তৃতীয় পর্ব – অরোরা
৮. নিষিদ্ধ গ্রহ
আমি এখানে থাকলে সমস্যা হবে, গোলান?
মোটেই না, জেনভ?
যদি কিছু জিজ্ঞেস করি?
বল।
কী করছ তুমি?
ভিউস্ক্রিন থেকে চোখ তুলল ট্র্যাভিজ। যে নক্ষত্রগুলো নিষিদ্ধ গ্রহের কাছাকাছি মনে হচ্ছে সেগুলোর দূরত্ব মাপার চেষ্টা করছি। জানতে হবে ওগুলো প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কাছাকাছি আছে। ওগুলোর মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র জানার জন্য ভর এবং দূরত্ব জানাটা জরুরি। তা নইলে নিরাপদে জাম্প করা যাবে না।
কীভাবে করবে?
বেশ, এই তিন নক্ষত্রের কো-অর্ডিনেটস কম্পিউটারের মেমোরি ব্যাংকে আছে, সেগুলো কমপরেলিয়ান সিস্টেমে রূপান্তর করা যাবে। তারপর কমপরেলিয়ান সূর্যের ভিত্তিতে ফার স্টারের প্রকৃত অবস্থান বের করলেই ওগুলোর দূরত্ব জানতে পারব। স্ক্রিনে রেড ডোয়ার্ফগুলো অনেক কাছে মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনোটা অনেক দূরেও হতে পারে। আমাদের দরকার ত্রি-মাত্রিক অবস্থান।
মাথা নাড়ল পেলোরেট, আর তোমার কাছে নিষিদ্ধ গ্রহের কো-অর্ডিনেটসগুলো তো আছেই।
হ্যাঁ, কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট নয়। অন্য নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব আমার দরকার। শতকরা এক ভাগ এদিক সেদিক হলে ক্ষতি নেই। কারণ ওগুলোর মাধ্যাকর্ষণ ঘনত্ব অনেক কম। কিন্তু নিষিদ্ধ গ্রহ যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তার মাধ্যাকর্ষণ ঘনত্ব অনেক অনেক বেশি, আর তাই সেটার দূরত্ব আমাকে জানতে হবে অন্তত এক হাজার গুণ নিখুঁতভাবে। শুধু কো-অর্ডিনেটস দিয়ে কাজ হবে না।
কী করবে, তা হলে?
কাছাকাছি আরো তিনটা নক্ষত্র আছে, দেখেছ? এত বেশি অনুজ্জ্বল যে দেখার জন্য অনেক বেশি ম্যাগনিফিকেশন করতে হয়েছে। ঐ তিনটা নক্ষত্র থেকে নিষিদ্ধ গ্রহ বা তার নক্ষত্র-কত দূরে, আমি প্রথমে সেটা হিসাব করব। ধরে নেওয়া যায় ঐ নক্ষত্রগুলো। প্রকৃতপক্ষেই অনেক দূরে। তারপর তিনটা নক্ষত্রের একটাকে স্ক্রিনের ঠিক মাঝখানে রেখে নিষিদ্ধ গ্রহের লাইন অফ ভিশন বরাবর সোজা দশ পারসেক এর মতো জাম্প করব। ওগুলোর মাঝখানের দূরত্ব না জেনেইম নিরাপদেই কাজটা করা যাবে।
স্ক্রিনের মাঝখানে যে নক্ষত্র থাকবে জাম্পের পরেও সেটার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না। যদি তিন নক্ষত্রের মাঝখানের দূরতু আসলেই বেশি হয় তা হলে বাকি দুটো অনুজ্জ্বল নক্ষত্রের অবস্থানেরও চোখে পরার মতো কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু নিষিদ্ধ গ্রহ সমান্তরালভাবে অবস্থান পাল্টাবে। কী হারে অবস্থান পরিবর্তন করে সেটা দেখেই আমি প্রকৃত দূরত্ব নির্ণয় করতে পারব। দ্বিগুণ নিশ্চয়তার জন্য বাকি দুটো নক্ষত্র নিয়েও হিসাব করে দেখতে পারি।
কিন্তু সমান্তরালভাবে নিষিদ্ধ গ্রহের অবস্থান পাল্টাবে। তখনই আমি দূরত্ব বুঝতে পারব। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাকি দুটো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করেও হিসাব করতে পারি।
কতক্ষণ লাগবে?
বেশিক্ষণ না। ভারী কাজগুলো করবে কম্পিউটার। সময় লাগবে আসলে উপযুক্ত নির্দেশ দিয়েছি কিনা এবং প্রাপ্ত ফলাফল সঠিক কিনা সেটা নিশ্চিত করতে। নিজের উপর এবং কম্পিউটারের উপর যাদের অতিরিক্ত বিশ্বাস আছে তাদের মতো। হলে অল্প কয়েক মিনিটেই হয়ে যেত।
বিস্ময়কর। ভেবে দেখ কম্পিউটার আমাদের জন্য কত কিছু করছে।
আমি সবসময়ই ভাবি।
এটা না থাকলে তুমি কী করতে?
গ্র্যাভিটিকশিপ না থাকলে কী করতাম? মহাকাশ ভ্রমণের প্রশিক্ষণ না থাকলে কী করতাম? কী করতাম বিশ হাজার বছরের হাইপারস্পেসাল প্রযুক্তি না থাকলে? আসল কথা হচ্ছে আমি নিজে এখানে-এই মুহূর্তে। আরো বিশ হাজার বছর পরের ভবিষ্যৎ কল্পনা করো। প্রযুক্তি কল্পনা করো। প্রযুক্তি উন্নত হতে হতে কোন পর্যায়ে পৌঁছবে? নাকি তখন মানুষের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না?
প্রায় সেরকমই। প্রায় কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। গ্যালাক্সিয়া তৈরি না হলেও পথ প্রদর্শনের জন্য সাইকোহিস্টোরি থাকবে।
কম্পিউটার ছেড়ে চেয়ার ঘুরিয়ে বসল ট্র্যাভিজ। দূরত্ব বের করে যতবার খুশি পরীক্ষা করে দেখুক। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
তারপর আড়চোখে পেলোরেটের দিকে তাকিয়ে বলল, সাইকোহিস্টোরি! ফাউণ্ডেশন এর কুসংস্কার ছাড়া আর কী বলা যায় এটাকে। যুক্তি প্রমাণহীন অন্ধবিশ্বাস। তোমার কী ধারণা জেনভ? এ বিষয়ে তুমি বিশেষজ্ঞ।
প্রমাণ নেই একথা বলছ কেন, গোলান? টাইম ভল্টে হ্যারি সেলডনের প্রতিকৃতি এক ডজনেরও বেশি বার এসেছে, যা ঘটেছে তার সঠিক বর্ণনা দিয়েছে। বেঁচে থাকতে কী ঘটবে সেটা জানতেন না। তার মানে সাইকোহিস্টোরিক্যালি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। বেশ আকর্ষণীয়। মিউলের ব্যাপারে ভুল করেছিলেন, তারপরেও আকর্ষণীয়। কোনো জাদুর মতো মনে হয়। জাদুকররা অনেক কৌশল দেখাতে পারে।
কোনো জাদুকরই ভবিষ্যৎ পাঁচ শতাব্দীতে কী ঘটবে, সেটা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে না।
জাদুকররা তোমাকে যা বিশ্বাস করাবে তার কিছুই করতে পারে না।
গোলান, এমন কোনো কৌশল আমার জানা নেই যার সাহায্যে পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীর ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
এমন কৌশলও নিশ্চয়ই দেখোনি যার সাহায্যে জাদুকর কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত উপগ্রহে লুকোনো কোনো মেসেজ পড়ে শোনাচ্ছে। আমি একবার ঠিক এরকমই জাদুর খেলা দেখেছিলাম। তোমার কখনো মনে হয়নি টাইম ভল্ট, এবং হ্যারি সেলডনের প্রতিকৃতি সরকারের কৌশল?
মনে হল পেলোরেটের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, না মনে হয়নি। সরকার এধরনের কিছু করলে অনেক আগেই ধরা পড়ে যেত।
আমি নিশ্চিত নই। আসল কথা হচ্ছে সাইকোহিস্টোরি কীভাবে কাজ করে আমরা জানি না।
এই কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে আমি জানি না, কিন্তু জানি কাজ করে।
কারণ এটা কীভাবে কাজ করে সেটা অন্য কেউ জানে। যদি কেউ না জানত তখন কি হতো? নষ্ট হয়ে গেলে বা কাজ করা বন্ধ করে দিলে আমাদের কিছুই করার থাকত না। এবং যদি সাইকোহিস্টোরি হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়–
দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন জানে সাইকোহিস্টোরি কীভাবে কাজ করে।
তুমি জানলে কীভাবে?
সবাই বলে।
অনেক কিছুই বলা যায়।–আহ্, নিষিদ্ধ গ্রহের দূরত্ব পাওয়া গেছে, আশা করি নির্ভুল।
ফলাফল দেখতে লাগল ট্র্যাভিজ, মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে, হিসাব করছে মনে মনে। চোখ না তুলেই একবার জিজ্ঞেস করল, ব্লিস কোথায়?
ঘুমোচ্ছে। বলল পেলোরেট। ওর ঘুম প্রয়োজন, ওল্ড চ্যাপ। হাইপারস্পেস দূরত্বে গায়ার সাথে যুক্ত থাকতে অনেক শক্তি ক্ষয় হয়।
আমারও তাই ধারণা, বলল ট্র্যাভিজ, কম্পিউটারকে নতুন নির্দেশ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। কাজ শেষ করে বলল, আমি সিরিয়াস, জেনভ। সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে কি জানো তুমি?
কিছুই না। আমি একজন ইতিহাসবিদ। সাইকোহিস্টোরিয়ানের জগৎ থেকে আমার জগৎ আলাদা। অবশ্য মৌলিক অনুসিদ্ধান্ত দুটো জানি, সেটা সবাই জানে।
এমনকি আমিও জানি। প্রথম অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, জনগোষ্ঠী হতে হবে বিশাল, কিন্তু কতখানি বিশাল হলে সেটা পর্যাপ্ত হবে।
গ্যালাক্সির বর্তমান জনসংখ্যা আনুমানিক দশ কোয়াড্রিলিয়নের উপরে। অবশ্যই এটা পর্যাপ্ত।
কীভাবে জানো?
কারণ, তুমি যতই যুক্তি দেখাও, গোলান, সাইকোহিস্টোরি ঠিক মতোই কাজ করছে।
এবং দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, সাইকোহিস্টোরির কথা মানুষ জানবে না, অথচ তারা জানে।
শুধু এর অস্তিত্বের কথা, ওল্ড চ্যাপ। দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে সাইকোহিস্টোরির ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মানুষকে জানানো যাবে না, এবং মানুষ সেটা জানেও না।
আর শুধু এ দুটোর উপর ভিত্তি করেই সাইকোহিস্টোরি গড়ে উঠেছে। বিশ্বাস করা কঠিন।
শুধু এ দুটোই নয়,উন্নত গণিত আর বিস্তারিত পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে হ্যাঁরী সেলডন গ্যাসের কাইনেটিক থিওরি অনুযায়ী সাইকোহিস্টোরি তৈরি করেছেন। গ্যাসীয় পদার্থের অণুপরমাণুগুলো এত দ্রুত চলাচল করে যে পরিসংখ্যান ছাড়া সেগুলোর বেগ এবং অবস্থান বলা যাবে না। ঠিক সেভাবেই হ্যারি সেলডন মানব সমাজের আচরণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন, যদিও এই সমাধান একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
হয়তো, কিন্তু মানুষ তো পরমাণু না।
ঠিক। মানুষের সচেতনতা আছে, তার আচরণ অনেক বেশি জটিল। সেলডন কীভাবে সামলেছেন আমি জানি না, কিন্তু তিনি সামলেছেন।
আর পুরো ব্যাপারটিই মানুষের সাথে সম্পর্কিত। মনে হয় বালির বাঁধের উপর ভিত্তি করে বিশাল গাণিতিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। অনুমিতিগুলো পূর্ণ না হলে সবশেষ।
কিন্তু সেলডন প্ল্যান শেষ হয়নি…
অথবা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে শেষ হয়ে যাবে। অথবা, যদি তৃতীয় অনুসিদ্ধান্ত থাকে?
