ভৈরবী মন্দির লিমিটেড – কৃষণ চন্দর
সেইসব দিনের কথা, আমার যখন ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস ছিল এবং আমি পাঁচ বছর বেকার ছিলাম।
এই পাঁচ বছরে সবরকমের চেষ্টা করেছি।
বি.সি.এস.-এর পরীক্ষা দিয়েছি। ফেল।
তহশিলদার হওয়ার চেষ্টা করেছি। ফেল।
তহশিলদারের সহকারী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। ফেল। তাঁর কর্মচারী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। ফেল।
চারিদিক থেকে নিরাশ হওয়ার পর দিল্লিতে দাদার ফার্মের দরজায় গিয়ে হাজির হলাম। এই ফার্মের মালিক আমার দাদা নন। কিন্তু যেহেতু দাদা ফার্মের খাজাঞ্চি, এইজন্য আমরা সকলে বলতাম ‘দাদার ফার্ম’। ফার্মের নাম ছিল ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া। দাদা আমার একটা পছন্দমতো রোজগারের হিল্লা করে দিলেন। ফেল। আবার, জনসন অ্যান্ড টমসন অ্যান্ড কোং, রোলদুরাম ফোলদুরাম খোলদুরাম অ্যান্ড কোং, রায় সাহেব রাম জয়রাম ভায়া সহায়রাম অ্যান্ড ব্রাদার্স ইত্যাদি অন্যান্য ফার্মে চেষ্টা করলেন। তা-ও ফেল।
আমার দাদা দিল্লির বিশহাজারিতে থাকতেন। ভৈরবীর মন্দিরের নিচে। এই মন্দির একটা ছোট পাহাড়ের উপর। অদৃষ্টই বলতে হয়, দিল্লির এক শেঠ তিন-কামরাঅলা পনেরো-বিশটা কোয়ার্টার তৈরি করে রেখেছিলেন। সেখানে কেরানির মাগ-ছেলে মুরগি বেড়াল কুকুর সমেত বাস করতেন। এই কোয়ার্টারের ঠিক সামনে পাহাড়ের উপর ভৈরবীর মন্দির। ডানদিকে একটা গির্জা, বাঁ-দিকে মোটরের গ্যারেজ আর শিখ ডাক্তার সর্বসুখ সহায়ের কুঠি। দাদার সঙ্গে এই ডাক্তারের খুব খাতির ছিল। তিনি আমাকে তাঁর ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডারি শেখার জন্য রাখলেন। কিন্তু এখানে আমার আক্কেল বেশিদূর গড়াল না। কারণ, ওষুধের নামগুলো এত বেয়াড়া যে, বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। তার পর, কোটা বিষ, কোন্টা নয় সেসব আরও মুশকিলের ব্যাপার। কোনও কোনও ওষুধ বিশ ফোঁটা পর্যন্ত বিষ নয়, কিন্তু একুশ ফোঁটা হলেই বিষ হয়ে যায়। বুঝুন এখন। ভুলচুকও তো হতে পারে! বিশেষ জায়গায় একুশ ফোঁটাই যদি পড়ে যায়! রোগী তা হলে আদমের দেশ ছেড়ে সোজা রাস্তা ধরবে। না, বাবা, দরকার নেই কম্পাউন্ডারিতে। আমি ফিরে এলাম।
যখন কোনও কাজ পাওয়া গেল না এবং জীবনের পাঁচটা বছর তল্লাশেই কেটে গেল, দাদার মেজাজ-ব্যারোমিটারের পারদ তখন শেষ সীমানায় এসে পৌঁছল। একদিন গর্জন করে বললেন, ‘চাকরি পাবি, না, ছাই পাবি। না আছে ভগবানের ওপর আস্থা, না আছে ধর্মে বিশ্বাস। এমন নাস্তিক আক্কেলের ছোকরা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। যখনই দ্যাখো, খবরের কাগজ, সাময়িক পত্রিকা, সোশ্যালিজমের বই নিয়ে বসে আছে। তুই করবি চাকরি! চাকরি করার জন্য মনকে একটু কষ্ট দিতে হয়, দিনরাত ভগবানের আরাধনা করতে হয়। আমার দিকে চেয়ে দ্যাখ্। দিনভর আপিসে কাজ করি, সকাল-সন্ধ্যা আহ্নিক করি, রাত্রে শোবার সময় ফের মালা জপি। সেইজন্যই তো ভগবান চারটি ছেলে দিয়েছেন, ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়ার মতো বড় ফার্মের ক্যাশিয়ার করেছেন, দুনিয়ায় ইজ্জত দিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন। ডাক্তার সুখ সহায় পাড়ার একজন কর্তাব্যক্তি, তিনি নিজে নমস্কার জানান। সমস্ত পাড়ায় রোয়াব করে থাকি। আর, তুই –‘
তার পর তিনি আমাকে ভয়ানক ইতর গাল দিলেন একটা। এ-গালি সারাজীবনে আমাকে কেউ দেয়নি। আমি কাঁদতে লাগলাম। বউদি এসে আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। আমি আরও জোরে কেঁদে উঠলাম। বউদি রেগে বললেন, তুমি বেচারার ওপর বোমা ফাটাচ্ছ কেন। এখন তো ছেলেমানুষ। ভগবান করেন তো চাকরি পেয়ে যাবে। ওর দোষ কী?’
‘ওর দোষ নয় তো কার দোষ? ছেলেমানুষই তো! ছাব্বিশ বছর বয়েস ছেলেমানুষের! ওর সাথের পড়ুয়ারা দু-দুবার বিয়ে করেছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তহশিলদার, হেডক্লার্ক হয়েছে। আর, এ হল কি না এখন ছেলেমানুষ!’
বলে দাদা আমাকে মারবার জন্য হাত তুললেন।
বউদি মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন, ‘হায়, হায়, কী করছ! ছোটভাইয়ের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা হয় না তোমার? আপিসে যাও! আমি ঠিক ওকে বুঝিয়ে বলব।’
দাদা থেমে বললেন, ‘ওকে বলে দাও, যদি বাড়িতে থাকতে চায়, তবে এই গেঁয়োচণ্ডিপনা ছেড়ে দিতে হবে, ভগবানের নাম নিতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে যেতে হবে। আমি কখন বলেছি যে, চাকরি পায়নি, সেটা ওর দোষ? কিন্তু ভগবানের নাম নিলে সব বিপদ থেকে পার পাওয়া যায়। আমার ভাই কী অপরাধ করেছে তুমি দয়া করো, ভগবান!’
বলতে বলতে দাদা ভারি নরম হয়ে গেলেন। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বুধ (আমার নাম বুধরাজ। তিনি আদর করে ডাকেন, বুধ।), মন্দিরে যাওয়া-আসা করো, ভগবানকে অসন্তুষ্ট করা উচিত নয়। ভগবানকে পাওয়া গেল তো সব পাওয়া গেল। আমাকে কথা দাও, তুমি আমার কথা রাখবে।’
আমি চিরকালের জন্য মার্কসের বই বন্ধ করে ফেললাম এবং নিয়মিত ভৈরবীর মন্দিরে যাতায়াত শুরু করলাম।
ভৈরবীর মন্দিরে তিনজন পূজারি। একজন বৃদ্ধ, দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়, তৃতীয়জন যুবক। সবচেয়ে উদার বৃদ্ধ পূজারি, সবচেয়ে নীচ প্রৌঢ় পূজারি। যুবক পূজারি সৌম্যদর্শন, হাসিমুখ। প্রথম পূজারি পাণ্ডিত্যে অগ্রজ, মধ্যম পূজারি কলহপ্রিয়। ছোট পূজারি গায়ত্রী মন্ত্র পর্যন্ত ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু তার হাসিটুকু বড় মিষ্টি, চেহারাটি ভারি সুন্দর। শরীরটা বেশ সুঠাম। সিদ্ধি পানের পর তার চোখ লাল ধুতরার মতো মনে হয়। যখন সে ঢুলুঢুলু চোখে মেয়েদের দিকে তাকায়, হরিণও ভুলে যায় তার পটলচেরা চোখের গর্ব। কিন্তু মধ্যম পূজারি তার ওপর ভয়ানক কড়া নজর রাখে। আর, বৃদ্ধ পূজারি তাকে পেঁয়াজ এবং অন্যান্য গরম জিনিস খেতে মানা করে।
ভৈরবী মন্দিরের মালিক অন্য কোনও ব্যক্তি। বৃদ্ধ পূজারি হলেন এই মঠের গুরু। মঠের একটা মন্দির আছে লাহোরে, একটা রুড়কি আর একটা যোধপুরে। কিন্তু দিল্লির মন্দির সবচেয়ে বড়। এখানে দান সবচেয়ে বেশি পড়ে। তারপরেই লাহোরের মন্দিরের আয়। যোধপুরের মন্দিরের স্থান তার নিচে। রুড়কির মন্দিরের অবস্থা আদৌ ভালো নয়। সেখানকার পূজারির মাইনে এখান থেকে পাঠাতে হয়। বুড়ো পূজারি প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মনি-অর্ডারযোগে পাঠিয়ে দেয় রুড়কি।
ভৈরবীর মন্দিরের চত্বর খুব প্রশস্ত। মন্দিরটি বড় ছোট। কিন্তু সিদ্ধি তৈরির কামরাটা বেশ বড়। এই কামরার সংলগ্ন তিনটি কামরা। ছোট, ধুলোয় কালো, আরও ছোট দরজা। তার ওপর জানালা নেই। এ-পাশেরটা বৃদ্ধ পূজারির। তার পরের কামরা মধ্যম পূজারির। তার সম্মুখে যুবক পূজারির শোবার ঘর। তার সম্মুখে টিলার উপর ঝোঁপঝাড় এবং কোথাও কোথাও সাধুদের সমাধি-মন্দির চোখে পড়ে। শেষ সমাধি-মন্দির থেকে এক ফার্লং দূর হবে। এখানে বহিরাগত সাধুদের জন্য অতিথিশালা; কেবল মঠের সাধুরাই থাকতে পারে। মন্দির ও অতিথিশালার চারিদিকে দেয়াল।
ভৈরবীর মন্দিরে প্রতিদিন পঞ্চাশ-ষাট টাকা দান পড়ে। সকালে মেয়েদের ভিড় জমে। সন্ধ্যায় কাজকর্ম থেকে অবসর পাওয়ার পর পুরুষেরা আসে ঠাকুর-দর্শনে। কিন্তু মেয়েদের সকালে ঠাকুর দর্শন করতে হয়। এইজন্য তারা ভোরবেলাতেই মন্দিরে আসে। অনেক সময় এমনও ঘটে যে, সকালে এসে তাদের ছোট পূজারিকে ঘুম থেকে জাগাতে হয়। তার পর ঘণ্টাধ্বনি পাহাড়ের মাথায় আঘাত খায়, গর্জন তুলে বিশহাজারির আকাশ ছেয়ে ফেলে। যুবক পূজারি ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। তখন মেয়েরা মৃদু গলায় শোরগোল তোলে। সকালে যুবক পূজারির ওপর ঠাকুরকে জাগানোর ডিউটি পড়লে দর্শনার্থীদের প্রায়ই তাকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে হয়। ছোট পূজারির বড় ঘুম। বুড়ো পূজারি তাকে ভর্ৎসনা করে। প্রৌঢ় পূজারি করে গালাগালি। যুবক পূজারির শাস্তি হিসেবেই বোধহয় সকালে ডিউটি পড়ে। ভারি বিরক্ত হয় সে। কিন্তু গুরুর মর্যাদা ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে চুপ করে যায়।
যুবক পূজারি খুব শিগগির আমার বন্ধু বনে গেল। মন্দিরের পূজা-পাঠ ইত্যাদির পর আমরা তার কামরায় গিয়ে সারাটা দিন গালগল্প করে কাটাই। সে-ই আমাকে জানাল, মন্দির থেকে আজকাল বৃদ্ধ পূজারির প্রায় লাখ টাকা আমদানি। বৃদ্ধ পূজারি এখন শ্মশানের পথে। এখন তাদের মধ্যে উত্তরাধিকারী নিয়ে ঝগড়া চলছে। সে নিজেই চায় এই গদি। কিন্তু মর্যাদা ও বয়সের দিক থেকে বোধহয় প্রৌঢ় পূজারি উত্তরাধিকারী হবে। ব্যাপারটা ভারি খারাপ দাঁড়াবে। বুড়ো পূজারি প্রথমে তাকে ভালোবাসত, এখন তার মন ঢলেছে মধ্যম পূজারির ওপর। কারণ, তার ধারণা, যুবক পূজারির পূজা-পাঠের প্রাথমিক অধ্যায়ও শিক্ষা হয়নি।
‘এখন তুমি কী করবে?’ আমি হেসে বললাম।
সে ঘরের কোণ থেকে দু-কোষ পেঁয়াজ নিয়ে এল, আগে লুকিয়ে রেখেছিল। আমার দিকে একটা পেঁয়াজ ছুঁড়ে বলল, ‘খাও।’ অন্য পেঁয়াজটা সে নিজেই খেতে লাগল।
‘কচর-মচর– বেশ মজা কিন্তু।’ সে আমাকে বলল, ‘পেঁয়াজ আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমি মাংসও খাই। জ্যোতি-সাধুদের সবকিছু খাওয়া উচিত।’
‘কেন?’ বড় কষ্টে কাঁচা পেঁয়াজ খেতে-খেতে আমি প্রশ্ন করলাম।
‘জ্যোতি-সাধুদের মনে কোনও লালসা থাকা উচিত নয়। মাংস খাক, মদ চালাক, বিছানায় মেয়েছেলে নিয়ে রাত কাটাক– সবকিছু করে দুনিয়ার ভোগ-লালসা বের করে দিক মন থেকে। তখন সে ভগবান পেতে পারে।’ সে হাসতে লাগল।
‘হাসছ কেন?’
‘কাউকে বলবে না তো? ভৈরবীর দিব্যি করো!’
ভৈরবী-জ্যোতির দিব্যি।
‘এই-যে প্রৌঢ় পূজারি বাবা পন নাথ– আসলে কিন্তু ভয়ানক বদমাশ। চেহারা দেখে বুঝতে পারো না, কেমন শয়তানি-শয়তানি ভাব। একে সাধু বলে মনে হয়, না, চণ্ডাল?’
‘চণ্ডাল।’ আমি মাথা দুলিয়ে বললাম।
‘চণ্ডাল নিজে নিজেকে সাধু বলে। আমি এর নাড়ি-নক্ষত্র জানি।’
‘নাড়ি-নক্ষত্র?’
‘হ্যাঁ।’ সে অন্য কোণ থেকে এক বোতল মদ তুলে নিয়ে এল। ‘নাও চালাও।’
আমি বললাম, ‘না, আগে তুমি।’
সে বোতলে মুখ দিল। মাত্র দু-চুমুক বাকি রেখে হেসে বলল, ‘না, তুমি খাও। জ্যোতির চরণামৃত।’
‘সহায় হও, গুরুজি।’ আমি দুই চুমুক কণ্ঠনালির নিচে নামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘অমৃতের মজা পেয়েছি, গুরু। হ্যাঁ, তুমি বাবা পন নাথের কথা বলছিলে।’
‘একদম পয়লা নম্বরের হারামি। গুরুজি এখন খুব বুড়ো হয়ে গেছেন– তিনি ধনে নিয়ে বসে থাকেন। আমাকে কিন্তু বলে, পেঁয়াজ খেয়ো না, চোখ তুলে চেয়ো না, দিনরাত ধনে খাও। বাবা পন নাথ আমাকে বড় কড়া চোখে দেখে। মন্দিরে কোনও মেয়ের দিকে তাকাবার উপায় আছে? কিন্তু নিজে– নিজে
‘হ্যাঁ, কী করে?’
যুবক পূজারি ইতিউতি তাকাল। একবার বাইরের দরজা পর্যন্তও গেল। তার পর ফিরে এসে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলতে লাগল…
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘না, না, একথা সত্যি হতে পারে না।’
ভৈরবী-জ্যোতির দিব্যি। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ও নিজের বয়েসি মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। যুবতী মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কেউ রোগ-শোক-বিপদে জর্জরিত, কেউ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত, কারও ছেলেদের দৌরাত্ম্য থেকে হাঁফ ছাড়ার উদ্দেশ্য– নানারকমের মেয়ে আসে, আর বলে, আমাকে ভগবানের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দাও। তারা দিনরাত মন্দিরে যাতায়াত করে, মানত শোধে, প্রসাদ আনে, মন্দিরের সিঁড়ি নিজের চুল দিয়ে ঝাঁট দিয়ে দেয়, পূজারির পা টেপে, ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা মন্দিরের চত্বরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর বাবা পমন নাথের সঙ্গে প্রার্থনা করে, তিনি যেন তাদের ভগবানের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দেন, একবার ভগবান দেখিয়ে দেন।’
‘তার পর?’
‘ও তাদের ভগবানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়।’ যুবক পূজারি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘হি হি হি।’ হাসিটা চড়তে লাগল তার। বলল, ‘একবার যে মেয়ে ভগবান দেখেছে, সে না ঘরের, না ঘাটের। ব্যস্, একদম মন্দিরের সম্পত্তি হয়ে যায়।’
.
যোধপুরের মন্দির থেকে তিনজন বাইজি এসেছিল। মন্দিরের দেবদাসী এবং অতিথিদের সঙ্গে তাদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হল। তাদের পরনে গেরুয়া রঙের শাড়ি। চুল আলুলায়িত। কপালে চন্দনের তিলক। গৌর রঙ। দেহে যৌবন, অন্তরে ভগবানের জ্যোতি। বিশহাজারির আকাশে-বাতাসে আলোড়ন জাগল। প্রত্যেক মেয়ের এখন উৎসব-রাত্রি। যখন তারা করতাল সহযোগে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ’ গায়, বিশহাজারির মেয়েদের মন ভাবে গদগদ হয়ে ওঠে। তারা এদের সব আরতিতে যোগ দিতে লাগল। আজকাল ঘরে-ঘরে কেবল এই বাইজিদের কথা। জীবনে যারা মন্দিরে পা দেয়নি, তারা দিনে দু-তিনবার নিশ্চয়ই মন্দিরে আসবে। যদি মন্দিরে ভগবান-দর্শনে মন না-ভরে, তাদের কীর্তনের বায়না দেয় নিজের বাড়িতে। তার পর আর কী! জনসাধারণ বাইজি-দর্শনে আসছে, মেয়েরা প্রসাদ বিতরণ করছে, বাইজিদের জন্য দোশালার অর্ডার দিচ্ছে। প্রত্যেক কীর্তনের আসরে একশো সওয়াশো লোক জমা হয়। বাইজিদের নির্দেশ, সকলের আগে মন্দিরে ষাটটি টাকা এবং দোশালা পৌঁছে দিতে হবে। নচেৎ নাম-কীর্তনের আসর জমবে না। আবার পাড়ার একজন নাম-কীর্তন করাল, তখন অন্যে বাদ যাবে কেন? ঘরে-ঘরে মেয়েরা পালা করে নাম গাওয়াতে লাগল। ষাটটা টাকা, তিনজোড়া শাল আর ভগবানের নাম-গান। এ আর এমন কী! আরে মশায়, সবজি-মণ্ডির মেয়েরা- যারা আগে ঘরে এসে নাম-কীর্তন করত, এর কাছে কোথায় লাগে! তারা পঞ্চাশ টাকার কম স্পর্শ করত না। আর কী চেহারা! কালো পেতনি চিমসে মেয়েমানুষ! এদের ভজন-সভা দেখলে ভগবান নিজে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলতেন। আর, এই বাইজিদের গানে কী মজা… যেন… বাহ্ বাহ্ বাহ্…
শুনুন একবার এদের নাম-গান! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!– বাইজিদের চুল বাতাসে ঢেউয়ের মতো নাচছে। এলোমেলো চূর্ণকুন্তল সাপের মতো দুলছে। কয়েকগাছি এক বাইজির ঠোঁটের উপর এসে পড়েছে। পাতলা-পাতলা ঠোঁটে যেন দংশন করতে চায়। গলার উতরাইয়ে প্রাণস্পন্দন কীরকম, দেখেছেন! এই নরম বুক ভগবানের দর্শনের আশায় যেন তড়পাচ্ছে। চোখে কাজল। আহা, কী চোখ! কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। কানের ডালিটাই-বা কী সুন্দর! ইচ্ছে হয়, কাঁচা খেয়ে ফেলি। হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! এমন বদখেয়াল কেন মনে এল! ভগবান এর বিচার করো। ওই দ্যাখো, গোপিনীরা কদমতলায় গান ধরেছে, আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বাঁশরিতে সুর তুলে তুলে নাচছেন।
বড় বাইজির বয়েস পঁচিশ বছরের বেশি হবে না। কিন্তু যেন মূর্তিমতী রতি। এই চোখে কোনও রঙ নেই। এমন সুডোল হাত, যেন কলি দিয়ে গড়া। আর ওই আলতারাঙা তুলতুলে চরণ কোনও কাঁটার আঘাত পায়নি কোনওদিন। কী মোলায়েম! বড় বাইজির কপোল যেন পাকা আপেল। এখনি গাছ থেকে ছিঁড়ে পড়তে চায়। বুধ, তোমার ঝুলি বাড়িয়ে দাও।
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
মেজ বাইজির দুনিয়া-ঝলসানো দেহের দিকে তাকাও। সে বাইজির দলে সাপের মতো নাচের তালে তালে চমকাচ্ছে। এমন কালো বিষধর কেশপাশ তুমি কোথাও দেখেছ! এমন স্বপ্ন কোথায় দেখেছ তুমি? যেন ঘুমন্ত শিশুর হাসি, ঊষার বুকে শিশিরসিক্ত ফুল, সুন্দর স্বপ্ন দেখার পর চোখ মেলে বিকশিত হচ্ছে। যেন…। আধফোঁটা এই কলির মাধুর্যই অন্যরকম।
করতালের লয় হাজার মূর্ছনায় ফেটে পড়ছে। ছাতির ওপর গ্রীবাসমুদ্রের ঢেউ নাচছে, ভেঙে পড়ে দূরে হারিয়ে যাচ্ছে, আবার ভেঙে পড়ছে, তার পর সব নিস্তব্ধ। এই সুন্দর উপত্যকা, এই টিলা, এই দুধের ঝরনা…
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
বুড়ো পূজারি মারা গেছেন।
মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি কোলাহল তুলেছিল। পূজারি কাঁদছে। মেয়েরা মন্ত্রপাঠ করছে। বাইজিরা থালায় ফুল সাজিয়ে সাধুর সমাধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কলরব লেগেই থাকে।
এখন রাত্রি।
টিলা সুপ্ত। সাধুরা যার যার সমাধির ভেতর ঘুমিয়ে। বিশহাজারির ছোট-ছোট ঘরের ছোট্ট-ছোট্ট জীবনের কোলাহল ঘুমন্ত। পৃথিবীর কক্ষ-পরিভ্রমণ থেমে গেছে। মন্দিরের চত্বরে যুবক পূজারি একা বসে ছিল। সে আজ সিদ্ধি গিলেছে, চরস খেয়েছে, মদ টেনেছে। তবু তার চেতনায় কোনও বিভ্রাট নেই।
‘গুরু।’ আমি তার কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাক দিলাম। তার পর তার গায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল, আর আলগোছে চোখের জল মুছে ফেলছিল।
‘তোমার কিসের দুঃখ, গুরুদেব?’
‘আমি গদি চাই, আমি নারী দেহ চাই, আমি হোটেলে খেতে চাই, আমি আমার আত্মা থেকে সমস্ত ভোগ-লালসা দূর করে দিতে চাই। জানি না, আমি কী চাই।’
‘তুই গদি চাস, হোটেলে খেতে চাস?’ কে যেন তার মাথার উপর থেকে বলল। আমরা দু জনে ঘুরে দেখি, প্রৌঢ় পূজারি অগ্নিদৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে বলছে, ‘এই মন্দিরে লালসার ভিখারিদের জায়গা নেই। দূর হ এখনি এখান থেকে!’
যুবক পূজারি সটান খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার হাতের পেশি উছলে উঠেছে। দাঁত কটমট করছে। দম-আটকানো গলায় সে বলল, ‘এখনি তোকে খতম করে ফেলব। তুই দূর হয়ে যা– ‘
বাবা পন নাথ ভয়ে পালিয়ে গেল।
অতিথিশালায় তখনও আলো জ্বলছিল।
যুবক পূজারি অতিথিশালার দিকে এগোতে লাগল। সে একবার আমার দিকে তাকাল। তার পর মুখ ঘুরিয়ে আবার এগিয়ে চলল সামনের দিকে। আরও, আরও…। আর ফিরে তাকাল না। পূজারির ফুল-সাজানো সমাধি পার হয়ে সে এগিয়ে চলেছে। এবার অতিথিশালার দরজায় পৌঁছল। তার পর ভেতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
অতিথিশালার আলোও নিভে গেল।
টিলা সুপ্ত। সাধুরা সমাধির বুকে নিদ্রামগ্ন। বিশহাজারির ছোট-ছোট ঘরের ছোট্ট-ছোট্ট জীবনের স্পন্দন নিভে গেছে। থেমে গেছে পৃথিবীর গতি।
দ্বিতীয় দিন জানা গেল, বাবা পন নাথকে কে যেন খুন করে রেখে গেছে। পুলিশ সন্দেহক্রমে যুবক পূজারি ও বাইজি তিনজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। পরে বাইজিরা ছাড়া পেল। খুনের অভিযোগে মামলা চালানো হল কেবল ছোকরা পূজারির বিরুদ্ধে। কিন্তু সে-ও প্রমাণের অভাবে রেহাই পেয়ে গেল।
খালাস পেয়ে বেরিয়ে এসেই সে সুন্দর করে বাবা পমন নাথের সমাধি তৈরি করে দিল। এখন তিনজন বাইজি প্রতিদিন সেখানে ফুল ছড়ায়।
যোধপুর থেকে বাইজি তিনজনের ফিরে যাওয়ার আদেশ এল। সেখানকার পূজারি লিখেছে। কিন্তু যুবক পূজারি তা গ্রাহ্যই করল না। কেননা, দিল্লিতে ধর্মজ্ঞানের চর্চা এখন খুব বেশিমাত্রায় হওয়া দরকার। যুবক পূজারি জবাবে লিখল, যদি এইরকম বাইজি যোধপুরের মন্দিরে আরও থাকে, তাদের যেন দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর যোধপুরের পূজারি চুপ করে গেল।
দৈবক্রমে মঠের রায়মতো নতুন পূজারিই ভৈরবী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মনোনীত হল। সে গায়ত্রী পাঠ করতে জানে না। তাতে কী। সে এখন বৃদ্ধ পূজারির বিপুল ধনদৌলতের মালিক। বৃদ্ধ পূজারি এ সম্পদ ব্যাংকে রাখেনি, তার কুঠরির ভেতর পুঁতে রেখেছিল।
‘তুমি কেমন করে খবর পেলে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘এমনি। শুধু ভগবান আমাকে খবর দিয়েছিল। বুড়ো বাবার কুঠরির ভেতর ঢুকেই আমার খেয়াল এল। তিনি হাত-ইশারায় বলেছিলেন, তাঁর ঘরে কিছু আছে। এটা-সেটা খুঁড়ে দ্যাখো। যদি রাতারাতি না-দেখতাম, এই গুপ্তধন আমার কপালে জুটত না। আমি মামলা চালাতাম কী করে! কী করে হতাম এই গদির মালিক!’
সে গদির মালিক– গর্বভরে কথাটা সে বলছে, ঠিক এমনি সময় আমার চোখে পড়ল একখানা সাক্ষাৎকার কার্ড :
ভৈরবী মন্দির লিমিটেড
শাখা : লাহোর, দিল্লি, যোধপুর, রুড়কি
স্বত্বাধিকারী : বাবা দমন নাথ গোস্বামী
আমি এবার চিৎকার করে বললাম, ‘পেয়েছি, পেয়েছি।’
সাধু ভয় পেয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’
আমি ঘরমুখো ছুটতে ছুটতে বললাম, ‘ভগবান পেয়েছি, ভগবান পেয়েছি, পেয়েছি।’
.
গত পনেরো বছর যাবৎ আমি বোম্বাইয়ে স্থায়ীভাবে বাস করছি। জহুতে আমার নিজস্ব ভৈরবী মন্দির আছে। একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছি সুরাটে, আর একটি আহমদাবাদে। আনন্দপুরে বাইজিদের মঠ খুলেছি। সারা ভারতে কোথাও আপনার চোখে পড়বে না এমন সুতনু সাধন-সঙ্গিনী। বছরে আট মাস এই বাইজিরা ঘুরে-ঘুরে টাকা আর কাপড় সঞ্চয় করে।
হিন্দুস্থান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ভয়ানক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। হাজার হাজার মুসলমান মারা গেল। কিন্তু আমার আমদানি কিছুমাত্র কমেনি।
হ্যাঁ, দিল্লির গুরুজির লাহোরের শাখা-মন্দিরটা ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু গুরুজি দমবার পাত্র নন। তৎক্ষণাৎ দিল্লির একটা মসজিদ তাঁর হস্তগত হল। তিনি সেখানে ভৈরবী-জ্যোতির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। বোম্বাই, দিল্লি, যোধপুর, আহমদাবাদ ও অন্যান্য শহরে আগত শরণার্থীরা ভিক্ষা চায়। কিন্তু বাইজিরা যা পায়, তার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগও বেচারা শরণার্থীদের কপালে জোটে না। বোধহয় হাজার হাজার মেয়ে আমায় অনুরোধ করেছে ভগবানের সঙ্গে তাদের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য। যাদের কপাল ভালো, তারা ভগবানকে পেয়েছিল বইকি।
আমার আধ্যাত্মিক সিদ্ধিও বেড়ে গেছে। আমি এখন আমার কারবার বাড়ানোর কথা ভাবছি। এই বছর একটা ফিল্ম-কোম্পানি খোলার ইচ্ছা আছে, আর কলবা দেবী রোডের ওপর গণেশজির এক মন্দির। কলবা দেবী রোডে লাখপতি গুজরাটি ও মাড়োয়ারিদের কারবার চলে। এরা গণেশ ঠাকুরের প্রেমিক। মনে হয়, এই মন্দির জোরসে চলবে। দাদাকে চিঠি লিখেছি। তাঁর রায় এলে কাজ শুরু করব। এখন আমি দাদার অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ করি না। তিনিই আমাকে দেখিয়েছেন সত্য জ্ঞানের পথ। যদি নিজের পথে চলতাম, এইরকম বেকার থাকতাম এবং সোশ্যালিজমের অকেজো বাজে বই পড়ে পড়ে নরকে যেতাম।
হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ!
অনুবাদ : শওকত ওসমান