৫. মেলপোমিনিয়া

পঞ্চম পর্ব – মেলপোমিনিয়া

১৩. সোলারিয়া থেকে দূরে

তারা পালাল ঝড়ের বেগে। অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করল ট্র্যাভিজ, এয়ারলক খুলে ঢুকে পড়ল ঝটপট। ফেলম যে তাদের সাথে এসেছে সেটা সারফেস থেকে যথেষ্ট উপরে উঠার আগে সে টেরই পেল না।

পালানোটা এত সহজ হতো না, যদি সোলারিয়ানরা আকাশে উড়ার ব্যাপারে এতো পিছিয়ে না থাকত। ল্যাণ্ড করতেই তাদের প্রচুর সময় লাগল অন্য দিকে ফার স্টারকে সরাসরি উপড়ে তুলতে কম্পিউটারের কোনো সময়ই লাগল না।

যদিও মাধ্যাকর্ষণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া এবং প্রাথমিক ধাক্কা সামলানো গেল, কিন্তু অত্যধিক দ্রুতগতিতে উড্ডয়নের ফলে বায়ুর সাথে ঘর্ষণ ঠেকানো গেল না। দ্রুত অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেল আউটার হালের টেম্পারেচার।

উপরে উঠার সময়ই তারা দেখল যে দ্বিতীয় সোলারিয়ান যান ল্যাণ্ড করেছে, আরও অনেকগুলো আসছে। কতগুলো রোবট সামলাতে পারত ব্লিস, অবাক হয়ে ভাবল ট্র্যাভিজ। তবে আর পনের মিনিট নিচে থাকলেই দফারফা শেষ হয়ে যেত।

মহাকাশে বেড়িয়ে (অথবা প্রায় মহাকাশ, কারণ তাদের চারপাশে পতলা কুণ্ডলী পাকানো গ্রহের বহিমণ্ডল।) ট্র্যাভিজ গ্রহের রাতের অংশের দিকে চলল। মাত্র এক লাফের দূরত্ব, কারণ তারা সারফেস ত্যাগ করেছে প্রায় সূর্যাস্তের সময়। অন্ধকারে ফার স্টার একটু ঠাণ্ডা হওয়ার সুযোগ পাবে এবং ধীর সর্পিল গতিতে এগোতে পারবে।

নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে এল পেলোরেট। স্বাভাবিকভাবে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। বাথরুমের ব্যবহার একবার দেখেই শিখে নিয়েছে।

স্বাভাবিক। নিজের ম্যানসনেও নিশ্চয়ই এধরনের সুযোগ সুবিধা ছিল। ট্র্যাভিজ বলল।

আমার চোখে পড়েনি। আমি এত দ্রুত মহাকাশযানে ঢুকিনি কখনো।

আমিও না। কিন্তু বাচ্চাটাকে সাথে আনলাম কেন?

ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ নাড়ল পেলোরেট। ব্লিস ছাড়তে চায়নি। ব্যাপারটা আসলে একটা জীবন হত্যা করার ক্ষতি পূরণ বাবদ আরেকটা জীবন রক্ষার চেষ্টা। ওর ভীষণ কষ্ট–

আমি জানি। বলল ট্র্যাভিজ।

পেলোরেট বলল, বাচ্চাটার শারীরিক কাঠামো অদ্ভুত।

হার্মাফ্রোডিটিক। অদ্ভুত তো হবেই।

টেটিকল আছে।

ওগুলো ছাড়া শরীর চলবে না।

আর ছোট একটা যোনীপথ রয়েছে।

মুখ বিকৃত করল ট্র্যাভিজ, জঘন্য।

ঠিক তা না, দ্বিমত প্রকাশ করল পেলোরেট। জিনিসটা তার প্রয়োজন। এটা তো শুধু নিষিক্ত ডিম্বাণু বা ছোট একটা জ্বণ তৈরি করে, যা পরে রোবটের পরিচর্যায় পরিস্ফুটিত হয়।

যদি তাদের রোবট-সিস্টেম ভেঙে পড়ে তখন কী হবে। তারা আর সন্তান উৎপাদন করতে পারবে না।

সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে পড়লে যে-কোনো গ্রহই ভয়ংকর সমস্যায় পড়বে।

সোলারিয়ানদের জন্য আমার অবশ্য দুঃখ হবে না।

বেশ, স্বীকার করছি গ্রহটা আকর্ষণীয় নয়। কারণ অধিবাসীরা আমাদের মতো না। কিন্তু অধিবাসী এবং রোবটদের বাদ দিলে এর অবস্থা হতো–

অরোরার মতো। ব্লিস কেমন আছে, জেনভ?

ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এখন ঘুমাচ্ছে। ওর সময়টা ভালো যাচ্ছে না, গোলান।

আমি নিজেও খুব একটা উপভোগ করিনি।

চোখ বন্ধ করল ট্র্যাভিজ। তারও ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু আগে নিশ্চিত হতে হবে যে সোলারিয়ানরা আকাশে উড়ার ব্যাপারে দক্ষ নয়। কম্পিউটারের রিপোর্ট অনুযায়ী অবশ্য মহাকাশে কোনো কৃত্রিম বস্তু নেই।

তিক্ততায় ভরে গেল মনটা। দুটো স্পেসার গ্রহ দেখা হয়ে গেল, কিন্তু কোনোটাতেই পৃথিবী সম্পর্কে সামান্য সূত্রও পাওয়া যায়নি। বরং বাড়তি হিসেবে পেয়েছে ফেলমকে।

চোখ খুলে সে দেখল পেলোরেট গম্ভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ জোর দিয়ে বলল, সোলারিয়ান শিশুকে রেখে আসা উচিত ছিল।

অসহায় শিশু। ওরা তাকে মেরে ফেলত।

তারপরেও সে ঐ সমাজেরই অংশ যে সমাজের নিয়ম অধিবাসীর সংখ্যা বেড়ে গেলে হত্যা করে সংখ্যা স্থিতিশীল রাখা হবে।

ওহ্, মাই ডিয়ার ফেলো, নিষ্ঠুর কাজ হতো সেটা।

যুক্তিযুক্ত কাজ হতো। কীভাবে ওর যত্ন নিতে হবে, জানি না। এখানে হয়তো আরো বেশি কষ্ট হবে, মারাও যেতে পারে। কী খায় ও?।

আমরা যা খাই, তাই খায়। সমস্যা হচ্ছে আমরা কী খাবো? কী পরিমাণ মজুদ আছে।

প্রচুর। একজন অতিরিক্ত যাত্রী থাকার পরেও প্রচুর।

পেলোরেট খুব একটা খুশি হলো বলে মনে হলো না, খাবারগুলো একঘেয়ে মনে হচ্ছে এখন। কমপরেলন থেকে নতুন কিছু নিয়ে আসা উচিত ছিল-যদিও ওদের রান্না ভালো না।

সম্ভব ছিল না। মনে আছে কত দ্রুত আমাদের চলে আসতে হয়েছে। অরোরা, সোলারিয়াতেও তাই ঘটেছে। কিন্তু একটু একঘেয়ে হলে ক্ষতি কি। খাবারের মজাটা হয়তো নষ্ট হয়, কিন্তু প্রাণটাতো বাঁচে।

প্রয়োজন হলেই নতুন খাবার সংগ্রহ করা যাবে?

যে কোনো সময় জেনভ। গ্র্যাভিটিক শিপ এবং হাইপার স্পেসাল ইঞ্জিন থাকলে গ্যালাক্সি মনে হবে অনেক ছোট। একদিনেই কোনো জনবহুল গ্রহে পৌঁছানো যাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে অর্ধেক গ্যালাক্সিই এখন আমাদের ব্যাপারে সতর্ক। তাই অন্তত কিছুদিন প্রচলিত পথ থেকে দূরে থাকতে চাই।

সেটাই ভালো হবে।–মহাকাশযানের ব্যাপারে ব্যাণ্ডারের মনে হয় কোনো কৌতূহল ছিল না।

এমনকি মনে হয় অবচেতনেও কোনো কৌতূহল ছিল না। আমার সন্দেহ সোলারিয়ানরা বহু আগেই স্পেস ফ্লাইট বাদ দিয়েছে। তাদের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে একা থাকা, মহাকাশ ভ্রমণের মাধ্যমে নিজেদের জাহির করলে এই একাকীত্ব আর থাকবে না।

পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, গোলান?

তৃতীয় গ্রহে যাবো।

মাথা নাড়ল পেলোরেট, প্রথম দুইটার অবস্থা দেখে মনে হয় না তৃতীয়টাতে কিছু পাওয়া যাবে।

এই মুহূর্তে আমারও ঠিক ভরসা হচ্ছে না, কিন্তু একটা ঘুম দিয়ে উঠার পর আমি কম্পিউটাকে তৃতীয় গ্রহে যাওয়ার কোর্স তৈরি করতে বলব।

.

যা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশিক্ষণ ঘুমালো ট্র্যাভিজ। কারণ মহাকাশযানের ভেতরে দিন বা রাত বলে কিছু নেই। শরীরের স্বাভাবিক চক্র নিখুঁত ভাবে চলছে না। ওরা যদি মনে করে রাত তা হলে রাত, দিন মনে করলে দিন। ফলে ট্র্যাভিজ, পেলোরেট (বিশেষ করে ব্লিসের) খাওয়া বা ঘুমের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।

গা মোছার সময় (পানি স্বল্পতার কারণে সাবানের ফেনা পানি দিয়ে না ধুয়ে মুছে ফেলা ভালো, অনেকটা শরীর থেকে চেঁছে তোলার মতো।) ট্র্যাভিজ ধারণা করল প্রায় দুঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। তারপর ঘুরতেই চোখ পড়ল ফেলমের উপর, একেবারে তার মতোই ন্যাংটো বাবা হয়ে আছে।

এই ব্যক্তিগত শৌচাগার আয়তনে ঘোট, ফলে লাফ দিয়ে পিছনে সরতে গিয়ে কোথাও বাড়ি খেল ট্র্যাভিজ, গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়।

ফেলমের চোখে সীমাহীন কৌতূহল, আর আঙুল দিয়ে ট্র্যাভিজের পুরুষাঙ্গ দেখাচ্ছে। কথা কোনোটাই পরিষ্কার নয়, তবে মনে হয় সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্য কোনো উপায় নেই ট্র্যাভিজের, তাই দুহাত দিয়ে নিজের গোপন অঙ্গ ঢাকল।

তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বলল ফেলম, অভিনন্দন।

অনভ্যস্ত গ্যালাকটিক শুনে অবাক হলো ট্র্যাভিজ, শব্দগুলো বোধহয় সে মুখস্থ করেছে।

বেশ কষ্ট করে একেকটা শব্দ উচ্চারণ করছে ফেলম, ব্লিস-বলেছে-তুমি আমাকে-পরিষ্কার-করে দেবে।

হ্যাঁ? ট্র্যাভিজ বলল। দুহাত রাখল ফেলমের কাঁধে। এখানে-অপেক্ষা-করো।

আঙুল দিয়ে মেঝে দেখালো, ফেলমও তাকাল সেদিকে। মনে হলো কথাটা বুঝতে পারে নি।

নড়বে না। আবার বলল সে, এবং দুহাতে কাঁধে চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দিল কীভাবে অনড় থাকতে হয়। দ্রুত গা মুছে ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে ডাকল, ব্লিস!

মহাকাশযানের ভেতরে পরস্পরের কাছ থেকে চার মিটারের বেশি দূরে থাকা অসম্ভব। ডাক শোনার সাথে সাথে তার কামরার দরজায় এসে দাঁড়ালো ব্লিস। হাসিমুখে বলল, আমাকে ডাকছ, ট্র্যাভিজ, নাকি ঘাসের ভেতর দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম।

ঠাট্টা করো না, ব্লিস। ওটা কী? বুড়ো আঙুল দিয়ে পিছন দিকে দেখালো সে।

কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিল ব্লিস, বেশ, মনে হচ্ছে যে সোলারিয়ান শিশুকে আমরা নিয়ে এসেছি, এটা সেই।

তুমি এনেছ। কেন বললে যে আমি ওকে পরিষ্কার করে দেব?

ভেবেছিলাম তুমি খুশি হবে। খুব বুদ্ধিমান ক্রিয়েচার। দ্রুত গ্যালাকটিক শব্দগুলো শিখছে। একবার কোনোকিছু বুঝিয়ে দিলে আর ভুলছে না। অবশ্য আমি ওকে সাহায্য করছি।

স্বাভাবিক।

আমি ওকে শান্ত রেখেছি। সোলারিয়ায় বিরক্তিকর ঘটনাগুলো ঘটার সময় আমি কিছুটা হতবুদ্ধি করে রেখেছিলাম ওকে। ব্যবস্থা করেছি মহাকাশে এসে যেন ঘুমায় এবং আমি চেষ্টা করেছি যে রোবটকে সে গভীরভাবে ভালবাসে-জেম্বি–সেদিক থেকে তার মাইণ্ড কিছুটা ঘুরিয়ে দিতে।

যেন আমাদের সাথে সে থাকতে পারে।

হ্যাঁ, তাই। বয়স কম বলেই যে কোনো পরিস্থিতিতে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং আমিও যতদূর সম্ভব ওর মাইণ্ড পরিচালনা করছি। আমি ওকে গ্যালাকটিকে কথা বলা শেখাবো।

তা হলে তুমিই ওটাকে পরিষ্কার করে দাও। বুঝতে পেরেছ?

কাঁধ নাড়ল ব্লিস, তুমি চাইলে অবশ্যই করব, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম সে যেন সবাইকে বন্ধু মনে করে। পিতৃ-মাতৃসুলভ আচরণ করলে সেটা সহজ হবে। তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারো।

মোটেই না। আর ওটাকে পরিষ্কার করে ফেলে দিয়ে এখানে আসবে। কথা আছে।

রেগে উঠল ব্লিস ফেলে দিয়ে আসব মানে?

এয়ারলক খুলে ফেলে দিতে বলিনি। বলেছি তোমার ঘরের এক কোণায় বসিয়ে রেখে এখানে আসবে।

আসব।

ব্লিসের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ। তারপর পাইলট রুমে ঢুকে ভিউস্ক্রিন চালু করল।

সোলারিয়াকে এখন মনে হচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন বৃত্তের মাঝে একটা বাঁকা আলোক উজ্জ্বল অর্ধবৃত্ত। ডেস্কের উপর কন্টাক্ট স্পর্শ করল সে, সাথে সাথে পানি হয়ে গেল ভিতরের জমে থাকা রাগ।

মহাকাশযানের চতুর্দিকে এবং গ্রহের আশপাশে কোনো কৃত্রিম বস্তু নেই। সোলারিয়ানরা (বা বলা ভালো তাদের রোবট) অনুসরণ করতে পারবে না। বা করবে না। বেশ ভালো। তা হলে রাতের অংশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়।

প্ল্যানেটরি প্লেন থেকে মহাকাশযান বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কম্পিউটার সেট করল সে, তা হলে গতি বাড়ানো যাবে। ফলে নিরাপদে জাম্প করার জন্য দ্রুত মহাকাশের এমন অংশে পৌঁছবে যেখানে মহাকাশের বক্রতা অনেক কম।

নক্ষত্রগুলোর সীমাহীন অপরিবর্তনীয়তা সবসময়ই তাকে সম্মোহিত করে। দূরত্বের কারণে সেগুলোর উদ্দামতা মুছে গিয়ে মনে হয় আলোর ছোট একটা বিন্দু।

এই বিন্দুগুলোর কোনো একটাই হবে সেই সূর্য যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে-মূল সূর্য, যার বিকিরণ এবং আঁচলের তলায় ঘটেছে জীবনের সূত্রপাত এবং মানবজাতির বিকাশ।

স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো যেহেতু গ্যালাকটিক ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তা হলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সূর্যের ব্যাপারেও তাই ঘটেছে।

নাকি প্রাগৈতিহাসিক কোনো চুক্তির কারণে শুধুমাত্র স্পেসার ওয়ার্ল্ডের সূর্যগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে? হতে পারে গ্যালাকটিক ম্যাপে পৃথিবীর সূর্য দেখানো হয়েছে, কিন্তু যে সকল নক্ষত্র সূর্যের মতো দেখায় তাদের কক্ষপথে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ নেই, সেরকম অসংখ্য নক্ষত্রের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

সূর্যের মতো দেখায় এমন নক্ষত্রের সংখ্যা গ্যালাক্সিতে প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন, এবং প্রতি হাজারে একটা নক্ষত্রের কক্ষপথে বাসযোগ্য গ্রহ আছে। বর্তমান অবস্থানের একশ পারসেক এর ভেতর কয়েক হাজার বাসযোগ্য গ্রহ পাওয়া যাবে। সেগুলো খোঁজার জন্য সে কি প্রতিটা নক্ষত্রে ঢু মারবে?

নাকি মূল সূর্য গ্যালাক্সির এই অংশে নেই। গ্যালাক্সির কতগুলো অংশ বিশ্বাস করে যে মূল সূর্য তাদের প্রতিবেশী? তারাই সবচেয়ে পুরোনো সেটলার

তার তথ্য দরকার অথচ এখন পর্যন্ত কিছুই পায়নি।

এখন সন্দেহ হচ্ছে যে অরোরার হাজার বছরের পুরোনো ধ্বংসপ্প ভালোভাবে পরীক্ষা করলে পৃথিবীর অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যেত। আরো জোরালো সন্দেহ হচ্ছে যে সোলারিয়ানরা জানত অনেক কিছুই।

তারপরেও ট্র্যানটরের বৃহত্তম লাইব্রেরি, গায়ার সুবিশাল পুঞ্জীভূত স্মৃতিভাণ্ডার থেকে পৃথিবীর সমস্ত তথ্য অদৃশ্য হয়ে গেছে, কাজেই স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোতে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।

এবং যদি সে পৃথিবী খুঁজে পায়–কোনো কিছু তাকে বাধ্য করবে সেটা ভুলে যেতে? পৃথিবীর আররক্ষা এতোই নিচ্ছিদ্র? নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করতে সে এত বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ?

আসলে সে কি খুঁজছে?

পৃথিবী? নাকি সেলডন প্ল্যানের ক্রটি যা সে ভেবেছিল (অজানা কোনো কারণে) পৃথিবীতে খুঁজে পাবে।

সেলডনের দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ারের ধারণা বাতিল করে দিয়ে সে নির্বাচন করেছে গ্যালাক্সিয়া।

গ্যালাক্সিয়া হবে বিশাল এক স্বয়ং সম্পূর্ণ অর্গানিজম আর গ্যালাকটিক এম্পায়ার হবে তার নিজের আয়তনের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র আকারের অসংখ্য অর্গানিজমের সমন্বয়। এটা এমন এক ধরনের ইউনিয়ন যা মানবজাতির জন্মলগ্ন থেকেই দেখা যায়। দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার হয়তো সবচেয়ে বৃহৎ এবং সবার সেরা কিন্তু সেটা পুরোনো গুলোরই নতুন রূপ। কিন্তু গ্যালাক্সিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, গ্যালাকটিক এম্পায়ার থেকেও উন্নত।

অর্থাৎ সেলডন প্ল্যান এর কোথাও ত্রুটি আছে, এমন ত্রুটি যা মহান হ্যাঁরী সেলডন নিজেও ধরতে পারেন নি। কিন্তু হ্যারি সেলডন যা ধরতে পারেন নি ট্র্যাভিজ কীভাবে সেটা ধরবে। সে তো গণিতজ্ঞ নয়; সেলডন প্ল্যান সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞ; কেউ বুঝিয়ে দিলেও কিছু বুঝবে না।

শুধু প্রধান অনুমিতি দুটো জানে, এবং সেখান থেকেই ধারণা হয়েছে তৃতীয় আরেকটা অনুমিতি রয়েছে যা অনেক বেশি স্বাভাবিক এবং প্রত্যক্ষ। এতো বেশি স্বাভাবিক এবং প্রত্যক্ষ যে এটার কথা কেউ কখনো বলেনি বা চিন্তাও করেনি। তারপরেও সেটা ভুল হতে পারে। এমন এক অনুমিতি যে যদি সেটা ভুল হয় তা হলে গ্যালাকটিক এম্পায়ারের বদলে গ্যালাক্সিয়াই হবে ভালো।

কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী অনুমিতির কথা যদি কেউ নাই বলে তবে সেটা ভুল হয় কিভাবে? অথবা এর আসল প্রকৃতি কীভাবে জানল সে?

এটা কি আসলেই ট্র্যাভিজ-গায়ার মতে যার নির্ভুল অন্তৰ্জন রয়েছে? সেকি জানে কী করতে হবে অথচ জানে না কেন করতে হবে?

এখন সে স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে।–কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোতে কি তার প্রশ্নের উত্তর রয়েছে? অথবা উত্তরের সূত্রপাত? অরোরা, সোলারিয়ার পরে পৃথিবীর অবস্থান ছাড়া সেলডন প্ল্যানের সাথে সম্পর্কিত আর কি থাকতে পারে।

পৃথিবীর সাথেই বা সেলডন প্ল্যানের কী সম্পর্ক? এগুলো কি সব পাগলামি? সে কি নিজের অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা শুনে শুনে অতিরিক্ত আরবিশ্বাসী হয়ে পড়েছে?

দমবন্ধ করা সীমাহীন লজ্জার পাহাড় চেপে বসল তার উপর। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্থির নির্লিপ্ত নক্ষত্রের দিকে। মনে মনে ভাবল: আমিই গ্যালাক্সির মধ্যে সবচেয়ে বড় বোকা।

.

ব্লিসের কথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ল। বেশ, ট্র্যাভিজ, ডেকেছিলে কেন?–কোনো সমস্যা? ব্লিস সত্যিই উৎকণ্ঠিত।

কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল ট্র্যাভিজ। সেটা কাটিয়ে উঠে বলল, না, না, কোনো সমস্যা নয়। আমি-আমি-চিন্তা করছিলাম।

একটা কথা ভেবে অস্বস্তি হলো। তার আবেগ পরিষ্কার বুঝতে পারবে ব্লিস। শুধু মৌখিক নিশ্চয়তা পেয়েছে যে ব্লিস কখনো তার মাইণ্ডে উঁকি দেবে না।

ট্র্যাভিজের কথা মেনে নিল ব্লিস। নিজে থেকেই বলল, পেলোরেট ফেলমকে গ্যালাকটিক শেখাচ্ছে। আমরা যা খাই ওটাও তাই খায়। তুমি কী বলতে চেয়েছিলে?

এখানে না, আমার ঘরে চল।

ঘরে ঢুকে চোখ সরু করে বলল ব্লিস, তোমাকে এখন অসংযত মনে হচ্ছে না।

মাইণ্ড পরীক্ষা করে বলছ?

মোটেই না। তোমার চেহারাতেই লেখা আছে।

আমি অসংযত নই। মাঝেমাঝে হয়তো রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। যাই হোক তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

ট্র্যাভিজের বিছানায় বসল ব্লিস। সুন্দর মুখ আর গভীর বাদামি চোখে গাম্ভীর্য। কাঁধ সমান লম্বা কালো চুল সুন্দর করে গোছানো। হাত দুটো অলসভাবে পড়ে আছে। কোলের উপর। হালকা প্রসাধনীর গন্ধ ভেসে আসছে।

হাসল ট্র্যাভিজ। খুব সুন্দর সেজেছো। তুমি হয়তো মনে করেছে যে একজন চমৎকার সুন্দরী তরুণীর সাথে আমি চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারব না।

চিৎকার চেঁচামেচি করলে যদি তোমার ভালো লাগে, যত খুশি কর, আমার আপত্তি নেই। শুধু ফেলমের সাথে করবে না।

আমি তো করতে চাই না। তোমার সাথেও না। আমরা বন্ধু হব বলে ঠিক করেছি, তাই না?

গায়া সবসময়ই তোমাকে বন্ধু মনে করে ট্র্যাভিজ।

গায়ার কথা বলছি না। জানি তুমিই গায়া। কিন্তু তোমার একটা সত্তা ইণ্ডিভিজুয়াল। আমি সেই ইণ্ডিভিজুয়াল সত্তার কথা বলছি। আমি একজন আলাদা মানুষের সাথে কথা বলতে চাই, যার নাম ব্লিস। আমরা বন্ধু হব বলে ঠিক করেছি, তাই না ব্লিস?

হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ।

তা হলে সোলারিয়ায় রোবটগুলোকে সামলাতে এত দেরি করলে কেন? আমাকে শারীরিকভাবে অপদস্ত করা হল, তুমি কিছুই করলে না। প্রতিটা মুহূর্ত রোবটের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তুমি কিছু করলে না।

আত্মরক্ষার সুরে নয় বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল ব্লিস, আমি কিছু করছিলাম না, এই ধারণাটা ভুল, ট্র্যাভিজ। আমি গার্ডিয়ান রোবটদের মাইণ্ড পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কীভাবে সেগুলোকে সামলানো যায়।

হ্যাঁ, তুমি সেই কথাই বলেছিলে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না যেখানে তোমার পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার শক্তি আছে সেখানে মাইন্ডগুলো সামলানোর দরকার কি?

তোমার ধারণা একটা বুদ্ধিমান সত্তা হত্যা এতই সহজ?

বিরক্তিতে ঠোঁট বাঁকা করল ট্র্যাভিজ। বুদ্ধিমান সত্তা, ব্লিস? ওগুলো সামান্য কয়েকটা রোবট।

সামান্য কয়েকটা রোবট? উম্মা প্রকাশ পেল ব্লিসের গলায়। সবসময়ই এভাবে বলা হয়। সামান্য! সোলারিয়ান ব্যাণ্ডার আমাদের হত্যা করার আগে কেন দ্বিধা করছিল। আমরা তো ট্রান্সডিউসার লোবস ছাড়া সামান্য কয়েকটা মানুষ। ফেলমকে তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসতে কেন এত দ্বিধা? সে তো সামান্য একটা সোলারিয়ান শিশু, অপরিপক্ব। এভাবে চিন্তা করলে তুমি সব ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু প্রত্যেককেই একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ফেলা সম্ভব।

অদ্ভুত কথা বলো না। রোবট শুধুই রোবট। সেটা অস্বীকার করা যাবে না। রোবট মানুষ নয়, আমাদের মতো বুদ্ধিমান ও নয়। রোবট একটা যন্ত্র যা বুদ্ধিমান সত্তার অনুকরণ করে।

তুমি কিছু জান না বলেই সহজে কথা গুলো বলতে পারলে। হ্যাঁ, আমি ব্লিস। আবার আমিই গায়া। আমি নিজেই একটা বিশ্ব যার কাছে প্রতিটা পরমাণুই মূল্যবান। ও অর্থবহ। আর একাধিক পরমাণুর প্রতিটা সংগঠন আরো বেশি মূল্যবান ও অর্থবহ। আমি/আমরা/গায়া কোনো সংগঠনকে না ভেঙে বরং সেটাকে আরো জটিল এবং কার্যকরী করে তুলি।

সবচেয়ে উঁচু মাত্রার সংগঠন বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে। যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা অথবা বায়োক্যামিকেল বুদ্ধিমত্তা সেটা কোনো ব্যাপার না। আসলে আমি/আমরা/গায়া কখনো গার্ডিয়ান রোবটদের মতো বুদ্ধিমত্তার মুখোমুখি হইনি। সেগুলোকে ধ্বংস করার কথা চিন্তাই করা যায় না। একান্ত বাধ্য না হলে।

শুকনো গলায় বলল ট্র্যাভিজ, সেগুলোর তুলনায় আরো বেশি উন্নত তিনটা বুদ্ধিমত্তা তখন বিপদে ছিল; তোমার নিজের। পেলোরেট, যাকে তুমি ভালবাসো, এবং যদি তোমার আপত্তি না থাকে আমার নিজের।

চার! ফেলমকে এখনও গোনায় ধরনি-আমার মনে হয়েছিল তাদের তাৎক্ষণিক কোনো বিপদ নেই। মনে করো তুমি একটা ছবি দেখলে, একটা মাস্টার পিস। সে ছবি থাকার অর্থ তোমার মৃত্যু। কী করবে তুমি, রং তুলি নিয়ে ছবির উপর থেকে নিচে তুলির আঁচড়ে ছবিটা পুরো ঢেকে ফেলবে। ধ্বংস করে ফেলবে, ফলে তুমি থাকবে নিরাপদ। কিন্তু একটু সতর্ক হয়ে খেয়াল করলেই দেখবে যে এখানে একটু রঙের আঁচড়, ওখানে একটু পরিবর্তন করে ছবির সম্পূর্ণ আবহটাই পাল্টে দিতে পারবে তুমি। তখন ছবিটা মাস্টার পিস হিসেবেই থাকবে এবং তুমিও বাঁচবে। সেজন্য দরকার প্রচুর সময় এবং যত্ন। সময় গেলে দেখবে নিজেদের জীবনের মতো ছবিটাও রক্ষা করতে চাইছ তুমি।

হয়তো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি ছবিটাকে ধ্বংস করলেই। তুলির স্পর্শে ছবির আকার আকৃতির সূক্ষ্মতা ঢেকে দিলে, এবং করলে যখন ছোট হারমাফ্রোডাইট বিপদে পড়ল তখন, আমাদের বিপদে কিছুই করলে না।

আমরা আউটওয়ার্ল্ডারদের তাৎক্ষণিক কোনো বিপদ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হলো ফেলমের ভয়ংকর বিপদ। গার্ডিয়ান রোবট এবং ফেলম দুটোর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে, নষ্ট করার মতো সময় ছিল না, আমি ফেলমকে বেছে নিলাম।

তাই ঘটে, ব্লিস? একটা মাইণ্ডের বিপরীতে আরেকটা মাইণ্ড তুলনা করার জন্য দ্রুত হিসাব, দ্রুত পর্যবেক্ষণের সাহায্যে নির্ধারণ করা কে বেশি জটিল এবং মূল্যবান।

হ্যাঁ।

আসলে চোখের সামনে একটা শিশুকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে তোমার মাতৃভাব জেগে উঠল। তুমি তাকে রক্ষা করলে। অথচ তিনটা প্রাপ্তবয়স্ক জীবন রক্ষা করার আগে তুমি শুধু হিসাব-নিকাশই করছিলে।

ব্লিসের চেহারা একটু লাল হলো, যা বলছ হয়তো তাই ঘটেছে। কিন্তু তুমি যেভাবে বলছ সেরকম ঠাট্টা করার বিষয় এটা না। আমার কাজের পেছনে অনেক যুক্তি ছিল।

কে জানে কি যুক্তি ছিল। হয়তো ভেবেছিলে এই শিশু তার সমাজের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। নিজেদের সংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য কে জানে এভাবে কতজন শিশুকে হত্যা করেছে সোলারিয়ানরা।

তারচেয়েও অনেক বেশি, ট্র্যাভিজ। এই শিশুকে হত্যা করা হতো কারণ উত্তরাধিকার হওয়ার জন্য তার বয়স কম, কারণ তার পিতামাতা অপরিণত বয়সে মারা গেছে, এবং কারণ আমি তার পিতামাতাকে হত্যা করেছি।

ঠিক সেই সময় যখন সে আমাদের হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল।

কোনো গুরুত্ব নেই। আমি পিতামাতাকে হত্যা করেছি। আর আমার কৃতকর্মের জন্য একটা শিশু মারা যাবে, সেটা হতে দিতে পারি না। তা ছাড়া গায়া এমন একটা মস্তিষ্ক পরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছে যা.সে আগে পায়নি।

একটা শিশুর, মস্তিষ্ক।

সবসময়ই তো শিশু থাকবে না। মস্তিষ্কের দুপাশে ট্র্যান্সডিউসার লোবসগুলো পরিপক্ব হবে। এই লোেবসগুলোর যে ক্ষমতা সমস্ত গায়ার তা নেই। ব্যাণ্ডার এমন একটা এস্টেটে পাওয়ার সাপ্লাই করত যা আয়তন ও জটিলতায় কমপরেলনের শহরগুলোর তুলনায় আরো বিশাল। এবং সে ঘুমিয়ে থাকলেও কাজটা করতে পারত।

অর্থাৎ ফেলম তোমাদের জন্য গবেষণার একটা উপাদান।

একদিক দিয়ে তাই।

আমার অন্য রকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা বিপদ ঘাড়ে করে। নিয়ে এসেছি। ভয়ংকর বিপদ।

কোনদিক দিয়ে বিপদ? আমি সাহায্য করলে ফেলম দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। তার বুদ্ধিমত্তা অতি উন্নত শ্ৰেণীর। এরই মধ্যে সে আমাদের পছন্দ করে ফেলেছে, এবং আমি/আমরা/গায়া তার মস্তিষ্ক থেকে মূল্যবান, জ্ঞান আহরণ করতে পারব।

যদি সন্তান উৎপাদন করে। সেজন্য সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। সে নিজেই নিজের সঙ্গী।

সন্তান উৎপাদনের বয়স হতে তার এখনও অনেকদিন বাকি। স্পেসাররা একশ বছরের উপরে বাঁচে আর সোলারিয়ানরা নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে চায় না। কাজেই আগামী বহুবছরের মধ্যে ফেলমের কোনো সন্তান হবে না।

তুমি কীভাবে জানো?

জানি না, শুধু যুক্তি অনুসরণ করছি।

আমি বলছি ফেলম ভয়ংকর প্রমাণিত হবেই।

তুমি সেটা জান না, কোনো যুক্তিও অনুসরণ করছ না।

আমি অনুভব করছি, ব্লিস, কোনো কারণ ছাড়াই। আর গায়াই বলেছে যে আমার অন্তৰ্জ্জন নির্ভুল।

ভুরু কোঁচকালো ব্লিস, হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করছে।

.

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে পেলোরেট। বোঝার চেষ্টা করছে ট্র্যাভিজ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত কি না।

ট্র্যাভিজের হাত টেবিলের উপর, দৃষ্টি ভিউস্ক্রিনের উপর। কাজেই পেলোরেট ধরে নিল সে কাজ করছে, তাই দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল। বন্ধুকে বিরক্ত করার কোনো চেষ্টা করল না।

স্বভাবতই চোখ তুলে পেলোরেটের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। ঠিক সচেতন দৃষ্টি না। যখন সে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত থাকে তখন তার দৃষ্টি হয়ে উঠে উজ্জ্বল, মনে হয় যেন কোথাও তাকিয়ে নেই।

কিন্তু গেলোরেটের দিকে তাকিয়ে হালকা করে মাথা নাড়ল। তারপর কিছুক্ষণ পর হাতগুলো তুলে হাসল, ফিরে এল আবার আপন সত্তায়।

ক্ষমা প্রার্থনার সুরে পেলোরেট বলল, তোমার কাজে বাধা দিলাম।

কোনো ব্যাপার না, জেনভ। পরীক্ষা করে দেখছিলাম এখন জাম্প করা যাবে কিনা। যাবে, তারপরেও দুইঘণ্টা পরে করব। সৌভাগ্যের আশায়।

সৌভাগ্য বা দৈব ঘটনার কোনো ভূমিকা এখানে আছে?

কথার কথা, হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু দৈব-ঘটনার কিছু ভূমিকা আছে। তুমি কি বলতে এসেছিলে?

বসতে পারি?

নিশ্চয়ই, তবে এখানে না, আমার ঘরে চলো। ব্লিস কেমন আছে?

ভালো, এখন ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমানো প্রয়োজন, বুঝতেই পারছ।

পুরোপুরি। হাইপার স্পেসাল বিচ্ছিন্নতা।

ঠিক তাই, ওল্ড চ্যাপ।

আর ফেলম? পেলোরেটকে চেয়ারে বসতে দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হল ট্র্যাভিজ।

আমার লাইব্রেরি থেকে রূপকথার কিছু গল্পের প্রিন্ট তৈরি করেছিলে, মনে আছে? সেগুলো পড়ছে। যদিও গ্যালাকটিক খুব একটা বোঝে না, তবে মনে হয়। শব্দগুলো উচ্চারণ করতে খুব মজা পায়। সে (পুং লিঙ্গ)–আমি তার ব্যাপারে সবসময় পুংলিঙ্গ ব্যবহার করছি, কেন বলতে পারো।

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। সম্ভবত তুমি একজন পুরুষ বলেই।

হয়তো। তুমি জানো ফেলম প্রচণ্ড বুদ্ধিমান।

কোনো সন্দেহ নেই।

আমতা আমতা করছে পেলোরেট। আমি লক্ষ করেছি ফেলমকে তুমি পছন্দ করো না।

কিছু মনে করো না, জেনভ। আমার সন্তান নেই, বাচ্চাকাচ্চা খুব একটা পছন্দ করি না। যদুর মনে পড়ে তোমার সন্তান ছিল।

এক ছেলে।–সন্তানের মুখ দেখে সব ভুলে যেতাম। মনে আছে যখন ছোট এতটুকুন ছিল আমি কোলে নিতাম মাঝে মাঝে। হয়তো সেকারণেই ফেলমকে আমি ছেলে হিসেবে ধরে নিয়েছি। সিকি শতাব্দী পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

তোমার পছন্দ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, জেনভ।

তোমারও পছন্দ হবে, যদি একটু চেষ্টা করো।

নিশ্চয়ই হবে জেনভ, এবং হয়তো একদিন চেষ্টা করব।

আবার ইতস্তত করল পেলোরেট। আমার মনে হয় ব্লিসের সাথে তর্ক করে করে তুমি ক্লান্ত।

আসলে, আমার মনে হয় না খুব বেশি তর্ক হয়, জেনভ। গতদিন আমরা দুজন অনেকক্ষণ কথা বলেছি–গার্ডিয়ান রোবটগুলোকে ইনঅ্যাকটিভেট করার বিষয়ে কোনো ঝগড়া হয়নি, রাগারাগি.হয়নি। বারবার সে আমাদের জীবন রক্ষা করছে। কাজেই আমি বন্ধু না হয়ে কি পারি?

হ্যাঁ, আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু তর্ক বলতে ঝগড়া বোঝাচ্ছি না। বলছি গ্যালাক্সিয়া এবং ইণ্ডিভিজুয়ালিটি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সেটা।

ও সেটা! আমার মনে হয় এই বিতর্ক চলবেই–ভদ্রভাবে।

যদি আমি তার পক্ষ থেকে কথা বলি, তুমি কিছু মনে করবে, গোলান?

মোটেই না। তুমি কি গ্যালাক্সিয়ার ধারণা মেনে নিয়েছ, নাকি ব্লিসকে খুশি করতে চাও?

আমি নিজে মেনে নিয়েছি। আমার বিশ্বাস গ্যালাক্সিয়াই হওয়া উচিত আগামী ভবিষ্যৎ। তুমি এই পথ নির্বাচন করেছ। দিনে দিনে আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হচ্ছে। যে তোমার নির্বাচন সঠিক।

কারণ আমি এটা বেছে নিয়েছি। কোনো যুক্তি হলো না। গায়া যাই বলুক আমার ভুল হতে পারে। কাজেই ব্লিসের কথা শুনে প্রভাবিত হবে না।

আমার মনে হয় না তুমি ভুল করেছ। ব্লিস নয়, সোলারিয়া সেটা প্রমাণ করেছে।

কীভাবে?

বেশ, প্রথম কথা তুমি আর আমি আইসোলেট।

ব্লিসের মন্তব্য, জেনভ। আমি বলব ইণ্ডিভিজুয়াল।

অর্থ প্রায় একই। তুমি যে শব্দই ব্যবহার করো, আমরা আসলে নিজেদের ভেতর আবদ্ধ, নিজস্ব চিন্তাভাবনার গণ্ডিতে আবদ্ধ। আমাদের চরিত্রের মূলনীতি আররক্ষা, সেজন্য অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব বিপন্ন হলেও কুছ পরোয়া নেই।

অন্যের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে এমন মানুষের কথাও শোনা যায়।

খুব কম। বেশিরভাগই জীবন উৎসর্গ করেছে নিজেদের কোনো খেয়ালের বশে।

এর সাথে সোলারিয়ার কী সম্পর্ক?

সোলারিয়াতে আইসোলেট-বা ইণ্ডিভিজুয়ালের চূড়ান্ত পরিণতি দেখলাম। অল্প কয়েকজন সোলারিয়ান পুরো একটা গ্রহ নিজেদের ভেতর ভাগ করে নিয়েছে। সম্পূর্ণ একা জীবনযাপন করাকেই তারা মনে করে সত্যিকার স্বাধীনতা। এমনকি নিজেদের বংশধরদের প্রতিও কোনো মমতা নেই, বরং সংখ্যায় বেড়ে গেলে মেরে ফেলে। রোবট দাসগুলোকে তারা নিজেরা পাওয়ার সাপ্লাই করে। ফলে কোনো সোলারিয়ান মারা গেলে তার এস্টেটেরও একরকম মৃত্যু হয়। এটা কি মেনে নেয়া যায়, গোলান? গায়ার সূক্ষ্মতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতার সাথে এর কোনো তুলনা চলে?–ব্লিস কখনো এগুলো আমাকে বলেনি। এটা আমার নিজস্ব অনুভূতি।

এমন অনুভূতি হওয়াই স্বাভাবিক। আমিও একমত। আসলেই সোলারিয়ান সমাজ ভয়ংকর, কিন্তু সবসময়ই তো এমন ছিল না। তারা সরাসরি পৃথিবীর মানুষের বংশধর এবং অন্য স্পেসার যারা মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করত তাদের। চেয়ে ভিন্ন। সোলারিয়ানরা একটা চরম পথ বেছে নিয়েছে, কিন্তু এভাবে বিচার করলে চলবে না। রোবটের উপর নির্ভরশীল না হলে কি সোলারিয়ায় এমন সমাজ তৈরি হত? কোনো ইণ্ডিভিজুয়াল সমাজ রোবটের সাহায্য ছাড়া এমন ভয়ংকর হতে পারবে।

মুখ বাঁকা করল পেলোরেট। তুমি সবসময়ই ছিদ্র খুঁজে বেড়াও গোলান-অথবা যে গ্যালাক্সির বিপক্ষে তুমি ভোট দিয়েছ সেটাকে রক্ষা করতে চাও।

গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে যুক্তি আছে, কী যুক্তি, খুঁজে পেলেই জানব। অথবা সঠিক করে বলতে গেলে যদি খুঁজে পাই।

তোমার সন্দেহ আছে?

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। কী করে বলি।–তুমি জানো জাম্প করার আগে কেন আমি কয়েকঘণ্টা অপেক্ষা করছি, কেন দুই-তিন দিন অপেক্ষা করছি না?

তুমি বলেছিলে নিরাপত্তার জন্য।

হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে নিরাপদে জাম্প করা যায়। আসল ভয়টা হচ্ছে যে তিনটা স্পেসার ওয়ার্ল্ডের কো-অর্ডিনেটস্ পেয়েছি তার মধ্যে দুটো দেখা হয়ে গেছে। সেগুলো থেকে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি অল্পের জন্য। অথচ পৃথিবীর অবস্থান বা অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারিনি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল পেলোরেট। সুপ্রাচীন কিছু গল্প আছে। সেগুলোর মূল কাহিনী হচ্ছে এমন–কোনো ব্যক্তিকে তিনটে ইচ্ছে প্রকাশ করতে বলা হলো। তিন সংখ্যাটা সম্ভবত খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা বিজোড় সংখ্যা এবং সবচেয়ে ছোট গুণনীয়ক। তিনটে ইচ্ছের দুটো পূরণ হতো। আসল কথা হচ্ছে ইচ্ছেগুলো কোনো কাজে লাগত না। কেউ কখনো সঠিক ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারেনি। আমার ধারণা এটা প্রাচীন মতবাদ যার অর্থ কোনো কিছু কষ্ট করে অর্জন করলেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায় এবং–

লজ্জা পেয়ে থেমে গেল দুঃখিত, ওল্ড ম্যান। তোমাকে বিরক্ত করছি। আসলে এসব বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে আমি থামতে পারিনা।

তোমার কথা শুনতে সবসময়ই আমার ভালো লাগে, জেনভ। আসলে আমাদেরও তিনটে ইচ্ছে প্রকাশ করতে হবে। তারমধ্যে দুটো করে ফেলেছি, কোনো লাভ হয়নি। বাকি আছে মাত্র একটা। জানি এখানেও ব্যর্থ হব, তাই চাইছি এটা বাদ দিতে। সেকারণেই জাম্প করতে দেরি করছি।

পুনরায় ব্যর্থ হলে কী করবে? গায়া বা টার্মিনাসে ফিরে যাবে?

না, মাথা নেড়ে নিচু স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, অনুসন্ধান চলবেই–শুধু যদি জানতাম কীভাবে চলবে।

.

১৪. মৃত গ্রহ

হতাশ বোধ করছে ট্র্যাভিজ। অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে সুস্পষ্ট কোনো বিজয় অর্জিত হয়নি। যা হয়েছে তা শুধু পরাজয়কে একটু দেরি করিয়ে দিচ্ছে।

তৃতীয় স্পেসার গ্রহে জাম্প করতে দেরি করছে ট্র্যাভিজ। ফলে অস্বস্তি বোধ করছে অন্যরা। শেষ পর্যন্ত যখন কম্পিউটারকে হাইপার স্পেসে ঢোকার নির্দেশ দিতে যাবে সেই সময় পেলোরেট দরজায় এসে দাঁড়ালো, পেছনে ব্লিস, আর ফেলম শক্ত করে ব্লিস এর হাত ধরে রেখেছে।

চোখ তুলল ট্র্যাভিজ, উৎফুল্ল স্বরে বলল, কী চমৎকার পরিবার। তবে তার কৌতুক করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হলো না।

কম্পিউটারকে সে এমনভাবে নির্দেশ দিল যেন উদ্দিষ্ট নক্ষত্রের অবস্থান থেকে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট দূরে হাইপার স্পেস থেকে বেরিয়ে আসে। নিজেকে বোঝালো যে আগের দুটো গ্রহের ঘটনার কারণে সতর্কতার প্রয়োজন, কিন্তু বিশ্বাস করল না। আসলে সে যদি অনেক দূরে বেরিয়ে আসে তা হলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না ঐ নক্ষত্রের কোনো বাসযোগ্য গ্রহ আছে কি নেই। ফলে তিক্ত পরাজয় মেনে নেওয়ার আগে আরো কয়েকটা দিন সময় পাবে।

পিছনে সুখী পরিবার তাকিয়ে আছে তার দিকে, বড় করে শ্বাস নিয়ে ভেতরে আটকে রাখল কিছুক্ষণ, তারপর ঠোঁট গোল করে বাতাস ছাড়ল শিস দেওয়ার ভঙ্গিতে, একই সাথে চূড়ান্ত নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে।

নক্ষত্রের বিন্যাস বদলে গেল নিঃশব্দে। ভিউস্ক্রিন ফাঁকা, কারণ এই অঞ্চলের নক্ষত্রগুলো কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং দূরে দূরে অবস্থিত। কিন্তু প্রায় মাঝখানে অতি উজ্জ্বল একটা নক্ষত্র জ্বল জ্বল করছে।

দাঁত বের করে হাসল ট্র্যাভিজ, কারণ এটাও এক ধরনের বিজয়। তৃতীয় সেট কো-অর্ডিনেটসগুলো ভুলও তো হতে পারে। হয়তো কোনো জি-টাইপ গ্রহ নেই। বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, এটাই। নক্ষত্র নাম্বার তিন।

তুমি নিশ্চিত? হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল ব্লিস।

লক্ষ করো! এই অঞ্চলের যে ম্যাপ আছে সেটা চালু করছি। যদি এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটা অদৃশ্য হয়ে যায়, তা হলে গ্যালাকটিক ম্যাপে এটা রেকর্ড করা হয়নি, এবং এটাই আমরা খুঁজছি।

তার নির্দেশের সাথে সাড়া দিল কম্পিউটার, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল নক্ষত্রটা। যেন কখনো ছিলই না, কিন্তু বাকি নক্ষত্রগুলো আগের মতোই রয়েছে।

পেয়ে গেছি। ট্র্যাভিজ বলল।

তারপর ফার স্টারের গতি স্বাভাবিক গতির অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে আনল সে। বাসযোগ্য গ্রহের থাকা না থাকার ব্যাপারটা হিসাবে ধরতে হবে এখনো, এবং সেটা জানার জন্য খুব একটা তাড়াহুড়ো নেই। এমনকি তিনদিন এগোনোর পরেও বলার মতো কিছু পাওয়া গেল না।

আবার একেবারেই পাওয়া যায়নি সেটাও বলা যাবে না। কারণ একটা বিশাল গ্যাস জায়ান্ট অনেক দূর থেকে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে। এত দূরে যে গ্রহের দিনের অংশকে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে হালকা হলুদ রঙের পাতলা অর্ধচন্দ্রের মতো মনে হলো।

ভালো লাগল না ট্র্যাভিজের, কিন্তু প্রকাশ করল না সেটা। বরং গাইডের মতো নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ওটা একটা গ্যাস জায়ান্ট। বেশ চমৎকার, এখান থেকে দেখা যাচ্ছে পাতলা একজোড়া বলয় এবং দুটো বিশাল উপগ্রহ আছে।

অধিকাংশ সিস্টেমেই একটা গ্যাস জায়ান্ট থাকে, তাই না? প্রশ্ন করল ব্লিস।

হ্যাঁ, কিন্তু এটা অনেক বড়। উপগ্রহগুলোর দূরত্ব এবং প্রদক্ষিণের সময় থেকে বলা যায় যে এই গ্যাস জায়ান্ট যে-কোনো বাসযোগ্য গ্রহের তুলনায় দুই হাজার গুণ। বড়।

তাতে কী হয়েছে? আয়তন কোনো ব্যাপার না। গ্যাস জায়ান্টগুলো অনেক বড় হয়, নক্ষত্র থেকে অনেক দূরে থাকে এবং বসবাসের অনুপযুক্ত। বাসযোগ্য গ্রহ পেতে হলে নক্ষত্রের আরো কাছে যেতে হবে।

একটু আমতা আমতা করে আসল ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার সিদ্ধান্ত নিল ট্র্যাভিজ। আসলে গ্যাস জায়ান্টগুলো সৌরজগতের ঝাড়দারের কাজ করে। যে বস্তুগুলো তারা নিজেদের কাঠামোতে শোষণ করে নিতে পারে না সেগুলো একত্রিত হয়েই উপগ্রহ তৈরি হয়। নিজেদের অবস্থান থেকে অসীম দূরত্বেও অন্য কোনো কাঠামো তৈরি হতে এগুলো বাধা দেয়, কাজেই গ্যাস জায়ান্ট যত বড় হবে নির্দিষ্ট নক্ষত্রের একমাত্র গ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা ততোই বেড়ে যায়। আর হয়তো কিছু অ্যাস্টেরয়েড থাকতে পারে।

তুমি বলছ এখানে বাসযোগ্য কোনো গ্রহ নেই?

গ্যাস জায়ান্ট যত বড় হবে, বাসযোগ্য গ্রহের সম্ভাবনা ততই কমবে, আর এটা এত বিশাল মনে হয় যেন বামন নক্ষত্র।

সবাইকে দেখানোর জন্য দৃশ্য বড় করল ট্র্যাভিজ। পুরো স্ক্রিন জুড়ে এখন উজ্জ্বল অর্ধচন্দ্র। সেই অর্ধচন্দ্রের কেন্দ্র থেকে সামান্য দূরে একটা কালো রেখা ছেদ করেছে, গ্রহের বলয়গুলোর ছায়া, প্ল্যানেটরি সারফেসের পিছনে বলয়গুলোকে দেখা যাচ্ছে ঝলমলে বক্ররেখার মতো, কিছুদূর এগিয়ে গ্রহের অন্ধকার অংশে মিশে গেছে।

ট্র্যাভিজ বলল, অক্ষের উপর ৩৫ ডিগ্রি হেলে আছে, এবং বলয়গুলো রয়েছে গ্রহের বিষুব অঞ্চলে, ফলে কক্ষপথের এই অবস্থানে নিচের দিক থেকে নক্ষত্রের আলো এসে বিষুব অঞ্চলের উপরে বলয়ের ছায়া তৈরি করেছে।

মগ্ন হয়ে দেখছে পেলোরেট। বলয়গুলো অনেক পাতলা।

আসলে অস্বাভাবিক রকম বড়। ট্র্যাভিজ বলল।

কিংবদন্তি অনুযায়ী পৃথিবীর প্ল্যানেটরি সিস্টেমের গ্যাসজায়ান্টকে ঘিরে যে বলয় আছে সেটা আরো প্রশস্ত, উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট।

আমি অবাক হইনি। কোনো গল্প যদি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের হাত বদল হতে থাকে তা হলে তার ভেতর কতটুকু সত্য থাকবে বলে মনে করো তুমি?

চমৎকার। ব্লিস বলল, মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে ঘুরছে, মোচড়াচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলীয় ঝড়। আলোর সঠিক ওয়েভ-লেংথ বাছাই করতে পারলে আরো পরিষ্কার দেখতে পারবে। দাঁড়াও, চেষ্টা করি। ডেস্কের উপর হাত রেখে ট্র্যাভিজ কম্পিউটারকে সঠিক ওয়েভ লেংথ ধরতে বলল।

ঝাপসা আলোকিত অর্ধবৃত্তের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এত দ্রুত রং পরিবর্তন হতে লাগল যে ধাঁধা লেগে গেল চোখে। শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার নির্বাচন করল লালচে কমলা রং, অর্ধবৃত্তের ভেতর পরিষ্কার কিছু ঘূর্ণিপাক ভেসে চলেছে, ঘুরছে, পঁাচাচ্ছে, আবার পঁাচ খুলছে।

অবিশ্বাস্য, ফিসফিস করে বলল পেলোরেট।

ব্লিস বলল, চমৎকার।

সবই বিশ্বাস্য, আর মোটেই চমৎকার না। তিক্ত মনে ভাবল ট্র্যাভিজ। সে যে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছে এই গ্রহ তার প্রচেষ্টাকে কতখানি দুর্বল করে দিচ্ছে সেটা নিয়ে ব্লিস বা পেলোরেটের কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকবেই বা কেন? ট্র্যাভিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ নেই তাদের। নিশ্চিত মনেই তারা এই অভিযানের সঙ্গী হয়েছে। দোষ দিয়ে লাভ নেই।

রাতের অংশকে মনে হচ্ছে বেশি অন্ধকার, সে বলল, কিন্তু আমাদের দৃষ্টি আরেকটু তীক্ষ্ণ হলেই বুঝতে যে এটা আসলে গাঢ় উগ্র লাল। গ্রহটা মহাকাশে বিপুল পরিমাণ অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ করছে কারণ এটা প্রায় একটা সাব-স্টার।

অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বলল, এবার এটাকে বাদ দিয়ে বাসযোগ্য কোনো গ্রহ আছে কিনা দেখা দরকার।

হয়তো আছে, হাসিমুখে বলল পেলোরেট। হাল ছেড়ো না, বন্ধু।

আমি হাল ছাড়িনি। ট্র্যাভিজ বলল, যদিও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। একটা গ্রহ সৃষ্টি হওয়া এত বেশি জটিল যে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই। আমরা শুধু সম্ভাবনার কথা বলছি। ঐ দৈত্যটা থাকার কারণে সম্ভাবনা কমছে, তবে শূন্য হচ্ছে না।

অন্যভাবে চিন্তা করে দেখো। ব্লিস বলল । প্রথম দুই সেট কো-অর্ডিনেটস দিয়ে তুমি স্পেসারদের দুটো গ্রহ বের করেছ। তৃতীয় সেট কো-অর্ডিনেটস দিয়ে এরই মধ্যে উপযুক্ত নক্ষত্র পেয়েছ, সুতরাং বাসযোগ্য একটা গ্রহ থাকতে বাধ্য। সম্ভাবনার কথা বলছ কেন?