কী রকম তৃতীয় অনুসিদ্ধান্ত? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল পেলোরেট। আমি জানি না সেটা সম্ভবত অনেক বেশি যৌক্তিক। হয়তো তৃতীয় অনুমিতি এতো বেশি স্বাভাবিক এবং প্রত্যক্ষ যে সবাই স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে। মুখে বলা বা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। যাইহোক আমরা নিষিদ্ধ গ্রহের সৌরজগতের সীমানায় পৌঁছে গেছি।
স্ক্রিনে মাত্র একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে-ঠিক মাঝখানে। এতই উজ্জ্বল যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো ফিল্টার হয়ে গেলো।
ফার স্টারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার সুযোগ-সুবিধা খুব সীমিত। রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটিজ এর উপর কম চাপ ফেলার জন্য একান্ত বাধ্য না হলে পানি ব্যবহার করা হয় না। ট্র্যাভিজ ঘন ঘন ব্লিস এবং পেলোরেটকে একথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
তারপরেও সবসময় একটা তরতাজা ভাব বজায় রাখে ব্লিস। তার চুল কাঁচের মতো স্বচ্ছ, আঙুলের নোখে সবসময় আলোর ঝলকানি।
পাইলটরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোমরা এখানে!
চোখ তুলে বলল ট্র্যাভিজ, অবাক হওয়ার কিছু নেই। জাহাজের বাইরে যেহেতু যাইনি, আমাদের খুঁজে বের করতে মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ড লাগবে। সেজন্য মেন্টালি অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই।
ধরে নিচ্ছি এটা কোনো ধরনের সম্ভাষন, ব্লিস বলল, আমরা কোথায়?–পাইলট রুমে একথা বলার প্রয়োজন নেই।
ব্লিস. ডিয়ার, বলল পেলোরেট, আমরা তিনটা নিষিদ্ধ গ্রহের একটা গ্রহের প্ল্যানেটরি সিস্টেমের বহির্সীমানায় পৌঁছেছি।
পেলোরেটের কাঁধে হাত রাখল ব্লিস, আর পেলোরেট ব্লিসের কোমর জড়িয়ে ধরল।
খুব বেশি অভিশপ্ত নয় নিশ্চয়। কোনো কিছুই আমাদের থামাতে পারবে না। ট্র্যাভিজ বলল, দ্বিতীয় পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারী বা সেটলাররা এই স্পেসার বা প্রথম পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারীদের সাথে সম্পর্ক না রাখার নিয়ম তৈরি করেছে। আমরা সেই নিয়ম না মানলে কোনো সমস্যা নেই।
স্পেসাররা যদি বেঁচে থাকে, তারাও নিশ্চয়ই সেটলারদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা নিয়ম না মানলেও ওরা মানতে পারে।
ঠিক, ট্র্যাভিজ বলল, যদি আজো বেঁচে থাকে। কিন্তু আমরা জানি না আজো কোনো গ্রহে স্পেসাররা বেঁচে আছে কিনা। যত দূর দেখছি সবগুলো গ্যাস জায়ান্ট। দুটো, এবং বেশ ছোট।
কিন্তু তার মানে এই না যে স্পেসারদের গ্রহের কোনো অস্তিত্ব নেই। যে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ সূর্যের আরো কাছে হবে এবং অনেক ছোট হবে। এত দূর। থেকে কোনো চিহ্ন ধরা পড়বে না। মাইক্রো জাম্প দিয়ে আমাদেরকে আরো ভেতরে যেতে হবে। বুড়ো স্পেস ট্র্যাভেলারদের মতো কথাগুলো বলে বেশ গর্ব হলো পেলোরেটের।
তা হলে আমরা যাচ্ছি না কেন? ব্লিস বলল ।
এখনই না। সতর্ক হয়ে ধাপে ধাপে এগোব। গায়াতে যেমন ফাঁদে পড়েছিলাম, সেরকম আর ফাঁদে পড়তে চাই না।
ওরকম ফাঁদে প্রতিদিনই পড়তে পারি আমরা। আর গায়াতে আমি ব্লিসকে পেয়েছি।
হাসল ট্র্যাভিজ। তুমি কি প্রতিদিনই একজন নতুন ব্লিস পাওয়ার আশা কর?
আহত হলো পেলোরেট, বিরক্ত সুরে ব্লিস বলল, আরো দ্রুত এগোতে পারো। যতক্ষণ আমি আছি, তুমি কোনো ফাঁদে পড়বে না।
নিজের শক্তি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই তো, ব্লিস। এত দূর থেকে গায়ার মূল অংশের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য যে শক্তি ক্ষয় হচ্ছে সেটা পূরণ করার জন্য তোমাকে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। উৎস থেকে দূরে সড়ে আসার পর তোমার সীমিত ক্ষমতার উপর আমি কীভাবে ভরসা করি।
রেগে উঠল ব্লিস, এই সামান্য যোগাযোগে যে শক্তি পাই সেটা যথেষ্ট। রাগ করো না। শুধু জিজ্ঞেস করছি।–বুঝতে পারছ না এটা গায়ার একটা অসুবিধা? আমি গায়া নই। সম্পূর্ণ স্বাধীন ইণ্ডিভিজুয়াল একজন ব্যক্তি। অর্থাৎ নিজের গ্রহ এবং লোকজনদের ছেড়ে আমি যতদূর খুশি চলে যেতে পারি। আমার শক্তি সামর্থ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। আমি গোলান ট্র্যাভিজই থাকব। মহাকাশে যদি একা থাকি, যদি কোনো নক্ষত্র দেখার ক্ষমতা আমার না থাকে, নিজের মানুষদের কাছ থেকে যদি কোনো সাহায্য না আনতে পারি, তবুও আমি গোলান ট্র্যাভিজই থাকব। যদি মৃত্যু হয়, গোলান ট্র্যাভিজ হিসেবে মৃত্যু হবে।
মহাকাশে একা এবং সবার কাছ থেকে দূরে থাকলে তুমি অন্যদের বুদ্ধি এবং শক্তিকে কাজে লাগাতে পারবে না। একটা সমাজের অংশ হয়েও তুমি মর্মান্তিক ভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু তুমি নিঃশেষ হবে অন্যভাবে। আমার সমাজের সাথে যে বন্ধন, গায়ার সাথে তোমার ভিন্ন রকম বন্ধন। আর হাইপারস্পেস দূরত্বে সেই বন্ধন রক্ষা করার জন্য প্রচুর শক্তি ক্ষয় করতে হচ্ছে। সে কারণেই নিজেকে তোমার আমার চেয়ে বেশী নিঃশেষ মনে হবে।
ব্লিস এর তরুণ মুখে কাঠিন্য, হঠাৎ করে তাকে মনে হল বয়সহীন, ব্লিস নয় গায়া, তোমার সব কথা ঠিক হলেও গোলান ট্র্যাভিজ, যে সুবিধা পাবে তার জন্য কোনো মূল্য দেবে না? ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী যেমন মাছ না হয়ে তোমার মতো উষ্ণ রক্তের প্রাণী হওয়া ভালো নয় কি?
কচ্ছপ ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী। পেলোরেট বলল। অন্যান্য গ্রহে আছে, টার্মিনাসে নেই। শরীরে শক্ত আবরণ আছে, চলাফেরায় ধীরস্থির। কিন্তু দীর্ঘজীবী।
বেশ, কচ্ছপ না হয়ে মানুষ হলে উষ্ণ রক্তের জন্য মূল্য দিতে হবে, তোমার চারপাশে উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য শক্তির অপব্যয় করতে হয়। শরীরের শক্তি পূরণ করার জন্য ঘন ঘন খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। এখন তুমি কচ্ছপ হবে, ধীরস্থির কিন্তু দীর্ঘজীবী? নাকি দ্রুত চলনশীল, দ্রুত অনুভূতিপ্রবণ এবং দ্রুত চিন্তাশীল কোনো সত্তার জন্য মূল্য দেবে?
এটা কি সঠিক বিশ্লেষণ হলো, ব্লিস?
না ট্র্যাভিজ, গায়ার পরিস্থিতি আরো উন্নত। যখন একসাথে থাকি তখন অপ্রয়োজনে শক্তি ব্যয় করি না। শুধুমাত্র যখন গায়ার কোনো অংশ হাইপার স্পেস দূরত্বে থাকে তখনই শক্তি ব্যয়ের প্রশ্ন উঠে। তা ছাড়া তুমি বৃহৎ গায়ার পক্ষে ভোট দাওনি, সিদ্ধান্ত নিয়েছ গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে, গ্রহগুলোর আরো জটিল বন্ধন। গ্যালাক্সির যে-কোনো স্থানে তুমি গ্যালাক্সিয়ার অংশ। তখন সমগ্রকের সাথে যুক্ত থাকার জন্য বেশি শক্তি ব্যয় করতে হবে না। কোনো অংশই অন্য অংশের থেকে বেশি দূরে যেতে পারবে না। সবই তোমার সিদ্ধান্ত, ট্র্যাভিজ। নিজের নির্বাচন নিয়ে এত সন্দেহ হচ্ছে কেন?
চিন্তার ভারে নুয়ে পড়ল ট্র্যাভিজের মাথা। অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বলল, আমার এই সিদ্ধান্ত সম্ভবত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। শুধু ভালো শোনালেই চলবে না, আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা আসলেই ভালো।
আমি যা বলেছি তার বেশি আর কি প্রয়োজন তোমার?
জানি না। কিন্তু পৃথিবী খুঁজে বের করবই। দৃঢ় আরপ্রত্যয়ী গলা।
গোলান, নক্ষত্রকে এখন চাকতির মতো দেখাচ্ছে। বলল পেলোরেট।
কম্পিউটার নিজের কাজ করে চলেছে, চারপাশে যে আলোচনার ঝড় কোনো মাথা ব্যথা নেই সেটা নিয়ে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে নক্ষত্রের দিকে। এরই মধ্যে পার হয়ে এসেছে ট্র্যাভিজের নির্ধারণ করে দেওয়া দূরত্ব। . প্ল্যানেটরি প্লেন ধরে ভালোভাবেই এগোচ্ছে। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেতরের গ্রহের সবগুলোকে ফুটিয়ে তুলল।
সবচেয়ে ভেতরের গ্রহের ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তরল পানীয় তাপমাত্রা বিকিরণ হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন রয়েছে। কক্ষপথের হিসাব জানার জন্য অপেক্ষা করছে ট্র্যাভিজ। প্রাথমিক খসড়া হিসাব সঠিক বলে মনে হলো। শান্ত স্বরে বলল, এই গ্রহ বেশ ভালো রকম বাসযোগ্য।
আহ্, বিষণ্ণ মুখে যতটুকু সম্ভব খুশির আমেজ ফুটিয়ে তুলে বলল পেলোরেট।
অবশ্য কোনো উপগ্রহ নেই। কাজেই এটা পৃথিবী নয়।
ওটা নিয়ে চিন্তা করো না, গোলান। যখনই দেখেছি ঐ গ্যাস জায়ান্টগুলোর কোনো বলয় নেই তখনই বুঝেছি পৃথিবী পাইনি এখনও।
বেশ ভালো কথা। এখন দেখতে হবে ওখানে কী ধরনের জীবন আছে। অক্সিজেন যেহেতু আছে উদ্ভিদ থাকবে অবশ্যই। কিন্তু
এবং পশুজাতীয় প্রাণী। ব্লিস বলল।
ঝট করে ঘুরল ট্র্যাভিজ, কী?
আমার অনুভূতিতে ধরা পড়েছে। হালকাভাবে, দূরত্বের জন্য। কিন্তু এই গ্রহ নিঃসন্দেহে শুধু বাসযোগ্যই নয়, অবশ্যই বসতি করা হয়েছে।
.
ফার স্টার রয়েছে নিষিদ্ধ গ্রহের মেরু কক্ষপথে, এত দূরে রয়েছে যে প্রদক্ষিণ সময় লাগবে ছয় দিনের কিছু বেশি। কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো তাড়া নেই ট্র্যাভিজের।
যেহেতু এই গ্রহ বাসযোগ্য, ব্যাখ্যা করল সে, এবং ড্যানিডার মতে একসময় এখানে কারিগরিতে যথেষ্ট অগ্রসর মানুষ-তথাকথিত স্পেসার-বাস করত, তারা এখনও উন্নত হতে পারে। হয়তো আমাদের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি নেই। আমি চাই ওরাই আগে চেহারা দেখায়। যেন অবতরণ করার আগে কিছু জেনে নিতে পারি।
ওরা হয়তো জানে না আমরা এসেছি।
সেটা অসম্ভব। আমার ধারণা ওরা যোগাযোগের চেষ্টা করবে। এমনকি বেরিয়ে এসে আমাদের ধরার চেষ্টা করতে পারে।
কিন্তু ওরা যদি অনেক উন্নত হয় আর আমাদের পেছনে লাগে, তা হলে আমরা অসহায়ের–
বিশ্বাস করি না। এমন কোনো যুক্তিই নেই যে কারিগরি অগ্রগতি সবসময় একদিকে হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা আমাদের পিছনে থাকতে বাধ্য। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে আন্তগ্রহ যোগাযোগে স্পেসাররা অনেক পিছনে পড়ে আছে। ওরা নয় আমরাই গ্যালাক্সিতে বসতি স্থাপন করেছি। নিজেদের গ্রহ ছেড়ে স্পেসাররা কখনো বেড়িয়েছে এমন কোনো নিদর্শন এম্পায়ারের ইতিহাসে নেই। আর যদি মহাকাশ ভ্রমণের প্রযুক্তি না থাকে তা হলে মহাকাশ বিদ্যায় কীভাবে অগ্রসর হবে। গ্র্যাভিটিক শিপের মতো কোনোকিছু ওদের নেই। আমরা হয়তো নিরস্ত্র, কিন্তু কোনো যুদ্ধযান নিয়ে এগিয়ে এলে আমাদের ধরতে পারবে না, অসহায়ের মতো ধরা পড়বো না।
ওরা হয়তো মেন্টালিক্স এ অগ্রসর। হয়তো মিউল ছিল একজন স্পেসার
স্পষ্ট বিরক্ত হলো ট্র্যাভিজ। মিউল সবকিছু হতে পারে না, গায়ানরা তাকে নিজেদের গোষ্ঠীর বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেছে। তাকে একজন মিউট্যান্ট হিসেবেও ধরা হয়।
আরেকটা বিষয় বিবেচনা করা যায়-যদিও গুরুত্বহীন-মিউল একটা কৃত্রিম যন্ত্র বা রোবট।
যদি মেন্টালি বিপজ্জনক কোনো কিছুর সামনে পড়ি আমাদেরকে নির্ভর করতে হবে ব্লিস এর উপর। ভালো কথা, সে কি ঘুমাচ্ছে?
হ্যাঁ, কিন্তু যখন বেরিয়ে আসি তখন তাকিয়েছিল।
তাকিয়েছিল, তাই? বেশ, কিছু ঘটলে দ্রুত জাগাতে হবে। এদিকে তুমি লক্ষ্য রাখবে জেনভ।
রাখব, গোলান, শান্ত গলায় বলল পেলোরেট।
কম্পিউটারের উপর মনযোগ ফিরিয়ে আনল ট্র্যাভিজ। আমাকে ভাবাচ্ছে এন্ট্রি স্টেশনগুলো। সাধারণত এগুলো মানুষ বাসের এবং উন্নত প্রযুক্তির নিদর্শন। কিন্তু এগুলো–
কোনো সমস্যা?
অনেক। প্রথমত এগুলো বেশ প্রাচীন, মনে হয় হাজার বছরের পুরোনো। দ্বিতীয়ত থারমাল রেডিয়েশন ছাড়া আর কোনো ধরনের রেডিয়েশনের চিহ্ন নেই।
থারমাল কী?
সাধারণত কোনো বস্তু যদি আশপাশের অন্যান্য বস্তু থেকে বেশি উত্তপ্ত হয় তা হলে থারমাল রেডিয়েশন ছড়ায়। এন্ট্রি স্টেশনগুলোতে মানুষ থাকলে অন্য ধরনের রেডিয়েশন পাওয়া যেত। যেহেতু নেই ধরে নেওয়া যায় যে সম্ভবত কয়েক হাজার বছর ওগুলোতে মানুষের পা পড়েনি। অথবা যদি মানুষ থাকে, তারা এত বেশি উন্নত যে রেডিয়েশন গোপন রাখতে পারে।
সম্ভবত এই গ্রহের সভ্যতা অনেক উন্নত, কিন্তু এন্ট্রি স্টেশনগুলো খালি, কারণ এতো দীর্ঘ সময় আমরা ওদেরকে একা ফেলে রেখেছি যে আমাদের আগমন নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছে।
হয় তো।-অথবা কোনো ধরনের প্রলোভন।
আড়চোখে ব্লিসের আগমন দেখতে পেয়ে ট্র্যাভিজ বলল হাসিমুখে, হ্যাঁ, আমরা পৌঁছে গেছি।
তাই তো দেখছি, বলল ব্লিস। এটা বুঝতে পারছি কক্ষপথের পরিবর্তন হয়নি।
দ্বিধান্বিত স্বরে পেলোরেট বলল, ট্র্যাভিজ একটু সাবধানতা অবলম্বন করছে। এন্ট্রি স্টেশনগুলো খালি, বুঝতে পারছি না কেন?
ওটা নিয়ে ভাববার কিছু নেই। একই সুরে বলল ব্লিস। এই গ্রহে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।
অবাক হয়ে তাকালো ট্র্যাভিজ, কী বলছ? তুমি বলেছিলে-।
আমি বলেছিলাম, গ্রহে পশুশ্রেণীর প্রাণের অস্তিত্ব আছে। গ্যালাক্সির কোথায় শিখেছ পশুশ্রেণীর প্রাণ বলতে মানুষকে বোঝাবে।
তখন বলোনি কেন?
দূরত্বের কারণে। অত দূর থেকে শুধু পশুশ্রেণীর মস্তিষ্কের নিউরাল প্রবাহ ধরতে পেরেছি, কিন্তু মানুষ না প্রজাপতি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব ছিল না।
এখন?
এখন অনেক কাছে চলে এসেছি। আসলে আমি ঘুমাইনি। অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু আমি আসলে জটিল মেন্টালিটি শোনার চেষ্টা করছিলাম, যা দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব বোঝা যাবে।
কিন্তু নেই।
আমার ধারণা, সতর্কতার সাথে বলল ব্লিস, এই দূরত্ব থেকে যেহেতু কিছু ধরতে পারছি না, তা হলে কয়েক হাজারের বেশি মানুষ নেই। আরো কাছে গেলে পরিষ্কার বোঝা যাবে।
বেশ, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দ্বিধান্বিত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ।
ব্লিস কিছুটা বিরক্ত। আমারও তাই মনে হয়। আর এই রেডিয়েশন বা আরো কী সব বিশ্লেষণ করছ সেগুলো বাদ দাও। আমার গায়ান অনুভূতি কাজগুলো আরো দক্ষ এবং নিখুঁতভাবে করতে পারবে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আইসোলেট মানুষ না হয়ে গায়ান হওয়া অনেক ভালো।
জবাব দেওয়ার আগে সময় নিল ট্র্যাভিজ, কারণ প্রচণ্ড রাগ দমন করার জন্য কঠিন চেষ্টা করতে হচ্ছে তাকে। যখন কথা বলল কণ্ঠস্বর পুরোপুরি শান্ত এবং স্বাভাবিক। কথাটা জানানোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে-উদাহরণ দিয়ে বলি-শুধুমাত্র ঘ্রাণশক্তি বাড়ানোর জন্য নিজের মানবসত্তা বাদ দিয়ে ব্লাডহাউণ্ডে পরিণত হব না।
নিষিদ্ধ গ্রহ এখন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে, কারণ মেঘের স্তর পেরিয়ে এসে ভেসে বেড়াচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে উপর থেকে নিচের গ্রহটাকে মনে হলো পোকার আক্রমণের স্বীকার ।
যেমন আশা করা গিয়েছিল পোলার রিজিওনগুলো সেরকমই বরফ আচ্ছাদিত, কিন্তু আয়তনে ছোট। পাহাড়ি অঞ্চলগুলো রুক্ষ্ম, নিষ্ফলা, দু-একটা গ্লেসিয়ার, কিন্তু সেগুলোও আয়তনে বড় নয়। অনেক দূরে দূরে ছড়ানো ছোট কয়েকটা মরুভূমি দেখা গেল।
এসব কিছু বাদ দিলে, পুরো গ্রহটা আসলেই বেশ চমৎকার। বিশাল মহাদেশীয় অঞ্চল, কিন্তু সর্পিল, ফলে তৈরি হয়েছে সুদীর্ঘ বেলাভূমি এবং বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী সমভূমি। মৌসুমি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয়-দুধরনের বনাঞ্চলই রয়েছে, যে বনাঞ্চলগুলোকে ঘিরে রেখেছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি।
কিন্তু একটা বৈসাদৃশ্য। সবুজের সমারোহের মাঝে কোনো কোনো স্থানের উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে উন্মুক্ত মাটি। যেন ঐ স্থানগুলোতে কোনো বিষাক্ত পোকার আক্রমণে ক্ষচিহ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
উদ্ভিদের কোন ধরনের রোগ? অবাক হয়ে বলল পেলোরেট।
না, ধীর গলায় জবাব দিল ব্লিস, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং অনেক বেশি স্থায়ী।
আমি অনেক গ্রহে গিয়েছি, বলল ট্র্যাভিজ, কিন্তু এরকম কখনো দেখিনি।
আমি অল্প কয়েকটা গ্রহ দেখেছি, কিন্তু গায়ার মতে মানুষ যে গ্রহ পরিত্যাগ করে চলে গেছে সেটার অবস্থা এমনই হবে।
কেন?
চিন্তা করে দেখ, কাঠখোট্টা গলায় বলল ব্লিস। বাসযোগ্য গ্রহের কোনোটারই ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স নেই। হয়তো পৃথিবীতে একটা সত্যিকার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স ছিল, কারণ সেখানেই মানুষের উদ্ভব ঘটে, নিশ্চয়ই দীর্ঘ যুগ আগেই সেখান থেকে মানব সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কারিগরি নির্ভর সমাজ গড়ে তুলে প্রকৃতিকে অনুকূলে আনার মতো অন্য কোনো দক্ষ প্রজাতি না থাকায় একটা স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য-অবশ্যই সর্বদা পরিবর্তনশীল-তৈরি হতে বাধ্য। অন্যান্য সকল বাসযোগ্য গ্রহে পরিবেশ মানুষ নিজের সুবিধা অনুযায়ী তৈরি করে নিয়েছে এবং পছন্দমতে প্ল্যান্ট ও অ্যানিমেল লাইফ বজায় রেখেছে। কিন্তু সেখানে সঠিক ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স তৈরি হয়নি, কারণ প্রজাতির সংখ্যা কম। শুধু যেগুলো মানুষের জন্য আরামদায়ক এবং যেগুলো না থাকলেই নয়
একটা কথা মনে পড়েছে আমার, বলল পেলোরেট, বাধা দেওয়ার জন্য। দুঃখিত, ব্লিস। কিন্তু বর্তমান আলোচনায় আমার বক্তব্য এত বেশি সঙ্গতিপূর্ণ যেন না বলে পারছি না। অনেকদিন আগে একটা প্রাচীন ক্রিয়েশন মিথ পেয়েছিলাম: যেখানে বলা হয়েছে যে-কোনো একটা গ্রহে অল্প কয়েকটা প্রজাতির প্রাণের বিকাশ ঘটে, শুধুমাত্র মানুষের জন্য যেগুলো আরামদায়ক। তারপর প্রথম মানুষ খুব খারাপ কিছু একটা করে-কী করে সেটার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তার ফলে সেই গ্রহের মাটিতে অভিশাপ নেমে আসে। তীক্ষ কণ্টক আর বিষাক্ত আগাছা নেমে আসে ভূমিতে, ঠিক এই কথাগুলোই বলা হয়েছিল। যদিও যে সুপ্রাচীন গ্যালাকটিকে এটা লিখা হয়েছে সেই ভাষায় শুনলে আরো সুন্দর লাগত। আসল কথা হচ্ছে, এটা কি সত্যিই কোনো অভিশাপ? মানুষ যেগুলো চায় না বা পছন্দ করে না, যেমন কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ, আগাছা হযতো সেগুলোও ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সের জন্য প্রয়োজন।
ব্লিস হাসল। সত্যিই বিস্ময়কর, পেল, তুমি কীভাবে প্রতিটা আলোচনায় প্রাচীন কিংবদন্তির যোগসাজস খুঁজে পাও, সত্যিই চমৎকার। মানুষ নতুন গ্রহে বসতি স্থাপনের সময় সেই গ্রহের পরিবেশ নিজের অনুকূলে আনার জন্য কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ বা আগাছা যাই হোক সেগুলো বাদ দেয়, তারপর সেই গ্রহটাকে নিজের চেষ্টায় সক্রিয় রাখে। এটা গায়ার মতো কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্গানিজম নয়। বরং বিভিন্ন ধরনের আইসোলেট প্রজাতির সঙগ্রহ, যে সংগ্রহ সঠিক ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়। যদি মানবসভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, পরিবেশ রক্ষার জন্য কেউ না থাকে তখন গ্রহের লাইফ প্যাটার্ন ভেঙে পড়ে। গ্রহ নিজেই নিজেকে ডিজেনারেট করতে থাকে।
সংশয়ের সুরে বলল ট্র্যাভিজ, সেরকম কিছু ঘটলেও সেটা নিশ্চয়ই খুব দ্রুত ঘটে না, হয়তো বিশ হাজার বছর এই গ্রহে কোনো মানুষ বাস করে না, কিন্তু অধিকাংশ অঞ্চলই বেশ ভালো অবস্থায় আছে।
সেটা প্রথমত নির্ভর করে, বলল ব্লিস, ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স কতখানি নিখুঁত ছিল। যদি শুরুতেই একটা ভালো ভারসাম্য থাকে তা হলে মানুষ ছাড়াই সেটা অনেকদিন টিকবে। মানুষের জন্য বিশ হাজার বছর হয়তো অনেক সময়, কিন্তু একটা গ্রহের জন্য সেটা মাত্র এক রাতের ব্যাপার।
আমার ধারণা, গ্রহের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে পেলোরেট বলল, যেহেতু এই গ্রহের ভারসাস্য ভেঙে পড়ছে, কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায় এখানে মানুষ নেই।
ব্লিস বলল, মানুষের সমপর্যায়ের কোনো মেন্টাল এ্যাকটিভিটি ধরা পড়েনি আমার কাছে। শুধু নিচু শ্রেণীর মেন্টালিটির কলগুঞ্জন। সম্ভবত পাখি এবং কিছু স্তণ্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু তারপরেও এই ভারসাম্যহীনতা থেকে নিশ্চিত বলা যাবে না যে এখানে মানুষ নেই। কারণ মানুষ থাকার পরেও এধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
নিশ্চয়ই এধরনের সমাজ খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। আমার মনে হয় না যে উপাদানগুলো তাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য সেগুলোর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা মানুষ বুঝতে পারবে না।
পেল, তোমার মতো মানুষের উপর আমার এতখানি বিশ্বাস নেই। এটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হয় যে, শুধুমাত্র আইসোলেটদের নিয়ে তৈরি করা সমাজে আঞ্চলিক এমনকি ব্যক্তিস্বার্থ পর্যন্ত প্ল্যানেটরি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকে।
মোটেই স্বাভাবিক নয়, বলল ট্র্যাভিজ। আইসোলেটদের নিয়েই লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ে উঠেছে। সেগুলোর কোনোটাই এধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। কাজেই তোমার ভয় অমুলক, ব্লিস।
দিনের অংশ ত্যাগ করে মহাকাশযান প্রবেশ করল রাতের অংশে। প্রথমে মনে হল দিন শেষে সন্ধ্যা নামছে। তারপরেই চট করে বিকর্ষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল সবকিছু। আকাশে কয়েকটা তারা মিট মিট করছে।
বায়ুমণ্ডল এবং মাধ্যাকর্ষণের ঘনত্ব হিসাব করে মহাকাশযান যথার্থ উচ্চতা বজায় রেখেছে, যেন কোনো পাহাড়চূড়ার সাথে সংঘর্ষ না ঘটে। যদিও ভূ-তাত্ত্বিকভাবে নতুন কোনো পাহাড়শ্রেণী তৈরির পর্যায় এই গ্রহ পেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু কম্পিউটার ধরে নিয়েছে একটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
মখমলের মতো কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতস্বরে বলল ট্র্যাভিজ, প্রাণহীন গ্রহের সবচেয়ে উপযুক্ত প্রমাণ হল তার রাতের অংশে দৃশ্যমান আলোর অনুপস্থিতি। সব উন্নত সমাজই কৃত্রিম উপায়ে অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করে।–দিনের অংশে পৌঁছলেই আরো নিচে নামব।
কী লাভ? বলল পেলোরেট। ওখানে কিছু নেই।
কে বলল নেই?
তুমি, ব্লিস, দুজনেই বলেছ।
আমি বলেছি উন্নত প্রযুক্তির কোনো রেডিয়েশন নেই, ব্লিস বলেছে মানুষের মেন্টাল তরঙ্গ নেই। তার অর্থ এই না যে ওখানে কিছু নেই। মানুষ না থাকলেও ধ্বংসাবশেষ থাকতে পারে। আমার তথ্য প্রয়োজন, জেনভ। এই গ্রহের প্রযুক্তির অবশিষ্ট অংশ থেকে নিশ্চয় কিছু পাবো।
বিশ হাজার বছর পরে তুমি কী পাবে? ফিল্ম, পেপার প্রিন্ট, কিছু না। ধাতু ক্ষয় হয়ে যাবে, প্লাস্টিক গলে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি পাথরও ক্ষয় হবে।
হয়তো বিশ হাজার বছর কারণ কমপরেলিয়ান কিংবদন্তি অনুযায়ী এই গ্রহগুলো এত দীর্ঘ সময় ধরে মনুষ্যবিহীন। কিন্তু এমনও তো হতে পারে এই গ্রহের শেষ জীবিত ব্যক্তি মারা গেছে বা অন্য কোথাও চলে গেছে মাত্র এক হাজার বছর আগে।
রাতের অংশের অপর প্রান্তে পৌঁছে গেল তারা। মনে হল যেন ভোর হয়েই সাথে সাথে তীব্র দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল।
নিচে নামছে ফার স্টার, ভূ-পৃষ্ঠ দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত নিচে নামতেই লাগল। মহাদেশীয় উপকূলের দ্বীপগুলোকে মনে হল ছোট বিন্দু। অধিকাংশই সবুজ।
ক্ষতিগ্রস্থ স্থানগুলো আগে দেখা দরকার, ট্র্যাভিজ বলল। যেখানে মানুষের ঘনবসতি ছিল সেখানে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বেশি নষ্ট হয়েছে সম্ভবত। তোমার কী মনে হয়, ব্লিস?
সম্ভবত। যাই হোক, কিছুই যখন জানা নেই তখন যেদিক দিয়ে সহজ হবে সেদিক দিয়েই দেখা উচিত। বনাঞ্চল এবং তৃণভূমির ঘাস মনুষ্য বসতির সব চিহ্ন ঢেকে দিয়েছে। সুতরাং ওদিকে চোখ বোলানো মানে সময় নষ্ট করা।
আমার মাথায় একটা ধারণা এসেছে, পেলোরেট বলল, যা থাকবে সেগুলো নিয়েই একটা গ্রহ ভারসাম্য তৈরি করবে; অর্থাৎ নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হতে পারে; এবং ক্ষতিগ্রস্থ অংশে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে বসতি হতে পারে।
হতে পারে, পেল। নির্ভর করছে কত খারাপভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো গ্রহে নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ হাজার বছর যথেষ্ট নয়। কয়েক মিলিয়ন বছর লাগবে।
ফার স্টার এখন গ্রহের চারপাশে ঘুরছে না। পাঁচ শ কিলোমিটারের এক বন্ধ্যা ভূমি পাড়ি দিচ্ছে। ছড়ানো ছিটানো হলুদ এবং গাঢ় লাল ফুলবিশিষ্ট ঝোঁপঝাড়, হঠাৎ দুএকটা বড় গাছ চোখে পড়ে।
ওগুলো কী মনে হয়? হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ। মহাকাশযান বাতাসে ভেসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যাকর্ষণের কারণে কানে বাজছে ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন।
ট্র্যাভিজের নির্দেশিত দিকে বেশি কিছু দেখার নেই। এলোমেলো মাটির ঢিবি আর লম্বা লম্বা ঘাস।
আমার কাছে তো কিছুই মনে হচ্ছে না। বলল পেলোরেট।
আবর্জনার ভেতর দিয়ে একটা সোজা লাইন দেখা যাচ্ছে। সমান্তরাল লাইন, ডানদিক থেকেও কিছু লাইন যুক্ত হয়েছে। দেখেছ? দেখেছ? প্রকৃতির তৈরি নয়, মানুষের তৈরি কাঠামো। ভিত আর দেয়াল। যেন আমাদের চোখে পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
কী হলো তাতে। সবই তো ধ্বংসাবশেষ। সঠিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চালাতে বিশেষজ্ঞদেরই বহু বছর লাগবে।
হা, কিন্তু অতো সময় নেই। এটা কোনো প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ হতে পারে।
শেষ মাথায় গাছ পালার বিস্তার কিছুটা হাল্কা, সেখানে ফাঁকা স্থানে এখনও কিছু দেয়ালের আংশিক দাঁড়িয়ে আছে।
শুরু হিসেবে যথেষ্ট ভালো। আমরা ল্যান্ড করছি। বলল ট্র্যাভিজ।
.
৯. মুখোমুখি
ফার স্টার অবতরণ করল একটা টিলার মাথায়। কিছু না ভেবেই ট্র্যাভিজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে চারদিকে কয়েক মাইল দূর থেকে মহাকাশযান চোখে না পড়লে ভালো হয়।
সে বলল, বাইরে তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সে. বায়ুর গতি পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ১১ কিলোমিটার, এবং কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন। স্বাভাবিক বায়ু প্রবাহ সম্পর্কে কম্পিউটারের কোনো ধারণা নেই বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারছে না। যাই হোক আর্দ্রতা যেহেতু ৪০ পারসেন্ট, বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। আমরা বোধহয় আরামদায়ক অক্ষাংশ বা ঋতু বেছে নিয়েছি।
আমার মনে হয়, পেলোরেট বলল, যেহেতু এই গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পরিস্থিতি অনেক খারাপ হবে।
কোনো সন্দেহ নেই, বলল ব্লিস।
যাই হোক, ট্র্যাভিজ বলল, এখনও কয়েক হাজার বছর লাগবে। এই মুহূর্তে গ্রহটা আরামদায়ক, আমার মৃত্যুর পরেও অনেকদিন এরকম থাকবে।
কোমরে চওড়া বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে কথা বলছে সে। তীক্ষ্ণস্বরে ব্লিস জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী, ট্র্যাভিজ।
নেভির প্রশিক্ষণের কথা মনে পড়েছে। নিরস্ত্র অবস্থায় আমি কোনো অপরিচিত গ্রহে নামব না।
তুমি সত্যি সত্যি অস্ত্র নেবে?
অবশ্যই। এই যে আমার ডান হাতে, হোলস্টার তুলে বড় নলের একটা অস্ত্র দেখালো, আমার ব্লাস্টার, এবং বা হাতে, (সরু নলের ছোট অস্ত্র), নিউরোনিক হুইপ।
খুন করার দুধরনের অস্ত্র, ঘৃণার সাথে বলল ব্লিস।
মাত্র একটা। ব্লাস্টার দিয়ে খুন করা যায়। নিউরোনিক হুইপ ব্যথাদায়ক স্নায়ু। গুলোকে জাগিয়ে তুলে, এমনভাবে ব্যথা দেয়, তোমার মনে হবে যেন মরে যাওয়াই ভালো ছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমার কখনো অভিজ্ঞতা হয় নি।
এগুলো সাথে নিচ্ছ কেন?
বলেছি তো। এই গ্রহে বিপদ হতে পারে।
ট্র্যাভিজ, এটা প্রাণহীন গ্রহ।
তাই? প্রযুক্তিতে অগ্রসর কোনো সমাজ নেই। কিন্তু যদি আদিম বুনো সমাজ থাকে। তাদের হাতে হয়তো লাঠি বা পাথর ছাড়া অন্য কিছু থাকবে না, কিন্তু সেগুলোর আঘাতেও মানুষ মারা যায়।
বিরক্ত হলো ব্লিস। বোঝানোর জন্য নিচু স্বরে বলল, মানব নিউরনের কোনো চিহ্নই আমি পাইনি। তার মানে উন্নত বা অনুন্নত কোনো ধরনের মানুষ এখানে নেই।
তা হলে অস্ত্রগুলো আর ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু বহন করতে সমস্যা কোথায়? একটু ওজন বাড়বে, এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। আমার পরামর্শ তোমরা দুজনও–
না, সাথে সাথে বলল ব্লিস। হত্যা বা আঘাত করার মতো কোনো কাজ আমি করব না।
খুন করা নয়, নিজেকে খুন হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো।
আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজেকে রক্ষা করতে পারব।
জেনভ?
দ্বিধা করছে পেলোরেট, কমপরেলনে আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না।
শোন, জেনভ, কমপরেলন পরিচিত, ফাউণ্ডেশন-এর সহকারী। তা ছাড়া আমাদেরকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। সাথে অস্ত্র থাকলে সেগুলো নিয়ে যেত। তুমি একটা ব্লাস্টার রাখবে?
মাথা নাড়ল পেলোরেট। আমি কখনো নেভিতে যাইনি, ওল্ড চ্যাপ। কীভাবে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয় জানি না। প্রয়োজনের সময় দেখা যাবে-আমি কিছু না ভেবেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করব আর মারা পড়ব।
তুমি খুন হবে না, পেল, স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলল ব্লিস। গায়া তোমাকে আমার/তার নিরাপদ হেফাজতে রেখেছে। এই অহংকারী নাবিককেও রেখেছে।
ভালো। নিরাপদ হেফাজতে থাকতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমি অহংকারী নই। শুধু দ্বিগুণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি। বিশ্বাস করো এগুলো না করতে হলেই খুশি হতাম, কিন্তু আমি নিরুপায়।
অসীম মমতায় অস্ত্র গুলোর উপর হাত বোলাতে লাগল ট্র্যাভিজ। এবার চল নামা যাক। হয়তো এই গ্রহের বুকে অনেক হাজার বছর কোনো মানুষের পা পড়েনি।
.
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, বলল পেলোরেট, দিন প্রায় শেষ। কিন্তু সূর্যের অবস্থান দেখে বোঝা যায় এখন প্রায় দুপুর।
সম্ভবত সূর্যের ফ্যাকাশে কমলা রঙের আলোর জন্য। বলল ট্র্যাভিজ। মনে হয় যেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমার ধারণা সূর্যাস্তের সময় গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে।
ধীরে ধীরে ঘুরল সে, চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। অদ্ভুত আলো ছাড়া ও গ্রহের কেমন একটা মেটে গন্ধ রয়েছে। খুব একটা খারাপ না।
উদ্ভিদগুলোর উচ্চতা মাঝারি এবং বয়স্ক কর্কশ বাকল। কাণ্ড পুরোপুরি সোজা নয়, একটু হেলাননা বাতাস না মাটির কারণে ঠিক বলতে পারবে না। গাছগুলোর কারণেই কি গ্রহের পরিবেশ ভীতিজনক মনে হচ্ছে, নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে-অবাস্তব কিছু।
কী করতে চাও, ট্র্যাভিজ? বলল ব্লিস। শুধু দৃশ্য দেখার জন্য নিশ্চয়ই এত দূর ছুটে আসিনি?
আমি আসলে সেটাই করব। ধ্বংসস্তূপটা ঐদিকে। বিশেষজ্ঞ হিসেবে পেলোরেট অনুসন্ধান চালাবে, কারণ প্রাচীন কোনো নিদর্শনের গুরুত্ব আমাদের মধ্যে একমাত্র সেই বুঝতে পারবে। পেলোরেটের নিরাপত্তার জন্য তুমি সাথে যাবে। আর আমি এখানে পাহারা দিচ্ছি।
পাহারা কিসের বিরুদ্ধে? পাথর বা লাঠি হাতে কোনো আদিম মানুষের বিরদ্ধে? হয়তো, তারপর একটু মলিন হলো মুখের হাসি, অদ্ভুত ব্যাপার, ব্লিস। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, জানি না কেন।
এসো, ব্লিস। বলল পেলোরেট। আর অপেক্ষা করতে পারছি না। প্রাচীন নিদর্শন আমাকে জাদুর মতো টানে। যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাই
দূরে সরতে সরতে একসময় বাতাসে মিলিয়ে গেল পেলোরেটের গলা। আবার চারপাশের দৃশ্য দেখায় মন দিল ট্র্যাভিজ। কেন তার সন্দেহ বাড়ছে?
মানববসতিহীন কোনো গ্রহে এর আগে সে পদার্পণ করেনি। মহাকাশ থেকে অনেকগুলো দেখেছে। কিন্তু সেগুলো ছিল ছোট আর পানি এবং বায়ুহীন। দুএকবার অনুশীলন বা জাহাজ মেরামতের জন্য ঐ ধরনের গ্রহে অবতরণ করলেও তার মাটিতে নামার সুযোগ হয়নি।
ঐসব গ্রহে নামলেও কি এমন অনুভূতি হতো। নিঃসন্দেহে হতো না। কারণ সে থাকত স্পেস স্যুটের ভেতরে। সবকিছুই মনে হতো স্বাভাবিক।
এখন সে স্পেস স্যুট পরেনি, কারণ দাঁড়িয়ে আছে একটা বাসযোগ্য গ্রহে। প্রায় টার্মিনাসের মতো আরামদায়ক, কমপরেলন থেকে উষ্ণ। চিবুকে বাতাসের স্পর্শ উপভোগ করছে। পিঠে এসে লাগছে মিঠে রোদের উষ্ণতা, কানে বাজছে গাছের শাখার ফিসফিসানি। সবকিছু পরিচিত, স্বাভাবিক, শুধু এখানে কোনো মানুষ নেই–অন্তত এখন আর মানুষ এখানে বাস করে না।
এটাই কি কারণ? সেকারণেই কি এই গ্রহকে এত রহস্যময় মনে হচ্ছে? কারণ এক সময় এখানে মানুষ বাস করত, আর এখন এটা পরিত্যক্ত।
এর আগে কোনো পরিত্যক্ত গ্রহে পা ফেলেনি বা নাম শোনেনি; কোনো গ্রহ পরিত্যক্ত হতে পারে এই ধারণাই তার নেই। যতগুলোতে মানুষ বসবাস শুরু করেছে তার সবগুলোতে আজও বসবাস করছে।
আকাশের দিকে তাকালো। সবকিছুই এই গ্রহ ছেড়ে চলে যায়নি। হঠাৎ হঠাৎ একটা-দুইটা পাখি উড়তে দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিক, অন্তত স্লেটের মতো নীল আকাশ, কমলারঙের মেঘের তুলনায়।
অনেক গাছেই সে শুনতে পারছে পাখির ডাক, কানে ভেসে আসছে পোকা মাকড়ের মৃদু গুঞ্জন। ব্লিস প্রজাপতির কথা বলেছিল। সেগুলোর সংখ্যার প্রাচুর্য এবং রঙের প্রাচুর্য অবাক করার মতো।
মাঝে মাঝেই ঘাসঝাড়ের ভেতর খসখস শব্দ হচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না। কিসের শব্দ
তার দৃষ্টিসীমার ভেতরে কোনো ভয়ংকর জন্তু নেই। ব্লিসের মতে মানবস্পর্শ ছাড়া যে গ্রহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিবর্তিত হয় সেখান থেকে প্রথমেই ভয়ংকর বন্য প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়। ছোট বেলায় সে যত রূপকথা বা কল্পকাহিনী পড়েছে সব নিশ্চয়ই পৃথিবীর পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। হাইপারড্রামায় সিংহ, ইউনিকর্ন ড্রাগন, ভালুক, তিমি আরও কত ধরনের প্রাণী দেখাতো, সবই বোধহয় পৌরাণিক বা কাল্পনিক। শুনেছিল মৌমাছি নাকি হুল ফুটাতে পারত, বাস্তবে নিশ্চয়ই মৌমাছি এত ক্ষতিকারক নয়।
পাহাড়ের পাদদেশ ধরে ডানদিকে হাঁটতে লাগল ধীরে ধীরে। ঘাসগুলো লম্বা এবং সারিবদ্ধ কিন্তু ছড়ানো ছিটানো। গাছপালার ভেতর দিয়ে সে পথ তৈরি করে নিল। ঘাস বা গাছ যেখানেই জন্মেছে সেখানেই গুচ্ছবদ্ধ হয়ে জন্মেছে।
বিরক্তিসূচক শব্দ করল সে,কিছুই ঘটবে না। বরং জাহাজে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিলেই ভালো হবে। না, পাহারা দিতে হবে।
হয়তো সেন্ট্রির দায়িত্ব পালন করা উচিত-মার্চ করবে এক দুই, এক দুই। সূক্ষ্মভাবে প্যারেড ইলেকট্রো রড পরিচালনা করবে। (এক ধরনের অস্ত্র –তিন শতাব্দী পূর্বে এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলেও প্যারেড ড্রিলের সময় এখনও এটা অপরিহার্য।)।
আপন মনে হাসল সে, তারপর মনে হলো পেলোরেট আর ব্লিস এর সাথে যোগ দেওয়া উচিত। কেন? সে কী করবে?
ধরা যাক কোনো কিছু পেলোরেটের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে তার চোখে পড়তে পারে।–বেশ তার জন্য পেলোরেট ফিরে আসার পরেও অনেক সময় পাওয়া যাবে।
তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কারের কৃতিত্ব সে পেলোরেটকে দিতে চায়।
ওরা দুজন বিপদে পড়তে পারে? বোকা! কী ধরনের বিপদ? বিপদে পড়লে ওরা নিশ্চয়ই চিৎকার করবে।
দাঁড়িয়ে কান খাড়া করল, কোনো শব্দ নেই।
তারপরই খেয়াল হলো সে মার্চ করছে। দৃঢ় ভঙ্গিতে মার্চ করে একদিকে কিছুদূর এগিয়ে চমৎকারভাবে অ্যাবাউট টার্ন করল। আনমনাভাবে তাকালো দূরে মহাকাশযানের দিকে। তাকিয়েই সত্যি সত্যিই সে জমাট বরফ হয়ে গেল।
সে একা নয়।
এতক্ষণ কীটপতঙ্গ আর পাখি ছাড়া অন্য কোনো জীবিত প্রাণী চোখে পড়েনি। কোনো শব্দ শোনেনি, কিছু দেখেনি-কিন্ত তার আর মহাকাশ যানের মাঝে একটা বন্য প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে।
অপ্রত্যাশিত চমকে কী দেখছে সেটা বুঝতে তার অনেক সময় লাগল।
একটা কুকুর।
কুকুরের প্রতি ট্র্যাভিজের কখনো আকর্ষণ ছিল না। গ্যালাক্সির সব গ্রহের মানুষই কুকুর পোষে। কত প্রজাতির কুকুর আছে তার কোনো হিসাব নেই। তার মতে
শুধুমাত্র প্রভুভক্তি এবং ঘ্রাণ শক্তির কারণেই কুকুরের গুরুত্ব।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটতেই একটু মনোযোগী হল ট্র্যাভিজ। বিশাল কুকুর, কশকায়। লম্বা পা। চোখে প্রভুভক্তির কোনো চিহ্নই নেই। হাঁ করা মুখ দেখে মনে হবে যেন সম্ভাষণ জানাচ্ছে, কিন্তু ভয়ানক দাঁতগুলো দেখলে ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগবে না।
ট্র্যাভিজের মনে হলো এই কুকুর কখনো মানুষ দেখেনি, এবং তার পূর্বের অসংখ্য কুকুরপ্রজন্মও মানুষ দেখেনি। আর তাই এটা মানুষ দেখে ঠিক ট্র্যাভিজের মতোই অবাক। ট্র্যাভিজ যদিও দ্রুত প্রাণীটিকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু কুকুরটা পারেনি। আর তাই এখনও অবাক এবং সম্ভবত সতর্ক।
এধরনের একটা প্রাণীকে এভাবে ছেড়ে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। ট্র্যাভিজের ধারণা হলো কুকুরটার সাথে দ্রুত ভাব করা জরুরি।
আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সে। একটা হাত সামনে। বাড়ালো, শান্ত, নরম সুরে কথা বলছে। কুকুরের দৃষ্টি ট্র্যাভিজের উপর, এক পা দু পা করে পিছু হঁটছে আর গড়গড় শব্দ করছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল ট্র্যাভিজ। একদিকে সামান্য নড়াচড়া চোখে পড়তে ঘুরল সেদিকে, আরও দুটো কুকুর এগিয়ে আসছে সেদিক থেকে। ঠিক প্রথমটার মতোই ভয়ংকর।
হৃৎপিণ্ড টেনিস বলের মতো লাফাচ্ছে। মহাকাশযানে যাবার পথ বন্ধ। দৌড়ে লাভ নেই, কারণ কয়েকগজ যাবার আগেই কুকুরগুলো তাকে ধরে ফেলবে। ব্লাস্টার দিয়ে হয়তো একটাকে মারতে পারবে, বাকি দুটো ঝাঁপিয়ে পড়বে চোখের পলকে। দেখতে পারছে দূর থেকে আরো কুকুর এগিয়ে আসছে। নিজেদের ভেতর যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা আছে? এরা দলবেঁধে শিকার করে?
বাঁদিক ফাঁকা, তাড়াহুড়ো না করে ট্র্যাভিজ সেদিকে একটু সরল, কুকুরগুলোও তার সাথে জায়গা বদলালো।
কোনো সন্দেহ নেই এখনও আক্রান্ত হয়নি কারণ মানুষ এবং মানুষের গায়ের গন্ধ এই প্রাণীগুলোর কাছে অপরিচিত। কেমন আচরণ করতে হবে বুঝতে পারছে না। সে দৌড়ালে, সেই দৃশ্য কুকুরগুলোর পরিচিত মনে হবে এবং সেক্ষেত্রে কী করতে হয় সেটা প্রাণীগুলো ভালোভাবেই জানে।
ট্র্যাভিজ তার একপেশে হাঁটা অব্যাহত রাখল। কুকুরগুলোও এগোচ্ছে, কাছাকাছি হচ্ছে। তিনটা কুকুরের দৃষ্টি তার উপর। আরও দুটো যোগ দিল। দূরে আরো অনেকগুলো দেখা যাচ্ছে। সময় নেই, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
এবার!
যে গাছটার দিকে দৌড়ালো সেটা খুব বেশি দূরে ছিল না, কিন্তু মনে হয় দৌড়ে সে নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। টের পেল ঠিক গোড়ালি ঘেষে একটা হাঁ করা চোয়াল সরে গেল।
গাছে উঠার অভ্যাস নেই, যদুর মনে পড়ে দশ বছর বয়সের পরে আর কখনো গাছে চড়েনি। কিন্তু এখানে কাণ্ডগুলো একটু হেলানো, গাছের বাকল এবড়োখেবড়ো, ধরার সুবিধা আছে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, জান বাঁচানো প্রয়োজন। আর প্রয়োজন হলে মানুষ কি না করতে পারে।
প্রায় দশ মিটার উঁচু একটা ডালে চড়ল ট্র্যাভিজ। একটা হাত কেটে রক্ত পড়ছে সেদিকে লক্ষ নেই। গাছের গোড়ায় হামাগুড়ি দিয়ে বসেছে পাঁচটা কুকুর, তাকিয়ে আছে উপরে। জিভ ঝোলানো, অপেক্ষা করছে ধৈর্যের সাথে।
এখন কী করবে?
.
ট্র্যাভিজের যুক্তি কাজ করছে না, এলামেলো লাগছে সব।
ব্লিস বলেছিল গ্রহগুলো রূপান্তরের সময় মানুষ এমন ভারসাম্য হীন ইকোলজি তৈরি করে যা মানুষ ছাড়া অন্য কেউ টিকিয়ে রাখতে পারে না। যেমন বসতি স্থাপনকারী কখনোই নিজের থেকে বড় কোনো শিকারি প্রাণী সাথে আনে নি। পৌরাণিক জীবজন্তু-বাঘ, ভালুক, কুমীর-কে চায় গ্যালাক্সির সব জায়গায় এগুলো বয়ে বেড়াতে?
অর্থাৎ মানুষই একমাত্র বড় শিকারি প্রাণী এবং তারাই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী উদ্ভিদ আর প্রাণী নির্বাচন করেছে।
এখন কোনো কারণে মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেলে, অন্য কোনো প্রাণী তার স্থলাভিষিক্ত হবে। কিন্তু কোনগুলো? সবচেয়ে বড় যে প্রাণীগুলো মানুষ কাছাকাছি রেখেছিল কুকুর এবং বিড়াল। এগুলো পোষাপ্রাণী হিসেবে মানুষের কাছে থাকত।
যদি এগুলোর ভরণপোষণের জন্য কোনো মানুষ না থাকে? তখন নিজেদের এবং যে শিকারের উপর এই প্রাণীগুলো নির্ভরশীল সেগুলোর টিকে থাকার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেবে।
কাজেই কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বড় আকৃতির কুকুরগুলো বড় শিকারের পিছনে ছুটবে, ছোট আকৃতিরগুলো পাখি বা অন্য কোনো ছোট প্রাণী শিকার করবে। বিড়াল শিকার করে রাতে, একা। কুকুর শিকার করে দিনে দলবেঁধে।
এবং সম্ভবত বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হবে। হয়তো কোনো প্রজাতির কুকুর সমুদ্রের নিচ থেকে শিকার ধরার সামর্থ্য তৈরি করবে। কোনো কোনো প্রজাতির বিড়াল হয়তো আকাশে উড়ে উড়ে শিকার ধরার ক্ষমতা অর্জন করবে।
যখন ট্র্যাভিজ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করছে কী করা যায়, তখনই এতগুলো ভাবনা মুহূর্তের মধ্যে তার মাথায় খেলে গেল।..
কুকুরের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গুনে দেখল গাছের নিচে আছে তেইশটা, আরো। আসছে। কত বড় দল? লাভ কি জেনে? নিচে যে কয়টা আছে সেই কয়টাই যথেষ্ট।
হোলস্টার থেকে ব্লাসটার বের করল। কিন্তু শক্ত বাটে হাত বুলিয়েও নিরাপদ বোধ করল না। কয়টা চার্জ ফায়ার করতে পারবে সে? তেইশটা নিশ্চয়ই পারবে না।
ব্লিস আর পেলোরেটের কী হবে? বেরিয়ে এলে যদি কুকুরগুলো ওদের হামলা করে? না বেরোলেও একই কথা। যদি টের পায় যে ধ্বংসস্তূপের ভেতর আরো দুজন। মানুষ আছে তা হলে আর ঠেকানো যাবে না।
ব্লিস এগুলোকে থামাতে পারবে বা তাড়াতে পারবে? সে পারবে হাইপার স্পেস দূরত্ব থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করতে?
কী করবে সে, সাহায্যের জন্য চিৎকার করবে? চিৎকার শুনে ওরা বেরিয়ে এলে ব্লিসের দৃষ্টির সামনে কুকুরগুলো নতজানু হবে, (দৃষ্টি নাকি অন্য কোনো অবোধ্য মেন্টাল অ্যাকটিভিটি) নাকি কুকুরের আক্রমণে ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ট্র্যাভিজ বসে বসে দেখবে।
না, তখন ব্লাস্টার দিয়ে একটা বা দুটো কুকুর মেরে ফেলবে। বাকিগুলো কিছু সময়ের জন্য ভয় পাবে। গাছ থেকে নেমে ব্লিস আর পেলোরেটকে নিয়ে তখন আশা করা যায় জান বাজি রেখে জাহাজের দিকে দৌড়ানো যাবে।
ব্লাস্টারের মাইক্রোওয়েভ বিম সে তিন-চতুর্থাংশ মার্কে সেট করল। একটা কুকুর মারার জন্য যথেষ্ট, এতে বাকিগুলোও ভয় পাবে। আর শক্তি সঞ্চয় করে রাখা দরকার।
যত্নের সাথে লক্ষ্য স্থির করল ঠিক মাঝখানের কুকরটার উপর, আচরণ দেখে এটাকেই দলনেতা মনে হয়েছে, কারণ এটা অনেক বেশি ধীর স্থির এবং ভয়ংকর। সরাসরি তাকিয়ে আছে ব্লাস্টারের মাজলের দিকে। যেন ট্র্যাভিজের ক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করছে।
আগে কখনো কোনো মানুষের দিকে ব্লাস্টার ফায়ার করেনি, বা করতে দেখেনি। প্রশিক্ষণের সময় ব্যবহার করত ডামি। আর যুদ্ধ ছাড়া মানুষকে ফায়ার করবে কেন? কোন মানুষটা জোর করে ব্লাস্টার ব্যবহার করবে? শুধু এখানে মানুষের অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতির কারণে
পরিষ্কার কোনোকিছু ভাবতে না পারলেও এটা বুঝতে পারল যে একখণ্ড মেঘ সূর্য ঢেকে দিয়েছে, আর ঠিক ওই মুহূর্তেই সে ফায়ার করল।
ব্লাস্টারের নল থেকে লক্ষ্য স্থির করা কুকুর পর্যন্ত একটা চকচকে সরল রেখা তৈরি হলো; সূর্যের আলো থাকলে হয়তো দেখা যেত না। আঘাত পেয়ে মনে হলো যেন প্রাণীটা হাঁটু গেড়ে বসবে, তারপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল। শরীরের এক অংশের রক্ত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বাস্প হয়ে গেছে।
শব্দ হয়েছে খুব হালকা, ডামিতে প্র্যাকটিস করার সময় যেমন হতো নিহত কুকুরের ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি, যদিও হাড় মাংস এক হয়ে গেছে। ট্র্যাভিজের মনে হলো যেন নাড়িভুড়ি সব পেট থেকে বেরিয়ে আসবে।
বাকি কুকুরগুলো ফিরে তাকালো, কোনো কোনোটার গায়ে নিহত কুকুরের রক্ত মাংস ছিটকে এসে পড়েছে। মাত্র এক মুহূর্তের দ্বিধা, তারপর সবগুলো একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিহত কুকুরের মাংস খাওয়ার জন্য। আরও অসুস্থ বোধ করল ট্র্যাভিজ। প্রাণীগুলোকে সে ভয় দেখাতে পারেনি; বরং উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তা ছাড়া তাজা রক্ত মাংসের গন্ধে আরও কুকুর বা অন্যান্য শিকারি। প্রাণীগুলো ছুটে আসবে।
একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ট্র্যাভিজ কি-
ব্লিস আর পেলোরেট বেরিয়ে এসেছে ধ্বংসস্তূপ থেকে। দাঁড়িয়ে পড়ল ব্লিস, এক হাত দিয়ে পেলোরেটের পথ আটকে দিল। সাথে সাথেই পরিস্থিতি বুঝে গেছে, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই।
চিৎকার করল ট্র্যাভিজ, তোমরা আসার আগেই তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। ব্লিস, তুমি সামলাতে পারবে?
সামান্য, ব্লিস বলল, চিৎকার না করে, শুনতে কষ্ট হলো ট্র্যাভিজের যদিও কুকুরের ক্রুদ্ধ গর্জন আর নেই, যেন ওগুলোর উপর শান্ত নিঃশব্দতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কেউ।
সংখ্যায় অনেক, ব্লিস বলল, এবং ওগুলোর নিউরোনিক প্যাটার্ন আমার অপরিচিত। গায়াতে এমন হিংস্র প্রাণী নেই।
টার্মিনাসেও নেই, চিৎকার করল ট্র্যাভিজ, কোনো সভ্য গ্রহেই নেই। যতগুলোকে সম্ভব আমি গুলি করছি, বাকিগুলোকে তুমি সামলাও। সংখ্যায় কমলে তোমার জন্য সুবিধা হবে।
না, ট্র্যাভিজ। গুলি করলে অন্যগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। পিছনে সরে দাঁড়াও পেল। তুমি আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। ট্র্যাভিজ, তোমার অন্য অস্ত্রটা বের কর।
নিউরোনিক হুইপ?
হ্যাঁ, যেটা দিয়ে ব্যথা দেওয়া যায়। লো পাওয়ার। লো পাওয়ার!
তুমি-এরা ব্যথা পাবে? রাগের সাথে বলল ট্র্যাভিজ। এখন কি এসব ভাবার সময়?
যা বলছি তাই করো। লো-পাওয়ার, এবং যে কোনো একটা কুকুরকে আঘাত করো। আমি আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারব না।
গাছের গোড়া থেকে সরে গিয়ে কুকুরগুলো এখন ব্লিস আর পেলোরেটকে ঘিরে ফেলেছে। ওরা দুজন আবার দাঁড়িয়েছে একটা ভাঙা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। সবচেয়ে কাছের কুকুরটা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে আরো কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল। বোঝার চেষ্টা করছে যেখানে শিকার সহজেই আয়ত্তে আনা যায় সেখানে তারা অপেক্ষা করছে কেন? দুই-একটা আবার চেষ্টা করল দেয়ালের ওপারে গিয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করার।
নিউরোনিক হুইপের পাওয়ার ঠিক করার সময় হাত কাঁপতে লাগল ট্র্যাভিজের। এই অস্ত্র ব্লাস্টারের তুলনায় কম এনার্জি খরচ করে। লক্ষ্য স্থির করারও প্রয়োজন হয় না। কুকুর দলের উপর ঘুরিয়ে মারলেই হলো। সাধারণত এভাবেই উত্তেজিত জনতাকে থামানো হয়।
তবে ব্লিসের পরামর্শ মানল সে। একটা কুকুরকে লক্ষ্য করে ফায়ার করল। চিৎ হয়ে শুয়ে পরল কুকুরটা, যন্ত্রণায় পা ছুঁড়ছে। গলা চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ প্রলম্বিত চিৎকার।
বাকি কুকুরগুলো ছিটকে সরে এল, তারপর নিজেরাও শুরু করল তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার। ডান দিকে ঘুরে পালাতে শুরু করল, প্রথমে ধীর গতিতে তারপর দ্রুত এবং সবশেষে প্রাণপণে। আহত কুকুরটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ছুটছে সবার পিছনে।
কুকুরের ডাক মিলিয়ে গেল দূরের বাতাসে, ব্লিস বলল মহাকাশযানে ফেরা উচিত। এগুলো আবার আসতে পারে। অথবা, অন্য কোনো প্রাণী।
ট্র্যাভিজ ধারণা করল মহাকাশযানের প্রবেশ মুখ আগে কখনো এত দ্রুত খোলেনি, ভবিষ্যতেও খুলবে না।
.
ট্র্যাভিজের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক রাত নেমে আসছে। হাতের ক্ষতের উপর সিনথো স্কিন লাগানোর কারণে শারীরিক কোনো ব্যথা নেই, কিন্তু মনের ভেতর যে ক্ষত তৈরি হয়েছে সেটা সারবে না সহজে।
বিপদকে সে ভয় পায়নি। এরকম মুহূর্তে একজন সাধারণ সাহসী মানুষ যা করত ঠিক তাই করেছে সে। সে চমকে গেছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে বিপদ আসায়। কেমন হাস্যকর। কুকুরের ভয়ে সে গাছে উঠে বসেছিল, মানুষ শুনলে বলবে কি। একঝাক ক্রোধান্বিত ক্যানারি পাখির আক্রমণের মুখে পড়লে, সেই ঘটনাও এতখানি হাস্যকর শোনাবে না।
গত একঘণ্টা ধরে সে বাইরে কুকুরদের নতুন করে আক্রমণের শব্দ শুনছে। জোরালো গর্জন, মহাকাশযানের ইস্পাত কাঠামোতে নোখ দিয়ে আঁচড়ের শব্দ।
তুলনামূলকভাবে পেলোরেটকে অনেক ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই ব্লিস সামলাতে পারবে, ওল্ড চ্যাপ, তবে বলতেই হবে যে তুমি বেশ ভালোই অস্ত্র চালিয়েছ।
কাঁধ ঝাঁকালো ট্র্যাভিজ। এসব কথা বলতে ভালো লাগছে না।
পেলোরেটের হাতে তার লাইব্রেরি-সেই কমপ্যাক্ট ডিস্ক, যার ভেতরে তার সারা জীবনের গবেষণা এবং সংগ্রহ স্টোর করা। এটা নিয়ে ঢুকল বেডরুমে যেখানে তার ছোট রিডার রয়েছে। বেশ খুশি মনে হচ্ছে তাকে, ট্র্যাভিজ কারণটা বুঝতে পারছে না। যাই হোক কুকুরের চিন্তা দূর হলে এটা নিয়ে ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
একা হওয়ার পর নিরাসক্ত গলায় ব্লিস বলল, আমার মনে হয় তুমি কিছুটা অবাক হয়েছিলে।
অনেকখানি, হাসিমুখে বলল ট্র্যাভিজ। কে ভেবেছিল যে একটা কুকুরের ভয়ে আমাকে পালাতে হবে।
বিশ হাজার বছর মানুষ ছাড়া থাকার কারণে কুকুরগুলো আর কুকুর নেই। সম্ভবত এগুলোই এখন গ্রহের প্রধান শিকারি প্রাণী।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। গাছের মগডালে বসে ঠিক এই কথাগুলোই ভেবেছি। ইকোলজির ভারসাম্যহীনতার ব্যাপারে তোমার বক্তব্য পুরোপুরি নির্ভুল।
মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই নির্ভুল-কিন্তু চিন্তা করে দেখ কুকুরগুলো কেমন সংগঠিত হয়ে কাজ করেছে। পেল বলেছিল, যে প্রাণীগুলো আছে সেগুলো বিবর্তনের মাধ্যমে ফাঁকা জায়গা পূরণ করবে এবং প্রকৃতিতে স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য তৈরি হবে, কথাগুলো সত্যি হলে আমি একটুও অবাক হবে না।
বেশ অদ্ভুত। ঠিক একই ধারণা আমার মাথায়ও এসেছে।
নিশ্চয়ই ভারসাম্যহীনতা খুব বেশি ছিল না, নইলে সংশোধন করতে অনেক সময় লাগতো। তার আগেই হয়তো এই গ্রহ ধ্বংস হয়ে যেত।
একমত হলো ট্র্যাভিজ।
ব্লিস চিন্তিতস্বরে জিজ্ঞেস করল, সাথে অস্ত্র নেওয়ার কথা মনে হলো কেন তোমার?
কোনো লাভ হয়নি। তোমার শক্তির কারণেই
পুরোপুরি নয়। তোমার অস্ত্র আমার কাজে লাগাতে হয়। বাকি গায়ার সাথে আমার হাইপারস্পেসাল যোগাযোগ এবং আচমকা অনেকগুলো অপরিচিত বৈশিষ্ট্যের আইসোলেট মাইণ্ডের মুখোমুখি হই, তোমার নিউরোনিক হুইপ ছাড়া আমি কিছুই। করতে পারতাম না।
ব্লাস্টার কোনো কাজেই আসেনি। চেষ্টা করে দেখেছি।
ব্লাস্টার দিয়ে একটা কুকুরকে মেরে ফেলা যায়। বাকিগুলো অবাক হলেও ভয় পাবে না।
তারচেয়েও খারাপ। মৃত কুকুরের দেহাবশেষ জীবিত কুকুরগুলো খেয়ে ফেলে। আমি ওদের বসে থাকার জন্য পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। নিউরোনিক হুইপ ভিন্ন। এটা দিয়ে ব্যথা তৈরি করা যায়, এবং ব্যথা পেয়ে একটা কুকুর চিৎকার করলে বাকি কুকুরগুলো সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারবে, এবং সেগুলোও ভয় পেতে শুরু করবে। তুমি আঘাত করার পর আমি শুধু ওগুলোর মাইণ্ডে হালকা ধাক্কা দিয়ে ভয়টা বাড়িয়ে তুলি।
হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বুঝতে পেরেছিলে এই পরিস্থিতিতে হুইপ কাজে দেবে। আমি বুঝতে পারিনি।
আমার মাইও সামলানোর অভিজ্ঞতা আছে, তোমার নেই। সেজন্যই লো পাওয়ারের কথা বলেছিলাম। আমি চাইনি কুকুরটা মরে যাক। চেয়েছিলাম একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে তীব্র ব্যথা তৈরি করতে।
চমৎকার বুদ্ধি করেছিলে। আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
তোমার অস্ত্রের সাহায্য ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। চিন্তিত স্বরে বলল ব্লিস, অবাক লাগছে, যেখানে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বললাম এই গ্রহে কোনো মানুষ নেই, তারপরেও আমার কথা না শুনে তুমি সাথে অস্ত্র নিলে কেন? তুমি দিব্যচোখে কুকুরগুলো দেখেছিলে?
না,অবশ্যই না, অস্ত্র সাথে রাখার অভ্যাস আমার নেই। কমপরেলনে একবারও অস্ত্রের কথা মনে হয়নি। আমার ধারণা ইকোলজির ভারসাম্যহীনতা নিয়ে যখন আলোচনা করছিলাম তখনই মনের গভীরে কেন যেন মনে হয়েছে মানুষের অনুপস্থিতিতে জন্তু জানোয়ারগুলো হিংস্র হয়ে উঠবে। অবচেতন মনের প্রভাবেই হয়তো অস্ত্র নিয়েছি, আর কিছু না।
এত হালকাভাবে উড়িয়ে দিও না। আলোচনায় আমিও ছিলাম, কিন্তু আমার তো সেরকম কিছু মনে হয়নি। এটাই তোমার সেই বিশেষ অন্তদৃষ্টির ক্ষমতা গায়া যার মূল্য দেয়। বুঝতে পারছি এধরনের সুপ্ত অন্তর্দৃষ্টি তোমার কাছে বিরক্তিকর, কারণ কোনো যুক্তি ছাড়াই তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছ।
টার্মিনাসে সাধারণত এটাকে বলা হয় যা মন চায় তাই করা।
গায়াতে বলা হয় চিন্তা না করেই জানা। তুমি চিন্তা না করে কোনো কিছু জানা পছন্দ করো না, তাই না?
আমাকে খোঁচায়, হ্যাঁ। শুধু মনের আবেগ দিয়ে পরিচালিত হতে চাই না। আমার ধারণা মনের প্রতিটা আবেগের পিছনে যুক্তি আছে। কিন্তু যুক্তিগুলো না জানলে মনে হয় নিজের মাইণ্ডের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই–এক ধরনের উন্মাদনা।
এবং গায়া ও গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে রায় দেওয়ার সময় মনের নির্দেশ পালন করেছ, এখন পিছনের যুক্তিগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছ।
এক ডজনেরও বেশিবার কথাগুলো বলেছি।
তখন বিশ্বাস করিনি, সেজন্য দুঃখিত। এ-ব্যাপারে আর কখনো বাধা দেব না, তবে আশা করি গায়ার পক্ষে কোনো যুক্তি বলতে চাইলে তুমি শুনবে।
সবসময়ই, শুধু মনে রাখতে হবে যে সেই যুক্তিগুলো অমি নাও মানতে পারি।
কখনো মনে হয়েছে এই গ্রহটা আবার আদিম পর্যায়ে ফিরে যাচ্ছে এবং তার কারণ সম্ভবত যে বুদ্ধিমান জীব রক্ষকের ভূমিকা পালন করত তাদের অনুপস্থিতি। যদি এই গ্রহ গায়া হতো বা গ্যালাক্সিয়ার অংশ হতো, তা হলে কখনোই এমন ঘটত না। রক্ষক বুদ্ধিমান প্রজাতি সামগ্রিক গ্যালাক্সির রূপে সবস্থানেই বিদ্যমান থাকত। এবং পরিবেশে যদি কোনো ভারসাম্যহীনতা দেখা দিত স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা ভারসাম্যে ফিরে আসত।
তুমি বলতে চাও কুকুর প্রজাতি আর কখনো খাদ্য গ্রহণ করবে না?
অবশ্যই খাদ্য গ্রহণ করবে,তবে শুধু খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয় বরং একটা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এবং স্বনির্ধারিত পথে ইকোলজির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য।
ইণ্ডিভিজুয়াল ফ্রিডম কুকুরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না হলেও মানুষের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।–যদি মানুষের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, একটা-দুইটা গ্রহ না সব জায়গা থেকেই? যদি গ্যালাক্সিয়া তৈরি হয় কিন্তু কোনো মানুষ না থাকে? তখন কি অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রজাতি রক্ষকের ভূমিকা পালন করবে? অন্য সকল লাইফ ফর্ম এবং বস্তুর একত্রিত কনশাসনেস এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে।
ইতঃস্তত করছে ব্লিস। এ ধরনের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করা হয়নি, এবং মনে হয় না ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতি হবে।
কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষের মাইণ্ড অন্য সবকিছু থেকে আলাদা, এবং এর অনুপস্থিতিতে অন্য কোনো কনশাসনেস তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে না। সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে মানুষকে। একজন মানুষই আরেকজন মানুষের পরিপূরক হতে পারে না, অন্য প্রাণী তো দূরের কথা।
তথাপি তুমি গ্যালাক্সিয়ার পক্ষে রায় দিয়েছ।
তার পেছনের যুক্তিটা আমার অজানা।
পেছনের যুক্তি হতে পারে ভারসাম্যহীন ইকোলজির প্রভাব? গ্যালাক্সির প্রতিটা গ্রহই ছুরির ধারালো প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বা বলা যায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এবং এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় গ্যালাক্সিয়া। এর চেয়ে বড় যুক্তি আর কি হতে পারে? মানুষের অমানবিক যুদ্ধ আর প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা বাদই দিলাম।
না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এই বিষয়গুলো আমার মাথায় আসেনি।
তুমি নিশ্চিত হবে কীভাবে?
পরে কেউ কথাগুলো আমার সামনে বললে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম। আমার অন্তৰ্জ্জন কি ছিল। মনে হয় যেন এই গ্রহে আমি হিংস্র প্রাণী দিব্যচোখে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তুমি বলার আগে জানতাম না কি দেখছি।
বেশ, আমাদের দুজনের ক্ষমতা, তোমার দিব্যদৃষ্টি এবং আমার মেন্টালিজম এ দুটোকে একত্রিত করতে না পারলে আজকে আমরা মারা যেতাম। চল আমরা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বন্ধু হই।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। যদি তুমি চাও।
কণ্ঠস্বরের শীতলতা লক্ষ করে ভুরু উঁচু করল ব্লিস, কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে পেলোরেট ঝড়ের বেগে এসে ঢুকল, এমনভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে সে, যে-কোনো মুহূর্তে ঘাড় থেকে ছিটকে পড়ে যেতে পারে।
মনে হয়,বলল সে, আমরা পেয়েছি।
.
ট্র্যাভিজের ধারণা সহজ উপায়ে কোনো বিজয় পাওয়া যায় না, আবার মানুষই নিজের বিচার বুদ্ধির উপর সবচেয়ে কম ভরসা করে। টের পেল তার বুকের পেশী এবং গলা শক্ত হয়ে গেছে, তবে কথা বলতে পারল, পৃথিবীর অবস্থান? তুমি পেয়েছ, জেনভ?
ট্র্যাভিজের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল পেলোরেট। লজ্জিত স্বরে বলল, না, গোলান। ওই কথা মনেই ছিল না। ধ্বংসস্তূপে অন্য একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি। বোধহয় খুব একটা গুরুত্ব নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ, ঠিক আছে জেনভ। সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বল কী বলতে এসেছ?
আসলে প্রায় কোনোকিছুই রক্ষা পায়নি। বিশ হাজার বছরের ঝড়ো বাতাস কোনো কিছু রক্ষা পেতে দেয়নি। তা ছাড়া উদ্ভিদ এবং প্রাণীগুলো আগ্রাসী-যাই হোক বাদ দাও। আসল কথা হচ্ছে প্রায় কিছুই না এবং কিছুই না দুটোর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। . ধ্বংসস্তূপটা ছিল সম্ভবত কোনো পাবলিক বিল্ডিঙের কারণ কংক্রিটের কিছু স্তম্ভ আছে যেগুলোতে কিছু বর্ণমালা খোদাই করা। একেবারেই ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে আমি ছবি তুলে এনেছি। আমাদের কাছে বিল্ট-ইন কম্পিউটারসহ যে ক্যামেরাগুলো আছে সেগুলোর একটা দিয়ে–তোমাকে জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি–
অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল ট্র্যাভিজ, বলে যাও।
লেখাগুলো এত বেশি প্রাচীন যে আমার সমস্ত জ্ঞান এবং কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শুধু একটা শব্দ বুঝতে পেরেছি। শব্দটা বেশি গভীর করে খোদাই করা ছিল, কারণ সম্ভবত এটা গ্রহের পরিচয় বহন করে। শব্দটা হচ্ছেপ্ল্যানেট অরোরা তাই আমি অনুমান করছি যে গ্রহে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই গ্রহের নাম অরোরা।
নাম তো একটা থাকতেই হবে। বলল ট্র্যাভিজ।
হ্যাঁ, কিন্তু নাম নির্বাচনের গুরুত্ব আছে। আমার লাইব্রেরিতে খুঁজে অনেক পুরোনো দুটো কিংবদন্তি পেয়েছি। দুটোই এসেছে পরস্পরের কাছ থেকে সীমাহীন দূরত্বে অবস্থিত দুটো পৃথক গ্রহ থেকে। দুই কিংবদন্তিতেই অরোরা শব্দের অর্থ হচ্ছে ভোর।
ভোর বা উষালগ্ন নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয় সাধারণত স্পেস স্টেশন বা কোনো নির্দিষ্ট প্রকৃতির স্থাপনার মধ্যে যেগুলো প্রথম স্থাপিত হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে। এই গ্রহের নাম অরোরা হলে, এটা সম্ভবত এই ধরনের বসতি স্থাপনকারী গ্রহগুলোর ভেতর প্রথম।
তুমি বলতে চাও এটাই পৃথিবী এবং যেহেতু এখানেই মানব জাতির ঊষালগ্ন শুরু হয়েছিল তাই এর আরেক নাম অরোরা?
এতদূর বলার সামর্থ্য আমার নেই।
তিক্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, এখানে রেডিওএ্যাকটিভিটি নেই, বিশাল উপগ্রহ নেই, কোনো গ্রহের সুবিশাল বলয় নেই।
ঠিক। কিন্তু ড্যানিডার ধারণা এই গ্রহ প্রথম পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারী বা স্পেসার বিশ্বগুলোর একটা। অরোরা নামের কারণে ধরে নেওয়া যায় এটাই হচ্ছে । সর্ব প্রথম স্পেসার বিশ্ব। তার মানে এই মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর পরেই মানব জাতির সর্বাধিক প্রাচীন বাসভূমিতে। খুব এক্সাইটিং,তাই না?
চমৎকার, জেনভ। কিন্তু শুধু নাম থেকেই কি এতকিছু অনুমান করা যায়?
আরো আছে। আমি রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখেছি, বর্তমানে গ্যালাক্সিতে অরোরা নামের কোনো গ্রহ নেই, আমি নিশ্চিত তোমার কম্পিউটারেও নেই। অনেক গ্রহই ভোর শব্দের অন্য প্রতিশব্দগুলো ব্যবহার করে কিন্তু কেউই অরোরা শব্দটা ব্যবহার করে না।
কেন করবে? প্রি-গ্যালাকটিক শব্দ হলে ব্যবহার না করাই স্বাভাবিক।
কিন্তু নাম টিকে থাকে, অর্থহীন হলেও। এই গ্রহে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করা হলে নিশ্চয়ই এটা একসময় বিখ্যাত ছিল; হয়তো গ্যালাক্সির নেতৃস্থানীয় বিশ্ব ছিল। পরবর্তীতে অনেক গ্রহ নিশ্চয়ই নিউ অরোরা বা অরোরা মাইনর বা এধরনের অন্য কোনো নাম গ্রহণ করেছিল। এবং তারপরে অন্যগুলো-
বাধা দিল ট্র্যাভিজ, হয়তো এই গ্রহে প্রথম বসতি স্থাপন করা হয়নি। হয়তো এটার কোনো গুরুত্বই নেই।
আমার বক্তব্যের পেছনে জোরালো যুক্তি আছে। কী যুক্তি, জেনভ? প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের বসতিস্থানকারীদের ভেতর বিদ্বেষ ছিল। সে কারণেই দ্বিতীয় পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারীদের প্রথম পর্যায়ের কোনো গ্রহের নাম ব্যবহার করেনি। অনুমান করে নেওয়া যায় যে অরোরা নাম আর পুনরাবৃত্তি হয়নি।
হাসল ট্র্যাভিজ। তোমরা মিথলজিস্টরা কীভাবে কাজ করো তার সামান্য ধারণা পেলাম। তুমি সুন্দর একটা কাঠামো তৈরি করেছ, তবে সেটা হয়তো তৈরি করেছ বাতাসের উপর। কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে প্রথম পর্যায়ের বসতি স্থাপনকারীরা রোবটের সাহায্য নিয়েছিল এবং এটাই ছিল তাদের দোষ। এখন এই গ্রহে যদি একটা রোবট পাওয়া যায়, তা হলে তোমার বক্তব্য মেনে নিতে পারি।
গোলান, তোমাকে বলিনি আমি?–না, বলিনি নিশ্চয়। এত উত্তেজিত হয়ে আছি যে গুছিয়ে ভাবতে পারছি না। আমরা একটা রোবট দেখেছি।
কেউ ব্যথা পেলে যেভাবে হাত দিয়ে মালিশ করে, প্রায় সেভাবে কপালে হাত ঘষল ট্র্যাভিজ। রোবট? তোমরা রোবট দেখেছ?
হ্যাঁ। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল পেলোরেট।
কীভাবে বুঝলে?
কেন, ঐটা রোবট ছিল। দেখে বুঝতে পারব না?
এর আগে কখনো রোবট দেখেছ?
না, কিন্তু এটা ছিল ধাতুর তৈরি, দেখতে পুরোপুরি মানুষের মতো। মাথা, হাত পা, গোড়ালি সবই আছে। অবশ্য জং পড়া ধাতু, এবং ওটার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় ভাইব্রেশনের কারণে নিশ্চয়ই আরো ক্ষতি হয়। তাই যখন ধরার জন্য হাত বাড়াই–
ধরতে গেলে কেন?
আসলে নিজের চোখেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাত বাড়াই। ধরার সাথে সাথে জিনিসটা ভেঙে পড়ে যায়। কিন্তু
হ্যাঁ।
পড়ে যাওয়ার আগে চোখের আলো হালকাভাবে জ্বলে উঠেছিল এবং এমন একটা শব্দ করল যেন কিছু বলতে চায়।
তুমি বলতে চাও ওটা এখনও কার্যকর?
সামান্য কার্যক্ষমতা ছিল, গোলান। তারপর বন্ধ হয়ে যায়।
ট্র্যাভিজ ঘুরল ব্লিসের দিকে। তুমিও একই কথা বলবে, ব্লিস।
আমরা একটা রোবট দেখেছি। ব্লিস বলল।
এবং এখনও কার্যক্ষম?
ভেঙে পড়ার সময় হালকা নিউরোনিক প্রবাহ ধরতে পারি আমি।
নিউরোনিক প্রবাহ আসবে কোত্থেকে? কোষ দিয়ে তৈরি জৈবিক মস্তিষ্ক থাকে না রোবটের।
আমার ধারণা সমমানের কম্পিউটার থাকে, এবং আমি সেটা চিহ্নিত করতে পারি।
সেটা রোবটিক না মানবিক মেন্টালিটি, নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে।
এত হালকা ছিল যে নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়, তবে ছিল।
ট্র্যাভিজ প্রথমে ব্লিস তারপর পেলোরেটের দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণু স্বরে বলল, পুরো পরিস্থিতিই পাল্টে গেল।