দ্বিতীয় পর্ব – কমপরেলন
৩. এন্ট্রি স্টেশন
ট্র্যাভিজ বলেছে যে এখন থেকে যে-কোনো মুহূর্তে হাইপারস্পেসে জাম্প করবে। বলল ব্লিস।
পেলোরেট ঝুঁকে ছিল ভিউয়িং ডিস্কের উপর। উত্তর দেওয়ার আগে সোজা হয়ে বসল। হ্যাঁ, বলেছে যে আধঘণ্টার মধ্যেই হবে।
আমার ভালো লাগছে না, পেল। জাম্প কখনোই পছন্দ করিনি। অস্বস্তি হচ্ছে। গায়ার কোনো অংশ জাম্প করলে পুরো গায়া সেটা অনুভব করে। যদিও দূরত্বের কারণে প্রভাব হবে অনেক হাল্কা। তবে পুরো ধাক্কাটা যাবে আমার উপর দিয়ে। গায়ার উপাদানগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও আমাদের মাঝে পার্থক্য আছে। আর আমার গঠন অনেক বেশি স্পর্শকাতর।
শোন, ব্লিস। ফার স্টার কোনো সাধারণ মহাকাশযান নয়। অতি আধুনিক গ্র্যাভিটিক মহাকাশযান। সাধারণ মহাকাশযান নিয়ে হাইপারস্পেস জাম্প করলে সমস্যা হতো। কিন্তু ফার স্টারের ভেতরে বসে তুমি কিছুই টের পাবে না। তা ছাড়া এই মহাকাশযানের রয়েছে একটা শক্তিশালী কম্পিউটার, যা দিয়ে যে-কোনো জটিল পরিস্থিতি খুব সহজে সামলানো যায়।
চমৎকার। ট্র্যাভ বেশ দক্ষভাবে এই যান সামলাচ্ছে।
পেলোরেট ভুরু কোঁচকালো। প্লিজ, ব্লিস। বল ট্র্যাভিজ।
বলব, বলব। ও সামনে না থাকলে একটু রিল্যাক্স করি।
করো না। অভ্যাসটা ছাড়ার চেষ্টা কর। ট্র্যাভিজ এ ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর।
এ ব্যাপারে না। আমার ব্যাপারে স্পর্শকাতর। আমাকে সে পছন্দ করে না।
তোমার ধারণা ভুল, আন্তরিক গলায় বলল পেলোরেট। আমি ট্র্যাভিজের সাথে কথা বলেছি।–দাঁড়াও, দাঁড়াও, এভাবে তাকিও না। আমি খুব সতর্ক হয়ে কথা বলেছি। তোমাকে সে অপছন্দ করে না, শুধু গায়ার ব্যাপারে সন্দিহান। তোমাদের উপকারিতা বুঝতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
হতে পারে, তবে কারণ গায়া না। ট্র্যাভিজ যাই বলুক না কেন-মনে রাখবে সে তোমাকে খুব পছন্দ করে, তাই তোমাকে কষ্ট দিতে চায়নি। আসলে সে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করে।
না ব্লিস।
তুমি আমাকে ভালবাসো বলে সবাই যে বাসবে এমন কোনো কথা নেই। শোন ট্র্যাভ–ঠিক আছে, ট্র্যাভিজ-মনে করে আমি একটা রোবট।
পেলোরেটের স্বাভাবিক গম্ভীর মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল। তোমাকে কৃত্রিম মানুষ মনে করে, হতেই পারে না।
এত অবাক হচ্ছ কেন? গায়া তৈরি হয়েছিল রোবটের সাহায্যে। সবাই জানে!
মেসিন যেভাবে সাহায্য করে, রোবটও সেভাবে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে গায়া তৈরি করেছিল মানুষ পৃথিবীর মানুষ। ট্র্যাভিজ তাই মনে করে। আমি জানি।
গায়ার স্মৃতিতে পৃথিবীর কোনো কথা নেই। অবশ্য গ্রহটাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার তিন হাজার বছর পরেও কিছু রোবটের কথা আমাদের মনে আছে। সেই সময় একই সাথে গায়াকে প্ল্যানেটরি কনশাসনেস-এর পর্যায়ে উন্নীত করার কাজও চলছিল। সেজন্য অনেক সময় লেগেছিল, পেল। হতে পারে সে কারণেই পৃথিবীর কোনো কথা আমাদের স্মৃতিতে নেই। ট্র্যাভিজের ধারণা অনুযায়ী সেগুলো হয়তো আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হয়নি।
বুঝলাম, উদ্বিগ্ন স্বরে বলল পেলোরেট। কিন্তু রোবটের কথা আসছে কেন?
বেশ, গায়া তৈরি হবার পর রোবটরা চলে যায়। আমরাই চাইনি তারা থাকুক। আমাদের ধারণা হয়েছিল রোবট মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এই ধারণার উৎস কি জানি না, তবে সম্ভবত অতি প্রাচীন সময়ের কোনো ঘটনা এর জন্য দায়ী।
যদি রোবটরা চলেই যায়–
হতে পারে গুটি কয়েক রোবট থেকে গিয়েছিল। আমি হয়তো তাদেরই একজন-পনের হাজার বছরের পুরোনো। ট্র্যাভিজ তাই সন্দেহ করে।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল পেলোরেট। কিন্তু তুমি তা নও।
তুমি সেটা বিশ্বাস কর?
অবশ্যই করি। তুমি রোবট নও।
তুমি জানো?
ব্লিস, আমি জানি। তোমার ভেতর কোনো কৃত্রিমতা নেই। সেটা আমি ধরতে না পারলে অন্য কেউই পারবে না।
হতে পারে আমাকে এমন দক্ষভাবে তৈরি করা হয়েছে যে স্বাভাবিক মানুষের সাথে সূক্ষ্ম কোনো পার্থক্যও ধরা পড়বে না। যদি তাই হয়, তুমি আমাকে রক্ত মাংসের মানুষ থেকে কীভাবে আলাদা করবে?
আমার মনে হয় না তোমাকে এভাবে তৈরি করা সম্ভব।
তুমি যাই মনে কর, যদি সম্ভব হয়?
আমি বিশ্বাস করি না।
ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে ধরা যাক, আমি এমনভাবে তৈরি একটা রোবট মানুষের সাথে যার কোনো পার্থক্য নেই। তোমার মনোভাব কী হবে?
বেশ, আমি-আমি-।
ঠিক করে বলো। রোবটের সাথে প্রেম করতে তোমার কেমন লাগবে?
পেলোরেট হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে উঠল। অনেক প্রাচীন কাহিনীতে বলা হয়েছে। যে মেয়েরা কৃত্রিম মানুষের প্রেমে পড়ছে। বিপরীত ঘটনাও ঘটেছে। কখনো গুরুত্ব দিইনি। আমি আর ট্র্যাভিজ সেশেলে নামার আগে রোবট শব্দটাই শুনিনি। এখন মনে হচ্ছে ঐ কৃত্রিম মানব মানবীগুলো নিশ্চয় রোবট ছিল। তার মানে কাহিনী গুলোর গুরুত্ব আছে। চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল সে। হঠাৎ চমকে উঠল ব্লিসের করতালির শব্দ শুনে।
পেল ডিয়ার, এড়িয়ে যাচ্ছ তুমি। প্রশ্নটা হচ্ছে : রোবটের সাথে প্রেম করতে তোমার কেমন লাগবে?
পেলোরেটের চোখে অস্বস্তি। মানুষের সাথে যে রোবটের কোনো পার্থক্য ধরা যায় না?
হ্যাঁ।
আমার মতে, মানুষের সাথে যে রোবটের কোনো পার্থক্য ধরা যায় না সেও মানুষ। তুমি সেরকম রোবট হলেও আমার কাছে মানুষ ছাড়া আর কিছু না।
তোমার কাছে আমি এই কথাগুলোই শুনতে চেয়েছিলাম, পেল।
বেশ, শুনলে। এবার নিশ্চয়ই বলবে আমাকে যে তুমি স্বাভাবিক মানুষ।
না, এধরনের কিছুই বলব না। স্বাভাবিক মানুষের যে সংজ্ঞা দিয়েছ তাতে যদি তুমি সন্তুষ্ট থাকে, তা হলে আর আলোচনা করার কিছু নেই। তা ছাড়া তুমিও যে সেরকম কোনো রোবট না সেটা আমি কি করে বলব।
কারণ আমি বলছি।
আহ্, কিন্তু তোমাকে হয়তো এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যেন নিজেও বিশ্বাস কর এবং আমাকেও বলতে পারো যে তুমি মানুষ। আসলে তুমি একটু আগে যা বলেছ সেটাই মেনে নিতে হবে, কোনো উপায় নেই।
কথা শেষ করে পেলোরেটকে জড়িয়ে ধরে হালকা চুমু খেল। তারপরের চুমুটা হলো দীর্ঘস্থায়ী এবং আবেগঘন। সামলে নিয়ে ফিস ফিস করে পেলোরেট বলল, কিন্তু ট্র্যাভিজকে আমরা কথা দিয়েছি ওকে বিব্রত করার মতো কিছু করব না।
সবসময় প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখতে নেই। ঝাঁজালো গলায় বলল ব্লিস।
কিন্তু আমি পারব না। জানি রাগ করবে। আমি সবসময় গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করি, জানি কীভাবে আবেগকে দমিয়ে রাখতে হয়। দীর্ঘ জীবনের অভ্যাস এবং অন্যের কাছে খুব বিরক্তিকর। এমন কোনো মেয়ে দেখিনি যে এটা মেনে নিতে পেরেছে। আমার প্রথম স্ত্রী–বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছি।
হ্যাঁ, কিন্তু পুরোপুরি না। তুমি আমার প্রথম প্রেমিক নও।
ওহ্! পেলোরেট হতাশ। তারপর ব্লিসের তীর্যক হাসি দেখে বলল, মানে অবশ্যই না। সেটা আশা করাই বোকামি।যাই হোক, আমার প্রথম স্ত্রী এগুলো পছন্দ করত না।
কিন্তু আমি করি। তোমার চিন্তায় মগ্ন থাকার ব্যাপারটা আমাকে বেশ আকর্ষণ করে।
বিশ্বাস করতে পারছি না। তবে অন্য একটা বিষয় বেশ ভাবাচ্ছে। আমরা একমত হয়েছি রোবট বা মানুষ সেটা কোনো ব্যাপার না। আমি আইসোলেট মানুষ, গায়ার অংশ নই। আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তুমি গায়ার বাইরের আবেগ অনুভব করো, এমনকি যখন স্বল্প সময়ের জন্য তোমাদের চেতনায় যুক্ত কর, সেই সময়ের আবেগের ঘনত্ব গায়ার সাথে গায়া ঘনিষ্ঠ হলে যে আবেগ হয় তার ঘনত্বের চেয়ে কম।
তোমাকে ভালবাসার স্বকীয় আনন্দ আছে, পেল। আর বেশি কিছু আমার দরকার নেই।
আমাকে ভালবাসাই সব নয়। তুমি শুধু তুমি নও। তুমি গায়া। সে এটাকে বিকৃত আচরণ মনে করতে পারে।
করলে আমি জানতাম, কারণ আমি গায়া। যেহেতু আমি তোমাকে নিয়ে খুশি, গায়া খুশি। যখন আমরা দুজন ভালবাসি, গায়ার সকল অংশ সেই আনন্দ কমবেশি অনুভব করে। যখন বলি, আমি তোমাকে ভালবাসি, তার অর্থ গায়া তোমাকে ভালবাসে, যদিও তাৎক্ষণিকভাবে কাজটা সম্পন্ন করার দায়িত্ব আমার। বুঝতে পারোনি বোধহয়?
আমি আইসোলেট মানুষ, তাই কিছুই বুঝতে পারিনি।
আইসোলেট মানুষের শরীর দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যায়। যখন তুমি শিস দিয়ে গান গাও, তোমার পুরো শরীর সেই সুরের সাথে সাড়া দিতে চায়। যদিও কাজটা করার দায়িত্ব ঠোঁট, জিভ, এবং ফুসফুসের। তোমার ডান পায়ের গোড়ালি কিছুই করে না।
তাল মেলাতে পারে।
পারে। কিন্তু শিস বাজানোর জন্য তার কোনো প্রয়োজন নেই। তাল মেলানো মূল কাজ নয়, সেটা মূল কাজের একটা প্রতিক্রিয়া। এভাবে আমার যে-কোনো আবেগে গায়ার ছোট বড় সকল অংশ কমবেশি প্রভাবিত হয়। যেমন আমি তাদের আবেগে প্রভাবিত হই।
আমার মনে হয় তা হলে এটা নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই।
মোটেই না।
তারপরেও একটা অস্বস্তিকর দায়িত্বের বোঝা যেন চেপে বসেছে। মনে হয় যখন তোমাকে খুশি করতে চাই, তখন গায়ার সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করা উচিত।
প্রতিটি অণু পরমাণু-তুমি ঠিক সেটাই কর। সামগ্রিক আনন্দের অনুভূতিতে তোমার অবদান হয়তো অনেক কম, তবে আছে, এটা জেনে তোমার খুশি হওয়া উচিত।
ট্র্যাভিজ আশা করি হাইপারস্পেসে জাম্প এর হিসাব-নিকাশ নিয়ে আরও বেশ কিছুক্ষণ পাইলট রুমে ব্যস্ত থাকবে।
তুমি হানিমুন করতে চাও?
চাই।
তা হলে এক টুকরা কাগজ নিয়ে তাতে লিখ হানিমুন হেভেন, লিখে দরজার বাইরে লাগিয়ে দাও। এরপর যদি সে এখানে ঢুকতে চায়, সেটা তার সমস্যা।
ব্লিসের কথা মতো কাজ করল পেলোরেট, এবং তারা যখন মগ্ন হয়েছিল চরম সুখে ঠিক সেই সময় ফার স্টার নিঃশব্দে জাম্প করল হাইপারস্পেসে, ব্লিস বা পেলোরেট কিছুই বুঝতে পারল না, অবশ্য সচেতন থাকলেও পারত না বুঝতে।
.
এই প্রথমবার মহাকাশে এলেও গত কয়েকমাসে পেলোরেট পুরোপুরি মহাকাশচারী হয়ে পড়েছে। তিনটা গ্রহ মহাকাশ থেকে দেখেছে সে! টার্মিনাস, সেশেল, গায়া। আর এখন কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত টেলিস্কোপিক ভিউতে সে তাকিয়ে আছে চতুর্থ গ্রহের দিকে, সেটা হচ্ছে কমপরেলন।
এবং চতুর্থবারেও তাকে আগের বারের মতো হতাশ হতে হলো। যে-কোনো কারণেই তার ধারণা হয়েছিল যে মহাকাশ থেকে কোনো গ্রহের দিকে তাকালে সেই গ্রহের মহাদেশ এবং সেগুলোকে ঘিরে থাকা সমুদ্রের আউটলাইন দেখা যাবে; আর যদি মরুভূমি বিশ্ব হয় তা হলে হ্রদ এবং সেগুলোকে ঘিরে থাকা ভূমির আউটলাইন দেখা যাবে।
সেরকম কিছু হয়নি কখনো।
কোনো গ্রহ যদি বাসযোগ্য হয় তবে তার বায়ুমণ্ডল এবং আয়নমণ্ডল থাকবে। যদি পানি বাতাস থাকে তা হলে অবশ্যই মেঘ তৈরি হবে; আর মেঘ থাকলেই দৃষ্টি পথে বাধা তৈরি হবে। নিচে তাকিয়ে পেলোরেট মেঘের ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ হালকা নীল বা ধূসর বাদামি দেখতে পেল।
৩০০,০০০ কিলোমিটার দূর থেকে কোনো গ্রহ সহজে চেনা যায়-বোঝা যায়, ঘন মেঘ পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?
ব্লিস তাকিয়ে ছিল বলেই পেলোরেটের চেহারার পরিবর্তন ধরতে পারল, কী ব্যাপার, পেল? তোমাকে খুশি মনে হচ্ছে না।
মহাকাশ থেকে সব গ্রহই আমার কাছে একরকম মনে হয়।
কী বলছ, জেনভ? বলল ট্র্যাভিজ। টার্মিনাসের যে-কোনো উপকূল রেখাও তোমার কাছে একই রকম মনে হবে, যদি না জানা থাকে তোমাকে কী খুঁজতে হবে কোনো নির্দিষ্ট পাহাড়চূড়া, উপকূলবর্তী কোনো বিশেষ আকৃতির দ্বীপ।
পেলোরেট অসন্তুষ্টি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ঘন মেঘের ভিতর তুমি কি খুঁজছ। হয়তো কিছু বোঝার আগেই গ্রহের অন্ধকার অংশে চলে যাবে।
ভালোভাবে দেখো, জেনভ। একটু লক্ষ করলেই দেখবে মেঘগুলো নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী গ্রহটাকে প্রদক্ষিণ করে একটা কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই কেন্দ্র দুই মেরুর একটা হবে।
কোনটা? আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
এই গ্রহ নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করছে ঘড়ির কাঁটার দিকে, আমরা তাকিয়ে আছি নিচের দিকে, সুতরাং বলা যায় দক্ষিণ মেরু। যেহেতু মেরু শেষপ্রান্তের পনের ডিগ্রির মধ্যে অবস্থিত-এবং এই গ্রহ মূল অক্ষের উপর একুশ ডিগ্রি হেলে আছে, অর্থাৎ এখন সেখানে বসন্ত বা গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি। কম্পিউটার অল্প সময়েই সব জানিয়ে দিতে পারবে। রাজধানী বিষুব রেখার উত্তর অংশে, কাজেই সেখানে হেমন্ত বা শীতের মাঝামাঝি।
ভুরু কোঁচকালো পেলোরেট। এত কিছু বুঝতে পারছ? তারপর মেঘস্তরের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সেগুলো তার সাথে কথা বলবে, কিন্তু কোনো লাভ হলো না।
শুধু তাই নয়, ট্র্যাভিজ বলল, মেরু অঞ্চল থেকে আলাদা করার জন্য মেঘস্তরে কোনো ফাঁক চোখে পড়ছে না, কিন্তু আছে। সেখানে তোমার চোখে পড়বে বরফ, অর্থাৎ সাদার উপরে সাদা।
মেরু অঞ্চলে এটাই স্বাভাবিক।
বাসযোগ্য গ্রহে অবশ্যই। নিষ্প্রাণ গ্রহগুলো হয় পানি এবং বায়ুশূন্য, বা এমন কোনো চিহ্ন থাকে যা দেখে বলা যায় মেঘ জলীয় বাষ্পের কারণে হয়নি বা পানি জমাট বেঁধে বরফ হয়নি। এই গ্রহে তেমন কোনো চিহ্ন নেই, কাজেই বলা যায় যে আমরা তাকিয়ে আছি জলীয় বাষ্পের মেঘ এবং পানি জমাট বাঁধা বরফের দিকে।
তারপরে খেয়াল করতে হবে, দিনের অংশে ছেদহীন সাদা ক্ষেত্রের আয়তন। এবং অভিজ্ঞ চোখে সহজেই ধরা পড়বে যে এই আয়তন গড় আয়তন থেকে বেশি, এরই মাঝে তোমার চোখে পড়বে হালকা কমলা রঙের প্রতিসরিত আলো। তার অর্থ কমপরেলনের সূর্য টার্মিনাসের সূর্যের তুলনায় অনেক বেশি ঠাণ্ডা, যদিও কমপরেলন অনেক কাছ থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং কমপরেলন অন্যান্য বাসযোগ্য গ্রহের মতোই ঠাণ্ডা আবহাওয়ার বিশ্ব।
মনে হচ্ছে তুমি ভোলা বই পড়ছ। প্রশংসার সুরে বলল পেলোরেট। অবাক হওয়ার কিছু নেই। কম্পিউটার প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান দিয়েছে, অভিজ্ঞতার আলোকে এতকিছু বলছি। আসলে কমপরেলনে একটা বরফ যুগ শেষ হয়ে আরেকটা শুরু হতে যাচ্ছে।
ব্লিস নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল, আমার ঠাণ্ডা বিশ্ব ভালো লাগে না।
গরম কাপড় আছে আমাদের সাথে। ট্র্যাভিজ বলল।
সেটা কোনো ব্যাপার না। মানুষ ঠাণ্ডা আবহাওয়ার উপযুক্ত নয়। আমাদের পশম বা পালক নেই।
গায়া কি পুরোপুরি মৃদু আবহাওয়ার বিশ্ব?
অধিকাংশ অঞ্চলই তাই। ঠাণ্ডা আবহাওয়ার উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য ঠাণ্ডা অঞ্চল। এবং গরম আবহাওয়ার উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য গরম অঞ্চল আছে। এ ছাড়া পুরো গ্রহই মৃদু ভাবাপন্ন, কোনো প্রাণী বিশেষ করে মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করার মতো অতিরিক্ত শীত বা গরম পড়ে না।
মানুষ অবশ্যই। গায়ার সবকিছু জীবিত এবং সমান। কিন্তু মানুষের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
বোকার মতো কথা বলো না। বিরক্ত সুরে বলল ব্লিস। কনশাসনেসের মাত্রা এবং ঘনত্ব গুরুত্বপূর্ণ। সমান ওজনের পাথরের তুলনায় মানুষের গুরুত্ব অনেক বেশি, গায়ার সকল কাজই মানুষকে কেন্দ্র করে চলে–যদিও আইসোলেট বিশ্বে যতটা হয় ততটা না। এখানে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একটা অংশকে অবহেলা করা হলে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সবার উপর। নিশ্চয়ই চাও না অপ্রয়োজনীয়ভাবে আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হবে, চাও?
না, অপ্রয়োজনীয় অগ্ন্যুৎপাত চাই না।
তোমাকে বোঝাতে পারিনি, তাই না?
দেখ, একটা বিশ্ব আরেকটা থেকে আলাদা। কোনোটা ঠাণ্ডা, কোনোটা গরম। কোনো গ্রহে আছে বিশাল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল, কোনো গ্রহে আছে বিস্তৃত তৃণভূমি। ঐসব গ্রহের বাসিন্দারা নিজ নিজ পরিবেশে অভ্যস্ত। আমিও টার্মিনাসের পরিবেশে অভ্যস্ত-কিন্তু মাঝে মাঝে পালাতে চাই, বৈচিত্র্য চাই। আমাদের যা আছে, গায়ার তা নেই, সেটা হচ্ছে বৈচিত্র্য। যদি গায়া গ্যালাক্সিয়ায় পরিণত হয় তা হলে সব গ্রহের উপর মৃদু পরিবেশ চাপিয়ে দেবে। বৈচিত্র্যহীনতা তখন হয়ে উঠবে অসহ্য।
বৈচিত্র্য প্রয়োজন হলে তাও রক্ষা করা হবে।
তোমাদের ইচ্ছামতো, তাই না? আমি বরং বিষয়টা প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেব।
কিন্তু তোমরা প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দাওনি। প্রতিটি বাসযোগ্য গ্রহের পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রথমে সেগুলোর পরিবেশ ছিল বুনো, মানুষ বাসের অযোগ্য। যতদূর সম্ভব মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। এই গ্রহের আবহাওয়া যদি ঠাণ্ডা হয় তার মানে বাসিন্দারা এটাকে আরামদায়ক করে তোলার ব্যয় আর বহন করতে পারছে না। আমি নিশ্চিত যেসব অঞ্চলে মানুষ বাস করে সেখানে কৃত্রিম উপায়ে আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেবো বলে বেশি বাহাদুরী করার চেষ্টা করো না।
আমার ধারণা তুমি গায়ার পক্ষে কথা বলছ।
সবসময়ই গায়ার পক্ষে কথা বলি। আমি গায়া।
নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে গায়া যদি এতই নিশ্চিত থাকে, তা হলে আমাকে প্রয়োজন হলো কেন তোমাদের? আমাকে ছাড়াই এগিয়ে যাওনি কেন?
মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল ব্লিস, অতিরিক্ত আরবিশ্বাসী হয়ে ওঠা খারাপ। নিজের ভালো দিকগুলো সহজেই চোখে পড়ে। খারাপ দিকগুলো পড়ে না। সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। নিজেদের কাছে সঠিক মনে হলেই হবে না, নিরপেক্ষ হতে হবে, যদি নিরপেক্ষ সঠিক বলে কোনো বস্তু থাকে। সেই নিরপেক্ষ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য তোমাকেই আমাদের উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে, তাই তোমাকে পথ প্রদর্শক হিসেবে বেছে নেই।
এতই নিরপেক্ষ, বিষণ্ণ সুরে বলল ট্র্যাভিজ, যে আমি নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত বুঝতে পারছি না এবং যৌক্তিকতা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
তুমি খুঁজে পাবে।
আশা করি।
আসলে বন্ধু, পেলোরেট বলল, এবারের তর্কযুদ্ধে ব্লিস তোমাকে ভালোভাবেই কোণঠাসা করেছে। কেন মেনে নিচ্ছ না ওর বক্তব্য প্রমাণ করে গায়াই মানব জাতীর ভবিষ্যৎ?
কারণ, কর্কশ সুরে বলল ট্র্যাভিজ,সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় গায়ার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতাম না। কিছুই জানতাম না। কিছু একটা অবচেতনভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে, যে গায়ার বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে না–কিন্তু অনেক বেশি মৌলিক। আমাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুলল পেলোরেট, রাগ করো না, গোলান।
রাগ করিনি। আসলে স্নায়ুর চাপ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। চাই না গ্যালাক্সির সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি দুঃখিত। ব্লিস বলল, তোমার শারীরিক এবং মানসিক গঠনই এই দায়িত্ব তোমার কাঁধে চাপিয়েছে। আমরা ল্যাণ্ড করব কখন?
তিন দিনের মধ্যে। তার আগে অবশ্য কোনো একটা এন্ট্রি স্টেশনে থামতে হবে।
কোনো সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই, হবে? জিজ্ঞাসা করল পেলোরেট।
কাঁধ ঝাঁকালো ট্র্যাভিজ। নির্ভর করে কতগুলো মহাকাশ যান এখানে আসে, এন্ট্রি স্টেশনের সংখ্যা এবং সর্বোপরি অবতরণের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার নিয়মের উপর। সময়ের সাথে সাথে এই নিয়মগুলো বদলে যায়।
অনুমতি না দেওয়া বলতে কী বোঝাচ্ছ। ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিকদের ওরা প্রত্যাখ্যান করে কীভাবে? কমপরেলন ফাউণ্ডেশন ডমিনিয়নের অংশ, তাই না?
হ্যাঁ এবং না। আইনের কিছু জটিলতা আছে। জানি না কমপরেলনে কীভাবে সেগুলোর ব্যাখ্যা করা হয়। আমাদের বাধা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে খুব কম।
যদি নামতে না দেয়, তখন কি করবে?
আমি নিজেও জানি না। কি হয় দেখা যাক। তারপর বিকল্প কিছু ভাবা যাবে।
.
এখন খালি চোখেই কমরেলন বিশাল ভূ-গোলকের মতো দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এন্ট্রি স্টেশনগুলোও। কক্ষপথে স্থাপিত অন্যান্য কাঠামোগুলো থেকে সেগুলো অনেক বাইরে অবস্থিত এবং বেশি আলোকিত।
ফার স্টার এগোচ্ছে দক্ষিণ মেরুর দিকে, ফলে ভূ-গোলকের অর্ধেক সবসময়ই সূর্যালোকিত হয়ে থাকে। রাতের অংশের এন্ট্রি স্টেশনগুলো স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার দেখা যায়। প্রতিটি স্টেশনের মাঝখানে দূরত্ব সমান। ছয়টা দেখা যাচ্ছে (নিঃসন্দেহে দিনের অংশে আরও ছয়টা আছে) এবং সবগুলোই সমান এবং সুনির্দিষ্ট গতিতে কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে।
পেলোরেট সামনের দৃশ্য দেখে অবাক। গ্রহের কাছাকাছি আরও অনেক আলো দেখা যাচ্ছে। কী ওগুলো?
বলতে পারছি না। ট্র্যাভিজ বলল। কারখানা, গবেষণাগার, অবজারভেটরি বা জনবহুল টাউনশিপ হতে পারে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে এন্ট্রি স্টেশন ছাড়া কক্ষপথের অন্যান্য স্থাপনাগুলো বাইরের দিকে অন্ধকার করে রাখা। কমপরেলন অবশ্যই ব্যতিক্রম।
আমরা কোন এন্ট্রি স্টেশনে যাবো, গোলান?
নির্ভর করছে ওদের উপর। আমি মেসেজ পাঠিয়ে অবতরণ করার অনুমতি চেয়েছি, এখন ওরা আমাকে জানাবে কোন স্টেশনে যেতে হবে এবং কখন। আরও নির্ভর করছে এই মুহূর্তে কতগুলো মহাকাশ যান ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। যদি প্রতিটি স্টেশনেই কমপক্ষে একডজন মহাকাশ যান লাইনে থাকে, আমাদের অপেক্ষা। করা ছাড়া উপায় নেই।
এর আগে আমি মাত্র দুবার গায়া থেকে হাইপার স্পেসাল দূরত্বে এসেছিলাম, বলল ব্লিস, কিন্তু দুবারই ছিলাম সেশেল বা তার কাছাকাছি। এত দূরে কখনো। আসিনি।
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো ট্র্যাভিজ, তাতে কি? তুমি তো এখনও গায়া, তাই না?
প্রথমে মনে হলো ব্লিস বিরক্ত হয়েছে, তবে কিছুক্ষণ পরেই মুখে বিব্রত হাসি ফুটল, স্বীকার করছি, এবার তুমি আমাকে ফাঁদে ফেলেছ, ট্র্যাভিজ। গায়া শব্দের দুটো অর্থ আছে। প্রথম অর্থে গায়া বলতে বোঝায় মহাকাশের দৃশ্যমান নিরেট গোলাকার গ্রহ। দ্বিতীয় অর্থে বোঝায় এই ভূ-গোলকের অন্তর্গত সকল জীবিত বস্তু। আমরা দুটোই ব্যবহার করি। বিষয়বস্তু শুনে গায়ানরা বুঝতে পারে কোন অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
বেশ, নিরেট ভূ-গোলক গায়া থেকে তুমি হাজার পারসেক দূরে। সম্পর্কযুক্ত ক্রিয়াশীল প্রাণীসত্তা হিসেবে তুমি এখনও গায়া?
প্রাণীসত্তা হিসেবে আমি এখনও গায়া।
পুরোপুরি?
পুরোপুরি। আগেই তো বলেছি হাইপারস্পেসে জটিলতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু আমি এখনও গায়া।
তোমার কখনো মনে হয়েছে যে গায়া হলো কিংবদন্তির শুড়ওয়ালা দানব ক্র্যাকেন-যার শুড় ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে। তোমাদের কিছুই করতে হবে না। জনবহুল গ্রহগুলোতে একজন করে গায়ান নামিয়ে দাও, ব্যাস গ্যালাক্সিয়া তৈরি হয়ে যাবে। আসলে ঠিক সেই কাজটাই করেছ। কোন কোন গ্রহে গায়ানরা আছে? সম্ভবত, টার্মিনাস এবং ট্রানটরে একাধিক গায়ান আছে। আর কতদূর এগিয়েছ?
ব্লিসের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ। তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলব না, ট্র্যাভিজ, কিন্তু তার মানে এই না যে সবকিছু তোমাকে জানাতে হবে। এমন কিছু বিষয় আছে যা তোমার জানার কোনো প্রয়োজন নেই। গায়ানদের অবস্থান এবং পরিচয় তার মধ্যে একটা।
ঠিক আছে তাদের পরিচয় জানলাম না। কিন্তু কেন তারা আছে সেটা আমার জানার প্রয়োজন আছে?
গায়ার মতে কোনো প্রয়োজন নেই।
ধারণা করেছিলাম। তোমরা নিজেদের মনে করো গ্যালাক্সির অভিভাবক।
আমরা নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধশালী গ্যালাক্সি চাই। সেলডনের পরিকল্পনা ছিল প্রথমটার চেয়ে আরও শক্তিশালী এবং সুদৃঢ় দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার গড়ে তোেলা। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের সাহায্যে সেই কাজ ভালোভাবেই চলছে।
কিন্তু তোমরা প্রচলিত অর্থে কোনো দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার চাও না। তোমরা চাও গ্যালাক্সিয়া-জীবিত গ্যালাক্সি।
তুমি সমর্থন দিলে, আশা করি নির্দিষ্ট সময়েই গ্যালাক্সিয়া তৈরি হবে। যদি সমর্থন না দাও, তা হলে জীবন বাজি রেখে দ্বিতীয় এম্পায়ার গড়ে তুলব এবং যতদূর সম্ভব নিরাপদ রাখার চেষ্টা করব।
কিন্তু সমস্যা—
হালকা সংকেত ধ্বনি শুনে থামল ট্র্যাভিজ। বোধহয় এন্ট্রি স্টেশন থেকে খবর এসেছে। আসছি।
দ্রুত পায়ে পাইলট রুমে এসে ঢুকল। ডেস্ক টপের উপর দুহাত রেখে জেনে নিল কোন এন্ট্রি স্টেশনে যেতে হবে, তার অবস্থান এবং নিচে নামার সম্ভাব্য পথ। তারপর ফিরতি মেসেজ পাঠিয়ে বসল হেলান দিয়ে।
স্যালডন প্ল্যান! সে ভুলেই গিয়েছিল। পাঁচ শ বছর ধরে এই প্ল্যান গ্যালাক্সিকে শাসন করছে ফাউণ্ডেশন-এর মাধ্যমে। কিন্তু এখন তার অস্তিত্ব বিপন্ন, এই প্ল্যানকে পরিবর্তিত করে চালানো হবে সম্পূর্ণ নতুন পথে। ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই-গ্যালাক্সিয়া। এবং সে নিজেই এই পথ বেছে দিয়েছে।
কিন্তু কেন? সেলডন প্ল্যানে কি কোনো ত্রুটি আছে? মৌলিক কোনো ত্রুটি?
বিদ্যুৎ চমকের মতো তার মনে হলো ত্রুটি আছে, এবং সে জানে সেটা কী। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ই সে জানত। যেভাবে চিন্তাটা মাথায় এসেছিল ঠিক সেভাবেই বেরিয়ে গেল। কিছুই মনে থাকল না।
হয়তো কল্পনা ছিল। এখন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। কারণ সেলডন প্ল্যান এবং সাইকোহিস্টোরির কয়েকটি মৌলিক অনুমিতি ছাড়া বিস্তারিত কিছুই জানে না সে। গণিত তো কিছুই জানে না।
চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল
কিছুই মনে করতে পারল না।
কম্পিউটারের সাহায্য নিলে হতে পারে? ডেস্কটপে হাত রেখে কম্পিউটারের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করল। চোখ বন্ধ করে আবারও ভাবার চেষ্টা করল।
এবারও মনে করতে পারল না।
.
কমপরেলিয়ানের পরিচয়পত্রে নাম লেখা এ. কিণ্ড্রে। সাথে রয়েছে তার নাদুসনুদুস গোলাকার হালকা দাড়িওয়ালা মুখের হলোগ্রাফিক ইমেজ।
লোকটা খাটো। মুখের মতোই শরীরের কাঠামো গোলাকার। চোখের দৃষ্টি ও আচরণ সহজ, স্বতঃস্ফুর্ত, আরবিশ্বাসী এবং পরিষ্কার বিস্ময় নিয়ে সে ফার স্টারের ভেতরে দেখছে।
আপনারা এত দ্রুত আসলেন কীভাবে? জিজ্ঞেস করল সে। দুঘণ্টার আগে আশা করিনি।
নতুন মডেলের যান, স্বাভাবিক ভদ্র গলায় বলল ট্র্যাভিজ।
চেহারা যাই হোক কিণ্ড্রে বোকা না। পাইলট রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, গ্র্যাভিটিক?
অস্বীকার করার কোনো কারণ দেখল না ট্র্যাভিজ।
চমৎকার। শুনেছি, দেখিনি কখনো। মটরগুলো বাইরে হাল এ বসানো।
ঠিক।
কম্পিউটার দেখিয়ে বলল, কম্পিউটার সার্কিট?
তাই তো জানি। খুলে দেখিনি কখনো।
বেশ। আমার যা প্রয়োজন তা হচ্ছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ইঞ্জিন নাম্বার, প্লেস অফ ম্যানুফেকচার, শনাক্তকারী নাম্বার, মালামালের তালিকা। নিশ্চয়ই সব কম্পিউটারে আছে। আধ সেকেণ্ডের মধ্যে বের করে দিতে পারবেন।
তার চেয়েও কম সময় লাগল। আপনারা তিন জন যাত্রী? জিজ্ঞেস করল কিণ্ড্রে।
কোনো প্রাণী? উদ্ভিদ? স্বাস্থ্যের অবস্থা?
না, না। এবং ভালো। এক নিশ্বাসে বলল ট্র্যাভিজ।
উম! এখানে হাত রাখুন। নিয়ম, আর কিছু না।–ডান হাত প্লিজ।
ট্র্যাভিজ যন্ত্রটা দেখে অবাক হয়নি। আজকাল ব্যাপক হারে এটা ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং আরও আধুনিক হচ্ছে। কোন গ্রহ কতটুকু উন্নত সেটা তার মাইক্রো ডিটেক্টর দেখেই বলা যায়। অবশ্য অল্প কয়েকটা অনুন্নত গ্রহ আছে যাদের একটাও মাইক্রো ডিটেক্টর নেই। এম্পায়ারের পতনের পর থেকেই বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলো রোগ এবং বহির্জগতের অজানা রোগ জীবাণুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এটা ব্যবহার করে আসছে।
কী এটা? একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
সম্ভবত মাইক্রো ডিটেক্টর। বলল পেলোরেট।
ট্র্যাভিজ বুঝিয়ে বলল, এটা তেমন কিছু না। এই যন্ত্র সংক্রামক রোগজীবাণু আছে কিনা সেটা বের করার জন্য তোমার শরীরের যে-কোনো অংশ বাইরে ভিতরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষা করবে।
জীবাণুর, শ্রেণীবিভাগও করে। কিণ্ড্রে বলল, কিন্তু গর্বের লেশমাত্র নেই। কমপরেলনে তৈরি করা হয়েছে। যদি কিছু মনে না করেন, ডান হাত বাড়াবেন?
ডান হাত যন্ত্রে ঢুকিয়ে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন রংএর নাচানাচি দেখতে লাগল ট্র্যাভিজ। কিণ্ড্রে একটা সংযোগ স্পর্শ করতেই ফুটে উঠল লাল রঙের চিহ্ন। এখানে সই করুন, স্যার।
সই করে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ, অবস্থা কতটুকু খারাপ? আমার তেমন কিছু হয়নি, তাই না?
আমি ফিজিশিয়ান নই, সেজন্য বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে এখানে এমন কোনো চিহ্ন দেখিনি যার জন্য আপনাকে ফেরত পাঠাতে হবে বা স্বাস্থ্যনিবাসে পাঠাতে হবে। সেটাই যথেষ্ট।
কী সৌভাগ্য। ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল, শির শির ভাব দূর করার জন্য হাত ঝাড়ছে।
এবার আপনি, স্যার।
পেলোরেট দ্বিধাগ্রস্তভাবে হাত বাড়ালো।
আপনি, ম্যাম।
কয়েকমিনিট পর, কিণ্ড্রে ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অদ্ভুত দৃষ্টিতে ব্লিসের দিকে তাকালো। আপনি পুরোপুরি নীরোগ।
হাসল ব্লিস। চমৎকার।
হ্যাঁ, ম্যাম। আপনাকে আমার হিংসা হচ্ছে। প্রথম দস্তখতের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আপনার পরিচয়পত্র, মি. ট্র্যাভিজ।
ট্র্যাভিজ বের করে দিল। একবার দেখেই অবাক হয়ে মুখ তুলল কিণ্ড্রে। টার্মিনাস আইনসভার কাউন্সিলম্যান?
হ্যাঁ।
ফাউণ্ডেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা?
ট্র্যাভিজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক। এখন আপনি দ্রুত কাজ শেষ করবেন?
আপনি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন?
হ্যাঁ আমি।
এখানে আসার উদ্দেশ্য?
ফাউণ্ডেশনের নিরাপত্তা। এর বেশি কিছু আপনাকে আমি বলব না, বুঝতে পেরেছেন?
জি স্যার। কতদিন থাকবেন?
জানি না, সম্ভবত এক সপ্তাহ।
ভালো কথা। আর এই ভদ্রলোক?
ইনি ড. জেনভ পেলোরেট। আমি তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। ইনি টার্মিনাসের একজন স্কলার এবং বর্তমান মিশনে আমার সহকারী।
আমি বুঝেছি, স্যার। কিন্তু আমাকে কাগজপত্র দেখাতেই হবে। নিয়ম নিয়মই। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন স্যার।
পেলোরেট কাগজপত্র বের করে দিল।
আপনি ম্যাম।
ভদ্রমহিলাকে বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই। শান্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, আমি তারপক্ষেও নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
জি স্যার। কিন্তু আমার কাগজ পত্রের প্রয়োজন।
আমার কোনো কাগজ পত্র নেই, স্যার।বলল ব্লিস।
মাফ করবেন, বুঝতে পারিনি। কিন্ট্রে অবাক।
ট্র্যাভিজ জবাব দিল, ভদ্রমহিলা পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে আসেন নি। অসাবধানতা, তবে কোনো সমস্যা হবে না। দায়দায়িত্ব আমার।
সম্ভব হলে আপনাদের বিরক্ত করতাম না, কিন্তু আমার হাতে ক্ষমতা নেই। কিণ্ড্রে বলল। তা ছাড়া ডুপ্লিক্যাট কপি যোগাড় করা নিশ্চয়ই কঠিন হবে না। মহিলা নিশ্চয়ই টার্মিনাস থেকেই এসেছেন।
না।
তা হলে ফাউণ্ডেশন টেরিটোরির অন্য কোনো বিশ্ব থেকে?
না, তাও না।
কিণ্ড্রে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ব্লিসের দিকে তাকালো, তারপর ট্র্যাভিজের দিকে। ঝামেলা কাউন্সিলম্যান। নন-ফাউণ্ডেশনের আরেক সেট পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে হলে সময়। লাগবে। যেহেতু আপনি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক না, মিস ব্লিস, যে গ্রহে জন্ম এবং যে গ্রহের নাগরিক তার নাম আমাকে জানতে হবে। তারপর পরিচয়পত্র না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।
দেখুন, মি. কিণ্ড্রে, শুধু শুধু দেরি করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমি ফাউণ্ডেশন-এর পদস্থ কর্মকর্তা। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি। সামান্য পেপারওয়ার্কের জন্য আমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা উচিত হবে না।
কিছু করার নেই, কাউন্সিলম্যান, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে এই মুহূর্তে আপনাকে নিচে নামার ছাড়পত্র দিতাম। কিন্তু আমার সকল কাজ পাতলা একটা আইনের বই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তার বাইরে যেতে পারব না। অবশ্য কমপরেলিয়ান সরকারের কেউ একজন নিশ্চয়ই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। নামটা জানালে যোগাযোগ করতে পারি। তিনি অনুমতি দিলে আপনাদের এখনি ছেড়ে দেব।
ট্র্যাভিজ ইতস্তত করল। আসলে ব্যাপারটা রাজনৈতিক কিছু না। আমি আপনার উপরওয়ালার সাথে দেখা করতে পারি?
অবশ্যই পারেন। কিন্তু আপনি তো যেতে পারছেন না।
ফাউণ্ডেশনের কর্মকর্তার কথা শুনলে তিনি নিশ্চয়ই এখানে চলে আসবেন।
আসলে ঝামেলা তখন আরো বাড়বে। আমরা ফাউণ্ডেশন মেট্রোপলিটান টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত না, তাদের এসোসিয়েটেড পাওয়ার, এবং বিষয়টাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিই। জনগণ ফাউণ্ডেশন-এর হাতের পুতুল হতে ভয় পায়।–আমি স্বাভাবিক জনমতের কথা বলছি। নিজেদের স্বাধীন বোঝাতে তারা সবসময় উল্টো। কাজটা করবে। আমার উপরওয়ালা ফাউণ্ডেশন-এর কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে অস্বীকার করে নিজে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারবে।
ট্র্যাভিজ হতাশ হলো, আপনিও পারবেন, তাই না?
কিণ্ড্রে মাথা নাড়ল। সময় মতো বেতন পেলেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি রাজনীতির বাইরে। তাই অতিরিক্ত কোনো সুবিধা পাবো না। তবে যখন তখন বিপদে পড়তে পারি।
আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব।
না, স্যার, অভদ্রতা হলে আমি দুঃখিত, কিন্তু আপনি কিছুই করতে পারবেন না। আর বিব্রতকর হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি-দয়া করে আমাকে মূল্যবান কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে বেশ কঠোর।
আপনাকে ঘুষ দেওয়ার কথা ভাবছি না। ভাবছি আমার কাজে বাধা দেওয়ার জন্য টার্মিনাসের মেয়র আপনার কী করতে পারে।
কাউন্সিলম্যান, যতক্ষণ আইনের ভিতরে থাকবো আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কমপরেলন প্রেসিডিয়ামের সদস্যরা যদি ফাউণ্ডেশন-এর কাছ থেকে অভিযোগ পায়, সেটা তাদের মাথাব্যথা।–আপনি এবং ড. পেলোরেট যেতে পারেন। কিন্তু মিস ব্লিস এখানে থাকবে। ডুপ্লিক্যাট পরিচয়পত্র আসার সাথে সাথে তাকে সারফেসে নামিয়ে দেব। আর যদি কোনো কারণে না পাওয়া যায় তাকে কোনো বাণিজ্যিক মহাকাশযানে করে ফেরত পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে আপনারা ভাড়া দেবেন।
ট্র্যাভিজ লক্ষ করল পেলোরেটের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মি. কিন্ট্রে পাইলট রুমে আপনার সাথে একা কথা বলা যাবে? সে জিজ্ঞেস করল।
বেশ, কিন্তু বেশি দেরি করলে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।
খুব বেশি সময় লাগবে না।
পাইলট রুমে ট্র্যাভিজ ভান করল যেন খুব শক্ত করে দরজা বন্ধ করছে। তারপর নিচুস্বরে বলল, আমি অনেক জায়গায় গিয়েছি, মি. কিণ্ড্রে। কিন্তু কোথাও ইমিগ্রেশনের
এমন কড়াকড়ি নিয়ম দেখিনি। বিশেষ করে ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিকদের বেলায়।
কিন্তু মহিলা ফাউণ্ডেশন থেকে আসেনি।
তারপরেও।
এসব কথা বাতাসের আগে ছড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বাজে ঘটনা ঘটেছে। ফলে বেশ কড়াকড়িভাবে আইন মেনে চলছে সবাই। সামনে আসলে দেখবেন হয়তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু এখন কিছু করা সম্ভব না আমার পক্ষে।
চেষ্টা করুন মি. কিণ্ড্রে। অনুনয়ের সুরে বলল ট্র্যাভিজ। নিজেকে আমি আপনার দয়ার উপর ছেড়ে দিচ্ছি এবং একজন পুরুষ হিসেবে আরেকজন পুরুষের কাছে আবেদন করছি। পেলোরেট আর আমি এই মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি অনেকদিন। শুধু সে আর আমি। আমরা দুজন ভালো বন্ধু, কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন এভাবে কি আর একাকীত্ব কাটে। কিছুদিন আগে এই তরুণীর সাথে পেলোরেটের দেখা হয়, তারপর কি ঘটেছে সেটা খুলে বলতে চাই না, তবে আমরা তাকে সাথে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেই।
এখন আসল সমস্যা হচ্ছে, টার্মিনাসে পেলোরেটের একটা সম্পর্ক আছে। আমার কোনো পিছুটান নেই, কিন্তু পেলোরেট বৃদ্ধ এবং এমন একটা বয়সে পৌঁছেছে যে বয়সে মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠে। যৌবনকাল ফিরে পেতে চায়। মহিলাকে সে ছাড়তে পারবে না। অন্যদিকে যদি অফিসিয়ালি তার নাম রেকর্ড করা হয় পেলোরেট একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়বে।
আপনি একটু উপকার করলে কোনো ক্ষতি হবে না। মিস. ব্লিস, এই নামে যদি সে পরিচয় দেয় সম্ভবত তার পেশার জন্য চমৎকার নাম-খুব যে বুদ্ধিমতী তা না; তার বুদ্ধি আমাদের কাজে আসবে না। তার নাম উল্লেখ করার আসলে কোনো প্রয়োজন আছে? শুধু আমাকে আর পেলোরেটকে যাত্রী হিসেবে দেখানো যায় না? টার্মিনাস থেকে আসার সময় শুধু আমাদের নামই লেখা হয়েছে, অফিসিয়ালি মহিলার নাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া সে তো পুরোপুরি সুস্থ, আপনি নিজেই দেখেছেন।
কিণ্ড্রে চেহারায় সমবেদনা । আমি আপনাকে নিরাশ করতে চাই না। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, কারণ আমিও ভুক্তভোগী। এই স্টেশনে টানা একমাস কাজ করা মজার কোনো ব্যাপার না। আমারও স্ত্রী আছে। কিন্তু, আমি আপনাকে ছেড়ে দিলে ওরা যখন জানবে যে মহিলার সাথে কোনো পরিচয়পত্র নেই, তাকে গ্রেপ্তার করবে, আপনারা বিপদে পড়বেন, টার্মিনাসেও খবর চলে যাবে। এবং নিশ্চিতভাবেই আমার চাকরি চলে যাবে।
মি. কিণ্ড্রে, ট্র্যাভিজ বলল, আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। কমপরেলনে পৌঁছলে আমি নিরাপদ। মিশন নিয়ে উপযুক্ত লোকদের সাথে কথা বলতে পারব, তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। এখানে যা ঘটেছে আমি তার পুরো দায়-দায়িত্ব নেব। তা ছাড়া আমি আপনার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করব, এবং আপনি সেটা পাবেন।–পেলোরেটকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
কিণ্ড্রে একটু ইতস্তত করে বলল, ঠিক আছে, আপনাদের আমি যেতে দিচ্ছি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, সমস্যা হলে আপনাকে রক্ষা করার কোনো চেষ্টাই আমি করব না। সবচেয়ে বড় কথা এসব ব্যাপর এখানে কীভাবে সামলাতে হয় আমি জানি, আপনি জানেন না। যারা সীমা লঙ্ঘন করে তাদের জন্য কমপরেলন। বেশ কঠিন জায়গা।
ধন্যবাদ মি. কিণ্ড্রে, ট্র্যাভিজ বলল। কোনো সমস্যা হবে না। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
.
৪. কমপরেলনের বুকে
ফার স্টার অনেক দূর চলে এসেছে। এন্ট্রি স্টেশনগুলো এখন মনে হচ্ছে আকাশের মিটি মিটি তারা। আর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই মেঘের স্তর পার হয়ে যাবে।
প্যাচানো পথ অনুসরণ করে গ্র্যাভিটিক মহাকাশ যানের গতি কমানোর প্রয়োজন হয় না, আবার ঝপ করে দ্রুতগতিতে নিচে নামতে পারে না। মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হলেও বায়ুঘর্ষণে এর প্রভাব থেকেই যায়। এই ধরনের মহাকাশ যান সরল পথে নিচে নামতে পারে, তবুও একটু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। দ্রুত না নেমে, অবতরণ করে ধীরে ধীরে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? জানতে চাইল পেলোরেট, একটু দ্বিধাগ্রস্ত। মেঘের জন্য ভূ-খণ্ডগুলো আলাদা করতে পারছি না।
আমিও পারছি না, ট্র্যাভিজ বলল। তবে কমপরেলনের একটা হলোগ্রাফিক ম্যাপ পেয়েছি, সেটাতে ভূ-খণ্ড, ভূমির উচ্চতা, সমুদ্রের গভীরতা-এবং রাজনৈতিক বিভাজনও দেওয়া আছে। কম্পিউটার ম্যাপের সাথে মিলিয়ে আমাদের রাজধানীতে নিয়ে যাবে।
রাজধানীতে গেলেই আমরা রাজনৈতিক কোলাহলে পড়ব। এন্ট্রি স্টেশনের লোকটার কথা মতো ওরা যদি ফাউণ্ডেশন বিরোধী হয়, তা হলে সমস্যা হবে।
অন্য দিকে রাজধানী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্র হতে বাধ্য। তথ্য পেতে হলে এখানে ছাড়া আর কোথাও পাব না। আর ফাউণ্ডেশন বিরোধী হলেও আমার মনে হয় না সেটা খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারবে। মেয়র হয়তো পছন্দ করেন না আমাকে। কিন্তু কোনো কাউন্সিলম্যান কোথাও অপমানিত হবে–এমন ঘটনা তিনি ঘটতে দেবেন না।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল ব্লিস। অন্তর্বাস ঠিক করতে করতে বলল, আশা। করি বর্জ্যপদার্থগুলো ভালোমতো রিসাইকল হচ্ছে।
না হয়ে উপায় আছে, জবাব দিল ট্র্যাভিজ। তোমার কি মনে হয়, বর্জ্যগুলো রিসাইকল না হলে, পানির সরবরাহ কতদিন থাকত? খাবার কোথায় পেতাম, গাছ আছে? আশা করি তোমার রুচি নষ্ট করে দেইনি, ব্লিস।
কেন হবে? তোমার কি মনে হয়, গায়া অথবা এই গ্রহ অথবা টার্মিনাসে পানি এবং খাদ্য কোত্থেকে আসে?
গায়াতে বর্জ্যগুলোও জীবিত, তোমার মতোই।
জীবিত না, সচেতন। দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে। সচেতনতার মাত্রা অবশ্যই অনেক নিম্নমানের।
ট্র্যাভিজ চরম অবজ্ঞায় নাক ঝাড়ল, কিন্তু ব্লিসের কথার কোনো জবাব দিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি পাইলট রুমে যাচ্ছি কম্পিউটারকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। যদিও আমার না থাকলেও চলবে।
আমরা ও আসি? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট। কম্পিউটার একাই আমাদের নিচে নিয়ে যাবে বিশ্বাস হচ্ছে না।
ট্র্যাভিজ আকর্ণ হাসি দিয়ে বলল, দয়া করে বিশ্বাস কর। মহাকাশযান আমার হাতে যতুটুকু নিরাপদ থাকবে তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি নিরাপদ থাকবে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণে।
তারা রয়েছে গ্রহের আলোকিত অংশে। কারণ–ট্যুভিজ ব্যাখ্যা করে বলল–অন্ধকারের চেয়ে আলোতে কম্পিউটার প্রকৃত অবস্থার সাথে সহজে মেলাতে পারবে।
সেটাই স্বাভাবিক। বলল পেলোরেট।
মোটেই না। সারফেস থেকে যে অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিফলিত হয় সেটার কারণে কম্পিউটার অন্ধকারেও দেখতে পারবে। তবে নিখুঁতভাবে হয়তো দেখতে পারবে না। আর খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে আমি কম্পিউটারের জন্য পরিস্থিতি সহজ রাখতে চাই।
রাজধানী যদি রাতের অংশে হয়?
সম্ভাবনা আধাআধি। তবে দিনের অংশের সাথে ম্যাপ মেলানো হয়ে গেলেই, আমরা অনায়াসে যে কোনো দিকে যেতে পারবো–দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই।
তুমি নিশ্চিত, ব্লিস বলল। পরিচয়পত্র এবং কোন গ্রহের নাগরিক তার নাম ছাড়াই আমাকে নিচে নামিয়ে এনেছ-এদের কাছে আমি অবশ্যই গায়ার নাম বলব না। সারফেসে যদি ওরা আমার কাগজপত্র চায়, তখন কী করবে?
আশা করি জিজ্ঞেস করবে না। সবাই ধরে নেবে এন্ট্রি স্টেশনেই ওসব ঝামেলা মিটে গেছে।
কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করে?
সমস্যা যখন হবে তখন দেখা যাবে। আগেই কল্পনায় সমস্যা তৈরি করার দরকার নেই।
হয়তো তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।
আমার বিচক্ষণতার সাহায্যে দেরি হতে দেব না।
বিচক্ষণতার কথা যখন উঠলই, বল তো কীভাবে আমাদের পার করে আনলে?
ব্লিস-এর দিকে তাকালো ট্র্যাভিজ । সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। তাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে ছোট বালক। বুদ্ধি খাঁটিয়ে।
কী করেছো, বুড়ো খোকা? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।
আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে সঠিক উপস্থাপন। আমি লোকটাকে ভয় দেখালাম, ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তার যুক্তি এবং ফাউণ্ডেশন-এর প্রতি আনুগত্যের কথা মনে করিয়ে দিলাম, কোনো লাভ হয়নি। কাজেই শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলাম। আমি তাকে বলেছিলাম যে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করছ, পেলোরেট।
আমার স্ত্রী? কিন্তু প্রিয় বন্ধু, এই মুহূর্তে আমার কোনো স্ত্রী নেই।
আমি জানি, কিন্তু সে-তো জানে না।
স্ত্রী বলতে, ব্লিস বলল, তোমরা নিশ্চয়ই বোঝচ্ছ একজন নির্দিষ্ট পুরুষের নিয়মিত সঙ্গী।
তারও বেশি, ব্লিস, ট্র্যাভিজ বলল। একজন আইনগত সঙ্গী, পুরুষ সঙ্গীর সবকিছুর উপর যার পূর্ণ অধিকার আছে।
ভীত স্বরে বলল পেলোরেট, ব্লিস, আমার স্ত্রী নেই। যে ছিল সে অনেক আগেই চলে গেছে। তুমি যদি
ওহ্ পেল, ব্লিস উড়িয়ে দিল, মাথা ঘামাবো কেন? তোমার ডান হাত তোমার বাঁ হাতের যতটুক ঘনিষ্ঠ, তার চেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী সাথী ছিল আমার। আসলে আইসোলেটরাই নিজেদের একাকিত্ব দূর করতে এমন সূক্ষ্ম উপায় অবলম্বন করে।
কিন্তু আমি একজন আইসোলেট, ব্লিস ডিয়ার।
তোমার নিঃসঙ্গতা কমে যাবে। হয়তো সত্যিকারের গায়া হতে পারবে না, তবে নিঃসঙ্গতা কাটবে। তখন অনেক সঙ্গী পাবে।
আমি শুধু তোমাকে চাই, ব্লিস।
কারণ তুমি কিছুই জান না, তবে শিখবে।
ট্র্যাভিজ তাকিয়ে ছিল ভিউ স্ক্রিনের দিকে। যে মেঘস্তর কাছে চলে এসেছে, পরমুহূর্তেই স্ক্রিন ধূসর কুয়াশার রূপ ধারণ করল।
মাইক্রোওয়েভ ভিশন, ট্র্যাভিজ ভাবল, আর কম্পিউটার সাথে সাথে রাডার প্রতিধ্বনি চিহ্নিত করল। মেঘ সরে গিয়ে ছদ্মরঙে ফুটে উঠল কমপরেলনের সারফেস, সেক্টরগুলোর বিভাজন রেখা ঝাপসা এবং কাঁপাকাঁপা।
এখন থেকে কি এমনই দেখাবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
মেঘের নিচে না নামা পর্যন্ত। ট্র্যাভিজ বলল। তারপর সূর্যের আলোয় বেরিয়ে আসব। একথা বলতে না বলতেই সূর্যের আলো আর স্বাভাবিক দৃশ্য ফিরে এল।
তাই তো, ব্লিস বলল, তারপর ঘুরল ট্র্যাভিজের দিকে, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না পেলোরেট তার স্ত্রীকে ঠকাচ্ছে, তাতে এন্ট্রি স্টেশনের অফিসারের কি?
আমি কিণ্ড্রেক বলেছিলাম, যদি সে তোমাকে আসতে না দেয়, তা হলে খবরটা টার্মিনাসে পৌঁছবে, পেলোরেটের স্ত্রীও জানতে পারবে। ফলে তার বিপদ হবে, কী বিপদ, বিস্তারিত বলিনি, তবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কঠিন বিপদ। আসলে, ট্র্যাভিজের মুখে দন্ত বিকশিত করা হাসি, এসব ব্যাপারে পুরুষদের ভেতর এক ধরনের একারবোধ থাকে, এবং একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে সাহায্য করতে কসুর করে না। মেয়েদের ভেতরেও বোধহয় এধরনের কিছু একারতা আছে। আমি অবশ্য মেয়ে নই, তাই সঠিক বলতে পারব না।
ব্লিসের চেহারা থমথমে। এটা কি একটা রসিকতা? সে গম্ভীর গলায় বলল।
না, আমি সত্যি বলছি, কি েচায়নি পেলোরেটের স্ত্রীকে রাগাতে। কিন্তু এটা আসল কারণ না। আমাদের ছেড়ে দেওয়ার আসল কারণ হচ্ছে পুরুষদের ভেতর যে একারতার কথা বলেছি, সেটা।
কী ভয়ংকর। এই নিয়মগুলোই সমাজকে একসুতোয় বেঁধে রাখে। তুচ্ছ কোনো কারণে সেগুলো ভঙ্গ করা কি ঠিক?
বেশ, ট্র্যাভিজ আররক্ষার সুরে বলল, কিছু নিয়ম আসলেই তুচ্ছ। অল্প কয়েকটা গ্রহ শান্তির সময়ে নিজেদের সীমানায় প্রবেশের ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়ম পালন করে। যেমন ফাউণ্ডেশন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোনো কারণে কমপরেলন কিছুটা ভিন্ন। সেজন্য আমরা কষ্ট করব কেন?
সেটা আলোচনার বাইরে। যে নিয়মগুলো সঙ্গত এবং যৌক্তিক বলে মনে হয় শুধু যদি সেগুলো মেনে চলি তা হলে আর কোনো নিয়মের প্রয়োজন হয় না। কারণ অসঙ্গত বা অযৌক্তিক নিয়ম বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য যদি এভাবে নিয়ম ভাঙা হয় তা হলে সবসময় কোনো না কোনো নিয়ম অসঙ্গত আর অযৌক্তিক মনে হবে। ফলে সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
সমাজ এত সহজে ভাঙে না। তুমি কথা বলছ গায়া হিসেবে, এবং গায়া সম্ভবত ইণ্ডিভিজুয়াল মানবগোষ্ঠীর দৃঢ়বন্ধন কখনোই বুঝতে পারবে না। যুক্তি এবং বিচার বিশ্লেষণের দ্বারা নিয়ম তৈরি হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনে সেগুলো সহজেই অকেজো হতে পারে, তারপরেও সেগুলো নিষ্ক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। অপ্রয়োজনীয় এবং সত্যিকার ক্ষতিকর নিয়ম ভেঙে ফেলার জন্য সেগুলো শুধু সঠিকই নয়, অত্যন্ত কার্যকরী।
তা হলে সব চোর আর খুনী বলতে পারবে যে তারা মানবতার সেবা করছে।
তুমি চরমভাবে চিন্তা করছ। গায়ার অবকাঠামোতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামাজিক নিয়ম তৈরি হয় এবং সেগুলো অমান্য করার কথা কেউ ভাবতে পারে না। যে কেউ বলতে পারে গায়া জীবাশ্মে পরিণত হচ্ছে। স্বাধীন সহযোগিতায় ভিন্নমত থাকবেই। সবাই এটা মেনে নিয়েছে। সামাজিক পরিবর্তনের জন্য এতটুকু মূল্য তত দিতেই হবে। সত্যি কথা বলতে কি এটাই সব থেকে সঠিক মূল্য।
ব্লিসের স্বর একধাপ চড়ল, যদি ভেবে থাকো, গায়া জীবাশ্মে পরিণত হচ্ছে, তোমার ধারণা পুরোপুরি ভুল। আমাদের আদর্শ জীবন ধারণ পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে ক্রমাগত আর-নিরীক্ষণের মাধ্যমে। এগুলো স্থবির বা অযৌক্তিক নয়। গায়া চিন্তা এবং অভিজ্ঞতার দ্বারা শিক্ষালাভ করে; প্রয়োজন হলেই নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে।
যাই বলো, আরনিরীক্ষণ এবং শিক্ষণের গতি অবশ্যই কম। কারণ গায়াতে গায়া ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমাদের সমাজে কোনো বিষয়ে সকলে একমত হলেও অল্প কয়েকজন সেই মতের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই অল্প কয়েকজনই সঠিক হয়। যদি তারা যথেষ্ট সাহসী এবং বুদ্ধিমান হয় তা হলে পরবর্তী ইতিহাসে বীরের মর্যাদা লাভ করে। যেমন হ্যারি সেলডন-সাইকোহিস্টোরির জনক। পুরো গ্যালাকটিক এম্পায়ারের বিপক্ষে তিনি একা তার মতবাদ চালু করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন।
হ্যারী সেলডন কিছু সময়ের জন্য জয়ী হয়েছেন, ট্র্যাভিজ। তার পরিকল্পিত দ্বিতীয় এম্পায়ার কখনোই হবে না। হবে গ্যালাক্সিয়া।
হবে কি? হাসি মুখে বলল ট্র্যাভিজ।
এটাই তোমার সিদ্ধান্ত। এবং আমার সাথে যতই তর্ক করো, তোমার মনের সুপ্ত কোনো শক্তি তোমাকে আমি/আমরা/গায়ার সাথে একমত হতে বাধ্য করেছে।
আমার মনের সুপ্ত শক্তি, ট্র্যাভিজ আরও চওড়া হাসি দিয়ে বলল, সেটাই আমি খুঁজছি। শুরু থেকে এই পর্যন্ত, ভিউস্ক্রিনের দিকে নির্দেশ করে বলল। সেখানে ধীরে ধীরে এক মহানগরী উন্মুক্ত হচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে নিচু উচ্চতার কাঠামো, দুএকটা উঁচু কাঠামো। চারপাশে মাঠ,কুয়াশার কারণে বাদামি মনে হচ্ছে।
খুব খারাপ, আপসোস করে বলল পেলোরেট। কীভাবে এগোই সেটা দেখার ইচ্ছা ছিল। তোমাদের আলোচনার কারণে ভুলে গেলাম।
চলে যাওয়ার সময় দেখতে পারবে, জেনভ। কথা দিচ্ছি সেসময় আমার মুখ বন্ধ থাকবে। যদি তুমি ব্লিস এর মুখ বন্ধ রাখতে পারো।
.
গম্ভীর মুখে এন্ট্রি স্টেশনে ফিরে এল কি।ে তার দায়িত্ব শেষ।
দিনের শেষ ভূরিভোজনের সময় তার সহকর্মী একই টেবিলে বসল। লোকটা ঢ্যাঙা, পাতলা চুল। ভুরুর রঙ এতই বাদামি যে বোঝা যায় না সেগুলো আছে কিনা।
কী হয়েছে, কি? জিজ্ঞেস করল সে।
মুচকি হাসল কিণ্ড্রে। এইমাত্র যে মহাকাশ যানকে ছাড়পত্র দিলাম, গেটিস, সেটা একটা গ্র্যাভিটিক শিপ।
দেখতে অদ্ভুত আর কোনো রেডিওএকটিভিটি নেই?
সে কারণেই রেডিওএকটিভিটি নেই। জ্বালানি দরকার হয় না। গ্র্যাভিটিক।
যার জন্য আমাদের নজর রাখতে বলেছিল, ঠিক?
ঠিক।
আর তুমিই দেখতে পেলে। ভাগ্যবান।
অতটা ভাগ্যবান না। পরিচয়হীন একটা মেয়ে ছিল। আমি তার কথা রিপোর্ট করিনি।
কী? দেখ আমাকে বলো না। কিছু শুনতে চাই না। একটা শব্দও না। তুমি সাহসী হতে পারো, কিন্তু আমি কোনো সমস্যায় পড়তে চাই না।
আমি অতো ভাবছি না। এই জাহাজ নিচে পাঠানোর দরকার ছিল পাঠিয়েছি। ওরা এই গ্র্যাভিটিক বা অন্য কোনো গ্র্যাভিটিক যাই হোক পেতে চায়। . অবশ্যই, কিন্তু মেয়েটির কথা অন্তত রিপোর্ট করতে পারতে।
ইচ্ছে হয়নি। অবিবাহিতা মেয়ে। তাকে নিয়ে এসেছে শুধু-শুধু ব্যবহার করার জন্য।
কয়জন পুরুষ আছে? দুজন। আর তারা মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে শুধু-শুধু ঐজন্য। নিশ্চয়ই টার্মিনাস থেকে এসেছে।
হ্যাঁ।
টার্মিনাসে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।
ঠিক।
জঘন্য। আর এভাবেই ওরা নিচে গেছে।
দুজনের একজন বিবাহিত, স্ত্রীকে ঘটনাটা জানাতে চায় না। আমি রিপোর্ট করলে তার বউ সব জেনে ফেলবে।
মেয়েটা টার্মিনাসে যেতে পারে?
অবশ্যই, কিন্তু অন্য কোনো উপায় নিশ্চয়ই বের করে নেবে।
লোকটার বউ সব জানলেই উচিত শিক্ষা হবে।
আমি একমত।–কিন্তু অমি সেই দায়িত্ব নিতে চাই না।
কর্মকর্তারা তোমার বারোটা বাজাবে। একটা মানুষকে সমস্যায় ফেলতে চাও নি, এটা কোনো যুক্তি হলো না।
তুমি হলে রিপোর্ট করতে?
বোধহয় করতাম।
না করতে না। কর্তারা জাহাজ চায়। মেয়েটার কথা রিপোর্ট করার জন্য জোর করলে ওরা হয়তো অন্য কোনো গ্রহে চলে যেত। উপরওয়ালারা নিশ্চয়ই এটা চায় না।
তোমার কথা বিশ্বাস করবে?
আশা করি।–খুব সুন্দরী মেয়ে। চিন্তা করে দেখ এমন একটা মেয়ে স্বেচ্ছায় দুজন পুরুষের সাথে এসেছে, তাদের একজন আবার বিবাহিত। চমৎকার।
নিশ্চয়ই চাও না তোমার মিসেস জানুক তুমি এমন কথা বলেছ বা চিন্তা করেছ।
কে বলবে, তুমি? রূঢ় স্বরে বলল কি।ে
আরে না, তুমি ভালোভাবেই জানো আমি বলব না। তবে কোনো লাভ হবে না। সারফেসে অফিসারদের কাছে ঠিকই ধরা পড়বে। তুমি ছাড়লেও ওরা ছাড়বে না।
জানি। ওদের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। মেয়েটা যতটা সমস্যা তৈরি করবে, তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি সমস্যা করবে মহাকাশযান। জাহাজের ক্যাপ্টেন কয়েকটা কথা বলেছিল–
কিণ্ড্রে থেমে গেল, আর গেটিস আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, কী?
কিছু মনে করো না। সবাই জেনে ফেললে আমারই সমস্যা।
অমি কাউকে বলব না।
আমিও না। তবে টার্মিনাসের লোকগুলোর জন্য আমার আসলেই দুঃখ হচ্ছে।
.
যারা মহাকাশে ভ্রমণ করে এবং এর পরিবর্তনহীনতায় অভ্যস্ত তাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত হচ্ছে নতুন কোনো গ্রহে নামা। নিচে নামার সময় চোখে পড়বে পায়ের নিচে দ্রুত সরে যাচ্ছে ভূমি এবং পানি। হঠাৎ চোখে পড়বে সবুজের সমারোহ; ধূসর খালি ময়দান, সবচেয়ে উত্তেজনার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের সমারোহ; বড় বড় নগরী যেখানে প্রতিটি গ্রহের বিচিত্র সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের সমাবেশ ঘটে।
সাধারণ মহাকাশযান মাটিতে নেমে রানওয়ে ধরে কিছুদূর ছুটে তারপর থামে। কিন্তু ফার স্টারের ব্যাপার ভিন্ন। এটা বাতাসে ভেসে থেকে দক্ষভাবে বায়ুর প্রতিরোধ এবং মাধ্যাকর্ষণ এর সাথে ভারসাম্য তৈরি করে। ঝড়ো আবহাওয়া বলে একটু সমস্যা হচ্ছে। ফার স্টার যখন স্বল্প মাধ্যাকর্ষণের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে তখন শুধু ওজন না, তার ভরও অনেক কমে যায়। ভর যদি শূন্যের সমান হয় তখন ঝড়ো বাতাস তাকে পালকের মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। যাই হোক মাধ্যাকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ছে, আর জেট ইঞ্জিনগুলো সূক্ষ্মভাবে গ্রহের নিজস্ব ধাক্কা, বায়ুর গতি ঘনত্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিল। একটা অতি উন্নত কম্পিউটার ছাড়া দক্ষভাবে এই কাজ সম্ভব হতো না।
একবারে নিচে নেমে এসে ডানে বামে ভারসাম্যহীনভাবে একটু দুলে শেষ পর্যন্ত ফার স্টার স্পেসপোর্টে তার জন্য নির্দিষ্ট করা স্থানে অবতরণ করল।
আকাশ হালকা নীল, মাঝে মাঝে সাদা মেঘ। গ্রাউণ্ড লেভেলেও ঝড়ো বাতাস। এখন আর নেভিগেশন নিয়ে ব্যস্ত নয় বলে ট্র্যাভিজ ঠাণ্ডা অনুভব করল। বুঝতে পারছে তাদের পোশাক কমপরেলনের আবহাওয়ার উপযোগী নয়।
অন্যদিকে সশব্দে নাক দিয়ে নিশ্বাস টানল পেলোরেট। ঠাণ্ডা তার পছন্দ হয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাস বুকে লাগানোর জন্য কোটের একপাশ মেলে ধরল সে। বেশিক্ষণ রাখা যাবে না জানে, কিন্তু এই মুহূর্তে খোলা বাতাসের অস্তিত্ব সে অনুভব করতে চায়, জাহাজের ভেতরে সেটা পাওয়া যায় না।
কোট ভালোভাবে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিল ব্লিস, কান ঢাকল টুপি দিয়ে। চেহারা দেখে মনে হয় যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। ফিসফিস করে বলল, এই গ্রহ একটা শয়তান। আমাদেরকে সে ঘৃণা করে, তাই দুর্ব্যবহার করছে।
মোটেই না, ব্লিস ডিয়ার, আন্তরিক গলায় বলল পেলোরেট। কোনো সন্দেহ নেই এখানে যারা বাস করে তারা এই গ্রহকে বেশ পছন্দ করে এবং এটাও তাদেরকে–আহ–পছন্দ করে। এখুনি আমরা কোনো ঘরের ভেতর ঢুকব। সেখানে আর ঠাণ্ডা লাগবে না।
ট্র্যাভিজ যতদূর সম্ভব চেষ্টা করল ঠাণ্ডার কথা ভুলে থাকতে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটা ম্যাগনেটাইজড কার্ড পেয়েছে। পকেট কম্পিউটারে সেটা পরীক্ষা করে দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা। তারপর মহাকাশ যানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আরেকবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। (যদিও কোনো প্রয়োজন নেই, ফার স্টারের কলাকৌশল কমপরেলিয়ানদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে)।
যেখানে থাকার কথা সেখানেই পাওয়া গেল ট্যাক্সি-স্টেশন। স্পেসপোর্টের সুযোগ সুবিধা বেশ উন্নত। বোঝাই যায় বাইরের গ্রহের প্রচুর অতিথি সামলাতে এরা অভ্যস্ত।
একটা ট্যাক্সি ডাকল ট্র্যাভিজ। সুটে গন্তব্যের নাম পাঞ্চ করে শুধু লিখল শহর।
একটা ট্যাক্সি ভেসে এল। ইঞ্জিন বেশ শব্দ করে, একটু একটু কাঁপছে। রং ধূসর কালো। পিছনের দরজায় সাদা রঙে ট্যাক্সি লেখা। চালকের পরনে কালো কোট, সাদা পশমওয়ালা টুপি।
পেলোরেট খেয়াল করেছে। হালকা গলায় বলল, গ্রহের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় বোধহয় কালো আর সাদা রংই ব্যবহৃত হয়।
শহরে ঢুকলে হয়তো অন্যান্য রংও চোখে পড়বে। ট্র্যাভিজ বলল।
চালক কথা বলল ছোট মাইক্রোফোনে। সম্ভবত জানালা খুলতে চায় না। শহরে যেতে চান?
ট্র্যাভিজ হ্যাঁ বলতেই খুলে গেল পিছনের দরজা। প্রথমে ঢুকল ব্লিস, তারপর পেলোরেট সবার শেষে ট্র্যাভিজ। দরজা বন্ধ করতেই নিচ থেকে গরম বাতাসের প্রবাহ শুরু হল। দুহাত জোরে ঘষে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল ব্লিস।
ট্যাক্সি চালু করে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, আপনারা যে মহাকাশযানে এসেছেন সেটা গ্র্যাভিটিক, তাই না?
যেভাবে নেমে এসেছে তাতে কি মনে হয়? শুকনো গলায় বলল ট্র্যাভিজ।
তা হলে টার্মিনাস থেকে এসেছেন?
আর কোনো গ্রহ এমন জিনিস তৈরি করতে পারবে?
একটু হজম করার চেষ্টা করল ড্রাইভার। তারপর বলল, আপনি কি প্রশ্নের উত্তরে সবসময়ই প্রশ্ন করেন?
ট্র্যাভিজ নিজেকে সামলানোর কোনো চেষ্টাই করল না, কেন নয়?
সেক্ষেত্রে যদি জিজ্ঞেস করি আপনি গোলান ট্র্যাভিজ কিনা, কীভাবে উত্তর দেবেন?
আমার উত্তর হবে : আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?
স্পেসপোর্টের শেষ সীমানায় ট্যাক্সি থামিয়ে ড্রাইভার বলল, কৌতূহল! আবার জিজ্ঞেস করছি : আপনি গোলান ট্র্যাভিজ?
ট্র্যাভিজের গলার স্বর রুক্ষ, কঠিন, আপনার জেনে কাজ কী?
বন্ধু, আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমি এক পাও নড়ব না। দুই সেকেণ্ডের ভেতর পরিষ্কার জবাব দিতে হবে হ্যাঁ অথবা না, নইলে প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টের হিটার বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকব। আপনি গোলান ট্র্যাভিজ, কাউন্সিলম্যান অফ টার্মিনাস? উত্তর না হলে আপনার পরিচয়পত্র আমাকে দেখাতে হবে।
হ্যাঁ, আমি গোলান ট্র্যাভিজ, এবং ফাউণ্ডেশন-এর কাউন্সিলম্যান হিসেবে আমি আমার পদমর্যাদা অনুযায়ী আচরণ আশা করি। আপনি সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার কি?
এবার এগোনো যাক। ট্যাক্সি আবার চালু হলো। আমি খুব সতর্ক হয়ে যাত্রী বাছাই করি। দুজন পুরুষ যাত্রী আশা করেছিলাম; মহিলাকে দেখে মনে হয়েছিল কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। যাই হোক, আপনাকে যখন পেয়েছি, গন্তব্যে পৌঁছেই মহিলার বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন।
আমার গন্তব্য আপনি জানেন না।
জানি, আপনি যাচ্ছেন ডিপার্টমেন্ট অফ ট্র্যান্সপোর্টেশনে।
আমি সেখানে যেতে চাই না।
কিছুই যায় আসে না, কাউন্সিলম্যান। আমি ট্যাক্সি ড্রাইভার হলে আপনি যেখানে চান সেখানেই নিয়ে যেতাম। যেহেতু তা নই আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যেতে হবে।
মাফ করবেন, সামনে ঝুঁকে বলল পেলোরেট, আপনাকে ট্যাক্সি ড্রাইভার মনে হয়। আপনি ট্যাক্সি চালাচ্ছেন।
যে কেউ ট্যাক্সি চালাতে পারে। সবার লাইসেন্স থাকে না। আবার ট্যাক্সি মনে হলেও সব গাড়িই ট্যাক্সি না।
আমাদের নিয়ে খেলা বন্ধ করুন, ট্র্যাভিজ বলল, কে আপনি এবং কী চান? মনে রাখবেন এই আচরণের জন্য আপনাকে ফাউণ্ডেশন-এর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
আমাকে না, চালক বলল, আমার উপরওয়ালাদের হয়তো করতে হবে। আমি কমপরেলিয়ান সিকিউরিটি ফোর্সের একজন এজেন্ট। আমাকে বলা হয়েছে আপনার পদবী অনুযায়ী ব্যবহার করতে, কিন্তু আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে যেতে হবে। আর কিছু করার চেষ্টা করবেন না, কারণ এটা আর্মড ভেহিকেল। যে কোনো হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে।
ট্যাক্সির গতি অনেক দ্রুত হলেও ভেতরে কোনো শব্দ নেই। ট্র্যাভিজ জমাট বাঁধা বরফের মতো বসে আছে। বুঝতে পারছে পেলোরেট মাঝে মাঝেই তার দিকে এখন আমরা কী করব এমন একটা ভাব নিয়ে তাকাচ্ছে।
এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারল যে ব্লিস কিছুই বুঝতে পারেনি, পুরোপুরি শান্ত। অবশ্যই সে একাই একটা বিশ্ব। সমস্ত গায়া, যদিও সেটা এখন গ্যালাকটিক দূরত্বে রয়েছে তার ত্বকের নিচে। জরুরি প্রয়োজনে সে তার সমস্ত শক্তি ব্যবহার করতে পারবে।
কিন্তু তারপর কী হবে?
এটা পরিষ্কার যে এন্ট্রি স্টেশনের অফিসার নিয়ম মোতাবেক তার রিপোর্ট পাঠিয়েছে-ব্লিসকে বাদ দিয়ে অবশ্যই-সেটাই কোনো কারণে সিকিউরিটির মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, এবং সবকিছু বাদ দিয়ে ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রান্সপোর্টেশন কেন?
এখন শান্তির সময় এবং কমপরেলন আর ফাউণ্ডেশন-এর মাঝে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ চলছে কি না সে জানে না। সে নিজে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ ফাউণ্ডেশন অফিসিয়াল
ওহো, এন্ট্রি স্টেশনে সে বলেছিল কমপরেলন সরকারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এটাই তা হলে সব আগ্রহের কারণ।
তথাকথিত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ক্ষমতা তার কি হলো? কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে সে কি অতিরিক্ত আরবিশ্বাসী হয়ে উঠছে।
কীভাবে ফাঁদে পড়ল? জীবনে কি কখনো ভুল করেনি? সে বলতে পারবে আগামীকাল কী ঘটবে? ভাগ্যের সব খেলায় সে জিততে পারবে? উত্তর হল, না, না এবং না।
গোল্লায় যাক! আসল কথা হচ্ছে সে বলেছিল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজের কথা, বলেছিল ফাউণ্ডেশনের নিরাপত্তার কথা।
বেশ ফাউণ্ডেশন-এর নিরাপত্তার কথা বলতেই ওরা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তবে সব কিছু না জানা পর্যন্ত নিশ্চয়ই সম্মানিত অতিথির মতো ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই অপহরণ করবে না বা হুমকি দেবে না।
কিন্তু ঠিক তাই করছে। কেন?
টার্মিনাসের কাউন্সিলম্যানের সাথে এমন আচরণ করার সাহস কোথায় পেল ওরা।
এরজন্য কি পৃথিবী দায়ী? যে শক্তি মূল গ্রহকে নিপুণভাবে লুকিয়ে রেখেছে, এমনকি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন-এর মেন্টালিস্টদের কাছ থেকেও, সেই একই শক্তি কি এখন মূল গ্রহ অনুসন্ধান শুরুর প্রথমেই বাধা দিতে চাইছে? পৃথিবী কি সর্বজ্ঞ? সর্বশক্তিমান?
ট্র্যাভিজ মাথা নাড়ল। এভাবে চিন্তা করা বিপজ্জনক। সবকিছুর জন্য কি সে পৃথিবীকে দায়ী করবে? যে কোনো বিরুদ্ধ আচরণ, বাধা বিপত্তি, পরিস্থিতির পরিবর্তন সবই কি পৃথিবীর লুকোনো কলাকৌশলের ফসল? এভাবে কোনো লাভ হবে না।
সেই মুহূর্তেই ট্র্যাভিজ টের পেল তাদের বাহনের গতি কমছে। বাস্তবে ফিরে এল সে।
এতক্ষণ একবারও শহরের দিকে তাকায়নি। এবার তাকালো, বিতৃষ্ণা নিয়ে। ভবনগুলো সব নিচু, অবশ্য এটা ঠাণ্ডা গ্রহ, বেশিরভাগ কাঠামো সম্ভবত মাটির নিচে।
চারপাশের বর্ণহীন পরিবেশ তার কাছে মনে হলো মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ। পথচারী দু-একজন দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন পোশাকের পোটলা, তবে ভবনগুলোর মতো মানুষরাও সম্ভবত মাটির নিচে বাস করে।
ট্যাক্সি থেমে দাঁড়িয়েছে নিচু স্থানে তৈরি করা স্বল্প উচ্চতার প্রশস্ত এক ভবনের সামনে যার শেষ মাথা ট্র্যাভিজ দেখতে পারছে না। কিছু সময় চলে যাওয়ার পরও থেমে রইল, চালক একবারে স্থির। তার লম্বা সাদা টুপি বাহনের ছাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ট্র্যাভিজ অবাক হয়ে ভারল টুপি না খুলে সে কীভাবে ট্যাক্সিতে ঢোকে বা বের হয়, তারপর সম্মানিত ব্যক্তির সাথে দুর্ব্যবহার করলে যেভাবে কথা বলে সেরকম রাগত কিন্তু নিয়ন্ত্রিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, বেশ, ড্রাইভার, এবার কী?
ট্র্যাভিজ নিশ্চিত চালক এবং তাদের মাঝখানে যে পার্টিশন আছে সেটা আধুনিক। এর ভেতর দিয়ে শব্দ তরঙ্গ ঠিকই পার হবে কিন্তু প্রচণ্ড জোড়ে ছুঁড়ে মারলেও অন্য কোনো বস্তু পার করা যাবে না।
চালক বলল, আপনাদের নেওয়ার জন্য কেউ আসবে। ততক্ষণ আরাম করুন।
বলতে না বলতেই, যে নিচু স্থানে ভবন দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে সাবলীল গতিতে তিনটা মাথা বেরিয়ে এল, তারপর দৃষ্টিগোচর হলো শরীর। নিশ্চয়ই অ্যাস্কলেটর বা সেই ধরনের কিছু ব্যবহার করছে, কিন্তু এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না।
আগন্তুক তিন জন কাছে আসতেই খুলে গেল প্যাসেঞ্জার ভোর, একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিতরে।
বেড়িয়ে এল ট্র্যাভিজ, কাঁধের কাছে কোটের দুই প্রান্ত এক হয়ে আছে। বাকি দুজন তাকে অনুসরণ করল-ব্লিসের চেহারায় চরম বিরক্তি।
তিন কমপরেলিয়ানের কাঠামো বোঝা যাচ্ছে না। পোশাকগুলো বাইরের দিকে বেলুনের মতো ফুলে আছে, এবং সম্ভবত বৈদ্যুতিকভাবে উত্তপ্ত হয়। এনাক্রনে একবার ট্র্যাভিজ এ ধরনের পোশাক পরেছিল, জানে যে কিছুক্ষণের ভেতর এত বেশি গরম হয়ে যায় যে অস্বস্তি লাগতে থাকে।
প্রত্যেকেই সশস্ত্র এবং সেটা লুকানোর কোনো চেষ্টাই নেই। পোশাকের উপরে সবারই একটা করে হোলস্টারসহ ব্লাস্টার আছে।
কমপরেলিয়ানদের একজন সামনে এগিয়ে এসে কর্কশ সুরে বলল, মাফ করবেন, কাউন্সিলম্যান। তারপর একটানে ট্র্যাভিজের কোট খুলে ফেলে তার শরীর সার্চ করতে লাগল। ট্র্যাভিজ এতই হতভম্ব হয়েছে, কোনো কথা বলতে পারল না। দ্বিতীয় কমপরেলিয়ান পেলোরেটকেও একইভাবে পরীক্ষা করছে। তৃতীয়জন ব্লিসের দিকে এগোতেই সে আর অপেক্ষা করল না, এক ঝটকায় কোট খুলে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর তাপমাত্রার চেয়েও ঠাণ্ডা গলায় বলল, দেখতেই পারছেন, আমি নিরস্ত্র।
সবাই দেখছে। কমপরেলিয়ান কোট হাতে নিয়ে ঝাড়ল, যেন ওজন দেখেই বলতে পারবে অস্ত্র আছে কি না। তারপর পিছিয়ে গেল।
কমপরেলিয়ানদের একজন ইঙ্গিত করতেই বহির্বিশ্বের আগন্তুকরা তাকে অনুসরণ করল। বাকি দুজন রইল পেছনে। ফুটপাতে যে দু-একজন পথচারী রয়েছে তাদের কোনো বিকার নেই। সম্ভবত তারা ধরনের ঘটনা দেখে অভ্যস্ত অথবা দ্রুত উষ্ণ আরামদায়ক কোনো গন্তব্যে পৌঁছতে চাইছে।
ট্র্যাভিজ এখন দেখতে পাচ্ছে যেটাতে চড়ে কমপরেলিয়ান তিন জন উঠে এসেছিল সেটা একটা চলমান র্যাম্প। এখন তারা নামছে, ছয় জন, চারপাশে নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা প্রায় মহাকাশযানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতোই-অবশ্যই ভেতরটা গরম রাখার জন্য এবং বাতাসের ব্যবস্থার জন্য।
তারা এক সুবিশাল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করল।
৫. মহাকাশযানের জন্য লড়াই
ট্র্যাভিজের মনে হলো যেন সে কোনো হাইপারড্রামার মঞ্চে এসে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে যে গুলোতে ইম্পেরিয়াল যুগের রোমান্টিক দৃশ্য দেখানো হয়। সম্ভবত মাত্র একটাই মঞ্চ ছিল, প্রযোজকরা একটু অদলবদল করে সেটাকেই ব্যবহার করত গ্যালাক্সির অভিভাবক বিশ্বনগরী ট্র্যানটরের শৌর্য বীর্য প্রদর্শনের জন্য।
সামনে বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পথচারীরা ছুটছে ব্যতিব্যস্থ হয়ে, ছোট আকৃতির যানবাহনগুলো দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা পথে।
উপরে তাকালো ট্র্যাভিজ, নিরাপদ টানেল ধরে ছুটে চলা এয়ার ট্যাক্সি দেখার আশায়, কিন্তু সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বস্তুত প্রাথমিক বিস্ময় কেটে যেতেই সে বুঝতে পারল ট্রানটরে যেমন ছিল তার থেকে এই ভবন অনেক অনেক ছোট। এটা ছোট একটা ভবন, চতুর্দিকে হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত কোনো কমপ্লেক্সের। অংশ না।
রঙের ব্যবহারেও পার্থক্য আছে। হাইপারড্রামায় ট্রানটরকে সবসময় চিত্রিত করা হতো অত্যধিক উজ্জ্বল রঙে এবং পোশাক ছিল অবাস্তব এবং পুরোপুরি অকার্যকর। তবে এই কৃত্রিমতার উদ্দেশ্য ছিল এম্পায়ার বিশেষ করে ট্র্যানটরের অধঃপতন তুলে ধরা।
কমপরেলন ঠিক তার বিপরীত। রঙের ব্যবহার সম্বন্ধে পেলোরেট স্পেস পোর্টে যে কথাগুলো বলেছিল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এখানে।
দেয়ালগুলো ধূসর, ছাদ সাদা। পোশাকের রং কালো, ধূসর এবং সাদা। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ কালো পোশাক; তারচেয়েও কম চোখে পড়ছে সম্পূর্ণ ধূসর পোশাক; কিন্তু আপাদমস্তক সাদা পোশাক একটাও চোখে পড়ল না। ট্র্যাভিজের। ধরনটা সবসময়ই আলাদা, যেন মানুষগুলো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে সচেষ্ট।
সবার মুখ ভাবলেশহীন। মেয়েদের চুল ছোট করে ছাটা, পুরুষদের লম্বা এবং পেছনে বেণী করা! কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মনে হয় যেন কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য সবাই শ্বাস নিচ্ছে, যেন প্রত্যেকেরই নিজস্ব কাজ ছাড়া অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার সময় নেই। নারী পুরুষ সবার পোশাক একইরকম। শুধু লম্বা। চুল, বুকের উচ্চতা এবং কোমরের প্রশস্ততা দেখে তাদের আলাদা করা যাচ্ছে।
তাদেরকে একটা এলিভেটরে করে পাঁচ লেভেল নিচে নিয়ে আসা হল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। দরজার মাঝখানে অনুজ্জ্বল বর্ণে লেখা, মিটজা লিজেলর, মিন ট্রান্স। . সাথের কমপরেলিয়ান লেখাগুলো স্পর্শ করার কয়েক সেকেন্ড পরে সেগুলো জ্বলে উঠল। দরজা খুলল, ভিতরে ঢুকল তিন জন।
ঘরটা বিশাল কিন্তু প্রায় ফাঁকা। সামান্য আসবাবপত্রগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যেন এই ঘরের বাসিন্দার ক্ষমতা দেখাতে চায়।
দূরের দেয়ালের কাছে দুজন গার্ড, তাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে এইমাত্র যারা প্রবেশ করল তাদের উপর। ঘরের ঠিক কেন্দ্রের একটু পেছনে বিশাল এক টেবিল। তার পেছনে যে বসে আছে, সম্ভবত সেই মিটজা লিজেলর, বিশাল শরীর, মসৃণ মুখমণ্ডল, কালো চোখ। হাতদুটো শক্তিশালী, আঙুলগুলো লম্বা, অলসভাবে ফেলে। রেখেছে টেবিলের উপর।
মিন ট্র্যান্স (মিনিস্টার অফ ট্রান্সপোর্টেশন, ট্র্যাভিজ ধারণা করল) ধূসর পোশাক পরেছে, কিন্তু কলারের রং উজ্জ্বল সাদা। পোশাকের সাদা অংশ দুদিক থেকে আড়াআড়িভাবে পোশাকটাকে ঠিক বুকের মাঝখানের উপর দিয়ে ছেদ করেছে। পোশাক এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন মেয়েদের বুকের স্ফীত ভাব গোপন করে রাখে, অন্যদিকে ট্র্যাভিজের ধারণা সাদা ক্রস সেদিকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
মিনিস্টার নিঃসন্দেহে একজন মহিলা। বুকের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই, ছোট করে কাটা চুল দেখেই সেটা বলা যায়। কণ্ঠস্বর অবশ্যই মেয়েলি।
গুড আফটারনুন। ফাউণ্ডেশন-এর অতিথি পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের সবসময় হয় না। যেখানে একজন নামপরিচয়হীন মহিলা রয়েছে। পালাক্রমে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ট্র্যাভিজের উপর দৃষ্টি স্থির হলো, একজন আবার কাউন্সিলের সদস্য।
ফাউণ্ডেশনের একজন কাউন্সিলম্যান। ট্র্যাভিজ গুরুত্বের সাথে বলার চেষ্টা করল। কাউন্সিলম্যান গোলান ট্র্যাভিজ, বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত।
বিশেষ দায়িত্ব? ভুরু উপরে তুলে বলল মিনিস্টার।
বিশেষ দায়িত্ব, পুনরাবৃত্তি করল ট্র্যাভিজ। কেন আমাদের সাথে দাগী আসামির মতো ব্যবহার করা হচ্ছে? সশস্ত্র রক্ষীরা আমাদেরকে এখানে বন্দি করে নিয়ে এসেছে কেন? ফাউণ্ডেশন-এর কাউন্সিল, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটা শুনে খুশি হবে না।
যাই হোক, ব্লিস বলল, কণ্ঠস্বর রুক্ষ, আমরা সারাক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকব?
মিনিস্টার অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ব্লিস এর দিকে, তারপর এক হাত তুলে নির্দেশ দিল, তিনটে চেয়ার! জলদি!
কমপরেলিয়ান পোশাক পরিহিত তিন জন তিনটে চেয়ার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে ভেতরে ঢুকল। বসল ওরা।
এবার, মিনিস্টার বলল, মুখে নিষ্প্রাণ হাসি,আরামে কথা বলা যায়?
ট্র্যাভিজের সেরকম মনে হলো না। চেয়ারগুলো গদিহীন। শক্ত আর ঠাণ্ডা সমতল পৃষ্ঠ। তবে কোনো অনুযোগ না করে সে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখানে কেন?
মিনিস্টার কাগজ পত্র দেখতে লাগল। কয়েকটা ব্যাপার জানা হয়ে গেলেই আমি ব্যাখ্যা করে বলতে পারব। আপনার যানের নাম ফার স্টার। ঠিক, কাউন্সিলম্যান?
ঠিক।
চোখ তুলল মিনিস্টার। আমি আপনার পদবী ব্যবহার করছি, কাউন্সিলম্যান। ভদ্রতা হিসেবে আপনিও আমার পদবী ব্যবহার করুন।
ম্যাডাম মিনিস্টার বললে হবে? নাকি অন্য কোনো বিশেষ সম্বোধন আছে?
বিশেষ কোনো সম্বোধন নেই, স্যার, আর দ্বিগুণ শব্দ বলারও কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু ম্যাডাম বা মিনিস্টার বললেই চলবে। ..
তা হলে আপনার প্রশ্নের জবাব জি, মিনিস্টার।
জাহাজের ক্যাপ্টেন গোলান ট্র্যাভিজ, ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক এবং টার্মিনাস কাউন্সিলের সদস্য। আমি ঠিক বলেছি, কাউন্সিলম্যান?
আপনি ঠিক বলেছেন, মিনিস্টার। এবং যেহেতু আমি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক
আমার কথা শেষ হয়নি, কাউন্সিলম্যান। পরে আপত্তি জানাতে পারবেন। আপনার সঙ্গী জেনভ পেলোরেট, স্কলার, ইতিহাসবিদ এবং ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক। আপনিই ড. পেলোরেট,তাই না?
মিনিস্টারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল পেলোরেট, হ্যাঁ, এবং আমি- থেমে গেল মাঝপথে, তারপর শুধু বলল,জি, মিনিস্টার।
মিনিস্টার আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে সোজা হয়ে বসল। আমার কাছে যে রিপোর্ট এসেছে, সেখানে কোনো মহিলার কথা বলা নেই। সে-ও মহাকাশযানের সদস্য?
সে ও একজন সদস্য, মিনিস্টার। ট্র্যাভিজ বলল।
তা হলে আমি মহিলাকেই জিজ্ঞেস করছি, আপনার নাম?
আমি ব্লিস নামে পরিচিত, ঋজু ভঙ্গিতে চেয়ারে বসেছে, কথা বলছে শান্ত এবং স্পষ্ট স্বরে, যদিও আমার পুরো নাম অনেক বড়, ম্যাডাম। আপনি শুনবেন?
শুধু ব্লিস নামেই চলবে। আপনি ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক, ব্লিস?
না, ম্যাডাম।
কোন গ্রহের নাগরিক, ব্লিস?
কোনো নির্দিষ্ট গ্রহের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কোনো কাগজপত্র আমার কাছে নেই, ম্যাডাম।
কোনো কাগজ পত্র নেই, ব্লিস? সামনে রিপোর্ট দেখিয়ে সে বলল, এখানে তার উল্লেখ আছে। আপনি এই জাহাজে কেন?
আমি একজন যাত্রী, ম্যাডাম।
কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ অথবা ড. পেলোরেট জাহাজে উঠার সময় আপনার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছিল?
না, ম্যাডাম।
কোনো পরিচয়পত্র নেই সেটা আপনি তাদের জানিয়েছিলেন, ব্লিস?
না, ম্যাডাম।
কী কাজ করেন আপনি? নামের সাথে কাজের কোনো মিল আছে?
আমি শুধুই যাত্রী। আর কিছু না।
আপনি কেন এই মহিলাকে বিব্রত করছেন, মিনিস্টার, ট্র্যাভিজ বলল, কোন আইনটাকে সে অমান্য করেছে।
মিনিস্টার লিজেলর এর দৃষ্টি ব্লিস এর উপর থেকে এসে পড়ল ট্র্যাভিজের উপর, আপনি বাইরের গ্রহের নাগরিক, কাউন্সিলম্যান, আমাদের আইনকানুন সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। সব জায়গায় আপনার নিজের আইন চলতে পারে না; গ্যালাকটিক আইনের সাধারণ একটা নিয়ম এটা।
বুঝতে পারলাম, মিনিস্টার, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। কোন আইন সে অমান্য করেছে।
গ্যালাক্সির সাধারণ নিয়ম হলো, কাউন্সিলম্যান, অন্য গ্রহের নাগরিক তার নিজস্ব ডমিনিয়নের বাইরে কোনো গ্রহ ভ্রমণ করতে গেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সাথে রাখবে। পর্যটনকে আকৃষ্ট করার জন্য অনেক গ্রহই শিথিল নিয়ম পালন করে। আমরা খুব কঠোরভাবে আইন মেনে চলি। সে বিশ্বহীন এক উদ্বাস্তু। এখানে এসে আমাদের আইন ভঙ্গ করেছে।
আসলে মহাকাশ যানের নিয়ন্ত্রণ ছিল আমার হাতে। এখানে না এসে তার অন্য কোনো উপায় ছিল না। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না যে তাকে মহাকাশে রেখে আশাই ঠিক হতো।
শুধু বলব যে আপনিও আমাদের আইন ভঙ্গ করেছেন, কাউন্সিলম্যান।
না, আপনার কথা ঠিক না, মিনিস্টার। আমি বাইরের কেউ না, ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক। আর কমপরেলন এবং তার অধীনস্ত বিশ্বগুলো হচ্ছে ফাউন্ডেশন এর এসোসিয়েটেড পাওয়ার। ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক হিসেবে এখানে আমি স্বাধীনভাবে ভ্রমণ করতে পারি।
অবশ্যই, কাউন্সিলম্যান, যতক্ষণ আপনার দাবির স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারবেন।
আমি দেখিয়েছি, মিনিস্টার।
এমনকি, তারপরেও বিশ্বহীন কাউকে এখানে এনে আমাদের আইন অমান্য করতে পারেন না আপনি।
ইতস্তত করছে ট্র্যাভিজ। অফিসার কিণ্ডে তার কথা রাখেনি, কাজেই তাকে রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সে বলল, ইমিগ্রেশন স্টেশনে কেউ আমাদের থামায়নি, তাই ধরে নিয়েছিলাম এই মহিলাকে সঙ্গে আনলে কোনো সমস্যা হবে না।
সত্যি কথা আপনাদের থামানো হয়নি, কাউন্সিলম্যান। সত্যি কথা এই মহিলার কথা রিপোর্ট করা হয়নি। আমার ধারণা এন্ট্রি স্টেশনের অফিসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঝামেলা না করে আপনার মহাকাশযান সারফেসে পাঠানো বেশি জরুরি। অবশ্যই ওরা যেটা করেছে তা নিয়মবহির্ভূত এবং সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কোনো সন্দেহ নেই যে সে এই সিদ্ধান্তের পিছনে জোরালো কারণ দেখাতে পারবে। আমাদের আইন কড়া হলেও অন্যায্য কিছু করি না।
তা হলে এই মুহূর্তে আইনি মারপ্যাঁচ বন্ধ করার অনুরোধ করছি, মিনিস্টার। পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে নিয়ে এসেছি এই রিপোর্ট যদি নাই পান, তা হলে আপনার জানার কোনো উপায় নেই যে আমরা কোনো আইন অমান্য করেছি কিনা। অথচ এখানে ল্যাণ্ড করার সাথে সাথে আপনি আমাদের গ্রেপ্তার করার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। কেন মিনিস্টার, আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি?
মিনিস্টার হাসল, আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি, কাউন্সিলম্যন। আপনার সঙ্গিনীর সাথে আপনাদের গ্রেপ্তার করার কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা কাজ করছি। ফাউণ্ডেশন-এর পক্ষে, একটু আগে আপনিই বলেছেন আমরা ফাউণ্ডেশন-এর। এসোসিয়েটেড পাওয়ার।
কিন্তু সেটা অসম্ভব, মিনিস্টার। বিদঘুঁটে। উদ্ভট।
আমার জানার আগ্রহ হচ্ছে কেন আপনি বিদঘুঁটে, উদ্ভট, অসম্ভব মনে করছেন।
কারণ আমি ফাউণ্ডেশন-এর পদস্থ কর্মকর্তা, বিশেষ দায়িত্ব পালন করছি। বিশ্বাস করা যায় না তারা আমাকে গ্রেপ্তার করতে চায় বা সেই ক্ষমতা তাদের আছে, কারণ আমি কাউন্সিলের সদস্য।
আহ, আপনি পদবী এড়িয়ে গেছেন, তবে আপনার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ক্ষমা করা যায়। যাই হোক আপনাকে গ্রেপ্তার করার কথা সরাসরি কেউ বলেনি। গ্রেপ্তার করেছি শুধুমাত্র যে কাজ করতে বলা হয়েছে সেটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য।
সেটা কি, মিনিস্টার? ট্র্যাভিজ বলল, নিরুদ্বিগ্ন আরবিশ্বাসী মহিলার কাছ থেকে নিজের অস্থিরতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
সেটা হচ্ছে, কাউন্সিলম্যান, মহাকাশযান আপনার কাছ থেকে নিয়ে ফাউণ্ডেশনকে ফেরত দিতে হবে।
কী?
আবারও কোনো সম্বোধন নেই, এটা আপনার অভদ্রতা। এই জাহাজ আপনার না। আপনি এটা তৈরি করেছেন বা কিনেছেন?
অবশ্যই না, মিনিস্টার। ফাউণ্ডেশন আমাকে এটা দিয়েছে।
তা হলে এটা ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই ফাউণ্ডেশন-এর আছে, কাউন্সিলম্যন। এই মহাকাশযান সম্ভবত অত্যন্ত দামি।
ট্র্যাভিজ কোনো জবাব দিল না।
মিনিস্টার বলল, এটা গ্র্যাভিটিক শিপ, কাউন্সিলম্যান। অল্প কয়েকটা তৈরি করা হয়েছে। আপনাকে একটা দিয়ে ওরা নিশ্চয়ই পস্তাচ্ছে এখন। আপনি কমদামি আরেকটা মহাকাশযান চেয়ে নিতে পারবেন, সেটা দিয়েও কাজ চলবে। কিন্তু যে মহাকাশ যান নিয়ে এসেছেন সেটা ফেরত দিতেই হবে।
আমি ফেরত দেব না, মিনিস্টার। বিশ্বাস করি না ফাউণ্ডেশন আপনাকে এই অনুরোধ করেছে।
আমি একা না, কাউন্সিলম্যান। বিশেষ করে শুধু কমপরেলনকেই এই অনুরোধ করা হয়নি। আমার বিশ্বাস ফাউণ্ডেশন প্রভাব বলয়ের প্রতিটি গ্রহকেই একই অনুরোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ ওরা জানে না আপনি কোথায়,তাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এটাও পরিষ্কার যে ফাউণ্ডেশন-এর প্রতিনিধি হিসেবে কমপরেলনের সাথে আপনার বিশেষ কোনো কাজ নেই–সেক্ষেত্রে ওরা জানত আপনি কোথায় আছেন। সংক্ষেপে, আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছেন, কাউন্সিলম্যান।
ফাউণ্ডেশনের কাছ থেকে আপনি যে অনুরোধ পেয়েছেন, সেটা আমি দেখতে চাই, মিনিস্টার, ট্র্যাভিজ আমতা আমতা করে বলল। সেটা দেখার অধিকার আমার আছে নিশ্চয়ই।
অবশ্যই, যদি আইনের সাহায্য নিতে হয়। আইনি কাঠামোকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেই, কাউন্সিলম্যন, নিশ্চিত থাকতে পারেন নিজের কথা বলার অধিকার। আপনি পাবেন। তবে ভালো হবে যদি আমরা বেশি হৈ চৈ না করে, আইনগত ঝামেলায় না গিয়ে সমঝোতায় আসতে পারি।
ট্র্যাভিজ আবারও নিশ্চুপ।
মিনিস্টার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার কথা শুরু করল,
শুনুন, কাউন্সিলম্যান, সমঝোতা বা আইনের আশ্রয় যেভাবেই হোক মহাকাশ যান আমরা রাখবই। পরিচয়পত্র ছাড়া যাত্রী নিয়ে আসার শাস্তি নির্ভর করবে কোন পথ আমরা বেছে নেব। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলে ব্যাপারটা আপনার বিপক্ষে যাবে, এবং কথা দিচ্ছি শাস্তির মাত্রা হবে খুব কঠিন। বরং একটা চুক্তি করি, এবং আপনার যাত্রীকে কোনো কমার্শিয়াল ফ্লাইটে যেখানে যেতে চায় সেখানেই পাঠানো হবে। ইচ্ছে হলে আপনারাও তার সাথে যেতে পারবেন। অথবা যদি ফাউণ্ডেশন অনুরোধ করে তা হলে আমরা ভালো মহাকাশযান আপনাকে দেব, পরে ফাউণ্ডেশন এর কাছ থেকে সমমানের আরেকটা চেয়ে নেব। আর যদি আপনি ফাউণ্ডেশন নিয়ন্ত্রিত টেরিটোরিতে ফিরতে না চান তা হলে আমরা আপনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় এমনকি কমপরেলনের নাগরিকত্বও দিতে পারি। বুঝতেই পারছেন, সমঝোতা করলে অনেক দিক দিয়ে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আইনের আশ্রয় নিলে কিছুই পাবেন না।
আপনি বেশ আগ্রহী, মিনিস্টার। এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা আপনি রাখতে পারবেন না। ফাউণ্ডেশন আমাকে ফিরিয়ে দিতে বললে কোনো অবস্থাতেই আপনি আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবেন না।
কাউন্সিলম্যান, রাখতে পারব না এমন কোনো প্রতিশ্রুতি আমি দিই না। ফাউণ্ডেশন-এর প্রধান এবং একমাত্র অনুরোধ হচ্ছে মহাকাশ যানের জন্য। আপনাদের ব্যাপারে তারা কিছুই বলেনি।
ট্র্যাভিজ দ্রুত তাকালো ব্লিস এর দিকে, তারপর বলল, মিনিস্টার, ড. পেলোরেট এবং মিস ব্লিস-এর সাথে কিছুক্ষণ আলোচনা করা যাবে?
অবশ্যই, কাউন্সিলম্যান। আপনাকে পনের মিনিট সময় দেওয়া হলো।
একা কথা বলতে চাই, মিনিস্টার।
আপনাদের একটা আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে, পনের মিনিট পর আবার ফিরিয়ে আনা হবে এখানে, কাউন্সিলম্যান। কেউ আপনাদের আলোচনা শোনার চেষ্টা করবে না বা বাধা দেবে না। আমি কথা দিচ্ছি। যাই হোক আপনাদের কড়া পাহারা দেওয়া হবে, বোকার মতো পালানোর চেষ্টা করবেন না।
বুঝেছি, মিনিস্টার।
এবং যখন ফিরে আসবেন, আশা করি মহাকাশযান ফিরিয়ে দিতে আপনি স্বেচ্ছায় রাজি হবেন। অন্যথায় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, এবং আপনাদের কারো জন্যই সুখকর হবে না, কাউন্সিলম্যান। বুঝতে পেরেছেন?
বুঝতে পেরেছি, মিনিস্টার। ট্র্যাভিজ বলল, প্রচণ্ড রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না।
.
ছোট কক্ষ, কিন্তু যথেষ্ট আলোকিত, দুটো চেয়ার এবং একটা ছোট বিছানা রয়েছে, একটু কান পাতলেই ভ্যান্টিলেটিং ফ্যানের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাবে।
মিনিস্টার এর বিশাল, শূন্য অফিসের তুলনায় এটা অনেক বেশি আরামদায়ক।
লম্বা গম্ভীরদর্শন গার্ড তাদেরকে নিয়ে এসেছে, এক মুহূর্তের জন্যও ব্লাস্টার এর উপর থেকে হাত সরায়নি সে। কক্ষে ঢোকার পর কর্কশ স্বরে বলল,পনের মিনিট। তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
আশা করি আমাদের কথা কেউ শুনবে না। ট্র্যাভিজ বলল।
পেলোরেট বলল, মিনিস্টার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, গোলান।
তুমি নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার কর, জেনভ। তার তথাকথিত প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হলে কোনো দ্বিধা না করে সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে।
কোনো সমস্যা না, বলল ব্লিস। এই জায়গার চারপাশে আমি শিল্ড তৈরি করতে পারব।
তোমার কাছে শিল্ডিং ডিভাইস আছে? জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।
হাসির সাথে ব্লিসের দুধ সাদা দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল, গায়ার মাইণ্ড একটা শিল্ডিং ডিভাইস, পেল। শক্তিশালী মাইণ্ড।
আমাদের এই অবস্থায় পড়তে হয়েছে, ট্র্যাভিজ বলল, রাগত স্বরে,–শক্তিশালী মাইণ্ডের সীমাবদ্ধতার কারণে।
কী বলতে চাও?–বলল ব্লিস।
ত্রিমুখী বিরোধ যখন শেষ হয়, তুমি মেয়র এবং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন-এর, জেনডিবল দুজনের মাইণ্ড থেকে আমার কথা মুছে দাও।
এ ছাড়া উপায় ছিল না। তুমি আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
হ্যাঁ, গোলান ট্র্যাভিজ, দ্য এভার রাইট। কিন্তু তুমি তাদের মন থেকে মহাকাশ যানের কথা মুছে দাওনি? মেয়র ব্র্যান্নো আমাকে চান না, চান মহাকাশযান। এটার কথা তিনি ভুলতে পারেন নি।
ব্লিস ভুরু কুঁচকাল।
চিন্তা করে দেখ। গায়া স্বাভাবিকভাবে ধরে নিয়েছে আমি আর মহাকাশযান এক ইউনিট। যদি ব্র্যান্নো আমার কথা না ভাবে, মহাকাশযানের কথাও ভাববে না। সমস্যা হচ্ছে গায়া ইন্ডিভিজুয়ালিটি বোঝে না। সে মনে করেছে আমি আর মহাকাশযান সিঙ্গেল অর্গানিজম, এবং ভুল করেছে।
ব্লিস বলল, নরম গলায়, এটা সম্ভব হতে পারে।
বেশ, ট্র্যাভিজের গলা কঠিন, এই ভুল সংশোধনের দায়িত্ব তোমার। গ্র্যাভিটিক শিপ এবং কম্পিউটার আমার চাই। অন্য কিছু হলে চলবে না। কাজেই, ব্লিস, এগুলো যেন আমার হাতে থাকে তার ব্যবস্থা কর। তুমি মাইণ্ড কন্ট্রোল করতে পারো।
হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ, কিন্তু আমরা হালকাভাবে তার প্রয়োগ করি না। ত্রিমুখী বিরোধের সময় আমরা এটা প্রয়োগ করেছিলাম, কিন্তু জানো,তার জন্য কত সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল? কত হিসাব-নিকাশ এবং বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়েছিল? বহু বছর। ইচ্ছে হলেই আমি কোনো মহিলার মাইণ্ডে প্রবেশ করে অন্য কারো ইচ্ছামতো তাকে পরিবর্তন করতে পারি না।
এখন এমন একটা সময়–
জোর গলায় বাধা দিল ব্লিস। এভাবে শুরু করলে, কোথায় গিয়ে শেষ হবে? এন্ট্রি স্টেশনের অফিসারের মাইণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে আমরা দ্রুত বের হয়ে আসতে পারতাম।
কেন করোনি?
কারণ আমরা জানি না এর পরিণতি কী হবে। হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। মিনিস্টার এর মাইণ্ড পরিবর্তন করলে মানুষের সাথে তার আচরণের উপর প্রভাব পড়বে। যেহেতু সে তার সরকারের উঁচু পদে রয়েছে, আন্তমহাজাগতিক সম্পর্কের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। নিশ্চিত না হয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।
তা হলে তুমি আমাদের সাথে এসেছ কেন?
কারণ যে-কোনো মুহূর্তে তোমার জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। যে-কোনো মূল্যে তোমাকে আমার রক্ষা করতে হবে, পেল বা আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও। এন্ট্রি স্টেশনে তোমার কোনো বিপদ ছিল না। এখনও জীবনের উপর কোনো হামলা হচ্ছে না। তোমাকে নিজের চেষ্টায় এই সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে, করতে থাক যতক্ষণ না গায়া সঠিক পদক্ষেপ ঠিক করতে পারছে।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ট্র্যাভিজ। তারপর বলল, সেক্ষেত্রে, অন্য চেষ্টা করতেই হবে। হয়তো কাজ হবে না।
দরজা খুলে গেল। বিকট শব্দ করে বাড়ি খেল দেয়ালের সাথে । গার্ড কর্কশ সুরে বলল, বেরিয়ে আসুন।
বেরনোর সময় পেলোলারেট ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কী করবে, গোলান?
ট্র্যাভিজ একই রকম ফিসফিস করে জবাব দিল, জানি না। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হবে।
.
ওরা ঢুকতেই মিনিস্টার মুখ তুলে হাসল। আমার বিশ্বাস, কাউন্সিলম্যান, যে, আপনি বলতে এসেছেন, মহাকাশযান আপনি ফিরিয়ে দেবেন।
আমি এসেছি, মিনিস্টার, শান্ত সুরে বলল ট্র্যাভিজ, শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে।
আলোচনা করার মতো কোনো শর্ত নেই,কাউন্সিলম্যান। চাইলে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হবে, তারচেয়েও দ্রুত সেটা শেষ হবে। নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি আপনি দোষী সাব্যস্ত হবেনই। তারপর স্বাভাবিকভাবেই আপনার জাহাজ আমাদের হাতে চলে আসবে,আর আপনারা তিন জন কঠিন শাস্তি পাবেন। একদিন দেরি করিয়ে দেওয়ার জন্য শুধু শুধু কেন শাস্তি ভোগ করবেন।
যাই হোক, আলোচনা করতেই হবে, মিনিস্টার, কারণ বিচার যত দ্রুত শেষ হোক, আমাকে ছাড়া জোর করে মহাকাশযানের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে, সেই সাথে স্পেসপোর্ট এবং তার আশেপাশের সব বসতি ধ্বংস হয়ে যাবে। হুমকি দেওয়া বা বল প্রয়োগ আপনাদের আইনে নেই, নিজেই যদি আইন ভঙ্গ করেন, আমাদের নির্যাতন করেন বা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি করে রাখেন, ফাউণ্ডেশনে খবর পৌঁছবে। তারা এতে খুশি হবে না। মহাকাশযান ফিরে পাওয়ার জন্য তাদের যতই আগ্রহ থাকুক নিজের নাগরিকের কোনো ক্ষতি তারা মেনে নেবে না।–শর্ত নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি?
বোকার মতো কথা, ভুরু কুচকে বলল মিনিস্টার। প্রয়োজন হলে আমরা ফাউণ্ডেশনকে ডেকে আনতে পারি। নিজেদের জাহাজ কীভাবে খুলতে হয় তারা জানে।
আপনি আমার পদবী ব্যবহার করেন নি, মিনিস্টার, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ক্ষমা করা যায়। ভালোভাবেই জানেন, ফাউণ্ডেশনকে আপনি ডেকে আনবেন না, কারণ মহাকাশযান তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আপনার নেই।
মিনিস্টারের মুখের হাসি মুছে গেল। এটা কী ধরনের কথা হলো, কাউন্সিলম্যান।
এমন ধরনের কথা, মিনিস্টার, যা হয়তো অন্য কারো শোনা উচিত না। আমার সঙ্গীরা কোনো হোটেলে চলে যাক, ওদের বিশ্রামের প্রয়োজন। গার্ডদের দরজার । বাইরে যেতে বলুন। একটা ব্লাস্টার রাখতে পারেন। আপনি তো আর ছোট্ট খুকি না, হাতে ব্লাস্টার থাকলে আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি, নিরস্ত্র।
ডেস্কের ওপাশ থেকে ট্র্যাভিজের দিকে ঝুঁকে মিনিস্টার বলল, আপনাকে আমার ভয় পাবার কিছু নেই।
পিছনে না তাকিয়ে ইশারা করতেই একজন গার্ড সামনে এসে মেঝেতে ঠকাস করে গোড়ালি ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মিনিস্টার বলল, এই দুজনকে ৫ নাম্বার স্যুইটে নিয়ে গিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করবে আর ভালোভাবে পাহারা দেবে। ওদের কোনো সমস্যা হলে বা পালিয়ে গেলে দায়ী হবে তুমি।
মিনিস্টার উঠে দাঁড়াতেই সংকুচিত হয়ে গেল ট্র্যাভিজ। মহিলা যথেষ্ট লম্বা, ট্রাভিজের চেয়ে একটু বেশিই হবে। চিকন কোমর। কাঠামোর মাঝে একটা বিশালত্ব আছে। সাবলীল চলাফেরা। তিক্ত মনে ভাবল ট্র্যাভিজ, যদি হাতাহাতি লড়াই হয়, তা হলে তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারবে এই মহিলা।
চলুন, কাউন্সিলম্যান। যদি বোকার মতো কথা বলতেই থাকেন, যত কম লোকে শুনবে, আপনার জন্য ততই মঙ্গল।
বলেই হাঁটতে লাগল দ্রুত পায়ে, পিছু নিল ট্র্যাভিজ। নিজেকে তার অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে, কোনো মেয়ের সামনে এমন অনুভূতি আগে হয়নি।
এলিভেটরে চড়ল ওরা, দরজা বন্ধ করে মি নস্টার বলল, আমরা এখন একা, এবং যদি আপনি ভেবে থাকেন যে আমার উপর জোর খাটাতে পারবেন, তা হলে ভুলে যান। তার সুরেলা কণ্ঠস্বর আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পরিষ্কার আমুদে গলা। আপনি বেশ শক্তিশালী, কিন্তু প্রয়োজন হলেই আপনার একটা হাত বা শিরদাঁড়া ভেঙে দিতে পারব। অস্ত্র ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না।
ট্র্যাভিজ চিবুকে হাত ঘষতে ঘষতে মিনিস্টারের আপাদমস্তক দৃষ্টি বোলালো। মিনিস্টার, নিজের সমকক্ষ কারো সাথে লড়াই করতে আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার সাথে লড়াই না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি জানি কখন পিছিয়ে আসতে হয়।
চমৎকার। সন্তুষ্টির সুরে বলল মিনিস্টার।
আমরা যাচ্ছি কোথায়, মিনিস্টার?।
নিচে! অনেক নিচে। ভয়ের কিছু নেই। হাইপার ড্রামাগুলোতে এভাবেই নায়ককে পাতালঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কমপরেলনে কোনো পাতালঘর নেই-অল্প কয়েকটা জেলখানা আছে। যাচ্ছি আমার ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে; পাতালঘরের মতো রোমান্টিক না হলেও বেশ আরামদায়ক।
এলিভেটর থেকে বেরিয়ে ট্র্যাভিজ অনুমান করল প্রায় পঞ্চাশ মিটার নিচে নেমে এসেছে।
চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ট্র্যাভিজ।
আমার বাসস্থান আপনার পছন্দ হয়নি, কাউন্সিলম্যান? জিজ্ঞেস করল মিনিস্টার।
আমার পছন্দ না করার কোনো কারণ নেই, মিনিস্টার। শুধু অবাক হয়েছি। এরকম আশা করিনি। এখানে আসার পর যতটুকু দেখেছি বা শুনেছি তাতে ধারণা হয়েছে আপনারা যথেষ্ট মিতব্যয়ী-অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা এড়িয়ে চলেন।
ঠিক, কাউন্সিলম্যান। আমাদের সম্পদ সীমিত। আবহাওয়ার মতো জীবন যাত্রাও বেশ কঠিন।
কিন্তু, এটা, মিনিস্টার, ট্র্যাভিজ আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে দুহাত ছড়িয়ে বলল, কমপরেলনে আসার পর এই প্রথম রঙের ব্যবহার দেখছে সে। সোফাগুলো কুশন দিয়ে ঢাকা। দেয়াল থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে উজ্জ্বল নরম আলো। মেঝেতে নরম কার্পেট, হাঁটলে কোনো শব্দ হয় না। এটা অবশ্যই বিলাসিতা।
ঠিকই বলেছেন, কাউন্সিলম্যান, আমরা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা, লোকদেখানো বিলাসিতা, ব্যয়বহুল বিলাসিতা এড়িয়ে চলি। কিন্তু এই ব্যক্তিগত বিলাসিতার প্রয়োজন আছে। আমার দায়িত্ব অনেক, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এমন একটা জায়গা দরকার যেখানে সব ভুলে থাকা যায়।
সব কমপরেলিয়ানরাই এভাবে গোপন বিলাসী জীবনযাপন করে?
নির্ভর করে কাজের পরিমাণ এবং দায়িত্বের উপর। অল্প কয়েকজনেরই বিলাসী জীবনযাপনের ক্ষমতা আছে, অধিকার আছে বা করতে চায়।
কিন্তু মিনিস্টার, আপনার ক্ষমতা আছে, অধিকার আছে এবং আপনি করতে চান?
পদাধিকারের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি কিছু সুবিধাও আছে। এবার বসুন কাউন্সিলম্যান, তারপর আপনার পাগলামির কথা শোনা যাবে। নিজে একটা সোফায় বসে মুখোমুখি আরেকটা সোফায় ট্র্যাভিজকে বসতে বলল।
বসল ট্র্যাভিজ। পাগলামি, মিনিস্টার?
একটা বালিশের উপর ডান হাত দিয়ে হেলান দিয়ে মিনিস্টার আয়েশ করে বসেছে। এখানে কথাবলার সময় ফর্মালিটি করার প্রয়োজন নেই। আপনি আমাকে লিজেলর ডাকতে পারেন। আমি ট্র্যাভিজ ডাকব।
পায়ের উপর পা তুলে হেলান দিয়ে বসল ট্র্যাভিজ। লিজেলর,আপনি আমার জন্য দুটো পথ খোলা রেখেছেন, হয় সমঝোতায় আসা অথবা বিচারের মুখোমুখি হওয়া। দুই ক্ষেত্রেই মহাকাশযান আপনার হাতে তুলে দিতে হবে। তারপরেও আপনি মরিয়া হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে সমঝোতা করাই আমার জন্য ভালো হবে। বিনিময়ে আপনি অন্য একটা মহাকাশ যান দিতে চেয়েছেন, যেন আমি ও আমার বন্ধুরা পছন্দ মতো জায়গায় চলে যেতে পারি। এমনকি চাইলে কমপরেলনের নাগরিকত্বও পাব। অথচ বন্ধুদের সাথে আলোচনা করার জন্য মাত্র পনের মিনিট সময় দিলেন। এমনকি নিজের ব্যক্তিগত কোয়ার্টারেও নিয়ে এলেন, এবং সম্ভবত আমার বন্ধুরাও এখন আরামদায়ক কোয়ার্টারে বিশ্রাম করছে। সংক্ষেপে আপনি আমাকে ঘুষ দিচ্ছেন, লিজেলর, যেন আপসে মহাকাশযান আপনাকে দিয়ে দেই।
কেন, ট্র্যাভিজ,আমার মানবিক আচরণের কোনো মূল্যই আপনি দেবেন না?
না।
একবারও ভাববেন না যে বিচারের মুখোমুখি না হয়ে সমঝোতা করলে অনেক ঝামেলা কমবে?
না! আমি অন্য একটা পরামর্শ দেব।
যেমন।
বিচার কার্যের একটা সমস্যা হচ্ছে যে এটা গোপন থাকে না। এই গ্রহের কঠোর আইনকানুনের কথা আপনি অনেকবার বলেছেন। আমার ধারণা, সবটুকু রেকর্ড না করে আপনি কোনো বিচার শেষ করতে পারবেন না। সেরকম হলে ফাউণ্ডেশন জানবে। বিচার শেষে মহাকাশযান ফিরিয়ে দিতে হবে তাদেরকে।
অবশ্যই, ভাবলেশহীন গলায় বলল লিজেলর। তারাই তো এটার মালিক।
কিন্তু, গোপনে চুক্তি করলে কোনো রেকর্ড রাখতে হবে না। মহাকাশযান আপনারা রেখে দিতে পারবেন, যেহেতু ফাউণ্ডেশন কিছুই জানবে না, তারা জানবেও না যে আমরা এই গ্রহে এসেছিলাম–কমরেলন মহাকাশযান নিজের কাছে রাখতে পারবে। আমি নিশ্চিত আপনি এটাই করতে চান।
কেন সেটা করব? এখনও সে ভাবলেশহীন। আমরা ফাউণ্ডেশন কনফেডারেশনের অংশ, তাই না?
পুরোপুরি না। আপনাদের অবস্থান হচ্ছে অ্যাসোসিয়েটেড পাওয়ার হিসেবে।
তা হলেও অ্যাসোসিয়েটেড পাওয়ার হিসেবে আমরা ফাউণ্ডেশনকে সহযোগিতা করতে পারি।
করবেন কী? এমনকি হতে পারে না যে কমপরেলন স্বপ্ন দেখছে পুরোপুরি স্বাধীনতার; এমনকি নেতৃত্বেরও? আপনাদের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সব গ্রহই এমন দাবি করলেও আপনারা আসলেই প্রাচীন বিশ্ব।
মিনিস্টার পাতলা এক টুকরো ঠাণ্ডা হাসি দিয়ে বলল, প্রাচীনতম।
একটা সময় ছিল যখন কমপরেলন এই সিস্টেমের অন্তর্গত তুলনামূলকভাবে ছোট অনেকগুলো বিশ্ব শাসন করত। আবার হয়তো সেই হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
আপনার মনে হয় এমন অসম্ভব স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি? অসম্ভব হলেও, স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। টার্মিনাস গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে অবস্থিত । অন্যান্য গ্রহের তুলনায় তার ইতিহাস একেবারে নতুন, মাত্র পাঁচ শতাব্দী পুরোনো। অথচ গ্যালাক্সি শাসন করছে। তা হলে কমপরেলন পারবে না কেন? ট্র্যাভিজ হাসছে।
মিনিস্টার গম্ভীর, আমাদের বোঝানো হয়েছে যে টার্মিনাস এই অবস্থানে পৌঁছেছে হ্যাঁরী সেলডনের পরিকল্পনা অনুযায়ী।
নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য এটা এক ধরনের মানসিক অবলম্বন, মানুষ যতদিন বিশ্বাস করবে ততদিনই এর কার্যকারিতা থাকবে। হয়তো কমপরেলন সরকার এগুলো বিশ্বাস করে না। তা ছাড়া ফাউণ্ডেশন কারিগরি দিকে অনেক বেশি উন্নত-গ্র্যাভিটিক শিপ যার অনন্য উদাহরণ। একারণেই সে গ্যালাক্সিতে ক্ষমতা বিস্তার করতে পেরেছে। যদি কমপরেলন একটা গ্র্যাভিটিক শিপ হাতে পায়, তা হলে তারা অনেক কিছু শিখতে পারবে, এবং নিঃসন্দেহে কারিগরি ক্ষেত্রে একলাফে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। আমার অবশ্য মনে হয় না যে এই দিয়েই তারা ফাউণ্ডেশন-এর নেতৃত্বকে পরাজিত করতে পারবে। কিন্তু কমপরেলন সরকার হয়তো সেরকমই মনে করে।
আপনার কথার কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে না। কোন সরকার ফাউণ্ডেশন-এর তোপের মুখে পড়তে চায়। তাদের ক্রোধ কতখানি ভয়ংকর তার প্রমাণ তো ইতিহাসেই রয়েছে।
ফাউণ্ডেশন তখনই রাগবে যদি সে জানে যে রাগার মতো কিছু ঘটছে।
সেক্ষেত্রে, ট্র্যাভিজ-ধরা যাক আপনার কথাগুলো পাগলামি না, যুক্তি আছে, তা হলে কি উচিত হবে না দর কষাকষি করে মহাকাশ যান আমাদেরকে দিয়ে দেওয়া? আপনার কথা অনুযায়ী নীরবে এটা পাওয়ার জন্য আমরা সবকিছু দিতে প্রস্তুত।
আপনি বিশ্বাস করেন আমি ফাউণ্ডেশনকে রিপোর্ট করব না?
অবশ্যই। সেক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার কথাও বলতে হয় যে।
আমি বলতে পারি যে আমাকে জবরদস্তি করে বাধ্য করা হয়েছে।
হ্যাঁ। তবে মেয়র সেটা বিশ্বাস করবে না।–সমঝোতা করে ফেলুন।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। না, ম্যাডাম লিজেলর। মহাকাশযান আমার এবং আমারই থাকবে। আগেই তো বলেছি জোর করে দরজা খোলার চেষ্টা করলে প্রচণ্ড শক্তিতে বিস্ফোরিত হবে। দয়া করে আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমি ভাঁওতা দিচ্ছি না।
আপনি খুলতে পারেন,কম্পিউটারকে নতুন করে নির্দেশ দিতে পারেন।
নিঃসন্দেহে, কিন্তু আমি তা করব না।
লিজেলর লম্বা শ্বাস নিল। আমরা আপনার মত পাল্টানোর ব্যবস্থা করতে পারি–আপনাকে হয়তো কিছু করব না, কিন্তু ড. পেলোরেট বা ঐ মেয়েটার কিছু করতে কোনো সমস্যা নেই।
নির্যাতন, মিনিস্টার? এটাই আপনাদের আইন?
না,কাউন্সিলম্যন। নিষ্ঠুরতার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সাইকিক পোব বলে একটা কথা আছে।
এই প্রথম ভয়ের শীতল স্রোত ট্র্যাভিজের শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। সেটাও আপনি করতে পারবেন না। চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সাইকিক প্রোবের ব্যবহার বহু আগেই গ্যালাক্সিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু আমরা যদি মড়িয়া হয়ে–
আমি ঝুঁকি নেব।ট্র্যাভিজ বলল। কারণ মহাকাশ যান নিজের কাছে রাখার জন্য আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এবং সাইকিক প্রোব আমার মত পরিবর্তনে বাধ্য করার আগেই আমার মাইণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। (কথাটা মিথ্যে, ভয় আরও বেড়ে গেল।) এমনকি আপনি যদি খুব দক্ষভাবে সাইকিক প্রোব ব্যবহার করে মহাকাশযান নিরাপদে আপনার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাজি করান, তাতেও লাভ হবে না। কারণ এর কম্পিউটার অনেক বেশি উন্নত। কীভাবে জানি না–তবে যেভাবেই হোক এটা তৈরি করা হয়েছে শুধু আমার সাথে কাজ করার জন্য। যাকে বলে ওয়ান-ম্যান-কম্পিউটার।
ধরুন মহাকাশযান আপনার কাছেই থাকল, আপনিই এটা চালাবেন, তখন আমাদের জন্য চালাবেন–কমপরেলনের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে? প্রচুর বেতন। সীমাহীন বিলাসিতা। আপনার বন্ধুদেরও অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।
না।
তা হলে আপনার পরামর্শ কি? চলে যেতে দেব। জ্বি না, যেতে দেওয়ার আগে ফাউণ্ডেশনকে জানিয়ে দেব আপনি এখানে এসেছিলেন। তারপর তারাই সামলাবে।
মহাকাশ হারানোর ঝুঁকি নেবেন?
আমরা না পেলে ফাউণ্ডেশনই পাক। অন্য কোনো বর্বর গ্রহের হাতে না। পড়লেই হলো।
মীমাংসার জন্য আমার নিজের একটা পরামর্শ আছে।
বেশ বলুন শুনি।
সতর্কতার সাথে শব্দ বাছাই করে বলতে লাগল ট্র্যাভিজ। আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশন নিয়ে বেরিয়েছি। শুরু হয়েছিল ফাউণ্ডেশন-এর সহায়তায়, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা আর পাওয়া যাবে না, অথচ গুরুত্বপূর্ণ মিশন। আমি এখন কমপরেলনের সহায়তা চাই, সফলভাবে মিশন শেষ হলে কমপরেলনও লাভবান হবে।
লিজেলর এর মুখে সন্দেহের ছায়া, এবং মহাকাশযান ফাউণ্ডেশন-এর কাছে ফেরত দেবেন না?
ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা কখনোই ছিল না। থাকলে ওরা আমাকে খুঁজে বেড়াতো না পাগলের মতো।
এই কথায় প্রমাণ হয় না যে মহাকাশযান আমাদের দেবেন।
মিশন শেষ হলে এই মহাকাশযান হয়তো আমার আর কোনো প্রয়োজন হবে । তখন কমপরেলন সেটা পেলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আপনি বলছেন হয়তো । তার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই।
অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দিলে কি মূল্য থাকবে? আসলে আমি সতর্ক হিসাব-নিকাশ করে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যেন বুঝতে পারেন আমি আন্তরিক।
চালাক, লিজেলর মাথা নেড়ে বলল। আমার পছন্দ হয়েছে। বেশ, বলুন কী আপনার মিশন এবং কমপরেলন কীভাবে লাভবান হবে?
না, এবার আপনার পালা। যদি প্রমাণ করতে পারি যে আমার মিশন কমপরেলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হলে আমাকে সাহায্য করবেন?
মিনিস্টার লিজেলর উঠে দাঁড়াল। আমি ক্ষুধার্ত, কাউন্সিলম্যান। খালি পেটে আর কোনো কথা নয়। চলুন কিছু খেয়ে নেওয়া যাক, তারপর আলোচনা শেষ করা যাবে।
ট্র্যাভিজের মনে হলো মিনিস্টারের চেহারায় কেমন যেন আগ্রহী দৃষ্টি ফুটে উঠেছে, তার অস্বস্তি শুরু হলো।
.
খাবার সুস্বাদু হলেও পুষ্টিকর ঝাঁজালো সস মেশানো মাংস, সেই সাথে কটু স্বাদযুক্ত পাতাজাতীয় সবজি ট্র্যাভিজ ঠিক চিনতে পারল না। এ ছাড়া রয়েছে আপেলের মতো দেখতে এক প্রকার ফল, খুব একটা বিস্বাদ না। তবে গাঢ় রঙের যে গরম পানীয় দেওয়া হলো সেটা ট্র্যাভিজ মুখেই দিতে পারল না, এত বেশি তিতা।
কোনো চাকরবাকর চোখে পড়ছে না। মিনিস্টার নিজেই খাবার গরম করে পরিবেশন করল। আবার খাওয়া শেষে থালাবাসন তুলল নিজেই।
আশা করি খাবার আপনার ভালো লেগেছে, ডাইনিং রুম থেকে বের হওয়ার পথে লিজেলর জিজ্ঞেস করল।
চমৎকার হয়েছে, বলল ট্র্যাভিজ, বেশি আগ্রহ দেখাল না।
মিনিস্টার বসল আগের সোফাতেই। ঠিক আছে আলোচনা শুরু করা যাক। আপনি বলেছিলেন যে কমপরেলন হয়তো প্রযুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ফাউণ্ডেশন এর প্রভুত্ব ঠেকাতে চায়। কথাটা অল্প হলেও সত্যি, কিন্তু যারা আন্তমহাজাগতিক রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহী শুধুমাত্র তারাই মাথা ঘামাবে, এবং এ ধরনের লোকের সংখ্যা খুব কম। তা ছাড়া সাধারণ কমপরেলিয়ানদের অধিকাংশই ফাউণ্ডেশন-এর অনৈতিকতার ব্যাপারে আতঙ্কিত। সব গ্রহেই নৈতিক অধঃপতন ঘটছে, তবে টার্মিনাসে মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এই গ্রহের যারা টার্মিনাস বিরোধী, আমার মনে হয় তাদের বিরোধিতার মূল কারণ হচ্ছে এটাই।
অনৈতিকতা? ট্র্যাভিজ অবাক। ফাউণ্ডেশন গ্যালাক্সিতে তার নিয়ন্ত্রিত অংশ বেশ ভালোভাবেই শাসন করছে। অর্থনৈতিক,সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই সমতা রয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার রয়েছে সমান সুযোগ।
কাউন্সিলম্যান, আমি বলছি আপনাদের সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে যে অনৈতিকতা রয়েছে, সেটার কথা।
আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরোপুরি নৈতিক।
কাউন্সিলম্যান, ভালোভাবেই বুঝছেন আমি কি বলতে চাই। বিবাহকে আপনাদের সমাজে সংস্কার হিসেবে মানা হয় নাকি হয় না?
সংস্কার বলতে কি বোঝাতে চান?
নারী-পুরুষ একসাথে থাকার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে?
নিশ্চয়ই। কেউ চাইলে অবশ্যই করতে পারে, এতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
কিন্তু, বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটতে পারে।
অবশ্যই, দুটো মানুষকে একসাথে থাকতে বাধ্য করা অনুচিত হবে, যদি—
কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই?
ধর্ম? কিছু লোক প্রাচীন ধর্মীয় প্রার্থনাগুলো বিশ্বাস করে, কিন্তু তার সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক?
কাউন্সিলম্যান, এখানে কমপরেলনে যৌনতা ব্যাপারটা অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত। বিয়ে ছাড়া এটা ঘটতে পারবে না। এমনকি বিবাহিত জীবনেও তা খুব সীমিত থাকবে। অনেক বিশ্ব বিশেষ করে টার্মিনাসে অবাধ যৌনতা লক্ষ করে আমরা প্রচণ্ড মর্মাহত। ধর্মীয় বিধিনিষেধ না মেনে, কখন কীভাবে কার সাথে ঘটছে এসব বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাপারটাকে তারা সামাজিক আনন্দের বিষয়ে পরিণত করেছে।
কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। আমি দুঃখিত, কিন্তু গ্যালাক্সি বা এমনকি টার্মিনাসকে ভালো করার দায়িত্ব আমি নিতে পারি না–এবং আমার মহাকাশযানের সাথে এর কি সম্পর্ক?
আমি সাধারণ মানুষের মনোভাব এবং কীভাবে এটা আমার ক্ষমতাকে সীমিত করে তুলেছে, তার কথাই বলছি। কমপরেলনের জনগণ প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে যদি জানতে পারে যে আপনি সুন্দরী, আকর্ষণীয় এক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য। আপনাদের তিন জনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমি জনসমক্ষে বিচারের বদলে গোপনে সমঝোতা করার পরামর্শ দিয়েছিলাম।
বুঝতে পারছি, খাবার সময় আপনি ভয় দেখানোর এই নতুন পথ ভেবে তৈরি করেছেন। এখন কি আমাকে গণ আক্রমণের আশঙ্কায় থাকতে হবে?
আমি শুধু কোথায় বিপদ সেটা দেখিয়ে দিচ্ছি। অস্বীকার করতে পারবেন যে সঙ্গের মহিলা শুধুই একটা যৌন উপকরণ?
অবশ্যই অস্বীকার করব। ব্লিস আমার বন্ধু ড. পেলোরেটের সঙ্গী। হয়তো তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস মনে মনে দুজনেরই বিয়ে। হয়েছে।
বলতে চান আপনি কিছুই করেন নি?
অবশ্যই না। আমাকে কি মনে করেন?
বলতে পারব না। আমি তো জানি না, কী আপনার নীতি।
বলছি, আমার নীতি কী। আমি বন্ধুত্বকে সম্মান করি।
এমনকি আপনাকে প্রলুব্ধ করা হয়নি?
কেউ আমাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না, তা ছাড়া তেমন সুযোগও ছিল না।
সুযোগ ছিল না? হয়তো মেয়েদের প্রতি আপনার কোনো আগ্রহ নেই।
বিশ্বাস করবেন না, আমার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
শেষ কবে কোন মেয়ের সাথে মেলামেশা করেছেন?
বেশ অনেক মাস। টার্মিনাস ছাড়ার পর তো একজনের সাথেও না।
নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট হচ্ছে।
অবশ্যই, ট্র্যাভিজ অন্তর থেকে বলল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আমার কিছু করার নেই।
ড, পেলোরেট নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট লক্ষ করেছে। নিজের মেয়েমানুষকে আপনার সাথে শেয়ার করবে সে?
আমার কষ্ট তাকে বুঝতে দেইনি, বুঝতে পারলেও শেয়ার করতো না সে। আর ব্লিসেরও কোনো আগ্রহ নেই। আমাকে সে পছন্দ করে না।
কারণ আপনি পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাই বলতে পারছেন।
পরীক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই, বোঝা যায়। যাই হোক আমিও তাকে পছন্দ করি না।
অবাক ব্যাপার! মেয়েটা যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
শারীরিকভাবে, সে যথেষ্ট আকর্ষণীয়। যাই হোক আমাকে আগ্রহী করার কোনো চেষ্টাই সে করেনি। একটা কারণ, তার বয়স অনেক কম, প্রায় বাচ্চা মেয়ে।
তা হলে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের আপনি পছন্দ করেন?
ট্র্যাভিজ নিশ্চুপ। এটা কি একটা ফাঁদ? সতর্কতার সাথে বলল, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে। এর সাথে আমার মহাকাশযানের সম্পর্ক কী?
কিছুক্ষণের জন্য মহাকাশযানের কথা ভুলে যান। আমার বয়স ছেচল্লিশ, এবং অবিবাহিত। কাজের চাপে বিয়ে করার সময় পাইনি।
সেক্ষেত্রে,কমপরেলনের সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে সারা জীবন সংযত থাকতে হবে। এজন্যই জিজ্ঞেস করেছিলেন শেষ কবে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করেছি। আপনি এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ চান? যদি তাই হয়, আমি বলব যে এটা কোনো খাদ্য বা পানীয় নয়। সংযত জীবনযাপন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
মিনিস্টারের হাসির সাথে আবারও চেহারায় একটা আগ্রহী ভাব ফুটে উঠল।
আমাকে ভুল বুঝবেন না, ট্র্যাভিজ। পদাধিকারের অনেক সুবিধা আছে, কৌশল ব্যবহার করা যায়, আর আমিও খুব একটা সংযমী না। তবে, কমপরেলনের পুরুষরা বেশ বিরক্তিকর। নৈতিকতার প্রয়োজন আছে, কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি এটা এখানকার পুরুষদের পাপ পুণ্যের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন করে রেখেছে। ফলে তারা ঝুঁকি নিতে সাহস করে না। এবং সর্বোপরি অদক্ষ।
ট্র্যাভিজ আরও সতর্ক হয়ে বলল, এক্ষেত্রেও আমার কিছু করার নেই।
বলতে চান, দোষ আমার। আমিই ঠিকমতো উৎসাহ দিতে পারি না।
হাত তুলল ট্র্যাভিজ। সে কথা বলছি না।
সেক্ষেত্রে, আপনি সুযোগ পেলে কি করবেন। আপনি নৈতিকতাহীন বিশ্বের পুরুষ, যার সবধরনের যৌন অভিজ্ঞতা রয়েছে। সাথে অল্প বয়স্ক, আকর্ষণীয় মেয়েমানুষ থাকার পরেও যাকে সংযত জীবনযাপন করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। আমার উপস্থিতিতে আপনি কি করবেন। আমি যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক।
আপনার পদাধিকার অনুযায়ী যথাযথ ব্যবহার করব।
বোকামি করবেন না। মিনিস্টার বলল। ডানহাত কোমরের কাছে নিয়ে পোশাক খুলছে।
বরফের মতো জমে গেছে ট্র্যাভিজ। এই ছিল তার মনে–কখন? নাকি হুমকিতে কাজ হয়নি বলে এটা নতুন ধরনের ঘুষ?
খুলে পড়ল অন্তর্বাস। মিনিস্টার বসে আছে, কোমর থেকে উপরে সম্পূর্ণ নগ্ন। শরীরের সাথে মানানসই স্তন-বিশাল, দৃঢ়।
বেশ? বলল সে।
অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বলল ট্র্যাভিজ, অপূর্ব!
তুমি কী করবে?
কমপরেলনের নৈতিকতা কী বলে, ম্যাডাম লিজেলর?
টার্মিনাসের নৈতিকতা কী বলে? তোমার নৈতিকতা কী বলে? এসো-আমার ঠাণ্ডা বুক একটু উষ্ণতা চায়।
দাঁড়িয়ে কাপড় খুলতে লাগল ট্র্যাভিজ।
.
৬. বৈচিত্র্যময় পৃথিবী
নিজেকে ট্র্যাভিজের মনে হচ্ছে নেশাচ্ছন্ন, সময় কত পার হয়েছে তার কোনো ধারণা নেই।
মিটজা লিজেলর, মিনিস্টার অব ট্রান্সপোর্টেশন, শুয়ে আছে পাশে। মুখ ভোলা, নাক ডাকছে মৃদু।
চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করেছে ট্র্যাভিজ। লিজেলর এর শরীর বিশাল, (সে বলেছিল তার বয়স ছেচল্লিশ, কিন্তু বিশ বছরের কোনো অ্যাথলেটও তার কাছে হার মানবে।) এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
নাক ডাকার শব্দ হঠাৎ থেমে গেল, চোখ মেলল সে। কনুইতে ভর দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে তার এক কাঁধে হাত বোলাতে লাগল ট্র্যাভিজ।
ঘুমাও, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। সে বলল।
ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে হাসল লিজেলর। হালকা কিন্তু পরিপূর্ণ তৃপ্তির সুরে বলল, তোমার সম্পর্কে আমার ধারনা মোটেও ভুল ছিল না।
তুমি কি এখনো সাইকিক প্রোবের কথা ভাবছ?
হাসল লিজেলর। মাথা খারাপ। তোমাকে এখন হারাতে চাই না।
তারপরেও সাময়িকভাবে বিদায় জানানো দরকার।
কী? ভুরু কোঁচকালো সে।
এখানে যদি স্থায়ীভাবে থাকি তা হলে কানাঘুষা শুরু হতে বেশিদিন লাগবে না। বরং আমি আমার কাজে যাই, মাঝে মাঝে রিপোর্ট করার জন্য ফিরে আসব, তখন কিছুটা সময় একসাথে কাটালে সমস্যা হবে না।
ভাবছে লিজেলর, আলতোভাবে হাত বোলাচ্ছে ডান কোমরে। তারপর বলল, মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। আমার পছন্দ হচ্ছে না–কিন্তু তোমার কথাই ঠিক।
ভেবো না যে, আমি ফিরে আসব না, ট্র্যাভিজ বলল, আমি এত বোকা নই যে এখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে সেটা ভুলে যাব।
ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে হাসল সে, চিবুকে হালকা স্পর্শ করে বলল, তোমার ভালো লেগেছে?
ভালো লাগার চেয়েও বেশি।
তবুও তুমি তরুণ ফাউণ্ডেশনার, অনেক ধরনের মেয়ের সাথে মিশেছ-
কিন্তু তারা কেউ তোমার মতো ছিল না। জোর দিয়ে কথাটা বলতে ট্র্যাভিজের কোনো সমস্যা হলো না,কারণ সে সত্যি কথা বলছে।
লিজেলর খুশি হয়ে বলল, তারপরেও, পুরোনো অভ্যাস সহজে যায় না, এবং আমি পুরুষের কথা নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারি না। তুমি আর পেলোরেট যেতে। পারো, কিন্তু মেয়েটাকে আমি রেখে দেব, আরামেই থাকবে সে। আমার ধারণা। পেলোরেট তাকে চায়, সে-ই তোমাকে বাধ্য করবে ঘন ঘন এখানে ফিরে আসতে।
কিন্তু লিজেলর, সেটা অসম্ভব।
তাই? দৃষ্টিতে সন্দেহ। কেন অসম্ভব? মেয়েটাকে তোমার প্রয়োজন কেন?
শারীরিক কারণে না। তার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। এবং আমার ধারণা সেরকম চেষ্টা করলে তুমি তাকে দু টুকরো করে ফেলবে।
হাসতে গিয়েও হাসল না লিজেলর, তা হলে সে কমপরেলনে থাকলে তোমার কি?.
কারণ আমাদের মিশনে তার গুরুত্ব আছে। সে কারণেই তাকে দরকার।
বেশ, কী তোমার মিশন? এবার সময় হয়েছে বলার।
একটু দ্বিধা করল ট্র্যাভিজ। বলতে হবে সত্যি কথা। মিথ্যে বলে কোনো লাভ হবে না।
শোন, কমপলেন হয়তো প্রাচীন বিশ্ব, এমনকি প্রাচীনতম বিশ্বগুলোর একটা। কিন্তু এটা সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ব হতে পারে না। এখানে মানবজীবনের উৎপত্তি হয়নি। অন্য কোনো গ্রহ থেকে মানুষ এখানে এসেছিল, এবং সম্ভবত সেখানেও মানবজীবনের উৎপত্তি হয়নি, বরং আরও প্রাচীন অন্য কোনো বিশ্ব থেকে এসেছিল। স্বভাবতই অতীত সময়ের ইতিহাস খুঁড়তে থাকলে, একসময় থামতে হবে, আমরা প্রথম বিশ্বে পৌঁছব, সেটাই হবে দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হিউম্যান অরিজিনস। সংক্ষেপে আমি পৃথিবী খুঁজছি।
মিটজা লিজেলর এর আকস্মিক পরিবর্তনে সে হতবাক হয়ে গেল। বিস্ফারিত দৃষ্টি, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত, শরীরের প্রতিটি পেশি শক্ত হয়ে গেছে। ঝট করে দুই বাহু সোজা উপরে তুলল, এবং দুই হাতের প্রথম দুটো আঙুল দিয়ে ক্রস তৈরি করল।
তুমি এই নাম বললে, ফিসফিস করে কর্কশ সুরে বলল সে।
.
আর কিছুই বলল না; তাকালো না কোনো দিকে। শোয়া থেকে উঠে পা ঝুলিয়ে পিছন ফিরে বসল। ট্র্যাভিজ শুয়ে আছে, জমাট বরফের মতো।
সেশেল এর ট্যুরিস্ট সেন্টারে মান-লী-কমপর তার পিতৃপুরুষের গ্রহ সম্বন্ধে যে কথাগুলো বলেছিলো এখনো তার কানে বাজছে। বলেছিল-তারা এ ব্যাপারে খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যতবারই নামটা শুনবে, ততবারই দুহাত উপরে তুলে প্রথম দুই আঙুল দিয়ে ক্রস তৈরি করবে, যেন দুর্ভাগ্য তাদের ছুঁতে না পারে।
এখন আর ভেবে কি হবে।
কী করেছি আমি, মিটজা? ফিসফিস করে বলল সে।
মাথা ঝাঁকালো লিজেলর, উঠে ধীর পায়ে হেঁটে একটা দরজা দিয়ে অন্যপাশে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর পানি পড়ার শব্দ পেল ট্র্যাভিজ।
অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই তার। লিজেলর অল্প সময় পরে বেরিয়ে এসে কাপড় পড়তে লাগল।
ট্র্যাভিজ বলল, আমি যদি–
মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিল ট্র্যাভিজ। পুরুষালি ভঙ্গিতে হাঁটার চেষ্টা করল সে। কিন্তু ছোটবেলার মতো অস্বস্তি হচ্ছে, সেই সময় সে কোনো অপরাধ করলে তার মা কোনো শাস্তি না দিয়ে স্রেফ কথা বলা বন্ধ করে দিত।
গোসলখানার দেয়াল মসৃণ, ভালোভাবে খেয়াল করেও সে কিছু দেখল না। দরজা খুলে মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, শোন, শাওয়ার ছাড়তে হয় কীভাবে?
লিজেলর হাতের চিরুনি নামিয়ে রেখে এগিয়ে এল, তার দিকে না তাকিয়ে দেখিয়ে দিল। আঙুল অনুসরণ করে মসৃণ সাদা দেয়ালে হালকা গোলাপি একটা দাগ দেখল ট্র্যাভিজ। কাঁধ ঝাঁকিয়ে দেয়ালের দিকে ঝুঁকে দাগটা স্পর্শ করল সে। সাথে সাথে চারপাশ থেকে শুরু হলো হিমশীতল পানির স্রোত। খাবি খেতে খেতে পানি বন্ধ করল।
দরজা খুলল, জানে অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সে জিজ্ঞেস করল, গরম পানি কীভাবে পাব?
লিজেলর এবার তাকালো সরাসরি। অবস্থা দেখে রাগ, বা ভয় বা অন্য যা কিছুই থাক দূর হয়ে গেল সেটা। হেসে উঠল জোরে। বলল, কিসের গরম পানি? তোমার ধারণা পানি গরম করার জন্য জ্বালানি খরচ করব আমরা। ঠাণ্ডা পানির পর হালকা গরম পানি পাবে। আর কী চাও? ননীর পুতুল টার্মিনিয়ান্স!–যাও গোসল সেরে এস!
কিছু করার নেই ট্যাভিজের। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গোলাপি দাগ স্পর্শ করল, হিমশীতল পানির ধাক্কা সামলানোর জন্য শক্ত করে রেখেছে শরীর। টের পেল ফেনা তৈরি হচ্ছে শরীরে। ঘষামাজা শুরু করল। তারপরের পানির প্রবাহ খুব বেশি ঠাণ্ডা না, আবার গরমও না। তবে বরফের মতো ঠাণ্ডা শরীরে সেটা উষ্ণ বলেই মনে হল। শরীর শুকোবে কীভাবে সে জানে না, কারণ, তোয়ালে বা সে ধরনের কিছু নেই।
পানি বন্ধ করতেই শুরু হলো গরম বাতাসের জোরালো ঝাঁপটা। সব দিক থেকে সমান না হলে এই ঝাঁপটায় সে পড়ে যেত। বেশ গরম বাতাস। পানি গরম করার চেয়ে বাতাস গরম করতে জ্বালানি কম খরচ করতে হয়। কয়েক মিনিট পর সে বেরিয়ে এল শুকনো শরীরে, যেন জীবনে কোনোদিন গায়ে পানি ঢালেনি।
লিজেলর মনে হয় সামলে নিয়েছে পুরোপুরি, জিজ্ঞেস করল, ভালো লাগছে?
চমৎকার। ট্র্যাভিজ বলল। আমাকে শুধু তৈরি থাকতে হবে। তুমি আগে বলনি–
ননীর পুতুল, হালকা রসিকতা করল লিজেলর। কাপড় পড়তে পড়তে ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল, ঐ গ্রহকে আমি কী নামে ডাকব?
আমরা সেটাকে বলি ওলডেস্ট।
আমি কীভাবে জানব, যে নাম বলেছি সেটা এখানে অভিশপ্ত । তুমি বলনি।
তুমি জিজ্ঞেস করনি।
জানব কীভাবে যে জিজ্ঞেস করতে হবে?
এখন জানলে।
ভুলে যেতে পারি।
না ভুললেই ভালো করবে।
ক্ষতি কি? রাগ বাড়ছে ট্র্যাভিজের। এটা শুধুই একটা শব্দ, একটা ধ্বনি।
লিজের মুখ কালো করে বলল, কিছু শব্দ আছে যা কেউ বলতে চায় না। তুমি যত শব্দ জানো তার সবগুলো সব পরিস্থিতিতে ব্যবহার করো?
কিছু শব্দ অমার্জিত, কিছু শব্দ অপ্রযোজ্য, কিছু শব্দ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ক্ষতিকর। আমার বলা শব্দ কোন শ্রেণীতে পড়ে?
এটা বিষণ্ণ শব্দ, গম্ভীর শব্দ লিজেলর বলল। শব্দটা এমন এক গ্রহের প্রতিনিধি যা ছিল আমাদের পিতৃপুরুষের বাসস্থান, কিন্তু এখন নেই। মর্মান্তিক, এবং খুব বেশি অনুভব করি কারণ সেটা আমাদের কাছাকাছি রয়েছে। আমরা এই গ্রহ নিয়ে কথা বলতে চাই না, বললেও আসল নাম ব্যবহার করি না।
আর আঙুল ক্রস করার ব্যাপারটা? এটা কীভাবে দুঃখ কষ্ট দূর করে?
লজ্জা পেল লিজেলর। ওটা স্বাভাবিক আচরণ। অনেকের ধারণা শুধু শব্দটা ভাবলেই দুর্ভাগ্য শুরু হবে–আর এভাবেই সেটা দূর করার চেষ্টা করে।
তোমারও ধারণা এভাবে দুর্ভাগ্য দূর করা যায়?
না।–বেশ, কিছুটা হলেও করি। এরকম না করলে আমার অস্বস্তি হয়। ট্র্যাভিজের দিকে তাকাতে পারছে না সে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য দ্রুত বলল, তুমি। যে গ্রহের কথা বললে-সেটা খুঁজে বের করার সাথে কালো চুলের মেয়েটার সম্পর্ক কী?
বল ওলডেস্ট। নাকি সেটাও বলতে চাও না?
কিছু না বলতে পারলেই ভালো হতো, কিন্তু আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি।
ব্লিস যে গ্রহে বাস করে সেখানে তার পূর্বপুরুষরা এসেছিল সরাসরি ওলডেস্ট থেকে।
আমাদের মতো। লিজেলর বলল, অহংকারী সুরে।
তার গ্রহের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো ওলডেস্টকে বোঝার মূল চাবি, কিন্তু সেজন্য সেখানে পৌঁছতে হবে, রেকর্ডগুলো দেখতে হবে।
মিথ্যে কথা বলেছে।
হয়তো, কিন্তু না দেখে বলা যাবে না।
ঐ মেয়েটার বিষাক্ত জ্ঞান যদি তোমার কাছে থাকে, আর ওলডেস্ট খুঁজে বের করতে চাও, তা হলে কমপরেলনে এলে কেন?
ওলডেস্ট এর অবস্থান জানার জন্য। আমার বন্ধু ছিল ফাউণ্ডেশনার। তার পূর্বপুরুষরা কমপরেলনে বাস করত। সে বলেছিল ওলডেস্ট এর অধিকাংশ ইতিহাস কমপরেলন জানে।
তাই? আর কিছু বলেছিল?
হ্যাঁ। বলেছিল,ওলডেস্ট মৃত গ্রহ, পুরোপুরি রেডিওঅ্যাকটিভ। কেন হয়েছে জানে না, তবে তার মতে কারণটা বোধহয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ। সম্ভবত কোনো যুদ্ধ।
না! রাগে বিস্ফোরিত হলো লিজেলর।
না! কোনো যুদ্ধ হয়নি, নাকি ওলডেস্ট রেডিওঅ্যাকটিভ নয়, কোনটা?
রেডিওঅ্যাকটিভ ঠিক আছে, কিন্তু কোনো যুদ্ধ হয়নি।
তা হলে কীভাবে হলো। ওলডেস্ট এর বুকে যখন প্রথম মানুষের জন্ম হয় তখন সেটা রেডিওঅ্যাকটিভ ছিল না। হলে প্রাণের বিকাশ ঘটত না।
ইতস্তত করছে লিজেলর। দাঁড়িয়ে আছে জমাট পাথরের মতো। এটা ছিল একটা শাস্তি। ঐ গ্রহ রোবট ব্যবহার করত। তুমি জানো রোবট কি?
হ্যাঁ।
তাদের রোবট ছিল এবং সেজন্য শাস্তি দেওয়া হয়। যতগুলো গ্রহের রোবট ছিল, সবাইকে শাস্তি দেওয়া হয়, কেউ আর টিকতে পারে নি।
কে তাদের শাস্তি দিয়েছিল, লিজেলর?
যিনি শাস্তিদাতা। ইতিহাসের শক্তি। আমি জানি না। দৃষ্টি সরিয়ে নিল, অস্বস্তি বোধ করছে। তারপর নিচু স্বরে বলল, অন্যদের জিজ্ঞেস কর।
করব, কিন্তু কাকে? কমপরেলনে এমন কেউ আছে, যে প্রাচীন ইতিহাস জানে?
আছে, কেউ তাদের পছন্দ করে না-মানে সাধারণ কমপরেলিয়ানরা। কিন্তু ফাউণ্ডেশন ইন্টেল্যাকচুয়াল ফ্রিডমের জন্য চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে।
খারাপ প্রভাব না, আমার মতে।
চাপিয়ে দেওয়া সবকিছুই খারাপ।
কাঁধ নাড়ল ট্র্যাভিজ। তর্ক করে লাভ নেই। কমপরেলিয়ান সহকর্মীদের সাথে দেখা করতে তারা আগ্রহী হবে। তুমি ব্যবস্থা করতে পারবে, লিজেলর?
মাথা ঝাঁকালো সে। ভাসিল ড্যানিডা নামের এক ইতিহাসবিদ আছে, এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস করে। কোনো ক্লাস নেয় না, তবে যা জানতে চাও সব–বলতে পারবে।
কেন ক্লাস নেয় না?
এমন না যে সে অভিশপ্ত; শুধু শিক্ষার্থীরা তার বিষয় নির্বাচন করে না।
আমার ধারণা, ট্র্যাভিজ বলল, চেষ্টা করছে যেন কৌতুককর না শোনায়, শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়।
কেন শিক্ষার্থীরা শিখবে? এই লোকগুলো দুষ্টক্ষত। সব জায়গাতেই সবসময় কিছু ব্যক্তি থাকে যারা প্রচলিত মতের বিরোধী এবং পাগলের মতো বিশ্বাস করে। তারাই ঠিক, অন্যরা ভুল।
অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ধারণা ঠিক হতে পারে।
না! মুখ ঝামটে বলল লিজেলর, এবং পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয়। সাধারণ কমপরেলিয়ানরা যা বলতে পারবে না। ড্যানিডা তোমাদের সেটা বলতে পারবে।
যেমন?
তুমি কোনোদিনই ওলডেস্ট খুঁজে পাবে না।
.
নিজেদের জন্য বরাদ্দ করা কামরায় বসে ট্র্যাভিজের কথা শুনল পেলোরেট, লম্বা, গম্ভীর মুখ, ভাবলেশহীনচিন্তিত সুরে বলল, ভাসিল ড্যানি? নামটা শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না,তবে আমার লাইব্রেরিতে খুঁজলে হয়তো তার কোনো লেখা পাবো, সেজন্য মহাকাশযানে ফিরতে হবে।
কোনো সন্দেহ নেই তো? চিন্তা করে দেখ। বলল ট্র্যাভিজ।
এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কিন্তু প্রিয়বন্ধু, শত শত স্কলার আছে যাদের নাম আমি শুনিনি; বা শুনলেও মনে নেই।
তারপরেও এই লোক নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণীর কেউ, না হলে তুমি জানতে।
পৃথিবী নিয়ে গবেষণা—
ওলডেস্ট বলার অনুশীলন করো, জেনভ। নইলে ঝামেলা বাড়বে।
ওলডেস্ট নিয়ে গবেষণা জ্ঞানার্জনের জনপ্রিয় কোনো শাখা নয়। তাই প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ, এমনকি প্রাচীন ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরাও এক্ষেত্রে তেমন নাম করতে পারে না। অথবা অন্যভাবে বলা যায় যারা এরই মধ্যে এই বিষয়ে গবেষণা করছে তারা প্রথম শ্রেণীর গবেষক হলেও কেউ স্বীকৃতি দেবে না। কোনো সন্দেহ নেই যে, কারো বিবেচনাতেই আমি প্রথম শ্রেণীর কোনো গবেষক নই।
আমার বিচারে, পেল, মোলায়েম গলায় বলল ব্লিস।
হ্যাঁ, অবশ্যই তোমার বিচারেও, মাই ডিয়ার, পেলোরেট হেসে বলল, কিন্তু স্কলার হিসেবে আমার দক্ষতার ভিত্তিতে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই মূল্যায়ন করো না।
ঘড়ির কাটা অনুযায়ী এখন প্রায় রাত। ট্র্যাভিজ বুঝতে পারছে তার অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ব্লিস আর পেলোরেট যখনই আন্তরিক কথাবার্তা বলে তার এমন হয়।
আগামী কাল এই ড্যানিডার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু সেও। যদি মিনিস্টারের মতো কম জানে তা হলে আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না।
সে হয়তো বিস্তারিত জানে এমন কারো কাছে পাঠাতে পারবে। পেলোরেট বলল।
সন্দেহ আছে। পৃথিবীর প্রতি এই গ্রহের আচরণ–আমারও অনুশীলন করা উচিত-ওলডেস্ট নিয়ে এই গ্রহের আচরণ পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতা আর কুসংস্কার। যাই হোক, দিনটা পরিশ্রমের উপর দিয়ে গেছে, এবার খাওয়াদাওয়া করা দরকার-তারপর ঘুমানোর কথা ভাবা যাবে। তোমরা শাওয়ার কীভাবে ব্যবহার করতে হয় দেখেছ?
বন্ধু, আমাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করা হয়েছে। কীভাবে কী করতে হবে সব দেখিয়ে দিয়েছে, বেশিরভাগেরই কোনো প্রয়োজন ছিল না।
শোন, ট্র্যাভিজ, মহাকাশযানের কী হবে? ব্লিস জিজ্ঞেস করল।
কী হবে?
কমপরেলিয়ান সরকার এটা রেখে দেবে?
না, মনে হয় না।
আহ্। চমৎকার। কিন্তু কেন?
কারণ আমি মিনিস্টারকে মত পাল্টাতে বাধ্য করেছি।
অদ্ভুত।পেলোরেট বলল। তাকে আমার মত পাল্টানোর মতো মহিলা মনে হয়নি।
আমিও বুঝতে পারছি না। তবে, মাইণ্ডের গঠন বিন্যাস থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল সে ট্র্যাভিজের প্রতি আকৃষ্ট।
ট্র্যাভিজ হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে ব্লিসের দিকে ঘুরল। তুমি এটা ঘটিয়েছ, ব্লিস?
কী বলতে চাও, ট্র্যাভিজ?
মানে তাকে চালনা করে—
আমি তাকে চালনা করিনি। তোমার প্রতি সে আকৃষ্ট এটা খেয়াল করেই তার অনুভূতি বাড়িয়ে তুলি, কোনো চিহ্ন থাকবে না পরে। আমার মনে হয়েছিল তোমার প্রতি তাকে সদয় করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
সদয়? তারচেয়েও বেশি কিছু! সে একেবারে গলে গেছে।
তুমি নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছ না—
কেন নয়? হয়তো তার প্রথম যৌবন পার হয়ে গেছে, কিন্তু সকল কলাই সে জানে। এটা তার জীবনে প্রথমবার নয়, আমিও ভদ্রলোকের মতো আচরণ করিনি। ব্লিসকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।–শোন, জেনভ, ওখানে দাঁড়িয়ে কঠোর নীতিবাগীশের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকো না।
বিশ্বাস কর, গোলান, বিব্রত ভঙ্গিতে বলল পেলোরেট, আমার আচরণ নীতিবাগীশের মতো মনে হলে, তুমি ভুল করছ। আমার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু মিনিস্টার নীতিবাগীশ। ব্লিস বলল। আমি চেয়েছিলাম তোমার প্রতি একটু নরম হয়ে পড়ক; এমন শারীরিক সম্পর্ক আমি আশা করিনি।
ঠিক তাই ঘটেছে ব্লিস। জনগণের সামনে তাকে নীতিবাগীশ থাকতে হয়। ভিতরে জ্বালা আরও বেড়েছে।
আর তুমি সেই জ্বালা কমাতে সাহায্য করলে, তাই সে ফাউণ্ডেশন-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে
যেভাবেই হোক বিশ্বাসঘাতকতা করতই। মহাকাশযান সে চায় – থেমে গেল ট্র্যাভিজ, তারপর ফিসফিস করে বলল, কেউ শুনবে না তো?
না! ব্লিস বলল।
তুমি নিশ্চিত।
পুরোপুরি। গায়ার মাইণ্ডে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
বেশ, কমপরেলন মহাকাশযান নিজের জন্য চায়–তাদের বহরের নতুন সংযোজন।
নিশ্চয়ই ফাউণ্ডেশন সেটা ঘটতে দেবে না।
কমপরেলন ফাউণ্ডেশনকে জানাতে চায় না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্লিস, এটাই আইসোলেটদের বৈশিষ্ট্য। মিনিস্টার কমপরেলনের জন্য ফাউণ্ডেশন-এর সাথে বেঈমানী করত, আর এখন সামান্য শারীরিক সুখের বিনিময়ে কমপরেলনের সাথে বেঈমানী করবে।–আর ট্র্যাভিজ বিশ্বাসঘাতকতা করানোর জন্য খুশি মনে নিজের শরীর বিক্রি করে দিল। কী বিশৃঙ্খল আর অরাজক তোমাদের গ্যালাক্সি ।
ঠাণ্ডা সুরে বলল ট্র্যাভিজ, তুমি ভুল করছ, ইয়ং ওমেন।
আমাকে ইয়ং ওমেন বলবে না। আমি গায়। সমগ্র গায়া।
তুমি ভুল করছ গায়া। আমি শরীর বিক্রয় করিনি, খুশি হয়ে দিয়েছি। আমি উপভোগ করেছি এবং কোনো ক্ষতি হয়নি কারো। মহাকাশযান কমপরেলন চাইলে তার ঠিক বেঠিক কে বলতে পারবে। এটা ফাউণ্ডেশন-এর মহাকাশযান, কিন্তু দেওয়া হয়েছে আমাকে পৃথিবী অনুসন্ধান করার জন্য, সেই অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা আমারই থাকবে। আমার মতে ফাউণ্ডেশন চুক্তি ভঙ্গ করে ঠিক করেনি। আর কমপরেলন ফাউণ্ডেশন-এর শাসনাধীন নয়, স্বাধীনতার স্বপ্ন তারা দেখতেই পারে। কমপরেলনের দৃষ্টিতে ফাউণ্ডেশন-এর সাথে প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতা নয়, দেশপ্রেম।
ঠিক। কে বলতে পারে? অরাজক গ্যালাক্সিতে যৌক্তিকতা খুঁজে বের করা সম্ভব? কীভাবে ঠিক বেঠিক, ভালোমন্দ, বিচার-অপরাধ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন চিহ্নিত করা যাবে? নিজের লোকদের সাথে মিনিস্টারের বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে, যখন সে মহাকাশ যান তোমার কাছে রাখতে দেবে? সে কি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা চায়? সে বিশ্বাসঘাতক না স্বার্থপর?
নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছি না, আমি তাকে আনন্দ দিয়েছি বলেই মহাকাশ যান ফেরত দেবে। আমার বিশ্বাস এই সিদ্ধান্ত সে তখনই নিয়েছে যখন তাকে বলেছি যে আমি ওলডেস্ট খুঁজছি। এই গ্রহ তার কাছে অশুভ। সেটা অনুসন্ধান করে আমরাও অশুভ হয়ে পড়েছি। তার অনুভূতি বলছে, মহাকাশযান রাখতে চেয়ে সে নিজের জন্য এবং এই বিশ্বের জন্য দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। এখন আমাদেরকে ছেড়ে দিলে কমপরেলনের সম্ভাব্য দুর্ভোগ দূর করতে পারবে। এদিক থেকে সে দেশপ্রেমিকের কাজ করছে।
আমার সন্দেহ আছে। যদি তাই হয়, ট্র্যাভিজ, কুসংস্কারই আচরণের পরিচালক। নিশ্চয়ই স্বীকার করবে।
স্বীকার অস্বীকার কিছুই করব না। জ্ঞানের অভাবে কুসংস্কার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফাউণ্ডেশন সেলডন প্ল্যান বিশ্বাস করে, কিন্তু আমরা কেউ সেটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব না, বা এর সাহায্যে ভবিষ্যৎ বলতে পারব না। আমরা না জেনেই অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছি। এটা কুসংস্কার নয় কি?
হ্যাঁ, হতে পারে।
আর গায়া। তোমরা বিশ্বাস কর আমি সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছি। কিন্তু তোমরা জানো না কেন সঠিক, বা কতটুকু নিরাপদ। তোমরা শুধু না জেনে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে চাও। আমি অজ্ঞতা দূর করতে চাই বলে তোমরা বিরক্ত। এটা কি কুসংস্কার নয়?
মনে হয় এবার তোমাকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে, ব্লিস। বলল পেলোরেট।
না, পেল। এই অনুসন্ধানে নে হয় কিছুই পাবে না, অথবা এমন কিছু পাবে যা তার সিদ্ধান্তকেই প্রতিষ্ঠিত করবে।
এবং এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে, ট্র্যাভিজ বলল, অজ্ঞতা এবং অবিশ্বাস। অন্য কথায় কুসংস্কার।
.
ভাসিল ড্যানিডা ছোটখাটো মানুষ। খর্বাকৃতি কাঠামো। মাথা না তুলেই চোখ তুলে তাকানোর অভ্যাস। মাঝে মাঝে এক ধরনের মুচকি হাসি তার চেহারা আলোকিত করে তুলে। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন সে নীরবে এই গ্রহের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তার অফিস লম্বা এবং সরু। ঘর ভর্তি প্রচুর টেপ এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। একটাও জায়গামতো নেই, শেলফগুলোকে তাই দাঁত বের করা কঙ্কালের মতো মনে হয়। অতিথিদের যে তিনটা আসনে বসতে দিল সেগুলো ঝাড় পোছ করা হলেও পরিষ্কার হয়নি।
জেনভ পেলোরেট, গোলান ট্র্যাভিজ, এবং ব্লিস, সে বলল। আমি আপনার পুরো নাম জানি না ম্যাডাম।
আমি শুধু ব্লিস নামেই পরিচিত। বসতে বসতে ব্লিস বলল।
এতেই চলবে। ড্যানিডা বলল হাসিমুখে। আপনি এত আকর্ষণীয় যে নাম না । হলেও কোনো ক্ষতি নেই।
সবাই বসেছে। আমি আপনার নাম শুনেছি, ড. পেলোরেট, যদিও কখনো যোগাযোগ হয়নি। আপনি ফাউণ্ডেশনার, তাই না? টার্মিনাস থেকে এসেছেন?
হ্যাঁ, ড. ড্যানিডা।
আপনি কাউন্সিলম্যান, ট্র্যাভিজ। বোধহয় শুনেছিলাম আপনাকে কাউন্সিল থেকে বরখাস্ত করে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। যদিও জানি না কেন।
বরখাস্ত করা হয়নি, স্যার। আমি এখনও কাউন্সিলের সদস্য, অবশ্য জানি না আবার কবে কাজে যোগ দিতে পারব। নির্বাসনও দেওয়া হয়নি। একটা বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়েই আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
সাহায্য করতে পারলে খুশি হব। আর ফুলের মতো এই ভদ্রমহিলা? তিনিও টার্মিনাস থেকে এসেছেন।
সে অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। দ্রুত বলল ট্র্যাভিজ।
আহ্, বড় অদ্ভুত জায়গা এই অন্য গ্রহ। অনেক মানবসন্তানই এই গ্রহের বাসিন্দা। কিন্তু আপনারা দুজন ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক, এই সুন্দরী তরুণী অন্য গ্রহের বাসিন্দা, আর এই দুই শ্রেণীর কারো উপরে মিটজা লিজেলর এর দয়া আছে এমন কথা কেউ কখনো শোনেনি। অথচ বেশ আন্তরিকভাবে আপনাদের সে আমার কাছে পাঠালো কি মনে করে?
বোধহয় আমাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আপনি যত তাড়াতাড়ি সাহায্য করবেন, আমরা তত তাড়াতাড়ি কমপরেলন ছেড়ে চলে যাবো।
ড্যানিডা আগ্রহ নিয়ে ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো। অবশ্যই, আপনার মতো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর তরুণ যেখান থেকেই আসুক তাকে আকৃষ্ট করতে পারবে।
অভিনয় সে ভালোই করে কিন্তু নিখুঁত হয় না।
এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কঠিন গলায় বলল ট্র্যাভিজ।
না জানাই ভালো। অন্তত মানুষের সামনে। কিন্তু আমি একজন সংশয়বাদী এবং সহজে কোনোকিছু বিশ্বাস করি না। তো, কাউন্সিলম্যান, আপনার বিশেষ কাজটা কী বলুন। দেখি সাহায্য করা যায় কিনা।
এ ব্যাপারে ড. পেলোরেট কথা বলবেন।
কোনো আপত্তি নেই, ড. পেলোরেট?
সহজ ভাবে বলতে গেলে, ডকটর, পেলোরেট শুরু করল, আমার সারাটা জীবন কাটিয়েছি যে গ্রহে মৌলিকভাবে প্রাণের বিকাশ ঘটেছিল সেই গ্রহ নিয়ে গবেষণা করে এবং ট্র্যাভিজের সাথে পাঠানো হয়েছে যদি সম্ভব হয় সেটা খুঁজে বের করতে হবে–ওলডেস্ট, সম্ভবত আপনারা এই নামেই ডাকেন।
ওলডেস্ট? অর্থাৎ পৃথিবী।
পেলোরেটের চোয়াল বুকে গিয়ে ঠেকল। কথা জড়িয়ে যেতে লাগল।
আমার ধারণা ছিল–যে, আমাকে বোঝানো হয়েছিল–কমপরেলনে কেউ তারপর অসহায়ের মতো তাকালো ট্র্যাভিজের দিকে।
মিনিস্টার লিজেলর বলেছিলেন, কমপরেলনে কেউ এই শব্দ ব্যবহার করে না। ট্র্যাভিজ বলল।
অর্থাৎ তিনি এমন করেছিলেন? ড্যানিডা মুখ নিচু করল, হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে প্রতিহতের প্রথম দুই আঙুল দিয়ে ক্রস তৈরি করল।
হ্যাঁ, এমনই করেছিলেন।
হাসল ড্যানিডা। বোকামি। এরকম করাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে, অথচ কোনো প্রয়োজন নেই। এমন কোনো কমপরেলিয়ান নেই যে রেগে গেলে বা বিরক্ত হলে পৃথিবী শব্দটা বলে না। এটা আমাদের এখানে একটা সাধারণ অমার্জিত শব্দ।
অমার্জিত? দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।
অথবা, বিস্ময় প্রকাশক, যাই বলেন।
যাই হোক, ট্র্যাভিজ বলল, আমার মনে হয় শব্দটা শুনে মিনিস্টার বেশ ভয়, পেয়েছিলেন।
ওহ্, তিনি তো পাহাড়ি মেয়ে।
তার অর্থ, স্যার?
যা বলা হয়েছে, তাই। মিটজা লিজেলর এর জন্ম হয়েছে পার্বত্য এলাকায়। সেখানে শিশুদের কিছুটা প্রাচীন পদ্ধতিতে বড় করা হয়। তার অর্থ, যত ভালো শিক্ষাই তারা পাক, দুই আঙুলে ক্রস তৈরি করা থেকে তাদের কখনোই বিরত করা যাবে না।
তা হলে পৃথিবী শব্দটা শুনে আপনি ভয় পাচ্ছেন না, ডকটর? ব্লিস জিজ্ঞেস করল।
মোটেই না, ডিয়ার লেডি। আমি একজন সংশয়বাদী।
গ্যালাকটিক অনুযায়ী সংশয়বাদী শব্দের অর্থ আমি জানি, আপনারা কোন অর্থে ব্যবহার করেন? ট্র্যাভিজ বলল।
ঠিক আপনি যে অর্থে ব্যবহার করেন। আমি তখনই বিশ্বাস করব যখন উপযুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য এবং যৌক্তিক তথ্য প্রমাণ আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবে এবং নতুন তথ্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করব। একারণেই আমরা জনপ্রিয় না।
কেন?
আমরা আসলে কোথাও জনপ্রিয় হতে পারব না। কোনো গ্রহের মানুষ একটা স্বস্তিকর, আশ্রয়দায়ক বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতে চায় না। ভেবে দেখুন কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনারা সেলডন প্ল্যান কীভাবে বিশ্বাস করেন।
হ্যাঁ, আঙুলের নখের দিকে তাকিয়ে ট্র্যাভিজ বলল। উদাহরণ হিসেবে আমি গতকাল কথাটা বলেছিলাম।
প্রসঙ্গে ফিরে আসতে পারি? বলল পেলোরেট। পৃথিবী সম্পর্কে এমনকি জানা। যায় যা একজন সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করতে পারে?
খুবই কম। অনুমান করা যায়, কোনো একটা গ্রহে মানবপ্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল, কারণ একাধিক গ্রহে বা দুটো ভিন্ন গ্রহে স্বাধীনভাবে একই রকম প্রজাতির বিকাশ ঘটতে পারে না। সেই গ্রহকেই আমরা পৃথিবী বলি। এখানের প্রত্যেকেই গভীরভাবে বিশ্বাস করে পৃথিবী গ্যালাক্সির এই কোণে অবস্থিত, কারণ এই সেক্টরের বিশ্বগুলো সুপ্রাচীন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম বসতি স্থাপনকৃত বিশ্বগুলো পৃথিবীর কাছাকাছি হবে, দূরে হবে না।
প্ল্যানেট অব অরিজিন হওয়া ছাড়াও পৃথিবীর আর কোনো অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে? পেলোরেট আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল।
আপনি কিছু জানেন? ড্যানিডা বলল, মুখে স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি।
উপগ্রহ, অনেকেই যার নাম দিয়েছে চাঁদ। অস্বাভাবিক, তাই না?
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ড. পেলোরেট। আপনি হয়তো চিন্তাভাবনা করার খোরাক দিচ্ছেন।
এখনো কিন্তু বলিনি কেন অস্বাভাবিক।
অবশ্যই এর আয়তন, তাই না? পৃথিবীর সব কিংবদন্তিতে বহুবিচিত্র প্রাণের বিকাশ এবং ৩০০০-৩৫০০ ব্যাসের বিশাল উপগ্রহের কথা বলা হয়েছে। প্রাণের বিকাশ মেনে নেওয়া যায়, কারণ এটা এক ধরনের জৈবিক বিবর্তন। কিন্তু বিশাল উপগ্রহের কথা বিশ্বাস করা কঠিন। গ্যালাক্সির অন্য কোনো বাসযোগ্য গ্রহের উপগ্রহ নেই, শুধু বাসঅযোগ্য বা গ্যাস জায়ান্টগুলোর উপগ্রহ আছে। চাঁদের ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করি না।
লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণের বিকাশ যেমন পৃথিবীর একক বৈশিষ্ট্য, বিশাল উপগ্রহও তার একক বৈশিষ্ট্য হতে পারে। একটা আরেকটার পরিপূরক।
বুঝতে পারছি না পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণের বিকাশ কীভাবে শূন্য থেকে একটা বিশাল উপগ্রহ সৃষ্টি করবে।
অন্যরকমও ঘটতে পারে-সম্ভবত এই বিশাল উপগ্রহই লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিকাশে সাহায্য করেছে।
বুঝতে পারছি না কীভাবে এটাও সম্ভব হবে।
রেডিওঅ্যাকটিভিটির ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
নিশ্চয়ই যে বিলিয়িন বিলিয়ন বছর তার বুকে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল তখন এমন ছিল না। কীভাবে হলো। পারমাণবিক যুদ্ধ?
এটাই সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা, কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ।
কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে বিশ্বাস করেন না আপনি।
যুদ্ধের কোনো প্রমাণ নেই। গ্যালাক্সির সবার বিশ্বাস করাটাই উপযুক্ত প্রমাণ নয়।
কী ঘটেছিল বলে আপনার ধারণা।
কিছু ঘটেছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই। হতে পারে উপগ্রহের মতো। রেডিওঅ্যাকটিভিটিও কাল্পনিক কাহিনী।
পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী কী? বলল পেলোরেট। আমার পেশাগত জীবনে প্রচুর অরিজিন লিজেণ্ড সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কমপরেলনের কোনো কাহিনী জানি না। তবে শুনেছি কমপরেলনের কিংবদন্তিগুলোতে বেনহলী নামে একজন মানুষের কথা আছে, সে কোথা থেকে এসেছিল কেউ জানে না।
আমরা সাধারণত এগুলো বাইরে প্রচার করি না। আপনার মুখে বেনহলীর কথা শুনে সত্যি অবাক হয়েছি। সবই কুসংস্কার।
কিন্তু আপনার কোনো কুসংস্কার নেই এবং কথা বলতেও কোনো সমস্যা নেই, তাই না?
ঠিক। ছোটখাটো ইতিহাসবিদ বলল, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পেলোরেটের দিকে তাকিয়েছে। এতে আমার জনপ্রিয়তা আরও কমবে। অবশ্য আপনারা তিন জন শিগগির চলে যাচ্ছেন, আশা করি সোর্স হিসেবে আমার কথা বলবেন না।
আমরা কথা দিচ্ছি। দ্রুত বলল পেলোরেট।
বেশ কী ঘটেছিল সেই সম্পর্কে আমার ধারণা সংক্ষেপে বলছি। পৃথিবী অনির্দিষ্ট সময়কাল ধরে ছিল মানুষের একক বাসভূমি। বিশ থেকে পঁচিশ হাজার বছর আগে মানুষ হাইপারস্পেস জাম্প আবিষ্কার করে ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল শুরু করে এবং অল্পকয়েকটা গ্রহে কলোনি তৈরি করে।
এইসব গ্রহে বসতি স্থাপনকারীরা পৃথিবীর তৈরি রোবটের সাহায্য নেয়-রোবট কি আপনারা জানেন?
হ্যাঁ, জানি, জবাব দিল ট্র্যাভিজ, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের বেশ কয়েকবার। রোবট কি আমরা জানি।
বসতি স্থাপনকারীদের সমাজ হয় পুরোপুরি রোবট নির্ভর, কারিগরি দিক দিয়ে অনেক বেশি উন্নত হয় এবং নিজেদের পিগ্রহকে অস্বীকার করে বসে।
স্বভাবতই, পৃথিবী নতুন একদল বসতি স্থাপনকারী পাঠায় রোবট ছাড়া। নতুন বিশ্বগুলোর মধ্যে কমপরেলন প্রথম, আমরা তাই বিশ্বাস করি, যদিও কোনো প্রমাণ নেই। বসতি স্থাপনকারীদের প্রথম দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়, এবং–
কেন বিলুপ্ত হয়ে যায়, ড. ড্যানিডা? ট্র্যাভিজের প্রশ্ন।
কেন? কল্পনাবিলাসীদের ধারণা যিনি শাস্তিদাতা তিনি তাদের শাস্তি দিয়েছেন, অবশ্য কেউ বলে না যে তিনি এতদিন অপেক্ষা করলেন কেন। যাই হোক রূপকথা থেকে যুক্তি খোঁজার প্রয়োজন নেই। সহজভাবে বলা যায়, যে সমাজ পুরোপুরি রোবট নির্ভর হয়ে পড়ে, পরে সেই সমাজ ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে এবং ধ্বংস হয়ে যায়। সঠিক করে বলতে গেলে তাদের বাঁচার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়।
রোবট ছাড়াই বসতি স্থাপনকারীদের দ্বিতীয় স্রোত গ্যালাক্সি জয় করে নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে পৃথিবী হয়ে পড়ে রেডিওঅ্যাকটিভ, আস্তে আস্তে মানুষ ভুলে যায় তার কথা। সাধারণত কারণ দেখানো হয় যে পৃথিবীতে এখনও রোবট আছে।
এতক্ষণ অধৈর্য হয়ে শুনছিল ব্লিস। এবার কথা বলল, ড. ড্যানিডা, রেডিওঅ্যাকটিভ হোক বা না হোক, বসতি স্থাপনকারীদের যতগুলো দল থাকুক কোনো ব্যাপার না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন খুবই সহজ। পৃথিবী ঠিক কোনখানে অবস্থিত? কো-অর্ডিনেটস কী?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে : আমি জানি না। যাই হোক এখন লাঞ্চের সময়। এখানেই ব্যবস্থা করা যাবে। তারপর আলোচনা করা যাবে যতক্ষণ ইচ্ছা।
আপনি জানেন না? চড়াসুরে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
আসলে আমি যতদূর জানি, কেউই তা জানে না। কিন্তু সেটা অসম্ভব।
কাউন্সিলম্যান, হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ড্যানিডা, প্রকৃত সত্যকে যদি আপনি অসম্ভব বলেন, সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু কোনো লাভ হবে না।
.
৭. বিদায় কমপরেলন
খাবার হিসেবে দেওয়া হলো বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন স্বাদের কিছু গোলাকার বস্তু। সবগুলো স্বচ্ছ আবরণে মোড়ানো। ড্যানিডা দেখিয়ে দিল কীভাবে মোড়ক খুলতে হয়। এবং কোন রঙের গোলাকার বস্তুর ভিতর কোন খাদ্য আছে। কোনোটায় মাছ, কোনটায় সবজি বা পনির।
ট্র্যাভিজ একটা বল তুলে মুখে দিয়ে মাছের স্বাদ পেল। মুখে খাবার নিয়েই জিজ্ঞেস করল, লাঞ্চ করার সময় কাজের কথা বলা কি অভদ্রতা হবে?
কমপরেলিয়ান নিয়ম অনুযায়ী, কাউন্সিলম্যান, হবে। কিন্তু যেহেতু আপনারা আমার অতিথি, তাই আপনাদের নিয়ম মেনে চলব। যদি কথা বলতে চান, এবং যদি মনে করেন যে এতে খাবারের স্বাদ নষ্ট হবে না, তা হলে আলোচনা করতে আমার কোনো সমস্যা নেই।
ধন্যবাদ। ট্র্যাভিজ বলল। মিনিস্টার লিজেলর বলছিলেন, আপনাদের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। সত্যি?
অবশ্যই। আসলে কমপরেলন হতাশায় পরিপূর্ণ গ্রহ। কোনো একসময় যখন অল্প কয়েকটা গ্রহে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে, সেই সময় কমপরেলন ছিল নেতৃস্থানীয় বিশ্ব। কথাটা আমরা ভুলিনি। সম্রাটের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, এখন ফাউণ্ডেশন-এর অনুগত সহকারী। কমপরেলিয়ানরা আর কি। করতে পারে। নিজেদের রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলার জন্য বেছে নিয়েছে আমাদের, কারণ আমরা পুরোনো কিংবদন্তিগুলো বিশ্বাস করি না এবং কুসংস্কার মানি না।
যদিও অন্য কোনো মারারক বিপদ থেকে আমরা নিরাপদ,কারণ প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে। আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে না দিলে গ্যালাক্সিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্বীকৃতি থাকবে না। তা ছাড়া ফাউণ্ডেশন আমাদের সমর্থন দিচ্ছে।
একারণেই আপনি বলছেন না পৃথিবী কোথায়? ভয় পাচ্ছেন বলে দিলে, যত সুবিধাই থাকুক, আপনি বিপদ থেকে বাঁচতে পারবেন না?
ড্যানিডা মাথা নাড়ল। না, পৃথিবীর অবস্থান কেউ জানে না। ভয় পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে আমি কিছুই লুকোচ্ছি না।
কিন্তু, তাগাদার সুরে বলল ট্র্যাভিজ গ্যালাক্সির এই অংশে বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যা খুব কম এবং সবগুলোতেই বসতি স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো আপনি ভালোভাবেই চেনেন। তা হলে যে গ্রহ রেডিওঅ্যাকটিভ না হলে মানুষ বাস করতে পারত, এমন একটা গ্রহ খুঁজে বের করা কি কঠিন? তা ছাড়া আপনি এমন একটা গ্রহ খুঁজবেন যার রয়েছে বিশাল উপগ্রহ। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবী চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। হয়তো সময় একটু বেশি লাগবে, তবে ওটাই একমাত্র সমস্যা।
সংশয়বাদীদের মতে পৃথিবীর রেডিওঅ্যাকটিভিটি এবং বিশাল উপগ্রহ দুটোই কাল্পনিক। সেগুলো খোঁজার মানে হচ্ছে চড়ুই পাখির দুধ আর খরগোশের গায়ে পালক খোঁজা।
হয়তো, কিন্তু কমপরেলন চেষ্টা করে দেখতে পারত একবার। সঠিক গ্রহটা খুঁজে পেলে তাদের কিংবদন্তির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেত বহুগুণ।
হাসল ড্যানিডা, হয়তো সেজন্যই অনুসন্ধান করা হয়নি। যদি আমরা ব্যর্থ হতাম বা হয়তো এমন একটা পৃথিবী খুঁজে পেলাম যার সাথে প্রচলিত বর্ণনার কোনো মিল নেই। তখন কমপরেলনের কিংবদন্তিগুলো সবার কাছে হাসির খোরাক হয়ে যেত।
ট্র্যাভিজ চুপ, তারপর আন্তরিক সুরে বলল, এই দুটো বৈশিষ্ট্য ছাড়াও কিংবদন্তি অনুযায়ী তৃতীয় আরেকটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পৃথিবীর বুকে জানা-অজানা সকল ধরনের জীব প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল। যদি গ্রহটা রেডিওঅ্যাকটিভ না হয় তা হলে। এখনও নিশ্চয়ই সেখানে বিচিত্র প্রজাতির জীব বা কোনো একটা প্রজাতি বা অন্তত কোনো জীবাশ্ম পাওয়া যাবে।
কাউন্সিলম্যান, কমপরেলন কখনো কোনো অনুসন্ধান দল পাঠায়নি। তবে মাঝে মাঝে আমাদের মহাকাশযানগুলো কোনো কারণে নির্দিষ্ট গতিপথ থেকে সরে যেত। তারা যেসকল রিপোর্ট পাঠাত তাতে কখনোই এতসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তেমন কোনো গ্রহের কথা বলেনি। আর জনশূন্য কোনো গ্রহে তারা অবতরণ করত না। কাজেই জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। গত এক হাজার বছরে এমন কোনো রিপোর্ট আসেনি, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি পৃথিবী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, কারণ এর কোনো অস্তিত্ব নেই।
ট্র্যাভিজের কণ্ঠে হতাশা, কিন্তু কোথাও না কোথাও পৃথিবী আছে। কোথাও এমন একটা গ্রহ আছে যার বুকে মানুষসহ পরিচিত সব ধরনের জীবনের বিকাশ ঘটেছে। পৃথিবী গ্যালাক্সির এই অংশে না থাকলে আছে অন্য কোনো অংশে।
হয়তো, ঠাণ্ডা সুরে বলল ড্যানিডা, কিন্তু এত বছরেও কারো চোখে পড়ল না।
ভালোভাবে কেউ খোঁজেনি।
বেশ, আপনি খুঁজছেন। আপনার সৌভাগ্য কামনা করি। তবে সফলতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
সরাসরি অনুসন্ধান ছাড়া পৃথিবীর অবস্থান নির্ণয়ের অন্য কোনো চেষ্টা করা হয়েছিল?
হ্যাঁ, দুটো গলা একসাথে বলল। একটা গলার মালিক ড্যানিডা পেলোরেটকে বলল, আপনি ইয়েরিফ প্রজেক্টের কথা বলছেন?
তাই বলছি। বলল পেলোরেট।
তা হলে আপনিই কাউন্সিলম্যানকে বোঝান। আপনার কথা সে বিশ্বাস করবে।
পেলোরেট বলল, শোন, গোলান, এম্পায়ারের শেষ যুগে পৃথিবীকে ওরা বলত অরিজিন। এম্পায়ারের কাঠামো তখন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। কঠোর বাস্তবতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য অরিজিন এর অনুসন্ধান ছিল জনপ্রিয় বিষয়।
হামবল ইয়েরিফ নামের এক লিভিয়ান ইতিহাসবিদ ধারণা করেন যে প্ল্যানেট অফ অরিজিন যাই হোক, গ্যালাক্সি জয়ের প্রথম দিকে সে তার কাছাকাছি অবস্থানের গ্রহগুলোতে বসতি স্থাপন করে, দূরের গ্রহগুলোতে বসবাস শুরু করে পরে। অর্থাৎ যে গ্রহ যত দূরে সেই গ্রহে বসবাস শুরু হয় তত দেরিতে।
এখন গ্যালাক্সির সবগুলো গ্রহের তালিকা নিয়ে যদি সেগুলোকে বসবাস শুরুর তারিখ অনুযায়ী নেটওয়ার্ক–যেমন দশ হাজার বছর, বারো হাজার, পনের হাজার বছর পুরোনো-এভাবে প্রতিটা গ্রহের বয়স অনুযায়ী নেটওয়ার্ক তৈরি করলে সেই নেটওয়ার্ক হবে গোলাকার এবং সমকেন্দ্রিক। পুরোনো গ্রহগুলোর নেটওয়ার্ক হবে নতুন গ্রহগুলোর নেটওয়ার্কের তুলনায় ছোট। প্রতিটা বৃত্তের পরিসীমা নির্ণয় করলে সবচেয়ে ছোট বৃত্তের পরিসীমা হবে মহাকাশের তুলনামূলক ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল –ধরে নেওয়া যায় সেই অংশেই রয়েছে প্ল্যানেট অফ অরিজিন–পৃথিবী।
একই সাথে পেলোরেট হাত দিয়ে বৃত্ত একে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, বুঝতে পেরেছ, গোলান?
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। হ্যাঁ। কিন্তু আমার মনে হয় কোনো লাভ হয়নি।
তাত্ত্বিকভাবে হতে পারত কিন্তু একটা সমস্যা ছিল। গ্রহগুলো নিজেদের বয়সের ব্যাপারে বাড়িয়ে বলেছিল। সবাই নিজেদের অন্যের তুলনায় বেশি প্রাচীন দেখানোর জন্য মিথ্যা কথা বলেছিল, তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। এম্পায়ারও চায়নি গুরুত্বহীন বিষয়ে মাথা ঘামাতে।
কাজেই ইয়েরিফ মাত্র দু হাজার বছর পুরোনো গ্রহ যেগুলোর বিশ্বাসযোগ্য রেকর্ড ছিল সেগুলোর নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্র ছিল ট্র্যানটরের কাছাকাছি। কারণ ঐ গ্রহগুলোতে বসতি স্থাপন শুরু হয়েছিল ট্র্যানটর থেকে।
এটা ছিল আরেক সমস্যা। কারণ সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন গ্রহে বসতি স্থাপন শুধু পৃথিবীকেন্দ্রীক ছিল না। পুরোনো বিশ্বগুলোও নিজেদের মানুষ পাঠিয়ে বিভিন্ন গ্রহে বসতি শুরু করে। বেচারা ইয়েরিফ, তার প্রচেষ্টা সবার কাছে হাস্যকর হয়ে পড়ে। শেষ হয়ে যায় তার পেশাগত জীবন।
বুঝতে পেরেছি, জেনভ।–ড. ড্যানিডা, আশা জাগানোর মতো কিছু বলতে পারেন? এমন কোনো গ্রহ আছে যেখানে গেলে কিছু তথ্য পাব?
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ড্যানিডা। অনেকক্ষণ পর আমতা আমতা করে বলল, বে-এ-এ-শ, পৃথিবী আছে বা কখনো ছিল এটা আমি বিশ্বাস করি না। যাই হোক-তারপর আবার চুপ।
আমার মনে হয় আপনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চান, ডক্টর। ব্লিস বলল।
গুরুত্বপূর্ণ কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। মনে হয় কিছুটা হাস্যকর। যাই হোক, শুধু পৃথিবীর অবস্থান নিয়েই রহস্য তৈরি হয়নি। সেটলারদের প্রথম দলের দ্বারা বসতি স্থাপন কৃত গ্রহগুলো রয়েছে। আমাদের কিংবদন্তিতে তাদের বলা হয় স্পেসার। ওদের গ্রহগুলোকে কেউ বলে স্পেসার বিশ্ব, কেউ বলে নিষিদ্ধ বিশ্ব। পরের নামটাই বর্তমানে বেশি প্রচলিত।
কিংবদন্তিতে বলা হয়, এই স্পেসাররা দীর্ঘজীবন-একশ বা দেড়শ বছর বেঁচে থাকার কৌশল আবিষ্কার করে। অহংকারী হয়ে তারা স্বল্পজীবী পিতৃপুরুষদের নিজেদের গ্রহে আসতে দিত না। যখন আমরা তাদের পরাজিত করি, তখন পরিস্থিতি উল্টে যায়। আমরাই তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। মহাকাশযান এবং বণিকদের তাদের সাথে কোনো প্রকার লেনদেন করতে নিষেধ করা হয়। তাই এগুলোকে বলা হয় নিষিদ্ধ গ্রহ। আমরা নিশ্চিত-কিংবদন্তিতে যা। বলা হয়েছে-আমরা কিছু না করলেও যিনি শাস্তিদাতা তিনি তাদের ধ্বংস করবেন, করেছেনও। আমার মতে বহু হাজার বছর ধরে গ্যালাক্সিতে কোনো স্পেসারকে দেখা যায়নি।
আপনার ধারণা স্পেসাররা পৃথিবী সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে? ট্র্যাভিজ বলল।
হয়তো, যেহেতু তাদের গ্রহগুলো আমাদের যে-কারো গ্রহের তুলনায় বেশ প্রাচীন। অর্থাৎ যদি কোনো স্পেসার বেঁচে থকে, সেটা একেবারেই অসম্ভব।
বেঁচে না থাকলেও গ্রহগুলোতে নিশ্চয়ই অনেক রেকর্ড পাওয়া যাবে।
যদি আপনি সেখানে পৌঁছতে পারেন।
বিরক্ত হলো ট্র্যাভিজ। আপনি বলতে চান, পৃথিবীর অবস্থান অজানা, হয়তো স্পেসারদের গ্রহে গেলে জানা যাবে, কিন্তু সেগুলোর অবস্থানও কেউ জানে না?
বিশ হাজার বছর তাদের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। হয়তো পৃথিবীর মতো তারাও হারিয়ে গেছে।
স্পেসাররা কতগুলো গ্রহে বাস করত?
পঞ্চাশটা। তবে মনে হয় আরো কম হবে।
পঞ্চাশটা গ্রহের একটারও অবস্থান আপনি জানেন?
এখন মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
প্রাচীন ইতিহাস জানার জন্য আমি মাঝে মাঝেই পুরোনো রেকর্ড সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। গতবছর একটা মহাকাশযানের রেকর্ড পাই আমি, দুর্বোধ্য ভাষা। ঠিক সেই সময়ের প্রাচীন যখন কমপরেলনকে বলা হত বেলিওয়ার্ল্ড, সম্ভবত কিংবদন্তিতে আমাদের গ্রহের পুরোনো যে নাম বেনবেলী ওয়ার্ল্ড বলা হয়েছে তারও প্রাচীন নাম এটা।
আপনি প্রকাশ করেছিলেন? উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট।
না। সুইমিং পুলে পানি আছে কিনা সেটা না দেখে আমি ডাইভ দেই না, পুরোনো প্রবাদ। যাই হোক, রেকর্ডে বলা হয়েছে মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন স্পেসারদের একটা গ্রহে গিয়েছিল এবং একজন স্পেসার মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে আসে।
কিন্তু আপনি বলেছেন স্পেসাররা নিজেদের গ্রহে কাউকে নামতে দিত না। ব্লিস বলল।
ঠিক। সেকারণেই আমি এটা প্রকাশ করিনি। আমাদের পিতৃপুরুষদের সাথে স্পেসারদের দ্বন্দ্বের কথা অনেক গ্রহেই বিভিন্নভাবে প্রচলিত। তবে একজায়গায় সবার মিল রয়েছে। স্পেসার এবং সেটলাররা কখনোই এক হতে পারেনি। সামাজিকভাবে তাদের সাথে কোনো মেলামেশা ছিল না। তাই এই কাহিনী আমার মনে হয়েছিল কোনো ঐতিহাসিক রোমান্টিক গল্প।
হতাশ হলো ট্র্যাভিজ। আর কিছু নেই?
আছে, কাউন্সিলম্যান। মহাকাশযানের লগবুকে আমি বেশ কিছু সংখ্যা পাই। এগুলোর ব্যাপারে আমার ধারণা সঠিক হতেও পারে, নাও হতে পারে। আমার ধারণা এই সংখ্যাগুলো স্পেসারদের তিনটা গ্রহের কো-অর্ডিনেটস।
এমনও তো হতে পারে গল্পটা মিথ্যা হলেও কো-অর্ডিনেটসগুলো সত্যি।
হতে পারে। সংখ্যাগুলো আপনাকে দেব। যেভাবে খুশি ব্যবহার করবেন, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। তারপরেও একটা কথা ভেবে মজা পাচ্ছি, স্বভাবসুলভ মুচকি হাসল ড্যানিডা।
কী? বলল ট্র্যাভিজ।
হয়তো এই কো-অর্ডিনেটসগুলোর যে-কোনো একটা পৃথিবীর কো-অর্ডিনেট।
.
কমপরেলনের সূর্য গাঢ় কমলা রঙের, টার্মিনাসের সূর্যের তুলনায় অনেক বড় দেখায়। আকাশের অনেক নিচে অবস্থান করলেও খুব কম তাপ বিকীরণ করে। সৌভাগ্যক্রমে বাতাস যথেষ্ট হালকা, ট্র্যাভিজের চিবুকে হিমশীতল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। ইলেক্টিফায়েড পোশাকের ভিতর কেঁপে উঠে পাশে দাঁড়ানো মিটজা লিজেলরকে বলল, এক সময় নিশ্চয়ই গরম পড়ে, মিটজা।
ট্র্যাভিজের তুলনায় অনেক হালকা পোশাক পড়েছে মিটজা। ঠাণ্ডায় তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আকাশের দিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে বলল, আমাদের গ্রীষ্মকাল খুব চমৎকার, যদিও খুব অল্পসময়ের। ঐ সময়েই শস্য উৎপাদন করা হয়। গৃহপালিত পশুগুলো সব পশমওয়ালা। গ্যালাক্সিতে আমাদের তৈরি পশম ও উল সবার সেরা। তা ছাড়া কক্ষপথে অনেক ফার্ম আছে যেগুলোতে বিভিন্নজাতের ফল উৎপাদন করা হয়।
আমাদের সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। বলল ট্র্যাভিজ। কিন্তু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তোমার যদি কোনো সমস্যা হয়।
না! গর্বিতভাবে মাথা নাড়ল লিজেলর। কোনো সমস্যা হবে না। প্রথমত কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না আমাকে। এই স্পেস পোর্ট, এন্ট্রি স্টেশন, মহাকাশযানের আসা যাওয়া, বা ট্রান্সপোর্টেশনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সকল নিয়মকানুন আমি তৈরি করি। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভর করেন। আর যদি কেউ প্রশ্ন করে সত্যি কথা বলতে হবে।
তোমাদের সরকার মহাকাশযান নিজের জন্য চেয়েছিল, আমাকে ফিরিয়ে দিতে চায়নি।
তুমি খুব জটিল মানুষ, ট্র্যাভিজ। মহাকাশযান নিজের কাছে রাখার জন্য তুমি জানপ্রাণ দিয়ে লড়লে, আর এখন আমাদের ভালো চিন্তা করে হয়রান হচ্ছ। মনে হলো সে ট্র্যাভিজকে জড়িয়ে ধরবে, কিন্তু আবেগ সামলে নিল। রুক্ষ সুরে বলল, কেউ প্রশ্ন তুললে বলব, তুমি ওলডেস্ট খুঁজছ। সব সমস্যার সমাধান হবে। তোমাকে এখানে নামার অনুমতি দেওয়া হবে না।
আমি আসায় তুমি কি সত্যি দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা করছ?
অবশ্যই, কঠিন গলায় বলল লিজেলর। তারপর নরম সুরে বলল, এরই মধ্যে তুমি আমার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছ। তোমাকে জানার পর আর কোনো কমপরেলিয়ান পুরুষকে ভালো লাগবে না। যন্ত্রণাময় একাকীত্ব বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। যিনি শাস্তিদাতা তিনি এরই মধ্যে আমার শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
ট্র্যাভিজ ইতস্তত করে বলল, আমি চাই না তুমি কষ্ট পাও। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কারণে দুর্ভাগ্য নেমে আসবে এটা কুসংস্কার।
ড্যানিডা বলেছে, তাই না?
সে না বললেও আমি জানি।
আমি জানি অনেকেই এটাকে কুসংস্কার মনে করে। কিন্তু তারা হাজার চেষ্টা করেও সত্যকে দূর করতে পারেনি।
তারপর হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে বলল, বিদায়, গোলান। জাহাজে ওঠো, তোমার নাজুক টার্মিনিয়ান দেহ বরফ হয়ে যাওয়ার আগেই।
বিদায়, মিটজা, আশা করি ফিরে এসে তোমার দেখা পাব।
হ্যাঁ, কথা দিয়েছ তুমি ফিরে আসবে, আমিও সেটা বিশ্বাস করার চেষ্টা করছি। এমনকি ঠিক করেছি মহাশূন্যে গিয়ে জাহাজেই তোমার সাথে দেখা করব। ক্ষতি আমার হবে, আমার বিশ্বের যেন কিছু না হয়। কিন্তু তুমি ফিরবে না।
আমি অবশ্যই ফিরে আসব।
আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না, প্রিয় ফাউণ্ডেশনার,কিন্তু যারা ওলডেস্ট এর খোঁজে বেরোয়, তারা আর কখনো ফিরে আসে না।
কেঁপে উঠল ট্র্যাভিজ, ঠাণ্ডায় না ভয়ে বোঝা গেল না, এটাও কুসংস্কার।
এবং তারপরেও, লিজেলর বলল, কথাটা সত্যি।
.
ফার স্টারে ফিরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ। হতে পারে কামরাগুলো ছোট। হতে পারে অসীম মহাশূন্যে বিন্দুর মতো বন্দিশালা, কিন্তু এটা পরিচিত, আরামদায়ক এবং উষ্ণ।
শেষ পর্যন্ত আসতে পেরেছ দেখে খুশি হলাম। অনেকক্ষণ মিনিস্টারের সাথে ছিলে। বলল ব্লিস।
বেশিক্ষণ না। ট্র্যাভিজ বলল। খুব ঠাণ্ডা।
আমি তো ভেবেছিলাম, পৃথিবীর অনুসন্ধান বাদ দিয়ে মিনিস্টারের কাছে থেকে যাবে। আমি হালকাভাবেও তোমার মাইণ্ড চালিত করতে চাই না, তবে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল এবং মনে হলো যেন নিজের প্রবল ইচ্ছাকে জোরালোভাবে দমন করেছ।
ঠিকই বলেছো। একবার মনে হয়েছিল থেকেই যাই। মিনিস্টার চমৎকার মহিলা।–তুমি আমার প্রতিরোধ বাড়িয়ে তুলেছো, ব্লিস?
কতবার বলেছি, আমি তোমার মাইণ্ড কোনো অবস্থাতেই চালিত করিনি এবং করবো না। নিজের চেষ্টাতেই তুমি এই প্রবল আগ্রহ দমন করেছ, সম্ভবত শক্তিশালী দায়িত্ববোধের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
মনে হয় না। ক্লান্তভাবে হাসল ট্র্যাভিজ। এত নাটকীয় কিছু নেই। আমার প্রতিরোধ বাড়ার একটা কারণ হচ্ছে ঠাণ্ডা। দ্বিতীয় কারণটা দুঃখজনক। আমাকে মেরে ফেলতে বেশি সময় লাগবে না। মিনিস্টারের গতির সাথে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব।
যাই হোক, তুমি নিরাপদে ফিরে এসেছ। এবার কী করবে? বলল পেলোরেট।
নিরাপদ জাম্প করতে হলে কমপরেলনের সূর্য থেকে যথেষ্ট দূরে সরতে হবে। না সরা পর্যন্ত প্ল্যানেটরি সিস্টেমের ভেতর দিয়ে দ্রুত এগোব। কেউ আমাদের থামাবে না বা অনুসরণ করবে না?
না, আমার বিশ্বাস মিনিস্টার এখন চায় যত দ্রুত সম্ভব আমরা চলে যাই এবং আর কখনো ফিরে না আসি, যেন যিনি শাস্তিদাতা তার প্রতিহিংসা এই গ্রহের উপর না পড়ে। সত্যি কথা বলতে কি
হ্যাঁ।
তার মতে এই প্রতিহিংসা আমাদের উপর পড়বেই। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে আমরা ফিরে আসতে পারব না। কারণ পৃথিবী এত ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের বাহন, যেই এটা খুঁজবে সেই মারা যাবে।
কতজন কমপরেলিয়ান এ পর্যন্ত পৃথিবী অনুসন্ধান করতে বেরিয়েছিল? জিজ্ঞেস করল ব্লিস।
আমার সন্দেহ আছে একজনও বেরিয়েছিল কি না। তাই তো মিনিস্টারকে বলেছি এগুলো কুসংস্কার।
তুমি নিজে বিশ্বাস কর?
যেভাবে ভয় পেয়েছে তাতে কুসংস্কার ছাড়া কিছু মনে হয়নি, কিন্তু এর শিকড় অনেক গভীরে।
অর্থাৎ পৃথিবীতে অবতরণ করলে রেডিওঅ্যাকটিভিটির জন্য আমরা মারা যাব।
বিশ্বাস করি না পৃথিবী রেডিওঅ্যাকটিভ। আমার বিশ্বাস সে নিজেকে রক্ষা করছে। ট্রানটরের লাইব্রেরিতে পৃথিবীর কোনো রেকর্ড নেই। গায়ার শক্তিশালী স্মৃতিতে পৃথিবীর কোনো কথা নেই।
এই কাজগুলো করার ক্ষমতা যদি পৃথিবীর থাকে তাহলে মাইণ্ড অ্যাডজাস্ট করে সহজেই রেডিওঅ্যাকটিভিটির বিশ্বাস তৈরি করতে পারবে। ফলে কেউ আর অনুসন্ধান করবে না। আর যেহেতু কমপরেলন কাছাকাছি রয়েছে তাই আরেকটু সতর্কতার প্রয়োজন। সেজন্যই ড্যানিডার মতো লোকেরা বিশ্বাস করে না যে পৃথিবী আছে। পৃথিবী যদি এভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় তা হলে আমরা অনুসন্ধান করলে মেরে ফেলবে বা অন্য কোনোভাবে আমাদের বাধা দেবে।
ভুরু কুঁচকে বলল ব্লিস, গায়া–
ট্র্যাভিজ দ্রুত বলল, গায়া আমাদের রক্ষা করবে একথা বলো না। পৃথিবী যদি গায়ার প্রথম স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে পারে, তা হলে কোনো সন্দেহ নেই যদি দুটোর ভেতর সংঘর্ষ হয় তা হলে পৃথিবী জিতবে।
তুমি কীভাবে জানো স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। ঠাণ্ডা সুরে বলল ব্লিস। প্ল্যানেটরি মেমোরি তৈরি করতে গায়ার সময় লেগেছে অনেক। তাই হয়তো সেই সময়ের আগের কিছু মনে করতে পারি না। আর যদি মুছে ফেলাই হয় কেন ভাবছ কাজটা পৃথিবীর।
আমি জানি না, শুধু একটু হিসাব-নিকাশ করছি।
বিরক্ত সুরে বাধা দিল পেলোরেট, যদি পৃথিবী এত শক্তিশালী হয় আর লুকিয়ে থাকতে চায়, তা হলে অনুসন্ধান করে কি লাভ? তোমার মতে সফল হওয়ার আগেই সে আমাদের মেরে ফেলবে। তা হলে বাদ দেওয়া উচিত না?
মনে হয় বাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবী আছে এবং আমি অবশ্যই খুঁজে বের করব। আর গায়ার মতে যখন আমার ভেতরে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি হয় সেক্ষেত্রে আমার কোনো ভুল হয় না।
কিন্তু আমরা কি বাঁচতে পারব, ওল্ডচ্যাপ?
হয়তো, হালকা সুরে বলার চেষ্টা করল ট্র্যাভিজ, পৃথিবী আমার এই বিশেষ গুণের মূল্য দেবে এবং আমাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু নিশ্চিত নই তোমাদের ছাড়বে কিনা। এই দুশ্চিন্তা আগেও ছিল, এখন আরো বাড়ছে, তাই মনে হয় তোমাদের গায়াতে রেখে আসা উচিত। আমিই বলেছি পৃথিবীর গুরুত্ব আছে এবং সেটা খুঁজতে বেরিয়েছি। তোমরা কেন বিপদে পড়বে। ঝুঁকি নিতে হলে আমি নেব। আমাকে একা যেতে দাও-জেনভ।
চিবুক বুকের কাছে নেমে আসায় পেলোরেটের মুখ আরো লম্বা মনে হলো। ভয় পেয়েছি এটা অস্বীকার করব না। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে গেলে লজ্জায় নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবো।
ব্লিস?
তুমি যাই করো, গায়া তোমাকে একা ফেলে যাবে না, ট্র্যাভিজ। পৃথিবীতে বিপদ হলে গায়া যত দূর সম্ভব তোমাকে রক্ষা করবে। আর ব্লিস হিসেবে আমি কখনো পেলকে ছেড়ে যাবো না। সে যদি তোমার সাথে থাকে, আমাকেও তার সাথে থাকতে হবে।
বেশ ভালো কথা। হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ। তোমাদের সুযোগ দিয়েছিলাম। আমরা একসাথেই যাবো।
একসাথে। ব্লিস বলল।
পেলোরেট হাত রাখল ট্র্যাভিজের কাঁধে, একসাথে। সবসময়।
.
এদিকে দেখ, পেল। ব্লিস বলল।
পেলোরেটের লাইব্রেরিতে বসে থেকে সে বিরক্ত। তাই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মহাকাশযানের টেলিস্কোপ নাড়াচাড়া করছে।
এগিয়ে এল পেলোরেট, ব্লিস এর কাঁধে একটা হাত রেখে ভিউস্ক্রিনের দিকে তাকালো। কমপরেলিয়ান প্ল্যানেটরি সিস্টেমের গ্যাসীয় দানবগুলোর একটার ম্যাগনিফাইড ছবি দেখা যাচ্ছে, মনে হয় যেন আসল আয়তনের চেয়েও বড়।
রং হালকা কমলা, তারচেয়েও হালকা কিছু দাগ রয়েছে, এবং মহাকাশযান সূর্য থেকে যত দূরে রয়েছে তার থেকেও বেশি দূরে, আলোর পরিপূর্ণ গোলক।
চমৎকার, বলল পেলোরেট।
মাঝখানের দাগ পুরো গ্রহকে ঘিরে রেখেছে। এটা কি দৃষ্টি বিভ্রম?
জানি না, ব্লিস। তোমার মতো আমিও নবিশ।–গোলান?
নিস্তেজ কণ্ঠে জবাব দিল ট্র্যাভিজ কী ব্যাপার? বলতে বলতে পাইলট রুমে ঢুকল। ঘুমিয়েছিল বলে কাপড়ের অনেক জায়গায় ভাঁজ পড়েছে। ঘুম জড়ানো গলায় বলল, যন্ত্রপাতিগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করো না।
শুধু টেলিস্কোপ ধরেছি, বলল পেলোরেট। তাকাও এদিকে।
তাকালো ট্র্যাভিজ। একটা গ্যাস জায়ান্ট। যতদূর জানি এটা গ্যালিয়া।
দেখেই কীভাবে বললে?
প্রথম কারণ, আমি যে কোর্স তৈরি করেছি, গ্রহের আকৃতি এবং কক্ষপথের যে অবস্থান এবং সূর্য থেকে আমাদের বর্তমান দূরত্বে এই মুহূর্তে শুধু এই একটাই এতদূর ম্যাগনিফাই করা যাবে। দ্বিতীয় কারণ বলয়।
বলয়? ব্লিস এর বিস্মিত প্রশ্ন।
এখানে শুধু দেখা যাচ্ছে হালকা ঝাপসা রেখা, কারণ অনেক দূর থেকে দেখছি। কাছে গেলে আরো ভালোভাবে দেখা যাবে। দেখবে?
নতুন করে কোর্স হিসাব করার ঝামেলায় ফেলতে চাই না, গোলান। বলল পেলোরেট।
কোনো সমস্যা নেই। কম্পিউটারই সব কাজ করবে। বলতে বলতে সে নির্দিষ্ট জায়গায় হাত রাখল।
পেলোরেট আর ব্লিস দেখলো গ্যালিয়া গ্রহ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। উপরের মেরু এখন পরিষ্কার দৃশ্যমান, বিশাল গোলাকার অঞ্চল। নিচের মেরু হারিয়ে গেছে বৃত্তের স্ফীত অংশের আড়ালে।
উপরের অংশে গ্রহের অন্ধকার অংশ কমলা আলোর বৃত্তকে গ্রাস করে ফেলেছে, এবং চমৎকার বৃত্তটাকে মনে হয় ভারসাম্যহীন। মাঝখানের হালকা দাগ এখন আর . সোজা নেই, উত্তর দক্ষিণে বাঁকা হয়ে ঘিরে রেখেছে পুরো গ্রহকে। অথচ কোথাও গ্রহটাকে স্পর্শ করেনি। আর বলয় শুধু একটা না, অনেকগুলো বলয় একসাথে মিশে আছে।
এমন কিছু থাকতে পারে কল্পনাও করিনি। পেলোরেট বলল। এটা কীভাবে মহাকাশের নির্দিষ্ট স্থানে থাকছে।
যেভাবে একটা উপগ্রহ থাকে। বলল ট্র্যাভিজ। বলয়গুলো তৈরি হয়েছে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণা দিয়ে। প্রতিটি কণা এত কাছ থেকে গ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে যার ফলে কোনো প্রভাবই তাদেরকে আলাদা করতে পারছে না।
ভাবতেই অবাক লাগে, স্কলার হিসেবে জীবন কাটালাম অথচ মহাকাশ বিদ্যার কিছুই জানি না।
আমিও মানব ইতিহাসের কিছুই জানি না। একজনের পক্ষে সব জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয় না। মূল কথা হচ্ছে কোনো গ্রহের বলয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রতিটি গ্যাস জায়ান্টেরই যত হালকাই হোক একটা বলয় থাকে। টার্মিনাসের সৌর পরিবারে কোনো গ্যাস জায়ান্ট নেই, তাই কোনো টার্মিনিয়ান মহাকাশ ভ্রমণ না করলে বা প্রশিক্ষণ না পেলে এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবে না। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে এই বলয়টা অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং বিশাল। সম্ভবত কয়েক শ কিলোমিটার প্রশস্ত।
এই পর্যায়ে পেলোরেট তুড়ি বাজালো। ঠিক এই কথাই বলা হয়েছে।
কেঁপে উঠল ব্লিস। কী ব্যাপার, পেল?
সুপ্রাচীন গ্যালাকটিকে লেখা একটা কবিতার কিছু অংশ পড়েছিলাম অনেক আগে। এত প্রাচীন গ্যালাকটিক যে সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি। সেখানে বলা হয়েছে পৃথিবী যে সৌরজগতের অন্তর্গত সেই সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহকে ঘিরে রেখেছে বিশাল তিনটা আংটি। আমি গুরুত্ব দেইনি, কোনো রেকর্ডও রাখিনি।
রেকর্ড না রেখে ঠিকই করেছ, জেনভ।
কিন্তু এটার কথাই বোঝানো হয়েছে, স্ক্রিনের দিকে নির্দেশ করে পেলোরেট বলল। তিনটা প্রশস্ত আংটি, ঘন এবং গ্রহের নিজের আয়তনের চেয়েও বড়।
এমন কথা কখনো শুনিনি। বলল ট্র্যাভিজ। আমার মনে হয় না কোনো বলয় প্রদক্ষিণরত গ্রহের আয়তনের তুলনায় বড় হতে পারে।
কোনো বিশাল উপগ্রহের কথাও শুনিনি। শুনিনি কোনো রেডিওঅ্যাকটিভ গ্রহের কথা। এটা হলো বৈশিষ্ট্য নাম্বার তিন। যদি আমরা এমন কোনো গ্রহ খুঁজে পাই যা রেডিওঅ্যাকটিভ না হলে জীবন ধারণ সম্ভব হতো, যে গ্রহের বিশাল উপগ্রহ রয়েছে। এবং সেই সৌরজগতের অন্য একটা গ্রহের বিশাল বলয় রয়েছে, তা হলে কোনো সন্দেহ নেই আমরা পৃথিবীর সৌরজগতে প্রবেশ করেছি।
ট্র্যাভিজ হাসল। আমি একমত, জেনভ। যদি এই তিনটা জিনিস খুঁজে পাই তা হলে আমরা অবশ্যই পৃথিবী খুঁজে পাবো।
যদি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ব্লিস।
.
মূল গ্রহগুলোকে পিছনে ফেলে এসেছে তারা। এখন এগোচ্ছে শেষ প্রান্তের দুটো গ্রহের মাঝখান দিয়ে, ফলে ১.৫ বিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিশাল ভরযুক্ত বস্তু নেই। সামনে বিস্তৃত হয়ে আছে ধূমকেতুর মতো মেঘ, গ্র্যাভিটেশনালি গুরুত্বহীন।
ফার স্টার ০.১ সি গতিতে এগোচ্ছে। ট্র্যাভিজ জানে মহাকাশযান তাত্ত্বিকভাবে ছুটতে পারে প্রায় আলোর গতিতে, আবার এও জানে ০.১ সি হচ্ছে যথার্থ মাত্রা।
এই গতিতে সঠিক ভরের যে-কোনো বস্তুকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু অতিক্ষুদ্র বস্তু কণা বা স্বাধীন অণু পরমাণুগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। গতি খুব বেশি হলে এই ধরনের ক্ষুদ্র কণাগুলোও মহাকাশযানের হাল বাঁকা বা ফুটো করে ফেলতে পারে। আলোর গতিতে চললে অণুগুলো যে মহাজাগতিক উপাদান নিয়ে মহাকাশযানের হাল এ আঘাত করে, সেই মহাজাগতিক বিকিরণে ভেতরের আরোহীরা বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না।
মহাকাশযান এর গতি প্রতি সেকেণ্ড প্রায় ত্রিশ হাজার কিলোমিটার, ফলে দূরবর্তী নক্ষত্র এবং যাই চোখে পড়ছে মনে হয় যেন এক জায়গায় স্থির।
কম্পিউটার অনেক দূরের মহাকাশ স্ক্যান করে খুঁজে দেখছে গতিপথে কোনো বাধাদানকারী বস্তু এগিয়ে আসছে কি না। সেরকম কিছু থাকলে নিজে নিজেই আস্তে করে যানের মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
ট্র্যাভিজ এগুলো নিয়ে ভাবছে না মোটেই, গভীর মনযোগে সে ড্যানিডার কাছ থেকে পাওয়া কনফিগারেশনগুলো দেখছে।
কোনো সমস্যা? উদ্বিগ্নস্বরে প্রশ্ন করল পেলোরেট।
এখনই বলতে পারছি না। ট্র্যাভিজ বলল। এই কো-অর্ডিনেটসগুলোর আলাদাভাবে কোনো গুরুত্ব নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না জিরো পয়েন্ট বের করা যাচ্ছে। তা ছাড়া এগুলো কোন নিয়মে তৈরি করা হয়েছে–অর্থাৎ দূরত্বের মাপক, প্রধান সংযোজক রেখাগুলোও জানতে হবে।
কীভাবে জানবে?
কমপরেলনের ভিত্তিতে টার্মিনাস এবং আরো কয়েকটি পরিচিত স্থানের কো অর্ডিনেটস কম্পিউটারকে দিয়েছি। কম্পিউটার হিসাব করে বের করবে টার্মিনাস এবং অন্যান্য স্থানগুলোর অবস্থান কোন নিয়মে চিহ্নিত করা যাবে। নিয়ম তৈরি হলে এই সংখ্যাগুলোর একটা অর্থ পাওয়া যাবে সম্ভবত।
সম্ভবত? ব্লিসের প্রশ্ন
এই সংখ্যাগুলো অনেক পুরোনো-সম্ভবত কমপরেলিয়ান, নিশ্চিত নই। হয়তো এগুলো অন্য কোনো নিয়মে বের করা হয়েছে।
সেক্ষেত্রে?
সেক্ষেত্রে সংখ্যাগুলো হবে অর্থহীন। তবে–সত্য মিথ্যা যাচাই করে নিতে হবে আমাদের।
দ্রুত কম্পিউটারে তথ্য ঢোকালো ট্র্যাভিজ। তারপর ডেস্কের উপর চিহ্নিত স্থানে হাত রেখে অপেক্ষা করতে লাগল। জানা কো-অর্ডিনেটসগুলোর সাহায্যে দ্রুত হিসাব-নিকাশ করল কম্পিউটার। তারপর সবচেয়ে কাছের নিষিদ্ধ গ্রহের অর্ডিনেটস এর সাথে ফলাফল মিলিয়ে মেমোরি ব্যাংকের গ্যালাকটিক ম্যাপে চিহ্নিত করল।
একটা স্টার ফিল্ড তৈরি হলো স্ক্রিনে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয়ের জন্য দ্রুত ঘুরতে লাগলো। নক্ষত্রগুলো স্ক্রিনের চতুর্দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল বিদ্যুৎ গতিতে। শুধু রইল আনুমানিক দশ পারসেক (স্ক্রিনের নিচের সূচক অনুযায়ী) মহাকাশের মাঝে ছয়টা নক্ষত্রের অনুজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। আর কোনো পরিবর্তন নেই।
কোনটা নিষিদ্ধ গ্রহ? মৃদু স্বরে বলল পেলোরেট।
কোনোটাই না। চারটা রেড ডোয়ার্ফ, একটা প্রায় রেড ডোয়ার্ফ, আরেকটা হোয়াইট ডোয়ার্ফ। এগুলোর কোনোটার কক্ষপথেই বাসযোগ্য গ্রহ নেই।
দেখেই কীভাবে বললে?
আমরা আসল নক্ষত্র দেখছি না; দেখছি কম্পিউটারের স্মৃতিতে রক্ষিত গ্যালাকটিক মানচিত্রের কিছু অংশ। প্রতিটা গ্রহ নক্ষত্রের তালিকা রয়েছে, যদিও চোখে পড়ছে না। কিন্তু আমার হাত যতক্ষণ ওখানে যুক্ত আছে ততক্ষণ সব তথ্যই দিতে পারব।
হতাশ সুরে বলল পেলোরেট, কো-অর্ডিনেটসগুলো কোনো কাজে লাগল না।
চোখ তুলল ট্র্যাভিজ। না, জেনভ। এখনও শেষ হয়নি। সময়ের ব্যাপার আছে। কো-অর্ডিনেটসগুলো বিশ হাজার বছর পুরোনো। কমপরেলন এবং নিষিদ্ধ গ্রহগুলো সবসময়ই বিভিন্ন গতিতে এবং বিভিন্ন কক্ষপথে গ্যালাকটিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। ফলে গ্রহগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো কাছাকাছি হয়েছে বা সরে গেছে দূরে। নিষিদ্ধ গ্রহগুলো সম্ভবত নির্দিষ্ট স্থান থেকে আধা পারসেক হতে পাঁচ পারসেক সরে গেছে। অবশ্যই স্ক্রিনের নির্দেশিত দশ পারসেক বর্গক্ষেত্রের ভেতরে নেই।
এখন কী করব, তা হলে?
কমপরেলনের অবস্থানের ভিত্তিতে কম্পিউটার গ্যালাক্সিকে বিশ হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাবে।
করতে পারবে? অবাক সুরে বলল ব্লিস।
বেশ, আসল গ্যালাক্সিকে পিছনে নিয়ে যেতে পারবে না, কিন্তু মেমোরি ব্যাংকে রক্ষিত মানচিত্র বিশ হাজার বছর পিছিয়ে নিতে পারবে।
আমরা দেখতে পারব?
দেখ। বলল ট্র্যাভিজ।
ধীরে ধীরে আধডজন নক্ষত্র সরে গেল স্ক্রিন থেকে। ডান দিক থেকে সম্পূর্ণ নতুন আরেকটা নক্ষত্র উদয় হলো। উত্তেজিত গলায় বলল পেলোরেট, ঐ যে! ঐ যে!
দুঃখিত। বলল ট্র্যাভিজ। আরেকটা রেড ডোয়ার্ফ। খুবই সাধারণ ব্যাপার। অন্তত গ্যালাক্সির চার ভাগের তিন ভাগ নক্ষত্রই রেড ডোয়ার্ফ।
স্ক্রিনে আর কোনো পরিবর্তন নেই।
বেশ? ব্লিস বলল।
এটাই। বিশ হাজার বছর আগে গ্যালাক্সির এই অংশ দেখতে এমনই ছিল। স্ক্রিনের ঠিক মাঝখানের বিন্দুতেই নিষিদ্ধ গ্রহটা থাকার কথা।
থাকার কথা, কিন্তু নেই। ধারালো গলায় বলল ব্লিস।
নেই। নিরুত্তাপ গলা ট্র্যাভিজের।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পেলোরেট। ওহ্, খুব খারাপ, গোলান।
দাঁড়াও। হতাশ হয়ো না। আমি আশা করিনি নক্ষত্রটা এখানে থাকবে।
তুমি আশা করোনি? পেলোরেট অবাক।
না। বলেছি তো, এটা গ্যালাক্সির মানচিত্র। নক্ষত্র মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত না হলে আমরা সেটা দেখতে পারব না। আর এই গ্রহগুলো নিষিদ্ধ বলেই মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাই দেখছি না।
আমরা দেখছি না তার কারণ হয়তো এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। কমপরেলিয়ান কিংবদন্তিগুলো মিথ্যা, অথবা কো-অর্ডিনেটসগুলো ভুল। বলল ব্লিস।
সত্যি কথা। যাই হোক কম্পিউটার যেহেতু বিশ হাজার বছরের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে এখন বর্তমান সময়ের কো-অর্ডিনেটস কি হতে পারে সেটা হিসাব করবে। মানচিত্রের কো-অর্ডিনেটসগুলো সংশোধন করে নিয়ে আসল গ্যালাক্সির দিকে নজর দেব।
কিন্তু তুমি নিষিদ্ধ গ্রহগুলোর গড় বেগ অনুমান করেছ। যদি গড় বেগ না হয়? তা হলে আর সংশোধন হবে না।
আরো সত্যি কথা। তবে সংশোধন একেবারে না করার চেয়ে আমার মনে হয় গড় বেগের ভিত্তিতে সংশোধন আমাদের প্রকৃত অবস্থানের কাছে নিয়ে যাবে।
তুমি আশাবাদী! সন্দেহের গলায় বলল ব্লিস।
ঠিক, আমি আশাবাদী।–এবার আসল গ্যালাক্সি দেখা যাক।
দুই দর্শক উৎকণ্ঠা নিয়ে দেখছে, আর নিজের অস্থিরতা কমানোর জন্য মৃদু স্বরে কথা শুরু করল ট্র্যাভিজ।
বাস্তব গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ একটু কঠিন। মানচিত্র দেখার সময় দৃষ্টিপথে কোনো বাধা থাকলে সেটা অপসারণ সম্ভব, বিভিন্ন কোণ থেকে দেখা সম্ভব। কিন্তু বাস্তব গ্যালাক্সি বিভিন্ন কোণ থেকে দেখতে হলে আমাকেই অবস্থান পাল্টাতে হবে।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল স্ক্রিনে। ঝাঁকে ঝাঁকে নক্ষত্র পাউডারের মতো এখানে সেখানে ছিটিয়ে আছে।
মিলকিওয়ের বিশাল অংশের প্রতিচ্ছবি। ট্র্যাভিজ বলল। যেহেতু কো অর্ডিনেটসগুলো কমপরেলনের কাছাকাছি, তাই আমাকে সেই অংশের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে হবে।
কম্পিউটারকে নির্দেশ দিতেই দৃশ্যের পরিবর্তন শুরু হলো। প্রসারিত হলো স্টার ফিল্ড। হাজার হাজার নক্ষত্র বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে যেতে লাগল স্ক্রিনের চার কোণা দিয়ে। দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ প্রায় অসম্ভব। নিজের অজান্তেই তিন জন সম্মুখ গতির ধাক্কা সামলানোর জন্য শক্ত হয়ে পিছনে হেলান দিয়ে বসল।
পুরোনো দৃশ্য ফিরে এল আবার মানচিত্রে, যত অন্ধকার মনে হয়েছিল তত অন্ধকার নয়, বরং আধা ডজন নক্ষত্রের প্রতিচ্ছবি প্রায় আসল নক্ষত্রের মতোই জ্বল জ্বল করছে। কেন্দ্রের কাছাকাছি নতুন একটা নক্ষত্র অন্যগুলোর তুলনায় বেশি উজ্জ্বল।
এটা, ভয় পাওয়া গলায় ফিসফিস করল পেলোরেট।
হতে পারে বলল ট্র্যাভিজ। তারপর বর্ণালী বিশ্লেষণে মনযোগ দিল। দীর্ঘসময় নীরবতার পর বলল, স্পেকট্রাল শ্রেণীর জি-৪ নক্ষত্র, সে কারণে টার্মিনাসের সূর্যের তুলনায় অনেক ছোট এবং অনুজ্জ্বল, কিন্তু কমপরেলনের সূর্যের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল। জি-ক্লাস কোনো নক্ষত্রই কম্পিউটারের গ্যালাকটিক ম্যাপ থেকে বাদ দেওয়া হয়নি, কিন্তু যেহেতু এটা বাদ পড়েছে, নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায় যে নিষিদ্ধ গ্রহ এই সূর্যের সৌরজগতে রয়েছে।
এমনও তো হতে পারে এই নক্ষত্র প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোর মাঝে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ নেই। ব্লিস বলল ।
হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য দুটো নিষিদ্ধ গ্রহ খুঁজে বের করব।
সেগুলোও যদি ফলস্ এলার্ম হয়?
তখন অন্য কিছু চেষ্টা করা যাবে।
যেমন?
যদি জানতাম, হাসিমুখে বলল, ট্র্যাভিজ