আমি আশা করি তোমার কথাই ঠিক। বলল ট্র্যাভিজ। এবার নক্ষত্রের আরো কাছে এগোব।

ইচ্ছে প্রকাশ করার সাথে সাথেই পুরো ব্যাপারটা সামলে নিল কম্পিউটার। পাইলট-চেয়ারে হেলান দিয়ে ট্রাভিজের আরো একবার মনে হলো গ্র্যাভিটিক শিপ চালানোর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো সে আর কখনো স্বাভাবিক মহাকাশ যান চালাতে পারবে না ।

সে আর কখনো জটিল হিসাব-নিকাশ বা সূক্ষ্মভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কাজেই এই মহাকাশযান বা এটার মতো অন্য কোনো যান চালাতে হবে।

যেহেতু বাসযোগ্য গ্রহ আছে কি নেই, সেই প্রশ্ন থেকে নিজের মনটাকে সরিয়ে আনা দরকার তাই ভাবতে লাগল কেন সে প্ল্যানেটরি প্লেন এর নিচের দিকে না গিয়ে উপর দিয়ে যাচ্ছে।

আসলে সে সব সময়ই খেয়াল রাখে কোনো গ্রহ কীভাবে নিজ অক্ষে আবর্তন করছে এবং নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করছে। যদি সেটা হয় ঘড়ির কাটার উল্টোদিকে তা হলে হাত সোজা উপরে তুললে সেটা হবে উত্তর এবং নিচে পায়ের দিকটা হবে দক্ষিণ দিক। এবং পুরো গ্যালাক্সিতে উপর দিকে ধরা হয় উত্তর এবং নিচের দিকে ধরা হয়। দক্ষিণ দিক। এটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিয়ম কিন্তু এখনও মেনে চলা হয় । ট্র্যাভিজের মনে পড়ল তিন শতাব্দী আগে ইম্পেরিয়াল জেনারেল বেল রিয়োজ একবার তার স্কোয়াড্রন নিয়ে প্ল্যানেটরি প্লেন এর নিচ দিয়ে এগিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করেছিলেন। অভিযোগ করা হয়েছিল যে তিনি অন্যায্য কাজ করেছেন-অভিযোগটা তুলেছিল পরাজিত পক্ষ, অবশ্যই।

শক্তিশালী এবং সুপ্রাচীন এই নিয়ম নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছিল পৃথিবীতে এবং ঝটকায় বাসযোগ্য গ্রহের চিন্তা ফিরে এল ট্র্যাভিজের মনে।

পেলোরেট আর ব্লিস এখনো গ্যাস-জায়ান্টের দৃশ্য দেখছে। গ্রহটা ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে স্ক্রিন থেকে। সমতলের কমলা-লাল আলোর ঝড় মনে হচ্ছে আরো বেশি উদ্দাম এবং সম্মোহনী।

এমন সময় ফেলম এসে ঢুকল। তার কাপড় পাল্টে দেওয়ার জন্য ব্লিস বেরিয়ে গেল তাকে নিয়ে। পেলোরেট থাকল।

ট্র্যাভিজ বলল, গ্যাস-জায়ান্ট বাদ দিয়ে কম্পিউটারকে এখন সঠিক আকারের গ্র্যাভিটেশনাল ব্লিপ খোঁজার কাজে লাগাতে হবে।

নিশ্চয়ই, ওল্ড ফেলো, বলল পেলোরেট।

কিন্তু কাজটা আসলে আরো জটিল। শুধু সঠিক আকারের ব্লিপ পেলেই হবে না সেটা হতে হবে যথেষ্ট দূরে। এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য হয়তো কয়েকদিন লাগবে। প্রশান্ত কিন্তু গম্ভীর মুখে নিজের কামরায় ঢুকল ট্র্যাভিজ। ব্লিস অপেক্ষা করছিল তার জন্য, পাশেই ফেলম।

কম্পিউটারের সামনে তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি, ব্লিস বলল । কিন্তু এখন শোন।–বল ফেলম।

তীক্ষ সুরেলা কন্ঠে ফেলম বলল, আপনাকে অভিনন্দন, প্রটেক্টর ট্র্যাভিজ। মহাকাশে আপনার সঙ্গী হয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বন্ধু ব্লিস এবং পেল এর মহানুভবতার জন্যও আমি আনন্দিত।

শেষ করে চমৎকারভাবে হাসল ফেলম, আর ট্র্যাভিজ আরো একবার অবাক হয়ে ভাবল এটাকে সে কীভাবে দেখবে। ছেলে, মেয়ে নাকি দুটোই?

মাথা নাড়ল সে। চমৎকার মুখস্থ করেছে। উচ্চারণ প্রায় নিখুঁত।

মুখস্থ করেনি, রাগত সুরে বলল ব্লিস। বাক্যগুলো ফেলম নিজে তৈরি করেছে। শোনার আগে আমিও জানতাম না সে কি বলবে।

জোর করে হাসল ট্র্যাভিজ, সেক্ষেত্রে বলতেই হয় বেশ ভালো। লক্ষ করেছে ব্লিস স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ প্রকাশক কোনো সর্বনাম ব্যবহার করছে না।

ফেলমের দিকে ঘুরে ব্লিস বলল, আমি বলেছিলাম ট্র্যাভিজের পছন্দ হবে-এখন পেল এর কাছে যাও, নতুন কোনো বই পড়।

দৌড়ে চলে গেল ফেলম। ব্লিস বলল, এত দ্রুত গ্যালাকটিক শিখছে, সত্যি অবাক করার মতো। ভাষার প্রতি সোলারিয়ানদের নিশ্চয়ই বিশেষ আগ্রহ আছে। ভেবে দেখো শুধু হাইপার স্পেসাল কমিউনিকেশন শুনেই ব্যাণ্ডার কী চমৎকার গ্যালাকটিক বলতে পারত। এনার্জি ট্র্যান্সডাকশন ছাড়াও ওদের মস্তিষ্ক আরো অনেক সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে।

একমত হলো ট্র্যাভিজ।

ফেলমকে তুমি এখনও পছন্দ করো না।

পছন্দও করি না, অপছন্দও করি না। প্রাণীটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। কেমন বীভৎস অনুভূতি হয়।

এটা বাড়াবাড়ি ট্র্যাভিজ। ফেলম চমৎকার একটা জীবিত প্রাণী। ভেবে দেখো হার্মাফ্রোডাইট সমাজে তোমাকে আর আমাকে কেমন অদ্ভুত আর জঘন্য মনে হবে । পৃথক পৃথক নারী পুরুষ। বংশ বৃদ্ধির জন্য সাময়িক এবং বিরক্তিকরভাবে মিলিত হয়।

তাতে তোমার আপত্তি আছে, ব্লিস?

ভুল বোঝার চেষ্টা করো না। আমি শুধু হার্মাফ্রোডিটিক দৃষ্টিতে নিজেদের বিচার করছি। ওদের কাছে যা স্বাভাবিক আমাদের কাছে তাই অস্বাভাবিক। তাই ফেলমকে তোমার মনে হয় অস্বাভাবিক, সেটা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কিছুই না।

আসলে বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে আমি ওকে ছেলে বলব না মেয়ে বলব।

দোষটা ফেলমের নয়, আমাদের ভাষার। কোনো ভাষাতেই হার্মাফ্রোডিটিজমের জন্য উপযুক্ত কোনো শব্দ নেই। ব্যাণ্ডার যেমন এটা বা ওটা ব্যবহার করত, সেই সর্বনামটা আমরা ব্যবহার করি সেইসব ক্ষেত্রে যেখানে লিঙ্গ কোনো ব্যাপার না, আর উভয় লিঙ্গ বোঝানোর জন্য কোনো সর্বনাম নেই আমাদের ভাষায়। তাহলে আমরা স্ত্রী-লিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ যে কোনো একটা ব্যবহার করতে পারি। তুমি বলায় ভালোই হয়েছে, আমিও ভাবছিলাম। আমি ঠিক করেছি ওকে মেয়ে হিসেবে দেখব, কারণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর এবং গর্ভধারণ ক্ষমতা-যা সম্পূর্ণ নারীত্বের প্রতীক। পেলোরেট মেনে নিয়েছে, তুমিও মেনে নাও।

শ্রাগ করল ট্র্যাভিজ। ভালো, যদিও বলার প্রয়োজন নেই যে ওর টেসটি আছে, তবুও বেশ ভালো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্লিস। সবকিছু নিয়ে তোমার কৌতুক করার অভ্যাস। জানি বেশ চাপের মধ্যে আছে, তাই কিছু মনে করিনি। ফেলমকে শুধু মেয়ে হিসেবে দেখবে, তাতেই চলবে।

দেখব, তারপর বলবে না বলবে না করেও বলেই ফেলল ট্র্যাভিজ, তোমাদের দুজনকে যখনই একসাথে দেখি মনে হয় ফেলম তোমার সন্তান। কেন? তুমি সন্তান চাও, কিন্তু ভাবছ জেনভ তা দিতে পারবে না।

চোখ বড় হয়ে গেল ব্লিসের। সে তো বংশ বৃদ্ধি করার জন্য আসেনি। তুমি মনে করেছ আমি তাকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করব। তা ছাড়া আমার সন্তান ধারনের সময় আসেনি। যখন হবে সেটা হতে হবে গায়ান শিশু। পেলোরেটের সেই যোগ্যতা নেই।

অর্থাৎ পেলোরেটকে ছেড়ে দেবে?

মোটেই না। সাময়িক বিচ্ছেদ। কৃত্রিম নিষিক্তকরণের মাধ্যমেও তা করা যাবে।

আমার ধারণা তোমার সন্তান হবে তখনই যখন গায়া প্রয়োজন মনে করবে; যখন কোনো বয়স্ক গায়ানের মৃত্যুর ফলে শূন্যস্থান তৈরি হবে।

অদ্ভুত মনে হলেও কথাটা সত্যি। গায়ার প্রতিটি অংশ এবং সম্পর্কের ভেতর সামঞ্জস্য থাকতে হবে।

সোলারিয়ানদের মতো।

রাগে ঠোঁট চেপে বসল ব্লিসের, মুখের রং হয়ে গেছে সাদা। না, সোলারিয়ানরা অপ্রয়োজনীয় হারে বংশ বৃদ্ধি করে এবং অতিরিক্ত বংশধরদের মেরে ফেলে। গায়া শুধু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বংশ বৃদ্ধি করে। কাজেই হত্যা করার প্রয়োজন হয় না।

বুঝলাম। আশা করি জেনভের অনুভূতির মূল্য দেবে।

সন্তান ধারণের বিষয়? সেটা কখনো আলোচনায় আসেনি, আসবেও না।

না, সেটা না। আমার মনে হয়েছে ফেলমের প্রতি বেশি মনযোগ দিয়ে তুমি জেনভকে অবহেলা করছ।

তাকে অবহেলা করছি না এবং আমার মতো সেও ফেলমের প্রতি আগ্রহী। এভাবে আমরা দুজন আরো কাছাকাছি আসতে পেরেছি। বোধহয় তুমি নিজেকে মনে করছ উপেক্ষিত।

আমি? সত্যিই অবাক হলো সে।

হ্যাঁ, তুমি । গায়াকে তুমি যতদূর বুঝতে পারো আইসোলেটদের আমি তার বেশি বুঝতে পারি না, তবে আমার মনে হয়েছে মহাকাশযানে তুমি সবার মনযোগের কেন্দ্রে থাকতে চাও, ফেলমের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

হাস্যকর।

পেলকে উপেক্ষা করছি তোমার এই কথার চেয়ে বেশি হাস্যকর না।

ঠিক আছে একটা চুক্তি করা যাক। আমি চেষ্টা করব ফেলমকে মেয়ে হিসেবে দেখতে এবং জেনভের প্রতি তোমার আচরণ নিয়ে মোটেই চিন্তা করব না।

হাসল ব্লিস। ধন্যবাদ। তা হলে কোনো সমস্যা নেই।

চলে যেতে উদ্যত হল ট্র্যাভিজ, কিন্তু ব্লিস বাঁধা দিল, দাঁড়াও।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুরল ট্র্যাভিজ, কী ব্যাপার?

পরিষ্কার বুঝতে পারছি তুমি বিষণ্ণ এবং হতাশ। আমি কখনোই তোমার মাইণ্ডে অনুপ্রবেশ করব না, কিন্তু কী সমস্যা তুমি আমাকে বলতে পারো। গতকাল বলেছিলে এই সিস্টেমে একটা উপযুক্ত গ্রহ আছে, এবং খুশি মনে হয়েছিল তোমাকে।–আশা করি গ্রহটা এখনো আছে, তোমার কোনো ভুল হয়নি।

সিস্টেমে একটা উপযুক্ত গ্রহ ছিল এবং এখনো আছে।

সঠিক আয়তনের?

যেহেতু উপযুক্ত তার মানে সঠিক আয়তনের। এবং সূর্য থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্থিত।

বেশ, সমস্যা কোথায় তা হলে?

আমরা বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট কাছে চলে এসেছি। দেখা যাচ্ছে যে এই গ্রহে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই।

নেই?

না। এই গ্রহ বসবাসের অযোগ্য এবং নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত আর কোনো গ্রহ নেই যার বাসযোগ্য হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা আছে। আমাদের তৃতীয় প্রচেষ্টার ফলাফলও শূন্য।

.

পাইলট রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল পেলোরেট। ট্র্যাভিজের বিষণ্ণ নীরবতা ভাঙতে চাইল না। আশা করছে তার বন্ধুই প্রথম আলোচনা শুরু করবে।

করল না ট্র্যাভিজ। যদি কোনো নীরবতাকে কখনো একগুঁয়ে মনে হয়, তা হলে এটাকে ঠিক তাই বলা যাবে।

শেষ পর্যন্ত পেলোরেট আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ভয়ে ভয়ে বলল, আমরা কী করছি?

চোখ তুলল ট্র্যাভিজ, একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকল পেলোরেটের দিকে, আবার ঘুরল, তারপর বলল, গ্রহের দিকে এগোচ্ছি।

কিন্তু কোনো বায়ুমণ্ডল নেই…

কম্পিউটার বলছে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। এখন পর্যন্ত এটা তাই বলেছে যা আমি শুনতে চেয়েছি, মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন যা বলছে আমি শুনতে চাই না। তাই নিজেই পরীক্ষা করে দেখব। কম্পিউটার যদি কোনোদিন ভুল করে চাইছি যেন ভুলটা এখনই হয়।

মনে হয় ভুল করেছে?

না, আমার মনে হয় না।

ভুল হওয়ার মতো কোনো কারণ দেখাতে পারো?

না, পারি না।

তা হলে এত চিন্তা করছ কেন, গোলান?

চেয়ার পুরো ঘুরিয়ে পেলোরেটের মুখোমুখি হলো ট্র্যাভিজ। বিরক্তিতে মুখে ভাঁজ পড়েছে অনেকগুলো। বুঝতে পারছ না, জেনভ, এ ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। প্রথম দুটো গ্রহ থেকে পৃথিবীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারিনি। তৃতীয় গ্রহে একই অবস্থা। আমি এখন কী করব? একটা একটা করে গ্রহে যাবো, গিয়ে বলব, মাফ করবেন, দয়া করে বলবেন কি পৃথিবী কোথায়?–নিজের ট্র্যাক পৃথিবী খুব ভালোভাবে গোপন করেছে। কোথাও কোনো সূত্র রাখেনি। এখন আমার মনে হচ্ছে কোনো সূত্র থাকলেও যেন অমরা না পাই তার ব্যবস্থা সে করবে।

মাথা নাড়ল পেলোরেট। আমি নিজেও এগুলো ভাবছিলাম। কথা বললে রাগ করবে? জানি তোমার মন ভালো নেই, কথা বলতে চাওনা, কাজেই যদি একা থাকতে চাও, আমি চলে যাবো।

 বল, কী বলবে, বলল ট্র্যাভিজ, যেন আর্তনাদ করল । না শুনে আর কী করতে পারি।

তোমার কণ্ঠ বলছে আমার কথা শোনার আগ্রহ নেই, তারপরেও বলি। যদি শুনতে ভালো না লাগে তা হলে থামিয়ে দিও।–আমার মনে হয়, গোলান নিজেকে গোপন করার জন্য পৃথিবী শুধু অপ্রতিরোধী এবং নেতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু। সব রেফারেন্স সরিয়ে ফেলেনি। সম্ভবত মিথ্যা তথ্য প্রচার করেও গোপনীয়তা নিশ্চিত করেছে।

অর্থাৎ?

বেশ, অনেক জায়গায় আমরা শুনেছি পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ, এবং এধরনের বিষয় পৃথিবীর অবস্থান জানার যে কোনো প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। যদি সত্যি রেডিওঅ্যাকটিভ হয় আমরা তা হলে ঐ গ্রহে নামতে পারব না, রোবট পাঠালে ও তেজস্ক্রিয়তার কারণে টিকতে পারবে না বেশিক্ষণ। রেডিওঅ্যাকটিভ না হলেও গোপনীয়তা অক্ষত থাকবে। সম্ভবত আরো অনেক ব্যবস্থা করা আছে।

কষ্ট করে হাসল ট্র্যাভিজ। অদ্ভুত, জেনভ, আমিও ঠিক এগুলোই ভেবেছি। আমার আরো মনে হয় বিশাল উপগ্রহ এবং বিশাল রিং সিস্টেমসহ কোনো গ্যাস জায়ান্টের বিষয় পৃথিবীর কিংবদন্তিতে পরিকল্পিতভাবে যোগ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য সম্ভবত আমরা যেন এমন কিছু খুঁজি যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে হয়তো সঠিক প্ল্যানেটরি সিস্টেমে পৃথিবীর সামনে দিয়ে চলে যাবো, কিন্তু চিনতে পারব না।–আরো খারাপ ঘটনাও ঘটতে পারে।

এরচেয়ে খারাপ আর কী ঘটতে পারে?

হয়তো নিজেকে গোপন রাখার অসীম ক্ষমতা পৃথিবীর আছে। যদি আমাদের মাইণ্ড আচ্ছন্ন থাকে তা হলে কি হবে? হয়তো উপগ্রহ, রিং সিস্টেমসহ গ্যাস জায়ান্ট এবং পৃথিবী গ্রহের সামনে দিয়ে গেলেও চিনতে পারব না। হয়তো এরই মধ্যে পেছনে ফেলে এসেছি।

কিন্তু কথাগুলো যদি তুমি বিশ্বাস করো, তাহলে কেন আমরা–

বিশ্বাস করি একথা তো বলিনি। বলছি উদ্ভট কল্পনার কথা। আমরা খোঁজ চালিয়ে যাবো।

দ্বিধান্বিত স্বরে পেলোরেট বলল, কতদিন, ট্র্যাভিজ? এক সময় হাল ছাড়তেই হবে।

কখনোই না, হিংস্র স্বরে বলল ট্র্যাভিজ। যদি আমার বাকি জীবন দিতে হয়, দেব। যদি প্রতিটি গ্রহে গিয়ে প্রত্যেকটা লোককে বলতে হয়, প্লিজ, স্যার, পৃথিবী কোথায়? তাহলে তাই করব। চাইলে যে কোনো মুহূর্তে তোমাদের গায়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। আমি একা বেরোব তারপর।

না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না, গোলান, ব্লিসও যাবে না। আমরা তোমার সাথেই যাবো, কিন্তু কেন?

কারণ পৃথিবী আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে, এবং করবই। কীভাবে হবে জানি না, কিন্তু করবই।–এখন শোন, আমি এমন একটা অবস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি যেখান থেকে সূর্যের খুব কাছে না গিয়েও গ্রহের আলোকিত অংশকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। কাজ করতে দাও।

কথা বন্ধ করল পেলোরেট, তবে বেরিয়ে গেল না। স্ক্রিনে গ্রহের যে ইমেজ সেখানে অর্ধেকের বেশি অংশ দিনের আলোয় আলোকিত। পেলোরেট কোনো বৈশিষ্ট্য ধরতে পারছে না কিন্তু নিশ্চিত কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হয়ে ট্র্যাভিজ আরো। বিস্তারিত বুঝতে পারছে।

পাতলা কুয়াশা আছে। ফিসফিস করে বলল ট্র্যাভিজ।

প্রায় লাফিয়ে উঠল পেলোরেট। তা হলে নিশ্চয়ই বায়ুমণ্ডল আছে।

বেশি নেই। জীবন ধারণ অসম্ভব, তবে ধূলিকণা উড়ানোর জন্য যথেষ্ট। পাতলা বায়ুমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য এটা। হয়তো ছোট একটা পোলার-আইস-ক্যাপ আছে। অবশ্য কঠিন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের জন্য এই গ্রহ অনেক বেশি উত্তপ্ত।–রাডার ম্যাপিং চালু করতে পারলে রাতের অংশেও সহজে কাজ করা যেত। কিন্তু বায়ুশূন্য এবং মেঘহীন গ্রহে কাজটা কঠিন।

চুপ করল ট্র্যাভিজ। স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে গ্রহের বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি তৈরি হলো, অনেকটা ক্লিয়নিয়ান পিরিয়ডের শিল্পীদের আঁকা ছবির মতো। বেশ বিজয়ীর সুরে বলল সে, শব্দটা অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখল, তা. . আবার নিশ্চপ।

এই বেশ কিসের জন্য? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

আড়চোখে তাকালো ট্র্যাভিজ। কোনো জ্বালামুখ চোখে পড়ছে না।

সেটা কি ভালো।

একেবারে অপ্রত্যাশিত, ট্র্যাভিজ বলল, মুখে হাসি, এবং ভালো। সত্যি কথা বলতে কী চমৎকার।

.

মহাকাশযানের পোর্টহোলে নাক চেপে রেখেছে ফেলম, কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই সেদিকে মহাবিশ্বের সামান্য একটু অংশ দেখা যাচ্ছে।

ব্লিস, এতক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করছিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেলোরেটকে বলল জানি না কতটুকু বুঝতে পেরেছে। ওর কাছে তার বাবার ম্যানসনটাই পুরো মহাবিশ্ব। মনে হয় না রাতে কখনো বেরিয়েছে বা আকাশে তারা দেখেছে।

সত্যিই মনে হয়?

সত্যি। আমার কথা বোঝার মতো শব্দ না শেখা পর্যন্ত আমি তাকে সব দেখাতে সাহস পাচ্ছি না।–সৌভাগ্য যে তুমি ওর ভাষায় কথা বলতে পারো।

সমস্যা হচ্ছে, আমি খুব ভালো পারি না,ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলল পেলোরেট। আর মহাবিশ্বের ব্যাপার একবারে বোঝানোর চেষ্টা করলে হজম করা কঠিন হবে। আমাকে সে বলেছিল যে আলোর বিন্দুগুলি যদি সোলারিয়ার মতো গ্রহ হয় সেগুলো নিশ্চয়ই অনেক বড়-আর ঐভাবে শূন্যে ঝুলে থাকতে পারে না। পড়ে যেতে বাধ্য।

যা জানে তাতে ঠিকই বলেছে। বুদ্ধিমতীর মতো প্রশ্ন করে, এবং ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে। তার যথেষ্ট কৌতূহল আছে, আর শিখতে ভয় পায় না।

কথা হচ্ছে ব্লিস, আমিও কৌতূহলী । দেখেছ, আমরা যে গ্রহে যাচ্ছি সেটাতে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ না পাওয়াতে গোলানের আচরণ কেমন পাল্টে গেল। অথচ এতে কি লাভ হবে আমার কোনো ধারণাই নেই। তোমার আছে?

একটুও না। তবে আমাদের চেয়ে প্ল্যানেটোলজি সে অনেক বেশি জানে। আশা করি, কি করছে তা সে জানে।

যদি আমি জানতে পারতাম।

বেশ, জিজ্ঞেস করো।

ভয় হয়, আমি সম্ভবত সবসময় ওকে বিরক্ত করি। কোনো সন্দেহ নেই সে মনে করে এই বিষয়গুলো আমার জিজ্ঞেস না করেই জানা উচিত ছিল।

এটা বোকামি, পেল। প্রয়োজন মনে করলে গ্যালাক্সির কিংবদন্তি বা পৌরাণিক কাহিনী তোমার কাছে জেনে নিতে সে দ্বিধা বোধ করে না। তুমিও সুন্দর করে বুঝিয়ে দাও। সে বলবে না কেন? যাও গিয়ে জিজ্ঞেস কর। যদি বিরক্ত হয়, তবে একটু সামাজিক হওয়ার সুযোগ পাবে, তার জন্যই ভালো।

তুমি আসবে আমার সাথে?

না, অবশ্যই না। আমি এখানে ফেলমের মাথায় মহাবিশ্বের মৌলিক ধারণা ঢোকানোর চেষ্টা করছি। তুমি পরে আমাকে বুঝিয়ে দিও।

.

ইতস্তত পায়ে পাইলট-রুমে ঢুকল পেলোরেট। ট্র্যাভিজের আনন্দিত চেহারা, এবং তাকে শিস বাজাতে শুনে খুশি হলো।

গোলান, যতদূর সম্ভব উৎফুল্ল স্বরে ডাকল সে।

চোখ তুলল ট্র্যাভিজ। জেনভ! সবসময় এমন পা টিপে টিপে চল যেন আমার কাছে আসাটা অপরাধ। দরজাটা বন্ধ করে এসে বস, বস! এই জিনিসগুলো দেখ।

ভিউস্ক্রিনে একটা গ্রহ দেখাল সে। দুই বা তিনের বেশি জ্বালামুখ পাইনি, সবগুলোই বেশ ছোট।

তাতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে, গোলান?

পরিবর্তন? অবশ্যই। কেন জিজ্ঞেস করছ?

অসহায়ের মতো অঙ্গভঙ্গি করল পেলোরেট। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্য। কলেজে আমার মূল বিষয় ছিল ইতিহাস। সহায়ক হিসেবে সোসিওলোজি, সাইকোলজি, প্রাচীন ভাষাতত্ত্ব এবং সাহিত্য নিয়েছিলাম। পরে মিথলজিতে গ্র্যাজুয়েশন করি। জীবনে কখনো প্ল্যানেটোলজির ধারে কাছেও যাইনি।

সেটা কোনো অপরাধ না, জেনভ। তুমি যা জানো তার কিছুই আমি জানি না। ভালোভাবেই জানো, প্রাচীন ভাষা এবং মিথলজির উপর তোমার দক্ষতা আমাদের অনেক উপকার করছে। প্ল্যানেটোলজির ব্যাপার হলে আমি সামলাবো।

দেখো, জেনভ, সংঘর্ষের মাধ্যমে ছোট ছোট বস্তুগুলো একত্রিক হয়ে গ্রহের গঠন পূর্ণ হয়। চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় এই বস্তুগুলো জ্বালামুখ তৈরি করে। যদি গ্রহটা গ্যাস-জায়ান্টের মতো বড় হয় গ্যাসীয় বায়ুমন্ডলের নিচে তরল পদার্থ থাকে, এবং কোনো জ্বালামুখের চিহ্ন থাকে না।

ছোট গ্রহ, যেগুলো নীরেট, তুষারাবৃত বা পাথুরে, সেগুলোতে জ্বালামুখের চিহ্ন থাকে এবং মুছে ফেলার মতো কোনো উপাদান না থাকলে চিহ্নগুলো অনির্দিষ্ট কাল টিকে থাকে। তিনভাবে এই চিহ্নগুলো নিশ্চিহ্ন হয়।

প্রথমত তুষারাবৃত কোনো গ্রহের শক্ত বরফাচ্ছন্ন সমতলের নিচে তরল সমুদ্র থাকতে পারে। কোনো বস্তু ধাক্কা দিয়ে বরফ ভাঙার সময় প্রচুর পানি ছিটায়। তারপর পুনরায় জমাট বরফে পরিণত হয়ে, বলা যায় ক্ষতস্থান সারিয়ে তুলে। এই ধরনের গ্রহ বা উপগ্রহ গুলো হয়, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং বসবাসের অযোগ্য।

দ্বিতীয়ত যদি কোনো গ্রহে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি থাকে, তা হলে লাভা, বা ছাই জ্বালামুখের চিহ্ন ঢেকে দেয়। এধরনের গ্রহগুলোও বসবাসের অযোগ্য।

তৃতীয় ক্ষেত্রে গ্রহগুলো হয় বাসযোগ্য। এই গ্রহগুলোর পোলার আইস ক্যাপ থাকলেও অধিকাংশ মহাসাগর হয় তরল। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি থাকলেও অনেক দূরে দূরে অবস্থান করে। এই ধরনের গ্রহ জ্বালামুখ বন্ধ করতে পারে না বা ঢেকে দিতে পারে না। বরং এখানে ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব কাজ করে। বাতাস এবং ভাসমান পানি জ্বালামুখগুলোকে ক্ষয় করে ফেলে। জীবনের অস্তিত্ব থাকলে তা হয় আরো বেশি ক্ষয়কারক। বুঝেছ?

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বিষয়টা উল্টেপাল্টে বিবেচনা করল পেলোরেট। তারপর বলল, কিন্তু, গোলান, আমি মোটেই বুঝতে পারছি না। যে গ্রহে আমরা যাচ্ছি।

আগামী কাল সেখানে ল্যাণ্ড করব, উৎফুল্ল স্বরে বলল ট্র্যাভিজ।

এই গ্রহে কোনো মহাসাগর নেই।

শুধু পাতলা আইস-ক্যাপ।

পর্যাপ্ত বায়ুমণ্ডল নেই।

ঘনত্বের দিক দিয়ে টার্মিনাসের বায়ুমণ্ডলের একশ ভাগের এক ভাগ।

অথবা জীবন।

কোনো কিছুই চিহ্নিত করতে পারিনি।

তা হলে জ্বালামুখগুলো ক্ষয় হলো কীভাবে?

সাগর, বায়ুমণ্ডল এবং প্রাণ। শোন, যদি এই গ্রহ শুরু থেকেই পানি ও বায়ুশূন্য হতো তা হলে সমতলে এখনো জ্বালামুখ থাকত। এগুলোর অনুপস্থিতি প্রমাণ করে নিকট অতীতে এখানে সাগর এবং বায়ুমণ্ডল ছিল। তা ছাড়া অনেকগুলো বেসিন দেখা যাচ্ছে, যেগুলো একসময় হয়তো সাগর বা মহাসাগর ছিল, এখন শুকিয়ে গেছে। কাজেই এখানে ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব কাজ করেছে এবং এত কাছাকাছি সময়ে হয়েছে যে নতুন করে জ্বালামুখ তৈরি হওয়ার সময় পায়নি।

পেলোরেটের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। যদিও আমি প্ল্যানেটোলজিস্ট নই, তবে মনে হচ্ছে যদি কোনো গ্রহ কয়েক বিলিয়ন বছর পাতলা বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে, হঠাৎ করে সেই বায়ুমণ্ডল শেষ হয়ে যাবে না, তাই না?

আমারও তাই ধারণা, ট্র্যাভিজ বলল । কিন্তু বায়ুমণ্ডল অদৃশ্য হওয়ার আগে এই গ্রহে নিঃসন্দেহে জীবনের অস্তিত্ব ছিল, সম্ভবত মানুষ। গ্যালাক্সির অন্যান্য যে সকল গ্রহে মানুষ বাস করে সেগুলোর মতো এটাও নিশ্চয়ই একটা রূপান্তর করা বিশ্ব। সমস্যা হচ্ছে, আমরা জানি না মানুষ আসার আগে এখানে পরিবেশ কেমন ছিল অথবা কোন পরিস্থিতিতে জীবনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। হয়তো কোনো চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বায়ুমণ্ডল ধ্বংস করেছে। অথবা মারাত্মক কোনো অভারসাম্য ছিল, মানুষ চলে যাওয়ার পর যা চরম আকার ধারণ করেছে। ল্যাণ্ড করার পর হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর পাবো, অথবা পাবো না। কিছু আসে যায় না।

কিন্তু এই গ্রহে একসময় জীবন ছিল এখন নেই তাতেও কিছু আসে যায় না। যে। গ্রহ সবসময় বসবাসের অযোগ্য এবং যে গ্ৰহ কালের বিবর্তনে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে তার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

এখন বাসের অযোগ্য, একসময়কার বসতির ধ্বংসস্তূপ থাকবে এখানে।

অরোরাতেও ধ্বংসস্তূপ ছিল

ঠিক, কিন্তু সেই সাথে ছিল বিশ হাজার বছরের ঝড়, বৃষ্টি, বাতাস, তাপমাত্রার পরিবর্তন। আর ছিল জীবনের অস্তিত্ব–ভুলে যেও না। মানুষ ছিল না, কিন্তু অন্যান্য প্রাণী ছিল প্রচুর। ধ্বংসস্তূপ আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের চেয়েও দ্রুত ক্ষয় হয়। বিশ হাজার বছর পরে মূল্যবান কোনো তথ্য সেখানে পাওয়া যেত না। এখানে এই গ্রহে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে, হয়তো ঝড়, বৃষ্টি, বাতাস এবং জীবন ছাড়া অতিবাহিত হয়েছে বিশ হাজার বছর বা আরো কম। তবে তাপমাত্রার পরিবর্তন। হয়েছে স্বীকার করতেই হবে। অন্য কিছু ছিল না। ফলে ধ্বংসস্তূপগুলো আরো ভালো অবস্থায় থাকবে।

যদি, সন্দেহের গলায় ফিসফিস করল পেলোরেট, কোনো ধ্বংসস্তূপ না থাকে। হতে পারে এখানে কখনো জীবনের অস্তিত্ব ছিল না, অথবা মানুষ কখনো এখানে বাস করেনি এবং এমন কোনো কারণে বায়ুমণ্ডল নষ্ট হয়েছে যেখানে মানুষের কিছু করার ছিল না।

না, না, আমার মনে সন্দেহ ঢোকানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। কারণ এখান থেকে যা দেখছি কোনো সন্দেহ নেই সেটা একসময় শহর ছিল। কাজেই আগামী কাল ল্যাণ্ড করছি।

.

ফেলমের ধারণা আমরা তাকে তার রোবট জেম্বির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তিত স্বরে বলল ব্লিস।

উমম, বলল ট্র্যাভিজ, ভাসমান মহাকাশযানের নিচে পিছলে সরে যাওয়া সারফেস দেখছে। তারপর এমনভাবে চোখ তুলল যেন একটু দেরি করে মন্তব্যটা শুনেছে। ওটাকেই একমাত্র পিতামাতা হিসেবে জানে সে, তাই না?

হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু সে ভাবছে আমরা সোলারিয়ায় ফিরে এসেছি।

এটা দেখতে কি সোলারিয়ার মতো?

সে কীভাবে বলবে?

বল, এটা সোলারিয়া না। আমি তোমাকে কিছু ইলাসট্রেটেড বুক ফিল্ম দেব। সেখান থেকে বসগ্রিহের ছবি দেখিয়ে ফেলমকে বোঝাও যে এরকম লক্ষ লক্ষ গ্রহ। আছে। অনেক সময় পাবে তুমি। ল্যাণ্ড করার পর আমাকে আর জেনভকে কতক্ষণ বাইরে থাকতে হয় বলা যায় না।

তুমি আর জেনভ?

হ্যাঁ। কারণ আমি চাইলেও ফেলমকে সাথে নেওয়া যাবে না। কারণ ওর সাইজের স্পেসস্যুট নেই। যেহেতু এই গ্রহে নিশ্বাস নেওয়ার মতো কোনো বাতাস নেই সেহেতু স্পেসস্যুট পরে নামতে হবে।

আমি কেন?

ট্র্যাভিজের মুখে কঠোর হাসি। স্বীকার করছি তুমি সাথে থাকলে নিরাপদ বোধ করব। কিন্তু ফেলমকে একা মহাকাশযানে রেখে যাওয়া যাবে না। যন্ত্রপাতি নষ্ট করে ফেলতে পারে, ইচ্ছে করে করবে না হয়তো। জেনভ সাথে যাবে কারণ প্রাচীন কোনো লিপি থাকলে সেটা বোঝার ক্ষমতা ওরই আছে। অর্থাৎ তোমাকে ফেলমের সাথে থাকতে হবে।

ব্লিসকে অনিশ্চিত দেখাচ্ছে।

শোন, তুমি ফেলমকে সাথে রাখতে চাও, আমি চাই না। আমার কাছে সে একটা ঝামেলা। ফলে তার উপস্থিতি নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে, তোমাকে তার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। সে এখানে থাকবে, কাজেই তোমাকেও থাকতে হবে।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল ব্লিস, ঠিক আছে।

চমৎকার । জেনভ কোথায়?

ফেলমের সাথে।

যাও, ওকে পাঠিয়ে দাও। আমি কথা বলব।

পেলোরেট যখন এল ট্র্যাভিজ তখনো প্ল্যানেটরি সারফেস দেখছে। গলা খাকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে সে বলল, কোনো সমস্যা, গোলান?

ঠিক সমস্যা না, একটু অনিশ্চয়তা। অদ্ভুত গ্রহ এবং আমি জানি না ঠিক কী ঘটেছে। বেসিন দেখে মনে হয় সাগরগুলো ছিল বিশাল কিন্তু অগভীর। আমার মনে হয় এই গ্রহ ছিল লবণাক্ততাহীন এবং প্রচুর খাল ছিল, অথবা সমুদ্রগুলো খুব বেশি লবণাক্ত ছিল না, হলে বেসিনে লবণের চিহ্ন থাকত। অথবা সমুদ্রের সাথে সাথে লবণও শুকিয়ে গেছে–নিশ্চিতই মানুষের কাজ বলে মনে হয়।

দ্বিধান্বিত স্বরে পেলোরেট বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না, আমরা যা খুঁজছি তার সাথে কি এর কোনো সম্পর্ক আছে?

না, আমি একটু কৌতূহলী। যদি জানতে পারতাম কীভাবে এটা মানুষ বাসের যোগ্য হয়ে উঠেছে এবং তার আগে কেমন ছিল, তখন হয়তো বুঝতে পারতাম পরিত্যক্ত হওয়ার ঠিক আগে বা পরে কী ঘটেছে। তা হলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা যেত।

কী রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এটা মৃত গ্রহ, তাই না?

মৃত। পানি নেই; নিশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাস নেই; কোনো প্রকার মেন্টাল অ্যাকটিভিটি ধরা পড়েনি ব্লিসের চেতনায়।

তা হলে আর সমস্যা কী?

মেন্টাল অ্যাকটিভিটির অনুপস্থিতি মানে প্রাণের অনুপস্থিতি না।

তবে এটা নিশ্চিত যে বিপজ্জনক প্রাণী নেই।

জানি না।–কিন্তু এগুলো বলার জন্য ডাকিনি। প্রথম অনুসন্ধানের জন্য দুটো বড় শহর নির্বাচন করেছি। এখনো অক্ষত। বায়ু এবং সমুদ্রগুলোকে যাই ধ্বংস করে থাকুক না কেন শহরগুলো আক্রান্ত হয়নি। যাই হোক বড় শহরটাতে মনে হয় কোনো উন্মুক্ত স্থান নেই, শুধু শেষ সীমায় একটা স্পেসপোর্ট। যে শহরটা একটু ছোট সেটার ভেতর অনেকগুলো সাধারণ স্পেসপোর্ট -–কিন্তু, এগুলো থেকে কি বোঝা যায়?

দাঁত বের করে হাসল পেলোরেট, তুমি চাও আমি সিদ্ধান্ত নিই?

না, সিদ্ধান্ত আমিই নেব । তুমি শুধু তোমার ধারণা বল।

বিশাল এবং আকাশচুম্বী শহর হবে বাণিজ্য এবং উৎপাদনের কেন্দ্র। একটু ছোট শহর যেখানে অনেক উন্মুক্ত স্থান আছে সেটা হবে প্রশাসনিক কেন্দ্র। আর ওখানেই আমাদের যেতে হবে। কোনো মনুমেন্ট ভবন আছে?

তার মানে?

মুচকি হাসল পেলোরেট। আমিও ঠিক জানি না। সময় এবং গ্রহ ভেদে ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়। তবে আমার মনে হয় ওগুলো হবে বিশাল, অপ্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল-অনেকটা কমপরেলনের মতো।

পাল্টা হাসল ট্র্যাভিজ। সরাসরি নিচে বা পাশে তাকিয়ে পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তুমি প্রশাসনিক কেন্দ্র বেছে নিলে কেন?

ওখানেই গ্রহের সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, আর্কাইভস, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থাকবে।

ভালো। ওখানেই যাবো তা হলে। আগের দুবার ব্যর্থ হয়েছি। আশা করি এবার কিছু একটা পাওয়া যাবে।

থ্রি টাইমস লাকি।

ভুরু কপালে তুলল ট্র্যাভিজ। এটা পেলে কোথায়?

প্রাচীন কিংবদন্তিতে। অর্থ সম্ভবত তৃতীয় প্রচেষ্টায় সফল।

সেরকমই মনে হয়। বেশ, থ্রি টাইমস লাকি, জেনভ।

.

১৫. শেওলা

স্পেসস্যুটে ট্র্যাভিজকে দেখাচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার, যে অংশ স্যুটের বাইরে বেরিয়ে আছে, সেটা হচ্ছে তার হোলস্টার। আগেরগুলো না, বরং এগুলো আরো বড় এবং স্যুটেরই অংশ। রিচার্জ করা ব্লাস্টার এবং নিউরোনিক হুইপ সতর্কতার সাথে হোলস্টারে রাখল। এবার আর কেউ অস্ত্রগুলো তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।

ব্লিস হাসল । তুমি এখানেও অস্ত্র নেবে যেখানে বাতাস বা–বাদ দাও! তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আর কখনো প্রশ্ন করব না।

ট্র্যাভিজ পেলোরেটের হেলমেট ঠিক করায় ব্যস্ত। পেলোরেট আগে কখনো স্পেসস্যুট পরেনি। ভয়ার্ত সুরে বলল,  এগুলোর ভেতর সত্যি শ্বাস নিতে পারব, গোলান?

আমার উপর বিশ্বাস রাখো, ট্র্যাভিজ বলল ।

ফেলম ব্লিসের পাশে। ছোট সোলারিয়ান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে স্পেসস্যুটপরা দেহ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁপছে, আশ্বস্ত করার জন্য এক হাত তার কাঁধে রেখেছে ব্লিস।

এয়ারলক দরজা খুলে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল দুজন। দরজা বন্ধ হলো পিছনে। মূল দরজা খুলে পা রাখল একটা মৃত গ্রহের মাটিতে।

ভোর হচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার, ধূসর বর্ণ, সূর্য এখনো উঠেনি। যেদিকে সূর্যোদয় হবে সেদিকে দিগন্তে ঝাপসা ভাব।

ঠাণ্ডা। বলল পেলোরেট।

ঠাণ্ডা লাগছে তোমার? অবাক হয়ে বলল ট্র্যাভিজ।

না। কিন্তু দেখো- রেডিওর সাহায্যে কথা শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার। সে আঙুল তুলে সামনের দিকে নির্দেশ করল।

যে ভগ্ন পাথুরে ভবনের দিকে ওরা এগোচ্ছে, ভোরের ধূসর আলোয় দেখা গেল তার দেয়ালগুলো সাদা শিশিরকণায় ভেজা।

পাতলা বায়ুমণ্ডলের কারণে রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং দিনে প্রচণ্ড গরম পড়ে। এই সময়টা হচ্ছে দিনের সবচেয়ে ঠাণ্ডা অংশ, এবং তাপমাত্রা বাড়তে আরো কয়েকঘণ্টা লাগবে।

তার কথা যেন জাদুমন্ত্র, বলার সাথে সাথেই দিগন্তে উঁকি দিল সূর্য।

ওদিকে তাকিও না, স্বাভাবিক গলায় বলল ট্র্যাভিজ। তোমার ফেসপ্লেট রিফ্লেক্টিভ এবং অতি বেগুনি রশ্মি প্রতিরোধক। তারপরেও বিপদ হতে পারে।

উদীয়মান সূর্যের দিকে পিছন ফিরল সে, দেয়ালে তার লম্বা ছায়া পড়েছে। কুয়াশা কেটে যাচ্ছে সূর্যের আলোয়। একমুহূর্তের জন্য দেয়ালগুলো মনে হল অন্ধকার তারপর সেটাও দূর হয়ে গেল।

আকাশ থেকে ভবনগুলো যত ভালো মনে হয়েছিল এখন আর তা মনে হচ্ছে না। চিড় ধরেছে, ভেঙে পড়েছে। আমার ধারণা তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে এবং সম্ভবত প্রায় বিশ হাজার বছর ধরে যে সামান্য পানীয় উপাদান রয়েছে তা রাতে বরফে পরিণত হয়ে আবার দিনে গলে যাচ্ছে।

পেলোরেট বলল, প্রবেশ পথের উপরে পাথরে কিছু বর্ণ খোদাই করা, কিন্তু এমনভাবে ভেঙেছে যে পড়া মুশকিল।

পাঠোদ্ধার করতে পারবে, জেনভ?

কোনো ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যতদূর উদ্ধার করেছি মনে হয় এটা সম্ভবত ব্যাংক ।

সেটা আবার কী?

যে ভবনে বিভিন্ন সম্পদ জমা রাখা, উত্তোলন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ঋণের আদান প্রদান করা হয়।

পুরো একটা ভবন শুধু এই কাজ করত? কম্পিউটার ছাড়া?

কম্পিউটার ছাড়াই একসাথে সব কাজ করা হতো।

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। প্রাচীন ইতিহাস তাকে আকর্ষণ করছে না ।

দ্রুত এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাচ্ছে, কোনোটাতেই বেশি সময় নষ্ট করছে না। নিষ্প্রাণ পরিবেশ, সীমাহীন নিঃশব্দতা মনের উপর চাপ ফেলছে। বহু সহস্রাব্দের ধ্বংসস্তূপ দেখে মনে হয় শহরের কঙ্কাল। মাংস খসে গিয়ে হাড়গুলো আছে।

রোদ খুব একটা চড়া হয়নি কিন্তু ট্র্যাভিজের মনে হতে লাগল যেন পিঠে গরম লাগছে।

ডানদিকে প্রায় এক শ মিটার দূর থেকে চিৎকার করল পেলোরেট, এদিকে দেখো।

যেন বোমা ফাটল ট্র্যাভিজের কানে। চিৎকার করোনা, জেনভ। যত দূরেই থাকো ফিসফিস করলেও আমি পরিষ্কার শুনতে পারব। কী হয়েছে।

সাথে সাথে সামলে নিল পেলোরেট। এই ভবনটা হচ্ছে হল অব দ্য ওয়ার্ল্ডস। তাই লেখা আছে বলে মনে হয়।

তিন তলা কাঠামো, ছাদের কিনারাগুলো এবড়োখেবড়ো, বড় বড় পাথরের অংশবিশেষ কোনো রকমে টিকে আছে, সম্ভবত একসময় কোনো ভাস্কর্য দাঁড় করানো ছিল ওখানে।

তুমি নিশ্চিত?

ভেতরে গেলেই বোঝা যাবে।

নিচু কিন্তু প্রশস্ত পাঁচ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠার পর সুবিশাল উন্মুক্ত চত্ত্বর। পাতলা বাতাসে তাদের পায়ের ধাতব জুতো শব্দ তৈরি না করে কম্পন সৃষ্টি করছে।

এখন বুঝতে পারছি বড়, অপ্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল বলতে কী বুঝিয়েছিলে। ফিস ফিস করে বলল ট্র্যাভিজ।

একটা প্রশস্ত এবং উঁচু হলে প্রবেশ করল ওরা, লম্বা জানালা দিয়ে যেখানে আলো এসে পড়ছে সেখানে ঝিকমিক করছে, কিন্তু তারপরেও সবকিছু কেমন যেন। ছায়ায় ঢাকা। পাতলা বায়ুমণ্ডল আলো বেশি ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না।

ঠিক মাঝখানে প্রমাণ সাইজের থেকেও বড় একটা মানুষের মূর্তি, সিনথেটিক পাথরে তৈরি। এক হাত ভেঙে পড়ে গেছে, আরেক হাতের ফাটল ধরেছে কাঁধের কাছে, ট্রাভিজের মনে হলো যেন টোকা দিলেই পড়ে যাবে। এক পা পিছিয়ে এল সে যেন বেশি কাছে থাকলে এই অসহনীয় সৌন্দর্য খেয়ালের বশে ধ্বংস করে ফেলবে।

মানুষটা কে, সে বলল। কোথাও কোনো পরিচয় নেই। মনে হয় যারা এটা তৈরি করেছে তারা ভেবেছিল এই ব্যক্তির খ্যাতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে ফলে আলাদা করে পরিচয় লিখে রাখার দরকার নেই, কিন্তু এখন- কাঁধ নেড়ে দার্শনিক সুলভ চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলল।

পেলোরেট তাকিয়েছে উপরে, তার মাথা অনুসরণ করে ট্র্যাভিজও তাকালো। সেখানে দেয়ালে কিছু লেখা, আঁকাবাঁকা রেখা-ট্র্যাভিজ কিছুই পড়তে পারছে না।

অদ্ভুত, পেলোরেট বলল। সম্ভবত বিশ হাজার বছরের পুরোনো এবং এখানে সূর্যের আলো এবং ধুলোবালি থেকে নিরাপদ, এখনো পরিষ্কার।

আমার কাছে না।

অনেক প্রাচীন হস্তলিপি। কী আছে দেখা যাক-সাত-এক-দুই- কণ্ঠস্বর কমিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল, তারপর আবার জোড়ে বলল, পঞ্চাশটা নামের তালিকা, এবং আমরা জানি পঞ্চাশটা স্পেসার ওয়ার্ল্ড ছিল আর এটা হচ্ছে হল অব দ্য ওয়ার্ল্ডস। মনে হয় সবগুলো গ্রহের তালিকা বসতি স্থাপনের সময়ক্রম অনুযায়ী দেওয়া আছে। অরোরা প্রথম সোলারিয়া সর্বশেষ। খেয়াল করো সাতটা কলাম আছে, প্রথম ছয়টা কলামে সাতটা করে নাম সর্বশেষ কলামে আটটা নাম। সম্ভবত সেভেন বাই সেভেন গ্রিডের পরিকল্পনা ছিল, তারপর সোলারিয়া অন্তর্ভুক্ত হয়। আমার ধারণা, ওল্ড চ্যাপ, এই তালিকা সোলারিয়াতে বসতি শুরুর অনেক আগে। তৈরি হয়েছে।

আর আমরা কোন গ্রহের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি? বলতে পারবে?

তৃতীয় কলামের পাঁচ নাম্বার নামটা হচ্ছে তালিকার উনিশতম, অন্যগুলো থেকে বড় করে লেখা। বর্ণগুলোর বিন্যাস দেখে মনে হয় নিজেদের অহংকার আর আভিজাত্য প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া —

নামটা কী?

যত দূর বোঝা যাচ্ছে, লেখা আছে মেলপোমিনিয়া। কখনো শুনিনি।

এটা পৃথিবীর প্রতিশব্দ হতে পারে?

হেলমেটের ভেতর জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়ল পেলোরেট। প্রাচীন কিংবদন্তিতে পৃথিবীর অনেক প্রতিনাম ব্যবহার করা হয়েছে। গায়া তার একটা। এ ছাড়াও রয়েছে টেরা, এড্রা এরকম আরো অনেক। সবগুলোই ছোট। দীর্ঘ কোনো নাম ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই, অথবা মেলপোমিনিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করে এমন কোনো নাম।

তা হলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি মেলপোমিনিয়ায়। এবং এটা পৃথিবী নয় ।

হ্যাঁ। এবং তা ছাড়া নিজের নাম বড় বড় অক্ষরে লিখার পরেও আরো বড় প্রমাণ-এই গ্রহের কো-অর্ডিনেটস লেখা আছে ০,০,০।

কো-অর্ডিনেটস? বিষ্ময়ে চিৎকার করল ট্র্যাভিজ। তালিকায় কো-অর্ডিনেটস দেওয়া আছে?

প্রতিটা নামের পাশে তিনটা সংখ্যা দেওয়া আছে এবং আমার ধারণা ওগুলো কো-অর্ডিনেটস, আর কী হতে পারে?

উত্তর না দিয়ে ডান উরুর কাছে স্পেসস্যুটের ছোট কম্পার্টম্যান্ট থেকে একটা কম্প্যাক্ট ডিভাইস বের করল ট্র্যাভিজ। লম্বা তার কম্পার্টম্যান্টের সাথে যুক্ত। যত্নের সাথে যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে দেয়ালের শিলালিপির দিকে ফোকাস করল। মাত্র কয়েক মিনিটের কাজ কিন্তু আবৃত হাতে কাজটা করতে অনেক সময় লাগছে।

ক্যামেরা? পেলোরেটের অর্থহীন মন্তব্য।

এটা সরাসরি মহাকাশযানের কম্পিউটারে ইমেজ রেকর্ড করবে।

বিভিন্ন দিক থেকে অনেক গুলো ছবি তুলল সে, তারপর বলল, দাঁড়াও! উপরে উঠতে হবে। সাহায্য করো, জেনভ।

পেলোরেট সাথে সাথে হাত দিয়ে স্টিরাপ তৈরি করল কিন্তু মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। আমার ওজন রাখতে পারবে না। হাত আর হাঁটুতে ভর দিয়ে বস।

বেশ কষ্ট করে বসতে পারল পেলোরেট, ক্যামেরা আবার ভেতরে রেখে ট্র্যাভিজ একই রকম কষ্ট করে পেলোরেটের কাঁধে উঠল, সেখান থেকে মূর্তির পাদানিতে চড়ল । তারপর মূর্তির ভাঁজ করা হাঁটুতে ভর দিয়ে হাতবিহীন কাঁধ ধরল। অমসৃণ বুকে গোড়ালির ভর দিয়ে চড়ে বসল কাঁধে। যে মানুষগুলো দীর্ঘদিন আগে মারা গেছে তারা কোনো উদ্দেশ্যে এই মূর্তি তৈরি করেছিল। নিশ্চয়ই তাদের কাছে। ট্র্যাভিজের এই আচরণ চরম অপমানের মতো। এই চিন্তা করেই একটু হালকাভাবে বসার চেষ্টা করছে সে।

তুমি পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল পেলোরেট।

পড়ব না, কথার সাথে সাথে ক্যামেরা ফোকাস করল ট্র্যাভিজ। আরো। অনেকগুলো ছবি তুলল তারপর আগের মতো সাবধানে নেমে এল পাদানিতে। সেখান থেকে লাফ দিয়ে নামল মাটিতে, আর যেন সেটারই প্রয়োজন ছিল। লাফিয়ে নামার ফলে যে কম্পন তৈরি হলো তাতে মূর্তির অক্ষত হাতটাও ভেঙে পড়ল এবং পায়ের দিক থেকে লাফিয়ে উঠল একগাদা পাথর টুকরো। কিন্তু কোনো শব্দ হয়নি।

জমে গেছে ট্র্যাভিজ, তার প্রথম চিন্তাই ছিল ওয়াচম্যান দেখার আগেই কোথাও লুকাতে হবে। আশ্চর্য, ভাবল সে, এরকম পরিস্থিতিতে কীভাবে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে–যখন হাত থেকে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো জিনিস ভেঙে যায়। অল্প সময়ের ভাবনা, কিন্তু দাগ কেটে দিল মনে।

পেলোরেটের গলা কেমন ফাঁকা শোনালো, যেন তার চোখের সামনে কেউ অসামান্য একটা শিল্পকর্ম নষ্ট করে ফেলেছে। তবে সামলে নিতে পারল। ঠিক-ঠিক আছে, গোলান। এমনিতেই ভেঙে পড়ত।

পাদদেশের কাছে ছড়ানো টুকরোগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে যেন ভেঙে পড়ার কারণ বর্ণনা করবে, বড় একটা পাথর খণ্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, গোলান, এদিকে এস।

ট্র্যাভিজ কাছে যেতেই পেলোরেট যে পাথর খণ্ড দেখালো নিঃসন্দেহে সেটা মূর্তির কাঁধের সাথে জোড়া দিয়ে রেখেছিল। এটা কী? জিজ্ঞেস করল সে।

আঁশের মতো উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের কী যেন রয়েছে। স্পেসস্যুট দিয়ে ঢাকা আঙুল দিয়ে ঘষা দিতেই পরিষ্কার হয়ে গেল।

শেওলা মনে হচ্ছে। বলল ট্র্যাভিজ।

মাইণ্ড বিহীন যে জীবনের কথা বলেছিলে?

কতটুকু মাইণ্ড বিহীন ঠিক বলতে পারব না, ব্লিস বলতে পারবে, এবং মনে হয় বলবে যে এর কনশাসনেস আছে-কিন্তু সেতো বলে যে সামনের ঐ পাথরটারও কনশাসনেস আছে।

তোমার কি মনে হয় শেওলার কারণে পাথরগুলো ভেঙে পড়ছে?

কোনো না কোনো ভূমিকা তো আছেই। এই গ্রহে সূর্যের আলোর অভাব নেই, সামান্য পানি আছে। বায়ুমণ্ডলের অর্ধেক জলীয় বাষ্প। বাকি অংশ নাইট্রোজেন এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাস। কার্বন-ডাই অক্সাইড নেই বললেই চলে। সবাই ধরে নেবে এখানে কোন উদ্ভিদ নেই–কিন্তু কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা কম হওয়ার কারণ তা পাথরের সাথে মিশে আছে। এখন যদি পাথরে সামান্য কার্বনেট থাকে তবে শেওলা কোনো ধরনের এসিডের সাহায্যে পাথরের ভেতর থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ করবে।

চমৎকার।

নিঃসন্দেহে। তারচেয়েও চমৎকার হচ্ছে স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর কো-অর্ডিনেটস। কিন্তু আমরা চাই পৃথিবীর কো-অর্ডিনেটস। এখানে না থাকলে বিল্ডিঙের অন্য কোথাও আছে–অথবা অন্য কোনো বিল্ডিঙে। এসো জেনভ।

কিন্তু —

না, না। পরে কথা বলব। প্রথমে কী পাই সেটা দেখতে হবে। তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ডান হাতের দস্তানার উল্টোদিকে ছোট টেম্পারেচার রিডিং দেখে বলল ট্র্যাভিজ। এসো, জেনভ।

মৃদু পায়ে হাটছে অভিযাত্রীরা। যদিও শব্দ হচ্ছে না বা কেউ নজর রাখছে না। কিন্তু তারা একটু লজ্জিত। ভাইব্রেশনের মাধ্যমে আর কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই।

পায়ের আঘাতে ধুলো উড়ছে। যদিও বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারছে না পাতলা বাতাসের কারণে, পেছনে পায়ের ছাপ থেকে যাচ্ছে।

অনুজ্জ্বল কোণগুলোতে যখন তখন চোখে পড়ছে শেওলা। যদিও নিচু স্তরের জীবন, কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে, নিষ্প্রাণ, নিঃস্তব্ধ, মৃগ্রহে হেঁটে বেড়ানোর শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি থাকছে না, বিশেষ করে চারদিকের কাঠামো দেখে মনে হচ্ছে যে এটা একসময় ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।

তারপর পেলোরেট বলল, আমার মনে হয় এটা লাইব্রেরি।

কৌতূহলী হয়ে চারপাশে তাকাল ট্র্যাভিজ। অনেকগুলো সেলফ, আরেকটু তীক্ষ্ণ চোখে তাকানোর পরে যা দেখল সেগুলো প্রথমে মনে হলো কারুকাজ, তারপর ভাবল বুক ফিল্ম হলেও হতে পারে। সতর্কভাবে একটা হাতে নিল। পাতলা ভঙ্গুর ধারক। বুড়ো আঙুলের টোকা দিয়ে ডালা খুলল, আরো পাতলা এবং আরো ভঙ্গুর। যদিও পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন মনে করল না।

অবিশ্বাস্য রকম প্রাচীন।

হাজার বছরের পুরোনো, ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে পেলোরেট বলল, যেন অপ্রতিরোধ্য প্রযুক্তির অভিযোগ থেকে প্রাচীন মেলপোমিনিয়াকে রক্ষার চেষ্টা করছে।

ট্র্যাভিজ ডিস্কের মাঝখানে চমৎকার বিন্যাসে খোদাই করা বর্ণগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কি শিরোনাম? কী লিখেছে?

পড়ে দেখল পেলোরেট। ঠিক নিশ্চিত নই, ওল্ড ম্যান। একটা শব্দের অর্থ মনে হচ্ছে অণুজীব। সম্ভবত মাইক্রো-অর্গানিজম। আমার ধারণা এগুলো টেকনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টার্ম, স্ট্যাণ্ডার্ড গ্যালাকটিকেও আমি সেটা বুঝব না।

সম্ভবত। এবং বুঝতে পারলেও কোনো লাভ হবে না। জীবাণুর প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।–একটা কাজ করো, জেনভ। বইগুলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে ইন্টারেস্টিং কিছু পাও কিনা দেখ। ততক্ষণে আমি বুক ভিউয়ারগুলো একটু দেখি।

ওগুলো বুক ভিউয়ার? অবাক হয়ে বলল পেলোরেট। উবু হয়ে বসলে যেমন দেখায় সেরকম ত্রিকোণ কাঠামো, চূড়ায় একটা তীর্যক স্ক্রিন এবং বাঁকানো সমতল অংশ যেখানে হাত বা ইলেকট্রো নোটপ্যাড রাখা হতো-অবশ্য মেলপোমিনিয়ায় এধরনের জিনিস ছিল কি না বলা যাবে না।

এটা যদি লাইব্রেরি হয়, ট্র্যাভিজ বলল, কোনো না কোনো ধরনের বুক ভিউয়ার থাকতে বাধ্য, আমার মন বলছে এগুলোই সেই জিনিস।

আলতো ভাবে স্ক্রিনের উপর থেকে ধুলো মুছল সে, তারপরেও আস্ত থাকায় স্বস্তি পেল, যে পদার্থ দিয়ে জিনিসগুলো তৈরি করা হয়েছে তার স্পর্শে সেগুলো ভেঙে পড়েনি। হালকাভাবে একটার পর একটা বোতাম টিপতে লাগল, লাভ হলো না। পর পর কয়েকটা বুক-ভিউয়ার চালানোর চেষ্টা করে ফল হল একই।

অবাক হয়নি সে। বিশ হাজার বছর পরে এগুলো কাজ করলেও পাওয়ার আসবে কোত্থেকে। সংরক্ষিত এনার্জি সবসময়ই ক্ষয় হয়। ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। এটা থার্মোডাইন্যামিক্সের দ্বিতীয় সূত্র।

পেলোরেট ডাকল পেছন থেকে, গোলান?

হ্যাঁ। একটা বুক ফিল্ম পেয়েছি–

কী ধরনের?

আমার ধারণা এটা স্পেস ফ্লাইটের ইতিহাস।

দারুণ–কিন্তু ভিউয়ার না চালাতে পারলে কোনো লাভ হবে না। হতাশায় হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করল সে।

ফিল্মটা জাহাজে নিয়ে যেতে পারি।

আমাদের ভিউয়ারে কীভাবে ঢোকাবো আমি জানি না। স্ক্যানার সিস্টেমেও ফিট করা যাবে না।

কিন্তু এর কি কোনো প্রয়োজন আছে, গোলান? যদি আমরা

আসলেই প্রয়োজন আছে, জেনভ। এখন বাধা দিও না। কী করা যায় ভাবছি। ভিউয়ারে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের চেষ্টা করতে পারি। সম্ভবত সেটাই প্রয়োজন।

কোত্থেকে পাওয়ার আনবে?

বেশ–অস্ত্রগুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল ট্র্যাভিজ। ব্লাস্টার রেখে দিয়ে নিউরোনিক হুইপ খুলল। অস্ত্রটার এনার্জি সাপ্লাই লেভেল ম্যাক্সিমামে আছে।

হামাগুড়ি দিয়ে ভিউয়ারের পেছনে গেল সে। ঠেলা দিয়ে সামনে আনল। অনেক গুলো তার। দেয়াল থেকে যেটা বেড়িয়েছে নিঃসন্দেহে সেটাই পাওয়ার সাপ্লাই করে। প্রথমে আস্তে তারপর জোরে তার ধরে টানল। দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে দেখল। বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না।

মেঝেতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সেই সাথে ক্যাবল উঠে এল তার সাথে । কীভাবে দেয়াল থেকে ক্যাবল খুলে গেল বুঝতেই পারল না সে। ছিঁড়েছে বলে মনে হলো না, কারণ শেষ মাথা মসৃণ, দেয়ালের মেঝেতে যেখানে ক্যাবল ঢোকানো ছিল সেখানে মসৃণ দাগ।

গোলান, আমি–নরম সুরে বলল পেলোরেট।

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ট্র্যাভিজ। এখন না, জেনভ। প্লিজ!

হঠাৎ করেই বা হাতের দস্তানায় সবুজ রঙের কিছু পদার্থ চোখে পড়ল। সম্ভবত ভিউয়ারের পেছন থেকে শেওলা লেগেছে। দস্তানা কিছুটা সঁতসেঁতে হয়ে গেছে, কিন্তু শুকিয়ে গেল দ্রুত, সবুজ রঙ পাল্টে চোখের সামনেই হয়ে গেল বাদামি।

আবার ক্যাবলের বিচ্ছিন্ন মাথার দিকে গভীর মনযোগ দিল। মেঝেতে বসে নিউরোনিক হুইপের পাওয়ার ইউনিট খুলল। তারের একমাথা মুক্ত করে ঢোকাতে লাগল সাবধানে, না থামা পর্যন্ত ঢুকিয়ে গেল। আলতোভাবে টেনে দেখল শক্ত হয়েছে কিনা।

জেনভ, বলল সে, তুমি অনেক ধরনের বুক ফিল্ম নিয়ে কাজ করেছ। চেষ্টা করে দেখ এটা ভিউয়ারে ঢোকাতে পারো কিনা।

তার কি আসলে কোনো প্র–

প্লিজ, জেনভ, তুমি বারবার অবান্তর প্রশ্ন করছ। হাতে বেশি সময় নেই। রাত নামার আগেই ফিরতে হবে। নইলে ঠাণ্ডায় জমে মরব।

এভাবেই ঢোকানো উচিত। কিন্তু–

ঠিক আছে। যদি এটা স্পেস-ফ্লাইটের ইতিহাস হয় তাহলে পৃথিবীর কথা দিয়ে শুরু হবে, কারণ মহাকাশ ভ্রমণের জন্ম হয় পৃথিবীতে। এখন দেখা যাক এটা কাজ করে কিনা।

কাঁপা হাতে ভিউয়ারে বুক ফিল্ম ঢুকিয়ে নির্দেশনার জন্য কন্ট্রোলে চোখ বুলাল পেলোরেট।

নিজের অস্থিরতা কমানোর জন্য নিচু স্বরে কথা বলল ট্র্যাভিজ, আমার ধারণা এই গ্রহেও রোবট ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর পাওয়ার সাপ্লাই অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার চালু করলেও ব্রেইন কাজ করবে কি? গিয়ার বা লিভার হয়তো হাজার বছর টিকবে। কিন্তু ব্রেইনের সাব এটমিক মাইক্রোসুইচ টিকবে? নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যাবে, আর চালু থাকলেই বা পৃথিবীর ব্যাপারে কি বলতে পারবে। কত দূর

ভিউয়ার কাজ করছে, ওল্ড চ্যাপ। দেখ। পেলোরেট বলল।

অস্পষ্ট আলো জ্বলে উঠল। কাঁপতে লাগল বুক ভিউয়ার। ঝাপসা, কিন্তু ট্র্যাভিজ নিউরোনিক হুইপের পাওয়ার বাড়ানোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাতলা বাতাস সূর্যের আলো দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফলে ঘরের ভেতর অন্ধকার এবং ছায়াময়। তুলনামূলকভাবে স্ক্রিন বেশি উজ্জ্বল। এখনও কাঁপছে, মাঝে মাঝে কম্পিত ছায়া পড়ছে।

ফোকাস করতে হবে। বলল ট্র্যাভিজ।

জানি না, পেলোরেট বলল, কিন্তু এর বেশি কিছু করতে পারব না।

স্ক্রিনে ছায়া পড়েই দ্রুত সরে যাচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যেন আঁকাবাঁকা ঝাপসা প্রিন্ট দেখা গেল। তারপর এক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়েই ঝাপসা হয়ে গেল আবার।

ওই জায়গাটা ফিরিয়ে আনো, জেনভ।

পেলোরেট এরই মধ্যে চেষ্টা শুরু করেছে। অনেক কসরত করে উজ্জ্বল অংশটুকু ফিরিয়ে আনল।

আগ্রহের সাথে পড়ার চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ। তারপর হতাশ সুরে বলল, তুমি পড়তে পারছ, জেনভ।

পুরোটা না, স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে পেলোরেট বলল। তবে এতটুকু বলতে পারি এখানে সোলারিয়ার কথা বলা হয়েছে। আমার ধারণা প্রথম হাইপার স্পেসাল এক্সপিডিশনের কথা লেখা আছে। পুরো বর্ণনা স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো নিয়ে গোলান। পৃথিবীর কোনো কথা নেই।

থাকবে না, তিক্ত সুরে বলল ট্র্যাভিজ। এই গ্রহ, ট্র্যানটর সব জায়গা থেকে তথ্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বন্ধ করে দাও।

সেটা কোনো ব্যাপার না–

কারণ আমরা অন্য লাইব্রেরিতে খুঁজতে পারি? সেখানেও থাকবে না। তুমি জানো- কথা বলার সময় পেলোরেটের দিকে তাকিয়েছিল ট্র্যাভিজ, এখন তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠল আতঙ্ক। তোমার ফেসপ্লেটের কী হয়েছে? সে জিজ্ঞেস করল।

.

দস্তানা পড়া হাতে ফেসপ্লেট স্পর্শ করে, আবার সরিয়ে আনল পেলোরেট। কী এগুলো? হতভম্ব গলায় বলল সে। তারপর ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ফেস প্লেট কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে, গোলান।

নিজের অজান্তেই আয়নার জন্য চারপাশে তাকালো ট্র্যাভিজ, কিন্তু নেই। থাকলেও লাভ হতোনা, কারণ ঘর অন্ধকার। সূর্যের আলোর কাছে চলো।

প্রায় টেনেহিঁচড়ে পেলোরেটকে সে কাছাকাছি জানালার কাছে নিয়ে গেল। স্পেস স্যুটের প্রতিরোধ সত্ত্বেও পিঠে গরম লাগছে।

চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকাও, জেনভ। সে বলল।

ফেস প্লেটে যা ছিল সাথে সাথে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। স্যুটের ধাতব বুনটের সাথে যেখানে ফেস প্লেট মিশেছে সেখানে শেওলা জমেছে, সবুজ আসে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। জানে নিজের ফেসপ্লেটেরও একই অবস্থা।

পেলোরেটের ফেস প্লেটের উপর আঙ্গুল ঘষল সে, সবুজ রঙের গুঁড়ো পদার্থ আঙুলের সাথে উঠে এল। সূর্যের তাপে শেওলা দ্রুত শুকিয়ে বাদামি রং ধরছে। এবার সে ফেসপ্লেটের কোণাগুলোতে আরো জোরে ঘষল।

আমারটাও পরিষ্কার করে দাও, জেনভ। তারপর চলো ফিরে যাই। এখানে আর : কিছু করার নেই।

নিষ্প্রাণ বায়ুশূন্য শহরে সূর্য তার সব শক্তি দিয়ে তাপ ছড়াচ্ছে। পাথুরে ভবনগুলোতে আলো প্রতিফলিত হয়ে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ। যত দূর সম্ভব ছায়ার ভেতর দিয়ে হাটছে ট্র্যাভিজ। একটা ভাঙা দেয়ালের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে বের করে আনল। ফিসফিস করে বলল, শেওলা। এগিয়ে গিয়ে আঙুলটা সূর্যের আলোতে বাড়িয়ে ধরল।

কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ খুব কম। সে বলল, ফলে যেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড পাচ্ছে সেখানেই শেওলা জন্মাচ্ছে। আমরা এই মুহূর্তে একটা প্রধান উৎস, সম্ভবত এই মৃত গ্রহের যে-কোনো উৎস থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী এবং আমার ধারণা ফেস প্লেট যেখানে জোড়া লাগানো হয়েছে সেখান থেকেই গ্যাস লিক করছে।

তাই সেখানে শেওলা জন্মাচ্ছে।

হ্যাঁ।

ফেরার পথ মনে হলো অনেক দীর্ঘ, আর সকালের তুলনায় এখন গরমটাও বেশি। তবে পৌঁছে দেখল মহাকাশযান এখনও ছায়ার ভেতর রয়েছে।

দেখ! বলল পেলোরেট।

ট্র্যাভিজ দেখল। মেইনলকের কিণারাগুলোতে সবুজ শেওলার সরল রেখা।

আরো লিকেজ, বলল পেলোরেট।

হ্যাঁ, কিন্তু অল্প পরিমাণে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এমন ঘটনা আমি কখনো দেখিনি। শেওলার বীজ নিশ্চয়ই সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে এবং যেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড পাচ্ছে সেখানেই শিকড় গজাচ্ছে। রেডিও মহাকাশযানের ওয়েভলেংথে সেট করে ব্লিসকে ডাকল সে, ব্লিস, শুনতে পারছো।

ব্লিসের জবাব শুনতে পারলো দুজনেই, হ্যাঁ। ভেতরে আসার জন্য তেরি? কোনো সুখবর?

আমরা দরজার ঠিক বাইরেই আছি। কিন্তু দরজা খুলবে না। আমরা বাইরে থেকে খুলব। আবার বলছি, তুমি দরজা খুলবে না।

কেন?

ব্লিস, যা বলছি তাই করো। পরে বুঝিয়ে বলব।

ব্লাস্টার বের করে সাবধানে পাওয়ার সর্বনিম্ন মাত্রায় নির্দিষ্ট করল ট্র্যাভিজ। অনিশ্চিত বোধ করছে, এর আগে কখনো এত কম পাওয়ারে চালায়নি। চারপাশে তাকিয়ে পরীক্ষা করার মতো সেরকম কিছু খুঁজে পেল না।

অনেকটা বেপরোয়া হয়ে যে পাহাড়ের গোড়ায় ফার স্টার দাঁড়িয়ে আছে তার চূড়ার দিকে লক্ষ্য স্থির করে ফায়ার করল। লক্ষ্য বিন্দু বিস্ফোরিত হলো না, তবে মানসচক্ষে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট দেখতে পেল। তারপর ধারণা করল মহাকাশযানের হাল যে-কোনো বিপদ ঠেকানোর জন্য পাহাড়ের মতোই শক্ত হবে। মেইন লকের প্রান্তভাগের দিকে ব্লাস্টার ঘুরিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে ফায়ার করল সে।

কয়েক সেন্টিমিটার অংশের সবুজ শেওলা সাথে সাথে বাদামি হয়ে গেল হাত দিয়ে ঝাড়তেই ঝরে পড়ল বাদামি অংশটুকু।

কাজ হচ্ছে? উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

হচ্ছে। ট্র্যাভিজ বলল।

মেইনলকের চারদিকের প্রান্তভাগে ব্লাস্টারের রশ্মি ছোঁড়ার পর সবুজ রং অদৃশ্য হয়ে গেল। থাবা দিয়ে ভাইব্রেশন তৈরি করল যেন বাদামি ধুলো ঝরে পড়ে–এত মিহি ধুলো যে পাতলা বাতাসে ও গ্যাসের মতো অনেকক্ষণ ভেসে থাকল।

আমার মনে হয় এবার খোলা যায়, সেই সাথে কবজির কন্ট্রোলের বোম টিপে ভেতরে সংকেত পাঠিয়ে ওপেনিং মেকানিজম চালু করল। মেইন লক অর্ধেক খুলতেই পেলোরেটকে বলল, জলদি, জেনভ। দেরি করোনা। লাফ দিয়ে উঠে পড়ো।

নিজেও ঢুকল পেছন পেছন, দরজার কোণায় যেখানে পা ফেলেছে সেখানে লক্ষ্য। স্থির করে ফায়ার করল। তারপর মেইনলক বন্ধ করার সংকেত পাঠাল, পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চালু রাখল ব্লাস্টার।

আমরা ভেতরে ঢুকেছি, ব্লিস। এখানে কিছুক্ষণ থাকব। তুমি কিছু করবে না।

আমাকে কিছু সূত্র দাও। বলল ব্লিস। তোমাদের কোনো বিপদ হয়নি তো? পেল কেমন আছে?

আমি এখানে, ব্লিস, এবং পুরোপুরি নিরাপদ। চিন্তা করো না।

শুনেছি, পেল, তবে পরে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আশা করি তুমি সেটা জানো।

কথা দিচ্ছি, বলল ট্র্যাভিজ। আলো জ্বেলে পেলোরেটকে বলল, এখান থেকে। গ্রহের সব বাতাস পাম্প করে বের করে দেব, একটু অপেক্ষা করো।

মহাকাশযানের বাতাসের কী হবে? সেটা ঢুকতে দেবে?

এখনই না। আমিও তাড়াতাড়ি স্পেস স্যুট খুলে ফেলতে চাই, জেনভ। কিন্তু তার আগে যদি কোনো জীবাণু আমাদের সাথে আসে সেটা দূর করতে হবে।

আলো কম। সেই অবস্থাতেই ট্র্যাভিজ দরজার ভেতর দিকে, মেঝেতে, দেয়ালের উপর থেকে নিচে ব্লাস্টারের রশ্মি স্প্রে করল।

এবার তুমি, জেনভ।

অস্বস্তি নিয়ে তাকাল পেলোরেট, ট্র্যাভিজ বলল, একটু গরম লাগবে, তার বেশী কিছু না। খারাপ লাগলে সাথে সাথে বলবে।

অদৃশ্য রশ্মি প্রথমে ফেসপ্লেট তারপর ধীরে ধীরে স্পেসস্যুটের প্রতি ইঞ্চি জায়গার উপর ফেলল সে। ফিসফিস করে বলল, হাত তোল, জেনভ। আমার কাঁধে ভর দিয়ে এক পা তোল-এবার অন্যটা। গরম লাগছে বেশি?

এখানে তো ঠাণ্ডা বাতাস বইছে না। বলল পেলোরেট।

বেশ, নিজের তৈরি ওষুধ পরখ করে দেখি। আমার উপর চালাও।

আমি কখনো ব্লাস্টার চালাইনি।

চালাতে হবে। এভাবে মুঠ করে ধরো, বুড়ো আঙুল দিয়ে ছোট বোতামটায় চাপ দাও-আর ব্লাস্টার শক্ত হাতে ধরে রাখবে। ঠিক আছে।–এবার আমার ফেস। প্লেটের উপর ঘোড়াও। ধীরে, ধীরে, জেনভ, এক জায়গায় বেশিক্ষণ ধরে রাখবে না। বাকি হেলমেটের উপর, চোয়াল, ঘাড়।

পুরো শরীর গরমে ঘেমে না উঠা পর্যন্ত নির্দেশনা দিয়ে গেল ট্র্যাভিজ। তারপর ব্লাস্টার হাতে নিয়ে এনার্জি লেভেল দেখল।

অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে, বলল সে, এবং ভেতরের দেয়ালে রশ্মি ছুঁড়ল, সামনে পেছনে, উপরে নিচে এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ দিল না, চার্জ শেষ না হওয়া। পর্যন্ত ছুঁড়ে গেল।

পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই ট্র্যাভিজ মহাকাশযানের ভেতরে ঢোকার দরজা খোলার সংকেত দিল। ভেতরের ঠাণ্ডা বাতাস এবং দরজা খোলার হিস শব্দটাকে সে স্বাগত জানাল খুশিমনে। হয়তো কল্পনা, সাথে সাথে ঠাণ্ডা অনুভব করল সে। কল্পনা হোক আর যাই হোক এই অনুভূতিকেও সে খুশি মনে স্বাগত জানাল।

স্পেস স্যুট খুলে এখানেই রেখে যাও, জেনভ।

কিছু মনে করো না, বলল পেলোরেট, সব কিছুর আগে আমার দরকার গোসল।

সব কিছুর আগে না। সত্যি কথা বলতে কি, সবার আগে এমনকি ব্লাডার খালি করার আগে তোমাকে ব্লিসের সাথে কথা বলতে হবে।

ব্লিস অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য, চেহারায় উদ্বেগ। তার পেছন থেকে উঁকি মারছে ফেলম। শক্ত করে ব্লিসের ডান হাত জড়িয়ে রেখেছে।

কী ঘটেছে? কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল ব্লিস। এমন করছ কেন তোমরা?

জীবাণুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। শুকনো গলায় বলল ট্র্যাভিজ। আন্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন চালু করতে হবে। কালো গ্লাসগুলো নামিয়ে দাও। দেরি করো না।

আলোকিত দেয়ালের সাথে অতিবেগুনি রশ্মি যোগ হয়ে উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে তুলল। একে একে পরনের ঘামে ভেজা সব পোশাক খুলে ফেলল ট্র্যাভিজ। বিভিন্নভাবে নেড়ে চেড়ে শুকিয়ে নিল।

শুধু একটু সতর্কতা, বলল সে। তুমি ও করো, জেনভ, আর ব্লিস আমাকে সব, কাপড় খুলে ফেলতে হবে। তোমার অস্বস্তি লাগলে পাশের ঘরে চলে যেতে পারো।

ব্লিস বলল, অস্বস্তি লাগবে না বিব্রতও হব না। তুমি দেখতে কেমন সেই সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণা আছে। এবং অবশ্যই নতুন কিছু দেখাতে পারবে না।–কী ধরনের জীবাণু।

খুবই ছোট, যতদূর সম্ভব নিরাসক্ত গলায় বলার চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ। তবে আমার ধারণা মানুষের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।

.

শেষ হলো সব। অতিবেগুনি আলো তার কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করল। ফার স্টারে প্রথম উঠার পর জটিল ফিল্ম এবং ইস্ট্রাকশন থেকে সে জেনেছিল অতিবেগুনি আলো জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

মহাকাশ যান আকাশে উড়ল, এবং ট্র্যাভিজ এমনভাবে চালাচ্ছে যেন কোনো ক্ষতি না করে মেলপোমিনিয়ার সূর্যের খুব কাছে থাকা যায়। এদিকে সেদিকে বারবার ঘুরিয়ে মহাকাশযানের পুরো সারফেস অতিবেগুনি রশ্মিতে ভিজিয়ে নিচ্ছে।

সবার শেষে স্পেস স্যুট দুটো উদ্ধার করে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল ট্র্যাভিজ।

এত ঝামেলা, বলল ব্লিস, শুধু শেওলার জন্য। একথাই তো বলেছিলে, ট্র্যাভিজ? শেওলা?

বলেছিলাম। কারণ সবার আগে এই শব্দটাই মাথায় এসেছে। যদিও আমি উদ্ভিদবিজ্ঞানী নই। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে এগুলো গাঢ় সবুজ এবং খুবই অল্প পরিমাণে আলোক শক্তি ব্যবহার করে।

অল্প পরিমাণে করে কেন?

শেওলা অতিবেগুনি রশ্মি বা সামান্য আলোও সহ্য করতে পারে না। এগুলোর। বীজ সবখানেই ছড়ানো, অথচ জন্মায় শুধু দেয়ালের ফাঁকে বা ছাদের অন্ধকার লুকনো স্থানে যেখানে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎস আছে, ছড়ানো ছিটানো আলোক কণা থেকে শক্তি সংগ্রহ করে।

এবং তোমার ধারণা এগুলো বিপজ্জনক।

বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা যদি কোনো বীজ নিয়ে আসি এখানে প্রচুর পানি। এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড পাবে।

মাত্র ০.০৩ পারসেন্ট।

যথেষ্ট। আমাদের নাকের ফুটো বা চামড়ায় যদি শেওলা জন্মায়? যদি আমাদের খাবার নষ্ট করে ফেলে? যদি কোনো বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে? কয়েকটা বীজ থাকলেই যথেষ্ট। আমরা যেখানে যাবো সেখানেই ছড়িয়ে পড়বে। কী পরিমাণ ক্ষতি করবে কে বলতে পারে।

মাথা নাড়ল ব্লিস, জীবনের প্রকৃতি ভিন্ন হলেই বিপজ্জনক হবে এমন কোনো কথা নেই।

এটা গায়ার কথা। বলল ট্র্যাভিজ।

অবশ্যই, কিন্তু আশা করি আমি বোঝাতে পেরেছি। শেওলাগুলো এই গ্রহের স্বল্প আলো এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডে অভ্যস্ত। হয়তো অতিরিক্ত আলো এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড সেগুলোকে মেরে ফেলবে। হয়তো মেলপোমিনিয়া ছাড়া অন্য কোনো গ্রহে এগুলো বাঁচে না।

তুমি চাও আমি একটা সুযোগ নিই?

কাঁধ নাড়ল ব্লিস। বেশ, তোমার ব্যপারটাও আমি বুঝেছি। যা করেছ আইসোলেট হিসেবে হয়তো অন্য কোনো উপায় ছিল না।

হয়তো উত্তর দিত ট্র্যাভিজ, কিন্তু এই সময় তীক্ষ্ণ গলায় নিজের ভাষায় কথা বলে উঠল ফেলম।

পেলোরেটকে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, মেয়েটা কী বলছে?

ফেলম বলছে–

একটু দেরি হলেও ফেলমের মনে পড়ল যে তার নিজের ভাষা কেউ বুঝবে না। তাই আবার বলল, তুমি যেখানে গিয়েছিলে সেখানে জেম্বি আছে?

শব্দের উচ্চারণ হলো নিখুঁত, এবং ব্লিসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুব ভালো গ্যালাকটিক বলতে পারে এখন, তাই না? এবং দ্রুত।

আমি সব গুলিয়ে ফেলব, তুমি ওকে বুঝিয়ে বল ব্লিস যে এই গ্রহে আমরা কোনো রোবট দেখিনি।

আমি বুঝিয়ে বলছি, বলল পেলোরেট। এস ফেলম। হালকাভাবে বাচ্চাটার কাঁধে একটা হাত রাখল পেলোরেট, ঘরে চলো, পড়ার জন্য তোমাকে একটা বই দিচ্ছি।

বই? জেম্বির কথা থাকবে?

ঠিক সেরকম না– দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা।

তুমি জানো, ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল ট্র্যাভিজ, এই শিশুর সেবা যত্ন করে সময় নষ্ট করছি আমরা।

সময় নষ্ট? ও তোমার অনুসন্ধানে কোনো বাধা দিয়েছে, ট্র্যাভিজ?-দেয়নি। বরং তার সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে। এগুলো কি কিছুই না?

আবারও গায়া কথা বলছে।

হ্যাঁ, এবার তা হলে বাস্তববাদী হওয়ার চেষ্টা করো। তিনটা স্পেসার ওয়ার্ল্ড আমরা ভ্রমণ করেছি কিন্তু পাইনি কিছুই।

মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। খাঁটি কথা।

সত্যি কথা বলতে কি প্রতিটা গ্রহই ছিল বিপজ্জনক, তাই না? অরোরাতে ছিল হিংস্র বন্য কুকুর; সোলারিয়ায় অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক মানুষ; মেলোমিনিয়ায় বিপজ্জনক শেওলা। এটা পরিষ্কার কোনো গ্রহকে তার নিজস্ব প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলে সেখানে মানুষ থাক বা না থাক, সেটা ইন্টারস্টেলার কমিউনিটির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠে।

এগুলোকে তুমি সাধারণ নিয়ম হিসেবে ধরতে পার না।

তিনটার মধ্যে তিনটাই আমার ধারণার সাথে মিলে যায়, সত্যি প্রভাবিত করার মতো।

কীভাবে তোমাকে প্রভাবিত করেছে, ব্লিস?

বলছি। দয়া করে খোলা মন নিয়ে শোন। যদি বাস্তবে যেমন দেখা যায় সেরকম ভাবে শুধুমাত্র আইসোলেটদের নিয়ে লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ে উঠে তা হলে মানুষ তার প্রাধান্য বিস্তার করে নন-হিউম্যান লাইফ ফর্ম, নিষ্প্রাণ ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামো এবং এমনকি একে অন্যের উপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে গ্যালাক্সি হবে খুবই প্রাচীন, ভঙ্গুর এবং অকার্যকর একটা গ্যালাক্সিয়া। আমি কি বোঝাতে চাই তুমি ধরতে পেরেছ?

তুমি কি বলার চেষ্টা করছ সেটা আমি ধরতে পেরেছি-কিন্তু তার মানে এই না যে তোমার কথা আমি মেনে নেব।

শুধু শুনে যাও। মানা না মানা তোমার ব্যাপার, কিন্তু শোন। গ্যালাক্সিকে কার্যকর রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে ছদ্ম-গ্যালাক্সিয়া। ছদ্মবেশ যত কম হবে, গ্যালাক্সিয়া তত উন্নত হবে। গ্যালাকটিক এম্পায়ার ছিল ছদ্ম-গ্যালাক্সিয়া তৈরির শক্তিশালী পদক্ষেপ। যখন সেটা ভেঙে পড়ে, দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতা দেখা দেয় তখন ছদ্ম-গ্যালাক্সিয়াকে শক্তিশালী করার অনেকগুলো ধারাবাহিক পদক্ষেপ তৈরি হয়। ফাউণ্ডেশন কনফেডারেশন, মিউলের সাম্রাজ্য বা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন-এর পরিকল্পিত এম্পায়ার সেধরনেরই কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু এধরনের এম্পায়ার বা কনফেডারেশন না থাকলেও, পুরো গ্যালাক্সিতে বিশৃঙ্খলা থাকার পরও তার ভেতর একটা সম্পর্ক থাকত, প্রতিটি বিশ্ব যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া করত। সেটাও এতটা খারাপ হতো না।

তা হলে সবচেয়ে খারাপটা কী?

উত্তরটা তোমার জানা আছে, ট্র্যাভিজ। নিজেই দেখেছ। যদি মানুষের কোনো বসতি গ্রহের ভারসাম্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে সেটা হবে সত্যিকারের আইসোলেট, আর যদি অন্যান্য গ্রহের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সেটা বেড়ে উঠবে বিষফোঁড়ার মতো।

ক্যান্সার!

হ্যাঁ। সোলারিয়ার ব্যাপারটা ঠিক তাই। সে অন্য সব গ্রহের বিরুদ্ধে। এমনকি অধিবাসীরাও একে অপরের বিরুদ্ধে। এবং যদি সব মানুষ একসাথে অদৃশ্য হয়ে যায় শৃঙ্খলার সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছে যাবে। ফলে একে অপরের বিরোধিতা অযৌক্তিকভাবে বেড়ে উঠবে, যেমন কুকুর বা এই গ্রহের শেওলা। বুঝতেই পারছ, আমরা গ্যালাক্সিয়ার যত কাছে পৌঁছব সমাজ তত উন্নত হবে।

বেশ কিছুক্ষণ ব্লিসের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ। আমি ভাবছি। কেন এই ধারনা আমার একপেশে মনে হচ্ছে; অর্থাৎ ক্ষুদ্র যদি ভালো হয় বৃহৎ হবে বেশি ভালো, এবং সব মিলিয়ে হবে আরো বেশি ভালো? তুমিই বলেছ যে এই শ্যাওলাগুলো যেহেতু অল্প কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে সেহেতু যেখানে এই গ্যাসের প্রাচুর্য আছে সেখানে এগুলো বাঁচতে পারবে না। এক মিটার লম্বা মানুষের থেকে দুই মিটার লম্বা মানুষ ভালো; অন্য দিকে তিন মিটার লম্বা মানুষের থেকেও ভালো। একটা ইঁদুর যদি হাতির সমান বা একটা হাতি যদি ইঁদুরের মতো হয়, তা হলে কি বাঁচতে পারবে?

প্রতিটা বস্তু সেটা নক্ষত্র বা পরমাণু যাই হোক না কেন তার স্বাভাবিক আকৃতি স্বাভাবিক জটিলতা এবং স্বাভাবিক গুণ থাকবে, কথাটা প্রাণী এবং তাদের সমাজের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমি বলছি না যে গ্যালাকটিক এম্পায়ার আদর্শ ছিল, এবং ফাউণ্ডেশন কনফেডারেশনের বেশ কিছু ত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়েছে, কিন্তু আমি একথাও বলব না যে সামগ্রিক আইসোলেশন খারাপ এবং সামগ্রিক ইউনিফিকেশন ভালো। হয়তো দুটোই সমান খারাপ এবং পুরোনো গ্যালাকটিক এম্পায়ার যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন হয়তো এর বেশি কিছু করা আমাদের সামর্থ্যের বাইরে।

মাথা নাড়ল ব্লিস। কথাটা বোধহয় তুমি নিজেও বিশ্বাস করো না, ট্র্যাভিজ। তুমি কি বলতে চাও ভাইরাস এবং মানুষ সমান পরিত্যাজ্য এবং একটা মাঝামাঝি অবস্থানে থাকতে চায়-অনেকটা নরম ছাঁচের মতো।

না। বরং বলব যে ভাইরাস এবং সুপার হিউম্যান সমানভাবে পরিত্যাজ্য এবং একটা মাঝামাঝি পথ বেছে নেওয়া উচিত–যেমন সাধারণ মানুষ–যাই হোক, তর্ক করে লাভ নেই। পৃথিবী পাওয়া গেলেই আমার সমস্যার সমাধান হবে। ব্লিস মেলপোমিনিয়াতে বাকি সাতচল্লিশটা স্পেসার ওয়ার্ল্ডের কো-অর্ডিনেটস পেয়েছি।

তুমি সবগুলোতেই যাবে?

প্রত্যেকটাতে, যদি যেতে হয়।

সবার জীবনের উপর ঝুঁকি নেবে?

হ্যাঁ, যদি প্রয়োজন হয়।

ফেলমকে ঘরে রেখে ফিরে এল পেলোরেট। ব্লিস এবং ট্র্যাভিজের বাক্যবাণের মাঝখানে কিছু বলার চেষ্টা করল। মাথা একবার এদিক আরেকবার ওদিকে ঘোরাচ্ছে বারবার।

কতদিন সময় লাগবে? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।

যতদিন লাগে, লাগুক, বলল ট্র্যাভিজ, হয়তো পরবর্তী গ্রহেই প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবো।

অথবা কোথাও পাবো না।

অনুসন্ধান না করে বলা যাবে না।

এইবার শেষ পর্যন্ত কথা বলতে পারল পেলোরেট। কিন্তু কেন খুঁজব, গোলান। উত্তর আমরা পেয়ে গেছি।

পেলোরেটের দিকে অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ট্র্যাভিজ, থেমে গেল আচমকা। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী?

বলছি, উত্তরটা আমরা পেয়ে গেছি। মেলপোমিনিয়ায় কমপক্ষে পাঁচবার বলার চেষ্টা করেছি তোমাকে। কিন্তু নিজের কাজ নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিলে

কী উত্তর পেয়েছি? কী বলছ তুমি?

পৃথিবী। আমার ধারণা পৃথিবী কোথায় সেটা আমরা জানি এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *