৬. আলফা

ষষ্ঠ পর্ব – আলফা

১৬. বিশ্বসমূহের কেন্দ্র

চরম বিরক্তি নিয়ে পেলোরেটের দিকে তাকাল ট্র্যাভিজ। তারপর বলল, তুমি এমন কিছু দেখেছ যা আমি দেখিনি, অথচ বলনি আমাকে।

না, হালকা চালে উত্তর দিল পেলোরেট। তুমিও দেখেছ এবং আমি অনেকবার তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি।

বেশ, আবার চেষ্টা করো।

ওকে ধমক দেবে না, ট্র্যাভিজ। বলল ব্লিস।

আমি ধমক দিচ্ছি না। শুধু প্রশ্ন করছি। আর তুমিও শিশুর মতো ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করো না।

প্লিজ, বলল পেলোরেট, ঝগড়া না করে আমার কথা শোন–মানুষের উৎস খুঁজে বের করার প্রথম প্রচেষ্টার কথা তোমার মনে আছে, গোলান? ইয়েরিফ প্রজেক্ট? বিভিন্ন গ্রহে বসতিস্থাপনের তারিখের সাহায্যে অনুসন্ধান, ধারণা করা হয়েছিল যে ওয়ার্ল্ড অব অরিজিন বা মূলগ্রহের চারপাশে সমানভাবে বসতি স্থাপন করা হয়। ফলে নতুন গ্রহ থেকে যত পুরোনো গ্রহে যাবো ততই আমরা ওয়ার্ল্ড অব অরিজিন এর কাছাকাছি পৌঁছব।

অধৈর্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। আমার যতদূর মনে আছে এই প্রজেক্ট সফল হয়নি, কারণ বসতি স্থাপনের তারিখ বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

সেটা ঠিক, ওল্ড ফেলো। কিন্তু ইয়েরিফ যে গ্রহগুলো বেছে নিয়েছিল সেগুলো ছিল হিউম্যান রেস এর বসতি স্থাপনের যে স্রোত তার দ্বিতীয় পর্বের অংশ। সেই সময় হাইপার স্পেসাল ট্রাভেল অনেক অগ্রসর হয়েছে। বহুদূরের গ্রহে যাতায়াত হয়ে পড়েছে অনেক সহজ, এবং বসতি স্থাপন সুসংবদ্ধ বৃত্তের আকারে হয়নি। সে কারণেই সমস্যা দেখা দেয়।

কিন্তু স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর কথা চিন্তা করে দেখো, গোলান। ওগুলো ছিল বসতি স্থাপনের প্রথম পর্ব। হাইপার স্পেসাল ট্রাভেল তখন ছিল অনুন্নত। যেখানে দ্বিতীয় পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ গ্রহে বসতি স্থাপন করা হয় বিশৃঙ্খলভাবে, কিন্তু প্রথম পর্যায়ের পঞ্চাশটা গ্রহে সুশৃঙ্খলভাবে বসতি স্থাপন করা হয়। লক্ষ লক্ষ গ্রহে বসতি স্থাপন চলছে বিশ হাজার বছর ধরে, প্রথম পর্যায়ের পঞ্চাশটা গ্রহে বসতি স্থাপন করা হয় কয়েক শতাব্দীর ভেতর-প্রায় একই সাথে । ঐ পঞ্চাশটা গ্রহ একসাথে দেখলে মনে হবে ওয়ার্ল্ড অব অরিজিনকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে।

পঞ্চাশটা গ্রহের কো-অর্ডিনেটস আমাদের কাছে আছে। মনে আছে মূর্তির মাথা থেকে ছবি তুলে এনেছ তুমি। যে বা যারা পৃথিবীর তথ্যগুলো ধ্বংস করছে তারা হয়তো এই কো-অর্ডিনেটসগুলোর কথা ভুলে গেছে অথবা বুঝতে পারেনি যে এখান থেকে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য পাবো। তোমাকে যা করতে হবে, গোলান, সেটা হচ্ছে গত বিশ হাজার বছরের স্টেলার মোশনের সাথে এই-কো-অর্ডিনেটসগুলো সমন্বয় করে বৃত্তের কেন্দ্রটা বের করবে। তাহলে পৌঁছবে পৃথিবীর সূর্যের কাছাকাছি, অথবা অন্তত বিশ হাজার বছর আগে যেখানে ছিল পৌঁছাতে পারবে সেখানে।

মুখ হাঁ হয়ে গেছে ট্র্যাভিজের। পেলোরেটের কথা শেষ হওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পরে মুখ বন্ধ করল সে। বলল, এটা আমার মাথায় আসেনি কেন?

মেলপোমিনিয়ায় অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি তোমাকে।

কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কথা না শোনার জন্য ক্ষমা চাইছি, জেনভ। ঘটনা হচ্ছে আমার মনেই হয়নি যে– বিব্রতভাবে থামল সে।

শান্তভাবে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল পেলোরেট, যে আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে পারি। কিন্তু এই বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ। অবশ্য তোমার ধারণার পেছনেও যুক্তি আছে।

কখনোই না, জেনভ। নিজেকে আমার বোকা মনে হচ্ছে, আবারও ক্ষমা চাইছি-এখন আমাকে কম্পিউটারের কাছে যেতে হবে।

সে আর পেলোরেট পাইলটরুমে এসে ঢুকল, আর পেলোরেট বরাবরের মতোই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ট্র্যাভিজ ডেস্কের উপর হাত রাখতেই মানুষ এবং কম্পিউটার পরিণত হল এক সত্তায়।

আমাকে অনেক কিছু অনুমান করে নিতে হবে, জেনভ। বলল ট্র্যাভিজ। কম্পিউটারের সাথে তার চেতনা মিশে থাকায় মুখে একটা শূন্য ভাব। ধরে নিতে হবে প্রথম সংখ্যাটা পারসেক এ দূরত্ব, এবং অন্য দুটো কৌণিক রেডিয়্যান, প্রথমটা উপরের এবং নিচের, দ্বিতীয়টা ডান এবং বায়ের। ধরে নিতে হবে যোগ এবং বিয়োগ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে গ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ডে কোণ প্রকাশের জন্য এবং শূন্য-শূন্য-শূন্য হচ্ছে মেলপোমিনিয়ার সূর্যের অবস্থান।

কথায় যুক্তি আছে।

তাই। সংখ্যাগুলো সাজানোর সম্ভাব্য ছয়টা পদ্ধতি রয়েছে, চিহ্নগুলোকে সম্ভাব্য চারভাবে সাজানো যাবে, দূরত্বের একক পারসেক না হয়ে আলোকবর্ষ হতে পারে, কোণের একক রেডিয়ান না হয়ে ডিগ্রি হতে পারে। তার সাথে যোগ কর, দূরত্বের একক আলোকবর্ষ হলে বছরের দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। আরো যোগ কর যে পদ্ধতিতে কোণ মাপা হয়েছে সেটা আমি জানি না–আমার ধারণা মেলপোমিনিয়ান, ইকুয়েটরের ভিত্তিতে করা হয়েছে, কিন্তু প্রাইম মেরিডিয়ান কী?

এবার তুমি আমাকে আশাহত করছ।

না, আশা ছেড়ো না, অরোরা এবং সোলারিয়ার নাম তালিকায় আছে, এবং এই গ্রহগুলো মহাকাশের কোনখানে আমি জানি। কো-অর্ডিনেটস ব্যবহার করে সেগুলো খুঁজে বের করব। যদি ভুল হয় আবার চেষ্টা করব, সঠিক না হওয়া পর্যন্ত। আমার অনুমানগুলো সংশোধন করা হয়ে গেলে, বৃত্তের কেন্দ্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।

এতগুলো পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে না?

কী? বলল ট্র্যাভিজ। পুরোপুরি মগ্ন হয়ে গেছে, দ্বিতীয়বার বলতে হলো পেলোরেটকে। ওহ্ আসলে ধরে নেওয়া যায় যে কো-অর্ডিনেটসগুলো গ্যালাকটিক স্ট্যাণ্ডার্ড অনুসরণ করে এবং অজানা প্রাইম মেরিডিয়ানের সাথে সমন্বয় করা কঠিন কিছু না। মহাকাশে কোনো অবস্থান খুঁজে বের করার এই পদ্ধতিগুলো আবিস্কৃত হয় অনেক আগে, এবং অনেক নভোচারীর দৃঢ় বিশ্বাস স্পেস ট্র্যাভেলেরও আগে। মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ রক্ষণশীল, বিশেষ করে গণিতের কোনো নিয়ম তৈরি করলে সহজে পরিবর্তন করে না। আমার মতে-যদি প্রতিটি গ্রহ নিজস্ব গাণিতিক নিয়ম তৈরি করে যা আবার প্রতি শতাব্দীতেই পরিবর্তন হয় তা হলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ব্যাহত হত এবং একসময় থেমে যেত পুরোপুরি।

কথার সাথে সাথে কাজও করছে সে। এবার ফিসফিস করে বলল, এখন কথা বন্ধ।

তার চেহারা এখন গম্ভীর এবং মনোযোগের ছাপ। বেশ অনেকগুলো মিনিট কেটে যাওয়ার পর চেয়ারে হেলান দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল সে। শান্ত গলায় বলল, পদ্ধতিটা জানা গেছে। আরোরাকে চিহ্নিত করেছি আমি। কোনো সন্দেহ নেই দেখ।

স্ক্রিনে কেন্দ্রের কাছাকাছি উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বলল পেলোরেট, তুমি নিশ্চিত?

আমার নিজস্ব মতামত কোনো ব্যাপার না। কম্পিউটার নিশ্চিত। সে বলছে। এটাই অরোরা।

তা হলে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত।

না করে উপায় নেই। ভিউস্ক্রিন অ্যাডজাস্ট করে নেই যেন কম্পিউটার কাজ করতে পারে। তাকে কাজ করতে হবে পঞ্চাশটা কো-অর্ডিনেটস নিয়ে একসাথে।

কম্পিউটার স্পেস টাইমের চতুর্থ মাত্রায় কাজ করে, কিন্তু মানুষের পর্যবেক্ষণের জন্য দ্বিতীয় মাত্রাই যথেষ্ট। এখন স্ক্রিন মনে হচ্ছে নিকষ কালো চাদর, যেমন লম্বা তেমনি প্রশস্ত। নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা দেখার জন্য ঘরের আলো পুরোপুরি নিভিয়ে দিল ট্র্যাভিজ।

এখনই শুরু হবে, ফিসফিস করে বলল সে।

এক মুহূর্ত পরেই একটা নক্ষত্র ফুটে উঠল–তারপর আরেকটা-তারপর আরেকটা। নক্ষত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্ক্রিনের দৃশ্য পাল্টে যাচ্ছে। যেন মহাকাশ দ্রুত বেগে পিছনে ছুটছে আরো শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখানোর জন্য। একই সাথে পরিবর্তন ঘটছে উপরে, নিচে, ডানে, বায়ে–

পঞ্চাশটা আলোর বিন্দু ফুটে উঠল, ভেসে আছে মহাকাশের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবিতে।

আমি ভেবেছিলাম চমৎকার একটা বৃত্ত হবে, কিন্তু এটা দেখে মনে হচ্ছে একটা স্নো বলের কংকাল, যেন খুব তাড়াহুড়ো করে গোল আকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সমস্যা হবে। জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

খুব বেশি না। নক্ষত্রগুলোর নিজেদের বণ্টনই সুষম নয়, আর বাসযোগ্য গ্রহগুলোর ভেতর তো আরো সামঞ্জস্য নেই। কম্পিউটার গত বিশ হাজার বছরের গতি বিবেচনা করে এই বিন্দুগুলোর বর্তমান অবস্থান নির্ণয় করবে। ফলে সে একটা মোটামুটি বৃত্তাকার সারফেস এর ভেতর সাজাবে। তারপর আমরা কেন্দ্র নির্ণয় করতে পারব এবং বলা যায় পৃথিবী সেই কেন্দ্রের কাছাকাছি কোথাও হবে।–বেশি সময় লাগবে না।

.

আসলেই লাগল না। কম্পিউটারের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য সব কাজ পেতে পেতে এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ট্র্যাভিজ। কিন্তু এবার এত কম সময় লাগল যে সে নিজেও অবাক হয়ে গেল।

কেন্দ্র খুঁজে পেলে কম্পিউটারকে মৃদু শব্দ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল ট্র্যাভিজ। তেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই। শুধু শব্দটা শুনলে সে এই ভেবে সন্তুষ্টি বোধ করবে যে মিশন শেষ হয়েছে।

এক মিনিট পুরো হওয়ার আগেই শব্দ শোনা গেল যেন ধাতুর ঘণ্টায় মৃদুভাবে আঘাত করা হয়েছে। শারীরিকভাবে কম্পন অনুভব না করা পর্যন্ত শব্দটা ভেসে থাকল বাতাসে, তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।

সাথে সাথে দরজায় উঁকি দিল ব্লিস। বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? বিপদ?

মোটেই না। বলল ট্র্যাভিজ।

আগ্রহের সাথে যোগ করল পেলোরেট, আমরা বোধহয় পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি। এই শব্দ দিয়ে কম্পিউটার আমাদের সেটাই বলার চেষ্টা করছে।

ঘরে প্রবেশ করল ব্লিস, আমাকে সতর্ক করা উচিত ছিল।

দুঃখিত, ব্লিস, বলল ট্র্যাভিজ, এত জোরে শব্দ হবে বুঝতে পারিনি।

ব্লিসের পেছনে ফেলম। সে জিজ্ঞেস করল, এরকম শব্দ হলো কেন, ব্লিস?

ওর কৌতূহলও আছে দেখছি, বলল ট্র্যাভিজ। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, নিজেকে মনে হচ্ছে নিঃশেষ। পরবর্তী কাজ হচ্ছে বাস্তব গ্যালাক্সিতে স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর কেন্দ্র ফোকাস করে দেখতে হবে আসলেই জি-টাইপ কোনো নক্ষত্র আছে কিনা। বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তার ভয় লাগছে।

হ্যাঁ, ব্লিস বলল, থাকবে না কেন? সেও তো আমাদের মতো মানুষ।

তার পেরেন্ট সেটা মনে করতো না। এই শিশুকে নিয়ে ভয় হচ্ছে আমার। সামনে ওর জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।

কীভাবে বুঝলে?

দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিল ট্র্যাভিজ, আমার মন বলছে।

ট্র্যাভিজের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে ফেলমকে বলল ব্লিস, আমরা পৃথিবী খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি, ফেলম।

পৃথিবী কী?

আরেকটা গ্রহ, কিন্তু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রহ থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল। তুমি জানো পূর্বপুরুষ শব্দটার অর্থ কী?

এর অর্থ কী? কিন্তু পরের শব্দটা গ্যালাকটিক ছিল না।

পেলোরেট বলল, এটা পূর্বপুরুষ শব্দের সুপ্রাচীন অনুরূপ শব্দ। আমাদের পিতৃপুরুষ শব্দটা এর অনেক কাছাকাছি।

বেশ, হঠাৎ হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে ব্লিস বলল, পৃথিবী হচ্ছে সেই গ্রহ যেখান থেকে আমাদের পিতৃপুরুষরা এসেছিল, ফেলম। তোমার, আমার, পেল এবং ট্র্যাভিজের।

তোমার ব্লিস-আমারও। মনে হয় যেন ফেলম দ্বিধায় পড়ে গেছে। ওদের দুজনের?

আমাদের সবার পূর্বপুরুষ ছিল এক গ্রহের।

কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে এই মেয়ে ভালোভাবে জানে সে আমাদের থেকে ভিন্ন। বলল ট্র্যাভিজ।

ব্লিস নিচু স্বরে বলল, একথা বলবে না, তাকে বোঝাতে হবে সে আলাদা কিছু নয়।

আমার মনে হয় হার্মাফ্রোডিটিজম অপরিহার্য।

আমি মাইণ্ডের কথা বলছি।

ট্রান্সডিউসার লোবগুলোও অপরিহার্য।

শোন, ট্র্যাভিজ, ঝামেলা করো না। সবকিছু বাদ দিয়ে ও মানুষ এবং বুদ্ধিমতি।

তারপর ফেলমের দিকে ঘুরে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু গলায় বলল, চিন্তা করে দেখো, ফেলম। তোমার আমার পিতৃপুরুষ ছিল একই গ্রহের। প্রতিটি গ্রহের মানুষ-অনেক, অনেক গ্রহ-সবার পিতৃপুরুষ ছিল একই গ্রহের, এবং এই পিতৃপুরুষরা মূলত বাস করত পৃথিবী নামক গ্রহে। অর্থাৎ আমরা আরীয়, তাই না।

এবার ঘরে গিয়ে চিন্তা করো।

ট্র্যাভিজের দিকে একবার চিন্তিতভাবে তাকিয়ে ঘুরে দৌড় দিল ফেলম, যাওয়ার আগে তার পশ্চাদদেশে স্নেহের চাপড় মারল ব্লিস।

ট্র্যাভিজের দিকে ঘুরল ব্লিস, কথা দাও, ট্র্যাভিজ, ওর সামনে এমন কিছু বলবে না যেন বুঝতে পারে সে ভিন্ন।

দিলাম কথা। ওর শিক্ষায় বাধা দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা। আমার নেই। কিন্তু তুমি জানো সে আমাদের থেকে ভিন্ন।

যেমন আমি তোমাদের থেকে ভিন্ন।

কিন্তু ফেলমের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা অনেক বেশি।

সামান্য বেশি। তার সাথে আমাদের মিলটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে এবং তার গ্রহের অধিবাসীরা একদিন গ্যালাক্সিয়ার অংশ হবে এবং আমার বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।

বেশ, তর্ক করবো না। পরিষ্কার বিরক্তি নিয়ে সে কম্পিউটারের দিকে ঘুরল। এখন প্রকৃত মহাকাশে পৃথিবীর আনুমানিক অবস্থান বের করতে হবে। ভয় পাচ্ছি।

ভয়?

বেশ, হাস্যকর ভঙ্গিতে এক কাঁধ উঁচু করল ট্র্যাভিজ, যদি কাছাকাছি কোনো উপযুক্ত নক্ষত্র না থাকে?

না থাকলে নাই।

ভাবছি এখনই দেখার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা। জাম্প করতে আরো কয়েকদিন লাগবে।

আর এই কয়দিন দুঃশ্চিন্তা করে করে মাথা খারাপ করবে। এখনই দেখ। * অপেক্ষা করলে কি পরিস্থিতি পাল্টাবে।

ঠোঁট দুটো চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকল ট্র্যাভিজ। তারপর বলল, ঠিকই বলেছ। বেশ দেখা যাক।

কম্পিউটারের দিকে ঘুরে হাত রাখল ডেস্কের উপর। অন্ধকার হয়ে গেল স্ক্রিন। যাচ্ছি তা হলে। আমি থাকলে তোমার সমস্যা হবে। হাত নেড়ে চলে গেল ব্লিস। কথা হচ্ছে, ফিসফিস করল ট্র্যাভিজ, আমরা প্রথমে কম্পিউটারের গ্যালাকটিক ম্যাপ দেখব এবং পৃথিবীর সূর্য যদি হিসাব করা অবস্থানে থাকে তা হলে ম্যাপে সেটা দেখানো হবে না। কিন্তু তখন আমরা

স্ক্রিনে নক্ষত্রের ছবি ফুটে উঠতেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তার। সংখ্যায় অনেক কিন্তু অনুজ্জ্বল, এদিক সেদিক দুই একটা নক্ষত্র হঠাৎ জ্বলে উঠছে, বেশ ভালোভাবে ছড়ানো। কিন্তু কেন্দ্রের প্রায় কাছের একটা নক্ষত্র বাকিগুলো থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল।

আমরা পেয়েছি, বিজয়ীর সুরে বলল পেলোরেট। আমরা ওটা খুঁজে পেয়েছি, ওল্ড চ্যাপ! দেখ কত উজ্জ্বল।

কেন্দ্রীয় কো-অর্ডিনেটস এর যে-কোনো নক্ষত্র উজ্জ্বল দেখাবে। বলল ট্র্যাভিজ। এখনই উৎফুল্ল হতে পারছে না। তা ছাড়া দৃশ্যটা কমপক্ষে কেন্দ্রের এক পারসেক দূরে। তবে কেন্দ্রের নক্ষত্রটা যে রেড ডোয়াফ, অথবা রেড জায়ান্ট, অথবা উত্তপ্ত ব্লু হোয়াইট নয় এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কম্পিউটার কি বলে দেখা যাক।

কয়েক সেকেণ্ডের নীরবতা, তারপর ট্র্যাভিজ বলল, স্পেকট্রাল ক্লাস জি-২। আবার নীরবতা, তারপর ডায়ামিটার ১,৪০০,০০০ কিলোমিটার-ভর টার্মিনাসের সূর্যের ১.০২ গুণ-ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা পুরোপুরি ৬০০০-ঘূর্ণনগতি ধীর, মাত্র ৩০ দিন-কোনো অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম নেই। 

এগুলো তো যে নক্ষত্রের বাসযোগ্য গ্রহ আছে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, তাই না? বলল পেলোরেট।

স্বাভাবিক। এবং পৃথিবীর সূর্যের ব্যাপারে আমরা যা আশা করেছি ঠিক সেরকম। যদি প্রকৃতপক্ষে এখানেই জীবনের মৌলিক বিকাশ হয় তা হলে ধরে নেওয়া যায় পৃথিবীর সূর্য আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

কাজেই আশা করা যায় ওখানে একটা বাসযোগ্য গ্রহ আছে।

সেটা আমাদের চিন্তা করতে হবে না। গ্যালাকটিক ম্যাপে দেখানো হয়েছে এই নক্ষত্রের একটা বাসযোগ্য গ্রহ আছে যেখানে মানুষ বাস করে–কিন্তু পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

আগ্রহ বেড়ে গেল পেলোরেটের। ঠিক এটাই আশা করেছিলাম, গোলান। জীবনবাহী একটা গ্রহ আছে, কিন্তু নিজেদের লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার কারণে মানচিত্র প্রস্তুতকারীরা অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়।

না, এটা নিয়ে ভাবছি না, বলল ট্র্যাভিজ। এটা আশাও করিনি। চিন্তা করে দেখ কী নিখুঁতভাবে পৃথিবীর সমস্ত তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে যেন মানচিত্র প্রস্তুতকারীরা জানতে না পারে এই সিস্টেমে জীবনের অস্তিত্ব আছে, এমনকি এটাও যেন জানতে না পারে পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে। স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো মানচিত্রে নেই। পৃথিবীর সূর্য থাকবে কেন?

বেশ, আছে তো। কথা বাড়িয়ে লাভ কি? আর কী জানা যায়?

একটা নাম।

আহ! কী নাম?

আলফা।

সামান্য নীরবতা, তারপর অতি উৎসাহী গলায় পেলোরেট বলল, ঠিক আছে, ওল্ড ম্যান। এই শেষ প্রমাণটাই দরকার ছিল। অর্থটা জানো?

অর্থও আছে আবার? বলল ট্র্যাভিজ। আমার কাছে শুধুই একটা অদ্ভুত নাম। এবং গ্যালাকটিক মনে হচ্ছে না।

গ্যালাকটিক না। পৃথিবীর একটা প্রাগৈতিহাসিক ভাষা, যে ভাষা থেকে ব্লিসের গ্রহের নাম গায়া এসেছে।

তো, আলফার অর্থ কি?

যত দূর জানা যায় আলফা হলো পৃথিবীর সেই অতিপ্রাচীন ভাষার প্রথম বর্ণ যার অর্থ সর্ব প্রথম। কোনো সূর্যের নাম আলফা হলে বোঝায় সেটা প্রথম সূর্য। আর নিঃসন্দেহে প্রথম সূর্য হবে সেটাই যাকে সেই গ্রহ প্রদক্ষিণ করে যে গ্রহে সর্বপ্রথম মানুষের উদ্ভব হয়–

তুমি নিশ্চিত?

পুরোপুরি।

তুমি তো একজন মিথলজিস্ট–প্রাচীন কিংবদন্তিতে পৃথিবীর সূর্যের কোনো অদ্ভুত চরিত্রের কথা বলা হয়েছে?

না, আর কি অদ্ভুত চরিত্র থাকবে? পরিষ্কার সব বলা আছে, কম্পিউটারের দেওয়া বর্ণনার সাথে যা মিলে গেছে। তাই না?

আমার ধারণা, পৃথিবীর সূর্য সিঙ্গল স্টার?

অবশ্যই। আমি যতদূর জানি যে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ সবসময় সিঙ্গেল স্টারকে প্রদক্ষিণ করে।

আমিও তাই ভেবেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভিউস্ক্রিনের কেন্দ্রে যে নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে সেটা কোনো সিঙ্গেল স্টার নয়; একটা বাইনারি । দুটো নক্ষত্রের মধ্যে যেটা বেশি উজ্জ্বল, তাকে প্রদক্ষিণ করছে আরেকটা নক্ষত্র, ভর প্রথমটার চার ভাগের এক ভাগ মাত্র, একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে আশি বছর। খালি চোখে দুটো নক্ষত্র পৃথকভাবে দেখা যাচ্ছে না, তবে দৃশ্যটা বড় করলে অবশ্যই দেখা যাবে।

তোমার কোনো সন্দেহ নেই তো, গোলান? দমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

কম্পিউটার আমাকে এই কথাই বলছে। আর যদি এটা বাইনারি নক্ষত্র হয় তা হলে এটা পৃথিবীর সূর্য হতে পারে না।

.

কম্পিউটারের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঘরের আলো বাড়িয়ে তুলল ট্র্যাভিজ।

ব্লিসের জন্য এটাই পরিষ্কার সংকেত। ফেলমকে লেজে বাঁধিয়ে ফিরে এল সে।

বেশ, কী পেয়েছি আমরা? জিজ্ঞেস করল।

নিষ্প্রাণ গলায় বলল ট্র্যাভিজ, আশা জাগানোর মতো কিছু পাইনি। পৃথিবীর সূর্য সিঙ্গেল স্টার, কিন্তু পেয়েছি একটা বাইনারি স্টার। কাজেই পৃথিবী নেই ওখানে।

এখন কি করবে, গোলান? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।

কাঁধ ঝাঁকালো ট্র্যাভিজ। কেন্দ্রে পৃথিবীর সূর্য দেখব এমনটা আশা করিনি। এমনকি স্পেসাররাও পরিপূর্ণ বৃত্তের আকারে বসতিস্থাপন করেনি। স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন অরোরা নিজেও বসতি স্থাপনের জন্য অনেকগুলো দল পাঠিয়েছিল। সেটাও বৃত্তের কাঠামো নষ্ট করার জন্য দায়ী। তা ছাড়া পৃথিবীর সূর্য সম্ভবত স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলোর সূর্যের সমান তালে অবস্থান পরিবর্তন করেনি।

তার মানে বলতে চাও, পৃথিবী যে-কোনো স্থানেই হতে পারে।

না, যে কোনো স্থানে হতে পারে কথাটা ঠিক না। পৃথিবীর সূর্য অবশ্যই এই কো-অর্ডিনেটসগুলোর কাছাকাছি রয়েছে। আমরা যে নক্ষত্র চিহ্নিত করেছি সেটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সূর্যের প্রতিবেশী। ভয়ের কথা হচ্ছে যে কাছাকাছি ঠিক একই রকম একটা নক্ষত্র রয়েছে। পার্থক্য শুধু এটা বাইনারি।

তা হলে তো ম্যাপে পৃথিবীর সূর্য দেখতে পেতাম, তাই না? মানে আলফার কাছে?

না, আমি নিশ্চিত ম্যাপে পৃথিবীর সূর্য দেখানো হয়নি। এটাকে যতই পৃথিবীর সূর্যের মতো দেখাক আমার সন্দেহ এটা আসল না।

বেশ, ব্লিস বলল, তা হলে প্রকৃত মহাকাশের একই কো-অর্ডিনেটসে কি আছে দেখলেই তো হয়। যদি কেন্দ্রের কাছে আলফার মতো আরেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্র থাকে, কিন্তু সিঙ্গেল, এবং গ্যালাকটিক ম্যাপে যার উল্লেখ নেই, সেটাকেই তো পৃথিবীর সূর্য ধরে নেওয়া যায়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ। যদি তাই হয়, তোমার কথা মতো যদি ঐ নক্ষত্রের সৌরজগতে পৃথিবী থাকে আমি আমার অর্ধেক সম্পদ বাজি রাখতে পারি। কিন্তু দ্বিধা হচ্ছে।

কারণ তুমি ব্যর্থ হতে পারো, তাই না?

মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। যাই হোক আমাকে একটু দম নিতে দাও। তারপর জে র করে বাধ্য করব নিজেকে।

বয়স্ক তিন জন যখন কথা বলছে, ফেলম তখন ধীর পায়ে কম্পিউটার ডেস্কের দিকে এগোল। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে হাতের ছাপ দুটোর দিকে। দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে হাত বাড়ালো ধরার জন্য, আর ট্র্যাভিজ দ্রুত হাত বাড়িয়ে বাধা দিল, ধমক দিয়ে বলল, ধরবে না, ফেলম।

ভয়ে কেঁপে উঠল সোলারিয়ান শিশু, দৌড়ে গিয়ে সেঁধিয়ে গেল ব্লিসের বাড়ানো দুহাতের ভেতর।

পেলোরেট বলল, বাস্তবের মুখোমুখি হতেই হবে, গোলান। যদি প্রকৃত মহাকাশে কিছু পাওয়া না যায়?

তখন প্রথম পরিকল্পনা কাজে লাগাতে বাধ্য হব। সাতচল্লিশটা স্পেসার ওয়ার্ল্ডের প্রত্যেকটাতেই যাব।

তারপরেও যদি কিছু না পাওয়া যায়, গোলান?

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, যেন এধরনের চিন্তা মাথাতে আসতেই দেবে না। হাঁটুর দিকে তাকিয়ে বলল, তখন অন্য কোনো পথ ধরব।

কিন্তু যদি পিতৃপুরুষের কোনো গ্রহই না থাকে?

ঝট করে মাথা তুলল ট্র্যাভিজ, কে বলল কথাটা?

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ঘোর কেটে যেতেই সে পরিষ্কার বুঝল কে প্রশ্ন করেছে।

আমি বলেছি, ফেলম বলল।

ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ, আমাদের আলোচনা তুমি বুঝতে পারছ?

তুমি পিতৃপুরুষের গ্রহ খুঁজছ কিন্তু পাওনি। যদি এমন কোনো গ্রহ না থাকে।

না, ফেলম, গুরুত্ব দিয়ে বলল ট্র্যাভিজ, নিজেদের লুকানোর জন্য তারা অনেক পরিশ্রম করেছে। এতো পরিশ্রম তখনই করবে যখন আসলেই লুকানোর কিছু থাকবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

হ্যাঁ। তুমি আমাকে ওটা ধরতে দাওনি, নিশ্চয়ই খুব মজা হতো।

আহ্, তুমি ওগুলো কখনো ধরবে না, ফেলম।–ব্লিস তুমি একটা দানব তৈরি করছ। আমাদের সবাইকে শেষ করে ফেলবে। আমি না থাকলে ওকে কখনো পাইলট রুমে ঢুকতে দেবে না। এমনকি তুমি সাথে থাকলেও দুবার চিন্তা করবে।

ছোট ঘটনাটা ট্র্যাভিজের সিদ্ধান্তহীনতা দূর করে দিল। আমার বরং কাজে মন । দেওয়া উচিত। এখানে অনিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে ভয় আরো বাড়বে।

কমে গেলো আলোর উজ্জ্বলতা, এবং নিচু স্বরে ব্লিস বলল, কথা দিয়েছিলে ফেলমের সামনে কোনো খারাপ মন্তব্য করবে না।

তা হলে ওর দিকে একটা চোখ রাখবে, আর ভদ্রতা শেখাও। বলে দাও বড়দের মাঝে বাচ্চাদের সবসময় থাকতে হয় না।

শিশুদের প্রতি তোমার আচরণ জঘন্য, ট্র্যাভিজ।

হতে পারে, কিন্তু এখন আলোচনা করার সময় নেই।

তারপর এমন সুরে কথা বলল যে সুরে সন্তুষ্টি এবং স্বস্তি দুটোই প্রকাশ পায়, ঐ যে আসল মহাকাশে আলফার অবস্থান-এবং তার ডান দিকে সামান্য উপরে আরেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, কম্পিউটারের গ্যালাকটিক ম্যাপে যার কোনো উল্লেখ নেই। ওটাই পৃথিবীর সূর্য। আমার সমস্ত সম্পদ বাজি রেখে বলতে পারি।

.

বাজিতে হারলে তোমার সম্পদের এক কানাকড়িও আমরা নেব না। বলল ব্লিস। তুমি বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ওখানে নিয়ে চল।

মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। না। এখন ব্যাপারটা ভয় বা সিদ্ধান্তহীনতা নয়, বরং সতর্কতা। তিন তিনবার নতুন তিনটা গ্রহে গিয়ে অপ্রত্যাশিত বিপদে পড়েছি। প্রতিবারই তাড়াহুড়ো করে গ্রহগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। এবার আর না জেনে হাতের তাস ফেলছি না। রেডিওঅকটিভিটির একটা গল্প আমরা শুনেছি, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। তোমাদের অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আলফার একটা গ্রহ আছে যেখানে মানুষ বাস করে, মাত্র এক পারসেক দূরে পৃথিবী–

আলফার একটা গ্রহে মানুষ বাস করে একথা কি আমরা আসলে জানি? মাঝখানে বাধা দিল পেলোরেট। তুমি বলেছিলে কম্পিউটার নামের পাশে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে রেখেছে।

তারপরেও চেষ্টা করা যায়। একটু উঁকি দিয়ে দেখলে ক্ষতি কি? যদি ওখানে মানুষ থাকেই দেখাই যাক না পৃথিবী সম্বন্ধে কি জানে ওরা। ওদের জন্য তো পৃথিবী প্রাচীন কোনো কিংবদন্তি নয়, বরং আকাশের উজ্জ্বল, পরিচিত প্রতিবেশী বিশ্ব।

একটু চিন্তা করে ব্লিস বলল, মন্দ বলনি। আমার মনে হচ্ছে যদি আলফায় মানুষ থাকে এবং তারা যদি তোমার মতো আইসোলেট না হয় তা হলে নিশ্চয়ই বন্ধুভাবাপন্ন হবে। তা ছাড়া মুখের স্বাদ পাল্টানোর জন্য মজাদার খাবার পাওয়া যাবে।

আর নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে, বলল ট্র্যাভিজ। একথাটা ভুলো না । কোনো সমস্যা নেই তো, জেনভ?

সিদ্ধান্ত নেবে তুমি, ওল্ড চ্যাপ। যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো।

হঠাৎ ফেলম জিজ্ঞেস করল, জেম্বিকে পাব আমরা?

ট্র্যাভিজ কিছু বলার আগেই আমতা আমতা করে উত্তর দিল ব্লিস, আমরা খুঁজে দেখব, ফেলম।

এবং ট্র্যাভিজ বলল, তা হলে ঠিক হয়ে গেল। আমরা আলফায় যাচ্ছি।

.

দুইটি বড় নক্ষত্র, ভিউস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফেলম বলল।

ঠিক, বলল ট্র্যাভিজ। দুটো-ব্লিস, লক্ষ্য রেখে যেন কিছু না ধরে।

যন্ত্রগুলো দেখে সে মুগ্ধ হয়েছে, বলল ব্লিস।

হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু ওর মুগ্ধতা দেখে আমি মুগ্ধ হইনি, আর সত্যি কথা বলতে কি ভিউস্ক্রিনে এক সাথে দুটো সমান উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখে আমিও ওর মতো অবাক হয়েছি।

দুটো নক্ষত্রই যথেষ্ট উজ্জ্বল সমতল ডিস্কের মতো দেখাচ্ছে। জোরালো বিকিরণ প্রতিরোধের জন্য রেটিনার যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্রিনের ফিল্টারের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। ফলে চোখে পড়ার মতো অল্প দুএকটা নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নেই। আলোচ্য নক্ষত্র দুটোই এক বিশাল অঞ্চল নিয়ে রাজত্ব করছে।

আসলে আমি আগে কখনো বাইনারি সিস্টেমের এতো কাছাকাছি আসিনি।

আসনি? অবাক সুরে প্রশ্ন করল পেলোরেট। সেটা কীভাবে হয়?

আমি মহাকাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ সেরকম পর্যটক কখনোই ছিলাম না।

তোমার সাথে পরিচয়ের আগে আমি কখনো মহাকাশে আসিনি, কিন্তু মনে করতাম, যে মহাকাশ ভ্রমণ করেছে।

সব জায়গাই দেখেছে। আমি জানি। এমন চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। যারা সারা জীবন কোনো গ্রহের মাটিতে কাটিয়ে দেয় তাদের নিয়ে সমস্যা হলো যতই কল্পনাশক্তি থাকুক গ্যালাক্সির সত্যিকার আকার সম্বন্ধে কোনো ধারণাই করতে পারে না। সারা জীবন মহাকাশে ঘুরে বেড়ালেও গ্যালাক্সির বেশিরভাগ অংশই অদেখা থেকে যাবে। তা ছাড়া বাইনারিতে কেউ আসে না।

কেন আসে না, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ব্লিস। পর্যটক আইসোলেটদের মতো গায়া মহাকাশবিদ্যা সম্বন্ধে এতকিছু জানে না, তবে আমার ধারণা বাইনারি মহাকাশের স্বাভাবিক বস্তু।

হ্যাঁ। সিঙ্গেল স্টারের তুলনায় বাইনারি স্টারের সংখ্যা বেশি। যাই হোক কাছাকাছি দুটো নক্ষত্র থাকলে গ্রহ তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। বাইনারি সিস্টেমে গ্রহ তৈরির উপাদান কম থাকে। কোনো গ্রহ তৈরি হলেও তার কক্ষপথ হয় এলোমেলো। বাসযোগ্য গ্রহ তৈরির সম্ভাবনা লাখে এক।

প্রথম যুগের অভিযাত্রীরা নিঃসন্দেহে খুব কাছ থেকে বাইনারিগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিল। কিন্তু বসতি স্থাপনের জন্য তারা বেছে নিয়েছিল সিঙ্গেল স্টারগুলোকে। আর গ্যালাক্সিতে ঘনবসতি বেড়ে যাওয়ার পর যাতায়াত ও যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। শুধু সিঙ্গেল স্টার সিস্টেমগুলোর ভেতর। প্রাচীন যুগে সামরিক প্রয়োজনে দুএকটা বাইনারি ব্যবহার করা হয়েছে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য। কিন্তু হাইপার স্পেসাল ট্রাভেল এর উন্নতির সাথে সাথে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়।

আমি কত কিছু জানি না, অনুতাপের সুরে বলল পেলোরেট।

এসব নিয়ে মন খারাপ করো না, জেনভ। নেভিতে থাকার সময় অপ্রচলিত সামরিক কৌশল নিয়ে প্রচুর লেকচার শুনতে হয়েছে। সেখান থেকেই তোমাকে বললাম। ভেবে দেখ তুমি যে পরিমাণ মিথলজি, পল্লীসাহিত্য এবং প্রাচীন ভাষা জানো আমি তার কিছুই জানি না। আর তোমার মতো পণ্ডিত লোক আছে মাত্র গুটিকয়েক।

ব্লিস বলল, ওই দুটো নক্ষত্র মিলে বাইনারি সিস্টেম তৈরি করেছে এবং বড়টাকে ঘিরে একটা বাসযোগ্য গ্রহ প্রদক্ষিণ করছে।

আশা করি ব্লিস। সবকিছুরই ব্যতিক্রম থাকে। তা ছাড়া নামের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্নটাই সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে।–না, ফেলম ওগুলো খেলার জন্য নয়।–ব্লিস, হয় ওর হাতে হাতকড়ি পরাও, নয়তো বের করে নিয়ে যাও।

ও কোনো জিনিস নষ্ট করবে না, আররক্ষার সুরে বলল ব্লিস, একই সাথে সোলারিয়ান শিশুকে টেনে নিল নিজের দিকে। ঐ বাসযোগ্য গ্রহের ব্যাপারে এত আগ্রহ থাকলে এখনো সেখানে পৌঁছাইনি কেন?

প্রথম কারণ ব্লিস, মানুষ হিসেবে কাছ থেকে একটা বাইনারি সিস্টেম দেখার কৌতূহল আমারও আছে। তা ছাড়া আমি সতর্ক। গায়া ছেড়ে আসার পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমাকে শুধু সতর্ক হতে শিখিয়েছে।

আলফা কোনটা, গোলান? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।

পথ হারানোর কোনো ভয় নেই, জেনভ। কম্পিউটার ভালোভাবেই জানে কোনটা আলফা, সেইসাথে আমরাও জানি। উত্তপ্ত এবং হলুদাভ নক্ষত্রের নাম আলফা কারণ দুটোর মধ্যে এটাই বড়। ছোট নক্ষত্রের আলো কমলা রঙের অনেকটা

অরোরার সূর্যের মতো। তোমার মনে আছে?

হ্যাঁ।

তোমার সেই প্রাচীন ভাষার দ্বিতীয় বর্ণটা কী?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে পেলোরেট বলল, বিটা।

বেশ কমলা রঙের নক্ষত্রের নাম বিটা এবং সাদাটে হলুদাভ রঙের নক্ষত্রের নাম আলফা, আর আমরা যাচ্ছি আলফার দিকে।

.

১৭. নতুন পৃথিবী

চারটা গ্রহ, ফিসফিস করল ট্র্যাভিজ। সবগুলোই ছোট, সেইসাথে একটা অ্যাস্টেরয়েড। কোনো গ্যাস জায়ান্ট নেই।

পরিস্থিতি কি হতাশ করার মতো? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

না, স্বাভাবিক। বাইনারি যখন এত কাছ থেকে পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে তখন যে-কোনো একটা নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ রত কোনো গ্রহ থাকতে পারে না। দুটো নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করতে পারে, কিন্তু সেগুলো বাসযোগ্য গ্রহ হবে এটা পুরোপুরি অবিশ্বাস্য

অন্য দিকে বাইনারিগুলো যদি যথেষ্ট দূরে থাকে তা হলে প্রতিটা নক্ষত্রের নিজস্ব গ্রহ থাকবে যেগুলোর কক্ষপথ হবে স্থিতিশীল। কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী এই নক্ষত্র দুটোর মাঝখানের দূরত্ব ৩.৫ বিলিয়ন কিলোমিটার এবং যখন সবচেয়ে কাছে চলে আসে তখন দূরত্ব দাঁড়ায় ১.৭ বিলিয়ন কিলোমিটার। দুটো নক্ষত্রের ২০০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের কক্ষপথে এ টা গ্রহ স্থিতিশীলভাবে অবস্থিত। কিন্তু কোনো গ্রহেরই কক্ষপথ বেশি বড় নয়। তার মানে কোনো গ্যাস জায়ান্ট নেই।

কিন্তু এই চারটা গ্রহের যে-কোনো একটা বাসযোগ্য।

প্রকৃত পক্ষে দুই নাম্বার গ্রহের সত্যিকার সম্ভাবনা আছে। কারণ একমাত্র এই গ্রহ বায়ুমণ্ডল ধরে রাখার মতো বড়।

দুই নাম্বার গ্রহের দিকে তারা দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে এবং দুইদিনের ভেতর তার প্রতিচ্ছবি যথেষ্ট বড় হয়ে উঠল; প্রথমে হিসাব করা রাজকীয় গতিতে। তারপর যখন তাদের থামানোর জন্য কোনো মহাকাশযান এগিয়ে এল না তখন দ্রুত এবং ভয় জাগানোর মতো গতিতে চলল।

ফার স্টার মেঘের আচ্ছাদনের এক হাজার কিলোমিটার উপরে একটা অস্থায়ী কক্ষপথ ধরে চলছে। ট্র্যাভিজ হাসিমুখে বলল, এখন বুঝতে পারছি কেন এই গ্রহটাকে বাসযোগ্য দেখানোর পরেও পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। রেডিয়েশনের কোনো চিহ্ন নেই, না আলো, না রেডিও।

মেঘের আচ্ছাদন বেশ পাতলা মনে হচ্ছে। পেলোরেট বলল।

এটা রেডিও রেডিয়েশন আটকাতে পারবে না।

নিচে গ্রহটাকে পাক খেতে দেখছে তারা। মেঘের ঘূর্ণির ভেতর একটা ছন্দ আছে, হঠাৎ মেঘের ফাঁকে চোখে পড়ছে নীল রং, বোঝা যায় নিচে সাগর।

বাসযোগ্য গ্রহের জন্য মেঘের স্তর অনেক ভারী, বলল ট্র্যাভিজ। হয়তো এটা একটা অন্ধকার গ্রহ।–আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে, আরেকবার রাতের অংশে ঢোকার সময় সে যোগ করল, কোনো স্পেস স্টেশন আমাদের থামায় নি।

কমপরেলনে যেমন থামিয়েছিল? বলল পেলোরেট।

যে-কোনো বাসযোগ্য গ্রহে যেভাবে থামায়। পেপারস, মালপত্র, কতদিন থাকব এগুলো জানার জন্য আমাদের থামাননা স্বাভাবিক ছিল।

হয়তো কোনো কারণে ওদের সংকেত আমরা ধরতে পারিনি। ব্লিস বলল। আমাদের কম্পিউটার যে-কোনো ওয়েভলেংথ ধরতে পারবে। আর আমি সংকেত পাঠিয়েও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি। স্টেশন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ না করে মেঘের স্তরের নিচে নামা মহাকাশ আইনের পরিপন্থী। কিন্তু অন্য কোনো উপায় নেই।

ফার স্টারের গতি কমছে, সেই সাথে উচ্চতা বজায় রাখার জন্য এন্টিগ্র্যাভিটি আরো শক্তিশালী হল। আবার দিনের অংশে বেরিয়ে এসে গতি আরো কমল। মেঘের ভেতর বড় একটা ফাঁক চোখে পড়ল ট্র্যাভিজের। ডুব দিয়ে সেটা পেরিয়ে এল মহাকাশ যান। তাদের নিচে ঢেউয়ে নাচছে মহাসাগরের বিপুল জলরাশি, কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

ছোপ ছোপ সূর্যের আলো এবং মেঘের আচ্ছাদন থেকে বেরিয়ে এল তারা, নিচের বিস্তীর্ণ জলরাশি সাথে সাথেই হয়ে গেল পাথুরে ধূসর বর্ণের, আর তাপমাত্রা কমে গেল উল্লেখযোগ্য ভাবে।

ভিউস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফেলম প্রথমে কথা বলল নিজের ভাষায়, তারপর গ্যালাকটিকে। গলা কাঁপছে। নিচে ওটা আমি কী দেখছি?

মহাসাগর, আশ্বস্ত করার সুরে ব্লিস বলল, একসাথে অনেক পানি জমানো।

শুকিয়ে যাচ্ছে না কেন?

ব্লিসের অসহায় ভঙ্গি দেখে ট্র্যাভিজ উত্তর দিল, শুকিয়ে যাওয়ার জন্য পানির পরিমাণ অনেক বেশি।

এত পানি আমার দরকার নেই। এখান থেকে চলো। বলল ফেলম। তারপর ভয়ে আরো সংকুচিত হয়ে গেল। কারণ একটা ঝড়ো মেঘখণ্ডের ভেতর প্রবেশ করেছে ফার স্টার, ফলে ভিউস্ক্রিনের রং দুধসাদা আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ডোরাকাটা দাগের মতো দেখাচ্ছে।

আলো কমে গেল পাইলট রুমের আর হালকা ঝাঁকুনি খেতে লাগল মহাকাশযান।

অবাক হয়ে চোখ তুলল ট্র্যাভিজ। চিৎকার করে বলল, ব্লিস, তোমার ফেলম ট্র্যান্সডিউস করার মতো যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে। বৈদ্যুতিক শক্তি দিয়ে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ওকে থামাও!

ব্লিস শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ফেলমকে। সব ঠিক আছে, ফেলম, সব ঠিক আছে। ভয়ের কিছু নেই। এটা শুধু নতুন একটা গ্রহ। এরকম অনেক আছে।

তারপর নিচু স্বরে ট্র্যাভিজকে বলল, বাচ্চা মেয়েটা জীবনে কখনো সাগর দেখেনি, এবং সম্ভবত কুয়াশা বা বৃষ্টির অভিজ্ঞতাও নেই। তুমি একটু নরম হতে পার না।

যদি মহাকাশযান চালানোর চেষ্টা করে তা হলে পারি না। সেক্ষেত্রে আমাদের সবার জন্য বিপদ ডেকে আনবে সে। ঘরে নিয়ে গিয়ে ওকে শান্ত করো।

কাঠখোট্টাভাবে মাথা নাড়ল ব্লিস।

আমি সাথে আসছি, ব্লিস। পেলোরেট বলল।

না, পেল। তুমি এখানেই থাকো। আমি ফেলমকে শান্ত করছি তুমি ট্র্যাভিজকে শান্ত করো।

আমাকে শান্ত করার দরকার নেই, গজ গজ করে উঠল ট্র্যাভিজ। যদি বাড়াবাড়ি করে থাকি সেজন্য দুঃখিত, কিন্তু খেলার জন্য মহাকাশ যানের কন্ট্রোল কোনো বাচ্চার হাতে তুলে দিতে পারি না, পারি কি?

অবশ্যই পারি না, বলল পেলোরেট, কিন্তু বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেয়েছে ব্লিস। ফেলমকে সে সামলাতে পারে। বাচ্চাটা তার বাড়ি এবং-এবং তার রোবটকে ছেড়ে এসে অজানা পরিবেশে হিমশিম খাচ্ছে। তারপরেও তার আচরণ যথেষ্ট ভালো।

জানি, ফেলমকে সাথে আনতে চাইনি আমি। এটা ছিল ব্লিসের আইডিয়া।

হ্যাঁ, কিন্তু আমরা না আনলে নিজের লোকেরা তাকে মেরে ফেলত।

বেশ, পরে আমি ব্লিসের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। ফেলমের কাছেও চেয়ে নেব।

কিন্তু তার ভুরু এখনো কোঁচকানো, পেলোরেট নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, গোলান, ওল্ড চ্যাপ, কিছু একটা তোমাকে ভাবাচ্ছে?

সাগর, বলল ট্র্যাভিজ। ঝড়ো মেঘ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি কিন্তু মেঘ এখনো ঘন।

সমস্যাটা কী? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

অনেক বেশি, এই আর কি?

পেলোরেট বুঝতে পারল না, আবার বলল ট্র্যাভিজ, মাটির কোনো চিহ্ন নেই। ভূমি চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। বায়ুমন্ডল পুরোপুরি স্বাভাবিক, অক্সিজেন নাইট্রোজেনের অনুপাত চমৎকার। কাজেই প্রচুর উদ্ভিদ থাকার কথা। স্বাভাবিক অবস্থায় এধরনের বায়ুমণ্ডল চোখে পড়ে না-সম্ভবত, একমাত্র পৃথিবীতে ছিল, কীভাবে হয়েছে, কে জানে। কিন্তু এধরনের একটা গ্রহে যথেষ্ট পরিমানের শুকনো ভূমি থাকতে বাধ্য, পুরো গ্রহের এক তৃতীয়াংশ এবং কখনোই এক পঞ্চমাংশের কম হতে পারবে না। কিন্তু এই গ্রহে স্থলভাগ নেই কেন?

যেহেতু এটা বাইনারি সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত, তাই পুরোপুরি অস্বাভাবিক। হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই এখানে অদ্ভুত বায়ুমণ্ডল তৈরি হয়েছে এবং স্বাধীনভাবে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে, পৃথিবীতে যেমন হয়েছিল, কিন্তু এখানে শুধু সামুদ্রিক জীবন।

তোমার কথা মেনে নিলেও কোনো লাভ হচ্ছে না, জেনভ। সামুদ্রিক জীবন কখনোই প্রযুক্তির উদ্ভব করতে পারবে না। কারণ প্রযুক্তির মূল মন্ত্রই হচ্ছে আগুন, আর সাগরে আগুন জ্বালানো অসম্ভব। প্রযুক্তিবিহীন কিন্তু জীবনধারণকারী কোনো গ্রহ দেখার জন্য আমরা এতদূর আসিনি।

বুঝতে পেরেছি, আসলে আমি শুধু ধারণা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। কারণ আমরা তো জানি একসময় প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিল পৃথিবীতে। সেটলাররা সেইগুলোই নিজেদের স্বার্থে নিয়ে এসেছে। প্রযুক্তি সবসময় একরকম হবে একথা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারনা।

সাগরে চলাচলের জন্য স্ট্রিমলাইনের প্রয়োজন। সামুদ্রিক প্রাণীর অনিয়মিত আউট লাইন বা আমাদের হাতের মতো উপাঙ্গ নেই।

স্কুইডের শুঁড় আছে।

স্বীকার করছি অনেক কিছুই আমাদের অনুমান করে নিতে হবে, কিন্তু তুমি যদি মনে কর গ্যালাক্সির কোথাও বুদ্ধিমান স্কুইডের স্বাধীনভাবে বিকাশ ঘটেছে এবং তারা আগুন ছাড়াই একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছে সেটা হবে আমার মতে পুরোপুরি অস্বাভাবিক অনুমান।

তোমার মতে, নরম সুরে বলল পেলোরেট।

হঠাৎ হেসে ফেলল ট্র্যাভিজ, চমৎকার, জেনভ। বুঝতে পারছি ব্লিসের সাথে খারাপ ব্যবহার করায় তুমি যুক্তিতর্কে আমাকে হারানোর চেষ্টা করছ এবং আমি বলব সফল। কথা দিচ্ছি যদি স্থলভাগ না পাই তা হলে তোমার সভ্য স্কুইডদের খুঁজে বের করার জন্য যতদূর সম্ভব সাগরে অনুসন্ধান চালাবো।

তার কথা শেষ হওয়ার পরপরই মহাকাশ যান আবার অন্ধকার অংশে ঢুকল।

কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল পেলোরেট, ভাবছি, এটা কি নিরাপদ।

কী নিরাপদ, জেনভ?

এভাবে অন্ধকারে ছুটে বেড়ানো। যে-কোনো মুহূর্তে সাগরে গিয়ে পড়তে পারি।

একেবারেই অসম্ভব, জেনভ। সত্যি বলছি! কম্পিউটার সি-লেভেল থেকে যথেষ্ট উচ্চতা বজায় রেখেছে।

কত দূর?

প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার।

ভয় কাটছে না, গোলান। না দেখে হয়তো কোনো পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা খাব।

আমরা না দেখলেও মহাকাশযানের রাডার দেখবে এবং কম্পিউটার পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাবে।

যদি স্থলভাগ থাকে? অন্ধকারে আমরা মিস করব।

না, জেনভ, করব না। নিচে স্থলভাগ থাকলে আমি বোঝার অনেক আগেই কম্পিউটার সেটা বুঝতে পারবে।

কথা বন্ধ হল দুজনের, এবং কয়েক ঘণ্টার ভেতর তারা আবার ফিরে এলো, দিনের আলোতে নিচে এখনো সুবিশাল মহাসাগর বিরামহীন একঘেয়ে গতিতে বয়ে চলেছে। কিন্তু ঝড়ের কারণে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। একবার ঝড়ো বাতাস ধাক্কা দিয়ে ফার স্টারকে গতিপথ থেকে সরিয়ে দিল, কম্পিউটার বাধা দিল না, শক্তি ক্ষয় এবং কাঠামোর ক্ষতি ঠেকানোর জন্য। ঝড় পেরিয়ে যাবার পর আবার ফিরে এল নির্দিষ্ট পথে।

সম্ভবত কোনো হারিকেনের শেষ মাথা, বলল ট্র্যাভিজ।

পেলোরেট বলল, এদিকে দেখ, ওল্ড চ্যাপ। আমরা শুধু পূর্ব থেকে পশ্চিম-অথবা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে চলাচল করছি। অর্থাৎ শুধু বিষুব অঞ্চলটাই দেখছি।

আমরা উত্তর পশ্চিম-দক্ষিণ পূর্ব দিকে বিরাট বৃত্ত তৈরি করে ঘুরছি। ফলে মৌসুমি অঞ্চল এবং উষ্ণ অঞ্চলের পুরোটা দেখা হয়ে যাচ্ছে। আর একটা বৃত্ত শেষ করে আরেকটা বৃত্ত তৈরি করার সময় পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছি। কম্পিউটারের মতে বড় একটা মহাদেশ থাকার সম্ভাবনা দশ ভাগের একভাগেরও কম, এবং বড় একটা দ্বীপ থাকার সম্ভাবনা চার ভাগের এক ভাগের কম, আর প্রতিটা নতুন বৃত্ত তৈরি করার সময় সেই সম্ভাবনা আরো কমছে।

আমি কি করতাম জানো, ধীর গলায় বলল পেলোরেট, কারণ তারা আবার রাতের অংশে প্রবেশ করছে, গ্রহ থেকে যথেষ্ট দূরে থেকে রাডারের সহায্যে পুরো হেমিস্ফিয়ার চেক করতাম। মেঘের জন্য কোনো সমস্যা হতো না, হতো কি?

তারপর রাডার আবার অন্য অংশের দিকে জুম করতাম বা অপেক্ষা করতাম অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে কখন বিপরীত অংশ রাডারের আওতায় আসে। করা যেতো, জেনভ। তখন কি আর জানতাম যে একটা বাসযোগ্য গ্রহে ঢোকার সময় কোনো স্পেস স্টেশনে থামতে হবে না এবং মেঘস্তর পেরিয়ে আসার পর স্থলভাগ দেখতে পাব না। বাসযোগ্য গ্রহ মানেই-স্থলভাগ।

নিশ্চয়ই পুরোটাই স্থলভাগ না।

আমি সেটা বলছি না, হঠাৎ উত্তেজিত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ। বলছি যে আমরা মাটির দেখা পেয়েছি। শান্ত হও!

চেষ্টা করেও উত্তেজনা দমন করতে পারল না ট্র্যাভিজ। ডেস্কে হাত বসিয়ে কম্পিউটারের অংশ হয়ে গেল। সে বলল, এটা একটা দ্বীপ, লম্বায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। আয়তন সম্ভবত ১৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার। খুব বেশি বড় না, আবার ছোটও না। দাঁড়াও—

পাইলট রুমের আলো কমতে কমতে প্রায় নিভেই গেল।

আমরা কী করছি? বলল পেলোরেট, নিজের অজান্তেই ফিসফিস করছে, যেন অন্ধকার কোনো ভঙ্গুর জিনিস, শব্দ হলেই ভেঙে যাবে।

অন্ধকারের সাথে দৃষ্টি মানিয়ে নিচ্ছি। মহাকাশযান দ্বীপের দিকে এগোচ্ছে। কিছু দেখতে পারছ?

না-মনে হয় যেন আলো দেখলাম। নিশ্চিত করে বলতে পারব না।

আমিও দেখেছি। টেলিস্কোপিক লেন্স চালু করছি।

আলো! পরিস্কার দৃশ্যমান। এলোমেলো কয়েকটা বিন্দু।

এখানে বসতি আছে, বলল ট্র্যাভিজ এটা সম্ভবত গ্রহের একমাত্র বাসযোগ্য অংশ।

কী করব এখন?

অপেক্ষা করব দিনের আলোর জন্য। এই কয়েকঘন্টা বিশ্রাম নিতে হবে।

ওরা যদি আক্রমণ করে?

কী দিয়ে করবে? আলো এবং ইনফ্রারেড ছাড়া আর কোনো রেডিয়েশন ধরা পড়েনি। এই গ্রহ বাসযোগ্য এবং বসবাসকারীরা বুদ্ধিমান। তাদের একটা সভ্যতা আছে, কিন্তু সেটা সম্ভবত প্রি-ইলেকট্রনিক, কাজেই এত উপরে ভয়ের কিছু নেই।, আর আমার ভুল হলেও কম্পিউটার সময় থাকতেই সতর্ক করে দেবে।

দিনের আলো ফোঁটার পর?

অবশ্যই ল্যাণ্ড করব।

.

ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে তারা নিচে নামল। মেঘের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক আলো এসে দ্বীপের অংশবিশেষ আলোকিত করে তুলেছে-তরতাজা সবুজ দ্বীপের ভেতর দূরে একসারি ধূসর বর্ণের নিচু গোলাকার পাহাড়।

আরো নিচে নামার পর দু-একটা নিঃসঙ্গ গাছ, কিছু বাগান চোখে পড়ল, তবে দ্বীপের বেশিরভাগ অংশই সুরক্ষিত খামার। তাদের সরাসরি নীচে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভাঙাচোরা একসারি বোল্ডারের ভেতর ছড়ানো তৃণভূমি, তার পেছনে রুপোলি সমুদ্র সৈকত। দু-একটা বাড়িঘরও চোখে পড়ছে, কিন্তু শহরের মতো গায়ে গায়ে লাগানো না।

বেশ কয়েকটা রাস্তাও দেখা গেল, দুপাশে সারিবদ্ধ বাসস্থান, তবে বাসস্থানগুলো বেশ দূরে দূরে। তারপর ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে দেখা গেল একটা বায়ুযান। শুধু চলার ভঙ্গি দেখেই তারা বুঝতে পারল যে এটা পাখি নয় বায়ুযান। প্রথমবারের মতো গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণ হলো।

এটা সম্ভবত স্বয়ংক্রিয় যান, যদি ইলেকট্রনিক্স ছাড়া এধরনের জিনিস তারা তৈরি করতে পারে, বলল ট্র্যাভিজ।

হতে পারে, ব্লিস বলল, আমার মতে ওটাতে যদি মানুষ থাকে তবে নিঃসন্দেহে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। গতি নিয়ন্ত্রক ছাড়াই যেভাবে সরাসরি নিচে নেমে এসেছি-সত্যিই দেখার মতো।

আসলেই দেখার মতো জিনিস, চিন্তিত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, খুব বেশি গ্রহ গ্র্যাভিটিক স্পেসশিপের সূক্ষ উড্ডয়ন বা অবতরণ দেখেনি-বেলাভূমি ল্যান্ড করার জন্য চমৎকার জায়গা, কিন্তু বাতাসে ধুলো উড়লে বারোটা বেজে যাবে। বরং ঘাসের উপর ল্যাণ্ড করব।

অন্তত গ্র্যাভিটিক শিপ ল্যান্ড করার সময় কারো ব্যক্তিগত ভূমির ক্ষতি হয় না। বলল পেলোরেট।

চারটা প্রশস্ত প্যাড এর উপর ভর দিয়ে স্থির হল ফার স্টার। মহাকাশযানের ওজনে ডেবে গেল মাটি।

আবহাওয়া মোটামুটি।–গরম একটু বেশিই বলা যায়। বলল রিস, বলার সুরে ঠিক সন্তুষ্টি প্রকাশ পেল না।

বাইরে ঘাসের উপর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, অবাক হয়েছে বা ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। বরং চেহারায় সীমাহীন আগ্রহ।

মেয়েটার পরনে পোশাক খুব কম। বোধহয় আবহাওয়ার কারণে। পায়ের স্যাণ্ডেল জোড়া সম্ভবত ক্যানভাসের তৈরি, কোমরে ফুল লতাপাতার ছাপ আঁকা ছোট স্কার্ট, পা ঢাকার জন্য কিছু পড়েনি। কোমর থেকে উপরে কোনো পোশাক পরেনি।

কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চকচকে চুল, গায়ের রং হালকা বাদামি, সরু চোখ।

চারপাশে তাকিয়ে আর কোনো মানুষ চোখে পড়ল না ট্র্যাভিজের। কাঁধ নেড়ে বলল, এখনো সকাল হয়নি পুরোপুরি। বাসিন্দারা নিশ্চয়ই এখনো ঘুমাচ্ছে। তবে এখানে যে মানুষের সংখ্যা কম সেটা বলা যায়।

অন্যদের দিকে ঘুরে বলল, আমি একা গিয়ে ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলছি, যদি বোঝার মতো কিছু বলে আর কি। তোমরা–

আমার মতে, দৃঢ়গলায় বলল ব্লিস, আমরা সবাই যাব। আমি চাই হাত পায়ের জড়তা কাটাতে, মুক্ত বায়ু সেবন করতে এবং নতুন খাবারের স্বাদ নিতে। ফেলমেরও একটু ভোলা জায়গায় বেরনো দরকার। আর পেল সম্ভবত মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখলে খুশি হবে।

কে? আমি? বলল পেলোরেট, খানিকটা লজ্জা পেয়েছে। মোটেই না, ব্লিস, কিন্তু এই ছোট দলে আমিই একমাত্র ভাষাবিদ।

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। চল সবাই। তবে নিরীহ মনে হলেও আমি অস্ত্র সাথে নেব।

আশা করি ওই তরুণীর উপর ওগুলো তুমি ব্যবহার করবে না। বলল ব্লিস।

দাঁত বের করে হাসল ট্র্যাভিজ। খুব সুন্দরী, তাই না?

প্রথমে বেরোল ট্র্যাভিজ, পেছনে ব্লিস এবং তার হাত ধরে ফেলম। পেলোরেট সবার শেষে।

ওদেরকে বেরোতে দেখে কালো চুলের তরুণী এক পাও পিছায়নি। এখনো আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

ফিসফিস করল ট্র্যাভিজ, বেশ, দেখা যাক।

হাত দুটো অস্ত্রের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে রেখে বলল, অভিনন্দন।

তরুণী বোঝার চেষ্টা করল কয়েক মুহূর্ত তারপর বলল, আপনি এবং আপনার সঙ্গীদের সুস্বাগতম।

উল্লাসে লাফিয়ে উঠল পেলোরেট, কী চমৎকার! ক্লাসিক্যাল গ্যালাকটিক এবং নিখুঁত উচ্চারণ।

আমিও বুঝতে পেরেছি, ট্র্যাভিজ বলল, কিন্তু অসহায় ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল অর্থ পরিষ্কার হয়নি। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছে।

মুখে বন্ধুত্বের হাসি ফুটিয়ে বলল, আমরা এসেছি অনেক দূর মহাকাশ থেকে। অন্য এক গ্রহ থেকে।

উত্তম, স্বাভাবিক উঁচু গলায় তরুণী বলল, আপনারা এম্পায়ার থেকে আগমন করিয়াছেন?

আমরা এসেছি অনেক দূরের নক্ষত্র থেকে এবং আমাদের বাহনের নাম ফার স্টার।

চোখ তুলে মহাকাশ যানের গায়ে প্রিন্ট করা নামের দিকে তাকাল তরুণী, ওখানে ইহাই লিপিবদ্ধ আছে। তাহা হইলে প্রথম বর্ণটা বিপরীত ভাবে লিখা হইয়াছে।

আপত্তি জানাতে গেল ট্র্যাভিজ, কিন্তু পেলোরেট খুশির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, বলল, ঠিকই বলেছে। দুহাজার বছর আগে বর্ণটাকে ঠিক উল্টোভাবে লেখা হত।

ভালোভাবে তরুণীকে লক্ষ করল ট্র্যাভিজ। লম্বায় ১.৫ মিটারের বেশি হবে না। সুগঠিত স্তন কিন্তু ছোট। স্তনাগ্র বড় এবং গভীর রঙের, তবে সেটা গায়ের রঙের কারণেও হতে পারে।

সে বলল, আমার নাম গোলান ট্র্যাভিজ; আমার বন্ধু জেনভ পেলোরেট; মহিলার নাম ব্লিস; এবং এই শিশুর নাম ফেলম।

আপনারা যে দূর নক্ষত্র হইতে আসিয়াছেন সেইখানে তাহা হইলে দুই নাম দেওয়া হয়। আমি হিরোকো, হিরোকোর কন্যা।

আর তোমার বাবা? আচমকা জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ নাড়ল হিরোকো। মা বলিয়াছিলেন তাহার নাম সুল। আমি তাহাকে চিনি না।

অন্যেরা কোথায়? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ। মনে হয় তুমি একাই আমাদের স্বাগত জানাতে এসেছে।

প্রায় সকল পুরুষ মৎস্য শিকারে গিয়াছে; প্রায় সকল নারী কাজ করিতেছে মাঠে। আমি দুইদিন অবকাশ লইয়াছি, সেই হেতু এই অতীব চমৎকার ঘটনা অবলোকন করিতে পারিলাম। তথাপি মানুষ কৌতূহলী। বাহনের অবতরণ বহুদূর স্থানেও দৃশ্যমান হইয়াছে। অল্পক্ষণের মাঝেই অন্যেরা উপস্থিত হইবে।

কতজন বাস করে এখানে?

পাঁচ সহস্রের অধিক। গর্বের সাথে বলল হিরোকো।

সাগরে আর কোনো দ্বীপ আছে?

আর কোনো দ্বীপ, জনাব? দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো।

বুঝে গেছে ট্র্যাভিজ। এই দ্বীপ গ্রহের একমাত্র স্থান যেখানে মানুষ বাস করতে পারে এবং করে।

তোমাদের এই গ্রহের নাম কী?

আলফা, জনাব, আমাদিগকে শিখানো হইয়াছে পুরো নাম আলফা সেঞ্চুরি, কিন্তু আমরা শুধু আলফা বলিয়া থাকি। বুঝিতেই পারিতেছেন ইহা অতি উৎকৃষ্ট গ্রহ।

কী গ্রহ, বলল ট্র্যাভিজ, ব্যাখ্যার আশায় ঘুরল পেলোরেটের দিকে।

বলছে, সুন্দর গ্রহ। পেলোরেট বলল।

তা ঠিক। বিশেষ করে দিনের এই সময়টায়। ভোরের হালকা নীল আকাশের দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, তোমাদের দিনগুলো চমৎকার সূর্যালোকিত, হিরোকো, তবে আমার মনে হয় আলফাতে এত পরিষ্কার আকাশ খুব কমই থাকে।

শক্ত হয়ে গেলো হিরোকো। আমরা যতগুলো চাই ততগুলো রহিয়াছে, জনাব। যখন আমাদের বৃষ্টির প্রয়োজন তখন মেঘ প্রস্তুত হয়। নিঃসন্দেহে যখন মৎস্য শিকারের বাহনগুলো সমুদ্রে অবস্থান করে তখন উপরের মতো নীলাকাশ প্রয়োজন।

তোমরা তা হলে ওয়েদার কন্ট্রোল করতে পারো, হিরোকো?

তাহা না করিলে, জনাব গোলান ট্র্যাভিজ, অত্যধিক বৃষ্টিতে আমাদের টিকিয়া থাকাই দায় হইত।

কীভাবে করো?

আমি প্রকৌশলী নহি, আপনাকে বুঝাইয়া বলিতে পারিব না।

তোমরা যে দ্বীপে বাস করছ, এই দ্বীপের নাম কী? বলল ট্র্যাভিজ। মনে হচ্ছে যেন ক্লাসিক্যাল গ্যালাকটিকের অলংকারিক উচ্চারণে সে হাবুডুবু খাচ্ছে, একবার সন্দেহ হল প্রশ্নটা সে বোঝাতে পেরেছে কিনা।

হিরোকো বলল, বিস্তীর্ণ সাগরের মাঝে এই স্বর্গীয় দ্বীপকে আমরা বলি নতুন পৃথিবী।

বিস্ময় এবং আনন্দ নিয়ে পেলোরেটের সাথে চোখাচোখি হলো ট্র্যাভিজের।

.

শেষ মন্তব্য নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল না। কারণ আরো অনেকে আসা শুরু করেছে। একজন দুজন করে ভিড় বাড়ছে ক্রমেই। ট্র্যাভিজের ধারণা যারা মাছ ধরতে যায়নি বা মাঠে কাজ করতে যায়নি শুধু তারাই এসেছে এবং খুব বেশি দূর থেকে আসেনি। বেশিরভাগই এসেছে পায়ে হেঁটে, যদিও লক্কড়ঝক্কড় মার্কা দুটো পুরোনো গ্রাউণ্ড কার দেখা গেল।

কোনো সন্দেহ নেই কারিগরি দিক দিয়ে এই গ্রহ একেবারেই অনুন্নত, অথচ এরা ওয়েদার কন্ট্রোল করতে পারে।

সবাই জানে যে কারিগরি উন্নয়ন সবসময় এক ধাঁচে হয় না। কোনো একটা ক্ষেত্রে কেউ পিছিয়ে থাকলেও অন্য কোনো ক্ষেত্রে তার অগ্রগতি হতে পারে। কিন্তু এধরনের অসম কারিগরি উন্নয়ন দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন।

মহাকাশযান দেখতে আসাদের ভেতর অর্ধেকই বয়ষ্ক নারী পুরুষ। তিনটা বা চারটা শিশু আছে। বাকীদের মাঝে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। কারো। ভেতরই ভয় বা কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা নেই।

ট্র্যাভিজ নিচু স্বরে ব্লিসকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছ। মনে। হচ্ছে-একেবারে শান্ত।

আমি সামান্যতম নিয়ন্ত্রণও করছি না, বলল ব্লিস। বাধ্য না হলে কোনো মাইও স্পর্শ করি না। আমার ধারণা ফেলম।

কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য যে অল্প কয়েকজন মানুষ জমায়েত হয়েছে সেটা যে-কোনো গ্রহের স্বাভাবিক দৃশ্য, ফেলমের কাছে সেটাই অনেক বেশি। সে শুধু ফার স্টারের বয়স্ক তিন জনের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত। শব্দ করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। ফেলম, চোখ আধবোজা। যেন প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে।

ধীরে ধীরে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ব্লিস, শান্ত করার জন্য নানা ধরনের শব্দ করছে মুখ দিয়ে। ট্র্যাভিজের কোনো সন্দেহ নেই যে একই সাথে সে অতি সূক্ষ্মভাবে মেন্টাল ফাইবার পুনর্বিন্যাস করে দিচ্ছে।

খাবি খাওয়ার মতো করে হঠাৎ লম্বা শ্বাস টানল ফেলম, যেন কেউ তাকে একটা জোর ঝাঁকুনি দিয়েছে। একবার তাকাল জনতার দিকে, তারপর ব্লিসের বাহু আর শরীরের মাঝখানে মাথা লুকালো।

কাঁধে হাত রেখে সেই অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরল ব্লিস। মাঝে মাঝে চাপ দিচ্ছে যেন বোঝাতে চায়–ভয় নেই, আমি আছি।

আরও বেশি অবাক হয়েছে পেলোরেট, প্রত্যেকটা আলফানের উপর তার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে বলল, গোলান, এরা নিজেরাই একে অন্যের থেকে ভিন্ন।

ব্যাপারটা ট্র্যাভিজও খেয়াল করেছে। চুল এবং গায়ের রং একেকজনের একেকরকম, একজনের গায়ের রং গাঢ় লাল, চোখ নীল, চামড়া কোঁচকানো। বয়স্কদের মধ্যে কমপক্ষে তিনজন হিরোকোর মতো খাটো, এবং একজন বা দুজন ট্র্যাভিজের থেকেও লম্বা। নারী পুরুষ বেশিরভাগেরই চোখের রং হিরোকোর মতো, ট্র্যাভিজের মনে পড়ল ফিলি সেক্টরের বাণিজ্যিক গ্রহগুলোর অধিবাসীদের চোখের রং এরকম হয়, সে অবশ্য ঐ সেক্টরে কখনো যায়নি।

প্রত্যেক আলফান কোমরের উপরে কোনো পোশাক পরেনি এবং মেয়েদের প্রত্যেকের বুক ছোট। শুধু এই একটা শারীরিক ক্ষেত্রে মিল দেখা গেল।

ব্লিস কথা বলল, আচমকা, মিস, হিরোকো, এই শিশু মহাকাশ ভ্রমণে অভ্যস্ত নয় এবং তার পক্ষে যত দূর মেনে নেওয়া সম্ভব তার বেশি ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। ওর জন্য একটু বসার এবং খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা যায়?

বুঝতে পারেনি হিরোকো, পেলোরেট বুঝিয়ে দিল।

অনুতাপের ভঙ্গিতে মুখে একটা হাত তুলে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল হিরোকো, যেন কুর্নিশ করছে। মার্জনা করবেন, রেসপেকটেড ম্যাডাম। এই শিশুর প্রয়োজনের কথা ভাবনাতে আসেনি। ঘটনার আকস্মিকতা আমাকে হতবাক করিয়া দিয়াছে। আপনারা অতিথি, প্রাতরাশের জন্য রিফ্যাকটরিতে চলুন। হোস্ট হিসেবে আমরা কি সঙ্গ দিতে পারি?

ধন্যবাদ। বলল ব্লিস। ধীরে ধীরে প্রতিটা শব্দ আলাদা করে উচ্চারণ করল। ভালো হয় যদি হোস্ট হিসেবে শুধু তুমি থাকো। এই শিশু অধিক লোকের সান্নিধ্যে অভ্যস্ত নয়।

উঠে দাঁড়াল হিরোকো। আপনাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যবস্থা হইবে।

অলস ভঙ্গিতে ঘাসের উপর দিয়ে পথ দেখাল সে। বাকি আলফানরা সরে পথ করে দিল। তাদের আগ্রহ সম্ভবত আগন্তুকদের পোশাকের উপরই বেশি। পুরুষদের একজন সামনে বাড়ল এক পা, প্রশ্নবোধক আঙুল তুলল ট্র্যাভিজের জ্যাকেটের দিকে। জ্যাকেটটা খুলে তার হাতে দিল ট্র্যাভিজ।

নাও, বলল সে, দেখে ফেরত দিতে হবে। তারপর হিরোকোকে বলল, এটা যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়, মিস, হিরোকো।

নিশ্চিন্ত থাকুন, ফিরাইয়া দেওয়া হইবে, রেসপেকটেড স্যার। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল সে।

হাসল ট্র্যাভিজ। মৃদুমন্দ বাতাসে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

আলফানদের কারো কাছেই অস্ত্র নেই। এবং ওরা ট্র্যাভিজের অস্ত্রের প্রতিও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যত দূর বুঝতে পারছে আলফা পুরোপুরি নিরীহ গ্রহ।

মহিলাদের একজন ব্লিসের সামনে গিয়ে তার ব্লাউজ খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, আপনার স্তন নাই, রেসপ্যাকটেড মাডাম? উত্তর দেওয়ার আগেই সে হাত বাড়িয়ে ব্লিসের বুক স্পর্শ করল।

হাসল ব্লিস, আপনি নিজেই দেখিলেন, আছে। হয়তো আপনার মতো সুন্দর নহে। তবে সে কারণে ঢাকিয়া রাখিনি। আমার গ্রহে ঢাকিয়া রাখাই নিয়ম।

পাশে দাঁড়ানো পেলোরেটকে ফিসফিস করে বলল, ক্লাসিক্যাল গ্যালাকটিক কেমন শিখলাম?

চমৎকার, ব্লিস। প্রশংসা করল পেলোরেট।

ডাইনিং রুমটা বিশাল, মাঝখানে লম্বা টেবিল। দুই পাশে লম্বা বেঞ্চি। বোঝাই যাচ্ছে আলফানরা একসাথেই খানাপিনা করে।

হঠাৎ অনুশোচনা বোধ করল ট্র্যাভিজ। ব্লিসের অনুরোধে পাঁচজন বাদে সবাইকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগই আবার জানালার বাইরে সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রেখে উঁকি মারছে, (আসলে দেয়ালের মাঝে কিছু ফাঁকা জায়গা, এমনকি পর্দাও নেই), সম্ভবত আগন্তুকরা কীভাবে খায় সেটা দেখতে চায়।

হঠাৎ মনে হলো যদি বৃষ্টি হয়, তখন কী হবে। অবশ্য প্রয়োজন হলেই বৃষ্টি হবে। তা ছাড়া কখন বৃষ্টি হবে সেটা জানা থাকে বলে আলফানরা প্রস্তুত থাকতে পারে।

মুখোমুখি জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাগর, আর দূরের দিগন্তে ট্র্যাভিজের মনে হলো যেন চোখে পড়ল একদলা মেঘ, এই ছোট স্বর্গের আকাশ বাদে পুরো গ্রহের আকাশে যেরকম মেঘ ছড়িয়ে আছে, সেরকম।

ওয়েদার কন্ট্রোলের সুবিধাও আছে।

একজন আলফান তরুণী নাচের ছন্দের মতো হেঁটে হেঁটে খাবার পরিবেশন করল। কী খেতে চায় সেটা কেউ বলেনি। সবাইকে ছোট গ্লাসে দুধ, বড় গ্লাসে আঙুরের রস, তারচেয়েও বড় গ্লাসে দেওয়া হল পানি। প্রত্যেককে দেওয়া হল দুটো করে ডিম পোচ, পনিরসহ, বড় প্লেটে সবুজ ঠাণ্ডা পাতার উপর সিদ্ধ মাছ এবং আলু ভাজি।

খাবার দেখে আতঙ্ক বোধ করল ব্লিস। বুঝতে পারছে না কোনটা দিয়ে শুরু করবে। ফেলমের সেধরনের কোনো সমস্যা নেই। এক নিশ্বাসে আঙুরের রস শেষ করল, তারপর হাত বাড়ালো মাছ আর আলুর দিকে। একটা চামচ বাড়িয়ে দিল ব্লিস।

পরিপূর্ণ তৃপ্তির ভাব নিয়ে ডিমের দিকে চামচ বাড়াল পেলোরেট।

আসল ডিমের স্বাদ আবার মনে করা যাক। বলল ট্র্যাভিজ। তারপর সেও অনুসরণ করল।

ওদের খাওয়া দেখে নিজের খাবারের কথা ভুলে গেছে হিরোকো। জিজ্ঞেস করল, খাদ্য তৃপ্তিদায়ক?

চমৎকার। মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলল ট্র্যাভিজ। এই গ্রহে বোধহয় খাবারের কোনো কমতি নেই। নাকি ভদ্রতা করে বেশি দিচ্ছ?

মনযোগ দিয়ে শুনল হিরোকো, বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল জোরে জোরে। না, না, রেসপ্যাক্টেড স্যার। আমাদের গ্রহে প্রচুর শিকার পাওয়া যায়, সাগরে পাওয়া যায় আরো অধিক বেশি। হাসগুলো ডিম দেয়, ছাগলগুলো দুধ দেয়। আর আমাদের আছে প্রচুর শস্য। তাহা ছাড়া সাগরে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বহুবিদ মৎস্য, পুরো এম্পায়ারকে আমরা খাওয়াইতে পারি, তাহার পরেও শেষ হইবে না।

মুচকি হাসল ট্র্যাভিজ। পরিষ্কার বোঝা যায় আলফান তরুণী জানে না গ্যালাক্সি আসলে কত বড়।

হিরোকো, এই দ্বীপের নাম তুমি বললে নতুন পৃথিবী। তা হলে পুরোনো পৃথিবী কোথায়?

অবাক হয়ে ট্র্যাভিজের দিকে তাকাল হিরোকো। নতুন পৃথিবী? মাফ করবেন, রেসপ্যাকটেড স্যার। আমি বুঝিতে পারি নাই।

নতুন পৃথিবীর আগে তোমরা অন্য কোনো স্থানে বাস করতে। এই অন্য জায়গাটা কোথায় যেখান থেকে তোমরা এসেছো?

আমি কিছুই জানি না, রেসপেকটেড স্যার। সারা জীবন ধরিয়াই আমি এই স্থানে বাস করিতেছি এবং আমার মা, মাতামহী তারও আগে আমার, মাতামহীর পূর্বের বংশধররাও নিঃসন্দেহে এইখানে বাস করিত। অন্য কোনো ভূমির কথা আমি জানি না।

কিন্তু, নরম সুরে বোঝানোর চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ, তোমরা এই দ্বীপের নাম বলছ নতুন পৃথিবী। কেন?

কারণ, রেসপ্যাকটেড স্যার, শুরু থেকেই এই নামে ডাকা হইতেছে।

কিন্তু এটা নতুন পৃথিবী অর্থাৎ অনেক পরে তৈরি হয়েছে। পুরোনো একটা পৃথিবী থাকতে বাধ্য, যার ভিত্তিতে তোমাদের এই নামকরণ হয়েছে। প্রতি ভোরে নতুন একটা দিন শুরু হয়, অর্থাৎ তার আগে আরেকটা দিন ছিল। বুঝতে পারছ না এখানেও তাই ঘটেছে?

জি না রেসপ্যাকটেড স্যার। এই স্থানকে কি নামে ডাকা হয় আমি শুধু ইহাই জানি, অন্য কিছু জানি না। আপনার যুক্তি বিশ্লেষণও আমি বুঝিতে পারিতেছি না। অপরাধ নেবেন না।

মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, পরাজিত মনে হচ্ছে নিজেকে।

পেলোরেটের দিকে ঝুকল ট্র্যাভিজ,ফিসফিস করে বলল, যাই করি, যেখানেই যাই, কোনো তথ্যই পাই না।

পৃথিবী কোথায় আমরা এখন জানি, অত চিন্তার কি আছে? বলল পেলোরেট।

আমি আগেই কিছু তথ্য জেনে নিতে চাই।

ওর বয়স কম, বেশি কিছু জানার কথা না।

একটু চিন্তা করে মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ, ঠিক, জেনভ।

হিরোকোর দিকে ঘুরে বলল, মিস হিরোকো, আমরা কেন এখানে এসেছি সেটা তুমি জিজ্ঞেস করনি।

চোখ নামাল হিরোকো, বলল, আপনাদের আহার এবং বিশ্রামের পূর্বে জিজ্ঞাসা করিলে অভদ্রতা হইত।

বেশ, আমাদের খাওয়া শেষ, বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে। এখন তোমাকে বলব কেন আমরা এখানে এসেছি। আমার বন্ধু ড. পেলোরেট নিজের গ্রহের একজন স্কলার, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি একজন মিথলজিস্ট। আমার কথা বুঝতে পারছ?

জি না, রেসপ্যাকটেড স্যার।

তিনি বিভিন্ন গ্রহের পুরোনো গল্প নিয়ে গবেষণা করেন, যে গল্পগুলো পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিত। নতুন পৃথিবীতে কি এমন কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন যিনি এই গ্রহের পুরোনো গল্পগুলো জানেন?

চিন্তায় কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল হিরোকোর। আমি এই বিষয়ে অতি অল্প জানি। তবে একজন বৃদ্ধ আছেন যিনি প্রাচীন যুগের গল্প বলিতে ভালবাসে। তিনি কোথা হইতে শিখিয়াছেন আমি জানি না। সম্ভবত এগুলো তাহার বানোয়াট গল্প অথবা এমন কাহারো নিকট হইতে শুনিয়াছেন যিনি নিজেও বানোয়াট গল্প তৈরি করিতেন। আমার মতে, একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ তার কথা শুনছে কিনা, বৃদ্ধ শুধুই বকবক করে।

এরকম বকবক করা লোকই আমার দরকার। আমার বন্ধুকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে বৃদ্ধের–

নিজেকে সে মনোলী নামে অভিহিত করিয়া থাকে।

মনোলীর কাছে? আমার বন্ধুর সাথে কথা বলবে মননালী?

সে? কথা বলিব? কৌতুকের সুরে বলল হিরোকো। জিজ্ঞাসা করিতে হইবে সে কথা বলা বন্ধ করিয়া দিয়াছে কিনা। সে এমন একজন মানুষ যে সুযোগ পাইলে না থামিয়াই রাতের পর রাত কথা বলিয়া যাইবে। দোষ নেবেন না, রেসপ্যাকটেড স্যার।

দোষের কিছু নেই। তুমি এখনই আমার বন্ধুকে মনোলীর কাছে নিয়ে যেতে পারবে?

সেটা যে-কোনো সময় যে কেহই করিতে পারিবে। বৃদ্ধ সর্বদাই গৃহে অবস্থান করে এবং শ্রোতা পাইলে আনন্দিত হয়।

ম্যাডাম ব্লিসের সঙ্গে থাকার জন্য একজন বয়স্ক মহিলাকে দরকার। তার সাথে শিশু আছে। বেশি ঘুরতে পারবে না। সঙ্গী থাকলে ভালো হয়। কারণ, তুমি তো জানোই মেয়েরা–

কথা বলিতে পছন্দ করে? পরিষ্কার আমুদে গলায় বলল হিরোকো। পুরুষরা সর্বদা এই কথা বলে কেন বুঝিতে পারি না। অথচ আমি দেখিয়াছি পুরুষরাই বেশি কথা বলিয়া থাকে। আমাদের পুরুষরা মৎস্য শিকার হইতে ফিরিয়া আসুক, দেখিবেন কেমন গালগপ্পো জুড়িয়া দেয়। কেহই তাহাদের থামাইতে পারিবে না। যাহাই হোক, আমিও অধিক কথা বলিতে শুরু করিয়াছি। আমার মাতার এক বান্ধবীকে ডাকিয়া আনিতেছি ম্যাডাম ব্লিসকে সঙ্গ দিবার নিমিত্তে। তার পূর্বে তিনি রেসপ্যাকটেড ডক্টরকে বৃদ্ধ মনোলীর নিকট লইয়া যাইবেন। আমার ক্ষণিকের অনুপস্থিতি মার্জনা করিবেন কি?

সে চলে যাওয়ার পর বাকি দুজনকে বলল ট্র্যাভিজ, শোন, জেনভ, বৃদ্ধের কাছ থেকে যত বেশি তথ্য আদায় করা সম্ভব হয় করবে। ব্লিস তোমার সাথে যেই থাকুক তার কাছ থেকেও বেশি করে জানার চেষ্টা করবে। জানার চেষ্টা করবে শুধু পৃথিবীর কথা।

আর তুমি? বলল ব্লিস। তুমি কি করবে?

আমি হিরোকোর সাথে থাকব, ওর কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করব।

হাসল ব্লিস। আহ, নিশ্চয়ই। পেল থাকবে বৃদ্ধের সাথে আমি থাকব একজন বৃদ্ধমহিলার সাথে। তোমার তখন অশিক্ষিত তরুণীর সাথে না থেকে উপায় কি। কী। চমৎকার দায়িত্ব বণ্টন।

ঠিক তাই, ব্লিস, চমৎকার।

একবারও ভাবনি,এভাবে কাজ নাও হতে পারে।

না, কেন ভাবব?

তাই তো, কেন ভাববে তুমি? হিরোকো ফিরে এসে বলল, সকল ব্যবস্থা হইয়াছে। রেসপ্যাকটেড ড. পেলোরেটকে মনোলীর নিকট নিয়া যাওয়া হইবে। ম্যাডাম ব্লিস এবং এই শিশুকে সঙ্গ দেওয়ার ব্যবস্থা হইয়াছে। আমি কি আপনার সহিত থাকিব, রেসপ্যাকটেড স্যার, পুরাতন পৃথিবীর যে-

গালগপ্পো? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।

না, বলল হিরোকো, হাসছে। এখন আমি আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে অত্যুৎসাহী।

ট্র্যাভিজ পেলোরেটের দিকে ঘুরল, অত্যুৎসাহী?

আগ্রহী, নরম সুরে বলল পেলোরেট।

ট্র্যাভিজ বলল, মিস হিরোকো, তোমার সমস্যা না থাকলে তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালোই লাগবে।

ধন্যবাদ। বলল হিরোকো, উঠে দাঁড়িয়েছে।

ট্র্যাভিজও উঠে দাঁড়িয়েছে, ব্লিস, বলল সে, পেলোরেটের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখবে।

আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমার নিরাপত্তা তো সাথেই আছে- মাথা নেড়ে ট্র্যাভিজের হোলস্টার দুটো দেখাল সে।

মনে হয় না এগুলো ব্যবহার করতে হবে, অস্বস্তির সাথে বলল ট্র্যাভিজ।

হিরোকোকে অনুসরণ করে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এল সে। সূর্য প্রায় মাথার উপর চলে এসেছে। তাপমাত্রা বাড়ছে ক্রমেই। নতুন গ্রহের নতুন গন্ধ লাগছে নাকে। ট্র্যাভিজের মনে পড়ল কমপরেলনে গন্ধ ছিল কম, অরোরার ছিল কিছুটা মেটে গন্ধ, আর সোলারিয়ার গন্ধ ছিল চমৎকার (মেলপোমিনিয়ায় তারা ছিল স্পেস স্যুটের ভেতর, নিজের গায়েরটা ছাড়া অন্য কোনো গন্ধ পায়নি।) প্রতিটি ক্ষেত্রেই কয়েক ঘণ্টার ভেতর নাসারন্ধ্র নতুন গন্ধের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

আলফার বাতাসে কেমন ঘেসো গন্ধ। কিছুক্ষণের ভেতরেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে জানার পরেও বিরক্তি বোধ করল ট্র্যাভিজ।

ছোট একটা কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে তারা, সম্ভবত হালকা গোলাপি প্লাস্টারে তৈরি।

এইটা, বলল হিরোকো, আমার গৃহ। পূর্বে আমার মায়ের ভগিনীর বাসস্থান ছিল।

নিজে ভেতরে ঢুকে ট্র্যাভিজকেও অনুসরণ করতে ঈশারা করল সে। দরজা খোলা, অথবা, ঢোকার সময় খেয়াল করল ট্র্যাভিজ, আসলে কোনো দরজাই নেই।

বৃষ্টি হলে কী করো? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।

তখন এই পর্দাগুলো টানিয়া দেই। এগুলো ভারী এবং পানিরোধক।

কথা বলতে বলতে পর্দাগুলো নামিয়ে দিল সে। জিনিসগুলো কোনো একধরনের ক্যানভাস দিয়ে তৈরি।

এগুলো এখন টানিয়া দিলাম, হিরোকোর কথা শেষ হয়নি। এখন সকলেই জানিবে আমি ভেতরেই আছি কিন্তু ব্যস্ত। হয় ঘুমাইতেছি অথবা জরুরি কাজ করিতেছি।

গোপনীয়তা থাকে বলে তো মনে হয় না।

থাকিবে না কেন? দেখুন, পর্দা নামানো আছে।

কিন্তু যে কেউ এটা সরিয়ে উঁকি দিতে পারে।

আমার অনুমতি ব্যতিরেকে? আপনাদের গ্রহে বুঝি এইরকমই হয়? জঘন্য।

দাঁত বের করে হাসল ট্র্যাভিজ। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

দুই কামরার বাড়ি। ট্র্যাভিজকে দ্বিতীয় কামরায় নিয়ে এল হিরোকো। বসার জন্য দিল গদিমোড়া চেয়ার। পাথুরে কামরার ক্ষুদ্রতা এবং শূন্যতার মাঝে কেমন এক জমাটবদ্ধভাব, অথচ পরিকল্পনা দেখেই মনে হয় শুধু নির্জনতা বা আরামআয়েশের জন্য এই বাড়ি তৈরি হয়নি। ছাদের কাছে ছোট ছোট জানালা, কিন্তু কৌশলের সাথে কিছু আয়না বসানো আছে দেয়ালে, সেখানে আলো প্রতিফলিত হয়ে হালকাভাবে ঘর আলোকিত হচ্ছে। মেঝের ছোট একটা ফাটল দিয়ে উপরে উঠছে ঠাণ্ডা বাতাস। কৃত্রিমভাবে আলো জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ল না। আলফানরা সম্ভবত সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে এবং অস্ত যাবার পর পরই ঘুমোতে যায়।

ট্র্যাভিজ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হিরোকো কথা বলল, ম্যাডাম ব্লিস। আপনার সঙ্গিনী?

জানতে চাও সে আমার সেক্সয়াল পার্টনার কিনা? ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।

হিরোকোর চেহারা একটু লাল হলো, আশা করি আপনি মার্জিত কথা বলিবেন। তবে হ্যাঁ, আমি ব্যক্তিগত আমোদের কথা বলছি।

না, সে আমার বন্ধুর সঙ্গিনী।

কিন্তু বয়সে আপনি আরো তরুণ এবং সুদর্শন।

তোমার মতামতের জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু ব্লিস তা মনে করে না। সে আমার চেয়েও ড. পেলোরেটকে বেশি পছন্দ করে।

আমি অবাক হইয়াছি। সে আপনার সাথে শেয়ার করে না?

জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে করবে না, আর আমারও কোনো আগ্রহ নেই।

জ্ঞানীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল হিরোকো। বুঝিতে পারিয়াছি। তাহার নিতম্ব।

কী?

আপনি জানেন। ইহা। লাজ শরমের মাথা খেয়ে বোঝানোর জন্য সে নিজের পশ্চাদদেশে হালকা চাপড় মারল।

ওহ্, ওইটা! বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, ব্লিস এর পশ্চাদদেশ বেশ ভারী, অন্যান্য অঙ্গের তুলনায়। মুচকি হেসে হাত দিয়েও সে বুঝিয়ে দিল। (হেসে ফেলল হিরোকো।) যাই হোক অনেক পুরুষই এরকম পছন্দ করে।

আমার বিশ্বাস হইতেছে না। নিশ্চিতই ইহা অতিরঞ্জিত। যদি আমার বুক বিশাল হইতো, যদি বোঁটাগুলো ঝুলিয়া পড়িত গোড়ালি পর্যন্ত আপনি কি আমাকে পছন্দ করিতেন? ওরকম হইলে ম্যাডাম ব্লিস-এর মতো বুক ঢাকিয়াই রাখা উচিত।

ওরকম বড় হলে আমারো ভালো লাগত না, ঠিক, যদিও আমি নিশ্চিত যে, কোনো খুঁতের কারণে ব্লিস তার বুক ঢেকে রাখে না। তার গ্রহে এটাই নিয়ম।

তাহা হইলে আপনি আমার শারীরিক কাঠামো অপছন্দ করেন না?

সেটা করলে আমি একটা উন্মাদ। তুমি অসম্ভব সুন্দরী।

মহাকাশযান নিয়া এক গ্রহ হইতে অন্য গ্রহে যখন ঘুরিয়া বেড়ান তখন বিনোদনের জন্য কী করেন?

কিছুই না, হিরোকো। কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। কিন্তু আমরা যারা মহাকাশে ঘুরে বেড়াই তারা এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকি।

যদি কষ্টই হয় কী উপায়ে সেটা দূর করা যাইবে?

এই বিষয়ে কথা বলতে আমার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। উপায়টা তোমাকে বলা ভদ্রতা হবে বলে মনে হয় না।

আমি পরামর্শ দিলে কি অভদ্রতা হইবে?

নির্ভর করছে তুমি কি পরামর্শ দাও তার উপর।

আমার পরামর্শ হইতেছে আমরা দুইজন পরস্পরকে নিয়া আমোদিত হইতে পারি।

সেজন্যই তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, হিরোকো?

হোস্ট হিসেবে ইহা আমার কর্তব্য এবং আমার ইচ্ছাও বটে।

সেক্ষেত্রে এটা আমারও ইচ্ছা। বরং বলা যায় তোমার ইচ্ছাই শিরোধার্য। আমি আই-আমিও তোমাকে আমোদিত করিতে চাই।

.

১৮. সঙ্গীতানুষ্ঠান

লাঞ্চ করার জন্য আগের ডাইনিং রুমেই নিয়ে আসা হলো। ভেতরে আলফানরা গিজগিজ করছে। সবাই মিলে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাল সাদরে। ব্লিস আর ফেলমের খাবার দেওয়া হয়েছে। সবার থেকে আলাদা করে।

খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাছ, কচি ছাগলের মাংসের স্যুপ। স্লাইস করা পাউরুটি, মাখন, জ্যাম। সবশেষে সুস্বাদু সালাদ, তবে মিষ্টি জাতীয় কোনো খাবারের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো, অবশ্য বড় বড় গামলা ভর্তি ফলের রস আছে। সকালে ভর পেট খাওয়ার পর ফাউণ্ডেশনারদের আর রুচি নেই। তবে কেউ তাদের জোর করল না।

এতো খাওয়ার পরেও শরীরে চর্বি জমছে না কেন? নিচু স্বরে বলল পেলোরেট।

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ, সম্ভবত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে।

আলফানরা নিঃসন্দেহে কীভাবে খাবার টেবিলের ভদ্রতা বজায় রাখতে হয় সেটা শেখেনি। শব্দ করে খাবার চিবুচ্ছে, হাসাহাসি করছে কর্কশ স্বরে, শব্দ করে চামচ, পেয়ালা নামিয়ে রাখছে। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই, বরং তাদের গলার স্বর পুরুষদের চেয়ে আরো একধাপ চড়া।

নাক কুঁচকালো পেলোরেট, কিন্তু ট্র্যাভিজ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। সে বলল, আসলে এর একটা ভালো দিকও আছে। এই মানুষগুলোর কোনো চিন্তা নেই, জীবনকে উপভোগ করছে। খাদ্যের কোনো অভাব নেই। তাদের জন্য এটা হচ্ছে একটা সোনালি যুগ।

চিৎকার করে কথাগুলো বলল সে, পেলোরেটও চিৎকার করে উত্তর দিল, কিন্তু হট্টগোল খুব বেশি।

ওরা তাতে অভ্যস্ত।

ওরা কীভাবে একজন আরেকজনের কথা বুঝতে পারছে আমার কোনো ধারণাই নেই।

ফাউণ্ডেশনাররা কিছুই বুঝতে পারছে না। আলফানরা এত দ্রুত বিশুদ্ধ ব্যাকরণ সমৃদ্ধ ক্লাসিক্যাল গ্যালাকটিকে কথা বলে যে ফাউণ্ডেশনারদের কাছে তা শুধু নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দ। যেন চিড়িয়াখানায় পশুপাখিগুলো কোনো কারণে ভয় পেয়ে একসাথে চিৎকার করছে।

লাঞ্চের পর ছোট একটা বাসগৃহে ব্লিসের সাথে যোগ দিতে পারল। এটা হিরোকোর কোয়ার্টার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, সাময়িকভাবে থাকার জন্য তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। ফেলম পাশের কামরায়, একা হতে পেরে স্বস্তি বোধ করছে।

দেয়ালের ফাঁকা জায়গার মতো যে দরজা আছে সেদিকে তাকিয়ে অনিশ্চিত স্বরে পেলোরেট বলল, প্রাইভেসি নেই, আমরা কথা বলব কীভাবে?

নিশ্চিত থাকো, বলল ট্র্যাভিজ, ক্যানভাসের পর্দা নামিয়ে দিলে কেউ আর আমাদের বিরক্ত করবে না। এটা তাদের সামাজিক আইন।

কেউ শুনে ফেলতে পারে। উপরে জানালার দিকে তাকিয়ে বলল পেলোরেট।

আমাদের চিৎকার করে কথা বলার দরকার নেই। আড়িপাতার স্বভাব নেই আলফানদের। সকালের নাস্তার সময় ডাইনিং রুমের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা, তারপরেও যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছিল।

হাসল ব্লিস, হিরোকোর সাথে কিছুক্ষণ থেকেই এই গ্রহের সমাজ ব্যবস্থা অনেকখানি জেনে ফেলেছ। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এটাও জানো। কী ঘটেছে আসলে?

যদি বুঝতে পারো যে আমার মেন্টাল প্রবাহ ভালো অবস্থায় আছে, বলল ট্র্যাভিজ, আমি শুধু বলব যে আমার মাইও যেমন আছে তেমনই রেখে দাও তুমি।

ভালোভাবেই জানো গায়া কখনোই তোমার মাইণ্ড স্পর্শ করবে না, কেন সেটাও জানো। তারপরেও আমি তো মেন্টালি ব্লাইণ্ড নই। কী ঘটছে সেটা এক কিলোমিটার দূর থেকেও অনুভব করতে পারি। মহাকাশ ভ্রমণে এটা কি তোমার অপরিবর্তনীয় নিয়ম, মাই ইরোটোমানটিক* ফ্রেণ্ড। [* ইরোটোমান্টিক: যৌন উত্তেজনায় কাতর। অনুবাদক]

ইরোটোমানটিক? শোন রিস, দুইবার, পুরো অভিযানে মাত্র দুইবার?

আমরা মাত্র দুইটা গ্রহে নেমেছি যেখানে মানুষ বাস করে এবং মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। দুটোর মধ্যে দুটোতেই তুমি সফল।

তুমি ভালো করেই জানেনা কমপরেলনে আমার কিছু করার ছিল না।

সেটা তো বুঝলাম। কমপরেলনের মহিলা কেমন ছিল আমার মনে আছে। হিরোকো তোমাকে তার ইচ্ছামতো চলতে বাধ্য করেছে আমি তা মনে করি না।

অবশ্যই না। আমারও আগ্রহ ছিল। তবে পরামর্শ ছিল তার।

কিছুটা হিংসার সুরে বলল পেলোরেট, তোমার বেলায় কি সবসময় এরকম হয়, গোলান?

হতেই হবে, পেল, বলল ব্লিস। মেয়েরা অসহায়ের মতো ওর প্রেমে পড়ে যায়।

সেরকম হলে তো ভালোই হতো, বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু হয় না এবং সেজন্য আমি খুশি। জীবনে আরো অনেক কাজ করার আছে। তবে এই ক্ষেত্রে আমি বাধা দেইনি। কারণ, অন্য গ্রহ থেকে এই গ্রহে আসা আমরাই প্রথম মানুষ। হিরোকো বা সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটাও অন্য গ্রহের মানুষ দেখেনি কখনো। হিরোকো মনে করেছিল আমি আলফানদের থেকে ভিন্ন, শারীরিক দিক দিয়ে, অন্যান্য দিক দিয়েও। তবে তাকে হতাশ হতে হয়েছে।

ওহ। তুমিও হতাশ?

না। আমি অনেক গ্রহে গিয়েছি, অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবং বুঝতে পেরেছি যে মানুষের কোনো পরিবর্তন হয় না এবং সেক্সেরও কোনো পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন যদি হয়ই সেটা হয় বেশ সনাতন এবং নিরানন্দদায়ক। সারা জীবনে শিখেছি। এক মেয়ের সাথে পরিচয় ছিল তীক্ষ্ণ কর্কশ সঙ্গীত না শুনলে তার শরীর কোনো সাড়া দিত না। কিন্তু সেটা সহ্য হতো না আমার। বিশ্বাস করো পুরোনো কায়দাই আমার পছন্দ।

সঙ্গীতের কথায় মনে পড়ল, ডিনারের পর আমাদের একটা সঙ্গীতানুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছে আলফানরা। আমাদের সম্মানে। যা বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হয় নিজেদের সঙ্গীত নিয়ে আলফানরা খুব গর্বিত।

তারা গর্বিত বলেই সেটা আমাদের কানে মধুর শোনাবে না। মুচকি হেসে বলল ট্র্যাভিজ।

কথা শেষ করতে দাও, বলল ব্লিস, ওদের আসল অহংকার হচ্ছে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র তারা বেশ সুন্দর করে বাজাতে পারে। খুবই প্রাচীন। সেখান থেকে পৃথিবী সম্বন্ধে হয়তো কিছু জানা যাবে।

ভুরু উঁচু করল ট্র্যাভিজ, চমৎকার ভাবনা। এবং মনে পড়েছে যে তোমাদের কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছিলাম। জেনভ, দেখা করেছ মনোলীর সাথে?

অবশ্যই করেছি, বলল পেলোরেট। প্রায় তিন ঘণ্টা তার সাথে ছিলাম। হিরোকো মোটেই বাড়িয়ে বলেনি। পুরো সময়টাই মনোলী একা কথা বলেছে। লাঞ্চের জন্যও আমাকে ছাড়তে চায়নি। কথা দিয়ে আসতে হয়েছে যে আবার তার । কাছে যাবো।

উল্লেখযোগ্য কিছু বলেছে?

বেশ, অন্য সবার মতো-সেও বলেছে-পৃথিবী পুরোপুরি এবং ভয়ংকর রকম রেডিওঅ্যাকটিভ; আলফানদের পূর্বপুরুষরা সবার পরে পৃথিবী ছেড়েছে, নইলে মারা যেত।–এবং গোলান, কথাগুলো সে এত জোর দিয়ে বলেছে যে আমি বিশ্বাস না করে পারিনি। আমার ধারণা পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে, এবং আমাদের পুরো অভিযান ব্যর্থ।

চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ। নিচু বিছানায় বসেছিল পেলোরেট, তার পাশে ব্লিস। উঠে দাঁড়িয়ে পালাক্রমে পুরুষ দুজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে।

শেষ পর্যন্ত কথা বলল ট্র্যাভিজ, অভিযান শেষ হয়েছে কি হয়নি সেটা আমাকেই বিচার করতে দাও, জেনভ। বাঁচাল বুড়ো তোমাকে কি বলেছে সেটা বল। সংক্ষেপে অবশ্যই।

মনোলীর কথার সাথে সাথে, আমি নোট নিয়েছি। বলল পেলোরেট। কোনো সন্দেহ করেনি। কারণ নিজের কথা নিয়েই সে মশগুল ছিল। তার প্রতিটা কথার সাথে সাথেই নতুন নতুন বিষয় বেরিয়ে এল। কিন্তু সারা জীবন আমি দীর্ঘ বিস্তারিত বর্ণনা থেকে–

সংশ্লিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বের করে এনেছ। আসল কথা বল, ডিয়ার জেনভ। নরম সুরে বলল ট্র্যাভিজ।

অস্বস্তির সাথে গলা খাকারি দিল পেলোরেট, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ওল্ড চ্যাপ। আমি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং ধারাবাহিক একটা গল্প বের করার চেষ্টা করেছি। পৃথিবী ছিল, মানবজাতি এবং কোটি কোটি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আসল। জন্মস্থান। হাইপার স্পেসাল ট্রাভেল আবিষ্কারের পূর্বে এটাই ছিল একমাত্র বাসস্থান। তারপর স্পেসার ওয়ার্ল্ডগুলো গড়ে উঠে। তারা পৃথিবীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়, গড়ে তোলে নিজেদের আলাদা একটা সভ্যতা এবং মাতৃগ্রহের সাথে বিরোধিতা শুরু করে।

এর কয়েক শতাব্দী পরেই নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয় পৃথিবী। যদিও মনোলী বলেনি কীভাবে সম্ভব হয়েছে। আমিও জিজ্ঞেস করিনি, কারণ তা হলে হয়তো আলোচনা অন্য দিকে চলে যেত। তবে এলিজাহ্ বেইলি নামে এক প্রাচীন বীরের কথা সে বলেছে। কিন্তু চরিত্রটার বর্ণনা এত বেশি অতিরঞ্জিত যে

আমরা বুঝতে পেরেছি, পেল। বলল ব্লিস।

কথার মাঝখানে আবারও বাধা পেলো পেলোরেট। অবশ্যই। দুঃখিত। পৃথিবী সেটলম্যান্টের দ্বিতীয় একটা ধারার সূচনা করে নতুন পদ্ধতিতে বিভিন্ন গ্রহে বসতি তৈরি করে। নতুন সেটলাররা দৃঢ়ভাবে স্পেসারদের নতুন নতুন গ্রহে বসতি স্থাপন বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলে, এবং ধীরে ধীরে গড়ে তোলে গ্যালাকটিক এম্পায়ার। সেটলার এবং স্পেসারদের মাঝে যুদ্ধের সময়-না, যুদ্ধ নয়, মনোলী দ্বন্দ্ব শব্দটা ব্যবহার করেছিল এবং বেশ সতর্ক ছিল-সেসময়-পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে।

অসম্ভব, জেনভ। বলল ট্র্যাভিজ। একটা গ্রহে কীভাবে রেডিওঅ্যাকটিভিটি ছড়িয়ে পড়ে, গঠনের সময় সব গ্রহই কমবেশি রেডিওঅ্যাকটিভ হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা হ্রাস পায়। পুরো গ্রহ রেডিওঅ্যাকটিভ হতে পারে না।

কাঁধ নাড়ল পেলোরেট। সে আমাকে যা বলেছে আমি তোমাকে শুধু সেগুলোই বলছি। সে আবার শুনেছে অন্য কারো কাছ থেকে। এই অন্য কেউ আবার শুনেছে আরেকজনের কাছ থেকে। গল্পগুলো পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে চালু রয়েছে, ঠিক কি পরিমাণ বিকৃত হয়েছে সেটা এখন আর পরিষ্কার বলা যাবে না।

বুঝলাম, কিন্তু প্রাথমিক ইতিহাসের কোনো বই বা ডকুম্যান্টস নেই যেখান থেকে মোটামুটি সঠিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু উত্তর হলো, না। অস্পষ্টভাবে প্রাচীন একটা বইয়ের কথা বলেছিল, সেটাও কালের বিবর্তনে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। তবে সে যা বলেছে তার সবই ঐ বইয়ে ছিল।

হ্যাঁ, বেশ ভালোভাবেই বিকৃত হয়েছে। সেই একই গল্প। যেখানেই যাই তথ্যগুলো কোনো না কোনোভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে।–ঠিক আছে, পৃথিবীতে কীভাবে রেডিওঅ্যাকটিভিটি শুরু হয় সেটা বলেছে?

বিস্তারিত কিছু বলেনি। শুধু এইটুকু বলেছে যে স্পেসাররা ছিল শয়তান, পৃথিবীবাসীরা সকল দুর্ভাগ্যের জন্য দোষ দিত তাদেরকেই। রেডিওঅ্যাকটিভিটি

একটা পরিষ্কার কণ্ঠস্বর তার কথাকে ছাপিয়ে উঠল, ব্লিস, আমি একজন স্পেসার?

দুই ঘরের মাঝখানের সংকীর্ণ প্রবেশপথে ফেলম দাঁড়িয়ে আছে, চুল এলোমেলো, পরনে ব্লিসের একটা নাইটগাউন, একদিকের কাঁধ থেকে পিছলে নেমে গিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বুক বেরিয়ে পড়েছে। চিন্তা করছিলাম বাইরে থেকে কেউ আড়ি পাতে কিনা, কিন্তু ভিতরেও যে আড়ি পাতার মতো একজন আছে সে কথা মনেই ছিল না।–বলল ব্লিস। শোন, ফেলম, ওই কথা বললে কেন? ফেলমের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বাকি কথাগুলো বলল সে।

ওদের যা আছে আমার তা নেই, পুরুষ দুজনকে দেখিয়ে ফেলম বলল, অথবা তোমার যা আছে, ব্লিস। আমি অন্যরকম। কারণ আমি স্পেসার, তাই না?

তুমি স্পেসার, ফেলম, শান্ত করার সুরে বলল ব্লিস। কিন্তু ছোট দুএকটা পার্থক্য তেমন কোনো ব্যাপার না। যাও ঘুমাতে যাও।

বরাবরের মতোই ফেলম ব্লিসের ইচ্ছার অনুগত হয়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কি শয়তান? শয়তান কি?

ঘাড় ফিরিয়ে বাকি দুজনের উদ্দেশে বলল ব্লিস, আমার জন্য অপেক্ষা করো। এখুনি আসছি।

ঠিক পাঁচ মিনিট পর ফিরে এল সে। মাথা নাড়ছে। আমি না-জাগানো পর্যন্ত সে ঘুমাবে। বোধহয় আগেই করা উচিত ছিল, কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া মাই-এর কোনো ধরনের মডিফিকেশন করা ঠিক হতো না। তারপর কিছুটা আররক্ষার সুরে বলল, আমি চাই না আমাদের সাথে ওর যে শারীরিক পার্থক্য সেটা নিয়ে সে চিন্তা করে।

ওযে হার্মাফ্রোডিটিক একদিন এটা জানবেই। বলল পেলোরেট।

কোনো একদিন, বলল ব্লিস, কিন্তু এখন না। তোমার গল্পটা শেষ করো, পেল।

হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ বলল, নতুন কোনো বাধা আসার আগেই।

বেশ, পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে, বা বলা যায় যে এর ধুলোবালিতে তা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় পৃথিবীর অধিবাসীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, বাস করত বিশাল বিশাল সব শহরে যার অধিকাংশই ছিল মাটির নিচে।

হতেই পারে না, বাধা দিল ট্র্যাভিজ।.কোনো গ্রহের সোনালি যুগকে ফুটিয়ে তোলার জন্য এটা এক ধরনের দেশারবোধ, এবং এটা ট্রানটরের স্বর্ণযুগেরই বিকৃতি, যখন সেটা ছিল গ্যালাক্সি বিস্তৃত বিশ্বসমূহের ইমপেরিয়াল-ক্যাপিটাল।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল পেলোরেট, তারপর বলল, সত্যি, গোলান, আমার কাজ তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে না। আমরা মিথলজিস্টরা ভালো করেই জানি পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তিতে ধার করা উপাদান থাকে। থাকে নৈতিক শিক্ষা ঋতুচক্রের বর্ণনা এবং পাল্টে দেওয়ার মতো আরো অনেক উপাদান। কিন্তু আমরা সেগুলো বাদ দিয়ে প্রকৃত সত্য বের করে আনতে পারি। সত্যি কথা বলতে কি সব ধরনের ইতিহাসের ক্ষেত্রেই কৌশলটা প্রযোজ্য, কারণ কেউই পরিষ্কার, স্পষ্ট সত্য কথা লেখে না। এখন মনোলীর কাছ থেকে শোনা কথাগুলোই তোমাকে বলছি, এবং সম্ভবত আমিও কিছুটা পরিবর্তন করে বলছি, যদিও চেষ্টা করছি যেন কোনো পরিবর্তন না হয়।

বেশ, বেশ, বলল ট্র্যাভিজ। বলে যাও জেনভ। রাগ করো না।

রাগ করিনি। যাই হোক, রেডিওঅ্যাকটিভিটি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বড় বড় শহরগুলো হয়ে পড়ে বসবাসের অযোগ্য। অবশিষ্ট অধিবাসীরা মোটামুটি তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত এলাকায় গাদাগাদি করে বসবাস শুরু করল। জনসংখ্যা সীমিত। রাখার জন্য দুটো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমত জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কড়াকড়ি এবং দ্বিতীয়ত ষাটোর্ধ বয়সের ব্যক্তিদের যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা।

ভয়ঙ্কর, ক্ষুব্ধ স্বরে বলল ব্লিস।

নিঃসন্দেহে, বলল পেলোরেট, কিন্তু মনোলীর মতে ঠিক তাই ঘটেছিল, এবং কথাটা সত্যি হতে পারে, কারণ এটা ঠিক পৃথিবীবাসীদের কোনো প্রশংসা না। আর প্রথমে স্পেসারদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত, অত্যাচারিত এবং পরে এম্পায়ারের দ্বারা। বাধাপ্রাপ্ত, অত্যাচারিত হয়ে পৃথিবীবাসীরা নিজেদের সম্বন্ধে এমন একটা অবজ্ঞাসূচক মিথ্যা চালু করবে সেটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। হয়তো তাদের আরসম্মানবোধ খুব বেশি ছিল, যা অনেকটা কড়া নেশার মতো। একটা ঘটনা

হ্যাঁ, হ্যাঁ পেলোরেট, অন্য সময়। এখন পৃথিবীর গল্পটা শেষ করো।

এম্পায়ার হিতসাধনের উদ্দেশ্যে বিষাক্ত মাটি সরিয়ে তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত মাটি সরবরাহ করতে রাজি হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না পরিকল্পনাটা ছিল বিশাল, এবং খুব শিগগির এম্পায়ার ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বিশেষ করে পঞ্চম কিণ্ডার এর পতনের পর, সেই সময় পৃথিবী ছাড়াও এম্পায়ারের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মাথা ঘামানোর।

রেডিও এ্যাকটিভিটি বাড়ার সাথে সাথে কমতে লাগল জনসংখ্যা। শেষ পর্যন্ত এম্পায়ার অন্যভাবে উপকার করার চেষ্টা করল। তারা প্রস্তাব দিল বাকি অধিবাসীদের অন্য কোনো গ্রহে স্থানান্তর করবে–সংক্ষেপে বলতে গেলে এই গ্রহে।

প্রথম যুগের এক অভিযানে সম্ভবত সাগরগুলোতে মজুত তৈরি করা হয় যেন পৃথিবীর অধিবাসীদের ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের সময় আলফা খাদ্য এবং অক্সিজেনে ভরপুর থাকে। গ্যালাক্সির অন্য কোনো বিশ্ব এই গ্রহ দখল করার চেষ্টা করেনি কারণ বাইনারি সিস্টেমের কোনো নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত গ্রহের প্রকৃতিতে একটা স্বাভাবিক বৈপরিত্য থাকে। এধরনের সিস্টেমে খুব কম গ্রহই বসবাসের উপযুক্ত হয়। থাকলেও সবাই ধরেই নেয় যে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ নেই। উদাহরণ —

উদাহরণ পরে, বলল ট্র্যাভিজ। আগে ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের কথা বল।

বাকি থাকল শুধু, পেলোরেট বলল, এখন দ্রুত কথা বলছে, ল্যাণ্ড-বেস তৈরি করার কাজ। প্রথমে মহাসাগরের সবচেয়ে অগভীর অংশ খুঁজে বের করা হল। তারপর গভীর তলদেশ থেকে পলি তুলে এনে অগভীর অংশ ভরাট করে তৈরি করা হল নিউ আর্থ। বোল্ডার আর কোরাল তুলে এনে বাঁধ দেওয়া হল দ্বীপের চারপাশে। বীজ বপন করা হল যেন উদ্ভিদের শিকড় নতুন মাটিকে দৃঢ়তা দেয়। প্রথমে হয়তো এম্পায়ারের উদ্দেশ্য ছিল একটা মহাদেশ তৈরি করার, কিন্তু নিউ-আর্থ তৈরি করার পর বিভিন্ন কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

পৃথিবীবাসীদের যে কয়জন বাকি ছিল তাদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়। এম্পায়ারের মহাকাশযান তাদেরকে এখানে রেখে চলে যায়। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। পৃথিবীবাসীরা নিউ-আর্থে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে।

পুরোপুরি? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ। আমাদের আগে আর কেউ আসেনি এখানে?

প্রায়। আমার ধারণা, বাইনারি সিস্টেম সম্বন্ধে সাধারণ কুসংস্কার বাদ দিলেও এখানে আসার তেমন কোনো কারণ নেই। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আমাদের মতো দুই-একটা মহাকাশযান এসেছিল, কিন্তু সেগুলো বেশিক্ষণ থাকেনি, আর কখনো ফিরেও আসেনি।

পৃথিবী কোথায় অবস্থিত মনোলীকে তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে?

অবশ্যই। সে জানে না।

পৃথিবীর অবস্থান না জেনেই এত ইতিহাস কীভাবে জানল?

তাকে বিশেষভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গোলান, যে আলফা থেকে কয়েক পারসেক দূরে যে নক্ষত্র আছে পৃথিবী ওটাকে প্রদক্ষিণ করতে পারে। পারসেক কি সে জানত না, আমি বুঝিয়ে দিলাম অ্যাস্ট্রোনমিক্যালি পারসেক খুব অল্প দূরত্ব। তখন সে বলল যে কম বেশি কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর অবস্থান কেউ জানে না এবং কেউ জানে বলে ও তার জানা নেই, এবং তার মতে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা বোকামি হবে। মহাশূন্যে অনন্ত সময়ের জন্য শান্তিতে থাকার জন্য পৃথিবীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তুমি কি তার সাথে একমত?

বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল পেলোরেট, পুরোপুরি না। কিন্তু সে বলেছিল রেডিওঅ্যাকটিভিটি এত দ্রুত বাড়ছিল যে ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের পরপরই গ্রহটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। এখন তো নিশ্চয়ই আগুনের মতো জ্বলছে। ফলে কেউ আর সেখানে যেতে পারবে না।

ননসেন্স, দৃঢ় গলায় বলল ট্র্যাভিজ। একটা গ্রহ কখনো রেডিওঅ্যাকটিভ হতে পারে না। আর তা ছাড়া রেডিওঅ্যাকটিভিটির মাত্রা কখনো বাড়ে না বরং হ্রাস পায়।

কিন্তু মনোলী এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিল। সবগুলো গ্রহে আমরা যতজন মানুষের সাথে কথা বলেছি একটা ব্যাপারে তারা সবাই ছিল একমত-পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ। ওখানে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।

.

লম্বা দম নিয়ে সতর্ক নিয়ন্ত্রিত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, ননসেন্স, জেনভ। এটা সত্যি নয়।

তুমি বিশ্বাস করতে চাও বলেই কোনো কিছু বিশ্বাস করা ঠিক হবে না, ওল্ড চ্যাপ। বলল পেলোরেট।

আমার চাওয়া না-চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। প্রতিটা গ্রহেই দেখেছি পৃথিবীর সকল রেকর্ড মুছে ফেলা হয়েছে। গোপন করার মতো কিছু না থাকলে সেগুলো মুছে ফেলা হল কেন; যদি পৃথিবী মৃত বিশ্ব হয়, রেডিওঅ্যাকটিভ?

আমি জানি না, গোলান।

হ্যাঁ, তুমি জানো। মেলপোমিনিয়ায় যাওয়ার পথে তুমি বলেছিলে রেডিওঅ্যাকটিভিটি সম্ভবত মুদ্রার অপর পিঠ। সঠিক তথ্য গোপন করার জন্য সব রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে; রেডিওঅ্যাকটিভিটির গল্প তৈরি হয়েছে ভুল তথ্য সরবরাহের জন্য। দুটোই পৃথিবীর অনুসন্ধানের কাজে আমাদের নিরুৎসাহিত করবে। কিন্তু আমরা নিরুৎসাহিত হলে চলবে না।

ব্লিস বলল, তুমি মনে করছ কাছাকাছি নক্ষত্রই পৃথিবীর সূর্য। তা হলে রেডিওঅ্যাকটিভিটি নিয়ে তর্ক করার দরকার কি? কি আসে যায় তাতে? ঐ নক্ষত্রে গিয়ে কেন দেখছি না ওটা পৃথিবী কিনা, যদি হয় তা হলে দেখতে কেমন?

কারণ পৃথিবীতে যারা আছে তারা অস্বাভাবিক রকম শক্তিশালী, বলল ট্র্যাভিজ এবং আমি ঐ গ্রহ আর অধিবাসীদের সম্বন্ধে কিছু না জেনে সেখানে যেতে চাই না। বিপদ হতে পারে। তোমাদের আলফায় রেখে আমি একাই যেতে চাই। ঝুঁকি নিতে হলে একজনের জীবনের উপরেই নেওয়া ভালো।

না, গোলান, আন্তরিকভাবে বলল পেলোরেট। ব্লিস আর বাচ্চা মেয়েটা এখানে থাকতে পারে, কিন্তু আমি অবশ্যই তোমার সাথে যাব। তোমার জন্মের আগে থেকেই আমি পৃথিবী খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর এখন যখন উদ্দেশ্য পূরণ মাত্র কয়েক কদম দূরে তখন আর পিছনে থাকতে পারি না।

ব্লিস আর বাচ্চা মেয়েটা এখানে থাকবে না, বলল ব্লিস। আমি গায়া এবং গায়া আমাদেরকে এমনকি পৃথিবীর হাত থেকেও রক্ষা করতে পারবে।

আশা করি তোমার কথাই ঠিক, মুখ উজ্জ্বল করে বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু নিজেদেরকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পৃথিবীর ভূমিকা সম্বন্ধে প্রাথমিক স্মৃতি মুছে যাওয়া গায়া ঠেকাতে পারে নি।

সেটা ছিল গায়ার প্রথম যুগ যখন সে এতটা সংগঠিত এবং উন্নত ছিল না। তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতির মধ্যে কোনো মিল নেই।

তাই হবে আশা করি।–নাকি তুমি এমন কিছু জেনেছ যা আমরা জানি না। তোমাকে কোনো একজন বয়স্ক মহিলার সাথে কথা বলতে বলেছিলাম।

আমি তাই করেছি।

কী জানতে পেরেছে।

পৃথিবীর ব্যাপারে কিছুই না।

আচ্ছা।

কিন্তু এরা বায়োটেকনোলজিতে বেশ উন্নত।

ওহ?

এই ছোট দ্বীপে হাজার হাজার বছর আগে যখন তারা এসেছিল তখন খাদ্যশস্য এবং প্রাণী বৈচিত্র্য খুব কম ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী জন্মানোর কৌশল আবিষ্কার করে। সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে তারা ব্যাপক বিবর্তন ঘটাতে পেরেছে। ফলে শুধু যে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয় বরং খাদ্যের গুণগত মান এবং স্বাদও বেড়ে গেছে বহুগুণ। তাদের উন্নত বায়োটেকনোলজির কারণেই এই গ্রহের এত প্রাচুর্য্য। নিজেদের নিয়েও তাদের একটা পরিকল্পনা আছে।

কী রকম?

ওরা জানে পুরো গ্রহে যে ছোট এক টুকরা জমি আছে তাতে নিজেদের জনসংখ্যা বাড়ানো কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। তাই তারা উভচর হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

কী হতে চাইছে?

উভচর। বলল ব্লিস। ওদের পরিকল্পনা হচ্ছে ফুসফুসের পাশাপাশি নিজেদের দেহে মাছের শ্বাসযন্ত্র তৈরি করা যেন দীর্ঘসময় পানির নিচে থাকতে পারে। তা হলে সাগরের অগভীর অংশ খুঁজে বের করে সেখানে আবাসস্থল তৈরি করতে পারবে। যার সাথে কথা বলেছি এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট আশাবাদী হলেও স্বীকার করেছে যে পরিকল্পনাটা মাত্র কয়েক শতাব্দী আগের এবং এখনো খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।

দুটো ক্ষেত্রে ওরা আমাদের চেয়েও এগিয়ে আছে। বলল ট্র্যাভিজ। ওয়েদার কন্ট্রোল এবং বায়োটেকনোলজী। কৌশলটা কী হতে পারে ভাবছি।

আমাদের কোনো বিশেষজ্ঞকে খুঁজে বের করতে হবে। বলল ব্লিস। তবে ওরা কথা বলবে কিনা সন্দেহ আছে।

পেলোরেট বলল, আমরা টার্মিনাসেও বেশ ভালোভাবে ওয়েদার কন্ট্রোল করতে পারি।

নিয়ন্ত্রণ অনেক গ্রহেরই ভালো, বলল ট্র্যাভিজ। কিন্তু সবক্ষেত্রেই সেটা হয় পুরো গ্রহে এক সাথে। এখানে আলফানরা গ্রহের নির্দিষ্ট একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এবং ওদের এমন কোনো কৌশল আছে যা আমাদের নেই।–আর কিছু, ব্লিস?

সামাজিক আমন্ত্রণ। এই মানুষগুলো মনে হয় বেশ উৎসব প্রিয়। সুযোগ পেলেই খামার বা মৎস্য শিকারের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে উৎসবে মেতে উঠে। আজ রাতে ডিনারের পরে একটা সঙ্গীতানুষ্ঠান আছে, আগেই বলেছি। আগামী কাল দিনের বেলা হবে বিচ ফেস্টিভ্যাল। আগামী দুএকদিনের ভেতর বৃষ্টি হবে। তাই সবাই সূর্যের আলো উপভোগের জন্য সমুদ্র সৈকতে মিলিত হবে। তার পরের দিন সকালে মৎস্য শিকারির দল ফিরে আসবে এবং সন্ধ্যায় শিকার করা মাছ দিয়ে হবে খাদ্য উৎসব।

এমনিতেই খাবারের বহর দেখে মাথা ঘুরে যায়। খাদ্য উৎসবে যে কী হবে ভাবতেই পারছি না। গজ গজ করে বলল পেলোরেট।

এটা শুধু একটা প্রদর্শনী। পরিমাণ সামান্য, তবে বৈচিত্র্য থাকবে। যাই হোক প্রতিটি উৎসবেই আমাদের চার জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বিশেষ করে আজ রাতের সঙ্গীতানুষ্ঠানে।

এ্যান্টিক বাদ্যযন্ত্র? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।

ঠিক তাই।

ভালো কথা, ওগুলো কোন দিক দিয়ে এ্যান্টিক? প্রাচীন কম্পিউটার?

না, না, আসল ব্যাপারটা তো সেখানেই। এগুলো মোটেই বৈদ্যুতিক নয় তবে যান্ত্রিক। ওরা আমাকে বর্ণনা দিয়েছে। ধাতব তারে ঘষা দিয়ে, টিউবে ফুঁ দিয়ে, সমতল পৃষ্ঠে আঘাত করে সুর তৈরি করবে। তুমি বানিয়ে বলছ। বলল ট্র্যাভিজ।

না। বানিয়ে বলছি না। এবং তোমার হিরোকোও কোনো একটা টিউব বাজাবে নাম ভুলে গেছি-তোমাকে সেটা শুনতেই হবে।

আমার যেতে আপত্তি নেই, বলল পেলোরেট। প্রাচীন সঙ্গীত সম্বন্ধে আমি প্রায় কিছুই জানি না।

সে মোটেই আমার হিরোকো নয়, ঠাণ্ডা সুরে বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু এই যন্ত্রগুলো কি একসময় পৃথিবীতে প্রচলিত ছিল।

তাই তো শুনলাম, বলল ব্লিস। অন্তত আলফান মহিলা বলেছে যে ওগুলো এই গ্রহে তার পূর্বপুরুষরা আসার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল।

সেক্ষেত্রে, ট্র্যাভিজ বলল। হৈ হট্টগোল শুনতে যাওয়া যায়। দেখা যাক এখান থেকে পৃথিবীর কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা।

অদ্ভুত ব্যাপার। সঙ্গীতানুষ্ঠান নিয়ে অন্য সবার চেয়ে ফেলমই বেশি উচ্ছ্বসিত। সে আর ব্লিস তাদের কোয়ার্টারের পিছনে ছোট গোসলখানায় গোসল করছিল। ঠাণ্ডা এবং গরম দুধরনের পানির ব্যবস্থা আছে, গোসল করার জন্য একটা গামলা আর আছে একটা কমোড। আলোরও কোনো অভাব নেই।

গোসলের পর ব্লিস আলফানদের দেওয়া অন্তর্বাস এবং স্কার্ট পরিয়ে দিল ফেলমকে। ঠিক করল ফেলমের কোমরের উপরে কোনো পোশাক পরাবে না। নিজেও স্কার্ট পরল, একটু টাইট হলো, কোমরের কাছে। তবে বুক ভোলা রাখল না, নিজের ব্লাউজ পরে নিল। এত লোকের সামনে বুক খোলা রেখে ঘুরে বেড়ানো অস্বাভাবিক যেখানে আলফান মেয়েদের বুকের মতো সুগঠিত আর সুন্দর না। তারটা।

তারপর পুরুষ দুজন গোসল করতে ঢুকল। মেয়েদের সময় বেশি লাগার কারণে গজগজ করছে ট্র্যাভিজ।

ফেলমকে বলল ব্লিস, খুব সুন্দর স্কার্ট, ফেলম। তোমার পছন্দ হয়েছে?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ফেলম। তারপর বলল, হ্যাঁ, হয়েছে, উপরে কিছু পড়িনি। ঠাণ্ডা লাগবে না?

মনে হয় না, ফেলম। এই গ্রহ বেশ উষ্ণ।

তুমি তো পড়েছ।

হ্যাঁ, পড়েছি। আমার গ্রহে এটাই নিয়ম। শোন, ফেলম, ডিনার এবং তার পরে আমাদেরকে অনেক মানুষের মাঝে থাকতে হবে। তুমি সহ্য করতে পারবে?

অসহায় দেখালো ফেলমকে, ব্লিস বলল, আমি ডানপাশে বসে তোমাকে ধরে রাখব। পেল বসবে বাম পাশে। ট্র্যাভিজ বসবে মুখোমুখি। কাউকে তোমার সাথে কথা বলতে দেব না। তোমারও কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই।

চেষ্টা করব, ব্লিস। ফেলম তার চড়া সুরেলা গলায় বলল।

তারপরে, বলল ব্লিস। আলফানরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে আমাদের জন্য সঙ্গীত পরিবেশন করবে। তুমি জানো সঙ্গীত কি? শিস বাজিয়ে বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্রের সুর তোলার চেষ্টা করল সে।

যেন উজ্জ্বল আলোর বাতি জ্বলে উঠল ফেলমের চেহারায়। তুমি বলছ পরের শব্দটা ছিল তার নিজের ভাষায়, এবং চড়া সুরে গান গাইতে লাগল সে।

চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেছে ব্লিস এর। চমৎকার সুর, যদিও উদ্দাম এবং কম্পন অনেক বেশি। ঠিক, সঙ্গীত। বলল সে।

উত্তেজিত গলায় ফেলম বলল, জেম্বি সবসময়, (একটু দ্বিধা করে গ্যালাকটিক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল।) সুর তৈরি করত। ওটা সবসময় দিয়ে সুর তৈরি করত। পরের শব্দটা ছিল তার নিজের ভাষার।

সন্দেহ নিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করল ব্লিস। ফেলম শুধরে দেওয়ার পর বুঝতে পারল সে, কিন্তু নিজে আর উচ্চারণ করল না। জিজ্ঞেস করল, জিনিসটা দেখতে কেমন?

বর্ণনা দেওয়ার মতো যথেষ্ট শব্দ ভাণ্ডার ফেলমের নেই। আর হাত পা নাড়া দেখে ব্লিসও কিছু বুঝতে পারল না।

-–কীভাবে চালাতে হয় আমাকে দেখিয়েছিল সে, গর্বের সাথে বলল ফেলম। জেম্বি যেভাবে আঙুল নাড়ত, আমিও সেভাবে নাড়তাম। তবে বলেছিল যে কিছুদিন পর আমাকে আর আঙুল নাড়তে হবে না।

চমৎকার, বলল ব্লিস। দেখা যাক আলফানরা তোমার মতো দক্ষ কিনা।

বিরক্তিকর ভিড়, নিরানন্দ ডিনার, তীক্ষ্ণ গোলমাল সত্ত্বেও ডিনারের পর কি আসছে সেটা চিন্তা করে আনন্দে উদ্বেল হয়ে রইল ফেলম। শুধু খাবারের ডিশ টেনে নেওয়ার সময় একজন আলফান কাছাকাছি আসতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ব্লিস সাথে সাথে তাকে কোলে টেনে নিল।

নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারলে ভালো হতো, ফিসফিস করে পেলোরেটকে বলল সে। এই আইসোলেট অ্যানিমেল প্রোটিনগুলো জঘন্য।

সবই ওদের সরলতা আর অতিথেয়তা, বলল পেলোরেট, প্রাচীন ইতিহাস শেখার সুযোগ পেলে সে সব সহ্য করতে রাজি।

-এবং তারপরে শেষ হলো ডিনার, সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা দেওয়া হল।

.

যে হলরুমে সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে সেটা ডাইনিং রুমের চেয়েও বড়। প্রায় এক শ পঞ্চাশ জন বসার জন্য ভাঁজ করা আসন, ততটা আরামদায়ক না। সম্মানিত অতিথি হিসেবে তাদেরকে নিয়ে আসা হলো সামনের সারিতে। আলফানদের কাছ থেকে তাদের পোশাক সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক মন্তব্য ভেসে আসছে।

দুজনেরই কোমরের উপর থেকে নগ্ন। কথাটা মনে পড়লেই পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে ট্র্যাভিজের, আবার বুকের ঘন কালো পশমগুলোর জন্য গর্বও বোধ করছে। নিজেকে নিয়ে পেলোরেটের কোনো চিন্তা নেই। বিস্ময়ভরা কৌতূহল নিয়ে আলফানদের দেখছে সে। ব্লিসের ব্লাউজ দেখে অনেকে অবাক হলেও কোনো মন্তব্য করল না।

ট্র্যাভিজ খেয়াল করল হলরুমের মাত্র অর্ধেক ভর্তি হয়েছে এবং দর্শকদের অধিকাংশই মহিলা, কারণ, সম্ভবত পুরুষরা প্রায় সবাই সাগরে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত।

ট্র্যাভিজের কানের কাছে মাথা এনে পেলোরেট ফিসফিস করে বলল, ওদের ইলেকট্রিসিটি আছে।

দেয়ালে এবং ছাদে যুক্ত করা লম্বা টিউবগুলোর দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ। মৃদু নরম আলো ছড়াচ্ছে সেগুলো।

ফ্লুরোসেন্স। বলল সে। খুবই প্রাচীন।

হ্যাঁ, কিন্তু ওরা কৌশলটা জানে। আমাদের কামরাতেও ছিল। আমি ভেবেছিলাম ওগুলো শুধু ঘর সাজানোর জন্য। কীভাবে জ্বালাতে হয় জানা থাকলে আর অন্ধকারে থাকতে হতো না।

ওদেরই বলা উচিত ছিল। বিরক্ত সুরে বলল ব্লিস।

পেলোরেট বলল, ধরে নিয়েছে আমরা জানি; সবাই জানে।

পর্দার পেছন থেকে চার জন মহিলা বেরিয়ে এসে সামনের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো। প্রত্যেকের হাতে বার্নিশ করা কাঠের তৈরি প্রায় একই রকম দেখতে একটা করে বাদ্যযন্ত্র, কিন্তু সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। যন্ত্রগুলোর ভেতর মূল পার্থক্য হচ্ছে তাদের আকারে। প্রথমটা একেবারেই ছোট। দুইটা মোটামুটি বড়। চতুর্থটা বিশাল বড়। প্রত্যেক মহিলার হাতে একটা করে লম্বা রডও আছে।

মহিলাদের দেখেই মৃদু স্বরে শিস বাজাল দর্শকরা। শিল্পীরা মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। এক টুকরো লম্বা কাপড় দিয়ে চার জনের সবাই বুক বেঁধে রেখেছে। শক্ত করে, যেন বাজানর সময় সমস্যা না হয়।

শিসের শব্দ শুনে ট্র্যাভিজ ধরে নিল এটা কোনো ধরনের সম্মতি বা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। মনে হলো ভদ্রতা হিসেবে নিজেরও যোগ দেয়া উচিত। আর তাতে ফেলম যেভাবে কাঁপা স্বরে চিৎকার করে উঠল সেটাকে কোনোভাবেই শিস বলা যায় না। ব্লিস থামানোর আগেই সবাই ঘুরে তাকাল তার দিকে।

মহিলাদের তিনজন তাদের বাদ্যযন্ত্র তুলে ঠেস দিয়ে ধরল চিবুকের নিচে, সবচেয়ে বড়টা চতুর্থ মহিলার দুপায়ের ফাঁকে মাটিতে দাঁড় করানো থাকল। ডান হাতের লম্বা রড বাদ্যযন্ত্রের তারের উপর ঠেকিয়ে মাথা থেকে শেষ পর্যন্ত ঘষতে লাগল সবাই, সেই সাথে বা হাতের আঙুলগুলো তারের উপরের অংশে দ্রুত নাড়ছে।

যেরকম ভেবেছিল ট্র্যাভিজ সেরকম শব্দ হল না। বরং ধারাবাহিক ভাবে একটা ছন্দবদ্ধ সুর তৈরি হল; প্রত্যেকটা বাদ্যযন্ত্র নিজস্ব শব্দ তৈরি করছে। সবগুলো মিশিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অপূর্ব সুর লহরীর।

ইলেকট্রনিক মিউজিকের কোনো জটিলতা এখানে নেই (প্রকৃত সঙ্গীত ভাবল ট্র্যাভিজ) এবং প্রায় একই রকম মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অদ্ভুত শব্দের সাথে ট্র্যাভিজের কান অভ্যস্ত হলো, সঙ্গীতের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ধরতে পারল সে। মনোযোগ ধরে রাখা বেশ ক্লান্তিকর। তবে দীর্ঘক্ষণ শুনতে পারলে সে যে এই কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলোর বিশুদ্ধ সঙ্গীত পছন্দ করে ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কনসার্ট শুরু হওয়ার প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর মঞ্চে হাজির হলো হিরোকো। ট্র্যাভিজকে সামনের সারিতে দেখে চমৎকারভাবে হাসল সে। দর্শকদের সাথে শিস বাজিয়ে তাকে স্বাগত জানাল ট্র্যাভিজ। লম্বা স্কার্টে তাকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। বুকের কাছে শুধু একটা বড় ফুল, আর কিছু নেই।

হিরোকোর বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে কাঠের কালো একটা টিউব। প্রায় এক মিটারের মতো লম্বা এবং দুই সেন্টিমিটার মোটা। যন্ত্রের এক প্রান্ত মুখের কাছে তুলে ফুঁ দিল সে। পাতলা কিন্তু মিষ্টি একটা সুর তৈরি হল, টিউবের লম্বা প্রান্তে অনেকগুলো ধাতব চাবি টিপে সুরটাকে আরো মোহনীয় করে তুলল সে।

প্রথম শব্দ শুনেই ব্লিসের বাহু খামছে ধরল ফেলম, বলল, ব্লিস, ওটা-। পরের শব্দটা হচ্ছে এর আগে নিজের ভাষায় যে বাদ্যযন্ত্রের নাম বলেছিল, সেটা।

দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল ব্লিস। কিন্তু ফেলম আবারো বলল।

সবাই ঘুরে তাকিয়ে আছে এদিকে। ব্লিস এক হাত দিয়ে শক্ত করে ফেলমের মুখ চেপে ধরল। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, চুপ!

তারপরে ফেলম আর কোনো গোলমাল করল না। চুপ করে হিরোকোর বাজনা শুনতে লাগল। কিন্তু তার আঙুল নাচতে লাগল তালে তালে, যেন নিজেই বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে।

কনসার্টের সর্বশেষ শিল্পী একজন বয়স্ক পুরুষ। কাঁধে ঝোলানো অদ্ভুত ধরনের বাদ্যযন্ত্র। একদিকের অংশ সে চেপে ধরে ছেড়ে দিচ্ছে আরেক হাত দিয়ে অন্য প্রান্তের সাদা ও গাঢ় রঙের কিছু বস্তু একসঙ্গে চেপে ধরছে।

শব্দটা বুনো এবং আরো বেশি ক্লান্তিকর মনে হলো ট্র্যাভিজের কাছে, অরোরার বুনো কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউ ডাকের কথা মনে পড়ে গেল, যদিও আসলে কুকুরের ডাকের সাথে এই বাদ্যযন্ত্রের শব্দের কোনো মিল নেই। ব্লিসকে দেখে মনে হলো এখনি কান চেপে ধরবে, আর পেলোরেট ভুরু কুঁচকে রেখেছে। উপভোগ করছে একমাত্র ফেলম, কারণ মেঝেতে তালে তালে পা ঠুকছে সে, এবং একটা ব্যাপার লক্ষ করে অবাক হয়ে গেল ট্র্যাভিজ, বাদ্যযন্ত্রের একটা তালের সাথে ফেলমের মেঝেতে পা ঠুকে তৈরি করা তাল পুরোপুরি মিলে গেছে।

বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনির মধ্যে শেষ হলো কনসার্ট, সবাইকে ছাপিয়ে উঠল ফেলমের উল্লসিত চিৎকার।

দর্শকরা ছোট ছোট জটলা বেধে আলোচনা করতে লাগল। শিল্পীরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে হলরুমের সামনের দিকে, যারা অভিনন্দন জানাতে আসছে তাদের সাথে কথা বলছে।

ব্লিসের হাত থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে হিরোকোর কাছে ছুটে গেল ফেলম।

হিরোকো, রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করে উঠল সে,–আমাকে দেখতে দেবে?

কোন বস্তুটা খুকি?

যা দিয়ে তুমি সুর তৈরি করেছ।

ওহ্, হাসল হিরোকো, ওইটা একটা বাঁশি, ছোট্ট মেয়ে।

আমি দেখতে পারি?

বেশ, একটা বাক্স খুলে বাদ্যযন্ত্রটা বের করল হিরোকো। জিনিসটা তিন অংশে বিভক্ত ছিল, কিন্তু দ্রুত বিচ্ছিন্ন অংশ গুলো জোড়া দিল সে। মাউথপিস ফেলমের ঠোঁটের কাছে নিয়ে বলল, ফু দাও।

জানি, জানি, এক নিশ্বাসে বলল ফেলম, এবং ধরার জন্য হাত বাড়াল।

ঝটকা দিয়ে বাঁশি সরিয়ে নিল হিরোকো। ফুঁ দাও, খুকি, কিন্তু ধরিবে না।

হতাশ হলো ফেলম। আমি দেখতে পারি। ধরব না।

অবশ্যই।

আবারো বাঁশিটা এগিয়ে দিল সে আর ফেলম সীমাহীন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল।

এবং তারপরে ভেতরের ফ্লোরোসেন্ট আলোর উজ্জ্বলতা কমে গেলো কিছুটা, আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল বাঁশির সুর। দ্বিধাগ্রস্ত, কাঁপা কাঁপা।

সীমাহীন বিস্ময়ে হাত থেকে বাঁশি প্রায় ফেলেই দিয়েছিল হিরোকো আর আনন্দে চিৎকার করে উঠল ফেলম, আমি পেরেছি। আমি পেরেছি। জেম্বি বলেছিল একদিন আমি ঠিকই পারব।

এই সুর তুমিই বাজাইয়াছ? বলল হিরোকো।

হ্যাঁ, আমি করেছি। আমি করেছি।

কিন্তু কী উপায়ে করিলে, খুকি?

বিব্রত স্বরে ব্লিস বলল, দুঃখিত হিরোকো। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।

না। বলল হিরোকো। আমি পুনরায় বাজনা শুনিতে চাই।

আশপাশে অল্প যে কয়েকজন আলফান ছিল তারা কাছে এসে ভিড় জমাল। ফেলমের কপাল কুঁচকানো যেন কঠিন চেষ্টা করছে। ফ্লুরোসেন্টস কমে গেল আগের চেয়েও বেশি, আবারো শোনা গেল বাঁশির সুর, এবার অনেক নিখুঁত এবং আত্মবিশ্বাসী, তারপর একটু অনিয়মিত হয়ে পড়ল কারণ লম্বা দৈর্ঘ্যের উপর বসানো ধাতব বস্তুগুলো নিজে নিজেই নড়ছে।

–থেকে এটা আলাদা, বলল ফেলম, কিছুটা রুদ্ধশ্বাসে, যেন শক্তিচালিত যে বাতাস বাঁশি বাজাচ্ছে সেটা তার নিজেরই নিশ্বাস।

(সম্ভবত ফ্লুরোসেন্ট জ্বালানোর জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে সেখান থেকেই সে শক্তি সংগ্রহ করছে। ট্র্যাভিজকে বলল পেলোরেট।)

আবার চেষ্টা করো, খসখসে গলায় হিরোকো বলল।

চোখ বন্ধ করল ফেলম। বাঁশির সুর এখন অনেক নরম এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে। আপনাআপনিই বাজছে, আঙুল দিয়ে চাবিগুলো নাড়তে হচ্ছে না, বরং ফেলমের মস্তিষ্কের এখনো অপরিণত লোবস এর ট্রান্সডিউস করা দূরাগত শক্তির সাহায্যে বাজছে। এক অপূর্ব সুর মূর্ঘনা মোহিত করে ফেলল সবাইকে, হলরুমের সবাই এখন হিরোকো আর ফেলমকে ঘিরে ধরেছে, বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে হিরোকো বাঁশির এক প্রান্ত ধরে রেখেছে হালকাভাবে, আর ফেলম চোখ বন্ধ করে বাতাসের স্রোত এবং চাবিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে।

আমি এই সুরটাই বাজাইয়াছিলাম। ফিসফিস করে বলল হিরোকো।

আমার মনে আছে, ফেলম বলল, মাথা নাড়ল হালকা ভাবে যেন মনযোগ ছিন্ন না হয়।

শেষ হওয়ার পর হিরোকো বলল, কোথাও এতটুকু ভুল হয় নাই।

কিন্তু এটা ঠিক না, হিরোকো। তুমি ঠিক ভাবে বাজাতে পারোনি।

ফেলম! বলল ব্লিস। অভদ্রতা করো না। তুমি

দয়া করুন, দ্রুত বলল হিরোকো, বাধা দিবেন না। কেন ইহা ঠিক হয়নি খুকি।

কারণ আমি অন্যভাবে বাজাতাম।

দেখাও আমাকে, তাহা হইলে।

আবার বাঁশি বেজে উঠল, আগের চেয়েও জটিল ভঙ্গিতে, কারণ যে অদৃশ্যশক্তি চাবিগুলো চেপে ধরছে, সেটা করছে অনেক দ্রুত এবং ধারাবাহিকভাবে এবং আগের চেয়েও অনেক সূক্ষ সমন্বয়ে। এবারের সুর মূর্ঘনা অনেক বেশি জটিল এবং আবেগঘন। পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে গেছে হিরোকো, পুরো হলরুমে নিঃশব্দতা।

এমনকি ফেলমের বাজানো শেষ হওয়ার পরেও নিঃশব্দতা ভাঙল না। তারপর হিরোকো শব্দ করে গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলল, ছোট্ট খুকি, তুমি আগে কখনো এই বাদ্যযন্ত্র বাজাইয়াছিলে?

না, বলল ফেলম, এর আগে আমি শুধু আঙুল দিয়ে বাজিয়েছিলাম, কিন্তু আঙুল দিয়ে এত ভালো বাজাতে পারতাম না। তারপর সীমাহীন সরলতার সাথে বলল, কেউই পারে না।

তুমি অন্য কিছু বাজাইতে পারো?

আমি কিছু একটা তৈরি করতে পারি।

তাহার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে সুর তৈরি করিতে পারো?

কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে ব্লিসের দিকে তাকালো ফেলম। মাথা নাড়ল ব্লিস, তখন ফেলম বলল হ্যাঁ।

করিয়া দেখাও, তাহা হইলে। বলল হিরোকো।

দুএক মিনিট চিন্তা করল ফেলম, তারপর শুরু করল ধীরে ধীরে। অতি সাধারণ একটা স্বরলিপি তৈরি করল সে। ফ্লুরোসেন্ট একবার বাড়ছে একবার কমছে। কেউ বোধহয় খেয়াল করেনি, ধরেই নিয়েছে অদৃশ্য শক্তি নয় বরং সুরের উত্থান পতনের কারণেই এমনটা ঘটছে।

সাধারণ স্বরলিপির পুনরাবৃত্তি ঘটল এবার একটু জোরালোভাবে, তারপর জটিল সমন্বয়ে। তারপর এত দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে লাগল যে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল সবাই। তারপর থেমে গেল আচমকা, জোরে ধাক্কা দিয়ে শ্রোতাদের নামিয়ে আনল মাটিতে, যেন এতক্ষণ আসলেই তারা আকাশে ভাসছিল।

ট্র্যাভিজ, যে ভিন্নধরনের সঙ্গীতে অভ্যস্ত সেও বিষণ্ণ মনে ভাবল, এই সুর আমি আর কোনোদিন শুনতে পারবো না।

স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসার পর হিরোকো তার বাঁশি বাড়িয়ে ধরে বলল, নাও, ফেলম। ইহা তোমার।

খুশিতে ডগমগ হয়ে হাত বাড়ালো ফেলম, কিন্তু মাঝ পথেই থামিয়ে দিল ব্লিস। বলল, আমরা এটা নিতে পারি না, হিরোকো। এটা অতি মূল্যবান।

আমার আরেকটা আছে, ব্লিস, যদিও এটার মতো ভালো না, কিন্তু তাহাই তো হওয়া উচিত। এই যন্ত্র তাহার কাছেই থাকিবে যে ইহাকে উত্তমরূপে বাজাইতে পারিবে। এমন অপূর্ব সুর পূর্বে কখনো শুনি নাই। যে যন্ত্র নিখুঁতভাবে বাজাইতে পারি না তাহা আমার নিকট থাকাটা সমীচীন নয়। আঙুলের স্পর্শ ছাড়া কীভাবে বাঁশি বাজানো যায় যদি জানিতে পারিতাম।

বাঁশিটা নিল ফেলম, তারপর যেন সাত রাজার ধন খুঁজে পেয়েছে এমনভাবে চেপে ধরল বুকের সাথে।

.

তাদের কোয়ার্টারের প্রতিটি ঘরেই একটা করে ফ্লুরোসেন্ট বাতি জ্বালানো হয়েছে, বাইরের আউটহাউসে আছে একটা, মোট তিনটা। অনুজ্জ্বল আলো, পড়ালেখা করা যাবে না, তবে অন্তত ঘরের অন্ধকার তো দূর হল।

বাইরে পায়চারী করছে সবাই। আকাশভরা নক্ষত্র, টার্মিনাসবাসীদের চোখে যা সবসময়ই মনোমুগ্ধকর, সেখানের আকাশ নক্ষত্রহীন, শুধু গ্যালাক্সির ঝাপসা মেঘ একমাত্র পরিচিত দৃশ্য।

ফিরে আসার পথে তাদের সঙ্গ দিয়েছে হিরোকো। হয়তো ভয় পেয়েছে অতিথিরা পথ হারিয়ে ফেলবে বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। পুরোটা পথ ফেলমের হাত ধরে রেখেছিল সে। এখনো ফ্লুরোসেন্টগুলো জ্বালিয়ে দেবার পর বাইরে পায়চারী করছে তাদের সাথে আর বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে রেখেছে।

আবার চেষ্টা করল ব্লিস, কারণ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে হিরোকো একটা মানসিক দ্বন্দ্বের ভেতর রয়েছে, সত্যি হিরোকো, আমরা তোমার বাঁশি নিতে পারি না।

না, ফেলমের কাছেই ইহা থাকা উচিত।

এক মনে আকাশ দেখছে ট্র্যাভিজ। রাতের অন্ধকার প্রকৃত অর্থেই গাঢ়। এমন অন্ধকার বহুদূর থেকে ছিটকে আসা সামান্য আলোতে যা দূর হয় না; বহুদূরের ঘর। বাড়িগুলোর মিটমিটে আলো যে অন্ধকারকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

সে বলল, হিরোকো, সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটা দেখছ। কী নাম ওটার?

স্বাভাবিকভাবে চোখ তুলল হিরোকো, নিরুৎসুক গলায় বলল, ওটার নাম। কম্প্যানিয়ন।

এরকম নাম হয়েছে কেন?

প্রতি আশি বছরে ইহা আমাদের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। বছরের এই সময়ে ইহা হইল সন্ধ্যাতারা। আপনি ইহাকে দিনের বেলাতেও দেখিতে পারিবেন, যখন দিগন্তের উপরে অবস্থান করে।

চমৎকার, ভাবল ট্র্যাভিজ। অ্যাস্ট্রোনমী সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ নয় মেয়েটা। সে বলল, তুমি কি জানো আলফার আরেকটা সঙ্গী আছে, ছোট এবং অনেক দূরে। টেলিস্কোপ ছাড়া তুমি দেখতে পারবে না। (সে নিজেও দেখেনি, খুঁজে দেখার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু কম্পিউটারের মেমোরী ব্যাংকে তথ্যটা আছে।)

বিদ্যালয়ে আমাদের এইগুলো শেখানো হইয়াছে। নিরাসক্ত গলায় বলল হিরোকো।

ওটার ব্যাপারে কি জানো? এলোমেলো সরল রেখায় সাজানো নক্ষত্রগুলো দেখছো?

ওটা ক্যাসিওপিয়া।

সত্যি? কেঁপে উঠল ট্র্যাভিজ। কোন নক্ষত্রটা?

সবগুলোই। পুরোটা মিলেই ক্যাসিওপিয়া।

এরকম নাম হয়েছে কেন?

ইহা আমার জানা নাই। অ্যাস্ট্রোনমি আমি কিছুই জানি না, রেসপেকটেড ট্র্যাভিজ।

সবচেয়ে নিচের নক্ষত্রটা দেখেছো? ওটা কী?

একটা নক্ষত্র। নাম বলিতে পারিব না।

কিন্তু অন্য সঙ্গী দুটোকে বাদ দিলে এটাই আলফার সবচেয়ে কাছে। মাত্র এক পারসেক দূরে।

আপনি যাহা বলিবেন। আমি কিছু জানি না।

হয়তো পৃথিবী এই নক্ষত্রকেই প্রদক্ষিণ করে?

সামান্য আগ্রহ নিয়ে এবার নক্ষত্রের দিকে তাকালো হিরোকো। আমি জানি না। কখনো কাহারো কাছে শুনি নাই।

তুমি কখনো ভেবে দেখেছো?

কীভাবে বলিব? পৃথিবী কোথায় কেহই জানে না। আমি-আমাকে এইবার যাইতে হইবে। আগামী কাল ভোরে বিচ ফেস্টিভেলের পূর্বেই মাঠে কাজে যোগ দিতে হইবে। সেইখানেই আপনাদের সহিত সাক্ষাৎ হইবে। ঠিক আছে?

অবশ্যই, হিরোকো।

একটু তাড়াহুড়ো করেই চলে গেল সে। তার অপসৃয়মান ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকল ট্র্যাভিজ। তারপর বাকিদের অনুসরণ করে ঘরে ঢুকল।

ব্লিস, বলতে পারবে পৃথিবীর ব্যাপারে ও মিথ্যে কথা বলেছে কিনা? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।

মাথা নাড়ল ব্লিস। মনে হয় না। বেশ অস্থির হয়ে ছিল, সঙ্গীতানুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে আমি বুঝতে পারিনি। তুমি নক্ষত্রের কথা জিজ্ঞেস করার পরই সেটা দূর হয়ে যায়।

কারণ সে তার বাঁশি দিয়ে দিয়েছে?

হতে পারে। আমি জানি না। ফেলমের দিকে ঘুরল সে, ঘুমোতে যাও, ফেলম। তার আগে আউটহাউসে যাবে, ভালোভাবে হাতমুখ ধুয়ে দাঁত মেজে বিছানায় উঠবে।

আমি বাঁশি বাজাবো, ব্লিস।

অল্পক্ষণ, এবং খুব আস্তে, বুঝেছ ফেলম। এবং আমি যখনই বলব তখনই থামাতে হবে।

ঠিক আছে।

ব্লিস বসেছে একটা চেয়ারে; পুরুষ দুজন যার যার বিছানায় বসা।

এই গ্রহে আর থাকার কোনো প্রয়োজন আছে? বলল ব্লিস।

কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ, প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক আমরা জানতে পারিনি। বোধহয় ফিশিং ফ্লিটগুলো ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়।

আমার মতে অস্বাভাবিক। হিরোকোর কালো চোখের মোহে এখানে থাকতে চাইছ না তো?

ট্র্যাভিজ বলল অধৈর্য স্বরে, বুঝতে পারছি না ব্লিস, আমি যাই করি তাতে তোমার কী? আমার নৈতিক চরিত্র নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?

আমি তোমার নৈতিকতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। বিষয়টা আমাদের অনুসন্ধানকে ব্যহত করছে। আইসোলেট গ্রহ না গ্যালাক্সিয়া কোনটা ভালো হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তুমি পৃথিবী খুঁজে বের করতে চাও। আমিও চাই। তুমি বলেছো পৃথিবী আকাশের ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। চলো যাই সেখানে। স্বীকার করছি আগে থেকে কিছু জেনে যেতে পারলে লাভ হতো। কিন্তু এখানে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

আমাদের হয়তো চলে যাওয়াই উচিত, বলল পেলোরেট। দেখা উচিত পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ কিনা। এখানে বসে থাকার কোনো যুক্তি নেই।

ব্লিসের কালো চোখের মোহে চলে যেতে চাইছ না তো? তিরস্কারের সুরে বলল ট্র্যাভিজ। সাথে সাথেই আবার বলল, না, আমি কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি জেনভ। শিশুদের মতো আচরণ করছি। তারপরেও-হিরোকো ছাড়াও এই গ্রহ বেশ চমৎকার এবং বিশ্বাস করো পরিস্থিতি অন্য রকম হলে আমি হয়তো এখানে থেকে যেতাম। বুঝতে পারছ ব্লিস, আইসোলেটদের সম্বন্ধে তোমার ধারনা আলফা পাল্টে দিচ্ছে?

কীভাবে?

তুমি বারবার বলছ যে সত্যিকার আইসোলেট গ্রহগুলো ক্রমেই বিপজ্জনক এবং হিংস্র হয়ে পড়ে।

হ্যাঁ।

কিন্তু আলফা হয়নি। এই গ্রহ পুরোপুরি আইসোলেট। অথচ এদের সরলতা আতিথেয়তার মাঝে তুমি কোনো দোষ পেয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে না। হিরোকো এমনকি তোমাকে তার শরীরও দিয়েছে।

ব্লিস, তোমার তাতে কী? রাগত সুরে বলল ট্র্যাভিজ। সে আমাকে তার শরীর দেয়নি, আমরা দুজন দুজনকে শরীর দিয়েছি।

প্লিজ ব্লিস, বলল পেলোরেট। গোলান ঠিকই বলেছে। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তোমার আপত্তি জানানো উচিত না।

যদি সেগুলো আমাদের উপর প্রভাব না ফেলে। একরোখা সুরে বলল ব্লিস।

ফেলবে না, কথা দিচ্ছি।

আইসোলেটদের আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

ঝট করে হাত তুলল ট্র্যাভিজ, তর্ক না করে শেষ করা যাক—

কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না সে। দরজায় একটা শব্দ হলো।

শক্ত হয়ে গেছে ট্র্যাভিজ। কী ব্যাপার? নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল সে।

সামান্য কাঁধ নাড়ল ব্লিস। দরজা খুলে দেখ। তুমিই তো বলেছ এই গ্রহে কোনো বিপদ হবে না।

তারপরেও ইতস্তত করতে লাগল ট্র্যাভিজ। কিছুক্ষণ পর একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, দয়া করুন। আমি!

হিরোকোর গলা। ঝট করে দরজা খুলল ট্র্যাভিজ। দ্রুত ঘরে ঢুকল হিরোকো। চিবুক ভেজা।

দরজা বন্ধ করুন। রুদ্ধশ্বাসে বলল সে।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।

ট্র্যাভিজকে আঁকড়ে ধরল হিরোকো। বেশিক্ষণ থাকিতে পারিব না। চলিয়া যান। বাচ্চাটাকে নিয়া পালান আলফা ছেড়ে-অন্ধকার থাকিতেই।

কিন্তু কেন? বলল ট্র্যাভিজ।

নয়তো আপনারা মারা যাইবেন; সকলেই।

.

বহির্বিশ্বের আগন্তক তিন জন জমাট বরফের মতো দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকল হিরোকোর দিকে। তারপর ট্র্যাভিজ বলল, তুমি বলতে চাও তোমার লোকেরা আমাদের মেরে ফেলবে।

আপনারা ইতোমধ্যেই মৃত্যুর খাতায় উঠিয়া গিয়াছেন, রেসপ্যাকটেড ট্র্যাভিজ। এবং বাকি সকলেই-দীর্ঘদিন পূর্বে আমাদের গবেষকরা একখানা ভাইরাস তৈরি করে, স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু আউটওয়ার্ল্ডারদের জন্য ভয়ংকর। আমরা প্রতিশেধক তৈরি করিয়াছি। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ট্র্যাভিজের বাহু ধরে টানল সে, আপনাদের শরীরে জীবাণু ঢুকিয়াছে।

কীভাবে?

যখন আমরা ঘনিষ্ঠ হইয়াছিলাম। ইহা একটা উপায়।

কিন্তু আমি তো কোনো অসুবিধা বোধ করছি না।

ভাইরাস এখনো ইনঅ্যাকটিভ। ফিশিং ফ্লিট ফিরিয়া আসিবার পর ইহাকে অ্যাকটিভ করা হইবে। আমাদের আইন অনুযায়ী এই জাতীয় বিষয়ে সকলেই-এমনকি পুরুষেরাও সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এবং সকলেই অ্যাকটিভ করিবার পক্ষে মত দিবে, ততক্ষণ আমরা আপনাদের এইখানে রাখিব, অন্তত আরো দুই সকাল। অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই এবং কেউ সন্দেহ করার পূর্বেই চলিয়া যান।

তোমার লোকেরা এটা করবে কেন? ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করল ব্লিস।

নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। আমরা সংখ্যায় অল্প কিন্তু প্রাচুর্য অধিক। চাই না। বাহিরের কেউ এখানে আসিয়া সমস্যা তৈরি করে। এইখান থেকে ফিরিয়া গিয়া অন্যদের কাছে আমাদের কথা বলিলে তখন অনেকেই এখানে আসিবে। তাই কদাচিৎ কোনো মহাকাশযান চলিয়া আসিলে তাহা আর ফেরত যাইতে পারে না।

কিন্তু তা হলে, বলল ট্র্যাভিজ, সতর্ক করে দিয়ে তুমি আমাদের পালাবার পথ করে দিচ্ছ কেন?

কারণ জিজ্ঞাসা করিবেন না।–না। কিন্তু আমি বলিব, যেহেতু আবারো উহা শুনিতে পাইয়াছি। শুনুন–

পার্শ্ববর্তী কামরা থেকে মৃদু কোমল মোহনীয় সুর ভেসে আসছে। বাঁশি বাজাচ্ছে ফেলম।

আমি এই সঙ্গীত ধ্বংস করিতে পারিব না, কারণ বাচ্চাটাও মারা যাইবে।

এই কারণেই তুমি বাঁশিটা ফেলমকে দিয়েছ? জানতে সে মারা যাবে, তখন আবার ফেরত পাবে। কঠিন গলায় বলল ট্র্যাভিজ।

আতঙ্কের ছাপ হিরোকোর চেহারায়। না, ইহা আমার মনোবাসনা ছিল না। শিশুকে নিয়ে চলিয়া যান, সেই সাথে বাঁশিটাও। আমি হয়তো আর কখনো দেখিব না। কিন্তু আপনারা তো নিরাপদে মহাকাশে পৌঁছাইবেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর দেহের ভাইরাস নষ্ট হইয়া যাইবে। বিনিময়ে আমি চাই, আপনারা কাহাকেও এই গ্রহের কথা বলিবেন না। কেহই যেন কিছু জানিতে না পারে।

আমরা কাউকে বলব না।

কান্নাভেজা চোখে ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো হিরোকো,–নিচু স্বরে বলল, বিদায় বেলা আমি আপনাকে চুমু দিতে পারি?

না, একবার জীবাণু ঢুকেছে। সেটাই যথেষ্ট। তারপর একটু নরম সুরে বলল, কাঁদবে না। কাঁদলে তোমার লোকেরা কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারবে না। আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য এখন যা করছ সেই কথা মনে করে আমার সাথে যা করেছ সেটা ক্ষমা করে দেব।

সোজা হয়ে দাঁড়ালো হিরোকো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ধন্যবাদ। তারপর বেরিয়ে গেল দ্রুত।

আলো নিভিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব আমরা। তারপর বেরোব। বলল ট্র্যাভিজ।–ব্লিস, বাজানো বন্ধ করতে বল ফেলমকে। বাঁশি নেওয়ার কথা ভুলবে না, অবশ্যই।–তারপর মহাকাশযানের দিকে যাবো, যদি অন্ধকারে পথ খুঁজে পাই।

আমি পথ বের করে নেব। বলল ব্লিস। আমার পোশাক মহাকাশযানে রয়েছে। এবং যতই হালকা হোক, সেগুলোও গায়া। গায়াকে খুঁজে বের করতে গায়ার কোনো সমস্যাই হবে না। তারপর ফেলমকে আনার জন্য পাশের রুমে চলে গেল সে।

আমাদেরকে আটকে রাখার জন্য ওরা মহাকাশযানের ক্ষতি করতে পারে বলে মনে হয়? বলল পেলোরেট।

ওদের সেই কারিগরি জ্ঞান নেই, মুচকি হেসে বলল ট্র্যাভিজ। ব্লিস ফিরে আসতেই আলো নিভিয়ে দিল সে।

নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। অন্ধকারে মনে হলো যেন অর্ধেক রাত শেষ। কিন্তু আসলে কেটেছে মাত্র আধাঘণ্টা। তারপর ট্র্যাভিজ ধীরে ধীরে এবং কোনো শব্দ না করে দরজা খুলল। আকাশে মেঘের পরিমাণ মনে হয় একটু বেশি, কিন্তু নক্ষত্রগুলো জ্বলছে। আকাশের অনেক উপরের দিকে ক্যাসিওপিয়া, পৃথিবী যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে বলে ভাবছে সে, সেটা সারির শেষ মাথায় জ্বলজ্বল করছে সব থেকে উজ্জ্বল হয়ে।

সাবধানে বাইরে পা ফেলল ট্র্যাভিজ, বাকি সবাইকে অনুসরণ করার জন্য ইশারা করল। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেছে.নিউরোনিক হুইপের উপর। আশা করছে ব্যবহার করতে হবে না, তবে

নেতৃত্ব দিল ব্লিস। এক হাতে ফেলমকে ধরেছে অন্য হাতে পেলোরেটকে। পেলোরেট তার মুক্ত হাত দিয়ে ধরেছে ট্র্যাজিকে। ফেলমের অপর হাতে রয়েছে বশি। গাঢ় অন্ধকারে পা ফেলে ফার স্টারে তার পোশাকের সাথে হালকাভাবে জড়িয়ে থাকা গায়ার অস্তিত্ব অনুভব করে সবাইকে পথ দেখালো ব্লিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *