প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৩.১০ খানবাহাদুর – আয়াজ আস্‌মি

খানবাহাদুর – আয়াজ আস্‌মি

সায়েবদের প্রতি, সায়েবি ভাষার প্রতি, এমনকি যেসব জিনিস রঙে সাদা, তাদের প্রতি একটা গভীর টান ছিল নুরুল হুদার। বন্ধুরা তাঁকে বলতেন, ‘যেহেতু ওঁর নিজের চামড়ার রং একেবারে নিকষ-কালো, তাই সাদা রঙের এত ভক্ত উনি।’

সায়েবদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার হেতু গায়ের রং কালো হওয়া ছাড়া আর কিছু থাক বা না-ই থাক, গাঁয়ের লোকেরা কিন্তু পাকাপাকিভাবে একথাটা জেনে নিয়েছিল যে, চৌধুরী সাদা-চামড়াঅলাদের প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছেন। কথা বলতেন তিনি মাতৃভাষাতেই, কিন্তু ঢংটা ছিল সায়েবি। শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘শ্যুড্‌’ ‘উ্যড’-এর সীমানা পেরোতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু কথা বলার সময় ‘ইয়েস’ ‘নো’ ‘থ্যাংকিউ’ ‘সরি’ ইত্যাদি কথার ঘন ঘন প্রয়োগে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর পড়ার ঘরে ইংরেজ লেখকদের রাশি রাশি বই পরম যত্নে সাজানো থাকত। এগুলোর দিকে নজর পড়লেই নুরু চৌধুরীর ছাতি যেন ফুলে উঠত। এইসব গ্রন্থের রচয়িতা যেন তিনি নিজেই।

নুরু চৌধুরীর শোবার ঘরে বিলিতি লর্ড এবং সম্রাটদের খোদাই করা প্রতিকৃতি আর ছবি ছিল। সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের মস্ত এক মূর্তি তাঁর ঠিক শিয়রের ওপর থাকত। আরেকটা বিরাট ছবির নিচে চমৎকার অক্ষরে লেখা ছিল– ‘গড় সেভ্ দি কিং!’ ছবিটা এমন জায়গায় টাঙানো ছিল যে, সকালে ঘুম ভাঙতেই বিছানার উপর চোখ মেলে নুরু চৌধুরীর দৃষ্টি ঠিক ছবিটার ওপর পড়ত। নুরু চৌধুরী ইংরেজ লেখকদের বহুতর বাণী মাতৃভাষায় তর্জমা করে মুখস্থ করে রেখেছিলেন। আলাপ-আলোচনার সময় এগুলো যুৎসইভাবে প্রয়োগ করতেন তিনি।

নুরু চৌধুরীর এইসব গুণপনা নিয়ে গাঁয়ে প্রায়ই আলোচনা চলত; কিন্তু যেদিন তিনি সদরে হাকিমের কাছে খবর পাঠিয়ে লতিফ আর শব্বিরকে গ্রেফতার করালেন, সেদিন তাঁর নাম প্রতিটি শিশুরও মুখে মুখে ফিরতে লাগল।

গাঁয়ের কিছু লোক পুলিশের আবির্ভাবে চুপসে গেল। কিন্তু কেউ কেউ সাহসে ভর করে নুরু চৌধুরীর বাড়ির দিকে মুখ বাড়িয়ে মাটিতে থুতু ফেলল জোরে জোরে।

সারা গাঁয়ে বেশ কিছুকাল নুরু চৌধুরী লতিফ আর শব্বিরই মূল আলোচনার বিষয় হয়ে রইল–

‘শালা সায়েবদের দালাল নূরু চৌধুরীর এসব কী ধরনের কাণ্ড বল তো?’

‘হ্যাঁ, ভাই, জানো না, ও কত সাদা ঠাকুর নিজের ঘরে জমা করে রেখেছে?’

‘কিন্তু ভাই, বেচারা লতিফ আর শব্বিরের কী হবে?’

‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরই না হয়ে বসে আবার! ইংরেজ ওদের ওপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষকে খ্যাপানোর অভিযোগ আনবে। তারপর পাঠিয়ে দেবে সারাজীবনের মতো।’

‘ওদের ছেলেপিলেরা তাহলে খাবে কী? ‘

‘বাচ্চাগুলোর অভিশাপ পড়বে নুরু চৌধুরীর ওপর।

‘কিন্তু ভাই, নুরু চৌধুরী ওদের সঙ্গে শত্রুতা করতে শুরু করল কেন?

‘কেন জানে! হয়তো লতিফ আর শব্বির নুরু চৌধুরীকে বলেছিল– চাচা, এই ঠাকুরগুলোকে কতদিন আর বুকে করে পুষে রাখবে? এবার তো ওদের পাতাড়ি গুটোবার দিন ঘনিয়ে এল! হয়তো এরই ওপর আরো কথা হয়েছে। লতিফ বলেছে– চাচা, এ শালাদের তল্পি তোলার সময় এসেছে, মনে রেখ। যেসব বীর দেশকে স্বাধীন করার জন্যে জীবন দিয়েছে, এখন বরং ওদের ছবি আর ফটো দিয়ে ঘর সাজাও। হয়তো নুরু চৌধুরীর এসব কথা খুব খারাপ লেগেছে; তখন সে কিছু বলেনি। কিন্তু পরদিন, ভালো করে তখনো সকাল হয়নি, এমন সময় লতিফ শব্বির গ্রেফতার হল।’

.

সময় কাউকে চিরকাল মনে রাখে না। গ্রামবাসীও ক্রমশ লতিফ আর শব্বিরের কথা ভুলে যাচ্ছিল। তাদের মনে নুরু চৌধুরীর প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব উবে গিয়েছিল তা ক্রমেই ফিরে আসতে লাগল। কারণ সবাই দেখল, লতিফ আর শব্বিরের বিচারের পর নুরু চৌধুরী গাঁয়ের বহু লোককে জমায়েত করে তাদের কথা দিলেন, সরকার ওদের আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে বটে, কিন্তু তিনি ওদের নির্দোষ এবং নিজের ভাই বলে মনে করেন। তিনি ওদের ছেলেপিলের প্রতি বাস্তব সমবেদনার প্রমাণ স্বরূপ খরচ-পত্তরের জন্যে মাসিক পঞ্চাশ টাকা করে মঞ্জুর করে দিলেন। এইভাবে মাসে একশো টাকা খরচ করে নুরু চৌধুরী নিজের সম্পর্কে সারা গাঁয়ের মনোভাবকে দিলেন বদলে।

কিন্তু তবু নুরু চৌধুরী তৃপ্ত হতে পারলেন না। তিনি গ্রামবাসীদের ধারণাই শুধু বদলে দেবার চেষ্টা করলেন না, বরং তাদের মনকেও জয় করে নেবার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজের বাড়ির সামনের খালি জমিটুকুতে ছোট একটি পাঠশালা খুলে দিলেন। এছাড়াও গাঁয়ে কয়েকটি কুয়ো খোঁড়ালেন। গাঁয়ের প্রতিটি বিয়ে-শাদিতে, বিপদে-আপদে দেখাশোনা করা, অংশগ্রহণ করা ও সাহায্য করাটা নিজের অভ্যাসে পরিণত করে ফেললেন। আর, এদিকে তাঁর বাড়িতে বই, ছবি আর ঠাকুরেরও সংখ্যা বেড়ে চলল।

সেদিন নুরু চৌধুরীর বাড়ি ছাড়াও গোটা গাঁ-টাকেই আলোর মালায় সাজিয়ে দেওয়া হল। চৌধুরী নুরুল হুদা এবার খানবাহাদুর নুরুল হুদা হলেন। সায়েব-সুবোদের সংবর্ধনার জন্যে যে বিশেষ ঘরটি তৈরি হয়েছিল, সেদিন সেটির ভাগ্য গেল খুলে। এ-দিনটির আনন্দঅনুষ্ঠান সুসম্পাদিত করার জন্যে শহর থেকে অনেক লোক আনা হয়েছিল। সন্ধ্যা হতেই অভ্যাগতদের আবির্ভাব আরম্ভ হল– সবার শেষে এল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মোটর। খানবাহাদুরের খেতাবপ্রাপ্তিতে তিনি অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন।

ম্যাজিস্ট্রেট যখন তাঁর রাজকীয় ভাষায় বললেন, ‘কাবাহাডুর সায়েব কালা আডমি আছে, টাটে কোনো ক্ষটি নাই, উহার অন্টর আয়নার মটো পরিষ্কার আছে।’– তখন হলটি হাততালির চোটে ফেটে পড়ে আর কি! খানবাহাদুর নুরুল হুদার চেহারাও খুশির চোটে লাল হয়ে উঠল।

ভোজের পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং খানবাহাদুর নুরুল হুদার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হল। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলেন; তারপরও সারারাত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে রইল গ্রামখানা

কিন্তু দিন কয়েক পরেই গাঁয়ের আরো কয়জন যুবক গ্রেফতার হল এবং এদের বেলায়ও লোকে সন্দেহ করল, এরাও লতিফ আর শব্বিরের পথের পথিক ছিল।

.

খানবাহাদুর নুরুল হুদার খেতাব পাওয়ার এক বছরও হয়নি, এমন সময় ইংরেজ ঘোষণা করল, তারা ভারত ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু এ গাঁয়ে এ খবর এত দেরিতে পৌঁছল যে, জল তখন অনেকদূর গড়িয়েছে। দেশ জুড়ে দাঙ্গার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। ইংরেজ চলে গেলে খানবাহাদুরের বেশি চিন্তা হল নিজের জীবন নিয়ে। কারণ চারদিকে গুজব রটে গিয়েছিল, গাঁয়ে সকাল-সন্ধ্যা যে-কোনো সময়ে আক্রমণ হতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি কয়েকটা চিঠি লিখলেন, কয়েকবার নিজের বিশেষ বার্তাসহ লোক পাঠালেন। কিন্তু তিনি সদরের শান্তি রক্ষা করেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, খানবাহাদুরের আহ্বানে গাঁয়ে আসেন কেমন করে!

কিন্তু অবশেষে একদিন সশস্ত্র সৈন্যের একটা পল্টন খানবাহাদুরের নিরাপত্তার জন্যে শহর থেকে গাঁয়ে এল। সেদিন গাঁয়ের সমস্ত লোকের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল এবং সবার মনে খানাবাহাদুর নুরুল হুদার মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল।

আসলে ব্যাপারটা অন্যরকম। খানবাহাদুরও এই নতুন খেতাবের মারফতে পাওয়া সম্মানকে আরো খানিকটা দৃঢ় করার জন্যে অনেককিছুই করতে আরম্ভ করেছিলেন। ভাগ্যের জোরে দাঙ্গাও এই সময়ে তাঁকে গ্রামবাসীদের সেবা করার খাসা সুযোগ এনে দিল। গাঁয়ে যে-কোনো কাজই হোক না কেন– শান্তি-কমিটি গঠন কিংবা ‘মিলাদ-মাহফিলে’র অনুষ্ঠান কিংবা সভা-ধর্মসভা– খানবাহাদুর সবখানেই উঁচু আসন পেতেন। খানবাহাদুরের সায়েব-প্রীতি মূর্তি, ছবি আর বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পয়সার জোরে শুধু মর্যাদাই বাড়ে না, বরং এ যুগে পয়সা দিয়ে মানুষ পর্যন্ত কেনা যায়, এ শিক্ষা সম্ভবত তাঁকে এই বোবা বন্ধুরাই দিয়েছিল। এই কারণেই গাঁয়ের এবং আশপাশেরও সম্ভবত এমন কোনো সমিতি মণ্ডলী কিংবা রাজনৈতিক অরাজনৈতিক এমন কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না যাতে খানবাহাদুরের চাঁদা যেত না।

কোনো সমিতিকে চাঁদা পাঠাতে গিয়ে তিনি বন্ধুদের বিনীত কণ্ঠে বলতেন, ‘কী বল হে– এই সমিতির জন্যে আর্থিক সাহায্যটা কেমন হওয়া উচিত? আমার মনে হয় সমিতি গঠনমূলক কাজই করে যাচ্ছে। গরিব লোক এত ছুটোছুটি করছে, যদি ওদের আর্থিক সাহায্যটুকুর দিকেও খেয়াল না রাখি, তাহলে সমিতির কর্মীদের মন থেকে সেবার অনুপ্রেরণা জুড়িয়ে যাবে যে। তাছাড়া ভাই, এ দুনিয়ায় কে কার! আল্লা যা দিয়েছেন তা সৎ কাজে ব্যয় করাই দরকার।’

খানবাহাদুরের বিগত জীবনের কথা যতদূর জানা যায় এবং গ্রামবাসীরা যতটুকু জানে, তা হচ্ছে, খানবাহাদুরের জন্মের পরই তাঁর বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। কারণ, তিনি নিজে একেবারে লাল টুকটুকে এবং ফর্সা ছিলেন, আর খানবাহাদুর নুরুল হুদার মতো কালো কিটকিটে শিশু ভূমিষ্ঠ হতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল যে, এ শিশু তাঁর নয়– অন্য কারো

পিতৃহীন শিশু-খানবাহাদুরের লালন-পালন তাঁর চাচার তত্ত্বাবধানে হতে লাগল। খানবাহাদুরের বয়েস যখন মাত্র দু-বছর, তখন তাঁর মা এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে অবিনশ্বর জগতে যাত্রা করলেন। মা কোনো-এক সময়ে তাঁর বাবা চৌধুরী বদরুদ্দোজার ঘরে দাসীর মতন এসেছিলেন এবং এই ধরনের একটা ধারণাই চৌধুরীর মনের মধ্যে ছেয়ে গিয়েছিল যে, তাঁর স্বামী বাড়ির সক্কলের বিরোধিতা সত্ত্বেও একজন দাসীকে বিয়ে করেছেন।

গাঁয়ে খানবাহাদুরের চাচার অনেক সম্পত্তি ছিল। তাঁকে নিয়ে চাচা গাঁয়ে এলেন। খানবাহাদুর তখন মাত্র আড়াই বছরের। তাঁর যখন জ্ঞানগম্যি হয়েছে, তখন এ সংসারে একমাত্র আপনার যে লোকটি চোখে পড়ল, তিনি হচ্ছেন তাঁর চাচা। চাচার মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন খানবাহাদুর; এবং খানবাহাদুরের বাপ-চাচার সমস্ত ধন-দৌলত জমেছিল ইংরেজের দান ঠিকাদারির কৃপায়। এই জন্যে স্বাভাবিকভাবেই সায়েবদের সাথে তাঁর একটা সম্পর্ক জমে উঠছিল। এই সম্পর্ক বাড়তে বাড়তে প্ৰশংসা, তারপর পুজোর আকার ধারণ করেছে।

খানবাহাদুরের জীবনে চল্লিশটি বসন্ত পার হয়ে গেছে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবেরা অনেক বোঝানো সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করেননি। ঘরে ছিল দুজন চাকর। এদের মধ্যে দীনু তাঁর প্রাচীন প্রসাদভোগী। তাঁর বাবার আমল থেকে সে এখানে আছে।

একমাত্র দীনুই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, খানবাহাদুরের বাবা চৌধুরী বদরুদ্দোজা নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে আত্মহত্যা করেছেন। নইলে মায়ের গর্ভ তো কুমোরের চাক। দীনু বলে, ‘খানবাহাদুরের মা তাজি বিবিকে আমি ছেলেবেলা থেকেই জানি। বড় ভালো মেয়ে ছিলেন!’ সে কসম খেয়ে বলে, ‘তিনি যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, পরপুরুষ তো দূরের কথা, বাড়ির চাকরদের সামনে পর্যন্ত পর্দা করতেন।’

খানবাহাদুরের অতীত জীবন যেমনই হোক-না কেন, গ্রামবাসীদের তাতে কিছুই এসে যায় না। তারা শুধু এটুকুই জানে যে, চৌধুরী নুরুল হুদা যেদিন থেকে খানবাহাদুর হয়েছেন, সেদিন থেকে তাঁর মধ্যে বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি তাঁর টাকার থলে খুলে দিয়েছেন।

দাঙ্গার নামে খানবাহাদুর গদগদ হয়ে ওঠেন। কারণ দাঙ্গা তাঁকে দু-যুগের মতো বিখ্যাত করে দিয়েছে এবং গাঁ তো বটেই, শহরেও কোনো সভা হলে, কোনো সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলে, সভাপতিত্বের জন্যে খানবাহাদুরের কাছেই আবেদন আসে।

তারপর দাঙ্গার তামস ঝড়-ঝাপ্টা কেটে গেছে। দূর হয়েছে দাসত্বের অন্ধকারও। ইংরেজ চলে গেছে এবং বেরিয়ে এসেছে স্বাধীনতার প্রোজ্জ্বল সূর্য। ইংরেজদের চলে যাওয়ায় ঘরে ঘরে উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে।

কিন্তু খানবাহাদুর হয়ে পড়লেন উদাস। দীনুর মনে হল, যেদিন তাঁর চাচা মারা যান খানবাহাদুর সেদিনও তো এতখানি উদাস হননি!

স্বাধীনতার সাথে সাথে এ সংবাদও গাঁয়ে এল, যেসব লোক স্বাধীনতা-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জেলে গিয়েছিল, স্বাধীনতা দিবসে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। লতিফ আর শব্বিরের বিস্মৃত মুখ আবার গ্রামবাসীদের স্মৃতিতে টাকা হয়ে উঠল।

পরদিন দুপুরে যখন বন্ধু-বান্ধব আর সঙ্গী-সাথিদের সাথে মিছিল করে লতিফ আর শব্বির গাঁয়ে এসে পৌঁছল, তখন নেহালচন্দের খামারে সেই শোভাযাত্রার সংবর্ধনাকারীদের মধ্যে খানবাহাদুর নুরুল হুদাও ছিলেন। তিনি নাটকীয়ভাবে এগিয়ে গিয়ে লতিফ আর শব্বিরকে বুকে চেপে ধরলেন।

‘কী চৌধুরী সাহেব, আপনার মূর্তিগুলোর খবর কী?’ হাসতে হাসতে লতিফ খানবাহাদুরকে জিগ্যেস করল।

খানবাহাদুর চুপ মেরে গেলেন। কিন্তু গাঁয়ের মৌমাছিরা লতিফকে জানিয়ে দিল, চৌধুরী খানবাহাদুর বনে গেছেন।

‘বটে! ব্রিটিশ তাহলে যাবার সময় ওঁকে কিছু দিয়ে গেছে! চৌধুরী সাহেবের রাজভক্তি ব্যর্থ হয়নি।

খানবাহাদুর সংবর্ধনা থেকে বাড়ি ফিরে দেখলেন, সদরের কয়েক ব্যক্তি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট খানবাহাদুরের কাছে স্বাধীনতার অভিনন্দন ও জরুরি সমাচার দিয়ে পাঠিয়েছেন। খানবাহাদুর তাঁদের বিদায় দিলেন। কিন্তু আজ তিনি ভারী উদাস। লতিফের কথা তাঁর মনের ওপর একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে যেন।

‘চৌধুরী সাহেব, আপনার মূর্তিগুলোর খবর কী?’ লতিফের এ কথাটা খানবাহাদুরের মস্তিষ্কে হাতুড়ি ঠুকছে। অনিচ্ছুকভাবে তাঁর দৃষ্টি বার কয়েক ইংরেজ লর্ড আর মূর্তিগুলোর ওপর পড়েছে। ইদানীং এগুলোর ওপর তিনি কালো পর্দা চাপিয়েছেন। সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের বড় ছবিটার ওপরও তাঁর নজর পড়ল। ওটা ছিল তাঁর পালংকের সামনেই টাঙানো। পর্দাটা ইঁদুরে কেটে দিয়েছে। ইঁদুরে কাটা পর্দার ছিদ্র দিয়ে ছবির একটা চোখ উঁকি মারছে। খানবাহাদুরের মনে হল, যেন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের চোখে একটা গভীর উদাস ঝাপসা ছায়া। ও চোখ যেন খানবাহাদুরের কাছে কিছু চাইছে।

‘দীনু ভাই!’ খানবাহাদুর চোখটির দিকে আর চাইতে না পেরে বললেন, ‘দীনু ভাই, তোমাকে কতবার বললাম, ছবির পর্দাটা পাল্টে দাও। জানো না, এটা বাদশার ছবি!

খানবাহাদুরের কথা শুনে দীনু খুব তাজ্জব বনে গেল। পর্দা বদলাবার কথা তাকে এই প্রথম বলা হল। তার এত অবাক হওয়ার কারণ, ওই যে ছবিটার পর্দা ইঁদুরে কেটে ফেলেছে, ওটাকে বাদশার ছবি বলা হচ্ছে। কিন্তু এমন বাদশা দীনুর চোখে কখনো পড়েনি, যাঁর মুখে দাড়ি এবং হাতে তসবিহ নেই! এক শা-সাহেবের কাছে আবার শুধু দীনুই নয়, তার বাড়ির সবাই মুরিদ হয়েছে কিনা।

দীনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ কথাই ভাবছিল। খানবাহাদুর আবার বলে উঠলেন, ‘শুনেছ, লতিফ ছাড়া পেয়ে এখানে এসেছে?’

‘জি হ্যাঁ, বড় ভালো লোক।’

হ্যাঁ, আমারো তাই মনে হয়। আমার ইচ্ছে আছে– ওদের ছাড়া পাওয়ার খুশিতে গ্রামবাসীদের একটা বড়রকমের দাওয়াত দেব!’

দীনু আর কথা বলতে পারল না। তার চোখে আজ খানবাহাদুর একজন উঁচু দরের মহৎ ব্যক্তি বলে প্রতিভাত হতে লাগলেন।

.

ভোজের আয়োজন শুরু হল। এ উপলক্ষে কিছু নতুন মানুষ এল গাঁয়ে। খানবাহাদুর এদের নিজের বাড়িতে থাকার জায়গা দিলেন। কথাবার্তা শুনে চাকর-বাকররা জানতে পারল– নতুন মানুষগুলো গোয়েন্দা বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট।

খানবাহাদুরের চাকররা এ তথ্য লুকিয়ে রাখতে পারল না। গাঁয়ের অধিকাংশ লোকই জেনে ফেলল, খানবাহাদুরের কাছে গোয়েন্দা পুলিশের কিছু লোক এসেছে।

‘আরে ভাই, বড় লোকের কারবার। আল্লা দিয়েছেনও অনেক আর জান বাঁচানোর জন্যে সবকিছু তো ওঁকে করতেই হবে!’ কেউ কেউ ভাবল– গোয়েন্দা পুলিশের লোক খানবাহাদুরের জীবন এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্যেই এসে থাকবে।

লতিফ, শব্বির আর বিশিষ্ট গ্রামবাসীদের বসবার জন্যে খানবাহাদুর তাঁর খাস কামরায় বন্দোবস্ত করলেন। সায়েবদের সাদা মূর্তিগুলোর উপর কালো পর্দা দেখে লতিফ হেসে উঠল।

‘ঠিক করেছেন, চাচা– শালাদের মুখে কালি লেপে দিয়ে ঠিক করেছেন। আবর্জনাগুলো এখন বাইরে ফেলে দেওয়াই সবচেয়ে ভালো!’

লতিফের কথা শুনে খানবাহাদুরের চোখ সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের ছবির দিকে উঠে গেল। দীনু ওটার পর্দা বদলায়নি। ছবির একটা চোখ তখনো ছিদ্র দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খানবাহাদুরের সাথে লতিফও ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে সে হেসে ফেলল।

‘বারে, বাহ্! ইংরেজ চলে গেছে ঠিকই। কিন্তু ওদের একটা চোখ এখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে!’

কয়েক কলসি ঘাম যেন খানবাহাদুরকে নাইয়ে দিল।

‘না, না, তা নয়। ইঁদুরে পর্দাটা কেটে দিয়েছে।’

‘ইঁদুর!’ লতিফ বাঁকা হাসি হাসতে হাসতে চুপ হয়ে গেল।

নেমন্তন্ন শেষ হল। এ সময়ের মধ্যে খানবাহাদুর, লতিফ আর শব্বির কোনো কথাই বলেনি। নেমন্তন্ন থেকে ফেরার সময় লতিফ খানবাহাদুরকে জানাল, কাল সকালে সে শহরে যাচ্ছে। শব্বিরও থাকবে সাথে।

কেন জানে, কেন, খানবাহাদুরের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু তাঁর এ অবস্থা তিনি গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।

পরদিন সকালে লতিফ আর শব্বিরকে যারা বিদায় দিল, খানবাহাদুরও তাদের দলে রইলেন।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলা গাঁয়ে খবর এল– শহরে যাবার পথে লতিফ আর শব্বির গ্রেফতার হয়েছে। খানবাহাদুর তখন গ্রামবাসীদের বোঝাতে লাগলেন, ‘কতবার আমি ওদের বলেছি– এ দেশ আমাদেরই, আমাদেরই এ সরকার। কিন্তু ওরা শুনল কই– নিজেদের ছেলেপিলের ভাবনা পর্যন্ত ওদের নেই!’

‘কিন্তু, চৌধুরী সাহেব!’ গাঁয়ের প্রবীণ গণমান্য পাঁচজনে বললেন (ওঁরা খানবাহাদুরকে বরাবর চৌধুরী বলেন), ‘ওরা দেশের বা সরকারের বিরোধী তো নয়, অবশ্যি ইংরেজদের বিরোধী নিশ্চয়ই।’

‘তোমরা জানো না ভাই এই ছোকরাদের। যাকগে, ওসব কথা বাদ দাও। আমি ওদের ছাড়াবার চেষ্টা করছি। যতদিন ছাড়া না পায়, আমার কাছ থেকে ওদের ছেলেপিলেরা মাসে মাসে পঞ্চাশটা করে টাকা পাবেই। ‘

অনুবাদ : বাশীর আলহেলাল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *