প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৪.০৪ আত্মীয় – গোলাম মোহাম্মদ

আত্মীয় – গোলাম মোহাম্মদ

রূপসা নদীর ওই পারে নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। নারিকেল, খেজুর, সুপারিগাছ– যারা এতদিন আত্মীয়ের মতো জড়াজড়ি করে ছিল, তারা আর নেই। নতুন বাড়ি আরও অনেক তৈরি হচ্ছে। এখানে-সেখানে ইঁটের পাঁজা। শিক আর গৃহনির্মাণের অন্যান্য সামগ্রী স্তূপাকারে পড়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও বড় বড় ক্রেনে কাজ চলছে।

পরিবর্তন হয়নি শুধু গোলাকার পাকা চত্বরের কাছের ওই বটগাছটার। ওর অসংখ্য ঝুরি মাটি ফুঁড়ে কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। মাটির সঙ্গে ওদের বহুকালের আত্মীয়তা এখনও অটুট রয়েছে আগের মতোই। রশিদের দাদা বলতেন, অমুক সনে তাঁরা যখন আজমগড় থেকে এখানে এসে বসতি করেছিলেন, তখন বটগাছটার উঠতি বয়েস।

রূপসা নদীর সঙ্গে রশিদের আশৈশবের পরিচয়। এখনও এই নদীর পানিতে ঢেউ ওঠে। এখনও এ নদীর বুকে যৌবনের উন্মাদনা। নদীর এই পারে নতুন তিনটা ঘাট হয়েছে বটে, কিন্তু মাঝিরা আগের মতোই উচ্চসুরে গলা চড়িয়ে ভাটিয়ালি গায়, জেলেরা মাছ ধরে।

কতদিন আগের কথা! রশিদ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। রূপসাকে কতকাল দেখা হয়নি। এই রূপসার পানিতে সে কত ডুব দিয়েছে, সাঁতার কেটেছে। আহা, এই রূপসা তার জননীর মতো। রূপসার দুই কূলের মাটি তার গায়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে। এই মাটি ছেড়ে সে পূর্বপাকিস্তানের কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এ মাটি তাকে আর চিনতে পারবে না। রশিদের দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। এইসব বাড়ি এখানকার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। আরও অনেক নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এখানে-সেখানে ইটের পাঁজা। লোহার শিক আর অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী স্তূপাকারে পড়ে রয়েছে। আত্মীয়ের মতো জড়াজড়ি করে ছিল যেসব নারিকেল, খেজুর, সুপারিগাছ, তারা আর নেই। রয়েছে শুধু পুরনো বটগাছটা, যার অসংখ্য ঝুরি মাটি ফুঁড়ে কাণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই বটগাছ না থাকলে জায়গাটা চেনাই দায় ছিল।

রাস্তাগুলো আগের মতোই এখনও কাঁচা। এই রাস্তা দিয়ে কত ছুটোছুটি করেছে রশিদ। ছুটতে ছুটতে এক রাস্তার শেষ মাথায় ছিল পেয়ারাগাছ। সে গাছের গন্ধ যেন এখনও তার নাকের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। অনেকদিন বাড়ি থেকে রাগ করে সে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে ওই পেয়ারাগাছের ডালে। বাবা তাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে গেছেন পেয়ারাগাছ পর্যন্ত। বলেছেন, ‘খুলনা যাবা না? নামো, নামো, তাড়াতাড়ি করো।

মনে পড়ছে, ওই রাস্তাতেই খেজুরগাছে মাটির হাঁড়ি বাঁধা থাকত। শীতের সন্ধ্যায় খেলতে খেলতে ওরা সবাই মিলে ছিটকেল দিয়ে হাতের তাক ঠিক করত। কে আগে ভাঙতে পারে রসের হাঁড়ি। বেশির ভাগসময় রশিদই জয়ী হত। হাঁড়ি ভাঙতে পারলে টপটপ করে রস পড়ত। আর, তাই ওরা খেত আকাশপানে মুখ উঁচিয়ে, জিভ বের করে।

ওরা সব কোথায় গেল, কে জানে। হয়তো দেখা পেয়ে যাবে, হয়তো পাবে না। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল রশিদ। ওই-যে তাদের সেই পুরনো স্কুল। আর একটু এগিয়ে গেলে পড়বে তার বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি।

আহা, সেই বাড়ির এই অবস্থা! দেখলে বুক ফেটে যায়। এই বাড়ির জন্যই চাচা ঝগড়া করে লাহোর চলে গিয়েছিলেন। তিনি একাই দাদার সমস্ত সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছিলেন। বাবা চুপ থাকতেন, কিছুই বলতেন না। কিন্তু চাচা তবু ঝগড়া বাধাতেন। বাবা বলেছিলেন, এ সম্পত্তিতে তাঁর কোনও লোভ নেই। তিনি সব সম্পত্তি চাচাকে ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু রহিমা ফুফু বিধবা। তাঁকে বঞ্চিত করা কিছুতেই উচিত হবে না। তার পর চাচা লাহোরে থাকতে থাকতেই রহিমা ফুফু মারা গেলেন। বাবা ছিলেন রেলের ইঞ্জিনিয়ার। রূপসা থেকে তিনি বদলি করিয়ে নিলেন। বহু কষ্টে চাচার ঠিকানা জোগাড় করে লিখলেন: তুমি যদি এই বাড়ি চাও তো রূপসা ফিরে এসো। আমি চলে যাচ্ছি। আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমার জন্য ওয়াজেদ আলীর কাছে রেখে গেলাম।

তার পর, ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। রশিদ জানে না, কী হয়েছে। বাবা আর কোনওদিন ফিরে আসেননি। তিনি কোনওদিন কারও কাছে খোঁজ নেওয়ারও চেষ্টা করেননি।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল রশিদ। আগে এ-বাড়িতে কত লোকজন থাকত, আর এখন একেবারে ফাঁকা ফাঁকা। দরজায় মাড়সার জাল। বোঝা গেল, এ-বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত কম। মাথা থেকে মাকড়সার জাল ছাড়াতে ছাড়াতে এগিয়ে গেল আরও কিছুদূর। উড়ে পালাল একটা চামচিকে। দেয়ালের আস্তর খসে গেছে। ফাটল থেকে গজিয়ে উঠেছে পাকুড়গাছ। উঠোনে কয়েকটা গরু বাঁধা। একজন লোক দুধ দোয়াচ্ছিল। বলে, ‘কেডা?’

কী পরিচয় রশিদের, কেমন করে সে জানাবে। বলবে নাকি, আমি পাথর। আমি শিলায়িত ইতিহাসের জঞ্জাল। তুমি আমাকে চিনবে না। আমাকে চেনে ওই বুড়ো বটগাছ। আমাকে চেনে রূপসা নদী। আমার পরিচয় রূপসার দুই কূলের মাটিতে। সে মাটির সোঁদা গন্ধ এখনও আমার শরীরের পরতে পরতে মিশে রয়েছে। সেই মাটিতে একদিন আমার শেকড় ছিল। শেকড় ছিঁড়ে গেছে। মাটির সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক যার বিচ্ছিন্ন, সে মৃত। আমি মরে গেছি। আমি শিলায়িত প্রস্তর। আমি ইতিহাসের জঞ্জাল।

হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এল রূপসা নদীর ধারে। শহরে শহরে এতদিন সে ঘুরে বেড়িয়েছে। এখানে সে আগন্তুক। এখানকার মানুষ নয় শুধু– এখানকার ধান, পাট, গুল্মলতারাও হয়তো তাকে চেনে না। এখানকার মাঝি-মাল্লার গলায় ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া কতদিন শোনা হয়নি। সে আগন্তুক। এখানকার বাতাসও হয়তো তাকে আর চিনবে না।

অথচ, এখানকার মাটি আর বাতাসের টানেই সে চলে এসেছে। খুলনা এসেছিল সরকারি কাজে। কাজ ফুরোলে রোববারের সকালে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রূপসা নদী সোজা এখানে টেনে আনল তাকে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি দেখার তার বড় সাধ।

ডাকবাংলোর কাছে পুকুর। সেই পুকুরের ধারে গিয়ে রশিদ বসল। পানিতে ঢিল ফেলল। একইরকম পরিচিত ঢেউয়ের বৃত্ত উঠল, মিলিয়ে গেল।

কারও সঙ্গে দেখা হল না। কোথায় তারা, কে জানে। ফটিক, মানিক, জামাল, রবিউল, পার্বতী। ছোটবেলায় কত তারা একসঙ্গে খেলেছে। ঝগড়া করেছে। পেয়ারাগাছের ডাল ধরে ঝুলেছে। গাছের ডালে বসে কাঁচা কাঁচা পেয়ারা চিবিয়েছে। পার্বতীর যখন সাত বছর বয়েস, তখন তার বাবা বদলি হয়ে গেলেন শান্তিপুর। তার কয়েক বছর পরে দেশ স্বাধীন হল। পার্বতীরা এখন হয়তো ভারতের বাসিন্দা।

ছাব্বিশ বছর পর্যটনের পর আজ এই অবস্থা। ঢাকাতেও ছিল। কিন্তু ঢাকা তার ভালো লাগেনি। ঢাকা যেন ব্যাধিগ্রস্ত। বেদনায় কুঁকড়ে যাওয়া শহর।

বেদনায় কুঁকড়ে গেল রশিদও।

বটগাছের পাতার মতো তার অস্তিত্ব। পাতা ঝরে গেলে তার কথা কেউ মনে রাখে না। বাতাসের ঝাঁপটায় সে এখন পাতার মতোই উড়ে বেড়াচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে বটতলায় এসে দাঁড়াল রশিদ। আহা, এ গাছের ছায়ায় দাঁড়ালে সমস্ত দুঃখ ধুয়ে মুছে যায়। নাপিত চুল কাটছে। জ্যোতিষী তার পুরনো, ময়লা পুঁথি খুলে বসে রয়েছে ভাগ্যসন্ধানীর অপেক্ষায়। রশিদ তাদের মধ্যে গিয়ে বসে পড়ল।

নাপিতের কাঁচি আর মুখ একসঙ্গে চলছে দ্রুতগতিতে। রাজ্যের যত কথা তার পেট থেকে বেরুচ্ছে। ওদিকে জ্যোতিষীর কথায় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। কেউ কেউ বটগাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে। দুপুরের রোদ প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আস্ত জিভটা বের করে দিয়ে হাঁপাচ্ছে একটা কুকুর। বটগাছের নিচে ঠাণ্ডা হাওয়া।

নাপিত বলল, ‘রূপসা নদীর ওপরে একটা পুল হচ্ছে।’

‘হুঁহ্!’ জ্যোতিষীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।

‘এঞ্জিনিয়ার আইচিল– নদীর পানি মাপে গেচে।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি। খুব শিগগির এই গ্রাম একটা শহর হয়ি যাচ্চে।’

‘এখানে বড় বড় দালান উঠপে।’

‘এখানের রাস্তায় হরদম ভোঁ-ভোঁ মটরগাড়ি চলবে।’

‘শুনেচ কিছু, এখানে নাকি একটা বড় কারখানা হচ্চে?’

‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল রশিদ।

নাপিত বলল, ‘তুমি যেখানে বসে রয়েচ।’

‘আর এই বটগাছটা?’

নাপিত বড় নিশ্চিন্ত মনে বলল, ‘বটগাচ? কত বটগাচ কাটা হয়ি গেল। আর এটা কাটা পড়লি কি আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ি যাচ্চে!’

মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! কী আশ্চর্য! রশিদ ভাবতে লাগল, তার তিনপুরুষের এই বটগাছের শেকড়ও তা হলে নড়বে! রূপসার সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকেছে। আত্মীয় নেই, জন নেই– ছিল একমাত্র এই বটগাছ, যে তাকে চিনতে পেরেছে, সুশীতল কোলে দিয়েছে ঠাঁই, সে-ও থাকবে না।

অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *