মৌন – শফিকুর রহমান
বছরের শেষ দিন। শেষ দিনের শেষ রাত।
ফ্রন্ট থেকে কয়েক শো মাইল দূরে কোনো এক হোটেলে আমরা নাচ দেখছি। আমি, ডন আর নিক। আমরা এই তিনজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হোটেলের এক কোনার এই টেবিলটা সবসময় ব্যবহার করি আমরা। এই টেবিল আমাদের পছন্দ, আমাদের খুবই প্রিয়।
চারটা চেয়ারের তিনটায় আমরা বসেছি। একটা খালি পড়ে রয়েছে। ওটা জিফের। জিফ ফ্রন্ট থেকে ফিরে আসেনি। জিফের জাহাজ নিখোঁজ রয়েছে। কিছুদিন আগে জিফকেও নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়েছে।
মাত্র কয়েক বছর হল গড়ে উঠেছে আমাদের বন্ধুত্ব। কিন্তু এ বন্ধুত্ব সুদৃঢ়। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ দিয়েছে ঘুচিয়ে। জিফ এখন আমাদের সঙ্গে নেই; কিন্তু আমরা এই চারজন যেন এক সত্তা।
নিউজিল্যান্ডের ডন, ক্যানাডার নিক, আমেরিকার জিফ আর আমি একসঙ্গে চলাফেরা করি, একসঙ্গে খাই এবং যথাসম্ভব একসঙ্গে ছুটি নেওয়ারও চেষ্টা করি। ছুটি পেলেই আমরা এই হোটেলে এসে উঠি। এখানকার নাচ উপভোগ করার জন্য এই নির্দিষ্ট টেবিলটায় বসি। এবারেও বড়দিনের ছুটি পেয়ে আমরা এখানে চলে এসেছি। আর, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করব বলে এখানে এসে জুটেছি। আমরা সবাই এসেছি, কেবল জিফ আমাদের সঙ্গে নেই।
জিফ আমাদের সঙ্গে নেই। এমন দিনে তার অনুপস্থিতি আমাদের মনে বড় বাজছে। এখানে এসেই নিকের কাছে জিফের খবরটা প্রথম শুনলাম। আমি তার জন্য আমার বরাদ্দ চকোলেট সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। সেই চকোলেট আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু জিফ নেই। জিফ চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসে।
বছরের শেষ রাত। একই রাত্রে একটা বছর শেষ হয়ে অন্য বছর শুরু হবে। হোটেল সেই জন্য বিশেষভাবে আলোকসজ্জিত। এত আলো যে, দিন না রাত, বুঝবার উপায় নেই। ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে গান গাচ্ছে। অর্কেস্ট্রায় সুরের ঝঙ্কার। গান শেষ হলে একে একে দেশ-বিদেশের নাচিয়ে মেয়েরা নাচ দেখাচ্ছে। কখনো একা। কখনো একসঙ্গে অনেকে। এত আলো, এত আনন্দ, এত উল্লাস– অল্পক্ষণের জন্য হলেও মানুষ সব দুঃখ-বেদনা নিঃশেষে ভুলে যায়। আজকের গানের সুর ভিন্নতর। আজকের নাচের ছন্দ অনেক বেশি প্রাণ-উচ্ছল।
আজকে নাচ-ঘরে যারা এসেছে, তাদের বেশির ভাগই আমাদের মতো সৈনিক।
ডন বলল, ‘আমাদের কাছে এমন একটা ছবি নেই, যাতে একসঙ্গে আমরা চারজন রয়েছি। কোনোটাতে দুজন, কোনোটাতে তিনজন। জিফকে নিয়ে আমাদের চারজনের একটা গ্রুপ-ফোটো তুলে রাখা উচিত ছিল।’
নিক বলল, ‘আমার মন বলছে, জিফ মরেনি। জিফ বেঁচে থাকার জন্যেই এ দুনিয়াতে এসেছে। জিফ মরবার মতো ছেলে নয়। আমার মন বলছে, জিফ আবার আসবে।’
তারপর, জিফকে নিয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দূর গড়িয়ে গেল। এক-এক সময় মনে হতে লাগল, জিফ যেন আমাদের মধ্যেই বসে রয়েছে। তার হাসবার, হাসবার কায়দা, তার কথা বলবার ঢং, তার বাঁধ-ভাঙা প্রাণের জোয়ার, তার নাক-চোখ-মুখ, তার দুর্বার সাহসের কথা– সবই একে একে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ছায়াছবির মতো ভেসে যেতে লাগল।
ডন বলল, ‘জিফকে আমি কোনোবারই কিছু দিতে পারলাম না। একবার দোকানে একটা দামি ঘড়ি দেখে তার খুব লোভ হয়েছিল। কিন্তু তার কাছে অত টাকা নেই। আমার কাছে সে টাকা চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, এত দামি ঘড়ি কেনার কোনো মানে হয় না। আমি তাকে টাকা দিইনি। আজকে আমার মনটা কেমন খচ্খচ্ করছে। আজকে যদি সে এখানে থাকত, ঘড়িটা কিনে আমি তাকে দিয়ে দিতাম বড়দিনের উপহার হিসেবে।’
নিক বলল, ‘জিফের মতো বন্ধু হয় না। কতবার রুষ্ট হয়েছি, কতবার গালাগালি দিয়েছি, কতবার এমন হয়েছে যে, মাসের পর মাস চিঠি লিখিনি, কিন্তু জিফ কখনো তা মনে রাখেনি। দেখা হলেই তেমনি উদার হাসি দিয়ে সে আপায়ন করেছে।– এমনি দিনে কোথাও বসে বসে জিফও হয়তো আমাদের কথা ভাবছে।’
হোটেলের প্রৌঢ় ইংরেজ মালিক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমাদের কুশল জানতে চাইলেন। কিছুক্ষণ কথা বললেন আমাদের সঙ্গে। তারপর, আমাদের টেবিলে বয়কে ডেকে দিয়ে চলে গেলেন।
জাজ্ বাজতে শুরু করেছে। জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ নাচতে আরম্ভ করল।
নিক তার নিজের ইউনিটের কথা শোনাতে লাগল। তাদের ফ্রন্টে প্রত্যেকদিন বোমা পড়েছে। তাদের ইউনিটের একজন অসীম সাহসী তরুণের কথা সে শোনাল। বলল, আমি অমন সাহসী সৈনিক দেখিনি। সবসময় সবার আগে সে। চতুর্দিক থেকে গুলি আসছে, তারই মাঝখান দিয়ে তাকে আমি নিরাপদে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আমি তাকে এমন জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, সেখানে তার চারপাশে বোমা পড়ছে। সব অবস্থাতে সবসময় তার মুখে হাসিটুকু লেগেই রয়েছে। আমি কোনো সময় তাকে হাসি-ছাড়া পাইনি। তার সম্বন্ধে আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা, এই যুদ্ধে কোনো অস্ত্রের আঘাতই তাকে কাবু করতে পারবে না। আমি নিজেকেও তার সঙ্গে থাকলে নিরাপদ মনে করেছি। তার সাহস আমাকেও সাহসী করে তুলেছে। একদিন আমাদের ইউনিটের একটা অংশের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ হয়েছিল। শুনলাম, এই আক্রমণে আমাদের খুব ক্ষতি হয়েছে। দেখতে গেলাম। মৃতদেহ শনাক্ত হচ্ছিল। সেই লাশের স্তূপের মধ্যে আমি তাকে দেখলাম। দেখেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে মরে গেছে। কিন্তু তার ঠোঁটের কোনায় তেমনি হাসি– অনির্বাণ। মরা মানুষের হাসি আমি জীবনে কোনোদিনও ভুলতে পারব না।’
‘আর একটা জিনিস কখনো লক্ষ করেছ?’ ডন বলল, ‘যখন চারিদিকে বোমা ফাটে কিংবা মুষলধারে গুলি বর্ষে, তখন সারা শরীরে একরকমের উত্তাপ এসে যায়, সমস্ত ভয় মন থেকে দূরে চলে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড ভয় লাগে তখন, যখন চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে স্তব্ধতা, নীরবতা, মৌনতা, যখন এক দফা ঝড় উঠে থেমে গেছে আর দ্বিতীয় দফা ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই স্তব্ধতা কেন এত ভয়াবহ, বলতে পার? বলতে পার, এর এক-একটি মুহূর্ত কেন এক-একটা যুগ বলে মনে হয়?’
হোটেলের মালিক আবার এলেন। এসে বললেন, ‘ছেলেরা, তোমরা এত বিষণ্ণ কেন? আজকের রাত্রে দুঃখ করতে নেই। সবাই নাচছে, আর তোমরা বসে রয়েছ। ওই যে তিনটি মেয়ে, অনেকক্ষণ থেকে একাকী বসে বসে সঙ্গী খুঁজছে। আমি ডেকে দিই?’
হোটেলের মালিক দিল-দরিয়া মানুষ। অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি চলে গেলেন মেয়েদের ডাকতে।
আমার সঙ্গে যে মেয়েটি নাচল, তার চুল লাল, চোখ লাল, ঠোঁট লাল। দীর্ঘ, লীলায়িত দেহ। সুন্দরী। যৌবনবতী। তার লাল চুল এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। মুখে মদের গন্ধ। চোখে প্রেমের নেশা টইটম্বুর।
বলল, ‘তুমি যেন বোবা, কথা বলছ না কেন?
কথা বললাম।
আবার বলল, ‘তুমি যেন নিস্তেজ, অত আস্তে আস্তে নাছে কেন?’
জোরে জোরে নাচলাম।
বলল, ‘উফ্, তোমার হাত কী ঠাণ্ডা। চল মদ খেয়ে আসি।’
গেলাম। মেয়েটি মদ খেল। আমি খেলাম না। অনেক পীড়াপীড়ি করল। জানতে
চাইল, কেন খাব না। বললাম এখনো ধরিনি। যখন ধরব তখন থেকে খাওয়া যাবে। তখন আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল।
এমনি করে কয়েক দফা মেয়েটি আমার সঙ্গে নাচল। প্রতি দফা নাচ শেষ হলে আমাকে নিয়ে মদ খেতে গেল। প্রতি দফা সে আমাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করল। প্রতি দফা আমার ভাগটুকুও নিজেই খেয়ে ফেলল সে।
তারপর, মেয়েটি যখন আর নাচতে পারছিল না, যখন তার পা আর মন আর আদৌ তার বশে নেই, তখন তার কামরায় রেখে আসতে সে আমাকে অনুরোধ করল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় তার পা খুব বেশিরকম টলতে লাগল। তখন বলল, ‘আমাকে ধরছ না কেন। আমি যদি পড়ে যাই। তোমাকে আমি সঙ্গে আনলাম তাহলে কী জন্যে।’
আমি তার হাত চেপে ধরলাম। ধরে ধরে উপরে নিয়ে গেলাম।
বলল, ‘তুমি অত ভয়ে ভয়ে আমাকে ধরেছ কেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও আমি কিছুই মনে করব না।
দরজার কাছে পৌঁছে দিয়ে বললাম, ‘আমি তাহলে যাই। এখন তো আর তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।’
মেয়েটি দরজার চাবি আমার হাতে দিল। বলল, ‘তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আর তোমার এই ধর্মপরায়ণতা তোমার প্রতি আমার মনকে টেনে নিয়েছে। আমার মন চাইছে তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলার অনুরোধ তুমি রাখবে না?– দরজা খোলো।’
দরজা খুললাম।
বলল, ‘আমাকে খারাপ ভেবো না। তোমাকে আমার ভালো লাগছে, তার মধ্যে কোনো পাপ খুঁজো না। তোমাকে আমার আরও ভালো লাগবে যদি তোমার প্রথম মদের গ্লাস তুমি আমার মুখ থেকে নিয়ে খাও। এস, একটু বস। এই যে আলমারিতে মদের বোতল। এই ফ্লাস্কে বরফ। এস, আমার কাছে একটুখানি বস।’
মেয়েটির আঙুলের আংটির প্রতি আমি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
বলল, ‘হ্যাঁ, আমি বাগদত্তা। শিগগিরই আমাদের বিয়ে হবে। আমার বর অন্য মহাদেশে এখন যুদ্ধ করছে। কিন্তু আমরা এই দূরত্বকে দূরত্ব মনে করি না। আমরা ঘন-ঘন চিঠি লিখি। তার ছবি আমার বুকের উপর ঝুলছে। এই দেখ।’
সে আমাকে লকেট বের করে দেখাল। তাতে তার বরের ছোট একটি ছবি। ভারি সুন্দর, সুপুরুষ।
বলল, ‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি।’
মেয়েটির ভালোবাসার জয় কামনা করে বললাম, দূর বিদেশে হয়তো কোনো জঙ্গলে বসে এখন সে তোমার কথাই ভাবছে।’
‘হয়তো ভাবছে। যদি ভাববার সময় পায়, তাহলে নিশ্চয় ভাবছে। আর, বড়দিনের ছুটি পেয়ে থাকলে এমনি একটা হোটেলে ঢুকে এমনি আমার মতো প্রচুর মদ খাচ্ছে। হয়তো কোনো মেয়ের কোলে মাথা রেখে পকেট থেকে আমার ছবি বের করে তাকে দেখাচ্ছে। আর বলছে, সে আমাকে খুব ভালোবাসে।’
শুভরাত্রি জানিয়ে আবার বললাম, ‘তোমাদের ভালোবাসা অক্ষয় হোক।’
বলল, ‘না, না। তুমি এখনি যেও না। একটু বস। তোমার কালো চুল আর কালো চোখ আমার খুব ভালো লাগছে। আমার মন চাইছে, তুমি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধর। একজন ভদ্রমহিলা যদি কিছুক্ষণের জন্যে তোমার সঙ্গ চায়, তুমি তার অনুরোধ রাখবে না?’
আমরা তিনজন একত্র হয়ে আবার সেই টেবিলে গিয়ে বসলাম।
ডন সিগারেট ধরাল। একই দিয়াশলাইয়ের আগুনে দ্বিতীয় সিগারেট জ্বালিয়ে সে আগুন নিভিয়ে দিল। এটা তার চিরাচরিত অভ্যাস। তৃতীয় সিগারেটের জন্য সে আরও একটা দিয়াশলাই জ্বালল। ডনের এই স্বভাবকে নিক বলে বোকামি। ডন বলে, এক আগুনে তিনটা সিগারেট ধরানো অশুভ।
সে বলে, আগের বারের যুদ্ধের নাকি ঘটনা এটা। ফ্রন্টে রাত্রির অন্ধকারে তিন সৈনিক সিগারেট ধরাচ্ছিল। প্রথম সিগারেট ধরানোর সময় শত্রু-পক্ষ দূর থেকে আগুন দেখে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। দ্বিতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা তাক্ করল। তৃতীয় সিগারেট ধরানোর সময় তারা গুলি ছুড়ল। এক বন্ধু মারা গেল সেই গুলিতে।
ইতালীয় বালা মাইক্রোফোনে আবার গান গাইছে। গান শেষ হলে নাচ শুরু হচ্ছে। কখনো একসঙ্গে অনেক মেয়ে। কখনো একটা মেয়ে একা নাচছে।
ডন ইঙ্গিতে দেখাল, এক পাশ থাকে পর্দা একটুখানি ফাঁক করে হোটেলের বাবুর্চিখানার একটা কর্মচারী লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ দেখছে।
আমরা দেখলাম, দূরে একটা টেবিলে এক বৃদ্ধ অনেক মদ খেয়ে এখন টেবিল পিটিয়ে পিটিয়ে বেতালা সুরে গান গাইছে।
সব টেবিলেই মদ, আনন্দ, উল্লাস। যেন পরাজয় না মানার একটা নকল চেষ্টা। যেন এই সাময়িক কোলাহল দিয়েই শাশ্বত বেদনাকে ঢেকে রাখা যাবে। দুঃখ-ভারাক্রান্ত, পর্যুদস্ত মূল্যবোধের ভারবাহী এই মানুষেরা কেন এত হাস্যাস্পদ হতে চায় নিজেদেরই কাছে। কী কঠিন যাত্রায় রওনা হয়েছে তারা। কী দুর্গম তাদের পথ। কী দুর্লক্ষ্য তাদের মঞ্জিল। কী নিষ্ঠুর তাদের ভাগ্যের লিখন।
নিক বলল, ‘ডন, তুমিই না একবার বলেছিলে, জীবন হচ্ছে একটা মহাশূন্য। এই মহাশূন্যকে কে কতখানি আনন্দ দিয়ে, গান দিয়ে, হাসি দিয়ে ভরে রাখতে পারে, তারই ওপর নির্ভর করছে তার জীবনের সার্থকতা। তুমি বলেছিলে, মৃত্যু জীবনের মতো সত্য। বীমা কোম্পানির দালাল মৃত্যু দিয়ে তার ব্যবসায়ী কথার সূচনা করে। আর, আমরা করি জীবনকে হাওয়ার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে। আমরা যখন বেঁচে থাকি, মৃত্যুর কথা ভাবি না। আমরা যখন মরে যাই, তখন জীবনের কথা আমাদের মনে থাকে না।’
ডন শূন্য দৃষ্টি সদর দরজার পানে মেলে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি না, কেন আমি সৈনিক হয়েছি। আমি এত ভাবপ্রবণ, সৈনিক হওয়া আমার উচিত হয়নি।’
সদর দরজার পর্দা নড়ল। প্রবেশ করল একটা নিগ্রো সৈনিক। কিছুক্ষণ সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলটাকে দেখে নিল। তারপর, এককোনায় একলা বসল। বসেই মদ আনিয়ে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল খালি করে দিল।
জিফের শূন্য চেয়ারটার ওপর ডনের দৃষ্টি গেল। বলল, নিগ্রোটাকে এখানে এনে বসালে কেমন হয়।
এ প্রস্তাবে কেউ আপত্তি করল না। নিগ্রো সৈনিক জিফের চেয়ারে বসে নিজের পরিচয় দিল, ‘আমার নাম ডার্লিং।’
ডন বলল, ‘বাহ্, চমৎকার নাম তো! মেয়েপুরুষ নির্বিশেষে সবাই তাহলে আপনাকে ‘ডার্লিং’ বলেই ডাকে?’
‘না, তা ডাকবে কেন। মেয়েরা সাধারণত ‘মিস্টার ডার্লিং’ বলে ডাকে। আর, একান্ত আপনজন হলে ‘মিস্টার’ যোগ না করে আমার নামটাকে দুবার উচ্চারণ করে দেয়, ব্যস্। তবে অনেকে ‘ডার্কি’ বলেও ডাকে। তাতে আমি অপরাধ নিই না। গায়ের রংটা তো আর আমার নিজের দেওয়া নয়।’
ডার্লিং জানাল, আজ সন্ধ্যায় তার জাহাজ এখানে ভিড়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ছুটি পেয়েছে সে। কাল সকালে আবার ফ্রন্টে চলে যাবে।
বলতে বলতে প্রথম বোতল শেষ করে দ্বিতীয় বোতল আনিয়ে নিল। আমাদেরও খাওয়াতে চাইল। কিন্তু আমরা আপত্তি জানালে কয়েক চুমুকে অর্ধেক বোতল শেষ করে গল্প জুড়ে দিল ডার্লিং।
মাত্র কয়েক বছর হল সে বাহিনীতে ঢুকেছে। এই কয়েক বছরেই দুনিয়ার সমস্ত ছোট-বড় দেশ, বিখ্যাত শহর তার দেখা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। নতুন নতুন মহাদেশ, নতুন নতুন শহর, নতুন নতুন মানুষ। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সাধ পূর্ণ হয়ে গেল। সারা দুনিয়া ঘুরে ডার্লিং দেখতে পেল মাত্র চারটা জিনিস : সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল আর মাঠ। যেখানেই যাও, ঘুরে-ফিরে সেই একই জিনিস। কোনো শহর একটা থেকে অন্যটা ভিন্ন বলে মনে হয় না। একইরকম রাস্তা, রাস্তায় একইরকম মোটরগাড়ি, গাড়িতে একইরকম মানুষ। সব শহরেই পার্কে, চৌরাস্তায় মরে-যাওয়া মানুষের মূর্তি। সব শহরে একইকরম হোটেল, হোটেলে একইরকম মেয়েলোক, সব মেয়েলোক একই ভাষায় প্রেমনিবেদন করে। একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখে দেখে ডার্লিং-এর মনে ঘেন্না ধরে গেছে। যুদ্ধ থামলেই সে দেশে চলে যাবে– একেবারে নিজের গ্রামে, যে-গ্রামকে আগে সে ঘৃণা করত, অবজ্ঞার চোখে দেখত, যে-গ্রাম থেকে একবার বেরুতে পারলে আর সে কখনো গ্রামে ফিরবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। এখন সে নতুন করে শপথ নিয়েছে, এই গ্রামে ফিরে যাওয়ার আবার যদি কখনো সুযোগ আসে, তাহলে যতদিন বেঁচে থাকবে, কখনো সে আর গ্রাম ছাড়বে না।
তারপর, হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল, ‘আমার সম্বন্ধে তোমাদের কিরকম ধারণা হল?’
বললাম, ‘আপনার সম্বন্ধে আমাদের খারাপ ধারণা হওয়ার কোনো হেতু নেই। আপনি চমৎকার লোক।
‘ভুল। সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি মিথ্যেবাদী। আমি কখনো সত্য কথা বলি না। আমি কাপুরুষ। আমি যুদ্ধকে ভয় করি। আমি যুদ্ধকে ভয় করি বলেই পালিয়ে যেতে চাই। গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’
ডার্লিং ঘন-ঘন চুমুক দিয়ে বোতলটা শেষ করল। তারপর, আমাদের প্রতি সম্পূর্ণ অমনোযোগী হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। একটি মেয়েকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে নাচতে চাইল। তারপর নাচতে চলে গেল ডার্লিং।
যখন ফিরল, হোটেলের প্রৌঢ় মালিক তার সঙ্গে ছিলেন। তিনি অন্য টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসলেন। ডার্লিং আরও একটা বোতল আনাল। মালিক বললেন, ‘ডার্লিং-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার জ্যাককে ও চেনে। ওরা দুজন একই ইউনিটে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। জ্যাক আমার একমাত্র সন্তান।’ তারপর ডার্লিংকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলে এখন কোথায়, কিছুই কি বলতে পার না?’
‘কয়েক মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘জ্যাক আমার একমাত্র ছেলে। কলেজে পড়তে পড়তেই যুদ্ধে চলে গেল। একেবারে ছেলেমানুষ। বাচ্চা। আপনভোলা! জ্যাকের মা আর আমি ওরই জন্যে এখনো বেঁচে রয়েছি। এখন আমার বিশ্রাম নেয়ার সময়। কিন্তু জ্যাকের জন্যেই এখনো খেটে চলেছি। আমি এখানে, আর ওর মা দেশে। দু-বছর আগে একবার সে সামরিক পোশাকে ফিরেছিল ছুটি পেয়ে। আমরা চিনতেই পারিনি। একেবারে জোয়ান হয়ে উঠেছে। কতটুকু ছিল আর এই এক বছরে কত বড়টা হয়েছে। কতরকম সান্ত্বনা-বাক্য দিয়ে সে তার মায়ের কান্না থামাল। বলল, মা, তুমি মোটেও চিন্তা কর না। তোমার দেওয়া বাইবেল আমার বুক-পকেটে সবসময় থাকে। অমন ভালো ছেলে আর হয় না। মা মেরি নিশ্চয় তাকে রক্ষা করবেন।…শেষ কবে তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, ডার্লিং?’
‘অনেক দিন আগে। দু-তিন মাস থেকে আমি ইউনিটের বাইরে।’
‘ছোট থেকেই জ্যাক ভারি বুদ্ধিমান, মেধাবী। আজ পর্যন্ত কখনো সে একগুঁয়েমি দেখায়নি, আমাদের সামনে কখনো কড়া কথা বলেনি। আমার কত কাজ সে করে দিয়েছে। সকালে উঠে তার হাসি-মাখা মুখখানি দেখলেই আমি সব দুঃখ ভুলে যেতাম। মনে হত, যেন আমি নতুন সূর্যের আলো দেখলাম। কতবার যে কত দুর্ঘটনা থেকে সে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। একবার মোটর সাইকেল থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। কিন্তু ওর কিছুই হল না। তার আগে একবার খুব ছোটবেলায় সমুদ্রের ধারে জ্যাক হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সারারাত তাকে পাওয়া যায়নি। রাত্রে খুব ঠাণ্ডা পড়েছিল আর ঝড় উঠেছিল। পরের দিন সকালবেলায় তাকে একদম ভালো অবস্থায় পাওয়া গেল। এমনি আরও একবার কঠিন একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল। …গত বছর সে তার মা-কে চিঠি লিখেছে, অমুক তারিখ আমি উড়োজাহাজ হাঁকিয়ে তোমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাব। মায়ের সঙ্গে হয়তো এটা তার মশকরা। কিন্তু জ্যাকের মা বেচারি সারাদিন আকাশপানে চেয়ে থাকল। কত জাহাজ এল, গেল, কিন্তু কোনটা যে তার ছেলের জাহাজ, তা সে কিছুতেই ঠাওর করতে পারল না। জ্যাক লিখেছিল, শিগগিরই সে বাড়ি ফিরবে। তার ঘরটা যেন তৈরি রাখা হয়। বাড়ি ফিরে সে রোজ রাত্রে শোয়ার আগে মায়ের হাতের একগ্লাস করে গরম দুধ খাবে আর সকালে উঠে তুলোর তৈরি মোলায়েম স্লিপার পরবে। জ্যাকের মা প্রত্যেকদিন জ্যাকের ঘর সাজিয়ে রাখে। প্রত্যেক রাত্রে দুধ গরম করা থাকে। বিছানার কাছেই রেখে দেওয়া হয় জ্যাকের মোলায়েম স্লিপার। আমাদের পুরনো কুকুরটা মরে গেল। জ্যাকের মা কিছুতেই অন্য একটা কুকুর রাখবে না। বলবে, জ্যাক এলে নতুন কুকুর ওকে বাইরের লোক ভেবে চিৎকার জুড়ে দেবে। জ্যাকের মা বেশিক্ষণের জন্যে বাইরে পর্যন্ত যায় না, পাছে জ্যাককে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।…
ডার্লিং ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছিল। ওর বোধহয় ছুটির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে বিলের দিকে সে তাকাল।
হোটেলের মালিক বললেন, ‘তুমি জ্যাকের বন্ধু। তুমি তাই আজ আমার অতিথি। তোমার কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারব না। জ্যাকের সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিও।’ তিনি চলে গেলেন।
ডার্লিং বলল, ‘দেখেছ, কেমন মিথ্যে বললাম, সারাজীবন আমাকে এমনি মিথ্যে বলে যেতে হবে।’
ডন জিগ্যেস করল, ‘কেন, কেন, কী হয়েছে?’
‘জ্যাক কিছুদিন আগে মারা গেছে। আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। গুলি ওর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে গেছে। ওর বুক-পকেটে রাখা বাইবেল সুদ্ধ ছ্যাঁদা হয়ে গেছে।’ আর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ডার্লিং চলে গেল।
পুরনো বছর শেষ হয়ে নতুন বছর শুরু হওয়ার মুহূর্তটি এসে গেল। হৈচৈ পড়ে গেল সারা হল-ঘরে। উন্মাদনা-সৃষ্টিকারী নাচে-গানে-বাজনায় সারা পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠল। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে লাগল সবাই।
নতুন বছরের মুহূর্তগুলো একে একে কাটতে লাগল। নেশায় ঢুলু-ঢুলু চোখ, টলমল পা– দাঁড়িয়ে থাকার সাধ্য নেই অনেকের। তারা কোনোরকমে টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছে। তাদের এক-একটি আচরণ হাস্যকর। আর, সেই হাস্যকর আচরণ দেখে সবাই ঠাট্টা- মশকরায় মেতে উঠেছে। হাততালি দিচ্ছে। পরামর্শ দিচ্ছে আরও এক বোতল মদ খাওয়ার। হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে অনেকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত করল। সেখানকার তামাশাটা আরও মজার। এত বেশি টেনেছে যে, সব কাণ্ডজ্ঞানই লোপ পেয়েছে লোকটার।
তার প্রতিটি আচরণে সারা হল-ঘর হাসির পটকা ফুটতে লাগল।
লোকটা কফি খাওয়ার চেষ্টা করছে। পরম নিশ্চিন্তে চামচ দিয়ে চিনি তুলে দুধের পটে ঢেলে দিচ্ছে। খালি কাপটা তুলে নিয়ে দুধ ঢালার কায়দায় দুধের পটে উপুড় করছে। চামচ দিয়ে দুধের পট নাড়া দিচ্ছে। তাই দেখে কেউ হাসলে চামচ তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রাখছে।
কিছুক্ষণ থেকে আবার দুই চামচ দুধ নিয়ে গ্লাসে দিচ্ছে। সেই গ্লাসে খানিক কফি ঢেলে চামচ খুঁজছে। সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠছে দর্শকমণ্ডলী। কিছুক্ষণ থেমে লোকটা আবার শুরু করছে। সমস্ত কফি টেবিলের উপর ঢেলে দিচ্ছে। হাসির অট্টরোল উঠলে তাড়াতাড়ি রুমাল বের করে টেবিল মুছবার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ লোকটা উঠে দাঁড়াল। শূন্যদৃষ্টি মেলে এদিক-ওদিক চাইল। হৈচৈ একদম থেমে গেল।
লোকটা বলতে শুরু করল, ‘ভাই আমার, বন্ধু আমার, আমাকে মাফ করে দাও… আমি অন্ধ। আমি কিছুই দেখতে পাই না। বোমার টুকরো এসে আমার চোখে লেগেছিল। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আমি কিচ্ছু দেখতে পাই না। নইলে আমি কখনো এমন করতাম না। আমাকে মাফ করে দাও, ভাই আমার… বন্ধু আমার…’
পাশের ঘর থেকে একটা লোক এসে ওর হাত ধরল। ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। অর্কেস্ট্রায় আর সুর উঠছে না। নাচের পা আর একটুও নড়ল না। মশকরায় মত্ত লোকগুলোর মুখ হাঁ হয়ে রয়ে গেল। কারও মুখে কোনো কথা ফুটল না।
বহুক্ষণ যাবৎ গোলাগুলি চলার পর হঠাৎ তা থেমে গেলে যেমন হয়, তেমনি নিস্তব্ধতা– ভয়াবহ নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির