প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৫.০৫ হলুদ পাহাড় – গোলামুস্ সাক্‌লাইন নাক্‌বি

হলুদ পাহাড় – গোলামুস্ সাক্‌লাইন নাক্‌বি

চৌরাস্তায় এসে পৌঁছাতেই মুহূর্তটা দুই ধারায় ভাগ হয়ে গেল।

দুই ধারা একে অন্যের উল্টো দিকে বইতে লাগল। সৃষ্টির প্রথমদিন থেকে যে-ছবি তার মননের দিগন্তে অঙ্কিত ছিল, সেটা হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল এবং হলুদ পাহাড়ে পরিণত হল। একটা ধারা হলুদ পাহাড় থেকে দূরে সরতে লাগল। দ্বিতীয় ধারা তাকে হলুদ পাহাড়ের দিকে টানতে লাগল। আর, ভিড় চৌরাস্তার উপর থমকে দাঁড়িয়েছিল। কেননা সামনে তার পথ আগলে ছিল লাল বাতি।

অকস্মাৎ হলুদ পাহাড়ের চূড়া থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ভ্ৰাতঃ! ভ্রাতঃ!’

রাস্তার ওপারে দীর্ঘ বাঁশি বেজে উঠল। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল এবং ভিড় বিষম চঞ্চলতায় চৌরাস্তা পার হতে লাগল। তখন দুই ধারা হঠাৎ মিশে গেল। হলুদ পাহাড় তখন চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। তখন রোদ-মগ্ন হলুদ সব পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।

‘দেখতে পাচ্ছেন না, লাল বাতি জ্বলে গেছে?’

এই সতর্কবাণী শুনে সে ঠিক চৌরাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে পিটপিট করে রাস্তার ওপারের দৃশ্য দেখল। উঁচু উঁচু বিস্ময়কর সব অট্টালিকা ভিড়কে গ্রাস করে দাঁড়িয়ে ছিল। যন্ত্রের ঘূর্ণমান চাকার ঘড়ঘড় শব্দ তার কানে এসে লাগলে সে বলল, ‘যদি আমি চৌরাস্তা পার না-হই, তাহলে ফটক বন্ধ হয়ে যাবে– আমি বাইরে রয়ে যাব।’

‘যখন সবুজ সঙ্কেত হল, আপনি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলেন, আর লাল সঙ্কেতে চৌরাস্তা পার হতে চাইলেন। আপনার প্রাণের মায়া যদি না-ও থাকে, তবু ট্রাফিক মেনে চলুন।

‘পাগল-টাগল হবে।

‘চেহারা দেখে তো তা মনে হয় না। ‘

‘যখন সবুজ বাতি হল, ও আমার কাছে দাঁড়িয়েছিল।’

‘তারপর কী হল?’

‘হবে আর কী? দেখি, চোখ দিয়ে আকাশ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হয়, দেখা যায় না এমন কিছু ও দেখছিল।’

‘বুঝি সারারাত জেগে কাটিয়েছে। এখন ঠিক চৌরাস্তার উপর ঘুম পেয়ে থাকবে।’

‘না, ও জেগেই ছিল। ওর চোখ খোলা ছিল। ওর চোখ দূর দিগন্তে আটকে ছিল। ও সবকিছুই দেখছিল। অন্তত আমি এইটুকু বলতে পারি, তার দেহখানা এই দুনিয়াতেই ছিল।’

‘কিন্তু তার আত্মা এই দুনিয়ায় ছিল না।’

.

সে একটা রোগা-পটকা মেয়ে। চৌরাস্তার এই দিকে এই ফুটপাতে তাকে প্রায়ই দেখা যায়। ভিড়ের মধ্যে তাকে একটু স্বতন্ত্র বলে মনে হয়। মাথা হেলিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস্। ভিড়ের প্রত্যেকটা মানুষ তাকে একনজর অবশ্যই দেখে নেয়। সেইসব নজর থেকে সে এমনভাবে গা-বাঁচিয়ে চলে, যেন সেগুলো বিষ-মাখানো তীর। কিন্তু যারা তাকে দেখে, তাদের না-দেখেও উপায় নেই। তার ফ্যাকাসে অসুস্থ চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটে থাকে যে, তা প্রত্যেক দৃষ্টিকেই তার দিকে টানে। তার চেহারা হাজারটা থেকে স্বতন্ত্র। আর, চেহারার ভিড়ে এমন চেহারাও মাঝে মাঝে দেখা যায়, যা সন্ধানী চোখদের নিজের দিকে আকর্ষণ না-করে পারে না।

তারপর, আর একদিন যখন মুহূর্তের ধারা দু’ভাগে ভাগ হতে যাচ্ছিল, সেই সময় সে তার কাছে এসে থেমে গেল। চৌরাস্তার মাথায় ভিড় অস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্ত দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। হলুদ পাহাড় প্রকৃতির বুক চিরে বেরিয়ে এল। তার মাথা আকাশে গিয়ে ঠেকল।

তা করতে করতে সেই পাহাড়ের দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ‘ভ্ৰাতঃ! ভ্ৰাতঃ!’ প্রত্যেকে ভাবল, ‘ধ্বনির পর্বত’ থেকে তার ডাক এসেছে। চৌরাস্তার সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে হলুদ পাহাড়ের গগনস্পর্শী চূড়ার দিকে সবাই রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগল। কিন্তু তাদের পাগুলো মাটির সঙ্গেই লেগে রইল। যতক্ষণ পর্যন্ত-না ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক আসে, কারও পা মাটি থেকে মুক্ত হতে পারে না। ভিড় চৌরাস্তা পার হতে হলুদ পাহাড় মিলিয়ে গেল। তখন মুহূর্ত শেষ হয়নি, খুট্ করে লাল বাতি জ্বলে উঠল। সে চলার জন্য পা ফেলতেই ফ্যাকাসে চেহারার অসুস্থ মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়ান।

সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘মাফ করবেন। এক্ষুনি সবুজ বাতি জ্বলবে। তখন আমরা দুজনে চৌরাস্তা পার হব।’ সেই মেয়ে নত চোখ তুলে তার চেহারার ওপর বুলিয়ে নিল |

তার দুই চোখ ছিল অসুস্থ আর ঘুমে ঢুলু-ঢুলু। কিন্তু তা থেকে সহমর্মিতা আর করুণার যে ধারাবর্ষণ হচ্ছিল, তাতে তার অন্তর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার, পবিত্র হয়ে উঠেছিল।

তারা দুজনে পাশাপাশি চৌরাস্তা পার হয়ে গেল। যে বিন্দুতে তাদের পথ আলাদা হচ্ছিল, সেখানে সে জিগ্যেস করতে চাইল, ‘আপনিও কি হলুদ পাহাড়ের আওয়াজ শুনতে পান? হলুদ পাহাড়ের রহস্য কি আপনার জানা?’ কিন্তু সে ভাবল, ওই রহস্য আমার নিজে নিজে জানা দরকার।

মেয়েটি নীরবে নিজের পথে চলে গেল।

‘মেয়েটা কে হে?’

‘আমি তো জানি না।’

ফুটপাত ধরে যখন হাঁটে, কারও দিকে তাকায় না।’

‘কেমন অসুস্থ অসুস্থ মনে হয়।’

‘অসুস্থের ওই রূপ আমায় বড় টানে। ওর বড় বড় চোখ কেমন উদাস, তাই না? ওইখানেই তো ওর আকর্ষণের রহস্য হে।’

‘তাহলে যাও, ওর পিছু নাও। অফিসে পৌঁছাতে ওর নিশ্চয় কখনো দেরি হয়, কিংবা ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। গাড়িতে লিফটের অফার দিয়ে দেখ।’

‘না, ও ভড়কে যাবে। কোনো কারখানায় বোধহয় ও টাইপিস্ট হবে। খোঁজ কখনো-না কখনো পেয়ে যাবই। আচ্ছা, ওর সঙ্গে আর একজন লোক কে ছিল বটে?’

‘কেন, কালকের সেই দার্শনিক? চিনতে পারেননি?’

‘ঠিক ট্রাফিক-দুর্ঘটনায় পড়বে একদিন, দেখে নিও।’

‘তাতে আপনার কী?’

‘হ্যাঁ, আমার কী?’

.

‘মা, জেগে আছিস?’

‘হ্যাঁ, বাবা।’

‘আমাকে আজ ছাদে নিয়ে যাবি, মা?’

‘তুমি যে অসুস্থ, বাবা। অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে।’

‘কতকাল আমি ধ্বনির পর্বতকে সূর্যের আলোয় জন্ম নিতে দেখিনি।’

‘ধ্বনির পর্বত?’ তার ভরা পেয়ালার মতো দুই চোখ। সেখানে অসুস্থতার পিঙ্গল আলো ঝলমল করছে। বিস্ময়ে সেই চোখ বিস্ফারিত হল।

‘ধ্বনির পর্বত হচ্ছে সেই পর্বত, যার দুর্গের সব দেওয়াল আকাশে গিয়ে ঠেকে রয়েছে। সেখান থেকে আপনাআপনি আওয়াজ আসে। কেউ কেউ তাকে ‘দিনের হলুদ পাহাড়’ বলে। আমি কালের প্রহরী, তবু এখনো তার রহস্যভেদ করতে পারিনি।’

‘বাবা, তুমি আজ এসব কেমনধারা কথা বলছ?’

‘হলুদ পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে কারও কারও ডাক আসে। সেই ডাকের আওয়াজ শুনতে পায় সবাই। কিন্তু আমরা তার সঙ্গে যেতে পারি না। সে একলা ওই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওপারের অবস্থা কারও জানা নেই, মা। আমায় ছাদে নিয়ে যাবি? হয়তো কালের এই প্রহরীর কাছে আজকেই ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক এসে যাবে।’

অসুস্থ যৌবন বার্ধক্যের হাত ধরল। কেননা সেই তার একমাত্র অবলম্বন। অসুস্থ দুই চোখের পক্ষ্ম শিশিরে টইটম্বুর ছিল। ছাদের উপর প্রত্যূষের ঝাপসা আলো। পূর্বাচলের আঁচল কেঁপে উঠল। একটি অগ্নিশর নিক্ষিপ্ত হল, আর পূর্বাচলের আঁচলে আগুন লেগে গেল। তখন সূর্যোদয় হল। বার্ধক্যের ঠোঁট কেঁপে উঠল, ‘আমায় নিচে নিয়ে চল্‌, মা। এখনো আমার ডাক আসেনি।

অসুস্থ যৌবন বার্ধক্যের হাত ধরে তাকে নিচে নামিয়ে আনল।

‘মা, তুমি যখন সন্ধ্যায় ফেরো, ক্লান্তিতে একেবারে ভেঙে পড়, সেই অবস্থায় আবার তোমায় রাঁধতে যেতে হয়। ছোট ভাইগুলোর দেখাশুনো করতে হয়। তোমার মাইনের পয়সায় দু’বেলা দু’মুঠো জুটে যায় অনেক কষ্টে। বুড়োর বোঝা আর কতকাল বইবি, মা। আমাকে আমার হাতে ছেড়ে দে। নিজের মাইনের অর্ধেকের বেশি যা তুই আমার রোগ-ব্যাধি বার্ধক্যের পেছনে ঢালিস তা নিজের জন্যে খরচ কর।’

‘না বাবা।’

.

‘আপনি আবার থেমে পড়েছিলেন?’ সে জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ, বড্ড বেশি ভিড়। ভাবলাম, ভিড় কমে যাক, তখন চৌরাস্তা পার হব।’

‘ধ্বনির পর্বত থেকে যে আওয়াজ আসে, আপনিও তা শুনেছেন?’

‘ধ্বনির পর্বত?’ সেই মেয়ে অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল।

‘হ্যাঁ, দিনের হলুদ পাহাড়। সেই পাহাড় এখনি দিগন্তের কিনারায় মাথা তুলেছিল।’

‘দিনের হলুদ পাহাড়?’ মেয়েটি অবাক হয়ে আবার জিগ্যেস করল।

‘আমি ঠিক মুহূর্তটিতে তাকে প্রত্যেকদিন মাথা তুলতে দেখি।’

‘আপনি সেই আওয়াজ শুনেছেন?’

‘আমি প্রত্যেকদিন সেই আওয়াজ শুনি। প্রত্যেকে শোনে। সবাই ভাবে, সেই আওয়াজ তাকেই ডাকছে। এইজন্যেই তো গোটা ভিড় তার দিকে ছুটে যায়। কে জানে, এত বড় শহরে সেই আওয়াজ এখন কাকে ডেকেছিল, আর কে তারা চূড়ায় পৌঁছে অন্য পারে চলে গিয়েছে। ভিড় ওই পাহাড়ের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেই পাহাড় চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়।’

‘আর আপনি?’

‘আমি যখনি আওয়াজ শুনি, লাল বাতি আমার পথরোধ করে। দেখতে দেখতে একদিন আমি আর লাল বাতির তোয়াক্কা করব না। ওপারের ডাক ধীরে ধীরে আমার রক্তে ইচ্ছার আগুন জ্বালছে।’

‘কই, আমি তো ও-পাহাড় দেখতে পাই না। ‘

‘আপনি তাকে প্রত্যেক দিন দেখেন, কিন্তু আপনার চোখের সামনে তা অদৃশ্য থাকে।’

‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না তো।’

‘আগে আমিও বুঝিনি। একটি মুহূর্ত দুই ধারায় ভাগ হয়ে যায়। একটি ধারা ধ্বনির পর্বতের উলটো দিকে চলে যায়, অন্য ধারা তার নিচের দিকে বয়ে যায়। সেই মুহূর্ত যখন আসবে, তখন…’

একটি গাড়ি তাদের কাছে এসে ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘মহিলা, আপনি এ কোন দার্শনিকের পাল্লায় পড়েছেন?’ একটি অতিরিক্ত ভদ্র আওয়াজ শোনা গেল।

‘আপনি কে?’ মেয়েটি প্রশ্ন করল।

‘আমি পথচারী। ওই দার্শনিককে রোজ ফুটপাতে দেখি। মানুষকে ও পথভ্রষ্ট করে।’

‘আমাকে আমার পথে চলতে দিন। ধন্যবাদ।’

‘আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি অসুস্থ। তবু আপনি বাধ্য হয়ে কাজে যান। আপনার আঙুল দেখে মনে হয়, আপনি টাইপ করেন। টাইপ করলে বুকে দোষ হয়। এমনিতে আপনি ভালো খাদ্যের অভাবে রক্তাল্পতায় ভুগছেন। আমার পরামর্শ… ‘

‘আপনার পরামর্শ আমার লাগবে না। ধন্যবাদ।’

‘তবু যদি কখনো দরকার মনে করেন– আমি ওই সামনের মোড়ে প্রতিদিন গাড়ি দাঁড় করিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করব। পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারে আমি ধৈর্যধারণ করতে অভ্যস্ত।’

সেই মেয়ে দুই হাতে দুই কান চেপে ধরে বলল, ‘না না-আপনার পরামর্শ আমি চাই না।’

‘কে ভদ্রলোক?’ সে মেয়েটিকে জিগ্যেস করল।

‘পথচারী।‘

মনে হচ্ছে ওঁর এখনো হলুদ পাহাড় দেখার ভাগ্য হয়নি।’

‘চলুন, সবুজ বাতি জ্বলেছে।’

‘বাবা, হলুদ পাহাড়ের ওদিকে কী আছে?’ সে হঠাৎ জিগ্যেস করল।

‘সে রহস্য আমার জানা নেই, মা।’

‘সেদিন তুমি বলছিলে, তুমি কালের প্রহরী?’

‘হ্যাঁ, আমি কালের প্রহরী। প্রত্যেক মানুষই কালের প্রহরী। কিন্তু যদ্দিন-না ধ্বনির পর্বত থেকে তার ‘দ্বিতীয় সত্তা’র ডাক আসে, সে তার রহস্য জানতে পারে না।‘

‘দ্বিতীয় সত্তাটা কী, বাবা?’

‘আমি তা জানতে পারিনি।’

‘কেউ কি জানতে পেরেছে?’

‘শোনা যায়, ইয়েমেনের এক শাহ্জাদা হাতেম পেরেছে। ধ্বনির পর্বতের খোঁজে তার পাদদেশে গিয়ে পৌঁছালে সে তার এই দ্বিতীয় সত্তা পেয়েছিল। কাহিনীতে এইরকম বলা হয়েছে : মোটকথা, সেই শহরে হাতেমের ছ’মাস কেটে গেল। আর সেই সময়ের মধ্যে ওইরকম পনেরো জন মানুষ ওই পাহাড়ের দিকে গেল, তারপর আর ফিরল না। ঘটনাক্রমে হাতেম নামে এক ব্যক্তি সেখানে ছিল। হাতেমের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব ছিল আর তাদের মধ্যে গভীর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই কারণে তারা দুজন চব্বিশ ঘণ্টা এক জায়গায় থাকত।’

‘তারপর?’

‘যে হাতেমের দ্বিতীয় সত্তা ছিল, ধ্বনির পর্বত থেকে তার ডাক এল। সে চূড়ার দিকে ছুটল। তখন হাতেম ভাবল, সে-ও ওইদিকে চলে যাবে। সে মনে মনে বলল, দুঃখের বিষয়, ওর সঙ্গে আমার খুব বেশি ভালোবাসা আর ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এখন সে-ও ছেড়ে যাচ্ছে। না, আমি ওকে কিছুতেই ছাড়ব না। এইকথা বলে সে কষে কোমর বাঁধল। এবং তার হাত ধরে পাহাড়ের দিকে ছুটল। পড়ি-মরি করে দুজনে পাহাড়ের উপর গিয়ে পৌঁছাল।’

তার বাবা থেমে তার দিকে নজর ফেলল। অসুস্থ মেয়ের দুটি চোখের পক্ষ্ম বিস্ময়ের ঝিলে ডুবে ডুবে কাঁপছিল।

‘তারপর কী হল?’ মেয়ে জিগ্যেস করল।

বুড়ো বাপের কানে তার গলা বড় রহস্যময় ঠেকল। সেই আওয়াজ যেন অজানা যাত্রায় পা রেখেছে এমন কোনো যাত্রীর আওয়াজ– যার চোখের সামনে কোনো বিস্ময়কর জগতের একটি জানালা একটু উন্মুক্ত হয়ে গেছে।

‘যেই সেই দুর্গের কাছে গেছে, একটি ছোট দরজা দেখা গেল, এরা দুজন পড়ি-মরি করে তার ভেতর ঢুকে পড়ল। মানুষের চোখের সামনে থেকে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুদূর গেলে পাওয়া গেল নিঝুমপুরী। একটা সবুজ প্রান্তর দেখা গেল– যেন পান্নার চাদর চারদিকে বিছানো রয়েছে। কিন্তু অল্প একটু জায়গা খালি পড়ে ছিল। সেই যুবক সেখানে পা রাখতে গেল। পা রাখতেই জমি ধসে পড়ল, মাটি ফাঁক হয়ে গেল। সে তাতে তলিয়ে গেল। অমনি সেই স্থানটুকুও সবুজ হয়ে উঠল।’

‘হাতেমের দ্বিতীয় সত্তার যখন সবুজ প্রান্তরে ঠাঁই হয়ে গেল, তখন হাতেমের কী হল?’ মেয়ে জিগ্যেস করল। তখন তার আওয়াজে জীবনের দর্শনের আকাশ থেকে অবতীর্ণ একটি আলোকবিন্দু কাঁপছিল।

বৃদ্ধ বাবা বলল, ‘হাতেম সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এক বিরাট সমুচ্চ পর্বতের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছাল। সেখানে সে যে-পাথরই ওঠাল, দেখল, রক্ত। বারো দিন পর সেই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছাল। হাতের কাছে একটা মাঠ দেখা গেল। সেখানে মাটি আর জীব-জন্তু-পাখি কলহ, বিবাদ আর খুনোখুনি করে রক্ত ঝরাচ্ছে। বারো মাইল আরো গিয়ে দেখতে পেল এক রক্তের নদী। বড় দুশ্চিন্তা হল, সেই নদী সে কেমন করে পার হবে।’

নদীটা কি সে পার হতে পেরেছিল?’

‘আসল কথা, দ্বিতীয় সত্তার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে মানুষ আবার হলুদ পাহাড়ের দিকে ফিরে আসে, সেখানে দিগন্তবিস্তৃত সমতল মাঠ রয়েছে, রক্তের নদীতে ঢেউ উঠছে-পড়ছে, যেখানে পথের দিশা খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে পানির বা খাদ্যের কোনো চিহ্ন নেই, এমন একটা গাছও নেই যার ছায়ায় মানুষ দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে পারে।

মেয়ের ফ্যাকাসে মুখে আশার যে-আলোটুকু মিটমিট করে জ্বলে উঠেছিল, তা আবার নিভে গেল।

মা, যখন ধ্বনির পর্বত থেকে ডাক আসবে, তখন আমি সবুজ প্রান্তরের আকাঙ্ক্ষার পাহাড়ের চূড়া অতিক্রম করে যাব। তারপর সেই রহস্য আমার সঙ্গে সমাহিত হয়ে যাবে। কারণ, সে সময় আমি আর আমি থাকব না। অবশ্য আমি হলুদ পাহাড়ের ওপারের রহস্য পুরোপুরি জেনে যাব।’

‘ওপারের রহস্য কী, বাবা?’

‘ওপারে রয়েছে যন্ত্রের ঘড়ঘড়, ঘামের গন্ধ, অসুস্থ মানুষের ক্ষতের পূতিগন্ধ, গলিত দেহ আর বিক্ষিপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বাসি ঠোঁট আর মথিত ফুল, পোকায়-খাওয়া লাশ…’

‘বাবা–।’ সে হাতে হাত জড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

‘আমি একটা পাষণ্ড। হলুদ পাহাড়ের রহস্য কেন তোকে জানালাম আমি। আমার পোকায়-খাওয়া বার্ধক্যের কেন করুণা হল না তারুণ্যের ওপর। আমি এ কী করলাম, কালের প্রহরী হয়ে ধ্বনির পর্বতের রহস্যের যবনিকা আমি কেন তুললাম? সেই অজানা গন্তব্যের দিকে প্রত্যেকেরই তো আপন আপন বোধি অনুসারে নিজে নিজেই এগিয়ে যাওয়া উচিত।’

পরদিন যখন ভোরের আলো ফুটল, সকাল হল, তখন সেই অসুস্থ চেহারার মেয়েটির সামনে হলুদ পাহাড় বুক ফুলিয়ে এসে দাঁড়াল। তার কমল-আঁখি প্রভাতের বিষণ শিশিরের বদলে হলুদ রোদের কাল সাপের ভয়ে আতঙ্কিত হল।

‘মা, আমি বুঝতে পারছি, এবার আমার ডাক আসার সময় হয়েছে।’

‘অমন কথা বোলো না বাবা, অমন কথা তুমি বোলো না!

ভিড় হলুদ পাহাড় থেকে আসা ধ্বনির জন্য অপেক্ষা করছিল, সেই সময় ওরা দুজন ফুটপাতে এসে মিলল।

‘আসুন, চৌরাস্তা পার হই।’ মেয়েটি বলল।

এক-পা বাড়িয়ে সে চকিত আওয়াজে বলল, ‘দাঁড়ান!’

সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সে জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার চোখের সেই কেমন অসুস্থ উদাস ভাব কোথায় গেল?’

‘আমি জানি না।’

‘একটু আগেই আমি আপনার চোখে ভয়ের কাল-সাপকে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সেটা কি আমার কল্পনামাত্র?’

‘না।’

‘তাহলে বুঝি আপনিও হলুদ পাহাড় দেখতে পেয়েছেন?’ কিছু বলার জন্যে মেয়েটির ঠোঁট ফাঁক হল। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে শব্দ শোনা গেল, ‘ভ্রাতঃ! ভ্ৰাতঃ!’

ভিড় হলুদ পাহাড়ের দিকে ছুটল। মেয়েটির ঠোঁট কেঁপে কেঁপে থেমে গেল।

সে ভয় পেয়ে যুবকের হাত চেপে ধরল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘ওই ডাক কার জন্যে, বলুন!’

‘আমি বলতে পারি না। অত বড় ভিড়ের মধ্যে থেকে তাকে আমি কেমন করে চিনব?’

‘ওই ডাক যখন বাজছিল, তখন আমি একটা মূর্তি দেখেছি। সে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন ডাক এল, তার চেহারা লাল হয়ে উঠল। হলুদ পাহাড়ের দিকে সে ছুটে গেল। কে সে? কে সে?’

‘আমি তাকে দেখিনি। হবে কোনো কালের প্রহরী।’

‘কালের প্রহরী? হ্যাঁ, আমি তাকে চিনেছি।’

‘কে?’

‘সে বহুদিন থেকে হলুদ পাহাড়ের চূড়ার ওপারে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে ছিল। আজ খুব সকালে সে আমাকে বলেছিল : মা, আমি বুঝতে পারছি, আজ ধ্বনির পর্বত থেকে আমার ডাক আসবে।’

‘তাহলে তো ওই ডাক তার জন্যেই ছিল।’

‘হ্যাঁ। মাফ করবেন, আজ আমি আর চৌরাস্তা পার হব না। আপনি যান।’

সেই মেয়ে মুখ ফেরাল। লাল বাতির পর সবুজ বাতি হল। সে চৌরাস্তা পার হওয়ার অনুমতি পেয়েছিল। কিন্তু তার পা এগুতে পারল না। মেয়েটির পেছনে পেছনে সে চলতে লাগল।

.

‘মহিলা, আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে।’ ঠিক পেছনে গাড়ি এসে থামল। মেয়েটি কোনো কথা বলল না।

‘আপনার খুব তাড়া। দাঁড়ান।’

‘না। সে মৃদু গলায় বলল।

‘আমায় আপনার সেবার সুযোগ দিন। দেখুন, আমার গাড়ি প্রস্তুত রয়েছে। কড়া রোদ। আপনার ঘরও এখান থেকে অনেক দূর।’

‘দূর তো বটেই।’ তার পায়ের জ্বলন্ত পাতা থেকে যেন কথাটা এল।

‘তাহলে আসুন-না আমার গাড়িতে। আমি আপনাকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দি।’

‘দাঁড়ান। একটু দাঁ– ড়া– ন!’ দূরে কেউ তাকে ডাকল।

‘ওই দার্শনিকটার কথায় কান দেবেন না, মহিলা– দেবেন না। ও আপনাকে তার কথার ফাঁদে ফেলবে। আপনার গন্তব্যে ও আপনাকে পৌঁছাতে দেবে না। আপনি শ্রান্ত। ফুটপাত তেতে উঠছে। আপনার পায়ের তলা জ্বলছে।’

‘একটু দাঁড়ান! আমি আপনার সঙ্গে যাব। এই যাত্রায় আপনার একজন সঙ্গী দরকার। এখনি এক জনহীন ভয়ঙ্কর মাঠে গিয়ে পড়বেন। সেখানে না-কোনো সবুজের চিহ্ন পাবেন, না-ছায়া। তার ওপর এক রক্তের নদী– তাতে রক্তের ঢেউ।’ দার্শনিক পেছন থেকে বলল। ‘আমার গাড়ি খুব দ্রুত ছোটে। আমি এটাকে একশো মাইল গতিতে চালাতে পারি। এক মিনিটে…।’

মেয়েটি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড়ই শান্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করল, ‘আপনার গাড়ি রক্তের নদী পার হতে পারবে?’

‘অ্যাঁ? কী বললেন আপনি?’

‘হলুদ পাহাড়ের চূড়ার ওদিকে রক্তের যে-নদী আছে, সেই নদী।’

‘আমি কোনো হলুদ পাহাড়ের কথা তো শুনিনি কখনো।’

‘আমি বলেছিলাম-না–এখনো হলুদ পাহাড় দেখার ভাগ্য ওর হয়নি।’

চুপ কর, হাম্বাগ দার্শনিক! এই মেয়েটিকে তুমি ফুলানি দিচ্ছ! মহিলা, আপনি ওর ধোঁকায় পড়বেন না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি বড় দুঃখী। অন্যের দুঃখ আমি চট্‌ করে দেখতে পাই। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে সুখ দিতে পারি।’

‘কিন্তু– রক্তের নদী?’

‘রক্তের নদী? কোথায় রক্তের নদী? ওই দার্শনিকটা আপনার ওপর জাদু চালিয়েছে এখানে রক্তের নদী-টদী কিছুই নেই। আমার বাড়ি পর্যন্ত যে-রাস্তা গেছে, তা একেবারে সোজা, পরিষ্কার। সেই রাস্তার দু’পাশে ইউক্যালিপ্‌টাসের ছায়া। আমার বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানে সবুজ, সতেজ লন রয়েছে। আমার ড্রয়িং-রুমে সুন্দর সুন্দর ছবি। যে-কোনো ক্লান্ত পথিক, যে-কোনো দুঃখী আত্মা সেখানে গিয়ে আরাম আর শান্তিতে মগ্ন না- হয়ে পারে না।

‘কিন্তু আমার গন্তব্য যে হলুদ পাহাড়ের ওপারে। সেখানে রক্তের নদীতে প্রবল ঢেউ। আপনি কি সেখান পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দেবেন?’

‘আমি… না তো… পাগল মনে হচ্ছে। তুমি আমার বড্ড সময় নষ্ট করে দিলে। এই প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারলাম, আমার দরদ, আমার ব্যথা, আমার আবেগ কেমন এক মুহূর্তে ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তবে যাও, গিয়ে রক্তের নদীতে ডুবে মর। আমি– আমি– চললাম।’ ক্রোধান্বিত হয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সে চলে গেল।

আর, মেয়েটির উদাসীন ভয়ার্ত চোখ প্রদীপের মতো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল। তখন উদাসীন চোখে তার দিকে তাকাল, যে ছিল কালের প্রহরী, যে ধ্বনির পর্বতের রহস্য জানার জন্য তার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত। এ হচ্ছে সেই ধ্বনির পর্বত, যেখানে থেকে এখনি একজন কালের প্রহরীর ডাক এসেছে আর সে হলুদ পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে চলে গেছে। ধ্বনির পর্বতের ওপারে সবুজ প্রান্তর– সেখানকার এক টুকরো শূন্য জমিতে সে তলিয়ে গেছে, তারপর সেই জমিটুকুকে পান্নার মতো সবুজেরা এসে ঢেকে ফেলেছে। আর তার সামনে রক্তের নদী।— মেয়েটির শরীরে কাঁপন লাগল। তার রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল। দার্শনিক এগিয়ে এল। মেয়েটির হাত সে ধরতে চাইল, এমন সময় মুহূর্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল।

হলুদ পাহাড় আকাশের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়াল।

সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘আজকেই আমি আমার যাত্রা শুরু করে দেব। অজানা গন্তব্যের পথে আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন তো?’

মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত কোনো জবাব দিল না। তারপর সে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘এই যাত্রায় সবাইকে একলাই পথ চলতে হয়।

‘না।’

মেয়েটি মন্দ আওয়াজে বলল, ‘না।’

‘এ যাত্রায় একা পথ চলা যায় না। পথ দেখানোর জন্য দ্বিতীয় সত্তার প্রয়োজন।’

‘দ্বিতীয় সত্তা!’

সে মেয়েটির মুখের ওপর তার দৃষ্টিকে স্থাপন করল।

বিষণ্ন চেহারা আস্তে আস্তে আকাশে মিলিয়ে গেল। হলুদ রোদের রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠল। তখন তার মনে হল, ফুটপাতের উপর যেন সে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর মেয়েটির আপাদমস্তক তার আত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। সে চোখ খুলল।

তারা দুজন হাতে হাত রেখে হলুদ পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল।

অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *