিন্তু শুনে মনে হচ্ছে তুমি এমন কোনো নেশায় আসক্ত যা তোমাকে সাময়িক আনন্দ দিলেও ভয়াবহ আতঙ্কে ভুগতে হয়। আমি এ ধরনের সাময়িক আনন্দের জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চাই না।
আমি এখনও স্বাধীন, গোলান।
কিন্তু কতদিন থাকতে পারবে, জেনভ? সময়ের সাথে সাথে তুমি আরও বেশি পেতে চাইবে, যতক্ষণ না তোমার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। জেনভ, ব্লিসকে তুমি এ কাজ করতে দিও না। ভালো হয় আমি যদি এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলি।
না, না। তুমি রাখঢাক করে কথা বলতে পারো না। আমি চাই না ও কষ্ট পাক। চিন্তা করো না, ব্লিস আমার ভালোই যত্ন নিচ্ছে। নিজেকে নিয়ে আমি যতটুকু ভাবি তার চেয়ে বেশি ভাবে ও।
বেশ, তোমাকেই বলছি। জেনভ, আর এই কাজ করো না। বায়ান্ন বছর নিজের সুখ-দুঃখ নিয়ে কাটিয়েছ। মস্তিষ্ক তাতে অভ্যস্ত। এখন নতুন এবং অস্বাভাবিক আনন্দের জন্য ভারসাম্য নষ্ট করো না। এরজন্য চরম মূল্য দিতে হবে। এখন না হলেও ভবিষ্যতে অবশ্যই দিতে হবে।
হ্যাঁ, গোলান। নিচু স্বরে বলল পেলোরেট, চোখ নামিয়ে নিয়েছে। অন্যভাবে চিন্তা করে দেখ । ধর তুমি একটা এক কোষী প্রাণী–
ভুলে যাও। ব্লিস আর আমি আগেই কথা বলেছি এ ব্যাপারে।
হ্যাঁ, কিন্তু একটু ভেবে দেখ। ধর কোনো এককোষী প্রাণী যার মানুষের মতো অনুভূতি এবং চিন্তা শক্তি আছে, তাদেরকে জোর করে বহুঁকোষী সত্তায় পরিণত করতে চাইলে, তারা মনে করবে না তাদের স্বাধীনতা নষ্ট হচ্ছে? ঠেকাতে চাইবে না? ভুল হবে না তাদের? তারা কি জানে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা কতটুকু?
জোরে জোরে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। না, জেনভ, তোমার যুক্তি ভুল। এককোষী প্রাণীর অনুভূতি নেই, চিন্তাশক্তি নেই। এধরনের বস্তুর স্বাধীনতা হারানো কোনো ব্যাপার না, কারণ তাদের সেটা নেই। কিন্তু মানুষের চিন্তা শক্তি আছে। সত্যিকার অনুভূতি এবং স্বাধীন বুদ্ধিমত্তা আছে, যা হারাতে হবে তাকে। কাজেই তোমার যুক্তি ভুল।
দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল দুজনের মাঝে। তারপর আলোচনার মোড় ঘোরানোর জন্য পেলোরেট বলল, তুমি স্টার ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
অভ্যাস। ক্লান্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, কম্পিউটার বলছে গায়ান বা সেশেলিয়ান কোনো মহাকাশযান আমাদের অনুসরণ করছে না। তবুও উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছি। যেখানে কম্পিউটারের সেন্সব আমার চোখের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী। তা ছাড়া কম্পিউটার মহাকাশের অনেক সূক্ষ্ম বস্তু ধরতে পারছে, যা আমি কখনোই ধরতে পারব না। সব জেনেও আমি তাকিয়ে আছি।
গোলান, আমরা যদি বন্ধু হই–
কথা দিচ্ছি ব্লিসের কষ্ট হয়, এমন কিছু করব না।
অন্য ব্যাপার। তুমি কোথায় যাচ্ছ আমাকে জানাওনি, যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না। আমরা কোথায় যাচ্ছি? তুমি জানো পৃথিবী কোথায়?
দুঃখিত। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে কথাটা গোপন করেছি, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
কেন? কারণ হয়তো ব্লিস।
ব্লিস? তুমি ওকে জানাতে চাও না? পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় ওকে।
ঠিক সেরকম কিছু না। ব্লিসকে অবিশ্বাস করে কি হবে। ইচ্ছা হলেই আমার মাইণ্ড থেকে সে গোপন কথাটা জেনে নিতে পারবে। আসলে কারণটা বেশ শিশুসুলভ। মনে করেছিলাম তুমি ব্লিসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা ভুলেই গেছ।
পেলোরেট পুরোপুরি হতভম্ব। কিন্তু সেটা সত্যি না, গোলান।
জানি। এই আচরণের কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। তুমি যেমন আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভয় পেয়েছিলে, তেমনি ভয় পেয়েছিলাম আমিও। নিজের কাছে স্বীকার করতে পারিনি, কিন্তু মনে হয়েছিল ব্লিস যেন আমাকে কেটে তোমার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে। শিশুসুলভ আচরণ।
গোলান!
বললাম তো শিশুসুলভ আচরণ করেছি। যে-কোনো মানুষই করতে পারে। যাই হোক আমরা বন্ধু। তোমার কাছে আর লুকাবো না। আমরা কমপরেলন-এ যাচ্ছি।
কমপরেলন? পেলোরেট বুঝতে পারেনি।
আমার বেঈমান দোস্ত মান-লী-কমপর-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই।
মনে পড়তেই মুখ উজ্জ্বল হল পেলোরেটের। নিশ্চয় মনে আছে। তার পূর্বপুরুষরা এসেছিল কমপরেলন থেকে।
হয়তো। কমপরের সব কথা আমি বিশ্বাস করিনি। তবে কমপরেলন পরিচিত বিশ্ব, আর কমপর বলেছিল ওই গ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবীর কথা জানে। বেশ, আমরা সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করব। হয়তো লাভ হবে না, কিন্তু শুরু করার জন্য এই একটা তথ্যই আমাদের হাতে আছে।
তুমি নিশ্চিত?
নিশ্চিত হওয়া বা সন্দেহ করার কিছু নেই। আমরা নিরুপায়। এখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।
হ্যাঁ, কিন্তু কমপরের কথা মেনে নিলে তার সব কথাই মানতে হবে। মনে আছে, সে বলেছিল পৃথিবীর সারফেস রেডিওএ্যাকটিভ এবং প্রাণশূন্য। যদি তাই হয় কমপরেলনে গিয়ে আমাদের কোনো লাভ হবে না।
.
খেতে বসেছে তিন অভিযাত্রী।
চমৎকার, তৃপ্তির সাথে বলল পেলোরেট। এই খাবারগুলো কি টার্মিনাস থেকে এনেছিলাম?
না, বলল ট্র্যাভিজ। ওগুলো কবেই শেষ। এগুলো কিনেছিলাম সেশেল থেকে।
স্বাদটা কেমন যেন, তাই না? কোন ধরনের সিফুড।
ব্লিস নিশ্চুপ। খাবার নাড়াচাড়া করছে।
তোমাকে খেতে হবে, ডিয়ার। নরম সুরে বলল পেল।
জানি, পেল। খাচ্ছি।
অধৈর্য স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, স্টকে গায়ান খাবার আছে, ব্লিস।
জানি। জমা থাকুক। বলা তো যায় না কতদিন মহাকাশে থাকতে হয়। আর আমাকে আইসোলেট মানুষের খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে।
এতটাই খারাপ। নাকি গায়া শুধু গায়াকে খায়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্লিস। আসলে গায়াতে আমি যা খাই, যে অংশ আমার শরীরে মিশে যায় তার সবই গায়া। ব্যাপারটা ঠিক সচেতনতার উঠা নামা। অর্থাৎ যা খাই তার কিছু অংশের সচেতনতা বেড়ে যায়, আর যে অংশ বর্জ্য পদার্থ হিসেবে থাকে তার সচেতনতা নেমে যায়।
বেশ, এই যে সেশেল থেকে আনা নন-গায়ান খাবারগুলো তুমি খাচ্ছ, সেগুলোর কি হবে। এগুলোও কি গায়ার অংশ হবে?
হবে। খুব ধীরে ধীরে। যে অংশটুকু বর্জ্য হিসেবে বের করে দেব সেটা ধীরে ধীরে গায়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আসলে হাইপার স্পেসে থাকার কারণেই এই খাবারগুলো গায়ার অংশ হতে পারছে।
স্টোরে যে গায়ান খাবার আছে সে গুলোর কি হবে। ধীরে ধীরে গায়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না। যদি তাই হয়, তবে তোমার খেয়ে ফেলা উচিত।
চিন্তা করতে হবে না। ওগুলো এমনভাবে রাখা আছে যেন দীর্ঘ সময় পরেও গায়ার সাথে যুক্ত থাকে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করল পেলোরেট, আমরা যে গায়ান খাবার খেয়েছি সেগুলোর কী হবে? আমাদেরই বা কী হবে? আমরা ধীরে ধীরে গায়াতে পরিণত হব।
মাথা নাড়ল ব্লিস। চেহারায় অস্বস্তি। না তোমরা যা খেয়েছ সেগুলো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। শরীর থেকে যা বের করে দিয়েছ সেগুলো ধীরে ধীরে আবার গায়াতে পরিণত হবে, যেন ভারসাম্য ফিরে আসে। তবে তোমরা থাকার ফলে গায়ার অনেক অণু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কেন? ট্র্যাভিজের কৌতূহলী প্রশ্ন।
তোমরা এই পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে পারতে না। তোমরা ছিলে আমাদের অতিথি। কাজেই তোমাদের নিরাপত্তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়েছে।
সেজন্য দুঃখিত। এই নন-গায়ান খাবারগুলো তোমার ক্ষতি করবে না তো?
না। তোমরা যা খেতে পারবে আমিও খেতে পারব। হজম করতে সমস্যা হবে। সেজন্য আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তবে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সংক্রমণ হতে পারে। তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে বলল পেলোরেট। আগে মনে আসেনি কেন? প্রতি গ্রহেই জীবাণু থাকতে পারে, তুমি আক্রান্ত হবে সহজেই। আমাদের ফিরে যেতে হবে ট্র্যাভিজ।
ভয় পেয়ো না, পেল ডিয়ার। হাসিমুখে বলল ব্লিস। খাবার বা অন্য কোনোভাবে জীবাণুগুলো আমার শরীরে ঢুকে কোনো ক্ষতি করার আগেই দ্রুত গায়ায় পরিণত হবে।
খাওয়া শেষ হলো। মসলা মেশানো ফলের গরম রসে চুমুক দিয়ে পেলোরেট বলল, প্রসঙ্গ পাল্টানো যাক। মনে হয় আলোচনার বিষয় পাল্টানোর দায়িত্ব একা আমার কাঁধে চেপেছে। কেন?
ট্র্যাভিজ গম্ভীর গলায় বলল, কারণ আমি আর ব্লিস আলোচনার চেয়ে ঝগড়া করি বেশি। সেটা খারাপ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই তুমি আমাদের থামাবে। কোন। প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাও, পুরোনো বন্ধু।
কমপরেলন-এর সবগুলো রেফারেন্স ঘেটে দেখলাম। গ্রহটা যে সেক্টরে অবস্থিত সেখানে প্রচুর কিংবদন্তি, গল্প, উপকথা প্রচলিত রয়েছে। বহুদূর অতীতে সেখানে বসতিস্থাপন করা হয়, হাইপার স্পেসাল ট্রাভেলের প্রথম সহস্রাব্দে। কিংবদন্তি আছে বেনবেলী নামে কেউ একজন এই গ্রহে অধিবাস প্রতিষ্ঠাতা। কেউ জানে না সে কোত্থেকে এসেছিল। গ্রহের প্রাচীন নাম ছিল বেনবেলীর বিশ্ব।
এই কাহিনীতে সত্য ঘটনা কতটুকু আছে, জেনভ?
অনুমান করা কঠিন। ইতিহাসে বেনবেলী বলে কারো নাম কখনো পাইনি। তুমি পেয়েছ?
না, তবে জানোই তো ইম্পেরিয়াল যুগের শেষ পর্যায়ে প্রি-ইম্পেরিয়াল, যুগের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। শেষ শতাব্দীর সম্রাটদের মনে হয়েছিল স্থানীয় দেশারবোধ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে প্রতিটি সেক্টরের প্রতিটি গ্রহের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয় নতুন করে, ট্র্যানটরকে ঘিরে।
জানতাম না ইতিহাস এত সহজে মুছে ফেলা যায়। মন্তব্য করল ট্র্যাভিজ।
আসলে মোছা যায় না। তবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং শক্তিশালী সরকার ইতিহাসের ভিত্তি দুর্বল করে দিতে পারে। যদি যথেষ্ট দুর্বল করা যায় তা হলে প্রাথমিক ইতিহাস গড়ে উঠবে এলোমেলো তথ্যের উপর ভিত্তি করে, ফলে তৈরি হবে গল্প, উপন্যাস, রূপকথা, লোককাহিনী ইত্যাদি। প্রতিটা সেক্টর তাদের লোককাহিনীতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে তারাই সবচেয়ে প্রাচীন এবং শক্তিশালী, আর যতই অবিশ্বাস্য বা অযৌক্তিক হোক, সেগুলো বিশ্বাস করা দেশপ্রেমের অংশ। তোমাকে দেখাতে পারব যে গ্যালাক্সির প্রতিটি কোণের গল্পগাথায় বলা হয়েছে সেখানে সরাসরি পৃথিবীর মানুষ বসতি স্থাপন করেছে, যদিও সবাই পিতৃপুরুষের গ্রহকে এক নামে ডাকে না।
আর কী নামে ডাকে?
অনেক নামে ডাকে। যেমন দ্য ওনলি, দ্য ওল্ডেস্ট ইত্যাদি, কখনো বলে মুনড ওয়ার্ল্ড, কারো কারো মতে বিশাল উপগ্রহের কারণে এই নাম হয়েছে। আবার কেউ বলে এই শব্দের অর্থ হারানো বিশ্ব। মুনড শব্দটি মেরুনড শব্দের বিকৃত রূপ। এবং মেরুনড প্রি-গ্যালাকটিক শব্দ যার অর্থ নিখোঁজ বা পরিত্যক্ত।
জেনভ, থামো। নরম সুরে বলল ট্র্যাভিজ। সুযোগ পেলে এভাবে চালিয়ে যাবে। তুমি বলেছ এধরনের গল্প বা রূপকথা সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে।
হ্যাঁ, প্রচুর। মানুষকে একটা সুযোগ দাও, দেখবে কোনো ঘটনাকে রঙ চড়িয়ে কোথায় নিয়ে যায়। একবার–
জেনভ! থামো! কমপরেলনের গল্পের সাথে অন্য গল্পগুলোর কোনো পার্থক্য আছে?
ওহ্! পেলোরেট একমুহূর্ত ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পার্থক্য? বেশ, তারা বলছে যে পৃথিবী তাদের কাছাকাছি অবস্থিত। এই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। অন্যান্য বিশ্বগুলো পৃথিবীর অবস্থান সম্পর্কে রহস্য তৈরি করে রেখেছে, এমন অবস্থানের
বর্ণনা দিয়েছে যা বাস্তবে নেই।
হ্যাঁ। সেশেলিয়ানরা যেমন বলেছিল গায়া হাইপারস্পেসে চলে গেছে।
কথাটা শুনে ব্লিস মুচকি হাসল।
ট্র্যাভিজ কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, সত্যি। আমাদের কাছে এই কথা বলেছে ওরা।
আমি অবিশ্বাস করছি না। বেশ মজার কথা। আমরাই চেয়েছি ওরা যেন এটা বিশ্বাস করে। এই মুহূর্তে আমাদের একা থাকতে হবে, আর হাইপারস্পেস ছাড়া কোথায় নিরাপদে থাকব?
ঠিক একই উপায়ে, ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল, কোনো কিছু মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা সেটা অনেক অনেক দূরে অথবা সেটা একটা তেজস্ক্রিয় নরক।
শুধুমাত্র, পেলোরেটের মন্তব্য, এই গ্রহ তাদের কাছাকাছি রয়েছে।
কিন্তু রেডিওএ্যাকটিভ। সকল কাহিনীতেই পৃথিবীকে দুর্গম গ্রহ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ঠিকই বলেছো।
সেশেলিয়ানরা অনেকেই মনে করত গায়া অনেক কাছে; অনেকে এমনকি নক্ষত্র পর্যন্ত চিনিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সকলেই মনে করত সেখানে যাওয়া যাবে না। হয়তো কমপরেলিয়ানদের কেউ মনে করে পৃথিবী রেডিওএ্যাকটিভ এবং মৃত কিন্তু তার নক্ষত্র দেখিয়ে দিতে পারবে। তারপর যতই দুর্গম হোক, আমরা সেদিকে এগোব।
তুমি আসো, গায়া এটাই চেয়েছিল, ট্র্যাভিজ। ব্লিস বলল, আমাদের হাতে তুমি ছিলে অসহায়, কিন্তু তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। যদি পৃথিবী আরো শক্তিশালী এবং শত্রুভাবাপন্ন হয়, তখন কি হবে?
পরিস্থিতি যাই হোক আমাকে পৌঁছতে হবে। পৃথিবী খুঁজে পেলে সেদিকে রওনা দেওয়ার আগে নেমে যাওয়ার সময় পাবে তোমরা। চাইলে তোমাদেরকে আমি নিকটস্থ ফাউণ্ডেশন বিশ্ব বা ফিরে এসে গায়ায় নামিয়ে দেব। তারপর একাই যাবো।
প্রিয় বন্ধু, পেলোরেটের গলায় চরম বিতৃষ্ণা, আর কখনো এধরনের কথা বলবে না। তোমাকে একা ফেলে যাব না আমি।
আর আমি পেলকে ছেড়ে কোথাও যাব না। ব্লিস বলল।
অল্প সময়ের ভেতরে কমপরেলন-এর উদ্দেশে জাম্প করব। তারপর-প্রার্থনা করো যেন পরের জাম্প হয় পৃথিবীর দিকে।