প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৪.১১ বাবা নূর – আহমদ নদিম কাস্‌মি

বাবা নূর – আহমদ নদিম কাস্‌মি

একটি ছেলে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছ, বাবা নূর?’

‘এই একটু ডাকঘরে যাচ্ছি।’ অত্যন্ত রাশভারি সুরে উত্তর দিয়ে এগিয়ে যায় বাবা নূর।

ছেলেরা সব খিলখিল করে হেসে ওঠে 1

ওদিক থেকে মৌলবি কুদরতউল্লা আসছিলেন। বললেন, ‘হাসিস নে ছোঁড়ারা! এসব কথায় হাসতে নেই। আল্লা কার বরাতে কী রেখেছে, কে জানে!’

ছেলেরা তখনকার মতো চুপ হয়ে যায়। কিন্তু মৌলবি কুদরতউল্লা চলে গেলে ওরা আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। এ ওর গায়ে ঠেলা মেরে বলতে থাকে, ‘ডাকঘরে যাচ্ছে বাবা নূর।’

মসজিদের মেহ্রাবের কাছে থেমে জুতো খুলে বাবা নূর খালিপায়ে এগিয়ে যায়। হাত দুখানা মোবের উপর রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে ঠোঁট আর চোখ দিয়ে চুমো খায় কয়েকবার। তার পর পিছু হটতে হটতে ফিরে এসে জুতো পরে আবার চলতে থাকে।

বাবা নূর যখন মোবে চুমো খাচ্ছিল, ছেলেরা তখন নীরবে এ-গলি ও-গলি দিয়ে চুপচাপ সরে পড়ে। ভাবখানা এই যে পরস্পরকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেছে ওরা।

বাবা নূরের সর্বাঙ্গে ধবধবে সাদা খদ্দরের পোশাক। মাথায় খদ্দরের টুপি। পেছনদিকে সাদা চুলের সঙ্গে মিশে গিয়ে টুপির সবটাই ঘাড় পর্যন্ত নামানো বলে মনে হচ্ছে। সদ্য-আঁচড়ানো সাদা দাড়িগুলো একটা বিশেষ ভঙ্গিতে ছড়িয়ে রয়েছে বুকের উপর। ফর্সা রঙে একটা ফ্যাকাশে ছাপ পড়েছে। ছোট ছোট চোখের মণি দুটো ঘন কালো। দেখলে মনে হয় বুঝিবা চীনেমাটির পুতুলের চোখের মতো নকল চোখ। ফর্সা শরীর, চুল-দাড়ি আর পোশাকের এতসব সাদা রঙের ভেতর ভ্রমরের মতো কালো চোখদুটি সত্যিই অদ্ভুত মনে হয়; কিন্তু এই অদ্ভুত অসামঞ্জস্যই বাবা নূরের চেহারায় ফুটিয়ে তোলে শিশুর সরলতা। বাবা নূরের কাঁধে সবসময়ই পড়ে থাকে সাদা খদ্দরের একটা বড় রুমাল। ছেলেদের ভিড় থেকে মসজিদের মেহরাব পর্যন্ত যেতে রুমালখানা তিন-চার বার কাঁধ বদল করেছে।

একটা দোকানের দরজায় বসা ছোকরা দোকানি জিগ্যেস করে, ‘ডাকঘরে যাচ্ছ, বাবা নূর?’

‘হ্যাঁ বাবা, বেঁচে থাকো!’ বাবা নূর উত্তর দিয়ে রুমালটা ঝট্‌কা মেরে অন্য কাঁধে রাখে।

কাছেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। চট্ করে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, ‘আহা, বাবা নূর ডাকঘরে যাচ্ছে!’

দোকানি ধমকে ওঠে, ‘এই ছোঁড়া, ভাগ্‌ এখান থেকে!

বাবা নূর কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিল, পেছন ফিরে বলে, ‘ধমকাচ্ছ কেন ছেলেটাকে ছেলেপিলেদের কি ধমকাতে আছে? ঠিকই তো বলেছে ও। ডাকঘরেই তো আমি যাচ্ছি।’

দূর দূর থেকে ছেলেরা দৌড়ে আসছিল। এপাশ-ওপাশ থেকে খিলখিল করে হেসে ওঠে তারা। বাবা নূরের পেছনে একটা মিছিল খাড়া হবার উপক্রম হয় যেন। কিন্তু আশপাশের কয়েকজন জোয়ান ছেলে তেড়ে আসে। বাবা নূর বাধা দেওয়া সত্ত্বেও ছেলেদের তাড়িয়ে দেয় তারা।

গ্রাম পার হয়ে বাবা নূর এবার মাঠে এসে পড়ে। মেঠো পথ এঁকেবেঁকে আলের উপর দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ একসময় সবুজে ভরা ক্ষেতের মধ্যে মাথা গুঁজেছে। বাবা নূরের গতি কমে আসে সেখানে। গমের কচি চারাগুলোর পাশ কাটিয়ে অতি সাবধানে হাত-পা বাঁচিয়ে চলতে থাকে সে। কোনও পথচারীর অসাবধানতায় একটা চারা পথের উপর পড়ে আছে দেখতে পেলে সেটাকে অন্য চারার সঙ্গে হেলিয়ে বা জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, আর চারাটার যে-জায়গা একটু বেঁকে পড়েছে, সেখানটা এমনভাবে ছোঁয় যেন জখমে হাত বুলোচ্ছে। তার পর আলে উঠে এই দেরিটুকু পুষিয়ে নেওয়ার জন্য চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাতাসে তার দাড়ি ছড়িয়ে পড়ে, আবার গুটিয়ে যায়, কাঁধের উপর থেকে রুমালখানা উড়ে উড়ে ওঠে, কিন্তু বাবা নূরের চলার বেগ কমে আসে তখন, যখন রাস্তা আবার গমের ক্ষেতে নেমে আসে।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলে বাবা নূর। সামনে কিছু দূরে কয়েকজন কিষান আলের উপর বসে তামাক টানছে। একটি কিষান মেয়ে কাস্তে দিয়ে এমন কৌশলে ক্ষেত নিড়োচ্ছে যে, সাধ্য কি কোনও একটা গমের চারায় এতটুকুও আঁচড় লাগে। বাবা নূর একটু থেমে মেয়েটিকে দেখতে থাকে। ঘাসের মুঠ কেটে হাত পেছনে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, আর পিঠের উপর ঝোলানো একটা পোঁটলার ভেতর ঘাস রেখে দিয়ে আবার কাস্তে চালাচ্ছে।

‘আশ্চর্য!’ দূর থেকেই বাবা নূর কিষানদের উদ্দেশে বলে, ‘এ মেয়েটি যে একেবারেই জাদুকর দেখছি! এতবড় একটা কাস্তে চালাচ্ছে, গোছা গোছা গমের চারা ঘন হয়ে গজিয়ে রয়েছে ক্ষেতে, অথচ কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছে, ভুলেও একটি চারা ছুঁয়ে ফেলছে না। কার মেয়ে এ?’

বাবা নূর মেয়েটিকে জিগ্যেস করে, ‘তুমি কার মেয়ে, মা?’

মেয়েটি মৃদু হেসে বাবা নূরের দিকে তাকায়। ওদিক থেকে এক কিষানের গলা শোনা যায়, ‘আমার, বাবা।’

‘তোমার মেয়ে?’ বাবা নূর কিষানদের দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘বড় সেয়ানা মেয়ে তো! খুব ভালো কিষান হয়ে উঠেছে দেখছি! এমন পাকা কাজ আমি শুধু তোমার মেয়েরই দেখলাম। আর দেখেছিলাম আমার ছেলের। আল্লা তার হায়াত

দারাজ করুন!’

ডাকঘরে যাচ্ছ বাবা?’ মেয়েটির বাবা জিগ্যেস করে।

‘হ্যাঁ।’ বাবা নূর বলে, ‘আল্লা তোমার মঙ্গল করুন। ভাবলাম, একবার জিগ্যেস করে আসি। কী জানি কোনও চিঠিপত্র যদি এসে থাকে।’

তিনজন কিষানের মুখই হঠাৎ থমথমে হয়ে ওঠে। একপাশে সরে দাঁড়িয়ে তারা রাস্তা ছেড়ে দেয়। বাবা নূর এগিয়ে যায়।

‘কেন ও-কথা জিগ্যেস করলে তুমি?’ মেয়েটির বাপকে একজন কিষান বলে।

‘জিগ্যেস করা উচিত হয়নি।’ দ্বিতীয় জন বলে।

মেয়েটির বাপ লজ্জিত হয়ে রাস্তার উপর আঙুল দিয়ে আঁচড় কাটতে থাকে। বাবা নূর ক্ষেতের মাথায় পৌঁছে গিয়েছিল, এমন সময় মেয়েটি ডাক দিয়ে ওঠে, ‘লসি খাবে, বাবা নূর?

বাবা নূর ফিরে তাকায়। গ্রাম থেকে বেরোবার পর এই প্রথম তার ঠোঁটে মৃদু হাসির আভা ফুটে ওঠে, ‘খাব, বেটি।’ তার পর একটু থেমে আবার বলে, ‘তেষ্টা নেই বটে, তবে মুসাফিরকে পানি খাইয়ে একটু সওয়াব নিবি, তাতে তোকে বাধা দেব না। দে বেটি, দে!

রুমালখানা এক কাঁধ থেকে আর এক কাঁধে রাখে বাবা নূর। ‘হ্যাঁ, দ্যাখ, একটু শিগগির করে নিয়ে আয়। ডাকপিওন হাওয়ার ঘোড়ায় চড়ে থাকে, চলে না যায় আবার।’

ঘাসের পোঁটলাটা পিঠ থেকে নামিয়ে সেইখানেই ক্ষেতের মধ্যে রেখে দেয় মেয়েটি। তার পর দৌড়ে আলের উপর কুলগাছটার কাছে চলে যায়। গুঁড়ির আড়াল থেকে একটা পাত্র তুলে নিয়ে খুব করে ঝাঁকায়। শেষে অ্যালুমিনিয়মের একটা বাটি ভরে নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাবা নূরের কাছে ফিরে আসে।

বাবা নূর একনিঃশ্বাসে বাটিটা খালি করে দিয়ে রুমালে ঠোঁট মুছে বলে, ‘তোর নসিব এই লসির মতোই সাফ হোক, বেটি।’ তার পর আবার ডাকঘরের দিকে এগোতে থাকে সে।

মাদ্রাসার বারান্দায় অনেকগুলো লোকের সাথে বসে ডাক-মুন্সি নিজের প্রাত্যহিক কাজের ‘ফরম’ পূরণ করতে করতে গাঁয়ের লোকদের নতুন নতুন খবর শোনাচ্ছিল : ‘পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর ছিল লাহোর। এখন লোকে বলে, করাচি নাকি পয়লা নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি বলি, লাহোর গুটিয়ে-শুটিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম হয়ে যাক না কেন, তবু সে লাহোরই থাকবে।’

‘সে তো ঠিক কথাই।’ গাঁয়ের লোকদের ভেতর থেকে একজন বলে, ‘আল্লা করাচির বদনাম না-করান– আমার শালা করাচিতে চাপরাশির কাজ করত। যখন ও মারা যায়, তখন আমায় করাচি যেতে হল। আমি বলি কি, মুন্সিজি, করাচিটা একবার দেখেই এসো। হোক-না সে গাধা দিয়ে গাড়ি চালানো। কিন্তু গাড়ি কত! আমাদের গাঁয়ে এত পাখিও নেই। এক এক মোটরে এমন এমন সব মানুষ বসে থাকে যে, কী আর বলব। করাচিতে কেউ কারও ধারও ধারে না। আল্লার কুদরতের কথা মনে পড়ে যায়। নামাজ পড়তে ইচ্ছে করে। এক শেঠ বলছিল, ব্যস্, আর একটা মহাযুদ্ধ বেধে গেলেই করাচি একেবারে বিলেত বনে যাবে।’

‘শেঠের গুষ্টি…।’ মুন্সি একটা অশ্লীল গাল দিয়ে ওঠে।

‘আহা, কথাটা শোনোই-না আগে!’ লোকটি বলে, ‘তুমি খামোখা বেচারাকে গাল দিচ্ছ। সত্যিকথাই তো বলেছে বেচারা। আমায় সে বলল, কতবার যুদ্ধ বাধতে বাধতে থেমে গেছে। যুদ্ধ বাধলে মানুষ মারা পড়বে, এই বলে কেউ-না-কেউ মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যুদ্ধ না-লাগলেও তো লোক মরছে। যুদ্ধতে মরবে গোলাগুলির ঘায়ে, আর এমনি মরছে খেতে না-পেয়ে। যুদ্ধ বাধলে তবু যা-হোক চাকরি পাবে মানুষ! ‘

‘ঝাঁটা মারো অমন চাকরির মুখে!’ মুন্সিজি ফরমের উপর ঠক্ করে সিল মেরে বলে। তুমি দেখছি এখানেই যুদ্ধ লাগিয়ে দিলে, মুন্সিজি।’ গাঁয়ের আর সবাই হেসে ওঠে এ-কথায়।

কিন্তু মুন্সি হাসে না। সে এমনভাবে একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন তার দৃষ্টি দূরে একটি বিন্দুর উপর স্থির হয়ে গেড়ে বসেছে। মুহূর্তে তার মুখ সাদা হয়ে যায়, ঠোঁটদুটি একেবারে শুকিয়ে ওঠে। স্তিমিত গলায় সে আস্তে করে বলে, ‘বাবা নূর আসছে।’

একসঙ্গে সকলের চোখই বাবা নূরের দিকে ফেরে। সবার মুখই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

সাদা পোশাক পরনে বাবা নূর, সোজা মাদ্রাসার বারান্দার দিকে চলে আসছে কেমন যেন ঝিম-ধরা অস্বস্তি বোধ করে সবাই। দু-একজন বিব্রত হয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়।

বাবা নূর তখনও বারান্দার কাছে পৌঁছয়নি। কিন্তু মুন্সিজি আর চুপ করে থাকতে পারে না। চট করে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ‘এসো, বাবা নূর, এসো!’

বারান্দার কাছে পৌঁছে বাবা নূর বলে, ‘ডাক এসে গেছে, মুন্সিজি?’

‘এসে গেছে, বাবা নূর।’ মুন্সি উত্তর দেয়।

‘আমার ছেলের চিঠি-টিঠি আসেনি?’ বাবা নূর জিগ্যেস করে।

‘না, বাবা।’ মুন্সি উত্তর দেয়।

‘বড় খেয়ালি ছেলে। চিঠিপত্র একদম লেখে না।’ বাবা নূর বলে।

রুমালখানা এক কাঁধ থেকে নামিয়ে ঝেড়ে নেয় সে, তার পর অন্য কাঁধে ফেলে চুপচাপ ফিরে যায়। শেষে যখন তার মূর্তিটা দূরে গাঁয়ের আঁকাবাঁকা পথে একমুঠো সাদা তুলোর মতো হয়ে আসে, তখন মুন্সিজি বলে, ‘ভাই, কী করি, বলো তো! আজ দশ বছর ধরে বাবা নূর এমনি করে আসে, আর, প্রতিবারে এই একই কথা জিগ্যেস করে, আমিও প্রত্যেক দিন একই উত্তর দিই। সরকারের কাছ থেকে চিঠি এসেছিল, তোমার ছেলে বার্মায় বোমার আঘাতে মারা গেছে। সে চিঠিখানা আমিই তো পড়ে শুনিয়েছিলাম তাকে। বেচারার মনেই নেই সেকথা। চিঠিখানা আসার পর থেকে বেচারার মাথাটা যেন খারাপ হয়ে গেছে। দশ-বিশ দিন পরপরই ছেলের চিঠি নিতে এসে হাজির হয়। কিন্তু কসম খোদার, ভাই, এরপর বাবা নূর ফের যদি চিঠির কথা জিগ্যেস করতে আসে, তা হলে আমাকেও পাগল করে ছাড়বে।’

অনুবাদ : মোয়াজ্জম হোসেন

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *