কপোতের প্রাণ – আলি আব্বাস হোসাইনি
স্বপ্নও কত বিচিত্র, অদ্ভুত ধরনেরই-না হয়ে থাকে। দেহ পড়ে থাকে বিছানায়, কিন্তু মন চলে যায় অন্য কোথাও। কত জায়গায়-না উড়ে বেড়ায় মন পাখির মতো ডানা মেলে দিয়ে। কত ভীষণদর্শী লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। কত পরী এসে শুনিয়ে যায় মনের কথা। কখনো প্রেম হয় স্বপ্নে। কখনো মনের মিল না হলে ঝগড়া বাধে। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য– কোনোকিছু বাদ যায় না।
আমিও একদিন এইভাবে মসজিদের মোল্লার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমি নিজে সবসময় ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি, কাজেই আমার স্বপ্নও সেইরকম। কোনো এক কবির কোনো এক কবিতার একটি চরণ আমার মনে পড়ে গেল। সেইটি আমি মোল্লাকে শোনালাম। চরণের মর্ম এইরকম : ‘প্রেমের তরেই সৃষ্টি মানুষের– সেই জিনিসেরই বড় অভাব; এবাদত সবাই করে, যে এবাদতে প্রেম নিরস্তিত্ব।’
মোল্লা তো শুনেই চটে-মটে আগুন। কয়েকবার ‘লা-হওল’ পড়ে যখন তিনি বুকে ফুঁক দিচ্ছিলেন, তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল।
ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম, মোরগে আজান দিচ্ছে বটে, কিন্তু তখনো ফজরের সময় হয়নি। তখনো কাক ডাকেনি। তখনো সুবহে সাদেকের আলো ছড়িয়ে পড়েনি আল্লার রাজত্বে।
কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে পড়ে এপাশ-ওপাশ করলাম। তখন না ঘুমোনো যায়, না জেগে থেকে কোনো ফায়দা। সিগারেট ধরিয়ে স্বপ্নের সেই কবিতার সঠিক মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে লাগলাম। এই চেষ্টার ফলে চোখ জুড়িয়ে আসতে চাইল। ভাবলাম, শয়তান আমার চোখে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এখন যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তাহলে ফজরের নামাজ শিকেয় উঠবে, আর ফজরের নামাজ শিকেয় উঠলে শয়তানেরই লাভ।
সুতরাং, শয়তানকে নিরাশ করা উচিত বলে মনে হল। উঠলাম। উঠে, সময় না হওয়া সত্ত্বেও ওজু করে জায়নামাজে এসে বসলাম।
বসে বসে ‘নিদ্রা অপেক্ষা নামাজ শ্রেয়’ ধ্বনি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, এমন সময় বাইরের বারান্দার উপরের কার্নিশে ডানা-ঝাঁপটানোর শব্দ শুনলাম। অল্প পরেই একটা সাদা পায়রা বারান্দার খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উড়তে উড়তে, পড়তে পড়তে আমার কোলে এসে নামল। পাখিটি আমার জামার ভেতরে সেঁধতে চাইল। কাপড়ে তার সারা দেহ ঢেকে গেল, কেবল বেরিয়ে থাকল মাথাটুকু। ছোট্ট, গোল গোল চোখ দুটো দিয়ে পিট্ পিট্ করে তাকাতে লাগল। জামার ভেতরেও আমি টের পেলাম, তার সারা শরীর কাঁপছে। ছোট্ট, লাল জিবটা থেকে-থেকে বেরিয়ে পড়ছে। আস্তে করে পায়রাটার পিঠে হাত রাখলাম। এতে সে আরও সঙ্কুচিত হল। আস্তে আস্তে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলাম। এতে ক্রমে ক্রমে সে শান্ত হল আর ভয়ের ভাব কেটে যেতে লাগল।
তারপর, আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কী করি। পায়রাটা নিশ্চয় কোনো বিপদের মুখে পড়েছিল। সে আশ্রয়প্রার্থী। আশ্রয়প্রার্থীকে, বিপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আমার ফরজ। কিন্তু আমার ঘরে পায়রা রাখার খুপরি নেই। কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থার কথাও আমার মনে পড়ল না। সুতরাং, আপাতত একটা ঝুড়ির মধ্যে রাখব সাব্যস্ত করলাম।
জায়নামাজ থেকে নিজেকেই উঠতে হল। পাশের ঘরে আমার দুই দুটো জোয়ান ছেলে ঘুমুচ্ছে। তাদের জাগাতে মন সরল না। আমার ধর্মীয় নীতি-জ্ঞান আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, ঘরের জোয়ান ছেলেকে ফজরের সময় জাগাতে হলে জোরে জোরে আজান দাও বা একামত হাঁকো; তাতে জাগে জাগুক, না জাগে নাই জাগুক। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙিও না; কেননা তখন সে এমন অবস্থাতে থাকতে পারে, যা দেখলে তাকে লজ্জা পেতে হতে পারে।
সুতরাং, বারান্দায় বেরুলাম ঝুড়ি খুঁজতে। কার্নিশ থেকে ধ্বনি উঠল, ‘ম্যাও ম্যাও।’ ভাবলাম, আলো জ্বেলে বিড়ালটা কোথায় রয়েছে, দেখি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, বিড়ালের এই ডাকের মধ্যেও এক ধরনের কাকুতি রয়েছে, নালিশ রয়েছে। আমি তার শিকার ছিনিয়ে নিয়েছি মুখ থেকে। কারো মুখের আহার কেড়ে নেওয়ার কী অধিকার রয়েছে আমার! বিড়াল সেই নালিশই তো জানাচ্ছে আমার কাছে। দিন কয়েক আগে সে বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাদের চোখ ফোঁটানোর জন্য সে রোজ কয়েকবার করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা বয়ে নিয়ে বেড়ায়। নিজের এই ছোট সংসারের তত্ত্বাবধানে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয় তাকে। তার ওপর, এতগুলো বাচ্চাকে নিজের শরীর থেকেই দুধ নিংড়ে বের করে দিতে হয়। সেই দুধ কোত্থেকে আসবে যদি সে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে না পায়। আজকে ভারি চমৎকার একটা খাদ্য পেয়েছিল। পুরো একটা পায়রা সে পরম তৃপ্তিসহকারে পেট ভরে খেতে পারত।
নতুন ভাবনার জট পাকিয়ে গেল মনের মধ্যে। আমার ধর্মীয় বিবেক কোনো সমাধান করতে পারল না এ সমস্যার। আল্লাহ্তালা এক জীবকে অন্য জীবের খাদ্য করে সৃষ্টি করেছেন। গরু, মোষ, ছাগল– এরা ঘাস, শাক-সবজি, গাছের নরম নরম, কচি কচি পাতা খেতে খুবই ভালোবাসে। এইসব খেয়ে তারা যে বিষ্ঠা ত্যাগ করে, খাদ্য হিসেবে তা পোকামাকড়ের প্রিয়। পাখিতে আবার পোকামাকড় খেয়ে তৃপ্তি পায়। এইসব চতুষ্পদ জন্তু আর পাখি চলে যায় মানুষের পেটে। যে-সব চতুষ্পদ মানুষে খায় না, তাদেরকে ভক্ষণ করার জন্য অন্য জীবের অভাব নেই। কাউকে খায় বাঘে, না হয় ভল্লুকে, কাউকে খায় চিলে, না হয় শকুনে। বনে-জঙ্গলে কোনো জন্তু মাংসাশী, আবার কেউ-বা নির্ভেজাল নিরামিষাশী। পুরুষ-নারী-নির্বিশেষে এই প্রক্রিয়া অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।
আমি এইসব কথা চিন্তা করছি, এদিকে বালবের আলো খুকুমণির ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে লাগল, ওদিকে বিড়াল আমার হাতে পায়রা দেখতে পেয়ে আরও জোরে নালিশ জানাতে লাগল। ‘মিয়াও মিয়াও।’ খুকুমণির ঘুম গেল ভেঙে। খুকুমণি উঠল। উঠে বসল। বসে, আমার হাতে পায়রা দেখে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আব্বু, আমাতে দাও!’ খুকুমণি এখনো ক বলতে পারে না, বলে ত। তেমনি র-কে বলে ল।
আমি ওকে প্রবোধ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘না, মা-মণি, একটা অন্য লোকের পায়রা– আমি তোমাকে কেমন করে দিই!’
‘তুমি যে বলেছ– এটা আমাল।’
এখন কেমন করে ওকে বোঝাই, ধরলেই কিছু একজনের পায়রা অন্যের হয়ে যায় না। আমার সব সন্তানকেই আমি বরাবর এই শিক্ষা দিয়ে আসছি যে, রাস্তায় কোনো জিনিস কুড়িয়ে পেলেও সেটা তার হয়ে যায় না। তাছাড়া, পায়রাটাকে আমি কুড়িয়ে পাইনি। ধরিওনি। সে তো প্রাণরক্ষার জন্য নিজে থেকে আমার কোলে এসে পড়েছে। ধর্মে বলে, আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দাও। নিজের প্রাণ বিপন্ন করে হলেও বিপন্নকে রক্ষা কর।
এইসব কথা ভাবছি, এমন সময় খুকুমণির বড়টা অর্থাৎ খোকন জেগে উঠল। ঘুমের যখন পরিশিষ্ট দশা, তখন বোধহয় আমাদের কথা সে শুনেছিল। সুতরাং, বিনা ভূমিকায় সে রায় জারি করে দিল, ‘খুকুমণিকে এই পায়রা দিও না, আব্বু। ওর হাত থেকে পালিয়ে যাবে, ধরে রাখতে পারবে না।’
খুকুমণি ঘাড় বাঁকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তেন, পালিয়ে যাবে তেন? আমি যে খুব শক্ত কলে ধলে থাতব।’ এই বলে সে শক্ত করে ধরে থাকার ভঙ্গিটাও দু-হাত জোড়া লাগিয়ে দেখিয়ে দিল।
এ কথায় ফারসি কবিতা আমার মনে পড়ে গেল। আহা কী কবিতা!
‘দিলম্ মানন্দ্ কুঞ্জশ্কে
ব দস্ৎ-এ তিফ্ল্-এ নাদানে
কে আজ্ জাঁ দোসৎ-তর্ দারদ্
ওয়ালেকিন মি-কশদ্ জানে।’
(আমি যেন মূর্খ শিশুর হাতে চড়ুইপাখির মতো। প্রাণের চাইতে প্রিয় ভাবছে বটে, কিন্তু আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে।)
খোকন বলল, ‘আব্বু, পায়রাটা আমাকে দাও– আমি মোল্লাজিকে দিয়ে আসব। তিনি পায়রা পোষেন। কতজনের পায়রা যে ধরে ধরে পুষেছেন তিনি।’
‘বলছ কী! আর, যার পায়রা, সে চাইতে আসে না?’
‘হুঁহ্, চাইতে আসবে? কার এত সাহস যে, মোল্লাজির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে! যদি কেউ চাইতে আসেও, মোল্লাজি এমন ধমকটাই দেবেন যে, পালাতে পথ পাবে না।’
আমি জানি, খোকন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে খুব ওস্তাদ। ওকে তাই সে সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করলাম, ‘তখন কী বলেন মোল্লাজি, একটু শোনাও দেখি!’
‘বলেন, আমি এই পায়রা তোমার ঘর থেকে ধরে আনিনি। এ তোমার ঘরে থাকতে চায় না। তোমার কোনো পায়রার সঙ্গেই এর সম্পর্ক ভালো নয়। সেইজন্য এ আমার ঘরে নিজে থেকেই চলে এসেছে। আমার পায়রাদের সঙ্গে গটরগুঁ-গটরগুঁ করে সুখে-শান্তিতে আছে। এ পায়রা আমার দানা খেয়েছে, আমার পানি খেয়েছে। আমি কেমন করে একে আবার একটা জালেমের হাতে ছেড়ে দিতে পারি। ব্যস্, আপনি এখন আল্লার শুকর আদায় করতে করতে ঘরে ফিরে যান।’
এই কৃত্রিম বক্তৃতা শুনে আমার খুব হাসি পেল। আমি খোকনের কাছে খোকনের বিছানায় গিয়ে বসলাম। এই সুযোগে খুকুমণি চট্ করে পায়রার মাথায় হাত বুলোতে শুরু করে দিল। পায়রা বোধহয় এতে আরাম পেল, তাই সে চোখ বুজল পরম তৃপ্তিতে।
জীব-জন্তু, পশু-পক্ষীর বিষয় নিয়ে গল্প বলে আমি আমার ছেলেমেয়েকে জীবনের এই জটিল পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু উপদেশ দেব, ভাবছিলাম, এমন সময় বেড়ালটা উপরের কার্নিশ থেকে নেমে নিচের বারান্দায় একেবারে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর, পায়রার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
খোকন বেটা-ছেলে বলেই বোধহয় নিষ্ঠুর। তাই সে পরামর্শ দিল, ‘আব্বু, পায়রাটাকে বারান্দায় ছেড়ে দাও। আমরা দেখব, বেড়ালটা ওকে ধরতে পারছে, না পায়রাটা উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’
কিন্তু খুকুমণি বলল, ‘না, আব্বু, বেলাল তাহলে ওতে খেয়েই ফেলবে।’
শিশুদের নিষ্ঠুরতা আর কারুণ্যের মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনের মধ্যে আলোড়ন চলছিল, এমন সময় পাশের বাড়িতে একসঙ্গে অনেক পায়রার ডাক শোনা গেল। আমার প্রতিবেশী একসঙ্গে সব পায়রা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের আকাশে ওড়া আর ছাদে নামা টের পেলাম। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। বিড়ালটাও অনুসরণ করল আমাকে। বিড়ালটা সত্যি ক্ষুধার্ত। একবার মনে হল, সে বুঝি আমার হাত থেকে পায়রাটাকে ছিনিয়ে নেবে। আমি একটা ঢিল মেরে বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দিলাম। তারপর, প্রতিবেশীর পায়রাগুলো যেই আর এক দফা আকাশে উড়ল, অমনি হাতের পায়রাটাকে জোরে ছুঁড়ে দিলাম বাতাসে। প্রতিবেশীর পায়রাদের সঙ্গে সে অনায়াসে মিশে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি তাই দেখলাম, আর ভাবতে লাগলাম, না জানি কার পায়রা কার কাছে চলে গেল। তবু সান্ত্বনা, বিড়ালের হাত থেকে সে রক্ষা পেয়েছে।
কিন্তু বিড়ালটাকে তো চুপ করানো গেল না। ‘ম্যাও ম্যাও’ রবে তার বিক্ষোভ আর আর্তনাদ চলতেই থাকল। বিক্ষোভ মুখের আহার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে, আর্তনাদ ক্ষুধার্ত থাকার যন্ত্রণায়।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামবার সময় মুখে ‘চু চু’ ধ্বনি করে আর ‘পুষি পুষি’ বলে ডেকে তাকে নিচে নামাবার চেষ্টা করলাম। আমার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল না। কিন্তু বিড়াল আমাকে বিশ্বাস করতে পারল না। করবেই-বা কেন। একে তো সে আমার পোষা বিড়াল নয়, তার ওপর আমি তার মুখের আহার কেড়ে নিয়েছি। কাজেই আমার সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামল না সে। না নেমে কার্নিশ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘ম্যাও ম্যাও।’ আমি এই বুলির পরিষ্কার অর্থ করলাম, আমি ক্ষুধার্ত, আমি খাদ্য চাই।
খুকুমণি আমার এই অর্থের যেন প্রতিধ্বনি করেই বলল, ‘আব্বু, ওল ক্ষিধে পেয়েছে। কালকেল দুধ আছে, ওতে থেতে দাও।’
খোকন এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে উঠল। ‘বা বা, আর আমরা চা খাব কী দিয়ে?’
‘তেন, এথুনি দুধ আসবে না? সেই দুধ দিয়ে আমলা চা থাব।’
আমাদের হৈহুল্লা আর বিড়ালের চিৎকারে খোকা-খুকুর মায়ের বুঝি ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই হাঁক ছাড়লেন, ‘সাত-সকালে কিসের এত গোলমাল, শুনি?’
এ প্রশ্নের উত্তর দিল বিড়াল, ম্যাও ম্যাও।’
‘ও বুঝেছি, এই ভোরবেলায় আল্লা-রসুলের নাম না নিয়ে বাপ-বেটিতে বেড়ালকে নিয়ে মশকরা হচ্ছে বুঝি?’
বললাম, ‘না, মশকরা নয়, ও বেচারা খেতে পায়নি কিনা, তাই ‘
‘তা বাসি কিছু থাকলে খেতে দিলেই তো হয়। একগাদা বাচ্চা দিয়েছে, ক্ষিদে তো পাবেই।’ এই বলে মনে হল যেন, তিনি আবার পাশ ফিরে শুলেন।
খুকুমণির অনুরোধের সমর্থন পাওয়া গেল তার মায়ের কাছে। কাজে কাজেই একটা থালায় করে আধ পোয়াটেক দুধ আর তাতে পুরো একটা রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেশালাম। মিশিয়ে বিড়ালকে দেখিয়ে দেখিয়ে সিঁড়ির কাছে রেখে এলাম। আর নিজে দাঁড়িয়ে থাকলাম বিড়ালের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে। বিড়াল দ্রুত পায়ে থালার কাছে গিয়ে কয়েক মুহূর্তে সাফ করে দিল থালাটা।
এই দৃশ্য খুকুমণি দেখল খুঁটির আড়াল থেকে।
কিন্তু খেয়ে-দেয়ে বিড়াল আবার শুরু করল, ‘মিয়াও মিয়াও।’
খুকুমণি বলল, ‘ভাগ, ভাগ, দূল হ।’
এমন সময় পেপারঅলা খবরের কাগজ দিয়ে গেল। খোকন দৌড়ে গিয়ে খবরের কাগজ এনে দিল আমার হাতে। প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডলাইন। তার মর্ম : ইস্রাইল আজরাইল। ইস্রাইলের আজরাইলরা পূর্ব-জর্ডান আর মিসরের ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়েছে। হাওয়াই হামলায় শত শত মুসলমান নিহত, বহু গ্রাম ধ্বংসপ্রাপ্ত, হাজার হাজার পরিবার গৃহহারা।
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমি নিজেকে ডুবিয়ে ফেললাম চিন্তার মহাসমুদ্রে। এই কি সেই আরবজাতি, যাদের ডঙ্কাধ্বনি একদিন সারা দুনিয়ার বুক কাঁপিয়ে তুলেছিল। যারা কাইকাউস, কাইখর দেশ তুড়ি মেরে জিতে নিয়েছিল। যারা একদিন ত্রাসের কারণ ছিল গোটা ইউরোপের কাছে। যারা রোম সাম্রাজ্যের সমস্ত গর্ব ভূলুণ্ঠিত করে দিয়েছিল। যারা আলেকজান্ডারের দেশে পর্যন্ত গিয়ে রাজত্ব করেছিল। যাদের তারেক আর সালাহুদ্দিনের তরবারির কাছে তাবৎ ঈসাই আর ইহুদির মাথা নত হয়ে গিয়েছিল। সেই আরবজাতির বীরত্ব আজ কোথায় গেল?
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
মনে হল, দুনিয়াটাই পাল্টে যাচ্ছে। তলওয়ারের যুগ শেষ হয়েছে। এখন বোমার যুগ, রকেটের যুগ, ট্যাঙ্কের যুগ। ঢাল-তলোয়ার, তীর-ধনুক দিয়ে এখন আর যুদ্ধ করা যায় না। রেড-ইন্ডিয়ানরা পারেনি কেন রাইফেলের মুখে টিকে থাকতে। সাহসে কি তারা কম ছিল কোনো অংশে? দক্ষিণ আফ্রিকার জুলুরা বাঘের জাত। তাদের আজ কী অবস্থা? পেরেছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা টিকে থাকতে? রোডেশিয়ার কৃষ্ণকায়দের আজ কী অবস্থা? মুষ্টিমেয় সাদা চামড়ার প্রভুদের তারা আজ পারছে না কেন উচ্ছেদ করতে? ভিয়েতনামের আজ কী দশা? সর্বত্র সবল দুর্বলকে চিবিয়ে খাচ্ছে।
বিড়াল বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমার ভারি রাগ হল। কমবক্ত চায় কী? এই বাড়িতে যত খাদ্য রয়েছে, সবই খাইয়ে দিতে হবে নাকি তাকে। সাম্রাজ্যলোভী দেশের মতোই বিড়ালটাও লোভী। ওর পেট কোনোদিনও ভরবে না।
বিড়াল আবার বলল, ‘ম্যাও ম্যাও।’
আমি বললাম, ‘চুপ, আজরাইলের বাচ্চা!’ বলেই মনে মনে চমকে উঠলাম। ঠিক হল কি এই গাল দেওয়াটা? বারবার ‘লা-হওল’ পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে যেতে লাগলাম জায়নামাজের দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। ফজরের নামাজটা আমার কাজা হয়ে গেল। কাজা নামাজে দাঁড়ানোর পরও বারবার আমার মনোযোগ ছিঁড়েখুঁড়ে গেল এই ভাবনায় : একটা পায়রার প্রাণ রক্ষা করাটা কি আল্লার এবাদত নয়?
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির